১৮. ব্ল্যাক ক্রসের মুখোমুখি

চ্যাপ্টার

শুয়ে পড়লেও আহমদ মুসার ঘুম এলো না চোখে।
কেমন একটা অস্বস্তি মনে।
উঠে বসল। বসেও ভাল লাগল না। উঠে ব্যালকনিতে এল সে। দু’তলার ব্যালকনি। পশ্চিম দিকে দিগন্ত বিস্তৃত আটলান্টিক। সত্যিই সুন্দর এই রেস্ট হাউসটা।
উপরে চারটা বেড রুম, নিচের তলায় চারটা।
গোটা ওপর তলাটাই দখল করেছে আহমদ মুসারা।
এক রুমে মশিয়ে লিটল। অন্য রুমে ওমর বায়া এবং লুই ডোমাস। তৃতীয় রুমটিতে এলিসা গ্রেস এবং পিয়েরা পেরিন এবং অন্যটিতে আহমদ মুসা।
সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। রাত তখনও অনেকটা বাকি।
আহমদ মুসার ঝুলন্ত ব্যালকনি থেকে পশ্চিম, দক্ষিণ উত্তর তিন দিগই দেখা যায়।
আটলান্টিকের অন্ধকার সৌন্দর্যে চোখ আটকে গিয়েছিল আহমদ মুসার। চাঁদ বিহীন রাতের তারকা খচিত অন্ধকার আকাশ যেমন আহমদ মুসার ভালো লাগে, তেমনি ভালো লাগে রাতের অন্ধকার সমুদ্র। এ অন্ধকার সমুদ্রে আকাশের গভীরতা তো আছেই, তার সাথে আছে সমুদ্রের সরব কথা বলা। অন্ধকার থেকে উঠে আসা এ কথাকে অনন্তের একটা কন্ঠ বলে আহমদ মুসার মনে হয়। এর যে কত অর্থ করা যায়, কত যে মহাকাব্য রচনা করা যায়।
হঠাৎ উত্তর থেকে ভেসে আসা গাড়ির হর্নে চমকে উঠে আহমদ মুসা উত্তর দিকে তাকাল।
কিছুই দেখতে পেলনা।
কিছুক্ষণ নিরবতা।
তারপর সেই হর্ন আবার বেজে উঠল। পরপর দু’বার। সেই সাথে টিলার নিচের সমভূমিতে একটি গাড়ির হেডলাইট দেখতে পেল আহমদ মুসা। গাড়ীর গতি টিলার দিকেই।
গাড়িটির হর্ন এই দ্বিতীয় বার শোনার সাথে সাথেই আহমদ মুসার গোটা দেহ প্রবল এক উষ্ণ স্রোত বয়ে গেল।
ব্ল্যাক ক্রসের গাড়ি? আসছে এই রেস্ট হাউসের দিকে?
সংগে সংগেই আহমদ মুসার মনে হলো যেমন করে তার সন্ধান পেয়েছিল ওরা, সেভাবেই কি এখানকার সন্ধান ওরা পেল? তাহলে ওমর বায়া কিংবা এলিসার পোশাক পরিচ্ছদ বা অন্য কোন কিছুতে ট্রান্সমিটার চীপ সেট করা আছে?
আর ভাবতে পারল না আহমদ মুসা।
ব্ল্যাক ক্রসের গাড়ী দ্রুত ঢাল বেয়ে উঠে আসছে টিলার শীর্ষে অবস্থিত রেস্ট হাউসের দিকে।
আহমদ মুসা ছুটল তার ঘরের দিকে। ঘুমাবার পোশাক পাল্টাবার সময় নেই। তাড়াতাড়ি সে স্টেনগান ও রিভলবারটা তুলে নিয়ে ছুটল নিচে। ব্ল্যাক ক্রসকে কিছুতেই রেস্ট হাউসে ঢুকতে দেয়া যাবে না। এখানে এসে একবার ওরা ভেতরে ঢুকতে পড়তে পারলে ওদের ঠেকানো কঠিন হবে সুতরাং আগেই ঠেকাতে হবে ওদের।
নেমে গেল আহমদ মুসা নিচে।
কেউ জেগে নেই।
আহমদ মুসা গাড়ী বারান্দায় এসে দাঁড়াল।
রেস্ট হাউসের একটি মাত্র গেট সেটা উত্তর দিকে। নিচে উপত্যকা থেকে এঁকে বেঁকে উঠে আসা রাস্তা গেটে এসে ঠেকেছে। গেটটা বড় এবং মজবুত।
একজন সার্বক্ষণিক দারোয়ান থেকে গেটে।
সব সময় সকল মেহমানের জন্যেই গেট খোলা। সুতরাং কেউ চাইলে সংগে সংগেই গেট খুলে দেয়া হয়।
আহমদ মুসা একবার মনে করল গেটম্যান নিষেধ করবে খুলতে। কিন্তু তার আর সময় হলো না। ওরা এসে গেছে।
আহমদ মুসা চারদিকে তাকিয়ে গাড়ি বারান্দার দক্ষিণ দিকে পশ্চিম প্রান্ত ঘেঁষে পাথরের উঁচু প্লাটফর্মের ওপর একটা ভাস্কর্য দেখতে পেল।
আহমদ মুসা ছুটে গিয়ে ভাস্কর্যের বেদির আড়ালে বসল।
খুশি হলো আহমদ মুসা। সেখানে বসে গেট থেকে গাড়ি বারান্দা পর্যন্ত গোটা রাস্তা এবং গাড়ি বারান্দা থেকে রেস্ট হাউসের রিসিপশন পর্যন্ত সবটুকু জায়গা পরিষ্কার নজরে পড়ছে।
রেস্ট হাউসের বাইরের সেই গেটটা খুলে যেতে দেখল আহমদ মুসা।
গেট দিয়ে এক এক করে ভেতরে প্রবেশ করল ওরা সাত জন লোক।
গাড়ি ভেতরে না নেয়া থেকে আহমদ মুসা বুঝল, ওরা দ্রুত কাজ সেরে ফিরতে চায়।
সাত জনের হাতেই স্টেনগান।
আহমদ মুসাদের গাড়ি গেটের ভেতরে গাড়ি পার্কিং এ দাঁড়িয়ে ছিল।
এই সময় একজন বাইরে গেল। পরক্ষনেই পাজাকোলা করে কাউকে এনে ফেলে দিল গেটের ভেতরে। লোকটি দারোয়ান। তার হাত পা বেঁধে ফেলা হয়েছে।
যে লোকটি তাকে বাইরে থেকে নিয়ে এল সেই তাকে আহমদ মুসাদের গাড়ির দিকে ইংগিত করে কি যেন জিজ্ঞেস করল।
তারপরেই সেই লোকটি পকেট থেকে সাইলেন্সার লাগানো পিস্তল বের করে গাড়ির দিকে এগিয়ে গেল। গাড়ির সামনের দু’টি চাকায় গুলী করে ফুটো করে দিল।
আহমদ মুসা ভাবল, এই লোকটিই সম্ভবত দলের সর্দার।
