২১. কঙ্গোর কালো বুকে

চ্যাপ্টার

আহমদ মুসার গাড়ি যখন চলছিল ক্যামেরুন ক্রিসেন্টের অফিসের দিকে, সেই সময় আহমদ মুসার কানে আযানের শব্দ ভেসে এল ‘ক্যামেরুন ক্রিসেন্ট’ –এর মসজিদ থেকে।
আহমদ মুসা ব্রেক কষল গাড়ির।
‘আমাদের সবাইকে এখানে নামতে হবে?’ বলল ওমর বায়া।
‘হ্যাঁ। তবে আমরা শুধু নামায পড়ব এখানে’। বলল আহমদ মুসা।
‘সময় আছে, গন্তব্যে পৌঁছে আমরা নাময পড়তে পারতাম না?’ ওমর বায়া বলল।
‘পারতাম। কিন্তু নামাযের আহবান যে কানে এল?’
‘যেখানে এ আহবান কানে আসবে, সেখানে নামাযের জন্যে দাঁড়ানো কি অপরিহার্য?’
‘অপরিহার্য নয়, কিন্তু এই মুহূর্তে অপরিহার্য মনে হচ্ছে’।
‘এই মুহূর্তে? কেন?’
‘এমন একটা বিজয় হাতে নিয়ে ফিরছি, যা চাওয়ার চেয়ে বেশী। যিনি এ বিজয় দিয়েছেন, তার ইবাদতের আহবান উপেক্ষা করে এগুতে পারছি না। তাঁর কাছে হাজির হওয়ার এ সুযোগ আমার কাছে অমূল্য মনে হচ্ছে’।
বলল আহমদ মুসা ডঃ ডিফরজিস-এর দিকে চেয়ে বলল, ‘প্লিজ ডক্টর, একটু কষ্ট করুন’। তারপর ওকোচার দিকে চেয়ে বলল, একটু বস কেমন?’
আহমদ মুসা ও ওমর বায়া গাড়ি থেকে নামল।
পুরো ৪৫ মিনিট সময় লাগল আহমদ মুসাদের ফিরে আসতে।
মুসল্লিদের অনেকেই, যারা খবর জানে, বিস্মিত হয়েছে এবং মৌমাছির মত ছেঁকে ধরেছে আহমদ মুসাকে। তাদের প্রশ্নের জবাব দিয়ে ফিরতে সময় আরও বেশী খরচ হলো।
গাড়িতে উঠতে উঠতে আহমদ মুসা ডঃ ডিফরজিসকে বলল, ‘মাফ করবেন, বেশ দেরী হয়ে গেল’।
‘একটি সম্মিলিত প্রার্থনার জন্যে ৪৫ মিনিট সময় কি বেশী?’ বলল ডঃ ডিফরজিস।
‘ধন্যবাদ। তবে প্রার্থনার জন্যে সময় বেশী লাগে না। কিন্তু ‘আযান’ বা আহবানের পর প্রার্থনায় যোগদানের জন্যে আধাঘন্টার মত সময় দেয়া হয়। এতেই সময় বেশী যায়’। আহমদ মুসা বলল।
‘তোমার অবিশ্বাস্য ধরনের কাজ এবং সাহস আমাকে বিস্ময়বিমূঢ় করেছে, কিন্তু তার চেয়েও বিস্মিত হয়েছি ইশ্বরের প্রতি তোমার ভালোবাসা দেখে। আজ তো আধুনিকতা ও ধার্মিকতা পরস্পর বিরোধী হয়ে দাঁড়িয়েছে’। বলল ডঃ ডিফরজিস।
‘আধুনিকতা যদি হয় আধুনিক জ্ঞানে সজ্জিত হওয়া, তাহলে সে আধুনিকতা স্রষ্টার প্রতি ভালোবাসা বৃদ্ধি করে। আর আধুনিকতা বলতে যদি বুঝানো হয় জ্ঞান ও বুদ্ধির দুয়ারে তালা মের আধুনিক পণ্য-সম্ভারের মধ্যে নিমজ্জিত থাকা, তাহলে এই আধুনিকতা অবশ্যই স্রষ্টাকে ভুলিয়ে দেবে’। আহমদ মুসা বলল।
‘সুন্দর বলেছ’। বলে একটু থামল ডঃ ডিফরজিস। তারপর আবার বলল, ‘তুমি আমার ছেলের বয়সের। শুরু থেকেই একটা তীব্র কৌতুহল মনে জাগছে। জিজ্ঞেস করব?’
‘ছেলের মতও বলতে পারেন। কুমেটে আপনর ছেলে এবং আপনার বৌমা ডেবরার সাথে আমার দেখা হয়েছে’।
‘দেখা হয়েছে? তাদের সাথে? কিন্তু ওরা তো ব্ল্যাক ক্রস-এর হাতে বন্দী’।
‘ক্যামেরুনে আসার আগে তাদের সাথে আমি একই রেষ্টহাউসে ছিলাম কয়েকদিন’।
বলে আহমদ মুসা তাদেরকে কিভাবে উদ্ধার করে তার কাহিনী বলল।
বিস্ময়ে প্রায় বাকরোধ হয়ে গেল ডঃ ডিফরজিসের। কিছুক্ষণ পর বলল, ‘তুমি… তুমি উদ্ধার করেছ তাদেরও! কবে?
আহমদ মুসা তারিখ বলল।
ডঃ ডিফরজিস বলল, ‘আমি তো ঐ তারিখেই কিডন্যাপ হই’।
‘আমরা জানি। কিড্ন্যাপ ঠেকাবার জন্যে আমরা বিমান বন্দরে গিয়েছিলাম। কিন্তু দেরী হয়েছিল। যখন ওরা কিডন্যাপ করে পালাচ্ছিল, তখন আমরা রাস্তায়। আমরা ব্যর্থ হয়েছিলাম’।
‘আমার কিডন্যাপ হওয়ার বিষয় আগেই জানতে?’
‘অনুমান করেছিলাম’।
‘কিভাবে’?’
‘সে অনেক কথা’।
‘আমার ছেলে ও বৌমাকে উদ্ধার করার পর কি করলে?’
