৪
ইয়েউন্ডি থেকে ইয়াউন্ডি-বাতুয়া-বাতুরি হাইওয়ে ধরে পূর্ব দিকে ছুটে চলছিল আহমদ মুসার গাড়ি।
গাড়ির ড্রাইভিং সিটে আহমদ মুসা। পরনে তার পর্যটকের পোশাক। মাথায় স্পোর্টস হ্যাট, কপালের শেষ প্রান্ত পর্যন্ত নামানো।
পেছনের সিটে ব্ল্যাক বুল। অগাস্টিন ওকোচাকে সাথে নেয়ার কথা ছিল, কিন্তু সিদ্ধান্তটা শেষ পর্যন্ত বাতিল করেছে আহমদ মুসা। ওকোচা কিন্তু জেদ ধরেছিল। তার পিতাও বলেছিল, আফ্রিকার বোমাসা অঞ্চলের জন্যে ওকোচা উপকারী হতে পারে। ওকোচার মা এবং স্ত্রী দু’জনেই সায় দিয়েছে তার কথায়। কিন্তু আহমদ মুসা মিষ্টি হেসে বলেছে, ওকে সাথে নিয়ে যতখানি উপকৃত হবো, তার চেয়ে বেশী উপকৃত হবো যদি সে তার এই নতুন নীড়কে আরও সুন্দর করে তোলে।
ব্ল্যাক বুলের পরনে গাইডের পোশাক। তার হ্যাটের শীর্ষে এবং ইউনিফর্মের বুকে গাইডের মনোগ্রাম জ্বল জ্বল করছে। তার মুখ ভরা ফ্রেন্স কাট দাড়ী। ব্ল্যাক বুলকে চেনার কোন উপায় নেই। দাড়ী-গোঁফ, হ্যাট এবং পশ্চিমী ধাচের গাইডের পোশাক পরে সে সম্পূর্ণ নতুন মানুষ হয়ে গেছে।
ব্ল্যাক বুলের সিটের পেছনে তার প্রিয় কুকুর দু’টো। শান্ত বালকের মত পাশাপাশি তারা বসে আছে সামনে তাকিয়ে।
ব্ল্যাক বুলের অনুরোধেই আহমদ মুসা কুকুর দু’টিকে সাথে নিয়েছে। ব্ল্যাক বুল বলেছে, দু’টি কুকুর দু’জন মানুষের চেয়ে উপকারী হবে শুধু নয়, মানুষ পারে না এমন কিছু কাজ কুকুর দু’টি পারবে।
গাড়ি ছুটে চলেছে আহমদ মুসার।
সামনে যে শহরটি তার নাম এ্যাবং এমব্যাংগ। তীরের মত সোজা রাস্তা। আহমদ মুসার হাত দু’টি স্টেয়ারিং-এ স্থির হয়ে আছে। ঝড়ের গতিতে ছুটে চলেছে গাড়ি।
আহমদ মুসার চোখ দু’টি স্থির নিবন্ধ সামনে। হঠাৎ অলস মনের এক কোণে ডোনার অশ্রু সজল মুখটি ভেসে উঠল তার।
মনটা খারাপ হয়ে গেল আহমদ মুসার। আহমদ মুসা কি অবিচার করল ডোনার উপর। বিয়ের আসন থেকে তাকে সরে দাঁড়াতে হয়েছে।
কিন্তু আহমদ মুসার কোন দোষ নেই। সে তো ডোনার উপরই সব ছেড়ে দিয়েছিল। বলেছিল আহমদ মুসা, ‘সব শুনেছ, এখন কি করা যায় বল’। বেদনার একটা হাসি ফুটে উঠেছিল ডোনার ঠোঁটে। বলেছিল, ‘আমাকে বুঝি খুব দুর্বল মনে কর?’
‘না, তা কেন?’
‘তাহলে আমার সাথে আলোচনাকে সিদ্ধান্তের শর্ত বানিয়েছ কেন?’
‘তোমার অধিকার আমি অস্বীকার করতে পারি?’
‘এই সময়ে আমার অধিকার নিয়ে ভাবছ?’
