১৯. ক্রস এবং ক্রিসেন্ট

চ্যাপ্টার

লা স্যামসন রোড ধরে আহমদ মুসার নতুন নাম্বার প্লেটওয়ালা গাড়িটা যখন একাত্তর নাম্বার বাড়ির কাছাকাছি পৌঁছল, তখন রাত ঠিক বারটা।
এই গাড়িতে করেই পিয়েরে পল ও ফ্রান্সিস বাইকের লোকরা থমাস নিকানোর বাড়িতে আহমদ মুসাকে ধরতে গিয়েছিল। একটা গ্যারেজে পড়ে থাকা পুরানো জীপের নাম্বার প্লেট খুলে এনে আহমদ মুসা এ জীপে লাগিয়েছে।
একাত্তর নাম্বার বাড়িটার বিপরীত দিকে অন্ধকারে রাস্তার একটা গাছের আড়ালে গাড়িটা দাঁড় করিয়ে আহমদ মুসা নামল গাড়ি থেকে।
‘লা স্যামসন’ পূর্ব দুয়ালার বিখ্যাত আবাসিক এলাকার একটি রাস্তা। ফরাসি দখলদারিত্বের সময় আবাসিক এলাকার পত্তন হয়। রাস্তার নামটা একজন ফরাসি জেনারেলের নাম অনুসারে।
গাড়িতে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আহমদ মুসা একাত্তর নাম্বার বাড়িটার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাল।
বাড়িটার ঠিকানা পেয়েছে ব্লু বুকের সাথে গাড়ির ড্যাশবোর্ডের এক কেবিনে।
আহমদ মুসা থমাসের বাড়ি থেকে গাড়িটা নিয়ে পাঁচ মিনিট ড্রাইভ করে আসার পর একটা বিল্ডিং-এর পাশে অন্ধকার মত জায়গা দেখে গাড়িটা দাঁড় করিয়েছিল। তারপর তন্ন তন্ন করে সার্চ করেছিল গাড়িটা। কিন্তু সাহায্যে আসার মত তেমন কিছুই পায়নি। শুধু পেয়েছিল একটা ব্লু বুক, একটা ড্রাইভিং লাইসেন্স এবং সাথে একটা এনভেলাপ।
এনভেলাপে যে ঠিকানা সে পেয়েছিল, সেই একই ঠিকানা ছিল ব্লু বুক ও ড্রাইভিং লাইসেন্সে, শুধু ব্যক্তির নাম ছিল ভিন্ন।
আহমদ মুসা নিশ্চিত হয়েছিল, নিশ্চয় এ বাড়িটা ব্ল্যাক ক্রস অথবা ‘ওকুয়া’র একটা ঘাঁটি বা ঠিকানা হবে। তবে ঠিকানা বা ঘাঁটিটা ওকুয়ার হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। কারণ, যে লোকগুলো তাকে ধরতে গিয়েছিল মিঃ থমাসের বাড়িতে, তারা ব্ল্যাক ক্রস-এর লোক নয়।
বাড়িটা তিনতলা। প্রাচীর ঘেরা বাড়ি। প্রথমেই একটা গেট। গেট পেরুলে প্রাচীরের ভেতরে ঢোকা যাবে।
দূর থেকে গেটটিকে লোহার বলেই মনে হচ্ছে।
আহমদ মুসা রাস্তা পার হয়ে গেটটার সামনে ফুটপাতে গিয়ে দাঁড়াল।
গেটের সাথে একটা গার্ড রুম আছে। একটা কলিং বেল দেখল আহমদ মুসা গেটের নেমপ্লেটের ঠিক উপরে। গার্ড রুমের বাইরের দেয়ালের মাথা বরাবর উঁচুতে একটা লুকিং হোল রয়েছে। আহমদ মুসা বুঝল, কলিং বেলের শব্দ শুনে লুকিং হোল দিয়ে আগন্তুককে দেখে পরে দরজা খুলে দেয়। গেট নিয়ন্ত্রণের এই সাবেকি কায়দা দেখে আহমদ মুসা বুঝল, ‘ওকুয়া’ বা ‘ব্ল্যাক ক্রস’- এর কোন ঘাঁটি এটা হলে বুঝতে হবে, পশ্চিমের মত আধুনিক ব্যবস্থাপনার কোন ছোঁয়াই এখানে লাগেনি।
আহমদ মুসা একবার মনে করল, কলিং বেল টিপে গার্ডের কাছে এনভেলাপে দেখা নামটির খোঁজ করে ভেতরে ঢোকার একটা পথ সে করতে পারে। কিন্তু পরক্ষণেই ভাবল, আগে গণ্ডগোল বাঁধিয়ে লাভ নেই। গোপনে ঢুকে ওমর বায়াদের অবস্থান খুঁজে বের করাই হবে সবচেয়ে জরুরি।
গাছপালার ছায়ার ঘন অন্ধকারের আড়াল নিয়ে আহমদ মুসা বাড়িটার পেছনের অংশে প্রাচীরের গা ঘেঁষে দাঁড়াল।
প্রাচীর ছয় ফিটের মত উঁচু।
প্রাচীর টপকে ভেতরের ঘাসওয়ালা চত্বরে লাফিয়ে পড়ল আহমদ মুসা। ভেতরের চত্বরটা অনেকটা বাগানের মত। ছোট-বড় মিলে অনেক গাছ রয়েছে।
আহমদ মুসা উঠে দাঁড়িয়ে কয়েক পা এগোতেই ভয়ানক শব্দ করতে করতে ছুটে এল একটা কুকুর। বিশাল তার সাইজ।
আহমদ মুসা সাইলেন্সার লাগানো রিভলভার হাতে তুলে নিয়েছে।
কুকুরটি একেবারে সামনে এসে মুহূর্তের জন্যে তার শিকারের দিকে রক্তচক্ষু নিক্ষেপ করল। তারপরই শিকার লক্ষ্যে লাফ দেবার জন্যে তার দেহকে একটা ঝাঁকুনি দিল। কিন্তু আহমদ মুসার রিভলভার থেকে ছুটে যাওয়া বুলেট তার দেহের সেই ঝাঁকুনিকে আরও প্রবল করে তুলল। মাটি থেকে আর উঠল না কুকুরটি।
আহমদ মুসা কুকুরকে পাশ কাটিয়ে পনের-বিশ হাত এগিয়েছে, এমন সময়ে সামনে সে পায়ের শব্দ পেল। দেখল, অন্ধকার ঠেলে দুই অন্ধকার মূর্তি ঝড়ের গতিতে ছুটে আসছে।
আহমদ মুসা চট করে পাশের এক গাছের আড়ালে আশ্রয় নিল। ওরা নাক বরাবর এ পথেই ছুটে আসছে।
গাছের পাশ দিয়েই ওরা ছুটে যাচ্ছিল। ঠিক গাছ বরাবর আসতেই আহমদ মুসা বাম পা বাড়িয়ে দিল।
সংগে সংগেই হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল সামনের লোকটা। পেছনের লোকটা পড়ে গেল তার উপর।
ওরা উঠে দাঁড়িয়েছিল। আহমদ মুসা বলল, ‘উঠতে চেষ্টা করলে ঐ কুকুরের মতই গুলি খেয়ে মরবে। তোমরা উপুড় হয়ে শুয়ে পড়।’
ওরা হুকুম তামিল করল।
আহমদ মুসা ওদের কাছে এগিয়ে ওদের গায়ের গেঞ্জি ছিঁড়ে ওদের হাত-পা বেঁধে ফেলল।
তারপর একজনের মাথায় রিভলভার ঠেকিয়ে বলল, ‘আমি যা জিজ্ঞেস করব সংগে সংগে জবাব দেবে। এক মুহূর্ত দেরি হলে মাথায় বুলেট ঢুকে যাবে।’
অন্ধকারেও আহমদ মুসা বুঝল, দু’জনেই কৃষ্ণাংগ।
‘বল, এ বাড়িতে কারা থাকে?’
কোন উত্তর এল না।
আহমদ মুসার তর্জনী ট্রিগারে চাপ দিল। লোকটির দেহ প্রবল ঝাঁকুনি দিয়ে ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয়ে গেল।
আহমদ মুসা এবার তার রিভলভারের নল দ্বিতীয় লোকটির মাথায় ঠেকিয়ে বলল, ‘দেখলে তো, আমি এক কথা দু’বার বলি না। এখন বল, এই বাড়িতে কারা থাকে?’
‘এটা ‘ওকুয়া’র একটা ঘাঁটি।’
‘এখন এখানে কয়জন লোক আছে?’
‘আমরা দু’জন ছিলাম, আর গেটে একজন আছে।’
‘কুমেট থেকে পিয়েরে পল এসেছে, সে কোথায়?’
‘এখানেই ছিল। চলে গেছে।’
‘কোথায় গেছে, কখন গেছে?’
‘এইতো কিছুক্ষণ আগে চলে গেল।’
‘কোথায় গেল?’
‘ইয়াউন্ডিতে।’
‘কুমেট থেকে দু’জন লোক ধরে এনেছে, তারা কোথায়?’
‘তাদেরও নিয়ে গেছে।’
‘ঠিক বলছ, তাদের নাম জান?’
‘জানব না কেন, একজন তো পরিচিত। ওমর বায়া। অন্যজন ডিফরজিস।’
‘ওরা কিসে গেছে?’
‘সবাই মিলে দু’টি গাড়ি নিয়ে গেছে।’
‘ইয়াউন্ডির কোথায় ওদের ঠিকানা?’
‘মঁশিয়ে, আমি তা জানি না। এক ঘাঁটির লোককে অন্য ঘাঁটির ঠিকানা বলা হয় না।’
‘তুমি যদি কোথাও গিয়ে ‘ওকুয়া’র অফিস খুঁজে পেতে চাও, তাহলে কি করবে?’
লোকটি কথা বলল না।
আহমদ মুসা তার রিভলভারের নল দিয়ে তার মাথায় চাপ দিয়ে বলল, ‘বলেছি, দ্বিতীয়বার আদেশ আমি করি না।’
‘‘ওকুয়া’র অফিস বা ঘাঁটির কোন একটি দর্শনীয় জায়গায় কালো ক্রস হাতে ‘ব্ল্যাক আর্মি’-এর একটা মূর্তি অংকিত থাকবে।’
‘সে দর্শনীয় জায়গা কোনটা?’
‘আমি জানি না, তবে আমাদের এখানে বাড়ির নামফলকের ঠিক উপরে।’
আহমদ মুসা তার পায়ের বাঁধন খুলে দিয়ে বলল, ‘চল, তোমাদের এ বাড়িতে কেউ আছে কি না, তুমি ঠিক বলেছ কি না দেখব।’
লোকটি আগে আগে চলল।
আহমদ মুসা তার মাথায় রিভলভার ঠেকিয়ে পেছনে পেছনে চলল।
প্রথমে একতলা, তারপর দোতলা এবং সব শেষে তিনতলার সবগুলো ঘর তন্ন তন্ন করে দেখল আহমদ মুসা। কিন্তু কোথাও এমন কোন কাগজপত্র পেল না যা দিয়ে ওকুয়া’র পরবর্তী ঘাঁটির সন্ধান করা যায়।
‘কোন টেলিফোন গাইড নেই তোমাদের?’
‘আমাদের টেলিফোন করা এবং ধরা, দুই-ই নিষিদ্ধ। ঘাঁটির কর্তাই টেলিফোন ব্যবহার করতে পারেন। তাদের গাইডের প্রয়োজন হয় না। ওদের পকেট কম্পিউটারে সবকিছু নোট করা থাকে।’
‘এখান থেকে টেলিফোন করা যাবে না?’
‘যাবে না। কোড-লক দিয়ে বন্ধ করা আছে।’
‘ওমর বায়াদের নিয়ে ওরা ইয়াউন্ডি গেছে কেন?’
‘আমি জানি না মঁশিয়ে।’
‘যে দু’টি গাড়ি ওরা নিয়ে গেছে তার নাম্বার?’
