১০. বলকানের কান্না

চ্যাপ্টার

আর্মেনিয়া ও আজারবাইজানের ককেশাস ক্রিসেন্টকে পুনর্গঠিত ও পুনর্বিন্যস্ত করা হলো। আবার প্রয়োজন না হলে অস্ত্র হাতে নেয়াকে পরিহার করা হলো। ঠিক করা হলো, রাজনৈতিক পথেই সামনে এগুতে হবে। আর যে টুকু বাকি আজাদীর, তা রাজনৈতিক আন্দোলনের মাধ্যমেই শেষ করা যাবে।
এক ঘন্টার ব্যবধানে ‘তিরানা’ ও ‘রোম’ এর বিমান দু’টি ছাড়বে। আলবেনিয়ার রাজধানী ‘তিরানা’য় যাওয়ার বিমানটি ছাড়বে ৮টা ২৫ মিনিটে আর রোমের বিমানটি ছাড়বে সোয়া ন’টায়।
সিষ্টার মেরীর মা লেডী জোসিফাইন কে নিয়ে সোফিয়া এ্যাঞ্জেলার মা, সোফিয়া এ্যাঞ্জেলা এবং সালমান শামিল যাচ্ছে রোম। আহমদ মুসা এবং হাসান সেনজিক যাচ্ছে ‘তিরানা’। বহু চিন্তা করে আহমদ মুসা তিরানা যাওয়াই যুক্তি যুক্ত মনে করেছে। সোজা বেলগ্রেডে গেলে সহজেই মিলেশ বাহিনী’র চোখে পড়ার সম্ভবনা আছে। হাসান সেনজিকের ফটো নিশ্চয় ওরা এতদিনে যেগাড় করেছে। আর তিরানা গিয়ে যদি সড়ক পথে বেলগ্রেড যাওয়া যায় তাহলে ওদের চোখকে ফাঁকি দেয়া অনেক খানিই সহজ হবে।
তিরানাগামী বিমান টারমাকে রেডি। যাত্রীরা উঠতে শুরু করেছে।
আহমদ মুসা ও হাসান সেনজিক উঠে দাঁড়াল।
সিষ্টার মেরীর মা, লেডি জোসেফাইন, সোফিয়া এ্যাঞ্জেলা, সালমান শামিল, ওসামন এফেন্দী, আলি আজিমভ এবং আরও যারা বিদায় জানাতে এসেছিল সবাই উঠে দাঁড়াল।
সিষ্টার মেরীর মা ও লেডি জোসেফাইন দুজনেই পাশাপাশি দাঁড়িয়েছিল।
আহমদ মুসা ওদের সামনে গিয়ে মাথা নিচু করে বলল, আসি আম্মা। আপনাদের যে অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে, আল্লাহ তার জাযাহ আপনাদেরকে দিন।
-এসব কথা বলোনা বাবা, অনেক হারিয়েই তো তোমাদের মত অনেক ছেলেকে পেয়েছি।
দু’জনেই একবাক্যে কথাগুলো বলল।
একটু থেমে লেডি জোজেফাইন বলল, কি বলব বাবা, চাইলেই তো হবেনা, তোমাদের মত ছেলেদের কোন মা’ই তার কাছে ধরে রাখতে পারে না।
সোফিয়া এ্যাঞ্জেলার মা বলল, যাও বাবা, দোয়া করি, তাড়াতাড়ি আবার আমাদের মাঝে ফিরে এস।
সালমান শামিল, ওসমান এফেন্দীর চোখে পানি টল টল করছিল।
আহমদ মুসা সালমান শামিল ও ওসামান এফেন্দীর পিঠ চাপড়ে বলল, পাগল, আল্লাহর সৈনিকরা তো কাঁদেনা এভাবে, গোটা দুনিয়ায় তাদের ঘর।
গায়ে-মাথায় ওড়না জড়িয়ে এক প্রান্তে দাঁড়িয়ে ছিল সোফিয়া এ্যাঞ্জেলা। তার মাথার ওড়নার প্রান্ত কপালের নিচ পর্যন্ত নেমে এসেছে। সেদিকে তাকিয়ে খুশী হল আহমদ মুসা। সোফিয়া তাহলে আপনা থেকেই পর্দা করা শুরু করেছে। আসলে মানুষের মনই সব। মন থেকে মানুষ যখন কোন আদর্শ গ্রহন করে তখন তার বাহিরটাও সেই আদর্শের দাবী অনুসারে আপনাতেই পরিবর্তিত হয়ে যায়।
