১৭. ব্ল্যাক ক্রসের কবলে

চ্যাপ্টার

চোখ খোলার আগেই আহমদ মুসা অনুভব করল সে নরম বিছানায় শুয়ে। তার মনে পড়ল, সে গাড়ি চালাচ্ছিল, গাড়ির নিয়ন্ত্রণ সে রাখতে পারছিল না। তারপর আর কিছু মনে নেই তার। গাড়ি কি এ্যাকসিডেন্ট করেছিল?
সে এখন কোথায়, ভাবল আহমদ মুসা। ব্ল্যাক ক্রস-এর হাতে সে ধরা পড়েনি তা বুঝা যাচ্ছে এই নরম শয্যা দেখে। তাহলে সে কোথায়? গাড়ি থেকে সংজ্ঞাহীন অবস্থায় কেউ তাকে অবশ্যই তুলে এনেছে। তারা কারা? ব্ল্যাক ক্রস-এর কেউ নয়তো? ঐ ট্যাক্সির ড্রাইভার যদি ব্ল্যাক ক্রস-এর লোক হয়, তাহলে যে কেউ তা হতে পারে।
সে কি হাসপাতালে? বিছানার যে বৈশিষ্ট সে অনুভব করছে এবং নাকে যে গন্ধ আসছে, তাতে বুঝা যাচ্ছে এটা কোন হাসপাতাল বা ক্লিনিকের কক্ষ।
চোখ খুলে সে কাকে দেখতে পাবে?
ধীরে ধীরে চোখ খুলল আহমদ মুসা। চোখ খুলে আহমদ মুসা দেখতে পেল একজন নার্সকে। আহমদ মুসাকে চোখ মেলতে দেখে এগিয়ে এল নার্স।
ঘরের অন্যপাশে চেয়ারে বসা একজন তরুনীকে দেখতে পেল। তরুনীটি আহমদ মুসাকে তাকাতে দেখেই উঠে দাড়াল। মেয়েটির চোখে-মুখে আনন্দ, বিস্ময় এবং কিংকর্তব্যবিমূঢ়তা।
আহমদ মুসা চোখ ঘুরিয়ে নিয়ে তাকাল নার্স-এর দিকে। বলল, ‘নার্স, দয়া করে বলবেন কি আমি কোথায়?’
‘আপনি দ্বিজন গ্রামের একটি ক্লিনিকে’। বলল নার্স।
‘এই দ্বিজন গ্রাম কোথায়?’
‘নানতেজ-তুরস হাইওয়ের পাশে এদরে নদীর তীরে এবং তুরানে উপত্যকার মাথায় এই গ্রাম।
‘আজ কয় তারিখ এবং কি বার নার্স?’
নার্স জবাব দিল। তারপর বলল, ‘আপনি কেমন বোধ করছেন?’
‘ভালো’।
‘আপনাকে যারা এনেছেন এবং সবকিছু করছেন, আপনি তাদের সাথে কথা বলুন’ বলে নার্স চেয়ার থেকে দাড়িয়ে পড়া মেয়েটিকে কাছে ডেকে নিয়ে আহমদ মুসাকে বলল, ‘এ হলো জিনা লুইসা। এর আব্বা মিঃ ফ্রাংক মরিস। এদের পরিবার পিকনিকে গিয়েছিলেন ‘সুর লোরে’-এর এক পাহাড়ে। আপনাকে আহত ও সংজ্ঞাহীন পেয়ে তারা আপনাকে নিয়ে এসেছেন তাদের গ্রামের এই ক্লিনিকে’।
কথা শেষ করেই নার্স আবার বলল, ‘আপনারা কথা বলুন, আমি ডাক্তারকে খবর দেই’।
বসে নার্স বেরিয়ে গেল কেবিন থেকে।
‘ধন্যবাদ বোন। আপনাকে বোন বললে কি আপত্তি করবেন?’
জিনার কিংকর্তব্যবিমূঢ় ভাব এখনও যায়নি। এই অপরিচিত ও বিস্ময়কর লোকটির সাথে কিভাবে কথা বলবে, কি কথা বলতে হবে, ইত্যাদি নিয়ে তার ভয়, দ্বিধা, সংকোচ এখনও কাটেনি।
আহমদ মুসা বোন ডেকে ধন্যবাদ দিলে উজ্জ্বল হয়ে উঠল জিনার চোখ। জিনা অনুভব করল, লোকটির কন্ঠে কৃত্রিমতা নেই, আর চোখে তার পবিত্র দৃষ্টি। জিনার মনে পড়ল, ওল্ড ফাদারের চোখে এই পবিত্র দৃষ্টি সে দেখেছে। এ দৃষ্টি শত্রুকে মিত্র করে, দুরের মানুষকেও আপন করে নেয়।
জিনা মাথা নেড়ে জানাল, না তার আপত্তি নেই। তারপর জিনা বলল, ‘আমি আব্বা-আম্মাকে খবর দেই, তারা খুশী হবেন’।
বলে জিনা ঘুরে দাড়াতে গেল।
‘শুনুন বোন’। ডাকল আহমদ মুসা।
জিনা থমকে দাড়াল।
‘নার্স যে পিকনিকের কথা বললেন, সেটাতে আপনি ছিলেন?’
‘জি, কেন?’
‘আমি যে গাড়িতে ছিলাম, সে গাড়ি কি ভেঙ্গে গেছে বা তার ক্ষতি হয়েছে?’
‘জি না। ও গাড়ি ড্রাইভ করেই আব্বা ও আমি আপনাকে নিয়ে পাহাড়ের এপাশে আমাদের গাড়ির কাছে এসেছিলাম। কেন বলছেন গাড়ির কথা?’
‘আমি গাড়িটা এক ট্যাক্সি ড্রাইভারের কাছ থেকে ভাড়া নিয়েছিলাম। গাড়ি ভেঙ্গে গেলে লোকটির অনেক ক্ষতি হবে’।
বিস্মিত হলো জিনা। লোকটা তার এই বিপদে নিজের কথা না ভেবে ভাবছে দরিদ্র ট্যাক্সি ড্রাইভারের ক্ষতির কথা। যে বিপদ থেকে তিনি বেচেছেন, যে অনিশ্চয়তার মধ্যে তিনি পড়েছেন, তাতে ট্যাক্সি কেন উড়োজাহাজের ক্ষতির কথাও এই মুহুর্তে তার মনে আসার কথা নয়। আশ্চর্য লোক তো!
হঠাৎ ওল্ড ফাদারের কথা মনে পড়ল, ‘যারা অন্যের হাসিতে হাসে, অন্যের কান্নায় কাদে, তারা মানুষের মধ্যে মহত্তম’।
জিনা শ্রদ্ধার সাথে তাকাল আহমদ মুসার দিকে। নব্বই বছরের শুদ্ধ ধর্মনেতার জ্ঞান ও দৃষ্টি যে নব্য যুবকটির মধ্যে দেখা যাচ্ছে, সে কে?- এই প্রশ্নটি আবারও মাথা তুলল জিনার মনে।
বলল জিনা, ‘গাড়িটা ভাল আছে। দুর্ঘটনার স্থান থেকে গাড়ি দুরে থাকায় নিরাপদেই থাকবে’।
এই সময় এক সাথে ঘরে প্রবেশ করল, জিনার আব্বা, আম্মা এবং ছোট ভাই।
জিনা বলে উঠল, ‘আমি যাচ্ছিলাম তোমাদের খবর দিতে। কি করে খবর পেলে?’
‘নার্স টেলিফোন করেছে’।
জিনা তার আব্বা, আম্মা ও ছোট ভাই এর পরিচয় দিল আহমদ মুসাকে।
আহমদ মুসা উঠে বসতে বসতে বলল, ‘আমি নার্স ও জিনা বোনের কাছে কিছু শুনেছি। আমি আপনাদের কাছে কৃতজ্ঞ। আপনারা আমাকে বাঁচতে সাহায্য করেছেন’। অত্যন্ত নরম কন্ঠস্বর আহমদ মুসার।
আহমদ মুসাকে উঠতে বাধা দিয়ে জিনার আব্বা ফ্রাংক মরিচ বলল, ‘ঈশ্বরই সব কিছু করেন, মানুষ নিমিত্ত মাত্র। তুমি এখন কেমন বোধ করছ?’
‘ভাল’।
‘আমি ডাক্তারের সাথে কথা বলে এলাম। কোন কমপ্লিকেসি নেই। এখনই তোমাকে আমরা নিয়ে যেতে পারি’।
‘আপনাদের কষ্ট দেয়া হবে। সুস্থ হওয়া পর্যন্ত ক্লিনিকেই থাকতে পারি কিনা। কিছু মনে করবেন না। এখানে সিটরেন্ট কত?’
‘সিটরেন্টের প্রশ্ন নেই। এটা আমার ভাইয়ের ক্লিনিক। বাড়িতে নিলে তুমি ভাল থাকবে’।
আহমদ মুসা কিছু না বলে মুখ নিচু করল।
জিনার আব্বা মিঃ ফ্রাংক তার ছেলে মার্ক-এর দিকে তাকিয়ে বলল, দেখ, এ্যাম্বুলেন্স রেডি কিনা। ওদের আসতে বল’।
জিনার আম্মা এ সময় একশ’ ডলারের কয়েকটা নোট আহমদ মুসার দিকে এগিয়ে ধরে বলল, ‘বাছা, এ টাকাগুলো তোমার জুতার মধ্যে পাওয়া গেছে’।
লজ্জার একটা ছায়া নামল আহমদ মুসার চোখে-মুখে। বলল, ‘আমার তো রাখার কিছু নেই, ওগুলো কি আপনার কাছে থাকতে পারে না?’
জিনার মা’র মুখ প্রসণ্নতায় ভরে গেল। বলল, ‘ঠিক আছে বাছা’।
জিনাদের বাড়িতে এল আহমদ মুসা।
তাদের ফ্যামিলি গেস্টরুমের একটা সুন্দর সুসজ্জিত কক্ষে তাকে থাকতে দেয়া হলো। প্রতিদিন ডাক্তার এসে তাকে একবার দেখে যায়। জিনা এবং মার্ক তার দেখাশুনা করে।
আহমদ মুসা ঠিক করেছে তার মুসলিম পরিচয় আপাতত গোপন রাখবে। ব্ল্যাক ক্রস-এর লোকেরা সুর লোরের চারপাশে ঘুর ঘুর করতে পারে। ওদের তো পাগল হয়ে ওঠার কথা। একদিকে সে আহত, তার উপর তার মুসলিম পরিচয়ের প্রকাশ তার পরিচয় প্রকাশ করে দিতে পারে। ঘরে গোপনে সে নামায পড়ে।
সেদিন ভোর পাঁচটার সময় জিনা ও মার্ক বেরিয়েছে তুরস যাবার জন্যে। ছয়টায় তুরসে তাদের একটা প্রোগ্রাম আছে।
আহমদ মুসার রুমের পাশ দিয়ে যাবার সময় মধুর সুরেলা কন্ঠ শুনে দু’জনেই থমকে দাঁড়াল। কান পেতে শুনল সুরটা আহমদ মুসার রুম থেকেই আসছে। দু’জনেরই তীব্র কৌতুহলের সৃষ্টি হলো।
জিনা গিয়ে দরজা বন্ধ কিনা তা দেখার জন্যে ধীরে ধীরে চাপ দিল। দরজা আস্তে আস্তে ফাঁক হয়ে গেল।
ঘরের দরজা পশ্চিম দিকে। দরজা ফাঁক হলে তারা দেখল আহমদ মুসা কার্পেটের উপর একটা পরিষ্কার তোয়ালে ফেলে পূর্ব-দক্ষিণ কোণে মুখ করে দাড়িয়ে আছে তার হাত দু’টি বুকে বাঁধা। সুর করে দুর্বোধ্য ভাষায় অনুচ্চ স্বরে কি যেন পড়ছে। তারপর তারা আহমদ মুসাকে কোমর পর্যন্ত খাড়া রেখে ভাঁজ হতে দেখল। দেখল, কার্পেটের উপর কপাল রেখে মাটিতে উপুড় হয়ে পড়তে। মাঝখানে একবার বিরতি দিয়ে চার বার তাকে তারা একই কাজ করতে দেখল।
সবশেষে দেখল দু’হাত তুলে প্রার্থনা করতো।
দরজা আস্তে আস্তে ভেজিয়ে জিনা ও মার্ক বেরিয়ে এল। মার্ক বলল, ‘আপা, তুমি অবাক হচ্ছো! আমি আরও দু’বার তাকে এই কাজ করতে দেখেছি’।
‘কোন সময় দেখেছিস?’
‘দু’দিনই দেখেছি রাত দশটার পরে’।
‘এমন ধরণের শরীরচর্চা তো কোথাও দেখিনি’।
‘শরীরচর্চার পরে ঐ প্রার্থনাও তো অবাক ব্যাপার?’
‘কিন্তু এই শরীরচর্চা এমন সময়ে এবং বন্ধ ঘরে গোপনে কেন? তাছাড়া ঐ সব কি পাঠ করেন উনি?’