গাড়ির চাকা ফুটো করে দেয়ার পরই তারা একসাথে দ্রুত বিড়ালের নিঃশব্দে ছুটে এল গাড়ি বারান্দার দিকে।
আহমদ মুসা মনে মনে খুবই কষ্ট পেল ওদের অসহায়ত্ব দেখে।
একটা ব্রাস ফায়ারে ওরা সবাই শেষ হয়ে যাবে।
আহমদ মুসার স্টেনগানটা উঠতে চাইল না। এই ভাবে মানুষ হত্যায় তার মন বিদ্রোহী হয়ে উঠে। যদিও জানে এদের না মারলে ওরাই মারবে তবুও।
ওরা সবাই গাড়ি বারান্দায় এসে পৌঁছেছে।
আহমদ মুসা ভাস্কর্যের পেছনে উঠে দাঁড়াল। তারপর ওদের উদ্দেশ্য করে বলল, তোমরা ধরা পড়ে গেছে। ঘেরাও হয়েছ তোমরা। স্টেনগান ও রিভলবার মাটিতে ফেলে ………………।
আহমদ মুসার কথার শব্দ পেতেই ওরা সাঁ করে ঘুরে দাঁড়িয়েছিল আহমদ মুসার দিকে। সংগে সংগেই স্টেনগানের ব্যারেল উঁচু হয়েছে তাদের। গুলীর বৃষ্টি ছুটে এল আহমদ মুসার দিকে।
আহমদ মুসা সে গুলীর স্রোতের মধ্যে কথা শেষ না করে বসে পড়ল। ভাস্কর্যের আড়ালে না থাকলে আহমদ মুসার দেহ ঝাঁঝরা হয়ে যেত। ভাস্কর্যের গায়ে লেগে ছিটকে পড়া বুলেটের স্তূপ গড়ে উঠল ভাস্কর্যের গোড়ায়।
আহমদ মুসা বসে পড়েই স্টেনগান চালাল ওদের লক্ষ্য করে। ওপক্ষের গুলীতে কিছুটা ছেদ পড়ল।
সংগে সংগে আহমদ মুসা চকিতে ওদিকে একবার তাকিয়ে স্টেনগানের ব্যারেল কিছুটা ঘুরিয়ে নিল। গাড়ী বারান্দায় কোন আড়াল নেই। গাড়ী বারান্দা থেকে রিসেপশনে ঢুকার আগে আড়াল পাওয়ার কোন উপায় নাই।
আহমদ মুসার গুলির মুখে ওরা সেই চেষ্টাই করেছিল। কিন্তু গুলী তাদের রেহাই দেয় নি। গাড়ী বারান্দা ও রিসেপশনের দরজা পর্যন্ত ৬টি লাশকে আহমদ মুসা পড়ে থাকতে দেখল।
আরেকজন কোথায়? চমকে উঠল আহমদ মুসা।
সংগে সংগে সে চারদিকে সতর্ক দৃষ্টি নিক্ষেপ করল।
দেখল, একজন সাপের মত এগিয়ে আসছে ভাস্কর্যের দিকে। সে এসে পৌছে গেছে ভাস্কর্যের গোড়ায় পাথরের প্ল্যাট ফরমের কাছে।
আহমদ মুসা নিঃশব্দে পাথরের প্ল্যাট ফরমটির ওপর উঠে ঝাঁপিয়ে পড়ল নিচে ব্ল্যাক ক্রসের লোকটির ওপর।
ঝাঁপিয়ে পড়েই আহমদ মুসা তার হাতের পিস্তল কেড়ে নিয়ে ছুড়ে ফেলে দিল।
লোকটি প্রাথমিক ধাক্কা কাটিয়ে আহমদ মুসাকে গায়ের ওপর থেকে ছুড়ে ফেলে দিয়ে প্রবল বেগে উঠে দাঁড়াল।
আহমদ মুসা ছিটকে পড়ে গেল।
লোকটা ব্ল্যাক ক্রসের এই অভিযানের নেতাই হবে। এই লোকটাই আহমদ মুসাদের গাড়ির টাওয়ার ফুটো করে দিয়েছিল এবং ব্ল্যাক ক্রসের লোকদের সামনে এগোবার সময় এই লোকটিই নেতৃত্ব দিয়েছিল।
লোকটা উঠে দাঁড়িয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল আহমদ মুসার ওপর।
আহমদ মুসা গড়িয়ে সরে গেল।
লোকটার বিশাল বপু আছড়ে পড়ল মাটিতে।
আহমদ মুসা গড়িয়ে সরে গিয়েই উঠে দাঁড়াল।
লোকটা শুয়ে থেকেই একটু গড়িয়ে এসে চোখের পলকে দু’টি পা ছুড়ে মারল আহমদ মুসার দুই পা লক্ষ্যে।
আকস্মিক এই আঘাতে গোড়া কাঠা গাছের মত পড়ে গেল আহমদ মুসা।
উঠে দাঁড়িয়ে ছিল লোকটা। সে আবার ঝাঁপিয়ে পড়ল আহমদ মুসার ওপর।
লোকটা এসে পড়ার আগেই আহমদ মুসা তার দু’টি পা বুকের কাছে গুটিয়ে নিয়েছিল। লোকটা গায়ের ওপর এসে পড়ার সংগে সংগেই আহমদ মুসা পা দু’টি দিয়ে তাকে ছুড়ে ফেলল।
উল্টে গিয়ে আহমদ মুসার পেছনে পড়ে গেল লোকটা।
উঠে দাঁড়িয়েছিল আহমদ মুসা।
লোকটা পড়ে গিয়েই এবার রিভলবার বের করল। কিন্তু রিভলবার তাক করার আগেই আহমদ মুসা লাথি ছুড়ল তার রিভলবার ধরা হাত লক্ষ্যে।
ছিটকে পড়ে গেল লোকটার হাত থেকে রিভলবার।
আহমদ মুসা ছুটে গিয়ে তুলে নিল তার রিভলবার।
কিন্তু রিভলবার নিয়ে উঠে দাঁড়াতেই দেখল আহমদ মুসা, লোকটার হাত উদ্যত হয়েছে একটা ছুরি ছুড়ে মারার জন্যে।
আহমদ মুসা তাকে সে সুযোগ আর দিল না। ট্রিগার টিপল রিভলবারের। একটা বুলেট গিয়ে তার কপাল ফুটো করে ঢুকে গেল।
অস্ফুট একটা আর্তনাদ করে লুটিয়ে পড়ে গেল লোকটা।
আহমদ মুসা সে লাশের দিকে একবার তাকিয়ে ফিরে দাঁড়াল এবং চলল রেস্ট হাউসের দিকে।
রেস্ট হাউসের ল্যান্ড লেডি মহিলাসহ ওমর বায়ারা পাঁচজন এসে দাঁড়িয়েছে রিসেপশন কক্ষের দরজার বাইরে।
ভয়ে, বিস্ময়ে তাদের চোখ ছানাবড়া। ফ্যাকাসে হয়ে তাদের সবার মুখ। আহমদ মুসা নিকটবর্তী হতেই ল্যান্ড লেডি বৃদ্ধা মহিলাটি চোখ কপালে তুলে বলল, এসব কি? এরা কারা?
