১১. দানিয়ুবের দেশে

চ্যাপ্টার

শোয়া থেকে উঠে আড়মোড়া ভেঙে টান হয়ে বসে আহমদ মুসা বলল, এভাবে শুয়ে থাকলে শুয়ে থাকার মজা পেয়ে বসবে। আর নয়।
বলে আহমদ মুসা বাথরুমে গেল।
পাশেই আরেকটা সিটে হাসান সেনজিক শুয়েছিল।
গতকাল বিকেলে আহমদ মুসারা বেলগ্রেড এসে পৌঁছেছে। উঠেছে মাজুভের বোনের বাসায়। মাজুভের বোন ৭ বছরের এক মেয়ে নিয়ে বিরাট এক বাড়িতে বাস করে। মাজুভের ভগ্নিপতি নৌবাহিনীর একজন উচ্চ পদস্থ অফিসার। সে আছে এখন অদ্রিয়াতিক সাগরে।
মাজুভদের বিশেষ করে নাতাশাকে পেয়ে তার বোন মহাখুশি। নাতাশাও হাফ ছেড়ে বেঁচেছে প্রাণ খুলে কথা বলার লোক পেয়ে।
মাজুভের বোনের বাসা বেলগ্রেডের অভিজাত এলাকার সেনাবাহিনীর অফিসার কলোনীতে।
গতকাল থেকে গোটা সময়টাই মাজুভ, নাতাশা, হাসান সেনজিক ও আহমদ মুসা ঘুমিয়ে কাটিয়েছে। ক’দিনের উদ্বেগ-অস্থিরতার পর নিরাপদ ঘুমটা সবার জন্যেই মধুর হয়েছে। খাওয়া আর নামাজ ছাড়া আর কিছুই করেনি আহমদ মুসারা।
এই সময় তাদের নিস্তরঙ্গ জীবনে তরঙ্গ তুলেছে মাজুভের ৭ বছরের ভাগ্নী রিটা রাইন। মাজুভের বোন মারিয়া মাজুভ ও নাতাশার নামাজ পড়া দেখে ভীত হয়েছে, কিন্তু নামাজ পড়া দেখে খুব মজা পেয়েছে রিটা। তার প্রশ্নের জবাব দিতে সবাই অস্থির।
নাতাশাকে প্রথম নামাজ পড়তে দেখে রিটা অবাক হয়ে তার সামনে হা করে দাঁড়িয়ে থেকেছে। বার বার প্রশ্ন করেছে, কি করছ, কি করছ তুমি বল? কথা বলছ না কেন? সিজদায় গেলে নাতাশার চুল ধরে টানাটানি করেছে আর বলছে, কি হল তোমার মামী? এ রকম করছ কেন? কথা বলছ না কেন?
নাতাশা নামাজ পড়ছে, জবাব দেবে কেমন করে!
অবশেষে মারিয়া এসে রিটাকে ধরে সরিয়ে নিয়ে নাতাশাকে রক্ষা করেছে।
নামাজ শেষে নাতাশা রিটাকে কাছে টেনে বলেছে, নামাজের সময় কথা বলে না, কথা বলব কি করে?
-কেন বলে না? প্রশ্ন করেছে রিটা।
-আমার তোমার সকলের স্রষ্টা যে আল্লাহ সেই আল্লাহর হুকুম নামাজের সময় কথা বলা যাবে না, আর নামাজ যে পড়ছে তাকে কিছু জিজ্ঞাসাও করা যাবে না।
-নামাজ কি?
-নামাজ আল্লাহর কাছে প্রার্থনা।
-আম্মা নামাজ পড়ে না কেন?
বিপদে পড়ে গেল নাতাশা। এখন কি জবাব দেবে? কাছেই মারিয়া দাঁড়িয়েছিল। মুখ টিপে হেসে বলেছে, এখন জবাব দাও। তোমাদের নতুন ধর্ম গ্রহণে কি সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে দেখ।
নাতাশা রিটাকে কাছে টেনে আদর করে বলেছে, তোমার আম্মাও তো প্রার্থনা করে।
-কোথায় করে, একদিনও তো আমি নামাজ পড়তে দেখিনি।
-কেন গির্জায় যায় তো রোববারে। সেখানে প্রার্থনা করে তো।
-তোমার মত বাড়িতে নামাজ পড়ে না কেন?
মহা বিপদে পড়ে গেল নাতাশা। এখন কেমন করে বলে যে, তার মা খৃষ্টান, আর নাতাশারা মুসলমান। আর বললে বিপদ কমবে না, আরও বাড়বে। অবশেষে নাতাশা কোন রকমে পাশ কাটাবার জন্যে বলেছে, সবাই নামাজ পড়ে না, দেখ না আমি আগে পড়তাম না, এখন পড়ি। তোমার মাও একদিন পড়বে।
রিটা বোধ হয় কথাটার যুক্তি বুঝেছিল। সে একটু দম নিল। এই সময় মাজুভ রিটাকে ডাকলে সে ছুটে সেদিকে চলে গেল।
সে চলে যায় বটে, কিন্তু তার মা মারিয়া ধরে বসে নাতাশাকে। বলে, শিশুর কাছে মিথ্যা কথা বলা হলো না? আমি নামাজ পড়ব একথা কি ঠিক?
নাতাশা হেসে মারিয়ার হাত ধরে বলেছে, আপা, আমি ভবিষ্যতের কথা বলেছি। ভবিষ্যতের কথা নিশ্চিত করে আমিও বলতে পারিনা, আপনিও বলতে পারেন না। আমি ইসলাম গ্রহণ করব কোনদিন ভাবিনি।
-অর্থাৎ তুমি বলতে চাচ্ছ, তুমি যা ভাবনি তা যখন ঘটেছে, আমার ক্ষেত্রেও তা ঘটতে পারে।
-ঠিক তা আমি বলিনি। আমি নিছক একটা নীতি কথা বলেছি।
মারিয়া হেসে বলেছিল, তোমরা এই অভাবনীয় কান্ড কিভাবে ঘটালে? ভাবনা-চিন্তার জন্যেও তো সময় দরকার, সে সময়ও তো তোমরা নাওনি। যাদুতে আমি বিশ্বাস করলে বলতাম তোমরা যাদুর কবলে পড়েছ।
নাতাশা বলেছে, কোন ধর্ম যদি পড়া-শুনা করে বুঝে-সমঝে গ্রহণ করতে হয়, তাহলে তার জন্যে সময় দরকার হয়। কিন্তু আমরা পড়ে-বুঝে তো ইসলাম গ্রহণ করিনি। আমরা ইসলাম গ্রহণ করেছি ইসলামকে স্বচক্ষে দেখে।
-সেটা কি রকম? বিমূর্ত কোন আদর্শকে কি দেখা যায়, ইসলামের কি কোন রূপ আছে?