‘এই সময়েই বেশী ভাবা দরকার’।
‘কোন সময়ের কথা বলছ?’ ডোনার ঠোঁটে ফুটে উঠেছিল লজ্জাজড়িত হাসি।
‘আমি বলব না’।
ডোনা মুখ নিচু করেছিল। লজ্জায় লাল হয়ে উঠেছিল তার মুখ।
মুহুর্ত কয়েক মুখ না তুলে বলেছিল, ‘বল কি বলবে?’
‘তুমিই তো বলবে’।
‘আমি জানি তুমি সবদিক না ভেবে সিদ্ধান্ত নাও না। সুতরাং আমার আলাদা কোন বক্তব্য নেই’।
‘কথাটা তুমি খুব সহজে বলে ফেললে। আমার কিন্তু খুব খারাপ লাগছে’।
‘আমার জন্যে, তাই না?’
‘সত্যটা আমি ভুলব কি করে যে, তুমি রাজকুমারী মারিয়া জোসেফাইন লুই এক শান্তির ও নিরুপদ্রব জীবন থেকে ছিটকে পড়েছ আগুনের মধ্যে!’ আহমদ মুসার কন্ঠ ভারি শোনাচ্ছিল।
ডোনা চকিতে আহমদ মুসার মুখের দিকে চোখ তুলে চেয়েছিল। তারপর চোখ নামিয়ে নিয়েছিল। ধীরে ধীরে তার দু’চোখ থেকে গড়িয়ে পড়েছিল দু’ফোটা অশ্রু। বলেছিল, ‘ডোনাকে না বুঝে এভাবেই বুঝি তুমি কষ্ট পাও! তোমাকে কেমন করে বুঝাব যে, তথাকথিত রাজকুমারীর মরুময় জীবন আজ কূল উপচানো সুখ আর প্রশান্তির বাগান। তুমি যাকে আগুন বলছ, তার মত দুনিয়া জোড়া আগুনও এ প্রশান্তির স্পর্শে নিভে যায়’।
‘ধন্যবাদ ডোনা। আমার সৌভাগ্যের জন্যে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করছি’।
‘কোন সৌভাগ্য?’
‘এমন তোমাকে পাওয়ার সৌভাগ্য’।
ডোনা কথা বলেনি। একরাশ লজ্জা এসে তার মুখ রাঙা করে দিয়েছিল। তার বেদনাক্লিষ্ট শুল্ক ঠোঁট ভরে উঠেছিল উজ্জ্বল এক টুকরো হাসিতে। বলেছিল একটু সময় নিয়ে, ‘তোমার সৌভাগ্যের চেয়ে আমার সৌভাগ্য অনেক বড়’।
বলে একটু দম নিয়েই আবার শুরু করল, ‘একটা কথা বলব, সাহস পাচ্ছি না’।
‘কি কথা?’
‘মেইলিগুলি আপা মানে আমিনা আপা এমনি এক অভিযানে তার ‘মা-চু’কে তোমার সাথে দিয়েছিলেন। আমার তো কেউ নেই। আমি তোমার সাথী হতে পারি না?’ কান্নায় বুজে এসেছিল ডোনার কন্ঠ।
‘ডোনা, তুমি বুঝি আমিনার কথা ভুলতে পার না?’ শান্ত, ভারি কন্ঠ ছিল আহমদ মুসার।
‘আমার তো বড় আপা। আপা কি ডোনার মত? তুমি কি তাকে ভুলতে পার?’
‘ডোনা, তুমি তাকে ভালোবেসে তার গোটা আসনটাই তুমি দখল করে নিয়েছ’।
‘না, ঠিক নয়। আমি তার পাশে একটু স্থান ভিক্ষা পেয়েছি মাত্র’। ডোনার চোখে ছিল অশ্রু, ঠোঁটে হাসি।
‘ডোনা, তুমি অনেক বড়। আবার বলছি আমি ভাগ্যবান’।
ডোনা চোখ মুছে বলেছিল, ‘থাক ওসব কথা। আমার কথার জবাব তুমি দাওনি’।
আহমদ মুসা গম্ভীর হয়ে উঠেছিল। বলেছিল, ‘আমার সাথে দেবার তোমার ‘কেউ’ নেই তা ঠিক নয়’।
‘কে আছে?’ চোখ ছানাবড়া করে বলল ডোনা।
‘কেন আল্লাহ। আল্লাহ কি যথেষ্ট নয়?’