‘আসলে কিন্তু খুবই মজার ঘটনা আপা’।
‘ঠিক। একদিন জিজ্ঞাসা করতে হবে’।
সেদিন জিনাদের ফ্যামিলি ড্রইং রুমে জিনা, তার আব্বা, মা এবং ভাই মার্ক বসে।
কথা বলছিল জিনার মা। বলছিল, ‘শোন জিনার আব্বা, এই মুসায়েভ ছেলেটাকে না দেখলে আমার বিশ্বাসই হতো না এমন মানুষ দুনিয়াতে থাকতে পারে। এত লাজুক যে অধিকাংশ সময়ই মুখের দিকে তাকিয়ে কথা বলে না, আমাদের মানে মেয়েদের সাথে। জিনাকে সে বোন ডেকেছে, কিন্তু জিনার মুখের দিকে তাকে তাকাতে দেখিছি বলে আমার মনে পড়ে না’।
‘ঠিক বলেছ, আম্মা। আমার মাঝে মাঝে কিন্তু হাসি পায়’।
‘শুধু জিনা ও আমার ক্ষেত্রেই নয়, পাড়ার মেয়েরাও এসেছে। তাদের কেউ সামনে এলেই সে চোখ নামিয়ে নেয়’।
‘আমিও এটা লক্ষ্য করেছি। প্রথম দিকে ভাবতাম, এটা তার এক ধরনের নার্ভাসনেস। সুন্দরী ও সমবয়সী মেয়েদের সামনে পড়লে অনেকের এমন হয়। কিন্তু আহমদ মুসার ক্ষেত্রে এর লেশমাত্র নেই। তার কন্ঠ নরম কিন্তু অত্যন্ত পৌরুষদীপ্ত। তার কথার মধ্যে কোথাও সামান্য দুর্বলতা কিংবা দ্বিধার লেশমাত্র থাকে না’। বলল জিনার আব্বা।
‘তার বড় একটা গুণ সে অত্যন্ত স্বাবলম্বী। অসুস্থ অবস্থাতেই নিজের কাজ সে নিজ হাতে করতে চেয়েছে। সেদিন আমি ওষুধ খাওয়ার সময় তার গ্লাসে পানি ঢালতে গিয়েছিলাম। সে বলে উঠল, ‘সন্তান থাকতে মাকে যদি এসব কাজ করতে হয়, তাহলে সন্তানের অপরাধ হয় মা’। এমন সচেতনতা, এমন দৃষ্টিভংগি, মাকে এমন মর্যাদা দিতে আমি কাউকে দেখিনি’।
‘উনি সত্যিই অদ্ভুত মা। সেদিন উনি টয়লেটে ছিলেন, বিছানা-টেবিল দেখলাম আগোছালো। মনে করলাম, আমি গুছিয়ে দেই। গোছানো প্রায় শেষ করেছিলাম। উনি বেরিয়ে এলেন। আমাকে দেখে উনি একটু হাসলেন বটে। কিন্তু চারদিকে চেয়ে তার চোখ ও চেহারায় যে ভাব ফুটে উঠল তাতে বুঝলাম, তিনি অসন্তুষ্ট হয়েছেন। তিনি অত্যন্ত ভদ্রভাবে বলেই ফেললেন, বড় ভাইয়ের যা করা উচিত, তা ছোট বোনের করে দেয়া ঠিক নয়’।
আমি বলেছিলাম, ‘ঠিক নয়, কিন্তু করে দেয়া তো অন্যায় নয়’।
উত্তরে তিনি বলেছিলেন, ‘অন্যায় সম্পর্কে ধারণা সব সময় মূল্যবোধের উপর নির্ভরশীল। আমি যাকে অন্যায় বলব, তাকে তুমি অন্যায় মনে নাও করতে পার’।
‘এ কথাটুকুর মধ্যে তিনি বিরাট কথা বলেছিলেন। হজম করতে আমার সময় লেগেছিল। একটু পরে আমি বলেছিলাম, ‘বুঝেছি, আমাদের আলাদা মুল্যবোধের কথা বলছেন, আমি এ বিষয়টা ভাল বুঝি না’। বলে আমি চলে এসেছিলাম। আমার কিছুটা রাগ হয়েছিল, অপমানও বোধ করেছিলাম কিছুটা। সেদিনই যখন তাঁর সাথে আমার আবার দেখা হলো, তিনি বলেছিলেন, জিনা বোন, তুমি রাগ করেছ আমি বুঝতে পেরেছি। মনে রেখ, এই পৃথিবীতে যে জীবন ও জগৎ তুমি দেখছ, সেখানে সবাইকেই কিছু গ্রহণ এবং কিছু বর্জন করে চলতে হয়। এই গ্রহণ বর্জনের জন্যে তোমার ভ্যালু জাজমেন্ট (মাপকাঠি) থাকতে হবে। একে তুমি নীতিবোধ বা দৃষ্টিভংগিও বলতে পার। এটা না থাকলে গ্রহণ-বর্জনের গুরুত্বপূর্ন কাজে ভুল হতে পারে?’
আমি বলেছিলাম, বুঝেছি। আপনি বিরাট দার্শনিক কথা বলেছেন। কিন্তু এর দ্বারা আমাকে কি বুঝাতে চাইছেন’।
‘তোমার চোখে আমি অসন্তুষ্টি দেখেছিলাম, তাই একথাগুলো আমার বলা। আমি তোমাদের অল্প সময়ের অতিথি। আমার আচরণ যদি তোমাদের কষ্ট দেয়, তাহলে সেটা আমার জন্যে বড় কষ্ট হয়ে থাকবে’।
‘তাঁর কণ্ঠস্বর ভারি ছিল। আমার খুব খারাপ লেগেছিল। বুঝলাম, আমার কথায় তিনি আহত হয়েছেন। আমি বললাম, আমি আমার কথার জন্যে মাফ চাচ্ছি। কিন্তু আমি জানতে চাই, আমার কাজটুকুকে আপনি অন্যায় মনে করেছিলেন কেন?’
কিছুক্ষণ তিনি চুপ করে থাকলেন পরে বললেন, ‘অনেক কথা আছে বোন যা স্পষ্ট করে বলা যায় না। আসল ব্যাপার হলো, আমি যথা সম্ভব চাই না আমি একা থাকা অবস্থায় আমার বদ্ধ ঘরে একা এমন কোন মেয়ে প্রবেশ করুন যিনি আমার মা নন, সহোদর বোন, খালা নন, ফুফি নন। এটা আমার দুর্বলতা নয়, দুর্ঘটনার বিরুদ্ধে এটা আমার সতর্কতা’।
তিনি থামলেও আমি অনেকক্ষণ কথা বলতে পারিনি। আমি স্তম্ভিতভাবে তাকিয়েছিলাম তাঁর দিকে। তাঁর কথা আমি পুরোপুরিই বুঝতে পেরেছিলাম। হঠাৎ করেই আমার যেন মনে হয়েছিল, যাকে আমি দেখছি, তিনি আমার দেখা মানুষের মত কোন মানুষ নন।
কোন ভাবে আমি বলতে পেরেছিলাম, ধন্যবাদ ভাইয়া। আপনাকে ভাই বলে ডাকতে পারায় আমার গর্ববোধ হচ্ছে।
মাথা ঝুকিয়ে তাকে একটা বাও করে চলে এসেছিলাম।
সবাই অবাক বিস্ময়ে শুনছিল জিনার কথা।
‘আসলে এই ছেলেটা কে? চরিত্র, সাহস, শক্তি সবদিক দিয়েই বিস্ময়কর। কে এই ছেলেটি?’ বলল জিনার মা।
‘সুস্থ হয়ে উঠেছে, এখন জিজ্ঞাসা করা যায়’। বলল জিনার আব্বা।
‘আব্বা, তাকে আমি অদ্ভুত এক ধরণের ব্যায়াম করতে দেখেছি। জিনা আপাও দেখেছে’। বলল মার্ক মরিস।
‘অদ্ভুত কেমন?’ বলল জিনার মা।
‘মার্ক ঠিকই বলেছে মা। আমিও দেখেছি’। বলল জিনা।
‘বলত শুনি’। বলল জিনার আব্বা।
মার্ক তার দেখা সব কাহিনী খুটিয়ে খুটিয়ে বলল। সব শুনে ভ্রু কুচকালো জিনার আব্বা ফ্রাংক মরিচ। বলল, ‘মার্ক তুমি নিজে করে দেখাও দেখি ব্যাপারটা’।
মার্ক নিখুতভাবে তা দেখাল।
মার্ক-এর ডেমোনেস্ট্রেশন শেষ হবার আগেই জিনার আব্বা বলে উঠল, আর দরকার নেই মার্ক। এটা মুসলমানদের প্রার্থনা’। প্যারিসের মসজিদে একদিন এ প্রার্থনা আমি দেখেছি’।
‘এটা মুসলমানদের প্রার্থনা? তাহলে…’। প্রায় এক সংগেই বলে উঠল জিনার মা, জিনা এবং মার্ক।
‘তাহলে মুসায়েভ মুসলমান’- এ ব্যাপারে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই’। বলল জিনার আব্বা মিঃ ফ্রাংক।
‘এবং তাহলে প্রার্থনায় দুর্বোধ্য ভাষায় তাকে যেটা পড়তে শুনেছি, সেটা ওদেঁর ধর্মগ্রন্থের উদ্ধৃতি, তাই না আব্বা?’ সোৎসাহে বলে উঠল জিনা।
জিনা উঠল। বলল, ‘আমি যাই, এ সুখবর ফ্রান্সিসকে দিতে হবে’।
‘ফ্রান্সিসকে দিতে পার। কিন্তু যেহেতু সে ব্যাপারটা গোপন রেখেছে, তাই এটা প্রচার না হওয়াই ভাল’। বলল মিঃ ফ্রাংক।
‘ঠিক আছে’। বলে দৌড় দিল জিনা।
ফ্রান্সিসের বাড়িতে ঢুকেই পেল ফ্রান্সিসের মাকে। বলল, ‘চাচী আম্মা, ফ্রান্সিস কোথায়?’
‘কেন বাইরে নেই?’
‘নেই’।
‘তাহলে কোথাও গেছে’।
‘ও কি বাইরে কোথাও গিয়েছিল। ক’দিন দেখছি না যে’।
‘না কোথাও যায়নি। তোমার উপর মনে হয় খুব রেগে আছে। কাল তোমাকে ডাকতে যেতে বলেছিলাম আমার কম্পিউটারটা তোমাকে একটু দেখাব বলে। বলল, কারো বাড়িতে আমি যেতে পারব না। আমি ঠিক করে দেব’।
‘কেন রাগ করেছে চাচী আম্মা?’
‘সেদিন জন্মদিনে তুমি আসনি’।
‘ও এই’।
বলে জিনা বেরিয়ে গেল ফ্রান্সিসের খোজে।
পেল তাকে বাড়ির নিচেই ওদের বাগানে।
যেতে যেতে জিনা ভাবছিল, সত্যি কয়দিন থেকে জিনারও আসা হয়নি এদিকে। জন্মদিনে আসতে পারেনি আহত ও সংজ্ঞাহীন মেহমান নিয়ে ব্যস্ত থাকার কারণে। ঐ দিনই পিকনিক থেকে তাকে তাদের বাড়িতে নিয়ে আসা হয়।
ফ্রান্সিস বসে আছে তাদের সবজি ও ফুলের বাগানে। বাগানটিতে ফুল গাছের ফাকে ফাকে প্রচুর সবজিও ফলানো হয়েছে।
বসে বসে একটা সবজি গাছের পরিচর্যা করছিল ফ্রান্সিস।
জিনা ফ্রান্সিসের একদম পিঠের কাছে গিয়ে দাঁড়াল। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করল। খেয়াল করল না ফ্রান্সিস।
জিনা তর্জনি দিয়ে টোকা দিল ফ্রান্সিসের মাথায়।
ফ্রান্সিস চমকে ফিরে তাকাল। ঠোটে তার এক ঝলক হাসি ফুটে উঠেও মিলিয়ে গেল। মুখ গম্ভীর করে বলল, ‘এদিকে কি মনে করে?’
‘চাচী আম্মা ঠিকই বলেছেন। খুব তো রাগ দেখছি!’ ঠোটে দুষ্টুমী হাসি টেনে বলল জিনা।
‘রাগ কিসের? আমি জিজ্ঞাসা করছি, এদিকে কেন রাজপুত্তুরকে ছেড়ে?’ ক্ষোভে মুখ লাল করে ফেলল ফ্রান্সিস।
জিনার মুখ থেকে হাসি মিলিয়ে গেল। মুখে ফুটে উঠল তার অপমানের চিহ্ন। তীব্র কন্ঠে বলল, ‘ফ্রান্সিস তুমি কি বলছ জান?’
