১৬. মধ্য এশিয়ায় কালো মেঘ

চ্যাপ্টার

একটা রিভলভিং চেয়ারে গা এলিয়ে দিয়েছে আলেকজান্ডার পিটার। তার চোখ দু’টি বুজা, কিন্তু কপাল কুঞ্চিত। বোঝা যাচ্ছে গভীর চিন্তায় নিমগ্ন সে।
পিটার গ্রেট বিয়ারের মধ্য এশীয় চীফ।
পায়ের শব্দে চোখ খুলল আলেকজান্ডার পিটার।
দীর্ঘ ও সুগঠিত শরীরের একজন লোক এগিয়ে আসছে টেবিলের দিকে।
‘রিপোর্টটা এনেছ উস্তিনভ?’
উস্তিনভ পিটারের সহকারী।
‘হ্যাঁ।’ বলে উস্তিনভ একটি কাগজ তুলে দিল পিটারের হাতে।
সোজা হয়ে বসল পিটার।
কারসাপক ও সায়েজুর ঘটনার ওপর রিপোর্ট পাঠিয়েছে আলেক্সি স্ট্যালিন কারসাপক থেকে।
রিপোর্টে চোখ বুলিয়ে তাকাল উস্তিনভের দিকে। চোখে যেন আগুন জ্বলছে পিটারের। বলল, ‘আহমদ মুসাকে ওরা চিনতে পারলো না কেন? কেন ওকে বিনা প্রহরায় চিলেকোঠায় বন্দী করে রাখল? আহমদ মুসার ছবি ওদের কাছে ছিল না?’
‘ছিল, কিন্তু রাতের বেলা ওরা খেয়াল করতে পারেনি।’ বলর উস্তিনভ।
‘শোন এ ধরনের কোন ভুলের সুযোগ গ্রেট বিয়ারের আন্দোলনে নেই। ওদের প্রত্যাহার করে আটক করতে বল। পরবর্তী নির্দেশ আমি পাঠাচ্ছি।’
‘ঠিক আছে কিন্তু আহমদ মুসা তো আলেক্সি স্ট্যালিনের বন্দীখানা থেকেও পালিয়েছে।’
‘তা পালিয়েছে। কিন্তু আহমদ মুসাকে সাহায্যকারী নিজ কন্যা এলেনাকে তো আলেক্সি ছাড়েনি। প্রায়শ্চিত্ত হিসাবে জীবন দিতে হয়েছে এলেনাকে।’
একটু থামল। নড়ে-চড়ে বসল। তারপর আবার বলর পিটার, ‘কিন্তু আমি বুঝতে পারছিনা আহমদ মুসা আমিনভ ও ইয়াসিনভের সন্ধান পেল কি করে? আবু আমিনভের রুশ স্ত্রী যদি এর কারণ হয়, তাহলে ইয়াসিনভ ধরা পড়ল কেন?’
‘রিপোর্ট তো আছেই, একই সাথে ওদের প্রমোশন ও ট্রান্সফার দেখে আহমদ মুসা ওকে সন্দেহ করে।’
‘এই আহমদ মুসা লোকটার চোখ এত তীক্ষ্ণ?’
‘যেমন চোখ তীক্ষ্ণ, তেমনি অদ্ভুত ক্ষীপ্র ও কুশলীও।’
‘লজ্জা করছে না এই প্রশস্তি গাইতে, সে সোনা খায়, আর তোমরা বুঝি গোবর খাও?’
‘শত্রুকে শক্তিশালী বলা নিজেকে দুর্বল ভাবা নয়।’
‘ধন্যবাদ উস্তিনভ। পারবে এবার আহমদ মুসার লীলা খেলা সাঙ্গ করতে?’
‘চেষ্টা তো করবোই।’
‘চেষ্টা করা নয়, সফল হতে হবে।কি মেসেজ এসেছে জান?’
‘কি মেসেজ?’ আগ্রহ ফুটে উঠল উস্তিনভের চোখে-মুখে।
‘আজ মস্কো থেকে জানানো হয়েছে গ্রেট বিয়ারের হত্যা-লিস্টের অগ্রাধিকার তালিকায় আহমদ মুসাকে শামিল করা হয়েছে। সময় দেয়া হচ্ছে পনের দিন।’
‘আহমদ মুসা তো এখন তাসখন্দেই।’
‘তাসখন্দেই বটে, তবে এখনও তার দেখা পাওয়া যায়নি।’
‘তাসখন্দে তার বাড়ি নেই। স্টেট গেষ্ট হাউজ কিংবা কোন সরকারী রেস্ট হাউজেই তার থাকার কথা।’
‘কি যে বল তুমি। তার বাড়ি নেই তো কি হয়েছে। তাসখন্দের যে কোন মুসলিম বাড়িই তার বাড়ি। তাকে গেস্ট হাউজ বা রেস্ট হাউজে থাকতে হবে কেন?’
‘তার ঠিকানা খুজে পাওয়া মুশকিল হবে তাহলে।’
‘প্রেসিডেন্ট হাউজে পাহারা বসাও। ওখানে সে নিয়মিত আসেই।’
‘প্রেসিডেন্ট হাউজের যতটা নিকটে পাহারা বসালে কাজ হবে ততটা নিকটে পাহারা বসানো যায় না। চেষ্টা করলে ধরা পড়তে হবে। আর দূরে পাহারা বসিয়ে লাভ নেই। গাড়িতে কে যাচ্ছে কে আসছে কিছুই বুঝা যায় না।’
কোন জবাব না দিয়ে ড্রয়ার থেকে একটা কাগজের সিট বের করে বলল, ‘তোমার দৌড় বুঝা গেছে। এই কাগজটার ওপর নজর দাও। এতে বিজ্ঞানী ও রাজনীতিকদের নাম আছে এবং আরো আছে কতকগুলো অর্থনৈতিক প্রকল্পের নাম। অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে সাজানো আছে তারিখ সহ।’
উস্তিনভ কাগজটির ওপর চোখ বুলাল ধীরে ধীরে। তারপর চোখ তুললো কাগজ থেকে।
‘মুখস্থ কর। দশ মিনিট পরে আমাকে ফেরত দেবে। বুঝেছো এটা কি?’
‘আমাদের পরিকল্পনার প্রথম পর্যায়ে হত্যা ও ধ্বংস টার্গেটের তালিকা।’
‘ঠিক আছে। কিন্তু সায়েজুর আণবিক ও মহাশূণ্য গবেষণা কেন্দ্রে হাত দেয়া যাবে কিভাবে? ধারে কাছেও ঘেষা যাচ্ছে না।’
‘কা-পুরুষের মত কথা বলো না। গ্রেট বিয়ার শুধু সামনেই এগোয়, পিছু হটে না। যদি ঘেষতে আমরা না পারি, তাহলে সসার- প্লেন থেকে ওখানে আমরা ডিনামাইট বোমা ফেলব এবং ও দু’টি গবেষণা কেন্দ্র ধ্বংস আমরা করবোই।’
‘সসার-প্লেন দিয়েই তো আমরা এসব গবেষণা কেন্দ্র, বাঁধ, পানি-বিদ্যুৎ কেন্দ্র, ইত্যাদি সহজে এবং একরাতেই ধ্বংস করে ফেলতে পারি, কিন্তু আমরা তা করছি না কেন?’
‘তা পারি। কিন্তু আমাদের গোপন অস্ত্র সসার-প্লেন বিশ্বের সবার কাছ থেকে মস্কো গোপন রাখতে চায়। শস্য ও পশু সম্পদের ওপর রেডিয়েশন স্প্রে করার মত যেসব কাজ অন্য কোনভাবে সম্ভব নয়, সেকাজেই শুধু সসার-প্লেন ব্যবহার করা হচ্ছে। তাছাড়া এ কাজটা অনেকটা নিরাপদ। কিন্তু বাঁধ,পানি বিদ্যুৎ কেন্দ্র ইত্যাদি ছোট ও নির্দিষ্ট টার্গেট ধ্বংস করতে হলে সসার-প্লেনকে এতটা নীচে নেমে আসতে হয় যে তা সকলেরই নজরে পড়বে এবং অবশ্যই তা আক্রান্ত হবে।’
‘কিন্তু এই সব আক্রমণ কি সসার-প্লেনের ক্ষতি করতে পারবে?’
‘মানুষ কিংবা কোন বস্তু যতই শক্তিশালী হোক না কেন, তার একটা দূর্বল দিক থাকেই। সসার-প্লেনও দূর্বলতার উর্ধ্বে নয়। সসার-প্লেনের চারদিকের রাডার চোখগুলো খুবই সেনসিটিভ। এ চোখের ওপর আঘাত পড়লে মাস্টার কনট্রোল বিকল হয়ে পাকা ফলের মত সসার-প্লেন ভূমি শয্যা নিতে পারে।’
উস্তিনভ কিছু বলতে যাচ্ছিল। এমন সময় আলেকজান্ডার পিটারের ইন্টারকম কথা বলে উঠল। প্রাইভেট সেক্রেটারী মেয়েটার গলা। বলল, ‘স্যার ফিল্ডার এসেছে,মেসেজ আছে।’
‘ফিল্ডার’ গ্রেট বিয়ারের তৃণমুল পর্যায়ের কর্মী। তথ্য যোগাড়, শত্রুকে অনুসরণ, স্যাবেটাজ ওয়ার্ক ইত্যাদি সহ খুন-জখম সব কিছুতেই এরা পটু।
‘তাড়াতাড়ি আসতে বল।’ নির্দেশ দিল পিটার।
কয়েক মুহূর্ত পরেই ঘরে ঢুকলো এক যুবক। চেহারাটা না রুশ না তুর্কি। সম্ভবত কোন রুশ পিতা অথবা রুশ মাতার সন্তান সে।
‘কি খবর এনেছো, ভাল খবর?’ ভ্রু-কুচকে জিজ্ঞাসা করল পিটার।
‘আহমদ মুসা থাকছেন প্রেসিডেন্ট হাউজে-প্রেসিডেন্টের অতিথি হিসাবে। তিনি কখন বের হন, কখন ফেরেন কেউ বলতে পারে না।’ বলল যুবকটি।
‘তুমি কার কাছে জানলে এ তথ্য?’ বলল পিটার।
‘একজন হকার সেজে গিয়ে প্রেসিডেন্ট হাউজের সামনের রাস্তায় প্রহরায় দাঁড়ানো একজন পুলিশকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম।’
‘আহমদ মুসা কখন বের হয় কখন ফিরে আসে একথা সেখানকার প্রহরী পুলিশ জানবে না কেন?’
