১
কর্ডলেস টেলিফোন থেকে মুখ তুলে ফ্রান্সিস বাইক পিয়েরে পলের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘পি. এ. সাহেব বলেছেন চীফ জাষ্টিস এভাবে কথা বলেন না।’
‘বলবে না মানে? টেলিফোনটা আমাকে দিন।’ বলে টেলিফোন নেয়ার জন্যে হাত বাড়াল পিয়েরে পল। টেলিফোন মুখের কাছে এনেই বলল, ‘পি. এ. সাহেব?’
‘জি বলুন, বলছি আমি।’ বলল টেলিফোনের ওপ্রান্ত থেকে পি. এ.।
‘আপনাকে বলতে ভুলে গেছে, চীফ জাষ্টিসের সাথে ডঃ ডিফরজিস কথা বলবেন।’
‘কোন ডঃ ডিফরজিস? প্যারিসের?’
‘ঠিক। চীফ জাষ্টিস সাহেবের শিক্ষক।’
‘সব জানি। স্যরি স্যার। ওনাকে বলছি একটু ধরুন।’
পিয়েরে পল টেলিফোন থেকে মুখ একটু সরিয়ে ডঃ ডিফরজিসের দিকে চেয়ে বলল, ‘ডঃ গো ধরে থাকলে কোন লাভ হবে না। চীফ জাষ্টিসকে বলুন আমাদের সহযোগিতা করতে।’
বলেই মুখ টেলিফোনের কাছে নিয়ে বলল, ‘মাই লর্ড ডক্টর সাহেবকে দিচ্ছি।’ বলে পিয়েরে পল টেলিফোন ডঃ ডিফরজিসের হাতে তুলে দিল।
‘হ্যালো, উসাম কেমন আছ?’
‘ভালো। কিন্তু আমি কিছু বুঝতে পারছিনা। আমি আকাশ থেকে পড়েছি। না জানিয়ে আপনি ক্যামেরুন এসেছেন। বাসায় না এসে টেলিফোন করছেন। আপনি কোথায়? আমি আসব।’
‘আমি আসিনি, আমাকে আনা হয়েছে। আমি কোথায় আমি জানিনা।’
‘কি বলছেন আপনি? এটা বিশ্বাস করা যায়?’
‘যা চোখের সামনে উপস্থিত। তা বিশ্বাস-অবিশ্বাসের প্রশ্ন ওঠে না উসাম। আমাকে ওরা কিডন্যাপ করে এনেছে ক্যামেরুনে।’
‘কিডন্যাপ?’
ওপারের কথা শেষ হয়নি বুঝা যায়। কিন্তু কোন কথা ওপার থেকে শোনা গেল না। বিস্ময়ের ধাক্কা সামলে নিতে নিশ্চয় সময় লাগছে চীফ জাষ্টিসের।
আবার শোনা গেল ওপারের কণ্ঠ, ‘আমি কিছু বুঝতে পারছি না জনাব। কি ঘটেছে বলুন।’
‘আমাকে কারা যেন কিডন্যাপ করে এনেছে।’
‘কেন?’
‘আমাকে পণবন্দী করেছে ওরা।’
‘পণবন্দী? কিসের জন্যে?’
‘তোমার কাছ থেকে একটা কাজ চায় ওরা।’
‘আমার কাছে? কিন্তু আপনাকে পণবন্দী করে কেন?’
‘কাজটা বেআইনি। আমাকে ওরা বলেছিল তোমাকে বলে কাজটা করিয়ে দিতে। রাজী না হওয়ায় কিডন্যাপ করেছে। আমাকে পণবন্দী করে কাজটা বাগিয়ে নিতে চায়। তাদের ধারণা আমার জীবন বাঁচাবার জন্যে তুমি কাজটা তাদের করে দেবে।’
‘কাজটা কি?’ ওপারে চীফ জাষ্টিসের কণ্ঠ বড় শুকনো শুনাল।
‘কাজের কথা আমি তোমাকে বলব না এবং কোন অন্যায়ের কাছে নতি স্বীকার তুমি কর, এটা আমি চাইব না।’
‘স্যার, ওদের কেউ আছে? আমি কথা বলতে চাই। শুনতে চাই ব্যাপারটা কি?’
‘ঠিক আছে। দিচ্ছি কথা বল।’
টেলিফোন হাতে নিল পিয়েরে পল। বলল, ‘মাই লর্ড, বলুন।’
‘ডঃ ডিফরজিসের মত একজন বৃদ্ধ, সম্মানী, দরদী মানুষকে আপনারা কিডন্যাপ করেছেন! কে আপনারা?’
