২. অপারেশন তেলআবিব-২

১২

ঘুম ভেঙে গেল আহমদ মুসার।
ধাতব একটা ক্ষীণ শব্দ কানে আসছে।
ক্ষীণ হলেও এই শব্দেই তার ঘুম ভেঙে গেছে, বুঝল আহমদ মুসা।
ঘুম ভেঙে গেলেও চোখ খোলেনি।
বন্দী সেলে তখন তীব্র আলো। চোখ ধাঁধিয়ে যাওয়ার মত আলো। এরকম আলোর মধ্যে চোখ বন্ধ করে রাখলেই সুবিধা। তাছাড়া শব্দটার গতি কি হয় সেটাও সে আঁচ করতে চায়। সে বুঝতে পারছে, শব্দটা তার সেলের দরজা থেকে। তার মানে দরজায় কেউ আছে। চোখ খুললেই সে জেনে যাবে, আমি জেগে আছি। শত্রু বা লোকটির টার্গেট সম্পর্কে আরও একটু না জেনে সে তার অবস্থা তাকে জানাতে চায় না।
হ্যাঁ, ওটা দরজা থেকে আসাই শব্দ।
কে হতে পারে ওখানে?
পুলিশ কর্তৃপক্ষের কেউ? কিন্তু ওরা আসবে কেন? তোয়া সিটি পুলিশের প্রধানসহ কয়েকজন অফিসার একবার তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে গেছে। আহমদ মুসাকে তারা গুরুতর সন্দেহ করেছে। তার পাসপোর্ট ও কাগজপত্রকে তারা বানানো বলে মনে করেছে। তারা পরিষ্কার মন্তব্য করেছে, আমার চেহারা ও কথাবার্তার সাথে পাসপোর্ট ও কাগজপত্রের চরিত্রের মিল নেই। পুলিশ প্রধান ও গোয়েন্দা প্রধানগণ গুরুত্বপূর্ণ মিটিং-এ ব্যস্ত ছিল তারা আসতে পারেননি। তাই চূড়ান্ত জিজ্ঞাসাবাদ ও সিদ্ধান্তের ব্যাপারটা ঝুলে আছে। আসছে সকালে তার চূড়ান্ত জিজ্ঞাসাবাদ হবে। আহমদ মুসাও সেই সময়কে মুক্তি ও কাজ শুরুর মুহূর্ত হিসেবে ঠিক করেছে। জিজ্ঞাসাবাদের সময় সরে পড়ার চিন্তা সে করেছিল। কিন্তু সেলের গেটে চারটি তালা এবং একটু দূরে চারজন পুলিশ পাহারা থাকায় সে চেষ্টা আপাতত সে ত্যাগ করেছে। ভোর রাতে সে একবার উদ্যোগ নেবে, ভেবে রেখেছে। কিন্তু এর মধ্যে আবার দরজায় কে এলো?
নতুন শব্দ পেল আহমদ মুসা। সেলের দরজার হুক খোলার শব্দ।
হুক খুলে গেল দরজার।
দরজা খোলারও মোটা একটা ধাতব শব্দ হলো।
নিশ্চয় লোকটা আসছে।
রুদ্ধ নিঃশ্বাসে অপেক্ষা করছে আহমদ মুসা। আগে থেকেই ঘাড়ের পেছনে জ্যাকেটের গোপন পকেটে রিভলবার ঢোকানো আছে।
‘মি. গনজালেস, মি. গনজালেস’ একটা চাপা কন্ঠের ডাক তার কানে এল। ডাকটা নারী কণ্ঠের। নিনা নাদিয়া কি?
চোখ খুলল আহমদ মুসা।
হ্যাঁ, নিনা নাদিয়াই তার দিকে ঝুঁকে পড়ে বসে আছে।
আহমদ মুসা উঠে বসল।
নিনা নাদিয়া দাঁড়িয়ে গেল। বলল, তাড়াতাড়ি আসুন। বেরোতে হবে তাড়াতাড়ি।
বলে নিনা নাদিয়া সেলের বাইরে যাওয়ার পথ ধরল।
তার সাথে আহমদ মুসাও সেলের বাইরে বেরিয়ে এল। দেখল সে, চারজন পুলিশ টেবিলে মাথা রেখে ঘুমুচ্ছে।
আহমদ মুসাকে পুলিশের দিকে তাকানো দেখে নিনা নাদিয়া হেসে বলল, ওদের মদে ঘুমের ওষুধ মেশানোর ব্যবস্থা করেছিলাম।
তারা পুলিশের টেবিল অতিক্রম করে ঘর থেকে বেরোনোর করিডোরের কাছাকাছি এসে পৌছেছে, এ সময় অনেকগুলো বুটের শব্দ খুব কাছ থেকে তাদের কানে এল।
দু’জন তাকাল পরষ্পরের দিকে।
আহমদ মুসা নিনা নাদিয়াকে ইংগিত করল আড়ালে সরে যাওয়ার জন্যে। সংগে সংগেই নিনা নাদিয়া পাশের দরজা দিয়ে একটা ঘরে ঢুকে গেল।
আর কিছু ভাবনা-চিন্তা করার আগেই পাঁচজন পুলিশ এসে দরজায় দাঁড়াল। তাদের হাতে ষ্টেনগান। একজন অফিসারের হাতে একটা রিভলবার।
আহমদ মুসা তাদের দেখেই মুহূর্তে ঘাড়ের পেছনে জ্যাকেটের গোপন পকেট থেকে রিভলবার বের করে তাদের দিকে তাক করে বলল, তোমরা হাতের অস্ত্র ফেলে না দিলে গুলী করব।
ওরা আহমদ মুসাকে গুলী করার মুডে ছিল না। এরকম বোধ হয নির্দেশ ছিল না। যেহেতু তারা সংখ্যায় বেশি, তাই বোধ হয় তারা মনে করেছিল, তাদের দেখেই বন্দী আত্মসমর্পণ করবে। যে লোক বন্দী হয়ে আসতে সামান্য আপত্তিও করেনি, তার কাছ থেকে এটাই আশা করা যায়। এই ধারণা থেকে পুলিশ অফিসারসহ পুলিশরা বন্দীকে দেখেই তাকে গান-পয়েন্টে আনেনি। বন্দী নিরস্ত্র হওয়াও পুলিশদের অপ্রস্তুতির কারণ ছিল।
আহমদ মুসার রিভলবার এই সুযোগ গ্রহণ করেছে।
কিন্তু আহমদ মুসার কথা ও তার উদ্যত রিভলবারের নলের প্রতি তেমন গুরুত্ব না দিয়ে আহমদ মুসা লক্ষ্যে ষ্টেনগান ও রিভলবারের নল দ্রুত তুলে নিচ্ছিল। বন্দী একটা রিভলবার দিয়ে পাঁচজন পুলিশকে গুলী করতে সাহস পাবে, তা তারা মনেই করেনি।
আহমদ মুসা যা বলেছিল তাই করল।
তার ‘ব্ল্যাক ক্যানন’ পুলিশ অফিসারসহ সব পুলিশের ওপর দিয়ে ঘুরে এল।
মাত্র কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধান। পাঁচ পুলিশের লাশ পড়ে গেল করিডোরের ওপর।
মিস নিনা নাদিয়া বেরিয়ে………….।
কথা শেষ করতে হলো না আহমদ মুসাকে। বেরিয়ে আসছিল নিনা নাদিয়া। সব কিছুই সে দেখেছে। মুহূর্তের জন্যে মুখটা বিষণ্ণও হয়ে উঠেছিল।
তবু বেরিয়ে এসেই বলল সে আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে, আপনি দেখছি অসাধ্যও সাধন করতে পারেন মি. গনজালেস। সাহস, ক্ষীপ্রতা, কৌশল, লক্ষ্যভেদ সব দিক থেকেই আপনি দেখছি অদ্বিতীয়!
