১২. কর্ডোভার অশ্রু

চ্যাপ্টার

মাদ্রিদ বিমান বন্দরের মাটিতে পা রাখতেই গোটা শরীরে একটা শিহরণ খেলে গেল আহমদ মুসার। সে শিহরণের মধ্যে একটা গৌরবও আছে, কিন্তু বেদনার ভাবটাই মুখ্য। সাতশ’ এগারো খৃষ্টাব্দে তারিক বিন যিয়াদ এমনি করেই স্পেনের এক প্রান্ত জাবলুত তারিকে পা রেখেছিলেন। তার সেদিনের অনুভূতি ছিল বিজেতার, এই আইবেরীয়া উপদ্বীপের মানুষকে মুক্ত করার এবং তাদেরকে অন্ধকার থেকে আলোতে নিয়ে আসার আনন্দও ছিল তার অন্তরে। কিন্তু আজ স্পেনের মাটির স্পর্শ থেকে সৃষ্ট শিহরণ আহমদ মুসার হৃদয়টাকে যেন বেদনায় মুষড়ে দিল! দূরে সরে যাওয়া, পর হয়ে যাওয়া আত্মীয়ের মুখোমুখি হওয়ার মতোই যেন ব্যাপারটা। আহমদ মুসার মনে হলো স্পেনের মাটিই যেন তাকে বিস্ময়ের সাথে চোখ তুলে দেখছে! তার চোখেও যেন অতীতের বেদনার এক অনুরণন। অনাকাঙ্ক্ষিত দখলের অধীন কেউ যেমন হঠাৎ দেখা পাওয়া মুক্ত আপনজনের প্রতি বিস্ময় আর বেদনার আকুতি নিয়ে তাকায় এ যেন ঠিক তেমনি! আহমদ মুসার মনে হলো, স্পেনের বোবা এই দৃষ্টিতে এক সাগর কথা যেন উপচে পড়ছে। যেন বলছে, অযোগ্য, অপদার্থ তোমরা পালিয়ে গেছ আমাকে অন্ধকারে নিমজ্জিত করে, আজ অমন বেদনা নিয়ে তাকচ্ছ কেন?
স্পেনের মাটিতে পা রেখে আবেগে, আবেশে আহমদ মুসা হঠাৎ করে চলার শক্তি হারিয়ে ফেলেছিল। তার চোখের দৃষ্টিটা ঝাপসা হয়ে উঠেছিল। কিন্তু পেছনে তখন যাত্রীর স্রোত। কে একজন পেছন থেকে তার পায়ে হোঁচট খেয়ে ‘স্যরি’ বলে উঠল। সম্বিত ফিরে পেল আহমদ মুসা। হাঁটতে শুরু করল। কিন্তু পায়ে যেন জোর পাচ্ছে না সে। হঠাৎ কেমন এক অবসাদ এসে তাকে ঘিরে ধরেছে! স্পেনের বেদনাময় অতীত যেন সবটাই এসে তার মাথায় চেপে বসেছে। দেহের প্রতিটি রক্ত কণিকায় তা ছড়িয়ে দিয়েছে অবসাদজনক এক যন্ত্রণা।
আহমদ মুসা লাগেজের অপেক্ষায় বসে ছিল। বসে বসে সে মাদ্রিদের ট্যুরিষ্ট গাইডের ওপর নজর বুলাচ্ছিল।
পাশের চেয়ারে একজন তরুনী এসে বসল। স্প্যানিশ। পরনে প্যান্ট, গায়ে শার্ট। চেহারায় নরম লাবণ্য। কিন্তু চোখে মুখে ভাব-ভংগিতে বুদ্ধি ও শক্তি যেন ঠিকরে পড়ছে!
তরুণীটি বলল, ‘মাফ করবেন, আপনি কি অধূমপায়ী?’
তরুণীটি হাতে সিগারেটের একটি প্যাকেট ও একটি লাইটার।
‘হ্যাঁ, অধূমপায়ী।’ ট্যুরিষ্ট গাইড থেকে মুখ তুলে বলল আহমদ মুসা। ‘তবে আপনি ধুমপান করতে পারেন।’
‘থ্যাংক ইউ।’ সিগারেটের প্যাকেট ও লাইটার পকেটে রাখতে রাখতে বলল মেয়েটি।
‘বললাম তো আমার অসুবিধা নেই।’
মেয়েটির দিকে পরিপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে মুখে সামান্য হাসি টেনে বলল আহমদ মুসা।
‘থ্যাংক ইউ।‘ সংক্ষিপ্ত উত্তর মেয়েটির।
আহমদ মুসা আবার মনোযোগ দিল ট্যুরিষ্ট গাইডের দিকে। কিছুক্ষণ পর গাইডটি উল্টে পাল্টে বন্ধ করল। তারপর তরুণীর দিকে মুখ ঘুরিয়ে একটু দ্বিধা করে বলল, ‘মাফ করবেন, মাদ্রিদে কি মুসলিম হোটেল আছে?’
মেয়েটি চোখ তুলে মুহুর্তকাল আহমদ মুসার দিকে চেয়ে রইল। তার চোখে কৌতুহল। বলল সে, ‘আপনি নিশ্চয় মুসলমান?’
‘হ্যাঁ।’ বলল আহমদ মুসা।
‘নিশ্চয় স্পেনেও নতুন?’
‘হ্যাঁ।’
‘কিন্তু তবু স্পেনের কথা তো আপনার জানার কথা?’
‘তা ঠিক, কিছু জানি কিন্তু সব জানি না।’
‘স্পেনে মুসলিম পরিচয় নিয়ে কোন হোটেলে ওঠা সম্ভব নয়, এটা তো সবার জানা কথা।’
‘দুঃখিত, আমি এতটা জানি না।’
‘আপনার দেশ কোথায়?’
দ্বিধায় পড়ল আহমদ মুসা। কোনটাকে তার দেশ বলবে? সে তো যাযাবর। বিভিন্ন দেশ থেকে পাসপোর্ট নিয়েছে। অবশেষে বলল, ‘আমি যুগোশস্নাভিয়া থেকে আসছি।’
মেয়েটির মুখে ছোট্ট একটা হাসি ফুটে উঠল। বলল, ‘যুগোশস্নাভিয়া থেকে স্পেন তো বেশি দূরে নয়?’
‘আমার মাতৃভুমি আরো দূরে, মধ্যএশিয়া।’
’বুঝলাম।’
লাগেজ আসতে শুরু করেছে।
‘মাফ করবেন।’ বলে আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল।
মেয়েটির প্রশ্নের হাত থেকে বাঁচল। মেয়েটির প্রশ্নের হাত থেকে বাঁচতে পেরে খুশিই হলো আহমদ মুসা। কি করি, সংঘাতকালীন যুগোশস্নাভিয়া কেন গিয়েছিলাম, স্পেনে কেন এসেছি? এমন সব প্রশ্নেও সে করতে পারত।
আহমদ মুসা লাউঞ্জ থেকে কারপার্কে বেরিয়ে এসেছে। সে এক ড্রাইভারের সাথে কথা বলছে। আহমদ মুসা আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্কসমৃদ্ধ শেরাটন হোটেলে ওঠাই ঠিক করেছে। এসব হোটেলে হালাল খাদ্যের ব্যাস্থা থাকে।
এই সময় তার বাম পাশেই ধস্তাধস্তির শব্দ পেয়ে চমকে উঠে সেদিকে ফিরে তাকাল আহমদ মুসা। সে দেখল, সেই তরুনীকে দু’পাশ থেকে দু’জন জাপটে ধরেছে। মেয়েটি ছাড়া পাওয়ার চেষ্টা করছে। নিজেকে ছাড়াতে পারলও সে। দু’পাশের দু’জন লোক মাটিতে গড়াগড়ি যাচ্ছে। ভালো কংফু জানে মেয়েটি। কিন্তু মেয়েটি সোজা হয়ে দাঁড়াতে না দাঁড়াতেই সামনে থেকে একজন ঝাঁপিয়ে পড়ল তার ওপর। মেয়েটি অদ্ভুত ক্ষিপ্রতার সাথে ডান হাঁটুটি একটু মুড়ে, একটু নিচু হয়ে, তীব্র বেগে ডান হাতটি লোকটির তলপেটে ছুঁড়ে দিল। লোকটি কোন শব্দ না করেই জ্ঞান হারিয়ে সটান মাটিতে পড়ে গেল।
পাশে ভুমিতে গড়াগড়ি যাওয়া লোক দু’টি তখন উঠে দাঁড়িয়েছে। তারা পিস্তল বের করেছে। দু’দিক থেকে দু’জন মেয়েটির পাঁজরে পিস্তল চেপে ধরে ঠেলে নিয়ে পাশের একটি মাইক্রোবাসে তুলল। গাড়ি থেকে একজন নেমে জ্ঞান হারিয়ে পড়ে থাকা লোকটিকে দ্রুত তুলে নিয়ে গেল।
ভোজবাজির মতোই দ্রুত ঘটে গেল ঘটনা!
মেয়েটিকে হাইজ্যাক করে মাইক্রোবাসটি কারপার্ক থেকে বেরোবার জন্যে ছুটল সামনের দিকে।
আশেপাশের সবার মতো আহমদ মুসাও কিংকর্তব্যবিমূঢ়ভাবে দাঁড়িয়ে আছে।
মাইক্রোবাসটি চলতে শুরু করলে মেয়েটি ‘বাঁচাও’ বাঁচাও’ বলে চিৎকার করে উঠল। সম্বিত ফিরে পেল আহমদ মুসা।
ভাবল সে, স্পেনে নতুন, কিন্তু তাই বলে এমন একটা হাইজ্যাকের প্রতিবাদ সে করবে না! একটা অসহায় মেয়ের সাহায্যের আবেদনে সে সাড়া দেবে না!