-আদর্শ বিমূর্ত, আদর্শ দেখা যায় না। কিন্তু আদর্শবান মানুষের মধ্যে আদর্শকে জীবন্ত রূপে দেখা যায়। আমরা আহমদ মুসার মধ্যে ইসলাম দেখেছি। তাঁর প্রার্থনায়, তাঁর স্বভাবে, তাঁর আচরণে যে ইসলামকে এক মুহূর্তে আমরা চিনেছি, তা পড়ে বুঝতে বছরের পর বছর লাগত। এ কারণেই ইসলাম গ্রহণে আমাদের দেরি হয়নি।
একটু থেমে দম নিয়েছিল নাতাশা। তারপর আবার শুরু করে, ইসলাম সম্পর্কে অনেক কুৎসা শুনেছি, ইসলামের একটা ভয়ংকর রূপ আমাদের সামনে ছিল। সম্ভবত এ কারণেই ইসলামের প্রকৃত রূপ যখন আমরা দেখলাম, তখন আমরা অভিভূত হয়েছি বেশি। শত্রুর প্রতি যে মানবীয় আচরণ, মানুষের প্রতি যে ভালবাসা এবং সুন্দর ও সুদৃঢ় চরিত্র আমরা আহমদ মুসার মধ্যে দেখেছি, তা আমাদের জয় করে নিয়েছে। সুলতান সালাহউদ্দিনের কাহিনীকে রূপকথা মনে করতাম, কিন্তু আহমদ মুসার মধ্যে তাকে আমরা জীবন্ত দেখেছি।
মারিয়া নাতাশার কথাগুলো গভীর মনোযোগ দিয়ে শুনছিল।
নাতাশার কথা শেষ হলেও কিছুক্ষণ মারিয়া কথা বলেনি। সে কিছুটা আনমনা হয়ে পড়েছিল। বলেছিল, সত্যি নাতাশা, গতকাল থেকে আহমদ মুসা ও হাসান সেনজিকের সাথে আমার পাঁচবার দেখা হয়েছে, আলাপও করেছি তাদের সাথে। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার একবারও ওরা চোখ তুলে কথা বলেনি।
মারিয়া থামলে নাতাশা বলেছিল, ওরা যখন প্রার্থনায় দাঁড়ায় তখন মনে হয় ওরা যেন এ পৃথিবীর মানুষ নয়-দেবদূত। আবার যখন ওরা সংঘাত-সংঘর্ষের ময়দানে, তখন ওরা কঠোর বাস্তববাদী এবং বিবেচক মানুষ। ভাববাদ ও বাস্তববাদিতার এমন অনুপম সমন্বয় শুধু মুসলিম চরিত্রেই দেখলাম।
এ সময় রিটা আবার ছুটে আসে এবং নাতাশাকে জড়িয়ে ধরে বলে, মামী নতুন মামারা নামাজে ওগুলো কি পড়ছে?
নাতাশা তাড়াতাড়ি রিটাকে আহমদ মুসার ঘরের দরজা পর্যন্ত ঠেলে নিয়ে বলেছিল, ওদের পাশে গিয়ে চুপ করে বস। নামাজ শেষ হলে তোমার নতুন মামাকে জিজ্ঞেস করে নিও ওরা কি পড়ছিল।
রিটা ওঘরে চলে যায়।
‘আর এক ধাক্কা রিটার হাত থেকে বাঁচা গেল আপা।’ বলল নাতাশা।
মারিয়া গম্ভীর কণ্ঠে বলেছিল রিটার হাত থেকে এভাবে বাঁচবে সমাজের হাত থেকে কি বাঁচতে পারবে। তোমার সব যুক্তিই মানলাম সবই ঠিক আছে, কিন্তু এই দিকটা কেন একবারও ভাবনি তোমার? দেখছ না গোঁটা বলকানে আজ মুসলমানদের অস্তিত্ব বিনাশের চেষ্টা চলছে?
নাতাশাও গম্ভীর কণ্ঠে বলেছিল। আপা আমরা সবদিকই ভেবে দেখেছি। সব ভেবে পরকালের চিরন্তন শান্তিকেই আমরা অগ্রাধিকার দিয়েছি এর সাথে এ পৃথিবীতে শান্তির একটা বাড়তি লাভের ব্যাপার তো আছেই।
তোমাদের আশা পূর্ণ হোক। তোমাদের মত করে ভাবতে এখনও আমি পারছিনা নাতাশা। বলে মারিয়া নাতাশার চিবুকে একটা চুমু দিয়েছিল। মাজুভ মারিয়ার ছোট। নাতাশা মারিয়ার ছোট ভাইয়ের স্ত্রী। খুব ভালবাসে মারিয়া নাতাশাকে।
আহমদ মুসা বাথরুম থেকে বেরিয়ে এসে দেখল, হাসান সেনজিক উঠে বসেছে।
তুমি আবার উঠেছ কেন শুয়ে থাক। আমি বাইরে বেরুবো তাই উঠলাম। বলল আহমদ মুসা।
‘আমিও তো যাব।’ বলল হাসান সেনজিক।
‘না তুমি যাবে না।’ বলল আহমদ মুসা।
এই সময় ঘরে প্রবেশ করল মাজুভ। আহমদ মুসার শেষ কথাটা শুনেছিল মাজুভ।
বলল কে যাবে না, আপনি কোথাও বেরুচ্ছেন মুসা ভাই?
