১৫. আবার সিংকিয়াং

চ্যাপ্টার

আলমা আতা বিমান বন্দরে আহমদ মুসাকে স্বাগত জানাল মুসলিম মধ্যএশিয়া প্রজাতন্ত্রের প্রেসিডেন্ট কর্ণেল মুহাম্মদ কুতায়বা। আহমদ মুসাকে স্বাগত জানাবার জন্যেই কুতায়বা ছুটে এসেছে রাজধানী তাসখন্দ থেকে আলমা আতায়।
ফরাসী বিমানটি থামার পর বিমানে সিড়ি লাগার সঙ্গে সঙ্গে কুতায়বা তরতর করে সিঁড়ি ভেঙে উঠে গিয়েছিল বিমানে।
আহমদ মুসা সবে উঠে দাঁড়িয়েছিল।
কুতায়বা গিয়ে জড়িয়ে ধরল আহমদ মুসাকে।
বিমানের সব লোকই উঠে দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু যেহেতু প্রেসিডেন্ট বিমানে উঠেছেন, তাই তিনি না নেমে যাওয়া পর্যন্ত সকলের অবতরণ বন্ধ করে দেয়া হল।
একদিকে সিংকিয়াং এর ঘটনার আকস্মিকতা, অন্যদিকে বহুদিন পর আহমদ মুসাকে পেয়ে আবেগে কেঁদে ফেলল প্রেসিডেন্ট কুতায়বা।
বিমানের সব লোক হা করে দেখছিল ব্যাপারটা। তারা ভেবে পাচ্ছিলনা, প্রেসিডেন্ট যাকে ধরে কাঁদছেন, সাধারণ সারির এই অসাধারণ লোকটি কে?
আহমদ মুসা প্রেসিডেন্ট কুতায়বাকে সান্ত্বনা দিয়ে, পিঠ চাপড়ে বলল, ‘ভুলে যেয়ো না, তুমি এখন একটা স্বাধীন, সার্বভৌম দেশের প্রেসিডেন্ট। সব কাজ তোমার সাজে না।’
‘ওসব আমি জানি না। আমি আপনার একজন কর্মী।’
‘ঠিক আছে, চল যাই। মানুষকে আটকে রেখে লাভ নেই।’
বলে আহমদ মুসা কুতায়বাকে টেনে নিয়ে চলতে শুরু করল।
বিমানের সিঁড়ি থেকেই আহমদ মুসা দেখল, বিমানের সিঁড়ির মুখ থেকেই তার পুরানো সহকর্মীদের দীর্ঘ সারি। আহমদ মুসা কুতায়বাকে বলল, ‘এ তুমি কি করেছ কুতায়বা? সবাইকে এভাবে ডেকে এনেছ কেন?’
‘আমি একজনকেও ডাকিনি। হাওয়া থেকে জেনে ওরা ছুটে এসেছে। আমি যদি এ সুযোগ তাদের না দিতাম, তাহলে আমার প্রেসিডেন্টশীপই চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতো।’
আহমদ মুসা বিমানের সিঁড়ি থেকে নেমে সকলকে সালাম জানিয়ে দু’পাশের সবার সাথে হাত মিলিয়ে এগিয়ে চলল। আবেগে সবাই ভারাক্রান্ত, সবার চোখে পানি। আহমদ মুসার মুখে হাসি, কিন্তু তার চোখ থেকেও পানি গড়াচ্ছে।
আহমদ মুসা লাউঞ্জে এসে কুতায়বাকে বলল, ‘হরকেসে যাবার ব্যবস্থা রেডি তো কুতায়বা?’ হরকেস সিংকিয়াং এর উসু-উতাই রাস্তার মুখে মধ্যএশিয়া মুসলিম প্রজাতন্ত্রের কাজাখ প্রদেশের শেষ সীমান্ত শহর। এ সীমান্ত শহর থেকে উতাই-উসুর পথে সিংকিয়াং-এ প্রবেশ করা আহমদ মুসার পরিকল্পনা।
‘সব ব্যবস্থা রেডি মুসা ভাই, কিন্তু আমার ওখানে আপনার যেতে হবে। ওখানে শিরীন শবনম, রোকাইয়েভা, আরও কত কে যে এসেছে! আর বিশ্রাম না নেন, একটু কিছু মুখে দেবেন তো।’
‘জানি ছাড়বেনা। ঠিক আছে চল।’
‘আহমদ মুসারা বিমান বন্দর থেকে বেলা তিনটার দিকে বেরুলো। আশা করছিল আসরটা পড়েই কুতায়বার ওখান থেকে বেরিয়ে পড়বে। কিন্তু মাগরিবের নামাজের আগে কিছুতেই বেরুতে পারলো না।
আলোচনার সময় কুতায়বা রাষ্ট্র পরিচালনা বিষয়ে নানা কথা তুললো। সে সবের জবাব আহমদ মুসাকে দিতে হলো। এ এমন এক আলোচনা যার শেষ নেই। শেষ হয়তো হতো না। কিন্তু ভেতর থেকে কুতায়বার স্ত্রী শিরীন শবনম, আহমদ মুসার অভিভাবকত্বেই যাকে আহমদ মুসা কুতায়বার সাথে বিয়ে দিয়েছিল। বলল, ‘ভাইয়া এসেছেন কয়েক মুহূর্তের জন্যে, তার মাথায় কি এভাবে সমস্যা না চাপালে নয়! একটু বিশ্রাম নিতে দাও তাকে।’
‘বাঃ, আমি সমস্যা চাপাচ্ছি, না উনি আমার মাথায় সমস্যা চাপিয়ে গেছেন। আর তুমি জান না, কাজই তো ওঁর বিশ্রাম দেয়না।’
‘কাজ যদি বিশ্রাম না দেয়, তাহলে কাজের মধ্যেই বিশ্রাম খোঁজা ছাড়া উপায় কি থাকে?’
‘তাহলে ‘কাজ পাগল’ কথাটার কোন ভিত্তি নেই মনে কর?’
‘এ নিয়ে আমি তর্ক করব না। ওঁকে বলুন, যুবায়েরভের স্ত্রী রোকাইয়েভা এবং ফারহানা আপার ভাবী এখানে আমার সাথে আছেন। ওঁকে সালাম দিয়েছেন।’
ফারহানার নাম শুনার সাথে সাথে আহমদ মুসার মুখটা ম্লান হয়ে গিয়েছিল। আহমদ মুসার সাথে বিয়ের আগের রাতে আহমদ মুসা কিডন্যাপ হয় এবং ফারহানাও খুন হয়।
আহমদ মুসা ‘ওয়া আলাইকুমুস সালাম’ বলে সালাম গ্রহণ করে বলল, ‘আপনারা কেমন আছেন? আব্দুল্লায়েভ ও যুবায়েরভকে আমার কাজে সিংকিয়াং এ পাড়ি জমাতে হয়েছে, এজন্যে কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি আমি আপনাদের কাছে।’
‘না, ওটা আপনার কাজ নয়, আমাদের কাজ। অবশ্য যদি আপনি আমাদেরকে আপন ভাবেন।’ এক সাথে বলে উঠে ফারহানার ভাবী ও রোকাইয়েভা।
‘ধন্যবাদ, আমি কথা ফিরিয়ে নিচ্ছি।’
‘আমি ফারহানার ভাবী, আপনি যাবেন না আর আমাদের গ্রামে বেড়াতে?’ একটু পর ভেতর থেকে কথা বলে উঠল ফারহানার ভাবী।
প্রশ্নটায় কিছুটা আনমনা হয়ে উঠল আহমদ মুসা। তারপর বলল ধীরে ধীরে, ‘যাবার ইচ্ছে হয়, কিন্তু এভাবে বেড়াবার সুযোগ এ পর্যন্ত আমার কখনোই হয়নি ভাবী।’
এভাবে টুকিটাকি আরও কিছু কথা। তার ফাঁকে নাস্তাও হয়ে গেল।
মাগরিব নামাজের পর কাজাখস্তান প্রদেশের সীমান্ত শহর হরকেসে যাবার জন্যে হেলিকপ্টারে উঠল আহমদ মুসা। বিমান বাহিনীর হেলিকপ্টার।
হরকেস পর্যন্ত কুতায়বা আহমদ মুসার সাথে যেতে চেয়েছিল।
কিন্তু কুতায়বার এ ইচ্ছা শোনার পর ধমক দিয়েছে আহমদ মুসা। বলেছে, ‘তুমি তো এখন সেই আগের কর্ণেল কুতায়বা নও। তুমি পারমানবিক শক্তির অধিকারী অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটা মুসলিম দেশের প্রেসিডেন্ট। তোমাকে এতটা ঢিলেঢালা হওয়া চলবেনা।’
ধমক খেয়ে কুতায়বা চুপ করে গেছে। তবে কুতায়বার জেদের ফলে আহমদ মুসা রাজি হয়েছে একজন গোয়েন্দা অফিসারকে সিংকিয়াং অভিযানে সে সাথে নিবে।
হেলিকপ্টারের পাঁচজন ক্রু সকলেই হেলিকপ্টারে ওঠার সময় আহমদ মুসাকে সালাম ও স্যালুট দিয়ে বলল, ‘আমরা আপনার কর্মী স্যার। তাসখন্দে আমরা আপনার সাথে ছিলাম।’
‘ধন্যবাদ, কেমন আছ তোমরা?’
‘ভাল স্যার।’
হেলিকপ্টার আকাশে উড়ল। আহমদ মুসার পাশে সেই গোয়েন্দা অফিসারটি যে আহমদ মুসার সাথে যাবে।
সে অনেকক্ষণ উসখুস করার পর বলল, ‘স্যার আমি জনাব আলদার আজিমভের সাথে কাজ করতাম। আমি আপনাকে দেখেছি।’
‘তাহলে ভালই হলো, আমাদের অভিযানটা আমাদের জন্য আরও আরামদায়ক হবে। ভাল কথা, কুতায়বা রুট প্ল্যানটা কি বলল আমি ভুলে গেলাম।’
‘স্যার সিংকিয়াং এর সীমান্তটা এখন বেশ লুজ। ভোর ৪ টায় আমরা এই হেলিকপ্টারেই আলমা আতাই পাহাড়ের পাশে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ৫ টার মধ্যে আমরা উসু গিয়ে পৌঁছব। একটা জীপ ইতিমধ্যে ওপারে পাঠানো হয়ে গেছে। জীপটি উসুতে আমাদের জন্যে অপেক্ষা করবে।’
‘বেশ ভাল।’
এক ঘন্টা লাগলো হরকেসে পৌঁছতে।
হেলিকপ্টার ল্যান্ড করাল সরকারী রেস্ট হাউজের কম্পাউন্ডে।
রেস্ট হাউজটি বাংলো সাইজের একটি বাড়ি। ভি আই পি কিংবা বিশেষ রাষ্ট্রীয় অতিথিদের জন্যে এই রেস্ট হাউজটি। এর পাশেই দ্বিতীয় আর একটি পাঁচতলা বিশিষ্ট বিশাল রেস্ট হাউজ তৈরী হয়েছে। এখানে সাধারণ অতিথিরা থাকেন।
আহমদ মুসা হেলিকপ্টার থেকে নামার সংগে সংগে হরকেস নগরীর মেয়র ও প্রশাসক এসে অভ্যর্থনা জানাল আহমদ মুসাকে। তারপর আহমদ মুসাকে নিয়ে সে চলল রেস্ট হাউজের ভেতরে।
রেস্ট হাউজের চারদিকে প্রাচীর ঘেরা। এ ভি আই পি রেস্ট হাউজের পশ্চিম পাশে বহুতল বিশিষ্ট সাধারণ রেস্ট হাউজটি। ভি আই পি রেস্ট হাউজটির গেট দক্ষিণ বাউন্ডারী প্রাচীরের সাথে। তার পাশ দিয়েই উত্তর-দক্ষিণ রাস্তা। গেটে দন্ডায়মান স্টেনগানধারী দু’জন প্রহরী। পূর্ব দিকে বেশ বড় কৃত্রিম একটি লেক। লেকের চারদিক ঘিরে বাগান। তাতে মাঝে মাঝে বেঞ্চ পাতা। এলাকাটি সংরক্ষিত, কাঁটা তার দিয়ে ঘেরা। ভি আই পিরাই শুধু এ বাগানে আসে, লেকে তারা সাঁতার কাটে।
ভি আই পি রেস্ট হাউজের উত্তর প্রাচীর ঘেঁষেই একটা টিলা।
মোটামুটি সুন্দর ও সুরক্ষিত ভি আই পি রেস্ট হাউজ।
মেয়র ভদ্রলোক আহমদ মুসাকে নিয়ে রেস্ট হাউজের ভেতর প্রবেশ করল। সাথে সাথে প্রবেশ করল আহমদ মুসার সাথী সেই গোয়েন্দা ভদ্রলোকও।
দো-তলায় একটি সুপরিসর কক্ষে আহমদ মুসার থাকার ব্যবস্থা হয়েছে। পাশের কক্ষেই থাকবেন গোয়েন্দা অফিসার।
কক্ষের দরজার এক পাশে স্টেনগানধারী একজন বসেছিল চেয়ারে। মেয়র আহমদ মুসাদের নিয়ে সেখানে পৌঁছতেই প্রহরী উঠে দাঁড়িয়ে কড়া স্যালুট দিল। কক্ষটির দিকে ইংগিত করে মেয়র বলল, ‘এখানেই আপনি রাতটা থাকবেন স্যার।’
বলে দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করল মেয়র। তার সাথে আহমদ মুসা ও গোয়েন্দা অফিসার।
ঘর দেখিয়ে বলল মেয়র, ‘স্যার, আপনি বিশ্রাম নিন। ঠিক রাত ৯ টায় খাবার আসবে। রাত সাড়ে তিনটায় আপনাকে জাগিয়ে দেব আমি নিজে এসে।’
একটু থেমে ইতস্তত করে বলল, ‘স্যার, আমাকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে আপনাকে অনুরোধ করার জন্যে, আপনি যেন বাইরে না যান।’
‘কেন মেয়র, আমাকে নজর বন্দী করলে নাকি?’
