১৭. ব্ল্যাক ক্রসের কবলে

চ্যাপ্টার

বার্নেস টেলিফোন রাখতেই দরজায় দাঁড়ানো তার মেয়ে লেনা বলে উঠল, ‘কোথায যাচ্ছ আব্বা?’
‘এই একটু ঘুরে আসি’।
‘একটু ঘুরে আসার জন্যে বুঝি কেউ জাহাজ সাজায়?
‘না মানে শার্ক বে’তে যাব’।
‘শার্ক বে’তে কেন আব্বা?’ বলে একটু কাছাকাছি সরে এসে বলল, ‘আবার হাঙ্গরের কোন খোরক নিয়ে যাচ্ছ আব্বা?’
‘লেনা?’ বকুনির স্বর বার্নেসের কন্ঠে। পরক্ষণেই স্বরটা নামিয়ে নিয়ে নরম কন্ঠে বলল, ‘এ সব বিষয় নিয়ে কোন ভাবনা তোমার ঠিক নয়। তোমার সে বয়স হয়নি’।
লেনা বার্নেসের বড় মেয়ে এবং কলেজের ছাত্রী।
‘তোমার কথা ঠিক আব্বা। এসব চিন্তাকে কোন সময়ই আমি ওয়েলকাম করি না। কিন্তু আপনাতেই কানে প্রবেশ করে পীড়া দেয় আব্বা’।
‘কান না দিলেই তো হলো’।
‘আমার আব্বা জড়িত না থাকলে কান দিতাম না’।
‘তুমি বিষয়টাকে যেভাবে দেখছ, বিষয়টা তেমন নয়। অপরাধীকে শাস্তি দেবার বিধান সব যুগেই ছিল’।
‘কিন্তু তার আগে তো অপরাধ নির্ধারণের প্রশ্ন আছে’।
‘নিরপরাধ কারও গায়ে আমরা হাত দেই না। আজ যে আসামীকে আমরা নিয়ে যাচ্ছি, সে আমাদের তিনজনকে খুন করেছে।
‘আমি যে বিষয় জানি না, তা নিয়ে আমি তর্ক করবো না আব্বা। আমার বক্তব্য শাস্তি দেয়ার নামে হৃদয়হীনতা নিয়ে। অন্ধকার স্বৈরতন্ত্রের যুগে এক সময় রাজা-সম্রাটরা তাদের প্রতিপক্ষকে বন্যজন্তুর মুখে ছেড়ে দিয়ে মজা দেখতো। শার্ক বে’তে এই ঘটনাই ঘটছে’।
বার্নেস কোন জবাব দিল না। তার চোখে বিস্ময়। পরে গম্ভীর কন্ঠে বলল, ‘এসব কথা তুমি জানলে কোথায় মা?’
‘অনেকেই জানে আব্বা’।
‘অসম্ভব’।
‘অসম্ভব নয় আব্বা। আমি কলেজে একাধিকজনের কাছ থেকে এই কথা শুনেছি’।
‘কিন্তু কিভাবে?’
‘যারা অপরাধ করে, তারাই অপরাধের কথা ছড়ায় আব্বা। এর কারণ নানা হতে পারে’।
‘তুমি একে অপরাধ বলছ?’ বার্নেসের কন্ঠে বিরক্তি। অন্য কোন ক্ষেত্রে হলে বার্নেস একথাগুলোর কণামাত্র বরদাশত করতো না। কিন্তু এই মা মরা মেয়েটিকে সে অত্যন্ত ভালবাসে, তার এমন কোন আবদার নেই যা সে পুরণ করে না। এই সুযোগে মেয়েটি তাকে শাসন করতেও শিখেছে। মায়ের মতই চোখ রাখে তার উপর। এতে বার্নেস গর্বিত আনন্দিত। এই কারণেই বার্নেস লেনার কথায় রাগ করতে পারলো না, কিন্তু বিরক্ত বোধ করল ব্ল্যাক ক্রস-এর ব্যাপারে মেয়ে এতদুর জড়িয়ে পড়ায়।
‘আইন হাতে তুলে নেবার প্রতিটি ঘটনাই অপরাধ আব্বা, তুমিই প্রথম আমাকে এটা শিখিয়েছ’।
‘তুমি ঠিকই বলেছ মা। কিন্তু জাতীয় ব্যাপারে কিছু কিছু ক্ষেত্র আছে যেখানে আইন হাতে তুলে নেয়া জাতির জন্যে অপরিহার্য হয়ে দাঁড়ায়’।
‘মাফ কর আব্বা, জাতির যে অধিকার অর্জন করার জন্যে আইন হাতে তুলে নিয়ে বা গোপনে তা অর্জন করতে হয়, সেটা জাতীয় অধিকার নয়। নিশ্চয় কোন গ্রুপ স্বার্থকে জাতীয় অধিকার বলে চালিয়ে দেয়া হয়’।
‘মা তুমি বয়সের চেয়েও বড় হয়েছ দেখছি। যাক এসব কথা বাইরে বলাবলি করবে না’। বলে হাসি মুখে উঠে দাঁড়াল বার্নেস।
লেনা পিতার আরও কাছে সরে এল। মাথা নিচু করে বলল, ‘তোমার না গেলে হয় না আব্বা। তুমি এই কাজে যাও আমার কষ্ট লাগে’।
বার্নেস আবার চেয়ারে বসে পড়ল। মেয়েকে কাছে টেনে নিয়ে আদর করল। একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলল, ‘দশ বছর আগে যদি মায়ের কন্ঠ এভাবে বাধা দিতে পারতো, তাহলে জীবন হয়তো অন্য রকম হতো। কিন্তু এখন আর কোন উপায় নেই মা। তুমি এসব ভেবে মন খারাপ করো না। তুমি একে এক ধরনের যুদ্ধ বলে ধরে নাও। তাহলে সান্ত্বনার যুক্তি পাবে’।
‘কিন্তু যুদ্ধ গোপনে হয় না আব্বা। আর যুদ্ধও একটা আইনের অধীন। তার বন্দীদের জন্যে আন্তর্জাতিক আইন আছে’।
‘ঈম্বর তোমার মঙ্গল করুন, আরও জ্ঞান ঈশ্বর তোমাকে দিন। আমার মায়ের জন্যে আমার গর্ব হচ্ছে’। বলতে বলতে বার্নেস উঠে দাঁড়াল।
মেয়ের কপালে একটু চুমু দিয়ে বেরিয়ে এল ঘর থেকে।
ব্ল্যাক ক্রস-এর ঘাটিতে এসে পৌছাল বার্নেস। এখানেই আহমদ মুসাকে বন্দী করে রাখা হয়েছে। এখান থেকেই সবাই গিয়ে উঠবে জাহাজে।
হাত-পা বাঁধা আহমদ মুসাকে বন্দীখানা থেকে বের করে আনা হলো।
বার্নেস দেখল, আহমদ মুসার বামহাত রক্তাক্ত। তালুর ক্ষতস্থানটিতে রক্ত জমাট হয়ে আছে। আরও বুঝল, আহমদ মুসাকে কোন খাবার দেয়া হয়নি। হঠাৎ মনে পড়ল মেয়ে লেনার কথা। মনে পড়ল তার শেষ উক্তিঃ ‘যুদ্ধবন্দীদের জন্যেও আন্তর্জাতিক আইন আছে’। লেনা বন্দীর এই অবস্থা দেখলে নিশ্চয় চিৎকার করে উঠত।
‘বন্দীকে তোমরা খেতে দাওনি?’ সামনে দাঁড়ানো ঘাটির পরিচালককে বার্নেস কতকটা আনমনেই জিজ্ঞাসা করল।
‘এমন বন্দীকে খেতে দেয়ার কোন নিয়ম নেই’। বলল ঘাটির পরিচালক লোকটি।
‘ঠিক আছে। তোমরা খেতে দাও বন্দীকে। আর ওর আহত হাতটা ধুয়ে ওষুধ লাগিয়ে বান্ডেজ করে দাও’। বার্নেসের কন্ঠ নরম।
‘ধন্যবাদ’। বলল আহমদ মুসা বার্নেসকে লক্ষ্য করে।
‘কোন বন্দীর ধন্যবাদ আমরা গ্রহণ করি না’। বলে বার্নেস উঠে দাড়িয়েঁ পাশের কক্ষে চলে গেল।
বার্নেস চলে গেলে ঘাটির পরিচালক স্বগত বলল, ‘স্যারের মাথা খারাপ হয়ে গেল নাকি’।
তারপর পাশে দাঁড়ানো লোকদের নির্দেশ দিল, একে নিয়ে যাও। আর আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে বলল, নির্দেশ হয়েছে সেবা একটু করতে হবে কিন্তু কোন চালাকি করার চেষ্টা করো না, ফল খুব খারাপ হবে।
রাত ১২টায় সকলে জাহাজে উঠল। জাহাজ ছাড়ার আগে সব ঠিক-ঠাক আছে কিনা চেক করতে গিয়ে বার্নেস নানতেজ ঘাটির পরিচালক ডান্টনকে জিজ্ঞাসা করল, ‘একজন ফাদারকে নিতে বললাম, নিয়েছ?’
‘নিয়েছি। কিন্তু কেন এই বাড়তি ঝামেলা বলুন তো?’
‘হাঙ্গরের মুখে ফেলার আগে লোকটির ব্যাপটাইজ করা হবে। অন্ততঃ মৃত্যুর আগেও ব্যাপটাইজ যদি হয়, তাহলে তার আত্মা শান্তি পাবে’।
‘তার আত্মা শান্তি না পেলে আমাদের কি?’
‘দেখ, আমাদের সবারই মরতে হবে। খৃষ্টের দয়া তো আমাদের সবারই দরকার’।
‘অতীতে কোন সময়ই তো এমনটা করা হয়নি’।
‘হলে ভালই হতো’।
একটু থেমেই আবার বলল বার্নেস, ‘ফাদারকে কি বলে এনেছ? সে আবার ঝামেলা করবে না তো?’
