২১. কঙ্গোর কালো বুকে

চ্যাপ্টার

চ্যাপ্টার

আহমদ মুসার গাড়ি যখন চলছিল ক্যামেরুন ক্রিসেন্টের অফিসের দিকে, সেই সময় আহমদ মুসার কানে আযানের শব্দ ভেসে এল ‘ক্যামেরুন ক্রিসেন্ট’ –এর মসজিদ থেকে।
আহমদ মুসা ব্রেক কষল গাড়ির।
‘আমাদের সবাইকে এখানে নামতে হবে?’ বলল ওমর বায়া।
‘হ্যাঁ। তবে আমরা শুধু নামায পড়ব এখানে’। বলল আহমদ মুসা।
‘সময় আছে, গন্তব্যে পৌঁছে আমরা নাময পড়তে পারতাম না?’ ওমর বায়া বলল।
‘পারতাম। কিন্তু নামাযের আহবান যে কানে এল?’
‘যেখানে এ আহবান কানে আসবে, সেখানে নামাযের জন্যে দাঁড়ানো কি অপরিহার্য?’
‘অপরিহার্য নয়, কিন্তু এই মুহূর্তে অপরিহার্য মনে হচ্ছে’।
‘এই মুহূর্তে? কেন?’
‘এমন একটা বিজয় হাতে নিয়ে ফিরছি, যা চাওয়ার চেয়ে বেশী। যিনি এ বিজয় দিয়েছেন, তার ইবাদতের আহবান উপেক্ষা করে এগুতে পারছি না। তাঁর কাছে হাজির হওয়ার এ সুযোগ আমার কাছে অমূল্য মনে হচ্ছে’।
বলল আহমদ মুসা ডঃ ডিফরজিস-এর দিকে চেয়ে বলল, ‘প্লিজ ডক্টর, একটু কষ্ট করুন’। তারপর ওকোচার দিকে চেয়ে বলল, একটু বস কেমন?’
আহমদ মুসা ও ওমর বায়া গাড়ি থেকে নামল।
পুরো ৪৫ মিনিট সময় লাগল আহমদ মুসাদের ফিরে আসতে।
মুসল্লিদের অনেকেই, যারা খবর জানে, বিস্মিত হয়েছে এবং মৌমাছির মত ছেঁকে ধরেছে আহমদ মুসাকে। তাদের প্রশ্নের জবাব দিয়ে ফিরতে সময় আরও বেশী খরচ হলো।
গাড়িতে উঠতে উঠতে আহমদ মুসা ডঃ ডিফরজিসকে বলল, ‘মাফ করবেন, বেশ দেরী হয়ে গেল’।
‘একটি সম্মিলিত প্রার্থনার জন্যে ৪৫ মিনিট সময় কি বেশী?’ বলল ডঃ ডিফরজিস।
‘ধন্যবাদ। তবে প্রার্থনার জন্যে সময় বেশী লাগে না। কিন্তু ‘আযান’ বা আহবানের পর প্রার্থনায় যোগদানের জন্যে আধাঘন্টার মত সময় দেয়া হয়। এতেই সময় বেশী যায়’। আহমদ মুসা বলল।
‘তোমার অবিশ্বাস্য ধরনের কাজ এবং সাহস আমাকে বিস্ময়বিমূঢ় করেছে, কিন্তু তার চেয়েও বিস্মিত হয়েছি ইশ্বরের প্রতি তোমার ভালোবাসা দেখে। আজ তো আধুনিকতা ও ধার্মিকতা পরস্পর বিরোধী হয়ে দাঁড়িয়েছে’। বলল ডঃ ডিফরজিস।
‘আধুনিকতা যদি হয় আধুনিক জ্ঞানে সজ্জিত হওয়া, তাহলে সে আধুনিকতা স্রষ্টার প্রতি ভালোবাসা বৃদ্ধি করে। আর আধুনিকতা বলতে যদি বুঝানো হয় জ্ঞান ও বুদ্ধির দুয়ারে তালা মের আধুনিক পণ্য-সম্ভারের মধ্যে নিমজ্জিত থাকা, তাহলে এই আধুনিকতা অবশ্যই স্রষ্টাকে ভুলিয়ে দেবে’। আহমদ মুসা বলল।
‘সুন্দর বলেছ’। বলে একটু থামল ডঃ ডিফরজিস। তারপর আবার বলল, ‘তুমি আমার ছেলের বয়সের। শুরু থেকেই একটা তীব্র কৌতুহল মনে জাগছে। জিজ্ঞেস করব?’
‘ছেলের মতও বলতে পারেন। কুমেটে আপনর ছেলে এবং আপনার বৌমা ডেবরার সাথে আমার দেখা হয়েছে’।
‘দেখা হয়েছে? তাদের সাথে? কিন্তু ওরা তো ব্ল্যাক ক্রস-এর হাতে বন্দী’।
‘ক্যামেরুনে আসার আগে তাদের সাথে আমি একই রেষ্টহাউসে ছিলাম কয়েকদিন’।
বলে আহমদ মুসা তাদেরকে কিভাবে উদ্ধার করে তার কাহিনী বলল।
বিস্ময়ে প্রায় বাকরোধ হয়ে গেল ডঃ ডিফরজিসের। কিছুক্ষণ পর বলল, ‘তুমি… তুমি উদ্ধার করেছ তাদেরও! কবে?
আহমদ মুসা তারিখ বলল।
ডঃ ডিফরজিস বলল, ‘আমি তো ঐ তারিখেই কিডন্যাপ হই’।
‘আমরা জানি। কিড্ন্যাপ ঠেকাবার জন্যে আমরা বিমান বন্দরে গিয়েছিলাম। কিন্তু দেরী হয়েছিল। যখন ওরা কিডন্যাপ করে পালাচ্ছিল, তখন আমরা রাস্তায়। আমরা ব্যর্থ হয়েছিলাম’।
‘আমার কিডন্যাপ হওয়ার বিষয় আগেই জানতে?’
‘অনুমান করেছিলাম’।
‘কিভাবে’?’
‘সে অনেক কথা’।
‘আমার ছেলে ও বৌমাকে উদ্ধার করার পর কি করলে?’
আহমদ মুসা সংক্ষেপে কাহিনী বর্ণনা করল। তারপর বলল, ‘উদ্ধারের পর যখন ওদের কিডন্যাপ করার কারণ জানতে পারলাম এবং যখন জানলাম আপনি কুমেটে আসছেন, তখন নিশ্চিত হয়েছিলাম আপনার ছেলে ও বৌমা ওঁদের হাতছাড়া হবার পর ওরা আপনাকে কিডন্যাপ করবে’।
‘অসাধারণ বুদ্ধি তোমার। প্রশংসা করে তোমাকে খাটো করবো না। আমার ছেলে ও বৌমা কেমন ছিল? ওদের কোন প্রকার ক্ষতি হয়নি তো? শয়তানরা যে বার বার বলেছে আমার ছেলে ও বৌমা ওদের হাতে রয়েছে?’
‘আপনাকে দুর্বল করার জন্যে মিথ্যা কথা বলেছে। আপনার ছেলে ও বৌমা ভালই ছিল’।
‘ঈশ্বরকে ধন্যবাদ। ঈশ্বর তোমার মঙ্গল করুন। তোমার এসব কথা শুনে আমার কৌতুহল আরও বেড়েছে। আমার প্রশ্নের কি জবাব দেবে?’
‘কি প্রশ্ন?’
‘তোমার সম্পর্কে সামান্য কিছু শুনেছি ওমর বায়ার কাছে। সে বলতো, ‘একজন লোক আছে, সেই শুধু পারে আমাদের উদ্ধার করতে। অবশেষে সেই ‘একজন’ তুমি আমাদের উদ্ধার করলে। তুমি কে বৎস?’
‘দেবার মত বিশেষ পরিচয় আমার নেই। কোন দেশের কোন পদে আমি ছিলাম না। কোন বিষয়ে বিশেষজ্ঞ ছিলাম এমন পরিচিতি আমার নেই। আমার ছোট্ট একটা নাম আছে- আহমদ মুসা’।
ভোরের ফাঁকা রাস্তা ধরে তীব্র গতিতে চলছিল গাড়ি।
গাড়ি পূর্ণ গতিতে চলা শুরু করলে আহমদ মুসা ও ডঃ ডিফরজিসের মধ্যে কথা আর চলল না।
গাড়ি চালাচ্ছিল আহমদ মুসাই।
গাড়ি প্রথমে চীফ জাষ্টিসের বাসায় নেওয়াই ঠিক করেছে আহমদ মুসা। সেখানে ডঃ ডিফরজিসের সাথে ওমর বায়াকে রেখে ফ্রান্সিস বাইককে রাখার জন্যে যাবে রাশিদীর বাড়িতে। রাশিদীর বাড়িতে নয় অন্য কোথাও তাকে রাখতে হবে।
অন্ধকার তখনো পুরোপুরি কাটেনি।
আহমদ মুসার গাড়ি চীফ জাষ্টিসের গেটে গিয়ে দাঁড়াল।
আহমদ মুসা দেখল, চীফ জাস্টিসের বাড়ির চারদিক ঘিরেই পুলিশ পাহারা।
গেটে পুলিশের একটি গাড়ি দাঁড়িয়ে। গাড়িতে বসে আছে চারজন পুলিশ।
আহমদ মুসার গাড়ি দাঁড়াতেই গাড়ি থেকে চারজন পুলিশ তড়াক করে নেমে ষ্টেনগান বাগিয়ে এগিয়ে এল।
আহমদ মুসা লাফ দিয়ে নামল গাড়ি থেকে। পুলিশের সামনে গিয়ে বলল, ‘আমাকে গেটম্যানের কাছে নিয়ে চলুন’।
পুলিশ আহমদ মুসাকে সার্চ করল। পকেটে কোন অস্ত্র পেল না।
পকেটের রিভলবারটি আহমদ মুসা ওকোচা’র কাছে রেখে এসেছে।
পুলিশ আহমদ মুসাকে নিয়ে গেল গেটের দারোয়ানের কাছে।
দারোয়ানটি আহমদ মুসার অপরিচিত। আহমদ মুসা সেদিন বিকেলে যে দারোয়ানকে দেখেছিল সে এ নয়। আহমদ মুসা গেটম্যানকে বলল, ‘আপনি চীপ জাস্টিস সাহেবকে জানান, ডঃ ডিফরজিসকে আনা হয়েছে’।
‘তাঁকে এখন টেলিফোন করা যাবে না’।
‘তাহলে কাকে করা যাবে?’
‘পি,এ, সাহেব এলে পর’।
‘জাস্টিস সাহেবের সরাসরি টেলিফোন নেই?
‘আমি জানি না’।
‘আমার কাছে আছে নম্বারটা। নিন’। বলে আহমদ মুসা টেলিফোন নম্বারটা গেটম্যানকে দেবার জন্যে হাত বাড়াল।
‘এ সময় স্যারকে টেলিফোন করতে পারবো না’।
আহমদ মুসা পুলিশ অফিসারের দিকে চেয়ে বলল, ‘আপনি করুন, ব্যাপারটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ’।
‘গুরুত্বটা আমাকে বুঝতে হবে’। বলল পুলিশ অফিসার।
এই সময় গেটম্যান তড়াক করে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বলল, ‘আপনার গেট থেকে একটু সরে দাঁড়ান। ছোট ম্যাডাম এদিকে আসছেন’।
বলেই গেটের জানালা থেকে সে সরে দাঁড়াল।
গেটের মাঝ বরাবর তিন ফিট ষ্টিল শিটে ঢাকা। নিচের এক ফিট এবং উপরের এক ফিট ফাঁকা। গেটের পাশে এলে মোটা ষ্টিলবারের পাশ দিয়ে ভেতরের সবকিছুই দেখা যায়।
আহমদ মুসা দেখল, রোসেলিন ছুটে আসছে। তার পরনে ট্র্যাক স্যুট। তার পেছনে পেছনে আসছে আরেকজন। তার গায়ে-মাথায় চাদর দেখেই বুঝল, ও ডোনা হবে।
আহমদ মুসা ছুটে আসা রোসেলিনের কণ্ঠ শুনতে পেল। সে চিৎকার করে বলছে, ‘খুলে দাও দরজা, খুলে দাও দরজা’।
গেট খুলে গেল।
‘আহমদ মুসা ভাই আপনি ফিরেছেন?’ বলে গেটের কাছে এসে রোসেলিন হাঁটু গেড়ে বসে দু’হাত উপরে তুলে উর্ধ্বমূখী হয়ে বলল, ‘ঈশ্বর তুমি দয়ালু, তুমি আমাদের কথা শুনেশ’। আবেগ রুদ্ধ তার কণ্ঠ।
ডোনা এসে রোসেলিনের পেছনে দাঁড়াল। তার স্থির দৃষ্টি আহমদ মুসার উপর নিবদ্ধ। তার চোখে অশ্রু, ঠোঁটে হাসি।
আহমদ মুসা রোসেলিনের দিকে এগিয়ে বলল, ‘শুধু আমি আসিনি রোসেলিন, ডঃ ডিফরজিস এবং ওমর বায়াকেও উদ্ধার করে এনেছি। তোমার আব্বাকে খবরটা জানাও’।
‘কি ডঃ ডিফরজিস মুক্ত? কোথায় তিনি? গাড়িতে? যাই আব্বাকে খবর দেই’। বলে রোসেলিন দৌড় দিল বাড়ির দিকে।
আহমদ মুসা তার গাড়ির পেছন দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ওকোচা তুমি গাড়ি ড্রাইভ করে গাড়ি বারান্দায় নিয়ে এস’।
গাড়ি চলতে শুরু করল।
আহমদ মুসা ও ডোনা পাশাপাশি হাঁটতে লাগল।
ডোনার মুখ নিচু।
আহমদ মুসার মুখও নিচু।
ডোনা তার ডান হাত দিয়ে তার আহত বাম হাতটা ধরে ছিল। আস্তে হাতটা ছেড়ে দিয়ে ডান হাত দিয়ে পকেট থেকে রুমাল বের করে চোখ মুছে নিয়ে বলল, ‘তুমি ঠিক আছ তো? তুমি ভাল আছ তো?’
‘আলহামদুলিল্লাহ। একদম ভাল। তুমি কেমন আছ?’
ডোনা কোন জবাব দিল না। তার মুখ নিচু। হঠাৎ করেই তার মুখটা আবার বেদনাক্লিষ্ট হয়ে উঠেছে।
আহমদ মুসা একবার সেদিকে চাইল।
কিছু বলার জন্যে মুখ খুলেছিল আহমদ মুসা।
কিন্তু তার আগেই ডোনা বলল, ‘তুমি ঠিকানা দিয়ে যাওনি কেন?’ ডোনার কণ্ঠ ভারি।
আহমদ মুসা আরেকবার চকিতে ডোনার দিকে চাইল। তারপর বলল, ‘আমি দুঃখিত ডোনা। কিন্তু তুমি জান কেন আমি অন্যায়টা করেছি’।
‘সেই জন্যেই দুঃখটা আমার বেশী। তুমি শুধু ডোনার নও, তুমি কোটি মজলুম মানুষের। তাহলে কেন তুমি এক ডোনার নিরাপত্তার কথা এমন করে ভাববে তোমাকে বিপদগ্রস্ত করেও’।
‘কেন ভাবি সেটাও তুমি জান। ঘোর যুদ্ধক্ষেত্রেও শান্তির একটা তাঁবু থাকে, জীবনের থাকবে না কেন?’
‘আমি তোমার সাথে এখন তর্কে যাব না। কিন্তু বলব, তোমার পেছনে যারা থাকবে, তাদের চলার পথ চিহ্ণিত করে যাওয়া তোমারই দায়িত্ব, ডোনাকে অন্ধকারে রাখ ক্ষতি নেই’। ডোনার ভেজা কণ্ঠ।
‘আমি শুরুতেই দুঃখ প্রকাশ করেছি। তুমি ক্ষমা করতে পারনি ডোনা?’
‘আমি নিজের জন্যে কিছুই বলছি না, বলছি কোটি মজলুমের পক্ষে। তাদের স্বার্থেই তুমি কোথায় কি করছ তোমার পেছনের লোকদের তা জানা দরকার’।
‘তোমার রক্তে রয়েছে রাজ্য পরিচালনা, প্রজা পরিচালনার অভিজ্ঞতা। তুমি সুন্দর বলেছ ডোনা। আমি চাইলে কি হবে, তুমি একজনের নও সবার হয়ে উঠছ’। ম্লান হাসল আহমদ মুসা।
‘না, আমি ডোনা জোসেফাইন নারী হিসেবে একজনের। কিন্তু সমাজ ও জাতির একজন সদস্য হিসেবে সকলের প্রতি দায়িত্ব আছে, যে দায়িত্ব তুমিও পালন কর। আমার এ দায়িত্ব পালনও তোমার চাওয়ার বাইরে হতে পারে না’।
‘আহমদ মুসা কিছু বলতে যাচ্ছিল। ডোনা বাধা দিয়ে হেসে বলল, ‘আর কিছু বলতে হবে না। দেখ, রোসেলিনের, আব্বা আসছেন’।
গাড়ি তখন গাড়ি বারান্দায় দাঁড়িয়ে গেছে।
রোসেলিনের আব্বা চীফ জাস্টিস উসাম বাইক নেমে আসছেন গাড়ি বারান্দায়।
আহমদ মুসা ও ডোনাও গিয়ে পৌঁছল সেখানে।
চীফ জাস্টিস উসাম বাইক আহমদ মুসাকে দেখতে পেয়েই ছুটে এসে জড়িয়ে ধরল। বলল, ‘বাবা তুমি মানুষ নও, দেবদূত। স্বয়ং ঈশ্বর তোমার হাত দিয়ে কাজ করেন’।
বলে আহমদ মুসাকে ছেড়ে দিয়ে বলল, ‘কোথায় আমার স্যার, আমার পিতা’।
ততক্ষণে ডঃ ডিফরজিস, ওমর বায়া এবং ওকোচা গাড়ি থেকে নেমেছে।
আহমদ মুসাকে ছেড়ে দিয়েই উসামবাইক গিয়ে জড়িয়ে ধরল ডঃ ডিফরজিসকে।
তার অনেকক্ষণ একে অপরকে জড়িয়ে ধরে থাকল। উসাম বাইকের দুই চোখ অশ্রুতে ভরে উঠেছে।
ডঃ ডিফরজিস উসাম বাইকের পিঠ চাপড়ে সান্ত্বনা দিয়ে তাকে ছাড়ল এবং বলল, ‘আমার কিডন্যাপ যেমন আকস্মিক, মুক্তিও তেমনি আকস্মিক’।
‘ঈশ্বরকে ধন্যবাদ। আর ধন্যবাদ এই বিস্ময়কর যুবককে’। আহমদ মুসাকে দেখিয় বলল চীফ জাস্টিস উসাম বাইক।
‘তার বিস্ময়কর কীর্তির কথা আরও শুনেছি। পরিচয় এখনও জানতে পারিনি’।
‘কি বলনি’। বলে চীফ জাস্টিস তাকাল আহমদ মুসার দিকে।
‘সে বলা যাবে’। বলে আহমদ মুসা ওমর বায়াকে পরিচয় করিয়ে দিল চীফ জাস্টিসের সাথে।
তারপর ‘ওকোচা’কে দেখিয়ে বলল, ‘ওর নাম ওকোচা। ওর সম্পর্কে অনেক কথা আছে। ও আমাদের মূল্যবান সাহায্য করেছে’।
ওকোচা’র পিঠ চাপড়াতে গিয়ে চীফ জাস্টিসের চোখ পড়ল গাড়ির ভেতরে। সে দেখতে পেল, গাড়ির মেঝেয় পড়ে আছে হাত-পা বাঁধা সংজ্ঞাহীন বা ঘুমন্ত একজন লোক।
চীফ জাস্টিস বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকাল আহমদ মুসার দিকে।
আহমদ মুসা বুঝল। বলল, ‘আপনি না দেখলেই ভাল ছিল। যাক, উনি ‘ওকুয়া’ এবং ‘কোক’-এর প্রধান ফ্রান্সিস বাইক। প্রয়োজনে ওকে আনা হয়েছে, প্রয়োজন শেষ হলে ছেড়ে দেয়া হবে’।
বলে আহমদ মুসা ‘ওকোচা’র দিকে চেয়ে বলল, ‘ওকোচা তুমি গাড়িতে ওঠ। ওর পাশে বস। আমি ড্রাইভিং সিটে বসছি’।
তারপর চীফ জাস্টিসের দিকে চেয়ে বলল, ‘ওমর বায়া এখন এখানে থাকছে। আমি ফিরে এসে নিয়ে যাব’।
‘তোমরা কোথায় যাচ্ছ?’ বলল চীফ জাস্টিস।
‘রাশিদীর ওখানে যাই। ফ্রান্সিস বাইককে কোথায় রাখব তার পরামর্শ নিতে হবে’।
‘ঠিক আছে যাবে। দু’মিনিট বস। চল ভেতরে’। বলে হাঁটতে শুরু করল চীফ জাস্টিস ডঃ ডিফরজিসকে নিয়ে।
‘এই অবস্থায় বসা কেমন হবে?’
‘তোমার জন্যে সব অবস্থাই মানিয়ে যায়। চিন্তা করো না। চল’।
ডোনা এবং রোসেলিন আগেই ভেতরে চলে গিয়েছিল।
‘গাড়ির দরজাগুলো লক কর। চল গিয়ে একটু বসি। তোমার অসুবিধা হবে না তো?’ বলল আহমদ মুসা ওকোচাকে।
ওকোচা চাবি হাতে গাড়ির দিকে এগুতে এগুতে বলল, ‘না অসুবিধা হবে না। আমার খুব আনন্দই বোধ হচ্ছে’।
‘ওকোচা গাড়ি লক করে ফিরে এলে আহমদ মুসা, ওকোচা ও ওমর বায়া চীফ জাস্টিসের পিছে পিছে প্রবেশ করল বাড়ির ভেতরে।

চীফ জাস্টিস উসাম বাইক ও ডঃ ডিফরজিসের অনুরোধে আহমদ মুসাকে অভিযানের গোটা কাহিনী বলতে হলো।
তাছাড়া আছে যে কথা আহমদ মুসা বলতে পারেনি। কারণ আহমদ মুসা বসে তার কথা শুরু করার আগেই রাশিদী ইয়েসুগো, মুহাম্মদ ইয়েকিনি, লায়লা ইয়েসুগো, ফাতেমা মুনেকা এসে গিয়েছিল।
রোসেলিন তার আব্বাকে ডাকতে এসেই লায়লাকে টেলিফোন করে দিয়েছিল। টেলিফোন পেয়েই ওরা ছুটে এসেছে।
আহমদ মুসা তার অভিজান কাহিনী শেষ করে থামতেই চীফ জাস্টিস উসাম বাইক ওকোচাকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘বাবা আমরা তোমার কাছে কৃতজ্ঞ। তুমি বিরাট ত্যাগ স্বীকার করেছ’।
‘আহমদ মুসা ভাই আমাকে নতুন জীবন দিয়েছেন, আমাদের পরিবারকে, গোত্রকে বিরাট এক হানাহানি থেকে বাঁচিয়েছেন। তার তুলনায় আমি যা করেছি তা খুবই সামান্য’। বলল ওকোচা লজ্জিত কণ্ঠে।
ডঃ ডিফরজিস আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে বলল, ‘আমি ও ওমর বায়া তোমার রক্তের কেউ নই। এরপরও সাক্ষাৎ মৃত্যুকে হাতে নিয়ে ঐভাবে শত্রুপুরীতে প্রবেশ করেছিলে তুমি। ওদের হাতে বন্দী হবার পর আফসোস হয়নি তোমার?’
‘এটা খুব বড় হলো? মানুষ মানুষের জন্যে জীবন দেয়র দৃষ্টান্ত ইতিহাস ভরা’। বলল আহমদ মুসা।
‘প্রায় এক কুড়ি লোককে তোমার হত্যা করতে হয়েছে। তোমার কিছু মনে হয়নি, কিছু মনে হচ্ছে না?’ বলল চীফ জাস্টিস।
আহমদ মুসা মথা নিচু করল। তৎক্ষণাৎ জবাব দিল না।
একটু পর মুখ তুলল। বলল, ‘একটা অত্যন্ত নাজুক প্রশ্ন করেছেন জনাব। এ নিয়ে ভাবতে আমাকে ভয় করে। ওদের ১৮ জনের সবার নিশ্চয় মা, স্ত্রী, ছেলে-মেয়ে আছে। ওরা হয়তো উম্মুখ হয়ে থাকবে তাদের প্রিয়জন কখন ফিরবে সে অপেক্ষায়। কিন্তু যখন শুনবে ঐ হৃদয় বিদারক খবর, তখন সেখানে সৃষ্টি হবে এক হৃদয় বিদারক দৃশ্যের। সন্তান হারা মা, স্বামী হারা স্ত্রী, পিতা হারা সন্তানদের বুক ফাটা কান্ন থামবে কিভাবে, সান্ত্বনা পাবে তারা কিসে, কেমন করে?’
আহমদ মুসার শেষ কথাগুলো কাঁপছিল প্রবল এক উচ্ছ্বাসে। চোখ দু’টি সিক্ত হয়ে উঠেছিল তার।
আহমদ মুসা থেমেছিল।
কারো মুখে কোন কথা নেই। সকলের বিস্ময় জড়িত ভারি দৃষ্টি আহমদ মুসার উপর নিবদ্ধ।
আহমদ মুসা তার চোখ মুছে বলল, ‘আমি এ জন্যে পেছনে তাকাই না জনাব। তাকালে সামনে এগুতে পারবো না’।
‘এত অনুভুতিপ্রবন মন ও আবেগ সিক্ত হৃদয় নিয়ে তুমি কিভাবে এত বড় কঠিন দায়িত্ব পালন কর আহমদ মুসা?’ বিস্ময় জড়িত কণ্ঠে বলল চীফ জাস্টিস উসাম বাইক।
‘অন্যায়ের প্রতিবিধান ও সুবিচারের দাবী সহজাত সব অনুভুতি ও আবেগের চেয়ে বড় বলেই হয়তো’।
‘মানবিক অনুভুতি ও আবেগের দাবীকে কি কখনই বড় করে দেখা যাবে না?’ বলল রোসেলিন।
‘যাবে, যদি তা সুবিচারের পরিপন্থী না হয় এবঙ অন্যায়ের সাহায্য না করে’। বলল আহমদ মুসা।
‘তাহলে মানবিকতা তো কন্ডিশনাল হয়ে যাচ্ছে’। রোসেলিন বলল।
‘অবশ্যই কন্ডিশনাল হবে। কন্ডিশনাল না হলে মানুষ যা করবে, ভাববে তাই যদি মানবিকতার নামে বৈধ হয়ে যায়, তাহলে মানব সমাজ বন্য সমাজে পরিণত হবে’।
‘ন্যায়-অন্যায়ের সংঘাত অর্থাৎ হানাহানির হাত থেকে তাহলে তো বাঁচা যাচ্ছে না। রক্তপাত, মানবতার ক্রন্দন তো তাহলে দেখেই যেতে হবে। সমাধান কোথায়?’ বলল রোসেলিন আবার।
‘যাকে তুমি মানবতার ক্রন্দন বলছ, সেটা মানুষের ক্রন্দন, মানবতার নয়। মানবতার ক্রন্দন আসে শুধু জালেমের জুলুম থেকে। এ জুলুমে মজলুমের মানবতাও কাঁদে, জালেমের মনুষত্ব বা মানবতাও কাঁদে। মানবতা বা মনুষত্বের এই ক্রন্দনের সাথে মানুষের ক্রন্দনের পার্থক্য আছে। বেকায়দায় পড়লে জালেমরাও কাঁদে। এই ক্রন্দন মানুষের, মানবতা বা মনুষত্বের ক্রন্দন নয়’। একটু থামল আহমদ মুসা।
তারপর আবার শুরু করল, ‘তুমি সংঘাতের অবসান চেয়েছ। এটা সকলেরই কাম্য। অন্যায়ের শক্তিকে পরাভুত করে এবং পরাভুত রেখে ন্যায় ও সুবিচারের প্রতিষ্ঠা করতে পারলেই শুধু এই কামনা পুরণ হবে।
কিন্তু এই আদর্শ পরিবেশ কোনদিন আসবে বলা মুস্কিল। কারণ শয়তানি শক্তির পদচারণা কিয়ামতের পূর্ব পর্যন্ত থাকবে। সেই সাথে থাকবে মানুষের লোভ, লালসা এবং স্বার্থপরতার শক্তিশালী প্রবণতা। মানুষের এ কু-প্রবণতাকে শয়তান তার স্বার্থে ব্যবহার করে সংঘাত বাধাবেই’।
‘তাহলে আর করার কি থাকল?’ বলল রোসেলিন।
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘কেন করার মত কাজ তো আরও বাড়ল। অমঙ্গলের শক্তি শয়তান অন্যায়-অবিচারের রাজত্ব কায়েমে যত তৎপর হবে, মঙ্গলের শক্তিকে ন্যায় ও সুবিচার কায়েমে ততই তৎপর হতে হবে। করার কিছু থাকল না বলছ কেন?’
‘তাহলে সংঘাতই মানুষের অবধারিত ভাগ্য হয়ে দাঁড়াচ্ছে’।
‘এবং এটাই জীবন’।
‘তাহলে শান্তি?’
‘মঙ্গলের শক্তি ন্যায় ও সুবিচার প্রতিষ্ঠায় যে সংগ্রাম করে, তা শান্তির জন্যেই। কিন্তু শান্তি যদি না আসে, তবুও শান্তির সংগ্রামের মধ্যেই মানব জীবনের সাফল্য। এবং এর জন্যে মানুষ পরকালে পাবে পরম পুরষ্কার, অনন্ত এক শান্তির জীবন’।
‘আপনি জীবন থেকে পরজীবনে চলে গেলেন’।
‘স্বাভাবিক। অতি সংক্ষিপ্ত এই জীবন তো অনন্ত পরজীবনে প্রবেশের একটা টিকিট ঘর মাত্র’।
‘ধন্যবাদ্ বন্দুক হাতে আপনি যতটা দক্ষ, ধার্মিকতার দিক দিয়ে আপনি ততটাই দক্ষ’।
‘ঠিক বলেছ মা। আমার প্রশ্নেরও জবাব পেয়ে গেছি। বিপ্লবী হিসেবে আহমদ মুসা যত বড়, তার মানবতাবোধও তত বড়’। বলল রোসেলিনের আব্বা উসাম বাইক।
টেলিফোন বেজে উঠল।
রোসেলিন গিয়ে টেলিফোন ধরল। টেলিফোন ধরেই বলল, ‘আব্বা তোমার টেলিফোন’।
বলে কর্ডলেস টেলিফোন এনে রোসেলিন তার আব্বার হাতে দিল।
‘মাফ করবেন, টেলিফোনটা ধরে নেই’। সবার দিকে চেয়ে কথা কয়টি বলে চীফ জাস্টিস টেলিফোনে কথা বলতে শরু করল।
অনেকক্ষণ ধরে টেলিফোনে কথা হলো। চীফ জাস্টিস কথা বলল কম, ‘ইয়েস’, ‘নো’ ধরনের দু একটা। অধিকাংশ সময়ই শুনলো।
শুরুতেই চীফ জাস্টিসের চেহারায় কিছু পরিবর্তন এসেছিল। তাকিয়েছিল আহমদ মুসার দিকে।
তার দিকে চীফ জাস্টিসকে তাকাতে দেখেই আহমদ মুসা বুঝতে পেরেছিল নিশ্চয় কথার মধ্যে আহমদ মুসার কথা এসেছে।
তার সম্পর্কে কে কথা বলছে ওঁর সাথে? প্রশ্ন জাগল আহমদ মুসার মনে। ওকুয়ার কেউ? না, পিয়েরে পলের মৃতু্য এবং ফ্রান্সিস বাইক বন্দী হবার পর চীফ জাস্টিসের সাথে তার সম্পর্কে আলোচনার কেউ নেই।
তাহলে?
এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পেল না আহমদ মুসা।
টেলিফোনে কথা বলা শেষ হলো চীফ জাস্টিস উসাম বাইকের।
টেলিফোন পাশে রাখল চীফ জাস্টিস।
প্রথমে আহমদ মুসার দিকে তাকাল। তারপর ডঃ ডিফরজিসের দিকে একবার তাকিয়ে বলল, ‘আহমদ মুসার জন্যে কিছু ভাল খবর রয়েছে’।
‘কার টেলিফোন ছিল জনাব?’ বলল আহমদ মুসা।
‘আমাদের ল’ সেক্রেটারী লাউস মেইডি’র’।
‘ল’ সেক্রেটারী? কি কথা তিনি বললেন?’
নড়ে-চড়ে বসল চীফ জাস্টিস। তারপর বলল, ‘আহমদ মুসার পরিচয় পাবার পর আমি মনে করেছিলাম সে মুসলিম বিশ্বে অত্যন্ত জনপ্রিয়, কিন্তু সে যে অমুসলিম রাষ্ট্রগুলোরও এত প্রিয় তা ভাবতে পারিনি’।
‘কি হয়েছে? উনি কি বললেন আব্ব?’ বলল রোসেলিন।
‘বলছি। ফিলিস্তিন, সৌদি আরব, মিন্দানাও, মধ্য এশিয়া মুসলিম প্রজাতন্ত্র, আফগানিস্তান ইসলামী প্রজাতন্ত্র, বলকান প্রজাতন্ত্র, আজার বাইজান প্রজাতন্ত্র প্রভৃতি দেশের প্রেসিডেন্ট গতকাল আমাদের প্রসিডেন্টের সাথে এবং প্রধানমন্ত্রীর সাথে কথা বলেছেন। তারা জানিয়েছেন, মুসলিম জনগণের প্রিয় নেতা আহমদ মুসাকে ওকুয়া এবং ব্ল্যাক ক্রস ক্যামেরুনে এনে বন্দী করে রেখেছে। আহমদ মুসার মুক্তির ব্যাপারে তারা ক্যামেরুন সরকারের সাহায্য চেয়েছে।
‘ল’ সেক্রেটারী তোমাকে এঁটা জানাল কেন?’ বলল ডঃ ডিফরজিস।
‘ল’ সেক্রেটারী আমার পুরনো বন্ধু। সে টেলিফোন করেছিল সরকারের সংকট জানানোর জন্যে। এই তো ক’দিন আগে ফ্রি ওয়ার্ল্ড টিভি এবং ওয়ার্ল্ড নিউজ এজেন্সী নিউজ করল যে, ওকুয়া সমগ্র দক্ষিণ ক্যামেরুন থেকে মুসলমানদের উচ্ছেদ করেছে, সমগ্র ক্যামেরুনে মুসলমানদের উপর জুলুম চালাচ্ছে ওকুয়া। তার সাথে সাথেই এই খবর যে মুসলিম বিশ্বের প্রিয় ব্যক্তিত্ব আহমদ মুসাকে ওকুয়া বন্দী করে এনেছে। সরকারের কাছে খুবই বিব্রতকর হয়েছে ব্যাপারগুলো। সউদি আরবের বাদশাহ সহ সাতজন রাষ্ট্র প্রধান টেলিফোন করা কম কথা! সরকার সাংঘাতিক চাপের মধ্যে পড়েছে’।
আহমদ মুসার চোখে-মুখে গভীর চিন্তার রেখা। ভাবছিল। চীফ জাস্টিস থামতেই সে বলল, ‘কিন্তু সাতটি মুসলিম দেশ এত তাড়াতাড়ি এই ব্যাপারটা জানল কি করে?’
‘হ্যাঁ, ল’ সেক্রেটারী লাউস মেইডি এ সম্পর্কে বলেছেন। ব্ল্যাক ক্রসের পরিচয় দিয়ে গত পরশু রাতে কারা নাকি এ খবর জানিয়েছে ঐ মুসলিম দেশগুলোকে’।
‘বুঝেছি, ব্ল্যাক ক্রস বিজয়ের বাহদুরিও দেখাতে চায় এবং ব্ল্যাক মেইলও করতে চায়’। বলল আহমদ মুসা।
‘ব্ল্যাক মেইল কিভাবে?’ বলল চীফ জাস্টিস।
‘আহমদ মুসাকে মুক্তি দেয়ার ভোয়া টোপ দিয়ে তারা ঐ মুসলিম রাষ্ট্রগুলো থেকে টাকা খসাতে চায়’।
‘সাংঘাতিক ব্যবসায়’। বলল ডঃ ডিফরজিস।
‘তাদের এ ব্যবসার একদিক দেখলেন, আরও দিক আছে’। বলল আহমদ মুসা।
‘সেটা কি?’ বলল ডঃ ডিফরজিস।
‘ব্ল্যাক ক্রস এ খবর শ্বেতাংগ সন্ত্রাসবাদী সংস্থা ক্লু-ক্ল্যাক্স-ক্ল্যান, ইহুদি বিশ্ব গোয়েন্দা নেট ওয়ার্ক ‘ইরগুন জাই লিউমি’ এবং ধ্বংসাবশিষ্ট বাম গোপন সংগঠন ‘ওয়ার্ল্ড রেড ফোর্স’ (W.R.F) কে জানাবে এবং তারা কে কতত বিলিয়ন ডলার দিয়ে আমাকে কিনতে পারে তার দরকষকষি করবে’। আহমদ মুসা বলল।
‘তারা কিনবে কেন?’ বলল চীফ জাস্টিস।
‘কারণ তাদের বড় বড় পরাজয় ঘটেছে আমার হাতে। আমাকে হাতে পেলে তারা তার শোধ নিতে পারবে এবং আমাকে হাতে রেখে কিছু মুসলিম দেশকে বেকায়দায় ফেলে অতীতের ক্ষতিপূরণ করার চেষ্টা করবে’।
‘তারা বেকায়দায় পড়বে কিভাবে?’ বলল ডঃ ডিফরজিস।
‘কিছু মুসলিম রাষ্ট্র আছে যারা বৈষয়িক যে কোন মূল্যের চেয়ে আমার নিরাপত্তাকে বড় বলে মনে করে’।
‘বুঝেছি। তুমি ভাগ্যবান আহমদ মুসা’। বলল ডঃ ডিফরজিসই আবার।
‘ঠিক। ঈশ্বরকে ধন্যবাদ্ তিনি বড় বিপদ থেকে তোমাকে এবং তোমার জাতিকে রক্ষা করেছেন’। একটু থেমে চীফ জাস্টিস বলল, ‘ক্যামেরুনে তোমার আমার লক্ষ্য তো অর্জিত হয়েছে। এখন তোমার পরিকল্পনা কি?’ বলল চীফ জাস্টিস।
‘প্রথম লক্ষ্য অর্জিত হয়েছে দ্বিতীয় লক্ষ্য এখনো অর্জিত হয়নি’।
‘দ্বিতীয় লক্ষ্য কি? বলুন’। চীপ জাস্টিস বলল।
‘উচ্ছেদ হওয়া মুসলমানদের তাদের সহায়-সম্পত্তি ফিরে পাওয়া এবং তাদের পুনর্বাসন’।
‘এ তো বিরাট কাজ। এটা কিভাবে সম্ভব হবে?’ চীফ জাস্টিসই বলল।
‘সে পরিকল্পনা করেছি। ফ্রান্সিস বাইককে এ জন্যেই বন্দী করে এনেছি’।
‘ঈশ্বর তোমাকে সাহায্য করুন’।
‘আমিন’।
বলে আহমদ মুসা তাকাল রাশিদী ইয়েসুগোর দিকে। বলল, রাশিদী ফ্রান্সিস বাইককে তোমার গাড়িতে পার করে নাও। ওকোচা অনেক কষ্ট করেছে, আর নয়। ওর বাড়িতে এতক্ষণ নিশ্চয় কান্নার রোল পড়ে গেছে’।
‘না আহমদ মুসা ভাই, আমার কোন কষ্ট হয়নি। আমাকে নিয়ে তাড়াহুড়া করবেন না’। বলল ওকোচা।
‘কিন্তু বাড়ির সবাই তোমার জন্যে কষ্ট পাচ্ছে। শেষ রাতে বাড়ি থেকে বেরিয়েছ। স্ত্রীকেও বলনি। বাড়িতে গিয়ে দেখ কি সাংঘাতিক অবস্থা। থানাতেও খবর হয়ে গেছে এতক্ষণ’।
‘কিন্তু আপনাকে সাথে নিয়ে যেতে চাই। সবাই খুশী হবে’।
‘আমি জানি। আমি যাব, তবে তোমার সাথে নয়। তুমি যে আমাকে সাহায্য করেছ, একথা তোমাকে গোপন রাখতে হবে’।
‘কেন?’
‘কারণ আমি চাই না তোমাদের পরিবার বিপদগ্রস্ত হোক’।
‘ওকুয়া জানবে কি করে?’ বলল ওকোচা।
‘তোমার পরিবারের কেউ ওকুয়াকে বলবে না। কিন্তু এমন কেউ জেনে ফেলতে পারে যার কাছ থেকে ওকুয়ার কানে কথা পৌঁছতে পারে’।
‘বুঝলাম। মানলাম। তাহলে আপনি কবে কখন যাচ্ছেন?’
‘সেটা বলা মুস্কিল। তবে যাব। তোমার সাহায্য আমার দরকার হতে পারে’।
‘ধন্যবাদ ভাইয়া। আপনি শুধু আমাকে নতুন জীবন দেননি। আমার মনে হচ্ছে নতুন দৃষ্টিও আপনার কাছ থেকে পাব’। বলে উঠে দাঁড়াল ওকোচা।
রাশিদী ইয়েসুগো এবং মুহাম্মাদ ইয়েকিনিও উঠে দাঁড়িয়েছিল।
আহমদ মুসা উঠে হ্যান্ডশেক করল ওকোচার সাথে। তারপর তার পিঠ চাপড়ে বলল, ‘তুমি অবিশ্বাস্য কাজ করেছ ওকোচা। আমি কৃতজ্ঞ’।
‘ছোট ভাইকে এভাবে কেউ বলে?’ আহমদ মুসার দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে ক্ষোভ ভরা কণ্ঠে বলল ওকোচা।
আহমদ মুসা ওকোচাকে বুকে জড়িয়ে ধরল বলল, ‘ঠিক আছে, আর বলল না।’
ওকোচা, রাশিদী এবং ইয়েকিনি বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।
ওরা বেরিয়ে গেলে ডঃ ডিফরজিস বলল, ‘তুমি ঠিক বলেছ আহমদ ‍মুসা। ছেলেটা অবিশ্বাস্য কাজ করেছে।’
আহমদ মুসা কিছু বলতে যাচ্ছিল। এই সময় ঘরে প্রবেশ করল ডোনার আব্বা মিশেল প্লাতিনি।
মিশেল প্লাতিনি প্রবেশ করতেই ডঃ ডিফরজিস উঠে দাঁড়াল। মিশেল প্লাতিনি এবং ডঃ ডিফরজিস পরস্পরকে জড়িয়ে ধরল।
তারপর উভয়ের মধ্যে কুশল বিনিময় হলো, কথা হলো।
এক পর্যায়ে চীফ জাস্টিস উসাম বাইক মিশেল প্লাতিনিকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘বিরাট লস করেছেন। অপরুপ কাহিনী থেকে বঞ্চিত হলেন।’
‘হ্যাঁ, দুর্ভাগ্য আমার।রোসেলিন মা, ডোনা মা দু’জনেরই টেলিফোন পেয়েছি। কিন্তু ড্রাইভার ছিল না। আমাকে একা বেরুতে দিলেন না এ্যামবেসেডর।’ বলল মিশেল প্লাতিনি।
ড্রইং রুমে প্রবেশ করল রাশিদী ইয়েসুগো এবং মুহাম্মদ ইয়েকিনি।
রাশিদী ও ইয়েকিনি এসে বসতেই আহমদ মুসা রাশিদীকে জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি ওকোচাকে তোমার বাড়ির ঠিকানা দাওনি তো?’ আহমদ মুসা চোখে-মুখে কিছুটা শংকার মিশ্রণ।
রাশিদী সেদিকে চেয়ে বলল, ‘না’ কেন জিজ্ঞেস করছেন? দেয়া কি উচিত ছিল?’
‘ধন্যবাদ। না দিয়ে ঠিক করেছে।’
‘কেন। তাকে সন্দেহ করেন? এ জন্যেই কি তাকে আমাদের সাথে আমাদের বাড়ি পর্যন্ত নিলেন না?’
‘তাকে সন্দেহ করি বলে তাকে তোমার বাড়ি পর্যন্ত নিলাম না, তা নয়। আসলে এটা একটা সাবধানতা। আমি মনে করি সে সন্দেহের উর্ধ্বে। কিন্তু সে কারো হাতে পড়তে পারে এবং চাপে পড়ে ফ্রান্সিস বাইকের একটা হদিস হিসেবে তোমার বাড়ির ঠিকানা বলে দিতেও পারে। এমন সম্ভাবনার দরজা এই পর্যায়ে বন্ধ রাখা দরকার।
‘বুঝেছি আহমদ মুসা ভাই। ধন্যবাদ আপনাকে।’ বলল রাশিদী ইয়েসুগো।
‘এতদূর পর্যন্ত সামনে দেখে তুমি পথ চল আহমদ মুসা! আমি হলে তো এক ঠিকানা কেন, সবকিছু তাকে জানাতে দ্বিধা করতাম না।’ বলল চীফ জাস্টিস ইসাম বাইক।
‘এই জন্যেই আহমদ মুসাই শুধু আহমদ মুসা।’ বলে আহমদ মুসার দিকে তাকিয়ে ডঃ ডিফরজিস বলল, ‘এখন কিছু কিছু করে বুঝতে শুরু করেছে তুমি এত সফল কেন?’
আহমদ মুসার চোখে-মুখে লজ্জার একটা ভাব ফুটে উঠেছিল। সম্ভবতঃ কথার মোড় অন্যদিকে ঘুরিয়ে নেবার জন্যে বলল, ‘আমাদের এখন উঠতে হয়।’
বলে চীফ জাস্টিস উসাম বাইকের দিকে চেয়ে বলল, ‘অনুমতি দিন।’
উঠে দাঁড়াল আহমদ মুসা।
রোসেলিনের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আমরা গাড়ি নিয়ে যাচ্ছি, লায়লা ও ফাতেমা মুনেকা থাক। পরে গাড়ি পাঠানো হবে, বা তুমি পৌঁছে দিও।’
রোসেলিন মাথা নেড়ে বলল, ‘আমি পৌঁছে দেব।’
‘ধন্যবাদ।’ বলে আহমদ মুসা তাকাল ওমর বায়ার দিকে। বলল, ‘রাশিদীরা এসেছে, ওমর বায়া তুমি আমাদের সাথে চল।’
ওমর বায়া এলিসা গ্রেসের দিকে একবার চেয়ে উঠে দাঁড়াল। এলিসা গ্রেসও চেয়েছিল ওমর বায়ার দিকে।
ব্যাপারটা নজর এড়াল না আহমদ মুসার। বলল, ‘রোসেলিন, এলিসা গ্রেসকে লায়লাদের সাথে বেড়াতে নিয়ে যেতে পার।’
‘মারিয়া আপাকে?’ বলল রোসেলিন।
আহমদ মুসা একবার ডোনার দিকে চাইল। তারপর রোসেলিনের দিকে চেয়ে বলল, ‘ও সুস্থ হয়ে ওঠেনি। ওর ‘মুভ’ না করাই ভাল।’
ডোনার ঠোঁটে তখন হাসি।
আহমদ মুসা কথা শেষ করতেই ডোনার আব্বা মিশেল প্লাতিনি আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে বলল, ‘এখন তোমার পরিকল্পনা কি?’
‘পিয়েরে পল নিহত হয়েছেন, ফ্রান্সিস বাইককে আমরা বন্দী করেছি। ওকুয়া যে অবিচার করেছে তার প্রতিকারের জন্যে কিছু করতে হবে জনাব। ফ্রান্সিসের একটা ব্যবস্থা করে আপনাদের সাথে দেখা করবে। সব বলব তখন।’
বলে আহমদ মুসা সকলকে সালাম জানিয়ে ঘুরে দাঁড়াল। চলতে শুরু করল। তার সাথে সাথে রাশিদী, ইয়েকিনি এবং ওমর বায়া।
ওদের চলার পথের দিকে তাকিয়ে ছিল সবাই।
চীফ জাস্টিস উসাম বাইক তার পথের দিকে চোখ রেখেই বলল, ‘যন্ত্রের মত কর্তব্য পরায়ন অদ্ভুত মানুষ।’
‘যন্ত্রের কোন অন্তর থাকে না। কিন্তু ওর আছে সাগরের মত গভীর, আকাশের মত উদার একটা মন।’ বলল রোসেলিন।
‘আমি ভেবে পাই না, সার্বক্ষণিক টেনশন নিয়ে ও বাঁচে কি করে?’ বলল চীফ জাস্টিস।
‘না, ও কোন টেনশনে ভোগে না। ওর মধ্যে কোন টেনশন দেখিনি।’ বলল মিশেল প্লাতিনি।
‘উনি নিজেকে নিয়ে ভাবেন না। ফল নয়, কাজ উনার বড়। উনি মনে করেন, কাজ করা, চেষ্টা করার দায়িত্ব তার, ফল দেবেন আল্লাহ। সুতরাং টেনশন তার কাছে আসতে পারে না।’ বলল মিশেল প্লাতিনি।
‘তুমি কিছু বল মারিয়া আপা।’ ঠোঁটে একটা সুক্ষ্ম হাসি টেনে বলল রোসেলিন।
ডোনার মুখে সলজ্জ হাসি ফুটে উঠল। সে উঠে দাঁড়াল। বলল ‘আমার ওষুধ খাবার সময় হয়েছে। আমি চললাম।’
বলে দু’তলার সিঁড়ির দিকে এগুলো।
তার পেছনে পেছনে ছুটল রোসেলিন।
লায়লা এবং ফাতেমা মুনেকাও উঠে দাঁড়াল। তারাও হাঁটতে শুরু করল সিঁড়ির দিকে।
চীফ জাস্টিস উঠে দাঁড়িয়ে মিশেল প্লাতিনির দিকে চেয়ে বলল, ‘আপনি আমার স্টাডি রুমে আসুন। কথা আছে।’
এরপর ডিফরজিসের দিকে চেয়ে বলল, ‘আসুন, আপনি রেস্ট নেবেন।’
ডঃ ডিফরজিস এবং মিশেল প্লাতিনিও উঠে দাঁড়াল।
সবাই চলল দু’তলার সিঁড়ির দিকে।

