১৮. ব্ল্যাক ক্রসের মুখোমুখি

চ্যাপ্টার

আইফেল সার্ভিস সেন্টার।
ম্যানেজারের কক্ষ। ম্যানেজার বসে আছে তার চেয়ারে।
তার সামনে বসে চারজন। চারজনের চেহারাই এমন যে, দেখে মনে হবে এই মাত্র ওরা কাউকে খুন করে এসেছে। ওদের সামনে বসা ম্যানেজারকে চোরের মত অপরাধী মনে হচ্ছিল।
কথা বলছিল ওদের চারজনের মধ্যে থেকে সর্দার গোছের লোকটা। বলছিল, আপনি একটা কথাও সত্য বলছেন না। প্রতারণা করছেন আপনি আমাদের সাথে।
‘বিশ্বাস করুন, এই গাড়ির ব্যাপারে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়েছে, গাড়িটা বিক্রি করবে, এসব আমি কিছুই জানি না। নিছক সার্ভিসিং এর জন্যেই গাড়িটা রেখে গেছে। এই প্রতারণায় আমার কি লাভ?’
‘সে হিসেব আমাদের নয়। এখন থেকে চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে আমরা এ গাড়ির মালিককে চাই। আপনি হয় তাকে ডেকে আনবেন, নয়তো তার সঠিক ঠিকানা আমাদের দেবেন। চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে কিছু যদি না করেন, তাহলে আমরা কি করব তা আমরাই জানি’।
ম্যানেজারের মুখ ফাঁসির আসামীর মত চুপসে গেল।
এই সময় ম্যানেজারের কক্ষের দরজায় এসে দাঁড়াল আহমদ মুসা। বলল, ‘আসতে পারি?’
ভীত ম্যানেজারের মুখ এবার বিরক্তিতে ভরে গেল। সামনে বসা চারজনের দিকে একবার সে তাকাল। তারপর বলল, ‘আসুন?’
আহমদ মুসা ঘরে প্রবেশ করলে ম্যানেজার লোকটি তাকে বসতে বলে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকাল।
আহমদ মুসা বসে বলল, ‘মাফ করবেন আপনি নিশ্চয় ম্যানেজার?’
‘জি’। বলল ম্যানেজার।
‘আমি বিদেশী। আপনার সার্ভিস সেন্টারের এই গাড়িটি আমি কিনে নিয়েছি’। বলে আহমদ মুসা সার্ভিস সেন্টারের দেয়া ডোনাদের সেই গাড়িটার সার্ভিস রিসিট ম্যানেজারকে দেখাল।
আহমদ মুসা পরিকল্পনা করেই এসেছে। সে গাড়ির ক্রেতার পরিচয় দেবে। তার কাছে গাড়ি বিক্রি হওয়ার দলিল পত্রও নিয়ে এসেছে। সে নিশ্চিত জানে, ক্রেতা হিসেবে গাড়ির ডেলিভারি চাইলেই বিপদগ্রস্থ ম্যানেজার ব্ল্যাক ক্রসের লোকদের খবর দেবে অথবা গাড়ি সে নিয়ে যেতে লাগলেই ওঁত পেতে থাকা ব্ল্যাক ক্রসের লোকদের মুখোমুখি হওয়ার সে সুযোগ পাবে এবং ব্ল্যাক ক্রসের লোকদের মুখোমুখি হওয়ার সে সুযোগ পাবে এবং ব্ল্যাক ক্রসের ঠিকানা জানা অথবা পারলে তাদের কাছ থেকে ওমর বায়ার অবস্থান সম্পর্কে কথা বের করার একটা পথা সে পাবে।
গাড়ির সার্ভিস-রিসিটের দিকে তাকাতেই চোখ দু’টি ছানাবড়া হয়ে উঠল ম্যানেজারের। সামনের চারজনের দিকে একবার তাকিয়ে সে বলল, ‘গাড়ির মালিককে কোথায় পেলেন?’
‘কেন তার বাড়িতে?’
‘কিন্তু সার্ভিস সেন্টারে দেয়া এবং পত্রিকায় ছাপানো ঠিকানায় তো তার পাত্তা পাওয়া যায়নি’।
বলে ম্যানেজার সামনে বসা চারজনের দিকে চোখ ফিরিয়ে উৎসাহের সাথে বলল, ‘আপনারা যে গাড়ির মালিকের খোঁজ করছেন, সেই গাড়ি ইনি মালিকের কাছ থেকে কিনেছেন বলছেন।’
চারজন লোকই এক সংগে তাকাল আহমদ মুসার দিকে। তাদের চোখের দৃষ্টি এমন যেন আহমদ মুসাকে তারা গিলে খাবে। সেই সর্দার গোছের লোকটি বলল, ‘আমরা গাড়িটা কেনার জন্যে ক’দিন থেকে ঘুরছি। ঠিকানা কোথায় পেলেন তার?’
‘কেন কাগজের বিজ্ঞাপনে!’ বিস্মিত হওয়ার ভান করে বলল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসা বুঝল এরা ব্ল্যাক ক্রসের সেই লোক যারা ক’দিন ধরে গাড়ির মালিকের সন্ধানে রয়েছে।
‘বিজ্ঞাপনের ঠিকানায় গিয়ে কাউকে পাওয়া যায়নি।’
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘পরের দিনের কাগজে একই জায়গায় বিজ্ঞাপনের সংশোধনী ছিল। সে সংশোধনীটা আমি না পড়লে আমারও ভুল হতো।’
‘দেখুন আমরা খুব ভুগেছি এবং নিজেদের প্রতারিত মনে করছি। আপনার কাছে পরের দিনের সেই সংশোধিত বিজ্ঞাপনটি কি আছে?’
‘না, সে বিজ্ঞাপনটি নেই। তবে ঠিকানা চাইলে দিতে পারব। গাড়ি বিক্রির দলিলে তাঁর ঠিকানা আছে। কিন্তু ঠিকানা দিয়ে কি করবেন? আমি তো গাড়ি কিনে ফেলেছি।’
‘আমরা তো গাড়ির কেনা-বেচা করি। এ রকম গাড়ি যারা রাখেন, তারা গাড়ি-বিলাসে ভোগেন। তাদের সাথে পরিচয় থাকলে ভবিষ্যতে সুযোগ আমরা পেতে পারি।’
আহমদ মুসা মনে মনে লোকটির বুদ্ধির প্রশংসা করল। উপস্থিত বুদ্ধি দিয়ে খাসা একটা যুক্তি বের করেছে।
আহমদ মুসা পকেট থেকে বড় সাইজের একটা ভাঁজ করা কাগজ বের করে কাগজের ভাঁজ খুলে লেখার দিকে একবার নজর বুলিয়ে একটা স্লিপ পেপার টেনে তাতে একটা ঠিকানা লিখে ব্ল্যাক ক্রসের সেই লোকটির হাতে তুলে দিল।
আহমদ মুসা যে ঠিকানা লিখে দিল, সেটাও আগের ঠিকানার মতই ভুয়া। এই ভুয়া ঠিকানা দেয়াও আহমদ মুসার পরিকল্পনার একটা অংশ। আহমদ মুসার লক্ষ্য হলো, ঠিকানা পেয়ে তারা ছুটবে ঐ ঠিকানার উদ্দেশ্যে। আহমদ মুসা তাদের অনুসরণ করবে। ব্ল্যাক ক্রসের লোকেরা ভুয়া ঠিকানায় গিয়ে ব্যর্থতার দুঃখ নিয়ে সব কিছু রিপোর্ট করার জন্যে অবশ্যই তাদের কোন ঘাঁটিতে ফিরবে। ওদের অনুসরণ করে আহমদ মুসা ব্ল্যাক ক্রসের একটা ঘাঁটিতে পৌঁছতে পারবে।
আহমদ মুসার লেখা ঠিকানা হাতে নিয়ে ব্ল্যাক ক্রসের সেই লোকটি বলল, ‘ধন্যবাদ, আপনার কি আর একটু সাহায্য পেতে পারি?’
‘কি সাহায্য?’
‘আপনি আমাদের সাথে চলুন, তাহলে সহজেই আমরা ঠিকানাটা খুঁজে পাব।’
মনে মনে চমকে উঠল আহমদ মুসা। তাহলে কি আহমদ মুসাকে ওরা সন্দেহ করছে। মনে করছে কি যে, তাদেরকে ঠিক ঠিকানা দেয়া হয়নি? যাই হোক, ওরা খুব সিরিয়াস। ব্যর্থতার কোন অবকাশ তারা রাখতে চাচ্ছে না। কিন্তু তার যে পরিকল্পনা সে দিক থেকে এ ধরনের সহযোগিতা সে করতে পারে না। তাছাড়া ঠিকানাটি খুঁজে পাওয়ার কোন প্রশ্নই উঠে না। ঠিকানা খুঁজে না পেলে যে সংঘাত বাধবে তাদের সাথে, সেটা আগে বাধাই ভালো।
‘এই ঠিকানা বের করার জন্যে কোন সহযোগিতার প্রয়োজন নেই।’ বলল আহমদ মুসা।
‘আমরা ঠিকানা তো চাই না, চাই ঠিকানার মানুষকে। সে মানুষকে চিনেন আপনি। সুতরাং আপনি আমাদের সাথে থাকলে সুবিধা হবে।’
আহমদ মুসা তাদের যুক্তির বহর দেখে মনে মনে হাসল। বলল, ‘আমি তো প্রথমে তাকে চিনতাম না, না চিনেও তো তাঁকে খুঁজে পেয়েছি।’
‘দেখুন, ওসব যুক্তি-টুক্তি আমরা বুঝি না। আমদের সাথে আপনাকে যেতে হবে।’
ওদের মুখে এ ধমকের সুর শুনে আহমদ মুসা বুঝল, ওদের ত্বর সইছে না। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ওরা ঠিকানায় পৌঁছতে চায়। আহমদ মুসাকে কার্যত ওরা পণবন্দী করতে চাচ্ছে। ঠিকানা খুঁজে না পেলে কিংবা ঠিকানায় সংশ্লিষ্ট কাউকে না পেলে আহমদ মুসাকে ধরা হবে ওদের খুঁজে বের করার জন্যে। আহমদ মুসা নিশ্চিত যে, ওদের হুমকিমূলক কথার উপযুক্ত জবাব দিলে এখনি মারামারি শুরু হয়ে যাবে কিন্তু আহমদ মুসা ওদের সাথে এখনি মারামারি বাধাতে চায় না। ওদের যেমন টার্গেট গাড়ির মালিক অর্থাৎ ডোনাদের ঠিকানা বের করা, তেমনি আহমদ মুসার টার্গেট হলো ব্ল্যাক ক্রসের কোন ঠিকানা খুঁজে পাওয়া।
আহমদ মুসা বলল, ‘তাহলে সময় নষ্ট করে লাভ নেই চলুন।’
বলে আহমদ মুসা ম্যানেজারকে গাড়ি সার্ভিসের পয়সা পরিশোধ করে গাড়ির ডেলিভারি স্লিপ নিয়ে নিল।
ম্যানেয়াজার দারুণ খুশি। বলল, ‘যা সংকটে পড়েছিলাম। আপনি আসায় ওদের কাজ হলো এবং আমিও বাঁচলাম।’
‘ফিরে এসেও গাড়ি ডেলিভারি নিতে পারতেন। আমদের গাড়িতে সকলের জায়গা হতো।’ বলল সেই চারজনের সর্দার গোছের লোকটা।
‘কি দরকার এখানে ফেরার।’
বলে আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল। ওরা চারজন আগেই উঠে দাঁড়িয়েছিল।
ওরা বেরিয়ে এল কক্ষ থেকে।
আহমদ মুসা তার অর্থাৎ ডোনাদের গাড়িতে উঠতে যাচ্ছিল।
ওদের চারজনের সেই সর্দার গোছের লোকটা বলল, ‘মাফ করবেন। আপনি আমদের গাড়িতে উঠুন। গাড়ির মালিককে না পাওয়া পর্যন্ত এ গাড়ি আপনার নয়।’
ক্রোধে আহমদ মুসার অন্তরটা জ্বলে উঠল। কিন্তু এত তাড়াতাড়ি ঝগড়া বাধাতে চাইল না সে।
আহমদ মুসা কোন কথা না বলে ওদের গাড়িতে গিয়ে উঠল। পেছনের সিটের এক প্রান্তে এসে বসল সে। তার পেছনে বসল দু’জন। আর দু’জনের একজন ড্রাইভিং সিটে, আরেকজন তার পাশের সিটে।
ওদের মুখ প্রসন্ন। যেন বিশ্বজয় করে ফেলেছে ওরা।
সর্দার গোছের সেই লোকটি তার আসনে বসতে বসতে বলল আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে, ‘আপনার গাড়ির মালিক আমাদের খুব ভুগিয়েছে। তাই কোন অনিশ্চয়তার ঝুঁকি আমরা নিতে চাই না।’
আহমদ মুসা ভাবছিল তখন অন্য বিষয়। যা ঘটতে যাচ্ছে, তা ঘটতে দেয়া যায় না। ভুয়া ঠিকানা পর্যন্ত পৌঁছতে দিলে ব্যাপারটা জটিল হয়ে দাঁড়াবে। ওদের কোন ঘাঁটির ঠিকানা সংগ্রহ তার যে লক্ষ্য সেটা অনিশ্চিত হয়ে পড়তে পারে। সুতরাং আগেই কিছু একটা করতে হবে।
লোকটির কথায় আহমদ মুসার চিন্তায় ছেদ পড়ল। মুখ তুলল আহমদ মুসা। গাড়ির ইনসাইড লাইট তখনও জ্বলে আছে।
চোখ তুলতে গিয়ে সামনের দুই সিটের মাঝখানের জায়গায় কাগজের মোড়কের ওপর হঠাৎ আহমদ মুসার চোখ আটকে গেল।
কাগজের বড় ইনভেলাপ। বেশ পেট ফোলা। তার মধ্যে কাপড় কিংবা বই জাতীয় কিছু আছে। কিন্তু সেদিকটা আহমদ মুসার আগ্রহের বিষয় নয়। তার দু’টি চোখ নিবদ্ধ ইনভেলাপটির ওপরের লেখার ওপর। ফরাসী ভাষায় হস্তাক্ষরে লেখা। পড়ল আহমদ মুসা, ‘রলফ এইচ ফ্রিকে, ২১১, ‘রো আনাতল ডেলা ফর্গ’, প্যারিস ১৯।’
পড়ে চমকে উঠল আহমদ মুসা। এটা ব্ল্যাক ক্রসের কোন ঠিকানা? কাগজের এই কভারে করে সেখানে কোন কিছু এসেছিল? অথবা ব্ল্যাক ক্রসের ঘাঁটি থেকে কেউ এই কভারে করে কোন কিছু ঐ ঠিকানায় পাঠাচ্ছে? কোনটি ঠিক? এই প্রশ্নের সমাধানের একটা উপায় চিন্তা করল আহমদ মুসা।
লোকটির কথার জবাব দিতে সে বলল, ‘ধন্যবাদ। ঘটনা যাই হোক। একজন ভদ্রলোকের সাথে ভালো আচরণ করতে পারতেন আপনারা।’
‘আমরা খুব খারাপ কিছু করেছি?’ বলল সেই সর্দার গোছের সেই লোকটি।
‘গাড়ি সম্পর্কে আপনারা অশোভন আচরণ করেছেন। আমি ওদিক দিয়ে ‘রো আনাতল ডেলা ফর্গে’ যেতে পারতাম। উল্টো আমাকে এখানে আবার ফিরে আসতে হবে।’
কথাটা বলে মনে মনে খুব খুশি হলো আহমদ মুসা। ওদেরকে তাদের ঠিকানা সম্পর্কে কথা বলতেই হবে এবার।
কথা বললও তারা।
আহমদ মুসা কথাটা বলার সাথে সাথে চমকে উঠে সেই সর্দার গোছের লোকটা আহমদ মুসার দিকে ফিরে বলল, ‘আপনি রো আনাতল ডেলা ফর্গে থাকেন?’
