১৬. মধ্য এশিয়ায় কালো মেঘ

চ্যাপ্টার

ক্ষুদ্র শহর সায়েজু’র সুন্দর রেস্ট হাউজ। রেস্ট হাউজটি একটা ছোট পাহাড়ের মাথার উপর। রেস্ট হাউজের ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে পূর্ব দিকে তাকালে অল্প দুরে সমতল সুবিস্তৃত মালভুমির উপর মাথা উচু করে দাঁড়ানো মহাশূন্য গবেষণা কেন্দ্রটি দেখা যায়। অতীতে এই মহাশূন্য গবেষণাকেন্দ্র ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের। এখন মহাশূন্য গবেষণা কেন্দ্রটির মালিকানা মধ্য এশিয়া মুসলিম প্রজাতন্ত্রের। আর পশ্চিম দিকে তাকালে দেখা যায় মাইল দুই দূরে একটা পার্বত্য উপত্যকায় দাঁড়িয়ে আছে পারমাণবিক গবেষণা কেন্দ্র। এই পারমাণবিক গবেষণা কেন্দ্র এবং মহাশূন্য গবেষণা কেন্দ্র এখন এক মহা ষড়যন্ত্রের শিকার। মহাশূন্য গবেষণা কেন্দ্রে খুব বড় ঘটনা এখন্য ঘটেনি, কিন্তু পারমাণবিক গবেষণা কেন্দ্রে একের পর এক মারাত্মক ঘটনা ঘটে চলেছে। প্রকল্পের শীর্ষ বিজ্ঞানীসহ কয়েকজন পথম শ্রেনীর বিজ্ঞানী ইতিমধ্যেই নিহত হয়েছেন। গুরুত্বপূর্ণ রেকর্ড ও কম্পিউটার ব্যবস্থা বিধ্বস্ত প্রায়। শীর্ষ বিজ্ঞানী ও আণবিক প্রকল্পের প্রধান নবিয়েভ, যিনি সিংকিয়াং থেকে আহমদ মুসার সাথে ফিরে এসেছিলেন কিডন্যাপ অবস্থা থেকে মুক্ত হবার পর, নিহত হয়েছেন সায়েজুর বাইরে। অন্য সবগুলো ঘটনাই ঘটেছে সায়জুর পারমাণবিক প্রকল্প কেন্দ্রের ভেতরে। অথচ প্রকল্পটির নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত বলে মনে করা হয়। নিরাপত্তা ব্যবস্থা পরীক্ষা করে আহমদ মুসাও কোন ফাঁক খুঁজে পায়নি। কিন্তু এই নিরাপত্তার মধ্যেই নিরাপত্তাহীনতা সশরীরে অবস্থান করছে।
রেস্ট হাউজের ব্যালকনিতে একটা ছোট টেবিলের সামনে বসে আহমদ মুসা এই বিষয় নিয়েই ভাবছিল। পারমাণবিক কমপ্লেক্সের অভ্যন্তরেই যে শত্রু সশরীরে অবস্থান করছে, এ গুরুত্বপূর্ণ তথ্য এলেনাই জানিয়ে গেছে।
এলেনাকে বাঁচানো যায়নি। আঘাতটা অত্যন্ত মারাত্মক ছিল। যতক্ষন তার জ্ঞান ছিল, গ্রেট বিয়ার এবং তার তৎপরতা সম্পর্কে জানা সব কথাই সে বলে গেছে। তার শেষ প্রার্থনা ছিল, সে ইসলাম ধর্ম গ্রহন করেছে, তাকে যেন ওমরভের পাশে কবর দেয়া হয়, দ্বিতীয়ত তার মৃত্যুর খবরটা যেন তার মার ঠিকানায় পিটার্সবার্গে পাঠিয়ে দেয়া হয়। তার মা আঘাত পেলেও খুশী হবেন এই ভেবে যে তার মেয়ে গ্রেট বিয়ারের সাথে শেষ পর্যন্ত ছিল না। তার মা গ্রেট বিয়ারের লক্ষ্য ও কার্যক্রমের বিরোধী। এলেনার প্রথম প্রার্থনাটি বিপদে ফেলেছিল আহমদ মুসাদের। ওমরভের কংকাল কুড়িয়ে আনতে হয়েছিল এবং পরীক্ষা করে নিশ্চিত হতে হয়েছিল যে, ওটা ওমরভেরই। তারপর দু’জনকে পাশাপাশি কবর দিতে হয়।
এলেনার কাছ থেকেই জানা গেছে, সায়েজুতে গ্রেট বিয়ার এ পর্যন্ত যা করেছে তা ভেতরের দু’জন লোকের মাধ্যমে যারা আণবিক কমপ্লেক্সের কাজে কোন না কোন ভাবে যুক্ত আছে। এর বেশি তাদের পরিচয় সম্পর্কে এলেনা আর কিছু জানাতে পারেনি।
আহমদ মুসার কাছে এ তথ্যটিই অশেষ মূল্যবান। শত্রুদের চরদের পরিচয় যদিও এর মাধ্যমে জানা যায়নি, তবু তাদের ঠিকানা জানা গেছে-এটাও কম গুরম্নত্বপূর্ণ নয়। পারমানবিক কমপ্লেক্সের স্টাফ তালিকা সরকারী গোয়েন্দারা পরীক্ষা করেছে, কমপ্লেক্স কর্তৃপক্ষেরও সাহায্য নিয়েছে, কিন্তু তাতে কোন ফল হয়নি। সন্দেহ করার মত কাউকেও তারা পায়নি। পারিবারিক ইতিবৃত্ত সমেত পূর্ণ তালিকা আহমদ মুসা দেখতে চেয়েছে এবং ষ্টাফদের সাথেও সে একবার দেখা করতে চায়। এই উদ্দেশ্যেই তার সায়েজু’তে আসা।
আহমদ মুসা চেয়ারে গা এলিয়ে দিয়েছে। চোখ দু’টি বুজা। মুখে চিন্তার একটা গভীর ছাপ।
ভাবছে আহমদ মুসা গ্রেট বিয়ারকে নিয়েই। অদ্ভুত বেপরোয়া সংগঠন। আলেস্কি স্ট্যালিনের ৭, কারসাপক রোডের ঘাটিতে সেদিন রাতেই হানা দেয়া হয়েছিল, কিন্তু ধূলা আর ভাঙা কংক্রিটের স্তুপ ছাড়া আর কিছুই পাওয়া যায়নি ওখানে। সরকারী সৈন্যরা পৌঁছার যথেষ্ট আগেই আলেস্কি স্ট্যালিন তার ঘাটি ধ্বংস করে পালিয়ে গেছে। একটি দলকে, একটি জাতিকে কব্জা করার ওদের পরিকল্পনাটিও সর্বাধুনিক মানের।
পায়ের শব্দে আহমদ মুসা চোখ খুলল। দেখল মধ্য এশিয়া প্রজাতন্ত্রের গোয়েন্দা প্রধান আজিমভ প্রবেশ করেছে ব্যালকনিতে। তার হাতে একটা বড় ইনভেলাপ।
আজিমভ ইনভেলপটি আহমদ মুসার হাতে তুলে দিয়ে বলল, ‘এতে পারমানবিক কমপ্লেক্সের লোকদের পারিবারিক ইতিহাস ও সার্ভিস রেকর্ডসহ স্টাফ লিষ্ট আছে।’
আহমদ মুসার সামনের চেয়ারে বসল আজিমভ।
স্টাফ লিস্টটি ইনভেলাপ থেকে বের করল আহমদ মুসা। তার চোখের সামনে মেলে ধরল ষ্টাফ লিস্টটি সে।
অনেকক্ষণ পর লিস্ট থেকে মুখ তুলল আহমদ মুসা এবং চেয়ারে গা এলিয়ে দিয়ে চোখ বুজল। আরো কিছুক্ষণ পর চোখ খুলে আজিমভকে বলল, ‘কমপ্লেক্সের ডাইরেক্টর জেনারেল সাহেবকে কি এখন পাওয়া যাবে?
‘জি হ্যাঁ, মুসা ভাই। উনি ড্রইং রুমে অপেক্ষা করছেন। ডাকবো তাকে ?’
‘একটু পরে ডেকো।’ বলে থামল আহমদ মুসা। একটু পরে আবার শুরু করল, ‘তুমি কি জান, আণবিক কমপ্লেক্সে স্টাফ নিয়োগের ক্ষেত্রে কি ধরনের বিধি-নিষেধ আছে ?’
‘লিখিত যে বিধান রয়েছে তাতে বলা হয়েছে সৎ, চরিত্রবান ও সর্বোচ্চ যোগ্যতা সম্পন্ন ছাড়া কাউকে এ কমপ্লেক্সে নিয়োগ করা যাবে না। কিন্তু কিছু অলিখিত বিধান কঠোরভাবে অনুসরণ করা হয়। সেগুলো হলো, আণবিক কমপ্লেক্স ও মহাশূন্য গবেষণা কেন্দ্রে যাকে নিয়োগ করা হবে তাকে অবশ্যই মধ্য এশিয়া বা কোন মুসলিম দেশের জন্মগত মুসলিম হতে হবে। দুই, কম্যুনিষ্ট ব্যাক গ্রাউন্ড আছে অথবা রুশ পিতা অথবা রুশ মাতার সন্তান এমন কাউকেই এই কমপ্লেক্সে চাকুরী দেয়া যাবে না। তিন, ডিভাইডেড ফ্যামিলির সদস্য অর্থাৎ যার পরিবারের এক অংশ মধ্য এশিয়ায় আছে এবং আরেক অংশ রাশিয়ায় আছে তাকেও চাকুরী দেয়া যাবে না।’ থামল আজিমভ।
‘চাকুরী হবার পর কি তাদের ওপর নজর রাখা হয় ?’