‘হ্যাঁ বেরুচ্ছি। কিন্তু তুমি আর হাসান সেনজিক বাড়িতে থাকবে। আমি একাই একটু বেরুব।’ বলল আহমদ মুসা।
‘আপনি একা কেন, আমরা থাকব না কেন?’ বলল মাজুভ।
আহমদ মুসা বলল, ‘তুমি ও হাসান সেনজিক সকলের চেনা। তোমাদের সাথে নিলে কারো চোখের আড়ালে থাকা যাবে না। আমি একবার নিরুপদ্রবে বেড়িয়ে আসতে চাই হাসান সেনজিকদের শহীদ মসজিদ রোডটা।
মাজুভ ও হাসান সেনজিক আর বাধা দেবার সাহস পেল না। মাজুভ শুধু বলল, আপনি মিলেশদের জীপটা না নিয়ে আমার দুলাভাইয়ের কারটা নিয়ে যান। এটাই ভালো হবে।
সঙ্গে সঙ্গেই না সুচক জবাব দিয়ে আহমদ মুসা বলল, তোমার ভগ্নিপতি আমাদের আশ্রয় দিয়েছেন এই-ই যথেষ্ট, তাঁকে আমাদের সাথে জডাতে চাই না। তার গাড়ি নিলে চিহ্নিত হয়ে যেতে পারেন তিনি।
এবারও মাজুভ নিরব হয়ে গেল। মনে মনে আহমদ মুসার দুরদৃষ্টির প্রশংসা করল। আরও ভাবল, নিজেকে ঝুকির মধ্য ফেলেও অন্যের মঙ্গল চিন্তা এভাবে কয়জন করতে পারে।
আহমদ মুসা প্রস্তুত হয়ে বেরিয়ে গেল। জীপে উঠল আহমদ মুসা মিলেশ বাহিনীর কাছ থেকে নিয়ে আসা সেই জীপ। গাড়ির নাম্বার আবার পাল্টানো হয়েছে। একটা পরিচিত সরকারী ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের অকেজো হয়ে পডে থাকা নাম্বার এবার ব্যবহার করা হয়ছে।
জীপের ড্রাইভিং সিটে বসে ষ্টার্ট দিল।
পাশেই সিটের উপর শহরের একটা মানচিত্র। মানচিত্রে শহীদ মসজিদ রোডের বিস্তারিত বিবরণ দেয়া হয়েছে।
শহরের নানা রাস্তা ঘুরে আহমদ মুসা প্রবেশ করল শহীদ মসজিদ রোডে। শহীদ মসজিদ রোডের মুখেই তার জীপ দাঁড করানো হলো। দু’পাশে থেকে দু’জন এসে গাড়ী এবং তার দিকে শ্যেন দৃষ্টিতে তাকাল আহমদ মুসা কোন ছদ্মবেশ নেয়নি। তাকে চিনে এমন খুব একটা কেউ নেই। সেদিন রাতের বেলা ওদের হাতে গ্রেপ্তার হয়েছিল। কিন্তু তাকে ভালো করে দেখার সুযোগ কারোও হয়নি। এটা সে নিজেই দেখেছে।
দু’পাশ থেকে আসা দু’জন লোক একবার শ্যেন সন্ধানী দৃষ্টি ফেলেই চলে গেল।
আহমদ মুসা দু’পাশের পরিবেশ দেখে বুঝল ওদের আরও লোক এখানে আছে।
গাড়ি নিয়ে সামনে এগিয়ে চলল আহমদ মুসার।
শহীদ মসজিদ রোডের প্রায় মাঝামাঝি এসে পডেছে আহমদ মুসার গাড়ি, সামনেই হবে হাসান সেনজিকের বাড়ি। আহমদ মুসা মানচিত্র থেকে মুখ তুলে সামনে তাকাল। সঙ্গে সঙ্গেই তার কানে এল চিৎকার। দেখতে পেল ফুটপাত থেকে দু’টি তরুণীকে রাস্তার পাশে দাঁড়ানো একটা মাইক্রোবাসে জোর করে টেনে তোলা হচ্ছে। প্রাণপণ চিৎকার করছে দু’টি তরুণী।
তরুণী দু’টিকে গাড়িতে তুলে চলতে শুরু করল মাইক্রোবাসটি। আহমদ মুসার পাশ দিয়েই চলে যাচ্ছে। গাড়ির ভেতর থেকে চিৎকার ও গোঙানীর শব্দ শোনা যাচ্ছে।
চিৎকার ও গোঙানীর শব্দে আহমদ মুসার হৃদয়ে যেন হাতুড়ীর মত আঘাত করছে। আহমদ মুসার রক্তে যেন আগুন ধরে গেল মুহূর্তেই আহমদ মুসা তার গাড়ি ঘুরিয়ে নিল। দ্রুত ধাবমান মাইক্রোবাসটি অনেক দুর এগিয়ে গেছে।
আহমদ মুসা তার পিছু নিল।
শহীদ মসজিদ রোড় থেকে বেরুবার সময় গাড়ির জ্যামে পড়ে আরেকটু দেরি হলো আহমদ মুসার। কিন্তু মাইক্রোবাসটি তবু নজরের বাইরে যেতে পারেনি।
নিউ বেলগ্রেড এভেনিউ ধরে মাইক্রোবাসটি দক্ষিণ দিকে ছুটে চলেছে।
মাইক্রোবাসটি নতুন। বাতাসের বেগে এগিয়ে চলেছে। চালাচ্ছেও বেপরোয়া গতিতে। মনে হচ্ছে সাহসী কোন পক্ষ। কোন বিপদকে এরা থোড়াই পরোয়া করে।
ব্যস্ত রাস্তায় আহমদ মুসা নিজের ইচ্ছামত গাড়ি চালাতে পারছে না তাই দুই গাড়ির মধ্যকার ব্যবধান কমলেও মাইক্রোবাসটি এখনও বেশ দুরে। নিউ বেলগ্রেড এভেনিউটি বেলগ্রেডের নতুন এলাকা দক্ষিণ বেলগ্রেড ঘুরে দানিয়ুব পর্যন্ত পৌঁছেছে। সরল এবং প্রশস্ত এই দীর্ঘ রাস্তাটি।
নতুন বেলগ্রেডের শুরুতেই বিশাল এক বোটানিক্যাল গার্ডেন এবং পার্ক। এর প্রান্ত ঘেষেই নিউ বেলগ্রেড এভেনিউ। বোটানিক্যাল গার্ডেন ও পার্কে ঢোকার এক বিশাল গেট। টিকেট করে ঢুকতে হয়। মাইক্রোবাসটি বোটানিক্যাল গার্ডেনের গেটে গিয়ে দাঁড়াল। দাঁড়াবার সঙ্গে সঙ্গেই গেটটি খুলে গেল। খোলা গেট দিয়ে মাইক্রোবাসটি বোটানিক্যাল গার্ডেনে ঢুকে গেল।
‘ওরা বোটানিক্যাল গার্ডেনে প্রবেশ করছে কেন?’ ভাবল আহমদ মুসা। ভাবতে গিয়ে আঁৎকে উঠল আহমদ মুসা। তাহলে কি ওরা নিছক লালসা বশত তরুণীদ্ধয়কে কিডন্যাপ করেছে।
মাইক্রোবাসটি গেট দিয়ে ঢুকে যাওয়ার অল্পক্ষণ পরেই আহমদ মুসার জীপ গিয়ে গেটে পৌঁছল।
গেটে তখনও একজন লোক দাঁডিয়েছিল। আহমদ মুসা তাকে গেট খুলে দিতে বলল।
লোকটি বলল টিকেট করে আসুন। আর গাড়ি নিয়ে ভেতর যাওয়া যাবে না।