‘বিশ্বাস করুন, নাম্বার জানি না। গাড়ি দু’টি আজ কোত্থেকে যোগাড় করেছে।’
‘সহযোগিতার জন্যে তোমাকে ধন্যবাদ।’ বলে তাকে দু’খণ্ড রশি দিতে বলল।
রশি পেলে আহমদ মুসা তাকে পিছমোড়া করে হাত-পা বেঁধে বলল, ‘তোমার হাত-পা বাঁধা না থাকলে তুমি সন্দেহের শিকার হবে।’
বলে আহমদ মুসা বেরিয়ে এল বাড়ি থেকে। এল গেটে। দেখল, গেটম্যান ঘুমুচ্ছে চেয়ারে বসে।
আহমদ মুসা রিভলভার দিয়ে গুঁতো মারল। ধড়মড় করে উঠে দাঁড়াল। একবার আহমদ মুসার রিভলভারের নল আর একবার আহমদ মুসার মুখের দিকে চেয়ে দু’হাত উপরে তুলল।
‘হাত উপরে তোলো না। গেট খোল।’ বলল আহমদ মুসা।
লোকটা কাঁপতে কাঁপতে গিয়ে গেট খুলে দিল।
আহমদ মুসা রাস্তা পার হয়ে গাড়ির কাছে চলে আসার আগে গেটের নামফলকের উপরে কালো ক্রস হাতে কালো সৈনিকের ছবি দেখে নিল।
আহমদ মুসা এসে গাড়িতে উঠতে উঠতে ভাবল, ওকুয়া’র লোকদের সাথে দু’বার দেখা হওয়া থেকে বোঝা গেল, ওরা মারতেই অভ্যস্ত। লড়াই-এর অভ্যেস এদের খুব কম। এর অর্থ, এদের মুসলিম প্রতিদ্বন্দ্বীরা এখানে এতই দুর্বল যে, লড়াইয়ের প্রয়োজন তাদের কোন সময়ই হয়নি। এই উপলব্ধি আহমদ মুসাকে একদিকে খুব আহত করল, অন্যদিকে আনন্দিত করল যে, তাদের এই দুর্বলতা আমাদের মিশনকে সহজ করতে পারে।
গাড়ির ড্রাইভিং সিটে বসে আহমদ মুসা হাতঘড়ির দিকে তাকাল। সময় রাত একটা। সমগ্র দুয়ালাতে এই মুহূর্তে তার যাবার কোন জায়গা নেই, সুতরাং ইয়াউন্ডি যাত্রা করাই ভাল, ভাবল আহমদ মুসা। মনে হলো একবার মেরীদের বাড়ির কথা। কিন্তু ওখান থেকে সে বিদায় নিয়ে এসেছে। যদিও আসার সময় ওরা বলেছে, তাদের বাড়ির দুয়ার সব সময় আহমদ মুসার জন্যে খোলা। বিপদের কথা জানার পরেও তার প্রতি ওদের এই আন্তরিকতা আহমদ মুসার হৃদয় স্পর্শ করেছে। আহমদ মুসা ওদের জিজ্ঞেস করেছিল, তারা তো তাদের জাতির বিরুদ্ধে কাজ করছে। মেরীর মুখে ফুটে উঠেছিল রহস্যময় হাসি। তার আব্বার দিকে একবার চেয়ে নিয়ে সে বলেছিল, ‘রক্তের একটা টান আছে। আব্বা ফ্রান্সে পড়ার সময় খৃস্টান ধর্ম গ্রহণ করেন, কিন্তু আমাদের পরিবারের অবশিষ্ট সকলে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। তারা বাস করছেন নাইজেরিয়ার লাগোসে। আব্বা ওখান থেকেই আজ আসলেন।’
দূরে কোথাও পুলিশের বাঁশি আহমদ মুসার সম্বিত ফিরিয়ে আনল।
গাড়ি স্টার্ট দিল আহমদ মুসা। তার কল্পনার চোখে ইয়াউন্ডিগামী সড়কটার একটা চিত্র ফুটে উঠল। দুয়ালা থেকে পুবের হাইওয়ে ধরে বেরিয়ে যেতে হবে, তারপর পূর্ব-দক্ষিণে একটু বেঁকে ইদিয়া পর্যন্ত। সেখান থেকে সোজা পুবদিকে ইয়াউন্ডি মালভূমির চিরহরিৎ বনাঞ্চলের মধ্যে দিয়ে যেতে হবে ইয়াউন্ডি।
আহমদ মুসার গাড়ি তখন ইদিয়া পার হয়ে প্রবেশ করেছে ইয়াউন্ডি মালভূমির চিরহরিৎ বনাঞ্চলে। বনাঞ্চলের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে চলছিল আহমদ মুসার গাড়ি। রাস্তার দু’পাশে মাঝে মাঝেই উন্মুক্ত মাঠ, আবার দিগন্ত প্রসারিত চিরহরিৎ বৃক্ষরাজির সারি। গাড়ি তখন প্রবেশ করেছে একটা উন্মুক্ত এলাকা পেরিয়ে বনের ভেতর।
এই সময় আযানের একটা দরাজ কণ্ঠ এসে প্রবেশ করল আহমদ মুসার কানে।
আহমদ মুসা হাতের ঘড়ির দিকে তাকাল। ভোর সাড়ে চারটা।
গাড়ির ব্রেক কষল আহমদ মুসা। থেমে গেল গাড়ি।
রাস্তার বাম দিক অর্থাৎ উত্তর দিক থেকে আসছে আযানের আওয়াজ।
আহমদ মুসা খুব খুশি হলো। সিদ্ধান্ত নিল, সে ঐ মসজিদে গিয়ে নামায পড়বে। ক্যামেরুনে প্রথমবারের মত মুসলমানদের সাথে দেখা হবে তার।
খুঁজে রাস্তা বের করল আহমদ মুসা উত্তর দিকে যাবার। তারপর হাইওয়ে থেকে নেমে আযানের শব্দ লক্ষ্যে চলল উত্তরের রাস্তা ধরে।
রাস্তা থেকে অল্প অগ্রসর হবার পরেই রাস্তার দু’ধারে কোথাও দেখল পাম গাছের সারি, কোথাও কফি গাছের সারি, আবার কোথাও কোকো গাছের ক্ষেত। মনে পড়ল আহমদ মুসার, এ অঞ্চলে এগুলোই প্রধান ফসল। আগে এখানকার যাযাবর কালো মানুষরা বন কেটে গম-যবের মত দানাদার ফসল ফলাতো। কিন্তু যুগ-যুগের এই অভ্যাসের ফলে মাটির উর্বরতা শেষ হয়ে যায় পর্যাপ্ত বৃষ্টি এবং ভূমি পরিচর্যার অভাবে। এ কারণে রাষ্ট্রের আইন এবং অবস্থার কারণে বাধ্য হয়ে এ অঞ্চলের মানুষ পাম তেল, কফি এবং কোকোর মত গাছজাত ফসলের চাষে ফিরে এসেছে মাটির সেই উর্বরতা আবার ফিরিয়ে আনার জন্যে। অর্থকরী এ ফসল উৎপাদনে এ অঞ্চলের মানুষ আগের চেয়ে লাভবানই হয়েছে।
আহমদ মুসা রাস্তার দু’ধারে দিগন্তপ্রসারী এই গাছজাত ফসলের ক্ষেত দেখে ভাবল, ইয়াউন্ডি মালভূমির নিশ্চয় খুব উর্বর এলাকা এটা।
মাইলখানেক চলার পর পাম গাছের ফাঁকে ফাঁকে গুচ্ছ গুচ্ছ বাড়ি তার নজরে এল। বাড়িগুলো কাঠের বেড়া দিয়ে তৈরি। তার উপর টিনের চালা। দু’একটা বাড়িতে পাতার চাল দেখতে পেল। কোন কোন বাড়ি আবার টিনের বেড়া এবং টিনের চালা বিশিষ্ট। বাড়ি-ঘরের চেহারা দেখে আহমদ মুসার মনে হলো, এ এলাকার মানুষ তুলনামূলকভাবে স্বচ্ছল এবং ক্যামেরুনের এক সমৃদ্ধ এলাকা এটা।
আহমদ মুসা তখন চলছে পুবপাশের পাম গাছ আচ্ছাদিত গ্রাম এবং রাস্তার পশ্চিম পাশের দিগন্ত বিস্তৃত কফি ক্ষেতের মাঝখান দিয়ে। তার গাড়ির ইঞ্জিনের শব্দ এবং মাঝে মাঝে হর্নের আওয়াজ শান্ত ভোরের অখণ্ড নিস্তব্ধতাকে নিষ্ঠুরভাবে যেন ভেঙে দিচ্ছে। চারদিকের ঘুমন্ত নীরব পরিবেশের মাঝে একে খুব বেসুরো মনে হচ্ছে।
আহমদ মুসা হঠাৎ তার সামনের পথ রুদ্ধ দেখতে পেল। একদল লোক দাঁড়িয়ে আছে তার পথ রোধ করে। সুবহে সাদেকের স্বচ্ছতায় তাদের হাতের বর্শা, তীর-ধনুক এবং কয়েকটি বন্দুক বেশ স্পষ্টই দেখা যাচ্ছে।
তারা যেখানে দাঁড়িয়ে আছে, তার বরাবর রাস্তার পুবপাশে একটা চত্বর এবং তারপরেই একটা বড় ঘর। ঘরটি পূর্ব-দক্ষিণে কোণাকুণি করে তৈরি। চত্বরের গেটে কাঠের তৈরি মিনারের মত একটা স্থাপনা। তার মাথায় চারদিকে চারটা মাইক্রোফোনের হর্ন।
আহমদ মুসা দেখেই বুঝল, এটা মসজিদ। এই মসজিদের এই মিনারের হর্নগুলো থেকেই নিশ্চয় দরাজ কণ্ঠের আযান ধ্বনিত হচ্ছিল।
আহমদ মুসা নিশ্চিতই বুঝতে পারল, মসজিদের এত কাছে নিশ্চয়ই ওরা মুসলিম। ওরা তাকে শত্রু ভেবেছে এবং মোকাবিলার জন্যে অস্ত্রসজ্জিতভাবে দাঁড়িয়ে আছে। আহমদ মুসা দেখল, পুরুষদের একটু পেছনে মাথা ও গায়ে কাপড় জড়িয়ে তীর-ধনুক হাতে মেয়েরাও দাঁড়িয়ে আছে।
বিস্মিত হলো আহমদ মুসা, একটা গাড়ির শব্দ শুনে বা একটা গাড়িকে আসতে দেখে এত বড় প্রতিক্রিয়া ওদের মধ্যে হলো কেন!
আহমদ মুসা ওদের কাছাকাছি গিয়ে গাড়ি দাঁড় করাল।
তারপর সে গাড়ি থেকে নামল। এগিয়ে গিয়ে দাঁড়াল গাড়ির সামনে। প্রথমে সবাইকে সালাম দিল। তারপর বলল, ‘আমি একজন বিদেশী। যাচ্ছিলাম ইয়াউন্ডি। আযান শুনে এলাম ফজরের নামায পড়তে।’
সামনে দাঁড়ানো লোকদের মধ্যে দাঁড়িয়েছিল একজন যুবক। বিশ-বাইশ বছরের হবে। পরনে ফুলপ্যান্ট, গায়ে টি-শার্ট। মাথায় টুপি। শুধু সে নয়, পুরুষ সকলের মাথায় টুপি ছিল।
যুবকটি সালাম গ্রহণ করে বলল, ‘আপনার নাম কি? কোন দেশে বাড়ি?’
‘নাম আহমদ মুসা। বাড়ি মধ্য এশিয়ায়।’
‘সূরা বাকারার কয়েকটা আয়াত পড়ুন।’
আহমদ মুসা একটু হাসল। তারপর সূরা বাকারার প্রথম একটা রূকুই মুখস্ত পড়ল।
কোরআন পাঠ শুনে যুবকসহ সকলের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। তাদের সকলের উদ্যত অস্ত্রগুলো নেমে গেছে।
সামনের যুবকটি এসে আহমদ মুসাকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘আমাদের মাফ করুন ভাই। আমরা বড় বিপদে, তাই পরিচিত নয় এমন সবাইকে আমরা সন্দেহ করি, শত্রু ভাবি।’
বলে আহমদ মুসাকে হাত ধরে এনে লোকদের সারির মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকা পাকা চুল ও শ্মশ্রুমণ্ডিত সৌম্যদর্শন বৃদ্ধের সামনে দাঁড় করিয়ে বলল, ‘ইনি আমার আব্বা আবুবকর বিগোভিট। কুন্তা কুম্বে এলাকার ইনি সরদার।’
বৃদ্ধ হাত বাড়িয়ে আহমদ মুসার সাথে হ্যান্ডশেক করল এবং ফরাসি ভাষায় স্বাগত জানাল। বৃদ্ধ তারপর যুবকের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘নামাযের দেরি হয়ে গেছে।’
বলে বৃদ্ধ মসজিদের দিকে পা বাড়াল। তার সাথে সবাই চলল মসজিদের দিকে। যুবকটি আহমদ মুসার হাত ধরে এগিয়ে নিয়ে চলল।
সুন্নাত নামায পড়া হয়ে গেছে সবার। বসে আছে সবাই। সামনে পুরুষরা। মেয়েরা বসেছে পেছনে।
বুদ্ধ আবুবকর বিগোভিট উঠে দাঁড়াল। সবার দিকে একবার তাকিয়ে আহমদ মুসার দিকে চেয়ে বলল, ‘আমাদের ইমামকে আমাদের শত্রুরা পণবন্দী করে রেখেছে। আমি সম্মানিত অতিথিকে নামায পড়াবার জন্যে সবার তরফ থেকে অনুরোধ করছি। তার মত কোরআন পাঠ আমরা কেউ জানি না।’
আহমদ মুসার মনে পড়ল যুবকের উক্তি, ‘আমরা বড় বিপদে, তাই অপরিচিত সবাইকে শত্রু ভাবি।’ এই সাথে ‘শত্রুরা ইমামকে পণবন্দী করে রেখেছে’ শীর্ষক সরদারের কথার মধ্য দিয়ে বড় একটি দুর্ঘটনার আঁচ পেল সে।
কোন কথা না বলে আহমদ মুসা ইমামের আসনে গিয়ে দাঁড়াল।
ইমামের আসনে দাঁড়িয়ে আহমদ মুসার মন আবেগে উদ্বেলিত হয়ে উঠল। আফ্রিকার হৃদয়ের গভীরে ইয়াউন্ডি মালভূমির চিরহরিৎ বনের মধ্যে জ্বলে আছে ইসলামের আলো। কারা কত কষ্ট করে এখানে ইসলামের আলো পৌঁছিয়েছিল কে জানে! আফ্রিকার অজ্ঞাত-অপরিচিত এ কালো মানিক ভাই-বোনদের সাথে নামাযে দাঁড়াতে গিয়ে চোখ দু’টি অশ্রুসিক্ত হয়ে উঠল আহমদ মুসার।
নামাযে কোরআন পাঠের সময় আবেগ আরও উথলে উঠল তার। সূরা আর-রাহমান ও সূরা মুজাম্মিল- এই দুই সূরা দিয়ে দুই রাকাত নামায পড়ল আহমদ মুসা। তার হৃদয় নিংড়ানো ক্বেরাতের মর্মস্পর্শী সুরে প্রত্যেক নামাযীর চোখই অশ্রুসিক্ত হয়ে উঠল।
নামাযের পর অবতারণা হলো এক অভূতপূর্ব দৃশ্যের। প্রথমে বৃদ্ধ আবুবকর এসে জড়িয়ে ধরল আহমদ মুসাকে। বলল, ‘কোরআন শরীফকে আজ নতুন করে চিনলাম, উপলব্ধি করলাম।’
একে একে সবাই এসে আহমদ মুসার হাতে চুমু খেল।
মেয়েরা পেছনে স্থির বসেছিল। তাদেরও চোখ ভেজা। কোরআনের তেলাওয়াত মানুষের মনকে আল্লাহর প্রতি ভয়, ভক্তি, ভালোবাসায় কতখানি উদ্বেলিত করতে পারে, এই অভিজ্ঞতা তাদের এই প্রথম হলো।
আহমদ মুসার একপাশে বসেছিল যুবকটি।
‘তোমার নাম কি?’ আহমদ মুসা তাকে জিজ্ঞেস করল।
‘মুহাম্মাদ ইয়েকিনী।’
‘তুমি যে বিপদের কথা বললে এবং তোমার আব্বা যে তোমাদের ইমাম পণবন্দী থাকার কথা বললেন, এ বিষয়টা আমি জানতে চাই।’
মুহাম্মাদ ইয়েকিনীর চোখ তখনও পানিতে ভরা। সে চোখ দুটো মুছে বলল, ‘ঠিক আছে, আব্বাকে বলছি।’
বলে সে তার আব্বার কাছাকাছি হলো এবং কথা বলল।
বৃদ্ধ আহমদ মুসার কাছে এগিয়ে এল। বলল, ‘সে অনেক কথা। শুনবে আমাদের দুঃখের কাহিনী? শুনতে পার। আবার অপেক্ষা করলে আমাদের সংকটটা দেখতেও পাবে।’
‘কেমন?’
