১
আহমদ মুসার গাড়ি যখন চলছিল ক্যামেরুন ক্রিসেন্টের অফিসের দিকে, সেই সময় আহমদ মুসার কানে আযানের শব্দ ভেসে এল ‘ক্যামেরুন ক্রিসেন্ট’ –এর মসজিদ থেকে।
আহমদ মুসা ব্রেক কষল গাড়ির।
‘আমাদের সবাইকে এখানে নামতে হবে?’ বলল ওমর বায়া।
‘হ্যাঁ। তবে আমরা শুধু নামায পড়ব এখানে’। বলল আহমদ মুসা।
‘সময় আছে, গন্তব্যে পৌঁছে আমরা নাময পড়তে পারতাম না?’ ওমর বায়া বলল।
‘পারতাম। কিন্তু নামাযের আহবান যে কানে এল?’
‘যেখানে এ আহবান কানে আসবে, সেখানে নামাযের জন্যে দাঁড়ানো কি অপরিহার্য?’
‘অপরিহার্য নয়, কিন্তু এই মুহূর্তে অপরিহার্য মনে হচ্ছে’।
‘এই মুহূর্তে? কেন?’
‘এমন একটা বিজয় হাতে নিয়ে ফিরছি, যা চাওয়ার চেয়ে বেশী। যিনি এ বিজয় দিয়েছেন, তার ইবাদতের আহবান উপেক্ষা করে এগুতে পারছি না। তাঁর কাছে হাজির হওয়ার এ সুযোগ আমার কাছে অমূল্য মনে হচ্ছে’।
বলল আহমদ মুসা ডঃ ডিফরজিস-এর দিকে চেয়ে বলল, ‘প্লিজ ডক্টর, একটু কষ্ট করুন’। তারপর ওকোচার দিকে চেয়ে বলল, একটু বস কেমন?’
আহমদ মুসা ও ওমর বায়া গাড়ি থেকে নামল।
পুরো ৪৫ মিনিট সময় লাগল আহমদ মুসাদের ফিরে আসতে।
মুসল্লিদের অনেকেই, যারা খবর জানে, বিস্মিত হয়েছে এবং মৌমাছির মত ছেঁকে ধরেছে আহমদ মুসাকে। তাদের প্রশ্নের জবাব দিয়ে ফিরতে সময় আরও বেশী খরচ হলো।
গাড়িতে উঠতে উঠতে আহমদ মুসা ডঃ ডিফরজিসকে বলল, ‘মাফ করবেন, বেশ দেরী হয়ে গেল’।
‘একটি সম্মিলিত প্রার্থনার জন্যে ৪৫ মিনিট সময় কি বেশী?’ বলল ডঃ ডিফরজিস।
‘ধন্যবাদ। তবে প্রার্থনার জন্যে সময় বেশী লাগে না। কিন্তু ‘আযান’ বা আহবানের পর প্রার্থনায় যোগদানের জন্যে আধাঘন্টার মত সময় দেয়া হয়। এতেই সময় বেশী যায়’। আহমদ মুসা বলল।
‘তোমার অবিশ্বাস্য ধরনের কাজ এবং সাহস আমাকে বিস্ময়বিমূঢ় করেছে, কিন্তু তার চেয়েও বিস্মিত হয়েছি ইশ্বরের প্রতি তোমার ভালোবাসা দেখে। আজ তো আধুনিকতা ও ধার্মিকতা পরস্পর বিরোধী হয়ে দাঁড়িয়েছে’। বলল ডঃ ডিফরজিস।
‘আধুনিকতা যদি হয় আধুনিক জ্ঞানে সজ্জিত হওয়া, তাহলে সে আধুনিকতা স্রষ্টার প্রতি ভালোবাসা বৃদ্ধি করে। আর আধুনিকতা বলতে যদি বুঝানো হয় জ্ঞান ও বুদ্ধির দুয়ারে তালা মের আধুনিক পণ্য-সম্ভারের মধ্যে নিমজ্জিত থাকা, তাহলে এই আধুনিকতা অবশ্যই স্রষ্টাকে ভুলিয়ে দেবে’। আহমদ মুসা বলল।
‘সুন্দর বলেছ’। বলে একটু থামল ডঃ ডিফরজিস। তারপর আবার বলল, ‘তুমি আমার ছেলের বয়সের। শুরু থেকেই একটা তীব্র কৌতুহল মনে জাগছে। জিজ্ঞেস করব?’
‘ছেলের মতও বলতে পারেন। কুমেটে আপনর ছেলে এবং আপনার বৌমা ডেবরার সাথে আমার দেখা হয়েছে’।
‘দেখা হয়েছে? তাদের সাথে? কিন্তু ওরা তো ব্ল্যাক ক্রস-এর হাতে বন্দী’।
‘ক্যামেরুনে আসার আগে তাদের সাথে আমি একই রেষ্টহাউসে ছিলাম কয়েকদিন’।
বলে আহমদ মুসা তাদেরকে কিভাবে উদ্ধার করে তার কাহিনী বলল।
বিস্ময়ে প্রায় বাকরোধ হয়ে গেল ডঃ ডিফরজিসের। কিছুক্ষণ পর বলল, ‘তুমি… তুমি উদ্ধার করেছ তাদেরও! কবে?
আহমদ মুসা তারিখ বলল।
ডঃ ডিফরজিস বলল, ‘আমি তো ঐ তারিখেই কিডন্যাপ হই’।
‘আমরা জানি। কিড্ন্যাপ ঠেকাবার জন্যে আমরা বিমান বন্দরে গিয়েছিলাম। কিন্তু দেরী হয়েছিল। যখন ওরা কিডন্যাপ করে পালাচ্ছিল, তখন আমরা রাস্তায়। আমরা ব্যর্থ হয়েছিলাম’।
‘আমার কিডন্যাপ হওয়ার বিষয় আগেই জানতে?’
‘অনুমান করেছিলাম’।
‘কিভাবে’?’
‘সে অনেক কথা’।
‘আমার ছেলে ও বৌমাকে উদ্ধার করার পর কি করলে?’
আহমদ মুসা সংক্ষেপে কাহিনী বর্ণনা করল। তারপর বলল, ‘উদ্ধারের পর যখন ওদের কিডন্যাপ করার কারণ জানতে পারলাম এবং যখন জানলাম আপনি কুমেটে আসছেন, তখন নিশ্চিত হয়েছিলাম আপনার ছেলে ও বৌমা ওঁদের হাতছাড়া হবার পর ওরা আপনাকে কিডন্যাপ করবে’।
‘অসাধারণ বুদ্ধি তোমার। প্রশংসা করে তোমাকে খাটো করবো না। আমার ছেলে ও বৌমা কেমন ছিল? ওদের কোন প্রকার ক্ষতি হয়নি তো? শয়তানরা যে বার বার বলেছে আমার ছেলে ও বৌমা ওদের হাতে রয়েছে?’
‘আপনাকে দুর্বল করার জন্যে মিথ্যা কথা বলেছে। আপনার ছেলে ও বৌমা ভালই ছিল’।
‘ঈশ্বরকে ধন্যবাদ। ঈশ্বর তোমার মঙ্গল করুন। তোমার এসব কথা শুনে আমার কৌতুহল আরও বেড়েছে। আমার প্রশ্নের কি জবাব দেবে?’
‘কি প্রশ্ন?’
‘তোমার সম্পর্কে সামান্য কিছু শুনেছি ওমর বায়ার কাছে। সে বলতো, ‘একজন লোক আছে, সেই শুধু পারে আমাদের উদ্ধার করতে। অবশেষে সেই ‘একজন’ তুমি আমাদের উদ্ধার করলে। তুমি কে বৎস?’
‘দেবার মত বিশেষ পরিচয় আমার নেই। কোন দেশের কোন পদে আমি ছিলাম না। কোন বিষয়ে বিশেষজ্ঞ ছিলাম এমন পরিচিতি আমার নেই। আমার ছোট্ট একটা নাম আছে- আহমদ মুসা’।
ভোরের ফাঁকা রাস্তা ধরে তীব্র গতিতে চলছিল গাড়ি।
গাড়ি পূর্ণ গতিতে চলা শুরু করলে আহমদ মুসা ও ডঃ ডিফরজিসের মধ্যে কথা আর চলল না।
গাড়ি চালাচ্ছিল আহমদ মুসাই।
গাড়ি প্রথমে চীফ জাষ্টিসের বাসায় নেওয়াই ঠিক করেছে আহমদ মুসা। সেখানে ডঃ ডিফরজিসের সাথে ওমর বায়াকে রেখে ফ্রান্সিস বাইককে রাখার জন্যে যাবে রাশিদীর বাড়িতে। রাশিদীর বাড়িতে নয় অন্য কোথাও তাকে রাখতে হবে।
অন্ধকার তখনো পুরোপুরি কাটেনি।
আহমদ মুসার গাড়ি চীফ জাষ্টিসের গেটে গিয়ে দাঁড়াল।
আহমদ মুসা দেখল, চীফ জাস্টিসের বাড়ির চারদিক ঘিরেই পুলিশ পাহারা।
গেটে পুলিশের একটি গাড়ি দাঁড়িয়ে। গাড়িতে বসে আছে চারজন পুলিশ।
আহমদ মুসার গাড়ি দাঁড়াতেই গাড়ি থেকে চারজন পুলিশ তড়াক করে নেমে ষ্টেনগান বাগিয়ে এগিয়ে এল।
আহমদ মুসা লাফ দিয়ে নামল গাড়ি থেকে। পুলিশের সামনে গিয়ে বলল, ‘আমাকে গেটম্যানের কাছে নিয়ে চলুন’।
পুলিশ আহমদ মুসাকে সার্চ করল। পকেটে কোন অস্ত্র পেল না।
পকেটের রিভলবারটি আহমদ মুসা ওকোচা’র কাছে রেখে এসেছে।
পুলিশ আহমদ মুসাকে নিয়ে গেল গেটের দারোয়ানের কাছে।
দারোয়ানটি আহমদ মুসার অপরিচিত। আহমদ মুসা সেদিন বিকেলে যে দারোয়ানকে দেখেছিল সে এ নয়। আহমদ মুসা গেটম্যানকে বলল, ‘আপনি চীপ জাস্টিস সাহেবকে জানান, ডঃ ডিফরজিসকে আনা হয়েছে’।
‘তাঁকে এখন টেলিফোন করা যাবে না’।
‘তাহলে কাকে করা যাবে?’
‘পি,এ, সাহেব এলে পর’।
‘জাস্টিস সাহেবের সরাসরি টেলিফোন নেই?
‘আমি জানি না’।
‘আমার কাছে আছে নম্বারটা। নিন’। বলে আহমদ মুসা টেলিফোন নম্বারটা গেটম্যানকে দেবার জন্যে হাত বাড়াল।
‘এ সময় স্যারকে টেলিফোন করতে পারবো না’।
আহমদ মুসা পুলিশ অফিসারের দিকে চেয়ে বলল, ‘আপনি করুন, ব্যাপারটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ’।
‘গুরুত্বটা আমাকে বুঝতে হবে’। বলল পুলিশ অফিসার।
এই সময় গেটম্যান তড়াক করে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বলল, ‘আপনার গেট থেকে একটু সরে দাঁড়ান। ছোট ম্যাডাম এদিকে আসছেন’।
বলেই গেটের জানালা থেকে সে সরে দাঁড়াল।
গেটের মাঝ বরাবর তিন ফিট ষ্টিল শিটে ঢাকা। নিচের এক ফিট এবং উপরের এক ফিট ফাঁকা। গেটের পাশে এলে মোটা ষ্টিলবারের পাশ দিয়ে ভেতরের সবকিছুই দেখা যায়।
আহমদ মুসা দেখল, রোসেলিন ছুটে আসছে। তার পরনে ট্র্যাক স্যুট। তার পেছনে পেছনে আসছে আরেকজন। তার গায়ে-মাথায় চাদর দেখেই বুঝল, ও ডোনা হবে।
আহমদ মুসা ছুটে আসা রোসেলিনের কণ্ঠ শুনতে পেল। সে চিৎকার করে বলছে, ‘খুলে দাও দরজা, খুলে দাও দরজা’।
গেট খুলে গেল।
‘আহমদ মুসা ভাই আপনি ফিরেছেন?’ বলে গেটের কাছে এসে রোসেলিন হাঁটু গেড়ে বসে দু’হাত উপরে তুলে উর্ধ্বমূখী হয়ে বলল, ‘ঈশ্বর তুমি দয়ালু, তুমি আমাদের কথা শুনেশ’। আবেগ রুদ্ধ তার কণ্ঠ।
ডোনা এসে রোসেলিনের পেছনে দাঁড়াল। তার স্থির দৃষ্টি আহমদ মুসার উপর নিবদ্ধ। তার চোখে অশ্রু, ঠোঁটে হাসি।
আহমদ মুসা রোসেলিনের দিকে এগিয়ে বলল, ‘শুধু আমি আসিনি রোসেলিন, ডঃ ডিফরজিস এবং ওমর বায়াকেও উদ্ধার করে এনেছি। তোমার আব্বাকে খবরটা জানাও’।
‘কি ডঃ ডিফরজিস মুক্ত? কোথায় তিনি? গাড়িতে? যাই আব্বাকে খবর দেই’। বলে রোসেলিন দৌড় দিল বাড়ির দিকে।
আহমদ মুসা তার গাড়ির পেছন দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ওকোচা তুমি গাড়ি ড্রাইভ করে গাড়ি বারান্দায় নিয়ে এস’।
গাড়ি চলতে শুরু করল।
আহমদ মুসা ও ডোনা পাশাপাশি হাঁটতে লাগল।
ডোনার মুখ নিচু।
আহমদ মুসার মুখও নিচু।
ডোনা তার ডান হাত দিয়ে তার আহত বাম হাতটা ধরে ছিল। আস্তে হাতটা ছেড়ে দিয়ে ডান হাত দিয়ে পকেট থেকে রুমাল বের করে চোখ মুছে নিয়ে বলল, ‘তুমি ঠিক আছ তো? তুমি ভাল আছ তো?’
‘আলহামদুলিল্লাহ। একদম ভাল। তুমি কেমন আছ?’
ডোনা কোন জবাব দিল না। তার মুখ নিচু। হঠাৎ করেই তার মুখটা আবার বেদনাক্লিষ্ট হয়ে উঠেছে।
আহমদ মুসা একবার সেদিকে চাইল।
কিছু বলার জন্যে মুখ খুলেছিল আহমদ মুসা।
কিন্তু তার আগেই ডোনা বলল, ‘তুমি ঠিকানা দিয়ে যাওনি কেন?’ ডোনার কণ্ঠ ভারি।
আহমদ মুসা আরেকবার চকিতে ডোনার দিকে চাইল। তারপর বলল, ‘আমি দুঃখিত ডোনা। কিন্তু তুমি জান কেন আমি অন্যায়টা করেছি’।
‘সেই জন্যেই দুঃখটা আমার বেশী। তুমি শুধু ডোনার নও, তুমি কোটি মজলুম মানুষের। তাহলে কেন তুমি এক ডোনার নিরাপত্তার কথা এমন করে ভাববে তোমাকে বিপদগ্রস্ত করেও’।
‘কেন ভাবি সেটাও তুমি জান। ঘোর যুদ্ধক্ষেত্রেও শান্তির একটা তাঁবু থাকে, জীবনের থাকবে না কেন?’
‘আমি তোমার সাথে এখন তর্কে যাব না। কিন্তু বলব, তোমার পেছনে যারা থাকবে, তাদের চলার পথ চিহ্ণিত করে যাওয়া তোমারই দায়িত্ব, ডোনাকে অন্ধকারে রাখ ক্ষতি নেই’। ডোনার ভেজা কণ্ঠ।
‘আমি শুরুতেই দুঃখ প্রকাশ করেছি। তুমি ক্ষমা করতে পারনি ডোনা?’
‘আমি নিজের জন্যে কিছুই বলছি না, বলছি কোটি মজলুমের পক্ষে। তাদের স্বার্থেই তুমি কোথায় কি করছ তোমার পেছনের লোকদের তা জানা দরকার’।
‘তোমার রক্তে রয়েছে রাজ্য পরিচালনা, প্রজা পরিচালনার অভিজ্ঞতা। তুমি সুন্দর বলেছ ডোনা। আমি চাইলে কি হবে, তুমি একজনের নও সবার হয়ে উঠছ’। ম্লান হাসল আহমদ মুসা।
‘না, আমি ডোনা জোসেফাইন নারী হিসেবে একজনের। কিন্তু সমাজ ও জাতির একজন সদস্য হিসেবে সকলের প্রতি দায়িত্ব আছে, যে দায়িত্ব তুমিও পালন কর। আমার এ দায়িত্ব পালনও তোমার চাওয়ার বাইরে হতে পারে না’।
‘আহমদ মুসা কিছু বলতে যাচ্ছিল। ডোনা বাধা দিয়ে হেসে বলল, ‘আর কিছু বলতে হবে না। দেখ, রোসেলিনের, আব্বা আসছেন’।
গাড়ি তখন গাড়ি বারান্দায় দাঁড়িয়ে গেছে।
রোসেলিনের আব্বা চীফ জাস্টিস উসাম বাইক নেমে আসছেন গাড়ি বারান্দায়।
আহমদ মুসা ও ডোনাও গিয়ে পৌঁছল সেখানে।
চীফ জাস্টিস উসাম বাইক আহমদ মুসাকে দেখতে পেয়েই ছুটে এসে জড়িয়ে ধরল। বলল, ‘বাবা তুমি মানুষ নও, দেবদূত। স্বয়ং ঈশ্বর তোমার হাত দিয়ে কাজ করেন’।
বলে আহমদ মুসাকে ছেড়ে দিয়ে বলল, ‘কোথায় আমার স্যার, আমার পিতা’।
ততক্ষণে ডঃ ডিফরজিস, ওমর বায়া এবং ওকোচা গাড়ি থেকে নেমেছে।
আহমদ মুসাকে ছেড়ে দিয়েই উসামবাইক গিয়ে জড়িয়ে ধরল ডঃ ডিফরজিসকে।
তার অনেকক্ষণ একে অপরকে জড়িয়ে ধরে থাকল। উসাম বাইকের দুই চোখ অশ্রুতে ভরে উঠেছে।
ডঃ ডিফরজিস উসাম বাইকের পিঠ চাপড়ে সান্ত্বনা দিয়ে তাকে ছাড়ল এবং বলল, ‘আমার কিডন্যাপ যেমন আকস্মিক, মুক্তিও তেমনি আকস্মিক’।
‘ঈশ্বরকে ধন্যবাদ। আর ধন্যবাদ এই বিস্ময়কর যুবককে’। আহমদ মুসাকে দেখিয় বলল চীফ জাস্টিস উসাম বাইক।
‘তার বিস্ময়কর কীর্তির কথা আরও শুনেছি। পরিচয় এখনও জানতে পারিনি’।
‘কি বলনি’। বলে চীফ জাস্টিস তাকাল আহমদ মুসার দিকে।
‘সে বলা যাবে’। বলে আহমদ মুসা ওমর বায়াকে পরিচয় করিয়ে দিল চীফ জাস্টিসের সাথে।
তারপর ‘ওকোচা’কে দেখিয়ে বলল, ‘ওর নাম ওকোচা। ওর সম্পর্কে অনেক কথা আছে। ও আমাদের মূল্যবান সাহায্য করেছে’।
ওকোচা’র পিঠ চাপড়াতে গিয়ে চীফ জাস্টিসের চোখ পড়ল গাড়ির ভেতরে। সে দেখতে পেল, গাড়ির মেঝেয় পড়ে আছে হাত-পা বাঁধা সংজ্ঞাহীন বা ঘুমন্ত একজন লোক।
চীফ জাস্টিস বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকাল আহমদ মুসার দিকে।
আহমদ মুসা বুঝল। বলল, ‘আপনি না দেখলেই ভাল ছিল। যাক, উনি ‘ওকুয়া’ এবং ‘কোক’-এর প্রধান ফ্রান্সিস বাইক। প্রয়োজনে ওকে আনা হয়েছে, প্রয়োজন শেষ হলে ছেড়ে দেয়া হবে’।
বলে আহমদ মুসা ‘ওকোচা’র দিকে চেয়ে বলল, ‘ওকোচা তুমি গাড়িতে ওঠ। ওর পাশে বস। আমি ড্রাইভিং সিটে বসছি’।
তারপর চীফ জাস্টিসের দিকে চেয়ে বলল, ‘ওমর বায়া এখন এখানে থাকছে। আমি ফিরে এসে নিয়ে যাব’।
‘তোমরা কোথায় যাচ্ছ?’ বলল চীফ জাস্টিস।
‘রাশিদীর ওখানে যাই। ফ্রান্সিস বাইককে কোথায় রাখব তার পরামর্শ নিতে হবে’।
‘ঠিক আছে যাবে। দু’মিনিট বস। চল ভেতরে’। বলে হাঁটতে শুরু করল চীফ জাস্টিস ডঃ ডিফরজিসকে নিয়ে।
‘এই অবস্থায় বসা কেমন হবে?’
‘তোমার জন্যে সব অবস্থাই মানিয়ে যায়। চিন্তা করো না। চল’।
ডোনা এবং রোসেলিন আগেই ভেতরে চলে গিয়েছিল।
‘গাড়ির দরজাগুলো লক কর। চল গিয়ে একটু বসি। তোমার অসুবিধা হবে না তো?’ বলল আহমদ মুসা ওকোচাকে।
ওকোচা চাবি হাতে গাড়ির দিকে এগুতে এগুতে বলল, ‘না অসুবিধা হবে না। আমার খুব আনন্দই বোধ হচ্ছে’।
‘ওকোচা গাড়ি লক করে ফিরে এলে আহমদ মুসা, ওকোচা ও ওমর বায়া চীফ জাস্টিসের পিছে পিছে প্রবেশ করল বাড়ির ভেতরে।
চীফ জাস্টিস উসাম বাইক ও ডঃ ডিফরজিসের অনুরোধে আহমদ মুসাকে অভিযানের গোটা কাহিনী বলতে হলো।
তাছাড়া আছে যে কথা আহমদ মুসা বলতে পারেনি। কারণ আহমদ মুসা বসে তার কথা শুরু করার আগেই রাশিদী ইয়েসুগো, মুহাম্মদ ইয়েকিনি, লায়লা ইয়েসুগো, ফাতেমা মুনেকা এসে গিয়েছিল।
রোসেলিন তার আব্বাকে ডাকতে এসেই লায়লাকে টেলিফোন করে দিয়েছিল। টেলিফোন পেয়েই ওরা ছুটে এসেছে।
আহমদ মুসা তার অভিজান কাহিনী শেষ করে থামতেই চীফ জাস্টিস উসাম বাইক ওকোচাকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘বাবা আমরা তোমার কাছে কৃতজ্ঞ। তুমি বিরাট ত্যাগ স্বীকার করেছ’।
‘আহমদ মুসা ভাই আমাকে নতুন জীবন দিয়েছেন, আমাদের পরিবারকে, গোত্রকে বিরাট এক হানাহানি থেকে বাঁচিয়েছেন। তার তুলনায় আমি যা করেছি তা খুবই সামান্য’। বলল ওকোচা লজ্জিত কণ্ঠে।
ডঃ ডিফরজিস আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে বলল, ‘আমি ও ওমর বায়া তোমার রক্তের কেউ নই। এরপরও সাক্ষাৎ মৃত্যুকে হাতে নিয়ে ঐভাবে শত্রুপুরীতে প্রবেশ করেছিলে তুমি। ওদের হাতে বন্দী হবার পর আফসোস হয়নি তোমার?’
‘এটা খুব বড় হলো? মানুষ মানুষের জন্যে জীবন দেয়র দৃষ্টান্ত ইতিহাস ভরা’। বলল আহমদ মুসা।
‘প্রায় এক কুড়ি লোককে তোমার হত্যা করতে হয়েছে। তোমার কিছু মনে হয়নি, কিছু মনে হচ্ছে না?’ বলল চীফ জাস্টিস।
আহমদ মুসা মথা নিচু করল। তৎক্ষণাৎ জবাব দিল না।
একটু পর মুখ তুলল। বলল, ‘একটা অত্যন্ত নাজুক প্রশ্ন করেছেন জনাব। এ নিয়ে ভাবতে আমাকে ভয় করে। ওদের ১৮ জনের সবার নিশ্চয় মা, স্ত্রী, ছেলে-মেয়ে আছে। ওরা হয়তো উম্মুখ হয়ে থাকবে তাদের প্রিয়জন কখন ফিরবে সে অপেক্ষায়। কিন্তু যখন শুনবে ঐ হৃদয় বিদারক খবর, তখন সেখানে সৃষ্টি হবে এক হৃদয় বিদারক দৃশ্যের। সন্তান হারা মা, স্বামী হারা স্ত্রী, পিতা হারা সন্তানদের বুক ফাটা কান্ন থামবে কিভাবে, সান্ত্বনা পাবে তারা কিসে, কেমন করে?’
আহমদ মুসার শেষ কথাগুলো কাঁপছিল প্রবল এক উচ্ছ্বাসে। চোখ দু’টি সিক্ত হয়ে উঠেছিল তার।
আহমদ মুসা থেমেছিল।
কারো মুখে কোন কথা নেই। সকলের বিস্ময় জড়িত ভারি দৃষ্টি আহমদ মুসার উপর নিবদ্ধ।
আহমদ মুসা তার চোখ মুছে বলল, ‘আমি এ জন্যে পেছনে তাকাই না জনাব। তাকালে সামনে এগুতে পারবো না’।
‘এত অনুভুতিপ্রবন মন ও আবেগ সিক্ত হৃদয় নিয়ে তুমি কিভাবে এত বড় কঠিন দায়িত্ব পালন কর আহমদ মুসা?’ বিস্ময় জড়িত কণ্ঠে বলল চীফ জাস্টিস উসাম বাইক।
‘অন্যায়ের প্রতিবিধান ও সুবিচারের দাবী সহজাত সব অনুভুতি ও আবেগের চেয়ে বড় বলেই হয়তো’।
‘মানবিক অনুভুতি ও আবেগের দাবীকে কি কখনই বড় করে দেখা যাবে না?’ বলল রোসেলিন।
‘যাবে, যদি তা সুবিচারের পরিপন্থী না হয় এবঙ অন্যায়ের সাহায্য না করে’। বলল আহমদ মুসা।
‘তাহলে মানবিকতা তো কন্ডিশনাল হয়ে যাচ্ছে’। রোসেলিন বলল।
‘অবশ্যই কন্ডিশনাল হবে। কন্ডিশনাল না হলে মানুষ যা করবে, ভাববে তাই যদি মানবিকতার নামে বৈধ হয়ে যায়, তাহলে মানব সমাজ বন্য সমাজে পরিণত হবে’।
‘ন্যায়-অন্যায়ের সংঘাত অর্থাৎ হানাহানির হাত থেকে তাহলে তো বাঁচা যাচ্ছে না। রক্তপাত, মানবতার ক্রন্দন তো তাহলে দেখেই যেতে হবে। সমাধান কোথায়?’ বলল রোসেলিন আবার।
‘যাকে তুমি মানবতার ক্রন্দন বলছ, সেটা মানুষের ক্রন্দন, মানবতার নয়। মানবতার ক্রন্দন আসে শুধু জালেমের জুলুম থেকে। এ জুলুমে মজলুমের মানবতাও কাঁদে, জালেমের মনুষত্ব বা মানবতাও কাঁদে। মানবতা বা মনুষত্বের এই ক্রন্দনের সাথে মানুষের ক্রন্দনের পার্থক্য আছে। বেকায়দায় পড়লে জালেমরাও কাঁদে। এই ক্রন্দন মানুষের, মানবতা বা মনুষত্বের ক্রন্দন নয়’। একটু থামল আহমদ মুসা।
তারপর আবার শুরু করল, ‘তুমি সংঘাতের অবসান চেয়েছ। এটা সকলেরই কাম্য। অন্যায়ের শক্তিকে পরাভুত করে এবং পরাভুত রেখে ন্যায় ও সুবিচারের প্রতিষ্ঠা করতে পারলেই শুধু এই কামনা পুরণ হবে।
কিন্তু এই আদর্শ পরিবেশ কোনদিন আসবে বলা মুস্কিল। কারণ শয়তানি শক্তির পদচারণা কিয়ামতের পূর্ব পর্যন্ত থাকবে। সেই সাথে থাকবে মানুষের লোভ, লালসা এবং স্বার্থপরতার শক্তিশালী প্রবণতা। মানুষের এ কু-প্রবণতাকে শয়তান তার স্বার্থে ব্যবহার করে সংঘাত বাধাবেই’।
‘তাহলে আর করার কি থাকল?’ বলল রোসেলিন।
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘কেন করার মত কাজ তো আরও বাড়ল। অমঙ্গলের শক্তি শয়তান অন্যায়-অবিচারের রাজত্ব কায়েমে যত তৎপর হবে, মঙ্গলের শক্তিকে ন্যায় ও সুবিচার কায়েমে ততই তৎপর হতে হবে। করার কিছু থাকল না বলছ কেন?’
‘তাহলে সংঘাতই মানুষের অবধারিত ভাগ্য হয়ে দাঁড়াচ্ছে’।
‘এবং এটাই জীবন’।
‘তাহলে শান্তি?’
‘মঙ্গলের শক্তি ন্যায় ও সুবিচার প্রতিষ্ঠায় যে সংগ্রাম করে, তা শান্তির জন্যেই। কিন্তু শান্তি যদি না আসে, তবুও শান্তির সংগ্রামের মধ্যেই মানব জীবনের সাফল্য। এবং এর জন্যে মানুষ পরকালে পাবে পরম পুরষ্কার, অনন্ত এক শান্তির জীবন’।
‘আপনি জীবন থেকে পরজীবনে চলে গেলেন’।
‘স্বাভাবিক। অতি সংক্ষিপ্ত এই জীবন তো অনন্ত পরজীবনে প্রবেশের একটা টিকিট ঘর মাত্র’।
‘ধন্যবাদ্ বন্দুক হাতে আপনি যতটা দক্ষ, ধার্মিকতার দিক দিয়ে আপনি ততটাই দক্ষ’।
‘ঠিক বলেছ মা। আমার প্রশ্নেরও জবাব পেয়ে গেছি। বিপ্লবী হিসেবে আহমদ মুসা যত বড়, তার মানবতাবোধও তত বড়’। বলল রোসেলিনের আব্বা উসাম বাইক।
টেলিফোন বেজে উঠল।
রোসেলিন গিয়ে টেলিফোন ধরল। টেলিফোন ধরেই বলল, ‘আব্বা তোমার টেলিফোন’।
বলে কর্ডলেস টেলিফোন এনে রোসেলিন তার আব্বার হাতে দিল।
‘মাফ করবেন, টেলিফোনটা ধরে নেই’। সবার দিকে চেয়ে কথা কয়টি বলে চীফ জাস্টিস টেলিফোনে কথা বলতে শরু করল।
অনেকক্ষণ ধরে টেলিফোনে কথা হলো। চীফ জাস্টিস কথা বলল কম, ‘ইয়েস’, ‘নো’ ধরনের দু একটা। অধিকাংশ সময়ই শুনলো।
শুরুতেই চীফ জাস্টিসের চেহারায় কিছু পরিবর্তন এসেছিল। তাকিয়েছিল আহমদ মুসার দিকে।
তার দিকে চীফ জাস্টিসকে তাকাতে দেখেই আহমদ মুসা বুঝতে পেরেছিল নিশ্চয় কথার মধ্যে আহমদ মুসার কথা এসেছে।
তার সম্পর্কে কে কথা বলছে ওঁর সাথে? প্রশ্ন জাগল আহমদ মুসার মনে। ওকুয়ার কেউ? না, পিয়েরে পলের মৃতু্য এবং ফ্রান্সিস বাইক বন্দী হবার পর চীফ জাস্টিসের সাথে তার সম্পর্কে আলোচনার কেউ নেই।
তাহলে?
এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পেল না আহমদ মুসা।
টেলিফোনে কথা বলা শেষ হলো চীফ জাস্টিস উসাম বাইকের।
টেলিফোন পাশে রাখল চীফ জাস্টিস।
প্রথমে আহমদ মুসার দিকে তাকাল। তারপর ডঃ ডিফরজিসের দিকে একবার তাকিয়ে বলল, ‘আহমদ মুসার জন্যে কিছু ভাল খবর রয়েছে’।
‘কার টেলিফোন ছিল জনাব?’ বলল আহমদ মুসা।
‘আমাদের ল’ সেক্রেটারী লাউস মেইডি’র’।
‘ল’ সেক্রেটারী? কি কথা তিনি বললেন?’
নড়ে-চড়ে বসল চীফ জাস্টিস। তারপর বলল, ‘আহমদ মুসার পরিচয় পাবার পর আমি মনে করেছিলাম সে মুসলিম বিশ্বে অত্যন্ত জনপ্রিয়, কিন্তু সে যে অমুসলিম রাষ্ট্রগুলোরও এত প্রিয় তা ভাবতে পারিনি’।
‘কি হয়েছে? উনি কি বললেন আব্ব?’ বলল রোসেলিন।
‘বলছি। ফিলিস্তিন, সৌদি আরব, মিন্দানাও, মধ্য এশিয়া মুসলিম প্রজাতন্ত্র, আফগানিস্তান ইসলামী প্রজাতন্ত্র, বলকান প্রজাতন্ত্র, আজার বাইজান প্রজাতন্ত্র প্রভৃতি দেশের প্রেসিডেন্ট গতকাল আমাদের প্রসিডেন্টের সাথে এবং প্রধানমন্ত্রীর সাথে কথা বলেছেন। তারা জানিয়েছেন, মুসলিম জনগণের প্রিয় নেতা আহমদ মুসাকে ওকুয়া এবং ব্ল্যাক ক্রস ক্যামেরুনে এনে বন্দী করে রেখেছে। আহমদ মুসার মুক্তির ব্যাপারে তারা ক্যামেরুন সরকারের সাহায্য চেয়েছে।
‘ল’ সেক্রেটারী তোমাকে এঁটা জানাল কেন?’ বলল ডঃ ডিফরজিস।
‘ল’ সেক্রেটারী আমার পুরনো বন্ধু। সে টেলিফোন করেছিল সরকারের সংকট জানানোর জন্যে। এই তো ক’দিন আগে ফ্রি ওয়ার্ল্ড টিভি এবং ওয়ার্ল্ড নিউজ এজেন্সী নিউজ করল যে, ওকুয়া সমগ্র দক্ষিণ ক্যামেরুন থেকে মুসলমানদের উচ্ছেদ করেছে, সমগ্র ক্যামেরুনে মুসলমানদের উপর জুলুম চালাচ্ছে ওকুয়া। তার সাথে সাথেই এই খবর যে মুসলিম বিশ্বের প্রিয় ব্যক্তিত্ব আহমদ মুসাকে ওকুয়া বন্দী করে এনেছে। সরকারের কাছে খুবই বিব্রতকর হয়েছে ব্যাপারগুলো। সউদি আরবের বাদশাহ সহ সাতজন রাষ্ট্র প্রধান টেলিফোন করা কম কথা! সরকার সাংঘাতিক চাপের মধ্যে পড়েছে’।
আহমদ মুসার চোখে-মুখে গভীর চিন্তার রেখা। ভাবছিল। চীফ জাস্টিস থামতেই সে বলল, ‘কিন্তু সাতটি মুসলিম দেশ এত তাড়াতাড়ি এই ব্যাপারটা জানল কি করে?’