‘প্রেসিডেন্ট ও মন্ত্রীদের আসা-যাওয়া তারা জানতে পারে। কারণ তাদের সাথে পুলিশ পাহারা থাকে, গাড়িতে পতাকা থাকে। কিন্তু আহমদ মুসার এসব কিছুই থাকে না। তিনি একা চলাফেরা করেন। এমন গাড়ি অহরহই প্রেসিডেন্ট হাউজে আসছে যাচ্ছে। বুঝা যাবে কি করে যে, আহমদ মুসার গাড়ি কোনটি। তার ওপর অধিকাংশ গাড়িরই এখন শেড দেয়া কাঁচ।’
‘গেটের ভেতরের প্রহরীদের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করতে হবে, সেটার কতদূর?’ পিটারের কণ্ঠ কঠোর শুনালো।
‘আমি সে চেষ্টা করছি। আমি প্রহরী পুলিশকে অনুসরণ করে তার বাড়িতে গিয়েছি। আমি তাকে সিগারেট ও মদ উপহার দিয়ে বিপদে পড়েছিলাম। ওগুলো সে তো নষ্ট করলই উপরন্তু আমাকে প্রায় গ্রেপ্তার করেই ফেলেছিল। আমি বহু অনুনয় বিনয় করে ছাড়া পেয়েছি এই শর্তে যে, এ ধরণের কাজ আর কখনো করব না।’
‘বেশ করেছো, শুধু শর্ত দেয়া কেন, তার পদসেবায় লেগে যেতে পারতে। গর্দভ, মদ দিতে মুসলমানরা মদ খায়না, যারা খেতো তারাও এখন ছেড়ে দিয়েছে। কেন,টাকার অভাব ছিল? দশ হাজার, বিশ লাখ—-একজন পুলিশকে কিনতে কত লাগে?’
‘আমরা সে চেষ্টাও করেছি স্যার। হকারের ছদ্মবেশে আরেকজন পুলিশ অফিসারের সাথে সম্পর্ক গড়ে তুলেছলাম এবং আমাকে পুলিশের চাকুরী জুটিয়ে দেয়ার ব্যাপারে তাকে অনুরোধ করেছিলাম। এই বাহানায় তদ্বীরের খরচা-পাতি হিসাবে আমি তাকে পঞ্চাশ হাজার টাকা দেয়ার প্রস্তাব করেছিলাম এবং টাকা বেরও করেছিলাম ব্যাগ থেকে। আমার প্রস্তাব শুনেই সে আগুন হয়ে গিয়েছিল। বলেছিল যে, আমি গরীব হকার না হলে আমাকে গ্রেপ্তার করে জেলে পুরতো। আরও বলেছিল, যে ঘুষ দেয়ার মত অসৎ তার চাকুরী পুলিশ বিভাগে তো নয়ই, কোন চাকুরী পাওয়ারই সে উপযুক্ত নয়। বলে দিয়েছে সে, আমি যদি আর কখনও তার কাছে যাই তাহলে গ্রেপ্তার করবে।’
‘এ পুলিশ দু’জনের বাসা তো তুমি চেন। ক’জনকে নিয়ে ওদের দু’জনকেই ধরে আন। দেখি ওরা নীতি কথা কত জানে।’ পিটারের চোখে জ্বলছে ঘৃণার আগুন।
‘স্যার দু’দিন থেকে ওদের ডিউটিতে দেখছিনা। তাদের বাড়িও সে জায়গায় আর নেই।’ মুখ কাঁচু-মাচু করে বলল যুবকটি।
‘কি বলছ তুমি? হাওয়া হয়ে গেল তারা?’
‘ওদের প্রতিবেশীদের জিজ্ঞাসা করেও কিছু জানতে পারিনি। সম্ভবত ওরা অন্যত্র বদলী হয়েছে।’
‘জাহান্নামে যাক। যাও তুমি।’
বেরিয়ে গেল ফিল্ডার যুবকটি মাথা নিচু করে।
‘এই তো হল তোমাদের লোকদের যোগ্যতা।’
‘আমাদের যোগ্যতার দোষ নেই। ও সত্যি বলেছে। আগে পুলিশের পেট থেকে কথা বের করতে বিশ পঞ্চাশ রুবলের বেশি দরকার হতো না। কিন্তু এখন সে রুবল আর কোন কাজ দিচ্ছে না ,পঞ্চাশের বদলে পঞ্চাশ হাজারও নয়, লাখও নয়।’
‘অপদার্থের মত কথা বলোনা। বলতে চাও রাতারাতি সব মানুষ ফেরেশতা হয়ে গেছে?’
‘এই প্রশ্ন আমি ওদের একজন সরকারী অফিসারকে করেছিলাম। জবাব দিয়েছিল, ফেরেশতা নয় তারা মানুষ হয়েছে।’
‘এই গল্প বলে ওরা ছাড়া আর সবাইকে পশু বলতে চাচ্ছ তুমি?’
‘তা বলছি না, কিন্তু ওই মানুষদের উচিত শিক্ষা দেবার জন্যে আজ পশু সাজার প্রয়োজন আছে।’
‘ব্রাভো, ব্রাভো, তুমি এতক্ষণে আমার সহকারীর যোগ্য একটা কথা বলেছ।’ বলে উঠে দাঁড়াল পিটার।
উঠে দাঁড়াল উস্তিনভও।
ঘর থেকে বেরুতে বেরুতে পিটার বলল, ‘মনে আছে তো সময় পনের দিন। এই সময়ের মধ্যে আহমদ মুসাকে খুঁজে বের করতে হবে এবং—–’
‘বলতে হবে না, আমি জানি।’
‘জান কিন্তু ওকে পাওয়ার কি হবে?’
‘আমি ঠিক করে ফেলেছি?’
‘কি ঠিক করেছো?’
‘আমাদের একজন ফিল্ডার প্রেসিডেন্ট ভবনে গোপনে ঢুকতে গিয়ে ধরা পড়বে। জিজ্ঞাসাবাদের সময় বলে দেবে গ্রেট বিয়ারের হেডকোয়ার্টারের মিথ্যা ঠিকানা। আহমদ মুসা অবশ্যই অভিযানে আসবে। আর আমাদের পাতা ফাঁদে ধরা পড়বে।’
পিটার দাঁড়াল। বলল, ‘তোমার পরিকল্পনায় যুক্তি আছে, কিন্তু সে ঠিকানা আহমদ মুসা বিশ্বাস করবে মনে কর?’
‘বিশ্বাস না করলে আরও সুবিধা। যাচাই করার জন্যে সে নিজেই সন্ধানে আসবে।’
পিটার উস্তিনভের পিট চাপড়ে বলল, ‘সাবাস উস্তিনভ। পথ একটা বের করেছো। তোমার পরিকল্পনার কাজ কবে শুরু করছো?’
‘আরও দু’একটা দিন দেখার পরে।’
‘কি দেখবে?’
‘একটা লোককে ওদের হাতে তুলে দেবার আগে আরও কটা দিন দেখবো।’
‘নেতার মত কথা বলেছো উস্তিনভ। তুমি সফল হও।’
বলে পিটার করিডোর দিয়ে তিন তলার সিঁড়ির দিকে হাটতে শুরু করল।
আর উস্তিনভ হাঁটতে শুরু করল এক তলায় নামার সিঁড়ির দিকে।

ঘুরে ঘুরে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে আহমদ মুসা। দু’হাতে স্টিয়ারিং রেখে গা এলিয়ে দিয়েছে আহমদ মুসা সিটে। গাড়ির শেড দেয়া জানালা নামিয়ে রাখা। দুই জানালাই। ইচ্ছা করেই আহমদ মুসা জানালা খুলে দিয়েছে। তার ইচ্ছা সে গ্রেট বিয়ারের নজরে পড়ুক। আহমদ মুসারা গ্রেট বিয়ারকে খুঁজে পাচ্ছে না, গ্রেট বিয়ার যদি আহমদ মুসাকে খুঁজে পায়, তাহলে ওদের কাছে পৌঁছার একটা পথ হয়। ভাবছে আহমদ মুসা, গোটা শহরে তার আরো বেশি খোলা মেলা বেড়াতে হবে, যাতে নজরে পড়া সহজ হয়। হঠাৎ আহমদ মুসার মনে পড়ল, গ্রেট বিয়ারের নজরে পড়ার আরেকটা বড় উপায় হলো, বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়া এবং সেই খবর পত্রিকায় প্রকাশ পাওয়া। জনসমাবেশের মত কার্যক্রমে সে যোগদান করতে শুরু করলে দু’এক দিনের মধ্যেই গ্রেট বিয়ারের নজরে পড়বে। গ্রেট বিয়ার তখন তৎপর হবে তাকে হত্যা করতে অথবা কিডন্যাপ করতে। এভাবে আহমদ মুসা ওদের মুখোমুখি হতে পারবে।
মনটা খুশী হয়ে উঠল আহমদ মুসার। কিছুক্ষণ আগে মনটাকে কিছুটা বিরক্ত ও ক্লান্ত মনে হচ্ছিল, সে ভাবটা কেটে গেল। ভাবলো সে, এবার সে একটা মোক্ষম পথ খুঁজে পেয়েছে গ্রেট বিয়ারকে আড়াল থেকে বের করে আনার জন্যে।
মন খুশী হবার সাথে সাথে গাড়ির গতি বেড়ে গেল আহমদ মুসার।
গাড়ি চলছিল ইমাম বোখারী এভেনিউ দিয়ে। এই ইমাম বোখারী এভেনিউটি শহরের বাইরে গিয়ে তাইমুর লং হাইওয়ে নাম ধারণ করেছে। আরও দক্ষিণে এগিয়ে তাইমুর হাইওয়ের একটা শাখা পুবে ঘুরে ফারগানার দিকে চলে গেছে, অন্য অংশটি দক্ষিণে সমরখন্দ হয়ে বোখারা অতিক্রম করে আরো সামনে অগ্রসর হয়েছে।
আহমদ মুসার গাড়ি চলছিল শহরের প্রান্ত এলাকা দিয়ে। তার হাতের ডান পাশে অর্থাৎ দক্ষিণে তাসখন্দের বিখ্যাত বোটানিক্যাল গার্ডেন। আর বাম পাশে তাসখন্দ বিশ্ববিদ্যালয়।
তখন গোধূলি বেলা। পূর্ব দিগন্তে অন্ধকারের একটা কালো রেখা স্পষ্ট হয়ে উঠছে। রাস্তাটা নির্জন। কচিৎ দু’একটি গাড়ি দেখা যাচ্ছে রাস্তায়। শুক্রবার বলেই নির্জনতা একটু বেশি।
আহমদ মুসার গাড়ি চলছিল রাস্তার বাম পাশ দিয়ে। গাড়ি তখন তার বেশ গতি পেয়েছিল।
হঠাৎ রাস্তার ডান দিক থেকে নারী কণ্ঠের একটা চিৎকার কানে এল তার।
সংগে সংগেই থেমে গেল আহমদ মুসার গাড়ি। চাইলো ডানদিকে। দেখলো কয়েকজন লোক একজন মেয়েকে গাড়িতে টেনে তুলতে যাচ্ছে। চিৎকার করছে মেয়েটি।
আহমদ মুসা গাড়ির দরজা খুলে দৌড় দির ওদিকে।
ওরা পাঁচজন।
আহমদ মুসা নিকটবর্তী হতেই একজন তেড়ে এলো। বলল, ‘ফিরে যাও না হলে………..
