৩
যায়দ রাশিদীর লুকানো বাক্স থেকে সোনার যে মোহর বের হলো তার পরিমাণ দাঁড়ালো এক কোটি ডলার। ক্যামেরুনের টাকায় যার পরিমাণ হয় ৩০০ কোটি ফ্রাঙ্ক।
তিনশ’ কোটি ফ্রাঙ্ক মূল্যের সোনার মোহরের স্তুপের দিকে বিস্ময়ের দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রাশিদী ইয়েসুগো, মুহাম্মদ ইয়েকিনি, ব্ল্যাক বুল এবং অন্যান্যরা।
‘আমার একটা বিস্ময় কিন্তু যায়নি।’ মোহরের দিক থেকে চোখ ঘুরিয়ে আহমদ মুসার দিকে চেয়ে বলল রাশিদী ইয়েসুগো।
‘কী?’ বলল আহমদ মুসা।
‘ডায়েরীতে লুকানো বাক্সের যে সংকেত আছে, তা আমি দেখেছি। কিন্তু আমি কিছু বুঝিনি। আপনি কি করে জায়গাটা ঠিক ঠিক চিহ্নিত করে ফেললেন?’
‘এ জিজ্ঞাসা আমারও মনে।’ বলল ব্ল্যাক বুল।
‘ব্যাপারটা খুবই সহজ ছিল। পাখির বাসা বলতে বুঝানো হয়েছে যায়দ রাশিদীর বাড়ী, মৃত পাখির বাসা বলতে বুঝানো হয়েছে যায়দ রাশিদীর সমাধিকে। আর মোহর ভর্তি বাক্স হলো মৃত পাখির মুখের গোলাপ ফুল। সুতারাং বুঝতেই পারছ, সংকেতের মধ্যে কোন জটিলতা ছিলনা।’
‘এখন কোন জটিলতা দেখছি না, তবে পাখিকে যায়দ রাশিদী, পাখির বাসাকে তার বাড়ি, মৃত পাখির অবস্থান কে সমাধি এবং গোলাপ ফুলকে লুকানো ধন কল্পনা করা হাজার চেষ্টা করেও পারতাম না।’ বলল রাশিদী ইয়েসুগো।
‘থাক, এসব কথা। এখন বল, এই টাকা নিয়ে কী চিন্তা করছ?’
‘কেন যায়েদ রাশিদীর উইল অনুসারে এ টাকার মালিক আপনি।’
‘আচ্ছা ঠিক আছে, টাকার মালিক আমি হলে এ টাকা আমি তোমাদের দিয়ে দিলাম। এখন বল এ টাকা তোমরা কি করবে?’
‘আমরা জানিনা, আপনিই বলুন এ টাকা দিয়ে আমরা কি করব?’
‘ফ্রান্সিস বাইকের কাছ থেকে যে সম্পত্তি ফেরত পাওয়া গেছে তার সাথে যায়দ রাশিদীর বাড়িও আছে। এ টাকার একটা অংশ দিয়ে ঐ বাড়িটাকে পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে আনতে হবে। ব্ল্যাক বুলের নামে বাড়িটা কেনা হয়েছে সে, বাড়িটার মালিক থাকবে। আর…’
আহমদ মুসার কথার মাঝখানে ব্ল্যাক বুল বলে উঠল, ‘কিন্তু আমি মনে করি যায়দ রাশদীর এই সম্পত্তির মালিক হওয়ার যোগ্যতা আমার নেই। বাড়িটার একজন সেবক হতে পারলেই আমি খুশি হবো। আমি….’
আহমদ মুসা তাকে বাধা দিয়ে বলল, ‘ঠিক আছে, তোমার কথা আমরা বুঝেছি। শুনে রাখ, সন্তান অযোগ্য হলেই সে তার উত্তরাধিকার হারায় না।’
বলে একটু থামল আহমদ মুসা, তারপর আবার শুরু করল, ‘অবশিষ্ট টাকা ক্যামেরুন ক্রিসেন্ট পাবে। ক্যামেরুন ক্রিসেন্ট এই টাকা ইসলাম প্রচার এবং মানুষের সেবায় ব্যয় করবে। জাগতিক ও ইসলামী শিক্ষার প্রসার এবং দারিদ্র্য বিমোচন- এই লক্ষ্যে যদি ক্যামেরুন ক্রিসেন্ট কাজ করতে পারে, তাহলে পশ্চিম আফ্রিকায় এনজিও দের ষড়যন্ত্র বানচাল করে তোমরা ইসলামের আলো নতুন করে এ অঞ্চলে প্রজ্জ্বলিত করতে পারবে।’
‘ধন্যবাদ আহমদ মুসা ভাই। আপনি যে কাজের প্রস্তাব করেছেন সেটাই আমাদের আসল কাজ হওয়া উচিত। কিন্তু এই সাথে আমার কথা হলো আপনি বিশ্বব্যাপী কাজ করছেন। যায়দ রাশিদীর টাকার একটা অংশ যদি আপনার কেন্দ্রীয় তহবিলে যায়, তাতে আমি মনে করি তার পূন্য আরও বেশী হবে।’ বলল রাশিদী।
হাসল আহমদ মুসা, ‘বলল, আমার কোন কেন্দ্র নেই, কেন্দ্রীয় অফিসও নেই, কেন্দ্রীয় তহবিলও নেই। আমি যখন যেখানে থাকি সেটাই, আমার কেন্দ্র। সে কেন্দ্র্র থেকেই আমার খরচ চলে। সুতরাং আমার কোন তহবিল দরকার নেই।’
