১২. কর্ডোভার অশ্রু

চ্যাপ্টার

রাতের মাদ্রিদ, ফাঁকা রাস্তা। ট্যাক্সি চলছিল ঝড়ের বেগে।
ট্যাক্সির প্যানেল বোর্ডের দিকে তাকিয়ে আহমদ মুসা দেখল রাত তখন আড়াইটা।
কোথায় যেতে হবে জিজ্ঞেস না করেই ট্যাক্সি ড্রাইভার তার গাড়ি ছেড়ে দিয়ে ছিল। সোজা রাস্তাটি একটা মোড়ের মুখোমুখি হলে ট্যাক্সি ড্রাইভার পেছন দিকে না ফিরেই জিজ্ঞেস করল, ‘কোথায় যাবো স্যার?’
আহমদ মুসা ও মারিয়া পেছনের সিটে বসেছিল। ড্রাইভারের প্রশ্ন শুনে আহমদ মুসা মারিয়ার দিকে তাকাল।
মারিয়া বুঝল, কোথায় যেতে হবে সেটা মারিয়াকেই বলতে হবে। বিদেশি সে, বলবে কি করে।
মারিয়া একটু ভাবল। মাদ্রিদ বিমান বন্দর থেকে সোজা লা গ্রিনজাতে যেতে বলা হয়েছে। মাদ্রিদের বাড়িতে নিশ্চয়ই কেউ নেই। সুতরাং সেখানে গিয়ে লাভ নেই। লা-গ্রিনজাতে এই ট্যাক্সি যাবে না।
‘সেন্ট্রাল ট্যাক্সি পুলে চল।’ বলল মারিয়া। সেন্ট্রাল ট্যাক্সি পুল উত্তর মাদ্রিদে। অনেক দূর-প্রায় দশ মাইলের মতো এগোতে হবে।
ট্যাক্সি ড্রাইভার মোড়ে পৌঁছে উত্তরমুখী মাদ্রিদ সেন্ট্রাল হাইওয়ে ধরে এগিয়ে চলল।
কিছুক্ষণ চলার পর ড্রাইভার বলল, ‘শুরু থেকেই একটা গাড়ি আমাদের পেছনে। আমি যতই স্পিড বাড়াচ্ছি, ওরাও বাড়াচ্ছে। আমার সন্দেহ নেই ওরা আমাদের পিছু নিয়েছে।’
আহমদ মুসা সংগে সংগেই তার চোখ পেছনে ফেরাল। দেখল, দু’টো হেড লাইটচ ছুটে আসছে।
মারিয়াও চোখ ফেরাল পেছনে। সেও দেখতে পেল ছুটে আসা দু’টো হেডলাইট। তার চোখে ফুটে উঠল উদ্বেগ। সে পেছন থেকে চোখ ফিরিয়ে নিয়ে তাকাল আহমদ মুসার দিকে। কিন্তু অন্ধকারের মধ্যে আহমদ মুসার মুখ সে দেখতে পেল না। অন্ধকারের মতোই রাজ্যের উদ্বেগ এসে ঘিরে ধরল মারিয়াকে। সে অবশ্য ভাবল, পাশের সুন্দর, শান্ত, সরল লোকটির সঙ্গ সে যতটুকু পেয়েছে, যতটুকু তার কাজ দেখেছে তাতে এ বিস্ময়কর মানুষটির ওপর চোখ বুজে নির্ভর করা যায়। কিন্তু সেতো আহত, আর একজন মানুষের শক্তি কতটুকুই বা!
ওরা নিশ্চয় দল বেঁধে ছুটে আসছে!
আহমদ মুসা পেছন থেকে চোখ ফিরিয়ে নিয়ে সোজা হয়ে বসল। একবার হাত দিয়ে পকেটের রিভলবারটা স্পর্শ করল। তারপর বলল, ‘তুমি ঠিকই বলছ ড্রাইভার, ওরা আমাদের ফলো করছে। তুমি গাড়ির স্পিড বাড়িয়ে দাও। সামনের টার্নিং পয়েন্টে গাড়ি ঘুরিয়ে নেবে, দক্ষিণ দিকে চলবে। যা করার আমি করব। তোমার ভয় নেই।’
গাড়ির স্পিড বাড়াতে গিয়ে আঁৎকে উঠল ড্রাইভার, ‘স্যার, রং লেন ধরে সামনে থেকে একদম আমাদের নাক বরাবর একটা গাড়ি ছুটে আসছে!’
সংগে সংগে আহমদ মুসার চোখ চলে গেল সামনে। দেখল দু’টো হেডলাইট পাগলা ঘোড়ার মতো ছুটে আসছে। আহমদ মুসার বুঝতে বাকি রইল না, ক্লু-ক্ল্যাক্স-ক্ল্যান সামনে-পেছনে দু’দিকে থেকেই তাদের ঘিরে ফেলেছে। আহমদ মুসা বলল, ‘ড্রাইভার, আমাদের ওরা ফাঁদে আটকিয়েছে। সামনে-পেছনে দু’দিক থেকেই ওরা আসছে।’
‘স্যার, আমি গরীব মানুষ, আমার গাড়ির কিছু হলে…’ কথা শেষ না করেই থেমে গেল ড্রাইভার।
আহমদ মুসা একটু ভাবল। সামনের গাড়িটা বেশ দূরে আছে, পেছনের গাড়িটা কাছে এসে পড়েছে।
‘তোমার কোন ভয় নেই ড্রাইভার। তুমি গাড়ি থামিয়ে দাও। হ্যাজার্ড লাইট অন করো।’ নির্দেশ দিল আহমদ মুসা।
ড্রইভার অবাক হয়ে একবার পেছনে তাকিয়েই গাড়ি থামিয়ে দিল।
‘তারপর, এখন কি হবে?’ বিস্ময়ে চোখ কপালে তুলল মারিয়া।
‘আত্মসমর্পন নিশ্চয় করব না।’ বলে আহমদ মুসা গাড়ি থেকে নামতে নামতে বলল, ‘তুমি রেডি থাক ড্রাইভার, বলার সাথে সাথে যাতে গাড়ি স্টার্ট দিতে পার।’
আহমদ মুসা গাড়ি থেকে নেমে গাড়ির তলায় শুয়ে পড়ল। রিভলবারের ট্রিগারে তার আঙ্গুল।
পেছনের গাড়ি একদম কাছে এসে গেছে। হঠাৎ এ গাড়ি দাঁড়াতে দেখে এবং হ্যাজার্ড লাইট জ্বালাতে দেখে তারাও হ্যাজার্ড লাইট অন করেছে, কিন্তু গাড়ির স্পিড কমায়নি। সম্ভবত ওরা মনে করল মারিয়া, আহমদ মুসারা পালাবার চেষ্টা করছে। তাই তারা তাড়াতাড়ি এখানে পৌঁছতে চাচ্ছে।
রিভলবারের রেঞ্জের ভেতর আসতেই আহমদ মুসা ধীরে-সুস্থে গাড়িটির বাম পাশের সামনের চাকায় গুলী করল। তারপর রেজাল্ট দেখার অপেক্ষা না করেই লাফ দিয়ে গাড়িতে উঠে এলো। দরজা বন্ধ করতে করতে বলল, ‘স্টার্ট’।
সংগে সংগেই লাফিয়ে উঠে ছুটতে লাগল ট্যাক্সিটি।
মারিয়া জানালা দিয়ে পেছনে তাকিয়েছিল। মুখ ঘুরিয়ে এনে আহমদ মুসার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘কনগ্রাচুলেশন! গাড়িটা হুমড়ি খেয়ে রাস্তার পাশে উল্টে গেছে।’
‘উল্টানোর কথা ছিল না সম্ভবত লোড বেশি ছিল গাড়িতে।’ বলল আহমদ মুসা।
সামনে রাস্তার বাম পাশে মাদ্রিদ পার্ক। আর রাস্তার ডান পাশে প্রশাসনিক ভবনসমূহ।
‘রাস্তার বাম পাশ ঘেঁষে গাড়ি চালাও ড্রাইভার।’ বলল আহমদ মুসা, ‘আমি যেখানে তোমাকে থামতে বলব সেখানেই থেমে যাবে।’
তারপর আহমদ মুসা মারিয়াকে বলল,’তুমি এপাশে এসো, আমাকে বাম পাশটা দাও।’
মারিয়া সরে এলো। আহমদ মুসা বাম পাশে দরজা ঘেঁষে বসল।
সামনের গাড়ি তখন দু’শ গজের মতো দূরে। সামনেই রাস্তার ধার ঘেঁষে কয়েকটা জলপাই গাছ। এরপর কয়েক গজ ফাঁকা জায়গা, তারপর পার্ক শুরু।
‘ড্রাইভার, আমি নেমে যাবার পর দ্রুত তুমি গাড়ি ব্যাক করবে, যাতে সামনের গাড়ি বুঝতে পারে আমরা ভয় পেয়ে পিছিয়ে যাচ্ছি। সামনের গাড়িটি না থেমে যাওয়া পর্যন্ত তুমি পেছতেই থাকবে।’ কথা শেষ করেই আহমদ মুসা বলল, ‘দাঁড়াও!’ গাড়ি তখন জলপাই গাছ সোজাসুজি এসে গেছে।
দরজা আন-লক করেই বসেছিল আহমদ মুসা। গাড়ির গতি স্লো হতেই এবং গাড়ি থেমে যাবার জার্কিংটা আসার ঠিক আগেই আহমদ মুসা ধাক্কা দিয়ে দরজা খুলে ফেলল। অদ্ভুত দক্ষতার সাথে ডাইভ দিয়ে রাস্তায় গিয়ে পড়ল এবং কয়েকবার ডিগবাজি খেয়ে জলপাই গাছের ছায়া পর্যন্ত এগিয়ে গেল। তারপর শুয়ে থেকে একটু দম নিয়ে তাকাল ট্যাক্সির দিকে। হ্যাঁ, ট্যাক্সিটি দ্রুত পিছিয়ে যাচ্ছে। দৃষ্টি ফেরাল আহমদ মুসা, সামনের গাড়িটা দ্রুত ছুটে আসছে। আর কয়েক মুহূর্ত, তারপরেই গাড়িটি আহমদ মুসার সমান্তরালে চলে আসবে।
আহমদ মুসা ঘাসের ওপর দিয়ে সাপের মতো গড়িয়ে রাস্তার কিছুটা কাছে এগিয়ে গেল। এসে পড়ল গাড়িটা। জীপ গাড়ি।
সমান্তরালে আসার আগেই ৪৫ ডিগ্রি অবস্থানে সামনের ডান চাকা লক্ষ্য করে ধীরে সুস্থে গুলী করল আহমদ মুসা। মাত্র দশ গজ দূরত্ব থেকে। সশব্দে বিস্ফোরিত হলো টায়ার।