হয়তো ডাকাত হবে।
দারোয়ান কোথায়?
গেটের কাছে দারোয়ানকে বেঁধে ফেলে রেখেছে।
তুমি বৎস খুব সাহসী। এতগুলো ডাকাতকে সামাল দিয়েছ। থামল একটু। তারপর আবার বলা শুরু করল, তুমি দেখছি নাইট ড্রেস পরেই বেরিয়েছ। টের পেলে কি ভাবে।
ইশ্বর সাহায্য করেছেন।
‘কিভাবে?’ বিস্ময় ল্যান্ড লেডির চোখে-মুখে।
আহমদ মুসা বলল সব কাহিনী। শেষে বলল, ‘আমাদের এখনি চলে যেতে হবে।’
‘কেন? কেন?’
‘আমি তো ডাকাতদের মেরেছি। ওদের সাথীরা আমাদের ওপর চড়াও হতে পারে।’
‘তুমি ফরাসী পুলিশের ওপর আস্থা রাখ না? তাছাড়া পুলিশকে এদের কথা বলবে কে, তুমি ছাড়া?’
‘দারোয়ান আমার চেয়ে বেশি জানে। আপনি বিল রেডি করুন ম্যাডাম।’
বলে আহমদ মুসা ওমর বায়াদের বলল, ‘তোমরা তৈরি হও। এখনি বেরুতে হবে।’
আহমদ মুসারা সবাই ওপরে উঠতে লাগল।
আহমদ মুসা ভাই আমার জন্যে আপনার এত কষ্ট। সহ্য হচ্ছে না আমার।’ উঠতে উঠতে বলল ওমর বায়া।
আহমদ মুসা থমকে দাঁড়াল। সবাই দাঁড়াল তার সাথে।
আহমদ মুসা তাকাল ওমর বায়ার দিকে। বলল, ‘একজন মুসলমানের মত কথা বল ওমর বায়া। জীবনটাই একটা সংগ্রাম। এ সংগ্রামে হাসি আছে কান্নাও আছে।’
‘স্যরি।’ বলল ওমর বায়া।
‘ওরা কারা জনাব? সত্যিই ডাকাত?’ বলল এলিসা গ্রেস।
‘না, ব্ল্যাক ক্রস।’
‘ওরা কি আবার হামলা করতে আসবে এখানে?’
‘না। কারণ আমরা চলে যাচ্ছি।’
পাঁচ মিনিটের মধ্যে তৈরি হয়ে বেরিয়ে এল সবাই।
রিসেপশনে দাঁড়িয়েছিল ল্যান্ড লেডি।
আহমদ মুসা যেতেই একটা স্লিপ তুলে দিল আহমদ মুসার হাতে।
আহমদ মুসা নজর বুলিয়ে দেখল, এক হাজার ফ্রাংক।
আহমদ মুসা ল্যান্ড লেডির হাতে পাঁচশ’ ফ্রাংকের তিনটি নোট তুলে দিল।
তিনটি নোটের দিকে তাকিয়েই বৃদ্ধা ল্যান্ড লেডি আকর্ণ হাসল। বলল, ‘তুমি খুব ভালো ছেলে। তোমার যেমন সাহস, তেমনি মন। তুমি ঈশ্বরকে ভালবাস, তাই না বাছা?’
‘নিশ্চয়।’
‘বেশ বেশ। খুব ভালো। আমিও গীর্জায় যাই। অনেকেই যাই না। বলে, সমস্যা বাড়িয়ে লাভ কি?’
‘অন্ধেরা তা বলবেই। ধর্মকে যারা বাদ দিয়েছে, তাদের সমস্যা শত সহস্র গুণ বেড়েছে।’ বলে আহমদ মুসা ল্যান্ড লেডিকে শুভেচ্ছা জানিয়ে পা বাড়াল বাইরে বেরুবার জন্যে।
সবাই বেরিয়ে এল আহমদ মুসার সাথে।
‘আমাদের গাড়ির টায়ার তো ওরা নষ্ট করে গেছে। এক্সট্রা টায়ার তো নেই গাড়িতে।’ বলল এলিসা গ্রেস।
‘ওদের গাড়ি গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। ও গাড়িতেই আমরা যাব।’
সকলের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল।
গাড়িতে উঠে এল সবাই।
গাড়ি তন্ন তন্ন করে খুঁজল আহমদ মুসা। এক টুকরো কাগজও কোথাও পেল না। এমনকি গাড়ির ব্লু বুক এবং ড্রাইভিং লাইসেন্সও না।
ড্রাইভিং সীটে উঠে বসেছিল আহমদ মুসা।
পাশেই বসেছিল লুই ডোমাস। বলল, ‘এখন আমরা পিয়েরা কিংবা আমার বাসায় যেতে পারি।’
‘এখন সিদ্ধান্ত নেয়ার একটা সময়!’ প্রথমে লুই ডোমাসের দিকে, পরে পেছনে তাকিয়ে বলতে শুরু করল আহমদ মুসা, ‘লুই ডোমাস যে প্রস্তাব দিয়েছে, সে জন্যে তাকে ধন্যবাদ। কিন্তু আমরা, মানে আমি, ওমর বায়া এবং এলিসা গ্রেস যেখানেই যাবো, সেটাই ব্ল্যাক ক্রসের টার্গেট হয়ে উঠবে ওরা জানতে পারলেই। অথচ বিপদ যত কমানো যায়, ততই ভালো। সুতরাং লুই ডোমাস কিংবা পিয়েরা যাতে ব্ল্যাক ক্রসের সন্দেহের বাইরে থাকে, এজন্যে এখন তাদের বাড়িতে ফিরে যাওয়া দরকার।’
কথাটা শুনে পিয়েরার মুখটা ছোট্ট হয়ে গেল। বলল, ‘যুক্তি হিসেবে আহমদ মুসা ভাইজানের সাথে আমি একমত। কিন্তু যুক্তিই সবকিছু নয়। আমি ও লুই ডোমাস কিছুতেই আপনাদেরকে এই অবস্থায় ছেড়ে দিতে পারি না। আহমদ মুসা ভাই হলেও পারতেন না।’
