১৭. ব্ল্যাক ক্রসের কবলে

চ্যাপ্টার

রাত তখন নয়টা পেরিয়ে গেছে। প্যারিসে জুনের আরামদায়ক রাত।
ডোনা বসে আছে তার টেবিলে। পাশের জানালা খোলা। বাগান, করিডোর পেরিয়ে শোন নদীর স্নিগ্ধ বাতাস এসে প্লাবিত করছে ঘরকে।
ডোনার রেশমের মত সোনালী চুল সেই বাতাসে বার বার এসে আছড়ে পড়ছে দানিয়ুবের মত নীল চোখ এবং নীলাভ-শুভ্র গন্ডের উপর।
কিন্তু কোন দিকে ভ্রুক্ষেপ নেই ডোনার। তার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম।
চোখ থেকে নেমে আসা অশ্রুর ধারায় গন্ড ভেজা। চোখ দু’টি তার লাল। অনেক কেঁদেছে সে। কিন্তু এত কান্নার পরেও বুক ভরা রয়েছে তার ক্ষোভে, আর সমগ্র সত্তা জুড়ে রয়েছে যন্ত্রণার উত্তাপ। সেই উত্তাপেই ঘামছে সে।
বাতাসে উড়ে আসা কয়েকটা সোনালী চুল অশ্রুতে ভিজে গিয়ে গন্ডের সাথে লেপ্টে গেছে। স্থির বসে থাকতে পারছে না ডোনা। মাঝে মাঝে উঠে পায়চারি করছে।
বারবারই একটা কথা ডোনার মনে তীরের মত এসে বিদ্ধ হচ্ছে। আহমদ মুসা প্যারিসে এসেছে, কিন্তু তাকে জানায়নি, সে জানতে পারেনি। ক্লাউডিয়া না বললে ডোনা জানতেই পারত না আহমদ মুসার ফ্রান্সে আসার কথা। ক্লাউডিয়ার বাবাকে নিয়ে ক্লাউডিয়ার বাসায় যেতে পেরেছে কিন্তু তার কাছে আসতে পারেনি কেন? ক্লাউডিয়ার কাছ থেকে শুনতে হবে কেন তাকে আহমদ মুসার কথা? ফ্রান্সে আসবে কিন্তু তাকে আগে জানাবে না কেন?
এই ধরণের শত প্রশ্ন এসে ক্ষত-বিক্ষত করছে ডোনার কোমল হৃদয়টাকে। আহত হৃদয়ের রক্তটাই বেরিয়ে আসছে চোখ দিয়ে অশ্রু হয়ে।
আহমদ মুসা সম্পর্কে ক্লাউডিয়ার প্রশংসার কথাও অন্তরে তার তীর ফুটাচ্ছে। ক্লাউডিয়ার মত কোন সুন্দরী তরুণীর কাছে আহমদ মুসার কোন প্রশংসা সে শুনতে চায় না।
আহমদ মুসা বড় কাজ নিয়ে ফ্রান্সে এসেছে, একথা সে ক্লাউডিয়ার কাছে শুনেছে। কিন্তু কাজ যত বড়ই হোক, ডোনার সে খোঁজ নেবে না, দেখা করবে না ডোনার সাথে?