এসব কথার দিকে কান না দিয়ে আহমদ মুসা বলল, এখন কি করতে হবে বলুন।
আসুন। ওরা জানতে পেরেছে, সামনে দিয়ে আর বের হওয়া যাবে না। পেছন দিক দিয়ে বের হওয়ার গোপন পথ আছে, আসুন। বলল নিনা নাদিয়া।
বলে নিনা নাদিয়া দৌড়াতে শুরু করল। পেছনে আহমদ মুসা।
গভীর রাত, বিভিন্ন পয়েন্টে প্রহরী আছে। তাদের মধ্যে চাঞ্চল্য কিংবা বাড়তি সতর্কতা দেখল না। বন্দী পলায়নের খবর তারা পায়নি। তাহলে ওরা পাঁচজন জানতে পারল কি করে? পর মুহূর্তেই মনে পড়ল, ওরা বন্দীখানার নিয়ন্ত্রণ কক্ষের বাড়তি প্রহরী। সম্ভবত বন্দীসেলগুলোর দরজার সাথে এলার্ম সিষ্টেম রয়েছে বন্দীখানার কন্ট্রোল কক্ষে। আহমদ মুসার সেলের দরজা খোলার এলার্ম পেয়েই তারা ছুটে এসেছিল সেলে।
গোপন পথ দিয়ে বের হওয়ার পথে আর কোন বাধা পেল না আহমদ মুসারা। পাহারার পয়েন্টগুলো এড়িয়ে পেছনের গোপন দরজাটায় পৌছে গেল আহমদ মুসারা।
দরজাটা ডিজিটাল লকে আটকানো।
দরজার সামনে পৌছে নিনা নাদিয়া তাকাল আহমদ মুসার দিকে। বলল, এই লকই শেষ সমস্যা। এর সমাধান আমার কাছে নেই। ডিজিটাল লক ডিকোড করে খোলা না গেলে লকটা গুলী করে ভেঙে দিলেও দরজা খুলবে না।
গোপন পথের শেষ এই দরজাটা প্রায় দেড় ইঞ্চি পুরু ষ্টিলের। দরজা ভাঙার কোন প্রশ্নই ওঠে না। মিস নিনা নাদিয়া, দরজা খোলার ব্যাপারটা আমার ওপর ছেড়ে দিন। বলল আহমদ মুসা।
ডিজিটাল লকের সামনে গিয়ে দাঁড়াল আহমদ মুসা তারপর বলল, ওপেনার কোর্ডটা থ্রি ডিজিটের।
থ্রি ডিজিটের? কেমন করে জানলেন থ্রি ডিজিটের। কেন নয় ‘ফোর’ বা ‘ফাইভ’ ডিজিটের? বলল নিনা নাদিয়া। তার কণ্ঠে অপার বিস্ময়।
লকটা যে ডিজাইনের, যে সাইজের, তাতে এর ওপেনার কোড থ্রি ডিজিটের বেশি হওয়ার কোনই স্কোপ নেই। এই লকের নির্মাতা কোম্পানীর বিভিন্ন কোড-ডিজিটের লকগুলো একেবারেই ভিন্ন ভিন্ন সাইজের। আহমদ মুসা বলল।
এ সাংঘাতিক একটা ইনফরমেশন। এটা জানা ছিল না। ধন্যবাদ আপনাকে। বলল নিনা নাদিয়া।
আহমদ মুসা ততক্ষণে ডিজিটাল লক নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে।
নিনা নাদিয়া তার পাশে গিয়ে দাঁড়াল।
আহমদ মুসা একবার তার দিকে তাকিয়ে বলল, তিন অক্ষরের সবচেয়ে প্রিয় শব্দ এখন ইসরাইলীদের কি মিস নিনা নাদিয়া?
নাদিয়া একটু চিন্তা করল। তারপর বলল, ‘তোরাহ।’
‘হ্যাঁ, হিব্রু ভাষায় ‘তোরাহ’ তিন বর্ণে লেখা হয়। তবে সব ইহুদিদের এটা প্রিয় শব্দ, শুধু ইসরাইলীদের নয়। ইসরাইলীদের আলাদা কোন প্রিয় শব্দ কি আছে?
তেমন কোন শব্দ আমি দেখছি না। একটু চিন্তা করে বলল নিনা নাদিয়া।
আমার মনে হচ্ছে সে শব্দটা ‘তোয়া।’
‘তোয়া’ লিখতে ইংরেজিতে তিনটা বর্ণ লাগে। আর ডিজিটাল লকটা ইংরেজি বর্ণের। সুতরাং ওপেনার কোর্ডটা ইংরেজি বর্ণেই হবে। আমার মনে হয় ওপেনার কোর্ডটা ‘তোয়া হতে পারে।
বলেই আহমদ মুসা ডিজিটাল লকের ‘কি’ গুলোর উপর আঙুল চালাতে লাগল।
‘নিনা নাদিয়া’র চোখ বিস্ময়ে ছানাবড়া হয়ে গেছে। তোয়া এখন সব ইসরাইলীর মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু, সেহেতু ‘তোয়া’ এখন তাদের কাছে প্রিয় নামও। কিন্তু আমার তো এটা মনে পড়েনি। বাইরের একজন খৃষ্টান গনজালেসের এটা মনে হলো কেমন করে? আসলে কে এই ‘হাবিব গনজালেস’? তার নামের সাথে কিন্তু তার সাহস, শক্তি, বুদ্ধিমত্তা কিছুরই মিল নেই। কে তাহলে এই হাবিব গনজালেস?
নিনা নাদিয়ার এই চিন্তার মধ্যেই আহমদ মুসা বলে ওঠল, মিস নিনা নাদিয়া, আমরা সফল। খুলে গেছে দরজা। আসুন।
বলে আহমদ মুসা দরজা খুলে বের হয়ে গেল।
আহমদ মুসার কথায় নিনা নাদিয়ার চিন্তা সূত্র ছিন্ন হয়ে গেল। এরপরও মাথা থেকে তার প্রশ্নগুলো গেল না।
সে নীরবে আহমদ মুসাকে অনুসরণ করে দরজা দিয়ে বের হয়ে গেল।
নিনা বের হয়ে এলে আহমদ মুসা দরজাটা টেনে বন্ধ করে দিল। সংগে সংগেই ‘ক্লিক’ করে দরজার লকটাও বন্ধ হয়ে গেল।
ভালো হলো লকটা তার আগের জায়গায় ফিরে গেল। কিছু বুঝতে পারবে না, আমরা এই দরজা দিয়ে পালিয়েছি। আহমদ মুসা বলল।
কথা শেষ করেই আহমদ মুসা নিনা নাদিয়ার দিকে ঘুরে দাঁড়াল। বলল, আমার সীমাহীন কৃতজ্ঞতা আপনার প্রতি, এ কথা বলে আপনাকে ছোট করব না। কিন্তু আরো একটা ফেভার আমি আপনার কাছে চাই।
বলুন। আপনার কাছে আমার ঋণ শোধ হওয়ার নয়। বলল নিনা নাদিয়া গম্ভীর কণ্ঠে।
আপনি এভাবে কথা বলছেন। কথা তাহলে আমার বলা হলো না। আহমদ মুসা বলল।
নিনা নাদিয়া মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল, ঋণ, পরিশোধ এসব কথা বাদ। বলুন আপনার কথা।
আহমদ মুসার মুখটা গম্ভীর হয়ে ওঠল। বলল, মূল্যবান ভিআইপি বন্দীদের কোথায় রাখা হয়?
নিনা নাদিয়া বিস্মিত দৃষ্টিতে আহমদ মুসার দিকে তাকাল। একটু ভাবল। বলল, এমন কোন বন্দী তোয়াতে নেই। কিন্তু এ প্রশ্ন করছেন কেন?
মিস নাদিয়া, আমি দু’জন বন্দীকে খুঁজতে এসেছি। আপনার সাহায্য আমি চাই। আহমদ মুসা বলল।
কোন দুই বন্দী?
এমিলিয়া এবং বায়তুল আকসা মসজিদের ইমাম আব্দুল্লাহ ইবনে আব্দুর রহমানকে। আহমদ মুসা বলল।
বিস্ময়ে-বিস্ফোরিত হয়ে উঠেছে নিনা নাদিয়ার দু’চোখ। তাহলে গনজালেস নামের এই লোক ফিলিস্তিন থেকে এসেছে! এর নাম তাহলে গনজালেস অবশ্যই নয়। তাহলে কে? এসব ভাবনার মধ্যেই সে বলল, আমি যেহেতু আগেই ঠিক করেছি, আপনাকে সাহায্য করব, তাই আমি দুই বন্দীর তথ্য দিয়ে আপনাকে সাহায্য করবো। কিন্তু তার আগে বলুন, আপনি কে? আপনার নামের সাথে আপনার এই পরিচয় মেলে না, এটা আমি আগেই বুঝেছি। তাহলে আপনি কে?
