১৬. মধ্য এশিয়ায় কালো মেঘ

চ্যাপ্টার

তাঁর নেতৃত্বে শিরীন,* আয়েশা আলিয়েভা, রোকাইয়েভারা যেমন নতুন জীবন পেয়েছে, তাঁর অভিভাবকত্বেই তারা পেয়েছে সুন্দর ও শান্তির সংসার।
অথচ তাদের নেতা, তাদের ভাই আহমদ মুসা মৃত্যুর সাথে লড়াই করেই ফিরছে!
এ ধরনের অনেক কথা এসে পীড়া দিচ্ছিল শিরীন শবনমের মনকে।
ঘরের বাইরে পায়ের শব্দ পেল শবনম। উঠে বসল সে।
ধীর পায়ে ঘরে এসে প্রবেশ করল কুতায়বা। তাঁর মুখ শুকনো।
চোখের দৃষ্টিটা নিচের দিকে।
‘কি খবর?’ উদ্বিগ্ন কণ্ঠ শবনমের।
‘কিছুই জানা যায়নি।’ বসতে বসতে বলল কুতায়বা।
‘বিমান বন্দর ভর্তি মানুষ, চারদিকে গিজগিজ করছে পুলিশ। এর মধ্যে থেকে আহমদ মুসার মত মানুষ হাওয়া হয়ে গেল, কেউ দেখল না?’ বলল শিরীন শবনম।
‘ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ ও অনুসন্ধানের পর এটুকুই জানা গেছে যে, বিজ্ঞানী নবিয়েভের গাড়িতে বিস্ফোরণ ঘটার পর দেড়-দু’মিনিটের মধ্যে দু’টি গাড়ি সামান্য ব্যবধানে পাকিং প্লেসের গেট দিয়ে বেরিয়ে গেছে।’
‘এর অর্থ তোমার গোয়েন্দা বিভাগ কি করেছে।’
‘নিশ্চিত করে কিছুই বলা যাচ্ছেনা। হতে পারে গাড়ির বিস্ফোরণ দেখে গণ্ডগোলের ভয়ে তারা বেরিয়ে গেছে। আবার হতে পারে কাউকে সন্দেহ করে আহমদ মুসা তাঁর গাড়িকে আরেকটা গাড়ি নিয়ে ফলো করেছে। আবার এমনও হতে পারে, মধ্য এশিয়া মুসলিম প্রজাতন্ত্রের যারা শত্রু তাদের অনেকের কাছে আহমদ মুসা পরিচিত। সুতরাং তাদের দ্বারা তিনি কিডন্যাপ হয়েছেন।’
‘যে দু’টো গাড়ি বিমান বন্দর থেকে বেরিয়ে গেছে বিস্ফোরণের পর, তার কোন হদিস করা যায়নি?’
‘না যায়নি। পাকিং প্লেসের গেটে গাড়ির কোন লগ রাখা হয়না।’
‘হায় আল্লাহ! এত বিপদ আমাদের মাথায়, তবু সাবধান নই আমরা।’
‘ঠিক বলেছ শবনাম, এটা আমাদের দুর্বলতা। কিন্তু এত বড় বিপ্লব ও পরিবর্তনের পর শূন্য থেকে একটা পুর্নাংগ রাষ্ট্র ব্যবস্থা গড়ে তোলা সহজ নয়। অভিজ্ঞতার কোন বিকল্প নেই, এই অভিজ্ঞতার সংকটেই আমরা ভূগছি। আমরা বিপ্লব করেছি, কিন্তু বিপ্লব রক্ষার জন্য তৈরি লোক আমরা খুব বেশী পাইনি। আহমদ মুসা একাই লাখো লোকের যোগ্যতা ও জ্ঞান রাখেন। বিপ্লবের পর তিনি যদি থাকতেন, তাহলে এ দূর্বলতা হয়তো থাকতো না। কিন্তু তিনি চলে গেলেন আমাদের মত অযোগ্যদের হাতে সব ছেড়ে দিয়ে।’
কান্নায় জড়িয়ে গেল কুতায়বার শেষ কথাগুলো। অশ্রু গড়িয়ে পড়ল কুতায়বার চোখ থেকে।
চোখ মুছে কুতায়বা বলল, ‘আমি দায়িত্ব নিতে অস্বীকার করেছিলাম, কিন্তু মুসা ভাই শুনেননি।’
শিরীন শবনম এগিয়ে এসে স্বামীর একটা হাত তুলে নিয়ে বলল, ‘মুসা ভাই অন্যায় করেননি, ভুল করেননি।’
‘কিন্তু আমি তো পারছিনা। এর আগে হরকেস শহরের সরকারি বাংলো থেকে কিডন্যাপ হলেন আমাদের সবরকম নিরাপত্তা সত্বেও। আবারও হারিয়ে গেলেন কারসাপকে এসে। আমাদের নিরাপত্তা ব্যবস্থা কোনই কাজে লাগল না। তিনি নিশ্চয় শত্রুর হাতে আটকা পড়েছেন আমার এই কারসাপক শহরেই। অথচ আমি এদেশের প্রেসিডেন্ট।’
আবার কন্নায় বুঝে আসতে চাইল কুতায়বার কন্ঠ।
‘নিরাপত্তা ব্যবস্থার কোন দোষ নেই, যে ষড়যন্ত্র এ অঘটন ঘটাচ্ছে তা মনে হয় খুবই বড়। বাইরের হাতও এখানে থাকতে পারে।’
‘এরকম কোন তথ্য আমরা পাইনি। যে দেশটি এরকম করতে পারে, সেই রুশ সরকার দেখছি আমাদের প্রতি খুবই সহানুভূতিশীল। বিজ্ঞানীদের হত্যা, বিজ্ঞানাগার ও শষ্য ধ্বংসের সন্ত্রাসী ঘটনার তারা নিন্দা করেছে এবং গোয়েন্দা সহযোগিতা দিতে প্রস্তুত আছে বলে জানিয়েছে।’
‘আমার মনে হয়, ষড়যন্ত্রটা যে বড় রকমের কিছু তা মুসা ভাই আঁচ করতে পেরেছিলেন। তা না হলে স্ত্রীর দাফনের জন্য মদীনা না গিয়ে তড়িঘড়ি করে কারসাপকে চলে এলেন কেন? তিনি না ভেবে-চিন্তে কোন কাজ করেন না।’
‘তুমি ঠিক ধরেছ। সবাই এটাই মনে করছে।’
‘একটা বিষয় আমি বুঝতে পারছিনা। কারসাপক শহরের চারদিকের রাস্তা ও সবরকমের পথ যেহেতু সীল করে দেয়া হয়েছে, তাই বলা যায় বিষ্ফোরনের পর কেউ কারসাপক ত্যাগ করেনি। অর্থাৎ ক্রিমিনালরা এবং আহমদ মুসা তাহলে এই কারসাপক শহরেই রয়েছে। কারসাপক ছোট শহর। এই শহরের সব বাড়ি কি আমার সার্চ করতে পারিনা?’
