১৪. গোয়াদেলকুইভারে নতুন স্রোত

চ্যাপ্টার

ফিলিপের বাড়ির নিচতলার ড্রয়িংরুম।
আহমদ মুসা, ফিলিপ, জোয়ান, যিয়াদ, আবদুর রহমান বসে আছে সোফায়।
কথা বলছিল তখন আহমদ মুসা। বলছিল, ‘Elder’ সমস্যার সমাধান না করতে পারলে আমরা এক ইঞ্চিও এগুতে পারছি না।’
‘Elder’ অর্থ মুরুব্বী, অভিভাবক। ‘কু-ক্ল্যাক্স-ক্ল্যানের মুরুব্বী বা অভিভাবক কে?’ বলল ফিলিপ।
‘এই মুরুব্বী কোন সংগঠনও হতে পারে, যারা স্পেনীয় কু-ক্ল্যাক্স-ক্ল্যানের অভিভাবকত্ব করছে।’ বলল জোয়ান।
‘তা হতে পারে। কিন্তু আমার মনে হয় তেজস্ক্রীয় পাতার যে প্ল্যান ও ডায়াগ্রাম তা আমি মনে করি তারা কাছেই রাখবে, দেশের বাইরে রাখার কিংবা অন্য সংগঠনের হাতে দেবার তাদের প্রয়োজন কি?’ বলল আহমদ মুসা।
‘ঠিক মুসা ভাই। স্পেনের কু-ক্ল্যাক্স-ক্ল্যান নিজেদের এত দুর্বল মনে করে না যে ডকুমেন্ট তারা নিরাপত্তার জন্যে অন্য সংগঠন বা দেশের বাইরে রাখবে।’ বলল ফিলিপ।
‘কিন্তু নিরাপত্তা হীনতার কারণেই তো তারা ডকুমেন্টগুলো তাদের হেড কোয়ার্টারে রাখার সাহস করেনি।’ বলল জোয়ান।
‘একথা ঠিক মুরুব্বী বলা হয়েছে এমন এক আশ্রয়কে যা তাদের হেড কোয়ার্টারের চেয়ে নিরাপদ।’ বলল যিয়াদ।
‘একথা আমি বুঝতে পারছি না তেজস্ক্রীয় পাতার ডকুমেন্ট ‘Elder’-এর কাছে এ কথা ভাসকুয়েজের পারসোনাল কম্প্যুটার রেকর্ড করার প্রয়োজন হলো কেন? রেকর্ড করা যখন হলোই তখন নামটাকে আড়াল করা হলো কেন?’ বলল ফিলিপ।
‘এর উত্তর সম্ভবত এটাই যে, ডকুমেন্টগুলো কার কাছে আছে এটা শুধু ভাসকুয়েজই জানে। ভাসকুয়েজের যদি কিছু হয়ে যায়, তাহলেও যাতে তার স্থলাভিষিক্ত ব্যক্তি জানতে পারে সে তথ্য এজন্যেই তার পারসোনাল কম্প্যুটারে তা রেকর্ড করা হয়েছে। আর ‘Elder’ এর নাম না থাকার কারণ তাকে ‘Elder’ নামেই কু-ক্ল্যাক্স-ক্ল্যানের দায়িত্বশীলরা সবাই জানে।’
‘Elder’ নাম রেকর্ড থাকলে তা অন্যের কাছে প্রকাশ হয়ে পড়ার সম্ভাবনা আছে বলেই এটা উহ্য রাখা হয়েছে।’ বলল যিয়াদ।
‘বিষয়টি নিয়ে আমিও ভেবেছি, কিন্তু সমাধান খুঁজে পাইনি।’ আহমদ মুসা বলল।
‘এর জবাব হয়তো পরেও পাওয়া যাবে। কিন্তু এখন সামনে এগুবার পথ কি?’ বলল ফিলিপ।
আহমদ মুসার মুখে চিন্তার একটা ছায়া নেমে এল। বলল, ‘প্রতিটা দিন যাচ্ছে আর স্পেনে আমাদের কর্ডোভা, আল হামরা, গ্রানাডা, মাদ্রিদের মসজিদ কমপ্লেক্স প্রভৃতির জীবন থেকে একটা অংশ খসে পড়ছে। একবার ওগুলো তেজস্ক্রীয় দুষ্ট হয়ে পড়লে সেগুলো মেরামতের আর কোন উপায় থাকবে না। ওগুলো মুছে যাবে স্পেনের বুক থেকে, সেই সাথে মুছে যাবে স্পেন থেকে মুসলমানদের নাম নিশানা।’
থামল আহমদ মুসা। একটু ভাবল। তারপর বলল, ‘স্পেনে খৃষ্টান কিংবা শ্বেতকায়দের মুরুব্বী বা অভিভাবক বলে সাধারণ ভাবে মনে করা হয় এমন কেউ কি আছে?’
‘কার্ডিনাল পরিবারকে একবাক্যে সে ধরনের পরিবার বলা যায়।’
আহমদ মুসার মুখে হাসি ফুটে উঠল। বলল, ‘আশ্চর্য, ক’দিনে একবারও এ পরিবারের কথা আমার মনে হয়নি। তুমি ঠিকই বলেছ জোয়ান, স্পেনের খৃস্টানদের শীর্ষ অভিভাবক পরিবার এটি। আর এ পরিবারের সাথে কু-ক্ল্যাক্স-ক্ল্যানের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে। ঐতিহাসিক কার্ডিনাল হাউজের একটা অংশ কু-ক্ল্যাস্ক-ক্ল্যানকে দেয়াই তার প্রমাণ। কিন্তু জেনের আব্বা জেমেনিজ ডে সিসনারোসা কু-ক্ল্যাক্স-ক্ল্যানের ‘Elder’ কি না সেটাই জানার বিষয়।’
‘হ্যাঁ মুসা ভাই, এটাই জানার বিষয়।’ বলল জোয়ান।
‘মি: জেমেনিজ আমাদের প্রতিবেশী বলা যায়। লা-গ্রীনজায় আমাদের পাশেই তাদের স্বাস্থ্য নিবাসটা। ছোট বেলা থেকেই ওদের সবাইকে জানি। মি: জেমেনিজ অত্যন্ত সাধারণ ভাবে চলেন। বাড়িতে তেমন রাখ ঢাক নেই। কোন পাহারাও বাড়ীতে কখনও রাখেননি। মাদ্রিদের বাড়িও তাই। জোয়ান এটা আরও ভাল জানে। এমন লোক কিংবা এমন বাড়ী কু-ক্ল্যাক্স-ক্ল্যানের মূল্যবান দলিলের নিরাপদাশ্রয় হতে পারে বলে মন বলছে না।’ বলল ফিলিপ।
‘তোমার কথা ঠিক হওয়ার যুক্তি আছে। তবে সম্ভাবনাই আমাদের পরীক্ষা করে দেখতে হবে। এখন বল, কার্ডিনাল পরিবারের মত অথবা জেমেনিজের মত আর কাকে কাকে আমরা এমন সম্ভাবনার তালিকায় ফেলতে পারি।’ বলল আহমদ মুসা।
কথা বলার জন্য ফিলিপ মুখ তুলেছে এমন সময়, প্রহরী ছুটে এসে ডয়িং রুমে প্রবেশ করল। দ্রুত কণ্ঠে বলল, ‘একটা গাড়ী ভেতরে ঢুকতে চায়, গাড়ী দিয়ে গেট ধাক্কাচ্ছে। জিজ্ঞাসা করলে কোন কথা বলছে না। আমরা কি করব?’
সংগে সংগে আহমদ মুসা উঠে দাড়াল। ফিলিপও সংগে সংগে উঠে দাঁড়াল। বলল, ‘মুসা ভাই আপনি এবং জোয়ান থাকুন। আমরা দেখে আসি।’
‘না ফিলিপ, এটা কোন শত্রুর গাড়ি নয়। শত্রুর গাড়ি এমন হয়না, এমন করে না।’ বলতে বলতেই আহমদ মুসা চলতে শুরু করেছে।
সবাই পিছু নিল আহমদ মুসার।
আহমদ মুসারা গেটের সামনে গিয়ে দেখল গাড়িটি অবিরাম হর্ণ দেয়া ছাড়াও গেট ধাক্কাচ্ছে গাড়ী দিয়ে।
আমদ মুসা গেটের সিকিউরিটি উইনডো দিয়ে গাড়টির দিকে এক নজর তাকাল। দেখল গাড়ীতে একজন মাত্রই আরোহী।
আহমদ মুসা সুইচ টিপল। গেটের দু’টি পাল্লা সরে গেল দু’দিকে। গেটের সামনে জোয়ান ফিলিপ এবং অন্যান্যরা।
গেট খুলে যেতেই গাড়ী ঢুকে গেল ভেতরে। সেই সাথে গাড়ীর ভেতর থেকে এটা কণ্ঠ উচ্চারিত হল, ‘আমি জেন।’ কণ্ঠটা একটা দুর্বল চিৎকারের মত শোনাল।
ভেতরে প্রবেশ করেই গাড়িটা শা করে ছুটে গেল গাড়ী বারান্দার দিকে। গাড়ীর গতিটা বিশৃঙ্খল।
গাড়ীটা গাড়ী বারান্দায় স্বাভাবিকভাবে দাঁড়ালোনা। বারান্দায় গিয়ে ধাক্কা খেল।
জোয়ান জেনের নাম শুনতে পেয়েছিল এবং তার কণ্ঠও চিনতে পেরেছিল। কিন্তু জেনের এই আগমন এবং চিৎকার তাকে বিস্মিত করেছিল।
জোয়ান চুটছিল গাড়ীর পেছনে।
গাড়ী দাঁড়াতেই জোয়ান গাড়ীর জানাল দিয়ে ভেতরে এক ঝলক তাকিয়েই উদ্বিগ্নভাবে এক টানে দরজা খুলে ফেলল গাড়ীর।
গাড়ী খুলেই চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল জোয়ানের। সিটের ওপর এলিয়ে পড়েছে জেন। গাড়ী ভেসে যাচ্ছে রক্তে।
‘জোয়ান তুমি এখানে! তোমাকেই খুব আশা করছিলাম। আমার গুলি লেগেছে।’ দুর্বল কণ্ঠে বলল জেন।
এ কি করে হলো জেন? আর্তকণ্ঠে বলল জোয়ান।
আহমদ মুসা, ফিলিপ সবাই পেছনে এসে দাঁড়িয়েছিল।
আহমদ মুসা জোয়ানকে একটু পাশে ঠেলে ঝুকে পড়ে গুলিবিদ্ধ স্থানটি পরীক্ষা করল। দেখল, হাটুর নিচে মাংসল হিপটায় বিরাট ক্ষতের সৃষ্টি হয়েছে। গুলি এক পাশ দিয়ে ঢুকে আরেক পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেছে।
‘জোয়ান, ফিলিপ তোমাদের কোন বিশ্বস্ত ক্লিনিক আছে? জেনকে ক্লিনিকে নিতে হবে।’ সোজা হয়ে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল আহমদ মুসা।
জেন ধীরে ধীরে না সূচক মাথা নাড়ল। বলল, না কোন ক্লিনিক নয়, হাসাপাতাল নয়। ওরা এতক্ষনে মাদ্রিদের সব ক্লিনিক হাসপাতালে লোক পাঠিয়েছে আস্তে আস্তে দুর্বল কণ্ঠে বলল জেন।
‘মুসা ভাই, বাসাতে সব ব্যবস্থা করা যাবে।’ বলল ফিলিপ।
‘ঠিক আছে, জোয়ান জেনকে ভেতরে নাও।’ আহমদ মুসা বলল।
সরে এল গাড়ির দরজা থেকে আহমদ মুসা।
ফিলিপ ছুটে গেল ভেতরে।
জেনের গায়ে কোট, পরনে হাটুর নিচু পর্যন্ত নামানো স্কার্ট। ডান হাতের ওপর ঠেস দিয়ে একটা কাত হয়ে সিটের ওপর গা এলিয়ে পড়েছিল জেন।
জোয়ান তাকে তুলে নেয়ার জন্যে এগুলো।
জেন স্টিয়ারিং হুইল ধরে সোজা হতে চেষ্টা করল। চাপ পড়ল তার গুলিবিদ্ধ বাম পা টায়। কঁকিয়ে উঠল জেন।
‘তোমাকে উঠতে হবে না জেন, তুমি উঠো না।’ বলে জোয়ান এগিয়ে গিয়ে পাঁজাকোলা করে তুলে নিল জেনকে।
চোখ বন্ধ করে জেন নিজেকে এলিয়ে দিয়েছে জোয়ানের হাতের ওপর।
জোয়ান হাটতে হাটতে প্রশ্ন করল, কিছুই বুঝতে পারছিনা জেন, কোথায় কি করে এটা ঘটল?
