১৭. ব্ল্যাক ক্রসের কবলে

চ্যাপ্টার

রাত তখন নয়টা পেরিয়ে গেছে। প্যারিসে জুনের আরামদায়ক রাত।
ডোনা বসে আছে তার টেবিলে। পাশের জানালা খোলা। বাগান, করিডোর পেরিয়ে শোন নদীর স্নিগ্ধ বাতাস এসে প্লাবিত করছে ঘরকে।
ডোনার রেশমের মত সোনালী চুল সেই বাতাসে বার বার এসে আছড়ে পড়ছে দানিয়ুবের মত নীল চোখ এবং নীলাভ-শুভ্র গন্ডের উপর।
কিন্তু কোন দিকে ভ্রুক্ষেপ নেই ডোনার। তার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম।
চোখ থেকে নেমে আসা অশ্রুর ধারায় গন্ড ভেজা। চোখ দু’টি তার লাল। অনেক কেঁদেছে সে। কিন্তু এত কান্নার পরেও বুক ভরা রয়েছে তার ক্ষোভে, আর সমগ্র সত্তা জুড়ে রয়েছে যন্ত্রণার উত্তাপ। সেই উত্তাপেই ঘামছে সে।
বাতাসে উড়ে আসা কয়েকটা সোনালী চুল অশ্রুতে ভিজে গিয়ে গন্ডের সাথে লেপ্টে গেছে। স্থির বসে থাকতে পারছে না ডোনা। মাঝে মাঝে উঠে পায়চারি করছে।
বারবারই একটা কথা ডোনার মনে তীরের মত এসে বিদ্ধ হচ্ছে। আহমদ মুসা প্যারিসে এসেছে, কিন্তু তাকে জানায়নি, সে জানতে পারেনি। ক্লাউডিয়া না বললে ডোনা জানতেই পারত না আহমদ মুসার ফ্রান্সে আসার কথা। ক্লাউডিয়ার বাবাকে নিয়ে ক্লাউডিয়ার বাসায় যেতে পেরেছে কিন্তু তার কাছে আসতে পারেনি কেন? ক্লাউডিয়ার কাছ থেকে শুনতে হবে কেন তাকে আহমদ মুসার কথা? ফ্রান্সে আসবে কিন্তু তাকে আগে জানাবে না কেন?
এই ধরণের শত প্রশ্ন এসে ক্ষত-বিক্ষত করছে ডোনার কোমল হৃদয়টাকে। আহত হৃদয়ের রক্তটাই বেরিয়ে আসছে চোখ দিয়ে অশ্রু হয়ে।
আহমদ মুসা সম্পর্কে ক্লাউডিয়ার প্রশংসার কথাও অন্তরে তার তীর ফুটাচ্ছে। ক্লাউডিয়ার মত কোন সুন্দরী তরুণীর কাছে আহমদ মুসার কোন প্রশংসা সে শুনতে চায় না।
আহমদ মুসা বড় কাজ নিয়ে ফ্রান্সে এসেছে, একথা সে ক্লাউডিয়ার কাছে শুনেছে। কিন্তু কাজ যত বড়ই হোক, ডোনার সে খোঁজ নেবে না, দেখা করবে না ডোনার সাথে?
আবার ক্ষুব্ধ মন বলে উঠছে, দেখা করবে কেন ডোনার সাথে? ডোনা তার কে? কেউ তো নয়।
এই কথা ভাবতে গিয়ে অশ্রু উথলে উঠল দুই চোখে। বিছানায় নিজেকে ছুড়ে দিয়ে বালিশে মুখ গুজে পড়ে রইল ডোনা।
ডোনা ক্লাউডিয়ার বন্ধু। দু’জন এখন একই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। দু’জনই তুখোড় ডিবেটার ও টেনিস প্লেয়ার। এই হিসেবে দু’জনের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। এই সূত্রেই ক্লাউডিয়া তার জীবনের অদ্বিতীয় একটা ঘটনা হিসেবে আহমদ মুসার কথা গল্প করেছে ডোনার কাছে।
‘ডোনা’ ‘ডোনা’ বলে ডাকতে ডাকতে তার আব্বা মিঃ চার্লস প্লাতিনি ডোনার ঘরে প্রবেশ করল।
ঘরের মাঝখানে এসে দাড়িয়েছে ডোনার আব্বা।
ডোনা তখনও বালিশে মুখ গুজে পড়েছিল। বালিশে মুখ ঘষে ডোনা মুখ তুলল। উঠে বসল সে।
চোখ দু’টি লাল। অশ্রুতে ভেজা। গন্ডেও অশ্রুর দাগ। বেশ কিছু ভেজা চুল গন্ডের উপর তখনও লেপ্টে আছে।
‘কি হয়েছে ডোনা?’ বলে উদ্বিগ্ন মিঃ প্লাতিনি- এগিয়ে এসে ডোনার পাশে তার খাটে বসল।
‘কিছু হয়নি আব্বা’। মাথার রুমাল দিয়ে চোখ ভালো ঘসে বলল ডোনা।
ডোনা এখন মাথায় রুমাল পরে। বিশ্ববিদ্যালয়েও। এ নিয়ে আপত্তি উঠেছিল। কিন্তু কোন বাধা মানেনি। বিশ্ববিদ্যালয় অবশেষে মেনে নিয়েছে। এটা ডোনার বড় বিজয়। কিন্তু ডোনা এ বিজয়কে আহমদ মুসার বিজয় বলে মনে করে। এই রুমাল বা হেড ড্রেস আহমদ মুসাই তার মাথায় তুলে দিয়েছে। গোটা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরোধিতা আহমদ মুসার কাছে পরাজিত হয়েছে। কিন্তু ডোনা এসব কথাকে তুড়ি মেড়ে উড়িয়ে দিয়ে বলেছে, আমার মূল এবং মৌলিকতা অবশ্যই আছে, আমার পরিবার ফ্রান্সের সমাজ ও ইতিহাসের একটা মৌল অংগ। তাই মৌলবাদী হতে আমি রাজী।
ডোনার পিঠে হাত বুলিয়ে তার আব্বা বলল, ‘আমার শক্ত মা ডোনা বুঝি এমনিতেই কাদে?’
‘আমার খুব খারাপ লাগছে আব্বা’। বলে দু’হাতে মুখ ঢাকল।
‘কেন কি হয়েছে?’
‘ঘটনা ছোট, কিন্তু আমার খারাপ লাগছে’।
‘কি ঘটনা?’
‘ক্লাউডিয়ার কাছে শুনলাম, আহমদ মুসা এসেছে। কিন্তু সে আমাকে….’ কথা শেষ করতে পারলো না ডোনা। আরো রুদ্ধ হয়ে কন্ঠ তার থেমে গেল।
‘জানায়নি, এই তো! পাগল মেয়ে। তার কথাও তো ভাবা দরকার, জানাতে পারেনি কোন তাও তোমার ভাবা প্রয়োজন’।
‘আমাদের প্যারিসের ঠিকানা না জানতে পারেন, কিন্তু গ্রামের বাড়ি মন্ট্রেজুর ঠিকানা ও টেলিফোন উনি জানেন। ফ্রান্সে আসার আগেও তিনি জানাতে পারতেন’।
‘তুমি তাকে হৃদয় দিয়ে দেখেছ, মাথা দিয়ে চেননি মা। সে শাটল কর্কের মত। সে তো স্থির হবার সময়ই পায় না। তার উপর অবিচার করো না’।
একটু থামল ডোনার আব্বা। তারপর বলল, ‘ওর কিছু খারাপ খবর আছে মা’।
‘কার খারাপ খবর? আহমদ মুসার? কি খবর, কি হয়েছে?’ উদ্বেগ-রুদ্ধ কন্ঠে বলল ডোনা। মুহুর্তে অন্ধকার হয়ে গেল তার মুখ।
‘আজ এক অনুষ্ঠানে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রদুতের সাথে দেখা হয়েছিল। আমি তাকে আহমদ মুসার কথা জিজ্ঞাসা করেছিলাম। তিনি জানালেন যে, আহমদ মুসা এসেছেন কিন্তু নিখোঁজ হয়ে গেছেন। তাকে খুব উদ্বিগ্ন মনে হলো। তিনি বললেন, মিঃ ক্লাউডের ওখান থেকে আহমদ মুসা সকালে দুতাবাসে পৌছেন। সারাদিন তিনি বিশ্রাম নেন এবং ব্ল্যাক ক্রস সম্পর্কে পড়াশুনা করেন। সেদিন রাত ১২টায় তিনি বেরিয়ে যান ব্ল্যাক ক্রস-এর একটা ঘাটির উদ্দেশ্যে। আর….’
বাধা দিয়ে ডোনা বলল, ‘কেউ তার সাথে যায়নি’।
‘বলছি, এ ধরণের অনুসন্ধানমূলক অপারেশনে সে কাউকে সাথে নেয় না। সেদিনও কাউকে সাথে নিতে রাজী হয়নি’।
একটু হাসল মিঃ প্লাতিনি।
‘আর তিনি ফিরেননি?’ অধৈর্য্য ও উদ্বেগের সাতে ডোনা বলল।
‘না আর ফিরেননি’।
‘ঐ ঘাটিতে কেউ খোজ নেন নি?’