আহমদ মুসা তার কাছে গিয়ে বলল, আসি বোন।
-আমাদের জন্যে দোয়া করবেন। আর সাবধানে থাকবেন, নিজের যত্ন নিবেন। আপনার আঘাত এখনও সারেনি।
সোফিয় এ্যাঞ্জেলার শেষের কথা গুলো ভারী হয়ে উঠল। মুখ নিচু রেখেই কথা বলছিল সোফিয়া এ্যাঞ্জেলা।
‘শুকরিয়া বোন, আল্লাহ তোমাদের ভাল রাখুন’ বলে আহমদ মুসা অন্য সবাই এর কাছে বিদায় নিয়ে লাউঞ্জ থেকে বেরিয়ে এল।
আহমদ মুসা এবং হাসান সেনজিক হেটে হেটেই এগুচ্ছিল বিমানের দিকে।
‘মুসা ভাই’ হঠাৎ পেছন থেকে সালমান শামিলের ডাক শুনতে পেল আহমদ মুসা। থমকে দাঁড়িয়ে পেছন ফিরে তাকাল সে। তাকিয়েই দেখতে পেল, ডঃ পল জনসন এবং তার মেয়ে মারিয়া জনসন দ্রুত এগিয়ে আসছে। তাদের সাথে সালমান শামিল এবং সোফিয়া এ্যাঞ্জেলা।
আহমদ মুসাও পেছন ফিরে তাদের দিকে হাটা শুরু করল।
ডঃ পল জনসন কাছাকাছি হতেই আহমদ মুসা অত্যন্ত বিনীতভাবে বলল, আমাকে মাফ করবেন জনাব, আপনার সাথে দেখা না করে অন্যায় হয়েছে।
ডঃ পল জনসন এসে আহমদ মুসাকে বুকে জড়িয়ে ধরল। বলল, তোমরা যুদ্ধের ময়দানে আছ, তোমার কিছুই অন্যায় হয়নি বৎস।
কয়েক মুহুর্তবাদ আহমদ মুসাকে আলিঙ্গন থেকে ছেড়ে দিয়ে বলল, যুদ্ধ বিজয়ী বীরকে আমি স্বাগত জানাতে এসেছি, আমি আজ উচ্চস্বরে বলতে পারি বৎস, তোমরা যে বুদ্ধি, প্রজ্ঞা ও গতি দিয়ে হোয়াইট ওলফকে জয় করেছ, তার কাছে গোটা বিশ্বই পদানত হবে। অন্যের কাছে অস্ত্র ও শক্তি আছে, কিন্তু তোমাদের বাড়তি আছে উদ্দেশ্যের মহত্ব ও চরিত্র, যা আর কারো কাছে নেই।
-আপনার কথাকে আল্লাহ সত্য করুন। মাথা নিচু করে বিনীত কন্ঠে বলল আহমদ মুসা। একটু থেমে আহমদ মুসা বলল, জনাব আমরা রাজ্য ও সম্পদের জন্যে লড়াই করছিনা। ইসলামের লড়াই আল্লাহর বান্দাদেরকে মানুষের দাসত্ব, শোষণ ও নীপিড়ন থেকে মুক্তি করার জন্যে এবং আল্লাহর সৃষ্টি হিসেবে মানুষের অধিকার মানুষকে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্যে।
-এ লড়াই তোমাদের সফল হোক বৎস।
-এ লড়াই কি আপনারও হতে পারেনা? মাথা তুলে ডঃ পল জসসনের মুখের দিকে চেয়ে প্রশ্ন করল আহমদ মুসা। মুহূর্তকাল নিরব থাকল ডঃ পল জনসন।
তারপর ডঃ পল জনসন তার ডান হাত বাড়িয়ে আহমদ মুসার হাত চেপে ধরে বলল, আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, আল্লাহ ছাড়া আর কোন মা’বুদ নেই, মোহাম্মদ (স:) তাঁর প্রেরিত রসূল।
