২২. অদৃশ্য আতঙ্ক

চ্যাপ্টার

চ্যাপ্টার

তেষট্টি লিভিংস্টোন রোড।
আহমদ মুসা বাইবেল সোসাইটির সামনে দাঁড়িয়ে সামনের অংশটার উপর নজর বুলাল।
গেট পার হলেই প্রশস্ত একটা কম্পাউন্ড। তারপরে কম্পাউন্ডের উত্তর প্রান্ত বরাবর দীর্ঘ বারান্দা। চার ধাপের সিঁড়ি ভেঙে বারান্দায় উঠতে হয়। লম্বা বারান্দার মাঝখানে একটা বড় দরজা। বড় দরজার দু’পাশে বারান্দায় আরও কয়েকটা দরজা আছে। বিল্ডিং-এর মাথায় একটা সাইনবোর্ড। লেখা আছে, বাইবেল সোসাইটি স্কুল।
বাইবেল সোসাইটি স্কুলের পুব পাশে একটা গীর্জা। গীর্জা এবং স্কুল একই বাউন্ডারী প্রাচীরের ভেতরে। আহমদ মুসা বেলাল ম্যাকাকোর কাছ থেকে বাইবেল সোসাইটির যে বিবরণ পেয়েছে, তাতে এখানে বাইবেল স্কুল ও গীর্জা ছাড়াও একটা আবাসিক এলাকা ও গোডাউন এলাকা রয়েছে। সব নিয়েই বাইবেল সোসাইটি কমপ্লেক্স।
আহমদ মুসা বাইবেল সোসাইটির সামনে দিয়ে লিভিংস্টোন রোড ধরে হাঁটতে হাঁটতে ভাবল, গোডাউন ও আবাসিক এলাকা তাহলে গীর্জা ও স্কুলের পেছনে হবে।
আহমদ মুসা দেখেছে, স্কুল ও গীর্জার মাঝে উভয়কে বিভক্তকারী একটা প্রাচীর আছে।
সকালের আমেজ কেটে যাচ্ছে। রাস্তায় লোক চলাচল দু’একজন করে শুরু হয়েছে। কিন্তু গেটের ফাঁক দিয়ে উঁকি দিয়েও বাইবেল সোসাইটির ভেতরে কাউকে আনাগোনা করতে দেখা পেল না আহমদ মুসা। হয় সকলে ঘুমচ্ছে অথবা স্কুল ও গীর্জার কাজ শুরু হয়নি বলে কাউকে দেখা যাচ্ছে না। আহমদ মুসা মনে করল, ভেতরে ঢুকার এটাই সময়।
কিন্তু পরক্ষণেই ভাবল, স্কুল ও গীর্জার অফিস খুললে ভেতর ও বাইরের লোকের আনাগোনা বাড়বে, সেই সুযোগে প্রবেশ করাটা সবচেয়ে সুবিধাজনক। সে আরও ভাবল, ভেতরে ঢোকার আগে চারদিকটা একবার ভাল করে দেখা দরকার। এতে ভেতরে ঢুকে জরুরী মুহূর্তে সিদ্ধান্ত নেয়া তাঁর পক্ষে অনেক সহজ হবে।
ঠিক করল আহমদ মুসা, স্কুল ও গীর্জা খুলুক, ততক্ষণে সে বাইবেল সোসাইটি কমপ্লেক্সের চারদিকটা ঘুরে আসবে।
সোসাইটি কমপ্লেক্সের পুব দিক দিয়ে গীর্জার পাশ বরাবর বেশ ফাঁকা। তারপরে সীমানা প্রাচীর। প্রাচীরের পাশ দিয়ে পায়ে চলার মত রাস্তা।
আহমদ মুসা এগুলো সেই রাস্তা ধরে। পায়ে চলা রাস্তাটা উত্তর দিকে নদীর ধার পর্যন্ত গিয়ে শেষ হয়েছে।
আহমদ মুসা নদীর ধারে বাইবেল সোসাইটির সীমানা প্রাচীরের পূর্ব-উত্তর কোণ ঘেঁষে দাঁড়াল।
সেখান থেকে নদীর ধারটা ঢালু হয়ে নেমে গেছে নদীতে।
আহমদ মুসা বাইবেল সোসাইটির দিকে নজর ফেরাল। দেখল, হাত কয়েক দূরে উত্তর দিকের সীমানা প্রাচীরের গায়ে একটা বড় গেট। গেট থেকে একটা পাকা ঘাট নেমে গেছে নদীতে। গেটটা বন্ধ।
আহমদ মুসা বুঝল, নদী পথে এদের যোগাযোগ এ ঘাট পথেই। মুসলিম নেতৃবৃন্দকে কিডন্যাপ করে সম্ভবত এ ঘাট পথেই বাইবেল সোসাইটিতে ঢুকিয়েছে।
উত্তর সীমানার পশ্চিমে বেশ কিছুদূর এগিয়ে নদীর দিকে বেড়ে আসা বিল্ডিং এর মূল দেয়ালের সাথে মিশে গেছে। অর্থাৎ বিল্ডিং-এর পশ্চিম অংশের উত্তর প্রান্তটা, বলা যায়, পানির উপর দাঁড়িয়ে আছে।
আহমদ মুসা স্মরণ করল, বিল্ডিং-এর এই অংশটা বেলাল ম্যাকাকোর বিবরণ অনুসারে গোডাউন হিসেবে ব্যবহার হয়।
আহমদ মুসা ভাবল, পণবন্দি মুসলিম নেতৃবৃন্দকে নিশ্চয় গীর্জা ও স্কুল অংশে রাখা হয় নি। কারন ১২ জনের একটা বিরাট দলকে গীর্জা ও স্কুলের মত জনসমাবেশের স্থানে রাখা সম্ভব নয়। তাহলে নিশ্চয় রাখা হয়েছে আবাসিক অথবা গোডাউন এলাকায়। এ দু’য়ের মধ্যে কোথায় তাদের রাখা হতে পারে? মুসলিম বিশ্বের শীর্ষ ও সম্মানিত নেতাদের আরামদায়ক আবাসিক এলাকায় রাখাটাই স্বাভাবিক। কিন্তু যাদের জীবনের সীমা পনের দিনে সীমিত করা হয়েছে, তাদের সুখ-সুবিধার কথা নিশ্চয় ওদের বিবেচনার কথা নয়।
কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারল না আহমদ মুসা।
ভেতরে ঢুকেই সন্ধান করতে হবে, ভাবল আহমদ মুসা। তবে দিনের বেলা এই সন্ধান করা খুবই বিপজ্জনক। কিন্তু সামনে একটা রাত মাত্র তার হাতে আছে। তারপরেই ১৫তম দিন। কে জানে পনের তারিখের সূর্যোদয়কেই যদি ওরা বন্দীদের শেষ সময় ধরে থাকে। সুতরাং শেষ রাতের ঝুঁকি সে নিতে পারে না। তাই সকালেই সে ছুটে এসেছে।
কিন্তু দিনের এই ঝুঁকিপূর্ণ মিশন তার কেমন হবে? বন্দী নেতৃবৃন্দকে খুঁজে পাবার আগে সংঘর্ষ শুরু হয়ে গেলে ওদের কাছে ঠিক সময়ে পৌঁছা এবং যথাসময়ে উদ্ধার করা কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। অতীতে কখনই সময় তার কাছে এত মুল্যবান মনে হয় নি। শত্রুর এমন ‘ডেডলাইন’- এর মোকাবিলাও তাকে করতে হয়নি কখনও।
আহমদ মুসার দু’চোখ নিবদ্ধ ছিল বাইবেল সোসাইটির উত্তর প্রান্ত বরাবর নদী তীরের উপর। সংঘ নদীর স্বচ্ছ পানি ঢেউয়ে সোয়ার হয়ে এসে আছড়ে পড়ছে পাথর বাধানো তীরে। সেই ঢেউয়ে নাচছিল মাঝারি সাইজের একটা মটর বোট। মটর বোটটি আহমদ মুসার আগেই নজরে পড়েছে। কিন্তু হঠাৎ করেই এবার মটর বোটটির অবস্থান আহমদ মুসার দৃষ্টি আকর্ষণ করল। বোটটি ঘাট থেকে অতদূরে কেন?
ঘাট থেকে পশ্চিমমুখী প্রাচীরটা যেখানে গিয়ে শেষ হয়েছে, সেখান থেকে আট দশ ফিট পশ্চিমে তীর থেকে বেশ একটু দূরে বোটটি পানিতে ভাসছে।
আহমদ মুসা বিস্ময়ের সাথে লক্ষ্য করল, বোট থেকে একটা শিকল পানিতে নেমে গেছে। বোট নড়ার কারনে যখন শিকলে টান পড়ছে, দেখা যাচ্ছে পানির সমান্তরালে শিকলটি তীরের পাথরের মধ্যে ঢুকে গেছে। ওখানে তীরের পাথরের ফরমেশনটা অপেক্ষাকৃত খাড়া।
ভ্রু কুচকাল আহমদ মুসা। বোট ওখানে কেন? ঐভাবে কেন?
বেলাল ম্যাকাকোর বিবরণ অনুসারে বাইবেল সোসাইটি কমপ্লেক্সের ঐ অঞ্চলটা গোডাউন এলাকা। ওখানে কোন ঘাট নেই, কিন্তু বোট তাহলে কেন? এ ঘাট থেকে বোটটাকে কি ওখানে সরিয়ে রাখা হয়েছে? কিন্তু কেন? কি করে? পানিতে না নেমে বোটের কাছে পৌঁছা সম্ভব নয়। সুতরাং ঘাটের বোট ওখানে রাখা স্বাভাবিক নয়।
আহমদ মুসাকে সবচেয়ে বিস্মিত করল পানির সমান্তরালে বা পানির দু’এক ইঞ্চি নিচ দিয়ে বোটের শিকল তীরের পাথরের মধ্যে ঢুকে যাওয়ার ব্যাপারটা।
পাশেই একটা শব্দ হলো। শব্দটা এসেছে সেই দরজার দিক থেকে। দরজায় কেউ এলো নাকি?
আহমদ মুসা দ্রুত করে প্রাচীরের আড়ালে দাঁড়াল। উঁকি দিয়ে দেখল, দরজা খুলে গেছে। পায়ের শব্দ পেল আহমদ মুসা। মাথাটা প্রাচীরের আড়ালে নিয়ে পকেটে হাত দিয়ে রিভলবার স্পর্শ করল আহমদ মুসা।
দরজা দিয়ে দু’জন মহিলা পরপর বেরিয়ে এসে দরজার বাইরের ল্যান্ডিং-এ দাঁড়াল।
দু’জনেরই পরনে ট্রাক স্যুট।
স্পষ্টই বুঝা যাচ্ছে, ওরা ব্যায়াম করে বেরিয়ে এসেছে।
ল্যান্ডিং-এ বসল ওরা।
ট্রাক স্যুটের চেন ওরা খুলে ফেলল।
ওরা হাওয়া খেতে চায়।
দু’জনেরই বয়স তিরিশের কাছাকাছি হবে।
হাত-পা ছড়িয়ে বসে ওদের একজন বলল, ‘জেনি, যে দু’টো বোট ব্রাভাজিল গেছে, কবে ফিরবে?’
‘জানিনা, মনে হয় দু’একদিনের মধ্যেই।’ বলল জেনি নামের মেয়েটা।
‘এ সময় ঐ বোটটা ঘাটে এনে রাখা যায় না? এমন সময় কাজে না লাগলে কখন আর কাজে আসবে?’
‘রেন, তুমি দেখি কিছুই জাননা। ঐ বোটটা ওখানকার জন্যই।’
‘কেন?’
‘ইমারজেন্সী প্যাসেজের জন্যে রাখা হয়েছে।’
চমকে উঠল আহমদ মুসা। ইমারজেন্সী প্যাসেজ! এর অর্থ কি?
জরুরী মুহূর্তের বাহন হিসেবে বোটটাকে রিজার্ভ রাখা হয়েছে?না ইমারজেন্সী প্যাসেজেই বোটটাকে বেঁধে রাখা হয়েছে? ওখানে কি ইমারজেন্সী প্যাসেজ আছে?
ইত্যাদি প্রশ্ন এসে আহমদ মুসার মনে ভীড় জমাল। সে বুঝতে চেষ্টা করল। শেষের দু’টি প্রশ্নকেই সে ইতিবাচক মনে করল। অর্থাৎ মনে হলো, বোটটা যেখানে নোঙর করা, সেখানেই কোথাও গোপন প্যাসেজ রয়েছে।
খুশীই হল আহমদ মুসা। বোটের ওখানে গিয়ে যদি গোপন প্যাসেজটা বের করা যায়, তাহলে তার অভিযান অনেক নিরাপদ হতে পারে।
‘কে তুমি, এখানে কি করছ?’- পেছন থেকে আসা আকস্মিক এই শব্দে আহমদ মুসা লাফ দিয়ে উঠে ঘুরে দাঁড়াল। দেখল, মারমুখো এক শ্বেতাঙ্গ।
মারমুখো হবারই কথা। আহমদ মুসা যেভাবে গুটি গুটি মেরে প্রাচীরের আড়ালে বসে ছিল তাতে তাকে চোর-বাটপার কিংবা তার চেয়ে বড় কিছু ভাবা খুবই স্বাভাবিক।
আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াতেই লোকটার বাম হাত তড়াক করে এসে আহমদ মুসার জ্যাকেটের কলার চেপে ধরল। আর ডান হাতের এক প্রচণ্ড ঘুষি ছুটে এল আহমদ মুসার দিকে।
আহমদ মুসা ডান হাত দিয়ে তার ঘুষিটা ঠেকিয়ে বাম হাত দিয়ে লোকটির বাম বাহুর সন্ধিতে আঘাত করল।
লোকটির বাঁ হাত খসে গেল আহমদ মুসার কলার থেকে।
আহমদ মুসার এই আকস্মিক প্রতিরোধ সে আশা করেনি। মুহূর্তের জন্যে সে থমকে গিয়েছিল। তার চোখে ফুটে উঠেছিল বিস্ময়।
তার এই নিষ্ক্রিয় অবস্থার সুযোগ গ্রহন করল আহমদ মুসা। ডান হাতের কারাত চালাল সে লোকটির বাঁ কানের ঠিক নিচটায়।
টলতে লাগল লোকটির দেহ। কয়েক মুহূর্ত। পড়ে গেল লোকটি গোড়া কাটা গাছের মত।
আহমদ মুসা বাইবেল সোসাইটির সামনে ফিরে যাবার জন্যে পা বাড়িয়ে তাকাল সামনের রাস্তার দিকে।
তাকিয়েই চোখ দু’টি চঞ্চল হয়ে উঠল আহমদ মুসার। দেখল, দু’জন লোক মার মুখো হয়ে ছুটে আসছে। ওদের হাতে রিভলবার।
আহমদ মুসা চকিতে পেছনে নদীর দিকে একবার তাকাল। দেখল, যে মেয়ে দু’টিকে সে দরজার ল্যান্ডিং-এ বসে গল্প করতে দেখেছিল, ওরা নদীতে গোসল করতে নেমেছে।
আহমদ মুসার মাথায় একটা নতুন চিন্তা ঝিলিক দিয়ে উঠল। সংগে সংগে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিল সে।
লাফ দিয়ে আহমদ মুসা প্রাচীরের কোলে নদীর তীরে গিয়ে পড়ল। তারপর উত্তরের প্রাচীরের পাশ দিয়ে দৌড়ে দরজার ল্যান্ডিং-এ গিয়ে উঠল।
ল্যান্ডিং-এ মেয়ে দু’টির খুলে রেখে যাওয়া কাপড়।
নদীতে সাঁতাররত মেয়ে দু’টি দেখতে পেয়েছে আহমদ মুসাকে।
‘কে, কে তুমি, কি চাও’ বলে চিৎকার করে উঠল তারা।
সেদিকে খেয়াল করার সময় নেই আহমদ মুসার।
আহমদ মুসা দ্রুত দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল।
কয়েক মুহূর্ত পরে রিভলবারধারী দু’জন ছুটে এসে প্রাচীরের সেই কোনায় নদী তীরে দাঁড়াল। তাকাল নদীর দিকে। তাদের ধারণা তাড়া খেয়ে তাদের শিকার নিশ্চয় নদীতে ঝাপিয়ে পড়ে পালাবার চেষ্টা করছে।
নদীর দিকে তাকিয়ে দেখতে পেল মেয়ে দু’টিকে।
মেয়ে দু’টির উপর চোখ পড়তেই সম্ভ্রম ফুটে উঠল লোক দু’টির চোখে-মুখে।
মেয়ে দু’টির একজন মোবাসা বাইবেল সোসাইটি কমপ্লেক্সের প্রধান পরিচালকের স্ত্রী, অন্যজন গীর্জার অধ্যক্ষের স্ত্রী।
লোক দু’টির একজন দ্রুত সম্ভ্রমের সাথে জিজ্ঞেস করল, ‘শয়তানটা এখানে ঘাপটি মেরে আপনাদের উপর চোখ রাখছিল। পালাবার জন্যে নদীতে লাফ দিয়েছে নিশ্চয়! কোন দিকে গেছে?’
মেয়ে দু’টির চোখ তখনও ছানাবড়া। তীরের দিকে অনেকখানি উঠে এসেছে তারা। ওদের একজন বলল, ‘না নদীতে লাফ দেয়নি! ভেতরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিয়েছে।’
লোক দু’টি এক সংগে দরজার দিকে তাকাল। দেখল, দরজা বন্ধ। তাদের চোখে বিস্ময় ফুটে উঠল। তাদের একজন স্বগত কণ্ঠে বলল, ‘বিপদ দেখে লোকটির নিশ্চয় মাথা খারাপ হয়ে গেছে। তা না হলে নিজের পায়ে হেঁটে এসে কেউ খাঁচায় ঢোকে!’
বলে দু’জনেই দরজায় গিয়ে ধাক্কা দিল, দরজা ভেতর থেকে বন্ধ করে দেয়া।
হাসল আগের সেই কথা বলা লোকটি। বলল, ‘ফাঁদে ফেলে যেমন ইঁদুর ধরে, সেভাবেই লোকটিকে ধরা হবে।’
বলে একটু থেমেই তার সাথীকে বলল, ‘তুমি এ দরজা পাহারা দাও যাতে পালাতে না পারে দরজা খুলে। আমি গিয়ে সামনে দিয়ে ঢুকছি।’
যাবার জন্যে ঘুরে দাঁড়িয়ে তীরে উঠে আসা সেই মেয়ে দু’টিকে বলল, ‘দুঃখিত ম্যাডাম, ব্যাটা ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করে দিয়েছে। একটু কষ্ট করে সামনে দিয়ে ঢুকতে হবে। ব্যাটা নিশ্চয় কোন ছিঁচকে চোর বা মাথা খারাপ কেউ। এখনি ধরা পড়বে।’
বলে লোকটি রিভলবার পকেটে রেখে হাঁটা শুরু করল বাইবেল সোসাইটি কমপ্লেক্সের সামনে যাবার জন্যে।
ওদিকে আহমদ মুসা দরজা বন্ধ করেই পেছনে ঘুরে দাঁড়াল। দেখল সে একটি কংক্রিটের রাস্তার উপর দাঁড়িয়ে আছে। রাস্তাটি অল্প এগিয়ে একটা বাংলোতে উঠেছে। বাংলোটির পাশ দিয়ে রাস্তাটির আরও দুটি শাখা, একটি দক্ষিণে, অন্যটি উত্তরে চলে গেছে। রাস্তা থেকে আরেকটি শাখা তার ঠিক সামনে দিয়েই তার ডান পাশে পশ্চিম দিকে চলে গেছে। রাস্তার মাঝের স্থানগুলোতে মাঝে মাঝে ফুলের গাছ।
আহমদ মুসা সামনের বাংলোর দিকে যাবার জন্যর পা বাড়িয়েছিল। হঠাৎ দেখতে পেল সাম্নের বাংলোটির দরজা দিয়ে একজন লোক বেরিয়ে আসছে। আহমদ মুসা ভাবল, সে ডানের রাস্তা দিয়ে পশ্চিম দিকে সরে পড়বে। কিন্তু পা বাড়াতে গিয়ে দেখল, লোকটি আহমদ মুসাকে দেখতে পেয়েছে। এই অবস্থায় সরে পড়তে চেষ্টা করে কোন লাভ নেই।
সে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল।
‘আমি আপনার সাহায্য পেতে পারি, মশায়।’ লোকটির দিকে চেয়ে একটু উচ্চ স্বরে বলল আহমদ মুসা।
লোকটির পরনে হাফপ্যান্ট এবং গায়ে গেঞ্জি।
আহমদ মুসাকে দেখে লোকটির মধ্যে কোন ভাবান্তর সৃষ্টি হয়নি। কিন্তু আহমদ মুসা যখন সাহায্য চাইল, বিস্ময় ফুটে উঠল লোকটির চোখে-মুখে।
বিস্মিত লোকটি এগিয়ে এল আহমদ মুসার দিকে। বলল, ‘আপনার কি সমস্যা? নতুন কি আপনি এখানে?’
লোকটি নিশ্চয় আহমদ মুসাকে তাদের কোন মেহমান মনে করেছে।
‘আমি বন্দীদের এ্যাটেনডেন্ট, সকালে বাইরে বেরিয়ে রাস্তা হারিয়ে ফেলেছি।’ এ সস্তা মিথ্যে কথাটা লোকটাকে বিশ্বাস করানো যাবে না সন্দেহ নিয়েই কথাটা বলল আহমদ মুসা। কারন মুসলিম বন্দীরা কোথায় আছে তা জানাই তার এখন প্রধান কাজ।
আহমদ মুসার কথা শুনে কপালটা কুঞ্চিত হলো লোকটির। বিস্ময়টা তার আরও যেন গাঢ় হলো। বলল, ‘বন্দীরা তো গোডাউন সেকশনে, আপনি এতদুর এলেন কেন?’
আহমদ মুসা কে উত্তর দিতে হল না। পেছনের দরজায় ধাক্কা পড়তে লাগল। একজন চিৎকার করল, ‘কে কথা বলছেন, দরজা খুলুন।’
‘ও তো টুর্গোর গলা। ওপারে কেন?’ দরজার দিকে তাকিয়ে কথাগুলো উচ্চারন করে লোকটি আহমদ মুসা কে বলল, ‘মাফ করুন। আমি দরজাটা খুলে দিয়ে আসি।’
বলে সে দরজার দিকে পা বাড়াল।
আহমদ মুসা জানে। লোকটি দরজা খুলে দেয়া মানে আহমদ মুসার সংকট বাড়া।
সুতরাং তাকে দরজা খুলতে দেয়া যায় না।
লোকটি যখন আহমদ মুসাকে অতিক্রম করে যাচ্ছিল, তখন আহমদ মুসা ডান হাতের একটা কারাত চালাল লোকটির মাথা ও ঘাড়ের মধ্যবর্তী নরম জায়গাটায়।
লোকটি মুখ দিয়ে শব্দও করতে পারল না। একটা পাক খেয়ে সংজ্ঞা হারিয়ে রাস্তায় পড়ে গেল।
আহমদ মুসা দ্রুত তাকে টেনে একটা ফুলের গাছের আড়ালে রাখল।
তারপর আহমদ মুসা ডান পাশের যে রাস্তাটা প্রাচীরের সমান্তরালে পশ্চিম দিকে এগিয়ে গেছে, সে রাস্তা দিয়ে শান্তভাবে দ্রুত অগ্রসর হলো।
আহমদ মুসা জানে গোডাউন সেকশন বাইবেল সোসাইটি কমপ্লেক্সের উত্তর-পশ্চিম অংশে। সুতরাং নদীর সমান্তরালে পশ্চিম দিকে এগুলেই ওই সেকশনে পৌঁছাতে পারে। আহমদ মুসা নিজেকে এখন অনেকখানি হালকা অনুভব করছে। সে নিশ্চিত মুসলিম নেতৃবৃন্দকে গোডাউন সেকশনেই বন্দী করে রাখা হয়েছে।
একটু সামনেই বামপাশে একটা বাংলো পেল। লনে দুটি বালক একটা বল নিয়ে খেলার মহড়া দিচ্ছে।
লনের পাশ দিয়েই রাস্তা।
আহমদ মুসার দিকে চোখ পড়তেই ওরা খেলা বন্ধ করে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। ওদের বিস্ময় দৃষ্টি আহমদ মুসার দিকে।
আহমদ মুসা বুঝল, সে যে নতুন আগন্তুক এ কথা বালকরাও বুঝতে পেরেছে। এ আবাসিক এলাকায় নিশ্চয় এমন কোন আগন্তুক আসে না।
আরেকটু সামনে এগিয়ে আহমদ মুসা দেখল, দুই জোড়া পুরুষ মহিলা টেনিস খেলছে। ওদের পোশাক দেখলেই বোঝা যায় সকালের ব্যায়াম করছে ওরা।
আহমদ মুসা দ্রুত হাঁটছিল।
টেনিস কোর্টের সীমানায় গিয়ে থমকে দাঁড়াল।
তার সামনেই এ পাশের দু’জনের একজন, পুরুষ লোকটি, সার্ভ করতে যাচ্ছিল। তার বাম হাতে বল এবং ডান হাতে উদ্যত র‍্যাকেট।
‘মাফ করবেন, আমি এখানে নতুন। ওদিকটায় যাব। কোন পথে যেতে হবে?
লোকটির সার্ভ করা আর হল না। তার বল ও ব্যাকেট ধরা হাত দু’টি নিচু হয়ে ঝুলে পড়ল। তার চোখে একটু অবাক হওয়ার ভাব। বলল, ‘কে তুমি, কি কাজ ওদিকে?’
‘মুসলিম বন্দীরা আছে। ওখানে যাব।’
‘কি কাজ তোমার ওখানে? কে তুমি?’
লোকটির পার্টনার মহিলাটি এসে লোকটির পাশে দাঁড়িয়েছে। অন্যদিকে কোর্টের ওপাশ থেকে র‍্যাকেট নাচাতে নাচাতে বিরক্তির সাথে মহিলা একজন বলে উঠল, ‘সময় নেই, কি করছ তোমরা?’
ঠিক এই সময়েই পুব ও দক্ষিণ দিক থেকে চার পাঁচজন লোক ‘চোর’ ‘চোর’ বলতে বলতে ছুটে এল।
ঘিরে ফেলল ওরা আহমদ মুসাকে।
একজনের হাতে পিস্তল।
পিস্তলধারীকেই সে বাইরে দেখেছিল তার দিকে ছুটে আসতে।
‘বাছাধন, আমাদের একজন লোককে কুপোকাত করে ভেবেছিলে পার পেয়ে যাবে। তুমি কেমন অন্ধ চোর হে যে বাঘের খাঁচায় ঢুকেছ?’ বলে রিভলবারধারী লোকটি তার রিভলবারের নল দিয়ে খোঁচা দিল আহমদ মুসার মাথায়।
‘চোর মানে? লোকটি চোর নাকি?’ টেনিস খেলোয়াড় যার সাথে আহমদ মুসা কথা বলছিল, তার চোখে বিস্ময়।
‘চোর তো চোর। সাংঘাতিক লোক। ওপারে আমাদের একজন লোককে মেরে অচেতন করে ফেলেছে।’ বলেই রিভলবারধারী তার রিভলবারের বাঁট তুলল আহমদ মুসার মাথা লক্ষ্যে। ছুটে আসছিল তার ডান হাতে ধরা রিভলবারের বাঁটটি।
আহমদ মুসা শেষ মুহূর্তে মাথাটা একদিকে সরিয়ে বাঁ হাত দিয়ে তার ছুটে আসা হাতটা ঠেকিয়ে ডান হাত দিয়ে তার হাত থেকে রিভলবার কেড়ে নিয়ে লোকটির বুকে রিভলবারের নল চেপে চাপা কণ্ঠে কঠোর নির্দেশ দিল, ‘তোমার সাথীরা যে যেখানে দাঁড়িয়ে আছে, সেখানে হাত তুলে বসে পড়তে…’
আহমদ মুসার কথা শেষ হবার আগেই তার ডান পাশে দাঁড়ানো লোকটির টেনিস র‍্যাকেট এসে আঘাত করল আহমদ মুসার ডান হাতে।
আহমদ মুসার হাত থেকে রিভলবার পড়ে গেল।
সঙ্গে সঙ্গেই সামনে দাঁড়ানো লোকটি, যার বুকে পিস্তল ধরেছিল আহমদ মুসা, জাপটে ধরার জন্যে ঝাপিয়ে পড়ল আহমদ মুসার উপর।
আহমদ মুসা বুঝল বেকায়দায় সে পড়ে গেছে। এদের ঘেরাও থেকে মুক্ত হওয়াই এখন প্রথম কাজ।
সামনের লোকটি ঝাপিয়ে পড়ার সাথে সাথেই আহমদ মুসা বসে পড়েছিল। ঝাপিয়ে পড়া লোকটি ভারসম্য হারিয়ে আহমদ মুসার পেছনে হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল।
বেষ্টনীর সামনেটা ফাঁকা হয়ে গেল।
আহমদ মুসা উঠে দাঁড়িয়ে এক লাফে বেরিয়ে এল বেষ্টনী থেকে।
পকেট থেকে বের করে নিয়েছে রিভলবার।
কিন্তু সে সিদ্ধান্তই নিয়েছে, এই মুহূর্তে সে রিভলবার ব্যবহার করবে না। যুদ্ধের আগে যুদ্ধ করে তার আসল লক্ষ্য সে পণ্ড করতে চায় না। যতটা সম্ভব গোপনে প্রথমে তার বন্দীদের কাছে পৌঁছা দরকার।
আহমদ মুসার হাতে রিভলবার দেখে ওরা থমকে দাঁড়িয়েছিল। হুমড়ি খেয়ে পড়ে যাওয়া লোকটি পাশ থেকে রিভলবার কুড়িয়ে নিয়েই উঠে দাঁড়িয়েছিল।
‘কোথায় তোমরা মাইকেল?’ -এই শব্দটি এ সময় দক্ষিন থেকে ভেসে এল।
ওদিকে এক পলক চেয়েই আহমদ মুসা বাম হাত তার পকেটে ঢুকিয়ে টেবিল টেনিস বলের মত গোলাকৃতি একটা বস্তু বের করল। ভাবল, আর সময় নেয়া যাবেনা, এদের খোঁজে আরও লোক এসে পড়তে পারে।
গোল বস্তুটি একটা ক্লোরোফরম বল। দ্রুত প্রসারমান এর অদৃশ্য ধোয়া মানুষের নাকে প্রবেশ মাত্র সে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে।
আহমদ মুসা বাম হাতেই বলটা ছুড়ে মারল। পড়ল গিয়ে ওদের মাঝখানে।
ছোট্ট একটা শব্দ হল। তারপর কয়েক মুহূর্ত। লোকগুলো প্রায় একসাথে গোড়া কাটা গাছের মত লুটিয়ে পড়ল মাটিতে।
আহমদ মুসা পা বাড়াতে যাবে, এমন সময় দক্ষিনের রাস্তা দিয়ে ছুটে আসা একজন লোক আহমদ মুসার মুখোমুখি হয়ে গেল।
আহমদ মুসা বুঝল, এইমাত্র এই লোকটিই কোন এক ‘মাইকেলের’ নাম ধরে ডেকেছিল। যারা জ্ঞান হারিয়েছে তাদেরই একজন হয়তো সে হবে।
লোকটি আহমদ মুসার মুখোমুখি হয়ে প্রথমে বিস্মিত হয়ে পড়েছিল। পরে সামনেই তাদের লোকগুলোকে মাটির উপর নেতিয়ে পড়ে থাকতে দেখে আতংক ফুটে উঠল তার চোখে।
আহমদ মুসার ডান হাতে রিভলবার ছিলই।
আহমদ মুসা লোকটির দিকে রিভলবার তুলে ধরে বলল, ‘রিভলবারের কি কাজ তুমি জান। মরতে না চাইলে বল, ওধারে গোডাউনের অংশে পৌঁছার কাছাকাছি পথ কোনটা?’
লোকটার চেহারা ভয়ে ফ্যাকাশে হয়ে গেল। টার ঠোঁট কাঁপল, কিন্তু কোন কথা বেরুল না। যেন বাক রোধ হয়ে গেছে তার।
আহমদ মুসা তার রিভলবার তার মাথা বরাবর তুলে ধরল। তার তর্জনী ট্রিগারে চেপে বসতে লাগল।
লোকটি সবই দেখতে পাচ্ছিল।
তার চোখ ছানাবড়া হয়ে উঠল। মৃত্যুভয় ফুটে উঠল তার চোখে। বলল কাঁপা গলায়, ‘কাছে কোথাও গেট নেই। একটাই গেট, মেইন গেট।’
‘এস, চল। প্রাচীরের দিকে চল।’ বলল কঠোর কণ্ঠে আহমদ মুসা।
লোকটি আগে আগে চলল। রিভলবার সমেত হাতটা পকেটে রেখেছে আহমদ মুসা।
প্রাচীরের গোড়ায় গিয়ে দাঁড়াল লোকটা।
আহমদ মুসা গিয়ে দাঁড়াল তার পেছনে।
এই এলাকায় প্রচুর গাছ-গাছড়া। বড় গাছও আছে।
খুশী হল আহমদ মুসা। শত্রুর নজরে পড়া থেকে কিছুটা বাঁচা যাবে।
আহমদ মুসা পকেট থেকে রিভলবার সমেত হাতটা বের করল। রিভলবারের নল লোকটির পাঁজরে ঠেকিয়ে বলল, ‘এক প্রশ্ন আমি দু’বার করব না। বল ওপারে গোডাউন এলাকার কোথায় মুসলিম বন্দীদের আটক করে রাখা হয়েছে?’