‘একজন প্রফেসনাল ফাদারকে নিয়ে এসেছি। সে টাকা ছাড়া আর কিছু চেনে না’।
‘ধন্যবাদ ডান্টন’।
জাহাজ ছাড়ল। ছুটে চলল লোরে নদীর প্রশান্ত বুক চিরে পশ্চিম দিকে আটলান্টিক মহাসাগরের উদ্দেশ্যে।
জাহাজের লক্ষ্য ‘শার্ক বে’ অর্থাৎ হাঙ্গর সাগর। পূর্ব-উত্তর আটলান্টিকের মধ্যে সবচেয়ে বেশী হাঙ্গরের সমাবেশ এখানে। এই কারণেই এর নাম দেয়া হয়েছে ‘শার্ক বে’। স্থানটি লোরে নদীর মোহনা থেকে পশ্চিমে তিনশ’ মাইল এবং রিলে আইল্যান্ড থেকে দক্ষিণে দু’শ মাইল দুরে অবস্থিত।
এই স্থানটাই ব্ল্যাক ক্রস-এর ‘বিনোদন বধ্যভূমি’। শত্রু বন্দীদের এখানে তারা হাঙ্গরের মুখে ছেড়ে দিয়ে হাঙ্গরদের মানুষ শিকারের মহোৎসব দেখে। ক্রেনে বেঁধে শিকারকে নামিয়ে দেয়া হয় সাগরে। শিকার একবারে হাঙ্গরের মুখে তুলে দেয়া হয় না। হাঙ্গররা একটু একটু করে কেটে নেয়, ছিড়েঁ নেয় মানুষের দেহ। এই দূর্লভ দৃশ্য তারা দেখে মহা উৎসাহে। ব্ল্যাক ক্রস-এর কাছে এর চেয়ে বড় বিনোদন আর নেই।
ভোর চারটার দিকে জাহাজ শার্ক বে’তে গিয়ে পৌছল।
জাহাজের খোলে দরজা জানালাহীন একটা কেবিনে বন্দী ছিল আহমদ মুসা। বাতাস যাওয়া-আসার জন্যে কয়েকটা গবাক্ষ আছে মাত্র। কেবিনটা দরজাহীন এই অর্থে যে, দরজাটা কেবিনের দেয়ালের সাথে মিশে আছে। দূর নিয়ন্ত্রিত দরজাটার নির্মাণ এতই নিখুঁত যে একবার না দেখলে দরজার স্থান চিহ্নিত করা অসম্ভব।
হাত পিছমোড়া করে বাঁধা, পাও বাঁধা। এমন সেলে বন্দী করে রেখেও তারা নিশ্চিন্ত হয়নি হাত-পা বেঁধে ফেলে রেখেছে আহমদ মুসাকে। মিঃ ক্লাউডের কথা মনে পড়ল আহমদ মুসার। তিনি বলেছিলেন বলেছিলেন ব্ল্যাক ক্রস’রা খুবই আত্মবিশ্বাসী। খুব আত্মবিশ্বাসী যারা তারা তো একটু কম সতর্ক হয়। কিন্তু ব্ল্যাক ক্রসকে খুবই সতর্ক দেখা যাচ্ছে। তাকে প্যারিস থেকে আনার সময় হাত-পা বাঁধার পরেও সংজ্ঞাহীন করেছে। তারপর প্রত্যেকটা ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে তারা সামান্য ঝুকিরও অবকাশ রাখছে না।
মানুষ হিসেবেও ব্ল্যাক ক্রস এর লোকেরা জঘন্য, এ পর্যন্ত এটাই মনে হয়েছে আহমদ মুসার। ব্যতিক্রম শুধু বার্নেস নামক লোকটার আজকের রাতের ব্যবহার। তাকে ব্যান্ডেজ করে দেয়া এবং খেতে দেয়ার আদেশ দেয়া গোটা পরিবেশের সাথে বিদঘুটে মনে হয়েছে।
যাই হোক বার্নেসের কাছে কৃতজ্ঞ সে। হাতের ক্ষতস্থানে অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছিল। ব্যান্ডেজ করে দেবার পর অনেকটা ভাল লাগছে।
অন্ধকার সেলের মেঝেয় শুয়ে ভাবছিল আহমদ মুসা। নিজের চেয়ে ওমর বায়ার কথাই তার মনে পড়ছিল বেশী। বেচারার কোনই সন্ধান করা এখনও গেল না। মাঝখানে সেও আটকা পড়ে গেল। তার নিরুদ্দেশ হওয়ার খবর ফিলিস্তিন এমবেসি নিশ্চয় সব জায়গায় জানিয়ে দিয়েছে। প্যারিসে খোঁজও করবে তারা। কিন্তু কিছুই পাবে না। যে ঘাটির সন্ধান এমবেসি জানে, সে ঘাটিতো ব্ল্যাক ক্রস গত রাতেই ছেড়ে দিয়েছে। আহমদ মুসা ভাবল, তার মত করে ওমর বায়াকেও কি ওরা প্যারিসের বাইরে কোথাও নিয়ে গেছে। আহমদ মুসাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে ওরা? নানতেজ থেকে তাকে ওরা স্টিমারে তুলেছে। স্টিমারটি নিশ্চয় পশ্চিমে আটলান্টিকের দিকে যাচ্ছে। আটলান্টিকের তীরে কোন শহরে বা ঘাটিতে নিয়ে যাচ্ছে তাকে? না কোন দ্বীপে? আবার মিঃ ক্লাউডের কথা মনে পড়ল। তিনি বলেছিলেন, কোন শত্রুকে হাতে পেলে ব্ল্যাক ক্রস তাকে বাচিয়েঁ রাখে না। একথা ঠিক হলে ব্ল্যাক ক্রস তাকে কোন ঘাটি বা দ্বীপে বন্দী করে রাখতে নিয়ে যাবে, তা ঠিক নয়। তাহলে?
হঠাৎ আহমদ মুসার মনে পড়ল ডোনার কথা। সে ফ্রান্সে আসছে বা এসেছে, একথা ডোনাকে জানানো হয় নি। জানতে পারলে সে নিশ্চয় ভীষণ রাগ করবে অথবা কাঁদবে? ভীষণ জেদি আর দুষ্টু মেয়ে। তেমনি আবার সাহসীও। কাউকে পরোয়া করে কোন কাজ করে না। মনটা কিন্তু তার শিশুর মত সরল। ডোনার দেয়া মানিব্যাগটা এখনও আহমদ মুসার পকেটে। যদি কখনও দেখা হয়, তাহলে তাকে চমকে দেয়া যাবে।
কিন্তু ডোনাকে চমকে দেয়ার কথা ভাবতে গিয়ে আহমদ মুসা নিজেই চমকে উঠল। কেন সে এতদিন এ মানিব্যাগটা বহন করছে? তাসখন্দ থেকে আসার সময় অনেক কিছুই সে ছেড়ে এসেছে, কিন্তু টাকাহীন এ মানিব্যাগটাকে কেন সে পকেটে তুলেছে? কোন উত্তর আহমদ মুসার জোগাল না। তার বদলে হৃদয়ের গভীর কোণ থেকে ভেসে উঠল ডোনার সজল জেদি একটা মুখ। তার সাথে হৃদয়ে গোটা সত্তা জুড়ে ছড়িয়ে পড়ল অব্যক্ত একটা যন্ত্রণা। এ যন্ত্রণার সাথে পরিচিত আহমদ মুসা। আমিনার বিচ্ছেদ তাকে এ যন্ত্রণাই দেয়। চমকে উঠল আহমদ মুসা।
পায়ের শব্দে চিন্তায় ছেদ পড়ল আহমদ মুসার। পায়ের শব্দ কেবিনের বাইরে। একাধিক লোকের। আহমদ মুসার সেলে আলো জ্বলে উঠল। সেই সাথে খুলে গেল দরজা।
আহমদ মুসা দেখল, বাইরে দাড়িয়েঁ বার্নেস, ডান্টন এবং আরও দু’জন। বার্নেস ছাড়া সকলের হাতে স্টেনগান। বার্নেসের হাতে পিস্তল।
বার্নেস বলল, একজন গিয়ে ওর হাতের বাঁধন খুলে দাও।
হাতের বাঁধন খুলে দিলে আহমদ মুসা উঠে বসল।
‘চালাকির কোন চেষ্টা করো না। ব্ল্যাক ক্রস-এর নিশানা লক্ষ্যভ্রষ্ট হয় না মনে রেখ’। বলল বার্নেস।
একটু থেমেই আবার শুরু করল, ‘তোমার জন্যে খারাপ খবর। খারাপ আর কি, মৃত্যুটা জন্মের মতই স্বাভাবিক। তবে পদ্ধতি একটু বেসুরো এই যা। শোন, এই সমুদ্রে আমাদের একটা বধ্যভুমি আছে। নির্দেশ হয়েছে এই বধ্যভূমিতে তোমাকে ফেলে দেয়ার। ক্ষুধার্ত হাঙ্গরগুলো অনেকদিন হয় মানুষের স্বাদ পায়নি। তোমার এই ছোট্ট দেহে তাদের ক্ষুধার কিছুই হবে না, তবে স্বাদ গ্রহণটা হবে’।
অচঞ্চল চোখে শুনল আহমদ মুসা কথাগুলো। আহমদ মুসার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেল তাকে সাগরে নিয়ে আসার রহস্য। মনে মনে শিউরে উঠল ব্ল্যাক ক্রস-এর পশুসুলভ জিঘাংসা দেখে।
বার্নেস কথা শেষ করে একটু থেমেছিল। পরে আবার শুরু করল, ‘তুমি বধির নাকি, শুনতে পেয়েছ তোমার মৃত্যুদন্ডের কথা’।
‘শুনেছি, বলুন আপনার আর কি বলার আছে’।
‘কি ব্যাপার, তোমার ভয় করছে না? তোমার ভাব দেখে মনে হচ্ছে আমার কোন কথাই তুমি বুঝনি’।
‘ভয় কেন? ভয় কি কাউকে মৃত্যু থেকে বাঁচাতে পারে?’
বার্নেস বিস্ময়ের সাথে আহমদ মুসার দিকে চাইল। মৃত্যুকে সামনে দেখার পর কি কেউ এভাবে নির্বিকার থাকতে পারে! কি সাংঘাতিক নার্ভ এই লোকটার, ভাবল বার্নেস। আহমদ মুসার কথার উত্তরে বলল সে, ‘ভয় কাউকে মৃত্যু থেকে বাঁচায় না, কিন্তু ভীত মানুষ মাফ চেয়ে, কান্না-কাটি করে অনেক সময় বেঁচে যায়’।
‘দেখুন, সব বাঁচাই বাঁচা নয়, সব জীবন জীবন নয়’।
‘তোমাকে মনে হচ্ছে দার্শনিক সক্রেটিস কিংবা ধর্মগুরু পোপ। তবে কেন মরতে এসেছিলে আমাদের ঘাটিতে, কেন খুন করলে আমাদের তিনজন মানুষ?’
