১৩. আন্দালুসিয়ার প্রান্তরে

চ্যাপ্টার

ট্রিয়েস্ট থেকে বের হওয়ার চতুর্থ দিন মধ্যরাতে আহমদ মুসারা তুলুজ বিমান বন্দরে পৌঁছাল। অথচ সিডিউল অনুসারে দ্বিতীয় দিন মধ্যরাতে তাদের তুলুজে পৌঁছার কথা ছিল। ট্রিয়েস্টে তাদেরকে দেখা করতে হয়নি। সকালেই তারা মটেল ‘সি-কুইন’- এর রিসেপশনে টেলিফোন করে জানতে পেরেছিল, শুধু অধ্যাপক ভিলারোয়া ছাড়া সবাই রাতের প্লেনেই মাদ্রিদ রওনা হয়ে গেছে। আহমেদ মুসাদেরকে দু’দিন কাটাতে হয়েছে ভেনিসে।
আহমদ মুসারা ভেনিসে পৌঁছেছিল বুধবার বিকেলে। শুক্রবার পর্যন্ত তাদেরকে ভেনিসে থাকতে হয়েছে। ফিলিপ ও আবদুর রহমান সপ্তম এর বন্ধু ইব্রাহিম আলফনেসা কিছুতেই আহমেদ মুসাকে ছাড়তে রাজী হয়নি। তার যুক্তি ছিল, শুক্রবার বাদ জুমা গুরুত্বপূর্ণ দু’জন খৃস্টানের ইসলাম গ্রহণের অনুষ্ঠান আছে, এ অনুষ্ঠানে আহমদ মুসাকে হাজির থাকতেই হবে।
আপত্তি কিছু করলেও লোভ জেগেছিল আহমদ মুসার মনে। ভেনিসের মসজিদে জুমা পড়া যাবে, এখানকার মুসলমানদের সাথে সাক্ষাৎ হবে, সবচেয়ে বড় লাভ হবে দু’জন ভাইয়ের ইসলাম- গ্রহণ অনুষ্ঠানে হাজির থাকতে পারা।
সুতরাং ইব্রাহিম আলফনেসার যুক্তিতে দুর্বল হয়ে পড়েছিল। আহমদ মুসা সেদিন আলাপ করছিল আলফনসোর ড্রইংরুমে বসে।
আহমদ মুসা কি সিদ্ধান্ত নেবে না নেবে ভাবছিল সেই সময় ঘরে প্রবেশ করেছিল একটি মেয়ে। পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত নামানো তার স্কার্ট জুতার প্রান্ত কোন ছুঁই ছুঁই করছে। গায়ে কোট। মাথায় রুমাল, চোখের প্রান্ত পর্যন্ত নামানো।
ঘরে ঢুকে সালাম দিয়ে মেয়েটি ইব্রাহিম আলফনসোকে বলেছিল, ‘একটা সুখবর আব্বা’।
‘আমার মেয়ে আয়েশা। ভেনিস বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে’। মেয়েটিকে দেখিয়ে বলেছিল আলফনসো।
কথা শেষ করেই মেয়েটিকে জিজ্ঞাসা করেছিল আলফনসো, ‘তুমি বুঝি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এলে?’
‘জি, হ্যাঁ’।
‘তুমি তো এঁদের চিন না’।
‘চিনি না, আম্মার কাছে শুনলাম’।
‘কি শুনলে?’
‘ইনি সেই আহমদ মুসা’। আহমদ মুসার দিকে ইংগিত করে বলল মেয়েটি।
‘কোন আহমদ মুসা?’ একটু হেসে জিজ্ঞাসা করল আলফনসো।
‘যিনি মুসলমানদের জর্জওয়াশিংটন, যিনি মুক্ত করেছেন ফিলিন্তিন, মিন্দানাও, মধ্য এশিয়া, ককেশাস ও বলকানের মুসলমানদের?’
‘জর্জওয়াশিংটনের সাথে তুলনা কি মিলল, মা?’
‘ঠিক মেলে না, জর্জওয়াশিংটন একটা সেনাবাহিনীকে নেতৃত্ব দিয়েছেন মাত্র। কিন্তু ইনি একটা সার্বিক মুক্তি আন্দোলনের নির্মাতা ও সাফল্যদানকারি। ইনি সর্বোচ্চ সেনানায়ক, আবার সর্বনিম্ন সৈনিকও। ইনি যা আদেশ করেন, প্রথমে তিনি তা পালন করতে সামনে অগ্রসর হন। জর্জওয়াশিংটন শুধু ছিলেন মাথার ব্যক্তি, এমন মাথা ও মাটির ব্যক্তি ছিলেন না?’
আলফনসোর মুখের হাসি মিলিয়ে গিয়েছিল। তার জায়গায় এসেছিল বিস্ময়। মেয়ের দিকে অবাক বিস্ময়ে চেয়ে আলফনসো বলেছিল, ‘এত কথা এমন কথা তুমি জানলে কি করে, শিখলে কোত্থেকে মা?’
তখনই উত্তর দেয় নি আয়েশা। একটুক্ষণ চুপ করে ছিল। তারপর বলেছিল, ‘আপনাকে বলিনি আব্বা, আমরা ‘ইয়ুথ সোসাইটি ফর ইউরোপিয়ান রেনেসা’ নামে একটি সংগঠন করেছি। ছেলে ও মেয়েদের জন্যে এর দু’টি ভিন্ন ভিন্ন উইং আছে। দু’টো উইং স্বাধীনভাবে কাজ করে। প্রতি সপ্তাহে আমরা স্ট্যাডি সার্কেলে বসি। আমরা দু’টো কাজ করি, এক, ইসলামের আকিদা-বিশ্বাস ও ইতিহাস শিক্ষা করি আমরা, দুই, দেশ-বিদেশের সমস্যা নিয়ে আমরা আলোচনা করি, কোন দেশে মুসলমানদের কি সমস্যা সে তথ্য আমরা যোগাড় করি এবং বিশ্বের বিভিন্ন মুসলিম সংস্থা সংগঠনকে আমরা সাধ্যমত বই-পুস্তক, পত্র-পত্রিকা, কাটিং, স্লিপিং পাঠিয়ে সাহায্য করি। এই সূত্রেই আমরা জনাব আহমদ মুসা সম্পর্কে জেনেছি’।
‘এ সোসাইটি কি তোমার ভেনিস কেন্দ্রিক?’
‘না আব্বা। এ সোসাইটি প্রথম গঠিত হয় জার্মানির মিউনিখ শহরে। ইসলাম গ্রহণকারী একজন জার্মান তরুণ ইঞ্জিনিয়ার এই সোসাইটি গঠনের উদ্যোক্তা। এই ইঞ্জিনিয়ার সৌদি আরবে পাঁচ বছর ছিলো একটি পারমাণবিক প্রকল্পে এবং সেখানেই ইসলাম গ্রহণ করেন। এখন এই সোসাইটি গোটা মধ্য ইউরোপ জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে। আমাদের ইটালিতেই আছে ২০টি কেন্দ্র’।
আয়েশা থামতেই আহমদ মুসা বলে উঠেছিল, ‘বোন, তোমাদের কাজের মতই তোমাদের সোসাইটির নামটা সুন্দর। কিন্তু বলত, ‘আজকের সমৃদ্ধ ও সুন্দর ইউরোপ তার রেনেসাঁরই ফল, আবার ইউরোপে রেঁনেসা কেন?’
আয়েশার মুখে এক টুকরো সলজ্জ হাসি ফুটে উঠেছিল। বলেছিল সে, জনাব এর উত্তর আপনি জানেন, তবু বলছি, ইউরোপের সে রেনেসাঁ ইউরোপকে সমৃদ্ধি দিয়েছে এবং সমৃদ্ধিজাত সৌন্দর্য্য দিয়েছে ঠিকই, কিন্তু এই সমৃদ্ধি এবং সমৃদ্ধিজাত সৌন্দর্য্য নিয়ে তারা কোন পথে চলবে, কোন পথে চললে তাদের আত্মার পরিতৃপ্তি আসবে, কোন পথে চললে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে আনবে তাদের সার্বিক মংগল, সেই ব্যাপারে ইউরোপ আজ ভীষণ অন্ধকারে। এই অন্ধকারে তাদের হতাশা ক্রমেই বাড়ছে, জীবন হয়ে উঠেছে ক্লান্তিকর। মহত্তর ও মংগলতর অতি-জীবনিক একটি লক্ষ্যের অভাবে তাদের জীবন ও সমৃদ্ধি সবই অর্থহীন হয়ে পড়ছে। আমাদের রেনেসাঁ ইউরোপকে এই জীবন-বিনাশী অবস্থার হাত থেকে বাঁচাবার জন্যেই। আজ একমাত্র ইসলামেই আছে এই রেঁনেসার শক্তি’।
‘ধন্যবাদ বোন। তুমি যে মহত্তর ও মংগলতর অতি-জীবনিক একটা লক্ষ্যের কথা বললে সেটা কি?’
সেই সলজ্জ হাসি আবার ফুটে উঠেছিল আয়েশার মুখে। বলেছিল, ‘মাফ করবেন, আমার কথা আমি পরিষ্কার করতে পারিনি। অতি-জীবনিক বলতে বুঝাতে চেয়েছি জীবন-পরপারের অর্থাৎ পরকালীন জীবনের মহত্তর, উচ্চতর লক্ষ্যের কথা’।
‘অর্থাৎ আমাদের এই জীবনের স্বস্তি ও সুখকে এবং অর্থ-প্রাচুর্যের অর্থময়তাকে তুমি পরকালীন জীবন-মুখী মহত্তর ও উচ্চতর লক্ষ্যের সাথে সম্পৃক্ত করেছ। এর ব্যাখ্যা তুমি কিভাবে করবে’। বলেছিল আহমদ মুসা।
আয়েশার মুখ লজ্জায় লাল হয়ে উঠেছিল। বলেছিল সে, ‘সব বিষয় আমি ভালভাবে বুঝিনি। আমি যেটুকু বলতে পারব তাহলো, এই জীবনটাই যদি শেষ হয়, এই জীবনের পর যদি আর কিছু না থাকে, তাহলে অর্থ-প্রাচুর্য-সমৃদ্ধি সবকিছু সত্ত্বেও জীবনে এক সময় হতাশা এসে দাঁড়ায়, সবকিছু অর্থহীন হয়ে পড়ে। যেমন, যে কোন সময় মানুষের মৃত্যু ঘটতে পারে, আর মৃত্যুর সাথে সাথেই যদি সব শেষ হয়ে যায়, তাহলে জীবনের এত আয়োজন কেন, এর প্রয়োজন কি! এ থেকেই আসে জীবনে বিশৃঙ্খলা, জীবনের প্রতি বিতৃষ্ণা। যার একটা প্রকাশ হলো, অস্বাভাবিক ধরণের ভাব-প্রবণতা, নেশাগ্রস্ততা। এটা হলো একদিক। আরেকটা দিক হলো, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনকে সুন্দর ও শান্তিপূর্ণ করতে ভোগও প্রয়োজন, ত্যাগও প্রয়োজন। প্রয়োজন ভোগ ও ত্যাগের ভারসাম্য। কিন্তু পরকালীন জীবন যদি না থাকে, সেখানে যদি পুরস্কারের নিশ্চয়তা এবং শান্তির যদি বিষয় না থাকে তাহলে মানুষ অব্যাহতভাবে ত্যাগ করে যাবে কেন, স্বেচ্ছাচারিতা অন্যায় ও অবিচার থেকে স্বেচ্ছায় বিরত থাকবে কেন? সুতরাং আমাদের এই জীবনের সুখ-শান্তি-সমৃদ্ধি পরকালীন জীবনের উচ্চতর ও মহত্তর প্রতিশ্রুতি ও পুরস্কারের সাথে সম্পৃক্ত’।
আহমদ মুসার মুখ আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল। ভেনিসে বসে ইউরোপীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের একজন ইউরোপীয় তরুণীর কন্ঠে এই কথাগুলো শুধু অপরূপ নয়, অবিশ্বাস্য মনে হয়েছিল আহমদ মুসার কাছে। বলেছিল আহমদ মুসা, ‘ধন্যবাদ বোন, এত শিখলে কোথায়, স্ট্যাডি সার্কেলে?’
‘স্ট্যাডি সার্কেলে এবং বই পড়ে’।
‘কি বই?’
‘সাইয়েদ কুতুব ও আবুল আ’লার তাফসীর, তাদের জীবনী এবং আরও অনেকের বই’।
‘কোথায় পাও?’
‘আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক বই আছে’।
‘কিনেছে ওরা?’
সোসাইটির মাধ্যমে আমরা পরিকল্পনা করেছি, প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ চেষ্টার মাধ্যমে আমরা বিশ্ববিদ্যালয়কে দিয়েই এই সব বই কিনিয়ে নেব। আমরা তাই করেছি। এখন অন্ততঃ মধ্য ইউরোপের সব বিশ্ববিদ্যালয়েই প্রয়োজনীয় সব বই পাওয়া যায়’।
‘তোমাদের সোসাইটির কথা আমাকে বিস্মিত করেছে বোন। তোমরা অনেক-অনেক এগিয়েছ। আমার মনে হচ্ছে কি জান, ইউরোপের তোমরাই হবে আজকের বিশ্বে ইসলামের সবচেয়ে সুদক্ষ বাহিনী’।
‘ধন্যবাদ। কালকে আমাদের জোনাল সম্মেলন। ভেনিসেই। আপনাকে পেলে সেটা হবে আকাশের চাঁদ হাতে পাওয়ার চেয়েও বড় বিস্ময়। আপনাকে দাওয়াত দিচ্ছি আমি’।
আয়েশার আব্বা আলফনসো চট করে বলে উঠেছিল, ‘ওদের প্লেন আজ রাতেই, চলে যেতে চাচ্ছেন ওরা’।
আয়েশা ছোট চঞ্চলা মেয়ের মত উঠে দাঁড়িয়ে বলেছিল, ‘না আব্বা, ওঁদের যাওয়া হবে না কিছুতেই, যেতে দেব না। আহমদ মুসার উপর আমাদেরও অধিকার আছে। ইউরোপের প্রতিও ওঁর দায়িত্ব আছে’।
‘বল তুমি ওঁকে’। বলেছিল আলফনসো।
আহমদ মুসা সোফায় গা এলিয়ে দিয়েছিল। গম্ভীর কন্ঠে বলেছিল, ‘স্পেনে ফেরার কেন আমার এত তাড়া তা আপনারা জানলে দেরী করতে আমাকে বলতেন না। ওখানে মুসলমানদের অবশিষ্ট চিহ্নটুকুর উপর ভয়াবহ আঘাত আসছে, যে দীপ শিখাটুকু মাদ্রিদে জ্বলে উঠেছে, তাও নিভে যাওয়ার মুখে। আমরা একটা সাহায্যের জন্যে গিয়েছিলাম ট্রিয়েষ্টে ডঃ সালামের গবেষণা কেন্দ্রে। কিন্তু সে সাহায্য সম্ভব নয়। এখন কঠিণতর পথে আমাদের এগুতে হবে। প্রতিটি মুহূর্ত এখন আমার কাছে অসহ্য রকম দীর্ঘ মনে হচ্ছে।’
থামল আহমদ মুসা।
গোটা ড্রইং রুমে নেমে এসেছে গাম্ভীর্য। আয়েশার মুখেও একটা বেদনা ও শংকার ভাব ফুটে উঠেছে। কারও মুখে কোন কথা নেই।
আহমদ মুসাই আবার কথা বলেছিল, ‘তবু আমি থাকব দু’দিন ভেনিসে। জনাব আলফনসোর কথায় আমি দূর্বল হয়েছিলাম। আর আয়েশার কথায় আমি সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেছি।’
আয়েশার মুখে হাসি ফুটে উঠেছিল। ছুটে চলে যাচ্ছিল ভেতরে, সম্ভবতঃ তার মাকে সুখবরটি জানাবার জন্যেই। দু’পা গিয়েই ফিরে দাঁড়িয়েছিল আয়েশা। বলেছিল তার আব্বাকে লক্ষ করে, ‘আপনাকে যে সুখবর জানাতে এসেছিলাম সেটা হলো, শুক্রবারে দু’জন ছাড়াও আরো কয়েকজন ইসলাম কবুল করতে পারে।’
কথা শেষ করেই আয়েশা ছুটছিল ভেতরে।
আলফনসো বলে উঠেছিল, ‘শুন আয়েশা, এ খবর কার কাছ থেকে শুনলে, তুমি?