এ গাড়িটা উল্টে গেল না, কিন্তু টাল সামলাতে গিয়ে এঁকেবেঁকে রাস্তার অনেকখানি বাইরে চলে এসে থেমে গেল।
যেখানে এসে গাড়ি দাঁড়াল সেটা আহমদ মুসার সাথে সমান্তরাল অবস্থান। দূরত্ব আহমদ মুসা থেকে ৫ গজের বেশি নয়। আহমদ মুসা একটু পিছিয়ে জলপাই গাছের ছায়ায় সরে গেল।
জীপটি থামতেই ব্রাশ ফায়ার করতে করতে একজন নেমে এলো।
চাকার দিকে একবার তাকিয়েই সে চোখ ফেরাল জলপাই গাছের অন্ধকার ছায়ার দিকে।
রিভলবারে মাত্র আর দু’টি গুলী রয়েছে।
আহমদ মুসা তার রিভলবার তুলল স্টেনগানধারী লোকটিকে লক্ষ করে। ট্রিগারে চাপ দিল আহমদ মুসা।
ঠিক এই সময়েই গাড়ির ওপাশ থেকে আরেকজন স্টেনগানধারী এসে দাঁড়াল প্রথমজনের পাশে।
গুলীটা কপাল ভেদ করে ঢুকে গিয়েছিল। প্রথম স্টেনগানধারী দ্বিতীয় স্টেনগানধারীর পায়ের তলায় লুটিয়ে পড়ল।
চমকে উঠে দ্বিতীয় স্টেনগানধারী তার স্টেনগান ঘুরাল জলপাই গাছের অন্ধকারের দিকে।
আহমদ মুসা তার হাত আর নামায়নি। রিভলবারের নলটা সামান্য ঘুরিয়ে আরেকবার ট্রিগার টিপল সে। দ্বিতীয় স্টেনগানধারী তার স্টেনগানের ট্রিগার টেপার আগেই প্রথম জনের লাশের ওপর মুখ থুবড়ে পড়ে গেল।
ঠিক এই সময়েই দু’দিক থেকে দু’টি পুলিশের গাড়ি আসতে দেখা গেল।
পুলিশের একটা গাড়ি এসে থামল জীপের কাছে, আরেকটা ট্যাক্সির কাছে।
আহমদ মুসা জলপাই গাছের অন্ধকার থেকে বের হয়ে অগ্রসরমান দু’জন পুলিশের হাতে তার শূন্য রিভলবারটি তুলে দিয়ে জীপের কাছে সেই দুই লাশের পাশে এসে দাঁড়াল।
একজন পুলিশ অফিসার এগিয়ে এসে পুলিশের কাছ থেকে আহমদ মুসার রিভলবারটি হাতে নিয়ে বলল, ‘এই রিভলবার দু’টি গুলী দিয়ে এ দু’জনকে আপনি খুন করেছেন?’
‘হ্যাঁ, আমিই গুলী করেছি।’
‘আর চারটি গুলী কোথায়?’
‘একটি দিয়ে দক্ষিণে অল্প দূরে উল্টে থাকা গাড়ির চাকা ফুটো করেছিলাম?’
‘আর তিনটি?’
‘একটি দিয়ে এই জীপের চাকা ফাটিয়েছি।’
‘অবশিষ্ট দু’টি?’
‘অবশিষ্ট দু’টি এদের বন্দীখানা থেকে বের হবার জন্যে আমরা খরচ করেছি।’
এই সময় মারিয়া ও ড্রাইভারকে নিয়ে পুলিশের অন্য দলটি সেখানে এসে পৌঁছল।
আহমদ মুসা মারিয়াকে দেখিয়ে বলল, ‘ও আর আমি।’
মারিয়াদের নিয়ে আসা পুলিশ অফিসারটি বলল, ‘এই মেয়ে আর ওকে এই গ্রুপ কিডন্যাপ করে ওদের ঘাঁটিতে আটক করে। সেখান থেকে ওরা পালায়। ওরা ধরার জন্যে এদের পিছু নেয়। অবশেষে এখানে লড়াইটি বাঁধে।’
আগের পুলিশ অফিসারটি আহমদ মুসার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আপনি তো দেখছি একা দশজনের লড়াই করেছেন!’
‘বলেন কি, দশজনও এদের গায়ে হাত দিতে পারতো না।’ বলল অন্য পুলিশ অফিসারটি।
‘উল্টে পড়া গাড়িটা কোথায়?’ বলল প্রথম পুলিশ অফিসার।
‘গাড়িটা উল্টে গিয়ে আগুন ধরে গিয়েছিল। আহত হয়েছে কয়েকজন ওদের পাঠিয়ে দিয়েছি। ওখানে পাঁচটা স্টেনগান ও তিনটা রিভলবার পাওয়া গেছে।’
প্রথম পুলিশ অফিসারটি আহমদ মুসা, মারিয়া ড্রাইভারকে লক্ষ করে বলল, ‘উঠুন আপনারা গাড়িতে।’
দ্বিতীয় পুলিশ অফিসার বলল, ‘দু’জন পুলিশ দিয়ে ট্যাক্সি ড্রাইভারকে হেডকোয়ার্টারে পাঠিয়ে দিই। তাহলে ট্যাক্সিটাও নিয়ে যাওয়া হলো।’
‘ঠিকই বলেছেন।’ বলল প্রথম পুলিশ অফিসার।
‘আমাদের যেতে হবে কেন? আমাদের তো দোষ নেই। আমরা যা করেছি, নিজেদের বাঁচার জন্যেই করেছি।’ বলল মারিয়া।
‘সে বিচার তো আমরা করব না, করবে কোর্ট।’ বলল প্রথম পুলিশ অফিসার।
‘আর এটা আপনাদের নিরাপত্তার জন্যেও প্রয়োজন।’ বলল দ্বিতীয় পুলিশ অফিসার।
‘কিভাবে?’ বলল মারিয়া।
‘জানেন কারা আপনাদের কিডন্যাপ করেছে, কাদের সাথে আপনারা লেগেছেন? ক্লু-ক্ল্যাক্স-ক্ল্যান! ওদের গায় আমাদের সরকারও হাত দেয় না।’
‘তাহলে আমরা হাত দিয়ে নিশ্চয় অপরাধ করেছি?’ বলল আহমদ মুসা।
‘আমরাও ওদের এড়িয়ে চলি। ওদের গায়ে হাত দিয়ে কেউ রেহাই পায় না।’ বলল দ্বিতীয় পুলিশ অফিসার।
আহমদ মুসা ও মারিয়া গাড়িতে উঠল। গাড়িটা একটা প্রিজনারস্ ভ্যান।
আহমদ মুসা উঠলে বাইলে থেকে ভ্যানে তালা লাগিয়ে দেয়া হলো। ভ্যানে একটাই দরজা। ঘুলঘুলির মতো ছোট অনেক জানালা রয়েছে।
ভ্যানের ভেতর ডিম লাইট। বসার জন্যে লাইন করে বসানো লোহার চেয়ার। চেয়ারে বসে আহমদ মুসা চোখ বন্ধ করে গা এলিয়ে দিল বিশ্রামের জন্যে।
মারিয়ার মুখ পাংশু। মামলায় কি হবে কে জানে? একটা আতংক এসে তাকে ঘিরে ধরেছে। সবচেয়ে বড় বিপদ হলো তার পরিচয় প্রকাশ হওয়ার ভয়।
মারিয়া তাকাল আহমদ মুসার দিকে। আহমদ মুসার মুখ দেখে সে বিস্মিত হলো! সে মুখে কোন ভয়, উদ্বেগ বা দুশ্চিন্তার লেশমাত্র নেই। মনে হচ্ছে যেন নিজের বাড়ির ইজিচেয়ারে বিশ্রাম নিচ্ছে! লোকটাকে যতই সে দেখছে, তার বিস্ময়ের পরিধি বাড়ছে। এর কাছে কোন বিপদ যেন বিপদ নয়, কোন কাজই যেন অসাধ্য নয়! কে এই লোক? এ শুধু অসাধারণ নয়, অসাধারণদের মধ্যে অসাধারণ। এমন সরর, সুন্দর মুখচ্ছবির মধ্যে অসাধারণ মানুষ কেমন করে বাসা বেঁধে আছে!
কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেবার পর আহমদ মুসা চোখ খুলল। একবার চোখ তুলে তাকাল মারিয়ার দিকে। ঠোঁটে হাসি টেনে বলল, ‘কিছু ভেব না মারিয়া। আমরা ন্যায়ের ওপর আছি। আল্লাহ আমাদের সহায়।’
বলে আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল। একে একে সব জানালায় চোখ রাখল বুঝল হাইওয়ে থেকে বেরিয়ে অপেক্ষকৃত ছোট রাস্তা দিয়ে তারা এগোচ্ছে।
আহমদ মুসা সবশেষে দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়াল। পরীক্ষা করল দরজা। আন্ডার লক সিস্টেম। খুশি হলো সে।
এই সময় গাড়ির গতি কমে গেল। অবশেষে থেমে গেল। আহমদ মুসা তাড়াতাড়ি দরজার সামনে থেকে এসে একটা জানালায় চোখ রাখল। দেখল গাড়ি রাস্তা থেকে একটা বাড়ির সামনে দাঁড়িয়েছে। হেড কোযার্টারে গেলে ঝামেলায় পড়বে। নাম-ধাম প্রকাশ পাবে, ছবিও নেবে ওরা। কিন্তু বাড়িটার দিকে ভালো করে তাকাতেই চোখ খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠল। ওটা একটা বার। ক্লান্ত পুলিশ অফিসাররা নিশ্চয় বারে যাওয়ার মতলব করছে।
ঠিক তাই। গাড়ি থেকে বেরিয়ে এক অফিসারসহ দু’জন পুলিশ বারে প্রবেশ করল।
সংগে সংগে মেঝেতে বসে পড়ে জুতার গোড়ালি থেকে ল্যাসার নাইফ বের করে নিয়ে উঠে দাঁড়াল আহমদ মুসা।
ভীত ও বিম্ময়-বিস্ফরিত চোখ মেলে মারিয়া আহমদ মুসার কাজ দেখছে। পালাবার প্রস্তুতি চলছে তার বুঝতে কষ্ট হলো না। বুক কেঁপে উঠল মারিয়ার। ধরা পড়লে দশা কি হবে!
