আহমদ মুসা ভি, আই, পি, রুম থেকে বেরিয়ে বিমান চত্বরে একটি চক্কর দিয়ে টয়লেটের দিকে চললো। সাধারণ আরবী পোশাক তাঁর দেহে। টয়লেটে ঢুকতে গিয়ে একটি মুখের দিকে নজর পড়তেই তার চিন্তা যেন হোঁচট খেল। কাঁধে ক্যামেরা ঝোলানো একজন লোক বেরিয়ে আসছিল টয়লেট থেকে। সোডিয়াম লাইটের ধবধবে আলো লোকটির মুখের প্রতিটি রেখা যেন আহমদ মুসার কাছে স্পষ্ট করে তুলল। জোড়া ভ্রু, নাকের ডানপাশে কাটা দাগ, ঝুলে পড়া ঠোঁট, কোথায় যেন এ মুখ তিনি দেখেছেন। লোকটির পিছনে আর একজন লোক বেরিয়ে এল। এই লোকটিকে আহমদ মুসা চেনে-বাদশা শরিফের খাস ড্রাইভারদের প্রধান।
আহমদ মুসা টয়লেটে ঢুকলো। কিন্তু উড়োজাহাজের প্রফেলারের মত চিন্তা তার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল-‘তাস’-এর এ সাংবাদিক ভদ্রলোকটি কে? হঠাৎ তাঁর চোখের সামনে ভেসে উঠল ডসিয়ার এলবামের একটি মুখ, সেই জোড়া ভ্রু, নাকের ডানপাশে কাটা দাগ, ঝুলে পড়া ঠোঁট। নাম ইসাক এলিস। ইরগুণ জাই লিউমির দুর্ধর্ষ ইহুদী স্পাই। কথাটা মনে হওয়ার সাথে সাথে গোটা শরীর রোমাঞ্চ দিয়ে উঠল আহমদ মুসার। ‘ইরগুণ জাই লিউমি’র অপারেশন স্কোয়ার্ডের মধ্যমণি ইসাক এলিস এখানে? ‘তাস’ করেসপন্ডেন্ট সে কবে থেকে? বিজলির চমকের মত আর একটি প্রশ্ন ছুটে এল তাঁর মনে-খাস ড্রাইভার প্রধান শরীফ আলম ইসাক এলিসের পিছনে বেরিয়ে গেল কেন? শাহ ফয়সালের শাহাদতের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটতে যাচ্ছে না তো? কেঁপে উঠল মুসার লৌহ হৃদয়ও। আকাশে জেট ইঞ্জিনের শব্দ শোনা যাচ্ছে, ল্যান্ড করছে শাহ সউদের বিমান। টয়লেট থেকে ছুটে বেরিয়ে গেলো আহমদ মুসা। ঐ তো রানওয়ে দিয়ে ছুটে আসছে শাহ সউদের বিশেষ বিমানটি। বাদশাহ হাসান শরিফ ও উর্ধতন নেতৃবৃন্দ বিমান চত্বরে এসে দাঁড়িয়েছেন মহান অতিথিকে সম্বর্ধনার জন্য। দ্রুত কাজ করছিল আহমদ মুসার মন। বিন্দু বিন্দু ঘাম তাঁর কপালে। চোখে তাঁর দৃঢ় সিদ্ধান্তের ছাপ।
টয়লেট থেকে বেরিয়ে সে সোজা গেলো সালাম গ্রহণ মঞ্চের পিছনে দাঁড়ানো আবুল আসের কাছে। আবুল আস সাইমুমের রাবাত ইউনিটের প্রধান। খুব নীচু গলায় আহমদ মুসা বলেলো, ‘তাস’ করেসপন্ডেন্টের দিকে নজর রেখো, ওকে আমাদের চাই-ই। ড্রাইভার শরিফ আলমকেও সন্দেহ করছি। বলেই আহমদ মুসা দ্রুত ফিরে এলো বিমানের দিকে। বিমানের খোলা দরজায় সিঁড়ি লাগানো হয়ে গেছে। পরক্ষণেই দেখা গেল, শাহ সউদ নেমে আসছেন সিঁড়ি দিয়ে। সিঁড়ির গোড়ায় দাঁড়িয়ে বাদশাহ হাসান শরিফ। আহমদ মুসা গিয়ে দাঁড়ালেন বাদশাহর পাশে। মন তাঁর ছটফট করছিল। অবিলম্বে কয়েকটি কথা বলা দরকার বাদশাহকে। কিন্তু ফুরসৎ কই? এখান থেকে সোজা ওঁরা যাবেন সালাম গ্রহণ মঞ্চে, তারপর সেখান থেকে গাড়ীতে। কিন্তু বলতেই হবে তাঁকে কথা।