ইয়েসুগো প্রাসাদের ছাদে একটা ইজি চেয়ারে আধাশোয়া আহমদ মুসা।
তার খোলা স্থির চোখ দু’টি লাখো তারার আলো জ্বলা দূর আকাশে নিবদ্ধ।
আকামে চাঁদ তখনো উঠেনি। চাঁদের অভাব পুরণ করতে আকাশে লাখো তারার উজ্জ্বলতার হাসি। কালো আকাশে বুকে আলোর এক উৎসব।
প্রাসাদের আশেপাশে উচু কোন বিল্ডিং নেই। তার ফলে আকাশে আদিগন্ত দৃশ্য চোখে পড়ছে আহমদ মুসার।
ছাদের আলো শেডে ঢাকা হলেও ছাদে অন্ধকার কোথাও নেই।
সিঁড়ির খোলা দরজা পথে ছাদে উঠে এল লায়লা, ফাতেমা মুনেকা, ডোনা এবং রোসেলিন।
ডোনা ও রোসেলিন হাসপাতালে এসেছিল ডোনার চেকিং-এর জন্যে। সেখান থেকে যাবার পথে তারা উঠেছে লায়লার বাড়িতে এইমাত্র। আহমদ মুসা ছাদে লায়লা ডোনাদের নিয়ে এসেছে ছাদে।
সিঁড়ি ঘরটি ছাদের উত্তর-পূর্ব প্রান্তে। তারা সিঁড়ি ঘরের দক্ষিণমুখী দরজা দিয়ে বেরিয়ে আহমদ মুসার সামনেই পড়ে গেল।
অল্প দুরেই আহমদ মুসা আধাশোয়া। সে পশ্চিমমুখী, কিন্তু মাথাটা তখন উত্তর দিকে একটু কাত হয়ে আছে।
চারজন মানুষ ছাদে প্রবেশ করল প্রায় আহমদ মুসার সামনে দিয়ে। কিন্তু কোন প্রতিক্রিয়া নেই আহমদ মুসার মধ্যে।
ওরা একটু এগুলো। দেখল, আহমদ মুসার দৃষ্টি উপরে আকাশের দিকে নিবদ্ধ।
লায়লা কথা বলতে গিয়েছিল। ডোনা তার মুখ চেপে ধরে কথা বলতে দিল না। বলল, ‘দেখা যাক না, কখন আমরা ওর চোখে পড়ি।’
লায়লারা ছাদে ঘুরাঘুরি করল। আহমদ মুসার আশপাশ দিয়েও ঘুরে গেল। আহমদ মুসার দৃষ্টি তাদের প্রতি আকৃষ্ট হলো না।
অবশেষে তারা আবার এসে দাঁড়াল সিঁড়ি ঘরের সেই দরজার কাছে।
‘অবাক ব্যাপার! ওর সংজ্ঞা আছে তো?’ বলল রোসেলিন।
‘না, ইচ্ছা করেই উনি চোখে না পড়ার ভান করছেন আমরা মহিলা বলে।’ বলল লায়লা ইয়েসুগো।
ডোনা হাসল। বলল, ‘না এরকম উনি করতে পারেন না। উনি তাকাবেন না ঠিক আছে, কথা বলবেন না কেন? কিংবা এতগুলো মানুষ তার আশে পাশে ঘোরার প্রতিক্রিয়া হবে না কেন?’
‘তাহলে?’ বলল ফাতেমা মুনেকা।
‘আসলে উনি এ জগতে নেই।’ হেসে বলল ডোনা।
‘তার মানে?’ ফাতেমা মুনেকাই বলল।
‘প্রকৃতির মাঝে বিশেষ করে আকাশের অন্তহীন নীলের বুকে হারিয়ে যাবার তাঁর অভ্যাস আছে।’ বলল ডোনা।
‘হো হো করে হেসে উঠল রোসেলিন।
এবার নড়ে উঠেছে আহমদ মুসা।
সে মথা তুলে তাকিয়েছে লায়লাদের দিকে।
‘ডোনা, উনি জগতে ফিরেছেন। যাও খোঁজ নিয়ে এস।’ বলল রোসেলিন।
‘এস, তোমরাও দেখবে ঘটনাটা কি।’ বলে ডোনা পা বাড়াল আহমদ মুসার দিকে।
লায়লারাও ডোনার পিছু নিল।
‘ডোনা, তোমরা? এ সময় কোত্থেকে?’ ইজিচেয়ারে সোজা হয়ে বসে বলল আহমদ মুসা।
‘উত্তরটা পরে দিচ্ছি। আগে বল, আমরা এখানে কখন এসেছি?
‘এখানে মানে এ বাড়িতে, না ছাদে?’
‘ছাদে।’
‘ও, তোমরা অনেক্ষণ এসেছ বুঝি। খেয়াল করিনি। আমি আকাশটা দেখছিলাম।’ হেসে বলল আহমদ মুসা।
‘দেখছিলেন, না হারিয়ে গিয়েছিলেন?’ বলল রোসেলিন।
হাসর আহমদ মুসা। বলল, ‘মিথ্যে নয় রোসেলিন, আজ ইয়াউণ্ডির আকাশটা হারিয়ে যাবার মতই। আকাশে চাঁদ নেই, মেঘ নেই, কুয়াশা নেই, ধুলোবালিও ইয়াউণ্ডির আকাশে কম, তার উপর এই এলাকার গ্রাউণ্ড লাইনে উজ্জ্বল আলোর কোন ফ্লাশ নেই। যার ফলে তারার যে স্বচ্ছ হাসি আকাশে আমি দেখছি, তা বহুকাল দেখিনি।’
‘কেন ইউরোপে তো আমি এই আকাশ দেখেছি, এই তারার মেলাই দেখেছি।’ রোসেলিন বলল।
‘না দেখনি রোসেলিন।’
বলে আহমদ মুসা উত্তর দিগন্তে বিশ ডিগ্রীর মত কৌণিক অবস্থানের দিকে আংগুলি সংকেত করে বলল, রোসেলিন ঐ দেখ ‘এন্ড্রোমেডা’ গ্যালাক্সি। ইউরোপ থেকে কখনও একে আমি এই ভাবে দেখতে পাইনি। ওর দিকে তাকিয়ে সত্যিই আমি নিজেকে হারিয়ে ফেলেছিলাম। ও আমাদের এই ‘ছায়াপথ’ গ্যালাক্সি থেকে কতদূরে জা?’
‘না তো। বলল রোসেলিন।
‘বিশ লাখ আলোক বর্ষ দূরে। জগতের অত দূরের একটা অংশকে দেখছি ভাবতেই মনটা শিউরে ওঠে না!’ ধোঁয়ার পাতলা একটা পিন্ডের মত দেখাচ্ছে। ওর নাম ‘এ্যান্ড্রোমেডা?’ বলল লায়লা।
‘হ্যাঁ। কিন্ত ওটা ধোঁয়া নয়। আমাদের মাঝার উপর যে তারা জগৎ দেখছি, তার চেয়েও বিশাল তারার জগৎ ওটা। দূরত্বের কারণেই ধোঁয়ার মত আমরা দেখছি।
‘বিশ লাখ আলোক বর্ষ দূরে ওটা! তার পর কি আছে?’ প্রশ্ন করল রোসেলিন।
‘ঐ ‘এ্যান্ড্রোমেডা’র চেয়েও বড় আরও লাখো গ্যালাক্সি আছে, যেগুলো ‘এ্যান্ড্রোমেডা’র থেকেও কোটি কোটি আলোক বর্ষ দূরে।’
বলে আহমদ মুসা দক্ষিণ দিগন্তের দিকে চোখ ফিরাল। তারপর দক্ষিণ দিগন্তের দুটি স্থানের দুইটি ধোঁয়া পিন্ডের দিকে আঙুল স্থির করে বলল, ‘দেখ ঐটা ‘বড় ম্যাজেলানিক’, আর ওটা ‘ছোট ম্যাজেলানিক’ গ্যালাক্সি। বড়টি আমাদের ‘ছায়াপথ’ গ্যালাক্সি থেকে ষোল লাখ আলোক বর্ষ এবং ছোটটি আঠাল লাখ আলোক বর্ষ দূরে।
‘কোটি কোটি আলোক বর্ষ দূরে শেষ যে গ্যালাক্সি, তারপর কি আছে?’ বলল লায়লা ইয়েসুগো।
গোখ বুজল আহমদ মুসা।
অনির্বাচনীয় এক আবেগ এসে তার মুখে চায়া ফেলল। সুক্ষ্ণ একটা কম্পন জেগে উঠল তার ঠোঁটে। ধীরে ধীরে বলল, ‘এর উত্তর বিজ্ঞানী জানে না লায়লা। জানেন শুধু এই মহা সৃষ্টির যিনি মালিক।’
আহমদ মুসার ভারি গলা থেকে কথাগুলো কেঁপে কেঁপে বেরিয়ে এল।
তার চখের কোণায় বেরিয়ে আসা অশ্রু ম্লান আলোতেও চিক করে উঠল।
আহমদ মুসার আকষ্মিক এই পরিবর্তনে বিস্মিত লায়লারা।
আহমদ মুসা তাড়াতাড়ি চোখ খুলে চোখের কোণ মুছে নিয়ে মেখে হাসি টানতে চেষ্টা করে বলল, ‘কিছু মনে করো না তোমরা। চারদিকে অন্তহীনভাবে ছড়ানো সৃষ্টির বিশালত্বের মুখোমুখি দাঁড়ালে আমার নিজেকে শিশুর মত অসহায় মনে হয়। কান্না আসে নিজের ক্ষুদ্রতা এবং এই ক্ষুদ্র ও অসহায় সৃষ্টি মানুষের প্রতি মহানসৃষ্টির মহান স্রষ্টা আল্লাহর দয়ার কথা ভেব।’
আহমদ মুসার ঠোঁটে হাসি, কিন্তু কণ্ঠ তার আবেগ রুদ্ধ, ভারি।
লায়লাদের মুখেও আগের সেই চটুল হাসি এখন আর নেই। তাদের চোখ-মুখও বিস্ময়ে ভারি হয়ে উঠেছে।
আহমদ মুসা থামলেও ওরা তৎক্ষণাৎ কথা বলতে পারল না। তাদের বিস্মিত দৃষ্টি আহমদ মুসার উপর নিবদ্ধ।
একটু পরে লায়লা ধীর কণ্ঠে বলল, ‘কিন্তু ভাইয়া, মানুষ তো আশরাফুল মাখলুকাত-সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ, ক্ষুদ্র নয়।’
‘বিস্ময়তো এখানেই লায়লা। ক্ষুদ্র, দূর্বল মানুষকে করা হয়েছে আশরাফূল মুখলুকাত। শুধু তাই নয় মুখলুকাতকে মানুষের জন্যেই সৃষ্টি করা হয়েছে। ক্ষুদ্র মানুষের প্রতি কেন এত দয়া স্রষ্টার? তাঁর এ দয়াই মানুষকে আশরাফুল মুখলুকাত করেছে।’
ধীর নরম কণ্ঠ আহমদ মুসার। বলতে বলতে চোখ দু’টি বুজে গিয়েছিল আহমদ মুসার।
তৎক্ষণাৎ কেউ কথা বলল না লায়লাদের।
‘আপনার এই ‘কেন’-এর উত্তর কি আহমদ মুসা ভাই? অন্তহীন এই মহাবিশ্বের মানুষের অস্তিত্ব পরমাণু কণা’র মতও নয়। তবু কেন তার এই গুরুত্ব, কেন তার প্রতি এই দয়া/ বলল ধীর কণ্ঠে রোসেলিন।
‘আল্লাহ প্রিয় বান্দাহ এবং নবী দাউদ (আ) অশ্রুসজল চোখে আকুল কণ্ঠে এই প্রশ্নই করেছিলেন নিঃসীম আকাশের দিকে চেয়ে। মানুষের কৃতজ্ঞ ও পরিতৃপ্ত হৃদয়ের এই অবাক জিজ্ঞাসা থাকবে সব সময়। এ শুধু জিজ্ঞাসাই, জবাব প্রয়োজন নেই রোসেলিন।’
‘সত্যিই প্রয়োজন নেই। বোধ হয় মানুষের সৃষ্টি কাহিনীই এর জবাব।’ বলল লায়লা ইয়েসুগো।
‘আমার একটা বিস্ময় লাগছে।’ অনেকক্ষণ পর বলল ফাতেমা মুনেকা।
‘কি?’ বলল আহমদ মুসা।
‘মহাবিশ্বের অন্তহীন রাজ্যে প্রবেশ করার এবং তার মাঝে হারিয়ে যাবার মত তাহলে আপনার আছে?’ বলল ফাতেমা মুনেকা।
‘থাকবে না কেন?’
‘বারুদের গন্ধ এবং রক্ত স্রোতের তলায় এমন নরম ও সংবেদনশীল মন বাঁচতে পারে না।’ বলল ফাতেমা মুনেকা।
‘তারপর?’ বলল আহমদ মুসা।
‘আপনার সে মন বাঁচল কি করে, সেটাই আমার বিস্ময়!’ ফাতেমা মুনেকা বলল।
‘হয়তো বেঁচে নেই।’ বলল আহমদ মুসা।
‘শুধে বেঁচে থাকা নয়, সে মন আপনার সাংঘাতিক সজীব এবং সক্রিয়। বংর বলতে পারেন, সে মনটা আমাদের নেই, অথবা ছিল মরে গেছে। সে কাণেই ‘এ্যান্ড্রোমেডা’ ও ‘ম্যাজিলানিক’ গ্যালাক্সিগুলো আমরা দেখতে পাই না, লাখো তারার মিট মিটে চোখে আমরা কখনও চোখ রাখি না, আকাশের অন্তহীন রহস্যের প্রতি আমাদের দৃষ্টি আকৃষ্ট হয় না।’ থামল ফাতেমা মুনেকা।
সে থাকতেই রোসেলিন বলল, ‘ফাতেমা ঠিকই বলেছে, ইয়াউন্ডির যে রাত এবং রাতের যে আকাশ আপনার কাছে অনন্য আকারে ধরা দিয়েছে, সে রাত তো আমরা দেখি, কিন্তু আমাদের মনে তো সাড়া জাগয় না!’
‘আচ্ছা এসব থাক রোসেলিন, তোমাদের কোন খবর আছে? আর কি ব্যাপার, ডোনা, লায়লাদের মত করে তুমি চাদর পরেছ দেখছি।’ বলল আহমদ মুসা রোসেলিনকে লক্ষ্য করে।
রোসেলিনের মাথায় গায়ে চাদর জড়ানো। চাদরের মাথার প্রান্তটা কপাল পর্যন্ত নেমে আসা। তার পরণের স্কার্টও আর মিনি ধরনের নয়, পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত নামানো।
‘কেন চাদর পরা কি ডোনা-লায়লাদের মনোপলি যে আমার পরা চলবে না?’ হেসে বলল রোসেলিন।
‘পরা চলবে না বলিনি, পরেছ যে তাই বলছি?’ আহমদ মুসা বলল।
‘ভাইয়া ওতে অনেক আগে থেকেই মনে মনে চাদর পরে আছে, আজ প্রকাশ্যে পরেছে মাত্র। এরকম একটা চাদর সেদিন আমি রাশিদী ভাইয়াকে কিনতে দেখেছি।’ মুখ টিপে হেসে বলল লায়লা ইয়েসুগো।
লায়লার কথা শেষ করার আগেই রোসেলিন কিল তুলেছিল লায়লাকে লক্ষ্য করে। পিঠে কিল পড়ার আগেই পিঠ বাঁকিয়ে ছুটে পালাল লায়লা।
‘লায়লা খুব দুষ্টু হয়েছে ভাইয়া। ওর মুখে কিচ্ছু বাধে না।’
বলৈ একটু থামল রোসেলিন। তাপর আবার শুরু করল, ‘ভাইয়া ফাতেমা যে জিজ্ঞাসা তুলে ধরেছিল, তার কিন্তু জবাব আপনি দেখনি।’
‘সেটা কি?’
বারুধের অবিরাম গন্ধ আর ভয়াবহ রক্ত স্রোতের তলায় যে মন আপনার বাঁচার কথা নয়, তা বাঁচলো কি করে? বলল রোসেলিন।
আহমদ মুসা হাসল।
ইজি চেয়ারে আরেকটু সোজা হয়ে বসল। বলল, ‘যদি তা বেঁচেই থেকে থাকে বলে তোমরা মনে কর, তাহলে সেটা বাঁচার কারণ বোধ হয় এই যে, আমি আমার ব্যক্তিগত কোন শত্রুতা, ব্যক্তিগত কোন ক্রোধ, ব্যক্তিগত কোন লাভ বা স্বার্থে কখনও বন্দুক ধরিনি, এক ফোটা রক্তপাতও কারও করিনি, যা কিছু করেছি আল্লাহর বান্দাহ মজলুম মানুষৈর স্বার্থে। অন্য কথায়, যা করেছি আল্লাহর পথে আল্লাহর জন্যেই করেছি। এই কাজে আত্মরক্ষার প্রয়োজন ছাড়া কাউকে আমি আঘাত করিনি, হত্যা করিনি। এই কারণেই হয়তো লোভের যে অগ্নিদৃষ্টি মনের সবুজ সৌন্দর্যকে পুড়িয়ে দেয়, তা আমার মনের ওপর পড়েনি, স্বার্থপরতার যে কালিমা মনকে অন্ধ করে দেয়, তা আমার মনের ওপর কার্যকরী হয়নি এবং হিংসার যে ক্রুর কৃপাণ মনকে টুকরো টুকরো করে কাটে, তা আমার মনের ওপর আপতিত হয়নি।’ স্বাগত ধরনের নরম কণ্ঠ থামলো আহমদ মুসার।
মুহূর্তকাল নীরবতা।
উচ্ছ্বাসিত রোসেলিন-লায়লারা কিছু বলার জন্যে সবাই এক সংগে মুখ খুলেছিল।
আহমদ মুসা ওদের থামিয়ে দিয়ে বলল, ‘এবার আমার পালা। ডোনাকে যে প্রশ্ন করেছি তার জবাব এখনও পাইনি।’
‘কি প্রশ্ন করেছ?’ ডোনা বলল মিষ্টি হেসে।
‘তোমরা এ সময় কোত্থেকে এলে?’
‘হাসপাতালে গিয়েছিলাম আঘাতের জায়গাটা চেক করাতে।’
আহমদ মুসার ভ্রু কুঞ্চিত হলো। বলল, ‘এর কি দরকার ছিল?’
‘হাসপাতাল থেকে যে ডাক্তার দেখতে আসত, সেই ডেট দিয়েছিল।’
‘তোমরা দু’জন গিয়েছিলে শুধূ?’
‘না ড্রাইভার ছিল। কেন ঠিক হয়নি মনে করছ?’
‘আমার তাই মনে হচ্ছে। হাসপাতালে ‘ওকুয়া’র লোক আছে। আমার ধারণা তাদের কাছ থেকে খবর পাবার ফলেই ‘ওকুয়া’র পক্ষে সম্ভব হয়েছিল সেদিন হাসপাতালে আমাদের উপর আক্রমন করা।’
ডোনা ও রোসেলিন দু’জনের মুখ ম্লান হয়ে গেল। শুকিয়ে উঠল তাদের ঠোঁট।
তারা কোন কথা বলল না।
আহমদ মুসাই আবার কথা বলল, ‘গাড়ি নিয়ে ফেরার পথে কোন কিছু সন্দেহ করেছ? কেউ ফলো করেনি তো?’
‘না করেনি। আমি ভালোভাবে এটা লক্ষ্য রকেছি। অবশ্য হাসপাতাল থেকে এ পর্যন্ত রাস্তাও খুব অল্প।’ বলল ডোনা।
‘গাড়ি কোথায় ছিল? ড্রাইভার কোথায় ছিল?’
ডোনা উত্তর না দিয়ে তাকাল রোসেলিনের দিকে। রোসেলিন বলল, ‘আমরা ড্রাইভারকে গাড়ির কাছে রেখে গিয়েছিলাম। তারপর আর কিছু জানি না।’
এ সময় সেখানে এসে দাঁড়াল রাশিদী ইয়েসুগো। বলল, ‘চলুন ভাইয়া সময় হয়ে গেছে।’
বলে রাশীদি রোসেলিনের দিকে চেয়ে আস্তে বলল, ‘তোমরা এ সময়ে? কখন এলে?’
‘অনেক কথা। ভাইয়াকে বলেছি’। বলল রোসেলিন আস্তে।
রাশিদীর কথা শুনে আহমদ মুসা ঘড়ির দিকে তাকিয়েছিল। সময় দেখে বলল, ‘হ্যাঁ সময় হয়ে গেছে। কিন্তু বেরুবার আগে চল রোসেলিনের ড্রাইভারের সাথে একটু কথা বলি।’
‘কেন? কিছু ঘটেছে?’ বলল রাশিদী ইয়েসুগো।
‘ওরা দু’জনে হাসপাতালে গিয়েছিল। হাসপাতালে ‘ওকুয়া’র লোক আছে নিশ্চয়। সুতরাং সবদিক থেকে নিশ্চিত হওয়া দরাকার। বলল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসা উঠে দাঁড়িয়েছিল।
‘তোমরাও এস।’ রোসেলিনের দিকে চেয়ে কথাগুলো বলে চলতে শুরু করল আহমদ মুসা।
রাশিদী ইয়েসুগো তার পাশে পাশে হাঁটতে শুরু করলো। রোসেলিনরা সকলে তাদের পিছু পিছু চলল।
রোসেলিনের গাড়ির ড্রাইভার গাড়ির পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল। আহমদ মুসাদের গাড়ির দিকে আসতে দেখে সে একটা স্যালুট দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াল।
আহমদ মুসাকে দেখিয়ে রোসেলিন ড্রাইভারকে বলল, ‘এঁকে তো তুমি চেন ড্রাইভার?’
‘জি ম্যাডাম।’ বলল ড্রাইভার।
‘ইনি তোমার সাথে একটা বিষয়ে আলাপ করবেন।’
‘ইয়েস ম্যাডাম।’ বলে ড্রাইভার আহমদ মুসার দিকে বিনীতভাবে চাইল।
‘তেমন কোন কথা নয়, আমি জানতে চাচ্ছিলাম হাসপাতালের সামনে গাড়ি পার্ক করার পর তুমি কোথাও গিয়েছিলে কিনা?’ আহমদ মুসা জিজ্ঞেস করল ড্রাইভারের দিকে চেয়ে।
‘না, স্যার। গাড়ি ছেড়ে কোথাও যাইনি।’
‘কেউ তোমাকে কিছু জিজ্ঞেস করেছিল কিনা?’
‘না স্যার।’
‘দীর্ঘ সময়টাতে কেউ তোমার কাছে আসেনি, কারও সাথে তোমার কথা হয়নি?’
‘না, স্যার। শুধুমাত্র হাসপাতালের বেয়ারা ম্যাডামের ওষুধর একটা প্যাকেট আমাকে দিয়ে গিয়েছিল।’
চমকে উঠল রোসেলিন। তার দুই চোখে উত্তেজনা। দ্রুত বলল, ‘ওষুধের প্যাকেট? কি বলেছিল, কোথায় প্যাকেট?’
‘ড্যাস বোর্ডের কেবিনে রেখেছি। বেয়ারা বলেছীল, ম্যাডাম রোসেলিন ওষুদ পাঠিয়েছেন গাড়িতে রাখার জন্যে।’
রোসেলিনের চোখ দু’টি তখন বিস্ফারিত।
ডোনার চোখেও বিস্ময়!
‘তুমি ওষুদ কিংবা কোন প্যাকেট পাঠাওনি রোসেলিন?’ দ্রুত কণ্ঠে বলল আহমদ মুসা।
‘না পাঠাইনি।’ কাঁপা কণ্ঠে বলল রোসেলিন।
আহমদ মুসা দ্রুত ড্রাইভারের দিকে চেয়ে বলল, ‘গাড়ির সামনের দরজা এবং ড্যাশবোর্ডের কেবিন লক করা নেই তো?’
‘না, স্যার।’ শুকনো কণ্ঠে বলল ড্রাইভার।
আহমদ মুসা সকলের দিকে চেয়ে বলল, ‘জানি না প্যাকেটে কি আছে, তবু সাবধান হওয়া ভাল। তোমরা সরে দাঁড়াও।’
বলে আহমদ মুসা গাড়ির দিকে এগুলো।
ডোনা ছুটে এসে আহমদ মুসার পথ রোধ করে দাঁড়িয়ে বলল, ‘না তুমি যাবে না, আমি নিশ্চিত প্যাকেটে বোমা আছে।’
‘প্লিজ ডোনা সময় নষ্ট করো না। ওটা যদি বোমা হয়ে থাকে, তাহলে এখানে ফাটা ঠিক হবে না। এ বাড়িটা ‘ওকুয়া’র কাছে চিহ্নিত হয়ে যাবে।’ দৃঢ় নির্দেশের সুরে বলল আহমদ মুসা।
ডোনা আহমদ মুসার দিকে একবার চেয়ে ফ্যাকাসে, বিক্ষুব্ধ মুখ নিয়ে সরে দাঁড়াল আহমদ মুসার সামনে থেকে। ক্ষোভে-দুঃখে তার চোখ দু’টি ভারি হয়ে উঠেছে।
ধীরে ধীরে আহমদ মুসা গাড়ি দরজা খুলে মুহূর্তের জন্যে থমকে দাঁড়াল। তারপর ঘুরে দাঁড়িয়ে রোসেলিনকে বলল, ‘কয়টায় হাসপাতাল থেকে গাড়ি স্টার্ট নিয়েছে? হাসপাতাল থেকে তোমরা বাড়ি ক’মিনিটের পথ?’
রোসেলিন বিমুঢ়ভাবে তাকাল আহমদ মুসার দিকে। কোন উত্তর এল না তার কাছ থেকে। অসহায়ভাবে তাকাল সে ডোনার দিকে, ডোনারও নির্বাক চোখ নিবদ্ধ হলো আহমদ মুসার দিকে।
ড্রাইভার নড়ে-চড়ে দাঁড়াল। ব লল, ‘স্যার ৭টা ৩৫ মিনিটে গাড়িতে চড়েছি। সন্ধ্যার ব্যস্ত সময়ে বাসায় পৌঁছতে সময় লাগার কথা আধাঘন্টা।’
‘প্যাকেট তুমি কখন পেয়েছিলে?’
‘স্যার, ম্যাডামরা আসার দু’মিনিট আগে।’
‘এখানে পৌছেছো ক’টায়?’
‘সাতটা চল্লিশ মিনিটে।’
আহমদ মুসা তার হাত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল সময় তখন ৯টা ১০ মিনিট। অর্থাৎ প্যাকেটটি গাড়িতে আসার পর সময় গেছে ৩৭ মিনিট।
হাসি ফুটে উঠল আহমদ মুসার মুখে। ‘ধন্যবাদ ড্রাইভার’ বলে আহমদ মুসা গাড়ির ভেরত মাথঅ ঢুকিয়ে ড্যাশ বোর্ডের কেবিন খুলে অতি সন্তর্পনে প্যাকেটটা বের করে নিয়ে এল এবং আস্তে মাটিতে রাখল। বলল, ‘যদি এতে বোমা থেকে থাকে, তাহলেও আপাততঃ ভয় নেই। এটা অটো টাইমার মনোবা নিশ্চয় নয়।’
বলে আহমদ মুসা পকেট থেকে ছোট্ট একটা চাকু বের করে প্যাকেটের বাধন কেটে কভারের কাগজটি নামিয়ে ফেলল প্যাকেটের গা থেকে। বেরিয়ে এল চার ইঞ্চি বর্গ আয়তনের একটা পেপার বোর্ডের বাক্স। বাক্সের টপটি উপরের মোড়ক কাগজ খূলে ফেয়লার সাথে সাথেই খুলে গিয়েছিল। এবার আহমদ মুসা চাকুর ব্লেডের তীক্ষ্ণ অগ্রভাগ দিয়ে বক্সের চার কোণ লম্বাভাবে কেটে ফেলল।
সবাই রুদ্ধশ্বাসে দেখছীল আহমদ মুসার কাজ। ডোনার কপালে জমে উঠেছে বিন্দু বিন্দু ঘাম। ভয়ে তার মুখ পাংশু হয়ে উঠেছে।
চার কোণ কাটার পর বক্সটির কভঅর চার ভাগ হয়ে মাটিতে পড়ে গেল। তার সাথে পড়ে গেল স্পঞ্জের চারটি টুকরা। শুধু দাঁড়িয়ে থাকল ঠিক আপেলাকৃতির বড় একটা গোলক।
‘বোমা’-সবার মুখ থেকেই অস্ফুটে বেরিয়ে এল।
আহমদ মুসা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে পরীক্ষা করল বোমাটিকে। নতুন ধরনের গাড়ি-বোমা। বোমার মত শীর্ষ দেশে একটা মাইক্রো কম্পুটার বসানো। কম্পুটারে সেট করা প্রোগ্রাম অনুসারে কম্পুটারটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে বোনার বিস্ফোরণ ঘটায়। কম্পুটারের প্রোগ্রামটি সেট করা থঅকে সময়ের উপর নয়, কিলোমিটারের উপরে। কিলো মিটারের যে সংখ্যার উপর প্রোগ্রাম সেট করা থাকে, সেই দূরুত্বে গাড়ি পৌছার সংগে সংগে বোমার বিস্ফোরণ ঘটে।
কম্পুটারের ডিজিটাল প্যানেলে আহমদ মুসা দেখল লাল ডিজিটাল নাম্বারটি আট। অর্থাৎ রোসেলিনের গাড়ি আট কিলোমিটার যাবার পর বোমার বিস্ফোরণ ঘটতো।
কম্পুটারের রানিং ডিজিটাল প্যানেলে চার সংখ্যাটি স্থির হয়ে আছে। এর অর্থ গাড়িটি হাসপাতাল থেকে রাশিদী ইয়েসুগোর বাড়ি পর্য়ন্ত চার কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে এসেছে।
আহমদ মুসা সবাইকে কাছে ডাকল। নতুন ধরনের এ গাড়ি বোমার পরিচয় দিয়ে ওদের বলল, রোসেলিন গাড়িটা আট কিলোমিটার যাবার পর এ বোমার বিস্ফোরণ ঘটতো। আট কিলোমিটারের মধ্যে এ বাড়ি পর্য়ন্ত গাড়ি চার কিলোমিটার এসেছে। এখান থাকে আবার গাড়ি ছারার চার কিলোমিটারের মাথায় বোমার বিস্ফোরণ ঘটে গাড়িটা ধ্বংস হয়ে যেত।
কারও মুখে কোন কথা নেই। পাথরের মত যেন স্থির হয়ে গেছে সকলে। রোসেলিন ও ডোনার মুখ চোখের অবস্থা কান্নার চেয়েও করুণ।
হঠাৎ রোসেলিন পাশের লায়লাকে জড়িয়ে ধরে কেদে উঠল। বলল, ‘ঈশ্বর ডোনাকে রক্ষা করেছেন। তোমার এখানে এসে বেচে গেলাম। না হলে এতক্ষণ সর্বনাশ হয়ে যেত।’
‘এভাবেই আল্লাহ মানুষকে রক্ষা করেন। দেখ, আহমদ মুসা ভাই যদি সন্দেহ না করতেন, যদি ড্রাইভারকে জিজ্ঞাসা না করতেন, তাহলে এখান থেকে চার কিলোমিটার যাবার পর গাড়ি ধ্বংস হয়ে যেত।’ বলল লায়লা।
রোসেলিন লায়লাকে ছেড়ে দিয়ে ছুটে গিয়ে আহমদ মুসার কাছে হাটু গেড়ে বসল। দুই হাত জোড় ভংগিতে তুলে বলল,’আপনি মানুষ না ভাইয়া। নিশ্চয় ঈশ্বর আপনার সাথে কথা বলেন। আপনি এত জানেন, এত বুঝেন কি করে! ভাইয়া সেদিন দুর্বৃত্তদের হাত থেকে বাচিয়েছিলেন, আজ আবার নতুন জীবন দিলেন আমাদের। কি বলে কোন ভাষায় কৃতজ্ঞতা জনাব আমি?’
আহমদ মুসা হাসল। বলল,’কৃতজ্ঞতা আমাকে নয় বোন, আল্লাহকে জানাও। আমাদের জ্ঞান, বুদ্ধি, বিবেচনা সবই তো তারই দেয়া। সব প্রশংসা, সব কৃতজ্ঞতা তারই প্রাপ্য।’
‘যে ধর্ম আপনাকে এই মহত্ব দিয়েছে, এই দৃষ্টি দিয়েছে, সে ধর্মে কি আমাকে গ্রহণ করবেন ভাইয়া?’ বলল আবেগ রুদ্ধ কণ্ঠে রোসেলিন।
‘অবশ্যই। ওয়লকাম বোন। এ ধর্ম তো আমার কিংবা কারও নয়, সমগ্র মানব জাতির।’
বলে আহমদ মুসা উঠে দাড়ালো। বলল,’ওঠ বোন।’
উঠে দাড়িয়ে আহমদ মুসা রাশিদীকে লক্ষ্য করে বলল,’তোমাদের পূর্বপাশে পরিত্যক্ত ডিপটিউব ওয়েলের পাইপ বসানো দেখিছি। পাথর চাপা আছে। তুমি বোমাটি পাইপের মধ্যে ফেলে দিয়ে এস। কবরস্থ হয়ে থাকবে।’
আহমদ মুসা বোমাটি রাশিদীর হাতে তুলে দিল। বলল, ‘ভয় করো না চার কিলোমিটার না পেরুলে বোমা ফাটবে না।’
রাশিদী চলে গেল।
আহমদ মুসা রোসেলিনের দিকে চেয়ে বলল,’আমাদের জুরুরী কাজ ‘ক্যামেরুন ক্রিসেন্ট’ এর অফিসে। চল তোমাদের বাড়িতে পৌছে দিয়ে আমরা সেখানে যাব।’
রাশিদী ফিরে এসেছে।
গাড়িতে উঠতে যাচ্ছে আহমদ মুসারা।
এই সময় লায়লা আহমদ মুসাকে বলল,’একটা জিজ্ঞাসা ধরে রাখতে পারছি না ভাই।’
‘কি জিজ্ঞাসা?’ আহমদ মুসা বলল।
‘ড্রাইভারের কাছ থেকে সময় সম্পর্কে শোনার পর আপনি হেসেছিলেন। আমার মনে হয়েছিল, বোমা ফাটবে না বলে সে সময় নিশ্চিত হয়েছিলেন। এটা ঠিক কিনা? ঠিক হলে কেমন করে আপনি তা জেনেছিলেন?’
‘খুব সোজা হিসেব। ড্রাইভারের কাছে হিসেব নিয়ে জানলাম, হাসপাতাল থেকে রোসেলিনের বাড়ি যেতে লাগে ৩০ মিনিট। কিন্তু হাসপাতাল থেকে রোসেলিনের গাড়ি বের হবার পর তখন পর্যন্ত পার হয়েছিল ৩৭ মিনিট। গাড়িতে টাইম বোমা পেতে রাখলে ৩০ মিনিটের মধ্যে তার বিষ্ফোরণ ঘটার কথা। তা যখন ঘটেনি, তখন প্যাকেটে বোমা থাকলেও তা টাইম বোমা নয়।’
‘সাইত্রিশ মিনিট আপনি কোথায় পেলেন?’
‘কেন, রোসেলিনরা হাসপাতাল থেকে গাড়িতে উঠার ২মিনিট আগে প্যাকেট এসেছিল গাড়িতে। ৫মিনিট সময় লেগেছিল হাসপাতাল থেকে তোমাদের বাড়িতে আসতে, আর রোসেলিনরা তখন পর্যন্ত তোমাদের বাড়িতে সময় খরচ করেছিল ৩০ মিনিট। এখন হিসেব করে দেখ।’
লায়লার বিষ্ময়-বিমুঢ় দৃষ্টি আহম মুসার দিকে নিবদ্ধ। বলল,’রোসোলিন ঠিক বলেছে, আল্লাহ আপনার সাথে কথা বলেন। না হলে চরম টেনশনের সময়ও এই সব বিবেচনা, হিসেব আপনার মাথায় আসে কি করে?’
‘অন্যায় বলেছ লায়লা। আল্লাহ এইভাবে কথা বলেন না। তিনি তার বান্দাদের জ্ঞান, বুদ্ধি ও বিবেচনা দিয়ে সাহায্য করেন।’
‘আল্লাহ আমাকে মাফ করুন। তবে আল্লাহ আপনার প্রতি তার অনুগ্রহ বেহিসেব ঢেলে দিয়েছেন।’
‘আল-হামদুলিল্লাহ।’
বলে আহমদ মুসা রাশিদীর দিকে তাকাল। বলল,’রোসেলিনের গাড়ির ড্রাইভারকে তোমার সাথে তোমার গাড়িতে নাও। রোসেলিনের গাড়ি আমি ড্রাইভ করব।’
রোসেলিন ও ডোনা গাড়িতে উঠলে আহমদ মুসা গিয়ে ড্রাইভিং সিটে বসল।
গাড়ি দুটি স্টার্ট নিল।
‘ওরা পিছু নিতে পারে বলে সন্দেহ করছেন ভাইয়া?’ বলল রোসেলিন।
‘গাড়ি বোমা সেট করার পর তারা অনুসরণ করবে বলে আমি মনে করিনা। তাছাড়া ‘ওকুয়া’র সে সাহস অবশিষ্ট আছে বলে মনে হয় না।’
‘কিন্তু এত বড় কাজ যে তারা করতে পারল?’
‘এ কাজে সাহস ও শক্তির দরকার হয় না, দরকার হয় বুদ্ধির। যা একজন দূর্বলও করে বসতে পারে।’
‘এই কাজটা কি পরিকল্পিত ভাইয়া?’ ডাক্তারের যোগসাজস কি থাকতে পারে?’
‘আমার মনে হয়না। ডাক্তারের যোগসাজস থাকলে হাসপাতালের ভেতরেই কোন দুর্ঘটনা ঘটতে পারত। গাড়িতে বোমা সেট করার মত অনিশ্চিত পথ তারা বেছে নিত না।’
‘ঠিক বলেছেন ভাইয়া।’
পথে আহমদ মুসা ও রোসেলিন অনেক কথা বলল। ডোনা একটা কথাও বলেনি। বোমার ঘটনার পর থেকে নির্বাক হয়ে গেছে। তার চোখে মুখে ভয় নয়, বেদনার চিহ্ন।
রোসেলিনের গাড়ি গিয়ে তাদের গাড়ি বারান্দায় দাড়ালো।
আহমদ মুসাগাড়ির দরজা খুলতে যাবে, এ সময় কথা বলে উঠলো ডোনা। বলল,’আমি দু:খিত, হাসপাতালে যাবার সিদ্ধান্ত নেবার আগে তোমাকে জনানো উচিত ছিল আমার। বুঝতে পারছি আমার ভুল হয়েছে।’ গম্ভীর, ভারী কণ্ঠস্বর ডোনার।
আহমদ মুসা পিছন ফিরে ডোনার দিকে তাকাল। বলল নরম কণ্ঠে,’এই জন্যে বুঝি কথা বলছ না, মন খারাপ করে বসে আছ?’
একটু থামল আহমদ মুসা। তারপর শুরু করল আবার,’না তোমার ভুল হয়নি। সিদ্ধান্ত তোমার ঠিকই হয়েছে। তবে সুযোগ থাকলে পরামর্শ করা সব সময় ভাল, বিশেষ করে বর্তমান পরিস্থিতে।’
‘ধন্যবাদ। কিন্তু এই সাংঘাতিক ব্যাপারে আমাদের প্রতি তোমার আরও কঠোর হওয়া উচিত ছিল।’
‘কিন্তু আমি মনে করি ভলের চেয়ে পরমুখাপেক্ষী প্রবণতা আরও ক্ষতিকর। ভুলের মধ্যে সংশোধনের শিক্ষা আছে। এই শিক্ষাই যোগ্যতার সৃস্টি করে।’
‘ধন্যবাদ। এতক্ষণে বুক ভরে বাতাস নিতে পারছি।’ বহুক্ষণ পর ডোনার ঠোটে হাসি ফুটে উঠল। থামল ডোনা।
আহমদ মুসাও নীরব।
‘আমি নেমে যাই, আপনারা কথা বলুন।’ বলে রোসেলিন নামতে যাচ্ছিল। তার ঠোটে দুষ্টুমির হাসি।’
‘না যেওনা, তোমার সাথে কথা আছে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘কি কথা?’ স্থির হয়ে বসে রোসেলিন তাকাল।
‘তোমাকে বকুনি দেব।’
‘বকুনি? কেন?’ কণ্ঠে কৃত্রিম কান্নার সুর টেনে বলল রোসেলিন।
‘তোমাদের হাসপাতালে যাওয়ার কথা তোমার আব্বাকে বলনি কেন?’
বিষ্ময় ফুটে উঠল রোসেলিনের মুখে। বলল বলিনি যে কেমন করে জানলেন?’
‘বললে যে, তোমার আব্বা দু’জনকে একা বেরুতে দিতেন না।’
রোসেলিন মুহূর্ত কয়েক কথা বলতে পারল না। আরও বেশী বিষ্ময় এসে তার উপর ভর করেছে।
অল্পক্ষণ পরে বলল,’বুঝতে পারছি কেন আপনি অজেয়। বাতাসেও বোধ হয় সত্যের গন্ধ পান।’
বলে একটু থেমেই আবার দ্রুত কণ্ঠে বলল,’কিন্তু যাই হোক, বকুনি কি আমার জন্যই বরাদ্দ? ডোনা আপাতো বকুনি খেল না। কৃত্রিম ক্ষোভ রোসেলিনের চোখে মুখে।’
‘কারণ তোমাকে আদরটা বেশী করেন। কথায় বলে শাসন করা তারেই সাজে সোহাগ করে যে গো।’ ঠোটে হাসি টেনে বলল ডোনা।
‘তাহলে যাকে তিনি প্রাণের চেয়ে ভালবাসেন, তার তরে কি গো…?’ বলে রোসেলিন গাড়ির দরজা খুলে হাসতে হাসতে ছুটে পালাল।
মুখ ভরা রক্তিম হাসি নিয়ে ডোনা বেরিয়ে যাচ্ছিল। আহমদ মুসা হেসে বলল,’রোসেলিনের প্রশ্নের জবাব দিয়ে যাবে না?’
‘উত্তরটা আমার নয়, তোমারই দেবার কথা।’ বলে ডোনাও হাসতে হাসতে বেরিয়ে গেল।
আহমদ মুসা গাড়ি থেকে বর হলো।
পেছনে রাশিদীর গাড়ি তখন এসে প্রবেশ করল গাড়ি বারান্দায়।
গাড়ি দাড়াতেই গাড়ি থেকে রোসেলিনের ড্রাইভার নেমে এল। রাশিদী ও নামছিল।
আহমদ মুসা সেদিকে এগুতে এগুতে বলল, ‘আর নেম না রাশিদী। চল আমরা যাই।’
ছুটে এল রোসেলিন। বলল, ‘এত বড় ঘটনা ঘটল আব্বার সাথে দেখা করে যাবেন না, কথা বলে যাবেন না?’
‘আমাদের দেরী হয়ে গেছে। তুমি খবরটা দিও। আমি পরে দেখা করব।’ ‘বলল আহমদ মুসা।
‘আপনাদের অনেক দেরী করে ফেলেছি। আর নয়। খোদা হাফেজ।’
‘খোদা হাফেজ।’ বলে আহমদ মুসা এসে গাড়িতে রশিদীর পাশে বসল।’
স্টার্ট নিল গাড়ি।
গাড়ি ছুটে বেরিয়ে এল রোসেলিনদের গেট দিয়ে।

ক্যামেরুন ক্রিসেন্টের হেড কোয়ার্টার। ভূগর্ভস্থ একটি কক্ষ।
ফ্রান্সিস বাইক এবং আহমদ মুসা মুখোমুখি সোফায় বসে।
ফ্রান্সিস বাইককে এই কক্ষে বন্দী রাখা হয়েছে।
আহমদ মুসার দু’পাশের আরও দু’টি সোফায় বসে রাশেদী ইয়াসুগো এবং মুহাম্মদ ইয়োকিনি।
ফ্রান্সিস বাইককের মুখ বিসন্ন। মাথা নিচু।
কথা বলছিল আহমদ মুসা। ‘মিঃ বাইক আপনাকে চিন্তা করার যে সময় দেয়া হয়েছিল, তা শেষ।’
ফ্রান্সিস বাইক মুখ তুলল না, কথাও বলল না।
‘মিঃ বাইক আপনি যদি উত্তর দেয়ার মত ভদ্রতা না দেখান, তাহলে আমাদেরকে অভদ্র হতে হবে।’ অত্যন্ত তীক্ষ্ণ কঠোর শোনাল আহমদ মুসার কন্ঠ।
মুখ তুলল ফ্রান্সিস বাইক তার চোখে চাঞ্চল্য, ভয়ের চিহ্নও। বলল ‘আপনার কি চান বলুন?’
‘আপনাকে তা বলা হয়েছে।’
‘সে তো অনেক কথা বলেছেন।’
‘বেশী নয় আমরা তিনটি কথা বলেছি। এক, সমগ্র দক্ষিণ ক্যামেরুনে উচ্ছেদকৃত মুসলমানদের ক্ষতিপূরণসহ তাদের স্ব স্ব বাড়িতে পূনর্বাসন, দুই, তাদের সম্পত্তি তাদের ফেরত দান এবং তিন, আপনারা যারা বিদেশ থেকে উড়ে এসে জুড়ে বসেছেন গায়ের জুরে, তাদের ক্যামেরুন থেকে চলে যাওয়া।’
‘কিন্তূ আপনাদের দাবী তো ছিল ইয়াউন্ডি হাইওয়ের দক্ষিণে ইদেজা পর্যন্ত অঞ্চলের মুসলমানদের পূর্নবাসন এবং তাদের সম্পত্তি ফেরত পাওয়া।’
‘সে দাবী ছিল জনস্টিফেন এবং ফ্রাসোয়া বিবসিয়েরের কাছে। তাঁরা ঐ অঞ্চলের দায়িত্বে, তাই তাদের কাছে তাঁরা যেটুকু করতে পারেন, সেটুকুই দাবি করা হয়েছিল। আপনি গোটা ক্যামেরুনের দায়িত্বে শুধু নন, গোটা পশ্চিম আফ্রিকার দায়িত্বে, তাই আপনার কাছে আপাতত দক্ষিন ক্যামেরুনের মুসলমানদের প্রতি যে অবিচার করেছেন, তার নিরাময় দাবী করা হচ্ছে।’
‘এরপর কি গোটা পশ্চিম আফ্রিকার দাবী তুলবেন?’
‘আমরা ভবিষ্যত নিয়ে এখন মাথা ঘামাচ্ছি না, আপনি বর্তমানের কথা বলুন।’
‘আমি কি বলব। আমি আপনাদের বন্দী, একজন বন্দীর কথা বাইরের ওরা মানবে কেন?’
‘সে মাথা ব্যথা আপনার নয়।’ কঠোর হয়ে উঠল আহমদ মুসার কন্ঠ।
মাথা নিচু করে চুপ থাকল ফ্রান্সিস বাইক।
কথা বলল আহমদ মুসা আবার। বলল, ‘শুনুন মিঃ ফ্রান্সিস বাইক, আপনাকে দেয়া সময় আমাদের উত্তীর্ণ হয়ে গেছে। আমরা আর এক মুহুর্ত নষ্ট করবো না। আমরা আপনার প্রতি অবিচার করিনি। আমাদের বিচার ট্রাইবুন্যালে আপনাকে আত্মপক্ষ সমর্থনের পূর্ণ সুযোগ দেয়া হয়েছিল। আপনি আপনার অন্যায় স্বীকার করেছেন, তবে বলছেন অপরাধ আপনার একার নয়। সেটা আমরা জানি সব অপরাধিই তার শাস্তি পাবে। আপনার দন্ড আপনাকে পেতে হবে, তা আমরা আপনাকে বলছি। এ দন্ড এড়ানোর আপনার একমাত্র পথ অন্যায়ের প্রতিবিধানে আপনার রাজী হওয়া।’ থামল আহমদ মুসা।
‘আমাকে কি করতে হবে?’ বলল ফ্রান্সিস বাইক।
‘আমাদের তিনটি দাবীর বাস্তবায়ন হবে?’
‘সেটা পরে জানতে পারবেন।’
‘আমার একটা প্রশ্ন।’
‘বলুন।’
‘আমি একজন বন্দী। আমি স্বীকার করার পরও আমার করণীয় কিছু থাকবে না। কি করবেন তাহলে আপনারা আমার স্বীকারুক্তি নিয়ে?’
‘এ প্রশ্নের উত্তর আপনার প্রয়োজন নেই।’
‘ঠিক আছে, আমি রাজী হলেই যদি সব হয়ে যায়, তাহলে বলছি তিনটি দাবী মেনে নিতে আমার আপত্তি নেই।’
‘ধন্যবাদ ফ্রান্সিস বাইক।’ বলে আহমদ মুসা রাশিদীকে লক্ষ্য করে বলল, ‘কাগজটা দাও।’
রাশিদী ব্যাগ থেকে ভাঁজ করা এক শিট কাগজ করে আহমদ মুসার হাতে তুলে দিল।
আহমদ মুসা কাগজটি ফ্রান্সিস বাইকের হাতে তুলে দিয়ে বলল, ‘পড়ুন এবং সই করুন।’
কাগজটি হাতে নিয়ে ফ্রান্সিস বাইক তাতে নজর বুলাল। দেখল, তিন দফা দাবীর স্বীকৃতি পত্র।
ফ্রান্সিস বাইকের হাতে একটি কলম তুলে দিল আহমদ মুসা।
ফ্রান্সিস বাইক মুখ তুলে আহমদ মুসার দিকে একবার তাকাল। তারপর স্বীকৃতি পত্রে দস্তখত করল।
‘এই স্বীকৃতি পত্রটি কিছুই নয়। এতে দস্তখত করেও আপনি সব কিছু অস্বীকার করতে পারেন। তবু লাভ এইটুকু যে আপরাধ আপনারা করেছেন, আপনার দস্তখতে লিখিত তার একটা দলিল থাকল।’
কথা শেষ করে আহমদ মুসা রাশেদীর কাছে থেকে একগুচ্ছ কাগজ নিয়ে ফ্রান্সিস বাইকের হাতে তুলে দিল।
ফ্রান্সিস বাইক কাগজগুলোর উপর চোখ বুলাল। বিস্ময় ফুটে উঠল তার চোখে মুখে। বলল ‘এই স্বীকৃতিপত্রগুলো পেলেন কি করে? দক্ষিন ক্যামেরুনের আমাদের সব ঘাটির সব নেতা উপনেতাকে তাহলে আপনারা আটক করেছেন?’
‘হ্যাঁ, করতে হয়েছে।’
‘কিভাবে?’
‘আপনার ক্ষেত্রে যা হয়েছে, সেইভাবে। তবে রক্তপাত হয়নি। বিশটি ঘাটির ৪০ জনকে আটক করতে কোন প্রানহানি ঘটেনি।’
‘সকলের কাছ থেকে নেয়া নিছক এই স্বীকারুক্তি আপনাদের কোন কাজে আসবে?’
দক্ষিন ক্যামেরুনের ১২টি অঞ্চলের ১২টি আঞ্চলিক প্রধানের কাছে থেকে চিঠি নিয়ে তাদের অফিস থেকে মুসলমানদের থেকে নানাভাবে আপনারা যে ভূমি দখল করেছেন, তার বিস্তারিত রেকর্ড আমরা নিয়ে এসেছি।’
‘বুঝলাম। এরপর আপনারা কি করবেন?’
আপনাদের ভূমি ক্রয় বা দখলের এই তালিকা নিয়ে আপনার ঘাটি প্রধানদের সাথে আলোচনা করেছি। তাতে আমরা দেখেছি, মুসলমানদের কাছ থেকে অবৈধভাবে ক্রয় বা দখলকৃত জমির শতকরা ৯০ ভাগ রেজিস্ট্রি হয়েছে কোক ও ওকুয়া’র সদস্যদের নামে। এই সদস্যদের নামের তালিকাও আমারা তৈরী করেছি। তাদের দখল করা জমির বিবরণও পাওয়া গেছে।’ বলে থামল আহমদ মুসা।
একটু পরে বলল, ‘আমাদের কাজ শেষ, এবার কাজ আপনাদের। আপনারা যা মেনে নিয়েছেন, সে অনুযায়ী আপনাদের কাজ করতে হবে।’
‘কি রকম?’
‘আপনাদের দু’টি কাজ করতে হবে। তার একটি করবে সংগঠন হিসাবে ‘কোক’ ও ‘ওকুয়া’। আরেকটি করবে ‘কোক’ ও ‘ওকুয়া’র সদস্যরা ব্যাক্তিগতভাবে।’
‘কোক’ ও ‘ওকুয়া’ কি করবে?
‘উদ্বাস্তূ মুসলমানদের স্ব স্ব ভিটায় পুনর্বাসনের জন্যে ক্ষতিপূরণের টাকা নগদ পরিবেশন করবে ‘কোক’ বা ‘ওকুয়া’।’
‘আর ‘কোক’ ও ‘ওকুয়া’র সদস্যদের ব্যাক্তিগতভাবে কি করতে হবে?’
‘তাদের নামের রেজিস্টি জমিগুলো তার যাদের জমি সেই মুসলমানদের নামে রেজিস্ট্রি করে দেবে।’
হো হো করে হেসে উঠল ফ্রান্সিস বাইক। বলল, ‘আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে সব কিছু পাকা ফলের মত আপনার হাতে এসে পড়বে।’
আহমদ মুসা মুখভাবের কোন পরিবর্তন হলো না। যেভাবে সে কথা বলছিল, সেভাবেই বলল, ‘হ্যাঁ, পাকা ফলের মতই এসে পড়বে। এবং আজ থেকেই তা শুরু হবে, শেষ হবে তিন দিনের মধ্যে।’
‘চমক সৃষ্টি করার জন্যে হলে আপনার কথা ঠিক আছে।’
‘চমক সৃষ্টি করা বা রঙ্গ-রস করার মত সময় আমার নেই মিঃ ফ্রান্সিস।’ গম্ভীর কণ্ঠে বলল আহমদ মুসা।
তারপর রাশিদীর দিকে চেয়ে বলল, ‘তুমি ওদের নিয়ে এস এবং কাগজ পত্রও।’
রাশিদী বের হয়ে কয়েক মুহূর্ত পরে ‘কোক’ এবং ‘ওকুয়া’র অর্থ পরিচালক ‘ফিনিদি’ এবং ট্রেজারার ‘সিয়া সিয়া’কে সাথে নিয়ে ঘরে করল।
‘এদের চেনেন মিঃ ফ্রান্সিস?’
ওদের ঘরে ঢুকতে দেখেই ভূত দেখার মত তার চোখ ছানাবাড়া হয়ে গিয়েছিল। বিস্ময়ের ধাক্কায় কথা বলতে পারেনি ফ্রান্সিস বাইক কিছুক্ষণ পর সে বলল, ‘এদেরও গ্রেফতার করেছেন। এরা তো কোন সাতে-পাঁচে নেই।’
‘ওদের কেন আটক করেছে নিশ্চয় বুঝেছেন। ওরা হাতে থাকলে ক্ষতি পূরণের টাকা আদায় সহজ হবে।’
ফ্রান্সিস বাইক কোন কথা বলল না।
আহমদ মুসাই কথা বলল, লা-ফ্যাংগ রোডে আপনাদের প্রশাসনিক সদর দফতরে গিয়ে এদের পেয়েছি। নগদ অর্থসহ ওদের নিয়ে এসেছি। নগদ ৫ মিলিয়ন ডলার এবং ১০ মিলিয়ন ফ্রাংক পাওয়া গেছে। ভয় করবেন না। টাকাগুলো ‘ফিনিদি’ ও ‘সিয়া সিয়া’র তত্বাবধানেই রেখেছি। আপনার সাথে আমাদের হিসেব নিকেশ না হওয়া পর্যন্ত এভাবেই থাকবে।
‘আপনারা দস্যুতা করেছেন। এর ফল ভোগ করতে হবে না ভাববেন না।’ ক্ষোভে-দুঃখে ভেংগে পড়া গলায় কথাগুলো বলল ফ্রান্সিস বাইক।
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘আমরা দস্যুতা করিনি। দস্যুদের কাছ থেকে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্যে ক্ষতিপূরণ উদ্ধারের চেষ্টা করছি আমরা।’
বলে একটু থামল আহমদ মুসা। তারপর আবার শুরু করল, ‘শুনুন মি: ফ্রান্সিস বাইক, আমরা হিসেব করে দেখেছি তিন লাখ উদ্বাস্তু মুসলমানকে পুনর্বাসন করতে কমপক্ষে তিন’শ মিলিয়ন ক্যামেরুন ফ্রাংক প্রয়োজন। নগদ যা পেয়েছি তাতে ৫ মিলিয়ন ডলার থেকে আসবে ১৫০ মিলিয়ন ফ্রাংক। আর এর সাথে ১৫ মিলিয়ন ফ্রাংক মিলে হবে ১৬৫ মিলিয়ন ফ্রাংক। আর প্রয়োজন ১৩৫ মিলিয়ন ফ্রাংক। এই টাকার ব্যবস্থা করে দিন, তাহলে ক্ষতিপূরণ আদায়ের প্রথম কাজ আমাদের শেষ হয়।’
‘এভাবে আমাদের পণবন্দী বানিয়ে আদায় করতে চান টাকা?’ বলল ফ্রান্সিস বাইক।
‘দস্যুরা আইনের কথা মানে না, যুক্তির কথা মানে না। তাদের সাথে এই আচরণই করতে হয়।’ কঠোর কণ্ঠে বলল আহমদ মুসা।
‘আমি বন্দী আমি কোত্থেকে কিভাবে টাকা দেব?’ বলল ফ্রান্সিস বাইক।
‘ব্যাংকের সমস্ত রেকর্ডপত্রসহ আমরা ফিনিদি ও সিয়া সিয়াকে নিয়ে এসেছি। আমরা দেখেছি, ইয়াউন্ডির চারটা ব্যাংকে ওকুয়া’র নামে তিনশ’ মিলিয়ন ফ্রাংক রয়েছে। চারটা ব্যাংকের জন্যে আমাদের চারটা চেক দেবেন। চার চেকে টাকার মোট পরিমাণ হবে ১৩৫ মিলিয়ন ফ্রাংক। আপনি ব্যাংকে টেলিফোন করবেন, টাকা এনে দেবে সিয়া সিয়া আমাদের লোকদের সাথে গিয়ে।’
‘সে যদি গিয়ে আর না আসে, পুলিশে সব বলে দেয়।’
‘সেটা মি: সিয়া সিয়া নিশ্চয় করবেন না। তার কোমরে বাঁধা থাকবে বেল্টের বদলে কম্পুটার নিয়ন্ত্রিত বোমা বেল্ট। কম্পুটারটা থাকবে আমাদের লোকদের হাতে। তার বিশ্বাসঘাতকতার সামান্য ইংগিত পেলেই বোমা ফাটিয়ে দেয়া হবে সুতরাং মি: সিয়া সিয়া আমরা যেভাবে বলব সেভাবে আমাদের সহযোগিতা করবেন।’
ভয়ে চুপসে যাওয়া সিয়া সিয়া সম্মতিসূচক মাথা নাড়ল।
‘মি: সিয়া সিয়া আপনি চেকবইগুলো বের করুন এবং চারটি চেক লিখুন।’
সংগে সংগেই সিয়া সিয়া হাতের ফোল্ডার থেকে চারটি চেক বের করল, তারপর তাকাল ফ্রান্সিস বাইকের দিকে।
এটা লক্ষ্য করে আহমদ মুসা বলল, ‘মি: ফ্রান্সিস বাইক মি: সিয়া সিয়া আপনার অনুমতি চাচ্ছেন। চেক লেখার অনুমতি দিয়ে দিন।’
‘টাকা আমার নয়, আমি পারবো না।’ বলল ফ্রান্সিস বাইক।
‘আপনার টাকা আমরা চাই না। ‘কোক’ ও ‘ওকুয়া’র টাকা আমাদের প্রয়োজন এবং এগুলো তাদেরই টাকা।
ফ্রান্সিস বাইক কোন কথা বলল না।
আহমদ মুসার মুখ লাল হয়ে উঠল। রিভলবার বের করল পকেট থেকে। সবাইকে চমকে দিয়ে রিভলবার থেকে একটা গুলী ফ্রান্সিস বাইকের বাম কান স্পর্শ করে চলে গেল। রক্তের ক্ষীণ একটা ধারা নামল কানের আহত স্থান থেকে।
ফ্রান্সিস বাইক কানে হাত বুলিয়ে সিয়া সিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘এটা আমার অফিস নয়, নির্দেশের প্রয়োজন নেই। যা বলে লিখে দাও।’
চেক লিখল সিয়া সিয়া।
‘মি: সিয়া সিয়া মি: ফিনিদি ও মি: ফ্রান্সিস- এর কাছ থেকে দস্তখত নিন চেকে।’
চেকে তাদের দস্তখত হয়ে গেলে আহমদ মুসা বলল, ‘মি: সিয়া সিয়া দস্তখত ঠিক আছে তো? চেক যদি ফেরত আসে, তাহলে আপনি কিন্তু ফেরত আসবেন না।’
সিয়া সিয়া মাথা নেড়ে বলল সব ঠিক আছে।
‘ধন্যবাদ। কাল ৯টায় আপনি ব্যাংকে যাবেন আমাদের লোকদের সাথে।’
একটু থেমেই আবার শুরু করল, ‘রাশিদী দলিলগুলো মি: ফ্রান্সিসকে দেখতে দাও।’
রাশিদী হ্যান্ড ব্যাগ থেকে কতকগুলো কাগজ বের করে ফ্রান্সিসের হাতে তুলে দিল।
ফ্রান্সিস বাইক কাগজগুলোর উপর নজর বুলাল। কাগজগুলো জমির বিক্রয় দলিল। রেজিস্ট্রির জন্যে তৈরী।
‘মি: ফ্রান্সিস দলিলগুলো ভালো করে দেখুন। আমরা খোঁজ নিয়ে নিশ্চিত হয়েছে, আপনার নামে রেজিস্ট্রি এই বিপুল মুসলিম সম্পত্তির কোনটিই টাকা দিয়ে কেনা নয়। সুতরাং এই সম্পত্তি মালিকদের ফেরত দিতে হবে। সব দলিল রেডি। কালকে ৯টায় আমাদের লোকদের সাথে আপনি রেজিস্ট্রি অফিসে যাবেন। সব ঠিকঠাক আছে। আপনি পৌঁছলেই রেজিস্ট্রি শুরু হবে।’
‘যদি সেখানে গিয়ে রাজী না হই?’
‘রাজী হবেন। আপনারও কোমরে বাধা থাকবে কম্পুটার নিয়ন্ত্রিত বোমা। সুতরাং অবশ্যই আপনি আমাদের কথার বাইরে যাবেন না।’
‘সকলের কাছ থেকে এই ভাবেই কি আপনারা জমি রেজিস্ট্রি করে নেবেন?’
‘শতকরা আশি জনই স্বেচ্ছায় জমি ফিরিয়ে দিচ্ছে। অবশিষ্ট বিশ জনের ক্ষেত্রেই আপনার মত ব্যবস্থার আশ্রয় নিতে হচ্ছে।’
কথা শেষ করেই রাশিদীর দিকে তাকিয়ে আহমদ মুসা বলল, ‘চারটি চেক এবং দলিলগুলো তুমি রাখ এবং মি: ফিনিদি ও মি: সিয়া সিয়াকে রেখে এস।’
রাশিদী ওদের রেখে ফিরে এল।
‘তাহলে আজকের মত চলি ফ্রান্সিস বাইক। কাল সকালে আপনার দু’টো কাজ। এক, চারটি ব্যাংকে টেলিফোন করা এবং দুই, সকাল ৯টায় রেজিস্ট্রি অফিসে যাওয়া।’
‘আমি কিডন্যাপড হয়েছি ব্যাংক জানে না?’
‘থানায় কিংবা ব্যাংকে জানায়নি কেউ। আর জানাবার লোক বোধ হয় নেই। যারা আপনার খবর জানত, তাদের সবাইকে আমরা আটক করতে পেরেছি বলে মনে হয়।’
‘অসম্ভব। কিভাবে?’
‘আপনাকে নিয়ে আসার পর ওরা ‘ইয়াউন্ডি’ রোডের ঘাটি ছেড়ে দেয়। পরের দিন সন্ধ্যায় ওরা সকলে মিটিং-এ বসেছিল লা-ফ্যাংগ রোডের প্রশাসনিক ঘাটিতে। ওখান থেকে আমরা সবাইকে হাতে পেয়েছি।’
বলে আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল।
উঠে দাঁড়াল তার সাথে রাশিদী এবং মুহাম্মদ ইয়েকিনি।
বের হয়ে এল তারা ঘর থেকে।
ঘরের দরজার বাইরে দাঁড়ান স্টেনগানধারী দু’জন প্রহরী আহমদ মুসাদের সালাম দিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল।
ঘর থেকে বের হয়ে আহমদ মুসা বলল, ‘চল চীফ জাস্টিসকে টেলিফোন করে অগ্রগতিটা জানাতে হবে।’
‘ল’ সেক্রেটারীর কাছ থেকে সহযোগিতা নেয়ার যে কথা চীফ জাস্টিস সাহেব বলেছিলেন, সেটা কতদূর?’ বলল রাশিদী।
‘আলোচনাটা এগিয়েছে। ফ্রি ওয়ার্ল্ড টিভি এবং ডব্লিউ এন এ খবর প্রচারের পর বিষয়টা সরকারের গোচরে গেছে এবং সরকার ‘কোক’ ও ওকুয়াকে চাপ দিয়েছেন, তার ফলে মুসলমানদেরকে জমি ফিরিয়ে দেয়া হচ্ছে এবং তাদের পুনর্বাসনও হচ্ছে ক্ষতিপূরণ দিয়ে। এই রিপোর্ট সরকারের পক্ষ থেকে জাতিসংঘ, হিউম্যান রাইটস কমিশন ও সংস্থাসমূহ এবং সংবাদ মাধ্যমসমুহের কাছে পাঠানো হবে। এতে সরকারের লাভ হবে যে, সবাই জানবে সরকার অভিযোগের ব্যাপারে ত্বরিৎ পদক্ষেপ নিয়েছে। অন্যদিকে আমাদেরও লাভ হবে যে, এখানে মুসলমানদের সম্পত্তি ফিরে পাওয়া এবং ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসন হওয়া আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভ করল। ভবিষ্যতে তাদেরকে কোন প্রকার হয়রানি করা কঠিন হবে। এখন আমাদের যেটা করতে হবে সেটা হলো জমি হস্তান্তর ও পুনর্বাসনের তথ্যগুলো সরকারকে দিতে হবে যাতে সরকার তাদের রিপোর্ট এগুলো দেখাতে পারে।’
‘সব তথ্য দিতে হবে? সে তো বিরাট ব্যাপার।’ বলল মুহাম্মদ ইয়েকিনি।
‘না সব চায়নি। উদাহরণ হিসেবে কিছু দিতে হবে।’
‘কিভাবে হস্তান্তরের কাজ হচ্ছে, তা কি সরকার জানতে পেরেছে?’ বলল রাশিদী।
‘না, পারেনি।’
‘সরকারের মধ্যে ‘কোক’ ও ‘ওকুয়া’র প্রচুর লোক আছে, তারা তো জানতে পারে।’
‘যারা আটক হয়েছে তারা ছাড়া আসল ব্যাপারটা বাইরের কেউ জানে না। তারা বুঝছে যে, রেডিও, টিভি ও সংবাদপত্রে জমি আত্মসাৎ ও মুসলিম উচ্ছেদের ব্যাপারটা ফাঁস হয়ে যাবার পর ‘কোক’ ও ‘ওকুয়া’ কর্কৃপক্ষ সরকার ও বাইরের চাপে মুসলমানদের সম্পত্তি ফেরত দিতে সম্মত হয়েছে। সরকারের ভেতরে যারা আছে, তারাও এটাই জানছে।’
কথা বলতে বলতে আহমদ মুসারা ভূগর্ভ থেকে উপরে উঠে এল। বসল অফিসের ড্রইং রুমে।
টেলিফোন টেনে নিল আহমদ মুসা।
ডায়াল করল চীফ জাস্টিস ওসাম বাইকের নম্বারে।