‘খুন করিনি, খুন হয়েছে। সব সময় আক্রমণকারী জেতে না, আক্রান্তও জিততে পারে’।
‘মনে হচ্ছে ওরা তোমার বাড়িতে ডাকাতি করতে গিয়েছিল?’ মুখ বাকিয়েঁ কথাগুলো বলল বার্নেস। তারপর সাথীদের দিকে ফিরে নির্দেশ দিল, ‘একে নিয়ে চল হল রুমে। আর আহমদ মুসার দিকে লক্ষ করে বলল, ‘শুনে খুশী হবে, আমরা তোমার ব্যাপটাইজ করব। তোমার আত্মার সদগতি হবে। মনে শান্তি পাবে’।
আহমদ মুসার ঠোটেঁ হাসি ফুটে উঠল। কিছুই বলল না।
‘এরপরও হাসছিস, তোর মাথা খারাপ নাকি?’- বলে ডান্টন আহমদ মুসাকে পা ধরে হিড় হিড় করে টেনে নিয়ে চলল হল রুমের দিকে।
হল ঘর ভর্তি লোক। জাহাজের পাচক-বয়-বেয়ারা থেকে শুরু করে সবাই এসেছে ব্যাপটাইজ দেখতে। ঘরের একপ্রান্তে একটা বেদি। সেখানে বসেছেন একজন ফাদার। তার গলায় ঝুলছে একটা সোনালী ক্রস।
আহমদ মুসাকে তার সামনে নিয়ে রাখা হলো। তার পা তখনও বাঁধা।
‘ওর পা খুলে দিন। মুক্ত মানুষ না হলে ব্যাপটাইজ হয় না’।
হল ঘরের অন্য তিনদিক ঘিরে দাড়িয়েঁ আছে ব্ল্যাক ক্রস-এর লোক। তাদের প্রত্যেকের হাতে ঝুলছে স্টেনগান। তাদের পেছনে অন্যান্য লোক। আহমদ মুসার কাছে বেদির পাশে আরেকজন দাড়িয়ে। তার হাতের স্টেনগান আহমদ মুসার দিকে তাক করা।
বার্নেসের নির্দেশে একজন এসে আহমদ মুসার পায়ের বাঁধা খুলে দিল।
বার্নেস আর ডান্টন দাড়িয়েছিল ঘরের মাঝখানে। তাদের হাতে রিভলবার।
বাঁধ খুলে দেয়ার পর আহমদ মুসা দু’পায়ের উপর ভর দিয়ে সোজা হয়ে বসল।
ফাদারও একটু নড়ে-চড়ে বসে বাইবেল হাতে নিয়ে আহমদ মুসার দিকে লক্ষ্য করে বলল, ‘একটু এগিয়ে এস বৎস’।
আহমদ মুসা মুখ তুলে চাইল ফাদারের দিকে।
মাত্র গজ খানেক দুরে বেদির পাশে দাঁড়ানো স্টেনগান ধারীর দিকেও তার নজর পড়ল। তার স্টেনগানের ব্যারেল ১২০ ডিগ্রী এ্যাংগেলে উপরে উঠানো।
আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল ফাদারের দিকে এগিয়ে যাবার জন্যে। কিন্তু দু’পা এগিয়েই ঝাপিয়ে পড়ল স্টেনগানধারীর উপর।
বাম হাত দিয়ে তার স্টেনগান কেড়ে নিয়ে ডান হাত দিয়ে একই সাথে তার কানের নিচে একটা কারাত চালাল। তারপর স্টেনগানের ট্রিগার চেপে ধরেই ঘুরে দাড়াল আহমদ মুসা এবং চোখের নিমেষে স্টেনগানের ব্যারেল ঘুরিয়ে নিল গোটা ঘরে।
বার্নেস এবং ডান্টন আহমদ মুসার উপর ঝাপিয়ে পড়েছিল সে স্টেনগান কেড়ে নেবার সঙ্গে সঙ্গেই। কিন্তু তারা গুলী বৃষ্টির মুখে পড়ে গিয়েছিল। ঝাঁঝরা হয়ে গেল তাদের দেহ।
ঘরের চারদিকে যারা দাড়িয়েঁছিল, তারা সবাই মেঝেয় লুটোপুটি খাচ্ছে। রক্তে ভাসছে তারা।
ব্ল্যাক ক্রস-এর লোকরা সবাই সামনেই দাড়িয়েছিল। তারা কেউ বেচে নেই বলেই আহমদ মুসার মনে হলো।
ফাদার ভয়ে যেন পাথর হয়ে গেছে। তার মুখ কাগজের মত সাদা। সে হাত দিয়ে বাইবেল তুলেছিল। বাইবেল ধরেই বসে আছে।
আহমদ মুসা তার দিকে মুখ ঘুরিয়ে বলল, ‘আপনার কোন ভয় নেই। আপনি উঠুন। মৃত ও আহতদের আলাদা করুন’।
তারপর আহমদ মুসা ঘরের দিকে মুখ ফিরিয়ে বলল, যারা বেচে আছ তারা উঠে দাড়াও। দেরী করলে আবার গুলী চালাব।
আহমদ মুসা কথা শেষ করার সঙ্গে সঙ্গেই পাচজন লোক উঠে দাড়াল। এবং সমস্বরে বলল, আমরা জাহাজে ছোট চাকুরী করি। আমাদের কোন দোষ নেই।
আহমদ মুসা তাদের একজনকে ডেকে বলল, ‘তুমি ব্ল্যাক ক্রস-এর সংজ্ঞাহারা এই লোকটাকে বেধে ফেল। আর তোমরা ফাদারের সাথে ওদের পরীক্ষা করে দেখ। আহতদের আলাদা কর এবং সমস্ত অস্ত্র এনে ঘরের মাঝখানে জড়ো কর’।
আহত পাওয়া গেল চারজনকে। মৃত দশজন।
‘জাহাজে আর কেউ আছে?’ ওদের সবাইকে জিজ্ঞাসা করল আহমদ মুসা।
‘মাষ্টার সারেং আছেন’। একজন জবাব দিল।
‘ওকে ডাক’। বলল আহমদ মুসা।
সঙ্গে সঙ্গেই একজন গিয়ে ডেকে আনল।
‘মাষ্টার সারেং পঞ্চাশোর্ধ বয়সের। কাঁপতে কাঁপতে সে এসে প্রবেশ করল।
‘আপনি এঘরে আসেননি যে?’ তাকে জিজ্ঞাসা করল আহমদ মুসা।
‘এসব দেখতে আমার ভাল লাগে না’।কাঁপা গলায় সে বলল।
‘কোন সব দেখতে ভাল লাগে না’।
‘খুনোখুনি, হাঙ্গরের মুখে মানুষ ফেলা ইত্যাদি।
‘কত বছর চাকুরী করেন এখানে’।
‘পাঁচ বছর’।
‘ভাল না লাগলে এতদিন কেউ থাকে?’
‘ইচ্ছা করলেই কেউ এখান থেকে চাকুরী ছাড়তে পারে না। কান্না জড়ানো সুরে বলল সারেং।
‘তোমাদের কেউ একজন গিয়ে জাহাজের ‘মেডিকেল কিট’ নিয়ে এস।
যে লোকটি সারেংকে ডাকতে গিয়েছিল সেই ছুটে গেল।
‘মেডিকেল কিট’ নিয়ে এলে আহমদ মুসা ওদের নির্দেশ দিল আহতদের ব্যান্ডেজ বেঁধে দিতে।
ব্যান্ডেজ বাঁধা শেষ হলে আহমদ মুসা সারেংকে বলল আহত ও ফাদারসহ সবাইকে বেঁধে ফেলতে। বলল, ‘আমি ভয় করছি না, কিন্তু কোন ঝুকিঁ নিতে চাই না’।
তারপর অস্ত্রগুলো সাগরে ফেলে দিয়ে এবং সবাইকে হল ঘরে রেখে হল ঘর বন্ধ করে দিল। শুধু একটা রিভলবার এবং একটা স্টেনগান নিজের কাছে রাখল। রিভলবার পকেটে ফেলে স্টেনগানটি হাতে নিয়ে সারেংকে বলল, ‘চলুন জাহাজ স্টার্ট দেবেন’।
জাহাজ স্টার্ট নিলে আহমদ মুসা সারেংকে কনট্রোল চেয়ারে বসিয়ে নিজে তার পেছনে চেয়ার নিয়ে বসল।
জাহাজ চলতে শুরু করল।
‘হাঙ্গরের এই বধ্যভূমিতে ওরা কত মানুষকে খুন করেছে?’ জিজ্ঞাসা করল আহমদ মুসা।
‘আমার চাকুরীকালে শ’খানেক হবে’।
‘আমি কে, আমাকে কেন ওরা খুন করতে চেয়েছিল জানেন আপনি’।
‘কোন সময়ই আমাদের কিছু জানানো হয় না’।
‘ব্ল্যাক ক্রস-এর চীফ কে, এদের হেড কোয়ার্টার কোথায় জানেন?’
‘বলেছি জনাব, আমাদের কিছুই জানতে দেয়া হয় না’।
‘জানলেও আপনি বলতে পারবেন না। জিজ্ঞাসা করাই ভুল হয়েছে’।
‘ভুল বুঝবেন না জনাব, আমরা এখানে ক্রীতদাস শ্রমিকের মত। এই জাহাজের বাইরে আমরা কিছুই চিনি না। ছুটি পেলে চোখ বন্ধ করে বাড়ি যাই এবং চোখ বন্ধ করে বাড়ি থেকে ফিরে আসি। কোন জাহাজে চাকুরী করি, তাও কাউকে বলতে পানি না’।
বেলা ৮টার দিকে লোরে নদীর মোহনায় এসে পৌছাল জাহাজ।
‘জাহাজ নানতেজে নেব, না সেন্ট নুজায়েরে নোঙ্গর করব?’ জিজ্ঞাসা করল সারেং।
‘নানতেজ পর্যন্ত যাওয়ার প্রয়োজন নেই। সেন্ট নুজায়েরে নোঙ্গর করুন’।
জাহাজ নোঙ্গর করার পর আহমদ মুসা সারেংকে বেঁধে ফেলল। বলল, আপনাকে বেঁধে রাখা আপনার জন্যেই প্রয়োজন। এতে ওরা বুঝবে আপনি আমাকে কোন সাহায্য করেননি।
কেবিন থেকে বেরিয়ে যাবার জন্যে আহমদ মুসা পা বাড়ালে সারেং বলল, ‘আপনি কে জানি না। কিন্তু শত্রু এমনও হতে পারে, তা আপনাকে না দেখলে কোনদিনই জানতাম না। আপনার জীবনের চরম বৈরী আহত শত্রুর আপনি চিকিৎসা-শুশ্রুসার ব্যবস্থা করেছেন। এমন শত্রুর কথা আমার কাছে অকল্পনীয়। আপনি বিদেশী। বলবেন কি, আপনি কে?’