‘তাদের গতিবিধির প্রতি নজর রাখার ব্যবস্থা আছে।’
‘তাদের পারিবারিক বিষয়াবলীর প্রতি নজর রাখার কি কোন ব্যবস্থা আছে ?’
আজিমভ একটু চিন্তা করে বলল, ‘জি না, এরকম বিশেষ কোন নির্দেশ দেয়া নেই।’
‘প্রোমোশন-ডিমোশনের ক্ষেত্রে কি সিস্টেম এখানে অনুসরণ করা হয় ?’
‘এ ব্যাপারে পরিচালনা বোর্ড সিদ্ধান্ত নেয়। ডাইরেক্টর জেনারেল সার্ভিস রেকর্ডসহ পরিচালনা বোর্ডের কাছে প্রস্তাব পেশ করেন ?’
‘কিসের ভিত্তিতে তিনি প্রস্তাব তৈরী করেন ?’
‘কনফিডেন্সিয়াল রিপোর্টের ভিত্তিতে।’
‘এ রিপোর্ট কে তৈরী করেন ?’
‘প্রত্যেক বিভাগের ডাইরেক্টর তার বিভাগের স্টাফদের রিপোর্ট তৈরী করেন। এ রিপোর্ট সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও প্রস্তাবকারী ডিজির কাছে পেশের জন্যে দায়িত্বশীল হলেন স্টাফ ডাইরেক্টর।’
‘ডাইরেক্টর জেনারেল সম্পর্কে তোমার মত কি ?’
‘আপনিও তাকে জানেন। ছাত্র জীবন থেকেই কম্যুনিজমের সাথে ভিন্নমত পোষন করতেন। তারপর বিপ্লবের সাথী হন এবং এই অপরাধে দীর্ঘ দিন তাকে বন্দী শিবিরে কাটাতে হয়। তাঁকে সবাই আমরা সব সন্দেহের উর্ধে মনে করি।’
‘আর স্টাফ ডাইরেক্টর ?’
‘স্টাফ ডাইরেক্টর সুলেমানভ কম্যুনিস্ট পক্ষ ত্যাগকারী একজন লোক। তিনি লন্ডনে এক অর্থনৈতিক প্রতিনিধি দলের সদস্য হিসাবে স্বপক্ষ ত্যাগ করেন। বিপ্লবের পরে ফিরে আসেন মধ্য এশিয়ায়। বিপ্লবের প্রতি তাঁকে আমরা আন্তরিক পেয়েছি।’
‘তার স্ত্রী আছে ?’
‘না, মারা গেছেন।’
‘কতদিন তার স্ত্রী নেই ?’
‘তিন বছর।’
‘বিয়ে করেননি কেন আর ?’
‘বড় বড় ছেলে-মেয়ে আছে, সংসারে তিনি নতুন কোন অশান্তি সৃষ্টি করতে চান না?’
‘স্বপক্ষ ত্যাগের পর তিনি বৃটেনে কতদিন ছিলেন ?’
‘পাঁচ বছর।’
‘ঠিক আছে তুমি ডাইরেক্টর জেনারেলকে ডেকে দাও। আর বলে দিয়ে এস, স্টাফ ডাইরেক্টর সুলেমানভকে এক্ষুণি আসার জন্যে।’
আজিমভ চলে গেল।
অল্পক্ষণ পর ডাইরেক্টর জেনারেল ওসমানভকে নিয়ে আজিমভ আহমদ মুসার কাছে ফিরে এল।
আহমদ মুসা উঠে দাঁড়িয়ে স্বাগত জানাল মাঝ বয়সী ওসমানভকে।
সবাই বসল।
‘জনাব আপনাকে কষ্ট দিয়েছি কয়েকটা বিষয় জানার জন্যে।’ ওসমানভের দিকে নরম কন্ঠে বলল আহমদ মুসা।
‘এ আমার দূর্লভ সৌভাগ্য জনাব। আপনার সান্নিধ্যে এমন সৌভাগ্য যদি আমার প্রতিদিন হতো!’
‘গত দু’বছর যে প্রমোশনগুলো আপনার প্রতিষ্ঠানে হয়েছে, আপনি তাতে সন্তুষ্ট ?’
‘অসন্তুষ্ট আমি কোনটাতেই নই।’ একটু চিন্তা করে জবাব দিল ওসমানভ।
‘একজনের প্রমোশন কতদিন পরপর হওয়ার নিয়ম ?’
‘ধরাবাধা কোন নিয়ম নেই। প্রতিষ্ঠানের বয়স কম বলে কোন ঐতিহ্যও গড়ে উঠেনি। প্রয়োজনই এখন সবরকম পরিবর্তন ও সিদ্ধান্তের মানদন্ড। এদিক থেকে প্রমোশন ঘন ঘনও হতে পারে কারো ক্ষেত্রে, আবার কারো প্রমোশন দেরীতেও হতে পারে।’
‘আপনার এই মানদন্ড অনুসারে কোন প্রমোশন বা ট্রান্সফার কি একটু-আধটুও অসমীচিন বা অসংগত মনে হয়েছে, আপনার কাছে ?’
ওসমানভ মাথা নিচু করে ভাবল। অনেক্ষণ পর মাথা তুলে বলল, ‘অফিসের আভ্যন্তরীণ সিকুরিটি বিভাগের রেকর্ড কিপার আবু আমিনভ এবং গবেষণা বিভাগের লগ-এ্যাসিস্টেন্ট ইয়াসিনভ-এর ট্রান্সফার ও প্রমোশন আমার কাছে অসংগত নয়, তবে খুব প্রয়োজনীয় বিষয় ছিল না বলে আমার মনে হয়েছিল।’
আহমদ মুসার চোখের উজ্জ্বল্য যেন বেড়ে গেল। বলল, ‘এছাড়া আর কারও ?’
‘আমার মনে পড়ছে না।’ চিন্তা করে বলল ওসমানভ।
‘ঐ দুইজনের প্রমোশন ও ট্রান্সফার খুব প্রয়োজনীয় মনে হয়নি, কিন্তু তবু হলো কেন ?’
‘ট্রান্সফারের ফলে ঐ পদ দু’টি খালি হয়। কিন্তু এই ট্রান্সফার খুব প্রয়োজনীয় ছিল না।’
‘ধন্যবাদ আপনাকে। আপনাকে অনেক কষ্ট দিয়েছি।’
উঠে দাঁড়াল ওসমানভ। আহমদ মুসাও। সালাম দিয়ে হ্যান্ডশেক করে বিদায় নিল ওসমানভ।
‘সোলাইমানভ এসেছে মুসা ভাই, ডাকব তাকে ?’
আহমদ মুসা বসতে বসতে বলল, ‘বস, কথা আছে, একটু পরে ডাক ওকে।’
বসল আজিমভ।
‘জিজ্ঞাসাবাদের পর সুলাইমানভকে আণবিক কমপ্লেক্সে ফিরে যেতে দেয়া যাবে না। তাকে হয় কোথাও পাঠাতে হবে, না হয় আটকে রাখতে হবে। এ দু’টির কোনটিই যদি আমরা না করি, তাহলে তাকে যা জিজ্ঞাসা করতে চাই তা জিজ্ঞাসা করা যাবে না।’
আজিমভ চোখ ছানাবড়া করে বলল, ‘মুসা ভাই আমি কিছুই বুঝতে পারছি না, কোন পথে এগুচ্ছেন আপনি। সুলাইমানভ আমাদের কি করতে পারে ?’
‘কিছুই করতে পারে না। কিন্তু আমাদের জিজ্ঞাসাবাদে তার যে সন্দেহ জাগবে তা কাউকে সে বলে দিতে পারে।’
‘বুঝেছি মুসা ভাই, কাউকে সাথে দিয়ে সুলাইমানভকে আমরা তাসখন্দে পাঠাতে পারি কিছু একটা কাজের কথা বলে।’
ভাবছিল আহমদ মুসা। আজিমভ কথা শেষ করলে আহমদ মুসা বলল ‘ঠিক আছে সুলাইমানভকে কোথাও পাঠিয়ে কাজ নেই। ওকে বলবে আজকের সন্ধ্যেটা তিনি আমাদের সাথেই থাকবেন।’
একটু থামল আহমদ মুসা। তারপর আবার শুরু করল, ‘আণবিক কমপ্লেক্সে দ্বিতীয় সিফটের কাজ আর আধাঘন্টার মধ্য শেষ হচ্ছে। তুমি তোমার লোকদের বলে দাও, সিকুরিটি বিভাগের আবু আমিনভ এবং গবেষণা বিভাগের ইয়াসিনভ যখন অফিস থেকে বের হবে, তখন তাদের যেন চোখে চোখে রাখা হয়।’
‘আপনি কি ওদের সন্দেহ করছেন মুসা ভাই?’
‘ওদের ওপর সন্দেহটা গিয়ে পড়েছে, সেটাই পাকাপোক্ত করার চেষ্টা করছি। আবু আমিনভ -এর ব্যাপারে সন্দেহ করার একটা শক্তিশালী কারণ খুঁজে পেয়েছি, কিন্তু ইয়াসিনভের ক্ষেত্রে পায়নি। তবে তাঁর প্রমোশনও আবু আমিনভ-এর মতই অস্বাভাবিক। দু’জনেই অল্প সময়ে দু’টো করে প্রমোশন ও ট্রান্সফার পেয়েছে একই সময়ে।’
থামল আহমেদ মুসা। আজিমভ কোনো কথা বলল না। দেখল, আহমেদ মুসা গভীর ভাবনায় ডুবে আছে।
একটু পরেই আহমদ মুসা আবার মুখ খুলল। বলল, ‘তোমরা তো স্টাফদের বাইরের গতিবিধির উপর নজর রাখ, বলতে পার ইয়াসিনভ কোথায় বেশি উঠাবসা করে, কারও সাথে তাঁর বেশি সম্পর্ক আছে কি না?’