‘মাই লর্ড, পরিচয়টা এই মুহূর্তে দিতে পারছিনা।’
‘কেন তাঁকে আপনারা কিডন্যাপ করেছেন?’
‘আমরা দুঃখিত মাই লর্ড। আমাদের উপায় ছিল না। ছোট একটা সহযোগিতা করতে তিনি রাজী হননি। কাজটা মোটেই বড় নয়।’
‘কাজটা কি?’
‘দুঃখিত, টেলিফোনে বলা যাবে না। মনে হয় টেলিফোনে এ ধরনের আলোচনা শোভনও হবে না।’
‘কিন্তু আমি এ মুহূর্তে শুনতে চাই।’
‘তাতে আমরা খুব খুশী হবো। কিন্তু টেলিফোনে নয়।’
‘তাহলে?’
‘মাই লর্ড, আজ কোর্ট ছিল না। আপনার সান্ধ্য ভ্রমনের অভ্যাস আছে। আপনি ‘ইন্ডিপেনডেনস পার্ক’ -এর গেটে আসুন। গেট পেরুলে প্রথম যে বেঞ্চ সেখানে আমরা বসব।’
‘এটা সম্ভব নয়। আমার বাড়িতে আসুন। আমার বাগানের নিরিবিলিতে কোথাও বসে কথা বলব।’
‘আমার আপত্তি নেই। এখন ৬টা। আমি সাড়ে ৬টায় বাগানের গেটে পৌঁছব। ৭টা পর্যন্ত থাকব।’
‘ঠিক আছে আসুন।’
‘মাই লর্ড, সাড়ে ছয়টায় বাগানের বাইরের গেটটা খোলা রাখতে হবে। গাড়ি বাগানের মধ্যে নিয়ে আমি গাড়ি থেকে নামব। চামড়া রংয়ের মুখোশ থাকবে মুখে।’
‘অলরাইট।’
‘আর একটা কথা। আশা করি অন্য কিছু ঘটবে না। আমি যদি ৮টার মধ্যে ফিরে না আসি তাহলে ডঃ ডিফরজিসের জীবন বিপন্ন হবে।’
‘আমি বিচারক। আপনার সাথে লড়াই-এ নামিনি আমি। একটি বিষয় জানার জন্যে আমি আপনাকে ডাকছি।’
‘ধন্যবাদ, মাই লর্ড।’
‘ধন্যবাদ।’
টেলিফোন রেখে পিয়েরে পল বলল, ‘মিঃ ফ্রান্সিস বাইক আমি তৈরী হতে গেলাম। আপনি ড্রাইভারকে গাড়ি বের করতে খবর দিন।
তারপর ডঃ ডিফরজিসের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আপনার পক্ষ থেকে তাকে কিছু বলার আছে?’
‘নেই। তবে আমার একটা জিজ্ঞাসা আছে।’
‘কি?’
‘আমার সন্তান ও বৌমাকে কোথায় রেখেছেন আপনারা?’
‘দুঃখিত, আমাদের কথায় রাজী না হওয়া পর্যন্ত বলব না।’
‘আরেকটা কথা। কুমেটে যে বাড়িতে আপনারা আমাদের রেখেছিলেন, সেখান থেকে আমাদের আসার মুহূর্তে গোলা-গুলি হয়েছিল কেন? আমাদের সন্তানদের কোন ক্ষতি হয়নি তো?’