‘বলতে পার, মোটামুটিভাবে সেই কাজটা আমরা করেছি। কিন্তু মুস্কিল হলো, কম্যুনিষ্ট আমলে তৈরি অনেক বাড়িতেই গোপন ভূ-গর্ভস্থ প্রকোষ্ঠ আছে যার সন্ধান স্বেচ্ছায় বলে না দিলে খুঁজে পাওয়া মুস্কিল। তবে এ পর্যন্ত অনুসন্ধান করে একটা উল্লেখযোগ্য নমুনা পাওয়া গেছে, তোমাকে বলতে ভুলে গেছি।’
‘সেটা কি?’ উদগ্রীব কন্ঠে বলল শবনম।
‘একটা পরিত্যক্ত দু’তলা বাড়ির ছাদের কুঠরীর মেঝেতে ধূলার ওপর আহমদ মুসার জুতোর মত জুতোর জীবন্ত ছাপ পাওয়া গেছে। কুঠরীটি ছিল একটি বন্দীখানা। ওখানে দুটো কংকালও পাওয়া গেছে। সবচেয়ে উলেস্নখযোগ্য হলো, কুঠরীর দেয়ালে সদ্য করা একটা সুড়ঙ্গ পাওয়া গেছে। মনে করা হচ্ছে কেউ যেন দেয়ালের ইট খসিয়ে সুড়ঙ্গ করে বন্দীখানা থেকে বেরিয়ে গেছে। সুড়ঙ্গের পাশেই ষ্টীলের চেয়ারের ভাঙ্গা পায়া পাওয়া গেছে। মনে করা হচ্ছে ঐ ভাঙ্গা পায়ার ধারালো মাথা দিয়ে ইট খসিয়ে সুড়ঙ্গ করা হয়েছে। বন্দীখানার ভাঙ্গা চেয়ার এবং সেই ভাঙ্গা পায়া নিয়ে আসা হয়েছে হাতের ছাপ পরীক্ষার জন্যে।’
থামল কুতায়বা।
‘কি রেজাল্ট পাওয়া গেছে?’ চোখ দু’টি বিষ্ফোরিত করে বলল শবনম।
‘আজ সকালে উদ্ধার করা হয়েছে। রেজাল্ট আজই পাওয়া যাবে।’
এই সময় পাশেই রাখা লাল ফোনটি বেজে উঠল।
কুতায়বা গিয়ে ফোন ধরল।
টেলিফোন কানে ধরে সম্ভবত ওপারের কথা শুনেই তার মুখটি আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠল।
‘একটু দাড়াও’ বলে টেলিফোন থেকে মুখ সরিয়ে কুতায়বা বলল, ‘শবনম ভাঙ্গা পায়া এবং চেয়ারে যে হাতের ছাপগুলো পাওয়াগেছে তার সবগুলোই আহমদ মুসার।’
‘আল হামদুলিলস্নাহ।’ আনন্দে শবনমের চোখ-মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল।
শবনমকে কয়েকটা কথা বলেই কুতায়বা টেলিফোনে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে বলল, ‘কিন্তু বেরিয়ে উনি কোথায় গেলেন, আবার কিছু ঘটল কি না, তোমরা কিছু অনুসন্ধান করছ?’
ওপারের কথা শুনল কুতায়বা। শুনতে শুনতে তার মুখটা মলিন হয়ে গেল।
টেলিফোন শেষ করে বসল এসে কুতায়বা।
‘কি হল, কি শুনলে, কোথায় গেলেন তিনি?’ বলল শবনম।
‘কিছুই বুঝা যাচ্ছে না। ঐ বাড়ি থেকে যে রাস্তা শহরে ঢুকেছে তার মাইক্রোস্কপিক পরীক্ষা করা হয়েছে। রাস্তাটির এক মাইল পর্যন্ত আহমদ মুসার পায়ের ছাপ পাওয়া গেছে। তারপর আর কোন ছাপ নেই। মনে করা হচ্ছে ওখানে তিনি গাড়িতে উঠেছেন অথবা তাকে গাড়িতে কেউ তুলে নিয়েছে। তবে পায়ের ছাপের গতি থেকে কোন ধস্তা-ধস্তির প্রমাণ পাওয়া যায়নি। শেষ কয়েকটি ধাপে অবশ্য দৌড় দেয়ার চিহ্ন পাওয়া গেছে।’
থামল কুতায়বা। বিষণ্নতার অন্ধকারে ছেয়ে গেছে তার মুখ।
শবনমের মুখও উদ্বেগাকুল হয়ে উঠেছে। সেও কিছু বলল না।
‘তোমার কি ধারণা? আমার ভয় হচ্ছে, আবার তিনি শত্রুর হাতে পড়েছেন। তা না হলে বন্দীখানা থেকে বের হবার পর চলে আসার কথা।’ বলল শবনম।
‘আমার ধারণাও তোমারই মত।’ বলল কুতায়বা। কিছু বলতে যাচ্ছিল শবনম। কিন্তু টেলিফোন বেজে উঠল। শবনম মুখ বন্ধ করল। কুতায়বা দ্রুত উঠে গেল টেলিফোন ধরার জন্য।
টেলিফোনটা ছিল খুবই সংক্ষিপ্ত। টেলিফোনটা শেষ করে কুতায়বা এসে বসল। তার মুখে কোন আলো নেই। শবনম চোখ ভরা প্রশ্ন নিয়ে তাকিয়ে আছে কুতায়বার দিকে।
‘আশার কিছু পাওয়া যায়নি শবনম। ঐ পরিত্যক্ত বাড়িটার খোজ খবর নেয়া হয়েছে। বাড়িটা পরিত্যক্ত ঘোষিত হবার পর মালিকের কাছ থেকে একজন বাড়িটা কিনে নিয়েছে। কিন্তু সেই ক্রেতার কোন হদিস মিলেনি। যে ঠিকানাটা রেজিষ্ট্রি অফিসে আছে, তা ভূয়া। সুতরাং সে পথে আর এগুনো যাচ্ছে না। আরেকটা বিষয় জানা গেছে। আহমদ মুসা ভাই-এর পায়ের চিহ্ন যেখানে শেষ হয়েছে, সেখানে থেমে যাওয়া যে গাড়ির চাকার দাগ পাওয়া গেছে তা একটি ট্রাক। ট্রাকটা হালকা থেমেও ছিল। মনে হচ্ছে এই ট্রাকেই আহমদ মুসাকে তুলে নেয়া হয়েছে। ঐ ট্রাকের গতি অনুসরন করা হয়েছে, কিন্তু হাইওয়েতে উঠার পর ট্রাকের চিহ্ন আর ডিটেক্ট করা যায়নি।’
থামল কুতায়বা।
নিরব শবনম। চোখে তার শূন্য দৃষ্টি।
কিছুক্ষণ পর কথা বলল কুতায়বাই। বলল, ‘আল্লাহ তাঁকে সুস্থ রাখুন, তাড়াতাড়ি তাঁকে বিপদমুক্ত করুন।’
‘কিন্তু এভাবে কতদিন চলবে ওঁর? বিশ্রামের প্রয়োজন নেই তাঁর?’ বলল শবনম।
‘একথা আমিও মাঝে মাঝে ভাবি শবনম।’
‘দেখ, মধ্য এশিয়ার ঘটনার পর একদিনও তার বিশ্রাম হলো না । বন্দী হয়ে পৌছল চীনে। সেখান থেকে ককেশাস, তারপর বলকান, বলকান থেকে স্পেন। স্পেন থেকে আবার সিংকিয়াং-এ, চীনে। ঘটনা তাকে আবার নিয়ে এসেছে মধ্য এশিয়ায়। এ যে শ্বাসরুদ্ধকর জীবন।’
‘আল্লাহ যাঁদের বিশেষভাবে ভালবাসেন, তাঁদের জীবন বোধ হয় এ রকমেরই শবনম। আল্লাহর বিশেষ বাছাই করা মানুষ নবী-রাসূলরা। দেখ, তাঁদের জীবনে কোন বিশ্রাম নেই। তুমি আমাদের রাসূল (সঃ)-এর জীবনে কোন অলস দিন পাবে না।’
‘তুমি ঠিকই বলেছ। কিন্তু আমরা সাধারন মানুষ। ভাবতে খারাপ লাগে। মেইলিগুলি ভাবী মারা গেলেন। ওঁর একটা ঠিকানা গড়ে উঠেছিল। সেটাও ভেঙ্গে গেল।’
‘এঘটনায় আহমদ মুসা ভাই খুবই আঘাত পেয়েছেন। শুনেছি, শিশুর মত তিনি কেঁদেছিলেন।’
‘বাইরে থেকে ওঁকে দেখলে খুব শক্ত মনে হয়, কিন্তু ফারহানা আপা* বলেছেন, মনটা ওঁর শিশুর মত নরম। তাঁর মধ্যে যেমন আছে আদর্শের দৃঢ়তা, তেমনি আছে আবেগের বিস্ফোরণ।’
‘সে জন্যেই তো তিনি অনন্য।’
‘শুধু প্রশংসা নয়, তাঁর কথা আমাদের ভাবতে হবে।’
‘আমরা তো ভাবি।’
‘কি ভাব? এইতো ভাবী গেলেন, কি ভাবছ তাঁর সম্পর্কে?’