গাড়ি তখন সার্ভিস সেন্টার থেকে বেরিয়ে অনেক দূর এগিয়ে এসেছিল। দ্রুত চলছিল গাড়ি।
‘হ্যাঁ। চেনেন ওদিকটা?’
‘চিনব না কেন? আমরা তো ঐ রোডেই থাকি।’
‘আপনারা সবাই?’ যেন খুশি হয়ে-আহমদ মুসা বিস্তারিত জানার লক্ষ্যে প্রশ্ন করল।
‘সবাই বলতে পারেন।’
‘ওখানে আপনাদের অফিস, না বাসা?’
‘অফিস। বাসাও আছে।’
আহমদ মুসা আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করল। নিশ্চিত হলো সে, ২১১ রো আনাতল ওদের একটা ঘাঁটির ঠিকানা।
দ্রুত চিন্তা করছিল আহমদ মুসা। ভুয়া ঠিকানাটা নির্মানাধীন একটা সরকারি ভবনের। ওখানে পৌঁছলে তাকেই অসুবিধায় পড়তে হবে। সুতরাং অবিলম্বে এদের আটকাতে হবে এবং তাকে ওদের রো আনাতল-এর ঘাঁটিতে পৌঁছতে হবে।
গাড়ি তখন ‘লিটল ইল ডেলা সাইট’ নামক বিখ্যাত পার্কের পাশ দিয়ে যাচ্ছিল।
সেদিকে একবার তাকিয়ে আহমদ মুসা বলল, ‘পার্কে একটু গাড়ি দাঁড় করান, আমাকে একটু টয়লেট করতে হবে।’
সর্দার গোছের লোকটি আহমদ মুসাকে কি যেন বলতে শুরু করেও থেমে গিয়ে ড্রাইভ যে করছিল তার দিকে ফিরে বলল, ‘ঠিক আছে দাঁড় করাও।’
গাড়ি পার্কে প্রবেশ করল।
বিশাল পার্ক। দিনের অফিস চলাকালীন এ সময়ে পার্কে লোক থাকে না বললেই চলে।
পার্কে কিছু পাবলিক টয়লেট আছে। টয়লেটগুলো একটা করে যেন সবুজ দ্বীপ। টয়লেট ঘিরে সবুজ ঝোপ সৃষ্টি করা হয়েছে। মাঝখানে টয়লেট বিল্ডিং। টয়লেটগুলো আসলে বিশ্রাম কেন্দ্রও।
একটা টয়লেটের মাঝে গিয়ে গাড়ি দাঁড় করানো হলো।
আহমদ মুসা গাড়ি থেকে নেমে টয়লেটে প্রবেশ করল।
আহমদ মুসা নেমে যেতেই সর্দার গোছের সেই লোকটি অন্যদের বলল, ‘তোমরা ভেতরে যাও। সাবধানের মার নেই।’
ড্রাইভিং সিটে বসা লোকটিসহ ওরা তিনজন গাড়ি থেকে নেমে আহমদ মুসার পিছু পিছু টয়লেটে ঢুকে গেল।
আহমদ মুসা টয়লেটে ঢুকে দাঁড়িয়েছিল। টয়লেটের বারান্দায় ওদের তিনজনকে উঠে আসতে দেখে আহমদ মুসা দরজার আড়ালে দাঁড়াল।
ওদের চারজনকেই আহমদ মুসা টয়লেটে আশা করছিল। তার হিসেব মেলেনি। সর্দারটাই আসেনি। এর অর্থ তার ওপর সর্দার লোকটির সন্দেহটা খুব পাকাপোক্ত নয়।
ওরা তিনজন হুড়মুড় করে টয়লেটে প্রবেশ করল।
সংগে সংগেই আহমদ মুসা পেছন থেকে দরজা বন্ধ করে রিভলবার বের করে হাতে নিল।
দরজা বন্ধ হওয়ার শব্দে ওরা তিনজনই ঘুরে দাঁড়াল।
উদ্ধত রিভলবার হাতে আহমদ মুসাকে দরজায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ওরা ভূত দেখার মত আঁৎকে উঠল।
আহমদ মুসা বলল, ‘তিনটা গুলী ছুঁড়তে এক সেকেন্ডের বেশি সময় লাগবে না। রিভলবারে সাইলেন্সার আছে। আপনারা খুন হলে কেউ জানতে পারবে না।’
বলে আহমদ মুসা বাম হাত দিয়ে পকেট থেকে পেস্টিং টেপের একটা রোল সামনের লোকটার হাতে ছুঁড়ে দিয়ে বলল, ‘তুমি ঐ দু’জনকে পিছমোড়া করে হাত-পা বেঁধে ফেল।’
ইতস্তত করছিল লোকটা।
আহমদ মুসা ট্রিগার টিপল রিভলবারের। নিঃশব্দে একটা গুলী লোকটার মাথার হ্যাট উড়িয়ে নিয়ে গেল। বলল আহমদ মুসা, ‘দ্বিতীয় গুলী তোমার কপাল ফুটো করে দেবে।’
সংগে সংগেই লোকটা কাজে লেগে গেল। বেঁধে ফেলল দু’জনকে।
পরে আহমদ মুসা অবশিষ্ট লোকটাকে বেঁধে দরজা লক করে বেরিয়ে এল।
আহমদ মুসা টয়লেট বুশ থেকে বেরুতে বেরুতে দেখল সেই সর্দার লোকটা গাড়ি থেকে বেরিয়ে বুশের দিকে এগিয়ে আসছে।
আহমদ মুসার দিকে এক পলক তাকিয়েই জিজ্ঞেস করল, ‘ওরা কোথায়?’
‘কেন টয়লেটে?’
‘তিনজন টয়লেটে কি করছে?’ তার চোখে-মুখে সন্দেহ।
‘যে জন্যে ওরা গেছে টয়…।’
আহমদ মুসা কথা শেষ করার আগেই সর্দার সেই লোকটা তার পকেটে রাখা হাতটা বের করে আনল। হাতে রিভলবার। আহমদ মুসা কথা শেষ না করেই লোকটার পকেট থেকে বেরিয়ে আসা রিভলবার ধরা হাতটির ওপর এক লাথি ছুঁড়ে মারল।
লোকটা প্রস্তুত ছিল না এর জন্যে। আচমকা লাথি খেয়ে হাত থেকে রিভলবার ছিটকে পড়ে গেল।
মুহূর্তের জন্যে অপ্রস্তুত হয়ে পড়েছিল লোকটা। কিন্তু পরক্ষণেই সামলে নিয়ে বাঘের মত ঝাঁপিয়ে পড়ল আহমদ মুসার ওপর।
প্রায় সাড়ে ছয়ফুট লম্বা বিশাল বপু লোকটা আছড়ে পড়ল মাটিতে আহমদ মুসাকে নিয়ে। লোকটা দু’হাতে গলা চেপে ধরেছিল আহমদ মুসার।
দু’পা গুটিয়ে চিৎ হয়ে পড়ে গিয়েছিল আহমদ মুসা। পড়ে যাবার পর জোড়া দু’টি পা লোকটির কোমরে গেঁথে ছুঁড়ে দিল তার দেহের পেছনের অংশকে।
লোকটার দেহ উল্টে গিয়ে ছিটকে পড়ল আহমদ মুসার মাথার ওপাশে। তার হাতটা নেমে গেল আহমদ মুসার গলা থেকে।
লোকটার দেহ ছুঁড়ে দেবার পর আহমদ মুসা নিজের দেহকে উল্টো মুখে ছুঁড়ে দিল একজন অতি দক্ষ এ্যাক্রোব্যাটের মত।
আহমদ মুসা গিয়ে পড়ল লোকটার ওপর। লোকটা তখন মাথা তুলছিল। আহমদ মুসা গিয়ে তার ওপর পড়ায় তার মাথাটা আবার নিচে নেমে গিয়েছিল। কিন্তু সক্রিয় হয়ে উঠেছিল তার হাতটা। তার ডান হাতের প্রচণ্ড একটা ঘুষি ছুটে গেল আহমদ মুসার চোয়াল লক্ষ্যে।
আহমদ মুসা মাথা সরিয়ে এবং বাম হাত দিয়ে ঘুষিটা ঠেকিয়ে ডান হাত দিয়ে পাল্টা ঘুষি চালাল লোকটার কানের পাশের নরম জায়গাটায়।
পাল্টা আক্রমণ এল না লোকটার দিক থেকে। দেখল লোকটা সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলেছে।
আহমদ মুসা উঠে দাঁড়িয়ে লোকটাকে টেনে বুশ টয়লেটের ভেতর নিয়ে একটা টয়লেটে ঢুকিয়ে লক করে বেরিয়ে এল।
এসে উঠল গাড়িতে।
ছুটতে শুরু করল গাড়ি ‘রো আনাতল ডেলা ফর্গে’র ব্ল্যাক ক্রসের আস্তানার দিকে।
এলাকাটা অনেক দূর।
বেশ সময় লাগল পৌঁছতে।
২০৯ নাম্বার বাড়ির সামনে একটা কার পার্কিং-এ গাড়ি দাঁড় করিয়ে আহমদ মুসা হেঁটে এগিয়ে চলল ২১১ নাম্বার বাড়ির দিকে। গাড়ি ২১১ নাম্বারে না নিয়ে যাবার কারণ ব্ল্যাক ক্রসের গাড়ি থেকে সে নামলে শুরুতেই ওরা তাকে সন্দেহ করে বসবে।
২১১ নাম্বার একটা তিনতলা বাড়ি। এলাকাটা পুরানো প্যারিসের একটা অংশ। দেয়াল ঘেরা বাড়ি। গেট পেরুলেই ছোট্ট সবুজ চত্বর। তারপর উঁচু বারান্দা। বারান্দার পরেই একটা দরজা। দরজা দিয়ে যে ঘরে প্রবেশ করা যায়, সেটা একটা বড় হলঘর বলে মনে হয়। দরজার দু’পাশে দুটি জানালা। জানালা দুটি খোলা। দরজা বন্ধ।
বন্ধ দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়াল আহমদ মুসা। ধীরে ধীরে চাপ দিল দরজায়। দরজা বন্ধ।
দরজায় নক করল আহমদ মুসা। হাতে তুলে নিল রিভলবার।
আহমদ মুসা সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সময় বেশি নেয়া যাবে না। যারা ঘাঁটিতে আছে তাদের কাবু করেই যা জানার জেনে নিতে হবে এবং ঘাঁটিটা একবার খুঁজে দেখতে হবে।
দরজাটা নড়ে উঠল। কেউ দরজা খুলছে। উৎকর্ণ ছিল আহমদ মুসা। কিন্তু ভেতরে কারও পায়ের শব্দ পেল না সে। তাহলে কি আগে থেকেই লোক ছিল।
দরজা খুলে গেল।
শক্ত-সমর্থ দীর্ঘকায় একটা লোক দরজার সামনে দাঁড়িয়ে।
আহমদ মুসা তার বুক বরাবর পিস্তল তুলে ধরল এবং বাম হাত দিয়ে দরজাটা ভেজিয়ে দিল।
লোকটা নির্বিকারভাবে পিছু হটতে লাগল। অবাক হলো আহমদ মুসা যে, লোকটার চোখে-মুখে ভয়ের চিহ্ন পর্যন্ত নেই।
লোকটাকে লক্ষ্য করে আহমদ মুসা চাপা কণ্ঠে বলল, ‘উপুড় হয়ে মেঝেয় শুয়ে পড়। এক আদেশ আমি দু’বার করি না।’
লোকটা সংগে সংগেই শুয়ে পড়ল।
আহমদ মুসা বাম হাত দিয়ে পকেট থেকে পেস্টিং টেপের রোলটি বের করে এগোলো শুয়ে পড়া লোকটির দিকে।
এই সময় ঘরের দু’প্রান্ত থেকে দু’টি কণ্ঠ হো হো করে হেসে উঠল। বলে উঠল দু’টি কণ্ঠই, ‘রিভলবার ফেলে দাও সম্মানিত অতিথি। আমরা এক আদেশ দু’বার করি না।’
রিভলবার হাতে রেখেই আহমদ মুসা মুখ ফিরিয়ে দেখল, স্টেনগানধারী দু’জন ঘরের দু’প্রান্তে দাঁড়িয়ে। তাদের স্টেনগান আহমদ মুসার দিকে উদ্যত।
বুঝল আহমদ মুসা, তাকে ফাঁদে ফেলা হয়েছে। এরা আগেই তৈরি ছিল। লোকটির মুখে ভয় ও উদ্বেগ দেখিনি এই কারণেই। কিন্তু এরা জানতে পারল কেমন করে?