‘ওদের দু’জনের উপর চোখ রাখার কথা বলে এই খবরটা দিয়ে আসি মুসা ভাই তাহলে!’
‘যাও।’
আজিমভ উঠে দাঁড়াল।
আহমদ মুসা আবার সেই স্টাফ লিস্টের উপর চোখ বুলাতে লাগল।
অল্পক্ষণ পরেই আজিমভ ফিরে এল। বসতে বসতে বলল, ‘ওদের চোখে চোখে রাখার কথা বলে এলাম মুসা ভাই আর ইয়াসিনভের বাইরের জীবনের ব্যাপারে খুব বেশি তথ্য দিতে পারল না। বাইরে তাঁর ঘোরাফেরা খুবই কম। তা এক মেয়ে বান্ধবী আছে, যার সাথে বিয়ে হবে। তার উঠা-বসার জায়গা একমাত্র ওটাই।’
‘মেয়ে বান্ধবীর নাম কি?’ নড়েচড়ে বসে প্রশ্ন করল আহমদ মুসা।
‘ইভানোভা।’
‘রাশিয়ান?’ চোখ-মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল আহমদ মুসার।
‘জি, হ্যাঁ, রাশিয়ান।’
আহমদ মুসা চেয়ারে গা এলিয়ে দিয়ে বলল, ‘আমি এরকমটাই আশা করছিলাম আজিমভ।’
‘আমি এখনো কিছু বুঝতে পারছি না মুসা ভাই। এ বিষয়টাকে আমরা কেউ গুরুত্ব দেইনি। মধ্য এশিয়ায় রাশিয়ান স্ত্রী একটা সাধারণ ঘটনা।’
‘ঠিক, কিন্তু কখনো কখনো আসাধারণ হয়ে উঠতে পারে অসাধারণত্ব কিছু আছে কি না, তাই আমি জানার চেষ্টা করছি। তুমি সুলাইমানভকে ডাক।’
অল্প কয়েকটি মুহুর্ত। আজিমভ সুলাইমনভকে নিয়ে ফিরে এল।
মাথাটা একটু নিচে করে জড়সড়োভাবে সুলাইমনভ এসে দাঁড়াল আহমদ মুসার সামনে। চল্লিশোর্ধ ভদ্রলোক। বুদ্ধিদীপ্ত চোখ, কিন্তু মুখের ওপর মলিন একটা ছায়া।
‘বসুন।’ সুলাইমানভের সাথে হ্যান্ডশেক করে বসতে বসতে উচ্চারণ করল আহমদ মুসা।
বসল সুলাইমানভ।
‘আণবিক গবেষণাগার নতুন করে চালু হবার পর থেকেই তো আপনি আছেন?’ আহমদ মুসার প্রথম জিজ্ঞাসা।
‘জি, হ্যাঁ।’ মুখ তুলে জবাব দিল সুলাইমনভ।
‘আপনি তো জানেন গবেষণাগারে ইতিমধ্যই আনেকগুলো মারাত্মক ঘটনা ঘটে গেছে। এ ব্যাপারে আমরা আপনার কাছে সাহায্য চাই।’
‘অবশ্যই, সাহায্য করতে পারলে খুশী হবো । প্রতিষ্ঠান তো আমাদের।’
সুলাইমনভের কথাই কোনো খাদ নেই, আনুভব করল আহমেদ মুসা।
‘আপনি একটা গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে রয়েছেন। প্রমোশন ও ট্রান্সফারের ক্ষেত্রে অসংগত ও অস্বাভাবিক কিছু কখনও আপনার দ্বারা হয়েছে বলে আপনি কি মনে করেন? কিছু মনে করবেন না, প্রশ্নটা খুব অপ্রীতিকর হয়ে গেল।’
সুলাইমনভের মুখের মলিন ছায়াটা গভীর হল, তৎক্ষণাৎ কোন জবাব দিল না। একটু সময় নিয়ে ধীরে ধীরে বলল, ‘আপনার কাছে কিছুই লুকানো থাকবে না। এ ধরণের দু’টি কাজ আমার দ্বারা হয়েছে, যার জন্য আমি অনুতপ্ত।’
‘যেমন’ বলল আহমদ মুসা ।
‘একটি আবু আমিনভের ক্ষেত্রে, আরেকটি ইয়াসিনভের ক্ষেত্রে।’ সুলাইমানভের কন্ঠ ভারী ও কাঁপা শোনাল।
‘বুঝতে পারছি অনিচ্ছা সত্বেই হয়েছে ,কিন্তু কিভাবে হলো।’
‘আমার দুর্বলতার কারণে।’
‘সে দুর্বলতা কি?’
‘আবু আমিনভ ও তার পরিবারবর্গ আমার বাড়িতে খুব বেশি যাতায়াত করতো। আবু আমিনভ এবং ইয়াসিনভ দু’জন ঘনিষ্ঠ বন্ধু।’
‘আর কিছু?’
‘আরও আছে। আপনার কাছে কিছুই আমি লুকাতে পারব না। আবু আমিনভের স্ত্রীর বড় বোন ও আসতো আমাদের বাড়ীতে। আমি তার প্রতি দুর্বল হয়ে পড়েছিলাম।’ বলে সুলাইমানভ দু’হাতে মুখ ঢেকে কান্নায় ভেঙে পড়ল।
সুলাইমানভ কিছুটা শান্ত হলে আহমদ মুসা বলল, ‘তারপর।’
‘তারপর আল্লাহ আমাকে সাহায্য করেছেন। ধীরে ধীরে দুর্বলতা আমি কাটিয়ে উঠতে পেরেছি।’
‘এ ব্যাপারে আপনি আবু আমিনভের ভুমিকাকে কি দৃষ্টিতে দেখেন?’
‘ওকে কোনো দোষ আমি দেই না। দুর্বলতাটা আমার নিজস্ব ছিল।’
‘তাদের প্রমোশন ও ট্রান্সফার আপনার প্রস্তাব ছিল, না তাদের অনুরোধ ছিল?’
‘তাদের অনুরোধ ছিল।’
‘যুক্তি কি ছিল তাদের?’
‘তাদের ব্যাক্তিগত পছন্দ ছিল।’
‘তাদের বিশ্বস্ততা সম্পর্কে আপনার অভিমত কি??
‘এ সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট বিভাগ ভাল বলতে পারবে। তবে তাদেরকে আমার অবিশ্বস্ত মনে হয়নি।’
‘আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ, কঠিন হলেও আপনি সত্য কথা বলেছেন।’
সুলাইমানভ উঠে দাঁড়াল এবং সালাম জানিয়ে চলে গেল।
আহমদ মুসা গা এলিয়ে দিল চেয়ারে। চোখ বুজল।
আজিমভ কথা বলে আহমদ মুসাকে বিরক্ত না করে পায়চারী করতে লাগল।
কিছুপর চোখ খুলল আহমদ মুসা। ডাকল আজিমভকে।
আজিমভ এসে বসল।
‘আবু আজিমভ ও ইয়াসিনভ সম্পর্কে আমাদের এ আলোচনা কোনোভাবে কি আজ কিংবা দু’একদিনের মধ্য তাদের কানে পৌছতে পারে?’ আহমদ মুসা বলল।
‘পৌছবে না একথা বলা মুস্কিল। আমরা যদি সুলাইমানভকে ধরে রাখি, তাহলে এটা তাদের কানে যেতে পারে। আর যদি কোথাও পাঠিয়ে দেই, সেখান থেকে সুলাইমানভ এদের সাথে যোগাযোগ করতে পারে।’
‘আমি চিন্তা করছি এছাড়া আরও কোন পথ আছে কিনা।’
‘সেটা কি হতে পারে?’
‘দেখ, আমার সন্দেহ যে ঠিক তা এখনো যদিও প্রমাণ হয়নি, তবে ঠিক হলে এই নেটওয়ার্কে আরও লোক থাকতে পারে এবং তাদের চোখ আমাদের এই কাজগুলো লক্ষ্য করতে পারে। দ্বিতীয়ত, আমাদের শত্রুপক্ষের প্রযুক্তি আমাদের চেয়ে উন্নততর। তারা যদি ইলেকট্রনিক ইনফরমেশন নেটওয়ার্ক গড়ে তুলতে থাকে, তাহলে এই গুরুত্বপূর্ণ রেস্ট হাউজ তাদের নেটওয়ার্কের বাইরে নয়। অর্থাৎ সেক্ষেত্রে আমাদের আজকের গোটা আলোচনা এতক্ষণে ওদের কাছে পৌছে গেছে।’
খুব চিন্তাক্লিষ্টভাবে কথা শেষ করলো আহমেদ মুসা।
‘আপনার প্রত্যেকটা কথা সত্য হতে পারে মুসা ভাই। ‘স্পাই বাগ ডিটেক্টর’ দিয়ে রেস্ট হাউজটা পরীক্ষা করব?’ উদ্বিগ্ন কন্ঠে বলল আজিমভ।
‘করতে পার, কিন্তু চলে যাওয়া কথা গুলো আর ফিরে আসবে না। তাছাড়া এমন কিছু ‘গোয়েন্দা তথ্য প্রেরক যন্ত্র’ আজকাল ব্যবহার করা হচ্ছে যা প্রচলিত ‘স্পাই বাগ ডিটেক্ট’ দিয়ে ধরতে পারছে না।’
‘তাহলে?’
