১৭. ব্ল্যাক ক্রসের কবলে

চ্যাপ্টার

পূর্ব প্যারিস। শোন নদীর প্রথম ব্রীজ থেকে দু’শ গজ উত্তরে একটা অখ্যাত গলির মুখে দাড়িয়ে সুদৃশ্য প্রাসাদ তুল্য একটা বাড়ি। দাড়িয়ে আছে শোনের দিকে মুখ করে। এই বাড়িরই শীর্ষ তিনটি ফ্লোর নিয়ে ব্ল্যাক ক্রস-এর প্যারিস হেডকোয়ার্টার। নিচের ফ্লোরগুলোকে বাণিজ্যিক কাজে ব্যবহার করছে ব্ল্যাক ক্রস।
শীর্ষ ফ্লোরের একটা বিরাট কক্ষ।
সেই কক্ষের বিরাট টেবিলের পেছনে দৈত্যাকার রিভলভিং চেয়ারে ঠেস দিয়ে দাড়িয়ে ব্ল্যাক ক্রস এর প্রধান পিয়েরে পল রাগে ফুসছে। আর টেবিলের ওপাশে ধরাপড়া চোরের মত পাংশু মুখে দাড়িয়ে আছে ফ্রান্স এলাকার ব্ল্যাক ক্রস অপারেশন কমান্ডার মিঃ জিয়ান টুর্গো।
মিঃ পিয়েরে পল ক্রোধে চোখ-মুখ লাল করে তীব্র কন্ঠে বলছিল, ‘কে একজন লোক প্যারিসে আমাদের তিনজনকে মারল, জাহাজে হত্যা করল দশজনকে, নানতেজের ঘাটিতে আরও তিনজনকে এবং সুর লোরেতে হত্যা করল আরও নয় জনকে, আর তোমরা বসে ঘোড়ার ঘাস ঘাটছ!’
‘স্যার লোকটাকে ঘরেও আটকানো যায়নি’। মুখ কাঁচু-মাচু করে বলল জিয়ান।
‘আটকানো যাবে কেন? তোমরা তো শেয়ালের বাচ্চা, আর সে সিংহের বাচ্চা। লজ্জা করে না এসব কথা বলতে?’
‘স্যার, আমাদের লোকদের চেষ্টার কোন ত্রুটি ছিল না। তাদের জীবন দেয়াই তো তার প্রমাণ’।
‘আর বলো না এসব কথা। মরে তো গরু ছাগল ধরনের লোকরাই’।
‘লোকটা ভয়ানক ধূর্ত স্যার?’
‘এর অর্থ তোমরা ভয়ানক বোকা? তার নামে তোমরা জানতে পেরেছ?’
‘না স্যার’।
‘অপদার্থের দল। গোটা একটা রাত, একটা দিন তোমাদের হাতে ছিল লোকটা, আর তার নাম জানতে পারনি!’
‘স্যার, যারা তার সাথে কথা বলেছে তারা কেউ বেঁচে নেই স্যার।
‘লজ্জা করছে না এসব কথা বলতে। তাকে খুজে বের করার কি ব্যবস্থা করলে?’
‘তার চেহারার সঠিক বর্ণনা কেউ দিতে পারছে না স্যার। ব্ল্যাক ক্রস-এর যে ড্রাইভার তাকে সুর লোরে নিয়ে গিয়েছিল, সে বলছে লোকটির চেহারার দিকে ভালো করে সে তাকায়নি। আর জাহাজের যারা বেঁচে আছে, তারা বিভিন্ন বর্ণনা দিচ্ছে। তারা বলছে তারা নাকি লোকটার মুখের দিকে তখন তাকাবারই সাহস পায়নি’।
‘তোমার লোকেরা এমন অপদার্থ হলে তুমি কি? বড় অপদার্থ নও? জান লোকটা কোন দেশী?’
‘স্যার, কেউ বলে তুর্কি, কেউ বলে চীনা, কেউ বলে আরবী, কারও কারও মতে সে বলকান কিংবা ইউরোপেরও হতে পারে’।
টেবিলে একটা প্রচন্ড ঘুষি মেরে চোখে আগুন ঝরিয়ে বলল, ‘গর্দভ, একজন লোকের এত দেশের চেহারা হয় কি করে?’
‘স্যার, ফরাসি গোয়েন্দা দফতরের সাহায্য নিলে হয় না। ওদের হাতে সব ক্রিমিনালের ছবি আছে। সেগুলো দেখলে হয়তো আইডেনটিফাই করা যাবে’।
‘ও! তুমি দেখছি একজন ফুঁচকে খুনিকে কার্লোস বানাতে চাও!’
এই সময় দরজায় নক হলো।
মিঃ পিয়েরে সোজা হয়ে দাড়িয়ে চেয়ারে ফিরে এল। তাকাল পাশের ছোট্ট টিভি স্ক্রিনের দিকে। তার মুখটা প্রষন্ন হয়ে উঠল। চেয়ারের হাতলের সাথে সেট করা একটা বোতাম চাপ দিল পিয়েরে পল। অমনি দরজা খুলে গেল।
ঘরে প্রবেশ করল ‘ওকুয়া’ প্রধান মাইকেল সোম্বা।
‘যাও কাজ করগে। জিয়ান টুটোর দিকে তাকিয়ে বলল পিয়েরে পল।
জিয়ান বেরিয়ে গেল।
মিঃ পিয়েরে উঠে দাড়িয়ে স্বাগত জানাল মাইকেল সোম্বাকে।
দু’জন বসল।
প্রথমেই কথা বলল সোম্বা, ‘কেমন আছেন মিঃ পল?’