যায়দ রাশিদীর লুকানো বাক্স থেকে সোনার যে মোহর বের হলো তার পরিমাণ দাঁড়ালো এক কোটি ডলার। ক্যামেরুনের টাকায় যার পরিমাণ হয় ৩০০ কোটি ফ্রাঙ্ক।
তিনশ’ কোটি ফ্রাঙ্ক মূল্যের সোনার মোহরের স্তুপের দিকে বিস্ময়ের দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রাশিদী ইয়েসুগো, মুহাম্মদ ইয়েকিনি, ব্ল্যাক বুল এবং অন্যান্যরা।
‘আমার একটা বিস্ময় কিন্তু যায়নি।’ মোহরের দিক থেকে চোখ ঘুরিয়ে আহমদ মুসার দিকে চেয়ে বলল রাশিদী ইয়েসুগো।
‘কী?’ বলল আহমদ মুসা।
‘ডায়েরীতে লুকানো বাক্সের যে সংকেত আছে, তা আমি দেখেছি। কিন্তু আমি কিছু বুঝিনি। আপনি কি করে জায়গাটা ঠিক ঠিক চিহ্নিত করে ফেললেন?’
‘এ জিজ্ঞাসা আমারও মনে।’ বলল ব্ল্যাক বুল।
‘ব্যাপারটা খুবই সহজ ছিল। পাখির বাসা বলতে বুঝানো হয়েছে যায়দ রাশিদীর বাড়ী, মৃত পাখির বাসা বলতে বুঝানো হয়েছে যায়দ রাশিদীর সমাধিকে। আর মোহর ভর্তি বাক্স হলো মৃত পাখির মুখের গোলাপ ফুল। সুতারাং বুঝতেই পারছ, সংকেতের মধ্যে কোন জটিলতা ছিলনা।’
‘এখন কোন জটিলতা দেখছি না, তবে পাখিকে যায়দ রাশিদী, পাখির বাসাকে তার বাড়ি, মৃত পাখির অবস্থান কে সমাধি এবং গোলাপ ফুলকে লুকানো ধন কল্পনা করা হাজার চেষ্টা করেও পারতাম না।’ বলল রাশিদী ইয়েসুগো।
‘থাক, এসব কথা। এখন বল, এই টাকা নিয়ে কী চিন্তা করছ?’
‘কেন যায়েদ রাশিদীর উইল অনুসারে এ টাকার মালিক আপনি।’
‘আচ্ছা ঠিক আছে, টাকার মালিক আমি হলে এ টাকা আমি তোমাদের দিয়ে দিলাম। এখন বল এ টাকা তোমরা কি করবে?’
‘আমরা জানিনা, আপনিই বলুন এ টাকা দিয়ে আমরা কি করব?’
‘ফ্রান্সিস বাইকের কাছ থেকে যে সম্পত্তি ফেরত পাওয়া গেছে তার সাথে যায়দ রাশিদীর বাড়িও আছে। এ টাকার একটা অংশ দিয়ে ঐ বাড়িটাকে পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে আনতে হবে। ব্ল্যাক বুলের নামে বাড়িটা কেনা হয়েছে সে, বাড়িটার মালিক থাকবে। আর…’
আহমদ মুসার কথার মাঝখানে ব্ল্যাক বুল বলে উঠল, ‘কিন্তু আমি মনে করি যায়দ রাশদীর এই সম্পত্তির মালিক হওয়ার যোগ্যতা আমার নেই। বাড়িটার একজন সেবক হতে পারলেই আমি খুশি হবো। আমি….’
আহমদ মুসা তাকে বাধা দিয়ে বলল, ‘ঠিক আছে, তোমার কথা আমরা বুঝেছি। শুনে রাখ, সন্তান অযোগ্য হলেই সে তার উত্তরাধিকার হারায় না।’
বলে একটু থামল আহমদ মুসা, তারপর আবার শুরু করল, ‘অবশিষ্ট টাকা ক্যামেরুন ক্রিসেন্ট পাবে। ক্যামেরুন ক্রিসেন্ট এই টাকা ইসলাম প্রচার এবং মানুষের সেবায় ব্যয় করবে। জাগতিক ও ইসলামী শিক্ষার প্রসার এবং দারিদ্র্য বিমোচন- এই লক্ষ্যে যদি ক্যামেরুন ক্রিসেন্ট কাজ করতে পারে, তাহলে পশ্চিম আফ্রিকায় এনজিও দের ষড়যন্ত্র বানচাল করে তোমরা ইসলামের আলো নতুন করে এ অঞ্চলে প্রজ্জ্বলিত করতে পারবে।’
‘ধন্যবাদ আহমদ মুসা ভাই। আপনি যে কাজের প্রস্তাব করেছেন সেটাই আমাদের আসল কাজ হওয়া উচিত। কিন্তু এই সাথে আমার কথা হলো আপনি বিশ্বব্যাপী কাজ করছেন। যায়দ রাশিদীর টাকার একটা অংশ যদি আপনার কেন্দ্রীয় তহবিলে যায়, তাতে আমি মনে করি তার পূন্য আরও বেশী হবে।’ বলল রাশিদী।
হাসল আহমদ মুসা, ‘বলল, আমার কোন কেন্দ্র নেই, কেন্দ্রীয় অফিসও নেই, কেন্দ্রীয় তহবিলও নেই। আমি যখন যেখানে থাকি সেটাই, আমার কেন্দ্র। সে কেন্দ্র্র থেকেই আমার খরচ চলে। সুতরাং আমার কোন তহবিল দরকার নেই।’
রাশিদী ইয়েসুগো নাছোড়বান্দা। বলল, ‘ইসলামের বিশ্বব্যাপী যে কাজ হচ্ছে, তার তো একটি কেন্দ্রীয় তহবিল আছে। যেমন ধরুন ‘সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিক’ -এর বারবারেতি শহরে আন্তর্জাতিক সম্মেলন হচ্ছে। সেখানে বিশ্বের মুসলমানদের সবচেয়ে সক্রিয় ও শক্তিশালী সংগঠন ওয়ার্ল্ড মুসলিম কংগ্রেস-এর প্রধানসহ বিশ্ব বরেণ্য অনেক মুসলিম নেতা এসেছেন। এসব কাজে তো বিরাট খরচ। যায়দ রাশিদীর অর্থের একটা অংশ যদি এসব কাজে খরচ হয়, তিনি অনেক বেশী পূণ্য পাবেন।’ বলল রাশিদী ইয়েসুগো।
‘তুমি ঠিকই বলেছ। ‘বারবারেতি’ শহরে ‘ডার্ক আফ্রিকা ব্রাইট হার্ট’ -এর উদ্যোগে ‘আফ্রিকা এবং ইসলাম’ বিষয়ের উপর যে আন্তর্জাতিক সেমিনার হচ্ছে, তার জন্যে যদি অর্থের প্রয়োজন হতো তাহলে আমি তোমার কথা মেনে নিতাম। আসলে ‘ডার্ক আফ্রিকা ব্রাইট হার্ট’ আফ্রিকায় ‘ওয়ার্ল্ড মুসলিম কংগ্রেস’ পরিচালিত একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন। তাদের যাবতীয় খরচ ‘ওয়ার্ল্ড মুসলিম কংগ্রেস’ বহন করে থাকে। তবু তোমরা চাইলে তাকে সাহয্য করা যাবে। কিন্তু এ জন্য এখনই বাজেটের প্রয়োজন নেই। আমি ওদের সাথে কথা বলে সে ব্যবস্থা করব।’
‘আপনার তো বিরাট খরচ। আপনি কি আপনার এ টাকা থেকে কিছুই নিতে পারেন না?’ মুখ ভার করে বলল রাশিদী ইয়েসুগো।
আহমদ মুসা হাসল। রাশিদীর পিঠ চাপড়ে বলল, ‘মন খারাপ করছ কেন? সত্যিই আমার প্রয়োজন নেই। এই যে আমি তোমাদের এখানে এসেছি, কোন খরচ আমাকে তোমরা করতে দিয়েছ? এর বাইরে যে টাকা আমার প্রয়োজন তার ব্যবস্থা আছে। ফিলিস্তিন সরকার ‘আল জাজিরা ব্যাংক ইন্টারন্যাশনাল’-এর একটা ‘কোডেড ক্রেডিট নাম্বার’ আমাকে দিয়েছে। আমি পৃথিবীর যে কোন ব্যাংকে গিয়ে এই নাম্বার দিয়ে টাকার যে কোন অংক চাইলে দিয়ে দিবে। দরকার পড়লে এই নাম্বার আমি ব্যাবহার করি। ঠিক আছে? এবার খুশী?’
হাসল রাশিদী। বলল ‘ঐ নাম্বার যে কেউ ব্যাংককে দিলে টাকা দিয়ে দিবে?’
‘হ্যাঁ।’
‘তাহলে আমিও তো ঐ নাম্বার দিয়ে টাকা তুলতে পারি।’ বলল রাশিদী।
‘নাম্বার পাবে কোথায়?’
‘আপনি দেবেন।’ বলল রাশিদী।
‘এ ধরনের নাম্বার যাকে দেয়া হয়, সে যদি কাউকে এটা জানায়, তাহলে সেদিন সে এটা ব্যাবহারের অধিকার হারায়।’
‘বুঝলাম। দায়িত্বটা এরকম না হলে সুযোগটা অতবড় হতো না। কিন্তু একটা প্রশ্ন, ব্যাংক তো কোডেড নাম্বারটা জানতে পারে, তারা যদি এটা অন্যকে জানিয়ে দেয় বা নিজেরা ব্যবহার করে?’ বলল রাশিদী।
‘না পারবে না কোডেড নাম্বার এর সাথে একটা সিরিয়াল সংকেত আছে। এই সংকেত প্রত্যেকবার পৃথক হয় এবং সিরিয়াল অনুসারে হয়, যেভাবে আল জাজিরা ব্যাংক ইন্টারন্যাশনাল-এর রেকর্ডে সংরক্ষিত আছে।’
‘কিন্তু এ ব্যাপারটা তো স্থানীয় এবং বিভিন্ন ব্যাংকের জানার কথা নয়, তারা যদি ভূল করে টাকা দিয়ে দেয়?’ বলল রাশিদী।
‘প্রত্যেক ব্যাংকের কম্পিউটারের পেমেন্ট সেকশনে ইন্টারন্যাশনাল কাউন্টার আছে। যেসব আন্তর্জাতিক ব্যাংক ক্রেডিট কার্ড ও কোডেড নাম্বার-এ পেমেন্ট করে, তারা সবসময় প্রতি মহুর্তে কম্পিউটারের ইন্টারন্যাশনাল পেমেন্ট কাউন্টারে আপ টু-ডেট-রাখে। সুতরাং যখনি কেউ কোডেড নাম্বার ব্যাংকে দেয়, তখন তারা সেটা কম্পিউটারে প্রবেশ করায়। পেমেন্ট সেকশনের ইন্টারন্যাশনাল কাউন্টার থেকে গ্রীন সিগনাল পেলেই তবেই তারা পেমেন্ট করে।’
‘বাঃ চমৎকার ব্যবস্থা।’ বলল রাশিদী।
রাশিদী থামতেই মুহাম্মদ ইয়েকিনি বলল, ‘আমার ভিন্ন একটা প্রশ্ন, এত বড় এবং গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক সেমিনার বারবারেতি শহরে অনুষ্ঠিত হচ্ছে কেন?’
‘হতে পারেনা কেন মনে করছ?’ বলল আহমদ মুসা।
‘জায়গাটা তেমন খ্যাতনামা নয়। মুসলিম স্বার্থের উপস্থিতির দিক দিয়েও গুরুত্বপূর্ণ নয়।’ বলল মুহাম্মদ ইয়েকিনি।
আহমদ মুসা হাসল। বলল, তুমি ঠিকই বলেছ। জায়গাটা বিখ্যাত এবং মুসলিম স্বার্থের দিক দিয়ে গুরুত্বপূর্ণও নয়। কিন্তু নতুন নতুন জায়গাতেই তো ইসলাম যাবার কথা। অন্ধকারেই তো আলোর আগমন বেশী প্রয়োজন।’
থামল একটু আহমদ মুসা। একটু গম্ভীর হয়ে উঠল তার মুখ। বলল, ‘একটা ঘটনা এবং একটা স্মৃতি সেন্ট্রাল আফ্রিাকান রিপাবলিকের এই বারবারেতিকে স্মরণীয় করে রেখেছে। প্রায় দু’শ বছর আগে সংঘ নদী তীরের ঐ বারবারেতিতে আকস্মিকভাবে উদয় হয়েছিলেন সুলতানুল আউলিয়া আহমদ বিন আহমদ আবদুর রহমান। উদয় হয়েছিলেন বলা হয় এ জন্যই যে, উনি কিভাবে কোথেকে এসেছিলেন, কেউ বলতে পারেনা। কেউ বলে মালি, নাইজেরিয়া ও ক্যামেরুন হয়ে মধ্য আফ্রিকা প্রজাতন্ত্রের এই দুর্গম স্থানে তিনি এসেছিলেন, কারো মতে সুদান থেকে মধ্য আফ্রিকা প্রজাতন্ত্রে তিনি প্রবেশ করেছিলেন, কেউ মনে করেন সোমালিয়া, কেনিয়া, উগান্ডা ও জায়ার হয়ে এখানে তিনি এসেছিলেন। আবার কেউ বলেন, তিনি বাঁশের ভেলায় চড়ে কংগো নদী হয়ে সংঘ নদী পথে বারবারেতি এসেছিলেন। সত্য যেটাই হোক ঘোর এক দুর্দিনে বারবারেতির মানুষ স্বর্গের সাহায্য রূপে তাকে দেখতে পেয়েছিল।“কথিত আছে, একদিন ভোরে ইউরোপীয় দাস ব্যাবসায়ীরা একটা স্টীম বোটে করে বারবারেতি এলাকায় প্রায় দেড় শ’ যুবককে ধরে নিয়ে যাচ্ছিল। ইউরোপীয়দের গুলি বৃষ্টিরে মুখে যুবকদের আত্মীয় স্বজনরা নদীর তীরে গড়াগড়ি দিয়ে আহাজারি করছিল। তারা বিস্ময়ের সাথে দেখল নদীর তীরে দাঁড়ানো বাঁশের ভেলায় বসে ধ্যানরত একজন সৌম্যমূর্তি বৃদ্ধ উঠে দাড়ালো এবং দরাজ কণ্ঠে স্টিম বোটকে থামার নির্দেশ দিল। বোট থামল না। বৃদ্ধ তাঁর ডান হাত ঊর্ধ্বে উত্তোলন করল। সঙ্গে সঙ্গে বোট সব শক্তি হারিয়ে নিশ্চল হয়ে গেল। ইউরোপীয়দের বন্দুকগুলো তাক করল বৃদ্ধকে। কিন্তু বন্দুকগুলো থেকে ধোয়া বেরুল, শব্দ হলো, গুলি বেরুল বটে, কিন্তু গুলিগুলো ঝরে পড়ল বৃদ্ধের দেহ থেকে। বৃদ্ধ হাত দিয়ে ইঙ্গিত করল বোটটিকে কূলে ভেড়ার জন্য। ইঞ্জিন স্টার্ট হওয়া ছাড়াই নিঃশব্দে বোটটি কূলে এসে ভিড়ল। বৃদ্ধ তাঁর সেই দরাজ গলায় ইউরোপীয়দের তাদের বন্দুকগুলো নদীর তীরে ফেলে দিতে বলল এবং বন্দীদের ছেড়ে দিতে নির্দেশ দিল। ইউরোপীয়রা পাথরের মত হয়ে গিয়েছিল। তারা পুতুলের মত হুকুম পালন করল। বারবারেতির দেড়শ’ বন্দী মুক্তি পেয়ে তীরে নেমে এল। এরপর বৃদ্ধ ইউরোপীয়দের চলে যাবার নির্দেশ দিল এবং সাবধান করেদিল আর যেন দাস ব্যবসায় তারা না করে।
স্টার্ট নিয়ে বোট চলে গেল।
বৃদ্ধটি বাঁশের ভেলা থেকে ধীরে ধীরে তীরে নেমে এল। বারবারেতির সকল মানুষ তাঁর সামনে উপুড় হয়ে পড়ল। তারা মনে করল স্বয়ং ঈশ্বর মানুষের রূপ ধরে তাদের সামনে এসেছে। কিন্ত বৃদ্ধ ‘অমানুষ’ নামে অভিহিত কালো মানুষগুলোকে পা থেকে বুকে টেনে তুলল। জড়িয়ে নিল বুকে।
যা হোক, বৃদ্ধ আহমদ বিন আব্দুর রহমান বারবারেতিতেই তাঁর নিবাস বানাল। তিনি আসার পর দাস সংগ্রহের আর কোন হামলা বারবারেতিতে হয় নি।
চারিদিকে নাম ছড়িয়ে পড়ল বৃদ্ধের। ঈশ্বরের সাক্ষাৎ প্রতিভু হয়েও তিনি মাটির মানুষ, প্রাণের মানুষ। দাস ব্যবসায় তিনি আসায় বন্ধ হয়ে গেছে। অন্যায়-অশান্তি ও হানাহানিও তিনি কমিয়ে দিয়েছেন। এই কাহিনী আমি পড়েছি পশ্চিমি পরিব্রাজকের এক বইতে। তিনি স্থানীয় ভাষায় লিখিত একটা পুস্তিকার বরাত দিয়ে এই কাহিনী লিখেছেন।
বৃদ্ধ আহমদ বিন আব্দুর রহমান বারবারেতিতে জ্বালালেন ইসলামের আলো। ইসলাম প্রচারের এক কেন্দ্র হয়ে দাঁড়ালো বারবারেতি।
বারবারেতিকে কেন তিনি বেছে নিয়েছিলেন?
সেই সময়ের আফ্রিকার অবস্থার দিকে যদি তাকাই তাহলে দেখব বারবারেতি আলো এবং অন্ধকারের মাঝে একই সীমারেখা। নাইজেরিয়া থেকে যে রাস্তা উত্তর ক্যামেরুন হয়ে দক্ষিণে অগ্রসর হয়েছিল, তা বারবারেতি এসে থেমে গিয়েছিল। এর দক্ষিণে বাইরের কোন কাফেল তখনও পা রাখেনি। বারবারেতির পশ্চিমে দক্ষিণ ক্যামেরুন তখন মুসলিম শূন্য, আর বারবারেতির পুবে মধ্য আফ্রিকা প্রজাতন্ত্রের দক্ষিণাঞ্চলও তখন কোন মুসলিমের পদচারণায় ধন্য হয়নি। আর দক্ষিণে অবস্থিত কংগো,গ্যাবন, জায়ার তো তখন একেবারেই তিমির অন্ধকারে ঢাকা। মানুষ এবং পশু তখন সে অঞ্চলে একাকার।
এই বিশাল জমাট অন্ধকারের প্রান্তে দাঁড়ানো বারবারেতি ছিল সোনালী সিংহদ্বারের মত। সেখান থেকে উত্তরের সাথে স্থল পথে যোগাযোগ করা যায়, আর অন্ধকার দক্ষিণের সাথে সংযোগ গড়ে তোলা যায় নদী পথে। অন্ধকারের সোনালী সিংহদ্বার এই বারবারেতিকে কেন্দ্র করে বৃদ্ধ আহমদ বিন আব্দুর রহমান অন্ধকার দক্ষিণে ইসলামের আলো ছড়িয়ে দিয়েছিলেন।
এই হলো বারবারেতির স্মৃতি।
আর যে ঘটনার কথা বলেছি, বারবারেতির সেই ঘটনা হলোঃ
আহমদ বিন আব্দুর রহমান স্থানীয় জনগণের পাশে থাকতে গিয়ে এবং ইসলাম প্রচারের কারণে পশ্চিমী খৃষ্টান মিশনারী এবং উদীয়মান ফরাসী ঔপনিবেশিক শক্তির শত্রুতে পরিণত হয়েছিলেন। ঠিক এই সময়ি আহমদ বিন আব্দুর রহমান বারবারেতিতে একটা আন্তর্জাতিক ইসলামী সম্মেলনের আয়োজন করেছিলেন। এ সম্মেলনে তুরস্কের ওসমানিয়া খেলাফতের প্রতিনিধি ও মিসরের গ্র্যান্ড মুফতিসহ মালি খিলাফত, নাইজেরিয়া সালতানাত এবং উত্তর ক্যামেরুনের ইয়েসুগো সুলতানের প্রতিনিধিকে দাওয়াত দেয়া হয়েছিল। এই মহামান্য মেহমানদের এনে আহমদ বিন আব্দুর রহমান তিমিত অন্ধকারে ঢাকা এক আফ্রিকাকে দেখাতে চেয়েছিলেন এবং বলতে চেয়েছিলেন এই অন্ধকারের বাসিন্দাদের প্রতি তাদের দায়িত্বের কথা।
কিন্তু তাঁর এ ইচ্ছা পূরণ হয়নি। সম্মেলনের চারদিন আগে এক রাতে সম্মেলন কেন্দ্রে যখন তিনি কর্মরত ছিলেন, তখন এক অগ্নিকাণ্ডে সম্মেলন কেন্দ্রে ভস্মীভূত হয় এবং তিনি নিহত হন। অগ্নিদগ্ধ আহমদ বিন আব্দুর রহমানের পৃষ্ঠদেশে গভীর ছুরিকাঘাতের চিহ্ন ছিল। স্থানীয় মুসলিমরা মনে করত, খৃষ্টান মিশনারী ও ঔপনিবেশিকরা যোগসাজস করে তাঁকে হত্যা করেছে এবং সম্মেলন পণ্ড করেছে। আর স্থানীয় অন্যান্য অধিবাসীরা বিশ্বাস করত, দাস ব্যবসায়ী শয়তানরা হত্যা করেছে তাদের স্বর্গীয় পিতাকে। এক মাস ধরে শোক পালন করেছে স্থানীয় অধিবাসীরা। তাঁর নিহত হবার দিনকে স্থানীয় অধিবাসীরা শোক দিবস হিসেবে পালন করে আসছে গত দু’শ বছর ধরে।
এই বারবারেতি শহরেই ‘ডার্ক আফ্রিকা ব্রাইট হার্ট’- এর উদ্যাগে আন্তর্জাতিক ইসলামী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। বলা যায়, দু’শ বছর আগের একটা অসমাপ্ত কাজ আজ সমাপ্ত হচ্ছে। এখন বল ইয়েকিনি, জায়গাটার সিলেকশন ঠিক হয়েছে কিনা?’
আহমদ মুসার কথা গোগ্রাসে গিলছিল ইয়েকিনি রাশিদীরা।
আহমদ মুসার প্রশ্ন শুনে হাসল ইয়েকিনি। বলল, ‘কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু এত কথা আপনি জানলেন কি করে?’
‘ঠিক। আমরা আহমদ বিন আব্দুর র।হমান সম্পর্কে অনেক কথা জানি। আমার আব্বা ওখানে একবার গিয়েছেন। কিন্তু আমরা যা জানি, আপনার তুলনায় তা সামান্য।’ বলল রাশিদী ইয়েসুগো।
হাসল আহমদ মুসা। বলল, রাশিদী তোমাদের পারিবারিক লাইব্রেরীতে ‘মধ্য আফ্রিকায় উপনিবেশ-এর সূচনা পর্ব’ নামে ফরাসী ভাষায় একটি বই পড়লাম। বইটি এর আগেও একাধিক লাইব্রেরীতে দেখেছি, কিন্তু পড়ার সুযোগ হয় নি। এবার পড়লাম। এ বইয়ের কাহিনীর সাথে যদি ‘আফ্রিকায় প্রাথমিক যুগের সুফি-সাধক এর বিবরণ যোগ কর, তাহলে আমি যে কাহিনী বললাম তার চেয়েও বেশি জানতে পারবে।’
এ সময় ব্ল্যাক বুল উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘আমার একটা কাজ আছে। আমি আছি আমার ঘরে।’
বলে ঘর থেকে বেড়িয়ে গেল ব্ল্যাক বুল। তার পর পরই ঘরে প্রবেশ করল লায়লা। তার হাতে একটা ইনভেলাপ। ইনভেলাপটি রাশিদীর হাতে তুলে দিতে দিতে বলল, ‘ভাইয়াকে দাও, রোসেলিনের আব্বার চিঠি।’
রাশিদী ইনভেলাপটি আহমদ মুসার হাতে তুলে দিল।
বন্ধ ইনভেলাপ থেকে চিঠি বের করল আহমদ মুসা। পড়ল চিঠি। চিঠি পড়ে তার ঠোঁটে এক টুকরো হাসি ফুটে উঠল। বলল, ‘রাশিদী, রোসেলিনের আব্বা তোমার সাথে রোসেলিনের বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছেন।’
‘আপনার কাছে?’ ঠোঁটে হাসি টেনে বলল লায়লা।
‘হ্যাঁ। সম্ভবত আমাকেই এখন রাশিদীর যথার্থ অভিভাবক মনে করেছেন।’ হাসল আহমদ মুসা।
‘তাঁর মনে করাটা সত্য। আপনার চেয়ে আমার বড় অভিভাবক এই দুনিয়ায় আর কে হতে পারেন?’
‘আম্মা মানে তোমার আম্মার অধিকার অস্বীকার করোনা, রাশিদী।’ বলল আহমদ মুসা হাসতে হাসতে।
‘আম্মাকে জিজ্ঞেস করে দেখুন, এ অধিকার আম্মা আপনার হাতেই তুলে দিয়েছেন।’ বলল রাশিদী।
‘তাহলে এ অধিকার কিন্তু আরও অনেক জায়গায় খাটাব।’
‘যেমন?’ বলল রাশিদী।
‘রোসেলিনের আব্বা একটা প্রস্তাব দিয়েছেন, আমারো একটা প্রস্তাব আছে।’
রাশিদীর মুখ মলিন হয়ে উঠল।
আহমদ মুসা ব্যাপারটা আঁচ করতে পেরে হেসে বলল, ‘ভয় করো না, তোমার বিয়ের পাল্টা প্রস্তাব নয়, অন্য বিয়ের একটা প্রস্তাব আমার আছে।’
রাশিদী লজ্জায় মুখ নিচু করল। পরক্ষণেই মুখ তুলে বলল, ‘প্রস্তাবটা বলুন।’
‘বলব?’ বলে একটু থামল আহমদ মুসা। তারপর বলল, ‘এলিসা গ্রেস এর সাথে ওমর বায়া এবং বোন লায়লার সাথে ভাই মুহাম্মাদ ইয়েকিনির বিয়ে তোমাদের সাথে একই সময়ে হয়ে যেতে পারে।’
শুনেই রাশিদী সোৎসাহে বলে উঠল, ‘এক সাথে মানে, এদের বিয়েই আগে হবে।’
মুহাম্মাদ ইয়েকিনি লজ্জায় মুখ নিচু করল। আর দু’হাতে মুখ ঢেকেছে লায়লা।
‘আগে হওয়ার যুক্তি কি?’ হেসে বলল আহমদ মুসা।
‘প্রধান যুক্তি হলো, লায়লা সব সময় কথা বলা, দাবী আদায়, খাওয়া- সব ব্যাপারে আমার উপরে এবং আগে থাকতে চায়, সুতরাং এ ব্যাপারেও…।’
‘চাইলে কি হবে, তুমিই তো আগে থাক।’ লজ্জা রাঙা মুখে লায়লা তীব্র প্রতিবাদ করল।
‘ঠিক আছে, আর আগে থাকব না।’
লায়লা মুখ খুলতে যাচ্ছিল। আহমদ মুসা বাধা দিয়ে হেসে বলল, ‘ তোমাদের ভাইবোনের ঝগড়া আপাতত বন্ধ। আগে-পরের ব্যাপারটা আমি দেখব।’ বলে থামল আহমদ মুসা।
কিছু বলতে যাচ্ছিল আহমদ মুসা। তার আগেই মুখ খুলল লায়লা। বলল, ‘চিঠি তো অনেক বড় দেখছি, আর কি লিখেছে,ভাইয়া?’
আরও কিছু আছে নাকি?’ বলল আহমদ মুসা।
‘আছে বলে মনে হয়’। লায়লা বলল।
‘কেমন করে জান? পড়েছ নাকি চিঠি?’
‘তওবা। এটা আমি করতে পারি না। রোসেলিন আমাকে টেলিফোনে বলেছে’।
‘রোসেলিন কি করে জানে?’
‘তার আব্বা এবং মারিয়া আপার আব্বার কথা সে শুনেছে’।
‘রোসেলিন কি বলেছে লায়লা? বলল রাশিদী একটু ফাঁকা পেয়ে।
‘বলব ভাইয়া?’ আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে মুখ টিপে হেসে বলল লায়লা।
জবাব না দিয়ে আহমদ মুসা চিঠিটা এগিয়ে দিল রাশিদীর দিকে ম্লান হেসে।
রাশিদী ইয়েসুগো চিঠিতে চোখ বুলিয়ে লাফিয়ে উঠল খুশীতে। প্রায় চিৎকার করে বলল, ‘মারিয়া আপা ও আহমদ মুসা ভাইয়ের ঐতিহাসিক বিয়ে যদি ক্যামেরুনে হয়, ধন্য হবে ক্যামেরুন’।
‘ঠিক বলেছ ভাইয়া। ক্যামেরুনের মুসলিম সমাজের জন্যে এর চেয়ে বড় আনন্দ আর কিছু হয়নি, আর হবেও না। তবে ভাইয়া বিয়েটা কিন্তু আমাদের বাড়িতে হতে হবে। রোসেলিন চাইবে বিয়ে, তাদের বাড়িতে হোক। তুমি রোসেলিনের পক্ষে যেতে পারবে না’। উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলল লায়লা।
আহমদ মুসা গম্ভীর। কোন কথা বলল না।
এ সময় এদিনের খবরের কাগজ দিয়ে গেল বেয়ারা এসে।
খবরের কাগজ রাশিদী ইয়েসুগোই তুলে নিল প্রথম হাতে। কাগজ হাতে নিয়ে প্রথম পাতায় চোখ বুলিয়েই চিৎকার করে উঠল রাশিদী।
‘ভাইয়া সর্বনাশ হয়ে গেছে’। কেঁপে উঠেছিল রাশিদীর কণ্ঠ।
‘কি হয়েছে রাশিদী? কিসের সর্বনাশ?’ আহমদ মুসার কণ্ঠে বিস্ময়।
রাশিদী তখন হুমড়ি খেয়ে পড়েছে একটা নিউজের উপর। পড়ছে নিউজ সে। মুহূর্ত কয়েক পরে কিছু না বলে শুকনো মুখে কাগজটি এগিয়ে দিল আহমদ মুসার দিকে।
খবরের কাগজ হাতে নিয়ে প্রথম পাতায় চোখ বুলাতেই চোখে পড়ল নিউজটা। হেডিংটা পড়ে বেদনায় পাংশু হয়ে গেল আহমদ মুসার মুখ।
নিউজের হেডিং-এ বলা হয়েছেঃ
ভয়াবহ বিষ্ফোরণে বারবারেতির ইসলামী সম্মেলন কেন্দ্র উড়ে গেছে। সম্মেলনের সকল মেহমান ও নেতৃবৃন্দ নিহত।
রুদ্ধশ্বাসে নিউজটা পড়ল আহমদ মুসাঃ ‘সম্মেলনের অধিবেশন চলাকালে গতকাল রাত ৯টা ৩ মিনিটে ভয়াবহ এক বিষ্ফোরণে গোটা সম্মেলন কেন্দ্র উড়ে গেছে এবং বিশ্ব মুসলিম কংগ্রেসের প্রধান শেখ আবদুল্লাহ আলী আল রাশিদ মাদানীসহ উপস্থাত সকল মেহমান নিহত হয়েছেন।
ঘটনার বিবরণে বলা হয়েছে, ‘সম্মেলনের দ্বিতীয় রুদ্ধদ্বার সেশনের সমাপ্তি পর্বে এই বিষ্ফোরণের ঘটনা ঘটে। সম্মেলনে দুই শতাধিক ডেলিগেট এবং প্রায় একক ডজন বিদেশী বিশিষ্ট মেহমানের সকলেই বিষ্ফোরণে নিহত হয়েছেন বলে নিশ্চিত জানা গেছে। রুদ্ধদ্বার হলে উপস্থিত কেউ বেঁচেছে বলে প্রত্যক্ষ দর্শীর কোন বিবরণ পাওয়া যাচ্ছে না। শুধু মূল সম্মেলন কক্ষ নয়, ঐ সম্মেলন ভবনে যারা ছিল, তাদের দেহও বিষ্ফোরণে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন ও ভষ্মিভূত হয়েছে। ভবনের আশেপাশের লোকদের আহত অবস্থায় পাওয়া গেছে। সম্মেলনের প্রোগ্রাম থেকে জানা যাচ্ছে, অধিবেশন সমাপ্ত হবার কথা রাত ৯টায়। তারপেরই এশার নামায হবার কথা। মনে করা হচ্ছে, নামাযের জন্যে সম্মেলনের মেহমান ও নেতৃবৃন্দ যখন মঞ্চের পেছনে এসছিলেন এবং ডেলিগেটরাও যখন তৈরী হচ্ছিল নামাযের জন্যে, সেই সময় বিষ্ফোরণটি ঘটে। সম্মেলনের প্রোগ্রাম থেকে দেখা যাচ্ছে, বিষ্ফোরণের সময় সম্মেলন কক্ষে বিশ্ব মুসলিম কংগ্রেসের প্রধান শেখ আবদুল্লাহ আলী আল রাশিদ মাদানী, মুসলিম যুব সম্মেলনের প্রেসিডেন্ট কামাল ইনুনু, মিসরের আল আজহারের গ্রান্ড শেখ সাইয়েদ আলী কুতুব প্রমুখ ১২জন বিশ্ব বরেণ্য মুসলিম ব্যক্তিত্ব হাজির ছিলেন। তাছাড়া ছিলেন ‘ডার্ক আফ্রিকা ব্রাইট হার্ট’ সংগঠনের সভাপতি তারেক আল মাহদি সুদানী সহ কয়েকজন নেতা। অনুমান করা হচ্ছে বিষ্ফোরণে সকলের মর্মান্তিক প্রাণ বিয়োগ ঘটেছে। প্রায় ধুলো হয়ে যাওয়া ধ্বংস স্তুপে কোন জীবনের অস্তিত্ব তো দূরে থাক, কোন আস্ত দেহের অস্তিত্বও কোথাও আছে বলে মনে করা হচ্ছে না।
এই ধরনের ধ্বংসাত্মক বিষ্ফোরণের ঘটনা আফ্রিকার সাম্প্রতিক ইতিহাসে নেই। স্থানীয় বিশেষজ্ঞদের ধারণা, সম্পূর্ণ নতুন ধরনের দূরনিয়ন্ত্রিত বোমায় ভবনটিক ধ্বংস করা হয়েছে।
ঘটনাকে নাশকতা বলে সবাই মনে করছেন। কিন্তু কারা এই নাশকতামূলক কাজের সাথে জড়িত থাকতে পারে, এ ব্যাপারে কেউ কিছু বলতে পারছে না। উদ্যোক্তা ‘ডার্ক আফ্রিকা ব্রাইট হার্ট’ এবং স্থানীয় মুসলিম সংগঠনের যাদের পাওয়া গেছে, তারা বলেছেন এ ধরনের কাজ করতে পারে, এমন সন্দেহজনক কেউ তাদের নজরে নেই। সম্মেলনের ব্যাপারে কারো বিরোধিতা তো দূরে, সামান্য অসন্তুষ্টি বা দ্বিমতও কারও মধ্যে তারা দেখেননি’।
খবর পড়া শেষ হলেও আহমদ মুসার চোখ কাগজের উপর থেকে সরে এল না। যেন তার চোখ দু’টি আটকে গেছে কাগজের সাথে।
বিষ্ময় ও বেদনার ধাক্কায় তার চিন্তার শক্তি যেন থেমে গেছে, বোবা হয়ে গেছে যেন সে।
এক সময় তার হাত থেকে কাগজটা পড়ে গেল।
সম্বিত ফিরে পেয়ে আহমদ মুসা একটু নড়ে-চড়ে উঠে সোফায় গা এলিয় দিল। একটা ক্লান্তি এসে তাকে ঘিরে ধরল। চোখ বুজল সে। চোখ বুজতেই তার মনটা ছুটে গেল দু’শ বছর আগের একটা ঘটনার দিকে সেদিনও একটা বিষ্ফোরণ এ ধরনেরই একটা সম্মেলন পন্ড করে দিয়েছিল। দুই ঘটনার মধ্যে পার্থক্য হলো, দু’শ বছর আগের বিষ্ফোরণ সংঘটিত সম্মেলনের আগে এবং তাতে বিদেশী মেহমান কেউ মারা যায়নি। আর এ বিষ্ফোরণ সংঘটিত হলো সম্মেলন চলাকালে এবং তাতে নিহত হলেন ডজন খানেক গুরুত্বপূর্ণ মেহমান।
এটুকু পার্থক্য থাকলেও দু’টি ঘটনা একই ধরনের এবং উদ্দেশ্যও নিঃসন্দেহে এক। তাহলে কি ধরে নয়া যায়, একই ধরনের লোক এই দুই ঘটনা ঘটিয়েছে?
চোখ খুলল আহমদ মুসা।
রাশিদী, ইয়েকিনি, লায়লা বিমূঢ় হয়ে পড়েছিল। তাকিয়েছিল আহমদ মুসার দিকে।
আহমদ মুসাই প্রথমে মুখ খুলল। বলল, ‘দু’শ বছর আগের ঘটনারই আবার পুনরাবৃত্তি ঘটল’।
অনেকটা স্বগত কণ্ঠে উচ্চারণ করল আহমদ মুসা।
‘তাহলে কি একই ধরনের শত্রুর কাজ?’ বলল রাশিদী ইয়েসুগো।
সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু নিউজে ওখানকার দায়িত্বশীলরা এটা সরাসরি স্বীকার করেননি’। আহমদ মুসা বলল।
‘দুর্ভাগ্য বারবারেতির বিশেষ কোন দুর্ভাগ্য নয়। ক্যামেরুনে মুসলমানদের যে দুর্ভাগ্য বারবারেতির। এমন দুর্ভাগ্য মনে হয় আফ্রিকার আর কোন নগরীর হয়নি’। বলল রাশিদী ইয়েসুগো।
‘বারবারেতির বিশেষ কোন দুর্ভাগ্য নয়। ক্যামেরুনে মুসলমানদের যে দুর্ভাগ্য দেখছ, তারই অন্য একটা রূপ দেখতে পাচ্ছ বারবারেতিতে। মৌলিক কোন পার্থক্য নেই দুইয়ের মধ্যে’। আহমদ মুসা বলল।
‘বিরাট ক্ষতি হলো মুসলিম বিশ্বের। বিশ্ব মুসলিম কংগ্রেসের প্রধান আবদুল্লাহ আলী, আল আজহারের গ্রান্ড শেখ সাইয়েদ আলীর ক্ষতিপূরণ হবে কি দিয়ে? বিশেষ করে ‘ডার্ক আফ্রিকা ব্রাইট হার্ট’-এর তারেক আল মাহদীর মত আগুনের ছেলেকে মুসলিম আফ্রিকা আবার কবে পাবে কে জানে!’ বলতে বলতে রাশিদী ইয়েসুগোর গলা ভেঙ্গে পড়ল কান্নায়।
‘হ্যাঁ রাশিদী, এ দিক থেকে এটা যে কত বড় ক্ষতি তা পরিমাপ করা যায় না। মন চাচ্ছে, ওদিকে একবার যাই। এতবড় ঘটনা ঘটাতে যারা সাহস পেল তারা অনেক বড় শত্রু’।
‘কে এই বড় শত্রু বুঝতে পারছি না আহমদ মুসা ভাই। ‘ওকুয়া এবং ‘কোক’ মধ্য ও পশ্চিম আফ্রিকার সবচেয়ে বড় সংগঠন। মনে হচ্ছে এই দু’টো সংগঠন আজ যে অবস্থায় পড়েছে, তাতে ঐ ঘটনা ওরা ঘটায়নি। আর যতদূর জানি, মধ্য আফ্রিকা প্রজাতন্ত্রে বড় ধরনের কোন সন্ত্রসী সংগঠন নেই’।
‘কিন্তু ঘটনা তো ঘটেছে। কোন বড় কেউই তা ঘটিয়েছে’।
বলে আহমদ মুসা একটু থামল। তারপর বলল, ‘চল, ক্যামেরুন ক্রিসেন্টের অফিসে যাই। ফ্রান্সিস বাইকদের সাথে একটু কথা বলে দেখি, কোন কথা বের করা যায় কিনা’।
আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল।
তার সাথে সাথে সবাই।

ক’দিন পরের ঘটনা।
রাশিদী ইয়েসুগো একটা খবরের কাগজ হাতে ঘরে ঢুকে কাগজটা আহমদ মুসার হাতে তুলে দিল। একটা নিউজের দিকে ইংগিত করে বলল, ‘নিউজটা পড়ুন আহমদ মুসা ভাই, সুন্দর নিউজ’।
আহমদ মুসা সোফায় গা এলিয়ে বসেছিল। কাগজটা হাতে নিয়ে সোজা হয়ে বসল। নিউজের উপর নজর দিল আহমদ মুসা।
হেডিং পড়লঃ
“এক সাক্ষাৎকারে আইনমন্ত্রী”
“ক্যামেরুনে বর্তমানে মানবাধিকার পরিস্থিতি চমৎকার”
পড়ল আহমদ মুসা খবরটা। খবরে বলা হয়েছে, “ক্যামেরুনের গণতান্ত্রিক সরকার দেশের প্রতিটি নাগরিকের নাগরিক অধিকারের প্রতি সতর্ক দৃষ্টি রেখেছে। ক্যামেরুনে বর্তমানে মানবাধিকার পরিস্থিতি অত্যন্ত চমৎকার। সরকার দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় দৃঢ় প্রতিজ্ঞ’। ক্যামেরুনের আইনমন্ত্রী মিঃ হাম আগবো ‘সানস অব অ্যাডাম’ নামক একটা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থার একটি প্রতিনিধি দলকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে এই মন্তব্য করেন। সম্প্রতি সংবাদ মাধ্যম ও সংবাদপত্রের প্রচারিত দক্ষিণ ক্যামেরুনে মুসলমানদের উচ্ছেদ ও তাদের সম্পত্তি গ্রাসের বিষয়ে আইন মন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বলেন, এই ধরণের ঘটনা কিছু ঘটেছে। এর সাথে জড়িত বেসরকারী দু’একটা সংগঠন। সরকার এ সবের কিছুই জানত না। এ সংক্রান্ত খবরটি বের হবার পর সরকার এ ব্যাপারে খোঁজ খবর নিয়েছে এবং উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসন, তাদের জমি তাদেরকে ফিরিয়ে দেয়া এবং এমনকি তাদের ক্ষতি পূরণেরও ব্যবস্থা হয়েছে।’ এ ধরণের দু’চারজন পুনর্বাসিত উদ্বাস্তুর সাথে কি তারা দেখা করতে পারে না- এমন একটি প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, দু’চারজন কেন আমরা লিস্ট দিয়ে দিতে পারি, আপনারা যত ইচ্ছা দেখা করতে পারেন।’ এমন ঘটনা ভবিষ্যতে যাতে ঘটতে না পারে, তার জন্যে আপনারা কি বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করছেন- এই প্রশ্নে আইন মন্ত্রী বলেন, ‘হ্যা বিষয়টা নিয়ে আমরা চিন্তা করেছি। আমরা আইন করতে যাচ্ছি, সংখ্যালঘু বিশেষ করে মুসলমানদের জমি হস্তান্তর করতে হলে জাতীয় ধরণের কেন্দ্রীয় কোন মুসলিম সংগঠনের অফিসিয়াল সার্টিফিকেট লাগবে। কোন অমুসলিম এ ধরণের সার্টিফিকেট ছাড়া কোন মুসলমানের সম্পত্তি কিনতে পারবে না। তাছাড়া বাস্তুভিটা ক্রয়-বিক্রয় আমরা নিষিদ্ধ করতে যাচ্ছি।’ সম্পত্তি হস্তান্তর এবং উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসন করতে গিয়ে আপনারা শক্তিশালী এনজিওদের পক্ষ থেকে কোন বাধার সম্মুখীন হয়েছেন কিনা, এ প্রশ্নের জবাবে আইন মন্ত্রী জানান, এনজিওদের পক্ষ থেকে কথা উঠেছিল, কিন্তু তাদেরকে আমরা দেখিয়েছি যে, জমি হস্তান্তরের ব্যাপারটা শান্তিপূর্ণ ও স্বেচ্ছা প্রণোদিত ছিল। কোন জোরাজুরির ঘটনা ঘটেনি।’’
খবরটা পড়া শেষ করে আহমদ মুসা বলল, ‘সানস অব অ্যাডাম’ সংস্থাকে ধন্যবাদ জানাতে হয়। প্রয়োজনীয় সব কথাই ওরা বের করে নিয়েছে সরকারের মুখ থেকে। রোসেলিনের আব্বা চীফ জাস্টিসের অবদানই অবশ্য এক্ষেত্রে বেশী। তিনিই সরকারকে এভাবে তৈরী করার ব্যবস্থা করেছেন আইন সচিব লাউস মেইডি’র মাধ্যমে।’
‘তবে ‘সানস অব অ্যাডাম’ও আমাদের যথেষ্ট উপকার করল। কে এই ‘সানস অব অ্যাডাম’?’ বলল রাশিদী ইয়েসুগো।
‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক একটা মানবাধিকার সংস্থা।’ বলল আহমদ মুসা।
‘এ টুকুই কি এর পরিচয়?’ বলল রাশিদী ইয়েসুগো।
‘তুমি ঠিকই ধরেছ। এ টুকুই এর পরিচয় নয়। এটা আমেরিকার একটা মুসলিম মানবাধিকার সংস্থা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আফ্রো-আমেরিকান মুসলিম কম্যুনিটি এই সংস্থাটির প্রতিষ্ঠা করেছে। তবে তারা সামনে নেই। খৃষ্টান ও মুসলিম কিছু শিক্ষাবিদ ও আইনবিদকে নিয়ে এই সংস্থাটি গঠিত হয়েছে। এই সংস্থাটির মূল শ্লোগান হলোঃ ‘আদমের সন্তান আমরা সকরে সমান’।’
‘তারা কি ক্যামেরুনের সব জেনেই এখানে এসেছে।’ বলল মুমাম্মাদ ইয়েকিনি।
‘হ্যা।’
‘আপনি কি জানতেন তারা আসবে?’ বলল মুহাম্মাদ ইয়েকিনিই আবার।
‘জানি, আবার জানিও না।’
‘সেটা কেমন?’ বলল রাশিদী ইয়েসুগো।
‘FWTV এবং WNA –এর মাধ্যমে নিউজ করা, মুসলিম মানবাধিকার সংস্থার এ ধরণের সফর ইত্যাদি ‘মুসলিম শ্লোগান প্রোপাগান্ডা প্লানিং’ (MGPP) এর অংশ। সুতরাং বলা যায়, আমি জানি তারা আসবে।’
‘তাদের সাথে আপনি কথা বলবেন না?’ বলল ইয়েকিনি।
‘এ ধরণের সাক্ষাৎ কৌশলগত কারণে সব সময় নিষিদ্ধ। যার কাজ সে করবে, এটাই নিয়ম।’
‘বুঝলাম।’
‘আহমদ মুসা কথা বলছিল আর কাগজে নজর বুলাচ্ছিল। হঠাৎ তার চেহারা পাল্টে গেল। কোন কিছুর প্রতি তার নজর হঠাৎ করেই যেন আটকে গেল। কিছু পড়ছে সে।
মুহূর্ত কয়েক পরে কাগজ থেকে মুখ তুলে আহমদ মুসা ‌‌‌ব‌‌লল, ’দেখ অদ্ভুত একটা বিজ্ঞাপন।’
বলে আহমদ মুসা কাগজের ঐ অংশটি সবার সামনে তুলে ধরল।
সবাই পড়ল বিজ্ঞাপনটা। ছোট্ট বিজ্ঞাপন, কিন্তু শিরোনামটা বেশ বড়। পাতার উপর চোখ বুলালে প্রথম দৃষ্টিতেই চোখে পড়ে। বিজ্ঞাপনের শিরোনাম হলোঃ
‘বারবারেতির ভয়াবহ বিস্ফোরণ সম্পর্কে আগ্রহীদের জ্ঞাতব্য।’
এই শিরোনামের অধীনে বিজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, ‘‘বিজ্ঞাপন-দানকারী ‘নিউজ ব্যাংক’ একটি সৌখিন সংস্থা। এই সংস্থা দাতব্য কাজে সহযোগিতার লক্ষ্যে নিউজ এবং নিউজ উপকরণ বিক্রি করে থাকে। এই উদ্দেশ্যে বড় বড় ঘটনা এক দেশ, জাতি ও সংস্কৃতি সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ নিউজ, নিউজ পটভূমি ও নিউজ উপকরণ ‘নিউজ ব্যায়’ সংগ্রহ করে থাকে। বারবারেতি’র ভয়াবহ ঘটনা সম্পর্কেও করেছে। আগ্রহী ক্রেতাগণ নিম্ন ঠিকানায় যোগাযোগ করুন।’’
বিজ্ঞাপনের নিচে ঠিকানা বলতে দু’টি টেলিফোন নম্বার দেয়া হয়েছে। একটা নাইরোবির, আরেকটা মধ্য আফ্রিকা প্রজাতন্ত্রের রাজধানী বাংগুই-এর।
বিজ্ঞাপনটি পড়ে রাশিদী ইয়েসুগো বলল, ‘মজার বিজ্ঞাপন। এমন সংস্থান নাম কোনদিন শুনিনি।’
কিন্তু রাশিদী ইয়েসুগোর কথা আহমদ মুসার কানে প্রবেশ করল বলে মনে হলো না। সে সোফায় গা এলিয়ে দিয়েছে। চোখে তার শূণ্য দৃষ্টি। যেন কোথাও হারিয়ে গেছে তার মন।
মুহাম্মাদ ইয়েকিনি কিছু বলতে যাচ্ছিল। রাশিদী ইয়েসুগো আংগুল তুলে থামিয়ে দিল ইয়েকিনিকে।
ইয়েকিনিও ব্যাপারটা লক্ষ্য করল। চুপ করে গেল সে। দু’জনেই বুঝল গুরুত্বপূর্ণ কোন চিন্তায় ডুব দিয়েছে আহমদ মুসা। কিছুক্ষণ পর আহমদ মুসা ঘুম থেকে জেগে ওঠার মত নড়ে উঠল। রাশিদী ইয়েসুগোর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘গোটা বিজ্ঞাপনটা একবার পড়তো।’
রাশিদী ইয়েসুগো পড়ল বিজ্ঞাপনটা।
পড়া শেষ করেই বলল, ‘বিজ্ঞাপন নিয়ে ভাবছেন কিছু আহমদ মুসা ভাই? কিছু কি আমরা কিনব ওদের কাছ থেকে?’
‘দেখ তো সবগুলো কাগজে এ বিজ্ঞাপন আছে কিনা।’ বলল আহমদ মুসা।
রাশিদী এবং ইয়েকিনি দু’জনে মিলে সবগুলো কাগজ তন্ন তন্ন করে দেখল। বলল রাশিদী, ‘ফরাসী ভাষায় সবগুলো কাগজে আছে। স্থানীয় ভাষায় কোন কাগজে নেই।’
‘আমাদের হাতের ‘দি লাইট’ ছাড়া অন্য কাগজগুলো বিজ্ঞাপনটা কোন পাতায় ছেপেছে?’ আহমদ মুসা বলল।
‘শেষ পাতায়।’ বলল রাশিদী।
‘অর্থাৎ একমাত্র ‘দি লাইট’ বিজ্ঞাপনটি প্রথম পাতায় ছেপেছে।’ বলল আহমদ মুসা।
‘তাই। কিন্তু এতে কি হয়েছে?’ বলল রাশিদী।
‘বলব।’ বলে একটু থামল আহমদ মুসা। একটু পর বলল, ‘রাশিদী বিজ্ঞাপনে নাইরোবির যে টেলিফোন নম্বার দেয়া হয়েছে, সেখানে টেলিফোন কর। জানতে চাও কি কি নিউজ রিপোর্ট এবং ফটোগ্রাফ তাদের কাছে পাওয়া যাবে। পরিচয় জিজ্ঞেস করলে বলবে, ক্রিসেন্ট ফটোগ্রাফিক সোসাইটি।’
‘কিন্তু নাইরোবিতে কেন? ‘বাংগুই’ তো আমাদের কাছেই।’ বলল রাশিদী ইয়েসুগো।
‘প্রয়োজন আছে। যা বলেছি তা করো।’
রাশিদী তার পাশ থেকে সেলুলার টেলিফোনটি তুলে নিল। ডায়াল করল। কথা বলল।
কথা শেষ করে টেলিফোন অফ করে দিল রাশিদী।
আহমদ মুসার ঠোঁটে এক টুকরো হাসি। বলল রাশিদীকে লক্ষ্য করে, ‘ওরা বিজ্ঞাপন সম্পর্কে কিছুই জানেনা না?’
‘ঠিক বলেছেন। আপনি তাহলে ধরে ফেলেছেন। কিন্তু জানে না কেন?’
‘কারণ বিজ্ঞাপন দাতারা ধরণাই করেনি যে, বাংগুই ছেড়ে কউ নাইরোবিকে জিজ্ঞেস করতে যাবে।’
‘কিছুই বুঝতে পারছি না আহমদ মুসা ভাই।’ বলল ইয়েসুগো।
‘বলব। তুমি বাংগুই-এর নম্বারে টেলিফোন কর। ‘ক্রিসেন্ট ফটোগ্রাফিক সোসাইটি’র ঠিকানা তাদের জানাবে না।’
‘সোসাইটি নেই, ঠিকানা থাকবে কি করে?’ হেসে বলল রাশিদী।
রাশিদী বাংগুই-এর নম্বারে ডায়াল করল। কথা বলল।
কথা শেষ করে টেলিফোন অফ করে রাশিদী মুখ ঘোরাল আহমদ মুসার দিকে।
‘ওখানে তাহলে কিছুই মিলল না?’ হেসে বলল আহমদ মুসা।
‘মিলেছে। ইয়াউন্ডির ওদের একটা পোস্ট বক্স নম্বার।’ বলল রাশিদী ইয়েসুগো।
‘এই ঠিকানায় বুঝি সব জেনে নিতে বলেছে? আর কি বলল ওরা?’ আহমদ মুসা বলল।
‘ঠিক ধরেছেন। পোস্ট বক্স নম্বার দিয়ে বলেছে, ওখানে যোগাযোগ করলেই সব জানা যাবে।’
উত্তরে কোন কথা বলল না আহমদ মুসা। তার কপাল কুঞ্চিত। চিন্তা করছিল। ধীরে ধীরে গা সোফায় এলিয়ে দিল সে। চোখও তার বুজে গিয়েছিল।
‘কিছু ভাবছেন আহমদ মুসা ভাই?’ বলল রাশিদী ইয়েসুগো।
‘একটা রহস্যের সন্ধান করছি।’
‘রহস্য? কোথায়?’ রাশিদী ইয়েসুগো বলল।
‘বিজ্ঞাপন থেকে শুরু করে তোমার শেষ কথা পর্যন্ত একটা রহস্য ছড়িয়ে আছে।’
‘বুঝলাম না।’ রাশিদী ইয়েসুগো বলল।
‘আমিও।’ ইয়েসুগোর কথায় সায় দিল মুহাম্মাদ ইয়েকিনি।
‘শেষটার কথাই ধর। ও ধরণের একটা সংস্থার কোন একটা রাজধানীর ‘যোগাযোগ’ পয়েন্টে টেলিফোন থাকবে না, এটা বিশ্বাস যোগ্য নয়। সাধারণভাবে মনে করা হয় যারা তাদের ঠিকানা আড়ালে রাখতে চায় তারা পোস্ট বক্স নম্বরের ব্যবস্থা করে। তারা তাই করেছে। কিন্তু ও ধরনের একটা সংস্থা এই ভাবে লুকোচুরি খেলবে কেন?’ থামল আহমদ মুসা।
‘ঠিক, এটা একটা রহস্য। তারপর?’ বলল মুহাম্মাদ ইয়েকিনি।
‘নাইরোবির কথা চিন্তা কর। ওরা ওই বিজ্ঞাপন সম্পর্কে কিছুই জানে না। কিন্তু এটা স্বাভাবিক নয়। এ থেকে প্রমাণ হয়, নাইরোবিতে কেউ যোগাযোগ তা তারা মনে করেনি কিংবা চায়নি যে কেউ সেখানে যোগাযোগ করুক। তাই তারা নাইরোবিকে কিছুই জানায়নি।’
‘তাহলে নাইরোবির ঠিকানাটা দিল কেন?’ বলল রশিদী ইয়েসুগো।
‘নাইরোবি একটা আন্তর্জাতিক শহর। তাদের বিশ্বাসযোগ্যতা সৃষ্টির জন্যই তারা নাইরোবির সুনামকে কাজে লাগিয়েছে।’
‘অর্থাৎ এই বিজ্ঞাপনের টার্গেট গোটা দুনিয়া নয়, বরং একটা বিশেষ অঞ্চল।’ বলল মুহাম্মদ ইয়েকিনি।
‘ঠিক বলেছ। কিন্তু বলত সেই অঞ্চল কোনটা?’ বলল আহমদ মুসা।
ইয়েকিনি মুখ খোলার আগেই রাশিদী ইয়েসুগো বলল, আমার মনে হয় আফ্রিকার মধ্য পশ্চিমাঞ্চল সেটা।’
‘ধন্যবাদ রাশিদী। ঠিক ধরেছ।’
‘এবার বিজ্ঞাপনের রহস্যের কথা বলুন আহমদ মুসা ভাই।’
‘একটু মনোযোগী হলে রহস্যটা তোমাদেরও নজরে পড়তো। দেখ, বিজ্ঞাপনটা প্রকাশ হয়েছে শুধু ফরাসী ভাষার কাগজে। দ্বিতীয় লক্ষণীয় বিষয় হলো, বিজ্ঞাপনটা শুধু দি লাইট পত্রিকার পাতায় ছাপা হয়েছে, ফরাসী অন্যান্য পত্রিকায় ছাপা হয়েছে শেষ পাতায়।’ একটু থামল আহমদ মুসা।
এই সুযোগে রাশিদী ইয়েসুগো বলল, ‘এই দু’টি বিষয় থেকে আমরা কি বুঝতে পারি?’
‘ভাষার সিলেকশন থেকে বুঝা যায় বিজ্ঞাপনটি বিদেশীদের জন্যে প্রচার করা হয়েছে। আর ‘দি লাইট’ কে গুরুত্ব দেয়া থেকে বুঝা যায়, বিজ্ঞাপনটির লক্ষ্য মুসলিম সমাজ।’
‘বিজ্ঞাপনটি মুসলিম সমাজের জন্য হবে কারণ বিস্ফোরণের সাথে মুসলিম স্বার্থ জড়িত। কিন্তু তাহলে বিজ্ঞাপনটি বিদেশীদের জন্যে হবে কেন?’ বলল রাশিদী ইয়েসুগো।
‘প্রশ্ন আরও একটা আছে, তাদের নাইরোবি অফিস বিজ্ঞাপন সম্পর্কে কিছু না জানা থেকে বুঝা যায়, বিজ্ঞাপনটা বাইরের বিদেশী মুসলমানদের জন্য নয়। টার্গেট হলো, এই অঞ্চলের বিদেশী মুসলমান। এর অর্থ কি?’
‘প্রশ্নগুলো সত্যি রহস্যের সৃষ্টি করছে। এই রহস্যের সমাধান কি?’ বলল মুহাম্মদ ইয়েকিনি।
‘সমাধান করতে হবে।’
‘কিভাবে?’ রাশিদী ইয়েসুগো বলল।
‘অবলম্বন হলে বাংগুই থেকে পাওয়া পোস্ট বক্স নম্বর। ঐ নম্বরে একটা চিঠি ফেলে দাও। তবে তোমরা নাম ঠিকানা দেবে না, দেবে পোস্ট বক্স নম্বর।’
‘আমরা ঠিকানা দেব না কেন?’ বলল মুহাম্মাদ ইয়েকিনি।
‘কিছু না। ওদের সমান থাকা আর কি।’
‘যোগাযোগ করে ওদের কি বলব?’ বলল রাশিদী ইয়েসুগো।
‘লিখে ওদের জানাও কি কি ফটো এবং নিউজ আছে। তারপর অবস্থা বুঝে যা হয় তা করা হবে।
বলে আহমদ মুসা ঘড়ির দিকে তাকাল। সময়টা দেখে নিয়ে বলল, ‘চল উঠি, আমাদের একটা প্রোগ্রাম আছে না?’
‘চিঠিটা তাহলে তো লিখে ফেলতে হয়।’ বলল রাশিদী ইয়েসুগো।
‘অবশ্যই। চল আমাদের দেরী হয়ে যাচ্ছে।’
বলে আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল। তার সাথে সবাই।
পোস্ট বক্সে চিঠি ছাড়ার পঞ্চম দিনেই পোস্ট বক্সের মাধ্যমে ফিরতি চিঠি পেয়েছিল আহমদ মুসারা। চিঠিতে মাত্র কয়েকটা বাক্য লেখা ছিলঃ “আমাদের সংস্থা ইয়াউন্ডিতে নতুন। অস্থায়ীভাবে এক জায়গায় বসছি। টেলিফোন নেই। ইয়াউন্ডি সার্কুলার বি-৩ এর ৬৩ নম্বর ঠিকানায় যোগাযোগ করলে সব জানতে পারবেন।”
চিঠি পড়ে একটু ভেবেছিল আহমদ মুসা। তারপর ইয়েকিনির দিকে তাকিয়ে বলেছিল, ‘তাদের সাথে কথা বলার দায়িত্ব তুমি গ্রহণ কর।’
দায়িত্ব পেয়ে আনন্দিত হয়েছিল ইয়েকিনি। ধন্যবাদ দিয়েছিল আহমদ মুসাকে। সব দায়িত্বই সব সময় আহমদ মুসা নিজের কাঁধে তুলে নেয়। তার কাছ থেকে দায়িত্ব পাওয়া সৌভাগ্যের ব্যাপার। ইয়েকিনি আরও আনন্দিত হয়েছিল এই কারণে যে, বিষয়টার সাথে রহস্যের গন্ধ আছে।’ ভাড়া গাড়ি নিয়েছিল মুহাম্মাদ ইয়েকিনি।
ইয়াউন্ডি শহরটা মুহাম্মাদ ইয়েকিনির প্রায় মুখস্থ। ইয়াউন্ডি সার্কুলার বি-৬৩ সড়কটি শহরের উত্তর পশ্চিম প্রান্তে। আর ৬৩ নম্বরটি হবে সড়কটির মাঝ বরাবর।
গাড়িটা মুহাম্মাদ ইয়েকিনি ঠিক ঠিক ৬৩ নম্বরেই নিয়ে দাঁড় করাল।
একটা গেটের সামনে গিয়ে গাড়ি দাঁড়াল। গেট বন্ধ।
ইয়েকিনি গাড়ি থেকে নেমে গেট রুমের দিকে এগিয়ে গেল।
গেটম‌্যান গলা বাড়াল গেট রুমের জানালা দিয়ে।
‘এখানে তো ‘নিউজ ব‌্যাংক’-এর অফিস’। বলল ইয়েকিনি।
‘হ্যা। কেন?’ বলল গেট ম‌্যান।
‘ওদের সাথে আমার এখন দেখা করার কথা।’
কয়েক মুহুর্তের জন্যে তার মাথাটা গেটের ভেতরে চলে গেল।
তারপর মাথাটা মুহুর্তের জন্যে বের করে বলল, ‘আসছি।’
গেট খুলে গেল।
ইয়েকিনি গাড়ি ছেড়ে দিয়ে ভেতরে ঢুকে গেল।
সামনে একটা চত্ত্বর। তারপরেই বারান্দা। বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিল একজন কৃষ্ণাঙ্গ।
সে এগিয়ে এসে ইয়েকিনিকে স্বাগত জানাল। বলল, ‘আপনি মিঃ ইয়েকিনি?’
‘হ্যাঁ।’
‘আসুন, আমরা আপনার জন্যে অপেক্ষা করছি।’
লোকটির সাথে এগিয়ে গিয়ে ইয়েকিনি প্রবেশ করল একটা কক্ষে। কক্ষটি বেশ প্রশস্ত। কক্ষটির চারদিকে একবার তাকিয়েই বুঝতে পাল নতুন বা তাড়াহুড়ো করে সাজানো একটা অফিস।
একটা বড় টেবিলের ওপাশে একটা চেয়ারে বসে একজন শ্বেতাংগ যুবক।
ইয়েকিনি ঘরে ঢুকতেই যুবকটি উঠে দাঁড়িয়ে এগিয়ে এসে স্বাগত জানাল ইয়েকিনিকে।
খাতিরটা একটু বেশীই মনে হলো, অন্তত আফ্রিকান স্ট্যান্ডার্ডে। ভাবল আবার ইয়েকিনি, নতুন অফিস তো। ক্লায়েন্টের প্রতি খাতির তাই বেশীই হতে পারে।
শ্বেতাঙ্গ যুবকটি হ্যান্ডশেক করে বলল, ‘আমি আয়ান ফ্লেমিং।’
বসার পর কথা শুরু হলো।
‘আপনার সংস্থার নাম কি যেন? হ্যাঁ, ক্রিসেন্ট ফটোগ্রাফিক সোসাইটি। আপনারা কি মুসলমানদের স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট ফটোগুলোই শুধু যোগাড় করেন?’ বলল যুবকটি, আয়ান ফ্লেমিং।
‘প্রধানত তাই।’ বলল ইয়েকিনি।
‘দেশের বাইরে থেকে কিভাবে ফটো যোগাড় করেন?’ আয়ান ফ্লেমিং বলল।
‘আমরা খুবই সূচনা পর্বে। সবে কাজ শুরু করেছি। বাহিরকে নিয়ে এখনও খুব চিন্তা আমরা করিনি।’
মুখে কথাগুলো বললেও মনে মনে বলল, ক্রিসেন্ট ফটোগ্রাফিক সোসাইটিই নেই, তার আবার ফটো যোগাড়।
মিথ্যা কথাগুলো যে অবলীলাক্রমে বলতে পারল ইয়েকিনি, তাতে নিজেই বিস্মিত হলো সে। তবে সান্ত্বনার কথা এই যে, আহমদ মুসা ভাই বলেছেন, শত্রুর কাছে বা সন্দেহজনক কারো কাছে সত্য গোপন করা অন্যায় নয়।
‘ফটো সংগ্রহের জন্য সবচেয়ে বেশী প্রয়োজন যোগাযোগ। কোথায় কি হচ্ছে, নিউজ মেকার কে আসছে, কে যাচ্ছে, তা নখদর্পণে রাখতে হয়। আপনাদের এ কাজগুলো করার ধরন কি?’ বলল আয়ান ফ্লেমিং।
‘কয়েকজন ফটোগ্রাফার মাত্র আমাদের অবলম্বন।’ বলল ইয়েকিনি।
‘আমাদের ‘নিউজ ব্যাংক’-এর কাজ আপনাদের মতই। পার্থক্য হলো, আপনারা শুধু কেনেন, আর আমরা ক্রয়-বিক্রয় দু’টাই করি। গুরুত্বপুর্ণ ফটো কেনার জন্যে আমরা এমনকি বিদেশেও ছুটে যাই।’
থামল আয়ান ফ্লেমিং। মুহুর্ত কয়েক পর আবার শুরু করল, ‘আপনাদের সংগ্রহে কি তেমন ফটো আছে যা আমরা কিনতে পারি? থাকলে আমরা যেমন আপনার কাছে বিক্রি করছি, তেমনি কিনতেও পারি।’
‘বুঝতে পারছি না, কি ধরনের ফটোর কথা বলছেন?’
‘যেমন ধরুন আহমদ মুসার মত দুর্লভ কোন ব্যাক্তিত্বের সাথে কোন ঘটনার ছবি। তিনি বিশ্ব ব্যাপী আকর্ষণের কেন্দ্র।’
আয়ান ফ্লেমিং-এর মুখে আহমদ মুসার নাম শুনে বিস্ময়ের চেয়ে ভয়ই বেশী পেল ইয়েকিনি। বিজ্ঞাপন ঘিরে যে সব রহস্যের কথা বলেছেন আহমদ মুসা তা মনে পড়ে গেল। আপনা থেকেই তার মন বলল নিশ্চয় সামনে বড় কোন ঘটনা আছে। সতর্ক হলো ইয়েকিনি। বলল, আপনারা আহমদ মুসাকে চেনেন, জানেন?
‘চিনি না, তবে জানি। আমাদের কেন্দ্রীয় সংগ্রহে তার অনেক ছবি আছে।’
আয়ান ফ্লেমিং থামল। একটা ঢোক গিলল। শুরু কলল কথা আবার, ‘শুনেছি তিনি ক্যামেরুনে এসেছেন। তার জন্যে আমাদের একটা এ্যাপ্রেসিয়েশন লেটার আছে অনেকদিন ধরে। ঠিকানা না পাওয়ায় দিতে পারি না। আপনি কি জানেন তার সম্পর্কে কিছু?’
ইয়েকিনির মনে তখন চিন্তার ঝড়। আয়ান ফ্লেমিং এর কথা শুনে মনে হচ্ছে তারা আহমদ মুসার দারুণ ভক্ত। যা স্বাভাবিক নয়। কেমন করে স্বাভাবিক হবে যে তারা আহমদ মুসাকে এ্যাপ্রেসিয়েশন লেটার দেবে? এসব প্রশ্ন থেকে ইয়েকিনি ভাবল, ওদের আরও বাজিয়ে দেখা দরকার।
আয়ান ফ্লেমিং এর প্রশ্নের উত্তরে ইয়েকিনি বলল, ‘তেমন কিছু জানা নেই। ইয়াউন্ডি কেন্দ্রীয় মসজিদে এক প্রোগ্রামে তাকে দেখেছিলাম। ফটোও তুলেছিলাম।’
ভীষণ খূশি হয়ে উঠল আয়ান ফ্লেমিং এবং তাদের কৃষ্ণাংগ লোকটি।
‘কতদিন আগে?’ আয়ান ফ্লেমিং-এর কন্ঠ দ্রুত। ভেতরের উত্তেজনা চাপা দিতে চাইলেও বেরিয়ে পড়েছে অনেকখানি।
‘বেশী দিন নয়। চারদিন আগে।’
‘তাহলে উনি ইয়াউন্ডি আছেন নিশ্চয়?’ কথার সাথে সাথে ফ্লেমিং এর চোখ দুটি উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে।
‘থাকতে পারেন?’
‘উনি কোথায় উঠেছেন জানেন?’
‘না জানি না।’
‘ঐ মসজিদের কেউ জানেন নিশ্চয়?’
‘ঠিক বলতে পারবো না। কারণ মসজিদ কর্তিপক্ষ সেদিনের অনুষ্ঠান করেননি।’
‘অনুষ্ঠান কারা করেছিলেন?’
‘আমি ঠিক জানি না। বন্ধুর মুখে খবর শুনে গিয়েছিলাম। ফটো তোলাই ছিল আমার টার্গেট।’
কয়েক মুহূত চুপ থাকল আয়ান ফ্লেমিং। তার বলল ‘ধরুন আমরা যদি মসজিদ কর্তৃপক্ষকে আহমদ মুসার জন্যে একটা চিঠি দেই, কিংবা আপনাকেই যদি এ কাজের জন্যে অনুরোধ করি, তাহলে কি সে চিঠিটা কোনওভাবে তাঁর কাছে পৌছানো সম্ভব?
ইয়েকিনি ভাবল, চিঠি নেয়া দরকার। চিঠিটা যে কোন ‘লেটার অব এ্যাপ্রেসিয়েশন নয়’ সে নিশ্চিত। তাহলে চিঠিটা কি জানা দরকার।’