আহমদ মুসা রিভলবার ছুঁড়ে ফেলে দিল হাত থেকে।
দুই স্টেনগানধারী এগিয়ে এল আহমদ মুসার দিকে। মেঝেয় শুয়ে পড়া লোকটি উঠে দাঁড়াল। একজন স্টেনগানধারী স্টেনগানের নল দিয়ে আহমদ মুসার ঘাড়ে আঘাত করে হাত থেকে পেস্টিং টেপের রোল কেঁড়ে নিয়ে মেঝে থেকে উঠে দাঁড়ানো লোকটির দিকে তুলে ধরে বলল, ‘বেঁধে ফেল শয়তানকে।’ বহুত ঘড়েল এক লোক। ওরা আসুক তারপর বিহিত করা যাবে।
এই সময় জানালার দিক থেকে দুপ করে মৃদু একটা শব্দ হল।
আহমদ মুসার বাম পাশের স্টেনগানধারী উল্টে গিয়ে আছড়ে পড়ল মেঝেতে।
আহমদ মুসা মুখ ফিরাল জানালার দিকে। সেই সময়ই তার কানে এসে বাঁজল সে ‘দুপ’ শব্দ আবার। দুর্বোধ্য এক গোঙ্গানি তুলে আহমদ মুসার ডান পাশের লোকটি লুটিয়ে পড়ল মেঝের উপর।
আহমদ মুসা দেখল, দু’হাতে পিস্তল ধরে জানালায় দাঁড়িয়ে ডোনা।
আহমদ মুসা ঘটনার আকস্মিকতার ধাক্কা কাটিয়ে ওঠার আগেই দেখল ডোনার পিস্তল ধরা হাত শক্ত হয়ে উঠেছে। সেই সাথে চিৎকার করে উঠল ডোনার কণ্ঠ, ‘বসে পড় তুমি।’
সঙ্গে সঙ্গেই আহমদ মুসা নিজের দেহটাকে ছুঁড়ে দিল মেঝের উপর। দেখল, যে লোকটি তাকে বাঁধতে আসছিল, সে লোকটি মেঝে থেকে রিভলবার নিয়ে উঠে দাঁড়াচ্ছে। কিন্তু সেই ‘দুপ’ শব্দ আবার তার কানে এসে বাজল। ডোনা গুলী করেছে আবার।
লোকটি আর রিভলবার তুলে উঠে দাঁড়াতে পারল না। গুলী তার মাথা গুঁড়ো করে দিয়েছে। যেমনভাবে সে উঠে দাঁড়াচ্ছিল, তেমনভাবেই সে হুমড়ি খেয়ে পড়ল মাটির ওপর।
দরজা ঠেলে ডোনা প্রবেশ করল ঘরে। এখনও সে দু’হাতে পিস্তল ধরে আছে। তার দৃষ্টিতে বিহ্বল ভাব। শিথিল পায়ে সে এগিয়ে আসছে। টলছে সে।
আহমদ মুসা উঠে দাঁড়িয়েছে।
দ্রুত এগিয়ে সে ধরল ডোনাকে।
ডোনার হাত থেকে পিস্তল পড়ে গেল। সে জড়িয়ে ধরল আহমদ মুসার বাহু শক্ত করে। মাথা রাখল সে আহমদ মুসার কাঁধে।
আহমদ মুসা ডোনার পিঠে হাত বুলিয়ে সান্তনা দিল। বলল, ‘এই সময় সাহস হারাতে নেই। তুমি তো জিতে গেছ ডোনা।’
অল্পক্ষণ পরে আহমদ মুসা আবার বলল, ‘আমরা এখানে বেশি সময় পাব না ডোনা। ওরা এসে পড়বে।’
ডোনা কাঁধ থেকে মাথা তুলল। সরে দাঁড়াল। তার চোখ-মুখের দিশেহারা ভাব এখনও কাটেনি। বলল, ‘আর কি কাজ আছে এখানে?’
‘ঘাঁটিটা সার্চ করব। কোন কাগজপত্র, দলল-দস্তাবেজ পাই কিনা। কথা আদায় করার কোন লোক তো অবশিষ্ট থাকল না।’
বলে আহমদ মুসা মেঝে থেকে ডোনার পিস্তলটি তুলে নিয়ে চুমু খেল পিস্তলটায়। তারপর ডোনার হাতে তুলে দিল পিস্তলটা।
ডোনার চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল।
রক্তিম ঠোঁটটা নড়ে উঠল কিছু বলার জন্যে। কিন্তু কথা ফুটল না।
আহমদ মুসা তখন চলতে শুরু করেছে ভেতর বাড়ির দিকে। বলল, ‘এস ডোনা।’
দশ মিনিট পরে আহমদ মুসা এবং ডোনা বেরিয়ে এল বাইরের সেই হল ঘরটায়।
আহমদ মুসার চোখে-মুখে বিস্ময়। বাড়িতে সব আসবাবপত্রই আছে। কিন্তু এক টুকরা কাগজও নেই। টেলিফোন আছে। কিন্তু টেলিফোন সেটে নাম্বার স্লিপ নেই, টেলিফোন গাইডও নেই। নানতেজের ঘাঁটিতেও আহমদ মুসা এটাই দেখেছে, মনে পড়ল আহমদ মুসার। অর্থাৎ ব্ল্যাক ক্রস তাদের ঘাঁটিতে এমন কিছুই রাখে না বা থাকে না যা দেখে এদের কোন হদিস পাওয়া যেতে পারে। এদের কোন ব্যক্তিও তা অন্য সহযোগী কিংবা অন্য কোন ঘাঁটি সম্পর্কে কিছু জানে না, জানতে দেয়া হয়না। অদ্ভুত সিকিউরিটি ব্যবস্থা এদের। মনে মনে প্রশংসা না করে পারল না আহমদ মুসা।
হলঘর থেকে বেরিয়ে বারান্দা থেকে চত্বরে নামতে নামতে আহমদ মুসা বলল, ‘অদ্ভুত সংগঠন এই ব্ল্যাক ক্রস। ঢুকতেই পারছি না ওদের ভেতরে, যে পথ ধরছি, সে পথই বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।’
ডোনা তাকাল আহমদ মুসার দিকে।
নরম সহানুভূতি তার চোখে-মুখে। কিন্তু মুখে কিছু বলল না।
গেটের বাইরেই দাঁড় করানো ছিল ডোনার গাড়ি।
গাড়িতে উঠে বসল দু’জন। ডোনা আগেই ড্রাইভিং সিটের পাশের সিটে গিয়ে বসল। আহমদ মুসা বসল ড্রাইভিং সিটে।
চলতে শুরু করল গাড়ি।
‘দেখবেন, পার্কের বুশ টয়লেটে ওদের পাওয়া যায় কিনা?’ বলল ডোনা।
আহমদ মুসা ডোনার ‘তুমি’ পর্যায় থেকে ‘আপনি’ পর্যায়ে উঠে আসা লক্ষ্য করল। ঈষৎ হেসে তাকাল ডোনার দিকে।
অল্প পরে বলল, ‘লাভ হবে না। ওরাই ঘাঁটিতে খবর পাঠিয়ে এদের সাবধান করেছিল। সুতরাং ওরা এতক্ষণে মুক্ত হয়েছে বা মুক্ত করা হয়েছে।’
থামল আহমদ মুসা। একটু পরে আবার শুরু করল, ‘তুমি আমাকে বোকা বানিয়েছ ডোনা। তুমি আমাকে ফলো করবে তা আমি কল্পনাও করতে পারিনি।’
‘রাগ করেছ তুমি? আমি চুপ করে থাকতে পারিনি।’ অপার্থিব এক আবেগে উপচে পড়ছে ডোনার চোখ-মুখ থেকে।
ডোনার এ প্রশ্ন এড়িয়ে গিয়ে আহমদ মুসা বলল, ‘তুমি এত সুন্দর পিস্তল চালাতে পার, ভাবতেও আমার অবাক লাগছে?’
‘ঠিক নয়, আমি ভালো পিস্তল চালাতে পারি না। আজ কি ঘটেছে বলতে পারবো না। মনে হয় সজ্ঞানে আমি কিছু করিনি।’
‘তাহলে প্রিন্সেস মারিয়া জোসেফাইন জেগে উঠেছিল। হাজার হলেও বুরবো রাজকুমারী। তার নিশানা অব্যর্থ না হয়ে পারে না।’ আহমদ মুসার ঠোঁটে হাসি।
‘বুরবো রাজকুমারী হলে অমন ভেঙে পড়তো না। আপনাকে অবলম্বন না পেলে আমি সংজ্ঞা রাখতে পারতাম না।’
ডোনার ‘আপনি’ ও ‘তুমি’ আবার লক্ষ্য করে হাসল আহমদ মুসা। কিন্তু এ প্রসঙ্গে না গিয়ে বলল, ‘অবলম্বন ছিল বলেই ভেঙে পড়েছিলে। না থাকলে প্রতিরোধ শক্তি আরও বৃদ্ধি পেত।’
‘হবে হয়তো। আমি বুঝি না।’
বলে ডোনা একটু হাসল। তারপর গাড়ির সিটে গা এলিয়ে দিয়ে দু’চোখ বন্ধ করে বলল, ‘আপনি মারিয়া জোসেফাইনকে বেশি কৃতিত্ব দিতে চান। মারিয়া জোসেফাইনের প্রতি আপনার পক্ষপাতিত্ব আছে।’
‘আর তুমি মারিয়া জোসেফাইনকে আড়ালে রাখতে চাও।’
‘কারণ আপনার পরিচয় ডোনা জোসেফাইনের সাথে।’
‘আমার পরিচয়ের ডোনা জোসেফাইন আজ আবির্ভূত হয়েছে মারিয়া জোসেফাইন রূপে।’
‘এখানেই আপত্তি।’
‘তোমার কাছে যা অপত্তির, আমার কাছে তা অলংকার।’
‘অলংকার?’ চোখ খুলল ডোনা।
‘হ্যাঁ। বুরবো রাজ-ঐতিহ্য ডোনা জোসেফাইনকে মনোহর সৌকর্য ও সম্মানের আলোকে উদ্ভাসিত করেছে।’
ডোনা ধীরে ধীরে বলল, ‘আপনি এমন কথা আগেও বলেছেন। কিন্তু আমার ভয় করে। বুরবোদের কাল পাপ না আবার ডোনাকে ঢেকে দেয়। ইসলামকে যতদূর বুঝেছি তাতে শিরকের পরেই ইসলাম সবচেয়ে ঘৃণা করে অবিচারকে।’
‘ভয় তোমার অমূলক ডোনা। বুরবোদের নীল-রক্তের তুমি উত্তরাধিকারী, তাদের কাল-কর্মের উত্তরাধিকার তোমার নেই। দেখ জাগতের শেষ নবী আমাদের রসূল মুহাম্মদ স। পৌত্তলিক কোরাইশ বংশে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। পৌত্তলিকতাকে তিনি উচ্ছেদ করেন, কিন্তু কোরাইশ বংশধারাকে তিনি সম্মান করতেন, এজন্য গর্বও করতেন।’
থামল আহমদ মুসা। ডোনা জবাব দিল না। অনেক্ষণ কথা বলল না। অবশেষে মুখ খুলল। বলল, ‘ধন্যবাদ। ডোনা আর মারিয়া হতে আপত্তি করবে না।’ ডোনার কণ্ঠ আবেগে কাঁপল।
বলেই ডোনা পকেট থেকে একটা লাল গোলাপ বের করে দু’হাতে আহমদ মুসার দিকে তুলে ধরে বলল, ‘মারিয়ার এই অভিষেক মুহূর্তে তার পক্ষ থেকে তোমাকে দেবার মতো এছাড়া আর কিছুই নেই।’
ফুলটি হাত পেতে নিল আহমদ মুসা। একদম তাজা গোলাপ। একবার গন্ধ নিয়ে আহমদ মুসা বলল, ‘মনে হচ্ছে সদ্য তোলা। কোথায় পেলে এই তাজা গোলাপ?’
‘পার্কে তুমি যখন বুশ টয়লেট থেকে বেরিয়ে শেষ লোকটিকেও কুপোকাৎ করলে, তখনই এ গোলাপ আমি তুলেছিলাম। আমি তখন বসেছিলাম একটা গোলাপ ঝাড়ের আড়ালে।’
এ প্রসংগে আহমদ মুসা আর কিছু বলল না। মুহূর্ত কয়েক চুপ থাকার পর বলল, ‘একটা কথা বলি ডোনা?’
‘আপনি’ এবং ‘তুমি’-এর দ্বন্দ্ব তোমার কবে কাটবে?’ মুখে হাসি আহমদ মুসার।
ডোনা মাথা নিচু করল। উত্তর দিল না।
অল্পক্ষণ পরে বলল, ‘পারছি না।’
‘কেন?’
‘হৃদয়ের চাওয়া এবং বিবেকের দণ্ড তো পাশাপাশি থাকে।’
‘হৃদয়ের চাওয়া যদি বিবেকের রায়সম্মত হয়, তাহলে বিবেক দণ্ড উচায় না।’
‘কিন্তু এই চাওয়া এবং এই রায়ের মাঝে সংঘাত আছে। হৃদয়ের চাওয়া কোন শর্ত বিচার করে না, কিন্তু বিবেক তো বাস্তবতা, সম্ভাব্যতা ও ন্যায্যতা সবই পরখ করে দেখে। হৃদয় আকাশের চাঁদ চাইতে পারে, কিন্তু বিবেকের কাছে এটা হাস্যকর।’
মুখ নিচু রেখেই কথা বলছিল ডোনা। তার কন্ঠ ভারী। যেন অশ্রুর কোন সরোবর থেকে তা উঠে আসছে।
কিছু বলার জন্যে মুখ খুলেছিল আহমদ মুসা। কিন্তু বলা হল না। সামনে রাস্তায় পুলিশ দেখে ওদিকে দৃষ্টি আকৃষ্ট হল।
সামনেই রাস্তার ডান পাশে প্যারিসের বিখ্যাত লুক্সেমবার্গ প্রাসাদ। সে প্রাসাদের সামনেই পুলিশের বিরাট সমারোহ। বিস্মিত দৃষ্টি সেদিকে ঘুরিয়ে সামনে রাস্তার পাশে চাইতে আহমদ মুসা দেখল রাস্তার ফুটপাত কার পার্কিং জুড়ে অনেক মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। হাতে তাদের প্ল্যাকার্ড। সব মেয়ের মাথায় ওড়না। দেখেই আহমদ মুসা বুঝল এরা মুসলিম মেয়ে। ভাল করে দৃষ্টি দিল ওদের প্ল্যাকার্ডের দিকে। প্রথমেই দৃষ্টি দিল যে প্ল্যাকার্ডের দিকে তাতে লেখাঃ ‘ধর্মীয় ঐতিহ্যিক অধিকার জাতসঙ্ঘ সনদও নিশ্চিত করেছে।’ অন্য একটিতে লেখাঃ ‘মুসলমানদের ধর্মীয় অধিকার ফরাসী সরকার পদদলিত করেছে।’ অপর একটিতে আহমদ মুসা পড়ল, ‘মুসলিম মেয়েদের ওড়না কেড়ে নেয়া মানে তাদের নিশ্বাসকে হত্যা করা।’
ডোনা দ্রুত উচ্চকণ্ঠে বলল, ‘ওহো, লুক্সেমবার্গ প্রাসাদে আজ ইউরোপীয় ইউনিয়নের মানবাধিকার কমিশনের বৈঠক বসেছে। মুসলিম মেয়েরা এসেছে ফরাসী সরকার কর্তৃক তাদের অধিকার দমনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে।’
‘ইউরোপীয় হিউম্যান রাইটস কমিশন কি ফ্রান্সে বসে ফ্রান্সের বিরুদ্ধে টু’শব্দ করবে?’ বলল আহমদ মুসা।
‘ফ্রান্সে বসে কেন, অন্য কোন জায়গায় বসেও করবে না। আসলে একে ওরা মানবাধিকার লঙ্ঘন মনেই করছে না।’ বলল ডোনা।
‘অধিকারটা মুসলমানদের বলেই কি?’
‘ওটা একটা কারণ। সবচেয়ে বড় কারণ হল ধর্মীয় মূল্যবোধ, শালীনতা, এমনকি সাধারন নৈতিকতা সম্পর্কেও ওরা কোন জ্ঞান রাখে না। ওদের বড় বড় ডিগ্রি, সুন্দর সুন্দর পোশাক নিয়ে আর পালিশ করা পরিবেশের মধ্যে মানুষ রূপী যাদের ঘুরে বেড়াতে দেখছেন তারা বলতে পারেন পশু। ফরাসী বিপ্লবের পর এডমন্ড বার্ক কি বলেছিলেন আপনার মনে আছে?’