‘বলেছি, কোন সহযোগিতাই আমরা আপনাকে করব না।’
বলে পিয়েরে পল বেরিয়ে এল ঘর থেকে।
চীফ জাষ্টিসের বাড়ি এবং বাড়ির রাস্তা পিয়েরে পলের মুখস্থ। ইয়াউন্ডি আসার পর বেশ কয়েকবার এখানে এসেছে।
পিয়েরে পল যখন চীফ জাষ্টিস উসাম বাইকের বাগানের গেটে পৌঁছল, তখন ঠিক সাড়ে ছয়টা।
গেট খোলা ছিল বাগানের।
গেট দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে গাড়ি থেকে নামল পিয়েরে পল। তার আগে গাড়িতে বসেই মুখে মুখোশ লাগিয়ে নিয়েছিল।
গাড়ি থেকে নেমেই পিয়েরে পল দেখতে পেল অল্প দূরে বড় একটি আলো-শেড-এর নিচে একটা চেয়ারে একজন বসে আছে। চারদিকের আলোর মাঝখানে সেখানে অন্ধকারের একটা পাতলা আবরণ।
পিয়েরে পল ওদিকে চলল।
পিয়েরে পল সেখানে পৌঁছতেই উঠে দাঁড়াল চেয়ারে বসা সেই লোকটি।
‘গুড ইভেনিং, আসুন।’ বলে পিয়েরে পলকে বসার জন্য চেয়ার দেখিয়ে দিল।
বসল দু’জনে।
চীফ জাষ্টিস মধ্য বয়সী একজন লোক। রঙে সে খাস আফ্রিকান নিগ্রো। কিন্তু চোখ, চুল, ঠোঁট ইত্যাদির গড়ন তার বলে দেয় সে আফ্রো-ইউরোপীয় অথবা আফ্রো-এশীয় মিশ্র পরিবারের সন্তান। তার চেহারার মধ্যে একটা পবিত্র প্রসন্নতা।
চীফ জাষ্টিস বসেই বলল, ‘আমি ফ্রাংকোইস উসাম বাইক। আমি আপনার কথা শোনার জন্যে প্রস্তুত। বলুন।’
‘মাই লর্ড, আপনাকে কষ্ট দেয়ার জন্যে আমি প্রথমেই ক্ষমা প্রার্থনা করছি। আমরা নিরুপায় হয়েই এই অবস্থায় পৌঁছেছি। আপনার সাথে আমাদের কোন পরিচয় নেই। তাই চেয়েছিলাম ডঃ ডিফরজিস আমাদেরকে সহযোগিতা করবেন।কিন্তু স্বেচ্ছায় তিনি তা করেননি।’
বলে একটু থামল পিয়েরে পল। সম্ভবত কথাগুলো একটু গুছিয়ে নিল। শুরু করল আবার, ‘প্রথমেই বলে রাখি, আমার কিংবা কারও ব্যক্তিগত স্বার্থের জন্যে আমি আসিনি। আমরা যা করতে চাই তা করতে পারলে লাভবান হবে জাতি, কোন ব্যক্তি নয়।’
একটু দম নিল পিয়েরে পল।
‘শুনছি, বলুন’ বলল চীফ জাষ্টিস।
‘মাই লর্ড, দক্ষিণ ক্যামেরুনের উপকূলীয় কাম্পু উপত্যকার দশ হাজার একরের একটা জমি খন্ড নিয়ে গন্ডগোল। ঐ জমি খন্ডের চারদিকের সব জমিই চার্চের। মাঝখানের ঐ জমি খন্ড একজন মুসলমানের। এই এক খন্ড জমি নানা দিক দিয়ে আমাদের অসুবিধা সৃষ্টি করছে এবং আরও অসুবিধার কারণ হতে পারে। তাই অনেক বছর ধরে আমরা ঐ জমির মালিককে অনুরোধ করে আসছি, জমির যা মূল্য তার চেয়ে কয়েকগুন বেশী মূল্য দেবো। কিন্তু জমি হস্তান্তরে সে রাজী হয়নি। পরে আমরা জানতে পেরেছি, তার এ অস্বাভাবিক অস্বীকৃতির মূলে একটা ষড়যন্ত্র রয়েছে। মক্কা ভিত্তিক ইসলামী সংগঠন রাবেতায়ে আলম আল-ইসলামী সেখানে বড় রকমের একটা ঘাঁটি বানাতে চায়। এই পরিস্থিতি আমাদের ভীষণ উদ্বিগ্ন করে। কারণ, তারা শান্তিপূর্ণ এ অঞ্চলে সংঘাত বাধাবার জন্যেই এটা করতে চায়। এসব জেনে আমরা নতুন করে যখন তাকে অনুরোধ করলাম, তখন সে রাবেতার পরামর্শে আপনার কোর্টে একটা উইল করে দেশ থেকে পালিয়ে যায়। আসলে জমি তার লক্ষ্য নয়, গন্ডগোল বাধানোই তার লক্ষ্য। আমরা জাতীয় স্বার্থেই এটা হতে দিতে পারি না।’
থামল পিয়েরে পল।
‘বলুন।’ বলল চীফ জাস্টিস উসাম বাইক।
‘এই অবস্থায় আমরা চাই, আপনি আমাদের সাহায্য করুন।’
‘উইলে কি আছে?’
‘সে কোর্টে হাজির হয়ে জমি হস্তান্তর না করলে তার জমি হস্তান্তর বৈধ হবে না। দ্বিতীয়তঃ সে যদি দুই বছর পর্যন্ত নিখোঁজ থাকে, তাহলে জমি ক্যামেরুন মুসলিম ট্রাস্টের সম্পত্তি বলে গণ্য হবে।’
‘আমার কাছে কি সাহায্য চান?’