‘ওরা ঢুকল কি করে গাড়ি নিয়ে। আর ওরা তো টিকেটও করেনি?’ বলল আহমদ মুসা।
লোকটি বলল, ওদের সাতখুন মাফ। ওদের টিকেট করতে হয় না।
‘কারা ওরা?’ বলল আহমদ মুসা।
‘ওরা মিলেশ বাহিনীর লোক।’ লোকটি বলল।
চমকে উঠল আহমদ মুসা মিলেশ বাহিনীর নাম শুনে। এত তাড়াতাড়ি ওদের মুখোমুখি হচ্ছে সে এইভাবে।
‘কত টিকেটের দাম?’ জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা।
‘দশ দিনার।’ বলল লোকটি।
আহমদ মুসা ওর হাতে ৫০ দিনার তুলে দিয়ে বলল, আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে। তুমি টিকিট করে নিও। আর আমি ওদেরই কাছে যাব, গেট খুলে দাও।
লোকটি একবার ৫০ দিনারের নোট এবং একবার আহমদ মুসার দিকে তাকিয়ে গেট খুলে দিল।
আহমদ মুসার জীপটি দ্রুত ঢুকে গেল বোটানিক্যাল গার্ডেনের ভেতরে।
বিশাল বোটানিক্যাল গার্ডেন। এদিক সেদিক ঘুরাঘুরি করে অবশেষে মাইক্রোবাসটির সন্ধান পেল আহমদ মুসা। ছুটে গেল গাড়ি নিয়ে সেখানে।
কাছাকাছি পৌঁছেই দেখল, মেয়ে দু’টিকে তারা মাইক্রোবাস থেকে টেনে নামিয়েছে।
মেয়ে দু’টির পরনে ঢিলা লম্বা জামা পা পর্যন্ত নেমে গেছে। দু’জনার গলায় পেছানো চাদর। অভিজাত চেহারা। দেখলেই বুঝা যায় শিক্ষিত এবং অভিজাত পরিবারের মেয়ে দু’টি।
মেয়ে দু’টি আর কাঁদছে না। কিন্তু ভয়ে আতংকে ওদের চোখ যেন বেরিয়ে আসছে।
কিডন্যাপকারী ওরা চার জন।
দু’জন এগিয়ে গিয়ে মেয়ে দু’টির ওডনা টেনে খুলে ফেলল। তারপর দু’জন লোভাতুর বাঘের মত মেয়ে দু’টির দিকে দু’হাত বাড়িয়ে এগিয়ে গেল। মেয়ে দু’টি ভয়ে চিৎকার করে পিছিয়ে গেল।
ঠিক সেই সময় আহমদ মুসা জীপের হর্ন বাজাল। হর্নের শব্দে ওরা চারজনই চমকে উঠে ফিরে তাকিয়েছে।
আহমদ মুসা লাফ দিয়ে জীপ থেকে নেমে ওদের সামনে গিয়ে দাঁড়াল।
আহমদ মুসা কিছু বলার আগেই ওদের একজন বলল, তুমি এখানে কেন, যেখানে যাচ্ছিলে যাও। নাক গলাতে এলে ভাল হবে না।
-তোমরা মেয়ে দু’টিকে জোর করে ধরে এনেছ, ছেড়ে দাও। শান্ত কণ্ঠে বলল আহমদ মুসা।
-একশ’ বার ধরে আনব। তোমার কি, তোমার কাজে তুমি যাও।
-মেয়ে দু’টিকে ছেড়ে না দিলে আমি যাব না।
-তোমার কপাল মন্দ হবে যদি বাড়াবাড়ি করো। এরা হিদেন, মুসলমান। শয়তানী এরা। এদের যা ইচ্ছা তাই করার অধিকার আমাদের আছে।
আহমদ মুসার বুকটা কেঁপে উঠল ওদের কাছ থেকে মেয়ে দু’টির পাওয়া পরিচয়ে। ওরা মুসলমান। দেহের প্রতিটি স্নায়ুতন্ত্রীতে একটা প্রচণ্ড জ্বালা ছড়িয়ে পড়ল আহমদ মুসার। গোটা দেহ তার শক্ত হয়ে উঠল। বলল সে, ওরা যেই হোক, ওদের ছেড়ে দাও।
-আমাদের হুকুম দিচ্ছ, স্পর্ধা তো কম নয়। জান আমরা কে? ওদের একজন বলল।
-না, পরিচয় আমার প্রয়োজন নেই। আমি তোমাদের সাথে আত্মীয়তা করতে যাচ্ছি না।
ক্রোধে ওরা জ্বলে উঠল। ওদের লাল চোখ আরও লাল হয়ে উঠল। একজন দু’ধাপ এগিয়ে আহমদ মুসার একেবারে সামনে এসে বলল। ভাল চাওতো এখনি এখান থেকে সরে যাও।
তার কথার প্রতি ভ্রুক্ষেপ না করে আহমদ মুসা বলল, আমার প্রশ্নের জবাব দাও মেয়ে দু’টিকে ছাড়বে কিনা?
আহমদ মুসার কোথা শেষ হবার আগেই লোকটি একটা প্রচণ্ড ঘুষি ছুড়ে মারল আহমদ মুসার নাক লক্ষ্য করে।
আহমদ মুসা মুখটা সরিয়ে নিয়েছিল। ঘুষিটা আহমদ মুসার মুখে না লেগে গিয়ে লাগল কপালের বাম পাশে। লোকটির হাতে সম্ভবত তীক্ষ্ণ আংটি ছিল। আহমদ মুসার কপাল কেটে গিয়ে ঝর ঝর করে রক্ত বেরিয়ে এল।
আহমদ মুসা তার মাথাটা সোজা করেই বিদ্যুৎ গতিতে ডান হাতের একটা কারাত চালাল লোকটির ঘাড়ের বাম পাশে কানের নিচে।
সঙ্গে সঙ্গেই লোকটি জ্ঞান হারিয়ে টলতে টলতে পডে গেল মাটিতে।
ঘুষি বাগিয়ে আরেকজন তেড়ে এল আহমদ মুসার দিকে।
আহমদ মুসা একধাপ এগিয়ে লোকটির তলপেট লক্ষ্যে একটা লাথি মারল এবং তারপরেই ডান হাতের প্রচণ্ড কারাত চালাল লোকটির ঘাড়ে।
লোকটি টলারও সুযোগ পেল না। বোঁটা থেকে খসে পড়া আমের মতই ঝরে পড়ে গেল মাটিতে।
লোকটি যখন পড়ে যাচ্ছিল তখন আহমদ মুসা দেখল সামনের দু’জনেই পকেটে হাত দিচ্ছে।
আহমদ মুসা এক লাফে সামনে দাঁড়ানো লোকটির ঘাড়ে পড়ে বাম হাতে তার গলা পেঁচিয়ে তাকে বুকের সাথে চেপে ধরল।
লোকটি সবে পিস্তল হাতে নিয়েছিল।
আহমদ মুসা তার হাত থেকে পিস্তল কেড়ে নিল।
লোকটি ছাড়া পাবার জন্যে যতই জোর করছিল, ততই আহমদ মুসার বাম হাতের লৌহ বেষ্টনি তার গলায় চেপে বসতে লাগল।
দ্বিতীয় লোকটি পিস্তল তুলে ধরেছে। কিন্তু মহাবিপদে পড়েছে সে। গুলি করলে গিয়ে লাগে নিজের সাথীর বুকে। আহমদ মুসা তাকে বুকে জাপটে ধরে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছে।
