২২. অদৃশ্য আতঙ্ক

চ্যাপ্টার

জেনেভার মধ্য দিয়ে বয়ে যাওয়া রণ নদীর দক্ষিন তীরের কিছুটা দূরে বিশাল দশ তলা ভবনের আট তলার একটা অফিস ফ্ল্যাট।
জেনেভায় ব্ল্যাক-ক্রস এর লিয়াজো অফিস।
ব্ল্যাক ক্রস এর প্রধান সাইরাস শিরাক এইমাত্র এসে পৌঁছেছেন এখানে। অফিসে উৎসবের আমেজ।
ব্ল্যাক ক্রসের জেনেভা অফিস তার লক্ষ্য অর্জনে দারুন সাফল্য অর্জন করেছে। ইতিমধ্যেই WNA এবং FWTV সংবাদ সংস্থা দু’টির ৬জন গুরুত্বপূর্ণ সাংবাদিক মরেছে। মিশন চলছে একদম নিরাপদেই। সাফল্যের আনন্দ ভোগ করার জন্য স্বয়ং সাইরাস শিরাক আজ জেনেভা এসেছেন।
তার আগমন উপলক্ষে সেই কাক ডাকা ভোরেই সবাই গিয়ে বসেছে মিটিং রুমে।
প্রথমেই কথা বলল সাইরাস শিরাক, ‘এ পর্যন্ত সাফল্যের জন্য আপনাদের ধন্যবাদ। এখনকার পরিবেশ কেমন?’
সাইরাস শিরাকের সামনে টেবিল ঘিরে বসে বিশেষ অপারেশন চীফ মিঃ রেনেন, জেনেভা হেড কোয়ার্টারের প্রধান মিঃ পল এবং লিয়াজো অফিস চীফ মিঃ ফি।
কথা বলল পল। জানাল, পরিবেশ ভাল। বিশেষ সিসি মাছির কামড়েই ওদের মৃত্যু ঘটেছে বলে ওরা মনে করছে। পুলিস ল্যাবরেটরি এবং বিশ্ববিদ্যালয় ল্যাবরেটরি এক্সপার্ট আমাদের কথা অনুসারে কাজ করছে। পুলিশ প্রধান একটু বাঁকা লোক, কিন্তু তাকে কিছু জানতেই দেয়া হয়নি। তার ডেপুটি আমাদের খুব সাহায্য করেছে।’
‘ওদের উপর প্রতিক্রিয়া কি?’ বলল সাইরাস শিরাক।
‘সংবাদ সংস্থা দু’টি লোকদের উপর? ওরা তো পুলিশকে পাগল করে তুলেছে। চরম আতংকে ভুগছে সবাই।’
‘কিন্তু আমরা তো শুধু লোক হত্যা নয়, আমরা দেখতে চাই, সংবাদ সংস্থা দু’টি কত দ্রুত বন্ধ হচ্ছে। বলল সাইরাস শিরাক।
‘ওদের আতংক চরমে পৌঁছেছে। গত রাতেও আমরা একটা শিকার করেছি। আমার মনে হয়, আর দু’একটা ঘটনার পর সাংবাদিক কর্মচারীরাই পালিয়ে যাবে। তাছাড়া পুলিশ থেকেও তাদের চাপ সৃষ্টি করা হয়েছে। বলা হয়েছে, সংস্থা দু’টিতেই কিছু ঘটেছে, না হলে এমন মৃত্যুর ঘটনা শুধু এ দু’টি সংস্থাতেই ঘটছে কেন? ভেতরের কোন শত্রুতা এর পেছনে কাজ করতে পারে। পুলিশকে এ ক্ষেত্রে প্রভাবিত করার চেষ্টা আমরা করেছি সাংবাদিকদের মাধ্যমে। অবস্থার কারনে প্রতিষ্ঠান দু’টি সাময়িক ভাবে বন্ধ করার পরামর্শ তাদের কানে তোলা হয়েছে।’ বলল মিঃ পল।
‘ভাল খবর, বলে সাইরাস শিরাক রেনেন-এর দিকে চেয়ে বলল, ‘ধন্যবাদ, তোমার অস্ত্র ভাল কাজ করছে। এ অস্ত্র আমি মনে করি বিরাট মার্কেট পাবে রেনেন। তোমার অস্ত্রগুলো নতুন পরিবেশে কেমন আছে?’
‘না পরিবেশ তাদের জন্যে একেবারে নতুন নয়। হ্রদের লাগোয়া কাঁচের ছাদ দেয়া ঘরে কাদার মেঝেতে একটা বনজ স্যাঁৎ স্যাঁতে পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়েছে। ৩৭ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপের জলীয় বাষ্পের মধ্যে অস্ত্রগুলো ভালই আছে।’ বলল রেনেন।
‘আমার আশঙ্কা ছিল সিসি’র হুলে জেলিফিস পয়জন নিষিক্ত করার কাজ তোমার ল্যাবরেটরি কেমন পারবে।’ বলল সাইরাস শিরাক।
‘কোন অসুবিধা হয়নি। সিসিকে বিশেষ প্রেসার টিউবে তুলে প্রেসার দিয়ে টিউবের বিশেষ একটি সংকীর্ণ স্থানে এনে ফেলা হয়। তারপর টিউবের ফুটো দিয়ে মডারেট করা জেলিফিশ পয়জন ইঞ্জেক্ট করা হয়। একেবারে মোক্ষম। ফল দিচ্ছে হান্ড্রেড পারসেন্ট। কোন অন্যথা হয়নি। কিন্তু…’
থেমে গেল রেনেন।
কপাল কুঞ্চিত হল সাইরাস শিরাকের। বলল ‘কিন্তু কি? থামলে কেন? বল?’
‘আজ একটা অঘটন ঘটে গেছে। আমাদের এজেন্ট যে WNA-তে আমাদের ফাঁদ পাতার কাজ করছিল, সে ধরা পড়ে গেছে।…
সাইরাস শিরাক রেনেন কে থামিয়ে দিয়ে উত্তেজিত কণ্ঠে বলল, ‘ধরা পরে গেছে, ওদের কাস্টডিতে?’
‘না স্যার। সম্ভবত ওদের একজন তাকে সন্দেহ করেছিল।’
‘তারপর?’
‘ওকে হত্যা করে এসেছি।’
‘সাবাস। কিন্তু কাজের কি হয়েছে?’
‘ফাঁদ পেতে আসার পথে সে সন্দেহের শিকার হয়। আমি দুরবীন দিয়ে দেখেছি সে ফাঁদ ঠিক মতই পাতে।’
‘রেজাল্ট জানা গেছে?’