‘মাফ করবেন স্যার, এটা সীমান্ত শহরতো। তাই এ সতর্কতা।’
‘অশুভ কাউকে সন্দেহ কর তোমরা এ শহরে?’
তেমন কোন চিহ্নিত কেউ নেই স্যার। তবে সংখ্যায় যত ক্ষুদ্রই হোক কম্যুনিষ্টরা ভেতরে ভেতরে ষড়যন্ত্র করছে। ক্রিমিনালরা ওদের সহযোগী হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাশিয়া এবং বাইরের কম্যুনিষ্ট গ্রুপ তাদের উৎসাহ দিচ্ছে। তাছাড়া রাশিয়ার জাতীয়তাবাদী সরকারও ভেতরে ভেতরে আমাদের বৈরিতা শুরু করেছে। সব মিলিয়ে সীমান্ত শহরগুলোর ব্যাপারে আমাদের সাবধান থাকতে হবে।’
‘ধন্যবাদ মেয়র। তোমাদের সচেতনতার প্রশংসা করছি।’
বলে আহমদ মুসা বসে পড়ল সোফার ওপর।
সালাম জানিয়ে মেয়র গোয়েন্দা অফিসারকে নিয়ে বেরিয়ে গেল।

হরকেস শহরের উপকণ্ঠে একটি টিলার পাদদেশে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আছে একটা বাড়ি। বাড়িটার বাইরের সব আলো নিভানো। শুধু একটা ঘরের দুইটা ঘুলঘুলি দিয়ে আলোর কিছুটা রেশ দেখা যাচ্ছে।
একটি বেবিট্যাক্সি এসে থামল বাড়ির সামনের রাস্তায়। বেবিট্যাক্সি থেকে নামল একজন লোক। মাঝারি গড়ন। পাহলোয়ানের মত শরীর। প্রশস্ত কাঁধ, প্রকান্ড ছাতি, মুখ দেখে বুঝার উপায় নেই কাজাখ না রুশ।
লোকটি গাড়ির ভাড়া চুকিয়ে বাড়ির সামনের উঠানটি পার হয়ে সেই অন্ধকার বাড়িতে এসে উঠল। বাইরের দরজার সামনে তিনবার নক করল দরজায়। একটু পরেই দরজা খুলে গেল। ঢুকে গেল লোকটি বাড়ির ভেতরে।
বাড়িতে ঢোকার পরেই ড্রইং রুম। সেখান থেকে ভেতরে এগুলে একটি করিডোর। করিডোর উত্তর দক্ষিণ লম্বা। তবে একটু উত্তরে এগুলে করিডোরটির একটি শাখা বাঁক নিয়ে পশ্চিম দিকে গেছে। লোকটি করিডোরের সাথে বাঁক নিয়ে পশ্চিম দিকে এগুলো। একটু এগুতেই একটি দরজা। দরজা খোলাই ছিল। ভেতরে আলো। লোকটি ঢুকে গেল ঘরের ভেতরে।
ঘরটি বিশাল। জানালা সব বন্ধ, তার ওপর ভারী পর্দায় ঢাকা। ঘরের এক পাশে একটি খাট। অন্য পাশে একটা ছোট সেক্রেটারিয়েট টেবিল, তার সাথে একটা রিভলভিং চেয়ার। টেবিল সামনে তিনদিকে ঘিরে খান ছয়েক কুশন চেয়ার।
মধ্য এশিয়া মুসলিম প্রজাতন্ত্রে ‘ফ্র’ এর এটাই প্রথম অফিস। এটাই এখন ওদের হেডকোয়ার্টার। সিংকিয়াং থেকে জেনারেল বরিসই একে পরিচালনা করছে।
ঘরে শয্যাটি শূন্য। কিন্তু টেবিলে বসে আছে একজন লোক। দীর্ঘকায় লোকটি। চেহারায় কাজাখ। শক্ত চোয়াল। চোখে-মুখে একটা ক্রুরতা। বারান্দায় পায়ের শব্দ শুনেই সে মুখ তুলেছিল। আগন্তুককে ঘরে ঢুকতে দেখে চাঙ্গা হয়ে উঠল। সোৎসাহে বলল, ‘এস কিরভ। তোমার জন্যেই আমি অপেক্ষা করছি।’
আগন্তুক এসে সামনের চেয়ারে বসল।
‘কি খবর বল।’ জিজ্ঞাসা করল ঘরের লোকটি। তার নাম নিকোলাস নুরভ। সে কাজাখ কম্যুনিস্ট পার্টির গুপ্ত পুলিশের একজন নিষ্ঠুর চরিত্রের অফিসার। কাস্পিয়ানের উত্তর তীরস্থ কাজাখ শহর গুরিয়েভ এর ত্রাস বলে পরিচিত ছিল সে। তার গোপন সম্পর্ক জেনারেল বরিস-এর ‘ফ্র’ এর সাথে। মধ্যএশিয়া স্বাধীন হবার পর বহুদিন সে পালিয়ে বেড়িয়েছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবার পর জেনারেল বরিসের নির্দেশ অনুসারেই সে এই হরকেস শহরে এসে আড্ডা গেড়েছে। সে এখন হরকেস শহরের ‘ফ্র’ প্রধান।
‘খবর খুব ভালো। আহমদ মুসা এসেছে।’ নুরভের প্রশ্নের জবাবে বলল কিরভ।
‘তুমি শুনেছ, না দেখেছ।’
‘ভি আই পি রেস্ট হাউজের প্রাঙ্গণে হেলিকপ্টার ল্যান্ড করা দেখেছি, মেয়র আহমদ মুসাকে স্বাগত জানিয়ে রেস্ট হাউজে নিয়ে গেল তাও দেখেছি।’
‘কেমন করে বুঝলে সে আহমদ মুসা?’
‘কতবার ফটো দেখেছি। আর এক কপি ফটো তো আমাদের সাথেই রেখেছি।’
কিরভের পুরো নাম কুজনভ কিরভ। সে রুশ বংশোদ্ভুত। তার দাদী ছিল কাজাখ। সেই সূত্রে চেহারায় সে কিছুটা কাজাখ ধাঁচ পেয়েছে। কম্যুনিস্ট সরকারের অধীনে সে একজন গোয়েন্দা কর্মী হিসাবে কাজ করত। তারও কর্মসংস্থান ছিল গুরিয়েভ শহরে। নুরভের সাথে সেই সময় থেকেই তার পরিচয়। মধ্যএশিয়া স্বাধীন হওয়ার পর সে হরকেস-এ পালিয়ে এসে একটা নির্মাণ প্রতিষ্ঠানে চাকুরী নেয়। একদিন হঠাৎ করে নুরভের সাথে তার দেখা। তারপর কিরভ ‘ফ্র’ এর কর্মী হিসাবে কাজ শুরু করল। আজ নুরভ তাকে পাঠিয়ে দিল আহমদ মুসার আসাটা স্বচক্ষে দেখে আসার জন্য।
‘আহমদ মুসার সাথে আর কে আছে?’
‘একজন এসেছে, তবে সে উচ্চ পর্যায়ের কেউ নয় বলেই মনে হয়।’
‘কি করে বুঝলে?’
‘সে আহমদ মুসার সাথে সাথে হাঁটেনি, এমনকি মেয়রের সাথেও নয়। মেয়রের পেছনে পেছনে তাকে যেতে দেখেছি।’
‘তোমার বুদ্ধিকে সাবাস কিরভ।’
কিছু বলতে যাচ্ছিল কিরভ। এমন সময় বারান্দায় পায়ের শব্দ পাওয়া গেল। কিরভ নেমে গেল।
একজন তরুণ এসে ঘরে ঢুকল।
তরুণকে ঢুকতে দেখেই উচ্ছসিত হয়ে উঠল নুরভ। বলল, ‘পিটার, এস এস। তোমাকে নিয়ে খুব উদ্বিগ্ন ছিলাম।’
পিটার ম্লান হেসে বসল এসে চেয়ারে।
পিটার ভি আই পি রেস্ট হাউজের একজন ওয়েটার। সেখানে তার নাম রশিদভ। রশিদভ তার ছদ্ম নাম। এই নামেই সে আলমা আতার ক্যাটারিং ইন্সটিটিউট থেকে ডিগ্রি নেয়ার পর যথারীতি ইন্টারভিউ দিয়ে সে চাকরী পেয়েছে হরকেস এর ভি আই পি রেস্ট হাউজে।
রশিদ অর্থাৎ পিটার নুরভ এর ভাতিজা। নুরভের বড় ভাই অর্থাৎ পিটারের আব্বা ছিল গুরিয়েভ এর কম্যুনিস্ট পার্টির সেক্রেটারী। আর পিটার কিশোর বয়সেই যোগ দিয়েছিল কম্যুনিস্ট যুব সংগঠন কসমোসলে। মধ্যএশিয়া স্বাধীন হওয়ার প্রাক্কালে এক সশস্ত্র সংঘর্ষকালে পিটারের আব্বা মারা যায়। পিটার পালিয়ে আসে আলমা-আতায়। নুরভ তাকে খুঁজে পায় এবং ভর্তি করে দেয় ক্যাটারিং ইন্সটিটিউটে।
নুরভ ভীষণ খুশী যখন তার ভাতিজা চাকুরী পেল হরকেস এর ভি আই পি রেস্ট হাউজে। এই ভি আই পি রেস্ট হাউজ হরকেস এর নার্ভ সেন্টার। রাষ্ট্রীয় ও বিদেশী বড় বড় অতিথি এখানে এসে থাকেন। অনেক খবর, অনেক গোপন তথ্যের আকর হরকেস ভি আই পি রেস্ট হাউজ। পিটারের মাধ্যমে সবই জানতে পারে নুরভ। আহমদ মুসা হরকেস আসছে এবং ভি আই পি রেস্ট হাউজেই এক রাতের জন্যে উঠবে তা সে পিটারের মাধ্যমেই জানতে পারে। এবং তা জানার পর জেনারেল বরিসকে তা অবহিত করে। অতপর জেনারেল বরিসের পরামর্শ ক্রমে একটা পরিকল্পনা আঁটে আহমদ মুসাকে কিডন্যাপ করার। এই কিডন্যাপ পরিকল্পনার ফাইনাল প্রস্তুতির ব্যাপারে তথ্য বিনিময়ের জন্যেই পিটার এসেছে নুরভের এখানে।
নুরভ ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল, ‘এখন রাত এগারটা, তুমি কিভাবে বেরুলে রেস্ট হাউজ থেকে? সন্দেহ করবে না তো কেউ? এখন তো ডিউটির সময়।’
‘না সন্দেহ করবে না। আমি আধাঘন্টার ছুটি নিয়ে এসেছি ওষুধ কিনব বলে।’
‘ঠিক আছে তুমি এখনি চলে যাও। শুধু তোমার কাছে একটাই জানার। তুমি তার রুম-সার্ভিসের ডিউটি পেয়েছ কি না এবং তার খাবার পানির সাথে ওষুধ মেশাতে পেরেছ কি না?’
‘হ্যাঁ আংকল। রাত ৯ টায় আমিই তার রুমে খাবার দিয়েছি, আবার আমিই তার রুম পরিস্কার করেছি। তার খাওয়ার আগেই পানিতে সে ওষুধ মিশিয়েছি। সে পানি তিনি খেয়েছেন এবং নিশ্চয় আরো খাবেন।’
‘সাবাশ ভাতিজা। শুধু আমরা এবং জেনারেল বরিস নয়, তোমার পিতা-মাতার আত্মাও এতে খুশী হবেন।’
নুরভের শেষ কথা গুলো উচ্চারণের সংগে সংগেই পিটারের মুখ শক্ত হয়ে উঠল। তার চোখে যেন জ্বলে উঠল প্রতিশোধের আগুন। বলল সে, ‘আমি ইচ্ছা করলে তাকে খুন করতে পারি আংকল।’
‘না ভাতিজা, তাঁকে জীবন্ত আমাদের ধরতে হবে। তাকে হাতে পেলে আমরা অনেক কাজ করতে পারব। যার মূল্য টাকার অংকে পরিমাপ করা যাবে না। তাকে হাতে পেলে দরকষাকষি করে আমরা এমনকি রাজ্যও পেয়ে যেতে পারি। সে হলো আমাদের সাত রাজার ধন। তাকে বিক্রি করে সাত রাজ্য না হোক এক রাজ্য তো আমরা পেতে পারি।’
চোখ দুটি উজ্জ্বল হয়ে উঠল পিটারের।
নুরভ পকেটে হাত ঢুকিয়ে এক গুচ্ছ নোট বের করে পিটারের হাতে দিয়ে বলল, ‘তুমি বেবী ট্যাক্সি নিয়ে তাড়াতাড়ি চলে যাও। আজ রাতের সব পরিকল্পনা তোমার মনে আছে তো?’
‘জি আংকল।’ বলে উঠে দাঁড়াল পিটার।
তারপর ‘শুভ রাত্রি’ জানিয়ে ফিরে দাঁড়িয়ে চলতে শুরু করল। চলে গেল পিটার।
পিটার চলে যেতেই ওয়াকি টকি বের করে একটি নির্দিষ্ট চ্যানেলে যোগাযোগ করল।
‘হ্যালো, মিং!’
ওপার থেকে মিং এর সাড়া পেল। বলল, ‘তুমি ঠিক আছ? তোমার হেলিকপ্টার রেডি?’
