১১. দানিয়ুবের দেশে

চ্যাপ্টার

জাকুব মিলেশ বাহিনীর অন্যান্যদের সাথে ‘টিটো স্মরনী-এক’ এর মুখে এসে গাড়ি থেকে নামল। এই ‘টিটো স্মরনী-এক’ এর মাঝ বরাবর স্থানেই ষ্টিফেন পরিবার অর্থাৎ হাসান সেনজিকের বাড়ি।
এই রাস্তার দুই মুখে মিলেশ বাহিনী সার্বক্ষণিক পাহারা বসিয়েছে। রাস্তার দুই মুখেই পাঁচ ছয় জন করে সর্বক্ষণ ঘোরা ফেরা করছে। ছদ্মবেশে তারা আশে-পাশের রেস্টুরেন্ট ও দোকানের লোকদের সাথে মিশে থেকে রাস্তার প্রতিটি লোক প্রতিটি গাড়ির দিকে নজর রাখছে। তাদের প্রত্যেকের পকেটে পিস্তল এবং কোটের তলায় কাঁধে ঝুলানো স্টেনগান। সন্দেহ হলেই তারা লোকদের নামিয়ে, গাড়ি থামিয়ে পরীক্ষা করছে, জিজ্ঞাসাবাদ করছে। এছাড়া মিলেশ বাহিনীর লোকেরা হাসান সেনজিকের বাড়ির সামনে পাহারা বসিয়েছে। সেটাও ছদ্মবেশে। হাসান সেনজিকের বাড়ির বিপরীত দিকের রাস্তার দক্ষিন পাশে একটা আধা সরকারি ডিপার্টমেন্টাল ষ্টোর। কর্মচারীরা সবাই খৃষ্টান। এখানে মিলেশ বাহিনী তাদের তাদের চারজন লোক বসিয়েছে হাসান সেনজিকের বাড়ির গেটে নজর রাখার জন্য। বাড়িতে কে ঢোকে কে বেরোয় তা তারা মনিটর করছে। বাড়ির পেছনটাও নিশ্চিদ্র করেছে মিলেশ বাহিনী। হাসান সেনজিকের বাড়ির পেছনে প্রাচীর ঘেরা বিরাট মাঠ। সেখানেও সার্বক্ষণিক পাহারার ব্যবস্থা করেছে।
এসব ব্যবস্থা ছাড়াও হাসান সেনজিকের বাড়ির সামনের রাস্তা অর্থাৎ ‘টিটো স্মরণী-এক’ এ মিলেশ বাহিনীর দুটি গাড়ি প্রায়ই চক্কর দিয়ে ফিরছে।
হাসান সেনজিকের বাড়ি ঘিরে মিলেশ বাহিনীর এভাবে আট-ঘাট বেঁধে বসার লক্ষ্য দুটি। এক, হাসান সেনজিকের মায়ের পালিয়ে যাওয়া অথবা তার স্থানান্তর রোধ করা, দুই, এইভাবে হাসান সেনজিককে মায়ের কাছে আসতে বাধ্য করে তাকে ফাঁদে ফেলা।
জাকুব গাড়ি থেকে বলল, আমি এখানে নতুন রাস্তাটা, এলাকাটা একবার ঘুরে-ফিরে দেখতে পারি তো? হাসান সেনজিকের বাড়ি চিনিনা, ওটাও দেখা হবে।
টিমের অপারেশন কমান্ডার ব্রাংকো বলল, কোন অসুবিধা নেই, সব জায়গায় যেতে পারেন।
‘ওদের কোন লোকজন নেই?’ বলল জাকুব।
ব্রাংকো হাসল। বলল, পাগল হয়েছেন ওরা আসবে এখানে মরতে! ওরা এখানে সেখানে চোরা-গোপ্তা মিছিল করে, হ্যাণ্ডবিল ছড়ায়। সামনে আসবার শক্তি ওদের নেই। ওরা নাকি হোয়াইট ক্রিসেন্ট নামে একটা গুপ্তদল গড়েছে, কিন্তু ওদের কোন সাক্ষাৎ এ পর্যন্ত আমরা পাইনি।
‘হাসান সেনজিকের বাড়ীতে কেউ নেই?’ বলল জাকুব।
তাচ্ছিল্যের সাথে ব্রাংকো আবার হাসল। বলল, শুন্য নীড়। পরিবারের মধ্যে আছে শুধু দুই মহিলা হাসান সেনজিকের মা আর তার ফুফু আর আছে ঝি, আয়া এবং কয়েকজন চাকর-বাকর ও একজন দারোয়ান।
‘চলে কি ভাবে ওদের?’ বলল জাকুব।
‘পারিবারিক সম্পত্তি থেকে কিছু আয় পায়। বাড়ির সংলগ্ন কয়েকটা দোকান আছে, তার ভাড়া থেকেও কিছু আয় আসে।’ বলল ব্রাংকো।
জাকুব পায়ে হেটে ধীরে ধীরে সামনে এগুল।
সন্ধ্যার অন্ধকার তখন ঘনিয়ে আসছে।
দুপুরেই জাকুব কনস্টানটাইনের সাথে বেলগ্রেড পৌঁছেছে। পৌঁছেই সে পরিকল্পনা করেছে ‘টিটো স্মরণী-এক’ এ আসার। তারপর যখন জানতে পেরেছে একটি স্কোয়াড় ‘টিটো স্মরনী-এক’ এ আসছে, তখন তার সাথেই সে শামিল হয়েছে।
হাটতে হাটতে ভাবছিল জাকুব, আহমদ মুসারা নিশ্চয় দুপুরের আগেই বেলগ্রেড পৌঁছেছে ওরা কি এসেছে হাসান সেনজিকের বাড়ীতে। মিলেশ বাহিনী যেভাবে বাড়ীটাকে বেরিকেড দিয়ে রেখেছে তাতে এ বাড়িতে পা দেবার কথা চিন্তা করা সহজ নয়। কিন্তু আহমদ মুসার অসাধ্য কিছুই নয়, এই বাধা আহমদ মুসাকে আটকাতে পারেনা। ও একটা বিস্ময়কর মানুষ। মাজুভের বাড়িতে সেদিন সে শুধু আত্মরক্ষাই করেনি, দু’জনকে পরাভূত ও ৫ জনকে হত্যা করে সে মাজুভকে উদ্ধারও করেছে। আর সবচেয়ে অবাক ব্যাপার হলো গ্যাস বোমায় অজ্ঞান আহমদ মুসারা কোকার ভূ-গর্ভস্থ বন্দীখানা থেকে বেরিয়ে আসতে পারল কেমন করে? জাকুব তো জানে, তাকে ইনেজকশন দিয়ে মিলেশ বাহিনীর লোকেরা তার জ্ঞান ফিরিয়েছে। তাদের জ্ঞানই বা ফিরল কেমন করে, আর ৯ জনকে হত্যা করে ওরা বেরিয়ে আসতে পারল কেমন করে? মিলেশ বাহিনী এখন একমাত্র আহমদ মুসাকেই ভয় করছে।’