‘জানি, রাজপুত্তুরের কথা। ময়ুরপংখীতে চড়ে আসা রাজপুত্তুরের কথা’।
‘চুপ কর ফ্রান্সিস, ওর সম্পর্কে একটা কথাও বলবে না’। কঠোর কন্ঠ জিনার। রাগে, ক্ষোভে তার মুখ লাল হয়ে উঠেছে। কাঁপছে তার ঠোট।
ফ্রান্সিসের চোখ-মুখ আরও কঠোর হয়ে উঠল। বলল অনেকটা ব্যাংগ করেই, ‘জানতাম তোমার খুব লাগবে’।
‘তুমি পাগল হয়ে গেছ। কমনসেন্স হারিয়ে ফেলেছ ফ্রান্সিস’। তীব্র ক্ষোভে চিৎকার করে উঠল জিনার কন্ঠ।
‘এখানে চিৎকারের কোন প্রয়োজন নেই। তুমি যাও। আমি রাজপুত্তুর নই, ছোট্ট জাতির সামান্য মানুষ আমি’। বলে আবার বসে পড়ল ফ্রান্সিস।
‘ঠিক আছে আমি যাচ্ছি। আমাকে তুমি এত ছোট করবে, তুমি এত ছোট হবে আমি ভাবিনি’। কান্নায় ভেঙে পড়ল জিনা। তারপর দু’হাতে মুখ ঢেকে ঘুরে দাড়িয়ে পাগলের মত দৌড় দিল সে।
কয়েক গজ গিয়েই বাগানের লাইট পোস্টের সাথে ধাক্কা খেল জিনা। একটা ছোট্ট আর্তনাদ তুলে পড়ে গেল সে।
দেখতে পেল ফ্রান্সিস। একটু দ্বিধা করল। তারপর ছুটে গেল জিনার কাছে। টেনে তুলল জিনাকে মাটি থেকে। এক হাতে জড়িয়ে রেখে মাথা পরীক্ষা করে বলল, ‘কেটে গেছে’। পকেট থেকে রুমাল বের করে আহত স্থানটা চেপে ধরল এবং বলল, ‘চল বাসায়’।
জিনা নিজেকে ছাড়িয়ে নেবার চেষ্টা করে বলল, ‘ছেড়ে দাও আমাকে। আর মায়া দেখাতে হবে না। যেতে দাও আমাকে তোমার রাজপুত্তুরের কাছে’।
‘মায়া দেখাচ্ছি না। যাবে। তার আগে বাসায় চল’। বলে ফ্রান্সিস জিনাকে টেনে নিয়ে চলল বাসার দিকে।
বাসায় ঢুকতেই ফ্রান্সিসের আম্মা বলল, ‘কি হয়েছে জিনার?’
‘ইলেকট্রিক পোলের সাথে ধাক্কা লাগিয়ে মাথা কেটে ফেলেছে আম্মা’। বলল ফ্রান্সিস।
‘কিভাবে ধাক্কা খেল? খুব কেটে গেছে?’
‘ও রাগলে কিছু চোখে দেখে না আম্মা’।
‘আবার আমাকেই দোষ দিচ্ছ?’ তার কন্ঠে কান্নার সুর।
‘ফ্রান্সিস তুই এখান থেকে যা। তোর কান্ডজ্ঞান কোনদিন হবে না’। বলে ফ্রান্সিসের মা জিনাকে কাছে টেনে নিল। বলল, ‘দেখি মা কেমন কেটেছে’।
ফাস্ট এইড বক্স নিয়ে ফিরে এল ফ্রান্সিস।
আঘাতটা বড় কোন কাটার পর্যায়ে যায়নি। চামড়া একটু ছিড়ে গিয়ে একটু রক্ত বেরিয়েছে। তবে জায়গাটা ফুলে উঠেছে বেশ। কিচুক্ষণ বরফ দেয়ার পর তুলা দিয়ে ওষুধ লাগিয়ে দিল ফ্রান্সিস।
‘এ কিছু নয়, দু’এক দিনেই সেরে যাবে। মাথায় চিরুনিটা একটু সাবধানে কোরো’। বলল ফ্রান্সিসের আম্মা।
‘আসি চাচী আম্মা’। বলে জিনা চলতে শুরু করল।
ফ্রান্সিস হাত পরিষ্কার করে রুমাল দিয়ে হাত মুছতে মুছতে বাড়ির গেটে জিনার সামনে দাঁড়াল।
জিনা মুখ তুলে চাইল ফ্রান্সিসের দিকে। মুহুর্তকাল চেয়ে থেকে বলল, ‘আর কি অপমান করার তোমার বাকি আছে?’ থাকলে করো’।
ফ্রান্সিসের চোখে এখন আর রাগ নেই। চোখে-মুখে কিছুটা অনুশোচনার ভাব। বলল, ‘সব দোষ আমার, তোমার কোন দোষ নেই?’
‘দোষ তো আছেই। তাই তো যা তা বলেছ, আরও বল’। বলে জিনা ফ্রান্সিসকে পাশ কাটিয়ে চলতে শুরু করল।
গেট থেকে বেরিয়ে এসে জিনা ফিরে তাকাল। ফ্রান্সিস দাড়িয়ে ছিল গেটে মুখ ভার করে।
ফ্রান্সিসের দিকে না তাকিয়ে মুখ নিচু করে বলল, ‘আমি তোমাকে এমন একটা সুখবর দিতে এসেছিলাম, যা এই গ্রামে, এই দেশে তোমাকেই খুশী করত সবচেয়ে বেশী। কিন্তু তুমি বলতে দিলে না। চাপালে আমার মাথায় অপবাদের বোঝা’। বলে জিনা ঘুরে দাড়িয়ে চলতে শুরু করল।
ফ্রান্সিস ছুটে গিয়ে জিনার সামনে দাঁড়াল। বলল, ‘ঠিক আছে তুমি যাও কিন্তু একটা কথা বল, আমি যা তোমাকে বলেছি, তা আমি কি বিশ্বাস করি?’ ভারি কন্ঠ ফ্রান্সিসের।
‘আমি যা উত্তর দেব, তা তুমি জান। কিন্তু আমি জিজ্ঞাসা করি এমন কথা তুমি বলতে পার কেমন করে?’
‘এমন অবস্থায় পড়লে তোমার রাগ হতো না?’
‘হয়তো হতো। কিন্তু এমন জঘন্য কথা তোমাকে বলতে পারতাম না’। আবেগে রুদ্ধ হয়ে গেল জিনার কন্ঠ।
অশ্রু নেমে এল ফ্রান্সিসের চোখে।
জিনার পথ থেকে সরে দাড়িয়ে ফ্রান্সিস বলল, ‘ঠিক আছে যাও জিনা’।
জিনা নড়ল না। বলল, ‘কথাটা শুনবে না?’ ফ্রান্সিসের দিকে না তাকিয়েই বলল জিনা।
উত্তর দিল না ফ্রান্সিস। দাড়িয়ে রইল চুপ করে।
জিনা পকেট থেকে রুমাল বের করে ফ্রান্সিসের দিকে তুলে ধরে বলল, ‘চোখ মুছে এস আমার সাথে’।
‘কোথায়?’
‘তোমার রাজপুত্তুরের কাছে’।
‘আমাকে শাস্তি দেবার আর কোন পথ কি তোমার নেই জিনা?’
জিনার মুখে হাসি ফুটে উঠল। বলল, ‘আবার ঝগড়া বাধাবে? আমাকে চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করতে পার না?’
‘ঠিক আছে, চল জিনা’। চোখ মুছে নিয়ে বলল ফ্রান্সিস।
দু’জনেই হাঁটতে শুরু করল জিনার বাড়ির দিকে।
‘রাগ করে হোক, যেভাবেই হোক তুমি একটা সাংঘাতিক সত্য কথা বলেছে ফ্রান্সিস’। বলল জিনা।
‘কি বলেছি?’
‘আমাদের মেহমান সত্যিই রাজপুত্তুর। এমন বিস্ময়কর মানুষ চোখে দেখতে পাব তা কোনদিন ভাবিনি’।
‘যতই বল রাগ আর আমার আসবে না’।
‘তোমার রাগের কথা নয়। কথাটা আমি সত্যিই বলছি। চল গেলেই বুঝতে পারবে। জান সে কে?’
‘কে?’
‘মুসলমান’।
‘মুসলমান? মুসলমান?’ বলতে বলতে দাড়িয়ে পড়ল ফ্রান্সিস।
‘এস, দাঁড়াবার দরকার নেই’ বলে টেনে নিয়ে যেতে যেতে জিনা বলল, ‘উনি পরিচয় দেননি। ব্যাপারটা আমরা গোপনে দেখেছি। গোপনে আমরা তাকে প্রার্থনা করতে দেখেছি, তোমাদের ধর্মগ্রন্থ থেকে উদ্ধৃতি পাঠ করতেও শুনেছি’।
আনন্দ ও বিস্ময়ে মনটা ভরে গেল ফ্রান্সিসের। বলল, ‘কিন্তু পরিচয়টা গোপন করেছে কেন?’
‘বললাম না লোকটা বিস্ময়কর। আমরা নিজ চোখে দেখলাম, আক্রান্ত হওয়ার পর দশজন লোককে পরাজিত ও হত্যা করে বিজয় লাভ করল। কিন্তু এ শক্তির চেয়ে বিস্ময়কর হলো তার চরিত্র। একটা কেন একশ’টা জিনা তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারবে না, তা জানো গর্দভ’।
‘তুমি সত্যিই আমার সাথে রসিকতা করছ জিনা’।
‘ঠিক আছে চল’।
আহমদ মুসার ঘরে তাকে পেল না জিনা। বলল, ‘চল ফ্রান্সিস, নিশ্চয় ভেতরের ড্রইং রুমে আছেন তিনি’।
ড্রইং রুমে প্রবেশ করল জিনা ও ফ্রান্সিস। দেখল জিনা, তার আব্বা, আম্মা, মার্ক ও আহমদ মুসা বসে গল্প করছে।
জিনা ফ্রান্সিসকে দেখিয়ে আহমদ মুসাকে বলল, ‘মুসায়েভ ভাইয়া এ ফ্রান্সিস, আমার বন্ধু’।
আহমদ মুসা হাত বাড়াল ফ্রান্সিসের দিকে। হ্যান্ডশেক করল দু’জনে।
ফ্রান্সিস প্রথম দৃষ্টিতেই আহমদ মুসা সম্পর্কে যে উপলব্ধি করল তা হলো, লোকটা একদম স্বচ্ছ। তার মুখের দিকে তাকাতেই তার হৃদয়টাকে দেখা যায়। ফ্রান্সিসের দ্বিতীয় অনুভূতিটা হলো, লোকটা যেন তার শত বছরের চেনা। কোন অপরিচয়ের ব্যবধান তাদের মধ্যে যেন নেই। মুহুর্তেই আপন হয়ে গেছে। আহমদ মুসার সাথে যখন হ্যান্ডশেক করল তার মনে হলো, আত্মশক্তির একটা বিদ্যুৎ প্রবাহ যেন খেলে গেল তার গোটা সত্ত্বায়।
জিনা গিয়ে বলল তার আব্বার পাশে। আর ফ্রান্সিস বসল মার্ক-এর সোফায়।
‘যে কথা বলতে যাচ্ছিলাম বৎস’, বলে শুরু করলো জিনার আব্বা, ‘সেদিন সুর লোরে’তে তোমাকে যেভাবে আমরা মোকাবিলা করতে দেখলাম, তারপর গত কয়েকদিন তোমাকে যা দেখলাম, তাতে, সত্যি বলছি, তোমাকে সাধারণ কেউ বলে আমাদের মনে হয়নি, এজন্যে আমাদের বিরাট কৌতুহল তোমাকে জানার’।
একটু থামল জিনার আব্বা। থেমেই আবার শুরু করল, ‘আমরা বুঝতে পারছি, তুমি এশিয়ান। তোমার দেশ কোথায়?’
আহমদ মুসা মুখ নিচু করল। তারপর বলল, ‘একজন অপরিচিত সম্পর্কে এই কৌতুহল স্বাভাবিক জনাব। কিন্তু বুঝতে পারছি না আপনার প্রশ্নের উত্তরে কি বলব আমি। চীনের তুর্কিস্থান (সিংকিয়াং) প্রদেশে আমি জন্মগ্রহণ করি। কিন্তু আজ আমার কোন দেশ নেই’। শান্ত ও নরম কন্ঠ আহমদ মুসার।
‘কেন, তোমার বাড়ি নেই?’
‘না, আমার কোন বাড়ি নেই’।
‘কেন বাপ, মা, ভাই, বোন…’।
‘না, আমার কেউ নেই জনাব’। একটা ম্লান হাসি ফুটে উঠল আহমদ মুসার ঠোটে। তাতে বেদনাই ঝরে পড়ল বেশী। চোখ নিচের দিকে রেখে কথা বলছিল আহমদ মুসা।
কারও মুখে কোন কথা নেই। আহমদ মুসার উত্তরগুলো সবাইকে স্তম্ভিত করেছিল। তাদেরকে কিছুটা বেদনার্তও করেছে। সবার দৃষ্টি আহমদ মুসার ম্লান মুখের দিকে।
‘এমনটা কি করে হয় বৎস?’ বলল জিনার আম্মা।
‘হয় আম্মা। সিংকিয়াং থেকে হাজার হাজার মুসলিম পরিবারকে উচ্ছেদ করা হয়েছে। আমার পরিবার তার একটি। বিতাড়িত হবার সময় সব হারিয়েছি। কেউ মারা গেছেন, কেউ নিহত হয়েছেন’।
‘তাই বলে তোমার দেশ থাকবে না, বাড়ি থাকবে না?’
‘সব দেশই আমার দেশ। আর বাড়ির প্রয়োজন হয়নি আমার’।
‘কিন্তু তোমার পাসপোর্ট?’
‘ওটা কোন সমস্যা হয় না। মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে যখন যে দেশের পাসপোর্ট চাই দিয়ে দেয়’।
বিস্ময়ে চোখ কপালে তুলল জিনার আব্বা মিঃ ফ্রাংক মরিচ। এ কথা সবাইকেই বিস্মিত করর। ফ্রান্সিস শুধু বিস্মিত নয়, তার হৃদয়টা একটা অপরিচিত বেদনায় ভরে গিয়েছিল। সে ভাবতে পারছিল না, এমন মূলহীন অসহায় মানুষ দুনিয়াতে থাকে! আর জিনা ভাবছিল, কি অদ্ভূত! রাজপুত্তুরের ভেতরে এক চরম ‘নিঃস্বতার বেদনা!’