আহমদ মুসা লোকটির হাত থেকে কেড়ে নেয়া পিস্তল এবার দ্বিতীয় লোকটির দিকে তুলে ধরে বলল, পিস্তল ফেলে দাও না হলে মাথা গুড়িয়ে দেব।
কিন্তু বেপরোয়া লোকটি পিস্তল হাতে ছুটে এল আহমদ মুসার দিকে।
আহমদ মুসা তার কৌশলটা বুঝল। সে এসে জড়িয়ে ধরে আহমদ মুসার পিঠ দখল করতে চায়। আহমদ মুসা আর সময় নষ্ট করতে চাইল না। সে উদ্যত রিভলভারের ট্রিগার টিপে ধরল।
মাথাটি গুড়িয়ে গেল লোকটির।
মুখ থুবড়ে পড়ে গেল লোকটি আহমদ মুসার একদম কাছেই।
আহমদ মুসা যাকে ধরে রেখেছিল, তাকেও এবার ছেড়ে দিল।
ছেড়ে দেয়ার সঙ্গে সঙ্গেই লোকটি গোড়া কাটা লতার মত লুটিয়ে পড়ল।
মেয়ে দু’টি কাঠের মত দাঁড়িয়েছিল। রক্তহীন ফ্যাকাশে তাদের মুখ। বাক শক্তি তারা হারিয়ে ফেলেছিল।
আহমদ মুসা পিস্তলটি পকেটে ফেলে ধীরে ধীরে মেয়ে দুটির দিকে এগুলো। নতমুখে নরম কন্ঠে বলল, আর কোন ভয় নেই, তোমরা এস গাড়িতে।
বলে আহমদ মুসা ফিরে দাঁড়িয়ে গাড়ির দিকে হাটতে লাগল।
মেয়ে দু’টিও যন্ত্রের মত ধীরে ধীরে গাড়ির দিকে হেটে এল।
আহমদ মুসা জীপের ড্রাইভিং সিটে উঠে বসল। মেয়ে দু’টি গাড়ির কাছে এসে দাঁড়ালে বলল, তোমরা পিছনের সিটে উঠে বসে বোন।
সিটে বসেই আবার নেমে গেল আহমদ মুসা। নেমে গিয়ে গাড়ির নাম্বার প্লেট খুলে এনে ড্রাইভিং প্যানেলের উপর রেখে দিল। তারপর গাড়ি ষ্টার্ট দিল আহমদ মুসা।
জীপটি গেটে আসতেই সেই লোকটি তাড়াতাড়ি গেট খুলে দিতে এল।
আহমদ মুসার মুখ রক্তাক্ত দেখে লোকটি চমকে উঠল। তার চোখে সন্দেহের চিহ্ন ফুটে উঠল। কিন্তু কিছু বলার সাহস পেল না।
গাড়ি গেট থেকে যখন বের হতে যাচ্ছে, তখন লোকটি বোধ হয় মরিয়া হয়েই জিজ্ঞেস করল, স্যার ওরা কোথায়? এরা তো আপনার গাড়িতে যাবার সময় ছিল না?
আহমদ মুসা গেট থেকে বের হয়ে একটু হেসে বলল, এসব প্রশ্নের জবাবে তোমার কোন প্রয়োজন নেই, থাকলে দিতাম।
গাড়ি যখন চলে যাচ্ছে, তখন গেটম্যান ভয় ও সন্দেহের দৃষ্টি নিয়ে গাড়ির নাম্বার প্লেটের দিকে চাইল। তার চোখ ছানা-বড়া হয়ে উঠল যখন সে দেখল যে গাড়ির কোন নাম্বার প্লেট নেই।
আহমদ মুসা দ্রুত গাড়ি চালিয়ে বোটানিক্যাল গার্ডেন পেরিয়ে প্রায় মাইল দুয়েক উত্তরে এসে রাস্তার পাশে একটা নির্জন স্থানে নেমে এল। তারপর গাড়ির নাম্বার প্লেট দু’টি নিয়ে গাড়ি থেকে নেমে গেল এবং নাম্বার প্লেট যথাস্থানে লাগিয়ে দিল।
মেয়ে দু’টি মুর্তির মত আহমদ মুসার সব কাজ দেখছিল। তাদের চোখ থেকে আতংকের ঘোর তখনও সম্পূর্ণ কাটেনি। তবে তারা নিশ্চিত হয়েছে, এই মানুষের কাছে তারা সম্পূর্ণ নিরাপদ। তাদের কাছে মনে হচ্ছে, এ মানুষটি যেন মানুষ নয়, আল্লাহর ফেরেশতা। যে মানুষটি একাই চারজন মানুষকে পরাভূত করল মহাশক্তিধর বীরের মত, তার কন্ঠস্বর, সম্বোধন এতো নরম হয়! কঠোরতা ও নমনীয়তার অপূর্ব সমাহার। ফেরেশতা ছাড়া আর কি! ফেরেশতার মতই তো হঠাৎ করে উদয় হয়েছেন।
আহমদ মুসা গাড়ির নাম্বার প্লেট লাগিয়ে এসে ড্রাইভিং সিটে আবার ফিরে এল। এরপর সে গাড়ির ফার্স্ট এইড বক্স থেকে তুলা বের করে মুখের রক্ত মুছতে লাগল।
মেয়ে দু’টি আহমদ মুসার সারা মুখে রক্ত দেখে আঁৎকে উঠল। তারা এতক্ষণ খেয়াল করেনি। অবাক হলো তারা। তাহলে কি আতংকের ঘোর কেটে তাদের চোখ এখনও স্বাভাবিকভাবে সব কিছু দেখতে পারছে না, বুঝতে পারছে না!
আহমদ মুসা মুখ থেকে রক্ত পরিষ্কার করে কপালের ক্ষতটায় তুলা লাগাল। কিন্তু তুলার নরম আঘাতেও সেখান থেকে ফিনকি দিয়ে রক্ত নেমে এল। আহমদ মুসা তাড়াতাড়ি বেশি পরিমাণ তুলা ক্ষতস্থানে চাপা দিয়ে ধরে রাখল। আশ-পাশে তাকিয়ে বেঁধে রাখার মত কিছু দেখল না। মেয়েদের একজন আহমদ মুসার দিকে ওড়না এগিয়ে দিয়ে বলল, এটা দিয়ে আপনি ব্যান্ডেজ বাঁধুন। আহমদ মুসা বলল, না লাগবে না বোন অল্পক্ষণের মধ্যেই রক্ত বন্ধ হয়ে যাবে।
সেই মেয়েটি বলল, কিন্তু এভাবে তুলা ধরে রেখে তো গাড়ি চালাতে পারবেন না।
সত্যি, কথাটায় বাস্তবতা আছে।
আহমদ মুসা ওড়না নিয়ে কপালে ভালো করে ব্যান্ডেজ বাঁধল।
তারপর আহমদ মুসা গাড়ি ষ্টার্ট দিতে গিয়ে থেমে গেল। পেছন দিকে না তাকিয়েই আহমদ মুসা বলল, তোমাদেরকে কোথায় পৌঁছে দেব বোন?
মেয়ে দু’টি পরামর্শ করল, তারপর তাদের একজন পূর্ব বেলগ্রেডের একটা রাস্তার কথা বলল।
আহমদ মুসা মানচিত্রে চোখ বুলাল। না মানচিত্রে সে রাস্তার নাম নেই।
আহমদ মুসা বলল, মানচিত্রে ও রাস্তার নাম নেই। আমি বেলগ্রেডে নতুন তো রাস্তা ঘাট আমি চিনি না। তোমরা বলে দিতে পারবে না?