‘শত্রুরা আজ সকাল পর্যন্ত শেষ সময় দিয়েছে। ওরা সকালেই আসবে।’
‘শত্রু আপনাদের কে?’
‘কিংডম অব ক্রাইস্ট (KOC)।’
‘কিংডম অব ক্রাইস্ট?’ কপাল কুঞ্চিত হলো আহমদ মুসার।
‘হ্যাঁ।’
‘তারা কি করেছে, তাদের সাথে কি হয়েছে?’
‘সে অনেক কথা।’ বলে বৃদ্ধ আবুবকর বিগোভিট একটু দম নিল।
তারপর শুরু করলঃ ‘ইদিয়া থেকে ইয়াউন্ডিগামী যে সড়ক দিয়ে তুমি এলে, সে সড়কের দক্ষিণ দিকের গোটা ক্যামেরুন বলা যায় ওরা দখল করে নিয়েছে। কিছু কিছু জমি ও এলাকা মুসলমানদের ও গোত্র ধর্মানুসারীদের এখন রাস্তার আশে-পাশের অঞ্চলে আছে। কিন্তু সেগুলো না থাকার শামিল। তাদের সাধ্য নেই ঐ জমিগুলোর দখল তারা নেয়। দক্ষিণ এলাকার অনেক মুসলমান আমাদের কুন্তা কুম্বে এলাকাতেও এসে আশ্রয় নিয়েছে।
ওদের সাথে আমাদের প্রথম বিরোধ ওদের এক প্রস্তাবকে কেন্দ্র করে। ওরা আমাদের কুন্তা কুম্বে এলাকায় তাদের স্বনির্ভর কর্মসূচি প্রকল্পের জন্যে বিশ একর জমি কিনে নেয়ার প্রস্তাব দেয়। প্রস্তাবে আমরা রাজি হই না। কারণ, ওদের ভূমিদখল কৌশলের এটা প্রথম পদক্ষেপ। তাদের এ ধরনের ফাঁদে পা দিয়ে দক্ষিণ ক্যামেরুনের মুসলমানরা যে ভুল করেছে, তার পুনরাবৃত্তি আমরা করতে চাই না।
ওদের প্রস্তাব গ্রহণ না করায় ওরা ক্ষেপে যায়। এরপর ওরা গোপনে একটা গোত্র-ধর্মানুসারী পরিবারের কাছ থেকে প্রতারণার মাধ্যমে চার একর জমি কিনে নিয়ে একটা গীর্জা তৈরির উদ্যোগ নেয়। জমিটা আমাদের এলাকার মাঝ বরাবর। আমরা তাদেরকে জমি দখল নিতে বাঁধা দেই এবং জমিটা আমাদের একটা মাদ্রাসা-সংলগ্ন বিষয়। জমিটা আমরা কেনার জন্যে দেশের আইন অনুসারে কোর্টে টাকা জমা দেই।
ভীষণ ক্ষেপে যায় ওরা। এর মধ্যে আরেকটা ঘটনা ঘটে। ওদের এলাকার দু’টি গোত্র-ধর্মানুসারী পরিবার স্বেচ্ছায় ইসলাম গ্রহণ করে এবং আমাদের এলাকায় এসে আশ্রয় নেয় সপ্তাহখানেক আগে। কোক(KOC)-এর লোকরা দলবল নিয়ে এখানে আসে এবং ঐ দু’টি পরিবারকে তাদের হাতে তুলে দেবার দাবি জানায়। আমরা তাদেরকে বুঝিয়ে বলি যে, তারা ইসলাম গ্রহণের পর আর তাদের হাতে তুলে দেয়া যায় না। কিন্তু তারা কিছুই শোনে না। তারা তিনদিনের মধ্যে পরিবার দুটোকে তাদের হাতে তুলে দেবার দাবি জানিয়ে চলে যায়।
তাদের দাবি দেশের আইনে বেআইনী বিধায় তিনদিনের মধ্যেই আমরা থানায় মামলা দায়ের করি এবং ঠিক তিনদিনের মাথায় আমাদের ইমামের নেতৃত্বে পাঁচজনকে আমরা কোক(KOC)-এর এলাকায় পাঠাই তাদেরকে একথা বলে আসার জন্যে যে, তারা যেন না আসে।
ইমাম সাহেবরা ওখানে গেলে সব শোনার পর ইমাম সাহেবকে তারা আটক করে। তার সাথী পাঁচজন এতে বাঁধা দিতে গেলে তিনজনকে তারা গুলি করে হত্যা করে। অবশিষ্ট দু’জন কোনমতে পালিয়ে আসে।
পাঁচদিন আগে তারা খবর পাঠিয়েছে, এবার যদি ইসলাম গ্রহণকারী ঐ দু’টি পরিবারকে আমরা ফেরত দেই এবং সেই চার একর জমিসহ তাদের দাবিকৃত বিশ একর জমি ছেড়ে দিতে রাজি হই, তাহলে তারা ইমাম সাহেবকে ছেড়ে দেবে। তাদের এ প্রস্তাবের চূড়ান্ত জবাব জানার জন্যে তারা আজ সকালে আসবে।’
থামল বৃদ্ধ।
‘চার একর জমির ব্যাপারে আপনারা যে টাকা জমা দিয়েছিলেন তার কি হয়েছে?’ বলল আহমদ মুসা।
‘কিছুই হয়নি। ‘কোক’-এর মত খৃস্টান সংগঠনের বিরুদ্ধে মামলা করে কোনই ফল পাওয়া যায় না কোন সময়ই। আইনজীবী, বিচারক কেউই ওদের বিরাগভাজন হতে চায় না।’ বলল বৃদ্ধ।
‘ইমামকে আটক এবং তিনজনকে হত্যা করার পর কোন মামলা দায়ের করা হয়নি?’
‘হয়েছে। কিন্তু পুলিশ ঘটনাস্থল একবার দেখতেও যায়নি।’
‘না যাক, কেস দু’টি করে অত্যন্ত ভাল কাজ করেছেন। ওরা সেদিন এখানে কি নিয়ে এসেছিল? কতজন লোক ছিল সাথে?’
‘দু’টি গাড়িতে করে ওরা সেদিন দশজন এসেছিল।’ বলল বৃদ্ধ সরদার।
‘ওদের সাথে কি অস্ত্র ছিল?’
‘রাইফেল, স্টেনগান।’
‘আপনারা তো অবশ্যই পরিবার দু’টিকে দেবেন না। ওরা সেক্ষেত্রে কি করতে পারে?’
‘ওরা আমাদের ইমাম সাহেবকে ফেরত দেবে না। আবার দু’টি পরিবারকে জোর করে কেড়ে নিয়ে যেতেও চেষ্টা করতে পারে। ওদের অসাধ্য কিছু নেই। থানা-পুলিশ ওদেরই হাতে। কোর্টেও ওদের বিরুদ্ধে কথা বলতে কেউ সাহস করে না।’
‘আপনারা ওদের মোকাবিলা কিভাবে করবেন ঠিক করেছেন?’
‘যে পরিণতিই হোক আমরা তাদের মোকাবিলা করব। ইমাম সাহেবকে আমরা মুক্ত করতে চাই। আবার ঐ দু’টি পরিবারকেও আমরা ফেরত দেব না।’
‘মোকাবিলা কিভাবে করবেন?’
‘ওদের কাছে আধুনিক অস্ত্র আছে। রাইফেল তো আছেই। রিভলভার ও স্টেনগানও আছে। আমরাও আধুনিক অস্ত্র যোগাড়ের চেষ্টা করছি। কিন্তু সমস্যা হলো, ওরা চেষ্টা করছে কোন অস্ত্র-কালোবাজারী যেন আমাদের কাছে অস্ত্র বিক্রি না করে। দ্বিতীয়ত, কালোবাজারে অস্ত্র কিনতে ক্যাশ ডলারের প্রয়োজন হয়। ডলারের বড় অভাব আমাদের।’
‘আত্মরক্ষার জন্যে অস্ত্র প্রয়োজন। কিন্ত নিছক অস্ত্রের উপর নির্ভর করলে ওদের সাথে পারা যাবে না।’
একটু থামল আহমদ মুসা। তারপর বলল, ‘‘কোক’-এর সাথে কোন সংঘর্ষ অতীতে মুসলমানদের হয়েছে?’
‘ব্যক্তিগত পর্যায়ে কেউ তাদের সাথে সংঘাতে গেছে। ব্যাপক পর্যায়ের কোন সংঘর্ষ হয়নি। কৌশলে তারা একেকজনের সম্পত্তি একেকবার গ্রাস করেছে এবং তাদের উচ্ছেদ করেছে। ঐক্যবদ্ধ সংঘাত সৃষ্টি হওয়ার কোন সুযোগই দেয়নি। কারণ, শুরুতে তারা এলাকায় অনুপ্রবেশ করেছে দু’চার খণ্ড জমি কিনে। তারপর বিভেদ সৃষ্টি করেছে এবং এই বিভেদের সুযোগ নিয়ে একজন একজন করে উচ্ছেদ করেছে। বহুদিন পর আমাদের এখানে এসে ওরা একটা সমস্যায় পড়েছে। ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ মোকাবিলা করতে হচ্ছে তাদের। তাই ভীষণ ক্ষ্যাপা তারা।’
‘আজ ওরা এলে কি করবেন আপনারা?’
‘আমরা যদি ওদের কথায় রাজি না হই, তাহলে আজ ওরা সংঘর্ষ বাঁধাতে পারে। সেক্ষেত্রে আমরা আত্মরক্ষা করব।’
‘পুলিশে খবর দিলে তারা কোন ভূমিকা পালন করবে না?’
‘করার কথা। কিন্তু বাস্তবে এ ধরনের সংঘাতে তারা ভূমিকা পালন করে না। একে তারা রাজনৈতিক দাংগা বলে চালিয়ে দেয়।’
‘রাজনৈতিকভাবে এর কোন প্রতিকার করা যায় না?’
‘দেশে একদলীয় শাসন। আমাদের এলাকার এম.পি. একজন গোত্র ধর্মীয় কৃষ্ণাংগ। সে নিরপেক্ষ থাকতে চায়। খৃস্টানদের চটাতে সে ভয় করে। আবার আমাদের বিরোধী সে নয়।’
পুরুষরা সবাই তখনও মসজিদে বসেছিল। দু’একজন ছাড়া মহিলারা সবাই চলে গিয়েছিল।
কথা শেষ করে সরদার আবুবকর বিগোভিট সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘তোমরা সবাই এখন যাও। মসজিদের মিনার থেকে ‘আল্লাহু আকবার’ ধ্বনি দিলে তোমরা এসে যাবে। ওরা আমাদের এলাকায় প্রবেশ করলেই এ ধ্বনি দেয়া হবে।’
সবাই সালাম জানিয়ে চলে গেল।
‘ওরা আপনাদের এলাকায় প্রবেশ করলে জানতে পারবেন কেমন করে?’ বলল আহমদ মুসা।
‘আমাদের সীমান্তে বড় গাছের মাথায় আমাদের পর্যবেক্ষণ টাওয়ার আছে। সেখান থেকে রাতের বেলা আলোকসংকেত দেয়ার ব্যবস্থা আছে এবং দিনের বেলা ধোঁয়া সৃষ্টি করা হয়। আমাদের মসজিদের মিনার থেকে এসব পর্যবেক্ষণের সার্বক্ষণিক ব্যবস্থা রয়েছে।’
কথা শেষ করে বৃদ্ধ আবুবকর বিগোভিট তার ছেলে মুহাম্মাদ ইয়েকিনীর দিকে চেয়ে বলল, ‘মেহমানকে তুমি বাড়িতে নিয়ে যাও। আমি আসছি।’
মুহাম্মাদ ইয়েকিনী উঠল।
উঠল আহমদ মুসাও।
মুহাম্মাদ ইয়েকিনীদের বাড়ি দোতলা। টিনের বেড়া এবং টিনের চাল। নিচের তলায় বসার ঘর।
সেখানে আহমদ মুসা এবং মুহাম্মাদ ইয়েকিনী গিয়ে প্রবেশ করল।
আহমদ মুসাকে বসিয়ে ভেতরে গেল মুহাম্মাদ ইয়েকিনী।
অল্পক্ষণ পর ফিরে এসে বসল মুহাম্মাদ ইয়েকিনী আহমদ মুসার পাশে।
প্রায় তার সাথে সাথে নাশতা নিয়ে প্রবেশ করল একজন তরুণী। বয়স বিশ-একুশ বছর হবে।
তরুণী সালাম দিল ঘরে ঢুকে।
তার পরনে ঢিলা আফ্রিকান পোশাক। মাথায় রুমাল বাঁধা। মুখ ছাড়া গোটা দেহই আবৃত।
আহমদ মুসা অবাক হলো, মুহাম্মাদ ইয়েকিনী এবং তরুণীটির চেহারায় নিগ্রো ছাপ নেই। রং কিছুটা কালো বটে, চেহারার অন্য বৈশিষ্ট্য নিগ্রোদের মত নয়।
তরুণীর দিকে ইংগিত করে মুহাম্মাদ ইয়েকিনী বলল, ‘এ আমার ছোট বোন ‘ফাতেমা মুনেকা’।’
ফাতেমা মুনেকা নাশতা রেখে দাঁড়িয়েছিল।
‘বস ফাতেমা।’ বলল আহমদ মুসা।
ফাতেমা মুনেকা বসলে আহমদ মুসা মুহাম্মাদ ইয়েকিনীর দিকে চেয়ে বলল, ‘তোমরা ক’ভাই বোন?’
