২১. কঙ্গোর কালো বুকে

চ্যাপ্টার

যায়দ রাশিদীর লুকানো বাক্স থেকে সোনার যে মোহর বের হলো তার পরিমাণ দাঁড়ালো এক কোটি ডলার। ক্যামেরুনের টাকায় যার পরিমাণ হয় ৩০০ কোটি ফ্রাঙ্ক।
তিনশ’ কোটি ফ্রাঙ্ক মূল্যের সোনার মোহরের স্তুপের দিকে বিস্ময়ের দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রাশিদী ইয়েসুগো, মুহাম্মদ ইয়েকিনি, ব্ল্যাক বুল এবং অন্যান্যরা।
‘আমার একটা বিস্ময় কিন্তু যায়নি।’ মোহরের দিক থেকে চোখ ঘুরিয়ে আহমদ মুসার দিকে চেয়ে বলল রাশিদী ইয়েসুগো।
‘কী?’ বলল আহমদ মুসা।
‘ডায়েরীতে লুকানো বাক্সের যে সংকেত আছে, তা আমি দেখেছি। কিন্তু আমি কিছু বুঝিনি। আপনি কি করে জায়গাটা ঠিক ঠিক চিহ্নিত করে ফেললেন?’
‘এ জিজ্ঞাসা আমারও মনে।’ বলল ব্ল্যাক বুল।
‘ব্যাপারটা খুবই সহজ ছিল। পাখির বাসা বলতে বুঝানো হয়েছে যায়দ রাশিদীর বাড়ী, মৃত পাখির বাসা বলতে বুঝানো হয়েছে যায়দ রাশিদীর সমাধিকে। আর মোহর ভর্তি বাক্স হলো মৃত পাখির মুখের গোলাপ ফুল। সুতারাং বুঝতেই পারছ, সংকেতের মধ্যে কোন জটিলতা ছিলনা।’
‘এখন কোন জটিলতা দেখছি না, তবে পাখিকে যায়দ রাশিদী, পাখির বাসাকে তার বাড়ি, মৃত পাখির অবস্থান কে সমাধি এবং গোলাপ ফুলকে লুকানো ধন কল্পনা করা হাজার চেষ্টা করেও পারতাম না।’ বলল রাশিদী ইয়েসুগো।
‘থাক, এসব কথা। এখন বল, এই টাকা নিয়ে কী চিন্তা করছ?’
‘কেন যায়েদ রাশিদীর উইল অনুসারে এ টাকার মালিক আপনি।’
‘আচ্ছা ঠিক আছে, টাকার মালিক আমি হলে এ টাকা আমি তোমাদের দিয়ে দিলাম। এখন বল এ টাকা তোমরা কি করবে?’
‘আমরা জানিনা, আপনিই বলুন এ টাকা দিয়ে আমরা কি করব?’
‘ফ্রান্সিস বাইকের কাছ থেকে যে সম্পত্তি ফেরত পাওয়া গেছে তার সাথে যায়দ রাশিদীর বাড়িও আছে। এ টাকার একটা অংশ দিয়ে ঐ বাড়িটাকে পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে আনতে হবে। ব্ল্যাক বুলের নামে বাড়িটা কেনা হয়েছে সে, বাড়িটার মালিক থাকবে। আর…’
আহমদ মুসার কথার মাঝখানে ব্ল্যাক বুল বলে উঠল, ‘কিন্তু আমি মনে করি যায়দ রাশদীর এই সম্পত্তির মালিক হওয়ার যোগ্যতা আমার নেই। বাড়িটার একজন সেবক হতে পারলেই আমি খুশি হবো। আমি….’
আহমদ মুসা তাকে বাধা দিয়ে বলল, ‘ঠিক আছে, তোমার কথা আমরা বুঝেছি। শুনে রাখ, সন্তান অযোগ্য হলেই সে তার উত্তরাধিকার হারায় না।’
বলে একটু থামল আহমদ মুসা, তারপর আবার শুরু করল, ‘অবশিষ্ট টাকা ক্যামেরুন ক্রিসেন্ট পাবে। ক্যামেরুন ক্রিসেন্ট এই টাকা ইসলাম প্রচার এবং মানুষের সেবায় ব্যয় করবে। জাগতিক ও ইসলামী শিক্ষার প্রসার এবং দারিদ্র্য বিমোচন- এই লক্ষ্যে যদি ক্যামেরুন ক্রিসেন্ট কাজ করতে পারে, তাহলে পশ্চিম আফ্রিকায় এনজিও দের ষড়যন্ত্র বানচাল করে তোমরা ইসলামের আলো নতুন করে এ অঞ্চলে প্রজ্জ্বলিত করতে পারবে।’
‘ধন্যবাদ আহমদ মুসা ভাই। আপনি যে কাজের প্রস্তাব করেছেন সেটাই আমাদের আসল কাজ হওয়া উচিত। কিন্তু এই সাথে আমার কথা হলো আপনি বিশ্বব্যাপী কাজ করছেন। যায়দ রাশিদীর টাকার একটা অংশ যদি আপনার কেন্দ্রীয় তহবিলে যায়, তাতে আমি মনে করি তার পূন্য আরও বেশী হবে।’ বলল রাশিদী।
হাসল আহমদ মুসা, ‘বলল, আমার কোন কেন্দ্র নেই, কেন্দ্রীয় অফিসও নেই, কেন্দ্রীয় তহবিলও নেই। আমি যখন যেখানে থাকি সেটাই, আমার কেন্দ্র। সে কেন্দ্র্র থেকেই আমার খরচ চলে। সুতরাং আমার কোন তহবিল দরকার নেই।’
রাশিদী ইয়েসুগো নাছোড়বান্দা। বলল, ‘ইসলামের বিশ্বব্যাপী যে কাজ হচ্ছে, তার তো একটি কেন্দ্রীয় তহবিল আছে। যেমন ধরুন ‘সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিক’ -এর বারবারেতি শহরে আন্তর্জাতিক সম্মেলন হচ্ছে। সেখানে বিশ্বের মুসলমানদের সবচেয়ে সক্রিয় ও শক্তিশালী সংগঠন ওয়ার্ল্ড মুসলিম কংগ্রেস-এর প্রধানসহ বিশ্ব বরেণ্য অনেক মুসলিম নেতা এসেছেন। এসব কাজে তো বিরাট খরচ। যায়দ রাশিদীর অর্থের একটা অংশ যদি এসব কাজে খরচ হয়, তিনি অনেক বেশী পূণ্য পাবেন।’ বলল রাশিদী ইয়েসুগো।
‘তুমি ঠিকই বলেছ। ‘বারবারেতি’ শহরে ‘ডার্ক আফ্রিকা ব্রাইট হার্ট’ -এর উদ্যোগে ‘আফ্রিকা এবং ইসলাম’ বিষয়ের উপর যে আন্তর্জাতিক সেমিনার হচ্ছে, তার জন্যে যদি অর্থের প্রয়োজন হতো তাহলে আমি তোমার কথা মেনে নিতাম। আসলে ‘ডার্ক আফ্রিকা ব্রাইট হার্ট’ আফ্রিকায় ‘ওয়ার্ল্ড মুসলিম কংগ্রেস’ পরিচালিত একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন। তাদের যাবতীয় খরচ ‘ওয়ার্ল্ড মুসলিম কংগ্রেস’ বহন করে থাকে। তবু তোমরা চাইলে তাকে সাহয্য করা যাবে। কিন্তু এ জন্য এখনই বাজেটের প্রয়োজন নেই। আমি ওদের সাথে কথা বলে সে ব্যবস্থা করব।’
‘আপনার তো বিরাট খরচ। আপনি কি আপনার এ টাকা থেকে কিছুই নিতে পারেন না?’ মুখ ভার করে বলল রাশিদী ইয়েসুগো।
আহমদ মুসা হাসল। রাশিদীর পিঠ চাপড়ে বলল, ‘মন খারাপ করছ কেন? সত্যিই আমার প্রয়োজন নেই। এই যে আমি তোমাদের এখানে এসেছি, কোন খরচ আমাকে তোমরা করতে দিয়েছ? এর বাইরে যে টাকা আমার প্রয়োজন তার ব্যবস্থা আছে। ফিলিস্তিন সরকার ‘আল জাজিরা ব্যাংক ইন্টারন্যাশনাল’-এর একটা ‘কোডেড ক্রেডিট নাম্বার’ আমাকে দিয়েছে। আমি পৃথিবীর যে কোন ব্যাংকে গিয়ে এই নাম্বার দিয়ে টাকার যে কোন অংক চাইলে দিয়ে দিবে। দরকার পড়লে এই নাম্বার আমি ব্যাবহার করি। ঠিক আছে? এবার খুশী?’
হাসল রাশিদী। বলল ‘ঐ নাম্বার যে কেউ ব্যাংককে দিলে টাকা দিয়ে দিবে?’
‘হ্যাঁ।’
‘তাহলে আমিও তো ঐ নাম্বার দিয়ে টাকা তুলতে পারি।’ বলল রাশিদী।
‘নাম্বার পাবে কোথায়?’
‘আপনি দেবেন।’ বলল রাশিদী।
‘এ ধরনের নাম্বার যাকে দেয়া হয়, সে যদি কাউকে এটা জানায়, তাহলে সেদিন সে এটা ব্যাবহারের অধিকার হারায়।’
‘বুঝলাম। দায়িত্বটা এরকম না হলে সুযোগটা অতবড় হতো না। কিন্তু একটা প্রশ্ন, ব্যাংক তো কোডেড নাম্বারটা জানতে পারে, তারা যদি এটা অন্যকে জানিয়ে দেয় বা নিজেরা ব্যবহার করে?’ বলল রাশিদী।
‘না পারবে না কোডেড নাম্বার এর সাথে একটা সিরিয়াল সংকেত আছে। এই সংকেত প্রত্যেকবার পৃথক হয় এবং সিরিয়াল অনুসারে হয়, যেভাবে আল জাজিরা ব্যাংক ইন্টারন্যাশনাল-এর রেকর্ডে সংরক্ষিত আছে।’
‘কিন্তু এ ব্যাপারটা তো স্থানীয় এবং বিভিন্ন ব্যাংকের জানার কথা নয়, তারা যদি ভূল করে টাকা দিয়ে দেয়?’ বলল রাশিদী।
‘প্রত্যেক ব্যাংকের কম্পিউটারের পেমেন্ট সেকশনে ইন্টারন্যাশনাল কাউন্টার আছে। যেসব আন্তর্জাতিক ব্যাংক ক্রেডিট কার্ড ও কোডেড নাম্বার-এ পেমেন্ট করে, তারা সবসময় প্রতি মহুর্তে কম্পিউটারের ইন্টারন্যাশনাল পেমেন্ট কাউন্টারে আপ টু-ডেট-রাখে। সুতরাং যখনি কেউ কোডেড নাম্বার ব্যাংকে দেয়, তখন তারা সেটা কম্পিউটারে প্রবেশ করায়। পেমেন্ট সেকশনের ইন্টারন্যাশনাল কাউন্টার থেকে গ্রীন সিগনাল পেলেই তবেই তারা পেমেন্ট করে।’
‘বাঃ চমৎকার ব্যবস্থা।’ বলল রাশিদী।
রাশিদী থামতেই মুহাম্মদ ইয়েকিনি বলল, ‘আমার ভিন্ন একটা প্রশ্ন, এত বড় এবং গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক সেমিনার বারবারেতি শহরে অনুষ্ঠিত হচ্ছে কেন?’