রাশিদী ইয়েসুগো নাছোড়বান্দা। বলল, ‘ইসলামের বিশ্বব্যাপী যে কাজ হচ্ছে, তার তো একটি কেন্দ্রীয় তহবিল আছে। যেমন ধরুন ‘সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিক’ -এর বারবারেতি শহরে আন্তর্জাতিক সম্মেলন হচ্ছে। সেখানে বিশ্বের মুসলমানদের সবচেয়ে সক্রিয় ও শক্তিশালী সংগঠন ওয়ার্ল্ড মুসলিম কংগ্রেস-এর প্রধানসহ বিশ্ব বরেণ্য অনেক মুসলিম নেতা এসেছেন। এসব কাজে তো বিরাট খরচ। যায়দ রাশিদীর অর্থের একটা অংশ যদি এসব কাজে খরচ হয়, তিনি অনেক বেশী পূণ্য পাবেন।’ বলল রাশিদী ইয়েসুগো।
‘তুমি ঠিকই বলেছ। ‘বারবারেতি’ শহরে ‘ডার্ক আফ্রিকা ব্রাইট হার্ট’ -এর উদ্যোগে ‘আফ্রিকা এবং ইসলাম’ বিষয়ের উপর যে আন্তর্জাতিক সেমিনার হচ্ছে, তার জন্যে যদি অর্থের প্রয়োজন হতো তাহলে আমি তোমার কথা মেনে নিতাম। আসলে ‘ডার্ক আফ্রিকা ব্রাইট হার্ট’ আফ্রিকায় ‘ওয়ার্ল্ড মুসলিম কংগ্রেস’ পরিচালিত একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন। তাদের যাবতীয় খরচ ‘ওয়ার্ল্ড মুসলিম কংগ্রেস’ বহন করে থাকে। তবু তোমরা চাইলে তাকে সাহয্য করা যাবে। কিন্তু এ জন্য এখনই বাজেটের প্রয়োজন নেই। আমি ওদের সাথে কথা বলে সে ব্যবস্থা করব।’
‘আপনার তো বিরাট খরচ। আপনি কি আপনার এ টাকা থেকে কিছুই নিতে পারেন না?’ মুখ ভার করে বলল রাশিদী ইয়েসুগো।
আহমদ মুসা হাসল। রাশিদীর পিঠ চাপড়ে বলল, ‘মন খারাপ করছ কেন? সত্যিই আমার প্রয়োজন নেই। এই যে আমি তোমাদের এখানে এসেছি, কোন খরচ আমাকে তোমরা করতে দিয়েছ? এর বাইরে যে টাকা আমার প্রয়োজন তার ব্যবস্থা আছে। ফিলিস্তিন সরকার ‘আল জাজিরা ব্যাংক ইন্টারন্যাশনাল’-এর একটা ‘কোডেড ক্রেডিট নাম্বার’ আমাকে দিয়েছে। আমি পৃথিবীর যে কোন ব্যাংকে গিয়ে এই নাম্বার দিয়ে টাকার যে কোন অংক চাইলে দিয়ে দিবে। দরকার পড়লে এই নাম্বার আমি ব্যাবহার করি। ঠিক আছে? এবার খুশী?’
হাসল রাশিদী। বলল ‘ঐ নাম্বার যে কেউ ব্যাংককে দিলে টাকা দিয়ে দিবে?’
‘হ্যাঁ।’
‘তাহলে আমিও তো ঐ নাম্বার দিয়ে টাকা তুলতে পারি।’ বলল রাশিদী।
‘নাম্বার পাবে কোথায়?’
‘আপনি দেবেন।’ বলল রাশিদী।
‘এ ধরনের নাম্বার যাকে দেয়া হয়, সে যদি কাউকে এটা জানায়, তাহলে সেদিন সে এটা ব্যাবহারের অধিকার হারায়।’
‘বুঝলাম। দায়িত্বটা এরকম না হলে সুযোগটা অতবড় হতো না। কিন্তু একটা প্রশ্ন, ব্যাংক তো কোডেড নাম্বারটা জানতে পারে, তারা যদি এটা অন্যকে জানিয়ে দেয় বা নিজেরা ব্যবহার করে?’ বলল রাশিদী।
‘না পারবে না কোডেড নাম্বার এর সাথে একটা সিরিয়াল সংকেত আছে। এই সংকেত প্রত্যেকবার পৃথক হয় এবং সিরিয়াল অনুসারে হয়, যেভাবে আল জাজিরা ব্যাংক ইন্টারন্যাশনাল-এর রেকর্ডে সংরক্ষিত আছে।’
‘কিন্তু এ ব্যাপারটা তো স্থানীয় এবং বিভিন্ন ব্যাংকের জানার কথা নয়, তারা যদি ভূল করে টাকা দিয়ে দেয়?’ বলল রাশিদী।
‘প্রত্যেক ব্যাংকের কম্পিউটারের পেমেন্ট সেকশনে ইন্টারন্যাশনাল কাউন্টার আছে। যেসব আন্তর্জাতিক ব্যাংক ক্রেডিট কার্ড ও কোডেড নাম্বার-এ পেমেন্ট করে, তারা সবসময় প্রতি মহুর্তে কম্পিউটারের ইন্টারন্যাশনাল পেমেন্ট কাউন্টারে আপ টু-ডেট-রাখে। সুতরাং যখনি কেউ কোডেড নাম্বার ব্যাংকে দেয়, তখন তারা সেটা কম্পিউটারে প্রবেশ করায়। পেমেন্ট সেকশনের ইন্টারন্যাশনাল কাউন্টার থেকে গ্রীন সিগনাল পেলেই তবেই তারা পেমেন্ট করে।’
‘বাঃ চমৎকার ব্যবস্থা।’ বলল রাশিদী।
রাশিদী থামতেই মুহাম্মদ ইয়েকিনি বলল, ‘আমার ভিন্ন একটা প্রশ্ন, এত বড় এবং গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক সেমিনার বারবারেতি শহরে অনুষ্ঠিত হচ্ছে কেন?’
