১০. বলকানের কান্না

চ্যাপ্টার

যে লোকটি পিস্তল বাগিয়ে গেটের বাইরে এসেছিল, তাকে দেখেই আহমদ মুসা চিনতে পারল। বিমান বন্দরে গাড়ির ড্রাইভার বাদে আরও যে দু’জন গাড়ির ওপাশে দাঁড়িয়েছিল তাদেরই একজন সে।
আহমদ মুসা খুশী হলো এই ভেবে, তার মিশনকে আল্লাহ প্রথমেই সাফল্যের মুখ দেখালেন। ঠিক জায়গায় সে এসেছে। তার মনে একটা ক্ষীন সন্দেহ ছিল, গাড়িটি জেমস জেংগার হলেও হাসান সেনজিককে তারা জেংগার বাড়ীতেই তুলবে তার কোন কথা নেই। কিন্তু এখন সে নিশ্চিত হাসান সেনজিককে তারা জেংগার বাড়িতেই এনেছে।
আহমদ মুসা আগেই ঠিক করে নিয়েছিল, তাদের হাতে ধরা পড়ার মাধ্যমে সে দ্রুত এবং সহজে জেংগা কিংবা হাসান সেনজিকের কাছে পৌছতে পারবে যা তার জন্য খুবই জরুরী।
–আমি হাসান সেনজিকের বন্ধু। তার ব্যাপারে আমি তার সাথে কথা বলব।
জেংগার কাছে সে আছে তা তোমাকে কে বলেছে?
আহমদ মুসা চমকে উঠল। এমন প্রশ্নের মুখোমুখি হবার কথা তো চিন্তা করেনি। তাড়াতাড়ি কথা স্থির করে নিল। বলল, কেউ বলেনি, আমি জেনেছি। কেমন করে জেনেছি তা জেংগাকেই বলব।
তারা গেট রুমে এসে পড়েছে।
আহমদ মুসার কথা শেষ হতেই পিস্তলধারী লোকটি তার পিস্তলের বাট দিয়ে আহমদ মুসার ঘাড়ে একটা বাড়ি দিয়ে বলল, তুমি খুব সেয়ানা লোক দেখছি, চল জেংগার কাছেই। মজাটা ওখানেই হবে।
বলে লোকটি টেলিফোন হাতে নিল।
আরেকজন লোক, মনে হলো সেই আসল গেটম্যান, পিস্তল বাগিয়ে থাকল আহমদ মুসার দিকে।
সম্ভবত লোকটি টেলিফোনে জেংগার সাথে কথা বলল।
কথা শেষ করে বলল, চল জেংগা তোমাকে স্বাগত জানাবার জন্য প্রস্তুত হয়ে আছেন।
বলে পিস্তলের নল আহমদ মুসার ঘাড়ে ঠেকিয়ে সামনের দিকে ধাক্কা দিল।
জেমস জেংগার তিনতলা বাড়ী। গেট থেকে একটা ফুটবল মাঠের মত ফাঁকা জায়গা। পুকুরের উত্তর ধারে দক্ষিণমুখী হয়ে দাঁড়ানো বাড়ীটি। গেট থেকে বেরিয়ে লাল ইটের একটা সুন্দর রাস্তা পুকুরের পাড় দিয়ে বিল্ডিং এর সিঁড়িতে গিয়ে ঠেকেছে।
পুরানো বাড়ী। একতলাটাই মাটি থেকে বেশ উঁচু। সিঁড়ির চারটা ধাপ ভেঙে এক তলার বারান্দায় উঠতে হয়। উঠার পরেই দোতলায় উঠার সিঁড়ি।
পিস্তল ধারী আহমদ মুসাকে দু’তালায় হল ঘরে নিয়ে এল।
আহমদ মুসা বুঝল জেমস জেংগার এটাই সাধারণ বৈঠকখানা। ঘরের তিন দিকে সোফা সাজানো। উত্তর দিকটায় জেমস জেংগার সিংহাসন আকারের এক আসন। তার আশে পাশে কোন চেয়ার নেই। অর্থাৎ জেমস জেংগার সহকারী কেউ নেই। সবাই তার হুকুম তামিলকারী। জেমস জেংগার মত আধা ক্রিমিনাল আধা পলিটিশিয়ানদের ক্ষেত্রে এটাই হয়। এরা হয় অত্যন্ত আত্মবিশ্বাসী। সবাইকে ব্যবহার করে, মর্যাদা দেয় না কাউকেই।

গোটা কক্ষ লাল কার্পেটে ঢাকা। সোফাগুলো কিন্তু সাদা, জেংগার সিংহাসনটাও। কনট্রাষ্টটা খুবই চোখে লাগছিল। কালার কম্বিনেশন থেকে আহমদ মুসা মনে করল, জেমস জেংগার বুদ্ধি স্থূল, কিন্তু নার্ভ খু্বই শক্তিশালী।
জেমস জেংগার দিকে তাকিয়েও আহমদ মুসা এরই সমর্থন পেল । তার দেহের তুলনায় তার মাথাটা ছোট ।
আহমদ মুসাকে দেখেই জেমস জেংগা হেড়ে গলায় বলে উঠল, ফেউ তো দেখি খাসা, সে কি বলেরে টমাস?
–হাসান সেনজিকের ব্যাপারে সে আপনার সাথে কথা বলতে চায়।
–জানল কি করে যে হাসান সেনজিকের খবর আমার কাছে আছে?
–সেটাও সে নাকি আপনার কাছেই বলবে।
–বেশ জিজ্ঞাসা কর, আমার কথা তাকে কে বলেছে।
টমাস তাকে জিজ্ঞাসা করার আগেই আহমদ মুসা বলল, সিটি করপোরেশনের অফিসে গিয়ে গাড়ির নাম্বার থেকে নাম সংগ্রহ করেছি।
মিথ্যা কথা বলার চেয়ে সত্য কথা বলার মধ্যে ঝামেলা কম দেখছিল আহমদ মুসা। সত্য কথাই সে বলল।
টমাস নামের লোকটি পাশে একটু দূরে দাঁড়িয়ে আহমদ মুসার দিকে পিস্তল তাক করে দাঁড়িয়েছিল।
আহমদ মুসার কথা শোনার পর জেমস জেংগার মুখ গম্ভীর হয়ে উঠল। সে বলল, টমাস ফেউটাকে সার্চ করেছ?