‘হতে পারেনা কেন মনে করছ?’ বলল আহমদ মুসা।
‘জায়গাটা তেমন খ্যাতনামা নয়। মুসলিম স্বার্থের উপস্থিতির দিক দিয়েও গুরুত্বপূর্ণ নয়।’ বলল মুহাম্মদ ইয়েকিনি।
আহমদ মুসা হাসল। বলল, তুমি ঠিকই বলেছ। জায়গাটা বিখ্যাত এবং মুসলিম স্বার্থের দিক দিয়ে গুরুত্বপূর্ণও নয়। কিন্তু নতুন নতুন জায়গাতেই তো ইসলাম যাবার কথা। অন্ধকারেই তো আলোর আগমন বেশী প্রয়োজন।’
থামল একটু আহমদ মুসা। একটু গম্ভীর হয়ে উঠল তার মুখ। বলল, ‘একটা ঘটনা এবং একটা স্মৃতি সেন্ট্রাল আফ্রিাকান রিপাবলিকের এই বারবারেতিকে স্মরণীয় করে রেখেছে। প্রায় দু’শ বছর আগে সংঘ নদী তীরের ঐ বারবারেতিতে আকস্মিকভাবে উদয় হয়েছিলেন সুলতানুল আউলিয়া আহমদ বিন আহমদ আবদুর রহমান। উদয় হয়েছিলেন বলা হয় এ জন্যই যে, উনি কিভাবে কোথেকে এসেছিলেন, কেউ বলতে পারেনা। কেউ বলে মালি, নাইজেরিয়া ও ক্যামেরুন হয়ে মধ্য আফ্রিকা প্রজাতন্ত্রের এই দুর্গম স্থানে তিনি এসেছিলেন, কারো মতে সুদান থেকে মধ্য আফ্রিকা প্রজাতন্ত্রে তিনি প্রবেশ করেছিলেন, কেউ মনে করেন সোমালিয়া, কেনিয়া, উগান্ডা ও জায়ার হয়ে এখানে তিনি এসেছিলেন। আবার কেউ বলেন, তিনি বাঁশের ভেলায় চড়ে কংগো নদী হয়ে সংঘ নদী পথে বারবারেতি এসেছিলেন। সত্য যেটাই হোক ঘোর এক দুর্দিনে বারবারেতির মানুষ স্বর্গের সাহায্য রূপে তাকে দেখতে পেয়েছিল।“কথিত আছে, একদিন ভোরে ইউরোপীয় দাস ব্যাবসায়ীরা একটা স্টীম বোটে করে বারবারেতি এলাকায় প্রায় দেড় শ’ যুবককে ধরে নিয়ে যাচ্ছিল। ইউরোপীয়দের গুলি বৃষ্টিরে মুখে যুবকদের আত্মীয় স্বজনরা নদীর তীরে গড়াগড়ি দিয়ে আহাজারি করছিল। তারা বিস্ময়ের সাথে দেখল নদীর তীরে দাঁড়ানো বাঁশের ভেলায় বসে ধ্যানরত একজন সৌম্যমূর্তি বৃদ্ধ উঠে দাড়ালো এবং দরাজ কণ্ঠে স্টিম বোটকে থামার নির্দেশ দিল। বোট থামল না। বৃদ্ধ তাঁর ডান হাত ঊর্ধ্বে উত্তোলন করল। সঙ্গে সঙ্গে বোট সব শক্তি হারিয়ে নিশ্চল হয়ে গেল। ইউরোপীয়দের বন্দুকগুলো তাক করল বৃদ্ধকে। কিন্তু বন্দুকগুলো থেকে ধোয়া বেরুল, শব্দ হলো, গুলি বেরুল বটে, কিন্তু গুলিগুলো ঝরে পড়ল বৃদ্ধের দেহ থেকে। বৃদ্ধ হাত দিয়ে ইঙ্গিত করল বোটটিকে কূলে ভেড়ার জন্য। ইঞ্জিন স্টার্ট হওয়া ছাড়াই নিঃশব্দে বোটটি কূলে এসে ভিড়ল। বৃদ্ধ তাঁর সেই দরাজ গলায় ইউরোপীয়দের তাদের বন্দুকগুলো নদীর তীরে ফেলে দিতে বলল এবং বন্দীদের ছেড়ে দিতে নির্দেশ দিল। ইউরোপীয়রা পাথরের মত হয়ে গিয়েছিল। তারা পুতুলের মত হুকুম পালন করল। বারবারেতির দেড়শ’ বন্দী মুক্তি পেয়ে তীরে নেমে এল। এরপর বৃদ্ধ ইউরোপীয়দের চলে যাবার নির্দেশ দিল এবং সাবধান করেদিল আর যেন দাস ব্যবসায় তারা না করে।
স্টার্ট নিয়ে বোট চলে গেল।
বৃদ্ধটি বাঁশের ভেলা থেকে ধীরে ধীরে তীরে নেমে এল। বারবারেতির সকল মানুষ তাঁর সামনে উপুড় হয়ে পড়ল। তারা মনে করল স্বয়ং ঈশ্বর মানুষের রূপ ধরে তাদের সামনে এসেছে। কিন্ত বৃদ্ধ ‘অমানুষ’ নামে অভিহিত কালো মানুষগুলোকে পা থেকে বুকে টেনে তুলল। জড়িয়ে নিল বুকে।
যা হোক, বৃদ্ধ আহমদ বিন আব্দুর রহমান বারবারেতিতেই তাঁর নিবাস বানাল। তিনি আসার পর দাস সংগ্রহের আর কোন হামলা বারবারেতিতে হয় নি।
চারিদিকে নাম ছড়িয়ে পড়ল বৃদ্ধের। ঈশ্বরের সাক্ষাৎ প্রতিভু হয়েও তিনি মাটির মানুষ, প্রাণের মানুষ। দাস ব্যবসায় তিনি আসায় বন্ধ হয়ে গেছে। অন্যায়-অশান্তি ও হানাহানিও তিনি কমিয়ে দিয়েছেন। এই কাহিনী আমি পড়েছি পশ্চিমি পরিব্রাজকের এক বইতে। তিনি স্থানীয় ভাষায় লিখিত একটা পুস্তিকার বরাত দিয়ে এই কাহিনী লিখেছেন।
বৃদ্ধ আহমদ বিন আব্দুর রহমান বারবারেতিতে জ্বালালেন ইসলামের আলো। ইসলাম প্রচারের এক কেন্দ্র হয়ে দাঁড়ালো বারবারেতি।
বারবারেতিকে কেন তিনি বেছে নিয়েছিলেন?
সেই সময়ের আফ্রিকার অবস্থার দিকে যদি তাকাই তাহলে দেখব বারবারেতি আলো এবং অন্ধকারের মাঝে একই সীমারেখা। নাইজেরিয়া থেকে যে রাস্তা উত্তর ক্যামেরুন হয়ে দক্ষিণে অগ্রসর হয়েছিল, তা বারবারেতি এসে থেমে গিয়েছিল। এর দক্ষিণে বাইরের কোন কাফেল তখনও পা রাখেনি। বারবারেতির পশ্চিমে দক্ষিণ ক্যামেরুন তখন মুসলিম শূন্য, আর বারবারেতির পুবে মধ্য আফ্রিকা প্রজাতন্ত্রের দক্ষিণাঞ্চলও তখন কোন মুসলিমের পদচারণায় ধন্য হয়নি। আর দক্ষিণে অবস্থিত কংগো,গ্যাবন, জায়ার তো তখন একেবারেই তিমির অন্ধকারে ঢাকা। মানুষ এবং পশু তখন সে অঞ্চলে একাকার।
এই বিশাল জমাট অন্ধকারের প্রান্তে দাঁড়ানো বারবারেতি ছিল সোনালী সিংহদ্বারের মত। সেখান থেকে উত্তরের সাথে স্থল পথে যোগাযোগ করা যায়, আর অন্ধকার দক্ষিণের সাথে সংযোগ গড়ে তোলা যায় নদী পথে। অন্ধকারের সোনালী সিংহদ্বার এই বারবারেতিকে কেন্দ্র করে বৃদ্ধ আহমদ বিন আব্দুর রহমান অন্ধকার দক্ষিণে ইসলামের আলো ছড়িয়ে দিয়েছিলেন।
এই হলো বারবারেতির স্মৃতি।
আর যে ঘটনার কথা বলেছি, বারবারেতির সেই ঘটনা হলোঃ
আহমদ বিন আব্দুর রহমান স্থানীয় জনগণের পাশে থাকতে গিয়ে এবং ইসলাম প্রচারের কারণে পশ্চিমী খৃষ্টান মিশনারী এবং উদীয়মান ফরাসী ঔপনিবেশিক শক্তির শত্রুতে পরিণত হয়েছিলেন। ঠিক এই সময়ি আহমদ বিন আব্দুর রহমান বারবারেতিতে একটা আন্তর্জাতিক ইসলামী সম্মেলনের আয়োজন করেছিলেন। এ সম্মেলনে তুরস্কের ওসমানিয়া খেলাফতের প্রতিনিধি ও মিসরের গ্র্যান্ড মুফতিসহ মালি খিলাফত, নাইজেরিয়া সালতানাত এবং উত্তর ক্যামেরুনের ইয়েসুগো সুলতানের প্রতিনিধিকে দাওয়াত দেয়া হয়েছিল। এই মহামান্য মেহমানদের এনে আহমদ বিন আব্দুর রহমান তিমিত অন্ধকারে ঢাকা এক আফ্রিকাকে দেখাতে চেয়েছিলেন এবং বলতে চেয়েছিলেন এই অন্ধকারের বাসিন্দাদের প্রতি তাদের দায়িত্বের কথা।
কিন্তু তাঁর এ ইচ্ছা পূরণ হয়নি। সম্মেলনের চারদিন আগে এক রাতে সম্মেলন কেন্দ্রে যখন তিনি কর্মরত ছিলেন, তখন এক অগ্নিকাণ্ডে সম্মেলন কেন্দ্রে ভস্মীভূত হয় এবং তিনি নিহত হন। অগ্নিদগ্ধ আহমদ বিন আব্দুর রহমানের পৃষ্ঠদেশে গভীর ছুরিকাঘাতের চিহ্ন ছিল। স্থানীয় মুসলিমরা মনে করত, খৃষ্টান মিশনারী ও ঔপনিবেশিকরা যোগসাজস করে তাঁকে হত্যা করেছে এবং সম্মেলন পণ্ড করেছে। আর স্থানীয় অন্যান্য অধিবাসীরা বিশ্বাস করত, দাস ব্যবসায়ী শয়তানরা হত্যা করেছে তাদের স্বর্গীয় পিতাকে। এক মাস ধরে শোক পালন করেছে স্থানীয় অধিবাসীরা। তাঁর নিহত হবার দিনকে স্থানীয় অধিবাসীরা শোক দিবস হিসেবে পালন করে আসছে গত দু’শ বছর ধরে।
এই বারবারেতি শহরেই ‘ডার্ক আফ্রিকা ব্রাইট হার্ট’- এর উদ্যাগে আন্তর্জাতিক ইসলামী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। বলা যায়, দু’শ বছর আগের একটা অসমাপ্ত কাজ আজ সমাপ্ত হচ্ছে। এখন বল ইয়েকিনি, জায়গাটার সিলেকশন ঠিক হয়েছে কিনা?’
আহমদ মুসার কথা গোগ্রাসে গিলছিল ইয়েকিনি রাশিদীরা।
আহমদ মুসার প্রশ্ন শুনে হাসল ইয়েকিনি। বলল, ‘কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু এত কথা আপনি জানলেন কি করে?’
‘ঠিক। আমরা আহমদ বিন আব্দুর র।হমান সম্পর্কে অনেক কথা জানি। আমার আব্বা ওখানে একবার গিয়েছেন। কিন্তু আমরা যা জানি, আপনার তুলনায় তা সামান্য।’ বলল রাশিদী ইয়েসুগো।
হাসল আহমদ মুসা। বলল, রাশিদী তোমাদের পারিবারিক লাইব্রেরীতে ‘মধ্য আফ্রিকায় উপনিবেশ-এর সূচনা পর্ব’ নামে ফরাসী ভাষায় একটি বই পড়লাম। বইটি এর আগেও একাধিক লাইব্রেরীতে দেখেছি, কিন্তু পড়ার সুযোগ হয় নি। এবার পড়লাম। এ বইয়ের কাহিনীর সাথে যদি ‘আফ্রিকায় প্রাথমিক যুগের সুফি-সাধক এর বিবরণ যোগ কর, তাহলে আমি যে কাহিনী বললাম তার চেয়েও বেশি জানতে পারবে।’
এ সময় ব্ল্যাক বুল উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘আমার একটা কাজ আছে। আমি আছি আমার ঘরে।’
বলে ঘর থেকে বেড়িয়ে গেল ব্ল্যাক বুল। তার পর পরই ঘরে প্রবেশ করল লায়লা। তার হাতে একটা ইনভেলাপ। ইনভেলাপটি রাশিদীর হাতে তুলে দিতে দিতে বলল, ‘ভাইয়াকে দাও, রোসেলিনের আব্বার চিঠি।’
রাশিদী ইনভেলাপটি আহমদ মুসার হাতে তুলে দিল।
বন্ধ ইনভেলাপ থেকে চিঠি বের করল আহমদ মুসা। পড়ল চিঠি। চিঠি পড়ে তার ঠোঁটে এক টুকরো হাসি ফুটে উঠল। বলল, ‘রাশিদী, রোসেলিনের আব্বা তোমার সাথে রোসেলিনের বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছেন।’
‘আপনার কাছে?’ ঠোঁটে হাসি টেনে বলল লায়লা।
‘হ্যাঁ। সম্ভবত আমাকেই এখন রাশিদীর যথার্থ অভিভাবক মনে করেছেন।’ হাসল আহমদ মুসা।
‘তাঁর মনে করাটা সত্য। আপনার চেয়ে আমার বড় অভিভাবক এই দুনিয়ায় আর কে হতে পারেন?’
‘আম্মা মানে তোমার আম্মার অধিকার অস্বীকার করোনা, রাশিদী।’ বলল আহমদ মুসা হাসতে হাসতে।
‘আম্মাকে জিজ্ঞেস করে দেখুন, এ অধিকার আম্মা আপনার হাতেই তুলে দিয়েছেন।’ বলল রাশিদী।
‘তাহলে এ অধিকার কিন্তু আরও অনেক জায়গায় খাটাব।’
‘যেমন?’ বলল রাশিদী।
‘রোসেলিনের আব্বা একটা প্রস্তাব দিয়েছেন, আমারো একটা প্রস্তাব আছে।’
রাশিদীর মুখ মলিন হয়ে উঠল।
আহমদ মুসা ব্যাপারটা আঁচ করতে পেরে হেসে বলল, ‘ভয় করো না, তোমার বিয়ের পাল্টা প্রস্তাব নয়, অন্য বিয়ের একটা প্রস্তাব আমার আছে।’
রাশিদী লজ্জায় মুখ নিচু করল। পরক্ষণেই মুখ তুলে বলল, ‘প্রস্তাবটা বলুন।’
‘বলব?’ বলে একটু থামল আহমদ মুসা। তারপর বলল, ‘এলিসা গ্রেস এর সাথে ওমর বায়া এবং বোন লায়লার সাথে ভাই মুহাম্মাদ ইয়েকিনির বিয়ে তোমাদের সাথে একই সময়ে হয়ে যেতে পারে।’
শুনেই রাশিদী সোৎসাহে বলে উঠল, ‘এক সাথে মানে, এদের বিয়েই আগে হবে।’
মুহাম্মাদ ইয়েকিনি লজ্জায় মুখ নিচু করল। আর দু’হাতে মুখ ঢেকেছে লায়লা।
‘আগে হওয়ার যুক্তি কি?’ হেসে বলল আহমদ মুসা।
‘প্রধান যুক্তি হলো, লায়লা সব সময় কথা বলা, দাবী আদায়, খাওয়া- সব ব্যাপারে আমার উপরে এবং আগে থাকতে চায়, সুতরাং এ ব্যাপারেও…।’
‘চাইলে কি হবে, তুমিই তো আগে থাক।’ লজ্জা রাঙা মুখে লায়লা তীব্র প্রতিবাদ করল।
‘ঠিক আছে, আর আগে থাকব না।’
লায়লা মুখ খুলতে যাচ্ছিল। আহমদ মুসা বাধা দিয়ে হেসে বলল, ‘ তোমাদের ভাইবোনের ঝগড়া আপাতত বন্ধ। আগে-পরের ব্যাপারটা আমি দেখব।’ বলে থামল আহমদ মুসা।
কিছু বলতে যাচ্ছিল আহমদ মুসা। তার আগেই মুখ খুলল লায়লা। বলল, ‘চিঠি তো অনেক বড় দেখছি, আর কি লিখেছে,ভাইয়া?’