‘হ্যাঁ, ল’ সেক্রেটারী লাউস মেইডি এ সম্পর্কে বলেছেন। ব্ল্যাক ক্রসের পরিচয় দিয়ে গত পরশু রাতে কারা নাকি এ খবর জানিয়েছে ঐ মুসলিম দেশগুলোকে’।
‘বুঝেছি, ব্ল্যাক ক্রস বিজয়ের বাহদুরিও দেখাতে চায় এবং ব্ল্যাক মেইলও করতে চায়’। বলল আহমদ মুসা।
‘ব্ল্যাক মেইল কিভাবে?’ বলল চীফ জাস্টিস।
‘আহমদ মুসাকে মুক্তি দেয়ার ভোয়া টোপ দিয়ে তারা ঐ মুসলিম রাষ্ট্রগুলো থেকে টাকা খসাতে চায়’।
‘সাংঘাতিক ব্যবসায়’। বলল ডঃ ডিফরজিস।
‘তাদের এ ব্যবসার একদিক দেখলেন, আরও দিক আছে’। বলল আহমদ মুসা।
‘সেটা কি?’ বলল ডঃ ডিফরজিস।
‘ব্ল্যাক ক্রস এ খবর শ্বেতাংগ সন্ত্রাসবাদী সংস্থা ক্লু-ক্ল্যাক্স-ক্ল্যান, ইহুদি বিশ্ব গোয়েন্দা নেট ওয়ার্ক ‘ইরগুন জাই লিউমি’ এবং ধ্বংসাবশিষ্ট বাম গোপন সংগঠন ‘ওয়ার্ল্ড রেড ফোর্স’ (W.R.F) কে জানাবে এবং তারা কে কতত বিলিয়ন ডলার দিয়ে আমাকে কিনতে পারে তার দরকষকষি করবে’। আহমদ মুসা বলল।
‘তারা কিনবে কেন?’ বলল চীফ জাস্টিস।
‘কারণ তাদের বড় বড় পরাজয় ঘটেছে আমার হাতে। আমাকে হাতে পেলে তারা তার শোধ নিতে পারবে এবং আমাকে হাতে রেখে কিছু মুসলিম দেশকে বেকায়দায় ফেলে অতীতের ক্ষতিপূরণ করার চেষ্টা করবে’।
‘তারা বেকায়দায় পড়বে কিভাবে?’ বলল ডঃ ডিফরজিস।
‘কিছু মুসলিম রাষ্ট্র আছে যারা বৈষয়িক যে কোন মূল্যের চেয়ে আমার নিরাপত্তাকে বড় বলে মনে করে’।
‘বুঝেছি। তুমি ভাগ্যবান আহমদ মুসা’। বলল ডঃ ডিফরজিসই আবার।
‘ঠিক। ঈশ্বরকে ধন্যবাদ্ তিনি বড় বিপদ থেকে তোমাকে এবং তোমার জাতিকে রক্ষা করেছেন’। একটু থেমে চীফ জাস্টিস বলল, ‘ক্যামেরুনে তোমার আমার লক্ষ্য তো অর্জিত হয়েছে। এখন তোমার পরিকল্পনা কি?’ বলল চীফ জাস্টিস।
‘প্রথম লক্ষ্য অর্জিত হয়েছে দ্বিতীয় লক্ষ্য এখনো অর্জিত হয়নি’।
‘দ্বিতীয় লক্ষ্য কি? বলুন’। চীপ জাস্টিস বলল।
‘উচ্ছেদ হওয়া মুসলমানদের তাদের সহায়-সম্পত্তি ফিরে পাওয়া এবং তাদের পুনর্বাসন’।
‘এ তো বিরাট কাজ। এটা কিভাবে সম্ভব হবে?’ চীফ জাস্টিসই বলল।
‘সে পরিকল্পনা করেছি। ফ্রান্সিস বাইককে এ জন্যেই বন্দী করে এনেছি’।
‘ঈশ্বর তোমাকে সাহায্য করুন’।
‘আমিন’।
বলে আহমদ মুসা তাকাল রাশিদী ইয়েসুগোর দিকে। বলল, রাশিদী ফ্রান্সিস বাইককে তোমার গাড়িতে পার করে নাও। ওকোচা অনেক কষ্ট করেছে, আর নয়। ওর বাড়িতে এতক্ষণ নিশ্চয় কান্নার রোল পড়ে গেছে’।
‘না আহমদ মুসা ভাই, আমার কোন কষ্ট হয়নি। আমাকে নিয়ে তাড়াহুড়া করবেন না’। বলল ওকোচা।
‘কিন্তু বাড়ির সবাই তোমার জন্যে কষ্ট পাচ্ছে। শেষ রাতে বাড়ি থেকে বেরিয়েছ। স্ত্রীকেও বলনি। বাড়িতে গিয়ে দেখ কি সাংঘাতিক অবস্থা। থানাতেও খবর হয়ে গেছে এতক্ষণ’।
‘কিন্তু আপনাকে সাথে নিয়ে যেতে চাই। সবাই খুশী হবে’।
‘আমি জানি। আমি যাব, তবে তোমার সাথে নয়। তুমি যে আমাকে সাহায্য করেছ, একথা তোমাকে গোপন রাখতে হবে’।
‘কেন?’
‘কারণ আমি চাই না তোমাদের পরিবার বিপদগ্রস্ত হোক’।
‘ওকুয়া জানবে কি করে?’ বলল ওকোচা।
‘তোমার পরিবারের কেউ ওকুয়াকে বলবে না। কিন্তু এমন কেউ জেনে ফেলতে পারে যার কাছ থেকে ওকুয়ার কানে কথা পৌঁছতে পারে’।
‘বুঝলাম। মানলাম। তাহলে আপনি কবে কখন যাচ্ছেন?’
‘সেটা বলা মুস্কিল। তবে যাব। তোমার সাহায্য আমার দরকার হতে পারে’।
‘ধন্যবাদ ভাইয়া। আপনি শুধু আমাকে নতুন জীবন দেননি। আমার মনে হচ্ছে নতুন দৃষ্টিও আপনার কাছ থেকে পাব’। বলে উঠে দাঁড়াল ওকোচা।
রাশিদী ইয়েসুগো এবং মুহাম্মাদ ইয়েকিনিও উঠে দাঁড়িয়েছিল।
আহমদ মুসা উঠে হ্যান্ডশেক করল ওকোচার সাথে। তারপর তার পিঠ চাপড়ে বলল, ‘তুমি অবিশ্বাস্য কাজ করেছ ওকোচা। আমি কৃতজ্ঞ’।
‘ছোট ভাইকে এভাবে কেউ বলে?’ আহমদ মুসার দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে ক্ষোভ ভরা কণ্ঠে বলল ওকোচা।
আহমদ মুসা ওকোচাকে বুকে জড়িয়ে ধরল বলল, ‘ঠিক আছে, আর বলল না।’
ওকোচা, রাশিদী এবং ইয়েকিনি বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।
ওরা বেরিয়ে গেলে ডঃ ডিফরজিস বলল, ‘তুমি ঠিক বলেছ আহমদ মুসা। ছেলেটা অবিশ্বাস্য কাজ করেছে।’
আহমদ মুসা কিছু বলতে যাচ্ছিল। এই সময় ঘরে প্রবেশ করল ডোনার আব্বা মিশেল প্লাতিনি।
মিশেল প্লাতিনি প্রবেশ করতেই ডঃ ডিফরজিস উঠে দাঁড়াল। মিশেল প্লাতিনি এবং ডঃ ডিফরজিস পরস্পরকে জড়িয়ে ধরল।
তারপর উভয়ের মধ্যে কুশল বিনিময় হলো, কথা হলো।
এক পর্যায়ে চীফ জাস্টিস উসাম বাইক মিশেল প্লাতিনিকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘বিরাট লস করেছেন। অপরুপ কাহিনী থেকে বঞ্চিত হলেন।’
‘হ্যাঁ, দুর্ভাগ্য আমার।রোসেলিন মা, ডোনা মা দু’জনেরই টেলিফোন পেয়েছি। কিন্তু ড্রাইভার ছিল না। আমাকে একা বেরুতে দিলেন না এ্যামবেসেডর।’ বলল মিশেল প্লাতিনি।
ড্রইং রুমে প্রবেশ করল রাশিদী ইয়েসুগো এবং মুহাম্মদ ইয়েকিনি।
রাশিদী ও ইয়েকিনি এসে বসতেই আহমদ মুসা রাশিদীকে জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি ওকোচাকে তোমার বাড়ির ঠিকানা দাওনি তো?’ আহমদ মুসা চোখে-মুখে কিছুটা শংকার মিশ্রণ।
রাশিদী সেদিকে চেয়ে বলল, ‘না’ কেন জিজ্ঞেস করছেন? দেয়া কি উচিত ছিল?’
‘ধন্যবাদ। না দিয়ে ঠিক করেছে।’
‘কেন। তাকে সন্দেহ করেন? এ জন্যেই কি তাকে আমাদের সাথে আমাদের বাড়ি পর্যন্ত নিলেন না?’
‘তাকে সন্দেহ করি বলে তাকে তোমার বাড়ি পর্যন্ত নিলাম না, তা নয়। আসলে এটা একটা সাবধানতা। আমি মনে করি সে সন্দেহের উর্ধ্বে। কিন্তু সে কারো হাতে পড়তে পারে এবং চাপে পড়ে ফ্রান্সিস বাইকের একটা হদিস হিসেবে তোমার বাড়ির ঠিকানা বলে দিতেও পারে। এমন সম্ভাবনার দরজা এই পর্যায়ে বন্ধ রাখা দরকার।
‘বুঝেছি আহমদ মুসা ভাই। ধন্যবাদ আপনাকে।’ বলল রাশিদী ইয়েসুগো।
‘এতদূর পর্যন্ত সামনে দেখে তুমি পথ চল আহমদ মুসা! আমি হলে তো এক ঠিকানা কেন, সবকিছু তাকে জানাতে দ্বিধা করতাম না।’ বলল চীফ জাস্টিস ইসাম বাইক।
‘এই জন্যেই আহমদ মুসাই শুধু আহমদ মুসা।’ বলে আহমদ মুসার দিকে তাকিয়ে ডঃ ডিফরজিস বলল, ‘এখন কিছু কিছু করে বুঝতে শুরু করেছে তুমি এত সফল কেন?’
আহমদ মুসার চোখে-মুখে লজ্জার একটা ভাব ফুটে উঠেছিল। সম্ভবতঃ কথার মোড় অন্যদিকে ঘুরিয়ে নেবার জন্যে বলল, ‘আমাদের এখন উঠতে হয়।’
বলে চীফ জাস্টিস উসাম বাইকের দিকে চেয়ে বলল, ‘অনুমতি দিন।’
উঠে দাঁড়াল আহমদ মুসা।
রোসেলিনের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আমরা গাড়ি নিয়ে যাচ্ছি, লায়লা ও ফাতেমা মুনেকা থাক। পরে গাড়ি পাঠানো হবে, বা তুমি পৌঁছে দিও।’
রোসেলিন মাথা নেড়ে বলল, ‘আমি পৌঁছে দেব।’
‘ধন্যবাদ।’ বলে আহমদ মুসা তাকাল ওমর বায়ার দিকে। বলল, ‘রাশিদীরা এসেছে, ওমর বায়া তুমি আমাদের সাথে চল।’
ওমর বায়া এলিসা গ্রেসের দিকে একবার চেয়ে উঠে দাঁড়াল। এলিসা গ্রেসও চেয়েছিল ওমর বায়ার দিকে।
ব্যাপারটা নজর এড়াল না আহমদ মুসার। বলল, ‘রোসেলিন, এলিসা গ্রেসকে লায়লাদের সাথে বেড়াতে নিয়ে যেতে পার।’
‘মারিয়া আপাকে?’ বলল রোসেলিন।
আহমদ মুসা একবার ডোনার দিকে চাইল। তারপর রোসেলিনের দিকে চেয়ে বলল, ‘ও সুস্থ হয়ে ওঠেনি। ওর ‘মুভ’ না করাই ভাল।’
ডোনার ঠোঁটে তখন হাসি।
আহমদ মুসা কথা শেষ করতেই ডোনার আব্বা মিশেল প্লাতিনি আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে বলল, ‘এখন তোমার পরিকল্পনা কি?’
‘পিয়েরে পল নিহত হয়েছেন, ফ্রান্সিস বাইককে আমরা বন্দী করেছি। ওকুয়া যে অবিচার করেছে তার প্রতিকারের জন্যে কিছু করতে হবে জনাব। ফ্রান্সিসের একটা ব্যবস্থা করে আপনাদের সাথে দেখা করবে। সব বলব তখন।’
বলে আহমদ মুসা সকলকে সালাম জানিয়ে ঘুরে দাঁড়াল। চলতে শুরু করল। তার সাথে সাথে রাশিদী, ইয়েকিনি এবং ওমর বায়া।
ওদের চলার পথের দিকে তাকিয়ে ছিল সবাই।
চীফ জাস্টিস উসাম বাইক তার পথের দিকে চোখ রেখেই বলল, ‘যন্ত্রের মত কর্তব্য পরায়ন অদ্ভুত মানুষ।’
‘যন্ত্রের কোন অন্তর থাকে না। কিন্তু ওর আছে সাগরের মত গভীর, আকাশের মত উদার একটা মন।’ বলল রোসেলিন।
‘আমি ভেবে পাই না, সার্বক্ষণিক টেনশন নিয়ে ও বাঁচে কি করে?’ বলল চীফ জাস্টিস।
‘না, ও কোন টেনশনে ভোগে না। ওর মধ্যে কোন টেনশন দেখিনি।’ বলল মিশেল প্লাতিনি।
‘উনি নিজেকে নিয়ে ভাবেন না। ফল নয়, কাজ উনার বড়। উনি মনে করেন, কাজ করা, চেষ্টা করার দায়িত্ব তার, ফল দেবেন আল্লাহ। সুতরাং টেনশন তার কাছে আসতে পারে না।’ বলল মিশেল প্লাতিনি।
‘তুমি কিছু বল মারিয়া আপা।’ ঠোঁটে একটা সুক্ষ্ম হাসি টেনে বলল রোসেলিন।
ডোনার মুখে সলজ্জ হাসি ফুটে উঠল। সে উঠে দাঁড়াল। বলল ‘আমার ওষুধ খাবার সময় হয়েছে। আমি চললাম।’
বলে দু’তলার সিঁড়ির দিকে এগুলো।
তার পেছনে পেছনে ছুটল রোসেলিন।
লায়লা এবং ফাতেমা মুনেকাও উঠে দাঁড়াল। তারাও হাঁটতে শুরু করল সিঁড়ির দিকে।
চীফ জাস্টিস উঠে দাঁড়িয়ে মিশেল প্লাতিনির দিকে চেয়ে বলল, ‘আপনি আমার স্টাডি রুমে আসুন। কথা আছে।’
এরপর ডিফরজিসের দিকে চেয়ে বলল, ‘আসুন, আপনি রেস্ট নেবেন।’
ডঃ ডিফরজিস এবং মিশেল প্লাতিনিও উঠে দাঁড়াল।
সবাই চলল দু’তলার সিঁড়ির দিকে।
২
ইয়েসুগো প্রাসাদের ছাদে একটা ইজি চেয়ারে আধাশোয়া আহমদ মুসা।
তার খোলা স্থির চোখ দু’টি লাখো তারার আলো জ্বলা দূর আকাশে নিবদ্ধ।
আকামে চাঁদ তখনো উঠেনি। চাঁদের অভাব পুরণ করতে আকাশে লাখো তারার উজ্জ্বলতার হাসি। কালো আকাশে বুকে আলোর এক উৎসব।
প্রাসাদের আশেপাশে উচু কোন বিল্ডিং নেই। তার ফলে আকাশে আদিগন্ত দৃশ্য চোখে পড়ছে আহমদ মুসার।
ছাদের আলো শেডে ঢাকা হলেও ছাদে অন্ধকার কোথাও নেই।
সিঁড়ির খোলা দরজা পথে ছাদে উঠে এল লায়লা, ফাতেমা মুনেকা, ডোনা এবং রোসেলিন।
ডোনা ও রোসেলিন হাসপাতালে এসেছিল ডোনার চেকিং-এর জন্যে। সেখান থেকে যাবার পথে তারা উঠেছে লায়লার বাড়িতে এইমাত্র। আহমদ মুসা ছাদে লায়লা ডোনাদের নিয়ে এসেছে ছাদে।
সিঁড়ি ঘরটি ছাদের উত্তর-পূর্ব প্রান্তে। তারা সিঁড়ি ঘরের দক্ষিণমুখী দরজা দিয়ে বেরিয়ে আহমদ মুসার সামনেই পড়ে গেল।
অল্প দুরেই আহমদ মুসা আধাশোয়া। সে পশ্চিমমুখী, কিন্তু মাথাটা তখন উত্তর দিকে একটু কাত হয়ে আছে।
চারজন মানুষ ছাদে প্রবেশ করল প্রায় আহমদ মুসার সামনে দিয়ে। কিন্তু কোন প্রতিক্রিয়া নেই আহমদ মুসার মধ্যে।
ওরা একটু এগুলো। দেখল, আহমদ মুসার দৃষ্টি উপরে আকাশের দিকে নিবদ্ধ।
লায়লা কথা বলতে গিয়েছিল। ডোনা তার মুখ চেপে ধরে কথা বলতে দিল না। বলল, ‘দেখা যাক না, কখন আমরা ওর চোখে পড়ি।’
লায়লারা ছাদে ঘুরাঘুরি করল। আহমদ মুসার আশপাশ দিয়েও ঘুরে গেল। আহমদ মুসার দৃষ্টি তাদের প্রতি আকৃষ্ট হলো না।
অবশেষে তারা আবার এসে দাঁড়াল সিঁড়ি ঘরের সেই দরজার কাছে।
‘অবাক ব্যাপার! ওর সংজ্ঞা আছে তো?’ বলল রোসেলিন।
‘না, ইচ্ছা করেই উনি চোখে না পড়ার ভান করছেন আমরা মহিলা বলে।’ বলল লায়লা ইয়েসুগো।
ডোনা হাসল। বলল, ‘না এরকম উনি করতে পারেন না। উনি তাকাবেন না ঠিক আছে, কথা বলবেন না কেন? কিংবা এতগুলো মানুষ তার আশে পাশে ঘোরার প্রতিক্রিয়া হবে না কেন?’
‘তাহলে?’ বলল ফাতেমা মুনেকা।
‘আসলে উনি এ জগতে নেই।’ হেসে বলল ডোনা।
‘তার মানে?’ ফাতেমা মুনেকাই বলল।
‘প্রকৃতির মাঝে বিশেষ করে আকাশের অন্তহীন নীলের বুকে হারিয়ে যাবার তাঁর অভ্যাস আছে।’ বলল ডোনা।
‘হো হো করে হেসে উঠল রোসেলিন।
এবার নড়ে উঠেছে আহমদ মুসা।
সে মথা তুলে তাকিয়েছে লায়লাদের দিকে।
‘ডোনা, উনি জগতে ফিরেছেন। যাও খোঁজ নিয়ে এস।’ বলল রোসেলিন।
‘এস, তোমরাও দেখবে ঘটনাটা কি।’ বলে ডোনা পা বাড়াল আহমদ মুসার দিকে।
লায়লারাও ডোনার পিছু নিল।
‘ডোনা, তোমরা? এ সময় কোত্থেকে?’ ইজিচেয়ারে সোজা হয়ে বসে বলল আহমদ মুসা।
‘উত্তরটা পরে দিচ্ছি। আগে বল, আমরা এখানে কখন এসেছি?
‘এখানে মানে এ বাড়িতে, না ছাদে?’
‘ছাদে।’
‘ও, তোমরা অনেক্ষণ এসেছ বুঝি। খেয়াল করিনি। আমি আকাশটা দেখছিলাম।’ হেসে বলল আহমদ মুসা।
‘দেখছিলেন, না হারিয়ে গিয়েছিলেন?’ বলল রোসেলিন।
হাসর আহমদ মুসা। বলল, ‘মিথ্যে নয় রোসেলিন, আজ ইয়াউণ্ডির আকাশটা হারিয়ে যাবার মতই। আকাশে চাঁদ নেই, মেঘ নেই, কুয়াশা নেই, ধুলোবালিও ইয়াউণ্ডির আকাশে কম, তার উপর এই এলাকার গ্রাউণ্ড লাইনে উজ্জ্বল আলোর কোন ফ্লাশ নেই। যার ফলে তারার যে স্বচ্ছ হাসি আকাশে আমি দেখছি, তা বহুকাল দেখিনি।’
‘কেন ইউরোপে তো আমি এই আকাশ দেখেছি, এই তারার মেলাই দেখেছি।’ রোসেলিন বলল।
‘না দেখনি রোসেলিন।’
বলে আহমদ মুসা উত্তর দিগন্তে বিশ ডিগ্রীর মত কৌণিক অবস্থানের দিকে আংগুলি সংকেত করে বলল, রোসেলিন ঐ দেখ ‘এন্ড্রোমেডা’ গ্যালাক্সি। ইউরোপ থেকে কখনও একে আমি এই ভাবে দেখতে পাইনি। ওর দিকে তাকিয়ে সত্যিই আমি নিজেকে হারিয়ে ফেলেছিলাম। ও আমাদের এই ‘ছায়াপথ’ গ্যালাক্সি থেকে কতদূরে জা?’
‘না তো। বলল রোসেলিন।
‘বিশ লাখ আলোক বর্ষ দূরে। জগতের অত দূরের একটা অংশকে দেখছি ভাবতেই মনটা শিউরে ওঠে না!’ ধোঁয়ার পাতলা একটা পিন্ডের মত দেখাচ্ছে। ওর নাম ‘এ্যান্ড্রোমেডা?’ বলল লায়লা।
‘হ্যাঁ। কিন্ত ওটা ধোঁয়া নয়। আমাদের মাঝার উপর যে তারা জগৎ দেখছি, তার চেয়েও বিশাল তারার জগৎ ওটা। দূরত্বের কারণেই ধোঁয়ার মত আমরা দেখছি।
‘বিশ লাখ আলোক বর্ষ দূরে ওটা! তার পর কি আছে?’ প্রশ্ন করল রোসেলিন।
‘ঐ ‘এ্যান্ড্রোমেডা’র চেয়েও বড় আরও লাখো গ্যালাক্সি আছে, যেগুলো ‘এ্যান্ড্রোমেডা’র থেকেও কোটি কোটি আলোক বর্ষ দূরে।’
বলে আহমদ মুসা দক্ষিণ দিগন্তের দিকে চোখ ফিরাল। তারপর দক্ষিণ দিগন্তের দুটি স্থানের দুইটি ধোঁয়া পিন্ডের দিকে আঙুল স্থির করে বলল, ‘দেখ ঐটা ‘বড় ম্যাজেলানিক’, আর ওটা ‘ছোট ম্যাজেলানিক’ গ্যালাক্সি। বড়টি আমাদের ‘ছায়াপথ’ গ্যালাক্সি থেকে ষোল লাখ আলোক বর্ষ এবং ছোটটি আঠাল লাখ আলোক বর্ষ দূরে।
‘কোটি কোটি আলোক বর্ষ দূরে শেষ যে গ্যালাক্সি, তারপর কি আছে?’ বলল লায়লা ইয়েসুগো।
গোখ বুজল আহমদ মুসা।
অনির্বাচনীয় এক আবেগ এসে তার মুখে চায়া ফেলল। সুক্ষ্ণ একটা কম্পন জেগে উঠল তার ঠোঁটে। ধীরে ধীরে বলল, ‘এর উত্তর বিজ্ঞানী জানে না লায়লা। জানেন শুধু এই মহা সৃষ্টির যিনি মালিক।’
আহমদ মুসার ভারি গলা থেকে কথাগুলো কেঁপে কেঁপে বেরিয়ে এল।
তার চখের কোণায় বেরিয়ে আসা অশ্রু ম্লান আলোতেও চিক করে উঠল।
আহমদ মুসার আকষ্মিক এই পরিবর্তনে বিস্মিত লায়লারা।
আহমদ মুসা তাড়াতাড়ি চোখ খুলে চোখের কোণ মুছে নিয়ে মেখে হাসি টানতে চেষ্টা করে বলল, ‘কিছু মনে করো না তোমরা। চারদিকে অন্তহীনভাবে ছড়ানো সৃষ্টির বিশালত্বের মুখোমুখি দাঁড়ালে আমার নিজেকে শিশুর মত অসহায় মনে হয়। কান্না আসে নিজের ক্ষুদ্রতা এবং এই ক্ষুদ্র ও অসহায় সৃষ্টি মানুষের প্রতি মহানসৃষ্টির মহান স্রষ্টা আল্লাহর দয়ার কথা ভেব।’
আহমদ মুসার ঠোঁটে হাসি, কিন্তু কণ্ঠ তার আবেগ রুদ্ধ, ভারি।
লায়লাদের মুখেও আগের সেই চটুল হাসি এখন আর নেই। তাদের চোখ-মুখও বিস্ময়ে ভারি হয়ে উঠেছে।
আহমদ মুসা থামলেও ওরা তৎক্ষণাৎ কথা বলতে পারল না। তাদের বিস্মিত দৃষ্টি আহমদ মুসার উপর নিবদ্ধ।
একটু পরে লায়লা ধীর কণ্ঠে বলল, ‘কিন্তু ভাইয়া, মানুষ তো আশরাফুল মাখলুকাত-সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ, ক্ষুদ্র নয়।’
‘বিস্ময়তো এখানেই লায়লা। ক্ষুদ্র, দূর্বল মানুষকে করা হয়েছে আশরাফূল মুখলুকাত। শুধু তাই নয় মুখলুকাতকে মানুষের জন্যেই সৃষ্টি করা হয়েছে। ক্ষুদ্র মানুষের প্রতি কেন এত দয়া স্রষ্টার? তাঁর এ দয়াই মানুষকে আশরাফুল মুখলুকাত করেছে।’
ধীর নরম কণ্ঠ আহমদ মুসার। বলতে বলতে চোখ দু’টি বুজে গিয়েছিল আহমদ মুসার।
তৎক্ষণাৎ কেউ কথা বলল না লায়লাদের।
‘আপনার এই ‘কেন’-এর উত্তর কি আহমদ মুসা ভাই? অন্তহীন এই মহাবিশ্বের মানুষের অস্তিত্ব পরমাণু কণা’র মতও নয়। তবু কেন তার এই গুরুত্ব, কেন তার প্রতি এই দয়া/ বলল ধীর কণ্ঠে রোসেলিন।
‘আল্লাহ প্রিয় বান্দাহ এবং নবী দাউদ (আ) অশ্রুসজল চোখে আকুল কণ্ঠে এই প্রশ্নই করেছিলেন নিঃসীম আকাশের দিকে চেয়ে। মানুষের কৃতজ্ঞ ও পরিতৃপ্ত হৃদয়ের এই অবাক জিজ্ঞাসা থাকবে সব সময়। এ শুধু জিজ্ঞাসাই, জবাব প্রয়োজন নেই রোসেলিন।’
‘সত্যিই প্রয়োজন নেই। বোধ হয় মানুষের সৃষ্টি কাহিনীই এর জবাব।’ বলল লায়লা ইয়েসুগো।
‘আমার একটা বিস্ময় লাগছে।’ অনেকক্ষণ পর বলল ফাতেমা মুনেকা।
‘কি?’ বলল আহমদ মুসা।
‘মহাবিশ্বের অন্তহীন রাজ্যে প্রবেশ করার এবং তার মাঝে হারিয়ে যাবার মত তাহলে আপনার আছে?’ বলল ফাতেমা মুনেকা।
‘থাকবে না কেন?’
‘বারুদের গন্ধ এবং রক্ত স্রোতের তলায় এমন নরম ও সংবেদনশীল মন বাঁচতে পারে না।’ বলল ফাতেমা মুনেকা।
‘তারপর?’ বলল আহমদ মুসা।
‘আপনার সে মন বাঁচল কি করে, সেটাই আমার বিস্ময়!’ ফাতেমা মুনেকা বলল।
‘হয়তো বেঁচে নেই।’ বলল আহমদ মুসা।
‘শুধে বেঁচে থাকা নয়, সে মন আপনার সাংঘাতিক সজীব এবং সক্রিয়। বংর বলতে পারেন, সে মনটা আমাদের নেই, অথবা ছিল মরে গেছে। সে কাণেই ‘এ্যান্ড্রোমেডা’ ও ‘ম্যাজিলানিক’ গ্যালাক্সিগুলো আমরা দেখতে পাই না, লাখো তারার মিট মিটে চোখে আমরা কখনও চোখ রাখি না, আকাশের অন্তহীন রহস্যের প্রতি আমাদের দৃষ্টি আকৃষ্ট হয় না।’ থামল ফাতেমা মুনেকা।
সে থাকতেই রোসেলিন বলল, ‘ফাতেমা ঠিকই বলেছে, ইয়াউন্ডির যে রাত এবং রাতের যে আকাশ আপনার কাছে অনন্য আকারে ধরা দিয়েছে, সে রাত তো আমরা দেখি, কিন্তু আমাদের মনে তো সাড়া জাগয় না!’
‘আচ্ছা এসব থাক রোসেলিন, তোমাদের কোন খবর আছে? আর কি ব্যাপার, ডোনা, লায়লাদের মত করে তুমি চাদর পরেছ দেখছি।’ বলল আহমদ মুসা রোসেলিনকে লক্ষ্য করে।
রোসেলিনের মাথায় গায়ে চাদর জড়ানো। চাদরের মাথার প্রান্তটা কপাল পর্যন্ত নেমে আসা। তার পরণের স্কার্টও আর মিনি ধরনের নয়, পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত নামানো।
‘কেন চাদর পরা কি ডোনা-লায়লাদের মনোপলি যে আমার পরা চলবে না?’ হেসে বলল রোসেলিন।
‘পরা চলবে না বলিনি, পরেছ যে তাই বলছি?’ আহমদ মুসা বলল।
‘ভাইয়া ওতে অনেক আগে থেকেই মনে মনে চাদর পরে আছে, আজ প্রকাশ্যে পরেছে মাত্র। এরকম একটা চাদর সেদিন আমি রাশিদী ভাইয়াকে কিনতে দেখেছি।’ মুখ টিপে হেসে বলল লায়লা ইয়েসুগো।
লায়লার কথা শেষ করার আগেই রোসেলিন কিল তুলেছিল লায়লাকে লক্ষ্য করে। পিঠে কিল পড়ার আগেই পিঠ বাঁকিয়ে ছুটে পালাল লায়লা।
‘লায়লা খুব দুষ্টু হয়েছে ভাইয়া। ওর মুখে কিচ্ছু বাধে না।’
বলৈ একটু থামল রোসেলিন। তাপর আবার শুরু করল, ‘ভাইয়া ফাতেমা যে জিজ্ঞাসা তুলে ধরেছিল, তার কিন্তু জবাব আপনি দেখনি।’
‘সেটা কি?’
বারুধের অবিরাম গন্ধ আর ভয়াবহ রক্ত স্রোতের তলায় যে মন আপনার বাঁচার কথা নয়, তা বাঁচলো কি করে? বলল রোসেলিন।
আহমদ মুসা হাসল।
ইজি চেয়ারে আরেকটু সোজা হয়ে বসল। বলল, ‘যদি তা বেঁচেই থেকে থাকে বলে তোমরা মনে কর, তাহলে সেটা বাঁচার কারণ বোধ হয় এই যে, আমি আমার ব্যক্তিগত কোন শত্রুতা, ব্যক্তিগত কোন ক্রোধ, ব্যক্তিগত কোন লাভ বা স্বার্থে কখনও বন্দুক ধরিনি, এক ফোটা রক্তপাতও কারও করিনি, যা কিছু করেছি আল্লাহর বান্দাহ মজলুম মানুষৈর স্বার্থে। অন্য কথায়, যা করেছি আল্লাহর পথে আল্লাহর জন্যেই করেছি। এই কাজে আত্মরক্ষার প্রয়োজন ছাড়া কাউকে আমি আঘাত করিনি, হত্যা করিনি। এই কারণেই হয়তো লোভের যে অগ্নিদৃষ্টি মনের সবুজ সৌন্দর্যকে পুড়িয়ে দেয়, তা আমার মনের ওপর পড়েনি, স্বার্থপরতার যে কালিমা মনকে অন্ধ করে দেয়, তা আমার মনের ওপর কার্যকরী হয়নি এবং হিংসার যে ক্রুর কৃপাণ মনকে টুকরো টুকরো করে কাটে, তা আমার মনের ওপর আপতিত হয়নি।’ স্বাগত ধরনের নরম কণ্ঠ থামলো আহমদ মুসার।
মুহূর্তকাল নীরবতা।
উচ্ছ্বাসিত রোসেলিন-লায়লারা কিছু বলার জন্যে সবাই এক সংগে মুখ খুলেছিল।
আহমদ মুসা ওদের থামিয়ে দিয়ে বলল, ‘এবার আমার পালা। ডোনাকে যে প্রশ্ন করেছি তার জবাব এখনও পাইনি।’
‘কি প্রশ্ন করেছ?’ ডোনা বলল মিষ্টি হেসে।
‘তোমরা এ সময় কোত্থেকে এলে?’