‘না, তা হয় না।’ স্বগত উক্তি করল আহমদ মুসা। ‘অন্যায়ের প্রতিরোধ, ন্যায়ের আদেশ দেবার জন্যেই তো মুসলমান জাতির উত্থান।’
আহমদ মুসা চাইল সামনেই দাঁড়িয়ে থাকা ট্যাক্সি ড্রাইভারের দিকে। দ্রুত বলল, ‘মাইক্রোবাসটিকে ফলো করবে, যাবে?’
ট্যাক্সি ড্রাইভারটি ছেলে বয়সের। সেও ঘটনাটা দেখেছে। তার চোখে মুখেও উত্তেজনা। মুহুর্তকাল ভেবে নিয়ে বলল, ‘ঝুঁকির ব্যাপার স্যার। ঠিক আছে যাব।’
‘আমি গাড়ি চালাতে চাইলে তোমার আপত্তি আছে?’ গাড়ির কাছে যেতে যেতে বলল আহমদ মুসা
‘না, নেই।’ একটু ভেবে নিয়ে বলল ড্রাইভার।
আহমদ মুসা গিয়ে ড্রাইভিং সিটে বসল। ড্রাইভার বসর পাশের সিটাতে। ট্যাক্সি ষ্টার্ট নিতে যাচ্ছে, এম সময় গাড়ির খোলা জানালা দিয়ে একটা পিস্তলের নল এসে আহমদ মুসার মাথা বরাবর স্থির হয়ে দাঁড়াল।
আহমদ মুসা মাথা ঘুরিয়ে পিস্তলধারীর দিকে তাকাল। একজন ষন্ডামার্কা লোক। ডান হাতে পিস্তল বাগিয়ে ঠান্ডা চোখে তাকিয়ে আছে। আহমদ মুসা ওর দিকে তাকাতেই লোকটি বাম হাতে গাড়ির দরজা খুলে হুকুম দিল, ‘বেরিয়ে এসো।’
আহমদ মুসা দ্রুত নির্দেশ পালন করল। তার চিন্তা ফাঁকা জায়গা পেলে কিছু একটা সুযোগ হয়তো আসতে পারে।
বাইরে এসে দাঁড়াতেই পিস্তল নাচিয়ে লোকটি বলল, ‘মনে হচ্ছে তুমি বিদেশি, মরার জন্য পাখা উঠল কেন?’
বলেই কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়ে একটু উচ্ছ স্বরে বলে উঠল, ‘ব্লেদা এদিকে আয়, মালটাকে বেঁধে গাড়িতে তোল। যাবার সময় একটা গার্বেজে ফেলে দিয়ে যাব।’
আহমদ মুসা দেখল ওপাশের একটা প্রাইভেট কার থেকে একজন লোক বেরিয়ে এলো সরু প্লাষ্টিকের কর্ড হাতে নিয়ে।
ব্লেদা নামের লোকটি কাছে এগিয়ে আসতেই পিস্তরওয়ালা পিস্তলের নলটি নামিয়ে একটু সরে দাঁড়াচ্ছিল।
আহমদ মুসা সুযোগ নষ্ট করল না। বিদ্যুৎ গতিতে সে দ’পা এগিয়ে বাম হাত দিয়ে পিস্তলওয়ালার হাত মুচড়ে ধওে ডান হাত দিয়ে পিস্তল কেড়ে নিয়েই লোকটির কানের নিচটায় ঘাড়ে পিস্তল দিয়ে প্রচন্ড এক আঘাত করল।
লোকটি কিছু বুঝে ওঠার আগেই জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়ল মাটিতে। আহমদ মুসা ঘুরতে গিয়েই দেখল, গাড়ি থেকে নেমে আসা হাতে কর্ডওয়ালা লোকটি তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ছে। সরে দাঁড়ানোর সময় ছিল না। আবার গুলীও করতে মন চাইল না তার। শুরুতেই খুনোখুনিতে জড়িয়ে পড়ে বিপদ বাড়াতে চায় না সে।
আহমদ মুসা বসে পড়ায় লোকটি ভারসাম্য হারিয়ে আহমদ মুসার মাথার ওপর দিয়ে মাটিতে আছড়ে পড়ল।
দ্রুত উঠে দাঁড়াল আহমদ মুসা।
উপুড় হয়ে পড়ে যাওয়া লোকটির মুখ ভীষণভাবে ঠোকা খেয়েছে লনের নগ্ন একটা পাথরের সাথে। ঠোঁট কেটে গলগল করে রক্ত বেরুচ্ছে।
নেকড়ের মতো হিংস্র দৃষ্টি নিয়ে লোকটি উঠে দাঁড়াচ্ছিল।
আহমদ মুসা তার দিকে পিস্তল তাক করে কঠোর কন্ঠে বলল, ‘মাথা গুঁড়ো করে দেব, যেমন পড়ে আছ ঠিক তেমনি পড়ে থাক।’
বলে আহমদ মুসা দ্রুত পেছন হতে বাম হাতে ব্যাটি তুলে নিয়ে কর্ড হাতে লোকটি যে প্রাইভেট কার থেকে বেরিয়ে এসেছিল সেই গাড়িতে গিয়ে উঠল। তারপর দ্রুত গাড়ি চালিয়ে বেরিয়ে এলো কারপার্ক থেকে। একবার পেছন ফিরে দেখল, মাটিতে পড়ে থাকা লোকটি উঠে ছুটে যাচ্ছে সংজ্ঞাহীন লোকটার দিকে। আহমদ মুসা বুঝল, লোকটি তার সাথী জ্ঞান না ফিরিয়ে তার পিছু নিতে আসবে না।
বিমান বন্দর থেকে বেরিয়ে আসা তীরের মতো সোজা রোড ধরে ঝড়ো বেগে এগিয়ে চলছিল আহমদ মুসার গাড়ি।
পকেট থেকে মাদ্রিদের ট্যুরিষ্ট গাইড বের করে বাম হাতে রেখেছে, ডান হাতে তার ষ্টিয়ারিং হুইল।
আহমদ মুসা দেখল, বিমান বন্দর থেকে বেরিয়ে আসা রোডটি বড় একটা হাইওয়েতে পড়েছে। হাইওয়েটি পশ্চিমে মাদ্রিদ শহরে প্রবেশ করেছে। আর হাইওয়ে ধরে পূর্বদিকে এগোলে প্রথম যে ছোট্ট শহরটি পাওয়া যায় তার নাম টারজন ডে আরগোজ। আহমদ মুসা নিশ্চিত হলো মেয়েটিকে নিয়ে হাইজ্যাকররা মাদ্রিদেই যাচ্ছে। এর আর একটি বড় কারণ হলো, এরা চুনোপুঁটি হাইজ্যাকার নয়। যারা একটা মাইক্রোবাস, একটা প্রাইভেট কার নিয়ে হাইজ্যাক করতে যায়, যারা বিমান বন্দরের কারপার্কে গিয়ে হাইজ্যাক করতে সাহস করে, পেছন থেকে একটা পাহারায় রেখে আসার মতো আঁটঘাট বেঁধে যারা কাজ করার বুদ্ধি রাখে, তারা ছোটখাট হাইজ্যাকার নয়। রাজধানীতেই তাদের মানায়। সুতরাং মাদ্রিদের রাস্তা ধরে এগোবারই সিদ্ধান্ত গ্রহন করল আহমদ মুসা।
মাদ্রিদগামী বিমান বন্দর রোডটি বেশ প্রশস্ত। গাড়ি-ঘোড়াও বেশ কম। আহমদ মুসা গাড়ির বেগ বাড়িয়ে দিল। গাড়ির গতি যখন ১৪০ কিলোমিটার উঠল তখনও মনে হলো গাড়ির গতি আরও বাড়ানো যায়। খুশি হলো আহমদ মুসা। গাড়িটি নতুন আমেরিকান গাড়ি। বেশ মজবুত।
হাইজ্যাককারীর মাইকোবাসটি সাদা। তার নাম্বার এখনও জ্বলজ্বল করছে আহমদ মুসা সামনে। আহমদ মুসার দৃষ্টি সামনে প্রসারিত। একের পর এক গাড়িকে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে চলছে আহমদ মুসার গাড়ি।
দশ মিনিট চলার পর আহমদ মুসা সাদা মাইক্রোবাসটিকে দেখতে পেল। উজ্জ্বল হয়ে উঠল আহমদ মুসার মুখ। তাহলে হাইজ্যাকররা খুব বেশি এগোতে পারেনি! পেছনে পাহারা দেবার লোক আছে যেহেতু এবং সম্ভবত তাদের পিছু নেবে কেউ এমন আশংকা করে না বলেই তারা নিশ্চিত মনে মাঝারি চালে গাড়ি চালাচ্ছে।
আরও মিনিট খানেকের মধ্যে আহমদ মুসার গাড়ি মাইক্রোবাসটির একশ’ গজের মধ্যে পৌছালো।
মাইক্রোবাসটির গতি হঠাৎ স্লো হয়ে গেল। সংগে সংগে আহমদ মুসাও তার গাড়ির গতি স্লো করে দিল। এই সময় মাইক্রোবাসটিতে কয়েকবার হর্ন বেজে উঠল। তারপরই আবার দ্রুত চলতে শুরু করল মাইক্রোবাসটি।
চককে উঠল আহমদ মুসা! মাইক্রোবাসটি কি তাকে সন্দেহ করল? মাইক্রোবাসটির শক্তিশালী রিয়ারভিউ মিররে ১০০ গজ পেছনের তার এই গাড়ি অবশ্যই ধরা পড়ার কথা। পেছনে নিজেদের গাড়ি দেখেই কি তাহলে গতি ওভাবে স্লো করে দিয়েছিল? মাইক্রোবাসটির সামনে তো কোন গাড়ি ছিল না, তাহলে হঠাৎ হর্ন বাজিয়েছিল কেন? ওটা কি ওদরে কোন সংকেত ছিল? সংকেতের জবাব না পেয়ে কি তারা ধরে নিয়েছে তাদের গাড়ি শক্র পক্ষের হাতে পড়েছে?
