১৫. আবার সিংকিয়াং

চ্যাপ্টার

মধ্যএশিয়া মুসলিম প্রজাতন্ত্রের কাজাখ প্রদেশের মধ্য অঞ্চলের ছোট শহর কারসাপকের ছোট বিমান বন্দরে ল্যান্ড করল আহমদ মুসাদের ছোট বিমানটি পূর্ব পরিকল্পনার ঠিক চব্বিশ ঘণ্টা পর।
উরুমুচি বসে আহমদ মুসা যে পরিকল্পনা করেছিল, তাতে আলতাই পার্বত্য ভূমিতে রাত তিনটায় হেলিকপ্টারে উঠার পর কারসাপক শহরে এসে পৌঁছার কথা সকাল দশটায়। কিন্তু আহমদ মুসারা এসে পৌঁছল পরের দিন সকাল দশটায়।
সিংকিয়াং এর আলতাই পার্বত্য ভূমি থেকে হেলিকপ্টারে ওঠার পর আহমদ মুসা তার পরিকল্পনা পরিবর্তন করেছিল।
কারসাপকের পরিবর্তে তার হেলিকপ্টারকে ল্যান্ড করার নির্দেশ দিয়েছিল বলখাস হ্রদের পশ্চিম তীরের শহর বলখাসে।
আজিমভ বিস্মিতভাবে চোখ তুলেছিল আহমদ মুসার দিকে ।
‘কৌশল পরিবর্তন করলাম।’ হেসে বলেছিল আহমদ মুসা।
এতটুকু উত্তরে তৃপ্ত হয়নি আজিমভ এবং নবীয়েভ। তাদের চোখে প্রশ্ন রয়েই গিয়েছিল।
‘আমরা আজকের দিন’ আবার বলতে শুরু করেছিল আহমদ মুসা, এবং আজকের রাত এই হ্রদ শহর বলখাসেই থাকব। আগামীকাল সকালে আমরা যাত্রা করব কারসাপকের উদ্দেশ্যে।’
‘নিশ্চয় বড় কোন পরিকল্পনা আপনার আছে, সেটা কি?’ উন্মুখ হয়ে জিজ্ঞাসা করেছিল আজিমভ।
‘বলছি। তুমি বলখাসে নেমেই সংবাদ মাধ্যমে খবর পৌঁছাবে, ‘সারিজু আণবিক প্রকল্পের শীর্ষ বিজ্ঞানী আবদুল্লাহ আলী নবীয়েভ তার স্ত্রী ও মেয়ে সহ কিডন্যাপ হয়েছিলেন। তাদের প্রতিবেশী একটি দেশে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। দুষ্কৃতকারীরা তার স্ত্রী ও মেয়েকে হত্যা করেছে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত বিজ্ঞানীকে উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে। বিজ্ঞানী আজ সকাল দশটায় কারসাপকে ফিরছেন। তিনি এখানে দু’একদিন বিশ্রাম নেবার পর সারিজু প্রকল্পের কাজে যথারীতি যোগদান করবেন।’ এই খবর পৌঁছাবার সাথে সাথে তুমি প্রশাসনের কাছে নির্দেশ পৌঁছাবে, আজকের সান্ধ্যকালীন ও কালকের সকালের কাগজে অবশ্যই যেন খবরটি বের হয়। বিশেষ করে এই খবর কারসাপক ও সারিজুর কাগজগুলোতে অবশ্যই যেন ওঠে।’
আহমদ মুসার কথায় হাসি ফুটে উঠেছিল আজিমভের মুখে। উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলে উঠেছিল, ‘বুঝেছি মুসা ভাই আপনি কি ঘটাতে চান।’
‘কি?’ আহমদ মুসার মুখে হাসি।
‘ষড়যন্ত্রকারীদের আপনি দিনের আলোতে আনতে চান। আপনি চান তারা জনাব নবীয়েভকে কেন্দ্র করে সক্রিয় হোক।’
‘ঠিক বলেছ আজিমভ। ওরা সক্রিয় না হলে ওদের নাগাল পাওয়া যাবে না।’ বলল আহমদ মুসা।
‘আপনাকে ধন্যবাদ মুসা ভাই। আপনি যে কৌশল বের করেছেন, আমাদের সামনে এগুবার, আমার মনে হচ্ছে, এটাই একমাত্র পথ।’ বলল আজিমভ।
কারসাপক বিমান বন্দর ছোট।
সিঁড়ি লাগল গিয়ে বিমানে।
বিমান বন্দরের ভেতরে ও বাইরে অনেক লোকের সমাগম হয়েছে।