‘এত বড় ভাবনা কি আমরা ভাবতে পারি?’
‘তাহলে কে ভাববে? তাঁর কি পিতা-মাতা আছে, না কোন অভিভাবক আছে?’
‘ঠিক বলেছ শবনম। তবু তার সংসার নিয়ে ভাবার ক্ষেত্রে আমাদেরকে খুব ছোট মনে হয় । মনে হয়, এ ধরনের কোনো পরামর্শ দেয়া আমাদের জন্য যথার্থ নয় ।’
‘তাহলে এ দায়িত্ব কার? তিনি তো নিজেকে নিয়ে বিন্দুমাত্র ও ভাবেন না ।’
‘তিনি আল্লাহর সৈনিক। তাঁদের মতো যারা নিজেদের নিয়ে ভাবেন না, তাঁদের ভাবনা আল্লাহই ভাবেন। ফারহানা তো আমাদের সিলেকশন এ ছিল না, মেইলিগুলিকেও তো আমরা খুজে বের করিনি। মেইলিগুলির সাথে তাঁর বিয়েটাও দেখ মানুষের পরিকল্পনা অনুসারে হয়নি।’
‘ঠিক বলেছ। কিন্তু তবু তাঁর জীবনের শূন্যতায় উদ্বেগ বোধ হয়। সত্যই তাঁর কোনো স্বজন নেই। ভাবতে ভয় হয় স্বজনহীনতার কোনো বেদনা তাঁর মধ্যে গুমরে মরছে কিনা?’
শবনমের কণ্ঠ ভারী হয়ে উঠল।
‘ঠিক বলেছ। তিনি মানবিক আবেগের ঊর্ধে নন। কিন্তু তবু শবনম তাঁর জন্য কিছু করার মতো বড় আমরা নই। আমরা কর্মী। তিনি যেমন তাঁর সম্পর্কে ভাবেন না তেমন আমাদেরকেও ভাবতে দেন না। তাঁর ভাবনা তিনি আল্লাহর উপরই ছেড়ে দিয়েছেন ।’
‘আলহামদুলিল্লাহ। তাঁর চেয়ে বড় অভিভাবক তো আর কেউ নয়। আল্লাহ তাঁকে সাহায্য করুন, তাঁর প্রতি আরও সদয় হোন।’
‘আমিন।’ বলল কুতাইবা।
তার কণ্ঠ বাতাসে মেলাবার আগেই বেজে উঠল টেলিফোন।
কুতাইবা উঠল টেলিফোন ধরার জন্য।
উদগ্রীব হয়ে উঠল শবনম।

একদম ঘুটঘুটে অন্ধকার। অন্ধকূপ নাম তারা ঠিকই দিয়েছে। অন্ধকূপে নামার কোন সিঁড়ি নেই। তাঁকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেওয়া হয়েছে নিচে। রক্ষা যে, আহমদ মুসা ধাক্কা খেলেও লাফ দেওয়ার সুযোগ পেয়েছিল। তা না হলে মাথাটা পাকা মেঝেতে পড়লে চৌচির হয়ে যেত। অন্ধকূপটা কোথায়? মাটির নিচে তো অবশ্যই। কিন্তু কতখানি নিচে? তাকে দোতলা থেকে নিচ তলায় আনা হয়েছিল , সিঁড়ি দিয়ে টেনে সেই ফাঁস লাগানো অবস্থায়। লোকগুলো আসলে পশু। পশু না হলে মানুষকে কি কেউ পশুর মতো টেনে নিয়ে আসে? ফাঁস অবস্থায়ই তাকে অন্ধকূপে ফেলে দিয়েছে । ভাগ্যিস পা দু’টি খোলা ছিল। না হলে সে তো লাফ ও দিতে পারতো না। দু’তলা থেকে তাকে নামিয়ে এক তলার বারান্দা দিয়ে সর্ব উত্তরে একটি কক্ষে তারা প্রবেশ করে। ঐ কক্ষটিতেও দু’তলা থেকে একটি সিঁড়ি নেমে এসেছে। সিঁড়িটির গোড়ায় এসে ওরা দাঁড়ায়। একজন গিয়ে লোহার সিঁড়িটির শেষ ধাপটিতে পা দিয়ে চাপ দেয়। সঙ্গে সঙ্গে সিঁড়ির নিচের কংক্রিটের মেঝেটা দেয়ালের ভেতর সরে যায়। বের হয়ে পড়ে আরেকটা লোহার সিঁড়ি। সেই সিঁড়ি দিয়ে তাকে নামিয়ে নিয়ে আসে ওরা। এবার টেনে নয়, হাঁটিয়ে, সবার আগে আগে। ওদের শেষ লোকটি যখন শেষ ধাপটা থেকে নেমে এলো তখন সিঁড়িমুখের সরে যাওয়া মেঝেটা আবার তার জায়গায় ফিরে আসে। তারপর কক্ষটির সুইচ বোর্ডের একটা সুইচে ওদের একজন চাপ দেয়। সাথে সাথেই কক্ষের ঠিক মাঝখানে মেঝের একটা অংশ ইঞ্চিখানিক নিচে নেমে পাশে সরে যায়। মুখ ব্যাদান করে উঠে অন্ধকার এক গুহা মুখ। টেনে এনে ওই পথেই তাকে ফেলে দেওয়া হয়।
অন্ধকূপটা কতখানি গভীর? বার থেকে পনের ফুটের বেশি মনে হয়নি।
শরীরটায় খুব ক্লান্তি বোধ হচ্ছে। গত কয়েক ঘণ্টায় কম ধকল যায়নি শরীরের উপর দিয়ে। টান হয়ে শুয়ে পড়ল আহমদ মুসা মেঝেতে। চোখ বুজল। পেছনের দৃশ্যগুলো তার সামনে ভেসে উঠল আবার। দু’তলা হতে পারে, হতে পারে তিন তলা থেকে সিঁড়ি নেমে এসেছে অন্ধকূপের উপরের কক্ষ অর্থাৎ ভূগর্ভস্থ কক্ষ পর্যন্ত। সিঁড়িটা লোহার, অবশ্যই পরে তৈরি। অন্ধকূপ পর্যন্ত এই সিঁড়ি পরে তৈরি হল কেন? অন্ধকূপে আসার জন্য কি? অবশ্যই নয়। তাহলে? লক্ষ করেছে সে, এক তলার লোহার শেষ ধাপটিতে চাপ দিতেই ভূ-গর্ভস্থ সিঁড়ি মুখের দরজা খুলে গেল, আবার ভূ-গর্ভস্থ কক্ষের যে সিঁড়ি তার শেষ ধাপে শেষ লোকটির পা পড়তেই সিঁড়ি মুখ বন্ধ হয়ে গেল। মনে হয়, এ শেষ ধাপটিতে আবার চাপ দিলে আবার ওপরের সিড়িঁ মুখ খুলে যাবে। অনুরূপভাবে একতলার সিঁড়ির শেষ সিঁড়ি ধাপটিতে চাপ দিয়ে দু’তলা উঠার সিঁড়ি মুখ বা দরজাটি হয়তো খোলা যায়, বন্ধও করা যায়। তিনতলায় উঠানামার জন্যেও বোধহয় এই একই ব্যবস্থা। কিন্তু তিনতলা থেকে এই ভূ-গর্ভস্থ কক্ষ পর্যন্ত কেন এই স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা? অন্ধকূপের সাথে যোগাযোগের জন্য এটা হতে পারে না। তাহলে, আবার সেই প্রশ্ন দেখা দিল আহমেদ মুসার মনে। এই স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থায় কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই তিনতলা এবং অন্যান্য ফ্লোর থেকে ভূ-গর্ভস্থ কক্ষে আত্মগোপন করা যেতে পারে। অর্থাৎ বিপদকালে আত্মগোপনের একটা পথ এটা। এই ব্যাখ্যায় আহমদ মুসার মনের সব প্রশ্নের সমাধান হল না। যেকোনো সাধারণ শত্রুর কাছেও তাদের এ আত্মগোপন ধরা পরে যাবে লোহার সিঁড়ির অস্তিত্বের কারণে। তাহলে? আহমদ মুসার মনে হঠাৎ একটা কথা ঝিলিক দিয়ে উঠল, তাহলে পালাবার পথ এটা আত্মগোপনের নয়। এই চিন্তার সাথে সাথে মনটা খুশিতে ভরে উঠল আহমদ মুসার। তাহলে অন্ধকূপের উপরের কক্ষটিতে বাইরে বেরিয়ে যাবার একটা গোপন পথ আছে এবং সে পথ নিশ্চয় অন্ধকূপের দরজা খোলার মতো কোন গোপন সুইচ বা সুইচবোর্ডের কোনো সুইচ চেপে খোলা যাবে। এখন প্রয়োজন শুধু এ অন্ধকূপ থেকে বের হওয়া। এখন এই ‘শুধু বের হওয়া’র কাজটা কতটা কঠিন সেটাই দেখতে হবে।
