১২. কর্ডোভার অশ্রু

চ্যাপ্টার

‘মা, টেলিফোনটা একটু দেবে?’
দুর্বল কন্ঠে তার আম্মাকে উদ্দেশ্য করে বলল জেন। তার মা তখন কি কাজে জেনের ঘরে এসেছিল!
জেনের মা টেবিল থেকে কর্ডলেস টেলিফোনটা জেনের দিকে এগিয়ে দিতে দিতে বলর, ‘কথা বলতে তো তোর কষ্ট হচ্ছে। কোথায় টেলিফোন করবি?’
প্রবল জ্বরে বেহুশ অবস্থায় কয়েকটা দিন কেটেছে জেনের। জ্বর এখন নেই, কিন্তু ভীষণ দুর্বল। ক’দিনেই শুকিয়ে এতটুকু হয়ে গেছে জেন!
মায়ের প্রশ্নের উত্তরে জেন অস্ফুট কন্ঠে বলর, ‘ভালো লাগছে না, হান্নাকে একটা টেলিফোন করে দেখি।’
‘হান্না কয়েকবার টেলিফোন করেছিল তোর জ্বরের সময়।’
‘তাই?’ বলে জেন টেলিফোনের দিকে মনোযোগ দিল।
তার মা বের হয়ে গেল।
তার মা বেরিয়ে যেতেই ঘরে এসে ঢুকর হান্না।
আনন্দে চিৎকার করে উঠল জেন। বলল, ‘আমি তোকেই টেলিফোন করছিলাম। কী যে খুশি হলাম! সমগ্র অন্তর তোকেই চাচ্ছিল।’
‘আমাকেই চাচ্ছিল একথা কি ঠিক?’
‘আপাতত!’ মুখ লাল করে বলল জেন, ‘বল কেমন আছিস? ভালো?’
‘হ্যাঁ, জেন। তুই কেমন আছিস? জ্বর আছে?’
‘না, জ্বর নেই, কিন্তু উঠতে পারছি না।’
‘তা হবে। দারুণ ধকল গেছে তোর ওপর দিয়ে।’
‘ওদিকের খবর কি?’
‘আজও বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়েছিল? ডিপার্টমেন্টে এক বিরাট মিটিং হলো আজ।’
‘কি মিটিং?’
‘কি আবার, জোয়ানকে নিয়ে?’
‘জোয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়েছিল?’ জেনের কন্ঠে সজীব আনন্দের রেশ।
‘পাগল হয়েছিস! জোয়ানের বিরুদ্ধেই তো মিটিং।’
’কেমন?’
‘জোয়ানের সকল ডিগ্রি কেড়ে নেয়ার দাবি করে প্রস্তাব করা হয়েছে মিটিং-এ।’
‘কেন?’
‘জোয়ান তার পরিচয় গোপন করে বিশ্ববিদ্যালয়কে প্রতারণা করেছে বলে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে।’
‘কেন? মরিসকো হওয়া কি বেআইনি? রাষ্ট্রবিরোধী?’ জেনের কন্ঠে একরাশ ক্রোধ ঝরে পড়ল।
’শক্তি এখন আইনে জায়গায় জেন।’
‘হান্না, আমি তোকে ওর কথা জিজ্ঞেস করেছিলাম।’
‘জোয়ানের কথা?’ বলে হান্না একটা ঢোক গিলল, তারপর ধীর কন্ঠে বলল, ‘তোর সাথে সেদিন কথা বলার পর দু’বার ওর বাড়িতে গেছি। তুই অসুস্থ ছিলি, বলতে পারিনি সে সব কথা।’
‘ওর দেখা পেয়েছিলি, কথা হয়েছিল?’
‘বলছি,’ বলে শুরু কলল হান্না, ‘প্রথম দিন ওর দেখা পাইনি। দেখলাম জোয়ানের মা কাঁদছেন। আমাকে দেখেই জড়িযে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়লেন । বললেন, তোমরা জোয়ানকে বাঁচাও। ও যেন কেমন হয়ে যাচ্ছে। বলে আমাকে টানতে টানতে তিনি জোয়ানের ঘরে নিয়ে গেলেন। ঘরে গিয়ে জানালা দিয়ে স্তুপীকৃত পোড়া কাগজের ছাই দেখালেন। ছাই থেকে তখনও ধোঁয়া উঠছিল। আমি কিছু বুঝতে না পেরে জোয়ানের মার দিকে তাকালাম। তিনি আবার ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন। বললেন, জোয়ান তার শিক্ষা জীবনের সমস্ত সার্টিফিকেট, রেকর্ডপত্র ওখানে নিয়ে পুড়িয়ে ফেলেছে, শিক্ষা জীবনের কোন চিহ্নই সে..।’
‘আর বলিস না হান্না, আর বলিস না।’ বলে জেন কান্নায় ভেঙে পড়ল। বালিশে মুখ গুঁজল সে। কাঁদতে লাগল জেন।
হান্না কিছু না বলে জেনের মাথায় হাত বুলাতে লাগল।
কিছুক্ষণ পর মুখ তুলল জেন। অশ্রুধোয়া মুখ। বলল, ‘ওকে কি করে বাঁচাবে, ও বাঁচবে না, পাগল হয়ে যাবে।’
‘ও সবাইকে ভুল বুঝেছে জেন, তোকেও।’
‘কি হয়েছে হান্না, কিছু ঘটেছে?’
‘বলছি!’ বলে শুরু করল হান্না, ‘দ্বিতীয় বার জোয়ানের বাড়ি গিয়ে তার দেখা পেলাম। দেখলাম, জোয়ান তার টেবিরে বসে একমনে কি যেন করছে! ধীর পায়ে তার কাছে এগিয়ে গেলাম। দেখলাম, তার অত্যন্ত প্রিয় পারসোনাল নোট বুকটির পাতা একটি একটি করে ছিঁড়ে টুকুরো টুকরো করছে। আমি তার নোট বুকটি কেড়ে নিলাম। সে চমকে উঠে আমার দিকে তাকাল। অন্য সময় হলে হাসিতে তার মুখ ভরে যেত, কিন্তু তার মুখে এক কণা হাসিও ফুটে উঠতে দেখা গেল না। যেন অন্য এক জোয়ান। কিছুক্ষণ আমার দিকে চেয়ে থেকে শান্ত গম্ভীর কন্ঠে বলল, নোট বুকটা আমাকে দাও হান্না। আমি বললাম, না, মূল্যবান এ নোট বই আপনি ছিঁড়তে পারেন না। জোয়ানের মুখে একটা শুকনো হাসি ফুটে উঠল। বলল, আমি অতীত মুছে ফেলেছি। মরিসকো জোয়ানের সাথে এই অতীতের কোন সম্পর্ক নেই। আমি বললাম, মরিসকো কি এদেশে নেই? তুমি পাগলের মতো কাজ করছ কেন? জোয়ানের মুখে একখন্ড বিদ্রূপের হাসি ফুটে উঠল। বলল, তোমরা আমাকে পাগল করতে চেয়েছিলে, কিন্তু আমি পাগল হবো না। আমি বললাম, ‘তোমরা’ বলতে কাদের বুঝাচ্ছ, আমরা কি তোমার শত্রু? সে বলল, আমি কাউকে শত্রু ভাবি না, কিন্তু তোমরা আমাকে, আমার মতো মরিসকোকে ধ্বংস করতে চাও। আমি বললাম, এই ‘তোমরা’- এর মধ্যে আমাকে, জেনকেও কি ধরছ? জোয়ান কোন উত্তর দিল না। আমিই আবার বললাম, জান, জেন ভীষণ অসুস্থ? কোন উত্তর দিল না। শুধু চকিতে মুখ তুলে একবার চাইল। আমি বললাম আবার, জিজ্ঞেস কররে না, কি অসুখ, হঠাৎ করে কেন অসুখ? কোন উত্তর এলো না তার কাছ থেকে। আমিই কথা বললাম, উত্তর দিতে ভয় পাচ্ছ? তুমিই তার অসুখের কারন। কথা বলল সে। মুখ না তুলেই। বলল, একজন মরিসকো সম্পর্কে সুধারণা পোষণ করেতো, এই যন্ত্রণা তাকে পীড়া দিতেই পারে। সব ঠিক হয়ে যাবে হান্না। ওকে বলে দিও, যে জোয়ানের সাথে তার পরিচয় ছিল যে জোয়ান মাদ্রিদের সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটিতে পড়ত, সে জোয়ান আজ বেঁচে নেই। আজকের জোয়ান স্পেনের পদদলিত শ্রেণী মরিসকোদের সারিতে নেমে গেছে। আমি বললাম, জোয়ান, তুমি……!’
জেন তার ঠোঁট কামড়ে হান্নার কথা শুনছিল। বুঝাই যাচ্ছে, প্রাণপণে সে নিজেকে ধরে রাখতে চাচ্ছে। কিন্তু আর পারল না। সে দু’হাত দিয়ে মুখ ঢেকে কান্নায় ভেঙে পড়ল।
হান্না কথা থামিয়ে জেনের কাঁধে একটা হাত রেখে বলল. ‘তোকে এভাবে ভেঙে পড়লে চলবে না, শক্ত হতে হবে।’
‘না, আমি পারছি না। ও এভাবে শেষ হয়ে যাবে কেন?’ বলর জেন।
জেন থামতেই হান্না বলল, ‘আমার কিন্তু মনে হয়েছে, নতুন বাস্তবতা জোয়ান মেনে নিয়েছে। আমি তাকে বললাম, তুমি তোমার ওপর জুলুম করছ, এভাবে তুমি তোমাকে শেষ করে দিচ্ছ! সে তখন আমার দিকে অত্যন্ত স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, ’আমি আমার পরিচয় নিয়ে লজ্জিত নই হান্না, আমি গর্বিত। মনে হচ্ছে, আমার এই গর্ব এত বড় যে, আমি গোটা পৃথিবীর বিরুদ্ধে একা দাঁড়াতে পারি। এই সময় তার চোখে যে আলো আমি দেখেছি, তা কোনদিন আর দেখিনে।’
জেন ঠোঁট কামড়ে কান্না চেপে ধীরে ধীরে বলর, ‘হান্না, তুমি ভুল করছ, এই কথাগুলো তার সুস্থ মনের নয়। এর মধ্যে প্রবল ক্ষোভ, প্রচন্ড অভিমান তাড়িত বিদ্রোহের একটি সুর আছে যা তার আরো ক্ষতি করবে, সে ধ্বংস হয়ে যাবে হান্না।’
একটু থামল জেন। তারপর আবার বলল, ‘হান্না, তুই আমাকে তার কাছে নিয়ে চল। ও বড় একা। নিজের ওপরই সে প্রতিশোধ নিতে চাচ্ছে। ঠেলে দিচ্ছে নিজেকে বিপদের মধ্যে। ওকে বাঁচাতে হবে।’
হান্না চোখ তুলে জেনের ওপর একটা স্থির দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলল, ’সেটা হবে জেন, কিন্তু তোকে আমার একটা প্রশ্ন।’
‘কি?’