‘না, ভালো নেই মিঃ সোম্বা। গত কয়েকদিন আমরা আমাদের তিন ডজন লোক হারিয়েছি’।
‘হ্যাঁ, আমি শুনলাম এই কথা। উপদ্রবটি কোত্থেকে আমদানি হলো?’
‘আমরা বুঝতে পারছি না। আমাদের ঘাটিতে ঢুকেছিল চুরি বা অন্য কোন উদ্দেশ্যে। আমাদের হাতে ধরা পড়েছিল। শেষ পর্যন্ত ওর হাতে আমাদের ৩৪ জন লোক মারা পড়ল, কিন্তু তাকে আমরা কিছুই করতে পারলাম না’।
‘সাংঘাতিক ব্যাপারতো!’
‘হ্যাঁ, এ ব্যাপার নিয়েই এতক্ষণ ধমকালাম আমাদের অপারেশন কমান্ডারকে। যাক, কাজের কথায় আসা যাক’।
‘ফাদার ফ্রান্সিস বাইককে যে কথা বলেছিলেন, সে ব্যাপারে নাকি অনেকদুর এগিয়েছেন?’
‘অনেকদুর মানে আসল কাজ হয়ে গেছে’।
‘সেটা কি?’
‘ব্যাপারটা আমিও ঠিক বুঝি না। মানুষের উপর মনোদৈহিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তাকে হাতের মুঠোয় আনার বৈজ্ঞানিক কৌশল আবিস্কৃত হয়েছে। ওমর বায়ার উপর আমরা এই কৌশলই প্রয়োগ করতে চাচ্ছি। এতে সে স্বেচ্ছায় আমাদের হাতে চলে আসবে এবং আমরা তাকে যে আদেশ করব তাই সে পালন করবে’।
‘এটা সম্ভব?’ চোখ কপালে তুলে বলল মাইকেল সোম্বা।
‘সম্ভব’ কিন্তু এই জটিল কাজের জন্যে উপযুক্ত বিশেষজ্ঞ কয়েকজন মাত্র দুনিয়াতে আছেন। এদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ হলেন বিজ্ঞানী বেনহাম। তিনি ৪০ বছর ধরে ইহুদিদের এই প্রজেক্টের প্রধান হিসেবে কাজ করছেন’।
‘এর উপর ইহুদিদের প্রজেক্ট আছে?’
‘হ্যাঁ আছে’।
‘কেন?’
হাসল পিয়েরে পল। বলল, ‘আপনি শিশুর মত প্রশ্ন করলেন মিঃ সোম্বা। জুইস ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন (JIO) ইহুদিবাদ বিরোধীদের কুপোকাত করার জন্যে ‘মনোদৈহিক নিয়ন্ত্রণ’কেই প্রধান অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে আসছে। আরব ও মুসলিম জগতের শত শত নেতার উপর তারা এই পদ্ধতির প্রয়োগ করেছে। এটা আমার বানানো কথা নয় মিঃ সোম্বা। ফিনল্যান্ডের ‘হেলসিংকি বিশ্ববিদ্যালয়’- এর অধ্যাপক B. Kwan Choe তার ‘The Social Reality of Artificial Mind and Body Control’ শীর্ষক ১৩৪ পৃষ্ঠার এক নিবন্ধে বলেছেন, ‘ইহুদিবাদীরা তাদের নিজেদের হাত নিরাপদ রাখার জন্যে ‘মনোদৈহিক নিয়ন্ত্রণ’ ব্যবস্থার মাধ্যমে অন্যকে তাদের বাঞ্ছিত হত্যা ও অন্যান্য অপরাধ সংঘটনে বাধ্য করে। কেনেডি, রবার্ট কেনেডি, মার্টিন লুথার কিং, জর্জ ওয়ালেস-এর হত্যাকান্ড এই ব্যবস্থারই ফল। ইহুদিবাদ বিরোধী বহু আরব নেতাকে তাদের রাজনৈতিক ও সামাজিক মর্যাদা বিসর্জন দিতে হয়েছে, এমনকি তারা জীবন দিয়েছে এই ব্যবস্থার ফাদে পড়েই। এসব দ্বারা ইহুদিবাদীরা তাদের বড় বড় স্বার্থ হাসিল করেছে। সুতরাং ‘কেন’ তাদের প্রজেক্ট, এ জিজ্ঞাসার কোন অবকাশ নেই’।
‘কিন্তু এত বড় অস্ত্র ইহুদিরা মনোপলি করে রেখেছে। আমরা এর সন্ধান পাইনি কেন?’