আহমদ মুসা না ফিরেই বলল, ‘আমি আহমদ মুসা’। বলে কেবিন থেকে বেরিয়ে এল সে।
সেন্ট নুজায়ের ছোট্ট সমুদ্র শহর। লোরে নদীর শেষ প্রান্তে অবস্থিত।
এ শহর থেকে বাইরে যাবার একটাই পথ। সে পথটা সেন্ট নুজায়ের থেকে নানতেজ গেছে।
আহমদ মুসা নানতেজ যাওয়াই স্থির করল।
নানতেজ ব্ল্যাক ক্রস-এর ঘাটি সে দেখেছে। সেখানে গিয়ে সামনে এগুবার কোন পথ পাওয়া যায় কিনা তা দেখতে হবে।
জুতার শুকতলির নিচ থেকে ২’শ ডলারের একটা নোট বের করে তা ভাঙিয়ে আহমদ মুসা ট্যাক্সিতে করে নানতেজ যাত্রা করল।
সেন্ট নুজায়ের থেকে নানতেজ মাত্র একশ’ কিলোমিটার। নয়টার মধ্যেই আহমদ মুসা পৌছে গেল নানতেজ।
নানতেজের ব্ল্যাক ক্রস-এর যে ঘাটি আহমদ মুসা চেনে তা নানতেজ বন্দরের কাছাকাছি।
আহমদ মুসা সোয়া ৯টার দিকে ব্ল্যাক ক্রস-এর ঘাটিতে পৌছাল।
ঘাটি সুন্দর দোতলা একটা বাড়ি। একটাই মাত্র গেট। গেটে ভারি দরজা।
আহমদ মুসা গাড়ি থেকে নেমে ড্রাইভারকে বলল, ‘আমি কি আপনাকে ভাড়া মিটিয়ে দেব, না আমার জন্যে অপেক্ষা করবেন?’
‘কতক্ষণ দেরী হবে আপনার?’
‘বলতে পারি না। পনের-বিশ মিনিট দেরী হতে পারে, আমার নাও ফিরতে পারি’।
‘আপনি সুন্দর কথা বলেন তো! বুঝা যাচ্ছে, আপনি বাড়িটাতে গিয়ে বিপদে পড়তে পারেন। যাতে এমনকি আপনার জীবনও যেতে পারে। এই তো?’
‘হতে পারে’।
‘তাহলে আমি অপেক্ষা করব। আপনি বিদেশী। শেষ না দেখে আমি যেতে পারছি না’।
‘ধন্যবাদ। একটা কাজ করি, আমার কাছে চৌদ্দশ ফ্রাঙ্ক আছে। আপনার কাছে জমা রেখে যাই। ফিরে এলে পেয়ে যাব, না ফিরে এলে আপনি চলে যাবেন, তাতে টাকাগুলো শত্রুর হাতে পড়ল না’।
‘আমি যদি টাকা নিয়ে পালিয়ে যাই?’
‘আপনার কিছু উপকার হলে তাতে আমার মন খারাপ হবে না’।
‘আপনি আশ্চর্য মানুষ তো?’
আহমদ মুসা কোন জবাব না দিয়ে বাড়িটার দিকে পা বাড়াল।
ব্ল্যাক ক্রস-এর ঘাটির দিকে যেতে যেতে আহমদ মুসা ভাবল, ঘাটির পরিচালক ডান্টন নেই। নিশ্চয় আরও দু’চারজন এখান থেকে গেছে ডান্টনের সাথে। সুতরাং ঘাটিতে খুব বেশী লোক থাকার কথা নয়। আহমদ মুসার লক্ষ্য হলো, বাড়িটা সার্চ করা, ব্ল্যাক ক্রস-এর কোন তথ্য, দলিল দস্তাবেজ পাওয়া যায় কিনা তা দেখা।
আহমদ মুসা গিয়ে সরাসরি গেটে নক করল। শত্রুর উপর জয়ী হবার এটাও একটা বড় কৌশল। কেউ সাধারণত মনে করে না যে, তার কোন শত্রু এভাবে দরজা নক করে আসবে। সুতরাং অনেক ক্ষেত্রেই তাদের অপ্রস্তুত অবস্থায় পাওয়া যায়।
কয়েকবার নক করার পরেও ভেতর থেকে কোন জবাব এল না।
আহমদ মুসা ধীরে ধীরে দরজার উপর চাপ দিল। খুলে গেল দরজা। বিস্মিত হলো আহমদ মুসা। কিন্তু ভেতরে প্রবেশ করে দরজা ভেজিয়ে দিয়ে কয়েক ধাপ সামনে এগিয়ে যাবার পর আহমদ মুসার বুকটা হঠাৎ ছ্যাৎ করে উঠল। কোন ফাঁদ নয় তো?
সঙ্গে সঙ্গেই আহমদ মুসা পকেট থেকে রিভলবারটা তুলে নিল হাতে।
আরও কয়েক ধাপ এগিয়ে করিডোরের মুখে গিয়ে পৌছল সে।
পেছনে পায়ের শব্দ পেয়ে ঘুরে দাঁড়াল আহমদ মুসা। ঘুরেই দেখল, লোহার একটা বিরাট রড তার মাথা লক্ষ্যে নেমে আসছে।
আহমদ মুসা মাথাটা দ্রুত সরিয়ে নিল। কিন্তু শেষ রক্ষা হলো না। রডটি কপালের বাম পাশের বেশ খানিকটা চামড়া খুলে নিয়ে প্রচন্ড বেগে আহমদ মুসার ডান হাতে গিয়ে আঘাত করল। হাত থেকে ছিটকে পড়ে গেল রিভলবারটি।
আহমদ মুসা দেহের ভারসাম্য রাখতে পারল না। পড়ে গেল। পড়ে গিয়েই দেখল, দ্বিতীয়জনের আর একটি রড নেমে আসছে আবার তার মাথা লক্ষ্যে।
আহমদ মুসা দ্রুত গড়িয়ে নিজেকে সরিয়ে নিল। রডটা গিয়ে আঘাত করল পাথরের মেঝেতে। আগুন জ্বলে উঠল প্রবল ঘর্ষণে।
লোকটি তার রডটি পুনরায় হাতে তুলে নেবার আগে রডের নিচের মাথাটা ধরে ফেলল আহমদ মুসা এবং শুয়ে থেকেই হ্যাচকা টানে কেড়ে নিল রডটি। লোকটি ভারসাম্য হারিয়ে পড়ে গেল মেঝের উপর।
আহমদ মুসা উঠে দাড়াল বিদ্যুতগতিতে। প্রথম লোকটি আবার রড তুলেছিল মারার জন্য। আহমদ মুসা হাতের রড দিয়ে তার ছুটে আসার রডের আঘাত ঠেকিয়ে দিয়ে সংগে সংগেই ডান পায়ের একটা লাথি চালাল তার তলপেটে। তলপেট ধরে পড়ে গেল লোকটি।
তৃতীয় লোকটি রিভলবার বের করেছিল, আর অন্যদিকে যার হাত থেকে রড সে কেড়ে নিয়েছিল, সেও উঠে দাড়াচ্ছিল।
কিন্তু আহমদ মুসা ওদের সময় দিল না। আহমদ মুসা হাতের রড চালাল রিভলবার তুলে নেয়া হাতের উপর। সাপ মারার মতো আরও কয়েকবার রড চালাল তার উপর। রিভলবার তার আগেই হাত থেকে ছিটকে পড়েছিল। সেও মাটিতে লুটিয়ে পড়ল।
কিন্তু সময় পেয়ে গিয়েছিল উঠে দাড়ানো লোকটি। সে ঝাপিয়ে পড়ল আহমদ মুসার উপর। আহমদ মুসা পড়ে গেল এবং সেই সাথে সে লোকটাও।
দু’জনে লুটোপুটি, ধ্বস্তা-ধ্বস্তি চলল কিছুক্ষণ। লোকটি হাতের কাছে রিভলবার পেয়ে গেল। কিন্তু আহমদ মুসা তার রিভলবার ধরা দু’হাত তার দিকেই ঘুরিয়ে দিল। চার হাতের চাপা-চাপিতে ফায়ার হলো রিভলবার থেকে। কানের পাশ দিয়ে গুলী ঢুকে গেল লোকটির মাথায়।
রিভলবার নিয়ে উঠে দাড়াল আহমদ মুসা।
পেটে লাথি খাওয়া লোকটি উঠে দাড়াচ্ছিল টলতে টলতে।
আহমদ মুসা রিভলবার বাম হাতে নিয়ে ডান হাতের প্রচন্ড একটা কারাত চালাল লোকটির ঘাড়ে।
লোকটি অর্ধেক পর্যন্ত উঠে দাড়িয়েছিল। আবার লুটিয়ে পড়ল জ্ঞান হারিয়ে।
আহমদ মুসা পড়ে থাকা দ্বিতীয় রিভলবারটি পকেটে পুরে, আরেকটি রিভলবার হাতে নিয়ে এগুলো ঘরগুলো অনুসন্ধান করে দেখার জন্যে।
বাড়িতে সব মিলিয়ে ১২টা ঘর। কোন ঘরেই কিছু পেল না আহমদ মুসা। এক টুকরো কাগজও কোথাও নেই। কোন কাপড়-চোপড়ও নেই। তবে অন্য সবকিছু ঠিক আছে। টেলিফোনও আছে, কিন্তু টেলিফোন গাইড নেই এবং টেলিফোনের সেটে যে নাম্বার কোর্ড থাকে তাও নেই। অর্থাৎ ব্ল্যাক ক্রস পরিকল্পিত ভাবেই এ ঘাটি পরিত্যাগ করেছে। কেন? জাহাজের সব খবর তাহলে এখানে পৌছেছে কি? প্যারিসের যে ঘাটিতে আহমদ মুসা প্রবেশ করেছিল, সে ঘাটিও ব্ল্যাক ক্রস ছেড়ে দেয়। বুঝা যাচ্ছে, শত্রুরা তাদের কোন ঘাটি চিনে ফেললে সে ঘাটি আর তারা রাখে না।
কিন্তু প্রশ্ন হলো, জাহাজের খবর এত তাড়াতাড়ি এখানে পৌছাল কি করে?
