১১. দানিয়ুবের দেশে

চ্যাপ্টার

দক্ষিণ বেলগ্রেডের অভিজাত এলাকায় মিলেশ বাহিনীর হেড কোয়ার্টার। হেড কোয়ার্টারের সামনে দিয়ে নিউ বেলগ্রেড সার্কুলার রোড। চারপাশ দিয়ে উচু প্রাচীর।
হেড কোয়ার্টারটি তিনতলা বিল্ডিং। তৃতীয় তলায় কনষ্টানটাইনের বাসভবন। দ্বিতীয় ও প্রথম তলায় অফিস।
আহমদ মুসা মিলেশ বাহিনীর হেড কোয়ার্টারের কাছে যখন পৌঁছল, তখন রাত ৮টা। গাড়িটা রাস্তার পাশে পার্ক করে দু’জনে এগোল মিলেশ বাহিনীর হেড কোয়ার্টারের দিকে।
হাটতে হাটতে জাকুব মিলেশ বাহিনীর হেড কোয়ার্টারের একটা নকশা তুলে ধরল।
আহমদ মুসা বলল, আমরা ঘাটিতে ঢুকব পেছন দিক থেকে তার আগে চল আমরা সামনেটা একবার দেখে ওদিক দিয়ে পেছনে যাব।
সামনে রাস্তা ধরে বাড়ির সীমায় পা দিতেই দেখল, হেড লাইটের আলোতে রাস্তা আলোকিত করে দু’টি গাড়ি ছুটে আসছে। আহমদ মুসা ও জাকুব চট করে রাস্তার বাম পাশে নেমে প্রাচীরের আড়ালে চলে গেল। আরেকটু দেরি হলেই তারা হেড লাইটের আলোর মুখে পড়ে যেত।
যে প্রাচীরের আড়ালে তারা দাঁড়িয়েছিল সেটাই মিলেশ বাহিনীর হেড কোয়ার্টারের বহির্দেয়াল।
‘চল সামনে গিয়ে কাজ নেই, পেছন দিক দিয়ে আমরা ঘাঁটিতে ঢুকব বেড়িয়ে সময় নষ্ট আমরা করতে চাই না।’ বলল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসারা আর রাস্তায় ফিরে না এসে প্রাচীরের পাশ ঘেঁষে পূর্ব দিকে এগিয়ে চলল।
পূর্বদিকের প্রাচীরের গোড়ায় দিয়ে দাঁড়াল তারা। তারা পূর্বদিকে যেখানে দাঁড়াল, সেখানে প্রাচীর পেরুলেই গ্যারেজ। গ্যারেজের পশ্চিম পাশে ড্রাইভার, মালি, রাধুনেদের মত নিম্নকর্মচারীদের কোয়ার্টার। গ্যারেজ ও সার্ভেন্টস কোয়ার্টারের সামনে দক্ষিণ দিকে টেনিস লন।
জাকুব বলল, এদিকে কোন পাহারা থাকে না। ওদের এ প্রত্যয় খুব দৃঢ যে, ওদের ঘাটিতে হামলা চালাবার সাহস কারো নেই। ওদের ধারণা, আহমদ মুসা এসেছে হাসান সেনজিককে সাহায্য করতে, তার বেশি কিছু নয়।
‘শত্রুর বেশী আত্মপ্রত্যয়টা আল্লাহর তরফ থেকে আমাদের জন্যে একটা সাহায্য।’ বলে আহমদ মুসা কাঁধের ব্যাগ থেকে একটা নাইকর্ড বের করল। তার মাথায় একটা ভারি হুক। আহমদ মুসা হুকটা ছুড়ে মারল প্রাচীরের মাথায়। আটকে গেল হুক। প্রায় দশফিটের মত উঁচু দেয়াল।
প্রাচীর টপকালো আহমদ মুসা প্রথম, তার পরে জাকুব। প্রাচীরের ওপারে গ্যারেজের পাশেই গিয়ে ওরা নামল।
লম্বা গ্যারেজ। আট দশটি গাড়ি রাখা যায়। গ্যারেজে একটি মাইক্রোবাস এবং দু’টি জীপ দেখা যাচ্ছে।
গ্যারেজের পরেই কর্মচারীদের কোয়ার্টার।
গ্যারেজের সামনে উজ্জ্বল আলো। সে আলোতে গ্যারেজের সামনেটা আলোকিত। কিন্তু কর্মচারীদের কোয়ার্টারের সামনে কোন আলো নেই।
জানালা দিয়ে আলো এসে বাইরে কিছু আলো আঁধারীর সৃষ্টি করেছে।
আহমদ মুসা আলোর হাত থেকে বাঁচার জন্যে গ্যারেজের ভেতর দিয়ে পশ্চিম দিকে এগুলো। গ্যারেজের পশ্চিম প্রান্তে পৌঁছতেই একটা চিৎকার ও কান্নার শব্দ পেল। আহমদ মুসা দ্রুত গ্যারেজ পেরিয়ে কর্মচারীদের কোয়ার্টারের সামনে গিয়ে দাঁড়াল।
পাশেই একটা কর্মচারীর কোয়ার্টার। পশ্চিম দিকে পর পর এ ধরনের আট দশটি কোয়ার্টার।
পাশের কোয়ার্টার থেকেই চিৎকার ও কান্নার শব্দ আসছে। সামনের জায়গাটা অন্ধকার।
আহমদ মুসা কোয়ার্টারের দিকে এগুতেই দেখল, অন্ধকারের মধ্যে একজন লোক মুখ ঢেকে বসে আছে। আহমদ মুসাকে দেখেই সে উঠে দাঁড়াল।
আহমদ মুসা বলল, ভেতর কি হচ্ছে, কাঁদছে কে?
লোকটি কেঁদে ফেলল। বলল, আমি গরীব ছোট কর্মচারী, আমার স্ত্রীকে বলপূর্বক…… লোকটি কথা শেষ করতে পারলোনা গলায় যেন আটক গেল কথা।
কিন্তু আহমদ মুসার বুঝতে কষ্ট হলো না। তার গোটা গা জ্বলে উঠল ক্রোধে।
‘তুমি সরো আমি দেখছি।’ বলে লোকটিকে একপাশে ঠেলা দিয়ে আহমদ মুসা সামনে এগুলো।
লোকটি দু’হাত বাড়িয়ে আবার সামনে দাঁড়িয়ে বলল, ওরা তোমাকেও খুন করবে, আমাকেও করবে। যেও না।
আহমদ মুসা ওকে পাশে ঠেলে দিয়ে দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়াল।
দরজা বন্ধ। আহমদ মুসা দরজায় ধাক্কা দিল।
দু’তিনবার ধাক্কা দেয়ার পর ভেতর থেকে একটা পুরুষ কণ্ঠ বলল, বিরক্ত করিস না ডিউক। খুন করে ফেলব আর একবার ধাক্কা দিলে।
আহমদ মুসার আর সহ্য হলো না। প্রচন্ড এক লাথি মারল দরজায়। ছিটকিনি ভেঙে খুলে গেল দরজা।
আহমদ মুসা দেখল, একটা নগ্নপ্রায় তরুনীকে একজন বিশাল বপু লোক টেনে এনে বিছানায় তুলছে। দরজা ভাঙার শব্দে বিশাল বপু লোকটি তরুনীটিকে ছেড়ে দিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে পিস্তলও হাতে তুলে নিয়েছে। লোকটি রাগে-উত্তেজনায় কাঁপছে তার চোখ দু’টি লাল টকটকে।
আহমদ মুসা ভাবল, এ অর্ধমাতাল গুলি করতে এক মুহূর্তও দেরি করবে না।
সুতরাং তার পিস্তলের নলটি উঠে আসার আগেই আহমদ মুসা তার উপর ঝাপিয়ে পড়ে পিস্তল সমেত তার হাতটি ধরে ফেলল। তার পিস্তলের নলটি বেঁকে গেল। লোকটি ট্রিগার চেপেছিল। পিস্তল থেকে গুলি বেরুল, কিন্তু সে গুলি গিয়ে বিদ্ধ করল লোকটিকেই। তার তলপেটে গুলি লাগল। পিস্তলের নলটি লোকটির তলপেট স্পর্শ করেছিল। শব্দ বেশি হলনা। বিধ্বস্ত তলপেট চেপে ধরে লোকটি ঢলে পড়ে গেল। যে লোকটি বাইরে বসে মুখ ঢেকে কাঁদছিল, সে এবার ভেতরে ঢুকে ডুকরে কেঁদে উঠল। তরুণীটিও উঠে দাঁড়িয়ে কাপড় ঠিক করে নিয়েছিল। সেও কাঁপছিল।
লোকটি ডুকরে কেঁদে উঠে বলছিল, আমি এখন কি করব! আমাদের দু’জনকেই এরা জীবন্ত পুতে ফেলবে।
‘কিন্তু তোমার তো কোন দোষ নেই।’ বলল আহমদ মুসা।
‘তবু দোষ আমারই, আমার স্ত্রীর ঘরে এসেছিলে এবং এখানেই সে মারা গেছে।’ বলল লোকটি।
‘আরেকজনের স্ত্রীর উপর চড়াও হয়ে সেই তো অপরাধ করেছে এবং তার মৃত্যুর জন্যে তো সেই দায়ী।’ বলল আহমদ মুসা।
লোকটি চোখ মুছতে মুছতে বলল, আমাদের মত গরীবদের স্ত্রীর উপর চড়াও হওয়া তাদের অপরাধ নয় তারা এটা বরাবরই করে আসছে। আমি নতুন দু’দিন হলো চাকুরতে ঢুকেছি তাই আমি এবং আমার স্ত্রী কেউই এটা মেনে নিতে পারিনি। সবার মত আমরাও হয়তো ধীরে ধীরে মেনে নিতাম।
আহমদ মুসা লোকটির মুখের দিখে তাকিয়ে স্তম্ভিতভাবে কিছুক্ষণ বসে রইল। তারপর বলল, সবাই এ অবস্থা মেনে নিয়েছে কেন?
