১. অপারেশন তেলআবিব-১

জেবেল আলনুর। সাইমুমের হেড কোয়ার্টারের বিচার কক্ষ। প্রধান কাজী শেখ আলী কুতুব কাজীর আসনে সমাসীন। জনফ্রন্টের সদস্যদের বিচার আজ। জনফ্রন্টের মোট পাঁচ হাজার সদস্য ধরা পড়েছে এবং নেতৃবৃন্দের মধ্যে জর্জ বাহাশ ছাড়া সকলেই বন্দী হয়েছে।

আবদুর রহমান বাজাজ এবং আবদুল করিম হাসুনাসহ ২৭ জন জনফ্রন্ট কর্মকর্তা আসামীর কাঠগড়ায় দন্ডায়মান। বাদী মুসলিম জনগণের পক্ষে সাইমুম প্রধান আহমদ মুসা। বাদীর পক্ষ থেকে আরজি পেশ করতে এলেন আহমদ খলিল। তিনি বললেন, আসামী জনফ্রন্টের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে বাদী পক্ষের আরজ এই যে,

১। আসামীরা মুসলিম মিল্লাত থেকে সম্পর্ক ছিন্ন করে সম্পূর্ণ ভিন্ন মতাদর্শের দুশমনদের আনুগত্য স্বীকার করেছে;

২। আসামীরা তাদের সহযোগী প্রতিষ্ঠান ও আরব রাষ্ট্র সমূহের সাথে সম্পাদিত চুক্তির সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে ;

৩। আসামীরা মুসলিম জনগণের শত্রু ইসরাইলের সাথে আঁতাত করে নিম্নলিখিত বিশ্বাসঘাতকতার কাজ করেছে;

(ক) ফিলিস্তিনী জনগণের আত্মপ্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রামরত সাইমুমের ইসরাইলস্থ গোপন আস্তানাগুলোর ঠিকানা ইসরাইলকে সরবরাহ করেছে ;

(খ) সাইমুম ইসরাইলের গোপন সামরিক তথ্যাদি সংগ্রহ করছে, এই খবর ইসরাইলকে জানিয়েছে;

(গ) মুসলিম নরনারীর ছদ্মবেশে যে সমস্ত ইহুদী মুসলিম পরিবারে জড়িত থেকে ইসরাইলের জন্য গোয়েন্দাদের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে, সাইমুম তাদের খুঁজে বের করছে, একথা ইসরাইলকে জানিয়েছে এবং নতুন করে গোয়েন্দা চক্র স্থাপনের জন্য সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।

৪। আরবের মুসলিম জনগণ, আরব রাষ্ট্র এবং সাইমুমের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ও ষড়যন্ত্রমূলক কাজের সিদ্ধান্ত আসামীরা গ্রহণ করেছে। পরিশেষে আহমদ খলিল বলল বাদী পক্ষের সত্যতা যাচাইয়ের জন্য আপনার কাছে প্রয়োজনীয় সব কাগজপত্র ও নথিপত্র পেশ করা হয়েছে।

কাজীর পক্ষ থেকে আসামীদেরকে জিজ্ঞাসা করা হলো, বাদীর অভিযোগ তারা স্বীকার করে কিনা। আবদুর রহমান বাজাজ কাজীর প্রশ্নের জবাব না দিয়ে জানাল, আমাদের বিচার করবার কোন ক্ষমতা আপনাদের আইনের নেই।

-‘আপনাদের আইন’ বলতে আসামী মুসলিম আইন বুঝিয়েছেন কি? কাজী আলী কুতুব জিজ্ঞাসা করলেন।

কাজীর প্রশ্নটির কোন জবাব আবদুর রহমান বাজাজ দিল না।

আবদুর রহমান বাজাজের কথাই উপস্থিত সকল আসামীর কথা কিনা কাজী সাহেব জানতে চাইলেন। আসামীরা সম্মতিসূচক মাথা নাড়ল।

কাজী আলী কুতুব গভীর অভিনিবেশ সহকারে কিছুক্ষণ সম্মুখের নথিপত্র নাড়াচাড়া করলেন। তারপর কলম তুলে নিলেন হাতে।