আহমদ মুসা কথা শেষ করতেই পেছন থেকে ছোট্ট একটা শব্দ শুনতে পেল। যেন কোন কিছুতে জড়িয়ে একটা লতা কিংবা কোন কচি গাছ ছিঁড়ে গেল।
বিদ্যুৎ বেগে পেছন দিকে তাকিয়েই আহমদ মুসা দেহটাকে ছুড়ে দিয়েছিল মাটির দিকে।
প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই গুলীর শব্দ। আহমদ মুসার সামনে যে লোকটি দাঁড়িয়েছিল তার মাথায় গিয়ে বিদ্ধ হল একটা বুলেট।
আহমদ মুসা মুখ ঘুরিয়ে দেখতে পেয়েছিল, মাত্র সাত-আট গজ দূরে একজন শ্বেতাঙ্গ দাঁড়িয়ে। তার হাতের রিভলবার উঠে এসেছে তাকে লক্ষ্য করে। আর মুহূর্ত বিলম্ব হলে ঐ বুলেট গুড়ো করত আহমদ মুসার মাথাকেই।
রিভলবারধারী লোকটি তার গুলীতে তাদের নিজের লোক গুলী বিদ্ধ হয়ে ঢলে পড়তে দেখে কিছুটা বিমুঢ় হয়ে পড়েছিল।
এরই সুযোগ গ্রহন করেছিল আহমদ মুসা।
মাটিতে পড়ে গুলী করেছিল সে।
গুলীটি কপাল গুড়ো করে দিল রিভলবারধারীর।
ছিটকে পড়ে গেল লোকটির দেহ মাটিতে।
আহমদ মুসা গুলী করেই উঠে দাঁড়াল। ভাবল, পরপর দু’টি গুলীর শব্দ হয়েছে। নিশ্চয় সবার কানে পৌঁছে গেছে। এখনই সবাই ছুটে আসবে এদিকে। তাদের আসার আগেই ওপারে তাকে পৌছতে হবে।
তাকাল আহমদ মুসা প্রাচীরের দিকে।
প্রাচীরটা বেশ উঁচু, আট ফুটের মত হবে। এ প্রাচীর ডিঙানো তার জন্যে কঠিন নয়। কিন্তু সমস্যা হল ওপারে প্রাচীর ঘেঁষে উঁচু দেয়াল উথেছে, দু’তলা বিল্ডিং এর দেয়াল।
হতাশ হল আহমদ মুসা। দক্ষিন দিকটা বিপদজনক। ওদিকে এগুলে সহজেই লোকদের নজরে পড়ে যাবে।
তাকাল আহমদ মুসা উত্তর দিকে। দেখল, উঁচু বিল্ডিংটা প্রাচীর শেষ হবার ছয় সাত ফিট দক্ষিন থেকে পশ্চিম দিকে বেঁকে গেছে।
পেছন দিক থেকে পায়ের শব্দ ও মানুষের কণ্ঠ আহমদ মুসার কানে এল। পেছনে তাকিয়ে দেখল, কয়েকজন ছুটে আসছে এদিকে।
আর চিন্তা করার কোন অবকাশ নেই।
আহমদ মুসা উত্তর দিকে ছুটছিল।
তার লক্ষ্য প্রাচীরের ফাঁকা জায়গাটুকু, যেখানে প্রাচীর ঘেঁষে ওপারে কোন দেয়াল নেই। ওখান দিয়ে ওপারে লাফিয়ে পড়া যাবে।
আহমদ মুসা ছুটা অবস্থাতেই দাত দিয়ে রিভলবার কামড়ে ধরে প্রাচীর বেয়ে প্রাচীরের মাথায় উঠে বসল। পেছনে তাকাল। দেখল, চার পাঁচজন এদিকে ধেয়ে আসছে।
আহমদ মুসা সামনে তাকাল। দেখল, নদীর তীর ঘেঁষে উত্তর প্রান্ত বরাবর প্রাচীর। আর তার সমান্তরালে একটু দক্ষিন পশ্চিম দিকে চলে যাওয়া বিল্ডিং-এর দেয়াল। এ দু’য়ের মাঝখানে দীর্ঘ একটা চত্বর সবুজ ঘাসে ঢাকা। চত্বরটা তেমন কোন কাজে ব্যাবহার হয় বলে মনে হল না। খুশী হল আহমদ মুসা।প্রথমেই কোন বাধা আসার সম্ভাবনা এখানে কম থাকবে।
আহমদ মুসা প্রাচীরের উপর থেকে লাফিয়ে পড়ল নিচের চত্বরে। পরেই দাঁত থেকে রিভলবার হাতে তুলে নিয়ে চারদিকে তাকাল। না কোথাও কাউকে দেখা যাচ্ছে না। তার বাম পাশে বিল্ডিং-এর দেয়ালে কোন জানালা দরজা নেই। তবে একটু পশ্চিমে কয়েকটা জানালা দেখা যাচ্ছে।
পেছনে প্রাচীরের ওপাশে ওরা এসে গেছে। চোর চোর বলে চিৎকার করছে ওরা তারস্বরে।
আহমদ মুসা মনে মনে হাসল। তাকে যতক্ষণ ওরা চোর ভাবে ততক্ষণ তার সুবিধা।
ঘাসে ঢাকা মাটির উপর দিয়ে আহমদ মুসা সামনে এগুলো।
হঠাৎ পেছনের চিৎকারটা খুব কাছে মনে হল আহমদ মুসার।
মাথ ঘুরিয়ে দেখল, দু’জন প্রাচীরের মাথায় উঠে এসেছে।
আহমদ মুসা মুহূর্ত দেরি করল না। রিভলবার তুলে পরপর দু’বার গুলী করল। গুলীবিদ্ধ দু’জন লোক গড়িয়ে পড়ে গেল প্রাচীরের ওপারে।
আমদ মুসা মনে কিছুটা স্বস্তি পেল। ভাবল, এই মুহূর্তে অন্তত প্রাচীর ডিঙাতে কেউ চেষ্টা করবে না। সুতরাং নিরাপদ সে অনেকটা।
কিন্তু মুখ ঘুরিয়ে সামনে তাকাতেই তার চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল। দেখল, সামনে যেখানে সে জানালা দেখেছিল, সেখানে এখন একটা দরজা। দরজায় দাঁড়িয়ে দীর্ঘদেহী একজন শ্বেতাঙ্গ। তার হাতে রিভলবার। আহমদ মুসার দিকে তাক করা।
আহমদ মুসার সাথে চোখাচোখি হতেই সে বলল, ‘তুমি তো বড় সেয়ানা চোর হে। কিন্তু চুরি করার আর জায়গা পেলে না। রিভলবার এদিকে ফেলে দাও।’
আহমদ মুসার ডান হাতে ছিল রিভলবার।
রিভলবার ধরা তার ঝুলন্ত ডান হাতটা নড়ে উঠল। উঠতে লাগল একটু উপরের দিকে। মনে হল যেন নির্দেশ পালনের জন্যে সে রিভলবার সামনের দিকে ছুড়ে ফেলছে।
কিন্তু তার রিভলবার ধরা ডান হাতটা চোখের পলকে দরজায় দাঁড়ানো লোকটির সমান্তরালে উঠে এল এবং সঙ্গে সঙ্গেই গুলী বেরিয়ে এল একটি।
দরজায় দাঁড়ানো রিভলবারধারী লোকটি কতকটা রিলাক্সড মুডে ছিল। ভাবখানা একজন চোরের সাথে আর কি লড়াই হবে। তার চোখের সামনে যখন ঘটনাটা ঘটে গেল, তখনও যেন সে কিছু বুঝে উঠতে পারেনি। বুকে গুলী খেয়ে লোকটির দেহটা বার কয়েক এদিক-ওদিক দোল খেয়ে পড়ে গেল দরজার সামনে।
আহমদ মুসা চারদিকে তাকিয়ে জায়গাটার লোকেশনটা একবার বুঝে নিয়ে ছুটল দরজার দিকে।
লাশ ডিঙিয়ে দরজায় প্রবেশ করে আহমদ মুসা দরজা বন্ধ করে দিল।
আহমদ মুসা যেখানে প্রবেশ করল তা ঘর নয় একটা করিডোর।
আহমদ মুসা দেখল, অল্প একটু দুরেই পশ্চিম দিকে যাওয়া করিডোর থেকে আরেকটা শাখা দক্ষিণে বেরিয়ে গেছে।
আহমদ মুসা সেদিকে এগুলো। সবে এক ধাপ এগিয়েছে সে।
দক্ষিণ দিক থেক আসা করিডোর থেকে দু’জন স্টেনগানধারী এসে প্রবেশ করল এ করিডোরে। তাদের স্টেনগান উদ্যত।
আহমদ মুসা একদম মুখোমুখি হয়ে গেল তাদের। তাদের বাগিয়ে ধরা স্টেনগান স্থির হয়ে হয়েছে আহমদ মুসার বুক লক্ষ্যে।
আহমদ মুসার রিভলবার তার ডান হাতে ঝুলছিল।
‘রিভলবার ফেলে দাও।’ চিৎকার করে বলল তাদের একজন।
ওরা দু’জন পাশাপাশি দাঁড়িয়েছিল।
ওদের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে পড়েছিল আহমদ মুসা। হাত থেকে ছেড়ে দিল সে রিভলবার। পড়ে গেল তার পায়ের কাছেই।
রিভলবার পড়ে যেতেই ওদের একজন ছুটে এল। রিভলবার হাতে তুলে নিয়ে উঠে দাঁড়াচ্ছিল।
লোকটি আহমদ মুসা এবং একটু দূরে দাঁড়ানো দ্বিতীয় স্টেনগানধারীর মধ্যে একটা দেয়াল সৃষ্টি করেছিল।
আহমদ মুসা সুযোগ গ্রহণ করলো।
আহমদ মুসার ডান হাত বিদ্যুৎ গতিতে লোকটির গলা পেঁচিয়ে তাকে চেপে ধরেই বাম হাত দিয়ে তার কাছ থেকে রিভলবার কেড়ে নিল এবং সঙ্গে সঙ্গেই গুলী করল দূরে দাঁড়ানো স্টেনগানধারীকে লক্ষ্য করে।
লোকটি মুহূর্তের জন্যে বিমূঢ় হয়ে পড়েছিল। সম্বিৎ ফিরে পাওয়ার আগেই গুলী খেয়ে আছড়ে পড়ল।
আহমদ মুসার বাহুর সাড়াশির বাঁধনে আটকে পড়া লোকটি অসহায় ভাবে হাত-পা ছুড়ছিল।
আহমদ মুসা এবার রিভলবারের নলটা তার মাথায় চেপে ধরে বলল, ‘মুসলিম বন্দীদের কোথায় রেখেছ বল? তিন গুনার মধ্যে না বললে মাথা গুড়ো করে দেব।’
লোকটি মুহূর্ত দেরী করল না। সামনে করিডোরের দক্ষিন পাশের ঘরের দিকে ইঙ্গিত করে বলল, ‘ঐ ঘরে রয়েছে।’
‘কোন দিকে দরজা?’
‘ঘরের দক্ষিন দেয়ালে’ বলল লোকটি।
‘চল কোন দিকে?’ বলে ঐভাবে তাকে ধরে রেখেই চলতে শুরু করল।
দরজায় দাঁড়িয়ে দুজন প্রহরী। তারা আহমদ মুসাদের দেখেই তাঁদের স্টেনগান বাগিয়ে ধরল।
হেসে উঠল আহমদ মুসা। বলল, ‘ওদের দরজা খুলে দিতে বল।’
‘ওরা আমার নির্দেশের অধীন নয়। আমার নির্দেশ ওরা মানবে না।’ বলল লোকটি।
ক্রোধের চিহ্ন ফুটে উঠল আহমদ মুসার চোখে-মুখে। এসব কথা শুনে সময় নষ্ট করার সময় তার নেই।
আহমদ মুসা গার্ড দু’জনকে লক্ষ্য করে বলল, ‘দরজা খুলে দাও।’
গার্ড দু’জন যেমন দাঁড়িয়েছিল, তেমনি দাঁড়িয়ে থাকল। কোন ভাবান্তর দেখা গেল না তাদের চোখে-মুখে।
আহমদ মুসার রিভলবার তাদের লক্ষ্যে স্থির হলো। পরপর দুটি গুলী উদ্গীরন করল। গার্ড দু’জন দরজার উপরই ঢলে পড়ল মৃত্যুর কোলে।
আহমদ মুসা লোকটিকে ঐভাবে ধরে রেখেই দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। যাবার পথে পড়ে থাকা স্টেনগান দু’টি তুলে নিয়ে কাঁধে ঝুলিয়ে রাখল।
লোকটিকে একটা ধাক্কা দিয়ে সামনে ঠেলে দিয়ে বলল, ‘খুলে দাও দরজা।’
লোকটি আর অন্যথা করল না। খুলে দিল দরজা।
দরজা খুলে গেল।
ঘরের মাঝখানে ওরা বারোজন দাঁড়িয়েছিল। দরজার দিকে মুখ। তাদের চোখে-মুখে উদ্বেগ।
আহমদ মুসা এগিয়ে গেল দরজার কাছে।
ওদের লক্ষ্য করে সালাম দিল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসা কে সামনে দেখে অপার বিস্ময়ের একটা স্রোত খেলে গিয়েছিল তাদের মুখের উপর দিয়ে। পরমুহূর্তেই সেখানে নেমে এল আনন্দের প্রস্রবণ। আহমদ মুসার সালাম নিতে তারা ভুলে গেল। চিৎকার করে উঠতে যাচ্ছিল ত্তুরস্কের কামাল ইনুনু।
আহমদ মুসা ঠোঁটে আঙ্গুল চেপে কথা বলতে নিষেধ করে বলল, ‘আপনারা তাড়াতাড়ি বেরিয়ে আসুন।’
বেরিয়ে এল ওরা ঘর থেকে দ্রুত।
আহমদ মুসা আবার ওদের সালাম দিয়ে বলল, ‘আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করছি যে, আপনারা সুস্থ আছেন। এখনই আমাদের বেরুবার পথ করতে হবে। ওরা এখনি এসে পড়বে।’
বলে আহমদ মুসা সেই লোকটির মাথায় রিভলবারের নল চেপে ধরে বলল, ‘বেরুবার গোপন পথ কোনদিকে বল?’
‘গোপন পথ?’ অজ্ঞতার ভান করল লোকটি।
‘আর এক মুহূর্ত দেরী করলে মাথা গুড়ো করে দেব তোমার।’ বলল আহমদ মুসা চাপা কঠোর কণ্ঠে।
পশ্চিম দিকের একটা করিডোর দেখিয়ে বলল, ‘ওদিকে।’
আহমদ মুসা লোকটিকে ধাক্কিয়ে নিয়ে সেদিকে চলল। ওরা ১২জন তাদের পেছনে পেছনে চলল।
একটা চতুষ্কোণ ফাঁকা জায়গা তারা পার হচ্ছিল, এসময় বিপরীত দিক থেকে অনেকগুলো দ্রুত পদশব্দ এবং অনেকের উত্তেজিত কণ্ঠ ভেসে এল।
করিডোরের মুখ ঘেঁষেই একটা দরজা।
আহমদ মুসা লোকটিকে ঠেলে দ্রুত দরজার কাছে পৌঁছল। দরজার নব ঘুরাতেই দরজা খুলে গেল।
আহমদ মুসা পেছনে মুখ ঘুরিয়ে দ্রুত বলল, ‘আপনারা দ্রুত ভেতরে ঢুকে পড়ুন।’
সঙ্গে সঙ্গেই ওরা ১২জন ভেতরে ঢুকে গেল। আহমদ মুসা সেই আটকে রাখা লোককে ঠেলে নিয়ে ভেতরে ঢুকে গেল।
ঘরে ঢুকেই আহমদ মুসা দরজার ছিটকিনি লাগিয়ে দিল।
প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই অনেকগুলো লোক এসে প্রবেশ করল আহমদ মুসাদের পেরিয়ে আসা ফাঁকা জায়গাটায়। তাদের উত্তেজিত কথাবার্তা ও চিৎকার শোনা গেল। সম্ভবত বন্দীদের পালানোর ব্যাপারটা তারা টের পেয়েছে।
তাদের চিৎকারের মধ্যে একটু দূর থেকে একটা উচ্চ কণ্ঠ সব কণ্ঠকে ছাপিয়ে উঠল। সে বলছে, ‘পুলিশ, পুলিশ অনেক পুলিশ। বাড়ির তিন দিক তারা ঘিরে ফেলেছে।’
অনেক কণ্ঠের চিৎকার ও চেঁচামেচি এক মুহূর্তেই থেমে গেল।
‘কি চায় পুলিশ, কি বলছে তারা?’ একটা ভারী কণ্ঠ ধ্বনিত হলো।
‘তারা ভেতরে প্রবেশ করতে চায়।’ বলল সম্ভবত খবর নিয়ে আসা লোকটি।
‘ঠিক আছে, তোমরা কয়েকজন চারদিকটা দেখ বন্দীরা কোথায়, অন্যরা আমার সাথে এসো। দেখি পুলিশ এখানে নাক গলাতে এল কেন?’ বলল সেই ভরাট গলার লোকটা।
আহমদ মুসাসহ ঘরের সবাই এইসব কথা-বার্তা শুনছিল।
আহমদ মুসা মুখ ঘুরিয়ে ভেতরের দিকে মনোযোগ দিতেই ওয়ার্ল্ড এ্যাসেম্বলী অব মুসলিম ইয়ুথের নেতা কামাল ইনুনু বলল, ‘ওদের কেউ নিশ্চয় এদিকে খুজতে আসবে।’
বলেই একটু থেমে সে ঘরের এক পাশের মেঝেতে নিচে নেমে যাওয়া সিঁড়ির দিকে অঙ্গুলি সংকেত করে বলল, ‘আমার মনে পড়ছে এই সিঁড়ি দিয়েই আমরা উঠেছিলাম।’
‘কেন আপনারা কি আগে ভু-গর্ভের কোন কক্ষে বন্দী ছিলেন?’ বলল আহমদ মুসা।
‘না, এ পথেই আমরা বন্দীখানায় উঠেছিলাম। নদী থেকে এক সুড়ঙ্গ পথে আমাদের আণ্ডারগ্রাউন্ড কক্ষে আনা হয়েছিল।’
আহমদ মুসার মনে পড়ে গেল নদীর কুল ঘেঁষে দাঁড়ানো মোটর বোটের কথা। তার চোখে ভেসে উঠল মোটর বোটের নোঙরের রশি ঠিক পানির সমান্তরালে উপকূলের কংক্রিটের ভেতরে ঢুকে যাবার দৃশ্য।
আনন্দে মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল আহমদ মুসার। সুড়ঙ্গ পথের মুখে নিশ্চয় মোটর বোটটি দাঁড়িয়ে আছে।
আহমদ মুসা কামাল ইনুনুকে কিছু বলার জন্যে মুখ খুলেছিল এ সময় দরজায় ধাক্কা পড়তে লাগল।
আহমদ মুসা দরজার দিকে একবার তাকিয়ে কামাল ইনুনুকে লক্ষ্য করে বলল, ‘আপনি এঁদের নিয়ে দ্রুত নিচে নেমে যান। নিচের ফ্লোরে নেমে উত্তর দিকে এগিয়ে যাবেন। ফ্লোর লেভেলেই নদীতে বেরুবার দরজাটা পেয়ে যাবেন। আমার যতদুর মনে হয় উত্তর দেওয়ালের কোথাও সুইচ পেয়ে যাবেন। ঠিক সুইচটা চাপলেই দেয়াল সরে যাবে। সামনেই দেখবেন একটা মোটর বোট দাঁড়িয়ে। আমার যতদুর মনে হয় লাল সুইচ কিংবা নৌকা বা মাস্তুলের ছবি ওয়ালা কোন সুইচ থাকলে সেটাই টিপবেন। খোদা হাফেয।’
কামাল ইনুনু সিঁড়ির দিকে পা বাড়ানোর জন্যে নড়ে উঠলেও বিশ্ব মুসলিম কংগ্রেসের প্রধান শেখ মাদানী নড়ল না। বলল, ‘মনে হচ্ছে তুমি যাচ্ছ না। তুমিও চল।’
আহমদ মুসা তার দিকে চোখ তুলে দ্রুত বলল, ‘আমি নিশ্চয়ই আসব। কিন্তু এদের আটকাতে হবে এখানে।’
‘কেন দরজা শক্তভাবে বন্ধ আছে, ভাঙার আগেই আমরা চলে যেতে পারব।’
‘জনাব ওদের দরজা ভাঙতে দেরী হলে কিংবা দরজা ভাঙতে না পারলে ওরা নদীর দিকে ছুটে যাবে। সেখানে আমাদের আটকাতে চেষ্টা করবে। সুতরাং দরজা খুলেই ওদের এখানে ব্যস্ত রাখতে হবে। ইতিমধ্যে আপনাদের নিরাপদ দুরত্বে সরে পড়তে হবে।’ বলল দ্রুত কণ্ঠে আহমদ মুসা।
‘বুঝেছি বাবা তোমার কথা। তুমি একা এদের সাথে লড়াই করবে, আর আমরা পালাব?’ বলল ভারী কণ্ঠে শেখ মাদানী।
আহমদ মুসা হাত জোড় করে বলল, ‘আমাকে নিয়ে চিন্তা করবেন না। লড়াই থেকে একা একা সরে পড়া কঠিন নয়, কিন্তু সবাইকে নিয়ে সরে যাওয়া কঠিন। আপনারা দয়া করে যান।’
শেখ মাদানী আর পাল্টা কথা আর বলল না। ‘আল্লাহ হাফেজ’ বলে পা বাড়াল সিঁড়ির দিকে। সেই সাথে তার সাথী এগারোজন সকলেই।
দরজায় ধাক্কা বাড়ছিল।
আহমদ মুসা রিভলবার পকেটে রাখল। কাঁধ থেকে হাতে তুলে নিল স্টেনগান। ধরে রাখা সেই লোকটিকে বলল, ‘দরজা খুলে দাও আর বল, ‘এদিকে কেউ আসেনি। তাড়া খেয়ে তুমিই দরজা বন্ধ করেছিলে।’
বলে আহমদ মুসা দরজার বিপরীত দিকে সিঁড়ির পাশে দেয়াল বরাবর রাখা একটা ভাঙা টেবিলের আড়ালে গিয়ে বসল।
লোকটি টেবিলের নিচ দিয়ে হা করে থাকা স্টেনগানের কালো ব্যারেলের দিকে একবার তাকিয়ে দরজা খুলে দিল।
দরজা খোলার সাথে সাথে দরজা ঠেলে চার পাঁচজন ঘরে প্রবেশ করল উদ্যত স্টেনগান হাতে।
দরজা খুলে দেয়া সেই লোকটি দ্রুত তাদের আড়ালে গিয়ে দাঁড়াল এবং দরজার বিপরীত দিকে সিঁড়ির মুখের পাশে রাখা টেবিলের দিকে ইঙ্গিত করে বলল, ‘প্রথমে ওকে দেখ, তারপর…।’
তার কথা শেষ হতে পারল না।
আহমদ মুসার স্টেনগান থেকে এক ঝাক গুলী এসে ওদের সবাইকে ঘিরে ধরল। পর মুহূর্তেই ৬টি মানুষ লাশ হয়ে পড়ে গেল মেঝেতে।
আহমদ মুসা নড়ল না টেবিলের আড়াল থেকে। তার স্টেনগানের কাল নল হা করে তাকিয়ে থাকল দরজার দিকে শিকারের অপেক্ষায়।
এদিকে স্টেনগানের গুলীর শব্দ শুনেই সম্ভবত বিভিন্ন দিক থেকে আরও তিনজন এগিয়ে এল।
তারা দরজার সামনে এসে তিনজনেই তাদের স্টেনগান থেকে গুলী ছুঁড়ল। তাদের গুলী দরজা দিয়ে ঢুকে সিঁড়ির মাথার উপর দিয়ে দেয়ালকে গিয়ে বিদ্ধ করল। আহমদ মুসাকে আড়াল করা টেবিলটা দরজার বিপরীত দেকে হলেও একটা কৌণিক ব্যবধানে তার অবস্থান ছিল। সুতরাং বৃষ্টির মত আসা গুলীর হাত থেকে বেঁচে গেল সে।
গুলী বর্ষনের কোন পাল্টা উত্তর না পেয়ে ওরা গুলী বন্ধ করে স্টেনগান বাগিয়ে পা পা করে দরজার কাছাকাছি হলো।
আহমদ মুসার স্টেনগানের নল ওদিকেই তাকিয়ে ছিল। গুলী বর্ষণ করল এক পশলা।
দরজার সামনে মুখ থুবড়ে পড়ে গেল সেই এগিয়ে আসা তিনটি মানুষ।
আহমদ মুসা উঠল না তার জায়গা থেকে। স্টেনগানটা সেইভাবেই দরজার দিকে তাক করে রাখল। মুসলিম নেতৃবৃন্দ এখান থেকে বেরিয়ে বোটে না ওঠা পর্যন্ত ওদের মনোযোগ ভেতর দিকেই আটকে রাখতে হবে। ওদের বুঝাতে হবে ভেতরেই সংঘাত হচ্ছে, বন্দীরা ভেতরেই আছে।
আরও কিছু সময় গেল। কেউ আসছে না। আহমদ মুসা উঠে দাঁড়ালো।
বাইরে একটু দূর থেকে ভেসে আসা কথা শুনতে পেল আহমদ মুসা।
দরজা দিয়ে উঁকি দিয়ে দেখল, এদিকে আসছে পুলিশ এবং সেই সাথে কিছু লোক।
আহমদ মুসা দ্রুত দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে সিঁড়ির দিকে ছুটল।
আণ্ডারগ্রাউন্ড ফ্লোরে নেমে ছুটল উত্তর দিকে। উত্তরে দেয়ালে সে দরজা খোলাই দেখতে পেল।
আহমদ মুসা দরজায় এসে স্তম্ভিত হয়ে দেখল, মোটর বোটে মুসলিম নেতৃবৃন্দ সবাই উঠেছে, কিন্তু বোটটি ঠায় দাঁড়িয়ে আছে।
আহমদ মুসা কে দেখেই ‘ডার্ক আফ্রিকা ব্রাইট হার্টের’ প্রধান তারিক আল-মাহদী বলল, ‘লোহার বিশেষ চেন দিয়ে বোট আটকানো সম্ভবত ভেতর থেকে। কোন ক্রমেই খোলা যায়নি।’
আহমদ মুসা ঘুরে সুইচ বোর্ডের কাছে গেল। নজর বুলাল প্যানেলের সুইচগুলোর উপর। আহমদ মুসা নিশ্চিত, চেন খুলে দেবার জন্যে এখানেই একটা সুইচ আছে।
সাদা সুইচের উপর সাদা চেন আঁকা একটা সুইচ পেয়ে এগিয়ে গেল আহমদ মুসা। অফ করে দিল সুইচটা। সামনের দেয়ালের কোথাও থেকে ক্লিক করে একটা শব্দ উঠল।
‘খুলে গেছে চেন’ বুঝল আহমদ মুসা।
ছুটে ফিরে গেল দরজায় আহমদ মুসা। বলল, অনুচ্চ স্বরে, ‘চেন খুলে গেছে স্টার্ট দিন বোটে।’
ঠিক এই সময়েই পেছনে পায়ের শব্দ শুনতে পেল আহমদ মুসা।
স্টেনগান বাগিয়ে চরকির মত ঘুরে দাঁড়াল আহমদ মুসা। ট্রিগার টানতে যাচ্ছিল সে স্টেনগানের। কিন্তু দেখতে পেল পুলিশকে আর দেখতে পেল পুলিশের পাশেই দাঁড়িয়ে আছে ব্ল্যাক বুল এবং মিঃ ম্যাকাকো।
বিস্মিত হল আহমদ মুসা। তার স্টেনগানের ব্যারেল নিচে নেমে গেল।
মোটর বোট স্টার্ট নেয়ার শব্দ পেল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসা মুখ ফিরিয়ে চিৎকার করে বলল, ‘স্টার্ট বন্ধ করে দিন।‘
ব্ল্যাক বুল ও মিঃ ম্যাকাকো এগিয়ে এল। তার পেছনে পুলিশ অফিসাররা।
ব্ল্যাক বুল এসে আনন্দের অতিশয্যে জড়িয়ে ধরল আহমদ মুসাকে।
মিঃ ম্যাকাকোও বিস্ময় ও আনন্দের সাথে আহমদ মুসাকে মোবারকবাদ জানিয়ে বলল, ‘একক’ একজন যে এমন একটা যুদ্ধে জিততে পারে, সেই অবিশ্বাস্য এক যুদ্ধক্ষেত্র আজ দেখলাম।’
মিঃ ম্যাকাকো নামতেই ব্ল্যাক বুল একজন পুলিশ অফিসারের দিকে অংগুলি সংকেত করে বলল, ‘ইনি ‘সলো’ বন্দরের পুলিশ প্রধান, আমার ভাই। আরেকজনকে দেখিয়ে বলল, ইনি মিঃ উপাংগো। বোমাসার পুলিশ প্রধান, আমার ভাইয়ের বন্ধু।’
পুলিশ অফিসার দু’জন আহমদ মুসার দিকে হাত বাড়িয়ে বলল, ‘আমাদের জীবন ধন্য হলো, আমাদের চোখ সার্থক হলো আপনাকে দেখে।’
আহমদ মুসাও হাত বাড়িয়ে দিল তাদের দিকে।
মুসলিম নেতৃবৃন্দ নেমে এল বোট থেকে।

ব্ল্যাক ক্রস-এর প্যারিস হেড কোয়ার্টার।
বিশাল টেবিল সামনে নিয়ে রিভলবিং চেয়ারে দুলছিল ব্ল্যাক ক্রস-এর নতুন প্রধান সাইরাস শিরাক। চোখে তার শুন্য দৃষ্টি। যেন এই জগতে সে নাই। মাথার চুল উস্কো-খুস্কো। চোখ লাল।
তখন রাত ৮টা। সেই বিকেল ১টা থেকে এই চেয়ারেই বসে আছে সাইরাস শিরাক। মদ গিলছে পেগের পর পেগ।
ফ্রী ওয়ার্ল্ড টেলিভিশনের বিকেল ১টার নিউজ বুলেটিন সাইরাস শিরাকের মাথায় ভয়ানক বোমাটির বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে। FWTV বলেছে, “মধ্য আফ্রিকা প্রজাতন্ত্রের বারবারেতির ভয়ানক অগ্নিকান্ডে নিহত বলে কথিত ১২জন মুসলিম বিশ্বনেতাকে ইউরোপ ভিত্তিক সন্ত্রাসী সংগঠন ব্ল্যাক ক্রস কিডন্যাপ করে কঙ্গোর বোমাসা সীমান্ত শহরের বাইবেল সোসাইটিতে বন্দী করে রেখেছিল। ‘সলো’-এর পুলিশ প্রধান মিঃ জাগুয়াস ম্যাকা একটি গোপন সুত্রের খবরের ভিত্তিতে বোমাসার পুলিশ প্রধান মিঃ উপাংগোর সাহায্যে বন্দী মুসলিম নেতৃবৃন্দকে আজ সকালে মুক্ত করেন। প্রকাশ, ১২জন মুসলিম বিশ্ব নেতাকে কিডন্যাপ করার ঘটনা আড়াল করার জন্যেই ব্ল্যাক ক্রস বারবারেতির ইসলামী সম্মেলনে ভয়াবহ বিস্ফোরণ ঘটিয়ে কয়েক কুড়ি মানুষের হত্যাযজ্ঞের সৃষ্টি করে। মুসলিম বিশ্ব নেতাদের কেন কিডন্যাপ করা হয়েছিল, পুলিশ এ সম্পর্কে এখনও কিছু জানতে পারেনি।”
নিউজ শেষে FWTV ঘোষণা দেয়, ‘সচিত্র ও বিস্তারিত নিউজের জন্যে FWTV সকলকে বিকেল ৩টার বুলেটিনে আমন্ত্রণ জানাচ্ছে।’
FWTV-এর নিউজ ব্ল্যাক ক্রস প্রধান সাইরাস শিরাকের বুকে শেলবিদ্ধ করে। বাকরুদ্ধ হয়ে যায় তার। মুসলিম বন্দীদের উদ্ধার কিভাবে সম্ভব? গোটা দুনিয়া যাদের মৃত জানে, তাদের খুঁজতে গেল কেন দু’জন পেটি পুলিশ অফিসার? আর খুজে পেলইবা কি করে?
কোন প্রশ্নেরই উত্তর সাইরাস শিরাকের কাছে ছিল না।
সবচেয়ে দুর্বহ মনে হচ্ছে তার কাছে ব্ল্যাক ক্রস-এর বদনাম। ব্ল্যাক ক্রস আজ গোটা দুনিয়ায় সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে বিবেচিত হবে।
চেয়ার থেকে উঠতে পারল না সাইরাস শিরাক। বেলা তিনটার FWTV-এর নিউজ বুলেটিন তাকে দেখতে হবে। সচিত্র বিবরণে কি তারা দেখায়, টা দেখার পরে অনেক কিছু তার কাছে পরিষ্কার হয়ে যাবে।
কিছুতেই বুঝতে পারছে না সাইরাস শিরাক বোমাসা, সলো অথবা বারবারেতি থেকে কেউ কিছু জানাচ্ছে না কেন? তাহলে কি বোমাসা থেকে খবর দেবার মত কেউ বেঁচে নেই? শিউরে উঠল সাইরাস শিরাক। ক্যামেরুনে যা ঘটেছে তারই কি পুনরাবৃত্তি ঘটল বোমাসায়? সলো বন্দরে এশিয়ানকে আটক করা হয়েছিল, সে কে ছিল? সে ঘটনার পর যে অবস্থায় তাকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং যেভাবে সে পালিয়েছে, তা প্রমান করে সে অসাধারন কেউ। কে সে? আহমদ মুসা?
ঐভাবে চেয়ারে বসেই মিঃ সাইরাস শিরাক FWTV-এর ৩টার নিউজ বুলেটিন দেখে। বোমাসার বাইবেল সোসাইটির ভেতর-বাহির সবটাই দেখানো হয়। প্রায় ১৫-১৬টি লাশ তাঁর চোখে পড়ে। সবগুলোই ব্ল্যাক ক্রস-এর লোকদের। শত্রুপক্ষের একটা লাশও তার চোখে পড়ে না। ছবিতে ১২জন বিশ্ব নেতাকে দেখানো হয়। গর্বিত দু’জন পুলিশ অফিসারকেও দেখা যায় তাদের সাথে। তাদের সাক্ষাৎকারও প্রচার হয়। তারা বলে বড় বড় সুবিধা ও স্বার্থ আদায়ের গোপন দরকষাকষির অস্ত্র হিসেবে তাদের কিডন্যাপ করা হয়েছিল। তবে তারা তাদের গোপন দাবী আদায় করত, কিন্তু বন্দীদের তারা ছেড়ে দিত না। তাদের স্লো পয়জনিং করা হচ্ছিল।’
FWTV তাদের খবরে প্রাথমিক রক্ত পরীক্ষার বরাত দিয়ে বলে, মুসলিম বিশ্ব নেতাদের স্লো পয়জন করা পয়জনটি সম্পূর্ণ নতুন ধরনের। মনে হচ্ছে প্রথম বারের মত কোন মানুষের উপর এটা টেস্ট করা হয়েছে।
রাগে-দুঃখে মাথার চুল ছেঁড়ে সাইরাস শিরাক।
চেয়ার থেকে আর উঠতে পারেনি সে। স্রোতের মত টেলিফোন এসেছে। তাকেও টেলিফোন করতে হয়েছে অনেক।
ছয়টার মধ্যেই পৃথিবীর সকল রেডিও-টিভি নেটওয়ার্ক বোমাসার মুসলিম বন্দী উদ্ধারের ঘটনাকে তাদের প্রথম ও প্রধান ঘটনা হিসেবে প্রচার করে। FWTV-এর প্রচারিত ফটোগ্রাফ ব্যাবহার করে তারা।
মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যে সাইরাস শিরাকের সামনে পুরো পৃথিবীর মানচিত্রটা যেন পাল্টে গেল। তার সামনের উজ্জ্বল দিগন্তটা কালো হয়ে গেল। তার মনে হচ্ছে, ব্ল্যাক ক্রস-এর চেয়ে ব্যর্থ সংগঠন দুনিয়াতে আর নেই। কিন্তু কার জন্যে?