সুযোগ জুটে গেল। বিমান চত্বর থেকে ফেরার পথে শাহ সাহেব ও প্রধানমন্ত্রী হাস্যালাপ করছিলেন। সেই সুযোগে আহমদ মুসা বাদশাহকে বলল, এই মুহূর্তেই আপনাকে দু’টি আদেশ দিতে হবে, অত্যন্ত জরুরী।
বাদশাহ কিছুটা উদ্বেগ নিয়ে বললেন, বলুন।
পূর্ব নির্দিষ্ট গাড়ী বাদ দিয়ে সেনাবাহিনীর গাড়ী কিংবা অন্য কোন গাড়ীতে আপনাদের যাবার ব্যবস্থা করতে বলুন, ড্রাইভার শরিফ আলমকে অবিলম্বে গ্রেপ্তার করতে বলুন, আর ‘তাস’ করেসপন্ডেন্টকে আমরা গ্রেপ্তার করতে চাই।
-কিছু হয়েছে, কিছু ঘটেছে? এবার স্পষ্ট উদ্বেগ ঝরে পড়ল বাদশাহর কন্ঠে। তিনি প্রায় দাঁড়িয়ে পড়লেন।
-পরে সব জানতে পারবেন, আপনার রায় বলুন।
-আমি আবু আমরকে এখনই নির্দেশ দিচ্ছি। আবু আমর মরক্কোর সিকিউরিটি প্রধান।
গার্ড অব অনার শেষে সাংবাদিকদের সাথে সংক্ষিপ্ত দু’চারটি কথা বলার পর বাদশাহ হাসান শরিফ ও শাহ সউদ যখন সেনাবাহিনীর একটি গাড়ীর দিকে এগুচ্ছিলেন, ঠিক সেই সময় পূর্ব নির্দিষ্ট গাড়ীর পাশে এ্যাটেনশনভাবে দাঁড়ানো ড্রাইভার শরিফ আলমকে দু’জন নিরাপত্তা পুলিশ ধরে নিয়ে গেল।
বাদশাহর গাড়ী চলে যাবার পর বিমান বন্দরের বহিরাঙ্গন থেকে সাংবাদিকদের জন্য নির্দিষ্ট খোলা জিপটিও যাত্রা করল। দেখা গেল ‘তাস’ করেসপন্ডেন্ট আঁদ্রে শুখানভ ওরফে ইসাক এলিসও উঠে বসলেন ড্রাইভারের পাশের সিটে। সাংবাদিকদের জীপের পিছনে আর একটি ল্যান্ড রোভার ষ্টার্ট নিল। গাড়ীর পিছনের সিটে দু’জন মুকোশধারী, ড্রাইভিং সিটে আবুল আস নিজে। তাঁদের গাড়ী যখন বিমান বন্দরের গেট পার হলো, সেই সময় পিছন থেকে প্রচন্ড বিষ্ফোরণের শব্দ শোনা গেল। সালাম গ্রহণ মঞ্চের পার্শ্বে দাঁড়ানো ড্রাইভার শরীফ আলমের গাড়ীর ছাদ প্রচন্ড বিষ্ফোরণে উড়ে গেছে-জ্বলছে লিমোজিনটি। আবুল আস দেখতে পেল-সামনের সাংবাদিক জিপটি থেমে গেছে। জীপ থেকে লাফিয়ে পড়লেন রয়টার এবং এ, এফ, পি’র করেসপন্ডেন্ট। ছুটছেন তাঁরা বিমান বন্দরের দিকে দুর্ঘটনা দেখার জন্য। একটু পরে আঁদ্রে শুখানভ ওরফে ইসাক এলিসও নামলেন। আবুল আসের গাড়ীটিও সাংবাদিক জীপের পিছনে এসে থেমে গিয়েছিল। আর একটি নীল রংয়ের ভক্সওয়াগন এসে আবুল আসের গাড়ীর পিছনে থেমে গেল। আবুল আস মুখোশধারীদের একজনকে বললো, ‘তুমি আমার সাথে এসো।’ বলে আবুল আস গাড়ী থেকে নেমেই দেখলো, এলিস পিছনের গাড়ীটার পাশে প্রায় পৌঁছতেই দরজাটি হঠাৎ খুলে গেল, আর ঝুপ করে সে ঢুকে গেল গাড়ীর ভিতরে। সঙ্গে সঙ্গে নড়ে উঠলো গাড়ী। ব্যাপারটি বুঝে ফেলল আবুল আস। গুলী করল সে গাড়ীর টায়ার লক্ষ্য করে। কিন্তু লক্ষ্যভ্রষ্ট হলো সে গুলী। গাড়ীটির জানালা দিয়ে ডিম্বাকৃতি একটি বস্তু ছুটে এসে সশব্দে ফেটে গেল। মুহূর্তের মধ্যে গাঢ় কাল ধোয়ায় ছেয়ে গেল স্থানটি। আবুল আস তার নিজের গাড়ীও ঠাহর করতে পারলো না ধোঁয়ার সেই গাঢ় আবরণে। মুহূর্তকয় পর ধোঁয়া যখন সরে গেল, তখন পিছনের গাড়ীটির কোন অস্তিত্ব কোথাও নেই।
ইসাক এলিসকে নিয়ে এয়ারপোর্ট রোড ধরে তীব্র বেগে ছুটে চলছিল সেই নীল রংয়ের ভক্সওয়াগন। এলিসসহ মোট তিনজন আরোহী। এলিস পিছনের অন্ধকার ঢাকা পথের দিকে চেয়ে আশ্বস্ত হলো -না কেউপিছু নেয়নি। পরে পাশের লোকটির দিকে চেয়ে বলল, ‘শরিফ ধরা পড়েছে রবিন।’ রবিন নামক লোকটি বলল, শাহ ও বাদশাহকে অন্য গাড়ীতে দেখেই আমি তা বুঝতে পেরেছিলাম।
টাইম বোম্ব সে যথাসময়েই গাড়ীতে সেট করতে পেরেছিল, কিন্তু শেষ মুহূর্তে সব পন্ড হলো কি করে আমি তাই ভাবছি। বলল এলিস।
-আপনার পিছু নিয়েছিল ওরা কারা?
-যারাই হোক, সরকারের লোক নয়, এরাই ধরিয়ে দিয়েছে শরিফ আলমকে।
-আমার ধারণা, ওরা সাইমুমের লোক। আপনার পরিচয় শুধু ওদের পক্ষেই জানা সম্ভব।
এলিসের গাড়ীর পিছনে নিঃশব্দে ঝড়ের গতিতে ছুটে আসছিল আর একটি গাড়ী। কালো রং-এর ল্যান্ড রোভার। হেড লাইট নিভানো, তাই আগের গাড়ীর আরোহীদের কাছে গাড়ীটি অজ্ঞাতই রয়ে গেছে। গাড়ীতে একজন মাত্র আরোহী। আরবীয় পোশাক পরিধানে। কানের পাশ দিয়ে নেমে আসা রুমাল মুখের অধিকাংশ ঢেকে রেখেছে। তার পাশে পড়ে রয়েছে একটি সাব-মেশিনগান।
এলিসের গাড়ী এয়ারপোর্ট রোড ছেড়ে জনবিরল এরাবিয়ান হাইওয়েতে গিয়ে পড়ল। এই সময় সামনে থেকে আর একটি গাড়ী এসে পড়ল। তার হেড লাইটের আলোতে এলিসদের গাড়ীসহ পিছনের গাড়ীটি আলোকিত হয়ে উঠল। দৃর্ভাগ্যই বলতে হবে পিছনের গাড়ীর আরোহীর। তার অস্তিত্ব সামনের গাড়ীর আরোহীর কাছে পরিস্কার হয়ে গেল। প্রমাদ গুণল পিছনের গাড়ীর আরোহী।
এলিসদের গাড়ীর গতিবেগ বেড়ে গেল। গতিবেগ বাড়ালো পিছনের গাড়ীটিও। পিছনের গাড়ীর আরোহীর চোখ দু’টি সামনের গাড়ীর প্রতি স্থিরভাবে নিবদ্ধ। মুখে তার দৃঢ় সংকল্পের ছাপ। স্পিডোমিটারের কাঁটা কাঁপছে। ৮০ পেরিয়ে কাঁটা ৯০ ছুঁই ছুঁই করছে। সামনের গাড়ীর স্পিডোমিটারের কাঁটা তখন ৮০’তে, পারছে না প্রতিযোগিতায়। পিছনের গাড়ীটি মিনিট দেড়েকের মধ্যেই ধরে ফেলল সামনের গাড়ীটিকে। আগের গাড়ীর নিকটে