আহমদ মুসা চোখ খুলল। মাথাটা একটু উঁচু করল উঠার জন্য। কিন্তু পারল না, মাথাটা আবার নামিয়ে ভাবল, বের হওয়ার পথের সন্ধান পরে করা যাবে। তার আগে একটু বিশ্রাম প্রয়োজন। শরীরটা আবার মেঝের বুকে এলিয়ে দিল আহমদ মুসা।
সঙ্গে সঙ্গে ক্লান্তিতে দুটি চোখ বুজে গেল আহমদ মুসার। ঘুমিয়ে পড়ল সে।

হঠাৎ কানের কাছে নাম ধরে ডাক শুনে চোখ খুলল ও ধড়মড় করে উঠে বসল। অন্ধকূপ আলোকিত। উপর থেকে নেমে এসেছে একটা সিঁড়ি। তার সামনে সেই মেয়েটি যাকে হলঘরে সে দেখেছিল, যার নাম শুনেছিল এলেনা। আহমদ মুসার বিস্মিত দৃষ্টি মেয়েটির মুখে নিবদ্ধ হতেই মেয়েটি বলে উঠল, ‘আমি এলেনা নোভাস্কায়া, কারসাপকের গ্রেট বিয়ার প্রধান আলেস্কি স্টালিনের মেয়ে। আমার ডাক নাম রক। ছোটবেলায় আমি খুব দুরন্ত, দুঃসাহসিক ছিলাম বলে আমাকে এই নাম এ ডাকা হতো।’
‘গ্রেট বিয়ার?’ কথাটা শোনার সাথে সাথে কপাল কুঞ্চিত হল আহমদ মুসার।
‘গ্রেট বিয়ার জারের সাবেক রাজধানী পিটার দি গ্রেট এর নগরী পিটার্সবার্গ কেন্দ্রিক জংগী রুশ সংগঠন।’ বলল এলেনা।
‘কিন্তু ওরা কি করছে কারসাপকে?’
‘আপনি তো অনেক কিছুই জানেন। ওরা মুসলিম মধ্য এশিয়ার অর্থনীতি ও স্বাধীন রাজনৈতিক শক্তিকে ধ্বংসের পরিকল্পনা নিয়েছে। দেশের সবগুলো উল্লেখযোগ্য ব্রীজ, প্রোজেক্ট ইত্যাদি ধ্বংসের ওরা সিদ্ধান্ত নিয়েছে।’
‘ভল্লুকের মাথা ওদের কি?’
‘ওটা ওদের প্রতীক। ওদের ব্যবহার্য সব কিছুতে ওটা দেখবেন। এমনকি ওদের প্রত্যেকটা বাড়ি ও ঘাটির গেটেও ভল্লুকের মাথা খোঁদাই করা। ওদের গেটের নিচে দাঁড়িয়ে উপর দিকে মাথা তুললে খোঁদাই করা এ প্রতীক আপনি দেখতে পাবেন।’
‘আপনি আলেস্কি স্টালিনের মেয়ে, কিন্তু এখানে?’
‘আমাকে আপনি ‘আপনি’ বলে সম্বোধন করবেন না। আমি আপনার ছোট বোন। সেরগেই ওমরভের সাথে আমার বিয়ে হয়নি, কিন্তু নিজেকে আমি তার স্ত্রী বলে মনে করি।’
‘সেরগেই ওমরভ কে?’
‘সেই কঙ্কাল, যার কাছ থেকে আপনি এখানকার ঠিকানা এনেছেন।’
‘সে মুসলমান তাহলে?’
‘জি। মধ্য এশিয়ার মুসলিম মুসলিম প্রজাতন্ত্রের গোয়েন্দা বিভাগের একজন অফিসার ছিল সে।’
একটু থামল এলেনা। তারপর মুখ নিচু করে বলল, ‘আমি ওকে ভালবাসতাম। এই ভালবাসার মূল্য ওঁকে দিতে হয়েছে এক মর্মান্তিক পথে জীবন দিয়ে।’
কথা শেষ করার আগেই কান্নায় রুদ্ধ হয়ে পড়েছিল এলেনার কণ্ঠ।
‘ওমরভ কি জানতে পেরেছিল তোমার আব্বার পরিচয়?’
‘না। জানতে পারলে হয়তো তাকে মরতে হতো না, সাবধান হতে পারত সে। কিন্তু এরা বুঝেছিল যে ওমরভ সব জেনেই আমার সাথে সম্পর্ক করেছে তথ্য সংগ্রহের জন্যে।’
‘তুমি ওমরভকে সাবধান করনি?
‘এখানেই আমার ভুল হয়েছে। এমন কিছু ঘটবে আমি অনুমানও করতে পারিনি। সে যে গোয়েন্দা সেটাও আগে আমি জানতে পারিনি। যখন জানলাম, তখন আমার পরিচয় দিতে ভয় করছিলাম। সে যদি দূরে সরে যায় আমার কাছ থেকে !’
মেয়েটির কণ্ঠ আবার কান্নায় বুজে এল। মুহূর্তের জন্য থামল ।
একটা ঢোক গিলল । তারপর বলল, ‘দেরি হয়ে যাচ্ছে চলুন, আমাদের বেরুতে হবে। কেউ এখানে ঢুকেছে , এটা ওদের কাছে বেশিক্ষণ গোপন থাকবেনা।’
বলেই এলেনা উঠে দাঁড়াল । আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, ‘তুমি তোমার বিপদের কথা চিন্তা করেছ ? তুমি এখানে ঢুকেছ এটা ওদের কাছে গোপন থাকবে না ।’
‘আমি যে কোন পরিণতির জন্য প্রস্তুত । ওমরভ নেই, আমিও বাঁচতে চাইনা । আমার মৃত্যুটা যদি আপনার কোন উপকার করে হয়, তাহলে আমি ধন্য হবো , ওমরভ খুশি হবে।’
‘আমাকে তুমি চেন ?’
‘ওমরভের কাছে আপনার কাহিনী শুনেছি অনেক।’
অন্ধকূপ থেকে ওরা ভূ-গর্ভস্থ কক্ষে উঠে এল।
এলেনা আগে উঠে এসেছে । আহমদ মুসা তারপরে । আহমদ মুসা সিঁড়ির ধাপ থেকে মেঝেতে পা রাখার সাথে সাথে সিঁড়িটি উঠে এল এবং এক পাশে সরে গেল।
এলেনা ছুটে গিয়ে সুইচ বোর্ডের একটা সুইচ টিপে অন্ধকূপের মুখ বন্ধ করে দিল।
‘এই কক্ষেই তো বাইরে বেরুবার গোপন পথ আছে ।’ বলল আহমদ মুসা ।
‘আপনি জানলেন কি করে?’ বিস্ময়ে চোখ কপালে তুলে বলল এলেনা।
‘আমি অনুমান করেছি তিনতলা পর্যন্ত এই ঘরের সাথে সিঁড়ির লিঙ্ক দেখে।’
‘গোপন পথের সুইচ কোথায় আছে বলতে পারেন?’ মুখে হাসি টেনে বলল এলেনা।
‘বলতে পারবো না , তবে অনুমান করতে পারি। ঐ এক তলা থেকে নেমে আসা সিঁড়ির কোথাও এ সুইচটি হবে।’
‘আপনার এ অনুমানের কারণ ?’