কিন্তু কে কার কথা শুনে। আলফনসো’র কথা শুরু হতে হতেই আয়েশা ভেতরে।

আহমদ মুসা মেয়েদের ইয়ুথ সোসাইটি ফর ইউরোপিয়ান রেনেসাঁর জোনাল সম্মেলনে গিয়েছিল। ঈদের আনন্দ এসেছিল সেদিন ঐ সম্মেলনে। প্রথমে ছিল বক্তৃতা। পনের মিনিটেই তার কথা শেষ করেছিল আহমদ মুসা। তারপর শুরু হয়েছিল প্রশ্নোত্তর। আড়াই ঘন্টা চলেছিল প্রশ্নোত্তরের আসর। এই আড়াই ঘন্টায় ইসলামের গত চৌদ্দশ’ বছরের ইতিহাস, মুসলমানদের আজকের সমস্যা-সম্ভাবনার কোন প্রধানদিকই বাদ যায়নি। আহমদ মুসা ধৈর্যের সাথে সকল প্রশ্নের জবাব দিয়েছে। খুব খুশী হয়েছিল সে ইউরোপীয় বোনদের আগ্রহে। অনুষ্ঠান শেষে আহমদ মুসাকে ধন্যবাদ জানাতে গিয়ে সোসাইটির পক্ষ থেকে ভেনিস শাখার সভানেত্রী আয়েশা বলেছিল, ‘সোসাইটির জীবনে আজ ঐতিহাসিক দিন। আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের বিশেষ অনুগ্রহ আছে আহমদ মুসার উপর। তিনি যেখানে পা দেন, সেখানেই সোনার ফসল ফলে, মুসলমানদের জীবনের অন্ধকার কেটে গিয়ে আসে সোনালী দিন তার এই আগমন আমাদের মাঝে আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের এক পরিকল্পনার ফল আমরা মনে করি। তাঁর কথা, তাঁর শিক্ষা এবং তাঁর উৎসাহ দান আমাদের সোসাইটিকে নতুন জীবন দান করবে, আমাদের বহুদূর এগিয়ে নিবে। তাঁর কাছে আমাদের দাবী, ইউরোপ বঞ্চিত, ইউরোপের মানুষ বঞ্চিত, মুসলিম বিশ্ব ইউরোপের প্রতি নজর দিক। ইউরোপের মান অনুসারে উ্পযুক্ত ও যথেষ্ট ইসলামী সাহিত্য এখনও সৃষ্টি হযনি। ইংরেজীতে, ফরাসী ভাষায় কিছু আছে, ইউরোপের অনেক জাতীয় ভাষায় ইসলামী সাহিত্য শূণ্যের কোঠায়। যোগ্য মুসলিম মিশনারীর সংখ্যাও বলা যায় শূণ্যের অংকে এই বিষয়গুলোর দিকে আমরা আমাদের মহান ভাই-এর দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। জোর দিয়েই আমরা তাকে বলতে চাচ্ছি, ইসলামী আন্দোলনগুলো যে পরিশ্রম, যে কষ্ট, যে ত্যাগ ও কোরবানী মুসলিম দেশগুলোতে করছে, তা যদি তারা ইউরোপের জন্যে করে, তাহলে হাজারগুণ বেশী ফল তারা লাভ করবে। আমরা আশা করছি, ইউরোপের এই আকুল কণ্ঠ তাঁর মাধ্যমে মুসলিম বিশ্বে যাদের কাছে পৌঁছা দরকার তাদের কাছে নিশ্চয় পৌঁছবে। আমরা আল্লাহর কাছে আমাদের মহান ভাই-এর দীর্ঘ জীবন ও সব ক্ষেত্রে কামিয়াবী প্রার্থনা করছি। আর প্রার্থনা করছি, ইউরোপও যেন তাঁকে পায়।’
আহমদ মুসাকে ভেনিসের আবু আলী সুলাইমান মসজিদে নামায পড়াতে হয়েছিল।
ভেনিসের এই আবু আলী সুলাইমান মসজিদটি এ্ই নামের পুরানো মসজিদের ধ্বংসাবশেষের উপর নতুনভাবে নির্মিত হয়েছে। এই অপরূপ সুন্দর মসজিদ কমপ্লেক্সটিতে রয়েছে একটা বাজার, একটা শিক্ষালয়, একটা বড় সম্মেলন কেন্দ্র, একটা লাইব্রেরী।
এই আবু আলী সুলাইমান মসজিদের একটা ইতিহাস আছে।
তখন পঞ্চদশ শতকের শেষ দশক। তুরস্কে খলিফার আসনে তখন দিগ্বীজয়ী সুলাইমান। সমগ্র ভূমধ্যসাগর তার নৌবহরের দখলে। ইটালীর উপকূল ও বহু নগরী তাঁর কব্জায়। রোমের মত ভেনিস তখন খৃষ্টান প্রতিরোধের দুর্ভ্যেদ্য দূর্গ। এই দুর্ভেদ্য দূর্গে সুলাইমানের মুসলিম নৌবহর প্রবেশ করতে পারেনি। কিন্তু প্রবেশ করেছিল ইসলাম প্রচারক আবু আলী সুলাইমান। তাঁর হাতে ছিল কোরআন, আর তাঁর পিঠের ছোট্ট পুটুলিতে ছিল শুকনো রুটি। সৌম্যদর্শন, মৃদুভাষি ও দয়ালু হৃদয় আবু আলী সুলাইমান ছিল ভেনিসবাসীদের কাছে এক বিস্ময়। যে ভেনিসবাসীরা জানত মুসলমানরা যুদ্ধ, হত্যা ও নিষ্ঠুরতার প্রতীক, সেই ভেনিসবাসীরা একটা ভিন্ন চিত্র দেখল আবু আলী সুলাইমানের মধ্যে। তাঁর নম্রতা, ভদ্রতা ও শিষ্টাচারের কাছে দাঁড়ালে হিংসা-বিদ্বেষ কোথায় যেন হাওয়া হয়ে যায়। ভীষণ স্বভাবের অপরাধীরা তাঁর সংস্পর্শে এলে গলে খাঁটি সোনা হয়ে যায়। তখন চারদিকের রণ-উন্মাদনা ও রণ-ডংকার মধ্যে তিনি যেন শান্তির এক ছায়াদার বৃক্ষ।
আবু আলী সুলাইমান তার বাসের স্থান নির্দিষ্ট করেছিলেন ভেনিসের এক প্রান্তে এক ছোট্ট-শান্ত স্রোতস্বীনির তীরে। খুব শীঘ্রই স্থানটি ধনী-নির্ধন সকলের দর্শন গাহ হয়ে উঠল। তিনি সকলকে বলতেন, স্রষ্টা যেভাবে চান সেভাবে না চলার কারণেই মানুষের মনে, সমাজে, দেশে-সবটা জুড়ে আসে অশান্তি। সব আচরণের জন্যে স্রষ্টামূখী না হয়ে স্বেচ্ছাচারী হওয়াই মানবতার জন্যে সবচেয়ে বড় অপরাধ। তিনি মানুষকে জানালেন, ইসলাম শুধু মানুষের নয়, কুকুর, ঘোড়ার মত পশুদেরও নিরাপত্তা বিধান করে, তাদের সুখ-দুঃখের কথা ভাবে।
আবু আলী সুলাইমানের ক্ষুদ্র কুটিরের সামনে গড়ে উঠে মসজিদ। সেখান থেকে উচ্চারিত হতে থাকে মুয়াজ্জিনের আযান দিনে পাঁচবার। এক থেকে দুই, দুই থেকে তিন, তিন থেকে চার-এইভাবে ধীরে ধীরে নামাজিতে ভরে উঠে মসজিদ। গড়ে উঠে ভেনিসে একটি মুসলিম সমাজ। আবু আলী সুলাইমান শীঘ্রই শাসকদের কোপ দৃষ্টিতে পড়েন। বলা হলো আবু আলী সুলাইমান তুরস্কের সুলতান দিগ্বীজয়ী সুলাইমানের চর। একদিন ফজরের সময় নামাযীরা গিয়ে দেখল, আবু আলী সুলাইমানের রক্তাক্ত ও নিষ্প্রাণ দেহ পড়ে আছে মসজিদে জায়নামাযের উপর। তীন্ক্ষধার ছুরির আঘাতের পর আঘাতে তার দেহ বিকৃত হয়েছে, কিন্তু মুখ ভরা ছিল পবিত্র হাসি, যেমন তিনি হাসতেন ঠিক তেমনি। সে দৃশ্যের দিকে চেয়ে মানুষ ডুকরে কেঁদে উঠেছিল।
তারপর ভেনিসের মুসলমানরা মসজিদের নামকরণ করে আবু আলী সুলাইমান মসজিদ। আবু আলী সুলাইমান মরলেও মানুষ তার নামকে বাঁচিয়ে রাখতে চেষ্টা করে এইভাবে।
কিন্তু ভেনিসের দূর্বল সংখ্যালঘু মুসলমানরা শেষ পর্যন্ত তা পারেনি। আবু আলী সুলাইমানকে যেমন হত্যা করা হয়, তেমনি মসজিদটিকেও, প্রায় একশ’ বছর পরে, ধ্বংস করা হয় এবং সেখানে গড়ে তোলা হয় গীর্জা।
কিন্তু ঊনিশ শতকের শেষ দিক থেকেই গীর্জাটি পরিত্যক্ত হয়, কোন উপাসক সেখানে আর যেত না রোববারের নির্দিষ্ট প্রার্থনা সভায়। সেখানে গড়ে উঠে ক্লাব, পরে রেস্তোঁরা। স্থানটি কিন্তু পরিচিত ছিল সব সময় ‘হোলি আবু আলী সুলাইমান’ বলেই।
অনেক পরে ভেনিসের মুসলমানরা স্থানটি কেনার উদ্যোগ নেয়। সিদ্ধান্ত নেয় পুরানো বুনিয়াদের উপর আবু আলী সুলাইমান মসজিদটি পূনঃনির্মাণের। কিন্তু অনেক টাকা প্রয়োজন। কোথায় সে টাকা। অবশেষে মক্কার রাবেতায়ে আলম আল-ইসলামী সাহায্যে এগিয়ে আসে। স্থানটি কেনার জন্যে অর্থ সাহায্য দেয়। তারপর সৌদি সরকারের অর্থ সাহায্যে গড়ে উঠে সুন্দর, সুদৃশ্য আবু আলী সুলাইমান মসজিদ কমপ্লেক্স।
এই কাহিনী আহমদ মুসা শুনেছিল আগেই। যখন সে আবু আলী সুলাইমান মসজিদে প্রবেশ করেছিল, তার স্মৃতির পর্দায় ভেসে উঠেছিল আবু আলী সুলাইমানের সব কাহিনী। একা এক মানুষ আবু আলী এসেছিলেন এই ভেনিসে- দেশ ছেড়ে, আত্মীয় স্বজন, পরিবার-পরিজন সব ছেড়ে! কিসের টানে তিনি এসেছিলেন এই বিদেশ- বিভূই-এ! মানুষের প্রতি ভালবাসার টানে, তাদেরকে মুক্তির পথ দেখাবার উদগ্র বাসনায়। নিজেদের সমস্ত সুখ-শান্তি বিসর্জন দানকারী এই মহান ত্যাগি ব্যক্তিদের চেষ্টার কারণেই ইসলামের আলো বিশ্বের দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ে। এই মহান অগ্রজদের কথা স্মরণ করতে গিয়ে আহমদ মুসার চোখ দু’টি ঝাপসা হয়ে উঠেছিল অশ্রুতে।
ইমাম সাহেবের অনুরোধে আহমদ মুসাকেই জুম্মার খোতবা দিতে হয়েছিল।
বিরাট মসজিদ। এক পাশে ছেলেরা, আরেক পাশে মেয়েরা। ভরে গিয়েছিল মসজিদ। শুধু ভেনিস নয়, আশ-পাশ থেকে যারা টেলিফোনে খবর পেয়েছিল তারাও ছুটে এসেছিল। প্রায় তিন হাজারের মত মুসল্লি হাজির হয়েছিল। অধিকাংশই যুবক ও তরুণ।
খোতবায় আহমদ মুসা বলেছিল, ইসলাম প্রচলিত অর্থের কোন ধর্ম নয়। জাগতিক জীবনে মানুষ যাতে ক্ষতি ও অন্যায়-অবিচার থেকে বাঁচতে পারে, সুখে-শান্তিতে থাকতে পারে এবং পরকালে যাতে চিরন্তন শান্তির জীবন লাভ করতে পারে ইসলাম তারই একক একটি প্রাকৃতিক বিধান। আহমদ মুসা বলেছিল ইসলাম কিভাবে এসেছিল কিভাবে বিজয় লাভ করেছিল এবং কিভাবে দাঁড়িয়ে পড়েছিল বিশ্বব্যাপী। এই কথা বলতে গিয়ে সে স্মরণ করেছিল খাজা মঈনুদ্দিন চিশতীর কথা, শাহজালালের কথা, এক আবু আলী সুলাইমানসহ হাজারো শহীদি আত্মার কথা। বলতে গিয়ে আবেগে তার কন্ঠ রুদ্ধ হয়ে গিয়েছিল। কেঁদে উঠেছিল মসজিদের প্রতিটি মুসল্লি। অশ্রু গড়িয়েছিল তাদের চোখ থেকে অঝর ধারায়। তারপর আহমদ মুসা বলেছিল মুসলমানদের আদর্শ-বিচ্যুতি কি করে সেই সোনালী দিনের ইতি ঘটাল, স্বার্থপরতাজাত অনৈক্য কি করে তাদের পতন ঘটাল সেই কাহিনী। আত্মবিনাশের সেই মর্মন্তুদ কাহিনী আবার মুসল্লিদের চোখ সজল করে তুলেছিল। এরপর আহমদ মুসা বলেছিল, পতনের শেষতল থেকে মুসলমানরা আবার উঠে আসছে, পৃথিবীকে পথ দেখাবার দায়িত্ব নিয়ে যে জাতির উত্থান, সেই মুসলিম জাতি সেই দায়িত্ব গ্রহণের জন্যে আবার আজ এগিয়ে আসছে। স্বার্থপরতাজাত অনৈক্য যে মুসলিম জাতির একদিন পতন ঘটিয়েছিল, জীবন দেয়ার মত চুড়ান্ত ত্যাগ স্বীকার করে তারা আজ ঐক্যকে আবার সংহত করছে। মানবতার কল্যাণে এবং মহৎ উদ্দেশ্যে জীবন দেবার সংখ্যা যে জাতির মধ্যে ক্রমবর্দ্ধমান হারে বাড়ে, সে জাতির উত্থান কেউ রোধ করতে পারে না, সে জাতির বিশ্ব-নেতৃত্ব ঠেকিয়ে রাখতে পারে না কেউ। মুসলমানদের আবার বিশ্ব-নেতৃত্ব লাভ অবধারিত। আমি দুর দিগন্তে সে সোনালী দিনের স্বর্ণরেখা দেখতে পাচ্ছি। আহমদ মুসার এ শেষ কথাগুলো আনন্দে উজ্জ্বল করে তুলেছিল মুসল্লিদের মুখগুলোকে। আহমদ মুসা উপসংহারে বলেছিল, সে সোনালী দিনে পৌছার জন্যে সংগ্রামের এক কঠিন পথ এখনও আমাদের পাড়ি দিতে হবে।
জুম্মার নামাযের পর শুরু হয়েছিল ইসলাম গ্রহণ করতে আসা লোকদের ইসলামে দীক্ষা দানের অনুষ্ঠান।
কথা ছিল দু’ব্যক্তির ইসলাম গ্রহণের। একজন ভেনিস বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, আরেকজন তরুণ ব্যবসায়ী। কিন্তু ইসলাম গ্রহণকারীর সংখ্যা এসে দাঁড়িয়েছিল সাতে। এদের পরের পাঁচজনের মধ্যে তিনজন সরকারী চাকুরে, দু’জন ব্যবসায়ী। সবাই বয়সে যুবক। সকলের মধ্যে প্রবীণ একমাত্র ভেনিস বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। তাঁর বয়স পঞ্চাশ। পদার্থ বিজ্ঞানের অধ্যাপক তিনি। উল্লেখ্য, তাঁকে নিয়ে এ পর্যন্ত ভেনিস বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনজন অধ্যাপক ইসলাম গ্রহণ করলেন।
সকলের অনুরোধে আহমদ মুসাই ওঁদের সকলের ইসলাম গ্রহণ অনুষ্ঠান পরিচালনা করেছিল।
অনুষ্ঠান ও দোয়া শেষে আহমদ মুসা অত্যন্ত আগ্রহ নিয়ে আলোচনা করেছিল কয়েকজনের সাথে।
প্রবীণ অধ্যাপক জোস ওরতেগা, মুসলিম নাম আহমদ হাসান’কে আহমদ মুসা জিজ্ঞাসা করেছিল, ইসলামের কোন জিনিসটি আপনাকে আকৃষ্ট করেছিল সবচেয়ে বেশী’।
‘কোন একটা দিককে আমি চিহ্নিত করতে পারবো না। জীবন সম্পর্কে ইসলামের টোটাল দর্শনটাই আমাকে আকৃষ্ট করে’। বলেছিল অধ্যাপক ওরতেগা।
‘আকৃষ্ট হওয়ার বিষয়টা কি ছিল?’