‘জমি হস্তান্তর দলিলে ওমর বায়ার দস্তখতকে তার উপস্থিতি বলে ধরে নিতে হবে।’
‘ওমর বায়া কোথায়?’
‘আমাদের হাতে আছে।’
‘তাহলে ওকে কোর্টে হাজির করিয়ে দস্তখত নিন।’
‘কোর্টে হাজির করে তার কাছ থেকে দলিলে দস্তখত পাওয়া যাবে না।’
‘তার উইল অনুসারে তাকে কোর্টে হাজির না করে তার জমি হস্তান্তর হবে না।’
‘ধরুন, সে জমি হস্তান্তর করল না। এর বদলে সে যদি আগের উইল বাতিল করার আবেদন করে কিংবা নতুন উইল করে!’
‘তার জন্যেও উপস্থিতি একটা শর্ত।’
‘কিন্তু এ শর্তটা জমি হস্তান্তরের মত অত কঠিন নয়।’
‘শর্ত শর্তই, কঠিন-সহজ হয়না।’
‘তাহলে আপনার সাহায্য আমরা কিভাবে পাব?’
‘আপনিই বলুন।’
‘আমি দুইটা পথের কথা বলেছি। এক, জমি হস্তান্তর দলিলে তার দস্তখত উপস্থিতি হিসেবে ধরে নিতে হবে। অথবা দুই, তার আগের উইল বাতিল করার আবেদন গ্রহন করতে হবে।’
‘হাজির না করে দুই পদ্ধতির কোনটাই আইনসিদ্ধ নয়।’
‘মাই লর্ড, আমরা সেটা জানি। জানি বলেই আপনার দ্বারস্থ হয়েছি। এখন বলুন আপনি আমাদের সাহায্য করবেন কিনা?’
‘এ অন্যায় সাহায্য না করলে কি করবেন?’
‘প্রথম কাজ হবে, আমরা পণবন্দীকে হত্যা করব। আরও কি করব সেটা আমরা এখন বলব না। শুধু জেনে রাখবেন, যত রক্তপাতের প্রয়োজন হোক, ‘ক্রস’ পরাজিত হবে না।’
‘আপনারা ওমর বায়ার জমির কি পরিমান মূল্য দিতে রাজি আছেন?’
‘ক্যামেরুনের সর্বোচ্চ যে রেট তার দ্বিগুন দিতে রাজি আছি।
‘এই টাকা কোর্টের সামনে অথবা কোর্টকে পরিশোধ করতে হবে।’
‘আমরা রাজি।’
‘দ্বিতীয়ত, ওমর বায়াকে কোর্টে এতটুকু হাজির করতে হবে যাতে আমরা তাকে দেখতে পাই। তার কথার কোন প্রয়োজন নেই।’
‘ঠিক আছে, এতে অসুবিধা নেই।’
‘তৃতীয়ত, ডঃ ডিফরজিস ও ওমর বায়াকে উইল রেজিস্ট্রির পর ছেড়ে দিতে হবে এবং চেম্বারে পৌঁছাতে হবে।’
‘আমরা ডঃ ডিফরজিসকে পৌঁছাব, কিন্তু ওমর বায়াকে নয়। তাকে আমরা ছাড়ব আমাদের জমির দখল সম্পূর্ণ হওয়ার পর। প্রয়োজন বোধ করলে আমরা তাকে দলিল সম্পর্কে আপত্তি উত্থাপনের শেষ মেয়াদতক রাখতে পারি।’
‘ঠিক আছে, আপনারা প্রসেস করুন। আপনার উকিল যেন আমার অফিস থেকে কেসের তারিখটা ঠিক করে নেয়।’
‘ইয়েস মাই লর্ড। আমার একটা শর্ত আছে। আজকের কথাগুলো এবং জমি সংক্রান্ত ব্যাপার আপনার কান ছাড়া যতগুলো কানে পৌঁছবে তারা আমাদের হত্যা তালিকায় থাকবে।’
‘এ কথাগুলো আমাকে না বললেও চলতো। বিচারপতিরা ক্যামেরুনের পুলিশ কিংবা গোয়েন্দার দায়িত্ব পালন করেন না।’
‘থ্যাংকস মাই লর্ড। উঠি।’
