২. অপারেশন তেলআবিব-২

ইসরাইলের আভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা সার্ভিস ‘সিনবেথ’ -এর নির্যাতন সেল। অন্ধকূপের মত সেলটি। দুই হাতের বেশী প্রশস্ত নয়। পাথুরে দেয়াল। একটি মাত্র লোহার দরজা বাইরে থেকে বন্ধ। কোন জানালা নেই। বহু উঁচুতে দেয়ালের ঘুলঘুলি দিয়ে একখণ্ড আলো এসে বিপরীত দিকের দেয়ালে পড়েছে। সেলের ঘুটঘুটে অন্ধকারের বুকে ঐ গোলাকার আলোক খণ্ডকে মনে হচ্ছে যেন কারও দৈত্যাকার রক্ত চক্ষু।
জ্ঞান ফিরে পেয়েছে এমিলিয়া অনেকক্ষণ। সারা গায়ে অসহ্য বেদনা। হাত ও পায়ের আঙ্গুল তীব্র যন্ত্রণায় খসে যাচ্ছে যেন। হাত ও পায়ের আঙ্গুলে সুচ ফুটানোর দুঃসহ স্মৃতি তার সামনে এল। শিউরে উঠল সে। উঃ ! কি সে বর্বরতা !!
কিন্তু সব বেদনা, সব যন্ত্রণা ছাপিয়ে উঠেছে তার তৃষ্ণা গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। তৃষ্ণায় ফেটে যাচ্ছে বুক। যেন এক সাগর পানি হলেও এ তৃষ্ণা মিটবে না। দিন কি রাত বোঝা যাচ্ছে না। কোথা থেকে যেন একটা খট্‌ খট্‌ শব্দ কানে এল। ভারী বুট পায়ে কে যেন হেটে যাচ্ছে। তৃষ্ণা অসহ্য হয়ে উঠলো তার। যন্ত্রণায় কঁকিয়ে উঠল সে। তার মুখ ফেটে চিৎকার বেরুলোঃ পানি, পানি, পানি……।
এই সময় খট্‌ করে খুলে গেল সেলের লৌহ দরজা। প্রবেশ করল ‘সিনবেথ’-এর আই, ও (Indoor Operation) বিভাগের প্রধান জন স্যামুয়েল। তার সাথে আর একজন লোক। নাম সলোমন। হাতে তার একটি জগ ও একটি গ্লাস।
পানি দেখে উন্মুখ হয়ে উঠল এমিলিয়া। তার চোখের কোণে আশার আলো চিক চিক করে উঠল। এই মুহূর্তে তার কাছে পানির চেয়ে বড় কিছু পৃথিবীতে নেই।
মিঃ স্যামুয়েল দাঁড়িয়েই বললেন, ‘মিস পলিন ফ্রেডম্যান, আপনি কি মনস্থির করতে পেরেছেন?
প্রশ্নের কোন উত্তর না দিয়ে এমিলিয়া বলল, আমাকে পানি দিন।
-আমি দুঃখিত মিস পলিন, আপনি আমাদের সাহায্য না করলে আমরা কেমন করে আপনাকে সাহায্য করতে পারি? নির্বিকার কন্ঠে বলল স্যামুয়েল।
-কি সাহায্য আমি করতে পারি? আমি তো বলেছি, সাইমুমের কারও পরিচয় আমি জানি না। কোন ঠিকানা তাদের আমার জানা নেই।
-আপনি তাদের কোন খবর রাখেন না? হাসালেন মিস পলিন।
-বিশ্বাস করুন আমাকে। কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল এমিলিয়া।
-আপনি আমাদের সকলের শ্রদ্ধার পাত্র জাতির অনতম প্রতিষ্ঠাতা মৃত ডেভিড বেনগুরিয়ানের নাতনি। আপনার প্রতি বিশ্বাস ও শ্রদ্ধা আছে বলেই আপনার কাছ থেকে কথা বের করতে আমাদের এত দেরী হচেছ। কিন্তু আর দেরী আমরা করতে পারি না, আপনি আমাদের বিশ্বাস ও শ্রদ্ধার মর্যাদা রাখেননি।
এমিলিয়া মাথা নীচু করেছিল। তৃষ্ণায় বুক ফেটে যাচ্ছে। চোখ দিয়ে অবিরাম ধারায় নামছে পানি। সে ধীরে ধীরে চোখ মুছে ফেলল। ভাবল, এদের কাছে অনুগ্রহ ভিক্ষা করে কোন লাভ নেই, কোন কথাই এরা বিশ্বাস করবে না। যত কষ্টই হোক, মৃত্যুর সীমা পেরিয়ে তো আর কিছু ঘটবে না।
মিঃ স্যামুয়েল কিছুহ্মণ থেমে আবার বলল, আপনাকে ভাববার জন্য ১০ মিনিট সময় দিচ্ছি। এর মধ্যে আপনি আমাদের সহযোগিতা করতে রাজী না হলে ভয়াবহ পরিণতির সম্মুখীন আপনাকে হতে হবে। তড়িৎ আসনের নাম শুনেছেন নিশ্চয়?