আরও কিছু আছে নাকি?’ বলল আহমদ মুসা।
‘আছে বলে মনে হয়’। লায়লা বলল।
‘কেমন করে জান? পড়েছ নাকি চিঠি?’
‘তওবা। এটা আমি করতে পারি না। রোসেলিন আমাকে টেলিফোনে বলেছে’।
‘রোসেলিন কি করে জানে?’
‘তার আব্বা এবং মারিয়া আপার আব্বার কথা সে শুনেছে’।
‘রোসেলিন কি বলেছে লায়লা? বলল রাশিদী একটু ফাঁকা পেয়ে।
‘বলব ভাইয়া?’ আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে মুখ টিপে হেসে বলল লায়লা।
জবাব না দিয়ে আহমদ মুসা চিঠিটা এগিয়ে দিল রাশিদীর দিকে ম্লান হেসে।
রাশিদী ইয়েসুগো চিঠিতে চোখ বুলিয়ে লাফিয়ে উঠল খুশীতে। প্রায় চিৎকার করে বলল, ‘মারিয়া আপা ও আহমদ মুসা ভাইয়ের ঐতিহাসিক বিয়ে যদি ক্যামেরুনে হয়, ধন্য হবে ক্যামেরুন’।
‘ঠিক বলেছ ভাইয়া। ক্যামেরুনের মুসলিম সমাজের জন্যে এর চেয়ে বড় আনন্দ আর কিছু হয়নি, আর হবেও না। তবে ভাইয়া বিয়েটা কিন্তু আমাদের বাড়িতে হতে হবে। রোসেলিন চাইবে বিয়ে, তাদের বাড়িতে হোক। তুমি রোসেলিনের পক্ষে যেতে পারবে না’। উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলল লায়লা।
আহমদ মুসা গম্ভীর। কোন কথা বলল না।
এ সময় এদিনের খবরের কাগজ দিয়ে গেল বেয়ারা এসে।
খবরের কাগজ রাশিদী ইয়েসুগোই তুলে নিল প্রথম হাতে। কাগজ হাতে নিয়ে প্রথম পাতায় চোখ বুলিয়েই চিৎকার করে উঠল রাশিদী।
‘ভাইয়া সর্বনাশ হয়ে গেছে’। কেঁপে উঠেছিল রাশিদীর কণ্ঠ।
‘কি হয়েছে রাশিদী? কিসের সর্বনাশ?’ আহমদ মুসার কণ্ঠে বিস্ময়।
রাশিদী তখন হুমড়ি খেয়ে পড়েছে একটা নিউজের উপর। পড়ছে নিউজ সে। মুহূর্ত কয়েক পরে কিছু না বলে শুকনো মুখে কাগজটি এগিয়ে দিল আহমদ মুসার দিকে।
খবরের কাগজ হাতে নিয়ে প্রথম পাতায় চোখ বুলাতেই চোখে পড়ল নিউজটা। হেডিংটা পড়ে বেদনায় পাংশু হয়ে গেল আহমদ মুসার মুখ।
নিউজের হেডিং-এ বলা হয়েছেঃ
ভয়াবহ বিষ্ফোরণে বারবারেতির ইসলামী সম্মেলন কেন্দ্র উড়ে গেছে। সম্মেলনের সকল মেহমান ও নেতৃবৃন্দ নিহত।
রুদ্ধশ্বাসে নিউজটা পড়ল আহমদ মুসাঃ ‘সম্মেলনের অধিবেশন চলাকালে গতকাল রাত ৯টা ৩ মিনিটে ভয়াবহ এক বিষ্ফোরণে গোটা সম্মেলন কেন্দ্র উড়ে গেছে এবং বিশ্ব মুসলিম কংগ্রেসের প্রধান শেখ আবদুল্লাহ আলী আল রাশিদ মাদানীসহ উপস্থাত সকল মেহমান নিহত হয়েছেন।
ঘটনার বিবরণে বলা হয়েছে, ‘সম্মেলনের দ্বিতীয় রুদ্ধদ্বার সেশনের সমাপ্তি পর্বে এই বিষ্ফোরণের ঘটনা ঘটে। সম্মেলনে দুই শতাধিক ডেলিগেট এবং প্রায় একক ডজন বিদেশী বিশিষ্ট মেহমানের সকলেই বিষ্ফোরণে নিহত হয়েছেন বলে নিশ্চিত জানা গেছে। রুদ্ধদ্বার হলে উপস্থিত কেউ বেঁচেছে বলে প্রত্যক্ষ দর্শীর কোন বিবরণ পাওয়া যাচ্ছে না। শুধু মূল সম্মেলন কক্ষ নয়, ঐ সম্মেলন ভবনে যারা ছিল, তাদের দেহও বিষ্ফোরণে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন ও ভষ্মিভূত হয়েছে। ভবনের আশেপাশের লোকদের আহত অবস্থায় পাওয়া গেছে। সম্মেলনের প্রোগ্রাম থেকে জানা যাচ্ছে, অধিবেশন সমাপ্ত হবার কথা রাত ৯টায়। তারপেরই এশার নামায হবার কথা। মনে করা হচ্ছে, নামাযের জন্যে সম্মেলনের মেহমান ও নেতৃবৃন্দ যখন মঞ্চের পেছনে এসছিলেন এবং ডেলিগেটরাও যখন তৈরী হচ্ছিল নামাযের জন্যে, সেই সময় বিষ্ফোরণটি ঘটে। সম্মেলনের প্রোগ্রাম থেকে দেখা যাচ্ছে, বিষ্ফোরণের সময় সম্মেলন কক্ষে বিশ্ব মুসলিম কংগ্রেসের প্রধান শেখ আবদুল্লাহ আলী আল রাশিদ মাদানী, মুসলিম যুব সম্মেলনের প্রেসিডেন্ট কামাল ইনুনু, মিসরের আল আজহারের গ্রান্ড শেখ সাইয়েদ আলী কুতুব প্রমুখ ১২জন বিশ্ব বরেণ্য মুসলিম ব্যক্তিত্ব হাজির ছিলেন। তাছাড়া ছিলেন ‘ডার্ক আফ্রিকা ব্রাইট হার্ট’ সংগঠনের সভাপতি তারেক আল মাহদি সুদানী সহ কয়েকজন নেতা। অনুমান করা হচ্ছে বিষ্ফোরণে সকলের মর্মান্তিক প্রাণ বিয়োগ ঘটেছে। প্রায় ধুলো হয়ে যাওয়া ধ্বংস স্তুপে কোন জীবনের অস্তিত্ব তো দূরে থাক, কোন আস্ত দেহের অস্তিত্বও কোথাও আছে বলে মনে করা হচ্ছে না।
এই ধরনের ধ্বংসাত্মক বিষ্ফোরণের ঘটনা আফ্রিকার সাম্প্রতিক ইতিহাসে নেই। স্থানীয় বিশেষজ্ঞদের ধারণা, সম্পূর্ণ নতুন ধরনের দূরনিয়ন্ত্রিত বোমায় ভবনটিক ধ্বংস করা হয়েছে।
ঘটনাকে নাশকতা বলে সবাই মনে করছেন। কিন্তু কারা এই নাশকতামূলক কাজের সাথে জড়িত থাকতে পারে, এ ব্যাপারে কেউ কিছু বলতে পারছে না। উদ্যোক্তা ‘ডার্ক আফ্রিকা ব্রাইট হার্ট’ এবং স্থানীয় মুসলিম সংগঠনের যাদের পাওয়া গেছে, তারা বলেছেন এ ধরনের কাজ করতে পারে, এমন সন্দেহজনক কেউ তাদের নজরে নেই। সম্মেলনের ব্যাপারে কারো বিরোধিতা তো দূরে, সামান্য অসন্তুষ্টি বা দ্বিমতও কারও মধ্যে তারা দেখেননি’।
খবর পড়া শেষ হলেও আহমদ মুসার চোখ কাগজের উপর থেকে সরে এল না। যেন তার চোখ দু’টি আটকে গেছে কাগজের সাথে।
বিষ্ময় ও বেদনার ধাক্কায় তার চিন্তার শক্তি যেন থেমে গেছে, বোবা হয়ে গেছে যেন সে।
এক সময় তার হাত থেকে কাগজটা পড়ে গেল।
সম্বিত ফিরে পেয়ে আহমদ মুসা একটু নড়ে-চড়ে উঠে সোফায় গা এলিয় দিল। একটা ক্লান্তি এসে তাকে ঘিরে ধরল। চোখ বুজল সে। চোখ বুজতেই তার মনটা ছুটে গেল দু’শ বছর আগের একটা ঘটনার দিকে সেদিনও একটা বিষ্ফোরণ এ ধরনেরই একটা সম্মেলন পন্ড করে দিয়েছিল। দুই ঘটনার মধ্যে পার্থক্য হলো, দু’শ বছর আগের বিষ্ফোরণ সংঘটিত সম্মেলনের আগে এবং তাতে বিদেশী মেহমান কেউ মারা যায়নি। আর এ বিষ্ফোরণ সংঘটিত হলো সম্মেলন চলাকালে এবং তাতে নিহত হলেন ডজন খানেক গুরুত্বপূর্ণ মেহমান।
এটুকু পার্থক্য থাকলেও দু’টি ঘটনা একই ধরনের এবং উদ্দেশ্যও নিঃসন্দেহে এক। তাহলে কি ধরে নয়া যায়, একই ধরনের লোক এই দুই ঘটনা ঘটিয়েছে?