‘মিঃ সোম্বা, বুঝতে পারছেন এসব কাজও তো ওদের মনোপলি। ওরা যেভাবে ওদের জাতির জন্যে কাজ করে, আমরা করিনা। জাতির জন্যেই তারা এ অস্ত্রের সন্ধান করেছে এবং প্রয়োগ করছে’।
‘কেন, জাতির জন্যে তো আমরাও কাজ করছি? গোটা দুনিয়াতেই আমাদের খৃষ্টান মিশন আছে, আমাদের এনজিও আছে। কিন্তু আমরা তো এ অস্ত্রের চিন্তা করি নি’।
‘না করার একটা কারণ হলো, আমাদের খৃষ্টানদের সংখ্যা বেশী, শক্তিতেও বড়। সুতরাং আমরা যা চাই তা এমনিতেই করতে পারি। কিন্তু ইহুদিদের সংখ্যা খুব অল্প। ধর্মান্তরের মাধ্যমে তাদের সংখ্যা বৃদ্ধিরও কোন উপায় নেই। কারণ বনি ইসরাইল বংশের লোক হওয়া ছাড়া কেউ ইহুদি হতে পারে না। সুতরাং খুব কম সংখ্যক মানুষ নিয়ে তারা তাদের দুনিয়া জোড়া স্বার্থ সংরক্ষণ ও সম্প্রসারণের চেষ্টা করছে। এজন্যে বৃদ্ধিই তাদের প্রধান হাতিয়ার। ‘মনোদৈহিক নিয়ন্ত্রণ’ এই বুদ্ধিবৃত্তিক হাতিয়ারেরই একটি’।
‘চমৎকার, চমৎকার বলেছেন মিঃ পিয়েরে পল। ইহুদিদের মত প্রয়োজন এখন আমাদেরও দেখা দিয়েছে’।
‘ঠিক বলেছেন। প্রয়োজন আমাদেরও দেখা দিয়েছে। আমাদের সংখ্যা, সামর্থ, অর্থ সবই আছে। কিন্তু মুসলমানদের আদর্শ- বিশ্বাসের মোকাবিলা করার কোন অস্ত্র আমাদের নেই। এই ক্ষেত্রেই আমরা প্রচন্ড রকম মার খেয়ে যাচ্ছি। আমাদের এই পরাজয় এড়াবার জন্যেই ইহুদিদের পথ আমাদের অনুসরণ করা দরকার। এই ক্ষেত্রে ওমর বায়া হবে আমাদের প্রথম শিকার’।
‘ধন্যবাদ মিঃ পিয়েরে। আমরা এ জন্যে আপনার কাছে চির কৃতজ্ঞ থাকব। আমরা যদি, ওমর বায়াকে হাতের মধ্যে এনে তাকে দিয়েই কাজ সারাতে পারি, তাহলে সেটা যে কি আনন্দের হবে। আমাদের বদনামও অনেক চলে যাবে। মুসলমানরা প্রপাগান্ডা করে, আমরা নাকি নানা ছলে বলে কৌশলে মুসলমানদের ভুমি দখল করে চলেছি। ওমর বায়া যদি নিজেই গিয়ে তার জমি আমাদের লিখে দেয়, তাহলে ঐ প্রপাগান্ডার মুখে প্রথমবারের মত কিছু ছাই গিয়ে পড়বে’।
‘কিন্তু এই লাভের জন্যে বিরাট মূল্যও দিতে হবে মিঃ সোম্বা’।
‘কি মুসা?’
‘আমাদের সাথে আপনাদের যে টাকার চুক্তি, বিজ্ঞানী বেনহামের সম্মানী তার বাইরে হবে’।
‘আমরা রাজি। কত টাকা?’
‘আনুসঙ্গিক সব খরচ সমেত মাত্র দুই লাখ ডলার’।
‘রাজী, মিঃ পিয়েরে’।
‘চলুন, উঠা যাক’।
‘কোথায়?’
‘বিজ্ঞানী ডঃ বেনহামের সাথে দেখা করতে’।
‘ডঃ বেনহাম? কোথায় উনি?’
‘উনি তো এসেছেন। আনা হয়েছে তাকে। তিনি হোটেলে আমাদের অপেক্ষা করছেন’।
‘হিপ হিপ হুররে। চলুন তাহলে’। বলে শিশুর মত চিৎকার করে উঠে দাঁড়াল মিঃ সোম্বা।
উঠল মিঃ পিয়েরে পলও। হোটেলে পৌছাল তারা। নক করল গিয়ে ডঃ বেনহামের কক্ষে।
ভেতর থেকে কোন সাড়া না পেয়ে মিঃ পিয়েরে চাপ দিল দরজায়।
দরজা খোলাই ছিল। খুলে গেল।
ঘরে প্রবেশ করল মিঃ পিয়েরে পল এবং মিঃ মাইকেল সোম্বা।
বিজ্ঞানী ডঃ বেনহাম তার টেবিলে বসে বই পড়ছিল।
ডঃ বেনহাম দীর্ঘকায়। হাল্কা-পাতলা গড়ন। সেমেটিক চেহারা। অর্থাৎ ডঃ বেনহাম একজন ইহুদি।
বইয়ের মধ্যে ডুবেছিল ডঃ বেনহাম।
মিঃ পিয়েরে তার দিকে এগিয়ে বলল, ‘গুড মর্নিং ডঃ বেনহাম’।
ডঃ বেনহাম মাথা তুলে বলল, ‘গুড মর্নিং’। কিন্তু আসন থেকে উঠলেন না ডঃ বেনহাম। ইংগিতে বসতে বলল সামনের সোফায়। ডঃ বেনহামের প্রশ্ন বোধক দৃষ্টি গিয়ে পড়ল মাইকেল সোম্বার উপর।
মিঃ পিয়েরে বলল, ‘ইনি মিঃ মাইকেল সোম্বা। যে কাজের জন্যে আপনাকে কষ্ট দিচ্ছি, সে কাজটা এদেরই’।
ডঃ বেনহাম ঘড়ির দিকে চেয়ে বলল, ‘কাজের কথায় আসা যাক মিঃ পিয়েরে’।
‘জি, আমরা প্রস্তুত’।
‘আমি কিছু শুনেছি, তবু এখন বলুন আপনারা কি চাচ্ছেন?’
‘ওমর বায়া একজন মুসলিম যুবক। তার বাড়ি ক্যামেরুন। সোম্বাদের এস্টেটের মাঝখানে ওমর বায়ার দশ হাজার একর জমি আছে। এই জমিটা ওমর বায়া স্বেচ্ছায় গিয়ে ‘আর্মি অব ক্রাইস্ট অব ওয়েস্ট আফ্রিকা’র কাছে হস্তান্তর করবে। এই ব্যবস্থা আপনি করবেন’।
‘জমি হস্তান্তরে কেন রাজী নয় ওমর বায়া?’