‘হতে পারেনা কেন মনে করছ?’ বলল আহমদ মুসা।
‘জায়গাটা তেমন খ্যাতনামা নয়। মুসলিম স্বার্থের উপস্থিতির দিক দিয়েও গুরুত্বপূর্ণ নয়।’ বলল মুহাম্মদ ইয়েকিনি।
আহমদ মুসা হাসল। বলল, তুমি ঠিকই বলেছ। জায়গাটা বিখ্যাত এবং মুসলিম স্বার্থের দিক দিয়ে গুরুত্বপূর্ণও নয়। কিন্তু নতুন নতুন জায়গাতেই তো ইসলাম যাবার কথা। অন্ধকারেই তো আলোর আগমন বেশী প্রয়োজন।’
থামল একটু আহমদ মুসা। একটু গম্ভীর হয়ে উঠল তার মুখ। বলল, ‘একটা ঘটনা এবং একটা স্মৃতি সেন্ট্রাল আফ্রিাকান রিপাবলিকের এই বারবারেতিকে স্মরণীয় করে রেখেছে। প্রায় দু’শ বছর আগে সংঘ নদী তীরের ঐ বারবারেতিতে আকস্মিকভাবে উদয় হয়েছিলেন সুলতানুল আউলিয়া আহমদ বিন আহমদ আবদুর রহমান। উদয় হয়েছিলেন বলা হয় এ জন্যই যে, উনি কিভাবে কোথেকে এসেছিলেন, কেউ বলতে পারেনা। কেউ বলে মালি, নাইজেরিয়া ও ক্যামেরুন হয়ে মধ্য আফ্রিকা প্রজাতন্ত্রের এই দুর্গম স্থানে তিনি এসেছিলেন, কারো মতে সুদান থেকে মধ্য আফ্রিকা প্রজাতন্ত্রে তিনি প্রবেশ করেছিলেন, কেউ মনে করেন সোমালিয়া, কেনিয়া, উগান্ডা ও জায়ার হয়ে এখানে তিনি এসেছিলেন। আবার কেউ বলেন, তিনি বাঁশের ভেলায় চড়ে কংগো নদী হয়ে সংঘ নদী পথে বারবারেতি এসেছিলেন। সত্য যেটাই হোক ঘোর এক দুর্দিনে বারবারেতির মানুষ স্বর্গের সাহায্য রূপে তাকে দেখতে পেয়েছিল।“কথিত আছে, একদিন ভোরে ইউরোপীয় দাস ব্যাবসায়ীরা একটা স্টীম বোটে করে বারবারেতি এলাকায় প্রায় দেড় শ’ যুবককে ধরে নিয়ে যাচ্ছিল। ইউরোপীয়দের গুলি বৃষ্টিরে মুখে যুবকদের আত্মীয় স্বজনরা নদীর তীরে গড়াগড়ি দিয়ে আহাজারি করছিল। তারা বিস্ময়ের সাথে দেখল নদীর তীরে দাঁড়ানো বাঁশের ভেলায় বসে ধ্যানরত একজন সৌম্যমূর্তি বৃদ্ধ উঠে দাড়ালো এবং দরাজ কণ্ঠে স্টিম বোটকে থামার নির্দেশ দিল। বোট থামল না। বৃদ্ধ তাঁর ডান হাত ঊর্ধ্বে উত্তোলন করল। সঙ্গে সঙ্গে বোট সব শক্তি হারিয়ে নিশ্চল হয়ে গেল। ইউরোপীয়দের বন্দুকগুলো তাক করল বৃদ্ধকে। কিন্তু বন্দুকগুলো থেকে ধোয়া বেরুল, শব্দ হলো, গুলি বেরুল বটে, কিন্তু গুলিগুলো ঝরে পড়ল বৃদ্ধের দেহ থেকে। বৃদ্ধ হাত দিয়ে ইঙ্গিত করল বোটটিকে কূলে ভেড়ার জন্য। ইঞ্জিন স্টার্ট হওয়া ছাড়াই নিঃশব্দে বোটটি কূলে এসে ভিড়ল। বৃদ্ধ তাঁর সেই দরাজ গলায় ইউরোপীয়দের তাদের বন্দুকগুলো নদীর তীরে ফেলে দিতে বলল এবং বন্দীদের ছেড়ে দিতে নির্দেশ দিল। ইউরোপীয়রা পাথরের মত হয়ে গিয়েছিল। তারা পুতুলের মত হুকুম পালন করল। বারবারেতির দেড়শ’ বন্দী মুক্তি পেয়ে তীরে নেমে এল। এরপর বৃদ্ধ ইউরোপীয়দের চলে যাবার নির্দেশ দিল এবং সাবধান করেদিল আর যেন দাস ব্যবসায় তারা না করে।
স্টার্ট নিয়ে বোট চলে গেল।