‘তাহলে আর কি, পাখি উড়ে গেল। ওদের নেটওয়ার্কে আর হাত দেয়া গেল না।’
কথা শেষ করেই আহমদ মুসা ঘড়ির দিকে তাকাল। তারপর উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, ‘তুমি মিঃ সুলাইমানভকে যেতে বল। আর চল একটু বেড়িয়ে আসি।’
আজিমভ উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘কোথায়?’
‘এমনি এদিক-ওদিক।’ বলে আহমেদ মুসা হাঁটতে শুরু করল।
গাড়িতে উঠার জন্য গাড়ির দিকে এগিয়েও ফিরে এল আহমদ মুসা। আজিমভ এলে তাকে বলল, ‘কোন ভাড়া গাড়ি পাওয়া যাবে না?’
‘কেন আমার গাড়ি?’
‘তোমার গাড়ির উপরও আমার আস্থা নেই। ওখানে স্পাই বাগ বসানো নেই কে বলবে।’
‘রেস্ট হাউজেরও গাড়ি আছে।’
‘না ওটাও নিরাপদ নয়।’
‘ওরা ওদের নেট ওয়ার্ক এতটা বিস্তার করেছে বলে মনে করেন?’
‘এটা আমার সন্দেহ, মিথ্যাও হতে পারে।’
আর কোন কথা না বলে আজিমভ তার ওয়াকি-টকিতে পুলিশ চীফকে বলল বেসরকারী ট্রান্সপোর্ট পুল থেকে ভাল একটা গাড়ি রেস্ট হাউজে পৌঁছে দেবার জন্যে।
গাড়ি এল। ড্রাইভারকে বিদায় দিয়ে ড্রাইভিং সিটে উঠে বসল আজিমভ। তার পাশের সিটে আহমদ মুসা।
গাড়ি স্টার্ট দিতে যাবে এমন সময় আজিমভের ওয়াকি-টকি কথা বলে উঠল। বলল, ‘ওদের দুজনকে আমাদের যে চারজন লোক অনুসরণ করছিল তারা ধরা পড়েছে। অনুসরণ শুরু করার পাঁচ মিনিটের মধ্যে সামনে ও পিছন থেকে দু’টি গাড়ি তাদের ঘিরে ফেলে এবং তাদের ধরে নিয়ে যায়। অফিস বন্ধ হবার ১০ মিনিট আগেই শিকার দু’জন বেরিয়ে আসে। তারা বাড়িতে না গিয়ে কারসাপক হাইওয়ে ধরে উত্তরে এগুচ্ছিল। সমস্ত পুলিশ পয়েন্টকে এ্যালার্ট করে দেয়া হয়েছে। চারদিক থেকে ওদের খুঁজে বের করার চেষ্টা করা হচ্ছে।’
বন্ধ হয়ে গেল কথা। সায়েজুর পুলিশ চীফ কথা বলছিল ওয়াকি-টকিতে।
আজিমভের সারা মুখে নেমে এসেছে ব্যর্থতার অন্ধকার। বলল, ‘আপনার সন্দেহটা এত সত্য হয়ে এত তাড়াতাড়ি সামনে আসবে তা ভাবিনি।’
‘আমারও ভুল হয়েছে আজিমভ। আরও আগে সতর্ক হলে এই ক্ষতিটা হয়তো এড়ানো যেত।’
‘আমরা তো এখন আবু আমিনভ-এর বাসাটা দেখতে পারি। মনে হয় তার রাশিয়ান স্ত্রীই আসল এজেন্ট।’ ব্যস্ত কণ্ঠে বলল আজিমভ।
‘মনে হয় বলছ কেন, সেই তো আসল। আবু আমিনভ বাহন মাত্র, ওদের হাতে ব্যবহৃত হয়েছে। সেই কারণেই আবু আমিনভের বাসায় গিয়ে সব শূন্য দেখবে। আবু আমিনভ ও ইয়াসিনভকে সাবধান করার আগেই ওরা আমিনভের স্ত্রীকে সরিয়ে নিয়েছে। তবু চল, শত্রু কোন চিহ্ন ফেলে রেখে গেছে কি না দেখা যাক।’
ছুটল গাড়ি আবু আমিনভের বাড়ির দিকে।
আবু আমিনভ আণবিক গবেষণা কমপ্লেক্সের সাধারণ কর্মচারীদের জন্যে নির্দিষ্ট রেসিডেন্সিয়াল ব্লকে থাকে। এ ব্লকটিও সুরক্ষিত। চারদিকে উঁচু প্রাচীর। তাছাড়াও আছে পাহারার ব্যবস্থা। রেসিডেন্সিয়াল ব্লকে ঢুকতে হলে গেটে সিকুরিটি পাশ দেখাতে হয়। কর্মচারীদের সুপারিশের ভিত্তিতেই এই পাশ ইস্যু হয়ে থাকে।
গাড়ি বারান্দায় গাড়ি দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বিস্মিত হলো আহমদ মুসা। গাড়িটা যেন ঠিক যাত্রার জন্যে তৈরী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
‘গাড়িটা কি আবু আমিনভের?’ বলল আহমদ মুসা।
‘নাম্বার দেখে তাই মনে হচ্ছে।’ আজিমভ উত্তর দিল।
‘তাহলে আবু আমিনভরা অফিস থেকে অন্য গাড়িতে গেছে। কিন্তু তার স্ত্রী গেল কোন গাড়িতে?’
‘কেউ এসে নিয়ে যেতে পারে, কিংবা এখনও যায়নি।’
‘এসে নিয়ে যাওয়া স্বাভাবিক নয়। আর সে এখনো বাসায় থাকতে নাও পারে।’
‘তাহলে?’
আহমদ মুসা গাড়ির সামনের ঢাকনা স্পর্শ করে বলল, ‘গাড়িটা ফিরে এসেছে। অর্থাৎ এ বাড়িতে ফাঁদ পাতা হয়েছে আমাদের জন্যে।’
‘বুঝেছি মুসা ভাই।’ মুখ উজ্জ্বল করে বলল আজিমভ।
আহমদ মুসা একটু ভাবল। তারপর বলল, ‘শোন, আমরা দু’জন গিয়ে এখন দরজার সামনে দাঁড়াব। তুমি দরজার ডোর ভিউ-এ হাত রাখবে। তারপর আমি চলে যাব বাড়ির পেছনে, পেছন দিয়ে আমি বাড়িতে ঢুকবো। আমি চলে যাবার দু’মিনিট পর তুমি দরজায় নক করবে। কিন্তু তোমার হাত অবশ্যই ডোর ভিউ-এ রাখতে হবে যাতে করে ভেতর থেকে দেখতে না পায় দরজায় ক’জন দাঁড়িয়ে।’
‘এর কি দরকার? লুকিং হোল খোলা থাকলেও তারা দেখবে আমরা শত্রু, বন্ধ থাকলেও তারা বুঝবে আমরা শত্রু।’
‘আমরা দু’জন এসেছি, ইতিমধ্যেই ওরা তা দেখেছে। তারপর দরজায় একজন দাঁড়ান দেখবে, তখন তাদের কাছে পরিষ্কার হয়ে যাবে আরেকজন অন্যপথে গেছে। আমরা তাদেরকে এটা জানতে দিতে চাই না।’
আহমদ মুসা ও আজিমভ অনেকটা অলস হাঁটার ভংগিতে গিয়ে দরজার সামনে দাঁড়াল। আজিমভ ধীরে ধীরে তার ডানহাত ডোর ভিউ-এর ওপর রাখল।
সংগে সংগেই চোখের পলকে ভোজ-বাজীর মতই খুলে গেল দরজা।
আকস্কিতার ধাক্কা কাটিয়ে আহমদ মুসা যখন সামনে চাইল দেখল তিনটি স্টেনগান তাদের দিকে হা করে তাকিয়ে আছে।
তাদের একটি কণ্ঠ হো হো করে হেসে উঠল। বলল, ‘আসুন, আসুন, আমরা আপনাদের জন্যেই অপেক্ষা করছি।’
কথা শেষ হবার আগেই স্টেনগানধারী একজন এগিয়ে এল। ডান হাতে স্টেনগান ধরে বাম হাত দিয়ে আজিমভের পকেট থেকে রিভলবার তুলে নিল। অন্য পকেটগুলো এবং কটিদেশও হাতিয়ে দেখল।
পরে এল আহমদ মুসার কাছে। কাছে আসার কারণে তার স্টেনগানের মাথাটা একটু উঁচু হয়ে উঠেছে।
আহমদ মুসার রিভলবারটি তার ডান পকেটে। সুতরাং এ রিভলবারটি তুলে নেবার সময় স্টেনগানধারীর বাম কাঁধ একটু বেঁকে আহমদ মুসার নিকটতর হয়ে পড়েছিল। পাঁচ ছয় হাত দূরে দাঁড়ানো দুইজন স্টেনগানধারীর সাথে কিছুটা আড়াল সৃষ্টি হয়েছিল।
আজিমভের মত আহমদ মুসার হাত দু’টিও ওপরে তোলা ছিল। স্টেনগানধারী যখন আহমদ মুসার পকেট থেকে রিভলবার তুলছিল, ঠিক সেই সময় আহমদ মুসার হাত দু’টি বিদ্যুৎবেগে নেমে এল। বাম হাত দিয়ে সাঁড়াশির মত গলা পেঁচিয়ে দেহটা ঘুরিয়ে নিয়ে চেপে ধরল বুকের সাথে। আর ডান হাত তার স্টেনগান কেড়ে নিয়ে আজিমভকে দিয়ে দিল। ওরা বুঝে ওঠার আগেই আজিমভ এক লাফে সরে এল আহমদ মুসার পেছনে। ইতিমধ্যে আহমদ মুসা নিজের পকেটের রিভলবারটি বের করে নিল।