তিনি ঘোষণা করলেনঃ আসামীদের বিরুদ্ধে উত্থাপিত এবং প্রমাণিত অভিযোগ অনুযায়ী আসামীগণ দুই ধরনের অপরাধে অপরাধী। প্রথমতঃ মুসলমানদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে শত্রুদের সাথে যোগ দিয়েছে। অপরাধের প্রকৃতি হিসাবে প্রথম অপরাধটি প্রধান এবং দ্বিতীয় অপরাধ প্রথম অপরাধের অবশ্যম্ভাবী প্রতিক্রিয়া মাত্র। এই দিক দিয়ে আসামীদের একটিই মূল অপরাধ এবং তা হলো, ইসলামের আনুগত্যের অস্বীকৃতি এবং তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহকারীদের বিরুদ্ধে কি ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে, ইসলামের ইতিহাসে তার জলন্ত প্রমাণ রয়েছে। রসূলুল্লাহ (সঃ) এর মৃত্যুর পর আরবের কতিপয় সুযোগ সন্ধানী ব্যক্তি ইসলামের আনুগত্য অস্বীকার এবং তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহের ধ্বজা উত্তোলন করে। চরম  প্রতিকূল পরিস্থিতি স্বত্ত্বেও আমিরুল মোমিনিন হযরত আবুবকর (রাঃ) ইসলামের প্রশ্নে কোন আপোস কনসেশনের বিষয় নীতি বিরুদ্ধ ঘোষণা করে বিদ্রোহী মুরতাদদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। ইসলামের আনুগত্যে পুনরায় ফিরে না এসেছ এমন প্রতিটি বিদ্রোহীকে হত্যা করা হয়েছে। অর্থাৎ মৃত্যুদন্ডই হলো ইসলামের আনুগত্য অস্বীকারকারী বিদ্রোহীদের একমাত্র শাস্তি। ইসলামী সংবিধানের নির্দেশও তাই। আমাদের বর্তমান আসামী অর্থাৎ জনফ্রন্টের বিদ্রোহী আসামীদের বেলায়ও এই  আইনই প্রযোজ্য। তারা অনুতপ্ত হয়ে যদি ইসলামের আনুগত্যে পুনরায় ফিরে আসে, তাহলে তাদের প্রথম অপরাধ ক্ষমার যোগ্য। এক্ষেত্রে তাদের দ্বিতীয় অপরাধের শাস্তি হিসেবে ফিলিস্তিনের সার্বিক মুক্তি না আসা পর্যন্ত তাদেরকে কারাগারে আটক থাকতে হবে। আর যদি ইসলামের আনুগত্যে ফিরে আসতে অস্বীকার করে তাহলে মৃত্যুই হবে তাদের শাস্তি। রায় ঘোষণা শেষ হতেই আসামীর কাঠগড়া থেকে সংযুক্ত জনফ্রন্টের ওয়ার্কিং কাউন্সিলের সদস্য আবদুল্লাহ ওয়াসিম এবং হাসান তালাত উঠে দাঁড়িয়ে বলল, আমরা আমাদের কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত। আমরা আমাদের ভুল বুঝতে পেরেছি। আমরা ইহুদীরের অর্থের প্রলোভনে পড়ে ইসলামী জীবন ব্যবস্থা ও মজলুম ফিলিস্তিনীদের প্রতি বিশ্বাসঘাতকাতা করেছিলাম। আমারা মার্কসের সমাজ দর্শনকে ইসলামী জীবন ব্যবস্থার বিকল্প মনে করতে পারি না। আমরা আমাদের পদস্থলনের জন্য রাববুল আলামিন আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থী। তিনি দয়া করে আমাদের ক্ষমা করুন।