বৃদ্ধটি বাঁশের ভেলা থেকে ধীরে ধীরে তীরে নেমে এল। বারবারেতির সকল মানুষ তাঁর সামনে উপুড় হয়ে পড়ল। তারা মনে করল স্বয়ং ঈশ্বর মানুষের রূপ ধরে তাদের সামনে এসেছে। কিন্ত বৃদ্ধ ‘অমানুষ’ নামে অভিহিত কালো মানুষগুলোকে পা থেকে বুকে টেনে তুলল। জড়িয়ে নিল বুকে।
যা হোক, বৃদ্ধ আহমদ বিন আব্দুর রহমান বারবারেতিতেই তাঁর নিবাস বানাল। তিনি আসার পর দাস সংগ্রহের আর কোন হামলা বারবারেতিতে হয় নি।
চারিদিকে নাম ছড়িয়ে পড়ল বৃদ্ধের। ঈশ্বরের সাক্ষাৎ প্রতিভু হয়েও তিনি মাটির মানুষ, প্রাণের মানুষ। দাস ব্যবসায় তিনি আসায় বন্ধ হয়ে গেছে। অন্যায়-অশান্তি ও হানাহানিও তিনি কমিয়ে দিয়েছেন। এই কাহিনী আমি পড়েছি পশ্চিমি পরিব্রাজকের এক বইতে। তিনি স্থানীয় ভাষায় লিখিত একটা পুস্তিকার বরাত দিয়ে এই কাহিনী লিখেছেন।
বৃদ্ধ আহমদ বিন আব্দুর রহমান বারবারেতিতে জ্বালালেন ইসলামের আলো। ইসলাম প্রচারের এক কেন্দ্র হয়ে দাঁড়ালো বারবারেতি।
বারবারেতিকে কেন তিনি বেছে নিয়েছিলেন?
সেই সময়ের আফ্রিকার অবস্থার দিকে যদি তাকাই তাহলে দেখব বারবারেতি আলো এবং অন্ধকারের মাঝে একই সীমারেখা। নাইজেরিয়া থেকে যে রাস্তা উত্তর ক্যামেরুন হয়ে দক্ষিণে অগ্রসর হয়েছিল, তা বারবারেতি এসে থেমে গিয়েছিল। এর দক্ষিণে বাইরের কোন কাফেল তখনও পা রাখেনি। বারবারেতির পশ্চিমে দক্ষিণ ক্যামেরুন তখন মুসলিম শূন্য, আর বারবারেতির পুবে মধ্য আফ্রিকা প্রজাতন্ত্রের দক্ষিণাঞ্চলও তখন কোন মুসলিমের পদচারণায় ধন্য হয়নি। আর দক্ষিণে অবস্থিত কংগো,গ্যাবন, জায়ার তো তখন একেবারেই তিমির অন্ধকারে ঢাকা। মানুষ এবং পশু তখন সে অঞ্চলে একাকার।
এই বিশাল জমাট অন্ধকারের প্রান্তে দাঁড়ানো বারবারেতি ছিল সোনালী সিংহদ্বারের মত। সেখান থেকে উত্তরের সাথে স্থল পথে যোগাযোগ করা যায়, আর অন্ধকার দক্ষিণের সাথে সংযোগ গড়ে তোলা যায় নদী পথে। অন্ধকারের সোনালী সিংহদ্বার এই বারবারেতিকে কেন্দ্র করে বৃদ্ধ আহমদ বিন আব্দুর রহমান অন্ধকার দক্ষিণে ইসলামের আলো ছড়িয়ে দিয়েছিলেন।
এই হলো বারবারেতির স্মৃতি।
আর যে ঘটনার কথা বলেছি, বারবারেতির সেই ঘটনা হলোঃ
আহমদ বিন আব্দুর রহমান স্থানীয় জনগণের পাশে থাকতে গিয়ে এবং ইসলাম প্রচারের কারণে পশ্চিমী খৃষ্টান মিশনারী এবং উদীয়মান ফরাসী ঔপনিবেশিক শক্তির শত্রুতে পরিণত হয়েছিলেন। ঠিক এই সময়ি আহমদ বিন আব্দুর রহমান বারবারেতিতে একটা আন্তর্জাতিক ইসলামী সম্মেলনের আয়োজন করেছিলেন। এ সম্মেলনে তুরস্কের ওসমানিয়া খেলাফতের প্রতিনিধি ও মিসরের গ্র্যান্ড মুফতিসহ মালি খিলাফত, নাইজেরিয়া সালতানাত এবং উত্তর ক্যামেরুনের ইয়েসুগো সুলতানের প্রতিনিধিকে দাওয়াত দেয়া হয়েছিল। এই মহামান্য মেহমানদের এনে আহমদ বিন আব্দুর রহমান তিমিত অন্ধকারে ঢাকা এক আফ্রিকাকে দেখাতে চেয়েছিলেন এবং বলতে চেয়েছিলেন এই অন্ধকারের বাসিন্দাদের প্রতি তাদের দায়িত্বের কথা।