চোখ খুলল আহমদ মুসা।
রাশিদী, ইয়েকিনি, লায়লা বিমূঢ় হয়ে পড়েছিল। তাকিয়েছিল আহমদ মুসার দিকে।
আহমদ মুসাই প্রথমে মুখ খুলল। বলল, ‘দু’শ বছর আগের ঘটনারই আবার পুনরাবৃত্তি ঘটল’।
অনেকটা স্বগত কণ্ঠে উচ্চারণ করল আহমদ মুসা।
‘তাহলে কি একই ধরনের শত্রুর কাজ?’ বলল রাশিদী ইয়েসুগো।
সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু নিউজে ওখানকার দায়িত্বশীলরা এটা সরাসরি স্বীকার করেননি’। আহমদ মুসা বলল।
‘দুর্ভাগ্য বারবারেতির বিশেষ কোন দুর্ভাগ্য নয়। ক্যামেরুনে মুসলমানদের যে দুর্ভাগ্য বারবারেতির। এমন দুর্ভাগ্য মনে হয় আফ্রিকার আর কোন নগরীর হয়নি’। বলল রাশিদী ইয়েসুগো।
‘বারবারেতির বিশেষ কোন দুর্ভাগ্য নয়। ক্যামেরুনে মুসলমানদের যে দুর্ভাগ্য দেখছ, তারই অন্য একটা রূপ দেখতে পাচ্ছ বারবারেতিতে। মৌলিক কোন পার্থক্য নেই দুইয়ের মধ্যে’। আহমদ মুসা বলল।
‘বিরাট ক্ষতি হলো মুসলিম বিশ্বের। বিশ্ব মুসলিম কংগ্রেসের প্রধান আবদুল্লাহ আলী, আল আজহারের গ্রান্ড শেখ সাইয়েদ আলীর ক্ষতিপূরণ হবে কি দিয়ে? বিশেষ করে ‘ডার্ক আফ্রিকা ব্রাইট হার্ট’-এর তারেক আল মাহদীর মত আগুনের ছেলেকে মুসলিম আফ্রিকা আবার কবে পাবে কে জানে!’ বলতে বলতে রাশিদী ইয়েসুগোর গলা ভেঙ্গে পড়ল কান্নায়।
‘হ্যাঁ রাশিদী, এ দিক থেকে এটা যে কত বড় ক্ষতি তা পরিমাপ করা যায় না। মন চাচ্ছে, ওদিকে একবার যাই। এতবড় ঘটনা ঘটাতে যারা সাহস পেল তারা অনেক বড় শত্রু’।
‘কে এই বড় শত্রু বুঝতে পারছি না আহমদ মুসা ভাই। ‘ওকুয়া এবং ‘কোক’ মধ্য ও পশ্চিম আফ্রিকার সবচেয়ে বড় সংগঠন। মনে হচ্ছে এই দু’টো সংগঠন আজ যে অবস্থায় পড়েছে, তাতে ঐ ঘটনা ওরা ঘটায়নি। আর যতদূর জানি, মধ্য আফ্রিকা প্রজাতন্ত্রে বড় ধরনের কোন সন্ত্রসী সংগঠন নেই’।
‘কিন্তু ঘটনা তো ঘটেছে। কোন বড় কেউই তা ঘটিয়েছে’।
বলে আহমদ মুসা একটু থামল। তারপর বলল, ‘চল, ক্যামেরুন ক্রিসেন্টের অফিসে যাই। ফ্রান্সিস বাইকদের সাথে একটু কথা বলে দেখি, কোন কথা বের করা যায় কিনা’।
আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল।
তার সাথে সাথে সবাই।

ক’দিন পরের ঘটনা।
রাশিদী ইয়েসুগো একটা খবরের কাগজ হাতে ঘরে ঢুকে কাগজটা আহমদ মুসার হাতে তুলে দিল। একটা নিউজের দিকে ইংগিত করে বলল, ‘নিউজটা পড়ুন আহমদ মুসা ভাই, সুন্দর নিউজ’।
আহমদ মুসা সোফায় গা এলিয়ে বসেছিল। কাগজটা হাতে নিয়ে সোজা হয়ে বসল। নিউজের উপর নজর দিল আহমদ মুসা।
হেডিং পড়লঃ
“এক সাক্ষাৎকারে আইনমন্ত্রী”
“ক্যামেরুনে বর্তমানে মানবাধিকার পরিস্থিতি চমৎকার”
পড়ল আহমদ মুসা খবরটা। খবরে বলা হয়েছে, “ক্যামেরুনের গণতান্ত্রিক সরকার দেশের প্রতিটি নাগরিকের নাগরিক অধিকারের প্রতি সতর্ক দৃষ্টি রেখেছে। ক্যামেরুনে বর্তমানে মানবাধিকার পরিস্থিতি অত্যন্ত চমৎকার। সরকার দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় দৃঢ় প্রতিজ্ঞ’। ক্যামেরুনের আইনমন্ত্রী মিঃ হাম আগবো ‘সানস অব অ্যাডাম’ নামক একটা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থার একটি প্রতিনিধি দলকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে এই মন্তব্য করেন। সম্প্রতি সংবাদ মাধ্যম ও সংবাদপত্রের প্রচারিত দক্ষিণ ক্যামেরুনে মুসলমানদের উচ্ছেদ ও তাদের সম্পত্তি গ্রাসের বিষয়ে আইন মন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বলেন, এই ধরণের ঘটনা কিছু ঘটেছে। এর সাথে জড়িত বেসরকারী দু’একটা সংগঠন। সরকার এ সবের কিছুই জানত না। এ সংক্রান্ত খবরটি বের হবার পর সরকার এ ব্যাপারে খোঁজ খবর নিয়েছে এবং উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসন, তাদের জমি তাদেরকে ফিরিয়ে দেয়া এবং এমনকি তাদের ক্ষতি পূরণেরও ব্যবস্থা হয়েছে।’ এ ধরণের দু’চারজন পুনর্বাসিত উদ্বাস্তুর সাথে কি তারা দেখা করতে পারে না- এমন একটি প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, দু’চারজন কেন আমরা লিস্ট দিয়ে দিতে পারি, আপনারা যত ইচ্ছা দেখা করতে পারেন।’ এমন ঘটনা ভবিষ্যতে যাতে ঘটতে না পারে, তার জন্যে আপনারা কি বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করছেন- এই প্রশ্নে আইন মন্ত্রী বলেন, ‘হ্যা বিষয়টা নিয়ে আমরা চিন্তা করেছি। আমরা আইন করতে যাচ্ছি, সংখ্যালঘু বিশেষ করে মুসলমানদের জমি হস্তান্তর করতে হলে জাতীয় ধরণের কেন্দ্রীয় কোন মুসলিম সংগঠনের অফিসিয়াল সার্টিফিকেট লাগবে। কোন অমুসলিম এ ধরণের সার্টিফিকেট ছাড়া কোন মুসলমানের সম্পত্তি কিনতে পারবে না। তাছাড়া বাস্তুভিটা ক্রয়-বিক্রয় আমরা নিষিদ্ধ করতে যাচ্ছি।’ সম্পত্তি হস্তান্তর এবং উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসন করতে গিয়ে আপনারা শক্তিশালী এনজিওদের পক্ষ থেকে কোন বাধার সম্মুখীন হয়েছেন কিনা, এ প্রশ্নের জবাবে আইন মন্ত্রী জানান, এনজিওদের পক্ষ থেকে কথা উঠেছিল, কিন্তু তাদেরকে আমরা দেখিয়েছি যে, জমি হস্তান্তরের ব্যাপারটা শান্তিপূর্ণ ও স্বেচ্ছা প্রণোদিত ছিল। কোন জোরাজুরির ঘটনা ঘটেনি।’’
খবরটা পড়া শেষ করে আহমদ মুসা বলল, ‘সানস অব অ্যাডাম’ সংস্থাকে ধন্যবাদ জানাতে হয়। প্রয়োজনীয় সব কথাই ওরা বের করে নিয়েছে সরকারের মুখ থেকে। রোসেলিনের আব্বা চীফ জাস্টিসের অবদানই অবশ্য এক্ষেত্রে বেশী। তিনিই সরকারকে এভাবে তৈরী করার ব্যবস্থা করেছেন আইন সচিব লাউস মেইডি’র মাধ্যমে।’
‘তবে ‘সানস অব অ্যাডাম’ও আমাদের যথেষ্ট উপকার করল। কে এই ‘সানস অব অ্যাডাম’?’ বলল রাশিদী ইয়েসুগো।
‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক একটা মানবাধিকার সংস্থা।’ বলল আহমদ মুসা।
‘এ টুকুই কি এর পরিচয়?’ বলল রাশিদী ইয়েসুগো।
‘তুমি ঠিকই ধরেছ। এ টুকুই এর পরিচয় নয়। এটা আমেরিকার একটা মুসলিম মানবাধিকার সংস্থা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আফ্রো-আমেরিকান মুসলিম কম্যুনিটি এই সংস্থাটির প্রতিষ্ঠা করেছে। তবে তারা সামনে নেই। খৃষ্টান ও মুসলিম কিছু শিক্ষাবিদ ও আইনবিদকে নিয়ে এই সংস্থাটি গঠিত হয়েছে। এই সংস্থাটির মূল শ্লোগান হলোঃ ‘আদমের সন্তান আমরা সকরে সমান’।’
‘তারা কি ক্যামেরুনের সব জেনেই এখানে এসেছে।’ বলল মুমাম্মাদ ইয়েকিনি।
‘হ্যা।’
‘আপনি কি জানতেন তারা আসবে?’ বলল মুহাম্মাদ ইয়েকিনিই আবার।
‘জানি, আবার জানিও না।’
‘সেটা কেমন?’ বলল রাশিদী ইয়েসুগো।
‘FWTV এবং WNA –এর মাধ্যমে নিউজ করা, মুসলিম মানবাধিকার সংস্থার এ ধরণের সফর ইত্যাদি ‘মুসলিম শ্লোগান প্রোপাগান্ডা প্লানিং’ (MGPP) এর অংশ। সুতরাং বলা যায়, আমি জানি তারা আসবে।’
‘তাদের সাথে আপনি কথা বলবেন না?’ বলল ইয়েকিনি।
‘এ ধরণের সাক্ষাৎ কৌশলগত কারণে সব সময় নিষিদ্ধ। যার কাজ সে করবে, এটাই নিয়ম।’
‘বুঝলাম।’
‘আহমদ মুসা কথা বলছিল আর কাগজে নজর বুলাচ্ছিল। হঠাৎ তার চেহারা পাল্টে গেল। কোন কিছুর প্রতি তার নজর হঠাৎ করেই যেন আটকে গেল। কিছু পড়ছে সে।
মুহূর্ত কয়েক পরে কাগজ থেকে মুখ তুলে আহমদ মুসা ‌‌‌ব‌‌লল, ’দেখ অদ্ভুত একটা বিজ্ঞাপন।’
বলে আহমদ মুসা কাগজের ঐ অংশটি সবার সামনে তুলে ধরল।
সবাই পড়ল বিজ্ঞাপনটা। ছোট্ট বিজ্ঞাপন, কিন্তু শিরোনামটা বেশ বড়। পাতার উপর চোখ বুলালে প্রথম দৃষ্টিতেই চোখে পড়ে। বিজ্ঞাপনের শিরোনাম হলোঃ
‘বারবারেতির ভয়াবহ বিস্ফোরণ সম্পর্কে আগ্রহীদের জ্ঞাতব্য।’
এই শিরোনামের অধীনে বিজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, ‘‘বিজ্ঞাপন-দানকারী ‘নিউজ ব্যাংক’ একটি সৌখিন সংস্থা। এই সংস্থা দাতব্য কাজে সহযোগিতার লক্ষ্যে নিউজ এবং নিউজ উপকরণ বিক্রি করে থাকে। এই উদ্দেশ্যে বড় বড় ঘটনা এক দেশ, জাতি ও সংস্কৃতি সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ নিউজ, নিউজ পটভূমি ও নিউজ উপকরণ ‘নিউজ ব্যায়’ সংগ্রহ করে থাকে। বারবারেতি’র ভয়াবহ ঘটনা সম্পর্কেও করেছে। আগ্রহী ক্রেতাগণ নিম্ন ঠিকানায় যোগাযোগ করুন।’’
বিজ্ঞাপনের নিচে ঠিকানা বলতে দু’টি টেলিফোন নম্বার দেয়া হয়েছে। একটা নাইরোবির, আরেকটা মধ্য আফ্রিকা প্রজাতন্ত্রের রাজধানী বাংগুই-এর।
বিজ্ঞাপনটি পড়ে রাশিদী ইয়েসুগো বলল, ‘মজার বিজ্ঞাপন। এমন সংস্থান নাম কোনদিন শুনিনি।’
কিন্তু রাশিদী ইয়েসুগোর কথা আহমদ মুসার কানে প্রবেশ করল বলে মনে হলো না। সে সোফায় গা এলিয়ে দিয়েছে। চোখে তার শূণ্য দৃষ্টি। যেন কোথাও হারিয়ে গেছে তার মন।
মুহাম্মাদ ইয়েকিনি কিছু বলতে যাচ্ছিল। রাশিদী ইয়েসুগো আংগুল তুলে থামিয়ে দিল ইয়েকিনিকে।
ইয়েকিনিও ব্যাপারটা লক্ষ্য করল। চুপ করে গেল সে। দু’জনেই বুঝল গুরুত্বপূর্ণ কোন চিন্তায় ডুব দিয়েছে আহমদ মুসা। কিছুক্ষণ পর আহমদ মুসা ঘুম থেকে জেগে ওঠার মত নড়ে উঠল। রাশিদী ইয়েসুগোর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘গোটা বিজ্ঞাপনটা একবার পড়তো।’
রাশিদী ইয়েসুগো পড়ল বিজ্ঞাপনটা।
পড়া শেষ করেই বলল, ‘বিজ্ঞাপন নিয়ে ভাবছেন কিছু আহমদ মুসা ভাই? কিছু কি আমরা কিনব ওদের কাছ থেকে?’
‘দেখ তো সবগুলো কাগজে এ বিজ্ঞাপন আছে কিনা।’ বলল আহমদ মুসা।
রাশিদী এবং ইয়েকিনি দু’জনে মিলে সবগুলো কাগজ তন্ন তন্ন করে দেখল। বলল রাশিদী, ‘ফরাসী ভাষায় সবগুলো কাগজে আছে। স্থানীয় ভাষায় কোন কাগজে নেই।’
‘আমাদের হাতের ‘দি লাইট’ ছাড়া অন্য কাগজগুলো বিজ্ঞাপনটা কোন পাতায় ছেপেছে?’ আহমদ মুসা বলল।
‘শেষ পাতায়।’ বলল রাশিদী।
‘অর্থাৎ একমাত্র ‘দি লাইট’ বিজ্ঞাপনটি প্রথম পাতায় ছেপেছে।’ বলল আহমদ মুসা।
‘তাই। কিন্তু এতে কি হয়েছে?’ বলল রাশিদী।
‘বলব।’ বলে একটু থামল আহমদ মুসা। একটু পর বলল, ‘রাশিদী বিজ্ঞাপনে নাইরোবির যে টেলিফোন নম্বার দেয়া হয়েছে, সেখানে টেলিফোন কর। জানতে চাও কি কি নিউজ রিপোর্ট এবং ফটোগ্রাফ তাদের কাছে পাওয়া যাবে। পরিচয় জিজ্ঞেস করলে বলবে, ক্রিসেন্ট ফটোগ্রাফিক সোসাইটি।’
‘কিন্তু নাইরোবিতে কেন? ‘বাংগুই’ তো আমাদের কাছেই।’ বলল রাশিদী ইয়েসুগো।
‘প্রয়োজন আছে। যা বলেছি তা করো।’
রাশিদী তার পাশ থেকে সেলুলার টেলিফোনটি তুলে নিল। ডায়াল করল। কথা বলল।
কথা শেষ করে টেলিফোন অফ করে দিল রাশিদী।
আহমদ মুসার ঠোঁটে এক টুকরো হাসি। বলল রাশিদীকে লক্ষ্য করে, ‘ওরা বিজ্ঞাপন সম্পর্কে কিছুই জানেনা না?’
‘ঠিক বলেছেন। আপনি তাহলে ধরে ফেলেছেন। কিন্তু জানে না কেন?’