‘সেদিন সুর লোরে’তে কাদের সাথে তোমার সংঘর্ষ হলো?’ বলল জিনার আব্বা।
আহমদ মুসা মুখ তুলে একবার চারদিকে চাইল। মিঃ ফ্রাংক মরিচ আহমদ মুসার দ্বিধা বুঝতে পারল। বলল, ‘এখানে সবাই আমরা তোমার মংগলকামী’।
‘ধন্যবাদ’, জানিয়ে আহমদ মুসা বলল, ‘ওরা ‘ব্ল্যাক ক্রস’-এর লোক’।
‘ব্ল্যাক ক্রস’-এর লোক?’ জিনার আব্বার কন্ঠে ভয় ও বিস্ময় দুটোই ফুটে উঠল।
‘ব্ল্যাক ক্রস’ কি আব্বা? তুমি চেন?’ পাশ থেকে বলে উঠল জিনা।
‘চিনি না। সম্প্রতি ওদের সম্পর্কে জেনেছি। ওটা একটা গোপন খৃষ্টান সংগঠন। বিশ্বজোড়া ওদের কাজ। ক্রুসেড চালাচ্ছে ওরা অন্য ধর্ম বিশেষ করে মুসলমানদের বিরুদ্ধে। ওদের সুনামও আছে, আবার সবাই জানে ওটা খুনে সংগঠন, পশুর চেয়েও নাকি নৃশংস। ওদের শত্রুর খাতায় নাম উঠলে তার আর রক্ষা নেই’।
‘আপনি ঠিক বলেছেন জনাব’। বলল আহমদ মুসা।
সকলের চোখেই ভয় এবং আতংক।
ড্রইং রুমের দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে এস। কোন কথা বাইরে না যাওয়াই ভাল।
‘ওদের সাথে তোমার এই সংঘাতের কারণ কি? তুমি শত্রু হলে কেমন করে ওদের?’ বলল জিনার আব্বাই।
আহমদ মুসা ম্লান হাসল। বলল, ‘আমার সাথে তাদের কোন শত্রুতা নেই। ক্যামেরুনের একজন যুবককে তারা প্যারিস থেকে কিডন্যাপ করেছে। সে আমার বন্ধু, তাকে আমি উদ্ধারের চেষ্টা করছি’। এরপর আহমদ মুসা একটু থেমে ওমর বায়াকে কেন্দ্র করে যা ঘটেছে সব কথা খুলে বলল।
সবাই মন্ত্রমুগ্ধের মত শুনল ওমর বায়ার সেই কাহিনী। সবার চোখে-মুখে ফুটে উঠল অসহনীয় এক বেদনার ছাপ। আর জিনা এবং ফ্রান্সিসের চোখ সিক্ত হয়ে উঠেছিল অশ্রুতে। আহমদ মুসা তাদের সকলের কাছে আরও মহত্তর রূপ নিয়ে আবির্ভূত হলো। নিজ জাতির জন্যে এমন ভালবাসা, একজন ব্যক্তি জন্যে এইভাবে বিপদে ঝাপিয়ে পড়ার কথা তারা বইতেই পড়েছিল কিন্তু তাকে আজ তারা চোখের সামনে মূর্তিমান দেখতে পাচ্ছে।
‘ওমর বায়ার কোন সন্ধান পেয়েছ?’ বলল জিনার আব্বা।
‘আমি মাত্র কয়েকদিন আগে প্যারিস এসেছি। প্যারিসে ওদের একটা ঘাটিঁর খোঁজ পাই। যে রাতে আমি আসি, তার পরের রাতেই ওদের ঘাটিতে যাই আমি ওমর বায়ার….’।
আহমদ মুসাকে কথা শেষ করতে না দিয়েই জিনার আব্বা জিজ্ঞাসা করল, ‘একা গেলে?’
‘জি, হ্যাঁ’।
আহমদ মুসা এরপর ব্ল্যাক ক্রস-এর সাথে তার যা ঘটেছে সব কথা বলল। ‘সুর লোরে’-এর ঘটনা পর্যন্ত।
আহমদ মুসা কথা শেষ করলেও কেউ কথা বলল না। বলতে পারল না। সবার মুখ ভয়ে, বিস্ময়ে হা হয়ে গেছে। যা তারা শুনল ফিল্মের কাহিনীর চেয়ে চমৎকার, ফিল্মের কাহিনীর চেয়েও যেন ভয়ংকর।
জিনা ও মার্ক-এর মনে হলো তাদের সামনের লোকটি একজন জীবন্ত রবিনহুড কিংবা তার চাইতেও বড়। আর ফ্রান্সিসের বুকটা অসীম এক আবেগে ভরে গেছে। আহমদ মুসাকে তার মানুষ বলে মনে হচ্ছে না। মনে হচ্ছে শত্রু নিধনের জন্যে স্বর্গ থেকে পাঠানো গ্রীক দেবতাদের একজন তিনি।
‘ব্ল্যাক ক্রস-এর ২৪জন এ পর্যন্ত তোমার হাতে নিহত হয়েছে?’ বিস্ময়-রুদ্ধ কন্ঠে বলল জিনার আব্বা।
‘আত্মরক্ষার প্রয়োজন ছাড়া কাউকে আমি মারি না। মারতে চাইলে জাহাজে আরও সাত আটজন লোক মরত’।
সবাই চুপ চাপ।
নীরবতা ভাঙল জিনার আম্মা। বলল, ‘আমরা যা ভেবেছি তাই, তুমি সাধারণের মধ্যে পড় না। কিন্তু তুমি কে? তুমি যে মুসলমান, তোমার প্রার্থনা করা থেকে আমরা বুঝেছি এবং আজ তুমিও বললে। তোমার আর পরিচয় কি?’
আহমদ মুসা মাথা নিচু করল। তৎক্ষণাৎ কোন কথা বলল না। তারপর ধীরে ধীরে মাথা তুলে বলল, ‘আপনারা আমাকে মৃত্যুর মুখ থেকে বাচিয়েছেন এবং আপনাদের কাছে যে স্নেহ পেয়েছি তাও কোনদিন ভুলবার নয়। আপনাদের কাছে কোন কিছু গোপন করা ঠিক নয়’। বলে একটু থামল আহমদ মুসা। তারপর আবার শুরু করল, ‘আমি আপনাদের কাছে আমার মিথ্যা নাম বলেছি। আমার নাম আহমদ মুসা।
জিনার আব্বার ভ্রু কুঞ্চিত হলো। বলল, আমি এক আহমদ মুসা সম্পর্কে পড়েছি। তিনি অতি বড় বিপ্লবী। ফিলিস্তিন, মিন্দানাও, মধ্য এশিয়া বিপ্লবের নায়ক তিনি। ককেশাস, বলকান এবং মাত্র কিছুদিন আগে স্পেনেও তিনি মুসলমানদের পক্ষে বিরাট পরিবর্তন এনেছেন। তাকে তুমি মানে তুমি..’।
কথা শেষ না করেই থেমে গেল জিনার আব্বা মিঃ ফ্রাংক মরিচ। যা তিনি বলতে চান তা যেন বলতে পারছেন না। তার চোখে মুখে বিস্ময় মিশ্রিত বিব্রত ভাব।
আহমদ মুসা তার নত মুখটা ঈষৎ উপরে তুলে শান্ত কন্ঠে বলল, ‘জি, আমি সেই আহমদ মুসা’।
কথাটা কানে যাওয়ার সাথে সাথেই জিনার আব্বা অজ্ঞাতেই যেন উঠে দাড়াল। আবার বসল। বিস্ফোরিত তার দু’টি চোখ। একটা অপ্রস্তুত, কিংকর্তব্যবিমূঢ় ভাব তার মধ্যে। জিনা, ফ্রান্সিস, মার্ক স্বপ্ন দেখছে যেন। হঠাৎ করেই পরিচিত পৃথিবীটা উল্টে গিয়ে যেন তারা এক রূপকথার দেশে হাজির হলো এবং দিগ্বিজয়ী এক রূপকথার রাজপুত্তুর তাদের সামনে। চোখ ভরে দেখছে তারা সেই রাজপুত্তুরকে।
জিনার মা বিস্মিত হয়েছে, কিন্তু তার প্রশ্নের জবাব পেয়ে গেছে। বলল, ‘তাই বলি, অতবড় মানুষ না হলে মানুষ এমন হয় না। এসব কাজ অন্য কার সাধ্য!’
‘আমি কোন দিক দিয়েই কোন বড় মানুষ নই আম্মা। আমি আমার জাতির সেবক, মজলুম মানুষের সেবক’। শান্ত ও নরম কন্ঠে বলল আহমদ মুসা।
জিনার আব্বা মিঃ ফ্রাংক নিজেকে সামলে নিয়েছিল। বলল, ‘মিঃ আহমদ মুসা ‘তুমি’ বলে আপনাকে যে অসম্মান করেছি তার জন্যে আমি লজ্জিত। আপনি যে কত বড় তা আমরা কল্পনাও করতে পারি না’।
আহমদ মুসা সংগে সংগেই উঠে দাঁড়াল। অভিমান ক্ষুব্ধ কন্ঠে বলল, ‘আপনি যদি এভাবে কথা বলেন, ‘আপনি’ বলে সম্বোধন করেন, তাহলে এখানে আমি এক মুহুর্তও থাকতে পারবো না। এ ধরনের সম্মান আমার কাছে বন্দুকের গুলীর চেয়েও কষ্টকর’। আহমদ মুসার কন্ঠ ভারি হয়ে উঠেছিল।
জিনার আব্বাও উঠে দাড়িয়েছিল। অবাক বিস্ময়ে অনেকক্ষণ চেয়ে থাকল আহমদ মুসার দিকে। তারপর ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে আহমদ মুসার দুই কাধে হাত দিয়ে বসিয়ে দিল। বলল, ‘তুমি আরও বড় হবে। এমন মানুষরাই বড় হয়’।
সোফায় ফিরে এল জিনার আব্বা।
আহমদ মুসা জিনা, মার্কদের দিকে চেয়ে বলল, ‘তোমাদের চোখ-মুখ দেখে মনে হচ্ছে, আমি তোমাদের পর হয়ে গেলাম হঠাৎ করে। দেখ, রক্তের সম্পর্কের আপন কেউ নেই তো আমার, তাই পর হওয়ার বেদনাটা আমি বেশী বুঝতে পারি’।
জিনা ও মার্ক দু’জনেরই চোখে-মুখে নেমে এল লজ্জা। জিনা মুখ ঢাকল।
‘তা নয় বাছা, বিস্ময়ের ধাক্কা ওরা সামলাতে পারেনি’। বলল জিনার মা।
‘ঠিক বলেছ আম্মা’। বলে জিনা আহমদ মুসার দিকে চেয়ে ফ্রান্সিসকে দেখিয়ে বলল, ভাইয়া, এই ফ্রান্সিসের আরেকটা পরিচয় আছে, সে মুসলমান। নাম ফ্রান্সিস আবুবকর।
‘মুসলমান?’
‘হ্যাঁ ভাইয়া’।
আহমদ মুসা উঠে দাঁড়ালো। এগুলো ফ্রান্সিসের দিকে। ফ্রান্সিসও উঠে দাড়িয়েছিল। আহমদ মুসা জড়িয়ে ধরল ফ্রান্সিসকে। অনেকক্ষণ জড়িয়ে ধরে থাকল। তারপর চুমু খেল তার কপালে একটা। বলল, ‘এমন এক স্থানে কোন ভাইকে দেখব ভাবিনি’।
ছেড়ে দিল ফ্রান্সিসকে। আনন্দ, বিস্ময় ও আবেগে চোখ অশ্রু সিক্ত হয়ে উঠেছে ফ্রান্সিসের।
আহমদ মুসা ফ্রান্সিসকে ছেড়ে গিয়ে পাশেই বসে থাকা মার্ক মরিসের কপালে চুমু খেয়ে বলল, ‘মনে করো না ফ্রান্সিসের চেয়ে তোমাকে কম ভালবাসি’।
‘ধন্যবাদ ভাইয়া’। মার্ক বলল হাসিতে উজ্জ্বল হয়ে।
ফ্রান্সিসের এই গৌরবে সবচেয়ে খুশী হয়েছিল জিনা। আনন্দের অপরিসীম ঔজ্জ্বল্য ঠিকরে পড়ছিল জিনার চোখ মুখ থেকে।
আহমদ মুসা তার আসনে ফিরে এলে জিনা বলল, ‘ভাইয়া, ফ্রান্সিস শুধু নামেই মুসলমান। ও ধর্মগ্রন্থই দেখেনি, প্রার্থনা করতেও জানে না এবং মুসলমান ধর্মের কিছুই পালন করে না’।
‘এটা ওর দোষ নয় জিনা, এ দোষ মুসলিম জাতির। জাতি ফ্রান্সিসদের প্রতি তার দায়িত্ব পালন করেনি’। বলল আহমদ মুসা।
‘ভাইয়া, আপনি ফ্রান্সিসকে সাংঘাতিক উপরে তুললেন। ও এখন জাতির ঘাড়ে দোষ দিয়ে বগল বাজাবে’। জিনা বলল ফ্রান্সিসের দিকে চেয়ে।
‘সে সুযোগ হবে না। আমি ওকে সব শিখিয়ে দেব। তারপর সে সব পালন করবে’।
‘আমাকেও শিখিয়ে দিতে হবে ভাইয়া। তা না হলে ও বাহাদুরি দেখাবে’।
‘ঠিক আছে’।
‘বাঁকা কথা বলে ঝগড়া বাধানো ওর একটা অভ্যাস ভাইয়া’। বলল ফ্রান্সিস।
‘আবার ফ্রান্সিস, সব কথা কিন্তু ভাইয়াকে বলে দেব’।
এই কথার সংগে সংগে ফ্রান্সিসের মুখটা চুপসে গেল। করুণ চোখে তাকাল জিনার দিকে। কিছুক্ষণ আগে আহমদ মুসাকে নিয়ে জিনার সাথে যা ঘটেছে তা তার মনে পড়ে গেছে। লজ্জায় লাল হয়ে উঠল তার মুখ।
‘থামাও তোমাদের ঝগড়া’। বলে জিনার আম্মা আহমদ মুসার দিকে চেয়ে বলল, ‘কিছু মনে করো না বাছা, ‘ঝগড়াই এ দু’জনের সংস্কৃতি। আগে মারামারি করত, এখন তার বদলে করে ঝগড়া’।
আহমদ মুসা হাসল। আহমদ মুসা কিছু বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু তার আগেই কথা বলে উঠল জিনার আব্বা মিঃ ফ্রাংক। বলল, ‘এখন তোমার কি পরিকল্পনা আহমদ মুসা’।
আহমদ মুসার মুখ গম্ভীর হয়ে উঠল। বলল, ‘সুস্থ হয়ে উঠেছি। এবার ওমর বায়ার সন্ধদনে বেরুব’।
‘আবার? একা?’ আৎকে উঠল জিনার কন্ঠ।
‘একাই বেরুতে হবে। ওমর বায়া কোথায় জানি না। জানলে অন্যের সাহায্য নেয়া যেতো’।
‘কিন্তু ব্ল্যাক ক্রস বিরাট দল, বিপুল জনশক্তি। আবার তো বিপদে পড়বে তুমি’। বলল জিনার আব্বা।
‘হয়তো পড়বো। কিন্তু অন্য পথ তো নেই ওমর বায়াকে উদ্ধারের’।
‘পুলিশকে বললে?’