‘হাসপাতালে গিয়েছিলাম আঘাতের জায়গাটা চেক করাতে।’
আহমদ মুসার ভ্রু কুঞ্চিত হলো। বলল, ‘এর কি দরকার ছিল?’
‘হাসপাতাল থেকে যে ডাক্তার দেখতে আসত, সেই ডেট দিয়েছিল।’
‘তোমরা দু’জন গিয়েছিলে শুধূ?’
‘না ড্রাইভার ছিল। কেন ঠিক হয়নি মনে করছ?’
‘আমার তাই মনে হচ্ছে। হাসপাতালে ‘ওকুয়া’র লোক আছে। আমার ধারণা তাদের কাছ থেকে খবর পাবার ফলেই ‘ওকুয়া’র পক্ষে সম্ভব হয়েছিল সেদিন হাসপাতালে আমাদের উপর আক্রমন করা।’
ডোনা ও রোসেলিন দু’জনের মুখ ম্লান হয়ে গেল। শুকিয়ে উঠল তাদের ঠোঁট।
তারা কোন কথা বলল না।
আহমদ মুসাই আবার কথা বলল, ‘গাড়ি নিয়ে ফেরার পথে কোন কিছু সন্দেহ করেছ? কেউ ফলো করেনি তো?’
‘না করেনি। আমি ভালোভাবে এটা লক্ষ্য রকেছি। অবশ্য হাসপাতাল থেকে এ পর্যন্ত রাস্তাও খুব অল্প।’ বলল ডোনা।
‘গাড়ি কোথায় ছিল? ড্রাইভার কোথায় ছিল?’
ডোনা উত্তর না দিয়ে তাকাল রোসেলিনের দিকে। রোসেলিন বলল, ‘আমরা ড্রাইভারকে গাড়ির কাছে রেখে গিয়েছিলাম। তারপর আর কিছু জানি না।’
এ সময় সেখানে এসে দাঁড়াল রাশিদী ইয়েসুগো। বলল, ‘চলুন ভাইয়া সময় হয়ে গেছে।’
বলে রাশীদি রোসেলিনের দিকে চেয়ে আস্তে বলল, ‘তোমরা এ সময়ে? কখন এলে?’
‘অনেক কথা। ভাইয়াকে বলেছি’। বলল রোসেলিন আস্তে।
রাশিদীর কথা শুনে আহমদ মুসা ঘড়ির দিকে তাকিয়েছিল। সময় দেখে বলল, ‘হ্যাঁ সময় হয়ে গেছে। কিন্তু বেরুবার আগে চল রোসেলিনের ড্রাইভারের সাথে একটু কথা বলি।’
‘কেন? কিছু ঘটেছে?’ বলল রাশিদী ইয়েসুগো।
‘ওরা দু’জনে হাসপাতালে গিয়েছিল। হাসপাতালে ‘ওকুয়া’র লোক আছে নিশ্চয়। সুতরাং সবদিক থেকে নিশ্চিত হওয়া দরাকার। বলল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসা উঠে দাঁড়িয়েছিল।
‘তোমরাও এস।’ রোসেলিনের দিকে চেয়ে কথাগুলো বলে চলতে শুরু করল আহমদ মুসা।
রাশিদী ইয়েসুগো তার পাশে পাশে হাঁটতে শুরু করলো। রোসেলিনরা সকলে তাদের পিছু পিছু চলল।
রোসেলিনের গাড়ির ড্রাইভার গাড়ির পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল। আহমদ মুসাদের গাড়ির দিকে আসতে দেখে সে একটা স্যালুট দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াল।
আহমদ মুসাকে দেখিয়ে রোসেলিন ড্রাইভারকে বলল, ‘এঁকে তো তুমি চেন ড্রাইভার?’
‘জি ম্যাডাম।’ বলল ড্রাইভার।
‘ইনি তোমার সাথে একটা বিষয়ে আলাপ করবেন।’
‘ইয়েস ম্যাডাম।’ বলে ড্রাইভার আহমদ মুসার দিকে বিনীতভাবে চাইল।
‘তেমন কোন কথা নয়, আমি জানতে চাচ্ছিলাম হাসপাতালের সামনে গাড়ি পার্ক করার পর তুমি কোথাও গিয়েছিলে কিনা?’ আহমদ মুসা জিজ্ঞেস করল ড্রাইভারের দিকে চেয়ে।
‘না, স্যার। গাড়ি ছেড়ে কোথাও যাইনি।’
‘কেউ তোমাকে কিছু জিজ্ঞেস করেছিল কিনা?’
‘না স্যার।’
‘দীর্ঘ সময়টাতে কেউ তোমার কাছে আসেনি, কারও সাথে তোমার কথা হয়নি?’
‘না, স্যার। শুধুমাত্র হাসপাতালের বেয়ারা ম্যাডামের ওষুধর একটা প্যাকেট আমাকে দিয়ে গিয়েছিল।’
চমকে উঠল রোসেলিন। তার দুই চোখে উত্তেজনা। দ্রুত বলল, ‘ওষুধের প্যাকেট? কি বলেছিল, কোথায় প্যাকেট?’
‘ড্যাস বোর্ডের কেবিনে রেখেছি। বেয়ারা বলেছীল, ম্যাডাম রোসেলিন ওষুদ পাঠিয়েছেন গাড়িতে রাখার জন্যে।’
রোসেলিনের চোখ দু’টি তখন বিস্ফারিত।
ডোনার চোখেও বিস্ময়!
‘তুমি ওষুদ কিংবা কোন প্যাকেট পাঠাওনি রোসেলিন?’ দ্রুত কণ্ঠে বলল আহমদ মুসা।
‘না পাঠাইনি।’ কাঁপা কণ্ঠে বলল রোসেলিন।
আহমদ মুসা দ্রুত ড্রাইভারের দিকে চেয়ে বলল, ‘গাড়ির সামনের দরজা এবং ড্যাশবোর্ডের কেবিন লক করা নেই তো?’
‘না, স্যার।’ শুকনো কণ্ঠে বলল ড্রাইভার।
আহমদ মুসা সকলের দিকে চেয়ে বলল, ‘জানি না প্যাকেটে কি আছে, তবু সাবধান হওয়া ভাল। তোমরা সরে দাঁড়াও।’
বলে আহমদ মুসা গাড়ির দিকে এগুলো।
ডোনা ছুটে এসে আহমদ মুসার পথ রোধ করে দাঁড়িয়ে বলল, ‘না তুমি যাবে না, আমি নিশ্চিত প্যাকেটে বোমা আছে।’
‘প্লিজ ডোনা সময় নষ্ট করো না। ওটা যদি বোমা হয়ে থাকে, তাহলে এখানে ফাটা ঠিক হবে না। এ বাড়িটা ‘ওকুয়া’র কাছে চিহ্নিত হয়ে যাবে।’ দৃঢ় নির্দেশের সুরে বলল আহমদ মুসা।
ডোনা আহমদ মুসার দিকে একবার চেয়ে ফ্যাকাসে, বিক্ষুব্ধ মুখ নিয়ে সরে দাঁড়াল আহমদ মুসার সামনে থেকে। ক্ষোভে-দুঃখে তার চোখ দু’টি ভারি হয়ে উঠেছে।
ধীরে ধীরে আহমদ মুসা গাড়ি দরজা খুলে মুহূর্তের জন্যে থমকে দাঁড়াল। তারপর ঘুরে দাঁড়িয়ে রোসেলিনকে বলল, ‘কয়টায় হাসপাতাল থেকে গাড়ি স্টার্ট নিয়েছে? হাসপাতাল থেকে তোমরা বাড়ি ক’মিনিটের পথ?’
রোসেলিন বিমুঢ়ভাবে তাকাল আহমদ মুসার দিকে। কোন উত্তর এল না তার কাছ থেকে। অসহায়ভাবে তাকাল সে ডোনার দিকে, ডোনারও নির্বাক চোখ নিবদ্ধ হলো আহমদ মুসার দিকে।
ড্রাইভার নড়ে-চড়ে দাঁড়াল। ব লল, ‘স্যার ৭টা ৩৫ মিনিটে গাড়িতে চড়েছি। সন্ধ্যার ব্যস্ত সময়ে বাসায় পৌঁছতে সময় লাগার কথা আধাঘন্টা।’
‘প্যাকেট তুমি কখন পেয়েছিলে?’
‘স্যার, ম্যাডামরা আসার দু’মিনিট আগে।’
‘এখানে পৌছেছো ক’টায়?’
‘সাতটা চল্লিশ মিনিটে।’
আহমদ মুসা তার হাত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল সময় তখন ৯টা ১০ মিনিট। অর্থাৎ প্যাকেটটি গাড়িতে আসার পর সময় গেছে ৩৭ মিনিট।
হাসি ফুটে উঠল আহমদ মুসার মুখে। ‘ধন্যবাদ ড্রাইভার’ বলে আহমদ মুসা গাড়ির ভেরত মাথঅ ঢুকিয়ে ড্যাশ বোর্ডের কেবিন খুলে অতি সন্তর্পনে প্যাকেটটা বের করে নিয়ে এল এবং আস্তে মাটিতে রাখল। বলল, ‘যদি এতে বোমা থেকে থাকে, তাহলেও আপাততঃ ভয় নেই। এটা অটো টাইমার মনোবা নিশ্চয় নয়।’
বলে আহমদ মুসা পকেট থেকে ছোট্ট একটা চাকু বের করে প্যাকেটের বাধন কেটে কভারের কাগজটি নামিয়ে ফেলল প্যাকেটের গা থেকে। বেরিয়ে এল চার ইঞ্চি বর্গ আয়তনের একটা পেপার বোর্ডের বাক্স। বাক্সের টপটি উপরের মোড়ক কাগজ খূলে ফেয়লার সাথে সাথেই খুলে গিয়েছিল। এবার আহমদ মুসা চাকুর ব্লেডের তীক্ষ্ণ অগ্রভাগ দিয়ে বক্সের চার কোণ লম্বাভাবে কেটে ফেলল।
সবাই রুদ্ধশ্বাসে দেখছীল আহমদ মুসার কাজ। ডোনার কপালে জমে উঠেছে বিন্দু বিন্দু ঘাম। ভয়ে তার মুখ পাংশু হয়ে উঠেছে।
চার কোণ কাটার পর বক্সটির কভঅর চার ভাগ হয়ে মাটিতে পড়ে গেল। তার সাথে পড়ে গেল স্পঞ্জের চারটি টুকরা। শুধু দাঁড়িয়ে থাকল ঠিক আপেলাকৃতির বড় একটা গোলক।
‘বোমা’-সবার মুখ থেকেই অস্ফুটে বেরিয়ে এল।
আহমদ মুসা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে পরীক্ষা করল বোমাটিকে। নতুন ধরনের গাড়ি-বোমা। বোমার মত শীর্ষ দেশে একটা মাইক্রো কম্পুটার বসানো। কম্পুটারে সেট করা প্রোগ্রাম অনুসারে কম্পুটারটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে বোনার বিস্ফোরণ ঘটায়। কম্পুটারের প্রোগ্রামটি সেট করা থঅকে সময়ের উপর নয়, কিলোমিটারের উপরে। কিলো মিটারের যে সংখ্যার উপর প্রোগ্রাম সেট করা থাকে, সেই দূরুত্বে গাড়ি পৌছার সংগে সংগে বোমার বিস্ফোরণ ঘটে।
কম্পুটারের ডিজিটাল প্যানেলে আহমদ মুসা দেখল লাল ডিজিটাল নাম্বারটি আট। অর্থাৎ রোসেলিনের গাড়ি আট কিলোমিটার যাবার পর বোমার বিস্ফোরণ ঘটতো।
কম্পুটারের রানিং ডিজিটাল প্যানেলে চার সংখ্যাটি স্থির হয়ে আছে। এর অর্থ গাড়িটি হাসপাতাল থেকে রাশিদী ইয়েসুগোর বাড়ি পর্য়ন্ত চার কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে এসেছে।
আহমদ মুসা সবাইকে কাছে ডাকল। নতুন ধরনের এ গাড়ি বোমার পরিচয় দিয়ে ওদের বলল, রোসেলিন গাড়িটা আট কিলোমিটার যাবার পর এ বোমার বিস্ফোরণ ঘটতো। আট কিলোমিটারের মধ্যে এ বাড়ি পর্য়ন্ত গাড়ি চার কিলোমিটার এসেছে। এখান থাকে আবার গাড়ি ছারার চার কিলোমিটারের মাথায় বোমার বিস্ফোরণ ঘটে গাড়িটা ধ্বংস হয়ে যেত।
কারও মুখে কোন কথা নেই। পাথরের মত যেন স্থির হয়ে গেছে সকলে। রোসেলিন ও ডোনার মুখ চোখের অবস্থা কান্নার চেয়েও করুণ।
হঠাৎ রোসেলিন পাশের লায়লাকে জড়িয়ে ধরে কেদে উঠল। বলল, ‘ঈশ্বর ডোনাকে রক্ষা করেছেন। তোমার এখানে এসে বেচে গেলাম। না হলে এতক্ষণ সর্বনাশ হয়ে যেত।’
‘এভাবেই আল্লাহ মানুষকে রক্ষা করেন। দেখ, আহমদ মুসা ভাই যদি সন্দেহ না করতেন, যদি ড্রাইভারকে জিজ্ঞাসা না করতেন, তাহলে এখান থেকে চার কিলোমিটার যাবার পর গাড়ি ধ্বংস হয়ে যেত।’ বলল লায়লা।
রোসেলিন লায়লাকে ছেড়ে দিয়ে ছুটে গিয়ে আহমদ মুসার কাছে হাটু গেড়ে বসল। দুই হাত জোড় ভংগিতে তুলে বলল,’আপনি মানুষ না ভাইয়া। নিশ্চয় ঈশ্বর আপনার সাথে কথা বলেন। আপনি এত জানেন, এত বুঝেন কি করে! ভাইয়া সেদিন দুর্বৃত্তদের হাত থেকে বাচিয়েছিলেন, আজ আবার নতুন জীবন দিলেন আমাদের। কি বলে কোন ভাষায় কৃতজ্ঞতা জনাব আমি?’
আহমদ মুসা হাসল। বলল,’কৃতজ্ঞতা আমাকে নয় বোন, আল্লাহকে জানাও। আমাদের জ্ঞান, বুদ্ধি, বিবেচনা সবই তো তারই দেয়া। সব প্রশংসা, সব কৃতজ্ঞতা তারই প্রাপ্য।’
‘যে ধর্ম আপনাকে এই মহত্ব দিয়েছে, এই দৃষ্টি দিয়েছে, সে ধর্মে কি আমাকে গ্রহণ করবেন ভাইয়া?’ বলল আবেগ রুদ্ধ কণ্ঠে রোসেলিন।
‘অবশ্যই। ওয়লকাম বোন। এ ধর্ম তো আমার কিংবা কারও নয়, সমগ্র মানব জাতির।’
বলে আহমদ মুসা উঠে দাড়ালো। বলল,’ওঠ বোন।’
উঠে দাড়িয়ে আহমদ মুসা রাশিদীকে লক্ষ্য করে বলল,’তোমাদের পূর্বপাশে পরিত্যক্ত ডিপটিউব ওয়েলের পাইপ বসানো দেখিছি। পাথর চাপা আছে। তুমি বোমাটি পাইপের মধ্যে ফেলে দিয়ে এস। কবরস্থ হয়ে থাকবে।’
আহমদ মুসা বোমাটি রাশিদীর হাতে তুলে দিল। বলল, ‘ভয় করো না চার কিলোমিটার না পেরুলে বোমা ফাটবে না।’
রাশিদী চলে গেল।
আহমদ মুসা রোসেলিনের দিকে চেয়ে বলল,’আমাদের জুরুরী কাজ ‘ক্যামেরুন ক্রিসেন্ট’ এর অফিসে। চল তোমাদের বাড়িতে পৌছে দিয়ে আমরা সেখানে যাব।’
রাশিদী ফিরে এসেছে।
গাড়িতে উঠতে যাচ্ছে আহমদ মুসারা।
এই সময় লায়লা আহমদ মুসাকে বলল,’একটা জিজ্ঞাসা ধরে রাখতে পারছি না ভাই।’
‘কি জিজ্ঞাসা?’ আহমদ মুসা বলল।
‘ড্রাইভারের কাছ থেকে সময় সম্পর্কে শোনার পর আপনি হেসেছিলেন। আমার মনে হয়েছিল, বোমা ফাটবে না বলে সে সময় নিশ্চিত হয়েছিলেন। এটা ঠিক কিনা? ঠিক হলে কেমন করে আপনি তা জেনেছিলেন?’
‘খুব সোজা হিসেব। ড্রাইভারের কাছে হিসেব নিয়ে জানলাম, হাসপাতাল থেকে রোসেলিনের বাড়ি যেতে লাগে ৩০ মিনিট। কিন্তু হাসপাতাল থেকে রোসেলিনের গাড়ি বের হবার পর তখন পর্যন্ত পার হয়েছিল ৩৭ মিনিট। গাড়িতে টাইম বোমা পেতে রাখলে ৩০ মিনিটের মধ্যে তার বিষ্ফোরণ ঘটার কথা। তা যখন ঘটেনি, তখন প্যাকেটে বোমা থাকলেও তা টাইম বোমা নয়।’
‘সাইত্রিশ মিনিট আপনি কোথায় পেলেন?’
‘কেন, রোসেলিনরা হাসপাতাল থেকে গাড়িতে উঠার ২মিনিট আগে প্যাকেট এসেছিল গাড়িতে। ৫মিনিট সময় লেগেছিল হাসপাতাল থেকে তোমাদের বাড়িতে আসতে, আর রোসেলিনরা তখন পর্যন্ত তোমাদের বাড়িতে সময় খরচ করেছিল ৩০ মিনিট। এখন হিসেব করে দেখ।’
লায়লার বিষ্ময়-বিমুঢ় দৃষ্টি আহম মুসার দিকে নিবদ্ধ। বলল,’রোসোলিন ঠিক বলেছে, আল্লাহ আপনার সাথে কথা বলেন। না হলে চরম টেনশনের সময়ও এই সব বিবেচনা, হিসেব আপনার মাথায় আসে কি করে?’
‘অন্যায় বলেছ লায়লা। আল্লাহ এইভাবে কথা বলেন না। তিনি তার বান্দাদের জ্ঞান, বুদ্ধি ও বিবেচনা দিয়ে সাহায্য করেন।’
‘আল্লাহ আমাকে মাফ করুন। তবে আল্লাহ আপনার প্রতি তার অনুগ্রহ বেহিসেব ঢেলে দিয়েছেন।’
‘আল-হামদুলিল্লাহ।’
বলে আহমদ মুসা রাশিদীর দিকে তাকাল। বলল,’রোসেলিনের গাড়ির ড্রাইভারকে তোমার সাথে তোমার গাড়িতে নাও। রোসেলিনের গাড়ি আমি ড্রাইভ করব।’
রোসেলিন ও ডোনা গাড়িতে উঠলে আহমদ মুসা গিয়ে ড্রাইভিং সিটে বসল।
গাড়ি দুটি স্টার্ট নিল।
‘ওরা পিছু নিতে পারে বলে সন্দেহ করছেন ভাইয়া?’ বলল রোসেলিন।
‘গাড়ি বোমা সেট করার পর তারা অনুসরণ করবে বলে আমি মনে করিনা। তাছাড়া ‘ওকুয়া’র সে সাহস অবশিষ্ট আছে বলে মনে হয় না।’
‘কিন্তু এত বড় কাজ যে তারা করতে পারল?’
‘এ কাজে সাহস ও শক্তির দরকার হয় না, দরকার হয় বুদ্ধির। যা একজন দূর্বলও করে বসতে পারে।’
‘এই কাজটা কি পরিকল্পিত ভাইয়া?’ ডাক্তারের যোগসাজস কি থাকতে পারে?’
‘আমার মনে হয়না। ডাক্তারের যোগসাজস থাকলে হাসপাতালের ভেতরেই কোন দুর্ঘটনা ঘটতে পারত। গাড়িতে বোমা সেট করার মত অনিশ্চিত পথ তারা বেছে নিত না।’
‘ঠিক বলেছেন ভাইয়া।’
পথে আহমদ মুসা ও রোসেলিন অনেক কথা বলল। ডোনা একটা কথাও বলেনি। বোমার ঘটনার পর থেকে নির্বাক হয়ে গেছে। তার চোখে মুখে ভয় নয়, বেদনার চিহ্ন।
রোসেলিনের গাড়ি গিয়ে তাদের গাড়ি বারান্দায় দাড়ালো।
আহমদ মুসাগাড়ির দরজা খুলতে যাবে, এ সময় কথা বলে উঠলো ডোনা। বলল,’আমি দু:খিত, হাসপাতালে যাবার সিদ্ধান্ত নেবার আগে তোমাকে জনানো উচিত ছিল আমার। বুঝতে পারছি আমার ভুল হয়েছে।’ গম্ভীর, ভারী কণ্ঠস্বর ডোনার।
আহমদ মুসা পিছন ফিরে ডোনার দিকে তাকাল। বলল নরম কণ্ঠে,’এই জন্যে বুঝি কথা বলছ না, মন খারাপ করে বসে আছ?’
একটু থামল আহমদ মুসা। তারপর শুরু করল আবার,’না তোমার ভুল হয়নি। সিদ্ধান্ত তোমার ঠিকই হয়েছে। তবে সুযোগ থাকলে পরামর্শ করা সব সময় ভাল, বিশেষ করে বর্তমান পরিস্থিতে।’
‘ধন্যবাদ। কিন্তু এই সাংঘাতিক ব্যাপারে আমাদের প্রতি তোমার আরও কঠোর হওয়া উচিত ছিল।’
‘কিন্তু আমি মনে করি ভলের চেয়ে পরমুখাপেক্ষী প্রবণতা আরও ক্ষতিকর। ভুলের মধ্যে সংশোধনের শিক্ষা আছে। এই শিক্ষাই যোগ্যতার সৃস্টি করে।’
‘ধন্যবাদ। এতক্ষণে বুক ভরে বাতাস নিতে পারছি।’ বহুক্ষণ পর ডোনার ঠোটে হাসি ফুটে উঠল। থামল ডোনা।
আহমদ মুসাও নীরব।
‘আমি নেমে যাই, আপনারা কথা বলুন।’ বলে রোসেলিন নামতে যাচ্ছিল। তার ঠোটে দুষ্টুমির হাসি।’
‘না যেওনা, তোমার সাথে কথা আছে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘কি কথা?’ স্থির হয়ে বসে রোসেলিন তাকাল।
‘তোমাকে বকুনি দেব।’
‘বকুনি? কেন?’ কণ্ঠে কৃত্রিম কান্নার সুর টেনে বলল রোসেলিন।
‘তোমাদের হাসপাতালে যাওয়ার কথা তোমার আব্বাকে বলনি কেন?’
বিষ্ময় ফুটে উঠল রোসেলিনের মুখে। বলল বলিনি যে কেমন করে জানলেন?’
‘বললে যে, তোমার আব্বা দু’জনকে একা বেরুতে দিতেন না।’
রোসেলিন মুহূর্ত কয়েক কথা বলতে পারল না। আরও বেশী বিষ্ময় এসে তার উপর ভর করেছে।
অল্পক্ষণ পরে বলল,’বুঝতে পারছি কেন আপনি অজেয়। বাতাসেও বোধ হয় সত্যের গন্ধ পান।’
বলে একটু থেমেই আবার দ্রুত কণ্ঠে বলল,’কিন্তু যাই হোক, বকুনি কি আমার জন্যই বরাদ্দ? ডোনা আপাতো বকুনি খেল না। কৃত্রিম ক্ষোভ রোসেলিনের চোখে মুখে।’
‘কারণ তোমাকে আদরটা বেশী করেন। কথায় বলে শাসন করা তারেই সাজে সোহাগ করে যে গো।’ ঠোটে হাসি টেনে বলল ডোনা।
‘তাহলে যাকে তিনি প্রাণের চেয়ে ভালবাসেন, তার তরে কি গো…?’ বলে রোসেলিন গাড়ির দরজা খুলে হাসতে হাসতে ছুটে পালাল।
মুখ ভরা রক্তিম হাসি নিয়ে ডোনা বেরিয়ে যাচ্ছিল। আহমদ মুসা হেসে বলল,’রোসেলিনের প্রশ্নের জবাব দিয়ে যাবে না?’
‘উত্তরটা আমার নয়, তোমারই দেবার কথা।’ বলে ডোনাও হাসতে হাসতে বেরিয়ে গেল।
আহমদ মুসা গাড়ি থেকে বর হলো।
পেছনে রাশিদীর গাড়ি তখন এসে প্রবেশ করল গাড়ি বারান্দায়।
গাড়ি দাড়াতেই গাড়ি থেকে রোসেলিনের ড্রাইভার নেমে এল। রাশিদী ও নামছিল।
আহমদ মুসা সেদিকে এগুতে এগুতে বলল, ‘আর নেম না রাশিদী। চল আমরা যাই।’
ছুটে এল রোসেলিন। বলল, ‘এত বড় ঘটনা ঘটল আব্বার সাথে দেখা করে যাবেন না, কথা বলে যাবেন না?’
‘আমাদের দেরী হয়ে গেছে। তুমি খবরটা দিও। আমি পরে দেখা করব।’ ‘বলল আহমদ মুসা।
‘আপনাদের অনেক দেরী করে ফেলেছি। আর নয়। খোদা হাফেজ।’
‘খোদা হাফেজ।’ বলে আহমদ মুসা এসে গাড়িতে রশিদীর পাশে বসল।’
স্টার্ট নিল গাড়ি।
গাড়ি ছুটে বেরিয়ে এল রোসেলিনদের গেট দিয়ে।
ক্যামেরুন ক্রিসেন্টের হেড কোয়ার্টার। ভূগর্ভস্থ একটি কক্ষ।
ফ্রান্সিস বাইক এবং আহমদ মুসা মুখোমুখি সোফায় বসে।
ফ্রান্সিস বাইককে এই কক্ষে বন্দী রাখা হয়েছে।
আহমদ মুসার দু’পাশের আরও দু’টি সোফায় বসে রাশেদী ইয়াসুগো এবং মুহাম্মদ ইয়োকিনি।
ফ্রান্সিস বাইককের মুখ বিসন্ন। মাথা নিচু।
কথা বলছিল আহমদ মুসা। ‘মিঃ বাইক আপনাকে চিন্তা করার যে সময় দেয়া হয়েছিল, তা শেষ।’
ফ্রান্সিস বাইক মুখ তুলল না, কথাও বলল না।
‘মিঃ বাইক আপনি যদি উত্তর দেয়ার মত ভদ্রতা না দেখান, তাহলে আমাদেরকে অভদ্র হতে হবে।’ অত্যন্ত তীক্ষ্ণ কঠোর শোনাল আহমদ মুসার কন্ঠ।
মুখ তুলল ফ্রান্সিস বাইক তার চোখে চাঞ্চল্য, ভয়ের চিহ্নও। বলল ‘আপনার কি চান বলুন?’
‘আপনাকে তা বলা হয়েছে।’
‘সে তো অনেক কথা বলেছেন।’
‘বেশী নয় আমরা তিনটি কথা বলেছি। এক, সমগ্র দক্ষিণ ক্যামেরুনে উচ্ছেদকৃত মুসলমানদের ক্ষতিপূরণসহ তাদের স্ব স্ব বাড়িতে পূনর্বাসন, দুই, তাদের সম্পত্তি তাদের ফেরত দান এবং তিন, আপনারা যারা বিদেশ থেকে উড়ে এসে জুড়ে বসেছেন গায়ের জুরে, তাদের ক্যামেরুন থেকে চলে যাওয়া।’
‘কিন্তূ আপনাদের দাবী তো ছিল ইয়াউন্ডি হাইওয়ের দক্ষিণে ইদেজা পর্যন্ত অঞ্চলের মুসলমানদের পূর্নবাসন এবং তাদের সম্পত্তি ফেরত পাওয়া।’
‘সে দাবী ছিল জনস্টিফেন এবং ফ্রাসোয়া বিবসিয়েরের কাছে। তাঁরা ঐ অঞ্চলের দায়িত্বে, তাই তাদের কাছে তাঁরা যেটুকু করতে পারেন, সেটুকুই দাবি করা হয়েছিল। আপনি গোটা ক্যামেরুনের দায়িত্বে শুধু নন, গোটা পশ্চিম আফ্রিকার দায়িত্বে, তাই আপনার কাছে আপাতত দক্ষিন ক্যামেরুনের মুসলমানদের প্রতি যে অবিচার করেছেন, তার নিরাময় দাবী করা হচ্ছে।’
‘এরপর কি গোটা পশ্চিম আফ্রিকার দাবী তুলবেন?’
‘আমরা ভবিষ্যত নিয়ে এখন মাথা ঘামাচ্ছি না, আপনি বর্তমানের কথা বলুন।’
‘আমি কি বলব। আমি আপনাদের বন্দী, একজন বন্দীর কথা বাইরের ওরা মানবে কেন?’
‘সে মাথা ব্যথা আপনার নয়।’ কঠোর হয়ে উঠল আহমদ মুসার কন্ঠ।
মাথা নিচু করে চুপ থাকল ফ্রান্সিস বাইক।
কথা বলল আহমদ মুসা আবার। বলল, ‘শুনুন মিঃ ফ্রান্সিস বাইক, আপনাকে দেয়া সময় আমাদের উত্তীর্ণ হয়ে গেছে। আমরা আর এক মুহুর্ত নষ্ট করবো না। আমরা আপনার প্রতি অবিচার করিনি। আমাদের বিচার ট্রাইবুন্যালে আপনাকে আত্মপক্ষ সমর্থনের পূর্ণ সুযোগ দেয়া হয়েছিল। আপনি আপনার অন্যায় স্বীকার করেছেন, তবে বলছেন অপরাধ আপনার একার নয়। সেটা আমরা জানি সব অপরাধিই তার শাস্তি পাবে। আপনার দন্ড আপনাকে পেতে হবে, তা আমরা আপনাকে বলছি। এ দন্ড এড়ানোর আপনার একমাত্র পথ অন্যায়ের প্রতিবিধানে আপনার রাজী হওয়া।’ থামল আহমদ মুসা।
‘আমাকে কি করতে হবে?’ বলল ফ্রান্সিস বাইক।
‘আমাদের তিনটি দাবীর বাস্তবায়ন হবে?’
‘সেটা পরে জানতে পারবেন।’
‘আমার একটা প্রশ্ন।’
‘বলুন।’
‘আমি একজন বন্দী। আমি স্বীকার করার পরও আমার করণীয় কিছু থাকবে না। কি করবেন তাহলে আপনারা আমার স্বীকারুক্তি নিয়ে?’
‘এ প্রশ্নের উত্তর আপনার প্রয়োজন নেই।’
‘ঠিক আছে, আমি রাজী হলেই যদি সব হয়ে যায়, তাহলে বলছি তিনটি দাবী মেনে নিতে আমার আপত্তি নেই।’
‘ধন্যবাদ ফ্রান্সিস বাইক।’ বলে আহমদ মুসা রাশিদীকে লক্ষ্য করে বলল, ‘কাগজটা দাও।’
রাশিদী ব্যাগ থেকে ভাঁজ করা এক শিট কাগজ করে আহমদ মুসার হাতে তুলে দিল।
আহমদ মুসা কাগজটি ফ্রান্সিস বাইকের হাতে তুলে দিয়ে বলল, ‘পড়ুন এবং সই করুন।’
কাগজটি হাতে নিয়ে ফ্রান্সিস বাইক তাতে নজর বুলাল। দেখল, তিন দফা দাবীর স্বীকৃতি পত্র।
ফ্রান্সিস বাইকের হাতে একটি কলম তুলে দিল আহমদ মুসা।
ফ্রান্সিস বাইক মুখ তুলে আহমদ মুসার দিকে একবার তাকাল। তারপর স্বীকৃতি পত্রে দস্তখত করল।
‘এই স্বীকৃতি পত্রটি কিছুই নয়। এতে দস্তখত করেও আপনি সব কিছু অস্বীকার করতে পারেন। তবু লাভ এইটুকু যে আপরাধ আপনারা করেছেন, আপনার দস্তখতে লিখিত তার একটা দলিল থাকল।’
কথা শেষ করে আহমদ মুসা রাশেদীর কাছে থেকে একগুচ্ছ কাগজ নিয়ে ফ্রান্সিস বাইকের হাতে তুলে দিল।
ফ্রান্সিস বাইক কাগজগুলোর উপর চোখ বুলাল। বিস্ময় ফুটে উঠল তার চোখে মুখে। বলল ‘এই স্বীকৃতিপত্রগুলো পেলেন কি করে? দক্ষিন ক্যামেরুনের আমাদের সব ঘাটির সব নেতা উপনেতাকে তাহলে আপনারা আটক করেছেন?’
‘হ্যাঁ, করতে হয়েছে।’
‘কিভাবে?’
‘আপনার ক্ষেত্রে যা হয়েছে, সেইভাবে। তবে রক্তপাত হয়নি। বিশটি ঘাটির ৪০ জনকে আটক করতে কোন প্রানহানি ঘটেনি।’
‘সকলের কাছ থেকে নেয়া নিছক এই স্বীকারুক্তি আপনাদের কোন কাজে আসবে?’
দক্ষিন ক্যামেরুনের ১২টি অঞ্চলের ১২টি আঞ্চলিক প্রধানের কাছে থেকে চিঠি নিয়ে তাদের অফিস থেকে মুসলমানদের থেকে নানাভাবে আপনারা যে ভূমি দখল করেছেন, তার বিস্তারিত রেকর্ড আমরা নিয়ে এসেছি।’
‘বুঝলাম। এরপর আপনারা কি করবেন?’
আপনাদের ভূমি ক্রয় বা দখলের এই তালিকা নিয়ে আপনার ঘাটি প্রধানদের সাথে আলোচনা করেছি। তাতে আমরা দেখেছি, মুসলমানদের কাছ থেকে অবৈধভাবে ক্রয় বা দখলকৃত জমির শতকরা ৯০ ভাগ রেজিস্ট্রি হয়েছে কোক ও ওকুয়া’র সদস্যদের নামে। এই সদস্যদের নামের তালিকাও আমারা তৈরী করেছি। তাদের দখল করা জমির বিবরণও পাওয়া গেছে।’ বলে থামল আহমদ মুসা।
একটু পরে বলল, ‘আমাদের কাজ শেষ, এবার কাজ আপনাদের। আপনারা যা মেনে নিয়েছেন, সে অনুযায়ী আপনাদের কাজ করতে হবে।’
‘কি রকম?’
