১০. বলকানের কান্না

চ্যাপ্টার

আহমদ মুসা, আলি আজিমভ ও ওসমান এফেন্দী মেরীদের ঘরের সামনে আসতেই মেরী, মেরীর মা এবং সভেৎলানা দরজা খুলে বেরিয়ে এল।
ওদের চোখে-মুখে আনন্দ।
আহমদ মুসা মেরীদের দিকে তাকিয়ে বলল, হোয়াইট ওলফের কেউ আর এ ঘাটিতে বেঁচে নেই। এখন নিরাপদ তোমরা। তোমরা আর একটু অপেক্ষা কর এখানে। আলি আজিমভ ও ওসমান এফেন্দী ঘাটিটা একবার সার্চ করে আসুক। আমার বন্দীখানায় একটু কাজ আছে।
বলে আহমদ মুসা পা তুলল যাবার জন্যে।
সভেৎলানা আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে বলল, একটু দাঁড়ান জনাব, ফাষ্ট এইডের ব্যাগ একটা পেয়েছি। আপনার আহত স্থানটা বেধে দেবে, এখনও রক্ত ঝরছে ওখান থেকে।
সভেৎলানা ফাষ্ট এইডের ব্যাগটি তুলে দিল আলি আজিমভের হাতে।
আলি আজিমভ সভেৎলানার হাত থেকে ব্যাগটি নিয়ে তাকে শুকরিয়া জানাল। তারপর আহমদ মুসাকে টেনে পাশের বিল্ডিং এর আড়ালে নিয়ে গেল। খুলে ফেলল তার সোয়েটার, জামা। দেড় ইঞ্চি পরিমাণ গভীর ক্ষতের সৃষ্টি হয়েছে কাঁধের নিচে বাম বাহুর সামনের উপর।
ব্যান্ডেজ হয়ে গেলে আহমদ মুসা ছুটল সেই দেয়াল ঘেরা একতলা বন্দীখানার দিকে।
বন্দীখানার চারিদিক দিয়ে দেওয়াল। উঁচু দেয়ালের উপর কাটাতারের বেড়া। বন্দীখানায় ঢোকার উঁচু গেট। ইস্পাতের দরজা।
আহমদ মুসা দরজার সামনে দাড়িয়ে প্রথমে পরীক্ষা করল দরজা বিদ্যূতায়িত কিনা? বিদ্যূতায়িত নয় নিশ্চিত হবার পর দরজা খোলার চেষ্টা করল। বুঝল দরজা স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থার অধীন। কন্ট্রোল রুম থেকেই দরজা খোলা-বন্ধ করা হয়। কিন্তু কন্ট্রোল রুমে যাবার এখন সময় নেই আহমদ মুসার। সে পকেট থেকে লেসার কাটার বের করল। কাটারের লাল সুইচটি চেপে তা দরজার চারদিকে একবার ঘুরিয়ে নিল। ইস্পাতের ভারি পাল্লাটি পড়ে গেল সশব্দে।
ভেতরে প্রবেশ করল আহমদ মুসা। তিন দিকে ঘুরানো একতলা বিল্ডিং।
উত্তরদিকের একটা কক্ষ থেকে ‘আল্লাহ’ ‘আল্লাহ’ শব্দ শুনতে পেয়েছিল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসা এগিয়ে গেল উত্তর দিকের ঘর গুলোর দিকে। সবগুলো ঘরের দরজা বন্ধ, মাত্র একটা ঘরের দরজা দেখতে পেল আধ-খোলা অবস্থায়। সে দরজার দিকে এগুলো আহমদ মুসা।
দরজা ঠেলে ধীরে ধীরে ঘরে প্রবেশ করল সে।
ছোট্ট ঘর। কোন আসবাব পত্র নেই। ঘরের এককোণে একটা প্লাষ্টিক বেদির উপর বড় ধরনের একটা পানির ফ্লাক্স। আর ঘরের এক পাশে ষ্টিলের খাটিয়া।
ঘরে ঢোকার পরেই খাটিয়ার উপর নজর পড়ল আহমদ মুসার। একজন যুবক কম্বল মুড়ি দিয়ে পড়ে আছে খাটিয়ার উপর।
আহমদ মুসা কাছে এগিয়ে গেল।
যুবকটির গলা পর্যন্ত কম্বলে ঢাকা। চোখ বন্ধ তার। ঘুমিয়ে পড়েছে। একেবারে তরুণ যুবক। সাদা ইউরোপীয় চেহারা। কিন্তু ঘন কালো কোকড়ানো চুল দেখতে এশিয়ানদের মত। গভীর কালো ভ্রু। মুখে প্রচন্ড ক্লান্তির ছাপ। কিন্তু সব কিছু ছাপিয়ে উঠেছে তার মুখের আকর্ষণীয় আভিজাত্য।
দেখেই আহমদ মুসা বুঝল, দেহে কিছু তুর্কি বৈশিষ্ট থাকলেও লোকটা ইউরোপীয়। আগে ‘আল্লাহ’ ‘আল্লাহ’ শব্দ শুনেছে, এখন তার কপালে সিজদার চিহ্ন দেকে বুঝল লোকটা মুসলমান।
আহমদ মুসা কিছুটা বিস্মিতই হলো। বিশ-বাইশ বছরের ইউরোপীয় মুসলিম যুবক আর্মেনীয় হোয়াইট ওলফের হাতে কেন?
আহমদ মুসা আরও কাছে এগিয়ে গেল।
যুবকটির সরল-নিষ্পাপ মুখচ্ছবি আহমদ মুসার মনে মায়ার সৃষ্টি করল।
আহমদ মুসা আস্তে আস্তে হাত রাখল তার মাথায়। কপালে হাত ঠেকতেই চমকে উঠল আহমদ মুসা’- কপাল ভীষণ গরম, যুবকটির গায়ে জ্বর। মাথায় হাত রাখতেই যুবকটি চমকে উঠে চোখ মেলল।
যুবকটির চোখ থেকে চমকে ওঠা ভাব কেটে যেতেই তাতে বিস্ময় ফুটে উঠল।
-আসসালামু আলাইকুম। আহমদ মুসা সালাম দিল যুবকটিকে।
-ওয়া আলায়কুম। অস্ফুটে ঠোট নেড়ে বলল যুবকটি।
যুবকটির চোখে তখনও বিস্ময়ের ঘোর।
-তোমাকে যারা আটকে রেখেছিল, তারা এখন কেউ নেই, তাদের পতন ঘটেছে। আমরা তোমার শুভাকাঙ্খী।
কথাটা শুনে যুবকটির চোখে একটা পলক পড়ল মাত্র। ঠোটে শুষ্ক হাসির একটা ক্ষীণ রেখা ফুটে উঠতেও দেখা গেল।
আহমদ মুসা বিস্মিত হলেন। যে সংবাদে যুবকটির আনন্দে উজ্জ্বল হবার কথা ছিল, তাকে এমন নির্লিপ্তভাবে যুবকটি গ্রহণ করল কেন? এমনটি তো সাধারণত হয় না!
