১৫. আবার সিংকিয়াং

চ্যাপ্টার

আহমদ মুসারা কিছুটা শান্ত হয়ে যখন করণীয় চিন্তা করছে এই সময়ে পাশের কোন কক্ষ থেকে বুক ফাটা একটা আর্তনাদ ভেসে এল।
তিনজনেই উৎকর্ণ হলো।
আবার চিৎকারের শব্দ ভেসে এল। কে যেন চিৎকার করে কি বলছে।
আহমদ মুসা পকেট থেকে রুমাল বের করে মেইলিগুলির মুখটা ঢেকে দিয়ে বলল, ‘চল দেখি কি ব্যাপার।’
তিনজনেই বেরিয়ে এল ঘর থেকে।
এ করিডোর সে করিডোর হয়ে তারা একটা খোলা দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়াল।
এ ঘর থেকেই চিৎকার আসছে। ‘আল্লাহ, কোথায় তুমি, কোথায় তুমি’ বলে কাজাখ ভাষায় চিৎকার করছে।
তিনজনেই ঘরে ঢুকল।
ঘরে বীভৎস এক দৃশ্য।
একজন লোককে হাত বেঁধে ছাদের ফ্যান পয়েন্টের সাথে টাঙিয়ে রাখা। আন্ডারওয়্যার ছাড়া তার গায়ে কিছু নেই। তার শরীর ক্ষত বিক্ষত,রক্তাক্ত।
মেঝেতে পড়ে আছে একজন যুবতী ও একজন তরুনীর দেহ। সম্পুণ বিবস্ত্র। পাশবিক নির্যাতন করা হয়েছে ওদের ওপর। সেই নির্যাতনে ওরা মারা গেছে।
দেখে শিউরে উঠল তিনজনেই।
চোখ বন্ধ করতে বাধ্য হলো তারা।
তারপর মেঝেতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা দু’খন্ড কাপড় তুলে নিয়ে আহমদ মুসা যুবতী ও তরুণীর দেহ ঢেকে দিল।
লোকটির চিৎকার বন্ধ হয়ে গিয়েছিলো। তার ঢলে পড়া মাথাটি কিঞ্ছিত খাঁড়া করে তাকাচ্ছিল আহমদ মুসাদের দিকে। তার চোখে সংশয় সন্দেহের সাথে আশারও কিছু আলো দেখা গেল।
আহমদ মুসা ঝুলে থাকা লোকটির দিকে এগিয়ে তার হাঁটু বরাবর জায়গাটা জড়িয়ে তার দেহ উঁচু করে তুলে ধরল, যাতে করে হাতে টানটা ঢিলা হয় এবং সে কিছু আরাম পায়।
লোকটির দেহ অনেকখানি ঢলে পড়ল আহমদ মুসার কাঁধে।
এদিকে আব্দুল্লায়েভ আজিমভের ঘাড়ে চড়ে লোকটির হাতের বাঁধন কেটে দিল।
আহমদ মুসা তাকে শুইয়ে দিল মেঝেয়।
মেঝেতেই পড়ে ছিল তার কাপড়। সেগুলো কুড়িয়ে পরিয়ে দেয়া হলো তাকে।
লোকটি যেন বোবা হয়ে গিয়েছিল। তার ঠোঁট কাঁপছিল, কথা বলতে পারছিল না।
বাঁধ ভাঙার মত হঠাৎ এক উচ্ছাস বেরিয়ে এল লোকটির কন্ঠ থেকে। ‘আমার স্ত্রী’ ‘আমার মেয়ে’ বলে সে কান্নায় ভেঙে পড়ল।
আহমদ মুসা তার মাথার পাশে বসে তাকে সান্তনা দিচ্ছিল। বলল, ‘এই জঘণ্য অত্যাচার কে করেছে জনাব?’
‘জেনারেল বরিস এবং তার লোকেরা।’ বলে আবার দু’হাতে মুখ ঢেকে কাঁপতে লাগল সে। বলল, ‘কেন আগে মরে গেলাম না! কেন এ দৃশ্য দেখতে হলো! এ যন্ত্রণা নিয়ে আমি বাঁচব কি করে!’ বলে পাগলের মত চিৎকার ও হাত-পা ছুঁড়তে লাগল সে।
আহমদ মুসা তাকে সান্তনা দিয়ে বলল, ‘ওরা শাস্তি পেয়েছে জনাব,জেনারেল বরিস নিহত হয়েছে।’
‘ডাঃওয়াং এবং আরো অনেকে নিহত হয়েছে।’ বলল যুবায়েরভ।
‘ওয়াং নিহত? কোথায়?’ বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞাসা করল আহমদ মুসা।
‘আমরা এখানে আসার আগে রেড ড্রাগনের সদর দফতরে গিয়েছিলাম। ওখানেই সে নিহত হয়েছে।’
‘জনাব, আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করুন। ওদের মাথা গুড়ো হয়ে গেছে, দেহটা আর থাকবে না।’
লোকটা ধীরে ধীরে উঠে বসল।
‘আপনার পরিচয় কি? আপনার সাথে জেনারেল বরিসের শত্রুতার কারন কি?’ বলল আহমদ মুসা।
‘আমার সাথে জেনারেল বরিসের কোন শত্রুতা নেই। তাকে আমি চিনতাম ও না।’
‘কিভাবে আপনি এখানে এলেন?’
‘আমাকে কাজাখস্থানের সারিজু থেকে কিডন্যাপ করা হয়েছে।’
‘সারিজু কোথায়? এ নামে একটা নদী আছে শুনেছি।’
‘স্থানটি কাজাখ উচ্চ ভূমির পশ্চিম প্রান্তে। মানচিত্রে এর কোন চিহ্ন নেই। এ এক গোপন বিজ্ঞান নগরী। সোভিয়েতরা এটা তৈরী করেছিল পারমাণবিক গবেষণা ও পরীক্ষার এক নগরী হিসাবে। আজও তাই আছে। পরমাণু বিজ্ঞানী হিসাবে ঐ নগরীর গবেষণাগারে যোগ দেই আমি আজ থেকে ২৩ বছর আগে। মধ্যেএশিয়া ষাধীন হওয়ার আগে আমি ছিলাম নিউক্লিয়ার রিসার্চ প্ল্যানিং ডাইরেক্টর। স্বাধীন হওয়ার পর গোটা সারিজু বিজ্ঞান গবেষণার প্রধানের দায়িত্ত আমার হাতে ন্যাস্ত করা হয়। কিডন্যাপের আগে পর্যন্ত এই দায়িত্বই পালন করে আসেছি।’
‘কেন আপনি কিডন্যাপ হলেন? বরিস আপনাকে কিডন্যাপ করল কেন?’
‘আগে আমিও বুঝিনি, বুঝেছি পরে। আণবিক যুদ্ধাস্ত্র সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহের জন্যে তারা আমার কাছে চেয়েছিল রিসার্চ এলবাম, প্রজেক্ট এলবাম এবং স্টোরেজ এলবামের কম্পুটার কোড এবং কম্পুরেট এলবাম। এই চারটি এলবাম ওদের হাতে গেলে আমাদের গবেষণা ও শক্তি-সরঞ্জামের সবকিছু ওদের হাতে চলে যাবে। সবকিছুই ওরা আমাদের হাটিয়ে নেবে অথবা ধবংস করে দেবে।’
থামল বিজ্ঞানী লোকটা।
‘তারপর?’ উদ্বিগ্ন কন্ঠ আহমদ মুসার।
যুবায়েরভ এবং আজিমভের চোখও বিস্ময়ে বিস্ফারিত।তাদের আণবিক প্রকল্পের বিরুদ্ধে এতবড় ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে।
‘দিনের পর দিন তারা ইন্টারোগেট করেছে আমাকে, অত্যাচার করেছে নানা ভাবে আমার কাছ থেকে কথা বের করার জন্য। কিন্তু আমি একটি কথাই বার বার বলেছি, আমাকে মেরে ফেললেও কোন কথা তারা পাবে না। তারা বলেছে, কথা বলাবার অস্ত্র তাদের আছে। দরকার হলে তারা আমার স্ত্রী কন্যাকে আমার সামনে নিয়ে আসবে আমাকে কথা বলাবার জন্য। আমি ওদের এ হুমকিতে আমল দেইনি। বলেছি, মনে করোনা তোমরা যা চাইবে তাই পারবে। কিন্তু পারল তারা। অল্প কয়েকদিন পরেই আমার স্ত্রী কন্যাকে তারা আমার সামনে হাজির করল। আমার স্ত্রী যেমন আমার জীবনের চেয়েও প্রিয়, তেমনি আমার কন্যা ছিল আমার জীবনের সব। তাদেরকে তাদের হাতের মুঠোয় আমার সামনে দেখে আমি পাগলের মত চিৎকার করে উঠলাম। জেনারেল বরিস বলল আমরা যা চেয়েছি তা যদি না দাও, তাহলে তোমার সামনে তোমার স্ত্রী কন্যার ওপর পাশবিক অত্যাচার করা হবে, তারপর তাদের হত্যা করা হবে। কথা শেষ করেই বরিস ও তার একজন লোক আমার স্ত্রী ও মেয়ের গায়ের জামা ছিড়ে ফেলল। আমি চিৎকার করে উঠলাম, তোমরা থাম। আমি যা জানি সব তোমাদের বলব। কিন্তু আমি থামতেই আমার স্ত্রী এবং কন্যা চিৎকার করে উঠল, জাতির প্রতি আপনি বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারেন না। জীবনের বিনিময়েও না। আমরা মরে গেছি, আমাদের বাঁচাবার চেস্টা করবেন না। আমরা যতোক্ষণ বাঁচব কুকুরদের সাথে লড়াই করে যাব। আপনি আল্লার ওয়াস্থে ধৈর্য ধরুন। সংকল্পে অটল থাকুন। বলেই আমার স্ত্রী এবং মেয়ে পাগলের মত ঝাপিয়ে পড়ল ওদের ওপর। পাগলের মত লাথি, ঘুষি, কিল চালাতে লাগল। আমি বাঁধা অবস্থায় পড়েছিলাম খাটিয়ায়। কি ঘটতে যাচ্ছে বুঝতে পারলাম। আল্লাহকে ডেকে চোখ বন্ধ করলাম। হৃদয়টা আমার ছিঁড়ে যাচ্ছিল। কিন্তু প্রাণপণে শরীরের সমস্ত শক্তি একত্রিত করে চোখ বন্ধ রাখলাম। এক সময় প্রচন্ড এক লাথি খেলাম পাঁজরে। চোখ খুলে গেল আমার। তখন আর কিছু অবশিষ্ট ছিলনা। আমার স্ত্রী-কন্যার বিবস্ত্র, রক্তাক্ত, প্রাণহীন দেহের দিকে চোখ পড়তেই আবার চোখ বন্ধ করলাম। ওরা আমার বাঁধন খুলে টেনে নিয়ে গিয়ে দু’হাত বেঁধে টাঙাল ছাদের সাথে। তারপর চামরার চাবুক দিয়ে পাগলের মত প্রহার শুরু করল আমাকে। আমি দাঁতে দাঁত চেপে সব সহ্য করেছি। একটি শব্দও উচ্চারণ করিনি। আমার শহীদ স্ত্রী-কন্যা আমাকে যে পরামর্শ দিয়েছিল তা আমাকে যেন অপরিসীম শক্তি যুগিয়েছিল। এক সময় অজ্ঞান হয়ে পড়লাম। তারপর আর কিছুই জানি না। এক সময় দেখলাম আমার স্ত্রী ও আমার মেয়েকে। দেখলাম অদ্ভুত সুন্দর সোনালী পোশাকে। হঠাৎ ওরা ‘আমরা চললাম’ বলে উড়ে আকাশে উঠতে লাগল। আমি বুক ফাটা চিৎকার দিয়ে উঠলাম। কিন্তু ওরা থামল না। ভুবন মাতানো হাসি হেসে ওরা উঠতেই লাগল। এর পরেই আমার চোখ খুলে গেল। শরীরে আমার আসহ্য যন্ত্রনা, হাত ছিড়ে যাচ্ছে যেন। চোখ বন্ধ করে ডাকতে লাগলাম আল্লাহকে। তারপর আল্লাহর রহম এল। আপনারা এলেন। আপনারা কে? কেমন করে বিশাল ও পরাক্রমশালী শক্তিকে পরাভূত করলেন?’
থামল বিজ্ঞানী।
আহমদ মুসা, আজিমভ, আব্দুল্লায়েভ সবাই হারিয়ে গেল বিজ্ঞানীর বলে যাওয়া হৃদয়বিদারক কাহিনীর মধ্যে। ওদের সকলের চোখ দিয়েই পানি ঝরছিল।
বিজ্ঞানী থামতেই আহমদ মুসা বলল, ‘আপনি সত্যই দেখেছেন জনাব। আপনার স্ত্রী কন্যা সত্যই বেহেস্তী পোশাকে ও গহণা পরে এ মর্তধাম থেকে বেহেশতে চলে গেছে। ওরা শহীদ। ওদের জন্যে আমরা গর্বিত।’
কেঁদে উঠল বিজ্ঞানী। বলল, ‘তাই যেন হয় মহান যুবক। তোমার কথা শুনে আমার খুব ভালো লাগছে। আমারও বুক গর্বে ফুলে উঠেছে।’
‘জনাব, আপনি কি দয়া করে বলবেন, আপনার নাম কি? নামটা কি আব্দুল্লাহ আলী নাবিয়েভ?’ জিজ্ঞাসা করল যুবায়েরভ।
‘হ্যা। কিন্তু আপনি জানলেন কি করে? আপনারা কারা?’
‘আমি আব্দুল্লাহ যুবায়েরভ। মধ্যএশিয়া প্রজাতন্ত্রের দেশরক্ষা মন্ত্রী। কিন্তু এখন নই। এখানে আসার সময় দায়িত্যটা অন্যকে দিয়ে এসেছি।’
একটা দম নিয়ে আজিমভ ও আব্দুল্লায়েভকে দেখিয়ে তাদের পরিচয় দিল।
বিজ্ঞানী নাবীয়েভ সসম্মানে তাদের সালাম জানিয়ে চোখ কপালে তুলে বলল, ‘আপনারা এখানে? একটা রাস্ট্রের দেশরক্ষামন্ত্রী, গোয়েন্দা প্রধান ও একজন সেনা কমান্ডার একত্রে ভিন্ন একটা দেশে এভাবে অকল্পনীয়।’
‘বললাম তো আমরা আসার এখানে সময় আমাদের দেশরক্ষা মন্ত্রী, গোয়েন্দা প্রধান ও সেনা কমান্ডারের পোশাক দেশে রেখে এসেছি। এখানে আমাদের পরিচয়, আমরা এঁর কর্মী।’ আহমদ মুসাকে ইংগিতে দেখিয়ে কথা শেষ করল যুবায়েরভ।
বিজ্ঞানী নবীয়েভ তার বিস্মিত দৃষ্টি তুলে ধরল আহমদ মুসার দিকে। বলল ‘আপনারা এঁর কর্মী। তাহলে ইনি কে?’