সারিজু আণবিক প্রকল্পের বিশিষ্ট কয়েকজন কর্মকর্তা এবং প্রশাসনের কয়েক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা এসেছিলেন বিজ্ঞানী আবদুল্লাহ আলী নবীয়েভকে স্বাগত জানাতে। এছাড়া কিছু পুলিশ ও গোয়েন্দা কর্মকর্তা এসেছিলেন আজিমভকে স্বাগত জানাবার জন্যে।
বিমানের দরজা খুলতেই তাদের কয়েকজন উঠে এল বিমানে। সারিজু প্রকল্পের কর্মকর্তারা তাদের হারানো রত্নকে ফিরে পেয়ে জড়িয়ে ধরল। কুশল বিনিময় ও প্রাথমিক কথাবার্তার পর তারা নামিয়ে নিয়ে গেল জনাব নবীয়েভ ও আজিমভকে।
তাদের পেছনে পেছনে চলল আহমদ মুসা। এ রকমই পরিকল্পনা ছিল। আহমদ মুসার কারসাপকে আগমন সম্পূর্ণ গোপন রাখা হয়েছে।
লাউঞ্জে এসে আহমদ মুসা পেল সেদিনের সকালের কাগজ। কাগজের প্রথম পাতা চোখের সামনে মেলে ধরতেই খুশী হয়ে উঠল আহমদ মুসা। বিজ্ঞানীর কিডন্যাপ ও প্রত্যাবর্তনের খবরকে পত্রিকার প্রথম বিষয় হিসাবে বিরাট আকারে ছাপা হয়েছে। দুই কলাম ব্যাপী বিরাট ফটো দেয়া হয়েছে বিজ্ঞানীর। তার জীবনী ও কৃতিত্বও ছাপা হয়েছে ঘটনার বিবরণের সাথে।
পড়ল আহমদ মুসা খবরটি।
পড়ে আনন্দিত হলো, সব কথাই খবরে এসেছে। আহমদ মুসার মনে হলো, খবরটা সাধারণ্যে ইতিমধ্যেই ছড়িয়ে পড়েছে। বাইরের বিরাট লোক সমাগম নিশ্চয় এ কারণেই।
একজন বিমান অফিসারকে কাছে পেয়ে আহমদ মুসা জিজ্ঞাসা করল, ‘বাইরে এত লোক সমাগম কেন?’
‘বিজ্ঞানী সাহেবের খবর বেরুবার পর এই কান্ড ঘটেছে। তাকে দেখার জন্যে এসেছে মানুষ।’ বলল বিমান অফিসারটি।
পুলিশ পরিবেষ্টিত হয়ে লাউঞ্জ থেকে বেরুল বিজ্ঞানী নবীয়েভ। তার সাথে সাথে আজিমভ। পেছনে ভীড়ের সাথে মিশে চলছে আহমদ মুসা।
মানুষ চলার পথের দুধারে দাঁড়িয়ে অভিনন্দন জানাচ্ছে বিজ্ঞানীকে। পুলিশ নবীয়েভকে কর্ডন করে নিয়ে চলেছে গাড়ির দিকে।
গাড়িতে উঠল গিয়ে নবীয়েভ।
পাশের আরেকটা গাড়িতে উঠল আজিমভ।
একটু দুরে একটা গাড়িতে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল আহমদ মুসা। তার চোখ নবীয়েভদের গাড়ির দিকে।
আহমদ মুসার পাশেই আরেকটা গাড়ি দাঁড়িয়েছিল। সে গাড়িতে ঠেস দিয়ে একজন লোক সিগারেট ফুঁকছিল।
লোকটির পোশাক আহমদ মুসার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। লোকটির পরনে আট সাট জিনসের প্যান্ট, আর গায়ে গেঞ্জি। গেঞ্জিতে ইয়া বড় ভল্লুকের মুখ আঁকা। রুশ-কাজাখ মিশ্র চেহারা লোকটির। লোকটির আরেকটা বৈশিষ্ট্য আহমদ মুসার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। সেটা হলো, তার ভাবলেশহীন চেহারা। আহমদ মুসা সহ চারদিকের সবার বিস্মিত দৃষ্টি পুলিশ বেষ্টিত বিজ্ঞানী নবীয়েভের দিকে। একদিকে কিডন্যাপ হওয়া বিজ্ঞানীর আগমন, অন্যদিকে বিপুল পুলিশের সমারোহ। এমন দৃশ্য কারসাপক বিমান বন্দরের জন্যে নতুন। সুতরাং সবার বিস্মিত দৃষ্টি সেদিকেই। কিন্তু এসব কিছুই যেন এই লোকটির দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারেনি।