জেন চোখ খুলল। তাকাল জোয়ানের দিকে। জেনের চোখে হাসির অস্পষ্ট প্রলেপ। বলল, ‘সব শুনবে। বলেছিলাম না আমি, তোমার কিছু কাজ আমাকে দিও’।
‘কিছু করতে গিয়েছিলে নাকি?’ জোয়ানের চোখে বিস্ময়।
‘বলব’। চোখ বন্ধ করে বলল জোন।
নিচের ড্রইং রুমের সিঁড়ির গোড়ায় দাঁড়িয়ে ছিল ফিলিপ। জেনকে নিয়ে জোয়ান ঢুকতেই বলল তিন তলায় নিয়ে চল জোয়ান। আম্মার পাশে মারিয়ার ঘরটায় ওর জন্যে ব্যবস্থা করেছি।
দোতলার সিঁড়ির মুখে দাঁড়িয়ে ছিল ফিলিপের আম্মা।
মারিয়ার বান্ধবী জেনকে ছোটবেলা থেকেই চেনে ফিলিপের আম্মা।
জেনকে দেখেই কেঁদে উঠল, ‘আমার মারিয়া গেল, তোমারও এই অবস্থা?’
‘জেন চোখ খুলে মারিয়ার মা’র দিকে চেয়ে বলল, ‘মারিয়ার মত করে আমি যেতে পারলাম না খালাম্মা।’
‘ওকথা বলোনা মা, তুমি বেঁচে থাক।’ জেনের মাথায় হাত রেখে চলতে চলতে বলল মারিয়ার মা।
জেনকে নিয়ে জোয়ান এবং অন্যান্য সকলে প্রবেশ করল ঘরে।
বেশ বড় ঘর। তক তকে চক চকে ঘর। জেন মারিয়ার কাছে এ ঘরে এসেছে।
খাটে সাদা ধবধবে নতুন বিছানা পাতা। চাদরের ওপর গোটা খাট জুড়ে একটা রাবার সিট বিছানো।
জোয়ান জেনকে বিছানায় শুইয়ে দিল।
মারিয়ার মা বসল জেনের মাথার কাছে। হাত বুলিয়ে দিতে লাগল জেনের মাথায়।
আমার এক সার্জেন বন্ধুকে বলেছি, এখনই এসে পড়বেন। ফিলিপ বলল।
ফিলিপ, তাড়াতাড়ি কিছু দুধ খাইয়ে দিতে হবে জেনকে। আহমদ মুসা বলল।
‘ফিলিপের মা উঠে বলল, আমার খেয়ালই হয়নি। যাই বাবা আসছি।
বলে ফিলিপের মা বেরিয়ে গেল। জেনের গুলিবিদ্ধ ক্ষতের দিকে তাকিয়ে আহমদ মুসা বলল, ক্ষত বাধার কাপড়টা বদলে দিতে হবে, ওটা রক্তে ভিজে গেছে।
গাড়ীতেই জেন তার মাথার স্কার্ট দিয়ে ক্ষতটা বেধে নিয়েছিল। তারপর গাড়ী বারান্দায় আহমদ মুসা সেটা পাল্টে তার রুমাল দিয়ে ক্ষতস্থানটা বেধে দেয়।
‘ডাক্তার এই এসে পড়ল বলে মুসা ভাই।’ বলল ফিলিপ।
জোয়ান জেনের পাশে বসেছিল।
বিছানায় শোয়ার পর চোখ বন্ধ করে ছিল জেন। একটু রেস্ট নেবার পর সে চোখ খুলল।
কোর্টের পকেট থেকে ধীরে ধীরে বের করল সেই ইনভেলাপ। কাঁপা হাতে সেটা জোয়ানের হাতে তুলে দিয়ে বলল, ‘মুসা ভাইকে দাও।’
জোয়ান বিস্ময়ের সাথে ইনভেলাপটি হাতে নিয়ে সেটা তুলে দিল আহমদ মুসার হাতে।
আহমদ মুসার চোখেও কৌতুহল্‌
সে ইনভেলাপটি হাতে নিয়ে বলল, ‘কি আছে বোন এতে?’
জেন চোখ বুজেছিল। আবার চোখ খুলে বলল, ‘দেখুন, বলব না।’ জেনের ঠোঁটে এক টুকরো হাসি।
‘আহমদ মুসা ইনভেলাপের ভেতর থেকে কাগজগুলো বের করল। কাগজগুলোর ওপর একবার চোখ বুলিয়েই ‘আল্লাহু আকবার’ বলে আহমদ মুসা সিজদায় পড়ে গলে মেঝের ওপর।
জোয়ান, ফিলিপ, আবদুর রহমানের চোখে মুখে বিস্ময়্‌
ডপলিপ কাগজুরো তুলে নিল আহমদ মুসার হাতের পাশ থেকে।
চোখ বুলিয়েই চিৎকার কওে উঠল, ‘জোয়ান এতো মুসরিম ঐতিহাসিক স্থান ও মাদ্রিদের মসজিদ কমপ্লেক্সে তেজস্ক্রিয় পাতার পরিকল্পনা ও ডায়াগ্রাম।’
‘বিস্ময়ে পাথর হয়ে যাওয়া জোয়ান ফিলিপের হাত তেকে কাগজগুলো নিয়ে ওগুলোর ওপর চোখ স্থাপন করল। আবদুর রহমানও এগিয়ে এল জোয়ানের কাছে। তারও চোখ কাগজগুলোতে।
জোয়ান, ফিলিপ, আবদুর রহমান নত মুখে কোন কথা নেই। যেন গভীর কোন স্বপ্নে নিমজ্জিত।
অনেক্ষণ পর সিজদা থেকে মাথা তুলর আহমদ মুসা। গন্ড দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে তার চোখের পানি, ধীরে ধীরে বলল, ‘আমরা যা আশা করতে পারিনি, তার চেয়েও বেশী সাহায্য করেছেন আল্লাহ আমাদেরকে।’
জেনের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আল্লাহ তোমাকে দীর্ঘজীবি করুক বোন। আর মানুষ যা আশা করতে পারেনা, তার চেয়েও বড় পুরস্কার আল্লাহ তোমাকে দিন, যখন ওটা মানুষের জন্যে সবচেয়ে বেশী প্রয়োজন হবে।’
আবেগে কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে এল আহমদ মুসার।
জেনের চোখ থেকেও গড়িয়ে পড়ছিল অশ্রু। শুকনো লাল ঠোঁট তার কাঁপছিল। আহমদ মুসার সিজদা, তার কথা, জোয়ানদের সপ্রশংস বিস্ময়, জেনের ছোট্ট হৃদয়টা ভরে দিয়েছে অসীম আনন্দ আর আবেগে। তারও মুখে কথা সরছে না।
আহমদ মুসাই আবার কথা বলল, ‘আমার জীবনে আজকের মত এত খুশি কোন দিন হইনি বোন।’
জেনের দিকে চেয়ে কথাগুলো বলল আহমদ মুসা। একটু থেমেই আবার বলল জেনকে, ‘তাহলে কু-ক্ল্যাক্স- ক্ল্যানের ‘elder’ তোমার আব্বা, তাই না?’
‘জি হ্যাঁ।’ চোখ মুছে বলল জেন।
‘তোমার আব্বার গুলিতেই তুমি আহত হয়েছ, তাই না?’
‘জি, হ্যাঁ। আপনি কি করে জানলেন ভাইয়া?’ জেনের কন্ঠে বিস্ময়!