–না। বলল টমাস।
পাশ থেকে পিস্তলটা হাতে তুলে নিয়ে জেমস জেংগা চিৎকার করে উঠল গর্দভ কোথাকার । তোমরা কি ঘাস খাও নাকি?
টমাস দ্রুত এসে আহমদ মুসার কোট ও প্যান্টের পকেট সার্চ করল। সাদা একটা পিস্তল ছাড়া আর কিছুই পেল না।
টমাস পিস্তলটি নিয়ে জেমস জেংগার পাশের টিপয়টিতে রেখে দিল।
আহমদ মুসার পকেট থেকে পিস্তল বের হবার পর জেমস জেংগার গম্ভীর মুখের দু’পাশে তার চোখ ক্রোধে জ্বলে উঠেছিল।
টমাস সরে এসে তার জায়গায় দাঁড়ানোর পর জেমস জেংগা তার সিংহাসন থেকে উঠল । ধীরে ধীরে এগিয়ে এল আহমদ মুসার দিকে।
এসে দাঁড়াল আহমদ মুসার সামনে। জ্বলছিল তার চোখ দু’টি। বলল, সিটি করপোরেশন আমার নামটা নিয়ে তোমার জন্যে বোধ হয় বসেছিল? মিথ্যা বলার যায়গা পাওনি।
বলে জেমস জেংগা অকস্মাৎ এক ঘুষি চালাল আহমদ মুসার মুখ লক্ষ্য করে।
আহমদ মুসা এটা আশা করেন নি। শেষ মুহুর্তে মুখ সরিয়ে নেয়ার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু অদ্ভুত ক্ষিপ্র জেমস জেংগা। ঘুষিটা তার পূর্ণ ওজন নিয়ে আঘাত করল বাম চোখের উপরটায়।
আহমদ মুসা পড়ে যেতে যেতে আবার দাঁড়িয়ে গেল।
আহমদ মুসার মনে হল তার কপালের হাড়টা যেন ভেঙ্গে গেছে। জেমস জেংগার আঙ্গুলে বোধ হয় আংটি ছিল। মনে হল ওটা কপালে বুলেটের মত বসে গেছে। কপাল থেকে চোখের পাশ দিয়ে কিছু নেমে এল। আহমদ মুসা বুঝল কপাল কেটে গেছে।
আহমদ মুসা স্থির হয়ে দাঁড়াতেই জেমস জেংগা আবার চিৎকার করে উঠল, বল কুত্তা কে বলেছে আমার নাম, না বললে টুকরো টুকরো করে তোকে কুত্তাকে খাওয়াব।
–আমি সত্য কথাই বলেছি, বলল আহমদ মুসা। আবার সেই কথা, বলেই জেমস জেংগা আহমদ মুসার মুখ লক্ষ্য করে দ্বিতীয় ঘুষি চালাল। এবার বাম হাতে। প্রচন্ড ঘুষিটা এবার ডান চোখের ভ্রু’র উপর পড়ল। মনে হলো ডান হাতের চেয়ে বাম হাতের ঘুষিই বেশী মারাত্মক।
এবার পড়ে গিয়েছিল আহমদ মুসা। বোঁ করে মাথা ঘুরে গিয়েছিল। বুঝা গেল, জেংগা প্রচন্ড শক্তি রাখে।
ভ্রু কেটে গিয়ে আহমদ মুসার কপাল থেকে ঝরঝর করে নেমে এল রক্ত । মুখ বেয়ে তা ঝরে পড়ল বুকের ওপর।
আহমদ মুসা সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, হাসান সেনজিকের দেখা পাওয়ার আগে সে আক্রমনে যাবে না।
আহমদ মুসার রক্তপ্লূত দেখে জেমস জেংগার রাগ যেন কিছুটা শীতল হল।
সে আহমদ মুসার কাছ থেকে কিছুটা সরে দাঁড়িয়ে বলল, জেংগার নাম যে-ই তোমাকে বলুক, জেংগার পরিচয় সে দেয়নি। এখন পাবে সে পরিচয়। ছারপোকার মত মারব তোমাকে। হাসান সেনজিকের খবর নিতে এসেছ তুমি জেংগার গুহায়। বলে হো হো করে হেসে উঠল জেংগা। হাসি থামলে টমাসকে লক্ষ্য করে বলল, গেসিচকে বলো হাসান সেনজিককে এখানে আনতে। দেখুক সে তার উদ্ধারকারী বন্ধুর পরিণতি। টমাস বেরিয়ে গেল।জেমস জেংগা তার পিস্তল হাতে পায়চারী করতে লাগল।
অল্পক্ষণ পরেই টমাস ফিরে এল। টমাস ফিরে এলে বলল জেংগা, নিচে রাকিচরা নেই?
–ওদের তো ‘মিলেশ’ এর ‘মিলেনকো’র কাছে পাঠিয়েছেন?
–ও ভুলে গেছিলাম।
আহমদ মুসা বুঝল, এদের একাধিক লোককে মিলেশ বাহিনীর কাছে পাঠানো হয়েছে। কেন? হাসান সেনজিককে হস্তান্তরের জন্যে? ওরা কি এসে পড়বে নাকি?