ওপার থেকে ইতিবাচক সাড়া পাওয়ায় তার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বলল, ‘তুমি প্রস্তুত থেকো, সব ঠিক থাকলে রাত দুইটায় আমরা পৌঁছব।’
ওয়াকি টকি বন্ধ করে রেখে দিল। তারপর ড্রয়ার থেকে বের করল তিনটি পাসপোর্ট। একটি নুরভের, একটি কিরভের এবং অন্যটি পিটারের। পাসপোর্ট গুলো শেষ বারের মত পরীক্ষা করল নুরভ। নুরভের পাসপোর্ট আলমা আতার একটা ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান হিসাবে। আর পিটারের পাসপোর্ট হয়েছে ওমরভ নামে। তার পরিচয় সে নুরভের পার্সোনাল সেক্রেটারী। পাসপোর্টে কিরভের নাম হয়েছে করিমভ। তার পরিচয় সে নুরভের ব্যবসায়ের রপ্তানী উপদেষ্টা। পাসপোর্টের ভিসা গুলো একবার দেখে নিয়ে সে পাসপোর্ট গুলো পকেটে পুরল।
‘হরকেস-এর সীমান্ত ফাঁড়িতে রাতে ডিউটি কার খোঁজ নিয়েছে?’ কিরভের দিকে মুখ তুলে জিজ্ঞাসা করল নুরভ।
‘হাঁ, অলিয়েভের আজ ডিউটি। খুব ভাল অফিসার। কাগজপত্র ঠিক থাকলে কোনো ঝামেলা করেনা।’
‘ঠিক আছে। তুমি যাও, গ্যারেজ থেকে গাড়ী বের করে সব ঠিক আছে কি না দেখ। তেল ঠিক ভাবে ভরে নিও।’
‘আচ্ছা’ বলে বেরিয়ে গেল কিরভ।
ঠিক সাড়ে ১২ টায় নুরভের গাড়ী বারান্দা থেকে একটা মিনি মাইক্রোবাস বেরিয়ে গেল। গাড়ীর সিটে কিরভ। এবং তার পাশের সীটে নুরভ।
রাত পৌনে একটায় তাদের গাড়ী একটা টিলার পেছনে এসে দাঁড়াল। জায়গাটা রাস্তা থেকে দুরে এবং অন্ধকার। রাস্তা ও এ স্থানটির মাঝখানে একটি মদের কারখানা। এখন পরিত্যক্ত, মধ্যএশিয়া স্বাধীন হওয়ার পর কারখানাটি বন্ধ হয়ে গেছে।
গাড়ি থেকে নামল নুরভ ও কিরভ।
টিলাটির ওপাশে ভি আই পি রেস্ট হাউজের দেয়াল। তারা ঢিলাটির পাশ ঘুরে রেস্ট হাউজের প্রাচীরের গোড়ায় এসে দাঁড়াল।
তারা প্রাচীরের উওর দেওয়াল ধরে পূর্ব দিকে এগুলো। একদম পূর্ব প্রান্তে যেখান দিয়ে ভেতর থেকে ড্রেন বেরিয়ে এসেছে সেখানে এসে দাঁড়াল। ঠিক ড্রেনের উপর প্রাচীরে একটা ক্ষুদ্র দরজা। স্টীলের কপাট তাতে।
নুরভ ধীরে ধীরে চাপ দিল দরজার উপর। নড়ে উঠল দরজা। নুরভের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। পিটার ভেতরের তালা যথাসময়েই তাহলে খুলে রেখে গেছে। পরিকল্পনা অনুসারে সে তাহলে কাজ করতে পেরেছে।
নুরভ দরজার উপর তার হাতের চাপ বাড়াল। ধীরে ধীরে খুলে গেল দরজা।
দরজার আশপাশটা পরিচ্ছন্ন নয়। এটা আসলে সুইপারস প্যাসেজ। প্রধানত ড্রেন পরিষ্কার জন্যই তাদের ডাকা হয়। এছাড়া নির্দিষ্ট সময় অন্তর ঘর দোর, বাথ তাদের দিয়েই সাফ করানো হয়।
দরজা দিয়ে উঁকি দিল নুরভ। সামনেই বাগান, তার পরেই অন্ধকার বাড়িটি দাঁড়িয়ে আছে। এদিকে বাগানের দিকে একটি মাত্র আলো।
বাগান পেরিয়ে ওপাশে রেস্ট হাউজের গোড়ায় গিয়ে দাঁড়াবার সিদ্ধান্ত নিল। এপাশেই সুইপার সার্ভেন্টেস্‌দের সিঁড়ি।
নুরভ ও কিরভ পা বাড়াতে যাবে এমন সময় রেস্ট হাউজের পশ্চিম কোনায় টর্চ জ্বলে উঠ্‌ল।
প্রাচীরের দরজা আগেই বন্ধ করে দিয়েছিল। সুতরাং দরজা দিয়ে ঝট করে পালাবার উপায় ছিলনা। উপায়ান্তর না দেখে দু’জন শুয়ে পড়ল মাটিতে। তারপর দু‘জন বুকে হেঁটে ফুল গাছের ঝোপে ঢুকে পড়ল।
প্রায় দম বন্ধ করে তারা অপেক্ষা করতে লাগল। শুনতে পেল, পায়ের শব্দ এগিয়ে আসছে। বুঝল, চারটি বুটের আওয়াজ। আওয়াজটা রেস্ট হাউজের পাশ দিয়ে পূর্ব দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।
এক সময় পায়ের শব্দ থেমে গেল। বুঝল, পূর্বদিকে যাওয়া শেষ। কিছুক্ষণ পর বুটের শব্দ আবার পশ্চিম দিকে এগিয়ে চলল। তাদের মাথার ওপর কয়েকবার আলোর ছুটাছুটি দেখল তারা। বুঝল, টর্চের আলো ফেলে তারা তাদের পাহারাদারির দায়িত্ব পালন করছে।
ধীর ধীরে তাদের পায়ের শব্দ মিলিয়ে গেল।
কিরভ উঠতে চাইল।
নুরভ তাকে টেনে ধরে বলল, ‘ওরা ওখানে দাঁড়িয়েও থাকতে পারে। তুমি থাক, আমি দেখছি।’
বলে নুরভ ধীরে ধীরে মাথা তুলল। দেখল না রেস্ট হাউজের পশ্চিম কোণ ফাঁকা।
তবু নুরভ আবার বসে পড়ল। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল, দেখতে হবে ওরা কখন ফেরে। নিশ্চয় ফিরবে। এরা গেটের প্রহরী নয়, নিশ্চয় টহল প্রহরী। রেস্ট হাউজের চারদিকেই ওরা টহল দিচ্ছে।
ঠিক দশ মিনিট পর ওরা ফিরে এল। একইভাবে ঐ একই দিক থেকে।
নুরভবলল, নিশ্চয় ওরা দুই গ্রুপে টহল দিচ্ছে। এক গ্রুপ দক্ষিণ ও পূর্বদিকে। আর এক গ্রুপটি পশ্চিম ও উত্তর দিকে। প্রতি দশ মিনিট পর ওরা ফিরে আসছে। মানে কোথাও গিয়ে দাঁড়াচ্ছে ওরা। না দাঁড়ালেই কিন্তু বিপদ। যাহোক আমাদের গণনায় ধরতে হবে পাঁচ মিনিট। কিন্তু মাঝখানের বিরতিটা যদি পাঁচ মিনিটের কম হয় তাহলেই বিপদ ঘটবে।
দ্বিতীয় রাউন্ডে ওদের চলে যাওয়ার পায়ের শব্দ মুছে যাবার সাথে সাথে নুরভ ও কিরভ হামাগুড়ি দিয়ে ফুলের গাছের মধ্য দিয়ে ছুটল রেস্ট হাউজের পূর্ব কোণের দিকে। ওখানেই ওপরে ওঠার সুইপার সার্ভেন্টদের সিঁড়ি।
আধা মিনিটেই ওরা পৌঁছে গেল ওখানে।
পেল সিঁড়িটা। সংকীর্ণ কাঠের সিঁড়ি। পা দিয়েই বুঝল মজবুত। তর তর করে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে লাগল দুজন। বুক টিপ টিপ করছে নুরভের। যদি সিঁড়ি মুখের দরজা খোলা না পায়, যদি পিটার দরজা না খুলে রেখে থাকে। যদি ভুলে গিয়ে থাকে! আবার ভাবল, প্রাচীরের দরজা যখন খুলে রেখেছে, তখন পরিকল্পনা অনুসারে সব কাজই করেছে।
সিঁড়ি দিয়ে আগে আগে উঠছিল নুরভ।
দরজার মুখোমুখি হলো সে।
দাঁড়াল নুরভ।
তার মানে হলো কাঠের দরজা। কিন্তু হাত দিয়েই বুঝল পুরু স্টিল দিয়ে তৈরী। একটু চাপ দিতেই ফাঁক হয়ে গেল দরজা।
অবশিষ্ট দরজা এমনিতেই খুলে গেল।
খুশীতে উজ্জ্বল হয়ে উঠল নুরভের মুখ। অবশিষ্ট দরজা খোলার কাজটা পিটার করেছে। যে ধরনের পরিকল্পনা ছিল ঠিক তাই।
খোলা দরজার সামনে দাড়িঁয়ে আছে পিটার।
‘আহমদ মূসার দরজার প্রহরীকে সরাতে পেরেছো তো?’
‘হ্যাঁ খুব সহজেই। ওকে চা অফার করতে হয়নি। পানি চেয়েছিল খেতে। পানিতেই ওষুধ মিশিয়ে দিয়েছিলাম। খাওয়ার অল্পক্ষণ পরেই কুপোকাত। ওকে টেনে এনে ঐ দেখুন ঐ কোণায় ফেলে রেখেছি।’
‘বাহঁ! ভাতিজা, আমি যা আশা করেছিলাম, তার চেয়েও বেশী করেছ। ধন্যবাদ তোমাকে। এখন চল আহমদ মূসা কোথায়? ‘মাষ্টার কি’ যোগাড় করতে পেরেছে, না ভাঙ্গতে হবে?’
‘ওটা আমাদের পক্ষে যোগাড় করা কঠিন নয়। এনেছি ওটা।’
‘সাথে আসা পাশের লোকটির কি খবর?’
‘একই অবস্থা আংকল। ওঁকেও আমিই খাবার দিয়েছিলাম।’
‘চল তাহলে, কোন দিকে?’
সবাই এসে দাঁড়াল আহমদ মূসার রুমের দরজায়।
মাষ্টার কি দিয়ে পিটারই তালা খুলল।
নুরভ ও কিরভ দু‘জনেই রিভলভার হাতে নিয়েছে। তাদের বুক দুরু দুরু করছে। যদি ওষুধ কাজ না করে থাকে, যদি ভুল হয়ে থাকে পিটারের ওষুধ দিতে, তাহলে তো বাঘের মুখে পড়তে হবে। যার সামনে গেলে জেনারেল বরিসেরও বুক কাঁপে, তার সামনে তারা তো কিছুই নয়।
পিটারই নিঃশব্দে দরজা খুলে ফেলল।
প্রথমে ঢুকল পিটার। দরজায় একটু দাঁড়াল নুরভ ও কিরভ।
পিটার ভেতরটা দেখে এসে হাত নেড়েঁ ডাকল।
এবার নিশ্চিন্ত মনে ঘরে ঢুকল নুরভ ও কিরভ।
আহমদ মূসা শুয়ে আছে। বুঝাই যাচ্ছে গভীর ঘুমে অচেতন। চাদরটাও সে গায়ে তুলে নেয়নি।
নুরভ ও কিরভের হাতে তখনো রিভলভার তাক করা আহমদ মূসার দিকে।
কেউ তার গায়ে হাত দিতে সাহস করছে না।
নুরভ পিটারকে বলল, আমরা রিভলভার ধরে আছি। তুমি ওকে একটু কাত ফিরিয়ে দেখ, জেগে উঠে কিনা।
পিটার সসংকোচে দু’হাত লাগিয়ে আহমদ মূসাকে একদিকে পাশ ফিরাল। যেমন ফিরল তেমনই থাকল। তার হাত- পা কিংবা চোখ- মুখ কোন সচেতনতা পরিলক্ষিত হলো না। একদম শিথিল তার দেহ।
‘ঘাড়ে তুলে নিতে পারবে না একে কিরভ?’
কিরভ কোন উত্তর না দিয়ে খুব সহজেই আহমদ মূসার দেহ কাঁধে নিল।
‘সাবাশ কিরভ, এ না হলে তুমি পাহলোয়ান কি?’
ঘর থেকে প্রথম বেরিয়ে এল নুরভ। তার পেছনে কিরভ। সব শেষে পিটার। সিঁড়ির মুখে এসে সবাইকে দাঁড় করাল নুরভ। ঘড়ি দেখে বলল, আর মিনিট খানেকের মধ্যেই ওদের এদিকে টহলে আসার সময়। ওদের না চলে যাওয়া পর্যন্ত আমাদের অপেক্ষা করতে হবে।
এক মিনিট নয়, পাঁচ মিনিট পর ওরা এল। টহল শেষ করে ওরা চলে গেল।
ওদের পায়ের শব্দ মিলিয়ে যাবার পর নুরভ পিটারকে বলল, ‘তুমি আগে নেমে যাও। তোমার দায়িত্ব হলো নিচে দাঁড়িয়ে টহলের প্যাসেজ ছাড়বে এবং আমাদের সাথে যোগ দেবে।’
পিটার নামতে লাগল নিচে।
তার পিছে পিছে কিরভ ও নুরভ।
নিছে নেমে পিটার সিঁড়ির গোড়া থেকে একটু পশ্চিমে গিয়ে দাঁড়াল। তার হাতে রিভলভার।
কিরভ এবং নুরভ বাগানের মাঝামাঝি গেছে এমন সময় নুরভ হঠাৎ চোখ ফেরাতে গিয়ে রেস্ট হাউজের পশ্চিম কোণে টর্চ জ্বলে উঠতে দেখল।
সংগে সংগে নুরভ কিরভের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তাকে নিয়ে শুয়ে পড়ল এবং চাপা গলায় দ্রুত বলল, ‘চল টেনে নিয়ে যেতে হবে।’
তারপর দু’জনে হামাগুড়ি দিয়ে আহমদ মুসাকে টেনে নিয়ে চলল দ্রুত।
দরজার কাছে গিয়ে আঁতকে উঠল নুরভ। দরজা খুললে ওরা যদি টের পেয়ে যায়! কিন্তু উপায় কি?
ঠিক এই সময়েই রেস্ট হাউসের পশ্চিম কোণ থেকে একটা কণ্ঠ ভেসে এল, ‘কে ওখানে দাঁড়িয়ে?’