ভাবতে গিয়ে ইয়েকিনির দেরী হলে একটু উত্তর দিতে। এই ফাঁকে আবার কথা বললো আয়ান ফ্লেমিং। বলল, দেখুন ব্যপারটা আমাদের আবেগের সাথে জড়িত। বিশ্বে কোথাও ও কোন ঠিকানা নেই। খবরের কাগজও যোগাযোগের একটা মাধ্যম। কিন্তু আহমদ মুসা এবং এক ব্যাক্তিত্ব যাকে খবরের কাগজের কোন শিরোনামে আনা নিরাপদ নয়। এই জন্যেই অনুরোধ করছিলাম। খোঁজ করলে নিশ্চয় আপনি তার খোঁজ পাবেন।’
‘আমি চেষ্টা করতে পারি। কিন্তু কোন নিশ্চয়তা নেই। না পারলে চিঠি ফেরত কিভাবে দেব?’
আশা করি তার দরকার হবে না। হলে আমাদের পোষ্ট বক্সের ঠিকানায় ফেলে দেবেন।’
বলে একটু থেমেই আবার শুরু করল, ‘এবার আসুন কাজের কথায় আসি। আমাদের নিউজ ফাইল ও ফটো এ্যালবামের শিরোনামগুলো দেখুন। তারপর আপনার চয়েস অনুসারে নিতে পারবেন।’
বলে একটু থেমেই আবার শুরু করল, এবার আসুন কাজের কথায় আসি। আমাদের নিউজ ফাইল ও ফটো এ্যালবামের শিরোনামগুলো দেখুন। তারপর আপনার চয়েস অনুসারে নিতে পারবেন।’
আয়ান ফ্লেমিং কথা শেষ করতেই কৃষ্ণাংগ লোকটি পাশের ফাইল ক্যাবিনেট থেকে এ্যালবাম ও একটা বড় ফাইল বের করল।
ফটোগ্রাফ বা নিউজ কেনা ইয়েকিনির আসার প্রধান টার্গেট ছিল না। আহমদ মুসা তাকে পাঠানোর লক্ষ্য ছিল বিজ্ঞাপন ঘিরে যে রহস্য আঁচ করা যাচ্ছে, সেটার একটা কিনারা করা। এই কিনারা করার কাজ হয়তো সে এখনও করতে পারেনি, তবে তার কাছে এটা এখন পরিষ্কার হয়েছে যে ব্যবসায় নয়, আহমদ মুসাই ওদের আকষণের কেন্দ্র বিন্দু। আহমদ মুসার কাছে চিঠি দেয়ার ব্যাপারটা তারা যেভাবে উপস্থাপন করেছে, সেটা সেটা খুবই স্থুল। এমন স্থুল কান্ড কান্ড অনেক সময় বুদ্ধিমানরাও ঘটায়, যখন তারা সংশ্লিষ্ট ব্যাপারে মরিয়া হয়ে উঠে। ইয়েকিনির মনে হলো, এখানেও ব্যাপার তেমনই ঘটেছে।
আয়ান ফ্লেমিংদের সাথে ফটো ও নিউজ কেনার ব্যাপারে আলোচনা সেরে ইয়েকিনি রাস্তায় নামল।
রাস্তার ফুটপাতে নেমে আসতেই একটা ট্যাক্সি এসে ব্রেক কষল একদম সামনে এসে। ট্যাক্সিওয়ালা মুখ বাড়িয়ে বলল, ‘স্যার কোথায় যাবেন?
ইয়েকিনি গাড়ির দিকে এগুচ্ছিল। এমন সময় আহমদ মুসার একটা কথা তার মনে পড়ে গেল। কোথাও কোন মিশনে গেলে কোন গাড়ি এগিয়ে এলে বা যথাস্থানে দাঁড়িয়ে থাকলে তাতে চড়া উচিত নয়।
কথাটা মনে হওয়ার সংগে সংগে ইয়েকিনি পেছনে হটে এল।
বলল, ‘স্যরি, একটু অসুবিধা আছে।’
বলে ইয়েকিনি ফুটপাথ ধরে হাঁটতে শুরু করলো। সামনে মোড়েই ট্যাক্সি ষ্ট্যান্ড আছে।
ট্যাক্সি ঠিক করে ট্যাক্সিতে উটে বসল।
চিঠিটা তখনও হাতে আছে ইয়েকিনির। দেখল খামের মুখ ভালো করে বন্ধ করা। চিঠি সম্পর্কে অসীম কৌতুহল তার মনে। কিন্তু কৌতুহল নিবৃত্তির কোন পথ নেই। চলছে ইয়েকিনির ট্যাক্সি।
হঠাৎ ইয়েকিনির মনে পড়ল আহমদ মুসার একটা উপদেশের কথা। সে উপদেশটা ছিলঃ কোন মিশন থেকে ফেরার পথে সামনের চেয়ে পেছনটাকে গুরুত্ব দেবে বেশী। এক চোখ সামনে থাকলে, আরেক চোখ পেছনে রাখতে হবে।
কথাটা মনে হবার সঙ্গে সঙ্গে ইয়েকিনি পেছন ফিরে তাকাল।
সময় তখন বেলা তিনটা। তার উপর এলাকাটা নন-কমার্শিয়াল এলাকা। সে জন্যে রাস্তায় গাড়ি-ঘোড়া খুবই কম।
ইয়েকিনি পেছনে তাকিয়ে দেখতে পেল দুইটি প্রাইভেট কার তার গাড়ির পেছনে আসছে। সামনের প্রাইভেট কারটা তীব্র বেগে ছুটে আসছে। পেছনেরটা বেশ একটু পেছনে।
দেখতে দেখতে ছুটে আসা প্রাইভেট কারটা ইয়েকিনির গাড়ি অতিক্রম করে চলে গেল।
ক’মিনিট পরে পেছনে তাকিয়ে ইয়েকিনি দেখল মিনি ট্যক্সি দু’টো আর দেখা যাচ্ছে না। পেছনে পড়ে গেলে বা কোন গলিতে ঢুকে গেছে। পেছনের দ্বিতীয় প্রাইভেট কারটা এখনও সেই সমান দুরত্বে। যেন ইয়েকিনির গাড়ি যে স্পীডে চলছে, ঠিক সেই স্পীডেই চলছে গাড়িটা। বিস্মিতই হলো ইয়েকিনি।
কিন্তু সোজা হয়ে বসেই আহমদ মুসার একটি কথা মনে হওয়ায় চমকে উঠল ইয়েকিনি। আহমদ মুসা বলেছিলেন, অপরিচিত ও সংযোগহীন দুইটি গাড়ির গতি নিয়ন্ত্রণহীন কোন রাস্তায় বেশীক্ষণ এক গতিতে চলতে পারে না। যদি চলে তার মধ্যে তাহলে একটা উদ্দেশ্য থাকবে নিশ্চয়ই।
কথাটা মনে হতেই সতর্ক হলো ইয়েকিনি। মুখ ফিরিয়ে পেছনের লাল গাড়িটার দিকে তাকিয়ে ভাবল, কোন উদ্দেশ্য আছে নাকি তাহলে গাড়িটার!
করণীয় ভাবতে গিয়ে আহমদ মুসার আরেকটা কথা মনে পড়ে গেল ইয়েকিনির। আহমদ মুসা এক উপদেশে বলেছিল, পেছনে কাউকে সন্দেহ করলে সরাসরি আর না চলে কোন আড়ালের আশ্রয় নিয়ে তাকে বোকা বানাতে হবে।
ইয়েকিনি ভাবল, কোথায় কিসের আড়াল নেয়া যায়?
খুশী হয়ে উঠল তার মন। সামনে অল্প দূরেই একটা নতুন তিনতলা মার্কেট। খুব জমজমাট এখণ। তিন পাশ দিয়েই তার রাস্তা। ওখানে নেমে পেছনের গাড়িটাকে বোকা বানিয়ে সে কেটে পড়তে পারে।
সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল সে। মার্কেটের প্রায় কাছাকাছি এসে গেছে গাড়ি। মার্কেটে গাড়ি দাঁড় করাতে বলল ইয়েকিনি। মার্কেটের কার পার্কে গাড়ি দাঁড়াতেই ভাড়া চুকিয়ে দ্রুত মার্কেটে ঢুকে গেল ইয়েকিনি। মার্কেটে ঢোকার মুখে ইয়েকিনি পেছনৈ মুখ ঘুরিয়ে দেখল পেছনের সেই গাড়িটা মার্কেটের চত্বরের দিকে আসছে।
মার্কেটে ঢোকার পর প্রথমেই প্রশস্ত একটা করিডোর। তার দুই প্রান্ত দিয়ে দুটো সিঁড়ি দু’তলা, তিন তলায় উঠে গেছে। ইয়েকিনি ভেতরে ঢুকেই বাম দিকের সিঁড়ি বেয়ে দু’তলায় উঠে গেল দ্রুত। ঠিক উপরে না উঠে সিঁড়ির মাঝামাঝি ল্যান্ডিং-এ গিয়ে সিড়ির কাঁচের জানালা দিয়ে সে তাকাল নিচের চত্বরে। দেখল, সেই লাল গাড়িটা মার্কেটের কারপার্কে এসে দাঁড়াল। গাড়ি
থেকে দ্রুত বেরিয়ে এল একজন লোক। লোকটাকে চিনতে পারলো ইয়েকিনি। আয়ান ফ্লেমিং-এর অফিসে দেখা সেই কৃষ্ণাংগ। লোকটি গাড়ি থেকে নেমেই ছুটল মার্কেটের দিকে।
ইয়েকিনি সিঁড়ির ল্যান্ডিং থেকে দু’তলার দিকে কয়েক ধাপ উঠে রেলিং এর আড়াল নিয়ে চোখ রাখল করিডোরের দিকে।
দেখল ইয়েকিনি, কৃষ্ণাংগ লোকটি মার্কেটের ভেতরে ঢুকে মুহূর্তের জন্য দাঁড়াল। এদিক-ওদিক দৃষ্টি বুলাল দ্রুত। সিঁড়ির দিকেও। তারপরেই সে দ্রুত সামনে এগুলো এবং এক তলার দোকানগুলোর পাশ কাটিয়ে এগিয়ে চলল।
ইয়েকিনি সিঁড়ি দিয়ে নেমে এসেছ। সে বুঝল, কৃষ্ণাংগ লোকটি মার্কেটের ওপাশের রাস্তা লক্ষে এগুচ্ছে।
কৃষ্ণাংগ ঐ লোকটিকে আর যখন দেখা গেল না, তখন ইয়েকিনি সিঁড়ি থেকে নেমে দ্রুত করিডোর পেরিয়ে মার্কেট থেকে বেরিয়ে এল।
রাস্তায় নামতেই একটা ট্যাক্সিও পেয়ে গেল। চলন্ত একটা ট্যাক্সিকে ডেকে তাতে উঠে বসল।
ছুটে চলল ট্যাক্সি।
রোমাঞ্চ লাগল ইয়েকিনির। জীবনের প্রথম একক এক মিশনে সে জয়ী হয়েছে, বোকা বানাতে পেরেছে সে শত্রুকে।
ওরা কি সত্যিই শত্রু? ওরা কেন তার পিছু নিয়েছিল? ইয়েকিনির ঠিকানা জানাই কি ছিল ওদের টার্গেট? কেন? হঠাৎ আহমদ মুসাকে দেয়া তাদের চিঠির কথা মনে পড়ল। চিঠিতে কি আছে? কেন ওরা চিঠি দিয়েছে আহমদ মুসাকে?
এইভাবে একের পর এক প্রশ্ন তার মনে উদয় হতে লাগল। কিন্তু কোন প্রশ্নেরই সে জবাব খুঁজে পেল না।
ঘড়ি দেখল ইয়েকিনি।
বিকেল সাড়ে তিনটা।
বেশ দেরী করে ফেলেছে -ভাবল ইয়েকিনি। আজ রাশিদী ইয়েসুগোর বাড়িতে এক মহা অনুষ্ঠান। আহমদ মুসার বিয়ে। আজ চারদিন বিয়ের অনুষ্ঠান চলছে।
প্রথমদিন বিয়ে হয়েছে রাশিদী ইয়েসুগো ও ভিনিসা রোসেলিনের। তারপরের দিন এলিসা গ্রেস ও ওমর বায়ার বিয়ে। তৃতীয় দিন তার অর্থাৎ মুহাম্মদ ইয়েকিনি এবং লায়লা ইয়েসুগোর বিয়ে হয়েছে। চতুর্থ দিনে বিয়ে হয়েছে ফাতেমা মুনেকা এবং হাসান একাকুর।
এ বিয়েগুলোর মধ্যে রোসেলিনের বিয়ে হয়েছে চীফ জাস্টিসের বাসায়। অবশিষ্ট তিনটি বিয়ে হয়েছে রাশিদী ইয়েসুগোর বাড়িতে।
ভিন্ন ভিন্ন দিনে আহমদ মুসার পরিকল্পনা অনুসারে। তার কথা সবার বিয়ে এক সাথে হলে আনন্দ করার, কাজ করার লোক কোথায় পাওয়া যাবে?
পরিকল্পনা অনুসারে সর্বশেষ বিয়ে আহমদ মুসার। আজ সেই বিয়ে।
মনটা উসখুস করে উঠল মুহাম্মাদ ইয়েকিনির। মবাই আনন্দ করছে, আর সে কিনা বেরিয়েছে মিশনে। আহমদ মুসা চায়নি এদিন তাকে মিশনে পাঠাতে। কিন্তু উপায় ছিল না। সাক্ষাৎ করার এই একটি দিনই ওরা দিয়েছিল।
সুতরাং বাধ্য হয়েই আহমদ মুসা তাকে এ মিশনে পাঠায়।
গেটের ভেতরে গাড়ি না নিয়ে গেটের সামনে রাস্তাতেই নেমে পড়ল ইয়েকিনি।
গাড়ি থেকে বাড়ির দিকে তাকাতেই হঠাত্ ছাদের দিকে গেল তার দৃষ্টি। দেখল, ছাদের একদম এক প্রান্তে লায়লা ইয়েসুগো দাঁড়িয়ে। মুুহাম্মাদ ইয়েকিনিকে দেখেই সে হাত নাড়ল।
ইয়েকিনি বুঝল, লায়লা ইয়েসুগোরাস্তার দিকে তাকিয়ে ছিল। তার পথ চেয়ে কি? তৃপ্তির এক অপূর্ব শিহরণ খেলে গেল ইয়েকিনির বুকে, সারাদেহে। তার মনে হলেঅ, প্রিয়তমা নারীর এমন অপেক্ষমান চোখের চেয়ে সুন্দর, মধুর বুঝি আর কিছু নেই।
হঠাত্ মনে জাগল, তাদের প্রিয় নেতা আহমদ মুসা সহস্র মিশনে গেছেন, যাচ্ছেন। বাড়িতে কি অমন অপক্ষমান কোন ব্যাকুল চোখ তার পথ চেয়ে থাকে? তার তো বাড়িই নেই! বাড়িতে চোখ থাকবে কি করে!
‘এবার সে ব্যবস্থা ইনশাআল্লাহ হচ্ছে’-সানন্দে ভাবল ইয়েকিনি।
লায়লঅ ইয়ে সুগোর উদ্দেশ্যে হাত নেড়ে গেট দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করল ইয়েকিনি।
সুন্দর করে সাজানো হল ঘরে এসে হাজির হলো ইয়েকিনি।
বিশাল হল ঘরটির মাঝ বরাবর টাঙানো ভারি পর্দার পার্টিশন।
পার্টিশনের একপাশে মেয়েরা, অন্যপাশে ছেলেরা।
সবাই উপস্থিত। জমজমাট বিয়ের আসর।
হলের চারদিকে সাজানো সোফায় বসেছে সকলে। মাঝখানের বড় একটি সোফায় বসেছে আহমদ মুসা। তার এক পাশে রাশিদী ইয়েসুগো।
আহমদ মুসার সামনের সোফায় রোসেলিনের আব্বা চীফ জাস্টিস ওসাম বাইক এবং ডোনার আব্বা মিশেল প্লাতিনি।
ইয়েকিনি যখন হল ঘরে প্রবেশ করে, তখন কথা বলছিল মিশেল প্লাতিনি, ‘না আমি খুব খুশী। আমারর ইচ্ছা ছিল আমাদের পূর্ব পুরুষের প্রাসাদে বংশের একমাত্র উত্তরাধিকারীর বিয়ে হবে। কিন্তু সেখানে বিয়ে হলে যে খুশী আমার লাগত, তার চেয়ে অনেক বেশী খুশী লাগছে আমার এখানে।..’
ইয়েকিনি প্রবেশ করলে কথা বন্ধ করেছিল মিশেল প্লাতিনি।
ইয়েকিনি এগিয়ে এলে আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল। বলল, ‘এস ইয়েকিনি। বুঝাই যাচ্ছে তোমার মিশন সফল হয়েছে, কিন্তু সেই সাথে তোমার চোখে উদ্বেগ কেন?’
হলে উপস্থিত সকলের দৃষ্টি তখন ইয়েকিনির দিকে। পর্দার ওপাশে হলের ঐ অংশে মেয়েদের গুঞ্জন-কথাবার্তাও থেমে গেছে। তাদেরও মনোযোগ এদিকে।
ইয়েকিনি সবাইকে সালাম জানিয়ে আহমদ মুসার পাশে বসল। তারপর চাপদিকে আবার নজর বুলিয়ে দেখল বাইরের কেউ নেই। বলল, ‘সফল হয়েছে এই অর্থে য আমি তাদের দেখা পেয়েছি, কথা বলেছি। কিন্তু রহস্যের জট খোলেনি, বরং আরও জটিল হয়েছে।’
‘জটিল হয়েছে? খুলে বল।’ বলর আহমদ মুসা।
‘ওরা আমাকে বিদায় দেবার পর গোপনে আমাকে ফলো করেছিল। সম্ভবত আমার ঠিকানা জানার জন্যে।’ বলল ইয়েকিনি।
‘তারপর?’
‘আপনার উদেশ অনুযায়ী একটা মার্কেটে ঢুকে পড়ে ওদের বোকা বাবনিয়ে চলে এসেছি।’
‘যাক, ওরা যে পরিচয় দিয়েছে, ওটা যে আসল পরিচয় নয় বুঝা গেল। বল, তারপর?’
‘ওরা আপনাকে একটা চিঠি দিয়েছে।’
‘আমাকে চিঠি দিয়েছে? ওরা?’
‘হ্যাঁ।’
‘আমার কথা তুমি ওদের বলেছ?’
‘প্রশ্নই উঠে না। কথায় কথায় ওরাই আমাকে বলল, আমরা ছবি বিক্রি করি, আবার কিনিও। বিশেষ করে আহমদ মুসার মত ব্যাক্তিদের। উনি এসছিলেন ক্যামেরুনে। কোন ছবি দিতে পারেন তার?’
‘তারপর?’ আহমদ মুসার চোখে চাঞ্চল্য।
ইয়েকিনি একে একে চিঠির প্রসংগ তারা কিভাবে তুলল, কিভাবে চিঠি দিল ইত্যাদি খুলে বলল।
আহমদ মুসা গম্ভীর হয়ে উঠেছিল। বলল, ‘সম্ভবত আমি যা ভেবেছি, রহস্যটা তার চেয়েও গভীর।’
বলে আহমদ মুসা চিচঠি চাইল। ইয়েকিনি চিঠি দিল আহমদমুসাকে। ইভেলাপটি হাতে নিয়ে আহমদ মুসা উল্টে-পাল্টে দেখল। গম্ভীর হয়ে উঠল তার মুখ। বলল, ‘এটা ব্ল্যাক ক্রস-এর চিঠি।’
‘না খুলেই কি করে বুঝলেন?’ বলল ইয়েকিনি।
‘দেখ ইনভেলাপে নিউজ ব্যাংক-এর মনোগ্রামে কালো একটা সৈনিক মূর্তি রয়েছে। কালো এই সৈনিক মূর্তি এখন ব্ল্যাক ক্রস-এরও প্রতীক।’ বলে আহমদ মুসা ইনভেলাপ ছিড়ে চিঠিটি বের করল।
ভাঁজ খুলে চিঠিটি মেলে ধরল আহমদ মুসা তার চোখের সামনে।
চিঠি পড়তে শুরু করল আহমদ মুসা। পড়তে পড়তে তার চোখ-মুখের উদ্বেগজনক পরিবর্তন ঘটল। বিষাদের একটা কালো ছায়া তাকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছে।
চিঠি পড়া শেষ হলো আহমদ মুসার। চিঠি সমেত তার দু’টি হাত ঢলে পড়ল তার কোলের উপর। আহমদ মুসার চোখে শূণ্য দৃষ্টি।
‘চিঠিতে কি আছে আহমদ মুসা?’ উদ্বিগ্ন কন্ঠে জিজ্ঞেস করল ডোনার আব্বা মিশেল প্লাতিনি।
আহমদ মুুসা ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়িয়ে চিঠিটি তুলে দিল মিশেল প্লাতিনির হাতে।
মিশেল প্লাতিনি চিঠিটি তুলে ধরল তার চোখের সামনে। চীফ জাস্টিস ওসাম বাইকও ঝুঁকে পড়ল চিঠির দিকে। মিশেল প্লাতিনি তার হাতের চিঠি একটু এগিয়ে নিল চীফ জাস্টিসের দিকে। দু’জনেই পড়তে শুরু করল।
ঘরে তখন পিন-পতন নীরবতা। ঘরের মাঝখানের পর্দার ফাঁক দিয়ে ডোনা, লায়লা ও রোসেলিনের চোখ এদিকে নিবদ্ধ।
সকলের পচন্ড উদ্বেগ এবং কৌতুহলের মধ্যে যে চিঠি ওরা পড়তে লাগল তা এই:
“মি: আহমদ মুসা, আপনার বিজয়ের উত্সব-আনন্দ নিশ্চয় শেষ হয়নি। এই আনন্দ-উত্সবে আমাদের ছোট্ট একটা বজ্রাঘাত।
বারবারেতি’র ইসলামী সম্মেলন কেন্দ্র আমরা ধ্বংস করেছি। ধ্বংস করেছি একটা আড়াল সৃষ্টির জন্যে। আমরা কিডন্যাপ করেছি শেখ আবদুল্লাহ আলী আল রাশিদ মাদানী, কামাল ইনুনু, শেখ সাইয়েদ আলী কুতুব, তারেক আল মাহদী সুদানীসহ ১২ জন নেতাকে। কিন্তু দুনিয়ার চোখে তারা সবাই পুড়ে ছাই হয়ে গেছে ঐ বিস্ফোরণের আগুনে। দুনিয়ার কেউ প্রমাণ করতে পারবে না যে তারা কিডন্যাপ হয়েছে। আপনি জানার পরেও তা কোনভাবেই প্রমাণ করতে পারবেন না।
আপনাদের অগম্য একটি স্থানে তাদের বন্দী করে রাখা হয়েছে। দু:খের বিষয় তাদের ভালো অবস্থায় রাখতে পারিনি। তাদের জীবন দ্রুত ক্ষয়ে যাচ্ছে।
বিস্ফোরণের পনের দিন পর তাদের কেউই বাচবে না।
তাদের মুক্তির একমাত্র উপায় যথাসময়ে আপনার আত্মসমর্পণ। সংঘ নদীর ভবনের বিপরীত দিকে উইন্দ টাওয়ারের পাশের একটি গাছে একটা সাদা পতাকা টাঙানো থাকবে। পতাকাটি নামিয়ে নিয়ে সেটা হাতে নিয়ে অপেক্ষা করতে হবে। অপেক্ষার এক ঘন্টার মধ্যে সেখানে একটা গাড়ি গিয়ে হাজির হবে। গাড়ির ড্রাইভিং উইন্ডো থেকে অনুরূপ একটা সাদা পতাকা দেখানো হবে এবং সেই সাথে গাড়ির দরজা খুলে যাবে। ঐ গাড়িতে উঠে বসতে হবে।
পিয়ের পল হত্যার প্রতিশোধ নেয়া সবে শুরু। আপনি আত্মসমর্পণ না করলেও উল্লিখিত সময়ের মাথায় বন্দীরা নিহত হবে। আত্মসমর্পণ না করলেও আপনি বাঁচবেন না আমাদের হাত থেকে। আপনার রক্তই আমাদের প্রতিশোধ তৃষ্ণা মেটাতে পারে। আপনার আত্মসমর্পণ বন্দীদের বাঁচাতে পারে মাত্র।”
চিঠি পড়া শেষ করে ডোনার আব্বা মিশেল প্লাতিনি এবং চীফ জাস্টিস ওসাম বাইক ধীরে ধীরে মুখ তুলে তাকাল আহমদ মুসার দিকে। চোখে তাদের বোবা দৃষ্টি। সে দৃষ্টি উদ্বেগ-আতংকে বিহ্বল।
ডোনার আব্বার হাতে ছিল চিঠি। তার শিথিল হাত থেকে চিঠি পড়ে গেল।
পর্দার অন্তরাল থেকে বেরিয়ে গেল ডোনা। তার পরণে বিয়ের পোশাক। অপরূপ সাদা গাউনে তার দেহ আবৃত। তার চেয়েও অপরূপ একটা ওড়না মাথা থেকে মুখটা প্রায় ঢেকে ফেলেছে।
সে দ্রুত প্রবেশ করে তার আব্বার হাত থেকে পড়ে যাওয়া চিঠিটা ছোঁ মেরে নিয়ে ভেতরে চলে গেল।
কি আছে চিঠিতে ভাইয়া? উদ্বিগ্ন কন্ঠে বলল রাশিদী ইয়েসুগো।
ঘরে উপস্থিত সবার চোখেও এই একই প্রশ্ন।
আহমদ মুসা সোজা হয়ে বসল। বলল, প্রিয় ভাইয়েরে, চিঠিটা লিখেছে ব্ল্যাক ক্রস। ওরা জানিয়েছে, বারবারেতির ইসলামী সম্মেলন কেন্দ্র অরাই ধ্বংস করেছে এবং কিডন্যাপ করেছে ডজন খানেক মুসলিম নেতাকে।’
আহমদ মুসা একটু থামতেই রাশিদী ইয়েসুগো বলে উঠল, ‘বিস্ফোরণে তাহলে ওরা মারা যায়নি? কিডন্যাপ করা হয়েছে ওঁদের?’
‘ওঁদের পণবন্দী করা হয়েছে বলতে পার। আহমদ মুসা ওদের হাতে সারেন্ডার করলে ওদের মুক্তি দেবে বলে ওরা বলেছে।’
মুখ চুপসে গেল রাশিদী ইয়েসুগোর। বলল ভাঙা গলায়, ‘আর কি লিখেছে?’
‘বিস্ফোরণ থেকে পনের দিনের মাথায় বন্দীরা সবাই নিহত হবে। সংঘ ও কংগ নদীর সংগম স্থল বোমাসায় গিয়ে আমাকে আত্মসমর্পণ করতে হবে।’
‘না করলে কি হবে?’
‘বন্দীরা ছাড়া পাবে না।’
‘কোন সময় সীমা?’
‘১৫ দিনের মাথায় সবাই নিহত হবে। অতএব পনের দিনই সময় সীমা।’
রাশিদী ইয়েসুগো কোন কথা বলল না।
সবাই নীরব।
ডোনার আব্বা মিশেল প্লাতিনি এবং চীফ জাস্টিস অসাম বাইক দুজনেরই যেন বাকরোধ হয়ে গেছে। তাদের চোখ-মুখ থেকে উদ্বেগ যেন ঠিকরে পড়ছে।
এ সময় পর্দার বাইরে বেরিয়ে এল লায়লা ইয়েসুগো। আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে বলল, ‘চিঠির লেখা হারিয়ে গেছে।’ লায়লার কন্ঠে উদ্বেগ।
আহমদ মুসার মধ্যে কোন বিস্ময় বা চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হলো না। বরং দেখা গেল তার মুখে একটা হাসির রেখা। বলল, ‘ওরা কথা রাখল, কোন প্রমাণ তারা রাখল না। বিশেষ ভ্যানিশিং কেমিকেল দিয়ে চিঠিটা লেখা ছিল। লায়লার কাছ থেকে চিঠির কাগজটা নিয়ে এল রাশিদী ইয়েসুগো।’
রাশিদী ইয়েসুগো চিঠি নিয়ে এলে সবাই দেখল।
‘আহমদ মুসা চীফ জাস্টিস্কে লক্ষ্য করে বলল, ‘জনাব আমরা ক’জন ভেতরে একটু বসতে চাই।’
বলে আহমদ মুসা রাশিদী ইয়েসুগোর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তুমি বসার একটু ব্যবস্থা কর। ওঁরা দু’জন এবং তোমরা দু’জন।’
ভেতরের ফ্যামিলি ড্রইং রুমে গিয়ে বসল ওঁরা পাচজন।
আহমদ মুসার সামনের দু’টি সোফায় বসেছে ডোনার আব্বা এবং রোসেলিনের আব্বা। আর বাঁ পাশের দু’টির সোফায় মুহাম্মাদ ইয়েকিনি এবং রাশিদি ইয়েসুগো।
বসার পর কথা শুরু করল আহমদ মুসা। ডোনার আব্বা ও রোসেলিনের আব্বাকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘আপনারা চিঠি পড়েছেন, পরিস্থিতি বুঝতে পারছেন। আপনাদের পরামর্শ পেলে বাধিত হবো।’
‘কি করা উচিত বুঝতে পারছি না। আত্মসমর্পণ তো সব নয়।’ বলল ডোনার আব্বা মিশেল প্লাতিনি।
‘আমিও এটাই ভাবছি।’ বলল রোসেলিনের আব্বা চীফ জাস্টিস ওসাম বাইক।
আবার নীরবতা।
নীরবতা ভেঙে ধীরে ধীরে বলল আহমদ মুসা, ‘বিস্ফোরণের পর দশ দিন পার হয়ে গেছে। আর মাত্র ৫ দিন বাকী। বাকী এই সময়ের মধ্যে বন্দী মুসলিম নেতৃবৃন্দকে উদ্ধার করতে হবে। উদ্ধার করতে না পারলে তাদের কেউ বাঁচবেন না।’
‘উদ্ধার কিভাবে হবে? দুনিয়ার কেউ তো জানে না তাদের অবস্থার কথা।’ বলল ওসাম বাইক।
‘বিশ্ব মুসলিম কংগ্রেসসহ মুসলিম দেশসমুহ এবং দুনিয়াবাসীকে এই ব্যাপারটা জানিয়ে দেয়া যায়। তাহলে তাদের একটা সম্মিলিত ব্যবস্থা হতে পারে।’ বলল রাশিদী ইয়েসুগো।
‘তাতে লাভ হবে না। বিষয়টা নিয়ে হৈ চৈ হলে কিংবা ঘটা করে তাদের উদ্ধারের সম্মিলিত কোন ব্যবস্থা হলে বন্দীদের তারা সময়ের আগেই হত্যা করবে। তাছাড়া ঐ ধরনের উদ্যোগে উদ্ধারের জন্যে যে সময় প্রয়োজন, সে সময় এখন হাতে নেই।’ আহমদ মুসা বলল।
‘ব্ল্যাক ক্রস-এর উপর আন্তর্জাতিক কোন চাপ প্রয়োগ করা যায় না, যা তাদেরকে আন্তর্জাতিক মুসলিম নেতাদের হত্যা করা থেকে বিরত রাখতে পারে?’ বলল মুহাম্মাদ ইয়েকিনি।
‘ব্ল্যাক ক্রস-এর উপর এ ধরনের কোন চাপ দেয়া যাবে না। কারণ, তারা কিডন্যাপ করেছে এবং মুসলিম নেতৃবৃন্দ বেঁচে আছেন, এর কোন প্রমাণ নেই।’ বলল আহমদ মুসা।
আবার নীরবতা। কারো মুখে কোন কথা নেই।
পাশের ঘরেই রয়েছে ডোনা, লায়লা ইয়েসুগো, রোসেলিন, ফাতেমা মুনেকা এবং এলিসা গ্রেস। তাদের সমস্ত মনোযোগ এ ঘরের আলোচনার দিকে। তাদের সকলের চেহারাই আষাঢ়ের মেঘের মত ভেজা।
চিন্তাক্লিষ্ট আনত দৃষ্টি আহমদ মুসা মুখ তুলল। বলল, ‘ওঁদের উদ্ধারের দায়িত্ব এখন আমাদের। আমাকে যেতে হবে।’
‘আত্মসমর্পণের জন্যে?’ ডোনার আব্বার কন্ঠ।
‘আমি এখন বলতে পারছি না। তবে কোন উপায় না থাকলে আত্মসমর্পণ করতে হবে।’ স্থির, শান্ত কন্ঠে বলল আহমদ মুসা।
আবার নীরবতা। কথা বলার শক্তি যেন কারো নেই।
অনেকক্ষণ পর চীফ জাস্টিস ওসাম বাইক বলল, ‘বাবা, তোমার কথার উপর আমাদের কোন কথা চলতে পারে না। তুমি কবে যাবে মনে করছ?’
‘চাচা জান, দিন মাত্র পাঁচটা আছে। যে কাজ করতে হবে সে তুলনায় এ সময়টা কিছুই নয়। আমি আজ এখনি যাত্রা করতে চাই।’ বলল আহমদ মুসা।
আবার নীরবতা।
আহমদ মুসা ছাড়া উপস্থিত অন্য সকলের চোখ-মুখের সকল আলো যেন আক সংগে দপ করে নিভে গেল। অন্ধকার নামল মুখে-চোখে সকলের। পাশের ঘরে ডোনা লায়লাদেরও একই অবস্থা
নীরবতা ভাঙল চীফ জাস্টিস ওসাম বাইক। বলল, ‘তাহলে বিয়েটা তাড়াতাড়ি সেরে ফেলতে হয়।’
আহমদ মুসা মুখ নিচু হলো। বলল, ‘চাচা জান আমি এ নিয়ে ডোনার সাথে কথা বলতে চাই। সে আমার সাথে একমত হলে বিয়েটা স্থগিত রাখতে আমি অনুরোধ করব।’
আবার নীরবতা।
ডোনার আব্বা ও চীফ জাস্টিসের চোখ-মুখ বেদনা ক্লিষ্ট। রাশিদী ইয়েসুগো এবং মুহামাদ ইয়েকিনির কেঁদে ফেলা শুধু বাকী। ওদিকে লায়লা, রোসেলিন, ফাতেমা মুনেকা ও এলিসা গ্রেস অসহনীয় এক বেদনার বানে বিদ্ধ হয়ে নিজেদের অজান্তেই চোখ তুলেছে ডোনার দিকে।
ডোনার মাথা উঁচু। ভাবলেশহীন মুখ। চোখে একটা শূন্য দৃষ্টি। যেন কোথায় কোন চিন্তার সাগরে নিজেকে সে হারিয়ে ফেলেছে।
আবারও নীরবতা ভাঙল চীফ জাস্টিস ওসাম বাইক। বলল, ‘ঠিক আছে কথা বলবে।’
বলে সে তাকাল রশিদী ইয়েসুগোর দিকে।
‘ঠিক আছে ব্যবস্থা কড়ছি।’ বলে একটু থেমেই সে আহমদ মুসার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আপনার সাথে আমরা কারা যাচ্ছি আহমদ মুসা ভাই?’
আহমদ মুসা একটু হাসল। বলল, ‘তোমাদের কোন সুযোগ দিতে পারছি না। আমার সাথে যাবে ব্ল্যাক বুল এবং যদি রাজী হয় তাহলে অগাস্টিন ওকোচা’।
‘কিন্তু ওরা দু’জনই তো ‘কোক-ওকুয়া’র লোক, ওরা সহজেই ওদের চোখে ধরা পড়ে যাবে’। বলল রাশিদী।
‘এ চিন্তা তোমার মনে উদয় হওয়ার জন্যে তোমাকে ধন্যবাদ। কিন্তু ওদের নেব আমি ছদ্মবেশে, অন্য মানুষ বানিয়ে’।
‘আমরা পারি না কেন যেতে?’ মুখ ভার করে বলল রাশিদী ইয়েসুগো।
আহমদ মুসা ডোনার আব্বা ও রোসেলিনের আব্বার দিকে এক পলক তাকিয়ে রাশিদীকে বলল, ‘পরে বলব তোমাদের কারণটা। যাও তুমি লায়লাকে বলে ডোনাকে ডেকে দাও’। আহমদ মুসার ঠোঁটে হাসি।
রাশিদী ইয়েসুগো মুখ ভার করেই উঠে দাঁড়াল।

ইয়েউন্ডি থেকে ইয়াউন্ডি-বাতুয়া-বাতুরি হাইওয়ে ধরে পূর্ব দিকে ছুটে চলছিল আহমদ মুসার গাড়ি।
গাড়ির ড্রাইভিং সিটে আহমদ মুসা। পরনে তার পর্যটকের পোশাক। মাথায় স্পোর্টস হ্যাট, কপালের শেষ প্রান্ত পর্যন্ত নামানো।
পেছনের সিটে ব্ল্যাক বুল। অগাস্টিন ওকোচাকে সাথে নেয়ার কথা ছিল, কিন্তু সিদ্ধান্তটা শেষ পর্যন্ত বাতিল করেছে আহমদ মুসা। ওকোচা কিন্তু জেদ ধরেছিল। তার পিতাও বলেছিল, আফ্রিকার বোমাসা অঞ্চলের জন্যে ওকোচা উপকারী হতে পারে। ওকোচার মা এবং স্ত্রী দু’জনেই সায় দিয়েছে তার কথায়। কিন্তু আহমদ মুসা মিষ্টি হেসে বলেছে, ওকে সাথে নিয়ে যতখানি উপকৃত হবো, তার চেয়ে বেশী উপকৃত হবো যদি সে তার এই নতুন নীড়কে আরও সুন্দর করে তোলে।
ব্ল্যাক বুলের পরনে গাইডের পোশাক। তার হ্যাটের শীর্ষে এবং ইউনিফর্মের বুকে গাইডের মনোগ্রাম জ্বল জ্বল করছে। তার মুখ ভরা ফ্রেন্স কাট দাড়ী। ব্ল্যাক বুলকে চেনার কোন উপায় নেই। দাড়ী-গোঁফ, হ্যাট এবং পশ্চিমী ধাচের গাইডের পোশাক পরে সে সম্পূর্ণ নতুন মানুষ হয়ে গেছে।
ব্ল্যাক বুলের সিটের পেছনে তার প্রিয় কুকুর দু’টো। শান্ত বালকের মত পাশাপাশি তারা বসে আছে সামনে তাকিয়ে।
ব্ল্যাক বুলের অনুরোধেই আহমদ মুসা কুকুর দু’টিকে সাথে নিয়েছে। ব্ল্যাক বুল বলেছে, দু’টি কুকুর দু’জন মানুষের চেয়ে উপকারী হবে শুধু নয়, মানুষ পারে না এমন কিছু কাজ কুকুর দু’টি পারবে।
গাড়ি ছুটে চলেছে আহমদ মুসার।
সামনে যে শহরটি তার নাম এ্যাবং এমব্যাংগ। তীরের মত সোজা রাস্তা। আহমদ মুসার হাত দু’টি স্টেয়ারিং-এ স্থির হয়ে আছে। ঝড়ের গতিতে ছুটে চলেছে গাড়ি।
আহমদ মুসার চোখ দু’টি স্থির নিবন্ধ সামনে। হঠাৎ অলস মনের এক কোণে ডোনার অশ্রু সজল মুখটি ভেসে উঠল তার।
মনটা খারাপ হয়ে গেল আহমদ মুসার। আহমদ মুসা কি অবিচার করল ডোনার উপর। বিয়ের আসন থেকে তাকে সরে দাঁড়াতে হয়েছে।
কিন্তু আহমদ মুসার কোন দোষ নেই। সে তো ডোনার উপরই সব ছেড়ে দিয়েছিল। বলেছিল আহমদ মুসা, ‘সব শুনেছ, এখন কি করা যায় বল’। বেদনার একটা হাসি ফুটে উঠেছিল ডোনার ঠোঁটে। বলেছিল, ‘আমাকে বুঝি খুব দুর্বল মনে কর?’
‘না, তা কেন?’
‘তাহলে আমার সাথে আলোচনাকে সিদ্ধান্তের শর্ত বানিয়েছ কেন?’
‘তোমার অধিকার আমি অস্বীকার করতে পারি?’
‘এই সময়ে আমার অধিকার নিয়ে ভাবছ?’
‘এই সময়েই বেশী ভাবা দরকার’।
‘কোন সময়ের কথা বলছ?’ ডোনার ঠোঁটে ফুটে উঠেছিল লজ্জাজড়িত হাসি।
‘আমি বলব না’।
ডোনা মুখ নিচু করেছিল। লজ্জায় লাল হয়ে উঠেছিল তার মুখ।
মুহুর্ত কয়েক মুখ না তুলে বলেছিল, ‘বল কি বলবে?’
‘তুমিই তো বলবে’।
‘আমি জানি তুমি সবদিক না ভেবে সিদ্ধান্ত নাও না। সুতরাং আমার আলাদা কোন বক্তব্য নেই’।
‘কথাটা তুমি খুব সহজে বলে ফেললে। আমার কিন্তু খুব খারাপ লাগছে’।
‘আমার জন্যে, তাই না?’
‘সত্যটা আমি ভুলব কি করে যে, তুমি রাজকুমারী মারিয়া জোসেফাইন লুই এক শান্তির ও নিরুপদ্রব জীবন থেকে ছিটকে পড়েছ আগুনের মধ্যে!’ আহমদ মুসার কন্ঠ ভারি শোনাচ্ছিল।
ডোনা চকিতে আহমদ মুসার মুখের দিকে চোখ তুলে চেয়েছিল। তারপর চোখ নামিয়ে নিয়েছিল। ধীরে ধীরে তার দু’চোখ থেকে গড়িয়ে পড়েছিল দু’ফোটা অশ্রু। বলেছিল, ‘ডোনাকে না বুঝে এভাবেই বুঝি তুমি কষ্ট পাও! তোমাকে কেমন করে বুঝাব যে, তথাকথিত রাজকুমারীর মরুময় জীবন আজ কূল উপচানো সুখ আর প্রশান্তির বাগান। তুমি যাকে আগুন বলছ, তার মত দুনিয়া জোড়া আগুনও এ প্রশান্তির স্পর্শে নিভে যায়’।
‘ধন্যবাদ ডোনা। আমার সৌভাগ্যের জন্যে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করছি’।
‘কোন সৌভাগ্য?’
‘এমন তোমাকে পাওয়ার সৌভাগ্য’।
ডোনা কথা বলেনি। একরাশ লজ্জা এসে তার মুখ রাঙা করে দিয়েছিল। তার বেদনাক্লিষ্ট শুল্ক ঠোঁট ভরে উঠেছিল উজ্জ্বল এক টুকরো হাসিতে। বলেছিল একটু সময় নিয়ে, ‘তোমার সৌভাগ্যের চেয়ে আমার সৌভাগ্য অনেক বড়’।
বলে একটু দম নিয়েই আবার শুরু করল, ‘একটা কথা বলব, সাহস পাচ্ছি না’।
‘কি কথা?’
‘মেইলিগুলি আপা মানে আমিনা আপা এমনি এক অভিযানে তার ‘মা-চু’কে তোমার সাথে দিয়েছিলেন। আমার তো কেউ নেই। আমি তোমার সাথী হতে পারি না?’ কান্নায় বুজে এসেছিল ডোনার কন্ঠ।
‘ডোনা, তুমি বুঝি আমিনার কথা ভুলতে পার না?’ শান্ত, ভারি কন্ঠ ছিল আহমদ মুসার।
‘আমার তো বড় আপা। আপা কি ডোনার মত? তুমি কি তাকে ভুলতে পার?’
‘ডোনা, তুমি তাকে ভালোবেসে তার গোটা আসনটাই তুমি দখল করে নিয়েছ’।
‘না, ঠিক নয়। আমি তার পাশে একটু স্থান ভিক্ষা পেয়েছি মাত্র’। ডোনার চোখে ছিল অশ্রু, ঠোঁটে হাসি।
‘ডোনা, তুমি অনেক বড়। আবার বলছি আমি ভাগ্যবান’।
ডোনা চোখ মুছে বলেছিল, ‘থাক ওসব কথা। আমার কথার জবাব তুমি দাওনি’।
আহমদ মুসা গম্ভীর হয়ে উঠেছিল। বলেছিল, ‘আমার সাথে দেবার তোমার ‘কেউ’ নেই তা ঠিক নয়’।
‘কে আছে?’ চোখ ছানাবড়া করে বলল ডোনা।
‘কেন আল্লাহ। আল্লাহ কি যথেষ্ট নয়?’
শোনার সঙ্গে সঙ্গে ডোনা ‘আল হামদুলিল্লাহ’ বলে দু’হাতে মুখ ঢেকেছিল আনন্দের উচ্ছ্বাসটা ঢেকে ফেলার জন্যে। তারপর মুখের উপর থেকে হাত সরিয়ে উজ্জ্বল চোখ দু’টি আহমদ মুসার দিকে তুলে ধরে বলেছিল, ‘ধন্যবাদ আমাকে স্মরণ করিয়ে দেয়ার জন্যে। আমার তরফ থেকে আল্লাহ তোমার নেগাহবান’।
‘আলহামদুলিল্লাহ। দোয়া করো’।
বলে আহমদ মুসা একটু থেমেছিল। বলেছিল তারপর, ‘তাহলে আসি। ওঁরা অপেক্ষা করছে’।
‘এসো’। বলেছিল ডোনা ম্লান হেসে।
কিন্তু বিদায়ের সময় কেঁদেছিল ডোনা। চোখের অশ্রু আড়াল করার চেষ্টা করেও সে পারেনি।
ডোনার সেই অশ্রু সিক্ত মুখটাই এখন ভেসে উঠছে আহমদ মুসার মানস-চোখে।
আহমদ মুসার চোখের কোণটাও সিক্ত হয়ে উঠেছিল। আহমদ মুসা স্টেয়ারিং থেকে বাম হাতটা সরিয়ে সিটের উপর থেকে রুমালটা তুলে নিয়ে চোখ ভালো করে মুছে নিল।
গাড়ি ছুটে চলছে তীরের বেগে।
‘আবদুল্লাহ (ব্ল্যাক বুল) তোমার বাড়ি বারবারেতি থেকে কতদুর?’ পেছনে ব্ল্যাক বুলের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা।
‘যা দেখেছি ম্যাপে, বাস্তব কিছু জ্ঞান নেই। হবে হয়তো একশ’ দেড়শ’ কিলোমিটার’।
‘আমরা তো বোমাসায় যাব ঐ দিক দিয়েই’।
‘খুব মজার হবে। আমার আবাল্য একটা সাধ এতে পূরণ হবে’।
‘কিন্তু এলাকার মাটি, গাছ ইত্যাদি ছাড়া আর কি দেখতে পাবে?’
‘তবু গ্রামটাকে চোখ ভরে দেখব।’
‘আল্লাহ তোমার আশা পূরণ করুক।’
‘আমরা যখন বোমাসাতেই যাচ্ছি, তখন বাববারেতি না গিয়ে আমরা সামনে কাদেলি হয়ে স্টিম বোটে সংঘ নদী দিয়ে বোমাসা যেতে পারতাম।’
‘তা পারতাম, কিন্তু ঘটনার কেন্দ্র বাবরারেতি অবশ্যয় যাওয়া প্রয়োজন। পণবন্দীদের ওরা কোথায় রাখতে পারে তা জানার সব রকম চেষ্টা আমাদের করা উচিত।’
‘কোথায় রাখতে পারে?’
‘বলা মুস্কিল। কিন্তু আমি ভাবছি আমার আত্নসমর্পণের স্থান ওরা বোমাসায় নির্ধারণ করল কেন?’
‘দুর্গম বলেই হয়তো। সভ্যতার আলো তেকে অনেক দূরে ঐ এলাকা। রেল, বাস ইত্যাদি ঐ এলাকার মানুষ চোখেই দেখেনি এখনও।’
‘কিন্তু একা একজন মানুষকে ধরার জন্যে তাকে দুর্গম এলাকায় নিয়ে যাবার প্রয়োজন কি?’
‘আমি জানি না জনাব। ব্যাারটা অস্বাভাবিক বটে।’
‘অস্বাভাবিক যখন, তখন এর তাতপর্য নিয়ে বাবা উচিত।
কথা শেষ করেই ডানে তাকাল আহমদ মুসা। সামনেই ডানে বাতেরী শহর।
শহরের একেবারে উত্তর পাশ ঘেঁষে হাইওয়েটি। আর সীমান্তের কাছাকাছি ক্যামেরুনের শেষ শহর বারতুয়া অতিক্রম করেছে হাইওয়েটি শহরের দক্ষিণ পাশ ঘেঁষে।
আহমদ মুসার গাড়ি বারতুয়া পার হওয়ার পর দু’কিলোমিটারের মাথায় একটা বিপত্তিতে পড়ল।
আহমদ মুসার গাড়ির সামনে প্রাইভেট পরবহান কোম্পানীর একটা ট্যাক্সি চলছিল। হঠাত ট্যাক্সিটি তার পথ চেড়ে বেঁকে গিয়ে আহমদ মুসার গাড়ির সামনে এসে পড়ল।
ব্যাপারটা এত দ্রুত ঘটে গেল যে আহমদ মুসা তার গাড়ি পুরো নিয়ন্ত্রণে আনার সুযোগ পেল না। আহমদ মুসার গাড়ির মাথা সোজা গিয়ে আঘাত করল বেঁকে আসা ট্যাক্সির সামনের দরজায় কৌণিকভাবে।
ট্যাক্সিটি কিছুটা ছিটকে পড়ে থেমে গেল। আহমদ মুসার গাড়িও থেমে গিয়েছিল। আহমদ মুসা তাড়াতাড়ি গাড়ি থেকে নেমে ছুটল ট্যাক্সিটির দিকে।
ট্যাক্সির সামনের দরজার দুমড়ে গিয়ে কিচুটা ভেতরের দিকে বসে গিয়েছিল।
ট্যাক্সিটিতে ছিল একজন আরোহী এবং একজন ড্রাইভার।
আরোহী মাঝ বয়সী একজন কৃষ্ণাঙ্গ। ড্রাইভারও তাই। আরোহীর মাথার এক পাশের অল্প্ একটু জায়গা থেঁতলে গেছে। আর ড্রাইভারের কপাল অনেকখানি কেটে গেছে বিয়ারিং হুইলে ধাক্কা খেয়ে।
দু’জনেই গাড়ি থকে বের করল আহমদ মুসা।
আরোহীটির মাথার থেঁতলানো জায়গা এবং ড্রাইভারের কাটা কাপাল দিয়ে রক্ত ঝরছিল। ক্ল্যাক বুল ফাস্ট এইড বক্স সহই গাড়ি থেকে নেমেছিল।
আহমদ মুসা তাকে ধন্যবাদ দিয়ে ওদের আহত স্থান ব্যান্ডেজ করে দিল। ফাস্ট এইডের জিনিসপত্র গুছিয়ে নিতে নিতে আহমদ মুসা বলল, ‘শেষ মুহূর্তে আমি আমার গাড়িটি নিয়ন্ত্রণে আনতে পারিনি, আমি দু:খিত।’
‘কি বলেন আপনি। আপনাকেই আমাদের হাজার বার ধন্যবাদ দেয়া উচিত। আপনি গাড়ি যতটুকু সামলিয়ে ছিলেন, ততটুকু না সামলালে গাড়ি চিড়া চেপ্টা হয়ে যেত। আপনি আমাদের বাঁচিয়েছেন।’ বলল ড্রাইভার লোকটি বিনয়ের সাথে।
‘ঠিক বলেছ ড্রাইভার। কিন্তু এমন হলো কেন? গাড়িতে কি তোমার ক্রুটি আছে?’ বলল আরোহীটি।
‘না কোন ক্রুটি নেই। হঠাত ব্রেকফেল এমন কোন দিনই হয়নি।’
‘আপনারা কোথায় যাচ্ছিলেন?’ বলল আহমদ মুসা।
আরোহীটিকে ইংগিত করে ড্রাইভার বলল, ‘উনি যাবেন বারবারেতি। আমি সীমান্ত পর্যন্ত ওকেঁ পেৌছে দিচ্ছিলাম।’
বারবারেতির নাম মুনে চমকে উঠল আহমদমুসা। অজান্তেই তার দৃষ্টি আরোহীটির উপর গিয়ে পড়ল। মনটা আহমদ মুসার খুশীই হলো্ অন্তত বারবারেতির অবস্থা কিছুটা জানা যেতে পারে তার কাছ থেকে। বলর, আহমদমুসা,’ আপনাদের তো ভীষণ অসুবিধা হলো।’
‘আমার কিছু ক্ষতি হলো্ কিন্তু অসুবিধা হলো আমার আরোহীর। আমি কোনভাবে ফিরতে চাই্ উনি সীমান্তে পৌছবেন কি করে। এ সময় ভাড়া গাড়িও মিলবে না্ আপনারা কোথায় যাচ্ছেন?’
‘আমরা বারবারেতি যাচ্ছি। উনি ইচ্ছা করলে আমাদের সাথে যেতে পারেন।’ আহমদ মুসা বলল।
‘আপনি এ সাহায্য করবেন! কি যে উপকার হবে আমার্ ঈশ্বর আপনাকে কৃপা করুক।’ বলল আরোহী লোকটি আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে।
‘ধন্যবাদ।’ বলল আহমদ মুসা্ ট্যাক্সির ড্রাইভার উঠে গিয়ে গাড়ির ইঞ্জিন পরীক্ষা করে এসে বলল, ‘সব ঠিক আছে। এখন অনুমতি দিলে আমি যেতে পারি।’
‘ট্যাক্সিটা কার?’ আহমদ মুসা বলল।
‘প্রাইভেট কোম্পানীর।’
‘আপনার শেয়ার আছে তাতে?’
‘নেই।’
গাড়ি মেরামতের ব্যয় কে বহন করবে?’
‘অর্ধেক বহন করতে হবে আমাকে।’
‘কষ্ঠ হবে না আপনার?’
‘এ প্রশ্ন করছেন কেন?’
‘আমার গাড়ির ধাক্কায় আপনার গাড়ির ক্ষতি হয়েছে। ক্ষতি মেরামতে আমি অংশ নিতে চাই্’
বলে আহমদ মুসা পকেট তেকে এক হাজার ফ্রাংকের পাঁচটি নোট বের করে ড্রাইভারের দিকে তুলে ধরল।
ড্রাইভার টাকা নিতে দ্বিধা করে বলল, ‘আপনি বিদেশী পর্যটক, আমাদের মেহমান। এ টাকা নেয়া অন্যায় হবে।’
আহমদ মুসা টাকাটাতার পকেটে গুজেঁ দিয়ে বলল, ‘গাড়ি অন্যের না হলে এ টাকা আপনাকে দিতাম না্’
কথা না বলে কিছুক্ষণ মাথা নিচু করে থাকল ড্রাইভার্ যখন মাথা তুলল তার চোখ দু’টি ছল ছল করছে। বলল, ‘ আমার মা জটিল অসুখে ভুগছেন। তার চিকিতসার জন্যে কিচু টাকা জমিয়েছি। সেই টাকা দিয়ে গাড়ি ঠিক করব ভেবেছিলাম। আপনার টাকা মা’র চিকিতসা সম্ভব করে তুলবে। প্রভু স্রষ্টা আপনার মঙ্গল করুন।’
‘ধন্যবাদ। আল্লাহ আপনার মাকে সুস্থ করে তুলুক।’ বলে আহমদ মুসা নিজের গাড়ির দিকে এগুলো সেই আরোহী লোকটাকে তার সাথে আসতে বেল।
আহমদ মুসা আরোহীটিকে তার পাশের সিটে বসাল।
‘বারবারেতি বাড়ি বললেন? নাম কি আপনার?’বলল আহমদ মুসা।
‘নাম ডেনিয়েল। বারবারেতি থাকি।’ একটু সময় নিয়ে উত্তর দিল।
আহমদ মুসা চকিতে তার মুখের দিকে একবার তাকাল।
আহমদ মুসা আর কোন প্রশ্ন জিজ্ঞেস না করার আগেই সে প্রশ্ন করল, ‘ আপনি তো পর্যটক। বারবারেতি কি আপনার কাছে আকর্ষনীয়?’
পর্যটক হলে প্রশ্নটার উত্তর কিছু না ভেবেই দিতে পারত আহমদ মুসা। কিন্তু আহমদ মুসা তা নয়। সুতরাং মুহূর্ত কয়েক ভেবে নিয়ে সে বলল, ‘নতুন দেশ নতুন স্থান দেখার মধ্যেই আমার আগ্রহ। আফ্রিকার প্রকৃতিই আমাকে আকর্ষণ করে বেশী।’
‘আফ্রিকার সত্যিকার প্রকৃতি দেখতে হলে যেতে হবে বোমাসা এবং আরও দক্ষিণে।’
‘আমি সব চিনি না। প্রথম সফর তো!’
‘বারবারেতি খারাপ নয়। তবে আধুনিক হয়ে উঠছে তো। বাইরের পর্যটকদের কাছে আকর্ষণ হারচ্ছে। তার উপর ..’
কথা শেষ না করেই থেমে গেল ডেনিয়েল নামের লোকটি।
‘তার উপর কি?’ একটু মুখ ঘুরিয়ে তার দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা।
‘এই সেদিন বারবারেতিতে সাংঘাতিক দুর্ঘটনা ঘটে গেল তো। বাইরের অনেকেই সেখানে আসতে দ্বিধা করছে।’
আহমদ মুসা মনোযোগী হলো ডেনিয়েলের প্রতি। কিন্তু তার দিকে না তাকিয়ে নিরাসক্তভাবে জিজ্ঞেস করল, ‘দ্বিধা করছেন কেন? কোন ভয় আচে? দুর্ঘটনা সম্পর্কে আমি তেমন কিছুই জানিনা।’
‘উল্লেখযোগ্য কিছু বিদেশীসহ অনেক লোক মারা গেছে দুর্ঘটনায়। বাইরের চাপ আছে। তদন্ত চলছে। একটা আতংক আর কি।’
‘তদন্ত চলছে। আবার বাইরের চাপ আছে। তাহলে তো বড় ঘটনা্ আসল ব্যাপার কি বলুন তো?’
‘আমরা সকলে একে একটা বড় দুর্ঘটনা বলেই জানি। অবশ্য কেউ কেউ বলে ওটা একটা লাগানো আগুন। আবার অনেকে মনে করেন, সম্মেলনের উদ্যোক্তারা কোন কারণে কিচু বিস্ফোরক হয়তো ভেতরে রেখেছিলেন। তা থেকেই আত্নঘাতি ঘটনা ঘটেছে।’
‘সম্মেলন স্থানে আগুন লাগাতে যাবে, এমন কোন শত্রু কি সম্মেলনের উদ্যোক্তাদের ছিল?’
‘নিশ্চিত করে কিছুই বলা যায় না। তবে মধ্য আফ্রিকার সম্ভাবনাময় এই অঞ্চলে মুসলমানদের নতুন শক্তিবৃদ্ধির চেষ্টা অনেকেই ভালো চোখে নাও দেখতে পারে।’
‘অনেকে বলতে কাদের বুঝাচ্ছেন? সাধারণ জনগণ?
কাউকেই নির্দিষ্ট আমি করিনি। আমার ধারণা বলেছি মাত্র।
আহমদ মুসার মনে হলো ডেনিয়েল লোকটা জানে অনেক কিছু। কথার ধরনে তাকে খুব চালাক বলে মনে হলো আহমদ মুসার। কে লোকটি? লোকটির চেহারায় ভদ্রতার কাটিং আছে। তার আডালে একটু লক্ষ্য করলেই দেখা যায়, কর্কশ একটা রূপ তার আছে। আর তার ভাষায় আঞ্চলিক টান নেই। অর্থাৎ বাঁটু ভাষা বললেও বাঁটু সে নয়।
মধ্যে আফ্রিকা প্রজাতন্ত্রের কোন এলাকায় আপনার বাডি? জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা
আমার বাডি তানজানিয়ায়। তবে এখানে বহুদিন থেকেই। আবার এসেছি।
কেন জানি হটাত আহমদ মুসার মনে পডল যে বারবারেতির বিস্ফোরণ সম্পর্কিত ব্ল্যাক ক্রসের বিজ্ঞপ্তিটির একটা ঠিকানা স্মরণ করতে পারলো না।
সীমান্তের চেক পোষ্ট এসে গেছে। গাডি থামাতে হলো আহমদ মুসাকে। খুশী হলো আহামদ মুসা সীমান্তের চেক পোষ্টে তেমন কোন ঝক্কি ঝামেলা নেই, শুধু পাসপোর্ট দেখে তাকে একটা ভিসায় সিল দিয়েই খালাস। তাও আবার গাডি থেকে নামতে হয় না। গাডিতে এসে পুলিশ পাসপোর্ট চেক করে।
সীমান্ত অতিক্রমের পর আবার আগিয়ে চলল গাডি সোজা পূর্ব দিকে বারবারেতি লক্ক্যে।
সীমান্ত থেকে ২৫ কিলো মিটার দূরে বারবারেতি পথে আরেকটি ছোত্র শহর। নাম গাম্বুলা।
আহমদ মুসার গাডি। গাম্বুলা শহর অতিক্রম করছিল। শহরের ধক্ষিন পাশ ঘেসে রাস্তি, আর রাস্তার দক্ষিণ পাশ দিয়ে একটা ছোট নদী। শহর অতিক্রম করার আগেই ছোট নদীটি বাক নিয়ে দক্ষিণ দিকে চলে গেছে। তার সাতে বারবারেতির হাইওয়ে থেকে একটা সডক বের হয়ে ছোট নদীটির তীর বরাবর দক্ষিণে চলে গেছে।
বেলা তখন আডাইটার মত।
ছোট শহর তার উপর অফিস ও স্কুল – কলেজ ছুটির পরবর্তী ভাটির সময়। রাস্তা ঘাটে লোকজন। গাডি ঘোডা খুবই কম।
রাস্তাটিও তীরের মত সোজা
দু হাত স্তেয়ারিং এ রেখে দু টি চোখ সামনে ছুডে দিয়ে বলা যায় সিটে গা এলিয়ে দিয়েছিল একটা জীপ গাডি।
সামনেই চলছিল একটা জীপ গাডি।
সামনেই নদীটি দক্ষিণ দিকে বাক নিয়েছে এবং হাইওয়ে থেকে সেই সডকটিও বেরিয়ে গেছে দক্ষিণের দিকে।
জিপটির পেছনের দক্ষিন দিকের রেড লাইট জ্বলে উঠল। সিগনাল দিতে শুরু করল। জিপটা দক্ষিনের সডকে নেমে যাবে জিপটি টার্ন নিতে গিয়ে কয়েকবার হর্ন দিল।
হর্ন শুনে চমকে উঠল আহমদ মুসা।
জিপটি ব্ল্যাক ক্রস এর কোডে হর্ন দিচ্ছে কেন? জিপটি তাহলে কি ব্ল্যাক ক্রস এর।
দ্রত চিন্তা করছিল আহমদ মুসা।
ব্ল্যাক ক্রসকে এত কাছে পেয়ে তেদের তো সে ছেডে দিতে পারে না, দক্ষিণ দিকেই। ব্ল্যাক ক্রসের গাডি কোথায় যাচ্ছে? বোমাসা এখান থেকে দক্ষিণ দিকেই, ব্ল্যাক ক্রস এর গাডি আনুসরন করে সে ওদের কোন ঘাটি বা ঠিকানা অথবা ভাগ্য সুপ্রসন্ন হলে মুসলিম পনবন্দিদেরও খোজ সে পেয়ে যেতে পারে।
সিদ্ধান্ত নিয়ে নিল আহমদ মুসা।
ড্যানিয়েলকে উদ্ধেশ্য করে বলল মিঃ ডেনিয়েল এখানে থেকে বারবারেতি যাবার ট্রান্সপোর্ট পাওয়ায় কোন আসুবিধা আছে?
না এ কথা কেন বলছেন?
আমরা এখানে থেকে একটু বাম দিকে যেতে চাই, আপনার আসুবিধা হয় কিনা তাই বললাম।
আমার কোন আসুবিধা হবে না। কিন্তু আপনারা কি বারবারেতি যাচ্ছেন না?
আপাতত নয়।
আহমদ মুসা লক্ষ্য করলে দেখতে পেত। ডেনিয়েল নামক লোকটির চোখে মুখে মুহূর্তের জন্যে বিস্ময় ফুটে উঠছে, তারপরেই সেখানে বিস্ময়ের বদলে অর্থপূর্ণ এক আনুসদ্ধান ভাব ফুটে উঠল। যেন এই প্রথম বারের মত সে গভীর দৃষ্টতে পর্যবেক্ষণ করছে আহমদ মুসাকে। ধীরে ধীরে সে বলল এখানেই তো আপনাদের বামে ঘুরতে হবে, মোডটার উপর আমাকে নামিয়ে দিন।
আমরা দুঃখিত মিঃ ডেনিয়াল। বলল আহমদ মুসা।
না ধন্যবাদ। পর্যটকদের প্রোগ্রাম ঠিক থাকে না আমি জানি মিঃ ডেনিয়ালের কথাগুলো যত সরল তার মুখের হাসি ততটা সরল নয়।
মোডে নেমে গেল মি;ডেনিয়াল।
আহমদ মুসার গাডি ছুটল নদীর তীর বরাবর দক্ষিণ গামী সডক ধরে ব্ল্যাক ক্রস এর জীপটির পিছু পিছু।
গাডি থেকে নেমেই ডেনিয়াল চারদিকে চাইল ট্যাক্সির সন্ধানে।
ডেনিয়ালের মাথায় চিন্তাটা তখন গুছিয়ে আসেছে। ব্ল্যাক ক্রস এর গাডির হর্ন সেও শুনেছে। সে নিশ্চিত এই হর্ন শুনেই পর্যটক তার গন্তব্য পাল্টেছে এবং ব্ল্যাক ক্রস এর জীপটাকে সে আনুসরন করছে।
কিন্তু কেন? কে এই পর্যটক? কেন ব্ল্যাক ক্রস এর গাডি সে আনুসরন করল। ব্ল্যাক ক্রস এর কোড সে জানল কি করে?
ছোট শহর গাডি পাওয়া মুস্কিল।
একটু ভাবল ডেনিয়েল। তারপর সে অয়্যারলেস ট্রান্সমিটার বের করল পকেট থেকে। ছোট সিগারেট লাইটারের মত।
ডেনিয়েল জানে না ব্ল্যাক ক্রস এর জিপে কে যাচ্ছে। তার কাছে অয়্যারলেস আছে কিনা। তবু ডেনিয়েল ব্ল্যাক ক্রস এর মাস্টের চ্যানেলে মেসেজ থ্রো করল। বলল ছোট কাদেলীয় সডকে ব্ল্যাক ক্রস এর জীপটিকে একজন পর্যটক আনুসরন করছে।
ব্ল্যাক ক্রস এর অয়্যারলেস নেটওয়ার্কের মাস্টার চ্যানেল একটা গোপন ও জরুরী লাইন। চ্যানেলে ব্ল্যাক ক্রস এর সব পয়েন্টে মেসেজ পৌছানো যায়।
মেসেজ পাঠানোর পর মুহূর্তেই জবাব পেয়ে গেল ডেনিয়েল অয়্যারলেসে ভেসে আশা কণ্ঠ বলল ধন্যবাদ মেসেজের জন্য আমি নজর রাখছি। কিন্তু পর্যটকের মতলব কি?
আমি জানি না তবে লোকটা খুব সহজ হবে না। আপনার সাথে কে আছে?
স্ত্রী এবং ছেলে। আমি যাচ্ছি সলো। চিন্তা করো না লডাই করার মত অস্ত্র আমার আছে। গাডি খুজছি আসছি আমি।
কথা শেষ করতেই গাডি পেয়ে গেল ডানিয়েল। গাডি তার ছুটল আহমদ মুসার গাডির পিছু পিছু।