আহমদ মুসা বুকে জড়িয়ে ধরল ডঃ পল জনসনকে। বলল, জনাব আপনার এই ঘোষণা আর্মেনীয়া-আজারবাইজানের নতুন দিনের বার্তাবহ হোক।
ডঃ পল জনসন্ন আলিংগন মুক্ত হয়ে গম্ভীর কন্ঠে বলল, দোয়া কর বৎস।
পাশেই দাঁড়িয়েছিল মারিয়া জনসন। তার চোখে আনন্দোর ঝিলিক।
আহমদ মুসা তার দিকে চাইতেই সে বলল, আমি সোফিয়া আপার কাছে কালেমা আগেই পড়ে নিয়েছি ভাইজান।
-সোফিয়া এখন বুঝি গুরুর ভূমিকায়? হেসে বলল আহমদ মুসা।
-হবে না? জানেন না আপনি, সোফিয়া আপা অনেক জানেন।
এই সময় বিমানরে এক অফিসারের কাছ থেকে আহবান এল সময় আর নেই।
আহমদ মুসা দ্রুত সবার কাছ থেকে বিদায় নিল। বিদায় দিতে গিয়ে চপলা চঞ্চলা মারিয়া জনসন ঝর ঝর করে কেঁদে ফেলল। বলল, ভাইজান আবার আপনাকে দেখতে পাব?
আহমদ মুসা কোন জবাব দিলনা, দিতে পারল না। কি জবাব দেবে। এর জবাব তো তারও জানা নেই।
আহমদ মুসা ঘুরে দাঁড়িয়ে পা চালান বিমানের সিড়ির দিকে।
সিড়ির গোড়ায় গিয়ে পেছন ফিরে তাকাল আহমদ মুসা। সোফিয়া এ্যাঞ্জেলা এবং মারিয়া জনসন দু’জনেই চোখ মুছছিল।
ঘুরে দাঁড়িয়ে বিমানের সিড়িতে পা রাখল আহমদ মুসা। মনে পড়ল সিংকিয়াং এর উরুমুচি বিমান বন্দরে আমিনার এমন সজল চোখই সে দেখে এসেছিল। গতকালও টেলিফোনে আমিনা কান্নায় কথা বলতে পারেনি। ওর সে কান্নার কাছে নিজেকে বড় হৃদয়হীন মনে হয়েছে আহমদ মুসার। ওরা এত কোমল বলেই পুরুষরা এতটা কঠোর।
আহমদ মুসা বিমানের শেষ সিড়ি পেরিয়ে প্রবেশ করল বিমানে।
দু’জনের পাশাপাশি সিট। বসে পড়ল আহমদ মুসা এবং হাসান সেনজিক দু’জনেই।
ওরা দু’জনেই আর্মেনিয়ার নাগরিক হিসেবে আলবেনিয়ার ভিসা নিয়ে প্রবেশ করেছে আলবেনিয়ায়।
সিট বেল্ট বাঁধছিল হাসান সেনজিক। বাঁধতে বাঁধতে বলল, মুসা ভাই, মনে হচ্ছে আমি স্বপ্ন দেখছি। স্বপ্নে যেমন ১০ বছরের ঘটনা ১০ মিনিটেও দেখা যায়, তেমনি বহু বছরের জানা যেন আমার দু’দিনেই জানা হয়ে গেল। আমার সমাজ, আমর ধর্ম, আমার আদর্শকে যেন আমি প্রথমবারের মত উপলব্ধি করছি, জানছি, বুঝছি, দু’দিনে আমার নতুন জন্ম হয়েছে মুসা ভাই।
থামল হাসান সেনজিক।
আহমদ মুসা হাসান সেনজিকের পিঠ চাপড়ে বলল, এই তো চাই। বলকানকে জাগাবার দায়িত্ব যে তোমাদেরই নিতে হবে।
-নেতার আনুগত্য, নেতার প্রতি ভালবাসা কেমন হতে হয় তাও শিখলাম মুসা ভাই। বলল, হাসান সেনজিক।
-ইসলামে নেতা-কর্মী কোন ভেদাভেদ নেই হাসান সেনজিক, সবাই এখানে ভাই ভাই।