‘প্রথম কারণ জমি বিক্রির কোন প্রয়োজন নেই। কিন্তু আসল কারণ হলো, তারা বলছে খৃষ্টানরা এই ভাবে ভুমি কিনে বা দখল করে গোটা দক্ষিণ ক্যামেরুন শুন্য করে ফেলেছে। এখন ওমর বায়ার জমিটুকু বিক্রি হয়ে গেলেই গোটা দক্ষিণ ক্যামেরুনে মুসলমানদের অস্তিত্ব শেষ হয়ে যায়। এই কারণেই ওমর বায়া জমি বিক্রিতে রাজী নয়। অন্যদিকে এই জমি না হলে খৃষ্টানদের পরিকল্পনা পূর্ণ হয় না, শুধু তাই নয়, ভবিষ্যতে অস্তিত্বও হুমকির সম্মুখিন হতে পারে’।
‘বুঝেছি। এখন বলুন ওমর বায়া লেখা পড়া কি জানে?’
প্রশ্নটির উত্তর মিঃ পিয়েরে পলের জানা নেই। সে তাকাল মিঃ সোম্বার দিকে।
সোম্বার মুখেও বিব্রত ভাব ফুটে উঠল। বলল, ‘এ ব্যাপারে সঠিক কোন তথ্য আমার জানা নেই’।
‘সে কি বিবাহিত’।
‘জি না’। বলল সোম্বা।
‘এক্ষেত্রে তার কোন চয়েস আছে? অর্থাৎ কাউকে সে ভালবাসে কিনা?’
‘এটাও আমাদের জানা নেই’।
‘সে নিয়মিত প্রার্থনা ও ধর্মগ্রন্থ পাঠ করে কিনা?’
‘এটাও জানা নেই’ বলল সোম্বাই।
‘এছাড়া অন্য কোন ধরণের লেখা ও সাহিত্য সে পছন্দ করে?’
‘জানা নেই জনাব’।
‘আনন্দের সময় কাকে সে সাথী হিসেবে নেয়? আবার দুঃখ ও বিপদের সময় কার উপর সে নির্ভর করে?’
‘আমরা জানি না’।
‘এই যে জমি সে দিচ্ছে না, এটা তার নিজস্ব সিদ্ধান্ত, না কারও বুদ্ধিতে সে এটা করছে?’
‘এই ক্ষেত্রে সে তার পিতাকে অনুসরণ করছে। তার পিতাও এ ব্যাপারে আপোশহীন ছিল’।
‘সে অন্তঃমুখী ধরণের লোক, না বহিঃমুখী?’
‘সে খুব চাপা ধরণের ছেলে। কম কথা বলা অভ্যাস’।
‘জীবন যাপনের ব্যাপারে ইসলাম ধর্মের বহু বিধি-বিধান ও আদেশ-নিষেধ আছে। সে কি এসব পুরোপুরি মেনে চলে?’
‘বন্দী অবস্থায় নামায তাকে পড়তে দেখা যাচ্ছে। তবে নিয়মিত পড়ে কিনা জানি না। ধর্মের সব নীতি ও বিধান মেনে চলে কিনা বলতে পারব না। তবে একথা ঠিক যে, ইসলাম ধর্মের প্রকৃত ও পূর্ণ শিক্ষা অর্জনের সুযোগ ক্যামেরুনে নেই’।
‘সে কি হজ্জ করেছে?’
‘আমরা জানি না’।
‘কতকগুলো মানুষের প্রকৃতি এমন আছে যারা শক্তিকেও প্রতিরোধ করতে পারে, আবার আদর এবং প্রশংসাকেও প্রতিরোধ করতে পারে। আবার কেউ আছে শক্তিকে সে প্রতিরোধ করতে পারে, কিন্তু আদর বা প্রশংসার কাছে ভেঙে পড়ে। ওমর বায়া কোন ধরণের লোক?’
‘শক্তি প্রয়োগকে ওমর বায়া পরাভূত করেছে কিন্তু আদরের ব্যাপারটা পরীক্ষা করা হয় নি’।
‘ওমর বায়া যে স্কুল বা কলেজে পড়তেন, সেখানে তিনি নিয়মিত ছিলেন কিনা?’
‘আমরা এটা পরীক্ষা করিনি’।
‘পোষাক-পরিচ্ছেদ, চলা-ফিরা ও সাজান-গোছানোতে সে কি টিপ-টপ?’
‘এ তথ্যও আমাদের কাছে নেই’।
‘সে কোন রংয়ের পোষাক পরে কিংবা কোন রং পছন্দ করে তা কি আপনারা জানেন?’
‘খোঁজ না নিয়ে বলা যাবে না’।
‘কোন ধরণের খাবার সে পছন্দ করে?’
‘এটাও আমাদের জানা নেই’।
‘আচ্ছা আপনারা তো তার উপর অনেক দৈহিক নির্যাতন চালিয়েছেন। সে কি মুখ বুজে সব সহ্য করার ক্ষমতা রাখে, না মাঝে মাঝে চিৎকার করে?’
‘মাঝে মাঝে চিৎকার করেছে’।
‘তার হাতের লেখা দেখেছেন? তার হাতের লেখা কি পরিচ্ছন্ন, স্পষ্ট ও সমমাত্রিক, না বিশৃঙ্খল? একই সময়ে বা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ধরণের লেখা হয় কিনা, বানান ভুল করা তার অভ্যেস কিনা?’
‘দুঃখিত এ তথ্য আমাদের জানা নেই’।
‘তার হার্টবিট, রক্তচাপ, হরমোন, চোখের তারার মাপসহ দৃষ্টিশক্তি ইত্যাদি আপনারা রেকর্ড করেছেন কি?’
