২২. অদৃশ্য আতঙ্ক

চ্যাপ্টার

‘প্রথম ব্যর্থতার একটা যুক্তি আছে। কিন্তু দ্বিতীয় ব্যর্থতার কি যুক্তি আপনাদের কাছে আছে?’ তীব্র কন্ঠে বলল ব্ল্যাক ক্রস প্রধান সাইরাস শিরাক।
জেনেভায় ব্ল্যাক ক্রসের অফিস। সাইরাস শিরাকের সামনে বড় টেবিলটা ঘিরে বসেছিল জেনেভা ব্ল্যাক ক্রস-এর চার শীর্ষ ব্যক্তি।
তাদের মুখ নিচু। কোন জবাব দিল না তারা।
আবার মুখ খুলল সাইরাস শিরাকই। বলল, ‘দ্বিতীয় ব্যর্থতার ঘটনায় দেখা যাচ্ছে, ঘটনাচক্রে আমাদের সে মিশন ব্যর্থ হয়নি। প্রমাণ হচ্ছে, সুপরিকল্পিতভাবে ফাঁদ পাতা হয়েছিল আমাদের ধরার জন্যে। ভাগ্যক্রমে পালাতে পেরেছিলে। কেন তোমাদের এই ব্যর্থতা?’
‘আমরা কিছুই বুঝতে পারছি না। তারা যদি আমাদের সন্দেহ করতো, তাহলে অবশ্যই পুলিশের সাহায্য নিত কিন্তু পুলিশ কিছুই জানে না।’ বলল মিঃ পল।
‘কিন্তু তারা সন্দেহ করেছে এটা তো সত্য?’
‘সত্য বলেই তো বিস্ময়। এ সাহস তারা পেল কোথায়? তারা নিজেরা আমাদের বিরুদ্ধে অগ্রসর হবে, এটা কল্পনাও করা যায় না।’
‘কিন্তু তা সত্য প্রমাণিত হয়েছে। WNA এবং FWTV-এর সাংবাদিক-কর্মচারীদের অফিস ও বাসার খবর জান?’
‘জানি, সেখানে সর্বাত্মক সতর্কতা।’
‘জানি, তারা নিজস্ব গাড়িতে চড়া কমিয়ে দিয়েছে। যারা চড়ে; তাদের গাড়ি সার্বক্ষণিক পাহারায় থাকে?’
‘জানি।’
‘এর অর্থ কি?’
‘তাদের কাছে আমাদের সিসি মাছির ব্যাপারটা ধরা পড়ে গেছে।’
‘তাহলে তারা পুলিশকে জানাচ্ছে না কেন, খবর নিয়েছ?’
‘এটাই এখন বড় রহস্য।’
‘প্রথম ব্যর্থতার ঘটনায় রেনেন তুমি যাকে দেখেছিলে, দ্বিতীয় ব্যর্থতার ঘটনায় যার দ্বারা আক্রান্ত হয়েছিলে, তারা এক লোক কিনা?’
‘পোশাক ভিন্ন ছিল, কিন্তু তাদের এক লোক বলেই মনে হয়েছে।’
‘আমার বিশ্বাস, এই-ই আসল লোক। এ ঘটনার মোড় পাল্টে দিয়েছে। তোমরা অপদার্থ তাকে বাগে পেয়েও শেষ করতে পারনি।’
‘একজন এশিয়ান কি এতবড় কেউ হতে পারে?’
‘সে কি এশিয়ান?’
‘হ্যাঁ এশিয়ান।’
ভ্রু কুঞ্চিত হলো সাইরাস শিরাকের। বলল, ‘এশিয়ানদের ছোট ভাবছ কেন? আহমদ মুসা তো এশিয়ান।’
‘সে কি আহমদ মুসা?’ কন্ঠে বিস্ময় ঝরে পড়ল মিঃ পলের।
‘নিশ্চিত করে বলা যাবে না। তবে কাজ দেখলে তার কথাই মনে হয়। আবার সুইজারল্যান্ড এমন কিছু আন্তর্জাতিক ঘটনা ঘটার কথা প্রচারিত হয়নি, যে কারণে তার মত লোক এখানে আসতে পারে।’
বলে একটু থেমেই আবার সে বলল, ‘সেদিন লোকটিকে তোমাদের জীবন্ত ছেড়ে দেয়া ঠিক হয়নি। আর লোকটি ক্লিনিক থেকে কোথায় গেল খুঁজে বের করতে পারলে না?’