‘ফরাসি পুলিশ ব্ল্যাক ক্রস-এর কেশও স্পর্শ করবে না। পুলিশের কোন সাহায্য পাওয়া যাবে না’।
‘ব্ল্যাক ক্রস ভীষণ ক্ষেপে আছে তোমার উপর। এই অবস্থায় ওদিকে অগ্রসর হওয়া মানে মৃত্যুর কোলে ঝাপিয়ে পড়া’। বলল জিনার আব্বা।
‘ঝুকি তো নিতেই হবে, আর মৃত্যু আল্লাহর হাতে। আল্লাহর নির্দিষ্ট করা সময়েই তা আসবে। সুতরাং এ নিয়ে চিন্তা করার কিছু নেই’। নিশ্চিন্ত কন্ঠে শান্ত ভাষায় জবাব দিল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসা থামল।
কেউ কোন কথা বলল না।
সবার দৃষ্টি আহমদ মুসার উপর নিবদ্ধ।
দৃষ্টিতে তাদের বিস্ময়। সম্পর্কহীন একজন মানুষের জন্যে একজন মানুষ এইভাবে জীবন বিলিয়ে দিতে এগিয়ে যেতে পারে।
ভাবছিল জিনার আব্বা। বলল, ‘ক’দিন আগে একটা গল্প শুনেছিলাম। সেটাও কিডন্যাপের কাহিনী। তোমার কাহিনী শুনে সে কথাটা আমার মনে পড়ছে। বিস্ময়করভাবে আমার শোনা সে কাহিনীর বন্দীও মুসলিম’।
‘কি সেই কাহিনী জনাব’। আগ্রহের সাথে জিজ্ঞাসা করল আহমদ মুসা।
‘কাহিনীটা বেশী বড় নয়। সেই মুসলিম বন্দীকে কিডন্যাপ করে তার কাছ থেকে কথা আদায় ও তাকে বশে আনার জন্যে তার উপর অকথ্য নির্যাতন চালায়। দয়া পরবশ হয়ে একজন গোপনে তার খবর তার লোকদের কাছে পৌছাবার একটা সুযোগ করে দেয়। কিন্তু ধরা পড়ে যায় কৌশলটি। ধরা পড়ার পর কে তাকে সাহায্য করেছে এটা জানার জন্যে তার উপর অমানুষিক নির্যাতন চালানো হয়। কিন্তু মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েও সে তার সাহায্যকারীর নাম প্রকাশ করেনি। সাহায্যকারীর প্রতি লোকটির বিস্ময়কর দায়িত্ববোধের কথা বলতে গিয়েই এই গল্পটি আমার কাছে করেছে’।
‘ঘটনাটা কোথায় ঘটেছে?’
‘প্যারিসে’।
‘গ্রুপটির কিংবা লোকটির কি নাম জানা গেছে?’
‘নাম বলেনি, জিজ্ঞাসাও করিনি’।
‘গল্পটি যে বলেছে সে কোথায়?’
‘প্যারিস চলে গেছে’।
‘গল্প বলা লোকটির নাম কি?’
‘নাম ডুপ্লে’।
‘ডুপ্লে?’ আহমদ মুসার চোখ-মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল।
‘মনে হচ্ছে তুমি লোকটিকে চেন?’
‘চিনি না। কিন্তু এই নামের সাথে আমি পরিচিত। এই নামের একজন লোক ফিলিস্তিন দুতাবাসে একটা চিঠি দিয়ে জানায় যে, ব্ল্যাক ক্রস ওমর বায়াকে কিডন্যাপ করেছে। ওমর বায়াকে যেখানে প্রথমে বন্দী করে রেখেচিল তার ঠিকানাও সে দেয়’।
‘সেই ডুপ্লে এবং এই ডুপ্লে কি এক মানুষ হবে বলে তুমি মনে কর?’
‘আমার তাই মনে হচ্ছে। কারণ ঘটনা ও নাম মিলে যাচ্ছে’।
কিন্তু এই ডুপ্লে ‘ব্ল্যাক ক্রস’-এর খবর জানবে কি করে?’
‘আমি মনে করি ডুপ্লে স্বয়ং ‘ব্ল্যাক ক্রস’-এর লোক’।
‘জানলে কি করে?’
‘তার চিঠি পড়েই আমি অনুমান করেছি। আপনি কি এই ডুপ্লেকে কখনও খালি গায়ে দেখেছেন?’
‘একদম খালি গায়ে দেখিনি। তবে খেলার সময় গেঞ্জি গায়ে দেখেছি’।
‘তার গলায় কোন ক্রস ঝুলানো দেখেছেন?’
‘হ্যাঁ দেখেছি’।
‘রং কি কালো?’
‘হ্যাঁ। কিন্তু তুমি জানলে কি করে?’
‘ব্ল্যাক ক্রস-এর এটা চিহ্ন। ব্ল্যাক ক্রস-এর প্রত্যেক সদস্যকে কার্বনের তৈরী কাল ক্রস পরতে হয়’।
জিনার আব্বা মিঃ ফ্রাংক সহ সকলের মুখ বিস্ময়ে হা হয়ে গেল।
অনেকক্ষণ পর জিনার আব্বা বলল, ‘একদম আমাদের গায়ের ব্ল্যাক ক্রস! ভয় এবং বিস্ময় তার চোখে।
‘আমার একটা অনুমানের কথা বলি জনাব, ডুপ্লে মনের দিক দিয়ে দায়িত্বশীল ও দয়ালু লোক। ব্ল্যাক ক্রস-এর সাথে তার সম্পর্ক খারাপ হয়ে গেছে। ব্ল্যাক ক্রস- এর হাতে ডুপ্লেকে প্রাণ দিতে হতে পারে’।
আঁৎকে উঠল মিঃ ফ্রাংক এবং সবাই।
কেউ কথা বলতে পারলো না।
আহমদ মুসাই আবার মুখ খুলল। বলল, ‘ডুপ্লে খুন হওয়ার আগেই তার সাথে আমার দেখা হওয়া প্রয়োজন। এই মুহুর্তে সেই আমার অবলম্বন। সে ব্ল্যাক ক্রস-এর কোন ঘাটি অথবা হেডকোয়ার্টার-এর ঠিকানা দিয়ে আমাকে সাহায্য করতে পারে’।
‘ডুপ্লে সম্পর্কে এতটা নিশ্চিত তুমি কেমন করে হচ্ছে?
‘ঘটনার গতি তাই বলছে’।
একটু থামল আহমদ মুসা। তারপর বলল, ‘ডুপ্লের প্যারিসের ঠিকানা আমি কেমন করে পাব জনাব?’
‘ওর স্ত্রী ও মেয়েও চলে গেছে, তবে তার ভাই-ভাবীরা এখানে আছে, তাদের সাথে দেখা করবে?
‘এটা ওদের জন্যেও ঠিক হবে না, আপনাদের জন্যেও ঠিক হবে না’।
‘কেন?’
‘ব্ল্যাক ক্রস যদি ওদের উপর চোখ রেখে থাকে কিংবা ওদের কেউ যদি ব্ল্যাক ক্রস-এর হয়ে থাকে?’
‘এ রকম কি হয়?’
‘ওমর বায়াকে তাদের ভাষায় যে ‘বিশ্বাসঘাতক’ সাহায্য করেছে, তাকে তারা খুজে বের করবেই। যদি বের করতে না পারে, তাহলে যাদের উপর তাদের সন্দেহ হবে প্রত্যেককেই তারা শেষ করে দেবে। এর আগ পর্যন্ত সন্দেহজনকদের উপর তারা চোখ রাখবেই’।
‘মনে হচ্ছে আপনি সব জানেন। কিভাবে ওদের কথা আপনি বলতে পারেন? বলল জিনা।
‘শত্রু সম্পর্কে কিছু অনুমান করতে না পারলে সেই শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই করব কেমন করে?’
‘এ পর্যন্ত ৭টি দেশ বা অঞ্চলের বিপ্লব বা পরিবর্তনে আপনি নেতৃত্ব দিয়েছেন। অতীতের ঘটনার মধ্যে এমন ঘটনা কি আছে যা আপনার খুব মনে পড়ে বা আপনাকে কাঁদায়?’ জিনা প্রশ্ন করল।
আহমদ মুসা ম্লান হাসল। মুখ নিচু করল। বলল, ‘এমন সহস্র ঘটনা আছে বোন। আমি সে সব ভুলে থাকতে চাই’।
‘কিন্তু ভুলে থাকা কি যায়? আমাদের তুমি ভুলতে পারবে?’ বলল জিনার আম্মা।
‘ভুলা যায় না আম্মা। কিন্তু দৃষ্টি যদি সামনের দিকটা নিয়ে ব্যস্ত থাকে, তাহলে দৃষ্টিটা অতীতে ফেরার সময় খুব কম পায়’।
‘আমাদের ভুলে যাবেন?’ জিনা বলল।
‘জীবন এমন একটা ফিল্ম বোন, এখানে যে ঘটনা একবার দাগ ফেরে তা আর মুছে যায় না’।
‘কিন্তু ফিল্মের ঘটনা দেখার জন্যে তা ঘুরাতে হয়’।
‘জীবন নামের ফিল্মটা সরল রেখার মত লম্বা, জন্ম থেকে মৃত্যুর দিকে ধাবিত। এ ফিল্মকে ঘুরাতে হয় না। চোখ মেললেই দেখা যায়’।
‘ভাইয়া কিছু মনে করবেন না, আপনাকে দেখলে এবং আপনার কথা শুনলে আপনাকে একজন বন্দুকধারী মনে হয় না, মনে হয় আপনার হাতে আছে শিল্পীর কলম, চোখে আছে দার্শনিকের দৃষ্টি এবং মুখে আছে শিক্ষকের কথা’। জিনা বলল।
‘আমি এসব কিছু নই, আমি মানুষ এবং মানুষ বলেই আমি সবকিছু’।
‘ভাইয়া, আপনি আপনার এই কথাটা আবার বলুন। আমি লিখে নেব। লিখে আমি টাঙিয়ে রাখব’। বলে জিনা কলম বের করে কাগজ টেনে নিল। জিনা লিখে নিল কথাটা।
জিনার আব্বা বলল, ‘তুমি ঠিক বলেছ, ডুপ্লের বাড়িতে যাওয়া তোমার ঠিক নয়। কিন্তু আমরা গিয়ে জিজ্ঞাসা করলে ক্ষতি কি?’
‘ক্ষতি কিছু নেই। কিন্তু তাদের মনে একটা স্বাভাবিক প্রশ্ন জাগবে কেন আপনারা তা চাচ্ছেন। ভবিষ্যতে কি ঘটবে জানি না। কিন্তু কিছু যদি ঘটে, তাহলে এই ঠিকানা চাওয়াটা বড় হয়ে দেখা দিতে পারে’।
জিনার আব্বা কিছুক্ষণ নির্বাক হয়ে চেয়ে রইল আহমদ মুসার দিকে। তারপর বলল, ‘সত্যিই তুমি বিস্ময়। এতদুর ভবিষ্যত তুমি দেখতে পাও?’
একটু থামল। তারপর আবার বলল, ‘ঠিকই বলেছ তুমি। কিন্তু ঠিকানা সংগ্রহের কি করা যায়?’