বলে পিয়েরে পল উঠে দাঁড়াল।
চীফ জাস্টিস উসাম বাইক মাথা নাড়ল, মুখে কোন কথা বলল না।
ইয়াউন্ডি সুপার মার্কেট থেকে ফিরছিল ডোনা, ডোনার আব্বা এবং এলিসা গ্রেস।
আজ সকালেই তারা কুমেট থেকে ইয়াউন্ডি এসেছে।
সেদিন আহমদ মুসা কুমেট বিমান বন্দরে চলে যাবার এক ঘন্টা পর ডোনারা কুমেটে গার্লস ব্রিগেডের রেস্ট হাউসে সুমাইয়াদের কাছে পৌছে।
আহমদ মুসার প্লেন ১২টায় ক্যামেরুনরে উদ্দেশ্যে ছাড়ার কথা। সুতরাং ডোনাদের এয়ারপোর্টে নেয়ার সময় ছিল না।
আহমদ মুসার চলে যাবার সংবাদে ডোনা বিস্মিত হয়নি, কিন্তু আহত হয়েছিল। আহমদ মুসার সন্ধানে সে ছুটে এসেছিল প্যারিস থেকে সেন্টপোল ডে-লিউন-এ। কিন্তু অল্পের জন্যে দেখা পায়নি। আবার তারা ছুটে আসে কুমেটে। এক ঘন্টা দেরীর জন্যে এখানেও দেখা হয় নি।
আহমদ মুসার চলে যাবার খবর যখন সুমাইয়া দ্বিধাগ্রস্থ কন্ঠে ডোনাকে দিয়েছিল, তখন ডোনা মুহূর্তের জন্যে চোখ বুজে আঘাতটা সামলে নিয়েছিল।
পরে সুমাইয়া আহমদ মুসার রেখে যাওয়া চিঠি ডোনাকে দিয়েছিল।
কম্পিত হাতে ডোনা চিঠি নিয়েছিল। তার কাছে আহমদ মুসার এটাই প্রথম চিঠি। কি লিখেছে! প্যারিস থেকে তার চলে আসার জন্যে রাগ করেনি তো!
চিঠি নিয়ে ডোনা পাশের ঘরে চলে গিয়েছিল। চিঠিতে সে পড়েঃ
“মারিয়া,
আমি আমার কথা রাখতে পারিনি বলেই তোমাকে কষ্ট করে ডে-লিউন পর্যন্ত ছুটে আসতে হয়েছে। আবার কুমেট থেকেও টেলিফোন করতে পারিনি তোমাকে। করতে পারিনি ঠিক নয়, ভুলে গিয়েছিলাম। এ ভুলের মাশুল তোমাকেই দিতে হচ্ছে। তবু কুমেটে আমাদের দেখা হবে বলে মনে হচ্ছে না। এ সব কিছুর জন্যে নিজেকে দোষী ভাবার সাথে সাথে কিছুটা আনন্দবোধও আমার হচ্ছে। বুক ভরা উদ্বেগ নিয়ে কেউ কখনও এভাবে আমার পেছনে ছুটে আসেনি। কারও দুটি সজল চোখ এইভাবে কখনও আমাকে খুঁজে ফেরেনি। কিন্তু আমার জন্যে যা আনন্দ, তোমার জন্যে সেটা কষ্ট। তোমার এ কষ্টের জন্যে দুঃখ প্রকাশ ছাড়া আর কি করতে পারি আমি বলো।”
চিঠি শেষ করেও অনেক্ষন চিঠি থেকে চোখ সরাতে পারেনি ডোনা। তারপর তার চোখ দু’টি সরে গিয়ে দক্ষিনের জানালা দিয়ে নিবদ্ধ হয়েছিল দক্ষিন দিগন্তে। যেন দেখতে পাচ্ছে সে ক্যামেরুনের পথে ছুটে চলা আহমদ মুসার প্লেন। কান্নার মত এক টুকরো হাসি ফুটে উঠেছিল ডোনার ম্লান ঠোঁটে। ঠোঁটের বাঁধন ডিঙিয়ে বেরিয়ে এসেছিল তার স্বগত উচ্চারনঃ ‘তুমি যাকে আমার কষ্ট বলছ, তা আমার কত আনন্দের, কত তৃপ্তির, কত প্রশান্তির সেটা তুমি কি বুঝ!’