‘এঁকে আপনি না চিনলেও জানেন। ইনি আমাদের আপনাদের সকলের নেতা আহমদ মুসা।’ বলল যুবায়েরভ।
একবারেই চমকে উঠেছে নবীয়েভ। তার মুখ থেকে অস্ফুটভাবে বেরিয়ে এল, ‘ইনি আহমদ মুসা?’
বিস্ময়ে মুখ হা হয়ে গেছে তার। চোখ স্থির আহমদ মুসার ওপর। কিছুক্ষণ কথাই বলতে পারল না। ধীরে ধীরে তার বিস্ময় বেদনায় রুপান্তরিত হলো। তারপর বেদনা তরল রুপ নিয়ে নেমে এল তার চোখ দিয়ে। আবেগে কাপতে লাগল তার ঠোট। ধীরে ধীরে নবীয়েভ তার দু’টি হাত তুলে আহমদ মুসার ডান হাত তুলে নিয়ে চুম্বন করল। তারপর আকাশের দিকে তাকিয়ে দু’টি হাত তুলে বলল, ‘আল্লাহ, আমাদের নেতাকে আরেকটু আগে পাঠাতে পারতে না?’
‘জনাব উনি বেশ আগেই পৌচেছেন। আজ ভোরে। কিন্তু আপনার মত তাকেও কিডন্যাপ করে আনা হয়েছিল। তার স্ত্রীও বন্দী ছিলেন এখানে।’
‘কি সাংঘাতিক!’ বিস্ময়ে চোখ কপালে তুলল নবীয়েভ।
‘হ্যা সাংঘাতিক।’ বলে যুবায়েরভ সব বলল নবীয়েভ কে।
কাহিনীর শেষ অংশ অর্থাৎ মেইলিগুলির মৃত্যুর কাহিনী শুনে নবীয়েভ অভিভূত হয়ে পড়ল। আহমদ মুসার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘জনাব, এই অসহনীয় বেদনা বুকে নিয়ে অমন স্বাভাবিকভাবে আমাকে সান্তনা দিলেন কেমন করে?’
‘জনাব, আপনাকে ক’টি সান্ত্বনার কথা বলেছি বটে, কিন্তু আপনার কাছ থেকে আমি ধৈর্য্য ধরার শক্তি পেয়েছি অনেক।’
কিছু বলতে যাচ্ছিল নবীয়েভ। ঠিক সেই সময় ঘরে একটি কন্ঠ শ্রুত হল-‘মুসা ভাই, রোড থেকে দু’টি মাইক্রোবাস এ বাড়ীর দিকে আসছে। বাইরের দরজা কিন্তু খোলা।’
ছাদের মাঝ বরাবর লাইট পয়েন্টে লুকানো স্পিকার থেকে কথা গুলো ভেসে এল। কন্ঠ ওমর মা চ্যাং এর। পরিস্কার চিনতে পারল যুবায়েরভ। কিন্তু যুবায়েরভ বিস্মিত, তারা এ ঘরে আছে, তা টের পেল কেমন করে সে?
বিস্মিত আহমদ মুসাকে যুবায়েরভ ওমর মা চ্যাং ও নেইলি-এর সংক্ষিপ্ত পরিচয় দিয়ে বলল, ‘ওদেরকে আমরা টিভি ক্যামেরার কন্ট্রোল রুমে বসিয়ে রেখে এসেছি এ বাড়িতে আসার পথটা পাহারা দেয়ার জন্য। কিন্তু আমরা এ রুমে, আপনি মুক্ত-এসব সে জানল কি করে?’
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘যাদের টিভি ক্যামেরা রাস্তা পাহারা দেয়, তারা ঘর পাহারা দেবার জন্য টিভি ক্যামেরা কি রাখে না?’
‘কিন্তু আমাদের তা মনে হয় নি। আমরা হল রুমে ঢুকেছি তা ওরা টের পায়নি।’ বলল আজিমভ।
‘হয়তো তখন ভেতরের টিভি সার্কিট বন্ধ ছিল। জেনারেল বরিস বন্দীদের ওপর যে জঘন্য নির্যাতন চালিয়েছে তা অন্যদের চোখ থেকে ঢেকে রাখার জন্য হয়তো ভেতরের সার্কিট সাময়িক ভাবে বন্ধ রেখেছিল।’ বলল আহমদ মুসা।
‘কিন্তু খুলল কে? আমরা কন্ট্রোল রুম দখল করে সেখানে মা চ্যাং ও নেইলি কে বসিয়ে তবে এখানে এসেছি।’ বলল যুবায়েরভ।
‘নেইলি ডাঃ ওয়াং এর পি এস। সুতরাং অভ্যন্তরীন টিভি সার্কিটের কথা জানতে পারে। অথবা নেইলির এ সংক্রান্ত বিশেষ ট্রেনিং আছে যার জন্যে অভ্যন্তরীন সার্কিটের সন্ধান পেয়েছে।’
কথা শেষ করেই আহমদ মুসা আবার বলল, ‘এ সব আলোচনা থাক। নেইলিকে আসতে বল, সে জনাব নবীয়ভের কাছে থাকবে। আর মা চ্যাং কন্ট্রোল রুমেই থাকুক। যুবায়েরভ ও আজিমভ তোমরা সিঁড়ির দরজা খুলে ছাদে উঠে নেমে যাও নিচে। পেছন থেকে ওদের ঘেরাও করবে যদি তারা শত্রু হয়। আর আমি ও আব্দুল্লায়েভ হল রুমে যাচ্ছি। সেই দরজায় তো খোলা। ওরা সবাই ঘরে ঢুকলে তোমরাও দরজায় আসবে আর সবাই যদি ভেতরে না আসে তাহলে বাইরের লোকদের দায়িত্ব তোমাদের। মা চ্যাং প্রয়োজন হলে তোমাদের সাহায্য করবে।’
বলে আহমদ মুসা উঠে দাড়াল।
আব্দুল্লায়েভ, যুবায়েরভ ও আজিমভ ও উঠল।
‘আমাকে সাথে নিন, আমি রিভলবার চালাতে জানি।’ বলল নবীয়েভ।
‘মাফ করবেন, আমরা এখনও আপনাকে গবেষনার টেবিলে দেখতে চাই, রিভলবার হাতে না।’
বলেই আহমদ মুসা যুবায়েরভকে বলল, ‘এখান থেকেই মা চ্যাং শুনতে পাবে।’
তৎক্ষনাৎ মা চ্যাং এর গলা শোনা গেল। বলল, ‘নেইলি যাচ্ছে মুসা ভাই। ওরা গাড়ী নিয়ে মাঝামাঝি চলে এসেছে।’
‘ধন্যবাদ মা চ্যাং’ বলে আহমদ মুসা যুবায়েরভকে ছাদের দিকে যেতে বলে আব্দুল্লায়েভকে নিয়ে দৌড় দিল হল রুমের দিকে।
কন্ট্রোল রুম থেকে দু’টি ষ্টেনগান নিয়ে গেল যুবায়েরভ ও আজিমভ।
আহমদ মুসা ও আব্দুল্লায়েভের হাতে রিভলবার। তারা হলরুমে ঢুকে চারটি ষ্টেনগান পেয়ে গেল। কিন্তু মুশকিল হলো চারটি লাশ নিয়ে। তার বুদ্ধি বের হয়ে গেল। আহমদ মুসা ও আব্দুল্লায়েভ চারটি লাশ টেনে ভেতরের করিডোরে নিয়ে গেল এবং ভেতরের ছোট শাখা করিডোর থেকে খন্ড কার্পেটটি এনে বিছিয়ে দিল দরজার কাছের রক্ত ভেজা কার্পেটর উপর।
তারপর দু’জনে ষ্টেনগান নিয়ে উত্তর দিকের দেয়াল ও সোফার মাঝখানে শুয়ে পড়ল।
অল্পক্ষণ পরেই দরজা নড়ে উঠল। কিঞ্চিত খুলে গেল দরজা। একজন, যে সামনে ছিল, বলে উঠল, ‘কি ব্যাপার দরজা খুলে রাখা কেন?’
‘নিশ্চয় কন্ট্রোল রুম থেকে আমাদের দেখে খুলে দিয়েছে।’
‘কিন্তু আমরা তো নক করিনি। প্রয়োজনীয় নক না হলে খুলে দেয়ার কথা তো নয়।’
পেছনের জন আবার বলে উঠল, ‘চল ভেতরে গিয়ে জিজ্ঞেস করব।’
দু’জন ভেতরে ঢুকে গেল। তারপর দরজা সম্পূর্ণ খুলে বলল, ‘ওদের নিয়ে এস।’
বলে দু’জন একটু পূর্ব দিকে সরে গেল।
একটু পরেই হাত পা বাধা অবস্থায় চারজনকে এনে মেঝেতে ছুঁড়ে ফেলল।
আহমদ মুসা দুই সোফার ফাঁক দিয়ে চোখ রেখেছিল দরজার দিকে। মেঝেরও একটা অংশ দেখতে পাচ্ছিল। হাত পা বাধা লোকদের যখন নিয়ে আসছিল, ওদের মুখ দেখতে পেল না। কিন্তু মেঝেতে ওদের ছুড়ে ফেললে একজনের মুখ তার নজরে এল। দেখে চমকে উঠল আহমদ মুসা। এ যে নেইজেন! তাহলে কি আহমদ ইয়াং লি ইউয়ান সবাই আছে এদের মধ্যে? মন আনন্দে নেচে উঠল আহমদ মুসার।
একে একে ওরা ১২ জন ঘরে এসে জমায়েত হল।
বন্দীদের নিয়ে রঙ্গরস করতে লাগল।
ওরা হাতের ষ্টেনগানগুলি কেউ সোফায় ওপর, কেউ মেঝেটে ফেলে দিয়েছে।
দরজা বন্ধ হয়ে গেল ঘরের।
যে দু’জন প্রথম ঘরে ঢুকেছিল, তাদের একজন সবাইকে লক্ষ করে বলল, ‘জেনারেল বরিস ও ডাঃ ওয়াং এতক্ষণে এখানে ছুটে আসার কথা। এল না। নিশ্চয় কোন মউজে আছে। আমরা দু’জন দেখে আসি। তোমরা এখানেই অপেক্ষা কর।’

বলে ওরা ঘুরে দাড়িয়ে উত্তর দেয়ালের দিকে হাটতে লাগল। দেয়ালের সামনে অনাকাঙ্খিত ডবল কার্পেট দেখে ওরা ভ্রু কোঁচকালো। দেয়ালের দিকে একটু ঝুঁকতেই তারা দেয়ালে রক্তের ছিটা দেখতে পেল।
চোখ ছানাবড়া করে তারা সোজা হয়ে দাঁড়াল।
দাড়াতে দাড়াতে তারা কাঁধে ঝুঁলানো ষ্টেনগান হাতে তুলে নিচ্ছিল।
আব্দুল্লায়েভকে একটা ইংগিত করেই আহমদ মুসা এক ঝটকায় উঠে দাঁড়াল। তার সাথে সাথে আব্দুল্লায়েভও। তাদের ষ্টেনগানের ঐ বারো জনের লক্ষ্যে তাক করা।
‘সবাই হাত তোল। এক মূহুর্ত দেরি করলে সবার মাথা লুটিয়ে পড়বে মাটিতে।’ চিৎকার করে বলল আহমদ মুসা।
এই সময় দরজা ঠেলে প্রবেশ করল যুবায়েরভ ও আজিমভ।
আহমদ মুসা ও আব্দুল্লায়েভ মূহুর্তের জন্যে ফিরে তাকিয়েছিল দরজার দিকে।
এরই মধ্যে ঘরের পূর্বদিকে দাড়ানো প্রথম দু’জন লোক ষ্টেনগান তুলে ধরেছিল আহমদ মুসাদের লক্ষ্যে করে। আহমদ মুসা যখন তা দেখল দেরী হয়ে গেছে তখন। শুয়ে পড়ল আহমদ মুসা ও আব্দুল্লায়েভ।
মূহুর্তের ব্যবধানে তাদের মাথার উপর দিয়ে এক ঝাঁক বুলেট চলে গেল।
যুবায়েরভের ষ্টেনগান থেকে এক ঝাঁক গুলি ছুটে গেল ঘরের পূর্বদিকে দাড়ঁনো সেই দু’জন লোকের দিকে।
দুই পক্ষের গুলি প্রায় একই সময়ে হয়েছিল।
পূর্বদিকের দু’জন লোক পড়ে গেল গুলি খেয়ে।
তাদের সাথি অবশিষ্ট দশ জনের কেউ কেউ মরিয়া হয়ে স্টেনগান তুলে নিয়েছিল। কেউ কেউ তুলে নিতে যাচ্ছিল।
ইতিমধ্যে আহমদ মুসা ও আবদুল্লায়েভ উঠে দাঁড়িয়েছিল। তাদের স্টেনগান ও আজিমভের স্টেনগান প্রায় একই সাথে গুলি করেছীল ওদের লক্ষ্য করে।
মুহূর্তেই সাঙ্গ হয়ে গেল খেলা।
আহমদ মুসা, যুবায়েরভ, আজিমভ, আবদুল্লায়েভ সবাই ছুটে এল বন্দীদের বাঁধন খুলে দেওয়ার জন্য।
আহমদ মুসা ছাড়া সবার পকেটেই চাকু ছিল। খুব তাড়াতাড়িই বাঁধন কাটা হয়ে গেল।
ছাড়া পেয়েই আহমদ ইয়াং জড়িয়ে ধরল আহমদ মুসাকে।
কিংকর্তব্যবিমূঢ়ভাবে দাঁড়িয়েছিল লি ইউয়ান। আহমদ মুসা তাকে গিয়ে সালাম দিল এবং পরিচয় করিয়ে দিল যুবায়েরভ, আজিমভ ও আবদুল্লায়েভের সাথে।
সম্বিৎ ফিরে পেল যেন লি ইউয়ান। সে আহমদ মুসা এবং সবাইকে জড়িয়ে ধরে মোবারকবাদ জানাল। বিশেষ করে কৃতজ্ঞতা জানাল যুবায়েরভ ও আজিমভকে। বলল, ‘আমি জানতাম, আহমদ মুসা আসবেই, কিন্তু আপনারা যে এভাবে এসেছেন, এটা আমার কাছে অকল্পনীয় লাগছে।’
‘আপনি দয়া করে আমাদেরকে আহমদ মুসার নগণ্য কর্মী হিসাবে কল্পনা করুন, তাহলে আর অকল্পনীয় মনে হবে না।’
‘তা ঠিক।’ বলল লি ইউয়ান।
আহমদ মুসা এগিয়ে গেল নেইজেন ও নেইজেন এর মার দিকে। তারা কাঁদছিল। আনন্দের কান্না।
আহমদ মুসা নেইজেনের মাকে সালাম দিতেই নেইজেন ও তার মা এক সাথে বলে উঠল, ‘মেইলিগুলির খবর কি, সে কোথায়?’