আপনার ধারণা ঠিক। আমি হাবিব গনজালেস নই। নামের দিক দিয়ে আমি বড় কোন পদ, পরিচয়ের মালিক নই। আমি ফিলিস্তিন সরকারেরও কেউ নই। বলতে পারেন একজন ফ্রি ল্যান্সার সেবক আমি। ধর্মের পরিচয়ে আমি মুসলমান। আমি মানুষকে সাহায্য করি। নিজের নামটা গোপন রাখতে গিয়ে আহমদ মুসাকে এভাবে অনেক কথা বলতে হলো। নিজের মুসলিম পরিচয় ও এমিলিয়াদের উদ্ধার করতে এসেছে, একথা বললেও নিজের নাম তাকে বলতে চাইলো না কারণ, আহমদ মুসা জানে নিনা নাদিয়া ইসরাইলীদের একজন গোয়েন্দা অফিসার। তারা আহমদ মুসার প্রতিই এলার্জিক বেশি। আহমদ মুসার নাম শুনলে সাহায্য পাওয়া ভন্ডুল হয়ে যেতে পারে।
‘আপনি তাদের খোঁজ করতে এসেছেন। খোঁজ দিচ্ছি, তাঁদেরকে প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রী প্রাসাদের সিকিউরিটি জোনে বন্দী করে রাখা হয়েছে। কিন্তু খোঁজ নিয়ে আপনি কি করবেন?’
প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীর কি একই প্রাসাদ? আহমদ মুসার জিজ্ঞাসা।
হ্যাঁ, একই প্রাসাদে ওরা থাকেন। নিনা নাদিয়া বলল।
সিকিউরিটি জোনটা কোন দিকে?
‘প্রাসাদের রেসিডেন্সিয়াল ব্লকে থাকেন প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রী। তার চারধার ঘিরেই সিকিউরিটি জোন। এই এলাকা সার্বÿণিক ও সর্বোচ্চ পাহারার অধীন, যাতে রেসিডেন্সিয়াল ব্লক নিরাপদ থাকে। বলল নিনা নাদিয়া।
ধন্যবাদ। এই সেক্রেটারিয়েটের প্রধান গেটের বিপরীত দিকের বড় গেটটাই তো প্রেসিডেন্ট প্রাসাদের গেট, তাই না? জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
‘প্রেসিডেন্ট প্রাসাদের লোকেশন সম্পর্কে নিশ্চিত হতে চাইছেন কেন? আপনি কি তাদের উদ্ধারেরও চিন্তা করছেন? আমার একটা পরামর্শ, খোঁজ নেয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকুন। ঐ দুই বন্দীর সাথে ইসরাইলীদের ভাগ্যের সবটা জড়িত। যেখানে ভাগ্যের প্রশ্ন, সেখানে মানুষ মরিয়া হয়। বলল নিনা নাদিয়া।
উত্তরে আহমদ মুসা বলতে চাইল, এমিলিয়া ও খতিব আব্দুল্লাহ আব্দুর রহমানের উদ্ধারের সাথে গোটা ফিলিস্তিনি আবেগ জড়িত, তাদের মুক্তি ছাড়া অন্য কিছু ভাবার অবকাশ নেই। কিন্তু এ কথা না বলে আহমদ মুসা বলল, ধন্যবাদ আপনাকে একটা সত্য স্মরণ করিয়ে দেয়ার জন্যে।
‘ধন্যবাদ আপনাকেও।’ বলে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল, এখন রাত আড়াইটা। কোথায় যাবেন এখন আপনি?
ঠিক নেই। আমি যে কাজে তোয়া আসতে চেয়েছিলাম, সে কাজ তো হয়নি। বলল আহমদ মুসা।
বিমর্ষতা নামল নিনা নাদিয়ার চেহারায়। বলল, বুঝেছি। ইশ্বর আপনাকে হেফাজত করুন। আমি চলি।
বলে নিনা নাদিয়া হাত বাড়িয়ে দিল হ্যান্ড শেকের জন্যে।
আহমদ মুসা হ্যান্ড শেক না করে হেসে বলল, ‘মুসলিম পরিচয় দেয়ার পর আর পারছি না হ্যান্ড শেক করতে। ধন্যবাদ আপনাকে মিস নাদিয়া। আল্লাহ আপনার মঙ্গল করুন। আমিও চলি।
আহমদ মুসা ও নিনা নাদিয়া বিপরীত দিকে হাঁটতে শুরু করল।
কয়েক ধাপ এগিয়ে নিনা নাদিয়া পেছন ফিরে আহমদ মুসার দিকে তাকাল। আহমদ মুসাকে দ্বিধাহীনভাবে সামনে এগোতে দেখল। কিন্তু নিনা নাদিয়ার মুখে প্রবল দ্বিধা-দ্বন্দের ছাপ। অন্তরে তার ঝড় বইছে। তার বুঝতে বাকি নেই গনজালেস পরিচয়ের লোকটা তোয়ায় এসেছে এমিলিয়াদের উদ্ধারের জন্যেই। কিন্তু এটা হতে পারে কি করে? এমিলিয়ারাই ইসরাইলীদের ভাগ্যের ট্রাম কার্ড এটা হাতছাড়া হলে তাদের ভাগ্যও যে শেষ হয়ে যাবে।
চোখ-মুখের দ্বন্দ্ব-বিমর্ষতা আরও বাড়ল নিনা নাদিয়ার।

আহমদ মুসা প্রেসিডেন্ট প্রাসাদের পেছনে বাগানের একটা গাছের অন্ধকারে এসে বসল। পেছনের প্রাচীর টপকে আহমদ মুসা এখানে প্রবেশ করেছে। প্রাচীরের ওপারের তিনজন প্রহরী তাকে ধরে ফেলেছিল, যেন তারা তার জন্যেই অপেক্ষা করছিল। তবে তাদের সামলাতে গুলীর ব্যবহার করতে হয়নি। কারাত চালিয়েই তাদের কয়েক ঘণ্টার জন্যে ঘুম পাড়ানো গেছে।
আহমদ মুসা তোয়া নগরীর স্যাটেলাইট ফটোর উপর পেন্সিল টর্সের আলো ফেলে আবার তার উপর চোখ বুলাতে লাগল।
প্রেসিডেন্ট প্রাসাদ ঘিরে যে সিকিউরিটি জোন, তার মধ্যে পেছনে এই দিকটাই নিরাপদ, নিঃর্ঝঞ্চাট। অতএব বন্দীরা এদিকেই থাকা স্বাভাবিক। আহমদ মুসা এদিকটাই বেছে নিয়েছে প্রেসিডেন্ট প্রাসাদে প্রবেশের জন্যে।
আহমদ মুসা প্রেসিডেন্ট প্রসাদের স্যাটেলাইট ফটোর উপর আবার নজর বুলাতে লাগল। পেছনের দিকে নিরাপত্তার বাড়তি ব্যবস্থা হিসেবে ছোট একটা গার্ড ব্যারাক রয়েছে। ব্যারাকের পর তিন-চার গজের একটা ফাঁকা জায়গা। তারপর কাঁটাতারের বেড়া। বেড়ার পর প্রাসাদের দেয়াল।
দেয়ালের জানালাগুলোর ওপর চোখ বুলাচ্ছিল আহমদ মুসা।
আকস্মিক একটা টর্চের তীব্র আলোতে সে আলোকিত হয়ে ওঠল।
চমকে ওঠে আহমদ মুসা উপর দিকে তাকানোর বদলে আলোর বাইরে দাঁড়ানো ছায়ামূর্তির হাঁটু লক্ষ্যে মাথা সামনে নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল। লোকটির হাঁটুতে আহমদ মুসার মাথা প্রচন্ড শক্তিতে আঘাত হানল।
আঘাত লোকটির জন্যে অভাবিত ও আকস্মিক ছিল। সে হুমড়ি খেয়ে পড়ল উপুড় হয়ে আহমদ মুসার ওপর। সাথে সাথে টর্চের আলোও নিভে গিয়েছিল।