সামনে দাঁড়ানো দু’জন স্টেনগানধারী মুহূর্তের জন্যে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েছিল। কিন্তু তার পরেই তারা সক্রিয় হয়ে উঠল। কিন্তু সামনে গুলি করার উপায় ছিল না। তারা দু’পাশে দু’জন সরে গিয়ে গুলি করার সুযোগ বের করতে চাইল। কিন্তু আজিমভ আহমদ মুসার আড়ালে দাঁড়িয়ে গুলি করে তাদের উদ্যোগ ব্যর্থ করে দিল।
আহমদ মুসার রিভলবারও ওদের দিকে তাক করা ছিল। আহমদ মুসা কঠোর কণ্ঠে ওদের স্টেনগান ফেলে দেবার নির্দেশ দিল। কিন্তু নির্দেশ তারা পালন করল না। বরং ওদের চোখকে পশুর মত জ্বলে উঠতে দেখল আহমদ মুসা। বলল, ‘আমাদের সাথীকে ঢাল বানিয়ে বাঁচতে পারবে না। তোমার জন্যে আমরা একজন নয় এক’শ জন সাথীও হারাতে………’
কথা তাদের শেষ হলো না। শেষ করতে দিল না আহমদ মুসা। আহমদ মুসার বুঝার বাকি ছিল না, এরপর ওরা কি করবে। ওদের কথা শেষ করার আর সম্ভবত দু’টি শব্দ বাকি ছিল। এটুকু
সময়ের মধ্যে আহমদ মুসার রিভলবার দু’বার অগ্নি উদ্‌গীরণ করল। স্টেনগানধারী দু’জনের স্টেনগান হাত থেকে খসে পড়ল, ওরাও আছড়ে পড়ল মেঝের ওপর।
আহমদ মুসা যাকে ধরে রেখেছিল, তাকে এবার ছুড়ে ফেলল মেঝেতে। লোকটি মেঝেতে পড়েই তার ডান হাতের মধ্যমা আঙুলের আংটি কামড়ে ধরল।
আহমদ মুসা বুঝতে পারল কি ঘটছে। সংগে সংগে সে ঝাঁপিয়ে পড়ল লোকটির ওপর। তার হাতটি কেড়ে নিল মুখ থেকে। কিন্তু লাভ হলো না। সাংঘাতিক পটাসিয়াম সাইনাইড ততক্ষণে তার কাজ শুরু করে দিয়েছে। অল্পক্ষণের মধ্যেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ল লোকটি।
আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল। বলল, ‘ওদের কাউকে জীবন্ত ধরতে আবার ব্যর্থ হলাম। জয় অথবা মৃত্যুই ওদের মটো। ওরা কোন অবস্থাতেই ধরা পড়তে চায় না।’
ওদের পকেট সার্চ করে কিছু পাওয়া গেল না।
আহমদ মুসা ও আজিমভ গোটা বাড়িটাই সার্চ করল। কিন্তু উল্লেখ করার মতো প্রয়োজনীয় কিছুই পেল না।
আহমদ মুসা ও আজিমভ বেরিয়ে এল বাড়ি থেকে। হাঁটতে হাঁটতে আজিমভ বলল, ‘আমাদের জন্যে সবচেয়ে মূল্যবান ক্লু ছিল আবু আমিনভ এবং ইয়াসিনভ। আমরা ব্যর্থ হলাম ওদের ধরে রাখতে।’
বলে আজিমভ পকেট থেকে ওয়াকি-টকি বের করে বলল, ‘দেখি ওরা আবু আমিনভ ও ইয়াসিনভ-এর কোন সন্ধান পেল কি না।’
আহমদ মুসা হাসল। বলল, ‘ওদের সন্ধান আর পাবে না, পেতে পারো লাশের সন্ধান।’
আহমদ মুসা কথা শেষ করতেই আজিমভের ওয়াকি-টকি কথা বলে উঠল। বলল, ‘শহরের বাইরে একটা ছোট অখ্যাত রাস্তার পাশের খাদে আমাদের চারজন গোয়েন্দা কর্মীসহ আবু আমিনভ ও ইয়াসিনভের লাশ পাওয়া গেছে। সকলের লাশ পুলিশ হেডকোয়ার্টারে আনা হয়েছে।’
আজিমভের মুখ মলিন হয়ে পড়েছিল। বলল, ‘ওরা খুন করল আবু আমিনভ ও ইয়াসিনভকে?’
‘ওদের পরিচয় প্রকাশ হয়ে পড়ার পর ওরা হয়ে দাঁড়িয়েছিল বোঝা, সেই বোঝাই গ্রেট বিয়ার নামিয়ে দিয়েছে। আবু আমিনভের রাশিয়ান স্ত্রীই ছিল ওদের লোক। ওকে তারা সরিয়ে নিয়েছে এবং নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেছে দেখ ঠিক ভাবেই।’
‘চলুন মুসা ভাই, পুলিশ হেড কোয়ার্টারে যাই। কিছু ক্লু যদি পাওয়া যায়।’
‘কিছুই পাবে না আজিমভ, এমনকি ফিংগার প্রিন্টও নয়। বৃথা চেষ্টা। দেখলে না ওদের তিনজনের হাতেই গ্লাভস ছিল।’
আহমদ মুসা ও আজিমভ দু’জনেই এসে গাড়িতে উঠল। গাড়ি ষ্টার্ট দিল আজিমভ।
‘যদিও দুঃখ হচ্ছে আমিনভ ও ইয়াসিনভকে জীবিত হাতে না পাওয়ার জন্যে, তবু মনটা খুব হালকা মনে হচ্ছে মুসা ভাই। আমাদের আণবিক গবেষণা কেন্দ্র রাহু মুক্ত হলো। ভেতর থেকেই ওরা সবকিছু ঘটিয়েছে বলে আমাদের নিরাপত্তা ব্যবস্থা কোনই কাজে আসেনি। আমার এখন মনে হচ্ছে বিজ্ঞানী নবিয়েভকে আনার জন্যে যে গাড়ি এয়ারপোর্টে গিয়েছিল, তাতে বোমা ফিট করা আবু আমিনভদেরই কাজ।’
‘হতে পারে।’ বলে আহমদ মুসা একটু ভাবল। তারপর বলল, ‘আমারও মনে হচ্ছে আণবিক গবেষণা কেন্দ্রে গ্রেট বিয়ারের সোর্স এ দু’জনই ছিল। তবু আগামী কিছুদিন প্রতিটি কর্মচারীর প্রতিটি পদক্ষেপের খোঁজ নিতে হব। তাদের যোগাযোগের ক্ষেত্রকে যাচাই করে দেখতে হবে। কারও মধ্যে কোন অবৈধ অর্থনীতি ও নারীপ্রীতি যদি দেখা যায়, সংগে সংগে তাকে এখান থেকে সরিয়ে দিতে হবে। এ ধরনের চরিত্রহীনদেরকেই শত্রুরা কাজে লাগায়।’
‘আল্লাহর হাজার শুকরিয়া মুসা ভাই। আপনি অদ্ভুত নিখুঁতভাবে ক্রিমিনাল দু’জনকে চিহ্নিত করেছেন। না হলে আরও কত যে ক্ষতি হতো, আরও কতদিন যে অন্ধকারে ঘুরতে হতো! বুঝতে পারছি না, আমিনভকে সন্দেহ করলেন তার রাশিয়ান স্ত্রীর জন্যে, কিন্তু ইয়াসিনভকে?’
‘ওদের দু’জনের এক সাথে একাধিক প্রমোশন দেখে।’
‘সুলাইমানভকে আপনার কেমন মনে হয়?’
‘লোকটার দুর্বলতার সুযোগ নিয়েছে আবু আমিনভরা। তবে লোকটা ষড়যন্ত্রের মধ্যে নেই। কিন্তু ওকে আণবিক গবেষণা কেন্দ্র থেকে অন্য কোন চাকুরীতে সরিয়ে নিয়ে যাও।’
আহমদ মুসা কথা বললেও তাঁকে আনমনা মনে হলো।
‘কিন্তু কি ভাবছেন মুসা ভাই?’ আহমদ মুসার দিকে চেয়ে গম্ভীর কন্ঠে জিজ্ঞাসা করল আজিমভ।
‘হ্যাঁ ভাবছি, ‘গ্রেট বিয়ার’ –এর কথা। ওদের গায়ে হাত দেয়া গেল না, অথচ ওরা ওদের ধ্বংসযজ্ঞ নিরাপদেই করে চলেছে।’
আজিমভের মুখে চিন্তার ছায়া নেমে এল। কোন কথা বলল না সে।
‘এখন কোথায় চলছ তুমি?’ আহমদ মুসাই আবার কথা বলল।
‘রেষ্ট হাউজে।’
‘না রেষ্ট হাউজে নয়, কারসাপক এয়ারপোর্টে চল। আর তোমার অয়্যারলেসে বলে দাও আমার ব্যাগটা যেন সেখানে পৌঁছে দেয়।’
আজিমভের মুখটা যেন শুকিয়ে গেল। বলল, ‘এখানে আর কিছু করার নেই মুসা ভাই?’
‘আপাতত নেই। গ্রেট বিয়ারের মধ্য এশীয় হেড কোয়ার্টার তাসখন্দে। ওখানেই আমাকে যেতে হবে। ওদের বেশি সময় দেয়া যাবে না আজিমভ।’
‘আমার এখন করণীয়?’