সন্ধ্যা ৭টায় বৈঠক বসল ব্ল্যাক ক্রস নির্বাহী কমিটির।
জলন্ত অঙ্গারের মত সবার মুখমণ্ডল।
কিন্তু কারো মুখে কথা নেই।
কথা বলল সাইরাস শিরাকই প্রথমে।
বলল, ‘সবার চোখে আমি আগুন দেখছি। কিন্তু আগুনে পোড়াবে কাকে?’
কেঊ উত্তর দিল না। সবারই চোখে যেন একই জিজ্ঞাসা।
সাইরাস শিরাকই কথা বলল, ‘আহমদ মুসা সবচেয়ে বেশী ক্ষতি করেছে, অপূরণীয় ক্ষতি করেছে আমাদের। কিন্তু শেষ এই ঘটনায় তাকে আমরা দেখছি না।’
‘আমরা কি করব, আমাদের বোমাসার এত বড় বিপর্যয়ের জন্যে কাকে আমরা দায়ী করব?’ বলল একজন।
‘সেটা পরে খোঁজ নেয়া যাবে। সকলের আগে এখন আমাদের এক বড় শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে। যে শত্রুকে সরাতে না পারলে পদে পদে আমাদের হোঁচট খেতে হবে।’
‘কে এই শত্রু?’ একসাথে বলে উঠল কয়েকজন।
‘সময়ে জানতে পারবেন। তবে সে শত্রু কোন মানুষ নয়।’
‘মানুষ নয়?’
‘মানুষের চেয়েও পাওয়ারফুল। সেনসিটিভ।’
‘কে সে? কি তার নাম?’
‘বললাম তো সময়ে জানা যাবে।’ বলে একটু থেমে আবার বলল সাইরাস শিরাক, ‘অপারেশন চীফ মিঃ রেনেন, আপনার নতুন অস্ত্র প্রস্তুত তো? নতুন করে পরীক্ষা করেছেন আবার?’
‘প্রস্তুত। পরেও পরীক্ষা করেছি। সফল।’
‘ধন্যবাদ। সকলকে ধন্যবাদ’ বলে সাইরাস শিরাক চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াল।

আহমদ মুসা ক্যামেরুনে রাশেদী ইয়েসুগোর সাথে কথা বলছিল টেলিফোনে।
বলছিল, ‘ঘটনার পর ক’দিন চলে গেল আসিনি কেন বলছ? সময় থাকলেও সুযোগ পাইনি। বোমাসাতেই কেটেছে দু’দিন। ব্ল্যাক বুল তো সেখানে শুধু পীরজাদা নয়, রীতিমত পীর বনে গেছে। তার পায়ের ধুলোও যেন অসীম মুল্য তাদের কাছে। বুঝতেই পারছ কি রকম দাওয়াত খেতে হয়েছে। তাছাড়া আমরা ওখানে কিছু কাজও করেছি। বাংগুই থেকে ওদের জন্যে একজন ইমাম আনিয়েছি। একটা আরবী স্কুল চালু করেছি। একটা মিশনারী ইউনিট গঠন করেছি। সমাজ সেবার কাজ আবার চালু করা হয়েছে। বলতে পার দুই মাসের কাজ করেছি দুই দিনে।’
‘কিন্তু তারপর আরও ৫দিন গেছে’ আহমদ মুসার কথার মাঝখানে ওপার থেকে বলে উঠল, রাশিদী ইয়েসুগো।
‘পাঁচদিনের কথা বলছ? সলোতে এসে পাঁচটা দিন কিভাবে গেল বুঝতেই পারিনি। মনে হচ্ছে একদিনও যায়নি।’
‘কি ব্যাপার! কি ঘটেছে সেখানে?’ আবার আহমদ মুসাকে থামিয়ে দিয়ে বলে উঠল ওপার থেকে রাশিদী ইয়েসুগো।
‘বলছি শোন। মহা ঘটনা ঘটে গেছে। ব্ল্যাক বুলের বিয়ে হয়েছে। বিয়ের কাজে ও আনন্দে কোন দিক দিয়ে যে এ পাঁচটা দিন গেছে টের পাইনি!’
‘বিয়ে? কার সাথে? এভাবে হটাৎ?’ ওপার থেকে বলল রাশিদী ইয়েসুগো।
‘মেয়েটি ব্ল্যাক বুলের বংশের একজন এবং নিকট আত্মীয়। ওরা মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিল। সুতরাং দেরী হয়নি।’
‘ওঁকে আমাদের মোবারকবাদ দেবেন। ও বউ নেয়েই আসছে তো?’ বলল রাশিদী ইয়েসুগো টেলিফোনের অপর প্রান্ত থেকে।
‘ও আপাতত যাচ্ছে না। আমি মনে করি সলো ও বোমাসায় তাকে দিয়ে ইসলামের অনেক খেদমত হবে। স্থানীয় লোকদের মধ্যে সে খুবই জনপ্রিয় হবে।’
আহমদ মুসা মুহূর্তকাল থেমেই আবার বলতে শুরু করল, ‘রোসেলিনের ওখান থেকে ডোনা-রোসেলিন কাল সকালে যখন ফিরছেন, তখন সুবিধা হলে সকালে টেলিফোনের চেষ্টা করব। তুমি আমার আহত হওয়ার কথা রোসেলিনকে বলো না। সে কথা রাখতে পারবে না, ডোনাকে বলে দেবে।’
‘ঠিক আছে বলব না। কিন্তু আপনি ভাল তো? কিছু লুকচ্ছেন না তো?’
‘তুমি তা মনে করো?’
‘না মনে করিনা।’ বাক্যটা শেষ করে একটা ঢোক গিলে সঙ্গে সঙ্গেই বলল, ‘আহমদ মুসা ভাই আপনি তাড়াতাড়ি আসুন। আপনাদের শুভ কাজটা সম্পন্নের পর আপনাদের নিয়ে আমরা ‘লেক চাঁদ’ এলাকায় বেড়াতে যাব। বহুদিন যাই না। কেমন সুন্দর এলাকা দেখবেন।’
আহমদ মুসা হাসল। বলল, ‘বেড়াবার ওরকম একটা সুযোগ পেলে খুশীই হবো। তবে এই মুহূর্তে এর চেয়ে জরুরী কাজ একটা আছে।’
‘কি কাজ সেটা?’
‘বোমাসায় শুনলাম, ‘গ্যাবন এর পোর্ট জোন্টল-এ তিনশ মুসলমানের বাস। গ্রামাঞ্চল থেকে উচ্ছেদ হয়ে ওরা শহরে এসে একত্রিত হয়েছিল শহরতলীর একটা মসজিদ কে কেন্দ্র করে। সপ্তাহখানেক আগে কারা রাতের বেলা মসজিদ ভেঙে মাটির সাথে মিশিয়ে দিয়ে গেছে। বাধা দিতে গিয়ে ৪জন মুসলিম যুবক মারা গেছে। মনে করা হচ্ছে অবশিষ্ট মুসলমানকে পোর্ট জোন্টল থেকেও বহিষ্কার করা হবে। ক্যামেরুনে এসে আমি ওখানে যেতে চাই। মনে হয় ‘লেক চাঁদ’ সরকারের গ্যাবন-এর সমুদ্র তীরের পোর্ট জোন্টল সফর খারাপ হবে না।’
‘তা হবে। খেলায় আনন্দ আছে। কিন্তু অনেকে কাজে আনন্দ পায় বেশী।’
‘আচ্ছা তুমিই বল, খেলার আনন্দের চেয়ে মানুষের অশ্রু মোছানোর মধ্যে আনন্দ বেশী কিনা!’
‘এ সত্যটা কারও মতামতের অপেক্ষা করে না আহমদ মুসা ভাই।’ কথা শেষ করেই রাশিদী আবার বলে উঠল, ‘মুসলিম নেতৃবৃন্দ যাচ্ছেন কবে?’
‘রেডিও-টিভি’র খবরে তো শুনেছই, বারবারেতিতে গতকাল ইসলামী সম্মেলন হয়ে গেছে। আজ ওঁরা যাবেন।’
‘আপনি সম্মেলনে ছিলেন না?’
‘ছিলাম ব্যাক-বেঞ্চার হিসেবে, প্রৌঢ় একজন মৌলভীর পোশাকে।
‘ছদ্মবেশ কেন?’
‘পাগল হয়েছ, দুনিয়ার সব সাংবাদিক এবং গোয়েন্দারা এসে জমা হয়েছিল বারবারেতিতে। কি দরকার তাদের সামনে পরিচয়টা প্রকাশ করার!’
‘নতুন করে এ ধরনের সম্মেলনের সংবাদে আমার কিন্তু খুব ভয় হয়েছিল।’
‘ভয় হবারই কথা। একটা চ্যালেঞ্জ হিসেবেই সম্মেলন করা হয়েছে। এখানে ইসলামী সম্মেলন করার চেষ্টা দু’বার ব্যর্থ হয়েছে। একবার দু’শ বছর আগে, আর এবার একবার ক’দিন আগে। সুতরাং সম্মেলনে করে অতীতের ব্যর্থতার রেকর্ড ভাঙার প্রয়োজন ছিল। এ জন্যে আমার পরামর্শ ছিল মুসলিম নেতৃবৃন্দ সম্মেলন করেই মধ্য আফ্রিকা প্রজাতন্ত্র ত্যাগ করবেন। আলহামদুলিল্লাহ সম্মেলন সফলভাবেই অনুষ্ঠিত হয়েছে। আমার খুবই আনন্দ লাগছে, আফ্রিকার এই অঞ্চলে ইসলামের প্রথম নিজাম বরদার আহমদ বিন আব্দুর রহমানের দু’শ বছর আগের স্বপ্ন সফল হল। সম্মেলনটির মাধ্যমে তাঁর ভূলুণ্ঠিত পতাকা আবার উত্তোলিত হল।
‘আলহামদুলিল্লাহ’ টেলিফোনের অপর প্রান্ত থেকে বলল রাশিদী ইয়েসুগো।
‘তুমি শুনে খুশী হবে। সলোর পুলিশ প্রধান জাগুয়াস ম্যাকা ও তার পরিবার এবং বোমাসার পুলিশ প্রধান উপাংগো ইসলাম গ্রহণ করার পর গত ৫দিনে প্রায় তিন’শ পরিবার ইসলাম গ্রহণ করেছে এই দুই শহরে।’
‘আলহামদুলিল্লাহ।’
রাশিদী ইয়েসুগোর কণ্ঠ থামতেই আহমদ মুসা বলল, ‘এখন রাখি। সবাইকে সালাম দিও।’ বলে সালাম জানিয়ে আহমদ মুসা টেলিফোন রেখে দিল।
টেলিফোনের রিসিভারটা ক্র্যাডলে রেখে সোফায় একটু গা এলিয়ে বসতেই আবার টেলিফোন বেজে উঠল।
টেলিফোনের রিসিভার আবার তুলে নিল আহমদ মুসা।
ওপারের কণ্ঠ শুনতে পেয়েই আহমদ মুসা সোজা হয়ে বসল। তার চোখে-মুখে ফুটে উঠল সম্ভ্রমের চিহ্ন।
ওপার থেকে কথা বলছে বিশ্ব মুসলিম কংগ্রেসের প্রধান শেখ আব্দুল্লাহ আলী আল মাদানী।
‘জনাব আপনি কষ্ট করে টেলিফোন করেছেন। কিছুক্ষণের মধ্যে আমিই টেলিফোন করতাম।’
‘কেন পুত্রই শুধু এগুবে, পিতার এগুতে নেই বুঝি?’
কথাটা শেষ করেই শেখ আল মাদানী বলে উঠল, ‘তুমি তো জান, আজ আমরা চলে যাচ্ছি। তোমার কাছে বিদায় নেবার জন্যে টেলিফোন করেছি।’
‘আমি দুঃখিত যে, উপস্থিত থেকে আমি আপনাদের বিদায় জানাতে পারলাম না। এ বেয়াদবির জন্যে ক্ষমা চাইছি জনাব।’ বলল আহমদ মুসা।
‘তুমি আমাদের লজ্জা দিও না বাছা। তুমি আহত। তোমার বিশ্রাম দরকার। ঐ অবস্থায় বারবারেতি এসেছিলে-এটাই ঠিক হয়নি।’
মুহূর্তের জন্য থামল শেখ আল মাদনী। একটা ঢোক গিলল। তারপর আবার শুরু করল, ‘তোমার প্রতি আমার একটা অনুরোধ আছে।’
তার প্রথম বাক্যটা শেষ হতে না হতেই আহমদ মুসা তাকে বাধা দিয়ে বলে উঠল, ‘অনুরোধ নয়, আদেশ করুন। আমি আপনাদের মত গুরুজনদের কাছ থেকে আদেশ চাই।’
‘ঠিক আছে আদেশই ধরে নাও। আমি যা বলতে চাচ্ছি তা হলো, তুমি নিজের দিকে খেয়াল রাখবে। বিশেষ করে নিজের নিরাপত্তার ব্যাপারে খুবই সতর্ক থাকবে। তোমার জীবনের চেয়ে বেশী মুল্যের কেউ আর আজকের মুসলিম দুনিয়ায় নেই। আমাদের মত অকর্মণ্য, বাক্যবাগিশদের জন্যে তোমার জীবনের ঝুঁকি নেয়া উচিত নয়। সেদিন বোমাসার বাইবেল সোসাইটির যুদ্ধকালে তুমি আমাদের নিরাপদ করার জন্যে সবাইকে পাঠিয়ে দিয়ে প্রবল শত্রুর মোকাবিলার জন্যে একাই দাঁড়িয়েছিলে। কথাটা স্মরন হলে আমার এখনও বুক কেঁপে ওঠে। নিছক পদবী সর্বস্ব কয়েকজনকে বাঁচাবার জন্যে তুমি নিজেকে এভাবে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিতে পার না।’
‘আপনি নিজের উপর জুলুম করছেন জনাব। আজ ইসলামের যে রেনেসাঁ, তার ভিত্তি ও স্ট্রাকচার আপনারাই গড়েছেন।’
‘ভিত্তি ও স্ট্রাকচার গুরুত্বপূর্ণ বাছা, এতে জীবনের সক্রিয়তা না থাকলে এবং গতিমান না হলে একে মৃত লাশ ছাড়া আর কিছু বলা যায় না। তুমি দুর্গত মুসলিম সমাজকে জীবনের গতি দিয়েছ এবং শুধু বাচার নয় সংগ্রামের সাহসে সজ্জিত করেছ।’
‘লজ্জা দেবেন না জনাব। মানুষ কিছু করেনা, চেষ্টা করতে পারে মাত্র। আমি সামান্য একটা উপলক্ষ, সব কিছু আল্লাহর ইচ্ছাতেই হচ্ছে।’ কথাঢ় মাঝখানে বাধা দিয়ে বলে উঠল আহমদ মুসা।
‘ঠিকই বলেছ। কিন্তু এই উপলক্ষ হওয়াই এখন বড় কাজ। সেই কাজ তুমি করছ। যা আমরা পারছি না। আমরা ১২জন বন্দী ছিলাম। নিজেদের মুক্ত করার কোন উদ্যোগ নেইনি। কোন ঝুঁকি নেয়ার চিন্তাও করিনি। আর আহত হয়েও এবং বন্দী হবার পরেও নিজেকে মুক্ত করে ছুটে এসেছ তুমি আমাদের মুক্ত করার জন্য। শত্রুপুরীতে ঢুকেছ একা, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে। সুতরাং তুমি উপলক্ষ বটে, কিন্তু আল্লাহ এ ধরনের উপলক্ষই চান।’
‘ধন্যবাদ জনাব। দোয়া করুন। এই দায়িত্ব পালন যেন আরও আন্তরিকতার সাথে করতে পারি।’
‘ফি আমানিল্লাহ। আর একটা কথা বলি?’
‘বলুন জনাব।’
‘মদিনার গভর্নর মসজিদে নববীর পাশে এবং মক্কার গভর্নর ক্বাবার পাশে তোমাকে বাড়ি উপহার দিয়েছেন। তুমি উপহার দু’টো নিজে গিয়ে এখনও গ্রহণ করনি।’
‘ব্যস্ততার কারনে পারিনি জনাব। তবে আমি জানিয়েছি, হজ্জ ও ওমরার জন্যে আসা অতিথিদের যারা চান আমার বাড়ি দু’টো ব্যবহার করলে আমি বাধিত হবো। ঐ ওছিলায় কিছু নেকীও আল্লাহ দিতে পারেন।’
‘তোমার উপযুক্ত প্রস্তাব তুমি দিয়েছ। আমি ফিরে গিয়ে খোঁজ নেব কি হচ্ছে।’
একটু থামল শেখ আব্দুল্লাহ মাদানী। পর মুহূর্তেই আবার শুরু করল, ‘আরও একটা কথা বলব?’
‘অবশ্যই জনাব।’
‘তোমার ব্ল্যাক বুলের কাছ থেকে মারিয়া জোসেফাইন সম্পর্কে শুনেছি। আমি তোমার পিতার মত। আমরা আশা করতে পারি, বৌমাকে মদিনা অথবা মক্কার বাড়িতে রেখে তোমার একটা স্থায়ী ঠিকানা গড়ে তুলবে!’
আহমদ মুসা সঙ্গে সঙ্গে কিছু বলল না। একটু সময় নিয়ে ধীরে ধীরে বলল, ‘পবিত্র ক্বাবা ও মসজিদে নববীর সান্নিধ্যে বাস করার চেয়ে লোভনীয় আর কিছু নেই আমার কাছে। কিন্তু সব সাহাবীর কি এ সুযোগ হয়েছে? যারা চায়, তাদের সবার কি এ সুযোগ হয় জনাব?’
‘তোমার কথা ঠিক। কিন্তু আল্লাহ তোমাকে বিশেষ সুযোগ দিয়েছেন।’
‘আলহামদুলিল্লাহ। আল্লাহর ইচ্ছা তাঁর বান্দাহ-এর জন্যে শিরোধার্য।’
‘আলহামদুলিল্লাহ। আবার বলি, তোমার নিজের দিকে খেয়াল রেখ।’
বলে সালাম দিয়ে টেলিফোন ছেড়ে দিল শেখ আল মাদানী।
আহমদ মুসাও রাখল টেলিফোনের রিসিভার।
বিশ্ব মুসলিম কংগ্রেসের প্রধান শেখ মাদানীর কথাটা তখনও কানে বাজছিল আহমদ মুসার। মমতা ভরা পিতৃসুলভ উপদেশ গভীরভাবে স্পর্শ করেছিল তাঁর হৃদয়কে। এমন পিতৃসুলভ কণ্ঠ বহুদিন, বহুবছর সে শোনেনি। তাঁর চোখে পানি এসে গিয়েছিল।
পায়ের শব্দ কানে এল আহমদ মুসার। দরজার বাইরে থেকে।
আহমদ মুসা তাড়াতাড়ি চোখ মুছে ঘুরে বসল। দেখল, দরজা দিয়ে প্রবেশ করছে জাগুয়াস ম্যাকা। তার হাতে অনেকগুলো খবরের কাগজ।
জাগুয়াস ম্যাকা এসে হাতের খবরের কাগজগুলো টিপয়ের উপর রেখে আহমদ মুসার পাশে সোফায় বসতে বসতে বলল, ‘নাইরোবি’ থেকে এ কাগজগুলো একজন নিয়ে এসেছে। গত সাত দিনের কাগজ আছে। আপনার জন্যে নিয়ে এলাম। ইউরোপের কাগজ নিশ্চয়ই অনেকদিন দেখেননি।’
ধন্যবাদ। ইয়াউন্ডিতে কিছু কাগজ নিয়মিত পাওয়া যেত।’
একটু থামল আহমদ মুসা। সঙ্গে সঙ্গেই আবার শুরু করল, ‘কংগ্রাচুলেশন। টেলিভিশনে আপনার প্রমোশন এবং পুরষ্কারের খবর শুনলাম।’
জাগুয়াস ম্যাকা হাসল। বলল, ‘কেউ মরে বিল সেচে, কেউ খায় কই।’ আমার খুবই লজ্জা হচ্ছে এই প্রমোশন ও পুরস্কারের কথা শুনে।’
‘কেন?’
‘ঐ তো বললাম।‘কাজ করলেন আপনি, আর ফল পাচ্ছি আমি।’
‘কেন, কাজ তো করেছেন আপনি।’
‘কি করেছি তা আপনি জানেন। উপস্থিত হওয়া কাজ হলে কিছু কাজ করেছি।’
একটু থামল জাগুয়াস ম্যাকা। থেমেই আবার শুরু করল, ‘আমি বুঝতে পারছিনা, আপনি একেবারে পর্দার আড়ালে চলে গেলেন, আপনার বিষয়টা কাউকে জানতে দিলেন না কেন?’
‘সবই তো শুনেছেন। প্রকাশ হলে শত্রুর আরেক দফা রোশের মধ্যে পড়া ছাড়া কি লাভ হতো!’
‘সাংবাদিকদের না জানান, কিন্তু আমার পুলিশ কে জানালে তো ক্ষতি ছিল না।’
‘আপনি কি নিশ্চিত, আপনাদের পুলিশের কারও সম্পর্ক ব্ল্যাক ক্রস-এর সাথে নেই?’
জাগুয়াস ম্যাকা গম্ভীর হল। বলল, ‘না এটা বলতে পারবো না।’
বলেই হাসল জাগুয়াস ম্যাকা। বলল, ‘আপনার যুক্তি ঠিক। কিন্তু আমার খুব কষ্ট লাগছে, আপনার এত বড় একটা কৃতিত্বের কথা বিশ্ববাসী জানতে পারল না।’
‘কষ্ট লাগবে না আপনার যদি আপনি ভাবেন, কৃতিত্ব প্রকাশ না করার মধ্যেই আমার লাভ শতগুন বেশী।‘
‘শতগুন লাভটা কি?’
‘দেখুন, মুসলমানরা এ ধরনের কাজই করেন আল্লাহর জন্যে, মানে আল্লাহর দেয়া দায়িত্ব মনে করে।’ এজন্যে আল্লাহর কাছ থেকে রয়েছে অঢেল পুরষ্কার। দুনিয়ার মানুষের কাছে নাম ও কৃতিত্ব পাওয়ার জন্যে এ ধরনের কাজ করলে আল্লাহর কাছ থেকে এ পুরষ্কার পাওয়া যায় না।
‘কিন্তু মানুষের কাছে নাম ও কৃতিত্ব চাওয়ার মধ্যে ক্ষতিকর কি আছে, যার জন্যে আল্লাহ পুরষ্কার দেয়া বন্ধ করবেন?’
আহমদ মুসার মুখমণ্ডল গম্ভীর হয়ে উঠল। বলল, ‘মানুষ কেন নাম চায়? কেন তার কৃতিত্বের কথা প্রচার করতে চায়? চায় কারন, সে তার ভাল কাজের বিনিময় চায়। মানুষ তার কৃতিত্বের একটা বিনিময় দিক সে চায়। এই প্রবনতা তার কাজকে স্বার্থদুষ্ট করে তোলে। আর এই স্বার্থদুষ্টতা ধীরে ধীরে তাকে শোষক ও স্বেচ্ছাচারী করে তুলতে পারে। অন্যদিকে কাজটা যদি আল্লাহর দেয়া মানবিক দায়িত্বের অংশ হিসেবে হয়, যাকে বলা হয় ফি সাবিলিল্লাহ, তাহলে তার মধ্যে স্বার্থের কোন চাহিদা থাকে না। এ ধরনের লোক দ্বারা মানবতা শুধু উপকৃতই হয়, ক্ষতিগ্রস্থ হয় না।’
‘বুঝলাম। কিন্তু আমার ভুয়া ‘কৃতিত্ব’ নিয়ে যে দেশ জুড়ে হৈচৈ হচ্ছে তার কি করব।’
আহমদ মুসা হাসল। বলল, কৃতিত্ব যখন ভুয়া বলছ, তখন এ কৃতিত্বের দ্বারা মানবতার কোন ক্ষতি হবেনা।’
‘কৃতিত্ব ভুয়া হলেও, এ কৃতিত্বের যে পুরষ্কার আমার হাতে তুলে দিচ্ছে তা তো ভুয়া নয়। আমার প্রমোশন হচ্ছে, এটা বাস্তব ঘটনা।’
‘ক্ষতি নেই তাতে। প্রমোশন আসল বিষয় নয়, আসল বিষয় হলো যিনি প্রমোশন পাচ্ছেন তিনি। তিনি যদি অহংকারী ও ক্ষমতালিপ্সু না হয়ে ওঠেন এবং মনে করেন যে, প্রমোশন আল্লাহর করুনা হিসেবে তার হাতে এসেছে, তাহলে এর দ্বারা মানবতার উপকার হবে, কোন ক্ষতি নয়।’
‘ধন্যবাদ’ বলে জাগুয়াস ম্যাকা উঠে দাঁড়াল। বলল, ‘আমি পোশাক ছেড়ে আসছি।’
জাগুয়াস ম্যাকা চলে গেল বাড়ির ভেতর।
আহমদ মুসা কাগজগুলো টেনে নিয়ে সোফায় হেলান দিয়ে বসল।
চা নিয়ে ঘরে প্রবেশ করল ৭ বছরের নাওমি, জাগুয়াস ম্যাকার মেয়ে।
চা-এর ট্রলি নিয়ে আহমদ মুসার সামনে পোঁছতেই আহমদ মুসা বলে উঠল, নাওমি, কাজের ছেলেটা কোথায়? তোমার তো একাজ না?
‘আম্মা বলেন, ‘মেহমানদের মেহমানদারী নিজেরা করতে হয়। আপনার মেহমানদারী তো করতেই হবে।’
‘কেন করতে হবে?’
‘আপনি সাংঘাতিক লোক।’
‘সাংঘাতিক লোক? মানে খারাপ লোক আমি? হেসে উঠল আহমদ মুসা।
‘না, ভাল সাংঘাতিক আপনি। আপনি একাই দেড়কুড়ি শত্রুকে মেরেছেন, আম্মা বলেছেন।’
‘মানুষ মারা কি ভাল?’
‘মানুষ নয়তো, শত্রু, আম্মা বলেছেন।’
‘শত্রু কি মানুষ নয়?’
নাওমি সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিল না। উত্তর খুজছে সে। একটু পর আমতা আমতা করে বলল, ‘শত্রু কি তাহলে ভাল?’
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘তোমার আম্মা ঠিকই বলেছেন। শত্রু ভাল নয়, খারাপ। কিন্তু তারা মানুষ।’
‘তাহলে মানুষ শত্রু কেন, খারাপ কেন?’
‘মানুষের মধ্যে ভাল মানুষ, খারাপ মানুষ দুই-ই আছে’
‘খারাপ কেন?’
‘মানুষ যারা আল্লাহর আদেশ-নিষেধ মেনে চলে না, তারা খারাপ হয়ে যায়।’
‘আব্বা-আম্মার কথা না মানলে?’
‘সেটাও খারাপ কাজ। খারাপ কাজ করলে মানুষ খারাপ হয়।’
নাওমি একটুক্ষণ চুপ করে থাকল, তারপর বলল, ‘আপনি আমাদের বাড়িতে থাকবেন না কেন?’
‘কে বলল থাকব না?’
‘আম্মা বলেছেন’
‘কি বলেছেন?’
‘আপনি এক যায়গায় থাকেন না। ঘুরে বেড়ান।’
একটু থেমে একটা ঢোক গিলেই নাওমি আবার শুরু করল ‘আপনার বাড়ি নেই, আম্মা নেই?’
আকস্মিক এই প্রশ্নে আহমদ মুসা কি উত্তর দেবে ভাবছিল। এই সময় ভেতর থেকে নাওমির মা নাওমিকে ডাকল। ডাক শুনেই নাওমি দৌড় দিল ভেতরে।
আহমদ মুসা স্বস্তি বোধ করল। নাওমির শেষ প্রশ্নটা আহমদ মুসার মর্মে গিয়ে আঘাত করেছিল। হঠাৎ করেই তার মায়ের কথা মনে পড়ে গিয়েছিল। তার সাথে মনে পড়ে গিয়েছিল সিংকিয়াং-এর ছোট পার্বত্য গ্রামের ছোট একটা গৃহাঙ্গনের কথা।
নাওমি গেলেও স্মৃতির সেই গৃহাঙ্গন থেকে ফিরে আসতে পারল না আহমদ মুসার মন। কি অসীম সুখের বন্যা ছিল সেই গৃহাঙ্গনে। মায়ের কোল নিয়ে চলত দু’ভায়ের কাড়াকাড়ি। দুই কোলে দু’জনকে তুলে নিত মা। মায়ের কোলের সে উষ্ণতা হৃদয়ে যেন জীবন্ত হয়ে উঠল তার।
আহমদ মুসার চোখ দু’টি ভিজে উঠল।
ঠিক মাথার উপরেই দেয়াল ঘড়িতে সময় জ্ঞাপন ঘণ্টা বেজে উঠল।
আহমদ মুসা ফিরে এল অতীত থেকে। নড়ে-চড়ে বসল। চোখ দুটি মুছে সামনের টেবিল থেকে সংবাদপত্রগুলো টেনে নিল।
সংবাদপত্রগুলোর দিকে তাকিয়ে খুশী হল আহমদ মুসা। ফ্রান্সের বিখ্যাত দৈনিক লা মণ্ডে এবং সুইজারল্যান্ডের ‘দার ব্লিক’- এর গত কয়েকদিনের কয়েকটি সংখ্যা।
তারিখ অনুসারে কাগজগুলোকে সিরিয়াল করে নিয়ে সুইস পত্রিকা ‘দার ব্লিক’ তুলে নিল হাতে।
‘দার ব্লিক’ তার কাছে নতুন পত্রিকা। অনেক নাম শুনেছে। কিন্তু পড়েনি কখনও আহমদ মুসা।
‘দার ব্লিক’টাই আহমদ মুসা তুলে নিল হাতে।
প্রথমে আহমদ মুসা পৃষ্ঠাগুলোর উপর চোখ বুলিয়ে দেখল কোন পাতাকে কোন বিষয় দিয়ে সাজানো হয়েছে। তারপর আকর্ষণীয় কিছু নিউজ পড়তে লাগল। প্রথম পাতায় সিংগল কলামের একটা নিউজ আহমদ মুসার দৃষ্টি আকর্ষণ করল। শিরোনাম ‘মিষ্ট্রিয়াস ডেথ’ রহস্যজনক মৃত্যু। পড়ল নিউজটি আহমদ মুসা। উত্তর জেনেভায় একটি ফ্ল্যাটে একজন যুবককে মৃত অবস্থায় পাওয়া গেছে। নাম হাবিব ডুনান্ট। উত্তর জেনেভার একটি সুসজ্জিত ফ্যামেলি ফ্ল্যাটে তার রহস্যজনক মৃত্যু ঘটে। প্রচণ্ড ধরনের প্রাণীজ বিষের প্রভাবে তাঁর মৃত্যু ঘটে। বিষের প্রকৃতি ও প্রকার নিয়ে পরীক্ষা হচ্ছে।
এর একদিন পরের আরেকটি ‘দার ব্লিক’ পড়তে গিয়ে সিংগল কলামে প্রকাশিত আরেকটি নিউজ পড়ল আহমদ মুসা। অনুরুপ রহস্যজনক মৃত্যুর খবর। এ মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে দক্ষিণ জেনেভার একটি ফ্ল্যাটে। মৃত্যু ঘটেছে মধ্য বয়সী একজন মানুষের। এ মৃত্যুর কারণও আগের বিষ। লোকটির নাম ইউসেফ উইলিয়াম। ল্যাবরেটরি পরীক্ষায় প্রমানিত হয়েছে বিষটি ‘সিসি ফ্লাই-এর বিষের অনুরুপ। তবে সিসি মাছির বিষ এত দ্রুত ও প্রান সংহারী হয় না। বিষয়টি বিশেষজ্ঞ মহলে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছে।
দু’দিন পরের আরেকটি ‘দার ব্লিক’এর পাতায় চোখ বুলাতে গিয়ে চমকে উঠল আহমদ মুসা। সিসি মাছির বিষক্রিয়ায় আরেকটি মৃত্যুর খবর একেবারে ‘শীর্ষ নিউজ’ হিসেবে প্রকাশিত হয়েছে। একই ধরনের খবর। ঐ একই ধরনের বিষক্রিয়ায় যুবকের মৃত্যু। মধ্য জেনেভায় ‘রণ’ নদীর তীর এলাকায় একটি ফ্ল্যাটে তার মৃতদেহ পাওয়া গেছে। নাম আসফ আফেন্দী। ওয়ার্ল্ড নিউজ এজেন্সীর (WNA) কেন্দ্রীয় ডেস্কের চীফ নিউজ কো-অর্ডিনেটরদের একজন সে।
ল্যাবরেটরি পরীক্ষার বরাত দিয়ে নিউজে বলা হয়েছে, পর পর তিনটি মৃত্যুর ঘটনাই বিশেষ ধরনের সিসি মাছির কামড়ে ঘটেছে। এ এক নতুন ধরনের সিসি মাছি। কামড়ের পরপরই মানুষ ঘুমে ঢলে পড়ে এবং সে ঘুম আর ভাঙে না। মধ্য আফ্রিকার জলজ অঞ্চলে যে কয় ধরনের সিসি মাছি পাওয়া গেছে, তা থেকে এ মাছির বিষ আলাদা। কিন্তু প্রশ্ন হল আফ্রিকার বাইরে এ মাছি আসতে পারে কি করে?
ল্যাবরেটরি পরীক্ষার এই তথ্য প্রকাশ হওয়ার পর গোটা জেনেভা শহরে আতংক ছড়িয়ে পরছে। অশরীরী ভয়ের একটা কালো ছায়া আচ্ছন্ন করেছে গোটা শহরকে। একটা অদৃশ্য আতংক এসে গ্রাস করেছে গোটা শহরবাসীকে।
খবরটি পড়ে আহমদ মুসাও বিস্মিত হল। সিসি মাছির প্রকৃতি যা, যে আবহাওয়ায় সে বাঁচে, সেদিক থেকে সিসি মাছি সুইজারল্যান্ডে যেতেই পারেনা। তাছাড়া যে সব প্রজাতির সিসি মাছি আবিষ্কৃত হয়েছে, তার বাইরে ঐ সিসি মাছি এল কোথেকে?
মনটা আহমদ মুসার আরও খারাপ হয়ে গেল ওয়ার্ল্ড নিউজ এজেন্সীর একজন শীর্ষস্থানীয় সাংবাদিকের মৃত্যুর খবর শুনে। ওয়ার্ল্ড নিউজ এজেন্সীর একজন শীর্ষস্থানীয় সাংবাদিকের মুল্য অনেক। তাদের একজন কে হারালে সে স্থান পূরণ হওয়া সহজ নয়। আরও একটা দিক আহমদ মুসাকে দারুন ভাবে পীড়া দিল। সেটা হল, সিসি মাছির বিষে মৃত্যুবরণকারী তিনজনই মুসলমান। এটা কেন, কিভাবে সম্ভব হলো?
