১৯. ক্রস এবং ক্রিসেন্ট

চ্যাপ্টার

গার্লস ক্যাডেট কোরের রেস্টহাউস। রেস্টহাউসের লাউঞ্জ।
লাউঞ্জে বসে আছে রালফ, ডেবরা, ক্লাউডিয়া, জিয়ানা, সুমাইয়া এবং অন্যান্যরা। শুধু হাজির নেই আহমদ মুসা। সে টয়লেটে।
কথা বলছিল ডেবরা, ‘আহমদ মুসা সম্পর্কে গল্প শুনে বুঝতে পারতাম না তিনি কত বড়। আজ চোখে দেখে বুঝলাম।’
‘কোন ঘটনার কথা বলছ?’ ক্লাউডিয়া জিজ্ঞেস করল।
‘কোন ঘটনার কথা বলব! সব ঘটনাই একটা করে বিস্ময়। মনে হয়, যেন যাদুবলে আগে থেকেই তিনি সব জানতে পারেন। দেখ, তিনি আব্বার কিডন্যাপ হওয়ার কথা বললেন, ঠিক ঠিক তা ঘটে গেল। আবার দেখ, আমরা কিছুই বুঝলাম না, উনি ব্ল্যাক ক্রস-এর গাড়ি চিনে ফেললেন। তার নাম্বারও মুখস্থ করলেন কখন যেন। পরে প্রমাণ হলো, ঠিকই ব্ল্যাক ক্রস-এর গাড়ি।’
‘আমরা সবাই গাড়ি দেখেছিলাম, কিন্তু রং না শুনলে এখন বলতে পারতাম না।’ বলল ক্লাউডিয়া।
‘ঠিক, শোনার পর আমার মনে পড়েছিল গাড়িটা নীল ছিল।’ বলল জিয়ানা।
‘আমি তো ওর পাশে ছিলাম। কোন কিছু বুঝতে, সিদ্ধান্ত নিতে এবং তা সম্পাদন করতে কোন সময় তার নষ্ট হয় না। এমন ব্রেইন খুবই দুর্লভ, খুব অল্পই এরা পৃথিবীতে আসেন।’ বলল রালফ।
‘অদ্ভুত ঠাণ্ডা মানুষ তিনি। কোন কিছুই যেন তাকে উত্তেজিত করতে পারে না। প্রথম পরিচয় তার সাথে এক হোটেলে। একজন নিগ্রোকে বাঁচাবার জন্যে একদল গুণ্ডার সাথে লড়ে তাদের মেরে ফ্ল্যাট করে দিলেন। খেতে খেতে উঠে গিয়েছিলেন, মারামারির পর আবার এসে খেলেন। যেন কিছুই ঘটেনি।’ বলল সুমাইয়া।
এ সময় আহমদ মুসা প্রবেশ করল লাউঞ্জে। তার মাথায় টুপি। এশার নামায পড়ে এলো সে।
বসল আহমদ মুসা গদিওয়ালা একটা মোড়ায়। চার সোফাই অকুপাইড। পাঁচটি সিঙ্গেল সোফায় বসেছে রালফ, ডেবরা, নেকা, রিশলা ও জিয়ানা এবং ট্রিপল সিটের দু’টি সোফার একটিতে বসেছে ক্লাউডিয়া, অন্যটিতে সুমাইয়া। তাদের দু’জনের পাশেই দুটো করে সিট খালি। আহমদ মুসা সেখানে বসলো না।
‘মাফ করবেন জনাব, ক্লাউডিয়া ও সুমাইয়া আপার মত আপনার ঘনিষ্ঠজনদের পাশে বসাও কি নিষেধ?’ বলল ডেবরা।
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘এমন প্রশ্ন তুললে কেন?’
‘তুললাম এ কারণে যে, ক্লাউডিয়া এবং সুমাইয়া আপার পাশে দু’জনের জায়গা খালি থাকতেও সেখানে না বসে আপনি তাদের অপমান করেছেন।’ বলল ডেবরা।
‘কি বলছ তুমি ডেবরা?’ ক্লাউডিয়া এবং সুমাইয়া দু’জনেই বলে উঠল।
‘না আপা, ওকে জবাব দিতে দাও।’ বলল ডেবরা জেদের স্বরে।
মিষ্টি একটা হাসি আহমদ মুসার ঠোঁটে। বলল, ‘ঘনিষ্ঠজনদের নিকটবর্তী হওয়ার ব্যাপারেই নিষেধ বেশি।’
‘কেন?’ বলল ডেবরা।
‘ছেলে ও মেয়েদের ঘনিষ্ঠ হওয়ার মধ্যে বিপদ রযেছে।’ বলল আহমদ মুসা।
‘যে বিপদের কথা বলছেন বুঝতে পেরেছি। ছেলে-মেয়েদের নিজস্ব শক্তির প্রতি এটা অনাস্থা নয় কি? মাফ করবেন, আপনি, ক্লাউডিয়া ও সুমাইয়ার প্রতি এই অনাস্থা কি কেউ পোষণ করতে পারে?’
গম্ভীর হলো আহমদ মুসা। বলল, ‘দেখ ডেবরা, আইন বিশেষ করে খোদায়ী আইন তৈরি হয়েছে ব্যক্তিকে সামনে রেখে নয়। আল্লাহ্‌ তাঁর আইন দিয়েছেন মানুষের প্রকৃতি ও প্রবণতা সামনে রেখে, যা তিনিই সৃষ্টি করেছেন।’
‘মানুষের প্রকৃতি ও প্রবণতার গতি কি সব সময় মন্দের দিকে?’ বলল ডেবরা।
‘তুমি একটা জটিল প্রসংগ তুলেছ ডেবরা। মানুষের মধ্যে ভালো প্রকৃতি ও প্রবণতা এবং মন্দ প্রকৃতি ও প্রবণতা দুই-ই সুপ্ত আছে। বাইরের কোন দৃশ্য বা কথা বা ঘটনা মন্দ প্রবণতাকে উস্কে দেয়, আবার কোন দৃশ্য বা কথা বা ঘটনা ভালো প্রবণতাকে জাগিয়ে তোলে। আল্লাহ্‌র আইনের লক্ষ্য হলো, যে দৃশ্য বা যে কথা বা যে ঘটনা বা পরিবেশ মন্দ প্রবণতাকে উস্কে দেয়, তাকে বন্ধ করা। এটা মেনে চললে মানুষ সুস্থ থাকে, সমাজ সুস্থ থাকে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘আপনাদের মত অনড় নৈতিকতা ও দৃঢ় চরিত্রের লোকদের এসব মেনে চলা কি জরুরি?’ বলল ডেবরা।
‘একজন সুস্থ–সবল ব্যক্তির শরীরে রোগ-জীবাণু কখন প্রবেশ করে, সে জানতে পারে না। যখন জানতে পারে, তখন দেখে সে আক্রান্ত। এভাবেই একজন দৃঢ় চরিত্রের লোকও ঘটনা ও পরিবেশের কারণে তার অজান্তেই মন্দ প্রবণতায় আক্রান্ত হতে পারে।’ বলল আহমদ মুসা।
‘আপনার নিজের প্রতিও এ অনাস্থা আপনার আছে?’ ডেবরা বলল।
‘মানবসুলভ সকল দোষ–গুণ নিয়ে আমি একজন মানুষ। অন্যদের মধ্যে যে দুর্বলতাগুলো রয়েছে, সে সব আমার মধ্যেও আছে। আল্লাহর আইন মেনে চলে আমি সে দুর্বলতা থেকে বাঁচতে চাই।’
‘আমাদের পশ্চিমী সমাজে এই নৈতিকতা নেই। মাথায় রুমাল পর্যন্ত অনেক ক্ষেত্রে সহ্য করা হচ্ছে না। আপনি যে দুর্বলতা থেকে বাঁচতে চাচ্ছেন, সে দুর্বলতা থেকে বাঁচার কোন সুযোগ পাশ্চাত্য সমাজে নেই। এই অবস্থায় পাশ্চাত্যের মেয়েদের জন্যে আপনার বক্তব্য কি?’ বলল জিয়ানা।
‘এদিক থেকে পাশ্চাত্যের মেয়েরা অবস্থার একটা অসহায় শিকার। তবে সমাজ ব্যবস্থা যা-ই হোক, রীতি–সংস্কৃতি যা-ই হোক, প্রতিটি মানুষের মনে স্রষ্টার মোতায়েন করা বিবেক নামক এক প্রহরী আছে, যে সব সময় ভাল কোনটা বলে দেয়, ন্যায় কোনটা বলে দেয় এবং সকল অনুচিত কাজ ও অন্যায়ের প্রতি অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করে। ছেলেমেয়েদের সম্পর্কের ক্ষেত্রেও বিবেকের এই খবরদারি আছে। পাশ্চাত্যের যে মেয়েরা বিবেকের এই নির্দেশ মেনে চলতে পারে, তারা পাশ্চাত্য সমাজে থেকেও অনন্য চরিত্রের অধিকারী হয়।’
‘নর-নারীর মধ্যে হৃদয়ের সম্পর্ক সৃষ্টি হওয়ার যে স্বাভাবিকতা, তাকে তাহলে অস্বীকার করতে হবে?’ বলল ডেবরা।
‘না, ডেবরা। স্বাভাবিক হলে তা অস্বীকার করা যাবে না।’ বলল আহমদ মুসা।
‘এর মধ্যে স্বাভাবিক–অস্বাভাবিক বলে কি দুই ভাগ আছে?’ জিয়ানার প্রশ্ন।
‘অবশ্যই আছে। ঘনিষ্ঠ না হবার পরেও হৃদয়ের সম্পর্ক কখনও সৃষ্টি হতে পারে, কিন্তু তা নীতি–সংস্কৃতির সীমা যদি লংঘন না করে এবং যদি তা কোন পরিবার ও সমাজ–সম্পর্কের প্রতি হস্তক্ষেপকারী না হয়, তাহলে একে স্বাভাবিক বলা যাবে।’
‘মানুষ ও সমাজ সম্পর্কের এত গভীরে গিয়ে আপনি ভাবেন?’ বলল জিয়ানা।
‘খুব গভীরের কথা এটা নয় ডাঃ জিয়ানা। মানুষ কে, কি দায়িত্ব নিয়ে সে দুনিয়ায় এসেছে এবং কোথায় কেন সে যাচ্ছে- এই প্রশ্নগুলোর উত্তর সন্ধান করলে মানুষ ও সমাজ সম্পর্কের এ বিষয়গুলো একেবারে প্রাথমিক পর্যায়ের হয়ে দাঁড়ায়।’
‘বিপ্লবী হতে আপনাকে কে বলেছিল? কেন আপনি দার্শনিক কিংবা ধর্মপ্রচারক হননি?’ সোফা থেকে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল ক্লাউডিয়া।
সোফা থেকে উঠে ক্লাউডিয়া আহমদ মুসার কাছে এসে বলল, ‘আপনি ওখানে গিয়ে বসুন।’
‘আমি বসে আছি, এটা কি আসন নয়?’ বলল আহমদ মুসা।
‘দেখুন, তাহলে আমি মেঝেতে বসে পড়ব।’
আহমদ মুসার ঠোঁটে এক টুকরো হাসি ফুটে উঠল। সে উঠে গিয়ে ক্লাউডিয়ার সোফায় গিয়ে বসতে বসতে বলল, ‘এ জেদটা ঠিক ডোনার মত হলো।’
‘আকাশের চাঁদের সাথে মাটির প্রদীপের তুলনা করা ঠিক হলো না।’ বলল ক্লাউডিয়া ম্লান হেসে।
‘চাঁদ এবং মাটির প্রদীপের এই তুলনা তুমি ঠিক করলে না।’ বলল আহমদ মুসা।
‘কেন? সে রাজকুমারী এবং একজন বিশ্ববিপ্লবীকে জয় করে নেয়ার মত দুর্লভ সৌভাগ্যের অধিকারী।’ ক্লাউডিয়া বলল।
‘হয়তো এতে সে জেতেনি। অনিশ্চিত ও দুঃখের এক জীবন সে বেছে নিয়েছে।’
‘এ যদি জিত না হয়, তাহলে এ পরাজয় লাখো জয়ের চেয়ে মধুর।’ বলল জিয়ানা।
এদিকে আহমদ মুসা তার মোড়ার সিট থেকে উঠার সঙ্গে সঙ্গে ডেবরা ছুটে এসে সেখানে বসে বলল, ‘আপা, আপনি ঐ সোফায় গিয়ে বসুন।’
‘বেশ ভাল, আমি রালফের পাশে গিয়ে বসি, তাই না? ওর সামনেই ওর কথা ভায়োলেট করতে বল?’