‘ছেড়ে দাও তোমরা মেয়েটিকে।’ লোকটিকে কথা শেষ করতে না দিয়েই বলল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসার কথা শেষ হবার সংগে সংগেই লোকটির দেহ শূন্যে লাফিয়ে উঠলো এবং তার দু’পায়ের উড়ন্ত লাথি ছুটে এলো আহমদ মুসার মুখ লক্ষ্যে।
আহমদ মুসা মাথাটা চকিতে সরিয়ে নিল। লোকটির দেহ পাক খেয়ে ছুটল নিচের দিকে। কিন্তু বিস্ময়করভাবে লোকটি নিজেকে সামলে নিল, পড়ে গেল না। দাঁড়িয়ে গেল সে।
কিন্তু আহমদ মুসা তাকে নতুন প্রস্তুতির সুযোগ দিল না। লোকটি দাঁড়িয়ে দেহটা সোজা করার আগেই আহমদ মুসার ডান পায়ের একটা লাথি বুলেটের মত গিয়ে বিঁধল তার তলপেটে। ‘কোঁথ’ করে একটা শব্দ করেই ভূমি শয্যা নিল সে।
আহমদ মুসা ছুট দিল ঐ চারজনের দিকে যারা মেয়েটিকে টেনে গাড়িতে তুলছে।
কিন্তু গজ দু’য়েকের বেশি যেতে পারল না আহমদ মুসা। দেখল, দু’জন পাশাপাশি ছুটে আসছে তাকে লক্ষ্য করে। তাদের দু’জনের হাতেই ছুরি।
ওরা নিকটবর্তী হতেই আহমদ মুসা যেন ভয় পেয়েছে এমন ভাবে কয়েক পা পিছিয়ে এলো। দেখে ওরা যখন উৎসাহের সাথে উদ্যত ছুরি ওপরে তুলে ভয় দেখাবার লক্ষ্যে শিথিল পায়ে এগিয়ে আসার জন্যে পা তুলল, অমনি আহমদ মুসার পিছিয়ে যাওয়া পা শূন্যে লাফিয়ে উঠল এবং দু’পায়ের লাথি দু’জনের বুকে গিয়ে আঘাত করল। উল্টে পড়ে গেল ওরা দু’জন। ওরা পড়ে যেতেই ওদের একজনের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল আহমদ মুসা। তার হাতের ছুরি কেড়ে নিয়ে দুরে ছুড়ে ফেলে একটা ঘুষি চালালো তার কানের পাশে নমর জায়গাটায়। রেজাল্টটা না দেখেই তার জামার কলার এবং একটি ঠ্যাং ধরে এক ঝটকায় মাথার ওপর তুলে নিল। দ্বিতীয় লোকটি তখন সোজা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। আহমদ মুসা প্রথম লোকটির দেহটা প্রবল বেগে ছুড়ে দিল দ্বিতীয় লোকটির ওপর। দু’টি দেহই মুখ থুবড়ে পড়ল মাটিতে। পড়ে গিয়েও কিন্তু দ্বিতীয় লোকটি ছুরি ছাড়েনি। পড়ে গিয়েই সে পাশ ফিরে ছুরি নিক্ষেপ করল আহমদ মুসার দিকে। তীরের মত ছুটে আসছে ছুরি আহমদ মুসার বুক লক্ষ্যে। উপায়ন্তর না দেখ আহমদ মুসা ওপর থেকে মাছ চেপে ধরার মত ছুরি বাম হাত দিয়ে চেপে ধরলো। তারপর ছুটে গিয়ে উঠে দাঁড়াবার চেষ্টারত লোকটির কানের নীচে লাথি চালালো।
উঠতে হলোনা আর লোকটির।
আহমদ মুসা এবার ছুটলো শেষ দু’জনে দিকে।
ওরা মেয়েটিকে ছেড়ে দিয়ে রুখে দাঁড়াল। একজন ছুরি বের করলো, আরেকজন রিভলবার। মেয়েটি ওদের পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল। রিভলবার বের করার সংগে সংগেই মেয়েটি একটা থাবা দিয়ে তার হাত থেকে রিভলবারটি ফেলে দিল। আহমদ মুসা তার হাতের ছুরিটি সামনের ছুরি ওয়ালা লোকটির হাত লক্ষ্যে নিক্ষেপ করে ঝাঁপিয়ে পড়ল রিভলবার ওয়ালা লোকটির ওপর। সে রিভলবার কুড়িয়ে নেবার জন্যে নিচু হয়ে ছিল। আহমদ মুসা তাকে জামার কলার ধরে টেনে তুলে ঘুষি চালালো কানের পাশটায়। ঘুরে উঠে পড়ে গেল লোকটি। ছুরি ওয়ালা লোকটির ডান হাতে গিয়ে বিঁধেছিল আহমদ মুসার নিক্ষিপ্ত ছুরি। রিভলবার ওয়ালা লোকটিকে পড়ে যেতে দেখে আহত হাতটি চেপে ধরে সে দিল ভোঁ দৌড়।
আহমদ মুসা মেয়েটির কাছে গিয়ে দাঁড়াল। বলল, ‘ধন্যবাদ আপনাকে ওর রিভলবারটা ফেলে দেয়ার জন্যে। আপনি আঘাত পাননি তো?’
মেয়েটির মুখ ফ্যাকাসে। ভয় ও উদ্বেগের ছায়া সেখানে এখনও স্পষ্ট। তার শুকনো ঠোঁট দু’টিতে তখনও ভয়ার্ত কম্পন।
মেয়েটির পরনে বাদামী স্কাট, বাদামী কোট। রং এবং চেহারায় একদম রুশ। লম্বা হাল্কা- পাতলা চেহারা। অত্যন্ত বুদ্ধিদীপ্ত চোখ-মুখ।
আহমদ মুসার জিজ্ঞাসার জবাবে মেয়েটি পরিপূর্ণ দৃষ্টিতে আহমদ মুসার দিকে তাকাল। তার চোখে ফুটে উঠল বিস্ময় ও রাজ্যের কৃতজ্ঞতা। তার ঠোট দু’টি নড়ে উঠল, কিন্তু কথা ফুটলোনা।
আহমদ মুসাই আবার কথা বলল। জিজ্ঞাসা করল, ‘কোনটা আপনার গাড়ি?’
পাশের নতুন স্পোর্টস কারটা আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল মেয়েটি।
আহমদ মুসা গিয়ে গাড়ির দরজা খুলে দিয়ে বলল, ‘উঠুন। ড্রাইভ করতে পারবেন?’
‘পারব।’ শুকনো ও কম্পিত কণ্ঠে বলল মেয়েটি।
‘উঠুন।’ আবার বলল আহমদ মুসা।
ইতঃস্তত করছিল মেয়েটি।
‘একা যেতে পারবেন না?’
‘ভয় করছে।’ মুখ নিচু করে কম্পিত কণ্ঠে বলল মেয়েটি।
আহমদ মুসা আর কোন কথা না বলে গাড়ির পাশ ঘুরে গিয়ে ড্রাইভিং সিটে বসল। তার পাশের সিটেই উঠে বসল মেয়েটি।
স্টিয়ারিং হুইলে হাত দিতে গিয়ে তার বাম হাতের ব্যথা এবং রক্তাক্ত হাতের দিকে নজর গেল আহমদ মুসার। মনোযোগ এতক্ষণ অন্যদিকে নিবদ্ধ থাকায় ব্যথা ও রক্ত কিছুর প্রতিই নজর যায়নি তার।
আহমদ মুসা তার বুক পকেট থেকে তাড়া তাড়ি একটা রুমাল বের করে হাতের আহত স্থানটা চেপে ধরল। রক্ত বেরুচ্ছিল তখনও।
‘আপনি হাতে আঘাত পেয়েছেন?’ বলে মেয়েটি আহমদ মুসার কাছে এগিয়ে এল। তারপর কোন কিছু না বলেই আহমদ মুসার হাত টেনে নিতে গেল।
‘ধন্যবাদ তেমন কিছু নয়।’ বলে আহমদ মুসা হাত সরিয়ে নিতে চাইল। কিন্তু মেয়েটি হাত ছেড়ে না দিয়ে বলল, ‘মাফ করবেন। ক্ষতটা বেধে দিলে রক্ত পড়া কিছুটা কমতে পারে।’
মেয়েটি তার ব্যাগ থেকে নিজের রুমাল বের করে আহমদ মুসার রুমালসহ একটা ব্যান্ডেজ বেধে দিল এবং বলল, ‘আপনি এদিকে আসুন, আমি ড্রাইভ করতে পারব।’
‘কোন অসুবিধা হবে না।’ বলে আহমদ মুসা হাত ফিরিয়ে নিল ষ্টেয়ারিং হুইলে।
গাড়ী ষ্টার্ট দিল আহমদ মুসা।
চলতে শুরু করল গাড়ী।
ভয় ও উদ্বেগের চিহ্ন মেয়েটির মুখে আর নেই।
তার বিস্ময় এখন আহমদ মুসার মুখে নিবদ্ধ। তার বিস্ময় হলো, শান্ত-সুন্দর- ভদ্র চেহারার এই লোকটি খালি হাতে পাঁচ জন সশস্ত্র গুন্ডাকে কুপোকাত করল!
চলতে শুরু করার পর আরেকটা বিস্ময় এসে মেয়েটিকে ঘিরে ধরল, ঠিকানা জিজ্ঞেস না করে তাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে! বলল, ‘কোথায় যচ্ছেন? ঠিকানা যে নিলেন না?’
‘গুলরোখ-এর ১০১ ইমাম ইসমাইল রোড তো?’
বিস্ময়ে মেয়েটির দম আটকে যাবার যোগাড়। বলল, ‘আপনি চেনেন? কি করে জানলেন?’
‘আপনিই জানিয়েছেন।’
‘ইস! না। আমার নামও কি আপনি জানেন?’