‘এইত এখনই খবর হবে। জানা যাবে।’
টেলিভিশনে খবর হল।
সাইরাস শিরাকসহ সবাই শেষ পর্যন্ত খবরটা শুনল। কিন্তু সিসি মাছির নতুন ভিক্টিমের কথা বলা হলনা।
মুখ মলিন হয়ে গেল রেনেনের।
গম্ভীর হল সাইরাস শিরাকের মুখমন্ডল।
‘টার্গেটের বাসায় টেলিফোন করে দেখ মিঃ পল।’
পল টেলিফোন করল মিসেস ফাতেমা হিরেনের বাসায়। বাসা থেকে জানা গেল তিনি বাসায় ফেরেনি।
‘বাসায় না ফেরার কারণ এই হতে পারে যে, গতকাল খুনের ফলে অফিসে ব্যস্ততার কারনে বাসায় আসতে না পেরে অফিসে বা কোন বান্ধবীর বাসায় ছিল।’ বলল রেনেন।
‘না, তোমাদের পাতা ফাঁদ ধরা পরার কারনেই গাড়িতে বাসায় ফেরেনি?’ বলল সাইরাস শিরাক।
‘সে রকম কিছু ঘটলে অন্য গাড়িতে বাসায় ফিরতে পারত। আমার মনে হয় গাড়িতে ফাঁদ পাতার ব্যাপারটা কেউ দেখেনি, দেখলেও বুঝার কথা নয়। খুব বেশি হলে চুরির চেষ্টা করার জন্যে তাকে সন্দেহ করতে পারে।’ বলল রেনেন।
‘শত্রুকে সব সময় ছোট ভাবা ঠিক নয়।’ বলল সাইরাস শিরাক।
‘এখনি খবরের কাগজ এসে পড়বে। যদি সে রকম কিছু ঘটে থাকে, তাহলে সেটা কাগজের প্রধান শিরোনাম হবে। আমি নিশ্চিত আমাদের ফাঁদ ধরা পড়েনি। পড়লে আমাদের পুলিশ বন্ধুরা অনেক আগেই আমাদের জানাত।’ রেনেন বলল।
বলতে বলতেই কাগজ এসে গেল।
প্রধান দৈনিকটি হাতে তুলে পাগলের মত চোখ বুলাল রেনেন।
WNA-এর গেটম্যান খুনের ঘটনা ঘটনা সত্যিই প্রধান শিরোনাম পেয়েছে। গোগ্রাসে নিউজটা গিলল রেনেন।
পড়া শেষে চিৎকার করে উঠল, ‘থ্যাঙ্ক গড মিঃ সাইরাস। ওরা কিছুই জানতে পারেনি। পুলিশ বলেছে লেন-দেনে কোন গণ্ডগোল বা ব্যাক্তিগত কোন শত্রুতার শিকার হয়ে গেটম্যান খুন হয়েছে। প্রাথমিক অনুসন্ধানে পুলিশ নিশ্চিত হয়েছে, রহস্যজনক মৃত্যুগুলোর সাথে এ খুনের কোন সম্পর্ক নেই। পুলিশ আরও বলেছে, খুন হওয়ার আগে গেটম্যান কে অস্থিরভাবে এ গাড়ি সে গাড়ির কাছে ঘুরাফিরা করতে দেখা গেছে। মনে করা হচ্ছে, সে কোন গাড়ি চোর গ্যাং-এর সাথেও জড়িত থাকতে পারে। পরিশেষে খবরে লেখা হয়েছে, পুলিশ খুনিকে পাকড়াও করার জন্যে গেটম্যানের ইতিবৃত্ত নিয়ে অনুসন্ধান শুরু করেছে।’
‘পুলিশ ইতিবৃত্ত খুঁজতে গিয়ে যদি কিছু পেয়ে যায়?’ বলল পল।
‘তুমি এই ভয় করছ পল! নিউজে এসব লেখে, এর বাস্তব কোন মুল্য নেই। আর খুজলেও কিছু পাবেনা। একমাত্র তার হাতে টাকা দেয়া এবং সিসি মাছির টিউব পৌঁছানো ছাড়া তার সাথে আমাদের কোন চিহ্ন নেই। আমরা টিউব গুলো সবই ফেরত নিয়ে এসেছি। আর টাকাতে তো কারও নাম লেখা থাকেনা। সুতরাং তারা যতই সার্চ করুক, আমাদের কোন চিহ্ন কোথাও খুজে পাবেনা।’
‘ধন্যবাদ রেনেন। এখন বল কি চিন্তা করছ তুমি। দুঃখ যে, আমি এসে প্রথমে ব্যর্থতাই দেখলাম।’
‘দুঃখিত মিঃ সাইরাস। তবে আমাদের ফাঁদে শিকার পড়েনি, এটুকুই আমাদের ব্যর্থতা। কিন্তু আমাদের যে বড় লাভ হয়েছে সেটা হল, তাদের সন্দেহটা আমাদের কাছে ধরা পড়েছে এবং আমাদের কথা প্রকাশ হওয়ার পথ আমরা যথাসময়ে বন্ধ করতে পেরেছি।’
‘ধন্যবাদ রেনেন, এটা অবশ্যই বড় লাভ। এখন বল এগুবে কিভাবে?’
-আমাদের এজেন্ট গেটম্যান না থাকায় সেখানকার কার পার্কে ফাঁদ পাততে অসুবিধা হবে। তবে নিশ্চিত থাকুন, আগামী দু’একদিনের মধ্যে আমরা আমাদের হাত থেকে ফসকে যাওয়া শিকারকে ফাঁদে ফেলব। যেখানে সুযোগ পাবো সেখানেই।’
‘তবে একটু পিছিয়ে পড়লাম আমরা।’ বলল সাইরাস শিরাক।
একটু থেমেই আবার সাইরাস শিরাক বলল, ‘আমাদের লক্ষ্য সংবাদ সংস্থা দু’টি বন্ধ করা। শুন্য পদগুলোতে লোক নিয়ে তারা যদি কাজ করেই যায়, সেটা হবে সাংঘাতিক ব্যর্থতা, এটা আমরা হতে দিতে পারিনা। একথা তোমার মনে আছে তো?