‘আমি কেন, আমরা সকলেই জানি জোয়ানের সাথে তোর তো এরকম সম্পর্ক ছিল না? তুই তো ওকে সব সময় প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবতিস। ওর প্রতি একটা ঈর্ষাই আমরা তোর মধ্যে দেখেছি।’
হান্নার প্রশ্ন শুনে জেন দু’হাতে মুখ ঢাকল। বলল, ‘তোর প্রশ্নের উত্তর আমি দিতে পারব না। আমি কিছু জানি না।’
‘ঘটনা তোর, জানে বুঝি অন্যে? লুকোবার অর্থ কি বলত?’
‘না, আমি লুকোচ্ছি না। আমি বুঝতে পারছি না, কি থেকে কি হয়ে গেল! ও আমার প্রতিদ্বন্দ্বী, ওকে আমি ঈর্ষা করতাম। ঈর্ষার সাথে আমি কার্ডিনাল ফ্রান্সিসকো’র বংশীয় এ বড়াইও ছিল।’
একটু থামল জেন। তারপর আবার শুরু করল, ‘কিন্তু হান্না, সেদিন ডিপার্টমেন্টে গিয়ে যখন ফল জানলাম, আমি প্রথম হয়েছি এবং জোয়ান দ্বিতীয় স্থান পেয়েছে, তখন বুকটা আমার মোচড় দিয়ে উঠল। প্রথম বারের মতো মনে হলো এ ফল আমি চাইনি। ওর পরাজিত মুখের ছবি আমার কাছে বড় অসহ্য হয়ে উঠল। বুক কেঁদে উঠল আমার। তোমরা যখন আমাকে ঘিরে আনন্দ করছিলে, তখন মনে হচ্ছিল জোয়ানকে আমার কাছ থেকে তোমরা দূরে ঠেলে দিচ্ছ। তার ওপর জোয়ানের বিরুদ্ধে যখন মরিসকো হওয়ার অভিযোগ উঠল, তখন বুকটা আমার ছিঁড়ে যেতে চাইল। প্রথমবার অনুভব করলাম, জোয়ান আমার বুকের গভীরতম প্রদেশে সবটা স্থান জুড়ে আছে। জানি না এমনটা কখন ঘটল, কিভাবে ঘটল হান্না?’
কান্নায় কন্ঠ রুদ্ধ হয়ে গেল জেনের।
‘আমি মনে করি একজন ভালো ছাত্রের জন্য এটা একটা সাময়িক আবেগ তোর।’ জেনকে সান্তবনা দিয়ে বলল হান্না।
‘এসব কথা ভেবেও আমি মনকে সান্তবনা দিতে চেষ্টা করেছি হান্না। মনে হয়েছে, ওকে আমি কোনদিনই প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করিনি, আসলে ওটা ছি আমার একটা গর্ব। আর ওর প্রতি ঈর্ষা ছিল আমার অনুরাগ, আনন্দ। কৃত্রিম প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও ঈর্ষার প্রাচীর যখন ভেঙে গেল, আমি তখন ধরা পড়ে গেলাম হাতেনাতে।’
‘কিন্তু জেন, এখনকার বাস্তবতার বিষয়টা তো তোকে ভাবতে হবে। ভুলিস না, তুই কার্ডিনাল ফ্রান্সিসকো পরিবারের মেয়ে!’
‘ওসব আমি কিছুই ভাবছি না হান্না। একটাই আমার চিন্তা ওকে বাঁচাতে হবে। জীবন সম্পর্কে, ভবিষ্যত সম্পর্কে ওকে আশাবাদী করে তুলতে হবে।’
হান্না কিছু বলতে যাচ্ছিল। এই সময় এক গ্লাস দুধ হাতে ঘরে ঢুকল জেনের মা। জেনের মা’র পরপরই ঢুকল জেনের আব্বা।
জেনের আব্বা হান্নাকে দেখে বলল, ‘কেমন আছ মা? তোমার আব্বার সাথে দেখা হলো।’
‘ভালো আছি। আব্বার সাথে কোথায় দেখা হলো আংকেল?’ বলল হান্না।
‘বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কাউন্সিলের মিটিং ছিল আজ। এখানেই দেখা হলো।’
একটু থামল জেনের আব্বা। তারপর বলল, ‘বড় একটা খবর আছে হান্না। আজ একাডেমিক কাউন্সিলের বৈঠকে সিদ্ধান্ত হলো, বিশ্ববিদ্যায়য়ের ভর্তি ফরমে মরিসকোদের জন্যে আলাদা কলাম থাকবে, যেখানে তাদের পরিচয় লিপিবদ্ধ করা হবে। আরেকটা সিদ্ধান্ত হলো, মরিসকোরা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে চাইলে ওদের জন্য আলাদা পরীক্ষা নেওয়া হবে।’
‘আলাদা পরীক্ষা নেওয়া হবে।’
‘আলাদ পরীক্ষা কেন আংকেল?’
‘মরিসকোদের সব ক্ষেত্রেই আলাদা করে দেখতে হবে।’
‘কেন?’
‘তোমরা ছোট, কিছুই জান না। মরিসকোরা ছদ্মবেশী মুসলমান। ওরা আমাদের বন্ধু কোন সময়ই নয়। সুতরাং ওদেরকে ওপরে উঠে আসার সুযোগ দিলে সমস্যা আমাদের জন্যে বাড়ে।’
‘কেন ওরা আমাদের বন্ধু হতে পারে না।?’
‘পাগল মেয়ে, ওদের কাছ থেকে এ রাজ্য আমরা কেড়ে নিয়েছি না! ওরা এটা ভোলেনি। মুসলমানরা কিছুতেই তাদের অবসস্থান থেকে সরে না।’
‘কিন্তু মরিসকোরা তো আসলেই এখন মুসলমান নেই। ওরা তো খৃষ্ট ধর্ম গ্রহন করেনি, জোর করে এটা করতে ওদের বাধ্য করা হয়েছে?’
‘কিন্তু সেটা তো কয়েক জেনারেশন আগের কথা। মরিসকোদের বর্তমান জেনারেশন তো খৃষ্টান হয়েই জন্মেছে।’
‘তোমার কথা ঠিক, কিন্তু ইতিহাস তো তারা পড়ে। এখানেই হয়েছে বিপদ।’
‘কি বিপদ?’
‘ওরা পড়ে ওদের পূর্বপুরুষদের কিভাবে হত্যা করা হয়েছে, স্পেন থেকে নির্মূল করা হয়েছে এবং কিভাবে হত্যাবশিষ্টদের জোর করে খৃষ্টান বানানো হয়েছিল। এই ইতিহাস তাদের মন-মানসকে আমাদের জন্যে বিপজ্জনক করে তোলে। ওরা ছোবল দেয়ার কোন সুযোগই ছাড়বে না।’
‘কিন্তু আংকেল, ধর্মান্তর নতুন ব্যাপার নয়, যারা মুসলমান তারা খৃষ্ট ধর্ম কিংবা অন্য ধর্ম থেকেই মুসলমান হয়েছে, কিন্তু সেখানে তো ইতিহাস এভাবে বিপজ্জনক হওয়ার প্রশ্ন ওঠে না?’
জেনের আব্বা হাসল। বলল, ‘তুমি প্রশ্ন তুলেছ হান্না। এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টা সবার বুঝতে হবে। একটা বিষয় লক্ষ্য করবে, খৃষ্টান, বৌদ্ধ, হিন্দু প্রভৃতি ধর্মাবলম্বীরা সহজেই ধর্মান্তরিত হয় এবং স্বাভাবিকভাবেই অন্য ধর্ম পালন করে চলে। কিন্তু মুসলমানদের ব্যাপকভাবে ধর্মান্তরিত হবার কোন নজীর নেই। যেখানে এটা ঘটেছে, কোন চাপ ও লোভ বা অন্য কোন অস্বাভাবিক কারনেই ঘটেছে এবং প্রকৃত অর্থে তাদের ধর্মান্তর হয় না। মনে মনে তারা মুসলমানই থেকে যায়। এই কারনেই মরিসকোরা বিশ্বস্ত নয়।’
‘আংকেল, আমার একটা কৌতূহল। আমরা মুসলমানদের কাছ থেকে স্পেন কেড়ে নেয়ার পর মুসলমানদের আমরা ব্যাপকভাবে হত্যা করেছি, স্পেন থেকে নির্মূল করেছি, অবশিষ্টদের আমরা জোর করে খৃষ্টান বানিয়েছি, অথচ মুসলমানরা যখন খৃষ্টানদের কাছ থেকে স্পেন কেড়ে নিয়েছিল, তখন তারা এসব কিছুই করেনি। আমাদের ভূমিকার ব্যাখ্যা কি?’
‘আমার আগের কথার মধ্যেই এর কিছুটা উত্তর আছে। মুসলমানরা খৃষ্টানদের খৃষ্টান রেখে রাজ্য চালাতে পেরেছে কিন্তু মুনলমানদের মুসলমান রেখে আমরা দেশ চালাতে পারতাম না। মুসলমানরা চরিত্রগতভাবে স্বাধীনচেতা।’
‘কিন্তু নিরস্ত্র পরাজিত মুসলমানরা আমাদের কি ক্ষতি করতে পারত, আরা ওদের ভয় করেছি কেন?’
‘ভয় করেছি আমরা মুসলমানদের নয়, আমরা ভয় করেছি মুসলমানদের আদর্শকে। ওদের আদর্শ ভয়ানক প্রভাবশলী। আমরা যদি মুসলমানদের মুসলমান থাকতে দিতাম, তাহলে দেখা যেত আমাদের সংখ্যা কমছে আর ওদের সংখ্যা বাড়ছে। একদিন দেখা যেত স্পেনে শাসকরা খৃষ্টান, প্রজাদের মধ্যে কেউ খৃষ্টান নেই, সবাই মুসলমান হয়ে গেছে। তারপর শাসকরাও আর খৃষ্টান থাকতে পারতো না।
‘আংকেল, ইউরোপীয় দেশ আর স্পেন এক নয়। স্পেনের সভ্যতা মুসলমানদের গড়া, তারা শিক্ষা, সংস্কৃতি, রাজনীতি, সামাজিকত, সভ্যতা সবক্ষেত্রেই শ্রেষ্ঠতর অবস্থানে ছিল। যাকে অতিক্রম করতে অন্যান্য স্পেনীয় কোন সময়েই পারতো না্ এই স্পেনীয়দের ওপর মুসলমাদের যে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রভাব ছিল, তা অব্যাহত থাকতে দিলে স্পেনীয়রা ধীরে ধীরে ইসলাম গ্রহন করে মুসলমান হয়ে যেত। হান্না, তুমি জান, শত শত বছর গত হলেও স্পেনের মানুষ মুসলিম শাসনের কথা এখনও স্মরণ করে।’
জেন বালিশে মুখ গুঁজে পড়েছিল। মুখ তুলে প্রথম কথা বলল সে। বলল, ‘তাহলে আব্বা, যোগ্যতর একটা জাতিকে আমরা ধ্বংস করেছি যুক্তিসংগত কোন কারণে নয়।’
‘অবশ্যই যুক্তিসংগত কারণে মা। জাতির বাঁচার ব্যাপারটা কি যুক্তিসংগত কারণের মধ্যে পড়ে না।’
‘ওটা ছিল তো নিছক একটা ভবিষ্যত আশংকার ব্যাপার।’
‘আশংকা নয় মা, বাস্তবতা। ওদেরকে রেখে আমরা দেশ চালাতে পারতাম না।’
‘কিন্তু তাই বলে একটা নিরপরাধ জনগোষ্ঠীকে ঐভাবে ধ্বংস করা ….।’
জেনকে কথা শেষ করতে না দিয়ে জেনের কথার মাঝখানেই তার আব্বা কথা বলে উঠল, ‘তোমরা ছোট, আরও বড় হও বুঝবে, অনেক বাস্তবতা আছে যা নিষ্ঠুর হলেও প্রয়োজন। গাছের নিরপত্তার জন্যে আগাছা কেটে ফেলা তো একটা প্রাকৃতিক নিয়ম।’
‘গাছ ও মানুষকে কি এক কাতারে ফেলা যায়?’