‘কয়েকটা বড় ঘটনা ঘটলো তো এখানে? তুমি দু’দিন পরে তাসখন্দে এস।’
আহমদ মুসা চুপ করল।
আজিমভও নিরব। আজিমভের কিছু বলার নেই। কষ্ট লাগছে আহমদ মুসার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হতে। তবু মুসা ভাই যা বলেছেন তার বাইরে কোন কথা নেই।
দু’জনেই নিরব।
নিরবে গাড়িও এগিয়ে চলছে সামনে।
সায়েজু থেকে কারসাপক এক ঘন্টার পথ। সন্ধ্যা পার হয়ে গেল কারসাপক পৌঁছতে।
কারসাপক শহর থেকে কারসাপক বিমান বন্দরের দূরত্ব প্রায় পাঁচ মাইল।
গাড়ি এয়ারপোর্ট রোডে পড়তে যাচ্ছে এমন সময় হঠাৎ আহমদ মুসা আজিমভকে গাড়ি দাঁড় করাতে বলল। গাড়ি দাঁড় করিয়ে বিস্মিত চোখে আজিমভ তাকাল আহমদ মুসার দিকে।
‘বাবা খান ষ্ট্রীট কোথায় কোনদিকে আজিমভ?’
‘শহরের একদম পূর্ব প্রান্তে পুরাতন অংশে। কেন?’
‘এয়ারপোর্ট থেকে যে গাড়ি নিয়ে আমি গ্রেট বিয়ারকে অনুসরণ করেছিলাম, তার মালিকের বাড়ি ঐ ষ্ট্রীটে। গাড়ি ঘুরাও, ওখানে যেতে হবে।’
‘কেন?’
‘ওর গাড়ি ওকে না বলেই নিয়ে গিয়েছিলাম। হারিয়ে গেছে গাড়িটা। তার সাথে বেচারার ব্লু বুক, লাইসেন্স সবই হারিয়ে গেছে। দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সে। ক্ষতিপুরণ আমাদের করা প্রয়োজন।’
‘বাড়ির নাম্বার আপনার কাছে আছে মুসা ভাই?’
‘হ্যাঁ আছে, ড্রাইভিং লাইসেন্স থেকে আমি ঠিকানাটা মুখস্ত রেখেছি।’
‘ঠিকানাটা আমাকে দিন মুসা ভাই। আমি তার সাথে দেখা করে ক্ষতিপূরণ ও লাইসেন্সের ব্যবস্থা করে দেব। আপনার যাওয়ার প্রয়োজন নেই।’
‘হ্যাঁ এটাও হতে পারে। তবে তোমাকে নিজে গিয়ে ক্ষতিপুরণ করে আমার পক্ষ থেকে তার কাছে মাফ চাইতে হবে। গাড়িটা পাওয়ায় আমাদের অশেষ উপকার হয়েছে, কিন্তু হয়তো অসীম ক্ষতি হয়েছে তার। তার পরিবারটা নিশ্চয় ঐ গাড়ির আয়েই চলতো। গাড়ি হারিয়ে তাদের কি অবস্থা হচ্ছে জানি না। তুমি আজই ফেরার পথে খোঁজ নিয়ে যাবে।’
‘ঠিক আছে মুসা ভাই।’
আবার গাড়ি চলতে শুরু করল।
নিরব চারদিক। সামনে দেখা যাচ্ছে এয়ারপোর্ট টার্মিনালের জ্বল জ্বলে আলো।
আহমদ মুসা ও আজিমভ দু’জনের দৃষ্টিই সামনে।
ছুটে চলেছে গাড়ি শিকারকে তাড়া করার মতো এক বেপরোয়া গতিতে।

বিশাল তাসখন্দ নগরী।
এই নগরীর জনারণ্যে গ্রেট বিয়ার তার মধ্য এশীয় হেডকোয়ার্টার স্থাপন করেছে। হেড কোয়ার্টারটি আসলে একটা বাস্তবায়ন কেন্দ্র মাত্র, পলিসি-প্রোগ্রাম আসে রাশিয়ার নতুন কেন্দ্র পিটার্সবার্গ থেকে। গ্রেট বিয়ারের আসল হেড কোয়ার্টার পিটার্সবার্গ। মস্কোর প্রকাশ্য হেডকোয়ার্টারটা তার ছায়ামাত্র। পিটার্সবার্গ ছিল জারের শাসন কেন্দ্র। এই কেন্দ্রকে ভিত্তি করেই রাশিয়ার নতুন রুশ জাতীয়তাবাদ বা জারতন্ত্র মাথা তুলেছে। এই জারতন্ত্রের লক্ষ্য হলো মধ্য এশিয়ার মুসলিম প্রজাতন্ত্র সহ সব সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের যাবতীয় অংগরাজ্যকে আবার হাতের মুঠোয় নিয়ে আসা। গ্রেট বিয়ারের মাধ্যমে এই লক্ষ্যেরই বাস্তবায়ন তৎপরতা শুরু হয়েছে মধ্য এশিয়ার মুসলিম প্রজাতন্ত্রে।
তাসখন্দের বিশাল জনারণ্যে গ্রেট বিয়ারের হেড কোয়ার্টার কোথায় খুঁজে পাবে আহমদ মুসা! গ্রেট বিয়ারের কাউকেই এ পর্যন্ত হাতের মুঠোয় পাওয়া যায়নি কিংবা পাওয়া যায়নি তাদের কাছ থেকে কোন কাগজপত্র, যা থেকে তাদের পরিকল্পনা বা ঠিকানার কোন সন্ধান পাওয়া যায়। এলেনা নোভাস্কায়া গ্রেট বিয়ারের সদস্য ছিল না তাই তার কাছ থেকে বেশি কিছু তথ্য পাওয়া যায়নি। যা সে বলেছিল তার একটি হলো, গ্রেট বিয়ারের প্রতিটি বাড়ির গেটে গ্রেট বিয়ারের মাথা উৎকীর্ণ করা থাকে। গেটের বাইরে দাঁড়িয়েই তা দেখা যায়। এলেনার এ তথ্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু তাসখন্দের ছয়-সাত লাখ বাড়ি সার্চ করা কি সম্ভব।
গোয়েন্দা বিভাগকে কাজে লাগানো হয়েছে। আজিমভ, যুবায়েরভ ও আবদুল্লায়েভ সহ তাদের লোকজন অর্থাৎ গোটা সামরিক বেসামরিক প্রশাসনের উপযুক্ত সবাইকে কাজে লাগানো হয়েছে, কিন্তু রেজাল্ট কিছুই পাওয়া যায়নি।
প্রেসিডেন্টের সিকুরিটি সেলের মিটিং কক্ষ।
এই সিকুরিটি সেলের প্রধান মধ্য এশিয়া প্রজাতন্ত্রের প্রেসিডেন্ট কুতায়বা বসে আছেন তার চেয়ারে। তার পাশেই আহমদ মুসা। আহমদ মুসার সামনে কুতায়বা প্রেসিডেন্টের চেয়ারে বসতে চায়নি। কিন্তু আহমদ মুসা তাকে জোর করে বসিয়েছে। বলেছে, চেয়ারটা তোমার নয়, প্রেসিডেন্টের। প্রেসিডেন্টকে সেখানে বসতেই হবে।
প্রেসিডেন্ট ও আহমদ মুসা ছাড়া কক্ষে উপস্থিত আছে সেনাবাহিনী প্রধানসহ তিন বাহিনীর চীফ, পুলিশ বাহিনীর চীফ, গোয়েন্দা বাহিনীর প্রধান, পার্লামেন্টের সিকুরিটি বিষয়ক কমিটির চেয়ারম্যান, স্বরাষ্ট্র সেক্রেটারী এবং প্রেসিডেন্টের প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা।
কথা বলছিলেন প্রেসিডেন্ট কুতায়বা।
সবারই শুকনো মুখ উদ্বেগে আচ্ছন্ন। প্রেসিডেন্টেরও। শুধু আহমদ মুসার মুখটাই ভাবনাহীন।
পরপর দু’টি দুঃসংবাদ এসেছে রাজধানীতে। তাজিকিস্তানের বখশ নদীর ‘বাইপাজিন পানি বিদ্যুৎ কেন্দ্র’ প্রচন্ড এক বিস্ফোরণে ধ্বংস হয়ে গেছে। এর পরেই খবর এল কাজাখস্তানের বিকোনুর উপগ্রহ উৎক্ষেপণ কেন্দ্রে বিস্ফোরণের পূর্ব মুহূর্তে দু’টি শক্তিশালী ডিনামাইট উদ্ধার করা গেছে। ডিনামাইট দু’টি বিস্ফোরিত হলে মহাশূন্য কেন্দ্রের ক্ষতি হতো। দু’টি ঘটনায় কাউকে গ্রেফতার করা যায়নি, এমনকি সন্দেহও করা যায়নি।
এসব ঘটনাসহ সামগ্রিক নিরাপত্তা বিষয় নিয়ে আলোচনার জন্যেই আজকের এই মিটিং।
