১৯. ক্রস এবং ক্রিসেন্ট

চ্যাপ্টার

কুমেট অভিমুখে ছুটছিল পিকআপ কারটি। মোট পাঁচজন আরোহী। পাঁচজনই মহিলা। সামনের সিটে দু’জন এবং পেছনের সিটে তিনজন। তাদের পেছনে পিকআপে কিছু ব্যাগ-ব্যাগেজ।
তাদের সকলের মুখে ক্লান্তির চিহ্ন।
তারা ফিরছে ‘অল ফ্রান্স গার্লস ক্যাডেট কোর’-এর সাতদিন ব্যাপী অনুষ্ঠিত জাম্বুরী থেকে। জাম্বুরী অনুষ্ঠিত হয়েছে কুমেট-এর সংরক্ষিত বনে।
এই বনের মাঝখানে একটা বিশাল লেক আছে। সেই লেকের চারদিক ঘিরে সুন্দর সবুজ পাহাড়। এই পাহাড় এবং হ্রদ মিলিয়ে এই অপরূপ জায়গার নাম দেয়া হয়েছে ‘ড্রিমল্যান্ড’। আদিগন্ত বনরাজির মাঝে এই ‘ড্রিমল্যান্ড’ ফ্রান্সের একটা শ্রেষ্ঠ ট্যুরিস্ট স্পট। এখানে এলে মানুষ আধুনিক নগর সভ্যতার ইট-পাথর-সিমেন্টের উত্তাপ এবং কোলাহল থেকে মুক্তি লাভ করে নীরব-স্নিগ্ধ-প্রশান্তির আদিম যুগে যেন ফিরে যায়।
এখানেই ফ্রান্সের গার্লস ক্যাডেট কোর-এর ত্রি-বার্ষিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হলো।
আজ ছিল সমাপ্তি দিবস।
ইতোমধ্যে সবাই চলে গেছে কুমেট বিমানবন্দরের উদ্দেশ্যে।
শতাধিক গাড়িবহরের সর্বশেষ হলো পিকআপ কারটি।
এ গাড়ি ড্রাইভ করছে মিস ক্লাউডিয়া। সে ছিল এই জাম্বুরীর চীফ কোর কমান্ডার। চীফ হিসেবেই সে সব শেষ করে সবার শেষে যাচ্ছে। সাথের চারজনই তার সহকারী-সহকর্মী। তবে তারা সকলে বিভিন্ন পেশার এবং বিভিন্ন এলাকার।
‘মিস ক্লাউডিয়া’ প্যারিসের এবং একজন বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রী। অন্য চারজনের একজন ডাক্তার। নাম ‘জিয়ানা বার্নেস’। উত্তর ফ্রান্সের মেয়ে। আরেকজন ‘রিশলা’, ইঞ্জিনিয়ার। পূর্ব ফ্রান্সের লিওন এলাকার মেয়ে সে। অন্য দু’জন পেশায় সাংবাদিক। একজন দক্ষিণ ফ্রান্সের পাউ শহরের ‘সুমাইয়া’, অন্যজন তুলু এলাকার ‘নেকা’।
ফুল স্পীডে গাড়ি চালাচ্ছিল ক্লাউডিয়া। তার পাশের সিটে জিয়ানা বার্নেস।
‘এত তাড়াহুড়া করছ কেন ক্লাউডিয়া? সময় তো প্রচুর আছে। প্লেন তো সেই বারটায়।’ বলল জিয়ানা।
‘সবার পেছনে পড়ে গেছি তো, তাই।’ গাড়ির গতি স্লো করতে করতে বলল ক্লাউডিয়া।
‘আমার ফ্লাইট তো সেই ইভেনিং-এ’ বলল সুমাইয়া।
‘এতটা সময় তুমি কোথায় কাটাবে?’ বলল ক্লাউডিয়া।
‘বিমানবন্দরে গিয়ে বোর্ডিং কার্ড নিয়ে শহরে ঘুরতে বেরুব। একজন ফ্রেন্ড ছিল, তাকে খুঁজে দেখব।’ বলল সুমাইয়া।
‘বয়ফ্রেন্ড?’ বলল রিশলা।
‘বয়ফ্রেন্ড কোন কালেই ছিল না, এখনও নেই।’ সুমাইয়া বলল।
‘জানো না তুমি রিশলা, ও তো মুসলিম।’ বলল নেকা।
‘কেন, মুসলিম মেয়েদের বয়ফ্রেন্ড থাকে না?’ বলল জিয়ানা।
‘ছেলেদের সাথে অবাধ মেলামেশাই নিষিদ্ধ। বয়ফ্রেন্ড থাকবে কি করে?’ উত্তর দিল নেকা।
‘অসম্ভব কথা। কোন ফ্রেন্ড থাকবে না?’ বলল জিয়ানা।
‘কেন, গার্লফ্রেন্ড থাকবে।’ বলল সুমাইয়া।
হো হো করে হেসে উঠল জিয়ানা ও রিশলা। ক্লাউডিয়ার ঠোঁটেও হাসি।
‘তাহলে মুসলমানদের কি প্রেম নিষিদ্ধ?’ বলল ক্লাউডিয়া।
‘প্রেম নিয়ে তো কথা হচ্ছে না। কথা হচ্ছে, মেলামেশার জন্যে বয়ফ্রেন্ড থাকা না থাকা নিয়ে।’ বলল সুমাইয়া।
‘একই কথা হলো না?’ বলল জিয়ানা।
‘না, এক কথা নয়। বয়ফ্রেন্ড তো অহরহ বদল হচ্ছে। কিন্তু প্রেমের তো এমন পাত্র বদল সম্ভব নয়।’ সুমাইয়া বলল।
‘তাহলে মুসলিম মেয়েরা বয়ফ্রেন্ড শূন্য! কি সাংঘাতিক!’ বলল রিশলা।
‘মুসলিম মেয়েদের বয়ফ্রেন্ড থাকে না, থাকে হাজব্যান্ড-ফ্রেন্ড।’ বলল সুমাইয়া।
জিয়ানা, রিশলা, নেকা হো হো করে হেসে উঠল। এ হাসিতে যোগ দিল না ক্লাউডিয়া।
‘ব্যাপারটা হাসির মনে হচ্ছে ঠিকই, তবে মনে হয় ঐ জীবনে শান্তি আছে, স্বস্তি আছে এবং নিখাদ প্রেমও আছে, এ কথা বোধ হয় আমাদের স্বীকার করতে হবে।’ গম্ভীর কণ্ঠে বলল ক্লাউডিয়া।
‘অমুসলিম মেয়েদের জীবনে এসব নেই বলছ?’ বলল রিশলা।
‘অমুসলিম মেয়েদের কথা বলিনি, আমি বলছি পশ্চিমী মেয়েদের কথা। পশ্চিমী মেয়েদের জীবনে আজ ওসব সাধারণভাবে নেই, এ কথা সত্য।’ বলল ক্লাউডিয়া।
‘পশ্চিমী পরিবারে শান্তি, স্বস্তি ও নিখাদ প্রেম নেই বলছ?’