‘নিয়েছে। ভোর রাতে দুতাবাসের লোক সেই ঘাটিতে গিয়ে তিনটি লাশ দেখেছে এবং পেয়েছে পুলিশকে। কিন্তু আহমদ মুসা সম্পর্কে কিছুই জানতে পারেনি’।
‘ঐ লাশ কাদের আব্বা?’
‘ব্ল্যাক ক্রস-এর লোকদের। সেই রাত থেকে আহমদ মুসা নিখোজ’।
ডোনা ঠোট কামড়ে তার পিতার কাধে মুখ গুজল। তার চোখ ছল ছল করছে, কাঁপছে তার ঠোঁট।
মিঃ প্লাতিনি মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, ‘চিন্তার কথা মা, ব্ল্যাক ক্রস দুনিয়া ব্যাপী খৃষ্টানদের স্বার্থ রক্ষা করছে। এই ক্ষেত্রে তারা করতে পারে না এমন কোন কাজ নেই। প্রকৃতপক্ষে ব্ল্যাক ক্রস রেডক্রস-এর বিপরীত একটা খুনি সংগঠন’।
‘ওদের সাথে আহমদ মুসা কেন সংঘাতে জড়িয়ে পড়ল?’ ভাঙা গলায় বলল ডোনা।
ডোনার আব্বা মিঃ প্লাতিনি ওমর বায়ার ঘটনা ডোনাকে সব জানিয়ে বলল, ‘ব্ল্যাক ক্রস-এর হাত থেকে ওমর বায়াকে উদ্ধার করার জন্যেই আহমদ মুসা ফ্রান্সে ছুটে এসেছে’।
ডোনা কিছুক্ষণ নীরব থেকে ধীরে ধীরে বলল, ‘তুমি কি ভাবছ আব্বা, ব্ল্যাক ক্রস কি আহমদ মুসাকে আটক করেছে, না…’
কথা শেষ করতে পারলো না ডোনা। কন্ঠ রুদ্ধ হয়ে গেল তার।
‘চিন্তা করো না মা। ঈশ্বর তাকে রক্ষা করবেন। সে শুধু একজন মজলুম মানুষকে নয়, একটা মজলুম জাতিকে রক্ষার জন্যে ঝাপিয়ে পড়েছে’।
একটু থামল মিঃ প্লাতিনি। তারপর বলল, ‘আহমদ মুসা অনেক বড়। সে ব্ল্যাক ক্রস-এর চেয়েও অনেক বড় বড় শক্তির মোকাবিলা করেছে’।
এই সময় পাশের টিপয়ে রাখা কর্ডলেস টেলিফোন সংকেত দিয়ে উঠল। মিঃ প্লাতিনি টেলিফোন তুলে নিল হাতে।
কথা বলল টেলিফোনে। বলল ঠিক নয় শুনলই শুধু। শুনতে গিয়ে মাঝে মাঝেই তার ভ্রু কুচকে গেল এবং চিন্তা নতুন রেখা ফেলল তার কপালে।
গম্ভীর মুখে টেলিফোনটা রেখে বলল মিঃ প্লাতিনি, ‘ফিলিস্তিন দুতাবাসের টেলিফোন মা’।
মাথা তুলে উদগ্রীব হয়ে উঠল ডোনা।
‘না মা ভাল খবর নেই। তবে খবরগুলো আমার আশাব্যঞ্জক মনে হচ্ছে’।
‘কি খবর আব্বা?’ ডোনার চোখে আশার আলো।
‘দুতাবাস জানাল, পশ্চিম ফ্রান্সে কয়েকটা বড় ঘটনা ঘটেছে। লোরে নদীতে এক জাহাজে দশটি লাশ পাওয়া গেছে। ঐ দিনই নানতেজ শহরের একটি বাড়ীতে দুটি লাশ পাওয়া গেছে এবং ঐ দিন সুর লোরের পর্যটন স্পটে একটা গ্রেনেড বিধ্বস্ত গাড়িসহ ৬টি লাশ পাওয়া গেছে। মনে করা হচ্ছে গাড়ি বিধ্বস্ত হওয়ায় যারা মারা গেছে তাদের সংখ্যা তিন হবে’।
‘কিন্তু এগুলোর সাথে…’।
‘বলছি, ফিলিস্তিন দুতাবাস অনুসন্ধান করে জেনেছে সবগুলো লাশই ব্ল্যাক ক্রস-এর। তারা মনে করছে, আহমদ মুসার হাতেই এ ঘটনাগুলো ঘটতে পারে’।
ডোনার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বলল, ‘ওদের ধারণাকে ঈশ্বর সত্য করুন। কিন্তু ও যোগাযোগ করছে না কেন তাহলে?’
‘সে কি অবস্থায় আছে, সেটা তো আমরা জানি না মা। ঘটনাগুলো প্রমাণ করে, আহমদ মুসা ব্ল্যাক ক্রস-এর সাথে কঠিন সংঘাতে জড়িয়ে গেছে। দূতাবাস আরও জানাল, তাদের বিশেষজ্ঞরা ঘটনাগুলো দেখেছে, জাহাজের হত্যাকান্ড আগে ঘটেছে, তারপর নানতেজ শহরের এবং তারপর সুর লোকের। এই বিশ্লেষণ থেকে বলা হচ্ছে, ঈশ্বর করুন আহমদ মুসা ঐসব ঘটনার সাথে জড়িত থাকলে তিনি লোরে নদী থেকে সুর লোরের দিকে এসেছেন বা আনা হয়েছে’।
থামল মিঃ প্লাতিনি।
‘তারপর কি আব্বা?’
‘এটাই বিস্ময়ের। সুর লোরের পর ঘটনা থেমে গেছে। ফিলিস্তিন, মধ্য এশিয়া প্রজাতন্ত্র, সৌদি আরব, মিন্দানাও দূতাবাসের লোকেরা এলাকা সফর করেছে, কিন্তু কোন সুত্র তারা খুজে পায়নি’।
আবার মুখ অন্ধকার হয়ে গেল ডোনার।
ভাবছিল ডোনার আব্বা মিঃ প্লাতিনি।
অনেকক্ষণ পর ডোনা মুখ তুলে বলল, আমি সুর লোরে একবার যেতে চাই’।
‘কেন মা?’
‘আমার মন বলছে আমি ওখানে ওর কোন চিহ্ন খুজে পাব’। ডোনার শেষের কথা ভেঙ্গে ভেঙ্গে বেরিয়ে এল। তার দু’চোখ থেকে ঝর ঝর করে নেমে এল অশ্রু।
মিঃ প্লাতিনি মেয়েকে কাছে টেনে নিয়ে পিঠে হাত বুলিয়ে সান্ত্বনা দিয়ে বলল, ‘ঠিক আছে যাব মা। ওদিকে অনেকদিন যাইনি। আমাদের এস্টেটটাও দেখে আসা হবে। কয়েকদিন সেখানে থাকতেও পারি আমরা’।
ডোনা চোখ মুছে বলল, ‘আব্বা, ও কি কোনদিন স্থির হবে না? একের পর এক বিপদের মুখে সে ঝাপিয়ে পড়বেই? একজন মানুষকে উদ্ধারের জন্যে ছুটে আসবে চীন থেকে ফ্রান্সে?’ আবেগে কন্ঠস্বর কাঁপছিল ডোনার।
‘পৃথিবীতে অনেক মানুষ আসেন যারা নিজের জন্যে জন্মগ্রহণ করেন না মা। যারা নিজের চোখের পানিতে ভেসেও অন্যের চোখের পানি মুছে দেন’।
একটু থামল। একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলল মিঃ প্লাতিনি। তারপর বলল, ‘আহমদ মুসার আরও খারাপ খবর আছে মা’।
আহত হরিণীর মতই চমকে উঠে মুখ তুলল ডোনা। অশ্রুতে লেপটে যাওয়া তার মুখ। একরাশ প্রশ্ন তুলে ধরল সে চোখে। মুখে কিছুই বলল না।
আবার কথা বলল ডোনার আব্বাই। বলল, ‘সিংকিয়াং-এ আহমদ মুসারই জয় হয়েছে। কিন্তু তার স্ত্রীকে বাঁচাতে পারেনি, জীবিত উদ্ধার করতে পারেনি। নিহত হয়েছে গুলীবিদ্ধ হয়ে’।
‘কি বলছ আব্বা, আহমদ মুসা তো এই আঘাত সইতে পারবে না’। বলে দু’হাতে মুখ ঢাকল ডোনা।
‘আহমদ মুসা শুধু নয়, এই আঘাত সকলকেই কাদিয়েছে। ফিলিস্তিন রাষ্ট্রদূত এই খবর দিতে অশ্রু রোধ করতে পারেন নি। সবচেয়ে বেদনার কি জান, বিয়ের পর দু’জনের আর সাক্ষাত হয়নি। বিয়ের আসর থেকে আহমদ মুসা চলে এসেছিল ককেশাস, সেখান থেকে স্পেন। শেষের ইতিহাস তো আমরা জানি’।
থামল মিঃ প্লাতিনি।
কোন কথা এল না ডোনার কাছ থেকে।
দু’হাতে মুখ ঢেকে বসেছিল ডোনা। কাঁপছিল তার শরীর। আঙুলের ফাঁক দিয়ে গড়িয়ে পড়ছিল অশ্রু।
মিঃ প্লাতিনি মেয়েকে সান্ত্বনা দিয়ে বলল, ‘আমি শুনেছি, আহমদ মুসা মেইলিগুলিকে হারিয়ে শিশুর মত কেদেছে কিন্তু ভেংগে পড়ে নি সে। কর্তব্যের ডাকে স্ত্রীর লাশ নিয়েই চলে এসেছিল মধ্য এশিয়ায়। তারপর ডুবে গিয়েছিল কাজের মধ্যে’।
‘আব্বা, ওর এই কাজ নিজেকে আড়াল করার একটা কৌশল’। মুখ থেকে হাত নামিয়ে মাথা সোজা করে বলল ডোনা।
‘হতে পারে। তবে এই গুণ দূর্লভ মা’। বলে ডোনার আব্বা মিঃ প্লাতিনি উঠে দাড়াল। বলল, ‘মা তুমি তৈরী হয়ে নিও। আমরা কাল সকালেই সুর লোরের দিকে যাত্রা করতে পারি।
বেরিয়ে গেল ডোনার আব্বা।
ডোনা শুয়ে মুখ গুজল বালিশে।