‘ব্যাপারটা খুবই সহজ। তোমার গুলি লেগেছে হাঁটুর নিচে। ভাসকুয়েজ অথবা কু-ক্ল্যাক্স-ক্ল্যানের কেউ এই অবস্থায় গুলি করলে সেটা করত তারা তোমার বুকে, পিঠে অথবা মাথায়।’
কথা শেষ করেই আহমদ মুসা কাগজগুলো ফিলিপের হাতে তুলে দিয়ে বলল, ‘এগুলো ভালো করে রাখ তুমি।’
তারপর আব্দুর রহমানের দিকে ফিরে বলল, ‘তুমি এবং জিয়াদ বের হও বাইরে। কু-ক্ল্যাক্স-ক্ল্যানের তৎপরতা সম্পর্কে খোঁজ নাও। ওরা কিন্তু এখন ক্ষ্যাপা কুকুরের মত হয়ে যাবে। আর আমি নিচে যাচ্ছি, দেখি জেনের গাড়ীটা পরিষ্কার হলো কি না। গাড়ীর নাম্বার ব্লু-বুক সবই পাল্টে দিতে হবে।’
সবশেষে জোয়ানের দিকে চেয়ে বলল, ‘তুমি এখানে বস।’
জোয়ান ছাড়া সবাই বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।
জোয়ান বিস্ময়ে বোবা হয়ে গিয়েছিল। জেন তার আব্বা, তার পরিবার, তার জাতির বিরুদ্ধে গিয়ে ডকুমেন্টগুলো উদ্ধার করেছে! তার আব্বার পিস্তলে সে গুলী খেয়েছে! জেনের এই রূপ, এই বিশালতা জোয়ানের কল্পনাকেও ছাড়িয়ে গেছে। বিস্ময়ের ঘোর যেন তার কাটছে না।
আহমদ মুসা বেরিয়ে গেলে জোয়ান তার মুখটা নিচু করেছিল। তার মনে হলো আহমদ মুসা যেন ইচ্ছা করেই তাকে এবং জেনকে এভাবে একা রেখে গেল। তা নাও হতে পারে। এটা তার একটা অমূলক চিন্তা হতে পারে। কিন্তু এই চিন্তা তাকে কিছুটা আড়ষ্ট করেছিল। জোয়ান এবং জেনের ব্যাপারটা কারো কাছেই অপ্রকাশ্য থাকলো না।
জেন তাকিয়ে ছিল জোয়ানের দিকে। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল, ‘কথা বলছ না যে?’
জোয়ান মুখ তুলল। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল জেনের দিকে। তারপর ধীরে ধীরে বলল, ‘ট্রিয়েস্টে তুমি আমাকে জীবন বিপন্ন করে বাঁচিয়ে ছিলে, তখনও পরো তোমাকে আমি চিনতে পারি নি। সত্যি আমার চোখ এত কম দেখে। আজ তোমাকে চিনতে পেরেছি জেন।’
বলতে বলতে জোয়ানের কন্ঠ ভারী হয়ে এল। চোখ ফেটে নেমে এল অশ্রু।
জেনের ঠোঁটে হাসি। বলল, ‘এই চিনতে না পারা তোমার দোষ নয় জোয়ান। তুমি বিজ্ঞানী। তুমি বস্তুর গভীরে বিচরণে ব্যস্ত, মানুষের মনে প্রবেশের তোমার সময় কোথায়?’
থেমে একটু দম নিল জেন। তারপর বলল, ‘আজ কতটা চিনতে পেরেছে বলত জোয়ান। তাহলে বুঝব, বিজ্ঞানী সাহেবের চিনার মধ্যে কোন ফাঁক আছে কি না?’
জেনের চোখের ওপর চোখ রেখে জোয়ান বলল, ‘না বলব না। এটা বলার জিনিস নয়। হৃদয় দিয়ে অনুভব করার জিনিস এটা।’ জোয়ানের কন্ঠ তখনও ভারী। চোখে তখন পানি।
জেনের মুখ লাল হয়ে উঠল। কাঁপছে আবেগে তার পাতলা শুকনো ঠোঁট। বলল সে, ‘একটু কাছে আসবে জোয়ান? অন্যায় না হলে তোমার চোখের পানিটা আমি আমার হাত দিয়ে মুছে দিতে চাই’।
‘তোমার পক্ষ থেকে আমিই মুছছি।’ বলে জোয়ান হেসে পকেট থেকে রুমাল বের করে চোখের পানি মুছে নিয়ে রুমালটা জেনকে দিল।
জেন জোয়ানের রুমাল দু’হাত ভরে নিয়ে, সে দু’হাতের মধ্যে নিজের মুখট গুজলো।
এই সময় ফিলিপের মা দুধ নিয়ে প্রবেশ করল। তার প্রায় সাথে সাথেই ডাক্তার সহ আহমদ মুসা ও ফিলিপ ঘরে এসে ঢুকল। ডাক্তার ফিলিপের বাস্ক সম্প্রদায়েরই একজন। ডাক্তারের সাথে একজন নার্সও এসেছে।
ডাক্তার ক্ষতটি পরীক্ষা করে বলল, ‘ক্ষতটি বড়, কিন্তু বুলেট বেরিয়ে যাওয়ায় এখন আর তেমন জটিলতা নেই। কিন্তু প্রচুর রক্ত গেছে ইতিমধ্যেই, রক্ত দিতে পারলে ভাল হতো।’
‘সমস্যা আছে তুমি তো জান। অপরিহার্য হলে সে ব্যবস্থা এখানেই করতে হবে।’
ডাক্তার আরও পরীক্ষা করে বলল, ‘প্রয়োজন আছে যদিও, কিন্তু প্রয়োজনটা অপরিহার্য নয়। দু’এক দিনেই ঠিক হয়ে যাবে।’
জেন দুধ খেয়ে শুয়ে পড়ল।
ডাক্তার নার্সকে ইশারা করল, ব্যাগ খুলে প্রয়োজনীয় সব বের করার জন্যে।
নার্স কাজে লেগে গেল।
ডাক্তার এপ্রোনটি পরে নিয়ে হাতে গ্লাভস লাগিয়ে তৈরী হলো।
হাঁটু পর্যন্ত চাঁদর দিয়ে ঢেকে দেয়া হল জেনকে।
ডাক্তার ফিলিপের মাকে বলল, ‘খালাম্মা এর মাথার কাছে একটু বসেন।’
আহমদ মুসা, ফিলিপ, জোয়ান সবাই বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।
ডাক্তার জেনকে বলল, ‘তোমাকে ধৈর্য্য ধরতে হবে, একটু কষ্ট হবে বোন।’ বলে জেনকে একটা ইনজেকশন দিয়ে তুলা কাঁচি ইত্যাদি নিয়ে জেনের বুলেট বিদ্ধ ক্ষতের দিকে এগুলো।
জেন দাঁতে দাঁতে চেপে চোখ বন্ধ করল।

পরের দিন সকাল।
নামাজ পড়েই তারা আলোচনায় বসল।
আহমদ মুসা জেনের ডকুমেন্ট উদ্ধারের কাহিনী শুনিয়ে বলল, ‘জেন আজকের ত্যাগ ও সাহসের একটা দৃষ্টান্ত। সে আমাদের জন্যে আল্লাহর পত্যক্ষ সাহায্য। জেনের আজ বেশ জ্বর উঠেছে। সবাই দোয়া কর, আল্লাহ জেনকে তাড়াতাড়ি সুস্থ করে তুলুন।’
একটু থামল আহমদ মুসা। থেমেই আবার শুরু করল, ‘এখন কাজের কথায় আসি। যে ডকুমেন্টের জন্যে এতদিন আমরা উন্মুখ হয়েছিলাম, আল্লাহ সেটা আমাদের জুটিয়ে দিয়েছেন। এখন বল আমরা কোন পথে এগুবো?’