‘দেখ, আমাদের পশ্চিমা দেশে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক অনেকটা দুই বন্ধুর সম্পর্কের মত। অতি সামান্য কারণেও তা ভেঙে যাচ্ছে। কিন্তু প্রাচ্যে বিশেষ করে মুসলিম সমাজে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক ভক্তি, শ্রদ্ধা, দায়িত্ব ও প্রেম- সবকিছু মিলে গভীর এক আত্মিক ভিত্তির উপর গড়ে ওঠে, যা কদাচিৎ ভেঙে থাকে। এমন স্বস্তি এবং এমন আত্মিক সম্পর্কের কথা আমরা কল্পনাই করতে পারি না।’ ক্লাউডিয়া বলল।
‘নেগেটিভ দিকও তো রয়েছে।’ বলল জিয়ানা।
‘একঘেঁয়েমি, নতুনত্বের অভাব, নির্যাতনের সুযোগ ইত্যাদিকে নেগেটিভ লিস্টে আনতে পার। আসলে এ নেগেটিভ দিকগুলো ওদের জীবনে খুবই কম। নির্যাতন সেখানে আছে, কিন্তু এমন নির্যাতন আমাদের সমাজেও আছে। তবে ওদের সমাজে আত্মিক সম্পর্কের কারণে নির্যাতনটা আমাদের সমাজের চেয়ে কম। ওদের মেয়েদের অনেক কিছুকে আমরা নির্যাতন বলি, সে সব আসলে ওদের সংস্কৃতি, রীতি, নিয়ম- যা ছেলেমেয়ে নির্বিশেষে সবাই মেনে নেয়। আর একঘেঁয়েমি ও নতুনত্বের কথা?’
বলে থামলো ক্লাউডিয়া। হাসলো মুখ টিপে। তারপর বলল, ‘আমাদের অবাধ মেলামেশার কালচার, সত্যি বলতে কি, আমাদেরকে একটা ঘরে স্থির হতে দিচ্ছে না। উড়িয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে আমাদের এ ঘর থেকে সে ঘরে। এতে নতুনত্বের একটা বাহ্যিক স্বাদ আছে, কিন্তু নেই শান্তি, স্বস্তি এবং পারস্পরিক বিশ্বাস ও নির্ভরতা- যা আমরা মুসলিম সমাজের স্থিতিশীল পরিবারে পাই।’
‘আমাদের সভ্যতার মুণ্ডপাত করছো ক্লাউডিয়া? আর যে বড় লোভ দেখছি মুসলিম পরিবারের প্রতি!’ বলল রিশলা।
‘দেখ, একটা সভ্যতার সবকিছু ভাল হয় না। আমাদের সভ্যতা পৃথিবীকে বিজ্ঞান দিয়েছে, কিন্তু স্বীকার করতেই হবে, জীবন সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান দিতে পারেনি। আমরা গ্রীক দর্শনকে অনুকরণ করছি, তাও আবার বিকৃত করে। ধর্ম ও নৈতিকতার বাঁধন যে আকারেই হোক গ্রীকদের ছিল, আমরা তা ছিঁড়ে ফেলেছি।’
ক্লাউডিয়ার কথাগুলো ভারি। সবাই গম্ভীর হয়ে উঠেছে। কয়েক মুহূর্ত নীরবতা। জিয়ানাই মুখ খুলল প্রথমে। বলল, ‘জীবনের এ জ্ঞান কি মুসলিম সমাজ দিয়েছে? দেখবে, ওদের অনেক বাড়াবাড়ির কোন যুক্তি নেই। যেমন, সামান্য ওড়নার ব্যাপার নিয়ে ওরা কি হাঙ্গামাই না বাঁধাচ্ছে। তুমি কিছু মনে করো না সুমাইয়া।’
সুমাইয়া হাসলো। সে মুখ খোলার আগেই কথা শুরু করল ক্লাউডিয়া। বলল, ‘ওড়নাকে সামান্য বলছ কেন জিয়ানা? ওটা ওদের কালচার, যা তাদের বিশ্বাসের সাথে গভীরভাবে যুক্ত।’
‘তা আমি অস্বীকার করছি না ক্লাউডিয়া। এই বিশ্বাসের দিক ছাড়া এর ইউটিলিটি কি?’ বলল জিয়ানাই।
হাসল ক্লাউডিয়া। বলল, ‘এর ভাল জবাব সুমাইয়া দিতে পারবে। তবে আমি যেটা বুঝি সেটা হলো, মেয়েদের সৌন্দর্যের স্থানগুলোকে ছেলেদের চোখ থেকে গোপন রাখা বা আড়ালে রাখা এর লক্ষ্য।’
থামল ক্লাউডিয়া। ক্লাউডিয়া চুপ করতেই সুমাইয়া বলল, ‘ঠিক বলেছ ক্লাউডিয়া। এটাই আমারও কথা।’
‘ঠিক আছে। কিন্তু মেয়েদের একতরফাভাবে এটা করার দরকার কি? ছেলেদের এভাবে তো কিছু ঢাকা-ঢাকি নেই।’ বলল নেকা।
‘এর জবাব হলো, মেয়েরা প্রকৃতিগতভাবেই আত্মরক্ষাকারী পক্ষ এবং ছেলেরা আক্রমণকারী পক্ষ। অন্য কথায়, মেয়েরা সাধারণভাবে নিষ্ক্রিয় পক্ষ এবং ছেলেরা সক্রিয় পক্ষ। ইতিহাসের সেই আদিকাল থেকে আজ পর্যন্ত ছেলেরাই মেয়েদের উপর চড়াও হয়েছে। এ ধরনের অবাঞ্ছিত ঘটনার বিরুদ্ধে একটা স্বাভাবিক প্রতিরোধ হিসেবেই মেয়েদের সৌন্দর্য আড়াল করে রাখার ব্যবস্থা বলেই মনস্তাত্ত্বিক দিক থেকে আমার মনে হয়।’ বলল সুমাইয়া।
‘এতে কি অবাঞ্ছিত ঘটনা বন্ধ হয়েছে?’ বলল রিশলা।
‘বন্ধ হয়নি, কিন্তু মুসলিম সমাজে এই ধরনের অবাঞ্ছিত ঘটনা আমাদের তুলনায় বহুগুণ কম। এটা আমি ক্রাইম স্ট্যাটিস্টিকস-এ দেখেছি।’ বলল ক্লাউডিয়া।
‘শুধু ওড়না বা পর্দাতেই এই অবাঞ্ছিত ঘটনা সম্পূর্ণভাবে বন্ধ হয়ে যাবার কথা নয়। সম্পূর্ণ বন্ধ করার জন্যে এ সংক্রান্ত অপরাধের অত্যন্ত কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা রয়েছে।’ বলল সুমাইয়া।
‘ওরে বাবা, দোররা মারার কথা বলছ? আমি মেডিকেল জুরিসপ্রুডেন্সে মুসলিম সমাজের এ শাস্তি বিধানের কথা পড়েছি।’ বলল জিয়ানা।
‘ওরে বাবা বলছ কেন? নিরপরাধদের গায়ে তো দোররা পড়ার কথা নয়। অপরাধীর শাস্তি হোক চাও না?’