কিন্তু তাঁর এ ইচ্ছা পূরণ হয়নি। সম্মেলনের চারদিন আগে এক রাতে সম্মেলন কেন্দ্রে যখন তিনি কর্মরত ছিলেন, তখন এক অগ্নিকাণ্ডে সম্মেলন কেন্দ্রে ভস্মীভূত হয় এবং তিনি নিহত হন। অগ্নিদগ্ধ আহমদ বিন আব্দুর রহমানের পৃষ্ঠদেশে গভীর ছুরিকাঘাতের চিহ্ন ছিল। স্থানীয় মুসলিমরা মনে করত, খৃষ্টান মিশনারী ও ঔপনিবেশিকরা যোগসাজস করে তাঁকে হত্যা করেছে এবং সম্মেলন পণ্ড করেছে। আর স্থানীয় অন্যান্য অধিবাসীরা বিশ্বাস করত, দাস ব্যবসায়ী শয়তানরা হত্যা করেছে তাদের স্বর্গীয় পিতাকে। এক মাস ধরে শোক পালন করেছে স্থানীয় অধিবাসীরা। তাঁর নিহত হবার দিনকে স্থানীয় অধিবাসীরা শোক দিবস হিসেবে পালন করে আসছে গত দু’শ বছর ধরে।
এই বারবারেতি শহরেই ‘ডার্ক আফ্রিকা ব্রাইট হার্ট’- এর উদ্যাগে আন্তর্জাতিক ইসলামী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। বলা যায়, দু’শ বছর আগের একটা অসমাপ্ত কাজ আজ সমাপ্ত হচ্ছে। এখন বল ইয়েকিনি, জায়গাটার সিলেকশন ঠিক হয়েছে কিনা?’
আহমদ মুসার কথা গোগ্রাসে গিলছিল ইয়েকিনি রাশিদীরা।
আহমদ মুসার প্রশ্ন শুনে হাসল ইয়েকিনি। বলল, ‘কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু এত কথা আপনি জানলেন কি করে?’
‘ঠিক। আমরা আহমদ বিন আব্দুর র।হমান সম্পর্কে অনেক কথা জানি। আমার আব্বা ওখানে একবার গিয়েছেন। কিন্তু আমরা যা জানি, আপনার তুলনায় তা সামান্য।’ বলল রাশিদী ইয়েসুগো।
হাসল আহমদ মুসা। বলল, রাশিদী তোমাদের পারিবারিক লাইব্রেরীতে ‘মধ্য আফ্রিকায় উপনিবেশ-এর সূচনা পর্ব’ নামে ফরাসী ভাষায় একটি বই পড়লাম। বইটি এর আগেও একাধিক লাইব্রেরীতে দেখেছি, কিন্তু পড়ার সুযোগ হয় নি। এবার পড়লাম। এ বইয়ের কাহিনীর সাথে যদি ‘আফ্রিকায় প্রাথমিক যুগের সুফি-সাধক এর বিবরণ যোগ কর, তাহলে আমি যে কাহিনী বললাম তার চেয়েও বেশি জানতে পারবে।’
এ সময় ব্ল্যাক বুল উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘আমার একটা কাজ আছে। আমি আছি আমার ঘরে।’
বলে ঘর থেকে বেড়িয়ে গেল ব্ল্যাক বুল। তার পর পরই ঘরে প্রবেশ করল লায়লা। তার হাতে একটা ইনভেলাপ। ইনভেলাপটি রাশিদীর হাতে তুলে দিতে দিতে বলল, ‘ভাইয়াকে দাও, রোসেলিনের আব্বার চিঠি।’
রাশিদী ইনভেলাপটি আহমদ মুসার হাতে তুলে দিল।
বন্ধ ইনভেলাপ থেকে চিঠি বের করল আহমদ মুসা। পড়ল চিঠি। চিঠি পড়ে তার ঠোঁটে এক টুকরো হাসি ফুটে উঠল। বলল, ‘রাশিদী, রোসেলিনের আব্বা তোমার সাথে রোসেলিনের বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছেন।’
‘আপনার কাছে?’ ঠোঁটে হাসি টেনে বলল লায়লা।
‘হ্যাঁ। সম্ভবত আমাকেই এখন রাশিদীর যথার্থ অভিভাবক মনে করেছেন।’ হাসল আহমদ মুসা।
‘তাঁর মনে করাটা সত্য। আপনার চেয়ে আমার বড় অভিভাবক এই দুনিয়ায় আর কে হতে পারেন?’