‘আমাদের কাছে তো একটাই পথ। ডায়াগ্রাম অনুসারে খুঁড়ে তেজস্ক্রিয়গুলো তুলে ফেলতে হবে।’ বলল যিয়াদ বিন তারিক।
ফিলিপ, জোয়ান, আব্দুর রহমান সবাই তাকে সমর্থন করল।
‘কিন্তু এভাবে,’ বলতে শুরু করল আহমদ মুসা, ‘তুলে ফেলা কি সম্ভব? প্রথম কথা হলো ঐতিহাসিক স্থান গুলো সরকারের নজরে রয়েছে, তারা এভাবে খুড়তে দেবে কেন? সব চেয়ে বড় কথা হলো, তেজস্ক্রিয় পাতার ডকুমেন্টগুলো হারাবার পর কু-ক্ল্যাক্স-ক্ল্যান এখন নজর রাখবে মাদ্রিদের শাহ ফয়সাল মসজিদ সহ কর্ডোভা, গ্রানাডা, মালাগা, প্রভৃতি সবগুলো মুসলিম ঐতিহাসিক স্থানের উপর। কাজ করতে গেলেই ওদের হাতে ধরা পড়তে হবে অথবা সংঘাত বাঁধবে। এসবের মধ্যে দিয়ে আমরা আমাদের উদ্দেশ্য সিদ্ধ করতে পারবো না।’ কথা শেষ করল আহমদ মুসা।
ফিলিপ, জোয়ান, যিয়াদ, আব্দুর রহমান সকলেরই মুখ মলিন হয়ে উঠল। হতাশা দেখা দিল তাদের চোখে মুখে।
ফিলিপ বলল, ‘আপনি ঠিক বলেছেন মুসা ভাই। আমরা এ দিকটা চিন্তা করিনি। ওদের চোখ এড়িয়ে তেজস্ক্রিয় তুলে ফেলার কাজ কিছুতেই সম্ভব নয়।’
‘উপায় কি তাহলে এখন?’ বলল যিয়াদ।
‘ডকুমেন্ট পরীক্ষার করার পর গত রাত থেকে আমি ভিন্ন একটা চিন্তা করছি।’ বলল আহমদ মুসা।
‘কি সেটা?’ তিন জন এক সাথে বলে উঠল।
‘আমি ভাবছি, ডকুমেন্ট গুলো আন্তর্জাতিক একটি নিউজ মিডিয়া এবং মুসলিম বিশ্বের সংবাদপত্র গুলোর কাছে পাচার করে দেব’।
‘তার পর।’ বলল ফিলিপ।
‘আন্তর্জাতিক নিউজ মিডিয়া এবং মুসলিম বিশ্বের সংবাদপত্র গুলো এখবর লুফে নেবে বলে আমি মনে করি।’
‘তাতে আমাদের কি লাভ? আমাদের উদ্দেশ্য তো তাতে সিদ্ধ হবে না। তেজস্ক্রিয় গুলো তো উঠবে না।’ বলল যিয়াদ।
‘বল কি! আমরা একটা নয়, তখন তিনটা উদ্দেশ্য সিদ্ধ করতে পারবো।’
তিনজনই বিস্ময় ভরা দৃষ্টিতে আহমদ মুসার দিকে তাকাল।
‘প্রথম লাভ হলো, শুরু করল আহমদ মুসা, কু-ক্ল্যাক্স- ক্ল্যানের ভীষন বদনাম হবে, তার উপর সব দিক থেকে চাপ পড়বে এবং তাতে সংগঠনটাই দূর্বল হয়ে পড়বে। দ্বিতীয় লাভ মুসলিম জাতি সম্পর্কে স্পেনীয় দৃষ্টিভংগি বিশ্ববাসীর কাছে পরিষ্কার হয়ে যাবে, তার ফলে স্পেন সরকারের উপর প্রচন্ড চাপ পড়বে। তাছাড়া ঐতিহাসিক স্থান গুলো ধ্বংস হলে প্রতি বছর কোটি কোটি বৈদেশিক মুদ্রার আয় থেকে বঞ্চিত হবে স্পেন। স্পেন প্রতি বছর পর্যটন খাত থেকে আয় করে ১৬ বিলিয়ন ডলার, এর মধ্যে ১২ বিলিয়ন ডলার আসে মুসলিম ঐতিহাসিক স্থান গুলোর সাথে সংশ্লিষ্ট পর্যটকদের কাছ থেকে। সুতরাং বদনাম ও চাপ থেকে রক্ষা পাওয়া অন্য দিকে দেশের আর্থিক স্বার্থ রক্ষার জন্যেই স্পেন সরকার সরকারী ভাবে তেজস্ক্রিয় গুলো তুলার ব্যবস্থা করবে। তৃতীয় লাভ হলো, স্পেনীয় মুসলমানদের সম্পর্কে এই সচেতনতার সুযোগে স্পেনের মুসলমানরা তাদের ন্যায্য ও গণতান্ত্রিক অধিকার আদায় করে নেবার সুযোগ পেতে পারে।
থামল আহমদ মুসা।
ফিলিপদের চোখে তখন বিস্ময় ও আনন্দ ঠিকরে পড়ছে।
‘আল্লাহ আপনাকে দীর্ঘজীবি করুন।’ আপনি ক’টি কথায় একটা সোনালী স্বপ্ন ফুটিয়ে তুলেছেন আমাদের সামনে। আপনার প্রতিটি কথা সত্য হোক।’ আবেগের সাথে বলল যিয়াদ।
‘যিয়াদ স্বপ্ন বলেছে, কিন্তু আমার কাছে আপনার প্রতিটি কথা বাস্তব মনে হচ্ছে। কিন্তু একটা প্রশ্ন, কু-ক্ল্যাক্স- ক্ল্যান বা স্পেনের উপর চাপ আসবে কেন? মুসলমানদের সে রকম বন্ধু কোথায়?’ ফিলিপ বলল।
আহমদ মুসা হাসল। বলল, ‘তোমার কথা ঠিক কিন্তু তোমরা জান, প্রত্যেক জাতির ইতিহাস-ঐতিহ্য রক্ষার আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত বিধান আছে। এরই অংশ হিসেবে ইউনেস্কো পৃথিবীব্যাপী জাতি সমূহের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও পুরাকীর্তি রক্ষার চেষ্টা করছে। আন্তর্জাতিক এ বিধি, নিয়ম ও মনোভাবের সাহায্য আমরা পাব। কর্ডোভা ও গ্রানাডার অমন কীর্তিসমূহ এবং আল-হামরার মত অতুলনীয় স্থাপত্য কীর্তি ধ্বংস হোক দুনিয়ার মানুষ তা চাইবে না। সুতরাং চারদিক থেকে চাপ আসবেই।’
‘কিন্তু এই লক্ষ্য অর্জন করতে হলে তো চাই ব্যাপক প্রচার এবং প্রচারের মাধ্যমে বিশ্বজনমত গঠন। এটা কি সম্ভব হবে?’ বলল ফিলিপ।
‘কতখানি সম্ভব হবে জানিনা। তবে চেষ্টা আমাদের করতে হবে। আজ ভোরেই আমি ফিলিস্তিন, মধ্য এশিয়া প্রজাতন্ত্র ও সৌদি আরবের রাষ্ট্রদূতের সাথে বিষয়টা নিয়ে আলচনা করেছি। আমি তাঁদের ইংগিত দিয়েছি মুসলিম বিশ্বের কাগজ গুলোতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটা ডকুমেন্ট ছাপার ব্যবস্থা করতে হবে। তাদেরকে অনুরোধ করেছি কোনও ভাবে EWNA(EURO WORLD NEWS AGENCY)-এর সাথে যোগাযোগ করে ডকুমেন্টটি তাদের মাধ্যমে প্রচারের ব্যবস্থা করতে। তারা কাজ শুরু করে দিয়েছে। ১০টার দিকে তাদের কাছ থেকে জানতে পারবো কতদূর তারা এগুলো। মনে রেখো তোমরা, আজ সকাল ১০টায় যিয়াদকে সেন্টপল গীর্জার গেটের পশ্চিম পাশে দাঁড়ানো ৭৮৬৭৮৬ নং গাড়িতে গিয়ে উঠতে হবে। সেই গাড়ী কোন এক জায়গায় মধ্য এশিয়া প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রদূতের সাথে তাকে দেখা করিয়ে দেবে। ডকুমেন্ট গুলো তাকে দিতে হবে, সেই সাথে আমার চিঠি। আর তিনি যে খবর দেবেন তা আনতে হবে।’
থামল আহমদ মুসা।
‘আল হামদুলিল্লাহ, আপনি তো অনেক দূর এগিয়েছেন মুসা ভাই।’ বলল আবদুর রহমান।
‘অনেক দূর কোথায়, সবে তো শুরু।’
‘যোগাযোগের কাজটা তো হয়েছে, এই কাজেই তো আমাদের লাগতো দিনের পর দিন।’
‘তা হয়েছে।’
‘মুসা ভাই, বলতে শুরু করল জোয়ান, আমি একটা কথা ভাবছি, ডকুমেন্ট গুলো দিয়ে কি আমরা নিঃসন্দেহে প্রমাণ করতে পারবো যে, তেজস্ক্রিয় দিয়ে মুসলিম ঐতিহাসিক স্থানগুলো ধ্বংস করার ষড়যন্ত্রটি কু-ক্ল্যাক্স-ক্ল্যানের? আর ডকুমেন্ট গুলো দিয়ে কি প্রমাণ করা যাবে যে, সেটা এক ভয়াবহ ষড়যন্ত্র? যদি তা যায়, তা’হলে আমি মনে করি বিশ্বের নিউজ মিডিয়ায় তা ভাল কভারেজ পাবে, দুনিয়ায় চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করবে।’ বলল জোয়ান।
‘তুমি একটা গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট তুলেছ জোয়ান। ডকুমেন্টগুলোর নির্ভরযোগ্যতাই কিন্তু আমাদের মূলধন। এ বিষয়টা নিয়ে আমি চিন্তা করেছি। পরিকল্পনা আমরা যেটা পেয়েছি, তাতে তেজস্ক্রিয় ক্যাপসুলের কার্যকারিতার প্রকৃতি, কার্যকারিতার মেয়াদ, বিল্ডিং ও স্থাপনার প্রকৃতি ও থাকার আয়তন অনুসারে লক্ষ্য অর্জনের মেয়াদের বিভিন্নতা, কর্ডোভা, গ্রানাডা, মালাগা, মাদ্রিদ শাহ্‌ ফয়সল মসজিদ কমপ্লেক্স, প্রভৃতি থেকে তেজস্ক্রিয় ক্যাপসুল তুলে নেবার সময় নির্দিষ্ট, না তুললে এলাকার কি কি ক্ষতি হবে, ইত্যাদির বিবরণ সুষ্ঠভাবে দেয়া আছে। আর ডায়াগ্রামে রয়েছে কর্ডোভা, গ্রানাডা, মালাগা, প্রভৃতির ঐতিহাসিক স্থাপনাগুলোর কোন কোন স্থানে তেজস্ক্রিয় পুঁতে রাখা হয়েছে তার নিখুঁত মানচিত্র।…’
আহমদ মুসার কথার মাঝখানে ফিলিপ বলে উঠল, ‘আচ্ছা পরিকল্পনা ও ডায়াগ্রামে কর্ডোভা, গ্রানাডা প্রভৃতিকে কি তাদের নামেই উল্লেখ করা হয়েছে?’