‘চাই, কিন্তু প্রকাশ্য জনসমক্ষে ঐ দোররা মারার ব্যাপারটাকে বর্বরতা বলে মনে হয় যেন।’ বলল জিয়ানা।
‘এটা বর্বরতা নয়, আইনসঙ্গত কঠোরতা। বরং বলতে পার, অপরাধটা অত্যন্ত বর্বর। এই বর্বর অপরাধের মূলোচ্ছেদ করতে হলে কঠোর শাস্তি অবশ্যই প্রয়োজন।’
‘মূলোচ্ছেদ কি সম্ভব?’ বলল নেকা।
‘কোন অপরাধেরই একেবারে মূলোচ্ছেদ সম্ভব নয়। কিন্তু শূন্য পর্যায়ে আনা সম্ভব।’ বলল সুমাইয়া।
‘সম্ভব?’
‘সম্ভব। যেখানে মেয়েদের পর্দার বিধানসহ শাস্তির বিধান কার্যকরী আছে, সেখানে অপরাধ এই পর্যায়ে নেমে এসেছে। সৌদি আরব এর একটি দৃষ্টান্ত।’ বলল সুমাইয়া।
‘এই তোমরা সামনে দেখ!’ ড্রাইভিং সিট থেকে হঠাৎ চিৎকার করে উঠলো ক্লাউডিয়ার কণ্ঠ।
সবাই একসংগে তাকাল সামনে। ইতোমধ্যেই তাদের কানে এসেছিল পর পর অনেক ক’টি বিস্ফোরণের শব্দ। তারা দেখল, সামনে একটা গাড়ি বিস্ফোরণে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ছে, জ্বলছে দাউ দাউ করে।
‘ক্লাউডিয়া, আমাদের কোন গাড়ি নয়তো?’ উদ্বিগ্ন কণ্ঠে চিৎকার করে উঠল সুমাইয়া।
‘না, আমি লক্ষ্য করেছি, ওটা আমাদের গাড়ি নয়।’ বলল ক্লাউডিয়া।
‘বিস্ফোরণ কিভাবে ঘটল? কোন টেররিজম নয়তো? ইঞ্জিনের বিস্ফোরণ পরে ঘটল। এর অর্থ, প্রথম বিস্ফোরণগুলো বোমা থেকে হয়েছে।’ বলল জিয়ানা।
‘আমারও তা-ই মনে হয়। আরোহীদের কাউকে তো বেরুতে দেখা গেল না।’ বলল ক্লাউডিয়া।
‘যেভাবে বিস্ফোরণ ঘটেছে, তাতে মানুষ বেরুবে কি করে! গাড়ি স্লো করে দিলে ক্লাউডিয়া?’ জিজ্ঞেস করল জিয়ানা।
‘একটু দেখতে দাও, বুঝতে দাও। ব্যাপারটা টেররিজম হলে তো ভয়ের কথা।’
‘আশংকা করছ কিছু?’ বলল রিশলা।
‘ভেতরের বোমাতেও বিস্ফোরণ ঘটে এ ধরনের ঘটনা ঘটতে পারে। সুতরাং টেররিজমের ঘটনাই ঘটেছে, একথা নিশ্চিত করে বলা যাবে না।’ বলল জিয়ানা।
বিস্ফোরণটা রাস্তা জুড়েই ছড়িয়ে পড়েছে। পাশ কাটিয়ে যেতে হলে রাস্তার পাশে নামতে হবে।
‘আমাদের কি নামা উচিত নয়, কি ঘটেছে দেখা উচিত নয়?’ ক্লাউডিয়া বলল। গাড়ির গতি একদম থেমে যাবার পর্যায়ে নেমে এসেছে।
পেছন থেকে সুমাইয়া, রিশলা, নেকা একবাক্যে বলল, ‘নেমে কাজ নেই। চল, আমরা গিয়ে পুলিশে খবর দেব।’
‘কিন্তু দেখা প্রয়োজন কোন মানুষ বেঁচে আছে কিনা? সাহায্য করার কোন সুযোগ আমাদের আছে কিনা?’ বলল জিয়ানা।
‘অসম্ভব, কোন মানুষ বেঁচে থাকার কথা নয়। মোটামুটি দেখতেই পাওয়া যাচ্ছে সব কিছু।’
‘ঠিক আছে, আমরা যখন গাড়ি রাস্তার পাশ দিয়ে নিয়ে যাব, তখন জিয়ানা নেমে এক নজর চারদিকটা দেখে নেবে।’ বলল ক্লাউডিয়া।
‘নাইস।’ বলল জিয়ানা।
জিয়ানা নামতে যাবে এমন সময় তারা দেখল, বিপরীত দিক থেকে দুটো গাড়ি প্রচণ্ড বেগে ছুটে আসছে। তাদের গতির মধ্যে কোন দ্বিধাগ্রস্থতা নেই। মনে হচ্ছে, বিস্ফোরণের বিষয়টা তারা জানে।
জিয়ানা নামল না গাড়ি থেকে। ক্লাউডিয়াও নিষেধ করল তাকে।
ছুটে আসা গাড়িটা এসে জ্বলন্ত গাড়িটার সামনে দাঁড়াল। গাড়ি থেকে কয়েকজন নামল। একজন ছাড়া সবার হাতে স্টেনগান।
তারা এসে দাঁড়াল জ্বলন্ত গাড়িটার সামনে।
‘ফুয়েল ট্যাংকের বিস্ফোরণ সামনের সিট দুটোকে দেখো নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে। আর দেখো, চকোলেটগুলো সবই বিস্ফোরিত হয়েছে। খেলা সাঙ্গ হয়েছে শয়তানটার, যদি সে এ গাড়িতে এসে থাকে।’ মুখে ক্রুর হাসি টেনে বেশ উচ্চকণ্ঠেই বলল খালি হাতে নেমে আসা সরদার গোছের লোকটি।
অন্য চারজনও তার পাশে দাঁড়িয়ে তাকে সায় দিল।
লোকটি তার পকেট থেকে টেবিল টেনিস বলের মত ডিম্বাকৃতি বস্তু বের করে ছুঁড়ে দিল জ্বলন্ত গাড়িটার দিকে।