‘ওদের রেকর্ডে কিছুই নেই। নিজের ইচ্ছাতেই রিলিজ নিয়েছে। একজন মহিলা ও একজন পূরুষের সাথে একটি প্রাইভেট গাড়িতে করে চলে গেছে।‘জেনেভা’ না ‘মরজে’তে গেছে কেউ বলতে পারছে না।’
চেয়ারে হেলান দিয়ে চোখ বুজেছিল সাইরাস শিরাক। মিঃ পল থামলে সে সোজা হয়ে বসে বলল, ‘যাই হোক, আমাদের পরিকল্পনা বিপর্যয়ের মধ্যে পড়েছে। যেভাবে আমরা এগুচ্ছিলাম, সেভাবে আর এগুনো যাবে না। এখন বল কোন পথে এগুবে। আমি চাই, সংবাদ সংস্থা দু’টি বন্ধ হোক।’
‘আমরা চাচ্ছিলাম, সিসি মাছি রহস্যকে আড়ালে রাখতে এবং তার সাথে আমাদের ষড়যন্ত্রটাকেও আড়াল করতে। যে কোন ভাবেই হোক সিসি মাছি রহস্যটা ধরা পড়ে গেছে এবং এটা ষড়যন্ত্রেও ফল তাও ধরা পড়ে গেছে। কিন্তু এ ষড়যন্ত্রের পেছনে কারা আছে এটা অবশ্যই ধরা পড়েনি।’ বলল রেনেন।
‘কেমন করে বলছ ধরা পড়েনি। আমাদের ঘাঁটি কিংবা আমরা আক্রমণের শিকার হইনি বলে?’ বলল সাইরাস শিরাক।
‘হ্যাঁ তাই।’
‘তোমার অনুমানের পেছনে আর কি যুক্তি আছে?’ সাইরাস শিরাক বলল।
‘তারা আমাদেরকে অথবা আমাদের অবস্থান চিহ্নিত করতে পারলে অবশ্যই তারা পুলিশের আশ্রয় নিত। তারা এখন যেটা করছে সেটা আত্মরক্ষার কাজ। তারা বাঁচতে চাইলে তাদের আক্রমণাত্মক হতে হবে এবং তা হতে হবে পুলিশের মাধ্যমে।’
‘তারা তোমাদের ধরার জন্যে তাড়া করেছে দীর্ঘ ৪০ মাইল পথ, এটা কি আক্রমণাত্মক কাজ নয়?’ সাইরাস শিরাক বলল।
‘সব জেনে-শুনে যে আক্রমণ সেটা বড় ধরনের কোন আক্রমণ নয়। ঘটনা চক্রে এ সুযোগ তারা পেয়েছে।’
‘তোমরা কি খোঁজ নিয়েছ, এই ঘটনার পর তারা পুলিশকে বলেছে কিনা?’ প্রশ্ন করল সাইরাস শিরাক।
‘আজই পুলিশের সাথে কথা বলেছি। তারা বলেছে, এই কেসের ব্যাপারে কোন অগ্রগতি নেই। WNA এবং FWTV কর্তৃপক্ষ সুনির্দিষ্ট কোন অভিযোগ আনতে পারেনি, পুলিশের পক্ষেও কিছু বের করা সম্ভব হয়নি।’ বলল মিঃ পল, জেনেভা ব্ল্যাক ক্রস প্রধান।
কোন কথা বলল না সাইরাস শিরাক। চোখ বন্ধ করে চেয়ারে হেলান দিল সে আবার। একটু পরে চোখ খুলে বলল, ‘এখন বল তাহলে এগুবে কিভাবে?’ সাইরাস শিরাকের দৃষ্টি রেনেনের দিকে।
রেনেন সিসি মাছি অপারেশন প্রজেক্টের প্রধান।
রেনেন বলল, ‘সিসি মাছির ব্যাপারটা পুলিশের কাছে ধরা পড়েনি। এটা আমাদের জন্যে এখনও একটা বড় ইতিবাচক দিক। এখনও এই অস্ত্র পূর্ণ কার্যকরী আছে। এই অস্ত্রের এবার গণ ব্যবহার করব।’
‘কিভাবে?’
‘সংবাদ সংস্থা দু’টির বিল্ডিং- এর নক্সা জোগাড় করেছি। সংস্থা দু’টির মিটিং এ্যারেঞ্জমেন্ট ও টাইম- সিডিউল জোগাড় করেছি। সংস্থা দু’টিতে প্রতিদিন সন্ধ্যায় স্টাফ মিটিং হয় একটি হল রুমে। সেখানে শীর্ষ থেকে সিনিয়র সবাই হাজির থাকে। সেখানে আমরা সিসি মাছি ছেড়ে দিতে পারি।’
‘কিন্তু কিভাবে?’
‘দু’টি মিটিং রুমই অফিস দু’টির পেছন সাইডে। একটার পেছন দিকের পরবর্তী বিল্ডিং একটা ৫ তলা কারপার্কিং। অন্যটার ব্যাকওয়ার্ড সাইডে আছে একটা গোডাউন। সুতরাং আমরা নির্বিবাদে স্যানিটারী সার্ভিসম্যানদের ইউনিফর্ম পরে মিটিং রুমের জানালায় ড্রিলিং করে পাইপের মাধ্যমে কয়েক ডজন ক্ষুধার্ত সিসি মাছি মিটিং রুমে ছেড়ে দিতে পারি।’ বলল রেনেন।
‘তোমার বুদ্ধি মন্দ নয়, তবে এত ঝামেলা করার চেয়ে আমরা মিটিং রুমটাই তো উড়িয়ে দিতে পারি।’ সাইরাস শিরাক বলল।
‘ওতে ঘটনার স্বাভাবিকতা নষ্ট হয়ে যাবে। প্রমাণ হবে সংস্থা দু’টি শত্রুর ষড়যন্ত্রের শিকার। এর রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া হবে গোটা দুনিয়া ব্যাপী।’
‘তোমার সিসি মাছিও তো ধরা পড়ে যাবে। প্রমাণ হবে ওটাও ষড়যন্ত্র।’