ডেবরা হাসল। বলল, ‘থ্যাংকস। আমি ভুলে গিয়েছিলাম।’ বলে ডেবরা উঠে তার সোফায় ফিরে গেল।
ক্লাউডিয়া বসল আহমদ মুসার সিটে।
আহমদ মুসা ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছিল।
‘ভাইয়া, আপনি ঘড়ির দিকে তাকিয়ে ক্লাউডিয়া আপার প্রশ্ন চাপা দিতে পারবেন না।’ আহমদ মুসাকে উদ্দেশ্য করে বলল ডেবরা।
‘আমাকে বেরুতে হবে বোন।’ বলে একটু থামল আহমদ মুসা। শুরু করল আবার, ‘ক্লাউডিয়ার প্রশ্নের উত্তর খুবই সোজা। আল্লাহর জীবন বিধান ইসলামে প্রত্যেকেই বিপ্লবী, প্রত্যেকেই ধর্মপ্রচারক এবং দার্শনিক। ইসলামী সমাজে ধর্মপ্রচারের দায়িত্ব পালনে যিনি শীর্ষে, তিনিই রাষ্ট্রপ্রধান হন, তিনিই যুদ্ধক্ষেত্রে সেনাপতিত্বের দায়িত্ব পালন করেন।’
কথা শেষ করেই আহমদ মুসা বলল, ‘রাত একটু ভারি হওয়ার অপেক্ষা করছিলাম। এখন রাত এগারটা। বেরুতে হবে আমাকে এখন।’
‘কোথায়?’ সুমাইয়া বলল।
‘ব্ল্যাক ক্রসের ঘাঁটিতে।’
‘ব্ল্যাক ক্রসের ঘাঁটি? কোথায়?’ বলল ক্লাউডিয়া।
আহমদ মুসা পকেট থেকে মাইক্রো রিমোট সেন্সর বের করল। বোতামে চাপ দিয়ে দেখল, লাল অ্যারো ইন্ডিকেটরটি ঠিক পশ্চিম দিকে ইংগিত করছে। আহমদ মুসা বলল, ‘পশ্চিম দিকে।’
আহমদ মুসাকে ছোট বস্তুটি নিয়ে ব্যস্ত হতে দেখে সবাই উঠে এসেছিল। ঘিরে দাঁড়িয়েছিল আহমদ মুসাকে। মাইক্রো স্ক্রীনে রেড অ্যারোটি সবারই নজরে পড়েছিল।
আহমদ মুসার কথা শেষ হতেই ক্লাউডিয়া বলে উঠল, ‘অ্যারো হেডের মাথা দেখে কি পশ্চিম দিকের কথা বললেন?’
‘হ্যাঁ।’ বলল আহমদ মুসা।
‘কি জিনিস এটা?’ বলল ক্লাউডিয়া।
‘মাইক্রো সেন্সর।’
‘কিভাবে কাজ করে?’
‘এখান থেকে পঞ্চাশ বর্গমাইলের যে কোন স্থানের মাইক্রো ট্রান্সমিটারের লোকেশন এ বলে দিতে পারে দূরত্বসহ।’
‘ব্ল্যাক ক্রসের ঘাঁটি এখান থেকে কতদূর?’ বলল রালফ।
‘সাত পয়েন্ট ছয় শূন্য কিলোমিটার।’
‘কি করে এটা সম্ভব হলো? ওখানে মাইক্রো ট্রান্সমিটার এল কোত্থেকে?’
‘তোমাদের মনে আছে, এয়ারপোর্ট টার্মিনালের সামনে যখন আমি গাড়ি থামিয়ে নেমেছিলাম, তখন ব্ল্যাক ক্রসের ঐ গাড়ি লক্ষ্যে দু’বার গুলি ছুঁড়েছিলাম। ঐ গুলিতে ছিল রাবার বুলেট। রাবার বুলেটে জড়ানো ছিল মাইক্রো ট্রান্সমিটারের চিপ। রাবার বুলেট গাড়িতে আঘাত করার সাথে সাথে চুম্বক আকর্ষণে তা সেঁটে গেছে গাড়ির বডি বা কোন পার্টসের গায়ে। সেই মাইক্রো ট্রান্সমিটারকেই এ সেন্সর এখন চিহ্নিত করছে।’
সকলের চোখে বিস্ময়! আহমদ মুসা থামলেও কারও মুখেই যেন তৎক্ষণাৎ কথা যোগাল না।
মুহূর্ত কয়েক পরে ডেবরা মুখ খুলল। বলল, ‘চোখের পলক পড়ার মত ঐ অল্প সময়ে এই বুদ্ধি আপনার মাথায় এল কি করে?’
ডেবরা থামতেই জিয়ানা বলল, ‘বলা যায়, এই সেন্সর লোকেট করছে গাড়িটাকে। কিন্তু গাড়িটা যদি হেডকোয়ার্টারে না থাকে?’
‘তাহলে অনিশ্চয়তার এক সমুদ্রে পড়ে যাব।’
‘কিছু মনে করবেন না, আমার কৌতুহল, সেই অবস্থায় আপনি কি করবেন?’ বলল ডেবরা।
‘কি করব, কি করব! গাড়ির জানালা ভেঙ্গে ঢুকে গাড়ির মালিকের ঠিকানা জেনে নেব লাইসেন্স অথবা ব্লু বুক থেকে। এ চেষ্টা ব্যর্থ হলে গাড়ির নাম্বার কাজে লাগিয়ে ভেহিকেল রেজিস্ট্রেশন অফিস থেকে গাড়ির মালিকের ঠিকানা জেনে নেব। এ উদ্যোগ কোন ফল না দিলে বিপদেই পড়ব। সে ক্ষেত্রে রালফের নাম ও ঠিকানাসহ পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেব তার বাবার সন্ধান চেয়ে। নিশ্চয় ব্ল্যাক ক্রস তখন হানা দেবে রালফের ঠিকানায়। পালানো শিকার ধরে তাদের দু’জন লোক হত্যার প্রতিশোধ নেবার জন্যে। ব্ল্যাক ক্রস ব্যর্থ হবে, কিন্তু তাদের অনুসরণ করে আমি তাদের ঘাঁটিতে পৌঁছতে পারব।’
শ্বাসরুদ্ধভাবে ওরা শুনছিল আহমদ মুসার কথা। ওদের চোখে অপার বিস্ময় এবং আনন্দ।
‘দুনিয়ার সব বুদ্ধি আপনার মাথায় কম্পিউটারের মত প্রোগ্রাম করে ঢোকানো আছে নাকি?’ বলল ডেবরা।
‘সব মাথাই এক আল্লাহর সৃষ্টি ডেবরা।’ বলে আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল। বলল, ‘আমি একটু তৈরি হয়ে আসি। বেরুবো এখনই।’
‘শুধু আপনি তৈরি হবেন, আমরা তৈরি হবো না?’ বলল রালফ।
আহমদ মুসা দু’পা এগিয়ে থমকে দাঁড়াল। একটু হাসল। বলল, ‘না, তোমরা যাবে না।’
‘তা হয় না।’ বলল রালফ।
‘আপনাকে একা আমরা কি করে ছাড়ব?’ বলল ক্লাউডিয়া।
‘দেখো, আমি যাচ্ছি অনেকটা অনিশ্চিতভাবে। গাড়ি কোথায় আছে জানি না। তোমাদের যাওয়ার কোন প্রয়োজন নেই।’ বলল আহমদ মুসা।
‘ক্ষতি তো নেই।’ বলল জিয়ানা।
‘ক্ষতি আছে। বেশি লোক গেলে বেশি লোকক্ষয়ের সম্ভাবনা।’
‘এখানে কম লোকক্ষয় হলে যে ক্ষতি হবে সেটাই বেশি ক্ষতিকর।’ বলল ক্লাউডিয়া।
‘তোমরা বুঝছ না, এটা যুদ্ধক্ষেত্র।’ বলল আহমদ মুসা।
‘দেখুন, আমাদের প্রত্যেকের পিস্তল আছে। আমরা পিস্তল চালাতে জানি।’
‘তোমাদের বাপ-মা আছে। সাময়িক আবেগ থেকে এমন সিদ্ধান্ত তোমরা নিতে পারো না।’
‘সাময়িক আবেগ এটা আমাদের নয়। ওমর বায়া আপনার কে? তার জন্যে আপনি জীবন বাজি রেখেছেন। ডঃ ডিফরজিস আপনার কেউ নয়, কিন্তু তার জন্যে আপনি ছুটছেন মৃত্যু ভয় মাড়িয়ে। এসব কি আমাদের কোনই শিক্ষা দেয় না?’ বলল ক্লাউডিয়া আবেগপ্লাবিত স্বরে।
আহমদ মুসা সোফায় বসে পড়ল পিছিয়ে এসে। বলল, ‘আমি তোমাদের বোঝাতে পারছি না। এটা দল বেঁধে যুদ্ধ করার ক্ষেত্র নয়। দুই কারণে। এক. ওরা সংখ্যায় বেশি, দুই. ওরা আগে জানতে পারলে বন্দীদের সরিয়ে নিতে পারে অথবা বন্দীদের জীবন বিপন্ন হতে পারে।’
‘ঠিক আছে। আমরা বাইরে কোথাও অপেক্ষা করতে পারি না?’ বলল রালফ।
একটু ভাবল আহমদ মুসা। তারপর বলল, ‘ঠিক আছে। পারো। পাঁচ মিনিটের মধ্যে তোমরা তৈরি হয়ে নাও।’
ঠিক পাঁচ মিনিটের মধ্যেই ওরা দুই গাড়িতে করে রেস্টহাউস থেকে বেরিয়ে এল।

সবুজ টিলার উপর অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আছে ব্ল্যাক ক্রসের সেই বাড়িটি। বাড়িটার আশেপাশে বাড়ি নেই বলে এবং গাছপালা থাকার কারণে আশপাশটা অন্ধকার। অন্ধকারের আরও একটা কারণ, বাড়ির বাইরের অংশে কোন আলো জ্বালানো নেই।
তিনতলার বিশাল ঘরটির পাশে বড় একটা অফিস কক্ষ। একটা সুদৃশ্য সেক্রেটারিয়েট টেবিল সামনে রেখে বসে আছে পিয়েরে পল। তার মুখে তৃপ্তির ভাব। চোখ দু’টি আনন্দে উজ্জ্বল।
পিয়েরে পল টেবিলের কয়েকটা কাগজ গুছিয়ে ব্রিফকেসে রেখে ইন্টারকমের সুইচ টিপে বলল, ‘রুশো, তুমি ওমর বায়াকে তিনতলায় এনে ডঃ ডিফরজিসের পাশের রুমে রাখ। দরকার হলে ডক্টরকে ওমর বায়ার অবস্থাটা একবার দেখাবে।’
পিয়েরে পল উঠে দাঁড়াল কথা শেষ করে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল রাত বারটা।
পিয়েরে পল ধীরে ধীরে বেরিয়ে এল ঘর থেকে। মুখোমুখি পাশের ঘরটাতেই রাখা হয়েছে ডঃ ডিফরজিসকে।
পিয়েরে পল গিয়ে ডঃ ডিফরজিসের দরজার সামনে একটু দাঁড়াল। তারপর দরজার নব ঘুরিয়ে ধীরে ধীরে প্রবেশ করল ঘরে।
ঘরের এক প্রান্তে খাটে বিছানা পাতা রয়েছে। খাটের অল্প দূরে টিপয়ের দু’পাশে মুখোমুখি দু’টি সোফা পাতা রয়েছে। তারই একটিতে বসে রয়েছে ডঃ ডিফরজিস। সত্তরেরও বেশি বয়স ভদ্রলোকের। কিন্তু দেখে মনে হয় ষাট অতিক্রম করেননি। দেহের শক্ত গড়ন। তীক্ষ্ণ চোখ। উদ্বেগের একটা ছায়া ছড়িয়ে আছে তার সারা মুখে।
‘হ্যালো ডক্টর’ বলে পিয়েরে পল এগোলো ডঃ ডিফরজিসের দিকে।
ডঃ ডিফরজিস মুখ তুলে তাকাল পিয়েরে পলের দিকে। তার চোখে-মুখে বিস্ময়, বেদনা এবং কৌতুহলের সংমিশ্রণ। বলল, ‘হ্যালো, বসুন।’
‘ধন্যবাদ।’ বলে পিয়েরে পল ডঃ ডিফরজিসের সামনের সোফায় বসে পড়ল। বলল, ‘আপনি একজন মহৎপ্রাণ মানুষ, ডক্টর। আপনাকে কষ্ট দেয়ার জন্যে দুঃখিত।’
‘আপনি কে? আমার সন্তান ও আমার বৌমাকে আপনারাই কি কিডন্যাপ করেছেন?’