‘কারণ বিজ্ঞাপন দাতারা ধরণাই করেনি যে, বাংগুই ছেড়ে কউ নাইরোবিকে জিজ্ঞেস করতে যাবে।’
‘কিছুই বুঝতে পারছি না আহমদ মুসা ভাই।’ বলল ইয়েসুগো।
‘বলব। তুমি বাংগুই-এর নম্বারে টেলিফোন কর। ‘ক্রিসেন্ট ফটোগ্রাফিক সোসাইটি’র ঠিকানা তাদের জানাবে না।’
‘সোসাইটি নেই, ঠিকানা থাকবে কি করে?’ হেসে বলল রাশিদী।
রাশিদী বাংগুই-এর নম্বারে ডায়াল করল। কথা বলল।
কথা শেষ করে টেলিফোন অফ করে রাশিদী মুখ ঘোরাল আহমদ মুসার দিকে।
‘ওখানে তাহলে কিছুই মিলল না?’ হেসে বলল আহমদ মুসা।
‘মিলেছে। ইয়াউন্ডির ওদের একটা পোস্ট বক্স নম্বার।’ বলল রাশিদী ইয়েসুগো।
‘এই ঠিকানায় বুঝি সব জেনে নিতে বলেছে? আর কি বলল ওরা?’ আহমদ মুসা বলল।
‘ঠিক ধরেছেন। পোস্ট বক্স নম্বার দিয়ে বলেছে, ওখানে যোগাযোগ করলেই সব জানা যাবে।’
উত্তরে কোন কথা বলল না আহমদ মুসা। তার কপাল কুঞ্চিত। চিন্তা করছিল। ধীরে ধীরে গা সোফায় এলিয়ে দিল সে। চোখও তার বুজে গিয়েছিল।
‘কিছু ভাবছেন আহমদ মুসা ভাই?’ বলল রাশিদী ইয়েসুগো।
‘একটা রহস্যের সন্ধান করছি।’
‘রহস্য? কোথায়?’ রাশিদী ইয়েসুগো বলল।
‘বিজ্ঞাপন থেকে শুরু করে তোমার শেষ কথা পর্যন্ত একটা রহস্য ছড়িয়ে আছে।’
‘বুঝলাম না।’ রাশিদী ইয়েসুগো বলল।
‘আমিও।’ ইয়েসুগোর কথায় সায় দিল মুহাম্মাদ ইয়েকিনি।
‘শেষটার কথাই ধর। ও ধরণের একটা সংস্থার কোন একটা রাজধানীর ‘যোগাযোগ’ পয়েন্টে টেলিফোন থাকবে না, এটা বিশ্বাস যোগ্য নয়। সাধারণভাবে মনে করা হয় যারা তাদের ঠিকানা আড়ালে রাখতে চায় তারা পোস্ট বক্স নম্বরের ব্যবস্থা করে। তারা তাই করেছে। কিন্তু ও ধরনের একটা সংস্থা এই ভাবে লুকোচুরি খেলবে কেন?’ থামল আহমদ মুসা।
‘ঠিক, এটা একটা রহস্য। তারপর?’ বলল মুহাম্মাদ ইয়েকিনি।
‘নাইরোবির কথা চিন্তা কর। ওরা ওই বিজ্ঞাপন সম্পর্কে কিছুই জানে না। কিন্তু এটা স্বাভাবিক নয়। এ থেকে প্রমাণ হয়, নাইরোবিতে কেউ যোগাযোগ তা তারা মনে করেনি কিংবা চায়নি যে কেউ সেখানে যোগাযোগ করুক। তাই তারা নাইরোবিকে কিছুই জানায়নি।’
‘তাহলে নাইরোবির ঠিকানাটা দিল কেন?’ বলল রশিদী ইয়েসুগো।
‘নাইরোবি একটা আন্তর্জাতিক শহর। তাদের বিশ্বাসযোগ্যতা সৃষ্টির জন্যই তারা নাইরোবির সুনামকে কাজে লাগিয়েছে।’
‘অর্থাৎ এই বিজ্ঞাপনের টার্গেট গোটা দুনিয়া নয়, বরং একটা বিশেষ অঞ্চল।’ বলল মুহাম্মদ ইয়েকিনি।
‘ঠিক বলেছ। কিন্তু বলত সেই অঞ্চল কোনটা?’ বলল আহমদ মুসা।
ইয়েকিনি মুখ খোলার আগেই রাশিদী ইয়েসুগো বলল, আমার মনে হয় আফ্রিকার মধ্য পশ্চিমাঞ্চল সেটা।’
‘ধন্যবাদ রাশিদী। ঠিক ধরেছ।’
‘এবার বিজ্ঞাপনের রহস্যের কথা বলুন আহমদ মুসা ভাই।’
‘একটু মনোযোগী হলে রহস্যটা তোমাদেরও নজরে পড়তো। দেখ, বিজ্ঞাপনটা প্রকাশ হয়েছে শুধু ফরাসী ভাষার কাগজে। দ্বিতীয় লক্ষণীয় বিষয় হলো, বিজ্ঞাপনটা শুধু দি লাইট পত্রিকার পাতায় ছাপা হয়েছে, ফরাসী অন্যান্য পত্রিকায় ছাপা হয়েছে শেষ পাতায়।’ একটু থামল আহমদ মুসা।
এই সুযোগে রাশিদী ইয়েসুগো বলল, ‘এই দু’টি বিষয় থেকে আমরা কি বুঝতে পারি?’
‘ভাষার সিলেকশন থেকে বুঝা যায় বিজ্ঞাপনটি বিদেশীদের জন্যে প্রচার করা হয়েছে। আর ‘দি লাইট’ কে গুরুত্ব দেয়া থেকে বুঝা যায়, বিজ্ঞাপনটির লক্ষ্য মুসলিম সমাজ।’
‘বিজ্ঞাপনটি মুসলিম সমাজের জন্য হবে কারণ বিস্ফোরণের সাথে মুসলিম স্বার্থ জড়িত। কিন্তু তাহলে বিজ্ঞাপনটি বিদেশীদের জন্যে হবে কেন?’ বলল রাশিদী ইয়েসুগো।
‘প্রশ্ন আরও একটা আছে, তাদের নাইরোবি অফিস বিজ্ঞাপন সম্পর্কে কিছু না জানা থেকে বুঝা যায়, বিজ্ঞাপনটা বাইরের বিদেশী মুসলমানদের জন্য নয়। টার্গেট হলো, এই অঞ্চলের বিদেশী মুসলমান। এর অর্থ কি?’
‘প্রশ্নগুলো সত্যি রহস্যের সৃষ্টি করছে। এই রহস্যের সমাধান কি?’ বলল মুহাম্মদ ইয়েকিনি।
‘সমাধান করতে হবে।’
‘কিভাবে?’ রাশিদী ইয়েসুগো বলল।
‘অবলম্বন হলে বাংগুই থেকে পাওয়া পোস্ট বক্স নম্বর। ঐ নম্বরে একটা চিঠি ফেলে দাও। তবে তোমরা নাম ঠিকানা দেবে না, দেবে পোস্ট বক্স নম্বর।’
‘আমরা ঠিকানা দেব না কেন?’ বলল মুহাম্মাদ ইয়েকিনি।
‘কিছু না। ওদের সমান থাকা আর কি।’
‘যোগাযোগ করে ওদের কি বলব?’ বলল রাশিদী ইয়েসুগো।
‘লিখে ওদের জানাও কি কি ফটো এবং নিউজ আছে। তারপর অবস্থা বুঝে যা হয় তা করা হবে।
বলে আহমদ মুসা ঘড়ির দিকে তাকাল। সময়টা দেখে নিয়ে বলল, ‘চল উঠি, আমাদের একটা প্রোগ্রাম আছে না?’
‘চিঠিটা তাহলে তো লিখে ফেলতে হয়।’ বলল রাশিদী ইয়েসুগো।
‘অবশ্যই। চল আমাদের দেরী হয়ে যাচ্ছে।’
বলে আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল। তার সাথে সবাই।
পোস্ট বক্সে চিঠি ছাড়ার পঞ্চম দিনেই পোস্ট বক্সের মাধ্যমে ফিরতি চিঠি পেয়েছিল আহমদ মুসারা। চিঠিতে মাত্র কয়েকটা বাক্য লেখা ছিলঃ “আমাদের সংস্থা ইয়াউন্ডিতে নতুন। অস্থায়ীভাবে এক জায়গায় বসছি। টেলিফোন নেই। ইয়াউন্ডি সার্কুলার বি-৩ এর ৬৩ নম্বর ঠিকানায় যোগাযোগ করলে সব জানতে পারবেন।”
চিঠি পড়ে একটু ভেবেছিল আহমদ মুসা। তারপর ইয়েকিনির দিকে তাকিয়ে বলেছিল, ‘তাদের সাথে কথা বলার দায়িত্ব তুমি গ্রহণ কর।’
দায়িত্ব পেয়ে আনন্দিত হয়েছিল ইয়েকিনি। ধন্যবাদ দিয়েছিল আহমদ মুসাকে। সব দায়িত্বই সব সময় আহমদ মুসা নিজের কাঁধে তুলে নেয়। তার কাছ থেকে দায়িত্ব পাওয়া সৌভাগ্যের ব্যাপার। ইয়েকিনি আরও আনন্দিত হয়েছিল এই কারণে যে, বিষয়টার সাথে রহস্যের গন্ধ আছে।’ ভাড়া গাড়ি নিয়েছিল মুহাম্মাদ ইয়েকিনি।
ইয়াউন্ডি শহরটা মুহাম্মাদ ইয়েকিনির প্রায় মুখস্থ। ইয়াউন্ডি সার্কুলার বি-৬৩ সড়কটি শহরের উত্তর পশ্চিম প্রান্তে। আর ৬৩ নম্বরটি হবে সড়কটির মাঝ বরাবর।
গাড়িটা মুহাম্মাদ ইয়েকিনি ঠিক ঠিক ৬৩ নম্বরেই নিয়ে দাঁড় করাল।
একটা গেটের সামনে গিয়ে গাড়ি দাঁড়াল। গেট বন্ধ।
ইয়েকিনি গাড়ি থেকে নেমে গেট রুমের দিকে এগিয়ে গেল।
গেটম‌্যান গলা বাড়াল গেট রুমের জানালা দিয়ে।
‘এখানে তো ‘নিউজ ব‌্যাংক’-এর অফিস’। বলল ইয়েকিনি।
‘হ্যা। কেন?’ বলল গেট ম‌্যান।
‘ওদের সাথে আমার এখন দেখা করার কথা।’
কয়েক মুহুর্তের জন্যে তার মাথাটা গেটের ভেতরে চলে গেল।
তারপর মাথাটা মুহুর্তের জন্যে বের করে বলল, ‘আসছি।’
গেট খুলে গেল।
ইয়েকিনি গাড়ি ছেড়ে দিয়ে ভেতরে ঢুকে গেল।
সামনে একটা চত্ত্বর। তারপরেই বারান্দা। বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিল একজন কৃষ্ণাঙ্গ।
সে এগিয়ে এসে ইয়েকিনিকে স্বাগত জানাল। বলল, ‘আপনি মিঃ ইয়েকিনি?’
‘হ্যাঁ।’
‘আসুন, আমরা আপনার জন্যে অপেক্ষা করছি।’
লোকটির সাথে এগিয়ে গিয়ে ইয়েকিনি প্রবেশ করল একটা কক্ষে। কক্ষটি বেশ প্রশস্ত। কক্ষটির চারদিকে একবার তাকিয়েই বুঝতে পাল নতুন বা তাড়াহুড়ো করে সাজানো একটা অফিস।
একটা বড় টেবিলের ওপাশে একটা চেয়ারে বসে একজন শ্বেতাংগ যুবক।
ইয়েকিনি ঘরে ঢুকতেই যুবকটি উঠে দাঁড়িয়ে এগিয়ে এসে স্বাগত জানাল ইয়েকিনিকে।
খাতিরটা একটু বেশীই মনে হলো, অন্তত আফ্রিকান স্ট্যান্ডার্ডে। ভাবল আবার ইয়েকিনি, নতুন অফিস তো। ক্লায়েন্টের প্রতি খাতির তাই বেশীই হতে পারে।
শ্বেতাঙ্গ যুবকটি হ্যান্ডশেক করে বলল, ‘আমি আয়ান ফ্লেমিং।’
বসার পর কথা শুরু হলো।
‘আপনার সংস্থার নাম কি যেন? হ্যাঁ, ক্রিসেন্ট ফটোগ্রাফিক সোসাইটি। আপনারা কি মুসলমানদের স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট ফটোগুলোই শুধু যোগাড় করেন?’ বলল যুবকটি, আয়ান ফ্লেমিং।
‘প্রধানত তাই।’ বলল ইয়েকিনি।
‘দেশের বাইরে থেকে কিভাবে ফটো যোগাড় করেন?’ আয়ান ফ্লেমিং বলল।
‘আমরা খুবই সূচনা পর্বে। সবে কাজ শুরু করেছি। বাহিরকে নিয়ে এখনও খুব চিন্তা আমরা করিনি।’
মুখে কথাগুলো বললেও মনে মনে বলল, ক্রিসেন্ট ফটোগ্রাফিক সোসাইটিই নেই, তার আবার ফটো যোগাড়।
মিথ্যা কথাগুলো যে অবলীলাক্রমে বলতে পারল ইয়েকিনি, তাতে নিজেই বিস্মিত হলো সে। তবে সান্ত্বনার কথা এই যে, আহমদ মুসা ভাই বলেছেন, শত্রুর কাছে বা সন্দেহজনক কারো কাছে সত্য গোপন করা অন্যায় নয়।
‘ফটো সংগ্রহের জন্য সবচেয়ে বেশী প্রয়োজন যোগাযোগ। কোথায় কি হচ্ছে, নিউজ মেকার কে আসছে, কে যাচ্ছে, তা নখদর্পণে রাখতে হয়। আপনাদের এ কাজগুলো করার ধরন কি?’ বলল আয়ান ফ্লেমিং।
‘কয়েকজন ফটোগ্রাফার মাত্র আমাদের অবলম্বন।’ বলল ইয়েকিনি।
‘আমাদের ‘নিউজ ব্যাংক’-এর কাজ আপনাদের মতই। পার্থক্য হলো, আপনারা শুধু কেনেন, আর আমরা ক্রয়-বিক্রয় দু’টাই করি। গুরুত্বপুর্ণ ফটো কেনার জন্যে আমরা এমনকি বিদেশেও ছুটে যাই।’
থামল আয়ান ফ্লেমিং। মুহুর্ত কয়েক পর আবার শুরু করল, ‘আপনাদের সংগ্রহে কি তেমন ফটো আছে যা আমরা কিনতে পারি? থাকলে আমরা যেমন আপনার কাছে বিক্রি করছি, তেমনি কিনতেও পারি।’
‘বুঝতে পারছি না, কি ধরনের ফটোর কথা বলছেন?’