‘এটা প্রমাণ করা কঠিন হবে। ড্রিলিং করা ফুটো বুঝিয়ে দেয়া হবে সংগে সংগেই। আর সেই সময় বিদ্যুত যাবে কয়েক মিনিটের জন্যে। সে ব্যবস্থাও করা হয়েছে। সেই অন্ধকারে মানুষ কিছুই দেখবে না, কিন্তু মানুষের রক্তের গন্ধে পাগল সিসি মাছিগুলো ঠিক গিয়ে বসে যাবে লোকদের ঘাড়ে অথবা কানের পাশটায়। ঘাড় ও কানের পাশটা তাদের একটু চুলকাবে। ব্যস। আমাদের কাজ শেষ। চুলকানোর পর থাবা মেরে বা চুলকিয়ে সিসি মাছি নিজের অজান্তেই তারা মেরে ফেলবে। পরক্ষণেই আসবে আবার আলো। কারণ সার্কিট ব্রেকারের ক্রটিটা ততক্ষণে ঠিক হয়ে যাবে। আলো আসার পর দু’একটা মাছি থাকলেও তা তাদের দৃষ্টিগোচর হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম থাকবে। কারণ সিসি মাছি টিউবে নিষিক্ত হবার পর তার হিংস্রতা বেড়ে যাবে, কিন্তু উড়ার শক্তি ও আগ্রহ তার কমে যাবে।’
‘তার মানে আগের মৃত্যুগুলোর মতই এই গণ মৃত্যু রহস্যের আড়ালে ঢাকা থাকবে।’ সাইরাস শিরাক বলল।
‘আমি তাই মনে করি। গণমৃত্যু ওদের হলেও মৃত্যু তাদের এক জায়গায় হবে না। সময় ও অবস্থান হিসেবে কারও মৃত্যু হবে অফিসে, কারও বা বাড়িতে, আবার কারও হবে রাস্তায়। কিন্তু সকল মৃত্যুর উৎস যে মিটিং রুম তা কারও চিন্তাতেই আসবে না। অতএব সেখানে কোন অনুসন্ধানও হবে না।’
‘ব্রাভো, ব্রাভো। ধন্যবাদ মিঃ রেনেন। চমৎকার তোমার পরিকল্পনা। এই পরিকল্পনা কার্যকরী হলে সংবাদ মাধ্যম দু’টি সেদিনই বন্ধ হয়ে যাবে।’ আনন্দে টেবিলে মুষ্টাঘাত করে উচ্চস্বরে বলল সাইরাস শিরাক।
‘শুধু বন্ধ হয়ে যাওয়া নয়, সংস্থা দু’টির মালিক কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে মামলাও দায়ের হতে পারে ক্ষতিপূরণ দাবী করে অথবা এসব ঘটনার জন্যে তাদের অভিযুক্ত করে।’
‘কিন্তু রহস্যের কথা তারা যদি বলে দেয়?’ বলল সাইরাস শিরাক।
‘বললেও তা প্রমাণ করা কঠিন হবে। তাছাড়া কেন তারা বিষয়টা পুলিকে আগে জানায়নি, কেন তারা গোপন করেছে এজন্যে অভিযুক্ত হবে। এবং তাদের বিরুদ্ধেই এখন এ অভিযোগ উঠতে পারে যে, ষড়যন্ত্রটি তারাই করেছে বিশেষ উদ্দেশ্যে।’ বলল রেনেন।
‘ঠিক বলেছ রেনেন। তোমার বুদ্ধির প্রশংসা করছি। তোমাকে ধন্যবাদ।’
থেমে একটা দম নিল সাইরাস শিরাক। তারপর বলল, ‘তোমার পরিকল্পনা দ্রুত কার্যকরী করার ব্যবস্থা করা দরকার। কঁতদূর এগিয়েছ।’
‘খোঁজ-খবর নেয়া প্রায় সম্পূর্ণ। আমার সিসি বাহিনীও রেডি। এখন একটা দিন-ক্ষণ ঠিক করে এগুলেই হয়ে যায়।’ বলল রেনেন।
‘তোমার সিসি বাহিনীর সংখ্যা কত এখন?’ বলল সাইরাস শিরাক।
‘ছিল তিন ডজন। কিন্তু হ্রদের ঘাঁটিতে যে পরিবেশ ওদের রাখা হয়েছে তাতে ওদের বংশ বৃদ্ধিও ঘটেছে। তিন ডজন এখন মনে হয় ৬ ডজনেরও বেশী দাঁড়িয়েছে।’
‘ধন্যবাদ। বিরাট বাহিনী। দেখো, এই বাহিনী আমাদের ভাগ্য খুলে দেবে।’
‘ইশ্বর তাই যেন করেন মিঃ সাইরাস।’ বলল মিঃ পল।
টেলিফোন বেজে উঠল।
রেনেন উঠল টেলিফোন ধরার জন্যে।
সাইরাস শিরাকও উঠে দাঁড়াল। বলল, ‘আমি ওদিকে আছি।’
বলে সে দরজার দিকে পা বাড়াল।

‘আমাদের অবস্থার কথা বলছেন? আপনাকে হারিয়ে আমরা আতংকে উদ্বেগে দিশাহারা। পুলিশে খবর দেব না কি করব কিছুই বুঝতে পারছিলাম না আমরা। ভাবছিলাম, সিসি মাছির সব ব্যাপার পুলিশকে বলে পুলিশের আশ্রয় নেই।…’
বলছিল WNA-এর চেয়ারম্যান জামাল গটেফ। তার কথার মাঝখানেই আহমদ মুসা বলে উঠল, ‘সর্বনাশ …’
আহমদ মুসার কথার মাঝখানেই জামাল গটেফ আবার বলে উঠল, ‘সর্বনাশ হতে যাচ্ছিল, কিন্তু হয়নি। এক তরুণী রক্ষা করেছেন।’
‘এক তরুণী রক্ষা করেছেন?’
‘হ্যাঁ, এক বিস্ময়কর তরুনী উদয় হয়েছিল।’
‘বিস্ময়কর তরুণী? কিভাবে সে রক্ষা করল?’