আহমদ মুসা নিশ্চিত হলো, সে ওদের অনুসরণ করছে এটা ওদের কাছে ধরা পড়ে গেছে। ওরা এখন পালাচ্ছে।
আহমদ মুসাও তার গাড়ির গতি বাড়িয়ে দিল। প্রায় ১০০ গজের মতো পেছনে থেকেই আহমদ মুসার গাড়ি মাইক্রোবাসটিকে অনুসরণ করে চলল।
মিনিট পাঁচেক চলার পর মাইক্রোবাসটি হাইওয়ে থেকে নেমে অপেক্ষাকৃত একটা ছোট রাস্তা ধরে ধরে দক্ষিণ দিকে ছুটতে লাগল।
রাস্তাটি আরও নির্জন। গাড়ির চলাচল খুব কম। যতই সামনে এগোতে লাগল গাড়ির চলাচলের সংখ্যা মনে হলো আরও কমে যাচ্ছে। এলাকাটি মাদ্রিদের উপকন্ঠ, কিন্তু রেসিডেন্সিয়াল কিংবা শিল্প এলাকা নয়। মাঝে মাঝে টিলা, আর মধ্যে বড় বড় কৃষি ক্ষেত। দু’পাশে ক্ষেত রেখে মাঝের রাস্তা ধরে এগিয়ে চলেছে গাড়ি।
জলপাই গাছে ঢাকা একটা ছোট্ট টিলার মুখে হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ল মাইক্রোবাসটি।
আহমদ মুসা দাঁড়াবে কি না ভাবল। ভাবতে ভাবতেই প্রায় মাইক্রোবাসটির কাছাকাছি পৌছে গেল সে।
মাইক্রোবাসটি থেমেছে, কিন্তু কেউ গাড়ি থেকে বের হয়টি।
মাইক্রোবাসটির গড় দশের পেছনে থাকতেই আহমদ মুসা গাড়ির ব্রেক কষল।
ব্রেক কষতে গিয়ে রিয়ার ভিউতে চোখ পড়তেই ভুত দেখার মতো চমকে উঠল আহমদ মুসা! পেছনে থেকে একটা জীপ গাড়ি তার প্রায় ঘাড়ের ওপর এস পড়েছে। মাইক্রোবাসটির ওপর নজর থাকায় এতক্ষণ সে পেছনে খেয়ালই করেনি। নিজের বোকামিটাও এখন তার কাছে ধরা পড়ে গেল। শত্রু পিছু নিয়েছে একথা জানার পর সামনের মাইক্রোবাস যে অয়্যারলেসে তার বিপদের কথা নিজের লোকদের জানাতে পারে, তারা পেছন থেকে আহমদ মুসার ওপর যে চড়াও হতে পারে, আহমদ মুসাকে এ ধরনের ট্র্যাপে ফেলার জন্যেই যে এমন নির্জন, ফাঁকা জায়গায় নিয়ে আসছে, এসব কথা আহমদ মুসার আগেই আঁচ করা উচিত ছিল।
পেছনের জীপটি থামতেই চারজন চারটি পিস্তল হাতে জীপ থেকে লাফিয়ে পড়ল। ওদিকে সামনের জীপ থেকেও দু’জন নেমে এসেছে। ওদেও হাতেও পিস্তল।
আহমদ মুসার খালি হাত। জুতার খোলে ছোট একটি ছুরি আছে, একটা ল্যাসার কাটার আছে। ওগুলো দিয়ে এখানে লড়াই করা যাবে না। আর লোকগুলোকে নিছক হাইজ্যাকার মনে হচ্ছে না। ওদের ঠান্ডা মাথা, ঠান্ডা চোখ দেখে মনে হচ্ছে ওরা দক্ষ প্রফেশনাল। অয়্যারলেস ব্যবহারের যোগ্যতা যাদের আছে, তাদেরকে ছোট করে দেখার কোন অবকাশ নেই।
আহমদ মুসা শান্ত, নিরীহ মানুষের মতো গাড়ি থেকে নেমে মাইকোবাসের দিকে চলল। তার পেছনে চারজন পিস্তরধারী।
আহমদ মুসা মাইক্রোবাসের দরজার কাছে দাঁড়ানো দীর্ঘকায় লোকটির মুখোমুখি হয়ে মুখে একটু হাসি টেনে শান্ত কন্ঠে বলল, ‘একজন নিরস্ত্র লোকের জন্যে এত আয়োজন?’
মাইক্রোবাসের খোলা দরজা দিয়ে দেখা যাচ্ছে, মেয়েটি হাত, পা, মুখ বাঁধা অবস্থায় সিটে বসে আছে। সে আহমদ মুসার দিকে তাকিয়ে বিস্মিত হয়েছে। হয়তো সে ভাবতে পারেনি, বিমান বন্দরে দেখা হওয়া সেই বিদেশি তার উদ্ধারের জন্যে ছুটে আসতে পারে!
আহমদ মুসা দাঁড়ালে পিস্তলধারীরা এসে তাকে ঘিরে ফেলল।
‘তুমি কে, তুমি কি চাও?’ আহমদ মুসার প্রশ্নের জবাব না দিয়ে দীর্ঘকায় লোকটি পাল্টা প্রশ্ন করল।
‘আমি একজন বিদেশি। আমার চোখের সামনে থেকে একটি মেয়েকে হাইজ্যাক করা হলো, আমি তাকে উদ্ধার করতে এসেছি।’ বলল আহমদ মুসা
‘আমাদের গাড়ি কোথায় পেলে? আমাদের দু’জন লোককে কি করেছ?’
‘ওদের ওখানে রেখে গাড়ি নিয়ে চলে এসেছি।’
‘কী সুন্দর কথা! যেন তারা গাড়ি ওর হাতে তুলে দিয়েছে। ওস্তাদ, লোকটা মনে হচ্ছে ধাড়ি শয়তান!’ পেছন থেকে বলল একজন পিস্তলওয়ালা।
‘ঠিক আছে, সব শয়তানকেই আমরা ঠিক করতে জানি। একে বেঁধে গাড়িতে তোল। আর দু’জন বিমান বন্দরে চলে যাও। খোঁজ নাও ওদের।’ বলে দীর্ঘকায় লোকটি মাইক্রোবাসের সামনের সিটে গিয়ে উঠল। আহমদ মুসাকে বাঁধতে বাঁধতে একজন বলল, ‘ব্যাটা! আরেকজনকে উদ্ধার করতে এসেছিলি, একন তোকে উদ্ধার করে কে?’
ওর কথার ঢংয়ে আহমদ মুসার মুখ ফুটে হাসি বেরুল। সে আরও ভাবল, এই মুহুর্তে এর হাতের পিস্তলটি কেড়ে নিয়ে কয়েকজনকে শেষ করতে পারে, নিজে পালিয়েও যেতে পারে, কিন্তু মেয়েটির তো উদ্ধার হবে না।
আহমদ মুসার হাসি দেখে সম্ভবত লোকটির আত্মসম্মানে ঘা লেগেছিল। সে আহমদ মুসার হাত বাঁধা শেষ করে তার নাকের ওপর প্রবল ঘুষি চালিয়ে বলল, ‘আমাদের বুঝি পছন্দ হচ্ছে না, চল দেখিয়ে দেব।’
আহমদ মুসার নাক ফেটে গল গল করে রক্ত বেরিয়ে এলো। কিন্তু আহমদ মুসা মুখে হাসি টেনেই বলল, ‘আমার ভুল হয়েছে, যারা দুর্বল নারীদের হাইজ্যাক করে তাদের বীর ভাবা উচিত।’
পিস্তল উঁচিয়ে আর একজন পিস্তলধারী এগিয়ে এলো। বলল, ‘ব্যাটা ব্ল্যাক ডগ, তোর কাছে আমাদের নীতি শিখতে হবে না।’
বলে ধাক্কা দিয়ে আহমদ মুসাকে মাইক্রোবাসে উঠিয়ে দিল।
মেয়েটির পাশেই জায়গা হলো আহমদ মুসার।
মেয়েটির মুখ বিস্ময় ও বেদনায় ছেয়ে আছে। সবচেয়ে তাকে বিস্মিত করেছে, আহমদ মুসার ভয়হীন, নিরুদ্বিগ্ন মুখ ও সহজ হাসি। এ সময় তো ভয় ও উৎকন্ঠায় মুষড়ে পড়ার কথা! ঘুষি খেয়ে তার নাক ফেটে গেল, রক্তে ভেসে গেছে, এরপরও কত সহজ ও নির্ভয়ে কথা বলছে সে! সাধারন নার্ভ নিয়ে এটা সম্ভব নয়।
মাইক্রোবাসটি চলতে শুরু করেছে।
আহমদ মুসার পাশে দরজার কাছে একজন পিস্তলধারী বসেছে। আর দু’জন পিস্তলধারী পেছনের সিটে।
প্রান্তরের রাস্তা ধরে মাইক্রোবাস পশ্চিম দিকে এগোচ্ছে। আহমদ মুসা বুঝল, তারা মাদ্রিদে যাচ্ছে।
সামনের সিট থেকে দীর্ঘকায় লোকটি মাথা ঘুরিয়ে আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে বলল, ‘বিদেশি, মরবার জন্যে তোমর পাখা উঠেছিল বুঝি?’
‘মানুষ পিপীলিকা নয়।’ বলল আহমদ মুসা।
‘তাহলে তোমার পাখা বাঁচার জন্যে উঠেছে, না?’