‘এই সময় ‘গাছ ও মানুষ’কে এক কাতারে ফেলার কি হলো?’ বলতে বলতে ঘরে প্রবেশ করল জেনের আব্বার বন্ধু শিল্পপতি মি. সানচেজ।
জেনের আব্বা উঠে দাঁড়িয়ে তাকে স্বাগত জানিয়ে পাশে বসাল। তারপর হাসতে হাসতে ‘গাছ ও মানুষে’র ব্যাপারটা তাঁকে বুঝিয়ে বলল।
শুনে হো হো করে উচ্চ স্বরে হেসে উঠল মি. সানচেজ। বলল, ‘যাই বলো, ফ্রাঁসো-ফ্রান্সিসকো আমি আমার পূর্বপুরুষের কাজ সমর্থন করতে পারি না।’
একটু থামল সানচেজ। জেনের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল সমর্থন পাবার আশায়।
আবার শুরু করল সানচেজ, ‘আমাদের পূর্বপুরুষরা ছিল বোকা, যথেষ্ট দূরদর্শী নয়। তারা গাছ কেটে গোড়া রেখেই গেছে। তারা কর্ডোভা-গ্রানাডার মতো মুসলিম নিদর্শনগুলোকে উপড়ে ফেলেনি কেন, কেন তারা ব্যাটা মুসলমাদেরকে আবার খৃষ্টান বানাতে গেল। আমাদের জন্যে একটা মুসিবত রেখে গেছে।’
থামল। একটু ঢোক গিলল মি. সানচেজ। তারপর গা থেকে কোট খুলে বলল, ‘দেখো কি মুসিবত, আমাদের এ্যারোনটিক ইঞ্জিনিয়ারকে তো তুমি চেন ফ্রাঁসো।’
‘চিনব না মানে? মি. মিশেল তো খুব ভালো ছেলে। সোনার ছেলে বলতে পারো।’
‘আঃ থামো। ভালো হওয়াই তো হয়েছে বিপদ। ব্যাটা যে মরিসকো তা তো জানতাম না।’
জেনের আব্বা লাফ দিয়ে উঠল, ‘কি বলছ তুমি মি.মিশেল মরিসকো?’
‘মরিসকো মানে একদম বিশুদ্ধ মরিসকো। বিয়েও করেছে মরিসকোদের ঘরে। ব্যাপারটা গোপন করে রেখেছিল। জানতে পেরেছি হিস্টোরিক্যাল ফাউন্ডেশনের গোপন চিঠির মাধ্যমে। একেবারে বংশ তালিকা দিয়েছে ওরা।’
‘তারপর?’
‘তারপর আর কি? আমি সোজা মিশেলকে ডাকলাম আমার চেম্বারে। তার সামনে মেলে ধরলাম তার বংশ তালিকা। প্রথমটা সে চমকে উঠেছিল। কিন্তু মুহূর্তেই মুখে হাসি টেনে বলল, ‘জি স্যার, আমি মরিসকো।’
‘কিন্তু এতদিন বলনি কেন?’ আমি জিজ্ঞেস করলাম।
সে বলল, ‘স্যার, চাকুরির জন্যে এরকম শর্ত থাকলে অবশ্যই সত্য বলতাম।’
‘সত্যবাদী হওয়ার ভড়ং করো না। সত্য গোপন করেছ বলেই তো একজন মরিসকোকে এতদিন ধরে ‘দুধ কলা’ দিয়ে পুষছি।’ বললাম আমি।
সে বলল, ‘স্যার, বিনিময়ে আমি অত্যন্ত বিশ্বস্ততার সাথে আপনার প্রতিষ্ঠানের সেবা করেছি।’
এতগুলো কথা বলার পর থামল মি. সানচেজ। জেনের আব্বা আগ্রহের সাথে শুনছিল সানচেজের কথা। আসলেই জেনের আব্বা ছেলেটাকে অত্যন্ত ভালো জানত। জেন ও হান্নাও পলকহীন চোখে মি. সানচেজের দিকে চেয়ে তার কথা শুনছিল।
মি. সানচেজ থামলে জেনের আব্বা বলল, ‘মিশেলকে বুঝি চাকুরি থেকে তাড়িয়েছ?’
‘না, চাকুরি থেকে তাড়াইনি, দুনিয়া থেকেই তাড়িয়ে দিয়েছি?’
‘কেমন?’ বলল জেনের আব্বা।
‘কেমন আবার জিজ্ঞেস করছ! মিশেল আমার রুম থেকে ওর রুমে ফিরে যাবার পর আমার বডিগার্ড গিয়ে তার পিস্তলের একটা গুলী খরচ করেছে। ব্যাটা চেয়ার থেকে ওঠারও সুযোগ পায়নি। চূর্ণ হয়ে যাওয়া মাথা নিয়ে চেয়ারের ওপরই মুখ থুবড়ে পড়ে যায়।’
‘ওর পরিবার জানতে পারেনি?’
‘দেখ, কোন কাজে দেরি করি না আমি। মিশেলের রক্ত-মাথা কোটটা নিয়ে তার স্ত্রীকে বলা হয়েছে, আত্মগোপনকারী মরিসকোর এই শাস্তি তারপর তাকে এক কাপড়ে বাড়ি থেকে বের করে দিয়ে বাড়িতে তালা লাগানো হয়েছে। পরদিনই আরেকজন অফিসার সে বাড়িতে গিয়ে উঠেছে।’ থামল মি. সানচেজ।
মি. সানচেজের কথা শুনে জেন ও হান্না দু’জনেরই মুখ পাংশু হয়ে গিয়েছিল। জেন আতংকে চোখ বুজেছিল। কাঁপছিল তার বুক। জোয়ানের অসহায় মুখ তার সামনে ভেসে উঠল। মিশেলও এই রকম এক জোয়ান ছিল। প্রবল ভয় এসে ঘিরে ধরল জেনকে।
মি. সানচেজ থামলে জেনের আব্বা বলল, ‘সান, তুমি কাজের কাজে একটুও দেরি কর না, এটাই তোমার ভাগ্যলক্ষী।’ বলতে বলতে জেনের আব্বা উঠে দাঁড়াল। বলল, ‘চল সান, ড্রইংরুমে বসি, কথা আছে।’
জেনের আব্বা ও মি. সানচেজ উভয়ে বেরিয়ে গেল, জেনকে দুধ খাইয়ে জেনের মা আগেই বেরিয়ে গিয়েছিল।
জেনের আব্বা ও মি. সানচেজ বেরিয়ে যাবার পরও জেন কিংবা হান্না কেউই কথা বলল না। জেন তখনও চোখ বুজে পড়ে আছে এবং হান্নার মুখ বিস্ময় ও বেদনায় আচ্ছন্ন।
কিছুক্ষণ পর হান্না জেনের কাঁধে হাত রেখে বলল, ‘সংসারটা বড় কঠিন জেন। তোকে বাস্তববাদী হতে হবে। আর জোয়ানকে বাঁচানোর কথা বলছিস, তুই ও আমি চেষ্টা করলেই কী তা পারব? ওর হৃদয়ে যে ক্ষতের সৃষ্টি হয়েছে, তার নিরাময় আমাদের হাতে নেই। অন্যদিকে গোটা দেশের রোষ থেকে বাঁচাবার ক্ষমতাও আমাদের নেই।’
জেন কিছুই বলল না। তার চোখ থেকে অশ্রুর দু’টি ধারা নেমে এলো।
হান্নাই কথা বলল আবার। বলল, ‘নীতির দিক দিয়ে যদি বলি বলব, জাতি অন্যায় করছে, কিন্তু আমরা কি করতে পারি! আমরা জাতির একটা অতি ক্ষুদ্র অংশ ছাড়া আর কিছু নই।’
অনেকক্ষণ পর জেন বলল, ‘তুই আমাকে ওর কাছে নিয়ে যাবি?’
‘যেয়ে কি লাভ? তার চেয়ে তোকে ও ভুল বুঝেছে, এ অবস্থায়ই থাকা ভালো।’
জেন চোখ মুছে বলল, ‘না হান্না, আমাকে ওর কাছে যেতে হবে।’
‘কিন্তু জেন একটা কথা চিন্তা কর। মিশেল মাত্র তার পরিচয় গোপন করার কি শাস্তি পেল। তোর আর জোয়ানের ব্যাপারটা প্রকাশ হয়ে পড়লে কী ভয়ংকর অবস্থা সৃষ্টি হবে তা কি ভেবে দেখেছিস!’
‘যে অবস্থারই সৃষ্টি হোক হান্না ও আমাকে ভুল বোঝার কষ্ট আমার বুকে যতখানি, তার চেয়ে বেশি অবশ্যই নয়।’
‘বিস্মিত হচ্ছি জেন, তোদের মধ্যে এ রকম সম্পর্ক তো ছিল না!’
‘মানুষ তার নিজের সবটুকু কি জানে? আমিও জানতে পারিনি।’
একটু থেমেই বলল জেন আবার, ‘কবে আমাকে ওর কাছে নিয়ে যাবি?’
‘তোর এই অবস্থা নিয়ে?’
‘যতটা দুর্বল মনে হচ্ছে ততটা দুর্বল আমি নই।’
‘তবু তোর অন্তত কয়েকটা দিন রেষ্ট নেয়া উচিত বাইরে বেরুবার আগে।’
জেন কী যেন ভাবল! কোন জবাব দিল না হান্নার কথায়।
হান্নাও কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর বলল, ‘ঠিক আছে আমি তাহলে উঠি। দু’দিন পর আমি আসছি।’
বলে হান্না বেরিয়ে গেল।
জেন ভাবছিল। হান্নার চলে যাওয়ার দিকে একবার শূন্য দৃষ্টিতে চাইল। কিছু বলল না।
হান্না বেরিয় যেতেই জেনের মা ঘরে ঢুকল। বলল, ‘ওষুধ খাওয়ার সময় পার হয়ে যাচ্ছে। খেয়েছিস ওষুধ?’