‘না, এগুলো আমরা প্রয়োজন মনে করিনি’।
বিজ্ঞানী ডঃ বেনহাম আর কোন প্রশ্ন করল না। একটুক্ষণ চুপ করে থাকল। তারপর বলল, ‘মুসলমানদের বিরুদ্ধে আপনাদের লড়াইয়ে আমি আপনাদের সাহায্য করতে রাজী হয়েছি এবং সাহায্য করব। কিন্তু আমার এ সাহায্যের পথটা খুবই জটিল। এজন্যে আপনাদেরকেও কিছু কাজ করতে হবে’।
একটু থামল ডঃ বেনহাম। তারপর আবার শুরু করল, ‘মনোদৈহিক নিয়ন্ত্রণ আরোপের ব্যাপারটা একটা জটিল প্রক্রিয়া। যাকে নিয়ন্ত্রণ করতে চাই, ব্রেনওয়েভ ট্রান্সমিশন এবং অপটো-ইলেক্ট্রনিক্যাল কনট্রোল কৌশলের মাধ্যমে ভেতর থেকে তার মনোদৈহিক পরিবর্তন আনতে হবে। এজন্যে তার স্বভাব-প্রকৃতি, মেজাজ-মর্জি, বিশ্বাস-কর্ম ইত্যাদি সম্পর্কে জানা প্রয়োজন। তাহলে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার কাজটা সহজ হয়ে যায়। সুতরাং যে প্রশ্নগুলো আমি করলাম তার জবাব সংগ্রহের চেষ্টা করুন। ওমর বায়াকে আপনারা কোথায় রেখেছেন?’
‘আমাদের এক ঘাটিতে বন্দী আছে’।
‘বন্দী যখন হয়ে গেছে, তখন ছেড়ে দিলে তার উপর কাজ করার সুযোগ হবে না। সুতরাং বন্দী তাকে রাখতে হবে কিন্তু তাকে বন্দী পরিবেশে বাঁধা যাবে না। অর্থাৎ ঐ পরিবেশে থাকলে সে অহরহ বন্দীত্বের চাপ অনুভব করবে এবং একটা প্রতিরোধ স্পৃহা তার মধ্যে জাগরুক থাকবে, সে পরিবেশে তাকে রাখা যাবে না’।
‘সেটা কিভাবে সম্ভব?’ বলল পিয়েরে পল।
‘বলছি। তাকে এমন জায়গায় রাখতে হবে যেখান থেকে তার পালাবার সুযোগ থাকবে না। কিন্তু ভেতরে সে তার বাড়ির মতই স্বাধীন পরিবেশে থাকবে। এ ঘর থেকে সে ঘরে যাওয়া, টয়লেট ড্রইং রুমে যাওয়া, ব্যায়াম পায়চারী করা, ইচ্ছা ও পছন্দমত খাওয়া, বই পড়া, গান-বাজনা করা, গল্প ও হাসি-ঠাট্টা করা, ফিল্ম দেখা, ইত্যাদির তার সুযোগ থাকতে হবে। যাতে করে তার মনের উপর কোন চাপ না থাকে। আর তাকে একজন উপযুক্ত সংগী দিতে হবে। সে সুন্দরী, বুদ্ধিমতি ও বাকপটু হবে। তাকে নিয়োগ করা হবে ওমর বায়ার পরিচারিকা হিসেবে। কিন্তু ওমর বায়াকে দৈহিক ভাবে জয় করাই হবে তার কাজ। ওমর বায়ার চরিত্র যদি নষ্ট করা যায়, তাহলে তার আদর্শিক প্রতিরোধ ধ্বসে পড়বে। সেই পরিবেশে তার উপর মনোদৈহিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার কাজ সহজ হবে। আমার দীর্ঘ অভিজ্ঞতায় আমি দেখেছি, আদর্শবাদী মুসলমান, এমনকি আধা আদর্শবাদী মুসলমানকেও ইচ্ছামত মনোদৈহিক নিয়ন্ত্রণে আনা যায় না। তাদের মানসিক প্রতিরোধটা এতটা সবল ও সক্রিয় থাকে যে বিপরীতমুখী ব্রেনওয়েভ ট্রান্সমিশন এবং অপটো-ইলেক্ট্রনিক্যাল কনট্রোল প্রচেষ্টা বার বার তার কাছে ধ্বসে পড়ে। এ জন্যে সব ক্ষেত্রেই প্রথম প্রদ্যোগ নেয়া হয়েছে মুসলমানদের চরিত্র নষ্ট করার। মদ, টাকা, সুন্দরী নারী- এই তিনটিকেই ব্যবহার করা হয়েছে তাদের নষ্ট করার জন্যে। সত্যিকার আদর্শবান মুসলমান যারা, তাদের ক্ষেত্রে এ অস্ত্রও কোন কাজ দেয়নি। তবে আধা আদর্শনিষ্ঠরা আদর্শহীনদের মতই কিছুটা সুযোগ সন্ধানী হয়। তাদের ক্ষেত্রে এই তিনটি অস্ত্র ব্যবহার করে ফল পাওয়া গেছে। তাদের চরিত্র নষ্ট করার পর তাদেরকে খুব সহজেই মনোদৈহিক নিয়ন্ত্রণের মধ্যে এনে যা ইচ্ছে তাই করানো হয়েছে। ওমর বায়ার ক্ষেত্রে অর্থ ও মদ কোন কাজ দেবে না। সুন্দরী ও বুদ্ধিমতি নারী দিয়ে তাকে সহজেই জয় করা যাবে, কারণ সে অবিবাহিত। আপনাদের এই চেষ্টাই করতে হবে’।
‘আপনার কাজ কখন শুরু হবে?’ বলল মিঃ পিয়েরে পল।