কয়েক সেকেন্ডেই ল্যাসার নাইফ আন্ডার লক গলিয়ে হাওয়া করে দিল।
মারিয়াকে ইংগিত করে আহমদ মুসা দ্রুত দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে এলো।
ছুটল গাড়ির ড্রাইভিং কেবিনের দিকে। পেছনে মারিয়া।
আহমদ মুসা যা ভেবেছিল তাই। দরজা ওরা লক করে যায়নি। অবশ্য লক করে গেলেও ক্ষতি ছিল না।
আহমদ মুসা মারিয়াকে গাড়িতে ওঠার ইংগিত করে নিজে লাফ দিয়ে গিয়ে ড্রাইভিং সিটে বসল। একবার চকিতে বারের দরজার দিকে তাকিয়ে দেখল ফাঁকা, নিশ্চয় এতক্ষনে ওরা মদ গিলতে বসেছে।
দ্রুত গাড়ি ঘুরিয়ে রাস্তায় তুলে মারিয়ার দিকে চেয়ে বলল, ‘আমি তো কিছু চিনি ন।। কোন দিকে যাবো বল?’
মারিয়ার চোখ ভয়ে-বিস্ময়ে তখনও ছানাবড়া! একটা ঢোক গিলে বলল, ‘পুব দিকে চলুন। অল্প কিছু গেলেই সেন্ট্রাল হাইওয়ে। সেন্ট্রাল ট্যাক্সি পুল আর বেশি দূরে নয়।’
ঝড়ের বেগে চলতে লাগল গাড়ি।
আহমদ মুসা বলল, ‘হাইওয়ের মুখে গিয়েই আমরা গাড়ি ছেড়ে দেব। টের পেলেই ওরা গাড়ির নাম্বার ওয়ারলেসে সব জায়গায় জানিয়ে দেবে। ধরা পড়তে বিলম্ব হবে না।’
সেন্ট্রাল হাইওয়ের প্রায় মুখেই বলতে গেলে একটা ছোট পার্ক। চারদিক দিয়ে গাছে ঘেরা। বেশ অন্ধকার।
বেশি অন্ধকার দেখে একটা জায়গায় আহমদ মুসা গাড়ি দাঁড় করাল। তারপর লাফ দিয়ে নামতে নামতে বলল, ‘এস মারিয়া, দেখা যাচ্ছে ওটা নিশ্চয় তোমাদের সেন্ট্রাল হাইওয়ে।’
আহমদ মুসা ও মারিয়া এক দৌড়ে রাস্তার মুখে হাইওয়ের ফুটপাতে এসে দাঁড়াল। যেখানে দাঁড়াল তার বাম পাশেই একটা পেট্রল স্টেশন এবং তাদের পাশ দিয়েই সে স্টেশনে প্রবেশের পথ। তারা ওখানে দাঁড়াবার কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই একটা ট্যাক্সি এলো। ট্যাক্সিটা খালি। পেট্রল স্টেশনে প্রবেশ করছিল। মারিয়া হাত তুললে দাঁড়াল ট্যাক্সি।
‘যাবে?’ বলল মারিয়া।
‘কোথায়?’
‘ট্যাক্সি পুলে।’
‘ভাড়া দু’শো পিসেটা।‘
‘বেশি চাইলে, ঠিক আছে।’
আহদম মুসা ও মারিয়া ট্যাক্সিতে উঠে বসল।
তেল নিয়ে ট্যাক্সি হাইওয়েতে উঠে এলো। ছুটতে শুরু করল ট্যাক্সি।
‘ট্যাক্সি পুল থেকে আপনারা কোথায় যাবেন?’ বলল ড্রাইভার।
‘লা-গ্রীনজা।’ বলল মারিয়া।
‘আমার গাড়িটাও ট্রাক্সি পুলের।’
‘তুমি লা-গ্রীনজা যাবে?’
‘অবশ্যই যাব।’
মারিয়া আহমদ মুসার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ঠিক আছে?’
‘লা-গ্রীনজা সেতো অনেক দূর!’
‘হ্যাঁ, আমার ভাইয়া ওখানেই এখন আছেন।’
ওঁর সাথে তো আপনার দেখা করতেই হবে।’
কথা শেষ করেই মারিয়া ড্রাইভারকে লক্ষ্য করে বলল, ‘ঠিক আছে, চল লা-গ্রীনজা।’
‘ধন্যবাদ।’ বলল ড্রাইভার।
নড়ে-চড়ে বসল ড্রাইভার।
লা-গ্রীনজা মাদ্রিদ থেকে সোজা উত্তরে। প্রায় ১০০ মাইলের পথ ড্রাইভার তার ট্যাক্সির স্পীড বাড়াল।
লা-গ্রীনজা উত্তর স্পেনের একটা পার্বত্য নগরী। মনোরম জেরামা হ্রদের তীর থেকে অল্প দূরে সালডেল ফেনসো পর্বতমালার কোলে গড়ে উঠেছে নগরীটি। জেরামা হ্রদের দক্ষিণ তীরের বিখ্যাত শহর ‘বুত্রাগো ডেল লুজিয়াকে’ যদি বলা হয় মুখরা, হাস্যোজ্জ্বল তরুণী, তাহলে লা-গ্রীনজাকে বলা যাবে ধ্যানরতা শান্ত সুন্দর এক বালিকা। লা-গ্রীনজা সা ডেলফেনসো’র বুকের এক লুকানো মাণিক। নীল আকাশে মাথা তোলা সুউচ্চ পর্বতশৃংগের নিচে শান্ত, সুন্দর নগরী প্রথম দৃষ্টিতেই আহমদ মুসার মন কেড়ে নিয়েছিল। আজ দু’দিন হলো আহমদ মুসা লা-গ্রীনজায় মারিয়ার ভাই ফিডেল ফিলিপের বাড়িতে এসেছে।
ফিডেল ফিলিপের বাড়ি লা-গ্রীনজার একটা নির্জন টিলার ওপরে। বাড়িটিতে মনে হয় সবুজের সমুদ্রে সাদা একটা তিলক। ফিডেল ফিলিপ তার ছদ্ম নাম। বাস্ক গেরিলা নেতার আসল নাম স্যামুয়েল শার্লেম্যান। কোড নাম ‘ডাবল এস’। আসল নামেই তার এ বাড়ি এবং তিনি এখানে আসল নামেই পরিচিত। ফিডেল ফিলিপকে মানুষ জানে ভয়ংকর গেরিলা নেতা, কিন্তু স্যামুয়েল শার্লেম্যান একজন শান্ত, নিরীহ নাগরিক। বছরের কোন কোন সময় ফিলিপ লা-গ্রীনজায় আসেন, অধিকাংশ সময়ই থাকেন পিরেনিজের গেরিলা ঘাঁটিতে। সরকার বাষ্কদের অনেক দাবী মেনে নিয়ে পিরেনজ সন্নিহিত দু’টি প্রদেশে তাদেরকে স্বায়ত্ত শাসন দান করেছে। সেখানে বাষ্কদের রাজনৈতৈক সরকারও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, কিন্তু বাষ্করা এখনও তাদের অস্ত্র ছাড়েনি। কারণ অস্ত্র ছাড়লে এ স্বায়ত্ত শাসনও তাদের হারিয়ে যাবে।
বাড়িটির ভেতরে ফ্যামিলি ড্রইংরুম। ফিডেল ফিলিপের স্ত্রী জোনার সাথে কথা বলছিল মারিয়া। মারিয়া শোনাচ্ছিল তাকে তার কিডন্যাপের কাহিনী, উদ্ধারের কাহিনী। মারিয়ার বলার ঢং, আহমদ মুসার প্রশস্তির বহর দেখে মুখ টিপে হাসছিল জোনা। চোখ এড়ায় না তা মারিয়ার।
‘তুমি হাসছ ভাবি?’ বলল মারিয়া।
‘খুশি হবো না! আমার বাঘিনী ননদিনী তো কারো কখনো এত প্রশংসা করেনি!’
‘প্রশংসা কোথায় পেলে, আমি তো যা ঘটেছে তাই বলছি।’
‘প্রশংসা বেশি করনি, তবে সুন্দরের দেবতা, শক্তির দেবতা, বুদ্ধির দেবতা- সকলের আসন গিয়ে তার ভাগ্যেই জুটেছে।’
‘একটাও অতিরঞ্জিত কথা বলিনি ভাবি।’ মুখ লাল করে বলল মারিয়া।
‘ঠিকই বলছ। আমার ননদিনীকে জয় করা সাধারনের কাজ নয়।’
‘ভাবি, তুমি ইয়ার্কি করছ, তুমি বুঝছ না! তিনি, আমার মনে হয়, এমন এক শান্ত সাগর যার বুকে কখনও ঢেউ জাগে না।’ বলল মারিয়া।
গম্ভীর, ভারি কন্ঠ মারিয়ার।
জোনা মারিয়ার একটা হাত তুলে নিয়ে বলল, ‘তা আমার বুঝতে বাকি নেই ননদিনী। বন্ধ, নির্জন ঘরে আমার আগুন ননদিনী যাকে গলাতে পারেনি, আমার আগুন ননদিনীর নিবিড় সংগ যার মধ্যে চাঞ্চল্য আনতে পারেনি, সে রক্ত-মাংসের মানুষ বলে ভাবতে আমার কষ্ট হয়।’
‘কিন্তু তিনি মানুষ ভাবি। এখানেই আমার বিস্ময়! আমার প্রশংসা এখানেই। তিনি মুসলমান, কিন্তু আরও মুসলমান আমি দেখেছি, জার্মানিতে তাদের সাথে আমি মিশেছি। কিন্তু তাদের সাথে এর কোনই মিল নেই।’
বলল মারিয়ার ভাবি জোনা, ‘কী আশ্চর্য! এত সময় এক সাথে থাকলি, এত পথ এলি, তবু তোর সম্পর্কে কিছু জানল না, তারও কিছু জানাল না।’
‘তার কথা ও দৃষ্টিতে কোন বাড়তি আগ্রহ আমার চোখে ধরা পড়েনি। আমি তাকে না দেখলে মনে করতাম, তিনি ক্ষমতাদর্পী একজন অহংকারী, কিন্তু না, তিনি তা নন। তার চোখ দেখলে অন্তর দেখা হয়ে যায়। সেখানে লুকানো কিছু নেই। এত সরল, এত ঋজু মানুষ আমার কাছে অকল্পনীয়। ক্লু-ক্ল্যাক্স-ক্ল্যানের হাতে তিনি আহত হয়েছিলেন। গোটা মুখ ছিল রক্তে ভেজা। আমি ওর মুখ মুছে দিতে গিয়েছিলাম। কিন্তু তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। মনে হয়েছিল এটা তার অহংকার। পরে বুঝেছিলাম, আমার ভূল হয়েছে। ওটা তার নিজস্ব রীতি।’
‘কোথায় বাড়ি, কি করেন জানা যায়নি, না?’