নবীয়েভদের গাড়ি গুলো চলতে শুরু করল। প্রথমে একটি পুলিশের গাড়ি। তারপর স্টার্ট দিয়েছে নবীয়েভের গাড়ি।
সামনের চত্বরের মাঝামাঝি পথ গিয়েছে পুলিশের গাড়ি। ছয় সাত গজের বেশী যায়নি নবীয়েভের গাড়ি। পেছনে আজিমভের গাড়ি সবে স্টার্ট নিয়েছে। এমন সময় প্রচণ্ড বিস্ফোরণের শব্দ হলো। নবীয়েভের গাড়ি টুকরো টুকরো হয়ে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল। ধোয়ায় ঢেকে গেল স্থানটি।
আহমদ মুসা চমকে উঠে ঠেস দেয়া অবস্থা থেকে সোজা হয়ে দাঁড়াল। হঠাৎ আহমদ মুসা তার পাশের গাড়ি স্টার্ট নেয়ার শব্দ শুনতে পেল। ঝট করে মুখ ফেরাল আহমদ মুসা। দেখতে পেল ড্রাইভিং সিটে ভল্লুকের মাথাওয়ালা গেঞ্জি পরা সেই লোকটি। ঠোঁটে তার হাসি।
ভ্রু কুঁচকালো আহমদ মুসা। নির্বিকার নিরাসক্ত লোকটির হঠাৎ করে হাসি জাগল কেন? বিস্ফোরণ দেখে কি? ঘটনা কি ঘটল না দেখে সে চলে যাচ্ছে কেন?
প্রশ্নগুলোর উত্তর হিসাবে সামনে এল জমাট এক সন্দেহ।
লোকটির গাড়ি তখন চলতে শুরু করেছে।
আহমদ মুসা যে গাড়িটিকে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়েছিল তার দিকে তাকাল। দেখল, কি হোলে চাবি। আর গাড়ির ড্রাইভার বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটার পর ওদিকে এগিয়ে গেছে।
আহমদ মুসা আর কিছু ভাবল না।
গাড়ির দরজা খুলে ড্রাইভিং সিটে উঠে বসল। স্টার্ট দিল গাড়ি। লোকটির গাড়ি তখন চত্বরের প্রান্ত পর্যন্ত এগিয়ে গেছে।
আহমদ মুসার গাড়ি ছুটল তার পেছনে।
বিমান বন্দর পেরিয়ে গাড়ি এসে উঠল এয়ারপোর্ট রোডে।
আহমদ মুসার গাড়ি যখন এয়ারপোর্ট রোডে উঠল, দেখল যুবকটির গাড়ি তীর বেগে এগিয়ে যাচ্ছে। লোকটির গাড়ি নতুন। যেন হাওয়ার বেগে ছুটছে গাড়িটি।
আহমদ মুসা তার মাইল মিটারের দিকে তাকিয়ে দেখল ইতিমধ্যেই গাড়িটি ৫০ হাজার মাইল চলেছে। বলা যায় বৃদ্ধ গাড়ি। তবু আহমদ মুসার স্পর্শ পেয়ে প্রাণ প্রাচুর্যে চঞ্চল হয়ে উঠল গাড়ি।
আহমদ মুসার গাড়ি ছুটছে লোকটির গাড়ির পেছনে।
আহমদ মুসার দৃষ্টি সামনে। তার চোখে ভেসে উঠল বিজ্ঞানী নবীয়েভের টুকরো টুকরো হয়ে যাওয়া দেহ। বেদনায় মুচড়ে উঠল হৃদয়টা। সে দিব্যদৃষ্টিতে দেখতে পেল, মধ্যএশিয়ার আকাশে কাল মেঘ জমেছে। এ কাল মেঘের সাইক্লোন চায় মধ্যএশিয়াকে বিজ্ঞানী নবীয়েভের মতই ছিন্ন বিচ্ছিন্ন করে তার অস্তিত্বের ইতি ঘটাতে।
দাঁতে দাঁত চাপল আহমদ মুসা।
সামনে ছুটে চলা গাড়িটাকে তার মনে হচ্ছে জমাট কাল ষড়যন্ত্রের এক কুৎসিত হাসি। সে হাসি থেকে ঝরে পড়ছে বিজ্ঞানী নবীয়েভের চাপ চাপ লাল রক্ত।
আহমদ মুসা স্পীড বাড়িয়ে দিল তার গাড়ির।
বিচিত্র সব শব্দ তুলে লাফিয়ে লাফিয়ে ছুটে চলল গাড়িটি।

সাইমুম সিরিজের পরবর্তী বই
মধ্য এশিয়ায় কালোমেঘ