২
আহমদ মুসা ক্যামেরুনে রাশেদী ইয়েসুগোর সাথে কথা বলছিল টেলিফোনে।
বলছিল, ‘ঘটনার পর ক’দিন চলে গেল আসিনি কেন বলছ? সময় থাকলেও সুযোগ পাইনি। বোমাসাতেই কেটেছে দু’দিন। ব্ল্যাক বুল তো সেখানে শুধু পীরজাদা নয়, রীতিমত পীর বনে গেছে। তার পায়ের ধুলোও যেন অসীম মুল্য তাদের কাছে। বুঝতেই পারছ কি রকম দাওয়াত খেতে হয়েছে। তাছাড়া আমরা ওখানে কিছু কাজও করেছি। বাংগুই থেকে ওদের জন্যে একজন ইমাম আনিয়েছি। একটা আরবী স্কুল চালু করেছি। একটা মিশনারী ইউনিট গঠন করেছি। সমাজ সেবার কাজ আবার চালু করা হয়েছে। বলতে পার দুই মাসের কাজ করেছি দুই দিনে।’
‘কিন্তু তারপর আরও ৫দিন গেছে’ আহমদ মুসার কথার মাঝখানে ওপার থেকে বলে উঠল, রাশিদী ইয়েসুগো।
‘পাঁচদিনের কথা বলছ? সলোতে এসে পাঁচটা দিন কিভাবে গেল বুঝতেই পারিনি। মনে হচ্ছে একদিনও যায়নি।’
‘কি ব্যাপার! কি ঘটেছে সেখানে?’ আবার আহমদ মুসাকে থামিয়ে দিয়ে বলে উঠল ওপার থেকে রাশিদী ইয়েসুগো।
‘বলছি শোন। মহা ঘটনা ঘটে গেছে। ব্ল্যাক বুলের বিয়ে হয়েছে। বিয়ের কাজে ও আনন্দে কোন দিক দিয়ে যে এ পাঁচটা দিন গেছে টের পাইনি!’
‘বিয়ে? কার সাথে? এভাবে হটাৎ?’ ওপার থেকে বলল রাশিদী ইয়েসুগো।
‘মেয়েটি ব্ল্যাক বুলের বংশের একজন এবং নিকট আত্মীয়। ওরা মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিল। সুতরাং দেরী হয়নি।’
‘ওঁকে আমাদের মোবারকবাদ দেবেন। ও বউ নেয়েই আসছে তো?’ বলল রাশিদী ইয়েসুগো টেলিফোনের অপর প্রান্ত থেকে।
‘ও আপাতত যাচ্ছে না। আমি মনে করি সলো ও বোমাসায় তাকে দিয়ে ইসলামের অনেক খেদমত হবে। স্থানীয় লোকদের মধ্যে সে খুবই জনপ্রিয় হবে।’
আহমদ মুসা মুহূর্তকাল থেমেই আবার বলতে শুরু করল, ‘রোসেলিনের ওখান থেকে ডোনা-রোসেলিন কাল সকালে যখন ফিরছেন, তখন সুবিধা হলে সকালে টেলিফোনের চেষ্টা করব। তুমি আমার আহত হওয়ার কথা রোসেলিনকে বলো না। সে কথা রাখতে পারবে না, ডোনাকে বলে দেবে।’
‘ঠিক আছে বলব না। কিন্তু আপনি ভাল তো? কিছু লুকচ্ছেন না তো?’
‘তুমি তা মনে করো?’
‘না মনে করিনা।’ বাক্যটা শেষ করে একটা ঢোক গিলে সঙ্গে সঙ্গেই বলল, ‘আহমদ মুসা ভাই আপনি তাড়াতাড়ি আসুন। আপনাদের শুভ কাজটা সম্পন্নের পর আপনাদের নিয়ে আমরা ‘লেক চাঁদ’ এলাকায় বেড়াতে যাব। বহুদিন যাই না। কেমন সুন্দর এলাকা দেখবেন।’
আহমদ মুসা হাসল। বলল, ‘বেড়াবার ওরকম একটা সুযোগ পেলে খুশীই হবো। তবে এই মুহূর্তে এর চেয়ে জরুরী কাজ একটা আছে।’
‘কি কাজ সেটা?’
‘বোমাসায় শুনলাম, ‘গ্যাবন এর পোর্ট জোন্টল-এ তিনশ মুসলমানের বাস। গ্রামাঞ্চল থেকে উচ্ছেদ হয়ে ওরা শহরে এসে একত্রিত হয়েছিল শহরতলীর একটা মসজিদ কে কেন্দ্র করে। সপ্তাহখানেক আগে কারা রাতের বেলা মসজিদ ভেঙে মাটির সাথে মিশিয়ে দিয়ে গেছে। বাধা দিতে গিয়ে ৪জন মুসলিম যুবক মারা গেছে। মনে করা হচ্ছে অবশিষ্ট মুসলমানকে পোর্ট জোন্টল থেকেও বহিষ্কার করা হবে। ক্যামেরুনে এসে আমি ওখানে যেতে চাই। মনে হয় ‘লেক চাঁদ’ সরকারের গ্যাবন-এর সমুদ্র তীরের পোর্ট জোন্টল সফর খারাপ হবে না।’
‘তা হবে। খেলায় আনন্দ আছে। কিন্তু অনেকে কাজে আনন্দ পায় বেশী।’
‘আচ্ছা তুমিই বল, খেলার আনন্দের চেয়ে মানুষের অশ্রু মোছানোর মধ্যে আনন্দ বেশী কিনা!’
‘এ সত্যটা কারও মতামতের অপেক্ষা করে না আহমদ মুসা ভাই।’ কথা শেষ করেই রাশিদী আবার বলে উঠল, ‘মুসলিম নেতৃবৃন্দ যাচ্ছেন কবে?’
‘রেডিও-টিভি’র খবরে তো শুনেছই, বারবারেতিতে গতকাল ইসলামী সম্মেলন হয়ে গেছে। আজ ওঁরা যাবেন।’
‘আপনি সম্মেলনে ছিলেন না?’
‘ছিলাম ব্যাক-বেঞ্চার হিসেবে, প্রৌঢ় একজন মৌলভীর পোশাকে।
‘ছদ্মবেশ কেন?’
‘পাগল হয়েছ, দুনিয়ার সব সাংবাদিক এবং গোয়েন্দারা এসে জমা হয়েছিল বারবারেতিতে। কি দরকার তাদের সামনে পরিচয়টা প্রকাশ করার!’
‘নতুন করে এ ধরনের সম্মেলনের সংবাদে আমার কিন্তু খুব ভয় হয়েছিল।’
‘ভয় হবারই কথা। একটা চ্যালেঞ্জ হিসেবেই সম্মেলন করা হয়েছে। এখানে ইসলামী সম্মেলন করার চেষ্টা দু’বার ব্যর্থ হয়েছে। একবার দু’শ বছর আগে, আর এবার একবার ক’দিন আগে। সুতরাং সম্মেলনে করে অতীতের ব্যর্থতার রেকর্ড ভাঙার প্রয়োজন ছিল। এ জন্যে আমার পরামর্শ ছিল মুসলিম নেতৃবৃন্দ সম্মেলন করেই মধ্য আফ্রিকা প্রজাতন্ত্র ত্যাগ করবেন। আলহামদুলিল্লাহ সম্মেলন সফলভাবেই অনুষ্ঠিত হয়েছে। আমার খুবই আনন্দ লাগছে, আফ্রিকার এই অঞ্চলে ইসলামের প্রথম নিজাম বরদার আহমদ বিন আব্দুর রহমানের দু’শ বছর আগের স্বপ্ন সফল হল। সম্মেলনটির মাধ্যমে তাঁর ভূলুণ্ঠিত পতাকা আবার উত্তোলিত হল।
‘আলহামদুলিল্লাহ’ টেলিফোনের অপর প্রান্ত থেকে বলল রাশিদী ইয়েসুগো।
‘তুমি শুনে খুশী হবে। সলোর পুলিশ প্রধান জাগুয়াস ম্যাকা ও তার পরিবার এবং বোমাসার পুলিশ প্রধান উপাংগো ইসলাম গ্রহণ করার পর গত ৫দিনে প্রায় তিন’শ পরিবার ইসলাম গ্রহণ করেছে এই দুই শহরে।’
‘আলহামদুলিল্লাহ।’
রাশিদী ইয়েসুগোর কণ্ঠ থামতেই আহমদ মুসা বলল, ‘এখন রাখি। সবাইকে সালাম দিও।’ বলে সালাম জানিয়ে আহমদ মুসা টেলিফোন রেখে দিল।
টেলিফোনের রিসিভারটা ক্র্যাডলে রেখে সোফায় একটু গা এলিয়ে বসতেই আবার টেলিফোন বেজে উঠল।
টেলিফোনের রিসিভার আবার তুলে নিল আহমদ মুসা।
ওপারের কণ্ঠ শুনতে পেয়েই আহমদ মুসা সোজা হয়ে বসল। তার চোখে-মুখে ফুটে উঠল সম্ভ্রমের চিহ্ন।
ওপার থেকে কথা বলছে বিশ্ব মুসলিম কংগ্রেসের প্রধান শেখ আব্দুল্লাহ আলী আল মাদানী।
‘জনাব আপনি কষ্ট করে টেলিফোন করেছেন। কিছুক্ষণের মধ্যে আমিই টেলিফোন করতাম।’
‘কেন পুত্রই শুধু এগুবে, পিতার এগুতে নেই বুঝি?’