পিয়েরে পলের মন খুশিতে ভরে গেল। সে নিশ্চিত হলো যে, রালফ-ফ্রাংকদের পালাবার কথা ডঃ ডিফরজিস এখনো জানতে পারেনি। এই না জানা তাদের কাজ উদ্ধারে অনেক সাহায্য করবে। বলল পিয়েরে পল, ‘কিডন্যাপ করেছি নয়, নিরুপায় হয়ে বাধ্য হয়েছি ঐ মন্দ কাজটা করতে।’
‘মন্দ কাজ করেছেন, সেটা বোঝেন তাহলে?’
‘বুঝি। কিন্তু মন্দ সব সময় মন্দ থাকে না। বৃহত্তর স্বার্থে, বৃহত্তর কল্যাণের জন্যে আমরা যেটা করেছি, সেটা এখন আর মন্দ নেই।’
‘আমাকে তো ধরেছেন, আমার সন্তানদের এখন ছেড়ে দিন।’
‘দেব। আপনাকেও আমরা ধরে রাখবো না। কিন্তু এ সব কিছুই নির্ভর করছে আপনার উপর।’
‘আমার উপর কেন?’
‘আপনাকে তো আমাদের পক্ষ থেকে সবই বলা হয়েছে।’
‘ও, ক্যামেরুনের বিচারপতি উসাম বাইককে তোমরা যা চাও সেই ভাবে কাজ করতে বলতে হবে।’
‘ঠিক। তবে ‘আমরা যা চাই’ তা নয়, ‘জাতি যা চায়’ তা-ই আমরা করতে বলছি।’
‘জাতিকে ব্যবহার করছেন কেন? ঐ জমি কি জাতি নিচ্ছে?’
‘জমি ‘কিংডম অব ক্রাইস্ট’ নিচ্ছে চার্চের নামে।’
‘আপনার কথা সত্য হলেও ‘কিংডম অব ক্রাইস্ট’-এর অন্যায়কে সমর্থন করা যায় না। অন্যান্য জাতির পক্ষ থেকে করলেও অন্যায়, ব্যাক্তি করলেও অন্যায়।’
‘আপনি বাস্তবতাকে অস্বীকার করছেন, ডক্টর।’
‘কোন বাস্তবতার কথা বলছেন?’
‘ক্রস এবং ক্রিসেন্ট-এর লড়াইয়ের কথা।’
‘এটা তো একটা পুরানো ব্যাপার।’
‘পুরানো ব্যাপার। কিন্তু নতুন করে তীব্র হয়ে উঠেছে।’
‘কিংডম অব ক্রাইস্টের ঐ অন্যায় কর্মের সাথে ক্রস এবং ক্রিসেন্টের এই যুদ্ধের সম্পর্ক কি?’
হাসল পিয়েরে পল। বলল, ‘‘কিংডম অব ক্রাইস্ট’ (KOC) এবং ‘আর্মি অব ক্রাইস্ট অব ওয়েস্ট অফ্রিকা’ (AOCOWA) আফ্রিকায় ক্রস-এর পক্ষের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য সফল শক্তি।’
‘হতে পারে। কিন্তু তারা অন্যায় করছে। লুণ্ঠনের কাজ করছে।’
‘যদি স্বীকারও করি যে তারা এটা করছে, তবু সত্য এই যে, তারা নিজের জন্যে এটা করছে না, করছে আফ্রিকায় খৃস্টকে একচ্ছত্র বিজয়ের আসনে বসাবার জন্যে। এটা এমন বাস্তবতা যা অস্বীকারের কোন সুযোগ নেই।’
বলে একটু দম নিল পিয়েরে পল। শুরু করল আবার, ‘আফ্রিকার ধর্মীয় মানচিত্রের দিকে একবার লক্ষ্য করুন। ইসলাম বা ক্রিসেন্ট আফ্রিকায় যাত্রা শুরু করেছিল উত্তর থেকে। তারপর ক্রমশ এগিয়েছিল দক্ষিণে। আফ্রিকার যতই দক্ষিণে যাওয়া যায় মুসলমানদের সংখ্যা ততই কম। তবু আফ্রিকার প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ এলাকায় ইসলাম সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করেছিল। অবশিষ্ট এক-তৃতীয়াংশ অঞ্চলেও মুসলমানরাই ছিল সবচেয়ে সক্রিয় প্রভাবশালী গ্রুপ। এ কারণেই একমাত্র আফ্রিকা মহাদেশই ‘মুসলিম মহাদেশ’ আখ্যা লাভ করেছিল। মিঃ ডিফরজিস, প্রভূত সম্ভাবনাময় এই মুসলিম মহাদেশেই খৃস্টের রাজ্য প্রতিষ্ঠার জন্যে খৃস্টের ক্রস তার যাত্রা শুরু করে। আফ্রিকার দক্ষিণ থেকে এই যাত্রা শুরু হয়। যুদ্ধ শুরু হয় ক্রিসেন্টের সাথে ক্রসের। ডক্টর ডিফরজিস, আফ্রিকার ধর্মীয় মানচিত্রের দিকে তাকালে দেখবেন, আফ্রিকার দক্ষিণ প্রান্ত থেকে মধ্য আফ্রিকা পর্যন্ত মাত্র চারটি রাষ্ট্র ছাড়া অন্যান্য সবগুলোতেই ক্রস আজ ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত। মধ্য আফ্রিকায় চলছে আজ ক্রস এবং ক্রিসেন্টের মধ্যে লড়াই। এই মধ্য আফ্রিকা ছিল ক্রিসেন্টের শক্ত মুঠোর মধ্যে। কিন্তু সেই মধ্য আফ্রিকায় ক্রস আজ ক্রিসেন্টের শক্ত মুঠি ভেঙে দিচ্ছে। মুসলমানদের সংখ্যাধিক্য সেখানে ধ্বসে পড়ছে। চাদে মুসলিম সংখ্যা শতকরা ৮৫ ভাগ থেকে ৪৪ ভাগে, নাইজেরিয়ায় ৬৫ ভাগ থেকে ৫০ ভাগে এবং ক্যামেরুনে ৫৫ ভাগ থেকে ১৬ ভাগে নেমে এসেছে। এছাড়া নাইজেরিয়ার উত্তরে উপকূল বরাবর মুসলিম দুর্গ অঞ্চলের কয়েকটি পকেটে আমরা বিস্ময়কর অগ্রগতি অর্জন করেছি। ঘানায় মুসলমানের সংখ্যা ৪৫ ভাগ থেকে ১৩ ভাগে, গিনি বিসাও ও সিয়েরালিওনে ৮০ ভাগ থেকে ৩০ ভাগে এবং বুরকিনা ফাসোতে ৫৫ থেকে ৪০ ভাগে নেমে এসেছে। সবচেয়ে বড় কথা, নামিবিয়া থেকে ক্যামেরুনের মধ্য অঞ্চল পর্যন্ত বিশাল এলাকায় মুসলিম উচ্ছেদকরণ আজ সম্পূর্ণ হয়েছে। ‘ক্রস’-এর এই যে অকল্পনীয় সাফল্য, তার জন্যে সবচেয়ে বেশি কৃতিত্বের দাবি KOC এবং AOCOWA করতে পারে। দক্ষিণ ক্যামেরুনে ওমর বায়ার দশ হাজার একর জমি KOC দখল করতে পারলেই দক্ষিণ ক্যামেরুন থেকে মুসলিম উচ্ছেদ সম্পূর্ণ হয়ে যায়। ডঃ ডিফরজিস, আপনি এই জমিটুকু দখলে সহায়তা করে আফ্রিকায় ক্রস-এর বিজয় অভিযানে ঐতিহাসিক ভূমিকা রাখতে পারেন। ভেবে দেখুন, এই সহায়তা আপনি KOC বা AOCOWA কে করছেন না, সাহায্য করছেন প্রভু খৃস্টের ক্রসকে।’
‘আপনি বাস্তব অবস্থা তুলে ধরেছেন, আমি অস্বীকার করছি না। কিন্তু সহায়তার জন্যে আপনারা ভুল জায়গায় এসেছেন। আমি আইনের ছাত্র, সারাটা জীবন আইন নিয়েই কাজ করে আসছি। আমি আপনাদের বেআইনী কাজে শরীক হতে পারবো না। আমি অনু্রোধ করছি, আমাকে ও আমার সন্তানদের অহেতুক আটকে না রেখে ছেড়ে দিন।’
‘ডক্টর ডিফরজিস, আপনি জ্ঞানী মানুষ। আপনাকে বুঝিয়ে বলার প্রয়োজন নেই। আমরা যে কাজে হাত দেই, তা শেষ না করে ছাড়ি না। আপনি যদি বিচারপতি ডক্টর উসাম বাইককে চিঠি দিতেন, টেলিফোন করে দিতেন, তাহলে আপনি এখানেই থাকতে পারতেন। কিন্তু এখন আপনাকে আমাদের সাথে ক্যামেরুন যেতে হবে।’
পিয়েরে পল কথা শেষ করলে ডঃ ডিফরজিস অনেকক্ষণ কথা বলল না। ভাবছিল সে। বলল বেশ পরে, ‘এখানে যা করছি না, ওখানে গিয়ে তা কি করব?’