‘যেমন ধরুন আহমদ মুসার মত দুর্লভ কোন ব্যাক্তিত্বের সাথে কোন ঘটনার ছবি। তিনি বিশ্ব ব্যাপী আকর্ষণের কেন্দ্র।’
আয়ান ফ্লেমিং-এর মুখে আহমদ মুসার নাম শুনে বিস্ময়ের চেয়ে ভয়ই বেশী পেল ইয়েকিনি। বিজ্ঞাপন ঘিরে যে সব রহস্যের কথা বলেছেন আহমদ মুসা তা মনে পড়ে গেল। আপনা থেকেই তার মন বলল নিশ্চয় সামনে বড় কোন ঘটনা আছে। সতর্ক হলো ইয়েকিনি। বলল, আপনারা আহমদ মুসাকে চেনেন, জানেন?
‘চিনি না, তবে জানি। আমাদের কেন্দ্রীয় সংগ্রহে তার অনেক ছবি আছে।’
আয়ান ফ্লেমিং থামল। একটা ঢোক গিলল। শুরু কলল কথা আবার, ‘শুনেছি তিনি ক্যামেরুনে এসেছেন। তার জন্যে আমাদের একটা এ্যাপ্রেসিয়েশন লেটার আছে অনেকদিন ধরে। ঠিকানা না পাওয়ায় দিতে পারি না। আপনি কি জানেন তার সম্পর্কে কিছু?’
ইয়েকিনির মনে তখন চিন্তার ঝড়। আয়ান ফ্লেমিং এর কথা শুনে মনে হচ্ছে তারা আহমদ মুসার দারুণ ভক্ত। যা স্বাভাবিক নয়। কেমন করে স্বাভাবিক হবে যে তারা আহমদ মুসাকে এ্যাপ্রেসিয়েশন লেটার দেবে? এসব প্রশ্ন থেকে ইয়েকিনি ভাবল, ওদের আরও বাজিয়ে দেখা দরকার।
আয়ান ফ্লেমিং এর প্রশ্নের উত্তরে ইয়েকিনি বলল, ‘তেমন কিছু জানা নেই। ইয়াউন্ডি কেন্দ্রীয় মসজিদে এক প্রোগ্রামে তাকে দেখেছিলাম। ফটোও তুলেছিলাম।’
ভীষণ খূশি হয়ে উঠল আয়ান ফ্লেমিং এবং তাদের কৃষ্ণাংগ লোকটি।
‘কতদিন আগে?’ আয়ান ফ্লেমিং-এর কন্ঠ দ্রুত। ভেতরের উত্তেজনা চাপা দিতে চাইলেও বেরিয়ে পড়েছে অনেকখানি।
‘বেশী দিন নয়। চারদিন আগে।’
‘তাহলে উনি ইয়াউন্ডি আছেন নিশ্চয়?’ কথার সাথে সাথে ফ্লেমিং এর চোখ দুটি উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে।
‘থাকতে পারেন?’
‘উনি কোথায় উঠেছেন জানেন?’
‘না জানি না।’
‘ঐ মসজিদের কেউ জানেন নিশ্চয়?’
‘ঠিক বলতে পারবো না। কারণ মসজিদ কর্তিপক্ষ সেদিনের অনুষ্ঠান করেননি।’
‘অনুষ্ঠান কারা করেছিলেন?’
‘আমি ঠিক জানি না। বন্ধুর মুখে খবর শুনে গিয়েছিলাম। ফটো তোলাই ছিল আমার টার্গেট।’
কয়েক মুহূত চুপ থাকল আয়ান ফ্লেমিং। তার বলল ‘ধরুন আমরা যদি মসজিদ কর্তৃপক্ষকে আহমদ মুসার জন্যে একটা চিঠি দেই, কিংবা আপনাকেই যদি এ কাজের জন্যে অনুরোধ করি, তাহলে কি সে চিঠিটা কোনওভাবে তাঁর কাছে পৌছানো সম্ভব?
ইয়েকিনি ভাবল, চিঠি নেয়া দরকার। চিঠিটা যে কোন ‘লেটার অব এ্যাপ্রেসিয়েশন নয়’ সে নিশ্চিত। তাহলে চিঠিটা কি জানা দরকার।’

ভাবতে গিয়ে ইয়েকিনির দেরী হলে একটু উত্তর দিতে। এই ফাঁকে আবার কথা বললো আয়ান ফ্লেমিং। বলল, দেখুন ব্যপারটা আমাদের আবেগের সাথে জড়িত। বিশ্বে কোথাও ও কোন ঠিকানা নেই। খবরের কাগজও যোগাযোগের একটা মাধ্যম। কিন্তু আহমদ মুসা এবং এক ব্যাক্তিত্ব যাকে খবরের কাগজের কোন শিরোনামে আনা নিরাপদ নয়। এই জন্যেই অনুরোধ করছিলাম। খোঁজ করলে নিশ্চয় আপনি তার খোঁজ পাবেন।’
‘আমি চেষ্টা করতে পারি। কিন্তু কোন নিশ্চয়তা নেই। না পারলে চিঠি ফেরত কিভাবে দেব?’
আশা করি তার দরকার হবে না। হলে আমাদের পোষ্ট বক্সের ঠিকানায় ফেলে দেবেন।’
বলে একটু থেমেই আবার শুরু করল, ‘এবার আসুন কাজের কথায় আসি। আমাদের নিউজ ফাইল ও ফটো এ্যালবামের শিরোনামগুলো দেখুন। তারপর আপনার চয়েস অনুসারে নিতে পারবেন।’
বলে একটু থেমেই আবার শুরু করল, এবার আসুন কাজের কথায় আসি। আমাদের নিউজ ফাইল ও ফটো এ্যালবামের শিরোনামগুলো দেখুন। তারপর আপনার চয়েস অনুসারে নিতে পারবেন।’
আয়ান ফ্লেমিং কথা শেষ করতেই কৃষ্ণাংগ লোকটি পাশের ফাইল ক্যাবিনেট থেকে এ্যালবাম ও একটা বড় ফাইল বের করল।
ফটোগ্রাফ বা নিউজ কেনা ইয়েকিনির আসার প্রধান টার্গেট ছিল না। আহমদ মুসা তাকে পাঠানোর লক্ষ্য ছিল বিজ্ঞাপন ঘিরে যে রহস্য আঁচ করা যাচ্ছে, সেটার একটা কিনারা করা। এই কিনারা করার কাজ হয়তো সে এখনও করতে পারেনি, তবে তার কাছে এটা এখন পরিষ্কার হয়েছে যে ব্যবসায় নয়, আহমদ মুসাই ওদের আকষণের কেন্দ্র বিন্দু। আহমদ মুসার কাছে চিঠি দেয়ার ব্যাপারটা তারা যেভাবে উপস্থাপন করেছে, সেটা সেটা খুবই স্থুল। এমন স্থুল কান্ড কান্ড অনেক সময় বুদ্ধিমানরাও ঘটায়, যখন তারা সংশ্লিষ্ট ব্যাপারে মরিয়া হয়ে উঠে। ইয়েকিনির মনে হলো, এখানেও ব্যাপার তেমনই ঘটেছে।
আয়ান ফ্লেমিংদের সাথে ফটো ও নিউজ কেনার ব্যাপারে আলোচনা সেরে ইয়েকিনি রাস্তায় নামল।
রাস্তার ফুটপাতে নেমে আসতেই একটা ট্যাক্সি এসে ব্রেক কষল একদম সামনে এসে। ট্যাক্সিওয়ালা মুখ বাড়িয়ে বলল, ‘স্যার কোথায় যাবেন?
ইয়েকিনি গাড়ির দিকে এগুচ্ছিল। এমন সময় আহমদ মুসার একটা কথা তার মনে পড়ে গেল। কোথাও কোন মিশনে গেলে কোন গাড়ি এগিয়ে এলে বা যথাস্থানে দাঁড়িয়ে থাকলে তাতে চড়া উচিত নয়।
কথাটা মনে হওয়ার সংগে সংগে ইয়েকিনি পেছনে হটে এল।
বলল, ‘স্যরি, একটু অসুবিধা আছে।’
বলে ইয়েকিনি ফুটপাথ ধরে হাঁটতে শুরু করলো। সামনে মোড়েই ট্যাক্সি ষ্ট্যান্ড আছে।
ট্যাক্সি ঠিক করে ট্যাক্সিতে উটে বসল।
চিঠিটা তখনও হাতে আছে ইয়েকিনির। দেখল খামের মুখ ভালো করে বন্ধ করা। চিঠি সম্পর্কে অসীম কৌতুহল তার মনে। কিন্তু কৌতুহল নিবৃত্তির কোন পথ নেই। চলছে ইয়েকিনির ট্যাক্সি।
হঠাৎ ইয়েকিনির মনে পড়ল আহমদ মুসার একটা উপদেশের কথা। সে উপদেশটা ছিলঃ কোন মিশন থেকে ফেরার পথে সামনের চেয়ে পেছনটাকে গুরুত্ব দেবে বেশী। এক চোখ সামনে থাকলে, আরেক চোখ পেছনে রাখতে হবে।
কথাটা মনে হবার সঙ্গে সঙ্গে ইয়েকিনি পেছন ফিরে তাকাল।
সময় তখন বেলা তিনটা। তার উপর এলাকাটা নন-কমার্শিয়াল এলাকা। সে জন্যে রাস্তায় গাড়ি-ঘোড়া খুবই কম।
ইয়েকিনি পেছনে তাকিয়ে দেখতে পেল দুইটি প্রাইভেট কার তার গাড়ির পেছনে আসছে। সামনের প্রাইভেট কারটা তীব্র বেগে ছুটে আসছে। পেছনেরটা বেশ একটু পেছনে।
দেখতে দেখতে ছুটে আসা প্রাইভেট কারটা ইয়েকিনির গাড়ি অতিক্রম করে চলে গেল।
ক’মিনিট পরে পেছনে তাকিয়ে ইয়েকিনি দেখল মিনি ট্যক্সি দু’টো আর দেখা যাচ্ছে না। পেছনে পড়ে গেলে বা কোন গলিতে ঢুকে গেছে। পেছনের দ্বিতীয় প্রাইভেট কারটা এখনও সেই সমান দুরত্বে। যেন ইয়েকিনির গাড়ি যে স্পীডে চলছে, ঠিক সেই স্পীডেই চলছে গাড়িটা। বিস্মিতই হলো ইয়েকিনি।
কিন্তু সোজা হয়ে বসেই আহমদ মুসার একটি কথা মনে হওয়ায় চমকে উঠল ইয়েকিনি। আহমদ মুসা বলেছিলেন, অপরিচিত ও সংযোগহীন দুইটি গাড়ির গতি নিয়ন্ত্রণহীন কোন রাস্তায় বেশীক্ষণ এক গতিতে চলতে পারে না। যদি চলে তার মধ্যে তাহলে একটা উদ্দেশ্য থাকবে নিশ্চয়ই।
কথাটা মনে হতেই সতর্ক হলো ইয়েকিনি। মুখ ফিরিয়ে পেছনের লাল গাড়িটার দিকে তাকিয়ে ভাবল, কোন উদ্দেশ্য আছে নাকি তাহলে গাড়িটার!
করণীয় ভাবতে গিয়ে আহমদ মুসার আরেকটা কথা মনে পড়ে গেল ইয়েকিনির। আহমদ মুসা এক উপদেশে বলেছিল, পেছনে কাউকে সন্দেহ করলে সরাসরি আর না চলে কোন আড়ালের আশ্রয় নিয়ে তাকে বোকা বানাতে হবে।
ইয়েকিনি ভাবল, কোথায় কিসের আড়াল নেয়া যায়?