‘আব্বা, সেদিন ‘কম্যুনিটি ইনভেস্টমেন্ট ফোরাম’-এর তিনি সদস্য হলেন। ওখানে তো তাঁর প্যারিসের ঠিকানা থাকতে পারে’। বলল মার্ক।
‘ঠিক বলেছ মার্ক। নিশ্চয় ওখানে আছে’। চোখ-মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল জিনার আব্বার।
‘ঠিকানা তাড়াতাড়ি পেলে আমি বাধিত হবো জনাব’। বলল আহমদ মুসা।
‘অত তাড়া কেন? তুমি তো পুরোপুরি সুস্থ হওনি’। বলল জিনার আব্বা।
‘এত বিশ্রাম আমি বহুদিন নেইনি। শত্রুর হাতে একজন মানুষের দুঃসহ সময় কাটছে, তখন বিশ্রাম আরও বাড়ানো ঠিক নয়’।
‘তবুও ডাক্তারের মত তোমার নেয়া দরকার’। বলল জিনার আব্বা। বলে উঠে দাড়াল সে। সেই সাথে আহমদ মুসাও। জিনার আব্বা ভেতর বাড়ির দিকে হাঁটা শুরু করে বলল, ‘নিশ্চিন্ত থাক, ঠিকানা তাড়াতাড়িই পেয়ে যাব’।
জিনার আব্বার সাথে জিনার আম্মাও চলে গেল।
জিনা, মার্ক ও ফ্রান্সিসও উঠে দাড়িয়েছে।
আহমদ মুসা তার ঘরের দিকে হাঁটা শুরু করল।
‘ভাইয়া, আমাদের আপনি সবকিছু শিখিয়ে দিতে চেয়েছেন’। মুখ ভরা সংকোচ নিয়ে বলল ফ্রান্সিস।
আহমদ মুসা তার পিঠ চাপড়ে বলল, ‘আমি তোমাদের বাসায় যাব। গিয়ে শিখিয়ে দেব। লিখে দেব’।
‘তাহলে এখনি চলুন। আম্মা খুব খুশী হবেন’।
জিনা এবার বক্র দৃষ্টিতে ফ্রান্সিসের দিকে চাইল। অন্য সময় হলে ঝগড়া বাধিয়ে দিত। কিন্তু তা করল না। গম্ভীর সে। মুখটা অনেকখানি ভারি হয়ে উঠেছে। এক সাথে হাঁটতে হাঁটতে বলল, ‘ভাইয়া, আপনি বললেন জীবনটা সরল রেখার মত প্রলম্বিত, যদি এটা বৃত্তাকার হতো!’
‘কেন?’
‘তাহলে আবার দেখা হতো আপনার সাথে’।
আহমদ মুসা থমকে দাঁড়াল। বলল, সরল রেখার পরিসরেও অনেক বৃত্ত রেখা আছে। যার ফলে জীবন পথে মানুষের ঘুরে-ফিরে দেখা হয়’।
‘দেখা হবে কি তাহলে আমাদের আবার?’
‘বৃত্তটির অংকন তোমার, আমার, আমাদের কারো হাতে নেই জিনা’।
‘কেন তাহলে স্নেহ-প্রীতির সৃষ্টি করা হলো? কেন আমরা ভাই, বোন ইত্যাদি সম্পর্ক গড়ি তাহলে?’
‘এটাই আমাদের আনন্দ এবং বেদনার পৃথিবী’।
‘কিন্তু এই বেদনা স্রষ্টা কেন দিলেন?’
‘মানুষের জন্যে যে চিরন্তন পুরষ্কার আল্লাহ রেখেছেন তার যোগ্য কে, তা দেখার জন্যে তো বেদনার পরীক্ষা প্রয়োজন’।
‘কিন্তু প্রভূ যিশু তো সবার পক্ষ থেকে বেদনার সে পরীক্ষা দিয়ে গেছেন’।
‘না জিনা, কেউ কারো পরীক্ষা দিতে পারে না। ফল যার পরীক্ষাও তার’।
‘ঠিক বলেছেন ভাইয়া, কিন্তু খৃষ্টান বিশ্বাস…..’। কথা শেষ না করেই থেকে গেল জিনা।
‘খৃষ্টান বিশ্বাস সম্পর্কে কোন মন্তব্য আমি করব না, ইসলামের বিশ্বাসের কথা তোমাকে আমি বললাম’। বলল আহমদ মুসা।
‘ধন্যবাদ ভাইয়া’। বলে জিনা ফ্রান্সিসের দিকে চেয়ে বলল, ‘স্বার্থপরের মত ভাইয়াকে যেন একা নিয়ে যেও না। ভাইয়া সেখানে যে পাঠ দেবেন, সে পাঠশালায় আমি এবং মার্ক যোগ দেব’।
‘ওয়েলকাম বোন’।
তারপর মুখ টিপে একটু হেসে আহমদ মুসা বলল, ‘ফ্রান্সিসের সাথে তোমার খুব ঝগড়া তো। আমিই তোমাদের সাথে করে নিয়ে যাব’।
‘ঝগড়ার সৃষ্টি করে কিন্তু ফ্রান্সিস, ভাইয়া। আজকেই কিছু আগে…’।
‘জিনা, তোমার কান্ডজ্ঞান লোপ পাচ্ছে’। বলে জিনার কথায় বাধা দিল ফ্রান্সিস।
‘কান্ডজ্ঞান কার লোপ পাচ্ছে, এ প্রমাণ আজ তুমি দিয়েছ’। তীব্র কন্ঠে প্রতিবাদ করল জিনা।
আহমদ মুসা দু’হাত তুলে ওদের থামিয়ে দিয়ে হেসে বলল, ‘আমার খুব ইচ্ছা, তোমাদের ঝগড়া যেদিন এক মোহনায় এসে মিটে যাবে সেই শুভদিনে আমি যদি তোমাদের এক সাথে দেখতে পেতাম!’
ফ্রান্সিস মুখ নিচু করল। আর ‘ভাইয়া’ বলে চিৎকার করে উঠে লজ্জারাঙা মুখ লুকোতে দৌড় দিল জিনা।
আজ পালিয়ে গেলেও আহমদ মুসার বিদায়ের দিন জিনা চোখের পানিতে বুক ভাসিয়ে বলেছিল, ‘সেদিন আপনার ডাকার জন্যে আমি ও ফ্রান্সিস আপনাকে কোথায় খুজে পাব ভাইয়া?’

তিনতলা বিরাট বাংলোর সামনের সবুজ চত্তরে বেরিয়ে এল মিঃ প্লাতিনি এবং ডোনা। এই কিছুক্ষণ আগে তারা এসে পৌছেছে দ্বিজন গ্রামে তাদের বাংলোতে। ক্লান্তির সুস্পষ্ট চিহ্ন তাদের চোখে-মুখে।
তারা দ্বিজনে আসার আগে সুর লোরেতে বহু সময় কাটিয়েছে। বিভিন্ন জনকে জিজ্ঞাসা করে তারা ঘটনাস্থলে যায়। গাড়ি থেকে নেমে ঘটনার স্থান ও পাহাড় তারা দেখে। তারপর আশপাশের নানাজনকে জিজ্ঞাসা করেও আহমদ মুসা সম্পর্কে কোন তথ্য জোগাড় করতে তারা পারেনি। অবশেষে তারা চলে এসেছে দ্বিজন গ্রামে তাদের এস্টেটের খামার বাড়িতে।
তাদের আসার খবর পেয়ে গ্রামের গণ্যমান্য লোক এবং তাদের রায়ত (বর্গা প্রজা) এসেছে তাদের সাথে দেখা করার জন্যে। তাই বিশ্রাম না নিয়েই তাদের বেরিয়ে আসতে হয়েছে।
মিঃ প্লাতিনি এবং ডোনা বেরিয়ে আসতেই উপস্থিত সবাই সামনে ঝুকে মাথা নত করে বাও করল তাদের দু’জনকে। সকলের চোখে-মুখেই শ্রদ্ধার ভাব। তাদের মধ্য থেকে প্রবীণ একজন বলল, ‘আমি আমার গ্রামবাসীদের পক্ষ থেকে আমাদের মহান রাজার স্মৃতি প্রিন্স মিশেল প্লাতিনি ডি বেরী লুই এবং তাঁর কন্যা প্রিন্সেস মারিয়া জোসেফফাইন লুইকে স্বাগত জানাচ্ছি। আমাদের সকলের শ্রদ্ধা গ্রহণ করুন’।
উল্লেখ্য, ডোনার পারিবারিক নাম প্রিন্সেস মারিয়া জোসেফাইন লুই। কিন্তু কাগজে-কলমে সে ডোনা জোসেফাইন নামে পরিচিত আর ডোনার আব্বার পারিবারিক নামের সাথে ডি বেরী যুক্ত আছে অফিসিয়াল নামে নেই।
ডোনাদের পরিবার ফ্রান্সের অত্যন্ত পুরাতন শাসক পরিবার। ফ্রান্সের প্রাচীন বুরবো রাজবংশের উত্তরাধিকারী তারা। ফরাসী বিপ্লবোত্তর কালে ১৮১৫ সালে ফ্রান্সে রাজতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হলে বুরবো রাজবংশের অষ্টাদশ লুই ক্ষমতায় আসেন। তিনি রাজতন্ত্রের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসলেও রাজতন্ত্রীদের তিনি পছন্দ করেননি, যথাসাধ্য তাদের আমল দেননি। বরং তিনি সাহায্য সহযোগিতা করেছেন গনতন্ত্রীদের। তার ফলে রাজতন্ত্রীদের প্রবল চাপের মধ্যে থাকলেও তাঁর শাসনকালের অধিকাংশ সময় মানুষের গণতান্ত্রিক সুযোগ-সুবিধা প্রতিষ্ঠিত ছিল। সম্রাট অষ্টাদশ লুইয়ের উত্তরাধিকারী যুবরাজ ডিউক ডি বেরী ছিলেন পিতার চেয়েও গণতন্ত্রী। তিনি রাজতন্ত্রীদের হাতে নিহত হন। এই যুবরাজ ডিউক ডি বেরী ডোনাদের প্রত্যক্ষ উত্তরসূরী। ডিউক ডি বেরীর উত্তরসূরী এই পরিবারকে ফ্রান্সের লোকেরা ভালোবাসে। পরিবারটি প্যারিসের বদলে অধিকাংশ সময় জনগণের মধ্যে গ্রামে বাস করে। দক্ষিণ ফ্রান্সের মন্ট্রেজুতে ডোনাদের একটা বাড়ি আছে।
মিঃ প্লাতিনি সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে ডোনাকে নিয়ে তাদের জন্যে নির্দিষ্ট চেয়ারে গিয়ে বসলো। তাদের সামনে অনেকগুলো চেয়ার পাতা। মিঃ প্লাতিনি সবাইকে বসতে বললেন।
সবাই বসল। কিন্তু বরাবরের মত সবাই চেয়ারে না বসে সবুজ চত্তরের উপর বিছানো কার্পেটে গিয়ে বসল।
মিঃ প্লাতিনি ও ডোনা এতে আপত্তি করে তাদেরকে চেয়ারে উঠে বসার অনুরোধ করল।
তাদের মধ্য থেকে প্রবীণ সেই বৃদ্ধ উঠে দাড়িয়ে বলল, ‘আমাদের মাফ করবেন। আমরা আমাদের ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে সম্মান প্রদর্শন করছি। আমনারা একটা প্রতীকমাত্র’।
গ্রামবাসী গণ্যমান্যদের মধ্যে জিনার আব্বা মিঃ ফ্রাংক মরিসও ছিল।
কুশল বিনিময় শেষে কিছু গল্পগুজবের পর সবাই উঠল।
একে একে সবাই এসে বাও করল।
অল্পক্ষণের মধ্যেই ফাঁকা হয়ে গেল ডোনাদের সবুজ চত্তর।
‘আব্বা, ওদের কাউকে সুর লোরের ঘটনার কথা জিজ্ঞাসা করলে হতো না’।
‘হতো। কিন্তু কথাটা আমি তুলবো সবার সামনে। আমরা একটু বিশ্রাম নেই। তারপর ডেকে ‘খোঁজ-খবর নেয়া যাবে’।
মিঃ প্লাতিনি এবং ডোনা বাংলোর ভেতরে এল। উঠে এল তারা দু’তলায়। ডোনা তার আব্বাকে দু’তলায় তার কক্ষে রেখে নিজে উঠে গেল তিন তলায় তার কক্ষে।
তিন তলার সর্ব দক্ষিণে ডোনার শোয়ার ঘর। ঘরটির দক্ষিণে একটা ব্যালকনি। ডোনা কাপড় চেঞ্জ করে হাত-মুখ ধুয়ে সাজানো নাস্তা খেয়ে নিয়ে ব্যালকনির ইজি চেয়ারে গা এলিয়ে দিল।
ডোনা চেয়েছিল চোখ বন্ধ করে একটু রেস্ট নেবে। কিন্তু বাইরের দৃশ্যের দিকে চোখ পড়ার পর সে আর চোখ ফিরিয়ে নিতে পারল না।
বলা যায় তাদের বাড়ির গা ঘেষেই বয়ে যাচ্ছে এদেঁরে নদী। তারপর দিগন্ত প্রসারিত সবুজ উপত্যকা। আর তাদের বাড়ির দু’পাশ দিয়ে উঁচু-নিচু পাহাড়, টিলার উপর ছবির মত সুন্দর গ্রাম। ঘন সবুজ গাছের ফাকে ফাকে বাড়িগুলিকে পটে আকা ছবির মতই সুন্দর মনে হচ্ছে।
ডোনা সম্মোহিতের মত তাকিয়ে রইল এই অপরূপ দৃশ্যের দিকে।
হঠাৎ কয়েকটা শব্দ এসে ডোনার কানে প্রবেশ করল। একটা নারী কন্ঠ বলছে, ‘আবার হাত দিবি না, এতে কোরআনের উদ্ধৃতি আছে’।
তড়াক করে শোয়া অবস্থা থেকে লাফিয়ে উঠল ডোনা। মুসলমানদের কোরআনের কথা বলছে ওরা কারা?