‘হ্যাঁ।’ বলল আহমদ মুসা।
‘এখন বাকি থাকল,’ আহমদ মুসা শুরু করল আবার, ‘কু-ক্ল্যাক্স-ক্ল্যান এটা করেছে কি না তা প্রমাণ করা, এই তো? সেটাও সহজে প্রমাণ করার মত দলিল আমরা পেয়েছি। প্ল্যান ও ডায়াগ্রামের সাথে আদেশ দান সুলভ একটা চিঠি আছে। চিঠিতে কোন পটভূমিতে কি উদ্দেশ্যে কু-ক্ল্যাক্স-ক্ল্যান এর নির্বাহী কমিটি এ সিদ্ধান্ত নেয় তার উল্লেখ করে প্ল্যান কার্যকর করার নির্দেশ জারী করা হয়েছে। শেষে স্বাক্ষর রয়েছে ভাসকুয়েজের। আমি মনে করি, তেজস্ক্রিয় ষড়যন্ত্রের সাথে কু-ক্ল্যাক্স-ক্ল্যানের সম্পর্ক প্রমাণের জন্যে এ চিঠিই যথেষ্ট।’
ফিলিপদের মুখ খুশীতে উজ্জ্বল হয়ে উঠল।
ফিলিপ ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল, ‘চলুন, নাস্তা রেডি।’
সবাই উঠে দাঁড়াল।
রাত তখন দশটা।
ফিলিপের তিনতলার ড্রইংরুমে বসেছিল আহমদ মুসা, ফিলিপ ও জোয়ান।
খুশীতে মুখ উজ্জ্বল করে বাইরের দরজা দিয়ে ড্রইংরুমে প্রবেশ করল যিয়াদ ও আবদুর রহমান।
ওদের সাথে মধ্য এশিয়া প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রদূতের সাক্ষাতের সময় ছিল রাত ৮টায়। ডকুমেন্ট গুলো বিশ্ব সংবাদ মাধ্যমগুলোতে প্রচারের কি ব্যবস্থা হয়েছে সে বিষয়ে রাষ্ট্রদূতের যিয়াদদেরকে জানাবার কথা এ সময়।
ওদের হাসি মুখ দেখে খুশী হল আহমদ মুসারা।
ওরা এসে বসল।
‘কাঁটায় কাঁটায় দশটায়, কথা শুরু করল যিয়াদ, মধ্য এশিয়া প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রদূতের সাথে আমাদের দেখা হলো। তিনি আমাদের দেখে হাসলেন। বললেন, মাই বয় ইনশাআল্লাহ্‌ আমরা খেলায় জিতে যাচ্ছি। সৌদি আরব, আফগানিস্তান, ইরান ফিলিস্তিন সরকার এ বিষয়টাকে অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে গ্রহণ করেছে। যা কল্পনাও করতে পারিনি আমরা। দুপুরের মধ্যেই আমার সরকারের কাছ থেকে ওরা ডকুমেন্ট পেয়ে গেছে। সংগে সংগেই সৌদি আরব বিষয়টা ও আই সি সেক্রেটারিকে জানিয়েছে। খবরটা আজ শুধু মুসলিম দেশগুলোর পত্রিকায় আসবে তা নয়, খবর বেরুবার সাথে সাথে ও আই সি সহ দেশগুলোর তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করার ব্যবস্থাও হয়েছে। অন্যদিকে একটা সূত্রের মাধ্যমে ডকুমেন্টগুলোর Euro World News Agency এর ফ্রান্স অফিসে পৌঁছিয়েছি। সূত্রের মাধ্যমে আমরা জানিয়েছি তারা যদি আজ রাত ৮টা থেকে ৯টার মধ্যে নিউজটি ক্রিট করে, তা’হলে মুসলিম দেশের পত্র পত্রিকা তাদের নিউজই ছাপাবে, অন্যথায় সরাসরি ডকুমেন্ট গুলো আমরা তাদের দিয়ে দেব। EWNA নিউজটার প্রতি খুব আগ্রহ দেখাচ্ছে বলে সূত্রের মারফৎ আমরা জানতে পেরেছি। যদি EWNA নিউজটি শেষ পর্যন্ত ক্রিট না করে। বিকল্প চিন্তাও আমাদের আছে। এই হলো মধ্য এশিয়া প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রদূতের খবর, আমি তার কথাতেই পেশ করলাম।’
থামল যিয়াদ।
আহমদ মুসা সহ সবারই মুখ আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠল। আহমদ মুসা বলল, ‘মুসলিম বিশ্বের প্রতিক্রিয়ার সাথে সাথে আমরা ইউনেস্কো মানবাধিকার কমিশন, প্রভৃতি জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা এবং বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্র ও মানবাধিকার গ্রুপগুলোর প্রতিবাদ, অনুকুল প্রতিক্রিয়া আমরা চাই।
‘হ্যাঁ মুসা ভাই,’ বলতে শুরু করল যিয়াদ, ‘রাষ্ট্রদূত এ ব্যাপারেও বলেছেন। বলতে ভুলে গেছি। তিনি বলেছেন, ও আই সি’র মাধ্যমে আজকেই ইউনেস্কো মানবাধিকার কমিশন সহ জাতিসংঘে ডকুমেন্টগুলো পৌঁছে দেয়া হবে। পৃথিবীর অন্যান্য রাষ্ট্রের কাছেও ও আই সি ডকুমেন্টগুলো পৌঁছানোর দায়িত্ব নিয়েছে।’
‘আল হামদুলিল্লাহ। প্রাথমিক ও গুরুত্বপূর্ণ কাজটা মনে হচ্ছে ভালোভাবেই সম্পন্ন হয়েছে। তবে একটা কথা ভাবছি, E.W.N.A. W.N.A. N.A.N.A. ইত্যাদির মত পশ্চিমা সংবাদ মাধ্যমের দ্বারা যদি নিউজটা প্রচার করা না যায়, তা’হলে পশ্চিমা সংবাদ পত্রে কভারেজ পাবে না এবং তার ফলে পশ্চিমা জনমতকে অনুকুলে আনা কঠিন হবে।’ চিন্তিত ভাবে বলল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসা কথা শেষ করার সাথে সাথেই সামনে রাখা টেলিফোনটা বেজে উঠল।
টেলিফোন ধরল ফিলিপ।
টেলিফোন ধরে ওপারে কথা শুনেই চেহারা পরিবর্তন হয়ে গেল ফিলিপের। তার চোখে মুখে বিস্ময়ের ভাব ফুটে উঠল। বলল সে, ‘Hold on please দিচ্ছি।’ বলে ফিলিপ টেলিফোনটা আহমদ মুসাকে দিয়ে দিল।
আহমদ মুসা ‘হ্যালো’ বলার পর ওপারের কথা শুনার সংগে সংগেই তার চোখ মুখ অন্ধকার হয়ে গেল। তাড়াতাড়ি পকেট থেকে রুমাল বের করে রিসিভারের স্পীকারের ওপর বসিয়ে বলল, ‘সরি, রং নাম্বারে টেলিফোন করেছেন। নাম্বার আবার চেক করুন। থ্যাংকস।’ বলে আহমদ মুসা টেলিফোন রেখে দিল।
ফিলিপের মুখ কালো হয়ে গেছে আহমদ মুসার মিথ্যা বলা দেখে। বলল, ‘এ কি মুসা ভাই ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদের সাথে কথা বললেন না। আর একেবারে…’
কথা শেষ করতে পারলনা ফিলিপ। আহমদ মুসা তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল,‘মিথ্যা বললাম’ এই তো? মিথ্যা না বলে উপায় ছিলনা। মাহমুদ যে এতবড় ভুল করবে, ভাবতে আমার বিস্ময় লাগছে। সম্ভবত ডকুমেন্টগুলো পেয়ে এত খুশী হয়েছে কিংবা উত্তেজিত হয়েছিল যে, সে কাণ্ডজ্ঞান কিছুটা হারিয়ে ফেলেছিল। যা হোক, দেখো তার সাথে আমার কথা বলার অর্থ হলো, আহমদ মুসা কোন টেলিফোনে এখন আছে তা স্পেনের গোয়েন্দা বিভাগকে জানিয়ে দেয়া। আর টেলিফোন নাম্বার পেলে কম্পিউটারে মালিকের ঠিকানা বের করা কয়েক মিনিটের ব্যাপার মাত্র।’
কথা শেষ করেই আহমদ মুসা কি ভেবে দ্রুত কণ্ঠে বলল, ‘আচ্ছা ফিলিপ মাহমুদ তোমাকে কি বলেছিল?’
‘বলেছিল, আমি ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ বলছি। আহমদ মুসার সাথে কথা বলব।’
চোখে চাঞ্চল্য এবং কপালে চিন্তার রেখা ফুটে উঠল আহমেদ মুসার। বলল,‘ফিলিপ নতুন বাড়ীতে উঠার তোমার কতদূর?’