‘মনে আছে। শুন্য জায়গায় লোক নিলে সেই-ই হবে প্রথম টার্গেট। আমরা কোন ভাবেই লোক আসতে দেব না।’
একটু থামল রেনেন। তারপর আবার শুরু করল, ‘আগেই বলা হয়েছে, সংবাদ সংস্থা দু’টি বন্ধের পরিবেশ সৃষ্টির জন্যে পুলিশ ও সাংবাদিকদের মধ্যে বেশ কাজ হয়েছে। এটাও ফল দেবে বলে আমি মনে করি।’
‘তাই হোক রেনেন। বলে সাইরাস শিরাক উঠে দাঁড়াল। বলল, ‘চল উঠা যাক। ক্ষুধা লেগেছে।’
সবাই উঠে দাঁড়াল।

মিসেস ফাতেমা হিরেনের গাড়ি অনুসরণ করে আহমদ মুসার গাড়ি এসে প্রবেশ করল জেনেভাস্থ জাতিসংঘের ইউরোপীয় সদর দপ্তরের কার পার্কে।
সেদিন গেটম্যান নিহত হওয়া এবং ফাতেমা হিরেন বেচে যাওয়ার পর আহমদ মুসা ব্ল্যাক ক্রস সম্পর্কে তার অভিজ্ঞতা থেকে বুঝেছে, এরপর ফাতেমা হিরেনই হবে তাদের পরবর্তী টার্গেট। কোন টার্গেট ব্যার্থ হলে ব্ল্যাক ক্রস সে টার্গেটকেই আবার তাদের প্রথম টার্গেট বানায়।
আহমদ মুসা অনেক চিন্তা করেছে, মিসেস ফাতেমা হিরেনের উপর ব্ল্যাক-ক্রস এর আক্রমণ কিভাবে কোন দিক থেকে আসতে পারে। সে নিশ্চিতই মনে করেছে, সিসি মাছির অস্ত্রই ব্ল্যাক ক্রস ব্যবহারের চেষ্টা করবে। ব্ল্যাক ক্রস সুইস পুলিশ, সরকার এবং বিশ্ববাসীকে অন্ধকারে রেখে অব্যাহত ভাবে রহস্যজনক মৃত্যুর একটা আতংক সৃষ্টি করে সংবাদ সংস্থা দু’টিকে বন্ধ করতে চায়। সুতরাং পরিস্কার খুনোখুনির দিকে না গিয়ে রহস্যময় মৃত্যু ঘটানোর পথই তারা অনুসরণ করবে। সুতরাং অস্ত্র হবে সিসি মাছি এবং সিসি মাছির মৃত্যুফাঁদ পাতার জন্য গাড়ির ছোট্ট পরিবেশের চেয়ে উৎকৃষ্টতর ও নিশ্চিত কোন বিকল্প নেই।
ব্ল্যাক ক্রসকে ফাতেমা হিরেনের গাড়িতে এই মৃত্যু ফাঁদ পাতার সুযোগ করে দিতে হবে এবং এই সুযোগ দেয়ার মাধ্যমে তাদের পাকড়াও করতে হবে এবং ওদের ঘাঁটিতে যেতে হবে।
আহমদ মুসা এসব কথার প্রয়োজনীয় অংশ WNA-এর চেয়ারম্যান মিঃ গটেফকে জানালেও মিসেস ফাতেমা হিরেনকে কিছুই জানতে দেয়নি। ফাতেমা হিরেন ঘটনার পর আর সেই গাড়িতে চড়তেই রাজী হয়নি। বলেছিল, সবার সাথে সাধারন বাসে সে যাতায়াত করবে। কিন্তু এটা করলে আহমদ মুসার গোটা পরিকল্পনাই ব্যর্থ হয়ে যায়। তাই শুধু এটুকু সে তাকে বলেছিল স্বান্তনার জন্যে যে, মিসেস ফাতেমা হিরেন এমন আচরন করা কি ঠিক যাতে শত্রুরা সন্দেহ করতে পারে যে আমরা তাদের ষড়যন্ত্র ধরে ফেলেছি কিংবা আমরা তাদের সন্দেহ করছি? তার সকল কিছু স্বাভাবিক নিয়মে চালু থাকা দরকার। তার বাড়ির বাইরে সকল অবস্থায় আহমদ মুসা তার অনুসরণ করবে।
ফাতেমা হিরেন রাজ্যের ভয় মাথায় নিয়ে রাজী হয়েছে। বলেছে, দুনিয়ার অন্য কেউ বললে আমি রাজী হতাম না। কিন্তু ভয় হয়, আহমদ মুসার পরামর্শ না শুনলে গুনাহ হবে।
গাড়ি পার্ক করে ফাতেমা হিরেন সদর দপ্তরের ভেতরে চলে গেল।
জাতিসংঘের ইউরোপীয় সদর দপ্তরে বিশাল একটি লাইব্রেরী রয়েছে এবং রয়েছে সমৃদ্ধ ডাটা ব্যাংক। ফাতেমা হিরেন তার প্রতি সাপ্তাহিক ছুটির দিনের সন্ধ্যা এখানে এসে কাটায়।
আহমদ মুসা ফাতেমা হিরেনের গাড়ির দুই লাইন পেছনে তার গাড়ি পার্ক করে অর্ধশোয়া অবস্থায় থেকে ফাতেমা হিরেনের গাড়ির উপর চোখ রাখল।
তখন সন্ধ্যা নেমে এসেছে। সাড়ে ৫টা পার হয়ে গেছে, বিদ্যুতের আলোতে চারদিকে রাতের আমেজ।
একজন বলিষ্ঠ গড়ন লোক সদর দফতরের দিক থেকে এসে কার পার্কে ঢুকল। অত্যন্ত স্বাভাবিক পদক্ষেপে এসে সে ফাতেমা হিরেনের গাড়ির কাছে দাঁড়াল। যেন তার গাড়িতে সে উঠতে এসেছে, এমনি একটা স্বাভাবিক ভাব তার মধ্যে।
ভ্রু কুঞ্চিত হয়ে উঠেছে আহমদ মুসার। সে নড়েচড়ে উঠে গাড়ির দরজার হাতলে হাত রাখল।
লোকটি পকেট থেকে চাবি বের করল। খুলে ফেলল সামনের দরজা। পকেট থেকে বের করল সিরিঞ্জ।
আহমদ মুসা এক ঝটকায় দরজা খুলে ছুটল ফাতেমা হিরেনের গাড়ির দিকে।
পেছনে পায়ের শব্দ শুনে লোকটি ফিরে দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু তার আগেই আহমদ মুসা জাপটে ধরল তাকে।
কিন্তু জাপটে ধরার সঙ্গে সঙ্গেই আহমদ মুসা লোকটির কনুই-এর প্রচণ্ড একটা গুতা খেল পাঁজরে।
আহমদ মুসার হাত শিথিল হয়ে গিয়েছিল। এক ঝটকায় বেরিয়ে গেল লোকটি আহমদ মুসার হাত থেকে।
প্রচণ্ড আঘাতের ধকলটা সামলে নিতে আহমদ মুসার দেরি হয়েছিল। পাঁজরে প্রচণ্ড আঘাত খেয়ে টলে উঠেছিল তার দেহটা। গাড়িতে ঠেস দিয়ে সে ঠিক হয়ে দাঁড়িয়েই দেখল লোকটি ছুটে গিয়ে একটি গাড়িতে উঠেছে।
আহমদ মুসা ছুটল তার গাড়ির দিকে।
আহমদ মুসা লোকটির প্রায় পিছু পিছুই কার পার্ক থেকে বেরিয়ে এল।
লোকটির গাড়ির পেছনে ছুটে চলল আহমদ মুসার গাড়ি।
আহমদ মুসার গাড়িকে লোকটি শুরুতেই দেখে ফেলেছে।
এ রাস্তা সে রাস্তা ঘুরে লোকটির গাড়ি লেক জেনেভা হাইওয়েতে গিয়ে উঠল।
লেক জেনেভা হাইওয়ে পশ্চিম সুইজারল্যান্ডের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং গোটা সুইজারল্যান্ডের অন্যতম দীর্ঘ সড়ক। প্রথমে সড়কটি লেক জেনেভার তীর বরাবর উত্তরে ৩০ মাইল এগিয়ে গেছে লেক জেনেভার সুন্দর নগরী মরজেস পর্যন্ত। তারপর লেক জেনেভা পূর্বদিকে টার্ন নিয়েছে। লেক জেনেভা হাইওয়েও পূর্বদিকে টার্ন নিয়ে লেকের তীর ঘেঁষে বিখ্যাত নগরী লুজেন, তারপর মট্রেস্কু হয়ে লেক জেনেভার পূর্ব প্রান্ত ঘুরে সড়কটি পশ্চিমমুখী হয়েছে। তারপর লেক জেনেভায় পড়া আলপস-এর দৃষ্টি মনোহর রণ নদীর তীর ধরে এগিয়ে গেছে সুন্দর এবং দুর্গম আলপস পর্বতমালার দিকে।