সাম্নের গাডি একই গতিতে চলছে কোথাও দাডায়নি, গতি কমবেশিও হয়নি।
আহমদ মুসা ভাবল ব্ল্যাক ক্রস এর গাডিটি পেছনে সম্ভবত চোখ রাখেনি। কেউ আনুসরন করছে সন্দেহ নিরসনের জন্যে কিছু পরিক্ষা নীরিক্ষার চেষ্টা করে। কিন্তু সামনের গাডিটি তেমন কিছুই করেনি।
আহমদ মুসা খুশী হলো। ওকে সন্দেহ মুক্ত রাখলে ওদের ঠিকানায় পৌছা সহজ হবে।
আহমদ মুসা সামনে মানচিত্রের দিকে চেয়ে দেখল ছোট কাদেলী নদী সংঘ নদীর কাছাকাছি গিয়ে বড কাদেলী নদীতে মিশেছে। তারপর পডেছে গিয়ে সংঘ নদীতে, ঠিক সেই ভাবে রাস্তাটিও গিয়ে পডেছে সংঘ নদীর তীর বরাবর প্রলম্বিত সডক।
সংঘ নদীতে বরাবর দক্ষিনে আগিয়ে সডকটি শেষ হয়েছে ছোট গ্রাম বন্দর সলোতে।
তোমার দাদার গ্রামের নাম জান কি? ব্ল্যাক বুলকে উদ্দেশ্য করে জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা
সলো। বলল ব্ল্যাক বুল।
আমরা তো ধীরে ধীরে সলো এর দিকেই যাচ্ছি দেখছি।
তাই মনে হচ্ছে।
কি জানি বারবারেতি যাওয়া বোধ হয় হলো না।
সলো র দিকে যাচ্ছি বলে আমি কিন্তু খুব খুশী
সেই সলো কি আছে।
সেই মাটি আছে। সেই সংঘ আছে অনেক পুরানো গাছও আছে হয়তো সেদিনের সাক্ষী আছে।
তা আছে।
আহমদ মুসা আর কোন কথা না বলে সামনের দিকটা একবার দেখে নিয়ে ড্যাস বোর্ডের উপর রাখা মানচিত্রের দিকে আবার মনোযোগ দিল।
শুরুর দিকে রাস্তা তীরের মত সোজা ছিল। কিন্তু তার পরেই নদীর সমান্তরালে আকা বাকা হয়ে আগিয়ে গেছে রাস্তাটি। দু ধারেই ঘন বন কাছেই নদী কিন্তু দেখা যায় না।
খুবই ভালো লাগছে নিঝুম পরিবেসে বন ছায়া ঘেরা পথে ড্রাইভ করতে। আহমদ মুসা ভাবল যতই দক্ষিণে আগুনো যাবে বন জংগলের নিবিডতা ততই বাডবে, আফ্রিকার বিখ্যাত রেইন ফরেস্ট এলাকার চিহ এখনই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, কঙ্গো নদী ও তার অসংখ্য শাখা ও উপনদী স্নাত কঙ্গোর মধ্যে দক্ষিণ অঞ্চলটি পৃথিবীর সবচেয়ে দুর্ভেদ্য বনাঞ্চল, বোমাসা থেকে এই এলাকার শুরু।
ড্রাইভ করতে ভাল লাগলেও মুস্কিল হয়েছে সামনের গাড়িটাকে চোখে রাখার ব্যাপারটা। আঁকা বাঁকা এবং জংগলের দেয়ালে ঘেরা রাস্তায় অধিকাংশ সময়ই গাড়িটা চোখের আড়ালে থাকছে, যদিও দূরত্ব এখন দু’শ গজের বেশী নেই।
এ ধরনের রাস্তায় শত্রুর অনুসরণ আহমদ মুসার একদম নতুন অভিজ্ঞতা। সামনে-পেছনে দু’দিকটাই তার কাছে এখন অরক্ষিত মনে হচ্ছে। গাড়ির রিয়ারভিউ এখন আর কাজ দিচ্ছে না, সামনেও বনের দেয়ালে চোখ ধাক্কা খাচ্ছে। আহমদ মুসার মনে হচ্ছে, পরিস্থিতির উপর তার কোন নিয়ন্ত্রণ নেই, এক অমোঘ ব্যবস্থা যেন তাকে এগিয়ে নিচ্ছে, সে চলছে ঠিক অন্ধের মতই।
অন্ধত্ব ঘুচে গেল, যখন আহমদ মুসা তার নাকের ডগার উপর দেখল, কাদেলী সড়কটি সামনেই বারবারেতি-সলো সড়কের সাথে গিয়ে মিশেছে এবং মোড়ের উপর দাঁড়িয়ে আছে দু’টি জীপ এবং তাতে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে চারজন লোক। তাদের হাতে রিভলবার।
বিস্ময় কাটিয়ে উঠবার আগেই পেছনে শব্দ শুনে মুখ ফিরাল। দেখল, একটি গাড়ি পেছন থেকে প্রায় পাশে এসে দাঁড়িয়েছে।
বিস্মিত হলো আহমদ মুসা, গাড়িটার ড্রাইভিং সিটে ডেনিয়েল। তার হাতেও রিভলবার।
সবই বুঝল আহমদ মুসা। সে ফাঁদে পড়ে গেছে। কিন্তু কি করে? বুঝা যাচ্ছে, ডেনিয়েল ব্ল্যাক ক্রসের লোক। এবং এরা সবাই তাই। কিন্তু আহমদ মুসাকে চিনেছে কি ওরা? ডেনিয়েলের সাথে কথা বলে তো তা মনে হয়নি!
আহমদ মুসা কিছু চিন্তা করার আগেই ডেনিয়েল রিভলবার বাগিয়ে জীপ থেকে নেমে এল।
আহমদ মুসার কাছে এসে রিভলবার বাগিয়ে বলল, ‘মিঃ পর্যটক চলুন, ওরা আপনাকে স্বাগত জানাবার জন্যে অপেক্ষা করছেন।’
আহমদ মুসা গাড়ি থেকে নামল।
ব্লাক বুলও নামতে যাচ্ছিল। ডেনিয়েল ধমক দিয়ে বলল, ‘চুপচাপ বসে থাক গাইডের বাচ্চা। আসলটাকে দেখি, তারপর দরকার হলে…
বলে রিভলবার নাচিয়ে আবার বলল, ‘চলুন পর্যটক সাহেব।’
আহমদ মুসা হাঁটতে শুরু করল। তার দু’টি হাত জ্যাকেটের দুই পকেটে।
রিভলবার বাগিয়ে পেছনে পেছনে হাঁটছিল ডেনিয়েল।
দু’টি গাড়ি দাঁড়িয়েছিল সড়কের ওপ্রান্ত অর্থাৎ পুব প্রান্তে ঘেঁসে। গাড়িতে ঠেস দেয়ে ওরা চারজন দাঁড়িয়েছিল নির্বিকভাবে।
ওদের চার গজের মধ্যে গিয়ে আহমদ মুসা দাঁড়িয়ে পড়ল।
চারজনের একজন বলল, ‘মিঃ ডেনিয়েল এঁর পকেটগুলো দেখুন।’
ডেনিয়েল পেছন থেকেই ডান হাতে রিভলবার ধরে রেখে বাম হাত দিয়ে জ্যাকেট এবং প্যান্টের পকেট সার্চ করল। জ্যাকেটের পকেটে একটা রিভলবার পেল মাত্র।
গাড়িতে ঠেস দেয়া যে লোকটি পকেট সার্চের নির্দেশ দিয়েছিল, সেই আবার বলে উঠল, ‘কে তুমি? আমাদের পিছু নিয়েছিলে কেন?’
‘আমি ব্ল্যাক-ক্রস-এর সন্ধান করছি।’
‘ব্ল্যাক-ক্রস-এর কোড তুমি জান কি কওে?’
‘ব্ল্যাক-ক্রস আমার পুরনো বন্ধু।’ আহমদ মুসার ঠেটে ফুটে উঠল এক টুকরো হাসি।
‘পাঁচটা রিভলবারের মাঝখানে দাঁড়িয়ে হাসছ, জোক করছ? কে তুমি?’
‘ব্ল্যাক-ক্রস-এর পুরানো বন্ধু।’
কথা বলছিল যে লোকটি সে আহমদ মুসার দিকে রিভলবার তাক করে বলল, ‘তোমার সাথে রসিকতা করার জন্যে আমরা এখানে বসে নেই। কে তুমি, কেন আমাদের পিছু নিয়েছিলে?’
‘একজন এশিয়ান আমি। ফ্রান্স থেকে আমি এসেছি। দেখতেই পাচ্ছেন আমি পর্যটক।’
পর্যটক হিসেবে তুমি আমাদের অনুসরণ করনি। কে তুমি? কেন তুমি ব্ল্যাক ক্রস-এর সন্ধান করছ?
‘পিয়েরে পল আমার পুরানো বন্ধু কিনা।’
ওরা চারজন একে অপরের দিকে তাকাল। তাদের চোখ নাচল। সম্ভবত ক্রোধ এবং বিস্ময়ে। বিস্ময়ের কারণ তাদের মুঠোয় আসা অপরিচিত একজন লোকের ঔদ্ধত্য। আর ক্রোধের কারণ নিহত পিয়েরে পলকে লোকটি বিদ্রুপ করছে।
কথা বলছিল যে লোকটি, সে তার সাথের রিভলবারধারী একজনকে লক্ষ করে বলল, ‘মুখটা ওর ভেঙে দাও। বুঝিয়ে দাও আমরা রসালাপ করতে আসিনি।’
হুকুম পেয়ে লোকটা ছুটে গেল আহমদ মুসার দিকে। রিভলবারের বাঁট দিয়ে আহমদ মুসার মুখে, ঘাড়ে, মাথায় আঘাত করল।
আহমদ মুসার কপাল ও মুখের কয়েক জায়গা ফেটে সেখান থেকে রক্ত গড়াতে লাগল।
আহমদ মুসা দাঁড়িয়েছিল পাথরের মত। ভাবলেশহীন তার মুখ। কিন্তু সে এই ধরনের আক্রমন আশা করেনি। আহমদ মুসা তার কথার দ্বারা ব্ল্যাক ক্রসের লোকদের রাগিয়ে দিতে চেয়েছিল। রাগলেই মানুষ ভুল করে।
‘এতক্ষণ তোমার মাথার খুলি উড়ে যেত, কিন্তু তা আমরা কারনি। তোমাকে জানতে হবে আমাদের। আমরা এক এশিয়ানকে খুঁজছি।’ রক্তাক্ত আহমদ মুসার দিকে চেয়ে ক্রুর হেসে বলল সেই লোকটি।
সে থামতেই যে লোকটি আহমদ মুসাকে আঘাত করেছিল, সে চিৎকার করে বলল, ‘বল এবার, তুমি কে? দেরী করলে এখন প্রথম তোমার নাক ভাঙব, তারপর হাত-পা ভাঙা শুরু করব।’
‘কষ্ট করে বলার দরকার নেই। ইতিমধ্যেই প্রমাণ করেছ এসব তোমরা পার।’
‘আবার বিদ্রুপ।’ বলে আহমদ মুসার সামনে দাঁড়ানো রিভলবারধারী লোকটা আবার তার রিভলবারের বাঁট তুলল আহমদ মুসার নাক লক্ষ্যে।
আহমদ মুসা এবার এ্যাকশনে যাবার সিন্ধান্ত নিল। সে তার মাথাটা বিদ্যুৎ গতিতে সরিয়ে নিয়ে ডান হাত দিয়ে রিভলবার কেড়ে নিয়ে লোকটার সামনে ঝুঁকে আসা তলপেট লক্ষে প্রচন্ড একটা কিক চালাল। এবং তার সাথে সাথে চোখের পলকে হাতের রিভলবারটা পেছনের দিকে ঘুরিয়ে গুলী করল পেছনে দাঁড়ানো ডেনিয়েলকে লক্ষ্য করে।
ঘটনার আকস্মিকতা হকটকিয়ে দিয়েছিল ডেনিয়েলকে। সি কিছু সিন্ধান্ত নেবার আগেই গুলী খেয়ে পড়ে গেল রাস্তার উপর।
গুলী করেই আহমদ মুসা তার রিভলবার সামনে ঘুরিয়ে নিল।
সামনের লাথি খাওয়া লোকটি তখন টলতে সটলতে পড়ে যাচ্ছিল।
আহমদ মুসা তার মাথার উপর দিয়ে দুইটি গুলী ছুড়ল পর পর। গুলী করেই নিজের দেহটা ছুড়ে দিল রাস্তার উপর। দ্বিতীয় গাড়ির কাছে দাঁড়ানো তৃতীয় লোকটি রিভলবার তুলেছিল গুলী করার জন্যে।
তলপেটে আহমদ মুসার লাথি খাওয়া লোকটা পড়ে যাবার মুখেও উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করছিল।
তৃতীয় লোকটির গুলী এসে তার মাথায় বিদ্ধ করল পেছন দিক থেকে।
আহমদ মুসা মাটিতে পড়েই তার রিভলবার তৃতীয় লোকটিকে তাক করেছিল। কিন্তু তার গুলী গিয়ে বিদ্ধ করল তৃতীয় লোকটির রিভলবার ধরা হাতে। রিভলবার পড়ে গিয়েছিল তার হাত থেকে।
আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল।
তৃতীয় লোকটি ঝাঁপিয়ে পড়েছিল হাত থেকে পড়ে যাওয়া রিভলবারটি তুলে নেয়ার জন্যে। কিন্তু সে রিভলবার তুলে নিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াবার আগেই আহমদ মুসার রিভলবার তার লক্ষ্যে উঠে গিয়েছিল। আহমদ মুসার তর্জনি রিভলবারের ট্রিগারে চেপে বসছিল।
ঠিক এ সময় গাড়ির আড়াল থেকে একটি শিশু ছুটে তৃতীয় লোকটির সামনে এসে তাকে আড়াল করে দাঁড়িয়ে কান্না জড়িত কন্ঠে চিৎকার করে উঠল, ‘আমার আব্বুকে মের না।’
আরেকটা মহিলাও গাড়ির ওপাশে দাঁড়িয়েছিল। তার চোখে-মুখে মৃত্যুর আতংক।
শিশুটির বয়স পাঁচ ছয় বছর হবে।
শিশুটির আকুল আর্তি এবং ব্যাকুল চোখের দিকে তাকিয়ে আহমদ মসার হৃদয় কেঁপে উঠেছিল এক বেদনায়। তার তর্জনি সরে এসেছিল ট্রিগার থেকে। নেমে যাচ্ছিল রিভলবার সমেত তার হাত।
শিশুর আড়ালে দাঁড়ানো তৃতীয় লোকটি রিভলবার হতে ততক্ষণে সোজা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সোজা হয়ে দাঁড়িয়েই সে গুলী করল আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে।
ত্বরিৎ এক পাশে সরে মাথা ও বুক বাঁচাতে পালেও হাত বাঁচাতে পাড়ল না। গুলী এসে আহমদ মুসার একটা আঙুলসহ হাতের রিভলবারে বিদ্ধ হলো। হাত থেকে পড়ে গেল রিভলবার। আহমদ মুসা তার রিভলবার তুলে নিতে যাচ্ছিল।
শিশুর আড়ালে দাঁড়ানো সেই তৃতীয় লোকটি চিৎকার করে উঠল, ‘রিভলবার তুলে নিতে চেষ্টা করলে মাথা গুড়ো হয়ে যাবে।’
এ সময় পাশ এবং পেছন দিক থেকে গুলী বর্ষণ ও গাড়ির শব্দ শুনতে পেল আহমদ মুসা। তাকিয়ে দেখতে পেল, বারবারেতি সড়ক দিয়ে এবং কাদেলা নদীর পথে দুইটি গাড়ি ছুটে আসছে গুলী করতে করতে। আহমদ মুসা দেখল, স্ট্রেনগানের গুলীতে তার জীপের উপরের কভার ঝাঁঝরা হয়ে গেল। কেঁপে উঠল আহমদ মুসা। ব্ল্যাক বুল কি বাঁচতে পেরেছে?
পেছন থেকে চোখ ফেরাবার আগেই আহমদ মুসা তার মাথায় শক্ত কিছুর স্পর্শ অনুভব করল। বুঝল, সেই তুতীয় লোকটির রিভলবার।
অন্যদিকে নতুন আসা দুটি গাড়ি থেকে আরও চারজন নেমে তাদের স্টেনগান ও রিভলবার বাগিয়ে তাকে এসে ঘিরে ফেলল।
নতুন আসা চারজনের একজন আহমদ মুসার মাথায় রিভলবার তাককারী সেই তৃতীয় লোকটিকে লক্ষ্য করে বলল, স্যার এ সব কি দেখছি?
এঁর পরিচয় এখনও পাইনি। তবে ভয়ানক কেউ হবে। মাত্র ৫ সেকেন্ডে আমাদের চারজন লোককে খুন করেছে। বেঁধে ফেল একে। এঁর ব্যাপারে খোঁজ খবর নিয়ে তারপর সিদ্ধান্ত। বলল, আহমদ মুসার মাথায় রিভলবার ঠেকিয়ে দাঁড়ানো তৃতীয় লোকটি।
সেই তৃতীয় লোকটি শুরু থেকে আহমদ মুসার সাথে কথা বলছিল। সেই নির্দেশ করছিল তার সাথীদের এবং সেই আগন্তুকদের নির্দেশ দিল তাকে বাঁধার জন্য আহমদ মুসা বুঝল এদের মধ্যে এরই পদ মর্যাদা সবার উপরে। নিশ্চয় নেতা গোছের কেউ হবে। শিশুটির পিতা সে। নিশ্চয় মেয়েটি তার স্ত্রী হবে। আহমদ মুসা এদের গাড়িকে অনুসরন করে এসেছে।
আহমদ মুসাকে ওরা বেঁধে ফেলল।
বাঁধা হয়ে গেল নেতা লোকটি বলল, ‘বন্দীসহ আমার গাড়ির পেছনে উঠ একজন। আর তিনজন তিনটা গাড়ী নিয়ে এস।
সন্ধ্যা তখন প্রায় আসন্ন।
জীপের পেছনে জীপের মেঝেতে বন্দী আহমদ মুসাকে ফেলে রাখা হলো। স্টেনগান হাতে একজন পেছনের সিটে বসে আহমদ মুসার উপর চোখ রাখল।
জীপটির ড্রাভিংসিটে বসল নেতা গোছের সেই লোকটি। তার পাশের সিটে বসল সেই মহিলা এবং শিশুটি।
মহিলার বয়স ত্রিশের কম হবে। শিশু এবং মহিলা দু’জনেরই মুখ গম্ভীর। সিটে বসেই মহিলাটি একবার পেছনে আহমদ মুসার দিকে তাকাল।
গাড়ী স্টার্ট নিচ্ছিল।
আহমদ মুসা মাথাটা একটু তুলে বলল, তোমরা আমার লোককে কি করলে?
জাহান্নামে গেছে। এখন তোমার কথা ভাব। বলল, ড্রাইভিং সিট থেকে নেতা গোছের লোকটি।
‘বন্দীর নিজের কথা ভাববার কি আছে। আমার কথা ভাববে এবার তোমরা। বলল আহমদ মুসা।
‘তুমি মানুষটা কি বুঝলাম না। তোমার চোখ-মুখ দেখে মনে হচ্ছে, তুমি শ্বশুর বাড়ি যাচ্ছ। তোমার ভয় করছে না?
‘ভয় করলে কি হবে? তোমরা আমাকে ছেড়ে দেবে?
তা কখনও কেউ পারে?
তাহলে ভয় করে লাভ?
‘আচ্ছা মানুষ তো তুমি! লাভের জন্যে কেউ কি ভয় করে? ভয় আসে অপ্রতিরোধ্যভাবে, ভেতর থেকে এবং তা আসে ক্ষতির ভয়ে, জীবনের ভয়ে।
যাদের ক্ষতির ভয় নেই কিংবা জীবনেরও ভয় নেই, তাদের ভয় আসবে কোথা থেকে?
তুমি জীবনের ভয় কর না?
করি না। কারণ মৃত্যু ঠিক সময়ের আগেও আসবে না, পরেও আসবে না।
বাঃ দারুণ দার্শনিক কথা বলেছ। কিন্তু লাভ নেই। মৃত্যু তোমার আসছে। আমাদের চারজনকে তুমি খুন করেছ।
‘চারজন নয়, তিনজন।
‘চতুর্থজনও তোমার কারণেই মরেছে।
সুন্দর যুক্তি। কিন্তু একজনকে মেরে কি চারজনের শোধ উঠবে?
তুমি মানুষ না পাথর? রক্তাক্ত অবস্থায়ও তোমার মুখে বিদ্রুপ আসে? কে তুমি?
যার জীবন নেই বেশীক্ষণ, তার পরিচয়ের কি দরকার?
বাজে বকো না, পরিচয় তোমার আমরা বের করবই।
তা অবশ্যই বের করবে।
‘তোমার কপাল সত্যিই মন্দ। তুমি আমাদের মনে হয় ঠিক চেন না। তাই বিদ্রুপ রসিকতা তোমার মুখ থেকে যাচ্ছে না। খুব শীঘ্রই এর ফল তুমি দেখবে।
বলে সে নড়ে চড়ে বসে সামনের দিকে মনোযোগ নিবদ্ধ করলো।
মৃত্যুর দৃশ্য সামনের আসার পর আর কিছু দেখবার বাকি থাকে কি?
মহিলাটি দু’পক্ষের এ বাক-বিনিময় শুনছিল। অবশেষে আহমদ মুসাকে বলল উদ্দেশ্য করে বলল, দেখুন অনেক সময় কথা বলার চেয়ে না বলাই ভাল।
আহমদ মুসা তাৎক্ষণাৎ কোন জবাব দিল না।
মনে মনে বলল জানি ম্যাডাম। কিন্তু এ সময়টা সে সময় নয়। এ সময় আপনাদের বেশী বেশী জানার এবং পরিমাপ করার। এবং আমি তা কিছুটা পেরেছিও। তোমরা আমাকে চিননি, না চেনা পর্যন্ত তোমরা কিছু করতেও পারবে না। তোমরা ব্ল্যক ক্রসের উর্ধতন কেউ নও। কোন স্বাধীন সিদ্ধান্ত তোমাদের হাতে নেই। তোমাদের তুচ্ছ করে মানসিকভাবে তোমাদের দূর্বল করার মধ্যে আমার লাভ।
একটু সময় নিয়ে আহমদ মুসা বলল, স্বাধীনতা খুব মূল্যবান। কথা বলার স্বাধীনতাটুকু এখনও বাকি আছে। তাই তার একটু বেশীই ব্যবহার করছি।
মহিলাটির মুখে একটা বিস্ময়ের ছায়া নামল।
ড্রাইভিং সিটে বসা নেতা গোছের সেই লোকটি মুখ ঘুরিয়ে আহমদ মুসাকে উদ্দেশ্য করে বলল, তোমার বকবকি বন্ধ কর, না হলে মুখের মানচিত্র কিন্তু আরও বেশী পাল্টে যাবে।
আহমদ মুসা হাসল, কোন কথা বলল না।
আহমদ মুসাকে নিয়ে গাড়িটাই আগে চলছিল। তার পেছনে আরও তিনটি গাড়ি।
চলছে গাড়িগুলো সলো’র পথ ধরে।
ব্ল্যাক বুল এবং তার দু’টি কুকুর ঠিক সময়ে গাড়ির মেঝেতে শুয়ে পড়ায় বেচে গেছে। কিন্তু গাড়ি বাঁচেনি। রিজার্ভ টায়ারসহ পেছনের দু’টি টায়ার একদম ঝাঁঝরা হয়ে গেছে।
দুই কুকুর টম ও টমিকে দুই বগলে নিয়ে ব্ল্যাক বুল গাড়ি থেকে নামল। সাথে নিল আহমদ মুসার ব্যাগ এবং তার নিজের ব্যাগ।
আহমদ মুসাকে বহনকারী গাড়ির বহরের শব্দ মিলিয়ে যাবার পর গাড়ির আড়াল থেকে বেরিয়ে এল।
বেরিয়ে এসে অসহায় দৃষ্টিতে চারদিকে তাকাল ব্ল্যাক বুল। জংগলের সমুদ্রে নিজেকে এক ভাসমান মানুষ মনে হলো ব্ল্যাক বুলের। সড়ক আছে বটে কিন্তু কোন যানবাহনের দেখা নেই।
সড়কে দাঁড়িয়ে ব্ল্যাক বুল সূর্যের দিক বিচার করে বুঝল, আহমদ মুসাকে নিয়ে গাড়িগুলো সলো’র দিকে গেছে। সলো তার পিতৃ পুরুষের গ্রাম, এখন নাকি ছোট-খাট একটা নদী বন্দর।
ব্ল্যাক বুল কিছুক্ষণ এদিক সেদিক করে নিরুপায়ভাবে দু’টি কুকুরের চেন ধরে সলো’র পথ ধরে হাঁটতে শুরু করল।
সড়কটি সংঘ নদীর পূর্ব তীর বরাবর দক্ষিণে এগিয়ে গেছে।
সড়কের দুই ধারেই ঘন বন। সড়ক থেকে সংঘ নদী খুবই কাছে।কিন্তু মাঝখানে বন এতই ঘন যে মনেই হয় না আশেপাশে কোথাও নদী আছে।
সন্ধ্যা আসছে নেমে। রাতের কথা ভাবতেই গাকাঁটা দিয়ে উঠল ব্ল্যাক বুলের। এই এলাকায় সে কোন দিন আসে নি, কিন্তু জানে সে এলাকার খবর। মধ্য আফ্রিকা প্রজানন্ত্রের এই দক্ষিণাঞ্চল থেকেই কঙ্গো অববাহিকা ও গ্যাবনের দূর্ভেদ্যতম বনাঞ্চলের শুরু। এই জংগলে গরিলা, সিংহ, বাঘ সব ধরনেরই হিংস্র জানোয়ার আছে। তার উপর আছে বান্টুদের শত্রু কোকুইদের ছড়ানো আতংক। ওরা অঞ্চল বিশেষে গাছের ডালে ডালে ঘুরে বেড়ায়। বান্টুদের কাউকে একাকি পেলে ফাঁদে ফেলে ধরে নিয়ে যায় তাদের দেবতার কাছে। তার পর বলি দেয়।
অন্ধকার নেমে এল চারদিকে।
যতক্ষণ দিন ছিল ততক্ষণ সাহস কিছু ছিল। রাত নামার সাথে সাথে সে সাহসটুকুও অন্ধকারে হারিয়ে গেল।
ব্ল্যাক বুল শক্ত হাতে ধরল টম ও টমির চেন এবং আরেক হাতে বাগিয়ে ধরল রিভলবার। টম ও টমিকে এখন তার মনে হচ্ছে সবচেয়ে বড় বন্ধু এবং সবচেয়ে বড় বিপদেরও কারণ। কুকুরের গন্ধ শোঁকার শক্তি তার জন্যে এখন এ্যাসেট। হিংস্র বন্য জন্তু কিংবা শ্ত্রু মানুষ ইত্যাদি যাই হোক বেশ দূরে থাকতেই বাতাসে গন্ধ নিয়ে তাকে সাবধান করতে পারবে। কিন্তু সমস্যা হলো, কুকুরের লোভনীয় গন্ধ আবার হিংস্র পশুদের আমন্ত্রন জানাতে পারে।
পশু ও মানুষের নজর এড়াবার জন্যে ব্ল্যাক বুল সড়কের ধার দিয়ে, বনের পাশ ঘেঁষে এগিয়ে চলছিল।
ব্ল্যাক বুল যেমন চারদিকে সতর্ক দৃষ্টি মেলে পথ চলছিল, তেমনি সব সময় কুকুর দু’টির প্রতিক্রিয়ার দিকেও চোখ রাখছিল।
হঠাৎ এক সময় ব্ল্যাক বুলের হাতের চেনে টান পড়ল। ফিরে তাকিয়ে দেখল কুকুর দু’টি বসে গেছে।
ব্ল্যাক বুল চেন ধরে ওদের টানল, কিন্তু এক ইঞ্চিও নড়ল না।
ব্ল্যাক বুল হাতের চেনে ঢিল দিল। সংগে সংগেই কুকুর দু’টি পেছনে চলার জন্যে ঘুরে দাঁড়াল।
শিক্ষিত কুকুর দু’টির ইংগিত বুঝল ব্ল্যাক বুল। নিশ্চয় সামনে বাঘ, সিংহ, গেরিলা ধরনের হিংস্র কোন জন্তু আছে।
কি করবে এখন ব্ল্যাক বুল? চিন্তারও সময় নেই। ইতিমধ্যেই তাদের দেখতে না পেয়ে থাক তবেই রক্ষা। গন্ধ নিশ্চয় পেয়েছে, যেমন কুকুর পেয়েছে।
ব্ল্যাক বুল ডানে জঙ্গলের দিকে তাকাল।দেখল,কাছেই বিশাল কান্ড বিশিষ্ট বড় একটি গাছ।ব্ল্যাক বুলের গাছে উঠার অভ্যাস আছে।কিন্তু এই গাছে উঠা তার পক্ষে অসম্ভব।হতাশ হয়ে আশেপাশে তাকাল।আনন্দের সাথে দেখল,বড় গাছটি থেকে কয়েক গজ দূরে আরেকটি স্বল্প বেড়ের তরুণ গাছ।তীরের মত বড় গাছটির ডালপালা ভেদ করে উপরে উঠে গেছে।এ গাছটি দিয়ে বড় গাছের ডালে উঠা যায়।
ব্ল্যাক বুল সময় নষ্ট করল না।কুকুর দু’টিকে টেনে নিয়ে ছুটল সে গাছের দিকে।সমস্যায় পড়ল কুকুর দু’টিকে নিয়ে।ও দু’টিকে কাঁধে নিয়ে গাছ বেয়ে উঠা তার পক্ষে সম্ভব নয়।
হঠাৎ মাথায় বুদ্ধি এল।আহমদ মুসার ব্যাগে সে সিল্কের কর্ড দেখেছে।ওটাই যথেষ্ট হবে।
ব্ল্যাক বুল তাড়াতাড়ি কর্ড বের করে তার দুই প্রান্ত দুই কুকুরের চেনের সাথে শক্ত করে বেঁধে কর্ডের মাঝ বরাবর জায়গাটা নিজের বেল্টের সাথে গিট দিয়ে নিল।তারপর কুকুর দু’টি কে শান্তভাবে থাকতে বলে গাছে উঠতে শুরু করল।বিশ ফুটের মত উঠেছে এই সময় বোমা ফাটার মত ভীষণ শব্দে চারদিকটা কেঁপে উঠল।প্রবল্ভাবে চমকে উঠে হাত-পা ফসকে পড়ে যাচ্ছিল ব্ল্যাক বুল।শেষ মুহুর্তে প্রাণপণে হাত-পা দিয়ে গাছ আঁকড়ে ধরে রক্ষা পেল সে।
নিজেকে সামলে নিয়েই ব্ল্যাক বুল নিচের দিকে তাকাল।তার ভুল হয়নি বুঝতে যে ওটা বোমা ফাটার শব্দ নয়।সিংহের গর্জন ওটা।সিংহটা নিশ্চয় তাকে অথবা কুকুর দু’টিকে দেখতে পেয়েছে।দেখতে পেয়েই সে গর্জন করে উঠেছে শিকারকে ভীত করে তোলার জন্যে।লাফ দিয়ে শিকার ধরার দূরত্বে সিংহটি এসে গেছে।
তাড়াতাড়ি ব্ল্যাক বুল উপরে তাকাল।দেখল, মাত্র ফুট তিনেক উপরে বড় গাছটার একটা মোটা ডাল ব্ল্যাক বুলের গাছটার গা ঘেঁষে এগিয়ে গেছে।ব্ল্যাক বুল দ্রুত উঠতে লাগল।কুকুর দু’টি কে তুলে নিতে হলে তার বসার মত একটা আশ্রয় দরকার।
কিন্তু গাছের মোটা ডাল হাতে পাওয়ার আগেই সেই গর্জন আবার শুনতে পেল ব্ল্যাক বুল।সেই সাথে হাতের কর্ডে টান পড়ল।চমকে উঠে থেমে গেল ব্ল্যাক বুল।সিংহটা কি তার কুকুরের প্রতি চড়াও হয়েছে, না কুকুর দুটি পালাবার চেষ্টা করছে?
ব্ল্যাক বুল দুই পা এবং বাম হাতে গাছকে প্রাণপণে আঁকড়ে ধরে ডান হাত দিয়ে কর্ড ধরে কুকুর দু’টিকে টেনে তোলার চেষ্টা শুরু করল।
এক হাতে টেনে তোলা অসম্ভব।বাম হাতের সাহায্য নিল।কিন্তু বাম হাতের পক্ষে শরীরের ভার নিয়ে গাছ আঁকড়ে থাকা এবং দুইটি বাঘা কুকুরের ভার ধরে রাখা অত্যন্ত কঠিন।কিন্তু কঠিন তা অনুভব করার সময় ও নেই।পাগলের মত টেনে তুলতে লাগল কুকুর দুটিকে।কুকুর দু’টি যে ভীষণ ভারী আজই তা প্রথম মনে হলো ব্ল্যাক বুলের।মনে হচ্ছে সে ভার তাকে টেনে নামিয়ে নিয়ে যাবে গাছের তলায়।
কিছুদূর উঠেছে কুকুর দুটি,এমন সময় প্রাণ কাঁপানো এক হুংকার এবং সেই সাথে গাছের গোড়ায় ভারী কিছু পড়ার শব্দ হলো।
নিজের অজান্তেই কখন যেন কাঁপতে শুরু করেছে ব্ল্যাক বুল।কুকুরকে উপরে তোলা বন্দ হয়ে গিয়েছে।
কিন্তু পরক্ষণেই নিজেকে ফিরে পেল ব্ল্যাক বুল।
শুধু বাম হাতে পারছে না।দাঁত দিয়ে ব্ল্যাক বুল কামড়ে ধরল সিল্কের কর্ড।তারপর ডান হাত নিচে নামিয়ে কুকুর দু’টি কে আরও এক ফুট উপরে নিয়ে এল।খুশী হলো সে সিংহ কুকুরের কোন অংশের নাগাল পেলে সিংহের কাছ থেকে কুকুর দু’টিকে ছাড়িয়ে নেয়া তার পক্ষে সম্ভব হতো না।সে কুকুরকে যথেষ্ট উপরে তুলতে পেরেছে,যেখানে লাফ দিয়ে নাগাল পাওয়া সিংহের পক্ষে সম্ভব নয়।
কুকুরকে যখন ব্ল্যাক বুল এইভাবে তুলছে,গাছের গোড়ায় তখন লংকা কান্ড। নিচের কিছুই দেখা যাচ্ছে না।কিন্তু বুঝা যাচ্ছে প্রায় হাতের মুঠো থেকে শিকার হাত ছাড়া হওয়ায় পশুরাজ ক্রোধে উন্মত্ত হয়ে উঠেছে।মাটি কাঁপছে তার গর্জনে।কাঁপছে যেন গাছটিও।
কুকুর দু’টিকে সিংহের আওতার বাইরে আনতে পারায় ব্ল্যাক বুল খুশী।কিন্তু এই খুশী ধরে রাখা তার জন্যে সংকটজনক হয়ে দাঁড়াল।ঝুলন্ত কুকুর দু’টিকে যেখানে ধরে রাখাই কঠিন,সেখানে এই ভার নিয়ে উপরে উঠবে কেমন করে!আবার এইভাবে থাকাও সম্ভব নয়।
আবার উপরের দিকে চাইল ব্ল্যাক বুল।মাত্র ফুট খানেক উপরে ডালটা।কিন্তু ওখানে পৌঁছাবে কি করে!কুকুর দু’টিকে ধরে রাখতে গিয়ে তার ডান হাত বন্ধ।শুধু বাম হাত দিয়ে এত ভার টেনে গাছ বেয়ে ওঠা সম্ভব নয়।যে কোনভাবেই ডান হাতকে কার্যকরী করতে হবে।
ব্ল্যাক বুল ভাবল,ডান হাতের কর্ডটিকে যদি কোন ক্রমে কাঁধে এনে পেচানো যেত,তাহলে ডান হাতকে মুক্ত করা সম্ভব হতো।কিন্তু ওকাজটা প্রায় অসম্ভব।
হঠাৎ ঝিলিক দিয়ে ব্ল্যাক বুলের মাথায় একটা চিন্তার উদয় হলো।কর্ড বাহুতে পেচিয়ে কুকুর দু’টির ভার কাঁধের কাছাকাছি আনতে পারে।
চিন্তার সংগে সংগেই সে কর্ড প্রথমে হাতে,তারপর বাহুতে পেঁচানো শুরু করে দিল।হ্যাঁ পেচানো যাচ্ছে শুধু নয়,কর্ডটা হাতে থাকতে শযে ভারটা কষ্টকর মনে হচ্ছিল কর্ড বাহুতে আসার পর তা অনেকটা সহনীয় হয়ে গেল।কিন্তু কর্ডকে কনুই পার করে আনা খুবই কষ্টকর হয়ে গেল।আর চেষ্টা করল না ব্ল্যাক বুল।
এবার সে ইঞ্চি ইঞ্চি করে উপরে উঠা শুরু করল।
ইতিমধ্যে এক কষ্ট গিয়ে আরেক কষ্ট দেখা দিল।ভার বহনটা আগের চেয়ে অনেক স্বস্তিকর হলেও সিল্কের সরু কর্ড ভারের চাপে বাজুতে বসে যাচ্ছিল।যেন বাজুর পেশি কেটে দু’ভাগ হয়ে যাচ্ছে তার।চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছা করছিল তার।তবু দাঁতে দাঁত চেপে সে গাছ বেয়ে উপরে উঠছিল।
যখন ব্ল্যাক বুল গাছটি আঁকড়ে ধরে ডালটিতে ঘোড়ার মত উঠে বসল,তখন তার মনে হলো ের চেয়ে বড় বিজয় তার জীবনে আসেনি।এর চেয়ে বড় সাহায্য আল্লাহ তাকে আর কোনদিন করেননি।
কুকুর দু’টি কে তুলে সে ডালে বসিয়ে দিল।উপরে উঠে যাওয়া গাচটির সাথে শক্ত করে বাঁধল কুকুর দু’টির চেন।
বেশ মোটা ডাল।আরামেই বসা গেল।
ঘামে সে গোসল করে ফেলেছিল,পিঠে ঝুলানো ব্যাগ দুটি নামিয়ে রাখলে আরাম পাওয়া যেত।কিন্তু ব্যাগ দু’টি কে বিচ্ছিন্ন করতে চাইল না।একটি ব্যাগ আহমদ মুসার।যা মহামুল্যবান আমানত তার কাছে।
সিংহটি তখনও নীচে ক্রোধে গোঁ গোঁ করছিল।শব্দ শুনেই বুঝা যাচ্ছিল গাছের চারদিকে চক্কর দিচ্ছে সে।
এই সময় খুব কাছে প্রায় এক সাথে দুইটি মাটি ফাটানো গর্জন শুনতে পেল ব্ল্যাক বুল।বুকটা আবার নতুন করে কেঁপে উঠল ব্ল্যাক বুলের।ভয়ে ভয়ে নীচে তাকাল সে।
নিচে এখন একটির জায়গায় সিংহ তিন্টি।আরও আসবে নাকি?
ব্ল্যাক বুলের রাতটা কেটে গেল নির্ঘুম এবং আতংকের মধ্যে দিয়ে।ফর্সা হয়ে গেলে চারটা সিংহ প্রায় এক সংগেই চলে গেল।রোষ কষায়িত চোখে ওদের ওপরে তাকানো এবং রাজ যাত্রার মত ওদের ভারিক্কি চালে চলে যাওয়া চেয়ে চেয়ে দেখল ব্ল্যাক বুল।
পুবদিকে একটু দূরে রাস্তার দিকে তাকালে বুঝা যাচ্ছে সূর্য বেশ উপরে উঠেছে।কিন্তু গাছ থেকে নামতে সাহস পেল না।কিন্তু পরক্ষণেই তার শিক্ষিত দুই কুকুরের কথা মনে পড়ল।ভাবল,ওরাই তো তার ব্যরোমিটার।ওদের আচরণ থেকেই বুঝা যাবে আশেপাশে শ্ত্রু আছে কিনা।
‘টম, টমি দেখবি সব ঠিক আছে কিনা।’বলে ব্ল্যাক বুল কুকুর দু’টিকে নামিয়ে দিল মাটিতে।ব্ল্যাক বুলের টম ও টমি মাটিতে নেমে চারদিকে গড়াগড়ি দিয়ে নিশ্চিন্তে আনন্দ প্রকাশ করল।
ব্ল্যাক বুল নিশ্চিন্তে নেমে এল মাটিতে।
জঙ্গল থেকে বেরিয়ে সড়কের ধারে বসে ব্ল্যাক বুল ব্যাগ থেকে খাবার বের করে কিছু নিজে খেল, কিছু তার টম টমিকে খাওয়াল।
তারপর তৈরী হয়ে তাকাল পথের দিকে।সলো পৌছতে আরও সত্তর-আশি কিলোমিটার রাস্তা পাড়ি দিতে হবে।কিভাবে?
বারবারেতি ও সলো’-এর মধ্যে বাস সার্ভিস হয়তো আছে।কিন্তু কি করে জানবে তার সময়টা।বাসের জন্যে অনিশ্চিত বসে থেকে আরেকটি রাতের মুখোমুখি সে হতে চায় না।ব্যক্তিগত গাড়িও যাতায়াত করে ে পথে।সেটা আরও অনিশ্চিত।
নদীর কথাও ভাবল ব্ল্যাক বুল।এ অঞ্চলে নদী পথেই বেশী যাতায়াত হয়।ব্যক্তিগত নৌকা,ভাড়া নৌকা,ব্যবসায়ের নৌকা ইত্যাদি অনেক ধরণের নৌকা রয়েছে।তাছাড়া নদী পথে কাঠের ভেলার রয়েছে ব্যাপক প্রচলন।শহরের বাইরের এলাকার মানুষ অধিকাংশ ক্ষেত্রে কাঠের ভেলাই ব্যবহার করে থাকে।
হেঁটে অনেক পথ চলল।কত বার আকুলভাবে পেছনে তাকাল,গাড়ির কোন চিহ্ন নেই।
গাড়ির কথা এক সময় ভুলেই গিয়েছিল ব্ল্যাক বুল।হঠাৎ ইঞ্জিনের পরিচিত শব্দে পেছন ফিরে তাকাল সে।
দেখল একটা মাইক্রোবাস আসছে।কাছে এলে দেখল দু’একজন কৃষ্ণাঙ্গ আছে,আর সবাই শ্বেতাংগ।তারা সরকারের উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ হবে,নয়তো হবে পর্যটক।
আশায় বুক বেধে ব্ল্যাক বুল হাত তুলল ওদের থামাবার জন্যে।কিন্তু শ্বেতাংগ ড্রাইভার একবার চোখ তুলে তাকিয়ে বেপরোয়াভাবে চলে গেল।
যেটুকু আশার আলো জ্বলে উঠেছিল ব্ল্যাক বুলের মনে তা আবার দপ করে নিভে গেল।
আবার সেই চলা শুরু হলো তার।
আবার গাড়ির শব্দে পেছনে ফিরে তাকাল ব্ল্যাক বুল।
দেখল একটা জীপ আসছে।
কাছে এলে দেখল পুলিশের জীপ।
পুলিশে কোন ভেজালে যেতে চায় না ব্ল্যাক বুল। তাই ঠিক করল জীপটির কোন সাহায্য চাইবে না ব্ল্যাক বুল।
কিন্তু ব্ল্যাক বুলকে বিস্মিত করে দিয়ে পুলিশের জীপটি এসে ব্ল্যাক বুলের পাশে দাঁড়িয়ে গেল।
মনটা ধক করে উঠল ব্ল্যাক বুলের। ঘটনা তো পুলিশ নিশ্চয়ই টের পেয়েছে, লাশগুলো তো ওখানেই পড়ে আছে। তাকে পুলিশ সন্দেহ করছে নাকি। আচ্ছা আমি কোত্থেকে এলাম, এ অবস্থা কেন, এসব জিজ্ঞাসা করলে কি জবাব দেব?
পুলিশের গাড়ি দাঁড়াবার সাথে সাথে ব্ল্যাক বুলও দাঁড়িয়ে গেছে।
লাফ দিয়ে নামল একজন পুলিশ অফিসার। জীপে একমাত্র সেই।
অবশ্য ড্রাইভিং সিটে যে আছে সেও পুলিশের ইউনিফরম পরা। অর্থাৎ গের পুলিশ।
পুলিশ অফিসারটি কৃষাংগ। তার দৃষ্টি কুকুর দু’টির দিকে। লোভে তার চোখ দু’টি চক চক করছে। পুলিশের চোখ না চেনার কথা নয়। কুকুর দু’টির চাহনি দেখেই বুঝতে পেরেছে ও দু’টি সোনার টুকরা। দুর্লভ জাতের শিকারী কুকুর।
‘কে তুই?’ পুলিশ এমনভাবে কথাটি জিজ্ঞেস করল যেন ব্ল্যাক বুল কোন বড় আসামী।
‘আমি………’
ব্ল্যাক বুলকে কথা শেষ করতে না দিয়ে পুলিশ অফিসারটিই আবার বলল, ‘কুকুর দু’টি কোথায় পেলি?’
‘আমার। আমি ……..’
ব্ল্যাক বুলকে থামিয়ে দিয়ে বলল পুলিশ অফিসারটি, ‘বুঝেছি রহস্য একটা আছেই। সেটা আমরা দেখব। কুকুর দু’টি আমাকে দিয়ে দে।’
বলে পুলিশ অফিসারটি ব্ল্যাক বুলের হাত থেকে কুকুর দু’টির চেন কেড়ে নিতে গেল।
ব্ল্যাক বুল একটু পিছনে সরে গেল। বলল, ‘না দেব না।’
‘দিবি না?’ বলে পুলিশ অফিসার বেল্টের খাপ থেকে রিভলবার বের করে ব্ল্যাক বুলের বুক বরাবর তুলে ধরল।
মুহূর্তে ঘটে গেল ঘটনা।
হঠাৎ কুকুর দু’টি, টম ও টমি, পুলিশ অফিসারটির দু’পাশ বেয়ে দু’পায়ের উপর ভর দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বাঘের গর্জন করে উঠল। তাদের মুখের বিশাল হা দেখে মনে হলো এই বুঝি তারা কামড়ে ধরবে পুলিশ অফিসারটির গলা।
ঘটনার আকস্মিকতায় বিমূঢ় হয়ে পড়েছিল পুলিশ অফিসারটি। পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিয়ে হাতের রিভলবারটি ফেলে দিয়ে বলল, ‘ঠিক আছে তোদের প্রভুকে কিছু বলব না।’
ডরভলবার ফেলে দেয়ার সংগে সংগেই কুকুর দু’টি পুলিশ অফিসারটিকে ছেড়ে দিয়ে সরে দাঁড়াল এবং ফেলে দেয়া রিভলবারটি মুখ দিয়ে কামড়ে ধরে টম ও টমি দু’টিই গিয়ে ব্ল্যাক বুলের কাছে বসে পড়ল।
কিছুক্ষণ স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল পুলিশ অফিসারটি। তারপর হেসে উঠল। বলল, ‘কংগ্রাচুলেশন তোমাকে। তোমার কুকুর দু’টি খুবই ভালো।’
‘আমি দু”খিত, আপনার প্রতি বেয়াদবি করেছে টম ও টমি।’ বলে ব্ল্যাক বুল টমের মুখ থেকে রিভলবারটি নিয়ে কাপড়ে মুছে তা ফেরত দিল পুলিশ অফিসারকে।
‘না, ওটা বেয়াদবি নয়। প্রভুর পক্ষে যা করা দরকার তাই ওরা করেছে। সত্যি আমি মুগ্ধ।’
‘ধন্যবাদ। আপনি বুঝি পশুদের খুব ভালোবাসেন?’
‘বুদ্ধিমান পশুদের আমার খুব ভালো লাগে। বিশেষ করে শিকারী কুকুর। ওরা মানুষের চেয়ে হাজার গুণ বেশী বিশ্বস্ত ও উপকারী।’
বলে একটু থেমে আবার জিজ্ঞাসা করল পুলিশ অফিসারটি, ‘কে তুমি? কোথায় যাচ্ছ এভাবে?’
সমস্যায় পড়ল ব্ল্যাক বুল। তার মুসলিম নামটা প্রকাশ করা ঠিক হবে না। আবার ব্ল্যাক বুল নামটা কাউকে বলার মত নয়, এ ধরনের নাম কোন আফ্রিকান স্বেচ্ছায় গ্রহণ করে না।
হঠাৎ ব্ল্যাক বুলের মনে পড়ল তার দাদার নাম। ‘কমন্ড কাল্লা’, তার দাদা, সংঘ নদী তীরের ‘সলো’ গ্রাম (যা আজ বন্দর) থেকে হারিয় গিয়েছিল দাস ব্যবসায়ীদের হাতে ধরা পড়ে। সেই কমন্ড কাল্লা যদি আজ ‘সলো’তে ফিরে যায় কেমন হয়?
ব্ল্যাক বুল বলল, ‘আমার নাম ‘কমন্ড কাল্লা’। যাচ্ছি ‘সলো’।
‘কি নাম ‘কমন্ড কাল্লা?’ পুলিশ অফিসারটি যেন বিস্মিত হলো নামটায়। যেন নামটা তার কাছে পরিচিত।
‘জি।’ বলল ব্ল্যাক বুল।
পুলিশ অফিসারটি তৎক্ষণাৎ কোন কথা বলল না। যেন সে একটু আনমনা হয়ে পড়েছিল।
কয়েক মুহূর্ত পরে মুখে হাসি টেনে বলল, ‘নামটা সুন্দর। আসছো তোত্থেকে এভাবে?’
‘ইয়াউন্ডি থেকে। গাড়ি অচল হয়ে পড়ায়। গাড়ি ছেড়ে দিয়ে হাঁটছি এবং গাড়ি খোঁজ করছি সলো যাবার।’
পুলিশ অফিসারটির চোখ হঠাৎ তীক্ষè হয়ে উঠল। বলল, ‘গাড়িটা কোথায় নষ্ট হয়েছে?’
‘কাদেলীর তীরে।’
‘কবে?’
‘গতকাল।’
‘কাল থেকে হাঁটছো?’
‘হ্যাঁ।’
‘রাতে কোথায় ছিলে?’
‘গাছে।’
একটু ভাবল পুলিশ অফিসারটি। তারপর বলল, আমি ‘সলো’ যাচ্ছি। আমার সাথে যেতে পার।’
‘ধন্যবাদ। অসংখ্য ধন্যবাদ।’ ব্ল্যাক বুলের কথার মধ্যে হৃদয় নিঃসৃত কৃতজ্ঞতা ঝরে পড়ল, ‘ওয়েলকাম। উঠে পড়ো গাড়িতে।’
বলে পুলিশ অফিসারটি ড্রাইভারের পাশের সিটে গিয়ে উঠল।
পুলিশ অফিসারটি ‘সলো’র পুলিশ সুপার। সেখানকার সর্বোচ্চ পুলিশ অফিসার। নাম জাগুয়াস ম্যাকা।
ব্ল্যাক বুল জীপের পেছনের সিটে উঠে বসল তার টম ও টমিকে নিয়ে।
গাড়ি স্টার্ট নিল।
চলতে শুরু করল জীপটি।
‘তুমি সলোতে কোথায় যাবে?’
‘কোন হোটেলে উঠব।’
উত্তরে জাগুয়াস ম্যাকা কিছু বলল না। তার দৃষ্টি প্রসারিত হলো সামনে।

‘সলো’ বন্দরের শ্বেতাংগ কলোনীর মধ্যখানে সুন্দর একটি দু’তলা বাড়ি।
বাড়িটা জর্জের।
আহমদ মুসাকে ব্ল্যাক ক্রসের নেতা গোছের যে লোকটি বন্দী করে এনেছিল, এ তারই বাড়ি। বাড়ি ঠিক নয়। এটা ব্ল্যাক ক্রস- এর স্থানীয় অফিস। নিচের তলায় অফিস রুম এবং ব্ল্যাক ক্রস- এর ব্যবহৃত অন্যান্য ঘর। দু’তলায় ব্ল্যাক ক্রস- এর সলো’র প্রধান জর্জ তার স্ত্রী এবং একটি মেয়ে নিয়ে থাকে।
তখন রাত আটটা।
নিচের তলায় একটা দরজা বিশিষ্ট জানালা বিহীন একটা ঘর।
এই ঘরেই আহমদ মুসা বন্দী আছে।
হাতে খাবার একটা প্যাকেট এবং পানির একটা বোতল নিয়ে জর্জ এসে দরজার সামনে দাঁড়াল।
পেছনে পায়ের শব্দ শুনে তাকিয়ে দেখল স্ত্রী এলিজাবেথ এবং মেয়ে মেরী। বলল, ‘তোমরা আবার কেন?’
‘ক্ষতি আছে কি?’ জিজ্ঞাসা করলো এলিজাবেথ জর্জকে।
‘ক্ষতি নেই। কিন্তু বন্দীকে নিয়ে আমরা বিপদে আছি। বন্দী পরিচয় না দেয়া পর্যন্ত খাবার দেয়ার হুকুম নেই। চব্বিশ ঘন্টা গেল তার পরিচয় সে দেয়নি। এসেছি আবারও চেষ্টা করে দেখি। না হলে খাবার আবার ফেরত যাবে। তোমাদের এ সবে না থাকাই ভাল। বিশেষ করে মেয়েটার।’
‘কিন্তু মেয়েটাকেই তো রাখা যাচ্ছে না। সে তো তোমাদের পলিটিক্স বোঝে না। বন্দীর কথা তার মুখ থেকে যাচ্ছে না।’
জর্জ কিছু বলল না। ঘুরে দাঁড়িয়ে দরজার দিকে এগুলো।
দরজার বিরাট তালা ছাড়াও দরজার মাঝামাঝি অংশে দরজার পাল্লার গায়ে একটা তালা ঝুলছে। ওটা একটা জানালা। বন্দীর সাথে কথা বলা, তাকে খাবার দেয়া ইত্যাদি করানেই এ জানালার ব্যবস্থা।
জর্জ জানালা খুলল।
ভেতরে স্টিলের একটা খাটিয়ায় শুয়ে ছিল আহমদ মুসা।
পাশেই একটা চেয়ার ছিল সেটা নিয়ে জানালার সামনে বসল জর্জ।
আহমদ মুসার মুখটা ম্লান। কিন্তু তাতে হাসি ফুটে উঠল জর্জদের দেখে।
আহমদ মুসা ভেতরে ভেতরে অধৈর্য্য হয়ে উঠেছে। ক্ষুধার জ্বালায় নয়, পাঁচ দিনের ২টা দিন অর্থহীন ভাবে চলে যেতে দেখে। আহমদ মুসা বন্দিত্বকে এক অর্থে আল্লাহর একটা দয়া হিসেবেই গ্রহন করেছিল। মুস্লিম নেতৃত্ববৃন্দ কে ব্ল্যাক ক্রস কোথায় বন্দি করে রেখেছে তার কথা উদ্ধার করা দরকার। কিন্তু এখন তা সম্ভব হয় নি।
জর্জ চেয়ারে বসে মুখ খোলার আগে আহমদ মুসা ই কথা শুরু করল। বলল, ‘ওয়েল কাম, খুব ভাল আছি।’
আচ্ছা লোক ত তুমি। চব্বিশ ঘণ্টা খেতে পাওনি। বলছ ভাল আছি। তাহলে তোমার খারাপ কোনটা? ‘বলল জর্জ।
‘না তোমারা ভাল রেখেছ আমাকে। তোমাদেরকে এমন বন্দীখানা অ ত আছে যেখানে বন্দিদেরকে নিদ্দ্রিশ্ত সময় হত্যা করা হয় পয়জনাস গ্যাস ব্যবহার করে।’
হাসল জর্জ। বলল।’ ও তুমি বোমাসা’র মাবোইডিং বন্দীখানার কথা বলছ? ওটা একটা বিশেষ ব্যাবস্থা।
আহমদ মুসা উত্তর শুনে কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না। এত বড় সাংঘাতিক কথা জর্জ দিয়ে দিল। আজকের প্রথম তীরই অব্যর্থ। আল্লাহর শুক্রিয়া আদায় করল মনে মনে। বলল, ‘বিশেষ ব্যাবস্থা কেন?’
‘ওখানে আছে সব বিশ্ববিখ্যাত লোক। তাই ব্যাবস্থা ও বিশ্ববিখ্যাত। একটা এক্সপেরিমেন্ট ও ‘।
‘এক্সপেরিমেন্ট?’
‘হ্যাঁ। একটা স্লো পয়জনাস গ্যাস এয়ারকন্ডিশন এর সাথে সেট করা হয়। গ্যাস মিটারে যে সময় নির্দিষ্ট করা হবে, সে অনুসারে গ্যাস এয়ারকন্ডিশন এর উইন্ড ওয়েভের সাথে ছড়িয়ে পড়ে। যিনি নির্দিষ্ট সময় ধরে ঐ গ্যাস গ্রহন করবেন, তিনি ঐ নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে মারা যাবেন। ‘
‘তোমার পুলিসকে ভয় করো না।?’ লোকেশনকে স্পেসিফিক করার উদ্দেশে প্রশ্ন করল আহমদ মুসা।
‘হো হো করে হাসল জর্জ। বলল, ‘ব্ল্যাক ক্রস কচি খোকা নাকি? একটা বাইবেল সোসাইটির আড়ালে যেভাবে যে ব্যবস্থা করা হয়েছে, তা পুলিশের বাবার ও সাধ্য নেই যে খুজে বের করে।’
কথা শেষ করেই জর্জ বলল,’ ওসব যাক। এখন বল, ‘তুমি কে? তুমি আমাদের কিছু জান দেখছি।’
আহমদ মুসা মনে মনে আল্লাহর শুক্রিয়া আদায় করল। ঠিকানা র অন্তত তিনটা ক্লু পাওয়া গেছে, জা তার কাছে চাওয়ার চেয়ে বেশি মনে হচ্ছে। ব্ল্যাক ক্রসের এ লোকটা নিশ্চিত আজ দিল খোলা মুডে আছে। আর লক্তার স্ত্রি অ মেয়ে শুরু থেকেই তার প্রতি সহানুভূতিশীল মনে হয়েছে।
‘আমার পরিচয় দেবার কিছু নেই। থাকলে তোমরাই যোগাড় করবে।’ হাশি মুখে বলল আহমদ মুসা।
‘কিন্তু মনে রেখ, পরিচয় না দিলে তোমার খাবারও নেই।’
‘তোমাকে ব্রিটিশ বলে মনে হয়। বন্দীর সাথে বুঝি এই আচরণ করতে হয়?’
‘এটা ব্রিটিশ বন্দীখানা নয়। কেমন করে জানলে আমি ব্রিটিশ?’
‘তোমার ফরাসি উচ্চারণ ব্রিটিশ দের মত। ‘
‘পরিচয় দিলে ক্ষতি কি? ছাড়া যখন পাচ্ছ না, তখন পরিচয় গোপন করে লাভ কি?’
‘লাভ – ক্ষতি ভাবছি না। আমি তোমাদেরকে কন সহযোগিতা করবোনা।’
‘তোমার আর ভোগান্তি আছে।’ উঠে দাঁড়াল জর্জ। তার মুখ ক্রোধে লাল হয়ে উঠেছে।
খাবারের প্যাকেট অ পানির বোতল হাতে নিতে যাচ্ছিল।
জর্জের স্ত্রি এলিজাবেথ ছো মেরে খাবার প্যাকেট অ পানির বোতলটা তুলে নিয়ে বলল, ‘তুমি যাও আ সবের ব্যাবস্থা আমি করছি।’
‘এলিজা ভুল করছ। আমি জানি তুমি কি করবে। কিন্তু শোন,এ খাদ্য আমাদের নয়, আমাদেরকেও ইনি মেহমান নন। সুতরাং নিয়মের বাইরে আমরা কিছু করতে পারি না। ‘বলে জর্জ খাবার প্যাকেট এবং পানির বোতল নেবার জন্য হাত বাড়াল এলেজাবেথ এর দিকে। এলিজাবেথ স্বামীকে তা না দিয়ে জানালা দিয়ে খাদ্য অ পানীয় ঘরের ভেতরে ছুড়ে মারল। আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে বলল, ‘এ সবের জন্য দুঃখিত, আপনি দয়া করে খেয়ে নেবেন।’
জর্জ স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিল। তিব্র কন্থে বলল, ‘জান এলিজা, তোমার খামখেয়ালীপনার দায় আমার উপর বর্তায়।’
এলিজাবেথ উত্তর দিতে একটু সময় নিচ্ছিল।
ইতিমধ্যে আহমদ মুসা খাতিয়া থেকে উঠে খাবারের প্যাকেট অ পানির বোতল মেঝে থেকে কুঁড়িয়ে নিয়ে ছলে এল জানালায়। জর্জের দিকে খাবারের প্যাকেট অ পানির বোতল ছুড়ে ধরে বলল, ‘নিন, কিছু মনে করবেননা। মেয়েরা তো মূলত মা। তাদের মন নরম।’
বলে আহমদ মুসা স্থম্ভিত এলিজাবেথ এর দিকে চেয়ে বলল, ‘আপনাকে ধন্যবাদ বোন। কষ্ট পাবেন না। এমন না খেয়ে থাকার অভ্যাস আছে আমার। ‘
আহমদ মুসা খাটিয়ায় ফিরে এসে আবার শুয়ে পড়ল।
মুহূর্ত দেরি না করে মেয়ের হাত ধরে এলিজাবেথ সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে চলে গেল। অপমান অ যন্ত্রণায় তার মুখটা অস্বাভাবিক রুপ নিয়েছে।
জর্জ খাবারের প্যাকেট এবং পানির বোতল নিয়ে কিছুক্ষণ হতভম্বের মত দারিয়েছিল। তার মনেও যন্ত্রণা। একজন বন্দীর মানবিকতার কাছে সে হেরে গেল। কোন বন্দি এমন হয়, এই প্রথম সে তা দেখল।
আবার ভাবল, সে তো জর্জ নয়। সে তো ব্ল্যাক ক্রস এর একজন দায়িত্বশীল। মনের দুর্বলতা ঝেড়ে ফেলে দেবার চেষ্টা করে সেও সিঁড়ির দিকে পা বাড়াল উপরে উঠার জন্য।
পরখনেই আবার ঘুরে দাঁড়াল। ভাবল, খাবার প্যাকেট এলিজাবেথ তার হাতে দেখলে কষ্টটা তার আরও বাড়বে।
ফিরে এসে জর্জ জানালার কাছে দাঁড়াল। আহমদ মুসা লক্ষ্য করে বলল, ‘খাবার নাও, এস।’
‘আপনাদের নীতির খেলাপ হবে।’
‘তা হবে। কিন্তু কত আইনই তো ভেঙে থাকি। একটা ভাল কাজে না হয় ভাঙলাম আবার।’
‘এটা আমার প্রতি করুনা, না স্ত্রীকে সান্ত্বনা দেয়ার জন্য? ‘
হাসল জর্জ। বলল, ‘তুমি কে জানি না। কিন্তু আর দুশ বন্দীর মত যে নও তা পরিষ্কার। ‘
একটু থামল। আবার শুরু করল, ‘স্ত্রির প্রতি সান্ত্বনা এটা।’
‘তাহলে নিতে পারি।’
‘কেন? ‘
‘আমি চাই না আমার কারনে আপনাদের মধ্যে কোন মতান্তর ঘটুক।’
‘তুমি আমাদের চারজন লোককে খুন করেছ। কিন্তু তোমাকে দেখে তো খুনি মনে হয় না। কেন আমাদের লোককে অনুসরণ করেছিলে? ‘
‘সবই জানবে এক সময়। ধন্যবাদ।’ বলে আহমদ মুসা খাবার অ পানি নিয়ে তার খাটিয়ায় ফেরত এল।
জর্জ উঠে গেল উপরে।
সিঁড়ি দিয়ে উঠেই ড্রইং রুম।
ড্রইং রুমের সোফায় বসে আছে এলিজাবেথ। তার পাশেই মেরি। মেরীর পাশের সোফায় বসতে বসতে জর্জ বলল, ‘খুশি তো এলিজা, খাবার দিয়ে এসেছি।’
হটাত এলিজাবেথের দু চোখ থেকে দু ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। বলল, ‘আমার বাড়াবাড়ি জন্য আমি দুঃখিত। লোকটি যেই হন, তিনি আমার স্বামীকে নতুন জীবন দিয়েছেন। উনি ট্রিগার টিপতে যাচ্ছিলেন, মেরী তোমার সামনে দাড়িয়ে অনুরধ করায় ট্রিগার তিনি টিপেন নি। ছোট্ট বাচ্চার কথা তিনি শুনেছেন। আমি সারা জীবন কৃতজ্ঞ থাকব তার প্রতি।
‘লোকটা ভাল আব্বু। ‘বলল মেরী মায়ের কোলে মুখ গুজে।
‘আমার খুব খারাপ লাগছে, তিনি রিভল্বার নামালেন, আর তুমি তাকে গুলি করলে। সরে না দাঁড়ালে তার বুকে গুলি লাগত। জীবন রক্ষার বিনিময়ে তিনি জীবন দিতে বসেছিলেন।’
‘তুমি ঠিকই বলেছ। কিন্তু আমি দায়িত্ত পালন করেছি মাত্র। ও সুযোগ পেত, তাহলে পেছন থেকে আমাদের যে চারজন আসছিল, তারা বিপদে পড়তো। সে যেমন শার্প শুটার তাতে সে আমাদের গাড়ির কভার নিতে পারলে সবাইকে শেষ করতে পারত।’
‘তোমার দিক থেকে তুমি ঠিকই আছ। কিন্তু তার ত্যাগ অ মানবিকতার কোন মূল্য তোমরা দাওনি।’
‘সে যেটা করেছে মহানুভবতা। কিন্তু তার মূল্য দেয়া আমাদের পক্ষে অসম্ভব। জীবন – মৃত্যু র খেলায় ে সুযোগ নেই এলিজাবেথ।
‘তোমারা তাকে ছেড়ে দিতে পার।’
‘না পারি না। সে আমাদের লোকদের হত্যা করেছে। আমাদের গাড়িকে অনুসরণ করেছে। সে আমাদের চেনে, অথচ তার কোন পরিচয় আমরা এখনও পাইনি। ‘
‘উনি নিজে বাঁচতে গিয়েই খুন করেছেন, তার আগে তোমরা তাকে মেরে রক্তাক্ত করেছ।’
জর্জ কোন জবাব দিল না। এলিজাবেথ ই আবার কথা বলল, ‘তাকে দেখে তোমার কি খুনি মনে হয়?’
‘এলিজা আমি তুমি কি মনে করি তা কিছু আসে যায় না। বাস্তবে যা ঘটেছে, সেটাই এখন বড় কথা। ‘
‘তোমার তাকে কি করবে? ‘
‘সেটা পরিচয় উদ্ধার এর পরে ঠিক হবে। ‘
‘পরিচয় তো সে বলবে না।’
‘আমরা তার ফটো বারবারিতে পাঠিয়েছি। সেখান থেকে সে ফটো আজ সকালে গেছে নাইরোবিতে। সে বড় কেউ হলে তার পরিচয় শিগ্রই জানা যাবে।’
‘যাই বল, লোকটা বড় কেউ বলে। বড় কেউ না হলে ওমন বড় মন কার হয় না। আর শিশুরা শত্রু মিত্রু খুব তাড়াতাড়ি চিনতে পারে। আমাদের মেরী বিশ্বাসই করে না যে লোকটা চোর-ডাকাত কিংবা খুনি।’
‘তুমি ঠিকই বলেছ। আমার দেয়া খাবার সে নিত না। কিন্তু যখন বললাম খাবারটা দিচ্ছি আমার স্ত্রীকে সান্ত্বনা দেয়ার জন্যে তখন সে খাবার নিয়েছে। খুনি-দস্যুদের আচরণ এমন হয় না।’
‘তাহলে কে সে?’
‘সেটাই তো প্রশ্ন। একদিকে যেমন প্রশংসনীয় মানবিকতা দেখছ, অন্যদিকে তেমনি সে অত্যন্ত দক্ষ যোদ্ধা। তুমি যা বলেছ, সে যদি রিভলবার না নামাত, তার পরিকল্পনা মত চলত, তাহলে শেষের চারজনসহ কেউ আমরা বাঁচতাম না।’
‘ঠিক বলেছ। জীবন-মৃত্যুর যুদ্ধে জীবন না নিলে জীবন দিতে হয়। একটা শিশুর অনুরোধে সে জীবন না নিয়ে সে জীবন দেয়ারই বন্দোবস্ত করেছে। সুতরাং দেখা যাচ্ছে তার মানবিক মনটাই বড়।’
এলিজাবেথ কথা শেষ করতেই টেলিফোন বেজে উঠল।
জর্জ গিয়ে টেলিফোন ধরল।
টেলিফোনে কথা শুনছিল জর্জ। শুনতে শুনতে তার মুখভাব পাল্টে গেল। চোখে-মুখে ফুটে উঠল বিস্ময় ও উত্তেজনা।
এলিজাবেথও উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছিল। নিশ্চয় সাংঘাতিক কিছু ঘটেছে।
জর্জ টেলিফোন ছেড়ে দিতেই এলিজাবেথ উদ্বিগ্ন কন্ঠে বলল, ‘কিছু ঘটেছে, কোন দুঃসংবাদ?’
জর্জ সোফায় বসতে বসতে বলল, ‘বড় সুসংবাদ, তোমার জন্যে অবশ্য দুঃসংবাদ হতে পারে। লোকটির পরিচয় জানা গেছে।’
‘জানা গেছে? কে তিনি?’
‘আমরা যাকে হন্যে হয়ে খুঁজছি এ সেই আহমদ মুসা।’
‘আহমদ মুসা?’ জগতের সব বিস্ময় যেন এসে চোখে-মুখা নামল এলিজাবেথের।
‘হ্যাঁ। যাকে হাতে পাওয়ার জন্যে আমরা কত কি না করেছি, সেই কিনা এসে আমাদের বন্দীখানায় বসে আছে। ঈশ্বরকে ধন্যবাদ।’
এলিজাবেথ কোন কথা বলল না।
জর্জই কথা বলল। মুখ ভরা হাসি নিয়ে বলল, ‘জান, নতুন বস সাইরাস শিরাক আমাকে অভিনন্দন জানিয়েছে। নিশ্চয় আমাদের প্রমোশন হবে। অবশ্যই ইউরোপের বড় শহরে আমি পোস্টিং পাব।’
এলিজাবেথ নির্বাক বসে। জর্জের কথা তার কানে যাচ্ছে, কিন্তু কোন প্রতিক্রিয়া নেই।
জর্জই আবার মুখ খুলল। বলল, ‘নাইরোবি থেকে একটা বিশেষ টিম বারবারেতি এসেছে। ওরা রওনা দিয়েছে সলোর উদ্দেশ্যে। রাতেই ওরা আহমদ মুসাকে নিয়ে যাবে।’
চমকে জেগে ওঠার মত নড়ে উঠল এলিজাবেথ। বলল, ‘কোথায় নিয়ে যাবে?’
‘প্রথমে বারবারেতি, তারপর নাইরোবি। সেখান থেকে ইউরোপে। জান আহমদ মুসা জগতের সবচেয়ে মূল্যবান বন্দী।’
‘জানি। তোমার খুব খুশী লাগছে, তাই না?’ নির্বিকার কন্ঠে বলল এলিজাবেথ।
‘খুশী হবো না মানে? আহমদ মুসার মত ভয়ংকর এবং বিশ্ববিখ্যাত লোক আমার হাতে ধরা পড়েছে। এ তো ঐতিহাসিক ভাগ্য।’
‘তার প্রাণদন্ড হলে বুঝি তুমি আরও খুশী হবে?’
‘সেটা বড়দের ব্যাপার। তবে সে আমাদের নেতাসহ অসংখ্য লোককে খুন করেছে।’
‘সেটা আমি জানি। কিন্তু সে তোমাকে নতুন জীবন দিয়েছে।’
‘তুমি কি বলতে চাচ্ছ?’
‘তার জন্যে কি আমাদের কিছুই করণীয় নেই?’
‘কি আছে?’
‘আমার কি মনে হচ্ছে জান, তোমার হাত থেকে চাবিটা নিয়ে বন্দীখানার তালা খুলে ওঁকে বলি, আপনি চলে যান। আমার স্বামীকে বাঁচিয়েছিলেন। আমি আপনাকে বাঁচালাম।’
‘পাগল হয়েছ। তাহলে তোমার স্বামীই শুধু মরবে না। তুমি মরবে এবং আমাদের সন্তানও মরবে।’
এলিজাবেথ কেঁপে উঠল। তার মুখ হয়ে গেল ফ্যাকাশে।
সে দু’হাতে মাথা চেপে ধরে মাথাটা এলিয়ে দিল সোফায়।
রাত তখন ১২টা।
বারবারেতি থেকে ব্ল্যাক ক্রসের সে দলটা এল।
জর্জ ও তার স্ত্রী এলিজাবেথ জেগেই ছিল।
গেট খুলে দিল জর্জ।
এক তলা থেকে দু’তলায় উঠার সিঁড়ির মাঝখানের ল্যান্ডিং-এ দাঁড়িয়ে এলিজাবেথ।
বারবারেতি থেকে আসা ৫ সদস্যের ক্ষুদ্র দলটির নেতৃত্ব করছিল হ্যারি, ব্ল্যাক ক্রসের একজন অপারেশন কমান্ডার সে।
হ্যারি ঘরে ঢুকেই বলল, ‘বন্দী কোথায় নিয়ে চল জর্জ।’
‘না আগে উপরে চলুন। একটু কিছু মুখে দেবেন, তারপর এদিকে আসবেন।’
‘না না জর্জ, খাওয়া-দাওয়া সেরেছি। কোন সময় নষ্ট না করে আহমদ মুসাকে নাইরোবি পৌঁছাতে হবে। সুতরাং চল।’
বন্দীখানার দরজায় দাঁড়িয়ে হ্যারি বলল, ‘আহমদ মুসাকে বেঁধে রাখা হয়েছে?’
‘না।’ বলল জর্জ।
‘তাহলে তোমরা স্টেনগান বাগিয়ে দাঁড়াও।’ সাথে আসা চারজনের দিকে চেয়ে বলল হ্যারি। এবং নিজেও সে তার রিভলবার হাতে তুলে নিল।
জর্জ খুলল দরজা।
ঘরে ঢোকার আগে হ্যারি চিৎকার করে বলল, ‘আহমদ মুসা হাত তুলে দাঁড়াও। কোন প্রকার চালাকির চেষ্টা করলে তুমি ঝাঁঝরা হয়ে যাবে।’
‘দেখুন, মিথ্যা ভয় দেখাবেন না। আমার দেহকে ঝাঁঝরা করার শক্তি আপনার নেই। আপনি শুধু পারেন আমাকে নাইরোবি পৌঁছাতে।’ শান্ত কন্ঠে বলল আহমদ মুসা।
‘হাত তোল।’ আবার চিৎকার করে বলল হ্যারি।
‘ওরা সার্চ করেছেন, আমার হাতে কোন অস্ত্র নেই। তবু যখন তোমাদের ভয়, তখন হাত তুললাম।’ বলে আহমদ মুসা দু’হাত উপরে তুলল।
হ্যারি সবাইকে নিয়ে ঘরে ঢুকল। চারজন স্টেনগান বাগিয়ে। আর রিভলবার বাগিয়ে হ্যারি আগে আগে চলছিল।
এলিজাবেথ সিঁড়ি দিয়ে নেমে এসে সিঁড়ির গোড়ায় দাঁড়িয়েছিল। ওখান থেকে বন্দীখানার ভেতরের সবকিছুই দেখা যায়।
এলিজাবেথের মনে দুঃখ, কৃতজ্ঞতার চিহ্ন স্বরূপ লোকটার জন্যে সে কিছুই করতে পারলো না। এই দৃশ্যগুলো দেখতে গিয়ে তার মনের কষ্টটা বাড়ছিল। কিন্তু বিশ্ববিখ্যাত লোকটির সাথে ঘটনাগুলো না দেখে সে থাকতে পারছিল না।
হ্যারি ও জর্জ মাঝখানে। তাদের দু’পাশে দু’জন করে স্টেনগানধারী।
তারা আহমদ মুসার চারগজের মধ্যে পৌঁছলে আহমদ মুসা বলল, ‘আপনারা দাঁড়ান।’
আকস্মিক এই নির্দেশে সবাই দাঁড়িয়ে পড়ল।
তার কথার রেশ মিলিয়ে না যেতেই আহমদ মুসা আবার বলল, হ্যারিকে লক্ষ্য করে, ‘আপনার বেল্টের সাথে হাতকড়া ঝুলছে ওটা আমার হাতে পরাতে আসছেন আমি জানি। কিন্তু তার আগে আমার কয়েকটা কথা আছে।’
‘কি কথা?’
‘আমাদের নেতৃবৃন্দকে বন্দী করে রেখেছেন, তাদের কি হবে? আমি বন্দী হলে তারা ছাড়া পাবে কিনা?’
‘তোমার চিন্তা তুমি কর। ওদের কথা ভাবছ কেন?’ বলল হ্যারি।
‘তোমাদের শর্ত ছিল আমি আত্মসমর্পণ করলে তাদের তোমরা ছেড়ে দেবে।’
‘সে শর্তটা ছিল তোমাকে হাতে পাবার একটা কৌশল। তোমাকে হাতে পাওয়ার পর সে শর্তের কোন ভ্যালিডিটি এখন নেই।’
‘অর্থাৎ আমাকে পেলেও তাদের তোমরা ছাড়বে না?’
‘দেখ এসব কথার আমি কোন জবাব দেব না। শুনে রাখ, ব্ল্যাক ক্রস-এর হাতে বন্দী হবার পর কেউ আর বেঁচে থাকে না। আমরা চাই না আমাদের কথা বলার জন্যে কোন বন্দীখানার বাইরে…’
তার কথা শেষ হতে পারলো না। আহমদ মুসার উপরে উঠানো দুই হাত হঠাৎ বিদ্যুৎ গতিতে নিচের দিকে ছুটে গেল। তার দেহটা প্রবল এক পাক খেল। পা দু’টি উপরে উঠে হাতুরির মত আঘাত করল হ্যারি এবং জর্জ দু’জনকে। তারপর পা দু’টি ভূমি স্পর্শ করার সংগে সংগেই স্প্রিং-এর মত তার দেহ সোজা হয়ে দাঁড়াল।
সে উঠে দাঁড়িয়েছিল ডানপাশের দ্বিতীয় স্টেনগানধারীর প্রায় গা ঘেঁষে। স্টেনগানধারীর বিস্ময়ের ঘোর তখনও কাটেনি। আহমদ মুসা তার হাত থেকে স্টেনগান কেড়ে নিয়ে ট্রিগার চেপে তা ঘুরিয়ে আনল বামপাশের দুই স্টেনগানধারী থেকে তার ডান পাশের জন পর্যন্ত।
স্টেনগানধারী চারজনের চারটা লাশ পড়ে গেল বন্দীখানার মেঝেতে।
আহমদ মুসার পায়ের হাতুড়ির মত কিক খেয়ে হ্যারি এবং জর্জ দু’জনেই ছিটকে পড়ে গিয়েছিল মেঝের উপর।
আহমদ মুসা স্টেনগানের গুলী থামিয়ে দেখল, হ্যারি ও জর্জ দু’জনেই উঠে দাঁড়াচ্ছে।
আহমদ মুসা দেখেছিল হ্যারির হাত থেকে ছিটকে পড়া রিভলবারটা আহমদ মুসার পায়ের কাছে পড়ে আছে।
আহমদ মুসা স্টেনগান বাম হাতে নিয়ে তাড়াতাড়ি ডান হাতে রিভলবারটা তুলে নিল।
তুলে নিয়ে মাথা খাড়া করেই দেখল, হ্যারির হাত বোমা সহ তার পকেট থেকে বেরিয়ে আসছে।
আহমদ মুসা সময় নষ্ট করল না। রিভলবারের ট্রিগার টিপল।
গুলী গিয়ে বিদ্ধ করল হ্যারির কব্জীকে। আহত হাতটি বাম হাতে চেপে ধরে বসে পড়ল সে।
জর্জও পকেটে হাত দিয়েছিল।
‘দেখুন জর্জ, পকেট থেকে হাত বের করবেন না। একটা নিষ্পাপ শিশুর আবেদন একবার আপনাকে বাঁচিয়েছে। এবার বাঁচবেন না।’
আহমদ মুসা একটু অমনোযোগী হয়ে পড়েছিল হ্যারির দিকে থেকে। সেই সুযোগে হ্যারির বাম হাত ডান হাত থেকে গড়িয়ে পড়া বোমাটি তুলে নিয়েছিল।
আহমদ মুসা শেষ মুহুর্তে তা দেখে ফেলেছে। তার রিভলবার দ্বিতীয় বার গর্জন করে উঠল। এবার বাম হাতের কব্জীতে নয়, বাম বাহুর সন্ধীতে গুলী গিয়ে আঘাত করল।
ছিটকে কাত হয়ে পড়ে গেল হ্যারির দেহ।
এই সময় এলিজাবেথ এবং তার মেয়ে চিৎকার করে ঘরে প্রবেশ করল।
সিঁড়ির গোড়ায় দাঁড়িয়েছিল এলিজাবেথ। গোলা-গুলীর শব্দে তার মেয়ে মেরিও এসে দাঁড়িয়েছিল। এলিজাবেথের পাশে। তারা দু’জনেই কাঁপছিল। যখন আহমদ মুসার কন্ঠ চিৎকার করে উঠল জর্জের উদ্দেশ্যে এবং পরক্ষণেই গুলীর শব্দ হলো, এলিজাবেথ বুঝল তার স্বামীই এবার টার্গেট হয়েছে। সেই কারণেই কাঁদতে কাঁদতে এসে ঘরে ঢুকেছিল।
আহমদ মুসা এলিজাবেথকে লক্ষ্য করে বলল, ‘আপনারা বেরিয়ে যান। এসব রক্ত ও হিংস্রতা থেকে শিশুদের দূরে রাখবেন।’
তারপর আহমদ মুসা জর্জকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘ঘরের চাবিটা আমাকে দিন। আমি তালা লাগিয়ে যাচ্ছি। আমি চলে যাবার পর বের হবেন।’
চাবিটা আহমদ মুসাকে দেবার কোন লক্ষণই দেখা গেল না জর্জের দিক থেকে।
‘আমি দু’বার আদেশ করে না মিঃ জর্জ।’
জর্জও তা নিশ্চয় বুঝতে পেরেছে।
সে পকেট থেকে চাবিটা বের ফেলে দিতে যাচ্ছিল। আহমদ মুসা বলল, ‘না না আমার হাতে দিবেন।’
হাতে চাবিটা নিয়ে আহমদ মুসা রিভলবার বাগিয়ে পিছু হটে ঘর থেকে বেরিয়ে এল। তালা লাগিয়ে দিল ঘরে।
এলিজাবেথ ও মেরী সিঁড়ির গোড়ায় দাঁড়িয়েছিল। কাঁপছিল তারা।
আহমদ মুসা ছোট্ট মেরীর দিকে চেয়ে বলল, ‘ভয় নেই মা। মা ছেলেকে ভয় করে না।’ বলে আহমদ মুসা এলিজাবেথের দিকে চেয়ে বলল, ‘আমি এই চাবিটা আপনাদের গেটের বাইরে ফেলে রেখে যাব। একটু খুঁজে নিয়ে দরজা খুলে দেবেন আমি চলে যাবার পাঁচ মিনিট পর। আমি চাই না তারা আমার পিছু নিক।’
আহমদ মুসা ঘুরে দাঁড়িয়ে যাবার জন্যে পা বাড়িয়ে থমকে দাঁড়াল। এলিজাবেথের দিকে মুখ ফিরিয়ে বলল, ‘খেতে দেবার জন্যে ধন্যবাদ। সে খাওয়া আমাকে অনেক সাহায্য করেছে। চলতে পারছি আমি ভালোভাবে।’
কথা শেষ করে মুখ ঘুরিয়ে আবার চলতে শুরু করল আহমদ মুসা।
এলিজাবেথের গলায় এসে অনেক কথা ভীড় জমিয়েছিল। আপনি বাচ্চাদের এত ভালবাসেন কেন? আপনার বাচ্চা আছে কিনা? এমন শিশুতোষ মন নিয়ে আপনি এতবড় বিপ্লবী কি করে হলেন? কিন্তু কিছু বলতে পারলো না। কোন কথাই তার গলা থেকে বের হলো না। খেতে দেয়ার জন্যে ধন্যবাদ দিল। কিন্তু তার স্বামীর জীবন সে যে ফিরিয়ে দিয়েছে, এজন্যে ধন্যবাদটুকুও সে দিতে পারলো না। শুধু বোবার মত চেয়ে থাকল সে আহমদ মুসার চলে যাওয়া পথের দিকে।
আহমদ মুসা বেরিয়ে যাবার কয়েক মুহুর্ত পর মেরী বলল, ‘আম্মা আমি তো ওঁকে ভয় করিনি। মৃত্যু দেখে, রক্ত দেখে আমার ভয় লেগেছে।’
এলিজাবেথ কোন কথা না বলে ঘড়ির দিকে তাকাল। দেখল পাঁচ মিনিট হয়ে গেছে। বলল মেরীকে, ‘চল চাবি নিয়ে আসি।’
বলে মেরীর হাত ধরে বাইরে বেরুবার জন্যে সামনে পা বাড়াল।