প্রচণ্ড শব্দে হাত বোমাটি বিস্ফোরিত হলো। আরেক দফা ছিটকে পড়ল জ্বলন্ত গাড়িটার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ।
সেদিকে তাকিয়ে হো হো করে হেসে উঠল লোকটা। তারপর সে চোখে দূরবীন লাগিয়ে ক্লাউডিয়ার গাড়িটাকে দেখল।
ফিরে গেল ওরা গাড়িতে। গাড়ি দুটো ঘুরে দাঁড়িয়ে আবার সেই ঝড়ের গতিতেই ছুটে চলল কুমেট-এর দিকে।
গাড়ির ভেতরে ক্লাউডিয়ারা পাঁচজন বসেছিল পাথরের মত। চোখ ভরা আতংক। ঠোঁট তাদের শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে।
ওরা চলে গেলেও ক্লাউডিয়াদের মুখে কিছুক্ষণ কথা ফুটল না।
প্রথম কথা বলল ক্লাউডিয়াই। বলল, ‘ওরাই তাহলে বোমা পেতে গাড়ি ধ্বংস করেছে এবং গাড়ির আরোহীকে হত্যা করেছে।’
‘সেটা তো পরিষ্কার। কি নৃশংসতা! ধ্বংস হওয়া গাড়ি লক্ষ্যে আবার বোমা নিক্ষেপ! হিংস্রতা পশুর মতই।’ বলল জিয়ানা।
‘জিয়ানা, তোমার আর নামবার দরকার নেই। চল এবার আমরা যাই।’
বলে ক্লাউডিয়া গাড়িতে স্টার্ট দিল।
বিস্ফোরণ রাস্তার কিনারা পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছিল। এটা পাশ কাটাতে গিয়ে ক্লাউডিয়া রাস্তার পাশে নেমে এল।
রাস্তার ছোট ঝোপটার পাশ মাড়িয়ে চলার সময় ক্লাউডিয়া ঝোপের ভেতর পড়ে থাকা আহমদ মুসাকে দেখতে পেল। সংগে সংগে গাড়ি ব্রেক কষে চিৎকার করে উঠল ক্লাউডিয়া, ‘এখানে একজন মানুষ পড়ে আছে, জিয়ানা!’
গাড়ি দাঁড়িয়ে পড়েছিল।
জিয়ানা গাড়ির দরজা খুলে ছুটে বেরিয়ে এল। ক্লাউডিয়া গাড়ির দরজা খুলেছে, কিন্তু নামেনি। পেছনের তিনজনও তাই। তারা ভাবছে, নিশ্চয় কেউ মরে পড়ে আছে। জিয়ানা ডাক্তার, সেই ব্যাপারটা দেখুক।
জিয়ানা আহমদ মুসার গায়ে হাত দিয়েই চাপা কণ্ঠে বলে উঠল, ‘লোকটা বেঁচে আছে, তোমরা এস।’
ক্লাউডিয়াই প্রথম গিয়ে দাঁড়াল।
‘বিদেশী ক্লাউডিয়া, মনে হচ্ছে এশিয়ান যুবক।’
চিৎ হয়ে পড়ে থাকা আহমদ মুসার মুখের দিকে তাকিয়ে চমকে উঠল ক্লাউডিয়া। অজ্ঞাতসারেই মুখ থেকে বেরিয়ে এল, ‘এ কি!’
মুখে উদ্বেগ ফুটে উঠল ক্লাউডিয়ার।
জিয়ানা বিস্মিত চোখে ক্লাউডিয়ার দিকে চেয়ে বলল, ‘তুমি চেন একে ক্লাউডিয়া?’
ক্লাউডিয়া জবাব দেবার আগেই সেখানে এসে হাজির হলো ওরা তিনজন। এসে ঝুঁকে পড়ল ওরা আহমদ মুসার উপর। সুমাইয়া তার মুখের দিকে একনজর তাকিয়ে আর্তকণ্ঠে বলে উঠল, ‘এ কি, কি সর্বনাশ!’
বেদনায় চুপসে গেছে সুমাইয়ার মুখ।
জিয়ানা অবাক বিস্ময় নিয়ে সুমাইয়ার দিকে চেয়ে বলল, ‘তুমি চেন একে? ক্লাউডিয়াও দেখছি চেনে!’
সুমাইয়া ক্লাউডিয়ার দিকে চেয়ে বলল, ‘সত্যি তুমিও চেন?’
‘এসব পরে হবে জিয়ানা, মনে হয় ইনি মারাত্মকভাবে আহত, জ্ঞান হারিয়েছে। তুমি দেখ একে।’
জিয়ানা আহমদ মুসার ডান হাত ধরেই ছিল। বলল, ‘যুবকটি জ্ঞান হারায়নি, প্রচণ্ড অবসাদে ঘুমিয়ে পড়েছে।’
‘আঘাত কেমন?’ বলল সুমাইয়া।
‘একটু বড় আঘাত মাথায় ঐ এক জায়গাতেই। তবে দেখে আমার মনে হচ্ছে, আঘাতটা আগে থেকেই ছিল। তার উপর নতুন করে আঘাত লেগেছে।’ বলল জিয়ানা।
‘কি মনে করছ তুমি, আঘাতটা কিভাবে পেয়েছে?’ বলল ক্লাউডিয়া।
‘ব্যাপারটা খুবই পরিষ্কার। দেখ, ইনি পড়ে আছেন ধ্বংস হওয়া গাড়িটার বরাবর পাশেই। গাড়িটা বিস্ফোরিত হওয়ার ঠিক পূর্ব মুহূর্তে ইনি ঝাঁপিয়ে পড়েন গাড়ি থেকে। সেই সময় মাথার আহত জায়গায় আবার আঘাত লাগে।’
একটু থামল জিয়ানা। জ্বলন্ত গাড়িটার দিকে একবার তাকিয়ে বলল, ‘আমি বিস্মিত হচ্ছি, ঠিক বিস্ফোরণের মুহূর্তে গাড়ি থেকে বের হতে পারলেন কি করে? দেখ, উনি বিস্ফোরণের পাঁচ সেকেন্ড আগেও যদি বের হতেন, তাহলে গাড়ি বর্তমান স্থানে নয়, আরও সামনে এগিয়ে বিস্ফোরিত হতো। কিন্তু তা হয়নি। অর্থাৎ তার নামা এবং বিস্ফোরণ একই সাথে ঘটেছে।’