‘আসার পথে জিজ্ঞেস করেছিলাম। উত্তর দিয়েছিলেন তার কোন দেশ নেই। আর আল্লাহর বান্দাদের কাজে ঘুরে বেড়ানোই তার কাজ।’
‘আসলে তোক পাত্তা দেয়নি মারিয়া।’ মুখ টিপে হাসল জোনা।
‘হতে পারে!’ মুখ কালো করে বলর মারিয়া, ‘তবে একজন অজ্ঞাত-পরিচয় মেয়েকে বাঁচানোর জন্যে যিনি নিজেকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছিলেন, তিনি কাউকে ছোট মনে করেন বলে মনে করি না।’
‘দেশ নেই এমন লোক কি আছে, আর ঘুরে বেড়ানো লোক কি অমন হয় ননদিনী?’
‘এ জিজ্ঞাসা প্রশ্নকারী ভাবির চেয়ে আমার মাঝে আরও তীব্র। এ জিজ্ঞাসা আমাকে কষ্ট দিচ্ছে ভাবি।’
‘কষ্ঠ কেন রে? ও তোকে উদ্ধার করেছে বলেই কি?’ হেসে বলল জোনা।
‘যা জানতে চাই, তা জানতে না পারার মধ্যে কষ্ট আছে।’
‘জানার আগ্রহ স্বাভাবিক কি না, তাই জানার কষ্ট এখানে স্বাভাবিক নয়।’
‘হয়তো অস্বাভাবিক, কষ্ট লাগছে এটা বাস্তবতা। তুমি হয়তো এর মধ্যে ভিন্ন অর্থ খোঁজার চেষ্টা করবে। সে রকম কোন আর্ট আছে কিনা এখনও ভেবে দেখিনি। তবে তিনি যত বড় ব্যক্তিত্ব, তাতে তাকে না জানার এ কষ্ট স্বাভাবিক। ভাবি, তিনি শুধু শক্তি ও বুদ্ধিতে নন, তার হৃদয়বৃত্তিও দেখার মতো। বন্দীখানা থেকে বের হবার সময় একজন প্রহরীকে তিনি হত্যা করেছিলেন। কিন্তু অন্যজনকে তিনি হাত, পা, মুখ বেঁধে রেখে আসেন। এতে বেশ সময় খরচ হয়, যা ঐ সময়ের জন্যে জীবনের মতো মূল্যবান ছিল। পরে আমি তাকে জিজ্ঞাস করিছিলাম, একটা গুলী খরচ করলেই তো ঝামেলা চুকে যেত। তিনি কি উত্তর দিয়েছিরেন জান? বলেছিলেন, মানুষের জীবন খুব মূল্যবান। আমরা গোটা দুনিয়া মিলেও একজন মানুষ সৃষ্টি করতে পারব না! অথচ কিছু মানুষের স্বার্থের যূপকাষ্ঠে মানুষ নিমর্মভাবে বলি হচ্ছে। যতটা পারা যায় নিজের হাতকে এ থেকে মুক্ত রাখা উচিত।’
‘তাহলে দেখছি উনি নীতিবাগিশ, ভাববাদী!’ এই অবস্থায় তিনি হাতে পিস্তল ধরেন কেমন করে?’ বলল জোনা।
বলল মারিয়া, ‘ন্যায়-অন্যায় সম্পর্কে তার দৃষ্টিভঙ্গি সত্যিই অবাক করে দেয়ার মতো। আমরা প্রথম যে ট্যাক্সিটি ভাড়া করেছিলাম, তাকে আমরা ভাড়া দিতে পারিনে। ওকেও পুলিশ নিয়ে যায়, আমাদেরকেও। ট্যাক্সিটার নাম্বার ওর জানা ছিল। দ্বিতীয় যে ট্যাক্সিটা করে আমরা এখানে এলাম, সে ট্যাক্সি ড্রাইভারের মাধ্যমে উনি প্রথম ট্যাক্সির ভাড়া পাঠিয়ে দিয়েছেন। আমি বলেছিলাম, আমরা তো ইচ্ছে করে ভাড়া না দেয়ার চেষ্টা করিনি। আমাদের যেখানে দোষ নেই, সেখানে আমাদের দায়িত্ব কি? তিনি উত্তর দিয়েছিলেন, ট্যাক্সি আমাদের প্রয়োজনে আমরা ভাড়া করেছিলাম, ভাড়া পরিশোধের দায়িত্বও আমাদের। তাছাড়া সে যে পুলিশের ঝামেলায় পড়ল, তার জন্যেও দায়ী আমরা। সুতরাং গরীব ট্যাক্সি ড্রাইভারের ক্ষতিপূরণ করতে আমরা না পারি, তার ন্যায্য প্রাপ্য থেকে তাকে বঞ্চিত রাখতে পারি না।’ থামল মারিয়া।
মারিয়ার ভাবি জোনা তাকিয়েছিল মারিয়ার মুখের দিকে। মারিয়া থামলেও কিছুক্ষণ পর্যন্ত কথা বলতে পারল না তার ভাবি।
কিছুক্ষণ পর মুখ খুলল জোনা। বলল, ‘তুই আমাকে কি শোনালি মারিয়া! মুরদের, মুসলমানদের সততা, মানবতার কথা শুনেছি, কিন্তু সেতো বহু শতাব্দী আগের কথা, সে সব তো এখন কাহিনী! কাহিনী কেমন করে রূপ ধরে এলো। একজন ব্যক্তির মধ্যে কি করে বিপরীতমুখী এত গুণ থাকতে পারে!’
কিছু বলতে যাচ্ছিল মারিয়া। এমন সময় পেছন থেকে কথা বলে উঠল ফিডেল ফিলিপ। সে অনেকক্ষন ধরে পেছনে দাঁড়িয়ে ওদের কথাগুলো শুনছিল। ফিলিপ এসে সোফার সিটে হেলান দিয়ে বসতে বসতে বলল, ‘জোনা, মারিয়া ওকে যত বড় বলে কল্পনা করছে, উনি তার চেয়েও বড়।’
‘তুমি জেনেছ, ভইয়া?’ বলে সোফা থেকে লাফিয়ে উঠল মারিয়া।
‘হ্যাঁ, জেনেছি।’ বলতে শুরু করল ফিলিপ, ‘তিনি আমার কাছে ছিলেন এক স্বপ্ন, যার সাক্ষাৎ আমি কোনদিনই পাব ভাবিনি, তিনি হলেন সেই।’
মারিয়া, জোন দু’জনেই ভ্রু কুচকালো। শোনার জন্যে উন্মুখ হলো। তাদের দু’চোখ ভরা কৌতূহল।
‘ফিলিস্তন বিপ্লব, মিন্দানাও বিপ্লব, মধ্যএশিয়া বিপ্লবের নায়ক তিনি। আর্মেনিয়া, আজারবাইজান ও বলকানের সাম্প্রতিক পরিবর্তনের তিনিই কেন্দ্রবিন্দু।’
‘আহমদ মুসা তিনি?’ বিস্ময়ে হাঁ হয়ে ওঠা মারিয়ার মুখ থেকে বেরিয়ে এলো।
‘হ্যাঁ বোন, আহমদ মুসা তিনি। আমরা একটা বিপ্লব করতে পারি না, আর তিনি অর্ধ ডজন সফল বিপ্লবের নায়ক।’
একটু থামল ফিলিপ। তারপর আবার শুরু করল, ‘মারিয়ার কাহিনী শোনার পরেই আমার মনে হয়েছিল, ক্লু-ক্ল্যাক্স-ক্ল্যানের বন্দীখানা এভাবে ভাঙতে পারে, তাদের প্রতিরোধ এমনভাবে চূর্ণ করতে পারে একাকি, এমন তো কেউ আমার জানার মধ্যে নেই!’
মারিয়া, জোনা কারও মুখেই কোন কথা নেই। তারাও আহমদ মুসা সম্পর্কে অনেক পড়েছে। পক্ষে বিপক্ষে সবরকম। সমসাময়িক বিশ্বের সবচেয়ে সফল, সবচেয়ে দূর্ধর্ষ বিপ্লবী পুরুষ তাদের সামনে উপস্থিত। তাদের অনুভূতি যেন ভোঁতা হয়ে গেছে, বিশেষ করে বুক তোলপাড় করছে মারিয়ার! সেই জগৎ বিখ্যাত বিপ্লবী পুরুষের তিনি সংগ পেয়েছেন! এত কাছে থেকে তার কাজ দেখার সুযোগ হয়েছে!
