১৮. ব্ল্যাক ক্রসের মুখোমুখি

চ্যাপ্টার

আহমদ মুসা একটা বই নাড়াচাড়া করছিল আর ভাবছিল এই সব কথা। দরজায় নক হলো।
আহমদ মুসা মাথা তুলে একবার দরজার দিকে চাইল। তারপর উঠে গিয়ে দরজা খুলল।
দরজায় দাঁড়িয়ে ডোনার আব্বা ও ডোনা।
‘আসুন’ বলে আহমদ মুসা দরজাটা ঠেলে দরজার পাশে কিছুটা সরে এল।
সবাই এসে বসল সোফায়।
ডোনার আব্বা মি. প্লাতিনির চোখে-মুখে কিছুটা উত্তেজনার ছাপ।
বসেই বলে উঠল, ‘গাড়ি নিয়ে ঘটনা সাংঘাতিক পর্যায়ে যাচ্ছে’।
‘এমনটাই ঘটার কথা। দয়া করে বলূন কি ঘটেছে?’ বলল আহমদ মুসা।
‘তুমি কি ঘটার কথা বলছ?’
‘আমাদের গাড়ির খোঁজ পাবার জন্যে ব্ল্যাক ক্রস একদম হন্যে হয়ে উঠবে’।
‘ব্ল্যাক ক্রস?’
‘জি। ঘটনা কি ঘটেছে আগে আপনি বলুন, আমি বলছি ঐ ব্যাপার!’
‘তোমার কথা মত ক্রেতার ছদ্মবেশে একজনকে পাঠিয়েছিলাম সেই সার্ভিস সেন্টারে। সে লোক গিয়ে গ্যারেজ কর্তৃপক্ষকে গাড়ির কথা বলতেই তারা তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠেছেন। বলেছেন, মশাই গাড়ি কেনার কথা আর বলবেন না। আমরা মহাবিপদে। একটা পার্টি এসেছিল গাড়ি কিনতে। ওরা গিয়েছিল গাড়ির মালিকের বাড়িতে। ঐ নামের গাড়িওয়ালা সেখানে কেউ থাকে না। ক্রুব্ধ ক্রেতারা এখন আমাদের ঘাড়ে এসে চেপেছে। গাড়ির মালিককে আমাদের খোঁজ করে দিতে হবে। এসব শুনে এসেছে আমাদের লোক। এখন আমাদের কি করণীয়?’
এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলল ডোনার আব্বা।
‘ঐ ক্রেতারা ব্ল্যাক ক্রসের লোক। গাড়ির মালিকের সন্ধানে ওরা হন্যে হয়ে উঠেছে’।
‘বুঝলে কি করে তুমি?’
‘সেদিন বিজ্ঞাপন দেখেই বুঝেছিলাম। আজ আপনি তথ্য দিলেন, তাতে আরও নিশ্চিন্ত হলাম’।
‘যদি তাই হয়, তাহলে গাড়িটা ঐভাবে ওখানে দিয়ে আমরা কি ঝামেলায় জড়িয়ে পড়লাম না?’