‘তার মানে, উনি বিস্ফোরণ ঘটার ব্যাপারটা দুই-পাঁচ সেকেন্ড আগেও টের পাননি। আক্রমণটা তাহলে তার অজান্তে আকস্মিকভাবে হয়েছে। এই অবস্থায় এই ধরনের আক্রমণ থেকে আত্মরক্ষা সত্যি দুঃসাধ্য।’ বলল রিশলা।
‘ওর অভিধানে মনে হয় অসাধ্য বলে কিছু নেই।’ বলল ক্লাউডিয়া।
‘ঠিক বলেছে ক্লাউডিয়া। একটা বিস্ময় উনি।’ বলল সুমাইয়া।
‘কিন্তু তোমরা বলছ না কে উনি, এদেশী তো উনি নন। তোমরা চেন কেমন করে তাকে?’ বলল রিশলা ও নেকা প্রায় একসাথেই।
‘সবই জানবে তোমরা। প্রথমে এর চিকিৎসা দরকার।’ বলল ক্লাউডিয়া।
‘একে এখান থেকে সরিয়ে নেয়া প্রয়োজন।’ বলল জিয়ানা।
‘ওকে তাহলে তো জাগাতে হবে।’ বলল ক্লাউডিয়া।
‘সেটাই আগে দেখি চেষ্টা করে। জোর করে জাগানো ঠিক হবে না। সহজে উঠেন কিনা দেখি।’ বলে জিয়ানা পকেট থেকে চিরুনি বের করে আহমদ মুসার পায়ের তালুতে খুব আলতোভাবে সুড়সুড়ি দিল।
কাজ হলো।
খুব ধীরে ধীরে চোখ খুলল আহমদ মুসা। মনে হলো, চোখ খোলার আগে চিন্তা করল।
চোখ খোলার পর প্রথমে তার চোখ গিয়ে পড়ল গলায় স্টেথিস্কোপ ঝোলানো জিয়ানার দিকে। তারপর তাকাল ক্লাউডিয়ার দিকে। ক্লাউডিয়ার উপর চোখ পড়তেই তার চোখ চঞ্চল এবং চোখে-মুখে বিস্ময় ফুটে উঠল। এরপর সে দ্রুত সবার উপর চোখ বোলাল। চোখ গিয়ে পড়ল তার সুমাইয়ার উপর।
আহমদ মুসা এক ঝটকায় উঠে বসল। ক্লাউডিয়া ও সুমাইয়ার দিকে চেয়ে বলল, ‘ক্লাউডিয়া, সুমাইয়া আপনারা? এখানে?’
‘হ্যাঁ, আমরা এখানে।’ বলে ক্লাউডিয়া জিয়ানা, রিশলা ও নেকাকে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলল, ‘এখান থেকে প্রথমে সরে যাওয়া প্রয়োজন, তারপর আপনার চিকিৎসা প্রয়োজন।’
‘ওরা একবার ফিরে এসেছিল। আবারও আসবে আশংকা করছেন?’ বলল আহমদ মুসা।
‘কেমন করে জানলেন ওরা এসেছিল?’ প্রায় সমস্বরে বলে উঠল সকলে। তাদের চোখে-মুখে বিস্ময়।
‘আমার মনে হচ্ছে, ওরা ফিরে না এলে আপনারা আমাকে এখান থেকে সরাবার জন্যে তাড়াহুড়া করতেন না।’
‘কেন এটা মনে করছেন?’ বলল জিয়ানা।
‘এই জন্যে করছি যে, ওরা ফিরে না এলে আপনারা বুঝতেনই না কিভাবে দুর্ঘটনাটা ঘটল কিংবা কি ধরনের লোক এটা ঘটিয়েছে। অতএব আপনাদের ভয়ও জাগতো না।’
‘ভয় করছি কি আমরা?’ বলল জিয়ানা।
‘আমার তাই মনে হচ্ছে। প্রাথমিক চিকিৎসা করার আগেই যখন আপনারা এ স্থান থেকে সরতে চাচ্ছেন, তখন এটাই ধরতে হয় যে, ভয়টাই আপনাদের কাছে প্রথম বিবেচ্য।’ বলল আহমদ মুসা।
জিয়ানা, রিশলাদের চোখে-মুখে বিস্ময়ের পাশাপাশি সপ্রশংস অনুভূতির স্ফূরণ ঘটল।
‘ধন্যবাদ।’ জিয়ানা বলল। তারপর বলল, ‘আপনাকে গাড়িতে উঠতে হবে।’
‘উঠবো। কিন্তু তার আগে প্লিজ আমাকে বলুন, ওরা কতক্ষণ আগে গেছে, কোনদিকে গেছে এবং আপনারা কোনদিকে যাবেন?’
‘পাঁচ মিনিটের বেশি হবে না ওরা গেছে। ওরা কুমেটের দিকে গেছে, আমরাও কুমেটের দিকেই যাব।’
‘ধন্যবাদ।’ বলে আহমদ মুসা উঠল। আহমদ মুসার মনে হলো, তার শরীরটা আগের চেয়ে অনেক ভারি। বেশ দুর্বল মনে হচ্ছে নিজেকে।
আহমদ মুসা হাঁটতে শুরু করেছিল গাড়ির দিকে।
আহমদ মুসার মুখে হঠাৎ নেমে আসা মলিন ছায়া নজর এড়ালো না ডাক্তার জিয়ানা বার্নেসের। বলল, ‘আপনাকে কি আমি সাহায্য করতে পারি?’
‘থ্যাংকস। হাঁটতে অসুবিধা হচ্ছে না।’
‘আপনি শেষ খাবার কখন খেয়েছেন?’
‘গতকাল দুপুরের পর। কেন বলছেন একথা?’
‘আমার মনে হচ্ছে, আপনার খালি স্টমাকই এখন বড় সমস্যা।’
গাড়ির দরজায় এসে ক্লাউডিয়া আহমদ মুসাকে বলল, ‘আপনি পেছনের সিটে বসুন।’
‘কিছু মনে করবেন না, এটাই কি ভাল নয় যে, আমি সামনের সিটে বসলাম? পেছনে আপনারা চারজন বসলেন?’
