ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট থেকে ছাড়া পেয়ে জেন কেবিনে এসে উঠল।
জেনের গাড়ি একটা লাইট পোষ্টের সাথে ধাক্কা খায়। আঘাত গাড়ির বাম অংশের ওপর দিয়ে যায় বলে জেন প্রাণে বেঁচে গেছে। তবু সে মাথার বাম পাশে ও বাম চোখে ভয়ানক আঘাত পেয়েছে। ১২ ঘন্টা পর তার জ্ঞান ফেরে। গাড়ির ব্লু-বুক থেকে ঠিকানা নিয়ে পুলিশ জেনের আব্বাকে টেলিফোনে খবর দেয়। জেনের বাবা মা ছুটে আসে হাসপাতালে। সর্বাত্মক চিকিৎসা-যত্ন জেন পায়, কিন্তু তারপরও তার বাম চোখটার ক্ষত রোধ করা যায়নি। জেনকে বাঁচানেই যেহেতু মুখ্য ছিল, তাই চোখের ক্ষতিটা স্বীকার করে নেয়া হয়েছে। জেন জোয়ানের ওখানে গিয়েছিল একথা বাবা-মা’র কাছে গোপন রেখেছে। আর বাবা-মা জানতেও চেষ্টা করেনি, জেন কোথায় গিয়েছিল। জেনকে কেন তারা একা গাড়ি নিয়ে বেরুতে দিল, এজন্যে তারা নিজেরাই নিজেদের অপরাধী মনে করেছে। জেন বাবা-মা’র একমাত্র সন্তান। গত কয়েকদিন জেনের বাবা-মা হাসপাতালেই পড়ে আছে। জেন বিপদমুক্ত হওয়ার এবং ইনটেনসিভ কেয়ার থেকে ছাড়া পাবার পর জেনের বাবা-মা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে।
জেন ইনটেনসিভ কেয়ারে থাকার সময় জেনের বাবা-মা ছাড়া কোন ভিজিটরকেই এ্যালাউ করা হয়নি।
জেনকে কেবিনে স্থানান্তরিত করার কয়েক মিনিট পরেই হান্না গিয়ে হাজির হলো কেবিনের দরজায়। কেবিন থেকে বেরুচ্ছিল জেনের আব্বা-আম্মা। হান্নাকে দেখে তারা খুশি হলো। বলল, ‘মা, এখন আর কোন অসুবিধা নেই জেনের সাথে দেখা করার। যাও, জেন একাই আছে।’
বলে একটু থামল জেনের আব্বা। তারপর বলল, ‘তুমি কতক্ষণ থাকছ হান্না?’
‘কেন আংকেল?’
‘তাহলে আমরা দু’জন বাড়ি থেকে ঘুরে আসতে পারি। ধরো ঘন্টা দু’সময়।’
‘আমি দু’ঘন্টার বেশি থাকতে পারি। অসুবিধা নেই। আপনারা আসুন।’
জেনের আব্বা-আম্মা চলে গেল।
কেবিনে প্রবেশ করল হান্না।
চোখ বুজে শুয়ে আছে জেন। তার বাম চোখে ব্যান্ডেজ। মাথায় ব্যান্ডেজ।
জেন আরও শুকিয়ে গেছে।
হান্না ধীরে ধীরে জেনের পাশে বসে তার হাতে হাত রাখল।
চমকে উঠে চোখ খুলল জেন। হান্নাকে দেখে হেসে উঠল। বলল, ‘এতদিনে এলি, কতদিন তোকে দেখিনি।’
‘বারে প্রতিদিন এসেছি, কিন্তু ইনটেনসিভ ইউনিটে ঢুকতে দিলে তো!’
‘হ্যাঁ, শুনলাম বাবা-মা ছাড়া কাউকেই ঢুকতে দেয়নি।’
জেন মুহূর্তের জন্যে থামল। তারপরেই প্রশ্ন করল আবার, ‘তুই জানতে পেরেছিলি কবে?’
‘এ্যাকসিডেন্টের এক ঘন্টার মধ্যে।’
‘এক ঘন্টার মধ্যে! কি করে?’
‘সে এক কাহিনী!’ মুখ টিপে হেসে বলল হান্না।
‘কাহিনী? কি সেটা?’