আবার ক্ষুব্ধ মন বলে উঠছে, দেখা করবে কেন ডোনার সাথে? ডোনা তার কে? কেউ তো নয়।
এই কথা ভাবতে গিয়ে অশ্রু উথলে উঠল দুই চোখে। বিছানায় নিজেকে ছুড়ে দিয়ে বালিশে মুখ গুজে পড়ে রইল ডোনা।
ডোনা ক্লাউডিয়ার বন্ধু। দু’জন এখন একই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। দু’জনই তুখোড় ডিবেটার ও টেনিস প্লেয়ার। এই হিসেবে দু’জনের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। এই সূত্রেই ক্লাউডিয়া তার জীবনের অদ্বিতীয় একটা ঘটনা হিসেবে আহমদ মুসার কথা গল্প করেছে ডোনার কাছে।
‘ডোনা’ ‘ডোনা’ বলে ডাকতে ডাকতে তার আব্বা মিঃ চার্লস প্লাতিনি ডোনার ঘরে প্রবেশ করল।
ঘরের মাঝখানে এসে দাড়িয়েছে ডোনার আব্বা।
ডোনা তখনও বালিশে মুখ গুজে পড়েছিল। বালিশে মুখ ঘষে ডোনা মুখ তুলল। উঠে বসল সে।
চোখ দু’টি লাল। অশ্রুতে ভেজা। গন্ডেও অশ্রুর দাগ। বেশ কিছু ভেজা চুল গন্ডের উপর তখনও লেপ্টে আছে।
‘কি হয়েছে ডোনা?’ বলে উদ্বিগ্ন মিঃ প্লাতিনি- এগিয়ে এসে ডোনার পাশে তার খাটে বসল।
‘কিছু হয়নি আব্বা’। মাথার রুমাল দিয়ে চোখ ভালো ঘসে বলল ডোনা।
ডোনা এখন মাথায় রুমাল পরে। বিশ্ববিদ্যালয়েও। এ নিয়ে আপত্তি উঠেছিল। কিন্তু কোন বাধা মানেনি। বিশ্ববিদ্যালয় অবশেষে মেনে নিয়েছে। এটা ডোনার বড় বিজয়। কিন্তু ডোনা এ বিজয়কে আহমদ মুসার বিজয় বলে মনে করে। এই রুমাল বা হেড ড্রেস আহমদ মুসাই তার মাথায় তুলে দিয়েছে। গোটা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরোধিতা আহমদ মুসার কাছে পরাজিত হয়েছে। কিন্তু ডোনা এসব কথাকে তুড়ি মেড়ে উড়িয়ে দিয়ে বলেছে, আমার মূল এবং মৌলিকতা অবশ্যই আছে, আমার পরিবার ফ্রান্সের সমাজ ও ইতিহাসের একটা মৌল অংগ। তাই মৌলবাদী হতে আমি রাজী।
ডোনার পিঠে হাত বুলিয়ে তার আব্বা বলল, ‘আমার শক্ত মা ডোনা বুঝি এমনিতেই কাদে?’
‘আমার খুব খারাপ লাগছে আব্বা’। বলে দু’হাতে মুখ ঢাকল।
‘কেন কি হয়েছে?’
‘ঘটনা ছোট, কিন্তু আমার খারাপ লাগছে’।
‘কি ঘটনা?’
‘ক্লাউডিয়ার কাছে শুনলাম, আহমদ মুসা এসেছে। কিন্তু সে আমাকে….’ কথা শেষ করতে পারলো না ডোনা। আরো রুদ্ধ হয়ে কন্ঠ তার থেমে গেল।
‘জানায়নি, এই তো! পাগল মেয়ে। তার কথাও তো ভাবা দরকার, জানাতে পারেনি কোন তাও তোমার ভাবা প্রয়োজন’।
‘আমাদের প্যারিসের ঠিকানা না জানতে পারেন, কিন্তু গ্রামের বাড়ি মন্ট্রেজুর ঠিকানা ও টেলিফোন উনি জানেন। ফ্রান্সে আসার আগেও তিনি জানাতে পারতেন’।
‘তুমি তাকে হৃদয় দিয়ে দেখেছ, মাথা দিয়ে চেননি মা। সে শাটল কর্কের মত। সে তো স্থির হবার সময়ই পায় না। তার উপর অবিচার করো না’।
একটু থামল ডোনার আব্বা। তারপর বলল, ‘ওর কিছু খারাপ খবর আছে মা’।
‘কার খারাপ খবর? আহমদ মুসার? কি খবর, কি হয়েছে?’ উদ্বেগ-রুদ্ধ কন্ঠে বলল ডোনা। মুহুর্তে অন্ধকার হয়ে গেল তার মুখ।
‘আজ এক অনুষ্ঠানে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রদুতের সাথে দেখা হয়েছিল। আমি তাকে আহমদ মুসার কথা জিজ্ঞাসা করেছিলাম। তিনি জানালেন যে, আহমদ মুসা এসেছেন কিন্তু নিখোঁজ হয়ে গেছেন। তাকে খুব উদ্বিগ্ন মনে হলো। তিনি বললেন, মিঃ ক্লাউডের ওখান থেকে আহমদ মুসা সকালে দুতাবাসে পৌছেন। সারাদিন তিনি বিশ্রাম নেন এবং ব্ল্যাক ক্রস সম্পর্কে পড়াশুনা করেন। সেদিন রাত ১২টায় তিনি বেরিয়ে যান ব্ল্যাক ক্রস-এর একটা ঘাটির উদ্দেশ্যে। আর….’