রাস্তার উত্তর পাশের ফুটপাত ধরে হাটছিল জাকুব। হাসান সেনজিকদের গেটে এসে থমকে দাঁড়াল সে। গেটও বাড়ির যে বর্ণনা শুনেছিল তাতে গেট ও বাড়ির দিকে নজর পড়তেই জাকুব চিনতে পারল হাসান সেনজিকদের বাড়ি।
গেট ভেতর থেকে বন্ধ। জাকুব কয়েক মূহুর্ত গেটের সামনে দাঁড়াল। কিন্তু নক করতে সাহস পেলনা।
আরও সামনে এগুল জাকুব। হাসান সেনজিকের বাড়ি সংলগ্ন পূব পাশের কিছু দোকান হাসান সেনজিক পরিবারের। দোকানগুলো ভাড়া দেয়া আছে। জাকুবের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। ভাবল, নিশ্চয় দোকানের লোকদের সাথে হাসান সেনজিকের পরিবাবের লোকদের একটা সম্পর্ক আছে।
জাকুব একটা দোকানের সেলস কাউন্টারে গিয়ে দাঁড়াল।
তখন সূর্য ডুবে গেছে।
দোকানে তখন খদ্দের নেই। দু’জন ছিল, তারা জিনিস কিনে বেরিয়ে গেল।
জাকুব সেলস কাউন্টারে দাঁড়াতেই সেলসম্যান দ্রুত তার কাছে এল খদ্দের ভেবে।
‘মাফ করবেন, আমি খদ্দের নই, আমি একটা বিষয় জানতে চাই।’ বলল জাকুব।
অল্প বয়সের সেলসম্যান ছেলেটি জাকুবের মুখের দিকে একবার তাকাল, তারপর বলল, বলুন কি জানতে চান।
হাসান সেনজিকের বাড়ির দিকে ইঙ্গিত করে বলল, ওটা তো হাসান সেনজিকের বাড়ি, তাই না?
সেলসম্যান ছেলেটির মুখটা মলিন হয়ে উঠল কথাটা শুনেই। বলল, হ্যাঁ।
‘ও বাড়ির কাউকে তুমি অবশ্যই চেন, তাই না?’ বলল জাকুব।
ছেলেটি আবার জাকুবের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, চিনি। ছেলেটির মুখে উদ্বেগ ও ভয়ের চিহ্ন।
এ সময় দোকানের ভেতরের কক্ষ থেকে একজন যুবক বেরিয়ে এল।
যুবকটি সালেহ বাহমন।
সালেহ বাহমন এবং তার হোয়াইট ক্রিসেন্টের লোকেরা সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসাবে হাসান সেনজিকের বাড়ীর আশে-পাশে অবস্থান নিয়েছে। হাসান সেনজিকের পরিবারের ভাড়া দেওয়া এই দোকান গুলোর লোকজন প্রায় সকলেই এখন হোয়াইট ক্রিসেন্টের লোক। তাদের একটাই লক্ষ্য, বিপদের সময় হাসান সেনজিকের মাকে সাহায্য করা। ছদ্মবেশে সালেহ বাহমনও এখন এসে দোকানে বসছে।
সালেহ বাহমন তার ছদ্মবেশ হিসেবে লম্বা গোঁফ ব্যবহার করে। কিন্তু যখন দোকানের ভেতরের কক্ষ থেকে বেরিয়ে এল তখন মুখে সেই গোঁফ ছিলনা। তার আসল চেহারায় সে বেরিয়ে এসেছে। সালেহ বাহমন কাউন্টারে এসে প্রথমে এক নজর জাকুবকে দেখে নিল। তারপর বলল, হাসান সেনজিক পরিবারের কাউকে চেনার কথা আপনি জিজ্ঞাসা করেছেন কেন? আপনি কে?
জাকুব কিছু বলতে যাবে এমন সময় ফুটপাতে একটা হুইসেল বাজার শব্দ হলো এবং তার মূহুর্তকাল পরেই একজন লোক দ্রুত এসে সেলস কাউন্টারে সালেহ বাহমনের মুখোমুখি দাঁড়াল। এবং দাঁড়িয়েই চ্যালেঞ্জের সুরে বলল, তুমি সেই সালেহ বাহমন না?
সালেহ বাহমন চমকে উঠল। মূহুর্তে তার মুখটি উদ্বেগে আচ্ছন্ন হয়ে গেল। অনেকটা কষ্ট করেই যেন বলল, আপনি কে?
‘আমি মিলেশ বাহিনীর লোক তোমার যম।’ বলে লোকটি পিস্তল বের করে সালেহ বাহমনের বুক বরাবর ধরল, ভোজবাজির মত দ্রুত ঘটে গেল ঘটনাটা।
জাকুব প্রথমটায় হকচকিয়ে গিয়েছিল। তারপরেই সব পরিষ্কার হয়ে গেল তার কাছে আর পরিষ্কার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সে তার পকেট থেকে রিভলভার বের করে মিলেশ বাহিনীর সেই লোকটির বুক বরাবর ধরে বাম হাত দিয়ে তার হাত থেকে পিস্তল কেড়ে নিয়ে সালেহ বাহমনের হাতে দিয়ে দিল। তারপর দ্রুত তাকে টেনে দোকানের ভিতরের কক্ষে নিয়ে গেল। সালেহ বাহমনও পেছনে পেছনে ভেতরে ঢুকে গেল।
ভেতরে ঢুকা পর্যন্ত জাকুব দেরি করল না। পেছন পেছন ঢুকতে ঢুকতেই জাকুব রিভলভারের বাঁট দিয়ে মিলেশ বাহিনীর সেই লোকটির কানের নিচে ঘাড়ের পাশটিতে প্রচন্ড আঘাত করল।
সঙ্গে সঙ্গেই লোকটি জ্ঞান হারিয়ে পড়ে গেল।
জাকুব দ্রুত বলল, সালেহ বাহমন একে গায়েব করবার কোন জায়গা আছে এখানে?