‘আমাকে সবচেয়ে বিস্মিত করেছে তার সহজ সারল্য এবং নম্র-ভদ্র আচারন। মনেই হয় না তিনি এত বড় একজন বিপ্লবী!’ বলল ফিডেল ফিলিপ।
‘আমাকে তো তাকে সদ্য বিয়ে হওয়া বরের মতো লাজুক মনে হয়েছে। কোন মতে একবার চোখ তুলে চেয়েছে। আর চোখ তোলেনি একবারও। এজন্যেই মারিয়ার গল্পে আমার কাছে তেমন বিশ্বাস্য হয়নি। একজন বিপ্লবী অমন নরম-নধর কান্তি হয়?’ বলল জোনা।
‘চোখ তুলে চায় না, ভিন্ন মেয়েদের সামনে লজ্জা-সংকোচ, ওটা ওদের পর্দা। ভালো মুসলমান সত্যিকার মুসলমান ছেলেমেয়েরা পর্দা করে। ওটা ওদের অবশ্য পালনীয় রীতি, দুর্বলতা নয়।’ বলল ফিডেল ফিলিপ।
‘ভাইয়া, ক্লু-ক্ল্যাক্স-ক্ল্যানের বন্দীখানায় আমি ওর নামাজ দেখেছি। অকল্পনীয় এক ধ্যানমগ্নতা, মনে হয় যেন তিনি এ দুনিয়ায় নেই!’ বলল মারিয়া।
‘অমন সন্ন্যাসী প্রকৃতির লোক বিপ্লবী হলেন কেন? অন্ত্র হাতে তুলে নেন কেন? ঈশ্বরপ্রেমী সন্ন্যাসী চরিত্রের সাথে তো এটা মিলে না।’ বলল জোনা।
‘তুমি তাহলে মুসলমানদের কিছু জান না। যুদ্ধের ময়দানে ওরা বীর যোদ্ধা, আবার প্রার্থনার আসনে ওরা ঈশ্বর প্রেমে বিলীন হওয়া সন্ন্যাসী। মুরদের কাহিনী তুমি পড়নি।’ বলল ফিডেল ফিলিপ।
‘পড়িনি, কিন্তু মরিসকোদের তো আমি দেখেছি। সেবার বিলেতে গিয়ে একটা মুসলিম পরিবারকেও দেখেছিলাম।’ বলল জোনা।
‘মরিসকোরা তো খৃষ্টান মুসলমান! ওদের বুকে ঈমান লুকানো থাকলেও প্রকাশ্যে ওরা খৃষ্টান। আর বিলেতে যে মুসলিম পরিবার দেখেছ, ওরা মুসলমানদের ধ্বংসাবশেষ। এসব মুসলমানদের কারনেই মুসলিম শাসন ও সংস্কৃতির পতন হয়েছে। স্পেনে যতদিন মুসলমানরা প্রকৃত মুসলমান ছিল, মুসলিম রাজত্বের ওপর খৃষ্টানরা কোন আঁচড় কাটতেও সাহস করেনি। আহমদ মুসার তুলনা মরিসকোরা নয় কিংবা নয় বৃটেনের ঐ মুসলিম পরিবার। আহমদ মুসার তুলনা স্পেন বিজেতা তারিক বিন যিয়াদ, মুসা বিন নুসায়ের প্রমুখের সাথে।’ ফিডেল ফিলিপ বলল।
‘বাঃ আহমদ মুসা তো দেখি দু’ভাইবোনকে একদম শিষ্য বানিয়ে ছেড়েছে!’ বলল জোনা।
‘অমন বিপ্লবীর শিষ্য হওয়া ভাগ্যের কথা। আমি খুব খুশি হয়েছি, ওর কাছ থেকে কিছু শিখতে পারব।’
‘ও কেন স্পেনে এসেছেন জান?’
‘না জিজ্ঞেস করিনি।’
‘তোমাদের উনি জানেন?’
‘জানেন নিশ্চয়, আমাকে উনি বললেন, মুসলমানরা বাস্কদের কাছ থেকে অনেক সাহায্য পেয়েছে। এ কথা তিনি যখন জানেন, তখন অনেক কথাই তিনি জানবেন।’
‘কেমন আশ্চর্য না, মারিয়াকে এই সাহায্য উনি করতে না গেলে তো এই পরিচয় হতো না। একজন অজ্ঞাত-পরিচয় তরুণীকে সাহায্য করতে গিয়ে অত বড় একজন বিপ্লবী নিজেকে অমন বিপদগ্রস্ত করলেন কেন?
‘প্রথম আলাপেই আমি তাকে এজন্যে ধন্যবাদ দিয়েছিলাম। তিনি কি বললেন জান? বললেন, মানুষকে সাহায্য করা মানুষের দায়িত্ব। কোন মানুষ যদি আপনার সামনে জুলুমের শিকার হয়, আপনি যদি সাহায্য না করেন, তাহলে যে আল্লাহ আপনাকে শক্তি সাহস দিয়েছেন, তার কাছে কঠোর জবাবদিহির সম্মুখীন হতে হবে। সুতরাং যে আল্লাহ আমাদের এ শিক্ষা দিয়েছেন এবং শক্তি-সাহস দিয়েছেন, সব ধন্যবাদ, সব প্রশংসা তাঁরই প্রাপ্য।’
জোনা ট্যাক্সি ভাড়া দেয়া ও একজন প্রহরীকে না মারা সম্পর্কে মারিয়ার কাছে যে কাহিনী শুনেছিল তা ফিডেল ফিলিপকে বলল। শুনে ফিডেল ফিলিপ বলল, ‘মুরদের কাহিনী যদি পড়, তাহলে এ ধরনের অনেক কাহিনী জানতে পারবে। চরিত্র শক্তিই মুসলমানদের প্রধান শক্তি ছিল।’
মারিয়া বসে বসে ভাই-ভাবির আলাপ গোগ্রাসে গিলছিল। সে নড়ে-চড়ে বসে বলল, ‘ভাইয়া, ওর কে কে আছে, কোথায় বাড়ি?‘
আমি জিজ্ঞেস করিনি, আমাকে কিছু বলেওনি। কিন্তু তুই এ প্রশ্ন আমাকে জিজ্ঞেস করছিস কেন? আমরাই না তোকে জিজ্ঞেস করার কথা!’
‘পাথরের মতো শক্ত, বরফের মতো ঠান্ডা উনি ভাইয়া………..’
‘মারিয়ার আগুনের উত্তাপ তাকে গলাতে পারেনি।‘ মারিয়াকে কথা সম্পূর্ণ করতে না দিয়ে ফোঁড়ন কেটে বলে উঠল জোনা।
‘ভাবি যেভাবে কথাকে ভিন্ন দিকে ঠেলে দিচ্ছে, তাতে আর কথা চলে না ভাইয়া!’ বলে মারিয়া লাফ দিয়ে উঠে ছুটে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।
‘শোন মারিয়া, শোন’- বলে জোনাও ছুটল মারিয়াকে ধরতে।
সেদিনেরই গোধূলি লগ্ন।
আহমদ মুসা বারান্দার রেলিং- এ দু’কনুই ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। তার দৃষ্টি নিবদ্ধ ছিল নিচের সবুজ উপত্যকার দিকে। সবুজ উপত্যকার বুক চিরে একটা রাস্তা এগিয়ে গেছে উত্তরে। অল্প কিছু উত্তরে দাঁড়িয়ে আছে সান ডেলফেনসো পর্বতমালার বিখ্যাত শৃংগ ডে মাজুরা। এই শৃংগের বুক চিরেই উত্তর স্পেনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ডে মাজুরা গিরিপথ। উপত্যকার এই পথ ধরে ঐ গিরিপথ দিয়েই মুসা বিন নুসায়ের ও তারিক বিন যিয়াদের নেতৃত্বে মুসলিম বাহিনী উত্তর স্পেনে প্রবেশ করেছিল এবং পিরেনিজের উত্তর প্রান্তে ফ্রান্সের মাটিতে শান্তি ও মানবতার প্রতীক ইসলামের বিজয় পতাকা উড্ডীন করেছিল। আহমদ মুসা নিজেকে হারিয়ে ফেললেন এই পথ ও ঐ গিরিপথের দিকে চেয়ে। মনে হলো তিনি দেখতে পাচ্ছেন মুসা বিন নুসায়ের ও তারিক বিন যিয়াদের মুসরিম বাহিনীকে। ওদের ঘোড়ার খুরের শব্দ, পতাকার পত পত আওয়াজও যেন তার কানে এসে প্রবেশ করছে! তারপর তার চোখে ভেসে উঠসে মুসা বিন নুসায়েরের মুসলিম বাহিনী বিজয়ের বেশে ফিরে আসার দৃশ্যও। বিজয়ী সে বাহিনী ফিরে আসার মধ্যে বাঁধনহারা কোন উল্লাস নেই, অহংকারের কোন চিৎকার নেই।
তার কানে আসছে বিজয়ী বাহিনীর পতাকাধারী কন্ঠনিৎসৃত কুরআনের সুমিষ্ট নরম সুর ‘আর যখন তোমার প্রতিপালক ফেরেশতাদের বললেন, আমি পৃথিবীতে প্রতিনিধি সৃষ্টি করছি…..।’ আহমদ মুসার চোখের সামনে থেকে ধীরে ধীরে সে দৃশ্য সরে যায়। সে দৃশ্য বিজয়ের নয়, পরাজয়ের, আনন্দের নয়, কান্নার। পথে-প্রান্তরে মুসলমাদের লাশের সারি, রক্তের স্রোত, বিলাপে মুহ্যমান মুসলমান নারী-শিশুর মিছিল। স্পেনে পা রাখার মতো এক ইঞ্চি মাটিও দুর্লভ হয়ে উঠল মুসলমানদের জন্যে। বেদনায় ছেয়ে গেল আহমদ মুসার মুখ। ভারি হয়ে উঠল চোখ। আহমদ মুসা নিজেকে হারিয়ে ফেলেছিল অতীতের বুকে।
মারিয়া উঠে আসছিল উপত্যকা থেকে। উপত্যকা থেকে রাস্তা বারান্দার সেই রেলিং- এর নিচ দিয়েই ঘুরে এসে বাড়িতে উঠেছে। মারিয়া আপনহারা আহমদ মুসাকে দেখল। মারিয়া কিছু বলতে গিয়েছিল রাস্তা থেকেই, কিন্তু আহমদ মুসার চোখে অশ্রু দেখে সে চমকে উঠল!
মারিয়া ধীরে ধীরে রেলিং ঘুরে এসে আহমদ মুসার পেছনে দাঁড়াল। বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকল। কিন্তু আহমদ মুসা কিছুই টের পেল না।
মারিয়া গিয়ে আহমদ মুসার পাশে দাঁড়াল। মুখ ঘুরিয়ে আহমদ মুসার মুখের ওপর চোখ রেখে বলল, ‘আপনি কাঁদছেন?’
চমকে উঠে আহমদ মুসা সোজা হয়ে দাঁড়াল। তাড়াতাড়ি চোখ মুছে নিয়ে বলল, ‘না, মারিয়া, ও কিছু নয়।’
’কিন্তু আপনার চোখে যে অশ্রু!’