‘কি বলেছিলেন?’
‘তথাকথিত উদার নৈতিকতাবাদীরা যুক্তি ও বাস্তববাদের দোহাই দিয়ে সমাজ ও রাষ্ট্র থেকে যখন ধর্মকে ছেঁটে ফেলল, তখন বার্ক বলেছিলেন, ‘যুক্তি মানুষের সবচেয়ে বড় সম্পদ। তবে যুক্তিবাদের শক্তি যত বেশিই হোক না কেন, এটা সীমাহীন নয়।মানুষের জানা দরকার, এ অনন্ত বিশ্বে শান্ত প্রানী হিসেবে তার সবটা সে কখনও জানতে পারবে না। সব জেনে ফেলার দাবী যুক্তিবাদী মানুষের ক্ষমতার বিপজ্জনক অতিরঞ্জন। যুক্তিবাদ হল কাহিনীর অর্ধাংশ মাত্র। মানুষ্কে তার নিজের ওপর ছেড়ে দিলে অদৃশ্য প্রবৃত্তির বলে জীবন তার দুঃখময় হয়ে উঠবে এবং অসৎ উদ্দেশ্য প্রণোদিত হয়ে সে নিজেকে ও অন্যদেরকে ধ্বংস করবে। মানুষকে তার নিজের প্রবৃত্তির উপর ছেড়ে দিলে সে পশুরও অধম হয়ে পড়বে।’ থামল ডোনা।
‘বার্কের সে বক্তব্যের প্রয়োজনীয় অংশের কয়েকটা কথা বাদ রাখলে।’ বলল আহমদ মুসা।
‘কি সেটা?’
বার্ক আরও বলেছিলেন, ‘সভ্যতা নিরবচ্ছিন্ন সামাজিক প্রক্রিয়ারই ফল। সামাজিক ঐতিহ্য হল ব্যক্তি প্রকৃতিকে নিজস্ব সংকীর্ণতা থেকে মুক্ত করার শক্তি। এটা সভ্যতার অগ্রগতির ভিত্তি।’
‘ধন্যবাদ, দেখুন, বার্ক কথিত সেই যুক্তিবাদীরাই ক্ষমতার বিপজ্জনক অতিরঞ্জন। আজ তাদেরকে এবং সমাজকে পশুর স্তরে নামিয়ে দিয়েছে। যা সভ্যতার অগ্রগতি রূদ্ধ করে একে দ্রুত অধঃগতির দিকে নিয়ে যাচ্ছে।’
‘তোমাদের বার্কের বক্তব্য কোথাও কোথাও আমাদের ধর্মগ্রন্থ আল কুরআনের শিক্ষার প্রতিধ্বনি, আবার কোথাও তিনি ভুল করেছিলেন।’
‘যেমন?’
‘সপ্তম শতকের প্রথম শতকে নাযিল হওয়া আল কুরআনের ৯৫ নম্বর সূরা আত-ত্বীনে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেছেন যে, ‘মানুষ মহত্তম সৃষ্টি। কিন্তু সে যখন বিশ্বাসের পথ পরিত্যাগ করে তার সুস্থ যোগ্যতা ও প্রকৃতির বিকৃতি ঘটায়, তখন তাঁকে নিকৃষ্টতম পর্যায়ে নামিয়ে দেয়া হয়।’ আল-কুরআনের এই কথার কিছুটা প্রতিধ্বনি মেলে সপ্তদশ শতকের শেষে বলা বার্কের ‘পশুতত্ত্ব’-এর মধ্যে। কিন্তু বার্ক ভুল করেছেন যখন তিনি যুক্তি ও ধর্মকে পৃথক ভেবেছেন এবং এ দুয়ের মধ্যে সমন্বয় বা সহাবস্থান চেয়েছেন। ইসলাম বলে, যুক্তিই হল ধর্ম। ধর্মহীনতা হল যুক্তি ও বিবেকের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ।’
‘আপনার শেষ কথাটা খুব ভারী।’
‘আসলে ভারী নয়। কুরআনের তফসীর পড়েছ তো সব পরিষ্কার হয়ে যাবে তোমার কাছে।’
‘তবে একটা কথা, যুক্তিই ধর্ম একথা বোধ হয় সব ধর্মের ক্ষেত্রে খাটে না। যেমন খৃস্টান ধর্ম। যুক্তির বিরুদ্ধেই খৃস্টান ধর্মের লড়াই। দশম শতাব্দী থেকে সপ্তদশ শতাব্দী পর্যন্ত ৩৫ হাজার বিজ্ঞানীকে খৃস্টান চার্চ পুড়িয়ে মেরেছে।’
‘অথচ দেখ ইসলাম বিজ্ঞানকে ছড়িয়ে দিয়েছে। যে ধর্ম যুক্তি, বিবেক এবং সত্যিকার বিজ্ঞান চিন্তাকে ভয় করে সে ধর্ম ধর্ম নয় অথবা সে ধর্ম তার সঠিক অবস্থানে নেই।’
গাড়ি এসে গিয়েছিল মেয়েদের কাছাকাছি।
মেয়েদের বিক্ষোভ অবস্থানের পাশেই কার পার্কিং-এ গাড়ি দাঁড় করাতে অনুরোধ করে ডোনা বলল, ‘আমার দাঁড়াতে ইচ্ছা করছে। একটু দেখি।’
আহমদ মুসা গাড়ি দাঁড় করিয়ে বলল, ‘ওদের সাথে যোগ দেবে নাকি?’
‘কেন আমার মাথায় ওড়না আছে, এ দাবি নিয়ে আন্দোলন আমিও আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে করেছি, তাহলে যোগ দিতে পারবো না কেন?’
কথা শেষ করেই ডোনা তাদের গাড়ির পাশ দিয়ে চলে যাওয়া দু’টি গাড়ির দিকে তাকিয়েই দ্রুত কণ্ঠে বলে উঠল, ‘কিছু একটা অঘটন ঘটবে।’
‘কেন বলছ?’ দ্রুত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা।
‘দু’টি গাড়িতে করে স্কিন হেডেডদের যেতে দেখলাম। ওদের উপস্থিতি বিনা কারণে ঘটে না। যেখানে ওরা যায়, সেখানে একটা কিছু ঘটে।’
‘ওরা কারা?’
‘কিছু কিছু দেশে ওদের পরিচয় ওরা আল্ট্রা ন্যাশনালিস্ট।’
‘ওদের সাম্প্রতিক আরেকটা পরিচয়, ওরা ব্ল্যাক ক্রসের সহযোগী। আব্বা এটা বলেছেন। ওরা অ্যান্টি সেমেটিক ব্ল্যাক ক্রসের প্রভাবে এখন অ্যান্টি ইসলামও হয়ে দাঁড়িয়েছে।’
কথা শেষ করেই ডোনা ভয় ও বিস্ময়ের সাথে বলে উঠল, ‘দেখলেন ওরা আর্কাইভসে ঢুকল।’
‘আর্কাইভসে ঢুকল কেন?’
মেয়েদের পেছনেই আর্কাইভস বিল্ডিং। বিশাল আর্কাইভস বিল্ডিং। মেয়েরা আর্কাইভস বিল্ডিং-এর গোড়া বরাবর দাঁড়িয়ে আছে।
আহমদ মুসা ডোনার উত্তরে কিছু বলল না। চিন্তা করছিল সে।
ডোনা গাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল। একটু এগিয়ে একটা মেয়ের সাথে কথা বলতে শুরু করেছিল। পোশাকে-আশাকে এবং বয়সেও সে মেয়েদের সাথে মিশে গিয়েছিল।
ঠিক এই সময়েই মেয়েদের অবস্থানের লম্বা সারির মাঝখানে চিৎকার, হৈ চৈ ও হুটোপুটি শুরু হয়ে গেল। কিছু মেয়ে ছুটে ওদিকে চলে গেল, কিচু এল এদিকে, মাঝখান ফাঁকা হয়ে গেল। কিছু মেয়ে ছুটতে গিয়ে পড়ে গিয়েছিল। আর কাতরাচ্ছিল।
প্রাথমিক আতঙ্ক ও বিভ্রান্তির পর কয়েকজন মেয়ে ঘটনাস্থলের দিকে ছুটে গেল।
ডোনা ছুটে এসেছিল আহমদ মুসার কাছে।
আহমদ মুসা তাকে তুলে নিয়ে আহত মেয়েদের কাছে গাড়ি দাঁড় করাল। নামল গাড়ি থেকে আহমদ মুসা ও ডোনা দু’জনেই।
বেশ কয়েকজন মেয়ে পুড়ে গেল পুড়ে গেল বলে যন্ত্রণায় চিৎকার করছে। কিন্তু পোড়ার কোন চিহ্ন নেই। পুড়বেই বা কিসে। কিছুই তো ঘটে নি। হাঁটু থেকে নিচের দিকেই যন্ত্রণা বেশি।
আহমদ মুসা ঝুঁকে পড়ে কয়েকজনকে পরীক্ষা করল। তারপর ছুটে গেল ঘটনার জায়গায়। কিন্তু সেখানে কিছুই নেই।
ফিরে এল আহমদ মুসা।
‘কিছু বুঝলেন?’
‘কিছু।’
বলে আহমদ মুসা ছুটাছুটিরত নেত্রী গোছের একটি মেয়েকে ডেকে ব্বলল, ‘আমার মনে হচ্ছে এরা হিট ক্যাপসুলের আঘাতে আহত হয়েছে। এদের তাড়াতাড়ি ক্লিনিকে নেয়া দরকার।’
আহমদ মুসাদের ছাড়াও আরেকটা গাড়ি এসে দাঁড়িয়েছিল।
‘হিট ক্যাপসুল কি?’ সে মেয়েটি বলল।
‘বলছি, এদের আগে ব্যবস্থা করুন।’
‘আমার গাড়ি আছে, আর ওই গাড়িটা হলেই হয়ে যায়।’ বলল ডোনা।
‘ওটা আমাদের গাড়ি। অন্য গাড়িগুলো আধ ঘন্টা পরে আসার কথা।’ সেই মেয়েটি বলল।
কথা শেষ করেই সে নির্দেশ দিল আহত মেয়েদের গাড়িতে তোলার জন্য এবং বলল,’আমি এদের সাথে ক্লিনিকে যাচ্ছি তোমরা মিছিল নিয়ে চলে এস।’
দুই গাড়িতে সাতজন মেয়েকে তোলা হলো।
আহমদ মুসা ড্রাইভিং-এ বসল। পাশের সিটে ডোনার পাশে বসল সেই নেত্রী গোছের মেয়েটি। পেছনের ছয়টি সিটে ৪ জন আহত মেয়েসহ আরেকজন মেয়ে উঠেছে।
ডোনার গাড়ি ৬ দরজার বিশাল এক বিলাশবহুল কার।
ইতোমধ্যে পুলিশ এসে গিয়েছিল। তারা জানতে চাইল কোন ক্লিনিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে আহতদের। আরও বলল, আহতদের জবানবন্দী নিতে হবে।
সেই নেত্রী গোছের মেয়েটি ক্লিনিকের নাম জানিয়ে বলল,’কিসের জবানবন্দী নিতে হবে তাদের?’
‘পুলিশকে নিশ্চিত হতে হবে তারা অস্ত্র বহন করছিল না।’
‘ধন্যবাদ ইন্সপেক্টর। দুর্বল মারও খাবে আসামীও হতে হবে তাদের।’
বলে গাড়ির দরজা বন্ধ করে দিল মেয়েটি।
চলতে শুরু করল গাড়ি।
ডোনাই প্রথম কথা বলল।
মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করল,’আপনার নাম কি?’
‘ফাতমা।’
‘কোথায় পড়েন?’
‘লুই ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে।’
একটু থেমেই মেয়েটি প্রশ্ন করল,’আপনার নাম?’
‘মারিয়া জোসেফাইন।’
‘আপনি মুসলমান নন? আপনাকে আমি মুসলমান মনে করেছিলাম।’
‘কেন মারিয়া জোসেফাইন মুসলমান হতে পারে না?’
‘পারে, কিন্তু সাধারণত ফ্রান্সের মুসলমানরা তাদের নামের সাথে অন্তত একটা আরবী নাম যুক্ত করে। তাই বলছিলাম। তাছাড়া…।’
‘তাছাড়া কি?’
মেয়েটি মানে ফাতমা ডোনার দিকে ভালো করে চেয়ে বলল,’আপনাকে কোথাও দেখেছি, নামটাও আমার পরিচিত।’
‘আমাকে দেখেছেন? কোথায়?’
ফাতমা চোখ বন্ধ করে চিন্তা করছিল। হঠাৎ উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠে বলল,’পেয়েছি। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের জাদুঘরে দেখেছি। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা স¤্রাট অষ্টাদশ লুই। বিশ্ববিদ্যালয়ের জাদুঘরে রুইদের সচিত্র বংশ তালিকা আছে। এ বংশ ধারার লেটেস্ট ইনফরমেশনও এর সাথে যুক্ত থাকে। আমি ইতিহাসের ছাত্রী তো, তাই এসব ঘাটাঘাটি করি। দু’দিন আগেও আমি দেখেছি, এ বংশের শেষ নামটি লেখা প্রিন্সেস মারিয়া জোসেফাইন লুই। তার ফটো যুক্ত আছে। যার সাথে আপনার হুবহু মিল।’
‘চেহারার মিল তো থাকে।’
‘নাম ও চেহারার মিল এক সাথে এভাবে হয় না। সত্যি বলুন আপনি কে? তাছাড়া এ ধরনের গাড়িও ফ্রান্সে বিশেষ ভিআইপি’রা ছাড়া ব্যবহার করে না।’
ডোনা উত্তর দিল না। সে কিছুটা বিব্রত।
আহমদ মুসার ঠোঁটে হাসি। বলল,’আপনার সন্দেহ ঠিক। উনি মারিয়া জোসেফাইন লুই। কিন্তু নিজের রাজকীয় পরিচয় উনি চান না। তাই ওর ডাক নাম হয়েছে ডোনা জোসেফাইন।’
আহমদ মুসার কথা শোনার সঙ্গে সঙ্গেই ফাতমার চোখ-মুখে একটা বিস্ময় ও বিব্রতকর ভাব ফুটে উঠল। সে ডোনার কাছ থেকে একটু সরে বসতে চেষ্টা করে ছোট্ট একটা বাউ করল এবং ডোনাকে বলল,’মাফ করবেন। চিনতে না পেরে আপনার সাথে অন্য রকম ব্যবহার করেছি।’
ডোনা দু’হাতে ফাতমাকে জড়িয়ে ধরে বলল,’লুই বংশে জন্মগ্রহণ করা কি আমার অপরাধ যে আমার কাছ থেকে সরে বসতে হবে, আমাকে দূরে রাখতে হবে।’
ফাতমার মুখের বিস্ময়-বিমূঢ়তা তখন কাটেনি। বলল,’মাফ করবেন। আমি বুঝতে পারছি না আপনার মাথায় ওড়না কেন? ফ্রান্স কেন ইউরোপের কোন অমুসলমান মেয়ে এই স্টাইলে ওড়না ব্যবহার করে না।’
‘হতে পারে তারা এবং আমি এক নই।’ ফাতমাকে ছেড়ে দিয়ে সোজা হয়ে বসতে বসতে ডোনা বলল।
এই সময় আহমদ মুসা পেছনে আহত মেয়েদের দিকে তাকিয়ে বলল,’ক্লিনিক কতদূর?’