‘তাওহীদ, রিসালাত ও আখেরাত’ এর বিশ্বাস সম্মিলিতভাবে যে অপূর্ব ও ভারসাম্যপূর্ণ বিধানের জন্ম দিয়েছে সেটা’।
কথার মাঝখানে একটু হেসেছিল অধ্যাপক ওরতেগা। তারপর আবার শুরু করেছিল, তাওহিদের বিশ্বাস মানুষকে সমস্ত অন্ধবিশ্বাস, কুসংস্কার এবং সকল প্রকার দাসত্ব থেকে মুক্ত করে এক স্বাধীন মানুষে পরিণত করে, যেখানে উপরে এক আল্লাহ ছাড়া তার উপরে আর কেউ থাকে না। আর রেসালত সেই আল্লাহর খলিফা অর্থাৎ প্রতিনিধির মর্যাদায় অভিসিক্ত করে, আর তাকে দেয় স্রষ্টার দেয়া জীবন পরিচালনার সংবিধান। আখেরাতের বিশ্বাস ‘মানুষকে দেয় সকল কৃতকর্মের জওয়াবদিহীর সদাজাগরুক ভয় এবং পরকালের চিরন্তনী জীবনে সৎ জীবনের জন্যে পুরস্কারের নিশ্চয়তা এবং অসৎ জীবনের জন্যে শাস্তির প্রবল ভীতি। জাগতিক জীবনকে সুখ ও শান্তিপূর্ণ করার জন্যে মানুষের এমন এক ভারসাম্যপূর্ণ জীবন অপরিহার্য’।
আহমদ মুসা অধ্যাপক ওরতেগার কথা শুনে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করেছিল। বলেছিল, অধ্যাপক ওরতেগার এই উপলব্ধি যদি ইউরোপের জাগ্রত বিবেকের কাছে আমরা পৌঁছাতে পারি, তাহলে আমি মনে করি ইউরোপে পরিবর্তনের এক বিপ্লব ঘটে যাবে। মুসা বিন নুসায়েরের যে বিজয় অভিযান অষ্টম শতাব্দীতে ফ্রান্সের দক্ষিণ সীমান্ত পিরেনিজ পর্বতমালায় এসে থেমে গিয়েছিল, সে বিজয় আমরা ইউরোপে সম্পূর্ণ করতে পারবো। সমর শক্তি যা সেদিন পারেনি, ইসলামের আদর্শের শক্তি তা পারবে।
তরুণ-তরুণীর দল যারা হাজির ছিল সে সমাবেশে, তারা আনন্দে তকবীর দিয়ে উঠেছিল। তাদের চোখে-মুখে ফুটে উঠেছিল উজ্জ্বল ভবিষ্যতের এক স্বপ্ন।
আহমদ মুসা তরুণ যারা ইসলাম গ্রহণ করেছিল সেদিন তাদের সাথেও আলোচনা করেছিল, তাদের উপলব্ধির সাথে পরিচিত হবার জন্যে।
একজন তরুণ বলেছিল, আমি কম্যুনিষ্ট আন্দোলনের সাথে যুক্ত ছিলাম। কিন্তু কম্যুনিষ্ট অর্থনীতি ও তার সাম্যবাদ অবাস্তব ও ব্যর্থ প্রমানিত হবার পর আমি হতাশায় ভুগছিলাম। সে সময় আমি ‘ইয়ুথ সোসাইটি ফর ইউরোপিয়ান রেনেসা’ আয়োজিত একটি সেমিনারে উপস্থিত হয়েছিলাম। সে সেমিনারে একজন বক্তা বলেছিলেন, ‘শাসন দন্ড উচিয়ে বন্টনের সাম্যতা বিধানের মধ্যে শুধু অবাস্তবতা নয়, এক ধরণের নিপীড়নও বিদ্যমান রয়েছে। ইসলাম এই ধরণের সাম্যতা নয়, আইনের সাম্যতা বিধানে অত্যন্ত কঠোর এবং আপোষহীন। এখানে একজন দুর্বলতম সাধারণ লোকের অভিযোগে রাষ্ট্র প্রধানকেও আসামীর কাঠগড়ায় এসে দাঁড়াতে হয়। ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থায় একজন সাধারণ লোক রাষ্ট্র প্রধানকেও রাস্তায় দাঁড় করিয়ে কৈফিয়ত তলব করতে পারে। ইসলাম মানুষের স্বাধীন আয়-ব্যয়ের উপর এমন নৈতিক ও আইনগত বিধিনিষেধ আরোপ করে এবং আয় ও ব্যয়কারীকে এমন দায়িত্বরোধে উজ্জীবিত করে যার ফলে সম্পদ অব্যাহতভাবে বিতরণশীল হয়ে ওঠে এবং এই সমাজে ধনী হওয়া যেমন কঠিন, তেমনি গরীব থাকাও অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। এই কল্যাণ-সমাজে রাষ্ট্র প্রধানের ভাতা বা বেতন সাধারণ মানুষের অংশের চেয়ে বেশী হতে পারে না। আর এই কল্যাণ সমাজে শুধু মানুষ নয়, কুকুরও যদি না খেয়ে থাকে তার জন্যে আল্লাহর কাছে জওয়াবদিহীর ভয়ে রাষ্ট্র প্রধান ভীত থাকে’। এই কথাগুলো আমার সামনে অজানা এক জগতের দ্বার খুলে দেয় এবং আমাকে এমনভাবে প্রভাবিত করে যে, আমি ইসলাম সম্পর্কে পড়াশুনা করতে বাধ্য হই। ধীরে ধীরে আমার কাছে প্রতিভাত হয়ে ওঠে যে, মানবতার জন্যে স্বাভাবিক ও শান্তিময় জীবনের একমাত্র পথ ইসলাম। তার পরেই আমি ইসলাম গ্রহণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি’।
‘আপনার পরিবার থেকে কোন বাধা আসেনি?’ আগ্রহের সাথে জিজ্ঞাসা করেছিল আহমদ মুসা।
‘আসেনি। বরং আব্বা খুশী। তার বয়স একশ’ তিন বছর, একজন গোঁড়া ক্যাথলিক তিনি। তিনি খুশী হয়েছেন কারণ আমি ধর্মদ্রোহী কম্যুনিজম থেকে ধর্মের দিকে আসছি। তিনি আমাকে বলেছেন, ‘ইসলামই তোমাদের জন্যে উপযুক্ত। ধর্মগুলোর মধ্যে মাত্র ইসলামই তোমাদের দাবী পূরণ করতে পারে’।
আহমদ মুসার প্রশ্নের জবাবে আরেকজন যুবক বলেছিল, ‘ইসলামের নামায আমাকে প্রথম আকৃষ্ট করে। প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালে একটা মসজিদের কাছাকাছি আমি থাকতাম। আসা-যাওয়া কালে প্রায়ই এক সাথে মুসলমানদের নামায পড়তে দেখতাম। অনেক সময় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েও দেখেছি। মুসলমানদের নামাযের মধ্যে গণতন্ত্র, সাম্যতা ও স্রষ্টার প্রতি আনুগত্যের চুড়ান্ত প্রকাশ আমি দেখি। আরেকটা জিনিস আমাকে আকৃষ্ট করেছিল। সেটা হলো, দিনে পাঁচবার নামায। এই ভাবে দিনে পাঁচবার কেউ যদি তার প্রভুর সামনে দাঁড়ায়, তাহলে নিঃসন্দেহে সে সৎ ও সুন্দর জীবনের অধিকারী হবে। এই অনুভূতি থেকেই ইসলামকে জানার ব্যাপারে আমি আগ্রহী হই। ইয়ুথ সোসাইটি ফর ইউরোপিয়ান রেনেসাঁ’ এ ব্যাপারে আমাকে সাহায্য করে’।
আহমদ মুসা ঐ দিনই বিকেলে ‘ইয়ুথ সোসাইটি ফর ইউরোপিয়ান রেনেসাঁ’র ছেলেদের শাখার এক আঞ্চলিক সম্মেলনে যোগদান করেছিল।
এই দিনই সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় আহমদ মুসারা ভেনিস ছেড়েছিল। তাদেরকে বিমানে তুলে দিতে এসেছিল একদল যুবক। আর এসেছিল ইব্রাহিম আলফনসো এবং আয়েশা।
বিমানের গ্যাংওয়েতে প্রবেশের আগে আহমদ মুসা শেষ বিদায় সম্ভাষণ জানাবার জন্যে ফিরে দাঁড়িয়েছিল। ফিরেই দেখতে পেয়েছিল আয়েশা একদম পেছনেই। তার নীলচোখ ভরা জল।
‘কাঁদছ আয়েশা তুমি?’ বলেছিল আহমদ মুসা।
‘আর দেখা হবে না কোন দিন?’ বলেছিল আয়েশা।
‘জীবন পায়ে চলা পথের মত, কেউ তো নিশ্চিত করে কিছু বলতে পারে না আয়েশা?’
‘পথিক কি ফেরেনা তার ফেলে আসা পথে আর?’
‘ফেরে বোন, আবার ফেরেও না।’
‘তাহলে বোনরা কি হারিয়ে যাবে, ভাইদের জীবন থেকে?’ অসহ্য এ অনুভূতি।’
আয়েশার চোখটা ভিজে উঠেছিল।
‘না মা, এমন ভাবছ কেন? তুমিই না বলেছ, ইউরোপের দাবী আছে ওর প্রতি? ওকে আসতেই হবে।
‘পরিচিত ভাই-বোনদের কাছে ফিরে আসতে আমারও ইচ্ছে করে, কিন্তু এ ওয়াদা কোথাও করতে পারিনি।’
‘ক্ষণিকের এমন স্মৃতি বেদনাদায়ক।’ চোখ মুছে বলল আয়েশা।
‘তবু এমন হাজারো ঘটনা জীবনের চলার পথে ঘটবেই।’
‘মনকে আল্লাহর জন্যে প্রস্তুত করেননি কেন?’
‘মানুষ তাহলে বোন মানুষ হতো না।’
‘তাহলে কি আল্লাহ চান বোনরা ভায়ের জন্য এভাবে কাঁদবে?’
‘অর্ধেক বললে ভাইরাও কাঁদবে বোনের জন্যে, মা কাঁদবে সন্তানের জন্যে, সন্তান কাঁদবে মায়ের জন্যে। এই মমতার বাঁধনেই তো মানব সমাজ বাঁধা।’
দরজায় যাত্রীর ভীড় বেড়ে গিয়েছিল। আহমদ মুসা ইব্রাহিম আলফনসোর দিকে চেয়ে বলেছিল, ‘আসি জনাব, সবাইকে আমার সালাম বলবেন।’
তারপর আয়েশার দিকে চেয়ে বলেছিল, ‘আসি বোন।’
আয়েশার ঠোট কাঁপছিল। কিন্তু কোন শব্দ বেরোয়নি। তার ভেজা চোখে করুন এক দৃষ্টি। আহমদ মুসার অন্তরের কোথায় যেন মোচড় দিয়ে উঠেছিল। এমনভাবে বিদায় জানাবার মত তার কোন বোন নেই। বোনরা এমন মমতাময় হয় ভাইদের প্রতি! তাদের অশ্রু-জলে এমন ভাবেই কি সিক্ত হয়ে উঠে ভায়ের চলার পথ!
আহমদ মুসার মমতা-বুভুক্ষ হৃদয় বেদনায় চিনচিন করে উঠেছিল।
একটা আবেগ যেন বুক থেকে ঠেলে উপরে উঠতে চাইছিল।
আহমদ মুসা তাড়াতাড়ি ঘুরে দাঁড়িয়েছিল!
লম্বা পা ফেলে চলতে শুরু করেছিল সে গ্যাংওয়ে ধরে।
গ্যাংওয়েতে ঢোকার পথে দরজায় দাঁড়ানো একজন লোক বিষ্ফারিত চোখে দেখছিল আহমদ মুসাকে।
আহমদ মুসা চলে যেতেই সে জিজ্ঞাসা করেছিল ইব্রাহিম আলফনসোকে, ‘কে ইনি?’
‘আহমদ মুসা।’ বলেছিল আলফনসো।
‘ঠিক বলেছেন।’
‘আপনি চেনেন তাকে?’
‘না মানে ছবি দেখেছি। উনি কোথায় যাচ্ছেন?’
‘ফ্রান্সের তুলুজ।’
শুনেই লোকটি ঘুরে দাঁড়িয়েছিল। প্রবেশ করেছিল পাশের একটি কক্ষে। হাতে তুলে নিয়েছিল টেলিফোন।
‘আব্বা, ওর নাম বলে তুমি ঠিক করনি। লোকটিকে আমার ভাল মনে হলো না।’ বলেছিল আয়েশা।
‘ঠিক বলেছ মা, হঠাৎ বলে ফেলেছি।’
আয়েশার চোখে উদ্বেগ।
চোখ তখনও তার ভেজা অশ্রুতে।
তারা বাপ-বেটি দু’জন ঘুরে দাঁড়িয়ে ধীরে ধীরে হাঁটতে শুরু করেছিল বিমান বন্দর থেকে বেরিয়ে আসার জন্যে। বাইরে লবীতে অন্যেরা অপেক্ষায় ছিল।

ফ্রান্সের তুলুজ বিমান বন্দরে পা দেবার পর আহমদ মুসার মনটা আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিল নতুন চিন্তায়। চিন্তাটা স্পেনের মুসলিম স্মৃতি চিহ্নগুলো এবং মাদ্রিদের শাহ ফয়সাল মসজিদ কমপ্লেক্সকে তেজষ্ক্রিয়তার হাত থেকে উদ্ধার করার প্রশ্ন নিয়ে। একটা উদ্বেগ তার মনকে এসে ঘিরে ধরেছিল। মনে হচ্ছিল তার, একটি করে দিন যাচ্ছে আর তেজষ্ক্রিয় দানবের ভয়ংকর রূপ ভয়ংকরতর হয়ে উঠছে। যার গ্রাসে শেষ হয়ে যাচ্ছে স্পেন থেকে মুসলিম ইতিহাসের শেষ উপস্থিতিটুকু।
আহমদ মুসা বিমান বন্দর থেকে বেরিয়ে গাড়িতে উঠল এই চিন্তা মাথায় নিয়ে।
ভাড়া করা ট্যাক্সি। মুরেট পর্যন্ত ভাড়া করেছে। মুরেট তুলুজের ৫০ মাইল দক্ষিণে একটা ছোট্ট শহর। মুরেটে আব্দুর রহমান সপ্তমের বন্ধুর বাড়ি। রাতে তারা ওখানেই উঠবে।
গাড়ি ভাড়া করেছে আব্দুর রহমান সপ্তম। সে বসেছে ড্রাইভারের পাশে। পেছনের সিটে আহমদ মুসা এবং জোয়ান।
মধ্যরাতের তুলুজ। রাস্তায় লোকজন গাড়ি-ঘোড়া খুব কম। আধা ঘুমন্ত নগরী। আলো-আধারীর লুকোচুরি খেলা ছাড়া দু’পাশে দেখার কিছু নেই। আহমদ মুসা গাড়িতে উঠে চোখ বন্ধ করে সিটে গা এলিয়ে দিয়েছে। তাকে আবার সেই চিন্তাই পেয়ে বসেছে। বিজ্ঞান যে তেজষ্ক্রিয়ের লোকেশনকে ডিটেক্ট করতে পারছেনা, সেই অদৃশ্য শত্রুর বিরুদ্ধে সে অগ্রসর হবে কোন পথে! তেজষ্ক্রিয় বিকিরণ হওয়ার আগে কিংবা শুরুর পর্যায়ে তেজষ্ক্রিয় কেন্দ্রকে চিহ্নিত করা যেত, কিন্তু তেজষ্ক্রিয় একবার চারদিকে ছড়িয়ে পড়লে ওই তেজষ্ক্রিয়ের কেন্দ্র আর চিহ্নিত করা যায় না। কারণ তেজষ্ক্রিয় রাখা আছে ডিটেকশন প্রুফ কন্টেইনারে। কয়েকটি সুক্ষ্ম ছিদ্র দিয়ে তেজষ্ক্রিয়ের বিকিরণ হয়। বিকিরণের মাত্রা এত সুক্ষ্ম যে, ছড়িয়ে পড়া তেজষ্ক্রিয়ের সাথে তা প্রায় একাকার থাকে। এই অবস্থায় কেন্দ্রকে ডিটেক্টর আলাদাভাবে চিহ্নিত করতে পারে না। এই অবস্থায় তেজষ্ক্রিয় বিকিরণের উৎস চিহ্নিত করে তা অপসারণের কোন উপায় নেই, সেই সাথে এর কোন এন্টিডোটও নেই। এখন এগুবার পথ কি! এই চিন্তাটাই আহমদ মুসাকে পেয়ে বসেছে।
রাতের জনবিরল রাস্তায় তীব্র গতিতে এগিয়ে চলছিল আহমদ মুসাদের ভাড়া করা গাড়ি।
ড্রাইভার ছেলেটি যুবক বয়সের। পরনে ট্রাওজার, গায়ে জ্যাকেট। মাথার হ্যাটটা কপাল পর্যন্ত নামানো।
‘কি ড্রাইভার, আমরা এতক্ষণও তো গেরোনে হাইওয়ে পেলাম না?’ বলল আব্দুর রহমান সপ্তম।
ড্রাইভার তৎক্ষণাৎ জবাব দিল না।
আব্দুর রহমান সপ্তমের কথা বলার শব্দে আহমদ মুসার চিন্তাসূত্র ছিন্ন হয়ে গেল।
‘একটু অন্য পথ দিয়ে যাচ্ছি তো।’ একটু সময় নিয়ে জবাব দিল ড্রাইভার।
আব্দুর রহমান সপ্তমের প্রশ্ন, ড্রাইভারের দেরী করে জবাব দেয়া এবং ড্রাইভারের জবাবের ধরণ শুনে ভ্রু-কুঞ্চিত হয়ে উঠল আহমদ মুসার। একটু ভাবল আহমদ মুসা। তারপর বলল, অন্য পথটা কি বাঁকা পথ ড্রাইভার?
ড্রাইভার আবার একটু সময় নিয়ে বলল, জ্বি, একটু বাঁকা।
‘এয়ারপোর্ট থেকে গেরোনে হাইওয়ে কোন দিকে?’