প্রবল অস্বস্তি জেগে উঠল আহমদ মুসার মনে। তার মনে হতে লাগল, জেনেভা নগরীর তিন এলাকার তিনটি মৃত্যুর সাথে কোথায় যেন একটা যোগ আছে।
অনুসন্ধিৎসু হয়ে উঠল আহমদ মুসা।
নড়ে-চড়ে বসল আহমদ মুসা।
একটু ভাবল, তারপর হাত বাড়াল টেলিফোনের দিকে।
ডায়াল করল ওয়ার্ল্ড নিউজ এজেন্সী (WNA)-এর জেনেভাস্থ হেড অফিসের বিশেষ একটি নম্বরে। নম্বরটি WNA-এর চেয়ারম্যান মিঃ গটেফ-এর।
ও প্রান্ত থেকে মিঃ গটেফ-এর কণ্ঠ ভেসে এল, গুড মর্নিং, আমি গটেফ।
আহমদ মুসা সালাম দিয়ে নিজের পরিচয় দেয়ার পর বলল, ‘কেমন আছেন আপনারা?’
‘ভাল নেই। মনে মনে আপনার কথাই ভাবছিলাম।’
‘কেন? কি হয়েছে?’
‘কিছু শোনেননি আপনি?’
‘আজ এই মাত্র ‘দার ব্লিক’ পড়ে জানতে পারলাম বিশেষ ধরনের সিসি মাছির বিষক্রিয়ায় WNA-এর সিনিয়র সাংবাদিকের মৃত্যুর খবর’
‘সাংবাদিককোথায় একজন তিনজন’
‘তিনজন? অন্য যে দু’জন মারা গেছে তারাও WNA-এর সাংবাদিক?’
‘জি না। প্রথম দুজন ফ্রী ওয়ার্ল্ড টিভি (FWTV)-এর শীর্ষ সাংবাদিক।’
চমকে উঠল আহমদ মুসা। তার হৃদয় যেন প্রচণ্ড এক মোচড় দিয়ে উঠল।
তৎক্ষণাৎ কোন কথা বলতে পারলো না আহমদ মুসা।
কয়েক মুহূর্ত পর নিজেকে সামলে নিয়ে আহমদ মুসা বলল, ‘এমন ঘটনা কিভাবে ঘটল?”
‘পুলিশ কিছু বুঝতে পারছে না। মৃতদের শরীরে প্রচণ্ড শক্তির স্লিপিং পয়জন পাওয়া গেছে। এ স্লিপিং পয়জনের সাথে সিসি মাছির স্লিপিং পয়জনের মিল আছে। কিন্তু কোন ধরনের সিসি মাছির বিষই এমন প্রচণ্ড নয় যে, শরীরে প্রবেশের কয়েক ঘণ্টার মধ্যে ঘুমকে মৃত্যুতে রূপান্তরিত করবে।’
‘তাহলে কি ভাবছে পুলিশ?”
‘তারা ভাবছে, বিশেষ সিসি মাছি বা কোন নতুন ধরনের বিষাক্ত পোকার কামড়ে তাদের মৃত্যু হয়েছে।’
‘এটা কি নিশ্চিত?”
‘মৃতদের দেহ পরীক্ষায় তাদের দেহ মাছি বা পোকার কামড়ের চিহ্ন পাওয়া গেছে। পরীক্ষায় আরও প্রমানিত হয়েছে, কামড়গুলো জীবন্ত কোন মাছি বা পোকার। সুতরাং বিষয়টা নিশ্চিতই।’
‘কিন্তু বিশেষ ঐ সিসি মাছি বা নতুন ধরনের পকা এল কত্থেকে?’
‘এর জবাব বিশেষজ্ঞরা দিতে পারছেন না। মারাত্মক আতংক ছড়িয়ে পড়েছে জেনেভায়। অনেকেই জেনেভা থেকে পালাচ্ছেন।’
‘কিন্তু মৃত তিনজনই সাংবাদিক কেন, দু’টি বিশেষ সংস্থার কেন এবং তিনজনই মুসলিম কেন?’
‘হতে পারে এটা ঘটনার আশ্চর্যজনক এক সাযুজ্যতা’
‘হতে পারে। তাহলে কি মৃত্যুগুলোকে পুলিশ অস্বাভাবিক মাছি বা পোকার দ্বারা সংঘটিত ও স্বাভাবিক বলেই ধরে নিচ্ছে?’
‘স্যরি, একটু ধরুন জনাব। ইন্টারকম কথা বলছে শুনে নেই।’ ওপার থেকে বলল গটেফ।
ইন্টারকমের কথা টেলিফোনের মাধ্যমে আহমদ মুসা স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছিল।
শুনতে শুনতে উদ্বেগের ছায়া নামল আহমদ মুসার চোখে-মুখে।
ইন্টারকমে WNA-এর ম্যানেজিং এডিটর চেয়ারম্যানকে জানাচ্ছিল, এইমাত্র টেলিফোনে জানালেন (FWTV)-এর নির্বাহী পরিচালক আলাদিন উইলিয়াম মারা গেছে। পুলিশের প্রাথমিক বক্তব্যে বলা হয়েছে, রহস্যজনক ঐ মাছি বা পোকার ভয়ংকর স্লীপিং বিষেই তার মৃত্যু হয়েছে……।’
আরও অনেক কথাই ইন্টারকম থেকে টেলিফোনে ভেসে এসেছিল আহমদ মুসার কানেও প্রবেশ করছিল। কিন্তু আহমদ মুসা অন্য ভাবনায় তখন ডুবে গিয়েছিল।
প্রথমে প্রচণ্ড আঘাতে মুষড়ে পড়েছিল তার হৃদয়টা। আলাদিন উইলিয়াম কে সে জানে। যারা FWTV-কে গড়ে তুলেছে এবং জনপ্রিয় টিভি নেটওয়ার্ক হিসেবে বর্তমান পর্যায়ে একে নিয়ে এসেছে, আলাদিন উইলিয়াম তাদের একজন।
প্রাথমিক আঘাতটা সামলে নেবার পর আহমদ মুসার মনে যে কথাটা বড় হয়ে উঠল তা হলো, অর্থ কি এসব ঘটনার? এই চতুর্থ ঘটনাকেও কি ‘কো-ইন্সিডেন্স’ বলতে হবে?
আহমদ মুসার চিন্তা বাধাগ্রস্থ হল মিঃ গটেফ এর কণ্ঠে। বলছিল মিঃ গটেফ, ‘স্যরি জনাব আপনাকে কষ্ট দিয়েছি। ইন্টারকমের সব কথা আপনি শুনেছেন নিশ্চয়। বুক আমার কাঁপছে খবর শুনে। আমার ভয় হচ্ছে, সাংঘাতিক ঐ সিসি মাছি বা পোকা আমাদের অফিস দু’টির আশে-পাশে কোথাও কনভাবে বাসা বেধেছে কিনা।’
‘বিষয়টা খতিয়ে দেখেননি?’
‘দেখেছি, আমাদের দু’টি অফিসের প্রতিটি ইঞ্চি জায়গা এবং আশে-পাশের স্থান আমরা পরীক্ষা করেছি, সন্দেহজনক কিছুই মেলেনি।’
‘তাহলে আবার সন্দেহ করছেন কেন?’
‘কারন রহস্যজনক মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে আমাদের দু’অফিস থেকেই এবং অফিস দুটি পাশাপাশি।’
‘এই বিষয়টা নিয়ে পুলিশ ভাবছে না?’
‘অফিসে কেউ মারা যায়নি। যে চারজন মারা গেল তারা শহরের চার এলাকার। পুলিশ এক’বা দুই অফিসের হওয়ার বিষয়টাকে বিস্ময়কর কো-ইন্সিডেন্স মনে করছে। আমরাও তাই মনে করছি।’
আহমদ মুসা মুহূর্তকাল ভাবল। তারপর বলল, ‘জনাব আমি জেনেভা আসছি। আমার পরিচয় হবে আমি আপনার WNA-এর একজন সাংবাদিক। আপনাদের দেয়া ইন্টারন্যাশনাল এ্যাক্রডিটেশন কার্ড ব্যাবহার করব। আপনি দয়া করে আপনাদের নাইরোবি ব্যুরোকে বলে দিন তারা যেন কোন এয়ার লাইন্সকে বলে ইউরোপগামী কোন টিকিটের ব্যাবস্থা করে দেয়। আজকের হলে ভাল হয়, না হলে কাল সকালের জন্যে অবশ্যই।’
‘আলহামদুলিল্লাহ। আমার বুক ভরে গেল এ খবরে। এ বিপদে আশেপাশে আপনি থাকলে সাহস পাব। কিন্তু মানুষ যখন জেনেভা ছাড়ছে, তখন আপনার আসা কি ঠিক হবে?’
‘এসব আলোচনার সময় এখন নেই মিঃ গটেফ। আপনি এখনি যোগাযোগ করুন নাইরোবির সাথে।’
‘এত তাড়াতাড়ি ভিসার ব্যাবস্থা আপনি করতে পারবেন?’
‘আল্লাহর শুকরিয়া। আমি ফ্রান্সে থাকতে সুইজারল্যান্ডে যাব বলে ভিসা নিয়েছিলাম। মাল্টিপুল ভিসা। এখনও ভ্যালিড আছে।
‘ঠিক আছে। আমি এখনি নাইরোবি টে বলে দিচ্ছি।‘
‘শুকরিয়া’ বলে সালাম দিয়ে টেলিফোন ছেড়ে দিল আহমদ মুসা।

রাত দশটায় বারবারেতি বিমান বন্দরে প্যান আফ্রিকান ইয়ার লাইন্স-এর এক্তি বিমানে উঠে বসল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসা জেনেভায় কথা বলার দুঘণ্টা পরেই নাইরোবি থেকে টেলিফোন পেয়েছিল। নাইরোবি থেকে বলেছিল, রাত দশটায় প্যান আফ্রিকান এয়ার লাইন্স আহমদ মুসাকে নাইরোবি নিয়ে আসবে।
খার্তুমে আধ ঘণ্টার বিরতির পর এই বিমানই তাদের নিয়ে যাবে জেনেভায়।
বিমানের দরজা বন্ধ হয়ে গেল।
এখনি বিমান ছাড়বে মধ্য আফ্রিকা প্রজাতন্ত্রের মাটি। হঠাৎ মনটা খারাপ হয়ে উঠল আহমদ মুসার ব্ল্যাক বুলদের জন্যে।
আহমদ মুসা জানালা দিয়ে তাকাল গ্যাংওয়ের দিকে। দেখল ব্ল্যাক বুল এবং জাগুয়াস ম্যাকা এখনও দাঁড়িয়ে আছে পাশাপাশি। ব্ল্যাক বুলের কান্না থেমেছে কি?
আহমদ মুসার চলে আসার আকস্মিক খবরে শিশুর মত কেঁদেছে ব্ল্যাক বুল। বলেছে, ‘আমি মানুষ ছিলাম না, আমাকে মানুষ বানিয়েছেন এবং সুন্দর জীবনে ফিরিয়ে এনেছেন আপনি। আল্লাহর ইচ্ছায় এটা হয়েছে, কিন্তু কাজ আপনি করেছেন। আপনি চলে যাবেন, আপনাকে আর দেখব না, এটা ভাবতে পারছি না।’
জাগুয়াস ম্যাকাও কেঁদেছে।
আহমদ মুসাও কম ব্যাথা পায়নি।
গভীর অরন্য বেষ্টিত আফ্রিকার এ দুর্গম বুকের সরল সহজ মানুষগুলোর প্রতি কি এক অপরিচিত মায়া সৃষ্টি হয়েছিল আহমদ মুসার। কিন্তু তাদের না ছেড়ে উপায় কি। দায়িত্বের ডাক সে অস্বীকার করবে কেমন করে!
নড়ে উঠল বিমান। চলতে শুরু করল।
চোখের আড়াল হয়ে গেল জাগুয়াস ম্যাকা এবং ব্ল্যাক বুলের দাঁড়িয়ে থাকার দৃশ্য।
আকাশে উড়ল বিমানটি।
ছুটে চলল গন্তব্যের লক্ষ্যে।
সিট বেল্ট খুলে আহমদ মুসা শরীরটা এলিয়ে দিল সিটের উপর।
সবে চোখ ধরে এসেছিল আহমদ মুসার। পাশ থেকে ‘জোসেফাইন’ ডাক শুনে চোখ খুলে পাশে ফিরে তাকাল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসার পাশেই একজন শ্বেতাঙ্গ বালিকা বসে। তার পাশে একজন মধ্যবয়সী মহিলা। আহমদ মুসা বালিকাকে ঐ ডাকে সাড়া দিতে দেখে বুঝল, বালিকাটির নাম জোসেফাইন।
আহমদ মুসা মুখ ঘুরিয়ে নিল।
মনে পড়ে গেল মারিয়া জোসেফাইন (ডোনা জোসেফাইন) এর কথা।
সঙ্গে সঙ্গেই আহমদ মুসার হৃদয়ে বেদনার এক উষ্ণ স্রোত বয়ে গেল।
সুইজারল্যান্ডে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়ার পর আহমদ মুসা টেলিফোন করেছিল ইয়াউন্ডিতে রাশিদী ইয়েসুগোর বাড়িতে। ডোনাই টেলিফোন ধরেছিল। প্রথমে দ্বিধায় পড়েছিল আহমদ মুসা। খারাপ লাগছিল তার সুইজারল্যান্ডে যাওয়ার কথা ডোনাকে বলতে। বিয়ের আসন থেকে সে উঠে এসেছিল। ক্যামেরুনে ডোনাদের কাছে আবার ফিরে যাবে, এটাই কথা ছিল। সবাই আশা করেছিল তাদের বিয়েটা ওখানেই হবে। টা তো হচ্ছে না। উপরন্তু কারও সাথে দেখা না করে, ডোনাদের ওখানে ফেলে রেখেই তাকে চলে যেতে হচ্ছে সুইজারল্যান্ডে। একথা ডোনাকে বলতে কষ্ট হচ্ছে তার।
তবু কঠোর কথাটা আহমদ মুসা বলেছিল ডোনাকে।
আনন্দে নেচে ওঠা এক বালিকার মত টেলিফোন ধরেছিল ডোনা।
কিন্তু আহমদ মুসার কথা শোনার পর সে নীরব হয়ে গিয়েছিল। সঙ্গে সঙ্গে সে কথা বলতে পারেনি।
কিছু পরে শুকনো কণ্ঠে ডোনা বলেছিল, ‘তোমার কণ্ঠ শুনে মন হচ্ছে তুমি যেন অপরাধ করেছ।’
‘অপরাধ হয়ত করিনি, কিন্তু সব কিছু লন্ড-ভণ্ড করে দিলাম এটা তো ঠিক।’ বলেছিল আহমদ মুসা।
শুকনো কণ্ঠে একটা শুকনো হাসি ফুটে উঠেছিল ডোনার। বলেছিল, ‘সাজানো ছক মত তোমার জীবন কখনও কি চলেছে?’
‘তার জন্যে দুঃখ নেই। কিন্তু তোমার জীবনকেও লন্ড-ভণ্ড করে দিলাম।’
‘এজন্যে দুঃখ হচ্ছে বুঝি?’
‘সেটা কি অস্বাভাবিক?’
‘তাহলে তুমি নিজের জন্যে যা পছন্দ কর, আমার জন্যে তা পছন্দ করনা?’
‘সবার আমি ভাল চাই, সবার মুখে চাই আমি হাসি দেখতে। এই আকাঙ্ক্ষা তোমার ক্ষেত্রে কি আরও বেশী হওয়া উচিত নয়?’
হেসে ফেলেছিল ডোনা। বলেছিল, ‘তুমি কথারও রাজা। পারবোনা তোমার সাথে। এখন বল, ‘আমার প্রতি তোমার নির্দেশ কি?’
আহমদ মুসা তৎক্ষণাৎ কোন উত্তর দিতে পারেনি। হৃদয়ে একটা খোঁচা লেগেছিল তার। ডোনা তার আব্বাকে নিয়ে আহমদ মুসার জন্যেই ছুটে এসেছিল ফ্রান্স থেকে সুদূর ক্যামেরুনে। কি নির্দেশ এখন দেবে তাকে? বলবে যে, যেমন একা এসেছিলে, তেমনিভাবে ফিরে যাও!
ভারি মনে আহমদ মুসা বলেছিল, ‘তোমার প্রতি আস্থা আমার দুর্বল নয়, কোন নির্দেশ আমার নেই।’
‘জানি তুমি এড়িয়ে যাচ্ছ।’
একটু থামল ডোনা। থেমেই আবার শুরু করল, ‘আমি কিন্তু সুইজারল্যান্ডে আসব।’
‘না ডোনা, ঐ আতঙ্কের মধ্যে তুমি এসো না।’ নরম কণ্ঠে বলেছিল আহমদ মুসা।
‘বেশ ভাল কথা। তুমি আতঙ্কের সমুদ্রে ঝাঁপ দেবে, আর আমি নিজেকে রক্ষার জন্যে দূরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখব। তা আমি পারবো না।’
‘ঠিক আছে। একটা কথা দাও, আমার টেলিফোন পাওয়ার আগে যাবে না।’
‘তোমার শর্তের পেছনে যুক্তি কি আছে?”
‘একটাই যুক্তি, আমার টেলিফোন না পেলে আমার ঠিকানা পাবে কি করে?’
হেসেছিল ডোনা। বলল, ‘ধন্যবাদ, ভালো যুক্তি দিয়েছ। তবে এটাই একমাত্র এবং আসল যুক্তি নয়। যাক। আমি তোমার টেলিফোনের অপেক্ষা করব। তবে সেটা আমাদের প্যারিস পৌছার পর তিন দিন মাত্র।’
হেসেছিল আহমদ মুসা। বলেছিল, ‘আমার ঠিকানা না জানলে আমাকে খুঁজে পাবে কি করে?’
‘ক্যামেরুনে তোমাকে খুঁজে পাইনি? জেনেভায় তো বিষয়টা আমার জন্যে খুবই সহজ হবে।’
‘কেমন করে?’
‘জেনেভায় FWTV অথবা WNA-এর অফিসে গেলেই তোমার সাথে যোগাযোগ হয়ে যাবে।’
হেসেছিল আহমদ মুসা। বলেছিল, ‘ধন্যবাদ ডোনা। তোমার বুদ্ধির প্রশংসা করছি।’
কথা শেষ করে আহমদ মুসা একটু থেমেই আবার বলেছিল, ‘বিদায় দাও ডোনা, এখনি আমাকে ছুটতে হবে। সবাইকে আমার সালাম দিও। আর মাফ করতে বলো।’
‘বিদায়’ কথাটা ফিরিয়ে নাও। বল, ‘আসি।’
‘ফিরিয়ে নিলাম ‘আসি’, ঠিক আছে?’
সত্যি আজ খুব কষ্ট লাগছে। প্রত্যাশা বোধহয় খুব বেশী করেছিলাম। ভারী হয়ে ওঠা গলা কেঁপে উঠেছিল ডোনার।
‘আমি দুঃখিত ডোনা।’
‘আমাকে তুমি মাফ করো। একটা বড় কাজে যাবার সময় তোমাকে কষ্ট দিলাম।’ বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে বলেছিল ডোনা।
তারপর সালাম দিয়ে টেলিফোন রেখে দিয়েছিল।
টেলিফোন রেখে আহমদ মুসা কিছুক্ষন ঠায় বসেছিল। বুঝতে পারছিল আহমদ মুসা, ডোনা এখন নিশ্চয় কাঁদছে।
প্লেনের সিটে হেলান দিয়ে বসা আহমদ মুসার চোখের সামনে অশ্রু সজল ডোনার সেই মুখটাই ভেসে উঠছিল।
আনমনা হয়ে পড়ল আহমদ মুসা।
এয়ার হোস্টেজ-এর ‘এক্সকিউজ মি’ শব্দে সম্বিত ফিরে পেয়ে তাকাল আহমদ মুসা। দেখল, নাস্তা এসেছে।
প্লেনের একটা পাশের তিন সিটের শুরুতেই আহমদ মুসার সিট। তারপর বালিকাটির। বালিকার পর শেষ প্রান্তের সিটটা তার মায়ের।
বালিকাটি তার নাস্তার বাক্স খুলতে গিয়ে বাক্সটি ফেলে দিল নিচে। আহমদ মুসার ট্রের পাশ দিয়েই পড়ে গেল।
আহমদ মুসা ঝুকে পড়ে টিফিন বাক্সটি তুলে বালিকাটির ট্রের উপর রেখে বলল, ‘আমি সাহায্য করতে পারি?’
বালিকাটি মুখ তুলে তাকাল। কিন্তু কিছু বলল না।
আহমদ মুসা তার টিফিন বাক্সটি খুলে সুন্দর করে সাজিয়ে দিল।
‘ধন্যবাদ’ বলল মহিলাটি।
‘ধন্যবাদ’ বলল জার্মান ভাষায় বালিকাটি।
‘ওয়েলকাম গুড গার্ল। তোমার বাড়ি নিশ্চয় জার্মানিতে নয়’
‘ঠিক। আমরা সুইজারল্যান্ডের।’ বলল, বালিকাটি।
‘আমি মিসেস জিনা ডোনাল্ট। সাহায্যের জন্যে আপনাকে ধন্যবাদ। আপনি নিশ্চয় জার্মান ভাষা ভালো জানেন?’
‘নামমাত্র জানি। তবে শুনেছি অনেক। তাই পার্থক্যটা ধরতে পারি।’
‘ধন্যবাদ।’ বলে আহমদ মুসা সোজা হয়ে বসতেই একটা কর্কশ শব্দে চমকে উঠে সামনে তাকাল। দেখল, ককপিটের সামনে টয়লেট ও সার্ভিস কেবিনের মাঝখানে করিডোরের মুখে রিভলবার হাতে একজন দাঁড়িয়ে। বলছে লোকটি চিৎকার করে। ‘ককপিট আমরা দখল করে নিয়েছি। প্লেন এখন আমাদের নির্দেশে চলছে। সন্দেহজনক কেউ কিছু করলে তখনই তাকে হত্যা করা হবে এবং বিমান উড়িয়ে দেয়া হবে।’
তার কথাগুলো বাজলো যেন মৃত্যু ঘণ্টার মত। আতঙ্কের এক প্রবল ঢেউ খেলে গেল বিমানের কেবিনে। মুহূর্তে মানুষের চেহারা পাল্টে গেল। মৃত্যুর আতঙ্ক তাদের চোখ-মুখ থেকে ঠিকরে পড়ছে।
প্রাথমিক আতঙ্কের পর সব বোধগম্য হলে কান্না শুরু করে দিল কেউ কেউ।
আহমদ মুসা পাথরের মত বসে। তার স্থির দৃষ্টি রিভলবারধারী লোকটির প্রতি নিবদ্ধ। লোকটি শ্বেতাঙ্গ।
পাশের বালিকা জোসেফাইন কেঁদে উঠেছিল। আহমদ মুসা সেদিকে তাকাল। তার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, ‘কেদনা।’ ভয় নেই। কাঁদলে, ভয় করলে ওরা আরও সাহস পায়।’
বালিকাটির মা’র চেহারা রক্তশুন্য। পাথর হয়ে গেছে ভয়ে। মেয়েকে কিছু বলার শক্তিও যেন তার নেই।
আহমদ মুসা আবার দৃষ্টি ফেরাল রিভলবারধারী লোকটির দিকে।
লোকটির হাতে শুধু একটি রিভলবার। অন্য হাতটি খালি। আর লোকটির দেহের গঠন, চোখ-মুখের চেহারা এবং দাড়ানোর ভংগি দেখে তাকে কোন প্রফেশনাল মনে হল না।
হাইজ্যাকাররা কয়জন? আপাতত দু’জন মনে হচ্ছে। একজন সে আরেকজন ককপিটে। দেখতে হবে আরও লোক আছে কিনা ওদের।
কেন ওরা বিমান হাইজ্যাক করল? কি দাবী ওদের?
আহমদ মুসা দেখল, রিভলবারধারী লোকটি, পিছু হটে ককপিটের দিকে চলে গেল।
অল্প পরেই ফিরে এল। কিন্তু সেই লোকটি নয়। আরেকজন। তার হাতেও রিভলবার।
আহমদ মুসা বুঝল, এই লোকটিই এতক্ষন ককপিটে পাইলটদের পাহারা দিয়েছে। দ্বিতীয় লোকটি গিয়ে এই দায়িত্ব নেয়ার পর সে বেরিয়ে এসেছে।
আহমদ মুসার কোন সন্দেহ রইল না, হাইজ্যাকাররা মাত্র দু’জন।
প্লেনের মাইক্রোফোন কথা বলে উঠল এ সময়। ককপিটে চলে যাওয়া দ্বিতীয় লোকটির গলা। বলল, ‘ভদ্র মহিলা ও ভদ্র মহোদয়গন, প্লেন এবং প্লেনের সকল যাত্রী আমাদের পণবন্দী। প্লেন দক্ষিণ সুদানের জুবা বিমান বন্দরে ল্যান্ড করবে। দক্ষিন সুদান থেকে খার্তুম সরকারের সৈন্য প্রত্যাহার বা প্রত্যাহারের আন্তর্জাতিক অঙ্গীকার না হওয়া পর্যন্ত বিমান ও বিমানের যাত্রী আমাদের পনবন্দী থাকবে। আমরা ৪৮ ঘণ্টা সময় দিয়েছি। এর মধ্যে আমাদের দাবী না মানলে যাত্রী সমেত প্লেন ধ্বংস করা হবে। সুদান পিপলস লিবারেশন আর্মি (SPLA) চাচ্ছে, তাদের ন্যায্য দাবী মেনে নিলে যাত্রীদের জীবন বাঁচানো হবে।’ কথা থেমে গেল।
আহমদ মুসার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেল ব্যাপারটা।
মুসলিম রাষ্ট্র সুদানের খৃষ্টান বিদ্রোহী গ্রুপের গেরিলা অংশ SPLA এই বিমান টি হাইজ্যাক করেছে। তারা চাচ্ছে সমগ্র দক্ষিন সুদান থেকে সুদান সরকারের অর্থাৎ মুসলিম সৈন্য প্রত্যাহার করা হোক। যাতে তারা দক্ষিন সুদানকে বিচ্ছিন্ন করে পৃথক খৃষ্টান রাষ্ট্রের পত্তন করতে পারে।
সুদানের বিদ্রোহী খৃষ্টান গ্রুপের এই ভুমিকা একেবারেই অন্যায়। সুদানে মুসলিমদের সংখ্যা শতকরা ৮০ ভাগেরও বেশী। অবশিষ্ট মানুষের শতকরা ৫ ভাগ খৃষ্টান। এরাই চেষ্টা করছে দেশের দক্ষিণাংশ কে বিচ্ছিন্ন করতে। এক্ষেত্রে SPLA-এর ভুমিকাই মুখ্য।
সেই ভুমিকারই অংশ হিসেবে তারা আজ এক জঘন্য পথে পা বাড়িয়েছে। পনবন্দী করেছে প্রায় দু’শ নারী-পুরুষ ও শিশুকে। তাদের অসম্ভব দাবী নিশ্চয় পূরণ হবার নয়। সুতরাং এই দু’শ মানুষের জীবন বিপন্নই বলা যায়।
আহমদ মুসা আবার চোখ বুলাল পাশের বালিকার দিকে, চোখ পড়ল তার মায়ের দিকেও। তাদের চোখে-মুখে মৃত্যুর পাণ্ডুরতা।
সকলের একই অবস্থা।
আহমদ মুসা সিটে হেলান দিয়ে চোখ বুজল। করণীয় কি? অনেক রকম চিন্তা ভিড় জমাল তার মনে।
মাইক্রোফোনের মাধ্যমে ভেসে আসা কোথায় ছেদ নামল আহমদ মুসার চিন্তায়।
কণ্ঠ থেকে বুঝল, আগের লোকটিই কথা বলছে। সে বলছিল, একজন ভদ্র মহোদয় কিংবা ভদ্র মহিলাকে ককপিটে আসার জন্যে আহ্বান করছি। তাকে গ্রাউন্ড কন্ট্রোলের সাথে যাত্রীদের পক্ষ থেকে আমরা যা বলব সেইভাবে কথা বলতে হবে। কথা শেষ করার পরেই চলে আসুন।‘’
মাইক্রোফোনের কণ্ঠ থেমে গেল।
চারদিকে পিনপতন নীরবতা।
সবাই একে অপরের দিকে তাকাচ্ছে। কারও উঠার লক্ষন নেই।
চারদিকে একবার তাকিয়ে আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল। মনে মনে আল্লহর শুকরিয়া আদায় করল আহমদ মুসা। হাইজ্যাকারদের নিকটবর্তী হবার একটা সুযোগ আল্লাহ করে দিলেন।
উঠে দাঁড়িয়ে ককপিটের দিকে হাঁটতে শুরু করল আহমদ মুসা।
ককপিটের সামনে টয়লেট ও সার্ভিস কেবিনের মাঝের করিডোরের মুখে যে রিভলবারধারী দাঁড়িয়েছিল, সে আহমদ মুসাকে তার দিকে ডাকল।
যাত্রীদের সবার উদ্বেগ দৃষ্টি আহমদ মুসার দিকে।
আহমদ মুসা গিয়ে তার সামনে দাঁড়াল।
‘দু হাত উপরে তুলুন।’ কর্কশ কণ্ঠে লোকটি বলল।
আহমদ মুসা কনুই ভেঙে দু’হাত উপরে তুলল। তাতে কনুই পর্যন্ত দু’বাহু কাঁধের সমান্তরালে থাকল।
লোকটি ডান হাতে রিভলবার ধরে অন্য হাত দিয়ে আহমদ মুসাকে সার্চ করতে লাগল। সম্ভবত সে নিশ্চিত হতে চায় আহমদ মুসার কাছে কোন অস্ত্র নেই।
সুযোগের অপেক্ষায় ছিল আহমদ মুসা।
সার্চ করার জন্যে লোকটি যখন তার মাথাটা কিছুটা নিচের দিকে বাঁকিয়েছিল, তখনি আহমদ মুসার বাম হাত লোকটির রিভলবার ধরা হাতটি বাম পাশে ঠেলে দিল এবং সঙ্গে সঙ্গেই ডান হাতটির প্রচণ্ড কারাত দিয়ে আঘাত করল লোকটির কানের নিচের নরম যায়গাটায়।
হাত থেকে রিভলবার পড়ে গেল লোকটির। তারপর দু’একবার টলে উঠে সংগা হারিয়ে পড়ে গেল প্লেনের মেঝেয়।
আহমদ মুসা দ্রুত রিভলবারটি হাতে তুলে নিয়ে মুহূর্তের জন্যে যাত্রীদের দিকে ফিরে দাঁড়িয়ে তর্জনী ঠোঁটে ঠেকিয়ে ইংগিতে সবাইকে নীরব থাকতে বলে রিভলবারটা পকেটে ফেলে স্বাভাবিক গতিতে এগুল ককপিটের দিকে।
যাত্রীদের তখন শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা। আহমদ মুসা পাশের সিটের জোসেফাইনের মা মহিলাটি ভয়ে দু’হাত দিয়ে মুখ ঢেকেছে। এয়ার হোস্টেস ও সার্ভিস ম্যানরা যে যেখানে দাঁড়িয়েছিল, বসে পড়েছে প্লেনের মেঝেতে।
আহমদ মুসা ককপিটের দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকল।
পাইলটের মাথায় রিভলবারের নল ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটি মাথা ঘুরিয়ে পেছনে তাকাল। বলল, ‘আসুন, অয়্যারল্যাসে কথা বলুন। একটিই কথা বলবেন, জুবা বিমানবন্দরে নামতে না দিলে ওরা বিমান ধ্বংস করে দেবে। সুতরাং দু’শ মানুষের স্বার্থে বিমানকে জুবা বিমানবন্দরে নামতে দেয়ার অনুরোধ করছি।’
বলে সে নড়ে উঠল আহমদ মুসাকে এগুবার জায়গা করে দেবার জন্য। তার রিভলবার ধরা হাতটা সরে গিয়েছিল পাইলটের মাথা থেকে।
আহমদ মুসা এ সুযোগ হাতছারা করল না। ডান হাত দিয়ে লোকটির রিভলবার ধরা ডান হাতে আঘাত করল এবং সেই সাথে সাথেই বাম হাতে বাম পকেট থেকে রিভলবার বের করে একেবারে লোকটির মাথায় ঠেকিয়ে গুলী করল।
চোখের পলকে ঘটে গেল ঘটনা।
যেখানে দাঁড়িয়েছিল, সেখানেই লাশ হয়ে পড়ে গেল হাইজ্যাকারের দেহ।
ঘটনার আকস্মিকতায় পাইলট দু’জন বিমূঢ় হয় পড়েছিল। সম্বিত ফিরে পেয়ে তারা চিৎকার করে ধন্যবাদ জানাল আহমদ মুসাকে।
এ সময় এয়ার হোস্টেস এবং ক্রুরাও এসে দাঁড়িয়েছিল। তারাও আনন্দে চিৎকার করে উঠল।
কয়েকজন ছুটে গেল যাত্রীদের কাছে। চিৎকার করে তারা ঘোষণা করল, ‘যাত্রী যুবকটি হাইজ্যাকারকে হত্যা করে বিমানকে মুক্ত করেছে, মুক্ত করেছে।’
সকল যাত্রীও আনন্দে চিৎকার করে উঠল। সমবেত কণ্ঠে ইশ্বরকে ধন্যবাদ দিল।
আহমদ মুসা বেরিয়ে এল ককপিট থেকে। তাকে ঘিরে ছিল এয়ার হোস্টেস ও ক্রুরা।
এ সময় কেবিন মাইক্রোফোনে ধ্বনিত হল ক্যাপ্টেনের কণ্ঠ। বলল, ‘ভদ্র মহিলা ও ভদ্র মহোদয়গণ ইশ্বরকে ধন্যবাদ একজন যুবকের অসীম সাহসিকতায় বিমান মুক্ত হয়েছে। যুবকটি একজন হাইজ্যাকারকে পরাভুত এবং অন্যজনকে হত্যা করে বিমান ও যাত্রীদেরকে মুক্ত করেছেন। তাকে অশেষ ধন্যবাদ। এখন বিমান তার রুটে ফিরে এসেছে এবং গন্তব্যের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। সকলের যাত্রা শুভ হোক।’
যাত্রীরা সবাই উঠে দাঁড়িয়ে হাত নেড়ে নানাভাবে আহমদ মুসাকে কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছে।
খুবই বিব্রত বোধ করল আহমদ মুসা। তার সিটের সামনে এসে দু’হাত তুলে সবার দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করে বলল, ‘ভদ্র মহিলা ও ভদ্র মহোদয়গণ, অনুগ্রহ করে আমাকে লজ্জা দেবেন না। আমি বড় কিংবা অস্বাভাবিক কিছু করিনি। আপনারাও এগিয়ে গেলে এটাই করতেন। সকলকে ধন্যবাদ।’
সিটে বসে পড়ল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসা বসতেই বালিকাটি বলল, ‘ধন্যবাদ আপনাকে। আপনার খুব সাহস। দু’জন হাইজ্যাকার মেরেছেন।’
‘মানুষ মারা কি ভাল?’