‘তিনি পরামর্শ দিয়েছিলেন, পুলিশে খবর দেয়া যাবে না, জনাব আহমদ মুসা পুলিশের কাছে যা প্রকাশ করতে বলেননি, তা প্রকাশ করা যাবে না। ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতে হবে, পারলে নিজেরা কিছু করতে হবে।’
এবার আহমদ মুসার কাছে অনেকটা পরিষ্কার হয়ে গেল তরুণীটি কে হতে পারে। বলল সে, ‘নিশ্চয় তরুণীটি ডোনা জোসেফাইন।’
‘জি হ্যাঁ। মারিয়া জোসেফাইন। ডোনা জোসেফাইনও তার নাম।’ বলল গটেফ।
বলে একটু থেমেই আবার গটেফ শুরু করল, ‘মেয়েটি ভীষণ বুদ্ধিমতী ও সাহসী। সেদিনের পর প্রতিদিন সে যোগাযোগ করছে। হঠাৎ তাঁর আগমন না ঘটলে উদ্বেগ-আতংকে আমাদের অবস্থা যে কি হতো বলতে পারি না।’
‘কিন্তু একজন অপরিচিত মেয়েকে কিভাবে আপনারা বিশ্বাস করে সব কথা বললেন?’
‘কোথায় অপরিচিত, সে তো আপনাকে চেনে?’
‘কিন্তু সেটা তো আপনারা জানেন না। কোন শত্রু তো এভাবে মিথ্যা কথা বলতে পারতো।’
কিছুটা গম্ভীর জামাল গটেফ। বলল, ‘তা পারতো। কিন্তু তিনি যেভাবে বলেছেন, সেভাবে পারতো না। শুধু তো আমি না। সেদিন মিটিং-এ সবাই হাজির ছিলেন। তার কথা সবাই এক বাক্যে বিশ্বাস করেছিলেন।
হাসল আহমদ মুসা। ঠিকই বলেছেন, ‘সত্যের আলাদা একটা শক্তি আছে। মেয়েটি কোথায়?’
‘ফাতেমা হিরেন বলতে পারবে। ওঁর সাথেই যোগাযোগ। কিন্তু বলুন তো? বিস্ময়কর মেয়েটি আসলে কে?’
‘ফ্রান্সের ‘লুই’ রাসপরিবারের বোধহয় একমাত্র রাজকন্যা।’
জামাল গটেফ কিছুক্ষণ ‘হা’ করে আহমদ মুসার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, ‘তাই বলুন। একজন অপরিচিত মেয়ে অপরিচিত পরিবেশে এসে যে ‘কমান্ড’ করল তা রাজকীয়ই বটে। কিন্তু ফরাসী রাজকুমারী এখানে কেন? তার ইসলাম গ্রহনের ব্যাপারটাই বা কি?’
‘যে কেউ তো ইসলাম গ্রহন করতে পারে।’
‘কিন্তু এখানে আসা তার মত রাজকুমারীর?’
‘কিন্তু সে তো এখন রাজকুমারী নয়।’
‘তবু তার আসাটা?’
আহমদ মুসা একটু হাসল। বলল, ‘সব প্রশ্নের উত্তরই একসাথে পাওয়া যায় না। সময় অনেক প্রশ্নের উত্তর আপনাতেই পরিষ্কার করে দেয়। আবার অনেক প্রশ্ন এমন আছে, সরাসরি যার জবাব খুবই বিব্রতকর হতে পারে।’
জামাল গটেফ হাসল। বলল, ‘আমার শেষ প্রশ্নটি কি তেমন ধরনের?’
‘কতকটা তাই।’ আহমদ মুসার ঠোঁটে লজ্জা মিশ্রিত হাসি।
‘মাফ করবেন। আমার প্রশ্ন জেরার মত হয়েছে। যা অসুন্দর অবশ্যই। কিন্তু মন মানছিল না। আলমাহদুলিল্লাহ, আমি জবাব পেয়ে গেছি। মুবারক হোক আপনাদের পবিত্র সম্পর্ক। আমাদের গর্ব আহমদ মুসা যোগ্য সাথী খুঁজে পেয়েছেন।’
গম্ভীর হয়ে উঠেছে আহমদ মুসার মুখমন্ডল। বলল, ‘মিসেস ফাতেমা হিরেন কি অফিসে আছেন?’
‘আছেন। কথা বলবেন?’
‘হ্যাঁ। যদি ডাকেন।’
‘কোন মহিলা সাংবাদিক কর্মচারীকে সম্মিলিত কোন মিটিং ছাড়া কোন কক্ষে ডেকে কথা বলা হয় না। ইন্টারকমে কথা বলা হয়। অথবা কাঁচঘেরা সাক্ষাতকার কক্ষে গিয়ে কথা বলা যায়।’
‘ধন্যবাদ। এটাই ইসলামী নিয়ম। তাহলে ইন্টারকমে ওঁর সাথে লাইন করে দিন।’
ইন্টারকমে ফাতেমা হিরেনের সাথে সংযোগ হওয়ার পর আহমদ মুসা ডোনা কোথায় জানতে চাইল।
ফাতেমা হিরেন বলল, ‘আজ সকালে ওরা ‘ম্যাটার হর্ণ’- এ গেছেন।’
‘ম্যাটার হর্ণ’ বলা যায় সুইজারল্যান্ডের শ্রেষ্ঠ পর্যটন কেন্দ্র। সেখানে কেউ ‘স্নো-স্কি’ করতে যায়, কেউ দেখতে যায়। সবচেয়ে বড় কথা ওখানে দাঁড়িয়ে আল্পস পর্বতমালার অপরূপ দৃশ্য দেখা যায়।
‘ওরা মানে আর কে আছে?’
‘মারিয়া জোসেফাইন আপা এবং তাঁর আব্বা।’
‘ওরা কোথায় উঠেছেন?’
‘উঠেছেন একটা ট্যুরিষ্ট কটেজে। তবে মাঝে মাঝে আত্মীয়ের বাড়িতেও থাকবে। টেলিফোন নম্বার দেব দু’জায়গার?’