‘পারব।’ বলল ওদের একজন।
আহমদ মুসা গাড়ি ষ্টার্ট দিলে ওই মেয়েটিই বলল, আরেকটু উত্তর দিকে এগিয়ে প্রথম যে পূর্বমুখী রাস্তা পাবেন, সেটা দিয়ে এগুবেন।
আহমদ মুসা মানচিত্রের দিকে তাকিয়ে বলল, সেন্ট্রাল রোড দিয়ে তো?
মেয়েট বলল, জি হ্যাঁ।
সেন্ট্রাল রোড ধরে ছুটে চলল গাড়ি।
মেয়ে দু’টি সামনে তাকিয়ে আছে। তাদের চোখ বারবার ছুটে যাচ্ছে আহমদ মুসার দিকে। তাদের জিজ্ঞাসা করতে ইচ্ছে হচ্ছে, লোকটি কে? এমন উপকারী লোক আবার এদেশে আছে? বেলগ্রেডে নতুন, তাহলে বেলগ্রেডের বাইরে থেকে এসেছে। কিন্তু ওকে তো যুগোশ্লাভ মনে হয়না। হতে পারে, কত দেশের লোকই তো যুগোশ্লাভিয়ায় বাস করে। জিজ্ঞাসা করবে নাকি লোকটি কে? কিন্ত কেন করবে, প্রয়োজন কি? লোকটিই বা কি মনে করবে। তাদের তরফ থেকে এমন উদ্যোগ নেয়া ঠিক হবে না। যাই হোক উনি তো পুরুষ মানুষ, অপরিচিত।
আহমদ মুসার মনেও চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে। মেয়ে দুটি কে? মুসলমান তো শুনলাম। ওদের নাম কি জিজ্ঞেস করব? কেন করব? কি প্রয়োজন তার? তারা বিপদে পড়েছিল, সাহায্য করেছি। এখন ওদেরকে বাসায় পৌঁছে দেয়ার মধ্যেই তো আমার দ্বায়িত্ব শেষ। প্রয়োজন নেই এমন আলোচনায় যাওয়া তো ঠিক নয়। হ্যাঁ ওদের বাড়ির পুরুষদের পাওয়া গেলে কথা বলা যেতে পারে।
সেন্ট্রাল রোড তীরের মত সোজা একটা রাস্তা। রাস্তাটি সোজা এগিয়ে পূর্ব বেলগ্রেডের প্রান্তে নিউবেলগ্রেড এভেনিউতেই আবার পড়েছে। সেন্ট্রাল রোড নামকরণ যথার্থ হয়েছে। রোডটি বেলগ্রডকে মাঝ বরাবর দু’ভাগে ভাগ করেছে।
পূর্ব বেলগ্রেডে এসে পড়েছে আহমদ মুসার জীপ। সামনেই একটা চৌমাথা। সেন্ট্রাল রোড থেকে উত্তর ও দক্ষিণে দু’টি রাস্তা বেরিয়ে গেছে।
চৌমাথার কাছে পৌঁছতেই যে মেয়েটি পথ-নির্দেশ করছিল সে বলল, এবার আমাদের উত্তরের পথ ধরে যেতে হবে।
আরও কয়েকটি রাস্তা বদলে আহমদ মুসার জীপ একটা সুন্দর দোতলা বাড়ির সামনে দাঁড়াল। যে মেয়েটি গাইড করছিল সে বলল, আমরা পৌঁছে গেছি।
বাড়িটি ওমর বিগোভিগকের।
আহমদ মুসা বাড়ি ও বাড়ির নাম্বারের দিকে একবার চোখ বুলিয়ে বলল, তোমাদের আব্বার নাম কি? কি করেন?
মেয়ে দু’টির একজন যে গাইড করছিল, বলল, আমার আব্বার নাম ওমর বিগোভিক। এটা আমাদের বাড়ি। আমার আব্বা অধ্যাপনা করতেন, এখন ব্যবসা করেন।
একটু থেমে সাথের মেয়েটিকে দেখিয়ে বলল, এর বাড়ি উত্তর বেলগ্রেড এলাকায়। আমার আব্বা ওকে পৌঁছে দেবেন।
তোমার আব্বা কি এখন বাড়িতে আছেন? জানতে চাইল আহমদ মুসা।
মেয়েটি বলল, এক মিনিট, আমি দেখে আসছি।
বলে মেয়েটি বাড়ির ভেতর চলে গেল। মেয়েটি নাদিয়া নুর।
কয়েক মুহূর্ত পরে নাদিয়া নুর ফিরে এসে বলল, আব্বা বাড়িতে নেই, আম্মা আছেন। আপনি ভেতরে আসুন, বসবেন একটু।
আহমদ মুসা একটু হেসে মাথা নেড়ে বলল, ধন্যবাদ বোন। আজ নয়, পারলে আরেকদিন আসব।
নাদিয়া নুরের সাথের মেয়েটি ডেসপিনা জুনিয়র। ডেসপিনা জুনিয়র এবং নাদিয়া নুর হাসান সেনজিকের খবর জানাতে গিয়েছিল হাসান সেনজিকের মাকে। ওরা ফেরার সময় যখন গাড়ির সন্ধানে ফুটপাত দিয়ে হাঁটছিল তখনই তারা মিলেশ বাহিনীর হাতে কিডন্যাপ হয়। ওদেরকে হাসান সেনজিকের বাড়ি থেকে বেরুতে দেখে ইচ্ছা করেই ওদের কিডন্যাপ করা হয়।
নাদিয়া নুর তার পিতার সন্ধানে বাড়ির ভেতর গেলে ডেসপিনা গাড়ি থেকে নেমে গাড়ির কাছেই দাঁড়িয়ে ছিল।
নাদিয়া নুর ফিরে এসে তার কাছেই দাঁড়াল।
আহমদ মুসা কথা শেষ করে একটু মাথা নিচু করল। তারপর আবার মাথাটা তুলে বলল, একটা কথা বলব বোন, সমগ্র বলকান অঞ্চলে মুসলমানদের কঠিন দুর্দিন চলছে। এ সময় মুসলিম মেয়েদের অনেক সাবধানে থাকতে হবে, সাবধানে বেরুতে হবে।
-আপনি কি মুসলিম? জিজ্ঞেস করল ডেসপিনা।
-‘হ্যাঁ।’ বলল আহমদ মুসা।
-আমাদের ও সন্দেহ হয়েছিল। আমরা কি যে খুশি হয়েছি তা বুঝাতে পারবোনা। বোনদেরকে একটু মেহমানদারীরও সুযোগ দেবেন না?
-না আজ নয়। বলেছি তো, আরেকদিন সম্ভব হলে আসব। বাড়ি চিনে গেলাম।
বলেই গাড়ি ষ্টার্ট দিয়েই কি মনে করে গাড়ির কী বোর্ডের সেলফ থেকে একটা ইংরেজী বই বের করে বলল, তোমরা ইংরেজী জান?