‘আজ বিকেলে আম্মা এবং জেন চলে গেছে ওখানে। আম্মা কিছু জিনিষপত্রও নিয়ে গেছেন। অবশিষ্ট নিয়ে কালকেই আমরা চলে যাব।’ বলল ফিলিপ।
কাল সময় পেলে পার হওয়া যাবে, কিন্তু এখনি আমাদেরকে এখান থেকে সরতে হবে। আমার অনুমান মিথ্যা না হলে কিছুক্ষণের মধ্যেই অথবা আজ রাতে সরকারী গোয়েন্দারা অথবা তাদের কাছ থেকে খোঁজ পেয়ে কু-ক্ল্যাক্স-ক্ল্যান এ বাড়ীতে চড়াও হবে। আমি যদিও রং নাম্বার বলে টেলিফোন রেখে দিয়েছি, যদিও টেলিফোনের স্পিকারে রুমাল লাগিয়ে কণ্ঠ বদলের চেষ্টা করেছি, তবু এ কথা স্পেনের গোয়েন্দা বিভাগ নিশ্চিত ধরে নেবে, একটা দেশের প্রেসিডেন্ট কোন রং নাম্বারে টেলিফোন করতে পারেন না। তা’ছাড়া প্রথমে আমি অরিজিনাল পরে ‘হ্যালো’ বলেছি, পরে স্বর পরিবর্তন করেছি, এটাও তাদের নজর এড়াবে না। এখন ‘হ্যালো’ শব্দ যে আহমদ মুসার তা তারা রেকর্ডের সাথে মিলালেই বুঝতে পারবে। অতএব তারা নিশ্চিত হয়ে অথবা নিশ্চিত হবার জন্যে অবশ্যই এখানে ছুটে আসবে’।
কথা শেষ হবার সংগে সংগেই ফিলিপ উঠে দাঁড়াল। আবদুর রহমানকে লক্ষ্য করে বলল, ড্রাইভারদের গাড়ি বের করতে বল। জেনের গাড়িও।
ফিলিপ ছুটে ওপরে গেল।
‘আচ্ছা মুসা ভাই, আপনার চিন্তা কি রকেটের গতিতে চলে? কোন কিছুই কি আপনার নজর এড়ায় না?’ বলল যিয়াদ।
‘টেলিফোনের ব্যাপারটা বলছ তো? ওটা তো একটা সাধারণ ব্যাপার ছিল’।
‘কিন্তু আপনি না বললে এর মধ্যে কোন অস্বাভাবিক বা ক্ষতিকর কিছু খুঁজে পেতাম না’। বলল জোয়ান।
‘এখন বলছ পেতেনা, কিন্তু দায়িত্বে থাকলে অবশ্যই পেতে’। হেসে বলল আহমদ মুসা।
‘শুধু দায়িত্বের কারণে এ জ্ঞান আসে না, এমন জ্ঞান যাদের আছে তারাই দায়িত্বে আসে’। বলল যিয়াদ।
‘মৌলিক ভাবে তোমার এ কথা ঠিক যিয়াদ। কিন্তু দায়িত্বে গেলে জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা প্রসারিত হয়’। বলল আহমদ মুসা।
ফিলিপ তার লোকদের সাথে কিছু জিনিসপত্র নিয়ে নেমে এল।
সবাই মিলে চারটি গাড়িতে চেপে একে একে চলে গেল। সর্বশেষ গাড়িতে আহমদ মুসা ও ফিলিপ।
তিনটি গাড়ি চলে গেল।
আহমদ মুসাদের গাড়ি ফিলিপের বাড়ীর বিপরীত পাশের পার্কিংটায় গিয়ে দাঁড়াল।
আহমদ মুসাদের খুব বেশী বসতে হলো না।
ঘন্টা খানেকের মধ্যেই চারটি পিক-আপ ফিলিপের বাড়ীর কিছুটা দুরে এসে দাঁড়াল। তারপর পিকআপ থেকে নেমে এল প্রায় চার ডজন সামরিক লোক। তারা ছুটে গিয়ে ঘিরে ফেলল বাড়ী। আহমদ মুসা ও ফিলিপ দুজনেই দূরবীনে এ দৃশ্য দেখল।
‘আপনার জ্ঞান সামান্য ভুল করলে এখন কি ঘটত মুসা ভাই। ইদুর ফাঁদে পড়ার মতই আমরা ফাঁদে পড়তাম’। হেসে বলল ফিলিপ।
‘চল আমাদের কাজ শেষ, ওরা খুঁজে মরুক, আমরা চলে যাই’।
ফিলিপ স্টার্ট দিল গাড়িতে।
পার্কিং থেকে বেরিয়ে গাড়ী ছুটল ফিলিপের নতুন বাড়ির দিকে।

ভাসকুয়েজ ভীষণ উত্তেজিত।
পায়চারি করছে তার অফিসে। ঘরের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত পর্যন্ত। দু’টি হাত তার পেছনে মুষ্টিবদ্ধ।
সন্ধ্যায় খবর পাওয়ার পর থেকে পাগলের মত হয়ে গেছে ভাসকুয়েজ।
Euro World News Agency (ইউরো ওয়ালর্ড নিউজ এজেন্সী-EWNA) এর প্যারিস অফিসের কু-ক্ল্যাক্স-ক্ল্যানের একজন এজেন্ট ভাসকুয়েজকে টেলিফোনে সব জানিয়েছে। বলেছে, সমস্ত ডকুমেন্ট এজেন্সী কর্তৃপক্ষের কাছে পৌঁছেছে। কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্ত অনুসারে পূর্ণাঙ্গ রিপোর্ট তৈরী হয়ে ট্রান্সমিশন এডিটরের কাছে এসেছে।
খবরটা জানার পর ভাসকুয়েজের কাছে পরিষ্কার হয়েছে, কি ঘটতে যাচ্ছে। EWNA নিউজটি ক্রিট করার অর্থ বিশ্বের সমস্ত দৈনিকে তা প্রকাশিত হবে এবং স্পেনে মুসলিম স্থাপনা ও ঐতিহাসিক স্থানগুলো ধ্বংস করার কু-ক্ল্যাক্স-ক্ল্যানের ষড়যন্ত্র গোটা দুনিয়ায় ফাঁস হয়ে যাবে। তাতে তাদের উদ্দেশ্যই শুধু মাঠে মারা যাবে না, কু-ক্ল্যাক্স-ক্ল্যান বিশ্বব্যাপী নিন্দিত হবে, এমনকি স্পেন সরকারের রোষদৃষ্টিতে পড়বে তারা। এ অবস্থা ঠেকাবার একমাত্র পথ EWNA কে ঐ খবর প্রচার থেকে বিরত রাখা।
সন্ধ্যার পর থেকে ভাসকুয়েজ এই চেষ্টাই করেছে। আমেরিকায় কু-ক্ল্যাক্স-ক্ল্যানের সাহায্য চেয়েছে সে। আমেরিকান কু-ক্ল্যাক্স-ক্ল্যান এর প্রধান বিশ্ব ইহুদি কংগ্রেসের সভাপতি আইজাক আব্রাহামকে ধরেছে। আইজাক আব্রাহাম কথা দিয়েছে, EWNA এর চেয়ারম্যান মিখাইল এ্যাঞ্জেলোকে বলে দেবে যেন নিউজটি EWNA থেকে প্রচার না করা হয়। আইজাক আব্রাহাম কি করল কি করতে পারল তারই অপেক্ষা করছে ভাসকুয়েজ। ভাসকুয়েজের আশা জাগছে, EWNA-এর প্রধান মিখাইল বিশ্ব ইহুদি কংগ্রেসের সভাপতির কথা নিশ্চয় ফেলতে পারবে না।
ওদিকে ভীষণ অবস্থা তখন EWNA –এর সদর দফতরে।
বিশ্ব ইহুদি কংগ্রেসের সভাপতির টেলিফোন পাওয়ার পর মাথায় ঘাম দেখা দিল EWNA এর প্রধান মিখাইল এ্যাঞ্জেলোর। নিউজ তো অলরেডি ট্রান্সমিশন টেবিলে চলে গেছে। ওটাকে ফিরাবে কোন যুক্তিতে। আর এতবড় চাঞ্চল্যকর নিউজ EWNA তার জীবনে পায়নি। অন্যদিকে আইজাক আব্রাহামের অনুরোধ ফেলবে কি করে। তার অনুরোধ অনেকটা নির্দেশের মতই।
মিখাইল এ্যাঞ্জেলো ঠিক করলো একা এ সিদ্ধান্ত সে নেবে না। সাংবাদিকদের বুঝাবার প্রশ্ন আছে। তাদের মধ্যে যারা প্রফেশনাল এবং তার সংবাদ সংস্থার প্রাণ, তারা ঐ নিউজ পেয়ে আকাশের চাঁদ পাওয়ার মত খুশী হয়েছে।
বোর্ডের মিটিং বসল রাত আটটায়।
EWNA-এর পরিচালনা বোর্ডের মিটিং। মিটিং-এ মিখাইল সব ঘটনা উপস্থাপন করল।
পরিচালনা বোর্ডের সদস্য ৭ জন। সদস্যদের প্রত্যেকেই ইউরোপের শীর্ষস্থানীয় ধনকুবের ও রাজনীতিক।
সব শুনে জার্মানীর হেনরী হারজল বলল, ‘মিটিং না ডেকেও চেয়ারম্যান নিউজ বন্ধ করে দেবার সিদ্ধান্ত নিতে পারতেন। কারণ আইজাক নিষেধ করার পর এ নিউজ সার্ভিসে দেয়া যায় না। কিন্তু মিটিং ডাকা দেখে আমার মনে হচ্ছে, চেয়ারম্যান বোধ হয় আইজাকের অনুরোধের ব্যাপারে অন্য রকম চিন্তা করছেন’।
থামল হেনরী হারজল।
হেনরী হারজল থামতেই কথা বলে উঠল জার্মানীরই আরেকজন সদস্য হের গোয়োরং। বলল, সম্মানিত সদস্য হারজলের কথা শুনে মনে হচ্ছে আইজাকের কথাই যেন EWNA-এর জন্যে শেষ কথা। কিন্তু তা কিছুতেই হতে পারে না। আমাদেরকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে EWNA –এর স্বার্থ সামনে রেখে। যেহেতু বিষয়টা দু’দিক থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, তাই সম্মানিত চেয়ারম্যান সাহেব মিটিং ডেকে যথার্থ দায়িত্ব পালন করেছেন’।
‘মনে হয় কোন তর্কে না গিয়ে বিষয়টা সম্পর্কে বস্তুনিষ্ঠ মূল্যায়ন করে আমাদের সিদ্ধান্ত দেয়া উচিত। বিষয়টা আসলেই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নিউজের দিকে থেকে এমন মূল্যবান নিউজ EWNA কখনও পায়নি। আবার EWNA আইজাকের মত লোকের কাছ থেকে এমন অনুরোধ কখনও পায়নি। আমি সম্মানিত সদস্যদের সুচিন্তিত মত দেবার জন্যে অনুরোধ করছি’। বলল EWNA এর চেয়ার্যম্যান মিখাইল।
এবার কথা বলল ফ্রান্সের পিয়েরো মিঁতেরা। বলল, ‘সংবাদ সংস্থা হিসেবে নিউজ পেয়েছি, তা আমরা প্রচার করবো, এটাই আমাদের দায়িত্ব, গ্রাহকদের কাছেও এটা আমাদের কমিটমেন্ট। এখন দেখতে হবে প্রথমঃ নিউজটা নির্ভরযোগ্য কি না, দ্বিতীয়তঃ ছাপলে কি কি মন্দ দিক আমাদের জন্যে আছে। এ দু’দিকের বিচার করেই আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আমার মত হলো, নাম কিনতে যেয়ে যদি আমরা ক্ষতির মধ্যে পড়ি, তা’হলে আমরা নিউজ প্রচার থেকে বিরত থাকতে পারি’।
বৃটেনের সদস্য জেমস কিট বলল, ‘আমি পিয়েরেকে সমর্থন করছি। ক্ষতিকর দিকগুলোই আমাদের বিশেষ ভাবে বিবেচনা করতে হবে। আমাদের সংবাদ মাধ্যম একদিকে ব্যবসায়, অন্যদিকে আমাদের রাজনীতিও। ব্যবসার অর্থ এর মাধ্যমে আমরা লাভ করতে চাই, লাভ করার জন্যে এর ক্রমবর্ধমান প্রসার চাই। আর আমাদের রাজনীতির অর্থ হলো, আমাদের ইউরোপ, আমাদের পাশ্চত্যের স্বার্থের সংরক্ষণ আমরা করতে চাই। এই রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে আলোচ্য নিউজটি আমাদের মিত্রদেশ স্পেন এবং স্পেনের খৃষ্টান জনগণের ক্ষতি করবে। আমাদের জাতীয়তাবাদী ও জাতির সেবায় নিবেদিত কু-ক্ল্যাক্স-ক্ল্যানের ভীষণ ক্ষতি করবে। সম্ভবত আইজাক এই দিক গুলো সামনে রেখেই অনুরোধ করেছেন। রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে এ অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করা কঠিন। কঠিন নানা কারণে। বাস্তবতা হলো, আমাদের কোম্পানী যে ব্যাংকিং সুবিধা পাচ্ছে, তা বন্ধ করার ক্ষমতা আইজাক রাখেন, এ কথা আমরা সকলেই জানি। দ্বিতীয়তঃ আইজাক চাইলে EWNA-কে অচল করে দিতে পারেন। সকলেরই জানা আছে, আমাদের সংবাদ সংস্থার ৬০ভাগ সদস্য ইহুদি। তারা ঐক্যবদ্ধ এবং সক্রিয়। সুতরাং আইজাককে ক্ষেপালে আমাদের কোম্পানীর চাকাই অচল হয়ে যাবে। অন্যদিকে লাভটা হবে এই, গ্রাহকদের কাছে আমাদের সুনাম বাড়বে, ব্যবসায়ের সম্প্রসারণও হতে পারে। কিন্তু এই লাভের চেয়ে আমাদের ক্ষতির পাল্লা অনেক ভারি হবে। সুতরাং নিউজটা প্রচার না করার মধ্যেই কল্যাণ রয়েছে।
জেমস কিটের দীর্ঘ বক্তব্য শেষ হতেই হের গোয়েরিং বলল, ‘জেমস যে ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরেছে, তাতে ইহুদিদের স্বার্থরক্ষা করে চলা ছাড়া EWNA –এর আর কোন পথ নেই। এই যদি আমাদের কোম্পানীর ব্যবস্থা হয়, তা’হলে কোম্পানীর ভবিষ্যত নিয়ে ভাবা দরকার। আমাদের ব্যবসায়, আমাদের সংবাদ সংস্থা কোন এক গ্রুপের হাতে জিম্মি হয়ে থাকবে-তা হতে পারে না। কথাটা যখন জেমস তুলেছেই তখন বলতে চাই, ইউরোপে খৃষ্টানদের সংখ্যা ৪শ’ কোটিরও বেশী অথচ এখানে ইহুদিদের সংখ্যা মাত্র ১ কোটি ৪৬ লাখ। অথচ আমাদের কোম্পানীতে ইহুদি জনসংখ্যার হার ৬০ শতাংশ। এটা হলো কি করে?’