সে পড়ে গিয়ে স্থির হওয়ার আগেই আহমদ মুসা উঠে দাঁড়িয়ে অন্ধকারেই তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। লোকটি ওঠার চেষ্টা করছিল। আহমদ মুসা তাকে সামলানোর জন্যে সময়ক্ষেপণ করতে চাইল না। লোকটির নাগাল পেয়েই আহমদ মুসা লোকটির কানের নিচের জায়গাটায় তার ডান হাতের দু’টি মোক্ষম কারাত চালাল। লোকটি কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলল।
আহমদ মুসা উঠে দাঁড়িয়ে গার্ড ব্যারাকের দিকে এগোলো। এ গার্ডের খোঁজে অন্যেরাও এদিকে আসতে পারে। গাছের অন্ধকার থেকে বেরোনোর পর মাটিতে শুয়ে পড়ে দেহটা গুটিয়ে নিয়ে গড়িয়ে চলল গার্ড রুমের দিকে।
গার্ড রুমের সম্মুখটা প্রেসিডেন্ট প্রাসাদের দিকে। পেছনে তিনটি পর্যবেক্ষণ জানালা। জানালাগুলো দেয়ালের লেভেলে বাইরে বেরিয়ে আসা। এর তিন দিকে তিনটি জানালা।
মাঝখানের জানালার নিচে গিয়ে উঠে দাঁড়াল আহমদ মুসা। তাকালো ঘরের ভেতরে।
ছয়-সাতজন গার্ড বসে চা খাচ্ছে। সবার সামনেই একটি করে ষ্টেনগান।
একজন বলল, জনাথনের চা তো ঠান্ডা হয়ে গেল। এখনও আসছে না কেন। বাইরেটা একটু দেখতে পাঠানো হলো, কি হলো তার।
অন্য একজন বলল, তোমরা তাড়াতাড়ি চা-খাওয়া শেষ করো। আজকের রাতটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। হুকুম এসেছে, পাহারায় যেন সামান্য গাফিলতিও না হয়। ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করলে, সোজা গুলী করার হুকুম এসেছে। তোমরা তাড়াতাড়ি করো।
ঘর থেকে বের হওয়ার একমাত্র দরজা পশ্চিম দিকে। ওদেরকে ঘরে আটকাতে হবে, নয়তো শেষ করতে হবে। ওরা বেরিয়ে এলে প্রেসিডেন্ট প্রাসাদে ঢোকার আগেই আরেক ঝামেলায় পড়তে হবে।
আহমদ মুসা দ্রুত গুড়ি মেরে দৌড়ে গার্ড ব্যারাকের সামনে গিয়ে পৌছল। বারান্দার সিঁড়ি ভেঙে দ্রুত গিয়ে দরজার মাঝখানে দাঁড়াল।
ভেতরে সাত জনের একবারে প্রান্তের জন আহমদ মুসাকে দরজায় এসে দাঁড়াতে দেখেই সে দ্রুত দরজার আড়ালে সরে গিয়েছিল। আহমদ মুসার তা নজর এড়ায়নি।
সে দরজার আড়াল নিয়ে এগোচ্ছিল আহমদ মুসার দিকে।
আহমদ মুসা তার ‘ব্ল্যাক ক্যানন’ সামনের লোকদের দিকে তাক করে এক ধাপ সামনে এগিয়েই চোখের পলকে রিভলবার বাঁ দিকে ঘুরিয়ে ট্রিগার টিপেই রিভলবারের নল সামনে নিয়ে এল।
‘ব্ল্যাক ক্যানন’ গুলী করার পর একটুও শব্দ হলো না।
সাথীকে গুলী খেয়ে পড়ে যেতে দেখে ওরা পাগলের মত ষ্টেনগানগুলো পাশ থেকে তুলে নিয়ে আহমদ মুসার দিকে ঘুরতে গেল।
আহমদ মুসার নীরব কামান ‘ব্ল্যাক ক্যানন’ নীরবে গুলী বৃষ্টি করে সবার ওপর দিয়ে ঘুরে এল।
আহমদ মুসার দু’চোখ সবার ওপর দিয়ে ঘুরে এসে নিশ্চিত হয়ে দরজা বন্ধ করে বেরিয়ে এল।
বারান্দা থেকে নিচে মাটিতে ঝাপিয়ে পড়ে দেহটা গুটিয়ে দেহকে দ্রুত গড়িয়ে নিয়ে কাঁটাতারের বেড়ার পাশে গিয়ে স্থির হলো।
তারপর শুয়ে থেকেই জুতার গোড়ালি খুলে ভেতর থেকে রকেটাকৃতির ক্ষুদ্র ‘গামা বিমার’ (গামা রে’ উৎক্ষেপক) বের করল।
আহমদ মুসা বুঝেছে, কাঁটাতারের বেড়া বিদ্যুতায়িত করে রাখা হয়েছে। সে দেখতে পাচ্ছে তার কয়েক ধাপ পেছনে, কাঁটাতারের বেড়ার সাথে একটা বাদুড় পাখি আটকে আছে। সম্ভবত বাদুড়টা নিচু দিয়ে উড়ে যাওয়ার সময় বেড়ার বিদ্যুৎ তাকে টেনে নিয়েছে। আহমদ মুসা জানে ইদানিং বেড়ার বিদ্যুৎ প্রবাহটা বেশ শক্তিশালী ও আকর্ষণযোগ্য কিছু বেড়ার কাছাকাছি হলেই তাকে টেনে নেয় ধ্বংস করার জন্যে।
আহমদ মুসা গামা বিমার টর্চ হাতে নিয়ে ফায়ার লকটি অন করে বেড়ার সবচেয়ে নিচের তারটিকে লক্ষ্য করে গামা বিমারের লাল বোতামটি অন করে দিল। চোখের পলকে তারটি কেটে গেল, বিদ্যুৎ সামান্য স্পার্ক করার সুযোগ পেল না। এর উপরের তারটিও সে একইভাবে কেটে ফেলল। দু’ফুট উচ্চতা পরিমাণ ফাঁকা জায়গা তাতে সৃষ্টি হলো। এরপর আহমদ মুসা গড়িয়ে দু’আড়াই গজ পরিমাণ পেছনে গিয়ে কাঁটাতার দু’টির এ পাশটাও কেটে দিল। তার দু’টি মাটিতে পড়ে গেল।
আহমদ মুসা কাঁটাতারের খন্ড দুটি সরিয়ে দু’ফুট উঁচু এবং সাত ফুটের দীর্ঘ স্পেস দিয়ে খুব সহজে গড়িয়ে ভেতরে ঢুকে গেল।
ভেতরে ঢোকার পর শুয়ে থেকেই অপেক্ষা করতে লাগল।
কাঁটাতার কাটার সময় বিদ্যুৎ তরঙ্গে বিপরীত ওয়েভ সৃষ্টি হওয়া কিংবা তার কেটে পড়ার পর দুটি বিদ্যুৎ ওয়েভে যে ছেদ পড়েছে তার একটা প্রতিক্রিয়া কনট্রোল রুমের রাডারে স্পন্দিত হতে পারে। সেক্ষেত্রে তারা এখনি ছুটে আসবে, এখানে।
আসলও তারা।
আহমদ মুসা তাদের জন্যেই অপেক্ষা করছিল, কিন্তু সে তা টের পেল না।
তারা এল আহমদ মুসার দিক থেকে।
তারা এসে যখন আহমদ মুসার দিকে ষ্টেনগান তাক করে চিৎকার করে ওঠল, শুয়োরের বাচচা হাত তুলে উঠে দাঁড়া। তোর খেলা শেষ। যথেষ্ট ভুগিয়েছিস আমাদের।
আহমদ মুসা মাথার ওপর হাত রেখে উঠে দাঁড়াল। যেন সে মাথার পেছন দিকটা ধরে আছে।
ওরা তিনজন।
একজনের হাতে উদ্যত ষ্টেনগান। অন্য দু’জনের হাতে রিভলবার। আহমদ মুসা হাত তুলে উঠে দাঁড়ানোর পর তারা রিভলবার নামিয়ে নিয়েছে।
রিভলবারধারী একজন, তাকে বেরিয়ে আসতে বলল। আমরা কষ্ট করে ওখানে যাব কেন?