শোনার সঙ্গে সঙ্গে ডোনা ‘আল হামদুলিল্লাহ’ বলে দু’হাতে মুখ ঢেকেছিল আনন্দের উচ্ছ্বাসটা ঢেকে ফেলার জন্যে। তারপর মুখের উপর থেকে হাত সরিয়ে উজ্জ্বল চোখ দু’টি আহমদ মুসার দিকে তুলে ধরে বলেছিল, ‘ধন্যবাদ আমাকে স্মরণ করিয়ে দেয়ার জন্যে। আমার তরফ থেকে আল্লাহ তোমার নেগাহবান’।
‘আলহামদুলিল্লাহ। দোয়া করো’।
বলে আহমদ মুসা একটু থেমেছিল। বলেছিল তারপর, ‘তাহলে আসি। ওঁরা অপেক্ষা করছে’।
‘এসো’। বলেছিল ডোনা ম্লান হেসে।
কিন্তু বিদায়ের সময় কেঁদেছিল ডোনা। চোখের অশ্রু আড়াল করার চেষ্টা করেও সে পারেনি।
ডোনার সেই অশ্রু সিক্ত মুখটাই এখন ভেসে উঠছে আহমদ মুসার মানস-চোখে।
আহমদ মুসার চোখের কোণটাও সিক্ত হয়ে উঠেছিল। আহমদ মুসা স্টেয়ারিং থেকে বাম হাতটা সরিয়ে সিটের উপর থেকে রুমালটা তুলে নিয়ে চোখ ভালো করে মুছে নিল।
গাড়ি ছুটে চলছে তীরের বেগে।
‘আবদুল্লাহ (ব্ল্যাক বুল) তোমার বাড়ি বারবারেতি থেকে কতদুর?’ পেছনে ব্ল্যাক বুলের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা।
‘যা দেখেছি ম্যাপে, বাস্তব কিছু জ্ঞান নেই। হবে হয়তো একশ’ দেড়শ’ কিলোমিটার’।
‘আমরা তো বোমাসায় যাব ঐ দিক দিয়েই’।
‘খুব মজার হবে। আমার আবাল্য একটা সাধ এতে পূরণ হবে’।
‘কিন্তু এলাকার মাটি, গাছ ইত্যাদি ছাড়া আর কি দেখতে পাবে?’
‘তবু গ্রামটাকে চোখ ভরে দেখব।’
‘আল্লাহ তোমার আশা পূরণ করুক।’
‘আমরা যখন বোমাসাতেই যাচ্ছি, তখন বাববারেতি না গিয়ে আমরা সামনে কাদেলি হয়ে স্টিম বোটে সংঘ নদী দিয়ে বোমাসা যেতে পারতাম।’
‘তা পারতাম, কিন্তু ঘটনার কেন্দ্র বাবরারেতি অবশ্যয় যাওয়া প্রয়োজন। পণবন্দীদের ওরা কোথায় রাখতে পারে তা জানার সব রকম চেষ্টা আমাদের করা উচিত।’
‘কোথায় রাখতে পারে?’
‘বলা মুস্কিল। কিন্তু আমি ভাবছি আমার আত্নসমর্পণের স্থান ওরা বোমাসায় নির্ধারণ করল কেন?’
‘দুর্গম বলেই হয়তো। সভ্যতার আলো তেকে অনেক দূরে ঐ এলাকা। রেল, বাস ইত্যাদি ঐ এলাকার মানুষ চোখেই দেখেনি এখনও।’
‘কিন্তু একা একজন মানুষকে ধরার জন্যে তাকে দুর্গম এলাকায় নিয়ে যাবার প্রয়োজন কি?’