সংগে সংগেই আহমদ মুসার মুখ ম্লান হয়ে গেল। আহমদ মুসা চেষ্টা করেও তা রোধ করতে পারলো না। প্রশ্নের কোন উত্তর দিল না আহমদ মুসা
নেইজেনের চোখ তীক্ষ্ণ হয়ে উঠল। বলল, ‘কথা বলছেন না কেন ভাইজান, আপা কোথায়?’
‘এস তোমরা’ বলে আহমদ মুসা উত্তর দেয়ালের গোপন দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকে গেল। তার ভেতরে ঢুকল নেইজেন, আহমদ ইয়াং, নেইজেনের মা এবং লি ইউয়ান।
আহমদ মুসার পিছু পিছু চললো তারা।
আহমদ মুসার নিরবতা ও এই ধরনের রহস্যজনক ব্যবহারে উৎকণ্ঠিত হয়ে উঠেছিল সবাই। ঘরে ঢুকে দু’টি লাশ দেখে কেঁপে উঠলো নেইজেন। যে ভয়াবহ আশংকা তার মনের দুয়ারে উঁকি দিচ্ছিল, তা যেন ভয়ংকর রূপে তার সামনে এসে দাঁড়াল।
আহমদ মুসা বসে পড়েছিল মেইলিগুলির লাশের মাথার পাশে।
রুমালটি সরিয়ে ফেলল লাশের মাথার ওপর থেকে। নেইজেন এবং তার সাথের সবাই লাশের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল। তাদের কারোরই বুঝতে বাকি ছিল না ঘটনা কি ঘটেছে। সবারই মাথা নিচু এবং বেদনা-পাংশু মুখ।
রুমাল সরাবার সংগে সংগে মেইলিগুলির মুখের ওপর নজর পড়তেই তার বুকে ঝাপিয়ে পড়লো নেইজেন। চিৎকার করে উঠল, ‘এ কি হল আপা। কেন এমন হলো। পারলাম না আমি তোমাদের এক সাথে বাঁধতে! আমি হেরে গেলাম! তোমার মত করে তোমার সাথে কেন আমি যেতে পারলাম না।’
নেইজেনকে কেউ বাঁধা দিল না।
আহমদ মুসা বসেছিল পাথরের মত স্তব্ধ হয়ে।
অনেক পর লি ইউয়ান গিয়ে নেইজেনকে সান্তনা দিয়ে তুলে আনল।
‘কেঁদনা নেইজেন, ও কাঁদতে নিষেধ করে গেছে। যে গুলি আমার বুকে লাগার কথা, তা ও বুকে নিয়ে আমাকে বাঁচিয়ে গেছে।’ ধীর কণ্ঠে বলল আহমদ মুসা।
‘ঘটনা কি ঘটেছিল আহমদ মুসা?’ বলল লি ইউয়ান।
আহমদ মুসা সংক্ষেপে সব ঘটনা খুলে বলল। তারপর স্বাগত কণ্ঠেই উচ্চারন করল, ‘আমার সথে দেখা হওয়ার পর থেকেই বেচারী কষ্ট করে আসছে, কষ্ট পেয়ে আসছে, দাদা, বাপ-মা সব হারিয়েছে সে আমার কারণে, অবশেষে জীবনটাও।’
‘না ভাইয়া, আপনার কথা ঠিক নয়। আমার আপার চেয়ে সুখী মানুষ কেউ ছিল না। সে সব সময়ই বলত, ‘যেদিন আপনি তাকে গ্রহণ করেছেন, সে দিনই তার সব চাওয়া, সব পাওয়া পূর্ণ হয়ে গেছে। আল্লাহ তার কথাই মঞ্জুর করেছেন। তাঁকে ঐ অবস্থায়ই আল্লাহ তুলে নিলেন।’ বলে ফুফিয়ে কেঁদে উঠল নেইজেন। বলল, ‘কেন আল্লাহ তাকে ওভাবে নিয়ে গেলেন! তার জীবন সুর্য উঠল, কিন্তু সে সুর্যের আলোতে স্নাত হতে পারল না।’
‘কেউ কেউ অনন্ত, অমর জগতে গিয়ে সব কিছু পায়, মেইলিগুলি সেই তাদের একজন।’ বলে আহমদ মুসা মেইলিগুলির মুখ রুমাল দিয়ে ঢেকে তাকে পাজা কোলা করে তুলে নিল কোলে। তারপর চলতে শুরু করে সবাইকে বলল ‘আসুন।’
বিজ্ঞানী নবীয়েভ ও নেইলি যেখানে ছিল সেই ঘরে নিয়ে এল মেইলিগুলিকে। নেইজেনরা সবাই প্রবেশ করল সে ঘরে।
নবীয়েভের স্ত্রী ও মেয়ের পাশে মেইলিগুলিকেও রাখল আহমদ মুসা। তারপর নবীয়েভ ও নেইলিকে সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলল সংক্ষেপে নবীয়েভের কাহিনী।
আতঙ্কে শিউরে উঠে নেইজেন বলল, ‘আল্লাহর হাজার শুকরিয়া, আল্লাহ্ আমাদের উদ্ধারের ব্যবস্থা না করলে এই অবস্থাই এখানে আমাদের জন্যে অপেক্ষা করছিল।’
‘এরা মানুষ রুপী নরপশু ছিল। আল্লাহ যোগ্য শাস্তি দিয়েছেন ওয়াং ও বরিসকে।’ বলল নেইলি।
নেইলির কথা শেষ হতেই আহমদ মুসা বলল, ‘নেইলি, তুমি এদের নিয়ে দাঁড়াও। আহমদ ইয়াং তুমি আমার সাথে এস। ওদের সাথে বসে একটু পরামর্শ করতে হবে। তিনটি কফিন দরকার এখনই। তাছাড়া এ ঘাটিতে অনেক লাশ, এগুলো পরিস্কার করতে হবে। তারপর অনেক কাজ আছে।’
‘ভাইয়া কফিন কেন? শহীদদের তাড়াতাড়ি দাফন করে ফেলা কি উচিত নয়?’
‘না জেন। জবান নবীয়েভ এর স্ত্রী কন্যার দেহ পাঠিয়ে দেব তার কর্মস্থল সারিজুতে। আর মেইলিগুলিকে দাফন করতে চাই মদিনা মনওয়ারায়। ও বড় একটি শর্ত দিয়ে গেছে। ওর যেখানে কবর হবে, বছরে অন্তত একটি বার সেকানে আমাকে যেতে হবে। মক্কা-মদিনা ছাড়া এমন জায়গা তো আমার নেই নেইজেন!’
‘কিন্তু আমার আকাঙ্খা ছিল ভাইয়া, মেইলিগুলি আপার দাফন হবে তাঁর জন্মভূমিতে, তাঁর বাড়িতে। যেটা হবে আপনার একটি ঠিকানা।’ কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে বলল নেইজেন।
‘আমাকে আর ঠিকানায় বাঁধতে চেষ্টা করোনা বোন। প্রতি বছর সিংকিয়াং এ আসতে পারব এ গ্যারান্টি আমি দিতে পারবো না। কিন্তু প্রতি বছর মক্কা মদিনায় আমি যাবো ইনশাআল্লাহ। দুঃখ করো না বোন, সিংকিয়াং থেকে নিজেকে আমি বিচ্ছিন্ন করতে পারবো না কোন দিন। সিংকিয়াং তো শুধু মেইলিগুলির জন্মস্থান নয়, এ আমারও জন্মভূমি। এর আলো বাতাসে গড়ে উঠেছে আমার শিশু কিশোর জীবন। এখানে ঘুমিয়ে আছে আমার আব্বা, আম্মা, ভাই, বোন- আমার সব আত্মজন। সময় পেলেই যেখানে আমি আসব, সেটা হলো আমার সিংকিয়াং।’
‘ধন্যবাদ ভাইয়া, আমার আর আপত্তি নেই।’ নরম কণ্ঠে বলল নেইজেন।
আহমদ মুসা ঘুরে দাঁড়াল। আহমদ ইয়াংকে নিয়ে বের হয়ে এল ঘর থেকে।

রেড ড্রাগনের গোপন ঘাটিটিকেই আহমদ মুসা বানালো তার হেডকোয়ার্টার। কয়েক দিনের চেষ্টায় রেড ড্রাগন ও ফ্র এর যতগুলো আড্ডা উরুমুচি ও তার আশে পাশে ছিল সব ধ্বংস করে দিল।
সিংকিয়াং-এর নতুন গভর্নর রেড ড্রাগন প্রধান ডাঃ ওয়াং ও জেনারেল বরিসের মাত্রাতিরিক্ত স্বেচ্ছাচারিতায় এমনিতেই বিরক্ত ছিল। ডাঃ ওয়াং ও বরিসের লোকরা জেলখানা থেকে সাবেক গভর্নর লি ইয়ান ও তার পরিবারকে কিডন্যাপ করায় তিনি ভীষণ ক্রুদ্ধ হয়েছেন। জেলখানার কিছু লোককে ভয় ও লোভ দেখিয়ে ঢাঃ ওয়াং তাদেরকে কিডন্যাপ করার ব্যবস্থা করে। জেলখানার লোকদের শাস্তির ব্যবস্থা গভর্নর সংগে সংগেই করেছেন এবং বেইজিংকে বলে ডাঃ ওয়াং-এর রেড ড্রাগনও জেনারেল বরিসের ফ্র এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের আয়োজন গভর্নর করছিলেন। ঠিক এই সময় রেড ড্রগনের ঘাটিগুলো বিধ্বস্ত হতে দেখে এবং ডাঃ ওয়াং বা বরিস নিরুদ্ধেশ জেনে গভর্নর খুশীই হয়েছেন। রেড ড্রাগনের গোপন প্রধান ঘাটি, যাকে আহমদ মুসা তার ঘাটিতে পরিণত করেছে, সে সম্পর্কে সিংকিয়াং সরকার কিছুই জানতো না। সরকারী খাতায় এ বাড়ির পরিচয় জনৈক লিউশিং মিং নামক লোকের ব্যক্তিগত বসবাসের বাড়ি।
আহমদ মুসা গত কয়দিন রেড ড্রাগন ও ফ্র এর ঘাটিগুলো ধ্বংস করার সাথে সাথে আহমদ ইয়াংকে দিয়ে সিংকিয়াং এর মুসলিম সংগঠন এম্পায়ার গ্রুপকে আবার একত্রিত করল।
আহমদ মুসা রেড ড্রাগন ও ফ্র এর সবগুলো ঘাটি থেকে সব ধরনের কাগজ, ডকুমেন্ট, ফটো, ফিল্ম ক্যাসেট ইত্যাদি সংগ্রহ করে নিয়ে এল তার হেডকোয়ার্টারে। আর এ গোপন ঘাটিতেও পেয়েছিল প্রচুর।
প্রাপ্ত সব ডকুমেন্টের ভিত্তিতে একটা নিউজ পেপার রিপোর্ট তৈরী এবং যে ভিডিও ফিল্প পাওয়া গেছে তার সমন্বয়ে একটা পূর্ণাংগ ফিল্ম তৈরীর দায়িত্ব আহমদ মুসা দিয়েছিল আজিমভ, মা চ্যাং ও নেইলিকে।
প্রমানিত হয়েছে নেইলি অত্যন্ত কাজের মেয়ে। সে কম্পিউটার ও টিভি টেকনোলজিতে অত্যন্ত দক্ষ। তার মায়ের সাথে আহমদ মুসা দেখা করেছে। খুব খুশী হয়েছে তার মা সব কিছু শুনে। বলেছে, এতদিনে তার মেয়ে তার নাম ও তার মান মত একটি কাজ করছে। আহমদ মুসা ওমর মা চ্যাং- এর সাথে নেইলির বিয়ের প্রস্তাব করলে, লেইলির মা তা সানন্দে গ্রহণ করেছে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেছে, ওমর মা চ্যাং এর আব্বা আম্মাকে যেমন হত্যা করেছে হানরা, তেমনি আমার বাবাকেও। খুব খুশী হলাম চ্যাংকে আমার এক ছেলে হিসাবে পেয়ে। ওমর মা চ্যাং এখন নেইলির বাড়িতেই থাকছে।
মাত্র কয়েকদিন খেটে আজিমভ, মা চ্যাং ও নেইলি মূল্যবান ডকুমেন্ট সমৃদ্ধ দীর্ঘ একটি রিপোর্ট এবং একটি ভিডিও ফিল্ম সম্পূর্ন করল।
তৈরী সম্পূর্ন হলে এগুলোর একটি করে কপি পাঠিয়ে দিল আলমা আতায় মধ্যএশিয়া সরকারেরর কাছে। আর একটি করে প্রস্তুত করল “ওয়ার্ল্ড নিউজ এজেন্সি” (WNA) এবং ‘থার্ড ওয়াল্ড নিউজ’ (TON) এর জন্য। কিন্তু আহমদ মুসা প্রথমেই তাদের এসব ডকুমেন্ট দেয়া ঠিক মনে করল না। প্রথমে এ নিয়ে সে সিংকিয়াং সরকারের সাথে দরকষাকষি করতে চায়। সিংকিয়াং সরকার যদি বেংজিং কর্তৃপক্ষের সাথে পরামর্শ করে মুসলমানদের প্রতি যে অবিচার করা হয়েছে তার প্রতিকার করতে রাজি হয়, উচ্ছেদকৃত মুসলমানেদর পুনর্বাসনে যদি রাজী হয়, মুসলমানেদর যে ক্ষতি হয়েছে তা পূরণ করতে যদি তারা রাজী হয়, তাহলে সংবাদ সংস্থার মাধ্যমে বাইরে এই কাহিনী প্রচার করতে আহমদ মুসা ইচ্ছুক নয়। এ জন্যে আহমদ মুসা অত্যাচার নিপীড়ন উচ্ছেদের একটা ভিডিও এবং ডকুমেন্টসহ একটা বিবরনী সিংকিয়াং সরকারকে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিল।
ওমর মা চ্যাংকে দূত মনোনীত করল আহমদ মুসা। তার পিতা হানদেরর হাতে নিহত হয়েছে, তাদের সব কিছু লুণ্ঠিত হয়েছে এবং উচ্ছেদ হয়েছে নিজেদের বাড়ি থেকে। সবদিক থেকেই মা চ্যাং উপযুক্ত দূত।
ওমর মা চ্যাংকে সিংকিয়াং-এর গভর্ণরের কাছে পাঠানোর আগে আহমদ মুসা উদ্বাস্তুদের পক্ষ থেকে সিংকিয়াং-এর গভর্নরের সাথে কথা বলল।
ঘাটির নাম্বার বিহীন টেলিফোন থেকে আহমদ মুসা কথা বলল গভর্ণরের সাথে। ঠিক সাধরণ টেলিফোন এটা নয়। আবার অয়্যারলেসও নয়। একে বলা যায়, ওয়্যারলেস টেলিফোন। টেলিফোন তারের সাথে এ যুক্ত নয়। কিন্তু এই টেলিফোন থেকে সাধারন টেলিফোন লাইনের যে কোন টেলিফোন নাম্বারে কথা বলা যায়। এ টেলিফোন ডিটেক্ট করা যায়না।
টেলিফোন ধরেই জিঞ্জাসা করল, ‘গভর্ণর, আমি গভর্ণর, আপনি?’