গোয়েরিং এর কথা শেষ হতেই হেনরী হারজল গোয়েরিং-এর তীব্র প্রতিবাদ করে বলল, ‘গোয়েরিং সাম্প্রদায়িক প্রশ্ন তুলেছে। নাজীদের কবর হওয়ার পর এ সাম্প্রদায়িক প্রশ্নেরও কবর হয়েছে। যোগ্যতার ভিত্তিতেই আমাদের কোম্পাণীতে লোক রিক্রুট হয়, এতে আপত্তি করার কিছু নেই।’
‘যোগ্যতা ইহুদিদের মনোপলি আমি তা মানিনা। হারজল সাম্প্রদায়িকতার কবর হওয়ার কথা বলেছেন, কিন্তু আমি বলব যে বৈষম্য আমরা দেখছি, তা সাম্প্রদায়িকতাকে কবর থেকে আবার টেনে তুলবে। কোথাও কোথাও হয়েছে তা হারজল স্বীকার করবেন। সুতরাং উল্লেখিত ক্ষতির ও আমাদের ব্যবসায়িক সততার দৃষ্টিকোণ থেকে সিদ্ধান্ত নেয়া হোক।’ বলল আবার গোয়েরিং।
কথা বলল ইটালির সদস্য আলফন সো। বলল, ‘আমি গোয়েরিং এর প্রস্তাবের প্রশংসা করছি। কিন্তু অস্তিত্বের প্রশ্ন যেখানে, সেখানে সততার প্রশ্ন তুলে লাভ নেই। তাছাড়া আরেকটা প্রশ্ন আমাদের বিবেচ্য, এ নিউজ প্রচার থেকে প্রকৃত অর্থে লাভবান হবে মুসলমানরা, ক্ষতিগ্রস্ত হবে স্পেনের খৃষ্টান স্বার্থ। এ সরল হিসেব থেকেই আমরা সিদ্ধান্ত নিতে পারি।’
আলোচনা চলল আরও। যুক্তি, পাল্টা যুক্তি উঠল অনেক। অবশেষে সিদ্ধান্ত হলো নিউজ প্রচার না করার।
মিটিং তখনও শেষ হয়নি। তর্ক-বিতর্ক শেষে তাদের স্বাস্থ্যপান চলছে।
রাত তখন ৯টা ৩০ মিনিট।
একটা নোট এল EWNA-এর প্রশাসকের হাত থেকে মিখাইলের হাতে।
নোটটা পড়ল মিখাইল।
পড়তে পড়তে তার চেহারা মলিন হলো।
নোট থেকে মুখ তুলে মিখাইল বলল, ‘আমাদের মিটিং এখনও শেষ হয়নি। নতুন একটা ডেভলাপমেন্ট আছে ঐ নিউজ সম্পর্কে। আপনারা চাইলে বিষয়টা আমি মিটিংয়ে পেশ করতে পারি।’
সবাই একবাক্যে সম্মতি দিল।
মিখাইল বলল, ‘কথা ছিল ৮টা থেকে ৯টার মধ্যে আমরা নিউজটা প্রচার করব।’
মাঝখান থেকে হারজল প্রশ্ন করল, ‘কার সাথে কথা হয়েছিল?’
মিখাইল মুখ তুলে হারজলের দিকে একবার দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলল, ‘আমাদের সোর্সের সাথে এই কথা হয়েছিল।’
উত্তর দেয়ার পর একটু থেমে আবার মিখাইল শুরু করল, ‘৯টার সময় সীমা পার হবার পর নিউজ প্রচার হতে না দেখে তারা জানতে চেয়েছে আমরা কি সিদ্ধান্ত নিয়েছি। রাত ১০টার মধ্যে যদি কিছু না জানাই, তা’হলে তারা ধরে নেবে আমরা নিউজটা প্রচার করছিনা। সে ক্ষেত্রে তাদের অন্য একটা এজেন্সীর সাথে কথা হয়েছে তারা নিউজটা আজই প্রচার করবে। রাত দশটার পর ওদেরকেই ডকুমেন্ট দিয়ে দেয়া হবে। সেই সাথে ওয়ার্ল্ড প্রেসকে তারা জানিয়ে দেবে যে, EWNA নিউজটি করার পরও ট্রান্সমিশন টেবিলে তা পাঠাবার পরও ইহুদী ও ক্লু-ক্ল্যাক্স-ক্ল্যানের চাপে নিউজটি প্রচার করেনি।’
থামল মিখাইল।
সে থামতেই হারজল বলল, ‘সে সংবাদ সংস্থা কোনটা যাদের সাথে ওদের কথা হচ্ছে?’
‘আমি জানি না, তবে অনুমান করতে পারি সে সংস্থা WNA (World News Agency) অথবা TWNA (Third World News Agency) হবে। আমরা চাপে পড়ে নিউজটা গ্রহণ করিনি জানলে WNA নিউজটা লুফে নেবে।’ বলল মিখাইল।
‘তাতে আমাদের কি ক্ষতি হবে?’ জিজ্ঞাসা করল আলফন সো।
‘ক্ষতি হবে, আমাদের বার্তা সংস্থাকে ইহুদী এবং ক্লু-ক্ল্যাক্স-ক্ল্যানের মত হিংসাত্মক সংগঠনের স্বার্থের সংরক্ষক বলে ধরে নেয়া হবে, যা আমাদের নিরপেক্ষতা ও সুনামকে ধুলিস্মাৎ করে দেবে।’ মিখাইল বলল।
‘শুধু তাই না, গোটা ‘থার্ড ওয়ার্ল্ড’ এর দেশগুলো থেকে আমাদের পাততাড়ি গুটাতে হবে।’ বলল গোয়েরিং। সে আরও বলল, তাছাড়া একটা কথা আমাদের ভাববার বিষয়। সেটা হল, আমরা নিউজটা প্রচার না করলেও তা বন্ধ থাকছেনা। কেউ না কেউ তা প্রচার করবেই যখন, তখন আমরা পেছনে থাকব কেন?
একমাত্র হারজল ছাড়া সকলেই বলল, ‘গোয়েরিং এর কথায় যুক্তি আছে। একটা আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থা কোন গ্রুপের স্বার্থ রক্ষাকারী বলে চিহ্ণিত হলে সংবাদ সংস্থাটির ভূমিকা অকার্যকর হয়ে পড়বে। নিউজটি যখন প্রচার হচ্ছেই, তখন আমরা তা করলেই ভাল।’
‘যদি তা করতেই হয়, চেয়ারম্যান সাহেব আইজাক আব্রাহামের সাথে আলোচনা করুন। আমাদেরকে বাস্তববাদী হতে হবে।’ বলল হারজেল।
হের গোয়েরিং ছাড়া সকলেই হারজলকে সমর্থন করল। গোয়েরিং বলল, ‘একটি স্বাধীন সংস্থার সিদ্ধান্তকে বাইরের একজন লোকের মতামত নির্ভর করে তোলা আমি ঠিক মনে করিনা।’
শেষে বিশ্ব ইহুদী কংগ্রেসের সভাপতি আইজাক আব্রাহামের সাথে আলোচনা করারই সিদ্ধান্ত হলো।
মিখাইল তুলে নিল টেলিফোন।
সংগে সংগেই পাওয়া গেল আইজাক আব্রাহামকে।
সংক্ষেপে ঘটনা বলার পর মিখাইলের সাথে কথা শুরু হলো আইজাক আব্রাহামের।
‘সব তো শুনলেন এখন বলুন কি করা যায়।’ বলল মিখাইল।
‘আপনারা কি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন?’