‘আমি জানি না জনাব। ব্যাারটা অস্বাভাবিক বটে।’
‘অস্বাভাবিক যখন, তখন এর তাতপর্য নিয়ে বাবা উচিত।
কথা শেষ করেই ডানে তাকাল আহমদ মুসা। সামনেই ডানে বাতেরী শহর।
শহরের একেবারে উত্তর পাশ ঘেঁষে হাইওয়েটি। আর সীমান্তের কাছাকাছি ক্যামেরুনের শেষ শহর বারতুয়া অতিক্রম করেছে হাইওয়েটি শহরের দক্ষিণ পাশ ঘেঁষে।
আহমদ মুসার গাড়ি বারতুয়া পার হওয়ার পর দু’কিলোমিটারের মাথায় একটা বিপত্তিতে পড়ল।
আহমদ মুসার গাড়ির সামনে প্রাইভেট পরবহান কোম্পানীর একটা ট্যাক্সি চলছিল। হঠাত ট্যাক্সিটি তার পথ চেড়ে বেঁকে গিয়ে আহমদ মুসার গাড়ির সামনে এসে পড়ল।
ব্যাপারটা এত দ্রুত ঘটে গেল যে আহমদ মুসা তার গাড়ি পুরো নিয়ন্ত্রণে আনার সুযোগ পেল না। আহমদ মুসার গাড়ির মাথা সোজা গিয়ে আঘাত করল বেঁকে আসা ট্যাক্সির সামনের দরজায় কৌণিকভাবে।
ট্যাক্সিটি কিছুটা ছিটকে পড়ে থেমে গেল। আহমদ মুসার গাড়িও থেমে গিয়েছিল। আহমদ মুসা তাড়াতাড়ি গাড়ি থেকে নেমে ছুটল ট্যাক্সিটির দিকে।
ট্যাক্সির সামনের দরজার দুমড়ে গিয়ে কিচুটা ভেতরের দিকে বসে গিয়েছিল।
ট্যাক্সিটিতে ছিল একজন আরোহী এবং একজন ড্রাইভার।
আরোহী মাঝ বয়সী একজন কৃষ্ণাঙ্গ। ড্রাইভারও তাই। আরোহীর মাথার এক পাশের অল্প্ একটু জায়গা থেঁতলে গেছে। আর ড্রাইভারের কপাল অনেকখানি কেটে গেছে বিয়ারিং হুইলে ধাক্কা খেয়ে।
দু’জনেই গাড়ি থকে বের করল আহমদ মুসা।
আরোহীটির মাথার থেঁতলানো জায়গা এবং ড্রাইভারের কাটা কাপাল দিয়ে রক্ত ঝরছিল। ক্ল্যাক বুল ফাস্ট এইড বক্স সহই গাড়ি থেকে নেমেছিল।
আহমদ মুসা তাকে ধন্যবাদ দিয়ে ওদের আহত স্থান ব্যান্ডেজ করে দিল। ফাস্ট এইডের জিনিসপত্র গুছিয়ে নিতে নিতে আহমদ মুসা বলল, ‘শেষ মুহূর্তে আমি আমার গাড়িটি নিয়ন্ত্রণে আনতে পারিনি, আমি দু:খিত।’
‘কি বলেন আপনি। আপনাকেই আমাদের হাজার বার ধন্যবাদ দেয়া উচিত। আপনি গাড়ি যতটুকু সামলিয়ে ছিলেন, ততটুকু না সামলালে গাড়ি চিড়া চেপ্টা হয়ে যেত। আপনি আমাদের বাঁচিয়েছেন।’ বলল ড্রাইভার লোকটি বিনয়ের সাথে।
‘ঠিক বলেছ ড্রাইভার। কিন্তু এমন হলো কেন? গাড়িতে কি তোমার ক্রুটি আছে?’ বলল আরোহীটি।
‘না কোন ক্রুটি নেই। হঠাত ব্রেকফেল এমন কোন দিনই হয়নি।’
‘আপনারা কোথায় যাচ্ছিলেন?’ বলল আহমদ মুসা।
আরোহীটিকে ইংগিত করে ড্রাইভার বলল, ‘উনি যাবেন বারবারেতি। আমি সীমান্ত পর্যন্ত ওকেঁ পেৌছে দিচ্ছিলাম।’
বারবারেতির নাম মুনে চমকে উঠল আহমদমুসা। অজান্তেই তার দৃষ্টি আরোহীটির উপর গিয়ে পড়ল। মনটা আহমদ মুসার খুশীই হলো্ অন্তত বারবারেতির অবস্থা কিছুটা জানা যেতে পারে তার কাছ থেকে। বলর, আহমদমুসা,’ আপনাদের তো ভীষণ অসুবিধা হলো।’
‘আমার কিছু ক্ষতি হলো্ কিন্তু অসুবিধা হলো আমার আরোহীর। আমি কোনভাবে ফিরতে চাই্ উনি সীমান্তে পৌছবেন কি করে। এ সময় ভাড়া গাড়িও মিলবে না্ আপনারা কোথায় যাচ্ছেন?’