তড়িৎ আসনের কথা শুনতেই আতংকে শিউরে উঠল এমিলিয়ার গোটা দেহ। কিন্তু নিজেকে সামলে নিল সে। বলল, ১০ মিনিট কেন ১০ দিন সময় দিলেও আমার ঐ একই কথা মিঃ স্যামুয়েল। আমি যা জানি না তা বলতে পারব না।
কোন কথা না বলে মিঃ জন স্যামুয়েল বের হয়ে গেল। তার সঙ্গে সঙ্গে বের হয়ে গেল পানিওয়ালা সলোমন। এমিলিয়ার চোখে পড়ল, পানিওয়ালা যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল, সেখানে মেঝের উপর খানিকটা পানি জমে আছে -ফোঁটা ফোটাঁ করে পড়েছিল জগ থেকে। এমিলিয়া এগিয়ে গেল পানির দিকে এক সমুদ্র তৃষ্ণা নিয়ে। দরজা এই সময় বন্ধ হয়ে গেল। অন্ধকারে ডুবে গেল ঘর। এমিলিয়া হুমড়ি খেয়ে পড়ল পানির উপর। মাটিতে ঠোঁট ঠেকিয়ে শুষে নিল পানিটুকু। গলা জিহ্বা এতে ভিজল বটে কিন্তু আরো তীব্র হয়ে উঠল তৃষ্ণার জ্বালা। মেঝে থেকে পানির শেষ চিহ্নটুকু জিহবা দিয়ে শুষে নিয়ে কান্নায় লুটিয়ে পড়ল এমিলিয়া। অনেকক্ষণ ধরে কাঁদল সে। মনে পড়ল মাহমুদের কথা। সে কি জানতে পেরেছে তার এই অবস্থা। সে কি আর কোন দিন বেরুতে পারবে এই মৃত্যুপুরী থেকে? দেখতে পাবে কি আর মাহমুদকে?
বাইরে ভারি বুটের শব্দ হল। তালা খোলার শব্দ শোনা গেল। তারপর খট্‌ করে খুলে গেল দরজা। প্রবেশ করল সেই মিঃ জন স্যামুয়েল। দরজায় দাঁড়িয়ে থাকল আরও দু’জন। মিঃ স্যামুয়েল একই ধরনের প্রশ্ন পুনরায় আওড়ালো। আপনি কি মন স্থির করতে পেরেছেন মিস পলিন?