তার হৃদয়ে ঝড় বইছে। বিধ্বস্ত বুক আহমদ মুসার সামনে সে গিয়ে দাড়াবে কিভাবে। ডোনাকে দেখে তার হৃদয়ের ঘাটা আরও যন্ত্রণাদায়ক হয়ে উঠবে না? যদি ঘুর্নাক্ষরেও সে ভাবে যে ডোনা তার প্রিয়তমার প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল, তাহলে আমি দাঁড়াব কোথায়? কি করে বুঝাব তাকে যে, ডোনার হৃদয়ে বিন্দুমাত্রও স্বার্থ চিন্তা ছিল না। মেইলিগুলি ভাবীর বিষয়টা জানার পর ডোনা একবারের জন্যেও আহমদ মুসাকে ফ্রান্সে থাকতে বলেনি। সমগ্র অন্তর দিয়েই তাদের সুখি দেখতে চেয়েছে। হ্যাঁ, ডোনা চেয়েছে আহমদ মুসা ফ্রান্সে আসুন। কিন্তু সেটা ছিল হৃদয়ের অপ্রতিরোধ্য আবেগের একটা অর্থহীন চাওয়ারই প্রকাশ।
আবার ভাবে ডোনা, আহমদ মুসার মত সুন্দর সুবিবেচক কাউকে সে দেখেনি। ওর চেয়ে নরম হৃদয়ও ডোনার চোখে পড়েনি। তিনি ডোনার প্রতি অবিচার করবেন না। বুঝবেন তিনি ডোনাকে।
পাশ ফিরল ডোনা।
দেখল ঘড়িতে দশটা বাজে।
উঠে বসল সে।
সফরের ব্যাগটা রাতে গুছিয়ে রাখাই ভাল। সকালে উঠেই যাত্রা করা যাবে।

দ্বিজন গ্রাম।
দিগন্ত প্রসারিত উপত্যকার মাথায় বেশ কয়েকটি সমতল পাহাড় নিয়ে গড়ে উঠেছে গ্রামটি।
ছবির মত সুন্দর সবুজ গ্রাম দ্বিজন। বাড়িগুলো আরও সুন্দর।
গ্রামের পাশ দিয়ে পাহাড়গুলোর পা ঘেঁষে বয়ে গেছে নীল পানির এদরে নদী।
গ্রাম থেকে উপত্যকার মধ্যে দিয়ে দিগন্তের দিকে বয়ে যাওয়া ‘এদেরে’ নদীকে উপত্যকার সবুজ মাথায় সাদা ফিতার মত সুন্দর দেখায়।
গ্রামের একটি পাহাড়ের মাথায় একটি সুন্দর গীর্জা। গীর্জার মাথায় স্থাপিত ক্রসটি বহুদুর থেকে দেখা যায়।
সেদিন রোববার। গীর্জা মানুষে প্রায় পূর্ণ। প্রার্থনা সংগীত চলছে। হাত তুলে সবাই প্রার্থনায় শামিল। সবারই আনত দৃষ্টি।
গীর্জার এক প্রান্তে পাশাপাশি আসনে বসে জিনা লুইসা এবং ফ্রান্সিস বুবাকের।
জিনা লুইসা দু’হাত তুলে চোখ বন্ধ করে প্রার্থনায় মগ্ন।
ফ্রান্সিস বুবাকের প্রথমে তার হাত উঠায়নি। কিন্তু চারদিকে সবাই হাত উঠানোর পর দ্বিধাগ্রস্থভাবে সেও দু’হাত তুলে ধরেছে।
প্রার্থনা সংগীত শেষ। সবাই বেরিয়ে আসছে গীর্জা থেকে।
জিনা লুইসা এবং ফ্রান্সিস বুবাকেরও চলে আসার জন্যে বেরুল এক দরজা দিয়ে।
গীর্জার একজন কর্মী এসে তাদের সামনে দাঁড়াল। ফ্রান্সিস বুবাকেরকে বলল, ‘তোমাকে ডাকছেন ফাদার’।
বলে চলে গেল গীর্জার কর্মীটি।
ফ্রান্সিস বুবাকের তাকাল জিনা লুইসার দিকে।
জিনা লুইসার মুখ শুকনো। তার চোখে উদ্বেগের ছায়া।
‘ফাদার কেন ডাকলেন আমাকে?’ চিন্তিত কন্ঠে বলল ফ্রান্সিস বুবাকের।
‘আমারই ভুল, ফাদার নিষেধ করেছিলেন তোমাকে গীর্জায় আনতে’। শুকনো কন্ঠে বলল জিনা লুইসা।
‘ও…’। একটা বেদনার ছায়া নেমে এল ফ্রান্সিস বুবাকের চোখে-মুখে।
জিনা লুইসা ফ্রান্সিস বুবাকেরের হাত ধরে বলল, ‘ডেকেছেন, চল। আমিও যাব তোমার সাথে’।
দু’জনে চলল ফাদারের কক্ষের দিকে।
জিনা এবং ফ্রান্সিস দ্বিজন গ্রামের একটি মানিক জোড়। ফ্রান্সিস জিনার চেয়ে বছর দুয়েকের বড়। দু’জনের বাড়ি পাশাপাশি নয় কিন্তু কাছাকাছি। দু’জন তারা খেলার সাথী, এখন কলেজের সাথীও।
জিনা ও ফ্রান্সিস গিয়ে হাজির হলো ফাদারের কক্ষে।
ফাদারের বয়স চল্লিশের কোঠায়। পুরোপুরি যুবকই বলা যায়। বসে আছেন তিনি একটা বিশাল চেয়ারে।
জিনা ও ফ্রান্সিস তাঁর সামনে গিয়ে নতমুখে দাঁড়াল।
‘জিনা, তোমাকেও আসতে বলেছে? তোমাকে তো ডাকিনি’।
জিনার মুখ লাল হয়ে উঠল। একটা বিব্রত ভাবও ফুটে উঠল তার মুখে। বলল, ‘আমি ওঁর সাথে এসেছি। আসতে বলেনি কেউ ফাদার’।
ফাদার জিনার দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে তাকাল ফ্রান্সিস বুবাকেরের দিকে। বলল গম্ভীর কন্ঠে, ‘ফ্রান্সিস তোমাকে একথা বলার জন্যে ডেকেছি যে, তুমি পবিত্র হওনি, তোমার গীর্জায় আসা ঠিক নয়। গীর্জা ঈশ্বরের পবিত্র সন্তানদের জন্যে’।
থামল ফাদার।
একটু থেমে আবার বলল, ‘দুঃখিত ফ্রান্সিস, একথাগুলো তোমাকে সরাসরি না বলতে পারলেই ভাল হতো’।
জিনা ও ফ্রান্সিস বেরিয়ে এল ফাদারের কক্ষ থেকে।
ফ্রান্সিসের গোটা মুখ লাল। ঠোট কামড়ে ধরেছে সে। আর বেদনায় পাংশু হয়ে উঠেছে জিনার মুখ। শক্ত করে ধরেছে ফ্রান্সিসের হাত নিজের মুঠোর মধ্যে। কিন্তু জিনা তাকাতে পারছে না ফ্রান্সিসের মুখের দিকে।
গীর্জার গেট পেরুবার সময় জিনা ভয়ে ভয়ে একবার তাকাল ফ্রান্সিসের মুখের দিকে। দেখল, চোখ দিয়ে তার অশ্রু গড়াচ্ছে। বেদনায় ও অপমানে নিধ্বস্ত তার সুন্দর মুখ। ঠোঁট কামড়ে ধরে আছে সে। যেন নিজেকে সামলাবার চেষ্টা করছে।
জিনা যে হাত দিয়ে ফ্রান্সিসের হাত ধরেছিল সে হাত দিয়ে ফ্রান্সিসকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘ফ্রান্সিস কেঁদ না, তুমি অপবিত্র হলে আমিও অপবিত্র। আমি আর গীর্জায় আসব না’।
এই সময় পেছন থেকে ডাক এল, ‘জিনা-ফ্রান্সিস’।
জিনা মুখ ফিরিয়ে দেখল, ‘ওল্ড ফাদার’-এর প্রাইভেট সেক্রেটারী। জিনা ফিরে চাইতেই সে বলল, ‘ফাদার ফ্রান্সিসকে ডাকছেন’।
‘ওল্ড ফাদার’ এই দ্বিজন-গীর্জার পরিচালক। বয়স নব্বই-এর কাছাকাছি। পশ্চিম ফ্রান্সের সবচেয়ে প্রবীণ এবং সবচেয়ে সম্মানিত ধর্মনেতা তিনি। ভ্যাটিকান কাউন্সিলের তিনি একজন সদস্য। সম্প্রতি তিনি দ্বিজন গীর্জার দৈনন্দিন কাজ থেকে রিটায়ার করেছেন।
ফ্রান্সিসকে থামিয়ে দিয়ে তার মুখের দিকে চেয়ে নরম কন্ঠে অনুরোধ করল জিনা, ‘ওল্ড ফাদার ডেকেছেন। চল। উনি খুব ভাল মানুষ। উনার সময় দেখ কোন প্রবলেম হয়নি আমাদের’।
বলে জিনা ফ্রান্সিসকে টেনে ওল্ড ফাদারের অফিসের দিকে নিয়ে চলল।
ওল্ড ফাদার তার অফিসে ইজি চেয়ারে শুয়ে আছেন।
জিনা ও ফ্রান্সিস কক্ষে ঢুকে দু’জনেই মাথা ঝুকিয়ে ফাদারকে বাও করে তাঁর সামনে মাথা নত করে দাঁড়াল।
জিনা ও ফ্রান্সিস দু’জনের চোখেই অশ্রু।
ওল্ড ফাদার সেদিকে তাকাল। তার ঠোটে ফুটে উঠল ঈষৎ হাসি। বলল, ‘ফ্রান্সিসের কান্না জিনা তোমাকেও কাদিয়েছে। এটা খুবই পবিত্র। ঈশ্বর এই মিলনের অশ্রুকে খুবই ভালবাসেন’।
জিনা ফাদারকে আবার বাও করে বলল, ‘ফাদার আমাদের আশীর্বাদ করুন’। জিনার চোখে অশ্রুর বেগ বাড়ল। আবার বলল, ‘ফাদার, ফ্রান্সিস অপবিত্র হবে কেন?’