‘নাম বলবনা, মিথ্যা নামও বলবনা।’
‘এ টেলিফোন নাম্বার কোথেকে পেলেন?’
‘ডা: ওয়াং এর ডাইরী থেকে।’
‘ডা: ওয়াং কোথায়?’
‘মিথ্যা বলতে পারতাম। বলব না। উনি সংঘর্ষে নিহত।’
‘জেনারেল বরিসের খবরও নিশ্চয় আপনি বলতে পারবেন।’
‘জি হ্যাঁ। তিনিও সংঘর্ষে নিহত।’
‘সংঘর্ষ কার সাথে?’
‘তাদের অত্যাচারে যারা স্বজন হারা, সম্পদ হারা, গৃহ হারা।’
‘আপনি এদের পক্ষ থেকেই বলছেন?’
‘ধন্যবাদ। আমি তাদের মধ্য থেকে একজন।’
‘বলুন, কেন টেলিফোন করেছেন?’
‘সম্পদ, স্বজন ও গৃহ হারা মুসলমানদের সম্পর্কে আপনার দৃষ্টি আকর্ষণের জন্যে।’
‘বিশেষ কোন বক্তব্য আছে?’
‘আছে।’
‘কি সেটা?’
‘হারানো স্বজন তারা ফিরে পাবে না, কিন্তু বাড়ি-ঘর, সহায়-সম্পদ তাদের অবিলম্বে ফিরে পাওয়া উচিত।’
‘দু:খিত, এ উপদেশ আমি আমার সরকারের কাছ থেকে পেতে আগ্রহী।’
‘আমি জানি, এ জবাব আমি আপনার কাছ থেকে পাব। দয়া করে জানাবেন আপনার সরকার এ উপদেশ দিচ্ছেন কি না?’
‘এ প্রশ্নের জবাব আমি আপনাকে দেব না।’
‘একজন গভর্নরের যে জবাব দেয়া উচিত, সেই উত্তরই আপনি দিয়েছেন। সিংকিয়াং-এর গভর্নর হিসাবে আপনাকে আমি একটা প্রস্তাব করতে চাই।’
‘বলুন কি প্রস্তাব?’
‘আমরা আপনার কাছে একজন দূত পাঠাব।’
‘কেন?’
‘কিছু ডকুমেন্ট দিয়ে।’
‘কি ডকুমেন্ট?’
‘একটি ভিডিও এবং একটি রিপোর্ট।’
ওগুলো কিসের?
ডাঃ ওয়াং এর রেড ড্রাগন এবং জেনারেল বরিসের ফ্র বিগত দিন গুলোতে সিংকিয়াং- এর মুসলমানদের ওপর যে হত্যাকান্ড চালিয়েছে, যে লুণ্ঠন ও অত্যাচার করেছে, যেভাবে মুসলমানরা উচ্ছেদ হয়েছে ভিডিও ফিল্ম এবং ডকুমেন্ট সমৃদ্ধ বিস্তারিত বিবরণ।’
‘এগুলোর কি সত্যতা আছে?’
‘ভিডিও ফিল্মের দৃশ্যাবলী এর সাক্ষ্য দেবে। সেই সাথে সাক্ষ্য দেবে ডাঃ ওয়াং ও জেনারেল বরিসেরর হাতের লেখা বিভিন্ন চিঠিপত্র, রিপোর্ট, ডাইরী ও নানা ধরনের ডকুমেন্ট।’
‘এগুলোর আমার কাছে পাঠিয়ে আপনারা কি করতে চান?’
‘আমরা আপনার সরকারকে সুযোগ দিতে চাই এটা চিন্তা করার যে, এগুলো বিশ্বের সংবাদ মাধ্যমে এবং জাতিসংঘের কাছে প্রকাশ করে দিলে ভালো হয়, না আপনাদের সরকার চুপে চুপে যা ঘটেছে তার একটা প্রতিবিধান করলে ভাল হয়।’
‘অর্থাৎ আপনারা চাপ দিয়ে বাধ্য করতে চাচ্ছেন?’
‘না, আমরা আপনাদের সাহায্য করতে চাচ্ছি।’
‘আপনাদের মতলব কি বলুন তো?’ লি ইউয়ান (ক্ষমতাচ্যুত গভর্নর) কোথায়? ডাঃ ওয়াং ও জেনারেল বরিসের খবর যখন জানেন, তখন তার খবরও অবশ্যই আপনার জানার কথা।’
‘আমাদের প্রস্তাবের আলোচনার সাথে হঠাৎ আপনি লি ইউয়ানকে টেনে আনলেন কেন?’
‘আমার প্রশ্নের আগে জবাব দিন।’
‘লি ইউয়ান ভাল আছেন, সুস্থ আছেন। তবে তিনি কোন ভাবেই আপনার প্রতিবন্ধি নন। আর তিনি চলে যাচ্ছেন এদেশ ছেড়ে।’
‘কেন?’
‘কেন আপনি জানেন। তাঁর এ দেশে থাকার অর্থ হবে মুসলমানদের সংগঠিত করে তিনি ক্ষমতার লড়াইয়ে নেমেছেন।’
‘আপনি যেই হোন, আপনি বুদ্ধিমান। কিন্তু আপনি আমার কথাকে যেভাবে নিয়েছেন, ঠিক সে অর্থে আমি কখাটা বলিনি। তবু আপনার দেয়া তথ্যের জন্যে ধন্যবাদ। নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে তাঁর বাইরে যাওয়ার সিদ্ধন্ত সঠিক হয়েছে।’
‘আপনার এই স্পষ্ট কথার জন্যে ধন্যবাদ।’
‘বলুন আমি কি করতে পারি।’
‘আমার প্রস্তাব সম্পর্কে কিছু বলেননি।’
‘আপনি লোক পাঠাতে পারেন। যে ডকুমেন্ট গুলো পাঠাবেন, তা অবশ্যই আমি সরকারের নজরে আনব। এবং এটুকু পর্যন্তই আমার দায়িত্ব।’
‘না, আপনি সিংকিয়াং-এর গভর্নর। আপনার দায়িত্ব এটুকু পর্যন্ত নয়। আপনার মতামতের ওপর অনেক কিছুই নির্ভর করবে।’
‘আমি এ সম্পর্কে আপনাকে কিছু বলব না।’
একটু থামল গভর্নর। তারপরেই আবার বলল, ‘বার বার বলেছেন আপনি মিথ্যে বলেন না। বলুন তো আপনি এই অয়্যারলেস টেলিফোন কোয়ায় পেয়েছেন যা সিংকিয়াং সরকারেরও নেই?’
‘তাহলে ইতিমধ্যেই আমার ঠিকানা চিহ্নিত করার জন্যে গোয়েন্দাগিরি করেছেন।’
‘স্বাভাবিক। এটুকু করতেই হয়।’
‘এই অত্যাধুনিক ওয়ারলেস টেলিফোন পেয়েছি আপনার ডাঃ ওয়াং এর কাছ থেকে।’
‘ডাঃ ওয়াং এর কাছ থেকে?’
‘জি হ্যাঁ। এখন দেখুন আপনার ডাঃ ওয়াংরা আপনার রাজ্যে আরেকটা সরকার কায়েম করে বসেছিলেন। সংগ্রহ করেছিলেন যা আপনাদেরও নেই এমন উপায় উপকরণও।’
‘দেখুন, ডা: ওয়াং আমার ছিলনা এবং তার সম্পর্কে সব খবরই আমরা জানি।’
‘সব আপনি জানেন না, জানানো হয়নি আপনাকে। আমাদের ডকুমেন্টগুলো পেলেই তা বুঝবেন।’
‘ধন্যবাদ। আরেকটা কথা, আপনার যে দাবী বা প্রস্তাব যা ই বলি এটা প্রতিপক্ষ হিসেবে কিনা?’
‘আমরা একটা পক্ষ বটে, তবে আপনার অর্থাৎ সরকারের প্রতিপক্ষ আমরা নই। প্রতিপক্ষ হলে এই ডকুমেন্ট বিশ্বের সংবাদ মাধ্যমে ছড়িয়ে দিতাম। সরকারের বিরুদ্ধে একটা হই চাই বাধাতাম। কিন্তু আমরা তা চাইনি। চাইনি ডা: ওয়াং ও জেনারেল বরিসের পাপের বোঝা সরকারের ওপর চাপাতে।’
‘ধন্যবাদ। আপনার লোক কবে আসবে?’
‘আজই যাবে।’
‘নাম কি?’
‘ওমর মা চ্যাং।’
‘ঠিক আছে। গভর্নর হাউজের “দর্শনার্থী” রুমে তিনি পাঁচটায় আসবেন। তাকে আমার কাছে নিয়ে আসুন।’
‘ধন্যবাদ।’
‘ধন্যবাদ।’
আহমদ মুসা টেলিফোনের স্পিকারটা রাখল টেবিলে।
আহমদ ইয়াং, যুবায়েরভ, আজিমভ, আবদুল্লায়েভ, মা চ্যাং সবাই আহমদ মুসাকে ঘিরে দাঁড়িয়েছেন।
আহমদ মুসা টেলিফোনে কথা শেষ করতেই যুবায়েরভ বলে, ‘ম্যারাথন টেলিফোন টক। একজন গভর্নরের এত সময় থাকে।’
‘না, ভদ্রলোক একজন সত্যিকার রাজনীতিক। কথা শুনার ধৈর্য তার আছে।’ বলল আহমদ মুসা।
‘আমার শ্বশুর বলেন, হানদের মধ্যে যারা ভাল লোক তিনি তাদের একজন। দেং জিয়াও পিং এর উদারনীতির একজন সমর্থক তিনি। তার ওপর ব্যক্তিগতভাবে তিনি গণতন্ত্রের পক্ষে। ডা: ওয়াংদের সাথে বহু বিষয়ে তিনি একমত ছিলেন না। ডা: ওয়াংদের শত চাপ সত্বেও, আমরা শুনেছি, তিনি আমাদেরকে তাদের হাতে তুলে দেননি, যদিও তার প্রশাসনের অধিকাংশ এর পক্ষে ছিল। এদেরই সাহায্যে ডা: ওয়াং শেষ পর্যন্ত আমাদের কিডন্যাপ করেছিল।’ বলল আহমদ ইয়াং।
‘ঠিক বলেছ ইয়াং, তার সাথে কথা বলে সত্যিই আমার ভাল লাগল। যাক শোন তোমরা, মা চ্যাং আজ পাঁচটায় গভর্নর হাউজে যাবে।’
একটু থামল আহমদ মুসা। ভাবল একটু। তারপর বলল, ‘ওমর মা চ্যাং ভাড়া গাড়িতে যাবে এবং একটা গাড়ি ভাড়া করেই ফিরবে।’
‘কেন গাড়ি নিলে কি ক্ষতি?’