‘খাচ্ছি মা!‘ বলে জেন নিজে উঠে টেবিল থেকে ওষুধ নিল। জেনের মা দ্রুত এগিয়ে এসে বলল, ‘বলবি তো, তুই আবার উঠছিস কেন?’
‘আমার আজ খুব ভালো লাগছে?’ বলে হাসল জেন। বলল, ‘আমার একটু বাইরে বেড়িয়ে আসতে ইচ্ছা করছে মা।’
জেনের মা জেনের গায়ে-মাথায় হাত বুলিয়ে পরীক্ষা করে বলল, ‘হাটতে পরবি?’
‘পারব।’
‘ঠিক আছে। আশেপাশে কোথাও বেড়িয়ে আসিস। শরীরটা আরো ভালো লাগতে পারে।’
বলে জেনের মা চলে গেল।
জেনের মুখ আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠল।
বিকেল বেলা।
জোয়ান তার বাড়ির পাশের বাগানে খন্তা দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে আগাছা পরিষ্কার করছিল। বিরাট ফল ও ফুলের বাগান। সকালেও কিছু সময় কাজ করেছে। বিকেলে ঘন্টা খানেক কাজ করলে শেষ হয়ে যাবে বলে রেখে দিয়েছিল।
কয়েক দিন থেকে বাগানের মালি আসছে না। সুযোগ পেয়ে আগাছা দল বেঁধে মাথা তুলেছে। অপরিচর্যায় ফলও নষ্ট হচ্ছে। আজ সকালে খবর এসেছে মালি আর আসবে না। মালি ক্ষমা প্রার্থনা করে একটা চিঠি লিখেছে। তাতে বলেছে, জোয়ান পরিবারের কাছে সে আকন্ঠ ঋণী। সারা জীবন বিনা পয়সায় কাজ করলেও এ ঋণ শেষ হবে না। কিন্তু কাজ করতে সে অপারগ। তার কাছে হুমকি এসেছে, সে যদি মরিসকো’র বাসায় কাজ ছেড়ে না দেয়, তাহলে তাকে দেখে নেয়া হবে। অন্যদিকে বাইবেল-সোসাইটি থেকে বলা হয়েছে, মরিসকোর বাড়ির নওকরী সে যদি পরিত্যাগ না করে তাহলে সামাজিকভাবে তাকে বয়কট করা হবে। এই অবস্থায় কাজে যোগদান থেকে বিরত থাকা ছাড়া তার উপায় নেই। সে তার অপারগতার জন্যে ক্ষমা প্রার্থনা করেছে।
জোয়ান বাগানের আগাছা পরিষ্কার শেষ করে উঠে দাঁড়াল। তারপর খন্তাটা বাগানের পাশে স্টোর রুমে দিয়ে বাগানে পানি ছিটানোর কাজ শুরু করল।
জোয়ান পানি ছিটাচ্ছিল আর ভাবছিল, তাদের বিশ বছরের পুরানো মালিকের কাজ ছেড়ে দিতে হলো! কারণ মরিসকো পরিবারে কাজ করা অপরাধ। জোয়ানের মুখে একটা তিক্ত হাসি ফুটে উঠল।
জোয়ানের মা ধীরে ধীরে এসে বাগানে দাঁড়াল। তার চোখ কাজে ব্যস্ত জোয়ানের দিকে। চোখে তার একরাশ বেদন। জীবনে জোয়ানকে এসব কাজে হাত দিতে হয়নি। ভাগ্যের কী বিপর্যয়! যার হাতে ছিল এতদিন কলম, তাকে আজ হাতে তুলে নিতে হয়েছে খন্তা।
জোয়ানের মা ধীরে ধীরে ডাকল, ‘জোয়ান, এসো বেটা, এখন চা খাবার সময়।’
জোয়ান মায়ের দিকে ফিরে তাকাল। বলল, ‘আম্মা, তুমি আবার এতদূর এসেছ। ডাকলেই তো হতো।’
বলে জোয়ান পানির পাইপ বন্ধ করে মায়ের সাথে চলে এলো।
নাস্তা শেষ করার পর জোয়ান তার মায়ের কাপে চা ঢেলে তার মাকে এগিয়ে দিচ্ছিল।
জোয়ানের মা জোয়ানের হাতের দিকে চেয়ে চমকে উঠল। বলল, ‘জোয়ান, তোর হাতে ফোস্কা!’
জোয়ান তাড়াতাড়ি হাত টেনে নিয়ে বলল, ‘ও কিছু না আম্মা। অভ্যেস নেই তো!’
জোয়ানের মা একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল জোয়ানের দিকে। বেদনায় মুষড়ে যাওয়া তার মুখ। সে জোয়ানের দিকে তাকিয়ে আছে বটে, কিন্তু তার দৃষ্টিটা শূন্যে। যেন কোথায় হারিয়ে গেছে তার মন কিংবা গভীরভাবে কিছু সে ভাবছে!
জোয়ান চায়ে চুমুক দিয়ে মায়ের দিকে চেয়ে বলল, ‘আম্মা, এসব নিয়ে ভেবে মন খারাপ করবে না। নিজেদের সব কাজ নিজে করার জন্যে তৈরি থাকতে হবে। সুযোগ পেয়ে আমি খুশি আম্মা!’
মুখে হাসি টানার চেষ্টা করে বলল জোয়ান। জোয়ানের মা নিরব তবু।
‘কি ভাবছ আম্মা?’ বলল জোয়ান।
জোয়ানের মা ধীর, কিন্তু অত্যন্ত দৃঢ় কন্ঠে বলল, ‘আমি ভাবছি। ভাবছি, আমরা মাদ্রিদ থেকে চলে যাব।’
বিস্মিত হলো জোয়ান। বলল, ‘মাদ্রিদ থেকে আমরা চলে যাব? কেন আম্মা?’
‘কেন বুঝতে পারছ না! এখানে ওরা আমাদের জীবনকে দুঃসহ করে তুলবে। মালি কাজ ছেড়ে দিয়েছে, কাজের ছেলেটাও আজ আসেনি। শীঘ্রই শুনতে পাব, মরিসকোদের বাসায় সে কাজ করবে না। এভাবে সব দিক থেকে ওরা আমাদের বয়কট করবে।’
‘মাদ্রিদ থেকে চলে গেলেই কি এ সমস্যার সমাধান হবে মা?’
‘হবে, দূরের কোন শহরে চলে যাব। সেখানে কেউ আমাদেরকে চিনবে না।’
‘অর্থাৎ আমরা আবার আমাদের আত্মপরিচয় গোপন করব, এই তো?’
‘তাছাড়া উপায় কি বেটা? আমরা তো বাঁচতে চাই, ভালোভাবে বেঁচে থাকতে চাই।’
‘না, আম্মা! আমরা মাদ্রিদ থেকে যাবো না। আমার পূর্বপুরুষ একবার ভ্যালেনসিয়া থেকে মাদ্রিদ এসেছিল আত্মপরিচয় গোপন করার জন্যে। কিন্তু অবশেষে তা গোপন থাকল না।’
‘থাকল না সেটা এখনকার কথা। কিন্তু কয়েক পুরুষ তো গোপন ছিল। পরিবারের জীবনে শান্তি ও সমৃদ্ধিও এসেছিল।’
‘পলাকত জীবনের এ শান্তি-সমৃদ্ধি দিয়ে কি লাভ আম্মা?’
‘কি বলতে চাও তুমি?’
‘বলতে চাই, আর আত্মগোপন নয়, আর পলাতক জীবন নয়। আত্মপরিচয় নিয়ে পূর্ণভাবে প্রকাশিত হতে চাই।’
‘তারপর?’
‘তারপর কি আম্মা?’
‘ওরা কি শান্তিতে বাস করতে দেবে? বাঁচতে দেবে?’
‘বাঁচতে চেষ্টা করব, না পারি আত্মপরিচয় নিয়েই শেষ হয়ে যেতে চাই আম্মা।’
জোয়ানের আম্মা উঠে দাঁড়াল। জোয়ানের পাশে এসে জোয়ানের কাঁধে হাত রেখে ধীর কন্ঠে বলল, ‘যা কেউ করতে পারেনি, তুমি তা করবে? করতে পারবে?’
‘চেষ্টা করব মা।’
‘কিন্তু কি লাভ বেটা, এমন চরম অসম লড়াইয়ে কি লাভ হবে?’
‘লাভ এই হবে আমার পরিচয় সমুন্নত হবে। আমি হয়তো থাকব না, কিন্তু আমি যে মুসা আবদুল্লাহ, আত্মপরিচয় গোপনকারী জোয়ান নই, এই কথা এদেশবাসীর কাছে, বিশেষ করে মরিসকোদের কাছে বেঁচে থাকবে।’
জোয়ানের মার মুখ পাংশু হয়ে গেল। চোখ ফেটে ঝর ঝর করে নেমে এলো অশ্রু। বলল, ‘বেটা, দু’হাত বাড়িয়ে সেই পথকে স্বাগত জানানো কি ঠিক, যে পথ নিশ্চিতভাবে ধ্বংসের? তোমার পূর্বপুরুষরা ও মরিসকোরা কেউই এটা করেনি।’
‘তারা ভুল করেছেন। আম্মা, আমি ভুল করতে চাই না। আমি কাপুরুষের মতো বাঁচতে চাই না। পদদলিত জীবন নিয়ে আমি এক মুহূর্তে বাঁচতে চাই না।’
‘তোমার এসব ক্ষোভের কথা, আবেগের কথা। তোমাকে ভুললে চলবে না, স্পেনে মরিসকোরা আজ পর্যন্ত কৌশল করেই বেঁচে আছে।’
‘এ বাঁচায় কি লাভ আম্মা! আমরা আমাদের নিজের নাম বলতে পারি না, নিজের বিশ্বাসের কথা বলতে পারি না। এমন জীবনের ঘানি আমরা কেন বয়ে চলব শতাব্দীর পর শতাব্দীকাল ধরে?’
বলে জোয়ান উঠে দাঁড়াল। মায়ের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তার চোখে চোখ রেখে বলল, ‘আম্মা, আমার দিকে চেয়ে দেখ। আমি ক্ষোভ থেকে কিংবা আবেগ নিয়ে কোন কথা বলছি না। আমি আমার শান্ত মনের স্থির সিদ্ধান্ত থেকে এ কথা বলছি। আর আমাকে এ সিদ্ধান্ত নেয়ার নির্দেশ দিয়েছে আমার পূর্বপুরুষ আবদুল্লাহ বিন আবদুর রহমানের জীবন কাহিনী, যার মধ্যে দিয়ে আমি আমাকে খুঁজে পেয়েছি, যা এতদিন অজানা ছিল।’
জোয়ানের মা জোয়ানকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘বেটা, তোমার এতটুকুন বয়স, কেউ তো কোথাও সাহাযয্যের নেই। আমার ভয় করছে।’
এ সময় জোয়ানের দাদী ধীরে ধীরে বেরিয়ে এলো ঘর থেকে। তার মুখ উজ্জ্বল।
বেরিয়ে এসে একটা চেয়ার টেনে বসে বলল, ‘জোয়ান, তোর সব কথা আমি শুনতে পেয়েছি। আল্লাহ তোকে বাঁচিয়ে রাখুন!’