কথাটা শেষ করেই শেখ আল মাদানী বলে উঠল, ‘তুমি তো জান, আজ আমরা চলে যাচ্ছি। তোমার কাছে বিদায় নেবার জন্যে টেলিফোন করেছি।’
‘আমি দুঃখিত যে, উপস্থিত থেকে আমি আপনাদের বিদায় জানাতে পারলাম না। এ বেয়াদবির জন্যে ক্ষমা চাইছি জনাব।’ বলল আহমদ মুসা।
‘তুমি আমাদের লজ্জা দিও না বাছা। তুমি আহত। তোমার বিশ্রাম দরকার। ঐ অবস্থায় বারবারেতি এসেছিলে-এটাই ঠিক হয়নি।’
মুহূর্তের জন্য থামল শেখ আল মাদনী। একটা ঢোক গিলল। তারপর আবার শুরু করল, ‘তোমার প্রতি আমার একটা অনুরোধ আছে।’
তার প্রথম বাক্যটা শেষ হতে না হতেই আহমদ মুসা তাকে বাধা দিয়ে বলে উঠল, ‘অনুরোধ নয়, আদেশ করুন। আমি আপনাদের মত গুরুজনদের কাছ থেকে আদেশ চাই।’
‘ঠিক আছে আদেশই ধরে নাও। আমি যা বলতে চাচ্ছি তা হলো, তুমি নিজের দিকে খেয়াল রাখবে। বিশেষ করে নিজের নিরাপত্তার ব্যাপারে খুবই সতর্ক থাকবে। তোমার জীবনের চেয়ে বেশী মুল্যের কেউ আর আজকের মুসলিম দুনিয়ায় নেই। আমাদের মত অকর্মণ্য, বাক্যবাগিশদের জন্যে তোমার জীবনের ঝুঁকি নেয়া উচিত নয়। সেদিন বোমাসার বাইবেল সোসাইটির যুদ্ধকালে তুমি আমাদের নিরাপদ করার জন্যে সবাইকে পাঠিয়ে দিয়ে প্রবল শত্রুর মোকাবিলার জন্যে একাই দাঁড়িয়েছিলে। কথাটা স্মরন হলে আমার এখনও বুক কেঁপে ওঠে। নিছক পদবী সর্বস্ব কয়েকজনকে বাঁচাবার জন্যে তুমি নিজেকে এভাবে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিতে পার না।’
‘আপনি নিজের উপর জুলুম করছেন জনাব। আজ ইসলামের যে রেনেসাঁ, তার ভিত্তি ও স্ট্রাকচার আপনারাই গড়েছেন।’
‘ভিত্তি ও স্ট্রাকচার গুরুত্বপূর্ণ বাছা, এতে জীবনের সক্রিয়তা না থাকলে এবং গতিমান না হলে একে মৃত লাশ ছাড়া আর কিছু বলা যায় না। তুমি দুর্গত মুসলিম সমাজকে জীবনের গতি দিয়েছ এবং শুধু বাচার নয় সংগ্রামের সাহসে সজ্জিত করেছ।’
‘লজ্জা দেবেন না জনাব। মানুষ কিছু করেনা, চেষ্টা করতে পারে মাত্র। আমি সামান্য একটা উপলক্ষ, সব কিছু আল্লাহর ইচ্ছাতেই হচ্ছে।’ কথাঢ় মাঝখানে বাধা দিয়ে বলে উঠল আহমদ মুসা।
‘ঠিকই বলেছ। কিন্তু এই উপলক্ষ হওয়াই এখন বড় কাজ। সেই কাজ তুমি করছ। যা আমরা পারছি না। আমরা ১২জন বন্দী ছিলাম। নিজেদের মুক্ত করার কোন উদ্যোগ নেইনি। কোন ঝুঁকি নেয়ার চিন্তাও করিনি। আর আহত হয়েও এবং বন্দী হবার পরেও নিজেকে মুক্ত করে ছুটে এসেছ তুমি আমাদের মুক্ত করার জন্য। শত্রুপুরীতে ঢুকেছ একা, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে। সুতরাং তুমি উপলক্ষ বটে, কিন্তু আল্লাহ এ ধরনের উপলক্ষই চান।’
‘ধন্যবাদ জনাব। দোয়া করুন। এই দায়িত্ব পালন যেন আরও আন্তরিকতার সাথে করতে পারি।’
‘ফি আমানিল্লাহ। আর একটা কথা বলি?’
‘বলুন জনাব।’
‘মদিনার গভর্নর মসজিদে নববীর পাশে এবং মক্কার গভর্নর ক্বাবার পাশে তোমাকে বাড়ি উপহার দিয়েছেন। তুমি উপহার দু’টো নিজে গিয়ে এখনও গ্রহণ করনি।’
‘ব্যস্ততার কারনে পারিনি জনাব। তবে আমি জানিয়েছি, হজ্জ ও ওমরার জন্যে আসা অতিথিদের যারা চান আমার বাড়ি দু’টো ব্যবহার করলে আমি বাধিত হবো। ঐ ওছিলায় কিছু নেকীও আল্লাহ দিতে পারেন।’
‘তোমার উপযুক্ত প্রস্তাব তুমি দিয়েছ। আমি ফিরে গিয়ে খোঁজ নেব কি হচ্ছে।’
একটু থামল শেখ আব্দুল্লাহ মাদানী। পর মুহূর্তেই আবার শুরু করল, ‘আরও একটা কথা বলব?’
‘অবশ্যই জনাব।’
‘তোমার ব্ল্যাক বুলের কাছ থেকে মারিয়া জোসেফাইন সম্পর্কে শুনেছি। আমি তোমার পিতার মত। আমরা আশা করতে পারি, বৌমাকে মদিনা অথবা মক্কার বাড়িতে রেখে তোমার একটা স্থায়ী ঠিকানা গড়ে তুলবে!’
আহমদ মুসা সঙ্গে সঙ্গে কিছু বলল না। একটু সময় নিয়ে ধীরে ধীরে বলল, ‘পবিত্র ক্বাবা ও মসজিদে নববীর সান্নিধ্যে বাস করার চেয়ে লোভনীয় আর কিছু নেই আমার কাছে। কিন্তু সব সাহাবীর কি এ সুযোগ হয়েছে? যারা চায়, তাদের সবার কি এ সুযোগ হয় জনাব?’
‘তোমার কথা ঠিক। কিন্তু আল্লাহ তোমাকে বিশেষ সুযোগ দিয়েছেন।’
‘আলহামদুলিল্লাহ। আল্লাহর ইচ্ছা তাঁর বান্দাহ-এর জন্যে শিরোধার্য।’
‘আলহামদুলিল্লাহ। আবার বলি, তোমার নিজের দিকে খেয়াল রেখ।’
বলে সালাম দিয়ে টেলিফোন ছেড়ে দিল শেখ আল মাদানী।
আহমদ মুসাও রাখল টেলিফোনের রিসিভার।
বিশ্ব মুসলিম কংগ্রেসের প্রধান শেখ মাদানীর কথাটা তখনও কানে বাজছিল আহমদ মুসার। মমতা ভরা পিতৃসুলভ উপদেশ গভীরভাবে স্পর্শ করেছিল তাঁর হৃদয়কে। এমন পিতৃসুলভ কণ্ঠ বহুদিন, বহুবছর সে শোনেনি। তাঁর চোখে পানি এসে গিয়েছিল।
পায়ের শব্দ কানে এল আহমদ মুসার। দরজার বাইরে থেকে।
আহমদ মুসা তাড়াতাড়ি চোখ মুছে ঘুরে বসল। দেখল, দরজা দিয়ে প্রবেশ করছে জাগুয়াস ম্যাকা। তার হাতে অনেকগুলো খবরের কাগজ।
জাগুয়াস ম্যাকা এসে হাতের খবরের কাগজগুলো টিপয়ের উপর রেখে আহমদ মুসার পাশে সোফায় বসতে বসতে বলল, ‘নাইরোবি’ থেকে এ কাগজগুলো একজন নিয়ে এসেছে। গত সাত দিনের কাগজ আছে। আপনার জন্যে নিয়ে এলাম। ইউরোপের কাগজ নিশ্চয়ই অনেকদিন দেখেননি।’
ধন্যবাদ। ইয়াউন্ডিতে কিছু কাগজ নিয়মিত পাওয়া যেত।’
একটু থামল আহমদ মুসা। সঙ্গে সঙ্গেই আবার শুরু করল, ‘কংগ্রাচুলেশন। টেলিভিশনে আপনার প্রমোশন এবং পুরষ্কারের খবর শুনলাম।’
জাগুয়াস ম্যাকা হাসল। বলল, ‘কেউ মরে বিল সেচে, কেউ খায় কই।’ আমার খুবই লজ্জা হচ্ছে এই প্রমোশন ও পুরস্কারের কথা শুনে।’
‘কেন?’