ওরা তো ভাল মানুষ নয়।’
‘ওরা মানুষ ঠিকই, তবে ওদের কাজ ভাল নয়।’
বালিকাটি তৎক্ষণাৎ কিছু বলল না। বোধ হয় কথা খুঁজছিল।
এই ফাঁকে বালিকাটির মা বলে উঠল, ‘মাফ করবেন, আপনাকে কংগ্রাচুলেশন।’ বলে একটু থেমে আবার সে বলল, ‘কাজ খারাপ হলে মানুষও খারাপ হয় নাকি?’
আহমদ মুসা হাসল। বলল, ‘ঠিক। তবে পাপ এবং পাপী এক জিনিস নয়।’
‘কারণ।’
‘কারণ পাপ সব সময়েই খারাপ। কিন্তু পাপী সব সময় খারাপ থাকে না, সে ভালও হয়ে যেতে পারে।’
মহিলা কথা বলল না উত্তরে। তার চোখে-মুখে বিস্ময়। একটু সময় নিয়ে বলল, ‘আপনি মি…।’
‘আব্দুল্লাহ।’
‘মিঃ আব্দুল্লাহ, আপনি কি পেশায় শিক্ষক?’
‘পাসপোর্টে পরিষ্কার উল্লেখ আছে, আমি সাংবাদিক। শিক্ষক হওয়ার কথা বলছেন কেন?’
‘আপনি যে তত্ত্বকথা বলেছেন, তা একজন শিক্ষকের মুখেই মানায়।’
একটু থেমেই মহিলাটি আবার শুরু করল, সে যাক। আপনাকে আবারো ধন্যবাদ। আপনি যা করেছেন, কোন প্রশংসা দিয়েই তার ঋণ শোধ হবে না। আমার বিশ্বাস এয়ার লাইন্স কর্তৃপক্ষ আপনার অমুল্য কাজের বিষয়টা বিবেচনা করবে।
কথা আর সামনে এগুলো না।
ট্রে ঠেলে নাস্তা নিয়ে এসে দাঁড়াল এয়ার হোস্টেসরা।
আহমদ মুসা নড়ে-চড়ে বসল।
‘স্যার লাইন্স যাত্রীদের বিশেষ শুভেচ্ছা ড্রিঙ্ক সরবরাহ করছে’
‘ধন্যবাদ আমি ড্রিঙ্ক করিনা।’
‘আপনি মদ খান না, কিন্তু অন্য কোন ধরনের সফট ড্রিঙ্কস কিংবা কোন ধরনের জুস আপনি পছন্দ করবেন?’ একজন এয়ার হোস্টেস মাথা নুইয়ে অত্যন্ত সম্মানের সাথে জিজ্ঞেশ করল।
আহমদ মুসা একটু হাসল। সময়ের পরিবর্তনে সে এখন স্যার হয়ে গেছে। বলল, ‘ধন্যবাদ। নাস্তার সাথে ঠাণ্ডা পানি আর কিছু নয়।’
নাস্তা পরিবেশিত হলো।
আহমদ মুসা বিস্মিত হলো, মহিলাটি মদ নিল না। সে এবং বালিকা দু’জনেই কোক খেল।
‘মাফ করবেন ম্যাডাম, আমি অসুবিধা করলাম কি?’ সপ্রভিত কণ্ঠে বলল আহমদ মুসা মহিলাটিকে।
‘না না। আমি বরং আনন্দিত যে, একজন ভাল মানুষকে সম্মান দেখাতে মদ না খাওয়ার এই ঘটনা আমার চির দিন মনে থাকবে।’
আহমদ মুসা এ প্রসংগ এড়িয়ে বলল, ‘ম্যাডাম, একটা প্রশ্ন আমি জিজ্ঞেস করতে পারি?’
‘অবশ্যই।’
‘আপনার কোথায় দু’একটা রুশ শব্দ আসছে কেন?’
‘ও’ বলে মহিলাটি হাসল। বলল, আমার স্বামী একজন কূটনীতিক। দীর্ঘদিন তিনি মস্কোতে সুইজারল্যান্ডের কুটনীতিক ছিলেন। আমরা তার সাথে ছিলাম। রুশ ভাষায় অনুপ্রবেশ তারই ফল বলতে পারেন।’
কথা শেষ করেই মহিলাটি আবার বলল, ‘আপনি রুশ ভাষাও জানেন দেখছি।’
‘কিছু জানি।’
নাস্তার পর এল বিশ্রাম পর্ব।
আলো নিভে গেল।
আবছা অন্ধকারে ঢেকে গেল কেবিন।
আহমদ মুসা পাশের বালিকা জোসেফাইনকে ‘গুড নাইট গুড গার্ল’ বলে সিটে গা এলিয়ে দিল।
চোখ দুটি তার ধীরে ধীরে বুজে এল।

আহমদ মুসার সামনে বড় একটি টেবিল। টেবিলের তিন দিক ঘিরে আরও চারজন।
জেনেভায় ওয়ার্ল্ড নিউজ এজেন্সী (WNA)-এর অফিস।
আহমদ মুসা এসে জেনেভার একটি ট্যুরিস্ট বাংলোতে উঠেছে।
WNA এবং FWTV-এর সবাই তাকে তাদের গেস্ট হাউজে ওঠার জন্যে অনুরোধ করেছিল। কিন্তু আহমদ মুসা এ দু’টি সংস্থা থেকে বিচ্ছিন্ন থাকা ঠিক মনে করেছিল। সম্পূর্ণ তৃতীয় অবস্থানে থেকে সে ঘটনার উপর দৃষ্টি রাখতে চায়।
আহমদ মুসার সামনে বসেছিল WNA এবং FWTV-এর চেয়ারম্যান এবং সংস্থা দু’টির চীফ এডিটর।
খুব অভিনিবেশ সহকারে আহমদ মুসা কাগজগুলোর উপর নজর বুলাচ্ছিল।
কাগজগুলি দু’টি সংস্থার রহস্যজনক মৃত্যুর পোষ্টমর্টেম রিপোর্ট ল্যাবরেটরি পরীক্ষার রিপোর্ট এবং পুলিশ রিপোর্ট।
পোষ্টমর্টেম রিপোর্টে মৃত্যুর কারণ হিসেবে বেদনাহীন ও যন্ত্রনাহীন এ ধরনের বিষের প্রভাবের কথা উল্লেখ করেছে। বলেছে, ঐ বিষ দেহে প্রবেশের তিন ঘণ্টার মধ্যে মৃত্যু ঘটেছে। মৃত দেহের ব্যাপক পরীক্ষা করে যেখান থেকে বিষ গোটা দেহে ছড়িয়ে পড়েছে, সেই উৎসে গিয়ে ম্যাক্রো-মাইক্রোস্কপিক পরীক্ষায় অত্যন্ত সুক্ষ আঘাত পাওয়া গেছে, যা সুক্ষ ও জীবন্ত কিছুর আঘাতে সৃষ্টি।
আর ল্যাবরেটরি পরীক্ষায় বিষয়টিকে বিশেষ ধরনের সিসি মাছির বিষ বলে চিহ্নিত হয়েছে। ল্যাবরেটরি রিপোর্টেও বিষের প্রকৃতি কে বেদনাহীন, যন্ত্রনাহীন বলে চিহ্নিত করা হয়েছে।
বিষের এই প্রকৃতির কথা পড়তে গিয়ে হঠাৎ আহমদ মুসার মনে একটা চিন্তা ঝিলিক দিয়ে উঠল। পৃথিবীর বিষাক্ততম প্রানী ‘বক্স জেলিফিশ’-এর বিষও বেদনাহীন, যন্ত্রনাহীন! এ বিষের কোন কারসাজী কি আছে এই মর্মান্তিক মৃত্যুর ঘটনাবলীর মধ্যে। কিন্তু পরক্ষনেই চিন্তা জাগল আহমদ মুসার মনে, ল্যাবরেটরি তো বিষকে সিসি মাছির বলে চিহ্নিত করেছে। তাছাড়া বক্স জেলিফিশের বিষে তো মাত্র কয়েক মিনিট আক্রান্তেই মৃত্যু হয়। চিন্তার কোন খেই মিলল না আহমদ মুসার কাছে।
আহমদ মুসা কাগজগুলো থেকে চোখ উঠিয়ে চেয়ারে হেলান দিল। চোখ দু’টি বুজে এল তার। যেন গভীর চিন্তায় ডুবে গেল আহমদ মুসা।
-কি ভাবছেন, মিঃ আহমদ মুসা? বলল, FWTVএর চেয়ারম্যান বি, জারমিস(বাকের জারমিস)।
-ভাবছি কিন্তু কোন কিনারা পাচ্ছিনা। বলল, আহমদ মুসা।
-কাগজপত্র দেখে কি বুঝলেন? বলল, WNAএর চেয়ারম্যান জি, গটেফ (জামাল গটেফ)।
-কাগজ পত্র থেকে দেখা যাচ্ছে পরিষ্কার অজানা এক ধরনের সিসি মাছির কামড় থেকে উদ্ভুত বিষে তাদের মৃত্যু হয়েছে!
-সবারই তাই বিশ্বাস। বলল, মিঃ জারমিস।
-আপনারা কি মনে করছেন?
-পুলিশ এবং বিজ্ঞানীদের এই ব্যাখ্যা মেনে না নেবার পেছনে কোন যুক্তি আমরা পাচ্ছিনা। বলল, মিঃ জারমিস।
‘কিন্তু মাছি শুধু WNA এবং FWTV এই দুই প্রতিষ্ঠানে আক্রমন চালাচ্ছে কেন?’ বলল, আহমদ মুসা।
-এটাই আমাদের কাছে রহস্য। এই রহস্যের কোন সমাধান আমরা পাচ্ছি না। বলল, মিঃ গটেফ।
-পুলিশের বক্তব্য কি এ ব্যাপারে? বলল, আহমদ মুসা।
-পুলিশ একে ‘কো-ইন্সিডেন্স’ বলছে এবং সন্দেহ করছে যে এই দুই প্রতিষ্ঠানের কোথাও সিসি মাছি এসে বাসা বেঁধেছে। তারা বলছে, যেহেতু ছুটিতে থাকা কারও মৃত্যু এ পর্যন্ত ঘটেনি এবং যারা মরেছে, তারা সবাই অফিস থেকে যাবার নির্দিষ্ট সময় পরে, সুতরাং অফিসেই তারা সিসি মাছির কামড় খেয়েছে। বলল, মিঃ জারমিস।
-তার মানে সন্দেহ করছে আপনাদের উপর?
‘কতকটা তাই।’ বলল, মিঃ গটেফ।
আহমদ মুসা তৎক্ষণাৎ কিছু বলল না। চোখ বুজে আবার চেয়ারে গা এলিয়ে দিল।
টেবিল ঘিরে অন্যান্য সকলে। সকলের মাথা নিচু। ভাবছে সবাই।
অল্পক্ষণ প আহমদ মুসা সোজা হয়ে বসল। বলল, ‘আমার কাছে মৃত্যুগুলোর চাইতে সবগুলো ঘটনা এই দুই প্রতিষ্ঠানে ঘটার ব্যাপারটাই বেশী বিস্ময়কর। এই রহস্যের সমাধান হলে মৃত্যু রহস্যেরও সমাধান হয়ে যাবে।’
-তার মানে মৃত্যুগুলো এই দুই প্রতিষ্ঠানে ঘটার মধ্যেই বড় রহস্য লুকিয়ে আছে বলে আপনি মনে করছেন? বলল, মিঃ গটেফ।
-হ্যাঁ তাই। আমি একে কো-ইন্সিডেন্স বলে মনে করিনা।
-তার মানে একে পরিকল্পিত বলে মনে করেন? বলল, মিঃ গটেফ।
-তাই মনে করি।
-তার মানে কেউ উদ্দ্যেশ্যমুলক ঘটনাগুলো ঘটাচ্ছে? বলল, মিঃ গটেফ।
মিঃ গটেফ, মিঃ জারমিস এবং wna-এর চীফ এডিটর হাসান আলবার্তো- সকলেরই মুখ ভয়ে ফ্যাকাশে হয়ে গেল। তাদের চোখে-মুখে ফুটে উঠল আতংক।
-কিন্তু মৃত্যুগুলোর কারণ যদি বিষাক্ত সিসি মাছির কামড় হয়, তাহলে এটা পরিকল্পিত হওয়া কিভাবে সম্ভব? শুকনো কণ্ঠে বলল, হাসান আলবার্তো।
-এ রহস্যের সমাধান আমার কাছে নেই, তবে আমার মন এ ব্যাপারে দ্বিধাহীন যে, ঘটনাগুলো পরিকল্পিত। আহমদ মুসা বলল।
মিঃ জামাল গটেফের সেলুলার টেলিফোন সংকেত দিয়ে উঠল।
টেলিফোন ধরল মিঃ গটেফ।
ওপারের কিছু কথা শুনেই ‘কি বলছ তুমি’ বলে প্রায় চিৎকার করে উঠল মিঃ জারমিস। তার চোখ-মুখ মৃতের মত পান্ডুর হয়ে উঠল মুহূর্তে।
সবশুনে টেলিফোন ক্লোজ করে গুটিয়ে রেখে দু’হাতে মাথা চেপে ধরে বলল, ‘আমাদের এ্যাসোসিয়েট এডিটর ওমর ফার্ডিনেন্ড মেয়ার একই ভাবে মারা গেছে।’ বলে কান্নায় ভেঙে পড়ল মিঃ গটেফ।
যেন বজ্রপাত হল টেবিলটার উপর। পাথরের মত স্থির দৃষ্টি শুন্যে নিবদ্ধ।
কথা বলল আহমদ মুসা, ‘কোথায় তার মৃত্যু হয়েছে?’
-তার বাড়িতে। বলল, মিঃ গটেফ।
-ক’টায়?
-রাত ১১ টায়। সন্ধ্যে ৭ টায় অফিস থেকে ফেরে।
একটু থেমেই মিঃ গটেফ বলল, ‘শুনলাম সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয় WNA কয়েকদিন বন্ধ রাখার অনুরোধ করেছে।’
ভ্রু কুঞ্চিত হল আহমদ মুসার। বলল, ‘কখন তারা এ অনুরোধ করেছে?’
‘মৃত্যুর খবর তারা পাবার সঙ্গে সঙ্গেই। আমি টেলিফোন পাবার একটু আগেই একটা ফ্যাক্স মেসেজ এসেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয় থেকে।’
মিঃ জারমিসের কথা শেষ হতেই মিঃ জারমিস-এর পি,এ কক্ষটির দরজায় এসে দাঁড়াল। অনুমতি চাইল কক্ষে প্রবেশের। তার হাতে এক খন্ড কাগজ।
মিঃ জারমিস তাকে ডাকল।
সে এসে কাগজখন্ডটি মিঃ জারমিসের হাতে তুলে দিল।
মিঃ জারমিস তাতে দ্রুত চোখ বুলাল। তারপর কাগজ খণ্ডটি তুলে দিল আহমদ মুসার হাতে। আহমদ মুসা দেখল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের পক্ষ থেকে চিঠিটা লিখেছেন জেনেভার পুলিশ কমিশনার। পড়ল আহমদ মুসা। যার সারাংশ হল “ঘটনাবলী থেকে দেখা যাচ্ছে সিসি মাছির আক্রমন WNA এবং FWTV এই দুই অফিসকে কেন্দ্র করেই সংঘটিত হচ্ছে। আজও আরেকটি মর্মান্তিক ঘটনা ঘটেছে। সুতরাং দুটি প্রতিষ্ঠানের কর্মরত লোকদের নিরাপত্তার স্বার্থে অফিস দু’টি সাময়িকভাবে বন্ধ রাখা উচিত বলে মনে করছি। আশা করি আপনারাও একমত হবেন। পুলিশ ঘটনাবলীর তদন্ত করছে। আশা করা হচ্ছে শীঘ্রই রহস্যের কিনারা করা যাবে”।
আহমদ মুসা চিঠিটি মিঃ গটেফের হাতে তুলে দিয়ে বলল, ‘দেখুন, সম্ভবত এই চিঠিটা আপনারাও পেয়েছেন।’
মিঃ গটেফ চিঠিটা পড়ল। পড়ল WNA এবং FWTVএর দুই চীফ এডিটরও।
-চিঠি দেখেছেন, এখন বলুন করণীয় কি? বলল, মিঃল গটেফ।
-আপনারা কি করতে চান?
মিঃ গটেফ মিঃ জারমিসের দিকে একবার চাইল। তারপর একটু ভাবল। বলল ধীরে ধীরে, ‘পুলিশ কমিশনার যে যুক্তি দিয়েছেন তার সাথে আমি একমত। সাময়িক বন্ধ করে দিয়ে যদি এই ধরনের মর্মান্তিক মৃত্যু এড়ানো যায়, তাহলে বন্ধ করাই প্রয়োজন।’
আহমদ মুসা তাকাল মিঃ জারমিসের দিকে।
মিঃ জারমিসও ভাবছিল। বলল, ‘আমারও মত তাই, কর্মরত লোকজনদের নিরাপত্তাকেই আমাদের অগ্রাধিকার দিতে হবে।’
‘সাংবাদিক কর্মচারীদের মত কি হবে?’ জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা।
‘এ ধরনের সিদ্ধান্ত অগ্রহনযোগ্য হলেও বিশেষ অবস্থায় সাময়িক ভাবে সাংবাদিক কর্মচারীরা তা মেনে নিতে পারে। কারণ সংকটের কোন রিমোর্ট তাদের হাতে নেই।’ বলল, হাসান আলবার্তো, WNA-এর চীফ এডিটর।
আহমদ মুসার মুখে এক টুকরো হাসি ফুটে উঠল। কিন্তু পরক্ষনেই গম্ভীর হয়ে উঠল তার মুখ। বলল, ‘আর পুলিশের এ অনুরোধ উপেক্ষা করে যদি প্রতিষ্ঠান খোলা রাখা হয়, তাহলে সাংবাদিক কর্মচারীরা কাজ করবে কি?’
ওরা চারজনই নীরব। একটু পর মুখ খুলল FWTV-এর চীফ এডিটর কামাল কনরাও। বলল, ‘কাজ তারা অবশ্যই করবে, কিন্তু এতবড় ঝুঁকি নেয়া আমাদের ঠিক হবে না। বিশেষ করে পুলিশের অনুরোধের পর।’
আহমদ মুসা তৎক্ষণাৎ কথা বলল না। একটু পর ধীরে ধীরে বলল আহমদ মুসা, ‘আপনাদের কথায় যুক্তি আছে, কিন্তু আমি ভাবছি, প্রতিষ্ঠান দু’টো বন্ধ করে দিলে শত্রুর উদ্দেশ্য সফল হয়ে যায়, তাদের বরং সাহায্যই করা হয়।’
‘কিভাবে? শত্রু কে?’ প্রায় সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠল মিঃ গটেফ এবং মিঃ জারমিস।
-শত্রুর নাম পরিচয়কে এখনও আমি চিহ্নিত করতে পারিনি। তবে আমি নিশ্চিত, এ দু’টি সংবাদ মাধ্যম যাদের কায়েমী স্বার্থে আঘাত দিচ্ছে, তাদেরই কেউ এই শত্রু। তারা চাচ্ছে এ দু’টি সংবাদ মাধ্যম বন্ধ হয়ে যাক। এই হত্যাকান্ডগুলো মনে হচ্ছে সেই লক্ষ্যেই। বলল, আহমদ মুসা।
‘এই মৃত্যুগুলোকে আপনি হত্যাকাণ্ড মনে করেন? সত্যিই আপনি মনে করেন যে, আমাদের দুটি প্রতিষ্ঠান বন্ধ করার জন্যে কেউ হত্যাকান্ড ঘটাচ্ছে?’ দু’টি চোখ কপালে তুলে বলল মিঃ গটেফ।
অন্য সবারই চোখে ফুটে উঠেছে নতুন আতংকের ছাপ।
‘আমি জানি, আপনারা সিসি মাছি পোষেন না। তাহলে এই দুই প্রতিষ্ঠানের লোক তথাকথিত সিসি মাছির কামড়ে মরবে কেন? আমি মনে করি সিসি মাছি এই দুটি সংবাদ মাধ্যমের শত্রু নয়। তাহলে তারা এ দু’টি প্রতিষ্ঠানের উপর চড়াও হবে কেন? সুতরাং সিসি মাছি হোক বা অন্য কিছু- এদেরকে কেউ ব্যবহার করছে এ দু’টি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে।’ আহমদ মুসা বলল।
সবাই নীরব। সবার চোখে বিস্ময়।
নীরবতা ভাঙল মিঃ জারমিস। বলল, ‘আমরা এভাবে তো চিন্তা করিনি। এখন মনে হচ্ছে আপনার কথা ঠিক।’
‘আমারও এরকমই মনে হচ্ছে। তবে সে রকম কিছু যদি হয়, তাহলে হত্যাকান্ড এভাবে ঘটবে কেন?’
‘সেটা আমি জানিনা। তবে আমার মনে হয়, হত্যাকারীরা রহস্য সৃষ্টি করে আড়ালে থাকতে চায়।’ বললআহমদ মুসা।
সবাই আবার নীরব। সবাই ভাবছে।
সবার চোখে-মুখে উদ্বেগ-আতংকের ছাপ।
-আমরা এখন কি করব? পুলিশকে কি এসব কথা আমরা বলব?
‘পুলিশ কি করবে? তারা রহস্য উদঘাটনের তো চেষ্টা করছেই। বাড়তি কোন সাহায্য তাদের কাছে পাওয়া যাবে বলে মনে হয়না। তারা বরং আরো বেশী করে সাময়িকভাবে প্রতিষ্ঠান দু’টি বন্ধ করার পক্ষে যুক্তি দেবে।’
‘তাহলে আমাদের এখন কি করণীয়?’
‘প্রতিষ্ঠান দু’টি খোলা থাকবে। যেভাবে কাজ চলছিল সেভাবে কাজ চলবে।’
‘কিন্তু আবার যদি কিছু ঘটে?’ বলল, মিঃ গটেফ।
-কিন্তু বন্ধ করলে আর খোলার সাহস পাওয়া যাবেনা। কারণ খোলার পর আবার হত্যাকান্ড শুরু হবে, এ ভয় সব সময় তাড়া করে ফিরবে। আর সে ভয় উপেক্ষা করে খুললেও আবার সেই হত্যাকান্ডই শুরু হতে পারে। তাছাড়া প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে রহস্যের উন্মোচন করা যাবে না, শত্রুর পরিচয় অজানাই থেকে যাবে।
‘আল্লাহর হাজার শুকরিয়া। আপনার কথাগুলো দৈববাণীর মত মনে হচ্ছে। আমরা জীবন দিয়ে হলেও প্রতিষ্ঠান দু’টোখুলে রাখবো।’ আবেগঘন কণ্ঠে বলল হাসান আলবার্তো।
আলবার্তো থামতেই WNA-এর চেয়ারম্যান জামাল গটেফ এবং FWTV-এর চেয়ারম্যান বাকের জারমিস এক সঙ্গে বলে উঠল, ‘আলবার্তোর সাথে আমরা একমত। আমাদের জীবনের চেয়ে মুল্যবান সংবাদ সংস্থা দু’টিকে আমরা বন্ধ হতে দেবনা, শত্রুদের ষড়যন্ত্র আমরা সফল হতে দেবনা।’ এতক্ষনের ভয় আতংক কেটে গিয়ে তাদের চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে।
কিছুক্ষন নীরবতা।
গভীর ভাবনায় নিমজ্জিত আহমদ মুসা। তার মাথাটা ঈষৎ নুয়ে পড়ল।
একটু পর মাথা তুলল আহমদ মুসা। বলল, ‘আপনাদের ধন্যবাদ। আমরা ঝুঁকি নিচ্ছি। কিন্তু এর বিকল্প নেই। শত্রুকে চিহ্নিত করা ছাড়া আমাদের জীবনের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এ সংবাদ সংস্থা দুটিকে বাঁচানো যাবে না। কিছু কোরবানি দিয়ে হলেও আমাদেরকে সমাধানে পৌছতে হবে।’ ধীর ও গম্ভীর কণ্ঠে বলল আহমদ মুসা।
‘কিছু মনে করবেন না, এটা শত্রুর ষড়যন্ত্র এ সম্পর্কে আপনি নিশ্চিত?’ দ্বিধাজড়িত কণ্ঠে বলল হাসান আলবার্তো।
আহমদ মুসা একটু হাসল। বলল, ‘আমি বলছি আমার বিবেচনা থেকে। সত্য অন্য কিছুও হতে পারে। নিশ্চিত ব্যাপারটা আল্লাহই জানেন।’ আহমদ মুসা থামল।
কিন্তু কেউ কথা বলল না।
নীরবতা ভেঙে কথা বলল মিঃ গটেফ। বলল, ‘আমরা এত দিন একেবারেই অন্ধকারে ছিলাম। আপনি আমাদের আলোতে নিয়ে এসেছেন। সংকটকালে বিশ্বের বিভিন্ন এলাকার মুসলমানরা আপনার সাহায্য পেয়ে ধন্য হয়েছে। সুইজারল্যান্ডের মুসলমানরা আপনার মেহেরবানী থেকে বঞ্চিত হবেনা। নরম ও সশ্রদ্ধ কণ্ঠ মিঃ গটেফের।
‘ওয়ার্ল্ড নিউজ এজেন্সী এবং ফ্রী ওয়ার্ল্ড টেলিভিশন তো তাঁরও প্রতিষ্ঠান। বলল FWTV-এর চীফ এডিটর কনরাত।
‘এ প্রতিষ্ঠান দু’টি বিশ্বের সব মুসলমানের। আমি তাদেরই একজন মাত্র।’ বলল আহমদ মুসা।
‘আমাদের বিপদ দেখে তো সব মুসলমান ছুটে আসেনি, আপনি এসেছেন।’ বলল হাসান আলবার্তো।
‘সব দায়িত্ব সবার জন্য নয়।’
বলে একটু থেমেই আহমদ মুসা মিঃ গটেফের দিকে চেয়ে বলল, ‘আপনার সংস্থার সিনিয়র সদস্যরা সবাই কি গাড়িতে যাতায়াত করেন?’
‘জি হ্যাঁ।’
‘আপনাদের কার পার্কে বাইরের কেউ কার পার্ক করে?’
‘না করে না। তবে যারা আমাদের অফিসে আসেন, তারা তো অবশ্যই করবেন।’
‘দেখলাম, আপনাদের অফিসে প্রবেশ রেস্ট্রিকটেড। কিন্তু বাইরের কেউ ঢুকেই না বলে মনে করেন?’
‘সংবাদ সংক্রান্ত ব্যাপারে যারা আসেন, তাড়া রিসেপশনের নিউজ কাউন্টার পর্যন্ত আসতে পারেন। তার বেশী নয়। আর অর্থ বা প্রশাসনিক কোন ব্যাপারে যারা আসেন, তারাই শুধু তাদের পরিচয় নিশ্চিত করার পর প্রশাসন বিভাগে যেতে পারেন। সে যাওয়াটাও স্বাধীনভাবে নয়। সংশ্লিষ্ট অফিসার এসে তাকে নিয়ে যান এবং আবার রিসেপশনে রেখে যান। বলল, মিঃ গটেফ।
‘নিউজের স্টাফদের কোন মেহমান বা পরিচিত জোন যদি আসেন?’
‘সেক্ষেত্রে ব্যবস্থা হল, রিসেপশনের গেস্টরুমে তাদের বসানো হয়। সেখানেই এসে সংশ্লিষ্ট নিউজ স্টাফ তাদের সাথে কথা বলেন।’
‘এডিটর, নিউজ এডিটর পর্যায়ের কারও কাছে যদি আসে?
-তাদের ক্ষেত্রেও ঐ একই ব্যাবস্থা।
-তার মানে নিউজ ও ট্রান্সমিশন ডিপার্টমেন্টে বাইরের কেউই প্রবেশ করেনা?’
‘হ্যাঁ তাই।’
আহমদ মুসা কিছু বলল না।
তার শুন্য দৃষ্টি সামনের দেয়ালের দিকে নিবদ্ধ। ভাবছিল সে।
‘FWTV-এর কথা জিজ্ঞেস করবেন না?’ নীরবতা ভেঙে বলল, মিঃ জারমিস।
‘FWTV-এর কথা পরে।’ বলল আহমদ মুসা।
‘কেন?’
‘আমার অনুমান যদি মিথ্যা না হয়, তাহলে তথাকথিত সিসি মাছির আক্রমন WNA-এর উপরই আবার হবে।’
‘ WNA-এর উপর?’ মিঃ গটেফ অনেকটা আর্তনাদ করে বলে উঠল।
সকলের মুখেই এবার আতংক ছড়িয়ে পড়েছে। একটা নীরবতা নেমে এল।
‘আপনার অনুমানের কারণ?’ নীরবতা ভেঙে বলল, মিঃ জারমিস।
‘তথাকথিত সিসি মাছিকে খুব হিসেবি মনে হচ্ছে। সংখ্যা সমতা রক্ষার জন্যে এবার আক্রমন WNA-এর উপর হবার কথা।’
আহমদ মুসার এই কথা আবার যেন একটা ভয় ছড়িয়ে দিল।
আহমদ মুসা থামলে আবার একটা নীরবতা নেমে এল।
একটু পর হাসান আলবার্তো বলল, ‘বাইরে লোক অফিসে আসা-যাওয়ার কথা জিজ্ঞেস করলেন, বাড়িতেও এটা হতে পারে। সেটা তো জিজ্ঞেস করলেন না।’
‘সেটা তো বাড়িতেই জিজ্ঞেস করতে হবে। সেটা করব।’
‘কিন্তু অবিলম্বে অফিসের মতই সবার বাড়িতে বাইরে লোকের আগমন নিষিদ্ধ করা যায়না?’ বলল কামাল কনরাড ।
‘হ্যাঁ তা করা যেতে পারে।’ বলল আহমদ মুসা।
‘ঘটনা তো জীবন্ত সিসি মাছি অথবা এ জাতীয় পতঙ্গ নিয়ে। আপনি বাইরের লোকের প্রতি মনোযোগ দিচ্ছেন। আপনি কি এই দুইকে এক করে দেখছেন?’ বলল মিঃ হাসান আলবার্তো।
আহমদ মুসা একটু হাসল। বলল, ‘আমি নির্দিষ্ট করে কিছুই ভাবছি না। কিছু সম্ভাবনা সামনে রেখেছি। এভাবেই সামনে এগুচ্ছি।’
কথা শেষ করেই আহমদ মুসা বলল, ‘আপনাদের আর কোন কথা না থাকলে এখন আমরা উঠতে পারি।’
‘ধন্যবাদ মিঃ আহমদ মুসা।’ বলে উঠে দাঁড়াল মিঃ জারমিস।
সবাই উঠে দাঁড়াল।
আহমদ মুসা দাঁড়িয়েই হঠাৎ মিঃ গটেফের দিকে চেয়ে বলল, ‘আমার একটা অনুরোধ।
‘বলুন।’ বলল মিঃ গটেফ।
‘চীফ এডিটরসহ সব সিনিয়র নিউজ স্টাফ আজ অফিসে থাকলে ভাল হয়। শুধু আজকের রাতটাই। ইতিমধ্যে আরও কিছু ভাববার সুযোগ পাব।’
মিঃ গটেফ একটু ভেবে নিয়ে বলল, ‘ঠিক আছে। আপনি যেভাবে বলবেন, সেটাই হবে। আল্লাহ আপনাকে দিয়ে আমাদেরকে সাহায্য করুন। আপনি কাজ শুরু করেছেন দেখে আমার খুব আনন্দ লাগছে, নিজেকে হালকা মনে হচ্ছে।’ মিঃ গটেফের শেষের কথা আবেগে ভারি হয়ে উঠল।

আহমদ মুসা সন্ধ্যা থেকে WNA-এর কার পার্কে রাখা সিনিয়র সাংবাদিকদের গাড়ির উপর চোখ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
গভীর পর্যালোচনার পর এ সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে সে।
যাদের মৃত্যু ঘটেছে, তাদের বাড়িতে গিয়ে স্থান-কাল বিবেচনা করে সে দেখেছে, অফিস থেকে যাওয়ার পর সবাই পরিবারের মধ্যে থেকেছে এবং ঘুমিয়েছেও স্ত্রীর সাথে। তাই সিসি মাছি কিংবা অন্য কোন পোকা পতঙ্গ যাই হোক শুধু WNA এবং FWTV-এর সাংবাদিকদেরই কামড়াবে, একটি ক্ষেত্রেও বাড়ির অন্য কাউকে নয়, এটাই স্বাভাবিক নয় মোটেই। তাছাড়া ল্যাবরেটরির বিশ্লেষণে সিসির কামড় এবং তাদের মৃত্যুর যে ব্যবধান পাওয়া গেছে, তার সাথে তাদের অফিস থেকে বাড়িতে ফেরা ও তাদের মৃত্যুর সময়ের ব্যবধান মিলে না। সুতরাং তারা বাড়িতে তথাকথিত সিসি মাছি বা পোকার দ্বারা দংশিত হয়নি। আবার তাদের অফিসের যে পরিবেশ এবং নিহত হওয়ার দিনগুলোতে অফিসে নিহতের সময় চুলচেরা হিসেব নিয়ে সে দেখেছে, তারা বাইরের কারো সাথে দেখা করেনি, তাতে সে নিশ্চিত হয়েছে সিসি মাছি তাদের অফিস সময়ে দংশন করেনি। তথাকথিত মাছির দংশন থেকে মৃত্যু পর্যন্ত সময়ের ব্যাবধানও এ কথাই প্রমাণ করে। এ হিসেব থেকে আহমদ মুসা নিশ্চিত হয়েছে, সিসি মাছি বা কোন বিষাক্ত পোকার দংশনই যদি তাদের মৃত্যুর কারণ হয়, তাহলে তা ঘটেছে তাদের অফিস থেকে বের হওয়া থেকে শুরু করে বাড়ি পৌছা পর্যন্ত সময়ের মধ্যে। যারা নিহত হয়েছে তারা প্রত্যেকেই এ সময়টা গাড়িতে কাটিয়েছে। অতএব দংশন বা কামড় যাই ঘটুক তা ঘটেছে গাড়িতে।
এই উপসংহারে পৌছার পর আহমদ মুসার কাছে প্রশ্ন দেখা দিল, সিসি মাছি হোক, বিষাক্ত পোকা-পতঙ্গ হোক কিংবা বিষাক্ত কোন অজ্ঞাতনামা অস্ত্র হোক তা গাড়িতে প্রবেশ করল কখন। জেনেভার এই শীতে তারা নিশ্চয় গাড়ির জানালা খোলা রেখে গাড়ি চালায় নি। সুতরাং গাড়িতে কিছু প্রবেশের প্রশ্নই ওঠেনা।
এই অবস্থায় আহমদ মুসার কাছে সম্ভাব্য যে সময়টুকু অবশিষ্ট থাকে, তা হল অফিস থেকে বেরিয়ে গাড়িতে উঠার সময়টুকু। আহমদ মুসা সিদ্ধান্তে পৌঁছল, হয় এই সময়ে কিছু ঘটেছে অথবা গাড়ি পার্ক করে রাখা অবস্থায় কিছু ঘটেছে। আহমদ মুসা ভাবল, পার্ক করা অবস্থায় গাড়িতে যদি কিছু ঘটে থাকে তাহলে তা সন্ধ্যা উত্তর অপেক্ষাকৃত নির্জন পরিবেশেই ঘটা স্বাভাবিক।
এসব বিবেচনা থেকেই আহমদ মুসা রহস্য উদঘাটনের একটা পথ হিসেবে WNA-এর কার পার্কসহ অফিসের মূল প্রবেশের পথের উপর নজর রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
পরপর চারদিন সে সন্ধ্যা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত দীর্ঘ সময় কারপার্কের প্রবেশ পথের বাম পাশে দাড় করিয়ে রাখা একটা অচল মাইক্রো বাসের সিটে সবার অলক্ষ্যে বসে কাটিয়েছে। এখান থেকে গোটা কারপার্ক এবং মূল প্রবেশপথ দেখা যায় পরিষ্কার ভাবে।
আহমদ মুসা হতাশ হয়নি। কিন্তু মিঃ গটেফরা দুর্বল হয়ে পড়েছে। বলেছে, ‘আপনার এত কষ্ট! আমরা ঠিক পথে এগুচ্ছি তো?’