‘তাতিয়ানা। তাসখন্দ বিশ্ব-বিদ্যালয়ের দর্শনের শেষ বর্ষের ছাত্রী।’
মেয়েটিকে সত্যেই বিব্রত দেখাল। সে গভীর দৃষ্টিতে তাকাল আহমদ মুসার দিকে। চেষ্টা করল মনে করতে আহমদ মুসা তার পূর্ব পরিচিত কিনা। কিন্তু কিছুতেই স্বরণ করতে পারল না।
মেয়েটির অবস্থা দেখে আহমদ মুসাই বলল, ‘দুঃশ্চিন্তার কোন কারন নেই, ড্যাস বোর্ডে রাখা আপনার নোট বুকই আমাকে সব বলে দিয়েছে।’
মেয়েটি তাকাল ড্যাস বোর্ডের দিকে। দেখল ঠিকই তার নোট বুক সেখানে আছে। তাতে তার নাম ঠিকানাও লেখা আছে। তবে তা হঠাৎ করে চোখে পড়া সহজ নয় এবং ভালো করে তাকিয়ে না দেখলে সিটে বসে পড়াও কঠিন। কিন্তু আহমদ মুসা এভাবে ওদিকে কখনো তাকায়নি, মেয়েটি স্বরণ করল। আহমদ মুসার চোখ অসম্ভব রকমের তীক্ষ্ন, স্বীকার করল মেয়েটি। হবেই তো যে লোক একা খালি হাতে পাঁচজন গুন্ডাকে মাটিতে শুইয়ে দিতে পাওে, সে সাধারন লোক নয়।
তীর বেগে ছুটে চলছে গাড়ী।
গুলরোখ তাসখন্দের সবচেয়ে অভিজাত এলাকা। শহরের একদম উত্তর প্রান্তে। নতুন তৈরী হয়েছে। এই এলাকাকে তাসখন্দের কুটনৈতিক এলাকা বলে অভিহিত করা হয়। অধিকাংশ বাড়িই হয় দূতাবাস নয়তো কুটনীতিকদের বাসা।
আহমদ মুসা অনেকটা শিথিল ভংগিতে গাড়ির সিটে ঠেস দিয়ে গাড়ি চালাচ্ছিল। তার দৃষ্টি সামনে, ভাবলেশহীন মুখ। যেন কিছুই হয়নি, হাওয়া খেতে বেরিয়েছে সে।
মেয়েটি কিছু বলার জন্যে উশখুশ করছিল। কিন্তু আহমদ মুসার ভাবলেশহীন মুখের দিকে চেয়ে কিছু বলার সাহস পচ্ছিল না। সে খেয়াল করেছে, আহমদ মুসা গাড়িতে উঠার পর তার দিকে একবারও তাকায়নি। মনে হয় তাতিয়ানার কোন অস্তিত্ব এখানে আছে তা সে ভুলেই গেছে। তাতিয়ানার মত সুন্দরী তরুণীর পাশে বসা একজন যুবকের এই ধরনের নির্লিপ্ততা সে কল্পনাও করতে পারে না। বরং এক্ষেত্রে এটাই স্বাভাবিক ছিল যে, উদ্ধারকারী যুবক উদ্ধার করা তরুণীর সাথে ঘনিষ্ট হতে চেষ্টা করবে। কিন্তু আহমদ মুসাকে একদম উল্টো মনে হল তার কাছে।
গাড়ি প্রবেশ করল ইমাম ইসমাইল রোডে। গাড়ির স্পীড অনেক খানি কমিয়ে দিল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসা তার মুখটা অল্প একটু ঘুরিয়ে বলল, ‘মিস তাতিয়ানা, এবার আমি আপনার ওপর নির্ভরশীল।’ হাসির একটা আভা ফুটে উঠল আহমদ মুসার ঠোঁটে।
ঠিক এই সময়েই রাস্তা পার হতে যাওয়া একজন দ্বিধাগ্রস্থ বৃদ্ধ আহমদ মুসার গাড়ির সাথে ধাক্কা খেল। জরুরি ব্রেক কষে বৃদ্ধকে বড় রকমের আঘাত থেকে আহমদ মুসা বাঁচাতে পারল, কিন্তু ধাক্কা তবু একটা খেলই।
আহমদ মুসা গাড়ি দাঁড় করিয়ে তাড়াতড়ি নেমে পড়ল। বৃদ্ধ পড়ে গিয়েছিল। তার মাথার ফলের ঝুড়ির ফল রাস্তায় গড়াগড়ি খাচ্ছে। খাস রুশ চেহারা বৃদ্ধটির।
আহমদ মুসা বৃদ্ধটিকে মাটি থেকে তুলে বুকে জড়িয়ে ধরল। বলল, ‘আঘাত পেয়েছেন খুব?’
‘জি না, আঘাত লাগেনি তেমন। ভারসাম্য রাখতে না পেরে পড়ে গিয়েছিলাম। গাড়ির তেমন দোষ ছিলনা। দোষ আমারই।’
‘না দোষ আমার।’ বলে আহমদ মুসা বৃদ্ধকে ছেড়ে দিয়ে রাস্তা থেকে ফল কুড়িয়ে বৃদ্ধের ঝুড়িতে ভরতে লাগল। বৃদ্ধ বসে পড়েছিল রাস্তায়। আঘাত না পেলেও ভয় পেয়েছিল। স্বাভাবিক হতে দেরী হল তার।
গব ফল ঝুড়িতে তুলে আহমদ মুসা বৃদ্ধের কাছে এসে বলল, ‘আপনি কি বাজারে যাচ্ছেন?’
‘হ্যাঁ।’
‘বাড়িতে আর কে আছে?’
‘একটি মেয়ে এবং আমার স্ত্রী।’
‘এই বয়সে আপনার ঝুড়ি বহন করা কঠিন। কোথাও দোকান নিয়ে বসতে পারেন না?’
‘সরকার একটা দোকান বানিয়ে দিয়েছে, পুঁজি সংগ্রহ করেই বসব সেখানে।’
‘কেন সরকার পুঁজি দেয় না?’
‘দেবে শুনেছি, কিন্তু প্রার্থী তো অনেক।’
আহমদ মুসা একটু ভাবল। তারপর বলল, ‘আমি আপনার ছেলের মত। ব্যবসায়ের পুঁজি আমি কিছু দিতে পারি।’ বলে পকেট থেকে পাঁচ হাজারের একটা বান্ডিল বের করে বৃদ্ধের হাতে গুঁজে দিল।
বৃদ্ধ বাকহীনভাবে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকাল আহমদ মুসার দিকে। কিছু বলতে পারল না।
আহমদ মুসা একটা গাড়ি ডেকে বৃদ্ধকে ঝুড়ি সমেত গাড়িতে তুলে দিল এবং ভাড়াও মিটিয়ে দিল গাড়ির।
বৃদ্ধ গাড়িতে উঠতে উঠতে বলল, ‘ঈশ্বর তোমার মঙ্গল করুন বাবা, যিশু সহায় হোন তোমার।’
গাড়িতে ফিরে এল আহমদ মুসা। বলল, ‘মাফ করবেন, আপনার দেরী করে ফেললাম।’
‘লোকটিই তো দোষ করেছিল, আপনি ক্ষতি পূরণ দিতে গেলেন কেন? তার সাথে ব্যবহার দেখে মনে হল দোষটা আপনিই করেছেন।’
‘ওটা ওঁর দোষ নয়, বরং অসহায়ত্ব, অপারগতা। একজন বৃদ্ধ অসহায়কে আমিই আঘাত করেছি। আর আমি যা করেছি সেটা ক্ষতিপূরণ নয়, একজন মানুষের প্রতি একজন মানুষের সহায়তা।’
‘আপনার মন খুব নরম। পরোপকার আপনার নেশা বুঝি?’
গাড়ি তখন চলতে শুরু করেছে।
আহমদ মুসা তাতিয়ানার কথায় কান না দিয়ে বলল, ‘১০১ নাম্বারটা রাস্তার কোন ধারে?’
‘কেন শেষ এইটুকু আপনি বের করে নিতে পারবেন না?’
‘দেখুন আমি বলেছি, এ ব্যপারে আমি আপনার ওপর নির্ভরশীল। অবশ্য একা হলে আমিই খুঁজে নিতাম।’
‘তাহলে আমি প্রথমে আপনাকে একটা ডাক্তার খানায় নিয়ে যাব। পরোপকার করতে গিয়ে আপনার হাতের আরও ক্ষতি করেছেন। আবার ব্লিডিং শুরু হয়েছে।’
‘আপনাকে পৌছে দিয়েই আমি ক্লিনিকে যাব। কাছেই তো এসে গেছি মনে হয়।’
‘আপনার অনুমান ঠিক। সামনে বাম দিকের গেটটাই আমাদের।’ হেসে বলল মেয়েটি।
পাশ দিয়েই একটা খালি ট্যাক্সি যাচ্ছিল। আহমদ মুসা ইশারা করে ডাকল। বলল, ‘তুমি ঐ গেটের সামনে এস, আমি যাব।’
‘কেন আপনি বসবনে না?’ দ্রুত প্রতিবাদী কন্ঠে বলল মেয়েটি।
গাড়ি এসে পৌছুল গেটের সামনে।
‘মাফ করবেন, আজ নয়। কখনও সুযোগ পেলে আথিত্য গ্রহন করব।’
গেটের দরজা খুলে গেল।
ঢুকে গেল গাড়ি ভেতরে।
মেয়েটি লাফ দিয়ে নামল।
আহমদ মুসাও নেমে পড়ল।
নেমে তাতিয়ানা দাঁড়িয়েছিল। তার চোখে বিব্রত ও ব্যথিত দৃষ্টি।
‘মাফ করবেন, সময় হলে আসবো একদিন।’ তাতিয়ানার দিকে তাকিয়ে বলল আহমদ মুসা।
‘আমি বয়সে আপনার ছোট হবো, আমাকে আপনি ‘তুমি’ বলতে পারেন না?’ বলল মেয়েটি।
‘ঠিক আছে বলব।’ বলে ফেরার জন্য পা তুলল আহমদ মুসা।
‘আমি জানি, যে উপকার করতেই শুধু ভালবাসে, বিনিময় চায়না, তিনি অবশ্যই আসবেন না। তবু বলছি, ঋণ পরিশোধের মধ্যে আনন্দ আছে, এ আনন্দ থেকে মানুষকে বঞ্চিত করা ঠিক নয়।’
‘তোমার যুক্তিটা সুন্দর। আসি ধন্যবাদ।’ বলে আহমদ মুসা ঘুরে দাঁড়িয়ে পা চালাল সামনে।
আহমদ মুসা চলে গেলেও তাতিয়ানা গাড়িতে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকল। ভাবছিল সে। যা ঘটলো তা ভয়ংকর এক দুঃস্বপ্ন। কিন্তু সে দুঃস্বপ্নের চেয়েও বড় স্বপ্ন হলো এই লোকটি, যার নামও তার জানা হয়নি। লোকটি যেন একটি মানুষ মাত্র নয়, একটি জগৎ। পাঁচজন গুণ্ডার মধ্যে তাতিয়ানা যেন নরক জীবনকে জলজ্যন্ত দেখল, আর স্বর্গ প্রত্যক্ষ করল অপরিচিত এই যুবকটির মধ্যে। তার কপালের সিজদার চিহ্ন বলে দেয় সে মুসলমান, কিন্তু একজন রুশ-বংশোদ্ভুত খৃষ্টান বৃদ্ধকে সে বুকে জড়িয়ে ধরল নিজের ভাইয়ের মত করেই।
তাতিয়ানা গাড়িতে ঠেস দেয়া অবস্থা থেকে সোজা হয়ে দাঁড়াল। ধীরে ধীরে হাঁটতে শুরু করল বাড়িতে ঢোকার জন্যে। চলতে চলতে ভাবল লোকটির যদি ঠিকানা নিতো সে। এ ভুলটা তারই। নাম ঠিকানা জিজ্ঞাসা না করে আমিই তাকে উপেক্ষা করেছি। মনটা একটা অস্বস্তিতে ভরে উঠল তাতিয়ানার।
আহমদ মুসা গেট পেরুতেই গেটের দরজা বন্ধ হয়ে গেল।
আহমদ মুসা রাস্তায় পা দিতে গিয়ে থমকে দাঁড়াল। ঘুরে দাঁড়িয়ে কয়েকদিনের অভ্যাস মত গেটের ওপর একবার চোখ বুলালো।
হঠাৎ তার চোখ আটকে গেল গেটের ঠিক শীর্ষদেশে হালকা খোদাই করা একটি স্কেচের ওপর। ভালো করে চেয়ে দেখল স্কেচটি। ভল্লুকের একটা প্রকাণ্ড মাথা। হা করে আছে ভল্লুকটি।
ভল্লুকটি চোখে পড়ার সাথে সাথেই পাওয়ার একটা প্রবল আনন্দ আচ্ছন্ন করল আহমদ মুসাকে। গোটা শরীরে উষ্ণ স্রোত বয়ে গেল তার।