‘ঐ তো বললাম।‘কাজ করলেন আপনি, আর ফল পাচ্ছি আমি।’
‘কেন, কাজ তো করেছেন আপনি।’
‘কি করেছি তা আপনি জানেন। উপস্থিত হওয়া কাজ হলে কিছু কাজ করেছি।’
একটু থামল জাগুয়াস ম্যাকা। থেমেই আবার শুরু করল, ‘আমি বুঝতে পারছিনা, আপনি একেবারে পর্দার আড়ালে চলে গেলেন, আপনার বিষয়টা কাউকে জানতে দিলেন না কেন?’
‘সবই তো শুনেছেন। প্রকাশ হলে শত্রুর আরেক দফা রোশের মধ্যে পড়া ছাড়া কি লাভ হতো!’
‘সাংবাদিকদের না জানান, কিন্তু আমার পুলিশ কে জানালে তো ক্ষতি ছিল না।’
‘আপনি কি নিশ্চিত, আপনাদের পুলিশের কারও সম্পর্ক ব্ল্যাক ক্রস-এর সাথে নেই?’
জাগুয়াস ম্যাকা গম্ভীর হল। বলল, ‘না এটা বলতে পারবো না।’
বলেই হাসল জাগুয়াস ম্যাকা। বলল, ‘আপনার যুক্তি ঠিক। কিন্তু আমার খুব কষ্ট লাগছে, আপনার এত বড় একটা কৃতিত্বের কথা বিশ্ববাসী জানতে পারল না।’
‘কষ্ট লাগবে না আপনার যদি আপনি ভাবেন, কৃতিত্ব প্রকাশ না করার মধ্যেই আমার লাভ শতগুন বেশী।‘
‘শতগুন লাভটা কি?’
‘দেখুন, মুসলমানরা এ ধরনের কাজই করেন আল্লাহর জন্যে, মানে আল্লাহর দেয়া দায়িত্ব মনে করে।’ এজন্যে আল্লাহর কাছ থেকে রয়েছে অঢেল পুরষ্কার। দুনিয়ার মানুষের কাছে নাম ও কৃতিত্ব পাওয়ার জন্যে এ ধরনের কাজ করলে আল্লাহর কাছ থেকে এ পুরষ্কার পাওয়া যায় না।
‘কিন্তু মানুষের কাছে নাম ও কৃতিত্ব চাওয়ার মধ্যে ক্ষতিকর কি আছে, যার জন্যে আল্লাহ পুরষ্কার দেয়া বন্ধ করবেন?’
আহমদ মুসার মুখমণ্ডল গম্ভীর হয়ে উঠল। বলল, ‘মানুষ কেন নাম চায়? কেন তার কৃতিত্বের কথা প্রচার করতে চায়? চায় কারন, সে তার ভাল কাজের বিনিময় চায়। মানুষ তার কৃতিত্বের একটা বিনিময় দিক সে চায়। এই প্রবনতা তার কাজকে স্বার্থদুষ্ট করে তোলে। আর এই স্বার্থদুষ্টতা ধীরে ধীরে তাকে শোষক ও স্বেচ্ছাচারী করে তুলতে পারে। অন্যদিকে কাজটা যদি আল্লাহর দেয়া মানবিক দায়িত্বের অংশ হিসেবে হয়, যাকে বলা হয় ফি সাবিলিল্লাহ, তাহলে তার মধ্যে স্বার্থের কোন চাহিদা থাকে না। এ ধরনের লোক দ্বারা মানবতা শুধু উপকৃতই হয়, ক্ষতিগ্রস্থ হয় না।’
‘বুঝলাম। কিন্তু আমার ভুয়া ‘কৃতিত্ব’ নিয়ে যে দেশ জুড়ে হৈচৈ হচ্ছে তার কি করব।’
আহমদ মুসা হাসল। বলল, কৃতিত্ব যখন ভুয়া বলছ, তখন এ কৃতিত্বের দ্বারা মানবতার কোন ক্ষতি হবেনা।’
‘কৃতিত্ব ভুয়া হলেও, এ কৃতিত্বের যে পুরষ্কার আমার হাতে তুলে দিচ্ছে তা তো ভুয়া নয়। আমার প্রমোশন হচ্ছে, এটা বাস্তব ঘটনা।’
‘ক্ষতি নেই তাতে। প্রমোশন আসল বিষয় নয়, আসল বিষয় হলো যিনি প্রমোশন পাচ্ছেন তিনি। তিনি যদি অহংকারী ও ক্ষমতালিপ্সু না হয়ে ওঠেন এবং মনে করেন যে, প্রমোশন আল্লাহর করুনা হিসেবে তার হাতে এসেছে, তাহলে এর দ্বারা মানবতার উপকার হবে, কোন ক্ষতি নয়।’
‘ধন্যবাদ’ বলে জাগুয়াস ম্যাকা উঠে দাঁড়াল। বলল, ‘আমি পোশাক ছেড়ে আসছি।’
জাগুয়াস ম্যাকা চলে গেল বাড়ির ভেতর।
আহমদ মুসা কাগজগুলো টেনে নিয়ে সোফায় হেলান দিয়ে বসল।
চা নিয়ে ঘরে প্রবেশ করল ৭ বছরের নাওমি, জাগুয়াস ম্যাকার মেয়ে।
চা-এর ট্রলি নিয়ে আহমদ মুসার সামনে পোঁছতেই আহমদ মুসা বলে উঠল, নাওমি, কাজের ছেলেটা কোথায়? তোমার তো একাজ না?
‘আম্মা বলেন, ‘মেহমানদের মেহমানদারী নিজেরা করতে হয়। আপনার মেহমানদারী তো করতেই হবে।’
‘কেন করতে হবে?’
‘আপনি সাংঘাতিক লোক।’
‘সাংঘাতিক লোক? মানে খারাপ লোক আমি? হেসে উঠল আহমদ মুসা।
‘না, ভাল সাংঘাতিক আপনি। আপনি একাই দেড়কুড়ি শত্রুকে মেরেছেন, আম্মা বলেছেন।’
‘মানুষ মারা কি ভাল?’
‘মানুষ নয়তো, শত্রু, আম্মা বলেছেন।’
‘শত্রু কি মানুষ নয়?’
নাওমি সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিল না। উত্তর খুজছে সে। একটু পর আমতা আমতা করে বলল, ‘শত্রু কি তাহলে ভাল?’
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘তোমার আম্মা ঠিকই বলেছেন। শত্রু ভাল নয়, খারাপ। কিন্তু তারা মানুষ।’
‘তাহলে মানুষ শত্রু কেন, খারাপ কেন?’
‘মানুষের মধ্যে ভাল মানুষ, খারাপ মানুষ দুই-ই আছে’
‘খারাপ কেন?’
‘মানুষ যারা আল্লাহর আদেশ-নিষেধ মেনে চলে না, তারা খারাপ হয়ে যায়।’
‘আব্বা-আম্মার কথা না মানলে?’
‘সেটাও খারাপ কাজ। খারাপ কাজ করলে মানুষ খারাপ হয়।’
নাওমি একটুক্ষণ চুপ করে থাকল, তারপর বলল, ‘আপনি আমাদের বাড়িতে থাকবেন না কেন?’
‘কে বলল থাকব না?’
‘আম্মা বলেছেন’
‘কি বলেছেন?’
‘আপনি এক যায়গায় থাকেন না। ঘুরে বেড়ান।’
একটু থেমে একটা ঢোক গিলেই নাওমি আবার শুরু করল ‘আপনার বাড়ি নেই, আম্মা নেই?’