নিশ্চয় জাহাজের লোকেরা ছাড়া পেয়েছে। তারাই এখানে খবর পৌছিয়েছে টেলিফোনে। তারপরই ঘাটি ছেড়ে দেয়া হয় এবং ফাঁদ পেতে রাখা হয় তাকে ধরার জন্যে। ভাবল আহমদ মুসা।
কিন্তু একটা বিষয় বুঝতে পারল না সে, তাকে এত বড় শত্রু মনে করল কি করে! তাহলে কি তাকে খুব বড় শত্রু বলে তারা মনে করেছে, যে শত্রু প্রতিশোধ নেবার জন্যে ঘাটিতেও হানা দিতে পারে? কিন্তু কেন তা মনে করবে? জাহাজের ঘটনার পর কি তাদের ধারণা পাল্টে গেছে?
টেলিফোন বেড়ে উঠল।
টেলিফোনের রিসিভার উঠাল আহমদ মুসা।
‘হ্যালো, আমি লেনা’। ও প্রান্ত থেকে এক নারী কন্ঠের এই আওয়াজ শুনতে পেল আহমদ মুসা। কন্ঠকে একটা কিশোরীর বলে মনে হলো আহমদ মুসার কাছে।
‘কি চাও, কাকে চাও তুমি?’ জিজ্ঞাসা করল আহমদ মুসা।
সম্ভবতঃ আহমদ মুসার কথা শুনে ও প্রান্তের মেয়েটা একটু দ্বিধা করল। কথা বলল না কয়েক মুহুর্ত। একটু সময় পরে বলল, ‘আপনাকে মনে হচ্ছে বিদেশী। আপনি কি ওখানকার কেউ নন?’
‘হ্যা বিদেশী। কেউ নই এখানকার’।
‘কোথায় ওরা? ওদের কাউকে দিন’।
‘কেউ নেই ওরা। সবাই চলে গেছে’।
‘সবাই তো যেতে পারে না’।
‘ওরা এ বাড়ি পরিত্যাগ করেছে’।
‘বাড়ি পরিত্যাগ করে…’ কথা শেষ করতে পারল না মেয়েটি। কন্ঠ রুদ্ধ হয়ে গেল তার।
বিস্মিত হলো আহমদ মুসা। হঠাৎ ভাবল, মেয়েটি কি এ ঘাটির কারও কেউ হবে? জিজ্ঞাসা করল, ‘তুমি কে বোন? তুমি কি জানতে চাও। বল, আমি তো আছি’।
‘আমি বার্নেসের মেয়ে। আমার আব্বা ফিরেছেন কিনা বলতে পারেন? মনটা খুব অস্থির লাগছে আব্বার জন্যে’।
আহমদ মুসার বুকটা ধক করে উঠল। এ কোন বার্নেসের মেয়ে! যে বার্নেসকে সে জাহাজে হত্যা করেছে সেই বার্নেসের মেয়ে? বুক থর থর করে কেঁপে উঠল আহমদ মুসার। নিশ্চিত হবার জন্যেই আহমদ মুসা জিজ্ঞাসা করল, ‘তোমার আব্বা কোথায় গেছেন? কখন ফেরার কথা বোন?’ নরম কন্ঠ আহমদ মুসার।
‘শার্ক বে’র দিকে গেছেন। এতক্ষণ ফেরার কথা’।
আহমদ মুসার আর কোন সন্দেহ রইল না, সেই বার্নেসের মেয়েই এই লেনা।
নিশ্চিত হবার সাথে সাথেই বেদনার কালো আঁধারে ছেয়ে গেল তার গোটা হৃদয়টা। মুহুর্তের জন্যে বাকহারা হয়ে গেল আহমদ মুসা। শুনতে পাচ্ছে, ওপার থেকে মেয়েটি হ্যালো, হ্যালো বলে চিৎকার কর চলেছে।
কিন্তু কি জবাব দেবে সে পিতার প্রতীক্ষমান এই মেয়েকে! কেমন করে বলবে যে তার পিতা নিহত। কেমন করে বলবে যে তার হাতেই তার পিতা নিহত হয়েছে!
কিংকর্তব্যবিমূঢ় আহমদ মুসা মুহুর্তের জন্যে সম্বিত হারিয়ে ফেলেছিল। আর শিথিল হাত রিসিভার সমেত নেমে এসেছিল।
সম্বিত ফিরে পেয়েই রিসিভার কানে তুলল আহমদ মুসা। শুনতে পেল টেলিফোন একটানা পিপ পিপ শব্দ। লাইন কেটে গেছে। চিৎকার করে করে অস্থির, উদ্বিগ্ন মেয়েটি টেলিফোন রেখে দিয়েছে।
ওপারের একটা দৃশ্য ফুটে উঠল আহমদ মুসার চোখে। টেলিফোন রেখে দিয়ে নিশ্চয় চিৎকার করে জড়িয়ে ধরেছে মাকে অথবা বিছানায় লুটিয়ে পড়ে কাদছে উদ্বেগ ও অনিশ্চয়তার তীব্র বেদনায়।
আহমদ মুসা ধীরে ধীরে রিসিভারটি রেখে দিল। দু’চোখ থেকে দু’ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল তার।
চোখ মুছল আহমদ মুসা।
চোখ মুছতে গিয়ে আঙুলে রক্ত লাগল।
এতক্ষণে তার মনে পড়ল কপালের ডান পাশটা তার থেতলে যাবার কথা।
মুখের পাশ দিয়ে গড়িয়ে আসা রক্ত রুমাল দিয়ে মুছে ফেলল। কপালের ক্ষতে রুমাল ঠেকাতে গিয়ে বেদনায় কেপে উঠল শরীরটা।
এতক্ষণে লক্ষ্য করলো তার জ্যাকেটের উপরও রক্ত গড়িয়ে পড়েছে। তাছাড়া বাম হাতের তালুর ক্ষত থেকেও রক্ত ঝরছে।
আহমদ মুসা বেরিয়ে এল ব্ল্যাক ক্রস-এর ঘাটি থেকে।
দেখল ট্যাক্সি ঠিক জায়গায় দাড়িয়ে আছে।
আহমদ মুসা কাছে যেতেই গাড়ির ড্রাইভার বেরিয়ে এল গাড়ি থেকে। আহমদ মুসার সর্বাঙ্গে নজর বুলিয়ে বলল, ‘ইস কপালটা থেতলে গেছে, আপনি ভাল আছেন তো? আমার কাছে ফাস্ট এইড বক্স আছে। ব্যান্ডেজ করে দেব?’
‘ধন্যবাদ’ বলে আহমদ মুসা গাড়িতে উঠে বসতে বসতে বলল, ‘ফাস্ট এইড বক্সটা আমাকে দাও। আর গাড়ি স্টার্ট দাও তুমি’।
‘ফাস্ট এইড বক্স আহমদ মুসার হাতে তুলে দিয়ে ড্রাইডিং সিটে নড়ে-চড়ে বসে ড্রাইভার বলল, কোথায় যাব স্যার?’
প্রশ্ন শুনে আহমদ মুসার মনেও প্রশ্ন জাগল, এখন কোথায় যাবে সে? ব্ল্যাক ক্রস-এর সন্ধান পাবার সকল সুত্রই সে আবার হারিয়ে ফেলেছে। এখন কোথায় খুজবে তাদের, কোথায় খুজে পাবে ওমর বায়াকে। প্যারিসেই কি আবার ফিরবে সে?
মনস্থির করে আহমদ মুসা বলল, ‘প্যারিসের পথ কোনটা তুমি ভাল মনে কর?’
‘অনেক পথ আছে। তবে এ্যানজার, তুরস ও অরিয়েনস হয়ে যে রাস্তা প্যারিস গেছে, সেটাই সবচেয়ে ভাল রাস্তা। অর্ধেকটা পথ লোরে নদীর পাশাপাশি যাওয়া যাবে। পথে পাহাড়, বন, গ্রাম প্রভৃতি সব ধরণের দৃশ্যই চোখে পড়বে।
গাড়ি স্টার্ট দেবার আগে ড্রাইভার আহমদ মুসার দেয়া ১৪শ’ ফ্রাংক আহমদ মুসার দিকে তুলে ধরে বলল, ‘আপনার টাকা নিন স্যার’।
‘ঠিক আছে তুমি রাখ’। গন্তব্যে পৌছে তোমার ভাড়া রেখে আমাকে দিয়ে দেবে’।
‘আপনি রাখলেও সেটাই হবে। পৌছে আমার ভাড়াটা দিয়ে দেবেন’।
আহমদ মুসা টাকা রাখল।
গাড়ি চলতে শুরু করল।
বেলা ১২টার দিকে আহমদ মুসার গাড়ি লোরে নদীর পশ্চিম পাশে তুরেন উপত্যকা পার হয়ে তুরস শহরের সন্নিকটবর্তী সুর লোরে পাহাড়ী এলাকায় প্রবেশ করল। ‘সুর লোরে’ পশ্চিম ফ্রান্সের একটি উল্লেখযোগ্য পর্যটন কেন্দ্র। পরিকল্পিত সবুজ বনে আচ্ছাদিত পাহাড়গুলো। এই পাহাড় অঞ্চলের মধ্যে একে-বেকে এগিয়ে গেছে হাইওয়েটি তুরস শহরের দিকে।
আহমদ মুসা ড্রাইভারের পাশের সিটে বসেছিল।
আহমদ মুসা ‘সুর লোরে’তে প্রবেশের আগেই লক্ষ্য করছিল একটা গাড়ি তার গাড়ির সমান স্পীডে এগিয়ে আসছে অনেকক্ষণ ধরে একই গতিতে।
কিন্তু ‘সুর লোরে’ এলাকায় প্রবেশের পর গাড়িটা দ্রুত কাছাকাছি চলে এল এবং বার কয়েক হর্ণ দিল। তার পরপরই আহমদ মুসার গাড়িও হর্ণ দিয়ে উঠল। পেছনের হর্ণ শুনে আহমদ মুসার মনে হয়েছিল, গাড়িটা ওভারটেক করার জন্যে রাস্তার ভিন্ন চ্যানেলে চলে যেতে চায়। কিন্তু গাড়িটির গতিতে ওভারটেক করার কোন লক্ষণই দেখতে পেল না। তারপরও তার গাড়ির হর্ণ শুনে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেল। দুই গাড়ির হর্ণ একই মাপের একই টোনের। শুনেই আহমদ মুসার মনে হল তার গাড়ির হর্ণ পেছনের গাড়ির হর্ণের জবাব দিয়েছে। কিন্তু এটা তো স্বাভাবিক নয়। ট্রাফিক নিয়ম পেছনের গাড়ির ওভার টেকের সাথে তার পেছনের গাড়ির সম্পর্ক, সামনের গাড়ির নয়।
অল্প কিছুক্ষণ পর পেছনের গাড়িটি শটওয়েভ ভংগীতে এক নাগাড়ে কয়েকটি হর্ণ বাজাল।
আহমদ মুসা তাকাল ড্রাইভারের দিকে। দেখল, তার মুখটা বিষন্ন হয়ে উঠেছে এবং লক্ষ্য করল, ড্রাইভারের আঙুল হর্ণ-সুইচে কয়েকবার উঠানামা করল। এবারও হর্ণ বাজাল পেছনের গাড়ির মত করেই।
এবার আহমদ মুসার বিস্ময় সন্দেহে রুপান্তরিত হলো। এ দু’টি গাড়ির মধ্যে কি কোন সম্পর্ক আছে? কিংবা দু’টি গাড়ি কি কোন একই গ্রুপের? সে গ্রুপটি কি? হঠাৎ আহমদ মুসার মনে পড়ল। সেদিন রাতে প্যারিসে ব্ল্যাক ক্রস-এর ঘাটির গেটে ব্ল্যাক ক্রস-এর ক্যারিয়ারকে সে এই একই মাপ ও টোনে হর্ণ দিতে শুনেছিল।
আহমদ মুসার গোটা শরীরে একটা উষ্ণ স্রোত বয়ে গেল। তাহলে কি এ দু’টি গাড়ি তার সন্ধান পেল কি করে? এই গাড়ি কি তার সন্ধান দিয়েছে? কিন্তু এ ড্রাইভার জানবে কি করে যে আমি কে? নানতেজে ব্ল্যাক ক্রস-এর ঘাটিতে ঢুকেছিলাম, তাদের সাথে লড়াই হয়েছে-এ থেকেই কি? কিন্তু ড্রাইভার ব্ল্যাক ক্রস-এর লোক হলে ঐ ঘাটিতে তার কোন ভূমিকা ছিল না কেন?