হান্না গম্ভীর হলো। বলতে শুরু করল, ‘সেদিন সন্ধ্যা সাতটা। আমি বাইরে থেকে ফিরছি। গেটে জোয়ানের সাথে দেখা। আমাকে না পেয়ে সে ফিরে যাচ্ছিল। তার উস্কো-খুস্কো, বিধ্বস্ত চেহারা। আমাকে সামনে পেয়ে সে শিশুর মতো কেঁদে ফেলল। বলল, ‘হান্না, আমি জেনকে খুন করেছি। আমি আঁৎকে উঠলাম। ধমক দিয়ে বললাম, এসব কি বলছ জোয়ান? জোয়ান বলল, ঠিকই বলছি, ও অসুস্থ, ওকে রাগানো আমার ঠিক হয়নি। আমার ওপর রাগ করে অসুস্থ শরীর নিয়ে গাড়ি চালাতে গিয়ে ও এ্যাকসিডেন্ট করেছে। ও এখন জেনারেল হাসপাতালে। তুমি যাও হান্না, আমাকে খবর এনে দাও। বলে কান্নায় ভেঙে পড়ল জোয়ান। আমি সংগে সংগেই গাড়ি ঘুরিয়ে নিয়ে চলে আসি।’ হান্না থামল।
অশ্রুতে ভরে উঠেছিল জেনের চোখ।
‘ও কোথায় হান্না?’ বলল জেন।
‘ও প্রতিদিন হাসপাতারে আসে, আজও ওয়েটিং রুমে অপেক্ষা করছে। আমি খবর নিয়ে গেলে তবে যাবে।’
‘ওকে ডেকে দিতে পারবি হান্না?’
‘ডাকব। তার আগে একটা কথা বলি, তোর এতটা পাগলামী কি ঠিক হয়েছে? তুই সেদিনই যদি যাবি আমাকে খুলে বললি না কেন?’
‘মাফ কর হান্না, আমি কিছুতেই স্থির থাকতে পারিনি, দেরি করতে পারিনি।’
‘আর ওর ওপর এভাবে রাগ করলি কেন? অভিমান বুঝি এভাবে করে!’
‘কয়দিন ইনটেনসিভ কেয়ারে শুয়ে শুয়ে আমি ভেবেছি হান্না, ঐভাবে রাগ করা আমার ঠিক হয়নি। ওর দিকটা ভাবলে আমি ওর ওপর রাগ করতে পারতাম না।’ হান্না উঠে দাঁড়াল।
‘ওকে পাঠাচ্ছি জেন!’ বলে হান্না কেবিন থেকে বেরুবার জন্যে পা বাড়াল।
‘তুমি আবার চলে যেয়ো না যেন।’ বলল জেন হান্নাকে লক্ষ্য করে।
জোয়ান কেবিনে প্রবেশ করল, জেন তখন দরজার দিকেই তাকিয়ে ছিল। জোয়ান এসে জেনের পাশে দাঁড়াল। জেন তখন তার চোখ নামিয়ে নিয়েছে। চোখ বুজেছে সে। বোজা চোখ থেকে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে জেনের।
জোয়ানের বুকে তখন তোলপাড়। জেনের বাম চোখের ব্যান্ডেজটা তার বুকে সূচবিদ্ধ করছে। কোনদিন কি আর ঐ চোখ দিয়ে দেখতে পাবে জেন! এত বড় সর্বনাশ হলো তারই ভুলে, তারই দোষে। অসুস্থ জেন কোন কথা বলতে না চেয়েও কেন সে ঐসব কথা সেদিন বলেছিল! কি কথা আজ সে বলবে জেনকে। জোয়ানেরও চোখ থেকে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছিল। কেউই কথা বলতে পারছিল না।
সময় বয়ে চলছিল পল পল করে।
মুখ খুলল জোয়ানই প্রথম। বলল, ‘আমাকে মাফ কর জেন, আমি সেদিন ভুল বলেছিলাম। ভুলের খেসারত যে এত বড় হবে আমি বুঝিনি। তোমার চোখ….’
কথা শেষ করতে পারল না জোয়ান। কান্নায় কন্ঠ বন্ধ হয়ে গেল। চোখ খুলল জেন। চোখ থেকে উপছে পড়া অশ্রু স্রোতের মতো নেমে এলো গন্ড বেয়ে। বলল, ‘জোয়ান, আমি আজ সুখী। আমার জন্যে তোমার ঐ চোখের পানি গোটা দুনিয়ার চেয়ে আমার কাছে মূল্যবান। হান্না আমাকে সব বলেছে। একটা চোখ হারিয়েও যদি আমি এটা পেয়ে থাকি আমি ভাগ্যবতী।’
এসময় কেবিনে প্রবেশ করল হান্না। বলল, ‘দু’জনে গন্ডগোল পাকিয়ে অঘটন ঘটিয়ে দু’জনেরই আবার কাঁদা হচ্ছে! কান্না থামাও, চাচাজান আসছেন।’
জোয়ান ও জেন দু’জনেই চোখ মুছল। চোখ মুছে জেন জোয়ানকে নরম কন্ঠে বলল, ‘মরিসকোদের নিয়ে আমাদের কাছে যেমনটা তুমি বলেছিলে, আব্বার কাছে বলো না যেন। তোমাকে অনেক ধৈর্য ধরতে হবে জোয়ান।’
জোয়ান নিরবে গিয়ে বসল সোফায়।
জেনের আব্বা ফ্রান্সিসকো জেমেনিজ কেবিনে ঢুকেই দেখতে পেল জোয়ানকে। মুখে একটা বিস্ময়ের রেখা ফুটে উঠেই আবার মিলিয়ে গেল। তার মুখ থেকে বেরিয়ে এলো, ‘জোয়ান তুমি!’