‘পশ্চিম দিকে।’ ড্রাইভার মুখ খোলার আগেই জবাব দিল আব্দুর রহমান সপ্তম।
আহমদ মুসা বসেছিল ড্রাইভারের পেছনের সিটেই।
আব্দুর রহমান সপ্তম কথা শেষ করার সংগে সংগে আহমদ মুসার বাম হাতটি দ্রুত গিয়ে ড্রাইভারের গলা সাপের মত পেঁচিয়ে ধরল।
আহমদ মুসা দেখছিল স্পিডোমিটারের পাশে দিক নির্দেশক বোর্ডে গাড়ি যাচ্ছে উত্তর দিকে। কিন্তু আহমদ মুসা জানে তাদের গন্তব্যস্থল মুরেট দক্ষিণ দিকে। মুরেটগামী গেরোনে হাইওয়েতে পড়ার জন্য দক্ষিণ দিক দিয়ে ঘোরা স্বাভাবিক, কিন্তু উত্তরে যাওয়া স্বাভাবিক নয়।
আহমদ মুসার হাত সাঁড়াশির মত চেপে ধরেছিল ড্রাইভারের গলা।
ড্রাইভারের গলা থেকে একটা শব্দও বের হলো না। রুদ্ধশ্বাস ড্রাইভারের চোখ দু’টি বিষ্ফারিত হয়ে উঠেছিল। কিন্তু হাত দু’টি তার সক্রিয় ছিল। এক হাত ছিল স্টিয়ারিং হুইলে, অন্য হাতে চেপে ধরেছিল হর্ন। একটানা বেজে চলছিল হর্ন।
আহমদ মুসা তার ডান হাত দিয়ে ড্রাইভারে হাত সরিয়ে দিল হর্ন থেকে। আহমদ মুসার বুঝতে অসুবিধা হয়নি হর্নের মাধ্যমে সংকেত পাঠাচ্ছে সে।
ওদিকে আব্দুর রহমান সপ্তম আহমদ মুসা ড্রাইভারের গলা পেঁচিয়ে ধরার সাথে সাথে এগিয়ে গিয়ে স্টিয়ারিংটা ধরে ফেলেছিল। গাড়িটা অল্পকিছু এঁকে-বেঁকে এগিয়ে আবার সোজা চলতে শুরু করল।
ড্রাইভারের দেহটা শিথিল হয়ে এলে আহমদ মুসা টেনে তুলে তার দেহটা পেছনে নিয়ে এল এবং তাকে উপুড় করে ফেলে তাকে বেঁধে ফেলার জন্যে বলল জোয়ানকে। তারপর উঠে এল ড্রাইভারের সিটে। স্টিয়ারিং হুইল আব্দুর রহমান সপ্তমের হাত থেকে নিয়ে তাকে বলল, তুমি পেছনে গিয়ে ওকে সামলাও।
ড্রাইভিং সিটে বসে রিয়ার ভিউ মিররের দিকে তাকিয়ে আহমদ মুসা দেখল, পেছন থেকে তীব্র বেগে চার’টি হেডলাইট ছুটে আসছে।
মাত্র কয়েক মুহূর্ত। তারপরেই পেছন থেকে আহমদ মুসার গাড়ির দু’পাশে দু’টি গাড়ি উঠে এল। ঘন ঘন হর্ন দিচ্ছিল গাড়ি দু’টি।
আহমদ মুসা বুঝল, গাড়ি দু’টি ড্রাইভারের দলের। ওরা নিশ্চয় পেছন থেকে অনুসরণ করছিল। নিয়ে যাচ্ছিল আহমদ মুসাদেরকে নিশ্চয় কোন একটা ফাঁদে। ড্রাইভারের হর্নে বিপদ সংকেত পেয়েই সম্ভবত ওরা এসেছে খোঁজ নিতে। হর্ন দিয়ে ওরা জানতে চাচ্ছে, ড্রাইভার ঠিক আছে কিনা।
আহমদ মুসা আরও বুঝল, তারা কোন এক অজ্ঞাত শত্রুর কবলে পড়েছে। কিন্তু কারা এরা? বিমান বন্দরে কেউ কি তাদের চিনে ফেলল? তা হলেও এটা কি করে সম্ভব! বিমান বন্দরে চিনে ফেললেও শত্রুদের পক্ষে এই আয়োজন এত তাড়াতাড়ি করে তো সম্ভব নয়! মনে হচ্ছে ফাঁদ যেন পেতে রাখা হয়েছিল। তাহলে কি তাদের আগমনের খবর আগেই এসে পৌঁছেছিল? হতে পারে ভেনিস অথবা মার্শেই বিমান বন্দরে কেউ তাদের চিনে ফেলে টেলিফোন করে দিয়েছে এখানে। ফ্রান্সের মার্শেই বিমান বন্দরেও তাদের ১ ঘন্টা যাত্রা বিরতি করতে হয়েছিল। কারা এই শত্রু? ক্লু-ক্ল্যাক্স-ক্ল্যান কি? ক্লু-ক্ল্যাক্স-ক্ল্যানের হর্ন কোডের সাথে এদের হর্ন-সংকেতের মিল আছে। কিন্তু আনাড়ী মনে হচ্ছে অনেকটা। হতে পারে ক্লু-ক্ল্যাক্স-ক্ল্যানেরই কোন একটা গ্রুপ।
দু’পাশ থেকে দু’টি গাড়ি সমান্তরালে চলে আসার সাথে সাথে আহমদ মুসা গাড়ির গতি বেগ আকস্মিকভাবে বাড়িয়ে দিল। তীব্র বেগে সামনে এগোলো আহমদ মুসার গাড়ি।
ওরা মনে করল শত্রু পালাচ্ছে। ওরাও বাড়িয়ে দিল গাড়ির বেগ। কিছুক্ষণের মধ্যেই ওদের গাড়ি আবার আহমদ মুসার গাড়ির পেছনে চলে এল। এবার পেছন থেকে ওরা গুলী করল আহমদ মুসার গাড়ি লক্ষ্যে। পর পর দু’টো গুলী। আহমদ মুসার গাড়ির দু’টি টায়ার প্রায় একই সাথে ভীষণ শব্দে ফেটে গেল।
কয়েক গজ মাটি কামড়ে, এগিয়ে গাড়িটি স্থির দাঁড়িয়ে গেল।
‘আব্দুর রহমান দেখো, ওর পকেটে নিশ্চয় পিস্তল আছে।’
আব্দুর রহমান সপ্তম পিস্তল আগেই বের করে নিয়েছিল। দ্রুত সে পিস্তলটি আহমদ মুসার হাতে তুলে দিল।
পিস্তলটি হাতে নিয়েই আহমদ মুসা ডানদিকে তাকাল। দেখ গাড়ি থেকে বেরিয়ে দু’জন ছুটে আসছে। হাতে ওদের পিস্তল। আহমদ মুসা মুহূর্ত সময় নষ্ট না করে পর পর দু’টি গুলী ছুড়ল। অব্যর্থ নিশানা। গাড়ি থেকে মাত্র দু’হাত দূরে এসে লোক দুটি মুখ থুবড়ে পড়ে গেল।
আহমদ মুসা গুলী করার পর ওদিকে আর না তাকিয়েই লাফ দিয়ে চলে এল গাড়ির বাম পাশে।
‘মুসা ভাই গাড়ির এ পাশটা লক করে দিয়েছি। দু’জন ওপাশে গেছে।’ বলল আব্দুর রহমান সপ্তম।
‘ধন্যবাদ আব্দুর রহমান, ডান পাশটাও লক করে দাও।’ বলে আহমদ মুসা বাম পাশের দরজা খুলে গড়িয়ে পড়ল মাটিতে। তারপর সাপের মত দ্রুত বুকে হেঁটে গাড়ির সামনের দিকটা ঘুরে এসে ডান প্রান্তে উঁকি দিল। দেখল ওরা দুজন পিস্তল বাগিয়ে গাড়ির গা ঘেঁষে বুকে হেঁটে এগিয়ে আসছে গাড়ির সামনের দরজার দিকে।
আহমদ মুসা সময় নষ্ট করল না। আরও দুটি গুলী বেরিয়ে এল তার পিস্তল থেকে পর পর। গুরিয়ে গেল ওদের দুজনের মাথা।
আহমদ মুসা উঠে দাঁড়িয়েছে, এমন সময় সামনে ডান পাশের গাড়ি থেকে নারী কন্ঠের একটা গোঙানী ভেসে এল। আহমদ মুসা পিস্তল বাগিয়ে ছুটল ঐ গাড়ির দিকে। গাড়ির দরজা খোলাই ছিল। আহমদ মুসা দেখল হাত, পা, মুখ বাঁধা একটা মেয়ে গাড়ির সিটে বসে। মুখের বাঁধন খোলার চেষ্টা করছে।
আহমদ মুসা পিস্তলটি পাশে ফেলে দিয়ে মেয়েটির মুখের বাঁধন খুলে দিল।
মুখের বাঁধন খুলে গেলেই মেয়েটি কেঁদে উঠল হাউ মাউ করে।
আহমদ মুসা মেয়েটির হাত খুলে দিতে দিতে বলল, ‘কেঁদো না বোন, তোমার আর কোনও ভয় নেই।’
এ সময় পাশে এসে দাঁড়াল আব্দুর রহমান সপ্তম। তার সাথে জোয়ানও।
‘তোমরা গাড়িটা লক করে দিয়ে এসেছো?’ বলল আহমদ মুসা।
‘জি হ্যাঁ।’ বলল আব্দুর রহমান সপ্তম।
‘ভাল করেছ, পুলিশ অন্তত একজনকে তো পাবে। কিছু জানতে পারবে।’
মেয়েটির পায়ের বাধনও খোলা হয়ে গিয়েছিল। মেয়েটি মুখে রুমাল চেপে কাঁদছে তখনও।
‘বোন তুমি উঠে এসে সামনের সিটে বস।’ বলল আহমদ মুসা।
মেয়েটি সংগে সংগেই যন্ত্রের মত নির্দেশ পালন করল। সামনে ড্রাইভিং সিটের পাশে গিয়ে বসল।
আহমদ মুসা উঠে বসল ড্রাইভিং সিটে।
জোয়ান ও আব্দুর রহমান বসল পিছনের সিটে।
দূরে পেছনে পুলিশের গাড়ির সাইরেন শোনা গেল।
আহমদ মুসা স্টার্ট দিল গাড়িতে। ব্রান্ড নিউ গাড়ি। মাইল মিটারে দেখল মাত্র পাঁচশ মাইল চলেছে।
‘পেছনে চারটি হেডলাইট দেখা যাচ্ছে, পুলিশের গাড়ি এদিকে আসছে।’ পেছন থেকে বলল আব্দুর রহমান সপ্তম।
আহমদ মুসার গাড়ি তখন চলতে শুরু করেছে।
সব ঘটনা মাত্র দু’মিনিটে শেষ হয়ে গেল।
সামনেই রাস্তায় বড় একটা টার্ন। সে টার্নটি পার হবার পর পুলিশের গাড়ি আর দেখা গেল না। আহমদ মুসা আলো নিভিয়ে গাড়ি চালাচ্ছিল। সুতরাং অত পেছন থেকে আহমদ মুসার গাড়ি তাদের নজরে পড়ার কথা নয়।
আহমদ মুসার গাড়ি চলছিল একশ’ চল্লিশ কিলোমিটার বেগে।
টার্ন নেবের পর আহমদ মুসা গাড়ির গতিবেগ কমিয়ে আশিতে নিয়ে এল।
মেয়েটি তখনও রুমালে মুখ বুজে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে।
মেয়েটির পরনে ব্রাউন স্কার্ট, ব্রাউন কোট। মাথায় সাদা পশমের টুপি। বয়স বিশ বছরের বেশী হবে না। নিরেট ফরাসী চেহারা।
‘বোন, তুমি কে? কি করে ওদের হাতে পড়লে?’ বলল আহমদ মুসা মেয়েটির দিকে না তাকিয়েই।
মেয়েটির কান্না বেড়ে গেল। একটু পরে চোখ মুছে সে বলল, আমার দাদি মুমূর্ষ। টেলিফোন পেয়ে আমি যাচ্ছিলাম ওঁর কাছে। রাত ১১টায় ওরা আমাকে আমার এই গাড়ি সমেত কিডন্যাপ করে গেরোন হাইওয়ে থেকে।
‘কেন কিডন্যাপ করে?’
‘প্রথমে আমার গাড়ি ব্যবহার ওদের টার্গেট ছিল। পরে আমাকেও ওদের ঘাটিতে নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। ওদের মতলব খুব খারাপ ছিল।’
‘তোমার দাদির বাড়ি কোথায়?’
‘মন্ট্রেজু’তে।’
‘মন্ট্রেজু’তে? এত দূরের রাস্তা একা বেরিয়েছিলে এত রাতে?’
‘কি করব আমার আব্বা আম্মা থাকেন স্পেনে, ফ্রান্সের কূটনীতিক মিশনে। আমি তুলুজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি, একা থাকি।’
‘এখন তুমি কি করবে? কোথায় যেতে চাও?’
তৎক্ষণাৎ মেয়েটি কোন উত্তর দিল না। মনে হয় স্থির করতে পারছিল না।
আহমদ মুসাই কথা বলল আবার। বলল, দ্বিধা করো না বোন। এটা তোমার গাড়ি। যদি মনে কর আমরা এখানেই নেমে যাচ্ছি, তুমি বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে যাও। আর আমি মনে করি মন্টেজু-তে আজ তোমার যাওয়া ঠিক হবে না।
মেয়েটি মুখ তুলে পরিপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকাল আহমদ মুসার দিকে। তার চোখে-মুখে বিস্ময়ের চিহ্ন। মনে তার প্রশ্ন, কে এরা? সে নিজ চোখেই দেখেছে এই লোকটিই ঐ চারজন গুন্ডাকে পাখি শিকারের মত করে খুন করেছে। এর তো হওয়া উচিত ছিল ওদের চেয়েও কঠিন হৃদয় ও লোভী। এই রাত সাড়ে বারটায় যখন গাড়ি পাওয়া দুস্কর, তখন এভাবে গাড়ি ছেড়ে নেমে যাওয়ার প্রস্তাব করছে কেমন করে? এমন অস্বাভাবিক ব্যবহার তো সে দেখেনি!
“আজ আমাকে মন্টেজু” তে যেতে নিষেধ করছেন আপনি? বলল মেয়েটি।
ঠিক নিষেধ করছি না, আমি মনে করি একা যাওয়া নিরাপদ নয়।
মেয়েটির আরেক দফা বিস্মিত হবার পালা। একজন অচেনা, অজানা লোক তার নিরাপত্তার কথা এই ভাবে ভাবছে। মেয়েটির মনে পড়ল তার ছোটবেলার কথা। তখন পিতা মাতার সাথে থাকতো কায়রোতে। ওখানকার এক বৃদ্ধকে সে দেখত। তার কাজ ছিল অসুস্থ লোকের সেবা করা, পথহারা লোকদের পথ দেখানো এবং হারানো শিশুদের বাড়িতে পৌছে দেয়া। কিন্তু সে কারও গায়ে আচড় দিত না, আর এতো জলজ্যান্ত ৪টি লোক এখনি মারল। এখনও পিস্তল ওর পকেটে। এরপরও লোকটি এমন দায়িত্বশীল ও সৌজন্য বোধ সম্পন্ন হলো কি করে!
এ সময় নেমে গেলে আপনারা গাড়ি পাবেন কোথায়? এত রাতে তুলুজে কচ্চিত গাড়ি মেলে। বলল মেয়েটি।
কোন চিন্তা করো না। মানুষের চেষ্টা যেখানে শেষ হয়, বিধাতার চেষ্টা সেখান থেকে শুরু হয়।
মেয়েটি চোখ বড় বড় করে আহমদ মুসার দিকে তাকাল। বলল, আপনি বুঝি ঈশ্বরে খুব বিশ্বাস করেন?
অবশ্যই। তিনি আমার স্রষ্টা, তিনি আমার প্রতিপালক এবং তিনিই আমার সব কাজের বিচারক হবেন।
মেয়েটির মুখ হা হয়ে উঠল। লোকটি যে একদম গীর্জার ফাদারের মত কথা বলছে। কিন্তু গীর্জার ফাদাররা তো রক্তপাত করে না। কে এই বিচিত্র চরিত্রের চরিত্রের লোকটি।
একটু সময় নিয়ে মেয়েটি মুখ খুলল। ফিরে এল তার প্রসংগে। বলল, জনাব মন্ট্রেজু আমার যেতে হবে, জানি না আমার দাদির…….
মেয়েটির কন্ঠ ভারি হয়ে উঠেছিল। কথা শেষ না করেই সে থেমে গেল।
মিঃ সেভেন, আমাদের গন্তব্য তো মুরেট, মন্ট্রেজু এই একই রাস্তায় না? আহমদ মুসা একটু ঘাড় কাত করে পেছনে লক্ষ্য করে বলল।
আবদুর রহমান সপ্তমকে আহমদ মুসা বাইরের লোকদের সামনে তার নামে না ডেকে মিঃ সেভেন বলে।
জি হ্যাঁ। বলল আবদুর রহমান।
মুরেটে হল্ট করা কি আমাদের জন্য অপরিহার্য?
মোটেই না। আমরা শুধু ওখানে রাত কাটাতে চেয়েছিলাম।
আমরা তাহলে এখন সোজা মন্ট্রেজু যেতে পারি। ওকেও পৌছে দেয়া গেল, আমরা ওর গাড়িতে অনেকখানি এগিয়ে যেতে পারলাম।
এটাই বেটার হবে। বলল আবদুর রহমান সপ্তম।
আমি এখানকার রাস্তা ঘাট কিছুই চিনি না। তুমি আমাকে গাইড কর, এখন আমরা গেরোনে হাইওয়েতে উঠব। মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বলল আহমদ মুসা।
মেয়েটির চোখ মুখ আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল। জীবনের আশাই যেখানে সে ছেড়ে দিয়েছিল, সেখানে শুধু মুক্তি পাওয়াই নয়, রাতেই মন্ট্রেজুতেও সে যেতে পারছে। কৃতজ্ঞতায় ভরে উঠল তার মন পাশে বসা লোকটির প্রতি। সে তাকে সাক্ষাত জাহান্নাম থেকে উদ্ধার করেছে। জীবনের ভয় সে করে না। কিন্তু গুন্ডাদের হাতে পড়লে জীবনের চেয়েও মুল্যবান জিনিস তাকে হারাতে হতো।
অনেক ধন্যবাদ আপনাদের।
মেয়েটি রাস্তা বাতলে দিল। মিনিট পাচেকের মধ্যেই আহমদ মুসার গাড়ি উঠে এল গেরোনে হাইওয়েতে।
এবার ছুটল গাড়ি দক্ষিণ দিকে গেরোনে হাইওয়ে ধরে। একদম রাস্তার ধার বরাবর প্রবাহিত দক্ষিণ ফ্রান্সের একটা বড় নদী গেরোনে। এই নদীর নাম অনুসারেই হয়েছে রাস্তার নাম। গেরোনে নদী নেমে এসেছে পিরোনিজ পর্বতমালা থেকে। পিরেনিজ-অভ্যন্তরের ছোট্ট দুর্গম নগরী ভেল্লা পর্যন্ত হাইওয়ে ও নদী এক সাথেই গেছে। ভেল্লা স্পেনের উত্তর সীমান্তের উপর দাড়ানো ছোট্ট পার্বত্য শহর। এই শহরের অদূরে দুর্গমতর এক উপত্যকায় আবদুর রহমান সপ্তমের বসতি।
রাতের গেরোনে হাইওয়ে।
একদম ফাকা।
তীরের মত ছুটছে আহমদ মুসার গাড়ি।
ঐ গুন্ডারা আপনাদের কিডন্যাপ করেছিল কেন? মৌনতা ভেঙ্গে প্রশ্ন করল মেয়েটি।
আমরা ওদের চিনি না, মতলব কি তাও জানি না। আগে থেকেই ফাদ পেতে বসেছিল ওরা। বলল আহমদ মুসা।
ওদের গল্প থেকে বুঝেছি, ভেনিস বিমান বন্দর থেকে কেউ ওদের টেলিফোন করেছিল। ওদের গল্পে এও বুঝেছি, সাংঘাতিক একজনকে ওরা ধরতে যাচ্ছে। সেই সাংঘাতিক লোক কে? আপনি?