ক্লাউডিয়া সংগে সংগেই হেসে বলল, ‘একটু ভুল হয়েছিল আমার। ঠিক আছে।’ মনে মনে লজ্জিত হলো ক্লাউডিয়া। আহমদ মুসা মুসলিম এবং মেয়েদের সাথে অবাধ মেলামেশা ও সংগ এড়িয়ে চলে, এ কথা সে ভুলে গিয়েছিল।
‘থ্যাংকস।’ বলে আহমদ মুসা সামনের সিটে গিয়ে বসল।
ক্লাউডিয়া এসে বসল ড্রাইভিং সিটে।
জিয়ানা পেছনের পিকআপ থেকে একটা ক্যান এনে আহমদ মুসার হাতে দিয়ে বলল, ‘প্রথমে এটা খেয়ে নিন। শরীরটা ভাল লাগবে। তারপর স্ন্যাকস খেয়ে নিন।’ বলে স্যান্ডউইচের একটা ঠোঙাও তার হাতে দিল।
ক্যানটি হাতে নিয়ে আহমদ মুসা কিছু বলতে যাচ্ছিল। তার আগেই ক্লাউডিয়া বলল, ‘তুমি ভুল করেছ জিয়ানা। ইনি মুসলিম, ব্র্যান্ডি কেন, মদ জাতীয় কিছু খান না। তুমি জুস এনে দাও।’
‘স্যরি।’ বলে জিয়ানা ব্র্যান্ডির ক্যান ফিরিয়ে নিল এবং জুস এনে দিল।
পিকআপ থেকে ফাস্ট এইড বক্স নিয়ে জিয়ানা গাড়ির পেছনে প্রবেশ করল।
আহমদ মুসা বুঝল, গাড়ি অন্য কোথাও সরিয়ে নিয়ে তার আহত স্থানের শুশ্রুষা করা ওদের ইচ্ছা।
গাড়ি তখন চলতে শুরু করেছে।
‘ডাঃ জিয়ানা, আমি কি ফাস্ট এইড বক্সটা পেতে পারি?’ বলল আহমদ মুসা।
‘অবশ্যই। কিন্তু ফাস্ট এইড বক্সের আপনি কি চান?’ বলল জিয়ানা।
‘গোটা বক্সটাই।’
জিয়ানা ফাস্ট এইড বক্স বাড়িয়ে ধরল আহমদ মুসার দিকে।
‘থ্যাংকস’ বলে বক্সটি নিল আহমদ মুসা।
‘আমরা সামনে কোথাও দাঁড়াব। আপনার ক্ষতস্থানটা ড্রেসিং করতে হবে।’ বলল জিয়ানা।
‘ঠিক আছে। আপনার কাজটা যতদূর পারি এগিয়ে দিচ্ছি।’ বলল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসা স্পিরিটে তুলা ভিজিয়ে মাথার ক্ষতটা পরিষ্কার করতে লাগল।
‘ক্লাউডিয়া, ওর পরিচয় দিলে না, তোমাদের পরিচয়ের কথাও বললে না।’ বলল রিশলা।
ক্লাউডিয়া একটু হাসল। স্টিয়ারিং হুইলে হাত রেখে সামনের দিক থেকে দৃষ্টিটা ফিরিয়ে এনে তাকাল আহমদ মুসার দিকে। বলল, ‘জনাব, ওরা সকলে আমার এবং সুমাইয়ার বন্ধু। আপনার পরিচয় যদি বলি আপত্তি নেই তো?’
‘পরিচয়টা আনন্দদায়ক হবে না। তবু নিরানন্দের ভাগ ওদের দিতে পারেন।’ আহমদ মুসা বলল।
‘বাহ, আপনি বুঝি সাহিত্যের ছাত্র ছিলেন? সুন্দর সাহিত্যের ভাষায় কথা বলেন।’ বলল জিয়ানা।
আহমদ মুসা কিছু বলতে যাচ্ছিল। কথা বলে উঠল ক্লাউডিয়া। বলল, ‘সুমাইয়া, তুমি ওদের একটু ব্রিফ করো।’
বেশ কিছুক্ষণ নীরবতা। আহমদ মুসা তুলা দিয়ে মাথার আঘাত পরিষ্কার করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল। আর সুমাইয়া রিশলা, নেকা ও জিয়ানার মাথা দু’হাত দিয়ে কাছে টেনে নিয়ে আহমদ মুসার কাহিনী বলছিল। অন্যদিকে ক্লাউডিয়ার শূন্য দৃষ্টি সামনে প্রসারিত।
এক সময় সুমাইয়ার ব্রিফ শেষ হলো। জিয়ানা, রিশলা ও নেকার মাথা খাড়া হলো। তাদের মুখ গম্ভীর, চোখে-মুখে বিস্ময়! ব্রিফ শোনার শুরুতে তাদের যে চটুলতা ছিল, হালকা মনোভাব ছিল, তা এখন নেই। সবাই ভাবছে, আর যতটুকু পারে দেখছে আহমদ মুসাকে।
ক্লাউডিয়া তার শূন্য দৃষ্টিটা এক সময় ফিরিয়ে নিল আহমদ মুসার মুখের উপর। আবার ফিরিয়ে নিল তার দৃষ্টিটা। ধীর কণ্ঠে বলল, ‘ডোনা কেমন আছে?’
‘ডোনা? ডোনাকে আপনি চেনেন?’
‘আমাদের ‘আপনি’ না বললেই কি নয়?’
একটু থেমে আবার শুরু করল, ‘ডোনা আমার বন্ধু, একই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি।’
‘ডোনার সাথে আমার পরিচয়ের কথা কি করে জানলেন?’
‘শুধু পরিচয় নয়, ডোনার সৌভাগ্যের কথাও জানি।’
‘কি সৌভাগ্য?’