‘আমরা গরিব, চাকুরী আমাদের দরকার, আমরা টাকা চাই।’ বলল লোকটি।
এই সময় জাকুব বলল, এরা যুগোশ্লাভিয়া, অষ্ট্রিয়া ও ইটালীর সীমান্ত সন্নিহিত পাহাড়ী অঞ্চলের লোক। দরিদ্র, চাকুরীর সন্ধানে এরা এদিকে আসে।
আহমদ মুসা একটু ভাবল, তাপর পকেট থেকে ডলারের একটা বড় বান্ডিল বের করে তার হাতে তুলে দিয়ে বলল, কাল এখান থেকে সকালেই চলে যাবে।
ডলারের বান্ডিল দেখে লোকটি চোখ খুশীতে চক চক করে উঠল। কিন্তু তার পরেই তার মুখে নেমে এল বিষন্নতা। বলল, কাল সকাল পর্যন্ত আমরা বেঁচে থাকব না। আর যেখানেই আমরা পালাই ওরা ধরে আনবে।
‘তুমি নিশ্চিন্ত থাক, সে সুযোগ আর ওরা পাবে না। ওদের দিন শেষ হয়ে আসছে।’ বলে একটু থেমে আহমদ মুসা আবার বলল, ‘তোমরা এখনি এখান থেকে চলে যেতে পার। আমরা পেছনের দেয়াল টপকে এসেছি, তোমরাও যেতে পার।’
‘আপনারা কে?’ বলল লোকটি।
‘আমরা মুসলমান, আমরা ওদের শত্রু।’ বলল আহমদ মুসা।
লোকটির মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বলল, মুসলমানরা খুব ভালো। মিথ্যা বলে না, ঠকায় না। মানুষের প্রতি খুব দয়া ওদের।
‘কেমন করে তুমি জানলে।’ বলল আহমদ মুসা।
‘এই কিছুদিন আগে পর্যন্ত আমি যাগারেবে ছিলাম। আমি সেখানে একটি উল-ফ্যাক্টরীতে কাজ করতাম। ফ্যাক্টরীর মালিক ছিল মুসলমান। তাঁর মত ভাল মানুষ আমি জীবনে দেখিনি। একবার একজন সেলসম্যান ভুল করে একজন খদ্দেরের কাছ থেকে রেটের বেশি দাম নিয়েছিল। তা জানার সঙ্গে সঙ্গে তিনি বাড়তি টাকা ফেরত পাঠিয়েছিলেন। অনেক মুসলিক কর্মচারী ছিল ফ্যাক্টরীতে। দেখেছি, তারা মিথ্যা কথা বলতোনা এজন্যে তারা ক্ষতিগ্রস্থও হতো। যেমন, টাকা থাকলে মিথ্যা কথা বলতোনা বলে ধার গ্রহণকারীদের তারা ছিল সাধারণ শিকার। কিন্ত…..’ কথা শেষ না করেই থেমে গেল লোকটি। বেদনার একটা ছায়া নামল তার মুখে।
‘কিন্ত বলে থেকে গেলে কেন?’ বলল আহমদ মুসা।
লোকটি বলল, সে এক দুঃখের কথা। একদিন সন্ধ্যায় এই মিলেশ বাহিনীর লোকেরা কারখানায় গিয়ে চড়াও হয়। তারা মালিক এবং কর্মচারীদের হত্যা করে এবং ফ্যাক্টরী লুট করে। খৃষ্টান কর্মচারীরা রক্ষা পায়, কিন্তু আমরা চাকুরী হারাই।
‘তাদের হত্যা করে কেন?’ জিজ্ঞাসা করল আহমদ মুসা।
‘শুধু তো ওদের নয়, আরও মুসলমানদের ওরা হত্যা করেছে। মিলেশ বাহিনী মুসলিম বিদ্বেষী।’ বলল লোকটি।
একটু থেমেই লোকটি আবার বলল, ‘আজ ওরা দু’জন মুসলমানকে ধরে এনেছে।’
‘ধরে এসেন আমরা জানি। আমরা তাদের লোক। কোথায় তাদের রেখেছে?’ বলল আহমদ মুসা।
‘নিচের তলার একটি ঘরে। ঘরটি আসলে ছিল ষ্টোর রুম। জানালা নেই। ডবল দরজা। দরজার পরে গ্রীল করা আরেকটা দরজা। ওখানেই ওদরে দু’জনকে রেখেছে।’ বলল লোকটি।
আহমদ মুসা মনে মনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। ওদের যে কোন ক্ষতি হয়নি এজন্যে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করল। বলল, ঘাঁটিতে কতজন লোক আছে?
‘এখন লোক তেমন নেই। ওদেরকে ধরে এনে রেখেই দু’টো গাড়ি নিয়ে প্রায় সবাই ওরা বেরিয়ে গেছে। এখন গেটে একজন আছে, আর দু’জন আছে অফিসে। আরেকজন তো মারা গেল এখানে।’ বলল লোকটি।
‘সে ঘরটি কোনদিকে যেখানে ওদের রেখেছে?’ জিজ্ঞাসা কলল আহমদ মুসা।
লোকটি বলল, নিচ তলার উত্তর দিকের শেষ ঘর।
আহমদ মুসা লোকটিকে শুকরিয়া জানিয়ে ঘুরে দাঁড়াল। বেরিয়ে এল দরজা দিয়ে। তার পেছনে জাকুব।
আহমদ মুসা বের হয়েই একদম মুখোমুখি হয়ে পড়ল একজন লোকের। লোকটি লম্বা, পেশী বহুল এবং কুতকুতে খুনী চেহারা।
আহমদ মুসা তাকে দেখেই বুঝল, সে ঐ দুজনেরই একজন হবে। গুলির শব্দ শুনে খোঁজ নিতে এসেছে।
লোকটি পিস্তল হাতে গুটি গুটি এগিয়ে আসছিল। হঠাৎ আহমদ মুসার সামনে পড়ে লোকটিও হকচকিয়ে উঠল। সামলে উঠেই লোকটি পিস্তল তুলতে গেল।
আহমদ মুসা শুয়ে পড়ে জোড়া পায়ে তার হাত লক্ষ্যে একটা লাথি মারল। কিন্তু লাথিটা হাতে না লেগে আঘাত করল তলপেটে। আঘাতটা যুতসই হলো না। ভারসাম্য বজায় রাখতে না পেরে লোকটি পড়ে গেল। কিন্তু পড়ে গিয়েই পিস্তল তুলল সে।
আহমদ মুসা তাকে গুলি করার সুযোগ দিল না। সে একটু সময় চেয়েছিল, পেয়ে গেল। মাটিতে শুয়ে পড়েই আহমদ মুসা রিভলভার বের করে নিয়েছিল পকেট থেকে। শুয়ে থেকেই সে গুলি করেছিল।
সুতরাং লোকটি পিস্তল তুলে ট্রিগার টেপার আগেই আহমদ মুসার রিভলভারের গুলি এসে তার বুক এফোঁড়-ওফোঁড় করে দিল।
জাকুব ও হাতে পিস্তল তুলে নিয়েছিল।কিন্তু গুলি করার আর প্রয়োজন হলো না।
আহমদ মুসা রিভলভার আর পকেটে না পুরে হাতে নিয়েই সামনে এগুলো। তার পেছনে জাকুব।
কর্মচারীদের কোয়ার্টার গুলোর সামনে জমে ওঠা অন্ধকারের পথ ধরে আহমদ মুসা সোজা ওদের অফিস বিল্ডিং এর গোড়ায় গিয়ে দাঁড়াল। তারপর বিল্ডিং এর দেয়াল ঘেসে এগুলো দক্ষিণ দিকে। দক্ষিণ পাশ ঘুরে করিডোরে ওঠার জন্যে।
বিল্ডিং এর দক্ষিণ প্রান্তে গিয়ে পশ্চিম দিকে ঘুরার জন্যে ধীরে ধীরে মুখ বাড়াতেই দেখল ষ্টেনগান বাগিয়ে একজন গুটি গুটি এগিয়ে আসছে।