আহমদ মুসা বিপরীত মুখী চিন্তায় জড়িয়ে পড়ল। কোন সমাধান খুজে পেল না।
এই সময় ড্রাইভার বিষন্ন মুখে মুহুর্তের জন্যে আহমদ মুসার দিকে মুখ ফিরাল এবং বলল, ‘স্যার আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞাসা করব?’ ড্রাইভারের কন্ঠে উদ্বেগ।
‘অবশ্যই’। আহমদ মুসার চোখে-মুখে প্রবল উৎসুক্য।
‘স্যার ব্ল্যাক ক্রস কি আপনার শত্রু?’
‘এ প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করছ কেন?’ আহমদ মুসার চোখ-মুখ শক্ত হয়েছে। তার কন্ঠও খুব কাটখোট্টা শুনাল।
‘ব্ল্যাক ক্রস এর গাড়ি এই গাড়িকে ফলো করছে?’
‘কি করে জানলে তুমি?’
‘ওরা সিগন্যাল দিয়েছে’।
‘কি সিগন্যাল দিয়েছে?’
‘ওরা হাইওয়ে থেকে পাশে কোথাও নেমে যেতে বলেছে’।
‘তুমি কে?’
‘আমি ব্ল্যাক ক্রস-এর অনিয়মিত বাহিনীর একজন কর্মী। কিন্তু এই মুহুর্তে আমি আপনার নিয়োজিত একজন ড্রাইভার’।
‘আমি নানতোজ ব্ল্যাক ক্রস-এর ঘাটিতে যখন ঢুকলাম তখন এবং তারপরেও তো তুমি কিছু বলোনি?’
‘ওটা ব্ল্যাক ক্রস-এর ঘাটি ছিল আমি জানি না। শুধু ওদের আদেশ পালন ছাড়া ওদের কোন কিছুই আমরা অনিয়মিতরা জানি না’।
ড্রাইভার একটা ঢোক গিলল। তারপর আবার শুরু করল, স্যার ওরা আপনাকে খুন করবে। ওদের হাত থেকে কেউ বাচে না। স্যার আমাকে একটা আঘাত করে অজ্ঞান করে, রাস্তায় ফেলে দিয়ে আপনি গাড়ি নিয়ে চলে যান। চেষ্টা করুন বাচার’।
‘তুমি কেন আমাকে সাহায্য করবে?’ আহমদ মুসার কন্ঠে বিস্ময়।
‘আপনি বিদেশী। আপনাকে কোন অপরাধী বলে আমার মনে হয়নি। তাছাড়া আমার একমাত্র ছেলে হাসপাতালে এখন মুমূর্ষু। ঈশ্বর তাকে রক্ষা করুন। আমি কোন খুনোখুনির মধ্যে যেতে পারবো না’।
‘আমি তোমাকে আঘাত করতে পারবো না। এই চলন্ত গাড়ি থেকে ফেলে দিলে তুমি মারাত্মক আহত হবে।
‘স্যার, ঐ ফাস্ট এইড বক্সটা আমাকে দিন’।
আহমদ মুসা তাকে এগিয়ে দিল বক্সটা।
ড্রাইভার বাক্সটি খুলে এর একটা গোপন পকেট থেকে একটা ছোট শিশি বের করে নাকে চেপে ধরল।
আহমদ মুসা মুহুর্তেই ব্যাপারটা বুঝতে পারল। ড্রাইভার ক্লোরোফরম করছে নিজেকেই। আহমদ মুসা দ্রুত দিয়ে স্টেয়ারিং হুইলটা ধরে ফেলল। গাড়ি কয়েক মুহুর্ত একটু একে-বেঁকে আবার ঠিক হয়ে গেল।
আহমদ মুসা নিজের পকেট থেকে এক হাজার ফ্রাংকের একটা নোট বের করে সংজ্ঞাহীন ড্রাইভারের পকেটে গুজে দিল। তারপর গাড়ির গতি একটু স্লো করে ড্রাইভারকে গড়িয়ে নামিয়ে দিল রাস্তায়।
পেছনের গাড়িটি একেবারে কাছাকাছি এসে গিয়েছিল।
ড্রাইভারকে গড়িয়ে দেবার পর আহমদ মুসার গাড়ি পূর্ণ গতি পাওয়ার আগেই পেছন থেকে এক ঝাক গুলী ছুটে এল আহমদ মুসার গাড়ি লক্ষ্যে।
একটা টায়ার সশব্দে ফেটে গেল আহমদ মুসার গাড়ির। আহমদ মুসার গাড়ি পাক খেয়ে রাস্তা থেকে নেমে এল। যেখানে নেমে এল সেটাও একটা রাস্তা। দুই পাহাড়ের মাঝ দিয়ে এগিয়ে গেছে পাহাড় শ্রেণীর আরও গভীরে।
আহমদ মুসা ফেটে যাওয়া টায়ার নিয়েই কিছুটা এগিয়ে গেল। আর যাওয়া সম্ভব নয়। ওরা গুলী করতে করতে পেছনে পেছনেই আসছে।
আহমদ মুসা রাস্তার একটা বাকে এসে বাক সংলগ্ন পাহাড়ের গা ঘেষে গাড়িটাকে রাস্তার আড়াআড়ি দাড় করিয়ে দিল এবং গাড়ির আড়ালে গিয়ে গাড়ি থেকে নেমে পড়ল। পকেট থেকে হ্যান্ড গ্রেনেডটি বের করে নিয়েছিল। গাড়ি থেকে নেমেই সে হ্যান্ড গ্রেনেডটি ছুড়ে মারল পেছনে এসে দাড়ানো গাড়ি লক্ষ্যে।
আহমদ মুসার গাড়ি দাড়িয়ে পড়ার সংগে সংগেই পেছনের গাড়িটাও আহমদ মুসার গাড়ির পেছনে এসে দাড়িয়ে পড়েছিল। গাড়ি থেকে নেমে পড়েছিল ওরাও। এই সময় আহমদ মুসার হ্যান্ড গ্রেনেড গিয়ে আঘাত করল গাড়িটাকে।
মুহুর্তেই বিস্ফোরণে টুকরো টুকরো হয়ে গেল গাড়ি।
কিন্তু দু’জন বেচে গিয়েছিল বিস্ফোরণ থেকে। তারা চলে এসেছে আহমদ মুসার গাড়ির এ পাশে।
আহমদ মুসা যখন ওদের দেখতে পেল, তখন ওরা ওদের স্টেনগান উচিয়ে তুলছে।
আহমদ মুসা গাড়ির সামনের প্রান্তে দাড়িয়ে ছিল। সে ঝাপিয়ে পড়ল গাড়ির ওপাশে গাড়ির আড়াল নেবার জন্যে।
এক ঝাক গুলী উড়ে গেল গাড়ির ওপর দিয়ে। একটা গুলী গিয়ে বিদ্ধ করল জুতা সমেত আহমদ মুসার পা’কে।
প্রবল ঝাকুনি দিয়ে উঠল আহমদ মুসার গোটা দেহ। কিন্তু ওদিকে কোন ভ্রুক্ষেপ না করে আহমদ মুসা গাড়ির ওপাশে আছড়ে পড়ার পরেই শরীরটাকে বাকিয়ে গাড়ির এ প্রান্তে নিয়ে এল নিজের মাথাকে। উকি দিয়ে দেখল ওরা দু’জন ছুটে আসছে এদিকে। আহমদ মুসা দু’হাতে রিভলবার ধরে গুলী করল পর পর দুটো। গুলী খেয়ে দু’জনই প্রায় এক সাথেই আছড়ে পড়ল।
আহমদ মুসা সেদিকে একবার তাকিয়ে উঠে দাড়াবার উদ্যোগ নিল। এমন সময় হাইওয়ের দিক থেকে হর্ণের শব্দ ভেসে এল। সেই আগের মতই একই মাপে এবং একই টোনে।
আহমদ মুসা বুঝল, ব্ল্যাক ক্রস-এর আরেকটা গাড়ি আসছে।
আহমদ মুসা পাহাড়ের উপর তাকাল। দেখল, উপরে গাছপালা ক্রমশঃই ঘন। পাহাড়ের এদিকটা খুব খাড়াও নয়।
আহমদ মুসা আহত পা’টাকে টেনে টেনে ক্রলিং করে পাহাড়ের উপরে উঠতে লাগল।
মিনিট দুয়েকের মধ্যেই বড় কয়েকটি গাছের আড়ালে একটা ঘন ঝোপে গিয়ে পৌছাল। জায়গাটা সমতল। ক্লান্ত আহমদ মুসা শুয়ে পড়ল জায়গাটায়। অবিরাম রক্ত ঝরছে পা থেকে ঝিম ঝিম করছে তার গোটা শরীর।
কয়েক মুহুর্ত পর একটা গাছে হেলান দিয়ে পাহাড়ের নিচের দিকে তাকাল। দেখল, একটা গাড়ি এসে থেমেছে আহমদ মুসার গাড়ির সামনেই। গাড়ি থেকে নেমেছে চারজন লোক ওদের সবার হাতে স্টেনগান। ওরা ঘুরে ঘুরে লাশগুলো পরীক্ষা করছে। আহমদ মুসা ভাবল, আহমদ মুসার লাশই তারা খুজছে।
খোজা শেষে ওরা এক সাথে দাড়িয়ে কিছু আলোচনা করল। তারপর ওরা এক সাথেই পাহাড়ের উপরের দিকে তাকাল।
আহমদ মুসা নিশ্চিত হলো, ওরা সন্দেহ করছে পাহাড়ের ওপরে কোথাও সে লুকিয়ে আছে। ওরা এখন ওপরে উঠবে।
আহমদ মুসা পাহাড়ে উঠে আসার সময় ওদের একজনের স্টেনগান নিয়ে এসেছিল। ওটাকে হাতে তুলে নিল সে।
ওরা পাহাড়ে উঠতে শুরু করেছে। ওদের উঠার লাইন দেখে আহমদ মুসা বুঝল ওরা রক্তের দাগ অনুসরণ করেই এগিয়ে আসছে।
ওরা গুলীর বিরামহীন দেয়াল সৃষ্টি করে এগিয়ে আসছে। ওদের প্রত্যেকের স্টেনগানেই সাইলেন্সার লাগানো। সুতরাং কোন শব্দ হচ্ছে না, শুধু দেখা যাচ্ছে আগুনের ঝলক এবং পাওয়া যাচ্ছে বারুদের গন্ধ।
দু’একটা করে গুলী আহমদ মুসার আশেপাশে এসে পড়তে লাগল।
আহমদ মুসা একটা মোটা গাছের আড়ালে নিজেকে লুকিয়ে রেখেছে। এতে ওদের গুলীর হাত থেকে বাচা যাচ্ছে, কিন্তু স্টেনগান নিয়ে গাছের আড়াল থেকে বেরুতে না পারলে ওদের রোধ করা যাবে কেমন করে? ওরা একদম কাছে চলে এসেছে। এখন গুলী বৃষ্টি ঘিরে ধরেছে তাকে। কি করা যায় ভাবছে আহমদ মুসা। ওদের গুলীর বিরতি না হলে ওদের তাক করাও তো সম্ভব নয়। প্রথম গুলী মিস হলে পরে গুলী করার সুযোগ সে নাও পেতে পারে।