‘একজনের বিপদে সাহায্য করতে এগিয়ে এসেছি।’
‘আমরা একজন মানুষ হাইজ্যাক করেছি, তুমিও তো একটা গাড়ি হাইজ্যাক করেছ।’
নাক থেকে আসা রক্ত বার বার মুখে এসে পড়ছিল। বাঁধা হাত দিয়েই বার বার মুছতে হচ্ছে। বাঁধা হাত দু’টি তুলে ঠোঁটের ওপর নেমে আসা রক্ত আরেকবার মুছে আহমদ মুসা বলল, ‘আমি করেছি সেটা অপরাধ নয়, আপনাদের কৃত অপরাধেরই একটা ফল।’
‘বাহ্, চমৎকার যুক্তি।’
থামল লোকটি। একটু থেমেই আবার মুখ খুলল, ‘হাইজ্যাক করব না কেন? এমন অপরূপা তুমি কয়জন দেখেছ, তুমিই বলো।’
লোকটির মুখে চটুল হাসি।
‘এ জঘন্য কথার আমি কোন জবাব দেব না।’
‘জঘন্য বলছ, তুমি ফেরেস্তা নাকি? দেখব, ঠিক আছে।’
’আমি মানুষ, তবে প্রত্যেক মানুষের অধিকারকে আমি শ্রদ্ধা করি।’
‘আমার অধিকারকেও?’
’অবশ্যই।’
‘মেয়েটিকে আমার ভালো লেগেছে, ওকে হাইজ্যাক করা আমার অধিকার।’ তার মুখে আবার চটুল হাসি।
‘আমার ভালো লাগছে বলেই কাউকে আমি খুন করতে পারি না।’
লোকটি উত্তর দিল না। অল্পক্ষণ চুপ করে থাকল। তারপর বলল, ওরা ঠিকই বলেছে, তুমি সাংঘাতিক ঘড়েল লোক। এমন বিপদে এমন ঠান্ডা মাথা কাউকে তো আমি দেখিনি। কিন্তু জেনে রেখো, তোমার চেয়েও লাখো গুণ বড় ঘড়েলের হাতে পড়েছ। জান আমরা কে?’ লোকটির কথায় ক্রোধ ফুটে উঠেছে।
‘আগে জানতাম না। এখন মনে হয় বুঝতে পারছি।’
‘কি বুঝতে পেরেছ?’ লোকটি চমকে উঠে মুখ ফেরাল।
আহমদ মুসা নিজেকে সামলে নিল। ওরা যে ক্লু-ক্ল্যাক্স-ক্লানের লোক সে পরিস্কার বুঝতে পেরেছে। পাশের লোকটির পিস্তলের বাঁটে সাদা রংয়ের ছোবল-উদ্যত সাপের মাথা আঁকা। এটা ক্লু-ক্ল্যাক্স-ক্ল্যানের মনোগ্রাম। কিন্তু তাদের পরিচয় যে আহমদ মুসা জানতে পেরেছে, এ কথা এত তাড়াতাড়ি প্রকাশ করা ঠিক মনে করল না। সে চুপ করে রইল, লোকটির প্রশ্নের কোন জবাব দিল না।
‘কি বুঝতে পেরেছ, বল?’ লোকটি পিস্তল নাচিয়ে ধমকে উঠল।
তবু আহমদ মুসা দ্বিধা করল, কোন মিথ্যা কথা বলতে তার বিবেকে বাঁধল।
লোকটি এবার আহমদ মুসার মাথা বরাবর পিস্তল তাক করে বলল, ‘দেখ, প্রশ্নের জবাব না দিলে এখনি মাথা উড়িয়ে দেব।’
পাশের মেয়েটির মুখ পাংশু হয়ে উঠল। সে আর্ত কন্ঠে বলল, ‘বলুন, ওরা সব করতে পারে।’
আহমদ মুসা মেয়েটির দিকে একবার তাকিয়ে হেসে উঠে বলল, ‘ক্লু-ক্ল্যাক্স-ক্ল্যান’ এর লোকেরা তাদের পরিচয়ের ব্যাপারে এত স্পর্শকাতর তাতো জানতাম না।’
‘আমরা ক্লু-ক্ল্যাক্স-ক্ল্যান,’ কে তোকে বলল।
‘বলার তো দরকার নেই, এই যে পিস্তলের বাঁটে সাপের মাথায় মনোগ্রাম দেখেই বুঝতে পেরেছি।’
লোকটির মুখ কিছুক্ষণ বিস্ময়ে হাঁ হয়ে থাকল। তারপর বলল, ‘এটা যে ক্লু-ক্ল্যাক্স-ক্ল্যান এর মনোগ্রাম তা তুমি জানলে কেমন করে?’
আহমদ মুসা কথা সাজিয়েই রেখেছিল। বলল, ‘দেখুন, আমি লেখাপড়া জানি। দুনিয়ার ইতিহাস আমি ঘাঁটাঘাঁটি করি বলে বিভিন্ন খোঁজ-খবর রাখা আমার নেশা। ক্লু-ক্ল্যাক্স-ক্ল্যান বিয়ষটা খুব গোপন কিছু নয়।’
লোকটি তৎক্ষনাৎ কোন কথা বলল না।
অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, ‘বিদেশি, তুমি অনেক বিষয় জান। কিন্তু এটা জান না, পরিচয় জানার পর ক্লু-ক্ল্যাক্স-ক্ল্যানের হাত থেকে ছাড়া পাওয়া তোমার জন্যে এখন কঠিন হয়ে গেল?’
‘কেন?’
‘কেন? আমরা তোমাকে ভালো মানুষ ঠাওরে ছেড়ে দিই আর তুমি বাইরে গিয়ে এখন বলে দাও, বাসক গেরিলা প্রধানের বোন আমাদের হাতে বন্দী, তা হয় না।’
মেয়েটি বাসক গেরিলাপ্রধানের বোন শুনে আহমদ মুসা সবিস্ময়ে মেয়েটির দিকে চোখ ফেরাল। মেয়েটিও তখন তাকিয়েছে। চোখাচেখি হলো। এই পরিচয় শুনে মেয়েটির প্রতি মমতা ও সহানুভুতি যেন আরও বেড়ে গেল আহমদ মুসার!

‘হ্যাঁ, আমি বাসক গেরিলাপ্রধান ফিলিপের বোন।’ ওরা আহমদ মুসা ও মেয়েটিকে জানালাহীন এ কক্ষটিতে ঠেলে দিয়ে দরজা বন্ধ করে চলে যেতেই বলল মেয়েটি।
‘আপনি কিন্তু আপনার পরিচয় বলেননি। এরপরও আমাকে উদ্ধারের ইচ্ছা আপনার থাকবে?’ মেয়েটি শেষ করল তার কথা।
‘বাস্ক গেরিলাদের সম্পর্কে আমি বেশি কিছু জানি না, কিন্তু এুঁকু জানি উত্তর স্পেনের পিরেনিজ পাদদেশের কাটালোনিয়া ও ভাসেলিয়া প্রদেশে স্বাধিকারের যে আন্দোলন ছিল, সেটাই বাস্করা আজ করছে এবং তা করতে গিয়ে তারা অমানুষিক ত্যাগ স্বীকার করছে।’ বলল আহমদ মুসা।
থামল আহমদ মুসা। একটু থেমেই আবার শুরু করল, ‘কিন্তু আমি বুঝতে পারছি না, ক্লু-ক্ল্যাক্স-ক্ল্যান- এর সাথে আপনাদের বিরোধ কেন?’
‘কারন হলো,’ শুরু করল মেয়েটি, ‘স্পেনের ক্লু-ক্ল্যাক্স-ক্ল্যান-এর লোকজন ও সরকার একই লবীর, একই স্বার্থের ভাগীদার। তাই বাস্কদের আন্দোলন ধ্বংস করতে ক্লু-ক্ল্যাক্স-ক্ল্যান প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ উভয় সাহায্যই সরকারকে দিয়ে যাচ্ছে। জঘন্য এরা। বেনামীতে আমাদের লোকদের পণবন্দী করে এরা বহু টাকাও কামাই করেছে বাস্কদের কাছ থেকে।’
‘আপনাকে কিডন্যাপ করার কি টার্গেট ওদের? বলল আহমদ মুসা।
‘গাড়িতে ওদের আলাপে যতটুকু বুঝেছি, ‘ব্ল্যাক সেভেন’ নামে একটা গ্রুপের ছন্মনামে আমার ভাইয়ার কাছ থেকে এক কোটি টাকা দাবী করবে। ভাইয়াকে এসে নির্দিষ্ট লোকের কাছে এই টাকা হস্তান্তর করতে হবে। তাদের মূল টার্গেট হলো ভাইয়াকে হাতের মুঠোয় আনা। ভাইয়া হাতে এলে আমাদের দু’জনকে ওরা তুলে দেবে সরকারের হাতে তিন কোটি টাকার বিনিময়ে।’
‘আপনার ভাইয়া যদি টাকা দিতে না আসেন?’
‘তারা জানে, ভাইয়া আসবেন। আমি তার একমাত্র বোন। আমাকে মুক্ত করার জন্যে তিনি জীবনও দিতে পারেন।’
‘ধাপনি একা এতটা অসাবধানে এলেন কেন?’
‘আমি আসছি জার্মানি থেকে, সেখানে পড়ি। গতকাল এসে পৌঁছানোর কথা ছিল, তার জন্যে এখানে ব্যবস্থাও ছিল। কিন্তু ট্রানজিটে অসুবিধা হয়েছে। ১২ ঘন্টা দেরিতে ফ্লাইট পেয়েছি। একথা আর জানাবার সুযোগ হয়নি।’
‘তাহলে আপনার মূল্য এখন তিন কোটি টাকা!’ গম্ভীর কন্ঠে বলল আহমদ মুসা।
‘আমি আমার কথা ভাবছি না, ভাবছি ভাইয়াকে নিয়ে।’ মেয়েটির কন্ঠে যেন কান্না ঝরে পড়ল!