‘ওমর বায়াকে নতুন পরিবেশে স্থানান্তর করার পর আমার কাজ শুরু হবে। যে মেয়েকে ওমর বায়ার সংগী নির্বাচন করবেন, তার কাছ থেকে আমি যদি সহযোগিতা পাই, তাহলে দ্রুত ফল পাওয়া যাবে। সুতরাং মেয়েটির সিলেকশন ভাল হওয়া চাই’।
‘চিন্তা করবেন না, ব্ল্যাক ক্রস-এর মহিলা স্কোয়াড সবদিক দিয়েই যোগ্য। তাছাড়া তাদের যোগাযোগের মধ্যে বহু ভালো মেয়ে রয়েছে। টাকা হলে বাঘের চোখ মিলে মিঃ বেনহাম’। বলল পিয়েরে পল।
‘আর কিছু?’ বলল ডঃ বেনহাম।
‘আর কিছু নেই ধন্যবাদ’। বলে মিঃ পিয়েরে পল উঠে দাঁড়াল। উঠল মিঃ সোম্বাও।
বিজ্ঞানী ডঃ বেনহাম আবার মনোযোগ দিল তার বইতে।

ওমর বায়া লক্ষ্য করছিল, তার সাথে ব্ল্যাক ক্রস-এর লোকদের খারাপ ব্যবহার কমে গেছে। একটু ভালো খাবার-দাবারও পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু হঠাৎ ব্ল্যাক ক্রসের লোকরা তার সাথে খুবই ভালো ব্যবহার করতে লাগলো। খাবারের মানও হঠাৎ উন্নত হয়ে গেল। সে বিস্মিত হয়ে ব্ল্যাক ক্রসের একজন লোককে, যে তাকে সেদিন খাবার দিতে এসেছিল, জিজ্ঞাসা করল। লোকটি বলল, ‘আমরা কিছু জানি না স্যার। মানুষের মমতা সব সময় এক রকম থাকে না। শত্রু মিত্র হয়ে যায়, মিত্রও শত্রু হয়ে যায়’।
ওমর বায়া ভেবে পেল না, তার সম্পর্কে ব্ল্যাক ক্রসের মত পরিবর্তন কিভাবে সম্ভব। ওমর বায়া কিভাবে ব্ল্যাক ক্রস-এর মিত্র হতে পারে? সব ভাবনার পর ভাবল, আল্লাহর সাহায্যও তো কোনভাবে আসতে পারে!
সেদিন রাত ১২টা। ওমর বায়া শুয়ে পড়েছে কিন্তু ঘুমায়নি। পিয়েরে পল প্রবেশ করল তার ঘরে। দাঁড়াল এসে ঘরের মাঝখানে।
ওমর বায়া শুয়ে থেকেই তার দিকে পাশ ফিরল।
ওমর বায়া পাশ ফিরতেই পিয়েরে পল বলল, ‘আমি দুঃখিত ওমর বায়া। তোমাকে কষ্ট করতে হবে। আমরা এ জায়গা বদলে ফেলতে চাই। আজ রাতেই। একটু পরে তোমাকে নিয়ে যাবে’।
ওমর বায়া কোন কথা বলল না। তবে পিয়েরে পলের কথায় অবাকই হলো। পিয়েরে পল কোন ব্যাপারে ওমর বায়ার কাছে দুঃখ প্রকাশ এই প্রথম করল।
পিয়েরে পল কথা শেষ করে যাবার জন্যে ঘুরে দাড়িয়েই আবার থমকে গেল। ওমর বায়ার দিকে আবার ঘুরে দাঁড়াল সে। বলল, ‘ওমর বায়া, তোমার বড় ধরনের কোন অসুবিধা হচ্ছে না তো?’
‘আটক ব্যক্তির এসব নিয়ে ভাবার অবকাশ কোথায়?’
‘দেখ, তোমার প্রতি অবিচার হয়েছে। আমরা এখন মত পাল্টেছি। কোন কিছুতে তোমাকে বাধ্য করা আমাদের দায়িত্ব নয়। ‘ওকুয়া’র সাথে আমাদের চুক্তি ছিল, আমরা তোমাকে আটকে রাখার দায়িত্ব পালন করব, তোমাকে দিয়ে যদি কিছু করাতে হয় তারা তা করাবে। আমরা নই। শুরুতে অর্থের প্রলোভনে আমাদের লোকদের তারা মিসগাইড করেছে। আমরা আর সেটা হতে দিচ্ছি না। তাদের কাজ তারা করবে, আমাদের কাজ আমরা করব। তোমার সাথে আমাদের কোন ব্যক্তিগত শত্রুতা নেই। সুতরাং তোমাকে আটকে রাখা ছাড়া তোমার প্রতি আমাদের পক্ষ থেকে আর কোন অবিচার হবে না’।
কথা শেষ করেই ঘুরে দাড়িয়ে চলে গেল পিয়েরে পল। ওমর বায়ার কোন কথা শুনার অপেক্ষাও করল না।
ওমর বায়া সত্যিই অবাক হলো পিয়েরে পলের কথায়। একটু খুশীও হলো। যাক, পিয়েরে পলের কথা যদি সত্যি হয়, তাহলে ব্ল্যাক ক্রসের খারাপ আচরণ থেকে অন্তত বাঁচবে সে। কিন্তু পিয়েরে পল কি সত্য কথা বলেছে? মিথ্যা বলবে কেন? ওমর বায়াতো তাদের কাছ থেকে কিছু চায়নি। তাছাড়া পিয়েরে পলের কথা যে সত্য, তার প্রমাণও তো ইতিমধ্যেই পাওয়া গেছে। ব্ল্যাক ক্রস এখন থেকে তাকে ভাল খাবার দিচ্ছে এবং ব্ল্যাক ক্রস-এর লোকেরা তার সাথে বলা যায় ভালই ব্যবহার করছে। অবশেষে সে ভাবল পিয়েরে পলের কথা সত্যি হোক মিথ্যা হোক তার হারাবার কিছু নেই। যে খারাপ অবস্থায় সে পৌছেছে, মৃত্যু ছাড়া এর চেয়ে বড় আর কিছু আছে!