বাধা দিয়ে ডোনা বলল, ‘কেউ তার সাথে যায়নি’।
‘বলছি, এ ধরণের অনুসন্ধানমূলক অপারেশনে সে কাউকে সাথে নেয় না। সেদিনও কাউকে সাথে নিতে রাজী হয়নি’।
একটু হাসল মিঃ প্লাতিনি।
‘আর তিনি ফিরেননি?’ অধৈর্য্য ও উদ্বেগের সাতে ডোনা বলল।
‘না আর ফিরেননি’।
‘ঐ ঘাটিতে কেউ খোজ নেন নি?’
‘নিয়েছে। ভোর রাতে দুতাবাসের লোক সেই ঘাটিতে গিয়ে তিনটি লাশ দেখেছে এবং পেয়েছে পুলিশকে। কিন্তু আহমদ মুসা সম্পর্কে কিছুই জানতে পারেনি’।
‘ঐ লাশ কাদের আব্বা?’
‘ব্ল্যাক ক্রস-এর লোকদের। সেই রাত থেকে আহমদ মুসা নিখোজ’।
ডোনা ঠোট কামড়ে তার পিতার কাধে মুখ গুজল। তার চোখ ছল ছল করছে, কাঁপছে তার ঠোঁট।
মিঃ প্লাতিনি মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, ‘চিন্তার কথা মা, ব্ল্যাক ক্রস দুনিয়া ব্যাপী খৃষ্টানদের স্বার্থ রক্ষা করছে। এই ক্ষেত্রে তারা করতে পারে না এমন কোন কাজ নেই। প্রকৃতপক্ষে ব্ল্যাক ক্রস রেডক্রস-এর বিপরীত একটা খুনি সংগঠন’।
‘ওদের সাথে আহমদ মুসা কেন সংঘাতে জড়িয়ে পড়ল?’ ভাঙা গলায় বলল ডোনা।
ডোনার আব্বা মিঃ প্লাতিনি ওমর বায়ার ঘটনা ডোনাকে সব জানিয়ে বলল, ‘ব্ল্যাক ক্রস-এর হাত থেকে ওমর বায়াকে উদ্ধার করার জন্যেই আহমদ মুসা ফ্রান্সে ছুটে এসেছে’।
ডোনা কিছুক্ষণ নীরব থেকে ধীরে ধীরে বলল, ‘তুমি কি ভাবছ আব্বা, ব্ল্যাক ক্রস কি আহমদ মুসাকে আটক করেছে, না…’
কথা শেষ করতে পারলো না ডোনা। কন্ঠ রুদ্ধ হয়ে গেল তার।
‘চিন্তা করো না মা। ঈশ্বর তাকে রক্ষা করবেন। সে শুধু একজন মজলুম মানুষকে নয়, একটা মজলুম জাতিকে রক্ষার জন্যে ঝাপিয়ে পড়েছে’।
একটু থামল মিঃ প্লাতিনি। তারপর বলল, ‘আহমদ মুসা অনেক বড়। সে ব্ল্যাক ক্রস-এর চেয়েও অনেক বড় বড় শক্তির মোকাবিলা করেছে’।
এই সময় পাশের টিপয়ে রাখা কর্ডলেস টেলিফোন সংকেত দিয়ে উঠল। মিঃ প্লাতিনি টেলিফোন তুলে নিল হাতে।
কথা বলল টেলিফোনে। বলল ঠিক নয় শুনলই শুধু। শুনতে গিয়ে মাঝে মাঝেই তার ভ্রু কুচকে গেল এবং চিন্তা নতুন রেখা ফেলল তার কপালে।
গম্ভীর মুখে টেলিফোনটা রেখে বলল মিঃ প্লাতিনি, ‘ফিলিস্তিন দুতাবাসের টেলিফোন মা’।
মাথা তুলে উদগ্রীব হয়ে উঠল ডোনা।
‘না মা ভাল খবর নেই। তবে খবরগুলো আমার আশাব্যঞ্জক মনে হচ্ছে’।
‘কি খবর আব্বা?’ ডোনার চোখে আশার আলো।
‘দুতাবাস জানাল, পশ্চিম ফ্রান্সে কয়েকটা বড় ঘটনা ঘটেছে। লোরে নদীতে এক জাহাজে দশটি লাশ পাওয়া গেছে। ঐ দিনই নানতেজ শহরের একটি বাড়ীতে দুটি লাশ পাওয়া গেছে এবং ঐ দিন সুর লোরের পর্যটন স্পটে একটা গ্রেনেড বিধ্বস্ত গাড়িসহ ৬টি লাশ পাওয়া গেছে। মনে করা হচ্ছে গাড়ি বিধ্বস্ত হওয়ায় যারা মারা গেছে তাদের সংখ্যা তিন হবে’।
‘কিন্তু এগুলোর সাথে…’।
‘বলছি, ফিলিস্তিন দুতাবাস অনুসন্ধান করে জেনেছে সবগুলো লাশই ব্ল্যাক ক্রস-এর। তারা মনে করছে, আহমদ মুসার হাতেই এ ঘটনাগুলো ঘটতে পারে’।
ডোনার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বলল, ‘ওদের ধারণাকে ঈশ্বর সত্য করুন। কিন্তু ও যোগাযোগ করছে না কেন তাহলে?’