আহমদ মুসা হেসে বলেছে, ‘আল্লাহই শুধু এটা জানেন। তবে আল্লাহ যে বিচার বুদ্ধি দিয়েছেন, তাতে সামনে এগুবার আর দ্বিতীয় পথ আমার সামনে আপাতত নেই। সিদ্ধান্ত নিতে আমি কোন ভুল করেছি, এটাও এখনও প্রমাণ হয়নি।’
আহমদ মুসার উপর পর্বত প্রমাণ আস্থা, তবু মিঃ গটেফের বুকের দুরু দুরু ভাব যায়নি। পথ যদি ঠিক চিহ্নিত না হয়ে থাকে, তাহলে যে কোন সময় আরেকটা সর্বনাশ ঘটে যেতে পারে। পরক্ষনেই বুকে বল পেয়েছে এই ভেবে যে, আহমদ মুসা নিশ্চিত না হয়ে সামনে এগোন না।
সেদিন রাত ১১টা।
আহমদ মুসা একইভাবে বসেছিল মাইক্রোবাসের সিটটায়।
তার দৃষ্টি কারপার্কের বিশেষ গাড়িগুলোর দিকে। মাঝে মাঝে তার দৃষ্টি ঘুরে গিয়ে নিবদ্ধ হচ্ছে অফিসের মূল প্রবেশ পথটার উপর।
আহমদ মুসার শুন্য দৃষ্টি হঠাৎ তীক্ষ্ন হয়ে উঠল কারপার্কে প্রবেশকারী একজনের পদক্ষেপে অপরাধমূলক সতর্কতা।
মানুষের চোখের যেমন ভাষা আছে, তেমনি পায়ের চলায়ও একটা ভাষা আছে। চলার সময় সে ভাষার প্রকাশ ঘটে। আহমদ মুসা লোকটির চলায় অপরাধীর ভাষা দেখতে পেল।
গেট বক্সটির পাশ দিয়ে লোকটি প্রবেশ করেছে।
কার পার্কের একটা গেট বক্স আছে। একজন গেট ম্যান থাকে এখানে সার্বক্ষণিক।
প্রবেশকারী লোকটির চলায় অপরাধের ভাষা দেখে আহমদ মুসার চোখ দুটি সতর্ক হয়ে উঠল। নড়ে চড়ে বসল সে।
লোকটির যখন মুখ দেখতে পেল আহমদ মুসা, তখন মুহূর্তেই তার সব আনন্দ এক সঙ্গে উবে গেল। লোকটি কার পার্কের গেটম্যান।
কিন্তু গেটম্যানের চলায় অপরাধীর ছাপ কেন? নিরাশার মধ্যেও আশা জাগতে চাইল আহমদ মুসার মনে।
গেটম্যান গাড়ির দিকে এগুচ্ছে।
কেউ রং পার্কিং করেছে কিন? না অবাঞ্ছিত কোন পার্কিং হয়েছে?
আহমদ মুসার কৌতূহলী চোখ তাকে অনুসরণ করলো।
গেটম্যান গিয়ে দাঁড়াল একটা গাড়ির সামনে দরজার পাশে।
আহমদ মুসা দেখল গাড়িটা WNA-এর ব্যুরোসমুহের নির্বাহী সম্পাদক(ব্যুরো এডিটর) মিসেস ফাতেমা হিরেনের গাড়ি।
গড়িটার পাশে দাঁড়িয়েই গেটম্যান তার হাত বাড়িয়ে দিল গাড়ির ‘লক’-এর দিকে।
আহমদ মুসা ভাবল, গেটম্যান তাহলে কি গাড়ি অন্য জায়গায় সরিয়ে নেবে!
গেটম্যান গড়িটার দরজা ঈষৎ ফাঁক করেই তার কোটের পকেট থেকে ছোট নলের মত একটা কিছু বের করল এবং নলটি গাড়ির ভেতরে ঢুকিয়ে সিরিঞ্জের মত তার গোড়ায় একটা চাপ দিয়েই নলটি বের করে নিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল। তারপর দ্রুত চাবি ঘুরিয়ে দরজা লক করে ফিরে দাঁড়িয়ে গেটের দিকে হাঁটতে শুরু করল।
আহমদ মুসার চিন্তা যত দ্রুত চলল, তার চেয়েও দ্রুত কাজগুলো শেষ হয়ে গেল।
গেটম্যান গাড়ির দরজা খুলল কেন? আবার বন্ধই বা করল কেন? নলটি কি? কি করল তা দিয়ে? আর তার ফিরে আসার মধ্যেও সেই গভীর অপরাধী পদক্ষেপ কেন?
প্রশ্নগুলোর সমাধান পাবার আগেই গেটম্যান গেটবক্সের কাছাকাছি পৌঁছে গেল।
গেটম্যানকে কিছু জিজ্ঞেস করবে কি?
আহমদ মুসা দ্রুত গাড়ি থেকে বেরিয়ে এল। এগুলো গেটম্যানের পেছনে।
আহমদ মুসা যখন গেট বরাবর পৌঁছল, তখন গেটম্যান রাস্তায়।
রাস্তায় গেটের একপাশে একটা প্রাইভেট কার দাঁড়িয়েছিল। গেটম্যান সেদিকেই এগুচ্ছে।
হঠাৎ আহমদ মুসার গোটা চেতনা যেন ঝড়ের বেগে জেগে উঠল। গেটম্যান কারও পক্ষে কিছু করলো না তো! ঐ গাড়ির কাছ থেকে বেরিয়ে সোজা ঐ গাড়ির কাছে যাচ্ছে কেন?
আহমদ মুসার দিকে পেছন ফিরে একবার দেখে গেটম্যান দ্রুত এগুলো গাড়ির দিকে। গাড়ির খোলা জানালা দিয়ে একজনকে দেখা যাচ্ছে। সেও তাকিয়ে আছে আহমদ মুসার দিকে।
আহমদ মুসাও তার হাঁটা দ্রুত করল। এ সময় আহমদ মুসার সামনেই পুলিশের একটি গাড়ি এসে দাঁড়াল। দু’জন পুলিশ অফিসার নামছে গাড়ি থেকে।
আহমদ মুসা দেখল, গেটম্যান সেই নলটা তুলে দিল গাড়ির খোলা জানালার সেই লোকটির হাতে।
লোকটি বাম হাতে নলটি নিল। পরক্ষনেই তার ডান হাত জানালায় উঠে এল।
চমকে উঠল আহমদ মুসা, তার হাতে রিভলবার।
পরক্ষনেই গুলীর শব্দ। পর পর দু’টি।
রাস্তার উপর আছড়ে পড়ল গেটম্যানের লাশ।
আহমদ মুসা ছুটল, তার পেছনে পেছনে দু’জন পুলিশ অফিসারও ছুটল সেদিকে।
গুলীর শব্দের পরই গাড়িটা ছুটতে শুরু করেছে।
আহমদ মুসারা যখন গেটম্যানের কাছে পৌঁছল, গাড়ি তখন হাওয়া হয়ে গেছে।
মাথায় গুলী লেগেছে গেটম্যানের। সঙ্গে সঙ্গেই মৃত্যু ঘটেছে তার।
লাশ পুলিশের হাওয়ালা করে দিয়ে, অন্যান্য ফর্মালিটিজ চুকিয়ে আহমদ মুসা মিঃ গটেফকে নিয়ে অফিসে ফিরে এল।
পুলিশ কেসটি রেকর্ড করেছে বাদানুবাদ জনিত অন দি স্পট হত্যাকান্ড বলে।
হত্যার কোন মটিভ আছে কিনা পুলিশ জিজ্ঞেস করেছিল। আহমদ মুসার পরামর্শ অনুসারে মিঃ গটেফ বলেছিল আমরা কিছু জানিনা।
পুলিশ অফিসার বলেছিল, ‘ব্যক্তিগত কোন শত্রুতার ফল হতে পারে।’
একটু থেমেই পুলিশ আবার বলেছিল, ‘আপনাদের প্রতিষ্ঠানে যে সব অঘটন ঘটে চলেছে, তাতে পুলিশ কমিশনারের অনুরোধ অফিস কয়েকদিন বন্ধ রাখলে ভাল করতেন।’
আহমদ মুসা অফিসে ঢুকেই বলল মিঃ গটেফকে, ‘আমি যা বলেছিলাম- মিসেস ফাতেমা হিরনের গাড়ি না খোলা, তার গাড়িতে কেউ হাত না দেয়া এবং তাকে অন্য গাড়িতে বাড়ি পৌঁছে দেয়া- তা নিশ্চিত করা হয়েছে?’
‘হয়েছে। কিন্তু জনাব আহমদ মুসা আমি কিছুই বুঝতে পারছিনা।’
‘আসুন বলছি।’ বলে তাদেরকে নিয়ে মিঃ গটেফের অফিস কক্ষে প্রবেশ করল।
মি; গটেফের সাথে তার টেবিল ঘিরে বসল চীফ এডিটর মিঃ কামাল কনরাড, মিসেস ফাতেমা হিরন এবং আহমদ মুসা।
আহমদ মুসা ছাড়া সকলেরই মুখ শুকনো। চোখে-মুখে আতংক।
বসেই মিঃ গটেফ বলল, ‘সাংবাদিক কর্মচারীদেরমধ্যে নতুন করে আবার ভীতি ছড়িয়ে পড়েছে। মিসেস ফাতেমা হিরনের গাড়ি ও তার ব্যাপারটা ভীতিকে আবার আতংকে পরিনত করেছে। কি ঘটনা বলুন জনাব।’
‘সবাইকে ধৈর্য ধরতে হবে, ‘সাহসী হতে হবে জনাব। গেটম্যানের মৃত্যু আমাকে আনন্দিত করেছে। মনে হচ্ছে, বোধ হয় আমি রহস্যের একটা দরজায় পৌছতে পেরেছি।’
সকলের বিস্ময় দৃষ্টি এক সঙ্গে আহমদ মুসার উপর নিবদ্ধ হল। তাদের চোখে-মুখে একরাশ প্রশ্ন ঠিকরে পড়ছে। কিন্তু কারও মুখ থেকে কোন কথা বেরুল না।
আহমদ মুসাই কথা বলল, ‘চূড়ান্ত কথা আমি বলছি না, তবে যেটুকু প্রমাণ পেয়েছি তাতে গেটম্যান অন্যের পক্ষে কাজ করছিল। যাদের পক্ষে করছিল, তারাই তাকে হত্যা করেছে।’
‘কেন?’ কণ্ঠে উদ্বেগ মিঃ গটেফের।
‘যখন তারা বুঝল গেটম্যান আমার কাছে ধরা পড়ে গেছে, সেই মুহূর্তেই তার মুখ বন্ধ করার জন্য তাকে হত্যা করা হয়েছে।’
‘সে ধরা পড়েছিল আপনার কাছে?’ বলল মিঃ গটেফ।
‘আমি তাকে সন্দেহ করেছিলাম।’
‘শত্রুর পক্ষে কি কাজ করছিল সে?’ গটেফ বলল।
‘ব্যাপারটা আমার কাছে এখনও স্পষ্ট নয়। কালকে মিসেস ফাতেমা হিরনের গাড়ি খোলার পর হয়ত কিছু বলা যেতে পারে।’
‘গাড়ির সাথে তার সম্পর্ক?’ উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বলল ফাতেমা হিরন।
‘বলছি। গেটম্যান মিসেস হিরনের গাড়িতে কিছু ঢুকিয়েছে একটা ছোট পাইপ দিয়ে এবং সেই পাইপটা সে ফেরত দিয়েছে যে তাকে হত্যা করেছে। পাইপটা ফেরত দেয়ার পরই সে গুলী খেয়েছে। গেটম্যানের পিছু নিয়েছিলাম আমি, সেটা গেটম্যান এবং হত্যাকারী দু’জনেই দেখে ফেলে।
সবার চোখে-মুখে নতুন আতংক। ফাতেমা হিরনের মুখ মৃত্যুর মত ফ্যাকাশে।
‘কি ঢুকিয়েছে সে গাড়িতে। চাবি পেল কোথায়?’ শুকনো কণ্ঠে বলে ফাতেমা হিরন হাত ব্যাগ থেকে গাড়ির চাবি বের করল।
‘নিশ্চয় সে ধরনের চাবি সে জোগাড় করে বা তাকে জোগাড় করে দেয়া হয়। গাড়িতে কি ঢুকিয়েছে আমি জানিনা, তবে আমার মনে হয়েছে মৃত্যুর যে ঘটনাগুলো ঘটেছে, তার সাথে এর সম্পর্ক আছে।’
‘আল্লাহ’ বলে দু’হাতে মুখ ঢেকে আর্তনাদ করে উঠল মিসেস হিরন।
‘বুঝেছি মিঃ আহমদ মুসা, সব বুঝেছি।’ ভাঙ্গা গলায় বলল মিঃ গটেফ।
একটু থেমে আবার বলে উঠল মিঃ গটেফ, ‘মিসেস ফাতেমা হিরনের গাড়ি পাহারা দেবার ব্যবস্থা করি। অন্য গাড়িতে মিসেস হিরণকে বাড়ি পাঠিয়ে দেই।’
‘তাই করুন।’
‘আমার ভয় করছে বাড়িতে যেতে।’ কান্না জড়িত কণ্ঠে বলল মিসে হিরন।
‘আমাকে বিশ্বাস করুন বোন। সামান্য আশঙ্কা থাকলেও আমি আপনাকে বাড়িতে যেতে বলতাম না।
মিঃ গটেফ উঠে দাঁড়াল। সবাই উঠল সেই সাথে।
উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে আহমদ মুসা বলল, ‘মিঃ গটেফ আপনি টেলিফোনে FWTV-কে বলে দিন তাদের কার পার্কিং-এর গেটম্যান কে যেন আপাতত ছুটি দেয়া হয় এই মুহূর্ত থেকে।
‘জি আচ্ছা’ বলে অফিসের দরজার দিকে হাঁটতে শুরু করল মিঃ গটেফ।
WNA-এর চীফ এডিটর কামাল কনরাড বলল, ‘শুধু কারপার্কের গেটম্যানরাই কি সন্দেহের মধ্যে পড়ে? আরও চিন্তা কি আমাদের করতে হবে?’
‘আপাতত নয়।’
সবাই দরজার দিকে হাঁটতে শুরু করল।

পরদিন সকালে মিসেস ফাতেমা হিরনের গাড়ি খুব সাবধানতার সাথে খোলা হয়েছিল।
প্রথমে বাইরে থেকে গাড়ি ভালভাবে পরীক্ষা করা হয়। কিন্তু গাড়ির ভেতরে ফেলা হয়েছে, এমন বাড়তি কিছুই গাড়ির ভেতরে দেখা যায়নি। মিসেস ফাতেমা হিরনও সব দিক থেকে খুঁটে খুঁটে দেখেন কিন্তু কিছু মেলেনি।
কিন্তু আহমদ মুসা তা মেনে নিতে পারেনি। সে নিজ চোখে দেখেছে টিউব থেকে ভেতরে কিছু ফেলা হয়েছে এবং সে টিউবটা গেটম্যান তার হত্যাকারীকে ফেরত দিয়েছে। আহমদ মুসা ভাবে, টিউব কি কোন গ্যাস স্প্রে করে? গ্যাস তো চোখে দেখা যাবে না।
গাড়ির ভেতরের বাতাস পরীক্ষা করলে তা হয়ত জানা যাবে। কিন্তু তার আগে গাড়ির ভেতরটার মাইক্রোসকপিক পরীক্ষা হওয়া দরকার।
মাইক্রো টেলিলেন্স দিয়ে গাড়ির ভেতরটা পরীক্ষা করা হয়েছিল। এ লেন্সের মাধ্যমে দশ ফুট দূরের পিঁপড়াও তার সাইজের দশগুন বড় দেখা যায়।
গোটা গাড়ি সার্চের পর গাড়ির ড্যাস বোর্ডের একেবারে শেষ প্রান্তে যেখানে ড্যাস বোর্ড ও উইন্ড শিল্ড একসাথে মিশেছে সেখানে একটা বেশ বড় মাছি পাওয়া গেল।
পরীক্ষা করছিল আহমদ মুসা নিজে। চমকে উঠেছিল সে মাছি দেখে। বহুচেনা সিসি মাছি চিনতে তার কষ্ট হলনা।
গোটা দেহ আহমদ মুসার রোমাঞ্চ দিয়ে উঠছিল।
টেলি মাইক্রোসকোপটা আহমদ মুসা মিঃ গটেফের হাতে তুলে দিয়েছিল। বলেছিল, ‘দেখুন ওখানে।’
চোখ বুলিয়েই সে বলেছিল, ‘কি ওটা? একটা মাছির মত।’
‘ওটাই সিসি মাছি।’ বলেছিল আহমদ মুসা।
শব্দটা মিঃ গটেফের কানে পৌছার সাথে সাথেই তার গোটা দেহ আতংকের প্রচন্ডতায় অবশ হয়ে গিয়েছিল।
হাত থেকে তার টেলি মাইক্রোসকোপ পড়ে গিয়েছিল।
সামনেই দাঁড়িয়েছিল চীফ এডিটর কামাল কনরাড এবং ব্যুরো এডিটর মিসে ফাতেমা হিরেন।
তারা কয়েক ধাপ এগিয়ে এসে বলেছিল, ‘কি হয়েছে জনাব?’ বলে তারা তাকিয়েছিল আহমদ মুসার দিকে।
আহমদ মুসার ঠোঁটে ছোট এক টুকরো হাসি। বলেছিল, ‘কিছু হয়নি, উনি ভেতরে একটা সিসি মাছি দেখতে পেয়েছেন।’
‘সিসি মাছি? গাড়ির ভেতরে? দুই জন প্রায় এক সঙ্গেই বলে উঠেছিল, কিন্তু মিসেস ফাতেমা হিরনের কণ্ঠে আর্তনাদ, আর কামাল কনরাডের কণ্ঠ কাঠ শুকনো।’
মিসেস ফাতেমা হিরনের চোখে ফুটে উঠেছিল মৃত্যুর আতংক। বলেছিল, ‘কাল যদি গাড়িতে উঠতাম, তাহলে…’ কান্নার তোড়ে কথা শেষ করতে পারেনি।
অস্থিরতার জন্যে তার মুখের নেকাব খুলে গিয়েছিল। নেকাব ঠিক করে ফাতেমা হিরন আহমদ মুসার মুখোমুখি দাঁড়ায়। কান্নারুদ্ধ কণ্ঠে বলে, ‘আপনি আমাকে বাচিয়েছেন আল্লাহ আপনাকে দীর্ঘজীবি করুন।’
আহমদ মুসা মৃত সিসি মাছি গাড়ি থেকে বের করে। নিজেদের বিস্বস্ত একটা ল্যাবরেটরীতে মাছিটার পরীক্ষা করা হয়।
পরীক্ষা থেকে চাঞ্চল্যকর তথ্য পেল আহমদ মুসা।
বিশ্লেষণে মৃত সিসি মাছির মধ্যে দু’ধরনের বিষ পাওয়া গেছে। এক ধরনের বিষ মাছির ভেতরে যা সিসি মাছির নিজস্ব। আরেক ধরনের বিষ পাওয়া গেছে মাছির ‘হুল’- এ। সিসি মাছির ‘হুল’ কে বিশেষ নিয়মে এক বিশেষ ধরনের বিষে সিক্ত করা হয়েছে। মাছির কামড়ে এই বিষটি মানুষের দেহে প্রবেশ করলে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে তার মৃত্যু ঘটে। অন্যদিকে মাছিও বিষটির প্রভাবে ঘণ্টা খানেকের মধ্যেই মরে যায়। সেদিন রাত পৌনে ১২ টার দিকে মাছির হুল কে বিশেষ ধরনের ঐ বিষে সিক্ত করা হয়। এরপর খুনে রক্তপায়ী মাছিটি কোন মানুষ পেলে দংশন করত। মানুষটি মারা যেত, সেও মারা যেত।
বিশেষ বিষটির নাম পরিচয় ল্যাবরেটরি থেকে পাওয়া যায়নি। আহমদ মুসাই তাদের বলে যে, এই বিষে প্রকৃতির বিষের সাথে নতুন আবিষ্কৃত বিশেষ এক শ্রেনীর বক্স জেলিফিসের মিল আছে।
ল্যাবরেটরি পরিক্ষায় পরে প্রমানিত হয় আহমদ মুসার অনুমান ঠিক।
ল্যাবরেটরি রিপোর্ট, অন্যান্য তথ্য এবং বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনার জন্যে বৈঠক বসল WNA-এর মিটিং রুমে।
মিঃ বাকের জারমিস, মিঃ জামাল গটেফ, মিঃ কামাল কনরাড, মিঃ হাসান আলবার্তো, জেনেভা মুসলিম কম্যুনিটির প্রধান আব্দুল মজিদ ম্যাক্স-ফ্রিস এবং আহমদ মুসা- এই ৬জন একটা বড় টেবিল ঘিরে বসেছে।
গোটা পরিস্থিতি ব্রিফ করল WNA-এর চেয়ারম্যান মিঃ গটেফ। শেষে বলল, ‘গোটা বিষয়টা ড্রিল করেছেন আমাদের মহান ভাই আহমদ মুসা। আরও কিছু জানার থাকলে তিনি বলবেন।’
‘সব বিষয় কি পুলিশকে জানানো হয়েছে?’ প্রথমেই কথা বললেন মিঃ ম্যাক্স ফ্রিস।
‘না জানানো হয়নি। আমার মনে হয় বিষয়টা জনাব আহমদ মুসা বুঝিয়ে বললে ভাল হয়। অনেকের মনে এ প্রশ্নটা আছে।’ বলল মিঃ গটেফ।
আহমদ মুসা বলল, ‘ আমাদের শত্রু আসলে কে আমি জানিনা। তবে তারা নিঃসন্দেহে শক্তিমান ও প্রভাবশালী হবে। তারা দু’টি মুসলিম সংবাদ মাধ্যমকে ধ্বংস করতে চাচ্ছে। এরা ‘ব্ল্যাক ক্রস’ এর মত কোন দল যদি হয়, তাহলে তাদের সাথে পুলিশের একটা অংশের সম্পর্ক থাকতে পারে। সুতরাং সব বিষয় যদি আমরা পুলিশকে জানাই, তাহলে শত্রুদের সবকিছু জেনে ফেলার সম্ভাবনা আছে। সে ক্ষেত্রে তাদের বিরুদ্ধে অগ্রসর হওয়া আমাদের কঠিন হবে। আমরা তাদের কিছুই জানিনা। গোপনে অগ্রসর না হলে বর্তমান অবস্থায় তাদের নাগাল পাওয়া আমাদের পক্ষে সম্ভব হবে না।’
‘জনাব আহমদ মুসার বলার পর আমাদের আর কিছু বলার থাকেনা। কিন্তু আমি জানতে চাচ্ছি, পুলিশকে একদমকিছু না জানানো কি ঠিক হবে। অন্তত সিসি মাছি পাওয়ার ব্যাপারটা।’ বলল আবার ম্যাক্স ফ্রিস।
‘এটাই তো আসল কথা। এ বিষয়টা যদি পুলিশকে জানানো হয়, কালকেই এ নিয়ে হৈ চৈ পড়ে যাবে। শত্রু তার কৌশল পরিবর্তন করবে। আমরা তাদের মুখোমুখি হবার একটা যোগসুত্র হারিয়ে ফেলব।’ বলল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসা থামল। সবাই নীরব।
বেশ কিছুক্ষন পর মিঃ জারমিস বলল, ‘আহমদ মুসার সাথে আমি একমত।’
অন্য সবাই মাথা নেড়ে মিঃ জারমিসের কথায় সায় দিল। ম্যাক্স ফ্রিসও।
‘আমি বলেছি আমার যুক্তি হিসেবে। সবাইকে এর সাথে একমত হতে হবে তা ঠিক নয়। আমি কিছুটা এগিয়েছি, কিন্তু সামনে কোন পথে চলব আমার জানা নেই। আমি সফল হব এর কোন নিশ্চয়তা নেই। পুলিশের সাহায্য উপকারীও হতে পারে।’ বলল আহমদ মুসা।
মিঃ ম্যাক্স ফ্রিস চেয়ারে হেলান দিয়ে বসেছিল। সোজা হয়ে বসল। বলল, ‘আমিও বলেছি আমার একটা যুক্তি হিসেবে। আমার আস্থা পুলিশের উপর নেই। তারা তো কেসটা নিয়ে ড্রিল করছে আপনি এখানে আসারও অনেক আগে থেকে। তারা এক পাও এগুতে পারেনি। আপনি শত্রুকে ধরতে পারেননি এখনও কিন্তু মাত্র কদিনে রহস্য উদঘাটন করেছেন। আল্লাহই আপনাকে এখানে এনেছেন। আপনাকেই দায়িত্ব নিতে হবে।’
ম্যাক্স ফ্রিস থামতেই সবাই এক বাক্যে বলে উঠল, ‘আর কোন কথা নয়। আমরা ম্যাক্স ফ্রিসের কথার সাথে একমত।’
কিছুক্ষন সবাই নীরব।
নীরবতা ভেঙে হাসান আলবার্তো বলল, ‘শত্রু কারা আপনি কি অনুমান করছেন?’
আহমদ মুসা হাসল। বলল, ‘অনুমান দিয়ে কি লাভ হবে?’
‘অনুমানের পেছনেও যুক্তি থাকে।’ বলল হাসান আলবার্তো।
‘অনুমানটা জানতে পারলে আমরাও স্বান্তনা পেতাম।’ বলল মিঃ জারমিস।
‘উদ্বেগও বাড়তে পারে।’ বলল আহমদ মুসা।
‘তাহলে বোঝা যাচ্ছে, নিশ্চয়ই আপনি কিছু আঁচ করেছেন। বলুন সেটা কি?’ বলল কামাল কনরাড।
‘আমি সন্দেহ করছি ব্ল্যাক-ক্রস কে।’ বলল আহমদ মুসা।
‘ব্ল্যাক-ক্রস কে?’ একসঙ্গে কয়েকজন বলে উঠল।
তাদের চোখে-মুখে স্পষ্ট ভয়ের চিহ্ন।
‘হাঁ ব্ল্যাক-ক্রস কে। সন্দেহ আমার দুটি কারনে। এক, সম্প্রতি WNA এবং FWTV ক্যামেরুনে ব্ল্যাক ক্রসের ষড়যন্ত্র বানচাল করতে সাহায্য করেছে। এই সেদিন বোমাসার ঘটনার যে কভারেজ WNA এবং FWTV দিয়েছে, তাতে গোটা দুনিয়ার ব্ল্যাক ক্রস-এর মুখে কালমা লেপন হয়েছে। দ্বিতীয় কারণ হল, মধ্য আফ্রিকার সিসি মাছির ব্যবহার। ব্ল্যাক ক্রসের বড় বড় অনেক নেতা সাম্প্রতিককালে মধ্য আফ্রিকা গিয়েছেন। তাদের মাথায় সিসি মাছির ব্যবহারের চিন্তা আসা স্বাভাবিক।’ বলল আহমদ মুসা।
‘আপনার অনুমান সত্য হলে এ শত্রু তো সাংঘাতিক।’ বলল হাসান আলবার্তো।
‘সাংঘাতিক তো বটেই। পুলিশ কে বোকা বানিয়ে কি কৌশলে দেখুন ওরা মানুষ হত্যা করে চলেছে।’
‘শত্রু যদি ব্ল্যাক ক্রসই হয়, তাহলে তো পুলিশের মধ্যে ওদের সাথী সমর্থক থাকতে পারে, প্রভাব তো আছেই। নিশ্চয় এ জন্যেই আপনি পুলিশকে এড়িয়ে চলতে চাচ্ছেন। বলল ম্যাক্স ফ্রিস।
‘ঠিক বলেছেন।’ বলল আহমদ মুসা।
‘আপনাকে ধন্যবাদ। আপনার সম্পর্কে যত শুনেছি, যত ভেবেছি, তার চেয়েও আপনি অনেক বড়। এতদিন ভাবতাম, অস্ত্র চালনায় আপনার জুড়ি নেই। কিন্তু এখন দেখছি, বুদ্ধি চালনায় পুলিশ গোয়েন্দা আপনার কাছে কিছু নয়।’ বলল ম্যাক্স ফ্রিস।
কথাগুলোর দিকে কান না দিয়ে আহমদ মুসা মিঃ গটেফের দিকে চেয়ে বলল, ‘আমার জরুরী কিছু কাজ আছে, উঠতে পারি কিনা।’
‘নিশ্চয়, নিশ্চয়। আপনার কোন সময় নষ্ট করা আমাদের উচিত নয়।’ বলে গটেফ ম্যাক্স ফ্রিসের দিকে চেয়ে উঠে দাঁড়াল।

জেনেভার মধ্য দিয়ে বয়ে যাওয়া রণ নদীর দক্ষিন তীরের কিছুটা দূরে বিশাল দশ তলা ভবনের আট তলার একটা অফিস ফ্ল্যাট।
জেনেভায় ব্ল্যাক-ক্রস এর লিয়াজো অফিস।
ব্ল্যাক ক্রস এর প্রধান সাইরাস শিরাক এইমাত্র এসে পৌঁছেছেন এখানে। অফিসে উৎসবের আমেজ।
ব্ল্যাক ক্রসের জেনেভা অফিস তার লক্ষ্য অর্জনে দারুন সাফল্য অর্জন করেছে। ইতিমধ্যেই WNA এবং FWTV সংবাদ সংস্থা দু’টির ৬জন গুরুত্বপূর্ণ সাংবাদিক মরেছে। মিশন চলছে একদম নিরাপদেই। সাফল্যের আনন্দ ভোগ করার জন্য স্বয়ং সাইরাস শিরাক আজ জেনেভা এসেছেন।
তার আগমন উপলক্ষে সেই কাক ডাকা ভোরেই সবাই গিয়ে বসেছে মিটিং রুমে।
প্রথমেই কথা বলল সাইরাস শিরাক, ‘এ পর্যন্ত সাফল্যের জন্য আপনাদের ধন্যবাদ। এখনকার পরিবেশ কেমন?’
সাইরাস শিরাকের সামনে টেবিল ঘিরে বসে বিশেষ অপারেশন চীফ মিঃ রেনেন, জেনেভা হেড কোয়ার্টারের প্রধান মিঃ পল এবং লিয়াজো অফিস চীফ মিঃ ফি।
কথা বলল পল। জানাল, পরিবেশ ভাল। বিশেষ সিসি মাছির কামড়েই ওদের মৃত্যু ঘটেছে বলে ওরা মনে করছে। পুলিস ল্যাবরেটরি এবং বিশ্ববিদ্যালয় ল্যাবরেটরি এক্সপার্ট আমাদের কথা অনুসারে কাজ করছে। পুলিশ প্রধান একটু বাঁকা লোক, কিন্তু তাকে কিছু জানতেই দেয়া হয়নি। তার ডেপুটি আমাদের খুব সাহায্য করেছে।’
‘ওদের উপর প্রতিক্রিয়া কি?’ বলল সাইরাস শিরাক।
‘সংবাদ সংস্থা দু’টি লোকদের উপর? ওরা তো পুলিশকে পাগল করে তুলেছে। চরম আতংকে ভুগছে সবাই।’
‘কিন্তু আমরা তো শুধু লোক হত্যা নয়, আমরা দেখতে চাই, সংবাদ সংস্থা দু’টি কত দ্রুত বন্ধ হচ্ছে। বলল সাইরাস শিরাক।
‘ওদের আতংক চরমে পৌঁছেছে। গত রাতেও আমরা একটা শিকার করেছি। আমার মনে হয়, আর দু’একটা ঘটনার পর সাংবাদিক কর্মচারীরাই পালিয়ে যাবে। তাছাড়া পুলিশ থেকেও তাদের চাপ সৃষ্টি করা হয়েছে। বলা হয়েছে, সংস্থা দু’টিতেই কিছু ঘটেছে, না হলে এমন মৃত্যুর ঘটনা শুধু এ দু’টি সংস্থাতেই ঘটছে কেন? ভেতরের কোন শত্রুতা এর পেছনে কাজ করতে পারে। পুলিশকে এ ক্ষেত্রে প্রভাবিত করার চেষ্টা আমরা করেছি সাংবাদিকদের মাধ্যমে। অবস্থার কারনে প্রতিষ্ঠান দু’টি সাময়িক ভাবে বন্ধ করার পরামর্শ তাদের কানে তোলা হয়েছে।’ বলল মিঃ পল।
‘ভাল খবর, বলে সাইরাস শিরাক রেনেন-এর দিকে চেয়ে বলল, ‘ধন্যবাদ, তোমার অস্ত্র ভাল কাজ করছে। এ অস্ত্র আমি মনে করি বিরাট মার্কেট পাবে রেনেন। তোমার অস্ত্রগুলো নতুন পরিবেশে কেমন আছে?’
‘না পরিবেশ তাদের জন্যে একেবারে নতুন নয়। হ্রদের লাগোয়া কাঁচের ছাদ দেয়া ঘরে কাদার মেঝেতে একটা বনজ স্যাঁৎ স্যাঁতে পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়েছে। ৩৭ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপের জলীয় বাষ্পের মধ্যে অস্ত্রগুলো ভালই আছে।’ বলল রেনেন।
‘আমার আশঙ্কা ছিল সিসি’র হুলে জেলিফিস পয়জন নিষিক্ত করার কাজ তোমার ল্যাবরেটরি কেমন পারবে।’ বলল সাইরাস শিরাক।
‘কোন অসুবিধা হয়নি। সিসিকে বিশেষ প্রেসার টিউবে তুলে প্রেসার দিয়ে টিউবের বিশেষ একটি সংকীর্ণ স্থানে এনে ফেলা হয়। তারপর টিউবের ফুটো দিয়ে মডারেট করা জেলিফিশ পয়জন ইঞ্জেক্ট করা হয়। একেবারে মোক্ষম। ফল দিচ্ছে হান্ড্রেড পারসেন্ট। কোন অন্যথা হয়নি। কিন্তু…’
থেমে গেল রেনেন।
কপাল কুঞ্চিত হল সাইরাস শিরাকের। বলল ‘কিন্তু কি? থামলে কেন? বল?’