বিদ্যুতের আলো উদ্ভাসিত স্কেচটির দিকে আরেকবার তাকিয়ে ঘুরে দাঁড়াল আহমদ মুসা।
রাস্তায় নেমে গাড়িতে উঠতে গিয়ে আহমদ মুসা বাড়িটাকে ভালো করে একবার দেখে নিল। মনে মনে একটু হাসল। মেয়েটির আতিথ্য গ্রহণ করতে চেয়েছিল কিছু না ভেবে, কিন্তু এখন তো দেখি তা সত্যে পরিণত হতে চলছে। তবে আফসোস মেয়েটি অতিথি সেবার কোন সুযোগ পাবে না। অতিথিকে দেখবে সে অনুপ্রবেশকারী হিসাবে। তখন সেবার বদলে শত্রু নাশের জন্যে উচু হয়ে উঠবে তার রিভলবার।

আহমদ মুসার হাত সারতে কদিন সময় নিল।
সেদিন রাত ৩টা।
আহমদ মুসা তাতিয়ানাদের বাড়ির পেছনে এসে দাঁড়াল। বাড়িটি প্রাচীর ঘেরা। প্রাচীর ঘেরা জায়গার প্রায় মাঝখানে বাড়িটি দাঁড়ানো।
বাড়ির তিন দিক ঘেরা বাগান। পশ্চিম দিকে বাড়ির সম্মুখের ভাগ। সম্মুখ অংশটা ফাঁকা। ফাঁকা কম্পাউন্ডটার উত্তর অংশে গ্যারেজ। বাড়ির সম্মুখে প্রাচীরের সাথে বিরাট গেট।
বাড়ির পেছনে প্রাচীরের বাইরে প্রাচীরের গা ঘেষে দাঁড়াল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসা একাই এসেছে অভিযানে। একা আসাই পছন্দ করেছে সে। এ অভিযানের লক্ষ্য সংঘাত বাঁধানো নয়। গোপনে গ্রেট বিয়ারের অফিসে প্রবেশ করে পরিকল্পনা ও দলিল-দস্তাবেজ হস্তগত করা। বেশি লোক এসে সংঘাত-সংঘর্ষ বাঁধালে এই লক্ষ্য অর্জন করা যাবে না। প্রয়োজন হলে ওরা সব ধ্বংস করে দিয়ে পালিয়ে যাবে। তাই আহমদ মুসা একা আসাই ঠিক করেছে। তবে কথা হয়েছে ভোরের মধ্যে আহমদ মুসা না ফিরলে সদলবলে এসে বাড়ি ঘেরাও করে অভিযান চালানো হবে। তার আগ পর্যন্ত দু’জন গোয়েন্দা অফিসার বাড়িটির ওপর চোখ রাখবে।
চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। অমাবস্যার রাত। আহমদ মুসা মাথা তুলে চাইল প্রাচীরের মাথার দিকে। আট ফিটের মত উঁচু প্রাচীর। ইচ্ছা করলে আহমদ মুসা লাফিয়ে উঠে প্রাচীর ডিঙাতে পারে।
কিন্তু ভাবছে আহমদ মুসা, ওদের নিরাপত্তা ব্যবস্থাটা কি রকম। প্রাচীরে ওপর ফ্লাস লাইট নেই, তাহলে কি কোন বিকল্প ব্যবস্থা আছে? আহমদ মুসার মনে পড়ল সায়েজুর কাহিনী। ওরা সেখানে ইনফরমেশন সংগ্রহের জন্য লোক চক্ষুর অগোচরে সর্বাধুনিক গোয়েন্দাযন্ত্র ব্যবহার করেছে। এটা প্রমাণ করে ওদের ইলেক্ট্রনিক নিরাপত্তা সিস্টেম থাকতে পারে এবং সেটা যদি প্রাচীরে মাথায় বিছানো থাকে, তাহলে প্রাচীরে হাত বা পায়ের চাপ পড়ার সাথে সাথে কম্পিউটারে পৌছে যাবে। অথবা বেজে উঠবে এলার্ম।
এই চিন্তা করার পর আহমদ মুসা পিঠ থেকে ব্যাগটি নামাল। বের করল লম্বা সূচের মত হাল্কা-নরম একটি যন্ত্র।
যন্ত্রটি ইলেক্ট্রো রেডিয়াশন ডিটেক্টর। অত্যন্ত স্পর্শকাতর এ যন্ত্রটি। এই যন্ত্রটি যেমন ইলেক্ট্রিসিটি ও রেডিয়েশান অতি সূক্ষ্ণ পর্যায় পর্যন্ত ডিটেক্ট করতে পারে, তেমনি ডিটেক্টরটি যে সব বস্তুর মুখোমুখি হয়, তার পরিচয়ও জানিয়ে দিতে পারে। যেমন, বস্তুটি কঠিন, না নরম, ধাতব, না রাবার-প্লাষ্টিকের মত কৃত্রিম, ইত্যাদি।
সূচটিকে আহমদ মুসা এন্টেনার মত একটা সরু রডের বাঁকানো মাথায় বসিয়ে দিল। তারপর গুটানো এন্টেনা টেনে লম্বা করল। এন্টেনাটির গোড়ায় একটা ছোট্ট বাক্স। বাক্সটির একপাশে কম্পিউটার স্ক্রীন। বাক্সটি আসলে একটি কম্পিউটার। যে কোন জিনিস এন্টেনাটির এক ফুটের মধ্যে আসার সাথে সাথে জিনিসটির ছবি এবং বিশ্লেষণ কম্পিউটার স্ক্রীনে ধরা পড়ে।
এন্টেনা উঁচু করে ডিটেক্টরটি প্রাচীরে ওপর স্থাপন করল আহমদ মুসা। এন্টেনার গোড়ায় কম্পিউটার স্ক্রীনে প্রাচীরের মাথার ছবি ভসে উঠল। আহমদ মুসা যা সন্দেহ করেছিল তাই। দেখা গেল সিমেন্টের রং এর সূক্ষ্ণ তার প্রাচীরের ওপর। বুঝতে অসুবিধা হলো না, ওটা হাই-সেনসিটিভ ইলেকট্রিক তার। যার সংযোগ রয়েছে সিগন্যাল-সাইরেনের সাথে। তারের ওপর নির্দিষ্ট পরিমাণ কিংবা তার বেশি চাপ পড়লেই বেজে উঠবে সাইরেনটি।
আহমদ মুসা প্রাচীরের অনেকখানি এলাকা পরীক্ষা করল। দেখল, তারটি প্রাচীরে লম্বা লম্বি চলে গেছে।
প্রাচীরে উঠে তারটি এড়িয়ে ওপারে নামা যায়। কিন্তু অন্ধকারে তারটি দেখতে পাওয়ার কোন উপায় নেই।
কম্পিউটার স্ক্রীনে আহমদ মুসা ভালো করে আবার প্রাচীরের তারের অবস্থান প্রত্যক্ষ করল। দেখল প্রাচীরের মাথায় ঠিক মাঝ বরাবর দিয়ে তারের অবস্থান। অর্থাৎ তারের দু’পাশে মোটামুটিভাবে পাঁচ ইঞ্চি করে জায়গা আছে।
মুহূর্তের জন্য চোখ বন্ধ হয়ে গেল আহমদ মুসার। সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল সে।
ব্যাগ থেকে নাইলনের হুক-ল্যাডার বের করল সে। তারপর সাবধানে হুকটি ছুঁড়ল প্রাচীরের প্রান্ত লক্ষ্য করে। আটকে গেল হুকটি প্রাচীরের প্রান্তে। গাঢ় নীল পোষাকে আবৃত আহমদ মুসা নাইলনের মই বেয়ে উঠে গেল প্রাচীরের মাথা পর্যন্ত। মাথা পর্যন্ত উঠে ধীরে ধীরে আহমদ মুসা তার বাম পাটা সাবধানে প্রাচীরের প্রান্তে রাখল। পায়ের তালুর অর্ধেকটা থাকল প্রাচীরের ওপর বাকিটা বাইরে। তারপর বাম পায়ের ওপর ভর দিয়ে ধীরে ধীরে অতি সন্তর্পনে ডান পা নাইলনের মই থেকে তুলে প্রাচীরের ওপাশে ভেতরের প্রান্তে রাখল। দুই পা ও দুই হাত প্রাচীরের দুই প্রান্তে রেখে কিছুক্ষণ স্থির হয়ে থাকার পর নাইলনের মই তুলে নিয়ে প্রাচীরের ভেতরের প্রান্তে হুক লাগিয়ে মই ছেড়ে দিল নিচে। তারপর ডান পা ও হাতের ওপর ভর দিয়ে বাম পা ঘুরিয়ে এনে নাইলনের মইয়ে রাখল এবং দ্রুত নেমে এল নিচে। মইটি খুলে নিয়ে রাখল তার ব্যাগের ভেতর।
চারদিকে চাইল আহমদ মুসা। ঘুটঘুটে অন্ধকার। বাগানে কোথাও কোন আলো নেই।
পকেট থেকে আহমদ মুসা ইনফ্রারেড গগলস বের করল। এই অন্ধকারে আর কোন ফাঁদ তারা পেতে রেখেছে কিনা দেখা দরকার।
গগলস পরল আহমদ মুসা। অন্ধকার তার সামনে ফিকে হয়ে গেল।
সতর্ক দৃষ্টিতে গোটা বাগানের ওপর চোখ বুলিয়ে নিল সে। না, বাগানে কোথাও কোন পিলার বা পোস্ট নেই, যেখানে কোন গোপন ক্যমেরা বসানো থাকতো পারে। তবু আহমদ মুসা বাগানের মাঝ দিয়ে না গিয়ে ঘোরাপথ হলেও বাগানের প্রান্ত দিয়ে যাওয়া ঠিক করলো।
বাগানের পূব দেয়ালের অবশিষ্ট প্রান্তটা ঘরের উত্তরের দেয়াল ঘেষে আহমদ মুসা হামাগুড়ি দিয়ে পশ্চিম দিকে এগোল। অর্ধেক পথটা এগিয়েছে এমন সময় মাথা তুলে উঁকি দিতেই বাগানের মাঝখানটায় একটা গাছকে অস্বাভাবিক নড়ে উঠতে দেখল। সঙ্গে সঙ্গেই বসে পড়ল আহমদ মুসা। বসে বসেই উঁকি দিতে লাগলো। হ্যাঁ গাছ পালার হঠাৎ নড়া-চড়াটা ধীরে ধীরে পুব দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এনফ্রারেড গগলস চোখে না থাকলে এটা ধরা যেত না রাতের অন্ধকারে। আহমদ মুসার কাছে পরিষ্কার হযে গেল জন্তু অথবা মানুষ যাই হোক সংখ্যায় দুইটি বা দুইজন হবে এবং তারা এগিয়ে যাচ্ছে আহমদ মুসা যে জায়গায় নেমে ছিল ঠিক সেদিকে। মুহুর্ত কয়েকের মধ্যেই আহমদ মুসা বুঝে নিল ওরা মানুষই হবে, শিকারী কুকুর হলে ওদিকে না গিয়ে এদিকেই ছুটে আসত।
ওরা যদি আহমদ মুসার সন্ধানে এসে থাকে, তাহলে বলতে হবে মুসা ওদের কাছে ধরা পড়ে গেছে। কিন্তু কিভাবে? প্রাচীরের তারে অবশ্যই তার কোন স্পর্শ পড়েনি।
একটা ঝাউ গাছের আড়ালে বেশ কিছুক্ষণ বসল আহমদ মুসা। কানে সে এ্যাপ্লিফায়ার বসিয়েছে যাতে কিছু দুরের ছোট খাট কথা এবং শব্দও সে শুনতে পায়।
বেশ কিছুক্ষণ পর প্রাচীরের পাশ দিয়ে প্রায় মাটি কামড়ে একরাশ আলো ছুটে আসতে দেখল। ঝাউ গাছের ভিন্ন পাশে এবং পাতার আড়ালে থাকায় আহমদ মুসা রক্ষা পেয়ে গেল।
আলোটা এদিক ওদিক ছুটাছুটি করল। তারপর আবার অনেকক্ষণ চুপচাপ।
এক সময় আহমদ মুসা একটা কন্ঠ শুনতে গেল।
‘না ভেতরে কেউ ঢুকেনি।’ কে একজন বলল।
‘কিন্তু মানুষ প্রাচীরে উঠেছে এ সিগন্যালতো কম্পিউটার দিয়েছে।’ অন্য এক কন্ঠ।
‘দিয়েছে বটে, কিন্তু সাইরেন তো বাজেনি। কেউ প্রাচীর পার হলে অবশ্যই তা বাজতো।’
‘তাহলে কম্পিউটার সে সিগন্যাল দিল কি করে?’