কি কথা বলছ না যে, খুশী হওনি? বলল আহমদ মুসা।
যুবকটির ঠোটে এবার ম্লান হাসি ফুটে উঠল। বলল জি খুশী হয়েছি। শুকরিয়া। পরিষ্কার ইংরেজিতে বলল যুবকটি। বলে যুবকটি উঠে বসল।
গা থকে কম্বল পড়ে গেল। দেখা গেল দুই হাত শিকল দিয়ে বাধা। এক ফুট লম্বা শিকল।
আহমদ মুসা পকেট থেকে লেসার কাটার বের করে লেসার বীম দিয়ে শিকলের মাঝখানটা কেটে দিল।
দু’’হাতে দু’’প্রান্তের অবশিষ্ট অংশ ঝুলতে লাগল।
আহমদ মুসা সেদিকে তাকিয়ে বলল, ওগুলো পরে কেটে ফেলা যাবে।
‘’আরেকটি শিকল আছে’’ বলে যুবকটি পা বের করল। দেখা গেল আগের মত করেই ১ ফুট লম্বা শিকল দিয়ে পা’’দুটি বাধা। যা দিয়ে এক পা দু’পা করে হাটা যায় মাত্র।
আহমদ মুসা লেসার কাটারের লেসার বীম দিয়ে পায়ের শিকলটিও ঐভাবে কেটে দিল।
যুবকটি বিস্ময় বিষ্ফারিত চোখে দেখছিল লেসার বীমের অলৌকিক কাজ। বলল, লেসার পিস্তল, লেসার কাটারের কথা শুনেছিলাম। আজ দেখলাম।
যুবকটির চোখে এই প্রথমবারের মত একটা ঔজ্জল্য দেখা গেল। আহমদ মুসা খাটিয়ায় যুবকটির পাশে বসল। বলল, তুমি কে ভাই?
-লোকে আমাকে ‘পল’ বলে জানে।
-‘পল’ কেন?
-বাইরে সবার কাছে আমি খৃষ্টান নামে এবং খৃষ্টান বলেই পরিচিত।
-কিন্তু তোমার নাম?
-হাসান সেনজিক।
-কিন্তু তুমি কে? হোয়াইট ওলফের হাতে তুমি বন্দী কেন?
প্রশ্নটির তৎক্ষণাৎ কোন উত্তর দিলনা হাসান সেনজিক। উদাস চোখে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল আহমদ মুসার দিকে।
আহমদ মুসা খুটিয়ে খুটিয়ে দেখছিল যুবকটিকে। ইউরোপীয় চেহারা। দেখতে স্লাভদের মত। বুলগেরিয়া, যুগোশ্লোভিয়ার মত কোন বলকান দেশের সে মানুষ হবে।
এক সময় যুবকটি ধীরে ধীরে চোখ নামিয়ে নিয়ে বলল, ‘’আমি এক হতভাগা’’। কথার সাথে সাথে মুখটা তার আরও মলিন হয়ে উঠল।
একটু থেমে যুবকটি আবার বলতে শুরু করল, আমার বাড়ি আছে, দেশ আছে, কিন্তু আমি যাযাবর। বলা যায়, হোয়াইট ওলফের হাতে আমি পণবন্দী। এরা আমাকে বন্দী করে রেখেছে টাকার বিনিময়ে বলকানের ‘’মিলেশ বাহিনী’র’ হাতে তুলে দেবার জন্যে।
-তোমার অপরাধ?
-অপরাধ আমি সার্ভিয়া-রাজ ষ্টিফেনের বংশধর, দ্বিতীয় অপরাধ আমি মুসলমান।
-সার্ভিয়ার রাজা লাজারাসের পুত্র রাজা ষ্টিফেন?
-মুসলমান হওয়া অপরাধ বুঝলাম,কিন্তু ষ্টিফেনের বংশধর হওয়া অপরাধ হলো কেন?
-ষ্টিফেন যেহেতু অপরাধী,তার বংশধরাও অপরাধী।
-ষ্টিফেনের কোনটাকে তারা এত বড় অপরাধ ধরে?
সবটাকেই -সার্ভিয়া-রাজষ্টিফেন তুরস্কের সুলতান বায়েজিদের সাথে মৈত্রী স্থাপন করেছিলেন,তার বোন লেডী ডেসপিনাকে সুলতানের সাথে বিয়ে দিয়েছিলেন,সমগ্র ইউরোপ যখন সুলতান বায়েজিদের বিরুদ্ধে ক্রুসেড ঘোষনা করেছিলো, খৃষ্টান হওয়া সত্বেও ষ্টিফেন সে ‘ক্রুসেডে যোগ দেননি’,লেডী ডেসপিনার প্রভাব ও চেষ্টায় শুধু ষ্টিফেন পরিবার নয়,সার্ভিয়া,বসনিয়া, কসোভো,আলবেনিয়া প্রভৃতি অঞ্চলে ইসলাম আসন গেড়ে বসে।
সুলতান বায়েজিদ তুরস্কের খলিফা সুলতান মুরাদের ছেলে। সুলতান মুরাদ ১৩৮৯ খৃষ্টাব্দে কসভোর যুদ্ধে মধ্য ও পুর্ব ইউরোপের মিলিত শক্তিকে পরাভূত ও পর্যুদস্ত করলে সার্ভিয়ার রাজা ষ্টিফেনের মত আনেকেই তুর্কি সুলতানের আনুগত্য স্বীকার করে এবং মিত্র হয়। ষ্টিফেন ছাড়া সকলেই বিশ্বাস ঘাতকতা করে। ষ্টিফেন যতদিন জীবিত ছিলেন ততদিন শত প্রতিকুলতাও সমগ্র খৃষ্টান ইউরোপের ক্রোধ বহ্নির শিকার হওয়া সত্বেও সুলতানকে দেয়া ওয়াদার প্রতি তিনি বিশ্বস্ত থেকেছেন। ১৩৯৪ খৃষ্টাব্দে পোপ নবম বেনিফেসের নির্দেশে তুর্কি খিলাফাতের বিরুদ্ধে যে ক্রুসেড ঘোষিত হয়, ষ্টিফেন তাতে যোগদান না করায় ইউরোপের খৃষ্টান মিলিত শক্তি লুন্ঠন ও হত্যার মাধ্যমে ষ্টিফেনের রাজ্য উৎসন্ন করে ছাড়ে।
-শত শত বছর পার হলেও ষ্টিফেনের সেই ‘পাপ’ এখনো মোচন হয়নি? বলল আহমদ মুসা।
-না হয়নি। তবে হিংসাত্নক এ বিষয়টা ১৯৩০ সাল থেকে নতুন রূপ নিয়েছে। এ সময় সার্ভিয়াকে কেন্দ্র করে বলকান অঞ্চলে ‘মিলেশ বাহিনি’গঠিত হয়। তারা-‘ফাইনাল সলিউশন’ অর্থাৎ ‘নির্মূল অভিযান’পরিকল্পনা গ্রহন করে। হত্যা উচ্ছেদের মাধ্যমে বলকান অঞ্চল থেকে মুসলমানদের উচ্ছেদ এর লক্ষ্য। আর এরই একটা অংশ ষ্টিফেন পরিবারকে ধ্বংস করার জন্য ষ্টিফেন- পরিবারের পুরুষ সদস্যদের তারা হত্যা করে আসছে। বংশের গুরুত্বপূর্ন পুরুষ শিশুরা তাদের হাত থেকে রক্ষা পায়নি। ‘মিলেশ বাহিনি’এ পর্যন্ত-ষ্টিফেন পরিবারের বিরাশি জন পুরুষ সদস্যকে হত্যা করেছে। বিশৃঙ্খল-বিপর্যস্ত ষ্টিফেন পরিবার আজ চোখের জলে ভাসছে,আতংক আর আহাজারিতে নিষ্পেষিত হচ্ছে।
থামল হাসান সেনজিক।
আহমদ মুসা গভীর মনোযোগের সাথে হাসান সেনজিকের কথা শুনছিল। তার চোখ দু’টি হাসান সেনজিকের মুখের উপর নিবন্ধ।
-ষ্টিফেন পরিবারে তোমার অবস্থান কোথায় হাসান? প্রশ্ন করল আহমদ মুসা।
-ষ্টিফেনের বড় ছেলের ছেলে মুহাম্মাদের সাথে লেডি ডেসপিনার নাতনির বিয়ে হয়। তাঁরা আমার উত্তম পুরুষ। এই বংশ ধারার পুরুষ,শিশু ও যুবকের মধ্যে আমিই একমাত্র জীবিত আছি। বংশের অন্যধারা গুলোরও অবস্থা এই রকম।
-তুমি এতদিন বাঁচলে কেমন করে?