আহমদ মুসা মাথা নিচু করে চুপ করে ছিল। উস্কোখুস্কো তার চুল, চেহারাটা বিধ্বস্ত।
দু’জনের হাত-পা তখনও বাঁধা। হাত পিছমোড়া করে বেঁধে রেখে যাওয়ায় হাত কোন কাজেই লাগছিল না।
ঘরটা বেশ বড়। জানালা না থাকলেও অনেক উঁচুতে ছাদের কাছাকাছি জায়গায় দু’পাশের দেয়ালে দু’টা ঘুলঘুলি আছে। ঘরের এক কোণে ছোট একটা লোহার খাটিয়া। দু’টো কম্বল সেখানে।
আহমদ মুসা মেয়েটিকে বলল, বোন, তুমি অনেক পরিশ্রান্ত! ঐ খাটিয়ায় গিয়ে একটু বিশ্রাম নাও। অবস্থাকে আমাদের মেনে নিতে হবে।’
‘আপনি? আপনি তো আহত এবং আমার জন্যেই আপনার এই দুর্দশা।’ নরম কন্ঠে বলল মেয়েটি।
‘আমি এই মেঝেতেই দিব্যি ঘুমাতে পারব। আমার আহত হওয়ার কথা বলছ? একে আমি কিছুই মনে করি না।’
মেয়েটি বিস্ময়-বিমুদ্ধ চোখে তাকিয়েছিল আহমদ মুসার দিকে। অত্যন্ত শরিফ, শান্ত, সরল চেহারা লোটির। কিন্তু যে সাহস ও নির্ভীকতা সে এর মধ্য এ পর্যন্ত দেখেছে তা তার কাছে অকল্পনীয়। চুড়ান্ত বিপদ, জীবন-মরণের সন্ধিক্ষণে মানুষ অত ঠান্ডা, অত স্বাভাবিক থাকতে পারে, না দেখলে তার কোনদিনই বিশ্বাস হতো না। আর সাহসের সাথে তার শক্তি ও বুদ্ধি না থাকলে দু’জনকে কুপোকাত করে তদের গাড়ি ছিনিয়ে সে এসে পড়তে পারল কেমন করে!
মেয়েটি চোখ আহমদ মুসার ওপর থেকে না নামিয়েই জিজ্ঞেস করল, ‘আপনি কে তা কিন্তু জানা হয়নি। আমার কথাই শুধু আমি বলেছি।’
আহমদ মুসা ঘরের লোহার দরজাটাকে ভালো করে পর্যবেক্ষণ করছিল। মেয়েটির কথা কানে গেলে মুখটা ঘুরিযৈ মুহুর্তকাল মেয়েটির দিকে চেয়ে ইশারায় জিজ্ঞাস করতে নিষেধ করল।
মেয়েটি বিস্মিত হলো। কিছু বলতে যাচ্ছিল। কিন্তু আহমদ মুসা তাকে কথা বলতে না দিয়ে বলল, ‘চিন্তার কিছু নেই, আমাদের সব কথা ওরা শুনতে পাচ্ছে, কিছু চাইলে ওরা সংগে সংগেই জানতে পারবে।’
মেয়েটি ব্যাপারটা এবার বুঝতে পেরেছে। হাসল। আহমদ মুসা তার পরিচয় ক্লু-ক্ল্যাক্স-ক্ল্যানকে জানাতে চায় না বলেই তা না জিজ্ঞেস করার জন্যে ঐভাবে ইংগিত করল। কিন্তু এটা বুঝতে পেরে মেয়েটির ঔৎসুক্য আরও বেড়ে গেল। লোকটির এমন কি পরিচয় আছে যা ক্লু-ক্ল্যাক্স-ক্ল্যানকে জানানো যাবে না? মেয়েটির মনে পড়ল লোকটির নামটিও তো জানা হয়নি এবং তার নামও তো লোকটি এখনও জানে না।
মেয়েটি বলল, ‘আমরা কেউ কারো নামও তো জানি না।’
‘আপনি ঐ খাটিয়ায় গিয়ে বিশ্রাম নিন!’ মেয়েটির কথার দিকে কান না দিয়ে বলল আহমদ মুসা।
মেয়েটির মুখটি এবার মলিন হয়ে উঠল।
মেয়েটি ক্ষুণ্ণ হয়েছে বুঝতে পেরে আহমদ মুসা নরম সান্তবনার সুরে বলল, ‘যাও বোন! বিশ্রাম নাও, সামনে অনেক কথা বলার সময় হবে।’ আহমদ মুসার কথায় মেয়েটির মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। সে বসে বসে অনেক কষ্টে খাটিয়ার দিকে এগোলো।
আহমদ মুসা সবে কাত হয়েছে মেঝের ওপর। এই সময় কক্ষের দরজা খোলার শব্দ হলো। আহমদ মুসা শুয়েই থাকল, উঠল না।
খুলে গেল দরজা।
সেই দীর্ঘকার লোকটি ঘরে প্রবেশ করতে করতে বলল, ‘সুন্দর, সজ্জিত ঘরে তোমার হানিমুনটা কেমন লাগল? তোমার জন্যে দুঃসংবাদ, বিদেশি! সামনে কথা বলার অনেক সময় তোমরা পাবে না। কালকে সকালেই বাস্ক-নন্দিনী মারিয়া ফিলিপ যাচ্ছে আরও বড় জায়গায়, আর তোমাকেও যেতে হবে রাজধানী থেকে দূরে আরও একটু নিরিবিলি জায়গায়।’
লোকটির পেছন পেছন দু’জন প্রহরী এবং আরও একজন লোক ট্রলি করে খাবার নিয়ে প্রবেশ করল!
লোকটি কথা শেষ করেই পেছন ফিরে প্রহরীদের লক্ষ্য করে বলল, ‘ওদের হাত দুলে দে, খেয়ে নিক।’
আহমদ মুসা ও মারিয়া ফিলিপের হাত খুলে দিল প্রহরী এসে। পা তাদের বাঁধাই থাকল।
মারিয়া খাটিয়ায় বসে এবং আহমদ মুসা মেঝেতে বসে খেয়ে নিল।
আহমদ মুসারা যখন খাচ্ছিল, তখন দীর্ঘকার লোকটি বলল, ‘দেখো বিদেশি! ক্লু-ক্ল্যাক্স-ক্ল্যানের অনেক বদনাম আছে, কিন্তু পেটে খেলে পিঠে সয়-’ এ নিয়ম ক্লু-ক্ল্যাক্স-ক্ল্যান মেনে চলে।’
‘কেন পিঠে আমাদের কিছু সইতে হবে নাকি?’ বলল আহমদ মুসা।
‘তোমার পরিচয় তুমি বলনি, এমন কি মারিয়াকেও বললে না, তোমার কপালে দুঃখ আছে। কাল টের পাবে বসের কাছে গেলে। আর উনি তো আমাদের বড় মেহমান।’
‘তিন কোটি টাকা দামের মেহমান, তাই না?’
‘তুমি সব জেনেছ মারিয়ার কাছ থেকে, কিন্তু জানাটা তোমার জন্যে কাল হলো। কেউ এভাবে ক্লু-ক্ল্যাক্স-ক্ল্যানের ভেতরে ঢোকার পর আর প্রাণ নিয়ে ফিরে যেতে পারে না।’
‘ফিরে, যেতে পারা না পারা সবটাই কি তোমাদের হাতে?’
‘কেন, তোমার সন্দেহ আছে এতে? বের হবার একবার চেষ্টাই করো না, হয় কুকুরের মতো গুলী খেয়ে মরবে, না হয় বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়েও প্রাণ দিতে পার। আর বন্দীখানা থেকে এ পর্যন্ত কেউ বেরুতেই পারেনি। তোমার মতো একশ’জনও এ দরজা ভাঙ্গতে পারবে না। আর খুলতে পারলেও কোন লাভ হবে না। চৌকাঠের কব্জার ওপর কোন প্রকার চাপ পড়ালেই চারদিকে এলার্ম বেজে উঠবে।’ গর্বের সাথে কথাগুলো বলল লোকটি। আহমদ মুসা গ্রোগ্রাসে কথাগুলো গিলল।
খাওয়া শেষ হলে পরিবশেনকারী লোকটি বাসনপত্র গুছিয়ে নিয়ে ট্রলি ঠেলে বেরিয়ে গেল।
আহমদ মুসা ও মারিয়ার হাত আবার শক্ত করে বাঁধা হলো।
দীর্ঘকায় লোকটি বলল, ‘আমরা দুঃখিত! বাথরুম ব্যবহার করতে তোমাদের একটু অসুবিধা হবে, এ শেষ মধুযামিনীটাও তোমাদের জন্য আরামদায়ক হবে না। কিন্তু কি করব? আমরা ক্লু-ক্ল্যাক্স-ক্ল্যানের বন্দীখানার এটাই যে নিয়ম।’
‘হাত পা খোলা রাখলে ক্ষতি কি ছিল, ঘরের সব কিছু তো তোমরা দেখতেই পাচ্ছ!’ বলল আহমদ মুসা।
’না, বন্দীখানায় আমরা টিভি ক্যামেরা ফিট করিনি। কি দরকার ঝামেলা বাড়িয়ে, বেঁধে ফেলে রাখব সবদিক দিয়ে সেই ভালো।’
আহমদ মুসা ও মারিয়ার হাত বেঁধে ফেলার পর প্রহরীরা গিয়ে দরজায় দাঁড়িয়েছিল।
লোকটি কথা শেষ করে দরজার দিকে এগোতে এগোতে বলল, ‘শুভরাত্রি।’
‘শুভরাত্রি!’ আহমদ মুসা বলল। তার ঠোঁটের কোণ হাসি।
দরজা বন্ধ হয়ে গেল। ওদের পায়ের শব্দও মিলিয়ে গেল।
মাথা নিচু করে কিছুক্ষণ ভাবল আহমদ মুসা।
তারপর দেয়াল ঘড়িটার দিকে তাকাল। দেখল রাত দশটা।
আহমদ মুসা মারিয়ার দিকে চেয়ে বলল, ‘আপনি শুয়ে পড়ুন। এখন একটু বিশ্রাম খুব জরুরী।’
মেয়েটি বাঁধা গা দু’টি তুলে খাটিয়ার ওপর বসেছিল। তাকিয়েছিল আহমদ মুসার দিকেই। বলল,’ আমাকে আপনি না বললে খুব খুশি হবো।’
তারপর একটু থেকে আবার বলল, ‘একটা কম্বল আপনি নিন। কিন্তু কিভাবে দেব?’