‘দু’ভাইবোন আমরা। আব্বা ও আম্মা মিলে চারজন নিয়ে আমাদের সংসার।’
একটু থেমেই আবার সে বলল, ‘আমরা দু’ভাইবোন ইয়াউন্ডি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি। আমি রাষ্ট্রবিজ্ঞানে, আর ফাতেমা পদার্থবিজ্ঞানে।’
আহমদ মুসা কিছু বলতে যাচ্ছিল। এমন সময় মসজিদের মাইক থেকে ‘আল্লাহু আকবার’ শব্দ ভেসে এল।
সঙ্গে সঙ্গে মুহাম্মাদ ইয়াকিনী এবং ফাতেমার মুখ মলিন হয়ে গেল। তারা উঠে দাঁড়াল।
‘উঠলে কেন তোমরা? শত্রু আগমনের সংকেত শুনে?’ বলল আহমদ মুসা।
‘হ্যাঁ, এটাই নিয়ম। নারী-পুরুষ সবাইকে এখন যার যে অস্ত্র আছে তা নিয়ে হাজির হতে হবে মসজিদে।’ মুহাম্মাদ ইয়েকিনীর কথায় উত্তেজনা এবং তার ও ফাতেমার চোখে-মুখে উদ্বেগের চিহ্ন।
আহমদ মুসা হাসল। বলল, ‘দেখ, খাবার পরিবেশিত হলে নামায পড়ারও হুকুম নেই। এর অর্থ, খাবার খেয়ে তারপর নামায পড়তে হবে। অতএব তোমরা বস। খেয়ে তারপর আমরা যাব।’
আহমদ মুসার নিশ্চিন্ত চেহারার দিকে বিস্মিতভাবে তাকিয়ে তারা ধীরে ধীরে বসল।
আহমদ মুসাই ওদের হাতে খাবার তুলে দিল। তারপর নিজে খেতে শুরু করল।
‘আমাদের দেরি দেখলে আব্বা চিন্তা করবেন। আহবান শোনার পর দেরি করা এখানকার নিয়মও নয়।’ খেতে খেতে বলল মুহাম্মাদ ইয়েকিনী।
‘দেরি হবে না, আমরা ঠিক সময়ে পৌঁছব। এখনও ওরা দু’মাইল দূরে আছে। এ রাস্তায় ঘণ্টায় বিশ মাইলের বেশি জোরে গাড়ি আসবে না। সুতরাং, ওরা পৌঁছতে ছয় মিনিটের মত লাগবে। আর আমরা পাঁচ মিনিটের মধ্যে পৌঁছে যাব।’ বলল আহমদ মুসা।
‘অঙ্কটা আপনি কিভাবে কষলেন?’ বিস্মিত কণ্ঠে বলল ফাতেমা।
‘তুমিও পারবে। শত্রুপক্ষকে এ রাস্তায় প্রবেশ করতে দেখেই ওরা সংকেত পাঠিয়েছে। সুতরাং যখন সংকেত এসেছে, ওরা তখন দু’মাইল দূরে ছিল। কাঁচা রাস্তায় ওদের গাড়ির স্পীড বিশ মাইলের বেশি হবে না। অতএব বিষয়টা পরিষ্কার।’
‘কোন বিষয়কে আপনি এত নিখুঁতভাবে দেখেন!’ বলল ফাতেমা।
আহমদ মুসা এ কথার দিকে কান না দিয়ে বলল, ‘চল একটু তাড়াতাড়ি যাই। রাস্তার উপর আমার গাড়িটা সরিয়ে রাখতে হবে। ওরা গাড়ি না দেখাই ভাল।’
ওরা তিনজন চলে এল। আহমদ মুসা তার গাড়িটা রাস্তা থেকে একটা ঝোপের মধ্যে ঢুকিয়ে রেখে চলে এল মসজিদে।
মসজিদ এবং মসজিদের চত্বর তখন ভরে গেছে।
আহমদ মুসারা মসজিদে ঢুকতেই তাকে সবাই সরদারের কাছে যাওয়ার জন্যে জায়গা ছেড়ে দিল।
এলাকার প্রধানদের নিয়ে সরদার আবুবকর তখন করণীয় বিষয় নিয়ে আলাপ করছিল।
আহমদ মুসা বসলে সরদার সবার দিকে একবার চেয়ে বলল, ‘আমরা করণীয় বিষয় নিয়ে আলাপ করছি। সময় বেশি নেই। তুমি সম্মানিত মেহমান। তোমার মূল্যবান পরামর্শ আমরা চাই।’
আহমদ মুসা একটু ভাবল। তারপর উঠে দাঁড়াল। বলল, ‘সম্মানিত ভাই ও বোনেরা। মুহতারাম সরদারের কাছে আমি সব কথা শুনেছি। ‘কোক’ এবং ‘ওকুয়া’দের সম্বন্ধে আমি আগে থেকেই জানি। আপনাদের যদি আপত্তি না থাকে, তাহলে আমি আপনাদের পক্ষ থেকে ওদের সাথে কথা বলতে চাই।’
বলে আহমদ মুসা থামল এবং সরদারের দিকে চাইল। সরদার সবার দিকে চেয়ে বলল, ‘আপনাদের মত আছে?’ সবাই একবাক্যে সম্মতি দিল। তবে সেই সাথে অনেকে বলল, সরদার পাশে থাকবেন এবং ভুল হলে তিনি শুধরে দেবেন।
আহমদ মুসা বলল, ‘ঠিক আছে। তাই হবে। এরপর, আপনাদের সবার কাছে আমার অনুরোধ, তারা আপনাদের এলাকায় আসছে। সুতরাং তারা মেহমান। কথাবার্তায় যাই হোক, তারা আঘাত করতে না এলে আপনারা আঘাত করবেন না।’
আহমদ মুসা থামল। এবং আবার তাকালো সরদারের দিকে। সরদার আবার আগের মত করেই সবার মত চাইলেন। সবাই একবাক্যে সম্মতি দিল।
আহমদ মুসা খুব খুশি হলো এদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের পদ্ধতি দেখে। আফ্রিকার গভীর জংগলে যে গণতন্ত্র সে দেখছে, সভ্য সমাজের শহুরে রাজনীতিকদের মধ্যে এর চিহ্নও দেখা যায় না।
মসজিদ চত্বরের উত্তর পাশে একটা ফাঁকা জায়গায় দু’পক্ষের বসার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
আহমদ মুসাসহ গোত্রের প্রধানগণ সবাই মসজিদ থেকে বেরিয়ে এসেছে। ওদের গাড়ির শব্দ পাওয়া গেল। সরদার এবং অন্যান্য সকলের মুখে উদ্বেগ এসে নতুন করে ছায়া ফেলল। উত্তেজনায় চোখ তাদের চঞ্চল হয়ে উঠেছে।
আহমদ মুসা পেছন ফিরে সকলের উদ্দেশ্যে বলল, ‘ভাই-বোনেরা, আপনারা একটুও ভাববেন না। আল্লাহর সাহায্য আমাদের সাথে আছে।’
দুইটি ছোট মাইক্রোবাস এসে ঠিক মসজিদের সামনে দাঁড়াল।
দাঁড়ানোর সাথে সাথে গাড়ি থেকে স্রোতের মত নেমে এল প্রায় জনা বিশেক মানুষ। ওদের কারও হাতে রাইফেল, কারো হাতে স্টেনগান।
ওরা নেমে সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়াল এবং কয়েক পা এগিয়ে এল আহমদ মুসাদের দিকে।
এদিকে আহমদ মুসা সামনের সারির মাঝখানে দাঁড়িয়েছিল। তার একপাশে সরদার, অন্যপাশে মুহাম্মাদ ইয়েকিনী। তাদের পেছনে অন্যান্য লোকজন। মেয়েরা পাশে মসজিদের চত্বরে দাঁড়িয়ে। তাদের হাতে তীর-ধনুক, কিন্তু নিচু করে রাখা।
আহমদ মুসা কয়েক পা এগোলো। বলল, ‘আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি। আমরা বসার জায়গা করেছি। আসুন, বসুন।’
‘আমরা বসতে আসিনি। আমরা জবাব শুনতে এসেছি।’ আহমদ মুসার স্বাগত সম্ভাষণের কোন জবাব না দিয়ে নিরেট অভদ্রের মত কথাগুলো বলল ওপক্ষের একজন। লোকটি কৃষ্ণাংগ। তবে আশে-পাশের চার-পাঁচজন সবাই শ্বেতকায়।
‘জবাব অবশ্যই আমরা দেব। কিন্তু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলা কি শোভন হবে!’
‘আমাদের কথা বলার কিছু নেই। আমরা জবাব শোনার জন্যে এসেছি। জবাবও খুব বড় হবে না। এক বাক্যে কিংবা এক শব্দেও বলা যায়।’
আহমদ মুসারা এবং ওদের মধ্যেকার দূরত্ব চারগজের মত। ওপক্ষের যে কৃষ্ণাংগ কথা বলছে তার পাশেই দীর্ঘদেহী এক শ্বেতকায় দাঁড়িয়ে। আহমদ মুসার মনে হলো, সেই হলো আসল নেতা। কৃষ্ণাংগকে ব্যবহার করা হচ্ছে। সেই শ্বেতকায়ের দু’পাশে দাঁড়িয়ে দু’জন স্টেনগানধারী।
‘এক কথায় জবাব সব কিছুর হয় না। আমাদের কিছু জানার এবং বলার আছে।’ বলল আহমদ মুসা।
‘আমরা নতুন কোন দরকষাকষি করতে আসিনি। আমাদের প্রস্তাবে রাজি থাকলে এক্ষুণি দু’টি পরিবারকে আমাদের হাতে তুলে দিতে হবে। আর সে দু’টি ভূ-খণ্ডের দখল আমরা যেদিন পাব, সেদিন আপনাদের ইমামকে আমরা ছেড়ে দেব।’
‘আমাদের ইমাম বেঁচে আছেন, তার কি নিশ্চয়তা আছে এবং আপনারা যে কথা রাখবেন, তার কি গ্যারান্টি দেবেন?’
আহমদ মুসা চাচ্ছিল সময় বাড়াতে এবং কোনভাবে আজকের মত আলোচনা স্থগিত রাখতে।
আহমদ মুসার কথা শেষ হতেই দীর্ঘকায় শ্বেতাঙ্গটি মুখ খুলল। বলল, ‘তোমাকে একজন চালাক এশিয়ান মনে হচ্ছে। শোন, আমরা এখানে খোশগল্প করতে আসিনি। আমি এক থেকে তিন পর্যন্ত গুণবো। এর মধ্যে যদি আমি আমার প্রস্তাবের হ্যাঁ সূচক জবাব না পাই, তাহলে পরবর্তী ঘটনার জন্যে আমরা আর দায়ী হবো না।’
তার কথা শেষ হতেই তার দু’পাশের দুই স্টেনগানধারী তাদের স্টেনগান তাক করল আহমদ মুসাদের দিকে।
সরদার আবুবকর এবং মুহাম্মাদ ইয়েকিনী দু’জনেই তাকাল আহমদ মুসার দিকে। আহমদ মুসার দুই রিভলভার তার দুই পকেটে। সে সরদারের দিকে না তাকিয়েই বলল, ‘ধৈর্য্য ধরুন।’
শ্বেতকায় সেই লোকটি ‘তিন’ পর্যন্ত গোণা শুরু করেছে।
এক….
দুই…
দুই বলার সঙ্গে সঙ্গে স্টেনগানধারীদের হাত স্টেনগানের ফায়ারিং পয়েন্টে চলে গেল, লক্ষ্য করল আহমদ মুসা।
সরদার, মুহাম্মাদ ইয়েকিনী এবং পাশের সকলের ব্যাকুল চোখ আহমদ মুসার দিকে নিবদ্ধ। পেছনে সকলের মধ্যে মৃত্যুর নিস্তব্ধতা।
আহমদ মুসার স্থির দৃষ্টি সামনে।
শ্বেতকায় লোকটি উচ্চারণ করল-
তিন…।
স্টেনগানধারী দু’জনের দেহ নড়ে উঠল একটু, এরপরই ছুটে আসার কথা গুলির দেয়াল।
কিন্তু ‘তিন’ বলার সাথে সাথেই আহমদ মুসার দুই পকেট থেকে বিদ্যুৎ গতিতে বেরিয়ে এল দু’টি রিভলভার। সেই সাথে দু’টি গুলি বেরিয়ে এল তার দুই রিভলভার থেকে এবং তক্ষুণিই দেখা গেল, আহমদ মুসার দেহ কুণ্ডলি পাকিয়ে সামনে ছিটকে পড়ল। যখন তার দেহটি উঠে দাঁড়াল, দেখা গেল, তার দুই হাতের দুই রিভলভারের নল সেই শ্বেতকায় ও কৃষ্ণকায় লোক দু’জনের বুকে।
‘তোমরা তোমাদের সব লোককে অস্ত্র ফেলে দিতে বল, নইলে এক্ষুণি দু’জনের বুক এফোঁড়-ওফোঁড় হয়ে যাবে।’ গর্জে উঠল আহমদ মুসার কণ্ঠ তাদের উদ্দেশ্যে।
সেকেন্ডের মধ্যেই এতগুলো ঘটনা ঘটে গেল। ভানুমতির খেলার মত। সেকেন্ডের খেলা যখন শেষ তখন সরদার আবুবকর, মুহাম্মাদ ইয়েকিনী এবং সকলে বিস্ফারিত চোখে দেখল, দুই স্টেনগানধারীর রক্তাক্ত দেহ মাটিতে লুটোপুটি খাচ্ছে এবং তাদের মেহমান দাঁড়িয়ে আছে ওপক্ষের দুই সরদারের বুকে রিভলভার ধরে। এক মুহূর্তেই দৃশ্যপট পাল্টে গেছে। কিন্তু এই অসাধ্য সাধন করল কি করে তাদের মেহমান আহমদ মুসা!