কক্ষ থেকে বেরিয়ে এসে ডোনা তার আব্বাকে বলেছিল, ‘ও আমাদের ক্যামেরুন যেতে নিষেধ করেনি।’
‘যেতে কি বলেছে?’ বলেছিল ডোনার আব্বা।
‘তার নিষেধ না করাটাই যেতে বলা আব্বা।’
‘হ্যাঁ, এটাও ঠিক।’ বলে মিষ্টি হেসেছিল ডোনার আব্বা।
‘আব্বা তুমি ইয়াউন্ডির ফরাসী দুতাবাসকে বলে দাও আমার ও এলিসার জন্যে একটা ভাল ব্যবস্থা করতে।’
‘ওখানে রাষ্ট্রদূত হিসেবে আছেন আমার বন্ধু তোমার আংকেল ‘জিন মিশেল ব্রেন্ডার’। বাড়ির মতই থাকতে পারবে। কিন্তু তোমার আব্বাকে বাদ রাখছ কেন?’ হেসে বলেছিল ডোনার আব্বা।
‘লং জার্নিতে তোমার কষ্ট হবে আব্বা।’ বলেছিল ডোনা।
‘তার চেয়েও বেশী কষ্ট হবে মা কাছে না থাকলে।’ বলেছিল ডোনার আব্বা সস্নেহে হেসে।
ডোনা উঠে গিয়ে তার আব্বার পাশে বসে তার কাঁধে মাথা রেখে বলেছিল, ‘ঠিক আছে তুমিও যাবে।’
বলে একটু হেসেছিল ডোনা। তারপর ধীরে ধীরে বলেছিল, ‘মাঝে মাঝে ভেবে আমার কষ্ট হয় আব্বা আমি তোমাকে বিরাট টেনশনে ফেলেছি।’
‘দুনিয়াতে অনেক টেনশন আছে, যা সুখ স্বপ্নের চেয়েও মধুর।’
‘ধন্যবাদ আব্বা। আমার আব্বা দুনিয়ার সেরা আব্বা।’ বলেছিল ডোনা তার আব্বার কাঁধে কপাল ঘষতে ঘষতে।’
ডোনারা ক্যামেরুন যাবার আগে সুমাইয়া, ডেবরা ও রালফের সাথে অনেক কথা হয়েছে তাদের। শুনেছিল ক্লাউডিয়া ও ডাঃ জিয়ানার আত্মত্যাগের কাহিনী। শুনে কেঁদেছিল ডোনা। তার মনে পড়েছিল আহমদ মুসার কাছে শোনা রুশ কন্যা তাতিয়ানার কাহিনী, কেঁপে উঠেছিল ডোনার মন। কত ভাঙা হৃদয়ের কত দাবী যে আহমদ মুসাকে ঘিরে আছে! ডোনার ছোট্ট হৃদয়ের দুর্বল দাবী কি অবশেষে তার প্রিয়তম ঠিকানা খুঁজে পাবে!’
ডোনার আব্বা ঠিক বলেছিল। ক্যামেরুনের ফরাসী রাষ্ট্রদূত জিন মিশেল ব্রেন্ডার ডোনাদেরকে পরম আত্মীয়ের মতই গ্রহন করেছে। এ্যামবেসির গেস্ট হাউসে তাদের থাকতে দেয়নি। বাড়ির একটা বিরাট অংশ ছেড়ে দিয়েছে এ্যামবেসেডর ডোনাদের জন্যে। জিন মিশেল ব্রেন্ডারের কুটনৈতিক জীবনের শুরু ডোনার আব্বা মিশেল প্লাতিনীর পারসোনাল সেক্রেটারী হিসেবে।
ইয়াউন্ডিতে এসে খাওয়া দাওয়া শেষে দীর্ঘ ঘুম দেবার পর জরুরী কিছূ কেনা কাটা এবং শহর দেখার জন্যে ডোনারা বেরিয়েছিল।
মার্কেট থেকেই ফিরছিল তারা।
এ্যামবেসেডর জিন মিশেল একটা গাড়ি দিয়েছিল ডোনাদের স্বাধীনভাবে ব্যবহারের জন্যে। তার সাথে ডোনা চেয়েছিল ইয়াউন্ডির একটা রোড ম্যাপ। ড্রাইভারও দিয়েছিল। কিন্তু ডোনা ড্রাইভার নেয়নি। ডোনা দেখেছিল, যে মিশন নিয়ে সে ক্যামেরুনে এসেছে তাতে ড্রাইভার নিলে ঝামেলার সম্ভাবনা আছে। আহমদ মুসার সাক্ষাৎ না পাওয়া পর্যন্ত তাকেই তার দায়িত্ব বহন করার মত যোগ্যতা দেখাতে হবে।
গাড়ি ড্রাইভ করছিল ডোনা।
গাড়ি চলছিল ইয়াউন্ডির সেন্ট্রাল রোড ধরে।
বেলা তখন ৩টা।
ডোনা দেখল, রাস্তার পাশে একটা সুন্দর গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। গাড়িটির পাশে দাঁড়িয়ে আছে একজন তরুনী। ইউরোপীয়ান পোশাক। মেয়েটি কালোও নয় আবার সাদাও নয়। কালো ও সাদার মাঝখানে অব্যক্ত এক রঙের সুষমা তার দেহে।
মেয়েটি গাড়িতে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে অসহায়ভাবে এদিক-ওদিক চাইছে।
ডোনা গাড়িটির পাশাপাশি এসে ব্রেক কষল গাড়িতে। জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে ফরাসি ভাষায় ডোনা জিজ্ঞেস করল, ‘গুড ইভনিং, কোন সমস্যা?’