মিষ্টি হাসি ফুটে উঠল ক্লাউডিয়ার ঠোঁটে। বলল, ‘থাক ওসব কথা। আপনার মাথার ড্রেসিংটা হয়ে যাক।’ বলে ক্লাউডিয়া গাড়ি রাস্তা থেকে নামিয়ে নিল এবং ঝোপ ঘেরা একটা ফাঁকা জায়গায় দাঁড় করাল।
জায়গাটা নিরিবিলি সুন্দর। দক্ষিণ পাশ দিয়ে হাইওয়েটা পূর্বে কুমেটের দিকে চলে গেছে। কিন্তু রাস্তার পাশ দিয়ে গাছ এবং ঝোপ এত ঘন যে, রাস্তা থেকে এ জায়গাটা দেখাই যায় না। পূর্ব পাশ দিয়ে একটা পাকা রাস্তা হাইওয়ে থেকে বেরিয়ে উত্তরে বনের ভেতরে চলে গেছে। হাইওয়ে থেকে বেরুবার পর প্রথম দিকে রাস্তাটার দু’পার্শ্ব বনাচ্ছাদিত হলেও পরে তা ফাঁকা এবং জায়গাটার পূর্ব পাশ ঘেঁষে চলে গেছে। ফাঁকা জায়গার মাঝখানে একটা সুন্দর সবুজ টিলা।
নামল ক্লাউডিয়া গাড়ি থেকে। বলল, ‘এস জিয়ানা, ড্রেসিংটা করে দাও।’
সুমাইয়ার কাছ থেকে জিয়ানা, রিশলা ও নেকা আহমদ মুসার পরিচয় পাবার পর প্রায় নির্বাক হয়ে গিয়েছিল। অবাক হয়ে তারা দেখছিল আহমদ মুসাকে।
আহমদ মুসা বেরিয়ে এল। বলল, ‘ক্লাউডিয়া, তোমাদের সব কথা বলা হয়নি। খুব সংকটে আছি। এক সেকেন্ড সময়ও নষ্ট না করলে ভাল হতো।’
‘সংকটটা আমাদের বলুন। ইতোমধ্যে জিয়ানা মাথার ড্রেসিংটা করে দেবে।’ বলল সুমাইয়া।
সুমাইয়া, জিয়ানা, রিশলা, নেকা সবাই গাড়ি থেকে নেমে এসেছিল।
জিয়ানা গাড়ি থেকে ফাস্ট এইড বক্স নিয়ে এসে আহমদ মুসার সামনে দাঁড়াল। মুখে তার কোন কথা নেই। বিস্ময়-বোবা দৃষ্টি তার চোখে। জিয়ানার মধ্যে দ্বিধাগ্রস্থতা।
‘রোগী যে-ই হোক, সে ডাক্তারের অধীন।’ জিয়ানার দিকে চেয়ে ঠোঁটে এক টুকরো হাসি টেনে বলল ক্লাউডিয়া।
‘না, তা নয়। আমি ভাবছিলাম আমার সৌভাগ্যের কথা।’ বলে জিয়ানা আহমদ মুসার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘জনাব, আপত্তি না থাকলে আপনি বসুন। আমার সুবিধা হবে।’
ফাস্ট এইড বক্স খুলে কাজ শুরু করল জিয়ানা।
‘এবার আপনার সংকটের কথা বলুন।’ কিছু হালকা সুরে বলল সুমাইয়া।
‘এ সংকট জীবন-মৃত্যুর একটা বাজি খেলা সুমাইয়া।’
‘জানি জনাব, আপনি সামান্য কিছুতে জড়ান না।’ গম্ভীর কণ্ঠে বলল সুমাইয়া। তার কথায় তারল্য আর নেই।
‘খুব সামান্যের মধ্যে অসামান্য দুঃখ-বেদনা থাকতে পারে সুমাইয়া।’ বলল আহমদ মুসা।
‘সামান্য আমি সে অর্থে বলিনি।’ বলল সুমাইয়া।
‘সামান্যের হস্ত স্পর্শেও সামান্য অনেক সময় অসামান্য হয়ে ওঠে।’ বলল ক্লাউডিয়া।
‘সামান্যের কাছে যা যায়, তা প্রকৃতই অসামান্য নয়।’ বলল আহমদ মুসা।
একটু থেমেই আহমদ মুসা আবার বলল, ‘থাক এসব। ক্লাউডিয়া তুমি ওমর বায়ার কথা শুনেছ। আর সুমাইয়া তুমি ওমর বায়াকে দেখেছও।’
‘হ্যাঁ, তাকে কেন্দ্র করেই তো আপনার সাথে পরিচয়। কোন দিনই যা ভোলার নয়।’ বলল সুমাইয়া।
‘ওমর বায়াকে ব্ল্যাক ক্রস কিডন্যাপ করেছিল। গত রাতে তাকে উদ্ধার করেছিলাম। ভোর রাতেই তাকে আবার ওরা দ্বিতীয়বার কিডন্যাপ করতে সফল হয়েছে। ওদেরই পিছু…।’
কথা শেষ করতে পারলো না আহমদ মুসা। উত্তর-পূর্ব বনের দিক থেকে গুলির শব্দ এল। শব্দ এল একের পর এক।
আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল।
জিয়ানা আহত জায়গাটার উপর তুলার একটা লেয়ার দিয়ে টেপ দিয়ে আটকে দিচ্ছিল। কাজটা অসম্পূর্ণ থেকে যাচ্ছিল।
আহমদ মুসা দাঁড়ালেও জিয়ানা টেপ আটকে দেয়ার কাজ শেষ করল।
‘ধন্যবাদ জিয়ানা, ডাক্তার আপনি।’ বলে আহমদ মুসা আবার মনোযোগ নিবদ্ধ করল গুলির শব্দের দিকে।
‘মনে হচ্ছে, গাড়ি করে গুলি করতে করতে কেউ বা কারা এগিয়ে আসছে। সম্ভবত কেউ কাউকে তাড়া করেছে।’
বলে একটু থামল আহমদ মুসা। তারপর বলল দ্রুত কণ্ঠে, ‘ওরা এসে গেছে। ক্লাউডিয়া, তোমরা একটু গাড়ির আড়ালে যাও।’
ক্লাউডিয়া, জিয়ানা, সুমাইয়া, রিশলা, নেকা- সবার মুখ শুকিয়ে গিয়েছিল ভয়ে।
আহমদ মুসার কথা শুনেই নেকা ও রিশলা ছুটে গাড়ির আড়ালে চলে গেল। কিন্তু ক্লাউডিয়া, সুমাইয়া ও জিয়ানা তাকিয়েছিল আহমদ মুসার মুখের দিকে উদ্বিগ্নভাবে। বলতে চাচ্ছিল, আপনি বিপদগ্রস্থ, আপনি আহত, আপনারই প্রথম সরে যাওয়া দরকার। কিন্তু আহমদ মুসার মুখের দিকে চেয়ে কিছু বলার সাহস হলো না।
আহমদ মুসার কথা শেষ হবার পর মুহূর্তও গেল না। তীরের বেগে একটা কার বেরিয়ে এল রাস্তা ধরে বনের দিক থেকে। পাগলের মত তীব্র গতিতে ছুটে গাড়িটা হাইওয়েতে উঠতে চাচ্ছিল।
আবার গুলির শব্দ হলো। একই সাথে দুই গুলি।