‘আম্মা মানে তোমার আম্মার অধিকার অস্বীকার করোনা, রাশিদী।’ বলল আহমদ মুসা হাসতে হাসতে।
‘আম্মাকে জিজ্ঞেস করে দেখুন, এ অধিকার আম্মা আপনার হাতেই তুলে দিয়েছেন।’ বলল রাশিদী।
‘তাহলে এ অধিকার কিন্তু আরও অনেক জায়গায় খাটাব।’
‘যেমন?’ বলল রাশিদী।
‘রোসেলিনের আব্বা একটা প্রস্তাব দিয়েছেন, আমারো একটা প্রস্তাব আছে।’
রাশিদীর মুখ মলিন হয়ে উঠল।
আহমদ মুসা ব্যাপারটা আঁচ করতে পেরে হেসে বলল, ‘ভয় করো না, তোমার বিয়ের পাল্টা প্রস্তাব নয়, অন্য বিয়ের একটা প্রস্তাব আমার আছে।’
রাশিদী লজ্জায় মুখ নিচু করল। পরক্ষণেই মুখ তুলে বলল, ‘প্রস্তাবটা বলুন।’
‘বলব?’ বলে একটু থামল আহমদ মুসা। তারপর বলল, ‘এলিসা গ্রেস এর সাথে ওমর বায়া এবং বোন লায়লার সাথে ভাই মুহাম্মাদ ইয়েকিনির বিয়ে তোমাদের সাথে একই সময়ে হয়ে যেতে পারে।’
শুনেই রাশিদী সোৎসাহে বলে উঠল, ‘এক সাথে মানে, এদের বিয়েই আগে হবে।’
মুহাম্মাদ ইয়েকিনি লজ্জায় মুখ নিচু করল। আর দু’হাতে মুখ ঢেকেছে লায়লা।
‘আগে হওয়ার যুক্তি কি?’ হেসে বলল আহমদ মুসা।
‘প্রধান যুক্তি হলো, লায়লা সব সময় কথা বলা, দাবী আদায়, খাওয়া- সব ব্যাপারে আমার উপরে এবং আগে থাকতে চায়, সুতরাং এ ব্যাপারেও…।’
‘চাইলে কি হবে, তুমিই তো আগে থাক।’ লজ্জা রাঙা মুখে লায়লা তীব্র প্রতিবাদ করল।
‘ঠিক আছে, আর আগে থাকব না।’
লায়লা মুখ খুলতে যাচ্ছিল। আহমদ মুসা বাধা দিয়ে হেসে বলল, ‘ তোমাদের ভাইবোনের ঝগড়া আপাতত বন্ধ। আগে-পরের ব্যাপারটা আমি দেখব।’ বলে থামল আহমদ মুসা।
কিছু বলতে যাচ্ছিল আহমদ মুসা। তার আগেই মুখ খুলল লায়লা। বলল, ‘চিঠি তো অনেক বড় দেখছি, আর কি লিখেছে,ভাইয়া?’
আরও কিছু আছে নাকি?’ বলল আহমদ মুসা।
‘আছে বলে মনে হয়’। লায়লা বলল।
‘কেমন করে জান? পড়েছ নাকি চিঠি?’
‘তওবা। এটা আমি করতে পারি না। রোসেলিন আমাকে টেলিফোনে বলেছে’।
‘রোসেলিন কি করে জানে?’
‘তার আব্বা এবং মারিয়া আপার আব্বার কথা সে শুনেছে’।
‘রোসেলিন কি বলেছে লায়লা? বলল রাশিদী একটু ফাঁকা পেয়ে।
‘বলব ভাইয়া?’ আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে মুখ টিপে হেসে বলল লায়লা।
জবাব না দিয়ে আহমদ মুসা চিঠিটা এগিয়ে দিল রাশিদীর দিকে ম্লান হেসে।
রাশিদী ইয়েসুগো চিঠিতে চোখ বুলিয়ে লাফিয়ে উঠল খুশীতে। প্রায় চিৎকার করে বলল, ‘মারিয়া আপা ও আহমদ মুসা ভাইয়ের ঐতিহাসিক বিয়ে যদি ক্যামেরুনে হয়, ধন্য হবে ক্যামেরুন’।
‘ঠিক বলেছ ভাইয়া। ক্যামেরুনের মুসলিম সমাজের জন্যে এর চেয়ে বড় আনন্দ আর কিছু হয়নি, আর হবেও না। তবে ভাইয়া বিয়েটা কিন্তু আমাদের বাড়িতে হতে হবে। রোসেলিন চাইবে বিয়ে, তাদের বাড়িতে হোক। তুমি রোসেলিনের পক্ষে যেতে পারবে না’। উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলল লায়লা।
আহমদ মুসা গম্ভীর। কোন কথা বলল না।
এ সময় এদিনের খবরের কাগজ দিয়ে গেল বেয়ারা এসে।
খবরের কাগজ রাশিদী ইয়েসুগোই তুলে নিল প্রথম হাতে। কাগজ হাতে নিয়ে প্রথম পাতায় চোখ বুলিয়েই চিৎকার করে উঠল রাশিদী।
‘ভাইয়া সর্বনাশ হয়ে গেছে’। কেঁপে উঠেছিল রাশিদীর কণ্ঠ।
‘কি হয়েছে রাশিদী? কিসের সর্বনাশ?’ আহমদ মুসার কণ্ঠে বিস্ময়।
রাশিদী তখন হুমড়ি খেয়ে পড়েছে একটা নিউজের উপর। পড়ছে নিউজ সে। মুহূর্ত কয়েক পরে কিছু না বলে শুকনো মুখে কাগজটি এগিয়ে দিল আহমদ মুসার দিকে।
খবরের কাগজ হাতে নিয়ে প্রথম পাতায় চোখ বুলাতেই চোখে পড়ল নিউজটা। হেডিংটা পড়ে বেদনায় পাংশু হয়ে গেল আহমদ মুসার মুখ।
নিউজের হেডিং-এ বলা হয়েছেঃ
ভয়াবহ বিষ্ফোরণে বারবারেতির ইসলামী সম্মেলন কেন্দ্র উড়ে গেছে। সম্মেলনের সকল মেহমান ও নেতৃবৃন্দ নিহত।