আকস্মিক এই প্রশ্নে আহমদ মুসা কি উত্তর দেবে ভাবছিল। এই সময় ভেতর থেকে নাওমির মা নাওমিকে ডাকল। ডাক শুনেই নাওমি দৌড় দিল ভেতরে।
আহমদ মুসা স্বস্তি বোধ করল। নাওমির শেষ প্রশ্নটা আহমদ মুসার মর্মে গিয়ে আঘাত করেছিল। হঠাৎ করেই তার মায়ের কথা মনে পড়ে গিয়েছিল। তার সাথে মনে পড়ে গিয়েছিল সিংকিয়াং-এর ছোট পার্বত্য গ্রামের ছোট একটা গৃহাঙ্গনের কথা।
নাওমি গেলেও স্মৃতির সেই গৃহাঙ্গন থেকে ফিরে আসতে পারল না আহমদ মুসার মন। কি অসীম সুখের বন্যা ছিল সেই গৃহাঙ্গনে। মায়ের কোল নিয়ে চলত দু’ভায়ের কাড়াকাড়ি। দুই কোলে দু’জনকে তুলে নিত মা। মায়ের কোলের সে উষ্ণতা হৃদয়ে যেন জীবন্ত হয়ে উঠল তার।
আহমদ মুসার চোখ দু’টি ভিজে উঠল।
ঠিক মাথার উপরেই দেয়াল ঘড়িতে সময় জ্ঞাপন ঘণ্টা বেজে উঠল।
আহমদ মুসা ফিরে এল অতীত থেকে। নড়ে-চড়ে বসল। চোখ দুটি মুছে সামনের টেবিল থেকে সংবাদপত্রগুলো টেনে নিল।
সংবাদপত্রগুলোর দিকে তাকিয়ে খুশী হল আহমদ মুসা। ফ্রান্সের বিখ্যাত দৈনিক লা মণ্ডে এবং সুইজারল্যান্ডের ‘দার ব্লিক’- এর গত কয়েকদিনের কয়েকটি সংখ্যা।
তারিখ অনুসারে কাগজগুলোকে সিরিয়াল করে নিয়ে সুইস পত্রিকা ‘দার ব্লিক’ তুলে নিল হাতে।
‘দার ব্লিক’ তার কাছে নতুন পত্রিকা। অনেক নাম শুনেছে। কিন্তু পড়েনি কখনও আহমদ মুসা।
‘দার ব্লিক’টাই আহমদ মুসা তুলে নিল হাতে।
প্রথমে আহমদ মুসা পৃষ্ঠাগুলোর উপর চোখ বুলিয়ে দেখল কোন পাতাকে কোন বিষয় দিয়ে সাজানো হয়েছে। তারপর আকর্ষণীয় কিছু নিউজ পড়তে লাগল। প্রথম পাতায় সিংগল কলামের একটা নিউজ আহমদ মুসার দৃষ্টি আকর্ষণ করল। শিরোনাম ‘মিষ্ট্রিয়াস ডেথ’ রহস্যজনক মৃত্যু। পড়ল নিউজটি আহমদ মুসা। উত্তর জেনেভায় একটি ফ্ল্যাটে একজন যুবককে মৃত অবস্থায় পাওয়া গেছে। নাম হাবিব ডুনান্ট। উত্তর জেনেভার একটি সুসজ্জিত ফ্যামেলি ফ্ল্যাটে তার রহস্যজনক মৃত্যু ঘটে। প্রচণ্ড ধরনের প্রাণীজ বিষের প্রভাবে তাঁর মৃত্যু ঘটে। বিষের প্রকৃতি ও প্রকার নিয়ে পরীক্ষা হচ্ছে।
এর একদিন পরের আরেকটি ‘দার ব্লিক’ পড়তে গিয়ে সিংগল কলামে প্রকাশিত আরেকটি নিউজ পড়ল আহমদ মুসা। অনুরুপ রহস্যজনক মৃত্যুর খবর। এ মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে দক্ষিণ জেনেভার একটি ফ্ল্যাটে। মৃত্যু ঘটেছে মধ্য বয়সী একজন মানুষের। এ মৃত্যুর কারণও আগের বিষ। লোকটির নাম ইউসেফ উইলিয়াম। ল্যাবরেটরি পরীক্ষায় প্রমানিত হয়েছে বিষটি ‘সিসি ফ্লাই-এর বিষের অনুরুপ। তবে সিসি মাছির বিষ এত দ্রুত ও প্রান সংহারী হয় না। বিষয়টি বিশেষজ্ঞ মহলে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছে।
দু’দিন পরের আরেকটি ‘দার ব্লিক’এর পাতায় চোখ বুলাতে গিয়ে চমকে উঠল আহমদ মুসা। সিসি মাছির বিষক্রিয়ায় আরেকটি মৃত্যুর খবর একেবারে ‘শীর্ষ নিউজ’ হিসেবে প্রকাশিত হয়েছে। একই ধরনের খবর। ঐ একই ধরনের বিষক্রিয়ায় যুবকের মৃত্যু। মধ্য জেনেভায় ‘রণ’ নদীর তীর এলাকায় একটি ফ্ল্যাটে তার মৃতদেহ পাওয়া গেছে। নাম আসফ আফেন্দী। ওয়ার্ল্ড নিউজ এজেন্সীর (WNA) কেন্দ্রীয় ডেস্কের চীফ নিউজ কো-অর্ডিনেটরদের একজন সে।
ল্যাবরেটরি পরীক্ষার বরাত দিয়ে নিউজে বলা হয়েছে, পর পর তিনটি মৃত্যুর ঘটনাই বিশেষ ধরনের সিসি মাছির কামড়ে ঘটেছে। এ এক নতুন ধরনের সিসি মাছি। কামড়ের পরপরই মানুষ ঘুমে ঢলে পড়ে এবং সে ঘুম আর ভাঙে না। মধ্য আফ্রিকার জলজ অঞ্চলে যে কয় ধরনের সিসি মাছি পাওয়া গেছে, তা থেকে এ মাছির বিষ আলাদা। কিন্তু প্রশ্ন হল আফ্রিকার বাইরে এ মাছি আসতে পারে কি করে?
ল্যাবরেটরি পরীক্ষার এই তথ্য প্রকাশ হওয়ার পর গোটা জেনেভা শহরে আতংক ছড়িয়ে পরছে। অশরীরী ভয়ের একটা কালো ছায়া আচ্ছন্ন করেছে গোটা শহরকে। একটা অদৃশ্য আতংক এসে গ্রাস করেছে গোটা শহরবাসীকে।
খবরটি পড়ে আহমদ মুসাও বিস্মিত হল। সিসি মাছির প্রকৃতি যা, যে আবহাওয়ায় সে বাঁচে, সেদিক থেকে সিসি মাছি সুইজারল্যান্ডে যেতেই পারেনা। তাছাড়া যে সব প্রজাতির সিসি মাছি আবিষ্কৃত হয়েছে, তার বাইরে ঐ সিসি মাছি এল কোথেকে?
মনটা আহমদ মুসার আরও খারাপ হয়ে গেল ওয়ার্ল্ড নিউজ এজেন্সীর একজন শীর্ষস্থানীয় সাংবাদিকের মৃত্যুর খবর শুনে। ওয়ার্ল্ড নিউজ এজেন্সীর একজন শীর্ষস্থানীয় সাংবাদিকের মুল্য অনেক। তাদের একজন কে হারালে সে স্থান পূরণ হওয়া সহজ নয়। আরও একটা দিক আহমদ মুসাকে দারুন ভাবে পীড়া দিল। সেটা হল, সিসি মাছির বিষে মৃত্যুবরণকারী তিনজনই মুসলমান। এটা কেন, কিভাবে সম্ভব হলো?
প্রবল অস্বস্তি জেগে উঠল আহমদ মুসার মনে। তার মনে হতে লাগল, জেনেভা নগরীর তিন এলাকার তিনটি মৃত্যুর সাথে কোথায় যেন একটা যোগ আছে।
অনুসন্ধিৎসু হয়ে উঠল আহমদ মুসা।
নড়ে-চড়ে বসল আহমদ মুসা।
একটু ভাবল, তারপর হাত বাড়াল টেলিফোনের দিকে।
ডায়াল করল ওয়ার্ল্ড নিউজ এজেন্সী (WNA)-এর জেনেভাস্থ হেড অফিসের বিশেষ একটি নম্বরে। নম্বরটি WNA-এর চেয়ারম্যান মিঃ গটেফ-এর।
ও প্রান্ত থেকে মিঃ গটেফ-এর কণ্ঠ ভেসে এল, গুড মর্নিং, আমি গটেফ।
আহমদ মুসা সালাম দিয়ে নিজের পরিচয় দেয়ার পর বলল, ‘কেমন আছেন আপনারা?’
‘ভাল নেই। মনে মনে আপনার কথাই ভাবছিলাম।’
‘কেন? কি হয়েছে?’
‘কিছু শোনেননি আপনি?’
‘আজ এই মাত্র ‘দার ব্লিক’ পড়ে জানতে পারলাম বিশেষ ধরনের সিসি মাছির বিষক্রিয়ায় WNA-এর সিনিয়র সাংবাদিকের মৃত্যুর খবর’
‘সাংবাদিককোথায় একজন তিনজন’
‘তিনজন? অন্য যে দু’জন মারা গেছে তারাও WNA-এর সাংবাদিক?’
‘জি না। প্রথম দুজন ফ্রী ওয়ার্ল্ড টিভি (FWTV)-এর শীর্ষ সাংবাদিক।’
চমকে উঠল আহমদ মুসা। তার হৃদয় যেন প্রচণ্ড এক মোচড় দিয়ে উঠল।
তৎক্ষণাৎ কোন কথা বলতে পারলো না আহমদ মুসা।
কয়েক মুহূর্ত পর নিজেকে সামলে নিয়ে আহমদ মুসা বলল, ‘এমন ঘটনা কিভাবে ঘটল?”
‘পুলিশ কিছু বুঝতে পারছে না। মৃতদের শরীরে প্রচণ্ড শক্তির স্লিপিং পয়জন পাওয়া গেছে। এ স্লিপিং পয়জনের সাথে সিসি মাছির স্লিপিং পয়জনের মিল আছে। কিন্তু কোন ধরনের সিসি মাছির বিষই এমন প্রচণ্ড নয় যে, শরীরে প্রবেশের কয়েক ঘণ্টার মধ্যে ঘুমকে মৃত্যুতে রূপান্তরিত করবে।’
‘তাহলে কি ভাবছে পুলিশ?”
‘তারা ভাবছে, বিশেষ সিসি মাছি বা কোন নতুন ধরনের বিষাক্ত পোকার কামড়ে তাদের মৃত্যু হয়েছে।’
‘এটা কি নিশ্চিত?”
‘মৃতদের দেহ পরীক্ষায় তাদের দেহ মাছি বা পোকার কামড়ের চিহ্ন পাওয়া গেছে। পরীক্ষায় আরও প্রমানিত হয়েছে, কামড়গুলো জীবন্ত কোন মাছি বা পোকার। সুতরাং বিষয়টা নিশ্চিতই।’
‘কিন্তু বিশেষ ঐ সিসি মাছি বা নতুন ধরনের পকা এল কত্থেকে?’