‘আরও দশ মিনিট লাগবে।’
‘ক্লিনিকটা আপনাদের পরিচিত বোধ হয়?’
‘আমার আব্বা একজন পার্টনার। ভাইয়াও সেখানে ডাক্তার।’
কথা শেস করে পরক্ষণেই মেয়েটি আবার বলল,’আপনি হিট ক্যাপসুল সম্পর্কে বলতে চেয়েছিলেন।’
‘হিট ক্যাপসুল নতুন আবিষ্কার। ক্যাপসুলগুলো বাতাসের সংস্পর্শে আসার সাথে সাথে ক্যাপসুলের মোড়ক গলে যায়। ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে প্রচন্ড হিটওয়েভ। সে হিটওয়েভ আগুন সৃষ্টি করে না, কিন্তু মানুষের চামড়া ও গোশতের ওপর অসম্ভব ক্রিয়াশীল। চামড়ায় ফোস্কা পড়ে না, কিন্তু চামড়ার ভেতরের সেলগুলোকে পুড়িয়ে শেস করে দেয়। যথাসম্ভব ভালো চিকিৎসা না হলে মানুষ পঙ্গু কিংবা জীবন পর্যন্ত বিপন্ন হতে পারে।’
ভয় ফুটে উঠল ফাতমার চোকে-মুখে। বলল,’বুঝতে পারছি না এটা ঘটল কি করে?’
ক্যাপসুলগুলো নিক্সিপ্ত হয়েছে আরকাইভস বিল্ডিং-এর নিচতলার এক কক্ষ থেকে। এক প্রকার বিশেস বন্দুকে ক্যাপসুলগুলো ভরে ট্রিগার টিপে তা ছুঁড়ে দেয়া যায়। জল রংয়ের ক্যাপসুল মাটির কাছাকাছি দিয়ে বাতাসে ভেসে আসে। মিছিল ও বিক্ষোভকারীদের শায়েস্তা করার জন্যেই বিশেষভাবে এ অস্ত্র ব্যবহার করা হচ্ছে। এতে তাদের শায়েস্তাও করা হয়, আবার তাদের পাকড়াও করা যায় এই অভিযোগে যে তারা কোন অস্ত্র বহন করছিল যার বিস্ফোরণ ঘটে ঐ দুর্ঘটনার সৃষ্টি হয়েছে।’
‘সাংঘাতিক অস্ত্র তো।’
কিন্তু ফাতমার চোখে বিস্মিত দৃষ্টি। আহমদ মুসার দিকে চেয়ে সে বলল,’আপনি আর্মস এক্সপার্ট না ডাক্তার?’
‘দুটোর কোনটাই নই।’ ঠোঁটে হাসি টেনে উত্তর দিল আহমদ মুসা।
নারী কণ্ঠের একটা ‘বাঁচাও বাঁচাও’ চিৎকার ভেসে এল এ সময় রাস্তার বাম পাম থেকে।
আহমদ মুসা ওদিকে চোক ফিরিয়ে দেখল, একজন মেয়েকে দু’জন লোক জোর করে গাড়িতে তোলার চেষ্টা করছে।
আহমদ মুসা গাড়ির মাথা ঘুরিযে সেই গাড়িটার পাশে নিয়ে দাঁড় করাল।
লাফ দিয়ে নামল গাড়ি থেকে।
আহমদ মুসা ওদের কাছে যেতেই একজন মেয়েটিকে ছেড়ে দিয়ে আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে বলল,’এশিয়ান ভূত ভাগ, না হলে মাথা গুঁড়ো করে দেব।’
‘ছেড়ে দাও মেয়েটাকে। কি ঘটেছে শুনতেদাও আমাদের।’
আহমদ মুসার কথা শেষ না হতেই লোকটা এক ধাপ এগিয়ে এসে ঘুষি চালাল আহমদ মুসার চোয়াল লক্ষ্যে।
আহমদ মুসা একটু নিচু হয়ে তার ঘুষি পাশ কাটিয়ে তার কোমরের বেল্ট ধরে এক হ্যাঁচকা টানে তাকে মাথায় তুলে নিয়ে আছড়ে ফেলল মাটিতে।
ইতোমধ্যে দ্বিতীয় লোকটি তার সাথীর এই অবস্থা দেখে মেয়েটিকে ছেড়ে দিয়ে পিস্তল বের করেছিল। আহমদ মুসার দিকে পিস্তল বাগিয়ে সে বলল,’বিদেশী শয়তান এই মুহূর্তে ভাগ। না হলে মাথা ফু…।’
তার কথা শেষ হলো না।
মুহূর্তে আহমদ মুসার মাথা নিচে চলে গেল। তাঁর ডান পা ছুটে গেল লোকটার পিস্তল ধরা হাত লক্ষ্যে। তার হাত থেকে পিস্তল ছিটকে পড়ে গেল।
বিমূঢ় লোকটা কিছু বুঝে ওঠার আগেই আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল।
লোকটাও ছুটে এল ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্যে আহমদ মুসার ওপর।
আহমদ মুসা বাম হাতটা লাঠির মত সোজা করে তাকে ঠেকিয়ে দিয়ে ডান হাত দিয়ে তার বেল্ট ধরে টেনে নিয়ে শূন্যে তুলে ছুঁড়ে মারল প্রতম লোকটার ওপর। সে তখন উঠে দাঁড়িয়ে ছুটে আসছিল আহমদ মুসার দিকে। দু’জনেই আছড়ে পড়ল মাটিতে।
আহমদ মুসা ওদের লক্ষ্য করে বলল,’উঠতে চেষ্টা করো না। কুকুরের মত গুলী খেয়ে মরবে।’
আক্রান্ত মেয়েটি আহমদ মুসার পাশে দাঁড়িয়ে কাঁপছিল।
‘আপনি ওদের চেনেন বোন?’ জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা মেয়েটিকে।
‘না।’ বলর মেয়েটি।
‘কেন আপনাকে ওরা কিডন্যাপ করেছিল?’
‘কাফেতে চা খেতে খেতে ওদের সাথে দেখা। ওরা আজ রাতে আমাকে ডিনার অফার করেছিল। আমি রাজি হইনি। তারপর ওরা আমাকে তাদের সাথে যেতে বলেছিল। আমি যেতে চাইনি। তাই আমাকে জোর করে ধরে নিয়ে যাচ্ছিল।’
একটু থামল মেয়েটি।
তারপর মেয়েটি বলল,’আপনি আমাকে রক্ষা করেছেন। ঈশ্বর আপনার মঙ্গল করুন।’
পুলিশ এল এ সময়।
আহমদ মুসা সব ঘটনা পুলিশকে জানিয়ে বলল, ‘আপনারা দেখুন ব্যাপারটা।’
বলে আহমদ মুসা চলে আসছিল।
পুলিশ হাতকড়া পরাচ্ছিল দু’জন দুর্বৃত্তকে।
‘দেখুন আমি শান্তিতে থাকতে চাই, কোন মামলায় জড়াতে চাই না। আমার নিরাপত্তাহীনতা তাতে আরও বাড়বে।’ ভয়ার্ত কন্ঠে বলল মেয়েটি।
আহমদ মুসা দাঁড়াল।
একজন পুলিশ মেয়েটির কাছে এসে বলল, ‘আপনার ঠিকানা আমাদের দিয়ে চলে যান। আপনাকে বেশি কিছুতে না জড়াতে আমরা চেষ্টা করব।’
আহমদ মুসা চলে এল।
ডোনা, ফাতমা ও পেছনের মেয়েটি সবাই গাড়ি থেকে বেরিয়ে দাঁড়িয়েছিল। ফাতমা ও অন্য মেয়েটির চোখে বিস্ময়-বিমুগ্ধ দৃষ্টি।
‘দুঃখিত, কয়েক মিনিট দেরি হলো।’ ফাতমার দিকে চেয়ে কথা কয়টি বলে তাড়াতাড়ি এসে বসল ড্রাইভিং সিটে আহমদ মুসা।
ডোনা, ফাতমারাও উঠল গাড়িতে।
গাড়িতে উঠে বসেই ফাতমা বলল, ‘আমার মনে হয়ে দেরিতে হয়তো কিছু ক্ষতি হয়েছে, কিন্তু লাভ হয়েছে অনেক বড়।’
একটু থেমেই ফাতমা আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে আবার বলা শুরু করল, ‘আপনি আমাদের অবাক করেছেন, যা দেখলাম এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না। মনে হচ্ছে সিনেমার একটা দৃশ্য দেখলাম। রিভলবারওয়ালা দু’জন গুন্ডাকে আপনি একদম পুতুলে পরিণত করলেন, আশ্চর্য!’
ফাতমার চোখ থেকে বিস্ময়ের ঘোর কাটছে না। মন তার তোলপাড় করছে শান্ত-শিষ্ট, ভদ্র ও কোমল চেহারার এই লোকটি
৭৭
অমন ইস্পাতের মত কঠিন আর আগুনের মত অমন জ্বলে উঠতে পারল কেমন করে?
ডোনার ঠোঁটে হাসি। কিছু বলল না সে।
সেদিকে চেয়ে ফাতমা বলল, ‘বারে, আপনি হাসছেন, যেন কিছুই হয়নি।’
‘ও কিছু না। আসুন আমরা খারাপ অতীতকে ভুলে যাই।’ বলে আহমদ মুসা পেছনের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘বোনেরা কেমন আছেন?’
‘যন্ত্রণা আগের চেয়ে বাড়েনি।’ বলল পেছনের মেয়েটি।
‘আলহামদুলিল্লাহ, বেদনা না বাড়াটা খুবই ভালো লক্ষণ। পোড়া আরও গভীর না হওয়ারই লক্ষণ এটা।’
ফাতমা বুঝল, তার জিজ্ঞাসাকে মারিয়া এবং আহমদ মুসা দু’জনেই এড়িয়ে গেল। সুতরাং ফাতমা এ বিষয়ে আর কোন কথা বলল না। কিন্তু মনের আকুলি-বিকুলি কমল না। বরং যখন জানল আহমদ মুসা মুসলমান, তখন হৃদয়ে যেমন একটা গর্বের ভাব সৃষ্টি হলো, তেমনি মনে জিজ্ঞাসাও বেড়ে গেল। কিন্তু কিছুই বলল না। তার দৃষ্টি রইল সামনে নিবদ্ধ।
ডোনা ফাতমার অস্বস্তিটা বুঝতে পারছে। কিন্তু সে ভাবছে জিজ্ঞাসাটা আরও বাড়ুক। এক সময় বলা যাবে সব কথা। ডোনারও দৃষ্টি সামনে।
আহমদ মুসার দুই হাত স্টিয়ারিং হুইলে। দৃষ্টি তার রাস্তার ওপর নিবদ্ধ।
তারও মনে চিন্তার তোলপাড়।
ফ্রান্সের মুসলিম মেয়েরা রাস্তায় নেমেছে তাদের বিশ্বাস ও সাংস্কৃতিক অধিকার আদায়ের জন্যে।
তাদের এই শান্তিপূর্ণ চাওয়ার জবাব তারা পেল ‘হিট ক্যাপসূল’ এর আঘাতের মাধ্যমে। ফ্রান্সের মানবাধিকার যেমন তাদের ওপর এই অত্যাচারে কোন অপরাধবোধ করছে না। তেমনি ইউরোপীয়
৭৮
মানবাধিকার কমিশন এ বিষয় নিয়ে টু শব্দও করবে না। বরং উদোর পিন্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপানোর মত করে হিট ক্যাপসূলের যে আক্রমণ তার দায় মুসলমানদের ঘাড়েই চাপানোর চেষ্টা করবে। এই অসহনীয় অবস্থা থেকে মুসলমানদের মুক্তি কবে আসবে?
কারো মুখে কোন কথা নেই। এগিয়ে চলছে গাড়ি।

প্যারিস ক্রিসেন্ট ক্লিনিকের এমারজেন্সি ওয়ার্ড।
অনেকগুলো ছেলে ও মেয়ে ডা.ক্তার ব্যস্ত হয়ে উঠেছে আহত মুসলিম ছাত্রীদের নিয়ে। এদের মধ্যে ফাতমার ভাই যুবায়েরও রয়েছে।
ইমারজেন্সি ওয়ার্ডের একপাশে দাঁড়িয়ে ছিল ফাতমা।
ইমারজেন্সি ওয়ার্ডের চীফ সার্জন ডা. ওমর ফ্লেমিং এবং ডা. যুবায়ের এগিয়ে এল ফাতমার দিকে।
ওমর ফ্লেমিং বৃটিশ মুসলিম। বয়স পঞ্চাশের মত। তার চোখে-মুখে বিস্ময়।
‘তুমি নাকি ডা. যুবায়েরকে বলেছ ‘হিট ক্যাপসূল’ থেকে আঘাত পেয়েছে মেয়েরা?’ ফাতমাকে লক্ষ্য করে বলল ডা. ওমর ফ্লেমিং।
‘জি, বলেছি।’
ওমর ফ্লেমিং-এর কপাল কুঞ্চিত হলো। বলল, ‘অসম্ভব, তুমি জানলে কি করে? ক্লিনিক্যাল টেস্টের পর গত সপ্তাহে এই গোপন অস্ত্র বাজারে ছাড়া হয়েছে। আমি এ কথাটা শুনেছি রেডিয়েশন চিকিৎসা বিশেষজ্ঞ প্রফেসর গিলস ডে বোর-এর কাছে গতকাল। ডা. যুবায়ের না বললে আমি জানতে পারতাম না এগুলো ‘হিট ক্যাপসুল’- এর আঘাত।’
‘আমি কিছুই জানি না। যিনি গাড়িতে আহতদেরসহ আমাদের নিয়ে এসেছেন তিনি আমাদের একথা বলেছেন।’
‘কে তোমাদের নিয়ে এসেছে?’
‘একজন যুবক। তাঁর সাথে আছেন বুরবো রাজকুমারী প্রিন্সেস মারিয়া জোসেফাইন লুই। ঐ যুবকটি মুসলমান।’
‘কি বলছ তুমি? বুরবো রাজকুমারী এখানে এসেছেন? ঐ যুবকটির সাথে এসেছেন? এবং ঐ যুবকটি মুসলমান? অবিশ্বাস্য কথা। তুমি সত্যই জান মেয়েটি বুরবো রাজকুমারী এবং যুবকটি মুসলমান?’