ষ্টেনগানধারী তার ষ্টেনগানের নল নেড়ে ইশারা করে বলতে লাগল বেরিয়ে এস।
আহমদ মুসার নজর ছিল লোকটার ষ্টেনগানের নলের দিকে। যে মুহূর্তেই ইশারা করতে গিয়ে ষ্টেনগানের নল নড়েছে। সে মুহূর্তেই আহমদ মুসার ডান হাত মাথা থেকে কয়েক ইঞ্চি নিচে গিয়ে জ্যাকেটের গোপন পকেটে তার ‘ব্ল্যাক ক্যানন’-এর বাট ধরে চোখের পলকে তা ঘুরিয়ে এনে গুরী করল ষ্টেনগানধারীকে।
রিভলবারধারী দু’জন আহমদ মুসাকে গুলী করার জন্য তাদের রিভলবার তুলছিল দ্রুত।
ষ্টেনগানধারীকে গুলী করার পর আহমদ মুসা তার অটোমেটিক ‘ব্ল্যাক ক্যানন’-এর ট্রিগার থেকে তার তর্জনী তুলল না। শুধু ‘ব্ল্যাক ক্যানন’- এর নিঃশব্দ গুলীর ঝাঁক তাদের ঘিরে ফেলে।
ষ্টেনগানধারীর মত তারাও আতংকগ্রস্ত চোখ ও ঝাঁঝরা বুক নিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল।
আহমদ মুসা সেদিকে আর না তাকিয়ে পেছন ফিরে দৌড় দিল প্রাসাদের দিকে।
আশেপাশেও প্রহরী আছে। আহমদ মুসা তাদের নজরে পড়লে তারাও ছুটে আসবে।
একটা জানালার নিচে গিয়ে দাঁড়াল আহমদ মুসা। স্যাটেলাইট ফটোতে আগেই দেখেছিল এদিকের জানালাগুলো লোহার গরাদে ঢাকা। গরাদের পর আবার কি আছে বলা মুষ্কিল। তবে পাশ্চাত্যের নিয়ম হলো, জরুরি অবস্থা বা সিকিউরিটির অবস্থা বিবেচনা করে গরাদের পেছনে আর কিছু প্রতিবন্ধক রাখে না, যাতে জরুরি অবস্থায় বেরোনো যায়। তাই গরাদ ব্যবস্থাপনা ও গরাদকে তারা যথেষ্ট মজবুত করে।
এ জানালার গরাদ মনে হলো তার চেয়েও মজবুত। গরাদের ইস্পাত প্রায় দুই ইঞ্চি। কামানও এ গরাদের কিছু করতে পারবে না।
কিন্তু আহমদ মুসার কামান নয়, আছে ‘গামা বিমার’। কামানের চেয়েও শক্তিশালী। এর শক্তিশালী অতি বেগুনি রশ্মি এসব ইস্পাতকে নিমিষে টুকরো টুকরো করে ফেলতে পারে।
গামা বিমারটা হাতে নিল আহমদ মুসা।
মনোযোগ দিল গরাদের দিকে।
কিন্তু পরক্ষণেই ভাবল, ভেতরে প্রবেশ করার জন্য আর একটু ভেবে নেয়া দরকার। ঢুকে সে কোন দিকে যাবে! কোন দিকে এমিলিয়াদের পাওয়া যেতে পারে।
একথা ভেবে প্রেসিডেন্ট প্রাসাদের স্যাটেলাইট ফটোগ্রাফটি আবার বের করল। পাশের দেয়াল ও ছাদের গঠনের ওপর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি বুলাল। কিন্তু ছাদের লে-আউটে কোন পার্থক্য নেই। একই রকম গোটা ছাদটা। নিখুঁতভাবে দেখতে গিয়ে সব শেষে ছাদের পূর্ব দিকে দক্ষিণ পূর্ব কোণ থেকে কয়েকগজ উত্তরে ছাদের ওপর একটা ঢাকনা দেখতে পেল। এ রকম ঢাকনা গোটা ছাদের আর কোথাও নেই। ঢাকনা কি ঢেকে রেখেছে? আহমদ মুসা খুব ভালো করে দেখল, ঢাকনাটা আড়াই তিনফুটের কম নয়। আর ঢাকনাটা পূর্ব দেয়ালের সাথে লাগোয়া। এর অর্থ একটাই। সেটা হলো ঢাকনাটা একটা সিড়িমুখের ওপর। ভেতর থেকে সিঁড়ি সাধারণত দেয়াল অবলম্বন করেই ওঠে এবং বিপরীত দিকের আরেকটা দেয়ালেই সাধারণত এর শীর্ষটা স্থাপিত হয়। সুতরাং সিঁড়িমুখেই ঢাকনাটা স্থাপিত হয়েছে।
কিন্তু সিঁড়িটা এখানে কেন? সিকিউরিটি জোনে এই সিঁড়ির কারণ কি? এর অর্থ কি এটাই যে সিকিউরিটি জোনের কেন্দ্রবিন্দু এটা? জরুরি অবস্থায় ছাদ যাতে ব্যবহার করা যায়, এজন্যেই এই সিঁড়ির ব্যবস্থা। তাহলে এই এলাকারই কোথাও এমিলিয়া ও খতিব মহোদয়কে বন্দী করে রাখা হয়েছে।
এই সিদ্ধান্তে পৌছার পর আহমদ মুসা জানালার গরাদের দিকে এগোলো।
পকেট থেকে বের করে হাতে নিল ‘গামা রে’ বিমার’।
জানালা কাঁধ পরিমাণ উঁচু।
হাত যতটা উপরে তোলা যায় তুলে আহমদ মুসা জানালার ২ বর্গফুটের মত জায়গা ‘গামা রে বিমার’ দিয়ে কেটে ফেলল।
কাটা খন্ডটা বাইরে ফেলে দিয়ে লাফ দিয়ে জানালার ওপর উঠে নিচের দিকে একবার চোখ বুলিয়ে জানালার ওপর রাখা দেহের ভর রেখে দেহের পেছনটা নিচে নামিয়ে দিল।
নিঃশব্দে নেমে গের সে একটা অন্ধকার ঘরের মেঝেয়।
জানালার কাটা অংশ দিয়ে বাইরের আলো এসে পড়েছে ঘরের একাংশে। তাদের ঘরের অন্য অংশের অন্ধকারও ফিঁকে হয়ে গেছে।
ঘরটা একটা বেড রুম। ঘরে চারটি বেড পাতা। কিন্তু কোন বেডেই কেউ নেই।
আহমদ মুসা একটা বেডের পাশে গিয়ে একটা হাত রেখে তাপ পরীক্ষা করল। বেডটা গরম নয়, আবার ঠান্ডাও নয়। তার মানে পনের বিশ মিনিট আগেও এখানে লোক শুয়ে ছিল। গেল কোথায় তারা? এরা নিশ্চয় গার্ড ছিল, বেডের চেহারা দেখে তাই মনে হয়। গার্ডরা রাতে এক সাথে উঠে গেছে কেন? কোন খবর পেয়ে তাদের সবাইকে কি ডিউটিতে ডাকা হয়েছে? তাহলে তার আসার খবর এরা পেয়েছে? হঠাৎ আহমদ মুসার মনে পড়ল ব্যারাকের গার্ডদের কথোপকথনের কথা। তাদেরকেও প্রহরা জোরদার করতে বলা হয়েছিল আহমদ মুসার আরও মনে পড়ল, বাউন্ডারী ওয়ালের বাইরের গার্ডরাও তারই অপেক্ষা করছিল। সব মিলিয়ে তার মনে হলো, সব কিচু মোকাবিলার জন্যে তারা প্রস্তুত রয়েছে।
আহমদ মুসা ঘরের দরজা বন্ধ করে বেরিয়ে এল। বেরিয়ে এল একটা করিডোরে। তার দু’পাশেই ঘরের সারি। সবগুলোই বন্ধ। সবগুলোকেই গার্ড রুম বলে মনে হলো।
আহমদ মুসা করিডোরের পশ্চিম দিকে এগিয়ে আরেকটা অপেক্ষাকৃত প্রশস্ত করিডোরে এসে পড়ল।
ফটোতে দেখা সিঁড়িঘরটা আরেকটু উত্তরে হবে। আহমদ মুসা তাই প্রশস্ত করিডোরটি ধরে উত্তর দিকে এগোতে লাগল।
কোথাও একজন লোক, কিংবা কোন দিকে কোন সাড়াশব্দও সে পাচ্ছে না। সবাই কি প্রেসিডেন্ট প্রাসাদের সামনে গিয়ে মোতায়েন হয়েছে?