‘আছে’ সালেহ বাহমন বলল, ‘দোকানের পেছনেই আন্ডার গ্রাউন্ড ড্রেনের মুখ আছে।’
‘বেশ একে সরিয়ে ফেলুন, আর আশে-পাশে আপনি লুকিয়ে থাকুন। আমার মনে হচ্ছে, এখনি এক বা একাধিক কেউ এর খোঁজে আসবে, এ হু্‌ইসেল বাজানোর পর দোকানে এসেছে।’ বলল জাকুব।
বলে জাকুব দ্রুত দোকানের সেলস কাউন্টারে বেরিয়ে এল।
সেলসম্যান ছেলেটি ভয় পাওয়া হরিণের মত সন্ত্রস্তভাবে বসে আছে।
জাকুব এসেই সেলসম্যান ছেলেটিকে বলল, ‘যা ঘটেছে সব ভুলে যাও, মুখে হাসি নিয়ে এস।’
কথা শেষ করেই জাকুব আবার কয়েকটা জিনিসের অর্ডার দিল।
সেলসম্যান ছেলেটি জাকুবের মুখের দিকে একবার তাকিয়ে জিনিসগুলো আনতে গেল।
ঠিক এই সময় দু’জন লোক হন্ত-দন্ত হয়ে ছুটে এল। বলল, এখানে কেউ এসেছে, কিছু ঘটেছে?
জাকুব চোখ কপালে তুলে বলল, কে আসবে? কি ঘটবে?
লোক দু’টি অনেকটা দ্বিধাগ্রস্তের মত বলল, মানে এখানে এই এখনি একজন লোক এসেছে, সে গেল কোথায়?
‘আমিই তো এসেছি পাঁচ-ছ’ মিনিট হলো, আর কে আসবে কার আসার কথা বুঝিয়ে বলুন তো?’ বলল জাকুব।
‘অল্প কিছুক্ষণ আগে একজন লোক এখানে এসেছে। আমরা তার হুইসেল শুনেছি এবং তাকে এদিকেই আসতে দেখেছি।’ বলল আগন্তুকদের একজন।
‘কিসের হুইসেল শুনেছেন? আপনাদের পরিচয় কি বলুন তো?’ বলল জাকুব।
লোক দু’টি কয়েক মুহুর্ত কিছু বলল না। তারপর একটু রুক্ষকন্ঠে বলল, আপনার এত প্রশ্ন কেন, আমি যা বলছি তার জবাব দিন।
‘আপনাদের সাহায্য করতে চাই বলেই তো প্রশ্ন করছি, কিন্তু আপনারা তো দেখি উল্টো রাগ করছেন। আমি আপনার প্রশ্নের জবাব দিতে কি বাধ্য?’ বলল জাকুব।
‘অবশ্যই বাধ্য।’ বলে আগন্তুকের একজন পকেট থেকে পিস্তল বের করে নাচাতে নাচাতে বলল, ‘জবাব না দিলে জবাব দিতে বাধ্য করব।’
জাকুবও তার পকেট থেকে রিভলভার বের করে হেসে উঠে বলল, ও জিনিসটা আমারও আছে। পিস্তলের ভয় দেখাচ্ছেন আমাকে, স্পর্ধা আপনাদের কম নয়?
সেলসম্যান ছেলেটি জাকুব যে সব জিনিস চেয়েছিল তা নিয়ে দোকানের মাঝখানে মুর্তির মত দাঁড়িয়ে আছে। কাঁপছে সে।
লোক দু’টির চোখ এবার জ্বলে উঠল। বলল, জানেন আপনার এ ধৃষ্টতার কি শাস্তি হতে পারে, জানেন আমরা এখন ডাকলেই ডজন ডজন পিস্তল ছুটে আসবে?
‘আমি ডাকলেও আসবে।’ হেসে বলল জাকুব।
‘জানেন আমরা কে?’ বলল আগন্তুকের একজন।
‘এ প্রশ্ন তো আমি অনেক আগেই জিজ্ঞাসা করেছি।’ বলল জাকুব।
আগন্তুক দু’জনের একজন কাউন্টারে একটা ঘুষি মেরে বলল, আমরা তোমার যম, মিলেশ বাহিনীর লোক আমরা।
জাকুব হেসে তার কোটের কলারের প্রান্ত উল্টিয়ে ওদের দেখাল। সেখানে জ্বল জ্বল করছে মিলেশ বাহিনীর প্রতীক।
আগন্তুক দু’জনের রাগ একদম পানি হয়ে গেল। তাদের পিস্তল চলে গেল তাদের পকেটে। একাবারে ভিজা গলায় বলল তাদের একজন, কিন্তু আপনাকে তো আমরা চিনি না।
‘চিনবেন না, আজই আমি প্রিষ্টিনা থেকে কনষ্টানটাইনের সাথে বেলগ্রেড এসেছি। এখানকার কোন ডিউটিতে এখনও আমি যোগ দেইনি। ব্রাংকোর সাথে এ রাস্তায় আমি এসেছি পরিস্থিতি দেখতে।’ বলল জাকুব।
‘কিছু মনে করবেন না, নিজেদের মধ্যে ভুল বুঝাবুঝি হয়ে গেছে।’ বলল তাদের একজন।
কথা শেষ করেই আবার সে বলল, কিন্তু যে হুইসেল বাজিয়ে আমাদের আসার সংকেত দিল সে গেল কোথায়?
‘আপনারা কোনদিক থেকে এসেছেন?’ বলল জাকুব।
‘পশ্চিম দিকে রাস্তার ওপাশের ডিপার্টমেন্টাল ষ্টোর থেকে।’ ওদের একজন বলল।
‘হতে পারে কাউকে সে ধাওয়া করেছে, পুব পাশের দোকান গুলোতে আর একটু খোঁজ করুন। আমিও আপনাদের সাথে আসব, পয়সা চুকিয়ে আসছি।’ বলল জাকুব।
‘ঠিক বলেছেন ধাওয়া করে কোন দিকে যেতে পারে, সন্ধ্যার অন্ধকারে তো সঠিকভাবে কিছু ঠাহর করা যায়নি।’ বলে ওরা পুব পাশের দোকানের দিকে চলে গেল।
এ দোকানটিই সেনজিক পরিবারের দোকানগুলোর শেষ দোকান। এর পুব পাশ থেকে অন্যদের দোকান শুরু হয়েছে এবং মাঝখানে অল্প একটু ফাঁকা জায়গা। ফাঁকা জায়গাটিতে সেনজিক পরিবারের আরেকটা দোকানের কাঠামো তৈরী আছে, কিন্তু কাজ শেষ হয়নি এখনও।
ওরা চলে গেলে জাকুব সেলসম্যানকে জিনিসগুলো প্যাকেট করতে বলে দোকানের ভেতরের কক্ষে চলে গেলে।
সালেহ বাহমনও তখন সেখানে এসে প্রবেশ করেছে।
জাকুব তাড়াতাড়ি বলল, এখন কথা বলার সময় নেই। আপনি একটা ঠিকানা দিন যেখানে গিয়ে আজই আমি কথা বলতে পারি।
সালেহ বাহমন তাড়াতাড়ি কাগজের একটা টুকরো নিয়ে একটা ঠিকানা লিখে জাকুবের হাতে দিতে দিতে বলল, কখন আপনি যাবেন?