‘উঠি আব্বা।’ বলল পুলিশ অফিসার ম্যাকা।
‘উঠবি? তাড়া কেন?’ বলল ওকোটা উচি, পুলিশ অফিসার জাগুয়াস ম্যাকার আব্বা। বয়স তার ১২০ বছরের মত।
‘একজন মেহমান এসেছেন, তাকে হোটেলে রাখতে যেতে হবে।’
‘কৈ কেউ বলেনি তো! কে মেহমান?’
জাগুয়াস ম্যাকা সব ঘটনা তার আব্বাকে জানিয়ে বলল, ‘ ঐ কমন্ড কাল্লা নামটার জন্যেই বোধ হয় তাকে আপন মনে হচ্ছে।’
‘খেয়েছে মেহমান?’
‘হ্যাঁ আব্বা, খাবার দিয়ে এসেছি। পাওলা নোয়ানি ওদিকে দেখছে। আমি আপনার সাথে কথা বলতে এসেছি।’
‘ওঁর কেউ আছে সলো’তে?’
‘না নেই।’
‘তাকে ‘মেহমান’ বলছিস, আবার ‘আপন মনে হচ্ছে’ বলছিস, তারপর তাকে হোটেলে রাখতে যাচ্ছিস কেন?’
‘মেহমানের সাথে দু’টি কুকুর আছে। ওরকম শিকারী কুকুর আমি কোনদিন দেখিনি। তার সম্পর্কে মনে হয় আরও কিছু জানার আছে। তাই হুট করে বাড়িতে এনে রাখা ঠিক মনে করছি না আব্বা।’
‘চাকুরি করছিস তো পুলিশের, সবকিছুতেই তোর এখন সন্দেহ ঢুকেছে। তবু তুই যা বলেছিস যুক্তিসংগত।’
‘তাহলে আসি আব্বা।’
‘আচ্ছা আয়।’
ম্যাকা পা বাড়াল বাইরে গেস্ট রুমে আসার জন্যে।
ওদিকে গেস্ট রুমের টেবিলে ব্ল্যাক বুলের খাবার রেখে ম্যাকা ব্ল্যাক বুলকে বলেছিল, ‘তুমি খাও। আমি আব্বার সাথে কথা বলে আসি। পাওলাকে পাঠিয়ে দিচ্ছি। কিছু দরকার হলে তাকে বলো।’
ম্যাকা চলে গেলে ব্ল্যাক বুল ঢুকেছিল টয়লেটে। মুখ হাত ধুয়ে ব্ল্যাক বুল ফ্রেস হয়ে গেস্ট রুমে ফিরে আসছিল।
দরজায় প্রচন্ড ধাক্কা খেল ব্ল্যাক বুল কারো সাথে। গেস্ট রুমের ভেতর থেকে কেউ যেন ছুটে বের হয়ে আসছিল। দরজায় পর্দা থাকায় কেউ কাউকে দেখতে পায়নি।
ধাক্কা খেয়ে ওপাশ থেকে কেউ সশব্দে পড়ে গিয়েছিল।
ব্ল্যাক বুল তাড়াতাড়ি ভেতর ঢুকে দেখেছিল একটি মেয়ে মাটিতে পড়ে আছে। বয়স তার একুশ-বাইশ হবে। স্বাস্থ্যবান, নাদুস-নুদুস চেহারা। আফ্রিকান সিংহীর মত দেখতে।
ব্ল্যাক বুল দ্রুত গিয়ে মেয়েটিকে টেনে তুলেছিল। বলেছিল, ‘স্যরি, আমার আরও সাবধানে আসা উচিত ছিল। লাগেনি তো কোথাও?’
মেয়েটি ব্ল্যাক বুলের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। একবার তাকিয়েই চোখ বন্ধ করেছিল। বলেছিল, ‘লাগার কথা নয়। কিন্তু দেহের উপর কোন নিয়ন্ত্রণ ছিল না তো। বোধ হয় মাথার পেছনটায় একটু বেশী লেগেছে।’
‘দেখি।’ বলে ব্ল্যাক বুল মেয়েটির পেছনে গেল।
দেখল, মাথার পেছনে কিছু পরিমাণ জায়গা থেঁতলে গেছে। সামান্য রক্তও বেরিয়েছে।
ব্ল্যাক বুল তাকে টেনে চেয়ারে বসাল। বলল, ‘কিছুটা জায়গা থেঁতলে গেছে, রক্তও বেরুচ্ছে। আমার কাছে ভালো ওষুধ আছে লাগিয়ে দিচ্ছি।’
বলে ব্যাগ থেকে এ্যান্টিবায়োটিক স্পঞ্জ বের করে আঘাতের জায়গাটা পরিষ্কার করল। তারপর সেখানে তুলা দিয়ে এ্যান্টিবায়োটিক ক্রিম লাগিয়ে দিল। বলল, ‘দেখবে বেদনাই হবে না।’
মেয়েটি এ্যান্টিবায়োটিক স্পঞ্জ ও লোশন হাতে নিয়ে নেড়ে-চেড়ে বলল, ‘এমন ওষুধ আমাদের দেশে পাওয়া যায় না, কোথায় পেলেন?’ বলে মেয়েটি তাকাল ব্ল্যাক বুলের দিকে। তার চোখে মুগ্ধ দৃষ্টি।
ব্ল্যাক বুল বাল্যকাল ডিঙাবার পর এই প্রথম একটি মেয়েকে বাধ্য হয়ে স্পর্শ করেছে এবং সান্নিধ্যে এসেছে। মেয়েটির এই মুগ্ধ দৃষ্টি তার কাছে নতুন।
ব্ল্যাক বুলের চোখ সে দৃষ্টির সামনে কেমন যেন বিব্রত হয়ে পড়েছিল। চোখ নামিয়ে নিয়েছিল সে। বলেছিল, ‘এগুলো ফ্রান্সের তৈরী।’
মেয়েটি চেয়ার থেকে উঠতে উঠতে বলেছিল, ‘আপনি বুঝি আমাদের মেহমান, ভাইয়ার সাথে এসেছেন?’
‘হ্যাঁ ওঁর সাথে এসেছি, উনি আমার বিরাট উপকার করেছেন। তোমার নাম কি পাওলা?’
‘কি করে জানলেন আমার নাম?’
‘তোমার ভাইয়ার কাছ থেকে। তিনি খাবার দিয়ে বলে গেলেন, পাওলা আসছে, কিছু দরকার হলে তার কাছে চাইবে।’
‘হ্যাঁ। ঘরে কাউকে না দেখে আপনাকে খুঁজতেই তো যাচ্ছিলাম। এই সময় এই এ্যাকসিডেন্ট হওয়ায় নতুন ওষুধ দেখা হলো।’ বলে হেসে উঠেছিল পাওলা।
পাওলা খুব স্মার্ট ও খোলামেলা। বোধ হয় এটা আফ্রিকান কালো মেয়েদের সারল্যেরই একটা চিহ্ন।
পাওলা একটু থেমেই আবার বলেছিল, ‘নিন খেতে বসুন।’
বলে সে টেবিলে খাবার সাজাতে লেগে গিয়েছিল।
‘হাতটা একটু পরিষ্কার করে আসি।’ বলে ব্ল্যাক বুল বাইরে গেল।
খাচ্ছিল ব্ল্যাক বুল।
পাওলা সামনে দাঁড়িয়েছিল। মাঝে-মধ্যে এটা-ওটা তুলে দিচ্ছিল।
একটি মেয়ের এক জোড়া চোখের সামনে তার পরিবেশনা এইভাবে খাওয়া ব্ল্যাক বুলের জীবনে এই প্রথম। জীবনে এই প্রথম তার মনে হচ্ছিল সে যেন বিশিষ্ট কেউ, যাকে একটি সম্মানী মেয়ে দাঁড়িয়ে থেকে যত্নের সাথে খাওয়াচ্ছে।
চোখ তুলে মেয়েটির দিকে তাকাতে লজ্জা বোধ হচ্ছিল ব্ল্যাক বুলের। এই লজ্জার অনুভূতিও তার কাছে নতুন।
হঠাৎ পাওলা বলে উঠেছিল, ‘বাপরে! একটা ধাক্কায় আমি কুপোকাত। আমি দৌড়াচ্ছিলাম। ধাক্কায় আপনারই পড়ার কথা ছিল। কিন্তু ছিটকে পড়লাম আমি। আপনি সিংহের সাথে লড়তে পারবেন।’
ব্ল্যাক বুল হেসেছিল।
‘হাসছেন যে!’ বলেছিল পাওলা।
‘গত রাতে আমি আমার দু’টি কুকুর নিয়ে সিংহের তাড়া খেয়ে গাছে উঠে বসেছিলাম।’
খিল খিল করে হেসে উঠেছিল পাওলা। বলেছিল, ‘তারপর?’
‘তারপর আর কি। দিন হলে সিংহ চলে গেলে গাছ থেকে নেমে সলো’র পথ ধরলাম। তোমার ভাইকে না পেলে আরও একরাত গাছে কাটাতে হতো।’
‘কুকুর দু’টো আপনার সাথে কেন? আপনি কি কাজে কোথায় এসেছেন?’
‘সে অনেক কথা। পরে বলব।’
‘পরে কখন? আপনি তো চলে যাবেন।’
পাওলার চলে যাবেন শব্দটা ব্ল্যাক বুলের হৃদয়ের কোথায় যেন একটা সুঁচ ফুটিয়ে দিল। চলে যাওয়ার কথা যেন মন পছন্দ করছিল না।
‘ও, তাই তো!’ তবু কষ্ট করেই বলেছিল ব্ল্যাক বুল।
‘এখন কোথায় যাবেন?’
‘কোন একটা হোটেলে।’
‘ও তাহলে তো সলো’তেই থাকছেন। আমাকে জানাবেন হোটেলের ঠিকানা?’
‘তোমার টেলিফোন নম্বারটা দিও।’
‘নম্বার লাগবে না। টেলিফোন তুলে বলবেন পুলিশ সুপারের বাসা। আর কিছু বলতে হবে না। আচ্ছা, আপনার কে আছেন?’
‘আমার?’ বলে ব্ল্যাক বুল কিছুক্ষণ চুপ করে থেকেছিল। তারপর বলেছিল, ‘দুভার্গ্য, আমার কেউ নেই।’
‘কেউ নেই!’ বলে বিস্ময় দৃষ্টি নিয়ে পাওলা আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল, এই সময় ঘরে প্রবেশ করল পাওলার ভাই জাগুয়াস ম্যাকা।
‘এই তো তোমার খাওয়া হয়ে গেছে। একটু কি রেস্ট নেবে?” ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বলল ম্যাকা।
‘না দরকার নেই।’
‘কুকুরকে খেতে দিয়েছিস?’ পাওলার দিকে চেয়ে প্রশ্নটা করেই আবার বলে উঠল, ‘পরিচয় হয়েছে এর সাথে? এ আমার ছোট বোন পাওলা নোয়ানি। কলেজ পাশ করেছে। পুলিশ ট্রেনিংও শেষ করেছে।’
‘হয়েছে। আমি ওকে দেখেই বুঝতে পেরেছি ও পাওলা।’
‘কুকুরকে আগেই খেতে দিয়েছি।’ বলল পাওলা।
‘ধন্যবাদ পাওলা।’ বলে ম্যাকা ব্ল্যাক বুলকে বলল, ‘তুমি তৈরী হয়ে নাও। আমি হ্যাটটা নিয়ে আসি।’
পাওলা থালা-বাসন গুছিয়ে কাজের মেয়ে ডেকে তার হাতে পাঠিয়ে তার পেছনে যেতে যেতে দরজায় গিয়ে ফিরে দাঁড়াল। বলল, ‘এখান থেকে যাওয়ার পর আমাকে কি জানাতে চেয়েছিলেন বলুন তো?’
‘কি?’
‘এই ভুলে গেছেন। হোটলের নাম।’
‘স্যরি, এটার কথা বলেছ। না আমি ভুলিনি।
হোটেলে উঠেছে ব্ল্যাক বুল।
হোটেলে উঠার পর একটু রেস্ট নিয়ে ব্ল্যাক বুল তার কুকুর দু’টি নিয়ে বেড়িয়ে পড়ল ‘সলো’কে দেখার জন্য।
দুইটি লক্ষ্য। এক, তার পিতৃপুরুষের সেই সলো গ্রামকে পায়ে হেঁটে দেখা। দুই, কুকুর দু’টিকে সুযোগ দেয়া তাদের ঘ্রান শক্তির মাধ্যমে আহমদ মুসাকে তারা খুঁজে বের করতে পারে কিনা। আহমদ মুসাকে এই সলোত্ই আনা হয়েছে সে নিশ্চিত।
প্রায় চার ঘন্টা পায়ে হেঁটে ঘুরে বেড়াল ব্ল্যাক বুল। কিন্তু তার মনে হলো চার ঘন্টায় শহরের একটা অংশ মাত্র সে দেখতে পারল। তার ধারণার চেয়ে বন্দর-শহরটি অনেক বড়।
ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল ব্ল্যাক বুল। শেষে যেখানে সে পৌঁছল সেটা সংঘ নদী তীরের টুরিস্ট অবজারভেটরী। এটা একটা উঁচু টাওয়ার। এর মাথায় চড়ে পর্যটকরা আফিকার বনজ রূপ উপভোগ করে।
ক্লান্ত হলেও ব্ল্যাক বুলের লোভ হল তার মাতৃভূমিকাকে আরও ভালভাবে দেখা।
কুকুর দু’টি নিয়েই উপরে উঠল ব্ল্যাক বুল।
খুশী হলো উপরে উঠে।
ছোট বেলা থেকেই বনজংগল দেখছে ব্ল্যাক বুল। কিন্তু টাওয়ারে উঠে বনের যে রূপ দেখল, তা ছিল তার কাছে আকর্ষণীয়। জংগলের অন্ধকার যাকে বলে, সেই অন্ধকার দেখল ব্ল্যাক বুল দক্ষিণে তাকিয়ে। গোটা দক্ষিণ দিগন্ত ঘন অন্ধকারে ঢাকা। সে অন্ধকাররে দিকে তাকালে আনন্দ নয়, বুকটা কেঁপে উঠে ভয়ে। খুব কাছেই সংঘ নদীর পানি। কালোর প্রতিবিম্ব তার পানিকে কালি বানিয়ে দিয়েছে।
টাওয়ারে ছোট একটা রেস্টুরেন্ট আছে। আছে একটা টেলিফোন বুথ।
পাওলার কাছে টেলিফোন করার কথা মনে পড়ল ব্ল্যাক বুলের। হোটেলের নাম জানিয়ে তাকে টেলিফোন করবে এ ওয়াদা সে দিয়ে এসেছে।
টেলিফোন করল ব্ল্যাক বুল।
ওপার থেকে জবাব এল, ‘হ্যালো, আমি পাওলা।’
‘চিনতে পেরেছ?’ বলল ব্ল্যাক বুল।
হাসল পাওলা। বলল ‘চিনতে না পারলে নাম জিজ্ঞেস করলাম না কেন?’
‘ধন্যবাদ।’
‘না, ধন্যবাদ আমারই দেবার কথা।’
‘কেন?’
‘এই টেলিফোন করার জন্য, মনে থাকার জন্য। কেমন লাগছে হোটেল?’
‘বোঝার সময়ই পাইনি। হোটেলে ব্যাগেজ রেখেই বেরিয়ে এসেছি। পায়ে হেঁটে শহর দেখার জন্য।’
‘শহর কোথায়, বলুন বন-জংগল দেখার জন্য। তা পায়ে হেঁটে কেন?’
‘সলো’র মাটির স্পর্শ আমার কাছে সোনার চেয়ে মুল্যবান মনে হচ্ছে। ভালো লাগছে এর বন-জংগলের দিকে চেয়ে থাকতে।’
‘সলো’র সাথে এই প্রেমে পড়ার কারণ?’
‘বলবো একদিন।’
‘এ নিয়ে দু’বার বললেন ‘একদিন’ বলবেন। সে দিনটি কবে আসবে?’
‘আমি জানি না।’
‘দেখুন, আমি পুলিশের ট্রেনিং নিয়েছি। আমি কিছু বুঝতে পারি। আমার মনে হচ্ছে, বড় একটি মিশন নিয়ে আপনি সলো এসেছেন। বলবেন না আমাকে?’
‘শুনে কি করবেন?’
‘আর কিছু না হোক, আপনার চিন্তার অংশীদার হতে পারি।’
‘শুনতে নতুন লাগছে। ধন্যবাদ।’
‘নতুন লাগছে কেন?’
‘এমন অংশীদার কখনও আমার হয়নি।’
‘এখন বলতে আপত্তি আছে?’
‘বলব দেখা হলে।’
‘কখন হোটেলে ফিরবেন?’
‘জানি না। এখন রাখি। টাওয়ারের ব্যস্ত পাবলিক বুথ তো।’
‘দুঃখিত, ঠিক আছে। আমরাও এখনি একটু বেরুব। বাই।’
‘বাই।’
ব্ল্যাক বুল টাওয়ার থেকে সামান্য উত্তরে নদীর ধারে ওয়াশিংটন মনুমেন্টের মত একটা মিনার দেখতে পেল।
টাওয়ার থেকে নেমে ব্ল্যাক বুল মনুমেন্টের দিকে চলল।
মনুমেন্ট এলাকাটি খুবই সুন্দর। মনুমেন্ট এলাকার তিনদিক ঘিরে সবুজ গাছের সুশৃঙ্খল বেষ্টনি। বেষ্টনি নদীর পানি পর্যন্ত নেমে গেছে।
সবুজ বেষ্টনির মাঝখানে দাঁড়িয়ে মনুমেন্টটি।
মনুমেন্ট শীর্ষে উতকীর্ণ শিরোনামটি অনেক দূর থেকে পড়া যায়। লেখা আছে “স্মরণ স্তম্ভটি দেশ মাতৃকার হারানো সন্তানদের উদ্দেশ্যে নিবেদিত।”
‘হারানো সন্তান’ বলতে কি বুঝানো হয়েছে ব্ল্যাক বুল বুঝতে পারলো না। দেশের উতসর্গীত জীবন জানা অজানা সৈনিক অথবা নাগরিকদের স্মরণ স্তম্ভ সে দেখেছে। কিন্তু ‘হারানো’ বলতে কাদের বুঝানো হয়েছে?
ভেতরে প্রবেশ করল ব্ল্যাক বুল।
ভেতরে লোকজন তেমন নেই। যারা আছে, তারা অধিকাংশই শিশু ও কিশোর। তারা মনুমেন্টের চারদিকের বিস্তৃত লনে ছুটে বেড়াচ্ছে, খেলাধুলা করছে।
ব্ল্যাক বুল গিয়ে দাঁড়াল মনুমেন্টের সামনে। কংক্রিটের তৈরী স্মরণ স্তম্ভে বসানো শ্বেত পাথরে খোদিত নামের সারি দেখতে পেল ব্ল্যাক বুল।
দেখল সে, মনুমেন্টের এ দিকটা মনুমেন্টের সম্মুখ দিক নয়। সংঘ নদীর পাশটা এর সম্মুখ দিক।
ব্ল্যাক বুল ঘুরে মনুমেন্টের সম্মুখ দিকে দাঁড়াল।
দেখল, সামনের প্রশস্ত শ্বেত পাথরে লেখা অনেক কথা। তারপর নামের শুরু।
ব্ল্যাক বুল পড়ার জন্য আরও সামনে এগিয়ে গেল।
দেখল, লেখার উপর একটি শিরোনাম। শিরোনামটি হলোঃ ‘স্বজন হারানোর বিয়োগান্ত সেই ঘটনা।’
শিরোনামের পরেই সেই ঘটনার বিবরণ।
পড়তে লাগল ব্ল্যাক বুলঃ
‘তখন দাস ব্যবসায়ের অন্ধকার যুগ। সেই অন্ধকার যুগের এক ভোর বেলা। সমৃদ্ধ গ্রাম সলো’র মানুষ গভীর ঘুমে অচেতন। শত বন্দুকের গুলীর শব্দে তাদের ঘুম ভাঙল। শুরু হলো দাস ব্যবসায়ীদের লেলিয়ে দেওয়া সৈন্যের বন্দুক, কামানের বিরুদ্ধে তীর-ধনুকের অসম লড়াই। গ্রামবাসীদের তীর-বর্শার সঞ্চয় শীঘ্রই শেষ হয়ে গেল। যুদ্ধ শেষ হলো গ্রামের দুইশ’ জনের নিহত এবং প্রায় তিনশ’ জনের বন্দী হওয়ার মধ্যে দিয়ে। বন্দী তিনশ’ জনের মধ্য থেকে যুবক, যুবতী বাছাই করে দেড়শ’ জনকে তিনটি বড় বোটে করে ওরা ধরে নিয়ে যায়। সলোর জীবনে এটাই ছিল সবচেয়ে বড় দুর্ভাগ্যের দিন। যারা নিহত হলো, তারা হলো শেষ। তাদের লাশ ছিল দুঃখের মধ্যেও একটা সান্ত্বনা। কিন্তু দাস ব্যবসায়ীরা যাদের ধরে নিয়ে গেল, তারা বেঁচে থেকেও মৃত্যু যন্ত্রণায় নিমজ্জিত হলো এবং আত্মীয়-স্বজনদের বুকে রেখে গেল সারা জীবনের জন্য যন্ত্রণার জ্বলন্ত অঙ্গার। সেই যন্ত্রণার ইতি হয়নি এখনও। সেই যন্ত্রণারই এক প্রতিবিম্ব এই কালো মিনার। যন্ত্রণার এই কালো মিনারে উতকীর্ণ করে রাখা হলো আমাদের সেই হারানো সন্তানদের নামগুলো। পাঠক, এখানে এক মুহুর্ত হলেও দাঁড়িয়ে প্রার্থনা করুন আমাদের হারানো মানিকদের জন্য- ঈশ্বর যেন তাদের আত্মার শান্তি দান করেন।’
পড়তে পড়তে ঝর ফর করে অশ্রু নেমে এল ব্ল্যাক বুলের দু’চোখ দিয়ে। অবিরতভাবে তা গড়িয়ে চলল গন্ড বেয়ে।
ঝাপসা চোখেই আকুলভাবে পড়তে লাগল নামগুলো। প্রথম নামই পড়ল, ‘কমন্ড কাল্লা’ তার দাদার নাম।
নামটা পড়ার সাথে সাথেই কান্নার এক প্রবল উচ্ছাস এসে গ্রাস করল ব্ল্যাক বুলকে।
কয়েক মুহুর্তের মধ্যে নিজেকে সামলে নিয়ে চোখ মুছল ব্ল্যাক বুল। মুখ এগিয়ে নিয়ে ধীরে ধীরে চুমু খেল ‘কমন্ড কাল্লা’ নামের উপর।
চুমু দিতে গিয়ে আবার অপ্রতিরোধ্য কান্নায় ভেঙে পড়র ব্ল্যাক বুল।
একটি হাতের সযত্ন স্পর্শ অনুভব করল ব্ল্যাক বুল তার কাঁধে। চমকে উঠে ফিরে তাকাল। তার কাঁধে হাত রেখে দাড়িয়ে আছে জাগুয়াস ম্যাকা, তার পাশে পাওলা। দু’জনের চোখে-মুখে রাজ্যের বিস্ময়!
ব্ল্যাক বুল কুকুরের চেন হাত থেকে ছেড়ে দিয়ে পকেট থেকে রুমাল বের করে দু’হাতে দু’টি চোখ মুছে নিয়ে বলল, ‘আপনারা? এখন? এখানে?’ ব্ল্যাক বুলের চোখে বিস্ময়।
বিস্ময়ের ঘোর তখনও কাটেনি ম্যাকা ও পাওলার চোখ থেকে।
‘প্রতি বছর এই দিন আমাদের পরিবারের সকলেই একবার এইখানে আসি’ বলল ম্যাকা।
‘এই দিন কেন?’
‘এই দিন এই স্থান থেকে অন্যান্য অনেকের সাথে তুমি যে নামটায় চুমু দিলে সেই আমাদের কমন্ড কাল্লা চিরতরে হারিয়ে গেছে। প্রতিবছর এদিন এসে আমরা তার প্রার্থণা করি, আর তার উদ্দেশ্যে নদীতে ফুল ভাসিয়ে দেই।’
ব্ল্যাক বুলের চোখে তখন বিস্ময় ঠিকরে পড়ছে। বলল, ‘কমন্ড কাল্লার উদ্দেশ্যে কেন? কমন্ড কাল্লা আপনাদের কে?’
‘কিন্তু তার আগে তুমিবল, তুমি এমন আকুল হয়ে কাঁদছ কেন? কমন্ড কাল্লার নামে চুমু দিলে কেন?
ব্ল্যাক বুলের চোখে আবার অশ্রু নামল। সে মুখ নিচু করল। অল্পক্ষণ পরে মুখ তুলল। অশ্রু ধোয়া তার মুখ। আবেগে কাঁপছে তার দুটো ঠোঁট। বলল সে, ‘কমন্ড কাল্লা আমার দাদু।’ এক প্রবল উচ্ছাসে ভেঙে পড়ল তার কন্ঠ।
ব্ল্যাক বুলের মুখ থেকে বেরুনো শব্দগুলো যেন এক বজ্রপাত। বিস্ময়ের প্রচন্ড আঘাতে ম্যাকা ও পাওলা কাঠের মত শক্ত হয়ে গিয়েছিল, নিজেদের যেন হারিয়ে ফেলেছিল। কিন্তু তারপরেই কাঠের বুকে নামল যেন অশ্রুর ঝরণা। বাঁধ ভাঙা এক উচ্ছাসে ভেঙে পড়া ম্যাকা পাগলের মত জড়িয়ে ধরল ব্ল্যাক বুলকে। তার চোখ থেকে নামল অশ্রুর বন্যা।
বিস্ময়ে কাঠ হয়ে যাওয়া পাওলার দু’চোখ থেকে নামছিল অশ্রুর অবিরল ধারা।
কিছুক্ষণ পর ম্যাকা নিজেকে কিছুটা সামলে নিয়ে বলল, ব্ল্যাক বুলকে উদ্দ্যশ্য করে, ‘তোমার দাদু কমন্ড কাল্লাহ এবং আমাদের দাদী দুই আপন ভাইবোন। সেই দুর্ভাগ্যের দিন তোমার দাদুর হারিয়ে যাওয়া এবং তার বাপ-মা নিহত হওয়ার পর পরিবারের একমাত্র জীবিত মানুষ ছিলেন আমাদের দাদী।
অশ্রু রুদ্ধ কন্ঠে ‘ভাই’ বলে ব্ল্যাক বুল আবার জড়িয়ে ধরল ম‌্যাকাকে। ম্যাকাও ‘আমার ভাই’ বলে জড়িয়ে ধরল ব্ল্যাক বুলকে।
এক সময় ব্ল্যাক বুল ম্যাকাকে ছেড়ে দিয়ে তাকাল পাওলার দিকে। ব্ল্যাক বুল পাওলার দিকে তাকানোর সাথে সাথে পাওলার দু’গন্ডে শুকিয়ে যাওয়া অশ্রুর ধারা আবার সজীব হয়ে উঠল হঠাৎ চোখ ফেটে নেমে আসা নতুন অশ্রুতে। কালো পাওলার কালো গ্রানাইটের মত মসৃন ঠোঁট দু’টি কেঁপে উঠল প্রচন্ড এক আবেগে।
‘পাওলা!’ আবেগ রুদ্ধ কন্ঠে ডাকল ব্ল্যাক বুল।
সে ডাক বোধ হয় ধ্বসিয়ে দিল পাওলার বিবেচনার বাঁধকে। তার আবেগের নদীতে যেন জেগে উঠল প্রচন্ড বন্যা। যেন তারই প্রচন্ড ধাক্কায় পাওলা গিয়ে আছড়ে পড়ল ব্ল্যাক বুলের বুকে।
আবেগাপ্লুত ব্ল্যাক বুল এই অপরিচিত আকস্মিকতায় প্রথমটায় বিমুঢ় হয়ে পড়ল। তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে আলতোভাবে পাওলার পিঠে হাত বুলাল।
তারপর পাওলাকে ধরে নিয়ে ম্যাকা’র সামনে দাঁড়িয়ে বলল, ‘ভাইয়া, পাওলা এখনও ছোটই আছে। কিন্তু খুব ভালো মেয়ে পাওলা।’
ম্যাকার চোখে তখনও অশ্রু। কিন্তু তার ঠোঁটে ফুটে উঠল একটা সস্নেহ হাসি। বলল, আমাদের জন্যে নতুন সুখবর যে, পাওলাকে তুমি ভাল বলেছ। ওর অত্যাচারে সবাই অতিষ্ঠ। তাই তো ওকে পুলিশে চাকুরী দিচ্ছি।’
‘ভাইয়া……।’ চোখ মুছে পাওলা বলতে শুরু করল।
ম্যাকা তাকে বাধা দিয়ে বলল, ‘আমি তোকে কিছু বলিনি। কমন্ড কাল্লা তোকে ভাল বলল তাই তোকে কিছু তথ্য দিতে যাচ্ছিলাম। যাক এসব, সবাই এখন চল যাই বাসায়। আব্বাকে এ সুখবর তাড়াতাড়ি দিতে না পারলে বুক ফেটে যাবে আমার।’
‘ভাইয়া, আমার নাম ‘কমন্ড কাল্লা’ নয়। এখানে এসে এই নাম আমার এ জন্যেই বলেছি যাতে এই নামের সূত্র ধরেও যদি আমার দাদু বংশের কাউকে খুঁজে পাই।’ রুমাল দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে বলল ব্ল্যাক বুল।

‘তোমার উদ্দেশ্য স্বার্থক হয়েছে। তোমার কমন্ড কাল্লা নামই তোমার প্রতি আমাকে আকৃষ্ট করে। যার ফলে আগ্রহ করে তোমাকে গাড়িতে নেই, বাড়িতে নিয়ে আসি।’
একটু থেমেই ম্যাকা আবার বলল, ‘তাহলে তোমার নাম কি?’
নাম আমার একাধিক হয়েছে। ছোট বেলা জর্জ জায়েদী, তারপর ব্ল্যাক বুল এবং অবশেষে ‘আবদুল্লাহ জায়দ রাশিদী।’
‘এতো মুসলিম নাম।’ বিস্মিত কন্ঠে বলল ম্যাকা।
‘হ্যাঁ, মুসলিম নাম।’
‘তার মানে? তুমি মুসলিম? তোমার এত নাম পরিবর্তনের কারণ?
‘আমার দীর্ঘ দুঃখের ইতিহাসের সাথে এর কারণ যুক্ত আছে।’ গভীর বেদনার্ত কন্ঠে বলল ব্ল্যাক বুল।
ম্যাকা ও পাওলা দু’জনের মুখও গম্ভীর হয়ে উঠল। ম্যাকা ব্ল্যাক বুলের কাঁধে হাত রেখে বলল, ‘চল ভাই বাসায় ফিরি, তোমাদের ইতিহাস শোনার আগে আর কিছুই ভাল লাগবে না।’
‘চলুন।’ বলে ব্ল্যাক বুল কুকুরের চেন তুলে নিতে যাচ্ছিল।
তার আগেই চেন দু’টি তুলে নিল পাওলা। বলল, ‘কুকুর দু’টি এখন আমার।’
বলে পাওলা কুকুর দু’টির পিঠ ও মাথা নেড়ে আদর করল। কুকুর দু’টিও লেজ নেড়ে গা ঘেঁষে দাঁড়াল পাওলার। যেন নতুন প্রভূকে তারা স্বাগত জানাচ্ছে।
এত তাড়াতাড়ি আমার টম, টমি’কে তুমি দখল করে ফেললে? এ দু’টির প্রতি কিন্তু ভাইয়ারও একটা দাবী ছিল।’ হেসে বলল ব্ল্যাক বুল।
ম্যাকা হাসল। বলল, ‘পাওলা’র পক্ষে আমি আমার দাবী পরিত্যাগ করলাম।’
কথা শেষ করেই ‘এস, আর দেরী নয়’ বলে ম্যাকা হাঁটতে শুরু করল।
গেটের বাইরে এসে সবাই ম্যাকার জীপে উঠল। সামনে ড্রাইভিং সিটে বসল ম্যাকা। আর পেছনের সিটে ব্ল্যাক বুল এবং পাওলা।
গাড়ি চলতে শুরু করল ম্যাকাদের বাড়ির উদ্দেশ্যে।