রুদ্ধশ্বাসে নিউজটা পড়ল আহমদ মুসাঃ ‘সম্মেলনের অধিবেশন চলাকালে গতকাল রাত ৯টা ৩ মিনিটে ভয়াবহ এক বিষ্ফোরণে গোটা সম্মেলন কেন্দ্র উড়ে গেছে এবং বিশ্ব মুসলিম কংগ্রেসের প্রধান শেখ আবদুল্লাহ আলী আল রাশিদ মাদানীসহ উপস্থাত সকল মেহমান নিহত হয়েছেন।
ঘটনার বিবরণে বলা হয়েছে, ‘সম্মেলনের দ্বিতীয় রুদ্ধদ্বার সেশনের সমাপ্তি পর্বে এই বিষ্ফোরণের ঘটনা ঘটে। সম্মেলনে দুই শতাধিক ডেলিগেট এবং প্রায় একক ডজন বিদেশী বিশিষ্ট মেহমানের সকলেই বিষ্ফোরণে নিহত হয়েছেন বলে নিশ্চিত জানা গেছে। রুদ্ধদ্বার হলে উপস্থিত কেউ বেঁচেছে বলে প্রত্যক্ষ দর্শীর কোন বিবরণ পাওয়া যাচ্ছে না। শুধু মূল সম্মেলন কক্ষ নয়, ঐ সম্মেলন ভবনে যারা ছিল, তাদের দেহও বিষ্ফোরণে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন ও ভষ্মিভূত হয়েছে। ভবনের আশেপাশের লোকদের আহত অবস্থায় পাওয়া গেছে। সম্মেলনের প্রোগ্রাম থেকে জানা যাচ্ছে, অধিবেশন সমাপ্ত হবার কথা রাত ৯টায়। তারপেরই এশার নামায হবার কথা। মনে করা হচ্ছে, নামাযের জন্যে সম্মেলনের মেহমান ও নেতৃবৃন্দ যখন মঞ্চের পেছনে এসছিলেন এবং ডেলিগেটরাও যখন তৈরী হচ্ছিল নামাযের জন্যে, সেই সময় বিষ্ফোরণটি ঘটে। সম্মেলনের প্রোগ্রাম থেকে দেখা যাচ্ছে, বিষ্ফোরণের সময় সম্মেলন কক্ষে বিশ্ব মুসলিম কংগ্রেসের প্রধান শেখ আবদুল্লাহ আলী আল রাশিদ মাদানী, মুসলিম যুব সম্মেলনের প্রেসিডেন্ট কামাল ইনুনু, মিসরের আল আজহারের গ্রান্ড শেখ সাইয়েদ আলী কুতুব প্রমুখ ১২জন বিশ্ব বরেণ্য মুসলিম ব্যক্তিত্ব হাজির ছিলেন। তাছাড়া ছিলেন ‘ডার্ক আফ্রিকা ব্রাইট হার্ট’ সংগঠনের সভাপতি তারেক আল মাহদি সুদানী সহ কয়েকজন নেতা। অনুমান করা হচ্ছে বিষ্ফোরণে সকলের মর্মান্তিক প্রাণ বিয়োগ ঘটেছে। প্রায় ধুলো হয়ে যাওয়া ধ্বংস স্তুপে কোন জীবনের অস্তিত্ব তো দূরে থাক, কোন আস্ত দেহের অস্তিত্বও কোথাও আছে বলে মনে করা হচ্ছে না।
এই ধরনের ধ্বংসাত্মক বিষ্ফোরণের ঘটনা আফ্রিকার সাম্প্রতিক ইতিহাসে নেই। স্থানীয় বিশেষজ্ঞদের ধারণা, সম্পূর্ণ নতুন ধরনের দূরনিয়ন্ত্রিত বোমায় ভবনটিক ধ্বংস করা হয়েছে।
ঘটনাকে নাশকতা বলে সবাই মনে করছেন। কিন্তু কারা এই নাশকতামূলক কাজের সাথে জড়িত থাকতে পারে, এ ব্যাপারে কেউ কিছু বলতে পারছে না। উদ্যোক্তা ‘ডার্ক আফ্রিকা ব্রাইট হার্ট’ এবং স্থানীয় মুসলিম সংগঠনের যাদের পাওয়া গেছে, তারা বলেছেন এ ধরনের কাজ করতে পারে, এমন সন্দেহজনক কেউ তাদের নজরে নেই। সম্মেলনের ব্যাপারে কারো বিরোধিতা তো দূরে, সামান্য অসন্তুষ্টি বা দ্বিমতও কারও মধ্যে তারা দেখেননি’।
খবর পড়া শেষ হলেও আহমদ মুসার চোখ কাগজের উপর থেকে সরে এল না। যেন তার চোখ দু’টি আটকে গেছে কাগজের সাথে।
বিষ্ময় ও বেদনার ধাক্কায় তার চিন্তার শক্তি যেন থেমে গেছে, বোবা হয়ে গেছে যেন সে।
এক সময় তার হাত থেকে কাগজটা পড়ে গেল।
সম্বিত ফিরে পেয়ে আহমদ মুসা একটু নড়ে-চড়ে উঠে সোফায় গা এলিয় দিল। একটা ক্লান্তি এসে তাকে ঘিরে ধরল। চোখ বুজল সে। চোখ বুজতেই তার মনটা ছুটে গেল দু’শ বছর আগের একটা ঘটনার দিকে সেদিনও একটা বিষ্ফোরণ এ ধরনেরই একটা সম্মেলন পন্ড করে দিয়েছিল। দুই ঘটনার মধ্যে পার্থক্য হলো, দু’শ বছর আগের বিষ্ফোরণ সংঘটিত সম্মেলনের আগে এবং তাতে বিদেশী মেহমান কেউ মারা যায়নি। আর এ বিষ্ফোরণ সংঘটিত হলো সম্মেলন চলাকালে এবং তাতে নিহত হলেন ডজন খানেক গুরুত্বপূর্ণ মেহমান।
এটুকু পার্থক্য থাকলেও দু’টি ঘটনা একই ধরনের এবং উদ্দেশ্যও নিঃসন্দেহে এক। তাহলে কি ধরে নয়া যায়, একই ধরনের লোক এই দুই ঘটনা ঘটিয়েছে?