‘দরকার নেই, আমি ঘুমুচ্ছিনা।’
‘ঘুমাবেন না, কেন?’
‘এমন অবস্থায় আমার ঘুম আসে না।’ বলে আহমদ মুসা মেয়েটির দিকে তাকিয়ে চোখ ও মুখ নেড়ে ইশারা করল কথা না বলার জন্যে।
মারিয়া ইশারা বুঝল। আর কোন কথা সে বলল না।
আহমদ মুসা আগেই ঠিক করে ফেলেছে, যেমন করে হোক, আজকেই পালাতে হবে। মেয়েটিকে অন্যত্র সরালে তাকে উদ্ধার করা কঠিন হবে।
আহমদ মুসা নিজের বাঁধন খোলার দিকেই প্রথম মনোযোগ দিল।
হাত পা এমন শক্ত করে বাঁধা যে, জুতার মোজা থেকে ছুরিটা বের করে নেওয়াও অসম্ভব। হাত পিছমোড়া করে বাঁধা থাকায় তা কোনই কাজে আসছে না। বাম জুতার গোড়ালির একটা অংশে চাপ দিলেই তা খাঁজ থেকে উঠে আসবে। বেরিয়ে পড়বে একটা ছোট্ট কুঠুরি। ওখানেই লুকানো আছে বহু কাজের উপযোগী সুইডিশ একটা ছুরি।
আহমদ মুসা বহু চেষ্টা করেও জুতার গোড়ালিকে হাত কিংবা মুখের কাছে আনতে পারল না। কপালে কিছু ঘাম জমেছে তার।
হঠাৎ তার মনে পড়ল, সে তো চেষ্টা করলে জুতা খুলে ফেলতে পারে। এরপর আহমদ মুসা জুতা ঢিলা করার কসরত শুরু করল। কিছুক্ষন চেষ্টার পর বেশ ঢিলা হলো।
আহমদ মুসা গড়িয়ে গড়িয়ে খাটিয়ার কাছে গেল।
মারিয়া ফিলিপ বসে বসে অবাক চোখে আহমদ মুসার কাজ দেখছিল। আহমদ মুসাকে খাটিয়ার দিকে এগিয়ে আসতে দেখে বুঝল, সে খাটিয়ার ধারাল প্রান্তে বাঁধিয়ে জুতা খুলতে চায়। মারিয়া আহমদ মুসাকে ইশারা করল পা তার দিকে এগিয়ে আনার জন্য।
আহমদ মুসা পা দু’টি তার দিকে এগিয়ে দিল। মারিয়া খাটিয়া থেকে আহমদ মুসার পায়ের কাছে পেছন দিকে ফিরে বসল। কিন্তু পরক্ষনেই আবার ঘুরে বসে ইশারায় জানতে চাইল কোন জুতা। আহমদ মুসা বাম জুতার দিকে ইংগিত করল।
মারিয়া আবার পেছন ফিরে ঘুরে বসে বাঁধা দু’হাত দিয়ে বাম জুতাটি খুঁজে নিয়ে ফিতা খুলে জুতাটি খুলে ফেলল।
মারিয়া জুতা খুলে খাটিয়ায় উঠে বসতে যাচ্ছিল। আহমদ মুসা তাকে নিষেধ করল। তারপর গড়িয়ে জুতার কাছে গিয়ে পিছমোড়া করে বাঁধা দু’টি হাত দিয়ে জুতা টেনে নিল এবং নিমিষেই জুতার গোড়ালি থেকে ছুরি বের করে আনল।
মারিয়া এবার ব্যাপারটা বুঝতে পারল। তার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল।
এরপর আহমদ মুসা ছুরি হাতে নিয়ে পিছু ফিরে মারিয়ার বাঁধা হাতের কাছে পৌছল এবং মারিয়ার হাতের বাঁধন পরীক্ষা করে সাবধানে তা কেটে দিল।
হাত মুক্ত হতেই মারিয়া ঘুরে বসে আহমদ মুসার হাত থেকে ছুরি নিয়ে তার হাতের বাঁধন কেটে দিল।
হাত পায়ের বাঁধন কেটে দু’জনেই মুক্ত হয়ে গেল।
মুক্ত হবার পর মারিয়া ফিলিপ নিরবে মাথা ঝঁকিয়ে আহমদ মুসার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাল। তারপর সটান শুয়ে পড়ল খাটিয়ায়। তার চোখ মুখে ভীষণ ক্লান্তি।
আহমদ মুসা বিড়ালের মতো ধীর পায়ে বাথরুমে ঢুকল, অজু করার জন্যে। আসর ও মাগরিব নামায তার কাজা হয়ে আছে। এশার সময়ও যাচ্ছে। বের হবার চিন্তা করার আগে নামাযগুলো পড়ে নিতে হবে।
আহমদ মুসা অজু করে এসে নামাজে দাঁড়াল, ঘরের যে প্রান্তে খাটিয়া আছে সে দিকটাই পশ্চিম।
উত্তর- দক্ষিণে পেতে রাখা খাটিয়ার দক্ষিণ পাশে মেঝের অনেকখানি জায়গা খালি আছে। আহমদ মুসা সেখানেই নামাজ দাঁড়াল।
মারিয়া ফিলিপ উত্তর দিকে মাথা কাত করে শুয়ে থেকেই আহমদ মুসার ওঠা-বসা সব দেখতে পাচ্ছে। মারিয়া মুসলমানদের নামাজের কথা শুনেছে, কিন্তু কোনদিন দেখেনে। সে আগ্রহ ও কৌতুহলের সাথে একদৃষ্টে আহমদ মুসার দিকে তাকিয়ে আছে।
নামাজ দেখে চমৎকৃত হলো মারিয়া। প্রার্থনা এত সুন্দর হতে পারে! প্রার্থনায় এমন মগ্নতা, চেহারায় তার অমন অপরূপ অভিব্যক্তি তার কাছে বিস্ময়কর! প্রায় নিয়মিতই সে গীর্জায় যায়। কিন্তু প্রার্থনা যে এমন হতে পারে তা সে কল্পনাও করেনি কখনও। স্বর্গীয় অভিব্যক্তির কথা সে পুস্তকে পড়েছে, কিন্তু মনে হচ্ছে তার একটা বাস্তব ঝিলিক সে দেখল। নামাজ শেষ করে আহমদ মুসা গোটা ঘরটা ঘুরে একবার দেখল। তারপর সামনে দাঁড়িয়ে পকেট থেকে ছুরি বের করল, ছুরির অগ্রভাগটা দরজায় ঠেকিয়ে পরীক্ষা করল দরজায় বিদ্যুৎ প্রবাহ আছে কিনা। কিন্তু ছুরির বাঁটের গোড়ায় ছোট স্বচ্ছ কেবিনটিতে কোন আলো জ্বলল না। আহমদ মুসা নিশ্চিত হলো, অন্তত এ দরজাকে তারা বিদ্যুতায়িত করেনি। আহমদ মুসা ভাবল, এ দরজার পরেই করিডোর এবং এ দরজার পড় আর দু’দরজা পরেই ভূ-গর্ভ থেকে ওপরে ওঠার সিঁড়ি। এখানে সিঁড়ি মুখে আসার সময় দু’জন প্রহরীকে দেখে এসছে। এরপর বাইরের গেট পর্যন্ত আর কোন প্রহরীকে দেখেনি।
আহমদ মুসা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে। দরজা থেকে ঘুরে দাঁড়াল আহমদ মুসা।
মারিয়া ফিলিপ শুয়ে থেকে বিস্মিত দৃষ্টিতে আহমদ মুসার কাজ দেখছিল। সে বুঝতে পারল এসব বের হবার চিন্তা খুশি হলো মারিয়া। কিন্তু পরক্ষনেই খুশি উবে গেল। হাজার চেষ্টা করলেও এ ভু-গর্ভস্থ কক্ষ থেকে বের হবার পথ সে দেখছে না। লোহার দরজা খুলবে কি করে? আর খুললেও কি হবে। দরজার কব্জার সাথেই তো এলার্ম আছে।
মারিয়ার চিন্তায় ছেদ পড়ল আহমদ মুসাকে তার দিকে আসতে দেখে। আহমদ মুসার দৃষ্টিটা নিম্নমুখী। মারিয়া বিস্মিত হলো, আহমদ মুসা কোন সময়ই তার দিকে চাইছে না।