‘এসব কথাকে শাব্দিক অর্থে ধরো না। ভাষার পার্থক্য, জাতীয়তার পার্থক্য বুঝাতে যেমন কিছু শব্দ ব্যবহার হয়, তেমনি ধর্মীয় পার্থক্যের ক্ষেত্রেও কিছু শব্দ ব্যবহার করতে হয় মাত্র’।
বলে ওল্ড ফাদার চেয়ার দেখিয়ে দু’জনকে বসতে বলল।
কিন্তু জিনা ও ফ্রান্সিস চেয়ারে না বসে ওল্ড ফাদারের সামনে কার্পেটের উপর বসে পড়ল।
কথা শেষ করেই ওল্ড ফাদার চোখ বুজেছিল। ধীরে ধীরে চোখ খুলল ফাদার। তাকাল ফ্রান্সিসের দিকে। বলল, ‘ইন্টারকমে আমি সব কথাই শুনেছি ফ্রান্সিস। কিন্তু তুমি কাঁদছ কেন? অপমানে? অপবিত্র বলার কারণে?’
ফ্রান্সিস কোন জবাব দিল না।
ওল্ড ফাদারই আবার কথা শুরু করল। বলল, ‘বোকা ছেলে। তুমি, তোমাকে জাননা বলেই কেঁদেছ, অপমান বোধ করেছ। যদি জানতে তুমি কে, তাহলে এই ‘অপবিত্র’ হওয়াটাই তোমার জন্যে গৌরবের হতো’।
থামল ফাদার। একটু নড়ে-চড়ে শুয়ে চাদরটা গায়ের উপর ভালো করে তুলে নিয়ে বলল, ‘শুনলাম তুমি কাঁদছ। তাই তোমাকে ডেকেছি দু’টো কথা বলার জন্যে। আহত হৃদয়ের কান্না ঈশ্বর সইতে পারেন না’।
আবার থামল ওল্ড ফাদার। চোখ দু’টি ওপরের দিকে নিবদ্ধ করে ভাবল কয়েক মুহুর্ত। তারপর শুরু করল, ‘ফ্রান্সিস তোমার ধর্ম ইসলাম, মহান ধর্ম। মহত্তম ধর্ম। আমি তোমাদের ধর্মগ্রন্থের অনেক অংশ পড়েছি। জীবনের শেষ প্রান্তে দাড়িয়ে আজ স্বীকার করতে আনন্দ লাগছে, আমাদের প্রভু যেখান থেকে বাণী পেয়েছিলেন, তোমাদের নবী ইসলামের নবী মোহাম্মদও সেখান থেকেই বাণী পেয়েছিলেন। একজন খৃষ্টান ধর্মনেতা হয়েও আমি স্বীকার করছি, ফ্রান্সিস তোমার গর্ব করা উচিত তোমাদের ধর্মই একমাত্র যুগের দাবী পূরণ করছে, সময়ের চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করছে এবং অনাগত কালের প্রয়োজনও তোমাদের ধর্ম পূরণ করার সামর্থ রাখে। একথাগুলো স্বীকার করতে আমার লজ্জা বোধ হচ্ছে না। কারণ আমি ঈশ্বরের পূজক। আর আমার ঈশ্বরেরই শেষ ধর্ম হলো ইসলাম। তুমি জাননা ফ্রান্সিস, পৃথিবীর ১২৫ কোটি মানুষ তোমার ধর্মের অনুসারী এবং অত্যন্ত সক্রিয় অনুসারী’।
থামল ফাদার।
এক নাগাড়ে কথাগুলো বলে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল ফাদার।
জিনা এবং ফ্রান্সিস বিস্ফোরিত চোখে শুনছিল ওল্ড ফাদারের কথা। পৃথিবীতে মহান এক সভ্যতার জন্ম দিয়েছে, যেখানে জ্ঞান-বিজ্ঞান এবং বিশ্বাস একে-অপরের পরিপূরক। ফ্রান্সিস, তোমাদের সভ্যতাই আমাদের অন্ধকার ইউরোপে জ্ঞানের প্রদীপ প্রজ্জ্বলিত করেছিল। আজকের ইউরোপের বিজ্ঞানের যে অহংকার, তার জন্মদাতা তোমাদের ধর্ম ইসলাম। শুধু জ্ঞান-বিজ্ঞান নয়, রাজনৈতিক শক্তিতেও তোমাদের ধর্ম অপ্রতিরোধ্য। মৌলবাদী, সাম্পদায়িক, পশ্চাতপন্থী ইত্যাদি অপবাদ দিয়ে এই শক্তির অগ্রগতি রোধ করার চেষ্টা হচ্ছে। কিন্তু আমি বলছি, রোধ করা যাবে না। পৃথিবীর বিশেষ করে আমাদের পশ্চিমের মানুষ অন্তরের ক্ষুধায় যেভাবে অস্থির হয়ে উঠছে, অনৈতিকতা ও অনাচারের হাত থেকে বাঁচার জন্যে যেভাবে পাগল হয়ে উঠেছে, তাতে ইসলামের মৌলবাদ অর্থাৎ ইসলামের পবিত্র ও পরিচ্ছন্ন নৈতিক জীবনই তাদের কাছে একমাত্র বিকল্প হয়ে দাঁড়াচ্ছে’।
থামল ওল্ড ফাদার আবার। হাপিয়ে উঠছেন তিনি।
অপার বিস্ময় এসে গ্রাস করেছে জিনা ও ফ্রান্সিসকে। তারা মন্ত্রমুগ্ধের মত শুনছে ওল্ড ফাদারের কথা। তাদের চোখের পানি কখন যেন শুকিয়ে গেছে।
ইজি চেয়ারে একটু সোজা হয়ে বসে শুরু করল আবার ওল্ড ফাদার। বলল, ‘আমি যে পাহাড়ে, যে দ্বিজন গ্রামে বসে কথা বলছি, সেটা ছিল, ফ্রান্সিস, তোমার ধর্ম ইসলামের বিশাল সাম্রাজ্যের উত্তর সীমান্ত দাঁড়ানো একটা শক্ত ঘাটি। লোরে নদী ও এদেরে নদীর মর্ধবর্তী এই দ্বিজনে ছিল ইসলামী সাম্রাজ্যের প্রতিরক্ষা কেল্লা। যে পাহাড় শীর্ষের উপর বসে আমি কথা বলছি, সে পাহাড় শীর্ষে গীর্জার একটু উত্তরে বিরাট স্থান জুড়ে ইট-সুরকি আর পাথরের তৈরী যে বেদী তোমরা দেখ ওটা ছিল মুসলিম দুর্গ দ্বিজনের একটা পর্যবেক্ষণ টাওয়ার। সে সময়টা ৬শ বছর আগের। দক্ষিণ ফ্রান্স এবং পশ্চিম ফ্রান্সের বিশাল এলাকা জুড়ে তখন একটা মুসলিম সালতানাত প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। যদিও এই দ্বিজনে মুসলিম উপস্থিতি বেশী দিন ছিল না কিন্তু মুসলিম সালতানাতটি প্রতিষ্ঠিত ছিল প্রায় একশ’ বছর। এখান থেকে ৫৫ মাইল দক্ষিণে ক্লেন নদীর তীরে আজকের পোয়েটার নগরীর জায়গায় ইউরোপের সাথে মুসলিম সালতানাতের যে যুদ্ধ হয়েছিল, সেই যুদ্ধের পরই এই এলাকা মুসলমানদের হাত ছাড়া হয়। ফ্রান্সের পূর্ব-দক্ষিণে ভূমধ্যসাগর তীরবর্তী নারবো ছিল ফ্রান্সের মুসলিম সালতানাতের রাজধানী। দক্ষিণ ফ্রান্সের সবচেয়ে বড় নদী গেরনের সাথে খাল কেটে নারবো’র সংযোগ সাধন করা হয়েছিল এক সময়। ফলে মিলে গিয়েছিল আটলান্টিক এবং ভূমধ্যসাগর। সেই বিখ্যাত খালটিই পরিবর্ধিত হয়ে আজ নারবো থেকে পশ্চিম প্রান্তের লংগন পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে’।