এমিলিয়া এই নিরর্থক প্রশ্নের কোন জবাব দিল না। মিঃ জন স্যামুয়েল পুনরায় বলল, চরম পথ বেছে নিতে আমাদেরকে আপনিই বাধ্য করলেন মিস পলিন।
-যে পথই আপনারা গ্রহণ করুন, যা জানা নেই, তা আপনারা বের করতে পারবেন না। বলল এমিলিয়া।
-এ রকম কথা আমরা বহু শুনেছি, বহু জনের কাছে। কিন্তু শেষে বলতে তারা বাধ্য হয়েছে। বলে একটু থেমে দরজায় দাঁড়ানো দু’জনকে বলল, একে নিয়ে চল অপারেশন রুমে। বলে সে ঘর থেকে বের হয়ে গেল।
লোক দু’টি ঘরে ঢুকতেই এমিলিয়া অতি কষ্টে স্বেচ্ছায় উঠে দাঁড়ালো। দরজার সামনে রাখা স্ট্রেচারে শুয়ে পড়ল সে। লোক দু’জন ধরাধরি করে নিয়ে চলল স্ট্রেচার।
বাইরের খোলা বাতাস বুক ভরে গ্রহণ করল এমিলিয়া। কোথায় তাকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, তা সে জানে। এক মহা আতংক এসে তার বুকে চেপে বসতে চাইছে। মনকে হালকা করতে চাইল সে। তাকে লম্বা বারান্দা দিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। বারান্দার পাশ দিয়ে এক ফালি নীল আকাশ দেখা যাচ্ছে। নীশ আকাশের বুকে একখন্ড সাদা মেঘ কোন অজানার পথে পাড়ি জমিয়েছে। বেদনায় মোচড় দিয়ে উঠল এমিলিয়ার বুক। হায়রে মুক্ত জীবন।
হঠাৎ নীল আকাশ কোথায় হারিয়ে গেল। তাকে প্রবেশ করানো হলো একটি ঘরে, সে ঘর থেকে আর একটি ঘর। এ ঘর থেকে একটি সংকীর্ণ সিঁড়ি নেমে গেছে ভূগর্ভে। ভূগর্ভের সিঁড়ি দিয়ে এমিলিয়াকে নিয়ে পৌঁছানো হলো একটি প্রশস্ত কক্ষে। সেখানে আগে থেকেই উপস্থিতি ছিল মিঃ জন স্যামুয়েল এবং আরও দু’জন লোক। স্ট্রেচার সমেত এমিলিয়াকে রেখে বাহকরা ঘর থেকে বের হয়ে গেল।
পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ঘরটি। আসবাব বাহুল্য নেই। চারদিকে পাথরের দেয়াল। উত্তর দিকের দেয়ালে লোহার গরাদে ঢাকা একটি স্থান। মনে হলো জানালা। ঘরের ঠিক মাঝখানে কয়েক ইঞ্চি উঁচু একটি বেদীর উপর লম্বা ও সুদৃঢ় একটি কাঠের পাটাতন। পাটাতনের দু’পাশ থেকে দু’টি করে চামড়ার মোটা বেল্ট বের হয়ে এসেছে। পাটাতনের উপর পড়ে আছে একটি ইলেকট্রিক ম্যাগনেটো। জ্বলজ্বল করছে তার উপর সাদা দু’টি বোতাম। পাশেই সুইচ বোর্ড। ওদিকে একবার চেয়েই বুঝতে পালো-সেটা কি। এমিলিয়ার প্রতিটি স্নায়ুতন্ত্রী, প্রতিটি রক্ত কণিকায় যন্ত্রণার উষ্ণ স্রোত বয়ে গেল। সে মন শক্ত করতে চেষ্টা করল, মৃত্যুর পরপারে তো আর এ যন্ত্রণা পৌঁছবে না।