একটু থামল জোয়ানের দাদী। তারপর আবার শুরু করল, ‘অ-নে-ক দিন আগের কথা! আমি সবে স্কুল পাস করেছি। আমি আব্বার সাথে গ্রানাডার আল হামরা দেখতে গিয়েছিলাম। আমরা আল হামরা প্রাসাদ ঘুরে ঘুরে দেখতে দেখতে প্রাসাদের পেছন দিকে চলে গিয়েছিলাম। তুষারময় সিয়েরানিবেদা পাহাড়ের পাদদেশে দাঁড়িয়ে আল হামরার লাল প্রাসাদকে দেখতে অপরূপ লাগছিল। একটা জলপাই গাছের নিচে দাঁড়িয়ে আমরা আল হামরা দেখছিলাম। আব্বা আমারকে আল হামরার ইতিহাস বলছিলেন, ‘মুসলিম শাসনের আলোক প্রভায় সমগ্র স্পেন তখন আলোকিত। সভ্যতা ও সমৃদ্ধিতে স্পেন তখন সমগ্র ইউরোপের অন্ধকার জীবনে সূর্যসদৃশ। সেই সময় ১২৪৮ খৃষ্টাব্দে গ্রানাডার শাসক মোহাম্মদ আল হামর আল হামরা প্রাসাদের নির্মাণ শুরু করেন। বিশ্বে এমন প্রাসাদ দ্বিতীয়টি নেই। কিন্তু আজ যে এর দুর্ভাগ্য, এমন দুর্ভাগ্যও কোন প্রাসাদের ভাগ্যে আর জোটেনি। মুসলিম শাসনের প্রতীক হিসেবে আজ এ এক বিদ্রূপের বস্তু, এর গায়ে আদর করে হাত বুলাবার একজন লোকও নেই। এর শূন্য বুকে কান পাতলে মা, একটা আকুল হাহাকার শুনতে পাবে। এর প্রতিটা পাথর আজ একটি করে অশ্রু ফোঁটা।’ বলতে বলতে আব্বার চোখ থেকে অশ্রু গড়িয়ে পড়েছিল। আমি তাকে কোনদিন কাঁদতে দেখিনি। আমি অভিভূত হয়ে পড়েছিলাম। এই সময় পাশের ঝোপের আড়াল থেকে একজন যুবক বেরিয়ে এলো। বেরিয়ে এসে একেবারে আব্বার মুখোমুখি দাঁড়াল। পরিষ্কার কন্ঠে সালাম দিল। তারপর বলল, ‘মূর্তিমান দুর্ভাগ্য দেখে কাঁদছেন। এই দুর্বলতাই মুসলমানদের পতন ঘটিয়েছে। পৃথিবীতে দাঁড়িয়ে থাকার জন্য চারটা শক্তি প্রয়োজন-জ্ঞান চর্চা, সুবিচার, প্রার্থনা ও সাহসিতা। গ্রানাডার ভেতরে যান। দেখবেন প্রতিটি ভাঙা কলেজের তোরণে এই কথাগুলো লেখা আছে। কিন্তু বাস্তবক্ষেত্রে এ চারটি শক্তি যেদিন আমরা হারিয়ে ফেললাম, দুর্ভাগ্য মূর্তিমান হয়ে আমাদের দ্বারে এসে দাঁড়াল। সর্বশেষে হারিয়েছিলাম সাহসীদের শৌর্য। এর পরেই এলো কান্না। এখনও কাঁদছি আমরা। তাই কান্নাকে আমি দেখতে পারি না। কান্না নয়, চোখে চাই আগুন।’ বলেই যুবকটি যেভাবে এসেছিল সেভাবেই দৌড়ে ঝোপের আড়ালে পালিয়ে গেল। তারপর অনেকদিন, অনেক বছর চলে গেছে, আমি যুবকটিকে ভুলতে পারিনি, ভুলতে পারিনি তার ঐ কয়টি কথা।’
এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে জোয়ানের দাদী থামল। মুহূর্তের জন্যে চোখ বুজল। তারপর চোখ খুলে বলল, ‘জোয়ান, বহুদিন পর সেই যুবকের কন্ঠ তোর কন্ঠে প্রতিধ্বনিত হতে শুনলাম। আল্লাহ তোর মঙ্গল করুন, আল্লাহ তোকে বাঁচিয়ে রাখুন।’
জোয়ান ছুটে এসে দাদীর কাছে হাঁটু গেড়ে বসে বলল, ‘দাদী, তোমাকে ধন্যবাদ। তোমাকে নতুন দাদী মনে হচ্ছে। তোমার এ কথাগুলো আমার কাছে অসীম প্রেরণা। গল্পটা তোমার কাছে আরও বিস্তারিত শুনতে চাই দাদী।’
জোয়ানের দাদী জোয়ানের মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, ‘বলব, অবশ্যই বলব।’
জোয়ান উঠে দাঁড়াল। বলল, ‘দাদী বাগানে আর একটু কাজ বাকী আছে। সেরে আসি। তোমার গল্প বলতে হবে।’
বলে জোয়ান বেরিয়ে এলো বাড়ি থেকে। ঢুকল গিয়ে বাগানে।
ঠিক বিকেল পাঁচটায় একটা গাড়ি এসে প্রবেশ করল জোয়ানদের গাড়ি বারান্দায়।
গাড়ি থেকে নামল জেন। সে নিজেই গাড়ি ড্রাইভ করছিল।
বাড়িতে গাড়ি ঢুকতে দেখে দরজায় এসে দাঁড়িয়েছিল জোয়ানের মা।
জেনকে দেখে এগিয়ে এলো জোয়ানের মা। বলল, ‘একি! তুমি যে একেবারে অর্ধেক হয়ে গেছ! মা, তোমার অসুখ করেছিল বুঝি?’
‘জি, খালা আম্মা!’ ম্লান হেসে বলল। তারপর জিজ্ঞেস করল, ‘জোয়ান আছে খালা আম্মা?’
‘আছে। বাগানে। তুমি বস। আমি ডেকে দিচ্ছি।‘
বলে জোয়ানের মা বারান্দা থেকে এসে বাগানের দিকে চলল।
জেন কিন্তু ড্রইংরুমের দিকে না গিয়ে বাগানের দিকে চলল জোয়ানের মার পিছু পিছু।
জোয়ানের মা বাগানের ভেতর ঢুকে গেছে।
জেন বাগানের প্রান্তে গিয়ে থমকে দাঁড়াল। দেখতে পেল জোয়ান খন্তা দিয়ে একটা গাছের গোড়া খোঁচাচ্ছে। অন্য হাতে তার পানির পাইপ।
জোয়ানের মা জোয়ানকে কি বলল।
জোয়ান সংগে সংগে ফিরে তাকাল। দেখতে পেল জেনকে। মুহূর্তের জন্যে মাথাটা নিচে নামাল। পরক্ষনেই মাথা তুলে জেনকে লক্ষ্য করে জোয়ান উচ্চ স্বরে বলল, ‘জেন, তুমি গিয়ে আমার ঘরে বস, আসছি আমি।’
জোয়ানের মাও ঘুরে দাঁড়াল।
জোয়ানের মা জেনকে জোয়ানের ঘরে বসিয়ে বলল, ‘ওষুধ খাচ্ছ বুঝি? চা তো বারণ নেই?’
জেন জোয়ানের টেবিলের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল। জোয়ানের মার কথায় ঘুরে দাঁড়াল। বলল, ‘বারণ নেই খালাম্মা, কিন্তু আপনাকে কষ্ট করতে হবে না।’
‘পাগল-মেয়ে!’ বলল জোয়ানের মা। ‘চা করা আবার কষ্টের!’
বলে জোয়ানের মা বেরিয়ে গেল।
জেন ঘুরে ঘুরে ঘরের চারদিকে নজর বুলাচ্ছিল। ঘরের মেঝেতে লাল কার্পেট, সাদা বিছানা, সাদা সোফা, সাদা টেবিল ও সাদা কুশনের একটি চেয়ার- ঘরের সবই ঠিক আছে। কিন্তু নেই শুধু টেবিলের স্তুপাকার বই এবং টেবিলের এক প্রান্তে রাখা ডিপার্টমেন্টাল গ্রুপ ফটো। আর ফ্লাওয়ার ভাসের ফুলগুচ্ছও শুকিয়ে আছে। ক’দিন থেকে পাল্টানো হয়নি।
পেছনে পায়ের শব্দ শুনে জেন ঘুরে দাঁড়াল। পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে জোয়ান।
জেন ও জোয়ান একেবারে মুখোমুখি। দু’জনের চোখ দু’জনের চোখে নিবদ্ধ। কিছুক্ষণ দু’জনের কেউই কথা বলতে পারল না।
দু’জনেই বাকরুদ্ধ।
দু’জনের চোখ যেন দু’জনের চোখের সীমানা পেরিয়ে হৃদয়ের গভীরে অবগাহন করছে।
দুর্বল জেনের ঠোঁট দু’টি কাঁপছিল।
‘তুমি এত অসুস্থ জেন!’ উদ্বিগ্ন কন্ঠে বলল জোয়ান। ‘হান্না আমাকে বলেছিল, কিন্তু আমি এতটা ভাবিনি।’
জেন কথা বলার জন্যে ঠোঁট দু’টি ফাঁক করল। কিন্তু কথা বলতে পারল না। তার শরীর কাঁপতে লাগল।
জোয়ান তাড়াতাড়ি জেনকে ধরে সোফায় এনে বসাল। বলল, ‘বসে থাকতে পারবে, না বিছানায় শুইয়ে দেব?’
জেন কোন কথা বলল না। জোয়ানের একটা হাত সে শক্ত করে ধরে থাকল।
‘তুমি এ শরীর নিয়ে কেন এলে? কেন বাড়ি থেকে বেরুলে?’ নরম কন্ঠে বলল জোয়ান।
জেনের ঠোঁট কেঁপে উঠল আবার। একরাশ কান্না যেন তার চোখ-মুখে ঝাঁপিয়ে পড়ল!
‘তুমি তোমার সার্টিফিকেটগুলো কেন পুড়িয়েছ? কেন? কেন? তোমার টেবিলে কেন কোন বই নেই?’ কান্নার একটা বাঁধ ভাঙা উচ্ছাসের সাথে জেনের মুখ থেকে বেরিয়ে এলো কথাগুলো।
তার সাথে সাথে জেনের দুর্বল দেহ লুটিয়ে পড়ল সোফার ওপর।
জোয়ান তাড়াতাড়ি ধরে ফেলল তাকে।
জেন জ্ঞান হারিয়েছে।
জোয়ান ধীরে ধীরে জেনেরে মাথা একটু তুলে ধরে চিৎকার করে উঠল, ‘আম্মা, এদিকে এসো, জেন জ্ঞান হারিয়েছে।’
ছুটে এলো জোয়ানের মা।
‘কি হলো, জেনের কি হয়েছে?’ জোয়ানের মা’র কন্ঠে উদ্বেগ।
‘অসুস্থ, দুর্বল মাথা ঘুরে পড়ে গেছে আম্মা।’
‘ডাক্তার ডাকব?’