বিশাল প্রশস্থ হাইওয়ে।
লোকটির নতুন গাড়িটি হাওয়ার বেগে ছুটছিল সামনে। সব সময় চলছিল রাস্তার মিডল লাইন ধরে। আহমদ মুসা বুঝল, লোকটি হয় অনির্দিষ্টভাবে চলছে, নয়ত দূরবর্তী কোন লক্ষ্যে যাচ্ছে।
আহমদ মুসা চাইছিল গাড়িটাকে ওভারটেক করে তাকে থামতে বাধ্য করতে। কিন্তু ছোট ও পুরনো গাড়িতে সে স্পীড ছিল না।
সুতরাং গাড়িটিকে অনুসরণ করে চলারই সিদ্ধান্ত নিতে হল আহমদ মুসাকে। নিশ্চয় তাকে থামতে হবে। ফুয়েল তার শেষ হবেই। আহমদ মুসা তার গাড়ির ফুয়েল মিটারের দিকে নজর বুলিয়ে দেখল, ফুয়েল ট্যাংক ভর্তি। মনে মনে ধন্যবাদ দিল মিঃ গটেফকে। তবে গাড়িটা এ ধরনের ধরনের কাজের উপযোগী হয়নি।
রাত নেমে এসেছে। সুইজারল্যান্ডের একটি সুন্দর অঞ্চলের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে সে। দিন হলে দেখা যেত ডানে দিগন্ত প্রসারিত লেক জেনেভা এবং বামে সুন্দর সবুজ পাহাড়ের সারি এবং তার নিচে উঁচু-নিচু সবুজ উপত্যকা।
প্রাণপণ ছুটে চলছিল দুটি গাড়িই।
আধঘণ্টা পার হয়েছে।
আহমদ মুসার অনুমান গাড়ি এখন তাদের জেনেভা লেক তীরের মরজেস নগরীর আশেপাশে হবে।
আহমদ মুসা হঠাৎ করেই লক্ষ্য করল, সামনের গাড়িটার স্পীড কমে গেছে। গাড়ির পেছনের লাল বাতি দ্রুত আহমদ মুসার নিকটবর্তী হচ্ছে।
তেল কি ফুরিয়ে গেল গাড়িটার। হতে পারে। পালাবে নাতো।
গাড়ির স্পীড আরেকটু বাড়াল আহমদ মুসা।
যখন গাড়িটার কাছে পৌঁছল আহমদ মুসার গাড়ি, তখন সে গাড়িটা দাড়িয়ে গেছে। গাড়ি ছেড়ে পালিয়েছে নাকি।
গাড়ি থেকে নেমেই আহমদ মুসা সেই গাড়িটার চারদিকে নজর বুলিয়ে লোকটিকে দেখতে পেল না। ভাবল, গাড়ির ভেতরটা এক নজর দেখে সে চারদিক ভাল করে চোখ বুলাবে। এত তাড়াতাড়ি তার পালানো স্বাভাবিক নয়।
আহমদ মুসা দ্রুত গিয়ে জানালা দিয়ে গাড়ির ভেতরে নজর রাখল। দেখল, স্টিয়ারিং-এ দু’হাত রেখে নির্বিকার বসে আছে লোকটি।
চমকে উঠল আহমদ মুসা। তাহলে কি ট্র্যাপে পড়েছে সে! ফাঁদ পেতে সে নিশ্চিন্তে বসে আছে?
গোটা দেহ আহমদ মুসার সতর্কতার এক তড়িত প্রবাহে সতর্ক হয়ে উঠল। ঘুরে দাঁড়াল সে।
ঘুরে দারিয়ে যা দেখল তাতে আর কিছুই করার ছিল না তার। দু’হাত দিয়ে মাথা ঢেকে বসে পড়ল।
প্রায় একসাথেই কয়েকটা হকিস্টিক ও লোহার রড এসে তার উপর পড়ল। মনে হল হাত দু’টো ছাতু হয়ে গেল, তার সাথে তার মাথাও। তার চারদিকটা অন্ধকার হয়ে এল। সেই অন্ধকারে মনে হল, দু’টো তীব্র আলো তার দিকে ছুটে আসছে। তার আরও মনে হল তাকে ধাক্কা দিয়ে পাশের গাড়িটা চলে গেল। মাথায় রডের বাড়িও আর পড়ছে না। তারপর সব শব্দ, সব দৃশ্য-সব কিছুই কোথায় যেন হারিয়ে গেল তার সামনে থেকে।

ওয়ার্ল্ড নিউজ এজেন্সির (WNA) মিটিং রুম।
বিরাট গোল টেবিলের চারদিক ঘিরে বসেছে WNA এবং FWTV-এর চেয়ারম্যান, দুই সংস্থার দুইজন প্রধান প্রশাসক, সংবাদ দুটির চীফ এডিটরদ্বয় এবং মিসেস ফাতেমা হিরেন।
সকলেরই মুখ ছাইয়ের মত সাদা। আতংকে সবাই যেন মুহ্যমান।
শুরু করল WNA-এর চেয়ারম্যান জামাল গটেফ। বলল, ‘খবরটা আপনারা সবাই শুনেছেন। বিস্তারিত আপনাদের শোনা উচিত। মিসেস ফাতেমা হিরেনকে আমি ডেকেছি। তাকে আমি অনুরোধ করছি ঘটনা বলার জন্যে।’
মিসেস ফাতেমা হিরেন নড়ে-চড়ে বসল। তারপর শুরু করল। তার কণ্ঠ শুকনো এবং ভারী। বলল, ‘আমি আমার গাড়ি পার্ক করে জাতিসংঘের ইউরোপীয় সদর দপ্তরে প্রবেশের সময় কার পার্কের দিকে তাকিয়ে দেখলাম, জনাব আহমদ মুসা আমার গাড়ির দুই ‘রো’ পেছনে তার গাড়ি পার্ক করছেন। দু’ঘণ্টা পর আমি ফিরে এসে দেখলাম আমার গাড়ি খোলা, এমনকি দরজাটা পর্যন্ত বন্ধ করা নয়। আমি আতংকিত হয়ে তাকালাম জনাব আহমদ মুসার গাড়ির দিকে। দেখলাম তার গাড়ি নেই। আমি ছুটে গেলাম সেখানে। দেখলাম তার হাতের রুমালটি মাটিতে পড়ে আছে। আমি জাতিসংঘ অফিসের গেটে এসে আধ ঘণ্টা অপেক্ষা করলাম। তারপর ফিরে এসেছি। ভয়ে আমি আমার গাড়ির কাছে আর যাইনি।’
থামল ফাতেমা হিরেন।
ফাতেমা হিরেন থামতেই মিঃ গটেফ বলল, ‘আমরা পরদিন গিয়ে গাড়িটি নিয়ে এসেছি। কিন্তু আজ এই সকাল দশটা পর্যন্ত আহমদ মুসার কোন খোঁজ নেই।’
‘তিনি টেলিফোনও করেন নি? উদ্বেগের ব্যাপার!’ বলল FWTV-এর চেয়ারম্যান বাকের জারমিস।
‘তার মত বিবেচক লোকের জন্য এটা অসম্ভব।’ বলল WNA-এর চীফ এডিটর হাসান আলবার্তো।
‘তাহলে? বলল কামাল কনরাড, FWTV-এর চীফ এডিটর।
‘তিনি কি শত্রুর কবলে পরেছেন বলে আমরা মনে করব? বলল WNA-এর প্রধান প্রশাসক।
তার কথা শেষ হল। কিন্তু কেউ কথা বলল না। কান্নার চেয়েও করুন সকলের মুখের অবস্থা। কিছুক্ষণ নীরবতা।
নীরবতা ভাঙল বাকের জারমিস। বলল, ‘বুঝতে পারছিনা আমরা কি করব? আমাদের জন্যে কি করব বা তার জন্যে কি করতে পারি?’