ডোনা এক লাফে গিয়ে রেলিং ঘেঁষে দাঁড়াল। নিচে তাকিয়ে দেখতে পেল, ডোনাদের বাড়ির ধার ঘেঁষে নদী তীরের রাস্তা দিয়ে তিনজন তরুণ-তরুণী এগিয়ে যাচ্ছে। তরুণীটির হাতে একটা বই। ডোনা বুঝতে পারল বই হাতে মেয়েটিই কথা বলে দু’জন তরুণের কাউকে হয়তো বারণ করেছে বইয়ে হাত দিতে। ডোনা ভাবল, এদের কেউ মুসলমান অথবা তিনজনই মুসলমান। এটা ভাবার সাথে সাথেই ডোনার মনে একটা কথা ঝিলিক দিয়ে উঠল, এরা মুসলমান যখন, তখন আহমদ মুসা আশে পাশে কোথাও থাকলে এরা অবশ্যই জানবে। তাছাড়া আহমদ মুসাকে খোঁজার ব্যাপারে এদের কাজে লাগানোও যাবে।
ভাবার সঙ্গে সঙ্গেই ডোনা রেলিং থেকে মুখ বাড়িয়ে ওদের দিকে তাকিয়ে, ‘হ্যালো, আপনারা কি দয়া করে একটু উপরে আসতে পারেন?’
তিনজনেই এক সঙ্গে উপর দিকে তাকাল এবং দেখতে পেল ডোনাকে। দেখতে পাওয়ার সংগে সংগে নিচে থেকেই তারা সামনের দিকে ঝুঁকে এক সাথে বাও করলো ডোনাকে।
তারপর তিনজনের মধ্যে থেকে মেয়েটি উপরের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘সম্মানিতা প্রিন্সেস, আপনি ইচ্ছা করলে আমরা অবশ্যই আসব’।
‘ওয়েলকাম। খুব খুশী হব আপনারা এলে’।
তারপর ডোনা ব্যালকনি থেকে তার ঘরে ফিরে এসে ইন্টারকমে নিচতলার সার্ভিস পুলকে নির্দেশ দিল ঐ তিনজন মেহমানকে তার ঘরে নিয়ে আসতে।
পাঁচ মিনিটের মধ্যেই ডোনা তার কক্ষের বাইরে অনেকগুলো পায়ের শব্দ পেল।
ডোনা বেরিয়ে এল ঘর থেকে। দেখল, বেয়ারা ড্রইং রুম খুলে দিচ্ছে। তার পেছনে দাড়িয়ে দু’জন তরুণ ও একজন তরুণী। তিনজন প্রায় সমবয়সী। ডোনাকে দেখেই তাদের চোখে-মুখে একটা সংকোচ ও শ্রদ্ধার ভাব ফুটে উঠল। তারা বাও করলো ডোনাকে।
‘ওয়েলকাম, ফ্রেন্ডস’। বলল ডোনা।
ওদেরকে নিয়ে ডোনা তার ড্রইং রুমে গিয়ে বসল।
‘আপনারা তো এই গ্রামেরই?’ প্রথমেই কথা বলল ডোনা।
‘জি’। উত্তর দিল জিনা। তারপর নিজের পরিচয় দিয়ে বলল, ‘আমি জিনা লুইসা’ মার্ককে দেখিয়ে বলল, ‘ও মার্ক মরিস, আমার ছোট ভাই’ এবং ফ্রান্সিসকে দেখিয়ে বলল, ‘ও ফ্রান্সিস, আমার বন্ধু’।
আমি ‘ডোনা জোসেফাইন’। বলল ডোনা।
‘মাফ করবেন প্রিন্সেস, আপনি আমাদের কাছে ‘প্রিন্সেস মারিয়া জোসেফাইন লুই’। বলল জিনা সসংকোচে।
‘একই কথা’। বলল ডোনা।
‘সরি। এক কথা নয় প্রিন্সেস। আপনার পারিবারিক নামের মধ্যে আমাদের জন্যে একটা গৌরব আছে। এর দ্বারা আমাদের অতীত ইতিহাস-ঐতিহ্যের সাথে আমাদের বর্তমানের একটা সংযোগ ঘটে’। বলল জিনা।
‘আপনি খুব সুন্দর কথা বলেন। কিন্তু দেখুন, রাজতান্ত্রিক ইতিহাস স্মরণ করার মধ্যে কতটুকু গৌরব আছে?’ বলল ডোনা।
‘রাজতন্ত্রের যুগে রাজতন্ত্র ছিল, আজ গণতন্ত্রের যুগে গণতন্ত্র। দুইয়ের ঐতিহাসিক মুল্য একই। তাছাড়া মহামান্য সম্রাট অষ্টাদশ লুই সত্যিকার অর্থে গণতন্ত্রীই ছিলেন, সেই যুগে যতটুকু সম্ভব ছিল। আর তাঁর সন্তান এবং আপনাদের প্রত্যক্ষ পুরুষ মহামান্য যুবরাজ ডিউক ডি বেরীকে তো গণতন্ত্রী হওয়ার কারণেই জীবন দিতে হয়েছে। তাকে গোটা দেশ শ্রদ্ধা করে, স্মরণ করে প্রিন্সেস’।
‘ধন্যবাদ’। বলল ডোনা।
মুহুর্ত কয়েক চুপ করে থাকল ডোনা। তারপর ওদের দিকে একবার নজর বুলিয়ে বলল, ‘আপনাদের নাম শুনে কাউকে মুসলমান বলে মনে হলো না? কিন্তু আপনার মুখ থেকে আমি মুসলমানদের ধর্মগ্রন্থ ‘কোরআন’-এর নাম শুনেছি’।
জিনাসহ তিনজনের মুখই মুহুর্তে অন্ধকার হয়ে গেল। নিচু হলো তাদের মুখ। কথা বললো না তারা।
‘আপনারা বা আপনাদের মধ্যে কেউ বা গ্রামে কোন মুসলমান আছে?’ ‘কোরআন’-এর নাম আপনারা কোত্থেকে জানতে পারলেন?’
জিনাসহ তিনজনের মুখই শুকনো হয়ে উঠেছে। তাদের চোখে-মুখে প্রবল একটা অস্বস্তি।
‘দেখুন, আমি খারাপ দৃষ্টিতে এ প্রশ্ন করছি না। এ বিষয়টা জানা আমার খুবই প্রয়োজন। আপনারা আমাকে সাহায্য করুন’। এবার অনুরোধ ঝরে পড়ল ডোনার কন্ঠে।
জিনার চেহারায় কিছুটা উজ্জ্বলতা ফিরে এল। কিন্তু ফ্রান্সিসের মুখ তখনও অন্ধকার।
জিনা ফ্রান্সিসের দিকে ইংগিত করে বলল, ‘এ মুসলিম। নাম ফ্রান্সিস আবুবকর। আমাদের গ্রামে এই একটা পরিবারই মুসলমান’।
‘ওয়েলকাম’। ফ্রান্সিসের দিকে তাকিয়ে বলল ডোনা। ডোনার মুখে ঈষৎ হাসি। বলল, ‘কিছু মনে করবেন না, আমার প্রশ্নে আপনারা অস্বস্তিবোধ করছিলেন কেন?’
জিনার ঠোটেঁ সলজ্জ হাসি ফুটে উঠল। বলল, ‘সম্মানিতা প্রিন্সেস, আপনি সব জানেন। মুসলিম পরিচয় দেয়া আগের মত আর নিরাপদ নয়। সাম্প্রতিক ফরাসি সরকারগুলো মুসলমানদের একটু বৈরিতার দৃষ্টিতে দেখছে। অতীতে এমনটা ছিল না। আপনি জানেন, স্কুল-কলেজে মুসলিম ছাত্র-ছাত্রীদের প্রার্থনা করার অধিকার, মাথায় ওড়না দেয়ার অধিকার ইত্যাদি হরণ কথা হয়েছে’।
‘আরো আছে, মুসলমানদের ধর্মীয় অনুষ্ঠান ও ধর্মীয় বক্তৃতার উপরও নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হচ্ছে, তাদের ধর্মীয় বক্তৃতার উপরও নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হচ্ছে, তাদের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান তৈরীকে নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে’। ঈষৎ হেসে কথাগুলো যোগ করল ডোনা।
জিনাসহ তিনজনের চোখে-মুখেই ফুটে উঠল বিস্ময়। কোন কথা তারা বলল না।
ডোনাই আবার কথা বলল, ‘এর প্রকৃত কারণ কি জানেন? প্রকৃত কারণ হলো, ফ্রান্সের নীতি নির্ধারকরা মনে করেছিলেন মুসলমানদেরকে ইসলাম ভুলিয়ে দেয়া যাবে। কিন্তু শত চেষ্টার পরেও দেখা যাচ্ছে মুসলমানদের মধ্যে ইসলাম আরও শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। তাই ফ্রান্সের ষাট লাখ মুসলমানকে ফ্রান্সের একটা মহল হিংসা করতে শুরু করেছে। এই হিংসারই ফল ঐ পদক্ষেপগুলো’।
‘আপনি প্রিন্সেস মারিয়া জোসেফাইন হয়ে এই কথা বলছেন?’ বলল মার্ক।
‘কেন বলব না? আমি তো ঐ হিংসুকদের দলে নই?’
সেই বইটি তখনও জিনার হাতে।
সে নাড়াচাড়া করছিল বই।
ডোনা কয়েকবার তাকিয়েছে বইটির দিকে। এবার মার্কের প্রশ্নের উত্তর দিয়ে ডোনা বলল, ‘বইটা একটু দেখতে পারি আমি?’
জিনা যেন একটু অপ্রস্তুত হলো। সে এক নজর ফ্রান্সিসের দিকে চেয়ে বইটি তুলে দিল ডোনার হাতে। ডোনা তো অজু করেনি, তার হাতে বই দেবে কিনা এটাই ছিল জিনার দ্বিধা।
ডোনা বইটি হাতে নিয়ে পাতা উল্টাল। প্রথম কভার-পাতা উল্টাতেই কয়েক শিট কাগজ বেরিয়ে পড়ল। শিটগুলো ভর্তি লেখা। হাতের লেখা। লেখাগুলোর দিকে চোখ পড়তেই চমকে উঠল ডোনা। পরিচিত হস্তাক্ষর। আরো একটু ভালো করে দেখল। মুসলমানদের কিছু রীতি-নীতির বিষয়ে লিখা।
লেখাগুলো ভালো করে দেখতে গিয়ে সমগ্র শরীরে একটা তড়িৎপ্রবাহ খেলে গেল। একদম আহমদ মুসার লেখার মতই লেখাগুলো। বুকটা ধক ধক করে উঠল ডোনার। তার কন্ঠ চিরেই যেন বেরিয়ে এল, ‘এই লেখা কার?’ আর্ত চিৎকারের মত ডোনার কন্ঠ।
জিনা এবং ওরা চমকে উঠল ডোনার কন্ঠস্বরে। চমকে ওঠা ভাব কেটে গেলে ডোনার চেহারায় উত্তেজনা ও অস্থির ভাব ফুটে উঠতে দেখল। ওরা সত্যিই ভয় পেয়ে গেল। কিংকর্তব্যবিমূঢ়ভাবে ওরা তাকাল ডোনার দিকে।
প্রথম প্রশ্ন শেষ করেই ডোনার আরেকটা প্রশ্ন, ‘এটা কি আপনাদের কারও লেখা?’
‘না’। শুকনো কন্ঠে জিনা বলল।
‘এ গ্রামের কারও’।
‘না’।
‘তাহলে কে লিখেছে?’
জিনা তৎক্ষণাৎ জবাব দিল না। তার মুখটা পাংশু হয়ে উঠেছে। আহমদ মুসার কথা তারা কাউকে জানায়নি। এটা এর কাছে প্রকাশ করা কি ঠিক হবে। এদের যোগাযোগ সরকারের সাথে আছে, ব্ল্যাক ক্রসের সাথেও থাকতে পারে।
জিনার এসব চিন্তার মধ্যেই ডোনার আরেকটা প্রশ্ন ছুটে এল ‘কে লিখেছে, দয়া করে বলুন’।
‘আমাদের একজন মেহমান লিখেছিলেন?’
‘মেহমান? কি নাম?’
জবাব দিল না জিনা। কি জবাব দেবে সে?
অস্থির ডোনাই আবার প্রশ্ন করল, ‘তিনি কি মুসলমান?’
‘জি’। জিনা বলল।
‘তিনি কি এশিয়ান?’
‘জি’। ডোনার প্রশ্নে বিস্ময়ে বিস্ফোরিত হয়ে উঠেছে জিনার চোখ। তার সাথে ভয়ও। তবে সে আশ্বস্ত হচ্ছে ডোনার চোখ-মুখ দেখে। সেখানে ক্রোধ নেই, বিদ্বেষ নেই বরং আছে আশার একটা আকুলতা।
‘সে কি আহত ছিল?’