‘এক নাম্বার ক্ষতি, গাড়িটা ওদের কাছে চিহ্নিত হয়ে যাবে। এটাকে এড়ানোর জন্যে আমাদের গাড়ি নাম্বার, রঙ সবই পাল্টাতে হবে। আমরা অত ঝাক্কিতে যাব কেন? দ্বিতীয় ক্ষতি, মা চ্যাং গাড়ি থেকে নেমে যাবার পর গাড়ির কোথাও তারা ওয়্যারলেস সিগন্যাল বসিয়ে দিতে পারে। যার দ্বারা তারা আমাদের ঠিকানার সন্ধান পেয়ে যেতে পারে। সে ওয়্যারলেস সিগন্যাল আলফিনের অগ্রভাগের মতও হতে পারে। গাড়ি থেকে এদের খুঁজে বের করা খুবই মুশকিল। সুতরাং গাড়ি নেয়ার ঝুঁকি আমাদের না নেয়াই ভাল।’
‘আল্লাহু আকবার’ বলে মা চ্যাং চিৎকার করে উঠল। সপ্রশংস দৃষ্টিতে ওমর মা চ্যাং আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল। কিন্তু আহমদ মুসা তাকে বাধা দিয়ে বলল, ‘আমার কথা শেষ হয়নি।’
‘গভর্নরের সাথে দেখা করার পর’ বলতে শুরু করল আহমদ মুসা, মা চ্যাং-এর সরাসরি ঘাঁটিতে অথবা তার বাড়িতে ফেরা চলবে না। গাড়ি ভাড়া করে তাকে সোজা শিহেজী উপত্যকায় চলে যেতে হবে। তখন নিশ্চয় রাত হবে। রাতের অন্ধকারে তাকে পাহাড়ে আত্মগোপন করতে হবে। কেউ তাকে ফলো করছে না এটা নিশ্চিত হবার পর হাইওয়ে দিয়ে নয় বিকল্প পথে তাকে ঘোড়ায় চড়ে তাকে ঘাঁটিতে ফিরতে হবে। পাহাড়ের যে স্থানে মা চ্যাং এর সাথে আমাদের দেখা হয়েছিল, ঐখানে তার জন্য একটা ঘোড়া রাখা থাকবে।’
‘আহমদ মুসা ভাই জিন্দাবাদ। মা চ্যাং কে তারা অনুসরণ করতে পারে, এ সহজ কথাটা আমার মনেই হয়নি।’
‘কিন্তু এতটা কি গভর্নর সাহেব করবেন মুসা ভাই?’ বলল যুবায়েরভ।
‘প্রতিপক্ষ কি করবে তার ভিত্তিতে নয়, প্রতিপক্ষ কি করতে পারে সেটা হিসাব করেই তোমাকে সামনে এগুতে হবে যুবায়েরভ। দেখ, গভর্নর এবং তার প্রসাশন এক নাও হতে পারে। গভর্নরের নির্দেশ ছাড়া বা অজান্তেই তারা অনেক কাজ করে ফেলতে পারে।’
‘ঠিক বলেছেন মুসা ভাই। বিষয়টা আমার কাছে এখন পরিস্কার। বলল যুবায়েরভ।
‘কি আজিমভ, তুমি কথা বলছ না কেন?’ আজিমভের দিকে চেয়ে বলল আহমদ মুসা।
‘আমি ভাবছি মা চ্যাংকে ধরে রেখে ওরা আমাদের কথা আদায়ের চেষ্টা করে কি না?’ বলল আজিমভ।
‘তা করতে পারে। তবে তা করবে না বলেই আমার মনে হয়। প্রথম কারণ, শুরুতেই প্রকাশ্য বিরোধিতায় না এসে আমার পরিচয় সন্ধানকেই তারা গুরুত্ব বেশী দেবে, দ্বিতীয় কারণ, এ সময় ধরে তাদের খুব লাভ হবে না। তারা জানে, একজন ধরা পড়ার সাথে সাথে আমরা ঠিকানা চেঞ্জ করে ফেলব।’
কেউ আর কথা বলল না। আহমদ মুসাই কথা বলে উঠল। ‘মা চ্যাং, তুমি যাও, তৈরী হয়ে এস।’
বলে আহমদ মুসাও উঠে দাঁড়াল।
মা চ্যাং ঘাঁটি থেকে বেরিয়ে এল। দেখল তার সামনে নেইলি।
‘এমন তাড়াহুড়া করে যে বেরুলে?’ বলল নেইলি।
‘পাঁচটায় গভর্নরের সাথে সাক্ষাত করতে যেতে হবে।’
‘গভর্নরের সাথে! তুমি!’
‘এটাই সিদ্ধান্ত।’
‘তোমাকে পেলে কি ওরা ছাড়বে?’
‘না ছাড়ল।’
‘ভয় লাগছে না, খারাপ লাগছে না?’
‘একটুও না।’
‘তুমি আমার কথা একটুও ভাব না?’
‘তোমাকে ভাবা এবং সেখানে যাওয়া পরস্পর বিরোধী বলে তো জানি না।’
‘না, আমি তা বলছি না। আমি বলছি, আমার কষ্টের কথা তুমি ভাব না। ভাবলে ‘না ছাড়ল’ কথা অত আনন্দের সাথে প্রকাশ করতে পারতে না।’
‘ও ঐ কথা! তোমার মন এত নরম?’
‘তোমার মন বুঝি নরম নয়। আচ্ছা, শত্রুর ঘাঁটিতে যদি আমাকে পাঠাতো, তাহলে তোমার মন এমন নরম হতো না?’
‘না, গৌরব বোধ করতাম, তুমি বড় দায়িত্ব পালন করতে যাচ্ছ বলে।’
‘গৌরবের পাশে হারাবার এক বেদনা জাগতো না?’
মা চ্যাং নিরব রইল। এর উত্তর দিতে গিয়ে পারল না। হারাবার কথা শুনতেই মনের কোথায় একটা বেদনা চিন চিন করে উঠল।
‘আমি জানি জবাব দিতে তুমি পারবে না। কর্তব্যবোধ অবশ্যই সবচেয়ে বড়, কিন্তু তা হৃদয়ের অস্তিত্ব অস্বীকার করে নয়।’
‘হৃদয়ের কোন আরজু এসে কর্তব্যের পথ রোধ করে দাঁড়াতে পারে না?’
যদি দাঁড়ায় সেটা হবে দুর্বলতা। এ দুর্বলতার প্রশ্রয়কে ঠিক মনে করি না। কিন্তু আবার আমি বলব কর্তব্যবোধের পাশে হৃদয়ের বৃত্তির সচেতন উপস্থিতি সবসময়ই প্রয়োজন, তা বেদনাদায়ক হলেও। আমি মনে করি, সক্রিয় কর্তব্যবোধের পাশে হৃদয়ের কোন বেদনার অস্তিত্ব কর্তব্য কাজকে মহীয়ান করে তোলে।’
‘নেইলি, তোমার অনুভুতি গভীর। যতই দিন যাচ্ছে তুমি আমাকে মুগ্ধ করছ।’ নেইলির একটা হাত ধরে বলল মা চ্যাং।
মা চ্যাং এর হাতে একটা চাপ দিয়ে হাত ছাড়িয়ে নিল নেইলি। বলল, ‘ঘরের বাইরে এভাবে স্ত্রীর হাত ধরায় নিষেধ আছে। এভাবে প্রসংশা করাটাকেও নিষিদ্ধ করা হয়েছে।’
‘প্রথমটি ঠিক দ্বিতীয়টি ঠিক নয়। স্ত্রীর প্রসংশা করাটা নিষিদ্ধ নয়।’
‘তবু থাক। এত সুখকে আমার ভয় করে।’ বলে মুখ নিচু করল নেইলি।
‘সত্যিই অনন্য তুমি নেইলি।’
‘আবার!’
‘ঠিক আছে, মাফ করো।’ হাসল মা চ্যাং।
হাসল নেইলি।
এগিয়ে চলল দু’জন পথ ধরে।

বেইজিং, প্রধানমন্ত্রীর অফিস। প্রধানমন্ত্রীর সাথে রয়েছেন স্বরাষ্টমন্ত্রী। তারা পাশাপাশি দু’টি সোফায়। অন্য সোফায় বসে আছেন সিকিয়াং এর গভর্নর।
তাদের সামনে দেয়ালে বিশাল একটি টিভি স্ক্রীন। তাদের সকলের দৃষ্টি ছিল টিভি স্ক্রীনের দিকে। তারা দেখছিল একটি ভিডিও ফিল্ম। শেষ হয়ে গেল ফিল্মটি।
‘রিপোর্টে যা পড়লাম তা থেকে ফিল্ম তো আরো মারাত্মক। এসব ঘটনা সত্যই সেখানে ঘটেছিল।’ বলল চীনের লীন পিয়াও।
‘ছবি সাক্ষ্য দিচ্ছে, অস্বীকার করবার তো কোন উপায় নেই স্যার। ‘বলল সিংকিয়াং-এর গভর্ণর।
‘অস্বীকার করতে পারছেন না। কিন্তু এগুলো দেখেননি কেন?
‘আমরা মানে আমি জানতেই পারিনি স্যার।’
‘আপনার পুলিশ, আপনার গোয়েন্দা বিভাগ কি করেছে।’
এখন মনে হচ্ছে স্যার, তারা কিছু করেনি। বরং তারা ডাঃ ওয়াং ও বরিসকেই সাহায্য করেছে।’
‘মিঃ হোয়াং হুয়া, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, এর ব্যাখ্যা কি?’
‘স্যার, ঘটনা আমাকেও স্তম্ভিত করেছে। কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থাও এসব কোন তথ্যই আমাদের দেয়নি।
‘কেন এমনটা হলো? এই ব্যাপারে আমাদের পুলিশ ও গোয়েন্দা বিভাগ ব্যর্থ হলো কেন?
‘ব্যর্থ হয়নি স্যার। সিনহকিয়াং থেকে মুসলিমপন্থী সরকারের উচ্ছেদকে পুলিশ ও গোয়েন্দা বিভাগ মুসলিম বিরোধী একটা অভ্যুথান মনে করেছে। আর এই পরিবর্তনের সুযোগে ডাঃ ওয়াং-এর রেড ড্রাগন মুসলিম নিধন ও উচ্ছেদ শুরু করেছে, তখন পুলিশ ও গোয়েন্দা বিভাগ একে অভ্যুথানের সাথে সংগতিশীল মনে করেছে। এটা তাদের ভুল, কিন্তু ভুল ধরিয়ে দেয়ার সুযোগ হয়নি।’
‘ডাঃ ওয়াং এর স্বেচ্ছাচারী আচরণের কোন কিছুই কি আপনার চোখে ধরা পড়েনি?’ সিংকিয়াং এর গভর্ণের দিকে চেয়ে বলল প্রধানমন্ত্রী।
‘যেগুলো ধরা পড়েছে তার কিছু কিছু মোকাবিলা আমি করেছি। কিছু কিছু বিষয় কেন্দ্রে জানিয়েছিও। যেমন ডাঃ ওয়াং সাবেক লি ইউয়ান ও তার পরিবার বর্গকে আমাদের কারাগার থেকে তার হাতে নিয়ে নিজে বিচার করতে চেয়েছিল। আমি বিষয়টিকেন্দ্রে জানিয়েছি এবং তার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছি।’
‘কিন্তু এরপরেও লি ইউয়ানকে সে কিডন্যাপ করতে পারল!’ প্রধানমন্ত্রী বললেন।
‘স্যার, ডাঃ ওয়াংকে হান কর্মচারীরা তাদের ত্রাতা বলে মানে, সুতরাং সে গোপনে যে সাহায্য চায় পেয়ে যায়।’
‘আমি শুনেছি সে দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে। মুসলমানরাও চাচ্ছে না সে থাক। তারা মনে করছে, সে থাকলে মুসলমানরা ভুল বুঝাবুঝির শিকার হবে।’
‘এটা মুসলমানদের ভালো সিদ্ধান্ত।’
‘স্যার, তাদের দাবীর মধ্যে অস্বাভাবিক কিছু নেই। তারা নিজ মাটি, নিজ বাড়িতে ফিরে আসতে চাচ্ছে, কোন ক্ষতিও করেনি। তারা তাদের বাড়িতে ফিরে আসুক।’
‘আমরা কিছুই করিনি তা কি প্রমাণ করা যাবে? ছবিতে দেখলাম, ডাঃ ওয়াং হেলিকপ্টার ব্যবহার করেছে। রাষ্ট্রের হেলিকপ্টার সেটা। আমরা কি জবাব দেব এর।’
‘স্যার, তাদের সব আবদার আমরা মানতে পারবো না। পৃথিবীর অনেক দেশেই এমনটা ঘটছে। কিন্তু কয়জন জওয়াবদিহি করে?’
‘তুমি কি বল গভর্ণর?’
‘ওদের দখল করা ডকুমেন্ট নিয়েই হয়েছে সমস্যা। এগুলো যদি বিশ্বের সংবাদ মাধ্যমে যায়, গোটা দুনিয়ায় তোলপাড় পড়ে যাবে। বিভিন্ন দেশের প্রতিবাদ চাপ ছাড়াও বিষয়টি জাতিসঙ্ঘে উঠবে। হয়তো কমিশন ও তদন্তের জন্য আসবে জাতিসঙ্ঘ থেকে। তখন আরও অনেক কথাই ফাঁস হয়ে যেতে পারে। এছাড়া মুসলিম দেশগুলোর সাথে বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলোর সাথে আমাদের সম্পর্কের উন্নয়ন ও লেনদেন বাধাগ্রস্ত হতে পারে। গভর্ণর সাহেব ঠিকই বলেছেন। কিন্তু আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়ার ভয়ে আমরা যদি ওদের দাবী সব মেনে নেই, তাহলে আগে যা ছিল তার চেয়ে ও খারাপ অবস্থায় পৌঁছব। একবার দুর্বলতা দেখালে ওরা মাথায় চড়ে বসবে।’
‘একটা দিক বললেন, অন্যদিক বলুন। ওদেরকে ঘরে আসার সুযোগ দিয়েই যদি আমরা দায়িত্ব শেষ করি এবং তা যদি ওরা মেনে না নেয়, তাহলে আমরা কি করব। যে ভিডিও বিশ্বের সংবাদ মাধ্যমে ফিল্ম আমরা দেখলাম এবং যে রিপোর্ট আমরা পড়েছি, তা বিশ্বের সংবাদ মাধ্যমে যাক তা আমরা চাইব কিনা।’
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হোয়াং হোয়া কোন উত্তর দিল না।
প্রধানমন্ত্রী লিন পিয়াও একটু নড়ে চড়ে বসল। বলতে শুরু করল, ‘লাভ ক্ষতির অংক কষেই আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে। ডকুমেন্ট গুলোকে যদি আমরা বিশ্ব সংবাদ মাধ্যমে যেতে দেই, তাহলে আমরা যাই বলি উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনের দায়িত্ব অবশেষে আমাদের নিতেই হবে। আমরা যদি অস্বীকার করি, তাহলে জাতির নেতৃত্বে এন জি ওরা আসবে, আমরা বাধা দিতে পারবো না। তাতে বিশ্বব্যাপী আমরা নিন্দিত হবো, সমালোচনার সম্মুখীন এবং বিভিন্ন প্রকার অসহযোগীতার সম্মুখীন হবো, তার মূল্য এখন ওদের দাবী মেনে নিলে যে আর্থিক ক্ষতি, তার চেয়ে অনেক অনেক বেশী। সুতরাং ওদের দাবী মেনে নেয়ার মধ্যেই আমি কল্যাণ দেখি।’
‘ওদের দৌরাত্ম্য যে বাড়বে তার কি হবে?’ বলল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
‘মিঃ হোয়াং হোয়া, ওদের কিন্তু অনেক বিবেচক দেখছি। ওরা আমাদের জব্দ করতে চাইলে, যে ভয়ানক ডকুমেন্ট ওরা পেয়েছে তা বিশ্ব সংবাদ মাধ্যমে প্রচার করে আমাদের নাজেহাল করতে পারত। কিন্তু তা তারা করেনি। প্রসঙ্গটি বিশ্বের দরবারে না নিয়ে নিজেদের মধ্যেই এর সমাধান চেয়েছে। ওদের এই উদ্যোগটা প্রতিহিংসামুলক না হয়ে দেশপ্রেম মূলক হয়েছে। অতএব আপনি যে ভয় করছেন তা হবে না। বরং ওরা যদি বিশ্ববাসীর চাপে পুনর্বাসিত হয় ও অধিকার ফিরে পায় তাহলেই ওরা বেপরোয়া হবে এবং ওদের দৌরাত্ম বাড়বে। সে ক্ষেত্রে আমরা অসহায় হয়ে পড়ব।’
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হোয়াং হোয়া হাসল এবং বলল, ‘স্যার আপনার যুক্তি আমি মেনে নিচ্ছি। বুঝতে পেরেছি, ওদের দাবী মেনে নেওয়াটাই আমাদের জন্য মঙ্গলজনক। ধন্যবাদ স্যার।’
‘ধন্যবাদ। এখন বল গভর্নর, ওদের দাবী মেনে নিলে আমাদের কি করতে হবে এবং আর্থিক দায় কেমন হবে?’