‘ওরা পাশের দোকানের দিকে গেছে, ওদের সাথে আমাকে কিছুক্ষণ থাকতে হবে। তারপর ঘন্টা দু’য়েকের মধ্যে আমি আপনার সাথে দেখা করতে পারি।’ বলল জাকুব।
‘ঠিক আছে।’ বলে হাত বাড়িয়ে দিল সালেহ বাহমন।
জাকুব হ্যান্ডশেক করে বেরিয়ে এল দোকান থেকে। তার হাতে দোকান থেকে কেনা কয়েকটা জিনিসের একটা প্যাকেট।

ওমর বিগোভিকের ড্রইংরুম।
ওমর বিগোভিক এবং সালেহ বাহমন সোফায় পাশাপাশি বসে। দু’জনের চোখেই উদ্বেগ মুখ শুকনো।
ড্রইং রুমের পাশের ঘরে সংযোগ দরজার ওপারেই বসে আছে নাদিয়া নুর এবং তার মা। তাদেরও চোখে মুখে উদ্বেগ।
কথা বলছিল সালেহ বাহমন, ‘ভীষণ তাড়াহুড়া করে একটা জায়গার ঠিকানা চেয়েছে, হঠাৎ করেই আমি এখানকার ঠিকানা দিয়ে দিয়েছি লোকটিকে। পরক্ষণ থেকেই আমি ভাবছি, এ আমার ঠিক হয়নি। কোন হোটেল রেষ্টুরেন্টের কথা বললেই ভাল হতো।
‘লোকটির নাম কি?’ বলল ওমর বিগোতভিক।
‘নাম জানি না।’ বলল সালেহ বাহমন।
‘পরিচয়ও তো জিজ্ঞাসা করার সময় হয়নি।’
‘আমি মাত্র তাকে একটা প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করেছি, সে তার উত্তর দেবার আগেই ওরা এসে পড়েছে।’ বলল সালেহ বাহমন।
ওমর বিগোভিক কথা বলল না। চোখ বন্ধ করে সে ভাবছিল। অল্পক্ষণ পর সে চোখ খুলল। বলল, মৃত্যু অথবা কিডন্যাপের হাত থেকে লোকটি তোমাকে বাঁচিয়েছে, সে দিক থেকে তাকে বিশ্বাস করা যায়। কিন্তু তার যে পরিচয়, প্রকাশ পেয়েছে সন্দেহজনক। থামল ওমর বিগোভিক।
সালেহ বাহমন বলল, শুধু তো আমাকে বাঁচানো নয়, মিলেশ বাহিনীর লোকটিকে সেই হত্যা করেছে বলা যায়, কারণ গুম করার পরামর্শ সেই দিয়েছে।
‘ঠিক বলেছ, একথাটা আমার মনেই ছিল না। এদিক দিয়ে তো দেখা যাচ্ছে সে মিলেশ বাহিনীর বিরুদ্ধে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, গরম তর্ক-বিতর্ক, এমনকি পিস্তল বের করার পর মিলেশ বাহিনীর লোকেরা তাকে ছেড়ে দিল কেন? এবং পরে সেই বা কেন মিলেশ বাহিনীর লোকদের সাথে গেল? আর তুমি যা শুনেছ সে অনুসারে সে আজ কনষ্টানটাইনের সাথে প্রিষ্টিনা থেকে এসেছে, তাহলে তো সে মিলেশ বাহিনীর প্রধান কনষ্টানটাইনের বিশ্বস্ত লোক।’ বলল ওমর বিগোভিক।
চিন্তার নতুন একটা কালো ছায়া নামল সালেহ বাহমনের মুখে। বলল, সেদিক দিয়ে তো তাই।
থামল সালেহ বাহমন। তারপরেই আবার শুরু করল, কিন্তু হাসান সেনজিক পরিবারের কারো সাথে সে কথা বলতে চায় কেন? আমি তো হাসান সেনজিক পরিবারের লোক নই, আমার সাথে কথা বলতে চাইছে কেন?
‘ঠিক আছে সালেহ বাহমন, আমরা চিন্তা করে কোন কুল পাবনা। আল্লাহ ভরসা। আসতে দাও তাকে।’
ঠিক এই সময়েই ওমর বিগোভিকের গেটের কলিং বেল বেজে উঠল।
সালেহ বাহমনের বুকটা ধক করে উঠল।
সালেহ বাহমন ও ওমর বিগোভিক পরস্পর পরস্পরের দিকে তাকাল।
সালেহ বাহমন উঠে দাঁড়াল। বলল, চাচাজান আপনি বসুন, আমি দেখছি। বলে সালেহ বাহমন গেটের দিকে চলল। বিসমিল্লাহ বলে গেট খুলল।
ঠিক, গেটে দাঁড়িয়ে দোকানে দেখা সেই লোকটি।
সালেহ বাহমন উদ্বেগটা ভেতরে চেপে রেখে মুখে হাসি টেনে তাকে স্বাগত জানাল। বলল, আসুন, খুব খুশি হয়েছি, ভেতরে আসুন।
উভয়ে হ্যান্ডশেক করল। তারপর লোকটিকে নিয়ে সালেহ বাহমন চলে এল ড্রইং রুমে।
ওদেরকে ঢুকতে দেখে ওমর বিগোভিক উঠে দাঁড়াল।
সালেহ বাহমন লোকটিকে তার সাথে পরিচয় করে দেয়ার জন্যে বলল, ইনি ওমর বিগোভিক। আমার মুরব্বী।
হ্যান্ডশেক করে ওমর বিগোভিক লোকটিকে বসিয়ে তার পাশে বসে পড়ল। সালেহ বাহমন আরেকটি সোফায় বসল।
বসেই সালেহ বাহমন বলল, ওর সামনে তো আমরা আলাপ করতে পারি।
লোকটি অর্থাৎ জাকুব হেসে বলল, কোন অসুবিধা নেই, বরং ভালই হবে।
একটু চুপ করেই জাকুব আবার মুখ খুলল। বলল, প্রথমেই আমার পরিচয় সুষ্পষ্ট করতে চাই। আমি মিলেশ বাহিনীর লোক, আমার নাম জাকুব।
দম নিবার জন্যে কথায় একটু বিরতি দিয়েছিল জাকুব।
নাম ও মিলেশ বাহিনীর কথা শুনেই ওমর বিগোতিক ও সালেহ বাহমনের মুখ অন্ধকার হয়ে গেল।
তাদের এই পরিবর্তন জাকুবের নজর এড়াল না।