‘অজ্ঞাতসারে যে বিপদে আমরা জড়িয়ে পড়তাম, পরিকল্পিতভাবে আমরা সে বিপদের মুখোমুখি হয়েছি’।
‘অর্থাৎ’।
‘ব্ল্যাক ক্রসের হাত ফসকে ডুপ্লে বেরিয়ে যাওয়া, তার ওপর ডুপ্লের বাড়িতে সেদিন ব্ল্যাক ক্রসের তিনজন লোক নিহত হওয়া তাদের শক্তি ও মর্যাদাকেই শুধু আহত করেনি, তাদের গোপনীয়তার যে বৈশিষ্ট্য তাকেও হুমকির সম্মুখীন করেছে। সুতরাং ডুপ্লেকে তারা সন্ধান করবেই। আর ডুপ্লেকে খুঁজে পাওয়ার একটা সহজ পথ হলো আমাদের গাড়িটা খুঁজে বের করা। মানুষ লুকানো যায়, গাড়ি লুকানো যায় না। বুলেটে ফুটো হওয়া গাড়ি হয় আমরা বিক্রি করে দেব, নয়তো সার্ভিস সেন্টারে দেব মেরামতের জন্যে। আমার ধারণা প্যারিসের শুধু নয়, দেশের সবগুলো সার্ভিস সেন্টারে তারা চোখ রাখছে এবং বাড়তি ব্যবস্থা হিসেবে পত্রিকায় দিয়েছে ঐ বিজ্ঞাপন। যাতে বিক্রি করতে চাইলে, তারও সুযোগ যাতে তারা নিতে পারে’।
আহমদ মুসার ওপর নিবদ্ধ চোখ দু’টি উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে ডোনার আব্বার। বলল, ‘তুমি তো ঠিকই বলেছ আহমদ মুসা। আমাদের গাড়ি যখন সার্ভিস সেন্টারের লোকরা দেখে, তখন বলল, ‘গাড়ি আপনারা বিক্রি করতে চাইলে তাড়াতাড়ি বিক্রি হবে। আমাদের সেন্টারে একটা পক্ষ এসে বলে গেছে পেছনে ফুটো হওয়া এবং এ ধরণের ত্রুটিওয়ালা গাড়ির খবর কিংবা গাড়ির ঠিকানা যেন আমরা তাদের দেই। তারা এ ধরণের গাড়ি কিনতে আগ্রহী’। মধ্যস্থতার কমিশন হিসেবে তারা আগাম একটা ফান্ডও দিয়ে গেছে। সুতরাং তোমার কথা ঠিক যে, আমরা সজ্ঞানে এই পদক্ষেপ না নিলে অজ্ঞাতসারে এবং অপ্রস্তুতভাবে ওদের হাতে গিয়ে পড়তাম। তোমাকে ধন্যবাদ আহমদ মুসা’।
ডোনার মুগ্ধ দৃষ্টি আহমদ মুসার ওপর নিবদ্ধ। বলল, ‘আপনি ভবিষ্যৎকে এতটা নিখুঁতভাবে দেখতে পান কেমন করে? আপনি ভবিষ্যত গণনা জানেন?’
‘আল্লাহ ছাড়া ভবিষ্যৎ কেউ জানে না। ভবিষ্যৎ গণনার মত প্রতারণামূলক কাজ ইসলামে নিষিদ্ধ। আমি যেটা করি সেটা নিছক অনুমান। এই অনুমান সবক্ষেত্রে করা যায় না, সব সময় ঠিকও হয় না। যেমন দেখ, গাড়িকে কেন্দ্র করে এখন কি ঘটতে যাচ্ছে আমি বলতে পারবো না’।
‘এখন বল গাড়ি নিয়ে কি করব। গাড়ি কি নিয়ে আসব?’ বলল ডোনার আব্বা।
‘ব্ল্যাক ক্রস এটাই চাচ্ছে। মালিকের কেউ গাড়ি নিতে গেলে তার পিছু নিয়ে সে মালিকের সন্ধান লাভের চেষ্টা করবে’।
‘সর্বনাশ! এসব ঝামেলার চেয়ে গাড়ি ছেড়ে দেওয়াই ভালো’।
‘তার দরকার হবে না। আমি যাব’।
শুনেই ডোনার মুখ মলিন হয়ে গেল।
ভ্রু কুচকালো ডোনার আব্বা। বলল, ‘তুমি যাবে? কেন? কি দরকার?’