‘আপনার পরিকল্পনা কি জনাব?’ বলল লুই ডোমাস।
‘আমি এখন প্যারিসে যেতে চাই। সেখানে গিয়ে পরবর্তী কার্যক্রম ঠিক করব।’
‘তাহলে আমরাও প্যারিস যাব।’ বলল পিয়েরা।
‘এখন কোথাই যাচ্ছি?’ বলল লুই ডোমাস।
‘সেটা তুমিই বলবে। আপাতত শহরের আশেপাশে বা প্যারিসের পথের ওপর কোন রেস্ট হাউসে উঠতে চাই। বিশ্রাম হবে। সেই সাথে এ গাড়ি বাদ দিয়ে অন্য কোন গাড়ি জোগাড় করতে হবে। আমার গাড়িটা পড়ে আছে পিয়েরার রেস্টুরেন্টের সামনে। ওটা আনলে নতুন কোন গাড়ি আর লাগবে না। কিন্তু তার আগে এলিসা গ্রেস ও ওমর বায়ার পোশাক পাল্টাতে হবে। আমারও। এগুলোতে ‘ওয়্যারলেস ট্রান্সমিটার চিপ’ আছে বলে আমি নিশ্চিত। এই ট্রান্সমিটার চিপই রেস্ট হাউসে ব্ল্যাক ক্রসকে ডেকে এনেছিল।’
‘আমার বাসায় এ ধরনের পোশাক পাওয়া যাবে। যাবার পথে নিয়ে যাব।’ বলে পিয়েরা একটু থেমে আবার শুরু করল, ‘আপনার সে গাড়ি ওখানে নেই। আমার বান্ধবীকে অন্য কোথাও সরিয়ে রাখতে বলেছি।’
‘ধন্যবাদ পিয়েরা। কখন করেছ এটা?’
‘আপনার গাড়ি আমি চিনতাম। আপনাকে ধরে নিয়ে যাবার পর আমার এক বান্ধবীকে দিয়ে এটা করেছি আমি।’
‘তুমি খুব বুদ্ধিমতী। তোমাকে আবার ধন্যবাদ।’
‘ওয়েলকাম ভাইজান।’
‘আমাদের এ শহর থেকে দশ মাইল দূরে ইলের নদীর তীরে প্যারিস গামী রোডের ওপরই কয়েকটা রেস্ট হাউস আছে। ওগুলোরই কোন একটিতে উঠতে পারি আমরা।’ বলল লুই ডোমাস।
‘ধন্যবাদ লুই ডোমাস। সুন্দর সিলেকশন তোমার।’

ইলের ছোট একটা নদী।
পূর্বে অল্প দূরের পাহাড় থেকে বেরিয়ে আটলান্টিকে গিয়ে পড়েছে।
সুন্দর নদী।
নদীর দু’তীরেই ট্যুরিস্ট রেস্ট হাউস। অনেকগুলো।
দুর্ভাগ্য আহমদ মুসাদের। রেস্ট হাউসগুলো একদম ফুল। উইকএন্ড হওয়ার কারণেই এই দশা।
অবশেষে তিন রেস্ট হাউসে তাদের ছয়জনের জায়গা হলো। একটিতে দুই, আরেকটিতে তিন এবং অন্যটিতে একজন।
তিনটি রেস্ট হাউসই পাশাপাশি।
দু’টি রুম যেখানে পাওয়া গেল, সেখানে থাকল এলিসা গ্রেস এবং পিয়েরা। তিন কক্ষ যেখানে পাওয়া গেল সেখানে থাকল ওমর বায়া, লুই ডোমাস ও লিটল এবং তৃতীয়টিতে থাকল আহমদ মুসা স্বয়ং।

ব্ল্যাক ক্রস প্রধান পিয়েরে পল ক্রোধে উন্মত্ত প্রায়। তার হেড কোয়ার্টারের গোটা জনশক্তিই প্রায় ধ্বংস হয়ে গেছে ওমর বায়াকে আটকাতে গিয়ে আহমদ মুসার হাতে। পিয়েরে পল বিশাল সভাকক্ষের বিশাল টেবিলের সামনে বসে নিজের চুল নিজেই ছিঁড়ছে যেন।
তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে তার ব্যক্তিগত নিরাপত্তা অফিসার ডান্তন। তার মাথা নিচু।
‘বল কি করে এত বড় ঘটনা ঘটল?’
‘স্যার এর উত্তর দেবার জন্যে কোন দায়িত্বশীল অফিসার হেড কোয়ার্টারে অবশিষ্ট নেই।’ মাথা নিচু রেখেই বলল ডান্টন।
‘আমি বুঝতে পারছি না ডান্টন, ব্ল্যাক ক্রসের অপরাজেয় অপারেশন কমান্ডার আবে দুরুয়া-এর মত লোক তার বাছাই করা আড়াই ডজন গার্ডসহ নিহত হলো হেড কোয়ার্টারে। তবু একজন আহমদ মুসাকে ওরা প্রতিরোধ করতে পারল না, ওমর বায়াকে উদ্ধার করে নিয়ে গেলই। এমন অবিশ্বাস্য ঘটনা কিভাবে ঘটল?’
‘স্যার, আমাদের লোকেরা এবং আবে দুরুয়া চেষ্টার ত্রুটি করেনি। না হলে তাদের সবাইকে এভাবে জীবন দিতে হতো না।’
‘গর্দভ ডান্টন, এটাই তো জ্বালার কারণ। একজন আহমদ মুসা বন্দী হয়েও এত বড় ঘটনা ঘটিয়ে চলে গেল।’
‘স্যার সবাই বলে, ওর সাথে মুসলমানদের আল্লাহ স্বয়ং নাকি কাজ করেন।’
‘গর্দভ, আমদের সাথে ঈশ্বর পুত্র যিশু নেই?’