জবাব কারও কাছেই ছিল না। নীরব সবাই।
মিঃ গটেফ-এর পি,এ প্রবেশ করল ঘরে। গটেফকে বলল, ‘স্যার ফ্রান্স থেকে একজন মহিলা এসেছেন। আপনার সাথে দেখা করতে চান।’
‘ফ্রান্স থেকে? কি চায়?’
‘দেখা করতে চায়।’
‘কোন ব্যাপারে জিজ্ঞেস করনি?’
‘আমাকে বলবে না।’
মিঃ গটেফ মনে মনে ভয় পেল। ব্ল্যাক ক্রস-এর হেডকোয়ার্টার তো ফ্রান্সে। কোন ফ্যাসাদ আবার এল। আহমদ মুসার অনুপুস্থিতিতে কেউ কোন ফাঁদ পাততে এল না তো?
এসব চিন্তা করে গটেফ WNA-এর প্রধান প্রশাসকের দিকে চেয়ে বলল, ‘আমি পারছিনা। তুমি শুনে এস চার্লস।’
‘ইয়েস স্যার।’ বলে চার্লস চলে গেল।
ফিরে এল মিনিট তিনেক পর।
‘চলে গেলেন মহিলা?’
‘না, জনাব।’
‘তাহলে?’ মুখ কাল করে বলল মিঃ গটেফ।
‘সে আপনার সাথে কথা বলতে চায়।’
‘বলনি যে, আমি মিটিং-এ আছি।এখন দেখা করা সম্ভব নয়।’
‘বলেছি। বললেন, তাঁকে এখানে আসার অনুমতি দিতে।’
‘তুমি কি বলেছ?’
‘কোন মেহমানের ভেতরে আসার অনুমতি নেই। তিনি বলেছেন, জানি আপনাদের খারাপ দিন চলছে। আপনাদের কোন মহিলা আমাকে সার্চ করতে পারেন।’
‘তাঁর পরিচয় কি?’
‘তিনি নিজেকে মুসলিম বলে পরিচয় দিয়েছেন।’
‘প্রয়োজনীয় সার্চ করে আমি তাঁকে ভেতরে আনতে পারি।’ বলল মিসেস ফাতেমা হিরেন।
‘কিন্তু একটা জিনিস ভাববার আছে। মহিলা এসেছেন ফ্রান্স থেকে। আর ব্ল্যাক ক্রস-এর হেড কোয়ার্টারও ফ্রান্সে।’
‘তা ঠিক। কিন্তু ফ্রান্সেই তো আহমদ মুসা ব্ল্যাক ক্রস-এর বিরুদ্ধে অনেকের সাহায্য পেয়েছিলেন।’ বলল হাসান আলবার্তো।
‘মহিলা মুসলিম বলে তো পরিচয় দিলেন। পোশাক কেমন ওঁর?’ বলল মিঃ গটেফ।
‘ভাল মুসলিমের মত পোশাক।’ বলল চার্লস।
‘মহিলা তো, আমার মনে হয় এখানে ডাকা যায়। নিশ্চয় জরুরী কোন ব্যাপার আছে ওঁর।’ বলল জারমিস।
‘ঠিক আছে। মিস ফাতেমা হিরেন যান। তাঁকে দেখে-শুনে নিয়ে আসুন।’ বলল মিঃ গটেফ।
ফাতেমা হিরেন উঠল। মিনিট পাঁচেক পরে মিসেস ফাতেমা হিরেন মহিলাটিকে সাথে নিয়ে মিটিং রুমে ফেরত এল।
মহিলা আসলে একজন তরুণী।
বসল টেবিলে ফাতেমা হিরেনের পাশেই।
মিঃ গটেফ তাকে স্বাগত জানিয়ে নিজের ও অন্যদের পরিচয় দিয়ে বলল, ‘আমরা একটা জরুরী মিটিং-এ আছি। বলুন, আমরা আপনার কি সাহায্য করতে পারি?’
তরুণীটি ঘরে ঢুকেই আগে সালাম দিয়েছিল। মিঃ গটেফ থামলে সে বলল, ‘আপনারা একটা বিপজ্জনক সময় অতিক্রম করছেন। আমাকে কথা বলার সুযোগ দিয়েছেন এ জন্য আপনাদের ধন্যবাদ।’
একটু থামল তরুণীটি। তারপর বলল, ‘ আহমদ মুসা এখানে এসেছেন। আমি তাঁর খোঁজ নিতে এসেছি। তিনি কোথায় আছেন, কেমন আছেন জানালে বাধিত হবো।’
তরুণীটির কথার উত্তর কেউ দিল না। সবাই নীরব। তাদের চোখে-মুখে বিস্ময় ও সন্দেহ দুইই। এ ফরাসী তরুণী আহমদ মুসার কথা জিজ্ঞেস করছে কেন? আহমদ মুসার নিখোঁজ হওয়ার সাথে ওঁর আসার কি কোন সম্পর্ক আছে? আহমদ মুসাকে সরাবার পর কোন ফাঁদ পাততে এসেছে কি এই তরুণী?
নীরবতা ভেঙ্গে প্রথম কথা বলল গটেফ। বলল, ‘ আপনার পরিচয় কি? তাঁর কথা আমাদের জিজ্ঞেস করছেন কেন? তিনি এখানে এসেছেন একথা আপনি বলছেন কি করে?’