‘প্রাচীরের ইলেকট্রনিক তারটি অত্যন্ত স্পর্শকাতর। তারের প্লাস্টিক কভারে আছে সূক্ষ সূক্ষ ছিদ্র। তারের এক ফুটের মধ্যে কোন ধাতব বস্তু অথবা কোন প্রানী এলে, সঙ্গে সঙ্গে সে খবর পৌছে যায় কম্পিউটারে। কম্পিউটার স্ক্রীনে আমরা পাই তার সিগন্যাল।’
‘তাহলে বলা যায় তারের কাছাকাছি কেউ এসেছিল, কিন্তু ফেরত গেছে।’
‘এমন তো হতেই পারে। চোর-ছ্যাচ্চড় কতই তো ঘুরঘুর করে রাতে এ বাড়ি থেকে সে বাড়িতে। হয়তো সে রকম কেউ প্রাচীরে উঠার চেষ্টা করে ফেরত গেছে।’
আহমদ মুসা মাথাটা একটু উচিয়ে দেখছিল লোক দু’টিকে। ওরা গল্প করতে করতে বাগানের মধ্যে দিকে অগ্রসর হল।
আহমদ মুসাও হামাগুড়ি দিয়ে অগ্রসর হলো প্রাচীরের পাশ ঘেষে অন্ধকারে দাঁড়ানো বাড়ির দিকে।
বাড়ির একেবারে নীচ বরাবর এসে বাগান শেষ হয়েছে। বাগান ও বাড়ির মাঝ বরারব উত্তর-দক্ষিণ বিলম্বিত একটা ঘাসে ঢাকা রাস্তা।
আহমদ মুসা বাগানের পশ্চিম প্রান্তে সেই রাস্তার মুখে এসে উকি মারলো। লোক দু’জন তাদের টর্চ জ্বেলে সেই ঘাসে ঢাকা রাস্তাটি ভালো করে দেখল। তাদের একজনের চর্ট বিল্ডিং-এর গা বেয়ে ওপরে দুতলার এক জায়গায় এসে ঘোরা-ফিরা করতে লাগল। সেখানে দু’টি এয়ার কুলার দেখা গেল।
লোক দু’জন বাড়িটির দক্ষিণ প্রান্ত ঘুরে বাড়ির ওপাশে চলে গেল।
আহমদ মুসা চোখ থেকে ইনফ্রারেড গগলস খুলে ফেলল। অন্ধকার পরীক্ষা করা তার লক্ষ্য। আহমদ মুসা খুশী হলো, চারদিকে, ঘুটঘুটে অন্ধকার।
উঠে দাঁড়াল আহমদ মুসা।
বাড়িটির গোড়ায় দাঁড়িয়ে তাকাল বাড়িটার দিকে।
তিন তলা বাড়ি।
তিন তলার কয়েকটি কক্ষ থেকে হাল্কা আলো দেখা যাচ্ছে। ডিমলাটের আলো।
দু’তলার কোন কক্ষেই আলো দেখা যাচ্ছে না। নীচ তলার দক্ষিণ প্রান্তের একটি কক্ষ থেকে উজ্জ্বল আলো দেখা যাচ্ছে।
আহমদ মুসা নিশ্চিত হলো, দু’তলাটাই ওদের অফিস অংশ। আর সম্ভবত যেখানে ওদের টর্চ লাইটের আলো স্থির হয়েছিল, এয়ারকুলার ওয়ালা সেই দু’টি কক্ষই অফিস। কম্পিউটার এবং মাইক্রোফিল্ম জাতীয় মূল্যবান দলিলাদি নিশ্চয় ও দু’টি কক্ষেই আছে। এয়ারকুলার থাকা তারই প্রমাণ।
কক্ষ দু’টি দু’তলার উত্তর প্রান্তে। আহমদ মুসা তার নিচেই দাঁড়িয়ে।
চারদিকটা একবার দেখে নিয়ে আহমদ মুসা ব্যাগ থেকে সিল্কের কর্ড বের করল। হুকটা হাতে নিয়ে দু’তলার কার্নিস লক্ষ্যে ছুড়ে দিল।
হুকটা কার্নিসে ভালোমত আটকে গেছে কিনা দেখে নিয়ে আহমদ মুসা কর্ড বেয়ে তর তর করে উঠে গেল দু’তলার কার্নিসে।
কার্নিসে উঠে দাঁড়াল আহমদ মুসা। ভালো করে নজর বুলাল এয়ারকুলার লাগানো ঘরের দিকে। কিছু ব্যবধানে পাশা পাশি দু’টি এয়ারকুলার। ভিন্ন ভিন্ন দু’টি ঘরের দিকে, আবার ঘর একটিও হতে পারে।
স্টিলের ফ্রেম দেয়া কাঁচের জানালা। জানালায় নিশ্চয় শিকও আছে-ভাবল আহমদ মুসা।
জানালা পরীক্ষা করে হুক-এর জায়গাটা অনুমান করে নিয়ে আহমদ মুসা পকেট থেকে ‘লেসার বীম নাইফ’ বের করে লেসার বীম স্প্রে করল।
জানালা খুলে নড়ে উঠল। বুঝল আহমদ মুসা, হুক আর নেই।
জানালা খুলে ফেলল সে। তারপর লেসার বীম নাইফ দিয়ে কেটে ফেলল তিনটি শিকের গোড়া। শিকগুলো ভাঁজ করে ভেতরের দিকে ঠেলে দিল।
ভেতরে প্রবেশ করল আহমদ মুসা। পুরু কার্পেটে পা পড়ল তার। পেছনে ফিরে জানালা বন্ধ করল সে।
ঘরের ভেতরে জমাট অন্ধকার । সেই অন্ধকারে নিজের অস্তিত্বও যেন হারিয়ে ফেলল আহমদ মুসা । হঠাৎ তার মনে হলো সূর্য এবং তারার আলো যখন পৃথিবীতে পৌছেনি, সেই আদি দিনগুলোতে বুঝি অন্ধকারটা এমনি নিখাদ ছিল, নিশ্চিদ্র ছিল । সেই অন্ধকারটা ছিল পৃথিবীর নিরব-নিস্তব্ধ মৃতরূপ । অন্তহীন নি:শব্দতার সেই মৃতপুরীতে আলো আসে জীবনের বার্তা নিয়ে । আনমনা হয়ে পড়ল আহমদ মুসা। তার মনে হলো সে যেন কোন বদ্ধ কক্ষে নয়, অন্ধকার চাদরে ঢাকা আছে। পৃথিবীর জন মানবহীন অবারিত কোন প্রান্তরে যেন সে দাঁড়িয়ে।
চাপা কন্ঠের শব্দে সম্বিত ফিরে পেল আহমদ মুসা। শব্দ আসছে জানালা দিয়ে, নীচ থেকে।
আহমদ মুসা তাড়াতাড়ি পকেট থেকে পেন্সিল টর্চ বের করে পরীক্ষা করল ঘরটা।
হতাশ হলো সে। বেশ বড় ঘর সোফায় সাজানো। ঘরের এক প্রান্তে বিশেষভাবে তৈরী একটা বড় সোফা আছে। আহমদ বুঝল, এটা বিশেষ একটা সভা কক্ষ।
নীচে দৌড়া-দৌড়ি-ছুটাছুটি বেড়ে গেল। আহমদ মুসা জানালায় গিয়ে দেখল টর্চের আলোর ঘুরা-ফেরা। টর্চের আলো ঘুরে-ফিরে তার সে জানালা লক্ষ্যেও এল।
আহমদ মুসার বুঝতে বাকি রইল না যে, তার আগমন ধরা পড়ে গেছে।
উদ্বিগ্ন হলো আহমদ মুসা। তার আগমন বৃথা না হয়ে যায়, এটাই তার উদ্বেগের কারণ। অফিস বা কম্পিউটার রুম তার খুঁজে পাওয়া দরকার। সে কক্ষটি কি তিন তলায় হতে পারে? তিনতলাতেও সে সম্ভবত দুটি এয়ারকুলার দেখেছে। হতে পারে গুরুত্বপূর্ণ কক্ষটি গ্রেট বিয়ার নেতা, তার শয়ন-কক্ষের পাশেই রেখেছেন।
এই চিন্তার সংগে সংগেই আহমদ মুসা কক্ষ থেকে বের হবার জন্যে কক্ষের দরজার লক গলিয়ে ফেলল।
দরজার পাল্লা টানতে যাবে এমন সময় ছুটে আসা পায়ের শব্দ পেল। কে একজন ছুটে আসছে। দরজার সামনে দিয়েই পদ শব্দটি দক্ষিনে ছুটে গেল।
আহমদ মুসা দরজা ঈষৎ ফাঁক করে দেখল স্বাস্থবান ও দীর্ঘদেহী একজন লোক মেশিন পিস্তল হাতে ছুটছে দক্ষিন দিকে।
আহমদ মুসা ঘর থেকে বেরিয়ে ছুটল উত্তর দিকে। সেদিন আহমদ মুসা দেখেছিল, বাড়িতে দু’টি সিড়িঁ আছে। একটা দক্ষিন প্রান্তে, অন্যটা উত্তর প্রান্তে।
আহমদ মুসা উত্তরের সিড়িঁর দিকেই ছুটল। লক্ষ্য তার তিন তলা। পেয়ে গেল সিঁড়ি।
উঠতে গেল সিড়িঁ দিয়ে। সিড়িঁর উপর চোখ পড়তেই দেখল, সিড়িঁর মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে তাতিয়ানা। বিস্ময়ে বিস্ফোরিত তার দু’টি চোখ। কথা যেন হারিয়ে ফেলেছে। ঠোঁট তার কাঁপছে।
বাড়িতে কেউ বা কোন শত্রু অনুপ্রবেশ করেছে, এই খবর পেয়ে তাতিয়ানা তার পিতার পেছনে ছুটে আসছিল কি ব্যাপার তা জানার জন্য। সামনে আহমদ মুসাকে দেখে তার পা’দুটো যেন জমে গেছে। মুখেও কথা সরছে না। অবিশ্বাস্য এ দৃশ্য তার কাছে।