কয়েকবার ইশারায় কথা বলার সময় মুহুর্তের জন্যে তার চোখের ওপর চোখ ফেলেছে, কিন্তু তা মুহুর্তের জন্যেই। আর ওর দৃষ্টিটা কত পবিত্র! সে মেয়ে মানুষ, ছেলেদের দৃষ্টি সে বহু দেখেছে, সব সে বোঝে। আর এমন একটা পরিবেশে কি হতে পারে তা সে জানে। এ কেমন অদ্ভুত মানুষ! এমন মানুষও এই দুনিয়ায় আছে! মুসলমাদের উন্নত নৈতিকতার কথা সে শুনেছে কিন্তু আবার সেই সাথে মুসলিম দেশে মুসলমানদের মধ্যে হাজারো জঘন্য অপরাধ সংঘটনের কথাও পড়েছে।
আহমদ মুসা নত মুখে মারিয়ার কাছে এগিয়ে আসছে। একদম কাছে এসে মুহুর্তের জন্যে চোখ তুলে ঠোঁটে আঙুল ঠেকিয়ে একটু ঝুঁকে পড়ে ফিসফিসিয়ে বলল, ‘এখন বারটা, আমরা রাত দু’টায় বের হবার চেষ্টা করব। তুমি একটু ঘুমিয়ে নাও।’
বলে কোন কথা শোনার অপেক্ষা না করে সরে গেল আহমদ মুসা। ঘরের এক কোণায় গিয়ে বসে পড়ল। মাথাটা দেয়ালের সাথে হেলান দেয়া। চোখ বন্ধ।
মারিয়া ইচ্ছা করেও এই বিস্ময়কর লোকটির থেকে তার চোখ ফেরাতে পারল না, মারিয়ার হৃদয়ে তোলপাড়, তার বিশ বছরের জীবনে সুন্দর পোশাক, শিক্ষার অহংকার আর ভদ্র আচরণের যাদের দেখেছে তারা এর তুলায় পশুর চেয়ে বড় কিছু নয়।
ঠিক রাত দু’টায় আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল।
উঠে বসেই চিৎকার শুরু করল, ‘কে কোথায় আছ, তৃষ্ণা, তৃষ্ণ পানি চাই, পানি।’
একবার, দু’বার নয়। চিৎকার করেই চলল আহমদ মুসা। প্রথমটায় ঘাবড়ে গিয়েছিল মারিয়া। উদ্বেগে চোখ বড় বড় হয়ে উঠেছিল তার। সাংঘাতিক কিছু হলো নাকি লোকটির! কিন্তু কয়েক মুহুর্তের মধ্যেই আহমদ মুসার চেহারা দেখে সব ব্যাপারটা বুঝতে পারল।
কিছুক্ষণ চিৎকার চলার পর একটা কন্ঠ ভেসে এলো, ‘জানান্নামে যাও, রাত দুপুরে জ্বালাতন। থাম, যাচ্ছে পানি।’ ছাদের মাঝখান থেকে কথাগুলো ভেসে এলো। গোপন মাইক্রোফোনটি ওখানেই আছে বুঝা গেল।
আহমদ মুসা থামল। থেমেই বিড়ালের মতো নিঃশব্দে ছুটল দরজার দিকে। মারিয়াকেও দরজার দিকে আসতে ইংগিত করল। মারিয়াও ছুটে এলো।
দরজার পাল্লা ভেতর দিকে খোলার সিস্টেম। খোলার পর দরজার পাল্লা দেয়ালের যেখানে এসে দাঁড়ায়, আহমদ মুসা মারিয়াকে ঠিক সে স্থানে দেয়াল সেঁটে দাঁড় করিয়ে দিল। নিজে দরজায় গিয়ে দাঁড়াল। উৎকর্ণ হয়ে শুনতে লাগল কোন পায়ের শব্দ আসছে কি না।
মারিয়া এতক্ষণে কি ঘটতে যাচ্ছে বুঝতে পারছে। ওর খালি হাত। খালি হাতে একা বন্দুকধারীদের সাথে কি করে পারবে? ভয়ে তার মুখ পাংশু হয়ে উঠল। হার্টের স্পন্দন দ্রুত হলো।
বাইরে বুটের শব্দ পাওয়া গেল। আহমদ মুসা খেয়াল করে শুনে বুঝল, দু’জন লোক আসছে। দরজার তালায় চাবি লাগানোর শব্দ হলো।
মারিয়া মুখ বাড়িয়ে দেখল, আহমদ মুসা দরজার ভেতর থেকে তালা লাগানোর যে দু’টো রিং দু’পাশের পাল্লায় আছে তা শক্ত করে ধরে দাঁড়িয়ে আছে।
আঁৎকে উঠল মারিয়া। দরজা খুললেই তো সে গুলীর মুখে পড়ে যাবে! ওর কি মাথা খারাপ হয়ে গেল? মারিয়া হাত বাড়াল তাকে টেনে আনতে। ঠিক তখনই সশব্দে দরজার হুক খোলার শব্দ হলো, আর সেই সংগে … …। মারিয়া হাত টেনে চোখ বন্ধ করল।
আহমদ মুসা দু’পাশে দু’টি রিং ধরে তার সমস্ত মনোযোগ বাইরের হুক খোলার দিকে নিবদ্ধ করে দঁড়িয়েছিল। তার শরীরের প্রতিটি পেশী শক্ত হয়ে উঠেছে, প্রতিটি স্নায়ুতন্ত্রীতে অদম্য শক্তির এক শিহরণ।
আহমদ মুসা যখন বুঝল হুক খোলা এখন কমপ্লিট, তখনই দু’হাতে হ্যাঁচকা টানে দরজার পাল্লা খুলে ফেলল এবং ঝাঁপিয়ে পড়ে সামনের লোকটির হাত থেকে পিস্তল কেড়ে নিল। লোটির বাম হাতে রিভলবার ছিল, ডান হাত দিয়ে দরজার হুক খুলছিল।
আহমদ মুসা রিভলবার কেড়ে নিয়ে সংগে সংগেই রিভলবারের নলটি লোকটির বুকে চেপে ধরে ট্রিগাঁর টিপল। সাইলেন্সার চাপা বিস্ফোরণের মতো একটা শব্দের কম্পন উঠল শুধু। লোকটি কাটা কলাগাছের মতো উল্টে পড়ে গেল। লোকটির সাথের লোকটি একেবারে পেছনেই দাঁড়িয়েছিল। তার এক হাতে ছিল পানির জগ, অন্য হাতে রিভলবার। লোকটির চোখের ছানাবড়া ভাব কেটে যাওয়ার আগেই আহমদ মুসার রিভলবারের নল লোকটির বুক স্পর্শ করল।
ভয়ে লোকটির চোখ বেরিয়ে আসার দশা হলো। মুখ তার হাঁ হয়ে গেছে। কন্ঠ থেকে কোন শব্দ বেরুল না। হাত থেকে তার রিভলবার ও পানির জগ পড়ে গেল।
তার বুকে রিভলবার ধরে রেখেই ফিসফিসিয়ে বলল, ‘জামা খুলে ফেল।’
লোকটি সংগে সংগে যন্ত্রের মতো আদেশ পালন করল।
আহমদ মুসা তাকে শুয়ে পড়তে বলল। সে শুয়ে পড়লে তার জামা দলা পাকিয়ে তার মুখে ঢুকিয়ে দিল। তারপর পেছন ফিরে দেখল, মারিয়া দরজায় ভয়ে কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
আহমদ মুসা ইশারা করে তাকে কাছে ডেকে ফিসফিসিয়ে বলল, ‘বাঁধার দড়িগুলো নিয়ে এসো।’
মারিয়া ঘরের ভেতর থেকে দড়িগুলো এনে দিলে লোকটিকে পিছমোড়া করে বাঁধল। তারপর তাকে ঘরের মধ্যে ঠেলে দিয়ে ঘরে তালা লাগিয়ে দিল।’
দ্বিতীয় লোকটির রিভলবার করিডোর থেকে তুলে নিয়ে মারিয়ার হাতে তুলে দিতে দিতে বলল, ‘তুমি তো সাহসী মেয়ে, সেদিন একাই তো এদের তিনজনকে প্রায় কুপোকাত করে ফেলেছিলে!’