প্রেসিডেন্ট বলছিলেন, ‘আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের হাজার শুকরিয়া, আহমদ মুসা ভাইকে তিনি যথা সময়ে আমাদের মাঝে পাঠিয়েছেন। তাঁর কাছ থেকেই আমরা জানতে পেরেছি, একটা ষড়যন্ত্রের কালোমেঘ আমাদের প্রিয় দেশকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছে। তিনি আসার আগে হিংসাত্মক যে ঘটনাগুলোকে আমরা আমাদের আভ্যন্তরীণ কোন ব্যাপার বলে মনে করেছি, তা যে বৈদেশিক ষড়যন্ত্র তা আপনারা সকলেই জেনেছেন। সে বৈদেশিক ষড়যন্ত্র এখন আরও ভয়ংকর রূপ নিয়ে আমাদের সামনে এসেছে। এর মোকাবিলা আমরা কিভাবে করতে পারি, তাই ছিল আজকের আলোচ্য বিষয়। দীর্ঘক্ষণ ধরে এ বিষয় নিয়ে আমরা আলোচনা করেছি। এখন আলোচনার উপসংহার টানার জন্যে আমি আহমদ মুসা ভাইকেই অনুরোধ করছি।
সবাইকে দীর্ঘ আলোচনা ও মতামত প্রকাশের জন্যে মোবারকবাদ জানিয়ে আহমদ মুসা শুরু করল, ‘আমরা পরিস্থিতিকে যতটুকু গুরুতর মনে করছি, প্রকৃত অবস্থা তার চেয়েও গুরুতর। রাশিয়ার ‘গ্রেট বিয়ার’ সংগঠন সেখানকার সরকারের চেয়েও সম্ভবত শক্তিশালী এবং সমৃদ্ধ সবদিক থেকে। সেখানকার শাসক মহলের কারো সাহায্য-সহযোগিতা ছাড়া এমনটা হয়নি। গ্রেট বিয়ার আমাদের বিজ্ঞানী ও বিজ্ঞান গবেষণাগার ধ্বংস করে বুদ্ধি-বৃত্তিকভাবে আমাদের পংগু করতে চায়। বিশেষ করে একটি মুসলিম রাষ্ট্র বৈধভাবে যে পারমাণবিক শক্তির মালিক হয়েছে তার বিলোপ ঘটাতে চায়। ওরা আমাদের পানি-বিদ্যুৎ কেন্দ্র, বাঁধ ও সেচ-প্রকল্প, শস্য খেত, ইত্যাদি অর্থনৈতিক শক্তির উৎস ধ্বংস করে আমাদেরকে অন্যের করুণা-নির্ভর করতে চায়। ওরা আমাদের রাজনৈতিক নেতাদের হত্যা করে দেশে নেতৃত্বের সংকট সৃষ্টি করতে চায়। এরই পাশাপাশি ওরা জাতীয়বাদী হয়ে উঠা সাবেক কম্যুনিষ্ট এবং রুশ বংশোদ্ভুতদের একত্রিত করে পাল্টা একটা রাজনৈতিক শক্তি সৃষ্টি করতে চায়, যারা মীরজাফরের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে দেশকে রাশিয়ার নতুন জারদের হাতে তুলে দেবে।’
আহমদ মুসা একটু থেমে আবার শুরু করল, ‘ওদের ষড়যন্ত্রের এইরূপ দেখে হতাশ হবার কিছু নেই। সব পরিকল্পনার বড় পরিকল্পনা আল্লাহর। তিনিই আমাদের ভরসা।’
থামল আহমদ মুসা। কয়েক ঢোক পানি খেল। তারপর শুরু করল আবার, ‘সকলের সাথে আমি একমত তাজিকিস্তানের বখশ নদীর রুগুন ও নুরেক পানি বিদ্যুৎ কেন্দ্র, কিরগিজস্তানের চু-উপত্যকার বিশাল সেচ প্রকল্প , কাজাখস্তানের আণবিক গবেষণা ও মহাশুন্য কেন্দ্রসহ দেশের সকল অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানে সার্বক্ষণিক প্রহরা-ব্যবস্থাকে আরও শক্তশালী ও নিশ্চিদ্র করতে হবে। আমাকে বেকোনুর-এর রকেট সংরক্ষণাগার ও উৎক্ষেপণ কেন্দ্রে যেতে বলা হয়েছে, আমার আপত্তি নেই। তবে আমি মনে করি ষড়যন্ত্রের শাখা-প্রশাখা ভেঙে লাভ নেই, কারণ তা আবার গজাবে। হাত দিতে হবে ষড়যন্ত্রের গোড়ায়, হাত করতে হবে ওদের পরিকল্পনা, এ্যাকশনপ্লান ইত্যাদি। ঘা দিতে হবে ষড়যন্ত্রের শীর্ষ দেশে যারা আছে তাদের। তাহলেই শুধু ষড়যন্ত্র মুখ থুবড়ে পড়বে।’
আহমদ মুসা একটু থামতেই প্রেসিডেন্ট কুতায়বা কথা বলে উঠল, ‘আমি মনে করি মুসা ভাই ঠিক বলেছেন । আমাদের মত শুধু আমরা পেশ করেছি। তাঁর পরিকল্পনাই আমাদের পরিকল্পনা।’
মিটিং-এর সবাই একযোগে প্রেসিডেন্টকে সমর্থন করল।
আহমদ মুসা আবার শুরু করল, ‘আমরা তো ওদের ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করে দেবার চেষ্টা করছিই, এছাড়া ওদের দূরভিসন্ধির বিষয়টা বিশ্ববাসীর কাছে ফাঁস করে দিতে হবে। যে কথা আমি আগেই বলেছি, ওরা আমাদের শস্য খেত ও পশু সম্পদ ধ্বংস করার জন্যে যে ধীর ক্রিয়া সম্পন্ন তেজস্ক্রিয় বিষ ছড়াচ্ছে তা বিশ্ববাসীকে জানাতে হবে। সংশ্লিষ্ট অঞ্চল থেকে আক্রান্ত শস্য ও পশুর নমুনা পরীক্ষার জন্যে যদিও পাঠানো হয়েছে জেনেভাস্থ আন্তর্জাতিক আনবিক শক্তি কমিশনের ‘তেজস্ক্রিয় চিহ্নিতকরণ ল্যাবরেটরী’তে, কিন্তু আমাদেরকে প্রমাণ করতে হবে যে এ তেজস্ক্রিয়-বিষ ছড়াবার জন্যে রাশিয়ার গ্রেট বিয়ার দায়ী। এটা প্রমাণ করার মত দলিল আমাদের হাতে নেই। আমরা যদি ওদের গোপন অস্ত্র সসার প্লেন হাতে-নাতে ধরতে না পারি, তাহলে আর কোন প্রমাণে কাজ হবে না। সুতরাং গোপন অভিযানে আসা রাশিয়ার সসার প্লেন একটা আমাদের ধরতে হবে।’
‘সসার প্লেন বা ঐ ফ্লাইং সসারের যে বিবরণ আপনার কাছ থেকে শুনেছি, তাতে ঐ ফ্লাইং সসারকে ধরা বা অনুসরণ করার মত টেকনোলজি তো আমাদের নেই।’ বলল গোয়েন্দা প্রধান আজিমভ।
‘ঠিক, টেকনোলজি আমাদের নেই। কিন্তু এই অভাবকে পূরণ করতে হবে আমাদের চেষ্টা দিয়ে।’ বলল আহমদ মুসা।
‘গ্রেট বিয়ার আমাদের কাছে আজ ঠিকানা বিহীন, পরিচয় বিহীন, তাই ওদের গায়ে আমরা হাত দিতে পারছি না। ওদের সসার-প্লেনের ব্যাপারটা আমাদের আওতার আরও বাইরে। চেষ্টা আমাদের কি ধরনের হবে।’ বলল সেনাবাহিনী প্রধান ওমর আলী সিদ্দিকভ।
‘ওদের সসার প্লেন সম্পর্কে আমরা কয়েকটা বিষয় জানি। যেমন, এক, সসার প্লেনের সর্বোচ্চ গতিবেগ দশ হাজার মাইল। দুই, প্রয়োজনে প্লেনটি মাটির দু’তিন গজ ওপর দিয়েও চলতে পারে। তিন, প্লেনটি আসে মস্কো যথা পিটার্সবার্গ থেকে। এই বিষয়গুলো আরও কয়েকটি বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহনে আমাদের সাহায্য করবে। যেমন, এক, যেহেতু প্লেনটি অতি দ্রুতগামী, তাই সাধারণভাবে মাটি থেকে নিরাপদ উচ্চতা দিয়ে আসতে পছন্দ করে, দুই, প্লেনটি যত মাটির কাছাকাছি আসে ততই তার গতি কমে যায়, তিন, প্লেনটি যতক্ষণ রুশ আকাশ সীমায় থাকে, ততক্ষণ অনেক উচ্চতা দিয়ে অত্যন্ত দ্রুত আসে, চার, যখন আমাদের আকাশ সীমায় আসে তখন রাডারকে ফাঁকি দেবার জন্যে নীচে নেমে আসে এবং তার গতি নেমে আসে সাধারণ পর্যায়ে, পাঁচ,নীচে নেমে আসার কারণে সে গতিপথে সাধারণভাবে জনপদ ও পার্বত্য এলাকা এড়িয়ে চলতে চাই, ছয়, প্লেনটি যতটা বেশি সম্ভব রুশ এলাকার ওপর দিয়ে আসে, তারপর প্রবেশ করে আমাদের এলাকায়। উপরোক্ত বিষয়গুলো সামনে রাখলে চেষ্টা করার একটা পথ আমাদের সামনে উন্মুক্ত হয়।’
বলে আহমদ মুসা উঠে পেন্সিল নিয়ে দেয়ালে সেট করা বোর্ডের সামনে গিয়ে দাঁড়াল।