‘কারণ হলো, তিন তলা থেকে এই কক্ষে নেমে আসা পর্যন্ত কোথাও সুইচ টিপতে হয় না । সিঁড়ির শেষ ধাপে পা রাখার সাথে সাথে ওপরের সিঁড়ি মুখ বন্ধ হয়ে যায় এবং নীচের মুখ খুলে যায়। ঠিক তেমনভাবে আমার অনুমান হলো, এই ভূ-গর্ভস্থ কক্ষের সিঁড়ির শেষ ধাপটিতে পা রাখার সাথে সাথে ওপরের সিঁড়ি মুখটি বন্ধ হয়ে যাবে এবং বাইরে বেরুবার এ কক্ষের গোপন দরজাটি খুলে যাবে।’
বিস্ময়ে হা হয়ে গেছে এলেনার মুখ । বলল, ‘তিন তলা থেকে এখানে নেমে আশার এই ম্যাকানিজম কিভাবে আপনি জানতে পারলেন ?’
‘আমাকে ওরা নামিয়ে আনার সময় এ বিষয়টা আমি লক্ষ করেছি ।’
‘ভাইয়া আপনি অনন্য । ওমরভ আপনার সম্পর্কে যা বলেছে , যা আমি শুনেছি , তার চেয়ে আপনি অনেক বড় ।’
একটু থামল এলেনা । তারপর হাসিমুখে বলল, ‘চলুন সিঁড়ির শেষ ধাপটিতে চাপ দিয়ে পরীক্ষা করি আপনার অনুমান সত্য কিনা ।’
ওরা সিঁড়ির গোড়ায় পৌছাতেই ওপরে ছাপা শীষ দেবার মত একটা শব্দ হল।
চমকে উঠে ওপর দিকে এক পলক তাকিয়েই আহমদ মুসা এলেনার হাত ধরে টেনে নিয়ে ছুটল সিঁড়ির তলায় লুকোবার জন্য।
সিঁড়ির নিচে গিয়ে দাঁড়াবার সঙ্গে সঙ্গেই সিঁড়িতে পায়ের শব্দ শুনতে পেল ওরা। দু’জনের পায়ের শব্দ । দ্রুত নামছে।
লোহার সিঁড়ি। ফাঁক আছে । সিঁড়ির মাঝা মাঝি পথ আসতেই ওদের পা দেখতে পেল আহমদ মুসা।
এলেনার মুখ ফ্যাঁকাসে হয়ে গেছে। সীমাহীন উদ্বেগ ঝরে পরেছে তার কাল দু’চোখ দিয়ে।
ওরা নামছে আগে একজন, পেছনে অন্যজন ।
আহমদ মুসার চোখের অপর দিয়ে প্রায় প্রথম জনের পা নেমে গেল। এল দ্বিতীয় জনের পা । আহমদ মুসার হাত দুটি বিদ্যুৎ বেগে উপরে উঠল এবং দু হাত দিয়ে দ্বিতীয় লোকটির দু’টি পা টেনে ধরেই আবার ছেড়ে দিল।
ফলে আহমদ মুসা যা চেয়েছিল তাই হল।
দ্বিতীয় লোকটি হুমড়ি খেয়ে পড়ল প্রথম লোকটি ওপর ।
দু জনেই আছড়ে পড়ল সিঁড়ির ওপর এবং গড়িয়ে পড়ে গেল নিচে।
ওরা মেঝেয় গড়িয়ে পড়ার আগেই আহমদ মুসা ওখানে গিয়ে হাজির হয়েছিল । তার পেছনে পেছনে এলেনাও ।
ওরা গড়িয়ে একজন আরেকজন এর ওপর এসে পড়েছিল। আহমদ মুসা ওপরের জনকে কলার ধরে টেনে তুলে তার কানের নীচটায় একটা কারাত চালাল । সংজ্ঞা হারিয়ে পড়ে গেল লোকটি। এই সুযোগে দ্বিতীয়জন উঠে দাঁড়াচ্ছিল তার স্টেনগানটা নিয়ে। কিন্তু সোজা হয়ে দাঁড়াবার সুযোগ সে পেল না । আহমদ মুসার একটা লাথি গিয়ে পড়ল তার তলপেটে হাতুড়ির মত। তার হাত থেকে খসে পড়ল স্টেনগান । সে ঢলে পড়ল মেঝের ওপর ।
আহমদ মুসা লোকটির হাত থেকে খসে পড়া স্টেনগানটি তুলে নিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াতেই দেখতে পেল উদ্ধত স্টেনগান হাত দু’জন সিঁড়ির মাথায় ।
আহমদ মুসা বিদ্যুৎ বেগে নিজের দেহটাকে ছুড়ে দিল মেঝের ওপর । তার দেহের ওপর দিয়ে এক ঝাক গুলি ছুটে গেল। আহমদ মুসার একটি পা কেঁপে উঠল , তার সাথে তার দেহটিও । একটা গুলি এসে আঘাত করল আহমদ মুসার পায়ে । পা দু’টি ছিল সিঁড়ি বরাবর। এ সময় এলেনার একটা চিৎকার তার কানে এল।
কিন্তু আহমদ মুসা সে দিকে কোন ভ্রুক্ষেপ না করে মাটিতে আছড়ে পড়েই স্টেনগানের ব্যারেলটা ঘুরিয়ে নিয়ে গুলি চালাল সিঁড়ি মুখ লক্ষ্যে।
ওরা আহমদ মুসা কে দ্বিতীয়বার টার্গেট করার আগেই আহমদ মুসার গুলি বৃষ্টি ওদের গিয়ে ঘিরে ধরল । মুহূর্তেই গড়িয়ে পড়ল সিঁড়ি দিয়ে ওদের দুটি গুলিবিদ্ধ দেহ।
আহমদ মুসা উঠে দাঁড়িয়ে মেঝেয় লুটিয়ে পড়া এলেনার দিকে একবার তাকিয়ে ছুটে গেল সিঁড়ির গোড়ায় । শেষ ধাপটির ওপর দাঁড়িয়ে পর পর দুবার চাপ দিয়ে নেমে এল। দেখল সিঁড়ি র মুখের দরজা বন্ধ হয়ে গেছে।
আহমদ মুসা এলেনার দিকে এগুবার সময় সামনে চোখ ফেলতেই দেখল সিঁড়ির বিপরীত দিকে দেয়ালের একটা অংশ সরে যাওয়ায় একটা আলোক উজ্জ্বল করিডোর উন্মুক্ত হয়ে পড়েছে। খুশি হল আহমদ মুসা । এলেনা রক্তে ভাসছে । আহমদ মুসা ওর পাশে বসল । পরীক্ষা করল দেহ । পাঁজরে গুলি লেগেছে। আঘাত মারাত্মক ।
দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে এলেনা চোখ বুজে ছিল। চোখ খুলল আহমদ মুসার স্পর্শে । বলল ব্যস্ত কণ্ঠে , ‘আপনি শিগগির এখান থেকে ছলে যান । সিঁড়ির শেষ ধাপটায় দুটি চাপ দিন , গোপন পথ খুলে যাবে। আমার কথা চিন্তা করবেন না ।’
‘তোমাকে রেখে যেতে পারি না এলেনা।’ বলল আহমদ মুসা এলেনাকে পাঁজা কোলা করে তুলে নিল, তারপর ছুটল গোপন পথের সেই করিডোরটির দিকে।
করিডোরে প্রবেশ করে কয়েক ধাপ এগুতেই পেছনে হালকা শীষ দেয়ার মত একটা শব্দ হল। চমকে পেছনে তাকাল আহমদ মুসা । দেখল, করিডোরের মুখটি বন্ধ হয়ে গেছে।
মিনিট খানেক ছুটে চলার পর আহমদ মুসা একটি সিঁড়ির গোড়ায় এসে দাঁড়াল । আহমদ মুসার বুঝতে অসুবিধা হল না, এই সিঁড়িটাই ভূ-গর্ভ থেকে ওপরে উঠার পথ।
সিঁড়িতে পা দিয়ে মুহূর্ত দ্বিধা করল আহমদ মুসা । সিঁড়ি তাকে কার সামনে নিয়ে ফেলে কে জানে। কিন্তু পরক্ষণেই ভাবল, এটা পালাবার গোপন পথ। সুতরাং সিঁড়ি মুখের স্থানটা কারো চোখে না পড়ার মত নিশ্চয়ই হবে ।
সিঁড়ি দিয়ে উঠতে লাগল আহমদ মুসা। আলোকজ্জ্বল সিঁড়ির মাঝপথ পর্যন্ত উঠে দেখতে পেল, সিঁড়ি মুখের দরজা বন্ধ । নিয়ম অনুসারে সিঁড়ির প্রথম ধাপে পা দেয়ার পর দরজা খুলে যাবার কথা ছিল তা খুলেনি। এই দরজা খোলার ম্যাকানিজম তাহলে ভিন্ন হয়ে। উদ্বিগ্ন হলো আহমদ মুসা। এলেনার দিকে চেয়ে বলল, ‘শেষ সিঁড়ি মুখের দরজা খোলার কি ব্যবস্থা আছে এলেনা?’