‘আমরা বারবারেতি যাচ্ছি। উনি ইচ্ছা করলে আমাদের সাথে যেতে পারেন।’ আহমদ মুসা বলল।
‘আপনি এ সাহায্য করবেন! কি যে উপকার হবে আমার্ ঈশ্বর আপনাকে কৃপা করুক।’ বলল আরোহী লোকটি আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে।
‘ধন্যবাদ।’ বলল আহমদ মুসা্ ট্যাক্সির ড্রাইভার উঠে গিয়ে গাড়ির ইঞ্জিন পরীক্ষা করে এসে বলল, ‘সব ঠিক আছে। এখন অনুমতি দিলে আমি যেতে পারি।’
‘ট্যাক্সিটা কার?’ আহমদ মুসা বলল।
‘প্রাইভেট কোম্পানীর।’
‘আপনার শেয়ার আছে তাতে?’
‘নেই।’
গাড়ি মেরামতের ব্যয় কে বহন করবে?’
‘অর্ধেক বহন করতে হবে আমাকে।’
‘কষ্ঠ হবে না আপনার?’
‘এ প্রশ্ন করছেন কেন?’
‘আমার গাড়ির ধাক্কায় আপনার গাড়ির ক্ষতি হয়েছে। ক্ষতি মেরামতে আমি অংশ নিতে চাই্’
বলে আহমদ মুসা পকেট তেকে এক হাজার ফ্রাংকের পাঁচটি নোট বের করে ড্রাইভারের দিকে তুলে ধরল।
ড্রাইভার টাকা নিতে দ্বিধা করে বলল, ‘আপনি বিদেশী পর্যটক, আমাদের মেহমান। এ টাকা নেয়া অন্যায় হবে।’
আহমদ মুসা টাকাটাতার পকেটে গুজেঁ দিয়ে বলল, ‘গাড়ি অন্যের না হলে এ টাকা আপনাকে দিতাম না্’
কথা না বলে কিছুক্ষণ মাথা নিচু করে থাকল ড্রাইভার্ যখন মাথা তুলল তার চোখ দু’টি ছল ছল করছে। বলল, ‘ আমার মা জটিল অসুখে ভুগছেন। তার চিকিতসার জন্যে কিচু টাকা জমিয়েছি। সেই টাকা দিয়ে গাড়ি ঠিক করব ভেবেছিলাম। আপনার টাকা মা’র চিকিতসা সম্ভব করে তুলবে। প্রভু স্রষ্টা আপনার মঙ্গল করুন।’
‘ধন্যবাদ। আল্লাহ আপনার মাকে সুস্থ করে তুলুক।’ বলে আহমদ মুসা নিজের গাড়ির দিকে এগুলো সেই আরোহী লোকটাকে তার সাথে আসতে বেল।
আহমদ মুসা আরোহীটিকে তার পাশের সিটে বসাল।
‘বারবারেতি বাড়ি বললেন? নাম কি আপনার?’বলল আহমদ মুসা।
‘নাম ডেনিয়েল। বারবারেতি থাকি।’ একটু সময় নিয়ে উত্তর দিল।
আহমদ মুসা চকিতে তার মুখের দিকে একবার তাকাল।
আহমদ মুসা আর কোন প্রশ্ন জিজ্ঞেস না করার আগেই সে প্রশ্ন করল, ‘ আপনি তো পর্যটক। বারবারেতি কি আপনার কাছে আকর্ষনীয়?’