‘এর জবাব বিশেষজ্ঞরা দিতে পারছেন না। মারাত্মক আতংক ছড়িয়ে পড়েছে জেনেভায়। অনেকেই জেনেভা থেকে পালাচ্ছেন।’
‘কিন্তু মৃত তিনজনই সাংবাদিক কেন, দু’টি বিশেষ সংস্থার কেন এবং তিনজনই মুসলিম কেন?’
‘হতে পারে এটা ঘটনার আশ্চর্যজনক এক সাযুজ্যতা’
‘হতে পারে। তাহলে কি মৃত্যুগুলোকে পুলিশ অস্বাভাবিক মাছি বা পোকার দ্বারা সংঘটিত ও স্বাভাবিক বলেই ধরে নিচ্ছে?’
‘স্যরি, একটু ধরুন জনাব। ইন্টারকম কথা বলছে শুনে নেই।’ ওপার থেকে বলল গটেফ।
ইন্টারকমের কথা টেলিফোনের মাধ্যমে আহমদ মুসা স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছিল।
শুনতে শুনতে উদ্বেগের ছায়া নামল আহমদ মুসার চোখে-মুখে।
ইন্টারকমে WNA-এর ম্যানেজিং এডিটর চেয়ারম্যানকে জানাচ্ছিল, এইমাত্র টেলিফোনে জানালেন (FWTV)-এর নির্বাহী পরিচালক আলাদিন উইলিয়াম মারা গেছে। পুলিশের প্রাথমিক বক্তব্যে বলা হয়েছে, রহস্যজনক ঐ মাছি বা পোকার ভয়ংকর স্লীপিং বিষেই তার মৃত্যু হয়েছে……।’
আরও অনেক কথাই ইন্টারকম থেকে টেলিফোনে ভেসে এসেছিল আহমদ মুসার কানেও প্রবেশ করছিল। কিন্তু আহমদ মুসা অন্য ভাবনায় তখন ডুবে গিয়েছিল।
প্রথমে প্রচণ্ড আঘাতে মুষড়ে পড়েছিল তার হৃদয়টা। আলাদিন উইলিয়াম কে সে জানে। যারা FWTV-কে গড়ে তুলেছে এবং জনপ্রিয় টিভি নেটওয়ার্ক হিসেবে বর্তমান পর্যায়ে একে নিয়ে এসেছে, আলাদিন উইলিয়াম তাদের একজন।
প্রাথমিক আঘাতটা সামলে নেবার পর আহমদ মুসার মনে যে কথাটা বড় হয়ে উঠল তা হলো, অর্থ কি এসব ঘটনার? এই চতুর্থ ঘটনাকেও কি ‘কো-ইন্সিডেন্স’ বলতে হবে?
আহমদ মুসার চিন্তা বাধাগ্রস্থ হল মিঃ গটেফ এর কণ্ঠে। বলছিল মিঃ গটেফ, ‘স্যরি জনাব আপনাকে কষ্ট দিয়েছি। ইন্টারকমের সব কথা আপনি শুনেছেন নিশ্চয়। বুক আমার কাঁপছে খবর শুনে। আমার ভয় হচ্ছে, সাংঘাতিক ঐ সিসি মাছি বা পোকা আমাদের অফিস দু’টির আশে-পাশে কোথাও কনভাবে বাসা বেধেছে কিনা।’
‘বিষয়টা খতিয়ে দেখেননি?’
‘দেখেছি, আমাদের দু’টি অফিসের প্রতিটি ইঞ্চি জায়গা এবং আশে-পাশের স্থান আমরা পরীক্ষা করেছি, সন্দেহজনক কিছুই মেলেনি।’
‘তাহলে আবার সন্দেহ করছেন কেন?’
‘কারন রহস্যজনক মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে আমাদের দু’অফিস থেকেই এবং অফিস দুটি পাশাপাশি।’
‘এই বিষয়টা নিয়ে পুলিশ ভাবছে না?’
‘অফিসে কেউ মারা যায়নি। যে চারজন মারা গেল তারা শহরের চার এলাকার। পুলিশ এক’বা দুই অফিসের হওয়ার বিষয়টাকে বিস্ময়কর কো-ইন্সিডেন্স মনে করছে। আমরাও তাই মনে করছি।’
আহমদ মুসা মুহূর্তকাল ভাবল। তারপর বলল, ‘জনাব আমি জেনেভা আসছি। আমার পরিচয় হবে আমি আপনার WNA-এর একজন সাংবাদিক। আপনাদের দেয়া ইন্টারন্যাশনাল এ্যাক্রডিটেশন কার্ড ব্যাবহার করব। আপনি দয়া করে আপনাদের নাইরোবি ব্যুরোকে বলে দিন তারা যেন কোন এয়ার লাইন্সকে বলে ইউরোপগামী কোন টিকিটের ব্যাবস্থা করে দেয়। আজকের হলে ভাল হয়, না হলে কাল সকালের জন্যে অবশ্যই।’
‘আলহামদুলিল্লাহ। আমার বুক ভরে গেল এ খবরে। এ বিপদে আশেপাশে আপনি থাকলে সাহস পাব। কিন্তু মানুষ যখন জেনেভা ছাড়ছে, তখন আপনার আসা কি ঠিক হবে?’
‘এসব আলোচনার সময় এখন নেই মিঃ গটেফ। আপনি এখনি যোগাযোগ করুন নাইরোবির সাথে।’
‘এত তাড়াতাড়ি ভিসার ব্যাবস্থা আপনি করতে পারবেন?’
‘আল্লাহর শুকরিয়া। আমি ফ্রান্সে থাকতে সুইজারল্যান্ডে যাব বলে ভিসা নিয়েছিলাম। মাল্টিপুল ভিসা। এখনও ভ্যালিড আছে।
‘ঠিক আছে। আমি এখনি নাইরোবি টে বলে দিচ্ছি।‘
‘শুকরিয়া’ বলে সালাম দিয়ে টেলিফোন ছেড়ে দিল আহমদ মুসা।
রাত দশটায় বারবারেতি বিমান বন্দরে প্যান আফ্রিকান ইয়ার লাইন্স-এর এক্তি বিমানে উঠে বসল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসা জেনেভায় কথা বলার দুঘণ্টা পরেই নাইরোবি থেকে টেলিফোন পেয়েছিল। নাইরোবি থেকে বলেছিল, রাত দশটায় প্যান আফ্রিকান এয়ার লাইন্স আহমদ মুসাকে নাইরোবি নিয়ে আসবে।
খার্তুমে আধ ঘণ্টার বিরতির পর এই বিমানই তাদের নিয়ে যাবে জেনেভায়।
বিমানের দরজা বন্ধ হয়ে গেল।
এখনি বিমান ছাড়বে মধ্য আফ্রিকা প্রজাতন্ত্রের মাটি। হঠাৎ মনটা খারাপ হয়ে উঠল আহমদ মুসার ব্ল্যাক বুলদের জন্যে।
আহমদ মুসা জানালা দিয়ে তাকাল গ্যাংওয়ের দিকে। দেখল ব্ল্যাক বুল এবং জাগুয়াস ম্যাকা এখনও দাঁড়িয়ে আছে পাশাপাশি। ব্ল্যাক বুলের কান্না থেমেছে কি?
আহমদ মুসার চলে আসার আকস্মিক খবরে শিশুর মত কেঁদেছে ব্ল্যাক বুল। বলেছে, ‘আমি মানুষ ছিলাম না, আমাকে মানুষ বানিয়েছেন এবং সুন্দর জীবনে ফিরিয়ে এনেছেন আপনি। আল্লাহর ইচ্ছায় এটা হয়েছে, কিন্তু কাজ আপনি করেছেন। আপনি চলে যাবেন, আপনাকে আর দেখব না, এটা ভাবতে পারছি না।’
জাগুয়াস ম্যাকাও কেঁদেছে।
আহমদ মুসাও কম ব্যাথা পায়নি।
গভীর অরন্য বেষ্টিত আফ্রিকার এ দুর্গম বুকের সরল সহজ মানুষগুলোর প্রতি কি এক অপরিচিত মায়া সৃষ্টি হয়েছিল আহমদ মুসার। কিন্তু তাদের না ছেড়ে উপায় কি। দায়িত্বের ডাক সে অস্বীকার করবে কেমন করে!