‘দেখা যাক আম্মা। আমার ইনস্ট্রমেন্ট বক্সে দেখ একটা সাদা শিশিতে স্পিরিট আছে। স্পিরিটে একটু তুলা ভিজিয়ে নিয়ে আস আম্মা।’
স্পিরিটে ভেজানো তুলা জোয়ানের হাতে তুলে দিয়ে জোয়ানের আম্মা বলল, ‘তুমি এটা ওর নাকে ধর। আমি একটু গরম দুধ করে আনি।’
বেরিয়ে গেল জোয়ানের মা।
মিনিট দু’য়েকের মধ্যেই চোখ খুলল জেন। চারদিকে একবার চেয়ে উঠে বসতে চেষ্টা করল জেন। জোয়ান তাকে নিষেধ করে বলল, ‘এখনই উঠে বসা ঠিক হবে না। একটু গরম দুধ খেয়ে নাও। আম্মা এখুনি নিয়ে আসছেন।’
‘হঠাৎ মাথাটা ঘুরে গেছে।’ বলল জেন।
‘অসুস্থ শরীর, অতটা উত্তেজিত হওয়া ঠিক হয়নি।’
জোয়ানের উরুতে তখনও জেনের মাথা। জেন চোখ ওপরে তুলে স্থির দৃষ্টিতে তাকাল জোয়ানের দিকে। তার ঠোঁট দু’টি আবার কাঁপতে লাগল অবরুদ্ধ এক আবেগে।
জোয়ান তাড়াতাড়ি জেনকে সান্তনা দিয়ে বলল, ‘শান্ত হও জেন, আমি তোমাকে সব বলব।’
‘আমি তোমার কোন কথা শুনব না।’ বলে দু’হাতে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল জেন।
দুধের গ্লাস হাতে ঘরে ঢুকল জোয়ানের আম্মা।
জেনের মাথা জোয়ান ধীরে ধীরে সোফায় রাখতে রাখতে বলল, ‘জেন, আম্মা দুধ নিয়ে এসেছে।’
জোয়ান উঠে দাঁড়ালে জোয়ানের আম্মা জেনের মাথা কোলে তুলে নিল। জেন জোয়ানের মা’র কোলে মুখ গুঁজে কান্নায় ভেঙে পড়ল। বলল, ‘খালাম্মা, জোয়ান তার সার্টিফিকেটগুলো পুড়িয়ে ফেলেছে কেন, টেবিল থেকে বই সরিয় ফেলেছে কেন?’
জেনের কথাগুলো জোয়ানের মার বুকের ক্ষতকে যেন উস্কে দিল! তার চোখ থেকেও ঝর ঝর করে অশ্রু নেমে এলো। কান্নাজড়িত ভাঙা গলায় জোয়ানের মা বলল, ‘মা, দুধটুকু খেয়ে নাও, ওসব কথা পরে হবে। সব ওলট-পালট হয়ে গেছে মা।’
বলে জোয়ানের মা জেনকে তুলে বসাল। তারপর চোখ মুছে দিয়ে দুধ খাইয়ে দিল। জোয়ান মেঝের ওপর কাঠের মতো স্থির দাঁড়িয়েছিল। তার চোখে বেদনা ও অসহায়ত্বের একটা কালো ছায়া।
জেনের দুধ খাওয়া হলে জোয়ান বলল, ‘আম্মা, ওকে একটু বিছানায় শুইয়ে দাও। একটু বিশ্রাম নিক। আমি ওকে পৌছে দেব।’
জেন কোন কথা বলল না। একবার চোখ তুলে জোয়ানের বিছানার দিকে চাইল। জোয়ানের মা জেনকে ধরে বিছানায় শুইয়ে দিল। শান্ত বালিকার মতো জেন হুকুম তামিল করে শুয়ে পড়ল।
‘এখন কেমন লাগছে মা?’ জিজ্ঞেস করল জোয়ানের মা।
‘ভালো খালাম্মা। মনে হচ্ছে আমি হেঁটে বাসায় ফিরতে পারব।’
‘পাগল মেয়ে! একটু বিশ্রাম নাও, আমি আসছি।’ বলে জোয়ানের মা বেরিয়ে গেল।
জোয়ান ঠিক সেভাবেই মেঝের মাঝখানটায় দাঁড়িয়েছিল।
জেন চোখ তুলে জোয়ানের দিকে তাকাল। বলল, ‘বস।’
জোয়ান টেবিলের চেয়ারটা টেনে নিয়ে বিছানার পাশে বসল।
জোয়ান মাথা নিচু করে চেয়ারে বসে রইল। কোন কথা বলল না। জেন তাকিয়েছিল জোয়ানের দিকে।
সেই কথা বলল প্রথম। বলল, ‘সব বলতে চেয়েছিলে, বলো।’
‘আজ বলব না। তুমি অসুস্থ, সেরে ওঠ।’
‘ও তুমি পাশ কাটাতে চাচ্ছ।’
জোয়ান জেনের চোখে চোখ রেখে নরম কন্ঠে বলল, ‘না জেন। তোমার শরীর ভীষণ খারাপ, তোমার বিছানা থেকে ওঠা উচিত নয়। আমি ভেবে পাচ্ছি না, তুমি এলে কেমন করে!’
‘বলত কোন শক্তি আমাকে নিয়ে এসেছে?’
‘জেন, বাস্তবতাকে তুমি অস্বীকার করছ কেমন করে?’
‘কিসের বাস্তবতা?’
‘আমি মরিসকো। তুমি বিশ্বাস কর না?’
‘তুমি এ শব্দ উচ্চারণ করো না। আমি এ শব্দ শুনতে চাই না।’ দু’হাতে মুখ ঢেকে চিৎকার করে বলে উঠল জেন।
‘আমি উচ্চারণ না করলেও আমি মরিসকো।’ নরম কন্ঠে বলল জোয়ান।
‘আর দশজন ‘স্পেনীয়’র মতোই তুমি স্পেনীয়। তোমার গায়ে কি লেখা আছে তুমি মরিসকো, তোমার কপালে কি লেখা আছে তুমি মরিসকো?’ উত্তেজিত কন্ঠে বলল জেন।
‘আমার রক্তে লেখা আছে যা আমি জানতাম না জেন।’
‘না, জোয়ান, আমি তোমাকে ধ্বংস হতে দেব না, দিতে পারি না, আমি বাঁচবো না।’
কান্নায় ভেঙে পড়ল জেন।
‘জেন, আমি ধ্বংস হতে চাই না।’
‘তাহলে এ অভিযোগ মাথা পেতে নিচ্ছ কেন, অস্বীকার করছ না কেন?’
‘মরিসকো পরিচয়ে আমি গৌরব বোধ করছি জেন। মরিসকো হিসেবেই আমি মাথা তুলে দাঁড়াতে চাই।’
‘পারবে না জোয়ান, পারবে না। এটা ধ্বংসের পথ। না, এ পথে তোমাকে যেতে দেব না।’
‘জেন, ধ্বংসের হলেও এটাই আমার চলার পথ। তুমি আমাকে মাফ কর।’
‘জোয়ান তুমি অবুঝ হয়ো না, তুমি জান না তুমি একা, আর কত বড় ভয়ংকরের বিরুদ্ধে তোমার উত্থান! আজকেই গল্প শুনলাম, এ্যারোপ্লেন নির্মাণ কোম্পানী ‘এ্যারোনটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার্স’- এর চীফ ইঞ্জিনিয়ার মি. মিশেল ধরা পড়েন। তিনি মরিসকো। মানুষ হিসেবে তিনি মহত্তম এবং ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে দেশে অদ্বিতীয় হওয়া সত্ত্বেও তাকে গুলী করে মারা হয়েছে এবং তার স্ত্রীকে রাস্তায় বের করে দেয়া হয়েছে। জোয়ান, তুমি জান না ওরা কত অমানুষ!’ থামল জেন।
জোয়ান তৎক্ষণাৎ কথা বলতে পারল না। জেনের দেয়া খবর বিদ্যুৎশকের মতো জোয়ানের দেহ-মনকে আহত করেছে। মি. মিশেলকে জোয়ান চিনত। ফিজিক্সের ইঞ্জিনিয়ারিং পরিমাপ সম্পর্কিত একটা জটিল অংকের সমাধান নেবার জন্যে জোয়ান তার কাছে একবার গিয়েছিল। তার অসাধারণ প্রতিভা ও সারল্যে মুগ্ধ হয়েছিল জোয়ান। এই মি. মিশেল মরিসকো ছিল? মরিসকো হওয়ার অপরাধে তাকে জীবন দিতে হলো? বুক থেকে উঠে আসা একটা আবেগ রুখতে গিয়ে জোয়ান চোখ বুজল। তবু চোখের পাতা ঠেলে দু’চোখ থেকে বেরিয়ে এলো দু’ফোঁটা অশ্রু।
জেন তাকিয়েছিল জোয়ানের দিকে। জোয়ানের চোখের দু’ফোঁটা অশ্রু তার নজর এড়ালো না। সে কিছু বলতে যাচ্ছিল এই সময় জোয়ান কথা বলে উঠল। বলল, ‘জেন, আমি মাথা উঁচু করে ঘোষণা কতে চাই, আমি মরিসকো। মরিসকোদের উত্থান আমার থেকেই শুরু হবে।
জোয়ান চোখের কোণের দু’ফোঁটা অশ্রু মছে ফেলল।
‘তুমি আগুনে ঝাঁপ দিতে চাইছ। মিশেলের ঘটনা জানার পর একটুও তোমার ভয় করে না!’ অবরুদ্ধ স্বরে কাঁপা গলায় বলল জেন।
‘জেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে তোমার সামনে প্রথম যখন আমি শুনলাম আমি মরিসকো, হৃদয় তখন আমার ভেঙে গিয়েছিল। আমি মুষড়ে পড়েছিলাম। পাগলের মতো আমি বাড়িতে ছুটে এসেছিলাম। চাইছিলাম অভিযোগটাকে আমার মা, দাদী মিথ্যা বলুন। তারা মিথ্যা বলতে পারলেন না। বললেন, তারা মরিসকো, কিন্তু আব্বা, দাদা মরিসকো ছিলেন কি না বলতে পারলেন না। আমি বুঝে ফেললাম, আব্বা, দাদা মরিসকো না হলে মরিসকো মেয়ে বিয়ে করলেন কেন? আমার তখন মনে হচ্ছিল আমি শেষ হয়ে গেছি, নিজেকে মনে হচ্ছিল জগতের সবচেয়ে বড় অপরাধী। ধ্বংস হয়ে যাওয়াই আমার ভাগ্য লেখা। মুহূর্তে গোটা দুনিয়া আমার কাছে অপরিচিত হয়ে রূপ নিল। এই অবস্থা থাকলে মি. মিশেলের খবর শুনে আমি ভয় পেতাম, হয়তো মাদ্রিদ ছেড়ে পালাতাম। কিন্তু সে অবস্থা এখন নেই জেন।’
‘তারপর এমন কি ঘটেছে যার জন্যে তুমি ভয় করছ না?’