এই সময় মিঃ স্যামুয়েল এমিলিয়ার দিকে চেয়ে বলল, ‘সময় আছে এখনও মিস পলিন। আপনি সচেতন, আপনি শিক্ষিতা। আপনার সামনে রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক কষ্টের মধ্যে দিয়ে তিলে তিলে মৃত্যু, আর ক্ষমা এবং সুখ স্বাচ্ছন্দপূর্ণ জীবন। আপনি কোনটি করবেন, আপনিই ভেবে দেখুন।
এমিলিয়া মিঃ স্যামুয়েলের দিকে চেয়ে স্পষ্ট কন্ঠে বলল, সাইমুমের লোকজনদের পরিচয় ঠিকানা জানলেও আমি বলতাম কি না জানি না, তবে আমি আগেও বলেছি আবার বলছি তাদের কারও পরিচয়, ঠিকানা আমি জানি না।
সাপের মত ঠান্ডা এক হাসি টেনে নিরুত্তাপ স্বরে বলল মিঃ স্যামুয়েল, ‘আমি তা জানি মিস পলিন। আমাদের আগেই বোঝা উচিত ছিল, আজকাল মেয়ে স্পাইরাই সবচেয়ে কঠিন হয়ে থাকে‌ গত দু’দিনের অভিজ্ঞতায় আপনাকে দিয়েই এ বোধটা আমাদের মনে নতুন করে জাগল।’ বলে সে উঠে দাঁড়ালো।
উঠে গরাদ-ঢাকা সেই স্থানটিতে গিয়ে দাঁড়াল। একটি ছোট্ট হাতল ঘুরিয়ে গরাদ খুলে ফেলল। উন্মুক্ত হল একটি জানালা পথ। সে এমিলিয়ার দিকে চেয়ে বলল, আসুন মিস পলিন, দেখুন।
যন্ত্র-চালিতের মত উঠে গিয়ে স্যামুয়েলের পাশে দাঁড়াল এমিলিয়া। স্যামুয়েল জানালার পাশে একটা বোতামে চাপ দিল। অমনি জানালার বাইরের অন্ধকার সরে গেল। জানালার পাশ দিয়ে চলে যাওয়া সুগভীর পয়ঃপ্রণালী স্পষ্ট হয়ে উঠল। পয়ঃপ্রণালীর দু’পাশ দিয়ে প্রশস্ত করিডোর। মিঃ স্যামুয়েল সামনের করিডোরের দিকে ইঙ্গিত করে বলল, ‘চেয়ে দেখুন।’
এমিলিয়া তাঁর ইঙ্গিত অনুসরণ করে চেয়ে দেখল, নরমুন্ডের বিরাট স্তুপ।
স্যামুয়েল বলল, আমরা এই কক্ষে সহজে কাউকে আনি না। কেউ আসলে সে আর ফিরে যায় না। ঐ নরমুন্ডের স্তুপই তার প্রমান। তড়িৎ আসন ব্যর্থ হলে ঐ নরমুন্ডের মিছিলে তার স্থান।
এমন দৃশ্যের সম্মুখীন হলে আগে সে হয়ত ভয়ে ভিমরি খেয়ে যেতো, কিন্তু আজ তার সে অবস্থা নেই। অনুভূতি তার যেন ভোঁতা হয়ে গেছে। কোন উত্তর দিল না সে মিঃ স্যামুয়েলের কথার।
মিঃ স্যামুয়েল জানালা বন্ধ করে দিল। তারপর যন্ত্রের মত দাঁড়ানো লোক দু’জন একজনকে সম্বোধন করে বলল, ‘আইজাক, অধিবেশনের কাজ শুরু কর’ বলে সে ঘরের চেয়ারটিতে গিয়ে বসল।
এমিলিয়ার দিকে এগিয়ে এল আইজাক। কেঁপে উঠল এমিলিয়ার বুক। আইজাকের ইঙ্গিতে যন্ত্রচালিতের মত শুয়ে পড়ল এমিলিয়া পাটাতনের উপর। থর থর করে কাঁপছে গোটা শরীর। গলা-জিহ্বা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আছে। প্রকট হয়ে উঠল বুক-ফাটা তৃষ্ণা। এমিলিয়া স্থির করেছিল, কোন অনুরোধ কাউকে করবে না সে। কিন্তু পারল না। মুখ থেকে আপনিই বেরিয়ে গেল পানি, পানি দাও।