নাদিয়া ও ডেসপিনা দু’জনেই বলল, ইংরেজী আমাদের সাবসিডিয়ারী ভাষা। জানি মোটামুটি।
আহমদ মুসা বইটি তাদের দিকে তুলে ধরে বলল, বইটি তোমাদের দিলাম, ভাল বই।
বইটি সাইয়েদ কুতুব শহীদের। নামঃ ‘দ্য প্রসেস অব ইসালিমক রেভ্যুলেশন।’
ডেসপিনা বইটি হাতে নিয়েই বলল, লিখে দিন।
আহমদ মুসা বইটি হাতে নিয়ে লিখে দিলঃ ‘বোনদেরকে আহমদ মুসা।’
বইটি ওদের হাতে আবার তুলে দিয়েই গাড়ীতে ষ্টার্ট দিল আহমদ মুসা।
ডেসপিনা বইটি হাতে নিল।
দু’জনেই আহমদ মুসাকে সালাম জানিয়ে হাত নাড়তে লাগল।
আহমদ মুসাও একবার পিছনে তাকিয়ে হাত নাড়ল।
যতক্ষণ আহমদ মুসার গাড়ি দেখা গেল ওরা দাঁড়িয়ে থাকল।
আহমদ মুসার গাড়ি চোখের আড়াল হবার আগেই আরেকটি গাড়ি আসতে দেখল তারা। গাড়ি দেখে নাদিয়ার আব্বার গাড়ি মনে হচ্ছে। ওরা আর সরল না।
ঠিক, গাড়িটি নাদিয়ার আব্বারই।
গেটে এসে গাড়ি থেকে নামল নাদিয়ার আব্বা।
আব্বাকে দেখে নাদিয়া প্রায় চিৎকার করে বলে উঠল, আব্বা তুমি যদি দু’মিনিট আগে আসতে।
কিন্তু ওমর বিগোভিকের খেয়াল নাদিয়ার কথার দিকে নেই। সে নাদিয়া এবং ডেসপিনার চেহারা, চুল ও পোষাকের অবস্থা দেখে বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞাসা করল, তোমাদের একি অবস্থা? মনে হচ্ছে তোমরা যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ফিরলে! ডেসপিনাকে তো কোন দিন চাদর ছাড়া দেখিনি। কি হয়েছে তোমাদের?
আব্বার এ প্রশ্নে নাদিয়ার মুখভাব মুহূর্তে পাল্টে গেল। কিছুক্ষণ আগের দুঃস্বপ্নময় অতীত যেন তার উপর এসে ভর করল। আব্বাকে জড়িয়ে ধরে ফুঁফিয়ে কেঁদে উঠল নাদিয়া।
ওমর বিগোভিক নাদিয়া ও ডেসপিনাকে নিয়ে ভিতরে ঢুকে গেল।
গিয়ে বসল ভেতরের ড্রইং রুমে।
নাদিয়ার মাও এসে বসল। বলল, এই মাত্র ওরা এল। একজন জীপে করে রেখে গেল। লোকটির মুখে রক্তের দাগ। মাথায় ব্যান্ডেজ।
ওমর বিগোভিক উদ্বিগ্ন কন্ঠে বলল, বল কি। লোকটি চলে গেছে কখন?
‘এই তো দু’মিনিটের মত হল, তোমার সাথে কথা বলতে চেয়েছিল।’ বলল নাদিয়ার মা।
নাদিয়ার কান্না তখন থেমেছে। সে পিতার কাঁধে মুখ গুঁজে রয়েছে।
ডেসপিনা মুখ ভার করে বসে আছে।
ওমর বিগোভিক নাদিয়ার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, কি হয়েছে মা বল।
নাদিয়া মুখ তুলে বলল, ডেসপিনা তুমিই বল।
ওমর বিগোভিক ডেসপিনার দিকে চেয়ে বলল, ঠিক আছে মা তুমিই বল।
ডেসপিনা মুখ তুলল। মুখ তার ফ্যাকাশে। বলল, নাদিয়া হাসান সেনজিকের খবর নিয়ে আমার কাছে গিয়েছিল। আমি ওকে সাথে করে খবরটা দেয়ার জন্যে হাসান সেনজিকের মা’র কাছে গিয়েছিলাম আজ দশটায়। কথাবার্তা বলে ১১টার দিকে বেরিয়ে আসি। হাসান সেনজিকদের গেট থেকে বেরিয়ে ফুটপাত ধরে হাটছিলাম। হঠাৎ একটা মাইক্রোবাস আমাদের পাশে দাঁড়ায়। দাঁড়াবার সঙ্গে সঙ্গে দু’জন লোক বেরিয়ে এসে আমাদের ধরে টেনে হেঁচড়ে গাড়িতে তোলে। আমরা প্রাণপণে চিৎকার করি, কেউ সাহায্য করতে এগিয়ে আসে না।
বলতে বলতে ডেসপিনার চোখ দিয়ে ঝর ঝর করে অশ্রু নেমে এল।
অশ্রু বিজড়িত কন্ঠে ডেসপিনা তাদের কিডন্যাপ হওয়া এবং আলৌকিক ভাবে উদ্ধার কাহিনী বিস্তারিত বর্ণনা করল।
মুখ ভরা উদ্বেগ-আতংক নিয়ে বাক-রুদ্ধভাবে ওমর বিগোতিক ও নাদিয়ার মা ডেসপিনার কাহিনী শুনছিল।
ডেসপিনার কথা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ওমর বিগোভিক সোফা থেকে নেমে মেঝেতে কাবামুখী হয়ে সিজদায় পড়ে গেল।
সিজদা থেকে উঠে দু’টি হাত উপরে তুলে বলল, হে আল্লাহ তুমি আলৌকিক সাহায্য পাঠিয়ে আমাদের মেয়ে দু’টিকে রক্ষা করেছ। তোমার শুকরিয়া আদায়ের ক্ষমতা আমার নেই। আমরা যতদূর কল্পনা করতে পারি না তার চেয়েও তুমি শক্তিশালী, তোমাকে যত বড় দয়ালু বলে জানি, তার চেয়েও বড় দয়ালু তুমি।
ওমর বিগোভিক সোফায় ফিরে এসে বলল, আল্লাহ মানুষকে ফেরেশতা পাঠিয়েও সাহায্য করেন। ও লোকটি আল্লাহরই সাহায্য ছিল। তা নাহলে একজন লোক খালি হাতে এসে চারজন সশস্ত্র লোককে ওভাবে শেষ করে তোমাদের উদ্ধার করতে পারে! কিন্তু আশ্চর্য মা! এত বড় লোক কে, যে নিজে আহত হয়েছে উদ্ধার করতে গিয়ে, তোমরা ঘরে এনে একটু বসাতেও পারলে না, এক গ্লাস পানিও খাওয়াতে পারলে না।