পর্যটক হলে প্রশ্নটার উত্তর কিছু না ভেবেই দিতে পারত আহমদ মুসা। কিন্তু আহমদ মুসা তা নয়। সুতরাং মুহূর্ত কয়েক ভেবে নিয়ে সে বলল, ‘নতুন দেশ নতুন স্থান দেখার মধ্যেই আমার আগ্রহ। আফ্রিকার প্রকৃতিই আমাকে আকর্ষণ করে বেশী।’
‘আফ্রিকার সত্যিকার প্রকৃতি দেখতে হলে যেতে হবে বোমাসা এবং আরও দক্ষিণে।’
‘আমি সব চিনি না। প্রথম সফর তো!’
‘বারবারেতি খারাপ নয়। তবে আধুনিক হয়ে উঠছে তো। বাইরের পর্যটকদের কাছে আকর্ষণ হারচ্ছে। তার উপর ..’
কথা শেষ না করেই থেমে গেল ডেনিয়েল নামের লোকটি।
‘তার উপর কি?’ একটু মুখ ঘুরিয়ে তার দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা।
‘এই সেদিন বারবারেতিতে সাংঘাতিক দুর্ঘটনা ঘটে গেল তো। বাইরের অনেকেই সেখানে আসতে দ্বিধা করছে।’
আহমদ মুসা মনোযোগী হলো ডেনিয়েলের প্রতি। কিন্তু তার দিকে না তাকিয়ে নিরাসক্তভাবে জিজ্ঞেস করল, ‘দ্বিধা করছেন কেন? কোন ভয় আচে? দুর্ঘটনা সম্পর্কে আমি তেমন কিছুই জানিনা।’
‘উল্লেখযোগ্য কিছু বিদেশীসহ অনেক লোক মারা গেছে দুর্ঘটনায়। বাইরের চাপ আছে। তদন্ত চলছে। একটা আতংক আর কি।’
‘তদন্ত চলছে। আবার বাইরের চাপ আছে। তাহলে তো বড় ঘটনা্ আসল ব্যাপার কি বলুন তো?’
‘আমরা সকলে একে একটা বড় দুর্ঘটনা বলেই জানি। অবশ্য কেউ কেউ বলে ওটা একটা লাগানো আগুন। আবার অনেকে মনে করেন, সম্মেলনের উদ্যোক্তারা কোন কারণে কিচু বিস্ফোরক হয়তো ভেতরে রেখেছিলেন। তা থেকেই আত্নঘাতি ঘটনা ঘটেছে।’
‘সম্মেলন স্থানে আগুন লাগাতে যাবে, এমন কোন শত্রু কি সম্মেলনের উদ্যোক্তাদের ছিল?’
‘নিশ্চিত করে কিছুই বলা যায় না। তবে মধ্য আফ্রিকার সম্ভাবনাময় এই অঞ্চলে মুসলমানদের নতুন শক্তিবৃদ্ধির চেষ্টা অনেকেই ভালো চোখে নাও দেখতে পারে।’
‘অনেকে বলতে কাদের বুঝাচ্ছেন? সাধারণ জনগণ?