বিস্ফারিত হয়ে উঠেছিল সেই কৃষ্ণকায় ও শ্বেতকায় দু’জনেরও চোখ। প্রথমে তাদের কাছে স্বপ্ন মনে হয়েছে। কিন্তু সাথী দু’জনের রক্তাক্ত লাশ ও রিভলভারের নলের শক্ত স্পর্শ তাদের বলে দিল স্বপ্ন নয়, সবই বাস্তব। আহমদ মুসার চোখের দিকে একবার চেয়েই তারা বুঝেছিল, এ লোকের অসাধ্য কিছু নেই। সুতরাং, আহমদ মুসার কথা শেষ হতেই শ্বেতকায় লোকটি চিৎকার করে উঠল, ‘তোমরা সবাই অস্ত্র ফেলে দাও।’ তার চিৎকার আর্ত-চিৎকারের মত শোনাল।
তার আদেশের সাথে সাথেই তার দলের সবাই অস্ত্র ফেলে দিল।
আহমদ মুসা তাদের বুকে রিভলভার ধরে রেখে উচ্চস্বরে বলল, ‘মুহাম্মাদ ইয়েকিনী, তোমার লোকজন দিয়ে অস্ত্রগুলো কুড়িয়ে নাও। সকলের পকেট সার্চ করবে, রিভলভার থাকতে পারে তাদের পকেটে।’
আদেশের সাথে সাথে মুহাম্মাদ ইয়েকিনী কয়েকজনকে ডাক দিয়ে নিজেই ছুটল। প্রথমে সার্চ করল সেই শ্বেতকায় ও কৃষ্ণাংগ লোক দু’জনকে। তাদের পকেটে রিভলভার পেল।
সমস্ত অস্ত্র সংগ্রহ করে মসজিদের চত্বরে স্তুপীকৃত করা হলো।
রিভলভার পকেটে রেখে আহমদ মুসা হাতে তুলে নিয়েছে স্টেনগান। ওদের দিকে স্টেনগান বাগিয়ে আহমদ মুসা নির্দেশ দিল, ‘তোমরা সবাই উপুড় হয়ে শুয়ে পড়।’
সঙ্গে সঙ্গে সবাই তার নির্দেশ পালন করল।
আহমদ মুসা মুহাম্মাদ ইয়েকিনীকে বলল, ‘তোমরা ওদের সবাইকে পিছমোড়া করে হাত-পা বেঁধে ফেল।’
ওদের সবাইকে বেঁধে ফেলা হলো।
মুহাম্মাদ ইয়েকিনীকে আবার নির্দেশ দিল আহমদ মুসা, ‘ওদের গাড়ির সব জায়গা চেক করে এস।’
গাড়ি থেকে পাওয়া গেল আরও দু’টি স্টেনগান এবং চার বাক্স গুলি।
অস্ত্র ও গোলা-বারুদের দিকে তাকিয়ে পাশের সরদার ও অন্যান্যদের বলল, ‘ওরা ছোটখাট একটা যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়ে এসেছিল।’
‘এতক্ষণ যা দেখলাম, যা দেখছি সব যে সত্য একথা বিশ্বাস করতে মন চাইছে না। অলৌকিক কোন কিছু দেখিনি কোনদিন। আজ চোখের সামনে তা দেখলাম। তোমাকে কি বলে কৃতজ্ঞতা জানাব তা আমি জানি না।’ বলতে বলতে বৃদ্ধের চোখ থেকে ঝর ঝর করে পানি নেমে এল।
বৃদ্ধের মতই সকলের অবস্থা। সকলে আহমদ মুসাকে দেখছে এমন দৃষ্টিতে যেন সে কোন অলৌকিক জীব।
আহমদ মুসা বৃদ্ধ সরদারকে বলল, ‘একখণ্ড ভাল সাদা কাগজ দরকার।’
বৃদ্ধ সরদার তাকাল ইয়েকিনীর দিকে। ইয়েকিনীর পাশেই দাঁড়িয়েছিল ফাতেমা মুনেকা। সে বলল, ‘আমি নিয়ে আসছি ভাইয়া।’ বলে ছুটল বাড়ির দিকে।
একটা প্যাড নিয়ে ফিরে এল ফাতেমা মুনেকা দ্রুত।
প্যাড ও কলম নিয়ে আহমদ মুসা গেল সেই শ্বেতাঙ্গ লোকটির কাছে। খুলে দিল তার হাতের বাঁধন।
উঠে বসল শ্বেতাঙ্গ লোকটি।
আহমদ মুসা তার প্যাড ও কলম এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘লিখুন সেখানকার দায়িত্বশীলকে, পত্রবাহকদের হাতে ইমাম সাহেবকে দিয়ে দিতে। দেরি করবেন না। আমার সময় খুব কম।’
বৃদ্ধ সরদার, মুহাম্মাদ ইয়েকিনী, ফাতেমা এবং আরও কয়েকজন প্রধান ব্যক্তি আহমদ মুসাদের চারদিকে এসে দাঁড়িয়েছিল। তারা বুঝতে পারল আহমদ মুসা কি করতে যাচ্ছে।
শ্বেতাঙ্গ লোকটি প্যাড ও কলম হাতে তুলে নিল। তারপর পরিপূর্ণ দৃষ্টিতে আহমদ মুসার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আপনি কে?’
‘এ প্রশ্নের জবাব আমি দেব না। আপনি লিখুন।’
‘আমি জানি, আমাকে লিখতেই হবে। কিন্তু আপনার মত একজন মানুষ এই প্রথম দেখলাম। বলবেন কি, আপনার নাম কি?’
‘আমার নামও আমি বলব না।’
‘মনে হচ্ছে, কোথাও দেখেছি আপনাকে।’
‘দেখুন, আমি আপনার কোন প্রশ্নেরই জবাব দেব না। লিখুন তাড়াতাড়ি। আর শুনুন, কোন সঙ্কেত পাঠাবার চেষ্টা করবেন না।’
লিখল লোকটি।
প্যাড ও কলম সে ফেরত দিল আহমদ মুসার হাতে। বলল, ‘আপনাদের এ প্রতারণার ফল ভালো হবে না।’
হো হো করে হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘প্রতারণা আমরা করেছি? না আপনাদের প্রতারণা, ব্ল্যাকমেইল ও জঘন্য ষড়যন্ত্রের মোকাবিলার আমরা চেষ্টা করছি? তবে কিছু একটা করব আমরা। সব অন্যায়ের প্রতিবিধান না হওয়া পর্যন্ত তোমাদের ছাড়ব না।’
শ্বেতাঙ্গ লোকটির চোখে চোখ রেখে অত্যন্ত কঠোর কণ্ঠে কথা কয়টি বলল আহমদ মুসা।
লোকটির মুখ ম্লান হয়ে গেল। সে বিশ্বাস করল আহমদ মুসার প্রতিটি কথা।
আহমদ মুসা সরে এল ওদের কাছ থেকে। সরদারকে লক্ষ্য করে বলল, ‘একটু পরামর্শ দরকার, চলুন মসজিদে বসি।’
এলাকার প্রধানগণ সকলে মসজিদে বসল।
দাঁড়াল আহমদ মুসা। বলল, ‘এখন তিনটি আশু করণীয় কাজ আছে। এক, বন্দী লোকদের কোথাও কোন নিরাপদ জায়গায় রাখতে হবে। দুই, পুলিশ স্টেশনে কেউ গিয়ে মামলা দায়ের করে আসতে হবে যে, আমাদের ইমামকে কিডন্যাপ করে রাখার পর ইসলাম গ্রহণকারী দু’টি পরিবারকে ছিনিয়ে নেবার জন্যে ওরা মারাত্মক অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে হামলা করেছিল আমাদের পল্লীতে। রক্তক্ষয়ী সংঘাতের পর ওদের পরাজিত করা হয়েছে। সংঘর্ষে মারা পড়েছে তাদের কয়েকজন নেতা এবং তাদের বেশ কিছু লোক। ওদের চরমপত্রের একটা কপি পুলিশকে দিতে হবে। তিন নাম্বার কাজ হলো, কয়েকজন যেতে হবে ইমাম সাহেবকে খুলে আনতে।’
আহমদ মুসা বলল।
মুখ খুলল আবুবকর বিগোভিট। বলল, ‘আলহামদুলিল্লাহ! এ কাজগুলো আমাদের মাথায় ছিল না। সম্মানিত মেহমানকে মোবারকবাদ। তার প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি এবং আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করছি। আমার এখন মনে হচ্ছে, আল্লাহ মেহমানকে পাঠিয়েছেন এক গুরুতর সঙ্কটে আমাদের সাহায্য করতে। কল্পনা করতে ভয় হয়, তিনি আজ না থাকলে আমাদের কি ঘটত! এখনও আমার মনে হচ্ছে, যা দেখলাম সব যেন স্বপ্ন দেখলাম। বিপর্যয়কে তিনি যেভাবে বিজয়ে পরিণত করলেন, তা কোন মানুষের পক্ষে সম্ভব বলে আমার জানা ছিল না।’
উপস্থিত সবাই আল্লাহু আকবার ধ্বনি দিয়ে উঠল।
বৃদ্ধ সরদার থেমে গিয়েছিল। আবার বলতে শুরু করল, ‘আমাদের যে বন্দীশালা আছে, সেখানে বন্দীরা আপাতত থাকবে। আমাদের এলাকার নিরাপত্তার দায়িত্বশীল ‘আলী ওকোচা’ কয়েকজনকে নিয়ে থানায় যাবেন। ইতোপূর্বের মামলাগুলো তিনিই করেছেন। আর ইমাম সাহেবকে উদ্ধার করতে কে যাবেন, এটা সম্মানিত মেহমান ঠিক করলে ভালো হয়। এই উদ্ধার কাজ কেমন করে কিভাবে হবে তা আমার মাথায় আসছে না।’
থামল বৃদ্ধ।
আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল। বলল, ‘ইমাম সাহেবকে উদ্ধার করতে আমি যাব। আমার সাথে থাকবে দু’জন। তাদের একজন মুহাম্মাদ ইয়েকিনী। আরেকজনকে ঠিক করে দেবেন সরদার।’
আহমদ মুসার পাশেই বসা মুহাম্মাদ ইয়েকিনীর মুখ খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠল। মেহমান নিজে তাকে সঙ্গী হিসেবে নির্বাচন করেছেন- এই আনন্দ তার বুকে ধরছে না। আবেগ-উচ্ছ্বাসে তার দু’চোখের কোণায় অশ্রু দেখা দিল।
আহমদ মুসার কথা শেষ হলে সরদার চারদিকে চেয়ে বলল, ‘হাসান ইকোকু, তুমি দাঁড়াও।’
সঙ্গে সঙ্গে সুগঠিত দেহের একজন বলিষ্ঠ কৃষ্ণাংগ নব্য যুবক উঠে দাঁড়াল। বিনয়ের ভাব তার মুখে, একটা সলজ্জ দৃষ্টি তার চোখে। নিরেট নিগ্রো যুবক সে।
সরদার বলল, ‘খুব ভালো ছেলে হাসান ইকোকু। আমাদের একজন সেনাধ্যক্ষ সে।’
‘খোশ আমদেদ।’ যুবকটির দিকে চেয়ে সহাস্যে বলল আহমদ মুসা।
বৃদ্ধ সরদার আহমদ মুসার দিকে চেয়ে বলল, ‘কিন্তু তিনজনে কি হবে? শত্রুদের একদম মাঝখানে গিয়ে তো পড়তে হবে।’
‘কম লোক যেতে হবে। ওদের বোঝাতে হবে, আমরা যুদ্ধ করতে আসিনি।’
‘কিন্তু কিছু যদি ঘটে?’
‘আল্লাহ্‌ সাহায্য করবেন।’
বৃদ্ধ সরদার আহমদ মুসার পিঠে হাত বুলিয়ে বলল, ‘আলহামদুলিল্লাহ। তোমার কাছ থেকে আল্লাহ্‌ আমাদের অনেক শিক্ষা লাভের সুযোগ দিয়েছেন।’
‘আমাদের এখন ওঠা দরকার।’ বলল আহমদ মুসা।
উঠে দাঁড়াল বৃদ্ধ সরদার।
পরে উঠে দাঁড়াল সবাই।

হাসান ইকোকু মুহাম্মাদ ইয়েকিনীর বাড়ির সামনে দাঁড়িয়েছিল।
ফাতেমা মুনেকা বাইরে থেকে বাড়ির দিকে আসছিল। হাসান ইকোকুকে দেখে সে দাঁড়াল। বলল, ‘ইয়াউন্ডি বিশ্ববিদ্যালয়ে লেকচারার পদে দরখাস্ত করার কথা, করেছ দরখাস্ত?’
‘রাগ করো না, দরখাস্ত আমি করিনি।’
‘করনি? কেন?’
‘বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রফেসারী করার সময় কি আমাদের এটা? ক্রস এবং ক্রিসেন্টের এ লড়াই না মিটলে…।’
ফাতেমা মুনেকা বাঁধা দিয়ে বলল, ‘প্রফেসারী করে এ লড়াই করা যাবে না, কে বলেছে?’