বিকট শব্দ উঠলো টায়ার ফাটার। এবং তার সাথে সাথে ছুটে আসা গাড়িটা একটা পাক খেয়ে রাস্তা থেকে মাঠে প্রবেশ করে মুখ থুবড়ে পড়ে থেমে গেল আহমদ মুসার কাছ থেকে মাত্র অল্প কিছু দূরে।
ঠিক সেই মুহূর্তে আরেকটি গাড়ি তীব্র বেগে প্রবেশ করল মাঠে।
আগেই মাঠে ঢোকা মুখ থুবড়ে পড়া গাড়ি থেকে একজন তরুণ ও একজন তরুণী বেরিয়ে এল। তাদের চোখে-মুখে প্রবল শংকা। মৃত্যু যেন নাচছে তাদের দৃষ্টিতে।
গাড়ি থেকে বেরিয়ে আসা তরুণটি একবার চারদিকে চেয়ে দৌঁড় দিল আহমদ মুসার দিকে।
ততক্ষণে পেছনে এসে দাঁড়ানো গাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছে দু’জন রিভলভারধারী। তাদের একজন রিভলভার তুলল তরুণটির উদ্দেশ্যে।
আহমদ মুসা দাঁড়িয়েছিল স্থির দৃষ্টিতে ওদিকে তাকিয়ে। দুই পকেটে তার দুই হাত।
তার পেছনে দাঁড়িয়ে ছিল ক্লাউডিয়া, সুমাইয়া এবং জিয়ানা। ঘটনার এই আকস্মিতায় তারা যেন পাথর হয়ে গিয়েছিল। গাড়ির পেছনে পালাবার নির্দেশ তারা ভুলে গিয়েছিল। তাদের চোখে-মুখে ভয়-উদ্বেগ ঠিকরে পড়ছে।
আহমদ মুসা তরুণটিকে বাঁচাবার জন্যে চেষ্টার সিদ্ধান্ত নিয়ে নিল।
ঠিক সময়েই তার ডান হাত রিভলভারসমেত বেরিয়ে এল পকেট থেকে। আহমদ মুসা তরুণকে লক্ষ্য করে উদ্যত হয়ে উঠা রিভলভারধারী লোকটির হাত লক্ষ্যে গুলি করল। অব্যর্থ লক্ষ্য। লোকটার হাত থেকে রিভলভার পড়ে গেল। লোকটা বাম হাত দিয়ে চেপে ধরল ডান হাত।
কিন্তু আহমদ মুসার গুলির শব্দ মিলিয়ে যাবার আগেই পেছনের গাড়ি থেকে নামা দ্বিতীয় ব্যক্তির রিভলভার উদ্যত হলো আহমদ মুসার লক্ষ্যে।
আহমদ মুসার রিভলভারের নলও চোখের পলকে ঘুরে গেল তার দিকে। কিন্তু এবার আহমদ মুসা দ্বিতীয় লোকটির হাতের দিকে লক্ষ্য স্থির করার সময় পেল না। রিভলভারের নল ঘুরে এসেই স্থূল লক্ষ্যে গুলি বর্ষণ করল।
গুলিটি লোকটির বক্ষ ভেদ করল। উদ্যত হয়ে উঠা তার হাতের রিভলভারসমেতই ঢলে পড়ে গেল সে।
হাতে গুলিবিদ্ধ লোকটি গুলি খাওয়ার পর মুহূর্তেই সক্রিয় হয়ে উঠেছে। বাম হাত দিয়ে পকেট থেকে সে বের করে এনেছে টেবিল টেনিস বলের মত একটা হ্যান্ড গ্রেনেড। হাত উঠে আসছে তার মাথার উপর।
দ্বিতীয় গুলি ছোঁড়ার পর সেকেন্ডের মধ্যেই তৃতীয় গুলি বেরিয়ে এল আহমদ মুসার রিভলভার থেকে।
গুলিটা সম্ভবত আবার লোকটির হাতেই আঘাত করল। শব্দ উঠলো ভয়াবহ বিস্ফোরণের। বিস্ফোরিত হয়েছে হ্যান্ড গ্রেনেডটি লোকটির হাতেই। তারপর যা ঘটল তা দেখার মত নয়। ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল লোকটির দেহ।
ক্লাউডিয়াদের চোখ বিস্ফারিত হয়ে উঠেছে। হ্যান্ড গ্রেনেডটি তাদের উপর এসে পড়লে এতক্ষণে তাদের অবস্থাও ঐ দেহের মতই হতো।
আহমদ মুসা রিভলভার পকেটে রাখতে রাখতে বলল, ‘ওদের আমি চিনি না। আমি এ ছেলেটিকে বাঁচাতে চেয়েছিলাম, মারতে ওদের আমি চাইনি। কিন্তু…’
ক্লাউডিয়া, সুমাইয়া, জিয়ানা পেছন থেকে আহমদ মুসার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। রিশলা এবং নেকাও এসেছে। তাদের চোখে-মুখে আগের সেই মৃত্যুভয় নেই। কিন্তু উদ্বেগে বিবর্ণ তাদের মুখ।
‘কিন্তু কি?’ প্রশ্ন করল জিয়ানা শুষ্ক কণ্ঠে।
‘কিন্তু আমি না মরে ওদের বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব ছিল না। জানি না ওরা কারা। সাংঘাতিক বেপরোয়া। সাধারণত এমনটা দেখা যায় না।’ বলল আহমদ মুসা।
সেই তরুণ-তরুণী দু’জন মাটিতে শুয়ে পড়েছিল। তারা ছুটে এসে আহমদ মুসার পায়ের উপর পড়ে গেল। কেঁদে উঠল। বলল, ‘আপনি আমাদের বাঁচিয়েছেন।’
আহমদ মুসা ওদের হাত ধরে তুলল। বলল, ‘কাউকে বাঁচাবো সাধ্য কি আমার! আল্লাহ তোমাদের বাঁচিয়েছেন। আমি আমার কর্তব্য করেছি।’
তরুণ-তরুণী দু’জন তখনও কাঁপছিল। তরুণীটি ক্লাউডিয়াদের বয়সের। তরুণটি আহমদ মুসা থেকে দুই-চার বছরের ছোট। দেখে তাদের দু’জনকেই ছাত্র মনে হচ্ছে। সহজ-সরল মুখের ভাব। জীবনসংগ্রামের চিহ্ন তাতে নেই।
ক্লাউডিয়া ও সুমাইয়া গিয়ে তরুণীটিকে কাছে টেনে নিল।
আর আহমদ মুসা কথা শেষ করে তরুণটির কাঁধে হাত দিয়ে বলল, ‘এত ভয় কেন? ওরা এখন নেই।’
‘না, ওরা আছে। ওরা অনেক।’
‘ওরা কারা? কি শত্রুতা ওদের সাথে তোমাদের?’
‘সে অনেক কথা। ওরা…’
‘থাক এখন।’
বলে তরুণটিকে থামিয়ে ক্লাউডিয়ার দিকে চেয়ে বলল, ‘এখান থেকে এখনি আমাদের চলে যাওয়া দরকার। অযথা ঝামেলায় জড়িয়ে লাভ নেই।’
‘ঠিক বলেছেন।’
বলে সে গাড়ির দিকে এগোলো।
তার সাথে সকলে।
গাদাগাদি করে সবাই ক্লাউডিয়াদের গাড়িতেই উঠল।
ড্রাইভিং সিটে বসল আবার ক্লাউডিয়াই।
মাঠ থেকে গাড়ি বেরিয়ে ছুটল কুমেট-এর দিকে।

Top