‘কোন সন্দেহ নেই। রাস্তায় ঘটনা আরও মজার ঘটেছে। একটা মেয়েকে কিডন্যাপ করছিল দু’জন পিস্তলধারী সন্ত্রাসী। যুবকটি গাড়ি থামিয়ে নেমে গিয়ে পিস্তলধারী দু’জনকে খালি হাতে নাস্তানাবুদ করে মেয়েটিকে উদ্ধার করেছে। বিশালদেহী সন্ত্রাসী দু’জনকে যুবকটির কাছে খেলার পুতুল বলে মনে হয়েছে।’
চোখ ছানাবড়া হয়ে উঠল ডা. ফ্লেমিং ও ডা. যুবায়েরের।
কোন কথা বলল না তারা।
ফাতমাই কথা বলল আবার। বলল, ‘হিট ক্যাপসূল’-এর শুধু নাম বলাই নয়, এটা কি দিয়ে কিভাবে ছুঁড়তে হয়, কিভাবে যায়, কিভাবে ক্রিয়া করে, প্রতিক্রিয়া কি কি হয় ইত্যাদি সব কথাই তিনি বলেছেন।’
‘ওরা কোথায়?’
‘ওয়েটিং রুমে বসে আছেন।’
‘আছেন এতক্ষণ?’
‘আমি অনুরোধ করেছি।’
ডা. ওমর ফ্লেমিং ডা. যুবায়েরের দিকে চেয়ে বলল, ‘এরা কাজ করছে। চল আমরা একটু কথা বলে আসি।’
ওয়েটিং রুমে নয়, আহমদ মুসা ও ডোনা বসেছিল ডা. ওমর ফ্লেমিং এর অফিস কক্ষেই।
ফাতমা ডা. ফ্লেমিং ও ডা. যুবায়েরকে নিয়ে কক্ষে প্রবেশ করল।
৮০
উঠে দাঁড়াল আহমদ মুসা ও ডোনা।
ফাতমা ডা. ফ্লেমিং এবং ডা. যুবায়েরকে পরিচয় করিয়ে দিল তাদের সাথে।
ডা. ফ্লেমিং এবং ডা. যুবায়ের দু’জনে ঠিক বাউ করলো না, কিন্তু সামনের দিকে একটু মাথা ঝুঁকাল। ডা. ফ্লেমিং সসম্মানে ডোনাকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘আমাদের সৌভাগ্য যে, এক উপলক্ষে আপনাকে দেখার সৌভাগ্য আমার হলো। আমরা খুশি হয়েছি। আপনার সম্মানিত পিতার জন্যে আমাদের শ্রদ্ধা।’
‘আমি আপনার মেয়ের বয়সের। আমাকে ঐভাবে সম্বোধন করলে আমি এখানে বসতে পারবো না।’
‘ধন্যবাদ তোমাকে।’ বলে বসতে বসতে ডা. ফ্লেমিং আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে বলল, ‘ইতিমধ্যেই ফাতমা আপনার সম্পর্কে যা বলেছে তাতে আমরা চমৎকৃত হয়েছি। পরিচিত হতে এসেছি আপনার সাথে। ভীষণ খুশি হয়েছি জেনে যে আপনি মুসলমান।’
থামল ডা. ফ্লেমিং। আহমদ মুসা ও ডোনার দিকে একবার চেয়ে বলল, ‘একটা পার্সোনাল প্রশ্ন করলে কি রাগ করবেন আপনারা?’
‘মোটেই না, করুন।’ বলল আহমদ মুসা।
‘কিছু মনে করবেন না, আপনাদের পরিচয় যেহেতু দুই প্রান্তের, তাই আমার জানতে ইচ্ছা করছে আপনাদের দু’জনের মধ্যে কি সম্পর্ক?’
প্রশ্নটা বিদঘুটে এবং একেবার নগ্ন।
ডোনা তাকাল আহমদ মুসার দিকে। তার মুখ লাল হয়ে উঠেছে লজ্জায়। আহমদ মুসার ঠোঁটে ফুটে উঠেছে ছোট্ট এক টুকরো হাসি।
আহমদ মুসার দিকে তাকানোর পর মুখটা একটু নত করেছিল ডোনা। পরক্ষণেই মুখ তুলে সলজ্জ হেসে বলল, ‘কি উত্তর দেব আমি বুঝতে পারছি না।’ বলে আবার মুখ নামিয়ে নিল ডোনা।
ফাতমাসহ সবারই চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। ডোনা উত্তর দিতে না পারলেও ডোনার লাজরাঙ্গা মুখ জিজ্ঞাসার জবাব দিয়ে দিয়েছে।
‘ঠিক আছে। বেশ। তাতে কি।’ মুখে স্নেহের হাসি টেনে বলল ডা. ফ্লেমিং।
ডা. ফ্লেমিং-এর কক্ষের দরজায় পর্দার আড়ালে এসে দাঁড়িয়েছিল বয়স্ক একজন ভদ্রলোক এবং একজন ভদ্রমহিলা। তারা শুনছিল কথাগুলো। কক্ষে ঢুকবে কি ঢুকবে না চিন্তা করছিল। তারা ওয়ার্ডে একজন মেয়ের কাছ থেকে দু’জন অতিথির কথা শুনেছে পথের সব কাহিনীসহ। জেনেছে অতিথিদের একজন মুসলিম যুবক, আরেকজন প্রিন্সেস মারিয়া। সাগ্রহে তাদের সাথে দেখার করার জন্যেই এসেছে। পর্দার দু’ভাগের মাঝখান দিয়ে তারা দু’জনকেই দেখতে পাচ্ছে।
ডা. ফ্লেমিং থামতেই আহমদ মুসা ঈষৎ হেসে জড়তাহীন অত্যন্ত সরল কন্ঠে বলল, ‘একটা দুর্ঘটনাকে কেন্দ্র করে ওর সাথে আমার পরিচয়। তারপর স্পেন ও ফ্রান্সে বেশ কিছু ঘটনা-দুর্ঘটনা আমাদের বার বার দেখা করিয়েছে। সামনে আরও কিছু ঘটবে কিনা আমরা দু’জন কেউ তা জানি না।’
পর্দার এপারে দাঁড়ানো ভদ্রলোকের চোখে-মুখে আনন্দ উপচে উঠল।
‘চমৎকার, চমৎকার জবাব। এটা পৃথিবীর যে কোন উন্নত সাহিত্যের একটা অংশ হতে পারে!’ কথাগুলো বলতে বলতে ভদ্রলোক ও ভদ্রমহিলা দু’জন পর্দা ঠেলে ঘরে ঢুকল।
ভদ্রলোকটি আবু আমের আব্দুল্লাহ। বয়স সত্তরের কাছাকাছি। ফাতমার আব্বা এবং ভদ্রমহিলার নাম খাদিজা। ফাতমার আম্মা। বিক্ষোভ মিছিলে গন্ডগোল্লের খবর শুনে তারা ছুটে এসেছে ক্লিনিকে।
তারা প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গে ডা. ফ্লেমিং ও যুবায়ের উঠে দাঁড়াল। তাদের সাথে অন্যে সকলেই। প্রবেশ করেই বলল, ‘সকলের কাছে মাফ চাচ্ছি, এই অসৌজন্যমূলক প্রবেশের জন্যে। আরও মাফ চাচ্ছি, পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে কথা শোনার জন্যে।’
ফাতমা এসে তার আব্বা-আম্মার মাঝখানে দাঁড়াল। আহমদ মুসা ও ডোনাকে লক্ষ্য করে বলল, ‘আমার আব্বা, ইতিহাসের অধ্যাপক ছিলেন। ফরাসী ভাষায় কবিতা ও গল্পও লেখেন। কয়েক বছর আগে রিটায়ার করেছেন অধ্যাপনা থেকে। আমার আম্মা ও আমরা চার জেনারেশন ধরে ফ্রান্সে আছি।’
ফাতমা আহমদ মুসাদের সম্পর্কে বলতে যাচ্ছিল। বাধা দিয়ে তার আব্বা বলল, ‘বলতে হবে না, নাবিলা ন্যান্সির কাছে সব শুনেছি ইতিমধ্যেই।’
নাবিলা ন্যান্সিও আহত মেয়েদের সাথে আহমদ মুসার গাড়িতে এসেছিল।
বসল সবাই।
ডা. ফ্লেমিং বলল, ‘এই যুবকই আহতদের দেখে বলেছে ‘হিট ক্যাপসূলে’ মেয়েরা আহত হয়েছে। উনি না বললে এতক্ষণও আমরা বুঝতে পারতাম না যে, কিসে এমনটা ঘটল। তার ফলে যথাসময়ে উপযুক্ত চিকিৎসা আমরা শুরু করতে পারতাম না। তাই আমি কৃতজ্ঞতা জানাতে এসেছিলাম সেই সাথে আমার জানার আগ্রহ হয়েছিল, সপ্তাহ খানেক আগে বাজারে চালু হওয়া এই মারণাস্ত্র সম্পর্কে এতটা বিস্তারিত কিভাবে জানতে পারলেন?’
‘সপ্তাহ খানেক আগে বাজারে এসেছে ঠিক, কিন্তু ‘স্ট্রাটেজিক জার্নাল’ এবং ‘ওয়ার্ল্ড সাইন্স’ এক বছর আগে এই আবিষ্কার সম্পর্কে লেখে।’
‘জার্নাল দুটির নাম শুনেছি। কোনদিন দেখিনি। এ দু’টি দুর্লভ জার্নাল তাহলে আপনি নিয়মিত পড়েন?’
‘জি।’
‘আমার মত এক্টু-আধটু পড়ুয়া এবং জ্ঞান-গবেষণায় ব্যস্ত যারা, তারা তো কুংফু, কারাত বা মারামারি থেকে দশ যোজন দূরে থাকে।কিন্তু বাছা শুনলাম তুমি পিস্তলধারী দুই গুন্ডাকে খালি হাতেই সাবাড় করেছ। দুইতে তো মিলছে না বৎস!’
আহমদ মুসা একটু হাসল এবং বলল, ‘মানুষ বলতে পরিপূর্ণ মানুষ বুঝায়। মানুষকে পূর্ণ হতে হলে তো তাকে সব যোগ্যতাই অর্জন করতে হবে। মুসলমানদের ক্ষেত্রে এটা আরও বেশি সত্য। মুসলমানদের আল্লাহ উত্থান ঘটিয়েছেন পৃথিবীর মানুষকে ভালো কাজের নির্দেশ দেয়া এবং মন্দ কাজ থেকে বিরত রাখার জন্যে। অন্য কথায় পৃথিবীর নেতৃত্ব দেয়ার জন্যে। নেতৃত্ব দিতে হলে তো সব যোগ্যতাই তাদের অর্জন করতে হবে। অন্তত প্রতিটি মুসলমানকে একই সাথে গৃহী, পুলিশ ও সৈনিকের ভূমিকা পালনের মত যোগ্যতা অর্জন করতেই হবে। ইতিহাস বলে এই যোগ্যতা যখন আমরা হারিয়ে ফেলতে শুরু করেছি, মুসলমানদের পতন শুরু হয়েছে তখন থেকেই। আর……।’
‘থাম থাম বৎস! বলে ফাতমার আব্বা আহমদ মুসাকে থামিয়ে দিল। বলল, ‘একটু দাঁড়াও একথাগুলো আমি লিখে নিই। আমার জীবনে এমন কথা শুনিনি।’ বলে কাগজ-কলম বের করল ফাতমার আব্বা।
এরপর ফাতমার আব্বাই প্রথম কথা বলল, ‘কোটেশনের সাথে যার কোটেশন তার নাম থাকতে হয়। নামটা তোমার বল বৎস!’ বলে চোখ তুলে তাকাল আহমদ মুসার দিকে।
আহমদ মুসা একটু দ্বিধা করল। তাকাল ডোনার দিকে। তারপর ফাতমার আব্বার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘লিখুন, আহমদ মুসা।’
ফাতমার আব্বা মাথা নিচু করল লেখার জন্যে। কিন্তু লিখতে শুরু করেই হঠাৎ মাথা তুলে জিজ্ঞেস করল, ‘কোন আহমদ মুসা?’ তার কন্ঠে বিস্ময় ও জিজ্ঞাসার উচ্ছ্বাস।
আহমদ মুসা ও ডোনা ছাড়া সবার চোখে-মুখেই এই একই বিস্ময় এবং জিজ্ঞাসা।
আহমদ মুসা কোন জবাব দিল না।
ডোনার দৃষ্টি আহমদ মুসার দিকে নিবদ্ধ। ঠোঁটে তার গৌরবের হাসি।
‘বাড়ি তোমার কোন দেশে?’ ফাতমার আব্বাই প্রশ্ন করল।
‘কোন দেশেই আমার বাড়ি নেই।’
‘নেই? তোমার দেশ?’
‘আমার কোন দেশ নেই।’
‘দেশও নেই? তুমি কোন দেশের নাগরিক?’
‘প্রায় সকল মুসলিম দেশের নাগরিকত্ব আমার আছে।’
শুধু ফাতমার আব্বার নয় অন্যে সকলের দৃষ্টিও বিস্ময়ে বিস্ফারিত। পিনপতন নীরবতা।
‘কোন দেশ থেকে তুমি ফ্রান্সে এসেছিলে?’
‘মধ্যএশিয়া থেকে।’
‘মধ্যএশিয়ার কোন দেশ থেকে?’
‘সিংকিয়াং থেকে।’
‘সিংকিয়াং-এ কোন দেশ থেকে?
‘স্পেন অথবা বলা যায় ফ্রান্স থেকে।’
‘স্পেনে এসেছিলে কোত্থেকে?’
‘বলকান বা যুগোশ্লাভিয়া থেকে।’
‘সেখানে?’
‘ককেশাস থেকে।’
‘ককেশাসে?’
‘মধ্যএশিয়া থেকে।’
‘সেখানে?’
‘মিন্দানাও।’
‘আর মিন্দানাওয়ে?’
‘ফিলিস্তিন।’
‘ফ্রান্স থেকে কোথায় যাবে?’