‘আপনাদের দু’টি কাজ করতে হবে। তার একটি করবে সংগঠন হিসাবে ‘কোক’ ও ‘ওকুয়া’। আরেকটি করবে ‘কোক’ ও ‘ওকুয়া’র সদস্যরা ব্যাক্তিগতভাবে।’
‘কোক’ ও ‘ওকুয়া’ কি করবে?
‘উদ্বাস্তূ মুসলমানদের স্ব স্ব ভিটায় পুনর্বাসনের জন্যে ক্ষতিপূরণের টাকা নগদ পরিবেশন করবে ‘কোক’ বা ‘ওকুয়া’।’
‘আর ‘কোক’ ও ‘ওকুয়া’র সদস্যদের ব্যাক্তিগতভাবে কি করতে হবে?’
‘তাদের নামের রেজিস্টি জমিগুলো তার যাদের জমি সেই মুসলমানদের নামে রেজিস্ট্রি করে দেবে।’
হো হো করে হেসে উঠল ফ্রান্সিস বাইক। বলল, ‘আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে সব কিছু পাকা ফলের মত আপনার হাতে এসে পড়বে।’
আহমদ মুসা মুখভাবের কোন পরিবর্তন হলো না। যেভাবে সে কথা বলছিল, সেভাবেই বলল, ‘হ্যাঁ, পাকা ফলের মতই এসে পড়বে। এবং আজ থেকেই তা শুরু হবে, শেষ হবে তিন দিনের মধ্যে।’
‘চমক সৃষ্টি করার জন্যে হলে আপনার কথা ঠিক আছে।’
‘চমক সৃষ্টি করা বা রঙ্গ-রস করার মত সময় আমার নেই মিঃ ফ্রান্সিস।’ গম্ভীর কণ্ঠে বলল আহমদ মুসা।
তারপর রাশিদীর দিকে চেয়ে বলল, ‘তুমি ওদের নিয়ে এস এবং কাগজ পত্রও।’
রাশিদী বের হয়ে কয়েক মুহূর্ত পরে ‘কোক’ এবং ‘ওকুয়া’র অর্থ পরিচালক ‘ফিনিদি’ এবং ট্রেজারার ‘সিয়া সিয়া’কে সাথে নিয়ে ঘরে করল।
‘এদের চেনেন মিঃ ফ্রান্সিস?’
ওদের ঘরে ঢুকতে দেখেই ভূত দেখার মত তার চোখ ছানাবাড়া হয়ে গিয়েছিল। বিস্ময়ের ধাক্কায় কথা বলতে পারেনি ফ্রান্সিস বাইক কিছুক্ষণ পর সে বলল, ‘এদেরও গ্রেফতার করেছেন। এরা তো কোন সাতে-পাঁচে নেই।’
‘ওদের কেন আটক করেছে নিশ্চয় বুঝেছেন। ওরা হাতে থাকলে ক্ষতি পূরণের টাকা আদায় সহজ হবে।’
ফ্রান্সিস বাইক কোন কথা বলল না।
আহমদ মুসাই কথা বলল, লা-ফ্যাংগ রোডে আপনাদের প্রশাসনিক সদর দফতরে গিয়ে এদের পেয়েছি। নগদ অর্থসহ ওদের নিয়ে এসেছি। নগদ ৫ মিলিয়ন ডলার এবং ১০ মিলিয়ন ফ্রাংক পাওয়া গেছে। ভয় করবেন না। টাকাগুলো ‘ফিনিদি’ ও ‘সিয়া সিয়া’র তত্বাবধানেই রেখেছি। আপনার সাথে আমাদের হিসেব নিকেশ না হওয়া পর্যন্ত এভাবেই থাকবে।
‘আপনারা দস্যুতা করেছেন। এর ফল ভোগ করতে হবে না ভাববেন না।’ ক্ষোভে-দুঃখে ভেংগে পড়া গলায় কথাগুলো বলল ফ্রান্সিস বাইক।
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘আমরা দস্যুতা করিনি। দস্যুদের কাছ থেকে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্যে ক্ষতিপূরণ উদ্ধারের চেষ্টা করছি আমরা।’
বলে একটু থামল আহমদ মুসা। তারপর আবার শুরু করল, ‘শুনুন মি: ফ্রান্সিস বাইক, আমরা হিসেব করে দেখেছি তিন লাখ উদ্বাস্তু মুসলমানকে পুনর্বাসন করতে কমপক্ষে তিন’শ মিলিয়ন ক্যামেরুন ফ্রাংক প্রয়োজন। নগদ যা পেয়েছি তাতে ৫ মিলিয়ন ডলার থেকে আসবে ১৫০ মিলিয়ন ফ্রাংক। আর এর সাথে ১৫ মিলিয়ন ফ্রাংক মিলে হবে ১৬৫ মিলিয়ন ফ্রাংক। আর প্রয়োজন ১৩৫ মিলিয়ন ফ্রাংক। এই টাকার ব্যবস্থা করে দিন, তাহলে ক্ষতিপূরণ আদায়ের প্রথম কাজ আমাদের শেষ হয়।’
‘এভাবে আমাদের পণবন্দী বানিয়ে আদায় করতে চান টাকা?’ বলল ফ্রান্সিস বাইক।
‘দস্যুরা আইনের কথা মানে না, যুক্তির কথা মানে না। তাদের সাথে এই আচরণই করতে হয়।’ কঠোর কণ্ঠে বলল আহমদ মুসা।
‘আমি বন্দী আমি কোত্থেকে কিভাবে টাকা দেব?’ বলল ফ্রান্সিস বাইক।
‘ব্যাংকের সমস্ত রেকর্ডপত্রসহ আমরা ফিনিদি ও সিয়া সিয়াকে নিয়ে এসেছি। আমরা দেখেছি, ইয়াউন্ডির চারটা ব্যাংকে ওকুয়া’র নামে তিনশ’ মিলিয়ন ফ্রাংক রয়েছে। চারটা ব্যাংকের জন্যে আমাদের চারটা চেক দেবেন। চার চেকে টাকার মোট পরিমাণ হবে ১৩৫ মিলিয়ন ফ্রাংক। আপনি ব্যাংকে টেলিফোন করবেন, টাকা এনে দেবে সিয়া সিয়া আমাদের লোকদের সাথে গিয়ে।’
‘সে যদি গিয়ে আর না আসে, পুলিশে সব বলে দেয়।’
‘সেটা মি: সিয়া সিয়া নিশ্চয় করবেন না। তার কোমরে বাঁধা থাকবে বেল্টের বদলে কম্পুটার নিয়ন্ত্রিত বোমা বেল্ট। কম্পুটারটা থাকবে আমাদের লোকদের হাতে। তার বিশ্বাসঘাতকতার সামান্য ইংগিত পেলেই বোমা ফাটিয়ে দেয়া হবে সুতরাং মি: সিয়া সিয়া আমরা যেভাবে বলব সেভাবে আমাদের সহযোগিতা করবেন।’
ভয়ে চুপসে যাওয়া সিয়া সিয়া সম্মতিসূচক মাথা নাড়ল।
‘মি: সিয়া সিয়া আপনি চেকবইগুলো বের করুন এবং চারটি চেক লিখুন।’
সংগে সংগেই সিয়া সিয়া হাতের ফোল্ডার থেকে চারটি চেক বের করল, তারপর তাকাল ফ্রান্সিস বাইকের দিকে।
এটা লক্ষ্য করে আহমদ মুসা বলল, ‘মি: ফ্রান্সিস বাইক মি: সিয়া সিয়া আপনার অনুমতি চাচ্ছেন। চেক লেখার অনুমতি দিয়ে দিন।’
‘টাকা আমার নয়, আমি পারবো না।’ বলল ফ্রান্সিস বাইক।
‘আপনার টাকা আমরা চাই না। ‘কোক’ ও ‘ওকুয়া’র টাকা আমাদের প্রয়োজন এবং এগুলো তাদেরই টাকা।
ফ্রান্সিস বাইক কোন কথা বলল না।
আহমদ মুসার মুখ লাল হয়ে উঠল। রিভলবার বের করল পকেট থেকে। সবাইকে চমকে দিয়ে রিভলবার থেকে একটা গুলী ফ্রান্সিস বাইকের বাম কান স্পর্শ করে চলে গেল। রক্তের ক্ষীণ একটা ধারা নামল কানের আহত স্থান থেকে।
ফ্রান্সিস বাইক কানে হাত বুলিয়ে সিয়া সিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘এটা আমার অফিস নয়, নির্দেশের প্রয়োজন নেই। যা বলে লিখে দাও।’
চেক লিখল সিয়া সিয়া।
‘মি: সিয়া সিয়া মি: ফিনিদি ও মি: ফ্রান্সিস- এর কাছ থেকে দস্তখত নিন চেকে।’
চেকে তাদের দস্তখত হয়ে গেলে আহমদ মুসা বলল, ‘মি: সিয়া সিয়া দস্তখত ঠিক আছে তো? চেক যদি ফেরত আসে, তাহলে আপনি কিন্তু ফেরত আসবেন না।’
সিয়া সিয়া মাথা নেড়ে বলল সব ঠিক আছে।
‘ধন্যবাদ। কাল ৯টায় আপনি ব্যাংকে যাবেন আমাদের লোকদের সাথে।’
একটু থেমেই আবার শুরু করল, ‘রাশিদী দলিলগুলো মি: ফ্রান্সিসকে দেখতে দাও।’
রাশিদী হ্যান্ড ব্যাগ থেকে কতকগুলো কাগজ বের করে ফ্রান্সিসের হাতে তুলে দিল।
ফ্রান্সিস বাইক কাগজগুলোর উপর নজর বুলাল। কাগজগুলো জমির বিক্রয় দলিল। রেজিস্ট্রির জন্যে তৈরী।
‘মি: ফ্রান্সিস দলিলগুলো ভালো করে দেখুন। আমরা খোঁজ নিয়ে নিশ্চিত হয়েছে, আপনার নামে রেজিস্ট্রি এই বিপুল মুসলিম সম্পত্তির কোনটিই টাকা দিয়ে কেনা নয়। সুতরাং এই সম্পত্তি মালিকদের ফেরত দিতে হবে। সব দলিল রেডি। কালকে ৯টায় আমাদের লোকদের সাথে আপনি রেজিস্ট্রি অফিসে যাবেন। সব ঠিকঠাক আছে। আপনি পৌঁছলেই রেজিস্ট্রি শুরু হবে।’
‘যদি সেখানে গিয়ে রাজী না হই?’
‘রাজী হবেন। আপনারও কোমরে বাধা থাকবে কম্পুটার নিয়ন্ত্রিত বোমা। সুতরাং অবশ্যই আপনি আমাদের কথার বাইরে যাবেন না।’
‘সকলের কাছ থেকে এই ভাবেই কি আপনারা জমি রেজিস্ট্রি করে নেবেন?’
‘শতকরা আশি জনই স্বেচ্ছায় জমি ফিরিয়ে দিচ্ছে। অবশিষ্ট বিশ জনের ক্ষেত্রেই আপনার মত ব্যবস্থার আশ্রয় নিতে হচ্ছে।’
কথা শেষ করেই রাশিদীর দিকে তাকিয়ে আহমদ মুসা বলল, ‘চারটি চেক এবং দলিলগুলো তুমি রাখ এবং মি: ফিনিদি ও মি: সিয়া সিয়াকে রেখে এস।’
রাশিদী ওদের রেখে ফিরে এল।
‘তাহলে আজকের মত চলি ফ্রান্সিস বাইক। কাল সকালে আপনার দু’টো কাজ। এক, চারটি ব্যাংকে টেলিফোন করা এবং দুই, সকাল ৯টায় রেজিস্ট্রি অফিসে যাওয়া।’
‘আমি কিডন্যাপড হয়েছি ব্যাংক জানে না?’
‘থানায় কিংবা ব্যাংকে জানায়নি কেউ। আর জানাবার লোক বোধ হয় নেই। যারা আপনার খবর জানত, তাদের সবাইকে আমরা আটক করতে পেরেছি বলে মনে হয়।’
‘অসম্ভব। কিভাবে?’
‘আপনাকে নিয়ে আসার পর ওরা ‘ইয়াউন্ডি’ রোডের ঘাটি ছেড়ে দেয়। পরের দিন সন্ধ্যায় ওরা সকলে মিটিং-এ বসেছিল লা-ফ্যাংগ রোডের প্রশাসনিক ঘাটিতে। ওখান থেকে আমরা সবাইকে হাতে পেয়েছি।’
বলে আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল।
উঠে দাঁড়াল তার সাথে রাশিদী এবং মুহাম্মদ ইয়েকিনি।
বের হয়ে এল তারা ঘর থেকে।
ঘরের দরজার বাইরে দাঁড়ান স্টেনগানধারী দু’জন প্রহরী আহমদ মুসাদের সালাম দিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল।
ঘর থেকে বের হয়ে আহমদ মুসা বলল, ‘চল চীফ জাস্টিসকে টেলিফোন করে অগ্রগতিটা জানাতে হবে।’
‘ল’ সেক্রেটারীর কাছ থেকে সহযোগিতা নেয়ার যে কথা চীফ জাস্টিস সাহেব বলেছিলেন, সেটা কতদূর?’ বলল রাশিদী।
‘আলোচনাটা এগিয়েছে। ফ্রি ওয়ার্ল্ড টিভি এবং ডব্লিউ এন এ খবর প্রচারের পর বিষয়টা সরকারের গোচরে গেছে এবং সরকার ‘কোক’ ও ওকুয়াকে চাপ দিয়েছেন, তার ফলে মুসলমানদেরকে জমি ফিরিয়ে দেয়া হচ্ছে এবং তাদের পুনর্বাসনও হচ্ছে ক্ষতিপূরণ দিয়ে। এই রিপোর্ট সরকারের পক্ষ থেকে জাতিসংঘ, হিউম্যান রাইটস কমিশন ও সংস্থাসমূহ এবং সংবাদ মাধ্যমসমুহের কাছে পাঠানো হবে। এতে সরকারের লাভ হবে যে, সবাই জানবে সরকার অভিযোগের ব্যাপারে ত্বরিৎ পদক্ষেপ নিয়েছে। অন্যদিকে আমাদেরও লাভ হবে যে, এখানে মুসলমানদের সম্পত্তি ফিরে পাওয়া এবং ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসন হওয়া আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভ করল। ভবিষ্যতে তাদেরকে কোন প্রকার হয়রানি করা কঠিন হবে। এখন আমাদের যেটা করতে হবে সেটা হলো জমি হস্তান্তর ও পুনর্বাসনের তথ্যগুলো সরকারকে দিতে হবে যাতে সরকার তাদের রিপোর্ট এগুলো দেখাতে পারে।’
‘সব তথ্য দিতে হবে? সে তো বিরাট ব্যাপার।’ বলল মুহাম্মদ ইয়েকিনি।
‘না সব চায়নি। উদাহরণ হিসেবে কিছু দিতে হবে।’
‘কিভাবে হস্তান্তরের কাজ হচ্ছে, তা কি সরকার জানতে পেরেছে?’ বলল রাশিদী।
‘না, পারেনি।’
‘সরকারের মধ্যে ‘কোক’ ও ‘ওকুয়া’র প্রচুর লোক আছে, তারা তো জানতে পারে।’
‘যারা আটক হয়েছে তারা ছাড়া আসল ব্যাপারটা বাইরের কেউ জানে না। তারা বুঝছে যে, রেডিও, টিভি ও সংবাদপত্রে জমি আত্মসাৎ ও মুসলিম উচ্ছেদের ব্যাপারটা ফাঁস হয়ে যাবার পর ‘কোক’ ও ‘ওকুয়া’ কর্কৃপক্ষ সরকার ও বাইরের চাপে মুসলমানদের সম্পত্তি ফেরত দিতে সম্মত হয়েছে। সরকারের ভেতরে যারা আছে, তারাও এটাই জানছে।’
কথা বলতে বলতে আহমদ মুসারা ভূগর্ভ থেকে উপরে উঠে এল। বসল অফিসের ড্রইং রুমে।
টেলিফোন টেনে নিল আহমদ মুসা।
ডায়াল করল চীফ জাস্টিস ওসাম বাইকের নম্বারে।
৩
যায়দ রাশিদীর লুকানো বাক্স থেকে সোনার যে মোহর বের হলো তার পরিমাণ দাঁড়ালো এক কোটি ডলার। ক্যামেরুনের টাকায় যার পরিমাণ হয় ৩০০ কোটি ফ্রাঙ্ক।
তিনশ’ কোটি ফ্রাঙ্ক মূল্যের সোনার মোহরের স্তুপের দিকে বিস্ময়ের দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রাশিদী ইয়েসুগো, মুহাম্মদ ইয়েকিনি, ব্ল্যাক বুল এবং অন্যান্যরা।
‘আমার একটা বিস্ময় কিন্তু যায়নি।’ মোহরের দিক থেকে চোখ ঘুরিয়ে আহমদ মুসার দিকে চেয়ে বলল রাশিদী ইয়েসুগো।
‘কী?’ বলল আহমদ মুসা।
‘ডায়েরীতে লুকানো বাক্সের যে সংকেত আছে, তা আমি দেখেছি। কিন্তু আমি কিছু বুঝিনি। আপনি কি করে জায়গাটা ঠিক ঠিক চিহ্নিত করে ফেললেন?’
‘এ জিজ্ঞাসা আমারও মনে।’ বলল ব্ল্যাক বুল।
‘ব্যাপারটা খুবই সহজ ছিল। পাখির বাসা বলতে বুঝানো হয়েছে যায়দ রাশিদীর বাড়ী, মৃত পাখির বাসা বলতে বুঝানো হয়েছে যায়দ রাশিদীর সমাধিকে। আর মোহর ভর্তি বাক্স হলো মৃত পাখির মুখের গোলাপ ফুল। সুতারাং বুঝতেই পারছ, সংকেতের মধ্যে কোন জটিলতা ছিলনা।’
‘এখন কোন জটিলতা দেখছি না, তবে পাখিকে যায়দ রাশিদী, পাখির বাসাকে তার বাড়ি, মৃত পাখির অবস্থান কে সমাধি এবং গোলাপ ফুলকে লুকানো ধন কল্পনা করা হাজার চেষ্টা করেও পারতাম না।’ বলল রাশিদী ইয়েসুগো।
‘থাক, এসব কথা। এখন বল, এই টাকা নিয়ে কী চিন্তা করছ?’
‘কেন যায়েদ রাশিদীর উইল অনুসারে এ টাকার মালিক আপনি।’
‘আচ্ছা ঠিক আছে, টাকার মালিক আমি হলে এ টাকা আমি তোমাদের দিয়ে দিলাম। এখন বল এ টাকা তোমরা কি করবে?’
‘আমরা জানিনা, আপনিই বলুন এ টাকা দিয়ে আমরা কি করব?’
‘ফ্রান্সিস বাইকের কাছ থেকে যে সম্পত্তি ফেরত পাওয়া গেছে তার সাথে যায়দ রাশিদীর বাড়িও আছে। এ টাকার একটা অংশ দিয়ে ঐ বাড়িটাকে পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে আনতে হবে। ব্ল্যাক বুলের নামে বাড়িটা কেনা হয়েছে সে, বাড়িটার মালিক থাকবে। আর…’
আহমদ মুসার কথার মাঝখানে ব্ল্যাক বুল বলে উঠল, ‘কিন্তু আমি মনে করি যায়দ রাশদীর এই সম্পত্তির মালিক হওয়ার যোগ্যতা আমার নেই। বাড়িটার একজন সেবক হতে পারলেই আমি খুশি হবো। আমি….’
আহমদ মুসা তাকে বাধা দিয়ে বলল, ‘ঠিক আছে, তোমার কথা আমরা বুঝেছি। শুনে রাখ, সন্তান অযোগ্য হলেই সে তার উত্তরাধিকার হারায় না।’
বলে একটু থামল আহমদ মুসা, তারপর আবার শুরু করল, ‘অবশিষ্ট টাকা ক্যামেরুন ক্রিসেন্ট পাবে। ক্যামেরুন ক্রিসেন্ট এই টাকা ইসলাম প্রচার এবং মানুষের সেবায় ব্যয় করবে। জাগতিক ও ইসলামী শিক্ষার প্রসার এবং দারিদ্র্য বিমোচন- এই লক্ষ্যে যদি ক্যামেরুন ক্রিসেন্ট কাজ করতে পারে, তাহলে পশ্চিম আফ্রিকায় এনজিও দের ষড়যন্ত্র বানচাল করে তোমরা ইসলামের আলো নতুন করে এ অঞ্চলে প্রজ্জ্বলিত করতে পারবে।’
‘ধন্যবাদ আহমদ মুসা ভাই। আপনি যে কাজের প্রস্তাব করেছেন সেটাই আমাদের আসল কাজ হওয়া উচিত। কিন্তু এই সাথে আমার কথা হলো আপনি বিশ্বব্যাপী কাজ করছেন। যায়দ রাশিদীর টাকার একটা অংশ যদি আপনার কেন্দ্রীয় তহবিলে যায়, তাতে আমি মনে করি তার পূন্য আরও বেশী হবে।’ বলল রাশিদী।
হাসল আহমদ মুসা, ‘বলল, আমার কোন কেন্দ্র নেই, কেন্দ্রীয় অফিসও নেই, কেন্দ্রীয় তহবিলও নেই। আমি যখন যেখানে থাকি সেটাই, আমার কেন্দ্র। সে কেন্দ্র্র থেকেই আমার খরচ চলে। সুতরাং আমার কোন তহবিল দরকার নেই।’
রাশিদী ইয়েসুগো নাছোড়বান্দা। বলল, ‘ইসলামের বিশ্বব্যাপী যে কাজ হচ্ছে, তার তো একটি কেন্দ্রীয় তহবিল আছে। যেমন ধরুন ‘সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিক’ -এর বারবারেতি শহরে আন্তর্জাতিক সম্মেলন হচ্ছে। সেখানে বিশ্বের মুসলমানদের সবচেয়ে সক্রিয় ও শক্তিশালী সংগঠন ওয়ার্ল্ড মুসলিম কংগ্রেস-এর প্রধানসহ বিশ্ব বরেণ্য অনেক মুসলিম নেতা এসেছেন। এসব কাজে তো বিরাট খরচ। যায়দ রাশিদীর অর্থের একটা অংশ যদি এসব কাজে খরচ হয়, তিনি অনেক বেশী পূণ্য পাবেন।’ বলল রাশিদী ইয়েসুগো।
‘তুমি ঠিকই বলেছ। ‘বারবারেতি’ শহরে ‘ডার্ক আফ্রিকা ব্রাইট হার্ট’ -এর উদ্যোগে ‘আফ্রিকা এবং ইসলাম’ বিষয়ের উপর যে আন্তর্জাতিক সেমিনার হচ্ছে, তার জন্যে যদি অর্থের প্রয়োজন হতো তাহলে আমি তোমার কথা মেনে নিতাম। আসলে ‘ডার্ক আফ্রিকা ব্রাইট হার্ট’ আফ্রিকায় ‘ওয়ার্ল্ড মুসলিম কংগ্রেস’ পরিচালিত একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন। তাদের যাবতীয় খরচ ‘ওয়ার্ল্ড মুসলিম কংগ্রেস’ বহন করে থাকে। তবু তোমরা চাইলে তাকে সাহয্য করা যাবে। কিন্তু এ জন্য এখনই বাজেটের প্রয়োজন নেই। আমি ওদের সাথে কথা বলে সে ব্যবস্থা করব।’
‘আপনার তো বিরাট খরচ। আপনি কি আপনার এ টাকা থেকে কিছুই নিতে পারেন না?’ মুখ ভার করে বলল রাশিদী ইয়েসুগো।
আহমদ মুসা হাসল। রাশিদীর পিঠ চাপড়ে বলল, ‘মন খারাপ করছ কেন? সত্যিই আমার প্রয়োজন নেই। এই যে আমি তোমাদের এখানে এসেছি, কোন খরচ আমাকে তোমরা করতে দিয়েছ? এর বাইরে যে টাকা আমার প্রয়োজন তার ব্যবস্থা আছে। ফিলিস্তিন সরকার ‘আল জাজিরা ব্যাংক ইন্টারন্যাশনাল’-এর একটা ‘কোডেড ক্রেডিট নাম্বার’ আমাকে দিয়েছে। আমি পৃথিবীর যে কোন ব্যাংকে গিয়ে এই নাম্বার দিয়ে টাকার যে কোন অংক চাইলে দিয়ে দিবে। দরকার পড়লে এই নাম্বার আমি ব্যাবহার করি। ঠিক আছে? এবার খুশী?’
হাসল রাশিদী। বলল ‘ঐ নাম্বার যে কেউ ব্যাংককে দিলে টাকা দিয়ে দিবে?’
‘হ্যাঁ।’
‘তাহলে আমিও তো ঐ নাম্বার দিয়ে টাকা তুলতে পারি।’ বলল রাশিদী।
‘নাম্বার পাবে কোথায়?’
‘আপনি দেবেন।’ বলল রাশিদী।
‘এ ধরনের নাম্বার যাকে দেয়া হয়, সে যদি কাউকে এটা জানায়, তাহলে সেদিন সে এটা ব্যাবহারের অধিকার হারায়।’
‘বুঝলাম। দায়িত্বটা এরকম না হলে সুযোগটা অতবড় হতো না। কিন্তু একটা প্রশ্ন, ব্যাংক তো কোডেড নাম্বারটা জানতে পারে, তারা যদি এটা অন্যকে জানিয়ে দেয় বা নিজেরা ব্যবহার করে?’ বলল রাশিদী।
‘না পারবে না কোডেড নাম্বার এর সাথে একটা সিরিয়াল সংকেত আছে। এই সংকেত প্রত্যেকবার পৃথক হয় এবং সিরিয়াল অনুসারে হয়, যেভাবে আল জাজিরা ব্যাংক ইন্টারন্যাশনাল-এর রেকর্ডে সংরক্ষিত আছে।’
‘কিন্তু এ ব্যাপারটা তো স্থানীয় এবং বিভিন্ন ব্যাংকের জানার কথা নয়, তারা যদি ভূল করে টাকা দিয়ে দেয়?’ বলল রাশিদী।
‘প্রত্যেক ব্যাংকের কম্পিউটারের পেমেন্ট সেকশনে ইন্টারন্যাশনাল কাউন্টার আছে। যেসব আন্তর্জাতিক ব্যাংক ক্রেডিট কার্ড ও কোডেড নাম্বার-এ পেমেন্ট করে, তারা সবসময় প্রতি মহুর্তে কম্পিউটারের ইন্টারন্যাশনাল পেমেন্ট কাউন্টারে আপ টু-ডেট-রাখে। সুতরাং যখনি কেউ কোডেড নাম্বার ব্যাংকে দেয়, তখন তারা সেটা কম্পিউটারে প্রবেশ করায়। পেমেন্ট সেকশনের ইন্টারন্যাশনাল কাউন্টার থেকে গ্রীন সিগনাল পেলেই তবেই তারা পেমেন্ট করে।’
‘বাঃ চমৎকার ব্যবস্থা।’ বলল রাশিদী।
রাশিদী থামতেই মুহাম্মদ ইয়েকিনি বলল, ‘আমার ভিন্ন একটা প্রশ্ন, এত বড় এবং গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক সেমিনার বারবারেতি শহরে অনুষ্ঠিত হচ্ছে কেন?’
‘হতে পারেনা কেন মনে করছ?’ বলল আহমদ মুসা।
‘জায়গাটা তেমন খ্যাতনামা নয়। মুসলিম স্বার্থের উপস্থিতির দিক দিয়েও গুরুত্বপূর্ণ নয়।’ বলল মুহাম্মদ ইয়েকিনি।
আহমদ মুসা হাসল। বলল, তুমি ঠিকই বলেছ। জায়গাটা বিখ্যাত এবং মুসলিম স্বার্থের দিক দিয়ে গুরুত্বপূর্ণও নয়। কিন্তু নতুন নতুন জায়গাতেই তো ইসলাম যাবার কথা। অন্ধকারেই তো আলোর আগমন বেশী প্রয়োজন।’
থামল একটু আহমদ মুসা। একটু গম্ভীর হয়ে উঠল তার মুখ। বলল, ‘একটা ঘটনা এবং একটা স্মৃতি সেন্ট্রাল আফ্রিাকান রিপাবলিকের এই বারবারেতিকে স্মরণীয় করে রেখেছে। প্রায় দু’শ বছর আগে সংঘ নদী তীরের ঐ বারবারেতিতে আকস্মিকভাবে উদয় হয়েছিলেন সুলতানুল আউলিয়া আহমদ বিন আহমদ আবদুর রহমান। উদয় হয়েছিলেন বলা হয় এ জন্যই যে, উনি কিভাবে কোথেকে এসেছিলেন, কেউ বলতে পারেনা। কেউ বলে মালি, নাইজেরিয়া ও ক্যামেরুন হয়ে মধ্য আফ্রিকা প্রজাতন্ত্রের এই দুর্গম স্থানে তিনি এসেছিলেন, কারো মতে সুদান থেকে মধ্য আফ্রিকা প্রজাতন্ত্রে তিনি প্রবেশ করেছিলেন, কেউ মনে করেন সোমালিয়া, কেনিয়া, উগান্ডা ও জায়ার হয়ে এখানে তিনি এসেছিলেন। আবার কেউ বলেন, তিনি বাঁশের ভেলায় চড়ে কংগো নদী হয়ে সংঘ নদী পথে বারবারেতি এসেছিলেন। সত্য যেটাই হোক ঘোর এক দুর্দিনে বারবারেতির মানুষ স্বর্গের সাহায্য রূপে তাকে দেখতে পেয়েছিল।“কথিত আছে, একদিন ভোরে ইউরোপীয় দাস ব্যাবসায়ীরা একটা স্টীম বোটে করে বারবারেতি এলাকায় প্রায় দেড় শ’ যুবককে ধরে নিয়ে যাচ্ছিল। ইউরোপীয়দের গুলি বৃষ্টিরে মুখে যুবকদের আত্মীয় স্বজনরা নদীর তীরে গড়াগড়ি দিয়ে আহাজারি করছিল। তারা বিস্ময়ের সাথে দেখল নদীর তীরে দাঁড়ানো বাঁশের ভেলায় বসে ধ্যানরত একজন সৌম্যমূর্তি বৃদ্ধ উঠে দাড়ালো এবং দরাজ কণ্ঠে স্টিম বোটকে থামার নির্দেশ দিল। বোট থামল না। বৃদ্ধ তাঁর ডান হাত ঊর্ধ্বে উত্তোলন করল। সঙ্গে সঙ্গে বোট সব শক্তি হারিয়ে নিশ্চল হয়ে গেল। ইউরোপীয়দের বন্দুকগুলো তাক করল বৃদ্ধকে। কিন্তু বন্দুকগুলো থেকে ধোয়া বেরুল, শব্দ হলো, গুলি বেরুল বটে, কিন্তু গুলিগুলো ঝরে পড়ল বৃদ্ধের দেহ থেকে। বৃদ্ধ হাত দিয়ে ইঙ্গিত করল বোটটিকে কূলে ভেড়ার জন্য। ইঞ্জিন স্টার্ট হওয়া ছাড়াই নিঃশব্দে বোটটি কূলে এসে ভিড়ল। বৃদ্ধ তাঁর সেই দরাজ গলায় ইউরোপীয়দের তাদের বন্দুকগুলো নদীর তীরে ফেলে দিতে বলল এবং বন্দীদের ছেড়ে দিতে নির্দেশ দিল। ইউরোপীয়রা পাথরের মত হয়ে গিয়েছিল। তারা পুতুলের মত হুকুম পালন করল। বারবারেতির দেড়শ’ বন্দী মুক্তি পেয়ে তীরে নেমে এল। এরপর বৃদ্ধ ইউরোপীয়দের চলে যাবার নির্দেশ দিল এবং সাবধান করেদিল আর যেন দাস ব্যবসায় তারা না করে।
স্টার্ট নিয়ে বোট চলে গেল।
বৃদ্ধটি বাঁশের ভেলা থেকে ধীরে ধীরে তীরে নেমে এল। বারবারেতির সকল মানুষ তাঁর সামনে উপুড় হয়ে পড়ল। তারা মনে করল স্বয়ং ঈশ্বর মানুষের রূপ ধরে তাদের সামনে এসেছে। কিন্ত বৃদ্ধ ‘অমানুষ’ নামে অভিহিত কালো মানুষগুলোকে পা থেকে বুকে টেনে তুলল। জড়িয়ে নিল বুকে।
যা হোক, বৃদ্ধ আহমদ বিন আব্দুর রহমান বারবারেতিতেই তাঁর নিবাস বানাল। তিনি আসার পর দাস সংগ্রহের আর কোন হামলা বারবারেতিতে হয় নি।
চারিদিকে নাম ছড়িয়ে পড়ল বৃদ্ধের। ঈশ্বরের সাক্ষাৎ প্রতিভু হয়েও তিনি মাটির মানুষ, প্রাণের মানুষ। দাস ব্যবসায় তিনি আসায় বন্ধ হয়ে গেছে। অন্যায়-অশান্তি ও হানাহানিও তিনি কমিয়ে দিয়েছেন। এই কাহিনী আমি পড়েছি পশ্চিমি পরিব্রাজকের এক বইতে। তিনি স্থানীয় ভাষায় লিখিত একটা পুস্তিকার বরাত দিয়ে এই কাহিনী লিখেছেন।
বৃদ্ধ আহমদ বিন আব্দুর রহমান বারবারেতিতে জ্বালালেন ইসলামের আলো। ইসলাম প্রচারের এক কেন্দ্র হয়ে দাঁড়ালো বারবারেতি।
বারবারেতিকে কেন তিনি বেছে নিয়েছিলেন?