‘সেটা ওখানে গিয়ে আমরা দেখব। রাজি করার আরও কিছু উপায় আমাদের আছে। তাছাড়া আপনাকে পণবন্দী দেখিয়ে ক্যামেরুনের বিচারপতিকেও আমরা আমাদের হাতের মুঠোয় আনতে পারি।’
‘জানি না সেটা আপনারা পারবেন কিনা। তবে আমাকে ভয় দেখিয়ে কোন লাভ হবে না।’
‘সেটা আমাদের ব্যাপার। আমরা ভোরেই ক্যামেরুন যাচ্ছি। তাই এখানে কোন ঝামেলা করতে চাই না। তা না হলে রাজি করার দু’একটা পদ্ধতি এখানেও প্রয়োগ করা যেত।’
কথা শেষ করেই হাতের ওয়াকি-টকির একটা বোতাম টিপে মুখের কাছে তুলে ধরে বলল, ‘রুশো, দু’টো কফিন কমপ্লিট?’
‘হ্যাঁ।’ ওপাশ থেকে উত্তর এল।
‘তিনতলায় নিয়ে এস।’
‘এখনি নিয়ে যাচ্ছি স্যার।’
‘ওকে। এখন সাড়ে বারোটা। ভোর পাঁচটায় প্লেন। আমাদের ডক্টর সাহেব ও ওমর বায়াকে সসম্মানে কফিনে প্যাক করে ফেল, যেভাবে বলেছি, সেই ভাবে।’
ওয়াকি-টকি গুটিয়ে পকেটে রেখে উঠে দাঁড়াল পিয়েরে পল। বলল, ‘ডক্টর, সব তো শুনলেন। আশা করি, আমাদের সাথে সহযোগিতা করবেন। আমার মতো আমার লোকগুলো কিন্তু ভাল নয়। মানীর মান তারা বোঝে না।’ বলে পিয়েরে পল বেরিয়ে এল ঘর থেকে।

মাইক্রো সেন্সরের সংকেত অনুসরণ করে আহমদ মুসারা ব্ল্যাক ক্রস-এর টিলা বাড়িতে ঠিকই পৌঁছে গিয়েছিল।
অন্ধকারে ঢাকা বাড়িটি।
আহমদ মুসা টিলার গোড়ায় একটা ঝোপের আড়ালে গাড়িসমেত ক্লাউডিয়াদের রেখে আসে। আসার সময় আহমদ মুসা ওদের বলে, ‘দু’ঘণ্টার মধ্যেও যদি আমি না ফিরি, তাহলে তোমরা চলে যাবে।’
কথা শেষে একটু থেমেছিল আহমেদ মুসা। তারপর ক্লাউডিয়াকে লক্ষ্য করে বলেছিল, ‘ডোনাকে টেলিফোন করতে চেয়েছিলাম, ভুলে গেছি। ডোনার টেলিফোন নাম্বারটা তুমি রাখ।’ বলে আহমদ মুসা টিলা বেয়ে উঠে আসে।
ক্লাউডিয়াসহ সবাই দাঁড়িয়ে দেখছিল আহমদ মুসাকে। ক্লাউডিয়া, সুমাইয়া এবং জিয়ানার মুখে নতুন এক ঔজ্জ্বল্য এবং রহস্যময়তা।
আহমদ মুসা প্রাচীরের গোড়ায় এসে বাড়ির চারদিকটা একবার ঘুরে এল। প্রাচীর দিয়ে ঘেরা বাড়ি। ছয় ফুটের মতো উঁচু হবে প্রাচীর। একটাই মাত্র গেট। লোহার দরজা। গেটের দু’পাশে দু’টি আলো উপর থেকে শেডে ঢাকা।
গেটের পাশে কোন গেটরুম নেই।
‘তাহলে গেট কি দূর নিয়ন্ত্রিত কোন পদ্ধতিতে খোলা হয়?’ ভাবল আহমদ মুসা প্রাচীরের অন্ধকারে দাঁড়িয়ে। ‘গেটে টিভি ক্যামেরাও পাতা থাকতে পারে’– আরও ভাবল আহমদ মুসা। প্রাচীর টপকে কি সে ভেতরে ঢুকবে? কিন্তু সেখানেও অ্যালার্ম কয়েল পাতা থাকতে পারে।
আহমদ মুসা পিঠে ঝোলানো থলে থেকে এন এন্ড এস (নাইট এন্ড স্মোক) গগলস বের করে চোখে পড়ল। তারপর পকেট থেকে ‘স্মোক টিউব’ বের করে প্রাচীরের গা ঘেঁষে পা পা করে গেটের অনেকখানি নিকটবর্তী হলো এবং টিউবের ‘উইন্ডপ্রুফ নিল’ ছিঁড়ে ছুঁড়ে দিল দরজার সামনে।
মুহূর্তের মধ্যে কুয়াশার মতো সাদা ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে গেল গেট এলাকা।
আহমদ মুসা দ্রুত গিয়ে দাঁড়াল গেটের সামনে। ভাবল, টিভি ক্যামেরার চোখ অন্ধ করা গেছে কিন্তু দরজার সাথে অ্যালার্ম থাকতে পারে। আহমদ মুসা জানে, গেটের অ্যালার্ম সব সময় দরজা খোলার সাথে সম্পর্কিত থাকে। তার অর্থ, অ্যালার্ম দরজার কব্জার সাথে সংযুক্ত করা হয়, যাতে দরজা খুলতে গেলেই অ্যালার্ম বেজে উঠে।
আহমদ মুসা দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়ে নিল।
পকেট থেকে বের করল ল্যাসার কাটার এবং দরজার ঠিক মাঝখানে দুই বর্গফুট জায়গার ইস্পাত প্লেট কেটে ফেলল।
ভেতরে প্রবেশের আগে আরেকটা স্মোক টিউব ছুঁড়ে দিল ভেতরে। আহমদ মুসা সন্দেহ করছিল, ভেতরের দিকে মুখ করা ক্যামেরাও থাকতে পারে। দূর নিয়ন্ত্রিত গেটে তা-ই থাকে।
কয়েক মুহূর্ত সময় নিয়ে আহমদ মুসা ঢুকে গেল ভেতরে।
ভেতরের চত্বরটায় সুন্দর ফুলের বাগান। গেট থেকে লাল ইটের একটা প্রশস্ত রাস্তা চলে গেছে গাড়ি বারান্দা পর্যন্ত।
আহমদ মুসা পকেটের রিভলভারের বাঁটে হাত রেখে বেড়ালের মত নিঃশব্দে দ্রুত এগিয়ে চলল।
আহমদ মুসা সবে গাড়ি বারান্দায় পা রেখেছে, এমন সময় পেছন থেকে আসা প্রচণ্ড ধাক্কায় উপুড় হয়ে পড়ে গেল সে।
কিন্তু পড়ে গেলেও পকেট থেকে তার হাত সাইলেন্সার লাগানো রিভলভারসমেত বেরিয়ে এসেছে।
আহমদ মুসা বুঝল, পেছন থেকে অন্তত দু’জন তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ছে।
আহমদ মুসা পড়ে গিয়েই নিজের শরীরটাকে বাম দিকে উল্টে নিল ওরা তার উপর চেপে বসার আগে।
আহমদ মুসা তার শরীর বাম দিকে উল্টে নেবার ফলে তার শরীরটা পেছন থেকে আসা চাপের মূল কেন্দ্র থেকে একপাশে সরে এল, যার কারণে আক্রমণকারীদের একজন ডানপাশে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ল। শুধু তা-ই নয়, আহমদ মুসার ডান হাতে ধরা রিভলভারের মুখেও এসে পড়ল।
শরীরটা উল্টে নেবার পর গুলি করতে মুহূর্তও বিলম্ব করেনি আহমদ মুসা। সাইলেন্সার লাগানো রিভলভার থেকে অস্পষ্ট ‘দুপ’ করে একটা শব্দ উঠল। বুকটা এফোঁড়-ওফোঁড় হয়ে গিয়েছিল লোকটার।
এদিকে দ্বিতীয় লোকটা আহমদ মুসার উপর চেপে বসেছিল। তার শক্ত দুই হাত সাঁড়াশির মত বসে যাচ্ছিল আহমদ মুসার গলায়।
আহমদ মুসার মনে হচ্ছিল, গলাটা যেন ছিঁড়ে যাচ্ছে তার। চোখ দু’টি তার বিস্ফারিত হয়ে উঠছিল।
আহমদ মুসার ডান হাত উঠে এল। তার ডান হাতের রিভলভারটি এসে স্পর্শ করল লোকটির মাথা।
লোকটি চমকে উঠে চকিতে এদিকে একবার চোখ ঘুরিয়েই একটু কাত হয়ে মাথাটা সরিয়ে নিতে গেল। কিন্তু আহমদ মুসার আঙুল ট্রিগারে চাপ দিয়েছে তার আগেই।
আহমদ মুসার উপর থেকে উল্টে পড়ে গেল লোকটা। গুঁড়ো হয়ে গিয়েছিল তার মাথা।
আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল। একটু সরে এসে একটা থামের আড়ালে দাঁড়াল সে।
প্রায় মিনিটখানেক অপেক্ষা করল। না, কোন দিক থেকে কেউ এল না। আহমদ মুসা বুঝল, প্রাচীর বরাবর এই দু’জনই ছিল পাহারায়।
থামের আড়াল থেকে বেরিয়ে এল আহমদ মুসা। গাড়ি বারান্দার চারদিকে তাকাল। দেখল, একটু পশ্চিম দিকে পাকা শেড আকারের একটা ঘর। গাড়ি বারান্দা থেকে লাল ইটের একটা রাস্তা ঐ ঘর পর্যন্ত এগিয়ে গেছে। আহমদ মুসা বুঝল, ওটাই গ্যারেজ। ঐ গ্যারেজেই তার টার্গেট গাড়িটা রয়েছে।
আহমদ মুসা লক্ষ্য করল, লাল ইটের একটা সরু রাস্তা বিল্ডিং-এর পেছন দিক থেকে এসে গ্যারেজের সামনে দিয়ে প্রাচীরের দিকে চলে গেছে।
আহমদ মুসা গাড়ি বারান্দা থেকে তিনটি ধাপ ডিঙিয়ে বিল্ডিং-এর বারান্দায় উঠল।
বিরাট দরজা। দেখেই বুঝল, কাঠের দরজা। কিন্তু দরজার চার প্রান্তই ইস্পাতের পাত দিয়ে মোড়া। ‘কী-হোল’ পরীক্ষা করে দেখল। নিশ্চিত হলো আহমদ মুসা, এ দরজাও দূর নিয়ন্ত্রিত।
আহমদ মুসা মুশকিলে পড়ল। ল্যাসার কাটার দিয়ে কাঠের দরজা ধীরে ধীরে পোড়ানো যায়, কিন্তু কাটা যায় না। পোড়ানোর ব্যাপারটা সময়সাপেক্ষ। তাহলে?