সচেতন হয়ে উঠল আহমদ মুসা।
বেশী দেরী করা যাবে না। এদের কথায় আরও বুঝা গেল, এদের কেউ কেউ ঘাটিতে এখন হাজির নেই। লোকজন যে এখন কম আছে, আসার সময় তা বুঝা গেছে।
হাসান সেনজিককে নিয়ে প্রবেশ করল গেসিচ নামের লোকটা। তার হাতেও রিভলভার।
হাসান সেনজিক ঘরে প্রবেশ করে আহমদ মুসাকে রক্তাক্ত অবস্থায় দেখে চিৎকার করে ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরল আহমদ মুসাকে।
জেমস জেংগা কাছেই ছিল। ক্রুর হাসি ফুটে উঠেছে তার মুখে।
একটু এগিয়ে সে একটা হ্যাচকা টানে হাসান সেনজিককে ছুড়ে ফেলে দিল মেঝের উপর। হাসান সেনজিককে ছুড়ে ফেলে আহমদ মুসার দিকে ফিরে দাঁড়াতে পারেনি। এই সময় আহমদ মুসা চোখের পলকে ঝাঁপিয়ে পড়ে জেমস জেংগার পেছন থেকে বাম হাত দিয়ে সাঁড়াসির মত তার গলা পেঁচিয়ে ধরল এবং ডান হাত দিয়ে জেমস জেংগার হাত থেকে পিস্তল কেড়ে নিল। পিস্তলটি হাতে নিয়েই পাশে দাঁড়িয়ে থাকা টমাসের মাথা লক্ষ্য করে গুলি করল।
টমাস ব্যাপারটা বুঝে উঠে তার পিস্তল তুলে ধরার আগেই গুলি খেয়ে সে ঢলে পড়ল মেঝের কার্পেটের উপর।
জেমস জেংগা প্রচন্ড শক্তি রাখে। সে আহমদ মুসার হাতের বেড়ি থেকে খসে আসার প্রাণপণ চেষ্টা করছিল। কিন্তু যতই সে চেষ্টা করছিল, ততই আহমদ মুসার হাত সাঁড়াশির মত চেপে বসছিল তার গলায়।
আহমদ মুসা টমাসকে গুলি করেই তার পিস্তল তাক করেছিল নবাগত গেসিচকে।
গেসিচ আগেই পিস্তল তুলেছিল, কিন্তু জেমস জেংগার বিরাট বপুর পেছনে দাঁড়ানো মুসাকে গুলি করার কোন পথ পাচ্ছিল না।
আহমদ মুসা পিস্তল তুলে ধরে কঠোর কন্ঠে বলল, পিস্তল ফেলে দাও গেসিচ, না হলে এক্ষণি মাথা উড়ে যাবে।
গেসিচ একবার আহমদ মুসার দিকে তাকিয়ে পিস্তল হাত থেকে ফেলে দিল।
হাসান সেনজিক তখনও পড়ে ছিল মেঝের উপর। সে এবার তাড়াতাড়ি উঠে গেসিচের পিস্তলটি কুড়িয়ে নিল।
জেমস জেংগারে নড়াচড়া বন্ধ হয়ে ছিল। তার দেহটি শিথিল। এবার আহমদ মুসা তার হাত শিথিল করতেই জেমস জেংগার দেহ ঝরে পড়ল মাটিতে। তার দেহে প্রাণ নেই।
গেসিচ ভয়ে কাঁপছিল।
আহমদ মুসা বলল, ভয় নেই, বিনা কারণে আমরা কাউকে হত্যা করিনা।
আহমদ মুসা হাসান সেনজিককে নিয়ে ড্রইং রুম থেকে বেরিয়ে এল। দরজার লকের সাথে চাবি ঝুলতে দেখে খুশী হলো আহমদ মুসা। দরজা লক করে চাবিটি ছুড়ে ফেলে দিল মাঠের দিকে।
তারপর দ্রুত নেমে এল সিঁড়ি বেয়ে নিচে। সিঁড়ির মুখে একটা জীপ দেখে গিয়েছিল, দেখল সেটা এখনও আছে।
হাসান সেনজিককে গাড়িতে উঠতে বলে সে ড্রাইভিং সিটে উঠে বসল। ছুটে চলল গেটের দিকে। বাড়ীর আশে-পাশে কাউকে দেখলনা।
জেমস জেংগার পরিবার থাকে তিন তলায়, তারা কিছুই জানতে পারল না।
তিন তলার দিকে একবার চোখ তুলে তাকাল আহমদ মুসা। হৃদয়ে এক প্রচন্ড খোঁচা লাগল আহমদ মুসার। পৃথিবীতে এত মায়া, এত মমতা, তবু এত হানাহানি কেন?
জীপটি গেটের কাছাকাছি আসতেই গেটম্যান গেট রুম থেকে বেরিয়ে এল। কিন্তু জীপের দিকে চোখ পড়তেই আবার ফিরে গেল গেট রুমে।
রুম থেকে এবার সে গুলি করতে করেতেই বেরিয়ে এল। গুলির মুখে পড়ে গেল জীপ। গুলি বৃষ্টির আড়ালে দাঁড়ানো গেটম্যান।
গুলিতে জীপের উইন্ড শীল্ড চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে গেল।
আহমদ মুসা জীপ থেকে নেমে ঘুরে জীপের পিছনে চলে গেল। তারপর জীপের পূর্ব-উত্তর কোণায় গিয়ে দাঁড়াল। গুলির প্রধান টার্গেট সামনের সিট।
আহমদ মুসা পিস্তল বাগিয়ে ট্রিগারে আঙ্গুল চেপে মুখটা পলকের জন্য বাইরে নিয়ে গুলি করল। প্রথম গুলিটা ব্যর্থ হলো।
কিন্তু গুলির শব্দে গেটম্যান চমকে উঠেছিল এবং এদিক ওদিক তাকিয়েছিল। মুহূর্তে নিস্ক্রিয় হয়ে পড়েছিল তার ষ্টেনগান। এই সুযোগেরই সদ্ব্যবহার করল আহমদ মুসা।
এবার গুলি অব্যর্থ। গুলি খেয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল লোকটি ষ্টেনগানের ওপর।
আহমদ মুসা দ্রুত হাসান সেনজিককে নিয়ে বেরিয়ে এল সেই ছোট গেট খুলে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো ২ টা ৫০ মিনিট।
মোস্তফা ও সালমা সারাকায়া অসীম উৎকণ্ঠা নিয়ে তাকিয়ে ছিল গেটের দিকে। গোলা গুলির শব্দ তারাও শুনতে পাচ্ছিল। মোস্তফার হাত ছিল ষ্টেয়ারিং হুইলেই।
আহমদ মুসাকে গেট দিয়ে বেরুতে দেখেই মোস্তফা তার গাড়ি তীর বেগে গেটে নিয়ে গেল। গাড়ি দাঁড়াতেই সালমা সারাকায়া দরজা খুলে দিল। গাড়িতে উঠে বসল ওরা দু’জন। গাড়ি ছেড়ে দিল।
আহমদ মুসার রক্তাক্ত চেহারার দিকে তাকিয়ে মোস্তফা ও সালমা দুজনেই উৎকণ্ঠা ও উদ্বেগে এতটুকু হয়ে গিয়েছিল।
পেছনের সিটে বসেছিল আহমদ মুসা ও হাসান সেনজিক।
সামনের সিট থেকে তাকিয়ে ছিল সালমা আহমদ মুসার দিকে। কথা বলতে পারছিল না। তার দিকে চেয়ে আহমদ মুসাই বলল, ভয় নেই বোন। আমি ভাল আছি।
তারপর মোস্তফাকে লক্ষ্য করে বলল, গাড়ির নাম্বার পাল্টেছ?