বোর্ডে আহমদ মুসা মধ্য এশিয়া মুসলিম প্রজাতন্ত্রের পশ্চিম-উত্তর সীমান্ত অংকন করল। তারপর বলল, ‘মস্কো ও পিটার্সবার্গ এলাকা থেকে আমাদের দেশে ওদের টার্গেট এলাকায় প্রবেশের এটাই সোজা পথ। এই পথের মধ্যে আবার রাশিয়ার ‘ওরস্ক’ এলাকা আমাদের সবচেয়ে নিকটবর্তী। আরেকটা বিষয় লক্ষ্যণীয়। এই ‘ওরস্ক’ এলাকা থেকে আমাদের দেশে ওদের টার্গেট এলাকা কাজাখস্তানের কারসাপক থেকে দক্ষিণ উজবেক-তাজিক সীমান্তের আমুদরিয়া পর্যন্ত হাজার হাজার বর্গমাইল এলাকা একদম অবারিত। সুতরাং এ এলাকার মধ্য দিয়ে যথেষ্ট গতি নিয়েই সসার প্লেন উজবেক, তাজিক, কিরঘিজ ও কাজাখস্তানের টার্গেট এলাকায় প্রবেশ করতে পারে। সুতরাং ‘ওরস্ক’ এলাকার মোটামুটি এক’শ মাইল সীমান্তকে সন্দেহপূর্ণ বলে আমরা চিহ্নিত করতে পারি।’
থামল আহমদ মুসা।
সকলে গোগ্রাসে যেন গিলছিল আহমদ মুসার কথা। উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে সকলের চোখ-মুখ।
‘তারপর।’ বলল প্রেসিডেন্ট কুতায়বা।
‘এই এক’শ মাইল সীমান্তে আমাদের পাহারা বসাতে হবে। ‘লো আলটিচূড রাডার’ বসাতে হবে তিনটি পর্যায়ে। প্রথম সারিটি সীমান্ত বরাবর, দ্বিতীয় সারি পঞ্চাশ মাইল ভেতরে এবং তৃতীয় সারি সেখান থেকে আরও এক’শ মাইল ভেতরে। এই রাডার গুলোর ছবি প্রমাণ করবে সসার-প্লেন রাশিয়া থেকে মধ্য এশিয়ায় প্রবেশ করেছে। এটা হবে আমাদের প্রথম প্রমাণ। এই রাডার- ফটো নেয়ার কাজ শেষ হবার পর আমাদের দ্বিতীয় পদক্ষেপ শুরু হবে। এই দ্বিতীয় পদক্ষেপে আমরা রাশিয়ার ওরস্ক সীমান্ত থেকে এক’শ মাইল ভেতর বরাবর সীমান্তের সমান্তরালে এক’শ মাইল এলাকাকে চারটি লেসার জোনে বিভক্ত করবো। প্রতিটি লেসার জোনকে আমরা ‘লেসার বীম ব্যাটারী’ সাজিয়ে একটা বৃত্তে পরিণত করবো। সসার-প্লেন এই বৃত্তে প্রবেশের সংগে সংগেই রাডারের সংকেত অনুসরণে লেসার বীম ব্যাটারী চালু করা হবে। তার ফলে তৈরী হবে লেসার-বীমের দেয়াল ঘেরা লেসার বীমের একটা পিরামিড। সসার-প্লেন লেসার বীমের দেয়াল অতিক্রম করতে পারবে না। চেষ্টা ধ্বংস হবে। সুতরাং সসার-প্লেন আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হবে। আর যদি পালাতে চেষ্টা করেই, তাহলে ধ্বংসপ্রাপ্ত সসার-প্লেনের ধ্বংসাবশেষও সাক্ষী হিসাবে আমাদের কাজে লাগবে।’
থামল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসা থামার সাথে সাথে প্রেসিডেন্ট কুতায়বা সহ উপস্থিত সকলেই ‘আল্লাহু আকবর’ ধ্বনি দিয়ে উঠল। তাদের সকলের মুখ হাসিতে উজ্জ্বল।
‘আল হামদুলিল্লাহ, আল্লাহ আপনাকে দীর্ঘজীবী করুন মুসা ভাই। উপায়হীন অন্ধকারেও আপনি আলোর মশাল জ্বালাতে পারেন। সসার-প্লেনের বৈশিষ্ট্য আমাদের সামনেও ছিল, কিন্তু আমরা তা নিয়ে চিন্তা করতে পারিনি। এখন মনে হচ্ছে, আল্লাহ আমাদের জন্যে একটা পথ করেই রেখেছেন যা আপনি আবিষ্কার করে দিলেন।’ বলল প্রেসিডেন্ট কুতায়বা।
‘মুসা ভাই, চারটি লেসার জোনকে নিয়ে যে বৃত্ত হচ্ছে সীমান্তের সমান্তরালে তার প্রতিটির ব্যাস হতে হবে পঁচিশ মাইল এবং সীমান্ত থেকে লম্বাভাবে ব্যাস হবে পঞ্চাশ মাইল, তাইতো?’’ বলল আজিমভ।
‘লেসার জোন মোট চারটা নয়, আটটা হবে। প্রস্তাবিত তিনটি রাডার লাইনের মধ্যবর্তী স্থান দু’টি এলাকায় বিভক্ত হচ্ছে। প্রতিটি এলাকাকে চারটি লেসার জোনে বিভক্ত করতে হবে। সীমান্তের পর প্রথম যে এলাকা তার চারটি জোনের পরিধি তুমি বলেছ তাই হবে, কিন্তু পরবর্তী যে এলাকা তার চারটি জোনের প্রতিটির ব্যাস সীমান্তের সমান্তরালে পঁচিশ মাইল হবে, কিন্তু সীমান্ত থেকে লম্বের দিক দিয়ে ব্যাস এক’শ মাইল হবে। আসল কথা হলো, আটটি লেসার জোনের মধ্যে এলাকার প্রতিটি ইঞ্চি জমি পড়তে হবে, এতে করে লেসার জোন বৃত্ত না হয়ে যদি বর্গক্ষেত্র হয় তাই করতে হবে।’
বলতে বলতে আহমদ মুসা এসে তার চেয়ারে বসল।
‘আহমদ মুসা ভাই যে পরিকল্পনা দিয়েছেন, তা বাস্তবায়নের কাজ দেখাশুনার দায়িত্ব আহমদ মুসা ভাইয়ের নেয়া উচিত বলে আমি মনে করি।’ বলল প্রেসিডেন্ট কুতায়বা।
‘না, কুতায়বা। আমি ওদিকে গেলে গ্রেট বিয়ার ও তার ষড়যন্ত্র খুঁজে বের করার আসল কাজ আমি করতে পারবো না। ঐ দায়িত্ব তুমি অন্যদের দাও।’
‘আপনি প্রস্তাব করুন। আমার চেয়ে আপনি ভাল জানেন।’ বলল প্রেসিডেন্ট।
‘আজিমভের নেতৃত্বে সেনাবাহিনী প্রধানসহ তিন বাহিনীর প্রধানকে সদস্য করে একটা কমিটি করে দাও।’ বলল আহমদ মুসা।
‘আল হামদুলিল্লাহ, মুসা ভাইয়ের প্রস্তাবিত কমিটি গঠিত হলো।’ বলল প্রেসিডেন্ট কুতায়বা।
‘মেনে নিচ্ছি, কিন্তু একটা শর্ত, আহমদ মুসা ভাই এই কমিটির উপদেষ্টা হবেন।’ বলল আজিমভ।
উপস্থিত সবাই একবাক্যে সমর্থন করল।
‘দায়িত্ব ছাড়া উপদেষ্টা হতে আমি মোটেই গররাজি নই।’ মুখে হাসি টেনে বলল আহমদ মুসা।
একটু থেমেই আহমদ মুসা আবার মুখ খুলল। বলল, ‘উপদেষ্টার কাজ শুরু করেই, আমার প্রথম উপদেশ হলো, উল্লেখিত এলাকায় লো আলটিচুড রাডার সেট করা এবং লেসার বীম ব্যাটারী বসানোর কাজ উপযুক্ত ক্যামোফ্লেজের অধীনে করতে হবে যাতে করে রাশিয়ার উপগ্রহের চোখ কোন কিছু সন্দেহ করতে না পারে। এই সাথে ওদের গোয়েন্দাদের চোখ থেকেও সব কিছু আড়াল রাখতে হবে। এই গোপনীয়তা রক্ষা আমাদের সাফল্যের প্রথম শর্ত।’
‘আল হামদুলিল্লাহ। আমাদের কমিটির কাজ শুরু হয়ে গেল। আমি আমাদের মধ্যে সবচেয়ে বয়োকনিষ্ঠ বিমান বাহিনী প্রধান আহমদ নুরভকে এই কমিটির মেম্বার-সেক্রেটারী নিয়োগ করছি এবং তাকে অনুরোধ করছি আহমদ মুসা ভাইয়ের এই পরামর্শ লিখে নেয়ার জন্যে।’ গম্ভীর কণ্ঠে বলল আজিমভ।
‘আমার ধর্ম, আমার জাতি, আমার দেশের জন্যে এই দায়িত্ব পালনের সুযোগ পাওয়ায় আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করছি।’ বলে বুদ্ধি ও তারুণ্য শক্তিতে উজ্জ্বল আহমদ নুরভ কাগজ টেনে নিয়ে লিখতে শুরু করল।
প্রেসিডেন্ট কুতায়বা আহমদ মুসার দিকে একটু ঝুঁকে ফিস ফিস করে কয়েকটা কথা বলে নিয়ে বলল, ‘আমি নতুন কমিটিকে স্বাগত জানাচ্ছি। সবাইকে ধন্যবাদ। আজকের মত আলোচনা এখানেই শেষ। আল্লাহ আমাদের সহায় হোন।’

Top