আহমদ মুসা বিদ্যুৎ বেগে মুখটা সরিয়ে নিল দেয়ালের আড়ালে। আর সঙ্গে সঙ্গেই এক পশলা গুলি ছুটে এল। মুখ সরিয়ে নিতে এক মুহুর্ত বিলম্ব হলেই গুড়িয়ে যেত মাথা।
আহমদ মুসা বিল্ডিং এর গা ঘেষে শুয়ে পড়ল।
অবিরাম গুলি আসছিল ষ্টেনগান থেকে। বুঝা যাচ্ছে, গুলি করতে করতেই লোকটি ইঞ্চি ইঞ্চি করে সামনে এগুচ্ছে।
আহমদ মুসা ষ্টেনগানের গুলির গতি বিচার করে দেখল, গুলি মাটি থেকে দুই ফুট উপর দিয়ে আসছে। অর্থাৎ লোকটি দাঁড়িয়ে একটু সামনে ঝুকে গুলি করতে করতে সামনে এগুচ্ছে।
আহমদ মুসা গুলির লেভেল ও মাটির মধ্যেকার দুই ফুট খালি গলি পথের সুযোগ নিতে চাইল।
আহমদ মুসা বাম হাতে রিভলভার ধরে তার নলটা ষ্টেনগানের শব্দ লক্ষ্যে স্থির করে মুখটা বিদ্যুৎ বেগে দেয়ালের বাইরে বের করেই নিশ্চিন্ত হয়ে তর্জনিটা চাপল ট্রিগারের উপর।
লোকটি দেখতে পেয়েছিল আহমদ মুসাকে। কিন্তু ষ্টেনগানের ব্যারেল নিচে নামার আগেই বুকে গুলিবিদ্ধ হলো সে। প্রবল ঝাকুনি দিয়ে উঠল তার শরীর। শিথিল হাত থেকে ষ্টেনগান ঝরে পড়ল। তার পাশেই মুখ থুবড়ে পড়ল লোকটি।
আহমদ মুসা জাকুবকে ষ্টেনগান কুড়িয়ে নিতে বলে ছুটল করিডোরের দিকে।
করিডোরে কেউ নেই।
গেটের লোকটি ষ্টেনগান হাতে উদ্বিগ্ন চোখে এদিকে তাকাচ্ছে।
জাকুব এসে আহমদ মুসার পাশে দাঁড়াল।
আহমদ মুসা বলল, জাকুব তুমি ষ্টেনগান নিয়ে গেটের রক্ষীকে পাহারা দাও। সে যেন পালাতে না পারে, আবার এদিকেও আসতে না পারে।
বলে আহমদ মুসা করিডোর ধরে ছুটল বন্দীখানার দিকে।
ঠিক সর্ব উত্তরের ঘরটাই বন্দীখানা। ডবল দরজা। আহমদ মুসা পকেট থেকে ল্যাসার পিস্তল বের করল। মিনিট খানেকের মধ্যেই ল্যাসার বিম দিয়ে দুই দরজারই তালা উড়িয়ে দিল। ভেতরে ঢুকল বন্দীখানার।
মাজুভ ও সালেহ বাহমন দু’জনারই হাত-পা বাঁধা। ওরা উঠে বসেছে। ওদের চোখে আনন্দের ঝিলিক।
আহমদ মুসা ওদেরকে সালাম দিল।
পকেট থেকে চাকু বের করে দ্রুত হাত-পা’র বাঁধন খুলে দিল ওদের।
আহমদ মুসা যখন সালেহ বাহমনের বাঁধন খুলছিল, সে বলল, আমরা যাকে উদ্ধার করতে এলাম তিনিই দেখি আমাদের উদ্ধার করছেন!
‘আল্লাহ এটা পারেন না মনে কর?’ হেসে বলল আহমদ মুসা।
‘তা মনে করব কেন, বন্দীখানায় এসে যখন দেখলাম আপনি নেই, তখন থেকে এই মুহুর্তেরই অপেক্ষা করছি।’ বলল সালেহ বাহমন।
আহমদ মুসা সালেহ বাহমনের পিঠ চাপড়ে বলল, এমন ক্ষেত্রে কারো অপেক্ষা করে বসে থাকা ঠিক নয়, যতটুকুই পারা যায় নিজে এগুনোর চেষ্টা করা দরকার।
আহমদ মুসা ওদেরকে নিয়ে বন্দীখানা থেকে বেরিয়ে এল। বেরিয়ে আসতে আসতে মাজুভ বলল, মুসা ভাই কনষ্টানটাইনরা শহীদ মসজিদ রোড়ে গেছে হাসান সেনজিকের মাকে ধরে আনার জন্যে।
শুনেই আহমদ মুসা থমকে দাঁড়াল। ভ্রুকুচকে বলল, কি বলছ, ওরা শহীদ মসজিদ রোড়ে গেছে? হাসান সেনজিকের মাকে ধরে আনার জন্যে? বলেই আহমদ মুসা আবার হাটতে শুরু করল।
করিডোরে পৌঁছে আহমদ মুসা মাজুভ ও সালেহ বাহমনকে বলল, গাড়ি বারান্দায় জাকুব আছে, ওখানে তোমরা যাও। আমি এদিক দিয়ে গেটম্যানের পেছনে পৌঁছব।
বলে আহমদ মুসা করিডোর থেকে লনে নেমে পড়ল। লনটি উজ্জ্বল আলোতে ভাসছে। কিন্তু সারিবদ্ধ ফুলের গাছ লনে কিছুটা আড়াল ও আলো-ছায়ার সৃষ্টি করেছে।
আহমদ মুসা প্রায় হামাগুড়ি দিয়ে উত্তর প্রাচীরের পাশ ঘেষে পশ্চিম দিকে এগিয়ে চলল। কিছু পর প্রাচীরের সাথে দক্ষিণ দিকে মোড় নিল আহমদ মুসা।
গেটরক্ষী গেট থেকে কয়েকগজ সামনে দাঁড়িয়ে তার ষ্টেনগানকে গাড়ি বারান্দায় দাঁড়ানো জাকুবের দিকে তাক করে আছে। জাকুবের পাশে তখন মাজুভ ও সালেহ বাহমনও এসে দাঁড়িয়েছে।
আর কয়েকগজ গেলেই আহমদ মুসা গেটরুমের আড়ালে যেতে পারে। এমন সময় তিন তলার বারান্দা থেকে একটা মেয়ে চিৎকার করে উঠল, জেরিনস্কি! ঠিক তোমার পেছনে।
ঐ চিৎকারের সাথে সাথে তিনতলা থেকে গুলির আওয়াজ হলো।
জেরিনষ্কি গেটরক্ষীর নাম।
আহমদ মুসা চিৎকার শুনেই বুঝতে পারল, কি ঘটতে যাচ্ছে। গেটরক্ষী পেছন ফিরলেই তাকে দেখতে পাবে।
মেয়েটি চিৎকার করে উঠার সঙ্গে সঙ্গেই আহমদ মুসা দৌড় দিল গেটরুমের আড়ালে যাবার জন্যে।
মেয়েটির চিৎকারে গেটরক্ষী চমকে উঠে যখন পেছনে ফিরল তখন আহমদ মুসার ছায়াটাই শুধু তার নজরে এল। সুতরাং তার ষ্টেনগানের গুলির ঝাঁক বৃথাই গেল।
গেটরক্ষী যখন পেছন ফিরে গুলি করছিল, তখন সেই সুযোগে জাকুব ষ্টেনগানের গুলি করতে করতে গেটের দিকে ছুটে এল।
গেটরক্ষী পুনরায় ফিরে দাঁড়িয়ে তার ষ্টেনগান তুলে ধরার আগেই সে জাকুবের গুলির মুখে পড়ে গেল। ঝাঁঝরা হয়ে গেল গেটরক্ষীর দেহ।
জাকুব লনের মাঝখানে দাড়িয়ে তিনতলার যেখান থেকে মেয়েটি চিৎকার করেছিল, গুলি এসেছিল সেদিকে তাকাল। তারপর ষ্টেনগান তুলে এক পশলা গুলি বৃষ্টি করল সেদিকে।
আড়াল থেকে আহমদ মুসা বেরিয়ে এসে বলল, থাক জাকুব, মেয়েদের উপর প্রতিশোধ নেবার দরকার নেই। আল্লাহর শুকরিয়া আদায় কর আল্লাহ আমাদের যে সফলতা দিলেন তার জন্যে।
সবাই এসে গেটের সামনে আহমদ মুসার কাছে দাঁড়াল।
আহমদ মুসা বলল, চল আর এক মুহুর্ত সময় নষ্ট করা যাবে না।