নড়ে উঠল বিমান। চলতে শুরু করল।
চোখের আড়াল হয়ে গেল জাগুয়াস ম্যাকা এবং ব্ল্যাক বুলের দাঁড়িয়ে থাকার দৃশ্য।
আকাশে উড়ল বিমানটি।
ছুটে চলল গন্তব্যের লক্ষ্যে।
সিট বেল্ট খুলে আহমদ মুসা শরীরটা এলিয়ে দিল সিটের উপর।
সবে চোখ ধরে এসেছিল আহমদ মুসার। পাশ থেকে ‘জোসেফাইন’ ডাক শুনে চোখ খুলে পাশে ফিরে তাকাল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসার পাশেই একজন শ্বেতাঙ্গ বালিকা বসে। তার পাশে একজন মধ্যবয়সী মহিলা। আহমদ মুসা বালিকাকে ঐ ডাকে সাড়া দিতে দেখে বুঝল, বালিকাটির নাম জোসেফাইন।
আহমদ মুসা মুখ ঘুরিয়ে নিল।
মনে পড়ে গেল মারিয়া জোসেফাইন (ডোনা জোসেফাইন) এর কথা।
সঙ্গে সঙ্গেই আহমদ মুসার হৃদয়ে বেদনার এক উষ্ণ স্রোত বয়ে গেল।
সুইজারল্যান্ডে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়ার পর আহমদ মুসা টেলিফোন করেছিল ইয়াউন্ডিতে রাশিদী ইয়েসুগোর বাড়িতে। ডোনাই টেলিফোন ধরেছিল। প্রথমে দ্বিধায় পড়েছিল আহমদ মুসা। খারাপ লাগছিল তার সুইজারল্যান্ডে যাওয়ার কথা ডোনাকে বলতে। বিয়ের আসন থেকে সে উঠে এসেছিল। ক্যামেরুনে ডোনাদের কাছে আবার ফিরে যাবে, এটাই কথা ছিল। সবাই আশা করেছিল তাদের বিয়েটা ওখানেই হবে। টা তো হচ্ছে না। উপরন্তু কারও সাথে দেখা না করে, ডোনাদের ওখানে ফেলে রেখেই তাকে চলে যেতে হচ্ছে সুইজারল্যান্ডে। একথা ডোনাকে বলতে কষ্ট হচ্ছে তার।
তবু কঠোর কথাটা আহমদ মুসা বলেছিল ডোনাকে।
আনন্দে নেচে ওঠা এক বালিকার মত টেলিফোন ধরেছিল ডোনা।
কিন্তু আহমদ মুসার কথা শোনার পর সে নীরব হয়ে গিয়েছিল। সঙ্গে সঙ্গে সে কথা বলতে পারেনি।
কিছু পরে শুকনো কণ্ঠে ডোনা বলেছিল, ‘তোমার কণ্ঠ শুনে মন হচ্ছে তুমি যেন অপরাধ করেছ।’
‘অপরাধ হয়ত করিনি, কিন্তু সব কিছু লন্ড-ভণ্ড করে দিলাম এটা তো ঠিক।’ বলেছিল আহমদ মুসা।
শুকনো কণ্ঠে একটা শুকনো হাসি ফুটে উঠেছিল ডোনার। বলেছিল, ‘সাজানো ছক মত তোমার জীবন কখনও কি চলেছে?’
‘তার জন্যে দুঃখ নেই। কিন্তু তোমার জীবনকেও লন্ড-ভণ্ড করে দিলাম।’
‘এজন্যে দুঃখ হচ্ছে বুঝি?’
‘সেটা কি অস্বাভাবিক?’
‘তাহলে তুমি নিজের জন্যে যা পছন্দ কর, আমার জন্যে তা পছন্দ করনা?’
‘সবার আমি ভাল চাই, সবার মুখে চাই আমি হাসি দেখতে। এই আকাঙ্ক্ষা তোমার ক্ষেত্রে কি আরও বেশী হওয়া উচিত নয়?’
হেসে ফেলেছিল ডোনা। বলেছিল, ‘তুমি কথারও রাজা। পারবোনা তোমার সাথে। এখন বল, ‘আমার প্রতি তোমার নির্দেশ কি?’
আহমদ মুসা তৎক্ষণাৎ কোন উত্তর দিতে পারেনি। হৃদয়ে একটা খোঁচা লেগেছিল তার। ডোনা তার আব্বাকে নিয়ে আহমদ মুসার জন্যেই ছুটে এসেছিল ফ্রান্স থেকে সুদূর ক্যামেরুনে। কি নির্দেশ এখন দেবে তাকে? বলবে যে, যেমন একা এসেছিলে, তেমনিভাবে ফিরে যাও!
ভারি মনে আহমদ মুসা বলেছিল, ‘তোমার প্রতি আস্থা আমার দুর্বল নয়, কোন নির্দেশ আমার নেই।’
‘জানি তুমি এড়িয়ে যাচ্ছ।’
একটু থামল ডোনা। থেমেই আবার শুরু করল, ‘আমি কিন্তু সুইজারল্যান্ডে আসব।’
‘না ডোনা, ঐ আতঙ্কের মধ্যে তুমি এসো না।’ নরম কণ্ঠে বলেছিল আহমদ মুসা।
‘বেশ ভাল কথা। তুমি আতঙ্কের সমুদ্রে ঝাঁপ দেবে, আর আমি নিজেকে রক্ষার জন্যে দূরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখব। তা আমি পারবো না।’
‘ঠিক আছে। একটা কথা দাও, আমার টেলিফোন পাওয়ার আগে যাবে না।’
‘তোমার শর্তের পেছনে যুক্তি কি আছে?”
‘একটাই যুক্তি, আমার টেলিফোন না পেলে আমার ঠিকানা পাবে কি করে?’
হেসেছিল ডোনা। বলল, ‘ধন্যবাদ, ভালো যুক্তি দিয়েছ। তবে এটাই একমাত্র এবং আসল যুক্তি নয়। যাক। আমি তোমার টেলিফোনের অপেক্ষা করব। তবে সেটা আমাদের প্যারিস পৌছার পর তিন দিন মাত্র।’
হেসেছিল আহমদ মুসা। বলেছিল, ‘আমার ঠিকানা না জানলে আমাকে খুঁজে পাবে কি করে?’
‘ক্যামেরুনে তোমাকে খুঁজে পাইনি? জেনেভায় তো বিষয়টা আমার জন্যে খুবই সহজ হবে।’
‘কেমন করে?’
‘জেনেভায় FWTV অথবা WNA-এর অফিসে গেলেই তোমার সাথে যোগাযোগ হয়ে যাবে।’
হেসেছিল আহমদ মুসা। বলেছিল, ‘ধন্যবাদ ডোনা। তোমার বুদ্ধির প্রশংসা করছি।’
কথা শেষ করে আহমদ মুসা একটু থেমেই আবার বলেছিল, ‘বিদায় দাও ডোনা, এখনি আমাকে ছুটতে হবে। সবাইকে আমার সালাম দিও। আর মাফ করতে বলো।’
‘বিদায়’ কথাটা ফিরিয়ে নাও। বল, ‘আসি।’
‘ফিরিয়ে নিলাম ‘আসি’, ঠিক আছে?’
সত্যি আজ খুব কষ্ট লাগছে। প্রত্যাশা বোধহয় খুব বেশী করেছিলাম। ভারী হয়ে ওঠা গলা কেঁপে উঠেছিল ডোনার।
‘আমি দুঃখিত ডোনা।’
‘আমাকে তুমি মাফ করো। একটা বড় কাজে যাবার সময় তোমাকে কষ্ট দিলাম।’ বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে বলেছিল ডোনা।
তারপর সালাম দিয়ে টেলিফোন রেখে দিয়েছিল।
টেলিফোন রেখে আহমদ মুসা কিছুক্ষন ঠায় বসেছিল। বুঝতে পারছিল আহমদ মুসা, ডোনা এখন নিশ্চয় কাঁদছে।
প্লেনের সিটে হেলান দিয়ে বসা আহমদ মুসার চোখের সামনে অশ্রু সজল ডোনার সেই মুখটাই ভেসে উঠছিল।
আনমনা হয়ে পড়ল আহমদ মুসা।
এয়ার হোস্টেজ-এর ‘এক্সকিউজ মি’ শব্দে সম্বিত ফিরে পেয়ে তাকাল আহমদ মুসা। দেখল, নাস্তা এসেছে।
প্লেনের একটা পাশের তিন সিটের শুরুতেই আহমদ মুসার সিট। তারপর বালিকাটির। বালিকার পর শেষ প্রান্তের সিটটা তার মায়ের।
বালিকাটি তার নাস্তার বাক্স খুলতে গিয়ে বাক্সটি ফেলে দিল নিচে। আহমদ মুসার ট্রের পাশ দিয়েই পড়ে গেল।
আহমদ মুসা ঝুকে পড়ে টিফিন বাক্সটি তুলে বালিকাটির ট্রের উপর রেখে বলল, ‘আমি সাহায্য করতে পারি?’
বালিকাটি মুখ তুলে তাকাল। কিন্তু কিছু বলল না।
আহমদ মুসা তার টিফিন বাক্সটি খুলে সুন্দর করে সাজিয়ে দিল।
‘ধন্যবাদ’ বলল মহিলাটি।
‘ধন্যবাদ’ বলল জার্মান ভাষায় বালিকাটি।
‘ওয়েলকাম গুড গার্ল। তোমার বাড়ি নিশ্চয় জার্মানিতে নয়’
‘ঠিক। আমরা সুইজারল্যান্ডের।’ বলল, বালিকাটি।
‘আমি মিসেস জিনা ডোনাল্ট। সাহায্যের জন্যে আপনাকে ধন্যবাদ। আপনি নিশ্চয় জার্মান ভাষা ভালো জানেন?’