‘আমি মারিয়া জোসেফাইন লুই। ডোনা জোসেফাইন বলেও আমাকে ডাকা হয়। আহমদ ফ্রান্সে থাকার সময় তাঁর সাথে আমার পরিচয়। আমি ঐ সময় ইসলাম গ্রহণ করি। আমি ক্যামেরুনেও ছিলাম। আমি ক্যামেরুন থেকে চলে এসেছি ফ্রান্সে, আর তিনি মধ্য আফ্রিকা প্রজাতন্ত্র থেকে এসেছেন সুইজারল্যান্ড। আমি জেনেভায় আসব উনি জানেন।’ বলল ডোনা নামের তরুণীটি।
ডোনা আজই তার আব্বার সাথে প্যারিস থেকে জেনেভা এসে পৌঁছেছে। উঠেছে একটা অভিজাত টুরিস্ট কটেজে। তার আব্বার বিশ্রাম নিচ্ছেন, সেই সুযোগে ডোনা এসেছে WNA অফিসে আহমদ মুসার খোঁজ নেয়ার জন্য। সে জানত আতংকজনক ঘটনাগুলোর পর WNA এবং FWTV এর অফিসে খুব সতর্কতা থাকবে। কিন্তু সতর্কতাটা এই পরিমাণে থাকবে তা সে ধারণা করেনি।
আবার নীরবতা।
তরুণীটির কথা বিশ্বাস করবে, না অবিশ্বাস করবে, এই দ্বিধাদ্বন্দ্ব সবার মধ্যে।
এবার নীরবতা ভাঙল মিসেস ফাতেমা হিরেন। বলল, ‘ মাফ করবেন। আমি জানতে চাচ্ছি তাঁর সাথে আপনার সম্পর্ক কি? আপনি ক্যামেরুন গিয়েছিলেন কেন?’
‘আমি জেনেভায় যেভাবে এসেছি, সেভাবেই ক্যামেরুনে গিয়েছিলাম। সম্পর্ক সম্পর্কে আমি কি বলব?’ বলে তরুণীটি একটু থামল। তারপর বলল, ‘আমি তাকে চিনি, তিনি আমাকে চেনেন, আপাতত এটুকু জানা কি যথেষ্ট হয় না?’
‘মাফ করবেন। আমরা যদি ‘আপনাকে কোন সাহায্য করতে পারব না’ বলে দুঃখ প্রকাশ করি।’ বলল হাসান আলবার্তো।
‘আমি কিছুই মনে করব না। একজন অপরিচিতকে এই কথা বলাই আপনাদের জন্য স্বাভাবিক। তবে আমার একটা অনুরোধ, আমি একটা টেলিফোন নাম্বার রেখে যাচ্ছি। তিনি ভাল থাকলে আমাকে কিছু জানাবার দরকার নেই, কোন অসুবিধায় যদি তিনি পড়েন, তাহলে এই টেলিফোনে আমাকে জানাবেন।’
বলে একটা টেলিফোন নাম্বার লিখে ফাতেমা হিরেনকে দিয়ে ডোনা উঠে দাঁড়াল।
মিঃ গটেফ এবং অন্যান্যরা একে অন্যের মুখ চাওয়া –চাওয়ি করল।
এতক্ষণে মিঃ গটেফের মুখের উপর আসন গেড়ে বসা সন্দেহের ছায়া কিছু ম্লান হলো। ভাবল, তরুণীটি আহমদ মুসার অবশ্যই কোন শুভাকাঙ্ক্ষী। এই চিন্তার সাথে সাথেই সে শশব্যাস্তে বলল, ‘ আপনি আহমদ মুসার শুভাকাঙ্ক্ষী হলে আপনাকে একটা খবর না দেয়া অন্যায় হবে।’
‘কি খবর?’ ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল ডোনা।
‘আমরা দুঃখের সাথে জানাচ্ছি যে আহমদ মুসা গতকাল থেকে নিখোঁজ।’ বলল মিঃ গটেফ।
‘নিখোঁজ? গতকাল থেকে?’ বলে চেয়ার আবার বসে পড়ল ডোনা। হঠাৎ তার দেহ যেন গভীর এক অবসন্নতায় ছেয়ে গেল।
অনেকক্ষণ কথা বলতে পারল না ডোনা।
পরে ডোনা শুনল সব কথা মিসেস ফাতেমা হিরেনের কাছ থেকে। সব শুনে ডোনা বলল, ‘ আমার বিশ্বাস তিনি শত্রুর হাতে বন্দী হয়েছেন। শত্রুরা এসেছিল মিসেস ফাতেমা হিরেনের গাড়িতে ফাঁদ পাততে। আহমদ মুসার চোখে তারা ধরা পড়ে যায়। তারা তাড়াহুড়ো করা পালায়। আহমদ মুসাও তাড়াহুড়ো করে তাদের অনুসরণ করে এবং সম্ভবত তা করতে গিয়ে আহমদ মুসা তাদের হাতে বন্দী হয়ে যায়।’ শুকনো ও ভারি কণ্ঠস্বর ডোনার।
‘আপনি কেন এতটা নিশ্চিত যে, আহমদ মুসা শত্রুর হাতে ধরা পড়েছেন?’ বলল মিঃ গটেফ।
‘আহমদ মুসা মুক্ত থাকলে হয় চলে আসতেন, না আসতে পারলে টেলিফোন করতেন।’ বলল ডোনা।
‘টেলিফোন নাও তো পেতে পারেন সেখানে?’