আহমদ মুসা টেলিফোন নম্বারগুলো লিখে নিয়ে বলল, ‘আপনি ওর সাথে কবে কথা বলেছেন?’
‘প্রতিদিন কয়েকবার করে কথা হয়। আজ ওরা যাবার আগে মিস মারিয়া আমার সাথে কথা বলেছেন।’
একটু থেমেই ফাতেমা হিরেন আবার বলল, ‘জানেন আরও কি বলেছেন?’
‘কি বলেছেন?’
‘বলেছেন, আপনি শত্রুর হাতে ধরা পড়েননি।’
‘তাই বলেছেন? কি করে জানলেন?’
‘আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম। বলেছেন, আপনি শত্রুর হাতে ধরা পড়লে আমাদের দু’টো প্রতিষ্ঠানে আরও আক্রমণ হতো, থেমে যেতো না। আক্রমণ থেমে যাবার অর্থই হলো শত্রু পর পর দু’বার ব্যর্থ হবার পর পুরনো কৌশল নিয়ে সামনে এগুতে দ্বিধা করছে। আহমদ মুসা তাদের হাতে থাকলে বা আহমদ মুসাকে তাদের পথ থেকে সরাতে পারলে তারা এই দ্বিধা করতো না।’
‘ওর অনুমান ঠিক।’
‘ঠিক না হয়ে পারে। কে উনি দেখতে হবে তো!’
‘আপনি দেখছি তার অনেক কিছু জানেন?’
‘আমাদের ‘ভাবী’র অনেক কিছু জানব সেটাই তো স্বাভাবিক।’
‘দোয়া করুন আমাদের জন্যে।’ গম্ভীর কন্ঠে আহমদ মুসা বলল।
‘আমরা ভাগ্যবান এবং আনন্দিত যে, দু’জনকে এক সাথে দেখার সৌভাগ্য হলো।’
‘ধন্যবাদ। ওরা কবে ফিরবেন বলেছেন?’
‘বলেননি।’
আহমদ মুসা সালাম দিয়ে টেলিফোন রেখে দিয়ে জামাল গটেফকে লক্ষ্য করে বলল, ‘এখন উঠি।’
‘অবশ্যই উঠবেন। কিন্তু আমাদেরকে কিছু আশার কথা শোনান। আমরা সবাই আতংকে প্রতি মুহূর্তে ভাবছি, কোন দুঃসংবাদ কোত্থেকে আসে।’
আহমদ মুসা হাসল। বলল, ‘ডোনা জোসেফাইন মিসেস ফাতেমা হিরেনকে যে কথা বলেছেন, সেটা আপনাকে শোনাই। তিনি বলেছেন, ‘দু’টি সংস্থার উপর শত্রুর আক্রমন বন্ধ থাকাই প্রমাণ করে আহমদ মুসা শত্রুর হাতে পড়েননি। দু’বার ব্যর্থতার পর শত্রু এখন দ্বিধ্যগ্রস্ত। কোন পথে তারা এগুবে চিন্তা করছে।’
উচ্ছ্বাসিত হয়ে উঠল জামাল গটেফ। বলল, ‘ঠিক। কিন্তু এভাবে আমরা চিন্তা করতে পারিনি। ঠিক তাদের আক্রমণ এ কারণেই বন্ধ আছে। সত্যি মিস মারিয়া জোসেফাইনের বিচার-বুদ্ধি বিম্মযকর।’
‘আমি এখন উঠি জনাব। পরে দেখা হবে।’ বলতে বলতে উঠে দাঁড়াল আহমদ মুসা।
জামাল গটেফও উঠে দাঁড়াল। বলল,‘এখন তাহলে আমাদের করনীয়?’
‘চিন্তা করছি। মোরজে’র রাস্তায় সেই ঘটনার সময় ওদের একজনের একটা মানি ব্যাগ পড়ে গিয়েছিল। সেটা আমি পরে পেয়েছি। তাতে এক চিরকুটে একটা টেলিফোন নম্বার আছে। এই ক্লু ধরে একটু এগুবার চেষ্টা করে দেখি।’
বলে আহমদ মুসা সালাম দিয়ে দরজার দিকে পা বাড়াল।
জামাল গটেফ সালাম নিয়ে বলল,‘আল্লাহ আমাদের সহায় হোন।’
আহমদ মুসা কটেজে ফিরে টেলিফোন নম্বারটা নিয়ে অনেক ভাবল। টেলিফোন করে যাচাই করার চিন্তা সে বাদ দিয়ে দিল। টেলিফোন নম্বারটা যদি সত্যিই ব্ল্যাক ক্রস-এর কারো হয়, তাহলে তার টেলিফোন তাদের মনে সন্দেহের সৃষ্টি করতে পারে। কোন প্রকার সন্দেহের সুযোগ আহমদ মুসা তাদের দিতে চায় না।
টেলিফোন গাইড থেকে টেলিফোন নম্বারটির ঠিকানা নিয়ে সে দেখল, উত্তর জেনেভায় অবস্থিত লেক আইল্যান্ডের ৯৯নং বাড়ির টেলিফোন নম্বার এটি। নাম অনুসারে বাড়িটা একটা কমার্শিয়াল টিভি স্টুডিও।
হতাশ হলো আহমদ মুসা। অমন একটা কমার্শিয়াল স্টুডিও ব্ল্যাক ক্রস- এর ঘাঁটি নয় নিশ্চয়। আক্রমণকারীদের কেউ হয়তো অভিনয়ের সাথে জড়িত ছিল। তারই মানিব্যাগে ছিল নম্বারটা। যাচাই না করে শুধু অনুমানকে সত্য বলে ধরে নেওয়াও আহমদ মুসা ঠিক মনে করলো না।
পরদিন রাত ৯টা।
আহমদ মুসা লেক আইল্যান্ডে যাবার জন্যে তৈরী হয়েছে।
বেরুবার আগে সে টেলিফোন করল ফাতেমা হিরেনকে। জানতে চাইল ডোনা জোসেফাইনের কোন খবর আছে কিনা।
ফাতেমা হিরেন বলল, ‘না এ দু’দিন কোন টেলিফোন আসেনি।’
‘মি. জামাল গটেফকে টেলিফোন করে পেলাম না। তার জন্যে একটা মেসেজ কি আমি আপনাকে দিতে পারি?’