আহমদ মুসার মনে পড়ল বাড়ির পেছন থেকে আসা রাস্তার কথা। ওটা ক্লিনার প্যাসেজ নয়তো?
আহমদ মুসা নেমে এল বারান্দা থেকে।
লাল ইটের সরু রাস্তা ধরে এগোলো বাড়ির পেছন দিকে।
সেই রাস্তাটি আহমদ মুসাকে একটা ছোট সাইজের দরজার সামনে নিয়ে দাঁড় করাল। ভারি ইস্পাতের তৈরি দরজা। পরীক্ষা করে দেখল, অটো লক সিস্টেম। বাইরে থেকে চাবি দিয়ে খোলার কোন ব্যবস্থা নেই। তবু খুশি হলো আহমদ মুসা। এ লকগুলো কাটা ল্যাসার কাটার দিয়ে খুব সহজ। দরজার গায়ে কী-লকের চিহ্ন দেখে ‘লক’-এর অবস্থান চিহ্নিত করল আহমদ মুসা। তারপর সেই স্থানে দরজা ও চৌকাঠের মাঝ বরাবর ল্যাসার কাটারের বীম প্রবেশ করাল।
মাত্র কয়েক সেকেন্ড। নড়ে উঠল দরজা। ‘লক’ কেটে গেছে।
কয়েক মুহূর্ত অপেক্ষা করে ধীরে ধীরে দরজা ঠেলে প্রবেশ করল আহমদ মুসা।
জায়গাটা করিডোরের একটা প্রান্ত। আহমদ মুসা ফিরে দাঁড়িয়ে দরজাটা বন্ধ করতে গিয়ে চমকে উঠল। দেখল, ‘লক’-এর সাথে একটা অ্যালার্ম ট্রান্সমিটার লাগানো। এর অর্থ, ‘লক’-এর উপর আঘাত এলে তা আহত করবে ট্রান্সমিটারকেও। সঙ্গে সঙ্গেই তা সংকেত পাঠাবে অ্যালার্ম-এর গ্রাহক যন্ত্রে বা বাজিয়ে দেবে অ্যালার্ম।
দরজা বন্ধ না করেই ঘুরে দাঁড়াল আহমদ মুসা। সে নিশ্চিত, এতক্ষণে অ্যালার্ম বেজে গেছে এবং ব্ল্যাক ক্রস-এর লোকেরা এতক্ষণে সক্রিয় হয়ে উঠেছে।
আহমদ মুসা রিভলভার হাতে নিয়ে বেড়ালের মত সামনে এগোলো।
করিডোরের দুই পাশের রুমগুলোকে বিভিন্ন জিনিসের স্টোর বলে মনে হলো আহমদ মুসার।
করিডোরটি একটি বড় ঘরে গিয়ে শেষ হয়েছে। কক্ষে কয়েকটি কাটিং টেবিল এবং কয়েকটি ওয়াশ বেসিন। আহমদ মুসা বুঝল, এটা কুকিং প্রিপারেশন রুম।
কক্ষে এসে শেষ হওয়া করিডোর-মুখ থেকে বিপরীত দিকে কক্ষটিতে আরেকটা দরজা আছে। সেখান থেকে আরেকটা করিডোরের শুরু।
করিডোরে উঁকি দিতেই অনেকগুলো পায়ের শব্দ শুনতে পেল আহমদ মুসা।
চকিতে সরে এসে দরজা ঘেঁষে দেয়ালের আড়ালে দাঁড়াল সে।
ছুটে আসা প্রথম লোকটি ঘরের ভেতরে পা বাড়ালে আহমদ মুসা তার ডান পা এগিয়ে দিল ছুটে আসা পায়ের সামনে। লোকটি হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল। তার স্টেনগানটা ছিটকে চলে এল আহমদ মুসার পায়ের কাছে।
আহমদ মুসা স্টেনগান তুলে নিয়েই গুলি চালাল। পড়ে যাওয়া লোকটি উঠে দাঁড়াচ্ছিল এবং ইতোমধ্যে আরেকজন লোক এসে ঘরে ঢুকেছিল। তারা দু’জনেই গুলিবিদ্ধ হয়ে পড়ে গেল।
ওদের উপর গুলি চালিয়ে স্টেনগানের ব্যারেলটা ঘুরিয়ে নিল করিডোরের দিকে।
করিডোর দিয়ে ছুটে আসা চারজন একদম গুলির মুখে পড়ল। কোন কিছুর আড়াল নেবার কোন সুযোগ ছিল না তাদের। চারজনই গুলি খেয়ে বোঁটা ছেঁড়া ফলের মত করিডোরের উপর ঝরে পড়ল।
আহমদ মুসা করিডোরে উঁকি দিয়ে দেখল, কেউ নেই আর করিডোরে।
স্টেনগান বাগিয়ে করিডোরের মুখে গিয়ে দাঁড়াল। অপেক্ষা করল কিছুক্ষণ। বিস্মিত হলো, কোন তৎপরতা তাদের নেই কেন? আশংকার এক মেঘ দ্রুত মনে উদয় হলো, তারা কি আক্রমণের পথ পরিবর্তন করেছে?
মনের এ চিন্তাটা শেষ না হতেই তার কানে এল পেছন থেকে পায়ের শব্দ।
সঙ্গে সঙ্গেই বোঁ করে ঘুরল আহমদ মুসা। কিন্তু স্টেনগান তোলার সুযোগ হলো না। দেখল, তার মাত্র দুই গজ পেছনে ঘরের মেঝেতে দাঁড়িয়ে একজন। তার স্টেনগানের নল আহমদ মুসার বুক বরাবর উঠানো।
আহমদ মুসার প্রাথমিক বিমূঢ়তা তখনও কাটেনি। এমন সময় রিভলভারের একটা গুলির শব্দ শুনতে পেল আহমদ মুসা। আর সাথে সাথেই সামনের স্টেনগানধারী লোকটির দেহ ঝাঁকুনি দিয়ে উঠে পেছন দিকে উল্টে পড়ে গেল।
আহমদ মুসা দেখতে পেল পিস্তল হাতে ক্লাউডিয়াকে এবং তার পেছনে ওপাশের করিডোরের মুখে সুমাইয়া ও জিয়ানাকে। তাদের হাতেও পিস্তল। ক্লাউডিয়া এবং ওরা তাকিয়েছিল আহমদ মুসার দিকে। আহমদ মুসা ওদিকে এগোবার জন্যে পা একধাপ বাড়িয়েছিল। এই সময় রিভলভারের গর্জন শোনা গেল। সঙ্গে সঙ্গে ক্লাউডিয়া বুক চেপে ধরে মাটিতে পড়ে গেল।
আহমদ মুসা শব্দ শুনেই তাকাল ঘরের উত্তর দিকে। দেখল, সেখানে একটা দরজা খুলে গেছে। এ দরজা আহমদ মুসার নজরে পড়েনি আগে। দরজার এপারে দাঁড়িয়ে একজন লোক। তার রিভলভারের নল ঘুরে আসছে ক্লাউডিয়ার দিক থেকে আহমদ মুসার দিকে।
আহমদ মুসা স্টেনগান তুলেই তাকিয়েছিল শব্দ লক্ষ্যে। লোকটির উপর তার নজর পড়ার সাথে সাথেই আহমদ মুসার স্টেনগান গুলি বৃষ্টি করল।
লোকটি গুলি খেয়ে ঝাঁঝরা দেহ নিয়ে যেখানে দাঁড়িয়েছিল সেখানেই পড়ে গেল।
আহমদ মুসা গুলি করেই ছুটে গেল ক্লাউডিয়ার কাছে। রক্তপ্লাবিত ক্লাউডিয়ার মাথাটা হাতে তুলে নিল।
জিয়ানা ও সুমাইয়াও ছুটে আসছিল ক্লাউডিয়ার দিকে। ডাঃ জিয়ানা ছিল সামনে। ঘরের মাঝখানে যখন সে, উত্তরের দরজার দিকে শব্দ শুনে তাকিয়ে দেখতে পেল, দরজায় দাঁড়িয়ে একজন লোক। তার হাতের ভয়ংকর মেশিন রিভলভার উঠেছে আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে।
ডাঃ জিয়ানা একটা চিৎকার তুলে ছুটে গিয়ে নিজের দেহ দিয়ে আহমদ মুসার দেহ ঢেকে দিল। প্রায় সাথে সাথেই মেশিন রিভলভার থেকে এক ঝাঁক গুলি ছুটে এল আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে। সবগুলো গুলিই এসে বিদ্ধ করল জিয়ানাকে।
ওদিকে সুমাইয়া জিয়ানাকে উত্তরের দরজার দিকে তাকিয়ে আহমদ মুসার দিকে চিৎকার করে ছুটতে দেখে উত্তরের দরজার দিকে চাইল। সে দেখতে পেল, একজন লোকের রিভলভার আহমদ মুসার দিকে উদ্যত। সে মুহূর্তে তার মেশিন রিভলভার গুলিবর্ষণ করল।
সুমাইয়াও তার রিভলভার তুলেছিল। কিন্তু দেরি হয়ে গিয়েছিল। সুমাইয়ার গুলি যখন লোকটির বুক এফোঁড়-ওফোঁড় করে দিল, তখন যা হবার হয়ে গেছে। ঝাঁঝরা হয়ে গেল ডাঃ জিয়ানার দেহ।
আহমদ মুসা ধীরে ধীরে জিয়ানার নিষ্প্রাণ দেহ মেঝেয় রাখল।
দেখল, ক্লাউডিয়া কিছু বলতে চাচ্ছে। সুমাইয়া ছুটে এসে ক্লাউডিয়ার মাথাটা তুলে ধরেছে।
আহমদ মুসা একটু এগিয়ে ক্লাউডিয়ার দিকে ঝুঁকে পড়ে বলল, ‘এ তোমরা কি করলে ক্লাউডিয়া! কি ঘটে গেল এসব!’