‘সেটা পার্টটাইম হবে। কিন্তু জাতি যে ফুলটাইম চায়। তুমিও কি এটা চাও না মুনেকা?’
ফাতেমা মুনেকার মুখ গম্ভীর হয়ে উঠল। বলল, ‘চাই। কিন্তু লড়াই-এর ক্ষেত্র কি একটাই? বুদ্ধিবৃত্তিক লড়াই কি লড়াই নয়? বুদ্ধিবৃত্তিক লড়াইয়ে আমাদের লোক নেই!’
‘তোমার সাথে আমি একমত মুনেকা। কিন্তু আগ্রাসনের মুখে জাতির অস্তিত্ব যখন বিপন্ন হয়, তখন সশস্ত্র লড়াইটাই অগ্রাধিকার পায়। আমি সেটাই করেছি।’
‘তুমি দরখাস্ত করনি, সে কথা আগে কেন বলনি?’
‘তুমি এটা পছন্দ করবে না, তাই বলিনি।’
‘কেন, জাতিকে আমি ভালোবাসি না?’
‘না, তা আমি বলিনি।’
‘দেখ, আমিও জাতিকে ভালোবাসি। জাতির জন্যে জীবন দিতে হলে তোমার চেয়ে পেছনে থাকবো না। কিন্তু আমি মনে করি, সবার অগ্রাধিকার এক রকমের হওয়া ঠিক নয়।’
‘তুমি ঠিক বলেছ। এ সংকটটা কেটে যাক, তুমি যা চাও তা-ই করব।’
ফাতেমা মুনেকার মুখে একটা সলজ্জ হাসি ফুটে উঠল। বলল, ‘এভাবে কথা বলো না। আমি তোমার পাশে থাকতে চাই, পথপ্রদর্শক হতে চাইনি কখনও।’
হাসান ইকোকু কথার মোড় ঘুরিয়ে নেবার জন্যে বলল, ‘খুশি হওনি, আমি আহমদ মুসার সঙ্গী হতে পারছি অভিযানে?’
‘আমার হিংসে হচ্ছে। তুমি যে সৌভাগ্য পেলে আমার তা জুটল না।’
‘আচ্ছা, আমাদের মেহমান এই আহমদ মুসা কে?’
‘আমারও প্রশ্ন এটা। উনি যে পরিচয়টুকু দিয়েছেন, সেটা আসল পরিচয় নয়। যে বুদ্ধি, যে সাহস এবং যে ক্ষিপ্রতা উনি দেখিয়েছেন, সেটা অলৌকিকের মত। গোটা পৃথিবীতে দু’চারজন লোক এমন থাকে।’
হাসান ইকোকু কিছু বলতে যাচ্ছিল। কিন্তু বলতে গিয়ে থেমে গেল। বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসছে আহমদ মুসা এবং মুহাম্মাদ ইয়েকিনী।
ওরা কাছাকাছি আসতেই ফাতেমা মুনেকা সালাম দিল আহমদ মুসাকে এবং বলল, ‘জনাব, এ ধরনের অভিযানে মেয়েদের অংশগ্রহণ কি নিষিদ্ধ?’
‘না, নিষিদ্ধ নয়। তবে মেয়েদেরকে প্রথমেই আক্রমণকারী শক্তি হিসেবে ব্যবহার করা হয় না। প্রথমে তারা প্রতিরক্ষা শক্তি, পরে তারা আক্রমণকারী শক্তি। আর ছেলেরা সব সময় আক্রমণকারী শক্তি, যদি আক্রমণের প্রয়োজন হয়।’
‘আক্রমণে মেয়েরা দ্বিতীয় পর্যায়ের শক্তি কেন?’
‘ছেলেদের আক্রমণ ব্যর্থ হলে মেয়েরা তাদের সহযোগিতায় আসবে, এটাই সবদিক দিয়ে স্বাভাবিক।’
‘ধন্যবাদ। আমি বুঝেছি। কিন্তু মাঠে যখন লড়াই, তখন ঘরে থাকা কত কষ্টকর বুঝবেন না।’
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘বোন, ঘরে করার মত অনেক কাজ আছে। আমি তোমাকে একটা কাজ দিয়ে যেতে চাই।’
‘কাজ চাওয়ার পরে তো বলছেন!’ ফাতেমা মুনেকার কণ্ঠে অভিমানের সুর।
‘সত্যি ভুলে গিয়েছিলাম। তুমি আমাকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছ।’
‘ধন্যবাদ। বলুন।’ হেসে বলল ফাতেমা মুনেকা।
‘তুমি একটা রিপোর্ট তৈরি কর। এখানকার মুসলিম অধিবাসীরা কি ধরনের জুলুম ও ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছে KOC-এর পক্ষ থেকে, এর প্রতিবিধানের জন্যে তোমরা সরকারের কাছে কিভাবে কতবার গেছ এবং তার কোন ফল হয়নি-এসবসহ ইসলাম ধর্মগ্রহণকারী দু’টি পরিবারকে কিভাবে ফেরত চাইল ওরা, কিভাবে ইমাম সাহেবকে পণবন্দী করল, কি করে দু’টি ভূখণ্ড দাবি করল, কি চরমপত্র তারা দিল এবং সর্বশেষে আজকের ঘটনা- সবই তোমার রিপোর্টে থাকতে হবে।’
বলে আহমদ মুসা পিঠের ব্যাগ থেকে ক্ষুদ্র একটা অটো-ক্যাসেট বের করে ফাতেমা মুনেকার হাতে দিয়ে বলল, ‘রিপোর্ট লেখার পর এই ক্যাসেটে সেটা রেকর্ড করবে। সবশেষে তোমার পরিচয় বলবে, ‘ফাতেমা মুনেকা, ইয়াউন্ডি, ক্যামেরুন, কোডঃ এ, এম-১১ এবং আর, এফ, এ, এম-৮।’’
‘কিন্তু কিছুই বুঝলাম না। রেকর্ড করবো কেন, আমার পরিচয় কি দরকার, কোড নাম্বার কি এবং কেন?’
‘রেকর্ড করবে। কারণ, তোমার এই রেকর্ড যাবে ‘ওয়ার্ল্ড নিউজ এজেন্সী’ (WNA) এবং ‘ফ্রি ওয়ার্ল্ড টেলিভিশন’ (FWTV)-এর কাছে। তোমার পরিচয় দরকার। কারণ, পরিচয়হীন কারও রিপোর্ট তারা পড়েও দেখে না। আর কোড নাম্বার দরকার। কারণ, কোড নাম্বার না হলে তারা রিপোর্ট বিশ্বাস করবে না।’
‘রিপোর্ট কি করবে তারা?’
‘ওয়ার্ল্ড নিউজ এজেন্সী ও ফ্রি ওয়ার্ল্ড টেলিভিশনের মাধ্যমে গোটা পৃথিবীতে তা ছড়িয়ে পড়বে।’
‘আমার এই রিপোর্ট?’
‘হ্যাঁ।’
‘কিন্তু তারা তা করবে কেন? আমার পাঠানো এই রিপোর্টের প্রতি তারা গুরুত্ব দেবে কেন?’
‘এই জন্যে তো কোড নাম্বার।’
‘এ, এম-১১ -এর অর্থ কি?’
‘আহমদ মুসা-১১। এর অর্থ, আহমদ মুসা তার এগারোতম রিপোর্টার হিসেবে ফাতেমা মুনেকাকে রিকমেন্ড করছে।’
‘ঐ দুই নিউজ মিডিয়ার তাহলে আমি সাংবাদিক হয়ে যাব!’ আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠল ফাতেমা মুনেকার চোখ-মুখ।
‘অবশ্যই।’
‘শেষোক্ত কোডটার অর্থ কি?’
‘আর, এফ, এ, এম-৮ -এর অর্থ হলো, আহমদ মুসার পক্ষ থেকে অষ্টম রিপোর্ট।’
‘আগের কোড এবং এই কোডের মধ্যে পার্থক্য বুঝলাম না।’
‘আগেরটা তোমার নিজস্ব সাংবাদিক কোড। আর দ্বিতীয়টা আমার নিজস্ব রিপোর্টের কোড।’
‘কিন্তু রিপোর্টটি তো আমি পাঠাচ্ছি।’
‘তুমি পাঠাচ্ছ বটে। তবে রিপোর্টটি আমার নির্দেশে পাঠানো হয়েছে বলে তারা ধরে নেবে এবং জরুরি ভিত্তিতে তখনই রিপোর্টটা প্রচার করবে।’
‘তাহলে আমাদের নিজস্ব পাঠানো রিপোর্ট এই ধরনের জরুরি বিবেচিত হবে না, তাই না?’
‘তোমাদের রিপোর্টের প্রচার নির্ভর করবে গুরুত্বের উপর। সঙ্গে সঙ্গেও প্রচার হতে পারে, আবার পরেও হতে পারে।’
‘আমরা যদি আপনার কোড ব্যবহার করি?’
‘তা পারবে না। কারণ, আমার কোড এবার ৮ হয়েছে, পরে কত হবে তুমি জানবে না।’
‘বুঝেছি। আরেকটা কথা।’
‘কি?’
‘আপনি আমাকে ঐ দু’টি নিউজ মিডিয়ার সাংবাদিক বানালেন, আপনার রিপোর্টকে ওরা তক্ষুণি প্রচার করবে- এসবের কারণ কি? আপনার সাথে ওদের সম্পর্ক কি?’
‘এসব কথা পরে হবে। এখন সময় নেই। তুমি রিপোর্ট রেকর্ড কর।’ বলে আহমদ মুসা তাকাল মুহাম্মাদ ইয়েকিনীর দিকে। বলল, ‘চল।’
‘আল্লাহ্ হাফেজ হাসান, আল্লাহ্ হাফেজ মুহাম্মাদ ইয়েকিনী।’ বিদায় জানাতে গিয়ে বলল ফাতেমা মুনেকা।
‘সত্যি হিংসে হচ্ছে। এমনভাবে বিদায় কেউ আমাকে দেয় না।’ বলল আহমদ মুসা। হাসি তার মুখে।
‘কেন আব্বা, আম্মা, ভাই, বোন, কিংবা নিজস্ব কেউ নেই আপনার?’
‘যখন ছিল, তখনকার কথা প্রায় ভুলেই গেছি।’
‘বাড়িতে তাহলে কে আছে আপনার?’
‘বাড়ি থাকলে তবেই তো সেখানে কারও থাকার প্রশ্ন আসে।’ হেসে বলল আহমদ মুসা।
কিন্তু এই হাসি ফাতেমা মুনেকা, হাসান ইকোকু ও মুহাম্মাদ ইয়েকিনীর কাছে কান্নার চেয়েও করুণ মনে হলো। বিস্মিত দৃষ্টিতে তারা তাকাল আহমদ মুসার দিকে।
‘এস’ বলে হাঁটতে শুরু করেছে।
‘খোদা হাফেজ, আহমদ মুসা ভাইয়া।’ মুখে হাসি টেনে বলল ফাতেমা মুনেকা।
আহমদ মুসা মুখ ফিরিয়ে ফাতেমা মুনেকার দিকে চেয়ে বলল, ‘ফি আমানিল্লাহ্ বোন।’ আহমদ মুসার ঠোঁটেও হাসি। কিন্তু চোখে নিঃসীম তৃষ্ণার একটা ছায়া। হঠাৎ করেই তার চোখে ভেসে উঠেছিল সিংকিয়াং-এর এক মরু-পল্লীর দৃশ্য। যেখানে নিজেকে সে দেখতে পেল মায়ের কোলে, পিতার বাহুবন্ধনে এবং ছোট ভাই ও বোনের মিষ্টি ডাকে পরিপ্লাবিত অবস্থায়।
আনমনা হয়ে পড়েছিল আহমদ মুসা মুহূর্তের জন্যে। ওদের তিনজনের কারোরই তা নজর এড়াল না।
পরক্ষণেই আহমদ মুসা হেসে উঠল। বলল, ‘স্মৃতির আক্রমণের শিকার হয়েছিলাম। চল।’
বলে হাঁটতে শুরু করল আহমদ মুসা।
মুহাম্মাদ ইয়েকিনী এবং হাসান ইকোকুও হাঁটতে শুরু করল তার পেছনে।
‘কোক’দের নিয়ে আসা একটি গাড়ি নিল আহমদ মুসা।
মাইক্রোবাসটির ড্রাইভিং সিটে বসল সে।
মুহাম্মাদ ইয়েকিনী এবং হাসান ইকোকু বলল পাশের সিটে।
‘ইদেজা, যেখানে আমাদের যেতে হবে, কতদূর হবে?’
‘হাইওয়ে থেকে দক্ষিণে বিশ মাইলের মত হবে।’
‘তোমরা দু’জনেই তো চেন, তাই না?’
‘হ্যাঁ।’ বলল মুহাম্মাদ ইয়েকিনী।
‘তোমাদের দু’জনের কাছে কাগজ-কলম আছে?’
‘আছে।’ বলল তারা দু’জনেই।
‘‘ইদেজা’য় ‘কোক’-এর যে ঘাঁটি, তার বিল্ডিংগুলোর লোকেশন তোমাদের মনে আছে?’