এলেনা দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে চোখ বন্ধ করে ছিল। ধীরে ধীরে চোখ খুলে বলল, ‘ম্যাগনেটিক লক, সামনে গেলেই খুলে যাবে।’ বলেই আবার চোখ বন্ধ করল এলেনা।
ঠিক তাই । দরজার কাছাকাছি পৌছতেই দরজা আপনাতেই খুলে গেল। সিঁড়ি থেকে বাইরে বেরিয়ে এল আহমদ মুসারা । বাইরেটা বাগানের এক প্রান্তে ফুলের গাছ ঘেরা একটা সুন্দর বসার জায়গা । মাথার উপরে সুন্দর বিশাল একটি কংক্রিটের ছাতা।
সিঁড়ি থেকে বেরিয়ে আসতেই সিঁড়ি মুখের দরজা বন্ধ হয়ে গেল।
দরজাটার ভেতরের স্তর ইস্পাতের, কিন্তু বাইরের লেয়ারটা কংক্রিটের। সুতরাং ম্যাগনেটিক লকটি বাইরে কোন কাজ করে না।
বাইরে কংক্রিটের দরজাটির ওপর আছে ফুলের পাঁচটি টব। আহমদ মুসারা বাইরে আসার পর কংক্রিটের দরজাটি পাশ থেকে সরে গিয়ে যখন সিঁড়ি মুখ ঢেকে দিল, তখন আর কিছু বুঝার উপায় রইল না। কংক্রিটের ছাতির নিচে চার দিকে বসার চেয়ার, মাঝখানে পাঁচটি ফুলের টব। মনে হবে, বসার জায়গাটির সৌন্দর্য বর্ধনের জন্যেই এই ব্যবস্থা।
আহমদ মুসা বাইরে বেরিয়ে চারদিকে চাইল। সে ধারণা করছিল, পালাবার যখন পথ রাখা হয়েছে, তখন পালাবার মত বাহনের ব্যবস্থা অবশ্যই থাকবে।
আহমদ মুসার অনুমান সত্য হলো। বসার জায়গাটার একটু উত্তরে দুই ঝাউ গাছের মাঝখান দিয়ে একটা গাড়ি দেখতে পেল।
এলেনাকে পাঁজাকোলা করে নিয়ে ছুটল আহমদ মুসা গাড়ির দিকে।
গাড়িটা আট সিটের একটা বিশাল সাইজের কার। এক হাত দিয়ে এলেনাকে জড়িয়ে রেখে অন্য হাত দিয়ে দুরু দুরু বুকে দরজা টানল, সেই সাথে মনে মনে প্রার্থনা করল, আল্লাহ দরজা যেন লক করা না থাকে।
দরজা খুলে গেল।
আহমদ মুসা এলেনাকে গাড়ির সিটে শুইয়ে দিয়ে এলেনার গলায় পেচানো ওড়না দিয়ে পাজরের ক্ষতস্থানটা বেঁধে দিল। প্রচুর রক্তপাত হচ্ছে, সে রক্তে ভিজে গেছে আহমদ মুসার বুক থেকে গোটা শরীরটা।
‘আমাকে নিয়ে কষ্ট করছেন কেন? আমার সময় বেশি নেই। আপনার বাঁচা দরকার। আপনি চলে যান।’ চোখ খুলে ক্ষীণ কন্ঠে বলল এলেনা।
‘কোন ভাই কি বোনকে এভাবে ফেলে রেখে যেতে পারে?’ এলেনার কপালে হাত বুলিয়ে বলল আহমদ মুসা।
মানুষের কন্ঠ কানে এল আহমদ মুসার। পেছনে চেয়ে দেখল, সেই বসার জায়গার সিঁড়ি মুখ দিয়ে লোক উঠে আসছে।
আহমদ মুসা দ্রুত গাড়ির দরজা বন্ধ করে ভেতর দিয়েই ড্রাইভিং সিটে গিয়ে বসল।
কি বোর্ডে চাবি ঘুরিয়ে ইঞ্জিন স্টার্ট দিল। সামনে চেয়ে আবছা আলোয় দেখল, উঁচু প্রাচীরের গায়ে ইস্পাতের দরজা। মনটা দমে গেল আহমদ মুসার, গাড়ির স্পীড দিয়ে ইস্পাতের ঐ দরজা কি ভাঙা সম্ভব হবে? কিন্তু কোন বিকল্প নেই। নেমে গিয়ে কিছু করার উপায় নেই।
বিসমিল্লাহ বলে স্টার্ট দিল গাড়িতে। গাড়ি চলতে শুরু করতেই আহমদ মুসা দেখল ইস্পাতের গেটটি খুলে গেল। আহমদ মুসা ভাবল, গাড়ি চলতে শুরু করার সাথে সাথে গেটটি খুলে যাবে, এই স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থাই ওরা করে রেখেছিল। পালাবার পথকে সব দিক থেকেই নিষ্কন্টক করেছিল ওরা।
এই সময় পেছন থেকে এক ঝাঁক গুলি এসে ঘিরে ধরল গাড়িটিকে। মাথা নিচু করল আহমদ মুসা। সে এক ঝাঁক গুলিতে গাড়িটা ঝাঁঝরা হয়ে যাবার কথা। কিন্তু কিছুই হলো না, আহমদ মুসা বিস্ময়ের সাথে দেখল। পরক্ষণেই খুশীতে মন ভরে গেল আহমদ মুসার, গাড়িটি বুলেট প্রুফ। পালাবার জন্যে ওরা বুলেট প্রুফ গাড়ি রেখেছিল শেষ পর্যায়ের আক্রমণ থেকে বাঁচার জন্যে। যা এখন তার সাহায্যে আসবে।
আহমদ মুসার গাড়ি শাঁ করে বেরিয়ে এল গেট দিয়ে বাগান থেকে। রাস্তায় এসে পড়ল আহমদ মুসার গাড়ি। রাস্তায় পড়তে গিয়েই দেখতে পেল পরপর দু’টি গাড়ি বেরিয়ে এল এলেনাদের গেট দিয়ে। রিয়ার ভিউতে দেখতে পেল গাড়ি দু’টি ছুটে আসছে তার পেছনে। ব্যবধান বিশ গজের বেশি নয়। প্রাণপনে ছুটে আসছে পেছনের দু’টি গাড়ি। ওরা চেষ্টা করছে দু’পাশ থেকে সামনে এগিয়ে আহমদ মুসার গাড়ির পথ রোধ করতে।
এভাবে কিছু এগোবার পর ওরা পেছন থেকে গুলি শুরু করল। আহমদ মুসা জানে বুলেট প্রুফ এ ধরনের গাড়ির চাকাও অনেক ক্ষেত্রে বুলেট প্রুফ হয়ে থাকে। কিন্তু এ বুলেট প্রুফেরও সীমাবদ্ধতা আছে। কোনক্রমে টায়ারের গোড়ায় যদি একটি গুলি লাগে, টায়ার ফেটে যাবে।
আহমদ মুসাকে অনেকটা অন্ধের মত গাড়ি চালাতে হচ্ছে। কোথায় যাবে তার ঠিক নেই, রাস্তার বাঁক সম্পর্কে তাঁর কোন জ্ঞান নেই, রাস্তার পাশের ট্রাফিক সাইনগুলো ভালো করে দেখার সুযোগ নেই। তার ওপর রাত এবং রাস্তায় আলোর স্বল্পতা। ফলে আহমদ মুসা মুক্ত হাতে গাড়ি চালাতে পারছে না।
একটা বড় মোড়ে এসে পড়তেই সামনে থেকেও অনেকগুলো হেডলাইটকে সে ছুটে আসতে দেখল। পেছন থেকে সমানে গুলি বৃষ্টি চলছে তখনও। হঠাৎ সামনে থেকেও গুলি বৃষ্টি শুরু হলো। আহমদ মুসা ধরে নিল সামনে-পেছনে দুই দিক থেকেই সে শত্রুর ঘেরাও-এর মধ্যে পড়েছে।