নুরভ বুঝল, তারা নয়, পিটার ওদের নজরে পড়ে গেছে।
সংগে সংগেই নুরভ বসে বসেই দরজার পাল্লা ফাঁক করে আহমদ মুসাকে প্রথমে ঠেলে দিল দরজার বাইরে। তারপর তারা দু’জনে গড়িয়ে দরজার ওপারে চলে গেল।
আহমদ মুসাকে যখন নুরভরা ঠেলে দিচ্ছিল দরজার বাইরে, ঠিক সে সময়েই প্যাসেজের এদিক থেকে একটা গুলির শব্দ হলো। কিন্তু তার পরেই এক ব্রাশ ফায়ার এল পশ্চিম দিক অর্থাৎ রেস্ট হাউসের পশ্চিম কোণ থেকে।
নুরভরা যখন দরজার ওপারে গড়িয়ে পড়ল, তখনও চলছিল ব্রাশ ফায়ার।
দরজার ওপারে গড়িয়ে পড়েই নুরভ বলল, ‘কিরভ, একে নিয়ে তাড়াতাড়ি যাও, আমি আসছি।’
কিরভ আহমদ মুসাকে কাঁধে করে ছুটল গাড়ির দিকে।
নুরভ প্রাচীরের দরজা টেনে বন্ধ করে রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করছিল কি ঘটেছে তা বুঝার জন্যে। যা সে বুঝতে পারছে, তাতে টহলদার দু’জন সৈনিকের চোখে ধরা পড়ার সংগে সংগেই পিটার কাউকে গুলি করেছিল তাদের লক্ষ্য করে। সৈনিক দু’জনের কাউকে গুলি লাগুক বা না লাগুক, তাদেরই একজন ব্রাশ ফায়ার করেছিল পিটারকে লক্ষ্য করে।
নুরভ অপেক্ষা করছিল পিটারের শেষ অবস্থা জানার জন্য। পিটার এ পর্যন্ত না আসা থেকেই বুঝতে পারছে, পিটার স্বাভাবিক অবস্থায় নেই।
এই সময় একজনের উচ্চ কণ্ঠ শুনতে পেল। সে বলছে কাউকে লক্ষ্য করে, ‘এদিকে এস, দেখ এক চোর ব্যাটা শেষ হয়ে গেছে।’
কথাটা শুনেই বুকটা ধ্বক করে উঠল নুরভের। তাহলে পিটার আর নেই! বুকের কোথায় যেন বেদনায় চিন চিন করে উঠল তার।
কিন্তু আর দেরী করলনা সে। ছুটল গাড়ির দিকে।
ওরা সব জেনে ফেলার আগেই ওদের নাগালের বাইরে যেতে হবে তাদেরকে।
গাড়িতে লাফ দিয়ে উঠে বসল নুরভ। ড্রাইভিং সিটেই উঠল।
কিরভ তখনও আহমদ মুসাকে বাক্সে প্যাক করার কাজে ব্যস্ত। সাত ফুট লম্বা, দুই ফুট প্রশস্ত এবং আড়াই ফুট উঁচু বিরাট কাঠের তৈরী ফলের ঝুড়িতে আহমদ মুসাকে তোলা হয়েছে। ঝুড়িতে দুটি কেবিন। উপরেরটা ফলে ভর্তি। নিচের কেবিনে আহমদ মুসা। কেউ ঝুড়ি চেক করতে গেলে দেখবে ফলের স্তুপ।
নুরভ ড্রাইভিং সিটে বসেই স্টার্ট দিল গাড়ি।
কিরভ ছুটে এল নুরভের কাছে। বলল, ‘পিটার, পিটার আসবে না?’
‘পিটার কোন দিনই আর আসবে না।’
‘কি বলছেন স্যার!’
‘পিটার ওদের ব্রাশ ফায়ারে মারা গেছে।’
‘ও যেসাস!’
‘পিটার জীবন দিয়ে আমাদের বাঁচিয়েছে, আমাদের পলিকল্পনাকে সফল করতে সাহায্য করেছে। পিটার টহল প্যাসেজে দাঁড়িয়ে ওদের দৃষ্টি আকৃষ্ট করায় এবং ওদের চোখে পড়ার পরেও না পালিয়ে ওদের সাথে লড়াই এ লিপ্ত হওয়ার ফলেই আমরা পালানোর সুযোগ পেয়েছি। একজন চোর মারা পড়েছে বলে ওরা মনে করছে। সুতরাং প্রকৃত ঘটনা ওদের নজরে আসতে আরও সময় লাগবে। এটুকু সময়ের মধ্যেই আমাদের সরে পড়তে হবে।’
কিরভ ফিরে গেল তার কাজে।
গাড়ি চলতে শুরু করেছে তখন।
সড়কে উঠে এসে গাড়ি তীর বেগে ছুটে চলল। লক্ষ্য তাদের সীমান্ত।
হরকেস শহর- বলা যায় সীমান্ত্মের ওপর দাঁড়ানো। শহরের সীমান্ত থেকে সীমান্ত ফাঁড়ির দূরত্ব মাত্র এক মাইল। আর শহরের কেন্দ্র থেকে মাত্র ৩ মাইল।
সুতরাং নুরভরা সীমান্ত ফাঁড়ীতে পৌঁছতে তিন মিনিটের বেশী লাগল না।
সীমান্ত ফাঁড়ির স্থানটা একটা গিরিপথ মত জায়গা। দু’পাশ থেকে পাহাড় শ্রেণী এগিয়ে এসেছে। সেখানে এসে থেমে গেছে পাহাড় এবং সৃষ্টি করেছে এক গিরিপথ। গিরিপথটা আঁকা বাঁকা দীর্ঘ এক উপত্যকার মুখ। এ উপত্যকা মুখ অর্থাৎ মধ্যএশিয়া মুসলিম প্রজাতন্ত্রের সীমান্ত ফাঁড়ি থেকে ৫০ গজ পূর্ব দিকে সিংকিয়াং এর সীমান্ত ফাঁড়ি।
মধ্যএশিয়া মুসলিম প্রজাতন্ত্রের সীমান্ত ফাঁড়ির এক পাশে একটি সিক্যুরিটি ব্যারাক, অন্য পাশে চেকপোস্ট। সীমান্ত পথটি ইস্পাতের দরজা দিয়ে বন্ধ। দরজাটি দূর নিয়ন্ত্রিত। সিক্যুরিটি ব্যারাকের সাথে লাগানো সিক্যুরিটি পোস্ট নিয়ন্ত্রনকারী সুইচ রয়েছে। সীমান্ত অতিক্রম ইচ্ছুক ব্যক্তির কাগজপত্র ঠিকঠাক থাকলে একটা পাশ পেয়ে যায়। এই পাশ সিক্যুরিটি বক্সে দেখালেই সুইচ টিপে দরজা খুলে দেয়া হয়।
নুরভদের কাগজপত্র সব ঠিক ছিল। পাশ পেতে দেরী হলো না। তাছাড়া ডিউটি অফিসার অলিয়েভ তাদের কিছুটা পরিচিত ছিল বলে আরও সুবিধা হলো তাদের। গাড়ি চেকও তেমন একটা হলোনা। গাড়িটার ভেতরে তারা রুটিন মাফিক চোখ বুলাল এবং ভেতরে একবার উঁকি দিল মাত্র।
সব মিলিয়ে পাঁচ মিনিটের মত সময় লাগল। সীমান্ত ফাড়ির খোলা গেট দিয়ে সাঁ করে বেরিয়ে গেল নুরভের গাড়ি। পেছনে তাকিয়ে নুরভ সীমান্ত ফাঁড়ির গেটটাকে বন্ধ হতেও দেখল। প্রশস্ত হাসি ফুটে উঠল নুরভের মুখে। নুরভ স্টেয়ারিং হুইলের উপর এক প্রচন্ড মুষ্টাঘাত করে বলল, ‘কিরভ, তুমি বুঝতে পারছনা কি ঐতিহাসিক ঘটনা আমরা ঘটিয়েছি! সাত রাজার ধন এখন আমাদের হাতের মুঠোয়।’
কিরভ ঝুড়ি থেকে একটা আপেল নিয়ে তাতে কামড় বসিয়ে বলল, ‘স্যার, আমাদের এই আনন্দ ষোল কলায় পূর্ণ হতো যদি পিটার আমাদের সাথে থাকতো।’
পিটারের নামটা শুনেই নুরভের মুখটা ম্লান হয়ে গেল। ধীরে ধীরে বলল, ‘বেচারা পিটার! এ ঐতিহাসিক সাফল্যের সবটুকু কৃতিত্বই তার।’
বলে চুপ করল নুরভ। গম্ভীর হয়ে উঠল তার মুখ। তাতে বেদনার ভারী ছাপ। বাপ-মা হারা ভাতিজাকে নুরভ নিজের ছেলের মতই ভালোবাসত।
নুরভের বেদনায় ভারি হওয়া চোখ সামনে প্রসারিত।
ছুটে চলেছে গাড়ি।

জেনারেল বরিস ঘরে ঢুকে ধীরে ধীরে আহমদ মুসার শয্যার পাশে গিয়ে দাঁড়াল।
আহমদ মুসা শুয়েছিল এক খাটের ওপর। চোখ দু’টি তার বন্ধ। জ্ঞান তার তখনো ফিরেনি। আহমদ মুসাকে সংজ্ঞাহীন করার জন্যে বিশেষ ধরনের ওষুধ ব্যবস্থা করা হয়েছিল। নিরাপত্তামূলক ওষুধ ব্যবহার না করলে চব্বিশ ঘণ্টার আগে জ্ঞান ফেরে না। আহমদ মুসার জ্ঞান ফিরিয়ে আনার জন্যে সকালেই তাকে ইনজেকশন করা হয়েছে। ডাক্তার বলেছে ধীরে ধীরে তার জ্ঞান ফিরে আসবে। সকাল ১০ টার মধ্যেই সে জেগে উঠবে।
ঠিক নয়টা পঞ্চান্ন মিনিটে ঘরে ঢুকেছে জেনারেল বরিস।
আহমদ মুসার শয্যা পাশে এসে দাঁড়িয়ে ছিল জেনারেল বরিস।
আহমদ মুসার হাত পা বেঁধে রাখা হয়েছে। কখন জ্ঞান ফিরে আসে, কখন কি করে বসে এই ভয়ে। সিংহকে পিঞ্জরাবদ্ধ করেও ওদের স্বস্তি নেই।
জ্ঞান ফিরে আসেনি দেখে জেনারেল বরিস দরজার দিকে এগুলো। দরজার পাশের সুইচবোর্ডে একটা ক্ষুদ্র সাদা বোতামে চাপ দিল। সংগে সংগে দরজার বিপরীত দিকের দেয়াল সরে গেল। আহমদ মুসার ছোট কক্ষটি বিশাল এক কক্ষে পরিণত হলো।
কক্ষের মাঝখানের দেয়াল সরে যাবার সংগে সংগে ওপাশের আরেক বিছানায় মেইলিগুলিকে দেখা গেল। শুয়ে আছে সে। তার এক পায়ে বিরাট ব্যান্ডেজ। তার ম্লান, কাতর মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে সে সুস্থ নেই।
দেয়াল সরে যাবার হিস হিস শব্দেই সম্ভবত মেইলিগুলি চোখ মেলেছিল।
মেইলিগুলির শয্যাটা ছিল উত্তর দেয়াল ঘেঁষে ঘরের একদম পূর্ব প্রান্তে।
মেইলিগুলি চোখ খুলেই দেখতে পেল আহমদ মুসাকে। অলক্ষ্যেই যেন একটা চিৎকার বেরিয়ে এল মেইলিগুলির মুখ থেকে- ‘ওগো, তুমি …… তুমি …… তুমি এখানে।’
উত্তেজনা আতংকে উঠে বসেছিল মেইলিগুলি।
জেনারেল বরিসের মুখে ক্রুর হাসি।
সে দরজার সামনে থেকে সরে আসতে আসতে বলল, ‘বিস্মিত হয়েছ সুন্দরী, মনে করেছিলে তোমার বিশ্বজয়ী স্বামীর গায়ে কেউ হাত দিতে পারবেনা। শুধু দেয়া নয় একদম খাচায় এনে ভরেছি। একবার পালিয়েছিল। সে সময় আবার আর তাঁকে আমরা দেব না।
মেইলিগুলি সামনে থেকে দুনিয়ের সব আলো যেন দপ করে এক সাথে নিভে গেল। ধপ করে আবার শুয়ে পডল বিছানায়।
শ্বাসরুদ্ধকর আতংক। আর বুকের অসহ্য জ্বালা নিয়ে সে তাকিয়ে রইল আহমদ মুসার দিকে ওকি ঘুমিয়ে আছে না অজ্ঞান? এ সময় ঘুম স্বাভাবিক নয়। নিশ্চয় অজ্ঞান। অজ্ঞান মানুষকে আবার হাত পা বেঁধে রাকতে হয়েছে বেঁধে রেখেছে আবার খাটিয়ার সাথেও।
জেনারেল বরিস আবার ঘুরে দাড়িয়েছে আহমদ মুসার দিকে। হাতে তার রিভলভার। সে হাত ঘড়ির দিকে একবার তাকিয়ে রিভলভার নল দিয়ে খোচা মারল আহমদ মুসার মাথায়।
একটু পরেই আহমদ মুসা নড়ে উঠল সম্ভবত পাশ ফিরতে চেয়েছিল, হাত পা এবং দেহটা খাটের সাথে বাধা থাকায় বাধা পেল তার স্বাধীনভাবে ঘুরবার প্রচেষ্টা। সংগে সংগে চোখ খুলে গেল তার।
চোখ খুলেই দেখতে পেল রিভলভার হাতে দাড়ানো জেনারেল বরিসকে। এবং চোখ ফিরিয়ে চাইল একবার খাটের দিকে এবং উপরের ছাদও সামনের দেয়ালের দিকে।
‘কি দেখছ আহমদ মুসা?’ রিভলভার নাচিয়ে ক্রুর হেসে বলল জেনারেল বরিস।
‘বুঝতে চেষ্টা করছি। আগের ন্যায় এবারও তুমি আমাকে কাপুরুষের মত কিডন্যাপ করেছ কি না!’ স্বাভাবিক ও অত্যন্ত স্পষ্ট কণ্ঠে বলল আহমদ মুসা।
‘কি বুঝলে?’
‘বুঝলাম হরকেস এর রেস্ট হাউজে আমাকে কোনও ভাবে অজ্ঞান করে তোমার লোকেরা কিডন্যাপ করে এখানে এনেছে।’
‘কোথায় তোমাকে এনেছি বলতে পার?’