জোয়ান তার আম্মার কাছে আব্বার রেখে যাওয়া বাক্স পাওয়া এবং বাক্সের ভেতর থেকে পারিবারিক ইতিহাস পাওয়া ও পড়ার কথা উল্লেখ করে বলল. ‘মরিসকো হওয়ার জন্যে জেন, আমার মনে আজ কোন দুঃখ নেই, কোন ক্ষোভ নেই, বরং গর্বে আমার বুক ভরে গেছে! আজ আমার মনে যে শান্তি, যে শক্তি তা অতীতে কোন সময়ই ছিল না। এক মিশেল হত্যার খবর কেন, এক হাজার মিশেল হত্যার খবরও আমার হৃদয়ে কোন কম্পন সৃষ্টি করতে পারবে না। আজ আমার হৃদয় সব জুলুম, সব অন্যায়ের প্রতিকার প্রত্যাশী।’ থামল জোয়ান।
জেন বোবা দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে ছিল জোয়ানের দিকে। জোয়ানকে তার নতুন জোয়ান মনে হচ্ছিল। আগের জোয়ানের মধ্যে ছিল প্রতিভার এক শান্ত জ্যোতি, আর এ জোয়ানের মধ্যে দেখতে পাচ্ছে একজন প্রতিবাদী-বিপ্লবীর অদম্য তেজ। জোয়ানের এ রূপ তার কাছে আরও মোহনীয়, আরও পৌরুষদীপ্ত মনে হলো।
কিছুক্ষণ এভাবে তাকিয়ে থাকার পর জেন বলল, ‘ঐ ইতিহাসে কী জেনেছ বলবে?’
‘নিশ্চয় তোমাকে বলব জেন!’ বলে জোয়ান কিভাবে তার পূর্বপুরুষ ভ্যালেনসিয়া থেকে উচ্ছেদ হয়েছিল, কিভাবে পিতা-মাতার কাছে থেকে সন্তানদের কেড়ে নেয়া হয়েছিল, পিতা-মাতা থেকে তার বালক পূর্বপুরুষের মর্মান্তিক জীবনটা কেমন ছিল ইত্যাদি যত কাহিনী জোয়ান জেনকে শোনাল। বলা শেষ করে থামল জোয়ান।
চোখ বুজল জেন। কোন কথা সে বলল না। তার দৃষ্টিতে তখন ৫শ’ বছর আগের দৃশ্য। শিক্ষা, সভ্যতা, শক্তিতে বিশ্বের সেরা একটি জাতি, মুসলমানরা স্পেনে রাজত্ব করতো। তারা স্পেনকে, স্পেনীদেরকে অন্ধকার থেকে আলোতে নিয়ে এলো। সুআচরণ ও সুব্যবহার দিয়ে তারা স্পেনীয়দের আপন করে নিল, স্পেনীয়রাও তাদেরকে বুকে জড়িয়ে ধরল। জেন ভাবল, জোয়ান সেই মহান জাতিরই একজন। তাদের গৌরব, তাদের শক্তিই জোয়ানের বুকে এসে মাথা তুলেছে। কিন্তু অতীত তো বর্তমান হতে পারে না!
জেন চোখ খুলল। দেখল, জোয়ান তার দিকেই তাকিয়ে আছে। জেন বলল, ‘একটা কথা বলব?’
‘বল।’
‘তোমাকে বর্তমান নিয়ে ভাতে হবে জোয়ান। এখন তোমার কি আছে, কি নেই তার ভিত্তিতেই তোমাকে কথা বলতে হবে।’
‘তোমার কথা বুঝেছি। আমি তো লড়াইয়ে নামতে চাচ্ছি না। আমি শুধু আমার পরিচয় নিয়ে বেঁচে থাকতে চাই।’
‘এজন্য তুমি মরিসকো- একথা ঘোষণা করার দরকার আছে?’
‘আছে জেন, মরিসকোদেরকে তাদের হীন অবস্থা থেকে নিজের পরিচয় নিয়ে মাথা তুলে দাঁড়াতে হবে। নিজেদেরকে তাদের প্রকাশ করতে হবে।’
কোন উত্তর দিল না জেন।
আবার সে চোখ বুজেছে।
এবার জোয়ানই কথা বলল। বলল, ‘জেন, একটা কথা বলব তোমাকে।
‘বল, কি কথা?‘ তড়িঘড়ি চোখ খুলে জোয়ানের দিকে চোখ তুলে বলল জেন।
জোয়ান একটু দ্বিধা করল। তারপর ধীরে ধীরে বলল, ‘এই যে দীর্ঘ দিনের জানাজানি আমাদের, আজ তুমি যে এলে, এত কথা হলো, সব আমাদের ভুলে যাওয়া উচিত।’
‘কেন?’ দৃঢ় কন্ঠ জেনের।
‘কেন একথা বলছি তুমি জান।’
‘আমার কাছে ওটা যদি কোন কারণ না হয় তাহলে?’
‘অবুঝ হলে চলবে না জেন। এটা বাস্তবতা। আমি চাই না তোমার সুন্দর জীবন কোন ঝড়ের কবলে পড়ুক!’
‘তুমি না চাইলে আমি কেমন করে চাইতে পারি তোমার মতো অতুলনীয় একটা প্রতিভা ধ্বংসের কবলে পড়ুক?’
‘আমি যে অবস্থায় পড়েছি সেটা একটা বাস্তবতা। আমরা চাইলেও এটা এড়াতে পারতাম না।’
‘আর ঝড়ে উপড়ে পড়ার ভয়ে আমি বুঝি আমার নিজের বাস্তবতা পরিত্যাগ করতে পারি?’
‘আমাকে ভূল বুঝ না জেন, সময় আমাদের এ আবেগ, এ অনুভূতিকে মুছে ফেলতে পারে।’
লাফ দিয়ে উঠে বসল জেন। হামগুড়ি দিয়ে ছুটে এলো জোয়ানের কাছে। মুখোমুখি হয়ে বলল, ‘কি বললে তুমি, কি বললে তুমি জোয়ান।’
বলতে বলতে উঠে দাঁড়াল জেন। অশ্রুরুদ্ধ কন্ঠে বলল, ‘জোয়ান, তুমি নিজেকে দিয়ে সবাইকে বিচার করতে পার না।’
বলে জেন ছুটে বেরিয়ে গেল।
জোয়ান বোবার মতো বসে রইল। সে যেন এই জগতে নেই।
কয়েক মুহূর্ত পরেই ছুটে এসে ঘরে ঢুকল জোয়ানের মা। বলল, ‘জেনের কি হলো? ও কি গাড়ি চালাতে পারবে?’
জোয়ানের সম্বিত ফিরে পেল। আতংকে তার মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেল।
ছুটে বাইরে বেরিয়ে গেল জোয়ান।
জোয়ান যখন গাড়ি বারান্দায় পৌঁছল, জেনের গাড়ি গেট পেরিয়ে তখন রাস্তায় গিয়ে পড়েছে। জোয়ান গাড়ি দেখতে পেল না।
দু’হাতে মাথা চেপে ধরে গাড়ি বারান্দায় বসে পড়ল জোয়ান। জেন শুধু দুর্বল নয়, তার মাথাও এখন ঠিক নেই। এ অবস্থায় গাড়ি চালানোর অর্থ …..।
বিভীষিকাময় একটা দৃশ্য ফুটে উঠল জোয়ানের চোখে।
জোয়ানের মা এসে জোয়ানের মাথায় হাত রাখল।
জোয়ান শিশুর মতো কেঁদে উঠল, ‘আম্মা, আমি জেনকে খুন করেছি।’

মাদ্রিদ জেনারেল হাসপাতাল।
ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট থেকে ছাড়া পেয়ে জেন কেবিনে এসে উঠল।
জেনের গাড়ি একটা লাইট পোষ্টের সাথে ধাক্কা খায়। আঘাত গাড়ির বাম অংশের ওপর দিয়ে যায় বলে জেন প্রাণে বেঁচে গেছে। তবু সে মাথার বাম পাশে ও বাম চোখে ভয়ানক আঘাত পেয়েছে। ১২ ঘন্টা পর তার জ্ঞান ফেরে। গাড়ির ব্লু-বুক থেকে ঠিকানা নিয়ে পুলিশ জেনের আব্বাকে টেলিফোনে খবর দেয়। জেনের বাবা মা ছুটে আসে হাসপাতালে। সর্বাত্মক চিকিৎসা-যত্ন জেন পায়, কিন্তু তারপরও তার বাম চোখটার ক্ষত রোধ করা যায়নি। জেনকে বাঁচানেই যেহেতু মুখ্য ছিল, তাই চোখের ক্ষতিটা স্বীকার করে নেয়া হয়েছে। জেন জোয়ানের ওখানে গিয়েছিল একথা বাবা-মা’র কাছে গোপন রেখেছে। আর বাবা-মা জানতেও চেষ্টা করেনি, জেন কোথায় গিয়েছিল। জেনকে কেন তারা একা গাড়ি নিয়ে বেরুতে দিল, এজন্যে তারা নিজেরাই নিজেদের অপরাধী মনে করেছে। জেন বাবা-মা’র একমাত্র সন্তান। গত কয়েকদিন জেনের বাবা-মা হাসপাতালেই পড়ে আছে। জেন বিপদমুক্ত হওয়ার এবং ইনটেনসিভ কেয়ার থেকে ছাড়া পাবার পর জেনের বাবা-মা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে।
জেন ইনটেনসিভ কেয়ারে থাকার সময় জেনের বাবা-মা ছাড়া কোন ভিজিটরকেই এ্যালাউ করা হয়নি।
জেনকে কেবিনে স্থানান্তরিত করার কয়েক মিনিট পরেই হান্না গিয়ে হাজির হলো কেবিনের দরজায়। কেবিন থেকে বেরুচ্ছিল জেনের আব্বা-আম্মা। হান্নাকে দেখে তারা খুশি হলো। বলল, ‘মা, এখন আর কোন অসুবিধা নেই জেনের সাথে দেখা করার। যাও, জেন একাই আছে।’
বলে একটু থামল জেনের আব্বা। তারপর বলল, ‘তুমি কতক্ষণ থাকছ হান্না?’
‘কেন আংকেল?’