‘জানি না, ঘটনা যেখানে নিয়ে যায়।’
ঝট করে উঠে দাঁড়াল ফাতমার আব্বা।
ফাতমা, ডা. যুবায়ের, ডা. ফ্লেমিং সবাই বিস্ময় বিমূঢ়।
ফাতমার আব্বা উঠে এসে সবাইকে অবাক করে দিয়ে হাঁটু গেড়ে বসল আহমদ মুসার চেয়ারের পাশে। আহমদ মুসার একটি হাত নিয়ে চুমু খেল এবং হু হু করে কেঁদে উঠল। বলল, ‘তুমি আমাদের স্বপ্নের আহমদ মুসা! আল্লাহ নিয়ে এসেছেন আমাদের মাঝে। তাঁর অপার করুণা।’ বলে বৃদ্ধ দু’হাত ওপরে তুলল মোনাজাতের জন্যে।
সবার চোখ সিক্ত হয়ে উঠেছে। ডোনারও। ফাতমারও। বৃদ্ধের বাঁধ ভাঙ্গা আবেগ সকলের হৃদয়কেই স্পর্শ করেছে।
‘মাফ করবেন, আমি খুবই বিব্রত বোধ করছি। যে ভালবাসা আমি আপনাদের কাছে পেয়েছি, বিনিময়ে আমি কিছুই করতে পারিনি।’ ভারী কন্ঠ আহমদ মুসার।
‘বিনয় তোমার মহত্ব। তুমি তো এখনই বললে, তোমার বাড়ি নেই, দেশ নেই। কেন নেই? জাতির জন্যেই তো। জাতিকে তুমি তোমার সবটুকুই দিয়ে দিয়েছো।’ বলল ফাতমার আব্বা।
সবাই নীরব।
ফাতমা, যুবায়ের, ওমর ফ্লেমিং কারও মুখে কোন কথা নেই, সবাই যেন বোবা হয়ে গেছে। সবার অনিমেষ দৃষ্টি আহমদ মুসার প্রতি নিবদ্ধ।
বৃদ্ধই আবার কথা বলল, ‘কি যে আনন্দ লাগছে! জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ ঈদ আমার আজ। তোমার কাহিনী শুনেছি আর কত যে ভেবেছি, আমার বয়স থাকলে তোমার সাথী হতাম তোমার ফায়ফরমাস খাটার জন্যে।’
‘আমি দুঃখিত, এ ধরনের কথা বলে আমাকে কষ্ট দেবেন না।’
বলে আহমদ মুসা একটু থেমেই আবার বলল, ‘আপনাদের সাথে পরিচিত হয়ে আমার খুব আনন্দ লাগছে। এর আগেও ফ্রান্সে এসেছি, কিন্তু এখানকার মুসলিম কমিউনিটির সাথে মেশার সুযোগ পাইনি। এবার সে সুযোগ হলে আপনাদের সাথে এবং অন্যদের সাথে দেখা অবশ্যই করব। আমি এখন উঠতে চাই।’
‘অসম্ভব এভাবে আমরা তোমাকে ছাড়তে পারি না।’ বলল বৃদ্ধ। সঙ্গে সঙ্গেই ফাতমা বলল, ‘কিছুক্ষণের মধ্যেই সিটি হলে আমাদের একটা প্রতিবাদ সভা হচ্ছে। সেখানে আপনাকে না নিয়ে ছাড়বো না আমরা।’
আহমদ মুসা হাসল। বলল, ‘বোন আমি খুশি হতাম ওখানে যেতে পারলে। কিন্তু যাওয়া হবে না। আমি এসেছি সে কথা ফরাসী সরকার ও পুলিশকে আমি এখনো জানতে দেইনি। ছদ্মনামে আমি এয়ার পোর্টে নেমেছি। এর পরও ওখানে গেলে যে আমার পরিচয় প্রকাশ হবে, সেটা আমি ভাবছি না। ওখানে গেলে তোমাদের ক্ষতি হবে, এ জন্যেই আমি সেখানে যাব না।’
‘ঠিক আছে ওখানে নয়, আমার গরিবালয়ে যেতে হবে। আমার গরিবালয়ের কপালে ইতিহাসের এক তিলক পরাতে চাই। আমার এ আকাঙ্ক্ষাকে পদদলিত করতে পারবে না।’ ফাতমার আব্বার কন্ঠে অনুনয়ের সুর ফুটে উঠল।
‘আমাকে অপরাধী করবেন না। একটু অবসর হলেই আমি আসব। এখন আমার সমস্ত চিন্তা মনোযোগ অন্য একটা বিষয়ের প্রতি নিবদ্ধ। এখন থেকে কয়েক ঘন্টার মধ্যেই আমি প্যারিস থেকে বেরিয়ে যাব।’
কথাটা শুনেই ডোনা তাকাল আহমদ মুসার দিকে। তার মুখটা ম্লান হয়ে গেল।
‘একটা প্রশ্ন করতে পারি?’ বলল ডা. যুবায়ের, ফাতমার ভাই।
‘অবশ্যই।’ হেসে বলল আহমদ মুসা।
‘দু’টি প্রশ্ন। এক, আমি পড়েছি এবং শুনেছি, বড় ও গুরুতর কিছু ঘটলেই আপনি সেখানে যান। স্পেনে যে বিরাট কাজ করেছেন, সে উপলক্ষেই গতবার আপনি ফ্রান্সে এসেছিলনে। আপনি যখন ফিরে এসেছেন, নিশ্চয় গুরুতর কিছু ঘটেছে। আপনার কথা থেকেও সেটা বুঝলাম। বিষয়টা কি?’
দুই, আপনার প্যান্ট ও জুতায় রক্তের ছিটা দেখেছি, এটা কোন ঘটনার ইংগিত দেয়। আমার কৌতূহল সেটা কি?’
‘দ্বিতীয় প্রশ্নের জবাবটাই প্রথম দেই।’ বলে শুরু করল আহমদ মুসা, ‘শত্রুর ঠিকানা যোগাড় করতে গিয়ে সেই শত্রুর ফাঁদে পড়েছিলাম। তারা আমাকে একটা গাড়িতে নিয়ে যাচ্ছিল। ওরা ছিল চারজন। পথে একটা পার্কের বুশ টয়লেটে ওদের আটকে রেখে আমি ওদের ঘাঁটিতে যাই। কিন্তু……।’
আহমদ মুসাকে বাধা দিয়ে ফাতমা বলল, ‘ওরাই তো আপনাকে ধরে নিয়ে যাচ্ছিল, আপনি ওদের আটকালেন কিভাবে?’ ফাতমা এবং অন্যদের চোখে আগ্রহ ও জিজ্ঞাসা ঠিকরে পড়ছে।
আহমদ মুসা কাহিনীটা বলে আবার শুরু করল, ‘কিন্তু আমি যাদের আটকে রেখে গিয়েছিলাম তারা ওয়্যারলেসে আমি তাদের ঘাঁটিতে পৌঁছার আগেই আমার কথা জানিয়ে দিয়েছিল। সুতরাং ঘাঁটির লোকরা আমার জন্যে ফাঁদ পেতে বসে ছিল। আমি তাদের ফাঁদে পড়ে যাই। তারা তিনজন যখন আমাকে বাঁধতে যাচ্ছিল, তখন ডোনা মানে আপনাদের প্রিন্সেস মারিয়া জোসেফাইন পিস্তলের গুলীতে ঐ তিনজন লোককে হত্যা করে আমাকে উদ্ধার করে। তাদেরই রক্তের ছিটা আমার প্যান্টে ও জুতায়।’
‘প্রিন্সেস তো আপনার সাথে ছিল না, তাহলে কিভাবে……?’
জিজ্ঞাসা অসমাপ্ত রেখেই চুপ করল ডা. ফ্লেমিং।
‘আমি বিপদে পড়ব- এই আশংকায় সম্ভবত ডোনা আমার অলক্ষ্যে আমাকে ফলো করছিল।’ বলে আহমদ মুসা সার্ভিস সেন্টারে আসার সময়ের কাহিনী জানাল।
ডোনার মুখ লাল হয়ে উঠেছিল লজ্জায়। সে মুখ নিচু করে বসেছিল।
‘আপনি বুশ টয়লেটে বন্দী রেখে ওদের ওয়্যারলেস করা সুযোগ দিলেন কেন?’ জিজ্ঞেস করল ডা. যুবায়ের।
‘ওদের বিপজ্জনক মনে না করা এবং তাদের সার্চ না করা আমার ভুল হয়েছিল। আর বন্দী না রেখে হত্যা করতে পারতাম, তাহলে সব বালাই চুকে যেত। কিন্তু আমি নিজের জীবন বাঁচানোর প্রয়োজন ছাড়া হত্যাকান্ড ঘটাই না।’
‘কেন কথা আছে না, শত্রুর শেষ রাখতে নেই!’ বলল ফাতমার আব্বা বৃদ্ধটি।
‘ওটা ইসলামের নীতি নয়।’ বলল আহমদ মুসা।
‘বুঝিয়ে বলুন।’ বলল ফাতমা।
‘ইসলাম চায় মানুষের ইহকালীন শান্তি ও পরকালীন মুক্তির জন্যে দুনিয়ার সবাইকে আল্লাহর বান্দায় পরিণত করতে। শত্রুও এর মধ্যে শামিল।সুতরাং শুধু শত্রুর বিনাশ নয়, তাকে যতটা সম্ভব আল্লাহর বান্দা হবার সুযোগও দিতে চায় ইসলাম।’
‘ফ্রান্সের যাদের সাথে আপনার এই সংঘাত, সেই শত্রু কারা?’
‘ব্ল্যাক ক্রস।’
‘ব্ল্যাক ক্রস?’ এক সাথে ফাতমার আব্বা, ডা. ফ্লেমিং এবং ডা. যুবায়েরের কন্ঠ আঁৎকে উঠে উচ্চারণ করল।
আঁৎকে ওঠা কন্ঠ মিলিয়ে না যেতেই ডা. যুবায়ের বলে উঠল, ব্ল্যাক ক্রস সাংঘাতিক বড় প্রভাবশালী এবং সাংঘাতিক শক্তিশালী খুনী সংগঠন। প্রথম দিকে একে নির্দোষ এনজিও মনে করতাম। কিন্তু প্রমাণ হয়েছে, খৃস্টানদের ন্যায়-অন্যায় যে কোন স্বার্থে রক্ষা এবং মুসলমানদের ক্ষতি বা বিন্যাশ করার ব্যাপারে তাদের জুড়ি ইউরোপে নেই। মুসলিম ছাত্রীদের ওপর আজ যা ঘটল, আমি মনে করি এটাও ব্ল্যাক ক্রসের পরিকল্পনা।’
‘ঠিকই বলেছেন।’ বলল আহমদ মুসা।
‘কিন্তু কিভাবে এদের সাথে আপনার যোগাযোগ ও সংঘাত বাঁধল?’ বলল যুবায়ের।
‘প্রথম প্রশ্নের জবাবেই এটা পেয়ে যাবেন।’ বলে আহমদ মুসা ওমর বায়ার সাথে তার দেখা হওয়া থেকে শুরু করে ওমর বায়ার সমস্ত কাহিনী, তার সর্বশেষ কিডন্যাপ হওয়া, তাকে উদ্ধারের জন্যে তার ফ্রান্সে আসা, ব্ল্যাক ক্রসের সাথে তার সংঘাতের সব কাহিনী বর্ণনা করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘এ পর্যন্ত ব্ল্যাক ক্রসের প্রায় জনা চল্লিশেক নিহত হয়েছে, কিন্তু ওমর বায়ার সন্ধান এখনও পাইনি, তাকে উদ্ধারের কাজ এখনও শুরুই করতে পারিনি।’
ফাতমার আব্বা আবু আমের আবদুল্লাহ, ডা. ওমর ফ্লেমিং, ডা. যুবায়ের, ফাতমা সকলেই বলা যায় রুদ্ধশ্বাসে শুনছিল আহমদ মুসার কাহিনী।
আহমদ মুসা থামার পর ধীরে ধীরে মুখ খুলল ফাতমার আব্বা আবু আমের আব্দুল্লাহ। বলল, ‘তোমার জন্যে আল্লাহর কাছে দোয়া করি, আল্লাহ তোমাকে আরও বড় দিল দিন, আরও যোগ্যতা দিন এবং আরও বড় সাফল্য দিন। তুমি মাত্র একজন মানুষ, একজন ভাইকে উদ্ধারের জন্যে ফ্রান্সে এসেছে এবং এত বড় বিপদে জড়িয়ে পড়েছে!’
‘জনাব, ওমর বায়া এখন একজন ব্যক্তি মাত্র নয়। সে সমগ্র ক্যামেরুনের মুসলিম স্বার্থের প্রতীক। তার বিজয় সেখানে নতুন বিজয়ের যাত্রা সূচিত করবে। আর পরাজয় সেখানকার মুসলিম ভবিষ্যতকে গাঢ় অন্ধকারে ঢেকে দেবে। এই অস্তিত্বের সংগ্রামে আমরা বিনাযুদ্ধে পরাজয় মেনে নিতে পারি না।’
‘আল্লাহ আপনাকে সফল করুন। আমাদের কিছু করণীয় নেই?’ বলল ডা. যুবায়ের।
‘আপাতত নেই। ওমর বায়ার সন্ধান পাবার পর এমন কিছুর প্রয়োজন দেখা দিতেও পারে। তবে আমি চাই না এখনকার কম্যুনিটিকে এর সাথে সংশ্লিষ্ট করে ব্ল্যাক ক্রসকে তাদের বিরুদ্ধে আরও বেশি খেপিয়ে তুলতে।’
‘আপনি প্যারিসের বাইরে কোথাও যাবেন বললেন?’ বলল ফাতমা।
‘ব্ল্যাক ক্রসের হেড কোয়ার্টারের সন্ধানে।’
‘কোথায়?’ ফাতমাই বলল।
‘কোথায় যদি জানতে পারতাম!’
‘তাহলে কোথায় যাবে?’ বলল ফাতমার আব্বা।
‘ইংলিশ চ্যানেলের মুখে কোন এক শহর, সেই শহরের এক ঐতিহাসিক গীর্জায় ব্ল্যাক ক্রসের হেড কোয়ার্টার। আমি সেই শহর এবং সেই গীর্জা খুঁজে বের করব।’
‘কি বললে ইংলিশ চ্যানেলের মুখে শহর এবং সেখানকার ঐতিহাসিক গীর্জা?’
স্বগতোক্তির মত কথাগুলো বলে চোখ বন্ধ করল বৃদ্ধ আবু আমের আবদুল্লাহ।
অল্পক্ষণ পরে চোখ খুলে বলল, ‘তুমি কিভাবে এগোবে ঠিক করেছ?’