নিজের অবস্থার কথা ভাবতে গিয়ে তার মনে পড়ল তার মায়ের কথা, তার আব্বার কথা, ছোটবেলার স্মৃতি বিজড়িত তাদের সেই সবুজ উপত্যকার কথা এবং সহজ-সরল তার জাতির লোকদের কথা। এখন সে সব কিছুই নেই। তার আব্বার মৃত্যুর পরই খৃষ্টান মিশনারী ও খৃষ্টান এনজিওদের দৌরাত্ম বেড়ে যায়। তার পিতার স্থান সে পূরণ করতে পারে নি। ফলে খৃষ্টান মিশনারী ও খৃষ্টান এনজিওদের গোপন সন্ত্রাসবাদী সংগঠন ‘আর্মি অব ক্রাইস্ট অব ওয়েস্ট আফ্রিকা’ (ওকুয়া)-এর হাতে পরাজিত হতে লাগল মুসলমানরা। জমি ও ঘর-বাড়ি হারিয়ে মুসলমানরা বিতাড়িত হলো দক্ষিণ ক্যামেরুন থেকে। ওমরা বায়াকেও পালাতে হলো। তার মা নিষ্ঠুরভাবে নিহত হলো ‘ওকুয়া’র হাতে। আজ সে নিজেও ‘ওকুয়া’র হাতে বন্দী। একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলল ওমর বায়া। ‘ওকুয়া’দের পেছনে, খৃষ্টান মিশনারী ও খৃষ্টান এনজিওদের পেছনে রয়েছে পাশ্চাত্যের দেশগুলো। অসহায় মুসলমানদের কোন সাহায্যকারী নেই। ইসলামের নামে, মুসলমানদের নামে কোন সাহায্য করাকে ‘মৌলবাদ’ বলা হচ্ছে, বলা হচ্ছে একে সাম্প্রদায়িকতা। এটা বলা হচ্ছে এই কারণে যাতে ইসলাম ও মুসলিম নামের সংগঠনগুলো কাজ করার সুযোগ না পায়। মুসলিম বিশ্বের অনেক সরকার তাদের ফাদে পড়ে ‘মৌলবাদ’ ও ‘সাম্প্রদায়িকতা’ বিরোধিতার নামে ইসলাম ও মুসলমানদের অগ্রগতি রুদ্ধ করছে।
পাশ ফিরল ওমর বায়া। ভাবনা তার অন্যদিকে মোড় নিল, সেকি কোন দিন মুক্তি পাবে এদের কবল থেকে। ব্ল্যাক ক্রস কয়দিন তার সাথে এই ভাল ব্যবহার করবে। এক সময় নিশ্চয় তাকে তুলে দেবে ‘ওকুয়া’র হাতে। ‘ওকুয়া’ তাকে কি করবে সে ভালো করেই জানে। মনে পড়ল আহমদ মুসার কথা। তিনি কি জানতে পেরেছেন ওমর বায়ার কথা? জানতে পারলে কি হবে, তিনি কতদিক সামলাবেন। ফিলিস্তিন দূতাবাসের লোকদের কাছ থেকে সে আহমদ মুসার গল্প শুনেছে। কত বড় বড় কাজ তিনি করেছেন এবং করছেন। এক ওমর বায়ার কথা ভাববার কি তার সময় আছে! এমন আশা করাও স্বার্থপরতা। একজন ব্যক্তির চেয়ে জাতি অনেক বড়। সেই জাতির কাজে তিনি ব্যস্ত। না, তার আসার দরকার নেই।
ভাবনা আর এগুতে পারল না ওমর বায়ার। পায়ের শব্দে সে ফিরে তাকাল। দেখল ঘরের ভেতরে চারজন লোক। ওমর বায়া তাদের দিকে তাকাতেই বলল, ‘আপনি উঠুন। আমরা এখনি যাত্রা করব’।
উঠল ওমর বায়া।
ওমর বায়া বিস্মিত হলো, তাকে এবার ওরা বাধল না। এ পর্যন্ত সে তিনবার স্থান পরিবর্তন করেছে। প্রত্যেক বারই তার হাত-পা বেধে পশুর মত গাড়িতে ছুড়ে ফেলে তাকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
চারজন তাকে চারদিক থেকে ঘিরে নিয়ে চলল। তাদের প্রত্যেকরই পকেটে হাত। অর্থাৎ তাদের প্রত্যেকেরই হাতে রিভলবার। বাড়ির ভেতরের চত্তরে দাড়িয়েছিল গাড়ি। মাইক্রোবাস। জানালাগুলোতে রঙীন কাঁচ লাগানো।
বাইরে আরো দু’জন দাড়িয়েছিল। তাদের হাতে স্টেনগান।
ওমর বায়াকে গাড়ির মাঝখানে বসিয়ে চারদিকে ঘিরে থাকল ওরা পাঁচজন। স্টেনগান ধারী একজন ড্রাইভারের পাশে বসেছিল।
গাড়ি চলতে শুরু করল। সাত ঘন্টা ধরে চলল গাড়ি।
কোথায় তাকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে? ফ্রান্সের বাইরে কোথাও? ওমর বায়া জিজ্ঞাসা করেও এর জবাব পায়নি। ভদ্র কন্ঠের উত্তর পেয়েছে, ‘আমাদের কিছু বলার হুকুম নেই। আপনি কর্তাকে জিজ্ঞাসা করলেই ভাল করতেন’।