সেই সময়ের আফ্রিকার অবস্থার দিকে যদি তাকাই তাহলে দেখব বারবারেতি আলো এবং অন্ধকারের মাঝে একই সীমারেখা। নাইজেরিয়া থেকে যে রাস্তা উত্তর ক্যামেরুন হয়ে দক্ষিণে অগ্রসর হয়েছিল, তা বারবারেতি এসে থেমে গিয়েছিল। এর দক্ষিণে বাইরের কোন কাফেল তখনও পা রাখেনি। বারবারেতির পশ্চিমে দক্ষিণ ক্যামেরুন তখন মুসলিম শূন্য, আর বারবারেতির পুবে মধ্য আফ্রিকা প্রজাতন্ত্রের দক্ষিণাঞ্চলও তখন কোন মুসলিমের পদচারণায় ধন্য হয়নি। আর দক্ষিণে অবস্থিত কংগো,গ্যাবন, জায়ার তো তখন একেবারেই তিমির অন্ধকারে ঢাকা। মানুষ এবং পশু তখন সে অঞ্চলে একাকার।
এই বিশাল জমাট অন্ধকারের প্রান্তে দাঁড়ানো বারবারেতি ছিল সোনালী সিংহদ্বারের মত। সেখান থেকে উত্তরের সাথে স্থল পথে যোগাযোগ করা যায়, আর অন্ধকার দক্ষিণের সাথে সংযোগ গড়ে তোলা যায় নদী পথে। অন্ধকারের সোনালী সিংহদ্বার এই বারবারেতিকে কেন্দ্র করে বৃদ্ধ আহমদ বিন আব্দুর রহমান অন্ধকার দক্ষিণে ইসলামের আলো ছড়িয়ে দিয়েছিলেন।
এই হলো বারবারেতির স্মৃতি।
আর যে ঘটনার কথা বলেছি, বারবারেতির সেই ঘটনা হলোঃ
আহমদ বিন আব্দুর রহমান স্থানীয় জনগণের পাশে থাকতে গিয়ে এবং ইসলাম প্রচারের কারণে পশ্চিমী খৃষ্টান মিশনারী এবং উদীয়মান ফরাসী ঔপনিবেশিক শক্তির শত্রুতে পরিণত হয়েছিলেন। ঠিক এই সময়ি আহমদ বিন আব্দুর রহমান বারবারেতিতে একটা আন্তর্জাতিক ইসলামী সম্মেলনের আয়োজন করেছিলেন। এ সম্মেলনে তুরস্কের ওসমানিয়া খেলাফতের প্রতিনিধি ও মিসরের গ্র্যান্ড মুফতিসহ মালি খিলাফত, নাইজেরিয়া সালতানাত এবং উত্তর ক্যামেরুনের ইয়েসুগো সুলতানের প্রতিনিধিকে দাওয়াত দেয়া হয়েছিল। এই মহামান্য মেহমানদের এনে আহমদ বিন আব্দুর রহমান তিমিত অন্ধকারে ঢাকা এক আফ্রিকাকে দেখাতে চেয়েছিলেন এবং বলতে চেয়েছিলেন এই অন্ধকারের বাসিন্দাদের প্রতি তাদের দায়িত্বের কথা।
কিন্তু তাঁর এ ইচ্ছা পূরণ হয়নি। সম্মেলনের চারদিন আগে এক রাতে সম্মেলন কেন্দ্রে যখন তিনি কর্মরত ছিলেন, তখন এক অগ্নিকাণ্ডে সম্মেলন কেন্দ্রে ভস্মীভূত হয় এবং তিনি নিহত হন। অগ্নিদগ্ধ আহমদ বিন আব্দুর রহমানের পৃষ্ঠদেশে গভীর ছুরিকাঘাতের চিহ্ন ছিল। স্থানীয় মুসলিমরা মনে করত, খৃষ্টান মিশনারী ও ঔপনিবেশিকরা যোগসাজস করে তাঁকে হত্যা করেছে এবং সম্মেলন পণ্ড করেছে। আর স্থানীয় অন্যান্য অধিবাসীরা বিশ্বাস করত, দাস ব্যবসায়ী শয়তানরা হত্যা করেছে তাদের স্বর্গীয় পিতাকে। এক মাস ধরে শোক পালন করেছে স্থানীয় অধিবাসীরা। তাঁর নিহত হবার দিনকে স্থানীয় অধিবাসীরা শোক দিবস হিসেবে পালন করে আসছে গত দু’শ বছর ধরে।
এই বারবারেতি শহরেই ‘ডার্ক আফ্রিকা ব্রাইট হার্ট’- এর উদ্যাগে আন্তর্জাতিক ইসলামী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। বলা যায়, দু’শ বছর আগের একটা অসমাপ্ত কাজ আজ সমাপ্ত হচ্ছে। এখন বল ইয়েকিনি, জায়গাটার সিলেকশন ঠিক হয়েছে কিনা?’
আহমদ মুসার কথা গোগ্রাসে গিলছিল ইয়েকিনি রাশিদীরা।
আহমদ মুসার প্রশ্ন শুনে হাসল ইয়েকিনি। বলল, ‘কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু এত কথা আপনি জানলেন কি করে?’
‘ঠিক। আমরা আহমদ বিন আব্দুর র।হমান সম্পর্কে অনেক কথা জানি। আমার আব্বা ওখানে একবার গিয়েছেন। কিন্তু আমরা যা জানি, আপনার তুলনায় তা সামান্য।’ বলল রাশিদী ইয়েসুগো।
হাসল আহমদ মুসা। বলল, রাশিদী তোমাদের পারিবারিক লাইব্রেরীতে ‘মধ্য আফ্রিকায় উপনিবেশ-এর সূচনা পর্ব’ নামে ফরাসী ভাষায় একটি বই পড়লাম। বইটি এর আগেও একাধিক লাইব্রেরীতে দেখেছি, কিন্তু পড়ার সুযোগ হয় নি। এবার পড়লাম। এ বইয়ের কাহিনীর সাথে যদি ‘আফ্রিকায় প্রাথমিক যুগের সুফি-সাধক এর বিবরণ যোগ কর, তাহলে আমি যে কাহিনী বললাম তার চেয়েও বেশি জানতে পারবে।’
এ সময় ব্ল্যাক বুল উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘আমার একটা কাজ আছে। আমি আছি আমার ঘরে।’
বলে ঘর থেকে বেড়িয়ে গেল ব্ল্যাক বুল। তার পর পরই ঘরে প্রবেশ করল লায়লা। তার হাতে একটা ইনভেলাপ। ইনভেলাপটি রাশিদীর হাতে তুলে দিতে দিতে বলল, ‘ভাইয়াকে দাও, রোসেলিনের আব্বার চিঠি।’
রাশিদী ইনভেলাপটি আহমদ মুসার হাতে তুলে দিল।
বন্ধ ইনভেলাপ থেকে চিঠি বের করল আহমদ মুসা। পড়ল চিঠি। চিঠি পড়ে তার ঠোঁটে এক টুকরো হাসি ফুটে উঠল। বলল, ‘রাশিদী, রোসেলিনের আব্বা তোমার সাথে রোসেলিনের বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছেন।’
‘আপনার কাছে?’ ঠোঁটে হাসি টেনে বলল লায়লা।
‘হ্যাঁ। সম্ভবত আমাকেই এখন রাশিদীর যথার্থ অভিভাবক মনে করেছেন।’ হাসল আহমদ মুসা।
‘তাঁর মনে করাটা সত্য। আপনার চেয়ে আমার বড় অভিভাবক এই দুনিয়ায় আর কে হতে পারেন?’
‘আম্মা মানে তোমার আম্মার অধিকার অস্বীকার করোনা, রাশিদী।’ বলল আহমদ মুসা হাসতে হাসতে।
‘আম্মাকে জিজ্ঞেস করে দেখুন, এ অধিকার আম্মা আপনার হাতেই তুলে দিয়েছেন।’ বলল রাশিদী।
‘তাহলে এ অধিকার কিন্তু আরও অনেক জায়গায় খাটাব।’
‘যেমন?’ বলল রাশিদী।
‘রোসেলিনের আব্বা একটা প্রস্তাব দিয়েছেন, আমারো একটা প্রস্তাব আছে।’
রাশিদীর মুখ মলিন হয়ে উঠল।
আহমদ মুসা ব্যাপারটা আঁচ করতে পেরে হেসে বলল, ‘ভয় করো না, তোমার বিয়ের পাল্টা প্রস্তাব নয়, অন্য বিয়ের একটা প্রস্তাব আমার আছে।’
রাশিদী লজ্জায় মুখ নিচু করল। পরক্ষণেই মুখ তুলে বলল, ‘প্রস্তাবটা বলুন।’
‘বলব?’ বলে একটু থামল আহমদ মুসা। তারপর বলল, ‘এলিসা গ্রেস এর সাথে ওমর বায়া এবং বোন লায়লার সাথে ভাই মুহাম্মাদ ইয়েকিনির বিয়ে তোমাদের সাথে একই সময়ে হয়ে যেতে পারে।’
শুনেই রাশিদী সোৎসাহে বলে উঠল, ‘এক সাথে মানে, এদের বিয়েই আগে হবে।’
মুহাম্মাদ ইয়েকিনি লজ্জায় মুখ নিচু করল। আর দু’হাতে মুখ ঢেকেছে লায়লা।
‘আগে হওয়ার যুক্তি কি?’ হেসে বলল আহমদ মুসা।
‘প্রধান যুক্তি হলো, লায়লা সব সময় কথা বলা, দাবী আদায়, খাওয়া- সব ব্যাপারে আমার উপরে এবং আগে থাকতে চায়, সুতরাং এ ব্যাপারেও…।’
‘চাইলে কি হবে, তুমিই তো আগে থাক।’ লজ্জা রাঙা মুখে লায়লা তীব্র প্রতিবাদ করল।
‘ঠিক আছে, আর আগে থাকব না।’
লায়লা মুখ খুলতে যাচ্ছিল। আহমদ মুসা বাধা দিয়ে হেসে বলল, ‘ তোমাদের ভাইবোনের ঝগড়া আপাতত বন্ধ। আগে-পরের ব্যাপারটা আমি দেখব।’ বলে থামল আহমদ মুসা।
কিছু বলতে যাচ্ছিল আহমদ মুসা। তার আগেই মুখ খুলল লায়লা। বলল, ‘চিঠি তো অনেক বড় দেখছি, আর কি লিখেছে,ভাইয়া?’
আরও কিছু আছে নাকি?’ বলল আহমদ মুসা।
‘আছে বলে মনে হয়’। লায়লা বলল।
‘কেমন করে জান? পড়েছ নাকি চিঠি?’
‘তওবা। এটা আমি করতে পারি না। রোসেলিন আমাকে টেলিফোনে বলেছে’।
‘রোসেলিন কি করে জানে?’
‘তার আব্বা এবং মারিয়া আপার আব্বার কথা সে শুনেছে’।
‘রোসেলিন কি বলেছে লায়লা? বলল রাশিদী একটু ফাঁকা পেয়ে।
‘বলব ভাইয়া?’ আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে মুখ টিপে হেসে বলল লায়লা।
জবাব না দিয়ে আহমদ মুসা চিঠিটা এগিয়ে দিল রাশিদীর দিকে ম্লান হেসে।
রাশিদী ইয়েসুগো চিঠিতে চোখ বুলিয়ে লাফিয়ে উঠল খুশীতে। প্রায় চিৎকার করে বলল, ‘মারিয়া আপা ও আহমদ মুসা ভাইয়ের ঐতিহাসিক বিয়ে যদি ক্যামেরুনে হয়, ধন্য হবে ক্যামেরুন’।
‘ঠিক বলেছ ভাইয়া। ক্যামেরুনের মুসলিম সমাজের জন্যে এর চেয়ে বড় আনন্দ আর কিছু হয়নি, আর হবেও না। তবে ভাইয়া বিয়েটা কিন্তু আমাদের বাড়িতে হতে হবে। রোসেলিন চাইবে বিয়ে, তাদের বাড়িতে হোক। তুমি রোসেলিনের পক্ষে যেতে পারবে না’। উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলল লায়লা।
আহমদ মুসা গম্ভীর। কোন কথা বলল না।
এ সময় এদিনের খবরের কাগজ দিয়ে গেল বেয়ারা এসে।
খবরের কাগজ রাশিদী ইয়েসুগোই তুলে নিল প্রথম হাতে। কাগজ হাতে নিয়ে প্রথম পাতায় চোখ বুলিয়েই চিৎকার করে উঠল রাশিদী।
‘ভাইয়া সর্বনাশ হয়ে গেছে’। কেঁপে উঠেছিল রাশিদীর কণ্ঠ।
‘কি হয়েছে রাশিদী? কিসের সর্বনাশ?’ আহমদ মুসার কণ্ঠে বিস্ময়।
রাশিদী তখন হুমড়ি খেয়ে পড়েছে একটা নিউজের উপর। পড়ছে নিউজ সে। মুহূর্ত কয়েক পরে কিছু না বলে শুকনো মুখে কাগজটি এগিয়ে দিল আহমদ মুসার দিকে।
খবরের কাগজ হাতে নিয়ে প্রথম পাতায় চোখ বুলাতেই চোখে পড়ল নিউজটা। হেডিংটা পড়ে বেদনায় পাংশু হয়ে গেল আহমদ মুসার মুখ।
নিউজের হেডিং-এ বলা হয়েছেঃ
ভয়াবহ বিষ্ফোরণে বারবারেতির ইসলামী সম্মেলন কেন্দ্র উড়ে গেছে। সম্মেলনের সকল মেহমান ও নেতৃবৃন্দ নিহত।
রুদ্ধশ্বাসে নিউজটা পড়ল আহমদ মুসাঃ ‘সম্মেলনের অধিবেশন চলাকালে গতকাল রাত ৯টা ৩ মিনিটে ভয়াবহ এক বিষ্ফোরণে গোটা সম্মেলন কেন্দ্র উড়ে গেছে এবং বিশ্ব মুসলিম কংগ্রেসের প্রধান শেখ আবদুল্লাহ আলী আল রাশিদ মাদানীসহ উপস্থাত সকল মেহমান নিহত হয়েছেন।
ঘটনার বিবরণে বলা হয়েছে, ‘সম্মেলনের দ্বিতীয় রুদ্ধদ্বার সেশনের সমাপ্তি পর্বে এই বিষ্ফোরণের ঘটনা ঘটে। সম্মেলনে দুই শতাধিক ডেলিগেট এবং প্রায় একক ডজন বিদেশী বিশিষ্ট মেহমানের সকলেই বিষ্ফোরণে নিহত হয়েছেন বলে নিশ্চিত জানা গেছে। রুদ্ধদ্বার হলে উপস্থিত কেউ বেঁচেছে বলে প্রত্যক্ষ দর্শীর কোন বিবরণ পাওয়া যাচ্ছে না। শুধু মূল সম্মেলন কক্ষ নয়, ঐ সম্মেলন ভবনে যারা ছিল, তাদের দেহও বিষ্ফোরণে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন ও ভষ্মিভূত হয়েছে। ভবনের আশেপাশের লোকদের আহত অবস্থায় পাওয়া গেছে। সম্মেলনের প্রোগ্রাম থেকে জানা যাচ্ছে, অধিবেশন সমাপ্ত হবার কথা রাত ৯টায়। তারপেরই এশার নামায হবার কথা। মনে করা হচ্ছে, নামাযের জন্যে সম্মেলনের মেহমান ও নেতৃবৃন্দ যখন মঞ্চের পেছনে এসছিলেন এবং ডেলিগেটরাও যখন তৈরী হচ্ছিল নামাযের জন্যে, সেই সময় বিষ্ফোরণটি ঘটে। সম্মেলনের প্রোগ্রাম থেকে দেখা যাচ্ছে, বিষ্ফোরণের সময় সম্মেলন কক্ষে বিশ্ব মুসলিম কংগ্রেসের প্রধান শেখ আবদুল্লাহ আলী আল রাশিদ মাদানী, মুসলিম যুব সম্মেলনের প্রেসিডেন্ট কামাল ইনুনু, মিসরের আল আজহারের গ্রান্ড শেখ সাইয়েদ আলী কুতুব প্রমুখ ১২জন বিশ্ব বরেণ্য মুসলিম ব্যক্তিত্ব হাজির ছিলেন। তাছাড়া ছিলেন ‘ডার্ক আফ্রিকা ব্রাইট হার্ট’ সংগঠনের সভাপতি তারেক আল মাহদি সুদানী সহ কয়েকজন নেতা। অনুমান করা হচ্ছে বিষ্ফোরণে সকলের মর্মান্তিক প্রাণ বিয়োগ ঘটেছে। প্রায় ধুলো হয়ে যাওয়া ধ্বংস স্তুপে কোন জীবনের অস্তিত্ব তো দূরে থাক, কোন আস্ত দেহের অস্তিত্বও কোথাও আছে বলে মনে করা হচ্ছে না।
এই ধরনের ধ্বংসাত্মক বিষ্ফোরণের ঘটনা আফ্রিকার সাম্প্রতিক ইতিহাসে নেই। স্থানীয় বিশেষজ্ঞদের ধারণা, সম্পূর্ণ নতুন ধরনের দূরনিয়ন্ত্রিত বোমায় ভবনটিক ধ্বংস করা হয়েছে।
ঘটনাকে নাশকতা বলে সবাই মনে করছেন। কিন্তু কারা এই নাশকতামূলক কাজের সাথে জড়িত থাকতে পারে, এ ব্যাপারে কেউ কিছু বলতে পারছে না। উদ্যোক্তা ‘ডার্ক আফ্রিকা ব্রাইট হার্ট’ এবং স্থানীয় মুসলিম সংগঠনের যাদের পাওয়া গেছে, তারা বলেছেন এ ধরনের কাজ করতে পারে, এমন সন্দেহজনক কেউ তাদের নজরে নেই। সম্মেলনের ব্যাপারে কারো বিরোধিতা তো দূরে, সামান্য অসন্তুষ্টি বা দ্বিমতও কারও মধ্যে তারা দেখেননি’।
খবর পড়া শেষ হলেও আহমদ মুসার চোখ কাগজের উপর থেকে সরে এল না। যেন তার চোখ দু’টি আটকে গেছে কাগজের সাথে।
বিষ্ময় ও বেদনার ধাক্কায় তার চিন্তার শক্তি যেন থেমে গেছে, বোবা হয়ে গেছে যেন সে।
এক সময় তার হাত থেকে কাগজটা পড়ে গেল।
সম্বিত ফিরে পেয়ে আহমদ মুসা একটু নড়ে-চড়ে উঠে সোফায় গা এলিয় দিল। একটা ক্লান্তি এসে তাকে ঘিরে ধরল। চোখ বুজল সে। চোখ বুজতেই তার মনটা ছুটে গেল দু’শ বছর আগের একটা ঘটনার দিকে সেদিনও একটা বিষ্ফোরণ এ ধরনেরই একটা সম্মেলন পন্ড করে দিয়েছিল। দুই ঘটনার মধ্যে পার্থক্য হলো, দু’শ বছর আগের বিষ্ফোরণ সংঘটিত সম্মেলনের আগে এবং তাতে বিদেশী মেহমান কেউ মারা যায়নি। আর এ বিষ্ফোরণ সংঘটিত হলো সম্মেলন চলাকালে এবং তাতে নিহত হলেন ডজন খানেক গুরুত্বপূর্ণ মেহমান।
এটুকু পার্থক্য থাকলেও দু’টি ঘটনা একই ধরনের এবং উদ্দেশ্যও নিঃসন্দেহে এক। তাহলে কি ধরে নয়া যায়, একই ধরনের লোক এই দুই ঘটনা ঘটিয়েছে?
চোখ খুলল আহমদ মুসা।
রাশিদী, ইয়েকিনি, লায়লা বিমূঢ় হয়ে পড়েছিল। তাকিয়েছিল আহমদ মুসার দিকে।
আহমদ মুসাই প্রথমে মুখ খুলল। বলল, ‘দু’শ বছর আগের ঘটনারই আবার পুনরাবৃত্তি ঘটল’।
অনেকটা স্বগত কণ্ঠে উচ্চারণ করল আহমদ মুসা।
‘তাহলে কি একই ধরনের শত্রুর কাজ?’ বলল রাশিদী ইয়েসুগো।
সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু নিউজে ওখানকার দায়িত্বশীলরা এটা সরাসরি স্বীকার করেননি’। আহমদ মুসা বলল।
‘দুর্ভাগ্য বারবারেতির বিশেষ কোন দুর্ভাগ্য নয়। ক্যামেরুনে মুসলমানদের যে দুর্ভাগ্য বারবারেতির। এমন দুর্ভাগ্য মনে হয় আফ্রিকার আর কোন নগরীর হয়নি’। বলল রাশিদী ইয়েসুগো।
‘বারবারেতির বিশেষ কোন দুর্ভাগ্য নয়। ক্যামেরুনে মুসলমানদের যে দুর্ভাগ্য দেখছ, তারই অন্য একটা রূপ দেখতে পাচ্ছ বারবারেতিতে। মৌলিক কোন পার্থক্য নেই দুইয়ের মধ্যে’। আহমদ মুসা বলল।
‘বিরাট ক্ষতি হলো মুসলিম বিশ্বের। বিশ্ব মুসলিম কংগ্রেসের প্রধান আবদুল্লাহ আলী, আল আজহারের গ্রান্ড শেখ সাইয়েদ আলীর ক্ষতিপূরণ হবে কি দিয়ে? বিশেষ করে ‘ডার্ক আফ্রিকা ব্রাইট হার্ট’-এর তারেক আল মাহদীর মত আগুনের ছেলেকে মুসলিম আফ্রিকা আবার কবে পাবে কে জানে!’ বলতে বলতে রাশিদী ইয়েসুগোর গলা ভেঙ্গে পড়ল কান্নায়।
‘হ্যাঁ রাশিদী, এ দিক থেকে এটা যে কত বড় ক্ষতি তা পরিমাপ করা যায় না। মন চাচ্ছে, ওদিকে একবার যাই। এতবড় ঘটনা ঘটাতে যারা সাহস পেল তারা অনেক বড় শত্রু’।
‘কে এই বড় শত্রু বুঝতে পারছি না আহমদ মুসা ভাই। ‘ওকুয়া এবং ‘কোক’ মধ্য ও পশ্চিম আফ্রিকার সবচেয়ে বড় সংগঠন। মনে হচ্ছে এই দু’টো সংগঠন আজ যে অবস্থায় পড়েছে, তাতে ঐ ঘটনা ওরা ঘটায়নি। আর যতদূর জানি, মধ্য আফ্রিকা প্রজাতন্ত্রে বড় ধরনের কোন সন্ত্রসী সংগঠন নেই’।
‘কিন্তু ঘটনা তো ঘটেছে। কোন বড় কেউই তা ঘটিয়েছে’।
বলে আহমদ মুসা একটু থামল। তারপর বলল, ‘চল, ক্যামেরুন ক্রিসেন্টের অফিসে যাই। ফ্রান্সিস বাইকদের সাথে একটু কথা বলে দেখি, কোন কথা বের করা যায় কিনা’।
আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল।
তার সাথে সাথে সবাই।
ক’দিন পরের ঘটনা।
রাশিদী ইয়েসুগো একটা খবরের কাগজ হাতে ঘরে ঢুকে কাগজটা আহমদ মুসার হাতে তুলে দিল। একটা নিউজের দিকে ইংগিত করে বলল, ‘নিউজটা পড়ুন আহমদ মুসা ভাই, সুন্দর নিউজ’।
আহমদ মুসা সোফায় গা এলিয়ে বসেছিল। কাগজটা হাতে নিয়ে সোজা হয়ে বসল। নিউজের উপর নজর দিল আহমদ মুসা।
হেডিং পড়লঃ
“এক সাক্ষাৎকারে আইনমন্ত্রী”
“ক্যামেরুনে বর্তমানে মানবাধিকার পরিস্থিতি চমৎকার”
পড়ল আহমদ মুসা খবরটা। খবরে বলা হয়েছে, “ক্যামেরুনের গণতান্ত্রিক সরকার দেশের প্রতিটি নাগরিকের নাগরিক অধিকারের প্রতি সতর্ক দৃষ্টি রেখেছে। ক্যামেরুনে বর্তমানে মানবাধিকার পরিস্থিতি অত্যন্ত চমৎকার। সরকার দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় দৃঢ় প্রতিজ্ঞ’। ক্যামেরুনের আইনমন্ত্রী মিঃ হাম আগবো ‘সানস অব অ্যাডাম’ নামক একটা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থার একটি প্রতিনিধি দলকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে এই মন্তব্য করেন। সম্প্রতি সংবাদ মাধ্যম ও সংবাদপত্রের প্রচারিত দক্ষিণ ক্যামেরুনে মুসলমানদের উচ্ছেদ ও তাদের সম্পত্তি গ্রাসের বিষয়ে আইন মন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বলেন, এই ধরণের ঘটনা কিছু ঘটেছে। এর সাথে জড়িত বেসরকারী দু’একটা সংগঠন। সরকার এ সবের কিছুই জানত না। এ সংক্রান্ত খবরটি বের হবার পর সরকার এ ব্যাপারে খোঁজ খবর নিয়েছে এবং উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসন, তাদের জমি তাদেরকে ফিরিয়ে দেয়া এবং এমনকি তাদের ক্ষতি পূরণেরও ব্যবস্থা হয়েছে।’ এ ধরণের দু’চারজন পুনর্বাসিত উদ্বাস্তুর সাথে কি তারা দেখা করতে পারে না- এমন একটি প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, দু’চারজন কেন আমরা লিস্ট দিয়ে দিতে পারি, আপনারা যত ইচ্ছা দেখা করতে পারেন।’ এমন ঘটনা ভবিষ্যতে যাতে ঘটতে না পারে, তার জন্যে আপনারা কি বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করছেন- এই প্রশ্নে আইন মন্ত্রী বলেন, ‘হ্যা বিষয়টা নিয়ে আমরা চিন্তা করেছি। আমরা আইন করতে যাচ্ছি, সংখ্যালঘু বিশেষ করে মুসলমানদের জমি হস্তান্তর করতে হলে জাতীয় ধরণের কেন্দ্রীয় কোন মুসলিম সংগঠনের অফিসিয়াল সার্টিফিকেট লাগবে। কোন অমুসলিম এ ধরণের সার্টিফিকেট ছাড়া কোন মুসলমানের সম্পত্তি কিনতে পারবে না। তাছাড়া বাস্তুভিটা ক্রয়-বিক্রয় আমরা নিষিদ্ধ করতে যাচ্ছি।’ সম্পত্তি হস্তান্তর এবং উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসন করতে গিয়ে আপনারা শক্তিশালী এনজিওদের পক্ষ থেকে কোন বাধার সম্মুখীন হয়েছেন কিনা, এ প্রশ্নের জবাবে আইন মন্ত্রী জানান, এনজিওদের পক্ষ থেকে কথা উঠেছিল, কিন্তু তাদেরকে আমরা দেখিয়েছি যে, জমি হস্তান্তরের ব্যাপারটা শান্তিপূর্ণ ও স্বেচ্ছা প্রণোদিত ছিল। কোন জোরাজুরির ঘটনা ঘটেনি।’’
খবরটা পড়া শেষ করে আহমদ মুসা বলল, ‘সানস অব অ্যাডাম’ সংস্থাকে ধন্যবাদ জানাতে হয়। প্রয়োজনীয় সব কথাই ওরা বের করে নিয়েছে সরকারের মুখ থেকে। রোসেলিনের আব্বা চীফ জাস্টিসের অবদানই অবশ্য এক্ষেত্রে বেশী। তিনিই সরকারকে এভাবে তৈরী করার ব্যবস্থা করেছেন আইন সচিব লাউস মেইডি’র মাধ্যমে।’
‘তবে ‘সানস অব অ্যাডাম’ও আমাদের যথেষ্ট উপকার করল। কে এই ‘সানস অব অ্যাডাম’?’ বলল রাশিদী ইয়েসুগো।
‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক একটা মানবাধিকার সংস্থা।’ বলল আহমদ মুসা।
‘এ টুকুই কি এর পরিচয়?’ বলল রাশিদী ইয়েসুগো।
‘তুমি ঠিকই ধরেছ। এ টুকুই এর পরিচয় নয়। এটা আমেরিকার একটা মুসলিম মানবাধিকার সংস্থা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আফ্রো-আমেরিকান মুসলিম কম্যুনিটি এই সংস্থাটির প্রতিষ্ঠা করেছে। তবে তারা সামনে নেই। খৃষ্টান ও মুসলিম কিছু শিক্ষাবিদ ও আইনবিদকে নিয়ে এই সংস্থাটি গঠিত হয়েছে। এই সংস্থাটির মূল শ্লোগান হলোঃ ‘আদমের সন্তান আমরা সকরে সমান’।’
‘তারা কি ক্যামেরুনের সব জেনেই এখানে এসেছে।’ বলল মুমাম্মাদ ইয়েকিনি।
‘হ্যা।’
‘আপনি কি জানতেন তারা আসবে?’ বলল মুহাম্মাদ ইয়েকিনিই আবার।
‘জানি, আবার জানিও না।’
‘সেটা কেমন?’ বলল রাশিদী ইয়েসুগো।
‘FWTV এবং WNA –এর মাধ্যমে নিউজ করা, মুসলিম মানবাধিকার সংস্থার এ ধরণের সফর ইত্যাদি ‘মুসলিম শ্লোগান প্রোপাগান্ডা প্লানিং’ (MGPP) এর অংশ। সুতরাং বলা যায়, আমি জানি তারা আসবে।’
‘তাদের সাথে আপনি কথা বলবেন না?’ বলল ইয়েকিনি।
‘এ ধরণের সাক্ষাৎ কৌশলগত কারণে সব সময় নিষিদ্ধ। যার কাজ সে করবে, এটাই নিয়ম।’
‘বুঝলাম।’
‘আহমদ মুসা কথা বলছিল আর কাগজে নজর বুলাচ্ছিল। হঠাৎ তার চেহারা পাল্টে গেল। কোন কিছুর প্রতি তার নজর হঠাৎ করেই যেন আটকে গেল। কিছু পড়ছে সে।
মুহূর্ত কয়েক পরে কাগজ থেকে মুখ তুলে আহমদ মুসা বলল, ’দেখ অদ্ভুত একটা বিজ্ঞাপন।’
বলে আহমদ মুসা কাগজের ঐ অংশটি সবার সামনে তুলে ধরল।
সবাই পড়ল বিজ্ঞাপনটা। ছোট্ট বিজ্ঞাপন, কিন্তু শিরোনামটা বেশ বড়। পাতার উপর চোখ বুলালে প্রথম দৃষ্টিতেই চোখে পড়ে। বিজ্ঞাপনের শিরোনাম হলোঃ
‘বারবারেতির ভয়াবহ বিস্ফোরণ সম্পর্কে আগ্রহীদের জ্ঞাতব্য।’
এই শিরোনামের অধীনে বিজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, ‘‘বিজ্ঞাপন-দানকারী ‘নিউজ ব্যাংক’ একটি সৌখিন সংস্থা। এই সংস্থা দাতব্য কাজে সহযোগিতার লক্ষ্যে নিউজ এবং নিউজ উপকরণ বিক্রি করে থাকে। এই উদ্দেশ্যে বড় বড় ঘটনা এক দেশ, জাতি ও সংস্কৃতি সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ নিউজ, নিউজ পটভূমি ও নিউজ উপকরণ ‘নিউজ ব্যায়’ সংগ্রহ করে থাকে। বারবারেতি’র ভয়াবহ ঘটনা সম্পর্কেও করেছে। আগ্রহী ক্রেতাগণ নিম্ন ঠিকানায় যোগাযোগ করুন।’’
বিজ্ঞাপনের নিচে ঠিকানা বলতে দু’টি টেলিফোন নম্বার দেয়া হয়েছে। একটা নাইরোবির, আরেকটা মধ্য আফ্রিকা প্রজাতন্ত্রের রাজধানী বাংগুই-এর।
বিজ্ঞাপনটি পড়ে রাশিদী ইয়েসুগো বলল, ‘মজার বিজ্ঞাপন। এমন সংস্থান নাম কোনদিন শুনিনি।’
কিন্তু রাশিদী ইয়েসুগোর কথা আহমদ মুসার কানে প্রবেশ করল বলে মনে হলো না। সে সোফায় গা এলিয়ে দিয়েছে। চোখে তার শূণ্য দৃষ্টি। যেন কোথাও হারিয়ে গেছে তার মন।
মুহাম্মাদ ইয়েকিনি কিছু বলতে যাচ্ছিল। রাশিদী ইয়েসুগো আংগুল তুলে থামিয়ে দিল ইয়েকিনিকে।
ইয়েকিনিও ব্যাপারটা লক্ষ্য করল। চুপ করে গেল সে। দু’জনেই বুঝল গুরুত্বপূর্ণ কোন চিন্তায় ডুব দিয়েছে আহমদ মুসা। কিছুক্ষণ পর আহমদ মুসা ঘুম থেকে জেগে ওঠার মত নড়ে উঠল। রাশিদী ইয়েসুগোর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘গোটা বিজ্ঞাপনটা একবার পড়তো।’
রাশিদী ইয়েসুগো পড়ল বিজ্ঞাপনটা।
পড়া শেষ করেই বলল, ‘বিজ্ঞাপন নিয়ে ভাবছেন কিছু আহমদ মুসা ভাই? কিছু কি আমরা কিনব ওদের কাছ থেকে?’