‘জনাব, ওমর বায়াকে উদ্ধারের জন্যে আমাকে ব্ল্যাক ক্রসের কাছে পৌছাতে হবে। এ পর্যন্ত ব্ল্যাক ক্রসকে যতবার পেয়েছি, হারিয়ে ফেলেছি। তাদেরকে জিজ্ঞাসাবাদের সুযোগ পাইনি। আমি ওদের কাছে পৌছাতে চাই’।
‘এ কাজে আরও লোকের সাহায্য নেয়া যায় না?’ গম্ভীর কন্ঠে বলল ডোনা।
‘অভিযানের মত কাজ হলে সাহায্য নেয়া যায়। অনুসন্ধানমুলক কাজে এমন সাহায্য খুব কাজে আসবে না।
‘কেন?’ প্রশ্ন করল ডোনা।
‘ধর, বর্তমান ক্ষেত্রে আমি যদি কারও সাহায্য নিতে চাই, তাহলে সেই লোককে গাড়ির কাছে পাঠাতে হবে কিন্তু আমার মনে হচ্ছে ব্ল্যাক ক্রস আজ যে পরিমাণ হন্যে হয়ে উঠেছে, তাতে সে লোক যতটুকু অগ্রসর হতে পারবে, তার চেয়ে অনেক বেশি বিপদগ্রস্থ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে’।
‘এ কথা কি আপনার ক্ষেত্রেও সত্য নয়?’ ডোনার কন্ঠে ক্ষোভ ও বেদনার একটা উচ্ছ্বাস ফুটে উঠল। তৎক্ষণাৎ উত্তর দিল না আহমদ মুসা। একটু পরে ধীরে ধীরে বলল, ‘কথাটা আমার ক্ষেত্রেও সত্য। কিন্তু মূল দায়িত্ব যিনি গ্রহণ করেন, তাকেই মূল কাজ করতে হয়। তা না হলে লাভের চেয়ে ক্ষতি বাড়ে’।
ডোনা উত্তরে কিছু বলল না। নিচু করল তার ম্লান মুখটি।
‘তোমার তাহলে পরিকল্পনা কি?’ বলল ডোনার আব্বা।
‘আমি সার্ভিস সেন্টারে যাব। সন্ধান করব ব্ল্যাক ক্রসের লোকদের’।
‘আমাদের কিছু করার নেই?’
‘আপনারা আমার জন্যে অনেক করেছেন। গাড়িটি ব্ল্যাক ক্রসের কাছে পৌছার আমার একটি সেতুবন্ধ’।
মুখ তুলল ডোনা। তার চোখে-মুখে বেদনা ও ক্ষোভের একটা বিস্ফোরণ। বলল, ‘আমাদের প্রাপ্য বোধ হয় আমাদের দিয়ে দিলেন?’
সংগে সংগে উত্তর এল না আহমদ মুসার কাছ থেকে। গম্ভীর হয়ে উঠল তার মুখ।
মুখ তুলেছিল আহমদ মুসা কিছু বলার জন্যে। কিন্তু আহমদ মুসা কিছু বলার আগেই ডোনার আব্বা বলল, ‘বাবা, এসব ব্যাপারে তোমার কথার উপরে আমাদের কোন কথা চলে না। তোমার ওপর পূর্ণ আস্থা আমাদের আছে। কিন্তু বাবা, ব্ল্যাক ক্রস তোমার ওপর ভীষণ ক্ষেপে আছে, এটাই আমাদের চিন্তার বিষয়’।
‘আমার যতটুকু সাধ্য, আমার ব্যাপারে আমি সতর্ক, বাকিটুকু আল্লাহর হাতে। তাঁর চেয়ে বড় নেগাহবান আর কেউ নেই’।
ডোনার আব্বা উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, ‘ঈশ্বর তোমার সহায় হোন। তুমি কখন বেরুচ্ছ?’
আহমদ মুসাও উঠে দাঁড়াল। বলল, ‘এখনি জনাব’।
ডোনার আব্বা মি. প্লাতিনি বের হয়ে গেল ঘর থেকে। তার সাথে ডোনাও বেরিয়ে গেল মাথা নিচু করে।
ওরা চলে গেলে আহমদ মুসা শুয়ে পড়ল। চোখ বন্ধ করে নিজেকে সঁপে দিল গভীর বিশ্রামের কোলে।
প্রস্তুত হয়ে বেরিয়ে এল আহমদ মুসা।
বেরুবার সময় ডোনাকে না দেখে তার ঠোঁটে এক টুকরো হাসি ফুটে উঠল। তার ঐ কথায় রাগ করেছে ডোনা। ডোনার কথা ভাবতে গিয়ে আহমদ মুসার মনে হলো বুকের কোথায় যেন ছোট্ট একটা অস্বস্তি বোধ করছে সে। মনে হচ্ছে ডোনা সামনে এসে দাঁড়ালে এ অস্বস্তি আনন্দে রূপান্তরিত হতো।
আহমদ মুসা মনের এ ভাবনাকে মন থেকে ঝেড়ে ফেলে সামনের পদক্ষেপ দ্রুত করল।
লিফট থেকে নেমেই আহমদ মুসা দেখতে পেল ডোনা দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
পরনে তার সাদা গাউন। মাথা ও গায়ে সাদা ওড়না পেঁচানো।
আহমদ মুসার পায়ের শব্দে তার দিকে ফিরে তাকাল ডোনা। বেদনা মাখা মুখ, সজল চোখ।
‘তুমি এখানে?’ ম্লান হেসে বলল আহমদ মুসা।
ঠেস দেয়া অবস্থা থেকে সোজা হয়ে দাঁড়াল ডোনা। দাঁড়াল মুখ নিচু করে। কোন কথা বলল না।
‘রাগ করার মত খুব বড় কথা বলেছি বুঝি আমি?’