থামল ওল্ড ফাদার। চোখ বুজে কথা বলছিল ফাদার। তার কপালে জমে উঠেছে বিন্দু বিন্দু ঘাম। গা থেকে ফাদার তার চাদর নামিয়ে দিল। হাঁপাচ্ছিল ওল্ড ফাদার। এক সংগে অনেক কথা বলেছেন।
জিনা এবং ফ্রান্সিস নিজেদের হারিয়ে ফেলিছিল ওল্ড ফাদারের এই কাহিনীর মধ্যে। দ্বিজন এবং ফ্রান্সের সেই অতীতটা তাদের চোখের সামনে বর্তমান হয়ে উঠেছিল। তারা যেন দেখতে পাচ্ছিল দ্বিজনের সেই পর্যবেক্ষণ যুদ্ধক্ষেত্র। বিশেষ করে ফ্রান্সিস বুবাকের যেন নবজন্ম লাভ করল ওল্ড ফাদারের কথায়। ফ্রান্সিস জানতো খৃষ্টান থেকে তার ধর্ম আলাদা। কিন্তু দেখত তার ক্ষুদ্র ধর্মটির কোন নাম-ধাম কোথাও নেই। বরং ছোটবেলা থেকেই সে শুনে আসছে মুসলমানরা এক খুনে জাতি, আচার-আচরণে অসভ্য ও বর্বর তারা। তার মনে পড়ে একবার সে উত্তর ফ্রান্সের এক বন্ধুর বাড়িতে গিয়েছিল। বন্ধুর বোন তাকে বলেছিল, আমি শুনেছি, আমাদের ইতিহাসের শিক্ষক বলেছেন, মুসলমানরা মানুষ খেকো। কিন্তু তোমাকে দেখে তো তেমন মনে হচ্ছে না? ছোটবেলা থেকে সর্বত্র সব জায়গায় এ সব শুনে তার ধর্মের জন্যে এবং নিজে মুসলিম হওয়ার জন্যে সে লজ্জা বোধ করতো। অপরিচিত কাউকেই সে নিজের পরিচয় দিত না। এমনকি মায়ের কাছেও ধর্ম সম্বন্ধে কোন কথা তুলতে সে সাহস পেত না। ফ্রান্সিস বাবাকে হারিয়েছে অনেক আগে। শুনেছে তার মা খৃষ্টান থেকে মুসলিম হয়ে তার আব্বাকে বিয়ে করে। ফ্রান্সিস যুক্তি খুজেঁ পেত না কেন তার মা মুসলমান হয়। তবে ফ্রান্সিসের মনে মনে গর্ব হতো, তার মা এখন মুসলমান হলেও এক সময় খৃষ্টান ছিল। পরিচিত বন্ধুদের সবাইকে সে একথা বলতো। তার আব্বাকে খুবই মনে পড়ে ফ্রান্সিসের। খুব ভালো, খুব সুন্দর মানুষ ছিলেন তিনি। মুসলমানকে কেউ গালি দিলে খুব দুঃখ পেতেন তার আব্বা। কোন এক হলিডে’তে এক খোশগল্পের আসরে একজন তার দেশপ্রেম দেখাবার জন্যে একটা কাগজে অর্ধচন্দ্র একে এবং আরেকটা কাগজে মুসলিম ধর্মগ্রন্থের নাম লিখে পা দিয়ে মাড়িয়ে দিয়েছিল। আব্বা সে আসর থেকে তাকে নিয়ে নীরবে চলে এসেছিলেন। ধর্ম নিয়ে সেদিনই শুধু তার চোখকে অশ্রু সিক্ত হতে দেখেছে ফ্রান্সিস। মনে পড়ে তার আব্বা বলেছিলেন, ‘আমি আমার ধর্মগ্রন্থ দেখিনি, ইসলামের অর্ধচন্দ্র খচিত পতাকাও দেখিনি। কিন্তু তবু তো এগুলো আমাদের’। ফ্রান্সিস কোন দিনই তার পিতার এই অশ্রুর কথা ভুলতে পারেনি। নিজ ধর্মের ব্যাপারে হতাশ ও দুর্বল হয়ে পড়লেই পিতার এই কথা তার মনে পড়তো। এখান থেকেই সে শক্তি পেত নিজ ধর্ম যত তুচ্ছই হোক তার উপর টিকে থাকার। কিন্তু ওল্ড ফাদারের কথা শুনে আজ গর্বে তার বুক ভরে গেল। বুঝল, তার ধর্ম শুধু বড় নয়, খৃষ্টান ধর্মের চেয়েও এবং মহত্তর। তার আরও গর্ববোধ হলো, তার মাতৃভুমি এই ফ্রান্সেও তার ধর্মের রাজত্ব ছিল। ফ্রান্সিস সবচেয়ে খুশী হলো ওল্ড ফাদারের এই কথায় যে, অন্ধকার ইউরোপে জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রদীপ জ্বালিয়েছিল তার ধর্মই।
অনেকক্ষণ পর চোখ মেলল ওল্ড ফাদার।
জিনা ও ফ্রান্সিস এক দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল তার দিকে।
ওল্ড ফাদারের ঠোটে এক টুকরো হাসি। তার চোখ নিবদ্ধ হলো ফ্রান্সিস বুবাকের উপর। বলল, ‘আর গীর্জায় যাওয়ার তোমার প্রয়োজন হবে বৎস? এত কথা বললাম তুমি কে তা বুঝাবার জন্যে’।
ফ্রান্সিস উঠে দাড়িয়ে ওল্ড ফাদারকে মাথা ঝুকিয়ে বাও করে বলল, ‘প্রয়োজন হবে না ফাদার। আপনি আমাকে নতুন জীবন দিয়েছেন’।
ফাদারের ঠোটের হাসি আর একটু প্রসারিত হলো। বলল, ‘বৎস ফ্রান্সিস, তোমার ধর্মে একমাত্র ঈশ্বর ছাড়া কোন মানুষের কাছে মাথা নত করার বিধান নেই। তোমার ধর্ম ইসলাম সব মানুষকে সমান করে দিয়েছে’।
আবার বাও করল ফ্রান্সিস।
জিনা উঠে দাড়াল। তার মুখ ভরা হাসি।
ওল্ড ফাদার এক টুকরো স্নেহের হাসি হেসে বলল, ‘ফ্রান্সিসের ধর্মের প্রশংসায় তুমি যে খুশী জিনা?’
জিনার মুখ গম্ভীর হয়ে উঠল। বলল, ‘ফাদার আপনি ফ্রান্সিসের অবনত মাথাকে আজ উন্নত করে দিয়েছেন। তার হৃদয়ের অসহনীয় এক যন্ত্রণার আপনি উপশম ঘটিয়েছেন। আমার বিশ বছর জীবনের সবচেয়ে আনন্দের দিন আজ ফাদার। ফাদার, ওকে গীর্জায় এনে সান্ত্বনা দেয়ার এবং বড় করার এতদিন ব্যর্থ চেষ্টা করতাম!’ জিনার কন্ঠ ভারি হয়ে উঠেছিল।
ওল্ড ফাদার তার ঠোটে স্নিগ্ধ হাসি ফুটিয়ে বলল, ‘যে অন্যের জন্যে কাঁদতে পারে, হাসতে পারে, সে মানুষের মধ্যে মহত্তম মানুষ। ঈশ্বর তোমার মঙ্গল করুন বৎস’। বলেই চোখ বন্ধ করল ওল্ড ফাদার। বলল, ‘এস তোমরা’।
জিনা ও ফ্রান্সিস দু’জনেই ওল্ড ফাদারকে বাও করে বেরিয়ে এল কক্ষ থেকে।
জিনা ফ্রান্সিসের হাত ধরে হাঁটছিল। হাঁটতে হাঁটতে হাতে চাপ দিয়ে বলল, ‘তোমার ধর্মে বাও করা নেই, বাও যে করলে আবার?’
‘আমি তো জানিনা জিনা, আমার ধর্মে কিভাবে সম্মান ও শ্রদ্ধা দেখাতে হয়’।
‘এবার তো খুশী! তোমার ধর্মকে ওল্ড ফাদার মহত্তম ধর্ম বলেছেন!’