তোমার তাই মনে হয় আমাকে?
মেয়েটির মুখে এক টুকরো হাসি ফুটে উঠলো। বললো, হ্যাঁ।
কেন?
সাংঘাতিক না হলে ওভাবে চারজন ভীষণ গুন্ডা কি মরত?
সাংঘাতিক শব্দ কিন্তু কদর্যে ব্যবহৃত হয়। আমি কিন্তু ওদের হত্যা করিনি, ওদের হাত থেকে আমরা আত্মরক্ষা করেছি।
সরি। আমি সাংঘাতিক বলতে শক্তি বুঝিয়েছি।
আহমদ মুসা উত্তরে কিছু বলল না।
চলছিল গাড়ি ঝড়ের বেগে।
মাফ করবেন, আপনি কে? আপনারা কে? মেয়েটি মুখ ঘুরিয়ে আহমদ মুসার দিকে তাকিয়ে বলল।
পরিচয় জিজ্ঞাসা না করলেই খুশী হতাম মি….। তোমার নাম যেন কি?
আমি ডোনা জোসেফাইন। আপনার নাম?
বললাম তো জিজ্ঞাসা না করলেই খুশী হতাম। সংক্ষেপে, এ, এম, বলতে পার আমাকে। তোমার আব্বা কি রাষ্ট্রদূত স্পেনে?
জি হ্যাঁ।
তুমি তোমার আব্বার সাথে থাক না?
ছিলাম প্রাইমারী লেভেল পড়া পর্যন্ত।
কোন কোন দেশ তুমি দেখেছ?
কায়রো, রিয়াদ ও আংকারার কথা মনে আছে।
তোমার আব্বা মুসলিম দেশেই তো বেশী ছিলেন দেখছি?
হ্যাঁ, আমার আব্বা সারাসিনিক স্ট্যাডিজ-এ ডক্টরেট নিয়েছেন।
তোমরা কি খৃষ্টান?
বলছি, কিন্তু আপনার এ, এম, এর অর্থ কি?
ঠিক এই সময় সামনে অল্প দূরে রেড সিগন্যাল স্টিক জ্বলে উঠতে দেখা গেল।
প্রত্যেক গাড়িতেই এ ধরনের সিগন্যাল থাকে। বিপদে পড়লে এটা দিয়ে সংকেত দেয়া হয়।
হেড লাইটের আলোতে পরিস্কার দেখা যাচ্ছে, দুজন লোক পাশাপাশি দাড়িয়ে আছে। একজনের হাতে রেড সিগন্যাল। তাদের পাশেই রাস্তার এক ধারে একটা গাড়ি পার্ক করা।
রেড সিগন্যাল দেখার সাথে সাথেই ডোনার মুখ শুকিয়ে উঠেছিল। বলল, আজকেই কাগজে পড়েছি হাইওয়েতে রাতের বেলা ডাকাতি হচ্ছে, কিডন্যাপ হচ্ছে। কিডন্যাপ করে রেখে বড় অংকের টাকা দাবী করছে।
ভয় নেই ডোনা, ওরা তো সংখ্যায় খুব বেশী দেখছিনা।
বলে আহমদ মুসা বাম হাতে স্টিয়ারিং ধরে ডান হাত দিয়ে পকেট থেকে পিস্তল বের করে নিল এবং বলল, ডোনা, জোয়ান, আবদুর রহমান তোমরা মাথা নিচু রাখ। মতলব ওদের খারাপ হলে নিশ্চয় ওরা গুলী করবে।
আহমদ মুসা গাড়ির গতি একটুও স্লো করলো না। সে পরীক্ষা করতে চাইল, ওরা সত্যিই বিপদগ্রস্থ কেউ কিনা। বিপদগ্রস্থ হলে সিগন্যাল দেখানো এবং চিৎকার করে কিছু বলার চেষ্টা ছাড়া আর কিছুই করবে না। আর যদি ডাকাত-হাইজাকার হয় ওরা, তাহলে গাড়ি না দাড়াতে দেখলে নিশ্চয় গাড়ির টায়ার ফাটাবার চেষ্টা করবে।
তাই হলো। আহমদ মুসার গাড়ি যখন দাঁড়ানোর ভাব দেখালো না এবং দাঁড়ানো লোক দু’টি যখন পয়ঁতাল্লিশ ডিগ্রি এ্যাংগেলে এল, তখন দু’জনই দ্রুত রিভলবার বের করল।
আহমদ মুসা একটু অপেক্ষা করছিল। ডান হাতে পিস্তল তার রেডি ছিল। ওরা পিস্তল হাতে তুলে নেয়ার সাথে সাথে আহমদ মুসা গুলী করল পরপর দু’টি।
ওদের পিস্তল উঠে আসছিল আহমদ মুসার গাড়ি লক্ষ্যে। কিন্তু লক্ষ্যে উঠে আসার আগেই গুলী খেয়ে দু’জন পড়ে গেল রাস্তায়।
একই গতিতে গাড়ি ছুটছিল। গুলী করার সময় মনোযোগটা টার্গেটের দিকে শিফট হবার পরও গাড়ির মাথাটা একটুও কাঁপেনি। বাম হাতটা নিখুঁতভাবে নিয়ন্ত্রণ করেছে গাড়িটাকে।
গাড়িটা ওদের ছাড়িয়ে এগিয়ে চলে এল।
পেছন থেকে জোয়ান বলল, মুসা ভাই, গাড়ি থেকে আরও তিনজন বেরিয়ে এসেছে। ছুটছে এ দিকে।
পর মুহূর্তেই গুলীর তিনটি শব্দ পাওয়া গেল। প্রায় এক সাথেই। সম্ভবতঃ হাত ছাড়া হয়ে যাওয়া শিকারের লক্ষ্যে তিনটি গুলী ছুড়ে ব্যর্থতার জ্বালা জুড়াবার চেষ্টা করেছিল ওরা।
‘গুলী খাওয়া দু’টির খবর কি জোয়ান?’ জিজ্ঞাসা করল আহমদ মুসা।
‘দু’জন মাটি থেকে আর ওঠেনি।
ডোনা বিস্মিত চোখে তাকিয়ে ছিল আহমদ মুসার দিকে। সবিস্ময়ে সে ভাবছিল, কি অদ্ভুত লোক! কত কঠিন কাজ সে কত সাধারণভাবে করে ফেলে! এত বড় বিপদের সে মোকাবিলা করল, তার মুখে চিন্তার কোন ছায়াও পড়েনি। গোটা ব্যাপারটাই তার কাছে যেন ছিল একটা খেলার মত। এমন নার্ভ, গুলীর এমন নিশানা তার কাছে রূপ কথার মত লাগছে। রূপ কথার মত এই যে লোক, সে নিশ্চয় অসাধারণ কেউ হবে।
আহমদ মুসার দিকে অপলক চেয়ে ডোনা বলল, দয়া করে কি বলবেন আপনি কে? ওঁ আপনাকে ‘মুসা ভাই’ বলেছে, আপনার নাম এ, এম, এর অর্থ কি? এম এর অর্থ ‘মুসা’ ধরে নিলাম, কিন্তু ‘এ’-এর অর্থ?
‘ধন্যবাদ ডোনা, খুব বুদ্ধিমতি তো তুমি। আবিস্কার করেই ফেলেছ নামটা। ‘এ’-এর অর্থ ‘আহমদ’।
‘অর্থাৎ আপনি, ‘আহমদ মুসা’। মুসলমান?’
‘কায়রো, রিয়াদ ও আংকারায় তো তুমি মুসলমান দেখেছ, তাই না?’
‘দেখেছি। কিন্তু মুসলমানদের খুব ভয় করি ওরা নাকি খুব ঝগড়াটে জাতি। তিন’শ বছর ধরে আমাদের বিরুদ্ধে ক্রসেড করেছে।’
‘ডোনা, ক্রসেড হয়েছিল কোথায় বলত?’
‘ফিলিস্তিন অঞ্চলে।’
‘ঐ অঞ্চলে কাদের বাস?’
‘মুসলমানদের।’
‘তাহলে ক্রসেড করতে মুসলমানরা এসেছিল, না খৃষ্টানরা গিয়েছিল?’
একটু ভাবল। হাসল ডোনা। বলল, বুঝেছি, বলতে চাচ্ছেন, খৃষ্টানরাই ক্রসেড করতে গিয়েছিল মুসলিম ভূ-খন্ডে। এবং দায়ী খৃষ্টানরাই।’
‘আমি বলতে চাচ্ছি না ডোনা, ইতিহাস বলে এটা। খৃষ্টানরা অমূলক এক উম্মাদনা আর কুৎসিত এক রক্ত পিপাসা নিয়ে অন্যায় এক যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়েছিল মুসলমানদের উপর। সে সময় খৃষ্টানরা ধর্মের নামে যা করেছে, তার চেয়ে অধর্মের কাজ আর নেই ইতিহাসই এটা বলছে।’
’আমি ইতিহাস জানি না। আব্বা এ বিষয়টা ভাল বলতে পারবেন। তিনি বলেন, কায়রো, আংকারার মত জায়গায় সাধারণভাবে যে সব মুসলমান দেখ, ওরা ইসলামের ধ্বংসাবশেষ।’
‘অর্থাৎ?’
‘আব্বা বলেন, কোন নগরীর বিক্ষিপ্ত সামান্য ধ্বংসাবশেষ দেখে যেমন সেই নগরীর পূর্ণাংগ ছবি আঁকা যায় না, তেমনি ঐসব মুসলামানের সমাজ ও জীবন দেখে ইসলামের পূর্ণ রূপ কল্পনা করা যায না।’
‘তোমার আব্বা ঠিকই বলেছেন, ইসলামকে নিশ্চয় তিনি জানেন। তবে কি জান, ইসলাম কিন্তু আল-কোরআন, হাদীসে রসূল (সঃ)-এর মাধ্যমে অবিকৃত অবস্থায় বর্তমান আছে, বিকৃত হয়েছে ঐ মুসলমানরা। এই বিকৃতিকে সংশোধনের কাজও কিন্তু চলছে।’
‘আপনাকে দেখে এটাই মনে হচ্ছে। একমাত্র বাপ-মার’র কাছ ছাড়া আজকের এই সময়ের মত এমন নিরাপত্তা বোধ আর কখনও করিনি। আমার জীবনে ‘বোন’-এর সম্মানজনক সম্বোধন দিয়ে কেউ আমাকে ডাকেনি।’
ডোনার কণ্ঠ গম্ভীর শোনাল।
‘ইসলাম সকল মানুষকে ভাই ও বোনের মধুর সম্পর্কে এক সাথে বেঁধে দিয়েছে।’
ডোনা একটা ভাবল। একটু পর বলল, ‘আমার ভাবতে ভাল লাগছে, এমন পবিত্র সম্পর্ক যেখানে, সে সমাজে শান্তি ও সকলের নিরাপত্তা আসা আমার মনে হয় খুব সহজ।’
ডোনার কথাটা স্বগতোক্তির মত শোনাল। তার দৃষ্টি প্রসারিত ছিল সামনে।
আহমদ মুসাও আর তৎক্ষণাৎ কোন কথা বলল না। তারও দৃষ্টি সামনে প্রসারিত।
বাইরে রাতের নিঃশব্দ প্রহর।
দু’পাশে অন্ধকারে চুপটি করে দাঁড়িয়ে থাকা পাহাড়ের অন্তহীন শ্রেণী।
এরই মাঝে মসৃণ পাথুরে পথ বেয়ে শোঁ শোঁ এক শব্দ তুলে তীর বেগে এগিয়ে চলেছে আহমদ মুসার গাড়ি।

মন্ট্রেজু থেকে গোরানে হাইওয়ে ধরে পিরেনিজ পর্বতমালার কোলে দাঁড়ানো দক্ষিণ ফ্রান্সের সর্বশেষ শহর। ম্যানোনার দিকে এগিয়ে চলছিল আহমদ মুসার গাড়ি। গাড়িটি ডোনার। মন্ট্রেজু থেকে আসার সময় গাড়িটি ডোনা উপহার দিয়েছে আহমদ মুসাকে। আহমদ মুসা নিতে অস্বীকার করেছিল। বলেছিল স্পেনে যাবার ট্যাক্সি সার্ভিস আছে, অসুবিধা হবে না। উত্তরে ডোনা কিছু বলেনি। তার দু’চোখ ভরে উঠেছিল অশ্রুতে, নেমে এসেছিল দু’গন্ড বেয়ে। ডোনার আব্বা পাশেই দাঁড়িয়েছিল। পক্ককেশ কুটনীতিক চার্লস প্লাতিনি আহমদ মুসার পিট চাপড়ে বলেছিল, আমার একটি মাত্রই মা। বড় একা। তাই বোধহয় বড় জেদি। একটা ভাই পেয়ে ওর কি গর্ব। ওকে প্রত্যাখান করো না।
‘না, আব্বা, থাক। কারো ভাল লাগা, না লাগা, পছন্দ-অপছন্দের উপর জোর খাটানো যায় না আব্বা।’ বলে ডোনা দু’হাতে মুখ ঢেকে ছুটে পালাচ্ছিল।
‘ডোনা, দাঁড়াও। আহমদ মুসা শক্ত কণ্ঠে নির্দেশের সুরে বলেছিল। ডোনা এ নির্দেশ উপেক্ষা করতে পারেনি। নির্দেশের সাথে সাথে সে দাঁডিয়ে গিয়েছিল। দাঁড়িয়ে থেকেই ধীরে ধীরে সে ঘুরে দাঁড়িয়েছিল। অশ্রুতে তার চোখ ভিজা।
আহমদ মুসা দু’ধাপ সামনে এগিয়ে তার সামনা-সামনি হয়ে বলেছিল, আমার উপর অবিচার করছ ডোনা। উপহার মানুষ যত্নে রাখে। আমার সে জায়গা কোথায়, সময় কোথায়? চীনে তোমারই মত এক বোন তার প্রিয় সাদা রিভলবার আমাকে উপহার দিয়েছিল। আমি তা রাখতে পারিনি। বলকানে এসে তা খুইয়েছি। তোমার গাড়ি আজ নেব, কালকেই হয়তো দেখবো এক ঝাঁক গুলীতে এর দেহ ঝাঝরা হয়েছে, অথবা বোমা মেরে কেউ উড়িয়ে দিয়েছে। অথবা আমার হাত ছাড়াও হতে পারে। তখন আমার কষ্ট লাগবে।’
‘তাহলেও ঐ পিস্তলের মত আমার গাড়ি হবে সৌভাগ্যবান।’
‘ঠিক আছে, তোমারই জয় হলো ডোনা। তোমার এই সহমর্মীতা ও সহযোগীতার জন্যে ধন্যবাদ তোমাকে।’
‘কোথায় আমি কি করলাম? ‘
‘তোমার গাড়ি আমাদের যাত্রাকে অনেক সহজ ও স্বাধীন করবে।’
‘ধন্যবাদ। আমার ভাগ্য, আমার গাড়ি বিশ্ববিখ্যাত আহমদ মুসার সঙ্গ পাবে।’
বলে ছুটে চলে গিয়েছিল ডোনা তার গাড়ির কাছে।
আহমদ মুসার পরিচয় প্রকাশ হয়ে পড়েছিল ওদের কাছে আহমদ মুসা ডোনার বাড়িতে আসার পরেই।
ডোনার আব্বা চার্লস প্লাতিনি তার মা’ অসুস্থতার খবর স্পেন থেকেই পেয়েছিল। পেয়েই স্থল পথে ছুটে এসেছিল মন্ট্রেজু’তে। ডোনা পৌঁছার আগেই তার আব্বা পৌঁছে গিয়েছিল।
ডোনা বাড়িতে পৌঁছে আহমদ মুসাদের ড্রইং রুমে বসিয়ে ছুটে গিয়েছিল ভেতরে। ভেতরে ঢুকে পেয়েছিল তার আব্বাকে। তার আব্বা তখন টেলিফোন করছিল তুলুজে। ডোনাকে দেখে টেলিফোনে রেখে সে লাফিয়ে উঠেছিল। জড়িয়ে ধরেছিল ডোনাকে। বলেছিল, সেই সন্ধ্যায় বেরিয়েছিস তুলুজ থেকে। তোর কোথায় কি হলো ভেবে আমাদের দম বন্ধ হবার যোগাড়। রাস্তায় কিছু হয়েছিল? এত দেরী হলো কেন? কেন রাতে একা বেরিয়েছিলি?’
ডোনা সংক্ষেপে বলেছিল তার কিডন্যাপ হওয়া এবং উদ্ধার পাওয়ার ঘটনা।
শুনতে গিয়ে বার বার কেঁপে উঠেছিল ডোনার আব্বা চার্লস প্লাতিনি। শেষে আহমদ মুসার নাম শুনে চমকে উঠেছিল। বিস্ময়ের সাথে বলেছিল, ঠিক বলছিস ওঁর নাম, উনি আহমদ মুসা বলেছিলেন? ঠিক শুনেছিস তুই?’
‘ঠিক আব্বা। নাম বলতে চাননি, বলেছিলেন, এ.এম। তারপর তার সাথীর ডাক থেকে তা প্রকাশ হয়ে পড়ে। পরে স্বীকার করেন।
থেমেছিল ডোনা একটু, ‘তারপরেই আবার চোখে-মুখে বিস্ময় নিয়ে বলেছিল, ওভাবে যে বলছ, চেন নাকি আব্বা তাঁকে?
‘বিশ্ববিখ্যাত মুসলিম বিপ্লবী আহমদ মুসাকে জানি, তার ফটো দেখেছি। তোমার মুখে যে দুঃসাহসিক কাজ ও যে দুর্লভ চরিত্র বৈশিষ্টের কথা শুনলাম, তাতে ইনিই সেই আহমদ মুসা হবে। আমরা জেনেছি তিনি স্পেন অঞ্চলে এসেছেন।’
আব্বার কথা শুনে ডোনার মুখ থেকে ও বিস্ময় আনন্দ ঠিকরে পড়েছিল। আহমদ মুসার কথা পড়েছে পত্রিকায়। বার বার তাকে নিয়ে আলোচনাও হয়েছ। কেউ তাকে ‘নিউ সালাহ উদ্দিন বলতো, কেউ বলতো সে মুসলমানদের ‘মাওসেতুং’, কারও কাছে সে ছিল স্পেন বিজয়ী ‘তারিক বিন জিয়াদ’ ও ‘মুসা বিন নুসায়ের’-এর নতুন রূপ, কেউ আবার তাকে ডাকতো ‘মুসলিম রবিনহুড’ বলে। আসার পথে ডোনার একবারও কিন্তু এসব কথা খেয়াল হয়নি, একবারও মনে আসেনি এ আহমদ মুসা সে আহমদ মুসাই হতে পারে!