ঘড়ির দিকে নজর বুলিয়ে আহমদ মুসা আবার কথা শুরু করল। পনের মিনিট হলো ওরা এখান থেকে ষ্টার্ট করেছে। আর কয়েক মিনিটের মধ্যেই ওরা হাসান সেনজিকের বাড়িতে পৌঁছবে। ওদেরকে আমরা ওখানেই ধরব।
সবাই বেরিয়ে এল গেট দিয়ে। হাটতে শুরু করল তারা রাস্তার পাশে রেখে আসা গাড়ির লক্ষ্যে।
হাটতে হাটতে সালেহ বাহমন বলল, মুসা ভাই মিলেশ বাহিনী যদি হাসান সেনজিকের মাকে ধরে আনতে যায়, তাহলে তাকে সরিয়ে আনার একটা জরুরী ব্যবস্থা করে রেখেছি। সেটা হলো, হাসান সেনজিকের মা’র ঘর এবং পুব পাশের একটি দোকানের সাথে সুড়ঙ্গ সংযোগ আছে। ঐ সুড়ঙ্গ পথে প্রথমে তাকে দোকানে আনা হবে তারপর তাকে ডেসপিনার বাড়ীতে সরিয়ে নেয়া হবে। প্রথম কাজটা সহজ, দ্বিতীয় কাজটা সহজ নয়। তবু একটা ব্যবস্থা আমরা করে রেখেছি।
আহমদ মুসা থমকে দাঁড়াল। তারপর সালেহ বাহমনের পিঠ চাপড়ে বলল, আমাকে অনেকটা নিশ্চিন্ত করলে সালেহ বাহমন।
একটু থামল আহমদ মুসা। তারপর আবার বলল, তাহলে আমরা শহীদ মসজিদ রোড়ের পূর্ব প্রান্ত দিয়ে প্রবেশ করব।
চারজন গিয়ে গাড়িতে উঠল। ড্রাইভিং সিটে বসল আহমদ মুসা। ঘড়ির দিকে একবার তাকিয়ে গাড়িতে ষ্টার্ট দিল আহমদ মুসা।
সালেহ বাহমন এই সময় প্রশ্ন করে বসল, মুসা ভাই আপনাকে একটা প্রশ্ন করতে পারি?
‘অবশ্যই পার।’ বলল আহমদ মুসা।
‘মুসা ভাই, কয়েকটি বিপ্লবে আপনি নেতৃত্ব দিয়েছেন। অনেক অভিযান আপনি পরিচালনা করেছেন। আজ এক অভিযানের এই মুহুর্তে আপনি অতীতের কোন ঘটনাকে সবচেয়ে বেশি স্মরণ করছেন?’
আহমদ মুসার হাত ছিল ষ্টিয়ারিং হুইলে। তার দৃষ্টি ছিল সামনে প্রসারিত। সালেহ বাহমনের প্রশ্ন শোনার পর তার মুখে নেমে এল গাম্ভীর্য। গাম্ভীর্য রুপান্তরিত হলো ধীরে ধীরে গভীর বেদনায়। বেদনার এক কালো আস্তরণে যেন ঢেকে গেল তার মুখ।
আহমদ মুসা বলল, আমি অতীতের দিকে ফিরে তাকাই না। সেখানে আনন্দের চেয়ে বেদনাই আমাকে পীড়িত করে বেশি বাহমন।
-কিন্তু আমরা তো দেখি ভিন্ন চিত্র। আপনি কোটি কোটি মানুষকে জুলুম থেকে মুক্তি দিয়েছেন, তাদের মুখে হাসি ফুটিয়েছেন। বলল সালেহ বাহমন।
-দেহের বেদনা-পীড়িত জায়গার কথাই মনে থাকে বেশী, সেখানেই বার বার হাত যায়। বলল আহমদ মুসা।
-দেহের জন্যে একথা সত্য, জাতির জন্যে একথা কি সত্য? এখানে বিজয়কে, বিজয়ের প্রাপ্তিকেই তো বড় করে দেখা হয়। বলল সালেহ বাহমন।
তোমার একথাটা জাতির জন্যে সত্য, ব্যক্তির জন্যে নয়। বিজয়ের প্রাপ্তি এক ব্যক্তিকে গৌরবান্বিত করে, কিন্তু সে যখন বিজয়-পথের দিকে দৃষ্টি ফেরায় তখন পথের অনেক কষ্ট, হারানোর অনেক বেদনা তাকে আকুল করে। বিজয়ের প্রাপ্তির চেয়ে এই বেদনা একজন ব্যক্তির মনে বেশি দাগ কাটে, কারণ বিজয়ের প্রাপ্তিটা প্রকাশ্য, অন্য সকলের সাথে এর যোগ আছে। কিন্তু ঐ বেদনা হয় নিজস্ব, হৃদয়ের গভীরে থাকে লুকানো, যা অলক্ষে মানুষকে পোড়ায় বেশী। বলল আহমদ মুসা।
-ঠিক বলেছেন মুসা ভাই। এমন বেদনার দু’একটি ঘটনা আপনার মুখে শুনতে চাই যা আপনি ভুলতে পারেন না।
আহমদ মুসা হাসল। বলল, এ ধরণের গল্প বলে মানুষ কর্মহীন সন্ধ্যায় সোফায় গা এলিয়ে, অথবা নিরব রাতের নিঝুম প্রহরে কম্বলের ভেতর ঢুকে।
এবার মাজুভ কথা বলল। বলল সে, ঠিক আছে সালেহ বাহমন তোমার প্রস্তাব তোলা রইল। অমন সন্ধ্যারই আমরা অপেক্ষা করব।
আহমদ মুসা মিষ্টি হাসল।
তারপর সবাই নিরব।
তীর বেগে তখন এগিয়ে চলছিল গাড়ি শহীদ মসজিদ রোড়ের দিকে।
আহমদ মুসা যখন শহীদ মসজিদ রোডে পৌছল, তখন রাত আটটা পার হয়ে গেছে। রাস্তায় লোক চলাচল কমে গেছে।
আহমদ মুসার গাড়ি শহীদ মসজিদ রোডে ঢুকে বাম পাশের ফুটপাত ঘেষে ধীরে ধীরে এগিয়ে চলেছে পশ্চিম দিকে। হাসান সেনজিকের বাড়ির পুব পাশে তাদের দোকানের যে সারি, তা দেখা গেল। সব দোকানেই আলো জ্বলছে একমাত্র সর্ব পশ্চিমের একটি দোকান ছাড়া। সালেহ বাহমন ফিস ফিস করে বলে উঠল, মুসা ভাই হাসান সেনজিক ভাইয়ের মাকে বাড়ি থেকে সরিয়ে আনা হয়েছে। সর্ব পশ্চিমের দোকান বন্ধ হয়ে যাওয়াই তার প্রমাণ। কথা আছে, চূড়ান্ত বিপদ মুহূর্ত যখন আসবে, যখন হাসান সেনজিকের মাকে সরিয়ে আনার প্রয়োজন হবে, তখন তার আগেই দোকানটি বন্ধ করে দিতে হবে। আমার মনে হয় কথা মোতাবেক কাজ হয়েছে।
‘ধন্যবাদ সালেহ বাহমন, তোমাদের পরিকল্পনা সত্যিই প্রশংসনীয়। তুমি কি মনে কর, হাসান সেনজিকের মাকে বাড়ি থেকে দোকানে সরিয়ে আনার পর এখান থেকে স্থানান্তর করার যে কথা তা হয়েছে?’ বলল আহমদ মুসা।
‘না মুসা ভাই, সুড়ঙ্গ দিয়ে দোকানে সরিয়ে আনা হয়েছে, কিন্তু সেখান থেকে স্থানান্তর সম্ভব হয়নি, তার প্রমাণ দোকানের বাইরের আলো। কথা ছিল, দোকান থেকে তাকে যখন স্থানান্তর করা হবে, তখন ঐ আলোও নিভে যাবে। সম্ভবত স্থানান্তর নিরাপদ মনে করা হয়নি।’ বলল সালেহ বাহমন।
‘সুড়ঙ্গের মুখটা বাড়ির কোথায়?’ জিজ্ঞাসা করল আহমদ মুসা।
‘হাসান সেনজিকের মা’র ঘরের একটা বড় কাঠের আলমারী থেকে সুড়ঙ্গের শুরু।’ বলল সালেহ বাহমন।
‘তাহলে তো সুড়ঙ্গের মুখ খুঁজে পাওয়া ওদের পক্ষে কঠিন হবে না। হাসান সেনজিকের মাকে না পেলে ওরা পাগল হয়ে উঠবে, আলমারীটা তারা না দেখে ছাড়বে না।’ বলল আহমদ মুসা।