‘কেমন আছো তাতিয়ানা, গ্রেট বিয়ারের কম্পিউটার-অফিসটি আমাকে দেখিয়ে দাও।’ দ্রুত কন্ঠে বলল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসার কথা অনেকটা নির্দেশের মত শোনালেও, তার চোখে ছিল অবনত দৃষ্টি। তাতে সহযোগিতার আবেদন, নির্দেশ নয়।
বোবা দৃষ্টিতে তাতিয়ানা আঙুল দিয়ে সিড়িঁর পাশের দুতলার রুমটি দেখিয়ে দিল।
‘সিঁড়ির পাশে এই রুম?’ জিজ্ঞাসা করে নিশ্চিত হতে চাইল আহমদ মুসা।
হ্যাঁ সুচক মাথা নাড়ল তাতিয়ানা। তার চোখে রাজ্যের বিস্ময়।
‘ধন্যবাদ তাতিয়ানা’ বলে আহমদ মুসা ঘুরে দাঁড়িয়ে ছুটল দরজার দিকে।
সিড়ির গোড়ায় নেমে এল তাতিয়ানা। বিস্ময় ও উদ্বেগের সাথে দেখল, কি এক অদ্ভুত যন্ত্র দিয়ে দরজার লক গলিয়ে ফেলে ভেতরে প্রবেশ করল আহমদ মুসা। ভেতরে ঢুকে আহমদ মুসা দরজার ডবল ছিটকিনি লাগিয়ে দিল তার শব্দ ও পেল।
বেশ বড় ঘর। তবে আগের ঘরটার চেয়ে বেশ ছোট। ঠিক দরজার বিপরীত দিকে একটা সেক্রেটারিয়েট টেবিল। টেবিলের ওপাশে রিভলভিং চেয়ার। টেবিলের বাম পাশে হাতের আওতার মধ্যে একটা ছোট্ট টেবিলের ওপর একসারি সর্বাধুনিক কম্পিউটার। আর টেবিলের ডান পাশে একটি র‌্যাকে কয়েকটা টেলিফোন এবং একটা অয়্যারলেস সেট। ঠিক চেয়ারের উপরেই দেয়ালে টাঙানো একটা পাওয়ার ফুল আগুন নির্বাপক গ্যাস সিলিন্ডার, যা গোটা বাড়ির আগুন নিভিয়ে ফেলতে পারে এবং তার পাশেই টাঙানো রয়েছে একটা গ্যাস মাস্ক।
খুশী হলো আহমদ মুসা গ্রেট বিয়ারের হেড কোয়ার্টারে তার মূল অফিসটা যেমন হওয়া দরকার, এ অফিসটা তেমনি। প্রাচীর ডিঙাবার সময়ই আহমদ মুসা বুঝেছিল এটাই গ্রেট বিয়ারের হেড কোয়ার্টার। হেড কোয়ার্টার ছাড়া একটা সাধারণ ঘাটির প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এমন ইলেক্ট্রনিক্স হতে পারে না।
আহমদ মুসা ধীরে ধীরে এগুলো টেবিলের দিকে। তার প্রথম টার্গেট কম্পিউটার সার্চ করা, তারপর একে একে সবকিছু।
ওদিকে আহমদ মুসা অফিস কক্ষে ঢোকার সংগে সংগেই করিডোর দিয়ে কয়েকজনকে ছুটে আসতে দেখা গেল। তারা সদলবলে ঢুকল প্রথম এয়ারকন্ডিশন ঘরটায় যেখানে আহমদ মুসা প্রথমে জানালা খুলে প্রবেশ করেছিল। মিনিট খানেকের মধ্যেই বেরিয়ে এল তারা। ছুটে এল আরও সামনে। এসে দাঁড়াল আহমদ মুসা প্রবেশ করেছে যেখানে সেই অফিস কক্ষের দরজায়। একজন লক পরীক্ষা করে চিৎকার করে উঠল, লক গলিয়ে এখনি এই কক্ষে কেউ প্রবেশ করেছে, লকটা এখনও গরম।
তার চিৎকার শুনে ছুটে এল সেই স্বাস্থ্যবান ও দীর্ঘদেহী লোকটা।
এর নাম আলেকজান্ডার পিটার। খাস রাশিয়ান। মধ্য এশিয়া গ্রেট বিয়ারের প্রধান সে। এই আলেকজান্ডার পিটারেরই একমাত্র মেয়ে তাতিয়ানা। আলেকজান্ডার নিজেও লকটা পরীক্ষা করল। বলল, ‘ঠিক বলেছ, এইমাত্র শয়তানটা এখানে প্রবেশ করেছে।’ বলেই পিটার পাশের একজনের দিকে চেয়ে বলল, জুকভ তুমি কয়েকজনকে পাঠাও ঘরের ওপাশটা পাহারার জন্যে, যাতে জানালা ভেঙে সে পালাতে না পারে।’
জুকভ চলে গেল।
‘স্যার আমরা কি দরজা ভাঙব? সে তো ভেতর থেকে ছিটকিনি লাগিয়ে দিয়েছে।’ একজন বলল।
‘ভাঙতে পারবে দরজা, একবার চেষ্টা করো না।’ মুখে হাসি টেনে বলল পিটার।
পিটারের কথার পরেই চারজন একটু দূর থেকে দৌড়ে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল দরজার ওপর। মৃদু শব্দ হওয়া ছাড়া সামান্য একটু কাঁপলও না দরজা।
‘চারজন কেন চারগন্ডা এলেও দরজা ভাঙবে না। সেভাবেই দরজা তৈরী। ধড়িবাজ লোক এটা বুঝেই ছিটকিনি লাগিয়ে নিজেকে নিরাপদ ভাবছে কিন্তু কতক্ষণ?’ বলল পিটার।
‘স্যার ভেতরে আমরা আগুন কিংবা গ্যাস স্প্রে করতে পারি, তাহলে বাছাধন এখনি দরজা খুলে বেরিয়ে আসবে।’ অন্য একজন বলল।
‘তোমার এই কৌশল কাজে লাগবে না। ভেতরে আগুন নির্বাপন আসে, গ্যাস মাস্কও আছে।’
‘তাড়াহুড়োর কি আছে। আপনাতেই খাঁচায় উঠেছে। একটু খেলিয়ে ধীরে-সুস্থে বের করে নেব।’
তাতিয়ানা এক হাত দিয়ে সিঁড়ির রেলিং চেপে ধরে সিঁড়ির গোড়ায় মূর্তির মত দাঁড়িয়ে ছিল। প্রবল এক বিস্ময় এবং উদ্বেগের ঝড় তাকে দলিত-মথিত করছে। তাকে উদ্ধারকারী ঐ লোকটির পরিচয় সে জানে না কিন্তু লোকটি তার কাছে অনেক বড় বিস্ময়কর সুন্দর একটি চরিত্র। তাঁকে তাতিয়ানা আমন্ত্রণ জানিয়েছিল আসার জন্য। কিন্তু তিনি এভাবে এ বাড়িতে কেন? কেন তিনি প্রবেশ করেছেন অফিস কক্ষে? এমনভাবে তিনি নিজেকে ফাঁদে ফেললেন কেন? কোন বোকার মত কাজ করার লোক তিনি অবশ্যই নন। তিনি কোন সাধারণ লোকও নন অবশ্যই। কিছুক্ষণ আগে চরম বিপদগ্রস্থ অবস্থায় তাকে দেখেছে সে। কিন্তু তার চোখে-মুখে দুর্ভাবনার কোন কিছু সে দেখেনি। অসাধারণ কোন নার্ভের অধিকারী না হলে এমন বেপরোয়া কেউ হতে পারে না। তাছাড়া যে অস্ত্র দিয়ে তিনি লক গলিয়ে অফিস কে প্রবেশ করেছেন তাও অসাধারণ। কিন্তু এ কি কাজ করলেন তিনিক! কি হবে এখন! কেঁপে উঠল তাতিয়ানার হৃদয়।
পুব আকাশে সুবেহ সাদেকের আলো ফুটে উঠল।
ঠিক এই সময়েই সামনের লন থেকে স্টেনগানের আওয়াজ ভেসে এল। পরে পিস্তল ও স্টেনগানের শব্দ এল বাড়ির চারদিক থেকেই। সেই সাথে শুরু হলো দৌড়া দৌড়ির শব্দ।
আলেকজান্ডার পিটার দাঁড়িয়েছিল বন্ধ অফিসটির সামনেই। সে উৎকর্ণ হয়ে উঠল স্টেনগানের আওয়াজে। পরক্ষণেই তার মনোভাব হয়ে উঠল অত্যন্ত কঠোর। একজন ছুটে এসে বলল, ‘স্যার সৈন্যরা আমাদের বাড়ি ঘিরে ফেলেছে।’
‘জানি। যাও সভাকক্ষে আমার সোফার নীচ থেকে আমার ব্রিফকেস নিয়ে এস।’
কয়েক মুহূর্তের মধ্যে ব্রিফকেস এনে হাজির করল লোকটা।
ব্রিফকেস খুলতে খুলতে ঐ লোকটিকে লক্ষ্য করেই বলল, ‘দুতলায় উঠার সিঁড়ির দরজা দু’টি বন্ধ করে দিয়ে সাইরেনটা বাজিয়ে দাও। সবাই সরে পড়ুক। আর যাও গোপন পথের দরজা খুলে দিয়ে তোমরা সবাই সরে পড়। মনে রেখ জীবন্ত কারও ধরা পড়া চলবে না। যাও।’
বিস্ময়-বিস্ফরিত চোখ মেলে তাতিয়ানা সব দেখছে এবং শুনছে। সে ভেবে পাচ্ছে না, সৈন্যরা তাদের বাড়ি ঘেরাও করল কেন? তার উদ্ধারকারী লোকটা আটকা পড়ার সাথে কি এর কোন সম্পর্ক আছে? লোকটিকে উদ্ধার করার জন্যেই কি ওদের আগমন? কিন্তু কেন?