ম্লান হাসল হাসান সেনজিক। বলল বাঁচার মত বাঁচা নয়। প্রান ভয়ে দেশ ছাড়া। যুগোশস্নাভিয়ার রাজধানী এবং আমার পুর্ব-পুরুষের রাজধানী শহর বেলগ্রেডে আমার জন্ম। জন্মের পরদিনই মা আমাকে বাঁচানোর জন্য আমাকে নিয়ে বুলগেরিয়ার রাজধানী সোফিয়া চলে যান আমার এক খালার বাড়ীতে। খালার বাড়ীতে থেকেই আমি কৈশোরে পৌছলাম। কিন্তু মিলেশ বাহিনীর চোখ অবশেষে এড়ানো গেলোনা। তারা আঁচ করতে পেরেছিল,মরিয়া হয়ে খুঁজছিল তারা আমাকে। আমার দাদার আব্বা ডঃ মুহাম্মাদ ছিলেন বলকান মুসলমানদের বিখ্যাত রাজনৈতিক নেতা। মুসলমানদের আজাদী আন্দোলন ‘যুগোশস্নাভেনস্কামুসলিমানাস্কা অর্গানাইজেসিয়া’র তিনি ছিলেন প্রতিষ্ঠাতা। এই কারনে মিলেশ বাহিনী আমাদের পরিবারের উপর আরো বেশি ক্ষ্যাপা। তারা আমার দাদাকে মেরেছে,আব্বাও সবশেষে তাদের হাত থেকে বাঁচতে পারেননি। আমাকেও তারা এখন হন্যে হয়ে খুঁজছে। তারা যখন সোফিয়াতে আমার সন্ধান পেল,সোফিয়া থেকেও পালালাম। বুলগেরিয়া থেকে গেলাম স্পেনে। সেখানে আমারএক দুরসম্পর্কীয় আত্নীয় থাকতেন। লেখাপড়া আমোরকায় করেছি,সেখান থেকে ফিরে স্পেনেই থাকতাম।
থামল হাসান সেনজিক।
-তারপর কেমন করে তুমি হোয়াইট ওলফের হাতে পড়লে? প্রশ্ন করল আহমদ মুসা।
সংগে সংগে কোন উত্তর দিল না হাসান সেনজিক। সে মুখ নামিয়ে নিল। মুখটা তার আরও মলিন হয়ে উঠল। চোখের কোণ দু’টি তার ভিজে উঠল।
এই সময় আলি আজিমভ,ওসমান এফেন্দী,সিষ্টার মেরী,মেরীর মা লেডী জোসেফাইন এবং সভেৎলানা এসে দরজার সামনে দাঁড়াল। হাসান সেনজিক পশ্চিম মূখী হয়ে বসে ছিলো,সে তাদের দেখতে পেল না।
আহমদ মুসা সেদিকে একবার তাকিয়ে মনোযোগ দিলো হাসান সেনজিকের দিকে।
হাসান সেনজিক মুখ তুলল। বলল,পনের বছর হলো মাকে দেখিনি। দিন সাতেক আগে চিঠি পেলাম,মা ভয়ানক অসুস্থ,মুমূর্ষ। মা লিখেছেন,আমি যেন যাই। সব সময় মা যেতে নিষেধ করছেন,এই প্রথম লিখলেন যেতে। চিঠি পেয়ে আমি অস্থির হয়ে গেলাম। পরদিনই ইস্তাম্বুলে আসার জন্যে স্পেনের মালাগা বন্দরে এলাম। বন্দরের এক হোটেলের রুম থেকে হোয়াইট ওলফ আমাকে কিডন্যাপ করে। কিডন্যাপ করে হোটেলের অন্য একটি কক্ষে নিয়ে আমাকে একটি ইনজেকশন দেয়। তারপর আর কিছু মনে নেই আমার। চোখ মেলে এই ঘরেই আমি আমাকে দেখছি।
–হোয়াইট ওলফ কেন কিডন্যাপ করল? তার স্বার্থ কি?
–মিলেশ বাহিনী ও হোয়াইট ওলফ একই মিশন নিয়ে কাজ করছে। তাছাড়া টাকার লোভ। মিলেশ বাহিনী এ কাজের জন্য ৫০ হাজার ডলার দিতে চাচ্ছে। কিন্তু হোয়াইট ওলফ বলছে এক লাখ ডলার না পেলে আমাকে ওদের হাতে দেবে না।
–হোয়াইট ওলফ এখন আর নেই। বেচারারা ৫০ হাজার ডলারও হারাল।
একটু থামলো আহমদ মুসা। তারপর আবার বলল,তুমি এখন মুক্ত,তোমার মাকে দেখতে যাবে তুমি এখন?