‘আছে।’ বলল তারা একসাথে।
‘তাহলে তোমরা দু’জনে ওদের ঘাঁটির দু’টি স্কেচ আঁক। তাতে যতদূর সম্ভব রাস্তা, ফাঁকা জায়গা, বিল্ডিং, দরজা ইত্যাদির অবস্থান দেখাবে।’
খুশি মনে ওরা দু’জন পকেট থেকে কাগজ বের করে স্কেচ আঁকায় মনোযোগ দিল।
গাড়ি ছুটে চলল দক্ষিণে কোক-এর উত্তরাঞ্চলীয় গুরুত্বপূর্ণ ঘাঁটি ইদেজার উদ্দেশ্যে।
ইয়াউন্ডিগামী হাইওয়েতে উঠার পর হাইওয়ে ধরে কিছুটা পুবে এগিয়ে ইদেজাগামী সড়কে উঠল আহমদ মুসারা। সড়কটি সম্প্রতি পাকা করা হয়েছে।
ইদেজা ছোট একটা শহর।
সুঙ্গা নদীর একটা শাখার তীরে এই শহরটি। শহরের পূর্ব প্রান্তে নদীর তীরে একটা এলাকা জুড়ে ‘কোক’-এর আঞ্চলিক সদর দফতর।
‘কোক’-এর দফতরটির দক্ষিণ পাশ দিয়ে নদী আর উত্তর পাশ দিয়ে ইয়াউন্ডির দিক থেকে আসা সড়ক।
সড়ক থেকে গজ পাঁচেক দূরে একটা বড় গেট। গেটে একটা বড় নামফলকঃ ‘কিংডম অব ক্রাইস্ট’।
গেটটি খোলা। গেটের দু’পারে দু’জন গার্ড দাঁড়িয়ে। তাদের হাতে রাইফেল।
আহমদ মুসার সামনে ড্যাশবোর্ডে হাসান ও মুহাম্মাদের আঁকা দুইটি স্কেচই মেলে রাখা।
স্কেচ দেখেই জায়গাটা আহমদ মুসা ঠিক চিনল।
যে গতিতে আহমদ মুসা সড়ক দিয়ে এসেছিল, সে একই গতিতে সে গেটের দিকে অগ্রসর হলো।
গাড়িটি দেখেই গেটম্যানরা গাড়িটিকে প্রথমে ক্লিয়ারেন্স দিয়েছিল। কিন্তু গেটের কাছাকাছি হলে আহমদ মুসাদের দেখার পর তারা হাত তুলে গাড়ির গতিরোধ করে দাঁড়াল।
গাড়ি দাঁড় করাল আহমদ মুসা।
গেটম্যান দু’জন শ্বেতাংগ।
তারা দু’দিক থেকে দু’জন গাড়ির জানালায় দাঁড়াল।
‘জন স্টিফেন আমাদের পাঠিয়েছেন। তিনি চিঠি দিয়েছেন ফ্রাসোয়া বিবসিয়েরের কাছে।’ বলল আহমদ মুসা।
‘দেখি চিঠি?’ বলল গার্ডদের একজন।
‘চিঠি তো ফ্রাসোয়ার জন্যে, আপনার জন্যে নয়।’
‘কিন্তু আমরা দেখতে পারি।’
‘দেখতে হলে তাকে ডাকুন, তিনিই দেখাবেন।’
গার্ড দু’জন পরস্পরের দিকে তাকাল। তারপর তারা সরে দাঁড়াল গাড়ির রাস্তা থেকে।
ভেতরে ঢুকল আহমদ মুসার গাড়ি।
সামনের দিকে তাকিয়ে বলল আহমদ মুসা, ‘তোমাদের স্কেচ অনুসারে প্রথম গাড়ি বারান্দাই মূল অফিস বিল্ডিং-এর প্রবেশপথ, তাই না?’
‘হ্যাঁ।’ বলল মুহাম্মাদ ইয়েকিনী।
গাড়ি বারান্দায় আহমদ মুসার গাড়ি এসে দাঁড়াতেই করিডোরের মুখে দরজায় দাঁড়ানো স্টেনগানধারী ছুটে এল। বলল, ‘কাকে চাই?’
‘ফ্রাসোয়া বিবসিয়ের। তার জন্যে ‘জন স্টিফেন’-এর চিঠি নিয়ে এসেছি।’
‘ওয়েলকাম। চলুন, তিনি অফিসে।’
স্টেনগানধারী আহমদ মুসাদেরকে এ করিডোর সে করিডোর ঘুরিয়ে একটা দরজার সামনে এনে দাঁড় করিয়ে বলল, ‘এখানেই তিনি বসেন। চেনেন মঁশিয়ে ফ্রাসোয়াকে?’
‘চিনি না।’ বলল আহমদ মুসা।
‘তিনি জন স্টিফেনের ডেপুটি।’
বলে স্টেনগানধারী তার জায়গায় ফিরে গেল।
আহমদ মুসা দরজায় নক করতে গিয়ে থমকে দাঁড়াল। ফিরল হাসান ইকোকু এবং মুহাম্মাদ ইয়েকিনীর দিকে। বলল, ‘হিসেবে একটা ভুল করেছি আমরা।’ একটু আনমনা আহমদ মুসা।
‘কি ভুল হয়েছে?’ উদ্বিগ্ন হাসান ইকোকু প্রশ্ন করল।
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘পেছনের কথা ভেবে আর লাভ নেই। চল, সামনে এগোই।’
দরজায় নক করতেই প্রশস্ত দরজাটি খুলে গেল।
ঘরের ভেতর চোখ পড়তেই আহমদ মুসা দেখল, তিনটি স্টেনগান হা করে তাকিয়ে আছে তাদের দিকে। আর তাদের পেছনে বিশাল টেবিলের ওপারে বিরাট এক রাজাসনে বসে আছে একজন শ্বেতাংগ। আহমদ মুসা ভাবল, এই-ই হবে ফ্রাসোয়া বিবসিয়ের।
শ্বেতাংগ লোকটি হো হো করে হাসতে হাসতে উঠে দাঁড়াল। বলল, ‘তোমরা হাত তুলে দাঁড়াও।’
আহমদ মুসা নিজে হাত তুলল। দেখে মুহাম্মাদ ইয়েকিনী এবং হাসান ইকোকুও হাত তুলল। অপরিসীম উদ্বেগ এবং আশংকা এসে তাদেরকে ঘিরে ধরেছে। তারা তাকাল আহমদ মুসার দিকে। দেখল, আহমদ মুসার মুখে ভয়-ভাবনার কোন চিহ্নই নেই। যেন কিছুই ঘটেনি। বিস্মিত হলো তারা আহমদ মুসার নার্ভের শক্তি দেখে।
ফ্রাসোয়া এগিয়ে এল। আহমদ মুসার সামনে এসে দাঁড়াল। ফ্রাসোয়ার হাতে রিভলভার। বলল আহমদ মুসার দিকে রিভলভার নাচিয়ে, ‘কই চিঠি, দাও? জন স্টিফেনের চিঠি।’
‘তার আর প্রয়োজন নেই মিঃ ফ্রাসোয়া।’ বলল আহমদ মুসা খুব স্বাভাবিক কণ্ঠে।
‘কেন?’
‘চিঠি দিয়ে যে কোন লাভ হবে না তা আপনি প্রমাণ করেছেন।’
‘তবু আমি দেখতে চাই স্টিফেনকে দিয়ে তোমরা কি লিখিয়েছ।’
‘একটাই কথা, আমাদের ইমাম সাহেবকে আমাদের হাতে তুলে দেবেন।’
আবার হো হো করে হেসে উঠল ফ্রাসোয়া। হাসি থামলে বলল, ‘মনে করেছ স্টিফেনকে দিয়ে লিখিয়ে নিলেই আমরা বিশ্বাস করবো?’
‘বিশ্বাস করবেন না তা জানি। কিন্তু চিঠি ছিল আপনার কাছ পর্যন্ত আমাদের পৌঁছার মাধ্যম।’
‘বেশ মজার লোক তো তুমি। কথা বলছ এমনভাবে যেন আমরা দুই বন্ধু। তোমার ভয় করছে না?’
‘ভয় করার মধ্যে কোন লাভ আছে? বিপদ তাতে কিছু কি কমবে?’
‘খুব সাহসের কথা বলেছ। মনে হয়, এ লাইনে তুমি খুব নতুন। ভয়ের কোন কিছু এখনও দেখনি।’
বলে ফ্রাসোয়া মুখ ঘুরিয়ে স্টেনগানধারীদের একজনের উদ্দেশ্যে বলল, ‘তোমরা একজন এসে এদের সার্চ…।’
ফ্রাসোয়া তার কথা শেষ করতে পারলো না। আহমদ মুসা বিদ্যুৎ গতিতে এক ধাপ এগিয়ে ফ্রাসোয়ার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে এক হাত দিয়ে তার হাতের রিভলভার কেড়ে নিয়ে অন্য হাত দিয়ে তার গলা পেঁচিয়ে ধরে তার মাথায় রিভলভারের নল ঠেকিয়ে বলল, ‘ওদের স্টেনগান ফেলে দিতে বল ফ্রাসোয়া। দ্বিতীয়বার নির্দেশ দেব না। তার বদলে তোমার মাথা ছাতু হয়ে যাবে।’
ঘটনার আকস্মিকতায় ফ্রাসোয়ার দু’চোখ ছানাবড়া হয়ে গেছে। সে নির্দেশ দিল তার তিনজন লোককে স্টেনগান ফেলে দেবার জন্যে।
ওরা স্টেনগান ফেলে দিতেই মুহাম্মাদ ইয়েকিনী ও হাসান ইকোকু দৌঁড়ে গিয়ে স্টেনগানগুলো কুড়িয়ে নিল।
‘ধন্যবাদ তোমাদের। তোমরা এখন তিনজনকে ঘরে ঢোকাও।’ মুহাম্মাদ ইয়েকিনী ও হাসান ইকোকুকে উদ্দেশ্য করে বলল আহমদ মুসা।
ইয়েকিনী ও ইকোকু স্টেনগান বাগিয়ে ওদের ঘরে ঢোকাল। দু’হাত তুলে সুবোধ বালকের মত ওরা ঘরে ঢুকল।
আহমদ মুসা ফ্রাসোয়ার মাথায় রিভলভার ধরে রেখেই তাকে ঠেলে নিয়ে ঘরে ঢুকল।
দরজা বন্ধ করে দিল। বলল ইয়েকিনীদের উদ্দেশ্য করে, ‘টেবিলে ঐ দেখ কস্টিক টেপ। ওদেরকে বেঁধে ফেল।’
হাসান ইকোকু স্টেনগান ধরে ওদের পাহারা দিল। আর ইয়েকিনী পিছমোড়া করে ওদের হাত-পা বেঁধে ফেলল।
এবার আহমদ মুসা ফ্রাসোয়াকে ছেড়ে দিল। বলল, ‘তুমি টেবিলের উপর বস।’
বসল ফ্রাসোয়া টেবিলের উপর। ভয়ার্ত দু’টি চোখ তার।
আহমদ মুসা তার বুকের উপর রিভলভার নাচিয়ে বলল, ‘দেখ মিঃ ফ্রাসোয়া, আমার হাতে সময় খুব কম। একটা আদেশ একবার করব এবং তা তুমি তামিল করবে। অন্যথা হলে রিভলভারের বুলেট এর জবাব দেবে।’ বলল আহমদ মুসা ফ্রাসোয়ার চোখের দিকে স্থিরভাবে তাকিয়ে।
‘ইমাম সাহেব কোথায়?’ জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা।
ফ্রাসোয়া ভয়ার্ত চোখে তাকাল আহমদ মুসার দিকে। ঠোঁট তার নড়ল, কিন্তু কথা বলল না।
আহমদ মুসার সাইলেন্সার লাগানো রিভলভারের নল বিদ্যুৎ গতিতে উঠে এল। নিঃশব্দে অগ্নি উদগীরণ করল। ফ্রাসোয়ার বাম কানের একাংশ নিয়ে তা বেরিয়ে গেল।
কান চেপে ধরে ফ্রাসোয়া বলল, ‘বলছি। আমাকে মের না তোমরা।’
ইয়েকিনী এবং হাসান অবাক বিস্ময় নিয়ে তাকাল আহমদ মুসার দিকে। আহমদ মুসার এই চেহারা তাদের কাছে নতুন।
একটু থেমে ফ্রাসোয়া আবার শুরু করেছিল, ‘এই বিল্ডিং-এর একটা আন্ডারগ্রাউন্ড ঘরে বন্দী আছে।’
‘সেখানে নামার পথ কোথায়?’
ফ্রাসোয়া আহমদ মুসার দিকে এক পলক তাকিয়ে ত্বরিত জবাব দিল, ‘পাশের হল ঘর থেকে একটা সিঁড়ি নেমে গেছে আন্ডারগ্রাউন্ডে।’
‘পাশের হল ঘরে যাবার রাস্তা কোন দিকে?’