ব্ল্যাক বুল বলছিল কাহিনী। তার দাদু কমন্ড কাল্লার কাহিনী।
জাগুয়াস ম্যাকা, তার আব্বা, পাওলা এবং ম্যকার স্ত্রী, ফুফু সবাই পিনপতন নীরবতার মধ্যে শুনছিল। ব্ল্যাক বুলের মুখে কমন্ড কাল্লার কাহিনী।
বৃদ্ধের পাশে বসেছিল ব্ল্যাক বুল। আর তাদের সামনে অর্ধচন্দ্রাকারে বাড়ির সবাই।
রাজ্যত্যাগী রাজা যায়দ রাশিদীর সাথে কমন্ড কাল্লার ইয়াউন্ডি পৌঁছা পর্যন্ত কাহিনী বলে থামল ব্ল্যাক বুল।
সকলেরই চোখে অশ্রু।
‘তারপর?’ বৃদ্ধ বলল।
ব্ল্যাক বুল পরবর্তী কাহিনী শুরু করল। কি করে সুলতান যায়দ রাশিদীর একমাত্র পুত্র মারা গেল, কেন যায়দ রাশিদী হজ্জ্ব যাত্রা বন্ধ করে ইয়াউন্ডিতে ছেলের কবরের পাশে স্থায়ীভাবে বসবাসের সিদ্ধান্ত নিলেন, মহৎ হৃদয় যায়দ রাশিদী কমন্ড কাল্লাকে স্বাধীনভাবে যেখানে ইচ্ছা চলে যেতে অনুমতি দিলেও তিনি থেকে গেলে কি করে যায়দ রাশিদী তাকে সন্তান হিসেবে গ্রহণ করে একমাত্র কন্যার সাথে বিয়ে দিলেন।
একটু থামল ব্ল্যাক বুল। আবার শুরু করল, ‘এইভাবে কমন্ড কাল্লা একজন শাহজাদী এবং বিপুল বিত্ত-বৈভবের মালিক হলেন। কিন্তু সুখ সইল না তার কপালে। খৃষ্টান মিশনারীরা হত্যা করল সুলতান যায়দ রাশিদী এবং তার স্ত্রীকে। সকল সম্পত্তি আত্মসাতের জন্য সম্পত্তি একমাত্র উত্তরাধিকারী কমন্ড কাল্লার স্ত্রীকেও বন্দী করল এবং কমন্ড কাল্লাকে তাদের একজন নিকৃষ্ট কর্মচারী হতে বাধ্য করল। তার কোন স্বাধীনতা ছিল না, বাইরে বেরুবার কোন সুযোগ ছিল না। শুরু হয়েছিল তার এক ধরনের দাস জীবন। এ দুর্বিসহ জীবন ছিল আমার আব্বার এবং আমিও তা ভোগ করে এসেছি।’
‘তোমার সে কাজটা কি ছিল?’ জিজ্ঞেস করল ম্যাকা।
‘সে এক ঘৃনিত কাজ। ঘাতকের দায়িত্ব পালন। তারা যাদের বন্দী করে আনত, তাদের শিরচ্ছেদ করা চিল আমার কাজ।’
একটু থামল ব্ল্যাক বুল। তারপর বলল, ‘আমার হতাশ ও অন্ধকারময় জীবন এভাবেই হয়ত কেটে যেত, কিন্তু জীবন চিত্র আমার পাল্টে গেল হঠাৎ। একজন মহান মানুষ এবং মহাবিপ্লবীকে ওরা বন্দী করে আনল। তার কাছ থেকেই আমি প্রথম জানলাম আমি মানুষ, মানুষ হিসেবে শির উঁচু কারে আবার মানুষের মধ্যে দাঁড়াতে পারি। তিনি ওদের পরাভূত ও ধ্বংস করে নিজে মুক্ত হলেন এবং করে অন্ধকার জিন্দানখানা থেকে আমাকেও মুক্ত করে আনলেন। এবং প্রতিষ্ঠা করলেন যায়দী রাজবংশের এক উত্তরসুরী হিসেবে, যায়দ রাশিদীর বাড়ি ও প্রচুর সম্পদও আমার হাতে তুলে দিলেন। আমি নতুনভাবে আমার পিতৃধর্ম ইসলামে ফিরে এলাম। আমার নতুন নাম হলো আবদুল্লাহ যায়দ রাশিদী। আমার পিতা যেহেতু প্রকাশ্যে ইসলাম ধর্ম পালন করতে পারতেন না, আমার মুসলিম নামও রাখা সম্ভব ছিল না। তাই তিনি আমার নাম রেখেছিলেন জর্জ রাশিদী। নামের অর্ধেক খৃস্টান, অর্ধেক মুসলমান। আর ঘাতক হিসেবে ওরা আমার নাম রেখেছিল ব্ল্যাক বুল।’ থামল ব্ল্যাক বুল।
‘তারপর? এখানে এলে কেমন করে? আমাদের কথা মনে পড়ল কি করে?’ বলল ম্যাকা।
সংগে সংগে উত্তর দিল না ব্ল্যাক বুল।
পাশের বালিশটায় একটু হেলান দিয়ে বসল। বলল, ‘সে অনেক কথা। আমি আসিনি। আমাকে অন্য একজন সাথে করে নিয়ে এসেছেন ভিন্ন এক মিশনে। ভাগ্যই আমাকে এখানে এইভাবে নিয়ে এসেছে।’
‘কার সাথে? কি মিশন?’ বলল পাওলা।
‘বিরাট একটি মিশন। মিশনটা আমার নয়। আমি একজন সহযোগী মাত্র। বলা ঠিক হবে কিনা বুঝতে পারছি না।’
‘মিশন যার, যার সাথে তুমি এসেছ সে কোথায়?’ বলল ম্যাকা।
ব্ল্যাক বুলের মুখ ম্লান হয়ে উঠল। বেদনা ভারাক্রান্ত মুখ নিচু করল সে।
ব্ল্যাক বুলের বেদনাক্লিষ্ট মুখের দিকে চেয়ে সকলে বেদনা অনুভব করল।
কেউ কথা বলল না।
ব্ল্যাক বুলই কথা শুরু করল আবার। বলল, ‘উনি আহত অবস্থায় বন্দী হয়েছেন।’ ব্ল্যাক বুলের কথা ভারী, অশ্রু ভেজা।
অস্বস্তি এবং বেদনার ছায়া নামল গোটা ঘরে।
নীরবতা ভেঙ্গে মুখ খুলল ম্যাকা। বলল, ‘তার জন্যে এমন ভালবাসা, কে সে?’
‘এ সেই লোক যে আমাকে অন্ধকার থেকে আলোতে নিয়ে এসেছে, যে আমাকে নতুন জীবন দিয়েছে, যাকে আমি আমার জীবনের চেয়ে বেশী ভালোবাসি।’
‘কোথায় সে আহত এবং বন্দী হলো?’
‘সংঘ হাইওয়ের যেখানে কাদেলী রোড এসে মিশেছে সেখানে।’
সোজা হয়ে বসল ম্যাকা। তার চোখ-মুখ তীক্ষ্ণ হয়ে উঠল। বলল, ‘আমি বারবারেতি থেকে আসার পথে ওখানে চারটি লাশ দেখেছি। আর হাইওয়ের পাশে কাদেলী রোডের মুখে গুলীতে ঝাঁঝরা হয়ে যাওয়া একটা জীপ দেখেছি। এই ঘটনার কথা তুমি বলছ?’
‘গুলীতে ঝাঁঝরা হয়ে যাওয়া জীপটি করেই আমরা এসেছিলাম। আর ঐ চারজন নিহত হয়েছে আমার সাথীর হাতে।’
‘তোমার সাথীর হাতে? তাহলে তোমার সাথী বন্দী হলো কিভাবে?’
‘ওদের ওঁত পেতে থাকা চারটি গাড়ি আকস্মিকভাবে আমাদের ঘেরাও করে ফেলে এবং হঠাত করেই বন্দুকের মুখে আমার সাথীকে ধরে নিয়ে যায় হাইওয়ের উপর। ওরা বন্দুকের বাঁট দিয়ে আমার সাথীকে মারধোর করে ওঁকে রক্তাক্ত করে ফেলে। কিন্তু অসম্ভব রকমের সামান্য সুযোগের সদ্ব্যবহার করে আমার সাথী ওদের চারজনকে হত্যা করে। পঞ্চম জনকেও যখন গুলী করতে যাবে, এ সময় একটি পাঁচ ছয় বছরের শিশু হঠাত সামনে এসে তার পিতাকে হত্যা না করার আবেদন জানায়। আমার সাথী রিভলবার নামিয়ে নেয়। এই সুযোগে পঞ্চম ব্যক্তি তাকে লক্ষ্য করে গুলী করে। সে নিজেকে বাঁচাতে পারলেও হাত আহত হয় এবং তার হাত থেকে রিভলবার ছিটকে পড়ে যায়। ঠিক এই সময় আরও দু’টি গাড়িতে আরও চারজন সেখানে হাজির হয়। বন্দী হয়ে যায় আমার সাথী।’
‘তুমি বাঁচলে কেমন করে?’
‘আমি কৃষ্ণাঙ্গ, আমাকে ওরা গাইড মনে করেছে। তাই গুরুত্ব দেয়নি। অবশ্য শেষে ব্রাশ ফায়ার করেছিল আমার গাড়ি লক্ষ্যে। মেঝেতে শুয়ে থাকায় বেঁচে গেছি।’
‘ওরা কি সবাই শ্বেতাংগ ছিল?’
‘ওরা শ্বেতাংগ ছিল। আমার সাথী এশিয়ান।’
‘এশিয়ান? বল তো ঐ শ্বেতাংগরা কারা?’
ব্ল্যাক বুল একটু দ্বিধা করল। তারপর বলল, ‘ওরা ব্ল্যাক ক্রস-এর লোক।’
‘ব্ল্যাক ক্রস?’ ম্যাকা’র কন্ঠ প্রায় চিৎকার করে উঠল।
‘তুমি চেন ওদের?’ বলল বৃদ্ধ, ম্যাকার আব্বা।
সংগে সংগে উত্তর দিল না ম্যাকা। সে অনেকটা বিস্ময়-বিমুঢ় হয়ে পড়েছিল। একটু সময় নিয়ে বলল, ‘হ্যাঁ চিনি আব্বা। সমগ্র পৃথিবী বিস্তৃত অত্যন্ত শক্তিশালী এবং দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসবাদী সংগঠন।’
থামল ম্যাকা। একটু পর বলল, ‘আমাদের উপর সরকারী নির্দেশ আছে পারতপক্ষে ওদের কাজে যেন আমরা নাক না গলাই। ওদের এড়িয়ে চলতে বলা হয় আমাদেরকে।’
কথা শেষ করে ব্ল্যাক বুলের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ওদের সাথে তোমার সাথীর ঝগড়া কিসের? তোমার সাথীর মিশনের লক্ষ্য কি ওরা?’
‘হ্যাঁ।’
বলে একটু থামল ব্ল্যাক বুল। চিন্তা করল। তারপর বলল, ‘ঝগড়ার কাহিনীটা বিরাট।’ এরপর একে একে ব্ল্যাক বুল ক্যামেরুনে কি করে ব্ল্যাক ক্রস সমূলে উৎপাটিত হলো এবং ব্ল্যাক ক্রসের সর্বোচ্চ নেতা নিহত হলো কার হাতে, কি করে ওরা বারবারেতি’র ইসলামী কনফারেন্স স্থানে বিস্ফোরন ঘটিয়ে আন্তর্জাতিক মুসলিম নেতাদের পনবন্দী করল তার বিস্তারিত বিবরন দিয়ে বলল, ‘ব্ল্যাক ক্রস শর্ত দিয়েছে আমার সাথী আত্মসমর্পন করলে তবেই তারা ছেড়ে দেবে মুসলিম নেতাদের। আমার সাথী তাদের মুক্ত করার লক্ষ্য নিয়েই আসছিলেন মধ্য আফ্রিকা প্রজাতন্ত্রে।’
ওদিকে বিস্ময়ে থ’ হয়ে গেছে ম্যাকা। তার চোখ ছানাবড়া হয়ে উঠেছে বিস্ময়ে। ব্ল্যাক বুল থামলে সে প্রায় চিৎকার করে উঠল, ‘কি বলছ তুমি! ওখান থেকে কেউ বাঁচেনি। মুসলিম নেতৃবৃন্দরা সবাই অস্বাভাবিক রকম শক্তিশালী বিস্ফোরনে পুড়ে ছাই হয়ে গেছেন। আমরা এটা জানি, গোটা দুনিয়া এটা জানে। ইসলামী সম্মেলন সংস্থার (ওআইসি) একটি বিশেষজ্ঞ দলও ঘটনাস্থল পরীক্ষা করে গেছে। তারাও আমাদের সাথে একমত। তুমি নতুন কথা বলছ।’
‘আপনি ঠিকই বলেছেন। ব্ল্যাক ক্রস এ রকম বিশ্বাসই জন্মিয়েছে। কিন্তু আসল ঘটনা হলো মুসলিম নেতৃবৃন্দকে কিডন্যাপ করার পর তারা বিস্ফোরন ঘটিয়েছে।’
‘সত্যি?’
‘হ্যাঁ, কোন সন্দেহ নেই।’
‘কি করে তোমরা জানলে?’
‘ওরা চিঠি পাঠিয়েছে। তাতে তারা ঐ শর্ত উল্লেখ করেছে।’
‘তোমার সাথীকে হাতে পাওয়ার জন্যে তাদের এটা একটা ফাঁদও তো হতে পারে।’
‘শুধু চিঠি নয়, আরও প্রমান পাওয়া গেছে।’
ব্ল্যাক বুল থামলেও ম্যাকা কোন কথা বলল না। ভাবছিল সে। বেশ কিছুক্ষন পর বলল, ‘হতেও পারে। ব্যাপারটা আমাদের পুলিশের জন্যে হবে বিব্রতকর।’
বলে একটু থামল। বলল তারপর, ‘কিন্তু তোমার এই সাংঘাতিক সাথীটা কে, যে একা লড়তে এসেছে, ব্ল্যাক ক্রসের সাথে এবং তাদের বিরুদ্ধে লড়ে জয়ী হয়েছে ক্যামেরুনে?’
‘শুধু ক্যামেরুন নয়। ফ্রান্সেও লড়েছে এবং জয়ী হয়েছে।’
‘এটাও যে অবিশ্বাস্য কথা বলছ। এমন ব্যক্তিত্ব কে আছে?’
‘আছে।’
‘কিন্তু কে সে?’
একটু দ্বিধা করল ব্ল্যাক বুল। তারপর বলল, ‘বলব, কিন্তু একটা শর্ত।’ একটু থামল। তারপর বলল, ‘আপনি পুলিশের লোক। আমার অনুরোধ তাঁর নাম বা পরিচয়টা পুলিশ বা সরকারের জানা ঠিক হবে না।’
ভ্রু কুঞ্চিত করল ম্যাকা।
একটু সময় নিয়ে বলল, ‘তোমার শর্ত মানব যদি তিনি মধ্য আফ্রিকা প্রজাতন্ত্রের লোক না হন এবং এখানকার কোন নাগরিক বা দেশের সাথে সংশ্লিষ্ট কোন অপরাধ যদি তিনি করে না থাকেন।’
‘আপনার শর্ত মানলাম।’
বলে একটা ঢোক গিলল ব্ল্যাক বুল। তারপর বলল, ‘তিনি আহমদ মুসা।’
ব্ল্যাক বুল নাম উচ্চারণের সাথে সাথে শক খাওয়ার মত এক ত্বড়িত তরঙ্গ খেলে গেল ম্যাকা’র গোটা দেহে। তার মুখ-চোখে ফুটে উঠল প্রশ্নমাখা এক বিস্ময়। তার চোখ দুটি স্থির হয়ে কিছুক্ষন চেয়ে থাকল ব্ল্যাক বুলের দিকে। তারপর বলল, ‘কোন আহমেদ মুসা? বিশ্ব ব্যাপী পএ পত্রিকায় যাকে নিয়ে আলোচনা হচ্ছে, সে কি?’
‘হ্যাঁ, সে’
‘অর্থ্যাৎ বলছ বিশ্ব বিশ্রুত আহমেদ মুসা তোমার সাথী এবং এখন তিনি মধ্য আফ্রিকা প্রজাতন্ত্রে?’
‘তাকে বন্দী করে ‘সলো’র দিকেই আনা হয়েছে’
‘সলোর দিকে? কেন? তাকে তো বারবারেতোএ মত বড় শহরের দিকে নিয়ে যাবার কথা।
‘কারণ বোধ হয় এই যে, মুসলিম নেতৃবৃন্দকে সলো থেকে বোমাসার মধ্য কোথাও বন্দী করে রাখা হয়েছে?’
ম্যাকা কোন কথা বলল না। বুঝা গেল সে ভাবছে। কিছুক্ষন পর বলল, ‘আমরা মনে হয় এখন উঠতে পারি। আবদুল্লাহ যায়দ ক্লান্ত। ওর বিশ্রাম প্রয়োজন।’
বলে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়তে পাওলার দিকে চেয়ে বলল, ‘মেহমানখানা একটু বাইরের দিকে। ওখানে যায়দকে রাখা ঠিক হবে না ওকে তুমি তোমার ঘরে নিয়ে যাও। আর তুমি যাও আম্মার ঘরে।’
হাঁটার জন্য পা বাড়াতে বাড়াতে বলল ব্ল্যাক বুলকে লক্ষ্য করে তুমি রেষ্ট নাও। আমি আসছি। কথা আছে।’
পাওলা ব্ল্যাক বুলকে নিজের ঘরে পৌছে দিয়ে বলল, ‘পছন্দ হবে তো ঘরটা?’
‘তোমার দুঃখ হচ্ছে না?’
‘দুঃখ হবে কেন?’
‘তোমার ঘর দখল করলাম’ দখল করবই বা না কেন? তুমি আমার কুকুর দখল করেছ, আমি তোমার ঘর দখল করলাম।’
পাওলা মুখ টিপে হাসল। বলল, আপনি আমার ঘর দখল করেছেন, না আমার ঘরে এনে আপনাকে দখল করলাম?’
‘কুকুর দখল যত সহজ, মানুষ দখল কি তত সহজ?’
‘মনে হয় মানুষ দখল বেশি সহজ। তবে সমস্যা হল দখলে যাবার পরেও মানুষ তা স্বীকার নাও করতে পারে, যা কুকুর পশু হলেও করে না।’
‘তার মানে দখল হওয়ার পরেও আমি স্বীকার করছি না!’
‘মানুষের মনের খবর আমি জানব কি করে? যাই আমি’।
দরজার দিকে হাঁটতে শুরু করল পাওলা। দরজা পর্যন্ত গিয়ে ফিরে দাঁড়িয়ে বলল, ‘মনের ‘সময়-কালটা’ কিভাবে চলে বলুন তো?’
ব্ল্যাক বুল প্রশ্নটা ঠিক বুঝতে পারল না। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল পাওলার দিকে।
পাওলা একটু হাসল। বলল, ‘পারলেন না। পারলেন না বলেই তো মানুষ দখল কঠিন বলেছেন। জানেন, মন কখনো এক পলকে হাজার দিলের পথ চলে, আবার কখনো হাজর দিনেও এক পলকের পথ চলতে পারে না। কুকুরের কিন্তু এ শক্তি নেই।’
বলে পাওলা দরজা পার হয়ে ছুটে পালাল।
হাসি ফুটে উঠল ব্ল্যাক বুলের ঠোঁটে।
হৃদয় জুড়ে তার স্নিগ্ধ প্রশান্তি। মনে হলো, এমন গল্প যদি সে পাওলার সাথে অনন্তকাল ধরেও করে, তবুও তার মনে ক্লান্তি আসবে না। সত্যি পাওলার মধ্য সে যেন হারিয়ে যাচ্ছে।
তার মনে হল এই হারিয়ে যাওয়ার যে সুখ, তার তুলনা দুনিয়াতে নেই।
ব্ল্যাক বুলের মন আগের চেয়ে অনেক সজীব, অনেক জীবন্ত হয়ে উঠেছে। কিন্তু দেহ জুড়ে ক্লান্তি।
‘ধীরে ধীরে ব্ল্যাক বুল পাওলার স্পর্শ জড়িত শূন্য বিছানার দিকে এগুলো।
পরদিন সকাল বেলা।
সকাল ৭টায় পাওলা হন্তদন্ত হয়ে ব্ল্যাক বুলের ঘরে প্রবেশ করল। বলল, ‘ভাইয়া টেলিফোন করেছে। আপনাকে, যেতে হবে।’
‘কোথায়?’
শ্বেতাংগ কলোনীর একটা বাড়ীতে বুলেটে ঝাঁঝরা হয়ে যাওয়া চারজন লোকের লাশ পাওয়া গেছে। দু’টি কুকুর নিয়ে আপনাকে এক্ষুণি যেতে হবে ওখানে।’
‘আমাকে?’ ‘কেন’
‘আমি জানিনা’
‘কুকুর দিয়ে আসামী ধরার ব্যবস্থা? কিন্তু আমি তো চিনি না?’
‘গাড়ি রেড়ি। আমি আপনাকে নিয়ে যাবো।’
‘ঠিক আছে চলো’
ওরা গিয়ে জীপে উঠল
ড্রাইভিং সিটে বসল পাওলা। পাশের সিটেই ব্ল্যাক বুল।
‘কিন্তু আমার মনে হয় কুকুরকে দিয়ে অপরাধী ধরার জন্য ডাকেননি। ঐ চারজনের মধ্যে আহমেদ মুসা নেই তো।’ ব্ল্যাক বুলের শুকনো কন্ঠ, চোখে মুখে প্রচন্ত উদ্বেগের চিহৃ।
‘এসব চিন্তা বাদ দিন। আপনার কাছ থেকে এবং ভাইয়ার কাছ থেকে আহমেদ মুসার যে কাহিনী শুনেছি, তাতে তিনি অখ্যাত সলো শহরে মার খেয়ে মরবেন না তা নিশ্চিত করে বলতে পারি।’
‘তুমি ঠিকই বলেছ পাওলা। আহমেদ মুসা, যে ‘আহমেদ মুসা’ তা উদ্বেগের তোড়ে ভুলেই গিয়েছিলাম।’
‘ভাইয়ার সাথে গত বিকেলে অত কি কথা বললেন?’
‘আমি কই বললাম। তিনি বললেন আমি শুনলাম’
‘বিষয়?’
‘ভাইয়া ব্ল্যাক ক্রস সম্পর্কে কিছু খোঁজ খবর নিয়েছিলেন, তাই আমাকে বলছিলেন।’
‘কিছু পেয়েছেন নাকি ভাইয়া?’
‘না পাননি তবে খোঁজ খবর নিয়ে জেনেছেন বিস্ফোরনের একদিন পর ব্ল্যাক ক্রস-এর একটি বড় দল সংঘ নদী পথে সলো অতিক্রম করে দক্ষিণে চলে গেছে। যতটা তিনি খোঁজ নিয়েছেন তার গোয়েন্দা সূত্রে তাতে ব্ল্যাক ক্রস-এর ঐ দলটি মধ্য আফ্রিকার সীমান্ত অতিক্রম করে বোমাসার দিকে চলে গেছে।’
‘ব্ল্যাক ক্রসের ঐ দলেই কি পণবন্দী মুসলিম নেতৃবৃন্দরা ছিলেন?’
‘ভাইয়া তাই মনে করেন, কারণ বিস্ফোরনের ঘটনার পর ব্ল্যাক ক্রসের কেউ বারবারোতি থেকে অন্য দিকে যায়নি।’
‘তাহলে পরিষ্কার’
‘ঠিক তাই’
‘আছা এখন দুঃচিন্তা থেকে মুক্ত হোন’।
‘হলাম’।
‘এখন ‘তোমার’ মানে আপনার পরিকল্পনা কি?’
ব্ল্যাক বুল পাওলার দিকে চেয়ে হাসল। বলল, ‘তুমি থেকে আবার আপনিতে যাচ্ছ কেন?’ আপন করে আবার পর করতে চাচ্ছ বুঝি?’
‘যায়দ’ ভয় করে। তোমাকে কাছে টানতে গেলে তুমি যদি দূরে ঠেলে দাও।’ সামনে চোখ নিবদ্ধ রেখে আবেগরুদ্ধ কন্ঠে কথাগুলো বলল পাওলা।
‘যার জীবনটাই মরুভুমিতে কাটছে, সে বুঝি মরুদ্যানকে দূরে ঠেলতে পারে? পাওলা বলল, ‘আলহামদুলিল্লাহ’। মুখে তার ফুটে উঠল একটু দুষ্টুমির হাসি।
‘এটা শিখলে কোথায়?’
‘প্রত্যেকবার খাওয়ার পর তোমাকে বলতে শুনেছি। নামযে তোমাকে বলতে শুনেছি। ভাইয়া এবং দাদুর সাথে কথা বলার সময় খুশি হলেই তোমাকে এটা বলতে শুনেছি।’
‘আমি মুসলমান, আমার ধর্ম তোমার ভাল লাগবে?’
‘দেখ আমাদের স্থানীয় যে ধর্ম। তা আসলে ধর্ম নয়। বাইরের ধর্মের মধ্য খৃষ্ট ধর্মের চেয়ে ইসলাম ধর্মকেই আমরা ভাল মনে করি।
এখন তো আরো ভাল লাগবে তোমার ধর্ম এবং আমাদের দাদুর ধর্ম বলে’।
‘শুধু কি ‘ভালো’ বলা পর্যন্ত শেষ?’
‘এই তো ‘আলহামদুলিল্লাহ’ পড়লাম, শিখিয়ে দিলে তোমার নামাযও আমি পড়ব। মুসলমানতো হয়েই গেলাম।’
হাসল ব্ল্যাক বুল। বলল, ‘এগুলো তো ধর্মের বাহ্যিক অনুষ্ঠান, বিশ্বাসের আনুষ্ঠানিক প্রকাশ। কিন্তু বিশ্বাসটাই গোড়ার কথা।’
‘বিশ্বাস কি?’
‘স্রষ্টা এবং তাঁর আদেশ সম্পর্কে তোমার সিদ্ধান্তর নাম।’
‘বুঝতে পারছিনা। উদাহরণ দিয়ে বলত’।
‘যেমন- আামদের ধর্ম বলে, এই পৃথিবী ও আকাশসহ গোটা বিশ্ব চরাচরের একজন স্রষ্টা আছেন। সমস্ত সৃষ্টি তাঁর দেয়া নির্দিষ্ট বিধানের আধীনে চলে। মানুষের দেহ ব্যবস্থাপনাও তাঁর দেয়া নিয়মে চলে। শুধুমাত্র মানষের ইচ্ছা শক্তিকেই আল্লাহ স্বাধীন রেখেছেন। মানুষ ইচ্ছা করলে ভাল কাজও করতে পারে, খারাপ কাজও করতে পারে। স্রষ্টা মানুষকে কাজের স্বাধীনতা এই জন্যেই দিয়েছেন যে, তিনি পরীক্ষা করতে চান কে ভাল পথে চলে, আর কে খারাপ পথে চলে। মৃত্যুর পর পৃথিবীর সব মানুষ, পৃথিবীতে সে কি কাজ করেছে তার জবাবদিহীর জন্য আল্লাহর কাছে হাজির হবে। যারা ভাল কাজ করবে বা সত্য পথে দুনিয়ায় চলছে তাদের দেয়া হবে অনন্ত শান্তি’।
ব্ল্যাক বুল একটু থামল। সে থামতেই পাওলা চট করে বলে উঠল ‘কোনটা ভাল কাজ বা কোনটা ভাল পথ, যে পথে চললে পুরষ্কার পাওয়া যাবে এবং যে পথে চললে মিলবে শান্তি- এসব মানুষ বুঝবে কি করে? না বুঝলে কিভাবে মানুষ শাস্তি এড়াবার চেষ্টা করবে?’
‘তার ব্যবস্থা না করে স্রষ্টা শাস্তির ব্যবস্থা করেননি। প্রথম মানুষকে আল্লাহ যখন দুনিয়াতে পাঠান, তখনই প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন পৃথিবীতে তিনি মানুষের জন্যে সত্য পথ প্রদর্শক পাঠাবেন। তাঁরা তাদের কাছে আল্লাহর কাছ থেকে আসা ভালো কাজের আদেশ এবং মন্দ কাজের নিষেধ মানুষকে জানাবেন, বুঝাবেন এবং নিজেরা তা পালন করে দেখাবেন। মানুষের জন্যে আল্লাহর শেষ বার্তাবাহক এসেছেন ৫৭০ খৃষ্টাব্দে এবং তিনিই ইসলামের নবী। আমরা তাঁর মাধ্যমে আসা আল্লাহর আদেশ নিষেধ মেনে চলি’।
‘এই আদেশ, নিষেধ এবং বিশ্বাসগুলো কি? তোমার উপরোক্ত কথাগুলো মেনে নেয়া কি বিশ্বাস?’
‘হ্যাঁ তাই। তবে মূল বিশ্বাসটাকে এইভাবে বলা যায়ঃ স্রষ্টা এক। তিনি সবকিছুর মালিক ও নিয়ন্ত্রক এবং বিধানদাতা। ৫৭০ খৃষ্টাব্দে তাঁর পাঠানো মোহাম্মাদ মোস্তফা (স.) তাঁর শেষ বার্তাবাহক। এবং যেসব আদেশ নিষেধ তিনি স্রষ্টার কাছ থেকে এনেছেন, যা আল কোরআন নামক গ্রন্থে সন্নিবেশিত হয়েছে, তা মানুষকে মেনে চলতে হবে’।
‘খুব সুন্দর ব্যবস্থা। আদেশ নিষেধের কিছু উদাহরণ দাও তো’।
‘সব মানুষ এক আদমের সন্তান। সাদা-কালো কোন ভেদাভেদ করা যাবে না। শাসক-শাসিত, ধনী-গরীব সবাই আল্লাহর কাছে সমান। সকলের প্রতি সুবিচার করতে হবে। সকল অন্যায়-জুলুম নিষিদ্ধ। প্রতিটি মানুষের আহার, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা ইত্যাদি মৌলিক প্রয়োজনসমূহ পূরণ করতে হবে ইত্যাদি জীবনের বিভিন্ন বিষয়ে আদেশ-নিষেধ রয়েছে। আর এ কাজগুলো করার জন্যে যে চরিত্র দরকার তা গঠন করার জন্যে রয়েছে আনুষ্ঠানিক ইবাদাতের’।
‘তাহলে দেখছি, গোটা জীবনকেই নিয়ন্ত্রণ করবে ধর্ম’।
‘হ্যাঁ তাই’।
‘মজার তো! আচ্ছা, আমি মুসলমান হয়ে গেলাম বললেই মুসলমান হয়ে যাব?’
‘না। বিশ্বাসের একটা ঘোষণা দিতে হয় এবং কতকগুলো মূল কাজ করতে হয়’।
‘কেমন ঘোষণা?’
‘ঘোষণা করতে হয়ঃ ‘আল্লাহ এক, মুহাম্মাদ (স.) তাঁর প্রেরিত রসুল’। এরপর নামায পড়তে, যাকাত দিতে, রোজা রাখতে এবং হজ্জ করতে রাজী হয়ে যেতে হয়’।
‘নামায বুঝেছি। অন্যগুলো কি?’
ইতিমধ্যে গাড়ি এসে পড়েছে শ্বেতাংগ কলোনির সেই বাড়িটির গেটে।
গাড়ি দাঁড়িয়ে গেল।
‘আচ্ছা উত্তর পরে দেব’। বলে ব্ল্যাক বুল গাড়ি থেকে নেমে পড়ল। পাওলাও নামল গাড়ি থেকে। সেই সাথে নামাল কুকুর দু’টিকে।
গেট খুলে তারা ভেতরে প্রবেশ করল।
কুকুর দু’টি টেনে নিয়ে পাওলা আগে এবং ব্ল্যাক বুল পেছনে চলল।
ওরা গাড়ি বারান্দায় পৌঁছতেই ভেতর থেকে বেরিয়ে এল জাগুয়াস ম্যাকা। ভেতরে দেখা গেল আরও কয়েকজন পুলিশ।
‘যায়দ তোমাকে কষ্ট দিয়েছি। কারণ, আমার মনে হচ্ছে তোমার সেই সংঘ হাইওয়ের চারজনের হত্যার সাথে এ হত্যার কিছুটা মিল দেখতে পাচ্ছি। ওখানে চারজন শ্বেতাংগ, এখানেও চারজন শ্বেতাংগ। ওরাও ছিল ব্ল্যাক ক্রসের, এরাও ব্ল্যাক ক্রসের’। বলল ম্যাকা।
‘ব্ল্যাক ক্রসের?’
‘হ্যাঁ’।
একটু থেমে ম্যাকা বলল, ‘তোমাকে কুকুর আনতে বলেছি। কারণ ওরা আহমদ মুসার গন্ধের সাথে পরিচিত’।
‘তার মানে আপনি বলতে চাচ্ছেন, আহমদ মুসা এখানে ছিল কিনা বা আছে কিনা?’ ব্ল্যাক বুলের কণ্ঠে উত্তেজনা।
‘ঠিক তাই’।
‘চলুন দেখি’।
সবাই ভেতরে প্রবেশ করল।
চারটি লাশ যেখানে পড়ে আছে, সেখানে প্রবেশ করল সবাই।
পাওলা দু’টি কুকুরের চেন হাতে ধরেছিল। ঘরে প্রবেশ করার সাথে সাথে কুকুর দু’টি ছুটল ঘরের একদম বিপরীত প্রান্তে রাখা খাঁটিয়ার দিকে। পাওলার হাত থেকে চেন খুলে গেল।
কুকুর দু’টি খাটিয়ার কাছে ছুটে গিয়ে লাফ দিয়ে খাটিয়ার উপর উঠল। মাথা নিচু করে বিছানা শুকতে লাগল। তার সাথে তারা লেজ নাড়াচ্ছিল এবং তাদের মুখ থেকে এক প্রকার নরম শব্দ বেরুচ্ছিল।
ম্যাকা, ব্ল্যাক বুল এবং পাওলা তিনজনের চোখেই বিষ্ময়। ওরাও দ্রুত গিয়ে খাটিয়ার পাশে দাঁড়াল।
ব্ল্যাক বুল খাটিয়ার পাশে দাঁড়াবার পর কুকুর দু’টি ব্ল্যাক বুলের দিকে তাকিয়ে তাদের লেজ নাড়া এবং মুখের শব্দ বাড়িয়ে দিল।
ব্ল্যাক বুলের চোখে-মুখে তখন বিমুঢ় ভাব।
‘কুকুরের এই আচরণের কি অর্থ করা যায়?’ বলল ম্যাকা।
‘কোন সন্দেহ নেই, এখানেই এই খাটেই আহমদ মুসা শুয়ে ছিল’। কুকুর দু’টি একটুও ভুল করেনি’। ব্ল্যাক বুলের শুকনো ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে অশ্রু ভেজা ভারী কণ্ঠ বেরিয়ে এল।
ঘরের চারদিকে আর একবার চেয়ে ম্যাকা বলল, ‘নিশ্চয় কোন বন্দী এখানে ছিল। তিনি যদি আহমদ মুসা হন, তাহলে বলতে হবে তিনি এ চারজনকে হত্যা করে বন্দীখানা থেকে চলে গেছেন’।
‘চলে যেতে পেরেছেন?’ ব্ল্যাক বুলের চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল।
‘আমি গোটা বাড়ি সার্চ করেছি। সব দেখে মনে হয়েছে একটি পরিবার উপর তলায় বাস করতো। তাড়াহুড়া করে তারা চলে গেছে। হতে পারে হত্যাকান্ডের পর এবং আহমদ মুসা চলে যাবার পর তারা বাড়ি ছেড়েছে। আবার এও হতে পারে, আহমদ মুসা পালাতে পারেনি, তাকে নিয়েই গৃহবাসীরা অন্যত্র সরে পড়েছে’।
ম্যাকা’র শেষ কথাটা শুনে ব্ল্যাক বুলের মুখটা চুপসে গেল।
ম্যাকা আবার বলল, ‘তবে তিনি চলে যেতে পেরেছেন, এটাই স্বাভাবিক। শুধু ঘরের ভেতর চারজন নিহত হওয়ায় প্রমাণ হয়, বাইরে কোন সংঘর্ষ হয়নি। লাশের অবস্থান, রক্তের চিহ্ণ থেকে বুঝা যায়, আহমদ মুসার বৈরী পক্ষের ৫জন লোক ঘরে প্রবেশ করেছিল। তার মধ্যে ৪জন নিহত এবং অন্যজন আহত হয়’।
‘আহত হয়েছে এবং সে ব্ল্যাক ক্রসের লোক এটা কেমন করে বুঝলেন?’
ঘরের উত্তর-পূর্ব কোণে জমাট বেধে থাকা রক্তের দিকে ইংগিত করে বলল এ রক্ত নিহত চারজনের কারো নয় এবং আহমদ মুসারও নয়। আহমদ মুসার গুলীতে নিহত লাশের যে পজিশন তাতে আহমদ মুসা কোণায় গিয়ে আহত হবার কোন যুক্তি নেই। সবচেয়ে বড় কথা হলো, ঐ রক্ত আহমদ মুসার হলে কুকুরগুলো প্রথমে ওখানেই ছুটে যেত’।
‘ঠিক বলেছেন ভাইয়া। আমার আর কোন সন্দেহ নেই। আহমদ মুসা ভাই এখান থেকে নিশ্চয় বেরিয়ে গেছেন। গেট দিয়ে ঢোকার সময় থেকেই আমার টম ও টমির চোখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে এবং মাটির ঘ্রাণ নেয়া শুরু করে’।
‘তোমার কথাই ঠিক হোক। চল আমরা যাই পুলিশ এদিকের ব্যবস্থা করবে’।
বেরিয়ে এল তারা তিনজন।
বাড়িতে এসে গাড়ি থেকে নেমেই ম্যাকা বলল, ‘এস তোমরা, আগে জরুরী কয়েকটা কথা বলে নেই’।
তারা গিয়ে বসল ড্রইং রুমে।
‘তারা বলেছিল, আহমদ মুসাকে সারেন্ডার করতে যেতে হবে কোথায়?’ ম্যাকাই প্রথমে কথা শুরু করল।
‘বোমাসা এয়ারপোর্টের কাছাকাছি কোন জায়গা’। বলল ব্ল্যাক বুল।
‘তাহলে মুক্ত হয়ে আহমদ মুসা বোমাসা যেতে পারে বলে মনে কর?’
‘পণবন্দী মুসলিম নেতৃবৃন্দের উদ্ধার আহমদ মুসার টার্গেট’।
‘যেহেতু আহমদ মুসাকে আত্মসমর্পণ করতে বলেছে বোমাসায়, তাহলে ওদের পণবন্দী করে রেখেছে বোমাসা অথবা বোমাসারই আশেপাশে কোথাও। এই ধারণায় আহমদ মুসার বোমাসা যাওয়াটাই সবচেয়ে যুক্তিসংগত’।
‘আমারও তাই মনে হয়’।
ম্যাকার কপাল কুঞ্চিত। সে ভাবছিল। ব্ল্যাক বুল থামলেও তৎক্ষণাৎ সে কথা বললো না। একটু পর বলল, ‘কি জানি বলেছিলে ওদের দেয়া সময়ের আর পাঁচদিন বাকী?’
‘পাঁচ দিনের মধ্যে দু’দিন চলে গেছে। আর মাত্র তিনদিন বাকী’।
‘তাহলে তো অবিলম্বে বোমাসা যাত্রা করতে হয়। কিন্তু আমি তো কাল সকালের আগে যেতে পারবো না। অফিসে জরুরী কাজ’।
‘কাল গেলে বাকী থাকবে আর দু’দিন। খুব অল্প সময় হবে না?’
‘তা হবে। অসুবিধা হবে না। বোমাসার পুলিশ প্রধান উপাংগো আমার বন্ধু। সে আমার ক্ল্যাস মেট। এক সাথেই ফ্রান্সে আমরা পুলিশ ট্রেনিং-এ ছিলাম’।
‘খুব ভালো হবে যদি আমরা ওখানকার পুলিশের সাহায্য পাই।
‘হ্যাঁ পাব, ইতিমধ্যে বোমাসা পুলিশ কাজ শুরু করে দিয়েছে। আমরা গেলে তা আরও ভালো হবে।
‘তাহলে আমরা কাল সকালে যাচ্ছি?’
‘অবশ্যই। দেখি পারলে তার আগেও’।
ব্ল্যাক বুল হঠাৎ উঠে গিয়ে ম্যাকার পায়ের কাছে বসল। তার দু’হাঁটুতে হাত রেখে বলল, ‘ভাইয়া দেখবেন অদ্ভুত এক যাদুকরি মানুষ তিনি। দেখা পেলে আপনি তাকে ভালো না বেসে পারবেন না। অত বড় ত্যাগী মানুষ দুনিয়াতে নেই। জানেন!’’ বলে থামল ব্ল্যাক বুল।
‘কি? বল’। বলল ম্যাকা।
‘ফ্রান্সের রাজকুমারীর সাথে ওঁর বিয়ে। বিয়ের পোশাক পরে দু’জনেই বিয়ের আসরে বসেছেন। এই সময় তিনি মুসলিম নেতৃবৃন্দের পণবন্দী হওয়ার খবর পেলেন এবং জানলেন তাদের শর্তের কথা যে, আহমদ মুসা আত্মসমর্পণ করলে তবেই তাদের মুক্তি। তিনি বিয়ের আসর থেকে উঠে দাঁড়ালেন এবং রাকজুমারীকেও বুঝালেন, এই অবস্থায় তিনি বিয়ে করতে পারেন না। এবং তিনি আমাকে নিয়ে চলে এলেন। তার কাছে নিজের কাজের চেয়ে, আল্লাহর বান্দা মানুষের উপকারের চেয়ে বড় কিছু নেই’।
‘যায়দ তার সম্পর্কে বেশী কিছু জানি না। কিন্তু যতটুকু জানি তাতে বুঝি, তিনি আমাদের মত কোন মানুষ নন’। বলল ম্যাকা।
‘ভাইয়া আমার পুলিশ ট্রেনিং আছে। আমিও তো যাচ্ছি বোমাসা’। আবদারের সুরে বলল পাওলা।
‘তা আমি জানি না। দেখ, যায়দ যদি অনুমতি দেয়’। বলে দ্রুত উঠে গেল ম্যাকা। তার ঠোঁটে হাসি।
লজ্জায় মুখ নিচু করেছে পাওলা। তার ভাইয়া বেরিয়ে গেল ড্রইং রুম থেকে।
ব্ল্যাক বুলের চোখে-মুখেও লজ্জার ছায়া নেমে ছিল। কিন্তু পরক্ষণেই তার ঠোঁটে ফুটে উঠল হাসি। বলল, ‘পাওলা দেখলে তো ভাইয়া কত ভাল। এখন আমার অনুমতি চাও’।
পাওলার ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠল। লজ্জার সাথে মিশে তা তাকে করে তুলল অপরূপ।
সে উঠে দাঁড়িয়ে ব্ল্যাক বুলের পিঠে একটা কিল বসিয়ে ছুটে পালাতে পালাতে বলল, ‘এই যে অনুমতি নিলাম’।
ব্ল্যাক বুল মুগ্ধ দৃষ্টিতে পলায়ন রতা পাওলার দিকে চেয়ে রইল।
পাওলা চলে গেছে, কিন্তু ব্ল্যাক বুল সেদিক থেকে তার চোখ ফেরাতে পারেনি।
হঠাৎ আনমনা হয়ে পড়েছে ব্ল্যাক বুল। তার চোখে ভেসে উঠেছে অতীতের এক দৃশ্য। অতীতের হতভাগ্য কশাই ব্ল্যাক বুল এবং আজকের এস সৌভাগ্যবান যায়দের মধ্যে কত পার্থক্য।
আল্লাহর প্রতি অসীম কৃতজ্ঞতায় দু’চোখের কোণায় অশ্রু নামল ব্ল্যাক বুলের।

সংঘ নদীর দ্ক্ষীণ তীরে বোমাসা শহর। কংগোর সর্ব উত্তরের একটি শহর বোমাসা।
নদীর তীরে অবস্থিত কয়েকটা বড় টিলাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে বোমাসা শহরটি। টিলার পরেই দক্ষিণে বিরাট বনজ একটা সমভূমি। এ এলাকায় বাদাম চাষ শুরু হয়েছে ঔপনিবেশিক আমলের শুরুতেই।
শহরের বড় টিলাগুলোর সব ক’টিই শ্বেতাংগদের দখলে। টিলাগুলোর সমম্বয়ে গড়ে উঠেছে বিশাল একটা শ্বেতাংগ কলোনী।
এ কলোনীর মধ্যে ‘মাবোইডিং’ এলাকা শ্বেতাংগ বসতির প্রাণকেন্দ্র। মাবোইডিং টিলাটি একেবারে নদীর ধারে, বলা যায় তীর ঘেঁষে।
মাবোইডিং টিলার একেবারে মাথায় উঁচু প্রাচীর ঘেরা বিশাল এলাকা নিয়ে বাইবেল সোসাইটি কমপ্লেক্স। কমপ্লেক্সের চারটি ভাগ। একভাগে গীর্জা, দ্বিতীয় ভাগে স্কুল ও হাসপাতাল। তৃতীয় ভাগে আবাসিক এলাকা। আর চতুর্থ ভাগটি গোডাউন। গীর্জা ও গোডাউন এলাকা পাশাপাশি নদীর ধারে।
গোডাউন এলাকার পশ্চিম প্রান্তে প্রায় নদীর তীর ঘেঁষে বড় একটি কক্ষ।
অফিস কক্ষ।
বিরাট একটা সেক্রেটারিয়েট টেবিল।
টেবিল ঘিরে কয়েকটি দামী কুশন চেয়ার। তার একটিতে বসে লালমুখো একজন ফরাসী। টেলিফোনে কথা বলছিল।
হঠাৎ তার মুখে হতাশার একটা কালো ছায়া নেমে এল। বলল, ‘পালিয়েছে স্যার?’
ওপারের কথা শুনল। তারপর বলল, ‘স্যাড স্যার। আমার মনে হয় ওরা যথেষ্ট সতর্ক ছিল না। যার ফলে ৪জনকে খুন ও একজনকে আহত করে ও পালাতে পেরেছে’।
ওপারের কথা শুনল এবং আবার বলল, ‘পালিয়ে যাবে কোথায় স্যার। ওকে বোমাসায় আসতেই হবে যদি সে মুসলিম নেতৃবৃন্দকে রক্ষা করতে চায়। তাকে আত্মসমর্পণ করতেই হবে’।
ওপারের কথা শুনে বলল আবার, ‘এদিকে সব ঠিকঠাক স্যার। আমাদের লোকরা সার্বক্ষণিক পাহারায় রয়েছে। এয়ারপোর্ট এলাকায় পৌঁছার সংগে সংগে তাকে বন্দী করা হবে। একটা হেলিকপ্টার আমরা ঠিক করে রেখেছি। বন্দী হওয়ার সংগে সংগে তাকে ‘বারগুই’ পাঠিয়ে দেবো। সেখান থেকে নাইরোবি। তারপর ফ্রান্স’।
আবার ওপারের কথা শুনল লালমুখো ফরাসী। উত্তরে বলল, ‘না স্যার, নিশ্চিন্ত থাকুন। বারোজন শীর্ষ নেতা মারা যাবে তার জন্যে, এটা কিছুতেই সে মেনে নেবে না। আসবেই সে বোমাসা। আত্মসমর্পণ তাকে করতে হবে’।
পরে ওপারের কথা শুনে আমতা আমতা করে বলল, ‘তা ঠিক স্যার, আত্মসমর্পণই যদি করবে, তাহলে পালালো কেন? আহমদ মুসাকে বুঝা খুব মুশকিল স্যার। তবু স্যার আমরা শেষ দিন পর্যন্ত বোমাসায় তার অপেক্ষা করব’।
ওপারের কথা একটু শুনল। তারপর বলল, ‘ঠিক আছে স্যার, শেষ দিন পর্যন্ত দেখার পর বোমাসার পাঠ চুকিয়ে আমরা চলে আসব। আমাদের মনে আছে স্যার, পনের দিন না পুরলে ডোজ পুরণ হবে না এবং তা কাজও করবে না। একটা কথা স্যার কেউ কেউ বলছেন, আহমদ মুসা যদি ধরা না দেয় তাহলে পণবন্দীদের ধরে রাখলে সুবিধা হবে আহমদ মুসাকে ফাঁদে ফেলার’।
পরে ওপারের কথা শোনার পর বলল, ‘বুঝেছি স্যার। অবশ্যই পাতার মত ফাঁদ আমাদের আরও আছে’।
লালমুখো লোকটি টেলিফোন রাখতেই ঘরে প্রবেশ করল আরও তিনজন শ্বেতাংগ।
চেয়ারে বসতে বসতে লালমুখো লোকটি বলল, ‘নতুন বস সাইরাস শিরাক টেলিফোন করেছিলেন। খুব খারাপ খবর’।
‘আহমদ মুসা পালিয়েছে’।
‘কি বলছেন মিঃ ফ্রাসোয়া? নাইরোবি থেকে লোক এল তাকে নিয়ে যাবার জন্যে। তবু পালাতে পারল? তিনজনের একজন বলল।
‘বড় বড় রাঘব বোয়ালদেরই যেখানে সে কাত করে, সেখানে চুনোপুঁটিদের ব্যর্থতা কি বড় কথা?’
‘ভাগ্য মন্দ আমাদের। মনে করছিলাম, আহমদ মুসাকে গত-রাতে নাইরোবি নিয়ে চলে গেছে। আজ আমরা হুকুম পাব এখানকার আসর গুটিয়ে চলে যাবার। তা হলো না’। তিনজনের আরেকজন বলল।
‘আহমদ মুসাকে নাইরোবি নিয়ে গেলেও পনের দিন পূর্ণ হবার আগে আমরা যেতে পারতাম না। প্রকৃতপক্ষে আত্মসমর্পণের সাথে এদের বন্দীত্বের কোন সম্পর্ক নেই। আহমদ মুসা আমাদের হাতে এলেও তারা পনের দিনের মাথায় নিহত হবে। সে ধরা না পড়লেও হবে। আহমদ মুসাকে দেয়া শর্তটা ভূয়া। আহমদ মুসা যাতে আত্মসমর্পণ করে সেজন্যেই ঐ শর্তটা তাকে দেয়া’।
তাই যদি হয় তাহলে ঐ বারজন লোককে কেন খাওয়াচ্ছি, পাহারা দিচ্ছি আর অপেক্ষা করছি পনের দিন পূর্ণ হবার জন্যে। বারটা বুলেট অথবা একটা ষ্টেনগান ব্যবহার করলে ওরা শেষ হয়ে যায়’। বলল ওদের তিনজনের একজন।
‘তা হয়। কিন্তু পয়জনটার পরীক্ষা তাতে হয় না’।
‘আসলেই কি পয়জনটার পরীক্ষামূলক ব্যবহার হচ্ছে এঁদের উপর?’
‘হ্যাঁ মানুষের উপর প্রথম পরীক্ষা। আমাদের নেতা হত্যার প্রতিশোধ হিসেবে এদের হত্যা করা হবে। অতএব পরীক্ষাটা এদের উপরই চালানোর ব্যবস্থা হয়েছে। এতে শত্রুও আমাদের মরবে এবং ওষুধেরও পরীক্ষা হয়ে যাবে- এক ঢিলে দুই পাখি।
‘বুঝেছি’।
‘ধন্যবাদ। এখন তোমাদের কি খবর বল’।
‘মিঃ ফ্রাসোয়া, গত এগার দিনে ওরা মানে বন্দীরা যতখানি দুর্বল হওয়ার কথা ছিল, ততখানি দুর্বল হয়নি। বরং খুবই সজীব দেখাচ্ছে ওদের’। বলল নবাগত তিনজনের একজন।
‘জিমি ব্যস্ত হচ্ছ কেন? ডোজ পনের দিনের। ডোজ পূর্ণ না হলে কি আর তা কাজ করবে?
‘কি জানি এক্সপেরিমেন্ট কাজ দিচ্ছে কিনা বুঝতে পারছি না’।
‘চিন্তা করো না, না যদি কাজ করে, তাহলে ১২টা বুলেট খরচ করতে হবে’।
বলে উঠে দাঁড়াল ফ্রাসোয়া ডেসফার। বলল, ‘চল ওদের সাথে একটু কথা বলে আসি’।
ফ্রাসোয়ার সাথে অন্য তিনজনও উঠে দাঁড়িয়েছে। কক্ষের দরজার দিকে হাঁটতে লাগল ওরা চারজন। গোডাউন এলাকার অন্য একটি কক্ষ। বাইবেল সোসাইটি কমপ্লেক্সের গোডাউন এলাকায় আসলেই কোন গোডাউন নেই।
গোডাউন এলাকা চারদিক উঁচু দেয়াল ঘেরা। ভেতরে বিল্ডিং আকৃতিতে গোডাউন, কিন্তু ভেতরের দৃশ্য গোডাউনের মত নয়। বেশ কিছু ঘর ষ্টোর রুম ও গুদাম হিসেবে ব্যবহার হলেও অন্যঘরগুলো যথেষ্ট ভেন্টিলেশন যুক্ত আধুনিক।
এই শ্রেণীরই একটা বড় ঘরে বারজন বসে আছেন। বেশ বড় ঘরটি। বারটি খাটিয়া পাতার পরেও ঘরের মাঝখানে প্রচুর জায়গা। আসলে এটা একটা হল ঘর। যাকে বেড় রুমে রুপান্তরিত করা হয়েছে। ঘরের দক্ষিণ দিকে দু’টো দরজা। সেদিকে কোন জানালা নেই। কিন্তু তিন দিকে বড় বড় তিনটি জানালা। জানালাগুলো কাঁচের বলে মনে হয়। কিন্তু তা নয়। জানালাগুলো স্বচ্ছ, শক্ত সিনথেটিকের। জানালাগুলো বন্ধ করে দিয়ে ঘরে এয়ারকন্ডিশন বসানো হয়। দেখলেই বুঝা যায়, এয়ারকন্ডিশন আগে ছিল না। সম্প্রতি লাগানো হয়েছে।
ঘরের মাঝখানের মেঝেতে গোল হয়ে বসেছিলেন বিশ্ব মুসলিম কংগ্রেসের প্রধান শেখ আব্দুল্লাহ আলী আল মাদানী, বিশ্বমুসলিম যুব সম্মেলনের প্রেসিডেন্ট কামাল ইনুনু, আল আজহারের গ্রান্ড শেখ সাইয়েদ আলী কুতুব, ‘ডার্ক আফ্রিকা ব্রাইট হার্ট’ সংস্থার সভাপতি তারেক আল-মাহদী প্রমুখ ১২ জন মুসলিম বিশ্বনেতা।
কথা বলছিলেন আল আজহারের গ্রান্ড শেখ বৃদ্ধ সাইয়েদ আলী কুতুব। বলছিলেন, ‘কামাল ইনুনু আপনি কেন হঠাৎ করে ঘরের জানালা খুলে রেখে আমাদের গরম এবং মশা, মাছি ও পোকা-মাকড়ের অসহনীয় উপদ্রুপের শিকারে পরিণত করছেণ বুঝতে পারছি না।’
কামাল ইনুনু একজন ডাক্তার। ডাক্তারী পেশায় না থাকলেও তিনি মেডিকেল সাইন্স পরিত্যাগ করেননি। পৃথিবীর বিখ্যাত বিখ্যাত মেডিকেল জার্নালে প্রায় তার প্রবন্ধ ওঠে। তিনি বললেন, ‘আমি দুঃখিত শেখ। আমি একটা আতংকের বশবর্তী হয়ে এটা করছি।’
‘কিন্তু আবার জানালা হঠাৎ করে বন্ধ করে দেন কেন?’ বলল শেখ আব্দুল্লাহ আলী।
‘ওটা করি জানালা খোলা রাখার ব্যাপার ওদের চোখ থেকে গোপন রাখার জন্যে। ওরা আসার সংকেত পেলে ওটা করি।’
‘কিন্তু কারণ কি?’ বলল আলী কুতুব।
সংগে সংগে জবাব দিল না কামাল ইনুনু। ভাবছিল। বেশ সময় নিয়ে বলল, ‘বলেছি, এটা করছি একটা আশংকা থেকে এবং চেয়েছিলাম এই আশংকার ব্যাপারটা আপনার কাছ থেকে গোপন রাখতে।’
একটু থামল কামাল ইনুনু। শুরু করল আবার, ‘বন্দীখানার এ ঘরে আসার আগে আমরা যখন একটা ঘরে অপেক্ষা করছিলাম, তখন পাশের ঘরে ওদের একটা কথা আমার কানে গিয়েছিল। একজন বলছিল, ‘পনের দিনের ঝামেলা, কারণ ওদের উপর পনের দিনের একটা গ্যাস এক্সপেরিমেন্ট হবে।’
‘পরক্ষণেরই চলে আসাতে আর কিছু শোনা সম্ভব হয়নি। তখন কথাটাকে আমি গুরুত্ব দেইনি। কিন্তু যখন আমাদের জানানো হলো, বন্দীখানায় থাকার মেয়াদ আমাদের পনের দিন, তখন সেই শোনা কথাটা আমার হঠাৎ করেই যেন মনে পড়ে গেল।
কিন্তু তখনও এ কথার তাৎপর্যটা আমি বুঝতে পারিনি। আর একদিন ওদের আরেকটি কথায় এর অর্থটা আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেল। আপনাদের মনে আছে, কথায় কথায় একদিন মি: ফ্রাসোয়া বলেছিলেন, আপনাদের জন্যে আমরা বুলেট খরচ করব না। ধীরে-সুস্থে শান্তির সাথে আপনারা মৃত্যুর কোলে ঘুমিয়ে পড়বেন। আপনারা সম্মানী লোক, অসম্মানের মৃত্যু আপনাদের সাজে না।’ এই তিনটি বিষয়কে এক সাথে দাঁড় করিয়ে আমি যে উপসংহার টানলাম তা হলো, পনের দিন মেয়াদের একটা গ্যাস ব্যবহার করে ওরা আমাদের হত্যা করবে।’
‘গ্যাস ব্যবহার করে? পনের দিনের মেয়াদে? তাহলে তো আর তিনদিন বাকী।’ বলল তারেক আল-মাহদী।
একমাত্র কামাল ইনুনু ছাড়া সকলের চোখে-মুখে বিস্ময়। কারও মুখে কোন কথা নেই।
কামাল ইনুনু আবার শুরু করল, ‘আমার পরবর্তী চিন্তা হলো, ওরা গ্যাস প্রয়োগ করছে কিভাবে, কোন মাধ্যমে। আর একদিন ওদের কথায় জানলাম, আমরা খুব ভাগ্যবান, কারণ আমাদের এয়ারকন্ডিশন দেওয়া হয়েছে।’ দেখলাম এয়ারকন্ডিশন সদ্য লাগানো। আমার মন বলল, এয়ারকন্ডিশনের কোল্ড উইন্ড ওয়েভের সাথে গ্যাসের শ্লো পয়জন স্প্রে করা হচ্ছে। আর একটা জিনিস আমার এ বিশ্বাসকে দৃঢ় করল, সেটা হলো এয়ারকন্ডিশন বন্ধ করার কোন ব্যবস্থা আমাদের হাতে রাখা হয়নি। এয়ারকন্ডিশন বারো ডিগ্রিতে রাখা হয়েছে এবং এটা ফিক্সড।
‘এয়ারকন্ডিশন বন্ধ করার ব্যবস্থা আমাদের হাতে না থাকায় আপনার বিশ্বাস দৃঢ় হলো কি করে?’
‘আমরা এয়ারকন্ডিশন বন্ধ করতে পারলে কোল্ড ওয়েব বন্ধ হওয়ার সাথে সাথে ওদের পয়জন স্প্রেও বন্ধ হয়ে যেত।’
‘ঠিক।’ প্রায় সমম্বরে বলে উঠল উপস্থিত সকলে। সকলের চোখ-মুখে উদ্বেগ।
তারেক আল মাহদী বলল, ‘জানালা খোলার ব্যাপারটা এবার বলুন।’ শুকনো কণ্ঠ তার।
‘জানালা খোলা রেখে এয়ারকন্ডিশনের কোল্ড ওয়েভ বের করে দেবার চেষ্টা করেছি। যাতে করে তার সাথে পয়জন গ্যাসও বের হয়ে যায়।’
‘তাতে আমাদের কতখানি উপকার হবে?’ বলল আবার তারেক আল মাহদী।
‘এর ফলে তাদের নির্দিষ্ট পনের দিনের গ্যাস প্রয়োগে আমাদের মৃত্যু হবে না।’
‘আল-হামদুলিল্লাহ।’ সকলের সমবেত কণ্ঠে ধ্বনিত হলো।
‘আল্লাহ তোমাকে এই বুদ্ধি ও সচেতনতা দিয়েছেন, এ জন্যে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করছি। আল্লাহ আপনাকে দীর্ঘজীবী করুন।’ বলল আল আজহারের গ্রান্ড শেখ।
‘পনের দিনে যদি আমাদের মৃত্যু না ঘটে, তাহলে তো ওরা ভিন্ন ব্যবস্থা নেবে।’ বলল শেখ আব্দুল্লাহ আলী।
‘যে বুলেট ওরা খরচ করতে চেয়েছিল না, সেটাই তাহলে তারা খরচ করবে।’ বলল কামাল ইনুনু।
‘আল্লাহ সবচেয়ে বড় পরিকল্পনাকারী। ওদের পনের দিনের পরিকল্পনা ব্যর্থ হলে দ্বিতীয়টাও ব্যর্থ হতে পারে।’ বলল বৃদ্ধ গ্রান্ড মুফতি।
‘কিন্তু কিভাবে? প্রথম বারের নিমিত্ত হলেন কামাল ইনুনু, এবার আল্লাহ কাকে মনোনীত করবেন!’ তারেক আল মাহদী।
‘আমাদের যে ওরা কিডন্যাপ করেছে, গোটা দুনিয়া থেকে তা ওরা গোপন রেখেছে। দুনিয়ার সবাই জানে আমরা মরে গিয়েছি। কিন্তু আল্লাহর ইচ্ছায় আহমদ মুসাকে তাদের জানাতে হয়েছে। যার জানা সবচেয়ে বেশী প্রয়োজন ছিল।’ বলল শেখ আব্দুল্লাহ আলী।
‘আহমদ মুসাকে ওরা জানিয়েছে ওদের পরিকল্পনা অনুসারেই। ক্যামেরুনে ব্ল্যাক ক্রস, কোক ও ওকুয়ার যে পরাজয় এবং মুসলমানদের যে বিজয় তারই একটা প্রতিশোধ হিসেবে ওরা আমাদের হত্যা করতে চায়। কিন্তু বিস্ফোরণের মাধ্যমে হত্যা না করে কিডন্যাপ করেছে আহমদ মুসাকে ফাঁদে ফেলার জন্যে, এ উদ্দেশ্য ওদের পরিষ্কার হয়েছে। এখন আহমদ মুসাকেও বন্দী করতে পেরেছে। এই ফাঁদে ফেলে। এখন আমাদের সাথে আহমদ মুসাকে হত্যা করতে পারলেই ওদের মিশন পূর্ণ হবে।’ বলল বার জনের অন্য একজন ইস্ট আফ্রিকা ইসলামিক সার্কেল প্রেসিডেন্ট আলী ইব্রাহিম।
‘আপনি ঠিক বলেছেন। কিন্তু এটা ওদের পরিকল্পনা। পরিকল্পনা বাস্তবায়ন ওদের হাতেই শুধু নেই, তা প্রমাণ হয়েছে। আহমদ মুসা ওদের হাতে পড়ায় যেমন ওদের পরিকল্পনা সফল হবার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে, তেমনি ব্যর্থ হবারও সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। বন্দী আহমদ মুসা মুক্ত আহমদ মুসার মতই অপ্রতিরোধ্য তা বার বার প্রমাণ হয়েছে।’ বলল কামাল ইনুনু।
বিশ্ব মুসলিম কংগ্রেসের প্রেসিডেন্ট শেখ আব্দুল্লাহ আলী বলল, ‘আল্লাহ আহমদ মুসাকে দীর্ঘজীবী করুন। তাকে নিরাপদ রাখুন। সে নীরবে জাতিকে শুধু দিয়েই যাচ্ছে, নেয়নি কিছুই। পদ, পদবী, পাওয়ার কিছুই তার নেই। মদীনার গভর্নর মসজিদে নব্বীর পাশে তাকে একটা বাড়ি দিয়েছেন। দুনিয়াতে এটাই তার একমাত্র ঠিকানা। কিন্তু সে বাড়িতে, সে ঠিকানায় এখনও সে পা রাখেনি।’ বলতে বলতে শেখের কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে গেল আবেগে।
‘সত্যি আল্লাহর জন্যে যিনি কাজ করেন, এটাই তো তার চরিত্র। তিনি যা যা চান আল্লাহর কাছে, আর কারও কাছে নয়।’ বলল মিসরের গ্রান্ড শেখ।
তার কথা শেষ হতেই দরজায় নক হলো।
কামাল ইনুনু তাড়াতাড়ি জানালা তিনটির দিকে তাকাল। দেখল বন্ধ আছে। কিছুক্ষণ আগে ওরা তিনজন এসেছিল। সে সময় জানাল বন্ধ করে দেয়া হয়। বন্ধই আছে।
তারিক আল মাহদী গিয়ে দরজা খুলে দিল। প্রায় অর্ধ ডজন স্টেনগানধারী প্রহরী পরিবেস্টিত হয়ে ঘরে প্রবেশ করল ফ্রাসোয়া এবং তার তিন সাথী। ‘হুজুররা স্বীকার করবেন খুব ভাল আছেন আপনারা। খুব সজীব আর সুস্থ দেখাচ্ছে আপনাদের।’ বলল ফ্রাসোয়া বাঁকা হেসে।
‘মি: ফ্রাসোয়া সুস্থ ও সজীবতার সিংহ ভাগ নির্ভর করে মনের উপর। তোমাদের কালো থাবা আমাদের মন পর্যন্ত পৌঁছে না। তোমাদের বুলেট বুক বিদীর্ণ করা পর্যন্ত আমরা হাসতে পারি। সুতরাং সুস্থতা, সজীবতা দেখবেই।’ বলল কামাল ইনুনু।
‘বলেছি তো হুজুরারা, তোমাদের জন্যে আমরা আমাদের বুলেট খরচ করব না। আর এ ধরনের হত্যা অনেকটা স্থুল বা মধ্যযুগীয় হয়ে গেছে। প্রয়োজন এখন নীরব ও শান্তি পূর্ণ ব্যবস্থা আমরা তার চেষ্টা করছি।’
একটু থেমেই সে শুরু করল আবার, ‘আমরা জানি তোমরা সাহস একটু বেশীই দেখাও। এর জবাব দিতেও আমরা জানি। তোমাদের আহমদ মুসা আবার পালিয়েছে। কিন্তু পালিয়ে যাবে কোথায়? ধরা তাকে পড়তেই হবে। এবার ধরা পড়লে বাছাধনকে দেখাব আমরা। শুধু জীবনটাই রাখব, আর কিছু নয়।
আহমদ মুসার পালানোর সংবাদ শোনার সংগে সংগে আনন্দের ঢেউ খেলে গেল, চোখ মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল ওদের বারজনের।
ব্যাপারটা লক্ষ্য করে ফ্রাসোয়া বরল, ‘আনন্দ করে নাই। আর সময় পাবে না। আহমদ মুসাকে বোমাসা আসতেই হবে। আমাদের ফাঁদে পা তাকে দিতেই হবে। ‘
‘আহমদ মুসাকে এতটা নিচে নামিয়ে চিন্তা করতে আপনারা এখনও পারেন?’ বলল তারিক আল মাহদী।
‘এর জবাব তোমরা পাবে। ও, না, এর জবাব পাবার জন্যে তোমরা জীবিত থাকতে নাও পার। শেষ মুহূর্তে পঞ্চদশ দিবসে সে যদি আত্মসমর্পন করে তাহলে তোমাদের আর সে নাও পেতে পারে।
‘তোমরা যেভাবে কথা বলছ, তাতে মনে হচ্ছে তোমাদের ইচ্ছাতেই সবকিছু চলছে। তা কিন্তু চলছে না, চলবে না।’ বলল গ্রান্ড শেখ।
‘মৃত্যুকে স্বচক্ষে দেখার পরই তা স্বীকার করবে এবং সেটা আসছে।’ বলে মিঃ ফ্রাসোয়া বলল, ‘চল।’
ফ্রাসোয়া ফিরে দাঁড়িয়ে হাঁটতে শুরু করল। তার সাথে সবাই।
ওরা ঘর থেকে বেরিয়ে চলে যাবার পর দরজা বন্ধ হয়ে গেল।
সেদিকে তাকিযে কামাল ইনুন বলল, ‘যাই হোক ওরা একটা ভাল খবর দিয়ে গেল যে, আহমদ মুসা ওদের হাত থেকে বেরিয়ে আসতে পেরেছে।’
‘আল্লাহ্ আহমদ মুসাকে সাহায্য করুন।’ দু’হাত উপরে তুলে বলল গ্রান্ড শেখ।
সবাই বলে উঠল, ‘আমীন।’
‘সত্যিই আহমদ মুসা আল্লাহর অফূরান সাহায্য পুষ্ট। তাকে বন্দী করে একদিনও এরা রাখতে পারল না। আর আমরা বারদিন ধরে বন্দী আছি। বেরোবার চেষ্টা দূরে থাক, চিন্তাও করিনি।’
নিশ্চয় আহমদ মুসা বোমাসা আসছে। তবে ওদের কথা অনুযায়ী আত্মসমর্পণের জন্যে নয়। আমাদের উদ্ধারের জন্যই সে আসছে।’ বলল শেখ আব্দুল্লাহ আলী।
‘সমস্যা একটাই তার জন্যে। এই ঠিকানা খুজে বের করা। মনে আছে না যে ওরা বলেছিল এই বন্দীখানা খুজে বের করার সাধ্য কারো নেই।’
‘আরও একটা সমস্যা, আহমদ মুসা তো একা। তার একার পক্ষে এই দুর্ভেদ্য শত্রুপুরীতে হানা দেয়া মানবিক সাধ্যের মধ্যে আসে না।’ বলল আলী ইব্রাহিম।
‘মানবিক সাধ্যের বাইরে যখণ যায় কোনকিছু, তখনই আল্লাহর সাহায্য আসে। এ সাহায্য আহমদ মুসাকে আল্লাহ সব সময় করেন।’ বলল শেখ আব্দুল্লাহ্ আলী।
‘তাই হোক। আমিন।’ বলে উঠল সবাই।
কামাল ইনুন উঠে দাঁড়িয়ে জানালা খুলে দেবার জন্যে জানলার দিকে এগুলো।