তাতিয়ানা চমকে উঠল তার আব্বাকে ব্রিফকেস থেকে ডিনামাইট বের করতে দেখে। বুঝতে পারল তাতিয়ানা তার আব্বার পরিকল্পনা। ডিনামাইট দিয়ে গোটা বাড়িটি উড়িয়ে দিয়ে লোকটিসহ অফিস, রেকর্ড র্ধ্বংস করে সব চিহ্ন মুছে ফেলে সরে পড়তে চান বাড়ি থেকে।
ঠিক অফিস কক্ষের সামনে ডিনামাইট ফিট করে ছোট ফিউজটিতে অগ্নি সংযোগ করে দ্রুত উঠে দাঁড়াল আলেকজান্ডার পিটার। ছুটে এল সিঁড়ির দিকে। সিঁড়ির গোড়ায় দাঁড়ানো তাতিয়ানাকে লক্ষ্য করে বলর, ‘মা তাতি ঐ যে জরুরী পথের দরজা খুলে গেছে তুমি চলে যাও। আমি আসছি।’
বলে আলেকজান্ডার পিটার সিঁড়ি দিয়ে তর তর করে উঠে গেল তিন তলায়।
পিতা আলেকজান্ডার পিটারের কথাগুলোর কোনটাই তাতিয়ানার মনে ক্রিয়া করেনি। তার সমস্ত চিন্তা-মনোযোগ ডিনামাইটের দিকে। ডিনামাইট ফাটলে গোটা বিল্ডিং ধ্বসে পড়বে, আর ছাতু হয়ে যাবে অফিস কটি। ডিনামাইটটি ফাটতে কত দেরী, ফিউজটি কত বড়- এ প্রশ্নগুলো ঝড় তুলেছে তাতিয়ানার মনে। তার পিতা এখনই তিন তলা থেকে নামবে। তিনি না গেলে ডিনামাইটের গায়ে হাত দেয়া যাবে না। তিন তলার সিঁড়িতে পায়ের আওয়াজ পেল তাতিয়ানা। সঙ্গে সঙ্গে তাতিয়ানা এক দৌড় দিয়ে বন্ধ অফিস কক্ষের পাশের কক্ষে ঢুকে গেল। তাতিয়ানা দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে উঁকি দিয়ে দেখল, তার পিতা নেমে এসে ডিনামাইটটি পরীক্ষা করল। তারপর সিঁড়ির ওপাশে দেয়ালে খুলে যাওয়া গোপন দরজার দিকে ছুটে গেল। পিটার দরজা দিয়ে ঢুকে যাবার পর দরজাটা বন্ধ হয়ে গেল, দরজাটি পরিণত হলো আস্ত দেয়ালে।
ছুটে বেরিয়ে এল তাতিয়ানা। ছুটে গেল ডিনামাইটের কাছে। হাঁটু মুড়ে বসল তার পাশে। দেখল, ফিউজ শেষ হবার পথে। আতংকিত তাতিয়ানা জ্বলন্ত ফিউজটির শেষ অস্তিত্বটুকু ধরে তা খুলে ফেলল ডিনামাইট থেকে। জ্বলন্ত ফিউজের আগুনের ছোবল তাতিয়ানার অনামিকা ও বুড়ো আঙুলকে আহত করল। কিন্তু সেদিকে ভ্রুপে মাত্র নেই তাতিয়ানার।
ফিউজটি খুলে ফেলে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে যাচ্ছিল তাতিয়ানা, এমন সময় দেখল ডিনামাইটের অটোমেটিক ডেটোনেটর হোলে একটা পিন বসানো। অত্যন্ত সেনসিটিভ সে পিনটি স্থিরভাবে বসে আছে। তাতিয়ানা বুঝল, কম্পিউটার নিয়ন্ত্রিত কমান্ড সুইচটি তার পিতার হাতে আছে। সেখান থেকে সুইচটি টেপার সাথে সাথে পিনটি ডিনামাইটের নার্ভে আঘাত করবে, সঙ্গে সঙ্গেই ঘটবে প্রলয়ংকরী বিস্ফোরণ।
উদ্বেগ-আতংক তাতিয়ানার নিঃশ্বাস বন্ধ হবার যোগাড় হলো। কাঁপতে লাগল তার বুক, সমগ্র স্নায়ু মন্ডলী। পিনটা আলগা করতে না পারলে যে কোন মুহূর্তে বিস্ফোরণ ঘটে যাবে।
তাতিয়ানা শুয়ে পড়ল ডিনামাইটের পাশে। ধীরে ধীরে তার দু’টি আঙুল এগিয়ে দিল পিনের দিকে। তাতিয়ানার সমস্ত মনোযোগ, সমস্ত চেতনা পিনের ওপর কেন্দীভূত। কম্পিত দু’টি আঙুল তার এগিয়ে যাচ্ছে পিনকে লক্ষ্য করে। কিন্তু তাতিয়ানার আঙুল পিন স্পর্শ করতে সাহস পেলনা। ভয় হলো, তুলতে গিয়ে যদি চাপ লাগে, তাহলে পিন ডিনামাইটের নার্ভে গিয়ে আঘাত করতে পারে এবং ডেকে আনতে পারে ভয়াবহ বিষ্ফোরণ।
ঘেমে উঠেছে তাতিয়ানা। কপাল থেকে দর দর করে নেমে আসছে ঘাম তার গন্ড বেয়ে।
হঠাৎ তাতিয়ানার মনে পড়ল, তার চাবির রিঙের সাথে ক্ষুদ্র চাকু আছে তাতে রয়েছে শক্তিশালী চুম্বক। এই চুম্বক সহজেই টেনে তুলে আনতে পারে পিনটিকে।
তাতিয়ানা চাবির রিংটি বের করল এবং চাকুটি বের করে আনল কেবিন থেকে। তারপর চাকুটিকে পিন সোজা অনেক ওপরে নিয়ে ধীরে ধীরে নামিয়ে আনতে লাগল পিন লক্ষ্যে। তাতিয়ানা তখন নিঃশ্বাস ফেলতেও ভুলে গেছে। কাঁপছে তার হাত। মনে তার আশা-নিরাশার দ্বন্দ্ব। ঘামে ভিজে গেছে তাতিয়ানার দেহ।
তাতিয়ানার চুম্বক-চাকুটি পিনের এক ইঞ্চির মধ্যে আসতেই পিনটি লাফিয়ে বেরিয়ে এসে আঁকড়ে ধরল চুম্বক-চাকুর দেহকে।
‘ওহ গড’ বলে তাতিয়ানা তার মাথাটা এলিয়ে দিল মাটির ওপর। তার চোখ দুটি উর্ধমুখী হতেই দেখতে পেল চার-পাঁচ জন তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে সবার হাতেই ষ্টেনগান, পরণে সৈনিকের পোশাক। শুধু একজনের পরণে সাধারণ পোশাক। হাতে সর্বাধুনিক জাতের মেশিন রিভলবার। তাদের মুখে উদ্বেগ-আতংকের চিহ্ন তখনও মুছে যায়নি।
তাতিয়ানর সাথে চোখাচোখি হতেই সাধারণ পোশাকের সেই লোকটি বলে উঠল, ‘ধন্যবাদ বোন, আপনি কে জানি না। কিন্তু ধ্বংস থেকে রক্ষা করলেন এই বাড়িকে, আমাদের সকলকে। আহমদ মুসা কি এই ঘরে?ক’
‘আহমদ মুসা কে?’ বিস্ময়পূর্ণ জিজ্ঞাসা ফুঠে উঠল তাতিয়নার কন্ঠে। আহমদ মুসাকে সে দেখেনি, কিন্তু জানে তাকে। আহমদ মুসা সোভিয়েত সাম্রাজ্যের এক সর্বনাশের নায়ক।
‘এই বাড়িতে একজন লোক ঢুকেছিল সে …. ….’
তার কথা শেষ না হতেই সামনের দরজাটা খুলে গেল। বেরিয়ে এল আহমদ মুসা।
তাতিয়ানা ততক্ষণে শোয়া থেকে উঠে বসেছিল।
আহমদ মুসা বেরিয়ে আসতেই রিভলবার ওয়ালা লোকটি রিভলবার ফেলে দিয়ে জড়িয়ে ধরল আহমদ মুসাকে। বলল, ‘আহমদ মুসা ভাই, আপনি ভাল আছেন তো?’
‘হ্যা আজিমভ, গ্রেট বিয়ারের প্রধান আলেকজেন্ডার পিটারের অফিসে বসে নিশ্চিন্তে কাজ করছিলাম। জানতাম ভোরে তোমরা আসবে। কিন্তু ধ্বংসের এ আয়োজনের কথা তো ঘুর্ণাক্ষরেও ভাবিনি।’ ডিনামাইটের দিকে তাকিয়ে বলল আহমদ মুসা।
‘ধন্যবাদ দিন এই মেয়েটিকে। ফিউজ না খুলে ফেললে অনেক আগেই বিষ্ফোরণ ঘটে যেত। অটোমেটিক ডেটোনেটিং-এর ব্যবস্থাও ছিল বাড়তি ব্যবস্থা হিসাবে। অটোমেটিক ডেটোনেটরের পিনটিও সে খুলেছে অবিশ্বাস্য বুদ্ধিমত্তার সাথে। রুদ্ধশ্বাসে আমরা দাঁড়িয়ে থেকে তা দেখেছি।’
তাতিয়ানা উঠে দাঁড়িয়েছিল। তার মাথা নিচু। তার হৃদয়ে বিস্ময়ের ঝড়। এই লোকটি আহমদ মুসা! আহমদ মুসা তাকে বাঁচিয়েছিল সেদিন! সেদিনের ঘটনাগুলো এক এক করে মনে পড়ল তার। সাহস, শক্তি ও চরিত্রে অসাধারণ সে। অথচ এই লোকটির কত বদনাম সে শুনেছে। নিষ্ঠুর, রক্তপায়ী, চরিত্রহীন, কত কি! কিন্তু নিজের চোখে সে দেখল কত উপকারী সে। সেদিন একজন অমুসলিম বৃদ্ধকে সে যে সাহায্য করল, আপন করে নিল, এমনটা সম্ভব নয় একজন মানুষের পক্ষে যদি তার হৃদয় মানুষের জন্য দরদ ভরা না হয়। সেদিন সে তাতিয়ানাকে বাঁচিয়েছিল। এর বিনিময়ে সে তাতিয়ানার সাথে ঘনিষ্ঠ হওয়াতো দূরে থাক, তাতিয়ানার নাম-পরিচয়ও জিজ্ঞাসা করেনি। অত্যন্ত উচুমানের চরিত্র না হলে এমন কেউ হয়না। এমনি নানা কথা ভেবে চলেছে তাতিয়ানা।
সৈনিকরা চারিদিকে সার্চের জন্য বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে পড়েছিল। আহমদ মুসার পাশে শুধু দাঁড়িয়েছিল আজিমভ।
‘ধন্যবাদ তাতিয়ানা। তুমি আজ যা করেছ তার পরিমাপ কোন মানদন্ডেই হয়না।’
তাতিয়ানা একবার মুখ তুলে আহমদ মুসা দিকে তাকিয়ে আবার মুখ নিচু করল।
‘তোমার আব্বা এবং অন্যরা কোথায়?’
‘ওঁরা এখন নাগালের বাইরে।’
‘তোমাকে নিয়ে যায়নি?’
‘আমি পেছনে রয়ে গেছি তিনি জানতেন না।’
‘ডিনামাইট কে পেতেছিল?’
‘আব্বা, আলেকজেন্ডার পিটার।’
‘তোমার আব্বার অন্যায় শুধরাবার জন্য রয়ে গেল তাহলে?’
ক’কিছুক্ষণ কথা বলল না তাতিয়ানা। পরে মুখটা চকিতের জন্য একটু তুলে বলল, ‘আপনি যা ইচ্ছা ভাবুন।’
তাতিয়ানার কন্ঠ ভারি।
আহমদ মুসার তৎক্ষণাতই মনে হলো, তাতিয়ানাকে ঐভাবে কথা বলা তার ঠিক হয়নি। এইভাবে মানুষের নিয়তের উপর হাত দেয়া যায় না।
‘কিছু মনে করো না তাতিয়ানা, একটু মজা করলাম।’ বলে আহমদ মুসা অফিস রুমে ঢুকতে ঢুকতে আবার বলল, ‘একটু দাড়াও তাতিয়ানা, একটু কাজ বাকি আছে।’
আহমদ মুসা ঢুকে গেল অফিসের ভেতরে।
তাতিয়ানা করিডোরের রেলিং-এ ঠেস দিয়ে দাঁড়াল। তার চোখ অফিসের ভেতরে। দেখছে সে জগৎবিখ্যাত লোকটির তৎপরতা।

Top