‘আরেকজন মানুষকেও ফাদার মহত্তমদের একজন বলেছেন’।
জিনার মুখ লাল হয়ে উঠল লজ্জায়। কথা বলল না।
ফ্রান্সিস জিনার হাতকে আরও শক্ত করে ধরে বলল, ‘আজ আমার চেয়ে সুখী আর কেউ নেই। আমি আজ দুই ‘মহত্তম’-এর মালিক’।
‘দুই ‘মহত্তম’?’ মুখ না তুলেই লজ্জা রাঙা মুখে বলল জিনা।
‘হ্যাঁ দুই ‘মহত্তম’। একটা আমার ধর্ম, অন্যটা আমার তুমি’।
জিনা তার হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলল, ‘আমার মালিকানা তোমাকে দিয়ে দিয়েছি বুঝি?’
‘এই তো এক্ষুণি ওল্ড ফাদারের কাছে কাদো কাদো ভাবে কি বললে?’
‘যা বলেছি, ওল্ড ফাদারকে বলেছি। তোমাকে তো বলিনি!’
‘গীর্জা থেকে বেরুবার পর বললে না যে, আমি অপবিত্র হলে, তুমিও অপবিত্র? বলনি যে, আমি গীর্জায় যেতে না পারলে তুমিও যাবে না?’
‘ওটা তো সমবেদনা’।
‘সেদিন কলেজ-ফেস্টিভ্যালে আমার সাতে জোড় না হওয়ায় তুমি নাচনি। কেন বলব?’
‘তুমি নাচনি কেন?’
‘তোমার সাথে জোড় না হওয়ায় নাচিনি। কারণ তুমি আমার’।
জিনা কোন উত্তর দিল না।
‘তোমার উত্তরটা দাও’। চাপ দিল ফ্রান্সিস।
জিনা ফ্রান্সিসের হাত আবার হাতে তুলে নিয়ে বলল, ‘জবাব দেব না’।
‘জবাব দরকার নেই’।
‘কেন?’
‘হাতটা হাতে তুলে দেবার পর আবার মুখের জবাব কি দরকার’।
‘আচ্ছা, এই কথা’। বলে হাত খুলে নিয়ে দৌড় দিল জিনা।
‘শোন, শোন জিনা, কথা আছে’। ডাকল ফ্রান্সিস।
‘এখন নয়, বিকেলে দেখা হবে’। চিৎকার করে বলল জিনা।
‘জরুরী কথা। তুমি না শুনলে আমি এখানেই বসে থাকব সারাদিন’। বলে রাস্তার উপরেই বসে পড়ল ফ্রান্সিস।
দাড়িয়ে পড়ল জিনা। তারপর ধীরে ধীরে এগিয়ে এল ফ্রান্সিসের কাছে।
জিনা ফ্রান্সিসের কাছে হাটু গেড়ে বসে অভিমান ক্ষুব্ধ কন্ঠে বলল, ‘তুমি জান তোমাকে এভাবে রেখে আমি যেতে পারব না, তাই তোমার এই জেদ!’
‘মাফ কর জিনা। তোমাকে সত্যিই আমার প্রয়োজন। আজ মা’র সাথে আমি ঝগড়া করব তিনি কেন আমাকে অন্ধকারে রেখেছিলেন। তুমি আমার সাথে থাকবে’।
জিনা একটুক্ষণ চুপ করে থাকল। তারপর বলল, ‘ঠিক আছে যাব। কিন্তু ঝগড়া কেন? ওল্ড ফাদার যা জানেন, তোমার আম্মাও তা জানবেন, এটা তুমি জানলে কি করে?’
ফ্রান্সিস উঠে দাড়াতে দাড়াতে বলল, ‘তুমি ঠিক বলেছ জিনা। তোমাকে এই জন্যেই তো প্রয়োজন’।
জিনাও উঠে দাড়িয়েছিল।
দু’জন হাটতে শুরু করল ফ্রান্সিসের বাড়ির দিকে।
‘একই পাড়া অর্থাৎ একই পাহাড়ে জিনা ও ফ্রান্সিসের বাড়ি। জিনাদের বাড়ি পাহাড়ের পূর্ব প্রান্তে, আর ফ্রান্সিসদের বাড়ি পাহাড়ের পশ্চিম প্রান্তে।
ছোট্ট দু’তলা বাংলো বাড়ি ফ্রান্সিসদের। এ তুলনায় জিনাদের বাড়ি বলা যায় প্রাসাদ।
উপত্যকায় ফ্রান্সিসদের কয়েকখন্ড জমি আছে। এটাই তাদের আয়ের প্রধান উৎস। এছাড়া তুরস শহরে ফ্রান্সিসের আব্বা একটা ফ্যাক্টরী চালাত। সেটা এখনও আছে। তা থেকেও আয় আসে। সব মিলিয়ে ফ্রান্সিসরা ধনী না হলেও স্বচ্ছল পরিবার।
ফ্রান্সিস তার পিতা-মাতার একমাত্র ছেলে। বাড়িতে তার আম্মা এবং কয়েকজন কাজের লোক ছাড়া কেউ নেই।
বাড়িতে পৌছে ফ্রান্সিস তার আম্মাকে তার আম্মার ঘরে খুজে পেল।
ফ্রান্সিস এবং জিনা ঘরে ঢুকতেই ফ্রান্সিসের মা মরিয়ম মার্গারেটা বলল, ‘দু’জন কোত্থেকে আসা হচ্ছে? গীর্জা?’
‘হ্যাঁ, চাচী আম্মা’। জবাব দিল জিনা।
ফ্রান্সিস গম্ভীর।
‘ফ্রান্সিস গীর্জার রেগুলার সদস্য হয়ে গেল নাকি? লক্ষণ ভাল নয় তো!’ হেসে বলল ফ্রান্সিসের মা।
‘তার যাওয়াটা দেখা ছাড়া আর কিছু নয় চাচী আম্মা। চুপ করে বসে থাকে। কিছুই করে না’।
ফ্রান্সিসের গম্ভীর মুখের দিকে তার মা’র দৃষ্টি এতক্ষণে নিবদ্ধ হলো চুপ করে থাকা দেখে। একটু বিস্ময়ের দৃষ্টি নিয়ে বলল, ‘কথা বলছিস না যে। মুখটা ভারি দেখছি। কারো সাথে ঝগড়াঝাটি করেছিস নাকি?’
‘না আম্মা ঝগড়া করিনি’। গম্ভীর কন্ঠে কথাগুলো বলে কয়েক ধাপ এগিয়ে মাকে চেয়ারে বসিয়ে নিজে তার পাশে বসে বলল, ‘তোমার সাথে কথা আছে আম্মা’।
‘এত আয়োজন করে কি কথা বলবিরে মা’কে?’
‘তোমার সাথে ঝগড়া আছে আম্মা?’ গম্ভীর কন্ঠে বলল ফ্রান্সিস।
ফ্রান্সিসের মা মরিয়ম মার্গারেটা মুখ টিপে হাসল। বলল, ‘খুব বড় ঝগড়া বুঝি! তাই জিনাকে এনেছিস বুঝি সাহায্যের জন্যে?’
ফ্রান্সিসের মুখে হাসি ফুটে উঠল। বলল, ‘জিনাকে আমি ডাকব সাহায্যের জন্যে! কথা বলার আগেই তো সে তোমার পক্ষ নেবে। দেখো এখনি গিয়ে সে তোমার পেছনে দাড়িয়েছে’।
সত্যিই ফ্রান্সিসের মা মরিয়ম মার্গারেটা চেয়ারে বসলে জিনা গিয়ে চেয়ারের পেছনে দাড়িয়ে পেছন থেকে গলা জড়িয়ে ধরে আছে ফ্রান্সিসের মা’র।
ফ্রান্সিসের মা জিনার হাত ধরে সামনে টেনে এনে কোলে বসিয়ে চিবুকে একটা চুমু খেয়ে ফ্রান্সিসের দিকে চোখ রাঙিয়ে বলল, ‘চুপ, জিনার সাথে ঝগড়া বাধাব না বলছি’।
‘ও কথা আমাকে না বলে ওকেই তোমার বলা দরকার আম্মা। ঝগড়া ওই-ই বাধায়। বাইরে বেরুলেই মনে হয় ও বুঝি তোমার কাছ থেকে গভর্নরশীপ নিয়েছে’।
‘চাচীমা দেখুন, ঝগড়া কে বাধায়?’ জিনা ফ্রান্সিসের মা’র কোল থেকে উঠে আবার তার চেয়ারের পেছনে গিয়ে দাঁড়াল এবং গলা জড়িয়ে ধরে ফ্রান্সিসের মা’র কাধে মুখ রাখল।
ফ্রান্সিস কিছু বলতে যাচ্ছিল। তার মা বাধা দিয়ে বলল, ‘থাক ঝগড়াটা আমার সাথেই কর’।
ফ্রান্সিস চুপ করল। মাথা নিচু করে রাখল একটুক্ষণ।
তারপর মাথা তুলে গম্ভীর কন্ঠে বলল, ‘আম্মা, তুমি আমার গীর্জায় যাওয়ার কথা তুলেছ। কিন্তু গীর্জায় যেতে কখনও বাধা দাওনি। কখনও বলনি আমাদের পৃথক গীর্জা আছে কিনা’।
ফ্রান্সিসের মা’র মুখ গম্ভীর হয়ে উঠল। উত্তর দিল না সঙ্গে সঙ্গেই। অল্পক্ষণ পর বলল, ‘আমাদের তো কিছু নেই বাছা, কিসের কথা তোমাকে বলব, কোথায় তোমাকে যেতে বলব। ব্যথায় হাত দিলে ব্যথা আরও বাড়ে। আমি চাইনি কখনও ব্যথা বাড়াতে’।
‘কি নেই আমাদের? সবই তো আছে। আমাদের অতীত আছে, আমাদের বর্তমানও আছে’।
‘আছে। কিন্তু আমাদের ফ্রান্সের মুসলমানদের কি আছে?’ থাকলে তোকে গীর্জায় যেতে হতো না, মসজিদে যেতিস’।
‘মসজিদ কি আম্মা?’ উৎসুক্য ফুটে উঠল ফ্রান্সিসের চোখে।
‘মুসলমানরা যেখানে দিনে পাঁচবার প্রার্থনা করে এবং যেখানে প্রতি শুক্রবার সকলের উপস্থিতিতে বিরাট প্রার্থনা সমাবেশে প্রার্থনা এবং সমসাময়িক বিষয়ের উপর বক্তৃতা হয়’।
‘আমি তো এই মসজিদ কোথাও দেখিনি। তুরস, নানতেজ, আজার- এসব শহরেও মুসলমান দেখেছি। কিন্তু মসজিদ তো দেখিনি?’