‘স্যার, আমি একটা খসড়া বাজেট ও পরিকল্পনা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহোদয়কে দিয়েছি।’
‘ঠিক আছে গভর্নর, আজ আমরা ওটা নিয়ে বসব। আশা করি কাল তুমি সব ঠিকঠাক করে চলে যেতে পারবে। আর তুমি ওদের জানিয়ে দাও ওদের দাবী আমরা মেনে নিয়েছি।’
‘ধন্যবাদ স্যার।’ বলল গভর্নর।
‘ধন্যবাদ’ বলে উঠে দাঁড়াল প্রধানমন্ত্রী। তার সাথে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীও। তাদের সাথে সাথে বেরিয়ে গেল সিংকিয়াং-এর গভর্নরও।

অপরাধীদের শাস্তি প্রাপ্য, কিন্তু এই শাস্তির মধ্যেও এক বেদনা আছে। উইঘুর মুসলমানদের বাড়ি ছেড়ে দিয়ে যখন হানরা পথে নামছিল, তখন সেই বেদনাই আহমদ মুসাকে পীড়া দিচ্ছিল। মুসলমানদের সম্পদ তারা লুট করেছে। বহু মুসলমানদের জীবন তাদের হাতে শেষ হয়েছে একথা ঠিক, কিন্তু এখন পরাজয় স্বীকার করে দখল পরিত্যাগ করে চলে যাবার সময়, অনেকেই অশ্রু বর্ষণ করছে। তাদের এই অশ্রু বর্ণবাদী ডঃ ওয়াংদেরই পাপের ফল।
উরুমুচির মুসলিম বাড়িগুলো আবার আনন্দে গমগম করে উঠেছে। প্রতিটি পরিবারকেই সরকারের পক্ষ থেকে ক্ষতিপূরণ দেয়া হয়েছে। আরেকটা বড় কাজ হয়েছে পুলিশ বাহিনীতে মুসলমানদের রিক্রুট করার সিদ্ধান্ত সরকার নিয়েছে। সেনাবাহিনীতেও। সিদ্ধান্ত হয়েছে সিংকিয়াং-এ যে পুলিশ বাহিনী থাকবে তাতে জনসংখ্যার অনুপাত অনুসারে অন্তত চার ভাগের তিন ভাগ মুসলিম হবে।
শিহেজী উপত্যকায় আবার মুসলমানরা ফিরে এসেছে। আহমদ ইয়াং এসে আহমদ মুসাকে বলল, ‘চলুন, সবার দাবী শিহেজী উপত্যকায় যেতে হবে আপনার।’
সবাইকে নিয়ে আহমদ মুসা চলল শিহেজী উপত্যকায়।
তিন গাড়ির একটা বহর চলল শিহেজী উপত্যকার দিকে।
উসু তখন বেশ দূরে। জনমানবহীন পার্বত্য এলাকার একটা সরাইখানার পাশ দিয়ে চলছিল তাদের গাড়ি।
হঠাৎ সরাইখানা থেকে চিৎকার উঠল, সেই সাথে ভেসে এল গুলির শব্দ।
আহমদ মুসার গাড়ি থেমে গেল। সাথের অন্য দুটি গাড়ি ও থেমে গেল সেই সাথে।
চিৎকার তখনও শোনা যাচ্ছিল।
রাত তখন ৯টা।
আহমদ মুসা গাড়ি থেকে নেমে ছুটল সরাইখানার দিকে।
সরাইখানা দুতালা। দুতালা থেকেই চিৎকারের শব্দ আসছে।
সরাইখানার লনে একটা পুলিশের গাড়ি দাঁড়ানো দেখে বিস্মিত হলো আহমদ মুসা। পুলিশ আসার পর চিৎকার ও গুলি যেন হিসাবে মিলছে না।
আহমদ মুসা সিঁড়ি বেয়ে তর তর করে উপরে উঠে গেল।
সিঁড়ি গিয়ে মিলেছে একটা করিডোরে। করিডোরের পাশ দিয়ে এক সারি ঘর, বড়-ছোট নানা রকমের।
মাঝখানের একটা ঘর থেকে চিৎকার ও ধস্তাধস্তির শব্দ আসছে।
আহমদ মুসা সিড়ি মুখে উঠেই দেখতে পেল, যে ঘর থেকে চিৎকার ও ধস্তাধস্তির শব্দ আসছে, তার দরজায় দাঁড়িয়ে দু’জন পুলিশ।
আহমদ মুসা করিডোরে উঠতেই ওরা বন্দুক বাগিয়ে তেড়ে এল কয়েক ধাপ।
কয়েক ধাপ।
আহমদ মুসার হাত দুটি পকেটে। বলল, ‘কারা কাঁদছে, চিৎকার করছে আমি দেখতে চাই।’
‘তোমার কোন কাজ নেই এখানে। আর এক ধাপ এগুলে আমরা গুলি করব।’
‘তার মানে তোমরা অসৎ কিছু করছ।’
‘আর একটি কথাও নয়, গুলি করব।’
এই সময় দুটি নারী কন্ঠের চিৎকার সব কান্নাকে ছাপিয়ে উঠল।
বিদ্যুৎ বেগে আহমদ মুসার হাত বেরিয়ে এল পকেট থেকে।
দু’হাতে দু’টি রিভলভার পুলিশ দুজনের উদ্দেশ্যে উঠে এল।
পুলিশ দুজনের বন্দুক উঠে আসছিল আহমদ মুসার লক্ষ্যে। কিন্তু আহমদ মুসার রিভলভার যত দ্রুত উঠে এল তত দ্রুত নয়।
গুলি বর্ষণ হলো আহমদ মুসার রিভলভার থেকে।
পুলিশ দুজন গুলি খেয়ে পড়ে গেল করিডোরে।
গুলি করেই আহমদ মুসা দ্রুত ছুটল ঘরের দিকে।
দাঁড়াল গিয়ে দরজায়। দেখল, ঘরের মেঝেতে একজন যুবক রক্তে ভাসছে। মাঝ বয়েসি একজন লোক ও একজন মহিলা মেঝেতে পড়ে কাঁদছে। আরো কয়েকজন ছেলে লুটোপুটি করছে কান্নায়। তাদের চোখ মুখে আতংক। সবাই হান বংশীয় আর দু’জন পুলিশ অফিসার দু’জন আলু থালু বেশের তরুণীকে জড়িয়ে ধরে টেনে নিয়ে আসছে। সম্ভবত গুলির শব্দ পেয়ে ওরা বাম হাতে মেয়েদের ধরে রেখে ডান হাতে রিভলবার বের করে নিয়েছিল।
আহমদ মুসা দরজায় গিয়ে দাঁড়াতেই সামনে এগিয়ে পুলিশ অফিসারটি রিভলভার তুলল আহমদ মুসার দিকে। আহমদ মুসা দেখল ট্রিগারে তার হাত।
আহমদ মুসা প্রস্তুত হয়েই ঢুকেছিল। গুলি করতে বিন্দুমাত্র দেরী করল না। সামনে এগিয়ে আসা পুলিশ অফিসারটি উল্টে পড়ে গেল।
তার হাত থেকে খসে মেয়েটি ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরল মাঝ বয়সী মেয়েকে।
গুলি করেই আহমদ মুসা শুয়ে পড়েছিল। তার হিসাব নিঁখুত ছিল। একটি গুলি তার মাথার উপর দিয়ে চলে গেল। আর একমুহুর্ত দেরী করলে তার মাথা উড়ে যেত।
শুয়ে পড়ে আহমদ মুসা গুলি করল দ্বিতীয় পুলিশ অফিসারটির রিভলভার ধরা হাতে।
পুলিশ অফিসারটি তার একটি গুলি ব্যর্থ হবার পর দ্বিতীয় গুলি করার জন্যে রিভলভার ঘুরিয়ে নিচ্ছিল। কিন্তু গুলি করার সুযোগ তার আর হলো না। তার আগেই আহমদ মুসার গুলির আঘাতে তার হাত থেকে রিভলভার ছিটকে পড়ে গেল।
‘জান তুমি, এ পুলিশ হত্যার পরিণাম তোমার কি হবে?’
‘আমার পরিণাম নিয়ে আপনার চিন্তা করে লাভ নেই। বলুন, মেয়ে কিডন্যাপ করা কি পুলিশের দায়িত্ব?’
‘জানেন কাকে হত্যা করলেন?’
‘জানার প্রয়োজন নেই, আপনি মেয়েটিকে ছেড়ে দিন। দ্বিতীয়বার আর বলব না মাথা গুড়িয়ে দেব।’
সংগে সংগেই পুলিশ অফিসারটি মেয়েটিকে ছেড়ে দিল। মেয়েটি ছুটে গিয়ে আছড়ে পড়ল সেই মাঝ বয়সী মেয়েটির কোলে।
এই সময় আহমদ মুসার পেছনে এসে দাঁড়াল যুবায়েরভ, আজিমভ ও আহমদ ইয়াং।
‘আহমদ ইয়াং, এর হাত বেঁধে নিয়ে যাও নিচে। থানায় সোপর্দ করতে হবে হত্যা ও কিডন্যাপের অভিযোগে।’ বলল আহমদ মুসা।
আহমদ ইয়াং হাত বেঁধে তাকে নিচে নিয়ে গেল।
মাঝ বয়সী ভদ্রমহিলাটি ছুটে এসে আছড়ে পড়ল সেই নিহত যুবকটির উপর।
আহমদ মুসা এগিয়ে গিয়ে বলল, ‘নিহত যুবক নিশ্চয় আপনার সন্তান মা। কিন্তু এখন কান্নার চেয়ে বেশী প্রতিবাদী হতে হবে মা। না হলে এ স্বেচ্ছাচার আরও অনেকের ক্ষতি করবে।’
মহিলাটি একটু পর উঠল। চোখ মুছতে মুছতে বলল, ‘তুমি আমার মেয়ে দু’টিকে সর্বনাশের হাত থেকে বাঁচিয়েছ বাছা। আর একটু আগে এলে আমার সোনার ছেলেও বাঁচত। ওদের বাঁধা দিতে গিয়ে সে জীবন দিয়েছে।’
‘পুলিশরা কি আপনাদের পূর্ব পরিচিত কিংবা ওদের সাথে কোন শত্রুতা আছে আপনাদের?’
গাড়ি খারাপ হওয়ায় আমরা এ সরাইখানায় আশ্রয় নিয়েছি। পুলিশের একটা গাড়ি দেখে আমরা তাদের সাহায্য চেয়েছিলাম। তারা যেন নজর রাখে, চারদিকের অবস্থা ভাল নয়। ওরা চলে যায়, কিছুক্ষণ পর আবার ফিরে আসে। মেয়ে দু’টিকে ওদের সাথে দিতে বলে। এরপর যা ঘটেছে তা দেখছ।’
‘এত জঘন্য এরা?’
‘শুধু এরা নয়, পুলিশের অধিকংশই নষ্ট হয়ে গেছে। উইঘুরদের উপর এরা যা ইচ্ছা তাই করেছে, এখন আমাদের উপরও হাত তুলছে। এ ফ্রাঙ্কেনষ্টেইন আমরাই গড়েছি।’
‘ঠিক বলেছেন মা। উইঘুর মুসলমানদের উপর অত্যাচারে যারা হাত তালি দিয়েছে, তারাও এখন এদের অত্যাচারের শিকার হবে, এটাই প্রাকৃতিক বিধান।’
‘বলতে দ্বিধা নেই, আমরা এরই শিকার।’
‘আমরা আপনাদের জন্যে কি করতে পারি বলুন, আপনারা এখানে নিরাপদ নন।’
‘আমরা কি করব? আমাদের গাড়ি খারাপ কোন গাড়িও পাইনি।’
‘আপনারা চাইলে আপনাদের আমরা উসুতে পৌঁছে দিতে পারি। আপনারা কোথায় যাবেন?’
‘শিহেজী উপত্যকায়?’
‘কোথেকে আসছেন?’
‘হুনান থেকে।’
‘শিহেজীতে কার কাছে যাবেন? কে আছে ওখানে?’
‘ওখানে আমার বড় বোন থাকেন। ওর কাছে বেড়াতে যাচ্ছি।’
‘আপনার বোন জামাই নিশ্চয় হান?’
‘জি।’
‘কতদিন তারা শিহেজী উপত্যকায় আছে?’
‘এই এক মাস। শুনলাম ভাল বাড়ি পেয়েছে, জমি-জমাও পেয়েছে অনেক।’
‘আমি মনে করি শিহেজী গেলে ওদের পাবেন না।’
‘কেন?’ মেয়েটির চোখ বড় বড় হয়ে উঠল।
‘উইঘুরদের সরিয়ে তো তারা বসেছিলেন, উইঘুররা আবার ফিরে এসেছে।’
মাঝ বয়সী সেই লোকটি এতক্ষণ আলোচনা শুনছিল। সে উঠে এল। তার চোখে মুখে উদ্বেগ। বলল, ‘তাহলে কি সংঘাত সংঘর্ষ হয়েছে? হানরা কি তাহলে পরাজিত?’