মুখ তুলল ডোনা। তার সজল চোখ থেকে গড়িয়ে নেমে এল অশ্রু। বলল, ‘আমরা অনেক করেছি আপনার জন্যে, আর তো কিছু করার নেই’।
‘আমি কি সত্যই একথা বলতে চেয়েছি?’
ডোনা আহমদ মুসার কথায় কোন উত্তর না দিয়ে সামনের দিকে পা বাড়িয়ে বলল, ‘চলূন’।
‘কোথায়?’
‘অনেক করেছি তো, আরও কিছু করে আসি’।
বলে হাঁটতে শুরু করল ডোনা। তার ডান হাতে গাড়ির চাবি।
আহমদ মুসা ডোনার পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে বলল, ‘তোমরা যা করেছ, তোমাদের যা প্রাপ্য তাকি এর ধন্যবাদ দিয়ে শোধ করলাম! না শোধ করা যায়?’
‘তা জানি না। কিন্তু ঐ ধরণের ধন্যবাদ অনেক ক্ষেত্রে অসহনীয় বেদনার হতে পারে’। চোখ মুছে ডোনা বলল।
‘আমি তোমাকে ব্যথা দিতে চাইনি ডোনা’।
কথা বলতে বলতে তারা গাড়ি বারান্দায় এসে পৌছল।
গাড়ি বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে ডোনার গাড়ি।
ডোনা গাড়ির দিকে এগিয়ে গাড়ির দরজা খুলে ধরে বলল, ‘আসুন’।
কপাল কুঞ্চিত হয়ে উঠেছে আহমদ মুসার। আহমদ মুসা ডোনার মতলব বুঝতে পেরেছে। বলল, ‘ডোনা, তুমি তো জান আমি কোথায় যাচ্ছি’।
‘অবশ্যই জানি’। গম্ভীর কন্ঠ ডোনার।
‘এবং এও জান যে, তোমার কিংবা তোমাদের পরিবারের সাথে সম্পর্কিত কোন গাড়িতে আমি সেখানে যাব না’।
‘জানি’।
‘জানার পরেও বলছ আমাকে গাড়িতে উঠতে?’
‘এ গাড়ি এখন আমার পরিবারের গাড়ি নয়’।
‘অর্থাৎ’। বিস্ময়, আহমদ মুসার কন্ঠে।
‘আমি গাড়ির নাম্বার পাল্টে দিয়েছি। নতুন ব্লূ বুকও আছে’।
আহমদ মুসার মুখে হাসি ফুটে উঠল। বলল, ‘গোয়েন্দা কর্ম তাহলে শুরু করে দিয়েছ ডোনা?’
‘শিখছি’। মুখ ভার তখনও কাটেনি ডোনার।
আহমদ মুসা গাড়ির দরজা খুলে দাঁড়িয়ে থাকা ডোনার পাশে গিয়ে দাঁড়াল। গম্ভীর হয়ে উঠেছে আহমদ মুসার মুখ। ডাকল, ‘ডোনা’।
ধীর শান্ত কন্ঠ আহমদ মুসার। এ ডাকের মধ্যে একটা আবেগও ছিল।
ডোনা মুখ তুলল। চোখ রাখল আহমদ মুসার চোখে। ডোনার চোখে-মুখে লজ্জার একটা লাল প্রবাহের ঢেউ খেলে গেল। তার ঠোঁটে ফুটে উঠল হাসির একটা ছোট্ট কম্পন। বলল, ‘বুঝেছি আপনি কি বলবেন’।
‘কি বলব?’
‘বলবেন যে, ডোনা ওখানে যাওয়া কি তোমার জন্যে ঠিক?’