–জি হ্যাঁ, বলল, মোস্তফা।
–তাহলে আরো সামনে গিয়ে গাড়িটা কোন নিরিবিলি জায়গায় দাঁড় করিয়ে আসল নাম্বারটা এবার লাগিয়ে দাও।
মোস্তফা ক্রিয়া এবার বুঝতে পারল আহমদ মুসা কেন তাকে গাড়ির নাম্বার পাল্টাতে বলেছিল। জেংগার ওখান থেকে যারা গাড়ি আসতে দেখবে, তারা যাতে গাড়ির আসল নাম্বার চিহ্নিত করতে না পারে সে জন্যেই এই ব্যবস্থা। আহমদ মুসার দূরদর্শিতায় বিস্মিত হলো মোস্তফা ক্রিয়া। পরক্ষণেই আবার ভাবলো, হবে না কেন এমন দূরদর্শী, জেংগার ঘাটিতে একা এভাবে ঢুকতে পারে কোন সাধারণ লোক! জেংগার ঘাটিতে ঢুকে তার সাথে লড়াই করে আহমদ মুসা হাসান সেনজিক কে উদ্ধার করে নিয়ে এল, এটা এখনও তাঁর কাছে স্বপ্নের মতো অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে।
সালমা সারাকায়ার বুকের কাঁপুনি ক্রমে থেমে আসছে। যে ঘটনাকে তারা ফেলে এল, তা তার কাছে দুঃস্বপ্নের মতই ভয়াবহ। আহমদ মুসাকে মনে হচ্ছে তার জীবন্ত রক রবিন-হুড। একা এক মানুষ শত্রু পুরীতে ঢুকে যুদ্ধজয় করে বেরিয়ে এল। সালমা সারাকায়ার বিস্ময় ক্রমশ বাড়ছেই, কে এই মানুষটি। বিদেশ বিভূঁইয়ে এসেও যে একা প্রবল শত্রুর বিরুদ্ধে এমন লড়াই করতে পারে! প্রথমেই জেংগার গেটে পিস্তলধারীর হাতে ধরা পড়ার পর আহমদ মুসা জেংগার আস্তানা থেকে ফিরে আসতে পারবে, এ আশা সে ছেড়েই দিয়েছিল। কেমন করে এ অসম্ভবকে সম্ভব করল। মনে পড়ল জেংগার ঘাটিতে যাবার সময়কার আহমদ মুসার শেষ কথা, তোমরা ভেব না, আমাদের সাথে দ্বিতীয় একজন আছেন, তিনি সর্ব শক্তিমান আল্লাহ। আল্লাহর কথা আসতেই এক খোঁচা লাগলো সালমা সারাকায়ার মনে। সে নামে মুসলিম বটে, কিন্তু এই আল্লাহকে তো সে চেনে না। রাষ্ট্র নিরীশ্বরবাদী, সুতরাং শিক্ষা ও সমাজের কোথাও ধর্মের চিহ্ন রাখা হয়নি। মনে পড়ে তার দাদীমার কথা। কুরআন শরীফ সালমা দাদীর কাছে দেখেছিল। দাদী তা লুকিয়ে রাখতেন সকলের ধরা-ছোয়ার বাইরে বাক্সের মধ্যে। পবিত্র না হয়ে ওতে হাত দেয়া যায় না। ভোরে এবং রাতে তিনি কুরআন শরীফ পড়তেন আর কাঁদতেন। সালমা একদিন দাদীর গা ঘেঁষে বসে জিজ্ঞেস করেছিল, দাদী তুমি কাঁদ কেন?
দাদী চোখ মুছে বলেছিলেন, কুরআন না পড়লে বুঝবি না।
–তাহলে পড়ি, দাও। সালমা বলেছিল।
–তুইতো পড়তে শিখিসনি।
–তাহলে আমাকে শিখাও।
–তোর আব্বা শিখতে দেবে না।
সালমা তার আব্বাকে জিজ্ঞেস করেছিল, দাদী বলেছে, তুমি নাকি কুরআন শিখতে দেবে না?
আব্বা সালমাকে আদর করে বলেছিল, ওর কোন দরকার নেই মা, কেন সময় নষ্ট করবে?