চোখ খুলল আহমদ মুসা।
রাশিদী, ইয়েকিনি, লায়লা বিমূঢ় হয়ে পড়েছিল। তাকিয়েছিল আহমদ মুসার দিকে।
আহমদ মুসাই প্রথমে মুখ খুলল। বলল, ‘দু’শ বছর আগের ঘটনারই আবার পুনরাবৃত্তি ঘটল’।
অনেকটা স্বগত কণ্ঠে উচ্চারণ করল আহমদ মুসা।
‘তাহলে কি একই ধরনের শত্রুর কাজ?’ বলল রাশিদী ইয়েসুগো।
সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু নিউজে ওখানকার দায়িত্বশীলরা এটা সরাসরি স্বীকার করেননি’। আহমদ মুসা বলল।
‘দুর্ভাগ্য বারবারেতির বিশেষ কোন দুর্ভাগ্য নয়। ক্যামেরুনে মুসলমানদের যে দুর্ভাগ্য বারবারেতির। এমন দুর্ভাগ্য মনে হয় আফ্রিকার আর কোন নগরীর হয়নি’। বলল রাশিদী ইয়েসুগো।
‘বারবারেতির বিশেষ কোন দুর্ভাগ্য নয়। ক্যামেরুনে মুসলমানদের যে দুর্ভাগ্য দেখছ, তারই অন্য একটা রূপ দেখতে পাচ্ছ বারবারেতিতে। মৌলিক কোন পার্থক্য নেই দুইয়ের মধ্যে’। আহমদ মুসা বলল।
‘বিরাট ক্ষতি হলো মুসলিম বিশ্বের। বিশ্ব মুসলিম কংগ্রেসের প্রধান আবদুল্লাহ আলী, আল আজহারের গ্রান্ড শেখ সাইয়েদ আলীর ক্ষতিপূরণ হবে কি দিয়ে? বিশেষ করে ‘ডার্ক আফ্রিকা ব্রাইট হার্ট’-এর তারেক আল মাহদীর মত আগুনের ছেলেকে মুসলিম আফ্রিকা আবার কবে পাবে কে জানে!’ বলতে বলতে রাশিদী ইয়েসুগোর গলা ভেঙ্গে পড়ল কান্নায়।
‘হ্যাঁ রাশিদী, এ দিক থেকে এটা যে কত বড় ক্ষতি তা পরিমাপ করা যায় না। মন চাচ্ছে, ওদিকে একবার যাই। এতবড় ঘটনা ঘটাতে যারা সাহস পেল তারা অনেক বড় শত্রু’।
‘কে এই বড় শত্রু বুঝতে পারছি না আহমদ মুসা ভাই। ‘ওকুয়া এবং ‘কোক’ মধ্য ও পশ্চিম আফ্রিকার সবচেয়ে বড় সংগঠন। মনে হচ্ছে এই দু’টো সংগঠন আজ যে অবস্থায় পড়েছে, তাতে ঐ ঘটনা ওরা ঘটায়নি। আর যতদূর জানি, মধ্য আফ্রিকা প্রজাতন্ত্রে বড় ধরনের কোন সন্ত্রসী সংগঠন নেই’।
‘কিন্তু ঘটনা তো ঘটেছে। কোন বড় কেউই তা ঘটিয়েছে’।
বলে আহমদ মুসা একটু থামল। তারপর বলল, ‘চল, ক্যামেরুন ক্রিসেন্টের অফিসে যাই। ফ্রান্সিস বাইকদের সাথে একটু কথা বলে দেখি, কোন কথা বের করা যায় কিনা’।
আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল।
তার সাথে সাথে সবাই।
ক’দিন পরের ঘটনা।
| ← Previous | | | Next → | | সম্পুর্ণ বই এক পেজে »