জাকুব হাসল। বলল, জানি আমার এ পরিচয়কে আপনারা ভাল ভাবে নেবেন না। কিন্তু এটাই আমার সব পরিচয় নয়। থামল জাকুব।
সালেহ বাহমন ও ওমর বিগোতিক কোন কথা বলল না। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে চেয়ে রইল জাকুবের দিকে।
জাকুব আবার শুরু করল, আমি মিলেশ বাহিনীর লোক। কিন্তু আহমদ মুসা আমাকে জয় করে নিয়েছেন। আমি এখন মিলেশ বাহিনীর হয়েও মিলেশ বাহিনীর লোক নই।
-তোমার মানে আপনার আহমদ মুসার সাথে দেখা হয়েছে? চোখে আলো জ্বালিয়ে বলল ওমর বিগোতিক।
-শুধু আহমদ মুসা নয়, হাসান সেনজিকের সাথেও দেখা হয়েছে।
-কোথায়? কেমন করে? বলল সালেহ বাহমন।
‘সে এক বিরাট কাহিনী’ শুরু করল জাকুব, ‘সেদিন মিলেশ-এর জন্মদিনে আমি ছিলাম কসভোর মিলেশ স্মৃতি স্তম্ভে। শোনা গেল হাসান সেনজিকের মত একজনকে গাড়িতে মিলেশ স্মৃতি স্তম্ভের পাশ দিয়ে সিটানিক নদীর দিকে যেতে দেখা গেছে। দুরবীণ দিয়ে দেখা গেল তাদের গাড়ি মুরাদের বিজয় সৌধের কাছে থেমেছে। আমাকে ও আমার চাচাত ভাইকে পাঠানো হলো নিশ্চিত হবার জন্যে। আমরা ছুটলাম। গিয়ে আমরা হাসান সেনজিককেই সামনে পেলাম। নিশ্চিত হয়ে আমরা বিজয় সৌধের একটু আড়ালে গিয়ে পরিকল্পনা অনুসারে সংকেত দিলাম। এর কিছুক্ষণ পরেই আমরা দেখলাম, হাসান সেনজিক এবং আরো দু’জন তড়িঘড়ি গিয়ে গাড়িতে উঠেছে। বুঝলাম ওরা পালাচ্ছে আমাদের টের পেয়ে। আমরা দু’জন পিস্তল বাগিয়ে ছুটলাম। কয়েক মুহূর্ত পরেই পেছনে রিভলভারের গুলির আওয়াজ শুনে চমকে উঠে আমরা ফিরে দাঁড়ালাম। দেখলাম উদ্যত রিভলবার হাতে এক যুবক। আমাদেরকে পিস্তল ফেলে দিয়ে ব্রীজের দিকে হাটবার নির্দেশ দিল। বুঝলাম, আমাদের গুলি করে নদীতে ফেলে দেবার জন্যেই নিয়ে যাচ্ছে। আমরা মৃত্যুভয়ে তখন অস্থির। কাঁপছিলাম আমরা। ব্রীজের উপর নিয়ে আমাদের দাঁড় করিয়ে জিজ্ঞেস করল, আমরা কতদিন ধরে মিলেশ বাহিনীতে আছি, বাড়ীতে কে কে আছে। আমরা সত্য জবাব দিলাম। তারপর তিনি আমাদের জিজ্ঞাসা করলেন, আমরা সাঁতার জানি কিনা। জানি শুনে বললেন, যাও তোমরা সিটনিকে লাফিয়ে পড়ে চলে যাও, এটাই তোমাদের শাস্তি। আমরা কানকে বিশ্বাস করতে পারলাম না। জীবন নিতে আসা শত্রুকে যে কেউ মাফ করে, কেউ ছেড়ে দেয় এই প্রথম দেখলাম।
আমরা নদীতে ঝাপিয়ে পড়ে চলে এলাম। আমরা দুই ভাই ঠিক করেছিলাম তাদের বিরুদ্ধে আর যাব না। কিন্তু সেই রাত্রেই যেতে হল।
হাসান সেনজিকের সাথে সেদিন ঐ গাড়িতে ছিল আরও দু’জন, মাজুভ ও নাতাশা স্বামী-স্ত্রী। মাজুভ প্রিষ্টিনা শহরের মিলেশ বাহিনীর একজন নেতৃস্থানীয় লোক। প্রমাণ পাওয়া গেল এবং দেখা গেল সে আহমদ মুসার পক্ষে যোগ দিয়েছে। আরও অনুমান করা হলো এবং খোঁজ নিয়ে নিশ্চিত হওয়া গেল তার বাড়িতে আহমদ মুসা ও হাসান সেনজিক আছে। সংঙ্গে সঙ্গেই সিদ্ধান্ত হলো সেই রাতেই মাজুভ, নাতাশা, হাসান সেনজিক ও আহমদ মুসাকে কিডন্যাপ, না পারলে হত্যা করা হবে। ঠিক হলো সার্ভিয়া প্রদেশের মিলেশ বাহিনীর প্রধান দূর্ধর্ষ জারজেস জিবেঙ্কু সহ নয়জন এই অভিযানে অংশ নেবে। আমার ভাই যেতে রাজি হলো না, তাকে গুলি করে মারা হলো। ভয়ে আপত্তি না করে আমি অভিযানে শরিক হলাম।
আটজন দু’ভাগে ভাগ হয়ে আমরা চারজন গেলাম মাজুভ ও নাতাশাকে ধরে আনতে দোতালায়, অন্য চারজন গেল হাসান সেনজিক ও আহমদ মুসাকে কিডন্যাপ অথবা হত্যা করতে।
আমরা চারজন সফল হলাম। মাজুভকে ধরে নিয়ে এসে গাড়িতে তুললাম। নাতাশা কাঁদতে কাঁদতে এমনিতেই সাথে এসেছিল। জোর করে আনতে হয়নি।
কিন্তু অন্য চারজন তখনও ফেরেনি। এই সময় আমরা গাড়িতে এসে উঠতেই ভেতর থেকে ষ্টেনগানের গুলির শব্দ পাওয়া গেল।
আমাদের দু’জন ছুটল কি হল খোঁজ নেবার জন্যে। ওরা যাবার কয়েকমুহূর্ত পরেই আবার রিভলভারের দু’টি গুলির শব্দ হলো। রিভলভারের গুলির পর পরই আহমদ মুসাকে রিভলভার হাতে ছুটে নেমে আসতে দেখলাম আমরা। বুঝা গেল আমাদের লোকেরা পরাজিত হয়েছে। জারজেস একটা গুলি করল আহমদ মুসাকে। কিন্তু তার আগেই সে লনে শুয়ে পড়েছিল।