‘না, আব্বা, অনেক বলেছি, উনি কিছুতেই গাড়ি থেকে নামেননি। আপনি আছেন কিনা জিজ্ঞাসা করেছিলেন। থাকলে হয়ত নামতেন।’ বলল নাদিয়া নুর।
‘অদ্ভুত মানুষ উনি, আমাদের নামটা পর্যন্ত উনি জিজ্ঞেস করেননি। আমরা কি করি, কেমন করে কিডন্যাপের ঘটনা ঘটল ইত্যাদি যে সব কথা জিজ্ঞাসা করা স্বাভাবিক, সে সব কথাও জিজ্ঞেস করেননি। মনে হয় এসব কোন ব্যাপারে সামান্য আগ্রহও নেই। কিন্তু যাবার সময় যখন তিনি বলে গেলেন বলকান অঞ্চলে মুসলমানদের কঠিন দুর্দিন চলছে, মুসলিম মেয়েদের সাবধানে বের হওয়া উচিত, তখন মনে হল তিনি অত্যন্ত সচেতন ব্যক্তি।’ বলল ডেসপিনা।
‘উনি কি মুসলিম?’ ওমর বিগোভিক বলল।
‘জি’ বলল ডেসপিনা।
‘এমন একজন মুসলিম ছেলে, তার ঠিকানা জানলাম না, তার নামও পর্যন্ত তোমরা জিজ্ঞাসা করনি, কি দুর্ভাগ্য!’ খেদের সাথে বলল ওমর বিগোভিক।
‘আমাদের নাম যিনি জিজ্ঞাসা করেননি, তার নাম আমরা কেমন করে জিজ্ঞাসা করতে পারি?’ বলল নাদিয়া।
‘নাম পাওয়া গেছে নাদিয়া।’ বলে ডেসপিনা তার পাশে সোফার উপর পড়ে থাকা আহমদ মুসার দেয়া বইটি হাতে নিয়ে কভার উল্টিয়ে লেখার উপর নজর বুলাল।
নজর বুলানোর সঙ্গে সঙ্গে ডেসপিনার চেহারাটা একদম পাল্টে গেল। চোখ দু’টি তার বিস্ফারিত হলো। বাকরুদ্ধ হয়ে গেল সে। দেহটা তার যেন শিথিল, অবসন্ন হয়ে পড়েছে। তার হাত থেকে বইটা খসে পড়ে গেল।
ডেসপিনা অসুস্থ হয়ে পড়েছে মনে করে ওমর বিগোভিক ও নাদিয়ার মা ভীষণ ব্যস্ত হয়ে উঠল। ছুটে এল দু’জন তার কাছে।
কিন্তু নাদিয়া বুঝল লোকটির লেখার দিকে নজর বুলানোর পরই ডেসপিনা অস্বাভাবিক হয়ে পড়েছে।
নাদিয়া বইটি তুলে নিয়ে কভার উল্টিয়ে সেই লেখাটির প্রতি নজর দিয়ে চিৎকার করে উঠল, আব্বা লোকটি ছিল আহমদ মুসা।
‘কি বললে?’ বলে ওমর বিগোভিক নাদিয়ার হাত থেকে বইটি নিয়ে সেই লেখাটির প্রতি নজর বুলাল। দেখল পরিষ্কারভাবে লিখাঃ ‘বোনদেরকে- আহমদ মুসা।’
সোফার উপর ধপ করে বসে পড়ল ওমর বিগোভিক।
কিছুক্ষণ কেউ কোন কথা বলতে পারল না।
নাদিয়ার মা-ই প্রথম মুখ খুলল। বলল, তাই বলি এমন বিস্ময়কর ছেলে এদেশে কোত্থেকে আসবে যে মিলেশ বাহিনীর পিছু নিতে সাহস করে, যে খালি হাতে মিলেশ বাহিনীর চারজনের উপর ঝাপিয়ে পড়তে পারে এবং জয়ীও হতে পারে।
ওমর বিগোভিক সামনের দিকে একটু ঝুকে বসে দু’কনুই হাঁটুর উপর রেখে দু’হাতে মাথা চেপে ধরে বলল, দুর্ভাগ্য আজকের মুসলিম দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ সন্তানকে হাতে পেয়েও আবার হারিয়ে ফেললাম। তাও আবার সে আহত। আঘাতটা কি খুব বেশী মা?
ডেসপিনা এবং নাদিয়া দু’জনেই সোফায় হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে বসেছিল। তারা অতীতে ফিরে গেছে। বহুবিশ্রুত, বিষ্ময়কর আহমদ মুসাকে নতুন করে দেখার জন্য। কি করে সে জীপ থেকে নামল, কেমন শান্ত, অথচ অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে তাদের মুক্তি দাবী করল, কেমন করে আক্রান্ত হল, কেমন করে সে আত্মরক্ষা করে পাল্টা আক্রমণ করল, কেমন করে দু’টি পিস্তলের মুখে পড়েও অদ্ভুত ক্ষিপ্রতার সাথে তাদেরই একজনকে ঢাল বানিয়ে শেষে ওদেরই অস্ত্রে ওদেরকে পরাভূত করল, কেমন ভাবে চোখ নীচু রেখে নরম কন্ঠে তাদের গাড়িতে উঠতে বলল, তার রক্তাক্ত মুখের সেই দৃশ্য, এতবড় ঘটনার পরেও কেমন নিরুদ্বিগ্ন, ভাবলেশহীন ছিল সে, ইত্যাদি দৃশ্য তাদের চোখে এক এক করে ভেসে উঠছে। সেই সাথে ভেবে আঁৎকে উঠছে তারা, উনি যেতে যদি আর পাঁচ মিনিটও দেরি করতেন, তাহলে কি ঘটত তাদের ভাগ্যে। ঐ মানুষটির প্রতি কৃতজ্ঞতায় তাদের চোখে অশ্রু নেমে এল।
পিতার প্রশ্ন শুনে চোখ খুলল নাদিয়া। তারপর ওড়নায় চোখ মুছে বলল, রক্তে ঢাকা থাকার কারণে দেখা যায়নি আব্বা ক্ষতটা কেমন। তবে প্রচুর রক্ত পড়েছে। শেষ পর্যন্ত রক্ত বন্ধ হয়নি। ক্ষতের উপর তুলা দিয়ে ডেসপিনার ওড়না দিয়ে কোন রকমে একটা ব্যান্ডেজ বেঁধে উনি আমাদের পৌঁছে দিয়েছেন।
‘আল্লাহ ওকে ভাল রাখুন মা। দেখা ইনশাআল্লাহ আমাদের সাথে হবেই।’ বলল ওমর বিগোভিক।
ওমর বিগোভিক উঠে দাঁড়াল। বলল, ডেসপিনা মা, খেয়ে দেয়ে রেষ্ট নাও। আমি বিকেলে তোমাকে বাড়িতে পৌঁছে দেব। একা তোমাদের বেরুনো চলবে না।
ওমর বিগোভিক চলে গেল তার ঘরের দিকে। বাইরে থেকে এসে সে এখনও কাপড় ছাড়েনি।

Top