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘সত্যি ডোনা গোয়েন্দা কর্মে তুমি অনেক দূর এগিয়েছে’।
‘অযথা প্রশংসা করা হচ্ছে। এটা তো কমনসেন্সের ব্যাপার’। মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল ডোনা।
‘কমনসেন্সের ব্যাপার নয়, স্ট্রং কমনসেন্সের ব্যাপার। আর স্ট্রং কমনসেন্সই গোয়েন্দা কর্মের পুঁজি’।
‘ধন্যবাদ। উঠুন গাড়িতে’।
‘ডোনা, পাগলামি করো না। ওখানে তোমার যাওয়া হবে না’।
‘কেন?’ গম্ভীর কন্ঠ ডোনার।
‘এক অনিশ্চিত পরিস্থিতির মধ্যে আমি তোমাকে নিয়ে যেতে পারি না।
‘নিতে হবে না, আমার দায়িত্বে আমি যাব’।
‘দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিলেই কি তুমি যেতে পার?’
‘কেন পারি না? মেয়ে বলেই কি?’
অভিমান ক্ষুব্ধ একটা আবেগ এল ডোনার কন্ঠ থেকে।
‘ইসলামে মেয়েরা যুদ্ধ করতে পারে, যুদ্ধ করেছে। কিন্তু আমি কোন যুদ্ধে যাচ্ছি না। তাছাড়া তুমি শুধু মেয়ে নও, তুমি প্রিন্সেস মারিয়া জোসেফাইন লুই। আমি চাই না তোমাদের পরিবারটা কোন সংকটে পড়ুক’।
‘আমি প্রিন্সেস মারিয়া হতে চাই না। আমি সাধারণ মেয়ে ডোনা’।
‘তার পরেও তুমি প্রিন্সেস মারিয়া। নাম বদলালে তুমি বদলে যাবে না’।
‘আমি তো লড়াইয়ে নামছি না। আমি আপনাকে পৌছে দেব মাত্র’।
‘তারপর কি করবে?’
মারিয়া মুখ নিচু করল, কিছু বলল না।
আহমদ মুসার ঠৌঁটে ছোট্ট হাসি ফুটে উঠল। বলল, ‘তারপর তুমি গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করবে এই তো?’
‘কেন, লড়াইয়ে যোগ দিতে পারব না, অপেক্ষা করতেও কি পারবো না?’ কান্নায় রুদ্ধ হয়ে যাচ্ছিল ডোনার কন্ঠ।
একটা ঢোক গিলল, থেমে গিয়েছিল তার কথা। আবার শুরু করল। বলল, ‘আপনার ওপর আস্থা আছে আমার। কিন্তু তারপরও সব কাজ একা করা, সব কাজে একা যাওয়া ঠিক নয়’। গলাটা স্বাভাবিক করে তোলার চেষ্টা করে বলল ডোনা।
কথা শেষ করেই ডোনা গাড়ির এ দরজাটা খোলা রেখেই গাড়ি ঘুরে ড্রাইভিং সিটে এসে বসল সে। দুই হাত ষ্টিয়ারিং হুইলের ওপর রেখে তার ওপর কপাল ন্যাস্ত করল।
সেদিকে চেয়ে হাসি ফুটে উঠল আহমদ মুসার ঠৌঁটে। ভাবল সে, বুরবো রাজবংশের মেয়েদের রাজকীয় বৈশিষ্ট্য ঠিকই আছে। যা ভালো মনে করে তা করেই ছাড়বে।
আহমদ মুসা সিটে বসে গাড়ির দরজা বন্ধ করে দিয়ে বলল, ‘আমি একা সব কাজ করি না। তবে একজনের কাজে দু’জনকে শামিল করাও ঠিক মনে করি না ডোনা। প্রকাশ্য শক্তির লড়াইয়ে লোক বেশি হলে সুবিধা। কিন্তু বুদ্ধির লড়াইয়ে, বিশেষ করে যা লুকোচুরির মধ্যে দিয়ে চলে, লোক বেশি হলে উপকারের চেয়ে ক্ষতিই বেশি হয়’।
মুখ তুলল ডোনা। তখনও তার মুখ গম্ভীর। চোখটা অশ্রুতে লেপটানো। বলল, ‘আপনি অন্যকে যতটা ভালবাসেন নিজেকে ততটা ভালোবাসেন না’।
গম্ভীর হয়ে উঠল আহমদ মুসার মুখ। বলল, ‘না ডোনা, নিজেকে খুব বেশি ভালোবাসি বলেই তো আমি এই পথে আসতে পেরেছি’।
‘এত জটিল কথা আমি বুঝতে পারি না’।
‘আমি মানুষের ভালো চাই, আমি আমার জাতির ভালো চাই, মুক্তি চাই এই জন্যে যে, এই দায়িত্ব পালনের জন্যে আল্লাহ আমার ওপর সন্তুষ্ট হবেন যার ফলে আমি লাভ করব অসীম পুরষ্কার এবং অনন্ত শাস্তি’।
‘ওতো পরকালের পুরস্কার ও কল্যাণ, শান্তি ও সুস্থতা ইহকালের জন্যেও চাই’।
‘সেটাও আল্লাহ আমাকে অনেকের চেয়ে অনেক বেশি দিয়েছেন। দেখ দ্বিজনে কয়েকদিন কি আরামে থাকলাম। আবার দেখ এখানে কি রাজার হালে আছি’।
‘শান্তি বুঝি এটুকুরই নাম?’