খুশী হয়ে উঠল তার মন। সামনে অল্প দূরেই একটা নতুন তিনতলা মার্কেট। খুব জমজমাট এখণ। তিন পাশ দিয়েই তার রাস্তা। ওখানে নেমে পেছনের গাড়িটাকে বোকা বানিয়ে সে কেটে পড়তে পারে।
সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল সে। মার্কেটের প্রায় কাছাকাছি এসে গেছে গাড়ি। মার্কেটে গাড়ি দাঁড় করাতে বলল ইয়েকিনি। মার্কেটের কার পার্কে গাড়ি দাঁড়াতেই ভাড়া চুকিয়ে দ্রুত মার্কেটে ঢুকে গেল ইয়েকিনি। মার্কেটে ঢোকার মুখে ইয়েকিনি পেছনৈ মুখ ঘুরিয়ে দেখল পেছনের সেই গাড়িটা মার্কেটের চত্বরের দিকে আসছে।
মার্কেটে ঢোকার পর প্রথমেই প্রশস্ত একটা করিডোর। তার দুই প্রান্ত দিয়ে দুটো সিঁড়ি দু’তলা, তিন তলায় উঠে গেছে। ইয়েকিনি ভেতরে ঢুকেই বাম দিকের সিঁড়ি বেয়ে দু’তলায় উঠে গেল দ্রুত। ঠিক উপরে না উঠে সিঁড়ির মাঝামাঝি ল্যান্ডিং-এ গিয়ে সিড়ির কাঁচের জানালা দিয়ে সে তাকাল নিচের চত্বরে। দেখল, সেই লাল গাড়িটা মার্কেটের কারপার্কে এসে দাঁড়াল। গাড়ি
থেকে দ্রুত বেরিয়ে এল একজন লোক। লোকটাকে চিনতে পারলো ইয়েকিনি। আয়ান ফ্লেমিং-এর অফিসে দেখা সেই কৃষ্ণাংগ। লোকটি গাড়ি থেকে নেমেই ছুটল মার্কেটের দিকে।
ইয়েকিনি সিঁড়ির ল্যান্ডিং থেকে দু’তলার দিকে কয়েক ধাপ উঠে রেলিং এর আড়াল নিয়ে চোখ রাখল করিডোরের দিকে।
দেখল ইয়েকিনি, কৃষ্ণাংগ লোকটি মার্কেটের ভেতরে ঢুকে মুহূর্তের জন্য দাঁড়াল। এদিক-ওদিক দৃষ্টি বুলাল দ্রুত। সিঁড়ির দিকেও। তারপরেই সে দ্রুত সামনে এগুলো এবং এক তলার দোকানগুলোর পাশ কাটিয়ে এগিয়ে চলল।
ইয়েকিনি সিঁড়ি দিয়ে নেমে এসেছ। সে বুঝল, কৃষ্ণাংগ লোকটি মার্কেটের ওপাশের রাস্তা লক্ষে এগুচ্ছে।
কৃষ্ণাংগ ঐ লোকটিকে আর যখন দেখা গেল না, তখন ইয়েকিনি সিঁড়ি থেকে নেমে দ্রুত করিডোর পেরিয়ে মার্কেট থেকে বেরিয়ে এল।
রাস্তায় নামতেই একটা ট্যাক্সিও পেয়ে গেল। চলন্ত একটা ট্যাক্সিকে ডেকে তাতে উঠে বসল।
ছুটে চলল ট্যাক্সি।
রোমাঞ্চ লাগল ইয়েকিনির। জীবনের প্রথম একক এক মিশনে সে জয়ী হয়েছে, বোকা বানাতে পেরেছে সে শত্রুকে।
ওরা কি সত্যিই শত্রু? ওরা কেন তার পিছু নিয়েছিল? ইয়েকিনির ঠিকানা জানাই কি ছিল ওদের টার্গেট? কেন? হঠাৎ আহমদ মুসাকে দেয়া তাদের চিঠির কথা মনে পড়ল। চিঠিতে কি আছে? কেন ওরা চিঠি দিয়েছে আহমদ মুসাকে?
এইভাবে একের পর এক প্রশ্ন তার মনে উদয় হতে লাগল। কিন্তু কোন প্রশ্নেরই সে জবাব খুঁজে পেল না।
ঘড়ি দেখল ইয়েকিনি।
বিকেল সাড়ে তিনটা।
বেশ দেরী করে ফেলেছে -ভাবল ইয়েকিনি। আজ রাশিদী ইয়েসুগোর বাড়িতে এক মহা অনুষ্ঠান। আহমদ মুসার বিয়ে। আজ চারদিন বিয়ের অনুষ্ঠান চলছে।
প্রথমদিন বিয়ে হয়েছে রাশিদী ইয়েসুগো ও ভিনিসা রোসেলিনের। তারপরের দিন এলিসা গ্রেস ও ওমর বায়ার বিয়ে। তৃতীয় দিন তার অর্থাৎ মুহাম্মদ ইয়েকিনি এবং লায়লা ইয়েসুগোর বিয়ে হয়েছে। চতুর্থ দিনে বিয়ে হয়েছে ফাতেমা মুনেকা এবং হাসান একাকুর।
এ বিয়েগুলোর মধ্যে রোসেলিনের বিয়ে হয়েছে চীফ জাস্টিসের বাসায়। অবশিষ্ট তিনটি বিয়ে হয়েছে রাশিদী ইয়েসুগোর বাড়িতে।
ভিন্ন ভিন্ন দিনে আহমদ মুসার পরিকল্পনা অনুসারে। তার কথা সবার বিয়ে এক সাথে হলে আনন্দ করার, কাজ করার লোক কোথায় পাওয়া যাবে?
পরিকল্পনা অনুসারে সর্বশেষ বিয়ে আহমদ মুসার। আজ সেই বিয়ে।
মনটা উসখুস করে উঠল মুহাম্মাদ ইয়েকিনির। মবাই আনন্দ করছে, আর সে কিনা বেরিয়েছে মিশনে। আহমদ মুসা চায়নি এদিন তাকে মিশনে পাঠাতে। কিন্তু উপায় ছিল না। সাক্ষাৎ করার এই একটি দিনই ওরা দিয়েছিল।
সুতরাং বাধ্য হয়েই আহমদ মুসা তাকে এ মিশনে পাঠায়।
গেটের ভেতরে গাড়ি না নিয়ে গেটের সামনে রাস্তাতেই নেমে পড়ল ইয়েকিনি।
গাড়ি থেকে বাড়ির দিকে তাকাতেই হঠাত্ ছাদের দিকে গেল তার দৃষ্টি। দেখল, ছাদের একদম এক প্রান্তে লায়লা ইয়েসুগো দাঁড়িয়ে। মুুহাম্মাদ ইয়েকিনিকে দেখেই সে হাত নাড়ল।
ইয়েকিনি বুঝল, লায়লা ইয়েসুগোরাস্তার দিকে তাকিয়ে ছিল। তার পথ চেয়ে কি? তৃপ্তির এক অপূর্ব শিহরণ খেলে গেল ইয়েকিনির বুকে, সারাদেহে। তার মনে হলেঅ, প্রিয়তমা নারীর এমন অপেক্ষমান চোখের চেয়ে সুন্দর, মধুর বুঝি আর কিছু নেই।
হঠাত্ মনে জাগল, তাদের প্রিয় নেতা আহমদ মুসা সহস্র মিশনে গেছেন, যাচ্ছেন। বাড়িতে কি অমন অপক্ষমান কোন ব্যাকুল চোখ তার পথ চেয়ে থাকে? তার তো বাড়িই নেই! বাড়িতে চোখ থাকবে কি করে!
‘এবার সে ব্যবস্থা ইনশাআল্লাহ হচ্ছে’-সানন্দে ভাবল ইয়েকিনি।
লায়লঅ ইয়ে সুগোর উদ্দেশ্যে হাত নেড়ে গেট দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করল ইয়েকিনি।
সুন্দর করে সাজানো হল ঘরে এসে হাজির হলো ইয়েকিনি।
বিশাল হল ঘরটির মাঝ বরাবর টাঙানো ভারি পর্দার পার্টিশন।
পার্টিশনের একপাশে মেয়েরা, অন্যপাশে ছেলেরা।
সবাই উপস্থিত। জমজমাট বিয়ের আসর।
হলের চারদিকে সাজানো সোফায় বসেছে সকলে। মাঝখানের বড় একটি সোফায় বসেছে আহমদ মুসা। তার এক পাশে রাশিদী ইয়েসুগো।
আহমদ মুসার সামনের সোফায় রোসেলিনের আব্বা চীফ জাস্টিস ওসাম বাইক এবং ডোনার আব্বা মিশেল প্লাতিনি।
ইয়েকিনি যখন হল ঘরে প্রবেশ করে, তখন কথা বলছিল মিশেল প্লাতিনি, ‘না আমি খুব খুশী। আমারর ইচ্ছা ছিল আমাদের পূর্ব পুরুষের প্রাসাদে বংশের একমাত্র উত্তরাধিকারীর বিয়ে হবে। কিন্তু সেখানে বিয়ে হলে যে খুশী আমার লাগত, তার চেয়ে অনেক বেশী খুশী লাগছে আমার এখানে।..’
ইয়েকিনি প্রবেশ করলে কথা বন্ধ করেছিল মিশেল প্লাতিনি।
ইয়েকিনি এগিয়ে এলে আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল। বলল, ‘এস ইয়েকিনি। বুঝাই যাচ্ছে তোমার মিশন সফল হয়েছে, কিন্তু সেই সাথে তোমার চোখে উদ্বেগ কেন?’
হলে উপস্থিত সকলের দৃষ্টি তখন ইয়েকিনির দিকে। পর্দার ওপাশে হলের ঐ অংশে মেয়েদের গুঞ্জন-কথাবার্তাও থেমে গেছে। তাদেরও মনোযোগ এদিকে।
ইয়েকিনি সবাইকে সালাম জানিয়ে আহমদ মুসার পাশে বসল। তারপর চাপদিকে আবার নজর বুলিয়ে দেখল বাইরের কেউ নেই। বলল, ‘সফল হয়েছে এই অর্থে য আমি তাদের দেখা পেয়েছি, কথা বলেছি। কিন্তু রহস্যের জট খোলেনি, বরং আরও জটিল হয়েছে।’
‘জটিল হয়েছে? খুলে বল।’ বলর আহমদ মুসা।
‘ওরা আমাকে বিদায় দেবার পর গোপনে আমাকে ফলো করেছিল। সম্ভবত আমার ঠিকানা জানার জন্যে।’ বলল ইয়েকিনি।
‘তারপর?’
‘আপনার উদেশ অনুযায়ী একটা মার্কেটে ঢুকে পড়ে ওদের বোকা বাবনিয়ে চলে এসেছি।’
‘যাক, ওরা যে পরিচয় দিয়েছে, ওটা যে আসল পরিচয় নয় বুঝা গেল। বল, তারপর?’
‘ওরা আপনাকে একটা চিঠি দিয়েছে।’
‘আমাকে চিঠি দিয়েছে? ওরা?’
‘হ্যাঁ।’
‘আমার কথা তুমি ওদের বলেছ?’
‘প্রশ্নই উঠে না। কথায় কথায় ওরাই আমাকে বলল, আমরা ছবি বিক্রি করি, আবার কিনিও। বিশেষ করে আহমদ মুসার মত ব্যাক্তিদের। উনি এসছিলেন ক্যামেরুনে। কোন ছবি দিতে পারেন তার?’
‘তারপর?’ আহমদ মুসার চোখে চাঞ্চল্য।
ইয়েকিনি একে একে চিঠির প্রসংগ তারা কিভাবে তুলল, কিভাবে চিঠি দিল ইত্যাদি খুলে বলল।
আহমদ মুসা গম্ভীর হয়ে উঠেছিল। বলল, ‘সম্ভবত আমি যা ভেবেছি, রহস্যটা তার চেয়েও গভীর।’
বলে আহমদ মুসা চিচঠি চাইল। ইয়েকিনি চিঠি দিল আহমদমুসাকে। ইভেলাপটি হাতে নিয়ে আহমদ মুসা উল্টে-পাল্টে দেখল। গম্ভীর হয়ে উঠল তার মুখ। বলল, ‘এটা ব্ল্যাক ক্রস-এর চিঠি।’
‘না খুলেই কি করে বুঝলেন?’ বলল ইয়েকিনি।
‘দেখ ইনভেলাপে নিউজ ব্যাংক-এর মনোগ্রামে কালো একটা সৈনিক মূর্তি রয়েছে। কালো এই সৈনিক মূর্তি এখন ব্ল্যাক ক্রস-এরও প্রতীক।’ বলে আহমদ মুসা ইনভেলাপ ছিড়ে চিঠিটি বের করল।
ভাঁজ খুলে চিঠিটি মেলে ধরল আহমদ মুসা তার চোখের সামনে।
চিঠি পড়তে শুরু করল আহমদ মুসা। পড়তে পড়তে তার চোখ-মুখের উদ্বেগজনক পরিবর্তন ঘটল। বিষাদের একটা কালো ছায়া তাকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছে।
চিঠি পড়া শেষ হলো আহমদ মুসার। চিঠি সমেত তার দু’টি হাত ঢলে পড়ল তার কোলের উপর। আহমদ মুসার চোখে শূণ্য দৃষ্টি।
‘চিঠিতে কি আছে আহমদ মুসা?’ উদ্বিগ্ন কন্ঠে জিজ্ঞেস করল ডোনার আব্বা মিশেল প্লাতিনি।
আহমদ মুুসা ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়িয়ে চিঠিটি তুলে দিল মিশেল প্লাতিনির হাতে।
মিশেল প্লাতিনি চিঠিটি তুলে ধরল তার চোখের সামনে। চীফ জাস্টিস ওসাম বাইকও ঝুঁকে পড়ল চিঠির দিকে। মিশেল প্লাতিনি তার হাতের চিঠি একটু এগিয়ে নিল চীফ জাস্টিসের দিকে। দু’জনেই পড়তে শুরু করল।
ঘরে তখন পিন-পতন নীরবতা। ঘরের মাঝখানের পর্দার ফাঁক দিয়ে ডোনা, লায়লা ও রোসেলিনের চোখ এদিকে নিবদ্ধ।
সকলের পচন্ড উদ্বেগ এবং কৌতুহলের মধ্যে যে চিঠি ওরা পড়তে লাগল তা এই:
“মি: আহমদ মুসা, আপনার বিজয়ের উত্সব-আনন্দ নিশ্চয় শেষ হয়নি। এই আনন্দ-উত্সবে আমাদের ছোট্ট একটা বজ্রাঘাত।
বারবারেতি’র ইসলামী সম্মেলন কেন্দ্র আমরা ধ্বংস করেছি। ধ্বংস করেছি একটা আড়াল সৃষ্টির জন্যে। আমরা কিডন্যাপ করেছি শেখ আবদুল্লাহ আলী আল রাশিদ মাদানী, কামাল ইনুনু, শেখ সাইয়েদ আলী কুতুব, তারেক আল মাহদী সুদানীসহ ১২ জন নেতাকে। কিন্তু দুনিয়ার চোখে তারা সবাই পুড়ে ছাই হয়ে গেছে ঐ বিস্ফোরণের আগুনে। দুনিয়ার কেউ প্রমাণ করতে পারবে না যে তারা কিডন্যাপ হয়েছে। আপনি জানার পরেও তা কোনভাবেই প্রমাণ করতে পারবেন না।
আপনাদের অগম্য একটি স্থানে তাদের বন্দী করে রাখা হয়েছে। দু:খের বিষয় তাদের ভালো অবস্থায় রাখতে পারিনি। তাদের জীবন দ্রুত ক্ষয়ে যাচ্ছে।
বিস্ফোরণের পনের দিন পর তাদের কেউই বাচবে না।
তাদের মুক্তির একমাত্র উপায় যথাসময়ে আপনার আত্মসমর্পণ। সংঘ নদীর ভবনের বিপরীত দিকে উইন্দ টাওয়ারের পাশের একটি গাছে একটা সাদা পতাকা টাঙানো থাকবে। পতাকাটি নামিয়ে নিয়ে সেটা হাতে নিয়ে অপেক্ষা করতে হবে। অপেক্ষার এক ঘন্টার মধ্যে সেখানে একটা গাড়ি গিয়ে হাজির হবে। গাড়ির ড্রাইভিং উইন্ডো থেকে অনুরূপ একটা সাদা পতাকা দেখানো হবে এবং সেই সাথে গাড়ির দরজা খুলে যাবে। ঐ গাড়িতে উঠে বসতে হবে।
পিয়ের পল হত্যার প্রতিশোধ নেয়া সবে শুরু। আপনি আত্মসমর্পণ না করলেও উল্লিখিত সময়ের মাথায় বন্দীরা নিহত হবে। আত্মসমর্পণ না করলেও আপনি বাঁচবেন না আমাদের হাত থেকে। আপনার রক্তই আমাদের প্রতিশোধ তৃষ্ণা মেটাতে পারে। আপনার আত্মসমর্পণ বন্দীদের বাঁচাতে পারে মাত্র।”
চিঠি পড়া শেষ করে ডোনার আব্বা মিশেল প্লাতিনি এবং চীফ জাস্টিস ওসাম বাইক ধীরে ধীরে মুখ তুলে তাকাল আহমদ মুসার দিকে। চোখে তাদের বোবা দৃষ্টি। সে দৃষ্টি উদ্বেগ-আতংকে বিহ্বল।
ডোনার আব্বার হাতে ছিল চিঠি। তার শিথিল হাত থেকে চিঠি পড়ে গেল।
পর্দার অন্তরাল থেকে বেরিয়ে গেল ডোনা। তার পরণে বিয়ের পোশাক। অপরূপ সাদা গাউনে তার দেহ আবৃত। তার চেয়েও অপরূপ একটা ওড়না মাথা থেকে মুখটা প্রায় ঢেকে ফেলেছে।
সে দ্রুত প্রবেশ করে তার আব্বার হাত থেকে পড়ে যাওয়া চিঠিটা ছোঁ মেরে নিয়ে ভেতরে চলে গেল।
কি আছে চিঠিতে ভাইয়া? উদ্বিগ্ন কন্ঠে বলল রাশিদী ইয়েসুগো।
ঘরে উপস্থিত সবার চোখেও এই একই প্রশ্ন।
আহমদ মুসা সোজা হয়ে বসল। বলল, প্রিয় ভাইয়েরে, চিঠিটা লিখেছে ব্ল্যাক ক্রস। ওরা জানিয়েছে, বারবারেতির ইসলামী সম্মেলন কেন্দ্র অরাই ধ্বংস করেছে এবং কিডন্যাপ করেছে ডজন খানেক মুসলিম নেতাকে।’
আহমদ মুসা একটু থামতেই রাশিদী ইয়েসুগো বলে উঠল, ‘বিস্ফোরণে তাহলে ওরা মারা যায়নি? কিডন্যাপ করা হয়েছে ওঁদের?’