‘দেখ তো সবগুলো কাগজে এ বিজ্ঞাপন আছে কিনা।’ বলল আহমদ মুসা।
রাশিদী এবং ইয়েকিনি দু’জনে মিলে সবগুলো কাগজ তন্ন তন্ন করে দেখল। বলল রাশিদী, ‘ফরাসী ভাষায় সবগুলো কাগজে আছে। স্থানীয় ভাষায় কোন কাগজে নেই।’
‘আমাদের হাতের ‘দি লাইট’ ছাড়া অন্য কাগজগুলো বিজ্ঞাপনটা কোন পাতায় ছেপেছে?’ আহমদ মুসা বলল।
‘শেষ পাতায়।’ বলল রাশিদী।
‘অর্থাৎ একমাত্র ‘দি লাইট’ বিজ্ঞাপনটি প্রথম পাতায় ছেপেছে।’ বলল আহমদ মুসা।
‘তাই। কিন্তু এতে কি হয়েছে?’ বলল রাশিদী।
‘বলব।’ বলে একটু থামল আহমদ মুসা। একটু পর বলল, ‘রাশিদী বিজ্ঞাপনে নাইরোবির যে টেলিফোন নম্বার দেয়া হয়েছে, সেখানে টেলিফোন কর। জানতে চাও কি কি নিউজ রিপোর্ট এবং ফটোগ্রাফ তাদের কাছে পাওয়া যাবে। পরিচয় জিজ্ঞেস করলে বলবে, ক্রিসেন্ট ফটোগ্রাফিক সোসাইটি।’
‘কিন্তু নাইরোবিতে কেন? ‘বাংগুই’ তো আমাদের কাছেই।’ বলল রাশিদী ইয়েসুগো।
‘প্রয়োজন আছে। যা বলেছি তা করো।’
রাশিদী তার পাশ থেকে সেলুলার টেলিফোনটি তুলে নিল। ডায়াল করল। কথা বলল।
কথা শেষ করে টেলিফোন অফ করে দিল রাশিদী।
আহমদ মুসার ঠোঁটে এক টুকরো হাসি। বলল রাশিদীকে লক্ষ্য করে, ‘ওরা বিজ্ঞাপন সম্পর্কে কিছুই জানেনা না?’
‘ঠিক বলেছেন। আপনি তাহলে ধরে ফেলেছেন। কিন্তু জানে না কেন?’
‘কারণ বিজ্ঞাপন দাতারা ধরণাই করেনি যে, বাংগুই ছেড়ে কউ নাইরোবিকে জিজ্ঞেস করতে যাবে।’
‘কিছুই বুঝতে পারছি না আহমদ মুসা ভাই।’ বলল ইয়েসুগো।
‘বলব। তুমি বাংগুই-এর নম্বারে টেলিফোন কর। ‘ক্রিসেন্ট ফটোগ্রাফিক সোসাইটি’র ঠিকানা তাদের জানাবে না।’
‘সোসাইটি নেই, ঠিকানা থাকবে কি করে?’ হেসে বলল রাশিদী।
রাশিদী বাংগুই-এর নম্বারে ডায়াল করল। কথা বলল।
কথা শেষ করে টেলিফোন অফ করে রাশিদী মুখ ঘোরাল আহমদ মুসার দিকে।
‘ওখানে তাহলে কিছুই মিলল না?’ হেসে বলল আহমদ মুসা।
‘মিলেছে। ইয়াউন্ডির ওদের একটা পোস্ট বক্স নম্বার।’ বলল রাশিদী ইয়েসুগো।
‘এই ঠিকানায় বুঝি সব জেনে নিতে বলেছে? আর কি বলল ওরা?’ আহমদ মুসা বলল।
‘ঠিক ধরেছেন। পোস্ট বক্স নম্বার দিয়ে বলেছে, ওখানে যোগাযোগ করলেই সব জানা যাবে।’
উত্তরে কোন কথা বলল না আহমদ মুসা। তার কপাল কুঞ্চিত। চিন্তা করছিল। ধীরে ধীরে গা সোফায় এলিয়ে দিল সে। চোখও তার বুজে গিয়েছিল।
‘কিছু ভাবছেন আহমদ মুসা ভাই?’ বলল রাশিদী ইয়েসুগো।
‘একটা রহস্যের সন্ধান করছি।’
‘রহস্য? কোথায়?’ রাশিদী ইয়েসুগো বলল।
‘বিজ্ঞাপন থেকে শুরু করে তোমার শেষ কথা পর্যন্ত একটা রহস্য ছড়িয়ে আছে।’
‘বুঝলাম না।’ রাশিদী ইয়েসুগো বলল।
‘আমিও।’ ইয়েসুগোর কথায় সায় দিল মুহাম্মাদ ইয়েকিনি।
‘শেষটার কথাই ধর। ও ধরণের একটা সংস্থার কোন একটা রাজধানীর ‘যোগাযোগ’ পয়েন্টে টেলিফোন থাকবে না, এটা বিশ্বাস যোগ্য নয়। সাধারণভাবে মনে করা হয় যারা তাদের ঠিকানা আড়ালে রাখতে চায় তারা পোস্ট বক্স নম্বরের ব্যবস্থা করে। তারা তাই করেছে। কিন্তু ও ধরনের একটা সংস্থা এই ভাবে লুকোচুরি খেলবে কেন?’ থামল আহমদ মুসা।
‘ঠিক, এটা একটা রহস্য। তারপর?’ বলল মুহাম্মাদ ইয়েকিনি।
‘নাইরোবির কথা চিন্তা কর। ওরা ওই বিজ্ঞাপন সম্পর্কে কিছুই জানে না। কিন্তু এটা স্বাভাবিক নয়। এ থেকে প্রমাণ হয়, নাইরোবিতে কেউ যোগাযোগ তা তারা মনে করেনি কিংবা চায়নি যে কেউ সেখানে যোগাযোগ করুক। তাই তারা নাইরোবিকে কিছুই জানায়নি।’
‘তাহলে নাইরোবির ঠিকানাটা দিল কেন?’ বলল রশিদী ইয়েসুগো।
‘নাইরোবি একটা আন্তর্জাতিক শহর। তাদের বিশ্বাসযোগ্যতা সৃষ্টির জন্যই তারা নাইরোবির সুনামকে কাজে লাগিয়েছে।’
‘অর্থাৎ এই বিজ্ঞাপনের টার্গেট গোটা দুনিয়া নয়, বরং একটা বিশেষ অঞ্চল।’ বলল মুহাম্মদ ইয়েকিনি।
‘ঠিক বলেছ। কিন্তু বলত সেই অঞ্চল কোনটা?’ বলল আহমদ মুসা।
ইয়েকিনি মুখ খোলার আগেই রাশিদী ইয়েসুগো বলল, আমার মনে হয় আফ্রিকার মধ্য পশ্চিমাঞ্চল সেটা।’
‘ধন্যবাদ রাশিদী। ঠিক ধরেছ।’
‘এবার বিজ্ঞাপনের রহস্যের কথা বলুন আহমদ মুসা ভাই।’
‘একটু মনোযোগী হলে রহস্যটা তোমাদেরও নজরে পড়তো। দেখ, বিজ্ঞাপনটা প্রকাশ হয়েছে শুধু ফরাসী ভাষার কাগজে। দ্বিতীয় লক্ষণীয় বিষয় হলো, বিজ্ঞাপনটা শুধু দি লাইট পত্রিকার পাতায় ছাপা হয়েছে, ফরাসী অন্যান্য পত্রিকায় ছাপা হয়েছে শেষ পাতায়।’ একটু থামল আহমদ মুসা।
এই সুযোগে রাশিদী ইয়েসুগো বলল, ‘এই দু’টি বিষয় থেকে আমরা কি বুঝতে পারি?’
‘ভাষার সিলেকশন থেকে বুঝা যায় বিজ্ঞাপনটি বিদেশীদের জন্যে প্রচার করা হয়েছে। আর ‘দি লাইট’ কে গুরুত্ব দেয়া থেকে বুঝা যায়, বিজ্ঞাপনটির লক্ষ্য মুসলিম সমাজ।’
‘বিজ্ঞাপনটি মুসলিম সমাজের জন্য হবে কারণ বিস্ফোরণের সাথে মুসলিম স্বার্থ জড়িত। কিন্তু তাহলে বিজ্ঞাপনটি বিদেশীদের জন্যে হবে কেন?’ বলল রাশিদী ইয়েসুগো।
‘প্রশ্ন আরও একটা আছে, তাদের নাইরোবি অফিস বিজ্ঞাপন সম্পর্কে কিছু না জানা থেকে বুঝা যায়, বিজ্ঞাপনটা বাইরের বিদেশী মুসলমানদের জন্য নয়। টার্গেট হলো, এই অঞ্চলের বিদেশী মুসলমান। এর অর্থ কি?’
‘প্রশ্নগুলো সত্যি রহস্যের সৃষ্টি করছে। এই রহস্যের সমাধান কি?’ বলল মুহাম্মদ ইয়েকিনি।
‘সমাধান করতে হবে।’
‘কিভাবে?’ রাশিদী ইয়েসুগো বলল।
‘অবলম্বন হলে বাংগুই থেকে পাওয়া পোস্ট বক্স নম্বর। ঐ নম্বরে একটা চিঠি ফেলে দাও। তবে তোমরা নাম ঠিকানা দেবে না, দেবে পোস্ট বক্স নম্বর।’
‘আমরা ঠিকানা দেব না কেন?’ বলল মুহাম্মাদ ইয়েকিনি।
‘কিছু না। ওদের সমান থাকা আর কি।’
‘যোগাযোগ করে ওদের কি বলব?’ বলল রাশিদী ইয়েসুগো।
‘লিখে ওদের জানাও কি কি ফটো এবং নিউজ আছে। তারপর অবস্থা বুঝে যা হয় তা করা হবে।
বলে আহমদ মুসা ঘড়ির দিকে তাকাল। সময়টা দেখে নিয়ে বলল, ‘চল উঠি, আমাদের একটা প্রোগ্রাম আছে না?’
‘চিঠিটা তাহলে তো লিখে ফেলতে হয়।’ বলল রাশিদী ইয়েসুগো।
‘অবশ্যই। চল আমাদের দেরী হয়ে যাচ্ছে।’
বলে আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল। তার সাথে সবাই।
পোস্ট বক্সে চিঠি ছাড়ার পঞ্চম দিনেই পোস্ট বক্সের মাধ্যমে ফিরতি চিঠি পেয়েছিল আহমদ মুসারা। চিঠিতে মাত্র কয়েকটা বাক্য লেখা ছিলঃ “আমাদের সংস্থা ইয়াউন্ডিতে নতুন। অস্থায়ীভাবে এক জায়গায় বসছি। টেলিফোন নেই। ইয়াউন্ডি সার্কুলার বি-৩ এর ৬৩ নম্বর ঠিকানায় যোগাযোগ করলে সব জানতে পারবেন।”
চিঠি পড়ে একটু ভেবেছিল আহমদ মুসা। তারপর ইয়েকিনির দিকে তাকিয়ে বলেছিল, ‘তাদের সাথে কথা বলার দায়িত্ব তুমি গ্রহণ কর।’
দায়িত্ব পেয়ে আনন্দিত হয়েছিল ইয়েকিনি। ধন্যবাদ দিয়েছিল আহমদ মুসাকে। সব দায়িত্বই সব সময় আহমদ মুসা নিজের কাঁধে তুলে নেয়। তার কাছ থেকে দায়িত্ব পাওয়া সৌভাগ্যের ব্যাপার। ইয়েকিনি আরও আনন্দিত হয়েছিল এই কারণে যে, বিষয়টার সাথে রহস্যের গন্ধ আছে।’ ভাড়া গাড়ি নিয়েছিল মুহাম্মাদ ইয়েকিনি।
ইয়াউন্ডি শহরটা মুহাম্মাদ ইয়েকিনির প্রায় মুখস্থ। ইয়াউন্ডি সার্কুলার বি-৬৩ সড়কটি শহরের উত্তর পশ্চিম প্রান্তে। আর ৬৩ নম্বরটি হবে সড়কটির মাঝ বরাবর।
গাড়িটা মুহাম্মাদ ইয়েকিনি ঠিক ঠিক ৬৩ নম্বরেই নিয়ে দাঁড় করাল।
একটা গেটের সামনে গিয়ে গাড়ি দাঁড়াল। গেট বন্ধ।
ইয়েকিনি গাড়ি থেকে নেমে গেট রুমের দিকে এগিয়ে গেল।
গেটম্যান গলা বাড়াল গেট রুমের জানালা দিয়ে।
‘এখানে তো ‘নিউজ ব্যাংক’-এর অফিস’। বলল ইয়েকিনি।
‘হ্যা। কেন?’ বলল গেট ম্যান।
‘ওদের সাথে আমার এখন দেখা করার কথা।’
কয়েক মুহুর্তের জন্যে তার মাথাটা গেটের ভেতরে চলে গেল।
তারপর মাথাটা মুহুর্তের জন্যে বের করে বলল, ‘আসছি।’
গেট খুলে গেল।
ইয়েকিনি গাড়ি ছেড়ে দিয়ে ভেতরে ঢুকে গেল।
সামনে একটা চত্ত্বর। তারপরেই বারান্দা। বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিল একজন কৃষ্ণাঙ্গ।
সে এগিয়ে এসে ইয়েকিনিকে স্বাগত জানাল। বলল, ‘আপনি মিঃ ইয়েকিনি?’
‘হ্যাঁ।’
‘আসুন, আমরা আপনার জন্যে অপেক্ষা করছি।’
লোকটির সাথে এগিয়ে গিয়ে ইয়েকিনি প্রবেশ করল একটা কক্ষে। কক্ষটি বেশ প্রশস্ত। কক্ষটির চারদিকে একবার তাকিয়েই বুঝতে পাল নতুন বা তাড়াহুড়ো করে সাজানো একটা অফিস।
একটা বড় টেবিলের ওপাশে একটা চেয়ারে বসে একজন শ্বেতাংগ যুবক।
ইয়েকিনি ঘরে ঢুকতেই যুবকটি উঠে দাঁড়িয়ে এগিয়ে এসে স্বাগত জানাল ইয়েকিনিকে।
খাতিরটা একটু বেশীই মনে হলো, অন্তত আফ্রিকান স্ট্যান্ডার্ডে। ভাবল আবার ইয়েকিনি, নতুন অফিস তো। ক্লায়েন্টের প্রতি খাতির তাই বেশীই হতে পারে।
শ্বেতাঙ্গ যুবকটি হ্যান্ডশেক করে বলল, ‘আমি আয়ান ফ্লেমিং।’
বসার পর কথা শুরু হলো।
‘আপনার সংস্থার নাম কি যেন? হ্যাঁ, ক্রিসেন্ট ফটোগ্রাফিক সোসাইটি। আপনারা কি মুসলমানদের স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট ফটোগুলোই শুধু যোগাড় করেন?’ বলল যুবকটি, আয়ান ফ্লেমিং।
‘প্রধানত তাই।’ বলল ইয়েকিনি।
‘দেশের বাইরে থেকে কিভাবে ফটো যোগাড় করেন?’ আয়ান ফ্লেমিং বলল।
‘আমরা খুবই সূচনা পর্বে। সবে কাজ শুরু করেছি। বাহিরকে নিয়ে এখনও খুব চিন্তা আমরা করিনি।’
মুখে কথাগুলো বললেও মনে মনে বলল, ক্রিসেন্ট ফটোগ্রাফিক সোসাইটিই নেই, তার আবার ফটো যোগাড়।
মিথ্যা কথাগুলো যে অবলীলাক্রমে বলতে পারল ইয়েকিনি, তাতে নিজেই বিস্মিত হলো সে। তবে সান্ত্বনার কথা এই যে, আহমদ মুসা ভাই বলেছেন, শত্রুর কাছে বা সন্দেহজনক কারো কাছে সত্য গোপন করা অন্যায় নয়।
‘ফটো সংগ্রহের জন্য সবচেয়ে বেশী প্রয়োজন যোগাযোগ। কোথায় কি হচ্ছে, নিউজ মেকার কে আসছে, কে যাচ্ছে, তা নখদর্পণে রাখতে হয়। আপনাদের এ কাজগুলো করার ধরন কি?’ বলল আয়ান ফ্লেমিং।
‘কয়েকজন ফটোগ্রাফার মাত্র আমাদের অবলম্বন।’ বলল ইয়েকিনি।
‘আমাদের ‘নিউজ ব্যাংক’-এর কাজ আপনাদের মতই। পার্থক্য হলো, আপনারা শুধু কেনেন, আর আমরা ক্রয়-বিক্রয় দু’টাই করি। গুরুত্বপুর্ণ ফটো কেনার জন্যে আমরা এমনকি বিদেশেও ছুটে যাই।’
থামল আয়ান ফ্লেমিং। মুহুর্ত কয়েক পর আবার শুরু করল, ‘আপনাদের সংগ্রহে কি তেমন ফটো আছে যা আমরা কিনতে পারি? থাকলে আমরা যেমন আপনার কাছে বিক্রি করছি, তেমনি কিনতেও পারি।’
‘বুঝতে পারছি না, কি ধরনের ফটোর কথা বলছেন?’
‘যেমন ধরুন আহমদ মুসার মত দুর্লভ কোন ব্যাক্তিত্বের সাথে কোন ঘটনার ছবি। তিনি বিশ্ব ব্যাপী আকর্ষণের কেন্দ্র।’
আয়ান ফ্লেমিং-এর মুখে আহমদ মুসার নাম শুনে বিস্ময়ের চেয়ে ভয়ই বেশী পেল ইয়েকিনি। বিজ্ঞাপন ঘিরে যে সব রহস্যের কথা বলেছেন আহমদ মুসা তা মনে পড়ে গেল। আপনা থেকেই তার মন বলল নিশ্চয় সামনে বড় কোন ঘটনা আছে। সতর্ক হলো ইয়েকিনি। বলল, আপনারা আহমদ মুসাকে চেনেন, জানেন?
‘চিনি না, তবে জানি। আমাদের কেন্দ্রীয় সংগ্রহে তার অনেক ছবি আছে।’
আয়ান ফ্লেমিং থামল। একটা ঢোক গিলল। শুরু কলল কথা আবার, ‘শুনেছি তিনি ক্যামেরুনে এসেছেন। তার জন্যে আমাদের একটা এ্যাপ্রেসিয়েশন লেটার আছে অনেকদিন ধরে। ঠিকানা না পাওয়ায় দিতে পারি না। আপনি কি জানেন তার সম্পর্কে কিছু?’
ইয়েকিনির মনে তখন চিন্তার ঝড়। আয়ান ফ্লেমিং এর কথা শুনে মনে হচ্ছে তারা আহমদ মুসার দারুণ ভক্ত। যা স্বাভাবিক নয়। কেমন করে স্বাভাবিক হবে যে তারা আহমদ মুসাকে এ্যাপ্রেসিয়েশন লেটার দেবে? এসব প্রশ্ন থেকে ইয়েকিনি ভাবল, ওদের আরও বাজিয়ে দেখা দরকার।
আয়ান ফ্লেমিং এর প্রশ্নের উত্তরে ইয়েকিনি বলল, ‘তেমন কিছু জানা নেই। ইয়াউন্ডি কেন্দ্রীয় মসজিদে এক প্রোগ্রামে তাকে দেখেছিলাম। ফটোও তুলেছিলাম।’
ভীষণ খূশি হয়ে উঠল আয়ান ফ্লেমিং এবং তাদের কৃষ্ণাংগ লোকটি।
‘কতদিন আগে?’ আয়ান ফ্লেমিং-এর কন্ঠ দ্রুত। ভেতরের উত্তেজনা চাপা দিতে চাইলেও বেরিয়ে পড়েছে অনেকখানি।
‘বেশী দিন নয়। চারদিন আগে।’
‘তাহলে উনি ইয়াউন্ডি আছেন নিশ্চয়?’ কথার সাথে সাথে ফ্লেমিং এর চোখ দুটি উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে।
‘থাকতে পারেন?’
‘উনি কোথায় উঠেছেন জানেন?’
‘না জানি না।’
‘ঐ মসজিদের কেউ জানেন নিশ্চয়?’
‘ঠিক বলতে পারবো না। কারণ মসজিদ কর্তিপক্ষ সেদিনের অনুষ্ঠান করেননি।’
‘অনুষ্ঠান কারা করেছিলেন?’
‘আমি ঠিক জানি না। বন্ধুর মুখে খবর শুনে গিয়েছিলাম। ফটো তোলাই ছিল আমার টার্গেট।’
কয়েক মুহূত চুপ থাকল আয়ান ফ্লেমিং। তার বলল ‘ধরুন আমরা যদি মসজিদ কর্তৃপক্ষকে আহমদ মুসার জন্যে একটা চিঠি দেই, কিংবা আপনাকেই যদি এ কাজের জন্যে অনুরোধ করি, তাহলে কি সে চিঠিটা কোনওভাবে তাঁর কাছে পৌছানো সম্ভব?
ইয়েকিনি ভাবল, চিঠি নেয়া দরকার। চিঠিটা যে কোন ‘লেটার অব এ্যাপ্রেসিয়েশন নয়’ সে নিশ্চিত। তাহলে চিঠিটা কি জানা দরকার।’
ভাবতে গিয়ে ইয়েকিনির দেরী হলে একটু উত্তর দিতে। এই ফাঁকে আবার কথা বললো আয়ান ফ্লেমিং। বলল, দেখুন ব্যপারটা আমাদের আবেগের সাথে জড়িত। বিশ্বে কোথাও ও কোন ঠিকানা নেই। খবরের কাগজও যোগাযোগের একটা মাধ্যম। কিন্তু আহমদ মুসা এবং এক ব্যাক্তিত্ব যাকে খবরের কাগজের কোন শিরোনামে আনা নিরাপদ নয়। এই জন্যেই অনুরোধ করছিলাম। খোঁজ করলে নিশ্চয় আপনি তার খোঁজ পাবেন।’
‘আমি চেষ্টা করতে পারি। কিন্তু কোন নিশ্চয়তা নেই। না পারলে চিঠি ফেরত কিভাবে দেব?’
আশা করি তার দরকার হবে না। হলে আমাদের পোষ্ট বক্সের ঠিকানায় ফেলে দেবেন।’
বলে একটু থেমেই আবার শুরু করল, ‘এবার আসুন কাজের কথায় আসি। আমাদের নিউজ ফাইল ও ফটো এ্যালবামের শিরোনামগুলো দেখুন। তারপর আপনার চয়েস অনুসারে নিতে পারবেন।’
বলে একটু থেমেই আবার শুরু করল, এবার আসুন কাজের কথায় আসি। আমাদের নিউজ ফাইল ও ফটো এ্যালবামের শিরোনামগুলো দেখুন। তারপর আপনার চয়েস অনুসারে নিতে পারবেন।’
আয়ান ফ্লেমিং কথা শেষ করতেই কৃষ্ণাংগ লোকটি পাশের ফাইল ক্যাবিনেট থেকে এ্যালবাম ও একটা বড় ফাইল বের করল।
ফটোগ্রাফ বা নিউজ কেনা ইয়েকিনির আসার প্রধান টার্গেট ছিল না। আহমদ মুসা তাকে পাঠানোর লক্ষ্য ছিল বিজ্ঞাপন ঘিরে যে রহস্য আঁচ করা যাচ্ছে, সেটার একটা কিনারা করা। এই কিনারা করার কাজ হয়তো সে এখনও করতে পারেনি, তবে তার কাছে এটা এখন পরিষ্কার হয়েছে যে ব্যবসায় নয়, আহমদ মুসাই ওদের আকষণের কেন্দ্র বিন্দু। আহমদ মুসার কাছে চিঠি দেয়ার ব্যাপারটা তারা যেভাবে উপস্থাপন করেছে, সেটা সেটা খুবই স্থুল। এমন স্থুল কান্ড কান্ড অনেক সময় বুদ্ধিমানরাও ঘটায়, যখন তারা সংশ্লিষ্ট ব্যাপারে মরিয়া হয়ে উঠে। ইয়েকিনির মনে হলো, এখানেও ব্যাপার তেমনই ঘটেছে।
আয়ান ফ্লেমিংদের সাথে ফটো ও নিউজ কেনার ব্যাপারে আলোচনা সেরে ইয়েকিনি রাস্তায় নামল।
রাস্তার ফুটপাতে নেমে আসতেই একটা ট্যাক্সি এসে ব্রেক কষল একদম সামনে এসে। ট্যাক্সিওয়ালা মুখ বাড়িয়ে বলল, ‘স্যার কোথায় যাবেন?
ইয়েকিনি গাড়ির দিকে এগুচ্ছিল। এমন সময় আহমদ মুসার একটা কথা তার মনে পড়ে গেল। কোথাও কোন মিশনে গেলে কোন গাড়ি এগিয়ে এলে বা যথাস্থানে দাঁড়িয়ে থাকলে তাতে চড়া উচিত নয়।
কথাটা মনে হওয়ার সংগে সংগে ইয়েকিনি পেছনে হটে এল।
বলল, ‘স্যরি, একটু অসুবিধা আছে।’
বলে ইয়েকিনি ফুটপাথ ধরে হাঁটতে শুরু করলো। সামনে মোড়েই ট্যাক্সি ষ্ট্যান্ড আছে।
ট্যাক্সি ঠিক করে ট্যাক্সিতে উটে বসল।
চিঠিটা তখনও হাতে আছে ইয়েকিনির। দেখল খামের মুখ ভালো করে বন্ধ করা। চিঠি সম্পর্কে অসীম কৌতুহল তার মনে। কিন্তু কৌতুহল নিবৃত্তির কোন পথ নেই। চলছে ইয়েকিনির ট্যাক্সি।
হঠাৎ ইয়েকিনির মনে পড়ল আহমদ মুসার একটা উপদেশের কথা। সে উপদেশটা ছিলঃ কোন মিশন থেকে ফেরার পথে সামনের চেয়ে পেছনটাকে গুরুত্ব দেবে বেশী। এক চোখ সামনে থাকলে, আরেক চোখ পেছনে রাখতে হবে।
কথাটা মনে হবার সঙ্গে সঙ্গে ইয়েকিনি পেছন ফিরে তাকাল।
সময় তখন বেলা তিনটা। তার উপর এলাকাটা নন-কমার্শিয়াল এলাকা। সে জন্যে রাস্তায় গাড়ি-ঘোড়া খুবই কম।
ইয়েকিনি পেছনে তাকিয়ে দেখতে পেল দুইটি প্রাইভেট কার তার গাড়ির পেছনে আসছে। সামনের প্রাইভেট কারটা তীব্র বেগে ছুটে আসছে। পেছনেরটা বেশ একটু পেছনে।
দেখতে দেখতে ছুটে আসা প্রাইভেট কারটা ইয়েকিনির গাড়ি অতিক্রম করে চলে গেল।
ক’মিনিট পরে পেছনে তাকিয়ে ইয়েকিনি দেখল মিনি ট্যক্সি দু’টো আর দেখা যাচ্ছে না। পেছনে পড়ে গেলে বা কোন গলিতে ঢুকে গেছে। পেছনের দ্বিতীয় প্রাইভেট কারটা এখনও সেই সমান দুরত্বে। যেন ইয়েকিনির গাড়ি যে স্পীডে চলছে, ঠিক সেই স্পীডেই চলছে গাড়িটা। বিস্মিতই হলো ইয়েকিনি।
কিন্তু সোজা হয়ে বসেই আহমদ মুসার একটি কথা মনে হওয়ায় চমকে উঠল ইয়েকিনি। আহমদ মুসা বলেছিলেন, অপরিচিত ও সংযোগহীন দুইটি গাড়ির গতি নিয়ন্ত্রণহীন কোন রাস্তায় বেশীক্ষণ এক গতিতে চলতে পারে না। যদি চলে তার মধ্যে তাহলে একটা উদ্দেশ্য থাকবে নিশ্চয়ই।
কথাটা মনে হতেই সতর্ক হলো ইয়েকিনি। মুখ ফিরিয়ে পেছনের লাল গাড়িটার দিকে তাকিয়ে ভাবল, কোন উদ্দেশ্য আছে নাকি তাহলে গাড়িটার!
করণীয় ভাবতে গিয়ে আহমদ মুসার আরেকটা কথা মনে পড়ে গেল ইয়েকিনির। আহমদ মুসা এক উপদেশে বলেছিল, পেছনে কাউকে সন্দেহ করলে সরাসরি আর না চলে কোন আড়ালের আশ্রয় নিয়ে তাকে বোকা বানাতে হবে।
ইয়েকিনি ভাবল, কোথায় কিসের আড়াল নেয়া যায়?
খুশী হয়ে উঠল তার মন। সামনে অল্প দূরেই একটা নতুন তিনতলা মার্কেট। খুব জমজমাট এখণ। তিন পাশ দিয়েই তার রাস্তা। ওখানে নেমে পেছনের গাড়িটাকে বোকা বানিয়ে সে কেটে পড়তে পারে।
সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল সে। মার্কেটের প্রায় কাছাকাছি এসে গেছে গাড়ি। মার্কেটে গাড়ি দাঁড় করাতে বলল ইয়েকিনি। মার্কেটের কার পার্কে গাড়ি দাঁড়াতেই ভাড়া চুকিয়ে দ্রুত মার্কেটে ঢুকে গেল ইয়েকিনি। মার্কেটে ঢোকার মুখে ইয়েকিনি পেছনৈ মুখ ঘুরিয়ে দেখল পেছনের সেই গাড়িটা মার্কেটের চত্বরের দিকে আসছে।
মার্কেটে ঢোকার পর প্রথমেই প্রশস্ত একটা করিডোর। তার দুই প্রান্ত দিয়ে দুটো সিঁড়ি দু’তলা, তিন তলায় উঠে গেছে। ইয়েকিনি ভেতরে ঢুকেই বাম দিকের সিঁড়ি বেয়ে দু’তলায় উঠে গেল দ্রুত। ঠিক উপরে না উঠে সিঁড়ির মাঝামাঝি ল্যান্ডিং-এ গিয়ে সিড়ির কাঁচের জানালা দিয়ে সে তাকাল নিচের চত্বরে। দেখল, সেই লাল গাড়িটা মার্কেটের কারপার্কে এসে দাঁড়াল। গাড়ি
থেকে দ্রুত বেরিয়ে এল একজন লোক। লোকটাকে চিনতে পারলো ইয়েকিনি। আয়ান ফ্লেমিং-এর অফিসে দেখা সেই কৃষ্ণাংগ। লোকটি গাড়ি থেকে নেমেই ছুটল মার্কেটের দিকে।
ইয়েকিনি সিঁড়ির ল্যান্ডিং থেকে দু’তলার দিকে কয়েক ধাপ উঠে রেলিং এর আড়াল নিয়ে চোখ রাখল করিডোরের দিকে।
দেখল ইয়েকিনি, কৃষ্ণাংগ লোকটি মার্কেটের ভেতরে ঢুকে মুহূর্তের জন্য দাঁড়াল। এদিক-ওদিক দৃষ্টি বুলাল দ্রুত। সিঁড়ির দিকেও। তারপরেই সে দ্রুত সামনে এগুলো এবং এক তলার দোকানগুলোর পাশ কাটিয়ে এগিয়ে চলল।
ইয়েকিনি সিঁড়ি দিয়ে নেমে এসেছ। সে বুঝল, কৃষ্ণাংগ লোকটি মার্কেটের ওপাশের রাস্তা লক্ষে এগুচ্ছে।
কৃষ্ণাংগ ঐ লোকটিকে আর যখন দেখা গেল না, তখন ইয়েকিনি সিঁড়ি থেকে নেমে দ্রুত করিডোর পেরিয়ে মার্কেট থেকে বেরিয়ে এল।
রাস্তায় নামতেই একটা ট্যাক্সিও পেয়ে গেল। চলন্ত একটা ট্যাক্সিকে ডেকে তাতে উঠে বসল।
ছুটে চলল ট্যাক্সি।
রোমাঞ্চ লাগল ইয়েকিনির। জীবনের প্রথম একক এক মিশনে সে জয়ী হয়েছে, বোকা বানাতে পেরেছে সে শত্রুকে।
ওরা কি সত্যিই শত্রু? ওরা কেন তার পিছু নিয়েছিল? ইয়েকিনির ঠিকানা জানাই কি ছিল ওদের টার্গেট? কেন? হঠাৎ আহমদ মুসাকে দেয়া তাদের চিঠির কথা মনে পড়ল। চিঠিতে কি আছে? কেন ওরা চিঠি দিয়েছে আহমদ মুসাকে?
এইভাবে একের পর এক প্রশ্ন তার মনে উদয় হতে লাগল। কিন্তু কোন প্রশ্নেরই সে জবাব খুঁজে পেল না।
ঘড়ি দেখল ইয়েকিনি।
বিকেল সাড়ে তিনটা।
বেশ দেরী করে ফেলেছে -ভাবল ইয়েকিনি। আজ রাশিদী ইয়েসুগোর বাড়িতে এক মহা অনুষ্ঠান। আহমদ মুসার বিয়ে। আজ চারদিন বিয়ের অনুষ্ঠান চলছে।
প্রথমদিন বিয়ে হয়েছে রাশিদী ইয়েসুগো ও ভিনিসা রোসেলিনের। তারপরের দিন এলিসা গ্রেস ও ওমর বায়ার বিয়ে। তৃতীয় দিন তার অর্থাৎ মুহাম্মদ ইয়েকিনি এবং লায়লা ইয়েসুগোর বিয়ে হয়েছে। চতুর্থ দিনে বিয়ে হয়েছে ফাতেমা মুনেকা এবং হাসান একাকুর।
এ বিয়েগুলোর মধ্যে রোসেলিনের বিয়ে হয়েছে চীফ জাস্টিসের বাসায়। অবশিষ্ট তিনটি বিয়ে হয়েছে রাশিদী ইয়েসুগোর বাড়িতে।
ভিন্ন ভিন্ন দিনে আহমদ মুসার পরিকল্পনা অনুসারে। তার কথা সবার বিয়ে এক সাথে হলে আনন্দ করার, কাজ করার লোক কোথায় পাওয়া যাবে?
পরিকল্পনা অনুসারে সর্বশেষ বিয়ে আহমদ মুসার। আজ সেই বিয়ে।
মনটা উসখুস করে উঠল মুহাম্মাদ ইয়েকিনির। মবাই আনন্দ করছে, আর সে কিনা বেরিয়েছে মিশনে। আহমদ মুসা চায়নি এদিন তাকে মিশনে পাঠাতে। কিন্তু উপায় ছিল না। সাক্ষাৎ করার এই একটি দিনই ওরা দিয়েছিল।
সুতরাং বাধ্য হয়েই আহমদ মুসা তাকে এ মিশনে পাঠায়।
গেটের ভেতরে গাড়ি না নিয়ে গেটের সামনে রাস্তাতেই নেমে পড়ল ইয়েকিনি।
গাড়ি থেকে বাড়ির দিকে তাকাতেই হঠাত্ ছাদের দিকে গেল তার দৃষ্টি। দেখল, ছাদের একদম এক প্রান্তে লায়লা ইয়েসুগো দাঁড়িয়ে। মুুহাম্মাদ ইয়েকিনিকে দেখেই সে হাত নাড়ল।
ইয়েকিনি বুঝল, লায়লা ইয়েসুগোরাস্তার দিকে তাকিয়ে ছিল। তার পথ চেয়ে কি? তৃপ্তির এক অপূর্ব শিহরণ খেলে গেল ইয়েকিনির বুকে, সারাদেহে। তার মনে হলেঅ, প্রিয়তমা নারীর এমন অপেক্ষমান চোখের চেয়ে সুন্দর, মধুর বুঝি আর কিছু নেই।
হঠাত্ মনে জাগল, তাদের প্রিয় নেতা আহমদ মুসা সহস্র মিশনে গেছেন, যাচ্ছেন। বাড়িতে কি অমন অপক্ষমান কোন ব্যাকুল চোখ তার পথ চেয়ে থাকে? তার তো বাড়িই নেই! বাড়িতে চোখ থাকবে কি করে!