‘এই যুক্তি সত্য হলে সেটা খুশির কথাই হবে। তবে খারাপটাই চিন্তা করা ভাল।’ বলল ডোনা।
‘ঠিক, খারাপটা চিন্তা করেই আমাদের কিছু করা দরকার।’ বলল মিঃ জারমিস।
‘আমার মনে হয় ব্যাপারটা পুলিশকে জানানো দরকার।’ বলল গটেফ।
‘কি জানাবেন পুলিশকে?’ বলল ডোনা।
‘আহমদ মুসাকে কিডন্যাপ-এর কথা। অন্তত এটুকু।’ বলল গটেফ।
‘না, এটা পুলিশ কে জানানো যাবেনা। এমনকি আহমদ মুসা সুইজারল্যান্ডে এ বিষয়টাও পুলিশ জানতে পারলে নতুন সমস্যার সৃষ্টি হবে।’
‘কি সমস্যা সৃষ্টি হবে?’ বলল মিসেস ফাতেমা হিরেন।
‘তখন একই সাথে ব্ল্যাক ক্রস এবং পুলিশের সাথে লড়তে হবে।’ বলল ডোনা।
‘কেন?’ বলল ফাতেমা হিরেন।
‘আহমদ মুসার দাম কোটি কোটি ডলার। পুলিশ গোপনে তাকে তার শত্রুর হাতে তুলে দিয়ে এ অর্থ উপার্জনের চিন্তা করতে পারে। তাছাড়া পুলিশের মাঝে বিভিন্ন এজেন্সির আজ্ঞাবহ লোকও আছে। তারাও জেনে ফেলবে।’
সবাই স্তম্ভিত হয়ে ডোনার কথা শুনছিল। তারা যেন ডোনার মধ্যে আহমদ মুসারই কণ্ঠ শুনছিল। তারা লজ্জা অনুভব করল। মনে মনে বলল, তরুণী হলেও বুদ্ধিতে পরিপক্ক। আর আহমদ মুসার সাথে পরিচিত হবার এবং তাকে খোঁজ করবার মত যোগ্যতার অধিকারী সে নিঃসন্দেহে।
‘ম্যাডাম, আপনার পরামর্শের জন্য ধন্যবাদ। কিন্তু আমরা কি করব, কি করণীয় বুঝতে পারছি না। যে কাজ পুলিশের সে কাজ আমরা কিভাবে করব?’ বলল মিঃ গটেফ।
ডোনা তৎক্ষণাৎ কোন উত্তর দিল না। মুখ নিচু করে চিন্তা করল কিছুক্ষণ। তারপর ধীরে ধীরে বলল, ‘ কারা এটা করেছে জানলেও তাদের কোন স্থান-ঠিকানা আমাদের জানা নেই। এই অবস্থায় আল্লাহর উপর ভরসা করে অপেক্ষা করা ছাড়া কোন পথ নেই।’
‘কারা এটা করেছে জানেন?’ বলল ফাতেমা হিরেন।
‘অবশ্যই জানি। ব্ল্যাক ক্রস করেছে।’
‘ব্ল্যাক ক্রস-কে আপনি জানেন?’ বলল আবার ফাতেমা হিরেন।
‘জানি।’
‘তাহলে যেটুকু পরিচয় আপনি দিয়েছেন, সেটুকু আপনার সব পরিচয় নয় বলে আমার মনে হয়।’ বলল হাসান আলবার্তো।
‘সেটা বড় কথা নয়। কিছু বাকী থাকলে ওঁর কাছেও শুনতে পারবেন। আমি এখন উঠতে চাই।’ বলল ডোনা।
ডোনা ওদের সামনে স্বাভাবিক থাকলেও ভেতরটা তার কাঁপছে। সে জানে, ব্ল্যাক ক্রস আহমদ মুসার বিরুদ্ধে ক্ষ্যাপা কুকুরের মত হয়ে রয়েছে। আহমদ মুসা তাদের হাতে পড়ার ব্যাপারটা চিন্তাও করা যায় না।
‘ঠিক আছে। একটা কথা ম্যাডাম। আপনি অনেক কিছু জানেন বলেই বলছি। আমরা আহমদ মুসার ব্যাপারটা পুলিশকে জানালাম না। কিন্তু আমরা সিসি মাছির ব্যাপারটা পুলিশকে জানাব কিনা? আহমদ মুসা থাকতে আমরা জানাইনি, তিনি নিষেধ করেছিলেন এবং আমরাও তার সাথে একমত ছিলাম। কিন্তু এখন তিনি নেই, আমাদের নিরাপত্তার জন্যে পুলিশকে সব জানানো দরকার কিনা?
‘আমি বলেছি, আল্লাহর উপর ভরসা করে ধৈর্যের সাথে অপেক্ষা করা দরকার। সবচেয়ে খারাপ অবস্থার জন্যে প্রস্তুত থাকা উচিত, কিন্তু হতাশ হওয়া ঠিক হবে না। আমাদের মনে রাখতে হবে, তিনি আহমদ মুসা। এ ধরণের ঘটনা তার জীবনে অসংখ্যবার ঘটেছে। যে পরিস্থিতির উত্তরণ আমাদের কাছে অসম্ভব, সেটা তাঁর কাছে খুবই সহজ।’ বলল ডোনা।
কথাগুলো বলতে পেরে খুশী হলো ডোনা। কথাগুলো তার নিজেকেই সান্ত্বনা দিল বেশী। মন অনেক সাহস পেল তার।
সকলের মুগ্ধ দৃষ্টি ডোনার দিকে।
কথা বলতে যেন ভুলে গিয়েছিল তারা।
নীরবতা ভাঙল মিঃ গটেফ। বলল, ‘ধন্যবাদ আপনাকে। এই কথাগুলো বলার জন্যেই আল্লাহ আপনাকে আমাদের কাছে পাঠিয়েছেন। আমরা কৃতজ্ঞ। আমরা কি টেলিফোনে আপনার সাথে যোগাযোগ করতে পারি? আমি নিশ্চিত, আপনার পরামর্শের আমাদের দরকার হবে।’
‘মোস্ট ওয়েলকাম। আমি খুশী হবো। আমিও যোগাযোগ করব।’ বলে সালাম দিয়ে যাবার জন্যে পা বাড়িয়েও আবার ঘুরে দাঁড়াল ডোনা। বলল, ‘আপনারা জেনেভার হাসপাতাল-ক্লিনিকগুলোতে খোঁজ নিতে পারেন। আমিও নেব। আমার মনে হয় তিনটি অবস্থা হতে পারে। এক, তিনি শত্রুর হাতে পড়েছেন, দুই, তিনি আহত হয়ে কোন হাসপাতাল বা ক্লিনিকে থাকতে পারেন এবং তিন, তিনি জেনেভার বাইরে চলে গেছেন শত্রুকে অনুসরণ করে। দ্বিতীয় অবস্থা আমাদের আয়ত্বে এখন, এই চেষ্টা আমরা করতে পারি।’ থামল ডোনা।
‘আল্লাহ আমাদের মঙ্গল করুন। আপনি ঠিকই বলেছেন। আমরা অনুসন্ধান এখনি শুরু করছি।’
ডোনা ঘুরে দাঁড়িয়ে চলা শুরু করল।
এগিয়ে দেয়ার জন্যে মিসেস ফাতেমা হিরেনও উঠে দাঁড়াল।
ঘর থেকে বেরিয়ে পাশাপাশি হাঁটতে শুরু করল দু’জন।
‘আপনার সাথে পরিচিত হয়ে খুশী হলাম।’ বলল ডোনা।
‘আর আপনার সাথে পরিচিত হতে পেরে আমার গর্ব হচ্ছে। অল্প কয়েক মিনিট আপনার কথা শুনলাম। কিন্তু মনে হচ্ছে কতদিনের পরিচয়। আমার সবচেয়ে অবাক লাগছে, আহমদ মুসা যেমন স্বতন্ত্র, তেমনি মনে হচ্ছে আপনাকেও। একটা কথা জিজ্ঞেস করতে পারি? আপনি আহমদ মুসার আত্মীয় নন, আপনি ফরাসী হওয়াই তার প্রমাণ। তাহলে আহমদ মুসার সাথে সম্পর্ক কি?’