‘নামমাত্র জানি। তবে শুনেছি অনেক। তাই পার্থক্যটা ধরতে পারি।’
‘ধন্যবাদ।’ বলে আহমদ মুসা সোজা হয়ে বসতেই একটা কর্কশ শব্দে চমকে উঠে সামনে তাকাল। দেখল, ককপিটের সামনে টয়লেট ও সার্ভিস কেবিনের মাঝখানে করিডোরের মুখে রিভলবার হাতে একজন দাঁড়িয়ে। বলছে লোকটি চিৎকার করে। ‘ককপিট আমরা দখল করে নিয়েছি। প্লেন এখন আমাদের নির্দেশে চলছে। সন্দেহজনক কেউ কিছু করলে তখনই তাকে হত্যা করা হবে এবং বিমান উড়িয়ে দেয়া হবে।’
তার কথাগুলো বাজলো যেন মৃত্যু ঘণ্টার মত। আতঙ্কের এক প্রবল ঢেউ খেলে গেল বিমানের কেবিনে। মুহূর্তে মানুষের চেহারা পাল্টে গেল। মৃত্যুর আতঙ্ক তাদের চোখ-মুখ থেকে ঠিকরে পড়ছে।
প্রাথমিক আতঙ্কের পর সব বোধগম্য হলে কান্না শুরু করে দিল কেউ কেউ।
আহমদ মুসা পাথরের মত বসে। তার স্থির দৃষ্টি রিভলবারধারী লোকটির প্রতি নিবদ্ধ। লোকটি শ্বেতাঙ্গ।
পাশের বালিকা জোসেফাইন কেঁদে উঠেছিল। আহমদ মুসা সেদিকে তাকাল। তার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, ‘কেদনা।’ ভয় নেই। কাঁদলে, ভয় করলে ওরা আরও সাহস পায়।’
বালিকাটির মা’র চেহারা রক্তশুন্য। পাথর হয়ে গেছে ভয়ে। মেয়েকে কিছু বলার শক্তিও যেন তার নেই।
আহমদ মুসা আবার দৃষ্টি ফেরাল রিভলবারধারী লোকটির দিকে।
লোকটির হাতে শুধু একটি রিভলবার। অন্য হাতটি খালি। আর লোকটির দেহের গঠন, চোখ-মুখের চেহারা এবং দাড়ানোর ভংগি দেখে তাকে কোন প্রফেশনাল মনে হল না।
হাইজ্যাকাররা কয়জন? আপাতত দু’জন মনে হচ্ছে। একজন সে আরেকজন ককপিটে। দেখতে হবে আরও লোক আছে কিনা ওদের।
কেন ওরা বিমান হাইজ্যাক করল? কি দাবী ওদের?
আহমদ মুসা দেখল, রিভলবারধারী লোকটি, পিছু হটে ককপিটের দিকে চলে গেল।
অল্প পরেই ফিরে এল। কিন্তু সেই লোকটি নয়। আরেকজন। তার হাতেও রিভলবার।
আহমদ মুসা বুঝল, এই লোকটিই এতক্ষন ককপিটে পাইলটদের পাহারা দিয়েছে। দ্বিতীয় লোকটি গিয়ে এই দায়িত্ব নেয়ার পর সে বেরিয়ে এসেছে।
আহমদ মুসার কোন সন্দেহ রইল না, হাইজ্যাকাররা মাত্র দু’জন।
প্লেনের মাইক্রোফোন কথা বলে উঠল এ সময়। ককপিটে চলে যাওয়া দ্বিতীয় লোকটির গলা। বলল, ‘ভদ্র মহিলা ও ভদ্র মহোদয়গন, প্লেন এবং প্লেনের সকল যাত্রী আমাদের পণবন্দী। প্লেন দক্ষিণ সুদানের জুবা বিমান বন্দরে ল্যান্ড করবে। দক্ষিন সুদান থেকে খার্তুম সরকারের সৈন্য প্রত্যাহার বা প্রত্যাহারের আন্তর্জাতিক অঙ্গীকার না হওয়া পর্যন্ত বিমান ও বিমানের যাত্রী আমাদের পনবন্দী থাকবে। আমরা ৪৮ ঘণ্টা সময় দিয়েছি। এর মধ্যে আমাদের দাবী না মানলে যাত্রী সমেত প্লেন ধ্বংস করা হবে। সুদান পিপলস লিবারেশন আর্মি (SPLA) চাচ্ছে, তাদের ন্যায্য দাবী মেনে নিলে যাত্রীদের জীবন বাঁচানো হবে।’ কথা থেমে গেল।
আহমদ মুসার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেল ব্যাপারটা।
মুসলিম রাষ্ট্র সুদানের খৃষ্টান বিদ্রোহী গ্রুপের গেরিলা অংশ SPLA এই বিমান টি হাইজ্যাক করেছে। তারা চাচ্ছে সমগ্র দক্ষিন সুদান থেকে সুদান সরকারের অর্থাৎ মুসলিম সৈন্য প্রত্যাহার করা হোক। যাতে তারা দক্ষিন সুদানকে বিচ্ছিন্ন করে পৃথক খৃষ্টান রাষ্ট্রের পত্তন করতে পারে।
সুদানের বিদ্রোহী খৃষ্টান গ্রুপের এই ভুমিকা একেবারেই অন্যায়। সুদানে মুসলিমদের সংখ্যা শতকরা ৮০ ভাগেরও বেশী। অবশিষ্ট মানুষের শতকরা ৫ ভাগ খৃষ্টান। এরাই চেষ্টা করছে দেশের দক্ষিণাংশ কে বিচ্ছিন্ন করতে। এক্ষেত্রে SPLA-এর ভুমিকাই মুখ্য।
সেই ভুমিকারই অংশ হিসেবে তারা আজ এক জঘন্য পথে পা বাড়িয়েছে। পনবন্দী করেছে প্রায় দু’শ নারী-পুরুষ ও শিশুকে। তাদের অসম্ভব দাবী নিশ্চয় পূরণ হবার নয়। সুতরাং এই দু’শ মানুষের জীবন বিপন্নই বলা যায়।
আহমদ মুসা আবার চোখ বুলাল পাশের বালিকার দিকে, চোখ পড়ল তার মায়ের দিকেও। তাদের চোখে-মুখে মৃত্যুর পাণ্ডুরতা।
সকলের একই অবস্থা।
আহমদ মুসা সিটে হেলান দিয়ে চোখ বুজল। করণীয় কি? অনেক রকম চিন্তা ভিড় জমাল তার মনে।
মাইক্রোফোনের মাধ্যমে ভেসে আসা কোথায় ছেদ নামল আহমদ মুসার চিন্তায়।
কণ্ঠ থেকে বুঝল, আগের লোকটিই কথা বলছে। সে বলছিল, একজন ভদ্র মহোদয় কিংবা ভদ্র মহিলাকে ককপিটে আসার জন্যে আহ্বান করছি। তাকে গ্রাউন্ড কন্ট্রোলের সাথে যাত্রীদের পক্ষ থেকে আমরা যা বলব সেইভাবে কথা বলতে হবে। কথা শেষ করার পরেই চলে আসুন।‘’
মাইক্রোফোনের কণ্ঠ থেমে গেল।
চারদিকে পিনপতন নীরবতা।
সবাই একে অপরের দিকে তাকাচ্ছে। কারও উঠার লক্ষন নেই।
চারদিকে একবার তাকিয়ে আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল। মনে মনে আল্লহর শুকরিয়া আদায় করল আহমদ মুসা। হাইজ্যাকারদের নিকটবর্তী হবার একটা সুযোগ আল্লাহ করে দিলেন।
উঠে দাঁড়িয়ে ককপিটের দিকে হাঁটতে শুরু করল আহমদ মুসা।
ককপিটের সামনে টয়লেট ও সার্ভিস কেবিনের মাঝের করিডোরের মুখে যে রিভলবারধারী দাঁড়িয়েছিল, সে আহমদ মুসাকে তার দিকে ডাকল।
যাত্রীদের সবার উদ্বেগ দৃষ্টি আহমদ মুসার দিকে।
আহমদ মুসা গিয়ে তার সামনে দাঁড়াল।
‘দু হাত উপরে তুলুন।’ কর্কশ কণ্ঠে লোকটি বলল।
আহমদ মুসা কনুই ভেঙে দু’হাত উপরে তুলল। তাতে কনুই পর্যন্ত দু’বাহু কাঁধের সমান্তরালে থাকল।
লোকটি ডান হাতে রিভলবার ধরে অন্য হাত দিয়ে আহমদ মুসাকে সার্চ করতে লাগল। সম্ভবত সে নিশ্চিত হতে চায় আহমদ মুসার কাছে কোন অস্ত্র নেই।
সুযোগের অপেক্ষায় ছিল আহমদ মুসা।
সার্চ করার জন্যে লোকটি যখন তার মাথাটা কিছুটা নিচের দিকে বাঁকিয়েছিল, তখনি আহমদ মুসার বাম হাত লোকটির রিভলবার ধরা হাতটি বাম পাশে ঠেলে দিল এবং সঙ্গে সঙ্গেই ডান হাতটির প্রচণ্ড কারাত দিয়ে আঘাত করল লোকটির কানের নিচের নরম যায়গাটায়।
হাত থেকে রিভলবার পড়ে গেল লোকটির। তারপর দু’একবার টলে উঠে সংগা হারিয়ে পড়ে গেল প্লেনের মেঝেয়।