আহমদ মুসা সংক্ষেপে কাহিনী বর্ণনা করল। তারপর বলল, ‘উদ্ধারের পর যখন ওদের কিডন্যাপ করার কারণ জানতে পারলাম এবং যখন জানলাম আপনি কুমেটে আসছেন, তখন নিশ্চিত হয়েছিলাম আপনার ছেলে ও বৌমা ওঁদের হাতছাড়া হবার পর ওরা আপনাকে কিডন্যাপ করবে’।
‘অসাধারণ বুদ্ধি তোমার। প্রশংসা করে তোমাকে খাটো করবো না। আমার ছেলে ও বৌমা কেমন ছিল? ওদের কোন প্রকার ক্ষতি হয়নি তো? শয়তানরা যে বার বার বলেছে আমার ছেলে ও বৌমা ওদের হাতে রয়েছে?’
‘আপনাকে দুর্বল করার জন্যে মিথ্যা কথা বলেছে। আপনার ছেলে ও বৌমা ভালই ছিল’।
‘ঈশ্বরকে ধন্যবাদ। ঈশ্বর তোমার মঙ্গল করুন। তোমার এসব কথা শুনে আমার কৌতুহল আরও বেড়েছে। আমার প্রশ্নের কি জবাব দেবে?’
‘কি প্রশ্ন?’
‘তোমার সম্পর্কে সামান্য কিছু শুনেছি ওমর বায়ার কাছে। সে বলতো, ‘একজন লোক আছে, সেই শুধু পারে আমাদের উদ্ধার করতে। অবশেষে সেই ‘একজন’ তুমি আমাদের উদ্ধার করলে। তুমি কে বৎস?’
‘দেবার মত বিশেষ পরিচয় আমার নেই। কোন দেশের কোন পদে আমি ছিলাম না। কোন বিষয়ে বিশেষজ্ঞ ছিলাম এমন পরিচিতি আমার নেই। আমার ছোট্ট একটা নাম আছে- আহমদ মুসা’।
ভোরের ফাঁকা রাস্তা ধরে তীব্র গতিতে চলছিল গাড়ি।
গাড়ি পূর্ণ গতিতে চলা শুরু করলে আহমদ মুসা ও ডঃ ডিফরজিসের মধ্যে কথা আর চলল না।
গাড়ি চালাচ্ছিল আহমদ মুসাই।
গাড়ি প্রথমে চীফ জাষ্টিসের বাসায় নেওয়াই ঠিক করেছে আহমদ মুসা। সেখানে ডঃ ডিফরজিসের সাথে ওমর বায়াকে রেখে ফ্রান্সিস বাইককে রাখার জন্যে যাবে রাশিদীর বাড়িতে। রাশিদীর বাড়িতে নয় অন্য কোথাও তাকে রাখতে হবে।
অন্ধকার তখনো পুরোপুরি কাটেনি।
আহমদ মুসার গাড়ি চীফ জাষ্টিসের গেটে গিয়ে দাঁড়াল।
আহমদ মুসা দেখল, চীফ জাস্টিসের বাড়ির চারদিক ঘিরেই পুলিশ পাহারা।
গেটে পুলিশের একটি গাড়ি দাঁড়িয়ে। গাড়িতে বসে আছে চারজন পুলিশ।
আহমদ মুসার গাড়ি দাঁড়াতেই গাড়ি থেকে চারজন পুলিশ তড়াক করে নেমে ষ্টেনগান বাগিয়ে এগিয়ে এল।
আহমদ মুসা লাফ দিয়ে নামল গাড়ি থেকে। পুলিশের সামনে গিয়ে বলল, ‘আমাকে গেটম্যানের কাছে নিয়ে চলুন’।
পুলিশ আহমদ মুসাকে সার্চ করল। পকেটে কোন অস্ত্র পেল না।
পকেটের রিভলবারটি আহমদ মুসা ওকোচা’র কাছে রেখে এসেছে।
পুলিশ আহমদ মুসাকে নিয়ে গেল গেটের দারোয়ানের কাছে।
দারোয়ানটি আহমদ মুসার অপরিচিত। আহমদ মুসা সেদিন বিকেলে যে দারোয়ানকে দেখেছিল সে এ নয়। আহমদ মুসা গেটম্যানকে বলল, ‘আপনি চীপ জাস্টিস সাহেবকে জানান, ডঃ ডিফরজিসকে আনা হয়েছে’।
‘তাঁকে এখন টেলিফোন করা যাবে না’।
‘তাহলে কাকে করা যাবে?’
‘পি,এ, সাহেব এলে পর’।
‘জাস্টিস সাহেবের সরাসরি টেলিফোন নেই?
‘আমি জানি না’।
‘আমার কাছে আছে নম্বারটা। নিন’। বলে আহমদ মুসা টেলিফোন নম্বারটা গেটম্যানকে দেবার জন্যে হাত বাড়াল।
‘এ সময় স্যারকে টেলিফোন করতে পারবো না’।
আহমদ মুসা পুলিশ অফিসারের দিকে চেয়ে বলল, ‘আপনি করুন, ব্যাপারটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ’।
‘গুরুত্বটা আমাকে বুঝতে হবে’। বলল পুলিশ অফিসার।
এই সময় গেটম্যান তড়াক করে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বলল, ‘আপনার গেট থেকে একটু সরে দাঁড়ান। ছোট ম্যাডাম এদিকে আসছেন’।
বলেই গেটের জানালা থেকে সে সরে দাঁড়াল।
গেটের মাঝ বরাবর তিন ফিট ষ্টিল শিটে ঢাকা। নিচের এক ফিট এবং উপরের এক ফিট ফাঁকা। গেটের পাশে এলে মোটা ষ্টিলবারের পাশ দিয়ে ভেতরের সবকিছুই দেখা যায়।
আহমদ মুসা দেখল, রোসেলিন ছুটে আসছে। তার পরনে ট্র্যাক স্যুট। তার পেছনে পেছনে আসছে আরেকজন। তার গায়ে-মাথায় চাদর দেখেই বুঝল, ও ডোনা হবে।
আহমদ মুসা ছুটে আসা রোসেলিনের কণ্ঠ শুনতে পেল। সে চিৎকার করে বলছে, ‘খুলে দাও দরজা, খুলে দাও দরজা’।
গেট খুলে গেল।
‘আহমদ মুসা ভাই আপনি ফিরেছেন?’ বলে গেটের কাছে এসে রোসেলিন হাঁটু গেড়ে বসে দু’হাত উপরে তুলে উর্ধ্বমূখী হয়ে বলল, ‘ঈশ্বর তুমি দয়ালু, তুমি আমাদের কথা শুনেশ’। আবেগ রুদ্ধ তার কণ্ঠ।
ডোনা এসে রোসেলিনের পেছনে দাঁড়াল। তার স্থির দৃষ্টি আহমদ মুসার উপর নিবদ্ধ। তার চোখে অশ্রু, ঠোঁটে হাসি।
আহমদ মুসা রোসেলিনের দিকে এগিয়ে বলল, ‘শুধু আমি আসিনি রোসেলিন, ডঃ ডিফরজিস এবং ওমর বায়াকেও উদ্ধার করে এনেছি। তোমার আব্বাকে খবরটা জানাও’।
‘কি ডঃ ডিফরজিস মুক্ত? কোথায় তিনি? গাড়িতে? যাই আব্বাকে খবর দেই’। বলে রোসেলিন দৌড় দিল বাড়ির দিকে।
আহমদ মুসা তার গাড়ির পেছন দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ওকোচা তুমি গাড়ি ড্রাইভ করে গাড়ি বারান্দায় নিয়ে এস’।
গাড়ি চলতে শুরু করল।
আহমদ মুসা ও ডোনা পাশাপাশি হাঁটতে লাগল।
ডোনার মুখ নিচু।
আহমদ মুসার মুখও নিচু।
ডোনা তার ডান হাত দিয়ে তার আহত বাম হাতটা ধরে ছিল। আস্তে হাতটা ছেড়ে দিয়ে ডান হাত দিয়ে পকেট থেকে রুমাল বের করে চোখ মুছে নিয়ে বলল, ‘তুমি ঠিক আছ তো? তুমি ভাল আছ তো?’