বিস্ময়ে প্রায় বাক-রুদ্ধ জিনা বলল, ‘আপনি… আপনি… জানলেন কি করে এসব কথা?’
জিনার এ কথার দিকে ডোনা ভ্রুক্ষেপ মাত্রও করল না। আবেগে-উত্তেজনায় তার ঠোট কাঁপছে। কম্পিত কন্ঠে বলল, ‘তাঁর নাম কি আহমদ মুসা?’
কোন কথা যোগাল না জিনার কন্ঠে। সে, মার্ক এবং ফ্রান্সিস ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে রইল ডোনার দিকে। জগতের সব বিস্ময় এসে যেন জমা হয়েছে তাদের চোখে। কি করে এটা সম্ভব! কোথায় প্রিন্সেস মারিয়া জোসেফাইন লুই, আর কোথায় বিদেশী মুসলিম মুক্তি সংগ্রামী আহমদ মুসা! আহমদ মুসার নাম কি করে আসে তাদের প্রিন্সেসের মুখ থেকে। শুধু নাম আসা নয়, তাদের প্রিন্সেসের চোখে যে আবেগ এবং আকুলতা তারা দেখতে পাচ্ছে তা নাটকে রোমিওর জন্যে জুলিয়েটের এবং ফরহাদের জন্যে শিরির আকুলতায় তারা দেখেছে।
ডোনা উঠে দাড়িয়ে ছুটে গেল ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে থাকা জিনার কাছে। তারপর কার্পেটের উপর হাঁটু গেড়ে বসে জিনার দু’টি হাত চেপে ধরে বলল, ‘বলুন, আমি ঠিক বলেছি’।
জিনা তাড়াতাড়ি চেয়ার থেকে নেমে মাথা ঝুকিয়ে ডোনাকে বাও করে তার পায়ের কাছে বসে বলল, ‘আপনি ঠিকই বলেছেন, তিনি আহমদ মুসা’।
তারপর উঠে দাড়িয়ে ছুটে গেল ইন্টারকমের কাছে।
মার্ক এবং ফ্রান্সিস চেয়ার থেকে উঠে দাড়িয়ে অভিভূতের মত তাকিয়ে আছে তাদের প্রিন্সেসের দিকে। তারা কিছুতেই ডোনার সাথে আহমদ মুসার কোন হিসেব মেলাতে পারছে না।
ডোনা টেলিফোনে উত্তেজিত কন্ঠে বলল, ‘আব্বু, আহমদ মুসার সন্ধান মিলেছে, তুমি এস’।
ইন্টারকম থেকে সরে এসে সবাইকে দাড়িয়ে থাকতে দেখে বলল ডোনা, ‘আপনারা বসুন’।
কিন্তু কেউ বসল না। তারা মাঝে মাঝে তাকাচ্ছে দরজার দিকে। তারা ডোনার আব্বা মিঃ প্লাতিনির অপেক্ষা করছে।
ডোনা বসল তার চেয়ারে।
এই সময় ঘরে প্রবেশ করল মিঃ প্লাতিনি।
জিনা, মার্ক, ফ্রান্সিস ঝুকে পড়ে সসম্মানে বাও করল প্রিন্স মিশেল প্লাতিনি ডি বেরী লুইকে।
ডোনা উঠে দাড়িয়ে তার আব্বাকে স্বাগত জানিয়ে জিনাদের সাথে তাদের পরিচয় করিয়ে দিল এবং বইয়ের ভেতর পাওয়া শিটগুলোর লেখা দেখিয়ে বলল, ‘এটা আহমদ মুসার লেখা’। তারপর ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলল তার আব্বাকে।
চোখ ভরা বিস্ময় নিয়ে ডোনার আব্বা চেয়ারে বসল এবং সবাইকে বসতে বলল।
ডোনা বসল তার চেয়ারে এবং জিনারা বসল গিয়ে কার্পেটের উপর।
‘ও কোথায়?’ ডোনার দিকে চেয়েই প্রশ্ন করল ডোনার আব্বা।
‘ওঁর এই খোঁজ পেয়েই তোমাকে ডেকেছি আব্বা। আমি ওদের জিজ্ঞাসা করিনি এখনও’। বলে ডোনা তাকাল জিনার দিকে।
জিনা উঠে দাঁড়াল। ডোনা ও ডোনার আব্বার দিকে মাথা ঝুকিয়ে একবার বাও করে বলল, ‘মহামান্য স্যার, আহমদ মুসা ভাইয়া গতকাল সকালে চলে গেছেন’।
‘চলে গেছেন?’ ডোনা ও ডোনার আব্বা এক সাথেই বলে উঠল।
ডোনার আব্বার মুখটা ম্লান হয়ে গেল। আর হঠাৎ করেই যেন চুপসে গেল ডোনার মুখ। হতাশার একটা কালো মেঘ যেন এসে ছেয়ে ফেলল তার চেহারাকে।
‘জি হ্যাঁ, স্যার’। বলল জিনা।
‘কোথায় গেছেন?’ বলল ডোনা। চোখে-মুখে তার আকুল ব্যগ্রতা।
‘প্যারিসে’।
‘প্যারিসে কোথায়?’ বলল ডোনার আব্বা।
‘তা বলে যাননি। তবে তিনি একটা ঠিকানা নিয়ে গেছেন’।
‘কার ঠিকানা?’ বলল ডোনা।
‘ঠিকানাটা ব্ল্যাক ক্রস-এর একজন লোকের, যিনি ওমর বায়া সম্পর্কে খোঁজ দিয়ে সাহায্য করেছিলেন ফিলিস্তিন দুতাবাসকে’।
‘ঠিকানাটা কি পাওয়া যাবে?’ জিজ্ঞাসা করল ডোনা।
‘ঠিকানাটা আব্বা দিতে পারেন’। বলল জিনা।
‘কে তোমার আব্বা?’ জিজ্ঞাসা করল ডোনার আব্বা।
‘মিঃ ফ্রাংক মরিস’। জবাব দিল জিনা।
‘ও আচ্ছা’। বলল ডোনার আব্বা।
ডোনা ও ডোনার আব্বা নিচু স্বরে মত বিনিময় করল। তারপর ডোনার আব্বা জিনাকে বলল, ‘তোমার বাড়িতে তোমার আব্বার কাছে আমাকে কি নিয়ে যাবে?’
জিনা সলজ্জ মুখে ডোনার আব্বাকে বাও করে বলল, ‘লজ্জা দেবেন না মহামান্য স্যার, আমার আব্বাই আসবেন। কখন আসতে হবে স্যার?’
‘এখনি হলে ভাল হয়’। বলল ডোনার আব্বা।
মার্ক জিনাকে বলল, ‘আপা, আমি ও ফ্রান্সিস যাই আব্বাকে নিয়ে আসি’।
‘ধন্যবাদ মার্ক, তাহলে এখনি তোমরা যাও’।
মার্ক ও ফ্রান্সিস ডোনা ও ডোনার আব্বাকে বাও করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
ডোনার আব্বা উঠে দাড়াল। বলল, ‘তোমরা বসে গল্প কর। একটা জরুরী কাজ সেরে আসছি’। বলে ডোনার আব্বা বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।
ডোনাও উঠল। জিনাকে কার্পেট থেকে তুলে তাকে নিয়ে সোফায় বসল।
জিনা তার পাশাপাশি বসতে অস্বীকার করে বলল, ‘যার যে স্থান তাকে সে স্থান দেয়াই সভ্যতা। আমরা ফরাসীরা অসভ্য নই’। বসে জিনা ডোনার পাশ ঘেঁষে কার্পেটে বসে পড়ল।
ডোনা জিনার একটা হাত হাতে নিয়ে বলল, ‘তোমার কাছে আমার অনেক জিজ্ঞাসা’।
‘বলুন’। বলল জিনা।
‘আহমদ মুসা তোমাদের ওখানেই ছিল তাই না?’
‘হ্যাঁ, কি করে জানলেন?’
‘তাকে তোমার ভাই বলা থেকে। এখন বল ওর কাহিনী’।
‘আমরা সুর লোরের এক পাহাড়ে পিকনিক করছিলাম। আম্মা, আব্বা, আমি ও মার্ক। দূরবীণে দেখছিলাম চারদিকটা। হঠাৎ দেখলাম একটা গাড়িকে আরেকটা গাড়ি তাড়া করে এল। সামনের পাহাড়ে তারা নামল। তারপর সংঘাত হলো দীর্ঘ আধ ঘন্টা ধরে। একদিকে একজন, অন্য দিকে আর সবাই। জিতে গেল একজনের পক্ষটাই। ও পক্ষে দশজন নিহত হলো। কিন্তু ঐ একজন পায়ে গুলীবিদ্ধ হয়ে আহত হলো। আমরা দূরবীণে সব দেখলাম। শেষে দেখলাম, ঐ একজন হামাগুড়ি দিয়ে গাড়িতে উঠে গাড়ি চালাতে চেষ্টা করল। কিন্তু পারল না। গাড়িটা এসে ধাক্কা খেল আমাদের পাহাড়ের গোড়ায়। আমরা সবাই ছুটে গেলাম। দেখলাম লোকটি ড্রাইভিং সিটে অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে। আমরা উদ্ধার করে নিয়ে এলাম তাকে। ইনিই যে আহমদ মুসা তা আমরা জানতে পারলাম তিনি চলে যাবার দু’দিন আগে’।
‘ঔ সংজ্ঞাহীন হয়েছিলেন কেন?’ ভারী ও কাঁপা কন্ঠস্বর ডোনার।
কন্ঠস্বরে চমকে উঠে জিনা তাকাল ডোনার দিকে। দেখল, তার দু’চোখ দিয়ে নিঃশব্দে অশ্রু গড়াচ্ছে। জিনা আগেই বুঝেছিল ব্যাপারটা। কিন্তু সম্পর্কটা এত গভীর তা কল্পনা করেনি। তার মনে একটা প্রশ্ন কাঁটার মত বিঁধছিল, সেটা আরও তীব্র হয়ে উঠল। তাদের প্রিন্সেস-এর সাথে বিদেশী ও মুসলিম আহমদ মুসার সম্পর্ক হলো কি থেঁতলানো….’।
জিনা কথা শেষ করতে পারলো না। ডোনা তার মুখে হাত চাপা দিয়ে বন্ধ করে দিল তার কথা। বলল, ‘এসব আর শুনতে পারছি না বোন। তার চেয়ে বল কিভাবে ছিলেন, কি কি করেছেন। তোমরা তাকে কেমন দেখেছ’।
জিনা ধীরে ধীরে তার মনে থাকা প্রতিদিনের সব কাহিনী, সব কথা বর্ণনা করল। আহমদ মুসাকে কেন্দ্র করে ফ্রান্সিসের সাথে তার গন্ডগোলের কথা, পরে ফ্রান্সিস লজ্জিত হবার কথা কিছুই সে বাদ দিল না। তারপর বলল, ‘সবাই একমত, ওঁর চেয়ে বিস্ময়কর মানুষ কেউ কোথাও দেখেনি। মানুষকে আপন করে নেবার অদ্ভুত ক্ষমতা তার’।
থামল জিনা।
এই সময় ইন্টারকম কথা বলে উঠল। ডোনার আব্বার কন্ঠঃ ‘মা, জিনার আব্বা মিঃ ফ্রাংক এসেছিলেন। ঠিকানা পাওয়া গেছে’।
‘তাহলে এখনই আমরা প্যারিস রওয়ানা হবো আব্বা। তুমি ড্রাইভারকে রেডি হতে বল’।
‘ঠিক আছে মা’।
বন্ধ হয়ে গেল ইন্টারকম।
‘আপনারা এখনি যাবেন প্রিন্সেস?’
‘দেখ, তুমি আহমদ মুসার বোন নও?’
‘হ্যাঁ’। বলল জিনা।
‘তাহলে তুমি আমার বোন নও?’
‘হ্যাঁ’।
‘এরপর প্রিন্সেস আর বলবে?’
জিনা মাথা ঝুকিয়ে বাও করল ডোনাকে এবং বলল, ‘বলব না’।
একঘন্টার মধ্যে ডোনা ও ডোনার আব্বা তৈরী হয়ে বেরিয়ে এল।
গাড়ি প্রস্তুত।
মার্ক ও ফ্রান্সিস দাড়িয়ে আছে চত্তরের এক পাশে। গ্রামের কয়েকজন গণ্যমান্য লোকও এসেছে। জিনা ডোনার পাশে।
সবাই বাও করে বিদায় জানাল তাদের প্রিন্স এবং প্রিন্সেসকে।
জিনা বাও করে সোজা হয়ে দাড়াল ডোনা তাকে জড়িয়ে ধরে কানে কানে বলল, ‘আহমদ মুসাকে দাওয়াত দিয়েছ, আমাকে দিলে না?’
‘কিসের দাওয়াত?’ বলল জিনা।
‘তোমার ও ফ্রান্সিসের শুভদিনের?’
মুখটা লজ্জায় লাল হয়ে উঠল জিনার। বলল, ভাইয়া কি ভাবীকে ছেড়ে আসতে পারেন?
‘ওরে দুষ্ট’ বলে পিঠে একটা কিল দিয়ে ডোনা গাড়িতে গিয়ে উঠল।