আনন্দে চিৎকার করে উঠেছিল ডোনা। বলেছিল, ‘ঠিক বলেছ আব্বা, ইনি তিনিই হবেন। এ আহমদ মুসা সে আহমদ মুসা হলেই শুধু সব দিক থেকে মানায়।’
তারপর বাপ-বেটি দুজনেই ছুটে গিয়েছিল তাদের ড্রইং রুমে।
ডোনা ছোট্র চঞ্চলা বালিকার মত ছুটে গিয়ে আহমদ মুসার সামনে গিয়ে বলেছিল, ‘বুঝেছি, আপনার নাম বলতে চাননি কেন? চিনেছি আপনাকে। আপনি সেই আহমদ মুসা।’
একজন প্রৌঢ় ভদ্রলোককে সাথে নিয়ে ডোনাকে এসে দাঁড়াতে দেখে আহমদ মুসা উঠে দাঁড়িয়েছিল। আহমদ মুসা কিছু বলার জন্যে মুখ খুলেছিল। কিন্তু আহমদ মুসা মুখ খোলার আগেই ডোনার আব্বা আহমদ মুসার দিকে হাত বাড়িয়ে বলেছিল, ওয়েলকাম গ্রেটম্যান, আমি ডোনার আব্বা চার্লস প্লাতিনি।
আহমদ মুসা হ্যান্ডশেক করার জন্যে হাত বাড়িয়ে বলেছিল, ‘খুশী হলাম আপনার সাথে দেখা হওয়ায়।
চার্লস প্লাতিনি আহমদ মুসার সাথে হ্যান্ডশেক করে তাকে বুকে জড়িয়ে ধরেছিল। বলেছিল, ডোনা আমার একমাত্র সন্তান, তাঁকে আপনি নতুন জীবন দিয়েছেন। আমার কৃতজ্ঞতা গ্রহন করুন।
‘জনাব, আমার বা আমাদের কারও কৃতিত্ব নেই আমরাও হাইজ্যাক হয়েছিলাম। নিজেরা বাঁচতে গিয়ে ওকে বাঁচানোর সুযোগ পেয়ে যাই আমরা। প্রশংসা আল্লাহর। তিনিই আমাদের সাহায্য করেছেন।’
‘ধন্যবাদ আপনাকে, গ্রেটম্যানের কথা এরকমই হয়ে থাকে।’
‘লজ্জা দেবেন না, আমি আপনার ছেলের মত। আমাকে ‘তুমি’ বললে খুশি হবো।’
পরদিন সকাল ১০টা পর্যন্ত আহমদ মুসা ডোনাদের বাড়িতে ছিল। অনেক কথা হয়েছিল ডোনার সাথে, ডোনার আব্বার সাথে।
ডোনার আব্বার সাথে পরিচয় হয়ে উপকৃত হয়েছে আহমদ মুসা। ডোনার আব্বা চার্লস প্লাতিনি প্রবীণ কুটনীতিক। কুটনৈতিক ও গোয়েন্দা সূত্রের অনেক খবর তিনি রাখেন। তিনি আহমদ মুসা কে জানিয়েছিলেন, ক্লু-ক্ল্যাক্স-ক্ল্যান স্পেনে মুসলিম স্থাপনা ও ঐতিহাসিক স্মৃতি চিহ্ন গুলোতে যে তেজস্ক্রিয় পেতেছে, তা ফরাসি গোয়েন্দা সংস্থা অতি সম্প্রতি জানতে পেরেছে এবং স্পেন সরকারকে জানানো হয়েছে। কিন্তু স্পেন সরকার এটাকে ভিত্তিহীন প্রপাগান্ডা বলে অভিহিত করেছে। তাদেরকে বিশ্বাস করাবার মতো কোন ডকুমেন্টও নেই। ক্লু-ক্ল্যাক্স-ক্ল্যানকে কেউ-ই ঘাটাতে চায় না বলে ফরাসি গোয়েন্দা বিভাগও এ নিয়ে আর মাথা ঘামাচ্ছে না। ডোনার আব্বা আরও একটা মূল্যবান তথ্য আহমদ মুসাকে জানিয়েছিল। সেটা হলো, প্রথমে মুসলিম স্থাপনাগুলোর বিস্তারিত নক্সা তৈরী হয়। সেই নক্সায় বৈজ্ঞানিক পরিমাপ অনুযায়ী তেজস্ক্রিয় সেট করার স্থান নির্দিষ্ট হয়। সেই নক্সা অনুসারে নিখুঁতভাবে তেজস্ক্রিয়গুলো পাতা হয়। এই নক্সা ক্লু-ক্ল্যাক্স-ক্ল্যান এর কারও কাছে আছে। সেই নক্সা না পাওয়া গেলে সেই তেজস্ক্রিয় ইউনিটগুলো খুঁজে বের করা অসম্ভব।
আহমদ মুসা বলেছিল, স্থাপনাগুলোর ইট, পাথর, সিমেন্ট, মাটি ইত্যাদি পরীক্ষা করলেই তো তেজস্ক্রিয় ধরা পড়বে, স্পেন সরকারের কাছে এটা কি ডকুমেন্ট হতে পারে না?
ডোনার আব্বা উত্তরে বলেছিল, ‘এক খন্ড কংক্রিট পরীক্ষা করলে ঐ টুকুর মধ্যে যে মাত্রার তেজস্ক্রিয় পাওয়া যায় তা এতই স্বল্প যে, এ থেকে প্রমাণ হয় না অস্বাভাবিক কোন তেজস্ক্রিয় সংক্রমণের ফল এটা এবং এ থেকে আরও প্রমাণ হয় না যে, অব্যাহত তেজস্ক্রিয় সংক্রমন চলছে।’
কথার উপসংহার টানতে গিয়ে ডোনার আব্বা আরও বলেছিলেন, এ নতুন ধরণের এক ভয়ানক যন্ত্র। ইউরোপের দু’একটা ল্যাবরেটরীই হয়তো পারে এর সঠিক প্রকৃতি প্রতিক্রিয়া নিরুপণ করতে। এখানেই হয়েছে মুস্কিল, কেউ ব্যাপারটা বুঝতে পারছে না।’
আহমদ মুসা এই মূল্যবান তথ্য পেয়ে খুশী হয়েছিল, সেই সাথে ভীষণ হতাশও হয়ে পড়েছিল। চার্লস প্লাতিনি স্বান্তনা দিয়ে বলেছিল, মাদ্রিদে ফরাসি দূতাবাসের দ্বার আহমদ মুসার জন্যে খোলা, যতটা পারে, যতদিক দিয়ে পারে সে তাদেরকে সাহায্য করবে।’
পরদিন সকাল ১০টায় আহমদ মুসা তাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়েছিল।
বিদায়ের সময় চার্লস প্লাতিনি এবং ডোনা দুজনেই আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছিল। ডোনার আব্বা আহমদ মুসার সাথে বিদায়ী হ্যান্ডশেক করতে গিয়ে বলেছিল, ‘যুগের সবদিক থেকে সর্বোৎকৃষ্ট মানুষের সাথে একটা রাতের একটা অংশ আর একটা সকাল কাটাবার সৌভাগ্য আমার হলো। এমন সময় আরও পেলে খুশী হবো। আর ডোনা বলেছিল, ‘আমি আপনাকে বিদায় দিচ্ছি না, বোন ভাইকে বিদায় দেয় না।’ বলেই মাথা নিচু করেছিল ডোনা। দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরেছিল। একটা ভেঙ্গে পড়া উচ্ছ্বাসে তবু কাঁপছিল তার ঠোঁট।
ডোনার একথাগুলো এবং ডোনার আব্বার অনেক কথা বাজছিল আহমদ মুসার কানে, তার চোখে ভাসছিল ডোনাদের শেষ বিদায়কালীন ছবি। আহমদ মুসা ভাবল, মানুষের মনের মায়া-মমতা আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের সুন্দরতম নেয়ামত। এই নেয়ামতই মানুষের সমাজকে মানুষের সমাজ রেখেছে।
ড্রাইভিং সিটে ছিল আব্দুর রহমান সপ্তম।
ছুটে চলছিল গাড়ি ডোনাদের মন্ট্রেজুকে পেছনে ফেলে ফ্রান্সের সীমান্ত শহর ম্যানোনার দিকে গেরোনে হাইওয়ে ধরে।
ম্যানোনা যতই কাছে এগিয়ে আসছে, পথ ততই দুর্গম হয়ে উঠছে। গাড়ির গতি কমে আসছে ততই। বেলা একটার দিকে ম্যানোনা অতিক্রম করলো আহমদ মুসার গাড়ি। ম্যানোনা শহর পার হয়ে একটা উপত্যকায় গাড়ি থামিয়ে আহমদ মুসারা নামায পড়ে নিল।
ম্যানোনা থেকে ১০মাইল দূরে ফ্রান্স স্পেন সীমান্ত। সীমান্ত রেখাটি পিরেনিজের উত্তর ঢাল বরাবর। ফরাসী সীমান্ত পুলিশের ফাঁড়িতে নাম লিখিয়ে পাসপোর্ট দেখিয়ে স্পেনে প্রবেশ করতে হয়। স্পেন পুলিশের সীমান্ত ফাঁড়িতেও এ ধরণের একটা ব্যবস্থা। এসব আনুষ্ঠানিকতা শেষ করতে কোনই অসুবিধা হয়নি আহমদ মুসাদের। যাবার সময়ই আহমদ মুসার পাকা কাগজ-পত্র তৈরী হয়েছিল। স্পেনের নাগরিক হিসেবে পাসপোর্ট করা হয়েছিল আহমদ মুসার।
সীমান্ত ফাঁড়ির ঝামেলা চুকানোর পর আবার যাত্রা শুরু হলো আহমদ মুসাদের। এবার পথ আরও দুর্গম। পিরেনিজের একদম বুকের উপর দিয়ে চলছে এখন তারা। ভেল্লা পর্যন্ত পথ এ রকমই। ভেল্লা এখনও পনের মেইল দূরে।
ভেল্লা ছোট্ট একটি পার্বত্য শহর। উত্তরে স্পেনের সর্বশেষ শহর এটি। বাসক এলাকার মধ্যে পড়েছে এ অঞ্চলটি।
বেলা ৪টার দিকে। আহমদ মুসারা ভেল্লা শহরে প্রবেশ করল। আহমদ মুসারা ঠিক করেছে শহরে নাস্তা সেরে নামায পড়ে তারা আবার যাত্রা শুরু করবে মাদ্রিদের পথে। ভেল্লা থেকে মেইল দশেক পশ্চিমে পাহাড় ঘেরা একটা উপত্যকায় আব্দুর রহমান সপ্তমের বাড়ি। যাওয়ার পথে আহমদ মুসা আব্দুর রহমান সপ্তমের বাড়িতে গিয়েছিল। এক রাত সেখানে থেকেছিল। এবার আর সে রকম কোন প্রোগ্রাম নেই। আহমদ মুসা যতটা সম্ভব দ্রুত মাদ্রিদ পৌঁছুতে চায়।
নাস্তা ও নামায সেরে আবার যাত্রা শুরু করেছিল আহমদ মুসারা। আগের মতই ড্রাইভিং সিটে আবদুর রহমান সপ্তম।
একটা হাসপাতলের পাশ দিয়ে এগুচ্ছিল গাড়ি। হঠাৎ আবদুর রহমান সপ্তম ব্রেক কষে গাড়ি দাঁড় করিয়ে দরজা খুলে হাঁক দিলঃ আবুল হাসান।
কয়েক মুহূর্ত পরেই এক যুবক এসে দাঁড়াল আবদুর রহমান সপ্তমের সামনে।
‘আম্মা অসুস্থ, আমি ওষুধ নিতে এসেছি।’ এসে দাড়িয়েই যুবকটি বলল।
আহমদ মুসা যুবকটিকে চিনতে পারল। আবদুর রহমান সপ্তমের ছোট ভাই সে।
কি অসুখ? উদ্বিগ্ন কন্ঠে বলল আবদুর রহমান সপ্তম।
‘বুঝা যাচ্ছে না। ডাক্তার দেখেছেন। ওষুধ নিতে এসেছিলাম।’
আবদুর রহমান সপ্তম তাকাল আহমদ মুসার দিকে।
আহমদ মুসা বুঝতে পারল আবদুর রহমান সপ্তমের মনের কথা। বলল আবদুর রহমান গাড়ি ঘুরাও। ওঁকে না দেখে যাওয়া যায় না।
‘ধন্যবাদ মুসা ভাই। বলে আবদুর রহমান আবুল হাসানের দিকে তাকিয়ে বলল,’ গাড়ি এনেছ?’
‘হ্যাঁ’। বলল আবুল হাসান।
‘যাও, গাড়ি নাও, চল যাই।’
আবুল হাসান এগিয়ে গেল কার পার্কিং এর দিকে।
এবার গাড়ি চলতে শুরু করল। আবদুর রহমান সপ্তমের বাড়ির দিকে। আগে আহমদ মুসাদের গাড়ি। পেছনে আবুল হাসানের গাড়ি।
‘আবদুর রহমান সপ্তমের বাড়ি কোথায় কতদূর?’ বলল জোয়ান।
‘নিউ ভ্যালেনসিয়া, মাইল দশেক পশ্চিমে।’
নিউ ভ্যালেনসিয়া একটা সমৃব্ধ উপত্যকা। চারদিকে পাহাড়ের দেয়াল।
উপত্যকায় প্রবেশের একটাই পথ, উত্তর দিকের একটি মাত্র গিরি পথ। বেশ প্রসস্ত। এটাই উপত্যকায় প্রবেশের দরওয়াজা।
উপত্যকায় উর্বর মাটিতে প্রচুর ফল ও ফসল উৎপাদিত হয়। বাসিন্দারা নিজেদের প্রয়োজন মিটিয়ে প্রচুর পরিমানে বাইরে বিক্রি করতে পারে।
উপত্যকায় প্রায় ৫’শ বাসক ও মুসলিম পরিবার বাস করে। জনসংখ্যা প্রায় তিন হাজারের মত। এর প্রায় সবাই মুসলমান। এদের অনেকে দক্ষিণ ও স্পেন থেকে পালিয়ে আসা তবে বেশির ভাগই ধর্মান্তরিত। বাসক সম্প্রদায়ের প্রচুর পরিবার খৃষ্ট ধর্ম পরিত্যাগ করে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছে। জনশ্রুতি আছে ষোড়শ শতকের শুরুতেই এক দরবেশ নানা স্থান ঘুরে তার স্ত্রৗ সহ এসে এই উপত্যকায় আস্তানা গেড়েছিলেন। স্থায়ী জনপদ তখন এ উপত্যকায় গড়ে উঠেনি। সে পবিত্র দরবেশকে ঘিরে ধীরে ধীরে গড়ে উঠল স্থায়ী জনপদ। সে দরবেশ জ্ঞানে ছিলেন সবজান্তা সুপন্ডিত, চরিত্রে ছিলেন ফেরেশতা তুল্য। মানুষ তাকে ভক্তি, শ্রদ্ধা দিয়ে মাথায় রাখতো, কিন্তু তিনি নিজেকে মনে করতেন মানুষের এক নগন্য সেবক। যেখানে মানুষের বিপদ সেখানেই তিনি। প্রতিটি দুঃখী ও অসুস্থ মানুষ নিশ্চিন্ত থাকতো, তাদের পাশে সাহায্যের হাত নিয়ে, চিকিৎসকের সেবা নিয়ে পবিত্র দরবেশ আবদুর রহমান আসবেনই। তার চরিত্রে ইসলামের রুপ-মাধুর্য দেখে শুধু এই উপত্যকার নয়, আশে পাশের শত শত পরিবার ইসলাম গ্রহণ করে। আবদুর রহমান সপ্তমরা সেই দরবেশ আবদুর রহমানেরই বংশধর। উপত্যকার একটি সুন্দর সবুজ টিলায় তাদের বাড়ি। উপত্যকায় প্রবেশ করলেই দেখা যায় সুন্দর টিলাটি, তার আগে দেখা যায় টিলায় অবস্থিত মসজিদের সুউচ্চ মিনার।
আহমদ মুসাদের গাড়ি উপত্যকায় প্রবেশ করল, আযান ধ্বনিত হচ্ছিল সে মিনার থেকে। আযানের ধ্বনি সেই কেঁপে কেঁপে ছড়িয়ে পড়ছিল সমগ্র উপত্যকায়, প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল পাহাড়ের বুকে।
সবে সূর্য ডুবেছে। কিন্তু পাহাড় ঘেরা উপত্যকায় তখন অন্ধকার। উপত্যকার সবুজ আর সন্ধ্যার কালো একসাথে মিশে একাকার হয়ে গেছে।
অন্ধকার জড়িত নিঃশব্দ এই পরিবেশে মধুর আযানের ধ্বনি প্রতিধ্বনি অপরুপ লাগছিল আহমদ মুসার কাছে। সমগ্র সত্তা দিয়ে উপভোগ করছিল আহমদ মুসা সেই আযান।
‘এই আযান বাসক এলাকা ছাড়া স্পেনের আর কোথাও পাবেন না মুসা ভাই।’ বলল আবদুর রহমান সপ্তম।
‘এমন পরিবেশ হৃদয় আকুল করা এমন আযান জীবনে আর একবার শুনেছিলাম মধ্য এশিয়ায় উজবেকিস্তানের একটা গ্রামে। এ মসজিদটি কোথায়, কতদূরে আবদুর রহমান?’