ক্লাউডিয়া ঠোঁট নাড়ল। শুকনো ঠোঁট দু’টো ভিজিয়ে নিতে চেষ্টা করে ক্ষীণ কণ্ঠে বলল, ‘আমি এবং জিয়ানা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, আমরা ইসলাম গ্রহণ করব। আমাদের জন্যে আল্লাহর কাছে প্রা-র্থ-না ক-রো।’ ক্ষীণ হয়ে এসে তার কণ্ঠ থেমে গেল। কণ্ঠ থেমে যাওয়ার সাথে সাথে মুখ একদিকে ঢলে পড়ল তার। স্থির হয়ে গেল তার দেহ।
আহমদ মুসা কয়েকবার ব্যাকুল কণ্ঠে ডাকল ক্লাউডিয়াকে। তারপর মাথাটা নিচু করে দু’হাতে মুখ ঢাকল।
সুমাইয়া ক্লাউডিয়ার মাথা জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠল।
‘রুশো’ ‘রুশো’- এই শব্দগুলো কানে প্রবেশ করল আহমদ মুসার।
আহমদ মুসা মুখ থেকে হাত সরিয়ে শব্দ লক্ষ্যে উত্তরের দরজার দিকে তাকাল। আহমদ মুসার দু’টি গণ্ড চোখের পানিতে ধোয়া। সুমাইয়ার গুলিতে নিহত লোকটার পকেটে ওয়াকি-টকি দেখতে পেল আহমদ মুসা। ঐ ওয়াকি-টকিই শব্দের উৎস।
আহমদ মুসা দ্রুত উঠে গিয়ে ওয়াকি-টকি তুলে নিল। তখনও ওয়াকি-টকিতে কেউ বলছিল, ‘ওদিকে কি খবর, কথা বলছ না কেন, রুশো?’
আহমদ মুসা বুঝল, এই লোকটার নাম রুশো। নিশ্চয় পিয়েরে পল কিংবা কোন বড় নেতা কথা বলছে।
আহমদ মুসা একটু চিন্তা করে বলল, ‘আমরা ব্যস্ত স্যার। আমি লাইনে আছি, বলুন।’
‘বুঝেছি। শোন, আমরা দু’টো কফিন নিয়ে চলে যাচ্ছি। তোমরা এ ঘাঁটি ছেড়ে দাও। ক্যামেরুনে যোগাযোগ করবে।’
বন্ধ হয়ে গেল ওয়াকি-টকি।
আহমদ মুসা দ্রুত কণ্ঠে বলল, ‘সুমাইয়া, আমার সাথে এস। ওরা পালাচ্ছে।’
বলে আহমদ মুসা করিডোর ধরে ছুটল ভেতরে। তার লক্ষ্য বাইরে বেরুবার সেই বড় গেট।
আহমদ মুসা এ করিডোর, সে করিডোর ঘুরে বাইরে বেরুবার গেটের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। দেখল, সে দরজা আগের মতই বন্ধ।
এই সময় আহমদ মুসা মাথার উপর থেকে ইঞ্জিন স্টার্ট নেবার শব্দ শুনতে পেল। একটু শুনে আহমদ মুসা বলল, ‘নিশ্চয় ছাদের উপর একটা হেলিকপ্টার স্টার্ট নিচ্ছে।’
বলে পেছন ফিরে ছুটল হল ঘরের দিকে উপরে উঠার জন্যে।
পেছনে ছুটল সুমাইয়াও।
যখন আহমদ মুসা ছাদের উপর উঠল, তখন হেলিকপ্টারটি স্টার্ট নিয়ে ছাদ ছেড়ে বেশ উপরে উঠেছে। কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই বাড়ির এলাকা ছেড়ে চলে গেল হেলিকপ্টারটি।
ক্লান্ত দেহ নিয়ে আহমদ মুসা বসে পড়ল ছাদে। বলল, ‘ওমর বায়া এবং ডঃ ডিফরজিসকে নিয়ে পিয়েরে পল পালিয়ে গেল সুমাইয়া। পারলাম না ওদের কাছে পৌঁছতে। জানতাম না, ছাদে ওরা হেলিকপ্টার রেখেছে।’
একটু দম নিল আহমদ মুসা। তারপর বলল, ‘ওরা হাতের বাইরে চলে গেল সুমাইয়া।’
‘হাতের বাইরে? কোথায়?’
‘পিয়েরে পল ওমর বায়া এবং ডঃ ডিফরজিসকে নিয়ে ক্যামেরুন চলে গেল।’
একটু থামল। বলল আবার, ‘কিন্তু বুঝতে পারছি না, ওমর বায়া ও ডঃ ডিফরজিসকে কফিনে করে নিয়ে গেল কেন?’
কথাটা বলেই আহমদ মুসা ভাবল, নিশ্চয় ওদেরকে বিমানে করে নিয়ে যাওয়া হবে। কিন্তু অস্বীকৃত এবং কিডন্যাপ করা দু’জন লোককে বিমানে মুক্তভাবে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়।
এই কথা মনে হওয়ার সাথে সাথেই আহমদ মুসার মনে হলো, বিমানবন্দরের সাহায্যে তো দুটো কফিনকে চেক করানোর ব্যবস্থা করা যায়! চেক করা গেলেই তারা ধরা পড়ে যাবে।
নতুন আশার আনন্দে আহমদ মুসার মন সজীব হয়ে উঠল। বলল, ‘চল সুমাইয়া, এদের ঘাঁটিটা একটু পরীক্ষা করে আমরা চলে যাব।’
কিছু অস্ত্র ছাড়া গোটা ঘাঁটিতে কোন কাগজপত্র পেল না। কোন টেলিফোন গাইডও নয়। টেলিফোনগুলোতেও কোন নাম্বার নেই।
আবার পুরানো বিস্ময়টাই আহমদ মুসাকে আচ্ছন্ন করল, আশ্চর্য এই দল! কোন চিহ্ন এরা পেছনে রেখে যায় না।
আহমদ মুসা ও সুমাইয়া বেরিয়ে এল ব্ল্যাক ক্রসের ঘাঁটি থেকে। সাথে নিল ক্লাউডিয়া এবং জিয়ানার নিষ্প্রাণ দেহ।

সকাল নয়টায় ঘুম থেকে উঠল আহমদ মুসা।
ভোর রাতেই ক্লাউডিয়া ও জিয়ানার লাশ আহমদ মুসা পাঠিয়ে দিয়েছিল তাদের বাড়িতে। সাথে আহমদ মুসা লিখে দিয়েছিল চিঠি। রালফ এবং ডেবরারা পরামর্শ দিয়েছিল গুণ্ডা-বদমাইশদের হাতে আক্রান্ত হয়ে দুর্ঘটনা ঘটার কাহিনী লিখতে। কিন্তু আহমদ মুসা তাতে রাজি হয়নি। কারণ, তাতে তাদের আত্মত্যাগের কাহিনী সবার অজানা থাকবে। সত্য জানার পর তাদের বাপ-মা যদি আহমদ মুসার প্রতি বিরূপ হয়, গালি দেয়, তাহলে আহমদ মুসা তার প্রাপ্য বলে সেটা মাথা পেতে নেবে। এটুকু গালমন্দ খেয়ে আহমদ মুসা তাদের বিরাট আত্মত্যাগকে বুলন্দ করতে যদি পারে, তাহলে এটা হবে আহমদ মুসার জন্যে বিরাট সান্ত্বনা। খুব অল্প সময়ে তারা পৃথিবী থেকে চলে গেছে, কিন্তু তারা বেঁচে থাকবে তাদের এই ত্যাগের আদর্শের মধ্যে। এসব চিন্তা করে আহমদ মুসাকে ক্লাউডিয়ারা উদ্ধার করা থেকে শুরু করে তাদের ইসলাম গ্রহণের সিদ্ধান্ত পর্যন্ত সব কথাই আহমদ মুসা লিখে দিয়েছে।
পরে আহমদ মুসার এ সিদ্ধান্তের সাথে সবাই একমত হয়েছে। বলেছে, ‘সত্যের এমন একটা শক্তি আছে যা মানুষকে জয় করতে পারে।’
আহমদ মুসা ঘুম থেকে উঠে লাউঞ্জে গেল। সেখানে আগে থেকেই রালফ, ডেবরা, সুমাইয়া বসেছিল। নেকা, রিশলা ভোরেই চলে গিয়েছিল।
‘স্যরি রালফ, ঘুমিয়ে অনেক মূল্যবান সময় নষ্ট করেছি। সকালেই বিমানবন্দরে খোঁজ নেয়া দরকার ছিল। রালফ, বিমানবন্দরের কার্গো সেকশনে লাগাও দেখি।’
‘কি বলব ভাইয়া?’
‘ক্যামেরুনের ‘দুয়ালা’ অথবা রাজধানী ‘ইয়াউন্ডি’তে আজ ফ্লাইট কখন? ফ্লাইট থাকলে জিজ্ঞেস করবে, ঐ ফ্লাইটের জন্যে দুটো কফিন বুক হবার কথা ছিল, হয়েছে কিনা। ব্যস।’ বলল আহমদ মুসা।
‘বুঝেছি।’ বলে রালফ পাশ থেকে মাইক্রো টেলিফোন তুলে নিয়ে উঠে গেল পাশের কক্ষে।
মিনিটখানেক পরেই ফিরে এল রালফ। তার মুখ মলিন। বলল, ‘আজ ভোর পাঁচটায় ক্যামেরুনে ডাইরেক্ট ফ্লাইট ছিল। সে ফ্লাইটে দুটো কফিন গেছে।’
‘ফ্লাইটটা ‘দুয়ালা’ না ‘ইয়াউন্ডি’তে?’
‘দুয়ালা।’
‘আর কোন খবর?’
‘আজ আর কোন ফ্লাইট ক্যামেরুনে নেই। তবে নাইজেরিয়ার লাগোস-এ একটা ফ্লাইট আছে। লাগোস থেকে কানেক্টিং ফ্লাইট আছে দুয়ালা’র জন্যে।’
‘ক’টায়?’
‘বারটায়।’
আহমদ মুসা কথা বলল না। মাথা নিচু করে ভাবল কিছুক্ষণ। তারপর মাথা তুলে সোফায় হেলান দিয়ে বলল, ‘রালফ, আরেকটু কষ্ট কর। এয়ারপোর্টের বুকিং–এ টেলিফোন করে একটা সিট বুক করো লাগোসগামী ফ্লাইটে।’
‘কেন? কে যাবে?’
‘আমি।’
‘আপনি?’ বলল রালফ। সুমাইয়া, ডেবরা এবং রালফ- সবারই বিস্ময় দৃষ্টি আহমদ মুসার উপর নিবদ্ধ।
কিছুক্ষণ তারা কথা বলতে পারলো না। কথা বলল অবশেষে সুমাইয়া, ‘আপনি ক্যামেরুনে যাবেন- এ চিন্তা আমার মাথায় এসেছিল। কিন্তু এত তাড়াতাড়ি যাবেন, তা ভাবিনি।’
‘ওদের ষড়যন্ত্র আমাদের সবার কাছে পরিষ্কার। ওরা ডক্টর ডিফরজিসকে বাধ্য করবে অথবা তাকে পণবন্দী করে বাধ্য করবে ক্যামেরুনের চীফ জাস্টিসকে তাদের ষড়যন্ত্র সফল করতে। এ সুযোগ তাদের দেয়া যাবে না।’
‘তাহলে টিকেট একটা নয়, দু’টি করতে হবে।’ বলল রালফ।
‘কেন?’
‘আমিও যাব।’
‘না, তোমার যাওয়া হবে না।’
‘কেন, আমার পিতাকে মুক্ত করার অভিযানে আমি যাব না?’