‘এক উরুমুচি ছাড়া তোমার জন্য নিরাপদ জায়গা আর কোথাও নেই জেনারেল বরিস।’
আহমদ মুসার কথায় জ্বলে উঠেছিল জেনারেল বরিসের চোখ। তার রিভলভারের বাট দিয়ে আহমদ মুসার কাধে একটা আঘাত করে বলল, ‘এর জন্য এককভাবে তুমিই দায়ী আহমদ মুসা।’
‘তোমার এত ভয় জেনারেল বরিস। একজন অজ্ঞান লোককে হাত পা বেঁধে রেখেও তোমার স্বস্তি হয়নি। তার দেহটাকেও তুমি বেঁধে রেখেছ খাটের সাথে।’
‘একবার তুমি খাচা থেকে পালিয়েছ। এবার জেনারেল বরিস আর কোন ঝুকি নেবে না।’
একটু থেমেই জেনারেল বরিস আবার বলল, ‘যাই হোক তোমাকে ধন্যবাদ দিচ্ছি আহমদ মুসা। আমাকে দেখে তোমার চোখ একটুও কাপেনি। তোমার কলিজাটা গন্ডারের চামড়া দিয়ে তৈরী। তবে আহমদ মুসা তোমার কলিজা কাঁপানোর ব্যবস্থা আমি করেছি। তোমার মেইলিগুলি কোথায় জান?’
মেইলিগুলি একটু দুরে ঘরের ও প্রান্তের বিছানায় শুয়ে সব কথাই শুনছিল। ভয় উদ্ধেগ উত্তেজনায় তার গোটা দেহ আড়ষ্ট। গলা শুকিয়ে যেন কাঠ হয়ে গেছে। কথা বলার শক্তিও যেন তা ফুরিয়ে গেছে।
জেনারেল বরিসের কথা শেষ হতেই আহমদ মুসা কঠোর দৃষ্টিতে জেনারেল বরিসের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘মেইলিগুলি কথায় বরিস? তার কোন ক্ষতি হলে তুমি যে শাস্তি পাবে তা তুমি কল্পনাও করতে পারবে না।’
‘সেটা পরের কথা। তবে আমি তার কোন ক্ষতি করিনি। ক্ষতি করব এবং সেটা তোমার সামনেই। এটা আমার বহুদিনের ইচ্ছা। আমি জানি তোমাকে শাস্তি দেবার এর চেয়ে বড় পথ আর নেই।’
আহমদ মুসার মুখের ওপর একটা কালো ছায়া নামল। বরিসের ইংগিত সে বুঝেছে। আহমদ মুসার গোটা দেহ শক্ত হয়ে উঠল। অসহ্য এক যন্ত্রণা ছড়িয়ে পড়ল তার গোটা দেহে।
‘কি, কথা বলছ না কেন আহমদ মুসা, ভয় পেলে? আমি জানি মেইলিগুলিই তোমার সবচেয়ে দুর্বল জায়গা। ওখানে আঘাত করলেই তুমি ভেঙ্গে পড়বে। সেই ব্যবস্থাই আজ আমি করেছি। ঐ দেখে নাও তোমার মেইলিগুলিকে।’
বলে জেনারেল বরিস খাটটা একটু ঘুরিয়ে দিল।
এবার আহমদ মুসা ঘাড় ফেরাতেই দেখতে পেল মেইলিগুলিকে।
মেইলিগুলি তাকিয়েছিল। চার চোখে মিলন হলো।
এতক্ষণের আসহায়ত্তের বোবা বাধ আহমদ মুসার দৃষ্টি স্পর্শে হঠাৎ করেই যেন ভেঙ্গে গেল। কণ্ঠে শব্দ ফুটে উঠল মেইলিগুলির। ডুকরে কেঁদে উঠল সে। গড়িয়ে নামল সে বিছানা থেকে নিচে। তারপর একটি ভাল পা ও একটি হাত দিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে সে আহমদ মুসার দিকে আসতে শুরু করল।
জেনারেল বরিস আহমদ মুসার কাছ থেকে একটু সরে এল মেইলিগুলির দিকে চেয়ে কঠোর কণ্ঠে বলল যেমন আছ ঠিক তেমনিভাবে থাক। আর এক ইঞ্চি এগুলে তোমার স্বামী আহমদ মুসার এক পা গুড়ো করে দেব, আরো একটু এগুলে আরেক পা গুড়ো করে দেব। শেষে গুড়ো করব মাথা।
মেইলিগুলি থেমে গেল।
কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল মেঝের ওপর।
আহমদ মুসা তাকিয়েছিল মেইলিগুলির দিকে।
‘আমিনা।’ ডাকল আহমদ মুসা।
মেইলিগুলি মুখ তুলল। কান্নারত অবস্থায় তাকাল আহমদ মুসার দিকে অশ্রুতে ধুয়ে যাচ্ছে তার মুখ।
‘কেদনা আমিনা। মজলুমের অস্রু জালিমের জন্য পুরষ্কার। আমার আল্লাহ্‌ ছাড়া আর কারো সাহায্যের মুখাপেক্ষী নই।’
হো হো করে হেসে উঠল জানারেল বরিস। বলল, ‘তোমার আল্লাহ্‌ আর যেখানেই থাক আমাদের এখানে নাক গলাতে আসবে না। কেউ বাঁচাবার নেই তোমাদের।’
একটু থামল জেনারেল বরিস। তারপর বলল, ‘জানি আহমদ মুসা, মেইলিগুলি তোমার পেয়ারের। কিন্তু আমি যদি একটু ফষ্টিনষ্টি করি ওর সাথে তাহলে কি রাগ করবে?’
‘তোমার মত কাপুরুষের সাথে কথা বলতে ঘৃনা করি বোধ করি বরিস।’
‘ঠিক আছে, কথা বল কি না দেখছি। তোমার সামনে তোমার মেইলিগুলিকে আজ লুণ্ঠন করব।’
বলে জেনারেল বরিস নেকড়ের মত এগুলো মেইলিগুলির দিকে।
আহমদ মুসার কথা শুনার পর মেইলিগুলি তার চোখের পানি মুছে ফেলেছে। ঠিক অশ্রু দেখলে ওরা আরও খুশী হয়। আরও ভাবল মেইলিগুলি, সে তো আহমদ মুসার স্ত্রী। জেনারেল বরিসের সামনে ইদয় হতে দেখলে যে বন্দী আহমদ মুসার চোখে সামান্য কাঁপনও জাগেনা, সে আহমদ মুসার স্ত্রী হয়ে মেইলিগুলি ভয় পাবে কেন! কেন সে মোকাবিলা করতে পারবে না পরিস্থিতিকে!
জেনারেল বরিস পা পা করে এগুচ্ছে মেইলিগুলির দিকে। তার মুখে বিজয়ের হাসি। শিকার নিয়ে খেলার ভঙ্গী তার মধ্যে।
মেইলিগুলির গায়ে উজবেক পোশাক। মাথায় ওডনা। নেমে এসেছে কোমর পর্যন্ত। বাম হাতে মাটিতে ঠেস দিয়ে বসে আছে মেইলিগুলি।আর ডান হাত ওড়নার ভেতরে।
পাঁচ গজের মধ্যে এসেছে বরিস। তার ডান হাত নেই।
বাম হাতের রিভলভারটা কোর্টের পকেটে রেখে বাম হাতটা শিকারের মত বাড়িয়ে অগ্রসর হচ্ছে বরিস।
মেইলিগুলির চোখে আর কোন ভয় নেই। সে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে জেনারেল বরিসের দিকে। তার ডান হাতটি আন্ডারওয়্যারের পকেটে ক্ষুদ্র পিস্তলটির বাটে।
জেনারেল বরিস এগিয়ে আসতে আসতে বলল, ‘বাঘিনীর মত ফুসে উঠছ কেন? কোন লাভ নেই। ধরা দিতেই ……
কথা শেষ করতে পারল না জেনারেল বরিস।
মেইলিগুলির ডান হাতে বিদ্যুৎ বেগে বেরিয়ে এল ওড়নার ভেতর থেকে উঠে এল জেনারেল বরিসের বুক লক্ষ্যে।
ভুত দেখার মত চমকে উঠেছিল জেনারেল বরিস।
চমক ভাঙ্গার আগেই বুকে গুলি লেগে মাটিতে ছিটকে পড়ল জেনারেল বরিস।
পূর্ব দিকে পড়েছিল তার মাথা। ডান দিকে কাত হয়ে পড়ে গিয়েছিল সে।
কিন্তু পড়ে গিয়েই বাম হাত দিয়ে পকেট থেকে পিস্তল বের করে নিল। তারপর দাঁত কামড়ে মাথাটা একটু উঁচু করে লক্ষ্য করল আহমদ মুসাকে।
গুলি করেই মেইলিগুলি হামাগুড়ি দিয়ে এগুচ্ছিল আহমদ মুসার দিকে।
কিন্তু জেনারেল বরিসের দিকে নজর পড়তেই সে আৎকে ঘুরে দাড়াল।
বরিসের রিভলভার তখন উঁচু হয়ে উঠে ছিল আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে।
মেইলিগুলির হাতেও পিস্তল। কিন্তু গুলি করার সময় নেই। সে দ্রত এক ঝাপ বরিসের রিভলভারের সামনে গিয়ে দাড়াল।
বরিস ট্রিগার টিপেছিল।
গুলি গিয়ে বিদ্ধ হলো মেইলিগুলির বুকে।
এক ঝাকানি খেয়ে কাত হয়ে পড়ে গেল মেইলগুলির দেহ।
কিন্তু গুলি খেয়ে পড়ে গেলেও পিস্তল ছাড়েনি মেইলিগুলি। পড়ে থেকেই দু’হাতে পিস্তল ধরে গুলি করল মেইলিগুলি।
জেনারেল বরিস দ্বিতীয় গুলি করার জন্য মাথা তুলেছিল বহুকষ্টে। কাঁপছিল তার মাথা।
কিন্তু দ্বিতীয় বার তার হাত উঠার আগেই মেইলিগুলির দ্বিতীয় গুলি গিয়ে তার মাথা গুড়ো করে দিল।
আহমদ মুসার চোখের সামনে ভোজবাজীর মতই ঘটে গেল ঘটনাগুলি।
মেইলিগুলি যখন গুলিবিদ্ধ হলো, ‘মেইলিগুলি’ বলে চিৎকার করে উঠল আহমদ মুসা। এমন বুকফাটা চিৎকার বোধ হয় আহমদ মুসার জীবনে এই প্রথম।
জেনারেল বরিসকে গুলি করার পর মেইলিগুলি গুলিবিদ্ধ বুকের বাম পাশটা চেপে ধরে গড়িয়ে ফিরল আহমদ মুসার দিকে। তারপর তাকাল আহমদ মুসার দিকে।
মেইলিগুলির দিকে তাকিয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল আহমদ মুসা।
মেইলিগুলি বাঁ হাতে বুকটা চেপে ধরে ডান হাতে আর ডান পা দিয়ে মাটি ঠেলে ইঞ্চি ইঞ্চি করে এগিয়ে চলল আহমদ মুসার দিকে। বাইরে থেকে অনেক গুলো পায়ের শব্দ ছুটে আসার শব্দ পেল আহমদ মুসা। দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে দেহের সমস্ত শক্তি একত্র করে গতি বাড়াতে চেষ্টা করল মেইলিগুলি। যেমন করেই হোক আহমদ মুসার বাঁধন তার খুলে দিতে হবে।

উসু-এর সরাইখানায় নাস্তা খেয়ে যুবায়েরভরা আবার এসে গাড়িতে উঠল। ছুটে চলল আবার গাড়ি উরুমুচির উদ্দেশ্যে।
মাইল দু’য়েক আসতেই যুবায়েরভের পকেটের অয়্যারলেস সংকেত দিতে শুরু করল। তাড়াতাড়ি বের করল অয়্যারলেসটি। নিশ্চয় আলমা আতা কিংবা তাসখন্দের কোন মেসেজ।
সিগারেট লাইটারের মত অয়্যারলেস সেটটি কানে তুলে ধরল যুবায়েরভ।
শুনতে শুনতে বিবর্ণ হয়ে গেল যুবায়েরভের মুখ। একটা যন্ত্রণা ফুটে উঠল তার সারা মুখে।
মেসেজ শেষ হলো।
অয়্যারলেস ধরা হাত যুবায়েরভের খসে পড়ল তার কোলের ওপর।
আজিমভ ও ওমর মা চ্যাং উদ্বিগ্ন চোখে তাকিয়েছিল যুবায়েরভের দিকে।
ড্রাইভিং সিটে ছিল আবদুল্লায়েভ। সেও উদ্বিগ্নভাবে বার বার তাকাচ্ছিল যুবায়েরভের দিকে।
মেসেজ শেষ হবার পর তিনজন প্রায় একই সাথে বলে উঠল, ‘কি খবর? খারাপ কিছু নিশ্চয়?’
‘সাংঘাতিক খারাপ খবর। আহমদ মুসা কিডন্যাপ হয়েছেন।’
‘কিডন্যাপ হয়েছেন আহমদ মুসা? কোথেকে? কিভাবে?’