‘সে কি অবস্থায় আছে, সেটা তো আমরা জানি না মা। ঘটনাগুলো প্রমাণ করে, আহমদ মুসা ব্ল্যাক ক্রস-এর সাথে কঠিন সংঘাতে জড়িয়ে গেছে। দূতাবাস আরও জানাল, তাদের বিশেষজ্ঞরা ঘটনাগুলো দেখেছে, জাহাজের হত্যাকান্ড আগে ঘটেছে, তারপর নানতেজ শহরের এবং তারপর সুর লোকের। এই বিশ্লেষণ থেকে বলা হচ্ছে, ঈশ্বর করুন আহমদ মুসা ঐসব ঘটনার সাথে জড়িত থাকলে তিনি লোরে নদী থেকে সুর লোরের দিকে এসেছেন বা আনা হয়েছে’।
থামল মিঃ প্লাতিনি।
‘তারপর কি আব্বা?’
‘এটাই বিস্ময়ের। সুর লোরের পর ঘটনা থেমে গেছে। ফিলিস্তিন, মধ্য এশিয়া প্রজাতন্ত্র, সৌদি আরব, মিন্দানাও দূতাবাসের লোকেরা এলাকা সফর করেছে, কিন্তু কোন সুত্র তারা খুজে পায়নি’।
আবার মুখ অন্ধকার হয়ে গেল ডোনার।
ভাবছিল ডোনার আব্বা মিঃ প্লাতিনি।
অনেকক্ষণ পর ডোনা মুখ তুলে বলল, আমি সুর লোরে একবার যেতে চাই’।
‘কেন মা?’
‘আমার মন বলছে আমি ওখানে ওর কোন চিহ্ন খুজে পাব’। ডোনার শেষের কথা ভেঙ্গে ভেঙ্গে বেরিয়ে এল। তার দু’চোখ থেকে ঝর ঝর করে নেমে এল অশ্রু।
মিঃ প্লাতিনি মেয়েকে কাছে টেনে নিয়ে পিঠে হাত বুলিয়ে সান্ত্বনা দিয়ে বলল, ‘ঠিক আছে যাব মা। ওদিকে অনেকদিন যাইনি। আমাদের এস্টেটটাও দেখে আসা হবে। কয়েকদিন সেখানে থাকতেও পারি আমরা’।
ডোনা চোখ মুছে বলল, ‘আব্বা, ও কি কোনদিন স্থির হবে না? একের পর এক বিপদের মুখে সে ঝাপিয়ে পড়বেই? একজন মানুষকে উদ্ধারের জন্যে ছুটে আসবে চীন থেকে ফ্রান্সে?’ আবেগে কন্ঠস্বর কাঁপছিল ডোনার।
‘পৃথিবীতে অনেক মানুষ আসেন যারা নিজের জন্যে জন্মগ্রহণ করেন না মা। যারা নিজের চোখের পানিতে ভেসেও অন্যের চোখের পানি মুছে দেন’।
একটু থামল। একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলল মিঃ প্লাতিনি। তারপর বলল, ‘আহমদ মুসার আরও খারাপ খবর আছে মা’।
আহত হরিণীর মতই চমকে উঠে মুখ তুলল ডোনা। অশ্রুতে লেপটে যাওয়া তার মুখ। একরাশ প্রশ্ন তুলে ধরল সে চোখে। মুখে কিছুই বলল না।
আবার কথা বলল ডোনার আব্বাই। বলল, ‘সিংকিয়াং-এ আহমদ মুসারই জয় হয়েছে। কিন্তু তার স্ত্রীকে বাঁচাতে পারেনি, জীবিত উদ্ধার করতে পারেনি। নিহত হয়েছে গুলীবিদ্ধ হয়ে’।
‘কি বলছ আব্বা, আহমদ মুসা তো এই আঘাত সইতে পারবে না’। বলে দু’হাতে মুখ ঢাকল ডোনা।