মনে পড়ে সালমার, আব্বার কথা সেদিন তার ভাল লাগেনি। ভাল না লাগলেও আব্বার কথাই মানতে হয়েছে।
সালমা ছোট বেলা সেই যে দাদীর নামাজ পড়া দেখেছিল, তারপর প্রায় এক যুগ পর আজ আহমদ মুসার নামাজ দেখল।
একশ দশ বছর বয়সে দাদী মারা গেছেন। তার মৃত্যুর পর কুরআন এবং জায়নামাজ তার আম্মা দাদীর বাক্সে সেই যে তুলে রেখেছেন, তা আর বের করা হয়নি। তার আব্বা মাঝে মাঝে সব ফেলে দিয়ে বাক্স সাফ করতে চেয়েছেন, কিন্তু সালমার মা রাজী হননি। বলেছেন, আমি ঐ জিনিসগুলির মধ্যে শাশুড়ী আম্মাকে দেখতে পাই। আমি পারব না তাঁর কোন জিনিসের অবমাননা করতে। সালমার আম্মার এ কথায় তার আব্বাও নিরব হয়ে যেতেন।
সালমা সারাকায়ার খুবই গর্ব হচ্ছে, তার দাদীর সেই আল্লাহই আহমদ মুসার আল্লাহ। সালমা আল্লাহকে চিনে না,কিন্তু তার দাদীতো চিনতো।
গাড়িতে স্পিড কমে গিয়ে এক সময় দাঁড়িয়ে গেল। সালমা সারাকায়া চমকে উঠে তাকিয়ে দেখল, তারা তিরানার পুরানো এলাকার শিশু পার্কে এসে প্রবেশ করেছে।
তখন তিনটা পনের মিনিট। শিশু পার্ক ফাঁকা।
এ সময় শিশুরা থাকে না, আরও পরে আসবে।
একটা ঝোঁপের পাশে নির্জন জায়গায় এসে গাড়ি দাঁড়িয়েছে।
গাড়ি দাঁড়াতেই মোস্তফা গাড়ি থেকে নামল। নামতে নামতে বলল, সালমা ফাস্ট এইড বাক্সে দেখ গজ তুলা আয়োডিন আছে। নিয়ে এস এগুলো।
মোস্তফা ক্রিয়া প্রথমেই গিয়ে গাড়ির নাম্বার প্লেটের লাগানো ভূয়া নাম্বারের কাগজটি তুলে ফেলল।
আর সালমা গজ তুলা আয়োডিন নিয়ে আহমদ মুসার সামনে গিয়ে বসল।
আহমদ মুসার মুখে গড়িয়ে আসা রক্ত তখনও কাঁচা, শুকিয়ে যায়নি।
সালমা তুলে নিয়ে রক্ত মুছে দেয়ার জন্য আহমদ মুসার দিকে এগুতেই আহমদ মুসা হেসে বলল, তুলা আমাকে দাও বোন। বলে আহমদ মুসা তার দিকে হাত বাড়াল।
সালমা সারাকায়া একবার চোখ তুলে আহমদ মুসার দিকে তাকিয়ে তুলার বান্ডিল আহমদ মুসার হাতে দিয়ে দিল।
সালমা সারাকায়া গম্ভীর হলো। তার চোখে মুখে একটা অভিমানের ছায়া নামল।
ব্যাপারটা আহমদ মুসার দৃষ্টি এড়াল না।
এ সময় মোস্তফা এসে পড়েছে।
সে আহমদ মুসার হাত থেকে তুলার বান্ডিল নিয়ে বলল, মুসা ভাই আমার ফাস্ট এইড ট্রেনিং আছে। অবশ্য সালমা আমার চেয়েও দক্ষ।
মোস্তাফা আহমদ মুসার মুখ ও গলা থেকে রক্ত পরিস্কার করে কপালের দু’পাশের কাটা ও থেতলে যাওয়া জায়গায় আয়োডিন দিয়ে ব্যান্ডেজ করে দিল।
ব্যান্ডেজ শেষ করে মোস্তাফা বলল, কি করে আহত হলেন মুসা ভাই?
পাশেই বসে ছিল সালমা সারকায়া। তার চোখ-মুখ ভারি।
–তোমার জেমস জেংগার পুরস্কার মোস্তাফা। বলল আহমদ মুসা।
–মানে?
–কপালের কাটা দু’টো জেংগার হাতুড়ি মার্কা ঘুষির চিহ্ন।
–জেংগা কোথায়?
–জেংগার কেমন খবর পেলে তোমরা খুশী হও?
–সে বেঁচে থাকলে বিপদ হবে।
–বিপদ ঘটাবার জন্য তোমাদের জেংগা আর বেঁচে নেই।
–মরেছে সে? চোখ কপালে তুলে প্রশ্ন করল মোস্তাফা।
–হ্যাঁ তার সাথী সহ সে নিহত হয়েছে।
অপার বিস্ময় নিয়ে মোস্তাফা ও সালমা তাকিয়ে রইল আহমদ মুসার দিকে।
বেশ কিছুক্ষণ পর প্রশ্ন করল মোস্তাফা। বলল,আপনি খালি হাতে……
দেখলাম একজন পিস্তলধারী আপনাকে গেট থেকে ধরে নিয়ে গেল………..
প্রশ্ন শেষ না করেই থেমে গেল মোস্তাফা।
আহমদ মুসা হেসে বলল, এ কাহিনী পরে বলব। এখন বল, আমরা কোথায় যাব?
–কেন, আমাদের বাড়ীতে! আসুবিধা হবে আপনার?