মুখ তুলল হাসান সেনজিক। বলল,যাব। আর পালিয়ে থাকতে চাইনা। কি লাভ! যে ভাগ্য আমার দাদা,আমার আব্বা বরণ করছেন,যদি আসেই আমিও তা বরন করে নেব।
আহমদ মুসা হাসান সেনজিকের পিঠ চাপড়ে বলল,সাবাস হাসান,এমন ফাইটিং মনোভাবই তো চাই।
তারপর আহমদ মুসা দরজার দিকে মুখ ফিরিয়ে ডাকল, আলি আজিমভ, ওসমান তোমরা এদিকে এস।
ওরা দরজার ওপারে চুপ করে দাড়িয়ে ছিল। দেরি দেখে আহমদ মুসার খোঁজ নিতে ওরা এসেছিল। আহমদ মুসা ভেতরে একজন যুবকের সাথে গল্প করতে দেখে তারা বাইরেই দাড়িয়েছিলো।
ডাক শুনে আলি আজিমভ এবং ওসমান এফেন্দি ঘরে ঢুকে আহমদ মুসার পাশে এসে দাড়াল। আর সিষ্টার মেরী,মেরীর মা, সভেৎলানা এবং সভেৎলানার মেয়ে ঘরে ঢুকে দরজার সামনেই দাড়িয়ে থাকল।
হাসান সেনজিক আলি আজিমভদের উপর চোখ বুলিয়ে নিয়ে তাকাল মেরীদের দিকে। মেয়েদের উপর চোখ পড়তেই হাসান সেনজিক সলজ্জ চোখদু’টি সামিয়ে নিলো। মনে হলো হাসান সেনজিক খুবেই লাজুক প্রকৃতির।
আহমদ মুসা হাসান সেনজিকের দিকে ইংগিত করে বলল,এ হাসান সেনজিক,আমাদের একজন ভাই,জন্ম যুগোশস্নাভিয়ায়,আত্নগোপন করে মানুষ হয়েছে বুলগেরিয়ায় আর পালিয়ে ছিলো স্পেনে। অবশেষে হোয়াইট ওলফের হাতে পণবন্দি হয়ে এসেছে আর্মেনিয়ায়।
আলি আজিমভ ও মেরীদের পরিচয় করিয়ে দিয়ে আহমদ মুসা বলল,চল এবার উঠা যাক।
তারা ঘাটি থেকে বেরিয়ে এলো। এসে প্রধান গেটে দাড়ালো। গেটে এখনো দু’টি লাশ রক্তে ভাসছে। হাসান সেনজিকের চোখ দু’টি ভয়-বিষ্ফারিত। ঘাটির ভেতরে এমনি আরও অনেকগুলো লাশ সে দেখে এসেছে।
গেটে পৌছেই ঘুরে দাড়ালো আহমদ মুসা। পেছনেই দাড়িয়েছিল সিষ্টার মেরীরা। আহমদ মুসা সভেৎলানার দিকে তাকিয়ে বলল,আপনি এখন কি ভাবছেন?
প্রশ্ন শুনে একটু চিন্তা করল সভেৎলানা। তারপর বলল, আমি আপাততঃ লেলিনাকান যেতে চাই আমার বাবার কাছে!
-ইয়েরেভেনে ফিরে যাবেন, না এখান থেকেই?
-এখান থেকে লেলিনাকান নিকটে, আপনি যদি অন্য রকম মনে না রাখেন……
-নানা আপনি যা চাইবেন তাই হবে।
বলে আহমদ মুসা আলি আজিমভের দিকে চেয়ে বলল, তুমি এবং ওসমান এফেন্দী সভেৎলানাকে নিয়ে এখন লেলিনাকান যাবে।
সভেৎলানাকে মেরিদের কাছে বিদায় নিয়ে গাড়িতে গিয়ে উঠল। মিনিবাসের সামনের দু’’সিটে আলি আজিমভ ও ওসমান এফেন্দী আগেই উঠে বসেছিল।
আহমদ মুসা সভেৎলানার ছোট্ট মেয়ে এলিনার কপালে একটা চুমু খেয়ে গাড়িতে তুলে দিয়ে বলল, তোমার তো কোন কষ্ট হচ্ছে না মা, ক্ষুদা লেগছে?
এলিনা মাথা ঝাকিয়ে বলল, না, একটুও না।
আহমেদ মুসা সভেৎলানার দিকে এক পলক চেয়ে বলল, বোন আপনাকে বলার মত আমার কিছু নেই। শুধু প্রার্থনা করব, আল্লাহ্‌ আপনাদের ভাল রাখুন।
সভেৎলানা মুখ নিচু করে বসে ছিল। মুখ তুলে আহমদ মুসার দিকে তাকিয়ে বলল, আমার গত রাতের ব্যবহারের জন্যে আমি মাফ চাচ্ছি। যে শত্রু বন্ধুর চেয়ে বড় আপনি এমনই এক শত্রু। আপনি আমাকে নতুন জীবনের সন্ধান দিয়েছেন। আমি সে নতুন পথ যেন গ্রহণ করতে পারি, প্রার্থনা করবেন। সভেৎলানার কণ্ঠ শেষের দিকে ভারি হয়ে উঠল।
গাড়ি স্টার্ট নিল সভেৎলানার। চলতে শুরু করল গাড়ি। এলিনা হাত তুলে বলল, চাচ্চু তুমি যাবে না?
আসব মা, তুমি কি তোমার চাচ্চুকে মনে রাখবে? বলল আহমদ মুসা
–বারে তুমি তো আসবেই, ভুলব কেন? বলল এলিনা।
গাড়ি ততক্ষণে সামনে এগিয়ে গেছে।
গাড়ি থেকে মুখ বাড়িয়ে হাত নাড়ছে এলিনা।
আহমদ মুসা সেদিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে। তার চোখ যেন সেদিক থেকে সরিয়ে নিতে-পারছেনা। জগতের সকল ভাল-মন্দ, লাভ-ক্ষতির কত উর্ধ্বে শিশুরা। এমন যদি হত মানুষের সমাজ।
আহমদ মুসা ঘুরে দাড়াতেই সিষ্টার মেরী এগিয়ে গেল। বলল, ভাইয়া আমরা কি করব?
–ভাইয়ার উপর ছেড়ে দিলে হয় না? ঈষৎ হেসে আহমদ মুসা বলল।
–হয়।’ বলল সিষ্টার মেরী।
–তাহলে চল সোফিয়া এ্যাঞ্জেলার ওখানে যাই। সালমানও সেখানে আছে। সব চিন্তা সেখানে গিয়েই করব।
-বোনেরও যে কিছু কথা আছে।’ মুখ নিচু করে বলল সিষ্টার মেরী। হঠাৎ বেদনার একটা ছায়া নামল সিষ্টার মেরীর মুখে।
-বল, মেরীর মুখের দিকে চেয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বলল আহমদ মুসা।
-আমরা সোজা ইয়েরেভেন ইয়ারপোর্টে যেতে চাই।
-কোথায় যাবে?