দু’পাশ থেকে চামড়ার বেল্ট শক্ত করে বেঁধে ফেলেছিল এমিলিয়াকে। শরীরটা পাটাতনের সাথে এক হয়ে গেছে, নড়বার শক্তি ছিল না এতটুকুও। চেয়ারে বসেই কথা ছুঁড়ে মারল স্যামুয়েল, সাহায্য করতে পারলাম না বলে দুঃখিত মিস পলিন।
এমিলিয়ার দু’চোখ থেকে কানের দু’পাশ দিয়ে নেমে এল অশ্রুর দু’টি ধারা। তার শুকনো জিহ্বা আর শুকনো ঠোঁট থেকে অষ্ফুটে বেরুলো, আল্লাহ, তুমি সর্বশক্তিমান সবার উপর ক্ষমতাশালী তুমি।
এমিলিয়ার মুখে গুঁজে দেয়া হলো বড় একটি কাপড়। তার কিছু অংশ পোটলা হয়ে মুখের ভিতরে থাকলো, কিছু অংশ থাকলো বাইরে।
সকল প্রস্তুতি শেষ করে ইলেকট্রিক ম্যাগনেটোর সাথে কানেকশন নেয়া হলো সুইচ বোর্ডের। অন করল সুইচ। আইজাক ছোট্ট করে চাপ দিল ম্যাগনেটোর একটি বোতামে। গোটা দেহ হঠাৎ খিচুনী দিয়ে উঠলো এমিলিয়ার। অষ্ফুট গোঙ্গানী বেরুলো মুখ থেকে। চোখ দু’টি তার বিষ্ফোরিত হলো। বোতাম থেকে হাত উঠিয়ে নিল আইজাক।
দেহের খিচুনী থেমে গেল। কিন্তু গোঙ্গানী থামল না। হাঁপাচ্ছে এমিলিয়া। তার ঠোঁট কাঁপছে, চোখের পাতা কাঁপছে, থর থর করে কাঁপছে তার গোটা দেহ।
এবার বোতামে চাপ দিল আইজাক। আবার শুরু হলো সেই খিচুনী, ফুলে ফুলে উঠছে গোটা শরীর। চোখ দু’টি বিষ্ফোরিত হয়ে বের হয়ে আসছে যেন। চামড়ার বেল্ট কেটে বসে যাচ্ছে শরীরে।
এমিলিয়ার শরীরে ছড়িয়ে পড়েছে যন্ত্রণার এক ভয়াবহ আগুন। প্রতিটি মাংসপেশীর প্রতিটি কণিকাকে যেন কেটে কেটে পৃথক করে দিচ্ছে, আর সেই কণিকাগুলোকে ঝাঝরা করে দিচ্ছে আগুনের অসংখ্য সূঁচ।
চোখের প্রতিটি মাংস কণিকা যেন খন্ড খন্ড হয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ছে। সর্বশক্তি দিয়ে কামড়ে ধরেছে মুখে গুঁজে দেয়া কাপড়। দাঁতগুলো কেটে বসে গেছে কাপড়ে। অসহ্য যন্ত্রণা চেতনার প্রান্তসীমায় নিয়ে গেল এমিলিয়াকে। জ্ঞান হারিয়ে ফেলল সে।

সিনবেথ হেড কোয়ার্টারের বেয়ারা সলোমন। আজ পচিঁশ বছর হলো আছে সে এই চাকুরীতে। বয়স তার এখন পঞ্চাশ। জীবনের পঁচিশ বছর সে কাটিয়েছে বীরশিবায়। বীরশিবা তার জন্মস্থান।
তৃষ্ণার্ত এমিলিয়াকে পেছনে রেখে যখন সে সেল থেকে বের হয়ে আসছিল তখন তার মন গিয়ে পড়েছিল বীরশিবায়। তার চোখে ভেসে উঠেছিল এমনি একটি দৃশ্য। প্রায় পঁচিশ ছাব্বিশ বছর আগের কথা। বীরশিবা তখন একটি সমৃদ্ধ মুসলিম জনপদ। মুসলিম মহল্লারই একপ্রান্তে ছিল সলোমনদের বাড়ী। তারই ছিল বীরশিবার একমাত্র ইহুদী পরিবার। সুখে দুঃখে একাত্ম হয়েছিল তারা মুসলমানদের সাথে। হঠাৎ ওলট-পালট হয়ে গেল সব। দলে দলে এল ইহুদী। কেউ রাশিয়ার, কেউ জার্মানীর, কেউ আমেরিকার। উচ্ছেদ করা হলো মুসলমানদের। সে