‘স্যার, ঈশ্বর পুত্র মানুষ মাত্র। আর ওদের সাথে খোদ ঈশ্বর আছেন। তার ওপর আমরা গীর্জায় যাই না।’
‘আবার গ্রেট গর্দভ। আমি তুমি গীর্জায় যাই না, কিন্তু অনেকেই তো যায়। তাছাড়া আমরা তো বিশ্বব্যাপী যিশুর সাম্রাজ্য কায়েমেরই চেষ্টা করছি।’
এই সময় পিয়েরে পলের ইন্টারকম কথা বলে উঠল। কথা বলছে ইনফরমেশন চীফ। তার কণ্ঠ: ‘স্যার এই মাত্র জানা গেল, রেস্ট হাউস লা আটলান্টিক-এ আমাদের সাতজন লোককে নিহত পাওয়া গেছে। তাদের মধ্যে আমাদের সহকারী কমান্ডার ভলতেয়ারও রয়েছে।’
থামল কণ্ঠ।
মুহূর্তে পিয়েরে পলের চোখ-মুখ আগুনের মত লাল হয়ে উঠল। গর্জে উঠল তার কণ্ঠ, ‘খবর এটুকুই? আরো বলেনি যে, মুসলমানদের আল্লাহ স্বয়ং নেমে এসে ওদের হত্যা করে গেছে! যত্ত সব গর্দভ।’
পিয়েরে পলের হাতে সিগারেটের একটা পাইপ ছিল। সেটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে উঠে দাঁড়াল। পায়চারি করতে লাগল। তার চোখ দু’টি লাল এবং চুল উস্কু-খুস্কু। উন্মত্তের মত দেখাচ্ছে তাকে।
এক সময় পাইচারি থামিয়ে ডান্টনের দিকে চেয়ে বলল, ‘ডান্টন, বুঝতে পারছ, ব্ল্যাক ক্রস সত্যিই আজ দারুণ সংকটে। বলতে গেলে ব্ল্যাক ক্রসের হাত-পা সব ভেঙে গেছে। ওমর বায়া শনির মতই আমাদের হাতে এসেছিল। শনিটাকে আবার যদি হাতে পেতাম, তাহলে গোটাই চিবিয়ে খেতাম।’
বলে পিয়েরে পল এসে ধপ করে চেয়ারে বসে পড়ল।
‘ওমর বায়া শুধু নয় স্যার, ওকুয়াই তো আমাদের এ বিপদে ফেলেছে।’ ধীরে ধীরে বলল ডান্টন।
‘চুপ গর্দভ, ওকুয়া তো তার স্বার্থে কিছু করছে না। যা করছে তা ঈশ্বর পুত্র যিশুর সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার জন্যেই।’
পিয়েরে পলের টেলিকম আবার কথা বলে উঠল। কণ্ঠ ইনফরমেশন চীফের। তার কণ্ঠে উত্তেজনা। বলল, ‘স্যার, আমাদের ওয়্যারলেস ট্রাফিক কনট্রোল জানাল, ‘আমাদের সহকারী অপারেশন কমান্ডার ভলতেয়ার যে গাড়ি নিয়ে ‘লা আটলান্টিক’ রেস্ট হাউসে গিয়েছিল, সেই গাড়িটা মোরলেক্স গামী রোড ধরে এগিয়ে এখন ইলের নদীর তীরে গিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। প্রায় ৩০ মিনিট ধরে ওয়্যারলেসের ভূ-প্রান্তিক বিমিং স্থির রয়েছে।’
‘সে জায়গা কোনটা চিহ্নিত করো।’ টেবিলে এক দারুন মুষ্ঠাঘাত করে বলল পিয়েরে পল।
‘চিহ্নিত করা হয়েছে স্যার। গাড়িটি দাঁড়িয়ে আছে ইলের নদীর তীরে ‘লা উলের’ রেস্ট হাউসে।’ বলল ইনফরমেশন চীফ।
লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল পিয়েরে পল। বলল, ‘ডান্টন, তুমি গিয়ে গাড়ি রেডি কর। আমি আসছি।’
‘আপনি নিজেই যাবেন স্যার?’
‘আর কে আছে গর্দভ?’
দু’তিন মিনিটের মধ্যেই পিয়েরে পলের গাড়ি যাত্রা করল ইলের নদীর ‘লা ইলের’ রেস্ট হাউসের উদ্দেশ্যে।
পিয়েরে পলের গাড়ি যখন ‘লা ইলের’ রেস্ট হাউসের সামনে পৌঁছল, তখন রাত বেশ বাকি।
গাড়ি থেকে লাফ দিয়ে নামল পিয়েরে পল।
ঠিক ‘লা আটলান্টিকে’ যে গাড়িটা তাদের গিয়েছেল, সেটা দাঁড়িয়ে আছে।
পিয়েরে পল তার ‘মাস্টার কি’ দিয়ে গাড়িটা খুলে ভেতরে একবার নজর বুলিয়ে গাড়ির দরোজা বন্ধ করে ছুটল রেস্ট হাউসের রিসেপশনের দিকে।
রিসেপশনে বসেছিল একটি মেয়ে।
পিয়েলে পল মেয়েটির সামনে নিজের কার্ড মেলে ধরে বলল, ‘গত এক ঘণ্টায় রেস্ট হাউসে কে কে এসেছে জানতে চাই।’
মেয়েটি উঠে দাঁড়িয়ে একটা স্যালুট করে বলল, ‘এক মিনিট স্যার বলছি।’
মেয়েটি রেজিস্টারের ওপর নজর বুলিয়ে বলল, ‘এক ঘণ্টার মধ্যে এসেছে একজন নিগ্রো। নাম ওমর। হস্তি আকৃতির একজন এসেছে, নাম লিটল।’ নামটা উচ্চারণ করতে গিয়ে মেয়েটি হাসল।
কিন্তু পিয়েরে পলের চোখ দু’টি জ্বলে উঠল আগুনের মত। আর নিগ্রোর নাম ওমর শুনে চোখ দু’টি তার উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল বিজয়ের আনন্দে।
‘গত এক ঘণ্টার মধ্যে আরেকজন তরুণ এসেছে। নাম লুই ডোমাস।’ বলল রিসেপশনিস্ট মেয়েটি।
‘গোল্লায় যাক তোমার লুই ডোমাস। তুমি বল, ‘নিগ্রো’ ওমর এবং ‘লিটল’ নামের লোকটি কোথায় আছে।’ অধৈর্য কণ্ঠে বলল পিয়েরে পল।
‘ওরা পাশাপাশি দুই কক্ষে রয়েছেন। সাত তলায়। নাম্বার ৭১৫ এবং ৭১৬।’
মেয়েটিকে ধন্যবাদটুকুও না জানিয়ে পিয়েরে পল তার পেছনের লোকদের বলল, ‘তোমরা এস আমার সাথে।’
বলে পিয়েরে পল ছুটল লিফটের দিকে।
পিয়েরে পলের হাতে রিভলবার। অন্য সকলের হাতে স্টেনগান।
ওরা লিফটে উঠে গেলে রিসেপশনিস্ট মেয়েটির সহকারী কাঁপতে কাঁপতে এসে রিসেপশনিস্ট মেয়েটিকে বলল, ‘পুলিশে টেলিফোন কর তাড়াতাড়ি।’
রিসেপশনিস্ট মেয়েটির মুখ ভয়ে ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। বলল, ‘পুলিশের বাপ ওরা। পুলিশকে বললে কোন ফল হবে না।’
‘কে ওরা?’