-রোম। আমি কিছুক্ষণ আগে আমবার্ড দুর্গে ভাইয়ার সহকরী ফাদার জনসনের কাছে টেলিফোন করেছি। তিনি বাসা থেকে আমার লাগেজপত্র ও টিকিট ইয়ারপোর্টে পাঠিয়ে দিবেন। আমার টিকিট ইয়ারপোর্টে গেলে পাব জেনে নিয়েছি।
মুখ নিচু করে রেখেই কথাগুলো বলল সিষ্টার মেরী।
সঙ্গে সঙ্গে কিছু বলল না আহমদ মুসা। চিন্তা করল কিছুক্ষণ। তারপর মেরীর মা লেডি জোসেফাইনের দিকে চেয়ে বলল, আপনারও মত কি এটাই আম্মা?
-মেরী ওখানে পড়ে, আর আমার ছেলেও এখন রোমে। সুতরাং সেখানে যাওয়াটাই বোধ হয় ভাল। বলল মেরীর আম্মা।
ম্লান হাসল আহমদ মুসা। তারপর বলল, ঠিক আছে যাওয়া যাক। গাড়িতে উঠুন।
বেলা তখন ১১ টা। আহমদ মুসার গাড়ি ইয়েরেভেন ইয়ারপোর্টে বহিঃ লাউঞ্জের সিঁড়ির গোড়ায় গিয়ে দাঁড়াল।
গাড়ি দাঁড়াতেই মেরী নেমে পড়ল। নেমে হাত ধরে তার মাকে নামাল।
আহমদ মুসাও গাড়ি থেকে নেমেছিল। মেরী তার কাছে এসে বলল, আপনার আর এগুনো ঠিক হবে না ভাইয়া, আপনার জ্যাকেটের হাতটা রক্তে ভেজা।
আহমদ মুসা হাসল। বলল, ধন্যবাদ মেরী, তুমি ঠিকই বলেছ।
তারপর দু’’জনই নিরব।
মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে মেরী। পাশেই তার মা।
এ অবস্থাই কি বলতে হবে, আহমদ মুসা তা যেন খুঁজে পেল না।
কথা বলল মেরীই প্রথমে । বলল, কিছু বলবেন না ভাইয়া?
আহমদ মুসা মুখ তুলে মেরীর গম্ভীর বিষণ্ণ মুখের দিকে চেয়ে বলল, সালমানকে মাফ করে দিও মেরী। তোমরা তার অশেষ উপকার করেছ, বিনিময়ে অপুরণীয় ক্ষতি হয়েছে তোমাদের।
তৎক্ষণাৎ কোন কথা বলল না মেরী। তার শুকনো ও বেদনায় নীল হয়ে যাওয়া ঠোঁট কাঁপতে লাগল। তার দু’’গণ্ড বেয়ে নেমে এল নিরষ অশ্রুর দু’’টি ধারা।
নিজেকে সামলে নেবার চেষ্টা করে মেরী বলল, ওঁর কোন অপরাধ নেই ভাইয়া, আমিই না বুঝে ওঁকে কষ্ট দিয়েছি। আমাকে যেন ও . . . .
কথা শেষ করতে পারল না মেরী। দু’’হাতে মুখ ঢেকে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল।
মেরীর মা লেডি জোসেফাইন এগিয়ে এসে কাঁধে হাত রাখল মেরীর।
মেরী মায়ের কাঁধে মুখ গুজল।
আহমদ মুসা মুখ নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল। বেদনার একটা নিল ছায়াতারও মুখ ঢেকে দিয়েছে। কি বলবে সে মেরীকে ভেবে পেল না।
লেডি জোসেফাইনেরও চোখ ভিজা। তারও মুখে কোন কথা নেই। নিরবে মেয়ের পিঠে সে হাত বুলিয়ে দিচ্ছিল।
অসহনীয় এক নিরবতা। নিরবতা ভাঙ্গল সিষ্টার মেরীই।
রুমাল দিয়ে দু’’চোখ মুছে বলল, ভাইয়া আপনি যান, আপনি আহত।
-ভাইয়ার কিছু করার থাকলে বল মেরী।
-হোয়াইট ওলফের হাত থেকে বাঁচিয়ে ভাইয়া আমাদের নতুন জীবন দিয়েছেন। আমি জানি, আমরা যেখানেই থাকি ভাইয়া আমাদের খোজ নিবেন। মেরী থামল। একটা ঢোক গিলল মেরী। তারপর বলল, আমি পালাচ্ছি, কিন্তু সালমান আমাকে যে নতুন জীবন পথের সন্ধান দিয়েছে তা থেকে আমি পালাতে পারব না।
-খুশী হলাম মেরী। জীবনের ঐ পথ জীবনের সব ব্যথাই ভুলিয়ে দিতে পারে।
-না ভাইয়া, মানুষ সব ব্যথা ভুলতে চায়না। অনেক ব্যথা আছে যা জীবনের সঞ্চয়, জীবনের শক্তি। তা হারালে যে জীবনের সব হারিয়ে যায়।
কান্নায় রুদ্ধ হয়ে গেল মেরীর কণ্ঠ।
মেরী মুখ না তুলেই আহমদ মুসাকে ‘সালাম’ দিয়ে দ্রুত টলতে টলতে লাউঞ্জের সিঁড়ি ভেঙ্গে উপরে উঠতে লাগল। লেডি জোসেফাইন ও পেছনে পেছনে ছুটল।
আহমদ মুসা কিছুক্ষণ মেরীর পথের দিকে তাকিয়ে বিমূঢ়ের মত দাঁড়িয়ে রইল। এমন অসহায় নিজেকে যেন আর কোন দিনই মনে হয়নি।
আহমেদ মুসা ধীরে ধীরে এসে ড্রাইভিং সিটে বসল। পাশের সিটে মূর্তির মত বসেছিল হাসান সেনজিক।
চাবি ঘুরিয়ে গাড়ি স্টার্ট দিল। চলতে শুরু করল গাড়ি।
হাসান সেনজিক বলল, সালমান কে মুসা ভাই?
-ককেশাস ক্রিসেন্টের প্রধান।
-কিন্তু মিস মেরীকে এভাবে যেতে হল কেন, উনিতো দেখছি ইসলামও গ্রহণ করেছেন।
-দুঃখটাতো এখানেই হাসান। সব বলব তোমাকে। তার আগে এইটুকু জেনে রাখ মহান আল্লাহ নর-নারীর মেলামেশায় যে সীমারেখা বেধে দিয়েছেন, যেভাবেই হোক তার ব্যতিক্রম হলে হৃদয় বিদারক এ্যাকসিডেন্ট ঘটতে পারে। মানুষ তো তার প্রকৃতিকে অস্বীকার করতে পারে না।

আহমেদ মুসার গাড়ি যখন সোফিয়া এঞ্জেলাদের গেটে গিয়ে পৌছালো, ঠিক তখনই সোফিয়াদের গেট দিয়ে সালমান শামিল বের হয়ে এল হন্তদন্ত হয়ে।
আহমদ মুসাকে দেখে সালমান শামিল দ্রুত ছুটে এল। সালমান শামিলের দিকে একবার তাকিয়ে এক রাশ উদ্বেগ নিয়ে আহমদ মুসা গাড়ি থেকে নামল।
-সর্বনাশ হয়ে গেছে মুসা ভাই।
-কি হয়েছে?