‘ওঁদের পণবন্দী করা হয়েছে বলতে পার। আহমদ মুসা ওদের হাতে সারেন্ডার করলে ওদের মুক্তি দেবে বলে ওরা বলেছে।’
মুখ চুপসে গেল রাশিদী ইয়েসুগোর। বলল ভাঙা গলায়, ‘আর কি লিখেছে?’
‘বিস্ফোরণ থেকে পনের দিনের মাথায় বন্দীরা সবাই নিহত হবে। সংঘ ও কংগ নদীর সংগম স্থল বোমাসায় গিয়ে আমাকে আত্মসমর্পণ করতে হবে।’
‘না করলে কি হবে?’
‘বন্দীরা ছাড়া পাবে না।’
‘কোন সময় সীমা?’
‘১৫ দিনের মাথায় সবাই নিহত হবে। অতএব পনের দিনই সময় সীমা।’
রাশিদী ইয়েসুগো কোন কথা বলল না।
সবাই নীরব।
ডোনার আব্বা মিশেল প্লাতিনি এবং চীফ জাস্টিস অসাম বাইক দুজনেরই যেন বাকরোধ হয়ে গেছে। তাদের চোখ-মুখ থেকে উদ্বেগ যেন ঠিকরে পড়ছে।
এ সময় পর্দার বাইরে বেরিয়ে এল লায়লা ইয়েসুগো। আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে বলল, ‘চিঠির লেখা হারিয়ে গেছে।’ লায়লার কন্ঠে উদ্বেগ।
আহমদ মুসার মধ্যে কোন বিস্ময় বা চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হলো না। বরং দেখা গেল তার মুখে একটা হাসির রেখা। বলল, ‘ওরা কথা রাখল, কোন প্রমাণ তারা রাখল না। বিশেষ ভ্যানিশিং কেমিকেল দিয়ে চিঠিটা লেখা ছিল। লায়লার কাছ থেকে চিঠির কাগজটা নিয়ে এল রাশিদী ইয়েসুগো।’
রাশিদী ইয়েসুগো চিঠি নিয়ে এলে সবাই দেখল।
‘আহমদ মুসা চীফ জাস্টিস্কে লক্ষ্য করে বলল, ‘জনাব আমরা ক’জন ভেতরে একটু বসতে চাই।’
বলে আহমদ মুসা রাশিদী ইয়েসুগোর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তুমি বসার একটু ব্যবস্থা কর। ওঁরা দু’জন এবং তোমরা দু’জন।’
ভেতরের ফ্যামিলি ড্রইং রুমে গিয়ে বসল ওঁরা পাচজন।
আহমদ মুসার সামনের দু’টি সোফায় বসেছে ডোনার আব্বা এবং রোসেলিনের আব্বা। আর বাঁ পাশের দু’টির সোফায় মুহাম্মাদ ইয়েকিনি এবং রাশিদি ইয়েসুগো।
বসার পর কথা শুরু করল আহমদ মুসা। ডোনার আব্বা ও রোসেলিনের আব্বাকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘আপনারা চিঠি পড়েছেন, পরিস্থিতি বুঝতে পারছেন। আপনাদের পরামর্শ পেলে বাধিত হবো।’
‘কি করা উচিত বুঝতে পারছি না। আত্মসমর্পণ তো সব নয়।’ বলল ডোনার আব্বা মিশেল প্লাতিনি।
‘আমিও এটাই ভাবছি।’ বলল রোসেলিনের আব্বা চীফ জাস্টিস ওসাম বাইক।
আবার নীরবতা।
নীরবতা ভেঙে ধীরে ধীরে বলল আহমদ মুসা, ‘বিস্ফোরণের পর দশ দিন পার হয়ে গেছে। আর মাত্র ৫ দিন বাকী। বাকী এই সময়ের মধ্যে বন্দী মুসলিম নেতৃবৃন্দকে উদ্ধার করতে হবে। উদ্ধার করতে না পারলে তাদের কেউ বাঁচবেন না।’
‘উদ্ধার কিভাবে হবে? দুনিয়ার কেউ তো জানে না তাদের অবস্থার কথা।’ বলল ওসাম বাইক।
‘বিশ্ব মুসলিম কংগ্রেসসহ মুসলিম দেশসমুহ এবং দুনিয়াবাসীকে এই ব্যাপারটা জানিয়ে দেয়া যায়। তাহলে তাদের একটা সম্মিলিত ব্যবস্থা হতে পারে।’ বলল রাশিদী ইয়েসুগো।
‘তাতে লাভ হবে না। বিষয়টা নিয়ে হৈ চৈ হলে কিংবা ঘটা করে তাদের উদ্ধারের সম্মিলিত কোন ব্যবস্থা হলে বন্দীদের তারা সময়ের আগেই হত্যা করবে। তাছাড়া ঐ ধরনের উদ্যোগে উদ্ধারের জন্যে যে সময় প্রয়োজন, সে সময় এখন হাতে নেই।’ আহমদ মুসা বলল।
‘ব্ল্যাক ক্রস-এর উপর আন্তর্জাতিক কোন চাপ প্রয়োগ করা যায় না, যা তাদেরকে আন্তর্জাতিক মুসলিম নেতাদের হত্যা করা থেকে বিরত রাখতে পারে?’ বলল মুহাম্মাদ ইয়েকিনি।
‘ব্ল্যাক ক্রস-এর উপর এ ধরনের কোন চাপ দেয়া যাবে না। কারণ, তারা কিডন্যাপ করেছে এবং মুসলিম নেতৃবৃন্দ বেঁচে আছেন, এর কোন প্রমাণ নেই।’ বলল আহমদ মুসা।
আবার নীরবতা। কারো মুখে কোন কথা নেই।
পাশের ঘরেই রয়েছে ডোনা, লায়লা ইয়েসুগো, রোসেলিন, ফাতেমা মুনেকা এবং এলিসা গ্রেস। তাদের সমস্ত মনোযোগ এ ঘরের আলোচনার দিকে। তাদের সকলের চেহারাই আষাঢ়ের মেঘের মত ভেজা।
চিন্তাক্লিষ্ট আনত দৃষ্টি আহমদ মুসা মুখ তুলল। বলল, ‘ওঁদের উদ্ধারের দায়িত্ব এখন আমাদের। আমাকে যেতে হবে।’
‘আত্মসমর্পণের জন্যে?’ ডোনার আব্বার কন্ঠ।
‘আমি এখন বলতে পারছি না। তবে কোন উপায় না থাকলে আত্মসমর্পণ করতে হবে।’ স্থির, শান্ত কন্ঠে বলল আহমদ মুসা।
আবার নীরবতা। কথা বলার শক্তি যেন কারো নেই।
অনেকক্ষণ পর চীফ জাস্টিস ওসাম বাইক বলল, ‘বাবা, তোমার কথার উপর আমাদের কোন কথা চলতে পারে না। তুমি কবে যাবে মনে করছ?’
‘চাচা জান, দিন মাত্র পাঁচটা আছে। যে কাজ করতে হবে সে তুলনায় এ সময়টা কিছুই নয়। আমি আজ এখনি যাত্রা করতে চাই।’ বলল আহমদ মুসা।
আবার নীরবতা।
আহমদ মুসা ছাড়া উপস্থিত অন্য সকলের চোখ-মুখের সকল আলো যেন আক সংগে দপ করে নিভে গেল। অন্ধকার নামল মুখে-চোখে সকলের। পাশের ঘরে ডোনা লায়লাদেরও একই অবস্থা
নীরবতা ভাঙল চীফ জাস্টিস ওসাম বাইক। বলল, ‘তাহলে বিয়েটা তাড়াতাড়ি সেরে ফেলতে হয়।’
আহমদ মুসা মুখ নিচু হলো। বলল, ‘চাচা জান আমি এ নিয়ে ডোনার সাথে কথা বলতে চাই। সে আমার সাথে একমত হলে বিয়েটা স্থগিত রাখতে আমি অনুরোধ করব।’
আবার নীরবতা।
ডোনার আব্বা ও চীফ জাস্টিসের চোখ-মুখ বেদনা ক্লিষ্ট। রাশিদী ইয়েসুগো এবং মুহামাদ ইয়েকিনির কেঁদে ফেলা শুধু বাকী। ওদিকে লায়লা, রোসেলিন, ফাতেমা মুনেকা ও এলিসা গ্রেস অসহনীয় এক বেদনার বানে বিদ্ধ হয়ে নিজেদের অজান্তেই চোখ তুলেছে ডোনার দিকে।
ডোনার মাথা উঁচু। ভাবলেশহীন মুখ। চোখে একটা শূন্য দৃষ্টি। যেন কোথায় কোন চিন্তার সাগরে নিজেকে সে হারিয়ে ফেলেছে।
আবারও নীরবতা ভাঙল চীফ জাস্টিস ওসাম বাইক। বলল, ‘ঠিক আছে কথা বলবে।’
বলে সে তাকাল রশিদী ইয়েসুগোর দিকে।
‘ঠিক আছে ব্যবস্থা কড়ছি।’ বলে একটু থেমেই সে আহমদ মুসার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আপনার সাথে আমরা কারা যাচ্ছি আহমদ মুসা ভাই?’
আহমদ মুসা একটু হাসল। বলল, ‘তোমাদের কোন সুযোগ দিতে পারছি না। আমার সাথে যাবে ব্ল্যাক বুল এবং যদি রাজী হয় তাহলে অগাস্টিন ওকোচা’।
‘কিন্তু ওরা দু’জনই তো ‘কোক-ওকুয়া’র লোক, ওরা সহজেই ওদের চোখে ধরা পড়ে যাবে’। বলল রাশিদী।
‘এ চিন্তা তোমার মনে উদয় হওয়ার জন্যে তোমাকে ধন্যবাদ। কিন্তু ওদের নেব আমি ছদ্মবেশে, অন্য মানুষ বানিয়ে’।
‘আমরা পারি না কেন যেতে?’ মুখ ভার করে বলল রাশিদী ইয়েসুগো।
আহমদ মুসা ডোনার আব্বা ও রোসেলিনের আব্বার দিকে এক পলক তাকিয়ে রাশিদীকে বলল, ‘পরে বলব তোমাদের কারণটা। যাও তুমি লায়লাকে বলে ডোনাকে ডেকে দাও’। আহমদ মুসার ঠোঁটে হাসি।
রাশিদী ইয়েসুগো মুখ ভার করেই উঠে দাঁড়াল।