কাঠগড়ার অপর পঁচিশ জন আসামী মাথা নত করে দাঁড়িয়ে রইল। আসামীদেরকে কাঠ গড়া থেকে নামিয়ে নিয়ে যাওয়া হলো। পরে জনফ্রন্টের পাঁচ হাচার আসামী মুজাহিদের বিশজন প্রতিনিধিকে এনে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হলো। তাদের বিরুদ্ধেও ঐ একই অভিযোগ এবং কাজী আলী কুতুব ঐ একই রায় ঘোষণা করলেন। জনফ্রন্টের সদস্যরা শান্তচিত্তে ও নতমস্তকে অভিযোগ ও রায় শ্রবণ করলো। রায় ঘোষণা শেষ হলে, আসামী পক্ষ থেকে এক জন বলল, বাদী পক্ষ থেকে যে অভিযোগ সমূহ উত্থাপন করা হছেয়ে, আমরা বন্দী দশায় এসে তা জানতে পারলাম। এ সম্বন্ধে আমাদের বক্তব্য হলো, বিভিন্ন ভালো দিকের কথা আমাদের বলা হতো। কিন্তু আমাদের কর্তৃপক্ষ যে ইসলামের গন্ডী থেকে বেরিয়ে গিয়ে মার্কসের দর্শন গ্রহণ করেছেন, আমরা তা অবহিত নই। আমাদের নেতৃবৃন্দ যে আমাদের শত্রুদেশ ইসরাইলের সাথে আতাঁত করেছেন আমাদের ভ্রাতৃপ্রতিষ্ঠান সাইমুম এবং আমাদের সাহায্যকারী আরব রাষ্ট্র সম্পর্কে বিভিন্ন গোপন তথ্য সরবরাহ করেছেন, আরব রাষ্ট্রসমূহ ও সাইমুমের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের প্রস্ততি নিচ্ছেন, আমরা সে সম্পর্কে ঘূনাক্ষরেও কিছু জানি না। এমন কি ইসরাইলস্থ জনফ্রন্টের ঘাঁটি সমূহের কর্মকর্তারাও সংস্থার নেতৃবৃন্দের পরিকল্পনা সম্পর্কে অবহিত নয়। নেতৃবৃন্দ সরাসরি ইসরাইল রাষ্ট্রপ্রধানদের সাথে যোগাযোগ করেছেন। সাইমুমের আস্তানা সমূহের ঠিকানাও আমাদের নেতৃবৃন্দ সরাসরি ইসরাইল নেতৃবৃন্দকে জানিয়েছেন। আমরা সজ্ঞানে কোন অপরাধ করিনি। ষোল তারিখ রাতে এক জরুরী বার্তায় আমাদেরকে জানানো হয় যে, সাইমুমের সাথে আমাদের মতান্তর দেখা দিতে পারে, বিভিন্ন স্থানে ওদের অবস্থান, ওদের সংখ্যা ওদের কার্যকলাপ ও কার্যপদ্ধতির বিশদ বিবরণ হেড কোয়ার্টারে পৌঁছাও এবং কোন কাজে ওদের সহযোগিতা করো না। এ নির্দেশ ছাড়া ইসরাইলসস্থ আমাদের সহকর্মীদেরকে অতিরিক্ত আর একটি নির্দেশ দেওয়া হয় এবং তা হলো – ষোল তারিখ রাতেই তারা যেন সমস্ত পুরাতন ঘাঁটি ছেড়ে দেয়। এ নির্দেশ আমাদের প্রতিও ছিল, আমাদের জন্য পুরাতন ঘাঁটি ছেড়ে দেবার সময় নির্দিষ্টি ছিল ১৮ তারিখ সন্ধ্যায় জেবেল আল-শামছের আমাদের হেড কোয়ার্টারও অন্যত্র স্থানান্তরিত হতো। কিন্তু এ পরিকল্পনার ১২ ঘন্টা আগেই সাইমুম তাদের সব ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করে দিতে এগিয়ে যায়। আমাদের এই বক্তব্যের আলোকে মহামান্য আদালত সমীপে বন্দী ৫ হাজার মুজাহিদের তরফ থেকে আমাদের আরজ, আমরা নির্দোষ। আমরা জ্ঞানতঃ আমাদের রসূল (সঃ) এবং আমাদের ধর্ম ইসলামের বিরুদ্ধে কোন বিদ্রোহ করিনি এবং এ ধরনের কোন পরিকল্পনাও করিনি। আমরা আমাদের ভ্রাতৃ প্রতিষ্ঠান সাইমুম এবং কোন আরব রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে জ্ঞানতঃ কোন ষড়যন্ত্রে যোগ দেইনি কিংবা এ ধরনের কোন ইচ্ছাও পোষণ করিনি।

জনফ্রন্টের ৫ হাজার মুজাহিদ বেকসুর খালাস হয়ে গেল। পরে তারা সাইমুমের সঙ্গে এক সাথে কাজ করার জন্য শপথ গ্রহণ করল। আহমদ মুসা তাদেরকে রাজনৈতিক শিক্ষা ও সামরিক ট্রেনিং গ্রহণের জন্য সউদী আরবের আল-আসির এলাকার একটি পাঠিয়ে দিল। সাইমুমের রাজনৈতিক শিক্ষার মধ্যে ইসলামী শিক্ষা, ইসলামী জীবন দর্শনের সার্বজনীনতা এবং জগতের অন্যান্য মতাদর্শের পরিচয় শামিল রয়েছে। সাইমুমের সদস্য হওয়ার জন্য এই জ্ঞানলাভ অপরিহার্য। এই কড়াকড়ি সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করা হলে আহমদ মুসা বলেন, এই জ্ঞানটুকু ছাড়া এক জন মুসলমান তার আত্ম পরিচয় লাভ করতে পারে না। আত্ম পরিচয়ই যে পেলো না, সে নিজের এবং দুনিয়ার অপর কারও কোন উপকার করতে পারে না।

 

Top