–এ প্রশ্নটা তো আমিই তোমাকে করার কথা।
‘প্রশ্ন আর করতে হবে না,তাহলে উঠুন’ বলে মোস্তাফা উঠে দাঁড়াল। সবাই গাড়িতে উঠল।
সালমা আর একটা কথাও বলেনি। নিরবে সে গাড়িতে গিয়ে উঠল।
এ সময় হাসান সেনজিক ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল,মিলেশ বাহিনীর বেচারা লোকেরা
এতক্ষণে জেংগার শূন্য আস্তানা দেখে হতাশ হয়ে ফিরে গেছে।
–কয়টায় ওদের আসার কথা ছিল? জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা।
–তিনটায়? আহ্! আগে যদি বলতে।
–ঠিক হয়েছে না বলে, আপনার এখন বিশ্রাম প্রয়োজন। বলল মোস্তাফা।
গাড়ী তখন চলতে শুরু করেছে। মোস্তাফাদের নতুন তিরানা নগরীর অভিজাত এলাকায়।
প্রায় দশ মাইলের পথ।

সালমা সারকায়াদের বিশাল বাড়ী। সালমার আব্বা আলবেনিয়া সরকারের একজন বড় আমলা ছিলেন।
কম্যুনিষ্ট শাসনে আলবেনিয়ায় জনগণের কোন ব্যক্তিগত সম্পত্তি ছিল না। কিন্তু আমলারা জনগণের কাতারে পড়ে না। আমলা এবং কম্যুনিষ্ট পার্টি জনগনের শাসক। তাই জনগণের আইন তাদের উপর প্রযোজ্য নয়। তাই আমলা ও কম্যুনিষ্ট পার্টির লোকদের বাড়ী-গাড়ি সবই থাকতে পারে। একথাগুলো স্পষ্টবাদী মোস্তাফা ক্রিয়াই আহমদ মুসাকে বলেছিল।
মোস্তাফা ক্রিয়ার বাড়ীতে তিন দিন কেটেছে আহমদ মুসার। এই তিনদিনে আমূল বদলে গেছে বাড়ীর দৃশ্য।
সালমা সারকায়ার অভিমানের মধ্যে আহমদ মুসা বিপদের যে মেঘ দেখেছিল,তা কেটে গেছে সেই দিনই। হাসান সেনজিক আহমদ মুসার সব কথা বলে দেয় তাদেরকে সেদিন বিকেলেই।
সেদিনই সন্ধ্যায় সালমাকে আহমদ মুসা সম্পূর্ণ ভিন্ন সাজে দেখে। গায়ে ঢিলা জামা,গাউন,মাথায় ওড়না।
–ধন্যবাদ সালমা,মুসলিম মেয়ের মত মনে হচ্ছে তোমাকে। বলেছিল আহমদ মুসা।
–আপনি আমাকে মাফ করুন,আপনি আমার ভাইয়া।
–কেন একথা বলছ।
–আপনি আমাকে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন, আমি আহত বোধ করেছিলাম। আমি অন্যায় করেছিলাম।
আহমদ মুসার মনে পড়েছিল ফার্ষ্ট এইড নিয়ে যা ঘটেছিল সে কথা।
–তুমি কোন অন্যায় করনি সালমা। যে সংস্কৃতি তোমাকে গড়ে তুলেছে,সেদিক থেকে ওটাই স্বাভাবিক ছিল।
–নারী-পুরুষের এ সম্পর্ককে ইসলামী সংস্কৃতি কি দৃষ্টিতে দেখে ভাইয়া?
–ইসলামী সংস্কৃতি নারী-পুরুষের মেলামেশা ও মননের কতকগুলো সীমা নির্দেশ করেছে,নারী-পুরুষের এ সম্পর্ক যখন এ সীমার অধীনে অবস্থান করে তখন ইসলাম সেখানে হস্তক্ষেপ করতে যায় না।
–এ সীমানাটা কি ভাইয়া।
–এক কথায় এর উত্তর দেয়া যাবে না, একটা সোস্যাল সিস্টেমের এটা একটা অংশ। কোরআন-হাদিস পড়লে সব জানতে পারবে।
কোরআনের নাম শুনেই সালমা লাফিয়ে উঠেছিল। বলেছিল, আমার দাদীর একটা কোরআন ছিল ভাইয়া,১২ বছর হলো সেটা এখনও তাঁর বাক্সেই বন্ধ আছে। আপনি বের করে দিন ভাইয়া। আম্মাকে বলে আসি,বলে সালমা দৌড়ে ভেতরে চলে গিয়েছিল।
এই সময় মোস্তফা ক্রিয়া আহমদ মুসার ঘরে আসে।
কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই ফিরে এসেছিল সালমা। মোস্তাফা ক্রিয়াকেও আহমদ মুসার কাছে দেখে সে আরও উৎসাহিত হলো। প্রায় চিৎকার করে বলেছিল, আম্মা খুব খুশী হয়েছেন, দাদীর কোরআন বের করতে অনুমতি দিয়েছেন আম্মা। মুসা ভাইয়া এখনি চলুন, আম্মা বাক্স পরিষ্কার করছেন।
–কোরআন হাতে নিতে অজু করতে হয়। হেসে বলেছিল আহমদ মুসা।
–অজু করুন তাহলে, আমাদেরও শিখিয়ে দিন। দ্রুত বলেছিল সালমা।
তারা আহমদ মুসার সাথে বাথরুমে গিয়ে উৎসাহের সাথে অজু শিখেছিল। অজু করতে করতে সালমা বলেছিল,আমাদের নামাজও শিখাবেন মুসা ভাই। সেদিনই এশার সময় তারা নামাজ শিখেছিল। আহমদ মুসা ইমামের আসনে দাঁড়িয়েছিল। তাঁর পেছনে দাঁড়িয়েছিল হাসান সেনজিক,মোস্তাফা ক্রিয়া এবং তাদের পেছনে দাঁড়িয়েছিল সালমা সারকায়া এবং তার আম্মা। নামাজ শেষে কি যে আনন্দ তাদের!