‘আলহামদুলিল্লাহ। একদম ভাল। তুমি কেমন আছ?’
ডোনা কোন জবাব দিল না। তার মুখ নিচু। হঠাৎ করেই তার মুখটা আবার বেদনাক্লিষ্ট হয়ে উঠেছে।
আহমদ মুসা একবার সেদিকে চাইল।
কিছু বলার জন্যে মুখ খুলেছিল আহমদ মুসা।
কিন্তু তার আগেই ডোনা বলল, ‘তুমি ঠিকানা দিয়ে যাওনি কেন?’ ডোনার কণ্ঠ ভারি।
আহমদ মুসা আরেকবার চকিতে ডোনার দিকে চাইল। তারপর বলল, ‘আমি দুঃখিত ডোনা। কিন্তু তুমি জান কেন আমি অন্যায়টা করেছি’।
‘সেই জন্যেই দুঃখটা আমার বেশী। তুমি শুধু ডোনার নও, তুমি কোটি মজলুম মানুষের। তাহলে কেন তুমি এক ডোনার নিরাপত্তার কথা এমন করে ভাববে তোমাকে বিপদগ্রস্ত করেও’।
‘কেন ভাবি সেটাও তুমি জান। ঘোর যুদ্ধক্ষেত্রেও শান্তির একটা তাঁবু থাকে, জীবনের থাকবে না কেন?’
‘আমি তোমার সাথে এখন তর্কে যাব না। কিন্তু বলব, তোমার পেছনে যারা থাকবে, তাদের চলার পথ চিহ্ণিত করে যাওয়া তোমারই দায়িত্ব, ডোনাকে অন্ধকারে রাখ ক্ষতি নেই’। ডোনার ভেজা কণ্ঠ।
‘আমি শুরুতেই দুঃখ প্রকাশ করেছি। তুমি ক্ষমা করতে পারনি ডোনা?’
‘আমি নিজের জন্যে কিছুই বলছি না, বলছি কোটি মজলুমের পক্ষে। তাদের স্বার্থেই তুমি কোথায় কি করছ তোমার পেছনের লোকদের তা জানা দরকার’।
‘তোমার রক্তে রয়েছে রাজ্য পরিচালনা, প্রজা পরিচালনার অভিজ্ঞতা। তুমি সুন্দর বলেছ ডোনা। আমি চাইলে কি হবে, তুমি একজনের নও সবার হয়ে উঠছ’। ম্লান হাসল আহমদ মুসা।
‘না, আমি ডোনা জোসেফাইন নারী হিসেবে একজনের। কিন্তু সমাজ ও জাতির একজন সদস্য হিসেবে সকলের প্রতি দায়িত্ব আছে, যে দায়িত্ব তুমিও পালন কর। আমার এ দায়িত্ব পালনও তোমার চাওয়ার বাইরে হতে পারে না’।
‘আহমদ মুসা কিছু বলতে যাচ্ছিল। ডোনা বাধা দিয়ে হেসে বলল, ‘আর কিছু বলতে হবে না। দেখ, রোসেলিনের, আব্বা আসছেন’।
গাড়ি তখন গাড়ি বারান্দায় দাঁড়িয়ে গেছে।
রোসেলিনের আব্বা চীফ জাস্টিস উসাম বাইক নেমে আসছেন গাড়ি বারান্দায়।
আহমদ মুসা ও ডোনাও গিয়ে পৌঁছল সেখানে।
চীফ জাস্টিস উসাম বাইক আহমদ মুসাকে দেখতে পেয়েই ছুটে এসে জড়িয়ে ধরল। বলল, ‘বাবা তুমি মানুষ নও, দেবদূত। স্বয়ং ঈশ্বর তোমার হাত দিয়ে কাজ করেন’।
বলে আহমদ মুসাকে ছেড়ে দিয়ে বলল, ‘কোথায় আমার স্যার, আমার পিতা’।
ততক্ষণে ডঃ ডিফরজিস, ওমর বায়া এবং ওকোচা গাড়ি থেকে নেমেছে।
আহমদ মুসাকে ছেড়ে দিয়েই উসামবাইক গিয়ে জড়িয়ে ধরল ডঃ ডিফরজিসকে।
তার অনেকক্ষণ একে অপরকে জড়িয়ে ধরে থাকল। উসাম বাইকের দুই চোখ অশ্রুতে ভরে উঠেছে।
ডঃ ডিফরজিস উসাম বাইকের পিঠ চাপড়ে সান্ত্বনা দিয়ে তাকে ছাড়ল এবং বলল, ‘আমার কিডন্যাপ যেমন আকস্মিক, মুক্তিও তেমনি আকস্মিক’।
‘ঈশ্বরকে ধন্যবাদ। আর ধন্যবাদ এই বিস্ময়কর যুবককে’। আহমদ মুসাকে দেখিয় বলল চীফ জাস্টিস উসাম বাইক।
‘তার বিস্ময়কর কীর্তির কথা আরও শুনেছি। পরিচয় এখনও জানতে পারিনি’।
‘কি বলনি’। বলে চীফ জাস্টিস তাকাল আহমদ মুসার দিকে।
‘সে বলা যাবে’। বলে আহমদ মুসা ওমর বায়াকে পরিচয় করিয়ে দিল চীফ জাস্টিসের সাথে।
তারপর ‘ওকোচা’কে দেখিয়ে বলল, ‘ওর নাম ওকোচা। ওর সম্পর্কে অনেক কথা আছে। ও আমাদের মূল্যবান সাহায্য করেছে’।
ওকোচা’র পিঠ চাপড়াতে গিয়ে চীফ জাস্টিসের চোখ পড়ল গাড়ির ভেতরে। সে দেখতে পেল, গাড়ির মেঝেয় পড়ে আছে হাত-পা বাঁধা সংজ্ঞাহীন বা ঘুমন্ত একজন লোক।