‘এটাই তো বেদনার কাহিনী ফ্রান্সিস। আমরা আমাদের ভুলে গেছি, ভুলতে বাধ্য করা হয়েছে’।
থামল মরিয়ম মার্গারেটা। বেদনার ছায়া নেমেছে তার সমগ্র মুখ জুড়ে। চেয়ারে একটু হেলান দিয়ে কথা শুরু করল আবার, ‘তোর আব্বার কাছ থেকে শুনেছি। এই পশ্চিম ও দক্ষিণ ফ্রান্সে চারশ’ বছর আগেও প্রচুর মুসলমান ছিল। তাদের হয় হত্যা করা হয়েছে, নয়তো দেশ থেকে তাড়িয়ে দেয়া হয়েছে, অথবা তাদের মুসলিম পরিচয় বিলুপ্ত করতে বাধ্য করা হয়েছে। তোমার আব্বা বলেছেন, তোমার পূর্ব পুরুষ, আমাদের নবী মোহাম্মদ (স)-এর দেশ আরবের অধিবাসী ছিলেন। সেনাধ্যক্ষ হিসেবে দেশ জয়ে এসে তোমার এক পূর্ব পুরুষ আলজিরিয়ায় থেকে যান। সেই মুসলিম দেশ আলজিরিয়ায় যখন অষ্টাদশ শতকে ফরাসিরা উপনিবেশ স্থাপন করে, তখন হাজার হাজার মুসলমানের সাথে তোমার এক পূর্ব পুরুষকেও ফ্রান্সে ধরে আনা হয়। সেই হতভাগ্য ছিলেন তোমার দাদার আব্বা। এদেরকে ধরে এনে শুধু বাধ্যতামূলক শ্রমেই লাগানো হয় না, এদের ধর্মীয় পরিচয়ও বিলুপ্ত করার সার্বিক চেষ্টা করা হয়। সুতরাং মসজিদ গড়ে উঠবে কি করে? কি করে দেখবি তুই আজ মসজিদ? মসজিদ কেন, তুই কি তোর ধর্মগ্রন্থ চোখে দেখেছিস? দেখিসনি প্রতিদিন পাঁচবার প্রার্থনা করা মুসলমানদের জন্যে বাধ্যতামুলক। তুই কি প্রার্থনা করতে পারিস? জানিস কিভাবে প্রার্থনা করতে হয়? আমি জানিনা, তোর আব্বাও জানতেন না, তুইও জানিস না। সুতরাং আমাদের কি আছে? কিছুই নেই’।
থামল ফ্রান্সিসের মা। তার চোখ থেকে দু’ফোটা অশ্রু নেমে এসেছিল।
ফ্রান্সিসেরও চোখ-মুখ আবেগে ভারি হয়ে উঠেছে। ছল ছল করে উঠেছে তার চোখও। সে কামড়ে ধরেছে তার ঠোট। তার পূর্ব পুরুষ নবীর দেশ আরবের মানুষ এই কথা হৃদয়কে তার তোলপাড় করে তুলেছে। তার পূর্ব পুরুষের দুর্ভাগ্য, তার জাতির দুর্ভাগ্য, তার হৃদয়ে হাতুড়ির ঘা দিচ্ছে। তার আম্মা থামলে ফ্রান্সিস বলল, ‘আম্মা, তুমি দেখনি আমাদের ধর্মগ্রন্থ? কিংবা আব্বা?’
‘না বেটা, উনি দেখলে হয়তো আমিও দেখতে পেতাম’। চোখ মুছে বলল ফ্রান্সিসের মা।
‘আমাদের প্রার্থনা শেখার কি কোন উপায় নেই আম্মা? তোমরা কি কোনই চেষ্টা করনি?’
‘তোর আব্বা ছোট একটা বই জোগাড় করেছিলেন। যাতে প্রার্থনার কথা বলা আছে, ধর্মের শিক্ষা সম্পর্কেও সংক্ষেপে বলা আছে। কিন্তু প্রার্থনার বিস্তারিত নিয়ম কিছু নেই। তাছাড়া প্রার্থনার মধ্যে ধর্মগ্রন্থ থেকে পাঠ অপরিহার্য। সুতরাং ধর্মগ্রন্থের কিছু মুখস্থ না থাকলে তো প্রার্থনাই হয় না’।
তার আব্বার বইয়ের কথা শুনে ফ্রান্সিসের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল। তার আম্মা থামতেই বলল, ‘সেই বইটি কোথায় আম্মা?’
‘তোর আব্বার বাক্সে আছে’।
‘দেখাও না আম্মা’।
‘দেখতে চাইলে কাপড় ছেড়ে পরিস্কার কাপড় পরে আসতে হবে এবং ওজু করতে হবে’।
‘ওজু কি?’
‘তোর দাদীর কাছে এটা শুনেছি। ‘ওজু’ মানে হাত, মুখ, মাথা ও পা পানি দিয়ে ধোয়া। এর একটা নিয়ম আছে যা আমরা জানি না। আমরা এসব এমনি ধুয়ে বইটি হাতে নিয়েছি’।
‘ঠিক আছে, আমি কাপড় বদলে এবং হাত মুখ মাথা ধুয়ে আসছি’।
ফ্রান্সিসের মা’ও উঠে গেল কাপড় বদলাতে এবং ওজু করতে।
বাক্সের ভেতর আরেকটি সুন্দর কাগড়ে মুড়ে বইটি রাখা। ফ্রান্সিসের মা মরিয়ম মার্গারেটা বইটি হাতে তুলে নিয়ে টেবিলে বসল। টেবিল ঘিরে আরও চেয়ারে বসল ফ্রান্সিস এবং জিনা।
ফ্রান্সিসের মা কাগজের মোড়ক খুলে চুমু খেল বইটিকে।
‘বইটি ধরার জন্যে পরিস্কার কাপড় এবং ওজু করা শর্ত কেন আম্মা?’
‘এই বইটি ধরার জন্যে এ সব শর্ত নেই। বইটি প্রাথমিক ধরণের, খুব গুরুত্বপূর্ণ বই নয়। কিন্তু এই বইতে আমাদের ধর্মগ্রন্থের ভাষায় ধর্মগ্রন্থের হরফে, ধর্মগ্রন্থের কিছু উদ্ধৃতি আছে। ধর্মগ্রন্থ এবং ধর্মগ্রন্থের উদ্ধৃতি যুক্ত বই স্পর্শ করতে হলে ঐ সব শর্ত পালন করতে হয়’।
বইটির পাতার সংখ্যা ৫০-এর মত হবে। নাম, ‘বেসিক বিলিফস ইন ইসলাম’।
বইটির শিরোনাম-পাতার পরই প্রথম পাতার শুরু আরবীতে ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’ লেখার মাধ্যমে। তারপর আরবীতেই দুই লাইন আল্লাহর প্রশংসা এবং নবী (স)-এর প্রতি শান্তি বর্ষণমূলক দোয়া লেখা রয়েছে আরবীতে।
ফ্রান্সিসের মা লেখাগুলোকে চুমু খেয়ে বলল, ‘এগুলো ধর্মগ্রন্থের অংশ’।
ফ্রান্সিসও চুমু খেল ধর্মগ্রন্থের উদ্ধৃতিতে। চুমু খেতে গিয়ে তার চোখ ছল ছল করে উঠল।
গোটা বইতে আরও ধর্মগ্রন্থের উদ্ধৃতি আছে, সেগুলোও দেখাল ফ্রান্সিসকে।
‘উদ্ধৃতিগুলো তো পড়তে পার না আম্মা’।
‘না ফ্রান্সিস, তোর আব্বাও পারত না। প্রথমেই যে উদ্ধৃতি দেখছ, তোমার আব্বাই বলেছেন মুসলমানদের প্রত্যেক কাজের আগেই এটা পড়তে হয়’।
‘কথাটা কি আম্মা?’