আসতেই এক ঝাঁক গুলী এসে পিছনের গাড়ীর গায়ে লাগল। তবু বেপরোয়া আরোহীটি তার গাড়ী এনে সামনের গাড়ীর পথ রোধ করে দাঁড়াল। থেমে গেছে এলিসদের গাড়ীও, আলো নিভে গেছে তার। গাড়ীটি থামিয়েই আরবী পোশাকের আরোহীটি সাবমেশিনগানটি নিয়ে গড়িয়ে নেমে পড়েছে নীচে। চোখ তার ইনফ্রারেড গগলস। অন্ধকার স্বচ্ছ হয়ে উঠেছে তার চোখে। ঐ গাড়ী থেকে গুলীবৃষ্টি হচ্ছে। পিছনের গাড়ীর আরবীয় পোশাকের আরোহিটি কোন প্রত্যুত্তর না দিয়ে সাপের মত এগিয়ে চলেছে এলিসদের গাড়ীর দিকে। রাস্তার উত্তর পাশের ঢাল বেয়ে নিঃশব্দে এগুচ্ছিল সে। কোন প্রত্যুত্তর না পেয়ে ওপারের গুলীও বন্ধ হয়ে গেল। আরবীয় পোশাকের আরোহী দেখতে পেল, এলিসের গাড়ীর এপাশে লম্বালম্বি শুয়ে আছে একজন, হাতে তার উদ্যত স্টেনগান। মাথা ঈষৎ উঁচু করে সে চারিদিকটা একবার ভাল করে দেখার চেষ্টা করছে। পিছনের আরবী আরোহীটি গুলী করার লোভ সম্বরণ করল। বোঝা গেল গাড়ীর তিনজন আরোহীর কে কোথায়, তা সে প্রথমে জানতে চায়। গাড়ীর পিছন বরাবর গিয়ে সে থামল। অপর দু’জনকে সে গাড়ীর পিছনে দেখতে পেল। তাদের একজন শুয়ে, হাতে তার স্টেনগান, অপরজন হাঁটু গেড়ে বসে, হাতে তার রিভলভার। হাঁটু গেড়ে বসা লোকটিই ইসাক এলিস, তা বুঝতে পারল আরবী পোশাকের আরোহী। এলিসদের সকলের দৃষ্টি সামনের আড়াআড়ি করে রাখা আরবী লোকটির ঐ গাড়ীর দিকে। গাড়ীর উত্তর পার্শ্বে গাড়ীর লম্বালম্বি শুয়ে থাকা লোকটিকে এই সময়ে গুটি গুটি গাড়ীর পিছন দিকে আসতে দেখা গেল। আরবীয় পোশাকের আরোহীটি বোধ হয় এভাবে তিনজনকে এক সঙ্গেই চাচ্ছিল। প্রশস্ত মাইল পোস্টের আড়ালে শুয়ে স্টেনগানটি বাঁ হাতে ধরে ডান হাতে রিভলভার থেকে ধীরে সুস্থে প্রথম গুলীটি ছুঁড়ল সে। আর্তনাদ করে লুটিয়ে পড়ল গুটি গুটি করে আসা লোকটি। বিদ্যুৎ গতিতে ফিরে দাঁড়িয়েছিল এলিস। একটু মাথা তুলে ফিরবার চেষ্টা করেছিল গাড়ীর পিছনে শুয়ে থাকা লোকটিও। কিন্তু আরবীয় পোশাকের আরোহীটির দ্বিতীয় গুলী তার কানের পাশ দিয়ে ঢুকে গেল একদম মাথার ভিতরে, এলিয়ে পড়ল তার মাথা আবার মাটিতে। এলিসও গুলী ছুঁড়েছিল, কিন্তু লক্ষ্যহীন সে সব। এলিস এবার সঙ্গীর স্টেনগানটি তুলে নিয়ে দৌড়ে দক্ষিণ পার্শ্বে চলে গেল। বোঝা গেল, আরবীয় পোশাকের আরোহীটি ইচ্ছা করেই তৃতীয় গুলীটি ছুঁড়ল না। বরং সে দ্রুত স্থান ত্যাগ করে ঢাল বেয়ে দৌড়ে এলিসের গাড়ীটির ওপাশে গিয়ে উঠল। দেখতে পেল সে, এলিস রাস্তার ওপাশের ঢালে নেমে যাচ্ছে। কয়েক পা সামনে গিয়ে চিৎকার করে উঠল আরবীয় পোশাকের আরোহী স্টেনগান ফেলে দাও এলি কথা শেষ হলো না তার। ঝট করে এলিস পিছনে ফিরে দাঁড়াল, কিন্তু বেপরোয়া এলিসের স্টেনগান থেকে গুলী বেরুবার আগেই আরবীয় পোশাকের আরোহীর তৃতীয় বুলেটটি এলিসের বাম কাঁধে ঢুকে গেল। স্টেনগান পড়ে গেল হাত থেকে, বসে পড়ল সে।