‘হ্যাঁ ঠিক তাই, মুসা ভাই। বেশীক্ষণ ওকে ওখানে রাখা যাবে না।’ বলল সালেহ বাহমন।
গাড়ি তখন প্রায় দোকানগুলোর বরাবর পৌছে গেছে। আহমদ মুসা গাড়ি দাঁড় করাল।
গাড়ি দাঁড়ানোর পর সালেহ বাহমন বলল, দেখুন মুসা ভাই, ফুটপাতে তিনজন লোক বসে আছে। ওরা নিশ্চয় মিলেশ বাহিনীর লোক। ওরা এদিকটা পাহারা দিচ্ছে, যাতে এদিক দিয়ে বাড়ি থেকে কেউ বেরিয়ে আসতে না পারে।
আহমদ মুসা তাকিয়ে দেখল, ঠিক ফুটপাতের আধো আলো-অন্ধকারে বেশ দূরে দূরে তিনজন ফুটপাতের উপর বসে আছে। ওদের চোখ দোকান এবং বাড়ির দিকে।
আহমদ মুসা বলল, সালেহ বাহমন তুমি গাড়ি পূর্ব প্রান্তের দোকানটির কোণায় নিয়ে দাঁড় করাও। আমরা তিনজন এখানে নেমে যাচ্ছি ওদের তিনজনকে দেখার জন্যে।
আহমদ মুসা, মাজুভ ও জাকুভ গাড়ী থেকে নেমে এল। মজুভ ও জাকুভকে সে বলল, গুলি-গোলা এই মুহূর্তে আমরা করতে চাই না। সুতরাং ওদের কোন সময় না দিয়ে রিভলভার দেখিয়ে ওদের আত্মসমর্পনে বাধ্য করাতে হবে।
বলে আহমদ মুসা হাটতে লাগল তিন জনের মধ্যে সর্ব পশ্চিমের লোকটির উদ্দেশ্যে। মাজুভ ও জাকুভও তাদের লক্ষ্যে হাটতে শুরু করল।
রাস্তা পারাপার সব সময়ই হয়ে থাকে। সাধারণ পথচারীর মতই আহমদ মুসা, মাজুভ ও জাকুভ রাস্তা পার হয়ে ওপারে চলল।
আহমদ মুসা যখন পশ্চিম প্রান্তের সেই লোকটির চারগজের মধ্যে গিয়ে পৌঁছেছে তখনও লোকটি ওদিক থেকে চোখ ফিরায়নি। অবশেষে আহমদ মুসার পায়ের শব্দে সে যখন চমকে উঠে চোখ ফিরাল, তখন আহমদ মুসার রিভলভার একগজের মধ্যে তারবুক লক্ষ্যে স্থির।
আহমদ মুসা তাকে বলল, একটা কথা বললে শেষ করে দিব। উঠে দাঁড়িয়ে ফুটপাত দিয়ে পুবদিকে চল।
লোকটি একবার ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে ফুটপাত দিয়ে হাটতে শুরু করল।
আহমদ মুসা তাকিয়ে দেখল, মাজুভ এবং জাকুবও তাদের শিকারকে পোষ মানিয়ে নিয়ে চলেছে।
আহমদ মুসা আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করল।
ওদের তিন জনকেই দোকানের আড়ালে নিয়ে গেল।
সালেহ বাহমনও গাড়িটি নির্দিষ্ট স্থানে দাঁড় করিয়ে সেখানে গিয়ে হাজির হলো। সে গিয়ে দোকান থেকে দড়ি নিয়ে এল।
সালেহ বাহমনের সাথে আরও দু’জন এল। সালেহ বাহমন তাদেরকে আহমদ মুসার সাথে পরিচয় করিয়ে দিল। ওদের একজন বলল, কনষ্টানটাইন ওদের দলবল নিয়ে পাঁচ মিনিট আগে বাড়িতে প্রবেশ করেছে।
আহমদ মুসা দ্রুত ওদেরকে বলল, তোমরা এদের হাত, পা ও মুখ বেধে ফেল। আর সালেহ বাহমন তুমি আমার সাথে এস।
বলে আহমদ মুসা দ্রুত চলল সেই দোকানের দিকে যেখানে হাসান সেনজিকের মাকে এনে রাখা হয়েছে।
দোকানের পেছনের ঘরে একটা খাটে বিছানা পাতা। হাসান সেনজিকের মা সেখানে শুয়ে আছে। তার পাশে বসে আছে হাসান সেনজিকের ফুফু। ঘরের একপাশে দাঁড়িয়ে আছে দু’জন পরিচারিকা। হাসান সেনজিকের মা চোখ বন্ধ করে শুয়ে ছিল।
একটা কাঁসি দিয়ে ঘরে প্রথমে প্রবেশ করল সালেহ বাহমন। তার পেছনে পেছনে আহমদ মুসা।
তাদের পায়ের শব্দে চোখ খুলল হাসান সেনজিকের মা।
সালেহ বাহমন আহমদ মুসার দিকে ইঙ্গিত করে বলল, খালাম্মা ইনি আহমদ মুসা।
আহমদ মুসা হাসান সেনজিকের মাকে সালাম দিল।
আহমদ মুসার নাম শোনার সাথে সাথে হাসান সেনজিকের মা’র চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। একটু হাত তুলে বলল, দীর্ঘজীবী হও বাবা। তুমি এসেছ, আমার হাসান সেনজিক কোথায়?
‘হাসান সেনজিক নিরাপদে আছে খালাম্মা। আপনি এখান থেকে গেলেই দেখতে পাবেন।’ বলল আহমদ মুসা।
এই সময় হাসান সেনজিকের বাড়ির দিক থেকে শব্দ ভেসে আসতে লাগল। মনে হচ্ছে, কেউ যেন ভারী কিছু দিয়ে বন্ধ দরজার উপর আঘাত করে চলেছে।
আহমদ মুসা উৎকর্ণ হলো।
এই সময় হাসান সেনজিকের ফুফু বলল, আমরা ভাবীর ঘরের দরজা বন্ধ করে এসেছি। সেটাই ভাঙ্গার ওরা চেষ্টা করছে।
আহমদ মুসা সালেহ বাহমনের দিকে চেয়ে বলল, আর দেরি করা যাবে না।
বলে হাসান সেনজিকের মার দিকে চেয়ে বলল, খালাম্মা আপনাকে এবার উঠতে হবে।
হাসান সেনজিকের ফুফু উঠে দাঁড়াল। সে দুই পরিচারিকার দিকে চেয়ে বলল, এস তোমরা। বলে সে তার ভাবীর দিকে এগুলো।
আহমদ মুসা ও সালেহ বাহমন বাইরে বেরিয়ে এল।
দুই পরিচারিকা এবং হাসান সেনজিকের ফুফু হাসান সেনজিকের অসুস্থ মাকে ধরাধরি করে গাড়ির দিকে নিয়ে চলল।
আহমদ মুসার নির্দেশে সালেহ বাহমন গাড়ির ড্রাইভিং সিটে গিয়ে বসেছে। মাজুভ তার পাশের সিটে। জাকুব ও অন্যান্যরা দোকানগুলোর আশে-পাশে দাঁড়িয়ে পাহারা দিচ্ছে কেউ যাতে এদিকে আসতে না পারে। কিন্তু কারো নজর এদিকে আছে বলে মনে হলো না। সবারই নজর সম্ভবত বাড়ির দিকে নিবদ্ধ যেখানে কনষ্টানটাইন প্রবেশ করেছে।
আহমদ মুসা হাসান সেনজিকের মা’র সাথে সাথে গিয়ে তাদেরকে গাড়ীতে তুলে দিল। তারপর গাড়ির দরজা বন্ধ করে মাজুভ ও সালেহ বাহমনকে উদ্দেশ্য করে বলল, দোয়া করি, আল্লাহ নিরাপদে পৌঁছান। আর যদি কোন বাধা আসে তাহলে নির্মমভাবে তা দমন করে সামনে এগুবে।
সালেহ বাহমন বলল, কিন্তু মুসা ভাই আপনি?