আহমদ মুখা চোখ আবার ভালো করে মুছে নিল। কোন উত্তর দিল না।
‘আপনি কি ভাবছিলেন?’ মারিয়াই প্রশ্ন করল।
‘ভাবছিলাম না, দেখছিলাম।’
‘কি দেখছিলেন?’
তৎক্ষণাৎ কোন উত্তর দিল না আহমদ মুসা। চকিতে একবার চোখ তুলে তাকাল মারিয়ার দিকে। তারপর চোখ নামিয়ে নিয়ে বলল, ‘ঠিক দেখছিলাম নয়, মনে হচ্ছিল যেন দেখছি!’
‘কি সেটা?’
‘দেখছিলাম, ডে মাজুরা গিরিপথের ওপর থেকে উপত্যকার গোটা পথে লাশের সারি, রক্তের স্রোত ও নারী-শিশুর চোখে অশ্রুর বন্যা।’
‘বুঝলাম না!’ বিস্ময়ে চোখ কপালে তুলে বলল মারিয়া।
‘ছবিগুলো অনেক আগের মারিয়া। তখন সবে ষোড়শ শতকের শুরু। কার্ডিনাল ফ্রান্সিসকো’র উচ্ছেদ ও নির্মূল অভিযান শুরু হলে উত্তর স্পেনের ভাল্লাদলিদ এলাকার হাজার হাজার মুসলমান এই গিরিপথ, এই উপত্যকার পথেই পালিয়ে বাঁচাতে চেয়েছিল। কিন্তু বাঁচেনি। তাদেরই লাশে ভরে ওঠে ডে মাজুরা থেকে এই গোটা উপত্যকা পথ। আমি সেই দৃশ্যই দেখছিলাম মারিয়া।’ আহমদ মুসার ভারি কন্ঠ যেন কাঁপছিল!
‘সেতো অনেক অতীতের কথা।’ নরম কন্ঠে বলল মারিয়া।
‘সেই অতীতই হঠাৎ যেন আমার সামনে জীবন্ত হয়ে উঠেছিল!’
‘আপনার অশ্রু কি এজন্যই?’ বলল মারিয়া।
‘তাই হবে। আহত হৃদয়ের রক্তই তো হলো অশ্রু।’
‘এত পরে অত দূরের অতীত নিয়ে আপনার হৃদয় কাঁদে?’
‘নিজের প্রতি ভালোবাসা তো চিরনতুন। সময়ের ব্যবধান তাকে মলিন করেনি!’
‘আপনার জাতিকে আপনি এত ভালোবাসেন?’
‘নিজেকে আমি ভালোবাসি মারিয়া।’
‘জানতে আগ্রহ হচ্ছে, নিজের প্রতি এই ভালোবাসার পাশে অপরের প্রতি, অপর জাতির প্রতি বিদ্বেষ থাকে শুনেছি?’
‘দৃষ্টান্ত হিসেবে যদি হিটলার, ফ্রাংকো, মসোলিনী, বেগিন, খৃষ্টান ক্রুসেডারদের আন, তাহলে ঠিক আছে। কিন্তু দৃষ্টান্ত হিসেবে খালেদ, তারিক, মুসা ও সালাহ উদ্দিনদের যদি আন, তাহলে তোমার শোনা ঠিক নয়। মুসলমানরা নিজ জাতিকে ভালোবেসেই অপর জাতিকে ভালোবাসে।’
‘এই যার নাম বললেন যে স্পেনে মুসলিম নির্মূল অভিযানের প্রথম নেতা সেই কার্ডিনাল ফ্রান্সিসকো ও তার জাতির প্রতি আপনার বিদ্বেষ নেই?’
‘মানুষ ফ্রান্সিসকোর সাথে আমার বিরোধ নেই। তার হাতে জুলুমের তলোয়ার না থাকলে আমি তাকে বুকে জড়িয়ে ধরব তার জন্যে আমি জীবন দিতে রাজী, কিন্তু উদ্যত সংগীন হাতে দাঁড়ানো জালেম কার্ডিনাল ফ্রান্সিসকো’র বিরুদ্ধে আমি আজীবন লড়াই করতে প্রস্তুত।’
‘এ লড়াইয়ের জন্যেই কি আপনার স্পেনে আসা?’
‘আমি একা খালি হাতে স্পেনে এসেছি মারিয়া।’
‘মনে কিছু করলেন? আমি কিন্তু তা মিন করিনি।’
‘তাতে কি, তোমার জায়গায় হলে আমিও এ কথাই বলতাম।’
‘না, বলতেন না, আপনি ‘আমি’ নন।’
‘তুমি নিশ্চয় বিশ্বাস করবে মারিয়া, আমি একেবারে বেড়াবার জন্যে স্পেনে আসিনি।’
‘কেমন করে বিশ্বাস করব, কিছুই তো বলেননি, নামটিও না। বিশ্বাস করলে তো!’
তৎক্ষণাৎ আহমদ মুসার উত্তর এলো না। একটু চুপ করে থাকল। তারপর ধীর কন্ঠে বলল, ‘তোমার ভাইয়ার কাছে নিশ্চয় সব শুনেছ। ব্যাপারটাকে বিশ্বাস-অবিশ্বাসের মাত্রায় নিলে আমার ওপর অন্যায় করা হবে। পরিচয় নিয়ে আলাপ করার কোন সুযোগ কি আসলেই আমাদের হয়েছিল? আমার অসুবিধা নিশ্চয় তোমার বুঝার কথা।’
‘মাফ করবেন, বিষয়টাকে আমি এভাবে দেখিনি। আসলে কি জানেন, আপনার মতো বিস্ময়কর একজন মানুষের পরিচয় ভাইয়াকে দিয়ে চমকে দেয়ার সুযোগ আমার হয়নি, এটাই আমার দুঃখ।’
‘লোকটি আসলেই বিস্ময়কর নয়, ভাবলেই দুঃখটা কমে যাবে।’
‘মনের মতো করে ভেবে নিলেই সব দুঃখ যায় না।’
মারিয়া একটু থেমেই আবার শুরু করল, ‘জানেন, আমি ভাইয়াকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, আপনার কে কে আছে, কোথায় বাড়ি? উত্তরে ভাইয়া বললেন, বিষয়টা নাকি আমার কাছেই তাদের জিজ্ঞেস করার কথা। তাদের ধারণা আমি সব জানি আপনার সম্পর্কে। অথচ …….।’ কথা শেষ না করেই থেমে গেল মারিয়া।
‘ওরা ঠিক ধারনা করেছেন মারিয়া। দেখা হলে, এক সাথে কিছু পথ চললে তাদের মধ্যে পরিচয় হওয়া স্বাভাবিক কিন্তু পরিচয় দেবার জন্যে তো পরিচয় থাকা দরকার।’
‘বিশ্ববিখ্যাত বিপ্লবী আহমদ মুসার কোন পরিচয় নেই?’
‘জন্মভূমি আমার একটা ছিল, কিন্তু সতের-আঠার বছরের যখন আমি তখন সেখান থেকে উদ্বাস্তু হয়ে এসেছি, হারিয়ে এসেছি আব্বা-আম্মা, ভাইবোন সবাইকেই। সেদিন যে নিঃস্ব ছিলাম, আজও নিঃস্বই আছি। কোন দেশের নাগরিক আমি জানি না, কোথাও আমার জন্যে একটি ঘরও তৈরি হয়নি। এমন যে তার কি পরিচয় দেবার আছে মারিয়া?’
‘আপনার কাহিনী আমি পড়েছি। ফিলিস্তিন, মিন্দানাও, মধ্য এশিয়া, সিংকিয়াং, ককেশাস, বলকান দেশগুলো- সবই তো আপনার, সবার আপনি মাথার মণি।’
‘সব আমার বলেই তো কোথাও আমি নেই।’
‘আমি একটা কথা বলব, কিছু মনে করবেন না তো?’
‘অবশ্যই না।’
‘ছেলেরা ঘর অনেক সময় বাঁধে না, তাদের ঘরে বাঁধতে হয়, আপনার এ রকম…..’
‘বুঝেছি মারিয়া’, মারিয়ার কথা শেষ হওয়ার আগেই বলতে শুরু করল আহমদ মুসা, ‘তুমি যা বলতে চাও, আমিই সেটা বলছি। সিংকিয়াং থেকে আর্মেনিয়ায় আসার আধা ঘন্টা আগে আমি বিয়ে করেছি। ওদের মূল লক্ষ্য আমাকে একটা ঠিকানা বাঁধা। কিন্তু যিনি আমাকে বাঁধবেন তিনি কি বলেন জান, তার সাথে বিয়ে যেন আমার কাজের স্বাধীন গতিকে সামান্যও ব্যহত না করে।’
‘অবিশ্বাস্য! যাত্রার আধা ঘন্টা আগে বিয়ে হয়েছে? তারপর?’
‘বিমান বন্দরে আসার পথে গাড়িতে ওর সাথে কথা বলেছি।’
‘কাঁদেননি উনি?’
‘কেঁদেছেন, কিন্তু বলেছেন দায়িত্বকেই বড় করে দেখতে হবে?’
‘কোন দায়িত্ব?’
‘আমি তখন একটা মিশন নিয়ে আসছিলাম আর্মেনিয়ায়। আর্মেনিয়ার মজলুম মুসলমানরা ছিল তখন এক ভয়ানক সংকটে।’
‘বুঝলাম, উনি অনেক বড়, অনেক বড় ওর হৃদয়। তবু আমি বলব, আপনি ওর ওপর জুলুম করেছেন, অবিচার করেছেন।’
‘তোমার কথা হয়তো ঠিক মারিয়া। কিন্তু তার ও আমার হাজার হাজার ভাইবোন যখন বেঘোরে প্রাণ দিচ্ছে, লাখো ভাইবোন যখন নির্যাতিত-নিষ্পিষ্ট হচ্ছে, হাজার এতিম শিশু ও স্বামীহারা নারীর আর্তবিলাপ যখন আকাশ-বাতাসকে ভারি করে তুলছে, তখন কি আমরা ব্যক্তিস্বার্থের কথা ভাবতে পারি?’
মারিয়া তৎক্ষণাৎ কোন উত্তর দিল না। আবেগ উচ্ছল হয়ে আহমদ মুসার মুখের ওপর চোখ রাখল কিছুক্ষণ। তারপর বলল, ‘কিন্তু সব মজলুমের অশ্রু মোছাবার দায়িত্ব কি আপনার একার?’