এই অবস্থায় ভয়ে আমরা মাজুভকে নিয়ে গাড়ি করে পালালাম। কিন্তু নাছোড়বান্দা আহমদ মুসা মাজুভকে উদ্ধারের জন্যে আমাদেরই অন্য গাড়িটা নিয়ে আমাদের পিছু নিল। বেলগ্রেড হাইওয়ে দিয়ে দেড়শ মিটার আসার পরেই আহমদ মুসা আমাদের ধরে ফেলল। জারজেস জিবেঙ্কু পালাতে গিয়ে নিহত হলো। পেছনের সিটে আমি ও মাজুভ ছিলাম। আমি আগেই মাজুভের কাছে আত্মসমর্পন করেছিলাম। এবারও আহমদ মুসা আমাকে মাফ করে দিলেন। অভিযানের ৮ জনের মধ্যে আমিই শুধু বেঁচে গেলাম।
দু’টি গাড়িতে করে আমরা প্রিষ্টিনায় ফিরে যাচ্ছিলাম। প্রিষ্টিনার কাছাকাছি পৌঁছতেই মিলেশ বাহিনীর নেতা স্বয়ং কন্সটান্টাইনের নেতৃত্বে দু’টি গাড়ি আমাদের গতিরোধ করে দাঁড়ায়। গতিরোধ করেই ওরা আমাদের উপর মেশিনগানের অবিরাম গুলি বর্ষণ শুরু করে। তারপর আমার কিছু মনে নেই। আমার জ্ঞান ফিরল কোকা শহরে মিলেশ বাহিনীর ঘাটিতে। জ্ঞান ফিরেই সামনে দেখলাম মিলেশ বাহিনীর নেতা কনষ্টান্টাইনকে। আঁতকে উঠলাম, তাহলে কি আহমদ মুসাদের সবাইকে বন্দী করেছে অথবা মেরে ফেলেছে। পরে ওদের কাছেই শুনলাম, গ্যাস বোমা ফেলে সবাইকে অজ্ঞান করে বন্দী করে কোকার ভূগর্ভস্থ বন্দীখানায় বন্দী করে রাখা হয়েছে। আট ঘন্টার আগে কারও জ্ঞান ফিরবে না। আমাকে ওদের কাছ থেকে উদ্ধার করে ইনজেকশন দিয়ে জ্ঞান ফেরানো হয়েছে। আরও শুনলাম সকাল ৮ টায় মিলেশ বাহিনীর দরবার বসবে, সেখানে আহমদ মুসা, হাসান সেনজিক, মাজুভ ও নাতাশাকে এনে তাদের জ্ঞান ফিরিয়ে মহা উৎসবের মাধ্যমে তাদের হত্যা করা হবে।
মনটা আমার খুব খারাপ হয়ে গেল। আসলে মানুষকে আপন করে নেবার অদ্ভুত ক্ষমতা আছে আহমদ মুসার। তাছাড়া আহমদ মুসার মত বিষ্ময়কর সাহসী, অকল্পনীয় ক্ষিপ্র এবং অপরূপ কুশলী মানুষ মিলেশ বাহিনীর হাতে মারা যাবে আমার মন কিছুতেই মেনে নিতে চাইছিল না।
পৌনে ৮টায় দরবার বসল। ৮টায় কনষ্টান্টাইন দরবারে আসবেন। পৌনে ৮টায় ৯ জনকে পাঠানো হলো ভূগর্ভস্থ বন্দীখানা থেকে আহমদ মুসা, হাসান সেনজিক, মাজুভ ও নাতাশাকে আনার জন্যে।
আমার সামনে দিয়েই ওরা চলে গেল। আমার মনে হল আমার বুকের উপর দিয়ে ওরা যাচ্ছে। এত কষ্ট লাগল আমার। আমি উঠে দাঁড়ালাম। ওদের বীভৎস উৎসব নিজ চোখে দেখতে পারবো না।
আমি কিছুক্ষণ এদিক-ওদিক পায়চারি করে বাগানের দিকে যাবার জন্যে সিঁড়ি দিয়ে এক তলায় নামছিলাম। শেষ সিঁড়ি থেকে করিডোরে পা দিয়ে সামনে তাকিয়ে ভূত দেখার মত চমকে উঠলাম। সামনেই আহমদ মুসা, মাজুভ, হাসান সেনজিক ও নাতাশাকে দেখলাম। আহমদ মুসার হাতে ষ্টেনগান।
চমকে উঠার পরক্ষণেই খুশিতে আমার মন ভরে গেল। ওরা মুক্ত হতে পেরেছে দেখে আনন্দিত হলাম। ওরা চলে আসার সময় আমি আহমদ মুসাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, বেলগ্রেডে কোথায় আমি তাদের সাক্ষাৎ পাব। আমাকে হাসান সেনজিকের বাড়ির ঠিকানা দিয়ে ওখানেই তাদের খোঁজ নিতে বলা হয়েছিল। সেজন্যেই আমি আজ হাসান সেনজিকের ওখানে গিয়েছিলাম।
একটু থামল জাকুব। থেমেই আবার বলল, এত কথা বললাম এই কারণে যে মিলেশ বাহিনীর একজন লোককে বিশ্বাস করা আপনাদের জন্যে সহজ নয়।
ওমর বিগোভিক ও সালেহ বাহমনের মুখ তখনও হা হয়ে আছে। তারা যেন বিষ্ময়কর এক রূপকথা শুনছিল।
জাকুব থামার পর ওমর বিগোভিক বলল, আপনাকে ইনজেকশন দিয়ে জ্ঞান ফেরানো হলো। কিন্তু আহমদ মুসারা চারজন কি করে জ্ঞান ফিরে পেল? কেমন করেই বা তারা মুক্ত হলো? অবিশ্বাস্য ঘটনা।
জাকুব বলল, সেদিন মিলেশ বাহিনীর সকলের মনেই এ প্রশ্ন জেগেছিল, আমার মনেও জেগেছিল। কিন্তু উত্তর আমরা পাইনি। ওরা চলে যাবার পর বন্দীখানায় গিয়ে ষ্টেনগানের গুলিতে ঝাঝরা হয়ে যাওয়া মিলেশ বাহিনীর লোকদের ৯ টি লাশ পাওয়া গেছে। মিলেশ বাহিনীর সবার কাছেই ঘটনাটা অবিশ্বাস্য হয়ে আছে। কিন্তু আমি মনে করি আহমদ মুসাকে যতটুকু আমি দেখেছি তাতে মনে হচ্ছে, আহমদ মুসা সব অসম্ভবকেই সম্ভব করতে পারেন। অথচ লোকটির নিষ্পাপ হাসি, সরল মুখ, অত্যন্ত ভদ্র ও দয়ালু ব্যবহার দেখে মনেই হয় না যে অমন এক দুর্ধর্ষ লোক তিনি।
জাকুব থামতেই সালেহ বাহমন প্রশ্ন করল, ওরা কি বেলগ্রেড এসেছেন?