আহমদ মুসা বলল, আমি কনষ্টানটাইনকে দেখে তবে আসব। আল্লাহ ভরসা। বলে গাড়ি ছাড়ার নির্দেশ দিল আহমদ মুসা। সালেহ বাহমন গাড়ি ষ্টার্ট দিল। গাড়ী চলতে শুরু করল।
গাড়ি চোখের আড়ালে না যাওয়া পর্যন্ত দাঁড়িয়ে থাকল আহমদ মুসা ফুটপাতের উপর। তারপর ফিরে দাঁড়িয়ে দোকানের কাছে চলে এল যেখানে জাকুব দাঁড়িয়ে ছিল।
দোকানগুলোকে কেন্দ্র করে হোয়াইট ক্রিসেন্টের চারজন পাহারায় ছিল। তাদেরকে আহমদ মুসা নির্দেশ দিল মিলেশ বাহিনীর কেউ যাতে দোকানের পেছন দিকে যেতে না পারে। বলে আহমদ মুসা দ্রুত জাকুবকে নিয়ে সেই সুড়ঙ্গ ঘরে এল যেখানে হাসান সেনজিকের মা ছিল।
আহমদ মুসা নিশ্চিত, কনষ্টানটাইন এই সুড়ঙ্গপথে আসবেই হাসান সেনজিকের মা’র খোঁজে।
ঘরের আলো জ্বালাই ছিল। আহমদ মুসা পার্টিসনের আড়ালে সেলস-রুমে গিয়ে দাঁড়াল। সে এমন জায়গায় বসল যেখান থেকে পার্টিসন ডোর দিয়ে সুড়ঙ্গ মুখের আলমারীটা দেখা যায়। আর জাকুব দাঁড়াল কক্ষের বাইরে দোকানের পেছন দিকটায়।
বেশীক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো না আহমদ মুসাকে। মিনিট কয়েক পরেই সুড়ঙ্গ মুখের আলমারীর ভেতর ঠক করে শব্দ হলো। মনে হল কাঠের সাথে ধাতব কোন জিনিস বাড়ি খেল। ষ্টেনগানের নল কি? ভাবল আহমদ মুসা।
আরও কয়েক মুহূর্ত পরে, আহমদ মুসা দেখল, ধীরে ধীরে নিশব্দে আলমারীটির দরজা খুলে গেল। সেই খোলা পথে বেরিয়ে এল ষ্টেনগানের কাল কুচকুচে নল। পরে ষ্টেনগান ধরা হাত। তারপর পূর্ণ একটা মানুষ বেরিয়ে এল। আহমদ মুসা তাকে দেখেই চিনল, ‘কনষ্টানটাইন’ মিলেশ বাহিনীর প্রধান।
কনষ্টানটাইনকে দেখে আহমদ মুসার প্রতিটি স্নায়ুতন্ত্রীতে তীব্র একটা জ্বালা ছড়িয়ে পড়ল। এই সেই কনষ্টানটাইন যার হাত হাজারো মুসলমানের রক্তে রঞ্জিত, যার রাত-দিনের স্বপ্ন হলো বলকান এবং ইউরোপের মুসলমানদের নির্মূল করে সম্রাট শার্লেম্যানের খৃষ্টরাজ্য আবার প্রতিষ্ঠা করা।
কনষ্টানটাইন তার ষ্টেনগান বাগিয়ে বিড়ালের মত নিশব্দে নেমে এল আলমারী থেকে।
তার পেছনে পেছনে নেমে এল আরেকজন। তারও হাতে ষ্টেনগান।
কনষ্টানটাইন আলমারী থেকে নেমে মেঝের উপর মুহূর্ত কাল দাঁড়াল। তারপর কয়েক ধাপ এগিয়ে এল সেলস রুমের দিকে। কিন্তু সম্ভবত পেছনের খোলা দরজার দিকে চোখ পড়তেই সে ঘুরে সেদিকে চলল। আর সাথের লোকটি এর আগেই খোলা দরজা দেখে সেদিকে পা বাড়িয়েছিল।
আহমদ মুসা আর দেরি করল না। পার্টিসনের আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে কনষ্টানটাইনের মাথা বরাবর রিভলবারের নল তুলে বলল, কনষ্টানটাইন ফিরে যাচ্ছ কেন? আমি এখানে।
কথার শব্দ পাওয়ার সাথে সাথে কথা শেষ হতেই কনষ্টানটাইন চরকীর মত ঘুরে দাঁড়াল। মুহূর্তে সে ষ্টেনগান তুলতে যাচ্ছিল।
আহমদ মুসা কঠোর কন্ঠে বলল, ষ্টেনগানের নল আর এক ইঞ্চিও উঠলে তোমার মাথা গুড়ো হয়ে যাবে। মনে রেখ,আহমদ মুসা এক কথা দুই বার বলে না।
কনষ্টানটাইনের ষ্টেনগানের নল আর উপরে উঠল না।
আবার বলল আহমদ মুসা, ষ্টেনগান ফেলে দাও।
ঠিক এই সময় কনষ্টানটাইনের সাথী ঘুরে দাঁড়িয়ে ষ্টেনগান তাক করছিল আহমদ মুসার দিকে। জাকুব দরজার পাশেই অন্ধকারে দাঁড়িয়ে ছিল। সে কনষ্টানটাইনের সাথীকে ষ্টেনগানের ট্রিগার চাপার সুযোগ দিল না। তার রিভলভারের গুলি বুক ভেদ করল কনষ্টানটাইনের সাথীর।
সাথীর মৃত্যু কনষ্টানটাইনকে বোধ হয় অধৈর্য্য অথবা বেপরোয়া করে তুলছিল। সাথীর মুখের অন্তিম চিৎকার শোনার সাথে সাথেই তার ষ্টেনগানের নল নড়ে উঠল। উঠতে শুরু করল উপরে বিদ্যুৎ গতিতে।
কিন্তু আহমদ মুসার তর্জ্জনিটা রিভলভারের ট্রিগার স্পর্শ করে হুকুমের অপেক্ষা করছিল।
আহমদ মুসার সিদ্ধান্ত নিতে একটু বিলম্ব হলো না। তর্জ্জনিটা চেপে বসল ট্রিগারে। বেরিয়ে গেল এক ঝলক আগুন। কনষ্টানটাইনের মাথা গুড়ো করে দিল রিভলভারের নির্দয় বুলেট। আলমারীর গোড়ায় হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল কনষ্টানটাইনের বিশাল দেহ।
আহমদ মুসা এবং জাকুব সুড়ঙ্গের মুখে সেই ঘরে আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করল। কেউ এলো না।
অবশেষে আহমদ মুসা এবং জাকুব দু’জন সুড়ঙ্গে ঢুকে পড়ল। সাথে নিল দু’জনার দুই ষ্টেনগান এবং কনষ্টানটাইনের মাথার রক্তাক্ত হ্যাট।
সুড়ঙ্গ পথ বেশ প্রশস্ত। পাথর ও সিমেন্ট দিয়ে একদম পাকা করা।
দু’মিনিট লাগল ঘরের সুড়ঙ্গের মুখে পৌঁছতে।
সুড়ঙ্গ পথটি খোলা। সুড়ঙ্গ-মুখের আলমারী কাত হয়ে পড়ে আছে।
আহমদ মুসা হাটছিল। ধীরে ধীরে উঁকি দিল সুড়ঙ্গ-মুখে। দেখল, একজন ষ্টেনগান হাতে দাঁড়িয়ে আছে দরজায় আর দু’জন দরজার ডান পাশে দেয়াল ঘেষে দাঁড়ান ষ্টিলের আলমারী খুলে তার দেরাজগুলো হাতড়াচ্ছে।
আহমদ মুসা রিভলভার বাগিয়ে সুড়ঙ্গ দিয়ে উঠতে যাবে এমন সময় ওদিক থেকে একজন হাঁফাতে হাঁফাতে ছুটে এসে দরজায় ষ্টেনগান হাতে নিয়ে দাঁড়ানো লোকটিকে বলল, উস্তাদ মালখানা পাওয়া গেছে। পুরানো আমলের অনেক সোনা-দানা, টাকাপয়সা এবং জিনিসপত্র সেখানে। ষ্টেনগানধারী লোকটি তাকে ধমক দিয়ে বলল, একটাও যেন এদিক-সেদিক না হয়, সব তুলে নিয়ে এস তোমরা।
চলে গেল খবর নিয়ে আসা লোকটি। যারা ষ্টিল আলমারী হাতড়াচ্ছিল তারা তখনও সেখানে ব্যস্ত।
ষ্টেনগানধারী লোকটি কয়েক পা তাদের দিকে এগিয়ে বলল, কি তোমাদের হয়নি এখনও?