‘গুড ইভনিং, গাড়ি স্টার্ট নিচ্ছে না।’ বলল মেয়েটি বিব্রত কন্ঠে।
‘আমি কি চেষ্টা করে দেখতে পারি?’ বলল ডোনা।
‘ওয়েলকাম। আমি বাধিত হবো।’
ডোনা তার গাড়িটি রাস্তার পাশে নিয়ে দাঁড় করাল। বলল, ‘আব্বা, আমার মনে হচ্ছে মেয়েটি বিপদে পড়েছে। একটু দেখি।’
‘যাও দেখ।’ পেছনের সিট থেকে বলল ডোনার আব্বা।
ডোনা এবং এলিসা গ্রেস দুজনেই নামল গাড়ি থেকে।
ডোনা গিয়ে হ্যান্ডশেক করল মেয়েটির সাথে। বলল, ‘নামটা কি জানতে পারি?’
‘ভেনেসা রোসেলিন। আপনি?’
‘আমি মারিয়া জোসেফাইন। আর এ এলিসা গ্রেস।’
ডোনা প্রথমে ড্রাইভিং সিটে বসে সব কিছু চেক করে বলল, ‘দোষটা ইঞ্জিনে।’
বলে বেরিয়ে এল গাড়ি থেকে।
তারপর গাড়ির সামনে গেল ডোনা। রোসেলিন চাবি দিয়ে কভার আনলক করল এবং কভারটি তুলে ছিটকিনিতে ঠেস দিয়ে রাখল।
ইঞ্জিন পরীক্ষা করে রোসেলিন-এর দিকে মুখ তুলে বলল, ‘বড় কিছু ঘটেনি। আমি ঠিক করে দিচ্ছি।’
স্ক্রুড্রাইভার নিয়ে এল ডোনা নিজের গাড়ি থেকে। দু’মিনিটের মধ্যে ঠিক হয়ে গেল।
কাজ শেষ করে রোসেলিনকে বলল, ‘স্টার্ট দিয়ে দেখুন ঠিক আছে কিনা।’
রোসেলিন ড্রাইভিং সিটে গিয়ে গাড়ি স্টার্ট দিল। মিষ্টি গর্জন করে জেগে উঠল ইঞ্জিন।
হাসিতে মুখ উজ্জ্বল করে গাড়ি থেকে বেরিয়ে এল রোসেলিন। বলল, ‘ধন্যবাদ, অনেক ধন্যবাদ। গাড়ির কিছু আমি বুঝি না। কি যে বিপদে পড়তাম আপনাকে না পেলে।’
বলে একটু থামল রোসেলিন। কিন্তু ডোনাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই বলল, ‘আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে আপনি ফরাসি। তাই কি?’
‘ঠিক বলেছেন, আজ সকালেই আমরা ক্যামেরুন এসে পৌঁছেছি।’
‘কোথায় উঠেছেন?’ বেড়াতে এসেছন বুঝি?’
‘ফরাসি রাষ্ট্রদূতের অতিথি আমরা।’
‘তাহলে তো আমরা শহরের একই এলাকায় আছি। আমি কি আপনাদের চায়ের দাওয়াত করতে পারি?’
‘ধন্যবাদ। কেন নয়?’
রোসেলিন খুশীতে ডোনার সাথে হ্যান্ডশেক করল।
‘গাড়ির ফ্ল্যাগ স্টান্ডে একটা পতাকা ঢাকা দেখছি। কি পতাকা?’
রোসেলিন একটু সলজ্জ হাসল। বলল, ‘আমার আব্বা চিপ জাস্টিস তো। ওঁর গাড়ি। ওটা ক্যামেরুনের জাতীয় পতাকা।’
‘ও, ওয়ান্ডারফুল। সৌভাগ্য যে, আপনার সাথে পরিচিত হবার সুযোগ হলো।’ উচ্ছ্বসিত কন্ঠে বলল ডোনা। তার মনে পড়েছিল ব্ল্যাকক্রস ডঃ ডিফরজিস্কে কিডন্যাপ করেছে এই চীফ জাস্টিসকে বাগে আনার জন্যে। খুশী হলো। ঘটনার একটা পক্ষের সাথে পরিচিত হবার সুযোগ তো অন্তত হলো!