‘তা নয়। কিন্তু সবাই যদি বলে তার একার দায়িত্ব নয়, কেউ যদি না এগোয়, তাহলে অশ্রু মোছাবার কাজ কোনদিনই হবে না।’
‘আবার জিজ্ঞেস করছি, আপনি আপনার জাতিকে খুব ভালোবাসেন, তাই না?’
‘কারণ তারা সবচেয়ে বেশি মজলুম।’
‘কেন মুসলমানরা ছাড়া দুনিয়াতে আর কেউ কি নির্যাতিত হচ্ছে না?’
‘হচ্ছে হয়তো, কিন্তু মুসলমানরা জাতিগতভাবে সর্বব্যাপী এক নির্যাতনের শিকার। বলতে পার মারিয়া, স্পেনে মুসলমানরা যে নির্যাতনের শিকার হয়েছে, তার কোন দৃষ্টান্ত দুনিয়াতে আছে? যে মুসলমানরা সহায়-সম্পদে, জ্ঞানে-বিজ্ঞানে ও সভ্যতা-সংস্কৃতিতে স্পেনকে ইউরোপের মুকুট হিসেবে গড়ে তুলেছিল, সেই কোটি কোটি মুসলমান আজ কোথায়? পৃথিবীর ইতিহাসের সবচেয়ে মর্মান্তিক গণহত্যা, উচ্ছেদ ও বলপূর্বক ধর্মান্তরণের মাধ্যমে তাদের শেষ করা হয়েছে।’
‘আমি আপনার সাথে একমত। আমিও যখন পেছন ফিরে তাকাই তখন বেদনা বোধ করি। কিন্তু বিস্মিত হই, স্পেনের মুসলমানরা কারও কাছ থেকেই কোন সাহায্য পেল না!’
‘পাবে কোথেকে? উত্তর আফ্রিকার মুসলিম রাজ্যগুলো তখন ক্ষয়িষ্ণু, নিজেরাই লড়াইয়ে লিপ্ত। আর তূর্কি খিলাফত নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত। সবচেয়ে বড় কথা, রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে ইসলামী আদর্শবাদের বড় অভাব দেখা দিয়েছিল তখন।’
‘বেদনার শত স্মৃতিবিজড়িত স্পেনে আপনার সফর আপনাকে শুধু বেদনাই দেবে। লা-গ্রীনজার উপত্যকা আপনার চোখে অশ্রুর ফোঁটা এনেছে, কিন্তু ভগ্ন, বিরান কর্ডোভা ও গ্রানাডার মৌন মুখ আল হামরার দিকে চাইলে আপনি ডুকরে কেঁদে উঠবেন।’ মারিয়ার নরম কন্ঠ শেষ দিকে কেমন যেন ভারি হয়ে উঠল!
‘না, মারিয়া, মৌন মুখ আল হামরা ও কার্ডোভার ভগ্ন প্রাসাদগুলোর চেয়ে সেখানকার বাতাসে শত হৃদয়ের যে বিলাপ, ভাঙ্গা মসজিদের বোবা মিনারের যে হাহাকার জমাট বেঁধে আছে তার ভার দড় দুর্বহ।’ আহমদ মুসার ভারি কন্ঠ শেষের দিকে ভেঙে পড়ল। তার চোখের দুই কোণের শুকিয়ে যাওয়া ধারা আবার সজীব হয়ে উঠল।
মারিয়া আহমদ মুসার মুখ থেকে চোখ সরিয় নিয়ে বলল, ‘আপনার হৃদয়টা তো কবি-সাহিত্যিকের মতো স্পর্শকাতর, কোমর, বিপ্লবীর হৃদয় তো এমন হয় না!’
‘আমি বিপ্লবী নই মারিয়া, আমি মুসলিম। বিপ্লব আমার লক্ষ্য নয়, আমি চাই মজলুম মানুষের মুক্তি।’
‘পার্থক্য কোথায়? মুক্তির জন্যেই তো বিপ্লব চাই।’
‘পার্থক্য আছে। বিপ্লব লক্ষ্য হলে সেখানে অন্যায়, অবিচার ও হত্যা সব কিছুই বৈধ হয়ে যায়। কিন্তু মানুষের মুক্তি লক্ষ্য হলে অন্যায়, অবিচার ও অহেতুক হত্যা অবশ্যই এড়িয়ে চলতে হয়।’
মারিয়া পলকহীন চোখে তাকিয়েছিল আহমদ মুসার দিকে। বিমান বন্দরে আহমদ মুসার সাথে দেখা পাওয়ার পর থেকে লা-গ্রীনজায় পৌঁছা পর্যন্ত সব ঘটনা এক এক করে তার চোখের সামনে ভেসে উঠল। আহমদ মুসা শত্রুর সাথে আচরণ করেছেন বিদ্বেষ নিয়ে নয়, ভালোবাসা নিয়ে। শ্রদ্ধায় নুয়ে এলো মারিয়ার হৃদয়। মনে হলো, আহমদ মুসা সম্পর্কে যা সে শুনেছে, বুঝেছে ও ভেবেছে তার চেয়েও তিনি অনেক বড়। মনে হচ্ছে, বিনয়, কোমলতায় নুয়ে থাকা আহমদ মুসার ঐ মাথা যেন আকাশ স্পর্শী! মারিয়া নুয়ে পড়ে আহমদ মুসাকে অভিবাদন করে বলল, ‘আমার হৃদয়ের সবটুকু শ্রদ্ধা আপনার জন্যে। আমি গৌরবান্বিত। আপনার সাক্ষাত আমার জীবনের পবিত্রতম সম্পদ।’ আবেগে ভেঙে পড়ল মারিয়ার কন্ঠ। চোখের কোণটা ভেজা।
‘মারিয়া বোন, মানুষের কাছে মানুষের মাথা নত করতে নেই। এ মাথা শুধু স্রষ্টার কাছে অবনত হবার জন্যে।’
মারিয়া চোখের কোণ দু’টি মুছে নিয়ে বলল, ‘আমার খুব বেশি কি ইচ্ছে জানেন, এত বড় মানুষকে যিনি জয় করতে পেরেছেন, সেই ভাবিকে দেখার!’
বলেই মারিয়া ঘুরে দাঁড়াল। বলল, ‘আসুন মাগরিবের নামাজের সময় হয়েছে।’
মারিয়া বারান্দা থেকে ঘরে ঢুকে গেল। আহমদ মুসাও তাকে অনুসরণ করল।
বলল ফিলিপ, ‘যে কথা বলছিলাম, ইউরোপের সবচেয়ে পুরাতন, সবচেয়ে ঐতিহ্যবাহী জাতি-গোষ্ঠী হলো বাস্করা। ইউরোপের অন্য জাতি-গোষ্ঠীরা বার বার ভোল পাল্টেচ্ছে, একে অপরের মধ্যে বিলীন হয়ে গেছে, কিন্তু বাস্করা হাজার হাজার বছর ধরে তাদের রক্ত বিশুদ্ধ রেখেছে, তাদের জাতীয় বৈশিষ্ট্য অক্ষুন্ন রেখে চলেছে, তাদের কৃষ্টিতে সামান্যও বিকৃত হতে দেয়নি। ভাষার স্বাতন্ত্র্যও তাদের অমলিন আছে।’
‘এমন একটি জাতি-গোষ্ঠীর সাথে মুসলমাদের সম্পর্ক সৃষ্টি হলো কি করে?’ কাপড় গুছিয়ে ব্যাগে ভরতে ভরতে বলল আহমদ মুসা।
আজ আহমদ মুসার চলে যাবার দিন। যাবার জন্যে সে তৈরি হচ্ছে। ফিলিপরা আহমদ মুসাকে এত তাড়াতাড়ি যেতে দিতে চায়নি। আরও ক’টা দিন থেকে যেতে বলেছে। লোভ দেখিয়েছে আহমদ মুসাকে তারা বাস্ক এলাকায় নিয়ে যাবে, যেখানে দেখতে পাবে সে প্রচুর মুসলমানকে। পিরেনিজ পর্বতমালার উভয় পারে বাস্ক এলাকায় মোট জনসংখ্যার প্রায় এক-চতুর্থাংশ এখন মুসলমান। বাস্ক গেরিলা বাহিনীতে মুসলমানরা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় রয়েছে। এমনি বাস্কের কেন্দ্রীয় একজন অপারেশনাল কমান্ডার মুসলমান। নাম সপ্তম আবদুর রহমান, ডাক নাম ‘দি সেভেনথ’। আরও লোভ দেখিয়েছে বাস্ক এলাকায় গেলে আহমদ মুসা মসজিদ দেখতে পাবে, আজান শুনতে পাবে, যা স্পেনে কোথাও যে পাবে না। কিন্তু আহমদ মুসা বিনয়ের সাথে বলেছে, বাস্ক এলাকায় সে অবশ্যই যাবে কিন্তু যে গুরুত্বপূর্ণ মিশন নিয়ে স্পেনে এসেছে সেটা আগে তাকে সমাধান করতে হবে। আহমদ মুসা তার মিশনের কথা ফিলিপকে বলেছে। সব শুনে ফিলিপ উদ্বিগ্ন কন্ঠে বলেছে, ক্লু-ক্ল্যাক্স-ক্ল্যান যখন কোন কাজে হাত দেয়, আটঘাট বেঁধে হাত দেয়। ওদের কাজে কোন বাধা পড়লে ওরা সীমাহীন হিংস্র হয়ে ওঠে। আপনার মিশন খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। মাদ্রিদের আল ফয়সাল মসজিদ কমপ্লেক্স ও স্পেনের মুসলিম স্থাপত্যগুলো রেডিয়েশনের মাধ্যমে ধ্বংস করার উদ্যোগ যদি তারা নিয়ে থাকে, তাহলে এর প্রতিরোধের জন্য মসজিদ ও স্থাপত্যগুলোকে কেন্দ্র করেই কাজ করতে হবে এবং এই কাজে ওদের চোখে পড়ে যাবার আশংকাই বেশি। তারপরই বাঁধবে সংঘাত যা সবদিক থেকে ওদেরকেই আনুকূল্য দেবে। এসব যুক্তি তুলে ধরে ফিলিপ বলেছে, সুতরাং আহমদ মুসা, হঠাৎ করে ওকাজে হাত দেয়া ঠিক হবে না, ধীরে সুস্থে কোন পথ নিরাপদ তা প্রথম ঠিক করতে হবে।