ঠিক এই সুযোগেই আহমদ মুসা এবং তার পেছনে জাকুব সুড়ঙ্গ দিয়ে উঠে এল। আহমদ মুসার হাতে রিভলভার এবং জাকুবের হাতে ষ্টেনগান।
ষ্টেনগানধারী লোক বিপদ আঁচ করতে পেরেছিল। হঠাৎ তাকে শক্ত হয়ে উঠা দেখেই আহমদ মুসা এটা বুঝতে পেরেছিল।
ষ্টেনগানধারী লোকটি ষ্টেনগানের নলটি উঁচু করে ষ্টিল আলমারীর দিকে এগুবার জন্যে সামনে এক পা এগিয়ে বিদ্যুৎবেগে ঘুরে দাঁড়াতে গেল ষ্টেনগানের ট্রীগার চেপে ধরে।
ষ্টেনগানের গুলি বৃষ্টি শুরু হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু ষ্টেনগানের নলটি ঘুরে আহমদ মুসাদের বরাবর আসার আগেই আহমদ মুসার রিভলভারের গুলি ষ্টেনগানধারীকে থামিয়ে দিল। লোকটি গুলিবিদ্ধ হয়ে পড়ে মেঝের উপর তার ষ্টেনগান হাতে নিয়েই। লোকটি পড়ে যাবার সাথে সাথে যে দু’জন লোক আলমারীর কাছে দাঁড়িয়েছিল তাদের একজন ঝাপিয়ে পড়ল ষ্টেনগানধারী লোকটির লাশের উপর। মনে হয়েছিল তার লক্ষ্য লোকটির অবস্থা দেখা। কিন্তু না সে তার উপর পড়েই তার হাত থেকে ষ্টেনগান নিয়ে শোয়া অবস্থায় ষ্টেনগান তুলে ধরতে গেল আহমদ মুসাদের লক্ষ্যে।
এবার গর্জে উঠল জাকুবের ষ্টেনগান। সামনে এগিয়ে এল গুলি বৃষ্টির এক দেয়াল। তার সামনে পড়ে গেল লাশের উপরে এবং আলমারীর কাছে দাঁড়ানো দুই লোকই।
‘ধন্যবাদ জাকুব, তোমার ষ্টেনগান ঠিক সময়েই কথা বলেছে।’ বলল আহমদ মুসা।
‘খুশীর খবর মুসা ভাই, ওদের অবশিষ্ট তিন নেতাও শেষ।’ বলল জাকুব।
‘কেমন? বুঝলাম না।’ বলল আহমদ মুসা।
‘কনষ্টানটাইন তো গেছেই। তার সাথে ওখানে যে লোকটি মরেছে এবং এখানে যে ষ্টেনগানধারী আপনার গুলিতে মরল দুইজন কনষ্টানটাইনের পরের অবশিষ্ট দুই নেতা। এখন মুসা ভাই প্রকৃত পক্ষে মিলেশ বাহিনীকে কমান্ড করারও কেউ থাকল না।’ বলল জাকুব।
আহমদ মুসা কাঠের আলমারী টেনে সুড়ঙ্গের মুখে চাপা দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এল। জাকুবও বেরিয়ে এল তার পেছনে।
ষ্টিফেন পরিবারের ভূগর্ভস্থ মিউজিয়াম ও ষ্টোর রুমে প্রবেশ করেছিল তিনজন। মিলেশ বাহিনীর সে তিনজন লোককে আহমদ মুসা ও জাকুব ধরে নিয়ে এল। তারা বাধা দিতে চেষ্টা করেছিল। কিন্তু তারা যখন দেখল বাধা দেওয়া ও মৃত্যুর মধ্যে কোন পার্থক্য নেই, তখন তারা আত্মসমর্পন করলো। ওদেরকে পিছমোড়া করে বেঁধে ওপরে নিয়ে আসা হলো।
বাইরের করিডোরে পাহারা দিচ্ছিল দু’জন ষ্টেনগান হাতে। ওরা গাড়ি বারান্দা থেকে করিডোরে উঠে আসা সিঁড়ির দু’পাশের দু’টি পিলারে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়েছিল। ওদের ষ্টেনগান ওদের হাতে ঝুলন্ত অবস্থায় ছিল।
আহমদ মুসা ও জাকুব যখন ষ্টেনগান হাতে হলরুম থেকে করিডোরে এসে দাঁড়াল, তখন ওরা দু’জন চমকে উঠে ষ্টেনগান তুলে ধরতে চেষ্টা করছিল।
আহমদ মুসা খুব ঠান্ডা ভাষায় ওদের বলল, তোমরা মরতে চাইলে কোন কথা নেই। কিন্তু মরতে যদি না চাও তাহলে ষ্টেনগান ফেলে দাও।
ওরা মুহূর্ত কয়েক চিন্তা করল। পরস্পর পরস্পরের দিকে তাকাল। খোলা দরজা পথে তাকিয়ে হাত বাধা সহযোগীদেরও বোধহয় দেখতে পেল। তারপর ওরা দু’জনই ওদের ষ্টেনগান করিডোরের উপর ফেলে দিল।
জাকুব এগিয়ে গিয়ে ষ্টেনগান দু’টি কুড়িয়ে নিল। তারপর ওদের দু’জনকে পিছমোড়া করে বেঁধে হলরুমে ঢুকিয়ে দিল।
রাত তখন সাড়ে ৮টা।
আহমদ মুসা জাকুবকে বলল, আমি এ দিকটা দেখছি, তুমি গিয়ে হোয়াইট ক্রিসেন্টের ঐ চার ভাইকে ডেকে আন দোকানের সামনে থেকে।
পাঁচ মিনিট পর জাকুব ওদের চারজনকে নিয়ে এল। আহমদ মুসা ওদেরকে সব জানাল। তারপর বলল, বাড়ির অন্যান্য লোকজন কোথায়? গেট রক্ষী কোথায়?
চারজনের একজন বলল, জীবনহানি এড়াবার জন্যে সবাইকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে ওদের আসার খবর পাবার পরেই। ওদের ডাকব এখন?
আহমদ মুসা সম্মতি সূচক মাথা নাড়ল। সঙ্গে সঙ্গে চারজনের মধ্যে যে কথা বলছিল সে ছুটে বেরিয়ে গেল গেটের দিকে। সেখানে গিয়ে বোধহয় একটা সুইচ টিপল। সঙ্গে সঙ্গে গেটের মাথার লাইট জ্বলে উঠল। লোকটি ফিরে এল।
‘কি করলে, আলোই তো শুধু জ্বাললে!’ বলল আহমদ মুসা।
‘ঐ আলোটাই সংকেত। এ সংকেতের অর্থ বাড়ি এখন বিপদমুক্ত, ফিরে আসতে হবে এখন ওদের।’ বলল লোকটি।
আহমদ মুসা হেসে বলল, তোমাদের হোয়াইট ক্রিসেন্টকে ধন্যবাদ, আত্মরক্ষার তোমরা চমৎকার ব্যবস্থা করেছিলে। এ ব্যবস্থা না থাকলে রক্তপাত হতো অনেক।
হোয়াইট ক্রিসেন্ট আপনারও। আপনাকে পেয়ে আকাশের চাঁদ হাতে পাওয়ার মত আমরা গর্ব বোধ করছি।’ বলল সেই লোকটিই।
আহমদ মুসা হেসে বলল, হোয়াইট ক্রিসেন্ট অবশ্যই আমারও। আমি হোয়াইট ক্রিসেন্টের একজন। তোমার নাম কি ভাই?
এই সময় চারজন মধ্যবয়সী লোক, একজন বৃদ্ধ এবং দু’জন কিশোর প্রবেশ করল গেট দিয়ে। ওরা ভয় ও বিস্ময় নিয়ে করিডোরে উঠে এল।
সেই লোকটি সবার সাথে আহমদ মুসার পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলল, এরাই এ বাড়ির তত্ত্বাবধায়ক, সব কিছু দেখা-শোনার দায়িত্ব এদের।
আহমদ মুসা ওদের উদ্দেশ্য করে বলল, তোমরা তোমাদের বাড়ির দায়িত্ব বুঝে নাও। বলে আহমদ মুসা হল রুমে প্রবেশ করল যেখানে মিলেশ বাহিনীর পাঁচজন বাঁধা অবস্থায় ছিল।
আহমদ মুসা চারজনের দলের সেই লোকটিকে লক্ষ্য করে বলল, এদের ঘর থেকে এবং দোকান থেকে লাশগুলো সরাও। রক্তও পরিষ্কার করে নাও। একজনকে শুধু আমি সাথে নিচ্ছি।
বলে আহমদ মুসা ঐ পাঁচজনের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলল, কনষ্টানটাইন সহ তোমাদের নেতারা কেউ বেঁচে নেই। তোমরা বাঁচতে চাও, না মরতে চাও?