কাউকেই নির্দিষ্ট আমি করিনি। আমার ধারণা বলেছি মাত্র।
আহমদ মুসার মনে হলো ডেনিয়েল লোকটা জানে অনেক কিছু। কথার ধরনে তাকে খুব চালাক বলে মনে হলো আহমদ মুসার। কে লোকটি? লোকটির চেহারায় ভদ্রতার কাটিং আছে। তার আডালে একটু লক্ষ্য করলেই দেখা যায়, কর্কশ একটা রূপ তার আছে। আর তার ভাষায় আঞ্চলিক টান নেই। অর্থাৎ বাঁটু ভাষা বললেও বাঁটু সে নয়।
মধ্যে আফ্রিকা প্রজাতন্ত্রের কোন এলাকায় আপনার বাডি? জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা
আমার বাডি তানজানিয়ায়। তবে এখানে বহুদিন থেকেই। আবার এসেছি।
কেন জানি হটাত আহমদ মুসার মনে পডল যে বারবারেতির বিস্ফোরণ সম্পর্কিত ব্ল্যাক ক্রসের বিজ্ঞপ্তিটির একটা ঠিকানা স্মরণ করতে পারলো না।
সীমান্তের চেক পোষ্ট এসে গেছে। গাডি থামাতে হলো আহমদ মুসাকে। খুশী হলো আহামদ মুসা সীমান্তের চেক পোষ্টে তেমন কোন ঝক্কি ঝামেলা নেই, শুধু পাসপোর্ট দেখে তাকে একটা ভিসায় সিল দিয়েই খালাস। তাও আবার গাডি থেকে নামতে হয় না। গাডিতে এসে পুলিশ পাসপোর্ট চেক করে।
সীমান্ত অতিক্রমের পর আবার আগিয়ে চলল গাডি সোজা পূর্ব দিকে বারবারেতি লক্ক্যে।
সীমান্ত থেকে ২৫ কিলো মিটার দূরে বারবারেতি পথে আরেকটি ছোত্র শহর। নাম গাম্বুলা।
আহমদ মুসার গাডি। গাম্বুলা শহর অতিক্রম করছিল। শহরের ধক্ষিন পাশ ঘেসে রাস্তি, আর রাস্তার দক্ষিণ পাশ দিয়ে একটা ছোট নদী। শহর অতিক্রম করার আগেই ছোট নদীটি বাক নিয়ে দক্ষিণ দিকে চলে গেছে। তার সাতে বারবারেতির হাইওয়ে থেকে একটা সডক বের হয়ে ছোট নদীটির তীর বরাবর দক্ষিণে চলে গেছে।
বেলা তখন আডাইটার মত।
ছোট শহর তার উপর অফিস ও স্কুল – কলেজ ছুটির পরবর্তী ভাটির সময়। রাস্তা ঘাটে লোকজন। গাডি ঘোডা খুবই কম।
রাস্তাটিও তীরের মত সোজা
দু হাত স্তেয়ারিং এ রেখে দু টি চোখ সামনে ছুডে দিয়ে বলা যায় সিটে গা এলিয়ে দিয়েছিল একটা জীপ গাডি।
সামনেই চলছিল একটা জীপ গাডি।
সামনেই নদীটি দক্ষিণ দিকে বাক নিয়েছে এবং হাইওয়ে থেকে সেই সডকটিও বেরিয়ে গেছে দক্ষিণের দিকে।
জিপটির পেছনের দক্ষিন দিকের রেড লাইট জ্বলে উঠল। সিগনাল দিতে শুরু করল। জিপটা দক্ষিনের সডকে নেমে যাবে জিপটি টার্ন নিতে গিয়ে কয়েকবার হর্ন দিল।
হর্ন শুনে চমকে উঠল আহমদ মুসা।
জিপটি ব্ল্যাক ক্রস এর কোডে হর্ন দিচ্ছে কেন? জিপটি তাহলে কি ব্ল্যাক ক্রস এর।
দ্রত চিন্তা করছিল আহমদ মুসা।
ব্ল্যাক ক্রসকে এত কাছে পেয়ে তেদের তো সে ছেডে দিতে পারে না, দক্ষিণ দিকেই। ব্ল্যাক ক্রসের গাডি কোথায় যাচ্ছে? বোমাসা এখান থেকে দক্ষিণ দিকেই, ব্ল্যাক ক্রস এর গাডি আনুসরন করে সে ওদের কোন ঘাটি বা ঠিকানা অথবা ভাগ্য সুপ্রসন্ন হলে মুসলিম পনবন্দিদেরও খোজ সে পেয়ে যেতে পারে।
সিদ্ধান্ত নিয়ে নিল আহমদ মুসা।
ড্যানিয়েলকে উদ্ধেশ্য করে বলল মিঃ ডেনিয়েল এখানে থেকে বারবারেতি যাবার ট্রান্সপোর্ট পাওয়ায় কোন আসুবিধা আছে?
না এ কথা কেন বলছেন?
আমরা এখানে থেকে একটু বাম দিকে যেতে চাই, আপনার আসুবিধা হয় কিনা তাই বললাম।
আমার কোন আসুবিধা হবে না। কিন্তু আপনারা কি বারবারেতি যাচ্ছেন না?