‘অবশ্যই। আপনার কোন কাজে আসতে পারা আমার জন্যে সৌভাগ্যের।’
‘আমি একটা ঠিকানায় যাচ্ছি, মিঃ জামাল সেটা জানতে চেয়েছিলেন। আপনি দয়া করে লিখে নিন।’
বলে আহমদ মুসা লেক আইল্যান্ডের সেই বাড়িটার নম্বার এবং টেলিফোন নম্বার তাকে দিয়ে দিল।
টেলিফোন শেষ করে আহমদ মুসা বেরিয়ে এল রাস্তায়।
একটা ট্যাক্সি ডেকে তাতে উঠে বসল।
ড্রাইভারকে লেক আইল্যান্ডে যেতে বলে সিটে গা এলিয়ে দিল সে।
বেশ অনেকটাই পথ।
দক্ষিণ জেনেভা থেকে যেতে হবে উত্তর জেনেভায়। লেক আইল্যান্ড উত্তর জেনেভারও উত্তর প্রান্তে। লেক জেনেভারই একটা উপদ্বীপ এটা।
রাতের অপেক্ষাকৃত ফাঁকা রাস্তা।
বিশ মিনিটেই আহমদ মুসা পৌঁছে গেল লেক আইল্যান্ডের কেন্দ্র বিন্দুতে।
‘কোথায় যাবেন স্যার?’ ফরাসী ভাষায় ড্রাইভার বলল।
‘লেকভিউ স্টুডিও তুমি চেন?’ জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা।
‘কত নম্বার স্যার?’
আহমদ মুসা নম্বার বললে সে বলল, ‘লোকেশানটা চিনেছি।’ বলে সে গাড়ি স্টার্ট দিল।
ড্রইভার ঠিক তার গাড়িটা নিয়ে দাঁড় করাল ৯৯নং লেক আইল্যান্ড বাড়িটার সামনে।
একদম পানির কিনারায় বাড়িটা। যেন পানি থেকেই উঠে এসেছে।
ড্রইভার গাড়ি দাঁড় করিয়েই বলল, ‘স্যার স্টুডিও তো চালু নেই।’
‘চালু নেই? কিন্তু সাইনবোর্ড তো দেখছি।’ বলল আহমদ মুসা।
‘সাইনবোর্ড আছে, কিন্তু স্যার দরজায় ‘খোলা’ কিংবা ‘বন্ধ’ নির্দেশক কোন সাইনবোর্ড নেই।’
‘এ ধরনের সাইন বোর্ড কি অপরিহার্য?’
‘কমার্শিয়াল প্রতিষ্ঠানের জন্যে এটা অপরিহার্যই।’
‘ঠিক আছে নেমে দেখি।’
বলে আহমদ মুসা গাড়ি থেকে নামল এবং ড্রইভারকে ভাড়া চুকিয়ে দিল।
নামল, কিন্তু মনটা খারাপ হয়ে গেল আহমদ মুসার। স্টুডিও যদি সত্যিই বন্ধ থাকে, তাহলে তাকে ব্যর্থ হয়ে ফিরে যেতে হবে। আর সেই সাথে যে লিংকটার উপর নির্ভর করছিল ক’দিন ধরে, তা ছিন্ন হয়ে যাবে। আবার তাকে হাতড়ে ফিরতে হবে ক’দিন কে জানে!
কিন্তু আবার ভাবল, স্টুডিও বন্ধ হয়ে যাওয়ার অর্থ এখানে কোন লোক না থাকা নয়। তার প্রয়োজন তো স্টুডিও- এর সাথে নয়, এখানে মানুষ থাকলেই তার চলে।
‘ধীরে ধীরে বাড়িটার দিকে এগুলো আহমদ মুসা।
তিন তলা বাড়ি।
লেকের তীরে লম্বালম্বি বিল্ডিংটি। বাড়ির মাঝ বরাবর উপরে উঠার সিঁড়ি।
সিঁড়ির মুখে গেট চাইনিজ স্টাইলে তৈরি।
সাইন বোর্ডে নিওন সাইনের আলো ছাড়া বাড়িটার কোথাও এক বিন্দু আলো নেই। সবগুলো জানালা বন্ধ। সবগুলোই লোহার গরাদ এঁটে দেয়া। এমনটা ক্বচিত দেখা যায়। বাড়িতে কেউ না থাকলেই সাধারণত বাড়ি এমনভাবে সীল করা হয়।
আবার সেই সন্দেহটা মাথা চাড়া দিয়ে উঠল আহমদ মুসার মনে, তাহলে বাড়িতে কি কেউ নেই?