জাকুব বলল, আমি নিশ্চিত ওরা বেলগ্রেড এসেছেন। কিন্তু মিলেশ বাহিনী প্রমান পাচ্ছে না যে, তারা বেলগ্রেড এসেছেন। দক্ষিণ ও পশ্চিম দিক থেকে যত রাস্তা বেলগ্রেডে প্রবেশ করেছে, সব রাস্তার মুখে সকাল থেকেই মিলেশ বাহিনী পাহারা বসিয়েছে। প্রত্যেক ব্যক্তি, প্রত্যেকটি গাড়ি পরীক্ষা করা হয়েছে। তাদের চোখকে ফাঁকি দিয়ে কারোর শহরে ঢুকা অসম্ভব।
-তাহলে আপনি নিশ্চিত হচ্ছেন কি করে যে তারা বেলগ্রেড এসেছেন? বলল সালেহ বাহমন।
-আমি আগেই বলেছি, আহমদ মুসা এমন এক লোক যিনি অসম্ভবকে সম্ভব করেন। বুঝছেন না, মাজুভের মত মিলেশ বাহিনীর একজন নেতৃস্থানীয় লোক কি করে আহমদ মুসার ভক্তে পরিণত হলো, আর আমিই বা কি করে এত তাড়াতাড়ি মিলেশ বাহিনীর বিরুদ্ধে দাঁড়াবার সাহস পেলাম।
-আপনার কথাটাই বলুন তো, কেন কিসে আপনার এই পরিবর্তন? বলল সালেহ বাহমন।
-প্রথমেই আহমদ মুসার দয়া, উদারতা আমাকে মুগ্ধ করেছে। আমি ভেবেছি, শত্রুর কাছে যে লোক অত সুন্দর হয় সে অনেক বড় মানুষ। দ্বিতীয়তঃ তাকে দেখে আমার অতীতের কথা মনে হয়েছে। আমার দাদা এবং পূর্বপূরুষ মুসলমান ছিলেন। আহমদ মুসাকে দেখে আমার মনে হয়েছে, মুসলমান হওয়া একটা গৌরবের বিষয়। এ দু’টি বিষয়ই মিলেশ বাহিনীর সাথে আমার সম্পর্ক নষ্ট করেছে।
-আহমদ মুসারা বেলগ্রেডে এলে কোথায় উঠতে পারে বলে আপনি মনে করেন? বলল ওমর বিগোভিক।
-এটা বলা মুশকিল। আহমদ মুসার সাথে মাজুভ রয়েছে। মাজুভ বেলগ্রেডের সব কিছুই জানে। সুতরাং তাদের কোন অসুবিধা হবে না। বলল জাকুব।
একটু থেমেই আবার সে বলল, এতক্ষন আমি আমার কথাই বলেছি, আমি যা জানতে চাই তা জানা হয়নি। আপনাদের পরিচয়ও জানা হয়নি।
ওমর বিগোভিক বলল, আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকুরীচ্যুত একজন শিক্ষক, এখন ব্যবসা করি।
ওমর বিগোভিক থামলে সালেহ বাহমন বলল, আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্র। আরেকটা ছোট পরিচয় আছে। সেটা হলো, আমি হোয়াইট ক্রিসেন্টের একজন কর্মী।
হোয়াইট ক্রিসেন্টের নাম শুনে জাকুব আগ্রহী হয়ে উঠল। বলল, এ সংগঠনের কথা মিলেশ বাহিনীতে এখন খুব আলোচনা হচ্ছে। সংগঠনের বিস্তার কেমন হয়েছে, শক্তি সামর্থ কেমন অর্জন করেছে?
-নতুন সংগঠন। সংগঠিত হওয়ার পর্যায় চলছে। এখনও উল্লেখ করার মত কিছু সংগঠন করতে পারেনি।
-নতুন বটে, মিলেশ বাহিনীতে কিন্তু আতংকের সৃষ্টি হয়েছে। তারা ভয় করছে মুসলমানরা সংগঠিত হলে তাদের গায়ে আর হাত দেয়া যাবেনা, প্রতিটি আঘাতের প্রত্যাঘাত আসবে।
-তারা আঘাত না দিলেই তো পারে, শান্তিতে সহাবস্থান করা যায়। বলল ওমর বিগোভিক।
-এই শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানকেই মিলেশ বাহিনী এবং বিদ্বেষবাদী খ্রিষ্টানরা যমের মত ভয় করে।
-কেন? বলল সালেহ বাহমন।
-শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের অর্থ হলো, তারা মনে করে, খ্রিষ্টানদের বিপর্যয় এবং মুসলমানদের সংখ্যা বৃদ্ধি ও বিকাশ। বলল জাকুব।
-কেমন করে? বলল সালেহ বাহমন।
-আসলে খৃষ্টধর্ম তো কোন জীবন-ধর্ম নয়, নিষ্ক্রিয় কিছু বিশ্বাসের সমষ্টি মাত্র, যার আবার কোন বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। সুতরাং এ ধর্ম আজকের দিনের চাহিদা পুরণ করতে পারছে না। অন্যপক্ষে, তারা মনে করে, ইসলাম একটি জীবন-ধর্ম। ইসলাম শুধু বিশ্বাস নির্ভর নয়, কাজ নির্ভর ধর্ম, যা বিজ্ঞান ও বাস্তবতা সম্মত। সুতরাং মুসলমানরা শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের সুযোগ পেলে তাদের প্রভাব খৃষ্টানদের ঘরে ঘরে ছড়িয়ে পড়বে। শান্তি ও সত্য সন্ধানী সব খৃষ্টান ইসলামের ছায়ায় গিয়ে আশ্রয় নেবে।
-খৃষ্টানরা মুসলমানদের এত ভয় করে? বলল ওমর বিগোভিক।