‘বাঁচতে চাই।’ ওরা সমস্বরে বলল।
‘তাহলে আমাকে সাহায্য করতে হবে।’ বলল আহমদ মুসা।
ওরা সকলেই প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে আহমদ মুসার দিকে তাকাল।
আহমদ মুসা বলল, এই রাস্তার দু’পাশের দোকানে মিলেশ বাহিনীর লোকদের বসিয়ে রাখা হয়েছে তোমরা সকলেই জান। তাদের চিনিয়ে দিতে হবে।
ওদের একজন বলল, সব দোকানে নেই, কোন কোন দোকানে ছিল। কিন্তু আজ সকাল থেকেই ওদের কাজ শেষ। হাসান সেনজিকের বাড়ীতে ফাইনাল অপারেশন পর্যন্ত অর্থাৎ ৭ দিনের জন্যে ওদের রাখা হয়েছিল।
‘রাস্তার মুখেও তো পাহারা বসানো ছিল। ওরা নেই?’ বলল আহমদ মুসা।
‘ওরাও নেই। ওদের মধ্যে থেকে চারজন এ অপারেশনে শামিল হয়েছিল। অবশিষ্টদের ছুটি দেয়া হয়েছে।’ বলল সেই লোকটি।
‘দোকান ও রাস্তার পাহারা মিলে মোট কতজন ছিল ওরা?’ বলল আহমদ মুসা।
‘তিরিশ জনের মত হবে।’ বলল লোকটি।
‘এরা এখন কোথায়?’ জিজ্ঞাসা করল আহমদ মুসা।
জবাবে লোকটি বলল, এরা সবাই এখন নিজ নিজ কাজে ফিরে গেছে। এদের কেউ চাকুরে, কেউ ব্যবসায়ী, কেউ বা ছাত্র।
‘এরা মিলেশ বাহিনীর নিয়মিত লোক নয়?’ জিজ্ঞাসা করল আহমদ মুসা।
লোকটি বলল, মিলেশ বাহিনীর নিয়মিত লোক কম। যখন কাজ পড়ে লোক ডেকে আনা হয়। মিলেশ বাহিনীর সদস্য প্রচুর। চাকুরে, পেশাজীবি, ছাত্র সকলেই এর সদস্য হতে পারে। সদস্য হবার পর মিলেশ বাহিনী ওদের প্রশিক্ষণ দেয়। ওদের অঙ্গিকার করতে হয় যে, মিলেশ বাহিনী যখন যাকে ডাকবে, আসতে হবে জাতীয় দায়িত্ব মনে করে জাতির সবার জন্যে।
আহমদ মুসা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। বলল, যদি মিলেশ বাহিনী এদের না ডাকে?
‘না ডাকলে এরা কোন কাজে আসে না, নিজ নিজ কাজ নিয়েই ব্যস্ত থাকে।’ বলল সেই লোকটি।
‘কেন এরা স্বতঃস্ফুর্তভাবে জাতীয় দায়িত্ব মনে করে মিলেশ বাহিনীর কোন কাজ করতে এগিয়ে আসে না?’ বলল আহমদ মুসা।
লোকটি কতকটা বিস্ময়ের সাথে বলল, দায়িত্ব বিচার করবে, ঠিক করবে তো মিলেশ বাহিনী, তারা না ডাকলে, দায়িত্ব না বলে দিলে তারা নিজের থেকে কি করবে। এরকমটা কেউ করে না।
জাকুবের বলা কথা এ সময় আহমদ মুসার মনে পড়ল। বিশাল সমর্থক শ্রেণী নামক ভুমির উপর সরল ও সংর্কীণ লম্ব রেখার মত দাঁড়ানো ক্ষুদ্র পরিসরের লিডারশীপ ভেঙে পড়লে গোটা সংগঠনই শেষ হয়ে যাবে। জাকুবের এই কথাটা এতক্ষণে আহমদ মুসার কাছে আরো স্পষ্ট হলো। আহমদ মুসা নিশ্চিত হলো, নতুন আর এক কনষ্টানটাইন জন্ম না হওয়া পর্যন্ত এই আন্দোলন আর হাটতে পারবে না।
আহমদ মুসা হোয়াইট ক্রিসেন্টের ঐ চারজনকে উদ্দেশ্য করে বলল, শুনলে তো তোমরা সব। এই মুহূর্তে কোন বিপদ আর আমরা দেখি না। এখানকার কাজ আপাতত শেষ। আমরা এখন সালেহ বাহমনের ওখানে ফিরে যেতে পারি। এখানে আরো যা কিছু করার, সালেহ বাহমন ও হাসান সেনজিকরা এসে করবে।
বলে আহমদ মুসা করিডোরে বেরিয়ে এল। তার সাথে বেরিয়ে এল হোয়াইট ক্রিসেন্টের চারজনও।
করিডোরে এসে আহমদ মুসা একটু দাঁড়াল। হোয়াইট ক্রিসেন্টের চারজনকে লক্ষ্য করে বলল, মিলেশ বাহিনীর এই পাঁচজন এবং দোকানের ওখানে আরো বাঁধা আছে তিনজন- এই আটজনকে আপাতত তোমরা হাত-পা বেধে নিরাপদ কোথাও আটকে রাখ। আর সালেহ বাহমন এখানে না আসা পর্যন্ত তোমরা বাড়িটার পাহারায় থাকবে।
কথা শেষ করে আহমদ মুসা করিডোর থেকে নেমে এল গাড়ি বারান্দায়। গাড়ি বারান্দায় দু’টি গাড়ি দাঁড়িয়ে ছিল। একটি জীপ, একটি মাইক্রোবাস। এই দু’টি গাড়ি করেই এসেছিল কনষ্টানটাইন এবং তার লোকেরা।
আহমদ মুসা জীপের ফুয়েল মিটারের দিকে একবার নজর বুলিয়ে বলল, জাকুব চল আমরা জীপটা নিয়ে যাই।
আহমদ মুসা জীপের ড্রাইভিং সিটে উঠে বসল। জাকুব উঠে বসল পাশের সিটে।
হোয়াইট ক্রিসেন্টের চারজনের দিকে তাকিয়ে একবার হাত নাড়ল আহমদ মুসা। তারপর ষ্টার্ট দিল জীপে।
জীপ শব্দ তুলে চলতে শুরু করল। হোয়াইট ক্রিসেন্টের চারজন দাঁড়িয়ে অগ্রসরমান জীপের দিকে তাকিয়ে রইল।
তাদের পাশে এসে দাঁড়াল হাসান সেনজিকের বাড়ির পরিচারকদের প্রধান মোস্তফা ইম্পাহিক। ষাটের কোঠায় বয়স কিন্তু শক্ত সমর্থ। সে জিজ্ঞাসা করল, কথা বলল, হুকুম দিয়ে গেল এই লোকটি কে?
-‘আহমদ মুসা’ তুমি চিনবে না। বলল হোয়াইট ক্রিসেন্টের একজন।
-কনষ্টানটাইনকে এই-ই মেরেছে?
-হ্যাঁ। শুধু কনষ্টানটাইনকে কেন, কয়দিনে মিলেশ বাহিনীর সব নেতাকেই তো সে মেরেছে।
-সাংঘাতিক তো! কোত্থেকে এসেছে? আমাদের দেশী তো মনে হচ্ছে না।
-কিছুই দেখি তোমরা জাননা। তোমাদের হাসান সেনজিককে বন্দীদশা থেকে কে উদ্ধার করেছে, কে হাসান সেনজিককে দেশে এনেছে মিলেশ বাহিনীর সব বাধা সব প্রতিরোধ চূর্ণ করে? এই তো সেই লোক।
মোস্তফা মাথা ঝাঁকিয়ে আফসোস করে বলে উঠল, আগে কেন বললে না ভাই, আমি ওকে একটা সালাম করতাম? ওর হাতটা চুম্বন করতাম। এমন লোক আমার সামনে দিয়ে গেল, আর আমি কিছুই করতে পারলাম না।
হোয়াইট ক্রিসেন্টের লোকটি বলল, আর দুঃখ করো না। উনি চলে যাননি আবার আসবেন। ভালো করে রান্না করে খাইয়ে দিও।
বলে ফিরে দাঁড়াল সে। সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলল, চল নির্দেশ তো সবাই শুনেছ। এখন কাজগুলো আমাদের শেষ করতে হবে।
সবাই ঘুরে দাঁড়াল। একজনকে করিডোরে ষ্টেনগানসহ পাহারায় রেখে সবাই বাড়ির ভেতরে ঢুকে গেল।

Top