পায়ের কাছেই একটা বড় পাথর দেখতে পেল আহমদ মুসা। সঙ্গে সঙ্গেই বুদ্ধিটা মাথায় এল। সে পাথরটি তুলে নিয়ে ছুড়ে মারল পাশের ঝোপটার দিকে।
কাজ হলো। পাথরটি ঝোপটাকে সশব্দে আন্দোলিত করার সাথে ওদের চারজনের স্টেনগানই ঘুরে গেল সেদিকে।
এই সুযোগের অপেক্ষা করছিল আহমদ মুসা। সে গাছের আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে স্টেনগানের ট্রিগার চেপে তার ব্যারেলটা একবার ঘুরিয়ে আনল ঐ চারজনের উপর দিয়ে।
তারপর স্টেনগান ফেলে দিয়ে পাহাড় থেকে গড়িয়ে নেমে আসল নিচে।
দাড়াতে পারছিল না আহমদ মুসা। অসীম ক্লান্তি ও দুর্বলতায় তার দেহ ভেংগে আসছিল। বুঝতে পারল আহমদ মুসা রক্তক্ষরণ দুর্বল করে দিয়েছে তার দেহ।
দাড়াতে গিয়ে দেখল দেহ তার টলছে, চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে তার।
সে হামাগুলি দিয়ে গাড়ির ড্রাইভিং সিটে উঠে বসল। কোন রকমে তাকে হাইওয়েতে পৌছাতে হবে, ভাবল আহমদ মুসা।
ড্রাইভিং সিটে বসে মাথা ঠিক মত খাড়া করে রাখতে পারছিল না আহমদ মুসা।
গাড়ি ঘুরিয়ে নিয়ে আহমদ মুসা চলতে শুরু করল। কিন্তু সে বুঝতে পারল না, তার গাড়ি হাইওয়ের দিকে না গিয়ে উল্টো দিকে চলছে।
যে পাহাড়ে আশ্রয় নিয়েছিল আহমদ মুসা, সে পাহাড়ের পাশ দিয়ে পশ্চিম দিকে এগিয়ে চলল তার গাড়ি। ভারসাম্য রক্ষা করতে পারছিল না আহমদ মুসা। একটা পা অকেজো, অসহ্য যন্ত্রণা তাতে। একে-বেকে এগিয়ে চলছিল গাড়ি। তাও বেশী দুর এগুতে পারলো না।
সামনেই ছিল আরেকটা পাহাড়। সেখান থেকে রাস্তাটা বাঁক নিয়েছিল উত্তর দিকে।
আহমদ মুসা সংজ্ঞা হারিয়ে ঢলে পড়ল সিটের উপর। গাড়িটি পাহাড়ের ঢালে ধাক্কা খেয়ে এদিক সেদিক একেঁ-বেঁকে অবশেষে থেমে গেল।

দূরবীণে চোখ রেখেই চিৎকার করে উঠল জিনা লুইসা, ‘দেখ দেখ আব্বা, আম্মা, মার্ক’।
জিনা লুইসা যাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল তারাও দূরবীণ চোখে লাগিয়ে তাকাল জিনা লুইসার দৃষ্টি অনুসরণে।
চারজন দূরবীণ চোখ লাগিয়ে নির্বাকভাবে দেখছিল জীবন দেয়া-নেয়ার একটি বীভৎস দৃশ্য।
‘ও গড, ছবির দেখা দৃশ্যের চেয়েও ভয়ংকর’। দূরবীণে চোখ রেখেই আর্ত কন্ঠে বলে উঠল ফ্রাংক মরিস, জিনা লুইসার আব্বা।
‘ওরা যে লোকটাকে তাড়া করে এনেছিল, সেই ওদের গাড়ি উড়িয়ে দিল। গাড়ি থেকে যারা নামছিল তারাও বাঁচল না’। দূরবীণে চোখ রেখেই বলল জিনা লুইসা।
‘কিন্তু দেখ, মরল লোকটা, দু’জন তাকে স্টেনগান তাক করেছে’। দূরবীণ চোখে রেখেই চিৎকার করে উঠল মার্ক মরিস, জিনার ছোট ভাই।
‘আঃ লোকটা গুলী খেয়ে পড়ে গলে নাকি?’ বলল জিনা লুইসা।
‘না, আগেই লাফ দিয়েছে। দেখ লোকটার পায়ে গুলী লেগেছে। রক্ত বেরুচ্ছে, কাঁপছে পা’। বলল মিসেস গাব্রিয়েলা, জিনা ও মার্কের মা।
‘মার্ক দেখ, লোকটা বেঁচে আছে। এদিকে ফিরে লোকটা ওর দিকে এগিয়ে যাওয়া লোক দু’জনকে তাক করছে। হুররে দেখ, গুলী করেছে এ দু’জনকে। দেখ পড়ে গেছে দু’জন লোক’।
‘আহত লোকটি পাহাড়ের উপর দিকে উঠে যাচ্ছে। লোকটা বিদেশী’। বলল ফ্রাংক মরিস।
‘আব্বা, আরেকটা গাড়ি আসছে। ওরা কোন পক্ষের?’ বলল জিনা লুইসা।
‘ওরা চারজনই ফরাসি, দেখ ওরা নিশ্চয়ই আহত লোকটাকেই খুঁজছে’। বলল ফ্রাংক মরিস।
‘সর্বনাশ, ওরা আহত লোকটার খোজে পাহাড়ের উপরে উঠছে’। বলল মার্ক মরিস।
‘নিশ্চয় ওরা আহত লোকটার রক্তের দাগ অনুসরণ করছে’। বলল মিসেস গাব্রিয়েলা।
‘ওরা আহত লোকটাকে হত্যাই করতে চায়, দেখ স্টেনগান থেকে গুলী করতে করতেই ওরা উঠছে’। বলল জিনা লুইসা।
‘ঐ ঝোপেই তো লোকটা লুকিয়ে আছে। নিশ্চয় লোকটা এতক্ষণে মরে গেছে। ওদের গুলী তো এক ফুট জায়গাও বাদ রাখছে না’। বলল মার্ক মরিস।
‘না না দেখ, ওরা চারজন পড়ে গেল। নিশ্চয় আহত লোকটা গুলী করেছে’। বলল জিনা।
‘হ্যাঁ, ঐ তো আহত লোকটা বেঁচে আছে। গড়িয়ে নামছে পাহাড় থেকে’। বলল মিসেস গাব্রিয়েলা।
‘লোকটি দেখ দুর্বল হয়ে পড়েছে, দাঁড়াতে পারছে না। গাড়িতে উঠছে কেন? আহত পা। চালাতে পারবে গাড়ি?’ বলল জিনা লুইসা।
‘সর্বনাশ গাড়ি চালাতে পারছে না একসিডেন্ট করবে’। বলল ফ্রাংক মরিস।
‘চল আব্বা, ওর গাড়ি থামাতে হবে’। চোখ থেকে দূরবীণ নামিয়ে বলল জিনা।
সবাই চোখ থেকে দূরবীণ নামিয়ে ফেলেছে। তারা দেখল তারা যে পাহাড়ে দাড়িয়ে সেই পাহাড়ে এসেই ধাক্কা খেল গাড়িটা।
‘ওরা চারজনই নিচে নেমে এল গাড়ি যেখানে দাড়িয়ে পড়েছে সেখানে।
ফ্রাংক মরিসের এই পরিবার সুর লোরে এসেছিল পিকনিক করতে। যদিও দিনটা ছিল বুধবার। ফ্রাংক মরিস ছুটি ভোগ করছিল বলেই এদিন তারা এসেছিল সুর লোরে’তে। সুর লোরের গোটা এলাকা মানুষে গম গম করে সাপ্তাহিক ছুটির দিনগুলোতে। সারাদিন কাটিয়ে যায় মানুষ এখানে গোটা পরিবার নিয়ে।
ফ্রাংক মরিসের পরিবার বাস করে সুর লোরে থেকে ৫ মাইল দক্ষিণে লোরে নদীর ওপারে দ্বিজন গ্রামে। শস্য ভান্ডার এক বিশাল উপত্যকার মাথায় ফ্রান্সের বিখ্যাত একটি জনপদ এই দ্বিজন।
মিঃ ফ্রাংক মরিস একটি মিডল স্টান্ডার্ড স্কুলের অধ্যাপক।
তার মেয়ে জিনা লুইসা এবং ছেলে মার্ক মরিস দু’জনেই কলেজে পড়ে। তাদের মা মিসেস গাব্রিয়েলা একটা সমাজসেবা প্রতিষ্ঠানের একজন নির্বাহী পরিচালক।
গাড়ির দরজা খুললো ফ্রাংক মরিস। দেখল, তাদের দেখা সেই আহত লোকটির মাথাটা সিটের উপর, আর দেহের বাকি অংশটা গড়িয়ে পড়েছে সিটের নিচে।
‘লোকটি বেঁচে আছে আব্বা?’ উদ্বিগ্ন কন্ঠ জিনা লুইসার।
মিঃ ফ্রাংক মরিস নাড়ী ও নিঃশ্বাস পরীক্ষা করে বলল, ‘হ্যাঁ বেঁচে আছে। তবে তাড়াতাড়ি চিকিৎসা হওয়া প্রয়োজন’।
বলে মিঃ ফ্রাংক আহমদ মুসাকে পাঁজাকোলে করে বের করে আনল। শুইয়ে দিল।
‘একেবারে ছেলে মানুষ তো! শিশুর মত সরল চেহারা। এ এত খুনোখুনি করল?’ বলল গাব্রিয়েলা।
‘এমন গোল্ডেন কালার এশিয়ার কোন দেশের লোকের হয় আব্বা?’ বলল জিনা লুইসা।
‘এশিয়ার অনেক দেশেই আছে। তবে এর মধ্যে তুর্কি ও মংগোলীয় চেহারার সংমিশ্রণ দেখা যাচ্ছে।
মিঃ ফ্রাংক মরিস ইতিহাসের অধ্যাপক।
কথা শেষ করেই মিঃ ফ্রাংক স্ত্রী গাব্রিয়েলাকে বলল, ‘তুমি মার্ককে নিয়ে পাহাড়ের উপর থেকে জিনিসপত্র সহ ওপারে গাড়ির কাছে যাও। আমরা একে এই গাড়িতে করে আমাদের গাড়ির কাছে যাচ্ছি’।
বলে মিঃ ফ্রাংক দ্রুত আহমদ মুসাকে গাড়ির পেছনের সিটে তুলে নিল। তারপর ড্রাইভিং সিটে উঠে বসল। জিনা বসল পেছনের সিটে সংজ্ঞাহীন আহমদ মুসার মাথার কাছে।
‘আব্বা, এ জ্ঞান হারিয়েছে কি অধিক রক্তক্ষরণের জন্যে?’