আহমদ মুসা গাড়ি ঘুরিয়ে নিল ডান দিকে রাস্তায় প্রবেশের জন্যে।
গাড়ি ঘুরতেই সামনে থেকে যারা গুলি করতে করতে ছুটে আসছিল, তাদেরই গুলিতে সামনের বাম চাকাটা ফেটে গেল।
কতকটা হুমড়ি খেয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল গাড়ি।
আহমদ মুসা পেছনের সিটে এলেনার দিকে একবার তাকিয়ে সিটে গা এলিয়ে দিল। ভাবল, এলেনাকে নিয়ে পালাবার চেষ্টা বৃথা। ওকে ওদের হাতে তুলে দিয়ে কাপুরুষের মত আত্মরক্ষা করবে সে কেমন করে।
আহমদ মুসা হাল ছেড়ে দিয়ে যখন বিজয়ী শত্রুর অট্টহাসিপূর্ণ আগমনের অপেক্ষা করছে, তখন গাড়ির ডানের জানালা দিয়ে দেখল তাকে অনুসরণকারী শত্রুর দু’টি গাড়ি দক্ষিণ দিকে দ্রুত চলে যাচ্ছে।
তাদের গাড়ির আলো নেভানো। আর সামনে থেকে যারা গুলি করতে করতে আসছিল, তাদের গুলি বৃষ্টি তখনও বন্ধ হয়নি ওদের লক্ষ্য করে।
আহমদ মুসা আর কিছু ভাববার আগেই দেখল তার গাড়ি ঘিরে ফেলা হয়েছে। লাথি পড়তে লাগল গাড়ির দরজার উপর। অর্থাৎ গাড়ির দরজা খোলার নির্দেশ দিচ্ছে ওরা।
আহমদ মুসা দরজা খুলে বেরিয়ে এল। বাইরের অস্ত্রধারীদের ওপর চোখ পড়তেই আহমদ মুসার গোটা শরীরে একটা আনন্দের শিহরণ খেলে গেল। ওদের গায়ে সৈনিকের পোশাক। অর্থাৎ মধ্য এশিয়া মুসলিম প্রজাতন্ত্রের সৈনিক এরা। তার শত্রুরা কেন পিছটান দিল, তাও এবার বুঝতে পারল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসার গোটা দেহ রক্তাক্ত। সে বেরিয়ে আসতেই সৈনিকরা উদ্যত স্টেনগান হাতে তাকে ঘিরে দাঁড়াল।
আহমদ মুসা কিছু বলতে যাচ্ছিল এমন সময় ‘কি ব্যাপার এখানে, দেখি’ বলে একজন এগিয়ে এল সৈনিকদের মধ্য দিয়ে। সৈনিকরা দু’দিকে সরে গিয়ে তাকে রাস্তা করে দিল।
আহমদ মুসা এগিয়ে আসা সেনা-অফিসারের দিকে তাকিয়েই চিনতে পারল সুলতান আলীয়েভকে। প্রেসিডেন্টের গার্ড বাহিনীর সে প্রধান। কম্যুনিস্টদের বিরুদ্ধে মধ্য এশিয়ার মুক্তি সংগ্রামে সাইমুমের একজন তরুণ কর্মী ছিল সে।
আহমদ মুসার দিকে চোখ পড়তেই মুহূর্তের জন্যে বিস্ময়-বিস্ফারিত চোখে থমকে দাঁড়াল সে ভূত দেখার মত করে। আর পরক্ষণেই সে ছুটে গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল আহমদ মুসার বুকে। আহমদ মুসাও তাকে জড়িয়ে ধরল।
কয়েক মুহূর্ত পরে সুলতান নিজেকে ছাড়িয়ে নিল। কিন্তু কথা বলতে পারল না। ঠোঁট দু’টি তার কাঁপছে থর থর করে। তার দৃষ্টি আহমদ মুসার রক্তাক্ত দেহের দিকে।
আহমদ মুসা সুলতানের পিঠ চাপড়ে বলল, ‘সুলতান সৈনিককে তো আবেগ কিংবা উদ্বেগ কোনটার শিকার হয়ে পড়লে চলবে না।’
এক খন্ড কান্না এসে আছড়ে পড়ল সুলতান আলীয়েভের মুখে।
দু’হাতে মুখ ঢেকে সামলে নিয়ে সে ভাঙা গলায় বলল, ‘মুসা ভাই, স্যারকে বলে আসি।’ বলে ছুটল যেদিক থেকে সে এসেছিল সেদিকে।
আহমদ মুসাকে ঘিরে থাকা সৈনিকদের উদ্যত অস্ত্র নেমে পড়েছে। তাদের চোখে এখন বিস্ময় এবং সম্ভ্রম। তারা আহমদ মুসাকে চিনতে না পারলেও বুঝেছে সে একজন বিরাট কেউ হবে।
আহমদ মুসা ওদের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘সুলতান ‘স্যার’ বলল কাকে?’
‘স্যার, উনি প্রেসিডেন্টের কথা বলেছেন।’ একজন উত্তর দিল।
‘প্রেসিডেন্ট, মানে কুতায়বা?’ বলল আহমদ মুসা।
‘জি, হ্যাঁ।’ সেই সৈনিকটিই জবাব দিল।
‘এই রাতে কুতায়বা কোথায় যাচ্ছিল?’
‘স্যার, আমরা সায়েজু’তে যাচ্ছিলাম।’
‘কেন ওখানে কিছু ঘটেছে?’ চিন্তিত কন্ঠে বলল আহমদ মুসা।
‘সন্ধ্যায় বড় একটা বিস্ফোরণ ঘটেছে। আণবিক চুল্লি ও মূল গবেষণাগার রক্ষা পেলেও গুরুত্বপূর্ণ কম্পিউটার কেন্দ্রের একটা অংশ ধ্বংস হয়ে গেছে।’
এই সময় হঠাৎ সৈন্যরা চঞ্চল হয়ে পড়ল। এ্যাটেনশন হয়ে দাঁড়াল তারা সবাই। আহমদ মুসা দেখল, ছুটে আসছে কুতায়বা, মধ্য এশিয়া প্রজাতন্ত্রের প্রেসিডেন্ট।
ছুটে এসে আহমদ মুসাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে জড়িয়ে ধরল আহমদ মুসাকে। কান্না জড়িত তাঁর কন্ঠে ধ্বনিত হতে লাগল, ‘আল হামদুলিল্লাহ, আল হামদুলিল্লাহ………।’
আহমদ মুসা নিজেকে ছাড়িয়ে নিল। বলল, ‘গাড়িতে পেছনের সিটে একটি মেয়ে মুমূর্ষু। তাকে বাঁচাতে হবে। ওকে হাসাপাতালে নেয়ার ব্যবস্থা কর কুতাইবা।’
‘আপনার একি অবস্থা? আপনার কিছু হয়নি তো? আপনি ভাল আছেন তো?’ আহমদ মুসার রক্তাক্ত দেহের দিকে তাকিয়ে উদ্বিগ্ন কন্ঠে বলল কুতাইবা।
‘আমার জন্যে চিন্তা করো না। মেয়েটির ব্যবস্থা কর।’
ধীর পায়ে শবনম এসে দাঁড়িয়েছিল কুতায়বার পেছনে।
আহমদ মুসা কথা শেষ করে মুখ ঘুরাতেই তাকে দেখতে পেল। বলল, ‘ভাল আছ শবনম?’