‘এবার সে ব্যবস্থা ইনশাআল্লাহ হচ্ছে’-সানন্দে ভাবল ইয়েকিনি।
লায়লঅ ইয়ে সুগোর উদ্দেশ্যে হাত নেড়ে গেট দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করল ইয়েকিনি।
সুন্দর করে সাজানো হল ঘরে এসে হাজির হলো ইয়েকিনি।
বিশাল হল ঘরটির মাঝ বরাবর টাঙানো ভারি পর্দার পার্টিশন।
পার্টিশনের একপাশে মেয়েরা, অন্যপাশে ছেলেরা।
সবাই উপস্থিত। জমজমাট বিয়ের আসর।
হলের চারদিকে সাজানো সোফায় বসেছে সকলে। মাঝখানের বড় একটি সোফায় বসেছে আহমদ মুসা। তার এক পাশে রাশিদী ইয়েসুগো।
আহমদ মুসার সামনের সোফায় রোসেলিনের আব্বা চীফ জাস্টিস ওসাম বাইক এবং ডোনার আব্বা মিশেল প্লাতিনি।
ইয়েকিনি যখন হল ঘরে প্রবেশ করে, তখন কথা বলছিল মিশেল প্লাতিনি, ‘না আমি খুব খুশী। আমারর ইচ্ছা ছিল আমাদের পূর্ব পুরুষের প্রাসাদে বংশের একমাত্র উত্তরাধিকারীর বিয়ে হবে। কিন্তু সেখানে বিয়ে হলে যে খুশী আমার লাগত, তার চেয়ে অনেক বেশী খুশী লাগছে আমার এখানে।..’
ইয়েকিনি প্রবেশ করলে কথা বন্ধ করেছিল মিশেল প্লাতিনি।
ইয়েকিনি এগিয়ে এলে আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল। বলল, ‘এস ইয়েকিনি। বুঝাই যাচ্ছে তোমার মিশন সফল হয়েছে, কিন্তু সেই সাথে তোমার চোখে উদ্বেগ কেন?’
হলে উপস্থিত সকলের দৃষ্টি তখন ইয়েকিনির দিকে। পর্দার ওপাশে হলের ঐ অংশে মেয়েদের গুঞ্জন-কথাবার্তাও থেমে গেছে। তাদেরও মনোযোগ এদিকে।
ইয়েকিনি সবাইকে সালাম জানিয়ে আহমদ মুসার পাশে বসল। তারপর চাপদিকে আবার নজর বুলিয়ে দেখল বাইরের কেউ নেই। বলল, ‘সফল হয়েছে এই অর্থে য আমি তাদের দেখা পেয়েছি, কথা বলেছি। কিন্তু রহস্যের জট খোলেনি, বরং আরও জটিল হয়েছে।’
‘জটিল হয়েছে? খুলে বল।’ বলর আহমদ মুসা।
‘ওরা আমাকে বিদায় দেবার পর গোপনে আমাকে ফলো করেছিল। সম্ভবত আমার ঠিকানা জানার জন্যে।’ বলল ইয়েকিনি।
‘তারপর?’
‘আপনার উদেশ অনুযায়ী একটা মার্কেটে ঢুকে পড়ে ওদের বোকা বাবনিয়ে চলে এসেছি।’
‘যাক, ওরা যে পরিচয় দিয়েছে, ওটা যে আসল পরিচয় নয় বুঝা গেল। বল, তারপর?’
‘ওরা আপনাকে একটা চিঠি দিয়েছে।’
‘আমাকে চিঠি দিয়েছে? ওরা?’
‘হ্যাঁ।’
‘আমার কথা তুমি ওদের বলেছ?’
‘প্রশ্নই উঠে না। কথায় কথায় ওরাই আমাকে বলল, আমরা ছবি বিক্রি করি, আবার কিনিও। বিশেষ করে আহমদ মুসার মত ব্যাক্তিদের। উনি এসছিলেন ক্যামেরুনে। কোন ছবি দিতে পারেন তার?’
‘তারপর?’ আহমদ মুসার চোখে চাঞ্চল্য।
ইয়েকিনি একে একে চিঠির প্রসংগ তারা কিভাবে তুলল, কিভাবে চিঠি দিল ইত্যাদি খুলে বলল।
আহমদ মুসা গম্ভীর হয়ে উঠেছিল। বলল, ‘সম্ভবত আমি যা ভেবেছি, রহস্যটা তার চেয়েও গভীর।’
বলে আহমদ মুসা চিচঠি চাইল। ইয়েকিনি চিঠি দিল আহমদমুসাকে। ইভেলাপটি হাতে নিয়ে আহমদ মুসা উল্টে-পাল্টে দেখল। গম্ভীর হয়ে উঠল তার মুখ। বলল, ‘এটা ব্ল্যাক ক্রস-এর চিঠি।’
‘না খুলেই কি করে বুঝলেন?’ বলল ইয়েকিনি।
‘দেখ ইনভেলাপে নিউজ ব্যাংক-এর মনোগ্রামে কালো একটা সৈনিক মূর্তি রয়েছে। কালো এই সৈনিক মূর্তি এখন ব্ল্যাক ক্রস-এরও প্রতীক।’ বলে আহমদ মুসা ইনভেলাপ ছিড়ে চিঠিটি বের করল।
ভাঁজ খুলে চিঠিটি মেলে ধরল আহমদ মুসা তার চোখের সামনে।
চিঠি পড়তে শুরু করল আহমদ মুসা। পড়তে পড়তে তার চোখ-মুখের উদ্বেগজনক পরিবর্তন ঘটল। বিষাদের একটা কালো ছায়া তাকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছে।
চিঠি পড়া শেষ হলো আহমদ মুসার। চিঠি সমেত তার দু’টি হাত ঢলে পড়ল তার কোলের উপর। আহমদ মুসার চোখে শূণ্য দৃষ্টি।
‘চিঠিতে কি আছে আহমদ মুসা?’ উদ্বিগ্ন কন্ঠে জিজ্ঞেস করল ডোনার আব্বা মিশেল প্লাতিনি।
আহমদ মুুসা ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়িয়ে চিঠিটি তুলে দিল মিশেল প্লাতিনির হাতে।
মিশেল প্লাতিনি চিঠিটি তুলে ধরল তার চোখের সামনে। চীফ জাস্টিস ওসাম বাইকও ঝুঁকে পড়ল চিঠির দিকে। মিশেল প্লাতিনি তার হাতের চিঠি একটু এগিয়ে নিল চীফ জাস্টিসের দিকে। দু’জনেই পড়তে শুরু করল।
ঘরে তখন পিন-পতন নীরবতা। ঘরের মাঝখানের পর্দার ফাঁক দিয়ে ডোনা, লায়লা ও রোসেলিনের চোখ এদিকে নিবদ্ধ।
সকলের পচন্ড উদ্বেগ এবং কৌতুহলের মধ্যে যে চিঠি ওরা পড়তে লাগল তা এই:
“মি: আহমদ মুসা, আপনার বিজয়ের উত্সব-আনন্দ নিশ্চয় শেষ হয়নি। এই আনন্দ-উত্সবে আমাদের ছোট্ট একটা বজ্রাঘাত।
বারবারেতি’র ইসলামী সম্মেলন কেন্দ্র আমরা ধ্বংস করেছি। ধ্বংস করেছি একটা আড়াল সৃষ্টির জন্যে। আমরা কিডন্যাপ করেছি শেখ আবদুল্লাহ আলী আল রাশিদ মাদানী, কামাল ইনুনু, শেখ সাইয়েদ আলী কুতুব, তারেক আল মাহদী সুদানীসহ ১২ জন নেতাকে। কিন্তু দুনিয়ার চোখে তারা সবাই পুড়ে ছাই হয়ে গেছে ঐ বিস্ফোরণের আগুনে। দুনিয়ার কেউ প্রমাণ করতে পারবে না যে তারা কিডন্যাপ হয়েছে। আপনি জানার পরেও তা কোনভাবেই প্রমাণ করতে পারবেন না।
আপনাদের অগম্য একটি স্থানে তাদের বন্দী করে রাখা হয়েছে। দু:খের বিষয় তাদের ভালো অবস্থায় রাখতে পারিনি। তাদের জীবন দ্রুত ক্ষয়ে যাচ্ছে।
বিস্ফোরণের পনের দিন পর তাদের কেউই বাচবে না।
তাদের মুক্তির একমাত্র উপায় যথাসময়ে আপনার আত্মসমর্পণ। সংঘ নদীর ভবনের বিপরীত দিকে উইন্দ টাওয়ারের পাশের একটি গাছে একটা সাদা পতাকা টাঙানো থাকবে। পতাকাটি নামিয়ে নিয়ে সেটা হাতে নিয়ে অপেক্ষা করতে হবে। অপেক্ষার এক ঘন্টার মধ্যে সেখানে একটা গাড়ি গিয়ে হাজির হবে। গাড়ির ড্রাইভিং উইন্ডো থেকে অনুরূপ একটা সাদা পতাকা দেখানো হবে এবং সেই সাথে গাড়ির দরজা খুলে যাবে। ঐ গাড়িতে উঠে বসতে হবে।
পিয়ের পল হত্যার প্রতিশোধ নেয়া সবে শুরু। আপনি আত্মসমর্পণ না করলেও উল্লিখিত সময়ের মাথায় বন্দীরা নিহত হবে। আত্মসমর্পণ না করলেও আপনি বাঁচবেন না আমাদের হাত থেকে। আপনার রক্তই আমাদের প্রতিশোধ তৃষ্ণা মেটাতে পারে। আপনার আত্মসমর্পণ বন্দীদের বাঁচাতে পারে মাত্র।”
চিঠি পড়া শেষ করে ডোনার আব্বা মিশেল প্লাতিনি এবং চীফ জাস্টিস ওসাম বাইক ধীরে ধীরে মুখ তুলে তাকাল আহমদ মুসার দিকে। চোখে তাদের বোবা দৃষ্টি। সে দৃষ্টি উদ্বেগ-আতংকে বিহ্বল।
ডোনার আব্বার হাতে ছিল চিঠি। তার শিথিল হাত থেকে চিঠি পড়ে গেল।
পর্দার অন্তরাল থেকে বেরিয়ে গেল ডোনা। তার পরণে বিয়ের পোশাক। অপরূপ সাদা গাউনে তার দেহ আবৃত। তার চেয়েও অপরূপ একটা ওড়না মাথা থেকে মুখটা প্রায় ঢেকে ফেলেছে।
সে দ্রুত প্রবেশ করে তার আব্বার হাত থেকে পড়ে যাওয়া চিঠিটা ছোঁ মেরে নিয়ে ভেতরে চলে গেল।
কি আছে চিঠিতে ভাইয়া? উদ্বিগ্ন কন্ঠে বলল রাশিদী ইয়েসুগো।
ঘরে উপস্থিত সবার চোখেও এই একই প্রশ্ন।
আহমদ মুসা সোজা হয়ে বসল। বলল, প্রিয় ভাইয়েরে, চিঠিটা লিখেছে ব্ল্যাক ক্রস। ওরা জানিয়েছে, বারবারেতির ইসলামী সম্মেলন কেন্দ্র অরাই ধ্বংস করেছে এবং কিডন্যাপ করেছে ডজন খানেক মুসলিম নেতাকে।’
আহমদ মুসা একটু থামতেই রাশিদী ইয়েসুগো বলে উঠল, ‘বিস্ফোরণে তাহলে ওরা মারা যায়নি? কিডন্যাপ করা হয়েছে ওঁদের?’
‘ওঁদের পণবন্দী করা হয়েছে বলতে পার। আহমদ মুসা ওদের হাতে সারেন্ডার করলে ওদের মুক্তি দেবে বলে ওরা বলেছে।’
মুখ চুপসে গেল রাশিদী ইয়েসুগোর। বলল ভাঙা গলায়, ‘আর কি লিখেছে?’
‘বিস্ফোরণ থেকে পনের দিনের মাথায় বন্দীরা সবাই নিহত হবে। সংঘ ও কংগ নদীর সংগম স্থল বোমাসায় গিয়ে আমাকে আত্মসমর্পণ করতে হবে।’
‘না করলে কি হবে?’
‘বন্দীরা ছাড়া পাবে না।’
‘কোন সময় সীমা?’
‘১৫ দিনের মাথায় সবাই নিহত হবে। অতএব পনের দিনই সময় সীমা।’
রাশিদী ইয়েসুগো কোন কথা বলল না।
সবাই নীরব।
ডোনার আব্বা মিশেল প্লাতিনি এবং চীফ জাস্টিস অসাম বাইক দুজনেরই যেন বাকরোধ হয়ে গেছে। তাদের চোখ-মুখ থেকে উদ্বেগ যেন ঠিকরে পড়ছে।
এ সময় পর্দার বাইরে বেরিয়ে এল লায়লা ইয়েসুগো। আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে বলল, ‘চিঠির লেখা হারিয়ে গেছে।’ লায়লার কন্ঠে উদ্বেগ।
আহমদ মুসার মধ্যে কোন বিস্ময় বা চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হলো না। বরং দেখা গেল তার মুখে একটা হাসির রেখা। বলল, ‘ওরা কথা রাখল, কোন প্রমাণ তারা রাখল না। বিশেষ ভ্যানিশিং কেমিকেল দিয়ে চিঠিটা লেখা ছিল। লায়লার কাছ থেকে চিঠির কাগজটা নিয়ে এল রাশিদী ইয়েসুগো।’
রাশিদী ইয়েসুগো চিঠি নিয়ে এলে সবাই দেখল।
‘আহমদ মুসা চীফ জাস্টিস্কে লক্ষ্য করে বলল, ‘জনাব আমরা ক’জন ভেতরে একটু বসতে চাই।’
বলে আহমদ মুসা রাশিদী ইয়েসুগোর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তুমি বসার একটু ব্যবস্থা কর। ওঁরা দু’জন এবং তোমরা দু’জন।’
ভেতরের ফ্যামিলি ড্রইং রুমে গিয়ে বসল ওঁরা পাচজন।
আহমদ মুসার সামনের দু’টি সোফায় বসেছে ডোনার আব্বা এবং রোসেলিনের আব্বা। আর বাঁ পাশের দু’টির সোফায় মুহাম্মাদ ইয়েকিনি এবং রাশিদি ইয়েসুগো।
বসার পর কথা শুরু করল আহমদ মুসা। ডোনার আব্বা ও রোসেলিনের আব্বাকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘আপনারা চিঠি পড়েছেন, পরিস্থিতি বুঝতে পারছেন। আপনাদের পরামর্শ পেলে বাধিত হবো।’
‘কি করা উচিত বুঝতে পারছি না। আত্মসমর্পণ তো সব নয়।’ বলল ডোনার আব্বা মিশেল প্লাতিনি।
‘আমিও এটাই ভাবছি।’ বলল রোসেলিনের আব্বা চীফ জাস্টিস ওসাম বাইক।
আবার নীরবতা।
নীরবতা ভেঙে ধীরে ধীরে বলল আহমদ মুসা, ‘বিস্ফোরণের পর দশ দিন পার হয়ে গেছে। আর মাত্র ৫ দিন বাকী। বাকী এই সময়ের মধ্যে বন্দী মুসলিম নেতৃবৃন্দকে উদ্ধার করতে হবে। উদ্ধার করতে না পারলে তাদের কেউ বাঁচবেন না।’
‘উদ্ধার কিভাবে হবে? দুনিয়ার কেউ তো জানে না তাদের অবস্থার কথা।’ বলল ওসাম বাইক।
‘বিশ্ব মুসলিম কংগ্রেসসহ মুসলিম দেশসমুহ এবং দুনিয়াবাসীকে এই ব্যাপারটা জানিয়ে দেয়া যায়। তাহলে তাদের একটা সম্মিলিত ব্যবস্থা হতে পারে।’ বলল রাশিদী ইয়েসুগো।
‘তাতে লাভ হবে না। বিষয়টা নিয়ে হৈ চৈ হলে কিংবা ঘটা করে তাদের উদ্ধারের সম্মিলিত কোন ব্যবস্থা হলে বন্দীদের তারা সময়ের আগেই হত্যা করবে। তাছাড়া ঐ ধরনের উদ্যোগে উদ্ধারের জন্যে যে সময় প্রয়োজন, সে সময় এখন হাতে নেই।’ আহমদ মুসা বলল।
‘ব্ল্যাক ক্রস-এর উপর আন্তর্জাতিক কোন চাপ প্রয়োগ করা যায় না, যা তাদেরকে আন্তর্জাতিক মুসলিম নেতাদের হত্যা করা থেকে বিরত রাখতে পারে?’ বলল মুহাম্মাদ ইয়েকিনি।
‘ব্ল্যাক ক্রস-এর উপর এ ধরনের কোন চাপ দেয়া যাবে না। কারণ, তারা কিডন্যাপ করেছে এবং মুসলিম নেতৃবৃন্দ বেঁচে আছেন, এর কোন প্রমাণ নেই।’ বলল আহমদ মুসা।
আবার নীরবতা। কারো মুখে কোন কথা নেই।
পাশের ঘরেই রয়েছে ডোনা, লায়লা ইয়েসুগো, রোসেলিন, ফাতেমা মুনেকা এবং এলিসা গ্রেস। তাদের সমস্ত মনোযোগ এ ঘরের আলোচনার দিকে। তাদের সকলের চেহারাই আষাঢ়ের মেঘের মত ভেজা।
চিন্তাক্লিষ্ট আনত দৃষ্টি আহমদ মুসা মুখ তুলল। বলল, ‘ওঁদের উদ্ধারের দায়িত্ব এখন আমাদের। আমাকে যেতে হবে।’
‘আত্মসমর্পণের জন্যে?’ ডোনার আব্বার কন্ঠ।
‘আমি এখন বলতে পারছি না। তবে কোন উপায় না থাকলে আত্মসমর্পণ করতে হবে।’ স্থির, শান্ত কন্ঠে বলল আহমদ মুসা।
আবার নীরবতা। কথা বলার শক্তি যেন কারো নেই।
অনেকক্ষণ পর চীফ জাস্টিস ওসাম বাইক বলল, ‘বাবা, তোমার কথার উপর আমাদের কোন কথা চলতে পারে না। তুমি কবে যাবে মনে করছ?’
‘চাচা জান, দিন মাত্র পাঁচটা আছে। যে কাজ করতে হবে সে তুলনায় এ সময়টা কিছুই নয়। আমি আজ এখনি যাত্রা করতে চাই।’ বলল আহমদ মুসা।
আবার নীরবতা।
আহমদ মুসা ছাড়া উপস্থিত অন্য সকলের চোখ-মুখের সকল আলো যেন আক সংগে দপ করে নিভে গেল। অন্ধকার নামল মুখে-চোখে সকলের। পাশের ঘরে ডোনা লায়লাদেরও একই অবস্থা
নীরবতা ভাঙল চীফ জাস্টিস ওসাম বাইক। বলল, ‘তাহলে বিয়েটা তাড়াতাড়ি সেরে ফেলতে হয়।’
আহমদ মুসা মুখ নিচু হলো। বলল, ‘চাচা জান আমি এ নিয়ে ডোনার সাথে কথা বলতে চাই। সে আমার সাথে একমত হলে বিয়েটা স্থগিত রাখতে আমি অনুরোধ করব।’
আবার নীরবতা।
ডোনার আব্বা ও চীফ জাস্টিসের চোখ-মুখ বেদনা ক্লিষ্ট। রাশিদী ইয়েসুগো এবং মুহামাদ ইয়েকিনির কেঁদে ফেলা শুধু বাকী। ওদিকে লায়লা, রোসেলিন, ফাতেমা মুনেকা ও এলিসা গ্রেস অসহনীয় এক বেদনার বানে বিদ্ধ হয়ে নিজেদের অজান্তেই চোখ তুলেছে ডোনার দিকে।
ডোনার মাথা উঁচু। ভাবলেশহীন মুখ। চোখে একটা শূন্য দৃষ্টি। যেন কোথায় কোন চিন্তার সাগরে নিজেকে সে হারিয়ে ফেলেছে।
আবারও নীরবতা ভাঙল চীফ জাস্টিস ওসাম বাইক। বলল, ‘ঠিক আছে কথা বলবে।’
বলে সে তাকাল রশিদী ইয়েসুগোর দিকে।
‘ঠিক আছে ব্যবস্থা কড়ছি।’ বলে একটু থেমেই সে আহমদ মুসার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আপনার সাথে আমরা কারা যাচ্ছি আহমদ মুসা ভাই?’
আহমদ মুসা একটু হাসল। বলল, ‘তোমাদের কোন সুযোগ দিতে পারছি না। আমার সাথে যাবে ব্ল্যাক বুল এবং যদি রাজী হয় তাহলে অগাস্টিন ওকোচা’।
‘কিন্তু ওরা দু’জনই তো ‘কোক-ওকুয়া’র লোক, ওরা সহজেই ওদের চোখে ধরা পড়ে যাবে’। বলল রাশিদী।
‘এ চিন্তা তোমার মনে উদয় হওয়ার জন্যে তোমাকে ধন্যবাদ। কিন্তু ওদের নেব আমি ছদ্মবেশে, অন্য মানুষ বানিয়ে’।
‘আমরা পারি না কেন যেতে?’ মুখ ভার করে বলল রাশিদী ইয়েসুগো।
আহমদ মুসা ডোনার আব্বা ও রোসেলিনের আব্বার দিকে এক পলক তাকিয়ে রাশিদীকে বলল, ‘পরে বলব তোমাদের কারণটা। যাও তুমি লায়লাকে বলে ডোনাকে ডেকে দাও’। আহমদ মুসার ঠোঁটে হাসি।
রাশিদী ইয়েসুগো মুখ ভার করেই উঠে দাঁড়াল।
৪
ইয়েউন্ডি থেকে ইয়াউন্ডি-বাতুয়া-বাতুরি হাইওয়ে ধরে পূর্ব দিকে ছুটে চলছিল আহমদ মুসার গাড়ি।
গাড়ির ড্রাইভিং সিটে আহমদ মুসা। পরনে তার পর্যটকের পোশাক। মাথায় স্পোর্টস হ্যাট, কপালের শেষ প্রান্ত পর্যন্ত নামানো।
পেছনের সিটে ব্ল্যাক বুল। অগাস্টিন ওকোচাকে সাথে নেয়ার কথা ছিল, কিন্তু সিদ্ধান্তটা শেষ পর্যন্ত বাতিল করেছে আহমদ মুসা। ওকোচা কিন্তু জেদ ধরেছিল। তার পিতাও বলেছিল, আফ্রিকার বোমাসা অঞ্চলের জন্যে ওকোচা উপকারী হতে পারে। ওকোচার মা এবং স্ত্রী দু’জনেই সায় দিয়েছে তার কথায়। কিন্তু আহমদ মুসা মিষ্টি হেসে বলেছে, ওকে সাথে নিয়ে যতখানি উপকৃত হবো, তার চেয়ে বেশী উপকৃত হবো যদি সে তার এই নতুন নীড়কে আরও সুন্দর করে তোলে।
ব্ল্যাক বুলের পরনে গাইডের পোশাক। তার হ্যাটের শীর্ষে এবং ইউনিফর্মের বুকে গাইডের মনোগ্রাম জ্বল জ্বল করছে। তার মুখ ভরা ফ্রেন্স কাট দাড়ী। ব্ল্যাক বুলকে চেনার কোন উপায় নেই। দাড়ী-গোঁফ, হ্যাট এবং পশ্চিমী ধাচের গাইডের পোশাক পরে সে সম্পূর্ণ নতুন মানুষ হয়ে গেছে।
ব্ল্যাক বুলের সিটের পেছনে তার প্রিয় কুকুর দু’টো। শান্ত বালকের মত পাশাপাশি তারা বসে আছে সামনে তাকিয়ে।
ব্ল্যাক বুলের অনুরোধেই আহমদ মুসা কুকুর দু’টিকে সাথে নিয়েছে। ব্ল্যাক বুল বলেছে, দু’টি কুকুর দু’জন মানুষের চেয়ে উপকারী হবে শুধু নয়, মানুষ পারে না এমন কিছু কাজ কুকুর দু’টি পারবে।
গাড়ি ছুটে চলেছে আহমদ মুসার।
সামনে যে শহরটি তার নাম এ্যাবং এমব্যাংগ। তীরের মত সোজা রাস্তা। আহমদ মুসার হাত দু’টি স্টেয়ারিং-এ স্থির হয়ে আছে। ঝড়ের গতিতে ছুটে চলেছে গাড়ি।
আহমদ মুসার চোখ দু’টি স্থির নিবন্ধ সামনে। হঠাৎ অলস মনের এক কোণে ডোনার অশ্রু সজল মুখটি ভেসে উঠল তার।
মনটা খারাপ হয়ে গেল আহমদ মুসার। আহমদ মুসা কি অবিচার করল ডোনার উপর। বিয়ের আসন থেকে তাকে সরে দাঁড়াতে হয়েছে।
কিন্তু আহমদ মুসার কোন দোষ নেই। সে তো ডোনার উপরই সব ছেড়ে দিয়েছিল। বলেছিল আহমদ মুসা, ‘সব শুনেছ, এখন কি করা যায় বল’। বেদনার একটা হাসি ফুটে উঠেছিল ডোনার ঠোঁটে। বলেছিল, ‘আমাকে বুঝি খুব দুর্বল মনে কর?’
‘না, তা কেন?’
‘তাহলে আমার সাথে আলোচনাকে সিদ্ধান্তের শর্ত বানিয়েছ কেন?’
‘তোমার অধিকার আমি অস্বীকার করতে পারি?’
‘এই সময়ে আমার অধিকার নিয়ে ভাবছ?’
‘এই সময়েই বেশী ভাবা দরকার’।
‘কোন সময়ের কথা বলছ?’ ডোনার ঠোঁটে ফুটে উঠেছিল লজ্জাজড়িত হাসি।
‘আমি বলব না’।
ডোনা মুখ নিচু করেছিল। লজ্জায় লাল হয়ে উঠেছিল তার মুখ।
মুহুর্ত কয়েক মুখ না তুলে বলেছিল, ‘বল কি বলবে?’
‘তুমিই তো বলবে’।
‘আমি জানি তুমি সবদিক না ভেবে সিদ্ধান্ত নাও না। সুতরাং আমার আলাদা কোন বক্তব্য নেই’।
‘কথাটা তুমি খুব সহজে বলে ফেললে। আমার কিন্তু খুব খারাপ লাগছে’।
‘আমার জন্যে, তাই না?’
‘সত্যটা আমি ভুলব কি করে যে, তুমি রাজকুমারী মারিয়া জোসেফাইন লুই এক শান্তির ও নিরুপদ্রব জীবন থেকে ছিটকে পড়েছ আগুনের মধ্যে!’ আহমদ মুসার কন্ঠ ভারি শোনাচ্ছিল।
ডোনা চকিতে আহমদ মুসার মুখের দিকে চোখ তুলে চেয়েছিল। তারপর চোখ নামিয়ে নিয়েছিল। ধীরে ধীরে তার দু’চোখ থেকে গড়িয়ে পড়েছিল দু’ফোটা অশ্রু। বলেছিল, ‘ডোনাকে না বুঝে এভাবেই বুঝি তুমি কষ্ট পাও! তোমাকে কেমন করে বুঝাব যে, তথাকথিত রাজকুমারীর মরুময় জীবন আজ কূল উপচানো সুখ আর প্রশান্তির বাগান। তুমি যাকে আগুন বলছ, তার মত দুনিয়া জোড়া আগুনও এ প্রশান্তির স্পর্শে নিভে যায়’।
‘ধন্যবাদ ডোনা। আমার সৌভাগ্যের জন্যে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করছি’।
‘কোন সৌভাগ্য?’
‘এমন তোমাকে পাওয়ার সৌভাগ্য’।
ডোনা কথা বলেনি। একরাশ লজ্জা এসে তার মুখ রাঙা করে দিয়েছিল। তার বেদনাক্লিষ্ট শুল্ক ঠোঁট ভরে উঠেছিল উজ্জ্বল এক টুকরো হাসিতে। বলেছিল একটু সময় নিয়ে, ‘তোমার সৌভাগ্যের চেয়ে আমার সৌভাগ্য অনেক বড়’।
বলে একটু দম নিয়েই আবার শুরু করল, ‘একটা কথা বলব, সাহস পাচ্ছি না’।
‘কি কথা?’
‘মেইলিগুলি আপা মানে আমিনা আপা এমনি এক অভিযানে তার ‘মা-চু’কে তোমার সাথে দিয়েছিলেন। আমার তো কেউ নেই। আমি তোমার সাথী হতে পারি না?’ কান্নায় বুজে এসেছিল ডোনার কন্ঠ।
‘ডোনা, তুমি বুঝি আমিনার কথা ভুলতে পার না?’ শান্ত, ভারি কন্ঠ ছিল আহমদ মুসার।
‘আমার তো বড় আপা। আপা কি ডোনার মত? তুমি কি তাকে ভুলতে পার?’
‘ডোনা, তুমি তাকে ভালোবেসে তার গোটা আসনটাই তুমি দখল করে নিয়েছ’।
‘না, ঠিক নয়। আমি তার পাশে একটু স্থান ভিক্ষা পেয়েছি মাত্র’। ডোনার চোখে ছিল অশ্রু, ঠোঁটে হাসি।
‘ডোনা, তুমি অনেক বড়। আবার বলছি আমি ভাগ্যবান’।
ডোনা চোখ মুছে বলেছিল, ‘থাক ওসব কথা। আমার কথার জবাব তুমি দাওনি’।
আহমদ মুসা গম্ভীর হয়ে উঠেছিল। বলেছিল, ‘আমার সাথে দেবার তোমার ‘কেউ’ নেই তা ঠিক নয়’।
‘কে আছে?’ চোখ ছানাবড়া করে বলল ডোনা।
‘কেন আল্লাহ। আল্লাহ কি যথেষ্ট নয়?’
শোনার সঙ্গে সঙ্গে ডোনা ‘আল হামদুলিল্লাহ’ বলে দু’হাতে মুখ ঢেকেছিল আনন্দের উচ্ছ্বাসটা ঢেকে ফেলার জন্যে। তারপর মুখের উপর থেকে হাত সরিয়ে উজ্জ্বল চোখ দু’টি আহমদ মুসার দিকে তুলে ধরে বলেছিল, ‘ধন্যবাদ আমাকে স্মরণ করিয়ে দেয়ার জন্যে। আমার তরফ থেকে আল্লাহ তোমার নেগাহবান’।
‘আলহামদুলিল্লাহ। দোয়া করো’।
বলে আহমদ মুসা একটু থেমেছিল। বলেছিল তারপর, ‘তাহলে আসি। ওঁরা অপেক্ষা করছে’।
‘এসো’। বলেছিল ডোনা ম্লান হেসে।
কিন্তু বিদায়ের সময় কেঁদেছিল ডোনা। চোখের অশ্রু আড়াল করার চেষ্টা করেও সে পারেনি।
ডোনার সেই অশ্রু সিক্ত মুখটাই এখন ভেসে উঠছে আহমদ মুসার মানস-চোখে।
আহমদ মুসার চোখের কোণটাও সিক্ত হয়ে উঠেছিল। আহমদ মুসা স্টেয়ারিং থেকে বাম হাতটা সরিয়ে সিটের উপর থেকে রুমালটা তুলে নিয়ে চোখ ভালো করে মুছে নিল।
গাড়ি ছুটে চলছে তীরের বেগে।
‘আবদুল্লাহ (ব্ল্যাক বুল) তোমার বাড়ি বারবারেতি থেকে কতদুর?’ পেছনে ব্ল্যাক বুলের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা।
‘যা দেখেছি ম্যাপে, বাস্তব কিছু জ্ঞান নেই। হবে হয়তো একশ’ দেড়শ’ কিলোমিটার’।
‘আমরা তো বোমাসায় যাব ঐ দিক দিয়েই’।
‘খুব মজার হবে। আমার আবাল্য একটা সাধ এতে পূরণ হবে’।
‘কিন্তু এলাকার মাটি, গাছ ইত্যাদি ছাড়া আর কি দেখতে পাবে?’
‘তবু গ্রামটাকে চোখ ভরে দেখব।’
‘আল্লাহ তোমার আশা পূরণ করুক।’
‘আমরা যখন বোমাসাতেই যাচ্ছি, তখন বাববারেতি না গিয়ে আমরা সামনে কাদেলি হয়ে স্টিম বোটে সংঘ নদী দিয়ে বোমাসা যেতে পারতাম।’
‘তা পারতাম, কিন্তু ঘটনার কেন্দ্র বাবরারেতি অবশ্যয় যাওয়া প্রয়োজন। পণবন্দীদের ওরা কোথায় রাখতে পারে তা জানার সব রকম চেষ্টা আমাদের করা উচিত।’
‘কোথায় রাখতে পারে?’
‘বলা মুস্কিল। কিন্তু আমি ভাবছি আমার আত্নসমর্পণের স্থান ওরা বোমাসায় নির্ধারণ করল কেন?’
‘দুর্গম বলেই হয়তো। সভ্যতার আলো তেকে অনেক দূরে ঐ এলাকা। রেল, বাস ইত্যাদি ঐ এলাকার মানুষ চোখেই দেখেনি এখনও।’
‘কিন্তু একা একজন মানুষকে ধরার জন্যে তাকে দুর্গম এলাকায় নিয়ে যাবার প্রয়োজন কি?’