আপাতত নয়।
আহমদ মুসা লক্ষ্য করলে দেখতে পেত। ডেনিয়েল নামক লোকটির চোখে মুখে মুহূর্তের জন্যে বিস্ময় ফুটে উঠছে, তারপরেই সেখানে বিস্ময়ের বদলে অর্থপূর্ণ এক আনুসদ্ধান ভাব ফুটে উঠল। যেন এই প্রথম বারের মত সে গভীর দৃষ্টতে পর্যবেক্ষণ করছে আহমদ মুসাকে। ধীরে ধীরে সে বলল এখানেই তো আপনাদের বামে ঘুরতে হবে, মোডটার উপর আমাকে নামিয়ে দিন।
আমরা দুঃখিত মিঃ ডেনিয়াল। বলল আহমদ মুসা।
না ধন্যবাদ। পর্যটকদের প্রোগ্রাম ঠিক থাকে না আমি জানি মিঃ ডেনিয়ালের কথাগুলো যত সরল তার মুখের হাসি ততটা সরল নয়।
মোডে নেমে গেল মি;ডেনিয়াল।
আহমদ মুসার গাডি ছুটল নদীর তীর বরাবর দক্ষিণ গামী সডক ধরে ব্ল্যাক ক্রস এর জীপটির পিছু পিছু।
গাডি থেকে নেমেই ডেনিয়াল চারদিকে চাইল ট্যাক্সির সন্ধানে।
ডেনিয়ালের মাথায় চিন্তাটা তখন গুছিয়ে আসেছে। ব্ল্যাক ক্রস এর গাডির হর্ন সেও শুনেছে। সে নিশ্চিত এই হর্ন শুনেই পর্যটক তার গন্তব্য পাল্টেছে এবং ব্ল্যাক ক্রস এর জীপটাকে সে আনুসরন করছে।
কিন্তু কেন? কে এই পর্যটক? কেন ব্ল্যাক ক্রস এর গাডি সে আনুসরন করল। ব্ল্যাক ক্রস এর কোড সে জানল কি করে?
ছোট শহর গাডি পাওয়া মুস্কিল।
একটু ভাবল ডেনিয়েল। তারপর সে অয়্যারলেস ট্রান্সমিটার বের করল পকেট থেকে। ছোট সিগারেট লাইটারের মত।
ডেনিয়েল জানে না ব্ল্যাক ক্রস এর জিপে কে যাচ্ছে। তার কাছে অয়্যারলেস আছে কিনা। তবু ডেনিয়েল ব্ল্যাক ক্রস এর মাস্টের চ্যানেলে মেসেজ থ্রো করল। বলল ছোট কাদেলীয় সডকে ব্ল্যাক ক্রস এর জীপটিকে একজন পর্যটক আনুসরন করছে।
ব্ল্যাক ক্রস এর অয়্যারলেস নেটওয়ার্কের মাস্টার চ্যানেল একটা গোপন ও জরুরী লাইন। চ্যানেলে ব্ল্যাক ক্রস এর সব পয়েন্টে মেসেজ পৌছানো যায়।
মেসেজ পাঠানোর পর মুহূর্তেই জবাব পেয়ে গেল ডেনিয়েল অয়্যারলেসে ভেসে আশা কণ্ঠ বলল ধন্যবাদ মেসেজের জন্য আমি নজর রাখছি। কিন্তু পর্যটকের মতলব কি?
আমি জানি না তবে লোকটা খুব সহজ হবে না। আপনার সাথে কে আছে?
স্ত্রী এবং ছেলে। আমি যাচ্ছি সলো। চিন্তা করো না লডাই করার মত অস্ত্র আমার আছে। গাডি খুজছি আসছি আমি।
কথা শেষ করতেই গাডি পেয়ে গেল ডানিয়েল। গাডি তার ছুটল আহমদ মুসার গাডির পিছু পিছু।
সাম্নের গাডি একই গতিতে চলছে কোথাও দাডায়নি, গতি কমবেশিও হয়নি।
| ← Previous | | | Next → | | সম্পুর্ণ বই এক পেজে »