মুসা ভাই, আমি আলী আজিমভ ভাই এর কাছে সব শুনেছি। আপনার যাত্রা শুরু ফিলিস্তিনে। সেখান থেকে মিন্দানাওয়ে তারপর মধ্য এশিয়ায়। সেখান থেকে চীনে, চীন থেকে আর্মেনিয়ায়। এখন বলকানের পথে। আপনি এক বিস্ময় মুসা ভাই।
-এমনভাবে বলনা হাসান সেনজিক। আমরা সাবই আল্লাহর বান্দাহ। কাজ তো তিনিই করান। সব প্রশংসা তো তাঁরই।
একটু থামল আহমদ মুসা। তারপর আবার শুরু করল, মুসলমানরা সুখ-সম্পদ নিয়ে বসে থেকে জীবন কাটানোর মত কোন জাতি নয়। মুসলমানরা মিশনারী এক জাতি। এক মহা মিশন দিয়ে আল্লাহ তাদের দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন। এই দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে তাকে হতে হয় এক অস্থির বিপ্লবী। যেখানেই আল্লাহর বান্দারা শোষণ অত্যাচারে জর্জরিত, যেখানেই তাদের স্বাধীনতা বিপর্যস্ত, সেখানেই ঐ বিপ্লবীদের ছুটে যেতে হয় মানুষের মুক্তির বার্তা নিয়ে। কোন দেশের সীমার মাঝে তারা বাধ্য থাকবে কেমন করে?
থামল আহমদ মুসা।
শান্ত কন্ঠে ধীরে ধীরে শুরু করল হাসান সেনজিক, কিছু মনে করবেন না মুসা ভাই, আপনি আমার ম’র চোখের জল মুছাবার জন্যে আমাকে নিয়ে যাচ্ছেন আমার মা’র কাছে। কিন্তু আপনি কি আরেকজনের কান্নাকে পদদলিত করছেন না?
সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিল না আহমদ মুসা।
একটু ধীর কন্ঠে বলল, হয়তো করছি হাসান সেনজিক। কিন্তু সেটা একজনের ব্যক্তিগত কান্না। কিন্তু তোমার মা’র কান্না শুধু তোমার মা’র নয়। গোটা বলকানের অসংখ্য মুসলিম জনপদের লাখো হৃদয়ের কান্না আমি শুনতে পেয়েছি তোমার মায়ের কান্নায়।
থামল আহমদ মুসা।
হাসান সেনজিক পলকহীন দৃষ্টিতে চেয়ে আছে আহমদ মুসার দিকে। বিহব্বল তার দৃষ্টি।
অনেকক্ষণ পর ধীর কন্ঠে বলল হাসান সেনজিক, মুসা ভাই, আমার বলকানকে তো এভাবে কখনও ভাবিনি, কখনও তো দেখিনি বলকানকে এভাবে। কি জাদু জানেন আপনি মুসা ভাই, কি শোনালেন আপনি। বলকানের যুগোশ্লাভিয়া,বুলগেরিয়া, আলবেনিয়া এবং গ্রীসের লাখো মজলুম মুসলিমের কান্না যে আমি চোখ দিয়ে দেখতে পাচ্ছি। এতদিন তো বুঝিনি আমার কান্না, আমার মা’র কান্না তাদের কান্নারই একটা অংশ।
থামল হাসান সেনজিক।
তার দু’চোখের পাতা ভিজে উঠেছে অব্যক্ত এক বেদনার দুঃসহ ভারে।
আহমদ মুসা কোন কথা বলল না। শুধু সস্নেহে তার পিঠে হাত বুলাল।
বিমান তখন টেক-অফ পর্যায়ে। ভীষণ চাপা শব্দতুলে অস্থির ভাবে কেঁপে চলেছে বিমানটি। এগুচ্ছে ধীরে ধীরে সামনে।
এক সময় মাটির স্পর্শ ছিন্ন করে বিমানটি পাখা মেলল আকাশে। | ← Previous | | | Next → | | সম্পুর্ণ বই এক পেজে »
Top