তিনজনে এক সঙ্গে বলে উঠল। মুখ তাদের বিবর্ণ হয়ে গেল মুহুর্তে। চোখ তাদের ছানাবড়া।
আবদুল্লায়েভ সংগে সংগেই রাস্তার পাশে নিয়ে গাড়ি দাঁড় করাল। ঘটনা না শুনে চিন্তা না করে সামনে এগুনো উচিত নয়। আবদুল্লায়েভ নিজের বুদ্ধি থেকেই এ সিদ্ধান্ত নিল।
একটু থেমেই সংগে সংগে শুরু করল, ‘সিংকিয়াং-এ আসার পথে আমাদের সীমান্ত শহর হরকেস-এর ভি আই পি রেষ্ট হাউজে রাত্রিযাপন করছিলেন। সেই রাতেই ভোর চারটার দিকে তার হেলিকপ্টারে সিংকিয়াং-এ প্রবেশ করার কথা। কিন্তু তার আগেই তিনি কিডন্যাপ হয়েছেন তাঁর রেষ্ট হাউজের রুম থেকে।’
‘প্রহরী ছিল না?’ প্রশ্ন করল আজিমভ।
‘প্রহরী ছিল, তারা কিছুই টের পায়নি। ভি আই পি রেষ্ট হাউজের পেছন দিকের সুইপার সিঁড়ি দিয়ে সুইপার প্যাসেজের পথে তাকে কিডন্যাপ করা হয়েছে। আগেই বিশেষ ওষুধ খাইয়ে তাঁকে, তার সাথের গোয়েন্দা অফিসার ও কক্ষের দরজায় মোতায়েন প্রহরীকে সংজ্ঞাহীন করে ফেলা হয়েছিল।’
‘তাহলে নিশ্চয় ভেতরের লোক জড়িত ছিল?’ বলল আজিমভ।
‘জি। রেষ্ট হাউজের ক্যাটারার রশিদভ ষড়যন্ত্রের সাথে জড়িত ছিল। সে প্রহরীর গুলিতে নিহত হয়েছে।’
‘কারা এর সাথে জড়িত, আহমদ মুসাকে কোথায় নিয়ে গেছে, এ ব্যাপারে কোন কথা….।’ বলল আজিমভই।
‘বলছি। কিডন্যাপের ৬ মিনিটের মধ্যে একটা মাইক্রোবাস সীমান্ত অতিক্রম করে সিংকিয়াং এ প্রবেশ করেছে। গাড়িতে ছিল নিকোলাস নুরভ ও কুজনভ কিরভ নামের দু’জন লোক। তাদের পরিচয় ব্যবসায়ী। তাদের সাথে সাত ফুটের মত লম্বা একটা বড় সড় বাক্স ছিল যাতে ছিল আপেল ও অন্যান্য ফল। সারারাত আর কোন গাড়ি সীমান্ত পার হয়নি। মনে হচ্ছে, তারাই কিডন্যাপ করেছে আহমদ মুসাকে। তাদের যে ঠিকানা দেয়া হয়েছে তা ভুয়া। তাদেরকে জেনারেল বরিসের লোক মনে হচ্ছে।’
‘তাহলে আহমদ মুসাকে কিডন্যাপ করে উরুমুচিতে আনার সম্ভাবনাই বেশী।’
‘সম্ভাবনা নয়, নিশ্চিতভাবেই এটা হয়েছে। ওরা আহমদ মুসা ও মেইলিগুলিকে এক সাথে করতে চায়। আহমদ মুসার কাছ থেকে কিছু আদায়ের অথবা তাকে কোন ব্যাপারে বাধ্য করার জন্যে দরকষাকষির হাতিয়ার বানাতে পারে মেইলিগুলিকে।’ বলল যুবায়েরভ।
যুবায়েরভ থামল। কেউ কোন কথা বললনা। যুবায়েরভের শেষ কথাগুলো সবাইকে ভীত করে তুলেছে। জেনারেল বরিসের বর্বরতা, নীচতা সম্পর্কে তারা সকলেই জানে।
একটু পর আলদর আজিমভ বলল, ‘সময় নষ্ট করে লাভ নেই। ওয়াং ও বরিসের হেডকোয়ার্টারেই আমাদের হানা দিতে হবে।’
‘ঠিক তাই। আবদুল্লায়েভ গাড়ি ষ্টার্ট দাও। আমাদের প্রথম টার্গেট ওয়াং ও বরিসের হেডকোয়ার্টার। ওমর মা চ্যাং তুমি আমাদের গাইড।’
আবার ছুটে চলল যুবায়েরভদের গাড়ি।
‘আহমদ মুসাকে কিডন্যাপের জন্যে জেনারেল বরিসকে দায়ী করে এবং সে এই কাজে চীনের মাটি ব্যবহার করেছে বলে অভিযোগ এনে বেইজিং এর কাছে প্রতিবাদ করেছে আমাদের সরকার।’ বলল যুবায়েরভ।
‘ফল কিছু হবে?’ বলল আজিমভ।
‘আর কিছু না হোক জেনারেল বরিসের বিরুদ্ধে একটা অভিযোগ থাকল। আর অভিযোগটা ছোট না।’
উসু-উরুমুচি হাইওয়ে ধরে ছুটে চলছিল গাড়ি।
সাড়ে ৯ টা নাগাদ যুবায়েরভদের গাড়ি উরুমুচি শহরে প্রবেশ করল।
ওমর মা চ্যাং রাস্তা দেখিয়ে চলল। গাড়ি ছুটে চলল ওয়াং-বরিসের হেড কোয়ার্টারের দিকে।
শহরে প্রবেশের পাঁচ মিনিটের মধ্যেই গাড়ি এসে দাঁড়াল রেড ড্রাগন অর্থাৎ ওয়াং বরিসের হেড কোয়ার্টারের লনে।
গাড়ি থেকে নামতে নামতে যুবায়েরভ বলল, ‘মা চ্যাং দরজায় কোন প্রহরী দেখছিনা তো?’
‘নিশ্চয় রিসেপশনে বসে গল্প করছে।’
গাড়ি থেকে নেমে স্বাভাবিক হেঁটে তারা এগিয়ে চলল। প্রথমে যুবায়েরভ। তার সাথে ওমর মা চ্যাং। তাদের পেছনে আজিমভ ও আবদুল্লায়েভ।
যুবায়েরভ ও ওমর মা চ্যাং একই সাথে ঘরে প্রবেশ করল।
রিসেপশনের যুবকটি একটা টেবিল সামনে নিয়ে বসেছিল। তার টেবিলে একটা ইন্টারকম এবং একটা টেলিফোন সেট গোটা কয়েক চেয়ার তার টেবিলের সামনে। তার দু’টিতে বসে আছে দু’জন প্রহরী যাদের থাকার কথা ছিল গেটে। দু’জনের হাতেই দুটি ষ্টেনগান।
যুবায়েরভদের ঢুকতে দেখেই দু’জন প্রহরী উঠে দাঁড়াল। তারা ওমর মা চ্যাংকে চিনতে পেরেছে। তাদের দৃষ্টি ওমর মা চ্যাং এর দিকে। চোখে মুখে তাদের প্রশ্নের চিহ্ন। কিন্তু তারা কথা বলার আগেই যুবায়েরভ, আজিমভ ও আবদল্লায়েভের পিস্তল তাদের মাথা লক্ষ্য করল।
প্রথমটায় রিসেপশিনষ্ট ও প্রহরীদের মধ্যে বিষ্ময় বিমূঢ়তার সৃষ্টি হয়েছিল। তারপরই ভয়ে ফ্যাকাসে হয়ে গেল ওদের মুখ। একান্ত অনুগতের মত তিনজনেই হাত উপরে তুলল।
‘মা চ্যাং, আবদুল্লায়েভ এদের বেঁধে ফেল।’
সংগে সংগেই আজিমভ, আবদুল্লায়েব, মা চ্যাং এগিয়ে গিয়ে ওদের হাত পা বেঁধে ফেলল। তারপর মুখে টেপ আটকিয়ে ওদের মুখ বন্ধ করে টয়লেটে ঢুকিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল।
এক মিনিটের মধ্যেই শেষ হলো সব কাজ।
তারপর আবদুল্লায়েভকে রিসেপশন ও নিচের সিঁড়ি মুখটা সামলাতে বলে আজিমভ ও মা চ্যাং কে সাথে নিয়ে যুবায়েরভ ছুটল দু’তালায় ডাঃ ওয়াং ও জেনারেল বরিসের অফিসের দিকে।
সিঁড়ি দিয়ে উঠলে সিঁড়ি মুখেই পশ্চিমমুখি একটা করিডোর এবং দক্ষিণমুখি একটা করিডোর।
দক্ষিণমুখি করিডোরে প্রথমেই যে দরজা তা ডাঃ ওয়াং এর।
তারপরের দরজা জেনারেল বরিসের। তাদের দরজা দিয়ে ঢুকলে প্রথমেই তাদের সেক্রেটারীদের কক্ষ। সেক্রেটারীদের কক্ষ থেকে আরেকটি দরজা পেরিয়ে তাদের কক্ষ।
যুবায়েরভরা এসে দাঁড়াল প্রথম দরজার সামনে। যুবায়েরভ বলল, ‘মা চ্যাং তুমি ভেতরে গিয়ে ডাঃ ওয়াং এর পি এস নেইলিকে জিজ্ঞেস করে এস ডাঃ ওয়াং ও বরিস আছে কিনা।’
মা চ্যাং ঢুকতে যাচ্ছিল ঘরে।
যুবায়েরভ তাকে থামতে বলল। তারপর আজিমভের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘খোঁজ নেবার কোন দরকার নেই। তুমি বরিসের ঘরে ঢুকে যাও। ও থাকলে যা পরিকল্পনা তাই করবে। আর না পেলে ওদিক দিয়ে ডাঃ ওয়াং এর ঘরের দিকে খোঁজ নেবে। আমি ও মা চ্যাং যাচ্ছি ডাঃ ওয়াং এর ঘরে। তোমাদের যা বললাম, আমরাও তাই করব।’
‘খোদা হাফেজ’ বলে যুবায়েরভ দরজা ঠেলে গেল ভেতরে। সাথে মা চ্যাং।
তারা ঢুকতেই নেইলি উঠে দাঁড়াল। উঠে দাঁড়িয়েই মা চ্যাং এর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘এভাবে না বলে হঠাৎ মা চ্যাং?’
‘মাফ করবেন মিস নেইলি, খুব জরুরী প্রয়োজন। ডাঃ ওয়াং কি আছেন?’ মা চ্যাং কিছু বলার আগেই কথা বলে উঠল যুবায়েরভ।
‘জি, আছেন।’
‘তাহলে দয়া করে আপনি আমাদের নিয়ে চলুন।’
নেইলিকে পেছনে রেখে যাওয়া যুবায়েরভের ইচ্ছা নয়।
‘এভাবে তো তার সাথে দেখা করা যায় না। আমি তার অনুমতি নিয়ে আসি। আপনার পরিচয় বলুন।’
‘না মিস নেইলি দেরি হয়ে যাচ্ছে। আপনি চলুন।’ কঠোর কন্ঠ যুবায়েরভের। সেই সাথে পিস্তল হাতে তুলে নিয়েছে সে।
নেইলির মুখ ছাইয়ের মত সাদা হয়ে গেল। কাঁপতে লাগল সে।
হাটতে শুরু করল।
পিস্তল সহ হাত পকেটে ঢুকিয়ে যুবায়েরভ আগে চলল।
নব ঘুরিয়ে দরজা খুলে যুবায়েরভ ঘরে ঢুকতেই ডাঃ ওয়াং তড়াক করে উঠে দাঁড়িয়েছে। এমনভাবে কেউ তার ঘরে ঢুকবে এটা স্বাভাবিক নয় বলেই হয়তো।
ডাঃ ওয়াং-এর দুটি হাত টেবিলের উপরে ঝুলানো। চোখে তার একরাশ প্রশ্ন ও বিরক্তি।
ডাঃ ওয়াংকে দাঁড়াতে দেখে রিভলবার তুলল যুবায়েরভ।
ডাঃ ওয়াং-এর হাতের সাথেই একটি পেপার ওয়েট। যুবায়েরভ পিস্তল তোলার সংগে সংগে চোখের পলকে ডাঃ ওয়াং পেপার ওয়েটটা ছুঁড়ে মারল যুবায়েরভের রিভলভার লক্ষ্যে। ছুঁড়ে মারাটা এত ক্ষিপ্র ছিল যে, যুবায়েরভ কোন সুযোগই পায়নি রিভলভার তোলার অথবা সরিয়ে নেয়ার।
পেপার ওয়েটটা সরাসরি গিয়ে আঘাত করল রিভলভারে। ছিটকে পড়ল রিভলভার হাত থেকে।
মুহুর্তে চিত্র পালটে গেল। পেপার ওয়েট ছুড়েই ডাঃ ওয়াং তার রিভলভার তুলে নিয়েছে। তার নলটা যুবায়েরভকে লক্ষ্য করে স্থির ভাবে উঠানো।
নেইলি ও মা চ্যাং তখন কক্ষে প্রবেশ করেছে। ঘটনার এই পট পরিবর্তনে মা চ্যাং বিমূঢ়। সে তার পিস্তল বের করতে সুযোগ পেলনা। ডাঃ ওয়াং এর বাম হাতেও উঠে এসেছে রিভলভার।
ডাঃ ওয়াং হেসে উঠল হো হো করে।
কিন্তু হাসি থামার আগেই জেনারেল বরিসের ঘরের দিকে থেকে দরজা এক ঝটকায় খুলে গেল। দরজায় এসে দাঁড়াল আজিমভ। তার হাতের রিভলভার উদ্যত ডাঃ ওয়াং-এর লক্ষ্যে।
ক্ষিপ্র ও বেপরোয়া ডাঃ তার ডানের রিভলভার যুবায়েরভের দিকে স্থির রেখে বাম হাতের রিভলভার এক ঝটকায় ঘুরিয়ে নিয়েছিল আজিমভকে গুলি করা জন্যে।
কিন্তু মুসলিম মধ্যএশিয়ার গোয়েন্দা প্রধান আজিমভ ডাঃ ওয়াংদের চরিত্র ভাল করেই জানে। সুতরাং সে সময় নষ্ট করেনি। ডাঃ ওয়াং এর রিভলভার থেকে গুলি বেরোনোর আগেই আজিমভের রিভলভার ডাঃ ওয়াং-এর মাথা গুড়িয়ে দিল। তার দেহ গিয়ে ছিটকে পড়ল মাটিতে।
‘ধন্যবাদ আজিমভ। ঠিক সময়ে এসে পড়েছিলে। জেনারেল বরিস কোথায়?’ প্রশ্ন শেষ করে যুবায়েরভ মেঝে থেকে রিভলভার তুলে নিল।
‘জেনারেল বরিস নেই। ওদের নাকি একটা গোপন ঘাঁটি আছে, সেখানেই এখন উনি আছেন।’
যুবায়েরভ তার রিভলভার মিস নেইলির দিকে ঘুরিয়ে বলল, ‘মিস নেইলি, আপনার কথা মা চ্যাং এর কাছে শুনেছি। আপনি আমাদের শত্রু নন। আপনি আমাদের সাহায্য করুন।’
কাঁপছিল নেইলি। সে কোন কথা বলতে পারলো না।
‘ওদের গোপন ঘাঁটিটা কোথায় নেইলি?’