আহমদ মুসা গিয়ে দাঁড়াল গেটের সামনে।
দেখল তার দরজা কাঠের হলেও মজবুদ। ইন্টারলক সিস্টেম, তাই বলা মুষ্কিল দরজাটা ভেতর থেকে বন্ধ, না বাইরে থেকে।
আহমদ মুসা ধীরে ধীরে দরজার নব ঘুরাল। দরজা বন্ধ।
আহমদ মুসা পকেট থেকে বের করল ‘মাস্টার কী।’
খুলে গেল তালা।
এক ঝটকায় খুলে ফেলল দারজা। বিদ্যুত বেগে একবার চোখ বুলিয়ে নিল সামনে।
কেউ কোথাও নেই।
সামনে ছোটা চার কোণা একটা করিডোর। করিডোরের সামনের প্রান্ত থেকে সিঁড়ি উঠে গেছে উপরে। সিঁড়ির আলোই ম্লান আলোকে আলোকিত করেছে সামনের করিডোরটিকে। করিডোরের আলো নিভানো।
করিডোরের ডান ও বাম দেয়ালে দু’টি দরজা বন্ধ। এ দু’টি দরজা দিয়ে নিচের তলার দু’পাশের ঘরগুলোতে প্রবেশ করা যায়।
সিঁড়িতে লাইট জ্বলা দেখে আহমদ মুসার মনে আশার সঞ্চার হলো যে, ভেতরে মানুষ আছে।
সিঁড়ির দিকে চাইল আহমদ মুসা। ভাবল উপরে উঠার কথা। কিন্তু পরক্ষণেই তার মনে হলো, অনুসন্ধানের কাজটা নিচ থেকেই হওয়া দরকার। মানুষ থাকলে কোথায় আছে, কতজন আছে, কিছুই তার জানা নেই। সবকিছু দেখে নিশ্চিত হয়েই তার সামনে এগুনো উচিত।
ডানদিকের অংশে প্রথমে প্রবেশের সিদ্ধান্ত নিল আহমদ মুসা।
দরজার নব ঘুরাল।
দরজা প্রধান গেটের মতই বন্ধ। আগের মতই অতি সহজে মাস্টার কী দিয়ে খোলা গেল।
আহমদ মুসা ভাবল খুবই সিম্পল একটা বাড়ি বলে মনে হচ্ছে এটাকে। ব্ল্যাক ক্রসরা তো এত সিম্পল বাড়িতে থাকে না। ডিজিটাল লকের- ব্যবহার সুইজারল্যান্ডে ব্যাপক। তাহলে বাড়িটা কি বন্ধ হয়ে যাওয়া একটা স্টুডিও মাত্র।
ডান অংশের প্রায় সবগুলো ঘরই একে একে দেখা হয়ে গেল। দেখে বিস্মিত হলো, সবগুলো ঘরই সাইন্ড প্রুফ।
হতাশ মনেই ফিরছিল আহমদ মুসা। দৃষ্টি আকৃষ্ট হবার মত কোন ঘরেই কিছু দেখলো না সে।
নিচের তলার লেকের দিক দিয়ে ফিরছিল সে। লম্বা করিডোর। করিডোরের ডান অর্থাৎ লেক প্রান্ত বরাবর দেয়াল। আর বাম পাশে ছোট-বড় বেশ কয়েকটি কক্ষ। সবগুলো রুমই স্যুটিং লোকেশন আকারে সাজানো। আহমদ মুসা ভাবল, নিশ্চয় বিল্ডিংটি স্টুডিও হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। না হলে স্টুডিওগুলো এভাবে থাকতো না।
কাউকে বা সন্দেহজনক কিছু না পেয়ে সন্দেহ জাগছিল আহমদ মুসার মনে গোটা বিল্ডিং কি এভাবেই পরিত্যক্ত?
হঠাৎ আহমদ মুসার চোখে একটা অসংগতি ধরা পড়ল। সে দেখল, ডান পাশের করিডোর বরাবর যে দেয়াল, তার রং একেবারেই নতুন এবং দেয়ালের গায়ে নির্দিষ্ট দূরত্বের ব্যবধানে সমান্তরাল যে লম্বা কাটা তাকেও মনে হচ্ছে খুব নতুন। কিন্তু বাম পাশের ঘরগুলোর যে দেয়াল তার রং বেশ পুরানো।
আহমদ মুসা বুঝল ডান পাশের দেয়াল নতুন অথবা নতুন রং করা।
কিন্তু বিল্ডিং-এর ডিজাইন দেখে দেয়ালটিকে নতুন বলে তার মনে হলো না। তাহলে পুরানো দেয়ালে নতুন রং করা হয়েছে। কিন্তু ঘর বাদ দিয়ে শুধু দেয়ালে রং কেন?
আরও একটা অসংগতি ধরা পড়ল আহমদ মুসার চোখে। একটা পেইন্টিং টাঙানো আছে ডান পাশের দেয়ালে। প্রথমত, এমন অফসাইড দেয়ালে পেইন্টিং থাকার কথা নয়। দ্বিতীয়ত, পেইন্টিংটা দেয়ালের অসংগতত জায়গায় টাঙানো। রীতি অনুসারে পেইন্টিংটা টাঙানোর কথা দেয়ালের মাঝবরাবর, কিন্তু টাঙানো হয়েছে এক পাশে।
এমন অসংগতি স্বাভাবিক নয় আহমদ মুসা ভাবল। তাহলে এই অস্বাভাবিকতা কেন?
আগমদ মুসা গিয়ে পেইন্টিংটির সামনে দাঁড়াল। আলপস-এর খুবই পরিচিত একটা ল্যান্ডস্কেপ। বলা যায় পর্যটন বিভাগের বিজ্ঞাপনী চিত্রের মত। দেয়ালে রং করে এমন একটা চিত্র এখানে টাঙানোর কোন যৌক্তিকতাই আহমদ মুসা খুঁজে পেল না।
আহমদ মুসা পেইন্টিংটি নামিয়ে নিল হাতে।
পেইন্টিং সরিয়ে নেবার সংগে সংগে আহমদ মুসার দৃষ্টি উন্মুক্ত জায়গার দু’টি বোতামের উপর নিবদ্ধ হলো। একটি লাল ও একটি সাদা।
হঠাৎ আহমদ মুসার চোখ দু’টি উজ্জ্বল হয়ে উঠল। লুকানো এ দু’টি বোতাম কোন নতুন পথের সংকেত কি?