‘গেলে ভালই হতো। কিন্তু ডেবরাকে একা রেখে বর্তমান অবস্থায় তোমার যাওয়া হবে না।’
‘এখানে আমার মন মানবে না।’
‘দেখ, প্রয়োজন হলে তোমাকে জোর করেই নিতাম। প্রয়োজন যদি হয় তোমাকে ডাকব।’
‘কিন্তু আমার পিতার মুক্তির জন্যে আপনি যাবেন, আমি যাব না, এ কেমন কথা হবে?’
‘কিন্তু আমার স্বার্থই বড়। ব্ল্যাক ক্রস-এর ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করতে পারলে একটা যুদ্ধে আমার জাতির বিজয় হবে, না পারলে পরাজয়ের গতি আরও তীব্রতর হবে। সুতরাং, তোমার পিতাকে উদ্ধার করা আমার স্বার্থের অংগ হয়ে দাঁড়িয়েছে।’
‘ঠিক আছে, আমার অনুরোধ, আমাকে ডাকার কথা বলেছেন, সেটা রাখবেন।’ বলে রালফ উঠল টেলিফোনে বিমানবন্দরে কথা বলার জন্যে।
রালফ উঠে গেলে কিছুক্ষণ নীরবতা। তিনজনই নীরব। চোখ বন্ধ করে কিছু ভাবছে আহমদ মুসা।
‘কি হলো, কি হচ্ছে সুমাইয়া আপা! পৃথিবীর রূপটা আমার কাছে পাল্টে যাচ্ছে।’ বলল ডেবরা।
আহমদ মুসা চোখ খুলেছিল। সুমাইয়া কিছু বলার আগে আহমদ মুসা বলল, ‘আমি বুঝতে পারছি না সুমাইয়া, ব্ল্যাক ক্রসের ঘাঁটিতে ঢোকার সাংঘাতিক সিদ্ধান্ত তোমরা কেমন করে নিয়েছিলে?’
সুমাইয়ার মুখ ম্লান হয়ে গেল।
কথা বলল ডেবরা, ‘ক্লাউডিয়া এবং জিয়ানার জেদে এটা ঘটেছে। তাদেরকে রালফ এবং আমরা রুখতে পারিনি। শেষে তাদের সাথী হয় সুমাইয়া।’
সুমাইয়া বলল, ‘তবে আমরা ঘাঁটিতে ঢুকব, এ কথা তারাও প্রথমে ভাবেনি। ক্লাউডিয়া বলেছিল, আমরা কি হচ্ছে তা দেখব মাত্র। কিন্তু এগিয়ে গাড়ি বারান্দায় যখন দুটো লাশ দেখা গেল, তখন অবস্থার পরিবর্তন ঘটল। আপনাকে ঐ দু’জনের আক্রমণ এবং তাদের সাথে আপনার লড়াই আমরা গেটের আড়ালে থেকে দেখেছি। আপনি যখন বাড়ির পেছন দিকে এগোলেন, আমরাও এগোলাম। ঐ দু’জনের লাশ দেখে ক্লাউডিয়া এবং জিয়ানা দু’জনেই বলল, ‘আমাদের ওর পেছনে থাকা উচিত, যাতে এই ঘটনার মত আর কেউ তাকে পেছন থেকে আক্রমণ করতে না পারে।’ এরপরই আমরা আপনার পেছনে পেছনে ঘাঁটিতে ঢুকেছি।’ থামল একটু সুমাইয়া।
সুমাইয়া তার চোখের কোণায় জড়ো হওয়া অশ্রু ওড়না দিয়ে মুছে আবার শুরু করল, ‘ইসলামের জন্য ক্লাউডিয়া ও জিয়ানার মধ্যে কি যে আগ্রহের সৃষ্টি হয়েছিল! গত রাতে আপনার পিছে পিছে এগোবার সময় ক্লাউডিয়া বলেছিল, সে ফ্রান্সের সব মুসলিম ছাত্রীকে গার্লস ক্যাডেট কোরে নিয়ে আসবে এবং তাদেরকে ফ্রান্সের একটা সক্রিয় শক্তি হিসেবে গড়ে তুলবে। জিয়ানা বলেছিল, মুসলিম ছাত্রীদের নিয়ে সে একটা গার্লস হিউম্যান রাইটস ফোরাম গড়ে তুলবে, যারা লড়াই করবে ফরাসী সরকারের সাংস্কৃতিক নির্যাতন ও বৈষম্যনীতির বিরুদ্ধে। এসব কথা আমাকে এখন খুব পীড়া দিচ্ছে। তাদের এই স্বপ্ন কে বাস্তবায়ন করবে!’
থামল সুমাইয়া। তার দু’গণ্ড বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছিল।
‘তুমি, আমি কি ক্লাউডিয়া এবং জিয়ানা হতে পারি না? পারি না তাদের স্বপ্ন সফল করতে?’ বলল ডেবরা ভারি কণ্ঠে।
আহমদ মুসা চোখ বন্ধ করে শুনছিল তাদের কথা।
রালফ ফিরে এসে বসেছিল ডেবরার পাশে। সে ডেবরার একটা হাত মুঠোর মধ্যে নিয়ে বলল, ‘পারবে ডেবরা এটা! তাহলে সবচেয়ে খুশি হবো আমি। আমি তোমাদের সহযোগিতা করব সকল শক্তি দিয়ে।’
‘পারব আমরা। ডোনা আপা আমাদের নেতৃত্ব দেবে। তার মত সাহসী ও প্রাণবন্ত মেয়ে আমি ফ্রান্সে আর দেখিনি।’ বলল সুমাইয়া।
আহমদ মুসা চোখ খুলল। তার চোখের কোণা ভেজা। বলল, ‘আমি ফরাসি নই, তবু কিছু সহযোগিতা তোমাদের করতে পারব।’
‘কে বলল আপনি ফরাসি নন? ডোনা আপা ফ্রান্সের একজন শীর্ষ নাগরিক। আপনি ফরাসি হবেন না কেন?’ বলল ডেবরা।
ব্রেকফাস্ট রেডি হওয়ার খবর এল এ সময়।
ব্রেকফাস্ট শেষে আবার এসে বসল তারা।
বসেই সুমাইয়া বলল, ‘আপনাকে বলতে ভুলে গেছি, ক্লাউডিয়াকে যে নাম্বার দিয়েছিলেন সেই নাম্বারে আমি ডোনাকে টেলিফোন করেছিলাম।’
‘কখন?’
‘আটটার দিকে। কিন্তু ডোনা ভাবীকে পাইনি। ওর আব্বা ওকে নিয়ে একটু বাইরে বেরিয়েছেন।’
‘কার সাথে কথা বলেছ?’
‘এলিসা গ্রেস নামের কে একজনের সাথে। আপনি টেলিফোন করুন ওখানে। ডোনা ভাবী গতকাল থেকে কান্নার উপরে আছে। সবাই উদ্বিগ্ন সেখানে। ডোনা ভাবী বিস্ফোরণের শব্দ শুনেছেন। ডোনাকে একটু সান্ত্বনা দেবার জন্যেই ওর আব্বা ওকে একটু বাইরে নিয়ে গেছেন।’
‘আমার ভুল হয়েছে, গতকালই ওকে টেলিফোন করা উচিত ছিল। তুমি এলিসাকে আর কি বলেছ?’
‘আমি শুধু আপনার খবর দিয়েছি, আর কিছু নয়।’
‘তোমাদের আপত্তি না থাকলে একটা রিং করি লা-ইলে।’
‘আমাদের আপত্তি নেই, আপনার যদি আপত্তি না থাকে আমাদের মাঝে বসে কথা বলতে।’ বলল ডেবরা।
বলে ডেবরাই রিং করল লা-ইলে। লা-ইল রেস্টহাউসের পিএবিএক্স অপারেটরের কাছে ডেবরা লাইন চাইল ডোনাদের কক্ষের। কয়েক সেকেন্ড নীরবে অপারেটরের কথা শুনে টেলিফোন কানে রেখেই মুখ সরিয়ে নিয়ে ডেবরা বলল, ‘অপারেটর বলছে, ওরা আজ হোটেল ছেড়ে দিয়েছে।’
শুনেই আহমদ মুসা ডেবরার কাছ থেকে টেলিফোন হাতে নিল। টেলিফোনের স্পীকার মুখের কাছে এনে দ্রুত কণ্ঠে বলল, ‘ক’টায় ওরা হোটেল ছেড়েছেন?’
‘দশটায়।’
‘কোন মেসেজ রেখে গেছেন তারা?’
‘একটু ধরুন, দেখি।’
আধ মিনিট পরেই ওপার থেকে কণ্ঠ ভেসে এল। বলল, ‘একটা মেসেজ আছে স্যার। আমি পড়ছি, ‘সকাল আটটায় টেলিফোন পেয়ে আমি সেখানে চলে গেলাম।’-মারিয়া জোসেফাইন।’
‘ধন্যবাদ।’ বলে আহমদ মুসা রেখে দিল টেলিফোন।
আহমদ মুসার দিকে উদগ্রীব হয়ে তাকিয়েছিল সুমাইয়া, ডেবরা এবং রালফ।
‘ডোনারা এখানে আসছে।’ বলেই আহমদ মুসা সুমাইয়ার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি কি এই রেস্টহাউসের ঠিকানা দিয়েছিলে?’
‘দিয়েছি।’ বলল সুমাইয়া।
‘ডোনা দেখছি সাংঘাতিক চালাক হয়ে উঠেছে।’
‘কি ঘটেছে?’ বলল ডেবরা।
‘সে একটা মেসেজ রেখে এসেছে। তাতে সে বলেনি যে, সে কুমেট আসছে। বলেছে, ‘আটটার টেলিফোন পেয়ে সেখানে চলে গেলাম।’ অত্যন্ত বুদ্ধিমতীর কাজ করেছে সে।’
‘কেন করবে না? একে রাজরক্ত, তার উপর সুপারম্যানের সাহচর্য্য।’ বলল ডেবরা।
আহমদ মুসা আর এদিকে কান না দিয়ে ঘড়ির দিকে চেয়ে বলল, ‘এখন তো সাড়ে দশটা। আমাকে অন্তত এগারটায় এয়ারপোর্ট রওয়ানা হতে হবে।’
‘কিন্তু কোন সময় নষ্ট না করে খুব ভাল স্পীডেও যদি ডোনা আসেন, তবুও সাড়ে এগারটার আগে তিনি পৌঁছতে পারবেন না।’ বলল সুমাইয়া।
‘ঠিক। সব আল্লাহর ইচ্ছা। ঘটনার উপর আমাদের আর কোন নিয়ন্ত্রণ নেই।’
‘কেন, ক্যামেরুন যাত্রা একদিন পেছানো যায় না? উনি আসছেন জানার পর এভাবে চলে যাওয়াটা শোভন নয়।’ বলল ডেবরা।
‘ঠিক বলেছ ডেবরা, কিন্তু ওমর বায়া এবং ডঃ ডিফরজিস যে অবস্থায় ওদের হাতে আছে এবং যে ষড়যন্ত্র নিয়ে ওরা এগোচ্ছে, তাতে একদিনও তো নষ্ট করা যায় না। ডোনার সাথে দেখা হওয়াটা একান্তই একটা পারসোনাল ব্যাপার, কিন্তু ক্যামেরুনের ব্যাপারটা জাতীয় এবং অনেকটা জীবন-মরণের প্রশ্ন।’
‘জিজ্ঞেস করি, আপনার জীবনে আপনি কি নিজের জন্যে কোন সময় রেখেছেন? আপনি ডোনার প্রতি অবিচার করছেন।’ বলল সুমাইয়া।
‘এই মুহূর্তে ক্যামেরুন যাত্রা স্থগিত করা ঠিক হবে না। ডোনাও এটা পছন্দ করবে না।’ বলে আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল। বলল, ‘তোমরা বস, আমি তৈরি হয়ে নেই।’
আহমদ মুসা চলে গেল তার কক্ষের দিকে।
মিনিট পাঁচেক পরেই তৈরি হয়ে এল আহমদ মুসা। তার পিঠে ঝুলিয়ে রাখার মত একটা ট্যুরিস্ট ব্যাগ।
বসল আহমদ মুসা সুমাইয়ার মুখোমুখি সোফাটায়।
বসেই বলল, ‘সুমাইয়া, তুমি সাংবাদিক। তোমাকে একটা বড় কাজের দায়িত্ব দিয়ে যাব।’
‘কি সেটা?’ খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠল সুমাইয়ার মুখ।
‘তোমাকে একটা নিউজ করতে হবে।’
‘নিউজ?’