এলিস, এলিসের দুই সহকর্মী ও এলিসের গাড়ীটি সার্চ করে এলিসকে বেঁধে গাড়িতে তুলে নিয়ে গাড়ী ছেড়ে দিল এবার আরোহীটি। শহরের অকট্রয় পোস্টে আসতেই গাড়ীটি আটকে দিল সেনাবাহিনীর একটি ইউনিট। বুলেটের ঝাকে ঝাঁঝরা হয়ে যাওয়া গাড়ীটি তারা ঘিরে দাঁড়াল। কিন্তু তাদের অফিসার গাড়ীর সমনে এসে আরোহীকে দেখেই চমকে উঠে স্যালুট করে সরে দাঁড়াল। ঘিরে দাঁড়ানো সৈনিকরাও সরে দাঁড়াল সঙ্গে সঙ্গে। গাড়ীটি চলে যাওয়ার পর অফিসারটি উৎসুক সৈনিকদের জানাল, আহমদ মুসা।
নামটি শোনার সঙ্গে সঙ্গে সৈনিকদের বিস্ময়াবিষ্ট চোখ অপসৃয়মান গাড়ীটির দিকে ছুটে গেল আর একবার।
আরবীয় পোশাকের আরোহীটি আহমদ মুসা। এলিসের প্রতি দৃষ্টি রাখবার নির্দেশ আবুল আসকে দিয়েও নিশ্চিন্ত হতে পারেনি। তাই নিজেও পিছু নিয়েছিল তার।
এলিসকে নিয়ে আহমদ মুসা সোজা সাইমুমের রাবাত ঘাঁটিতে এসে হাযির হলো। আহমদ মুসাকে গাড়ী থেকে নামতে দেখে উদ্বেগাকুল আবুল আস ছুটে এল। কিছু বলতে যাচ্ছিল আবুল আস, কিন্তু গাড়ীর ভিতর থেকে হাত-পা বাঁধা এলিসকে পিট পিট করে চাইতে দেখে চমকে উঠে থেমে গেল সে। পরে আহমদ মুসাকে এক পাশে ডেকে বলল, শাহ এবং বাদশাহ দু’বার খোঁজ করেছেন আপনাকে। উদ্বিগ্ন তাঁরা। স্টেট গেস্ট হাউসে তাঁরা অপেক্ষা করছেন।
এলিসকে আবুল আসের হাতে সোপর্দ করে আহমদ মুসা তখনই চলল স্টেট গেস্ট হাউসের উদ্দেশ্যে।
গেস্ট হাউসের গেটে আহমদ মুসার গাড়ী পৌঁছার সঙ্গে সঙ্গে দায়িত্ব পালনরত অফিসার টেলিফোনে খবরটি ভিতরে পৌঁছিয়ে বাইরে এসে আহমদ মুসাকে স্যালুট করে দাঁড়াল। মুহূর্তে খুলে গেল গেট। ভিতরে প্রবেশ করল আহমদ মুসার গাড়ী। শাহ সউদ এবং বাদশাহ হাসান শরিফ দু’জনেই গাড়ী বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছেন। আহমদ মুসা গাড়ী থেকে নামতেই জড়িয়ে ধরলেন প্রথমে বাদশাহ এবং পরে শাহ সউদ।
বাদশাহ বললেন, আল্লাহ এক ভয়ানক দুর্ঘটনা থেকে আমাদের বাঁচিয়েছেন আপনার সাহায্যে।
শাহ বললেন, শুধু আমরা নই, শীর্ষ সম্মেলনটিও রক্ষা পেয়েছে।
-সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর। স্মিত হেসে জবাব দিল আহমদ মুসা।
গাড়ীর দিকে চেয়ে ভ্রুকুঁচকে শাহ সউদ বললেন, মনে হচ্ছে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ফিরলেন।