ক্যামেরুন, মধ্য আফ্রিকা প্রজাতন্ত্র ও কঙ্গো- তিন সীমান্তের গ্রন্থীতে দাঁড়ানো কঙ্গোর বোমাসা শহর। মধ্য আফ্রিকা প্রজাতন্তের সংঘ নদী যেখানে গিয়ে কঙ্গোতে প্রবেশ করেছে, ক্যামেরুন সীমান্তও সেখানে এসে মিসেছে। তারপর সংঘ নদী কঙ্গো ও ক্যামেরুনের সীমান্ত রেখা হিসেবে সামনে এগিয়ে গেছে ‘ওসো’ শহর পর্যন্ত।
সংঘ নদী সীমারেখা হলেও নদীটি পুরো কঙ্গোর ভাগে পড়েছে।
সংঘ নদীর পুরো নিয়ন্ত্রণ কঙ্গোর হাতে।
দেশগুলোর পাসপোর্ট ব্যবস্থা পুরোপুরি আছে, কিন্তু বর্ডার ক্রসের সময় ইনফরমেশন রেজিস্ট্রার করা ছাড়া পৃথক কোন ভিসা নেই। কিন্তু ইনফরমেশন এড়িয়ে যাওয়া এবং রাতে চলাচলের প্রতি খুব কড়া দৃষ্টি রাখা হয়।
বর্ডার থেকে বোমাসা শহরের দূরত্ব মাত্র কয়েকশ’ গজ। সংঘ নদীটা সোজা প্রস্থে নয়, একটু কোণাকুণি পার হলেই বোমাসা শহরের পূর্ব প্রান্ত পাওয়া যায়।
সেদিন রাত ৯টা।
সংঘ নদীর দক্ষিণ তীরে বোমাসা শহরের পূর্ব প্রান্তে অনেকগুলো টিলা নিয়ে গড়ে উঠা একটা সুন্দর বসতি।
সংঘ নদীর পানি থেকে উঠে গেছে একটা টিলা। টিলা শীর্ষের দক্ষিণ অর্ধাংশ জুড়ে সুন্দর একটা বাড়ি। টিলার উত্তর অর্ধাংশ ঘাসের কার্পেটে মোড়া সুন্দর একটি সবুজ লন। লনের উত্তর প্রান্তে নদীর ঠিক উপরে ওরা চারজন বসে আছে।
তাদের সামনে রূপালী নদী।
পূর্ণিমার রাত।
বনজ পরিবেশে পূর্ণিমার চাঁদের আলো যেন রজত স্রোতের মত ঢেলে পড়ছে চারদিক।
আফ্রিকার এই অঞ্চলে বিদ্যুত বড়ো দামী। বিদ্যুতের সীমিত ব্যবহার সে জন্যে।
ওদের সামনে বিরাট এক বাস্কেট মিষ্টি আলু ভর্তি। সেখান থেকে মিষ্টি আলু ছোট ছোট ঝুড়িতে তুলে প্যাক করছে।
এ প্যাকগুলো পাঠানো হবে নৌকা পথে ব্রাজাভিল এবং উপকুলের বিভিন্ন শহরে।
চাঁদের আলো এখানে এতই স্বচ্ছ যে, কোনই অসুবিধা হচ্ছে না তাদের কাজের। এমন কি খুঁতওয়ালা আলুগুলো তারা সহজেই বেছে বাদ দিতে পারছে।
সংঘ নদীর পানিতে পূর্ণিমার জোৎস্না অপরূপ দৃশ্যের সৃষ্টি করেছে। ওপারে উপকূল রেখা বরাবর ছোট ছোট গাছগুলোকে আলাদা আলাদা ভাবে দেখা যাচ্ছে।
ওদের চারজনের দু’জন মাঝ বয়সী নারী ও পুরুষ। অন্য দু’জনের একজন আঠার উনিশ বছরের তরুণী, অন্য জন নয়-দশ বছরের বালক।
তরুণীটি নদীর দিকে চেয়ে বলল, ‘আম্মা চাঁদের জোৎস্না আজ বেশী উজ্জ্বল বলে মনে হচ্ছে।’
‘হবে। গত দু’দিন বৃষ্টি গেছে। আজ আকাশে একটুও মেঘ নেই।’ বলল মাঝ বয়সী মহিলাটি।
‘লঞ্চ না হোক অন্ততঃ মটর বোর্ট থাকলে কি মজাই না হতো নদীতে বেড়াতে।’ তরুণীটি বলল।
‘লেখা পড়া শেষ কর। ডাক্তার হয়ে গেলে নিজেই মটর বোট কিনতে পারবে।’ বলল তার মা।
তরুণীটি ব্রাজিভিল মেডিকেল কলেজে ভর্তি হয়েছে।
‘মেয়েটা বলছে এখনকার কথা, তুমি বলছ দশ বছর পরের কথা।’ বলল মাঝ বয়সী লোকটি, তরুণীটির আব্বা।
‘দাও না তাহলে কিনে।’ বলল মহিলাটি।
‘আজ পারবো না কাল হয়তো পারবো। ইচ্ছা তো করতে পারি।’ বলল তরুণীর আব্বা।
তরুণীটি তাকিয়ে ছিল নদীর দিকে।
সে দেখতে পেল সীমান্তের দিক থেকে একটা নৌকা এগিয়ে আসছে। চাঁদের আলোয় দেখা যাচ্ছে নৌকায় একজন মাত্র আরোহী।
নৌকা মাঝ নদী বরাবর চলে এসেছে। বুঝা যাচ্ছে এ পারে ভিড়বে।
হঠাৎ সীমান্তের দিক থেকে পুলিশের সাইরেন বেজে উঠল। কঙ্গো পুলিশের সাইরেন।
তরুণীটি আগে থেকেই তাকিয়ে ছিল ওদিকে। সাইরেনের শব্দে সাবাই তাকাল। এ সাইরেনের সাথে তারা পরিচিত। নিয়ম না মেনে সীমান্ত কেউ ক্রস করলে পুলিশ এ সাইরেন বাজায় এবং আইন ভঙ্গকারীকে ধরার চেষ্টা করে।
সাইরেন বাজার পর পরই সংঘ নদীর সীমান্ত ফাঁড়ির দিক থেকে একটা বোটকে মাঝ নদী পর্যন্ত আসা নৌকার দিকে ছুটে আসতে দেখা গেল।
‘এই রে, এই নৌকাওয়ালা বুঝি কোন আকাম করে বসেছে। নিশ্চয় সীমান্ত ফাঁড়ি এড়িয়ে এসেছে।’ বলল মাঝ বয়সী লোকটা।
‘নিশ্চয় কোন চোরাচালানী।’ বলল মহিলাটি।
‘তা মনে হচ্ছে না আম্মা। চোরাচালানী এমন করে পুলিশ ফাঁড়ির নাকের ডগার উপর দিয়ে সোজাসুজি এভাবে আসে না। পুলিশের চোখ ফাঁকি দেবার জন্যে অবশ্যই কোন বিলক্প পথ ধরতো।’ বলল তরুণীটি।
‘ঠিক বলেছ চোরাচালানী বা ক্রিমিনালরা পুলিশ ফাঁড়ির সামনে দিয়ে মাঝ নদী হয়ে আসে না।’ বলল তরুণীর আব্বা।
এই সময় লাউড স্পীকারে একটি কণ্ঠ ধ্বনিত হলোঃ ‘সীমান্ত ফাঁড়িকে না জানিয়ে তুমি কঙ্গো প্রবেশ করেছ। আত্মসমর্পণ কর না হলে গুলি করব।’
ওরা সবাই বুঝল লাউড স্পীকারের শব্দ ভেসে আসছে পুলিশের বোট থেকে।
কিন্তু ওরা বিস্মিত হয়ে দেখল, মাঝ নদী পর্যন্ত এগিয়ে আসা নৌকা থামার কোন লক্ষণ দেখাল না। যেভাবে দ্রুত তা আসার চেষ্টা করছিল, সেভাবেই তা এগিয়ে আসছে।’
শংকিত হয়ে উঠলো ওরা। কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে, বুঝল তারা।
তাদের চমকে দিয়ে একটা রাইফেল গর্জন করে উঠ।
সঙ্গে সঙ্গে এগিয়ে আসা নৌকার আরোহী ঝুপ করে পড়ে গেল পানিতে।
“লোকটি কি গুলি খেয়ে পড়ে গেল?’ অনেকটা স্বাগত কণ্ঠে বলল মাঝ বয়সী লোকটি।
কেউ উত্তর দিল না তার প্রশ্নের। তাদের চারজনের আটটি চোখ জোৎস্না প্লাবিত নদীর পানির উপর নিবদ্ধ।
পল পল করে সময় বয়ে যাচ্ছে। ৮টি অপলক চোখ যেন ক্লান্ত হয়ে উঠল। বলল আবার মাঝ বয়সী লোকটিই, ‘সত্যিই লোকটি তাহলে গুলি খেয়েছে, তাই ডুবে গেছে।’
আগের মতই কেউ কোন কথা বলল না। এক প্রকার ভয়, বেদনা তাদের মনকে আচ্ছন্ন করেছে।
একদম সীমান্ত লাগা তাদের বাড়ি হলেও এমন চোখের সামনে এই ধরনের ঘটনা এর আগে কখনও ঘটেনি।
পুলিশের বোট অল্প কিছুক্ষণ ঘোরাফেরা করে ফিরে গেল তাদের ফাঁড়িতে। তাদের অব্যর্থ গুলি খেয়ে নদীতে ডুবে গেছে লোকটা, সম্ভবত এই বিজয় গৌরবে আর অনুসন্ধানের প্রয়োজন বোধ করল না তারা।
ওরা চারজন তখনও নদীর দিকে তাকিয়। পুলিশ বোটের জ্বলজ্বলে লাইটটা তখনও দেখা যাচ্ছে।
এই সময় ওদের টিলার গোড়ার কাছাকাছি নদীতে ভেসে উঠল একটা মাথা।
প্রথমে ওদের মধ্যে থেকে বালকটিরই চোখে পড়ল ব্যাপারটা। সে উত্তেজিত ফিস ফিস কণ্ঠে বলল, ‘এই দেখ, এখানে কি?’
সংগে সংগে অন্য তিনজনেরও চোখ সেদিকে আকৃষ্ট হলো।
তারা দেখল, একজন লোক অত্যন্ত সন্তর্পনে সাঁতরে উঠে আসছে। অল্পক্ষণের মধ্যেই সে টিলার গোড়ায় তাদের ঘাটে উঠে এল।
এক ধরনের ভয় ও বিস্ময়ে ওরা চারজন প্রায় নির্বাক হয়ে গেছে।
নীরবতা ভেংগে তরুণীটি ফিস ফিস করে বলল, ‘এই কি নৌকার আরোহী?’
‘এ কি সম্ভব? এতটা ডুবে আসতে পারে কেউ? বলল তরুণীটির আব্বা।
‘কিন্তু এ লোক তো অন্য কোন দিক থেকে আসা স্বাভাবিক নয়। ঘাটে উঠেই দেখ শুয়ে পড়েছে। কোন পরিকল্পনা নিয়ে আশে-পাশের কেউ এলে নিশ্চয় এভাবে সময় নষ্ট করতো না, আর এ সময়টাও বেছে নিত না।’ বলল, মাঝ বয়সী মহীলাটি।
‘তুমি ঠিকই বলেছ। লোকটি নৌকার আরোহীই হবে।’
তরুণীটি কিছু বলতে যাচ্ছিল। কিন্তু বন্ধ হয়ে গেল তার কথা। মুখে তার প্রবল উত্তেজনা ফুটে উঠেছে। বলল, ‘ঐ যে।’ ঘাটের দিকে আংগুলি সংকেত করল তরুণীটি।
সবাই দেখল, লোকটি টিলা বেয়ে উঠে আসছে।
তরুণীটির আব্বা মাঝ বয়সী লোকটি উঠে দাঁড়াল।
উঠে আসা লোকটিকে একটু দেখে নিয়ে বলল, ‘লোকটি আফ্রিকান নয়, ইউরোপিয়ান নয়। কোন অস্ত্র নেই লোকটির হাতে।
তরুণীর আব্বা একটু এগিয়ে চত্তরের প্রান্ত ঘেঁষে দাঁড়াল। আর মহিলাটি, তরুণীর মা, জ্বেলে দিলো চত্তরের বিদ্যুৎ বাতিটি।
সবাই এসে দাঁড়াল চত্তরের প্রান্ত ঘেঁষে।
‘লোকটির যদি কোন বদ মতলব থাকে?’ উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বলল মহিলাটি।
তরুণীর আব্বা পকেট থেকে রিভলবার বের করে হাতে নিয়ে বলল, ‘ও শত্রুটা করলে আমরাও শত্রুতা করব। তবে দেখে তেমন মনে হচ্ছে না। লোকটি এশিয়ান। হয়তোবা বিপদে পড়া কোন লোকও হতে পারে।’
চত্তরে দাঁড়ানো লোকদেরও দেখতে পেয়েছে এগিয়ে আসা লোকটি।
দেখতে পেয়েই লোকটি ডান হাত একবার উপরে তুলেছে।
‘ভয় নাই, লোকটি মৈত্রীর সিগন্যাল দিয়েছে।’ বলল তরুণীটির আব্বা।
টিলার ঢাল বেয়ে উঠে আসা লোকটি আরও এগিয়ে এসেছে। চত্তরের আলো এবার তার উপর গিয়ে পড়েছে।
ভিজে চুপসে গেছে যুকবটি। গায়ের জ্যাকেট ও ট্রাউজার দিয়ে তখনও অল্প অল্প পানি ঝরছে। মাথার চুলটাও তার মোছা হয়নি। মোছার মত কিছু নেই।
বলা যায় একেবারেই নব্য যুবক। আশ্চর্য্য হলো তরুণীটির আব্বা। যুবকটির চেহারার দিকে তাকিয়েই এ কথাটা তার মনে হলো, কোন ক্রিমিন্যালের চেহারা এটা নয়। একজন ভদ্র যুবক বলতে যা বুঝায় যুবকটি তা-ই।
আগন্তুক যুবকটি চার গজের মধ্যে আসতেই তরুণীটির আব্বা ভদ্রলোক বলল, ‘দাঁড়াও। আগে তোমার পরিচয়।’ বলল বান্টু ভাষায়।
‘আমি সলো থেকে বোমাসা এসেছি একটা প্রয়োজনে, পথে এই বিপদ ঘটেছে।’
পুলিশ তোমাকে কেন তাড়া করেছে?’
‘আমি জানি না।’
‘পুলিশের নির্দেশ তুমি মানলে না কেন?
‘অন্য সময় হলে মানতাম। কিন্তু আমার হাতের কাজটা এত জরুরী যে, দু’চার দিন পুলিশ হাজতে থাকার মত সময় আমার নেই।’
‘সীমান্ত ফাঁড়িতে তোমার নাম লিখিয়েছ?’
‘না।’ এই ধরনের আইন আগে আমি জানি না। আমি বিদেশী লোকতো! জানলে অবশ্যই আমি আইন মানতাম।
যুকবটির কথা শুনে তরুণীর আব্বা-আম্মা সহ ওদের সকলেরই কেন জানি মনে হলো, যুবকটি মিথ্যা কথা বলছে না।
‘এখন তুমি কোথায় যাবে?
‘কোন হোটেল পেলে আপাতত উঠব। আশে পাশে কোন হোটেলের কথা আপনি বলতে পারেন?’
‘সে ধরনের হোটেল এখান থেকে তিন মাইল পশ্চিমে হবে।’
‘কোন পথে যেতে হবে, দয়া করে একটু দেখিয়ে দেবেন কি?’
এতক্ষণে ওদের সকলের মত থেকে সংশয় মেঘ কেটে গেল বুঝল, যুবকটি যেমন সুন্দর, সুগঠিত, তেমনি মনের দিক দিয়ে খুব ভদ্র। যুবকটির প্রতি একটু করুণাই হলো।
‘এইভাবে তুমি হোটেলে যাবে? তোমাকে নির্গাত সন্দেহ করবে। আর জান সবগুলো হোটেলের উপরই পুলিশ চোখ রাখে।’
‘কি করবো উপায় তো নেই।’
তরুণীর আব্বা বালকের দিকে চেয়ে বলল, ‘ইউহোসবি তুমি ভেতর থেকে একটা তোয়ালে ও এক প্রস্থ কাপড় নিয়ে এস। গোসলখানাটা একে দেখিয়ে দাও।’
কথা শেষ করেই যুবকটির দিকে চেয়ে বলল, ‘আমি ম্যাকাকো।’
মহিলাকে দেখিয়ে বলল, ‘ও আমার মানে ‘ও’ হলো মিসেস ম্যাকাকো।’
আর তরুণী ও বালকটির দিকে ইংগিত করে বলল, ‘ওরা আমার ছেলেমেয়ে মাসাবো এবং ইউহোসবি।’
একটু থেমে বলল, ‘তোমার নাম কি তোমার দেশ?’
‘আমি জন্ম গ্রহণ করেছি চীনের সিংকিয়াং প্রদেশে।’ তারপর বাস করছি. . . . . . .।’
কথা শেষ করতে না দিয়ে ম্যাকাকো বলল, ‘তুমি আবার কম্যুনিষ্ট-টম্যুনিষ্ট নাকি?’
না, আমি কম্যুনিষ্ট নই। কেন কম্যুনিষ্ট ভয় করেন?’
‘না করে উপায় আছে। ওরাই শান্তির কাফেলাতে অশান্তির আগুণ জ্বালে। চীন-রাশিয়া আমেরিকার রাজনীতি তারা আমাদের গরীব দেশে এনে আমাদের শান্তি কেড়ে নিয়েছিল।’
একটু থামলো। একটু ঢোক গিলে বলল, তুমি ইউহোসবির সাথে যাও। কাপড় ছেড়ে নাও।’
গোছল ও কাপড় ছাড়ার পর আগুন্তুক যুবককে বাইরে মেহমান খানায় থাকার ব্যবস্থা করে দেয়া হল।
ম্যাকাকো তাকে খাওয়া-দাওয়ার পর বলেছে, ‘আজ বিশ্রাম নাও সকালে চলে যাবে।’
শোবার আয়োজন করছিল ম্যাকাকো। গ্লাস ভর্তি পানি টেবিলে রাখতে রাখতে মিসেস ম্যাকাকো বলল, ‘লক্ষ্য করেছ ছেলেটি ভীষণ লাজুক। খেয়াল করেছি, আমি ওর সামনে গেলে মুখ তুলে কখনও চায় না, এমনকি মাসাবা কাছে গেলেও নয়।’
‘ঠিকই বলেছ। আমার মনে হয়েছে, যুবকটি বর্তমান সময়ের নয়। এমন মার্জিত, সপ্রতিভ ও লাজুক ছেলে এখন হয়না। সত্যি ছেলেটাকে বিপদে সাহায্য করতে পেরে আমার খুব ভাল লাগছে।’ একটু থেমে আবার মিঃ ম্যাকাকো বলল, ‘ভাল লাগার সাথে সাথে একটি কথা আমার কাছে বড় হয়ে উঠছে। তা হলো, দু’তিন দিনও দেরী করা যাবে না, এমন কি কাজ আছে এখানে একজন যুবকের।’
‘তবে ছেলেটা যে অসীম সাহসী, অসম্ভব রকমের সামর্থ রাখে, তা তার পুলিশকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে চলে আসা এবং এতদূর জায়গা ডুব দিয়ে পাড়ি দেয়া থাকে বোঝা গেছে।’ বলল মিসেস ম্যাকামো।
ঘরে দৌড়ে প্রবেশ করল মাসাবো এবং ইউহোসবি। হাঁপাতে হাঁপাতে মাসাবা বলল, ‘দারুন খবর।’
‘কি খবর’ মাসাবার আব্বা-আম্মা দু’জনেই বলে উঠল।
‘আমরা মেহমানের ঘরের পাশ দিয়ে আসছিলাম. . . .. . .. .।’ থামলো মাসাবা।
‘আসছিলে, তারপর বল।’ বলল মাসাবার আম্মা উদগ্রীবভাব।
‘দেখলাম, আমাদের মেহমান. . .. . . . . . .’আবার থামলো মাসাবা।
মাসাবার আব্বা-আম্মা দু’জনেরই উৎকন্ঠায়, চোখ বড় বড় হয়েছে। কোন দুর্ঘটনা ঘটল নাকি; তাদের মনে আশংকা। বলল, ‘বল, কি হয়েছে বল।’
‘নামাজ পড়ছেন আমাদের মেহমান।’ বলল মাসাবা।
‘নামাজ পড়ছে? ঠিক দেখেছ?’ বলল মাসাবার আব্বা।
‘এখনও পড়ছে, দেখবে চল।’ বলল মাসাবা।
‘ঠিক আছে, চল দেখি।’ বলে উঠে দাঁড়াল মিঃ ম্যকাকো এবং তার সাথে মিসেস ম্যাকাকোও।
চারজনই গিয়ে দাঁড়াল মেহমান খানার জানালায়।
ঠিক। নামাজে দাঁড়িয়ে আগন্তুক যুবকটি। চারজন দাঁড়িয়ে দেখল। তারপর একটু সরে এল। মিঃ ম্যাকাকো ও মিসেস ম্যাককোর চোখে বিস্ময়। বলল মিসেস ম্যাকাকো, ‘তাই তো বলি ছেলেটা এত ভাল কেন! মুসলমান না হলে এমন ছেলে হয়!’
‘আমি ভাবছি অন্যকথা।’ বলে উঠল মিঃ ম্যাকাকো, ‘একজন মুসলিম যুবক এইভাবে বুমাসা এল। বুমাসায় সাংঘাতিক জরুরী কাজ তার। মেলাতে পারছি না। এস তার সাথে কথা বলি।’
বলে মিঃ ম্যাকাকো জানালায় এসে দেখল নামাজ হয়ে গেছে। দরজায় গিয়ে নক করল সে।
যুবকটি হাসি মুখে স্বাগত জানাল। বলল, ‘আসুন আপনারা।’
‘বিরক্ত করলাম তোমাকে দু’টি কারণে। প্রথম হলো আমাদের খুশীর কথা তোমাকে জানানো। দুই, আমরা যে একটা হিসাব মেলাতে পারছিনা তা তোমাকে বলা।’
ঘরে দু’টিই মাত্র চেয়ার। যুবক চেয়ার দু’টি মিঃ ম্যাকাকো ও মিসেস ম্যাকাকোর দিকে এগিয়ে দিয়ে তরুণীটিকে বলল, তুমি বেডের পাশটায় বসতে পারো বোন।’
আর বালকটিকে সে নিজের কাছে টেনে নিল।
‘বোন’ সম্বোধন শুনে তরুণী মাসাবা যুবকটির দিকে একবার চোখ তুলে চেয়ে ‘ধন্যবাদ’ বলে বসে পড়ল।
কথা শুরু করল মিঃ ম্যাকাকো বলল, ‘দেখ তোমার বিশ্রামে বিঘ্ন ঘটালাম কিছু মনে করো না। ভোর পর্যন্ত আমাদের খুশী ও কৌতুহল চেপে রাখা সম্ভব ছিল না।’ বলে একটু থামলো ম্যাকাকো।
‘না, আমার কোন কষ্ট হয়নি। বিশ্রামের সময় আমার এখন নয়। আমি বরং আপনাদের সাথে এই কথা বলার সুযোগ পেয়ে খুশী হয়েছি।’ বলল যুবকটি।
মিঃ ম্যাকাকো আবার শুরু করল, ‘কেন খুশী হয়েছ?’
‘আপনার সাহয্যের প্রয়োজন হবে আমার।’
‘কি সাহায্য?’
‘বলব, আপনার কথা আগে বলুন।’
‘আমাদের আনন্দের বিষয়টা হলো, জানলাম তুমি মুসলমান।’
ম্যাকাকোর মুখে আকস্মিকভাবে নিজের পরিচয় শুনে যুবকটি গম্ভীর হয়ে উঠল। বুঝতে পারলো না তার পরিচয় জানলো কি করে!
‘কি ভাবে জানলেন?’ মুখে হাসি টেনে বলল যুবকটি।
‘মাসাবা ও ইউহোসবি তোমাকে নামাজ পড়তে দেখেছে।’
‘নামাজ ওরা চিনল কি করে?’
হো হো করে হেসে উঠল ম্যাকাকো। বলল, ‘আমরা নিয়মিত নামাজ পড়ি না, নানা অসুবিধা আছে। ঈদে-চাঁদে তো পড়ি। জুমা পড়ি। সুতরাং নামাজ না চেনার কথা নয়।’
‘আপনারা মুসলমান?’
‘মুসলমান মানে খাটি মুসলমান।’ বলে একটু থামল ম্যাকাকো। তারপর বলল, ‘আমার নাম বেলাল ম্যাকাকো। তোমার পাশে আমার ছেলের নাম রাশিদ ইউহোসবি। আর আমার এ মেয়ের নাম ফাতেমা মাসেবা।’
যুবকটির চোখ-মুখ আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠল। আনন্দের প্রবল উচ্ছ্বাস যেন তাকে কিছুক্ষণ কথা বলতে দিল না।
এক সময় দু’হাত উপরে তুলে বলল, ‘হে আল্লাহ তুমি সবচেয়ে বড় সাহায্যদাতা। যখন একটি মুসলিম পরিবারের সাক্ষাত আমার সবচেয়ে বেশী প্রয়োজন, তখন তার সাক্ষাত পেলাম।’
বলে যুবকটি বালক ইউহোসবি’র কপালে একটা চুমু খেয়ে ম্যাকাকোকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘আপনার আনন্দের চেয়ে আমার আনন্দ অনেক বেশী।’
‘আমাদেরটা পরিমাপ না করে তুমি বলতে পার না। এখন বল, ‘তুমি কে? এমন কি জরুরী প্রয়োজনে তুমি বুমাসা এসেছ যার জন্য দু’একদিনের অপেক্ষাও তোমার পক্ষে অসম্ভব?’
যুবকটি তাৎক্ষণাত কোন উত্তর দিল না।
একটু ভাবল। তারপর বলল, ‘বলতে আমার আপত্তি নেই। কিন্তু তার আগে আমার একটা কৌতুহল নিবৃত্ত করলে খুবই খুশী হবো।’
‘কি সেটা?’ বলল ম্যাকাকো।
‘আপনাদের কথা। আফ্রিকার এত গভীরে দূর্গম কঙ্গোর এই কালো বুকে আপনার এই মুসলিম পরিবার কোথেকে এল?’
‘ও এই কথা। বোমাসায় আমার একটি পরিবার নয়, পাঁচশ’ মুসলিম পরিবার আছে এখানে। মোট মুসলিম জনসংখ্যা তিন হাজারের মত। একমাত্র রাজধানী ব্রাজাভিল ছাড়া কঙ্গো শহরে এত মুসলমান এক সাথে বাস করে না।’
‘অবিশ্বাস্য ব্যাপার।’ এই কথা বলার সময় যুবকটির কন্ঠে বিস্ময় থাকলেও, তার চেহারায় কোন বিস্ময় নেই। বরং তার ঠোটে খুব সুক্ষ একটা হাসির রেখা ফুটে উঠেছিল। সে যেন সব জানে। বাজিয়ে নিচ্ছে মাত্র যে, কতটুকু বিশ্বাস করা যায়, কতটুকু যায় না।
‘সকল আধুনিক যোগাযোগ থেকে বিচ্ছিন্ন গভীর অরণ্যের অন্ধকারে নিমজ্জিত কঙ্গোর এই একটি শহরে এত মুসলমানের অস্তিত্ব অবিশ্বাস্য বৈকি। এই শহরে খৃস্টানদের সংখ্যা মুসলমাদের অর্ধেক। অথচ গত দু’শ বছর ধরে খৃস্টানরাই এ অঞ্চলে আধিপত্য করছে।’ বলল ম্যাকাকো।
‘কারণ কি বলুন তো!’ যুবকটি বলল।
‘বোমাসায় এই মুসলিম বসতি স্থাপনের কৃতিত্ব মাত্র একজনের। তিনি হলেন উত্তর ক্যামেরুনের রাজ্যত্যাগী রাজা সুলতান যায়দ রাশিদী। তিনি সিংহাসন ত্যাগ করে এসে এখানে ২০ বছর অজ্ঞাতবাস করেছিলেন। তিনি এখানকার ছিলেন এক মুকুটহীন রাজা। তাঁর চরিত্র মাধুর্য এখানকার কালো মানুষগুলোর মধ্যে ইসলামের আলো প্রজ্জ্বলিত করে। পরবর্তিকালের বহিরাগতদের বাদ দিলে বোমাসার মূল বাসিন্দাদের অধিকাংশই মুসলমান।’
‘আল্লাহ তাকে পুরষ্কৃত করুন।’
‘সুলতান যায়দ রাশিদী কোথায় গেলেন তারপর?’ যুবকটির মুখে এখনও সেই হাসি। সব জান্তার হাসি।
‘আমরা ঠিক জানি না। কেউ বলে তিনি হজ্জে গিয়ে আর ফেরেন নি। কারও মত আবার, তিনি ক্যামেরুনেই ফিরে গেছেন।’
যুবকটি কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল। তারপর বলল, ‘মাফ করবেন আমাকে। এ বিষয়ে আমি অনেক কিছুই জানি। তারপরও আপনার কাছ থেকে জানতে চেয়েছি আপনার পরিচয় ঠিক কিনা তা নিশ্চিত হওয়ার জন্যে।’
ম্যাকাকো, মিসেস ম্যাকাকো, মাসাবা, ইউহোসবি সকলের মুখেই বিষ্ময় ফুঠে উঠল। কথা বলল ম্যাকাকো, ‘জান তুমি তাঁর শেষ খবরটা কি?’
যুবকটি সংক্ষেপে যায়দ রাশিদীর কাহিনী বলল। কি করে তিনি ইয়াউন্ডি গেলেন, কিভাবে তিনি সেখানে নিবাস গাড়লেন, কিভাবে তার দুঃখজনক মৃত্যু হলো ইত্যাদি।
মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনলো কথাগুলো ম্যাকাকো এবং তাদের পরিবার। কাহিনী শুনতে গিয়ে কখনও তাদের চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে, কখনও চোখ তাদের অশ্রু সিক্ত হয়েছে।
যুবকটি থামলেই ম্যাকাকো বলল, ‘জান বোমাসার মানুষ তাকে কত ভালবাসে! তার গড়া বিশাল মসজিদের পাশেই ছিল তার বাড়ি। সেই বাড়ি এখন বোমাসাবাসীদের তীর্থক্ষেত্র। তার ব্যাবহার্য সকল জিনিস সেখানে যাদুঘরের মত করে সংরক্ষিত রাখা হয়েছে। মানুষ সেগুলো মহা পবিত্র জ্ঞান করে। ইসলামে অনুমতি থাকলে তার মূর্তিও গড়া হতো। অমুসলিমরাও মুসলমানদের মত তাঁকে ভালোবাসে। তিনি যে তারিখে মসজিদের ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন, সেই তারিখে প্রতিবছর তিনি জনসাধারণকে খাওয়াতেন এবং স্রষ্টা ও মানুষের সম্পর্ক, জীবন কিভাবে শান্তিপূর্ণ ও সুন্দর করা যায় ইত্যাদি বিষয়ের উপর অভিভাবক সুলভ বক্তৃতা করতেন। এর মধ্য দিয়ে বোমাসার বাইরেও তার প্রভাব সৃস্টি হয় এবং সে সব স্থানেও মুসলিমদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে।
‘যায়দ রাশিদীর চালু করা সেই সম্মেলনের আয়োজন এখনও নিশ্চয় আপনারা করেন?’
‘না এখন হয় না, তার মতো লোক তো নেই, কে সেখানে কথা বলবে?’
‘কেন আলেম, ইমাম আপনাদের নেই?’ একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলল ম্যাকাকো। বলল, ‘কোন আলেম লোক আমাদের নেই। কোন ভাল ইমামও নেই। অনেক লেখালেখির পর রাববারেতির চেষ্টায় বিশ্ব মুসলিম কংগ্রেস আমাদের জন্যে একজন মুবাল্লেখ দিয়েছিল ইমাম ও শিক্ষকের দায়িত্ব পালনের জন্যে। কিন্তু দুর্ভাগ্য আমাদের সেই ভাই মিমি মাছির কামড়ে মারা যান, তারপর কেউ আর আসেনি। ইসলামের সাধারণ শিক্ষার সুযোগ থেকেও আমরা বঞ্চিত। আমিই যেখানে জানি না, সেখানে আমার ছেলে সন্তানদের কোরআন শিক্ষা, ইসলাম শিক্ষা দেব কি করে? আমি জানি, যে নামাজ আমরা পড়ি, তাকেও নামাজ বলে না।’
‘সত্যিই দুর্ভাগ্যজনক।’
‘না, আমাদের চেয়েও দুর্ভাগা মুসলমান কঙ্গো অববাহিকায় আছে। আমরা যতটুকু জানি তারা ততটুকুও জানে না। যুবকটি কোন কথা বলল না ম্যাকাকো থামলেও। কিছু বলার জন্যে ম্যাকাকোই মুখ খুলছিল। এ সময় কলিংবেল বেজে উঠল। কথা বলা হলনা ম্যাকাকো’র। সে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকাল স্ত্রীর দিকে।
‘ওটা গেটের কলিংবেল। এতরাতে কে এল?’ বলল মিসেস ম্যাকাকো। তার চোখে-মুখে বিরক্তি নয়, কিছুটা ভয়ের চিহ্ন।
মিঃ ম্যাকাকো উঠে দাড়ালো। বলল, তোমরা বস আমি দেখি।’ বলে মিঃ ম্যাকাকো পা বাড়াল যাবার জন্যে।
ত্বরিৎ উঠে দাঁড়ালো মিসেস ম্যাকাকো, স্বামীর সামনে দাঁড়িয়ে তাকে বাধা দিয়ে বলল, ‘না, তুমি যাবেনা। আমি দেখছি।’ বলে মিসেস ম্যাকাকো বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। তার পেছনে ছুটে গেল বালক ইউহোসবি।
একটি কলংবেল শুনে ম্যাকাকো পরিবারের আকস্মিক অস্বস্তি ভাব, ম্যাকাকোকে বাধা দিয়ে তার স্ত্রীর দরজা খুলতে যাওয়া-এই দুইটি বিষয় বিস্মিত করল মেহমান যুবকটিকে। সে বলল, ‘কি ব্যাপার জনাব, কলিংবেল শুনে মিসেস ম্যাকাকো’র মুখে ভয়ের চিহ্ন দেখলাম, আবার উনি আপনাকে যাতে দিলেন না।’
ম্যাকাকো গম্ভীর। বলল, ‘গত ১০ দিনে তিনটি মারাত্মক ঘঠনা ঘঠেছে। বোমাসা মুসলিম ট্রাষ্টের মোতাওয়াল্লী, বোমাসা ইসলামিক সার্কেল-এর সভাপতি এবং সাধারণ সম্পাদক নিখোঁজ হয়েছেন। এই তিনটি ক্ষেত্রেই গভীর রাতে কলিং বেলের শব্দে দরজা খোলার পর উধাও………………
কথা শেষ করতে পারলনা ম্যাকাকো। তার কথা থেমে গেল একটা উচ্চ কন্ঠের হুংকারে। কন্ঠটি হুংকার করে বলল, ‘বেরিয়ে এস ম্যাকাকো। কাপুরুষ বটে! স্ত্রীকে পাঠিয়েছ দরজা খুলতে।’ মুহূর্তে ম্যাকাকোর চেহারা ফ্যাকাসে হয়ে গেল। তাকাল সে যুবকটির দিকে।
গর্জে উঠল সেই কন্ঠ আবার, ‘এক সেকেন্ডও যদি দেরী কর তোমার স্ত্রী ও ছেলেকে হত্যা করব তুমি বাঁচবে না।’
কথা শোনার সংগে সংগে ম্যাকাকো পাগলের মত ছুটে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
তরুণী মাসাবা কাঁপতে কাঁপতে বসে পড়েছে মেঝেতে।
মেহমান যুবকটি দ্রুত বিছানা থেকে নামল। সান্ত্বনার ভংগিতে তরুণীর মাথায় হাত রেখে বেরিয়ে এল ঘর থেকে। দেখল, মিঃ ম্যাকাকো চত্তরের মাঝে পাথরের প্রাণহীন মূর্তির মত দাঁড়িয়ে আছে। কিছু দূরে দাড়িয়ে আছে মুখোশ পরা চারজন। ওদের একজনের রিভালবারের নল ম্যাকাকোর বুক লক্ষ্যে স্থির হয়ে আছে। ম্যাকাকোর স্ত্রী এবং ছেলেটি চত্তরে বসে পড়ে কাঁপছে। কান্নাও তাঁরা ভূলে গেছে, যেন বোবা হয়ে গেছে তাঁরা। রিভালবারধারী তার সাথীদের বলল, ‘যাও ম্যাকাকোকে তুলে নাও।’
দু’জন এগিয়ে এল ম্যাকাকোর দিকে। তারা এসে এক ধাক্কায় ম্যাকাকোকে মাটিতে ফেলে দিল। তারপর একজন তার দু’পা এবং অন্যজন দু’হাত ধরে তাকে শূন্যে তুলে এগুতে লাগল।
মেহমান যুবকটি দাঁড়িয়ে দেখছিল। তার একটি হাত পকেটে।
এতক্ষণে সে বলল, ‘দাড়াও।’ একটা কঠিন নির্দেশের সুর তার কন্ঠ।
কিন্তূ দু’জন দাঁড়ালো না।
উত্তরে রিভলবার ধারী বলল, ‘কুকুরের মত ঘেউ ঘেউ করো না, লাশ হয়ে যাবে।’
মেহমান যুবকের কন্ঠে আবার নির্দেশের সুর ধ্বনিত হলো, ‘মিঃ ম্যাকাকোকে ছেড়ে দাও।’
কিন্তূ ওরা দু’জন দাড়ালো না। বরং রিভলবার ধারী তার রিভলবারের নল লক্ষ্য করেছিল মেহমান যুবকটিকে।
মুহূর্তে ঘটে গেল ঘটনাটা।
মুখোশ ধারীর রিভলবার মেহমান যুবক পর্যন্ত উঠে আসার আগেই মেহমান যুবকের হাত বিদ্যুত বেগে বেরিয়ে এল পকেট থেকে এবং বুলেট উদ্‌গীরণ করল।
একদম বুকে গুলী খেয়ে পড়ে গেল মুখোশধারী।
তার পাশে দাঁড়ানো মুখোশধারীও তার পকেটে হাত দিয়েছিল।
মেহমান যুবকের দ্বিতীয় গুলীটা বিদ্ধ করল দ্বিতীয় মুখোশধারীকে। সে গুলি খেল মাথায়।
এদিকে যে দু’জন নাগর দোলা করে নিয়ে যাচ্ছিল ম্যাকাকোকে তাঁরা তাকে ছেড়ে দিয়ে ঝাপিয়ে পড়ল মেহমান যুবকটির উপর।
দ্বিতীয় গুলী করার পর যুবকটি রিভলবার ঘুরিয়ে নিয়েছিল ঝাঁপিয়ে পড়া দু’জনের দিকে।
একটা গুলী করারই সময় হলো। এই তৃতীয় গুলিটা তৃতীয় মুখোশধারীর বুকটা এফোড় ওফোড় করে দিল। ততক্ষণ চতুর্থ মুখোশধারী এসে ঝাঁপিয়ে পড়েছে মেহমান যুবকটির উপর। হাত থেকে তার রিভলবারটি ছিটকে পড়ে গেল।
মেহমান যুবকটি মাটিতে পড়ে গিয়েছিল। তার উপর এসে পড়েছিল মুখোশধারী। পড়েই মুখোশঢারী একটি ঘুষি চালিয়েছিল যুবকটির মুখে। ঠোট ফেটে গিয়েছিল যুবকটির।
ব্যাথার প্রবল ঝাকুনি কিছুটা ভোতা করে দিয়েছিল যুবকটিকে।
যখন সচেতন হলো বুঝল মুখোশধারীর দুইটি হাত সাঁড়াশির মত বসে যাচ্ছে তার গলায়।
যখন যুবকটি মাটিতে আছড়ে পড়ে তখনই তার অভ্যাস আনুসারে পা বুকের সাথে গুটিয়ে নিয়েছিল। গুটানো পাকে সে এবার কাজে লাগালো। হাটু এবং পা দিয়ে উপরে চেপে বসা মুখোশধারীর দেহটাকে প্রবল ধাক্কায় উপর দিকে ছুঁড়ে দিল।
মুখোশধারী উল্টে যুবকটির মাথার পেছনে এসে পড়ল। তার হাত শিথিল হয়ে পড়েছিল। যুবকটির গলা থেকে।
সংগে সংগে যুবকটি পাশ থেকে রিভলবারটি কুড়িয়ে নিয়ে উঠে দাঁড়াল। উঠেই দেখতে পেল মুখোশধারী শোয়া অবস্থাতেই পকেট থেকে রিভলবার বের করছে। কিন্তূ সময় পেল না রিভলবার লক্ষ্যে উঠে আসার। মেহমান যুবকটির চতুর্থ গুলিটি তার হাত আহত করে বিদ্ধ করল তার বুক।
মেহমান যুবক রিভলবার পকেটে রেখে ওদের চারজনের মুখোশ খুলে ফেলল। চারজনই শেতাংগ।
ততক্ষণে মিঃ ম্যাকাকো, মিসেস ম্যাকাকো এবং ইউহোসবি উঠে দাঁড়িয়েছে। তরুণীটিও বেরিয়ে এসেছে ঘর থেকে। ভয়ে তারা সবাই কাঠ হয়ে গেছে। কথা বলার শক্তি যেন তারা হারিয়ে ফেলেছে। তারা একবার তাকাচ্ছে চারটি লাশের দিকে, আবার তাকাচ্ছে মেহমান যুবকটির দিকে। যুবকটিকে তারা যেন নতুন করে দেখছে।
মেহমান যুবকটি মিঃ ম্যাকাকোর দিকে চেয়ে বলল, ‘আপনি কি এদের চিনতে পারছেন?’
কোন কথা বলল না মিঃ ম্যাকাকো। ছুটে এসে জড়িয়ে ধরল মেহমান যুবকটিকে। শিশুর মত কেঁদে উঠল চিৎকার করে। বলল, ‘তুমি ফেরেশতা। আমাকে বাঁচাবার জন্যে আল্লাহ্‌ তোমাকে পাঠিয়েছেন।’ তার পরিবারের অন্যান্যরাও এসে তার চারদিকে দাঁড়াল তাদের চোখে-মুখে আতংক। কাঁদতেও বোধ হয় তারা পারছে না।
যুবকটি মিঃ ম্যাকাকোকে সান্ত্বনা দিয়ে বলল, ‘আপনি কি এদের চেনেন?’
চোখ মুছে ম্যাকাকো বলল, ‘না এদের কাউকে চিনি না।’
যুবকটি বলল, ‘দেখি ওদের পকেটে কোন কাগজপত্র পাওয়া যায় কিনা, যাতে তাদের পরিচয় মেলে।’ বলে সে ওদের চারজনকেই সার্চ করল।
কাগজের মধ্যে একজনের পকেটে পেল একটি মুখ ছেড়া ইনভেলাপ এবং তার ভেতরে একটা চিঠি। চিঠির উপর একবার নজর বুলিয়েই রেখে দিল পকেটে।
মিঃ ম্যাকাকোর দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল, ‘এই লাশ গুলির কি ব্যাবস্থা করা যায়?’
‘আমি বুঝতে পারছি না, তুমি বল কি করব।’ কেঁদে উঠে বলল ম্যাকাকো।
যুবকটি একটু চিন্তা করল। বলল ‘দুইটা পথ আছে। সব ঘঠনা পুলিশকে বলে লাশগুলো পুলিশের হাওলায় দিয়ে দেয়া। দ্বিতীয়, লাশগুলি গুম করে ফেলা। এদু’টির কোনটি আপনার জন্য ভাল?’
‘পুলিশকে জানানো যায়। কিন্তূ পুলিশকে জানালে শুত্রুপক্ষ জেনে ফেলবে। তাতে ভবিষ্যতে বিপদ বাড়তে পারে। তার চেয়ে লাশ সরিয়ে ফেলাই নিরাপদ।’ বলল ম্যাকাকো।
মানুষ তো গুলির শব্দ পেয়েছে। এটা কোন অসুবিধা করবে না?’
‘গুলির ঘটনা বোমাসায় কোন বড় ঘটনা নয়। হাত সই করা, এমন কি বিনা কারণেও গোলাগুলির ঘটনা এখানে ঘটে। আর আমার বাড়ি সীমান্তের লাগোয়া এবং নদীর উপরে হওয়ায় মানুষ গুলি কয়টিকে পুলিশের বলেও ভাবতে পারে।’
‘এখানে আগ্নেয়াস্ত্রের জন্যে কোন লাইসেন্স নেই। এখানে এখনও জংগলের আইনই চালু আছে। শক্তি যার বেশী, আইন এখানে তার পক্ষে।’
লাশ গুলো নদিতে ফেলে দেয়া হলো। মেহমান যুবক এবং ম্যাকাকো যখন লাশগুলোর ব্যাবস্থা করছিল, তখন মিসেস ম্যাকাকো এবং অন্যরা বাড়ির রক্তাক্ত চত্তরটা ধুয়ে মুছে-সাফ করে ফেলেছে।
বালতি দিয়ে চত্তরে পানি ঢালতে ঢালতে বালকটি বলেছিল, আম্মা আমাদের মেহমান সত্যিই ফেরেস্তা নাকি! চোখের পলকে চারজনকে সে শেষ করে ফেলল।’
‘সত্যিই ফেরেস্তা বাবা, কোন মানুষের পক্ষে এটা সম্ভব নয়।’ বলেছিল মিসেস ম্যাকাকো।
‘দেখ মা, মেহমানের কাছে হঠাৎ করে রিভলবার এলো কোত্থেকে। আর দেখেছ উনি কেমন সব জান্তা। আমাদের দরবেশ রাজার সব কথা তিনি কেমন গড় গড় করে বলে গেলেন। সত্যি তিনি অলৌকিক কেউ।’ তরুণী মাসাবা বলেছিল।
ঘটনার মধ্যে অলৌকিকত্বের সন্ধান আরও কতক্ষণ চলত কে জানে। কিন্তু ম্যাকাকো এবং যুবকটি এসে পড়ায় তাদের গল্প বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।
সবকাজ শেষ করে গোসল শেষে ওরা সবাই যখন এসে ভেতরের ড্রইং রুমে বসল, তখন রাত ৩টা।
গরম চায়ে প্রথম চুমুক দিয়ে ম্যাকাকো মেহমান যুবকটিকে লক্ষ্য করে বলল, ‘আপনি আমাদের কাছে ফেরেশতা। কিন্তু ফেরেশতার ছায়া থাকে না শুনেছি, আপনার ছায়া দেখলাম। দয়া করে কি বলবেন আপনি কে?’
যুবকটি হাসল। বলল, ‘সেটা বলছি, কিন্তু তার আগে বলুন ঘটনাটা কি?’ ওরা আপনাদের তিনজনকে কেন গুম করেছে? কেন ওরা আপনাকে ধরে নিয়ে যেতে এসেছিল?’
মি: ম্যাকাকো একটু ভাবল, তারপর বলল, ‘ওদের চিনি না। কারা ওরা তাও জানি না। অন্যদের মত পুলিশেরও বক্তব্য হলো সংঘবদ্ধ সুপরিকল্পিতভাবে এটা ওরা করছে। মুসলিম সংগঠনের নেতৃ পর্যায়ের ঐ সব লোক উধাও হওয়া থেকে তারা বলছে, ব্যাপারটা রাজনৈতিক, অর্থনৈতিকও হতে পারে।’
‘রাজনীতি কি ধরনের?’ বলল যুবকটি।
‘এই সংগঠনের উর্ধ্বতন দায়িত্বশীলরা এভাবে উধাও হওয়াতে মনে করা হচ্ছে হত্যাকান্ডটা রাজনীতির কারণে হয়েছে। আমাকে ধরতে এসেছিল, কারণ আমি বোমাসা ইসলামিক সার্কেলের সিনিয়ার ভাইস প্রেসিডেন্ট।’
‘বোমাসায় এ রাজনীতি কে করতে পারে?’
‘আমি বুঝতে পারছি না।’
‘এ ধরনের উধাও হওয়ার ঘটনা আর কখনও ঘটেছে?’
‘না ঘটেনি। গত ১২ দিনের মধ্যে এই তিনটি ঘটনা ঘটেছে।’
যুবকটি পকেট থেকে একজন মুখোশধারীর কাছ থেকে পাওয়া ইনভেলাপটির ঠিকানার দিকে নজর বুলিয়ে আবার পকেটে রেখে দিল। বলল, ‘বোমাসার লিভিংস্টোন রোডটি কোথায়?’
‘মাবোইডিং-এ।’
‘মাবোইডিং নাম শুনে চমকে উঠল যুবকটি। বলল, ‘মাবোইডিং- এখানে কি কোন বাইবেল সোসাইটি আছে?’
‘হ্যাঁ, সেটা তো ঐ লিভিংস্টোন রোডেই।
‘কত নম্বার বলতে পারেন?’
‘হ্যাঁ ওদের কাগজপত্র প্রায় আমরা পাই। বাইবেল সোসাইটির নাম্বার ৬৩, লিভিংস্টোন রোড।’
আবার চমকে উঠল যুবকটি। মুখোশধারীর ইনভেলাপেও এই ঠিকানা লেখা। যুবকটি হঠাৎ কোন চিন্তায় ডুবে গেল।
যুবকটির চমকে উঠা এবং হঠাৎ করে চিন্তান্বিত হয়ে পড়া ম্যাকাকোর নজর এড়ালো না। ম্যাকাকোর মনে হলো যুবকটি ঐ ঠিকানার সাথে পরিচিত এবং সে অনেক কিছুই জানে। এই সংগে তার মনে পড়লো দু’একদিনের মধ্যে সমাপ্য জরুরী কাজে তিনি এসেছেন। অন্যদিকে মাত্র কয়েক সেকেন্ডে শেষ করেছেন চারজন সাংঘাতিক সন্ত্রাসীকে। সব মিলিয়ে যুবকটি অসাধারণ কেউ। এমন অসাধারণ মুসলিম যুবক কে হতে পারে।
ম্যাকাকোর সবিনয় কণ্ঠ আবার ধ্বনিত হলো, ‘দয়া করে কি জানাবেন কে আপনি? কৌতুহল আর ধরে রাখতে পারছি না।’
‘যুবকটি একটু হাসল। বলল, ‘চিনবেন না। জেনে রাখুন, আমি আপনাদের একজন সেবক।’
‘না চিনলেও বুঝব। বলুন, ‘কোথায় বাড়ি, কি করেন, কি নাম?’
আবার হাসল যুবকটি। বলল, ‘সব দেশই আমার দেশ। আমার বিশেষ কোন দেশ নেই, বাড়িও নেই। উল্লেখ করার মত কিছুই করি না।’
‘এমন পরিচয় যার তিনি অসাধারণ। আমাদের কৌতুহল আরও বাড়ল জনাব।’ বলল, মাসাবা।
যুবকটি হাসল বলল, ‘নামটাই শুনতে চাওতো! আহমদ মুসার নাম শুনেছ?’
ফাতেমা মাসাবা আহমদ মুসার নাম শুনেই সোজা হয়ে বসল, তীক্ষ্ণ হয়ে উঠল তার দৃষ্টি। বলল, ‘কোন আহমদ মুসা? পত্র-পত্রিকায় যাকে নিয়ে আলোচনা হয়?’
‘হ্যাঁ।’
‘পত্র-পত্রিকা যারা পড়েন, তারা কেন তাঁকে চেনে। কিন্তু এ প্রশ্ন কেন? আপনি কি…………।’
কথা শেষ করতে পারল না ফাতেমা মাসাবা বিস্ময়ে হা হয়ে গেছে তার মুখ। রুদ্ধ হয়ে গেছে তার কণ্ঠ।
মি: ম্যাকাকো ও মিসেস ম্যাকাকোর কৌতুহল দৃষ্টি যুবকের উপর নিবদ্ধ।
আহমদ মুসার মুখে হাসি। বলল, ‘আমি নিজেকে আহমদ মুসা বললে বিশ্বাস করবে বোন?’
মুহূর্তে ফাতেমা মাসাবার চেহারা পাল্টে গেল। বিস্ময়ের প্রবল আঘাত যেন তার চোখে মুখে আছড়ে পড়ছে। চোখ দু’টি তার যেন ঠিকরে বেরিয়ে পড়বে।
মি: ম্যাকাকো ও মিসেস ম্যাকাকো অকল্পনীয় দৃশ্য দেখার বিস্ময়ে অভিভূত। তারা মাসাবার মত অত পত্রপত্রিকা পড়েনি, কিন্তু আহমদ মুসাকে তারা মুসলমানদের কিংবদন্তীর নায়ক হিসেবে জানে।
ফাতেমা মাসাবা নিজেকে সম্বরণ করে মুখ নিচু করে বিনয়ের সাথে জবাব দিল, আপনার যে পরিচয় ইতিমধ্যেই আমরা পেয়েছি, তাতে আপনার নাম আহমদ মুসা হলেই শুধু আপনার পরিচয় যথার্থ হয়।’
মি: ম্যাকাকো এবং মিসেস ম্যাকাকো সোফা থেকে নেমে মেঝের উপর বসল এবং আহমদ মুসার দিকে মাথা ঝুঁকিয়ে বলল, ‘আমাদের সালাম ও শ্রদ্ধা গ্রহণ করুন।’
ফাতেমা মাসাবা ও বালক ইউহোসবিও তাদের আব্বা-আম্মার দেখাদেখি মেঝেতে নেমে বসে আহমদ মুসার দিকে মাথা ঝুঁকিয়ে সালাম করল। তাদের আচরণ দেখে মনে হলো, তারা যেন কোন দেবতাকে ভক্তি নিবেদন করছে।
বিস্মিত আহমদ মুসা বলল, ‘মি: ম্যাকাকো আপনারা একি করছেন? মুসলমানরা তো এভাবে কাউকে সম্মান দেখায় না, আল্লাহ ছাড়া কারো সামনে মাথা নোয়ায় না। আপনারা উঠে বসুন।’
ম্যাকাকো হাতজোড় করে বলল, ‘মহাত্মন, আমাদের মাফ করবেন। সম্মানিত শ্রদ্ধাভাজনদের পাশে বসা বেয়াদবী। তাদের পায়ের আশ্রয় আমাদের মত গুণাগারদের মুক্তির উপায়।’
‘আপনারা না উঠলে আমি মেঝেতে নেমে বসব।’ বলল আহমদ মুসা।
ম্যাকাকো এবং অন্যরা শশব্যস্তে উঠে দাঁড়াল। বলল, ‘আমরা মাফ চাচ্ছি। বেয়াদবী করতে আমাদের বলবেন না।’
কিছুতেই তারা আহমদ মুসার পাশে সোফায় বসল না। চাদর বিছিয়ে মেঝেয় বসল তারা। বলল ম্যাকাকো, ‘একটা কৌতুহল আমাদের পূরণ হয়েছে। এবার আমরা আপনার মিশন এবং এখানকার যা কিছু জানেন সে সব শোনার জন্যে উদগ্রীব জনাব।’
‘বারবারেতির ইসলামী সম্মেলন কেন্দ্রে বিস্ফোরণ ঘটার কথা আপনারা জানেন?’ বলল আহমদ মুসা।
‘জি জানি। বিস্ফোরণে মুসলিম বিশ্বের কয়েক জন নেতা নিহত হয়েছেন।’ ম্যাকাকো বলল।
‘না নিহত হননি। আপনারা ‘ব্ল্যাক ক্রস’ কে চেনেন?’
ম্যাকাকো জবাব দিল না। জবাব এল মাসাবার কাছ থেকে। বলল, ‘আমি শুনেছি ওটা খৃষ্টানদের গোপন সন্ত্রাসবাদী সংগঠন। অত্যন্ত শক্তিশালী এবং হিংস্র।’
‘ব্ল্যাক ক্রস বিস্ফোরণ ঘটিয়ে বারবারেতি ইসলামী সম্মেলন কেন্দ্র ধ্বংস এবং কিডন্যাপ করেছে মুসলিম নেতৃবৃন্দকে।’
‘কিডন্যাপ করেছে? তারা বেঁচে আছেন? বিস্ময় বিস্ফোরিত চোখে বলল ম্যাকাকো। মাসাবার চোখেও বিস্ফোরিত দৃস্টি।
‘ওদের কিডন্যাপ করে এই বোমাসায় পণবন্দী করে রেখেছে।
‘এই বোমাসায়? আমাদের বোমাসায়?’ শুকনো কণ্ঠে বলল ম্যাকাকো। ভয় ও বিস্ময় তাদের আচ্ছন্ন করে ফেলেছে।
‘ব্ল্যাক ক্রস শর্ত দিয়েছে আমি যদি আগামী কালের মধ্যে ওদের হাতে আত্মসমর্পণ করি, তাহলে মুসলিম নেতৃবৃন্দকে ওরা ছেড়ে দেবে। আমি তাদের শর্ত পূরণের জন্যে এখানে এসেছি।’ থামল আহমদ মুসা।
ম্যাকাকো এবং অন্যরা নির্বাক। তাদের অপলক দৃষ্টি আহমদ মুসার উপর নিবদ্ধ।
আহমদ মুসাই কথা বলল আবার, ‘মজার ব্যাপার হলো আপনাদের তিনজনকে যারা উধাও করেছে, আপনাকে যারা কিডন্যাপ করতে এসেছিল তাদের এবং মুসলিম নেতৃবৃন্দকে যেখানে পণবন্দী করে রেখেছে, সেটা একই ঠিকানা।’
‘একই ঠিকানা? বুঝলেন কি করে?’
‘একজন মুখোশধারীর পকেট থেকে যে মুখছেঁড়া ইনভেলাপ পেয়েছি, তাতে বাইবেল সোসাইটির ঠিকানা লেখা আছে। ঐ ঠিকানাতেই বন্দী করে রাখা হয়েছে মুসলিম নেতৃবৃন্দকে।’
‘বাইবেল সোসাইটিতে ওদের বন্দী করে রাখা হয়েছে?’ চোখ কপালে তুলে বলল ম্যাকাকো।
একটু থেমে। একটা ঢোক গিলে বলল, ‘আমাদের তিনজনও সেখানে বন্দী আছে? আমাকে তাহলে ব্ল্যাক ক্রসরা কিডন্যাপ করতে এসেছিল?’
‘আমি যতদূর অনুমান করছি, ওদের সেখানে বন্দী করে রাখা হয়নি, হত্যা করা হয়েছে। আপনাকেও হত্যার উদ্দেশ্যেই কিডন্যাপ করতে এসেছিল।’
এ কাজ ব্ল্যাক ক্রস করেনি। আমার ধারণা, ব্ল্যাক ক্রসের কাজে উৎসাহিত হয়ে এখানকার স্থানীয় খৃষ্টানরাই এখানকার মুসলিম শক্তিকে নেতৃত্ব শূন্য করে মুসলিম সমাজকে ধ্বংস অথবা হাতের মুঠোয় আনার জন্যেই এখানকার শীর্ষ মুসলিম নেতৃবৃন্দকে হত্যার পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে।’
আহমদ মুসা থামলেও ম্যাকাকো কথা বলতে পারলো না। তাদের চোখে ভয়, বিস্ময় ও আতংকের জীবন্ত ছবি।
কিছুক্ষণ পর ধীরে ধীরে ম্যাকাকো বলল, ‘বাইবেল সোসাইটি কখনো আমাদের ভালো চোখে দেখেনি। তবে প্রকাশ্য কোন বিরোধ তাদের সাথে আমাদের ছিল না। কিন্তু সম্প্রতি আমাদের মসজিদের পাশের দুইটি বড়ু টিলা তারা কেনার প্রস্তাব দেয়। টিলা দু’টি মসজিদের। আমরা বিক্রি করতে পারি না। তাছাড়া আমরা জানি ওখানে তারা কমুনিটি হল তৈরী করতে চায়, যা হবে তাদের নাচ গানের কেন্দ্র। আমরা টিলা দুইটি ছাড়তে রাজী হইনি। তারা মনে মনে খুব ক্ষুব্ধ হয়েছে। তারা গোপনে গোপনে প্রচার করছে, অতীত সরকারের দুর্বলতার সুযোগে আমরা অনেক জমি অন্যায়ভাবে দখল করেছি। হতে পারে তারা গোপন কোন ষড়যন্ত্র করছে। আপনি ঠিক বলেছেন, ব্ল্যাক ক্রস হয়তো তাদের সাহস দিয়েছে। আমার মনে হয় সামনে আমাদের দুর্দিন আসছে। আশ-পাশের সব অঞ্চলেই বহু কিছু ঘটেছে। কিন্তু জংগলে লুকানো এই শহরে এতদিন আমরা ভালোই ছিলাম।’ একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস সমেত কথা শেষ করল ম্যাকাকো।
একটু থেমেই ম্যাকাকো তার বিষন্ন দৃষ্টিটা আহমদ মুসার দিকে তুলে বলল, ‘সত্যি বলেছেন, আপনি আত্মসমর্পণ করতে এসেছেন?’
আহমদ মুসা হাসল। বলল, ‘তারা আমার আত্মসমর্পণ চায়, আমি চাই তাদের পরাজয়, আমি চাই তাদের পরাজয় এবং পণবন্দীদের মুক্তি। দেখা যাক, কার চাওয়া পূর্ণ হয়।’
হাসল আহমদ মুসা।
ওরাও কোন কথা বলল না।
আহমদ মুসাই আবার বলল, ‘এখন রাত ৪টা, আমি অল্পক্ষণ রেস্ট নেব। তারপর নামাজ পড়ে আমি সাড়ে ৫টার মধ্যে চলে যাব। আপনাদের সাথে সাক্ষাতের সুযোগ নাও হতে পারে। অতএব আমি এখনই বিদায় নিয়ে রাখতে চাই।’
‘কোথায় যাবেন?’ বিস্মিত কন্ঠে বলল ম্যাকাকো।
‘লিভিংস্টোন রোডে বাইবেল সোসাইটির দিকে।’
‘উদ্ধার অভিযানে?’
‘অভিযান কি বয়ে আনবে আমি জানি না। তবে আমার নিয়ত তো বলছি- আমি চাই ওদের পরাজয় এবং পণবন্দীদের মুক্তি।’
‘কিন্তু আপনি একা যাবেন কেন?’ লড়াই করার মতো সক্ষম যুবক আমাদের আছে কমপক্ষে পাঁচশত। দরকার হলে তারা সবাই যাবে আপনার সাথে।’
‘না মিঃ ম্যাকাকো। এভাবে গেলে যুদ্ধ হবে, কিন্তু পণবন্দীদের বাঁচানো যাবে না। তাছাড়া আমি চাই না, এখানকার জনপদ স্থায়ী এক আঞ্চলিক সংঘাতে জড়িয়ে পড়ুক। আমি মনে করি, আপনার চাওয়া ঠিক নয়।’
‘আপনার কথায় যুক্তি আছে। কিন্তু এ প্রয়োজনের চেয়ে বড়?’
‘যুক্তিটা একটা প্রয়োজনকে বিবেচনা করেই। যাক, বিষয়টা নিয়ে হৈ চৈ করা যাবে না। অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ মানুষের জীবনের প্রশ্ন এর সাথে জড়িত। আপনি একটা সাহায্য করতে পারেন?’
‘কী সেটা?’
‘বাইবেল সোসাইটির অবস্থান? কত বড়? কতগুলো ঘর? মাটির তলে ঘর আছে কিনা? ঢোকার ও বের হওয়ার কতগুলো পথ? সোসাইটিতে কত লোক থাকে? ইত্যাদি বিষয়ে যদি কিছু জানতে পারতাম।’
‘কিছু সাহায্য করতে পারব। আমাদের নতুন মসজিদ বিল্ডিং যে ইঞ্জিনিয়ার করেছেন, সে ইঞ্জিনিয়ারই করেছিলেন সোসাইটি কমপ্লেক্স। তিনি সোসাইটির ডিজাইন আমাদের দেখিয়েছিলেন। মাটির তলায় কোন ঘর সোসাইটির নেই।’
তারপর ম্যাকাকো সোসাইটি কমপ্লেক্সের গোটা বিবরণ দিয়ে বলল, ‘সোসাইটিতে বিশ পঁচিশ জন লোক সবসময় থাকে। আবাসিক অংশের হিসাব ধরলে সংখ্যা পঞ্চাশটিতে দাঁড়াবে।’
‘ধন্যবাদ আপনার এই সাহায্য আমাকে বিরাট উপকার করবে।’
বলে আহমদ মুসা উঠার অনুমতি চাইল।
সবাই উঠে দাঁড়াল।
উঠে দাঁড়িয়ে ম্যাকাকো বলল, ‘আমি প্রস্তুত থাকবো। আমি আপনাকে লিভিংস্টোন রোডে পৌছে দেব। এটুকুর অনুমতি নিশ্চয়ই পাব।’
আহমদ মুসা হেসে বলল, ‘ঠিক আছে।’
বলে আহমদ মুসা সালাম দিয়ে নিজের ঘরের দিকে পা বাড়াল।
সকাল ৮টা তখন।
বেলাল ম্যাকাকো আহমদ মুসাকে লিভিংস্টোন রোডে পৌছে দিয়ে বাসায় ফিরে ড্রয়িং রুমে সোফায় গা এলিয়ে দিল।
চা নিয়ে ড্রয়িং রুমে প্রবেশ করল মিসেস ম্যাকাকো। তার পিছনে ফাতেমা মাসাবা এবং রাশিদ ইউহোসবি।
ম্যাকাকোর চা ঢালতে ঢালতে মিসেস ম্যাকাকো বলল, ‘শত্রু পুরীতে ওঁকে একা একা রেখে এলে, কেমন লাগছে বলতো?’
‘সবই তো শুনেছ, ওঁর কথার উপর কি আমরা কথা বলতে পারি।’
‘সামনের ঘটনাগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এস, আমরা তাঁর জন্য দোয়া করি। উনি অনেক ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন, আজও যেন এক ইতিহাস সৃষ্টি করেন তিনি। ব্ল্যাক ক্রস-এর ঘাঁটি মানে হাজারো সাপের আস্তানা। আল্লাহ তাঁকে জয়ী করুন।’ বলল ফাতেমা মাসাবা। কলিংবেল বেজে উঠল।
‘মাসাবা, দেখতো মা কে এল।’ বলল ম্যাকাকো।
মাসাবা উঠে গেল কয়েক মহুর্ত পর দৌড়ে ফিরে এল। ফিস ফিস করে বলল, ‘আব্বা পুলিশ সুপার উপাংগো এসেছেন।’
‘পুলিশ সুপার উপাংগো? কেন?’ ভয়ের সুর ম্যাকাকোর কন্ঠে। হঠাৎ করেই তার মুখ শুকিয়ে গেল। রাতের কথা মনে পড়ল। পুলিশ কি সব জানতে পেরেছে? পুলিশকে জানিয়েছে কি কেউ? পুলিশ কি গ্রেফতার করতে এসেছে তাকে?’
অন্যান্যদের কেও ওই একই ভয় পীড়িত করছে? কিন্তু বসে থাকা যায় না, ভাবল ম্যাকাকো। উঠে দাঁড়িয়ে এগুলো বাইরের ঘরের দিকে। মনে মনে সাহস করল, পুলিশ উপাংগো তার অনেক দিনের পরিচিত, দেখা যাক কি হয়।
দুরু দুরু বুকে যথাসম্ভব স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করে দরজা খুলল ম্যাকাকো।
‘আসসালামুআলাইকুম, মিঃ ম্যাকাকো।’ দরজা খুলতেই সহাস্যে বলে উঠল উপাংগো।
উপাংগো নিজের গোত্র ধর্ম অনুসরণ করে। কিন্তু কার্যত তার কোন ধর্মই নেই। যে ধর্মের লোকের সাথে তার দেখা হয়, সেই ধর্মের কালচার সে অনুসরণ করে। তার বক্তব্য হল, এতে নাকি সবারই আপন হওয়া যায়।
উত্তরে সালাম জানিয়ে ম্যাকাকো বলল, ‘কি খবর উপাংগো?’
ম্যাকাকো দেখল উপাংগোর সাথে আরও দু’জন লোক। ঐ দু’জনও কৃষ্ঞাংগ।
‘এসেছি, তোমার কিছু সাহায্য প্রয়োজন।’
ম্যাকাকোর বুক থেকে একটা ভারী পাথর নেমে গেল। নিশ্চিত হলো উপাংগো তাকে গ্রেফতার করতে আসেনি।
হাসিমুখে বলল ম্যাকাকো, ‘তোমার সাথী দুজনকেই তো চিনলাম না।’
‘পরিচয় দেব। আগে বসতে তো দাও।’
‘দুঃখিত। এস ভেতরে।’
সবাইকে নিয়ে ম্যাকাকো ড্রয়িং রুমে এসে বসল।
‘ম্যাকাকো, খুবই একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজে এসেছি। যার সাথে তোমার স্বার্থও জড়িত রয়েছে। কিন্তু সে কথার দিকে যাওয়ার আগে এদের পরিচয় করিয়ে দেই।’
বলে উপাংগো তার পাশে বসা লোকটার দিকে ইংগিত করে বলল, ইনি সলো’র পুলিশ সুপার জাগুয়াস ম্যাকা। আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। আমরা একই সাথে ট্রেনিং নিয়েছি ফ্রান্সে।’
তারপর দ্বিতীয় লোকটির দিকে ইংগিত করে বলল, ‘উনি আবদুল্লাহ যায়দ রাশিদী। উনি এসেছেন ক্যামেরুন থেকে।’
বলেই একটু থেমে আবার বলল, তাঁর আরেকটা পরিচয় আছে। তিনি আমাদের হুজুর সুলতান যায়দ রাশিদীর নাতি।
‘আমাদের হুজুর সুলতানের নাতি?বলে ম্যাকাকো ছুটে গিয়ে আবদুল্লাহ যায়েদ রাশদীর পায়ের কাছে উপুড় হয়ে চুমু খেল ব্ল্যাক বুল ওরফে যায়দ রাশদীর পায়ে।
দ্রুত ঘটে গেল ঘটনা।
সংকুচিত হয়ে দাঁড়াল ব্ল্যাক বুল। বলল, ‘একি করছেন আপনি। আমি আপনার অনেক ছোট। আমাকে অপরাধী করবেন না।’
‘কি বলেন হুজুর! আপনি আমাদের সুলতানজাদা। আমাদের হুজুর।’
‘আপনি আমাদের দোয়া করুন।’ বলল ম্যাকাকো।
‘ঠিক আছে, তুমি বস ম্যাকাকো। আমার জরুরী কথাটা সেরে নেই।’
ম্যাকাকো উঠে দাঁড়াল। একটা চেয়ার নিয়ে এসে সোফার পিছনে বসল।’পিছনে বসলেন কেন?’ বলল জাগুয়াস ম্যাকা।
‘থাক ম্যাকা ও হুজুরজাদার সাথে সোফায় বসবে না।’ বলল উপাংগো।
বলে একটু থামল উপাংগো।একটু ভাবল। তারপর বলল, ‘ম্যাকাকো, আমাদের হুজুরজাদা আব্দুল্লাহ জায়দ রাশিদী একজন সম্মানিত সাথীসহ মধ্য আফ্রিকা প্রজাতন্ত্রে আসছিলেন। কিন্তু পথে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন তার সাথী। তিনি এসেছেন বোমাসায়। তিনি এখানে এলে মুসলিম সংগঠনের সাথে যোগাযোগ করতে পারেন। তাই……………..’
এ সময় ড্রইং রুমের দরজা ঠেলে প্রবেশকরল ব্ল্যাক বুলের কুকুর দু’টি। ছুটে এল সোফার দিকে।
‘ভুল হয়েছে গাড়ির দরজা আলগা রেখে আসায় সুযোগ পেয়ে ছুটে এসেছে। ‘বলল কথা থামিয়ে উপাংগো।
ব্ল্যাক বুল কুকুর দু’টিকে কাছে ডাকল।
কিন্তু সেদিকে কোন ভ্রুক্ষেপই করল না। অস্থিরভাবে কুকুর দু’টি সোফায় বিশেষ স্থান শুঁকতে লাগল। তারপর মাটি শুকতে শুকতে কুকুর দু’টি বাড়ির ভেতরে ঢুকে গেল।
‘দেখছি।’ বলে উঠে গেল ম্যাককো। কয়েক মুহূর্ত পরে ফিরে এসে বলল, ‘আমাদের মেহমান খানায় প্রবেশ করেছে।’
জাগুয়াস ম্যাকা তাকাল উপাংগোর দিকে। উপাংগো হাসল এবং ম্যাকাকোর দিকে চেয়ে বলল, ‘আমাদের হুজুরজাদার সাথীর সন্ধান আমরা পেয়ে গেছি ম্যাকাকো।’
‘তোমার ঘরে।’ বলল উপাংগো।
‘বুঝতে পারলাম না।’ চোখ কপালে তুলে বলল ম্যাককো।
উপাংগোর মুখে নেমে এল গাম্ভীর্য। বলল, ‘তোমার এখানে কেউ একজন ছিলেন বা আছেন তিনিই আমাদের হুজুর জাদার সাথী। তাকে খুঁজতেই আমরা এসেছি।’
ম্যাকাকোও গম্ভীর হয়ে উঠেছে। বলল, ‘তার নাম কি বলত।’
‘আহমদ মুসা।’
জাগুয়াস ম্যাকা এবং ব্ল্যাক বুল উদ্বেগ আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছে ম্যাকাকোর দিকে। তাদের আকাঙ্খা ম্যাকাকো বলুক যে আহমদ মুসা এসেছেন। তাদের তখন আশঙ্কা কুকুর ভুলও তো করতে পারে।
অন্যদিকে ম্যাকাকো ভাবছে, উপাংগো পুলিশ হলেও হুজুরজাদাকে সাথে নিয়ে এসেছে সুতরাং সে আহমদ মুসার পক্ষের শক্তিই হবে। ম্যাকাকোর মনে একটা আনন্দ ঝিলিক দিয়ে উঠল আহমদ মুসার কঠিন কাজে উপাংগো সহযোগিতা করতে পারে। ম্যাকাকোর মনে হলো, আল্লাহই এ সময়ে ওদেরকে নিয়ে এসেছেন। এখন তাকে সাহায্যের জরুরী সময়।
ম্যাকাকো উপাংগোর সাথে হ্যান্ডশেক করে বলল, তুমি ঠিক বলেছ। আহমদ মুসা এখানে এসেছিলেন। কিন্তু চলে গেছেন উনি।’
`কোথায় গেছেন?’
‘পণবন্দী উদ্ধারের অভিযানে।’
ব্ল্যাক বুল, জাগুয়াস ম্যাকার চোখ উত্তেজনায় বড় বড় হয়ে উঠেছে।
বলল ব্ল্যাক বুল, ‘চলে গেছেন?।’
‘চলে গেছেন।’
‘ঠিকানা জানেন?’ বলল উপাংগো।
‘জানি।’ বলে ঠিকানাটা বলল ম্যাকাকো।
‘ক’টায় গেছেন?’ বলল উপাংগো।
‘সাড়ে পাঁচটায়। আমি গিয়ে লিভিংষ্টোন রোডে ওঁকে পৌছে দিয়ে এসেছি। ঐ রোডে আমরা পৌছেছিলাম সাড়ে ছয়টায়।’ উঠে দাঁড়াল উপাংগো। বলল জাগুয়াস ম্যাকাকে লক্ষ্য করে, ‘চল, পুলিশ ফোর্স নিয়ে ওখানে এখনি যেতে হবে।’
‘নিতে পারবে তুমি তোমার পুলিশ ফোর্স?’ বলল ম্যাকা।
‘পারব না কেন? খবর পেয়েছি কিছু লোককে বেআইনি আটক রাখা হয়েছে। তাদেরকে উদ্ধার করতে গিয়ে উদ্ধার করলাম বিস্ফোরনে মৃত বলে ঘোষিত মুসলিম বিশ্বের কয়েকজন শীর্ষ নেতৃত্বকে।
আপনারা ফিরে পেলেন আপনাদের নেতাদের, আমি আমি বিশ্ববিখ্যাত হয়ে যাব রাতারাতি। চল, আর দেরী নয়।’ সবাই উঠে দাঁড়াল।
উঠে দাঁড়াল বেলাল ম্যাকাকোও। বলল, এই ঐতিহাসিক অভিযানে আমি তোমাদের সাথী হতে পারি?’
‘পার। কিন্তু তোমার জন্যে দেরী করতে পারব না, সিংহের গুহায় গিয়ে আহমদ মুসার কি অবস্থা হয়েছে কে জানে! সবাই যদি শেষ হয়ে যায়, কাকে আর তাহলে আমরা উদ্ধার করব?’
বলে উপাংগো হাঁটা শুরু করল। ব্ল্যাক বুল এবং জাগুয়াস ম্যাকা তার পিছু পিছু চলল।
একটু পরে বেলাল ম্যাকাকো ছুটে এসে তাদের সাথী হলো।
ওয়ারলেসে উপাংগো তার সহকারীকে নির্দেশ দিল কয়েক প্লাটুন পুলিশ নিয়ে বাইবেল সোসাইটির সামনে আসতে। তারপর ষ্টার্ট দিলো গাড়িতে।
গাড়ি ছুটে চলল ব্ল্যাক ক্রস- এর মাবোইডিং বন্দীখানার দিকে।

সাইমুম সিরিজের পরবর্তী বই
অদৃশ্য আতংক

Top