‘হ্যাঁ।’
‘কি নিউজ, কেন?’
‘দক্ষিণ ক্যামেরুনে মুসলমানদের ভূমি আত্মসাৎ এবং তাদের উচ্ছেদ চলছে- এই বিষয়ের উপর একটা রিপোর্ট তোমাকে করতে হবে। দৃষ্টান্ত হিসেবে ওমর বায়ার সম্পত্তি ঘিরে যে ষড়যন্ত্র হচ্ছে, তা নিয়ে আসতে হবে। বলতে হবে, ওমর বায়াকে পণবন্দী করে রাখা হয়েছে, তার যে জমি আত্মসাৎ করা হয়েছে তাকে বৈধ করিয়ে নেবার জন্যে। ক্যামেরুনের প্রধান বিচারপতি উসাম বাইকের আদালত থেকে নানা কৌশলে এই বৈধকরণ রায় লাভের চেষ্টা ষড়যন্ত্রকারীরা শুরু করে দিয়েছে।’ থামল আহমদ মুসা।
আনন্দে মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে সুমাইয়ার। বলল, ‘সাংঘাতিক বুদ্ধি করেছেন। তাদের ষড়যন্ত্রকে ব্লক করার জন্যে মোক্ষম অস্ত্র হিসেবে কাজ করবে এটা, এ চিন্তা আপনার মাথায় এল কি করে? পারব আমি এ রিপোর্ট করতে। তবে এ জন্যে আরও কিছু তথ্যের প্রয়োজন হবে।’
আহমদ মুসা তার পকেট থেকে ফোল্ডিং করা একখণ্ড কাগজ বের করে সুমাইয়ার দিকে বাড়িয়ে ধরে বলল, ‘প্রয়োজনীয় তথ্য তুমি এ থেকে পাবে।’
সুমাইয়া কাগজটি হাতে নিয়ে ভাঁজ খুলে গোটা কাগজটার উপর একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে বলল, ‘ধন্যবাদ। প্রয়োজনীয় সাহায্য এ থেকে পাব আশা করি।’
সুমাইয়া একটু থামল। ভাবল। সে-ই আবার শুরু করল কথা, ‘পরবর্তী নির্দেশ কি? কি করব আমি এই নিউজ? আমার কাগজে ছাপব কি?’
‘না, তোমার কাগজে ছাপাবে না। আমি চাই একে আন্তর্জাতিক নিউজ করতে, যাতে ক্যামেরুনেও পৌঁছে।’
আহমদ মুসা একটু থামল। সোজা হয়ে বসল সোফায়। বলল, ‘তুমি তো ‘ওয়ার্ল্ড নিউজ এজেন্সি’ (WNA) এবং ‘ফ্রি ওয়ার্ল্ড টেলিভিশন’ (FWTV)-এর একজন প্রতিনিধিও, তাই না?’
‘জি, আমি প্রতিনিধি। কিন্তু আপনি তো ওদের মাথার মণি।’ বলল সুমাইয়া।
‘শেষ কথাটা ওভাবে না বললেই ভালো হতো। বিশেষণের ব্যবহার কোন সময়ই সঠিক হয় না। আচ্ছা থাক এ কথা। তুমি যখন WNA এবং FWTV-তে নিউজ পাঠাবে, তখন নিউজের শেষে ‘RFAM-7’-এই কোডটি লিখে দেবে।’
সুমাইয়া হাসল। বলল, ‘বুঝলাম, ঐ দুই সংবাদমাধ্যমের জন্যে এটা আপনার কোড। কিন্তু কোডটা যে খুবই স্পষ্টঃ নাম্বার সেভেন রিকোয়েস্ট ফ্রম আহমদ মুসা।’
‘খুবই সহজ। কিন্তু শেষের নাম্বারটাই আসল। রিকোয়েস্টের সিরিয়াল নাম্বার তারা এবং আমি জানি। সুতরাং, সহজ হলেও এই কোড অন্য কারও পক্ষেই ব্যবহার করা সম্ভব নয়।’
কথা শেষ করে ঘড়ি দেখল আহমদ মুসা। বলল, ‘এখন উঠতে হয়।’
‘কিন্তু আরেকটা জিনিস আপনি বলেননি, রিপোর্টটা কবে পাঠাব।’ সুমাইয়া বলল।
‘হ্যাঁ, ঠিক কথা মনে করেছ। এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। আমি চাই, ব্ল্যাক ক্রস চীফ জাস্টিস উসাম বাইকের সাথে যোগাযোগ করার পর এ রিপোর্টটা ছাপা হোক। সুতরাং, এ রিপোর্টটা তুমি আজ থেকে ঠিক তৃতীয় দিনে পাঠাবে, তাহলে চতুর্থ দিনে রিপোর্টটা ছাপা হবে।’ বলে আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল।
‘কিন্তু এর মধ্যে যদি বিচারপতি উসাম বাইকের সাথে ওদের যোগাযোগ বা দেখা না হয়?’ উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল সুমাইয়া।
‘নাও হতে পারে। তবে যোগাযোগ করার জন্যে খুব বেশি সময় নেবার তাদের প্রয়োজন আছে কি? তারা চাইবে কাজ তাড়াতাড়ি শেষ করতে, এটাই স্বাভাবিক।’
উঠে দাঁড়িয়েছে রালফ এবং ডেবরাও।
‘তাহলে সুমাইয়া, ডেবরা, সময় যদি থাকে ডোনাকে এয়ারপোর্টে নিয়ে যাবে।’
‘কেন, আমরা এয়ারপোর্টে যাচ্ছি না?’ বলল সুমাইয়া।
‘না, আমার সাথে রালফ যাবে। তোমাদের এখানে থাকা উচিত, অন্তত ডোনার জন্যে।’
‘ঠিক আছে, থাকব। তাহলে আপনার সাথে আর দেখা হচ্ছে না?’ বলল ডেবরা।
‘যদি এয়ারপোর্টে যাও, দেখা হবে।’
‘সেটা ‘যদি’-এর প্রশ্ন।’ বলল ডেবরা।
‘একমাত্র সর্বশক্তিমান আল্লাহর কাজ ছাড়া দুনিয়ার সব কাজ, সব সাফল্য-ব্যর্থতাই তো এই ‘যদি’-এর মুখাপেক্ষী।’
‘ঠিক আছে। ‘যদি’সহই আমার প্রশ্নের জবাব হতে পারে।’ বলল ডেবরা।
‘যদি লাগিয়েও অনেক প্রশ্নের জবাব দেয়া যায় না। তবুও বলছি, যখন আল্লাহ ফ্রান্সে নিয়ে আসবেন এবং যদি আল্লাহ্‌ সুযোগ দেন, তাহলে দেখা হবে।’ বলে হাসল আহমদ মুসা।
কিন্তু ডেবরার মুখ গম্ভীর। সে বলল, ‘গত দু’দিনের সম্পর্ক স্মৃতির সামান্য খেলাঘর হলেও একে ভেঙে যেতে আপনার কষ্ট লাগছে না?’
আহমদ মুসা সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিল না। গম্ভীর হয়ে উঠল তার মুখ। তারপর সেই গাম্ভীর্যের উপর সজল বেদনার একটা আস্তরণ নেমে এল। তার উদাস দৃষ্টি জানালা দিয়ে দূর আকাশে নিবদ্ধ হলো। মুখ দিয়ে তার খুব ধীরে ধীরে বেরিয়ে এল, ‘ডেবরা, বোন, জীবন একটা বড় গ্রন্থের নাম। এর পেছনের সব পাতা কখনোই উল্টানো হয় না। কিন্তু আনন্দ অথবা বেদনার অশরীরী আঙুল কতকগুলো পাতাকে বার বার উল্টিয়ে দেয়। কুমেট আমার জীবনের এমনই একটা পাতা। ক্লাউডিয়া এবং জিয়ানার গৌরবময় ত্যাগের অমূল্য লাল রক্ত এ পাতাকে চিরকালের জন্যে চিহ্নিত করেছে। এদিকে তাকিয়ে মানুষকে আমি আরও ভালবাসতে শিখব, দায়িত্ব পালনে আরও উদ্বুদ্ধ হবো আমি।’
থামল আহমদ মুসা। শেষের কথাগুলো তার ভারি হয়ে ভেংগে পড়ার মত হলো। তার দুই চোখের কোণাও সিক্ত মনে হলো।
ডেবরা, সুমাইয়া, রালফ-এর মুখেও বেদনার ছায়া নেমে এসেছে।
‘আমি বুঝতে পারিনি। যাবার সময় আপনাকে এভাবে আঘাত করা আমার ঠিক হয়নি। আমাকে মাফ করুন।’ মুখ নিচু করে ভারি কণ্ঠে বলল ডেবরা।
ডেবরার কথাগুলো মনে হয় আহমদ মুসার কানে পৌঁছতে পারেনি। সে নির্বিকারভাবে তার চোখ দু’টি সরিয়ে নিল জানালা থেকে। তাকাল ডেবরা ও সুমাইয়াদের দিকে। পকেট থেকে এনভেলাপ বের করে সুমাইয়ার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, ‘এ চিঠিটা ডোনাকে দিও। আর তোমরা তাকে বলো, সে যেন আমার পক্ষ থেকে ক্লাউডিয়া এবং জিয়ানার আব্বার সাথে কথা বলে।’
কথা শেষ করে আহমদ মুসা রালফকে বলল, ‘চল, দেরি হয়ে যাবে।’
বলে আহমদ মুসা পা বাড়াল।
তার সাথে রালফও।
ডেবরা এবং সুমাইয়াও তাদের সাথে নিচে গাড়ি বারান্দায় নেমে এল আহমদ মুসাদের বিদায় জানাবার জন্যে।

Top