বাদশাহও গাড়ীর দিকে চেয়ে বললেন, “তাই তো!” তারপর তিনি বললেন “চলুন ভিতরে গিয়ে শোনা যাবে সব।”
স্টেট গেস্ট হাউসের সুদৃশ্য ড্রইং রুমে এসে বসলেন তাঁরা।
বাদশাহ প্রথম কথা বললেন, প্রথম চোটেই ড্রাইভার শরিফ আলম সব স্বীকার করেছে। অত্যাধুনিক টাইম বোম্বটি সাপ্লাই দিয়েছে আঁদ্রে শুখানভ।”
-আঁদ্রে শুখানভ নয়, ওর আসল নাম ‘ইসাক এলিস’ ইরগুণ জাই লিউমির দুর্ধর্ষ স্পাই।
-ইসাক এলিস! চমকে উঠলেন যেন শাহ ও বাদশাহ দু’জনেই। কিছুক্ষণ নির্বাক সকলেই।
প্রথম মুখ খুললেন বাদশাহ। বললেন, দুঃখ হচ্ছে, হাতের মুঠোয় পেয়েও আমরা তাকে ধরতে পারলাম না, আবুল আস কিন্তু চেষ্টার কোন ত্রুটি করেনি।
-আপনি খুশী হবেন, এলিস ধরা পড়েছে। তার দু’জন সাথী নিহত, সেও আহত। এইমাত্র তাকে আমি আবুল আসের হাতে তুলে দিয়ে এলাম।
-আলহামদুলিল্লাহ! ধরা পড়েছে এলিস! সপ্রশংস দৃষ্টিতে তাকালেন বাদশাহ আহমদ মুসার দিকে।
আহমদ মুসা পূর্বাপর সব ঘটনা তাদের জানালেন। সব শুনে বাদশাহ যেন অভিভূত হয়ে পড়লেন। শাহ সউদ বললেন, আল্লাহ আপনাকে দীর্ঘজীবি করুন। মজলুম মানবতার খেদমতের জন্য আল্লাহ আপনাকে বাঁচিয়ে রাখুন।
আহমদ মুসা বললেন, ইসাক এলিসের গ্রেপ্তারের খবর গোপন রাখতে হবে। আগামীকাল শুধু এইটুকু খবর থাকবে কাগজে, ‘বিষ্ফোরণের পর থেকে আঁদ্রে শুখানভের অন্তর্ধান ঘটেছে। অবশ্য কোন সাংবাদিকই এর বেশী কিছু বলতে পারবে না।
শরবত এল এ সময়। শরবত পান করার পর প্রসঙ্গান্তর ঘটল।
শাহ সউদ বললেন, এখন থেকে পনর মিনিটের মধ্যে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এখানে আসছেন।
-হঠাৎ তাঁর এ আগমন। বিস্ময় প্রকাশ করল আহমদ মুসা।
-আমার ধারণা, অনুরোধ ও হুমকি দুই-ই নিয়ে আসছেন তিনি।
-কি রকম? পূর্ণ দৃষ্টিতে চাইল আহমদ মুসা শাহ-এর দিকে।
-ফিলিস্তিনের প্রতিনিধি হিসেবে আমরা যেন আগামীকালের শীর্ষসম্মেলনে সাইমুমকে স্বীকৃতি না দেই, এ অনুরোধ তিনি জানাবেন। আর ইউরোপ ও আমেরিকার প্রাণস্বরূপ তেল নিয়ে অধিক বাড়াবাড়ি করলে আরবদেরকে প্রলয়ংকারী এক যুদ্ধের ঝুঁকি নিতে হবে, এ হুমকি তিনি দেবেন। থামলেন শাহ সউদ।
-‘আর এ হুমকি ও অনুরোধের মূল লহ্ম্য হলো ইসরাইল রাষ্ট্রের স্থায়িত্ব নিশ্চিত করা।’ শাহ সউদের কথার সঙ্গে যোগ করল আহমদ মুসা।
-ঠিক বলেছেন আপনি। বললেন বাদশাহ।
-জবাব তো নিশ্চয় আপনারা ঠিক করে ফেলেছেন? বলল আহমদ মুসা।
-কেন, আল-আসির বৈঠকে জবাবতো আমাদের তৈরী হয়েই আছে। বললেন শাহ সউদ।
একটু থেমে শাহ সউদ আবার বললেন, তবে উপস্থাপনাটা হবে একটু আলাদা ধরনের।