‘সংঘাত সংঘর্ষ হয়নি। সরকারই একটা আপোষ মূলক ব্যবস্থা করেছে। উইঘুরদের জায়গা তাদের ফেরত দিয়েছে। হানদের তাদের নিজের জায়গায় ফেরত পাঠাচ্ছে।
‘ও গড! তাহলে ওরা কোথায় গেল। আমরা এখন কি করব?’ বলল মেয়েটি।
‘আমরা আপনাদের উসুতে পৌঁছে দিতে পারি। সেখান থেকে কাল সকালে গাড়ি নিয়ে উরুমুচি কিংবা হান ফিরে যেতে পারেন।’
‘তাই হোক।’ পুরুষটি বলল।
‘ঠিক আছে। তাহলে আপনারা তৈরী হয়ে নিন।’ বলল আহমদ মুসা।
তারা উঠে দাঁড়াল।
মহিলাটি ইতস্তত করছিল এবং তার সন্তান যুবকটির লাশের দিকে তাকাচ্ছিল।
‘চিন্তা করবেন না, আপনাদের ছেলের দেহ আমরা সাথে নেব।’
বলে আহমদ মুসা যুবকের লাশটি পাঁজাকোলা করে তুলে নিল।
আজিমভ, আহমদ ইয়াং-এর সাথে আগেই নেমে গিয়েছিল।
নিচে নামতেই আহমদ ইয়াং ছুটে এল এবং আহমদ মুসার কাছ থেকে যুবকের লাশটি নিয়ে নিল।
গাড়িতে উঠল সবাই। পুলিশকেও গাড়িতে উঠানো হলো।
তাদের তিন গাড়ির বহরে ছিল একটি মাইক্রোবাস। সে মাইক্রোবাসের সামনের সিটে উঠল আহমদ মুসা। আর ড্রাইভিং সিটে বসর আহমদ ইয়াং।
পেছনে উঠাল যুবকটির লাশ। সেই সাথে সেই ভদ্রলোক, ভদ্রমহিলা এবং তার পরিবার।
গাড়ি ছাড়তে যাবে, এমন সময় ছুটে এল যুবায়েরভ এবং আজিমভ হন্তদন্ত হয়ে।
ওদের দেখে আহমদ মুসা দরজা খুলল।
দরজায় এসে দাঁড়াল যুবায়েরভ ও আজিমভ। একটু নিচু গলায় বলল, ‘আলমাআতা থেকে এই মাত্র মেসেজ পেলাম। সারেজুর আণবিক প্রকল্প সেন্টারে আমাদের দু’জন শীর্ষ বিজ্ঞানী খুন হয়েছে গত দু’দিনে এবং একটি কম্পুটার ব্যাংক তছনছ হয়েছে। আতংক ও নিরাপত্তাহীনতা ছড়িয়ে পড়েছে গোটা সারেজুতে।’
থামল যুবায়েরভ।
খবরটি শোনার সংগে সংগে আহমদ মুসার মুখ ম্লান হয়ে গেল। মাথা নিচু করে কিছুক্ষণ চিন্তা করল। তারপর মুখ ফিরাল আহমদ ইয়াং-এর দিকে। বলল, আহমদ ইয়াং, শুনেছ তো সব, তোমার শিহেজী উপত্যকায় আর যাওয়া হচ্ছে না। গাড়ি ঘুরিয়ে দাও উরুমুচির দিকে।’
তারপর ফিরল যুবায়েরভ ও আজিমভের দিকে। বলল, ‘তাড়াতাড়ি আমাদের উরুমুচিতে ফেরা দরকার। বিজ্ঞানী নবিয়েভকে সব ঘটনা জানাতে হবে। আমার মন বলছে, আজই আমাদের মায়েজ যাত্রা করা দরকার। যাও, তোমরা সব গাড়ি ঘুরাতে বল উরুমচির দিকে।’
চলে গেল যুবায়েরভ ও আজিমভ।
আহমদ মুসা পেছন দিকে ফিরে বলল, ‘জনাব, আমরা যদি উসুতে না গিয়ে উরুমচিতে ফিরি, তাহলে কি আপনাদের কোন অসুবিধা আছে?’
‘না না, সেটাই বরং আমাদের জন্যে ভাল। আমরা অনেকটা পথ এগিয়ে গেলাম রাতারাতি।’ বলল মাঝ বয়সী ভদ্রলোক।
‘ধন্যবাদ’ বলে আহমদ মুসা আহমদ ইয়াংকে গাড়ি ছাড়তে বলল।
উরুমচি পৌঁছে বেধে রাখা পুলিশ অফিসারদেরকে যুবায়েরভ থানায় সোর্পদ করে সাথে নিয়ে আসা পরিবারটিকে একটি হোটলে নিয়ে গেল।
ওদের লাগেজসহ ওদেরকে হোটেলে তুলে দিয়ে আহমদ মুসা ও আহমদ ইয়াং বিদায় নিতে চাইল।
ভদ্রলোক ও ভদ্রমহিলা দু’জনেই আহমদ মুসার পথ রোধ করে দাঁড়াল। বলল ভদ্রলোকটি, ‘তুমি আমাদের জন্যে এত কিছু করবে, অথচ তোমার নাম পরিচয়টাও আমাদের জানা হয়নি।’
‘আব্বা শুধু ওঁর পরিচয় নয়, ওঁকে আমাদের বাড়িতে দাওয়াত করুন। তিনি আমাদের নতুন জীবন দিয়েছেন।’ বলল ভদ্রলোকটির মেয়ে দু’জনের একজন তরুণী।
‘আমি আহমদ মুসা। আর এ আহমদ ইয়াং।’ বলল আহমদ মুসা।
‘কোন আহমদ মুসা?’ এক সাথেই বলে উঠল ভদ্রলোক ও ভদ্রমহিলা। তাদের চোখে এক সাগর প্রশ্ন।
আহমদ মুসা কিছু বলার আগে তারাই বলল, ‘ ঐ আহমদ মুসা নয়তো যে সোভিয়েত ইউনিয়নে বিপ্লব করেছে, সিংকিয়াং-এ গন্ডগোল করেছে এবং হানদের শত্রু?’
‘জি, আমি সেই আহমদ মুসাই।’
ভদ্রলোক, ভদ্রমহিলা এবং দুজন তরুণী চোখে অপার বিস্ময়। তারা ভূত দেখার মত নির্বাক চোখে তাকিয়ে রইল।
তাদের দিকে তাকিয়ে আহমদ মুসা একটু হাসল। বলল, ‘আমাদের এখুনি যেতে হবে, অনেক কাজ। শুধু বলে যাই, আমরা সিংকিয়াং-এ গন্ডগোল করিনি, আমরা হানদের শত্রুও নই।’
বলে আহমদ মুসা সামনে পা বাড়াতে চাইল। কিন্তু ভদ্রলোকটি দুই হাত প্রসারিত করে আহমদ মুসার পথ রোধ করে দাঁড়াল।
বলল, ‘না, আপনি সে আহমদ মুসা নন, যে আহমদ মুসার কথা আমরা শুনেছি।’
‘তাহলে কোন আহমদ মুসা আমি?’
‘যে আহমদ মুসা পরোপকারী এবং মানবতাবোধে উদ্ধুদ্ধ সেই আহমদ মুসা আপনি।’
‘এক মানুষের দুই সত্ত্বা থাকে না কি?’
‘আমি তা বলি না। আমি যে আহমদ মুসার কথা শুনেছি, তাকে আমি দেখিনি। যে আহমদ মুসাকে আমি দেখেছি, তিনি আমার সেই শোনা আহমদ মুসা নন। শোনা আহমদ মুসার কোন অস্বিত্ব আমার কাছে নেই।’
‘আপনার কাছে না থাকলেও হাজারো লোকের কাছে আছে। আপনি অস্বীকার করবেন কেমন করে?’
‘হাজারো লোকের শোনা কথার সাক্ষ্যের চেয়ে একজনের দেখা কথা সাক্ষ্য বড়। যে নিজের জীবন বিপন্ন করে একটি হান পরিবারকে রক্ষা করে, যে একজন হান যুবকের লাশ বহন করে এবং সামান্য প্রশংসারও যে মুখাপেক্ষী নয়, সে হানদের শত্রু আমি মানি না।’
‘কিন্তু এটা তো সত্য যে আমি হানদের বিরুদ্ধে এবং মুসলমানদের পক্ষে কাজ করছি।’
সংগে সংগে উত্তর দিলনা ভদ্রলোক। মাথা নিচু করে কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর বলল, ‘আজ আমার মনে হচ্ছে, যে কারণে আজ আমার পরিবারকে আপনি রক্ষা করতে ছুটে গিয়েছিলেন প্রাণ বিপন্ন করে, সে কারনেই আপনি ছুটে এসেছেন সিংকিয়াং-এর মুসলমানদের রক্ষার জন্যে।’
‘অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। এমন বাস্তব উপলদ্ধি সবার মধ্যে এলে দেশটা শান্তির রাজ্যে পরিণত হতো।’
বলে আহমদ মুসা ভদ্রমহিলার দিকে ফিরে বলল, ‘আসি মা।’
‘না বাবা, যেতে পারবে না। মা বলে ডাকার আমার কোন ছেলে নেই। তুমি আমাকে মা বলে ডেকেছ। যেতে দেব না তোমাকে এত তাড়াতাড়ি।’ বলল ভদ্রমহিলা।
‘যাবার সময় হলে কেউ কাউকে ধরে রাখতে পারে না। মাও না। আমার যাবার সময় হয়েছে সিংকিয়াং থেকে।’
‘চলে যাচ্ছ সিংকিয়াং থেকে?’
‘সম্ভবত এখানকার কাজ শেষ।’
‘তোমার দেশ কোথায়?’
‘জন্মেছিলাম সিংকিয়াং-এ, এখন গোটা পৃথিবীই আমার দেশ।’
‘তাহলে বাড়ি কোথায়?’
‘আমার কোন বাড়ি নেই।’
‘বাড়ি নেই? আমি যদি তোমার ঠিকানা চাই?’
‘দিতে পারবো না।’
‘তোমার স্ত্রী, ছেলে……।’
আহমদ মুসা ভদ্রমহিলার এ প্রশ্নটির জবাব সংগে সংগে দিতে পারলো না। হঠাৎ একরাশ আবেগ এসে তার কন্ঠ রুদ্ধ করে দিতে চাইল।
আহমদ মুসা মুখ নিচু করল।
মুখ নিচু রেখেই জবাব দিল, ‘স্ত্রী ছিল। সে সিংকিয়াং-এরই মেয়ে। ডাঃ ওয়াংদের গুলিতে নিহত হয়েছে, তার পিতা মাতাও।’
‘আমি দুঃখিত বাবা, এ প্রশ্ন তোলা আমার ঠিক হয়নি।’
‘ঠিক আছে। আনন্দ-বেদনার এ পৃথিবীতে সব কিছুই থাকবে মা। আমি আসি মা।’
‘তুমি অনেক বড় বাবা, আমার কল্পনার চেয়েও বড়। কোন মাই তোমাকে ধরে রাখতে পারবে না।’
একটু থামল ভদ্রমহিলা। তারপর বলল, ‘একটা বড় সান্ত্বনা পেলাম। একটা পর্বত প্রমাণ ভুল নিয়ে বেঁচে ছিলাম। তোমার সাথে দেখা হওয়ায় সে ভুল ভেঙ্গে গেল। আচ্ছা বলত, ইসলাম কি ঠিক তোমার মত? যে হানদের হাতে তুমি তোমার প্রিয় বস্তু হারিয়েছ, সে হানদের একটি পরিবারকে রক্ষার জন্যে জীবন বিপন্ন করে এগিয়ে গিয়েছিলে। এ উদারতা তোমার না তোমার ইসলামের?