‘আমি জানি না। ইংরেজিতে অর্থ লেখা আছে’।
‘আমি তো ইংরেজী জানি না, তুমি তো কিছু জান। পড়ে শোনাও না আম্মা’।
‘তোর আব্বার কাছে অল্প অল্প শিখেছি’। বলে ফ্রান্সিসের মা কোন রকমে বিসমিল্লাহর অর্থ বলে দিল।
‘সুন্দর কথা তো আম্মা। ধর্মগ্রন্থের ভাষা জানি না, এই কথা ফরাসী ভাষায় বললে হবে না?’
‘আমি জানি না বাছা। ধর্মের কোন নিয়ম কানুন বলা তো আমার সাজে না’।
‘আমার মনে হয় আমাদের ওল্ড ফাদার তোমাদের ধর্মগ্রন্থের এই উদ্ধৃতি পড়তে পারবেন’। বলল জিনা।
‘জিনা ঠিক বলেছে আম্মা। ফাদার আজ বলেছেন, তিনি আমাদের ধর্মগ্রন্থ পড়েছেন’। বলল ফ্রান্সিস সোৎসাহে।
‘কিন্তু বইটা তো তোর আব্বা অন্য কারও হাতে দিতেন না। আমিও দিতে পারবো না’। বলল ফ্রান্সিসের মা।
ফ্রান্সিসের মা বইটির পাতা উল্টিয়ে যাচ্ছিল। হঠাৎ একটা সুন্দর রঙীন ছবি বেরিয়ে পড়ল।
‘কিসের ছবি আম্মা ওটা?’ ফ্রান্সিস অনেকটা হুমড়ি খেয়ে পড়ল ছবির উপর।
‘মুসলমানদের গীর্জা অর্থাৎ মুসলমানদের কয়েকটা বিশ্ববিখ্যাত মসজিদের ছবি দেয়া আছে বইতে। প্রথম এই মসজিদটা মক্কার কা’বা শরীফ’।
‘মক্কার কা’বা শরীফ? যেখানে হজ্জ করতে হয়, যেখানে নবী (স)-এর জন্ম?’
‘হ্যাঁ, এ সেই’।
ফ্রান্সিস গভীর আবেগে চুমু খেল কা’বা শরীফকে এবং বলল, ‘মদিনার মসজিদ নেই আম্মা?’
‘হ্যাঁ আছে’। বলে পাতা উল্টাল ফ্রান্সিসের আম্মা। পরের পৃষ্ঠাতেই মসজিদে নব্বী।
ফ্রান্সিস এ মসজিদকেও চুমু খেল এবং বলল, ‘আম্মা এখানেই আমাদের নবী (স)-এর কবর’। বলতে গিয়ে আবেগে ভারি হয়ে উঠল ফ্রান্সিসের গলা।
‘তুই এত কথা জানলি কোত্থেকে, কেমন করে?’ বলল ফ্রান্সিসের মা।
‘মক্কার কা’বা শরীফ-এর নাম শুনেই বহু আগের এ কথাগুলো হঠাৎ আমার মনে পড়ে গেছে মা। চার বছর আগে তুরস-এর একটা লাইব্রেরীতে একটা বই দেখেছিলাম। তার নাম ছিল ‘পূর্বদেশীয় ধর্মীয় স্থানসমূহ’। অনেক সময় ধরে সেদিন লাইব্রেরীতে বসেছিলাম। সেই সময়ে এ দু’টি স্থানের বিবরণও পড়েছিলাম। কিন্তু তখন এতটা বুঝিনি’।
শেষ পাতায় গিয়ে ফরাসী ভাষায় হাতের লেখা কয়েকটা বাক্যের প্রতি এক সাথেই গিয়ে নজর পড়ল ফ্রান্সিস এবং তার মা’র।
লেখাটা ছিল একটা নাম। নামটা হলো, ‘ফ্রান্সিস আবু বকর’।
লেখাটা পড়েই ফ্রান্সিস বলল, ‘এটা তো আব্বার হাতের লেখা’। কি লিখেছেন আম্মা?’
লিখাটা দেখেই আনমনা হয়ে পড়েছিল ফ্রান্সিসের না মরিয়ম মার্গারেটা। ধীরে ধীরে তার চোখ বুজে গিয়েছিল।
ফ্রান্সিস এবং জিনা কারোই তা নজর এড়ালো না।
‘কি হলো আম্মা? অসুস্থবোধ করছ?’ ফ্রান্সিস জিজ্ঞাসা করল উদ্বিগ্ন কন্ঠে।
চোখ খুলল ফ্রান্সিসের মা। তার চোখ দু’টো ভারি। বলল, ‘না কিছু হয়নি বেটা। লেখাটা আমাকে অনেক দুর অতীতে টেনে নিয়ে গিয়েছিল’।
থামল ফ্রান্সিসের মা। মাথা নিচু করে একটু দম নিল যেন। তারপর আবার শুরু করল, ‘তখন তুই আমার পেটে। বইটা পড়া যেদিন শেষ করল তোর আব্বা বলল, আমাদের যদি ছেলে সন্তান হয়, তাহলে তার নাম রাখব ‘ফ্রান্সিস আবুবকর’। বলে তিনি নামটা এখানে লিখে রাখলেন। তুই হওয়ার পর এই নামই তোমার রাখা হয়’।
‘আমার নাম তাহলে ফ্রান্সিস আবুবকর?’
‘হ্যাঁ বেটা। স্কুলে যখন তোকে দিলাম, তারা ‘আবুবকর’ বাদ দিয়ে লিখল ‘বুবাকের’। সেই থেকে তুই হয়ে গেছ ফ্রান্সিস ‘বুবাকের’। নামটা রেখেও আমরা ঐ নামে ডাকতে পারিনি’।
‘কেন?’
‘আবুবকর নামটা এতটাই পরিচিত যে, এখানকার স্কুল-কলেজ একে ভালো চোখে দেখে না। তাছাড়া এই নামে তুই পরিচিত হলে, আমরা ভয় করেছি, তোর কোন ক্ষতি হতে পারে। বিপদে পড়তে পারিস মাঝে মাঝেই’।
‘আবুবকর নামটা পরিচিত কেন আম্মা?’
‘আবুবকর হলেন আমাদের নবীর সর্বশ্রেষ্ঠ সাথী। নবী (স)-এর মৃত্যুর পর তিনিই নবীর প্রতিনিধি বা ‘ধর্মনেতা’র পদে আসীন হন এবং ইসলামী জগতের শাসকও হন তিনি। তাঁর কাছেই রোমান সম্রাটের বাহিনী প্রথম পরাজয় বরণ করে এবং বিশাল এলাকাও হারায় তার কাছে’।
ফ্রান্সিস-এর চোখ দু’টি উজ্জ্বল হয়ে উঠল। গর্বে ভরে উঠল তার মন। নবীর সর্বশ্রেষ্ঠ সাথী এবং এতবড় মহান লোকের নামে তার নাম।
ফ্রান্সিস সোজা হয়ে বসে বলল, ‘এই নাম রাখার জন্যে তোমাকে এবং আব্বাকে ধন্যবাদ আম্মা’।
তারপর জিনার দিকে ফিরে বলল, ‘নামটা পছন্দ হয়? আমাকে কিন্তু এই নামেই ডাকবে’।
‘বড় নাম শুধু নিলে হবে না, বড় কাজও করতে হবে’। বলল জিনা।
‘তুমি সে বড় কাজের সাথী হবে’।
জিনার মুখ লাল হয়ে উঠল লজ্জায়। উঠে দাঁড়াল সে। বলল, ‘চাচী আম্মা, আমি আসি’। বলে ঘুরে দাড়িয়ে হাঁটা শুরু করল।
কথাটা বলে কিন্তু ফ্রান্সিস জিব কেটেছিল। তার মা’র সামনে জিনাকে এই কথা বলা ঠিক হয়নি। কথাটা বলে লজ্জা পেয়েছিল ফ্রান্সিস নিজেও।
‘জিনাকে এভাবে যখন তখন রাগাও কেন?’ বকুনির স্বরে বলল ফ্রান্সিসের মা।
‘জিনা শোন, শোন জিনা’। বলে ডাকতে ডাকতে ফ্রান্সিসও বেরিয়ে এল ঘর থেকে।
ঘর থেকে বেরিয়ে জিনাকে দেখতে পেল না ফ্রান্সিস। ভাবল, নিশ্চয় দৌড়ে পালিয়েছে। বাড়ির গেটে গিয়েও দেখতে পেল না তাকে। হঠাৎ তার মনে হল জিনা নিশ্চয় লুকিয়েছে।
ফিরতে যাবে এমন সময় পিঠে এসে একটা কিল পড়ল। ফিরে দাড়ানোর আগেই দেখল ছুটে পালাচ্ছে জিনা। চিৎকার করে বলছে, ‘আজকের মত মাফ করে দিলাম’।
‘কিলটা তাহলে কিন্তু বাড়তি হয়ে থাকল। পিঠটা রেডি রেখ’। চিৎকার করে বলল ফ্রান্সিস।
‘ঠিক আছে’।
ছুটে চলে গেল জিনা।
যতক্ষণ তাকে দেখা গেল তাকিয়ে রইল ফ্রান্সিস। তার চোখে স্বপ্ন। সুন্দর, পবিত্র এক স্বপ্ন।

Top