‘আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি নিউজটা প্রচার না করার।’
‘সিদ্ধান্তের উপর অটল থাকুন, এটাই আমার কথা।’
‘কিন্তু নিউজটা তো বন্ধ হচ্ছে না। তাছাড়া আমরা বিরাট অপপ্রচারের সম্মুখীন হব।’
‘নিউজটা প্রচার হওয়ার কথা ওদের একটা ব্লাফও হতে পারে। পশ্চিমের সংবাদ মাধ্যম এটা প্রচার করবে বলে মনে হয় না। WNA এর সাথে আমাদের সম্পর্ক ভাল না, কিন্তু ওখানে আমার লোকরাই মেজরিটি মনে রেখ। আমি ছাড়বোনা ওদের।’
‘কিন্তু ব্যাপারটা আপনার ব্যক্তিগত ভাবে নেয়া কি ঠিক হচ্ছে?’
‘ব্যক্তিগত ভাবে তো নয়, আমি জাতীয় ভাবে নিয়েছি। কু-ক্ল্যাক্স-ক্ল্যান আমার বন্ধু সংগঠন। কারণ তারা লড়াই করছে আমার শত্রুর সাথে। ঐ নিউজটা প্রচার হলে আমার বন্ধু ক্ষতিগ্রস্ত হবে, লাভবান হবে আমার শত্রু। ইহুদী ও খৃষ্টানদের শত্রুকে EWNA সাহায্য করবে?’
‘প্রশ্নটা সাহায্য করার নয়, প্রশ্ন হলো, নিউজটা যখন বন্ধ করা যাচ্ছে না, তখন আমরা প্রচার করার মধ্যে ক্ষতি কতটুকু।’
‘শত্রুকে সাহায্য করা কি ক্ষতি নয়? পশ্চিমী একটা সংবাদ মাধ্যম এ আত্মঘাতি কাজ করবে কেন?
‘স্যরি, মিঃ আইজাক, আমরা ব্যাপারটাকে ঐ দৃষ্টিতে দেখছিনা।
‘কি দৃষ্টিতে দেখছেন? সাংবাদিকতার দৃষ্টিকোণ থেকে? এ সাংবাদিকতা কোত্থেকে পেয়েছেন? কিভাবে চালাচ্ছেন তা একবার মনে করুন মিঃ মিখাইল।’
‘থ্যাংকস মিঃ আইজাক, আপনার কথা আমি বুঝেছি, আমার বোর্ডকে আমি তা বলব।’
‘থ্যাংকস মিঃ মিখাইল’ বলে আইজাক তার টেলিফোন রেখে দিল।
মিখাইলও টেলিফোন রাখল। তার মুখ গম্ভীর। আইজাকের শেষ কথায় মিখাইল দারুণভাবে অপমান বোধ করেছে।
আইজাক শেষে যা বলেছেন তা মিখাইল বোর্ডকে জানাল।
একমাত্র হারজল ছাড়া সকলের মুখেই একটা অস্বস্থি ফুটে উঠল। আইজাকের ক্ষমতা আছে, তবে তা এইভাবে প্রকাশ করা শোভন হয়নি। উত্তেজিত হয়ে উঠল গোয়েরিং। বলল, আইজাক যত বড়ই হোন, একটা সংবাদ সংস্থার চীফের সাথে এই ভাবে কথা তিনি বলতে পারেন না।’
মিখাইল গোয়েরিংকে শান্ত হবার অনুরোধ করে বলল, ‘আমি জানি আইজাক অত্যন্ত ক্ষমতাশালী, তার সাথে ঝগড়া করে আমরা ব্যবসা চালাতে পারব না। অন্যদিকে এরপর চেয়ারম্যান হিসেবে তার সাথে আলাচনায় যাওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। সুতরাং আমি এই মুহূর্ত থেকে পদত্যাগ করছি।’
হেনরি হারজল ছাড়া অন্য সবাই মিখাইলের এই কথার পর বলল, ‘এ অপমান আপনার নয় চেয়ারম্যান, গোটা কোম্পানী অপমানিত হয়েছে, আমরা অপমানিত হয়েছি। আপনি যদি পদত্যাগ করেন, তাহলে আমাদেরও পদত্যাগ করতে হবে।’
‘দেখুন, আমরা ব্যবসা করছি। মাথা গরম করলে চলবে না। দেখি আমি আলোচনা করছি আইজাকের সাথে।’ বলল হারজল।
একটু থেমেই উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে হারজল বলল, ‘মাফ করুন আমাকে, আমি একটু একান্তে তার সাথে আলোচনা করতে চাই। তাকে মতে আনতে হবে।’
বলে হারজল টেলিফোন করার জন্য পাশের কক্ষে চলে গেল।
ফিরে এল মিনিট দশেক পরে।
মুখে হাসি। বলল, মধ্যবর্তী একটা ব্যবস্থা হয়েছে। ১০টার মধ্যে আমরা সোর্সকে কিছু জানাবোনা। তাতে তারা বুঝবে আমরা নিউজ প্রচার করছিনা। এরপর যা তারা বলেছে সেই মোতাবেক অন্য নিউজ এজেন্সীকে তারা ডকুমেন্টগুলো দেবে। যদি দেয়, নিশ্চয় সে এজেন্সী নিউজ প্রচার করবে। সেটা দেখার পর আমরাও নিউজটা প্রচার করব।’
‘আমরা তো তা’হলে পেছনে পড়ে যাব।’ বলল গোয়েরিং।
‘ঠিক আছে ক্ষতি নেই একটু পেছনে পড়লে’, বলল মিখাইল।
মিখাইলের মুখে হাসি। বলল, ‘ভয় নেই গোয়েরিং WNA এবং EWNA, নিউজ তাদের টেলিপ্রিন্টারে তোলার সংগে সংগেই আমি জানতে পারব। আমাদের সব রেডি আছে। আমরা খুব পেছনে পড়ব না।’
‘মিখাইল তা’হলে গোয়েন্দা পুষছ না?’ বলল জেমস কিট।
‘ব্যবসায় আজ একটা কঠিন প্রতিযোগিতা। রাজনৈতিক প্রতিযোগিতায় গোয়েন্দা পুষলে, ব্যবসায়িক প্রতিযোগিতায় গোয়েন্দা থাকবে না কেন?’
সবাই হেসে উঠল।
মিটিং শেষ হলো।
হাসি মুখে বেরিয়ে এল সবাই। শুধু ইহুদী হেনরী হারজলের মুখটাই ভার।

এদিকে ভাসকুয়েজ এয়ারকন্ডিশন ঘরে বসে ঘামছে।
রাত তখন ২ টা।
ইন্টারকমে অফিস প্রশাসক ভেগাকে আসতে বলল।
ভাসকুয়েজের চুল উস্কো-খুস্কো।
চোখ দু’টি লাম।
টেবিলের সামনে কয়েকটি ট্রাভেল ব্যাগ ঠিক ঠাক করে রাখা।
টেবিলের ওপর টেলিপ্রিন্টারে আসা নিউজের স্তুপ। নিউজগুলো তার তেজস্ক্রিয় ডকুমেন্ট গুলোর ওপর। WNA এবং EWNA দু’টি সংবাদ সংস্থাই নিউজ করেছে।
রাত ৮টা থেকে ৯টা পর্যন্ত নিউজ EWNA করলনা। ভাসকুয়েজ তখন খুশি হয়ে উঠেছিল। ভেবেছিল তার লবী কাজ দিয়েছে। কিন্তু রাত ১১ টায় তাকে বিস্মিত করে নিউজ প্রচার শুরু করে WNA এর পনর মিনিট পর EWNA এর টেলিপ্রিন্টার নিউজ আসতে থাকে।
একেবারে আকাশ থেকে পডে ভাসকুয়েজ।পশ্চিমে সংবাদপত্রসহ বিশের সংবাদ পত্র খবরটা ছাপাবে। আর এর প্রতিক্রিয়া কি হবে তা সে ভালো করেই জানে। ইতিমধ্যেই ভাসকুয়েজ খবর পেয়েছে জাতিসংঘে ডকুমেন্ট গুলো পৌছেছে। খোদ ও আই সি এ ব্যাপারে লবী করেছে। তার সাথে যোগ দিয়েছে জাতিসংঘের থার্ডওয়ার্ল্ড গ্রুপ। অর্থাৎ ভীষণ হৈ চৈ হবে বিষয়টা নিয়ে। ভাসকুয়েজের সব চেয়ে বড় ভয় স্পেন সরকারের প্রতিক্রিয়াকে। স্পেন সরকার নিজে অপবাদ থেকে বাঁচার জন্য কু-ক্ল্যাক্স-ক্ল্যানের ওপর খড়গ হস্ত হবে। সবচেয়ে বড় টার্গেট হবে ভাসকুয়েজ।
এসব ভেবে চিন্তে ভাসকুয়েজ দেশ ত্যাগের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তার পরিবার ইতিমধ্যে বিমান বন্দরে পৌঁছে গেছে। ঘরে ঢুকল ভেগা। দাঁড়াল টেবিলের সামনে।
ভাসকুয়েজ চোখ তুলল তার দিকে।
‘শুনেছ তো আমি দেশের বাইরে যাচ্ছি। আমরা একটা বিপর্যয়ের মধ্যে পড়েছি। অবস্থা ভালো হলে আমি ফিরে আসব।’
একটা ঢোক গিলল ভাসকুয়েজ। তারপর শুরু করল, ‘তোমাদের কোন অসুবিধা হবে না। আমি টাকার ব্যবস্থা করে গেলাম। একাঊণ্টেণ্ট তোমাদের যখন যা প্রয়োজন দেবে। আর অফিস থেকে মুল্যবান জিনিসপত্র আজকেই সরিয়ে নাও। কাল থেকে অফিস বন্ধ থাকবে।’
বলে উঠে দাড়াল ভাসকুয়েজ। বলল বেয়ারাকে পাঠিয়ে ব্যাগগুলো গাড়িতে দাও।
বেরিয়ে এল ভাসকুয়েজ।
ক’মিনিট পর কু-ক্ল্যাক্স-ক্ল্যানের সদর দপ্তর থেকে একটা গাড়ি বেরিয়ে বিমান বন্ধরের উদ্দেশ্যে ছুটল।

Top