‘ইসলাম আমাকে গড়েছে মা। ইসলাম বাদ দিলে আমি ডাঃ ওয়াংদেরই একজন হয়ে যেতে পারি।’
‘ধন্যবাদ বাছা। তোমার মূল্যবান সময় অনেক নষ্ট করেছি। তোমাকে কষ্ট দিয়েছি। কিন্তু আমরা উপকৃত হয়েছি। তোমাকে, সেই সাথে তোমার ইসলামকে আমার মনে থাকবে।’
‘ইসলাম আমার নয় মা, ইসলাম গোটা মানব জাতির সম্পদ। ইসলাম আপনারও।’
‘ধন্যবাদ।’
‘ধন্যবাদ’ বলে আহমদ মুসা পা তুলতে যাচ্ছিল। ভদ্রমহিলার মেয়ে তরুণী দু’জনের একজন এগিয়ে এসে আহমদ মুসার হাতে একটি কাগজ তুলে দিল। বলল, ‘ আমরা দু’বোন আপনাকে কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। মৃত্যুর মুখে ঝাপিয়ে পড়ে আপনি আমাদের বাঁচিয়েছেন। সিংকিয়াং-এর কেউ এক পা এগুতে পারতোনা পুলিশ অফিসারদের বিরুদ্ধে। আপনার দ্বারাই মাত্র ওটা সম্ভব হয়েছে। কাগজে ঠিকানা দিলাম। বিপ্লবী নেতা আহমদ মুসা সম্পর্কে কিছু কিছু জানি। তবু বলছি, ঘটনাচক্রে কোন দিন কোন সুযোগ যদি পান আমাদের বাড়িতে পা দেয়ার, আমরা ধন্য হবো।’
‘হানরা তখন যদি পিত্রালয়ে না থাকে?’ মিষ্টি হেসে বলল আহমদ মুসা।
তরুণীর মুখ লাল হয়ে উঠল। বলল, ‘ যেখানেই থাকি ছুটে আসব।’
‘ধন্যবাদ’ বলে আহমদ মুসা পা বাড়াল।
‘যাবার সময় আরেকটা প্রশ্ন, ভাই, সন্তান ও স্বামী সুলভ এত মমতাময় ও অনুভূতি প্রবণ হৃদয় নিয়ে আপনি এত বড় বিপ্লবী কেমন করে?’ বলল ভদ্রলোকটি।
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘মানুষের প্রতি অসীম মমতাই মানুষকে বিপ্লবী করে। মানুষের প্রতি মমতা না নিয়ে বিপ্লবী হওয়া পাপ। এটাও ইসলামের শিক্ষা।’
বলে আহমদ মুসা বেরিয়ে এল কক্ষ থেকে। হোটেলের সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে আহমদ মুসার মনে হলো, প্রতিটি পদক্ষেপ যেন তার আব্বা, আম্মা, বোনদের মমতামাখা স্নেহের নীড়কে পদদলিত করছে। হৃদয়ের কোথায় যেন একটা বেদনা চিন চিন করে উঠল আহমদ মুসার।

আহমদ ইয়াং বসে ছিল গাড়িতে।
আহমদ মুসা উঠে বসতেই ছেড়ে দিল গাড়ি।
কোন কথা বলল না আহমদ মুসা।
আনমান হয়ে পড়েছিল সে।
রাতের উরুমচী নগরী।
আহমদ মুসার মনে হলো, অন্ধকারের বুকে রাস্তায় আলো গুলো
আকুল প্রতীক্ষায় জেগে থাকা নিস্পলক চোখের মত জ্বল জ্বল করছে।
তার হৃদয়ের কোন দূর দিগন্তে একটা বেদনা যেন কথা বলে উঠল, ‘পৃথিবীতে লাখো গৃহ আছে, কিন্তু কোন গৃহেই কোন ঘুম জাগা চোখ এমন প্রতীক্ষায় নেই তার জন্য।’
সবাই ঘাঁটিতে এসে পৌছল।
সবাইকে আসতে বলে আহমদ মুসা হল ঘরের দিকে চলল। আহমদ মুসা হল ঘরে গিয়ে দেখতে পেল আহমদ ইয়াং এর শ্বশুর সাবেক গভর্নর লি ইউয়ান কে। বলল, চাচাজান, জরুরী আলাপ আছে, নেইজেন ও চাচীমাও এলে ভাল হয়।
ঠিক আছে ডাক ওদের।
আহমদ মুসা হল ঘরের একটা পর্দা টেনে দিল। কয়েকটি সোফা আড়াল হয়ে গেল। তারপর আহমদ মুসা ইন্টারকমে নেইলিকে বলল, তুমি নেইজেন ও চাচীমাকে হল ঘরে নিয়ে এসো।
নেইলিকে ঘাঁটির ইলেক্ট্রিসিটি ও যাবতীয় ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার দ্বায়িত্ব দেয়া হয়েছে। সেই সাথে ঘাঁটির অভ্যন্তরীণ ব্যবস্তাপনা কো- অর্ডিনেটরের দ্বায়িত্বও পালন করছে।
আহমদ মুসা, নেইলি ও ওমর মা চ্যাং এর ব্যাপারে খুব আশাবাদী। তারা আহমদ ইয়াং-এর টিমে অত্যন্ত মুল্যবান সংযোজন হবে।
নেইজেনরা এল এবং এল যুবায়েরভ ও আজিমভরাও।
আহমদ মুসা লি ইউয়ানের পাশের সোফায় বসেছিল।
বিজ্ঞানী নবীয়েভ এসে প্রবেশ করল হল ঘরে। লি ইউয়ানের পাশে।
‘জনাব নবীয়েভ, আপনি যুবায়েরভের কাছ থেকে সারেজ আণবিক প্রকল্পের কথা শুনেছেন। এ ব্যাপারে আপনার মত বলুন।’ বলল আহমদ মুসা।
‘যতটা বুঝতে পারছি সর্বনাশের যাত্রা সেখানে শুরু হয়ে গেছে। যে দুজন বিজ্ঞানী নিহত হয়েছে শুনলাম, তারা আমাদের পরীক্ষণ ও তত্ত্ববিজ্ঞানের দু’জন শীর্ষ বিজ্ঞানী। একই সাথে দুজন শীর্ষ বিজ্ঞানী নিহত হওয়া ও কম্পিউটার ডাটা ব্যাংক বিধ্বংস হওয়া খুব তাত্পর্যপূর্ণ। অত্যন্ত পরিকল্পিত উপায়ে ওরা আমাদের একমাত্র স্বয়ংসম্পূর্ণ আণবিক প্রকল্পকে অচল করে দিচ্ছে। কোন ডাটা ব্যাংকটি বিধ্বস্ত হয়েছে এটা জানলে আঁচ করা যেত ক্ষতির প্রকৃতিটা কেমন।’
থামল নবীয়েভ।
‘সবচেয়ে উদ্বেগের হলো, দুজন বিজ্ঞানী খুন হলেন এবং একটা ল্যাবরেটরী ধ্বংস হলো, কিন্তু আমাদের গোয়েন্দা বিভাগ সন্দেহ করবার মত কাউকে পায়নি। শত্রুরা মনে হচ্ছে সবকিছু জানে। নিখুঁত ওদের কাজ।’ বলল যুবায়েরভ।
‘আমাকে জিজ্ঞাসাবাদকালে ওরা কিন্তু বারবারই বলেছে, তোমাদের কোন কিছুই গোপন নেই। শুধু জানি না তোমাদের ঐ কম্পুটার ফাইলগুলো কোথায়? যদি এ ফাইলগুলো না পাই, তাহলে আমরা এমন পথ অনুসরণ করব, তা তোমাদের জন্যে হবে আরো ভয়াবহ। ক্ষতি ও ধ্বংস হবে আরও বড়। জেনে রেখ, তোমাদের আণবিক শক্তি ধ্বংস করেই ছাড়ব।’
‘জেনারেল বরিস তো সামনের লোক, পেছনে কে আছে?’ বলল লি ইউয়ান।
‘আমার মনে হয় রাশিয়ার জাতীয়তাবাদী মহল। একদিন ওদেরকে আমি রাশিয়ার গোয়েন্দা চীফ এর পক্ষ থেকে পাঠানো একটি মেসেজ নিয়ে আলোচনা করতে শুনেছি।’ বলল নবীয়েভ।
‘রাশিয়ার কট্টর জাতীয়তাবাদীরা চাচ্ছে এর দ্বারা। বলল আহমদ ইয়াং।
‘চাওয়াটা পরিস্কার, আণবিক শক্তির অধিকারী একমাত্র মুসলিম দেশ মধ্যএশিয়ার আণবিক সামর্থ ধ্বংস করা। সামনের ভিক্তি ধ্বসে পড়লে তৈরী অস্ত্র কোন সমস্যা হবে না। আন্তর্জাতিক কোন সিদ্ধান্তের প্যাঁচে ফেলে অস্রগুলো এক সময় কেড়ে নেয়া হবে।’ বলল যুবায়েরভ।
‘আলমা আতা থেকে আসা মেসেজে সেখানে আমাদের যাবার কথা বলা নাই। আমরা কি সিদ্ধান্ত নেব?’ আহমদ মুসা বলল।
‘আপনি জেখানে আছেন, সেখানে আলমা আতা থেকে কিছু বলার প্রয়োজন বোধ করেনি। কিন্তু পরিস্তিতি অত্যন্ত ভয়াবহ। আপনার সহ আমাদের অবিলম্বে যাওয়া দরকার।’ বলল একই সাথে যুবায়েরভ ও আজিমভ।
তাদের কথা শেষ হতেই আহমদ ইয়াং বলল, ‘অবস্থা গুরুতর সন্দেহ নেই, কিন্তু আহমদ মুসা ভাই- এর যাবার মত হলে আলমা আতার মেসেজে অবশ্যই এর উল্লেখ থাকতো। এদিকে আহমদ মুসা ভাই-এর প্রয়োজন এখানে শেষ হয়নি।’
‘আমারও তাই মনে হয়।’ বলল মা চ্যাং।
আহমদ মুসা হাসল। বলল, ‘নেইজেন, নেইলি তোমরা কিছু বললে না।’
‘আমাদের দাবী এত ছোট নয়। কদিন থাকার জন্যে আমরা বলব না। আমাদের দাবী আপনি এ দেশে থাকবেন।’ বলল নেইজেন।
‘তোমার পুরানো এ দাবী নতুন করে আর বলার দরকার ছিল না।’
হাসতে হাসতে কথা কটি বলে আহমদ মুসা একটু থামল। একটু ভাবল। মুখটা গম্ভীর হয়ে উঠল তার। তারপর মাথা তুলল। শুরু করল, ‘শুধু সারেজুর আণবিক প্রকল্পের কথা বিচ্ছিন্নভাবে না ভেবে গোটা মধ্যএশিয়া প্রজাতন্ত্রের কথা আমাদেরকে ভাবতে হবে। আমাকে কিডন্যাপ করা হয়েছিল মধ্যএশিয়ার সীমান্ত শহর হরকেস থেকে। এটা খুব ছোট ষড়যন্ত্রের ফল নয়। আমি কোন দিন, কখন আসব, কোথায় উঠব, কিভাবে কিডন্যাপ করা হবে, ইত্যাদি প্ল্যান অনেক আগেই করা হয়েছিল। ভি আই পি রেস্ট হাউজে যেমন ওরা লোক ঢুকেছিল অনেক আগে, তেমনি তথ্য সংগ্রহের জন্যে সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে ওদের লোক আছে বলেই আমাদের ধরে নিতে হবে। হরকেসের কিডন্যাপের ঘটনা প্রমান করেছে গোটা একটা ষড়যন্ত্র সক্রিয় হয়ে উঠেছে।যার একটা ভয়াবহ প্রকাশ সারেজু আণবিক প্রকল্পের ঘটনা। সারেজুতে যে ষড়যন্ত্র সক্রিয় তার লক্ষ্য মধ্যএশিয়া মুসলিম প্রজাতন্ত্রের আণবিক শক্তি ও সামর্থ ধ্বংস করা।কিন্তু ষড়যন্ত্রের সামগ্রিক লক্ষ্য হলো মধ্যএশিয়া প্রজাতন্ত্রের ক্ষতি সাধন। এই ষড়যন্ত্রকে অবিলম্বে চিহ্নিত ও তা ভেঙে দিতে না পারলে বড় ক্ষতির সম্মুখীন আমাদের হতে হবে। হরকেসের কিডন্যাপ ও সারেজুর ঘটনা আমাদের জন্যে জরুরী এক সতর্ক সংকেত।
একটু থামল আহমদ মুসা। একটু নড়ে চড়ে বসে বলল, ‘আজ রাতেই আমি রওয়ানা হতে চাই।’
‘আজ রাতেই?’ বিস্মিত কণ্ঠে বলল আহমদ ইয়াং।
‘হ্যাঁ, আজ রাতেই। চিন্তা করো না ইয়াং। যে পরিকল্পনা করা হয়েছে, তার বাস্তবায়নে তোমরাই যথেষ্ট।’ বলে আহমদ মুসা যুভায়েরভের দিকে তাকাল। বলল, ‘তুমি আলমা আতার সাথে যোগাযোগ কর। রাত ৩টার দিকে সালতাই পাহাড়ের সর্ব্বোচ্চ শৃঙ্গের গোড়ায় যে চত্তর রয়েছে, সেখানে দু’টি হেলিকপ্টার আসবে। একটা এলিকপ্টার ফিরবে আলমা আতায়। মেইলিগুলির শবদেহ যাবে এ হেলিকপ্টারে। আলমা আতা থেকে মেইলিগুলির শবদেহ যাবে মদীনায় দু’একদিনের মধ্যে। আগামীকাল হাসান তারিক আসছে মদীনায়। সে সব ব্যবষ্থা করবে দাফনের। আরেকটি হেলিকপ্টার যাবে মধ্য কাজাখাস্তানের কারসাকপে। এ হেলিকপ্টারে জনাব নবীয়েভের স্ত্রী ও মেয়ের শবদেহ থাকবে। সেই সাথে থাকবেন জনাব নবীয়েভ, আমি ও আজিমভ।এই মেসেজ তুমি আলমা আতায় পাঠিয়ে দাও।’
যুবায়েরভ বেরিয়ে গেল কক্ষ থেকে।
আহমদ মুসা ফিরল নবীয়েভের দিকে। বলল, ‘জনাব, মি যে ব্যাপারে বলেছিলাম আপনি চিন্তা করছেন?’
‘চিন্তা করছি। আমি মনে করি তোমার প্রস্তাব যুক্তিযুক্ত। আপাতত কিছদিন আমাকে দেশের বাইরেই থাকা দরকার। সুতরাং আমি ও আমার স্ত্রী মধ্যএশিয়ায় যেতে রাজী আছি।’
‘কিন্তু আমরা যে সব দিক থেকেই এতিম হয়ে যাব।’ বলল আহমদ ইয়াং।
‘আহমদ ইয়াং তোমাকে আরও স্বাবলম্বী ও স্বাধীন করার জন্যেই এমন সিদ্ধান্ত আরও জরুরী।’
‘বাঃ ভাইয়া,এ কোন যুক্তি। সাঁতার শেখাতে অভিভাবকরা হাজির থাকে না?’ বলল নেইজেন।
‘আহমদ ইয়াং এবং তোমার সাতার শেখা অনেক আগে শেষ। এবার স্বাধীনভাবে সাতারের পালা।’
‘কিন্তু এখানকার আবহাওয়া কতটা প্রতিকূল, আপনি জানেন।’ নেইজেনও কথা বলল আবার।
‘খুব প্রতিকূল হবে না। সিংকিয়াং সরকার এখন মুসলমানদের সাথে ভাল ব্যবহার না করুক, খারাপ ব্যবআর অন্তত করবে না। আর বিষদাঁত যে দুটি ছিল ভেঙ্গে গেছে। রেড ড্রাগন সক্রিয় হতে চেষ্টা করলেও এর জন্যে অনেক সময় লাগবে। সুতরাং ভয়ের কিছু নেই।’
একটু থেমেই আবার বলল, একটা কথা তোমাদের বলব, হানরা এখন একটু বেকায়দায় পড়েছে, তাদের কারও কারও ক্ষোভও বেড়েছে। এই সময় তাদের সাথে ভাল ব্যবহার কর, ওদের সাহায্য কর। ওদের সাথে বিরোধ নয়, ওদেরকে আমাদের করে নেয়াই সমস্যার সমাধান। মিশনারী জাতি হিসাবে মুসলমানদের মুল দায়িত্ব এটাই।’
‘ধন্যবাদ মুসা ভাই, আপনার উপদেশ মনে রাখব।’
‘অনেক রাত হয়েছে। এবার উঠতে হয়। খাবার রেডি।’
আহমদ মুসা লি ইউয়ান ও নবীয়েভকে বলল, ‘চলুন উঠা যাক।’ বলে আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল।
উঠে দাঁড়াল সবাই।

Top