-সোফিয়া এ্যাঞ্জেলাকে ওরা কিডন্যাপ করেছে।
-কখন?
-আমি পাশেই ডাক্তারের কাছে গিয়েছিলাম। এসেই শুনলাম। বিশ মিনিট হবে।
আহমদ মুসার মনে হঠাৎ একটা দৃশ্য ঝিলিক দিয়ে উঠল। আহমদ মুসার গাড়ি যখন এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে মেইন রোডে পড়ছিল, তখন একটা গাড়ি তাকে রং সাইড থেকে দ্রুত ক্রস করে। আহমদ মুসা চকিতে একবার তাকিয়েছিল গাড়িটির দিকে। তার মনে হয়েছিল, গাড়িটির পিছনের সিটে মুখ বাধা একটা মেয়ে আর তার পাশে ভীমাকৃতি একজন লোক। মুহূর্ত কালের দেখা এ দৃশ্যটাকে আহমদ মুসা দৃষ্টি ভ্রম বলে আমল দেয়নি। কিন্তু এখন দৃষ্টি ভ্রম বলে মনে হচ্ছে না।
গাড়িটির কি রং ছিল? জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা।
সোফিয়ার মা এসে গেটে দাঁড়িয়েছিল। সেই উত্তর দিল। নীল রংয়ের কার।
আহমদ মুসার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। সে গাড়িটিও নীল ছিল।
আহমদ মুসা দ্রুত বলল, সালমান শিগগীর গাড়িতে উঠ।
তারপর সোফিয়ার মা’র দিকে তাকিয়ে বলল, চিন্তা করবেন না আম্মা, আল্লাহ সহায়। আমরা শিগগীরই ফিরে আসছি।
আহমদ মুসা দ্রুত গাড়ি ঘুরিয়ে রাস্তায় নামল। তারপর তীরের মত গাড়ি ছুটে চলল ইয়েরেভেন ইয়ারপোর্ট এর দিকে।
ইয়ারপোর্টের বহির্গমন কারপার্কিং এ প্রবেশ করেই আহমদ মুসা দেখল,হাঁ, সেই নীল গাড়িটি দাড়িয়ে আছে।
আহমদ মুসার জিপটি নীল গাড়িটির গা ঘেঁষে গিয়ে দাড়াল।
গাড়ি থেকে নামল আহমদ মুসারা তিনজন।
নীল গাড়িটা খালি। পেছনের সিটের উপর একটা কুঁচকানো রুমাল পাওয়া গেল। সম্ভবতঃ এই রুমাল দিয়ে সোফিয়া এ্যাঞ্জেলার মুখ বাধা ছিল।
লাউঞ্জে প্রবেশ করল আহমদ মুসারা তিনজন।
লাউঞ্জে তখন লোকজন নেই বললেই চলে। সতর্কভাবে একবার চারিদিকে চোখ বুলিয়ে দেখল, না সোফিয়ারা লাউঞ্জে নেই। উৎকণ্ঠিত হয়ে উঠল আহমদ। কুঞ্চিত হয়ে উঠল তার কপাল।
আহমদ মুসা দ্রুত কম্পিউটার স্ক্রীনে ফ্লাইট সিডিউলের দিকে নজর করে দেখল, ৮টা ২৫ মিনিটে একটা বিমান আলবেনিয়াতে যাচ্ছে।
আহমদ মুসা ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল ৮টা১০ বাজে। চঞ্চল হয়ে উঠল আহমদ মুসা।। তাহলে এই বিমানেই ওরা সোফিয়াকে নিয়ে পালাচ্ছে?
আর একবার চারিদিকে তাকাল আহমদ মুসা অসহায়ের মত। লাউঞ্জের একপ্রান্তে নজর পড়ল সিকুরিটি কাউন্টার।
আহমদ মুসা ছুটল সেদিকে।
সিকুরিটি কাউন্টারের কাছাকাছি যেতেই ভীতা চকিতা হরিণীর মত শিথিল পায়ে সামনে এসে দাঁড়াল সিস্টার মেরী।
সে সিকুরিটি বক্সের আড়ালেই দাঁড়িয়েছিল।
সিস্টার মেরীর মুখ ফেকাসে। চোখে তার একরাশ ভয়। ঠোট তার কাঁপছে।
কি ব্যাপার মেরী, তোমার কি হয়েছে, চোখে একরাশ বিস্ময় নিয়ে বলল আহমদ মুসা।
-ওরা সোফিয়া আপাকে ধরে নিয়ে গেছে।
-ওরা কি এই বিমানে উঠেছে?
-হাঁ, তাই মনে হল।
-সোফিয়া বাধা দেয়নি, কিছু বলেনি?
-কি বলবে, পিস্তল বাগিয়ে দু’জন তার সাথেই ছিল।
-সিকুরিটির লোকেরা সে সব দেখেনি? কিছু বলেনি তারা?
-ওরা লাউঞ্জে ঢুকেই একটি ফাঁকা ফায়ার করে বলেছে, আমরা হোয়াইট ওলফের লোক। আমরা বিমানে তিনটা সিট চাই।
থামল সিস্টার মেরী।
-তারপর কি ঘটল? কেউ কিছু বলল না?
-হোয়াইট ওলফকে কিছু বলার মত কেউ নেই। তাদেরকে বোর্ডিং কার্ড দিয়ে ভিতরে পাঠিয়ে দিল।
আহমদ মুসা আর কোন কথা না বলে ছুটল সিকুরিটি বক্সের দিকে।
সিস্টার মেরী মুখ নিচু করে দাড়িয়েছিল।
সালমান শামিল তার সামনে এসে দাঁড়াল।
সিস্টার মেরী দু’হাতে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল, সালমান, কেমন করে এটা ঘটল?
-ওর দুর্ভাগ্য মেরী। শুকনো কন্ঠে বলল সালমান শামিল।
তারপর একটু থেমেই বলল, তুমি ইয়ারপোর্টে কেন? আম্মা কোথায়?
সিস্টার মেরী মুখ না তুলেই বলল, ওঁকে আড়ালে বসিয়ে রেখেছি।
তারপর সিস্টার মেরী তার ভেজা চোখটি সালমান শামিলের দিকে তুলে ধরে বলল, আমরা রোম যাচ্ছি।
-রোম যাচ্ছ? কেন? আমি তো জানি না।
সিস্টার মেরী চোখ নামিয়ে নিল। কিছু বলল না।
এই সময় সিকুরিটি কাউন্টারের দিক থেকে গরম কথা কাটাকাটির শব্দ এল।
সালমান শামিল সেদিকে ছুটল।
সালমান শামিল যখন পৌছল, তখন আহমদ মুসা বলছিল, একজন নাগরিককে দূর্বৃত্তরা ধরে নিয়ে যাচ্ছে আপনারা বাধা দিলেন না?