জোয়ান উঠে দাঁড়িয়েছিল। বলল, ‘জি।’
‘তোমার খবরে আমরা সবাই দুঃখিত, কিন্তু সত্য যা তা হতেই হবে, কি বল?’ বলল জেনের আব্বা।
‘জি।’ বলল জোয়ান।
জেনের আব্বা সোফায় না বসে জেনের খাটে গিয়ে ঠেস দিয়ে দাঁড়াল। তার মুখ জোয়ানের দিকে। বলল, ‘বুঝলে জোয়ান, তুমি এতটুকুন বয়সে যে দুর্লভ কৃতিত্ব দেখিয়েছ এবং আরও যা তুমি পার, জাতির কোন কাজে আসবে না, এটাই দুঃখ। জাতির কেউ মরিসকোদের বিশ্বাস করে না।’
জোয়ান দাঁড়িয়েই ছিল। কোন উত্তর দিল না। মুহূর্ত কয়েক বিরতি দিয়ে জেনের আব্বা আবার শুরু করল, ‘জোয়ান, একটা কথা আমি বুঝি না, মরিসকোরা পরিচয় গোপন রেখে অন্যদের প্রতারণা করে কেন? এতে গন্ডগোল আরও বাড়ে। ধরো তোমার কথা, তুমি মরিসকো পরিচয় দিয়ে লেখাপড়া যদি করতে, তাহলে কি হতো? সুযোগ-সুবিধা, সহযোগিতা কম পেতে। এটা ঠিক। কিন্তু এটা তো বাস্তবতা! এ বাস্তবতা অস্বীকার না করলে তোমাকে তো এমন বিপর্যয়ে পড়তে হতো না।’ থামলো জেনের আব্বা।
জেন চোখ বুজে আছে। তার মুখ লাল হয়ে উঠেছে। জোয়ান মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। তার মুখও লাল। কিন্তু কোন কথা বলল না সে।
হান্না জেনের মাথার কাছে দাঁড়িয়ে আছে। সংকুচিত সে। ভয় করছে কিছু বলতে। ভাবছে কিছু বললে হয়তো আঙ্কেলের কথা খারাপের দিকে মোড় দিতে পারে।
জেনের আব্বা গা থেকে কোট খুলে কেবিনের হ্যাংগারে রাখতে রাখতে বলল, ‘জোয়ান, তুমি জেনকে দেখতে এসেছ খুব খুশি হয়েছি। হাজার হলেও ছোটবেলা থেকে এক সাথে পড়েছ। তবে জান কি, জেন ‘দি গ্রেট কার্ডিনাল’ পরিবারের মেয়ে। এভাবে তোমার আসাটা অনেকেই পছন্দ করবে না।’
জেনের মুখটা পাংশু হয়ে গেল যেন মুখের আলোটা দপ করে নিভে গেল! জিহবা, গলা তার শুকিয়ে এলো। কোন কথা বলতে পারল না। চোখ খুলে জোয়ানের দিকে তাকাতেও তার ভয় হতে লাগল। হান্না উৎকন্ঠিত চোখে তাকিয়ে ছিল জোয়ানের দিকে।
কিন্তু জোয়ান পাথরের মতো স্থির। মুখ নিচু তখন তার। দাঁত দিয়ে ঠোঁট সে কামড়ে ধরেছে।
জেনের আব্বা থামলে জোয়ান মুহূর্তের জন্যে চোখ বন্ধ করে, একটা ঢোক গিলে নিজেকে সামলে বলল, ‘আমি আসি, চাচাজান।’
বলে জোয়ান পা বাড়াল দরজার দিকে। পেছন থেকে জেনের আব্বা বলে উঠল, শোন জোয়ান, ‘একটু সাবধানে থেকো। তুমি ‘এ্যারোমেটিক ইঞ্জিনিয়ার্স’-এর চীফ ইঞ্জিনিয়ার মি. মিশেলের নাম শুনে থাকবে। সে মরিসকো বলে জানাজানি হবার পর কে বা কারা তাকে হত্যা করেছে।’
জোয়ান ঘুরে দাঁড়িয়েছিল। মুখ তুলে জেনের আব্বার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ধন্যবাদ চাচাজান!’
বলে ঘুরে দাঁড়িয়ে শান্ত পায়ে কেবিন থেকে বেরিয়ে গেল জোয়ান।’ | ← Previous | | | Next → | | সম্পুর্ণ বই এক পেজে »
১২. কর্ডোভার অশ্রু

Tags