‘শুধু এটুকু নয়, উদাহরণ দিয়েছি মাত্র’। মুখ টিপে হেসে আহমদ মুসা বলল।
‘ধন্যবাদ, জবাব আজ দেব না’। থামল ডোনা।
ইঞ্জিন গর্জন করে উঠল তার গাড়ির। গাড়ি নড়ে উঠল। চলতে শুরু করল গাড়ি।
‘কোথায় যেতে হবে জান?’
‘আস্থা রাখুন’।
‘ধন্যবাদ’। বলে চোখ বন্ধ করে আহমদ মুসা গা এলিয়ে দিল গাড়ির সিটে। ডোনার শেষ কথাটা তখনও তার কানে ভাসছে। সত্যিই নিশ্চিন্ত নির্ভরতার মধ্যে রয়েছে অপার আনন্দ। ভালো লাগছে ডোনার ওপর নির্ভর করতে। অন্তত কিছু সময় তো নিশ্চিন্ত থাকা যাচ্ছে।
গাড়ি থেমে যাবার ঝাঁকুনিতে তন্দ্রাবস্থা ভেঙে গেল আহমদ মুসার।
চোখ খুলে সোজা হয়ে বসল আহমদ মুসা। চারদিকে একবার চোখ বুলাল। দেখল, তার লক্ষ্য সার্ভিস সেন্টারটির বিপরীত দিকে যে সুপার মার্কেট তার কার পার্কিং-এ এসে দাঁড়িয়েছে গাড়ি। চমৎকার জায়গা। এখান থেকে সার্ভিস সেন্টারের গেট দিয়ে সেন্টারের ভেতরের অনেকখানি দেখা যায়। সার্ভিস স্টোর এবং সুপার মার্কেটের মাঝখানে ক্রস-লেন সার্ভিস সেন্টারের গেটের সামনের রোড দিয়ে যে কোন দিকে চলে যেতে পারে।
চোখ ফিরিয়ে তাকাল ডোনার দিকে। ডোনা দুই হাত ষ্টিয়ারিং হুইলে রেখে সামনের দিকে তাকিয়ে বসে আছে।
‘ধন্যবাদ ডোনা, তোমার চমৎকার সিলেকশন’। সপ্রশংস দৃষ্টিতে বলল আহমদ মুসা।
ডোনা স্টিয়ারিং হুইলে মাথা রেখে মুখ কাত করে তাকাল আহমদ মুসার দিকে। মুখ গম্ভীর। কোন কথা বলল না।
‘এখন তোমার কি পরিকল্পনা ডোনা?’
‘জানি না’।
আহমদ মুসা মাথা নত করল। বলল, ‘ডোনা, এক ঘন্টার মধ্যেও যদি না ফিরি, তাহলে চলে যাবে’।
অন্ধকারের একটা ঢেউ আছড়ে পড়ল ডোনার চোখে-মুখে। বলল, ‘এভাবে বলো না। বলো, এক ঘন্টার মধ্যে ফিরে আসবে’। কাঁপছিল ডোনার কন্ঠ।
আহমদ মুসা হাসল। বলল, ‘দোয়া করো ডোনা’।
‘ফি আমানিল্লাহ’। বলল ডোনা ষ্টিয়ারিং থেকে মাথা তুলে।
‘আলহামদুলিল্লাহ’।
বলে আহমদ মুসা গাড়ির দরজা খুলে বেরিয়ে গেল। | ← Previous | | | Next → | | সম্পুর্ণ বই এক পেজে »
Top