আহমদ মুসা দ্রুত রিভলবারটি হাতে তুলে নিয়ে মুহূর্তের জন্যে যাত্রীদের দিকে ফিরে দাঁড়িয়ে তর্জনী ঠোঁটে ঠেকিয়ে ইংগিতে সবাইকে নীরব থাকতে বলে রিভলবারটা পকেটে ফেলে স্বাভাবিক গতিতে এগুল ককপিটের দিকে।
যাত্রীদের তখন শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা। আহমদ মুসা পাশের সিটের জোসেফাইনের মা মহিলাটি ভয়ে দু’হাত দিয়ে মুখ ঢেকেছে। এয়ার হোস্টেস ও সার্ভিস ম্যানরা যে যেখানে দাঁড়িয়েছিল, বসে পড়েছে প্লেনের মেঝেতে।
আহমদ মুসা ককপিটের দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকল।
পাইলটের মাথায় রিভলবারের নল ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটি মাথা ঘুরিয়ে পেছনে তাকাল। বলল, ‘আসুন, অয়্যারল্যাসে কথা বলুন। একটিই কথা বলবেন, জুবা বিমানবন্দরে নামতে না দিলে ওরা বিমান ধ্বংস করে দেবে। সুতরাং দু’শ মানুষের স্বার্থে বিমানকে জুবা বিমানবন্দরে নামতে দেয়ার অনুরোধ করছি।’
বলে সে নড়ে উঠল আহমদ মুসাকে এগুবার জায়গা করে দেবার জন্য। তার রিভলবার ধরা হাতটা সরে গিয়েছিল পাইলটের মাথা থেকে।
আহমদ মুসা এ সুযোগ হাতছারা করল না। ডান হাত দিয়ে লোকটির রিভলবার ধরা ডান হাতে আঘাত করল এবং সেই সাথে সাথেই বাম হাতে বাম পকেট থেকে রিভলবার বের করে একেবারে লোকটির মাথায় ঠেকিয়ে গুলী করল।
চোখের পলকে ঘটে গেল ঘটনা।
যেখানে দাঁড়িয়েছিল, সেখানেই লাশ হয়ে পড়ে গেল হাইজ্যাকারের দেহ।
ঘটনার আকস্মিকতায় পাইলট দু’জন বিমূঢ় হয় পড়েছিল। সম্বিত ফিরে পেয়ে তারা চিৎকার করে ধন্যবাদ জানাল আহমদ মুসাকে।
এ সময় এয়ার হোস্টেস এবং ক্রুরাও এসে দাঁড়িয়েছিল। তারাও আনন্দে চিৎকার করে উঠল।
কয়েকজন ছুটে গেল যাত্রীদের কাছে। চিৎকার করে তারা ঘোষণা করল, ‘যাত্রী যুবকটি হাইজ্যাকারকে হত্যা করে বিমানকে মুক্ত করেছে, মুক্ত করেছে।’
সকল যাত্রীও আনন্দে চিৎকার করে উঠল। সমবেত কণ্ঠে ইশ্বরকে ধন্যবাদ দিল।
আহমদ মুসা বেরিয়ে এল ককপিট থেকে। তাকে ঘিরে ছিল এয়ার হোস্টেস ও ক্রুরা।
এ সময় কেবিন মাইক্রোফোনে ধ্বনিত হল ক্যাপ্টেনের কণ্ঠ। বলল, ‘ভদ্র মহিলা ও ভদ্র মহোদয়গণ ইশ্বরকে ধন্যবাদ একজন যুবকের অসীম সাহসিকতায় বিমান মুক্ত হয়েছে। যুবকটি একজন হাইজ্যাকারকে পরাভুত এবং অন্যজনকে হত্যা করে বিমান ও যাত্রীদেরকে মুক্ত করেছেন। তাকে অশেষ ধন্যবাদ। এখন বিমান তার রুটে ফিরে এসেছে এবং গন্তব্যের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। সকলের যাত্রা শুভ হোক।’
যাত্রীরা সবাই উঠে দাঁড়িয়ে হাত নেড়ে নানাভাবে আহমদ মুসাকে কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছে।
খুবই বিব্রত বোধ করল আহমদ মুসা। তার সিটের সামনে এসে দু’হাত তুলে সবার দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করে বলল, ‘ভদ্র মহিলা ও ভদ্র মহোদয়গণ, অনুগ্রহ করে আমাকে লজ্জা দেবেন না। আমি বড় কিংবা অস্বাভাবিক কিছু করিনি। আপনারাও এগিয়ে গেলে এটাই করতেন। সকলকে ধন্যবাদ।’
সিটে বসে পড়ল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসা বসতেই বালিকাটি বলল, ‘ধন্যবাদ আপনাকে। আপনার খুব সাহস। দু’জন হাইজ্যাকার মেরেছেন।’
‘মানুষ মারা কি ভাল?’
ওরা তো ভাল মানুষ নয়।’
‘ওরা মানুষ ঠিকই, তবে ওদের কাজ ভাল নয়।’
বালিকাটি তৎক্ষণাৎ কিছু বলল না। বোধ হয় কথা খুঁজছিল।
এই ফাঁকে বালিকাটির মা বলে উঠল, ‘মাফ করবেন, আপনাকে কংগ্রাচুলেশন।’ বলে একটু থেমে আবার সে বলল, ‘কাজ খারাপ হলে মানুষও খারাপ হয় নাকি?’
আহমদ মুসা হাসল। বলল, ‘ঠিক। তবে পাপ এবং পাপী এক জিনিস নয়।’
‘কারণ।’
‘কারণ পাপ সব সময়েই খারাপ। কিন্তু পাপী সব সময় খারাপ থাকে না, সে ভালও হয়ে যেতে পারে।’
মহিলা কথা বলল না উত্তরে। তার চোখে-মুখে বিস্ময়। একটু সময় নিয়ে বলল, ‘আপনি মি…।’
‘আব্দুল্লাহ।’
‘মিঃ আব্দুল্লাহ, আপনি কি পেশায় শিক্ষক?’
‘পাসপোর্টে পরিষ্কার উল্লেখ আছে, আমি সাংবাদিক। শিক্ষক হওয়ার কথা বলছেন কেন?’
‘আপনি যে তত্ত্বকথা বলেছেন, তা একজন শিক্ষকের মুখেই মানায়।’
একটু থেমেই মহিলাটি আবার শুরু করল, সে যাক। আপনাকে আবারো ধন্যবাদ। আপনি যা করেছেন, কোন প্রশংসা দিয়েই তার ঋণ শোধ হবে না। আমার বিশ্বাস এয়ার লাইন্স কর্তৃপক্ষ আপনার অমুল্য কাজের বিষয়টা বিবেচনা করবে।
কথা আর সামনে এগুলো না।
ট্রে ঠেলে নাস্তা নিয়ে এসে দাঁড়াল এয়ার হোস্টেসরা।
আহমদ মুসা নড়ে-চড়ে বসল।
‘স্যার লাইন্স যাত্রীদের বিশেষ শুভেচ্ছা ড্রিঙ্ক সরবরাহ করছে’
‘ধন্যবাদ আমি ড্রিঙ্ক করিনা।’
‘আপনি মদ খান না, কিন্তু অন্য কোন ধরনের সফট ড্রিঙ্কস কিংবা কোন ধরনের জুস আপনি পছন্দ করবেন?’ একজন এয়ার হোস্টেস মাথা নুইয়ে অত্যন্ত সম্মানের সাথে জিজ্ঞেশ করল।
আহমদ মুসা একটু হাসল। সময়ের পরিবর্তনে সে এখন স্যার হয়ে গেছে। বলল, ‘ধন্যবাদ। নাস্তার সাথে ঠাণ্ডা পানি আর কিছু নয়।’
নাস্তা পরিবেশিত হলো।
আহমদ মুসা বিস্মিত হলো, মহিলাটি মদ নিল না। সে এবং বালিকা দু’জনেই কোক খেল।
‘মাফ করবেন ম্যাডাম, আমি অসুবিধা করলাম কি?’ সপ্রভিত কণ্ঠে বলল আহমদ মুসা মহিলাটিকে।
‘না না। আমি বরং আনন্দিত যে, একজন ভাল মানুষকে সম্মান দেখাতে মদ না খাওয়ার এই ঘটনা আমার চির দিন মনে থাকবে।’
আহমদ মুসা এ প্রসংগ এড়িয়ে বলল, ‘ম্যাডাম, একটা প্রশ্ন আমি জিজ্ঞেস করতে পারি?’
‘অবশ্যই।’
‘আপনার কোথায় দু’একটা রুশ শব্দ আসছে কেন?’
‘ও’ বলে মহিলাটি হাসল। বলল, আমার স্বামী একজন কূটনীতিক। দীর্ঘদিন তিনি মস্কোতে সুইজারল্যান্ডের কুটনীতিক ছিলেন। আমরা তার সাথে ছিলাম। রুশ ভাষায় অনুপ্রবেশ তারই ফল বলতে পারেন।’
কথা শেষ করেই মহিলাটি আবার বলল, ‘আপনি রুশ ভাষাও জানেন দেখছি।’
‘কিছু জানি।’
নাস্তার পর এল বিশ্রাম পর্ব।
আলো নিভে গেল।
আবছা অন্ধকারে ঢেকে গেল কেবিন।
আহমদ মুসা পাশের বালিকা জোসেফাইনকে ‘গুড নাইট গুড গার্ল’ বলে সিটে গা এলিয়ে দিল।
চোখ দুটি তার ধীরে ধীরে বুজে এল।