প্রশস্ত করিডোরটি বড় একটা ঘরের দরজায় গিয়ে শেষ হলো। কিন্তু প্রশস্ত করিডোর থেকে অপেক্ষাকৃত সরু দু’টি করিডোর দু’পাশে বড় ঘরটির ধার ঘেঁষে এগিয়ে গেল। মনে হলো করিডোর দু’টি ঘরটিকে বেষ্টন করে তৈরি। বাইরে থেকেই ঘরটিকে গোলাকার মনে হলো।
এ ঘরটাতেই কি সেই সিঁড়ি। দূরত্বের বিচারে তাই মনে হয়।
ঘরে প্রবেশ করল আহমদ মুসা।
হ্যাঁ, এই ঘরেই সেই সিঁড়িটি।
আহমদ মুসা তাকাল ঘরের চারদিকে।
তার অনুমান ঠিক, ঘরের চারদিক ঘিরেই করিডোর। ঘরের চারদিকের দরজা সাত-আটটির মত হবে। সবগুলোই হা করে খোলা। কোন দরজাই বন্ধ বা হাফ বন্ধ নেই।
হঠাৎ আহমদ মুসার মনে হলো এটা পরিকল্পিত। তাকে ফাঁদে ফেলা হয়েছে।
আহমদ মুসার এই চিন্তা শেষ হওয়ার আগেই একটা ভারী কণ্ঠ উচ্চারিত হলো। বলল, ‘আহমদ মুসা তুমি ঠিকই ভেবেছ। তুমি আমাদের ফাঁদে পড়েছ। আটটি ষ্টেনগান তোমাকে ঘিরে আছে।’
থামল কণ্ঠটি।
কণ্ঠটি থামার সাথে সাথেই আট দরজা দিয়ে আটটি উদ্যত ষ্টেনগান তার দিকে এগিয়ে আসছে।
কয়েক মুহূর্ত।
আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে উদ্যত আটজন ষ্টেনগানধারী আহমদ মুসাকে ঘিরে বৃত্তের সৃষ্টি করে দাঁড়াল। বৃত্তের একটা প্রশস্ত মুখ কিন্তু থাকল। মুখটা উত্তরের প্রশস্ত দরজা বরাবর।
চারদিকে ঘেরা ৮টি উদ্যত ষ্টেনগানের মুখে ‘ব্ল্যাক ক্যানন’ দিয়ে আক্রমণে যাওয়া মৃত্যুকে আলিঙ্গন করার সমতুল্য। আহমদ মুসা তার রিভলবার নামিয়ে নিল।
উত্তরের প্রশস্ত দরজা পথে রাজসিকভাবে হেঁটে একজন প্রবেশ করল ঘরে। আহমদ মুসা তাকে খুব ভাল করে চিনে। সে হলো ইসরাইলের নিরাপত্তা ও কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স ‘সিনবেথ’-এর প্রধান জেনারেল শামিল এরফান।
দরজায় থাকতেই সে চিৎকার করে ওঠল আহমদ মুসা তোমাকে এবার আমাদের মত করে হাতে পেয়েছি। প্রথম দর্শনেই তোমাকে গুলী করে মারার কথা, কিন্তু কয়েকটা কথা না বলে পারছি না। তুমি ইসরাইলের যে ক্ষতি করেছ, ইতিহাসে সেরকম ক্ষতি আর কেউ করতে পারেনি। তুমি আমাদের পিতৃভূমি আমাদের কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছ। এখন আবার পিতৃভূমি উদ্ধার বা প্রতিশোধের একটা অবলম্বন মানে এমিলিয়া ও খতিব আব্দুল্লাহকে কেড়ে নিয়ে যেতে এসেছ। সে আশা তোমার সফল হবে না একথা বলার জন্যেই তোমাকে এই কয়েক মুহূর্ত বাঁচিয়ে রেখেছি। আহমদ মুসা, আমি কৃতজ্ঞ আমাদের দক্ষ গোয়েন্দা অফিসার নিনা নাদিয়ার প্রতি। তুমি তার উপকার করেছিলে, তোমাকে মুক্ত করে সেও তোমার উপকারের বিনিময় হিসেবে। কিন্তু দেশপ্রেমিক নিনা নাদিয়া তুমি যে প্রেসিডেন্ট প্রাসাদে আসছ, এ খবর দিয়ে তোমাকে ধরার ক্ষেত্রে অমূল্য সাহায্য করেছে।
বলতে বলতে সে আহমদ মুসার সামনে এসে দাঁড়াল। আহমদ মুসার হাত থেকে তার ‘ব্ল্যাক ক্যানন’ রিভলবারটা কেড়ে নিয়ে দরজা দিয়ে বাইরের দিকে ছুঁড়ে দিল।
রিভলবারটি ছুঁড়ে দেয়ার পরপরই দরজার ওপারে পাথরের মেঝেয় একটা খট খট শব্দ ওঠল। শব্দটা আহমদ মুসার চোখ দু’টিকে যেন টেনে নিয়ে গেল ঐ দরজা দিয়ে ঘরের বাইরে। দেখল, নিনা নাদিয়া আহমদ মুসার রিভলবারটা তুলে নিচ্ছে।
রিভলবার তুলে নিয়ে উঠে দাঁড়াল নিনা নাদিয়া। আহমদ মুসা তখনও তার চোখ ফিরিয়ে নেয়নি। চোখাচোখি হয়ে গেল আহমদ মুসার সাথে। আহমদ মুসা নিনা নাদিয়ার চোখে গভীর এক বিস্ময়-মোহিত দৃষ্টি দেখতে পেল। মুখটা তার ভারী, জেনারেল শামিল এরফানের কাছে নিনা নাদিয়ার যে কথা শুনল, তার সাথে নাদিয়ার এই চেহারা মেলে না।
জেনারেল শামিল এরফানের গর্জনে আহমদ মুসা তার চোখ ফিরিয়ে নিল।
জেনারেল শামিল এরফান বলছিল, আহমদ মুসা রেডি হও। মৃত্যু তোমার সামনে।
জেনারেল এরফানের রিভলবার তাক করা আহমদ মুসার দিকে।
তার তর্জনি তার রিভলবারের ট্রিগারে।
খুব আনন্দ হচ্ছে আহমদ মুসা কতদিন ধরে আমি এই ক্ষণটির জন্য অপেক্ষা করছি। তুমি আল্লাহর নাম নাও। আমি তিন পর্যন্ত গুণব। ‘তিন’ শব্দটিই তোমার জীবনের অন্তিম মুহূর্ত ঘোষণা করবে।
এক…. দুই……….. করে গোণা শুরু করল জেনারেল শামিল এরফান।
‘দুই’ বলার পর ‘তি…..’ উচ্চারণের সাথে সাথে একটা গুলীর শব্দ হলো। উপস্থিত গার্ডদের সবার দৃষ্টি গিয়ে পড়ল আহমদ মুসার দিকে। তারা দেখতে চেয়েছিল গুলী খেয়ে আহমদ মুসার লুটিয়ে পড়ার দৃশ্য। কিন্তু তার বদলে চিৎকার শুনল জেনারেল শামিল এরফানের। গার্ডদের সবার দৃষ্টি ফিরে গেল জেনারেল শামিল এরফানের দিকে।
অন্যদিকে আহমদ মুসা গুলীর শব্দ লক্ষ্যে তাকিয়ে ছিল উত্তরের দরজা দিয়ে বাইরে। দেখল নিনা নাদিয়ার ডান হাতের রিভলবার তখনও জেনারেল শামিল এরফানের দিকে তাক করা। তার রিভলবারের নল থেকে বেরোনো বিস্ফোরণের ধোঁয়া তখনও শেষ হয়ে যায়নি।
আহমদ মুসা নিনা নাদিয়ার দিকে তাকাতেই সে তার বাম হাতের রিভলবার ছুঁড়ে দিল আহমদ মুসার দিকে।
আহমদ মুসা রিভলবারটি হাতে পেয়েই নিজের দেহের পেছনটা মাটিতে ছুঁড়ে দিয়েই ট্রিগার টিপে রেখেই তা ঘুরিয়ে নিল গার্ডদের আটজনের বৃত্তের ওপর দিয়ে। ‘ব্ল্যাক ক্যানন’-এর গুলী বৃষ্টি সবাইকে লাশ করে মাটিতে শুইয়ে দিল।
পলকের মধ্যেই যেন ঘটনাটা ঘটে গেল।