‘সৌভাগ্য আমারও।’ বলে হেসে রোসেলিন বলল, ‘একটা কথা জিজ্ঞেস করি?’
‘অবশ্যই।’ বলল ডোনা।
‘আপনাদের পোশাক, বিশেষ করে গায়ে মাথায় ওড়না – এ ধরনের পোশাক তো ফরাসীরা পরে না।’
‘ফরাসীরা সবাই পরে না তা নয়। মুসলিম ফরাসীরা পরে।’ হেসে বলল ডোনা।
‘তাহলে আপনারা মুসলিম?’ বিস্ময় মিশ্রিত কন্ঠে বলল রোসেলিন।
‘খুশী হননি বুঝি?’ বলল ডোনা।
হাসিতে মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল রোসেলিনের। বলল, ‘আমার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বান্ধবী মুসলিম।’ কথাগুলো বলতে গিয়ে আবেগ-অনুরাগের একটা ঢেউ খেলে গেল রোসেলিনের মুখে।
ডোনা তাকিয়েছিল রোসেলিনের মুখের দিকে। সে বিস্মিত হলো রোসেলিনের মুখ ভাবের এই পরিবর্তনে। ডোনার মনে হলো রোসেলিন যেন কথা শেষ করেও করল না।
‘ও! নাইস! কি নাম আপনার বান্ধবীর?’ আনন্দে উচ্ছ্বসিত হয়ে বলল ডোনা।
‘লায়লা ইয়েসুগো। ইয়েসুগো রাজ পরিবারের মেয়ে। ইয়াউন্ডি বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার ক্লাসমেট।’
‘ইয়েসুগো রাজপরিবার ক্যামেরুনের?’ বলল ডোনা।
‘হ্যাঁ। ক্যামেরুনের একদম উত্তরে গারুয়া উপত্যকা থেকে ‘লেক চাঁদ’ পর্যন্ত এক সময় ওদের রাজত্ব ছিল।’
‘ও! খুশী হবো যদি আমাদের পরিচয় করিয়ে দেন।’
‘অবশ্যই। ওরাও খুশী হবে।’
বলেই রোসেলিন পকেট থেকে একটা কার্ড বের করে ডোনার দিকে তুলে ধরে বলল, আমার ‘নেম কার্ড’। যে কোন প্রয়োজনে টেলিফোন করবেন।
ডোনা কার্ড হাতে নিয়ে বলল, ‘আসুন আমার আব্বা গাড়িতে। তার সাথে পরিচয় করিয়ে দেই।’
বলে রোসেলিনের একটা হাত ধরে এগুল সে তার গাড়ির দিকে।
ওদেরকে গাড়ির দিকে আসতে দেখে ডোনার আব্বা মিশেল প্লাতিনি গাড়ি থেকে নেমে এল।
‘আব্বা, এ ভেনেসা রোসেলিন। ক্যামেরুনের চীফ জাস্টিস উসাম বাইকের মেয়ে।’
তারপর রোসেলিনের দিকে মুখ তুলে ডোনা বলল, ‘ইনি আমার আব্বা মিশেল প্লাতিনি লুই।’
দু’জন শুভেচ্ছা বিনিময় করছে, তখন ডোনা ড্যাশ বোর্ডের কার্ড কেস থেকে তার ‘নেম কার্ড’ নিয়ে এল।
কার্ড রোসেলিনকে দিয়ে বলল, ‘এতে এখানকার টেলিফোন নম্বারও আছে।’
‘ধন্যবাদ।’
বলে রোসেলিন ডোনার আব্বার দিকে চেয়ে বলল, ‘আংকেল, এখনকার মত চলি। আমি কিন্তু চায়ের দাওয়াত দিয়েছি।’
‘ঠিক আছে মা। আমরা খুশী হয়েছি।’ বলল ডোনার আব্বা।
তারপর রোসেলিন ডোনা ও এলিসা গ্রেসের সাথে হ্যান্ডশেক করে বলল, ‘চলি, মনে থাকে যেন চায়ের দাওয়াতের কথা। আমি টেলিফোন করব।’
রোসেলিন এবং ডোনার গাড়ি এক সাথেই ছাড়ল।
‘খাওয়ার সব ব্যবস্থা ঠিক-ঠাক আছে তো মা?’ চীফ জাস্টিস উসাম বাইক জিজ্ঞেস করলো রোসেলিনকে।
| | | Next → | | সম্পুর্ণ বই এক পেজে »