‘কথা বাড়িও না। কাজে যাও। ঝামেলা করলে আমাদের জানটাও যাবে।’
রিসেপশনিস্টের কথা শেষ না হতেই ব্রাস ফায়ারের শব্দে গোটা রেস্ট হাউসটাই যেন কেঁপে উঠল।
রিসেপশনিস্ট তার ফ্যাকাসে মুখ এবং চোখ ভরা আতংক নিয়ে ধপ করে চেয়ারে বসে পড়ল।
ব্রাস ফায়ারের আবারও শব্দ হলো এবং তার পরেই লিফটের দরজা খুলে গেল। নেমে এল পিয়েরে পল।
তার পেছনে কয়েকজন স্টেনগানধারী ওমর বায়াকে চ্যাংদোলা করে নিয়ে বেরিয়ে এল লিফট থেকে।
তারা দ্রুত রিসেপশন থেকে বেরিয়ে গাড়ির দিকে ছুটল।
রিসেপশন থেকে বেরিয়ে যাবার সময় পিয়েরে পল রিসেপশনিস্টকে লক্ষ্য করে বলল, ‘রিসেপশনিস্ট, কষ্ট করে তোমরা ‘লিটল’-এর লাশটা সরিয়ে ফেলো। পুলিশকে বলতে পার যে, ‘ব্ল্যাক ক্রস একজন বিশ্বাসঘাতককে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে।’
পিয়েরে পল ওমর বায়াকে নিয়ে তার গাড়িতে উঠল। বলল, ‘তোমরা সবাই এ গাড়িতে ওঠ। শুধু একজন আমাদের ঐ গাড়িটা ড্রাইভ করে পেছনে পেছনে এস।’
পিয়েরে পলের গাড়ি চলতে শুরু করল।

স্টেনগানের শব্দ থেমে যেতেই লুই ডোমাস দরজা খুলল। প্রথমে সে বুঝতে পারেনি কোন রুমে কি ঘটছে। ঘুম ভাঙার পর মনে হয়েছিল গোটা রেস্ট হাউসই যেন বুলেটে ঝাঝরা হচ্ছে। কিন্তু পাশেই যখন কক্ষের দরজায় স্টেনগানের গুলী বৃষ্টি হলো, তখন ব্যাপারটা বুঝতে পারল সে। এরপর সে রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করেছে যে, পরবর্তী আক্রমণ তার ঘরেই আসছে। কিন্তু আসেনি। স্টেনগানের গুলী থেমে যাবার পর সে ধীরে ধীরে দরজা খুলে বেরিয়ে এসেছে। বুদ্ধিমান লুই ডোমাস দেখল, ওমর বায়ার ঝাঁঝরা হয়ে যাওয়া ঘরের দরজা খোলা। ঘর খালি। ছ্যাত করে উঠল লুই ডোমাসের মন। ব্ল্যাক ক্রস আবার ধরে নিয়ে গেল ওমর বায়াকে!
লুই ডোমাস ‘লিটলে’র ঘরের সামনে এসে দেখল, লিটলের ঝাঝরা হয়ে যাওয়া দেহ মেঝেতে পড়ে আছে। তার ঘরের দরজাও বুলেটে ঝাঝরা হয়ে যাওয়া।
হঠাৎ আহমদ মুসার কথা মনে হলো লুই ডোমাসের। তিনি এখানে থাকলে নিশ্চয় এই ঘটনা ঘটত না। কি বলবেন তিনি এসে দেখলে। বিশেষ করে লুই ডোমাসকে অক্ষত দেখে! সত্যি লুই ডোমাস কিছুই করতে পারেনি।
বিরাট একটা আবেগ লুই ডোমাসের বুক ফুঁড়ে আসতে চাইল। সেই আবেগে তার চোখ ফেটে এল অশ্রু।
এই সময় পাশের দু’টি ঘরের দরজা খুলে বেরিয়ে এল সৌম্য দর্শন একজন ভদ্রলোক এবং একজন তরুণী।
লুই ডোমাসকে ভাঙা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভদ্রলোক জিজ্ঞেস করল, ‘কি ঘটেছে? ঘটনা কি?’
ভদ্রলোকের প্রশ্নে লুই ডোমাসের আবেগ আরও যেন উথলে উঠল। সে কথা বলতে পারল না। চোখে অশ্রু বেড়ে গেল।
ভদ্রলোক একটু এগিয়ে এসে ঘর দু’টির দিকে নজর বুলিয়ে লুই ডোমাসকে হাত ধরে টেনে তার ঘরে প্রবেশ করল।
তরুণীটিও তার ঘরের দরজা টেনে এ ঘরে এসে ঢুকল।
তারা সন্ধ্যায় প্যারিস থেকে সেন্ট পোল ডে লিউন যাবার পথে এখানে এসে উঠেছে। গত চারদিন আহমদ মুসার কোন খবর ডোনা পায়নি। উদ্বিগ্ন ডোনা আহমদ মুসার সন্ধানে পিতাকে নিয়ে এসেছে।
ঘরে প্রবেশ করে মিশেল প্লাতিনি চেয়ারে বসল।
ডোনা গিয়ে তার আব্বার বিছানায় বসল।
মি. প্লাতিনি লুই ডোমাসকে অবশিষ্ট চেয়ারটিতে বসতে বলল।
কিন্তু লুই ডোমাস মিশেল প্লাতিনির সৌম্য দর্শন অভিজাত চেহারার দিকে তাকিয়ে চেয়ারে বসতে গেল না। দাঁড়িয়েই থাকল।
কি ঘটেছে বল?’ বলল মিশেল প্লাতিনি।
‘আপনি দেখলেন, একজনকে ওরা হত্যা করে গেছে।
আরেকজনকে ধরে নিয়ে গেছে।’
‘ওরা কারা?’