তার অফিস ঘরের একটা পার্টিশন ডোরের দিকে ইংগিত করে বলল, ‘ঐ দরজা দিয়ে হল ঘরে যাওয়া যাবে।’
‘মিঃ ফ্রাসোয়া, উঠে দাঁড়াও। তোমাকে আমাদের সাথে যেতে হবে আন্ডারগ্রাউন্ডে। কোন চালাকির সামান্য ইংগিত পেলে তোমার মাথা গুঁড়ো হয়ে যাবে।’
বলে আহমদ মুসা ইয়েকিনীকে নির্দেশ দিল, ‘এ অফিস ঘরের বাইরের দরজাটা লক করে দাও। তোমরা দু’জন চারদিকে চোখ রেখে স্টেনগান নিয়ে আমাদের পেছনে পেছনে এস। কোন মানুষকে দেখলে নির্বিচারে গুলি চালাবে।’
ফ্রাসোয়াকে নিয়ে আহমদ মুসা হল রুমে প্রবেশ করল। দেখেই আহমদ মুসা বুঝল, এটা সভা কক্ষ। অনেকগুলো দরজা চারদিকে।
আহমদ মুসা হল রুমে ঢুকেই ইয়েকিনী ও ইকোকুকে বলল, ‘তোমরা হল রুমের প্রত্যেকটা দরজা লক করে দাও।’
আন্ডারগ্রাউন্ডে নামার সিঁড়িপথটা একটা দরজার আবরণে ঢাকা। দরজা খুলতেই সিঁড়ি বেরিয়ে পড়ল।
সিঁড়ি দিয়ে আন্ডারগ্রাউন্ডে নামল তারা। আন্ডারগ্রাউন্ডে কোন প্রহরী দেখা গেল না।
ফ্রাসোয়া রাস্তা দেখিয়ে নিয়ে গেল ইমাম সাহেবের কক্ষে।
ইমাম সাহেব মধ্যবয়সী মানুষ। কৃষ্ণাংগ। স্বাস্থ্য সুন্দর। থুতনিতে অল্প একটু দাড়ি। উজ্জ্বল ও বুদ্ধিদীপ্ত চোখ। পবিত্র চেহারা। দেখলেই বোঝা যায়, একজন আল্লাহওয়ালা লোক।
প্রথমেই ইমাম সাহেব ফ্রাসোয়া এবং আহমদ মুসাকে দেখতে পেয়েছিল। ফ্রাসোয়ার মাথায় অপরিচিত একজন লোককে রিভলভার ধরে রাখার দৃশ্য দেখে সে ভীত হয়ে পড়েছিল। কিন্তু পেছনে ইয়েকিনী ও হাসানকে আসতে দেখে তার মুখে হাসি ফুটে উঠেছিল। সে ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরল ইয়েকিনী ও হাসানকে। আনন্দের অশ্রু এসে জমেছিল ইমাম সাহেবের দুই চোখে।
ইমাম সাহেবকে নিয়ে তারা ফিরে এল ফ্রাসোয়ার সেই অফিস কক্ষে।
মেঝেয় পড়ে থাকা তৃতীয় স্টেনগানটি তুলে নিয়ে কাঁধে রাখল আহমদ মুসা। তারপর সে ইয়েকিনী ও হাসানকে বলল, ‘তোমরা পেছনটা দেখবে।’
বলে আহমদ মুসা রিভলভারের নল দিয়ে ফ্রাসোয়ার কাঁধে একটা খোঁচা দিয়ে বলল, ‘দরজা খুলুন।’
দরজা খুলে দিল ফ্রাসোয়া।
আহমদ মুসা ফ্রাসোয়ার ঠিক পেছনে দাঁড়িয়ে। তার রিভলভারের নল ফ্রাসোয়ার মাথায়।
দরজা খুলতেই আহমদ মুসা দেখল, উদ্যত স্টেনগান হাতে দু’জন দাঁড়িয়ে।
‘স্টেনগান তোমরা ফেলে দাও।’ বলল আহমদ মুসা।
স্টেনগান তাদের হাত থেকে পড়ল না।
আহমদ মুসার বাম হাত বেঁকে গিয়ে পেঁচিয়ে ধরল ফ্রাসোয়ার গলা এবং ডান হাতে ধরা তার রিভলভার সরে গেল তার মাথা থেকে। পর পর দু’বার গুলি বর্ষণ করল তার রিভলভার। স্টেনগানধারী দু’জন গুলিবিদ্ধ হয়ে পড়ে গেল দরজার সামনেই।
রিভলভার দিয়ে ফ্রাসোয়াকে সামনের দিকে ঠেলে দিয়ে বলল, ‘এগোন সামনে, চলুন গাড়ি বারান্দায়।’
একটু থেমেই আহমদ মুসা আবার বলল, ‘ইয়েকিনী, হাসান, স্টেনগান দু’টি তুলে নাও। শত্রুকে যত নিরস্ত্র করা যায়, ততই ভাল।’
ইয়েকিনী ও ইকোকু স্টেনগান দু’টি তুলে নিয়ে কাঁধে ঝোলাল।
এগিয়ে চলল ছোট দলটি গাড়ি বারান্দার দিকে।
আহমদ মুসা ফ্রাসোয়ার ঠিক পেছনে। তার রিভলভারের নল ফ্রাসোয়ার পিঠে সেঁটে আছে।
আহমদ মুসার পেছনেই ইমাম সাহেব।
ইমাম সাহেবের পেছনেই স্টেনগান বাগিয়ে পেছন ফিরে হাঁটছে মুহাম্মাদ ইয়েকিনী এবং হাসান ইকোকু। চোখে তাদের সতর্ক দৃষ্টি। মুখে তাদের প্রসন্ন ভাব, কোন উদ্বেগের চিহ্ন সেখানে নেই। তাদের এই ধরনের অভিযান এই প্রথম, তবু তাদের মনে হচ্ছে, এই এক অভিযানে এসে আহমদ মুসার কাছে তারা এত কিছু শিখেছে যা বছরের পর বছরের চেষ্টায় শেখা সম্ভব ছিল না। এই সাংঘাতিক অবস্থাতেও তাদের মনে কোন উদ্বেগ নেই। কারণ, ইতোমধ্যেই তাদের বিশ্বাস জন্মেছে, তারা এমন একজন লোকের সাথী যিনি অলৌকিক বুদ্ধি, শক্তি ও সাহসের অধিকারী।
করিডোরের শেষ প্রান্তে গিয়ে পৌঁছল আহমদ মুসারা। এরপরেই বারান্দা, তারপর সিঁড়ির তিন ধাপ নামলেই গাড়ি বারান্দা।
বারান্দায় করিডোরের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল আরও চারজন স্টেনগানধারী।
আহমদ মুসা বাম হাত দিয়ে ফ্রাসোয়ার গলা পেঁচিয়ে ধরে রিভলভারের নল দিয়ে ফ্রাসোয়ার মাথায় একটা চাপ দিয়ে বলল, ‘তোমার লোকদের নির্দেশ দাও স্টেনগানগুলো মাইক্রোবাসের সামনে রাখতে।’
আহমদ মুসাকে ইতোমধ্যেই চিনে ফেলেছে ফ্রাসোয়া। সুতরাং আহমদ মুসার নির্দেশের সংগে সংগেই সে তার লোকদের মাইক্রোবাসের সামনে নিয়ে অস্ত্র রাখার নির্দেশ দিল।
ওরা চারজন অস্ত্র রাখার জন্যে মাইক্রোবাসের দিকে চলল। আহমদ মুসাও ফ্রাসোয়াকে নিয়ে তাদের পেছন পেছন গাড়ি বারান্দায় নেমে এল।
ওরা অস্ত্র রাখলে ওদের উপুড় হয়ে শুয়ে পড়তে নির্দেশ দিল আহমদ মুসা। সংগে সংগেই ওরা নির্দেশ তামিল করল।
আহমদ মুসা গাড়ির আড়ালে এসে ইয়েকিনীকে গাড়ির গোটা ভেতরটা এবং ইঞ্জিনের স্টার্টার পরীক্ষা করতে বলল।
ইয়েকিনী সবটা পরীক্ষা করে বলল, ‘ঠিক আছে ভাইয়া।’
‘তাহলে স্টেনগানগুলো এবং ইমাম সাহেবকে তুলে নাও গাড়িতে।’
ওরা উঠলে আ্হমদ মুসা ফ্রাসোয়াকে টেনে নিয়ে সামনের সিটে উঠে এল। আহমদ মুসা ড্রাইভিং সিটে বসল এবং ফ্রাসোয়াকে তার পাশে সামনের সিটে বসাল।
হাসান ইকোকু বাইরে স্টেনগান বাগিয়ে চারদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখছিল।
আহমদ মুসা ইঞ্জিনের সবকিছু ঠিকঠাক আছে কিনা দেখে নিয়ে বলল, ‘হাসান ইকোকু, তুমি উঠে এসে ফ্রাসোয়ার পাশে বস।’
হাসান ইকোকু উঠে এসে ফ্রাসোয়ার পাশে বসল। আহমদ মুসা সুইচ টিপে সবগুলো দরজা লক করে দিল।
তারপর হাতের রিভলভারটা ড্যাশবোর্ডের উপরে রেখে ফ্রাসোয়ার দিকে মুখ ফিরিয়ে বলল, ‘আশা করি, কোন চালাকির চেষ্টা করবেন না।’
আহমদ মুসা গাড়ি ঘুরিয়ে ছুটে চলল গেটের দিকে।
দূর থেকে আহমদ মুসা দেখল, গেটের দরজা বন্ধ।
আহমদ মুসা কার-মাইক্রোফোনের সুইচ বাম হাতে অন করে বাম হাতেই স্পীকারটা ফ্রাসোয়ার হাতে তুলে দিয়ে বলল, ‘তোমার গার্ডদের বলে দাও গেট খুলে দিতে।’
গাড়ি ততক্ষণে গিয়ে দাঁড়িয়েছে একেবারে গেটের সামনে।
রাইফেলধারী গার্ড দু’জন গেটের পাশে ফ্রাসোয়ার দিকে ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল।
আহমদ মুসা মাইক্রোফোনের স্পীকার ফ্রাসোয়ার হাতে তুলে দেবার সাথে সাথে সে গেট খুলে দেবার নির্দেশ দিল।
গেট খুলে গেল।
শাঁ করে বেরিয়ে এল গাড়ি গেট দিয়ে। উঠে এল হাইওয়েতে।
আহমদ মুসা তার রিয়ার ভিউতে দেখল, আরেকটা গাড়ি কোক-এর গেট দিয়ে বেরিয়ে এসে তাদের পেছনে পেছনে হাইওয়েতে উঠল।
আহমদ মুসা আবার স্পীকারটা ফ্রাসোয়ার হাতে তুলে দিয়ে বলল, ‘তোমাদের গাড়ি পিছু নিয়েছে আমাদের। গাড়িটাকে ফিরে যেতে বল। না হলে গাড়ি আমি ওদের দিকে ঘুরিয়ে নেব। তোমাদের আরো লোকের প্রাণ যাবে, গাড়িটাও নষ্ট হবে, ফলে কিছুই করতে পারবে না।’ শান্ত অথচ কঠোর তার কণ্ঠ।
ফ্রাসোয়া আগের মত করেই তাদের গাড়িকে ঘাঁটিতে ফিরে যেতে নির্দেশ দিল।
অল্পক্ষণের মধ্যেই গাড়িটাকে আবার ঘাঁটির দিকে ফিরে যেতে দেখা গেল।
‘ধন্যবাদ ফ্রাসোয়া। এ ধরনের সহযোগিতা যদি করেন এবং অতীতের পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে রাজি হন, তাহলে আপনাদের সাথে আমাদের সহজেই ‘নো-ওয়ার’ প্যাক্ট হতে পারে।’ বলল আহমদ মুসা।
‘আমাকে কোথায় নিয়ে যাবেন?’
‘কেন, জন স্টিফেনের সাথে কিছুদিন আমাদের মেহমান হতে আপত্তি আছে?’
‘আপনি কে জানি না, কিন্তু এটাই শেষ ঘটনা নয় মনে রাখবেন।’
‘কোন ঘটনাই শেষ ঘটনা নয়। তবে ভবিষ্যতের ঘটনা অতীতের মতই ঘটতে থাকবে, এমনটা ভাবাও ঠিক হবে না।’
‘দেখুন, আপনি সব জানেন না, কিংডম অব ক্রাইস্ট (KOC) একা নয়।’
‘তা আমি জানি, ‘ওকুয়া’ আছে, ‘ব্ল্যাক ক্রস’ আছে।’
‘‘ব্ল্যাক ক্রস’-এর কথা আপনি জানেন কি করে?’
‘জানা কি অসম্ভব?’
‘অসম্ভব নয়, কিন্তু ব্ল্যাক ক্রস-এর সাথে আমাদের সম্পর্ক আছে, এটা জানলেন কি করে?’
‘সেটাও কি জানা অসম্ভব?’
‘অসম্ভব নয়, কিন্তু একটু অস্বাভাবিক বৈকি! এটা খুবই গোপন ব্যাপার।’
‘দেখুন, আপনাদের কোন আঁতাত, কোন ষড়যন্ত্রই গোপন নেই।’
‘তা বুঝতে পারছি। কিন্তু আপনি… আপনি কে?’
‘সময়ে সবই জানতে পারবেন।’ কথা শেষ করে আহমদ মুসা সামনের দিকে মনোযোগ দিল। এবং মুহাম্মাদ ইয়েকিনী ও হাসান ইকোকুকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘আমরা জন স্টিফেনের চিঠি নিয়ে ইমাম সাহেবকে উদ্ধার করতে গিয়ে কি ধরনের আতিথ্য পেলাম, তা তোমরা কেউ লিখে ফেলো। ফাতেমা মুনেকার রিপোর্টের সাথে এটা যুক্ত করা যাবে।’
মুহাম্মাদ ইয়েকিনী ও হাসান ইকোকু আহমদ মুসা এবং ফ্রাসোয়ার মধ্যেকার কথাবার্তা উদগ্রীব হয়ে শুনছিল। তাদের কাছে আরও পরিষ্কার হয়ে গেল, তাদের মেহমান আহমদ মুসা ‘কোক’, ‘ওকুয়া’দের জানে আগে থেকেই অনেক বেশি। এমনকি ‘ব্ল্যাক ক্রস’, যার নাম তারা শোনেনি, তাকেও আহমদ মুসা জানে। এসব নতুন করে জানার পর ফ্রাসোয়ার মত তাদের মনেও এ প্রশ্নটা খুব বড় হয়ে দেখা দিল, তাদের এই অতিথি আসলে কে? তাদের আরও মনে হলো, ক্যামেরুনের মুসলমানদের সাহায্যের জন্যে তারা ‘ক্যামেরুন ক্রিসেন্ট’ নামে যে যুব সংগঠন গড়ে তুলেছে, তার জন্যে এ রকম একজনের নেতৃত্ব পেলে মুসলমানদের বাঁচানো যেত ‘ক্রস’–এর আগ্রাসন থেকে।
আহমদ মুসার কথা তাদের চিন্তায় ছেদ নামাল। তারা একটু নড়ে-চড়ে বলল, ‘ঠিক আছে ভাইয়া।’
তাদের এই উত্তর আহমদ মুসার কানে বোধ হয় পৌঁছল না। তার মনে তখন অন্য চিন্তা। ক্রস যে সংঘাত চাপিয়ে দিয়েছে ক্রিসেন্টের উপর, সে রক্তক্ষয়ী সংঘাত অন্ধকার আফ্রিকায় কোন ইতিহাসের সৃষ্টি করবে! ইসলামের আলো আফ্রিকার অন্ধকার বুকে যে আলোর বন্যা সৃষ্টি করেছিল, তাকে কি আবার এবং আরও প্রোজ্জ্বলতর করে তোলা যাবে না!

Top