‘গীর্জার ডাইরেক্টরি থেকে দেখব ইংলিশ চ্যানেল মুখের কয়টি শহরে ঐতিহাসিক গীর্জা আছে। তারপর গীর্জা ভিত্তিক অনুসন্ধান চালাব।’
‘এজন্যেই তুমি আহমদ মুসা। ভুল পথে তুমি চল না।’
একটু থামল বৃদ্ধ। তারপর একটু নড়েচড়ে বসে বলল, ‘ঐ এলাকায় ব্যাপক ঘুরেছি। থেকেছিও অনেক সময়। তোমাকে বোধ হয়ে কিছু সাহায্য করতে পারি। শহরটি যদি ইংলিশ চ্যানেলের মুখে হয়, তাহলে এ শহর সন্ধান করতে হবে উত্তরে সেন্ট মালো উপসাগর থেকে দক্ষিণে ফ্রান্সের পশ্চিম উপকূলের শীর্ষ পর্যন্ত। আর যেহেতু বলা হয়েছে শহরটি সাগর উপকূলের মুখে, তাই এ শহরটিকে অবশ্যই সাগর তীরে হতে হবে। এই বৈশিষ্ট্য দু’টিকে সামনে রেখে ঐ অঞ্চলের চারটি শহর আমাদের বিবেচনায় আসে। সর্ব উত্তরে পামপুল,তাঁর পরের শহরগুলো হলো, পেরেজ গিরেক,সেন্ট পোল ডে লিউন এবং প্লেগেমো। এখন দেখতে হবে এ শহরগুলোর কোনটিতে কি কি ঐতিহাসিক গীর্জা রয়েছে। ইতিহাসের ছাত্র হিসাবে ফ্রান্সের পুরাকীর্তি আমার একটি পাঠ্য বিষয় ছিল। সেই জ্ঞান থেকে আনি বলতে পারি, এ চারটি শহরে কোথাও কোন ঐতিহাসিক গীর্জা নেই। থাকতে পারে না। কারন শহর চারটি বলা যায় সাম্প্রতিক কালের। কোনটারই বয়স ‘একশ’ বছরের বেশি নয়। প্লেগেমো শহরের পূর্ব দিকে বিখ্যাত শহর ব্রিস্টে তিনটি ঐতিহাসিক গীর্জা রয়েছে। কিন্তু শহরটিকে ইংলিশ চ্যানেলের মুখে বলা যায় না।
থামল বৃদ্ধ। শুরু করল আবার। বলল, ‘তবে ঐ চারটি শহরে ঐতিহাসিক গীর্জা না থাকলেও ঐতিহাসিক নামের গীর্জা আছে, যাদের বয়স খুব কম নয়’।
‘কয়টি গীর্জা এমন আছে? বলল আহমদ মুসা। তাঁর চোখ দুটি উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে।
‘এরকম গীর্জা দু’টি আছে। একটি পেরেজ গিরেকে। নাম সেন্ট অগাস্টাস। অন্যটি সেন্ট পোল ডে লিউন-এ। নাম চার্চ শার্লেম্যান’।
চোখের ওজ্জ্বল্য গোটা মুখে ছড়িয়ে পড়ল আহমদ মুসার। বলল, ‘আলহামদুলিল্লাহ্‌। ধন্যবাদ আপনাকে। অমুল্য সাহায্য আপনি আমাকে করলেন। পথ আমি পেয়ে গেছি। আমি মনে করি চোখ বন্ধ করে আমি এখন অগ্রসর হতে পারবো’।
‘কোনটার ব্যাপারে আপনি কি নিশ্চিত হতে পেরেছেন?’ বলল ডাঃ জুবায়ের।
‘আমার ফার্স্ট প্রাইওরিটি ‘চার্চ শার্লেম্যান’ এবং সেকেন্ড প্রাইওরিটি ‘সেন্ট অগাস্টাস’।
‘চার্চ শার্লেম্যান ফার্স্ট প্রাইওরিটি কেন?’ বলল ফাতমার আব্বা আবু আমের আবদুল্লাহ।
‘কারন শার্লেম্যান-এর আদর্শ ও লক্ষ্যের সাথে ব্ল্যাক ক্রসের আদর্শ ও লক্ষ্য মিলে যায়’।
কথা শেষ করেই আহমদ মুসা সবার দিকে একবার চোখ ঘুরিয়ে নিয়ে বলল, ‘অনুমতি দিন আমাদের এবার উঠতে হবে’।
‘আমার একটা কথা আছে’। বলল ফাতমা।
‘বল’। বলল আহমদ মুসা।
‘ভেনিসে আপনি মেয়েদের সম্মেলনে গিয়েছিলেন এবং সেখানে জুমার জামাতেও আপনি বক্তৃতা দিয়েছিলেন, তাহলে আমাদের সম্মেলনে যেতে আপনার অসুবিধা কি?’
‘একথা তুমি জানলে কেমন করে?’
‘আয়েশা আপা আমাকে বলেছেন। মনে আছে আপনার তাঁর কথা?’
‘অবশ্যই। কিন্তু তাঁর সাথে তোমার পরিচয় ও দেখা কিভাবে?’
‘উনি আমি সকলেই তো ‘ইয়ুথ সোসাইটি অব ইউরোপিয়ান রেনেসাঁ (YSOUR)-এর সদস্য। ডাঃ জুবায়ের ভাইয়াও সদস্য’।
‘খোশ আমদেদ তোমাদের’-বলে আহমদ মুসা উঠে দাড়িয়ে হ্যান্ডশেক করল ডাঃ জুবায়েরের সাথে। আনন্দের বন্যায় উজ্জ্বল আহমদ মুসার চোখ-মুখ। বসতে বসতে সে বলল, ‘এই ইয়ুথ সোসাইটির ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আমি খুব আশাবাদী। ইউরোপে এ এক নতুন রেনেসাঁ নিয়ে আসবে ইনশাআল্লাহ্‌’।
ডাঃ ফ্লেমিং, জুবায়ের, ফাতমা এবং ফাতমার আব্বা আম্মা এক সাথে আমীন বলে উঠল।
আহমদ মুসা বলল, ‘আমি ভেনিসে মেয়েদের সম্মেলনে গিয়েছিলাম, জুমআর জামাতেও বক্তৃতা দিয়েছিলাম, কারন তখন আমার কর্মক্ষেত্র স্পেনে। ফ্রান্সের সরকার কিংবা ফ্রান্সের কারো সাথে আমার তখন সংঘাত ছিলনা। সুতরাং আমার উপস্থিতি তখন ক্ষতিকর ছিল না, যেমনটা এখন হতে পারে’।
‘তাহলে আমাদের সম্মেলনে আপনি লিখিত একটা বানী দিন’। বলে ফাতমা এক শিট কাগজ ও একটা কলম তুলে ধরল আহমদ মুসার সামনে।
কাগজ হাতে নিয়ে বানী লিখল তাতে আহমদ মুসা। লেখা শেষ করে কাগজ তুলে দিল ফাতমার হাতে।
ফাতমা দাড়িয়ে লেখা দেখছিল।
‘ধন্যবাদ’ বলে ফাতমা কাগজ হাতে নিল।
‘পড়তো মা। ম্যাসেজটি আমরাও শুনি’। বলল ফাতমার আব্বা আবু আমের আবদুল্লাহ।
ফাতমা তাঁর সীটে ফিরে গিয়ে দাড়িয়ে থেকেই পড়া শুরু করলঃ
‘এক ভাইয়ের পক্ষ থেকে ফ্রান্সের ভাইবোনদের প্রতি।
অমুসলিম সমাজে মুসলমানদের উপস্থিতি বা আগমন, মরুভূমির অতিমুল্যবান দুর্লভ বৃষ্টির মতো। কিন্তু মরুভূমির আগুনে আগ্রাসী বাতাস যেমন শুষে নেয় মরুভূমির বৃষ্টির ধারাকে, অমুসলিম সমাজের শান ও পরিবেশও তেমনি চায় মুসলিম নামক শান্তির নির্ঝরণীকে নিরস্তিত্ব করতে। ন্যায়ের সাথে অন্যায়ের, সত্যের সাথে মিথ্যার এ এক নিরন্তন সংঘাত। এই সংঘাত মুসলিম জীবনের শুধু অলংকার বা অহংকার নয়, জান্নাতের সোনালী সড়কও।
মাথায় ওড়না পড়া নিয়ে ফ্রান্সের মুসলিম মেয়েরা যে বিপদে পড়েছে, তাঁকে আমি বিপদ মনে করি না, কোন সংকট মনে করি না। যাকে আমি বিপদ ভাবছি, সংকট মনে করছি, তা আমাদের আত্নোপলব্ধিকে শাণিত করতেই সাহায্য করবে এবং সৃষ্টি করবে এমন এক সক্রিয়তা যা সেই শাণিত উপলব্ধিকে দান করবে অপরুপ রুপময়তা। অন্যদিকে এই বিপদ অমুসলিম সমাজের এক বিরাট অংশের মধ্যে নিয়ে আসবে আগ্রহ, অনুসন্ধিৎসা ও সহানুভূতি। এই দুটি দিকের পরিপুরকতা এগিয়ে দিবে দেবে মুসলিম সমাজকেই। সুতরাং এই ধরনের বিপদ মুসলিম সমাজের জন্যে অগ্রগতির রজত সিঁড়ি। এই অগ্রগতির পথে মুসলমানদের সবচেয়ে বড় শত্রু অধৈর্য ও হঠকারিতা। আইন ভাঙ্গা নয়, আইনের পরিবর্তনের জন্যেই সংগ্রাম করতে হবে মুসলমানদের। এই সংগ্রামে নির্যাতন যত বাড়বে মুসলমানরা ততো লাভবান হবে এবং ক্ষতি হবে নির্যাতনকারী সংখ্যাগরিষ্ঠদের এবং এভাবেই বিজয় আসবে ফ্রান্সের মুসলমানদের এবং একদিন তারা সংখ্যালঘিষ্ঠতা থেকে উপনীত হবে সংখ্যাগরিষ্ঠতায়।
এই লক্ষ্য অর্জনের জন্যে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন আল্লাহ্‌র রহমত এবং তাঁর সাহায্যের। আল্লাহ্‌র সাহায্য লাভের জন্যে যোগ্যতা অর্জনের প্রশ্নটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। জ্ঞানে-মানে, ঈমানে-আমলে, দূরদর্শিতা ও দক্ষতা সব দিক দিয়েই যোগ্যতা অর্জন করতে হবে মুসলমানদের। এই যোগ্যতা অর্জনের দিকেই আমি আপনাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। ইসলামই আজ একমাত্র জ্ঞান ও যুক্তির ধর্ম। জ্ঞান ও যুক্তি দিয়েই আমাদের বিশ্ব জয় করতে হবে। ইসলামের এই বিশ্ব জয়ের সংগ্রামে আপনাদের, ইউরোপীয় মুসলমানদের, অগ্রণী ভুমিকা আমি প্রত্যাশা করি। আল্লাহ আপনাদের সহায় হোন। আমীন’।
পড়া শেষ করল ফাতমা। তাঁর আমীন উচ্চারনের সাথে সকলে ‘আমীন’ বলে উঠল। ডোনাও।
‘আমি খুব খুশি। ধন্যবাদ জানাচ্ছি আমাদের মহান ভাইকে। তাঁর এই বানীর প্রতিটি শব্দ স্থির,প্রদীপ্ত ধ্রুবতারার মত আমাদের দিক নির্দেশনা দিবে’। বলল ফাতমা।
‘ওয়েলকাম বোন’। বলল আহমদ মুসা।
কথা বলল ফাতমার আব্বা আবু আমের আবদুল্লাহ। বলল, ‘আহমদ মুসা তোমার বানী তোমার মতই। এতে এক সাগর কথাকে তুমি আটকে ফেলেছ। সময় থাকলে আমার অনেক জিজ্ঞাসা ছিল’।
‘দোয়া করুন, সময় যেন আল্লাহ্‌ দেন’। বলে আহমদ মুসা ফাতমার দিকে চেয়ে বলল, ‘তোমরা ডোনাকে মানে মারিয়া জোসেফাইনকে তোমাদের সোসাইটির সদস্য বানিয়ে নিও’।
আহমদ মুসা কথা শেষ করতেই ডোনা বলল, ‘নিও’ নয় ‘নাও’ বলুন এবং আজ থেকেই’।
ফাতমা আনন্দে হাততালি দিয়ে উঠল। বলল, ‘আমরা শুধু খুশি হবো না, আমরা আকাশের চাঁদ হাতে পাব। এই ঘটনা আমাদের জন্যে ‘ এ গ্রেট লিপ ফরওয়ার্ড(একটি বৃহৎ উল্লস্ফন)’ এবার তাহলে উঠি’। বলে উঠে দাঁড়াল আহমদ মুসা। ডোনাও।
‘আর একটি কথা’। বলে উঠল ফাতমা।
‘কি?’ বলল আহমদ মুসা।
ডোনার দিকে চেয়ে ফাতমা বলল, ‘যে পিস্তল দিয়ে তিনজন লোক মেরে মহান ভাই আহমদ মুসাকে আপনি উদ্ধার করেছেন, সেই পিস্তলটা আমি একটু দেখতে চাই’।
‘অবশ্যই দেখাব’। বলে ডোনা পিস্তল বের করল।
ফাতমা হাত বাড়াল পিস্তলের দিকে।
ডোনা পিস্তল দিল তাঁর হাতে।
ফাতমা পিস্তলটি হাতে নিয়ে ধীরে ধীরে চুমু খেল পিস্তলটায়। বলল, ‘আমি গর্বিত যে, একটি ফরাসী মেয়ে এবং একটি বুরবো রাজকুমারী এই পিস্তল ব্যবহার করেছেন ইসলামের পক্ষে’।
বলে ফাতমা পিস্তলটি ফিরিয়ে দিল ডোনার হাতে।
পিস্তল হাতে নিয়ে ডোনা সেটা আবার ফাতমার দিকে তুলে ধরে বলল, ‘পিস্তলটা তোমার জন্যে উপহার আমার পক্ষ থেকে’।
‘আমাকে?’ বিস্ময়-আনন্দ মিশ্রিত কণ্ঠ ফাতমার।
‘হ্যাঁ তোমাকে’।
ফাতমা পিস্তলটা হাতে নিয়ে আবার তাতে একটা চুমু দিয়ে জড়িয়ে ধরল ডোনাকে। বলল, ‘আপনি আমাদের সন্মানিত রাজকুমারী। আপনি আমাদের এক মহান ভাইয়ের একান্ত আপন। আপনার এই ঐতিহাসিক উপহার আমাকে ধন্য করেছে’। ভারী কণ্ঠ ফাতমার, চোখের পাতা ভিজে উঠেছে তাঁর।
ফাতমা ডোনাকে ছেড়ে দিয়ে চোখ মুছে হেসে বলল, ‘কিন্তু পিস্তল তো আপনারই বেশি প্রয়োজন ছিল’।
হাসল ডোনা। বলল, ‘একেবারে নিঃস্ব হয়ে তোমাকে দান করিনি’। বলে নিচু হয়ে মোজার ভেতর থেকে কালো রংয়ের ছোট্ট একটা পিস্তল বের করল।
‘আপনার তো সাংঘাতিক বুদ্ধি!’ মোজার ভেতরে পিস্তল, কল্পনারও অতীত’। বলল ফাতমা।
ডোনাকে মোজার ভেতর থেকে পিস্তল বের করতে দেখে বিস্মিত হয়েছে আহমদ মুসাও। কিন্তু তাঁর বিস্ময় দৃষ্টির মধ্যে গভীর বেদনারও একটা প্রলেপ আছে।
ফাতমার উত্তরে ডোনা আহমদ মুসার দিকে এক পলক তাকিয়ে বলল, ‘বুদ্ধি আমার নয়। ওর বুদ্ধির সামান্য একটা অনুসরন মাত্র’।
‘চাঁদ সূর্য থেকে আলো পায়। কিন্তু আমাদের কাছে আলোটা চাঁদেরই’। বলল বৃদ্ধ আবু আমের আবদুল্লাহ।
‘ধন্যবাদ জনাব’। সলজ্জ হাসল ডোনা।
আহমদ মুসা সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে এল। সবাই এগিয়ে দিল তাঁদের গাড়ি পর্যন্ত।
আহমদ মুসা বসল ড্রাইভিং সীটে। ডোনা তাঁর পাশে।
চলতে শুরু করল গাড়ি।
সবাই হাত নাড়ছিল।
আহমদ মুসা গাড়ির জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে হেসে বলল, ‘আমি বিদায় নিচ্ছি না’।
গাড়ি অনেকখানি এগিয়েছে। আহমদ মুসা শুনতে পেল; ওঁরা চিৎকার করে বলছে, ‘আমরাও বিদায় দিচ্ছি না’।

Top