কি নির্মম দৃশ্য। মুমূর্ষ মানুষের কত করুণ আকুতি সে দেখেছে। মনে পড়ে সলোমনের এমনি একজন প্রতিবেশী মুমূর্ষ মানুষের মুখে পানি তুলে দিতে গিয়ে নবাগত মারমুখো ইহুদীদের হাতে সে কেমনভাবে লাঞ্চিত হয়েছিল। তার চোখের সামনেই বুক ভরা পিপাসা নিয়ে তার মুমূর্ষ প্রতিবেশী চিরতরে চোখ মুদেছিল। আজ পিপাসাকাতর এমিলিয়ার মুখ দেখবার পর তারই কথা মনে হচ্ছিল সলোমনের। সলোমন রাজনীতি করে না, রাজনীতি বোঝে না। সকল নির্যাতনের বিরোধী সে। সাধ্য থাকলে ওই ফুলের মত মেয়েটিকে সে এদের হাত থেকে বাঁচাতো। সে জানে মেঝেতে ফেলা ঐ কয়েক ফোঁটা পানি এমিলিয়ার তৃষ্ণা মেটাতে পারবে না, তবু মনকে প্রবোধ দেয়ার জন্যই সে তা করেছিল।
বারটায় ডিউটি শেষে যখন সে অফিস থেকে বেরুচ্ছিল, তখন এমিলিয়ার চিন্তা তার সারা মন জুড়ে ছিল। ডেভিড বেনগুরিয়ানের মত লোকের নাতনি কি-ই বা এমন অপরাধ করেছে। অপারেশন রুমে মেয়েটি নির্ঘাত নরপশুদের অত্যাচারে মারা পড়বে।
মরদেশাই রোডের এক বাড়ীতে বাস করে সলোমন। তার বাড়ীর পাশেই একটি ফলের দোকান। দোকানের মালিক বৃদ্ধ খলিল শেখ। সলোমনের বন্ধু। বৃদ্ধ খলিলের বাড়ী ছিল জেরুজালেমের নিকট বিরসুবিরে। তার শশুর বাড়ী ছিল বীরশিবায়। সে যেত মাঝে মাঝে সেখানে। সেই থেকেই তার সাথে সলোমনের পরিচয়। সলোমন তার অবসর সময়ের অধিকাংশই খলিলের দোকানে আড্ডা দিয়ে কাটায়। সলোমন ফিলিস্তিনে বহিরাগত ইহুদীদের বাড়াবাড়ি কোন দিনই পছন্দ করতে পারেনি। এ বিষয়ে দু’জনের মধ্যে পূর্ণ ঐক্যমত রয়েছে। এ নিয়ে কত আলোচনা আর কত অভিজ্ঞতা বিনিময় হয় দু’জনার মধ্যে। বহিরাগত ইহুদীদের বিরুদ্ধে সলোমনের সবচেয়ে বড় অভিযোগ হলো, “ওরা বাইরে থেকে উড়ে এসে দেশের সমস্ত বড় বড় চাকুরী ও সম্পদ-সম্পত্তিতে জুড়ে বসেছে, আর মুষ্টিমেয় স্থানীয় ইহুদীরা চাপরাশী, কেরানী ও মুটে-মজুরের জীবন যাপন করছে।”
এ দিনও সলোমন অফিস থেকে ফিরে খাওয়া সেরে খলিলের ফলের দোকানে গিয়ে দেখা দিল। সলোমনকে দেখেই খলিল আগ বাড়িয়ে বলল, এস, এস, কেমন আছ?
-আর থাকা! মন বড় ভাল লাগছে না।
-কেন, কিছু হয়েছে বাড়ীতে? উদ্বিগ্ন খলিল।
-বাড়ীতে আর কি হবে, ঐ অফিসের কথাই বলছি!
-অফিসে আবার তোমার কি হলো?
-আমার আবার কি হবে? রোজ রোজ কি ঐসব দেখা যায়। আজ আবার বেনগুরিয়ানের নাতনিটিকে ধরে নিয়ে গেছে। এতটুকু এক মেয়ের উপর উঃ! কি অত্যাচার !! দু’দিন থেকে মেয়েটাকে পানিও খেতে দেয়নি।
সলোমনের কথা শুনে চমকে উঠলো খলিল। কিন্তু সামলে নিল নিজেকে। স্বাভাবিক কন্ঠে বলল, খুব মায়া হচ্ছে না?