অজু শেষে আহমদ মুসা, সালমা এবং মোস্তাফা ক্রিয়ার পেছনে পেছনে গিয়ে হাজির হয়েছিল তাদের দাদীর ঘরে।
বাক্সের ভেতরে সাদা লিনেনের কাপড়ে বাঁধা ছিল কোরআন শরীফ।
আহমদ মুসা কোরআন শরীফটি হাতে তুলে নেয়।
সবাই নিরব। গম্ভীর সবার মুখ। যেন কোরআন শরীফের এক অশরীরি প্রভাব সকলকে অভিভূত করে তুলেছিল।
আহমদ মুসা ধীরে ধীরে কোরআনের কাপড় খুলতে শুরু করে।
‘শাশুড়ি আম্মার বাঁধা,আজ বারো বছর হলো’—বলেছিল সালমার আম্মা। তাঁর কন্ঠ আবেগে কাঁপছিল।
সবাই তাঁর দিকে তাকিয়েছিল। আহমদ মুসাও। সালমার আম্মার চোখ অশ্রু সিক্ত হয়ে উঠেছিল।
কাপড়ের বাঁধন থেকে কোরআন শরীফ বের করে আহমদ মুসা পরম শ্রদ্ধায় তাতে চুমু খেল।
১২ বছর পর আবার মানুষের স্পর্শ পেয়েছিল কোরআন টি। সালমা সারকায়া বলেছিল,আমিও চুমু খাব ভাইয়া। সালমা চুমু খেয়েছিল,তার সাথে মোস্তাফা ক্রিয়া এবং সালমার মাও।
আবেগে আহমদ মুসার চোখও অশ্রু সিক্ত হয়ে উঠেছিল।
সকলেই পরম শ্রদ্ধা ও ভয়ের সাথে কোরআন শরীফকে দেখছিল।
কথা বলেছিল সালমা সারকায়া। বলেছিল, ভাইয়া আমাদের পড়ে শোনান কিছু।
–ঠিক আছে,চল বাইরে গিয়ে বসা যাক। বলেছিল আহমদ মুসা।
সবাই ভেতরের ফ্যামিলি ড্রইং রুমে গিয়ে বসেছিল। হাসান সেনজিকও এসেছিল।
আহমদ মুসা সোফায় বসে সামনে টেবিলে কোরআন শরীফ মেলে ধরেছিল।
কোরআন পাঠ শুরুর আগে আহমদ মুসা নবীর(সঃ) আগমন,তাঁর উপর ওহী নাজিলের ধরণ,কোরআন নাজিলের উদ্দেশ্য ইত্যাদি সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করেছিল। তারপর কোরআন থেকে তেলাওয়াত করেছিল,প্রথমে সুরা ফাতিহা,পরে সুরা বাকারার প্রথম রুকু।
অদ্ভুত সুন্দর তেলওয়াত আহমদ মুসার।
তার উচ্চ কন্ঠ মর্মস্পর্শী তেলাওয়াত অপূর্ব এক দৃশ্যের অবতারণা করেছিল। অশ্রু গড়িয়ে পড়ছিল আহমদ মুসার চোখ থেকে।
তেলাওয়াতের পর পঠিত আয়াতগুলোর অর্থ ও ব্যাখ্যাও করছিল আহমদ মুসা।
কোরআন পাঠ শেষ হওয়ার পরও অনেক্ষণ কেউ কথা বলেনি। সবারই মাথা নিচু।
অনেকক্ষণ পর কথা বলেছিল সালমাই প্রথম। বলেছিল, ভাইয়া আমরা কি মুসলমান আছি?
–মুসলিম চরিত্র কতকগুলো গুণের সমষ্টি, কিছু গুণ তোমাদের আছে, অবশিষ্ট গুণগুলো অর্জন করতে হবে। বলছিল আহমদ মুসা।
তারপর গত তিন দিন ধরেই সে কোরআনের দারস দিয়ে আসছে, কোরআন পাঠ শিখিয়ে আসছে।
পাঁচ ওয়াক্ত নামাজই আহমদ মুসার নেতৃত্বে জামায়াতে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে।
সালমাদের আত্মীয় ও বন্ধু পরিবারগুলোতেও একথা ছড়িয়ে পড়েছিল। সকলের উৎসাহ ও আবেগ দেখে অবাক হয়েছে আহমদ মুসা। কোরআন শরীফ পাঠ ও নামাজ শিখার জন্যে তারা পাগল। কিন্তু কোথায় শিক্ষক। আহমদ মুসা সালমা ও মোস্তফা ক্রিয়াকে বলেছিল, তাদেরকেই এ মহান দ্বায়িত্ব নিতে হবে।
তারা দু’ভাই বোন খুবই মেধাবী। তারা তিন দিনে তিন মাসের শিক্ষা সম্পূর্ণ করেছে। আরবী পড়ার কায়দা-কৌশল তারা ধরে ফেলেছে। সমস্যা দাঁড়িয়েছে কোরআন শরীফ নেই, একটা দিয়ে আর কতটা চলতে পারে।
বেলগ্রেড যাবার জন্যে আহমদ মুসা প্রস্তুত। কিন্তু যতবারই কথা তুলেছে তারা আমল দেয়নি। বলেছে, আমাদের হাতে আলো তুলে দিয়েছেন, পথে তুলে না দিলে আমরা পথ খুঁজে পাবো না।
তৃতীয় দিন রাতে শোবার আগে আহমদ মুসা সালমা, মোস্তফা ক্রিয়া, এবং তার মাকে জানাল কাল সকালেই আমাদের যাত্রা করতে হবে।
সকালে উঠেই আহমদ মুসা যাবার জন্যে তৈরী হলো।
যে পোশাকে আহমদ মুসা আলবেনিয়ায় এসেছিল, সেই পোশাক পরেছে। হাসান সেনজিকও রেডি।
মোস্তফা ক্রিয়া, সালমা সারাকায়া, এবং তাদের মা সবাই এসে তাদের পাশে দাঁড়িয়েছে।
–গাড়ি রেডি ভাইয়া। বলল মোস্তফা ক্রিয়া।
আহমদ মুসা বিস্মিত চোখে মোস্তফার দিকে তাকিয়ে বলল, গাড়ি কেন মোস্তফা?
–কেন, আপনি তো গাড়িতে যাবেন।
–তোমার গাড়ি নিয়ে?
–কেন অসুবিধা কি?
হাসল আহমদ মুসা। বলল, মোস্তফা আমরা প্রবেশ করছি অনিশ্চিত এক যুদ্ধ ক্ষেত্রে। কোথায় কখন যাব, কোথায় থাকব কিছুরই ঠিক নেই। গাড়ি রাখব কোথায়?
–কোন পথে যাবেন আপনি?