মারিয়ার কারাত ও কুংফু’র ট্রেনিং আছে। সে সাহসীও বটে, কিন্তু সে সাহস এই অবস্থার জন্যে নয়। সে আহমদ মুসার হাত থেকে রিভলবারটি হাতে নিতে নিতে বলল, ‘আমি আপনার কাছ থেকে অন্তত পালাব না।’
‘ধন্যবাদ বোন’ বলে আহমদ মুসা ছুটল ভূগর্ভ থেকে উঠবার সিঁড়ির দিকে। ছায়ার মতো তার পেছনে পেছনে মারিয়া।
সিঁড়ির মুখে প্রহরীর বসার জায়গা দু’টি খালি। আহমদ মুসা ভাবল এরাই তার ঘরে পানি নিয়ে গিয়েছিল। অনেকটা নিঃশঙ্ক চিত্তে তর তর করে উঠল সিঁড়ি দিয়ে। শেষ ধাপে উঠে দাঁড়িয়ে ডান দিকে ঘুরেই মুখোমুখি হয়ে গেল দু’জনের। আকস্মিকতায় আহমদ মুসা যেমন অপ্রস্তুত হয়ে পড়েছে, তেমনি ওরা দু’জনও। কিন্তু তা মুহূর্তের জন্যে। আহমদ মুসা প্রস্তুত হয়ে পিস্তল তুরে ধরার আগেই ওরা দু’জন এক সাথে ঝাঁপিয়ে পড়ল আহমদ মুসার ওপর।
আহমদ মুসা ত্বরিত একটু পিছু হটে পড়ে যাওয়া থেকে রক্ষা পেল। কিন্তু হাত থেকে পিস্তলটা ছিটকে পড়ে গেল এবং শক্ত একটা ঘুষি খেল সেই আহত নাকটার ওপর আবার।
ওদের একজন ভারসাম্য রাখতে না পেরে সিঁড়ির ঠিক মুখের ওপরই পড়ে গিয়েছিল। তার দ্বিতীয় প্রবল আর একটা ঘুষি ছুটে আসছিল তার সেই নাক লক্ষ্যে।
আহমদ মুসার নাক ফেটে আবার রক্ত নামছিল। নাক লক্ষ্য করে আসা দ্বিতীয় ঘুষিটাকে সত্যিই ভয় পেল আহমদ মুসা। সে বিদ্যুৎ গতিতে একটু নিচু হয়ে দু’হাত দিয়ে অদ্ভুত ক্ষিপ্রতার সাথে লোকটার ঘুষি বাগানো হাতের কব্জিটা ধরে প্রবল বেগে চরকির মতো একটা ঘুরপাক খেল। মট করে একটা হাড় ভাঙ্গার অথবা কনুইয়ের জয়েন্ট খুলে যাওয়ার শব্দ হলো। লোকটা ঘোড়ার মতো চিৎকার করে সটান মাটিতে পড়ে গেল। আর ওঠার নামটি করল না।
অন্যদিকে প্রথম লোকটি যে ভারসাম্য হারিয় সিঁড়ির মাথায় পড়ে গিয়েছিল, তার কপাটা শক্ত মেঝের সাথে ঠোকা খাওয়ায় মুহূর্তের জন্যে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছিল। নিজেকে সামলে নেবার পর সে উঠে দাঁড়িয়ে দ্বিতীয়বার আহমদ মুসার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে যাচ্ছিল। তখন আহমদ মুসা দ্বিতীয় লোকটিকে কুপোকাত করে পুরোপুরি উঠে দাঁড়াতে পারেনি। মারিয়া সিঁড়ির মুখেই দাঁড়িয়েছিল, লোকটি এদিকে লক্ষ্যই করেনি। লোকটি আহমদ মুসার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্যে বাম পায়ের ওপর দেহের চাপটা ছুঁড়ে দিয়ে ডান পা’টা একটু শূন্যে তুলে দিল। মারিয়া ঝাঁপিয়ে পড়ে তার সে আগলা পা’টা ধরে হ্যাঁচকা একটা টান দিল। লোকটি মুখ থুবড়ে পড়ে গেল কিন্তু আবার মাথা তোলার চেষ্টা করছিল সে। মারিয়া একটু ঝুকে পড়ে দু’হাতের একটা জোড় কারাত চালাল লোকটির ঘাড়ে। লোকটির মাথা স্থির হয়ে খসে পড়ল মাটিতে।
আহমদ মুসা ততক্ষণে উঠে দাঁড়িয়ে বিভলবারটা কুড়িয়ে নিয়েছে। মারিয়ার দিকে ঘুরে দাঁড়াল। তারপর ‘ধন্যবাদ এসো’ বলে ছুটল করিডোর ধরে পূর্বদিকে। আহমদ মুসার, মনে পড়ছে এ পথ দিয়েই তাদেরকে ভূ-গর্ভস্থ কক্ষে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।
করিডোরটি পূর্বদিকে শেষ প্রান্তে পৌছে দক্ষিণ দিকে ঘুরে গেছে। তার পরেই বেরুবার গেট। যেখানে করিডোরটি দক্ষিণ দিকে বেঁকে গেছে সেখান দিয়ে দোতালায় ওঠার সিঁড়ি। আহমদ মুসারা যখন সিঁড়ির মুখের কাছাকাছি পৌঁছে গেছে সে সময় তারা সিঁড়িতে পায়ের শব্দ পেল। ডান পাশেই একটা দরজা বন্ধ। আহমদ মুসা থমকে দাঁড়িয়ে ধীরে ধীরে চাপ দিলে নব ঘুরে গেল, খুলে গেল দরজা।
আহমদ মুসা মারিয়ার হাত ধরে টেনে দ্রুত ঘরের ভেতরে ঢুকে গেল। দরড়া পুরোপুরি বন্ধ কলল না, ঈষৎ ফাঁক রেখে সেখানে চোখ লাগিয়ে রাখল।
সিঁড়ি থেকে নেমে দু’জন লোক করিডোর দিয়ে দ্রুত পশ্চিম দিকে এগোচ্ছিল। একজন উদ্বিগ্ন কন্ঠে বলছিল, ‘বন্দীখানায় নিশ্চয় কিছু ঘটেছে, কারো কোন কথা নেই!’
ওরা দরজা পার হয়ে যেতেই আহমদ মুসা দরজা খুলে কক্ষ থেকে বেরিয়ে গেটের দিকে ছুটল।
দক্ষিণ দিকে বাঁকে ঘুরে আহমদ মুসা থমকে দাঁড়াল। মারিয়ার দিকে ফিরে বলল, ‘তুমি রিভলবার নিয়ে করিডোর ও সিঁড়ি পাহারা দাও। ওরা দু’জন শীঘ্রই ফিরবে। ওরা ফিরলে আমাকে ইংগিত দিও।’
বলে আহমদ মুসা দ্রুত লোহার মজবুত গেটের দিকে এগোলো। দরজায় তালা লাগানো আছে, আবার হুড়কোও। আহমদ মুসা দরজায় হাত দিতে গিয়েও আঁৎকে উঠে দু’পা পিছিয়ে এলো। মনে পড়ল সে দীর্ঘকায় লোকটির হুশিয়ারী ‘পালাতে গিয়ে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মরবে!’ গেটটা তো বিদ্যুতায়িত হতে পারে। আহমদ মুসা দ্রুত পকেট থেকে ছুরি বের করে তার অগ্রভাগ দিয়ে দরজা স্পর্শ করল। জ্বলে উঠল ছুরির বাঁটের বিশেষ কক্ষটি। হতাশ হয়ে আহমদ মুসা তাকাল দরজার চারপাশে কোথাও কোন গোপন সুইচ আছে কি না। না, নেই।
গেট প্যাসেজের পশ্চিম পাশের দেয়ালে আহমদ মুসা দেখল বিরাট একটা সুইছ বোর্ড। বোর্ডের মিটার বক্স ও মেইন সুইচের সারি। আহমদ মুসার চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। দ্রুত সে মারিয়াকে কাছে ডাকল। মারিয়া এলে বলল, ‘আমি গেটে গিয়ে দাঁড়ালে তুমি সব মেইন সুইচ অফ করে দেবে।’ দ্রুত আহমদ মুসা গেটে চলে গেল।
খটাখট সব মেইন সুইচ অফ করে দিল মারিয়া। আহমদ মুসা তার ছুরির অগ্রভাগ লোহার দরজায় স্পর্শ করল। মারিয়ার শেষ সুইচ অফ করার সাথে সাথে ছুরির বাঁট সংলগ্ন বিশেষ কেবিনটির আলো নিভে গেল অর্থাৎ গেট এখন আর বিদ্যুতায়িত নেই।
চারদিক তখন অন্ধকারে ডুবে গেছে। সম্ভবত বাড়িটির সব আলোই নিভে গেছে।
আহমদ মুসা মারিয়াকে গেটে আসার জন্যে নির্দেশ দিয়ে গেটের লোহার হুড়কোটি খুলে ফেলল। তারপর গেটের তালা ভালো করে দেখে নিয়ে রিভলবারের নল তাতে সেট করে গুলী করল। ভেঙে পড়ে গেল তালা। দ্রুত হুক খুলে ফেলল আহমদ মুসা। টান দিয়ে খুলে ফেলল দরজা।
করিডোরে এই সময় গুলীর শব্দ পাওয়া গেল। কে যেন করিডোর দিয়ে গুলী করতে করতে ছুটে আসছে।
আহমদ মুসা মারিয়াকে বাইরে ঠেলে দিয়ে নিজে বাইরে ছিটকে বেরিয়ে এলো এবং সংগে সংগে বাইরে থেকে গেটের দরজা ধড়াস করে বন্ধ করে দিয়ে বাইরে থেকে হুক লাগিয়ে দিল। এই সময় গেট রুমে গুলীর শব্দ পাওয়া গেল। কয়েকটি গুলী দরজার গায়েও শব্দ তুলল।
গেটের পরে বেশ বড় লন। তারপর বাইরের গেট। গেটে পাহারার কোন ব্যবস্থা আহমদ মুসা ঢোকার সময় দেখেনি। তবে গেটে তালা দেয়া থাকতে পারে। লনও অন্ধকারে ডুবে গেছে। তবে অন্ধকারটা ভেতরের মতো অত গাড় নয়।
বাইরে থেকে গেটের হুক বন্ধ করেই আহমদ মুসা মারিয়াকে বলল, ‘যতটা পার মাথা নিচু করে গেটের দিকে ছুটতে থাক। এবার ওপর থেকে লনে গুলী আসতে পারে।’
এলোও ঠিক। দোতলার জানালা দিয়ে স্টেনগান থেকে বৃষ্টির মতো গুলী নেমে এলো লনে। কিন্তু ততক্ষনে আহমদ মুসারা গেটে পৌছে গেছে। গেট টপকে তারা ছুটে বেশ খানিকটা জায়গা পাড়ি দিয়ে রাস্তায় গিয়ে উঠল।
কিন্তু রাস্তায় উঠেই মারিয়া আহমদ মুসাকে টেনে একটা অন্ধকার গলিতে নিয়ে এলো।
পকেট থেকে রুমাল বের করল মারিয়া।
আহমদ মুসা অবাক হয়েছিল। এখন বুঝতে পারল, আহত নাকের রক্তে মুখটা তার ঢেকে আছে, যা মানুষের মনে কৌতুহল বা সন্দেহ সৃষ্টি করতে পারে।
রুমালশুদ্ধ মারিয়ার হাত আহমদ মুসার মুখের দিকে এগিয়ে আসছিল।
‘ধন্যবাদ, মারিয়া’ বলে আহমদ মুসা তার হাত থেকে রুমাল নিয়ে নিজের মুখ পরিষ্কার করতে লাগল।
মারিয়া একটা হোঁচট খেল। সে বুঝল, মারিয় মুখের রক্ত মুছে দিক, এট আহমদ মুসা চায় না। যে স্বাভাবিক সেবাটুকু এই অবস্থায় সকলেরই স্বাগত জানানোর কথা, তাও সে করল না।
মুখ থেকে রক্ত মুছে ফেলার পর আহমদ মুসা ও মারিয়া আবার ফিরে এলো রাস্তায় এবং সংগে সংগে একটা ট্যাক্সি ডেকে ওরা উঠে বসল।