‘আমাদের বাড়ির সামনে মুসা ভাই। চলুন নামায আমরা ধরতে পারবো।’
আবদুর রহমান সপ্তমদের সুন্দর বিশাল বাড়িটির সামনে ছোট একটা চত্তর, তারপরেই মসজিদ। বিশাল মসজিদ। প্রথমে মসজিদটি ছিল বেড়ার। দরবেশ আবদুর রহমানের সময়েই জনগণ পাহাড় থেকে পাথর বয়ে এনে মসজিদ তৈরী করেছে। পরে আরও সম্প্রসারণ হয়েছে মসজিদটির।
মসজিদটি দেখে চমৎকৃত হলো আহমদ মুসা।
আহমদ মুসা ইতিহাসে পড়েছিল, মুসলিম সেনাপতি মুসা বিন নুসায়ের পিরেনিজ পর্বতে উঠেছিলেন, কিন্তু ফিরে যেতে হয়েছিল তাঁকে। সেই সাথে ইসলামও এখানে থেকে পশ্চাতপসরণ করেছিল, ইতিহাস এটাই বলে। কিন্তু ইতিহাস জানে না, পিরেনিজ এর বুকে এ রকম সুন্দর মসজিদ আছে, এ রকম সুন্দর সমৃদ্ধ মুসলিম জনপদ লুকিয়ে আছে। ইতিহাস শুধু রাজা-বাদশাহদের কথাই লিখে, লিখে না দরবেশ আবদুর রহমানদের কথা। লিখে না বলেই জানে না ইতিহাসের পরেও ইতিহাস আছে।
মাগরিবের জামায়াতের নেতৃত্ব দিতে হয়েছিল আহমদ মুসাকেই।
নামায শেষে আবদুর রহমান সপ্তম শুধু নামটা গোপন রেখে সকলের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল আহমদ মুসাকে। সকলের অনুরোধে ছোট-খাট বক্তৃতাও দিতে হয়েছিল আহমদ মুসাকে বিশ্বে মুসলমানদের বর্তমান অবস্থার উপর। উপসংহারে আহমদ মুসা একজন মহান ব্যক্তির কথা উদ্বৃত করে বলেছিল, ‘ইসলাম জিন্দা হয় প্রত্যেক কারবালার পর। কয়েক শতাব্দীর এক ভয়াবহ কারবালা মুসলমানদের উপর দিয়ে বয়ে গেছে। এবার তাদের উত্থানের পালা। এই জাগরণের গান শোনা যাচ্ছে চারদিকে। সামনের অন্ধকারের ওপারে সোবহে সাদেকের সফেদ আলোকছটা দেখা যাচ্ছে। মুক্তি আমাদের সুনিশ্চিত।’
নামায শেষে সকলের সাথে সালাম-মোহসাফা শেষ করে আহমদ মুসা আবুল হাসানের সাথে এল আবদুর রহমান সপ্তমের বাড়িতে। আবদুর রহমান সপ্তম আগেই চলে এসেছিল তার মায়ের কাছে।
বাড়িতে ঢোকার পথে দরজার উপরে কাঠের ফলকে স্প্যানিশ ভাষায় লেখা ‘দারুল হিকমাহ’। তার নিচে আরবৗ অক্ষরে একই কথা লেখা আছে। আহমদ মুসা, জোয়ান সবাই এ লেখাটা পড়ল। বুঝল এটা বাড়ির নাম।
প্রবেশ করল বৈঠক খানায়।
বিরাট বৈঠকখানা।
ঘরের চারদিকে সাজানো সোফা। একসাথে ত্রিশ-পঁয়ত্রিশজন লোক বসতে পারে।
আবদুর রহমান সপ্তমের বাড়ি শুধু এই উপত্যকায় নয় গোটা এই অঞ্চলের মিলন ক্ষেত্র। যত শালিস-দরবার সব এখানেই হয়। উত্তরাধীকার সূত্রে আবদুর রহমান সপ্তম এই এলাকার সর্দার। তবে আবদুর রহমান বাসক গেরিলা বাহিনীর দায়িত্বশীল পদে উন্নীত হবার পর তার ভাই আবুল হাসান তার পক্ষ থেকে সরদারীর দায়িত্ব পালন করে।
আহমদ মুসা ঘরে প্রবেশ করেই দেখল টেবিলে শরবত রাখা হচ্ছে। আঙুরের শরবত।
আবুল হাসান আহমদ মুসাদের শরবত পান করিয়ে ভেতরে চলে গেল।
আহমদ মুসা ও জোয়ান যেখানে বসেছিল সেখান থেকে সোজা ওপাশের দেয়ালে হাতে আঁকা পাশা-পাশি দু’টি ছবি। একটি বৃদ্ধ ভদ্রলোকের আর অন্যটি একটি বালকের।
ছবি দু’টি চোখে পড়ল জোয়ানের। ভাবল সে, নিশ্চয় বৃদ্ধের ছবিটি দরবেশ আবদুর রহমানের, আর বালকটি নিশ্চয় আবদুর রহমান সপ্তম হবে।
কৌতুহল হলো জোয়ানের। লোকটির চেহারার সাথে আবদুর রহমানের চেহারা মিলছেনা। আরও ভাল করে দেখার জন্যে জোয়ান উঠে গিয়ে ছবি দু’টির সামনে গিয়ে দাঁড়াল।
কাছে গিয়ে দাঁড়ানোর পর ছবির নিচের লেখাগুলো জোয়ানের কাছে স্পষ্ট হলো।
প্রথমে চোখ পড়ল বৃদ্ধের ছবির নিচে লেখাগুলোর দিকে।
পড়ল জোয়ান -“নাম আব্দুর রাহমান। জন্ম পূর্ব স্পেনের ভালেন্সিয়ার ১৪৫৫সালে। ভালেন্সিয়ার দারুন হিকমার তিনি অধ্যক্ষ ছিলেন। বিজ্ঞানের উপর অনেক গ্রন্থের তিনি প্রণেতা। সব মুসলিমদের সাথে তাকেও উচ্ছেদ করা হয় ভালেন্সিয়া থেকে ১৫০৩ সালে। তিনি ইন্তেকাল করেন ১৫৩০ সালে। তিনি হক্কুল্লাহ ও হক্কুল এবাদ প্রতিষ্ঠায় জীবন উৎসর্গ করেন। আল্লাহ তার বেহেস্ত নসিব করুন”।
পড়তে পড়তে হৃদয়টা কেঁপে উঠল জোয়ানের। মনে পড়ল তার পূর্ব পুরুষ আবদুল্লাহ বিন আব্দুর রাহমান খাতার কথা, খাতায় লেখা স্মৃতি কথার বিষয় গুলো। তার পূর্ব পুরুষ আবদুল্লাহর পিতার নামও তো ছিল আব্দুর রাহমান। তিনি দারুল হিকমার অধ্যক্ষ ছিলেন। ভালেন্সিয়া থেকে তিনিও উচ্ছেদ হয়েছিলেন। ঐ সময়েই।
কম্পিত হৃদয় নিয়ে জোয়ান গিয়ে দাঁড়াল বালকটির ছবির নিচে। বালকটির ছবির নিচে একটা কবিতা। চার লাইনের কবিতার সার কথা হলঃ “বালকটি দশ বছরের আবুদুল্লাহ বিন আব্দুর রাহমান। সেদিন ভালেন্সিয়ায় রাজা ফিলিপ্সের নিষ্ঠুর সৈন্যরা ক্রন্দনরত বালকটিকে কেড়ে নিয়েছিল ক্রন্দনরত মায়ের বুক থেকে, পিতার কাছ থেকে, একমাত্র আল্লাহ ছাড়া বালকটির নেগাহবান আর কেও ছিল না।“
পড়া শেষ করার আগেই জোয়ানের গোটা সত্তা জুড়ে নেমে এল দুর্বোধ্য এক অবসন্নতা। এই উপত্যকার নাম “নিউ ভালেন্সিয়া, এই বাড়ির নাম ‘দারুল হিকমা’ কেন তা তার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেল। মনে হল এ নামগুলো, এই ছবিগুলো তারই জন্য অপেক্ষা করছিল। আব্দুর রাহমান সপ্তম-এর অর্থ তার কাছে সুস্পষ্ট হয়ে গেল। সেই মহান আব্দুর রাহমানের সপ্তমের অধস্তন পুরুষ এই আব্দুর রাহমান।
মনে হল। এই “সপ্তম” শব্দটাও যেন তারই জন্য এক সংকেত। তার পূর্ব পুরুষ হতভাগ্য আবদুল্লাহ বছরের পর বছর দেশ-দেশান্তর ঘুরে যার দেখা পাননি, আমি আজ তার ঠিকানায়। আর চিন্তা করতে পারল না জোয়ান। সেই আচ্ছন্নতা গাড় অন্ধকার হয়ে ঘিরে ধরল তাকে। জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়ল সে মেঝের উপর।
ছুটে গেল আহমদ মুসা।
কোলে তুলে নিল জোয়ানকে।
অজ্ঞান জোয়ানকে যখন সোফায় শুইয়ে দিচ্ছে আহমদ মুসা, আব্দুর রাহমান সপ্তম এবং আবুল হাসান তখন ঘরে ঢুকল। জোয়ানকে ঐভাবে দেখে তাদের চোখ বিস্ফারিত হয়ে উঠল।
দ্রুত এগিয়ে এল তারা আহমদ মুসার কাছে।
“কি ব্যাপার, জোয়ানের কি হয়েছে মুসা ভাই?” জিজ্ঞাসা করল আব্দুর রাহমান সপ্তম।
জোয়ানকে সোফায় শুইয়ে দিয়ে সোজা হয়ে দাড়িয়ে আহমদ মুসা বলল, দেয়ালের ঐ ছবি দুটো দেখতে গেয়েছিল জোয়ান। ছবি দেখতে দেখতেই জ্ঞান হারিয়ে পড়ে গেছে জোয়ান। বলে আহমদ মুসা জোয়ানের একটি হাত তুলে নিল।
“ডাক্তার ডাকব মুসা ভাই”?
“না, দরকার নেই। এখনি ওর জ্ঞান ফিরে আসবে।“
বলে আহমদ মুসা জোয়ানের জুতা খুলে ওর পায়ের তালুর বিশেষ কিছু জায়গায় বিশেষ নিয়মে খোঁচা দিতে লাগল।
“আব্দুর রাহমান, ঐ ছবি দুটো কার”? জিজ্ঞাসা করল আহমদ মুসা।
ছবি দুটির পরিচয় দিল আব্দুর রাহমান। তারপর বলল, “ছবি দুটো দেখেই কি জোয়ান….।
“তা বলতে পারব না আব্দুর রাহমান। তবে ছবি দেখার সময় তাকে স্বাভাবিক মনে হয় নি।
মিনিট তিনেক পার হল।
আহমদ মুসা জোয়ান এর পায়ে সেই খোঁচা দিয়েই চলেছিল।
নড়ে উঠল জোয়ান। ধীরে ধীরে চোখ মেলল সে। চোখ মেলেই তড়িঘড়ি উঠে বসল।
সামনেই দাড়িয়ে আব্দুর রাহমান সপ্তম। জোয়ান উঠে দাড়িয়ে “আমার ভাই” বলে জড়িয়ে ধরল আব্দুর রাহমানকে। বলল, “পিরেনিজের বুকে এইভাবে আমাদের দেখা হবে কে জানত”। আবেগে ভারি হয়ে উঠল জোয়ানের কণ্ঠ।
আব্দুর রাহমান সপ্তম কিছু বুঝতে না পেরে বিব্রত বোধ করছিল। আব্দুর রাহমানের ন’বছরের মেয়ে বৈঠক খানায় ঢুকেছিল সেও হ্যাঁ করে দেখছে ব্যাপারটা।
জোয়ান আব্দুর রাহমান সপ্তমকে ছেড়ে দিয়ে জড়িয়ে ধরল আহমদ মুসাকে। বলল, “মুসা ভাই আমার পূর্ব পুরুষ যা খুঁজে পায়নি, আমি তা পেয়েছি, এ বড় আনন্দের। কিন্তু এ আনন্দে হাসা যায় না, কান্না পায়।“
জোয়ান ভারি কণ্ঠে যখন এ কথা গুলো বলছিল, অশ্রু ঝরছিল তখন জোয়ানের চোখ দিয়ে।
আব্দুর রাহমান এগিয়ে এসে জোয়ানের পিঠ হাতে রেখে বলল, আমি কিছুই বুঝতে পারছিনা ভাই, খুলে বলুন।
জোয়ান ঘুরে দাঁড়াল। অশ্রুতে ভেজা জোয়ানের চোখ।
কোন কথা না বলে জোয়ান আব্দুর রাহমান সপ্তমের হাত ধরে টেনে নিয়ে গেল বৃদ্ধের ছবির কাছে। বলল, “ভালেন্সিয়ার দারুল হিকমার অধ্যক্ষ এই আব্দুর রাহমান কে আপনার?”