‘আহমদ মুসা শুধু নয়, এই আঘাত সকলকেই কাদিয়েছে। ফিলিস্তিন রাষ্ট্রদূত এই খবর দিতে অশ্রু রোধ করতে পারেন নি। সবচেয়ে বেদনার কি জান, বিয়ের পর দু’জনের আর সাক্ষাত হয়নি। বিয়ের আসর থেকে আহমদ মুসা চলে এসেছিল ককেশাস, সেখান থেকে স্পেন। শেষের ইতিহাস তো আমরা জানি’।
থামল মিঃ প্লাতিনি।
কোন কথা এল না ডোনার কাছ থেকে।
দু’হাতে মুখ ঢেকে বসেছিল ডোনা। কাঁপছিল তার শরীর। আঙুলের ফাঁক দিয়ে গড়িয়ে পড়ছিল অশ্রু।
মিঃ প্লাতিনি মেয়েকে সান্ত্বনা দিয়ে বলল, ‘আমি শুনেছি, আহমদ মুসা মেইলিগুলিকে হারিয়ে শিশুর মত কেদেছে কিন্তু ভেংগে পড়ে নি সে। কর্তব্যের ডাকে স্ত্রীর লাশ নিয়েই চলে এসেছিল মধ্য এশিয়ায়। তারপর ডুবে গিয়েছিল কাজের মধ্যে’।
‘আব্বা, ওর এই কাজ নিজেকে আড়াল করার একটা কৌশল’। মুখ থেকে হাত নামিয়ে মাথা সোজা করে বলল ডোনা।
‘হতে পারে। তবে এই গুণ দূর্লভ মা’। বলে ডোনার আব্বা মিঃ প্লাতিনি উঠে দাড়াল। বলল, ‘মা তুমি তৈরী হয়ে নিও। আমরা কাল সকালেই সুর লোরের দিকে যাত্রা করতে পারি।
বেরিয়ে গেল ডোনার আব্বা।
ডোনা শুয়ে মুখ গুজল বালিশে।
তার হৃদয়ে ঝড় বইছে। বিধ্বস্ত বুক আহমদ মুসার সামনে সে গিয়ে দাড়াবে কিভাবে। ডোনাকে দেখে তার হৃদয়ের ঘাটা আরও যন্ত্রণাদায়ক হয়ে উঠবে না? যদি ঘুর্নাক্ষরেও সে ভাবে যে ডোনা তার প্রিয়তমার প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল, তাহলে আমি দাঁড়াব কোথায়? কি করে বুঝাব তাকে যে, ডোনার হৃদয়ে বিন্দুমাত্রও স্বার্থ চিন্তা ছিল না। মেইলিগুলি ভাবীর বিষয়টা জানার পর ডোনা একবারের জন্যেও আহমদ মুসাকে ফ্রান্সে থাকতে বলেনি। সমগ্র অন্তর দিয়েই তাদের সুখি দেখতে চেয়েছে। হ্যাঁ, ডোনা চেয়েছে আহমদ মুসা ফ্রান্সে আসুন। কিন্তু সেটা ছিল হৃদয়ের অপ্রতিরোধ্য আবেগের একটা অর্থহীন চাওয়ারই প্রকাশ।
আবার ভাবে ডোনা, আহমদ মুসার মত সুন্দর সুবিবেচক কাউকে সে দেখেনি। ওর চেয়ে নরম হৃদয়ও ডোনার চোখে পড়েনি। তিনি ডোনার প্রতি অবিচার করবেন না। বুঝবেন তিনি ডোনাকে।
পাশ ফিরল ডোনা।
দেখল ঘড়িতে দশটা বাজে।
উঠে বসল সে।
সফরের ব্যাগটা রাতে গুছিয়ে রাখাই ভাল। সকালে উঠেই যাত্রা করা যাবে।

দ্বিজন গ্রাম।
| ← Previous | | | Next → | | সম্পুর্ণ বই এক পেজে »

Top