‘শহরের বাইরে।’
‘তুমি চেন?’
‘মেইলিগুলিকে কোথায় রেখেছে জান?
‘ঐ ঘাঁটিতে।’
‘আহমদ মুসাকে ওরা কিডন্যাপ করেছে জান?’
‘ঠিক জানি না, এ খবর ডাঃ ওয়াং আজ একজনকে টেলিফোনে বলছিলেন সেটা আমি শুনেছি।’
‘আহমদ মুসাকে কোথায় রেখেছে?’
‘আমি জানি না।’
‘ধন্যবাদ মিস নেইলি। তোমার কোন চিন্তা নেই। আমরা তোমাকে সাহায্য করব। তুমি আমাদের সাথে চল। ঘাঁটিটা দেখিয়ে দাও।’
বলে যুবায়েরভ ফিরে দাঁড়াল।
সবাই বেরিয়ে এল ঘর থেকে।
যুবায়েরভরা নিচে নেমে আবদুল্লায়েভকে সব জানিয়ে বলল, ‘এ দিকের খবর কি?’
‘গুলির শব্দ পেয়ে ভেতরে থেকে তিনজন ছুটে এসেছিল উপরে উঠার জন্যে। ওদেরকে ওপাশের স্টোররুমে ঢুকিয়ে দরজা বন্ধ করে দিয়েছি ছিটকিনি এটে।’
গাড়িতে এসে উঠল সবাই। বেরিয়ে আসার সময় হেড কোয়ার্টারের বাইরে দরজা বন্ধ করে দিয়ে এল।
এবার ড্রাইভিং সিটে বসল যুবায়েরভ। তার পাশের সিটে নেইলি। পেছনের সিটে আজিমভ, আবদুল্লায়েভ ও মা চ্যাং।
আবার ছুটতে শুরু করল গাড়ি।
দশটা বাজতে তখন পনের মিনিট বাকি।
প্রতিটি বাঁকে এসে নেইলি বলে দিচ্ছে কোন দিকে যেতে হবে।
‘তোমার কে আছে নেইলি?’
‘মা আছেন, ছোট ভাই আছে।’
‘চাকুরী না করলে তোমার চলে না?’
‘চললে এই চাকুরী করতে কিছুতেই আসতাম না।’
‘এখন কি করবে?’
‘আরেকটা খুঁজতে চেষ্টা করব।’
‘সহজে চাকুরী পাওয়া যায়?’
‘পাওয়া যায়, কিন্তু সব চাকুরী নেয়া যায় না। মান-সম্মান থাকে না।’
‘অনেকেই তো মান সম্মানের চিন্তা করে না। করে কি?’
‘তা করে না। কিন্তু আমি করি। আমার মার শিক্ষা এটা।’
‘তাহলে তো তোমার মা খুব ভাল।’
‘জি হ্যা। আমার মা মুসলিম ঘরের মেয়ে ছিলেন তো। শানসি প্রদেশে ছিল তাদের বাড়ি। হানরা আমার আম্মার আব্বা-আম্মা, ভাই সবাইকে হত্যা করে। তাদেরই এক হাত যুবক আমার মাকে নিয়ে আসে এবং বিয়ে করে।’
যুবায়েরভের বুকটা বেদনায় চিন চিন করে উঠল। কিছুক্ষণ সে কথা বলল না। ভাবল শানসি প্রদেশের সেই দৃশ্যের কথা।
এক সময় বলল, ‘নেইলি, তুমি আমাদের বোন।’
একরাশ বিস্ময় নিয়ে চোখ ফিরাল নেইলি যুবায়েরভের দিকে।
‘বোন বলায় বিস্মিত হচ্ছ? তুমি মুসলিম মহিলার মেয়ে, আমরা মুসলিম।’
‘আপনারা মুসলিম? ও গড তাই তো বলি ওয়াং শত্রু কেন আপনাদের।’
‘না নেইলি, ওয়াং আমাদের শত্রু নয়, সেই আমাদের শত্রু বানিয়েছে।’
‘আমি জানি সেটা। আমার আম্মা ডাঃ ওয়াং ও বরিস দুজনেরই বিরোধী। আমার এ চাকুরীতে তিনি মত দেননি। কিন্তু বাঁচার জন্যে বাধ্য হয়ে এ চাকুরী নিতে হয়েছে আমাকে। আমার আম্মা আপনাদের কথা শুনলে খুশী হবেন।’
‘তুমি খুশি হওনি?’
‘আম্মা মুসলমানদের পক্ষে, মুসলমানদের ভালবাসেন তাই বলছিলাম।’
‘তুমি বুঝি ভালবাসনা?’
‘মায়ের ধর্মই সন্তানকে আকৃষ্ট করে বেশী। আমার ক্ষেত্রেও তাই। কিন্তু এ নিয়ে গভীরভাবে ভাবার কোন সুযোগ হয়নি। মা আমাকে ছোট বেলা ইসলাম ধর্মের অনেক কিছু শিখিয়েছেন। মায়ের সাথে গোপনে আমি নামাজও পড়েছি। কিন্তু বড় হবার পর সব গোলমাল হয়ে গেছে।’
‘জান, মা চ্যাং মুসলমান?’
‘মুসলমান? কই আমাকে তো বলেনি?’ উচ্ছ্বসিত কন্ঠে বলল নেইলি। আনন্দে তার চুখ মুখ উজ্জ্বল।
একটু থেমে বলল নেইলি, ‘আজ বুঝেছি, কেন ও আমার কাছে আসতো। টার্গেট ছিল ওয়াং।’ মুকটা একটু যেন ম্লান নেইলির।
কথা শেষ করেই নেইলি দ্রুত চাপা কন্ঠ বলল, আমরা এসে গেছি জনাব। দক্ষিণের ঐ বাড়িটাই ওদের সেই ঘাঁটি।
পুর্ব-পশ্চিম রাস্তা। রাস্তা থেকে একটু দুরে আলো-আঁধারের মাঝে দাঁড়িয়ে আছে একটি বাড়ি।
রাস্তা থেকে একটা ইট বিছানো পথ গিয়ে উঠেছে ও বাড়িতে। রাস্তার পাশে গাড়ি দাঁড় করাল যুবায়েরভ।
বাড়িটা উত্তরমূখি। বাড়ির উত্তর দিকের মাঝামাঝি কিছু অংশ ছাড়া চারদিকেই কিছু কিছু গাছ-পালা ও ঝোপ ঝাড় রয়েছে।
বাড়ির সম্মুখ দিয়ে গাড়ি বারান্দা পর্যন্ত যতটুকু দেখা যাচ্ভে তাতে কাউকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না।
‘আমার মনে হয় গাড়ি এখানেই রেখে যাওয়া উচিত। ওদের নজর এড়িয়েই আমাদের ওখানে পৌছতে হবে। ওখানকার কোন অবস্থাই তো আমরা জানিনা।’ বলল যুবায়েরভ।
‘আমারো তাই মত।’ বলল আজিমভ।
সবাই গাড়ি থেকে নামল। গাড়িটাকে ঠেলে দিল একটা ঝোপের আড়ালে।
‘নেইলি, তুমি এখানে অপেক্ষা করতে পার, আবার ইচ্ছে করলে চলে যেতে পার।’ নেইলির দিকে তাকিয়ে বলল যুবায়েরভ।
‘দু’টির কোনটিই আমি করবনা। আমি আপনাদের সাথে এ অভিযানে যাব।’ বলল নেইলি।
‘এতে বিপদ আছে বোন। তুমি সব জান।’
‘জানি বলে যেতে চাই। কোন দিন কোন ভাল কাজ করিনি। মা খুশি হবেন।’
আর কথা বড়ালোনা যুবায়েরভ। সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘আমরা বিভিন্ন দিক থেকে একই সাথে গিয়ে গাড়ি বারান্দার আশে-পাশে আত্মগোপন করব। শুধু আমি ও আজিমভ ওদের দরজায় গিয়ে নক করব। তারপর ইশারা করলে সবাই যাবে।’
সবাই ছড়িয়ে পড়ল ওবাড়িতে যাবার জন্য।
যুবায়েরভ ও আজিমভ দু’দিক থেকে ওবাড়ির দেয়ালের গোড়ায় পৌছে দেয়ালের পাশ ঘেঁষে অগ্রসর হয়ে গাড়ি বারান্দায় গিয়ে উঠল। গাড়ি বারান্দায় যে গাড়িটা দাঁড়ানো দেখা যাচ্ছিল তার পাশ ঘেঁষে যুবায়েরভ ও আজিমভ গিয়ে বারান্দায় উঠে দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। তারা দেখে বিস্মিত হলো, গাড়ি বারান্দায় দাঁড়ানো গাড়িটির দরজা খোলা। শুধু তাই নয়, গাড়ির চাবিটিও কি হোলে ঝুলছে। যুবায়েরভ বলল, ‘মনে হয় ওরা এই ঘাঁটিকে খুবই নিরাপদ বলে মনে করে।’
আজিমভ মাথা নাড়ল। ‘তাই মনে হচ্ছে বটে, কিন্তু একটা রহস্য আছে।’
‘তাহলে কি মনে কর, ঘাঁটির সামনেটা দেখার জন্যে টেলিভিশন ক্যামেরা সেট করা আছে? তাই কি এরা এত নিশ্চিত?’
‘আমার মনে হয় এরকম কিছু না হলে একটা ঘাঁটিকে এরা অরক্ষিত রাখতে পারেনা।’
‘তাহলে তো নক করলে ওরা নিশ্চয় মনে করবে টেলিভিশন ক্যামেরার চোখ এড়িয়ে নিশ্চয় শত্রু কেউ এসেছে। সে ক্ষেত্রে গোটা বাহিনী এলার্ট হওয়ার সম্ভবনা।’
‘ঠিক তাই।’
‘তাহলে বিকল্প পথ হচ্ছে লক গলিয়ে প্রবেশ করা।’
বলেই যুবায়েরভ পকেট থেকে লেসার বীম স্পাই মাল্টিপুল বের করল।
এ অত্যাধুনিক অস্ত্রটি সব কাজের কাজী। ধাতব যে কোন বস্তু কাটা ও ফুটো করায় এর জুড়ি নেই। যে কোন লক এক নিমিষে আন লক করতে পারে।
যুবায়েরভ স্পাই মাল্টিপুলের লেসার বীম দিয়ে দরজার তালা হাওয়া করে দিল।
মূহূর্ত কয়েক অপেক্ষা করল। তারপর ধীরে ধীরে দরজা খুলল।
নিঃশব্দে খুলে গেল দরজা।
যুবায়েরভ উঁকি দিল ভেতরে। কেউ নেই। বিরাট হল ঘর ফাঁকা। আজিমভ দেখল দেখার পর বলল, ‘কিন্তু যুবায়েরভ, ভেতরে যাবার তো কোন দরজা দেখিনা।’
কার্পেটে ঢাকা ঘর। চারদিকে সার করে পাতা সোফা।
চারদিকে তাকিয়ে যুবায়েরভ বলল, ‘দরজা থাকতেই হবে। দেখা যাচ্ছেনা এটাই রহস্য। আমার মনে হয় তাদের ডাকা যাক।’
‘ঠিক আছে ডাকছি,’ বলে আজিমভ বেরিয়ে গেল। অল্পক্ষণ পরে এসে বলল, ‘আমাদের মতই বাড়ির দেয়ালের গা ঘেঁষে ওদের নিয়ে এসেছি। ওরা এসেছে। ওরা দরজার বাইরে আপাতত থাক।’
‘আমার মনে হয় আব্দুল্লায়েভ আসুক।’
আজিমভ গিয়ে আব্দুল্লায়েভকে ডেকে আনল।
চারদিকে সতর্ক দৃষ্টি রেখে ওরা তিনজনে দেয়াল পরীক্ষা করতে লাগল। যুবায়েরভের বিশ্বাস, ভেতরে ঢুকার গোপন দরজা এখানেই আছে।
এই সময় মা চ্যাং ও নেইলি দরজা ঠেলে হন্ত দন্ত হয়ে ঘরে ঢুকে বলল, একটা জীপ এ গাড়ি বারান্দার দিকে আসছে।
যুবায়েরভ তত্ক্ষণাত সবাইকে দরজার বিপরীত দিক অর্থাৎ দক্ষিণ পাশের সোফার আড়ালে শুয়ে পড়তে বলল এবং নির্দেশ দিল রিভলভার হাতে রাখার জন্য।
সোফার আঁড়ালে শুয়ে রূদ্বশ্বাসে অপেক্ষা করছে যুবায়েরভরা।
ঘরটা সাউন্ড প্রুফের মত। গাড়ি আসার কোন শব্দ পেল না তারা। প্রায় তিন মিনিটের মত পার হয়ে গেল।
দুই সোফার ফাঁক দিয়ে যুবায়েরভ চোখ রেখেছিল দরজার ওপর। এক সময় দরজা নড়ে উঠল। খুলে গেল দরজা।
খোলা দরজায় দাঁড়িয়ে দরজার লকের দিকে তাকিয়ে উদ্বিগ্ন কন্ঠে একজন বলে উঠল, ‘হোয়াং, দরজার তালা কে যেন ল্যাসার বীম দিয়ে কেটে ফেলেছে।’
তার কথার সংগে সংগেই আরো তিনটি মুখ দরজার তালার ওপর যেন হুমড়ি খেয়ে পড়ল।
সবাই মুখ তুলল। সবার মুখই বিস্ময়ে বিস্ফারিত।
দরজা বন্ধ করে দিয়ে প্রথম জন বলল, ‘সন্দেহ নেই শত্রু ঘাঁটিতে ঢুকেছে, ভেতরে কি অবস্হা কে জানে?’