‘আশু কারণ হয়তো তাই। কিন্তু তার শরীরের উপর দিয়ে আরও ধকল গেছে মনে হচ্ছে। হাতে ব্যান্ডেজ বাঁধা। বড় ধরণের আঘাত বলে মনে হচ্ছে। তার কপালের ক্ষতটাও খুবই তাজা। কাঁচা রক্তের দাগ আছে ব্যান্ডেজে’।
‘আব্বা, ঘটনাকে আপনার কি মনে হয়?’
‘বলা খুব মুস্কিল। একজন লোককে এত লোক তাড়া করা বিস্ময়কর। যারা তাড়া করে এসেছিল, তাদেরকে চেহারা-ছুরতে ভাল লোক বলে মনে হয়নি কিন্তু তার চেয়ে বিস্ময়কর হলো, অল্প বয়সী একজন যুবক এত লোককে মোকাবিলা করে জয়ী হলো। সাধারণ কেউ হলে এটা সম্ভব হতো না’।
‘বিদেশী কোন গুপ্তচর কিংবা মাফিয়া চক্রের কোন সদস্যের মত অসাধারণ কেউ কিনা আব্বা?’
‘প্রতিপক্ষ যদি পুলিশ হতো, তাহলে গুপ্তচর ধরণের কিছু ভাবা যেত। অন্যদিকে মাফিয়া চক্রের সদস্য সর্বনিম্ন যে চেহারার হয়, তা এর মধ্যে দেখা যাচ্ছে না। মানুষের মুখের দিকে তাকালে তার পাপ-পূণ্য দেখা যায়। কিন্তু এর চেহারায় কোন পাপ নেই মা’।
‘আব্বা, এঁর পকেটে একটা রিভলবার। একটা গুলীও খরচ হয়নি’।
‘এটা তাহলে দ্বিতীয় রিভলবার। একটা রিভলবার দিয়ে তো গাড়ির আড়ালে শুয়ে গুলী ছুড়েছিল এবং তাতে দু’জন লোক মারা যায়’।
‘একজনের কাছে দুই রিভলবার? তাহলে এও তো সাংঘাতিক কেউ আব্বা?’
‘বললাম না, অসাধারণ কেউ। লড়াই দেখেই তা বুঝা গেছে’।
‘আব্বা, পকেটে পরিচয় পাওয়ার মত কিছু নেই, একটা পকেটে ৪শ’ ফ্রাংক মাত্র’।
গাড়ি গিয়ে পৌছাল পাহাড়ের ওপাশে। মিঃ ফ্রাংক মরিসদের গাড়ির কাছে। মিসেস গাব্রিয়েলারা তখনও এসে পৌছায়নি।
মিঃ ফ্রাংক ও জিনা লুইসা গাড়ি থেকে নেমে পড়ল।
মিঃ ফ্রাংক মরিসদের গাড়ি একটা ছোট মাইক্রোবাস। পেছনে আটটা সিট, সামনে দু’টা।
মিসেস গাব্রিয়েলারা এসে পৌছাল।
আহমদ মুসাকে তোলা হলো মাঝের চারটা সিটে। পেছনে জিনিসপত্র নিয়ে বসল মিসেস গাব্রিয়েলা। সামনে ড্রাইভিং সিটে মিঃ ফ্রাংক, তার পাশের সিটে জিনা এবং মার্ক।
‘ও গাড়িটা দেখছি ভাড়ার ট্যাক্সি?’ বলল জিনা।
‘হ্যাঁ, গাড়িটা নানতেজ-এর একজন ট্যাক্সি চালকের’।
‘তাহলে গাড়িগুলো সব নানতেজ থেকেই এসেছে’ বলল মার্ক।
‘হতে পারে’। বলল ফ্রাংক।
দশ মিনিটের মধ্যে ওরা দ্বিজন গ্রামের বড় ক্লিনিকটিতে এসে হাজির হলো। ক্লিনিকটির পরিচালক মিঃ ফ্রাংকের ভাই।
ইমারজেন্সিতে প্রাথমিক পরীক্ষার পর ডাক্তার জানাল, শুধু রক্তক্ষরণ নয়, না খাওয়া, দুর্বলতা, ক্লান্তি সব মিলিয়ে জ্ঞান হারিয়েছে। একে দীর্ঘ সময় বেঁধে রাখা হয়েছিল। হাত-পায়ে প্লাষ্টিক কর্ডের গভীর দাগ দেয়া যাচ্ছে। লোহার রড জাতীয় কোন শক্ত জিনিস দিয়ে মাথায় আঘাত করা হয়েছিল। আঘাতটা কপাল ও ডান বাহুর উপর দিয়ে পিছলে গেছে। কপালের থেতলে যাওয়া এবং ডান বাহুর কালশিরা বড় ধরণের আঘাতেরই সাক্ষ্য দিচ্ছে। আর বাম হাতের তালুর আঘাতটা ধারাল ছুরি জাতীয় কিছুর। হাতের তালু এফোঁড়-ওফোঁড় হয়ে হয়েছিল।
পরনের ট্রাউজার ছাড়া গা থেকে সব কাপড় খুলে নেয়া হয়েছিল আহমদ মুসার। জুতাও। জুতার ভেতর থেকে পাঁচশ’ ডলারের একটা নোট পাওয়া গেল।
সবাই আহমদ মুসার টেবিল ঘিরে দাড়িয়েছিল।
ডাক্তার আহমদ মুসার খোলা শরীরটার দিকে তাকিয়ে সপ্রশংস দৃষ্টিতে বলল, ‘এ রকম ভারসাম্যপূর্ণ পেশীর শরীর আমি দেখিনি। ডাক্তারী শাস্ত্রে একে মিরাকল কম্বিনেশন বলা হয়। এ শরীর অসম্ভব, অসাধ্যকে সম্ভব এবং সাধ্যের মধ্যে আনতে পারে। এ দেহ ইস্পাতের মত শক্ত হতে পারে, আবার মোমের মত নরমও হতে পারে’।
‘তোমার অপরাধ বিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে কি দেখছ?’ বলল ফ্রাংক।
‘অপরাধীর কোন চিহ্ন কোথাও দেখি না’।
‘পায়ের আঘাত কি দেখলেন?’ বলল জিনা লুইসা।
‘ও খুব ভাগ্যবান লোক। পায়ের গোড়ালির সবটুকু গোশত বুলেট তুলে নিয়ে গেছে, কিন্তু হাড় স্পর্শ করেনি’।
ডাক্তার নার্সের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘নার্স ইনজেকশনটা এখন দিয়ে দাও। স্যালাইন শেষ হলে অপারেশন থিয়েটারে নিতে হবে। আমি আসছি’। বলে ডাক্তার পাশের কক্ষে চলে গেল।
জিনা লুইসা মার্ককে বলল, মার্ক তুমি ওঁর জুতাটা প্লাষ্টিক ব্যাগে নাও। পরিষ্কার করে আনতে হবে’।
‘চল আমরা বাড়ি থেকে ঘুরে আসি। জিনিস পত্র রেখে আসা যাবে’। সবার দিকে চেয়ে বলল মিঃ ফ্রাংক।
‘না আব্বা, ব্যাপার খুব স্বাভাবিক নয় তো। কেউ একজন আমাদের থাকা দরকার। বলল জিনা।
‘আমি থাকছি, লাঞ্চ করেই জিনা তুমি এসে যেও, তারপর আমি যাব’। বলল মিসেস গাব্রিয়েলা।
‘ধন্যবাদ মা’। বলল জিনা লুইসা।
সকলে বেরিয়ে এল ক্লিনিক থেকে।
মিসেস গাব্রিয়েলা বসল একটা চেয়ার টেনে নিয়ে আহমদ মুসার টেবিলের পাশে।

Top