-ভয় করবে না? সোভিয়েত ইউনিয়নে কম্যুনিষ্ট সরকার সেখানকার মুসলমানদের জাতিসত্তা ধ্বংসের জন্যে হেন ব্যবস্থা নেই যা গ্রহণ করেনি। আরবী ভাষা বিলুপ্ত করেছে, কোরআন পড়া ও ধর্মীয় শিক্ষা বন্ধ করেছে, সচেতন মুসলমানদের হত্যা করেছে, চালান নীতির মাধ্যমে মুসলিম জনশক্তিকে বিভক্ত, বিশৃঙ্খল করে দিয়েছে। ইতিহাস বিকৃত করে অতীত থেকে তাদের বিচ্ছিন্ন করেছে, অন্য ধর্মাবলম্বীদের সাথে বিয়ে বাধ্যতামুলক করে তাদের জাতীয় বিশুদ্ধতা বিনষ্ট করেছে এবং ধর্ম-কর্ম অপ্রোয়জনীয় ও নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। যুগের পর যুগ ধরে এই শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা চলার পরেও দেখা যাচ্ছে মুসলমান জাতির মৃত্যু হয়নি। বরং অবস্থা এতটাই উদ্বেগজনক হয়ে দাঁড়িয়েছে যে, মুসলমানরাই অদুর ভবিষ্যতে সোভিয়েত ইউনিয়নের সংখ্যাগুরু জাতিতে পরিণত হবে। অর্থাৎ মুসলমানদের বিশ্বাসের কোন মৃত্যু নেই, বরং প্রতিকুল পরিবেশে এ বিশ্বাস আরও তাজা হয়ে ওঠে। এ কারণেই মিলেশ বাহিনী মুসলিম-নিধন নীতি গ্রহণ করেছে। তাদের কথা, মুসলমানদের বাঁচিয়ে রাখলে আর ওদের সাথে পারা যাবে না। থামল জাকুব।
-মেরে কি একটা জাতিকে শেষ করা যায়? বলল ওমর বিগোভিক।
-সেটা তারা ভাবছে না। তারা ভাবছে, যা তারা করছে, তার কোন বিকল্প নেই।
কথা শেষ করেই জাকুব বলল, আমার মূল প্রশ্নটায় আমি ফিরে আসতে চাচ্ছি। হাসান সেনজিক পরিবারের কারো সাথে যোগাযোগের পথ কি?
সালেহ বাহমন হাসল। বলল, ওর বাড়ীতে কোন ব্যাটা ছেলে নেই।
হাসান সেনজিকের মা ও ফুফু ছাড়া কোন মেয়ে ছেলেও আর নেই।
বাড়ীর আয়া, চাকর-বাকর তো কিছুই জানে না। অতএব তাদের ওখানে যোগাযোগের কোন পথ নেই। তাদের সাথে অন্যভাবে যোগাযোগ করতে হয়। আমরা এ ব্যাপারে আপনাকে সাহায্য করব।
জাকুব বলল, আমার বেশি প্রয়োজন নেই। আমি আহমদ মুসার সাথে যোগাযোগ করতে চাই। এই যোগাযোগের পয়েন্ট হিসাবে তিনি হাসান সেনজিকের বাড়ির কথাই উল্লেখ করেছেন।
‘ঠিক আছে, উনি যোগাযোগ করলেই আমরা আপনাকে জানাব।’ বলল সালেহ বাহমন।
কথা শেষ করেই সালেহ বাহমন আবার বলল, কিন্তু আপনাকে আমরা পাব কোথায়? জাকুব একটা চিরকুট সালেহ বাহমনের হাতে তুলে দিতে দিতে বলল, এটা মিলেশ বাহিনীর নতুন হেড কোয়ার্টারের ঠিকানা। ঠিকানাটা আপনাদের অবগতির জন্য দিলাম। ওখানে আমার খোঁজ করার দরকার নেই। আমি নিজেই হাসান সেনজিকের বাড়ির পাশের দোকানগুলোতে বিশেষ করে ঐ দোকানের ঐ সেলসম্যানের কাছে খোঁজ করব।
‘ঠিক আছে, এটাই সবচেয়ে সহজ হবে।’ বলল সালেহ বাহমন।
এই সময় ভেতরের দরজায় নক করার শব্দ হলো।
ওমর বিগোভিক ভেতরে চলে গেল।
গিয়েই ফিরে এসে হাসতে হাসতে বলল, আমার ভুল হয়ে গেছে, মেহমানকে শুধু কথাই শোনাচ্ছি, কোন মেহমানদারী এখনও হয়নি। ভেতর থেকে এই অভিযোগ উঠেছে। সুতরাং আপনারা একটু বসুন, আমি আসছি। বলে ওমর বিগোভিক ভেতরে চলে গেল।
সালেহ বাহমন বলল, বিকালে আমার নাস্তা হয়নি, সত্যিই ক্ষুধা পেয়েছে। বলে আবার আলোচনায় ফিরে এল তারা।
‘মা নাদিয়া, আনেক ঘটনা ঘটেছে, আহমদ মুসা ও হাসান সেনজিকরা বেলগ্রেড এসে পৌঁছেছে, এ খবর তো ডেসপিনার কাছে তোমাকে পৌঁছাতে হয়।’ বলল ওমর বিগোভিক।
‘আমার যেন বিশ্বাস হতে চাইছে না। ওরা সত্যিই কি এত প্রতিরোধের মধ্যে বেলগ্রেড ঢুকতে পেরেছেন?’ বলল নাদিয়া নূর।
‘জাকুবের কথা তোমরাও তো শুনেছ। আহমদ মুসা কি করে মিলেশ বাহিনীর পাতা জাল একের পর এক ছিন্ন করেছে, সে সব ঘটনা অকল্পনীয়, অবিশ্বাস্য মনে হয়নি? যদি ঐ অবিশ্বাস্য ব্যাপারগুলো সত্য হয়ে থাকে, তাহলে তোমার কাছে যা এখন অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে তা সত্য হবে না কেন?’ বলল ওমর বিগোভিক।
‘এই খবর ডেসপিনা এবং হাসান সেনজিকের মা শুনলে ভয়ানক খুশী হবে, আমি এখনই যাই আব্বা ডেসপিনার ওখানে।’ বলল নাদিয়া নূর।
‘আমি তো সে কথাই বলছি, ওদের তাড়াতাড়ি জানান দরকার খবরটা। আর আমরাও জানতে পারব কোন খবর তারা জানে কিনা।’ বলল ওমর বিগোভিক।
‘ঠিক বলেছেন,’ বলে উঠে দাঁড়াল নাদিয়া। হাতের ঘড়ির দিকে একবার তাকিয়ে চলে গেল নিজের ঘরের দিকে তৈরী হবার জন্যে।

Top