“আমার পূর্ব পুরুষ, নিউ ভালেন্সিয়ার এই উপত্যকায় তিনি এসে বসতি স্থাপন করেন,”। বলল আব্দুর রাহমান।
জোয়ান গিয়ে দাঁড়াল বালকের ছবির নিচে। বলল, আর এ হতভাগ্য বালক হল আমার পূর্ব পুরুষ যাকে ফিলিপের সৈন্যরা ছিনিয়ে এনেছিল পিতা-মাতার বুক থেকে, যাকে মর্মস্থুদ এক দাস জীবনযাপন করতে হয়েছে খ্রিষ্টান পরিবারে।
“জোয়ান” বলে চিৎকার করে আব্দুর রাহমান সপ্তম জড়িয়ে ধরল জোয়ানকে। এবার আব্দুর রাহমান সপ্তমের চোখ ফেটে বেরিয়ে এসেছে অশ্রু।
পাশে মূর্তির মত দাড়িয়ে আছে আবুল হাসান।
আব্দুর রাহমান জোয়ানকে ছেড়ে দিয়ে ছুটে চলে গেল ভিতরে। আবুল হাসানও। সেই ন’বছরের মেয়েটিও।
জোয়ান ফিরে এল সোফায়।
বসল আহমদ মুসার পাশে।
আহমদ মুসাও এই মিলন দৃশ্যে অনেকটা নির্বাক হয়ে গিয়েছিল।
প্রথমবারের মত মুখ খুলে বলল, এই মিলন আমার কাছে রূপ কথার চেয়েও অপরূপ লাগছে জোয়ান। স্পেনে মুসলমানদের বিপর্যয় বিচ্ছিন্ন একটি বংশের দুটি ধারার শত শত বছর পর এই মিলন অকল্পনীয়। আল্লাহর হাজার শুকরিয়া।“
কিছুক্ষণ পরে বৈঠকে খানায় ফিরে এল আব্দুর রাহমান সপ্তম। বলল, না বলেই চলে গিয়েছিলাম, মাফ করবেন মুসা ভাই। নিজেকে হারিয়ে ফেলেছিলাম হারানো মানিকের সন্ধান পেয়ে। আমরা কল্পনাও করতে পারি না মুসা ভাই, আমার পূর্ব পুরুষ দরবেশ আব্দুর রাহমান খ্রিস্টান এর ছদ্মবেশ নিয়ে ভালেন্সিয়ায় কত দিন কত রাত যে খুঁজে বেড়িয়েছে তার হৃদয়ের ধন ঐ বালককে! সন্ধান তিনি পাননি, সেই পাওয়া আজ আমরা পেলাম।
আব্দুর রাহমান সপ্তম চোখ মুছল। বলল, চলুন মুসা ভাই, চল জোয়ান, খাবার রেডি। আম্মা এবং পরিবারের সবাই অস্থির হয়ে উঠেছে জোয়ানের কথা শোনার জন্য, কিন্তু তার আগে খাওয়া।
খাবার ব্যবস্থা হয়েছিল পারিবারিক ডাইনিং রুমে। খাওয়া শেষে আহমদ মুসা ও জোয়ানকে এনে বসানো হল পারিবারিক ড্রইং রুমে। ড্রয়িং রুমের পাশেই একটা ঘরে বসেছে আব্দুর রাহমান সপ্তমের পরিবারের মেয়েরা।
ড্রয়িং রুমে আহমদ মুসা ছাড়াও রয়েছে আব্দুর রাহমান সপ্তমের ন’বছরের মেয়ে ৫ বছরের একটি ছেলে, আবুল হাসান এবং তারও পাঁচ বছরের একটি ছেলে, আব্দুর রাহমান সপ্তম ভিতরে ছিল।
অল্পক্ষণ পর সে ড্রয়িং রুমে এসে প্রবেশ করল। বলল, আমার আম্মা, আমার স্ত্রী ও আবুল হাসানের স্ত্রী এবং আমাদের দুই বোন আহমদ মুসা ভাই ও জোয়ানকে সালাম দিয়েছেন।
সালাম বিনিময় পর আব্দুর রাহমান সপ্তম বলল, আল্লাহর হাজার শুকরিয়া যে শত শত বছরের বিচ্ছিন্নতার পর আমাদের বংশের দুটি ধারার আল্লাহ মিলন ঘটিয়েছেন। আমাদের পরিচয় হয়েছে, জানাজানি হয়নি। আমাদের সবার মন আকুল বিকুল করেছে এই জানার জন্য, আমি ভাই জোয়ানকে অনুরোধ করছি, কিছু কথা বলার জন্য। পরিবারের সবাই এ কথাগুলো শুনতে চায় এ জন্য এই ব্যবস্থা।
জোয়ান শুরু করল-আমার নাম জোয়ান ফারদিনান্দ। এই নামেই আমি বড় হয়েছি, এই নামই আমার পরিবারে, এই নামেই আমার লেখাপড়া, পরিচয়, সবকিছু। আমার পিতার নাম জন সেমেনিজ। বাড়ির কেও কোনদিন গীর্জায় যায়নি, আমাদের বাড়িতে বাইবেল নেই, কিন্তু আমরা খ্রিষ্টান ছিলাম। নিজেকে আমি খ্রিস্টান মনে করতাম। আমি মাদ্রিদ বিশ্ববিদ্যালয় এর ভাল ছাত্রদের একজন ছিলাম। সব পরীক্ষায় সব সময় প্রথম স্থানে থেকেছি। আমার জীবনের মোড় পরিবর্তন ঘটল আমার অনার্স পরীক্ষার রেজাল্টের দিন। প্রথমবারের মত প্রথম স্থান থেকে দ্বিতীয় স্থানে নেমে গেলাম। সেই দিনই বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র ও শিক্ষকদের কাছে শুনলাম আমি মরিসকো, আমি ছদ্মবেশী মুসলমান। আমার এ পরিচয়ের কথা শুনে আমি আকাশ থেকে পড়েছিলাম, পরিচয়টা আমার কাছে আমার জন্যে মৃত্যুর পরোয়ানার মত ছিল। আমি ভীষণভাবে মুষড়ে পড়েছিলাম। পাগলের মত ছুটে এসেছিলাম বাড়িতে। আব্বা মারা গেছেন অনেক আগে। চাইছিলাম, আম্মা বলুন আমি মরিসকো নই, আমি ছদ্মবেশী মুসলমান নই, আমি খৃস্টান। না হলে যে আমার ২২ বছরের সাজানো জীবন মিথ্যা হয়ে যাবে। কিন্তু আম্মার কাছে, দাদির কাছে যা শুনলাম তা আমার উদ্বেগ-আতংককে আরও বাড়িয়ে দিল। তাঁরা বললেন, তাঁরা দু’জন মরিসকো, কিন্তু আমার আব্বা, আমার দাদা মরিসকো ছিলেন কিনা তা তারা জানেন না। আমার তখন মনে হলো আমার আব্বা, আমার দাদা নিশ্চয় মরিসকো ছিলেন। না হলে তারা মরিসকোকে বিয়ে করেছেন কেন। আমার ঘরে ফিরে আমি ভীষণভাবে কাঁদলাম। দুপুরে কিছু খেলাম না। গোটা দুনিয়া আমার কাছে বিষাদ হয়ে গেল। মনে হলো, আমার মরা আর বাঁচার মধ্যে আজ আর কোন পার্থক্য নেই। বিকেলে মা এলেন আমার ঘরে। তিনিও কাঁদছিলেন। তিনি আমার হাতে একটা কাঠের বাক্স তুলে দিয়ে বললেন, বেটা, এই বাক্স তোমার আব্বা তাঁর মৃত্যুকালে আমার কাছে আমানত রেখে গিয়েছিলেন। কথা ছিল, যেদিন তোমার বয়স বাইশ বছর পূর্ণ হবে, সেদিন যেন এই বাক্স তোমার হাতে তুলে দেই। বাক্সে কি আছে আমি জানি না।
বাক্স আমার হাতে তুলে দিয়ে আম্মা চলে গিয়েছিলেন। আমি পাগলের মত বাক্স খুলে ফেলেছিলাম। পেয়েছিলাম আমার কাছে লেখা আব্বার একটা চিঠি এবং একটি খাতা। চিঠির খামে লেখা ছিল ‘মুসা আবদুল্লাহ ওরফে জোয়ান ফার্ডিনান্ড’। এই প্রথম জানলাম আমি জোয়ান ফার্ডিনান্ড নই, আমি মুসা আবদুল্লাহ। আব্বার চিঠি পড়লাম। মূল কথাটা যা তিনি লিখেছেন, তা হলো- এই চিঠির সাথে চামড়া বাঁধানো যে খাতা পাবে, তা আমি পেয়েছিলাম এমনি বাক্সে করে আমার আব্বার কাছ থেকে। আমার আব্বা পেয়েছিলেন তার আব্বার কাছ থেকে। ছয় পুরুষ ধরে এই বাক্স এমনিভাবে আসছে। সপ্তম পুরুষ হিসেবে তোমার জন্যে বংশের এই পবিত্র আমানত আমি রেখে গেলাম।’
বংশের পবিত্র আমানত খাতা খানি আমি পড়লাম। ওটা ছিল আপনাদের বৈঠক খানায় যার ছবি টাঙানো আছে সেই বালক আবদুল্লাহ বিন আবদুর রহমানের আত্মকথা।’
জোয়ান সেই আত্মকথা ধীরে ধীরে বর্ণনা করলো। কেমন করে তাকে পিতা-মাতার কোল থেকে ছিনিয়ে আনা হয়েছিল, কি করে খৃস্টান শহর কোতোয়ালের বাড়িতে তার দাসজীবন শুরু হয়েছিল, কি মর্মন্তুদ নির্যাতন সেই বালকের উপর নেমে এসেছিল, কি শ্বাসরুদ্ধকর পরিবেশের মধ্যে সে বড় হয়ে উঠল, কি করে অবশেষে মুক্তি পেল, কি করে খৃস্টানের ছদ্মবেশে তার জীবন শুরু হলো, কেন তাকে শেষে পালিয়ে আসতে হলো মাদ্রিদে, কিভাবে শুরু হলো মাদ্রিদে তার ছদ্মবেশী খৃস্টান জীবন- সব কথাই জোয়ান একে একে বর্ণনা করল। বলতে বলতে বারবার কান্নায় জড়িয়ে গিয়েছিল জোয়ানের কথা। আবদুর রহমান সপ্তম, আবুল হাসান দু’জনেই কেঁদে ফেলেছিল শুনতে শুনতে। আহমদ মুসারও চোখ শুকনা ছিল না। সে আগে শুনেছিল, কিন্তু এতটা শুনেনি।
জোয়ান থামার পর অনেকক্ষণ কেউ কথা বলল না।
আবদুর রহমান সপ্তমের ৫ বছরের ছেলেটি ভেতর থেকে এসে তার আব্বার কানে কানে বলল, দাদি কাঁদছে।
আবদুর রহমান সপ্তম তার মুখ চাপা দিয়ে বলল, বেটা, তুমি যাও দাদির কাছে। তাঁর কোলে গিয়ে বস।
চলে গেল ছেলেটি।
আবদুর রহমান সপ্তম ধীরে ধীরে বলল, আল্লাহর হাজার শোকর, পূর্ব পুরুষরা এ কথাগুলো রেখে না গেলে অতীত শুধু আমাদের হারিয়ে যেত না, হারাতাম আমরা ভবিষ্যতও।
‘ঠিক বলেছেন ভাই জান, পূর্ব পুরুষ আবদুল্লাহ বিন আবদুর রহমানের স্মৃতি কথা পড়ার পর আমি আমার অতীতকে নিয়ে গর্ব করতে শিখেছি, নিজের পরিচয়কে ভালবাসতে শিখেছি এবং জাতির প্রতিও ভালবাসা সৃষ্টি হয়েছে।’ বলল জোয়ান।
‘আমাদের পূর্ব পুরুষ দরবেশ আবদুর রহমান কোন স্মৃতি কথা রেখে যাননি। রেখে গেছেন একটা ডাইরী। সেটা ঘটনার একটা দিনপঞ্জী। জাহাজ যোগে যাত্রা শুরুর পর কিভাবে ভূমধ্যসাগরের মেজর্কাদ্বীপে পৌঁছলেন, কি করে জাহাজ লুন্ঠিত হলো, কিভাবে তারা ফ্রান্সের ভেনড্রেস বন্দরে পৌঁছলেন, কিভাবে সেখান থেকে তাদের তাড়িয়ে দেয়া হলো পিরেনিজের পার্বত্য অঞ্চলের দিকে, কিভাবে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস পাহাড়ে পাহাড়ে ঘুরে, গাছের ফল-মূল খেয়ে বেঁচে থেকে অবশেষে একদিন এই উপত্যকায় পৌঁছলেন। প্রতিদিনের ঘটনাই সে ডাইরীতে লিখিত আছে। সে এক হৃদয় বিদারক উপন্যাস। ডাইরীটার আমরা কপি করিয়ে বাঁধিয়ে রেখেছি। একটা কপি ভাই জোয়ান তোমাকে দেব।’
থামল আবদুর রহমান সপ্তম।
জোয়ান বলল, ‘খুব খুশি হবো। আমার পূর্ব পুরুষ আবদুর রহমানের সন্তান আবদুল্লাহর স্মৃতি কথায় পড়েছি, তিনি তাঁর পিতার সন্ধানে মেজর্কা গেছেন, পিরেনিজের উত্তর পাদদেশেও ঘুরে বেরিয়েছেন দিনের পর দিন। সন্ধান পাননি তার পিতার। আমি খুশী হবো জানতে পারলে সেই কাহিনী, যা আমার পূর্ব পুরুষ জানতে পারেননি।’
‘জোয়ান ভাই, দরবেশ আবদুর রহমানও তার সন্তানকে খুঁজতে গেছেন ভ্যালেনসিয়া পর্যন্ত। একবার নয়, কয়েকবার। কিন্তু পাননি সন্ধান। সে সব কথাও তাঁর ডাইরীতে আছে।’ বলল আবদুর রহমান সপ্তম।
গভীর রাত পর্যন্ত চলল তাদের কথাবার্তা। ছোট ছেলেমেয়েরা সবাই সোফায় ঘুমিয়ে পড়েছিল, সেদিকে কারও খেয়াল ছিল না।
অবশেষে আবদুর রহমান সপ্তমের অসুস্থ মা ওপার থেকে বলেছিল, বেটা আবদুর রহমান, দীর্ঘ পথ তোমরা সফর করে এসেছ। সবাই তোমরা ক্লান্ত। মেহমানদের আর কষ্ট দিও না। ওঁদের শুইয়ে দাও। কালকে কথা বলা যাবে।
রাতে শোবার সময় আহমদ মুসা আবদুর রহমানকে বলল, আবদুর রহমান সপ্তম এবং আবদুল্লাহ সপ্তম, দুই সপ্তমে কাটাকাটি করলে দুই সপ্তমও শেষ হয়। সুতরাং আর সপ্তমের দরকার নেই। যে কারণে গুণাগুণি সেই প্রয়োজন শেষ।
‘ঠিকই বলেছেন মুসা ভাই, আর প্রয়োজন নেই।’ বলল আবদুর রহমান।
আহমদ মুসাদের শুইয়ে দিয়ে আবদুর রহমান চলে যাচ্ছিল। তাকে লক্ষ্য করে আহমদ মুসা বলল, ‘আব্দুর রহমান আমরা সকালেই কিন্তু চলে যাব, কিছুতেই দেরী করা যাবে না।’
আবদুর রহমান মাথা নেড়ে চলে গেল।
পরদিন সকাল ৮টা।
আহমদ মুসা এসে গাড়িতে উঠেছে। জোয়ান তখনও আসেনি। বিদায় নিতে গেছে আবদুর রহমানের মা’র কাছে। সকালেই আরেক দফা কথা হয়েছে জোয়ানের সাথে আবদুর রহমানের মা’র। ফজরের নামাযের পর আবদুর রহমান জোয়ানকে নিয়ে গিয়েছিল অন্দর মহলে বাড়ি-ঘর এবং অন্যান্য সব স্মৃতি চিহ্ন দেখাবার জন্যে। জোয়ান ঘুরে ঘুরে গোটা বাড়ি দেখেছে।
আবদুর রহমানের মা জোয়ানকে বলেছে, জোয়ান বেটা, দরবেশ আবদুর রহমানের সম্পত্তির তুমিও অংশীদার। এ বাড়িতে তোমারও ভাগ আছে। আজ থেকে তুমিও এ বাড়ির একজন!
শুনে কেঁদে ফেলেছে জোয়ান। বলেছে, মা, আপনাদের পেয়েছি এর চেয়ে বড় সম্পত্তি আর নেই। তবু আবদুর রহমানের মা কথা আদায় করেছে যে, সে তার মা’র দেয়া প্রস্তাব প্রত্যাখান করবে না।
সোয়া আটটার দিকে ফিরে এল জোয়ান ও আবদুর রহমান। জোয়ানের মুখ ভারি, চোখ ভেজা।
পেছনে বাড়ির দরজায় মেয়েরা দাঁড়িয়ে তাদের বিদায় দেয়ার জন্যে।
গাড়িতে চড়ল জোয়ান ও আবদুর রহমান।
আহমদ মুসা আগেই ড্রাইভিং সিটে উঠে বসেছিল।
গাড়ি স্টার্ট নিল। চলতে শুরু করল গাড়ি। জোয়ান ও আবদুর রহমান দু’জনেই পেছন ফিরে দেখল বিদায় দিতে আসা আপনজনদের। বাড়ির মেয়ে ও শিশু-কিশোর হাত নেড়ে বিদায় জানাল তাদের। আহমদ মুসা তার গাড়ির রিয়ার ভিউ-এ দেখতে পেল দৃশ্যটা। তার মনের কোথায় যেন খচ করে উঠল। মনে হল, এমন একটা গৃহস্থান তার নেই, যেখানে মা, বোনেরা একান্ত আপনজনরা তার পথ চাইবার জন্যে দাঁড়াতে পারে! আহমদ মুসার চোখে ভেসে উঠল সিংকিয়াং-এর এক গ্রামের দৃশ্য, সেই গ্রামের একটি সুন্দর বাড়ির ছবি, যা তার বাবা, মা, ভাই, বোন সকলের কলরোলে একদিন মুখরিত ছিল। কিন্তু সব হারিয়েছে, তার চোখের সামনেই তারা নিহত হয়েছে একের পর এক। আজ সে নিঃস্ব, ঠিকানাহীন! তাকে বুকে ধারণ করার জন্যে এমন কোন বাড়ি অবশিষ্ট নেই, এমন কোন আপনজন তার নেই। অজান্তেই চোখের কোণটা তার ভিজে উঠল। মনে পড়ল আমিনার কথা। তার মত সেও এক হতভাগী। কত কষ্ট পাচ্ছে কে জানে।
আনমনা হয়ে পড়েছিল আহমদ মুসা। ঢিলে হয়ে গিয়েছিল হাতের স্টিয়ারিং হুইল। গাড়িটা বেঁকে গিয়ে ধাক্কা খেতে যাচ্ছিল একটা গাছের সাথে। শেষ মুহূর্তে আহমদ মুসা গাড়িটাকে নিয়ন্ত্রনে আনতে পেরেছে।
গাড়ির এই অবস্থা দেখে বিস্মিত হলো জোয়ান। বিস্মিত হয়ে সে তাকালো আবদুর রহমানের দিকে। দেখল তারও চোখে বিস্ময়। বিস্মিত হবারই কথা। আহমদ মুসা অকল্পনীয় ধরনের সুনিপুণ ও সুদক্ষ ড্রাইভারই শুধু নন, গাড়ি চালনা যে চমৎকার একটা আর্ট সেটা আহমদ মুসার হাতেই তারা দেখেছে।
আহমদ মুসা গাড়িটা ঠিক লাইনে ফিরিয়ে এনে দাঁড় করাল। নেমে পড়ল গাড়ি থেকে। বলল, ‘আবদুর রহমান তুমি এস ড্রাইভিং সিটে।
জোয়ানের বিস্ময় উদ্বেগে পরিনত হলো। বলল, ‘মুসা ভাই শরীর খারাপ করছে না তো আপনার?’
‘না জোয়ান, এমনি একটু আনমনা হয়ে পড়েছিলাম।’ মুখে হাসি টেনে বলল আহমদ মুসা।
মুখে হাসি টানলেও জোয়ান ও আবদুর রহমান আহমদ মুসার চোখের কোণে জমে উঠা সেই অশ্রু বিন্দুটা দেখতে পেল।
আবদুর রহমান পেছনের সিট থেকে নেমে ড্রাইভিং সিটের দিকে এগুলো।
‘কিন্তু মুসা ভাই, এমন আনমনা হতে কোনদিন আপনাকে দেখিনি। আপনার চোখে আবার অশ্রুও দেখেছি।’ বলল জোয়ান।
‘ও কিছু নয় জোয়ান, হঠাৎ চীনের সিংকিয়াং-এ আমার নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়া গ্রামের কথা মনে পড়েছিল, মনে পড়েছিল আমার ছোট বাড়িটার কথা, মনে পড়েছিল হারিয়ে যাওয়া আব্বা, আম্মা, ভাই-বোনের কথা।’
‘মুসা ভাই, আপনিও এমন করে এসব ভাবেন? ভেবে এইভাবে আনমনা হন, কাঁদেনও?’
আহমদ মুসা গাড়িতে উঠে বসেছিল। চলতে শুরু করেছিল গাড়ি আবার।
‘কেন জোয়ান, একজন বাপের, একজন মায়ের আদরের সন্তান কি আমি নই? একজন ভাই, একজন বোনের স্নেহময় ভাই কি আমি না? তারা আজ কেউ নেই, স্মৃতি তো আছে।’ সামনে দূর দিগন্তের দিকে উদাস দৃষ্টি মেলে বড় নরম কন্ঠে বলল আহমদ মুসা। আবার আনমনা হয়ে পড়ল সে।
জোয়ান পলকহীন চোখে তাকিয়ে রইল আহমদ মুসার দিকে। কথা বলতে আর সাহস করল না জোয়ান। মনে হচ্ছে আহমদ মুসা পাশে থেকেও যেন নেই। বাল্য কিংবা কৈশোরের কোন স্মৃতি সে হাতড়ে ফিরছে কে জানে! জোয়ানের কাছে বিপ্লবী নেতা আহমদ মৃসার এ এক নতুন রূপ।
কথা বলে আহমদ মুসার এ ধ্যান-মগ্নতা ভাঙতে চাইলো না জোয়ান। বিস্ময়ের সাথে ভাবল শুধু, আহমদ মুসার সংগ্রামী জীবনের আড়ালে তার একান্ত ব্যক্তিগত একটা জীবন আছে যেখানে সে বড় দুর্বল, বড় একা। সেখানে তাকে পীড়া দেবার মত আছে অনেক অশ্রু, অনেক কান্না।
পাহাড়িয়া পথে এঁকে-বেঁকে চলছিল তখন গাড়ি। আবদুর রহমানের শক্ত হাতে ধরা স্টিয়ারিং হুইল।
প্রথমে তারা পার্বত্য শহর ভেল্লায় ফিরে যাচ্ছে। সেখান থেকে তাদের যাত্রা শুরু হবে মাদ্রিদের দিকে।
যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আহমদ মুসা মাদ্রিদ পৌছতে চায়।

Top