চীফ জাস্টিস বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকাল আহমদ মুসার দিকে।
আহমদ মুসা বুঝল। বলল, ‘আপনি না দেখলেই ভাল ছিল। যাক, উনি ‘ওকুয়া’ এবং ‘কোক’-এর প্রধান ফ্রান্সিস বাইক। প্রয়োজনে ওকে আনা হয়েছে, প্রয়োজন শেষ হলে ছেড়ে দেয়া হবে’।
বলে আহমদ মুসা ‘ওকোচা’র দিকে চেয়ে বলল, ‘ওকোচা তুমি গাড়িতে ওঠ। ওর পাশে বস। আমি ড্রাইভিং সিটে বসছি’।
তারপর চীফ জাস্টিসের দিকে চেয়ে বলল, ‘ওমর বায়া এখন এখানে থাকছে। আমি ফিরে এসে নিয়ে যাব’।
‘তোমরা কোথায় যাচ্ছ?’ বলল চীফ জাস্টিস।
‘রাশিদীর ওখানে যাই। ফ্রান্সিস বাইককে কোথায় রাখব তার পরামর্শ নিতে হবে’।
‘ঠিক আছে যাবে। দু’মিনিট বস। চল ভেতরে’। বলে হাঁটতে শুরু করল চীফ জাস্টিস ডঃ ডিফরজিসকে নিয়ে।
‘এই অবস্থায় বসা কেমন হবে?’
‘তোমার জন্যে সব অবস্থাই মানিয়ে যায়। চিন্তা করো না। চল’।
ডোনা এবং রোসেলিন আগেই ভেতরে চলে গিয়েছিল।
‘গাড়ির দরজাগুলো লক কর। চল গিয়ে একটু বসি। তোমার অসুবিধা হবে না তো?’ বলল আহমদ মুসা ওকোচাকে।
ওকোচা চাবি হাতে গাড়ির দিকে এগুতে এগুতে বলল, ‘না অসুবিধা হবে না। আমার খুব আনন্দই বোধ হচ্ছে’।
‘ওকোচা গাড়ি লক করে ফিরে এলে আহমদ মুসা, ওকোচা ও ওমর বায়া চীফ জাস্টিসের পিছে পিছে প্রবেশ করল বাড়ির ভেতরে।

চীফ জাস্টিস উসাম বাইক ও ডঃ ডিফরজিসের অনুরোধে আহমদ মুসাকে অভিযানের গোটা কাহিনী বলতে হলো।
তাছাড়া আছে যে কথা আহমদ মুসা বলতে পারেনি। কারণ আহমদ মুসা বসে তার কথা শুরু করার আগেই রাশিদী ইয়েসুগো, মুহাম্মদ ইয়েকিনি, লায়লা ইয়েসুগো, ফাতেমা মুনেকা এসে গিয়েছিল।
রোসেলিন তার আব্বাকে ডাকতে এসেই লায়লাকে টেলিফোন করে দিয়েছিল। টেলিফোন পেয়েই ওরা ছুটে এসেছে।
আহমদ মুসা তার অভিজান কাহিনী শেষ করে থামতেই চীফ জাস্টিস উসাম বাইক ওকোচাকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘বাবা আমরা তোমার কাছে কৃতজ্ঞ। তুমি বিরাট ত্যাগ স্বীকার করেছ’।
‘আহমদ মুসা ভাই আমাকে নতুন জীবন দিয়েছেন, আমাদের পরিবারকে, গোত্রকে বিরাট এক হানাহানি থেকে বাঁচিয়েছেন। তার তুলনায় আমি যা করেছি তা খুবই সামান্য’। বলল ওকোচা লজ্জিত কণ্ঠে।
ডঃ ডিফরজিস আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে বলল, ‘আমি ও ওমর বায়া তোমার রক্তের কেউ নই। এরপরও সাক্ষাৎ মৃত্যুকে হাতে নিয়ে ঐভাবে শত্রুপুরীতে প্রবেশ করেছিলে তুমি। ওদের হাতে বন্দী হবার পর আফসোস হয়নি তোমার?’
‘এটা খুব বড় হলো? মানুষ মানুষের জন্যে জীবন দেয়র দৃষ্টান্ত ইতিহাস ভরা’। বলল আহমদ মুসা।
‘প্রায় এক কুড়ি লোককে তোমার হত্যা করতে হয়েছে। তোমার কিছু মনে হয়নি, কিছু মনে হচ্ছে না?’ বলল চীফ জাস্টিস।
আহমদ মুসা মথা নিচু করল। তৎক্ষণাৎ জবাব দিল না।
একটু পর মুখ তুলল। বলল, ‘একটা অত্যন্ত নাজুক প্রশ্ন করেছেন জনাব। এ নিয়ে ভাবতে আমাকে ভয় করে। ওদের ১৮ জনের সবার নিশ্চয় মা, স্ত্রী, ছেলে-মেয়ে আছে। ওরা হয়তো উম্মুখ হয়ে থাকবে তাদের প্রিয়জন কখন ফিরবে সে অপেক্ষায়। কিন্তু যখন শুনবে ঐ হৃদয় বিদারক খবর, তখন সেখানে সৃষ্টি হবে এক হৃদয় বিদারক দৃশ্যের। সন্তান হারা মা, স্বামী হারা স্ত্রী, পিতা হারা সন্তানদের বুক ফাটা কান্ন থামবে কিভাবে, সান্ত্বনা পাবে তারা কিসে, কেমন করে?’