-ওরা দূর্বৃত্ত নয়। ওরা হোয়াইট ওলফের লোক।
-ওদের যা ইচ্ছা তাই করার অধিকার আপনারা দিয়েছেন?
-না তা আমরা দেইনি। তবে কোন কাজে ওদের সহযোগিতা আমরা যেমন করি না, তেমনি বাধা দেওয়ারও হুকুম নেই।
-ঠিক আছে তাহলে বিমান দেরি করানোর ব্যাবস্থা করুন। আমরাই ব্যাপারটা দেখছি।
বিমানবন্দরের সিকুরিটি প্রধান লোকটি মুহূর্তকাল চুপ করে থাকল। তারপর বলল, আমরা জানি, মেয়েটি জর্জ সাইমনের। তাঁর প্রতি আমার সমবেদনা আছে, কিন্তু কোন সাহায্য আপনাকে করতে পারব না। তবে আপনাকে কোন কাজে বাধা দেবনা। ব্যস।
বলে লোকটি কাউন্টার থেকে সরে গেল ভেতরের দিকে। তারপর ওয়াকিটকিটা মুখের কাছে তুলে নিচু স্বরে কি যেন নির্দেশ দিল।
আহমদ মুসা দ্রুত ছুটল ভেতরের লাউঞ্জের দিকে। পথেই পেল সে ফ্লাইট ইনফরমেশন কাউন্টার।
আহমদ মুসা কাউন্টারের অফিসারকে দ্রুত বলল আলবেনিয়ার ফ্লাইট কিছু দেরী করাতে, অপারেশন ডাইরেক্টরকে কোথায় পাব?
-এক বিশেষ যাত্রী আসবেন, ফ্লাইট দেরী করানো হয়েছে ৯ টা পর্যন্ত। অফিসারটি হেসে জবাব দিল।
‘ধন্যবাদ’ বলে আহমদ মুসা এবার বিমানের গ্যাং ওয়েতে ঢোকার জন্য দ্রুত পায়ে যাত্রী প্রবেশের দরজার দিকে ছুটল।
দরজায় দু’জন অফিসার দাঁড়িয়েছিল বোর্ডিং কার্ড চেক করার জন্য। আহমদ মুসাদেরকে ওরা বাধা দিল না। ভেতরে ঢুকেই আহমদ মুসা বিমানবন্দরের সেই সিকুরিটি চীফকে দেখতে পেল।
আহমদ মুসা তাকে কিছু বলতে যাচ্ছিল। কিন্তু বাধা দিয়ে সেই সিকুরিটি অফিসার নিচু গলায় বলল। ওরা গাংওয়ে লাউঞ্জে বসে আছে, ওদের আরেকজন কে আসবে, তারপর বিমানে উঠবে ওরা।
বলেই সে দরজা দিয়ে দ্রুত বেরিয়ে গেল। আহমদ মুসা তাকে ধন্যবাদ জানানোরও সুযোগ পেল না।
আহমদ মুসা এবার প্যান্টের পকেটে হাত ঢুকিয়ে নিঃশব্দে বিড়ালের মত সামনে এগুতে লাগল। তাঁর পিছনে সালমান শামিল, হাসান সেনজিক এবং সিস্টার মেরী।
আহমদ মুসা গাংওয়ে লাউঞ্জে ঢোকার সিকুরিটি প্যাসেজের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। দেখল নিরাপত্তা প্রহরী কেউ নেই। আহম্মদ মুসা বুঝল, সিকুরিটি চিফ সবাইকে সরিয়ে নিয়েছে।
আহমদ মুসা পেছন ফিরে সালমান শামিলকে বলল, তোমরা সবাই এখানে দাঁড়াও, প্রয়োজন না হলে লাউঞ্জে ঢুকবে না।
সালমান শামিল কিছু বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু আহমদ মুসার শক্ত হয়ে উঠা চোখের দিকে তাকিয়ে কিছু বলতে সাহস পেল না। শুধু মাথা নেড়ে তার সম্মতি জানাল।
আহমদ মুসা ধীর পায়ে লাউঞ্জের ভেতরে ঢুকে গেল। সালমান শামিল হাত দিয়ে পকেটের রিভলভারটা একবার স্পর্শ করে শুকনো মুখে লাউঞ্জের দরজার দিকে নজর রাখল।
আহমদ মুসা ডান হাতটি পকেটে ঢুকিয়ে স্বচ্ছন্দে হেটে প্রবেশ করল লাউঞ্জে।
লাউঞ্জে প্রবেশ করেই তার চোখে পড়ল, লাউঞ্জের এ দরজার দিকে মুখ করেই কিছু দুরে সোফায় বসে আছে সোফিয়া এ্যাঞ্জেলা। তার মুখ নিচু। তার পাশেই হোয়াইট ওলফের একজন লোক। হাতে তার পিস্তল। তার চোখটা ছিল ওপাশে গ্যাংওয়ের দিকে।
আহমদ মুসা অনেক পথ সামনে এগিয়েছে। হঠাৎ তার খেয়াল হলো, ও একা কেন? হোয়াইট ওলফের ওরা দু’জন তো। তার মাথায় ঝিলিক দিয়ে উঠল, ওকি আশে-পাশে কোথাও কিংবা টয়লেটে?