‘আজ একটা অঘটন ঘটে গেছে। আমাদের এজেন্ট যে WNA-তে আমাদের ফাঁদ পাতার কাজ করছিল, সে ধরা পড়ে গেছে।…
সাইরাস শিরাক রেনেন কে থামিয়ে দিয়ে উত্তেজিত কণ্ঠে বলল, ‘ধরা পরে গেছে, ওদের কাস্টডিতে?’
‘না স্যার। সম্ভবত ওদের একজন তাকে সন্দেহ করেছিল।’
‘তারপর?’
‘ওকে হত্যা করে এসেছি।’
‘সাবাস। কিন্তু কাজের কি হয়েছে?’
‘ফাঁদ পেতে আসার পথে সে সন্দেহের শিকার হয়। আমি দুরবীন দিয়ে দেখেছি সে ফাঁদ ঠিক মতই পাতে।’
‘রেজাল্ট জানা গেছে?’
‘এইত এখনই খবর হবে। জানা যাবে।’
টেলিভিশনে খবর হল।
সাইরাস শিরাকসহ সবাই শেষ পর্যন্ত খবরটা শুনল। কিন্তু সিসি মাছির নতুন ভিক্টিমের কথা বলা হলনা।
মুখ মলিন হয়ে গেল রেনেনের।
গম্ভীর হল সাইরাস শিরাকের মুখমন্ডল।
‘টার্গেটের বাসায় টেলিফোন করে দেখ মিঃ পল।’
পল টেলিফোন করল মিসেস ফাতেমা হিরেনের বাসায়। বাসা থেকে জানা গেল তিনি বাসায় ফেরেনি।
‘বাসায় না ফেরার কারণ এই হতে পারে যে, গতকাল খুনের ফলে অফিসে ব্যস্ততার কারনে বাসায় আসতে না পেরে অফিসে বা কোন বান্ধবীর বাসায় ছিল।’ বলল রেনেন।
‘না, তোমাদের পাতা ফাঁদ ধরা পরার কারনেই গাড়িতে বাসায় ফেরেনি?’ বলল সাইরাস শিরাক।
‘সে রকম কিছু ঘটলে অন্য গাড়িতে বাসায় ফিরতে পারত। আমার মনে হয় গাড়িতে ফাঁদ পাতার ব্যাপারটা কেউ দেখেনি, দেখলেও বুঝার কথা নয়। খুব বেশি হলে চুরির চেষ্টা করার জন্যে তাকে সন্দেহ করতে পারে।’ বলল রেনেন।
‘শত্রুকে সব সময় ছোট ভাবা ঠিক নয়।’ বলল সাইরাস শিরাক।
‘এখনি খবরের কাগজ এসে পড়বে। যদি সে রকম কিছু ঘটে থাকে, তাহলে সেটা কাগজের প্রধান শিরোনাম হবে। আমি নিশ্চিত আমাদের ফাঁদ ধরা পড়েনি। পড়লে আমাদের পুলিশ বন্ধুরা অনেক আগেই আমাদের জানাত।’ রেনেন বলল।
বলতে বলতেই কাগজ এসে গেল।
প্রধান দৈনিকটি হাতে তুলে পাগলের মত চোখ বুলাল রেনেন।
WNA-এর গেটম্যান খুনের ঘটনা ঘটনা সত্যিই প্রধান শিরোনাম পেয়েছে। গোগ্রাসে নিউজটা গিলল রেনেন।
পড়া শেষে চিৎকার করে উঠল, ‘থ্যাঙ্ক গড মিঃ সাইরাস। ওরা কিছুই জানতে পারেনি। পুলিশ বলেছে লেন-দেনে কোন গণ্ডগোল বা ব্যাক্তিগত কোন শত্রুতার শিকার হয়ে গেটম্যান খুন হয়েছে। প্রাথমিক অনুসন্ধানে পুলিশ নিশ্চিত হয়েছে, রহস্যজনক মৃত্যুগুলোর সাথে এ খুনের কোন সম্পর্ক নেই। পুলিশ আরও বলেছে, খুন হওয়ার আগে গেটম্যান কে অস্থিরভাবে এ গাড়ি সে গাড়ির কাছে ঘুরাফিরা করতে দেখা গেছে। মনে করা হচ্ছে, সে কোন গাড়ি চোর গ্যাং-এর সাথেও জড়িত থাকতে পারে। পরিশেষে খবরে লেখা হয়েছে, পুলিশ খুনিকে পাকড়াও করার জন্যে গেটম্যানের ইতিবৃত্ত নিয়ে অনুসন্ধান শুরু করেছে।’
‘পুলিশ ইতিবৃত্ত খুঁজতে গিয়ে যদি কিছু পেয়ে যায়?’ বলল পল।
‘তুমি এই ভয় করছ পল! নিউজে এসব লেখে, এর বাস্তব কোন মুল্য নেই। আর খুজলেও কিছু পাবেনা। একমাত্র তার হাতে টাকা দেয়া এবং সিসি মাছির টিউব পৌঁছানো ছাড়া তার সাথে আমাদের কোন চিহ্ন নেই। আমরা টিউব গুলো সবই ফেরত নিয়ে এসেছি। আর টাকাতে তো কারও নাম লেখা থাকেনা। সুতরাং তারা যতই সার্চ করুক, আমাদের কোন চিহ্ন কোথাও খুজে পাবেনা।’
‘ধন্যবাদ রেনেন। এখন বল কি চিন্তা করছ তুমি। দুঃখ যে, আমি এসে প্রথমে ব্যর্থতাই দেখলাম।’
‘দুঃখিত মিঃ সাইরাস। তবে আমাদের ফাঁদে শিকার পড়েনি, এটুকুই আমাদের ব্যর্থতা। কিন্তু আমাদের যে বড় লাভ হয়েছে সেটা হল, তাদের সন্দেহটা আমাদের কাছে ধরা পড়েছে এবং আমাদের কথা প্রকাশ হওয়ার পথ আমরা যথাসময়ে বন্ধ করতে পেরেছি।’
‘ধন্যবাদ রেনেন, এটা অবশ্যই বড় লাভ। এখন বল এগুবে কিভাবে?’
-আমাদের এজেন্ট গেটম্যান না থাকায় সেখানকার কার পার্কে ফাঁদ পাততে অসুবিধা হবে। তবে নিশ্চিত থাকুন, আগামী দু’একদিনের মধ্যে আমরা আমাদের হাত থেকে ফসকে যাওয়া শিকারকে ফাঁদে ফেলব। যেখানে সুযোগ পাবো সেখানেই।’
‘তবে একটু পিছিয়ে পড়লাম আমরা।’ বলল সাইরাস শিরাক।
একটু থেমেই আবার সাইরাস শিরাক বলল, ‘আমাদের লক্ষ্য সংবাদ সংস্থা দু’টি বন্ধ করা। শুন্য পদগুলোতে লোক নিয়ে তারা যদি কাজ করেই যায়, সেটা হবে সাংঘাতিক ব্যর্থতা, এটা আমরা হতে দিতে পারিনা। একথা তোমার মনে আছে তো?
‘মনে আছে। শুন্য জায়গায় লোক নিলে সেই-ই হবে প্রথম টার্গেট। আমরা কোন ভাবেই লোক আসতে দেব না।’
একটু থামল রেনেন। তারপর আবার শুরু করল, ‘আগেই বলা হয়েছে, সংবাদ সংস্থা দু’টি বন্ধের পরিবেশ সৃষ্টির জন্যে পুলিশ ও সাংবাদিকদের মধ্যে বেশ কাজ হয়েছে। এটাও ফল দেবে বলে আমি মনে করি।’
‘তাই হোক রেনেন। বলে সাইরাস শিরাক উঠে দাঁড়াল। বলল, ‘চল উঠা যাক। ক্ষুধা লেগেছে।’
সবাই উঠে দাঁড়াল।

মিসেস ফাতেমা হিরেনের গাড়ি অনুসরণ করে আহমদ মুসার গাড়ি এসে প্রবেশ করল জেনেভাস্থ জাতিসংঘের ইউরোপীয় সদর দপ্তরের কার পার্কে।
সেদিন গেটম্যান নিহত হওয়া এবং ফাতেমা হিরেন বেচে যাওয়ার পর আহমদ মুসা ব্ল্যাক ক্রস সম্পর্কে তার অভিজ্ঞতা থেকে বুঝেছে, এরপর ফাতেমা হিরেনই হবে তাদের পরবর্তী টার্গেট। কোন টার্গেট ব্যার্থ হলে ব্ল্যাক ক্রস সে টার্গেটকেই আবার তাদের প্রথম টার্গেট বানায়।
আহমদ মুসা অনেক চিন্তা করেছে, মিসেস ফাতেমা হিরেনের উপর ব্ল্যাক-ক্রস এর আক্রমণ কিভাবে কোন দিক থেকে আসতে পারে। সে নিশ্চিতই মনে করেছে, সিসি মাছির অস্ত্রই ব্ল্যাক ক্রস ব্যবহারের চেষ্টা করবে। ব্ল্যাক ক্রস সুইস পুলিশ, সরকার এবং বিশ্ববাসীকে অন্ধকারে রেখে অব্যাহত ভাবে রহস্যজনক মৃত্যুর একটা আতংক সৃষ্টি করে সংবাদ সংস্থা দু’টিকে বন্ধ করতে চায়। সুতরাং পরিস্কার খুনোখুনির দিকে না গিয়ে রহস্যময় মৃত্যু ঘটানোর পথই তারা অনুসরণ করবে। সুতরাং অস্ত্র হবে সিসি মাছি এবং সিসি মাছির মৃত্যুফাঁদ পাতার জন্য গাড়ির ছোট্ট পরিবেশের চেয়ে উৎকৃষ্টতর ও নিশ্চিত কোন বিকল্প নেই।
ব্ল্যাক ক্রসকে ফাতেমা হিরেনের গাড়িতে এই মৃত্যু ফাঁদ পাতার সুযোগ করে দিতে হবে এবং এই সুযোগ দেয়ার মাধ্যমে তাদের পাকড়াও করতে হবে এবং ওদের ঘাঁটিতে যেতে হবে।
আহমদ মুসা এসব কথার প্রয়োজনীয় অংশ WNA-এর চেয়ারম্যান মিঃ গটেফকে জানালেও মিসেস ফাতেমা হিরেনকে কিছুই জানতে দেয়নি। ফাতেমা হিরেন ঘটনার পর আর সেই গাড়িতে চড়তেই রাজী হয়নি। বলেছিল, সবার সাথে সাধারন বাসে সে যাতায়াত করবে। কিন্তু এটা করলে আহমদ মুসার গোটা পরিকল্পনাই ব্যর্থ হয়ে যায়। তাই শুধু এটুকু সে তাকে বলেছিল স্বান্তনার জন্যে যে, মিসেস ফাতেমা হিরেন এমন আচরন করা কি ঠিক যাতে শত্রুরা সন্দেহ করতে পারে যে আমরা তাদের ষড়যন্ত্র ধরে ফেলেছি কিংবা আমরা তাদের সন্দেহ করছি? তার সকল কিছু স্বাভাবিক নিয়মে চালু থাকা দরকার। তার বাড়ির বাইরে সকল অবস্থায় আহমদ মুসা তার অনুসরণ করবে।
ফাতেমা হিরেন রাজ্যের ভয় মাথায় নিয়ে রাজী হয়েছে। বলেছে, দুনিয়ার অন্য কেউ বললে আমি রাজী হতাম না। কিন্তু ভয় হয়, আহমদ মুসার পরামর্শ না শুনলে গুনাহ হবে।
গাড়ি পার্ক করে ফাতেমা হিরেন সদর দপ্তরের ভেতরে চলে গেল।
জাতিসংঘের ইউরোপীয় সদর দপ্তরে বিশাল একটি লাইব্রেরী রয়েছে এবং রয়েছে সমৃদ্ধ ডাটা ব্যাংক। ফাতেমা হিরেন তার প্রতি সাপ্তাহিক ছুটির দিনের সন্ধ্যা এখানে এসে কাটায়।
আহমদ মুসা ফাতেমা হিরেনের গাড়ির দুই লাইন পেছনে তার গাড়ি পার্ক করে অর্ধশোয়া অবস্থায় থেকে ফাতেমা হিরেনের গাড়ির উপর চোখ রাখল।
তখন সন্ধ্যা নেমে এসেছে। সাড়ে ৫টা পার হয়ে গেছে, বিদ্যুতের আলোতে চারদিকে রাতের আমেজ।
একজন বলিষ্ঠ গড়ন লোক সদর দফতরের দিক থেকে এসে কার পার্কে ঢুকল। অত্যন্ত স্বাভাবিক পদক্ষেপে এসে সে ফাতেমা হিরেনের গাড়ির কাছে দাঁড়াল। যেন তার গাড়িতে সে উঠতে এসেছে, এমনি একটা স্বাভাবিক ভাব তার মধ্যে।
ভ্রু কুঞ্চিত হয়ে উঠেছে আহমদ মুসার। সে নড়েচড়ে উঠে গাড়ির দরজার হাতলে হাত রাখল।
লোকটি পকেট থেকে চাবি বের করল। খুলে ফেলল সামনের দরজা। পকেট থেকে বের করল সিরিঞ্জ।
আহমদ মুসা এক ঝটকায় দরজা খুলে ছুটল ফাতেমা হিরেনের গাড়ির দিকে।
পেছনে পায়ের শব্দ শুনে লোকটি ফিরে দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু তার আগেই আহমদ মুসা জাপটে ধরল তাকে।
কিন্তু জাপটে ধরার সঙ্গে সঙ্গেই আহমদ মুসা লোকটির কনুই-এর প্রচণ্ড একটা গুতা খেল পাঁজরে।
আহমদ মুসার হাত শিথিল হয়ে গিয়েছিল। এক ঝটকায় বেরিয়ে গেল লোকটি আহমদ মুসার হাত থেকে।
প্রচণ্ড আঘাতের ধকলটা সামলে নিতে আহমদ মুসার দেরি হয়েছিল। পাঁজরে প্রচণ্ড আঘাত খেয়ে টলে উঠেছিল তার দেহটা। গাড়িতে ঠেস দিয়ে সে ঠিক হয়ে দাঁড়িয়েই দেখল লোকটি ছুটে গিয়ে একটি গাড়িতে উঠেছে।
আহমদ মুসা ছুটল তার গাড়ির দিকে।
আহমদ মুসা লোকটির প্রায় পিছু পিছুই কার পার্ক থেকে বেরিয়ে এল।
লোকটির গাড়ির পেছনে ছুটে চলল আহমদ মুসার গাড়ি।
আহমদ মুসার গাড়িকে লোকটি শুরুতেই দেখে ফেলেছে।
এ রাস্তা সে রাস্তা ঘুরে লোকটির গাড়ি লেক জেনেভা হাইওয়েতে গিয়ে উঠল।
লেক জেনেভা হাইওয়ে পশ্চিম সুইজারল্যান্ডের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং গোটা সুইজারল্যান্ডের অন্যতম দীর্ঘ সড়ক। প্রথমে সড়কটি লেক জেনেভার তীর বরাবর উত্তরে ৩০ মাইল এগিয়ে গেছে লেক জেনেভার সুন্দর নগরী মরজেস পর্যন্ত। তারপর লেক জেনেভা পূর্বদিকে টার্ন নিয়েছে। লেক জেনেভা হাইওয়েও পূর্বদিকে টার্ন নিয়ে লেকের তীর ঘেঁষে বিখ্যাত নগরী লুজেন, তারপর মট্রেস্কু হয়ে লেক জেনেভার পূর্ব প্রান্ত ঘুরে সড়কটি পশ্চিমমুখী হয়েছে। তারপর লেক জেনেভায় পড়া আলপস-এর দৃষ্টি মনোহর রণ নদীর তীর ধরে এগিয়ে গেছে সুন্দর এবং দুর্গম আলপস পর্বতমালার দিকে।
বিশাল প্রশস্থ হাইওয়ে।
লোকটির নতুন গাড়িটি হাওয়ার বেগে ছুটছিল সামনে। সব সময় চলছিল রাস্তার মিডল লাইন ধরে। আহমদ মুসা বুঝল, লোকটি হয় অনির্দিষ্টভাবে চলছে, নয়ত দূরবর্তী কোন লক্ষ্যে যাচ্ছে।
আহমদ মুসা চাইছিল গাড়িটাকে ওভারটেক করে তাকে থামতে বাধ্য করতে। কিন্তু ছোট ও পুরনো গাড়িতে সে স্পীড ছিল না।
সুতরাং গাড়িটিকে অনুসরণ করে চলারই সিদ্ধান্ত নিতে হল আহমদ মুসাকে। নিশ্চয় তাকে থামতে হবে। ফুয়েল তার শেষ হবেই। আহমদ মুসা তার গাড়ির ফুয়েল মিটারের দিকে নজর বুলিয়ে দেখল, ফুয়েল ট্যাংক ভর্তি। মনে মনে ধন্যবাদ দিল মিঃ গটেফকে। তবে গাড়িটা এ ধরনের ধরনের কাজের উপযোগী হয়নি।
রাত নেমে এসেছে। সুইজারল্যান্ডের একটি সুন্দর অঞ্চলের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে সে। দিন হলে দেখা যেত ডানে দিগন্ত প্রসারিত লেক জেনেভা এবং বামে সুন্দর সবুজ পাহাড়ের সারি এবং তার নিচে উঁচু-নিচু সবুজ উপত্যকা।
প্রাণপণ ছুটে চলছিল দুটি গাড়িই।
আধঘণ্টা পার হয়েছে।
আহমদ মুসার অনুমান গাড়ি এখন তাদের জেনেভা লেক তীরের মরজেস নগরীর আশেপাশে হবে।
আহমদ মুসা হঠাৎ করেই লক্ষ্য করল, সামনের গাড়িটার স্পীড কমে গেছে। গাড়ির পেছনের লাল বাতি দ্রুত আহমদ মুসার নিকটবর্তী হচ্ছে।
তেল কি ফুরিয়ে গেল গাড়িটার। হতে পারে। পালাবে নাতো।
গাড়ির স্পীড আরেকটু বাড়াল আহমদ মুসা।
যখন গাড়িটার কাছে পৌঁছল আহমদ মুসার গাড়ি, তখন সে গাড়িটা দাড়িয়ে গেছে। গাড়ি ছেড়ে পালিয়েছে নাকি।
গাড়ি থেকে নেমেই আহমদ মুসা সেই গাড়িটার চারদিকে নজর বুলিয়ে লোকটিকে দেখতে পেল না। ভাবল, গাড়ির ভেতরটা এক নজর দেখে সে চারদিক ভাল করে চোখ বুলাবে। এত তাড়াতাড়ি তার পালানো স্বাভাবিক নয়।
আহমদ মুসা দ্রুত গিয়ে জানালা দিয়ে গাড়ির ভেতরে নজর রাখল। দেখল, স্টিয়ারিং-এ দু’হাত রেখে নির্বিকার বসে আছে লোকটি।
চমকে উঠল আহমদ মুসা। তাহলে কি ট্র্যাপে পড়েছে সে! ফাঁদ পেতে সে নিশ্চিন্তে বসে আছে?
গোটা দেহ আহমদ মুসার সতর্কতার এক তড়িত প্রবাহে সতর্ক হয়ে উঠল। ঘুরে দাঁড়াল সে।
ঘুরে দারিয়ে যা দেখল তাতে আর কিছুই করার ছিল না তার। দু’হাত দিয়ে মাথা ঢেকে বসে পড়ল।
প্রায় একসাথেই কয়েকটা হকিস্টিক ও লোহার রড এসে তার উপর পড়ল। মনে হল হাত দু’টো ছাতু হয়ে গেল, তার সাথে তার মাথাও। তার চারদিকটা অন্ধকার হয়ে এল। সেই অন্ধকারে মনে হল, দু’টো তীব্র আলো তার দিকে ছুটে আসছে। তার আরও মনে হল তাকে ধাক্কা দিয়ে পাশের গাড়িটা চলে গেল। মাথায় রডের বাড়িও আর পড়ছে না। তারপর সব শব্দ, সব দৃশ্য-সব কিছুই কোথায় যেন হারিয়ে গেল তার সামনে থেকে।

ওয়ার্ল্ড নিউজ এজেন্সির (WNA) মিটিং রুম।
বিরাট গোল টেবিলের চারদিক ঘিরে বসেছে WNA এবং FWTV-এর চেয়ারম্যান, দুই সংস্থার দুইজন প্রধান প্রশাসক, সংবাদ দুটির চীফ এডিটরদ্বয় এবং মিসেস ফাতেমা হিরেন।
সকলেরই মুখ ছাইয়ের মত সাদা। আতংকে সবাই যেন মুহ্যমান।
শুরু করল WNA-এর চেয়ারম্যান জামাল গটেফ। বলল, ‘খবরটা আপনারা সবাই শুনেছেন। বিস্তারিত আপনাদের শোনা উচিত। মিসেস ফাতেমা হিরেনকে আমি ডেকেছি। তাকে আমি অনুরোধ করছি ঘটনা বলার জন্যে।’
মিসেস ফাতেমা হিরেন নড়ে-চড়ে বসল। তারপর শুরু করল। তার কণ্ঠ শুকনো এবং ভারী। বলল, ‘আমি আমার গাড়ি পার্ক করে জাতিসংঘের ইউরোপীয় সদর দপ্তরে প্রবেশের সময় কার পার্কের দিকে তাকিয়ে দেখলাম, জনাব আহমদ মুসা আমার গাড়ির দুই ‘রো’ পেছনে তার গাড়ি পার্ক করছেন। দু’ঘণ্টা পর আমি ফিরে এসে দেখলাম আমার গাড়ি খোলা, এমনকি দরজাটা পর্যন্ত বন্ধ করা নয়। আমি আতংকিত হয়ে তাকালাম জনাব আহমদ মুসার গাড়ির দিকে। দেখলাম তার গাড়ি নেই। আমি ছুটে গেলাম সেখানে। দেখলাম তার হাতের রুমালটি মাটিতে পড়ে আছে। আমি জাতিসংঘ অফিসের গেটে এসে আধ ঘণ্টা অপেক্ষা করলাম। তারপর ফিরে এসেছি। ভয়ে আমি আমার গাড়ির কাছে আর যাইনি।’
থামল ফাতেমা হিরেন।
ফাতেমা হিরেন থামতেই মিঃ গটেফ বলল, ‘আমরা পরদিন গিয়ে গাড়িটি নিয়ে এসেছি। কিন্তু আজ এই সকাল দশটা পর্যন্ত আহমদ মুসার কোন খোঁজ নেই।’
‘তিনি টেলিফোনও করেন নি? উদ্বেগের ব্যাপার!’ বলল FWTV-এর চেয়ারম্যান বাকের জারমিস।
‘তার মত বিবেচক লোকের জন্য এটা অসম্ভব।’ বলল WNA-এর চীফ এডিটর হাসান আলবার্তো।
‘তাহলে? বলল কামাল কনরাড, FWTV-এর চীফ এডিটর।
‘তিনি কি শত্রুর কবলে পরেছেন বলে আমরা মনে করব? বলল WNA-এর প্রধান প্রশাসক।
তার কথা শেষ হল। কিন্তু কেউ কথা বলল না। কান্নার চেয়েও করুন সকলের মুখের অবস্থা। কিছুক্ষণ নীরবতা।
নীরবতা ভাঙল বাকের জারমিস। বলল, ‘বুঝতে পারছিনা আমরা কি করব? আমাদের জন্যে কি করব বা তার জন্যে কি করতে পারি?’
জবাব কারও কাছেই ছিল না। নীরব সবাই।
মিঃ গটেফ-এর পি,এ প্রবেশ করল ঘরে। গটেফকে বলল, ‘স্যার ফ্রান্স থেকে একজন মহিলা এসেছেন। আপনার সাথে দেখা করতে চান।’
‘ফ্রান্স থেকে? কি চায়?’
‘দেখা করতে চায়।’
‘কোন ব্যাপারে জিজ্ঞেস করনি?’
‘আমাকে বলবে না।’
মিঃ গটেফ মনে মনে ভয় পেল। ব্ল্যাক ক্রস-এর হেডকোয়ার্টার তো ফ্রান্সে। কোন ফ্যাসাদ আবার এল। আহমদ মুসার অনুপুস্থিতিতে কেউ কোন ফাঁদ পাততে এল না তো?
এসব চিন্তা করে গটেফ WNA-এর প্রধান প্রশাসকের দিকে চেয়ে বলল, ‘আমি পারছিনা। তুমি শুনে এস চার্লস।’
‘ইয়েস স্যার।’ বলে চার্লস চলে গেল।
ফিরে এল মিনিট তিনেক পর।
‘চলে গেলেন মহিলা?’
‘না, জনাব।’
‘তাহলে?’ মুখ কাল করে বলল মিঃ গটেফ।
‘সে আপনার সাথে কথা বলতে চায়।’
‘বলনি যে, আমি মিটিং-এ আছি।এখন দেখা করা সম্ভব নয়।’
‘বলেছি। বললেন, তাঁকে এখানে আসার অনুমতি দিতে।’
‘তুমি কি বলেছ?’
‘কোন মেহমানের ভেতরে আসার অনুমতি নেই। তিনি বলেছেন, জানি আপনাদের খারাপ দিন চলছে। আপনাদের কোন মহিলা আমাকে সার্চ করতে পারেন।’
‘তাঁর পরিচয় কি?’
‘তিনি নিজেকে মুসলিম বলে পরিচয় দিয়েছেন।’
‘প্রয়োজনীয় সার্চ করে আমি তাঁকে ভেতরে আনতে পারি।’ বলল মিসেস ফাতেমা হিরেন।
‘কিন্তু একটা জিনিস ভাববার আছে। মহিলা এসেছেন ফ্রান্স থেকে। আর ব্ল্যাক ক্রস-এর হেড কোয়ার্টারও ফ্রান্সে।’
‘তা ঠিক। কিন্তু ফ্রান্সেই তো আহমদ মুসা ব্ল্যাক ক্রস-এর বিরুদ্ধে অনেকের সাহায্য পেয়েছিলেন।’ বলল হাসান আলবার্তো।
‘মহিলা মুসলিম বলে তো পরিচয় দিলেন। পোশাক কেমন ওঁর?’ বলল মিঃ গটেফ।
‘ভাল মুসলিমের মত পোশাক।’ বলল চার্লস।
‘মহিলা তো, আমার মনে হয় এখানে ডাকা যায়। নিশ্চয় জরুরী কোন ব্যাপার আছে ওঁর।’ বলল জারমিস।
‘ঠিক আছে। মিস ফাতেমা হিরেন যান। তাঁকে দেখে-শুনে নিয়ে আসুন।’ বলল মিঃ গটেফ।
ফাতেমা হিরেন উঠল। মিনিট পাঁচেক পরে মিসেস ফাতেমা হিরেন মহিলাটিকে সাথে নিয়ে মিটিং রুমে ফেরত এল।
মহিলা আসলে একজন তরুণী।
বসল টেবিলে ফাতেমা হিরেনের পাশেই।
মিঃ গটেফ তাকে স্বাগত জানিয়ে নিজের ও অন্যদের পরিচয় দিয়ে বলল, ‘আমরা একটা জরুরী মিটিং-এ আছি। বলুন, আমরা আপনার কি সাহায্য করতে পারি?’
তরুণীটি ঘরে ঢুকেই আগে সালাম দিয়েছিল। মিঃ গটেফ থামলে সে বলল, ‘আপনারা একটা বিপজ্জনক সময় অতিক্রম করছেন। আমাকে কথা বলার সুযোগ দিয়েছেন এ জন্য আপনাদের ধন্যবাদ।’
একটু থামল তরুণীটি। তারপর বলল, ‘ আহমদ মুসা এখানে এসেছেন। আমি তাঁর খোঁজ নিতে এসেছি। তিনি কোথায় আছেন, কেমন আছেন জানালে বাধিত হবো।’
তরুণীটির কথার উত্তর কেউ দিল না। সবাই নীরব। তাদের চোখে-মুখে বিস্ময় ও সন্দেহ দুইই। এ ফরাসী তরুণী আহমদ মুসার কথা জিজ্ঞেস করছে কেন? আহমদ মুসার নিখোঁজ হওয়ার সাথে ওঁর আসার কি কোন সম্পর্ক আছে? আহমদ মুসাকে সরাবার পর কোন ফাঁদ পাততে এসেছে কি এই তরুণী?
নীরবতা ভেঙ্গে প্রথম কথা বলল গটেফ। বলল, ‘ আপনার পরিচয় কি? তাঁর কথা আমাদের জিজ্ঞেস করছেন কেন? তিনি এখানে এসেছেন একথা আপনি বলছেন কি করে?’
‘আমি মারিয়া জোসেফাইন লুই। ডোনা জোসেফাইন বলেও আমাকে ডাকা হয়। আহমদ ফ্রান্সে থাকার সময় তাঁর সাথে আমার পরিচয়। আমি ঐ সময় ইসলাম গ্রহণ করি। আমি ক্যামেরুনেও ছিলাম। আমি ক্যামেরুন থেকে চলে এসেছি ফ্রান্সে, আর তিনি মধ্য আফ্রিকা প্রজাতন্ত্র থেকে এসেছেন সুইজারল্যান্ড। আমি জেনেভায় আসব উনি জানেন।’ বলল ডোনা নামের তরুণীটি।
ডোনা আজই তার আব্বার সাথে প্যারিস থেকে জেনেভা এসে পৌঁছেছে। উঠেছে একটা অভিজাত টুরিস্ট কটেজে। তার আব্বার বিশ্রাম নিচ্ছেন, সেই সুযোগে ডোনা এসেছে WNA অফিসে আহমদ মুসার খোঁজ নেয়ার জন্য। সে জানত আতংকজনক ঘটনাগুলোর পর WNA এবং FWTV এর অফিসে খুব সতর্কতা থাকবে। কিন্তু সতর্কতাটা এই পরিমাণে থাকবে তা সে ধারণা করেনি।
আবার নীরবতা।
তরুণীটির কথা বিশ্বাস করবে, না অবিশ্বাস করবে, এই দ্বিধাদ্বন্দ্ব সবার মধ্যে।
এবার নীরবতা ভাঙল মিসেস ফাতেমা হিরেন। বলল, ‘ মাফ করবেন। আমি জানতে চাচ্ছি তাঁর সাথে আপনার সম্পর্ক কি? আপনি ক্যামেরুন গিয়েছিলেন কেন?’
‘আমি জেনেভায় যেভাবে এসেছি, সেভাবেই ক্যামেরুনে গিয়েছিলাম। সম্পর্ক সম্পর্কে আমি কি বলব?’ বলে তরুণীটি একটু থামল। তারপর বলল, ‘আমি তাকে চিনি, তিনি আমাকে চেনেন, আপাতত এটুকু জানা কি যথেষ্ট হয় না?’
‘মাফ করবেন। আমরা যদি ‘আপনাকে কোন সাহায্য করতে পারব না’ বলে দুঃখ প্রকাশ করি।’ বলল হাসান আলবার্তো।
‘আমি কিছুই মনে করব না। একজন অপরিচিতকে এই কথা বলাই আপনাদের জন্য স্বাভাবিক। তবে আমার একটা অনুরোধ, আমি একটা টেলিফোন নাম্বার রেখে যাচ্ছি। তিনি ভাল থাকলে আমাকে কিছু জানাবার দরকার নেই, কোন অসুবিধায় যদি তিনি পড়েন, তাহলে এই টেলিফোনে আমাকে জানাবেন।’
বলে একটা টেলিফোন নাম্বার লিখে ফাতেমা হিরেনকে দিয়ে ডোনা উঠে দাঁড়াল।
মিঃ গটেফ এবং অন্যান্যরা একে অন্যের মুখ চাওয়া –চাওয়ি করল।
এতক্ষণে মিঃ গটেফের মুখের উপর আসন গেড়ে বসা সন্দেহের ছায়া কিছু ম্লান হলো। ভাবল, তরুণীটি আহমদ মুসার অবশ্যই কোন শুভাকাঙ্ক্ষী। এই চিন্তার সাথে সাথেই সে শশব্যাস্তে বলল, ‘ আপনি আহমদ মুসার শুভাকাঙ্ক্ষী হলে আপনাকে একটা খবর না দেয়া অন্যায় হবে।’
‘কি খবর?’ ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল ডোনা।
‘আমরা দুঃখের সাথে জানাচ্ছি যে আহমদ মুসা গতকাল থেকে নিখোঁজ।’ বলল মিঃ গটেফ।
‘নিখোঁজ? গতকাল থেকে?’ বলে চেয়ার আবার বসে পড়ল ডোনা। হঠাৎ তার দেহ যেন গভীর এক অবসন্নতায় ছেয়ে গেল।
অনেকক্ষণ কথা বলতে পারল না ডোনা।
পরে ডোনা শুনল সব কথা মিসেস ফাতেমা হিরেনের কাছ থেকে। সব শুনে ডোনা বলল, ‘ আমার বিশ্বাস তিনি শত্রুর হাতে বন্দী হয়েছেন। শত্রুরা এসেছিল মিসেস ফাতেমা হিরেনের গাড়িতে ফাঁদ পাততে। আহমদ মুসার চোখে তারা ধরা পড়ে যায়। তারা তাড়াহুড়ো করা পালায়। আহমদ মুসাও তাড়াহুড়ো করে তাদের অনুসরণ করে এবং সম্ভবত তা করতে গিয়ে আহমদ মুসা তাদের হাতে বন্দী হয়ে যায়।’ শুকনো ও ভারি কণ্ঠস্বর ডোনার।
‘আপনি কেন এতটা নিশ্চিত যে, আহমদ মুসা শত্রুর হাতে ধরা পড়েছেন?’ বলল মিঃ গটেফ।
‘আহমদ মুসা মুক্ত থাকলে হয় চলে আসতেন, না আসতে পারলে টেলিফোন করতেন।’ বলল ডোনা।
‘টেলিফোন নাও তো পেতে পারেন সেখানে?’