-যেমন? শাহ সউদের দিকে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে চাইল আহমদ মুসা।
-আমরা পরিষ্কার বলে দেব, ফিলিস্তিন নিয়ে আরবরা তিনবার যুদ্ধে নেমেছে, চতুর্থ যুদ্ধে তারা আর নামতে চায় না। এজন্য ফিলিস্তিনের প্রতিনিধি হিসেবে সাইমুমকে স্বীকার করে নিয়ে ফিলিস্তিন সম্পর্কিত সমস্ত দায়-দায়িত্ব তার কাঁধে ছেড়ে দিয়ে আরব রাষ্ট্রগুলো ফিলিস্তিনের ব্যাপারে প্রত্যক্ষভাবে জড়িয়ে পড়া থেকে অব্যাহতি পেতে চায়। আর তেল অবরোধের সাথে ফিলিস্তিন সমস্যা ও অধিকতর আরব এলাকা প্রত্যার্পণের প্রশ্ন জড়িয়ে আছে। সাইমুমকে স্বীকৃতি দেয়ার পর এবং ইসরাইলের নিকট থেকে অধিকৃত সব এলাকা ফিরিয়ে পাওয়ার পর ফিলিস্তিন প্রশ্ন আরবদের কাছে গৌণ হয়ে পড়বে, তৈল অবরোধের কোন প্রশ্নও তখন আর উঠবে না। আর এ কথাও আমরা সুস্পষ্টভাবে জানিয়ে দেব, ইসরাইল অধিকৃত এলাকা ফিরিয়ে দিলে ইসরাইলের সঙ্গে তাদের শান্তিচুক্তিও হতে পারে। থামলেন শাহ সউদ।
হাসি খেলে গেল আহমদ মুসার মুখে। বলল সে, আমি আশা করছি মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মহোদয় খুশীই হবেন।
-আবার একে new startegy মনে করতে পারেন তিনি। শাহ সউদ হেসে বললেন।
-তা অবশ্য পারেন। করবেনও হয়ত তিনি। কিন্তু আরব রাষ্ট্রগুলো যে ইসরাইলের ব্যাপারে কিছুটা soft লাইন নিয়েছে, এই বোধ তাকে আশ্বস্ত করবে। এর ফলে তারা পারস্পরিক আলোচনার সুফল সম্পর্কে আশাবাদী হবে।
আহমদ মুসার কথা শেষ হতেই বাদশাহ হাসান শরিফের লাল টেলিফোনটি বেজে উঠল। এয়ারপোর্ট থেকে টেলিফোন। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মিঃ হেনরী স্ট্রাফোর্ডকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসমাইল আবু বকর বিমান বন্দরে স্বাগত জানিয়েছেন। তাঁরা আসছেন।
আহমদ মুসা উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, আমাকে এবার যেতে হয়। ওদিকে কিছু কাজও পড়ে আছে। এযাযত দিন।
-কাজ থাকবেই, কিন্তু এই মুহূর্তে বিশ্রাম আপনার খুব প্রয়োজন।
শাহ এবং বাদশাহ আহমদ মুসাকে গাড়ী বারান্দা পর্যন্ত এগিয়ে দিলেন। তাঁদের সালাম দিয়ে গাড়ীতে বসল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসার গাড়ী যখন পার্ক এভিনিউ অতিক্রম করছিল, মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে নিয়ে একটি গাড়ীর মিছিল তখন স্টেট গেস্ট হাউসের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। | ← Previous | | | Next → | | সম্পুর্ণ বই এক পেজে »
২. অপারেশন তেলআবিব-২

Tags