‘চল আমাদের সাবধানে ঢুকতে হবে। শত্রুকে আঘাত করতে হবে পেছন থেকে। ভাগ্যিস আমরা কয়েকজন ফিরে এলাম। ঘাঁটি খালি করে এইভাবে সবাই ঐ অভিযানে শামিল হবার সিদ্ধান্ত নেয়া ঠিক হয়নি।’
ওদের চারজনের হাতেই স্টেনগান।
ওরা ধীরে ধীরে এগুলো উত্তরের দেয়ালের দিকে।
যুবায়েরভ বুঝল উত্তর দেয়ালেই গোপন দরজা আছে।
যুবায়েরভ ইংগিত করল আজিমভকে, আজিমভ আব্দুল্লায়েভকে, আব্দুল্লায়েভ মা চ্যাংকে যে, ওদের ভেতরে যেতে দেয়া যাবেনা।
ওদের চারজনের একজন হঠাৎ দক্ষিণ দেয়ালের কাছে সরে এল নেইলি তার নজরে পড়ে গেল। সংগে সংগে সে চিত্কার করে উঠল। ঘুরাল তার স্টেনগান। অন্য তিনজনও চরকির মত ঘুরে দাঁড়াল। যুবায়েরভ প্রস্তুত ছিল। তার রিভলভার প্রথম টারগেট করল নেইলিকে যে দেখতে পেয়েছিল তাকে। গুলি খেয়ে পড়ে গেল সে। অন্য তিনজন স্টেনগান তুলেছিল এলোপাথাড়ি গুলি করার জন্য।
তারা কাউকে দেখতে পাচ্ছিল না।
যুবায়েরভ ইতিমধ্যে দ্বিতীয় গুলি ছুঁড়েছে। তার দ্বিতীয় গুলি আরেকজনকে বিদ্ধ করেছে। অন্য দুই জন আজিমভ,আব্দুল্লায়েভ ও মা চ্যাং এর গুলি খেয়ে ঢলে পড়ল। একজনকে দুই গুলি গিয়ে পর পর বিদ্ধ করেছে।
সোফার আঁড়াল থেকে বেরিয়ে এল যুবায়েরভরা।
যুবায়েরভ ও আজিমভ ছুটে গেল উত্তর দেয়ালে। খুঁজতে লাগল দেয়ালে গোপন দরজার চিহ্ন।
দেয়ালে কিছুই পাওয়া গেল না।
কার্পেট উল্টে ফেলে দেয়ালের গোঁড়ায় খুঁজতে লাগল। অবশেষে পেল যুবায়েরভ। সাদা দেয়ালের গোড়ায়, সব সময় কার্পেটে ঢাকা থাকে, পাওয়া গেল সাদা একটা বোতাম। চাপ দিল সে বোতামে।
সংগে সংগে পাশ থেকে দেয়াল সরে গেল। সৃষ্টি হলো এক দরজা।
যুবায়েরভরা সকলে একটি করিডোরে বেরিয়ে এল। করিডোরটি গজ চারেক সামনে এগিয়ে আরেকটি করিডোরে পড়েছে। সে করিডোরটি পূর্ব পশ্চিমে লম্বা।
যুবায়েরভরা সামনে এগিয়ে পূর্ব-পশ্চিম লম্বা করিডোরে পড়তেই ডানে তাকিয়ে একটা দরজা দেখতে পেল।
সবাইকে দাঁড়াতে বলে যুবায়েরভ দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। ডান হাতে রিভলবার বাগিয়ে বাম হাতে এক ঝটকায় রজা খুলে ফেলল।
ঘরের ভেতর একজন লোক টিভি স্ক্রীনের সামনে বসে ছিল। তার পিঠ দরজার দিকে। আর স্টেনগান ধারী দু’জন লোক তার পেছনে কথা বলছিল।
দরজার খোলার শব্দে চমকে উঠে ওরা পেছনে ফিরছিল। কিন্তু সে সময় তারা পেল না।
যুবায়েরভ ও আজিমভ লাফ দিয়ে ভেতরে পড়ে পেছন থেকে ওদের গলা পেঁচিয়ে ধরল। আর আবদুল্লায়েভ গিয়ে রিভলভার ধরল টিভি স্ক্রিনের সামনে বসা লোকটির মাথায়।
লোক দু’টির গলা পেঁচিয়ে ধরা যুবায়েরভ ও আজিমভের হাত সাঁড়াশির মত চেপে বসছিল তাদের গলায়। মিনিট দেড়েকের মধ্যে ওদের দেহ ঝুলে পড়ল ওদের হাতে। ছেড়ে দিতেই ঝরে পড়ল মাটিতে।
তাড়াতাড়ি টেনে বাথরুমে ঢুকিয়ে দিল ওদের প্রাণহীন দেহ।
টিভি স্ক্রিনের সামনে বসা লোকটি কাঁপছিল।
‘আহমদ মুসা ও মেইলিগুলি কোথায়?’ কঠোর কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করল যুবায়েরভ।
‘করিডোর ধরে পূর্ব দিকে।’ কাঁপতে কাঁপতে বলল লোকটি।
‘আর জেনারেল বরিস?’
‘ওদিকেই হবে।’
যুবায়েরভ মা চ্যাংকে বলল, ‘একে বেধে ফেল, হাত-পা সব। মুখ বন্ধ করে দিয়ে টয়লেটে ঠেলে দাও। তারপর তুমি ও নেইলি এখানে বস। টিভি স্ক্রিন পাহারা দাও। কেউ এ বাড়ির দিকে এলে আমাদের খবর দেবে। আমরা আশেপাশে আছি।’
যুবায়েরভের কথা শেষ হতেই একটা শুলির শব্দ এল। যুবায়েরভরা উৎকর্ণ হয়ে বুঝতে চেষ্টা করল গুলির শব্দটা কোন দিক থেকে এল।
আরো অনুসন্ধান ও বুঝার লক্ষ্যে যুবায়েরভরা করিডোরে বেরিয়ে এল। ঠিক এ সময়েই আরেকটা গুলির আওয়াজ পাওয়া গেল।
এ আওয়াজটা বড় রিভলভারের আওয়াজ। আর আগেরটা মিনি পিস্তলের।
যুবায়েরভ, আজিমভ ও আবদুল্লায়েভ রিভলভার বাগিয়ে উদ্বিগ্ন ভাবে এগুলো করিডোর ধরে পূর্ব দিকে।
অল্প কিছুটা এগুতেই আরেকটা গুলির আওয়াজ হলো। আগের সেই পিস্তলের গুলি।
দৌড় দিল যুবায়েরভরা।
দুইটি বাক ঘুরার পর সামনেই একটি কক্ষের দরজা খোলা দেখা গেল।
সবাই দৌড় দিল সেদিকে।
প্রথম ঘরে ঢুকল যুবায়েরভ।
ঘরে ঢুকে দৃশ্য দেখে চিৎকার করে উঠল যুবায়েরভ ‘মুসা ভাই’ বলে।
যুবায়েরভের সাথে সাথেই প্রবেশ করল আজিমভ ও আবদুল্লায়েভ। তারাও দৃশ্য দেখে আর্তনাদ করে উঠল।
রক্তে ডুবে আছে জেনারেল বরিসের দেহ। রক্তে ভেজা মেইলিগুলি বুকে হেটে এগুচ্ছে আহমদ মুসার দিকে। আষ্টে-পৃষ্টে বাধা আহমদ মুসার বেদনা পিষ্ট মুখ চোখের পানিতে ভাসছে।
মেইলিগুলি আবদুল্লায়েভকে চেনে।
তাদের দেখে মেইলিগুলি এগুনো বন্ধ করে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল।
আজিমভ ও যুবায়েরভ ছুটে গেল আহমদ মুসার বাঁধন কাটার জন্যে। আর আবদুল্লায়েভ ছুটে গেল মেইলিগুলির কাছে।
‘ভাবী, একি হয়েছে’ বলে ডুকরে কেঁদে উঠল আবদুল্লায়েভ।
মেইলিগুলি মাথাটা ইঞ্চি খানেক তুলে বলল ক্ষীণ কণ্ঠে, ‘তাড়াতাড়ি ওর বাঁধন খুলে দাও।’
আবদুল্লায়েভ ছুটে গেল আহমদ মুসার দিকে।
তিন জনে মিলে তাড়াতাড়ি মুক্ত করল আহমদ মুসাকে।
আহমদ মুসা উঠেই ছুটে গেল মেইলিগুলির কাছে। কোলে তুলে নিল তার মাথা। তারপর যুবায়েরভদের দিকে চেয়ে ভাঙা গলায় বলল, ‘হাসপাতালে কি একে নেয়া যেতে পারে যুবায়েরভ।’
যুবায়েরভ এ প্রশ্নের উত্তর তাড়াতাড়ি দিতে পারল না। কি উত্তর দেবে সে? এদেশের কিছুই যে তাদের পক্ষে নয়! অশ্রু গড়াতে লাগল যুবায়েরভের চোখ থেকে। কান্না আটকাতে পারল না আজিমভ ও আবদুল্লায়েভও।
উত্তর দিল মেইলিগুলি নিজেই। বলল, ‘হাসপাতালের কথা ভেব না। সে সময় নেই। তোমার কাছে আমার একটি অনুরোধ, তুমি এমন জায়গায় আমার কবর দেবে যেখানে তুমি প্রতিদিন না হোক, মাসে না হোক, অন্তত বছর একবার তুমি আসতে পারো। বল রাখবে আমার এ আবেদন?’ আহমদ মুসার কোলে মুখ গোজা মেইলিগুলির ক্ষীণ কণ্ঠ থেকে বেরিয়ে এল কথা গুলো।
আহমদ মুসা কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে বলল, ‘না আমিনা তুমি এভাবে চলে যেতে পার না।’
মেইলিগুলি বহু কষ্টে তার দুর্বল একটি হাত তুলে আহমদ মুসার হাত জড়িয়ে ধরে বলল, ‘তোমার অনেক দায়িত্ব, তোমাকে ভেঙ্গে পড়লে চলবে না।’
একটু দম নিল মেইলিগুলি। ধীরে ধীরে আবার শুরু করল, ‘আমার কোন অতৃপ্তি নেই। আমি তোমার কোল পেয়েছি, এটুকুই ছিল আল্লাহর কাছে আমার শেষ চাওয়া। আর তাই পার্বত্য ভূমির বিজন পথের বুকে আমার মরার কথা ছিল। জ্ঞান হারাবার আগে আমার আল্লাহর কাছে আমি সময়ের জন্যে প্রার্থনা করেছিলাম। বলেছিলাম, আমার স্বামীকে একবার দেখার মত সময়টুকু আমি তোমার কাছে চাই। আমার প্রার্থনা তিনি মঞ্জুর করেছেন। আমি পরিতৃপ্ত। আমি কাঁদছি না, তুমি কেঁদো না।’
ক্ষীণ হতে ক্ষীণতর হয়ে থেমে গেল মেইলিগুলির কথা। চোখ দু’টি বুজে গেল মেইলিগুলির।
অল্প পরেই চোখ খুলল মেইলিগুলি ধীরে ধীরে। আহমদ মুসার অশ্রু ধোয়া চোখে চোখ রেখে মেইলিগুলি বলল, ‘তুমি আমার জীবনে আসার আগে আমার যে জীবন তা ছিল পাপে ভরা। তাতে এক ওয়াক্ত নামাজও নেই। আমার কি হবে?’
আহমদ মুসার মাথা নিচে নেমে এল। স্পর্শ করল মেইলিগুলির মাথা। নরম অশ্রু বিজড়িত কণ্ঠে বলল আহমদ মুসা, ‘তুমি অতীতের জন্যে তওবা করেছ আমিনা, আল্লাহ তোমাকে মাফ করবেন। আর আজ তোমার যে রক্ত ঝরল তা শহীদের রক্ত আমিনা। আল্লাহ তোমাকে শহীদের দরজা দেবেন।’
ধীরে ধীরে আবার চোখ বুজল মেইলিগুলি। তার দেহ আরও নিস্তেজ হয়ে পড়ল। আহমদ মুসার হাত থেকে মেইলিগুলির হাত খসে পড়ল।
আবার চোখ খুলে গেল মেইলিগুলির। তার শুকিয়ে যাওয়া ঠোঁট কাঁপল। অস্ফুটভাবে বেরিয়ে এল কথা, ‘আমার পিতা- মাতার সম্পত্তির আমি মালিক, আমার নিজেরও সম্পত্তি রয়েছে। তুমি ছাড়া আমার আর কেউ রইল না। এই সম্পত্তি সবই তোমার।
ইসলামের জন্যে যেভাবে পার কাজে লাগিও। আর আমার একটা একাউন্ট আছে জেদ্দার ইসলামিক সোস্যাল সিকুরিটি ব্যাংকে। আমার লকেটে তার কোড-কার্ড আছে। এ অর্থ তোমার সন্তানের জন্যে।’
বলেই চোখ বুজল মেইলিগুলি। তার কাঁপা ঠোট থেকে ভাঙ্গা ভাঙ্গা শব্দে বেরিয়ে আসতে লাগল, ‘লা- ইলাহা ইল্লাল্লাহু, মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ।’
কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল আহমদ মুসা মেইলিগুলির প্রাণ হীন দেহ বুকে জড়িয়ে ধরে।
অশ্রুর বান বইছিল যুবায়েরভ, আজিমভ এবং আবদুল্লায়েভের চোখে।
যুবায়েরভ ধীরে ধীরে এগিয়ে আহমদ মুসার কাঁধে হাত রাখল। কিন্তু মুখে কিছুই বলতে পারল না। যে শোক যুবায়েরভরা সইতে পারছে না, সে শোক আহমদ মুসা সইবে কেমন করে! তাকে কি সান্ত্বনা দেবে তারা!
যুবায়েরভ কাঁধে হাত রাখার পর আহমদ মুসা সম্বিত ফিরে পেল। একবার সবার দিকে তাকিয়ে চোখ ফিরাল মেইলিগুলির দিকে। ধীরে ধীরে অতি আদরে মেইলিগুলির মাথাটা নামিয়ে রাখল মেঝের ওপর। তারপর দু’হাতে মুখ ঢেকে উঠে দাঁড়াল আহমদ মুসা।
যুবায়েরভ, আজিমভ ও আবদুল্লায়েভ জড়িয়ে ধরল আহমদ মুসাকে।
চারজনের কান্না এক হয়ে মিশে গেল।

Top