শবনম সালাম দিল আহমদ মুসাকে। তারপর বলল, ‘জনাব আমরা সকলেই ভাল আছি, সুখে আছি, শুধু আপনি ছাড়া।’
শবনমের কন্ঠ কাঁপছে।
‘ভুল বললে শবনম, আমার চেয়ে সহস্রগুন খারাপ অবস্থায় আছে গুলিবিদ্ধ মেয়েটি।’
‘দুঃখিত জনাব, ওকে আমি দেখিনি তো? তাছাড়া আমার কথায় এই মুহূর্তের ভল থাকা খারাপ থাকা বুঝাতে চাইনি।’
ইতিমধ্যে কুতায়বার নির্দেশে সুলতান আলীয়েভ একটি গাড়িতে এলেনাকে তুলে নিল।
‘চলুন মুসা ভাই, মেয়েটিকে নিয়ে সুলতান নিজে হাসপাতালে যাবে। আপনাকে নিয়ে আমরা বাসায় ফিরব। কাল সকালে সায়েজু’তে যাব।’
‘না কুতায়বা, মেয়েটিকে এতটা অরক্ষিতভাবে পাঠানো যাবে না। গ্রেট বিয়োর রাস্তায় ওঁৎ পেতে থাকতে পারে, মেয়েটিকে কেড়ে নেয়ার সব রকম চেষ্টা করবে তারা।’
‘মেয়েটি কে? গ্রেট বিয়ার কে?’
‘সব বলব। মেয়েটি কারসাপকের গ্রেট বিয়ার নেতা আলেক্সি স্ট্যালিনের বিদ্রোহী কন্যা। এখন এতটুকুই।’
‘তাহলে চলুন। আমরা সবাই হাসপাতাল হয়ে ফিরব।’ বলল প্রেসিডেন্ট কুতায়বা।
‘সেটাই ভাল।’ বলল আহমদ মুসা।
সবাই চলতে শুরু করল।
আহমদ মুসা পা তুলতে গিয়ে তার গুলিবিদ্ধ বাম পা কে ভয়ানক ভারি মনে হলো। যন্ত্রণা ছড়িয়ে পড়ল সারা দেহে, সারা মুখে। অলক্ষ্যেই মুখ থেকে একটা ‘উঃ’ শব্দ বেরিয়ে এল।
দাঁড়িয়ে পড়ল সবাই। তাকাল আহমদ মুসার দিকে।
ছুটে এল কুতায়বা। বলল, ‘মুসা ভাই আপনি আহত বলেননি তো?’ কুতায়বার কন্ঠ আর্তনাদের মত শোনাল।
আহমদ মুসা পা টেনে নিয়ে চলতে শুরু করে বলল, ‘ও কিছু নয়, পায়ে গুলির চোট লেগেছে।’
কুতায়বা সংগে সংগে আহমদ মুসার পায়ের কাছে বসে পড়ে ফুটো হয়ে যাওয়া রক্তাক্ত প্যান্টের প্রান্তটা সরিয়ে দেখল, হাঁটুর ইঞ্চি তিনেক নিচে স্ফীত পেশীটার একটা বড় অংশ বিধ্বস্ত হয়েছে। এক খাবলা গোস্ত সেখানে নেই। গুলি ভেতরে থাকতেও পারে, আবার বেরিয়েও যেতে পারে। তখন রক্ত গড়াচ্ছে ক্ষত দিয়ে।
কুতায়বা রুমাল বের করে বাঁধতে যাচ্ছিল। কুতায়বার পি, এস, এবং গার্ড বাহিনীর কমান্ডার সুলতান আলীয়েভ দু’জনেই এগিয়ে এল। বিনীত ভাবে বলল, ‘স্যার আপনি উঠুন, আমরা বেঁধে দিচ্ছি।’
‘কেন আমি প্রেসিডেন্ট বলে তোমাদের খারাপ লাগছে? প্রেসিডেন্ট এত ছোট কাজ কেন করবে, তাই?’ কারো দিকে না তাকিয়ে বাঁধতে বাঁধতে বলল কুতায়বা।
কুতায়বা একটু থামল, ঢোক গিলল। তারপর মাথা তুলে আলীয়েভের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘কিন্তু আমি মুসা ভাইয়ের কাছে প্রেসিডেন্ট নই, আমি তাঁর একজন নগন্য কর্মী। তিনি আমার নেতা।’
‘তবু তুমি প্রেসিডেন্ট কুতায়বা। দেশ ও জনগনের সম্মানের প্রতীক তুমি। তাদের অসম্মান তুমি করতে পার না।’ বলল আহমদ মুসা।
‘এই কাজ যদি ওঁর অসম্মানের হয়, তাহলে সেই সম্মান ওর ত্যাগ করা উচিত।’ বলল শবনম। তার কন্ঠ ভারি।
‘শবনম, রাষ্ট্রের একটা নিয়ম কানুন আছে। কুতায়বা যে পদে আছে, তার একটা অধিকার রয়েছে। সে পদের দাবীকে তো সম্মান দেখাতে হবে।’
‘আপনার পদের চেয়ে কি সে পদ বড়?’ বলল শবনমই আবার।
‘আমার তো কোন পদ নেই শবনম।’
ঢিল হয়ে পড়া মুখের নেকাব টেনে দিয়ে শবনম বলল, ‘আপনি আপনার ওপর অপরিসীম জুলুম করছেন।’
‘নিজের ওপর জুলুম করাও পাপ। আমি সে ধরনের পাপ করছি বলে মনে কর?’
সংগে সংগে কোন জবাব এল না শবনমের কাছ থেকে।
কুতায়বা উঠে দাঁড়িয়েছিল। আহমদ মুসাকে ধরে নিয়ে হাঁটতে শুরু করে বলল, ‘চলুন মুসা ভাই। ঐ অভিযোগ আমাদেরও। আপনি চরকির মত গোটা বিশ্বময় ঘুরে বেড়াচ্ছেন। কোন বিশ্রাম নেই, বিশ্রামের একটা ঘরও নেই।’
আহমদ মুসা হাসল। বলল, ‘হিসেব করলে দেখা যাবে আমি জীবনের এক তৃতীয়াংশ সময় ঘুমিয়ে কাটিয়েছি। এরপর আর কি বিশ্রাম চাই? তোমরা যে বিশ্রামের কথা বলছ, সে বিশ্রামের সুযোগ মুসলমানদের নেই। মুসলমান একটা বিপ্লবী কর্মীদলের নাম। জগতের প্রতিটি মানুষের মুক্তি ও কল্যান নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত তারা স্থির হতে পারে না, অবকাশ নামের অহেতুক কোন বিশ্রামে তারা গা ঢেলে দিতে পারে না।’
সবাই মাথা নিচু করে শুনল আহমদ মুসার কথা। কিছু বলার জন্যে মুখ তুলেছিল কুতায়বা। কিন্তু গাড়ি এসে দাঁড়াল সামনে।
গাড়িতে উঠে বসল সবাই।
ছুটল গাড়ির মিছিল হাসপাতালের দিকে। | ← Previous | | | Next → | | সম্পুর্ণ বই এক পেজে »

Top