‘তাহলে আমরা দু’জন বাড়ি থেকে ঘুরে আসতে পারি। ধরো ঘন্টা দু’সময়।’
‘আমি দু’ঘন্টার বেশি থাকতে পারি। অসুবিধা নেই। আপনারা আসুন।’
জেনের আব্বা-আম্মা চলে গেল।
কেবিনে প্রবেশ করল হান্না।
চোখ বুজে শুয়ে আছে জেন। তার বাম চোখে ব্যান্ডেজ। মাথায় ব্যান্ডেজ।
জেন আরও শুকিয়ে গেছে।
হান্না ধীরে ধীরে জেনের পাশে বসে তার হাতে হাত রাখল।
চমকে উঠে চোখ খুলল জেন। হান্নাকে দেখে হেসে উঠল। বলল, ‘এতদিনে এলি, কতদিন তোকে দেখিনি।’
‘বারে প্রতিদিন এসেছি, কিন্তু ইনটেনসিভ ইউনিটে ঢুকতে দিলে তো!’
‘হ্যাঁ, শুনলাম বাবা-মা ছাড়া কাউকেই ঢুকতে দেয়নি।’
জেন মুহূর্তের জন্যে থামল। তারপরেই প্রশ্ন করল আবার, ‘তুই জানতে পেরেছিলি কবে?’
‘এ্যাকসিডেন্টের এক ঘন্টার মধ্যে।’
‘এক ঘন্টার মধ্যে! কি করে?’
‘সে এক কাহিনী!’ মুখ টিপে হেসে বলল হান্না।
‘কাহিনী? কি সেটা?’
হান্না গম্ভীর হলো। বলতে শুরু করল, ‘সেদিন সন্ধ্যা সাতটা। আমি বাইরে থেকে ফিরছি। গেটে জোয়ানের সাথে দেখা। আমাকে না পেয়ে সে ফিরে যাচ্ছিল। তার উস্কো-খুস্কো, বিধ্বস্ত চেহারা। আমাকে সামনে পেয়ে সে শিশুর মতো কেঁদে ফেলল। বলল, ‘হান্না, আমি জেনকে খুন করেছি। আমি আঁৎকে উঠলাম। ধমক দিয়ে বললাম, এসব কি বলছ জোয়ান? জোয়ান বলল, ঠিকই বলছি, ও অসুস্থ, ওকে রাগানো আমার ঠিক হয়নি। আমার ওপর রাগ করে অসুস্থ শরীর নিয়ে গাড়ি চালাতে গিয়ে ও এ্যাকসিডেন্ট করেছে। ও এখন জেনারেল হাসপাতালে। তুমি যাও হান্না, আমাকে খবর এনে দাও। বলে কান্নায় ভেঙে পড়ল জোয়ান। আমি সংগে সংগেই গাড়ি ঘুরিয়ে নিয়ে চলে আসি।’ হান্না থামল।
অশ্রুতে ভরে উঠেছিল জেনের চোখ।
‘ও কোথায় হান্না?’ বলল জেন।
‘ও প্রতিদিন হাসপাতারে আসে, আজও ওয়েটিং রুমে অপেক্ষা করছে। আমি খবর নিয়ে গেলে তবে যাবে।’
‘ওকে ডেকে দিতে পারবি হান্না?’
‘ডাকব। তার আগে একটা কথা বলি, তোর এতটা পাগলামী কি ঠিক হয়েছে? তুই সেদিনই যদি যাবি আমাকে খুলে বললি না কেন?’
‘মাফ কর হান্না, আমি কিছুতেই স্থির থাকতে পারিনি, দেরি করতে পারিনি।’
‘আর ওর ওপর এভাবে রাগ করলি কেন? অভিমান বুঝি এভাবে করে!’
‘কয়দিন ইনটেনসিভ কেয়ারে শুয়ে শুয়ে আমি ভেবেছি হান্না, ঐভাবে রাগ করা আমার ঠিক হয়নি। ওর দিকটা ভাবলে আমি ওর ওপর রাগ করতে পারতাম না।’ হান্না উঠে দাঁড়াল।
‘ওকে পাঠাচ্ছি জেন!’ বলে হান্না কেবিন থেকে বেরুবার জন্যে পা বাড়াল।
‘তুমি আবার চলে যেয়ো না যেন।’ বলল জেন হান্নাকে লক্ষ্য করে।
জোয়ান কেবিনে প্রবেশ করল, জেন তখন দরজার দিকেই তাকিয়ে ছিল। জোয়ান এসে জেনের পাশে দাঁড়াল। জেন তখন তার চোখ নামিয়ে নিয়েছে। চোখ বুজেছে সে। বোজা চোখ থেকে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে জেনের।
জোয়ানের বুকে তখন তোলপাড়। জেনের বাম চোখের ব্যান্ডেজটা তার বুকে সূচবিদ্ধ করছে। কোনদিন কি আর ঐ চোখ দিয়ে দেখতে পাবে জেন! এত বড় সর্বনাশ হলো তারই ভুলে, তারই দোষে। অসুস্থ জেন কোন কথা বলতে না চেয়েও কেন সে ঐসব কথা সেদিন বলেছিল! কি কথা আজ সে বলবে জেনকে। জোয়ানেরও চোখ থেকে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছিল। কেউই কথা বলতে পারছিল না।
সময় বয়ে চলছিল পল পল করে।
মুখ খুলল জোয়ানই প্রথম। বলল, ‘আমাকে মাফ কর জেন, আমি সেদিন ভুল বলেছিলাম। ভুলের খেসারত যে এত বড় হবে আমি বুঝিনি। তোমার চোখ….’
কথা শেষ করতে পারল না জোয়ান। কান্নায় কন্ঠ বন্ধ হয়ে গেল। চোখ খুলল জেন। চোখ থেকে উপছে পড়া অশ্রু স্রোতের মতো নেমে এলো গন্ড বেয়ে। বলল, ‘জোয়ান, আমি আজ সুখী। আমার জন্যে তোমার ঐ চোখের পানি গোটা দুনিয়ার চেয়ে আমার কাছে মূল্যবান। হান্না আমাকে সব বলেছে। একটা চোখ হারিয়েও যদি আমি এটা পেয়ে থাকি আমি ভাগ্যবতী।’
এসময় কেবিনে প্রবেশ করল হান্না। বলল, ‘দু’জনে গন্ডগোল পাকিয়ে অঘটন ঘটিয়ে দু’জনেরই আবার কাঁদা হচ্ছে! কান্না থামাও, চাচাজান আসছেন।’
জোয়ান ও জেন দু’জনেই চোখ মুছল। চোখ মুছে জেন জোয়ানকে নরম কন্ঠে বলল, ‘মরিসকোদের নিয়ে আমাদের কাছে যেমনটা তুমি বলেছিলে, আব্বার কাছে বলো না যেন। তোমাকে অনেক ধৈর্য ধরতে হবে জোয়ান।’
জোয়ান নিরবে গিয়ে বসল সোফায়।
জেনের আব্বা ফ্রান্সিসকো জেমেনিজ কেবিনে ঢুকেই দেখতে পেল জোয়ানকে। মুখে একটা বিস্ময়ের রেখা ফুটে উঠেই আবার মিলিয়ে গেল। তার মুখ থেকে বেরিয়ে এলো, ‘জোয়ান তুমি!’
জোয়ান উঠে দাঁড়িয়েছিল। বলল, ‘জি।’
‘তোমার খবরে আমরা সবাই দুঃখিত, কিন্তু সত্য যা তা হতেই হবে, কি বল?’ বলল জেনের আব্বা।
‘জি।’ বলল জোয়ান।
জেনের আব্বা সোফায় না বসে জেনের খাটে গিয়ে ঠেস দিয়ে দাঁড়াল। তার মুখ জোয়ানের দিকে। বলল, ‘বুঝলে জোয়ান, তুমি এতটুকুন বয়সে যে দুর্লভ কৃতিত্ব দেখিয়েছ এবং আরও যা তুমি পার, জাতির কোন কাজে আসবে না, এটাই দুঃখ। জাতির কেউ মরিসকোদের বিশ্বাস করে না।’
জোয়ান দাঁড়িয়েই ছিল। কোন উত্তর দিল না। মুহূর্ত কয়েক বিরতি দিয়ে জেনের আব্বা আবার শুরু করল, ‘জোয়ান, একটা কথা আমি বুঝি না, মরিসকোরা পরিচয় গোপন রেখে অন্যদের প্রতারণা করে কেন? এতে গন্ডগোল আরও বাড়ে। ধরো তোমার কথা, তুমি মরিসকো পরিচয় দিয়ে লেখাপড়া যদি করতে, তাহলে কি হতো? সুযোগ-সুবিধা, সহযোগিতা কম পেতে। এটা ঠিক। কিন্তু এটা তো বাস্তবতা! এ বাস্তবতা অস্বীকার না করলে তোমাকে তো এমন বিপর্যয়ে পড়তে হতো না।’ থামলো জেনের আব্বা।
জেন চোখ বুজে আছে। তার মুখ লাল হয়ে উঠেছে। জোয়ান মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। তার মুখও লাল। কিন্তু কোন কথা বলল না সে।
হান্না জেনের মাথার কাছে দাঁড়িয়ে আছে। সংকুচিত সে। ভয় করছে কিছু বলতে। ভাবছে কিছু বললে হয়তো আঙ্কেলের কথা খারাপের দিকে মোড় দিতে পারে।
জেনের আব্বা গা থেকে কোট খুলে কেবিনের হ্যাংগারে রাখতে রাখতে বলল, ‘জোয়ান, তুমি জেনকে দেখতে এসেছ খুব খুশি হয়েছি। হাজার হলেও ছোটবেলা থেকে এক সাথে পড়েছ। তবে জান কি, জেন ‘দি গ্রেট কার্ডিনাল’ পরিবারের মেয়ে। এভাবে তোমার আসাটা অনেকেই পছন্দ করবে না।’
জেনের মুখটা পাংশু হয়ে গেল যেন মুখের আলোটা দপ করে নিভে গেল! জিহবা, গলা তার শুকিয়ে এলো। কোন কথা বলতে পারল না। চোখ খুলে জোয়ানের দিকে তাকাতেও তার ভয় হতে লাগল। হান্না উৎকন্ঠিত চোখে তাকিয়ে ছিল জোয়ানের দিকে।
কিন্তু জোয়ান পাথরের মতো স্থির। মুখ নিচু তখন তার। দাঁত দিয়ে ঠোঁট সে কামড়ে ধরেছে।
জেনের আব্বা থামলে জোয়ান মুহূর্তের জন্যে চোখ বন্ধ করে, একটা ঢোক গিলে নিজেকে সামলে বলল, ‘আমি আসি, চাচাজান।’
বলে জোয়ান পা বাড়াল দরজার দিকে। পেছন থেকে জেনের আব্বা বলে উঠল, শোন জোয়ান, ‘একটু সাবধানে থেকো। তুমি ‘এ্যারোমেটিক ইঞ্জিনিয়ার্স’-এর চীফ ইঞ্জিনিয়ার মি. মিশেলের নাম শুনে থাকবে। সে মরিসকো বলে জানাজানি হবার পর কে বা কারা তাকে হত্যা করেছে।’
জোয়ান ঘুরে দাঁড়িয়েছিল। মুখ তুলে জেনের আব্বার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ধন্যবাদ চাচাজান!’
বলে ঘুরে দাঁড়িয়ে শান্ত পায়ে কেবিন থেকে বেরিয়ে গেল জোয়ান।’

Top