লুই ডোমাস মিশেল প্লাতিনির দিকে তাকাল। তার চোখে-মুখে শংকা। উত্তর দিল না প্রশ্নের।
‘ভয় করো না, রেস্ট হাউস কর্তৃপক্ষ এবং পুলিশকে আমি টেলিফোন করেছি। ওরা এসে যাবে।’ মিশেল প্লাতিনি অভয় দিয়ে বলল।
‘ওরা ব্ল্যাক ক্রস।’
‘ব্ল্যাক ক্রস?’ মিশেল প্লাতিনি এবং ডোনা এক সাথেই উচ্চারণ করল। তাদের চোখ-মুখেও ফুটে উঠল শংকার ছাপ।
‘ব্ল্যাক ক্রসের সাথে তোমাদের কি বিরোধ? তোমরা কারা?’
‘অনেক কথা স্যার।’
‘বল। পুলিশকেও তো জানাতে হবে!’ বলল মিশেল প্লাতিনি।
‘আমরা ঘণ্টা খানেক আগে এ রেস্ট হাউসে এসে উঠেছি। আমরা পাঁচজন। তিন জন এখানে ছিলাম। দু’জন মেয়ে আছে পশ্চিম পাশের রেস্ট হাউসে এবং আরেকজন পূর্ব পাশের রেস্ট হাউসে।’
‘ওদের খবর দিয়েছ?’
‘না স্যার। মাথা আমার গুলিয়ে গেছে। আপনার টেলিফোন ব্যবহার করতে পারি।’
‘অবশ্যই।’
লুই ডোমাস টেলিফোন করল আহমদ মুসার রেস্ট হাউসে। রেস্ট হাউসের এক্সচেঞ্জ ধরলে ১১ নং কক্ষে দিতে বলল।
কিছুক্ষণ পর এক্সচেঞ্জ জানাল, ‘টেলিফোন ধরছে না।’
লুই ডোমাস অনুরোধ করল, ‘খুবই জরুরি, দয়া করে ডেকে দিন। এখানে দুর্ঘটনা ঘটেছে।’
‘দুর্ঘটনার কথা আমরা শুনেছি। ধরুন, ডেকে দিচ্ছি।’
অল্পক্ষণ পরেই ওপার থেকে জানাল, ‘ঘরে কেউ নেই। গোলাগুলীর শব্দের পরপরই উনি বেরিয়ে গেছেন।’
টেলিফোন রেখে ধপ করে বসে পড়ল মেঝের ওপর লুই ডোমাস। উদ্বেগ ও হতাশায় ভেঙে পড়েছে সে।
‘কি হলো, আরো কিছু দুঃসংবাদ?’
‘সর্বনাশ হয়েছে স্যার, ঐ রেস্টুরেন্টে যিনি ছিলেন তিনিও নেই। গোলাগুলীর শব্দ পাবার পর পরই তিনি বেরিয়ে গেছেন।’
‘এতে সর্বনাশের কি আছে? উনি আছেন। আসবেন। কোথাও হয়তো পালিয়ে আছেন।’
‘না স্যার। দুনিয়ার সব লোক পালালেও উনি পালাতে পারেন না। আর যখন তিনি বেরিয়েছেন, তখন এখানে অবশ্যই আসতেন। তাঁর কিছু ঘটল কিনা আমার ভয় হচ্ছে।’
একটু থামল লুই ডোমাস। তারপর বলল, ‘স্যার আমি উঠি। পাশের রেস্ট হাউসে আমাদের সাথী দু’টি মেয়ে আছে। ওদের কিছু হলো কিনা দেখি। ওদের একজন খুবই বিপদগ্রস্ত। দেখা মাত্র ব্ল্যাক ক্রসের লোকেরা ওকে সামনের ঘরের এই লোকের মতই হয় খুন করবে, না হয় ধরে নিয়ে যাবে।’
বলে উঠে দাঁড়াল লুই ডোমাস।
ডোনার মুখে গভীর চিন্তার ছাপ। অনিশ্চিতের অন্ধকারে কি যেন হাতড়ে বেড়াচ্ছে সে। বার বার আহমদ মুসার মুখ তার হৃদয়ে এসে উঁকি দিচ্ছে। লুই ডোমাস উঠে দাঁড়ালে ডোনা দ্রুত বলল, ‘আপনি যে বিপদগ্রস্ত মেয়েটির কথা বললেন তার নাম কি, রুম নাম্বার কত?’
‘নাম এলিসা গ্রেস। নাম্বার ৩৩৩। পশ্চিম পাশের রেস্ট হাউসটিই।’
লুই ডোমাস বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।
লুই ডোমাস বেরিয়ে যেতেই ডোনা বলল, ‘আব্বা আমার মন খারাপ লাগছে খুব। আমি কোন প্রমাণ দিতে পারবো না। কিন্তু এসব ঘটনার মধ্যে আমি কেন জানি আহমদ মুসাকে দেখতে পাচ্ছি।’
‘তুমি এমনিতেই উদ্বিগ্ন। তাই এমন মনে হচ্ছে। ব্ল্যাক ক্রস কত ঘটনার সাথে জড়িত। সে ধরনেরই একটা কিছু এটা।’
‘ঐ অসহায় মেয়েটার কাছে যেতে ইচ্ছে করছে আব্বা। মনে হচ্ছে ওমর বায়ার মতই সে ব্ল্যাক ক্রসের একজন অসহায় শিকার।’
‘তুমি তো জান, ব্ল্যাক ক্রসের কোন ব্যাপারে তুমি, আমরা জড়াই, আহমদ মুসা তা পছন্দ করে না।’
‘এটা ওর অতি সাবধানতা। কিন্তু নিজের বেলায় উনি মোটেই সাবধান নন।’
‘মা তবুও তার অনুপস্থিতিতে ঐ ধরনের কোন কিছুতে জড়ানো ঠিক হবে না।’
‘জড়াব না আব্বা, আমি শুধু কথা বলব ওর সাথে। দেখুন, যতই অসুবিধা হোক আহমদ মুসা অসহায়ের সাথে থাকেন, বিপদ-আপদের তোয়াক্কা না করেই ছুটে যান তার সাহায্যে।’
‘ও তো সাধারণ নয় মা। ও একাই একটা আন্দোলন। ঠিক আছে মা, সকাল হোক ওখানে যাওয়া যাবে।’
চিন্তা ও উদ্বেগ-পীড়িত মন নিয়ে ডোনা ফিরে গেল তার কক্ষে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল, ফজর নামাজের সময় হয়ে গেছে।
ডোনা ওজু করার জন্যে টয়লেটে চলে গেল।

সকালে নিচে নেমে মিশেল প্লাতিনি দেখল, রেস্ট হাউসের পার্কিং-এ তাদের গাড়ি ছিল, সে গাড়ি এখন নেই। বিস্মিত হয়ে সে ডোনার দিকে তাকাল। ডোনারও চোখে-মুখে বিস্ময়। বলল, ‘গাড়ি কে নিয়ে যাবে আব্বা? লক করাও ছিল।’
ডোনা ও ডোনার আব্বা সিকিউরিটি বক্সে গিয়ে জিজ্ঞেস করল গাড়ির কথা।
সিকিউরিটির লোক বলল, ‘ব্যাপারটা আমরা রেস্ট হাউস কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি। আমাদের কিছু করার ছিল না স্যার।’
‘কি করার ছিল না? কি ঘটেছে?’ বলল মিশেল প্লাতিনি।
‘স্যার, যারা আমাদের রেস্ট হাউসে হামলা করেছিল, তারা চলে যাবার সময় পূর্ব পাশের রেস্ট হাউসের দিক থেকে একজন ছুটে আসে। সে আপনাদের গাড়িটি খুলতে চেষ্টা করে। খুলতে না পেরে জানালার কাঁচ ভেঙে ফেলে ভেতরে ঢুকে গাড়িটা নিয়ে যায়। তার হাতে রিভলবার ছিল। আমরা কিছুই করতে পারিনি ভয়ে।’
মিশেল প্লাতিনি ও ডোনা অবাক-বিস্ময়ে পরস্পরের দিকে তাকাল।
চলে এল তারা।
পশ্চিম পাশের রেস্ট হাউসের দিকে চলছিল ডোনা এবং তার আব্বা।
দু’জনের কারও মুখেই কোন কথা নেই।
এক সময় ডোনা বলল ব্যাপারটা নিয়ে ভাবছ আব্বা? এ ঘটনার অর্থ কি দাঁড়ায়?