-মায়া! সাধ্য থাকলে মেয়েটাকে নরপশুদের হাত থেকে ছিনিয়ে আনতাম।
-মানুষের অসাধ্য কিছু আছে নাকি? হেসে বলল খলিল।
-অসাধ্য কিছু নেই। আমিও তা জানি। আমিও পারি, বাঁচাতে পারি মেয়েটাকে। কিন্তু কি লাভ হবে তাতে? সিনবেথের হাত থেকে পরে সেও বাঁচবে না, আমিও বাঁচব না।
মনে মনে অধীর হয়ে উঠেছে, উত্তেজিত হয়ে উঠেছে খলিল। তবু শান্ত কন্ঠে সে বলল, তা ঠিক বলেছ। অর্থহীন ঝুঁকি নিয়ে কি লাভ?
এইভাবে খলিল ও সলোমনের মধ্যে গল্পের যে শুরু হলো, তা প্রতিদিনের রীতিমত নিরবচ্ছিন্নভাবে চল্লই কিন্তু প্রতিদিনের মত খলিল গল্পে মন বসাতে পারছিল না। এক সময় সে বলল, সলোমন তুমি বস, খবরের কাগজগুলো দেখ। আমি মিনিট পনের পর আসছি।
সলোমন বলল, আমিও উঠি খলিল, একটু স্টেডিয়ামের দিকে যাব। বেশ ভাল খেলা আছে আজ। বলত, তোমার টিকিটও কেটে রাখব।
খলিল বলল, আজ বোধ হয় সময় পাব না সলোমন।
সলোমন উঠে যেতেই খলিল ভিতরে ঢুকে গেল। পার্শ্বের ঘরে বসার একটি বেদী উল্টিয়ে একটি গোপন সিঁড়ি পথ ধরে নীচে নেমে গেল সে। খলিল সাইমুমের তেলআবিবস্থ ৪নং ঘটির একজন দায়িত্বশীল ব্যাক্তি। ওয়াজম্যান রোডের ৪নং ঘাটির সাথে একটি গোপন সুড়ঙ্গ দ্বারা সংযুক্ত। মরদেশাই রোডের এই ফলের দোকানের পরিচালনার ভার তারই হাতে রয়েছে।

গ্রীণ লজ। তার একটি কক্ষে পা এলিয়ে বসে ছিল মাহমুদ। সামনে জানালা দিয়ে জলপাই গাছের মাথার ওপর দিয়ে দেখা যাচ্ছে একখন্ড নীল আকাশ। ঘন সবুজ জলপাই গাছের মাথায় যেন নীলের প্রলেপ।
কিন্তু কিছুতেই মন নেই মাহমুদের। কাল রাত থেকে সে ভাবছে। ক্ষত-বিক্ষত হচ্ছে সে এক অসহ্য যন্ত্রণায়। কিন্তু এ যন্ত্রণা কাউকে জানানোর নয়। এমিলিয়াকে সে ভালবাসে। এ ভালবাসাই তাকে দুর্বল করে দিচ্ছে, শুষে নিচ্ছে শক্তি ও উদ্যম। ইসরাইলী বর্বরতার হাত থেকে ওকে বের করে আনতে হলে ঝুঁকি নেয়া প্রয়োজন। কিন্তু তার এমিলিয়ার জন্য সহকর্মীদের মূল্যবান জীবনকে সে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিবে কেন?
তেলআবিবের সকল সাইমুম-সদস্যদের মধ্যেও এসেছে ভাবান্তর। এমিলিয়ার ঘটনা সকলের মনকেই পীড়া দিচ্ছে। তারা সকলেই অপেক্ষা করছে নির্দেশের, কিন্তু পাথরের মত নীরব-নিস্পন্দ মাহমুদের কাছ থেকে কোন সাড়া তারা পায়নি।
চিন্তার অথৈ স্রোতে ডুবে গিয়েছিল মাহমুদ। পায়ের শব্দে চমকে দরজার দিকে চোখ ফিরালো সে। দেখল, রায়হান ঘরে ঢুকছে। রায়হানকে দেখে সোজা হয়ে বসে মাহমুদ বলল, কোন মেসেজ রায়হান?