উত্তরে আহমদ মুসা বলেছে, ‘তোমার সব কথাই ঠিক ফিলিপ। ক্লু-ক্ল্যাক্স-ক্ল্যানকে আমিও চিনি। কিন্তু ভয়ানক ষড়যন্ত্রটা কোন পর্যায়ে আছে, ভয়ংকর ক্ষতি কোন পর্যায়ে পৌঁছেছে, আমি তার কিছু জানি না। সুতরাং এক মুহূর্ত সময়ও এখন নষ্ট করা ঠিক হবে না।’
আহমদ মুসার এ কথা বলার পর ফিলিপ তৎক্ষনাৎ কোন কথা বলতে পারেনি। দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে মারিয়া আহমদ মুসা ও ফিলিপের আলাপ শুনছিল। আহমদ মুসা থামলেই মারিয়া বেরিয়ে আসে। এসে সে দাঁড়ায় ফিলিপের একেবারে পেছনে। ফিলিপের কাঁধে একটা কনুইয়ের ঠেস দিয়ে দাঁড়ায়। তারপর বলে, ‘ভাইয়া, আমি তোমাদের কথা শুনলাম। শুনে আরও নিশ্চিত হলাম, ওঁকে একা ছেড়ে দেয়া আমাদের ঠিক হবে না। আমার ব্যাপারটা নিয়ে ক্লু-ক্ল্যাক্স-ক্ল্যান ওর ওপর ভীষণ ক্ষেপে আছে, ওর মুক্ত চলাফেরই সম্ভব নয়। তার ওপর ঐ মিশন।’
ফিলিপ আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে বলে, ‘শুনলেন তো মারিয়ার কথা! আমি তার সাথে একমত।’
আহমদ মুসা বলে, ‘আমিও মারিয়ার সাথে একমত। কিন্তু একজন যাওয়ার মধ্যে বাড়তি কোন ঝুঁকি আমি দেখি না।’
সংগে সংগেই মারিয়া বলে ওঠে, ‘না, এটা ঠিক নয়, একজন এবং একটা টিম এক হতে পারে না।’
আহমদ মুসা বলে, ‘এটাও ঠিক, কিন্তু ক্লু-ক্ল্যাক্স-ক্ল্যানের যে সংখ্যা এবং যে শক্তি তাতে একজন না গিয়ে ৫ জন গেলে অবস্থার কোন পরিবর্তন ঘটবে না, বরং একা যাওয়াই আমার কাছে নিরাপদ।’
আহমদ মুসার কথা শেষ হতেই মারিয়া বলে ওঠে, ‘জানতাম আমি, আপনি সিদ্ধান্ত নিলে পাল্টাবেন না, বড় হওয়ার এটা একটা অহমিকা।’ বলে মারিয়া ছুটে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। তার শেষের কথাগুলো ভারি হয়ে ওঠে সম্ভবত বুক থেকে উঠে আসা জমাট এক অভিমান।
মারিয়া ঘর থেকে বেরিয়ে যাবার পর আহমদ মুসা ও ফিলিপ কথা বলছিল।
ফিলিপ আহমদ মুসার প্রশ্নের উত্তরে বলল, ‘বাস্কদের সাথে মুসলমানদের সম্পর্ক কিভাবে সৃষ্টি হলো, এই আপনাকে বলা হয়নি!’ একটু থামল ফিলিপ। তারপর আবার শুরু করল, ‘আপনি জানেন ‘গথ’ দের রাজা রডারিকে পরাজিত করে তারিক বিন যিয়াদ স্পেনে ইসলামী শাসনের প্রতিষ্ঠা করে। এক সময় জার্মানি থেকে এসে স্পেনে জেঁকে বসা গথরা ছিল বাস্কদের শত্রু। সুতরাং গথদের পতনে বাস্করা খুশি হয় এবং মুসলমাদের স্বাগত জানায়। মুসলিম শাসনামলে বাস্করা স্বায়ত্তশাসন ভোগ করে। বাস্ক এলাকা এই সময় ফরাসীদের দ্বারা আক্রান্ত হলে বাস্ক ও মুসলমানরা কাঁকে কাঁধ মিলিয়ে ফরাসীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে। ১৪৯২ খৃষ্টাব্দে স্পেনে মুসলিম শাসনের শেষ অবস্থান গ্রানাডার পতনের পর স্পেনে মুসলমানদের জীবনে কাল অমানিশা নেমে আসে, সেই সাথে বাস্কদের ঘোর দুর্দিন শুরু হয়। মুসলমাদের কাছ থেকে কেড়ে নেয়া সাম্রাজ্যের মালিক হওয়ার আনন্দে আত্মহারা ক্ষমতা-অন্ধ নতুন স্পেন সম্রাট ১৫১২ সালে বাস্ক এলাকার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং বাস্কদের স্বাধীনতা ও শান্তি নষ্ট হয়ে যায়। বাস্করা এই সময় স্বাভাবিকভাবেই মনে করল, মুসলিম শাসনের পতন না ঘটরে ‘বাস্কদের এই দুর্দিন আসতো না। এভাবেই মুসলমানদের সাথে বাস্কদের একটা গভীর সুসম্পর্কের সৃষ্টি হয়। এই সুসম্পর্কের কারণেই স্পেন থেকে মুসলমারা উচ্ছেদ হলে বাস্করো তাদেরকে ব্যাপকভাবে আশ্রয় দেয়। প্রচুর মুসলমান মধ্য ও উত্তর স্পেন থেকে পিরেনিজ পর্বত অঞ্চলের বাস্ক এলাকায় পালিয়ে আসে। তবে বাস্ক এলাকায় সবচেয়ে বেশি উদ্বাস্ত্ত আসে ভূমধ্যসাগরের পথে। দক্ষিণ ও পূর্ব স্পেন থেকে অবশিষ্ট উদ্বাস্ত্ত বোঝাই জাহাজ কোনটি উত্তর আফ্রিকার দিকে চলে যেত, কোনটি পশ্চিম ভূমধ্যসাগরীয় দ্বীপ মেজর্কা-মেনর্কা হয়ে পিরেনিজ-এর পাদদেশে অবস্থিত ফ্রান্সের সর্বদক্ষিণ পোর্ট ভেনসেড্রস দিয়ে এখানে পৌঁছাত। সেখান থেকে মুসরিম উদ্বাস্ত্তরা পিরেনিজের বাস্ক অঞ্চলে গিয়ে আশ্রয় নিত।’
আহমদ মুসা ফিলিপের কথা গোগ্রাসে গিলছিল। ফিলিপ থামলে বলল, ‘আমার হৃদয়ের বুকভরা কৃতজ্ঞতা গ্রহণ করুন মি. ফিলিপ। আমি কিছু কিছু জানতাম, কিন্তু এত কিছু জানতাম না। বাস্ক এলাকায় সফর আমার জন্যে ‘ফরজ’ হয়ে গেল।’
‘ধন্যবাদ মি. আহমদ মুসা, আমি খুশি হলাম।’ বলল ফিলিপ।
আহমদ মুসার ব্যাগ বাঁধা হয়ে গিয়েছিল। সে ঘড়ির দিকে চেয়ে বলল, ‘৫টা বাজছে। আমি তাড়াতাড়ি মাদ্রিদে পৌঁচতে চাই।’
ম্লান মুখে উঠে দাঁড়াল ফিলিপ। এগোলো দরজার দিকে নিরবে। তার পেছনে পেছনে আহমদ মুসা।
বারান্দায় দাঁড়িয়েছিল গাড়ি। ড্রাইভার প্রস্তুত হয়ে তার সিটে বসেছিল।
গাড়ি বারান্দায় নামার মুখে দাঁড়িয়েছিল মারিয়া ও জোনা। মারিয়ার মুখ মলিন। আহমদ মুসা ও ফিলিপ তাদের কাছাকাছি পৌঁতেই মারিয়া আহমদ মুসার দিকে এক ধাপ এগিয়ে গেল। তার মাথা নিচু। মাথা নিচু রেখেই বলল, ‘আমাকে মাফ করবেন, আমি তখন ‘অহমিকা’ শব্দ ‘অহংকার‘ অর্থে বলতে চাইনি।’ কাঁপল মারিয়ার গলা।
আহমদ মুসা থমকে দাঁড়াল। তারপর হেসে বলর, ‘আমি তোমার কথা বুঝেছি। আমি দুঃখিত যে, শব্দটা তুমি মনে রেখেছো।’
একটু থেমে আবার বলতে শুরু করল, ‘আমি সকলের সাহয্য-সহযোগিতা চাই মারিয়া, কিন্তু সামনে এগোবার পথে একে শর্ত হিসেবে দেখার আমি বিরোধী।’
কথা শেষ করে পা তুলতে যাচ্ছির আহমদ মুসা।
মারিয়া বলে উঠল, ‘সামনে এগোবার পর সাহায্যের যদি প্রয়োজন হয়?’
‘যেখান থেকে যতটুকু সাহায্য পাওয়া যায় চাইব।’
‘কিন্তু চাওয়ার যদি সুযোগ না পান?’ বলল মারিয়া।
আহমদ মুসা হাসল। বলল, ‘আমি এর উত্তর জানি না মারিয়া। আল্লাহ আমার ভরসা।’
বলে আহমদ মুসা মারিয়া ও জোনাকে ধন্যবাদ জানিয়ে পা বাড়াল সামনে।
মারিয়া আর কিছু বলতে পারল না। কিন্তু তার ভারি হয়ে ওঠা নীল চোখে অনেক কথার আকুলি-বিকুলি।
গাড়ির দরজা ড্রাইভার খুলে ধরেছিল।
আহমদ মুসা ফিলিপকে জড়িয়ে ধরে আরবীয় কায়দায় তাকে একটা চুমু থেয়ে বলল, ‘ভেবো না ফিলিপ, আল্লাহ আমার সাথে আছেন।’ বলে গাড়িতে উঠে বসল আহমদ মুসা। গাড়ির দরজা লাগিযে দিল ফিলিপ। স্টার্ট নিল গাড়ি। চলতে শুরু করল। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল আহমদ মুসা, বেলা ৫টা ১০ মিনিট। মাদ্রিদ পৌঁছতে দেড় ঘন্টার বেশি লাগার কথা নয়।