গার্ডরা গুলীর শব্দে প্রথমে তাকিয়ে ছিল আহমদ মুসার দিকে, তারপর চিৎকার শুনে তাকিয়ে ছিল জেনারেল শামিল এরফানের দিকে। এই যে সময় নিয়েছে গার্ডরা, এরই সুযোগ গ্রহণ করল আহমদ মুসা। নিনা নাদিয়ার ছুঁড়ে দেয়া রিভলবার যখন পেল, সেটা গার্ডদের নজরেও পড়েছিল। কিন্তু তখন তারা অপ্রস্তুত। তারা কিছু করার আগেই আহমদ মুসর ‘ব্ল্যাক ক্যানন’-এর তারা শিকার হয়েছে।
গুলী করা শেষ করেই আহমদ মুসা উঠে দাঁড়িয়েছে।
নিনা নাদিয়া ছুটে এসেছে দরজার কাছে। বলল, আসুন, এমিলিয়ারা এদিকে বন্দী আছে।
বলেই নিনা নাদিয়া ছুটল উত্তর দিকে। বৃত্তাকার করিডোর ক্রস করে ছুটছে সে উত্তরমুখী আরেকটা করিডোর ধরে।
আহমদ মুসা ছুটে গিয়ে নিনা নাদিয়ার পাশাপাশি দৌড়াতে লাগল। দৌড়াতে দৌড়াতে বলল, ধন্যবাদ মিস নিনা নাদিয়া আমার জীবন বাঁচানোর জন্যে।
কোন উত্তর দিল না নিনা নাদিয়া।
আহমদ মুসা তাকাল তার মুখের দিকে। দেখল, তার চোখে অশ্রু, মুখ ভারী।
আহমদ মুসা কিছু বলতে যাচ্ছিল।
থমকে দাঁড়াল নিনা নাদিয়া। বলল, ফিস ফিস করে, আমরা এসে গেছি। সামনে যে দরজা, তার পরে একটা ঘর, গার্ড রুম। গার্ড রুমের পরে আরেকটা দরজা। দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকলে একটা বড় হল ঘর। হল ঘরটাতে অনেকগুলো কেবিন। প্রত্যেকটা কেবিনের তিন দিকে দেয়াল, একদিকে মোটা গ্রীলের দেয়াল। তাতেই দরজা।
একটু থেমেই আবার বলে উঠল, সামনে এই যে পুরু ষ্টিলের দরজা, তা ভেতর থেকেই শুধু খোলা যায়। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে দরজার স্পিকারে কথা বলতে হবে।
ভেতর থেকে ফটোও দেখবে, কথাও শুনবে। মানুষ ও তার কথা তাদের তালিকার সাথে মিললে তবেই তারা দরজা খুলবে। তালিকার সাথে না মিললে সংগে সংগে তারা এটা জানিয়ে দেবে প্রেসিডেন্ট প্রাসাদের নিরাপত্তা হেডকোয়ার্টারে। তাছাড়া এই দরজায় গোপন ‘বুলেট-হোল’ রয়েছে। এই বুলেট-হোল ব্যবহার করে তারা আক্রমণেও আসতে পারে।
সব শুনে আহমদ মুসা একটু ভাবল। তারপর দরজাটায় তীক্ষ্ণ নজর বুলাল। চৌকাঠের উপরের দেয়াল এবং দরজার ঠিক উপরের ছাদের দিকে সন্ধানী নজর বুলাল। কিন্তু দরজার উপরের ছাদ ও দরজার উপরের দেয়ালে সন্দেহ করার মত সামান্য কিছুও পেল না। তাহলে দেয়ালের গায়ে সেট করা স্পিকার অথবা দরজা সংলগ্ন উপরের দেয়ালের নিচের প্রান্তের কোথাও সার্কিট ক্যামেরার চোখ কি সেট করা আছে।
চিন্তা করেই আহমদ মুসা মাটিতে বসে করিডোরের দুই পাশ দিয়ে গুটি গুটি হেঁটে দরজার মাটি সংলগ্ন কোণায় বসে দরজার উপরের মাথা সংলগ্ন দেয়ালের বটম প্রান্ত দু’পাশ থেকে পরীক্ষা করল। না, সেখানেও সন্দেহজনক কিছু নেই।
আহমদ মুসা নিশ্চিত হলো স্পিকারের সাথেই ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরার চোখ সেট করা আছে।
এই উপসংহারে পৌছেই আহমদ মুসা পকেটে ‘গামা রে বিমার’ বের করে হাতে নিয়ে গড়িয়ে দরজার কাছে চলে এল, যাতে ক্যামেরার চোখের বাইরে দিয়ে সে দরজার গোড়ায় পৌছতে পারে।
দরজার গোড়ায় পৌছে আহমদ মুসা দরজার গা ঘেঁষে উঠে দাঁড়াতে লাগল। স্পিকার যে লেবেলে, তার ফুট খানেক নিচে পৌছে হাত ওপরে তুলে স্পিকার হোল টার্গেটে ‘গামা রে বিমার’-এর বোতাম টিপে দিল।
মুহূর্তেই হাওয়া হয়ে গেল স্পিকারের অস্তিত্ব।
আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল।
দরজার উপর-নিচ বরাবর ভার্টিক্যাল দুই ধার আহমদ মুসা পরীক্ষা করতে লাগল কোথায় লক আছে তার সন্ধানে। আহমদ মুসা দেখল দরজাটির ষ্টিলের পাল্লা ডান দিকের দেয়ালের ভেতর থেকে বেরিয়ে এসেছে। কিন্তু দরজা কভার করার পর বাম দিকের দেয়ালের ভেতরে ঢুকে যায়নি। তার মানে লকের মাধ্যমে দেয়ালের সাথে দরজা আটকে রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছে। লক একাধিক থাকতে পারে।
কিন্তু লকের কোন চিহ্ন আহমদ মুসা দরজার গায়ে দেখতে পেল না। লককে বাইরে থেকে দৃশ্যমান করা হয়নি, সেজন্য বাইরে লক খোলার ব্যবস্থা নেই।
কিন্তু লকের অস্তিত্ব তো বের করতেই হবে। আহমদ মুসা আবার বাম দিকে দরজা ও দেয়ালের সংযোগ স্থানটা পরীক্ষা করল। কিন্তু লকের অস্তিত্ব বের করতে পারলো না। দেয়াল ও দরজার পাল্লার মধ্যেকার ফাঁকটা এতই সুক্ষ্ণ যে চোখের দৃষ্টি তার মধ্যে প্রবেশ করে না।
আহমদ মুসা ঘুরে দাঁড়িয়ে তাকাল নিনা নাদিয়ার দিকে। বলল, আমি করিডোরের এদিককার কয়েকটা বাল্ব নিভিয়ে দিতে চাই। আমার মনে হচ্ছে করিডোরটাকে অন্ধকার করলে দরজার লক বা লকগুলোর সন্ধান পাওয়া যাবে।
নিনা নাদিয়া গম্ভীর মুখে সপ্রশংস দৃষ্টিতে আহমদ মুসার দরজা খোলার চেষ্টাকে দেখছিল। চোখের অশ্রু এখন শুকিয়ে গেছে। কিন্তু মুঝের থমথমে গাম্ভীর্যটা যায়নি।
আপনি নেভাতে পারেন, আমার আপত্তি নেই। আহমদ মুসার প্রশ্নের জবাবে বলল নিনা নাদিয়া।
সংগে সংগেই আহমদ মুসা তার হাতের ‘ব্ল্যাক ক্যানন’-এর নল উপরে তুলে একে একে চারটি বাল্বে গুলী করে গুঁড়ো করে দিল। করিডোরের এ প্রান্তটা বেশ অন্ধকারে ছেয়ে গেল।
আহমদ মুসা দ্রুত এগোলো দরজার বাম দিকের প্রান্তের দিকে।
দেয়াল ও দরজার ফাঁকের দিকে তাকাতেই আহমদ মুসা খুশি হয়ে উঠল। ফাঁক বরাবর সুক্ষ্ম আলোর রেখা দেখা যাচ্ছে। আলোর ভার্টিক্যাল রেখার দুই জায়গায় সে ছেদ দেখতে পেল, উপরের দিকে এক জায়গায় এবং নিচের দিকের এক জায়গায়।
নিনা নাদিয়া পাশে এসে দাঁড়িয়ে ছিল।
মিস নিনা নাদিয়া দরজার দুই জায়গায় লক আছে। লকগুলোর ব্যাসও দেড় ইঞ্চির মত হবে।