আহমদ মুসার শেষ কথাগুলো কাঁপছিল প্রবল এক উচ্ছ্বাসে। চোখ দু’টি সিক্ত হয়ে উঠেছিল তার।
আহমদ মুসা থেমেছিল।
কারো মুখে কোন কথা নেই। সকলের বিস্ময় জড়িত ভারি দৃষ্টি আহমদ মুসার উপর নিবদ্ধ।
আহমদ মুসা তার চোখ মুছে বলল, ‘আমি এ জন্যে পেছনে তাকাই না জনাব। তাকালে সামনে এগুতে পারবো না’।
‘এত অনুভুতিপ্রবন মন ও আবেগ সিক্ত হৃদয় নিয়ে তুমি কিভাবে এত বড় কঠিন দায়িত্ব পালন কর আহমদ মুসা?’ বিস্ময় জড়িত কণ্ঠে বলল চীফ জাস্টিস উসাম বাইক।
‘অন্যায়ের প্রতিবিধান ও সুবিচারের দাবী সহজাত সব অনুভুতি ও আবেগের চেয়ে বড় বলেই হয়তো’।
‘মানবিক অনুভুতি ও আবেগের দাবীকে কি কখনই বড় করে দেখা যাবে না?’ বলল রোসেলিন।
‘যাবে, যদি তা সুবিচারের পরিপন্থী না হয় এবঙ অন্যায়ের সাহায্য না করে’। বলল আহমদ মুসা।
‘তাহলে মানবিকতা তো কন্ডিশনাল হয়ে যাচ্ছে’। রোসেলিন বলল।
‘অবশ্যই কন্ডিশনাল হবে। কন্ডিশনাল না হলে মানুষ যা করবে, ভাববে তাই যদি মানবিকতার নামে বৈধ হয়ে যায়, তাহলে মানব সমাজ বন্য সমাজে পরিণত হবে’।
‘ন্যায়-অন্যায়ের সংঘাত অর্থাৎ হানাহানির হাত থেকে তাহলে তো বাঁচা যাচ্ছে না। রক্তপাত, মানবতার ক্রন্দন তো তাহলে দেখেই যেতে হবে। সমাধান কোথায়?’ বলল রোসেলিন আবার।
‘যাকে তুমি মানবতার ক্রন্দন বলছ, সেটা মানুষের ক্রন্দন, মানবতার নয়। মানবতার ক্রন্দন আসে শুধু জালেমের জুলুম থেকে। এ জুলুমে মজলুমের মানবতাও কাঁদে, জালেমের মনুষত্ব বা মানবতাও কাঁদে। মানবতা বা মনুষত্বের এই ক্রন্দনের সাথে মানুষের ক্রন্দনের পার্থক্য আছে। বেকায়দায় পড়লে জালেমরাও কাঁদে। এই ক্রন্দন মানুষের, মানবতা বা মনুষত্বের ক্রন্দন নয়’। একটু থামল আহমদ মুসা।
তারপর আবার শুরু করল, ‘তুমি সংঘাতের অবসান চেয়েছ। এটা সকলেরই কাম্য। অন্যায়ের শক্তিকে পরাভুত করে এবং পরাভুত রেখে ন্যায় ও সুবিচারের প্রতিষ্ঠা করতে পারলেই শুধু এই কামনা পুরণ হবে।
কিন্তু এই আদর্শ পরিবেশ কোনদিন আসবে বলা মুস্কিল। কারণ শয়তানি শক্তির পদচারণা কিয়ামতের পূর্ব পর্যন্ত থাকবে। সেই সাথে থাকবে মানুষের লোভ, লালসা এবং স্বার্থপরতার শক্তিশালী প্রবণতা। মানুষের এ কু-প্রবণতাকে শয়তান তার স্বার্থে ব্যবহার করে সংঘাত বাধাবেই’।
‘তাহলে আর করার কি থাকল?’ বলল রোসেলিন।
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘কেন করার মত কাজ তো আরও বাড়ল। অমঙ্গলের শক্তি শয়তান অন্যায়-অবিচারের রাজত্ব কায়েমে যত তৎপর হবে, মঙ্গলের শক্তিকে ন্যায় ও সুবিচার কায়েমে ততই তৎপর হতে হবে। করার কিছু থাকল না বলছ কেন?’
‘তাহলে সংঘাতই মানুষের অবধারিত ভাগ্য হয়ে দাঁড়াচ্ছে’।
‘এবং এটাই জীবন’।
‘তাহলে শান্তি?’
‘মঙ্গলের শক্তি ন্যায় ও সুবিচার প্রতিষ্ঠায় যে সংগ্রাম করে, তা শান্তির জন্যেই। কিন্তু শান্তি যদি না আসে, তবুও শান্তির সংগ্রামের মধ্যেই মানব জীবনের সাফল্য। এবং এর জন্যে মানুষ পরকালে পাবে পরম পুরষ্কার, অনন্ত এক শান্তির জীবন’।
‘আপনি জীবন থেকে পরজীবনে চলে গেলেন’।
‘স্বাভাবিক। অতি সংক্ষিপ্ত এই জীবন তো অনন্ত পরজীবনে প্রবেশের একটা টিকিট ঘর মাত্র’।
‘ধন্যবাদ্ বন্দুক হাতে আপনি যতটা দক্ষ, ধার্মিকতার দিক দিয়ে আপনি ততটাই দক্ষ’।
‘ঠিক বলেছ মা। আমার প্রশ্নেরও জবাব পেয়ে গেছি। বিপ্লবী হিসেবে আহমদ মুসা যত বড়, তার মানবতাবোধও তত বড়’। বলল রোসেলিনের আব্বা উসাম বাইক।
টেলিফোন বেজে উঠল।
রোসেলিন গিয়ে টেলিফোন ধরল। টেলিফোন ধরেই বলল, ‘আব্বা তোমার টেলিফোন’।
বলে কর্ডলেস টেলিফোন এনে রোসেলিন তার আব্বার হাতে দিল।
‘মাফ করবেন, টেলিফোনটা ধরে নেই’। সবার দিকে চেয়ে কথা কয়টি বলে চীফ জাস্টিস টেলিফোনে কথা বলতে শরু করল।
অনেকক্ষণ ধরে টেলিফোনে কথা হলো। চীফ জাস্টিস কথা বলল কম, ‘ইয়েস’, ‘নো’ ধরনের দু একটা। অধিকাংশ সময়ই শুনলো।
শুরুতেই চীফ জাস্টিসের চেহারায় কিছু পরিবর্তন এসেছিল। তাকিয়েছিল আহমদ মুসার দিকে।
তার দিকে চীফ জাস্টিসকে তাকাতে দেখেই আহমদ মুসা বুঝতে পেরেছিল নিশ্চয় কথার মধ্যে আহমদ মুসার কথা এসেছে।
তার সম্পর্কে কে কথা বলছে ওঁর সাথে? প্রশ্ন জাগল আহমদ মুসার মনে। ওকুয়ার কেউ? না, পিয়েরে পলের মৃতু্য এবং ফ্রান্সিস বাইক বন্দী হবার পর চীফ জাস্টিসের সাথে তার সম্পর্কে আলোচনার কেউ নেই।
তাহলে?
এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পেল না আহমদ মুসা।
টেলিফোনে কথা বলা শেষ হলো চীফ জাস্টিস উসাম বাইকের।
টেলিফোন পাশে রাখল চীফ জাস্টিস।
প্রথমে আহমদ মুসার দিকে তাকাল। তারপর ডঃ ডিফরজিসের দিকে একবার তাকিয়ে বলল, ‘আহমদ মুসার জন্যে কিছু ভাল খবর রয়েছে’।
‘কার টেলিফোন ছিল জনাব?’ বলল আহমদ মুসা।
‘আমাদের ল’ সেক্রেটারী লাউস মেইডি’র’।
‘ল’ সেক্রেটারী? কি কথা তিনি বললেন?’
নড়ে-চড়ে বসল চীফ জাস্টিস। তারপর বলল, ‘আহমদ মুসার পরিচয় পাবার পর আমি মনে করেছিলাম সে মুসলিম বিশ্বে অত্যন্ত জনপ্রিয়, কিন্তু সে যে অমুসলিম রাষ্ট্রগুলোরও এত প্রিয় তা ভাবতে পারিনি’।
‘কি হয়েছে? উনি কি বললেন আব্ব?’ বলল রোসেলিন।
‘বলছি। ফিলিস্তিন, সৌদি আরব, মিন্দানাও, মধ্য এশিয়া মুসলিম প্রজাতন্ত্র, আফগানিস্তান ইসলামী প্রজাতন্ত্র, বলকান প্রজাতন্ত্র, আজার বাইজান প্রজাতন্ত্র প্রভৃতি দেশের প্রেসিডেন্ট গতকাল আমাদের প্রসিডেন্টের সাথে এবং প্রধানমন্ত্রীর সাথে কথা বলেছেন। তারা জানিয়েছেন, মুসলিম জনগণের প্রিয় নেতা আহমদ মুসাকে ওকুয়া এবং ব্ল্যাক ক্রস ক্যামেরুনে এনে বন্দী করে রেখেছে। আহমদ মুসার মুক্তির ব্যাপারে তারা ক্যামেরুন সরকারের সাহায্য চেয়েছে।
‘ল’ সেক্রেটারী তোমাকে এঁটা জানাল কেন?’ বলল ডঃ ডিফরজিস।
‘ল’ সেক্রেটারী আমার পুরনো বন্ধু। সে টেলিফোন করেছিল সরকারের সংকট জানানোর জন্যে। এই তো ক’দিন আগে ফ্রি ওয়ার্ল্ড টিভি এবং ওয়ার্ল্ড নিউজ এজেন্সী নিউজ করল যে, ওকুয়া সমগ্র দক্ষিণ ক্যামেরুন থেকে মুসলমানদের উচ্ছেদ করেছে, সমগ্র ক্যামেরুনে মুসলমানদের উপর জুলুম চালাচ্ছে ওকুয়া। তার সাথে সাথেই এই খবর যে মুসলিম বিশ্বের প্রিয় ব্যক্তিত্ব আহমদ মুসাকে ওকুয়া বন্দী করে এনেছে। সরকারের কাছে খুবই বিব্রতকর হয়েছে ব্যাপারগুলো। সউদি আরবের বাদশাহ সহ সাতজন রাষ্ট্র প্রধান টেলিফোন করা কম কথা! সরকার সাংঘাতিক চাপের মধ্যে পড়েছে’।
আহমদ মুসার চোখে-মুখে গভীর চিন্তার রেখা। ভাবছিল। চীফ জাস্টিস থামতেই সে বলল, ‘কিন্তু সাতটি মুসলিম দেশ এত তাড়াতাড়ি এই ব্যাপারটা জানল কি করে?’
‘হ্যাঁ, ল’ সেক্রেটারী লাউস মেইডি এ সম্পর্কে বলেছেন। ব্ল্যাক ক্রসের পরিচয় দিয়ে গত পরশু রাতে কারা নাকি এ খবর জানিয়েছে ঐ মুসলিম দেশগুলোকে’।
‘বুঝেছি, ব্ল্যাক ক্রস বিজয়ের বাহদুরিও দেখাতে চায় এবং ব্ল্যাক মেইলও করতে চায়’। বলল আহমদ মুসা।
‘ব্ল্যাক মেইল কিভাবে?’ বলল চীফ জাস্টিস।
‘আহমদ মুসাকে মুক্তি দেয়ার ভোয়া টোপ দিয়ে তারা ঐ মুসলিম রাষ্ট্রগুলো থেকে টাকা খসাতে চায়’।
‘সাংঘাতিক ব্যবসায়’। বলল ডঃ ডিফরজিস।
‘তাদের এ ব্যবসার একদিক দেখলেন, আরও দিক আছে’। বলল আহমদ মুসা।
‘সেটা কি?’ বলল ডঃ ডিফরজিস।
‘ব্ল্যাক ক্রস এ খবর শ্বেতাংগ সন্ত্রাসবাদী সংস্থা ক্লু-ক্ল্যাক্স-ক্ল্যান, ইহুদি বিশ্ব গোয়েন্দা নেট ওয়ার্ক ‘ইরগুন জাই লিউমি’ এবং ধ্বংসাবশিষ্ট বাম গোপন সংগঠন ‘ওয়ার্ল্ড রেড ফোর্স’ (W.R.F) কে জানাবে এবং তারা কে কতত বিলিয়ন ডলার দিয়ে আমাকে কিনতে পারে তার দরকষকষি করবে’। আহমদ মুসা বলল।
‘তারা কিনবে কেন?’ বলল চীফ জাস্টিস।
‘কারণ তাদের বড় বড় পরাজয় ঘটেছে আমার হাতে। আমাকে হাতে পেলে তারা তার শোধ নিতে পারবে এবং আমাকে হাতে রেখে কিছু মুসলিম দেশকে বেকায়দায় ফেলে অতীতের ক্ষতিপূরণ করার চেষ্টা করবে’।
‘তারা বেকায়দায় পড়বে কিভাবে?’ বলল ডঃ ডিফরজিস।
‘কিছু মুসলিম রাষ্ট্র আছে যারা বৈষয়িক যে কোন মূল্যের চেয়ে আমার নিরাপত্তাকে বড় বলে মনে করে’।
‘বুঝেছি। তুমি ভাগ্যবান আহমদ মুসা’। বলল ডঃ ডিফরজিসই আবার।