ঠিক এই সময়েই মুখ তুলেছে সোফিয়া এ্যাঞ্জেলা। আহমদ মুসাকে সামনে দেখেই আর্তস্বরে বলে উঠল, মুসা ভাই আপনি……
আহমদ মুসা মুখে আঙ্গুল তুলে তাকে চুপ করানোর আগেই তার কথা অর্ধেক বলা হয়ে গেছে।
হোয়াইট ওলফের লোকটি সোফিয়ার মুখে শব্দ উচ্চারিত হবার সাথে সাথেই বিদ্যুৎ বেগে মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছে। সাথে সাথে উঁচু হয়েছে তার পিস্তল।
কিন্তু তার পিস্তলটি উঠে আসার আগেই আহমদ মুসার রিভলভারটি লোকটির কপাল বরাবর উঠে গেছে। আহমদ মুসা কঠোর কন্ঠে বলল, রিভলভার ফেলে দাও।
ঠিক এই সময়েই আহমদ মুসা তার পেছনে অস্পষ্ট পায়ের শব্দ পেল। কে তার পেছনে এমন চিন্তা যখন সে করছে সেই সময়ই রিভলভারের একটা শক্ত নল ক্রমে তার মাথায় ঠেকল। পেছন থেকে কে ভারি গলায় বলে উঠল, আহ! আহমদ মুসা তোমাকে এভাবে পেয়ে যাব তা ভাবিনি। ফেলে দাও রিভলভার।
আহমদ মুসা হোয়াইট ওলফকে চেনে। কোন কাজে বিলম্ব করা ওদের অভিধানে নেই।
আহমদ মুসা রিভলভার ফেলে দিল।
ওদিকে মুসার মাথায় পিস্তল ঠেকাতে দেখেই উদ্বিগ্ন, উত্তেজিত সালমান শামিল পিস্তল বাগিয়ে লাউঞ্জে প্রবেশ করল। তার পিস্তলটি উঠে এল আহমদ মুসার পেছনে দাড়ানো লোকটির মাথা লক্ষ্য করে। কিন্তু সে দেখতে পাইনি তাকে লক্ষ্য করে সোফায় বসা হোয়াইট উলফের প্রথম লোকটির পিস্তল উঁচু হয়েছে।
সালমান শামিলের পেছনে পেছনে সিষ্টার মেরীও লাউঞ্জে প্রবেশ করেছিল। সে সোফায় বসা লোকটির পিস্তল তাক করা দেখতে পেয়েছে। সে মুহূর্তে পাগলের মত ছুটে গিয়ে সে লোকটির পিস্তলের সামনে দাঁড়াল। সংগে সংগেই গুলির শব্দ।
একই সময় সালমান শামিলের পিস্তলও অগ্নি উদগীরণ করেছে।
একই সংগে দু’টি দেহ লাউঞ্জের মেঝেয় গড়িয়ে পড়ল।
সোফার লোকটির পিস্তলের গুলিতে সিষ্টার মেরীর বুক ভেদ করেছে, আর সালমান শামিলের গুলি আহমদ মুসার পেছনের লোকটির মাথা গুড়িয়ে দিয়েছে।
আহমদ মুসা গুলির শব্দ শোনার সংগে সংগেই বসে পড়েছিল। বসে পড়েই তুলে নিয়েছিল তার পিস্তল।
সোফায় বসা লোকটি তখন উঠে দাঁড়িয়েছিল, সে পিস্তল ঘুরিয়ে নিচ্ছিল আহমদ মুসার দিকে।
কিন্তু হোয়াইট ওলফের লোকটি দ্বিতীয় গুলি করার সুযোগ আর পেলনা। আহমদ মুসা শুয়ে থেকেই গুলি করল। মাথা গুড়ো হয়ে গেল লোকটির। সোফার উপরই গড়িয়ে পড়ল তার দেহ।
এদিকে সালমান শামিল সিষ্টার মেরীকে গুলি খেয়ে পড়ে যেতে দেখেই পিস্তল ফেলে দিয়ে ছুটে এসেছিল সিষ্টার মেরীর কাছে।
সিষ্টার মেরীর বুকে গুলি লেগেছিল। সর্বাঙ্গ কাঁপছিল সিষ্টার মেরীর।
সালমান শামিল পাশে বসে সিষ্টার মেরীর মাথা হাতে তুলে নিল।
চোখ মেলল সিষ্টার মেরী। সালমান শামিলের দিকে চোখ পড়তেই বলল, ভাল আছ তুমি? তোমার কিছু হয়নি তো?
সিষ্টার মেরীর প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে সালমান শামিল রুদ্ধ কন্ঠে বলল, তুমি এ কি করলে মেরী?
-আমার খুব আনন্দ সালমান, জীবনের চেয়ে শতগুন ভাল লাগছে আমার এ মৃত্যু।
সোফিয়া এ্যাঞ্জেলা এসে সালমান শামিলের পাশে বসেছিল।
সে সিষ্টার মেরীর মুখের উপর মুখ রেখে কেঁদে উঠল, এ কি হল মেরী?
এই সময় সিষ্টার মেরীর মা ছুটে এসে মেরীর বুকে লুটিয়ে পড়ল।
সিষ্টার মেরী তার দূর্বল হাত দিয়ে মায়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিল। দূর্বল হয়ে পড়েছে সিষ্টার মেরী। জীবনী শক্তি তার নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে। দুর্বল কন্ঠে সে ডাকল, মা।
সিষ্টার মেরীর মা লেডি জোসেফাইন মাথা তুলে তাকাল মেয়ের দিকে।
সিষ্টার মেরী মুখ তুলে তাকাল সালমান শামিলের দিকে। বলল, মা এ তোমার ছেলে। তারপর সোফিয়া এ্যাঞ্জেলার দিকে চোখ তুলে বলল, এ তোমার মেয়ে মা। আমি এঁদের মাঝেই বেঁচে থাকব।
কথা শেষ করেই চোখ বন্ধ করে ঝিমিয়ে পড়ল। মুহূর্ত পরেই চোখ খুলে আহমদ মুসার দিকে তাকাল। আহমদ মুসা পাশেই পাথরের মত স্থির হয়ে বসেছিল। সিষ্টার মেরী তার দুর্বল দৃষ্টি জোর করে তার দিকে মেলে ধরে বলল, মুসা ভাই সাক্ষি থেকো আমি মুসলমান, লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মা–দুর রাসূ–লু–ল্লা–হ।
চোখ দু’টি বন্ধ হয়ে গেল সিষ্টার মেরীর। যেন ঘুমিয়ে পড়ল সে।
সিষ্টার মেরীর মা মেরীর বুকের উপর আছড়ে পড়ে ডুকরে কেঁদে উঠল।
আহমদ মুসা উঠে দাড়াল। তার দু’চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়েছে দু’ফোটা অশ্রু।
দু’হাতে মুখ ঢেকে ফুঁফিয়ে কাঁদছে সোফিয়া এ্যাঞ্জেলা। অশ্রু সালমান শামিলের চোখে। যেন এ জগতে নেই সে।
পাশেই দাড়িয়েছিল হাসান সেনজিক। বিমুঢ়-বেদনায় বিধ্বস্ত তার চোখ-মুখ।
আহমদ মুসা হাসান সেনজিককে বলল, তুমি এখানে দাড়াও, আমি ওদের দেখি।
বলে আহমদ মুসা লাউঞ্জের দরজা দিয়ে ওদিকে চলে গেল।
দরজা পেরুতেই দেখল, চিফ সিকুরিটি অফিসার কয়েকজনকে সাথে নিয়ে আসছে।
সেই প্রথম কথা বলল, সব জেনেছি আমি। এখন এয়ারপোর্ট থানায় আপনি অথবা আপনাদের অন্য কেউ ডাইরী করে আসুন। সাক্ষি হিসেবে আমাকে রাখবেন।
-অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। বলে আহমদ মুসা আবার লাউঞ্জে ফিরে এল।
ধীরে ধীরে আহমদ মুসা সালমান শামিলের কাধে হাত রেখে বলল, সালমান তুমি এস জরুরী কাজ। তোমাকে থানায় যেতে হবে। তারপর তাকে সব কথা বুঝিয়ে বলল।
চলে গেল সালমান শামিল। তার সাথে গেল চিফ সিকুরিটি অফিসার।

ইয়েরেভেনে আহমদ মুসার দু’টো দিন খুব ব্যস্ত কাটল। হোয়াইট ওলফের প্রতিরোধের যে পকেটগুলো অবশিষ্ট ছিল, তাও ধ্বংস করা হলো।
| | | Next → | | সম্পুর্ণ বই এক পেজে »

Top