একটু থামল আহমদ মুসা। একটু ভাবল। বলল, মিস নাদিয়া, আমি লকগুলো কাটতে যাচ্ছি। আমি যতটুকু অনুমান করছি, তাতে লকগুলো কাটার সাথে সাথেই দরজা ডান দিকের দেয়ালে ঢুকে যাবে।
ঠিক সেই মুহূর্তে ওদের গুলীও ছুটে আসতে পারে। সুতরাং আমাদের সাবধান থাকতে হবে। বলল নিনা নাদিয়া। আগের চেয়ে অনেকখানি সহজ কণ্ঠ তার।
ধন্যবাদ মিস নাদিয়া। আপনাকে করিডোরের ডান পাশ ঘেঁষে দরজার কাছাকাছি জায়গায় শুয়ে পড়তে হবে। নিচের লকটা কাটার পর আমিও শুয়ে পড়ব। প্লিজ আপনি ওপাশে যান। বলল আহমদ মুসা।
তার মানে ওদের আক্রমণের প্রথম শিকার আপনি হতে চান। কারণ দরজা খুলতে শুরু করার সাথে সাথে ওদের আক্রমণ এ প্রান্ত দিয়েই শুরু হবে। আমার ও প্রান্ত থেকে ওদেরও আক্রমণ হবে না, দরজার ব্লক থাকায় আমিও শুরুতে কিছু করতে পারবো না। আমিও বরং এ পাশেই থাকি। বলল নিনা নাদিয়া।
প্লিজ মিস নাদিয়া, দু’জন শুরুতেই এক সাথে বিপদে পড়া যৌক্তিক নয়। আপনি প্রাথমিক টার্গেটের বাইরে থাকলে ওদের বিরুদ্ধে আক্রমণে আসা আপনার জন্য সহজ হবে। সবচেয়ে বড় কথা হলো, আমাদের দিক থেকে আক্রমণের সুযোগ দুই প্রান্ত থেকেই থাকা দরকার। বলল আহমদ মুসা।
নিনা নাদিয়া তাকাল আহমদ মুসার দিকে। আহমদ মুসার কথাগুলো এত কোমল এতটাই হৃদয়-নিসৃত যে, নিনা নাদিয়ার হৃদয়-মনকে তা নিমিষেই দখল করে ফেলল। নিনা নাদিয়া মুগ্ধ দৃষ্টিতে একবার তাকানো ছাড়া আর কিছুই বলতে পারল না।
নির্দেশ পালন করল নিনা নাদিয়া।
আহমদ মুসা ‘গামা রে বিমার’ দিয়ে দ্রুত লক কাটতে শুরু করল।
নিচের শেষ লকটি বাম হাত দিয়ে কাটার সময় ডান হাতে ‘ব্ল্যাক ক্যানন’ ভেতরের দিকে টার্গেট করে ট্রিগারে আঙুল রাখল।
দরজা কাটা শেষ হতেই একটা ‘হিশ’ শব্দ ওঠলো এবং দরজা ডান দিকে সরতে শুরু করল।
দরজা কাটা শেষ করেই আহমদ মুসা শুয়ে পড়েছিল।
দরজা যতটুকু ফাঁক হচিছল, আহমদ মুসার ‘ব্ল্যাক ক্যানন’ ততটুকুকে কভার করছিল।
কয়েক ইঞ্চি ফাঁক হতেই আহমদ মুসা তার রিভলবারের নল করিডোরের গা ঘেঁষে ভেতরে ঢুকিয়ে দিয়েছিল।
ফুট খানেক ফাঁক হওয়ার সংগে সংগেই তার রিভলবারের নল দরজার সমান্তরালে ডান দিকে ঘুরিয়েই গুলী করতে শুরু করে দিল। আহমদ মুসা রিভলবারের ট্রিগারে আঙুল চেপে রেখেই বাম দিক পর্যন্ত ঘুরিয়ে নিল।
তার রিভলবারের নল বাম দিকে আসার আগেই দরজা ডান দিকের দেয়ালে ঢুকে গেল। আহমদ মুসা দেখল, ডান দিকে গেটের তিন চার গজ ভেতরে একটা চেয়ারের ওপর একটা লাশ পড়ে আছে।
আহমদ মুসা খুশি হলো, দু’জনের একজন তাহলে সে।
বাম দিক থেকে গুলীবর্ষণ তখন শুরু হয়ে গেছে আহমদ মুসার দিক লক্ষ্য করে।
ডান দিকে গুলী শুরু হলে বাম দিকের লোকটি নিরাপদ স্থানে সরে যাওয়ার সুযোগ পেয়ে গিয়েছিল। এখন সে আক্রমণে এসেছে।
আহমদ মুসা তার গুলী বন্ধ করে পেছনে সরে এসেছে, যাতে সে আহমদ মুসাকে টার্গেট করার জন্যে বেরিয়ে আসে।
বেরিয়ে সে এল।
নিনা নাদিয়ার টার্গেটে সে এল। এরই অপেক্ষা করছিল নিনা নাদিয়া।
নিনা নাদিয়া তার রিভলবার থেকৈ পরপর দু’বার গুলী করল।
আহমদ মুসাকে লোকেট করার জন্যে বেরিয়ে আসা দ্বিতয়ি গার্ডকে নিনা নাদিয়ার দু’টি গুলী গিয়েই আঘাত করল। লুটিয়ে পড়ল তার দেহ গেটের ভেতরের পাশে।
নিনা নাদিয়া উঠে দাঁড়িয়েছে।
আহমদ মুসাও উঠে দাঁড়াল।
দু’জনেই গেটের ভেতরে ঢুকে গেল।
ধন্যবাদ মিস নাদিয়া। আমার পক্ষে তাকে গুলী করা অসুবিধাজনক ছিল। বলল আহমদ মুসা।
নিনা নাদিয়ার মুখ উজ্জল হয়ে উঠেছে। বলল, কৃতিত্ব আপনার প্রাপ্য। গেম মেকার আপনি। আমি মাত্র ছুটে আসা বলে পা ছুইয়েছি, বল আপনাতে গোলে গেছে।
কথা শেষ করেই নিনা নাদিয়া সামনের দরজার দিকে ইংগিত করে বলল, আসুন ঐ দরজার ওপারেই ওঁরা আছেন।
ছুটল দু’জন দরজার দিকে।
দরজা ঠেলতেই খুলে গেল।
সামনের দিকটা উন্মুক্ত হয়ে গেল। চোখে পড়ল ‘কেবিন বন্দীখানা’ গুলো।
সামনেই পাশাপাশি দুই কেবিনে বন্দী আছে এমিলিয়া ও বায়তুল আকসার খতিব শেষ আব্দুল্লাহ ইবনে আব্দুর রহমান।
এমিলিয়া ও খতিব দু’জনেই দেখতে পেয়েছে আহমদ মুসাকে।
‘ভাইয়া’ বলে কেঁদে উঠল এমিলিয়া।
আলহামদুলিল্লাহ। আসসালামু আলায়কুম, আহমদ মুসা।
আহমদ মুসা সালাম গ্রহণ করে প্রথমে তার দরজার লকটাকে গুলী করে ভেঙে ফেলল।
অন্যদিকে নিনা নাদিয়া গিয়ে ভেঙে ফেলেছে এমিলিয়ার কেবিনের দরজার লক।
এমিলিয়াকে ধরে বের করে আনল নিনা নাদিয়াই।
খতিব আব্দুল্লাহ ইবনে আব্দুর রহমানকে আগেই বের করে নিয়ে এসেছে আহমদ মুসা।
আহমদ মুসার নিকটবর্তী হয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ল এমিলিয়া।
নিনা নাদিয়া তাকে জড়িয়ে ধরে রেখেছে।
কান্নার সময় শেষ বোন। ওদিকে সবাই ভাল আছে, মুক্ত হয়েছ। তুমিও এখন সৈনিক। কোন কান্না নয়। এখন বের হতে হবে আমাদের।
বলে আহমদ মুসা তাকাল নিনা নাদিয়ার দিকে।
বুঝতে পারল নিনা নাদিয়া আহমদ মুসার চোখের ভাষা। বলল, বের হওয়ার একটা গোপন পথ আছে। কিন্তু আপনি যে দিক দিয়ে প্রবেশ করেছেন, সেই পথটাই নিরাপদ। ওদিক দিয়ে বাইরের প্রাচীর ডিঙালেই সাগর-কূলে পৌছা যাবে। সাগর কূলে গিয়ে কিছু একটা যোগাড় করতে হবে।
ধন্যবাদ মিস নাদিয়া। আপনি পথ দেখান। বলল আহমদ মুসা।
নিনা নাদিয়া চলতে শুরু করল।
তার পেছনে এমিলিয়া ও খতিব আব্দুল্লাহ ইবনে আব্দুর রহমান।
সবশেষে আহমদ মুসা।

Top