অবশেষে গাড়ি থামল।
গাড়ির দরজা খুলে গেল।
ওমর বায়া গাড়ি থেকে নেমে দেখল একটা বাড়ির চত্তরে সে নামল। চত্তরটির চারদিক দিয়েই বাড়ির দেয়াল। একটা করিডোর দিয়ে গাড়ি প্রবেশ করেছে এ চত্তরে। করিডোরটির মুখেও দরজা।
‘চলুন’। বলে একজন স্টেনগানধারী ওমর বায়াকে সামনের একটা দরজার দিকে যাবার ইংগিত করল।
ওমর বায়া চলল সেদিকে।
দু স্টেনগানধারীর একজন ওমর বায়ার আগে, অন্যজন তার পেছনে।
ঠেলা দিতেই দরজা খুলে গেল।
তারা একটা করিডোর ধরে এগিয়ে চলল। করিডোরটি শেষ হলো আর একটা গেটে। গেটে তারা দাড়াল। স্টেনগানধারীদের একজন ওমর বায়াকে বলল, এই বাড়িতে আপনি থাকবেন। সম্মানের সাথে রাখা হবে। কিন্তু আপনি যদি পালাবার কোন প্রকার চেষ্টা করেন, তাহলে আপনি ভয়ানক বিপদ ডেকে আনবেন। আপনাকে অসম্মান করার হুকুম নেই কিন্তু পালাতে চেষ্টা করলে হত্যা করার হুকুম আছে। চেয়ে দেখুন, বাড়িটার চারদিক স্টেনগানধারী সার্বক্ষণিক প্রহরী দাড়িয়ে আছে। বাড়ির ভেতরে রয়েছে বাবুর্চী ও ফায়ফরমাস খাটার লোকজন। তারা সকলেই ব্ল্যাক ক্রস-এর লোক। আর আপনাকে দেখা শুনার জন্য রয়েছে একজন পরিচারিকা। আপনি গন্ডগোল না করলে খুব ভালই থাকবেন’।
কথা শেষ করে দরজায় নক করল লোকটি।
দরজা খুলে গেল।
দৈর্ঘ্যে-প্রস্থে সমান একজন ভীমাকৃতির লোক খোলা দরজায় দাড়িয়ে। তার দেহটা যত বড় তার মাথাটা তত ছোট। ছোট মাথাটি কামিয়ে বেল করা। অথবা মাথায় কোন দিন চুলই ওঠেনি। মুখটি তার মালভূমির মত এবড়ো-থেবড়ো। সাপের মত কুতকুতে ছোট দুটি চোখ।
লোকটিকে দেখে ওমর বায়ার কিছু ভয়ও হলো, তার সাথে সৃষ্টি হলো প্রবল এক বিতৃষ্ণার। এই ক্রিমিনালটার সাথেই তাকে থাকতে হবে।
স্টেনগানধারী সেই লোকটি দরজায় দাড়ানো মানুষ নামক পিন্ডটাকে লক্ষ্য করে বলল, ‘মশিয়ে লিটল, ইনিই আমাদের মেহমান। একে মিস এলিসা গ্রেস-এর কাছে নিয়ে যাও’। বলে ওমর বায়াকে ইংগিত করল ভেতরে যাওয়ার।
ওমর বায়া ঢুকে গেল ভেতরে।
ভেতরে ঢুকে দেখতে পেল, ফাঁকা চত্বরের উপর ছবির মত সুন্দর একটা বাংলো। চারদিক দিয়ে প্রাচীর ঘেরা। উপরে সুন্দর নীল আকাশ। বাতাসে সমুদ্রের লোনা গন্ধ। সেকি তাহলে সমুদ্রের তীরে কোথাও?
চত্তরটাকে ভূমি সমতল থেকে অনেক উচু বলে মনে হচ্ছে ওমর বায়ার কাছে। তাহলে চত্তরের নিচেও কি বাড়ি-ঘর আছে। না পাহাড়ের কোন টিলায় বাড়িটা?
খুব ভালো লাগল বাড়িটা ওমর বায়ার।
ওমর বায়া হাটছিল মশিয়ে লিটল নামক মানুষ পিন্ডটার পেছনে পেছনে।
এক জায়গায় এসে লোকটি ওমর বায়ার সামনে থেকে এক পাশে সরে হাঁটতে লাগল আবার সেই গেটের দিকে।
মশিয়ে লিটল- এর দেয়াল সামনে থেকে সরে যেতেই ওমর বায়ার চোখ গিয়ে পড়ল সামনের একটা ঘরের দরজায় দাঁড়ানো একটা তরুণীর উপর।
প্রথম দৃষ্টিতেই ওমর বায়ার মনে হলো সে পটে আকা একটা নিখুঁত ছবি দেখছে। কিন্তু ছবিটির যখন ঠোঁট নড়ে উঠল ভুল ভাঙল ওমর বায়ার। কষ্ট করে চোখ সে নামিয়ে নিল তার দিক থেকে।
‘আসুন। আমার নাম এলিসা গ্রেস। ভেতরে আসুন। আপনার কক্ষে আপনাকে পৌছে দিয়ে আসি’। মিষ্টি কন্ঠে স্বাগত জানাল মেয়েটি।
মশিয়ে লিটল নামক লোকটিকে দেখে ওমর বায়ার মনটা যতখানি খারাপ হয়ে উঠেছিল, সেটা এখন আর নেই।
মেয়েটি দরজার এক পাশে সরে দাড়িয়েছিল।
ওমর বায়া প্রবেশ করল কক্ষটিতে।

পরবর্তী বই
ব্ল্যাক ক্রসের মুখোমুখি

Top