–এখান থেকে সকুদ্রা। সেখান থেকে পূর্ব দিকে কসভো হয়ে বেলগ্রেড।
–এ পথে কেন? সকুদ্রা থেকে টিটোগ্রাদ ও টিটোভা হয়ে বেলগ্রেড তো সহজ ও আরামদায়ক পথ।
–ঠিক আছে, এ পথে যেতে হলে আপনাকে গাড়ি নিতেই হবে। এ পথে যানবাহন অনিয়মিত এবং বিদেশীদের জন্য ভাল নয়।
একটু থেমেই মোস্তফা আবার শুরু করল, গাড়ি নিয়ে অসুবিধা নেই ভাইয়া, যুগোশ্লাভিয়ার সরকারী গ্যারেজগুলোতে ভাড়ায় গাড়ি রাখা যায়।
আহমদ মুসা হাসল। বলল, তিন দিন তোমাদের আদরে থেকে শরীরটা বড় আরামপ্রিয় হয়ে উঠেছে, গাড়ি যদি দাও তাহলে আরামপ্রিয়তা আরও বাড়বে।
–শরীরটাকে কখনও বিশ্রাম দিয়েছেন ভাইয়া? বলল সালমা সারাকায়া।
–দেইনি, একথা বলার উপায় আছে? যদি হিসেব করি দেখব, জীবনের যে সময়টা অতীত হয়েছে তার তিনভাগের কমপক্ষে একভাগ ঘুমিয়ে কাটিয়েছি।
–ঘুম পেলেই কি শরীরের দাবী শেষ হয়ে যায়! তাহলে মানুষের কর্মঘন্টা সীমিত করা হয়েছে কেন?
–তোমার যুক্তি ঠিক আছে, কিন্তু তা শান্তিপূর্ণ সময়ের জন্য। অশান্তির সময়ে যখন মানুষ জুলুম- অত্যাচারে- জর্জরিত হতে থাকে, তখন শান্তির সময়ের যুক্তি আর চলেনা। আজ দুনিয়ার মুসলমানরা শোষণ ও জুলুম অত্যাচারে নিষ্পিষ্ট হচ্ছে, এ সময় কোন সচেতন মুসলমানই বিশ্রাম- বিনোদনের কথা ভাবতে পারে না।
কথা শেষ করে আহমদ মুসা ঘড়ির দিকে তাকাল। উঠে দাঁড়িয়ে বলল, এবার উঠতে হয়।
মোস্তফা ইতিমধ্যেই স্যুটকেশ গাড়িতে তুলে দিয়ে এসেছে।
কথাবার্তা বলতে বলতে তারা গাড়ির দিকে এল।
সালমার আম্মা আহমদ মুসাদের দোয়া করে বলল, বাবা তোমাদের আয়ু শতবর্ষ হোক, জাতির খেদমতের জন্যে আরও শক্তি আল্লাহ তোমাদের দিন।
সালমা সারাকায়া ও মোস্তফার চোখ-মুখ ভারী হয়ে উঠেছে।
সালমা সারাকায়া তার ওড়নার এক প্রান্ত মুখে চেপে বলল, স্বপ্নের এ তিনটা দিন জীবনে আর কোন দিন ফিরে পাবো না। আনন্দের চেয়ে এ বেদনাই বেশী দেবে।
সালমার চোখে অশ্রু।
আহমদ মুসা একটু ঘুরে সালমা সারাকায়ার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলল, সালমা বিদায় সবচেয়ে বেদনাদায়ক, কিন্তু বিদায় এ দুনিয়ার সবচেয়ে বড় বাস্তবতা। আমি শিশুকালকে বিদায় দিয়েছি, বাল্য-কৈশোরকে বিদায় দিয়েছি, বিদায় দিয়েছি আমার বাবা-মা প্রিয়জনদের, বিদায় নিয়েছে পরিচিত শতমুখ। সুতরাং বিষয়টা নতুন নয়। এই বাস্তবতাকে বড় করে দেখলে বেদনার ভারটা কমে যায়।
–এই বেদনাই বাস্তবতা ভাইয়া, আমাদের মহানবী (সঃ) তার জন্মভূমি মক্কা থেকে বিদায় নেবার সময় কেঁদেছিলেন।
–ঠিক বলেছ সালমা, কিন্তু মহানবী (সঃ) বিদায়ের যখন প্রয়োজন হল তখন এক মুহূর্তও বিলম্ব করেননি। মুখ টিপে হেসে বলল আহমদ মুসা।
হাসান সেনজিক গাড়ির দরজা খুলে ড্রাইভিং সিটের পাশের সিটে গিয়ে বসল।
সবাইকে সালাম জানিয়ে গাড়ির দরজার দিকে এগুলো আহমদ মুসা।
–আবার কবে দেখা হবে ভাইয়া? বলল সালমা সারাকায়া।
আহমদ মুসা গাড়ির দরজায় হাত দিয়েছিল। সালমার কথা শুনে ফিরে দাঁড়াল। ম্লান হেসে সে ধীরে ধীরে বলল, বহুবার বহু জায়গায় আমি এ প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েছি বোন, কাউকেই এর জবাব দিতে পারিনি। তোমাকেও পারলামনা। প্রয়োজনের স্রোতে আমি ভাসছি। বলে আহমদ মুসা আবার ঘুরে দাঁড়াল।
গাড়ির দরজা খুলে ড্রাইভিং সিটে গিয়ে বসল আহমদ মুসা।
গাড়ি স্টার্ট নিল। চলতে শুরু করল গাড়ি।
জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে একবার পেছনে তাকাল আহমদ মুসা। হাত নাড়ছে সবাই চোখ মুছছে মোস্তফা ও সালমা সারাকায়া।
আহমদ মুসা হাত নেড়ে চোখ ফিরিয়ে নিল সামনে। হৃদয়ের কোথায় যেন খচ করে উঠল। সালমা ঠিকই বলেছে, বিদায়ের মত বেদনাও বোধ হয় একটা চিরন্তন বাস্তবতা। যুক্তির বিচরণ হৃদয়ের যেখানে, মনে হয় প্রেম-প্রীতি, মায়া-মমতার অবস্থান তার চেয়েও আরও গভীরে। | ← Previous | | | Next → | | সম্পুর্ণ বই এক পেজে »

Top