‘ঠিক। ঈশ্বরকে ধন্যবাদ্ তিনি বড় বিপদ থেকে তোমাকে এবং তোমার জাতিকে রক্ষা করেছেন’। একটু থেমে চীফ জাস্টিস বলল, ‘ক্যামেরুনে তোমার আমার লক্ষ্য তো অর্জিত হয়েছে। এখন তোমার পরিকল্পনা কি?’ বলল চীফ জাস্টিস।
‘প্রথম লক্ষ্য অর্জিত হয়েছে দ্বিতীয় লক্ষ্য এখনো অর্জিত হয়নি’।
‘দ্বিতীয় লক্ষ্য কি? বলুন’। চীপ জাস্টিস বলল।
‘উচ্ছেদ হওয়া মুসলমানদের তাদের সহায়-সম্পত্তি ফিরে পাওয়া এবং তাদের পুনর্বাসন’।
‘এ তো বিরাট কাজ। এটা কিভাবে সম্ভব হবে?’ চীফ জাস্টিসই বলল।
‘সে পরিকল্পনা করেছি। ফ্রান্সিস বাইককে এ জন্যেই বন্দী করে এনেছি’।
‘ঈশ্বর তোমাকে সাহায্য করুন’।
‘আমিন’।
বলে আহমদ মুসা তাকাল রাশিদী ইয়েসুগোর দিকে। বলল, রাশিদী ফ্রান্সিস বাইককে তোমার গাড়িতে পার করে নাও। ওকোচা অনেক কষ্ট করেছে, আর নয়। ওর বাড়িতে এতক্ষণ নিশ্চয় কান্নার রোল পড়ে গেছে’।
‘না আহমদ মুসা ভাই, আমার কোন কষ্ট হয়নি। আমাকে নিয়ে তাড়াহুড়া করবেন না’। বলল ওকোচা।
‘কিন্তু বাড়ির সবাই তোমার জন্যে কষ্ট পাচ্ছে। শেষ রাতে বাড়ি থেকে বেরিয়েছ। স্ত্রীকেও বলনি। বাড়িতে গিয়ে দেখ কি সাংঘাতিক অবস্থা। থানাতেও খবর হয়ে গেছে এতক্ষণ’।
‘কিন্তু আপনাকে সাথে নিয়ে যেতে চাই। সবাই খুশী হবে’।
‘আমি জানি। আমি যাব, তবে তোমার সাথে নয়। তুমি যে আমাকে সাহায্য করেছ, একথা তোমাকে গোপন রাখতে হবে’।
‘কেন?’
‘কারণ আমি চাই না তোমাদের পরিবার বিপদগ্রস্ত হোক’।
‘ওকুয়া জানবে কি করে?’ বলল ওকোচা।
‘তোমার পরিবারের কেউ ওকুয়াকে বলবে না। কিন্তু এমন কেউ জেনে ফেলতে পারে যার কাছ থেকে ওকুয়ার কানে কথা পৌঁছতে পারে’।
‘বুঝলাম। মানলাম। তাহলে আপনি কবে কখন যাচ্ছেন?’
‘সেটা বলা মুস্কিল। তবে যাব। তোমার সাহায্য আমার দরকার হতে পারে’।
‘ধন্যবাদ ভাইয়া। আপনি শুধু আমাকে নতুন জীবন দেননি। আমার মনে হচ্ছে নতুন দৃষ্টিও আপনার কাছ থেকে পাব’। বলে উঠে দাঁড়াল ওকোচা।
রাশিদী ইয়েসুগো এবং মুহাম্মাদ ইয়েকিনিও উঠে দাঁড়িয়েছিল।
আহমদ মুসা উঠে হ্যান্ডশেক করল ওকোচার সাথে। তারপর তার পিঠ চাপড়ে বলল, ‘তুমি অবিশ্বাস্য কাজ করেছ ওকোচা। আমি কৃতজ্ঞ’।
‘ছোট ভাইকে এভাবে কেউ বলে?’ আহমদ মুসার দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে ক্ষোভ ভরা কণ্ঠে বলল ওকোচা।
আহমদ মুসা ওকোচাকে বুকে জড়িয়ে ধরল বলল, ‘ঠিক আছে, আর বলল না।’
ওকোচা, রাশিদী এবং ইয়েকিনি বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।
ওরা বেরিয়ে গেলে ডঃ ডিফরজিস বলল, ‘তুমি ঠিক বলেছ আহমদ ‍মুসা। ছেলেটা অবিশ্বাস্য কাজ করেছে।’
আহমদ মুসা কিছু বলতে যাচ্ছিল। এই সময় ঘরে প্রবেশ করল ডোনার আব্বা মিশেল প্লাতিনি।
মিশেল প্লাতিনি প্রবেশ করতেই ডঃ ডিফরজিস উঠে দাঁড়াল। মিশেল প্লাতিনি এবং ডঃ ডিফরজিস পরস্পরকে জড়িয়ে ধরল।
তারপর উভয়ের মধ্যে কুশল বিনিময় হলো, কথা হলো।
এক পর্যায়ে চীফ জাস্টিস উসাম বাইক মিশেল প্লাতিনিকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘বিরাট লস করেছেন। অপরুপ কাহিনী থেকে বঞ্চিত হলেন।’
‘হ্যাঁ, দুর্ভাগ্য আমার।রোসেলিন মা, ডোনা মা দু’জনেরই টেলিফোন পেয়েছি। কিন্তু ড্রাইভার ছিল না। আমাকে একা বেরুতে দিলেন না এ্যামবেসেডর।’ বলল মিশেল প্লাতিনি।
ড্রইং রুমে প্রবেশ করল রাশিদী ইয়েসুগো এবং মুহাম্মদ ইয়েকিনি।
রাশিদী ও ইয়েকিনি এসে বসতেই আহমদ মুসা রাশিদীকে জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি ওকোচাকে তোমার বাড়ির ঠিকানা দাওনি তো?’ আহমদ মুসা চোখে-মুখে কিছুটা শংকার মিশ্রণ।
রাশিদী সেদিকে চেয়ে বলল, ‘না’ কেন জিজ্ঞেস করছেন? দেয়া কি উচিত ছিল?’