‘মিসেস ফাতেমা হিরেন আপনি সাংবাদিক। বলুন কারা আত্মীয় হতে পারে? কোন ইউরোপীয় কি কোন এশিয়ানের আত্মীয় হতে পারে না?’ হৃদয়ের এবং আত্মার একান্ত যে সেই তো আত্মীয়।’ ঠোঁটে হাসি টেনে বলল ডোনা।
‘অভিনন্দন জানাচ্ছি আপনাকে ম্যাডাম। আমি এটাই জানতে চাচ্ছিলাম।’
‘মোস্ট ওয়েলকাম।’ বলল ডোনা। তারা রিসেপশনের দরজায় এসে গেছে।
ডোনা হাত বাড়াল বিদায়ী হ্যান্ডশেকের জন্যে।
ফাতেমা হিরেন ডোনার হাত চেপে ধরে বলল, ‘আমার খুব সাহস লাগছে। আসল লোক এসেছেন, তার সাথে তার রাইট হ্যান্ডও।’
‘কাকে রাইটহ্যান্ড বলছেন? আমাকে?’
‘অবশ্যই।’
‘না, আমি ওঁর কোন হ্যান্ডই নই। আমি অনাহুত এখানে এসেছি।’
‘কেন, আপনি এই কাজে ওঁকে সহযোগিতা করেন না?’
‘উনি পছন্দ করেন না।’
‘কেন?’
‘এই রণাঙ্গন মেয়েদের জন্যে নয় বলে।’
‘কেন, মেয়েরা কি সমাজ জীবনের অংশ নয়? এ রণাঙ্গন মেয়েদের জন্যও হবে না কেন? আপনি তার সাথে একমত?’
হাসল ডোনা। বলল, ‘ঠিক নীতি হিসেবে তিনি একথা বলেননি। তবে নিজের ক্ষেত্রে এটা তিনি অপছন্দ করেন।’
‘অর্থাৎ তিনি চান না আপনি এ সবের সাথে জড়িত হন।’
‘আমাকে নির্দিষ্ট করছেন কেন? অন্য কেউও হতে পারেন।’ সলজ্জ হেসে বলল ডোনা।
‘তাঁর আরও ‘অন্য কেউ’ আছে নাকি?’ মুখ টিপে হেসে বলল ফাতেমা হিরেন।
‘আমি তা বলিনি। আমি না হয়ে অন্য কেউও হতে পারেন।’
‘ধন্যবাদ। ঐ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আপনার মত বলুন। আপনার মতের মূল্য অনেক।’
‘লজ্জা দেবেন না। আমি খুবই সামান্য কেউ। মূল্য রয়েছে আপনাদের মতের। আপনারা দেশের জন্যে জাতির জন্যে ঝুঁকি নিয়ে কাজ করছেন।’
‘একটা কথা জিজ্ঞেস করতে ভুলে গিয়েছিলাম। আপনার নামের শেষে ‘লুই’ কেন? আমি যতদূর জানি ‘লুই’ রাজপরিবার ছাড়া এ শব্দ কেউ তাদের নামে ব্যবহার করে না।’
ডোনা মুহূর্তকাল চুপ করে থাকার পর গম্ভীর কণ্ঠে বলল, ‘অতীতের কংকাল সে পরিবারেরই একজন আমি।’
ফাতেমা হিরেন চমকিত হয়ে পূর্ণ চোখে তাকাল ডোনার দিকে।
মুহূর্ত কয় পরে মুখে ফুটে উঠল স্বচ্ছ হাসি। তারপর অভিনয়ের ভংগিতে ডোনাকে ‘বাউ’ করে বলল, ‘সম্মানিতা রাজকুমারী, এতক্ষণে আশ্বস্ত হলাম।’
চোখে-মুখে বিস্ময় টেনে ডোনা বলল, ‘কি আশ্বস্ত হলেন?’
‘আমাদের বিশ্ববিখ্যাত মহামান্য ব্যক্তিকে আল্লাহ যোগ্য সাথী মিলিয়ে দিয়েছেন।’
ডোনা গম্ভীর হলো। তার মুখ-চোখ ভারী হয়ে উঠল। বলল, ‘আপা এভাবে বলবেন না। এ রাজপরিবার ঘৃণ্য ও জননিন্দিত চরিত্রের মানুষকেও জন্ম দিয়েছে। পরীক্ষা আমাকে কোথায় নিক্ষেপ করবে আমি জানি না আপা। আমার জন্যে দোয়া করবেন।’
ফাতেমা হিরেনও গম্ভীর হলো। বলল, ‘আপনার এই উপলব্ধিই আপনার পবিত্র মন ও অপরিমিত যোগ্যতার প্রমাণ।’
থামল ফাতেমা হিরেন। থেমেই আবার শুরু করল, ‘কথাটা কিন্তু হারিয়ে যাচ্ছে। আপনার মতটা বলেননি।’
‘কোন বিষয়ে?’
‘ঐ যে রণাঙ্গনে নারীর অংশ গ্রহণের ব্যাপারটা।’
‘ও আচ্ছা।’ বলে ডোনা একটু চিন্তা করল। তারপর বলল, ‘আমার ব্যক্তিগত মত কি বলব! আমি একজন মেয়ে হিসেবে এ অধিকার চাই। কিন্তু আমাকে যদি বিচারকের আসনে বসিয়ে এ প্রশ্ন জিজ্ঞেস করা হয়, তাহলে আমি বলব এই অধিকার এইভাবে মেয়েদের পাওয়া উচিত নয়।’
‘কেন? কেন?’
‘নারী হিসেবে এমন কিছু দুর্বলতা ও অসুবিধা মেয়েদের রয়েছে এবং শত্রুর হাতে পড়লে এমন কিছু অবাঞ্ছিত ফল তার উপর চেপে বসতে পারে, যা তার এবং তার বৃহত্তর পারিবারিক জীবনে বিপর্যয় সৃষ্টি করতে পারে। এই অসুবিধা পুরুষের নেই।’
ফাতেমা হিরেন সংগে সংগে জবাব দিল না। তার বিস্ময় দৃষ্টি ডোনার উপর নিবদ্ধ।
কয়েক মুহূর্ত পর সে বলল, ‘ধন্যবাদ আপনাকে ম্যাডাম। বিষয়টাকে এভাবে আমি কোনদিন চিন্তা করিনি। আপনার এ রায়ের সাথে আমি একমত। এদিক দিয়ে পুরুষ ও নারীর অবাধ মেলামেশার যৌথ কর্মক্ষেত্রও অবাঞ্ছিত।’
‘আপনাদের মিটিং চলছে। আপনার অনেক সময় নিলাম। আমি এখন আসি।’ আবার হ্যান্ডশেকের জন্যে হাত বাড়িয়ে বলল ডোনা।
ফাতেমা হিরেন হ্যান্ডশেক করে বলল, ‘একদিন বাসায় দাওয়াত করার কি সাহস করতে পারি?’
‘দাওয়াত কেন? নেম কার্ড তো নিয়েছি। একদিন বাসায় গিয়ে হাজির হবো দেখবেন।’
‘মোস্ট ওয়েলকাম।’
ডোনা সালাম দিয়ে বাইরে বেরুবার জন্যে পা বাড়াল।

Top