‘আমি জানি না জনাব। ব্যাারটা অস্বাভাবিক বটে।’
‘অস্বাভাবিক যখন, তখন এর তাতপর্য নিয়ে বাবা উচিত।
কথা শেষ করেই ডানে তাকাল আহমদ মুসা। সামনেই ডানে বাতেরী শহর।
শহরের একেবারে উত্তর পাশ ঘেঁষে হাইওয়েটি। আর সীমান্তের কাছাকাছি ক্যামেরুনের শেষ শহর বারতুয়া অতিক্রম করেছে হাইওয়েটি শহরের দক্ষিণ পাশ ঘেঁষে।
আহমদ মুসার গাড়ি বারতুয়া পার হওয়ার পর দু’কিলোমিটারের মাথায় একটা বিপত্তিতে পড়ল।
আহমদ মুসার গাড়ির সামনে প্রাইভেট পরবহান কোম্পানীর একটা ট্যাক্সি চলছিল। হঠাত ট্যাক্সিটি তার পথ চেড়ে বেঁকে গিয়ে আহমদ মুসার গাড়ির সামনে এসে পড়ল।
ব্যাপারটা এত দ্রুত ঘটে গেল যে আহমদ মুসা তার গাড়ি পুরো নিয়ন্ত্রণে আনার সুযোগ পেল না। আহমদ মুসার গাড়ির মাথা সোজা গিয়ে আঘাত করল বেঁকে আসা ট্যাক্সির সামনের দরজায় কৌণিকভাবে।
ট্যাক্সিটি কিছুটা ছিটকে পড়ে থেমে গেল। আহমদ মুসার গাড়িও থেমে গিয়েছিল। আহমদ মুসা তাড়াতাড়ি গাড়ি থেকে নেমে ছুটল ট্যাক্সিটির দিকে।
ট্যাক্সির সামনের দরজার দুমড়ে গিয়ে কিচুটা ভেতরের দিকে বসে গিয়েছিল।
ট্যাক্সিটিতে ছিল একজন আরোহী এবং একজন ড্রাইভার।
আরোহী মাঝ বয়সী একজন কৃষ্ণাঙ্গ। ড্রাইভারও তাই। আরোহীর মাথার এক পাশের অল্প্ একটু জায়গা থেঁতলে গেছে। আর ড্রাইভারের কপাল অনেকখানি কেটে গেছে বিয়ারিং হুইলে ধাক্কা খেয়ে।
দু’জনেই গাড়ি থকে বের করল আহমদ মুসা।
আরোহীটির মাথার থেঁতলানো জায়গা এবং ড্রাইভারের কাটা কাপাল দিয়ে রক্ত ঝরছিল। ক্ল্যাক বুল ফাস্ট এইড বক্স সহই গাড়ি থেকে নেমেছিল।
আহমদ মুসা তাকে ধন্যবাদ দিয়ে ওদের আহত স্থান ব্যান্ডেজ করে দিল। ফাস্ট এইডের জিনিসপত্র গুছিয়ে নিতে নিতে আহমদ মুসা বলল, ‘শেষ মুহূর্তে আমি আমার গাড়িটি নিয়ন্ত্রণে আনতে পারিনি, আমি দু:খিত।’
‘কি বলেন আপনি। আপনাকেই আমাদের হাজার বার ধন্যবাদ দেয়া উচিত। আপনি গাড়ি যতটুকু সামলিয়ে ছিলেন, ততটুকু না সামলালে গাড়ি চিড়া চেপ্টা হয়ে যেত। আপনি আমাদের বাঁচিয়েছেন।’ বলল ড্রাইভার লোকটি বিনয়ের সাথে।
‘ঠিক বলেছ ড্রাইভার। কিন্তু এমন হলো কেন? গাড়িতে কি তোমার ক্রুটি আছে?’ বলল আরোহীটি।
‘না কোন ক্রুটি নেই। হঠাত ব্রেকফেল এমন কোন দিনই হয়নি।’
‘আপনারা কোথায় যাচ্ছিলেন?’ বলল আহমদ মুসা।
আরোহীটিকে ইংগিত করে ড্রাইভার বলল, ‘উনি যাবেন বারবারেতি। আমি সীমান্ত পর্যন্ত ওকেঁ পেৌছে দিচ্ছিলাম।’
বারবারেতির নাম মুনে চমকে উঠল আহমদমুসা। অজান্তেই তার দৃষ্টি আরোহীটির উপর গিয়ে পড়ল। মনটা আহমদ মুসার খুশীই হলো্ অন্তত বারবারেতির অবস্থা কিছুটা জানা যেতে পারে তার কাছ থেকে। বলর, আহমদমুসা,’ আপনাদের তো ভীষণ অসুবিধা হলো।’
‘আমার কিছু ক্ষতি হলো্ কিন্তু অসুবিধা হলো আমার আরোহীর। আমি কোনভাবে ফিরতে চাই্ উনি সীমান্তে পৌছবেন কি করে। এ সময় ভাড়া গাড়িও মিলবে না্ আপনারা কোথায় যাচ্ছেন?’
‘আমরা বারবারেতি যাচ্ছি। উনি ইচ্ছা করলে আমাদের সাথে যেতে পারেন।’ আহমদ মুসা বলল।
‘আপনি এ সাহায্য করবেন! কি যে উপকার হবে আমার্ ঈশ্বর আপনাকে কৃপা করুক।’ বলল আরোহী লোকটি আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে।
‘ধন্যবাদ।’ বলল আহমদ মুসা্ ট্যাক্সির ড্রাইভার উঠে গিয়ে গাড়ির ইঞ্জিন পরীক্ষা করে এসে বলল, ‘সব ঠিক আছে। এখন অনুমতি দিলে আমি যেতে পারি।’
‘ট্যাক্সিটা কার?’ আহমদ মুসা বলল।
‘প্রাইভেট কোম্পানীর।’
‘আপনার শেয়ার আছে তাতে?’
‘নেই।’
গাড়ি মেরামতের ব্যয় কে বহন করবে?’
‘অর্ধেক বহন করতে হবে আমাকে।’
‘কষ্ঠ হবে না আপনার?’
‘এ প্রশ্ন করছেন কেন?’
‘আমার গাড়ির ধাক্কায় আপনার গাড়ির ক্ষতি হয়েছে। ক্ষতি মেরামতে আমি অংশ নিতে চাই্’
বলে আহমদ মুসা পকেট তেকে এক হাজার ফ্রাংকের পাঁচটি নোট বের করে ড্রাইভারের দিকে তুলে ধরল।
ড্রাইভার টাকা নিতে দ্বিধা করে বলল, ‘আপনি বিদেশী পর্যটক, আমাদের মেহমান। এ টাকা নেয়া অন্যায় হবে।’
আহমদ মুসা টাকাটাতার পকেটে গুজেঁ দিয়ে বলল, ‘গাড়ি অন্যের না হলে এ টাকা আপনাকে দিতাম না্’
কথা না বলে কিছুক্ষণ মাথা নিচু করে থাকল ড্রাইভার্ যখন মাথা তুলল তার চোখ দু’টি ছল ছল করছে। বলল, ‘ আমার মা জটিল অসুখে ভুগছেন। তার চিকিতসার জন্যে কিচু টাকা জমিয়েছি। সেই টাকা দিয়ে গাড়ি ঠিক করব ভেবেছিলাম। আপনার টাকা মা’র চিকিতসা সম্ভব করে তুলবে। প্রভু স্রষ্টা আপনার মঙ্গল করুন।’
‘ধন্যবাদ। আল্লাহ আপনার মাকে সুস্থ করে তুলুক।’ বলে আহমদ মুসা নিজের গাড়ির দিকে এগুলো সেই আরোহী লোকটাকে তার সাথে আসতে বেল।
আহমদ মুসা আরোহীটিকে তার পাশের সিটে বসাল।
‘বারবারেতি বাড়ি বললেন? নাম কি আপনার?’বলল আহমদ মুসা।
‘নাম ডেনিয়েল। বারবারেতি থাকি।’ একটু সময় নিয়ে উত্তর দিল।
আহমদ মুসা চকিতে তার মুখের দিকে একবার তাকাল।
আহমদ মুসা আর কোন প্রশ্ন জিজ্ঞেস না করার আগেই সে প্রশ্ন করল, ‘ আপনি তো পর্যটক। বারবারেতি কি আপনার কাছে আকর্ষনীয়?’
পর্যটক হলে প্রশ্নটার উত্তর কিছু না ভেবেই দিতে পারত আহমদ মুসা। কিন্তু আহমদ মুসা তা নয়। সুতরাং মুহূর্ত কয়েক ভেবে নিয়ে সে বলল, ‘নতুন দেশ নতুন স্থান দেখার মধ্যেই আমার আগ্রহ। আফ্রিকার প্রকৃতিই আমাকে আকর্ষণ করে বেশী।’
‘আফ্রিকার সত্যিকার প্রকৃতি দেখতে হলে যেতে হবে বোমাসা এবং আরও দক্ষিণে।’
‘আমি সব চিনি না। প্রথম সফর তো!’
‘বারবারেতি খারাপ নয়। তবে আধুনিক হয়ে উঠছে তো। বাইরের পর্যটকদের কাছে আকর্ষণ হারচ্ছে। তার উপর ..’
কথা শেষ না করেই থেমে গেল ডেনিয়েল নামের লোকটি।
‘তার উপর কি?’ একটু মুখ ঘুরিয়ে তার দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা।
‘এই সেদিন বারবারেতিতে সাংঘাতিক দুর্ঘটনা ঘটে গেল তো। বাইরের অনেকেই সেখানে আসতে দ্বিধা করছে।’
আহমদ মুসা মনোযোগী হলো ডেনিয়েলের প্রতি। কিন্তু তার দিকে না তাকিয়ে নিরাসক্তভাবে জিজ্ঞেস করল, ‘দ্বিধা করছেন কেন? কোন ভয় আচে? দুর্ঘটনা সম্পর্কে আমি তেমন কিছুই জানিনা।’
‘উল্লেখযোগ্য কিছু বিদেশীসহ অনেক লোক মারা গেছে দুর্ঘটনায়। বাইরের চাপ আছে। তদন্ত চলছে। একটা আতংক আর কি।’
‘তদন্ত চলছে। আবার বাইরের চাপ আছে। তাহলে তো বড় ঘটনা্ আসল ব্যাপার কি বলুন তো?’
‘আমরা সকলে একে একটা বড় দুর্ঘটনা বলেই জানি। অবশ্য কেউ কেউ বলে ওটা একটা লাগানো আগুন। আবার অনেকে মনে করেন, সম্মেলনের উদ্যোক্তারা কোন কারণে কিচু বিস্ফোরক হয়তো ভেতরে রেখেছিলেন। তা থেকেই আত্নঘাতি ঘটনা ঘটেছে।’
‘সম্মেলন স্থানে আগুন লাগাতে যাবে, এমন কোন শত্রু কি সম্মেলনের উদ্যোক্তাদের ছিল?’
‘নিশ্চিত করে কিছুই বলা যায় না। তবে মধ্য আফ্রিকার সম্ভাবনাময় এই অঞ্চলে মুসলমানদের নতুন শক্তিবৃদ্ধির চেষ্টা অনেকেই ভালো চোখে নাও দেখতে পারে।’
‘অনেকে বলতে কাদের বুঝাচ্ছেন? সাধারণ জনগণ?
কাউকেই নির্দিষ্ট আমি করিনি। আমার ধারণা বলেছি মাত্র।
আহমদ মুসার মনে হলো ডেনিয়েল লোকটা জানে অনেক কিছু। কথার ধরনে তাকে খুব চালাক বলে মনে হলো আহমদ মুসার। কে লোকটি? লোকটির চেহারায় ভদ্রতার কাটিং আছে। তার আডালে একটু লক্ষ্য করলেই দেখা যায়, কর্কশ একটা রূপ তার আছে। আর তার ভাষায় আঞ্চলিক টান নেই। অর্থাৎ বাঁটু ভাষা বললেও বাঁটু সে নয়।
মধ্যে আফ্রিকা প্রজাতন্ত্রের কোন এলাকায় আপনার বাডি? জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা
আমার বাডি তানজানিয়ায়। তবে এখানে বহুদিন থেকেই। আবার এসেছি।
কেন জানি হটাত আহমদ মুসার মনে পডল যে বারবারেতির বিস্ফোরণ সম্পর্কিত ব্ল্যাক ক্রসের বিজ্ঞপ্তিটির একটা ঠিকানা স্মরণ করতে পারলো না।
সীমান্তের চেক পোষ্ট এসে গেছে। গাডি থামাতে হলো আহমদ মুসাকে। খুশী হলো আহামদ মুসা সীমান্তের চেক পোষ্টে তেমন কোন ঝক্কি ঝামেলা নেই, শুধু পাসপোর্ট দেখে তাকে একটা ভিসায় সিল দিয়েই খালাস। তাও আবার গাডি থেকে নামতে হয় না। গাডিতে এসে পুলিশ পাসপোর্ট চেক করে।
সীমান্ত অতিক্রমের পর আবার আগিয়ে চলল গাডি সোজা পূর্ব দিকে বারবারেতি লক্ক্যে।
সীমান্ত থেকে ২৫ কিলো মিটার দূরে বারবারেতি পথে আরেকটি ছোত্র শহর। নাম গাম্বুলা।
আহমদ মুসার গাডি। গাম্বুলা শহর অতিক্রম করছিল। শহরের ধক্ষিন পাশ ঘেসে রাস্তি, আর রাস্তার দক্ষিণ পাশ দিয়ে একটা ছোট নদী। শহর অতিক্রম করার আগেই ছোট নদীটি বাক নিয়ে দক্ষিণ দিকে চলে গেছে। তার সাতে বারবারেতির হাইওয়ে থেকে একটা সডক বের হয়ে ছোট নদীটির তীর বরাবর দক্ষিণে চলে গেছে।
বেলা তখন আডাইটার মত।
ছোট শহর তার উপর অফিস ও স্কুল – কলেজ ছুটির পরবর্তী ভাটির সময়। রাস্তা ঘাটে লোকজন। গাডি ঘোডা খুবই কম।
রাস্তাটিও তীরের মত সোজা
দু হাত স্তেয়ারিং এ রেখে দু টি চোখ সামনে ছুডে দিয়ে বলা যায় সিটে গা এলিয়ে দিয়েছিল একটা জীপ গাডি।
সামনেই চলছিল একটা জীপ গাডি।
সামনেই নদীটি দক্ষিণ দিকে বাক নিয়েছে এবং হাইওয়ে থেকে সেই সডকটিও বেরিয়ে গেছে দক্ষিণের দিকে।
জিপটির পেছনের দক্ষিন দিকের রেড লাইট জ্বলে উঠল। সিগনাল দিতে শুরু করল। জিপটা দক্ষিনের সডকে নেমে যাবে জিপটি টার্ন নিতে গিয়ে কয়েকবার হর্ন দিল।
হর্ন শুনে চমকে উঠল আহমদ মুসা।
জিপটি ব্ল্যাক ক্রস এর কোডে হর্ন দিচ্ছে কেন? জিপটি তাহলে কি ব্ল্যাক ক্রস এর।
দ্রত চিন্তা করছিল আহমদ মুসা।
ব্ল্যাক ক্রসকে এত কাছে পেয়ে তেদের তো সে ছেডে দিতে পারে না, দক্ষিণ দিকেই। ব্ল্যাক ক্রসের গাডি কোথায় যাচ্ছে? বোমাসা এখান থেকে দক্ষিণ দিকেই, ব্ল্যাক ক্রস এর গাডি আনুসরন করে সে ওদের কোন ঘাটি বা ঠিকানা অথবা ভাগ্য সুপ্রসন্ন হলে মুসলিম পনবন্দিদেরও খোজ সে পেয়ে যেতে পারে।
সিদ্ধান্ত নিয়ে নিল আহমদ মুসা।
ড্যানিয়েলকে উদ্ধেশ্য করে বলল মিঃ ডেনিয়েল এখানে থেকে বারবারেতি যাবার ট্রান্সপোর্ট পাওয়ায় কোন আসুবিধা আছে?
না এ কথা কেন বলছেন?
আমরা এখানে থেকে একটু বাম দিকে যেতে চাই, আপনার আসুবিধা হয় কিনা তাই বললাম।
আমার কোন আসুবিধা হবে না। কিন্তু আপনারা কি বারবারেতি যাচ্ছেন না?
আপাতত নয়।
আহমদ মুসা লক্ষ্য করলে দেখতে পেত। ডেনিয়েল নামক লোকটির চোখে মুখে মুহূর্তের জন্যে বিস্ময় ফুটে উঠছে, তারপরেই সেখানে বিস্ময়ের বদলে অর্থপূর্ণ এক আনুসদ্ধান ভাব ফুটে উঠল। যেন এই প্রথম বারের মত সে গভীর দৃষ্টতে পর্যবেক্ষণ করছে আহমদ মুসাকে। ধীরে ধীরে সে বলল এখানেই তো আপনাদের বামে ঘুরতে হবে, মোডটার উপর আমাকে নামিয়ে দিন।
আমরা দুঃখিত মিঃ ডেনিয়াল। বলল আহমদ মুসা।
না ধন্যবাদ। পর্যটকদের প্রোগ্রাম ঠিক থাকে না আমি জানি মিঃ ডেনিয়ালের কথাগুলো যত সরল তার মুখের হাসি ততটা সরল নয়।
মোডে নেমে গেল মি;ডেনিয়াল।
আহমদ মুসার গাডি ছুটল নদীর তীর বরাবর দক্ষিণ গামী সডক ধরে ব্ল্যাক ক্রস এর জীপটির পিছু পিছু।
গাডি থেকে নেমেই ডেনিয়াল চারদিকে চাইল ট্যাক্সির সন্ধানে।
ডেনিয়ালের মাথায় চিন্তাটা তখন গুছিয়ে আসেছে। ব্ল্যাক ক্রস এর গাডির হর্ন সেও শুনেছে। সে নিশ্চিত এই হর্ন শুনেই পর্যটক তার গন্তব্য পাল্টেছে এবং ব্ল্যাক ক্রস এর জীপটাকে সে আনুসরন করছে।
কিন্তু কেন? কে এই পর্যটক? কেন ব্ল্যাক ক্রস এর গাডি সে আনুসরন করল। ব্ল্যাক ক্রস এর কোড সে জানল কি করে?
ছোট শহর গাডি পাওয়া মুস্কিল।
একটু ভাবল ডেনিয়েল। তারপর সে অয়্যারলেস ট্রান্সমিটার বের করল পকেট থেকে। ছোট সিগারেট লাইটারের মত।
ডেনিয়েল জানে না ব্ল্যাক ক্রস এর জিপে কে যাচ্ছে। তার কাছে অয়্যারলেস আছে কিনা। তবু ডেনিয়েল ব্ল্যাক ক্রস এর মাস্টের চ্যানেলে মেসেজ থ্রো করল। বলল ছোট কাদেলীয় সডকে ব্ল্যাক ক্রস এর জীপটিকে একজন পর্যটক আনুসরন করছে।
ব্ল্যাক ক্রস এর অয়্যারলেস নেটওয়ার্কের মাস্টার চ্যানেল একটা গোপন ও জরুরী লাইন। চ্যানেলে ব্ল্যাক ক্রস এর সব পয়েন্টে মেসেজ পৌছানো যায়।
মেসেজ পাঠানোর পর মুহূর্তেই জবাব পেয়ে গেল ডেনিয়েল অয়্যারলেসে ভেসে আশা কণ্ঠ বলল ধন্যবাদ মেসেজের জন্য আমি নজর রাখছি। কিন্তু পর্যটকের মতলব কি?
আমি জানি না তবে লোকটা খুব সহজ হবে না। আপনার সাথে কে আছে?
স্ত্রী এবং ছেলে। আমি যাচ্ছি সলো। চিন্তা করো না লডাই করার মত অস্ত্র আমার আছে। গাডি খুজছি আসছি আমি।
কথা শেষ করতেই গাডি পেয়ে গেল ডানিয়েল। গাডি তার ছুটল আহমদ মুসার গাডির পিছু পিছু।
সাম্নের গাডি একই গতিতে চলছে কোথাও দাডায়নি, গতি কমবেশিও হয়নি।
আহমদ মুসা ভাবল ব্ল্যাক ক্রস এর গাডিটি পেছনে সম্ভবত চোখ রাখেনি। কেউ আনুসরন করছে সন্দেহ নিরসনের জন্যে কিছু পরিক্ষা নীরিক্ষার চেষ্টা করে। কিন্তু সামনের গাডিটি তেমন কিছুই করেনি।
আহমদ মুসা খুশী হলো। ওকে সন্দেহ মুক্ত রাখলে ওদের ঠিকানায় পৌছা সহজ হবে।
আহমদ মুসা সামনে মানচিত্রের দিকে চেয়ে দেখল ছোট কাদেলী নদী সংঘ নদীর কাছাকাছি গিয়ে বড কাদেলী নদীতে মিশেছে। তারপর পডেছে গিয়ে সংঘ নদীতে, ঠিক সেই ভাবে রাস্তাটিও গিয়ে পডেছে সংঘ নদীর তীর বরাবর প্রলম্বিত সডক।
সংঘ নদীতে বরাবর দক্ষিনে আগিয়ে সডকটি শেষ হয়েছে ছোট গ্রাম বন্দর সলোতে।
তোমার দাদার গ্রামের নাম জান কি? ব্ল্যাক বুলকে উদ্দেশ্য করে জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা
সলো। বলল ব্ল্যাক বুল।
আমরা তো ধীরে ধীরে সলো এর দিকেই যাচ্ছি দেখছি।
তাই মনে হচ্ছে।
কি জানি বারবারেতি যাওয়া বোধ হয় হলো না।
সলো র দিকে যাচ্ছি বলে আমি কিন্তু খুব খুশী
সেই সলো কি আছে।
সেই মাটি আছে। সেই সংঘ আছে অনেক পুরানো গাছও আছে হয়তো সেদিনের সাক্ষী আছে।
তা আছে।
আহমদ মুসা আর কোন কথা না বলে সামনের দিকটা একবার দেখে নিয়ে ড্যাস বোর্ডের উপর রাখা মানচিত্রের দিকে আবার মনোযোগ দিল।
শুরুর দিকে রাস্তা তীরের মত সোজা ছিল। কিন্তু তার পরেই নদীর সমান্তরালে আকা বাকা হয়ে আগিয়ে গেছে রাস্তাটি। দু ধারেই ঘন বন কাছেই নদী কিন্তু দেখা যায় না।
খুবই ভালো লাগছে নিঝুম পরিবেসে বন ছায়া ঘেরা পথে ড্রাইভ করতে। আহমদ মুসা ভাবল যতই দক্ষিণে আগুনো যাবে বন জংগলের নিবিডতা ততই বাডবে, আফ্রিকার বিখ্যাত রেইন ফরেস্ট এলাকার চিহ এখনই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, কঙ্গো নদী ও তার অসংখ্য শাখা ও উপনদী স্নাত কঙ্গোর মধ্যে দক্ষিণ অঞ্চলটি পৃথিবীর সবচেয়ে দুর্ভেদ্য বনাঞ্চল, বোমাসা থেকে এই এলাকার শুরু।
ড্রাইভ করতে ভাল লাগলেও মুস্কিল হয়েছে সামনের গাড়িটাকে চোখে রাখার ব্যাপারটা। আঁকা বাঁকা এবং জংগলের দেয়ালে ঘেরা রাস্তায় অধিকাংশ সময়ই গাড়িটা চোখের আড়ালে থাকছে, যদিও দূরত্ব এখন দু’শ গজের বেশী নেই।
এ ধরনের রাস্তায় শত্রুর অনুসরণ আহমদ মুসার একদম নতুন অভিজ্ঞতা। সামনে-পেছনে দু’দিকটাই তার কাছে এখন অরক্ষিত মনে হচ্ছে। গাড়ির রিয়ারভিউ এখন আর কাজ দিচ্ছে না, সামনেও বনের দেয়ালে চোখ ধাক্কা খাচ্ছে। আহমদ মুসার মনে হচ্ছে, পরিস্থিতির উপর তার কোন নিয়ন্ত্রণ নেই, এক অমোঘ ব্যবস্থা যেন তাকে এগিয়ে নিচ্ছে, সে চলছে ঠিক অন্ধের মতই।
অন্ধত্ব ঘুচে গেল, যখন আহমদ মুসা তার নাকের ডগার উপর দেখল, কাদেলী সড়কটি সামনেই বারবারেতি-সলো সড়কের সাথে গিয়ে মিশেছে এবং মোড়ের উপর দাঁড়িয়ে আছে দু’টি জীপ এবং তাতে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে চারজন লোক। তাদের হাতে রিভলবার।
বিস্ময় কাটিয়ে উঠবার আগেই পেছনে শব্দ শুনে মুখ ফিরাল। দেখল, একটি গাড়ি পেছন থেকে প্রায় পাশে এসে দাঁড়িয়েছে।
বিস্মিত হলো আহমদ মুসা, গাড়িটার ড্রাইভিং সিটে ডেনিয়েল। তার হাতেও রিভলবার।
সবই বুঝল আহমদ মুসা। সে ফাঁদে পড়ে গেছে। কিন্তু কি করে? বুঝা যাচ্ছে, ডেনিয়েল ব্ল্যাক ক্রসের লোক। এবং এরা সবাই তাই। কিন্তু আহমদ মুসাকে চিনেছে কি ওরা? ডেনিয়েলের সাথে কথা বলে তো তা মনে হয়নি!
আহমদ মুসা কিছু চিন্তা করার আগেই ডেনিয়েল রিভলবার বাগিয়ে জীপ থেকে নেমে এল।
আহমদ মুসার কাছে এসে রিভলবার বাগিয়ে বলল, ‘মিঃ পর্যটক চলুন, ওরা আপনাকে স্বাগত জানাবার জন্যে অপেক্ষা করছেন।’
আহমদ মুসা গাড়ি থেকে নামল।
ব্লাক বুলও নামতে যাচ্ছিল। ডেনিয়েল ধমক দিয়ে বলল, ‘চুপচাপ বসে থাক গাইডের বাচ্চা। আসলটাকে দেখি, তারপর দরকার হলে…
বলে রিভলবার নাচিয়ে আবার বলল, ‘চলুন পর্যটক সাহেব।’
আহমদ মুসা হাঁটতে শুরু করল। তার দু’টি হাত জ্যাকেটের দুই পকেটে।
রিভলবার বাগিয়ে পেছনে পেছনে হাঁটছিল ডেনিয়েল।
দু’টি গাড়ি দাঁড়িয়েছিল সড়কের ওপ্রান্ত অর্থাৎ পুব প্রান্তে ঘেঁসে। গাড়িতে ঠেস দেয়ে ওরা চারজন দাঁড়িয়েছিল নির্বিকভাবে।
ওদের চার গজের মধ্যে গিয়ে আহমদ মুসা দাঁড়িয়ে পড়ল।
চারজনের একজন বলল, ‘মিঃ ডেনিয়েল এঁর পকেটগুলো দেখুন।’
ডেনিয়েল পেছন থেকেই ডান হাতে রিভলবার ধরে রেখে বাম হাত দিয়ে জ্যাকেট এবং প্যান্টের পকেট সার্চ করল। জ্যাকেটের পকেটে একটা রিভলবার পেল মাত্র।
গাড়িতে ঠেস দেয়া যে লোকটি পকেট সার্চের নির্দেশ দিয়েছিল, সেই আবার বলে উঠল, ‘কে তুমি? আমাদের পিছু নিয়েছিলে কেন?’
‘আমি ব্ল্যাক-ক্রস-এর সন্ধান করছি।’
‘ব্ল্যাক-ক্রস-এর কোড তুমি জান কি কওে?’
‘ব্ল্যাক-ক্রস আমার পুরনো বন্ধু।’ আহমদ মুসার ঠেটে ফুটে উঠল এক টুকরো হাসি।
‘পাঁচটা রিভলবারের মাঝখানে দাঁড়িয়ে হাসছ, জোক করছ? কে তুমি?’
‘ব্ল্যাক-ক্রস-এর পুরানো বন্ধু।’
কথা বলছিল যে লোকটি সে আহমদ মুসার দিকে রিভলবার তাক করে বলল, ‘তোমার সাথে রসিকতা করার জন্যে আমরা এখানে বসে নেই। কে তুমি, কেন আমাদের পিছু নিয়েছিলে?’
‘একজন এশিয়ান আমি। ফ্রান্স থেকে আমি এসেছি। দেখতেই পাচ্ছেন আমি পর্যটক।’
পর্যটক হিসেবে তুমি আমাদের অনুসরণ করনি। কে তুমি? কেন তুমি ব্ল্যাক ক্রস-এর সন্ধান করছ?
‘পিয়েরে পল আমার পুরানো বন্ধু কিনা।’
ওরা চারজন একে অপরের দিকে তাকাল। তাদের চোখ নাচল। সম্ভবত ক্রোধ এবং বিস্ময়ে। বিস্ময়ের কারণ তাদের মুঠোয় আসা অপরিচিত একজন লোকের ঔদ্ধত্য। আর ক্রোধের কারণ নিহত পিয়েরে পলকে লোকটি বিদ্রুপ করছে।
কথা বলছিল যে লোকটি, সে তার সাথের রিভলবারধারী একজনকে লক্ষ করে বলল, ‘মুখটা ওর ভেঙে দাও। বুঝিয়ে দাও আমরা রসালাপ করতে আসিনি।’
হুকুম পেয়ে লোকটা ছুটে গেল আহমদ মুসার দিকে। রিভলবারের বাঁট দিয়ে আহমদ মুসার মুখে, ঘাড়ে, মাথায় আঘাত করল।
আহমদ মুসার কপাল ও মুখের কয়েক জায়গা ফেটে সেখান থেকে রক্ত গড়াতে লাগল।
আহমদ মুসা দাঁড়িয়েছিল পাথরের মত। ভাবলেশহীন তার মুখ। কিন্তু সে এই ধরনের আক্রমন আশা করেনি। আহমদ মুসা তার কথার দ্বারা ব্ল্যাক ক্রসের লোকদের রাগিয়ে দিতে চেয়েছিল। রাগলেই মানুষ ভুল করে।
‘এতক্ষণ তোমার মাথার খুলি উড়ে যেত, কিন্তু তা আমরা কারনি। তোমাকে জানতে হবে আমাদের। আমরা এক এশিয়ানকে খুঁজছি।’ রক্তাক্ত আহমদ মুসার দিকে চেয়ে ক্রুর হেসে বলল সেই লোকটি।
সে থামতেই যে লোকটি আহমদ মুসাকে আঘাত করেছিল, সে চিৎকার করে বলল, ‘বল এবার, তুমি কে? দেরী করলে এখন প্রথম তোমার নাক ভাঙব, তারপর হাত-পা ভাঙা শুরু করব।’
‘কষ্ট করে বলার দরকার নেই। ইতিমধ্যেই প্রমাণ করেছ এসব তোমরা পার।’
‘আবার বিদ্রুপ।’ বলে আহমদ মুসার সামনে দাঁড়ানো রিভলবারধারী লোকটা আবার তার রিভলবারের বাঁট তুলল আহমদ মুসার নাক লক্ষ্যে।
আহমদ মুসা এবার এ্যাকশনে যাবার সিন্ধান্ত নিল। সে তার মাথাটা বিদ্যুৎ গতিতে সরিয়ে নিয়ে ডান হাত দিয়ে রিভলবার কেড়ে নিয়ে লোকটার সামনে ঝুঁকে আসা তলপেট লক্ষে প্রচন্ড একটা কিক চালাল। এবং তার সাথে সাথে চোখের পলকে হাতের রিভলবারটা পেছনের দিকে ঘুরিয়ে গুলী করল পেছনে দাঁড়ানো ডেনিয়েলকে লক্ষ্য করে।
ঘটনার আকস্মিকতা হকটকিয়ে দিয়েছিল ডেনিয়েলকে। সি কিছু সিন্ধান্ত নেবার আগেই গুলী খেয়ে পড়ে গেল রাস্তার উপর।
গুলী করেই আহমদ মুসা তার রিভলবার সামনে ঘুরিয়ে নিল।
সামনের লাথি খাওয়া লোকটি তখন টলতে সটলতে পড়ে যাচ্ছিল।
আহমদ মুসা তার মাথার উপর দিয়ে দুইটি গুলী ছুড়ল পর পর। গুলী করেই নিজের দেহটা ছুড়ে দিল রাস্তার উপর। দ্বিতীয় গাড়ির কাছে দাঁড়ানো তৃতীয় লোকটি রিভলবার তুলেছিল গুলী করার জন্যে।
তলপেটে আহমদ মুসার লাথি খাওয়া লোকটা পড়ে যাবার মুখেও উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করছিল।
তৃতীয় লোকটির গুলী এসে তার মাথায় বিদ্ধ করল পেছন দিক থেকে।
আহমদ মুসা মাটিতে পড়েই তার রিভলবার তৃতীয় লোকটিকে তাক করেছিল। কিন্তু তার গুলী গিয়ে বিদ্ধ করল তৃতীয় লোকটির রিভলবার ধরা হাতে। রিভলবার পড়ে গিয়েছিল তার হাত থেকে।
আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল।
তৃতীয় লোকটি ঝাঁপিয়ে পড়েছিল হাত থেকে পড়ে যাওয়া রিভলবারটি তুলে নেয়ার জন্যে। কিন্তু সে রিভলবার তুলে নিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াবার আগেই আহমদ মুসার রিভলবার তার লক্ষ্যে উঠে গিয়েছিল। আহমদ মুসার তর্জনি রিভলবারের ট্রিগারে চেপে বসছিল।
ঠিক এ সময় গাড়ির আড়াল থেকে একটি শিশু ছুটে তৃতীয় লোকটির সামনে এসে তাকে আড়াল করে দাঁড়িয়ে কান্না জড়িত কন্ঠে চিৎকার করে উঠল, ‘আমার আব্বুকে মের না।’
আরেকটা মহিলাও গাড়ির ওপাশে দাঁড়িয়েছিল। তার চোখে-মুখে মৃত্যুর আতংক।
শিশুটির বয়স পাঁচ ছয় বছর হবে।
শিশুটির আকুল আর্তি এবং ব্যাকুল চোখের দিকে তাকিয়ে আহমদ মসার হৃদয় কেঁপে উঠেছিল এক বেদনায়। তার তর্জনি সরে এসেছিল ট্রিগার থ