‘কিছু কিছু বুঝতে পারছি। পূর্ব পাশের রেস্ট হাউসের যে লোকটি ঘর থেকে বেরিয়ে গেছে বলে শুনেছিলাম আমরা, সেই সম্ভবত আমাদের গাড়ি নিয়ে গেছে।’
‘ঠিক বলেছ আব্বা। আমারও তাই মনে হচ্ছে। কিন্তু আব্বা একটা অঙ্ক মিলছে না।’
‘কি অঙ্ক?’
‘থাক আব্বা।চল তাড়াতাড়ি এলিসাদের ওখানে।’
তিন তলায় ৩০ নাম্বার কক্ষ এলিসা গ্রেসের। এ কক্ষের পাশেরটিই সম্ভবত দ্বিতীয় মেয়েটির।
ডোন নক করল ৩৩ নাম্বার কক্ষের দরজায়।
দরজার ডোর ভিউ রয়েছে।
নক করার প্রায় সংগে সংগেই দরজা খুলে গেল কক্ষের।
দরজা খুলে দিয়ে ‘গুড মর্নিং’ বলে পাশে সরে দাঁড়াল লুই ডোমাস।
‘গুড মর্নিং’ বলে ঘরে প্রবেশ করল ডোনা। তার আব্বা মি. প্লাতিনি ডোনার পরে প্রবেশ করল ঘরে।
এলিসা গ্রেস কাঁদছিল।
চোখ মুছে সোজা হয়ে বসল সে। তার পাশেই বসে আছে পিয়েরা।
লুই ডোমাস দু’টি চেয়ার টেনে বসতে দিল মি. প্লাতিনি এবং ডোনাকে।
মি. প্লাতিনি বসল।
ডোনা বসার আগে এলিসা গ্রেসের দিকে চেয়ে বলল, ‘আপনি নিশ্চয় এলিসা গ্রেস। আপনার কথা শুনেছি। কথা বলতে এলাম। আমাদেরকে বিশ্বাস করতে পারেন।’
বলে একটু থেমে ডোনা আবার বলা শুরু করল, ‘উনি আমার আব্বা মিশেল প্লাতিনি লুই এবং আমি মারিয়া জোসেফাইন লুই।’
নাম শুনেই এলিসা গ্রেস, পিয়েরা পেরিন এবং লুই ডোমাসের চোখে-মুখে উৎসুক্য ফুটে উঠল। তাকাল তারা পরস্পরের দিকে।
বলল পিয়েরা, ‘মাফ করবেন। নাম দু’টি আমাদের পরিচিত। আমাদের বুরবো রাজবংশের নামগুলোর মত। আমাদের এ ধারণা কি সত্য?’
‘হ্যাঁ সত্য। এ প্রসংগ থাক। এখন বলুন, পূর্ব দিকের রেস্ট হাউস থেকে আপনাদের যে লোক বের হয়ে গিয়েছিল, তিনি ফিরেছেন কি?’
ডোনা যখন একথাগুলো বলছিল, তখন ওরা তিনজন উঠে দাঁড়িয়ে মাথা নিচু করে বাউ করল প্লাতিনি এবং ডোনাকে।
বাউ করে ওরা দাঁড়িয়ে থাকল। ডোনার প্রশ্নের জবাব দিল লুই ডোমাস। বলল, ‘না, ফেরেননি।’
‘ওর নাম কি?’
ওরা সবাই একটু দ্বিধা করল। তারপর এলিসা গ্রেস বলল, ‘নাম আহমদ মুসা।’
‘যিনি কিডন্যাপ হয়েছেন তিনি কি ওমর বায়া?’ দ্রুত কাঁপা কণ্ঠে বলল ডোনা।
‘হ্যাঁ।’ বলল এলিসা গ্রেস। বলেই দু’হাতে মুখ ঢেকে কেঁদে উঠল এলিসা গ্রেস।
ওদিকে ডোনা দ্রুত উঠে তার আব্বার কোলে মুখ গুজল। অল্পক্ষণ পর মুখ তুলে বলল, ‘শুনেই বুঝেছিলাম, আহমদ মুসা না হলে মানুষের জন্যে বিপদের পেছনে এমন করে কেউ ছুটতে পারে না আব্বা।’ ডোনার মুখ অশ্রু ধোয়া। বলতে গিয়ে তার কন্ঠ কান্নায় ভেঙে পড়ল।
ডোনার এই কান্না দেখে থেমে গিয়েছিল এলিসা গ্রেসের কান্না।
এলিসা গ্রেস, পিয়েরা ও লুই ডোমাস সকলের চোখেই অপার বিস্ময়।
তারা বুঝতে পারছে না, তাদের রাজকুমারী ওমর বায়ার নাম জানল কি করে, আহমদ মুসার কথা বলে কাঁদছেই বা কেন?

পরবর্তী বই
ক্রস এবং ক্রিসেন্ট

Top