-হেড কোয়ার্টার থেকে আপনার কল, মুসা ভাই কথা বলবেন।
লাফ দিয়ে উঠল মাহমুদ। খুব গুরুত্বপূর্ণ না হলে আহমদ মুসা লাইনে আসে না, মেসেজ পাঠায়। মাহমুদ দ্রুত রেডিও রুমে চলল।
সালাম বিনিময়ের পর প্রথমেই জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা, এমিলিয়ার খবর কি?
-পরবর্তী কোন খবর আর পাইনি।
-কোথায় রেখেছে তাকে?
-বোধ হয় কারাগারে।
-বোধ হয় কেন? এ খবরটুকুও নেওনি?
মাহমুদ নীরব। কি জবাব দেবে সে? কি বোঝাবে, কেমন করে সে বোঝাবে আহমদ মুসাকে। আহমদ মুসা বোধ হয় আঁচ করতে পারল মাহমুদের অবস্থা। সেও আনমনা হয়ে পড়ল। অনেক আগে ফেলে আসা এক অতীতে হারিয়ে গেল সে। হিমালয়ের এক অন্ধকার গুহায় ফেলে আসা ফারজানার মুখটি অনেকদিন পর আজ তার চোখে ভেসে উঠল। আহমদ মুসা ধীর স্বরে ডাকল, মাহমুদ!
-জি! উত্তর দিল মাহমুদ।
-তোমার দুর্বলতা ঢাকতে গিয়ে, একটি জীবনকে তুমি এক অসহ্য যন্ত্রণাদায়ক মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিবে, তা তো আমি ধারণা করতে পারিনি। তুমি কি জান না, ইসরাইলের Indoor Operation-এর শয়তানরা কত নরপশু।
কেঁপে উঠলো মাহমুদ। তার গোটা শরীরে ছড়িয়ে পড়ল অসহ্য এক যন্ত্রণা। কোন জবাব দিতে পারল না সে।
আহমদ মুসা আবার বলল, শোন আমার নির্দেশ, যে কোন মূল্যে এমিলিয়াকে বাঁচাতে হবে। সে আমাদেরই একজন। তার প্রতি আমাদের দায়িত্ব আছে। আমাদের জন্য সে যা করেছে, তা আমরা কেউই ভুলতে পারিনা।
আপনার আদেশ আমরা পালন করব জনাব। ধীর কন্ঠে বলল মাহমুদ। তার চোখে মুখে দৃঢ় সংকল্পের ছাপ।
-আর শোন, আগামী ২৫শে ফেব্রুয়ারী মিসর, সিরিয়া, জর্দান ও লেবাননের সঙ্গে ইসরাইলের শান্তি-চুক্তি স্বাক্ষরিত হচ্ছে। আর ২৭ শে ফেব্রুয়ারী ইসরাইলের ‘সাবাত দিবস’। আজ থেকে ঠিক ১ মাস ১ দিন পর। ইনশাআল্লাহ ঐ দিনটিই হবে ইসরাইল রাষ্ট্রের শেষ আনন্দের দিন। আমি ১১ ই ফেব্রুয়ারী ইসরাইলের শেষ কৃত্যের জন্য তেলআবিব আসছি।

মাহমুদ রেডিও রুম থেকে বেরিয়ে ঘরে প্রবেশ করে দেখে শেখ জামাল বসে আছে।
-কি সংবাদ জামাল? মাহমুদ বলল।
-এইমাত্র কিছু খবর খলিলের কাছ থেকে পাওয়া গেল।
-কি খবর?
-মিস্‌ এমিলিয়াকে আজ সকালে সিনবেথের অপারেশন চেম্বারে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। গত দু’দিন তাঁর উপর নির্মম অত্যাচার চলেছে, পানিও খেতে দেয়া হয়নি।
-হুঁ! দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে একটি ছোট্ট জবাব দিল মাহমুদ। এক ঘন্টা সময় আছে, যাও প্রস্তুত হও। শেখ জামাল বেরিয়ে গেল।

Top