‘ধন্যবাদ। না দিয়ে ঠিক করেছে।’
‘কেন। তাকে সন্দেহ করেন? এ জন্যেই কি তাকে আমাদের সাথে আমাদের বাড়ি পর্যন্ত নিলেন না?’
‘তাকে সন্দেহ করি বলে তাকে তোমার বাড়ি পর্যন্ত নিলাম না, তা নয়। আসলে এটা একটা সাবধানতা। আমি মনে করি সে সন্দেহের উর্ধ্বে। কিন্তু সে কারো হাতে পড়তে পারে এবং চাপে পড়ে ফ্রান্সিস বাইকের একটা হদিস হিসেবে তোমার বাড়ির ঠিকানা বলে দিতেও পারে। এমন সম্ভাবনার দরজা এই পর্যায়ে বন্ধ রাখা দরকার।
‘বুঝেছি আহমদ মুসা ভাই। ধন্যবাদ আপনাকে।’ বলল রাশিদী ইয়েসুগো।
‘এতদূর পর্যন্ত সামনে দেখে তুমি পথ চল আহমদ মুসা! আমি হলে তো এক ঠিকানা কেন, সবকিছু তাকে জানাতে দ্বিধা করতাম না।’ বলল চীফ জাস্টিস ইসাম বাইক।
‘এই জন্যেই আহমদ মুসাই শুধু আহমদ মুসা।’ বলে আহমদ মুসার দিকে তাকিয়ে ডঃ ডিফরজিস বলল, ‘এখন কিছু কিছু করে বুঝতে শুরু করেছে তুমি এত সফল কেন?’
আহমদ মুসার চোখে-মুখে লজ্জার একটা ভাব ফুটে উঠেছিল। সম্ভবতঃ কথার মোড় অন্যদিকে ঘুরিয়ে নেবার জন্যে বলল, ‘আমাদের এখন উঠতে হয়।’
বলে চীফ জাস্টিস উসাম বাইকের দিকে চেয়ে বলল, ‘অনুমতি দিন।’
উঠে দাঁড়াল আহমদ মুসা।
রোসেলিনের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আমরা গাড়ি নিয়ে যাচ্ছি, লায়লা ও ফাতেমা মুনেকা থাক। পরে গাড়ি পাঠানো হবে, বা তুমি পৌঁছে দিও।’
রোসেলিন মাথা নেড়ে বলল, ‘আমি পৌঁছে দেব।’
‘ধন্যবাদ।’ বলে আহমদ মুসা তাকাল ওমর বায়ার দিকে। বলল, ‘রাশিদীরা এসেছে, ওমর বায়া তুমি আমাদের সাথে চল।’
ওমর বায়া এলিসা গ্রেসের দিকে একবার চেয়ে উঠে দাঁড়াল। এলিসা গ্রেসও চেয়েছিল ওমর বায়ার দিকে।
ব্যাপারটা নজর এড়াল না আহমদ মুসার। বলল, ‘রোসেলিন, এলিসা গ্রেসকে লায়লাদের সাথে বেড়াতে নিয়ে যেতে পার।’
‘মারিয়া আপাকে?’ বলল রোসেলিন।
আহমদ মুসা একবার ডোনার দিকে চাইল। তারপর রোসেলিনের দিকে চেয়ে বলল, ‘ও সুস্থ হয়ে ওঠেনি। ওর ‘মুভ’ না করাই ভাল।’
ডোনার ঠোঁটে তখন হাসি।
আহমদ মুসা কথা শেষ করতেই ডোনার আব্বা মিশেল প্লাতিনি আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে বলল, ‘এখন তোমার পরিকল্পনা কি?’
‘পিয়েরে পল নিহত হয়েছেন, ফ্রান্সিস বাইককে আমরা বন্দী করেছি। ওকুয়া যে অবিচার করেছে তার প্রতিকারের জন্যে কিছু করতে হবে জনাব। ফ্রান্সিসের একটা ব্যবস্থা করে আপনাদের সাথে দেখা করবে। সব বলব তখন।’
বলে আহমদ মুসা সকলকে সালাম জানিয়ে ঘুরে দাঁড়াল। চলতে শুরু করল। তার সাথে সাথে রাশিদী, ইয়েকিনি এবং ওমর বায়া।
ওদের চলার পথের দিকে তাকিয়ে ছিল সবাই।
চীফ জাস্টিস উসাম বাইক তার পথের দিকে চোখ রেখেই বলল, ‘যন্ত্রের মত কর্তব্য পরায়ন অদ্ভুত মানুষ।’
‘যন্ত্রের কোন অন্তর থাকে না। কিন্তু ওর আছে সাগরের মত গভীর, আকাশের মত উদার একটা মন।’ বলল রোসেলিন।
‘আমি ভেবে পাই না, সার্বক্ষণিক টেনশন নিয়ে ও বাঁচে কি করে?’ বলল চীফ জাস্টিস।
‘না, ও কোন টেনশনে ভোগে না। ওর মধ্যে কোন টেনশন দেখিনি।’ বলল মিশেল প্লাতিনি।
‘উনি নিজেকে নিয়ে ভাবেন না। ফল নয়, কাজ উনার বড়। উনি মনে করেন, কাজ করা, চেষ্টা করার দায়িত্ব তার, ফল দেবেন আল্লাহ। সুতরাং টেনশন তার কাছে আসতে পারে না।’ বলল মিশেল প্লাতিনি।
‘তুমি কিছু বল মারিয়া আপা।’ ঠোঁটে একটা সুক্ষ্ম হাসি টেনে বলল রোসেলিন।
ডোনার মুখে সলজ্জ হাসি ফুটে উঠল। সে উঠে দাঁড়াল। বলল ‘আমার ওষুধ খাবার সময় হয়েছে। আমি চললাম।’
বলে দু’তলার সিঁড়ির দিকে এগুলো।
তার পেছনে পেছনে ছুটল রোসেলিন।
লায়লা এবং ফাতেমা মুনেকাও উঠে দাঁড়াল। তারাও হাঁটতে শুরু করল সিঁড়ির দিকে।
চীফ জাস্টিস উঠে দাঁড়িয়ে মিশেল প্লাতিনির দিকে চেয়ে বলল, ‘আপনি আমার স্টাডি রুমে আসুন। কথা আছে।’
এরপর ডিফরজিসের দিকে চেয়ে বলল, ‘আসুন, আপনি রেস্ট নেবেন।’
ডঃ ডিফরজিস এবং মিশেল প্লাতিনিও উঠে দাঁড়াল।
সবাই চলল দু’তলার সিঁড়ির দিকে।