বোতাম দু’টির সাধারণল অর্থ খুবই পরিষ্কার। সাদা বোতাম পজিটিভ, আর লাল বোতাম নেগেটিভ। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এই পজিটিভ ও নেগেটিভের পেছনে কোন রহস্য রয়েছে!
আহমদ মুসা ভাবল কোন প্রশ্ন পেছনে রেখে সামনে এগুনো ঠিক নয়।
আহমদ মুসা চাপ দিয়ে দেখল রিভলবার পকেটে ঠিকই আছে।
আহমদ মুসা বিসমিল্লাহ বলে সাদা বোতামে চাপ দিল।
সংগে সংগেই তার একবারে সামনেই দেয়াল সরে গিয়ে একটা দরজা বেরিয়ে পড়ল। সেই সাথে এক ঝলক ভ্যাপসা গরম বাতাস এসে লাগল তা গায়ে। বিস্মিত হয়ে তাকাল সে সামনে।
কড়া আলোয় ঝালসানো আয়তকার একটা চত্বর। উঁচু দেয়াল ও নিচ্ছিদ্র ছাদের নিচে একটা কাঁচের ঘর। গোটা চত্বর কর্দমাক্ত। স্যাঁৎস্যাঁতে পরিবেশ।
আহমদ মুসা দরজা দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করল।
আহমদ মুসা যতটুকু অনুমান করল তাতে বিল্ডিংটির পেছনে লেকের পানিতে মাটি ফেলে ভরাট করে কিছুটা জায়গা বাড়িয়ে নেয়া হয়েছে। আহমদ মুসা খেয়াল করল বাড়িটার দিকে আসার সময় বাড়ির পেছনে রেলিং ঘেরা বাড়তি একটা অংশ দেখেছে। সম্ভবত বসে বসে লেকের সৌন্দর্য উপভোগের জন্যে ওটা বাগান জাতীয় কিছু হবে। তারই একটা অংশে এই ঘর নির্মাণ করা হয়েছে। কিন্তু ঘরটা এমন নিচ্ছিদ্র, গরম ও স্যাঁৎস্যাঁতে কেন? কাঁচের ঘরটাই বা ঘরের ভেতরে কেন?
আহমদ মুসা ধীরে ধীরে এগুলো কাঁচের ঘরটার দিকে। কাঁচের ভেতরে ঘরের অবস্থার দিকে তাকিয়ে বিস্মিত হলো আহমদ মুসা। ঘরের ভেতরে এক শ্রেণীর লতাগুল্ম এবং সেই কর্দমাক্ত স্যাঁৎস্যাঁতে পরিবেশ। একটু ভালো করে চাইতে গিয়ে চোখ দু’টি আহমদ মুসার ছানাবড়া হয়ে গেল। দেখল বহু মাছি উড়ে বেড়াচ্ছে ভেতরে। দেখেই সে চিনতে পারল সিসি মাছি এগুলো।
শিউরে উঠল আহমদ মুসা, তাহলে সে ভয়ংকর মাছির গোডাউনে এসে হাজির! …
ভাবনায় ছেদ নামল আহমদ মুসার। পেছনে পায়ের শব্দ শুনতে পেল। তড়াক করে ঘুরে দাঁড়াল। কিন্তু দেখল একটা রিভলবারের নল তার কপাল বরাবর। তার দু’পাশে আরও দু’টি স্টনগান তার দিকে হা করে আছে।
‘কে তুমি? এ পর্যন্ত পৌঁছার কোন লোক এদেশে আছে বলে তো জানি না?’ বলল রিভলবারধারী।
আহমদ মুসা কোন উত্তর দিল না।
রিভলবারধারীই আবার বলল, ‘তুমিই সেই এশিয়ান। আমাদের নিরুপদ্রুব অগ্রযাত্রায় তুমি বিপর্যয় সৃষ্টি করেছ। কে তুমি?’
প্রশ্ন করেই আবার সে বলল, ‘এখান পর্যন্ত পৌঁছিলে কারও বাঁচার কথা নয়। কিন্তু তোমাকে এত সহজে হত্যা করা ঠিক হবে না। বস আসুক। তোমার গোড়ায় যাওয়া দরকার।’
কথা শেষ করেই একজন স্টেনগানধারীকে লক্ষ্য করে বলল, ‘একে বেঁধে ফেল।’
আহমদ মুসা কোন বাধা দিল না। দেয়ার পরিবেশও ছিল না। শুধু বলল, ‘তোমাদের বস কে?’
‘কে তা টের পাবে। বলল সেই রিভলবারধারী।
‘সাইরাস শিরাক কি?’
‘সাইরাস শিরাককে তুমি জান?’ বিস্ময় রিভলবারধারীর কন্ঠে।
আহমদ মুসা নিশ্চিত হলো, এরা ব্ল্যাক ক্রস নিঃসন্দেহে।
‘আমার প্রশ্নের জবাব না দিয়ে তোমার প্রশ্নের উত্তর আশা করতে পার না।’ বলল আহমদ মুসা।
‘সবই বুঝা যাবে সব আসলে। নিয়ে চল একে।’
আহমদ মুসার দুই হাত পিছমোড়া করে বেঁধে তাকে নিয়ে চলল।

Top