‘এই যুক্তি সত্য হলে সেটা খুশির কথাই হবে। তবে খারাপটাই চিন্তা করা ভাল।’ বলল ডোনা।
‘ঠিক, খারাপটা চিন্তা করেই আমাদের কিছু করা দরকার।’ বলল মিঃ জারমিস।
‘আমার মনে হয় ব্যাপারটা পুলিশকে জানানো দরকার।’ বলল গটেফ।
‘কি জানাবেন পুলিশকে?’ বলল ডোনা।
‘আহমদ মুসাকে কিডন্যাপ-এর কথা। অন্তত এটুকু।’ বলল গটেফ।
‘না, এটা পুলিশ কে জানানো যাবেনা। এমনকি আহমদ মুসা সুইজারল্যান্ডে এ বিষয়টাও পুলিশ জানতে পারলে নতুন সমস্যার সৃষ্টি হবে।’
‘কি সমস্যা সৃষ্টি হবে?’ বলল মিসেস ফাতেমা হিরেন।
‘তখন একই সাথে ব্ল্যাক ক্রস এবং পুলিশের সাথে লড়তে হবে।’ বলল ডোনা।
‘কেন?’ বলল ফাতেমা হিরেন।
‘আহমদ মুসার দাম কোটি কোটি ডলার। পুলিশ গোপনে তাকে তার শত্রুর হাতে তুলে দিয়ে এ অর্থ উপার্জনের চিন্তা করতে পারে। তাছাড়া পুলিশের মাঝে বিভিন্ন এজেন্সির আজ্ঞাবহ লোকও আছে। তারাও জেনে ফেলবে।’
সবাই স্তম্ভিত হয়ে ডোনার কথা শুনছিল। তারা যেন ডোনার মধ্যে আহমদ মুসারই কণ্ঠ শুনছিল। তারা লজ্জা অনুভব করল। মনে মনে বলল, তরুণী হলেও বুদ্ধিতে পরিপক্ক। আর আহমদ মুসার সাথে পরিচিত হবার এবং তাকে খোঁজ করবার মত যোগ্যতার অধিকারী সে নিঃসন্দেহে।
‘ম্যাডাম, আপনার পরামর্শের জন্য ধন্যবাদ। কিন্তু আমরা কি করব, কি করণীয় বুঝতে পারছি না। যে কাজ পুলিশের সে কাজ আমরা কিভাবে করব?’ বলল মিঃ গটেফ।
ডোনা তৎক্ষণাৎ কোন উত্তর দিল না। মুখ নিচু করে চিন্তা করল কিছুক্ষণ। তারপর ধীরে ধীরে বলল, ‘ কারা এটা করেছে জানলেও তাদের কোন স্থান-ঠিকানা আমাদের জানা নেই। এই অবস্থায় আল্লাহর উপর ভরসা করে অপেক্ষা করা ছাড়া কোন পথ নেই।’
‘কারা এটা করেছে জানেন?’ বলল ফাতেমা হিরেন।
‘অবশ্যই জানি। ব্ল্যাক ক্রস করেছে।’
‘ব্ল্যাক ক্রস-কে আপনি জানেন?’ বলল আবার ফাতেমা হিরেন।
‘জানি।’
‘তাহলে যেটুকু পরিচয় আপনি দিয়েছেন, সেটুকু আপনার সব পরিচয় নয় বলে আমার মনে হয়।’ বলল হাসান আলবার্তো।
‘সেটা বড় কথা নয়। কিছু বাকী থাকলে ওঁর কাছেও শুনতে পারবেন। আমি এখন উঠতে চাই।’ বলল ডোনা।
ডোনা ওদের সামনে স্বাভাবিক থাকলেও ভেতরটা তার কাঁপছে। সে জানে, ব্ল্যাক ক্রস আহমদ মুসার বিরুদ্ধে ক্ষ্যাপা কুকুরের মত হয়ে রয়েছে। আহমদ মুসা তাদের হাতে পড়ার ব্যাপারটা চিন্তাও করা যায় না।
‘ঠিক আছে। একটা কথা ম্যাডাম। আপনি অনেক কিছু জানেন বলেই বলছি। আমরা আহমদ মুসার ব্যাপারটা পুলিশকে জানালাম না। কিন্তু আমরা সিসি মাছির ব্যাপারটা পুলিশকে জানাব কিনা? আহমদ মুসা থাকতে আমরা জানাইনি, তিনি নিষেধ করেছিলেন এবং আমরাও তার সাথে একমত ছিলাম। কিন্তু এখন তিনি নেই, আমাদের নিরাপত্তার জন্যে পুলিশকে সব জানানো দরকার কিনা?
‘আমি বলেছি, আল্লাহর উপর ভরসা করে ধৈর্যের সাথে অপেক্ষা করা দরকার। সবচেয়ে খারাপ অবস্থার জন্যে প্রস্তুত থাকা উচিত, কিন্তু হতাশ হওয়া ঠিক হবে না। আমাদের মনে রাখতে হবে, তিনি আহমদ মুসা। এ ধরণের ঘটনা তার জীবনে অসংখ্যবার ঘটেছে। যে পরিস্থিতির উত্তরণ আমাদের কাছে অসম্ভব, সেটা তাঁর কাছে খুবই সহজ।’ বলল ডোনা।
কথাগুলো বলতে পেরে খুশী হলো ডোনা। কথাগুলো তার নিজেকেই সান্ত্বনা দিল বেশী। মন অনেক সাহস পেল তার।
সকলের মুগ্ধ দৃষ্টি ডোনার দিকে।
কথা বলতে যেন ভুলে গিয়েছিল তারা।
নীরবতা ভাঙল মিঃ গটেফ। বলল, ‘ধন্যবাদ আপনাকে। এই কথাগুলো বলার জন্যেই আল্লাহ আপনাকে আমাদের কাছে পাঠিয়েছেন। আমরা কৃতজ্ঞ। আমরা কি টেলিফোনে আপনার সাথে যোগাযোগ করতে পারি? আমি নিশ্চিত, আপনার পরামর্শের আমাদের দরকার হবে।’
‘মোস্ট ওয়েলকাম। আমি খুশী হবো। আমিও যোগাযোগ করব।’ বলে সালাম দিয়ে যাবার জন্যে পা বাড়িয়েও আবার ঘুরে দাঁড়াল ডোনা। বলল, ‘আপনারা জেনেভার হাসপাতাল-ক্লিনিকগুলোতে খোঁজ নিতে পারেন। আমিও নেব। আমার মনে হয় তিনটি অবস্থা হতে পারে। এক, তিনি শত্রুর হাতে পড়েছেন, দুই, তিনি আহত হয়ে কোন হাসপাতাল বা ক্লিনিকে থাকতে পারেন এবং তিন, তিনি জেনেভার বাইরে চলে গেছেন শত্রুকে অনুসরণ করে। দ্বিতীয় অবস্থা আমাদের আয়ত্বে এখন, এই চেষ্টা আমরা করতে পারি।’ থামল ডোনা।
‘আল্লাহ আমাদের মঙ্গল করুন। আপনি ঠিকই বলেছেন। আমরা অনুসন্ধান এখনি শুরু করছি।’
ডোনা ঘুরে দাঁড়িয়ে চলা শুরু করল।
এগিয়ে দেয়ার জন্যে মিসেস ফাতেমা হিরেনও উঠে দাঁড়াল।
ঘর থেকে বেরিয়ে পাশাপাশি হাঁটতে শুরু করল দু’জন।
‘আপনার সাথে পরিচিত হয়ে খুশী হলাম।’ বলল ডোনা।
‘আর আপনার সাথে পরিচিত হতে পেরে আমার গর্ব হচ্ছে। অল্প কয়েক মিনিট আপনার কথা শুনলাম। কিন্তু মনে হচ্ছে কতদিনের পরিচয়। আমার সবচেয়ে অবাক লাগছে, আহমদ মুসা যেমন স্বতন্ত্র, তেমনি মনে হচ্ছে আপনাকেও। একটা কথা জিজ্ঞেস করতে পারি? আপনি আহমদ মুসার আত্মীয় নন, আপনি ফরাসী হওয়াই তার প্রমাণ। তাহলে আহমদ মুসার সাথে সম্পর্ক কি?’
‘মিসেস ফাতেমা হিরেন আপনি সাংবাদিক। বলুন কারা আত্মীয় হতে পারে? কোন ইউরোপীয় কি কোন এশিয়ানের আত্মীয় হতে পারে না?’ হৃদয়ের এবং আত্মার একান্ত যে সেই তো আত্মীয়।’ ঠোঁটে হাসি টেনে বলল ডোনা।
‘অভিনন্দন জানাচ্ছি আপনাকে ম্যাডাম। আমি এটাই জানতে চাচ্ছিলাম।’
‘মোস্ট ওয়েলকাম।’ বলল ডোনা। তারা রিসেপশনের দরজায় এসে গেছে।
ডোনা হাত বাড়াল বিদায়ী হ্যান্ডশেকের জন্যে।
ফাতেমা হিরেন ডোনার হাত চেপে ধরে বলল, ‘আমার খুব সাহস লাগছে। আসল লোক এসেছেন, তার সাথে তার রাইট হ্যান্ডও।’
‘কাকে রাইটহ্যান্ড বলছেন? আমাকে?’
‘অবশ্যই।’
‘না, আমি ওঁর কোন হ্যান্ডই নই। আমি অনাহুত এখানে এসেছি।’
‘কেন, আপনি এই কাজে ওঁকে সহযোগিতা করেন না?’
‘উনি পছন্দ করেন না।’
‘কেন?’
‘এই রণাঙ্গন মেয়েদের জন্যে নয় বলে।’
‘কেন, মেয়েরা কি সমাজ জীবনের অংশ নয়? এ রণাঙ্গন মেয়েদের জন্যও হবে না কেন? আপনি তার সাথে একমত?’
হাসল ডোনা। বলল, ‘ঠিক নীতি হিসেবে তিনি একথা বলেননি। তবে নিজের ক্ষেত্রে এটা তিনি অপছন্দ করেন।’
‘অর্থাৎ তিনি চান না আপনি এ সবের সাথে জড়িত হন।’
‘আমাকে নির্দিষ্ট করছেন কেন? অন্য কেউও হতে পারেন।’ সলজ্জ হেসে বলল ডোনা।
‘তাঁর আরও ‘অন্য কেউ’ আছে নাকি?’ মুখ টিপে হেসে বলল ফাতেমা হিরেন।
‘আমি তা বলিনি। আমি না হয়ে অন্য কেউও হতে পারেন।’
‘ধন্যবাদ। ঐ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আপনার মত বলুন। আপনার মতের মূল্য অনেক।’
‘লজ্জা দেবেন না। আমি খুবই সামান্য কেউ। মূল্য রয়েছে আপনাদের মতের। আপনারা দেশের জন্যে জাতির জন্যে ঝুঁকি নিয়ে কাজ করছেন।’
‘একটা কথা জিজ্ঞেস করতে ভুলে গিয়েছিলাম। আপনার নামের শেষে ‘লুই’ কেন? আমি যতদূর জানি ‘লুই’ রাজপরিবার ছাড়া এ শব্দ কেউ তাদের নামে ব্যবহার করে না।’
ডোনা মুহূর্তকাল চুপ করে থাকার পর গম্ভীর কণ্ঠে বলল, ‘অতীতের কংকাল সে পরিবারেরই একজন আমি।’
ফাতেমা হিরেন চমকিত হয়ে পূর্ণ চোখে তাকাল ডোনার দিকে।
মুহূর্ত কয় পরে মুখে ফুটে উঠল স্বচ্ছ হাসি। তারপর অভিনয়ের ভংগিতে ডোনাকে ‘বাউ’ করে বলল, ‘সম্মানিতা রাজকুমারী, এতক্ষণে আশ্বস্ত হলাম।’
চোখে-মুখে বিস্ময় টেনে ডোনা বলল, ‘কি আশ্বস্ত হলেন?’
‘আমাদের বিশ্ববিখ্যাত মহামান্য ব্যক্তিকে আল্লাহ যোগ্য সাথী মিলিয়ে দিয়েছেন।’
ডোনা গম্ভীর হলো। তার মুখ-চোখ ভারী হয়ে উঠল। বলল, ‘আপা এভাবে বলবেন না। এ রাজপরিবার ঘৃণ্য ও জননিন্দিত চরিত্রের মানুষকেও জন্ম দিয়েছে। পরীক্ষা আমাকে কোথায় নিক্ষেপ করবে আমি জানি না আপা। আমার জন্যে দোয়া করবেন।’
ফাতেমা হিরেনও গম্ভীর হলো। বলল, ‘আপনার এই উপলব্ধিই আপনার পবিত্র মন ও অপরিমিত যোগ্যতার প্রমাণ।’
থামল ফাতেমা হিরেন। থেমেই আবার শুরু করল, ‘কথাটা কিন্তু হারিয়ে যাচ্ছে। আপনার মতটা বলেননি।’
‘কোন বিষয়ে?’
‘ঐ যে রণাঙ্গনে নারীর অংশ গ্রহণের ব্যাপারটা।’
‘ও আচ্ছা।’ বলে ডোনা একটু চিন্তা করল। তারপর বলল, ‘আমার ব্যক্তিগত মত কি বলব! আমি একজন মেয়ে হিসেবে এ অধিকার চাই। কিন্তু আমাকে যদি বিচারকের আসনে বসিয়ে এ প্রশ্ন জিজ্ঞেস করা হয়, তাহলে আমি বলব এই অধিকার এইভাবে মেয়েদের পাওয়া উচিত নয়।’
‘কেন? কেন?’
‘নারী হিসেবে এমন কিছু দুর্বলতা ও অসুবিধা মেয়েদের রয়েছে এবং শত্রুর হাতে পড়লে এমন কিছু অবাঞ্ছিত ফল তার উপর চেপে বসতে পারে, যা তার এবং তার বৃহত্তর পারিবারিক জীবনে বিপর্যয় সৃষ্টি করতে পারে। এই অসুবিধা পুরুষের নেই।’
ফাতেমা হিরেন সংগে সংগে জবাব দিল না। তার বিস্ময় দৃষ্টি ডোনার উপর নিবদ্ধ।
কয়েক মুহূর্ত পর সে বলল, ‘ধন্যবাদ আপনাকে ম্যাডাম। বিষয়টাকে এভাবে আমি কোনদিন চিন্তা করিনি। আপনার এ রায়ের সাথে আমি একমত। এদিক দিয়ে পুরুষ ও নারীর অবাধ মেলামেশার যৌথ কর্মক্ষেত্রও অবাঞ্ছিত।’
‘আপনাদের মিটিং চলছে। আপনার অনেক সময় নিলাম। আমি এখন আসি।’ আবার হ্যান্ডশেকের জন্যে হাত বাড়িয়ে বলল ডোনা।
ফাতেমা হিরেন হ্যান্ডশেক করে বলল, ‘একদিন বাসায় দাওয়াত করার কি সাহস করতে পারি?’
‘দাওয়াত কেন? নেম কার্ড তো নিয়েছি। একদিন বাসায় গিয়ে হাজির হবো দেখবেন।’
‘মোস্ট ওয়েলকাম।’
ডোনা সালাম দিয়ে বাইরে বেরুবার জন্যে পা বাড়াল।

জেনেভা লেকের পশ্চিম তীরে সুন্দর শহর মোরজে। পটে আঁকা ছবির মত সুন্দর শহরটি।
শহরটির পশ্চিমে মাউন্ট টেন্ডর। পর্বতটির সবুজ উপত্যকায় জেনেভা লেকের আদিগন্ত স্ফটিক জলরাশিকে সামনে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে মোরজে।
মাউন্ট টেন্ডর থেকে তাকালে মনে হয় সবুজ এক বাগান ভাসছে লেক জেনেভার স্বচ্ছ বুকে।
আবার লেক জেনেভার দিগন্ত থেকে শহরটিকে মনে হয় যেন সুন্দর একটা সবুজ তিলক ঘুমিয়ে আছে মাউন্ট টেন্ডর-এর কোলে।
শহরটির উত্তর-পূর্ব প্রান্তে লেকের ধার ঘেঁষে সুন্দর একটি বাড়ি।
বাড়িটি তৈরী হয়েছে লেকের বুক চিরে গড়ে ওঠা একটা মিনি উপদ্বীপের উত্তরে।
বাড়ির তিন দিকেই হ্রদের স্ফটিক পানির নিরন্তর নৃত্য। তীর বরাবর দীর্ঘ ও প্রশস্ত বাগানের একটা সবুজ মেলা। তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে শ্বেত সুন্দর বাড়িটি। মনে হয় যেন একটা রাজহংস সবুজ মালা পড়ে হ্রদের পানিতে ভাসছে।
বাড়িটি সুইজারল্যান্ডের সাবেক কুটনীতিত মিঃ কেলভিনের। এখন তার বয়স সত্তর। দশ বছর আগে রিটায়ার করার পর তিনি এখানেই বসবাস করছেন।
বাড়িটার দু’তলার ড্রইংরুম।
গল্প হচ্ছিল তিনজনের মধ্যে। একজন মহিলা, জিনা ডোনান্ট। তিনি একজন কূটনীতিকের স্ত্রী এবং মিঃ কেলভিনের একমাত্র সন্তান। সয়স পঁয়ত্রিশের কাছাকাছি।
আরেকজন বালিকা, জিনা জোসেফাইন। জিনা ডোনান্টের একমাত্র মেয়ে।
আর তৃতীয়জন তাতিয়ানা। রাশিয়ান মেয়ে। পিটার দি গ্রেট পরিবারের সন্তান সে। মিঃ কেলভিন দীর্ঘদিন মস্কো ছিলেন কুটনীতিক হিসেবে। তার মেয়ে জিনা ডোনান্টের স্বামীও তরুন কুটনীতিক তখন সেখানে। সেই সময় পিটার পরিবারের সাথে কেলভিন পরিবারের গভীর হৃদ্যতা গড়ে ওঠে। তাতিয়ানা সুইজারল্যান্ডে বেড়াতে এসে উঠেছে কেলভিনদের বাড়িতে। কেলভিন পরিবার আগেই তাকে জানিয়েছিল, সে যতদিন সুইজারল্যান্ড থাকবে ততদিন সে তাদের মেহমান হবে।
কথা বলছিল জিনা ডোনান্ট, ‘সত্যিই সিসি মাছির ব্যাপারটা দারুন আতংকের সৃষ্টি করেছে। ৬টি মর্মান্তিক মৃত্যুর রহস্য ভেদ এখনও হয়নি। এই জন্যেই তোমাকে এ সময় আসতে না করেছিলাম।’
‘আপনারা বাস করতে পারছেন, আর আমি ক’দিন থাকতে পারবো না কেন?’ বলল তাতিয়ানা।
‘আমরা বাড়িতে আছি। যাই ঘটুক, আমরা বাড়ি ছাড়তে পারি না, দেশ ছাড়তে পারি না।’ বলল ডোনান্ট।
আমার যুক্তিটা এ রকমই। মৃত্যু ভয় এড়িয়ে চলতে চাইলে গাড়ি-প্লেন কিছুতেই চড়া যাবে না। অপরাধী সন্ত্রাসীদের ভয়ে ঘরের বাইরে বেরুনোও তাহলে বন্ধ করতে হবে।’
‘ঠিকই বলেছ। তবে আমরা এই বয়সে যে ঝুঁকি নিতে পারি, তোমাদের তা নেয়া ঠিক নয়। ‘প্রকৃত’ জীবনটাই তোমার সামনে পড়ে আছে।’ বলে হাসল জিনা ডোনান্ট।
গম্ভীর হয়ে উঠল তাতিয়ানার মুখ। বলল, ‘প্রকৃত জীবন কখন আসবে তার কি নির্দিষ্ট সময় আছে?’
‘অবশ্যই আছে। তুমিও সেটা দেখবে। সে সময় তোমার আসছে।’ ঠোঁটে হাসি টেনে বলল জিনা ডোনান্ট।
একটা ম্লান হাসি তাতিয়ানার ঠোঁটে ফুটে উঠেই আবার মিলিয়ে গেল। ও হাসিটা কান্নার চেয়েও বেদনার। বলল, ‘মনে হচ্ছে আপনি একেবারে নিশ্চিত দেখতে পাচ্ছেন। কিন্তু সবার জীবনেই কি সে সময় আসে?’
‘তা আসে না। অনেকে তো সে সময় পর্যন্ত বাঁচেও না। কিন্তু তুমি এভাবে হতাশার সুরে কথা বলছ কেন?’ বলল জিনা ডোনান্ট।
তাতিয়ানা একটু হাসল। বলল, ‘এইতো আপনি বললেন সবার জীবনে আসে না। তাহলে বিষয়টা সবার জন্যে নিশ্চিত নয়। যা নিশ্চিত নয়, তার মধ্যেই তো একটা হতাশার ভাব থাকে।
জিনা ডোনান্ট তাতিয়ানার দিকে এক দৃষ্টিতে চেয়ে থেকে হেসে উঠে বলল, ‘তুমি ছোট বেলা থেকেই কথার রাজা, তুমি ঠকবে কেন কথায়! তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করব?’
‘করুন।’
‘আমি সে সময় দেখেছি, কিছুটা একাকিত্বকে তুমি যেন ভালবাসো। তোমার কোন বয় ফ্রেন্ড সে সময় আমি দেখিনি। নিশ্চয় তুমি এ অসামাজিকতা এখন ছেড়েছ?’
‘কোন বয় আমার ফ্রেন্ড হতে চাইলেই না এই অসামাজিকতা আমি ছাড়তে পারি।’ হেসে বলল তাতিয়ানা।
‘বাজে কথা বলছ তুমি।’
গম্ভীর হলো তাতিয়ানা। বলল, ‘বাজে কথা বলছি না আপা।’ তাতিয়ানার কন্ঠস্বর ভারি।
তাতিয়ানার গম্ভীর মুখ আর ভারি কন্ঠ নজর এড়াল না জিনা ডোনান্টের। বিস্মিত হলো সে। অবাক হয়ে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকল তাতিয়ানার দিকে। তার মনে হলো তাতিয়ানার গম্ভীর মুখের আড়ালে অনেক অশ্রু লুকিয়ে আছে। তাহলে কোন দুঃখ আছে নাকি তাতিয়ানার জীবনে? জিনা ডোনান্ট উঠে গিয়ে তাতিয়ানার পাশে বসল। বলল, ‘তাতিয়ানা আমার মনে হচ্ছে তুমি কিছু লুকাচ্ছ। কিছু ঘটেনি তো?’
তাতিয়ানা হাসতে চেষ্টা করে বলল, ‘ভাববেন না আপা। খারাপ ঘটনার দু’টো পক্ষ থাকে। কিন্তু আমার কোন অন্য পক্ষ নেই।’
জিনা ডোনান্ট তাতিয়ানার মুখ টেনে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিয়ে বলল, ‘তোমার এসব দার্শনিক কথার মানে কি?’
জিনা ডোনান্ট যখন কথা বলছিল, সে সময়েই টেলিফোন এল।
জিনা ডোনান্টের মেয়ে জিনা জোসেফাইন টেলিফোন ধরেছিল।
জিনা ডোনান্ট থামতেই তার মেয়ে জিনা জোসেফাইন তাকে বলল, ‘আম্মা, নানার টেলিফোন ক্লিনিক থেকে।’
জিনা ডোনান্ট গিয়ে টেলিফোন ধরল।
জিনা ডোনান্ট টেলিফোন ধরে ফিরে এসে বসতেই তাতিয়ানা বলল উদ্বিগ্ন কন্ঠে, ‘আংকল ক্লিনিকে কেন? কি হয়েছে সেখানে?’
‘একজন আহত লোককে আব্বা তার ক্লিনিকে নিয়ে গেছেন।’
‘এ্যাকসিডেন্ট?’
‘না। আব্বা ফেরার সময় শহরের বাইরে হাইওয়েতে লোকটিকে সংজ্ঞাহীন অবস্থায় পেয়েছে। কে বা কারা তাকে নির্দয়ভাবে মেরেছে।’
‘আংকল কি বললেন?’
‘বললেন, লোকটির জ্ঞান ফিরলেই আব্বা বাসায় ফিরবেন।’
‘আংকল কিন্তু আরও বেশী সংবেদনশীল হয়েছেন।’
‘ঠিক বলেছ। তার উপর লোকটি আবার বিদেশী তো।’
‘কোন ট‌্যুরিস্ট?’
‘বোধ হয় না। আব্বা বললেন, ট‌্যুরিস্টদের যেমন অবস্থায় পাওয়া যায়, সে তেমন নয়। তার সাথে কিছুই নেই। তার পাশে একটা মানিব্যাগ পাওয়া গেছে, তাতে অল্প কিছু সুইস মুদ্রা ছাড়া উল্লেখযোগ্য কিছুই পাওয়া যায়নি।’
কথা শেষ করেই জিনা ডোনান্ট উঠে দাঁড়ালো। বলল, ‘তোমরা এস। আমি দেখি টেবিলে খাবার দিতে বলি। আব্বাও এখনি এসে পড়বেন।’
জিনা ডোনান্ট চলে গেল।
পরদিন সকাল।
জিনা জোসেফাইন তার পড়ার ঘরে বসে পড়ছে।
তাতিয়ানা আয়াকে নিয়ে বেবিয়েছে লেকের ধারে ঘুরতে।
ড্রইং রুমে বসে গল্প করছে জিনা ডোনান্ট এবং তার আব্বা মিঃ কেলভিন।
কথা হচ্ছিল আগের রাতের ঘটনাটা নিয়েই।
‘ঘটনাটা কোন ছিনতাই, না কোন ব্যক্তিগত শত্রুতার ব্যাপার?’ বলল জিনা ডোনান্ট।
‘কোন একটা তো নিশ্চয় হবে। তবে চেহারায় ছেলেটাকে আমার ভাল মনে হয়েছে। আমি বিস্মিত হয়েছি, জ্ঞান ফেরার পর ওর মধ্যে সামান্য চাঞ্চল্যও আমি দেখিনি। আমি, নার্স এবং ডাক্তার তখন তার সামনে দাঁড়িয়েছিলাম। সে চোখ খুলে শান্ত চোখে আমাদের দিকে চাইল। যেন বাড়িতে সে ঘুম থেকে উঠল। তার মুখ থেকে প্রথম যে শব্দ বেরুল, সেটা ছিল আমাদের প্রতি তার ‘ধন্যবাদ।’ তারপর ডাক্তার যখন আমার পরিচয় দিয়ে বলল, আমি তাকে ক্লিনিকে নিয়ে গেছি, আমাকে লক্ষ্য করে বলল, ‘আমি কৃতজ্ঞ এক্সিলেন্সি।’ কোন দাঙ্গাবাজ বা সাধারণ চরিত্রের লোকের এমন নিশ্চিন্ত, শান্ত ও ভদ্র আচরণ হতে পারে না।’
টেলিফোন বেজে উঠল।
টেলিফোন ধরল মি কেলভিণ উঠে গিয়ে।
ক্লিনিক থেকে টেলিফোন।
কথা সেরে ফিরে আসতে আসতে বলল, ‘ক্লিনিকে যেত হয়।’
‘কেন লোকটির খারাপ কিছু হয়েছে?’ বলল জিনা ডোনাল্ট।
‘না খারাপ কিছু নয়। আহত ছেলেটা চলে যেতে চায়। অথচ বলেছে এ সময় তার সামান্য হাটাও নিরাপদ নয়।’
‘আপনি কি করতে চাচ্ছেন আব্বা?’
‘ক্লিনিকে যাওয়া উচিত ভাবছি। তুমিও যেতে পার আমার সাথে।’
‘ঠিক আছে আব্বা,চল ঘুরে আসি’
হাসপাতালে পৌঁছে তারা সোজা কেবিনে চলে গেল।
কেবিনে প্রবেশ করল মিঃ কেলভিন প্রথমে। তার পেছনে পেছনে জিনা ডোনাল্ট।
আহত লোকটির উপর চোখ পড়তেই জিনা ডোনান্ট ভূত দেখার মত চমকে উঠল।
আহত লোকটি আহমদ মুসা। যাকে মিসেস জিনা ডোনান্ট আব্দুল্লাহ বলে জানে। মিঃ কেলভিন সেদিন আহমদ মুসাকে সংগাহীন অবস্থায় হাইওয়ে থেকে তুলে ক্লিনিকে ভর্তি করেছিল।
পায়ের শব্দে চোখ খুলেছিল আহমদ মুসা।
তারও চোখ পড়েছিল জিনা ডোনান্টের উপর।
‘আপনি?’ বিস্ময়ের এক বিস্ফোরণ ঘটেছিল জিনা ডোনান্টের কন্ঠে।
জিনা ডোনান্টের কথায় বিস্মিত হয়ে মিঃ কেলভিন তাকাল একবার জিনা ডোনান্টের দিকে, আর একবার আহমদ মুসার দিকে।
তারপ্র বলল, ‘জিনা মা, তুমি একে চেন?’
‘জি আব্বা,প্লেন হাইজ্যাক চেষ্টার কাহিনী তুমি পড়েছ, আমিও তোমাকে বলেছি। ইনিই হাইজ্যাকারদের একজনকে হত্যা, আরেকজনকে কাবু করে প্লেন রক্ষা করেছিলেন।’
‘হ্যা। এ সেই ইয়ংম্যান?’
বলে মিঃ কেলভিন আহমদ মুসার দিকে এগিয়ে তার ডান হাত তুলে নিয়ে চেপে ধরে বলল,’ ব্রাভো, ইয়ংম্যান। কংগ্রাচুলেশন। আমার মেয়ে জিনার কাছে, আমার নাতনী জোসেফাইনের কাছে তোমার কথা, সেদিনের বিস্তারিত ঘটনা শুনেছি।তোমাকে ধন্যবাদ।’
জিনা ডোনান্টও এগিয়ে এল। বলল,’ কিন্তু সেদিন বিমানবন্দরে নেমে আপনি কোথায় হাওয়া হয়ে গিয়েছিলেন। জানেন, ইয়ারলাইন্স কতৃপক্ষ এবং আন্তর্জতিক বিমান পরিবহন সমিতি আপনাকে অনেক খুঁজেছে। আপনার জন্য একটা বড় পুরষ্কার বরাদ্দ করেছে। আপনি নিয়েছেন সে পুরষ্কার ?
আহমদ মুসা ম্লান হাসল। বলল,’ না, পুরষ্কার আমি নেইনি।‘
‘পত্রিকায় পড়েননি?’
‘পড়েছি।’
‘তাহলে?’
‘সেদিনই পুরষ্কার আমি পেয়ে গেছি। মানুষের আশীর্বাদই আমার পুরষ্কার’
‘তা বটে। কিন্তু তুমি এক বিস্ময়কর ছেলে তো। আজকের জমানায় এমন করে কেউ ভাবে?’
বলে এক্ টু থেমেই মিঃ কেলভিন আবার বলল,’ থাক, এসব কথা পরে হবে। এখন বল, তুমি ক্লিনিক ছাড়তে চাচ্ছ কেন?উঠে দাঁড়াবার মত সামর্থ তোমার হয়নি।ডাক্তার বলেছে।‘
‘একটু কষ্ট হবে। কিন্তু আমার যাওয়া প্রয়োজন।জরুরী কাজ আছে।’
‘কষ্ট হবে মানে? দারুন ক্ষতি হতে পারে। যতই জরুরী কাজ থাক, তার চেয়ে জীবন বড়। এখানে তোমার কে আছে?’
‘ক’জন বন্ধু আছে জেনেভায়।‘
‘তাদের ওখানে উঠেছ?’
‘না, এক ট্যুরিষ্ট কটেজে উঠেছি।‘
‘সেখানে কেউ আছে?’
‘না, সেখানে আমি একাই থাকি।’
‘তাহলে আর চিন্তা কি।এমন তো নয় যে বাড়িতে কোন সমস্যা আছে। সুস্হ হও তারপর যাবে।’
‘আব্বা,তুমি ডাক্তারকে বলে রিলিজ নাও।একে বাসায় নিয়ে যাব। বাসায় ভাল থাকবে। প্রতিদিন ডাক্তার যাবে দেখে আসবে।দরকার হলে নার্স আমরা ডেকে নেব।’
মিঃ কেলভিন উজ্জল চোখে তাকাল মেয়ের দিকে।বলল, ‘ধন্যবাদ মা। একথাটা আমার মনে আসেনি। সেটাই ভাল হবে।আমি ডাক্তারকে বলছি।’
বলে যেতে উদ্যত হলো মিঃ কেলভিন।
‘আমার একটু কথা আছে জনাব।’ হাত তুলে মিঃ কেলভিনকে বাধা দিয়ে বলল আহমদ মুসা।
‘বল।’ বলে দাঁড়াল মিঃ কেলভিন।
‘আমি ক্লিনিকেই থাকতে চাই।’
‘কেন? আমাদের ঝামেলায় ফেলতে চাও না এ জন্যে?’
‘একথা সত্য নয়। আমার অবস্থায় আপনিও কি একথা বলতেন না?’
‘শুনেছি তোমার কথা।’ হেসে কথাটুকু বলে মিঃ কেলভিন তাকাল জিনা ডোনাল্টের দিকে। বলল, ‘মা জিনা তুমি গিয়ে গাড়ির পেছনের সিটটা ঠিক করে নাও। আমি ডাক্তারকে বলে সব ঠিক করছি।’
সংগে সংগেই জিনা ডোনান্ট বেরিয়ে গেল। মিঃ কেলভিনও।
বেলা দশটা।
তাতিয়ানা বাইরে থেকে ফিরে দু’তলায় উঠার জন্যে সিঁড়িতে পা রেখেছিল।
জিনা জোসেফাইন দৌড়ে এসে তাতিয়ানার একটা হাত চেপে ধরে বলল,’ কি মজা আন্টি সেই লোক এসেছে।’
‘কোন লোক?’ জোসেফাইনের পিঠে একটা চাট্রি মেরে চোখ উলটে বলল তাতিয়ানা।
‘কেন গল্প করেছিলাম না, প্লেনে একজন লোক হাইজ্যাকারদের মেরে শেষ করে প্লেনটাকে তাদের হাত থেকে উদ্ধার করেছিল। সেই লোক।’
‘সেই লোক? তাকে কোথায় পাওয়া গেল?’
‘সেই-ই ত আহত লোক, নানু যাকে কাল ক্লিনিকে ভর্তি করেছিল।’
‘তাকে বাসায় আনা হয়েছে?’
‘হ্যাঁ। আম্মা, নানু কিছুক্ষন আগে তাকে নিয়ে এসেছেন’
‘কেন?’
‘খুব ভাল লোক তিনি’
কথা বলতে বলতে তাতিয়ানা এবং জোসেফাইন দু’তলায় ড্রইংরুমে এসে প্রবেশ করল।
ড্রইংরুমে বসেছিল জিনা ডোনান্ট, জোসেফাইনের মা। সে জোসেফাইনের শেষ কথাটা শুনতে পেয়েছিল। বলল,’কার কথা বলছ জোসেফাইন?’
‘আংকলের কথা বলছি আম্মা। খুব ভাল না?’
‘অবশ্যই ভাল মা। ভাল না হলে পরের জন্য কেউ জীবনের ঝুকি নিতে যায়?’
‘কিন্তু আন্টি, সে লোকটির এ দশা হলো কেন?’ বলল তাতিয়ানা।
‘সেই আলোচনাই এতক্ষণ করে এলাম। বেশি কথা বলে না তো, মেপে মেপে কথা বলে। এতটুকু বলল, যারা তাকে হত্যা করতে চেয়েছিল, তারা তার ব্যক্তিগত শত্রু নয়। একজন ক্রিমিনালকে সে তাড়া করতে গিয়ে এই ঘটনা ঘটেছে।’
‘লোকটির নাম কি?’
‘আব্দুল্লাহ’
‘আব্দুল্লাহ?মানে মুসলমান?’
‘হ্যাঁ’
‘আংকল বলছিলেন বিদেশী। কোন দেশী?’
‘এশিয়ান। চেহারায় মনে হয় তুর্কি’
‘শুনলাম উনি চলে যেতে চান, বাসায় আনলেন যে!’
‘সেদিন প্লেনে সে জোসেফাইনের পাশে বসেছিল। আমি জোসেফাইনের অন্যপাশে ছিলাম।সিটে বসার পর থেকেই তার সুন্দর আর সপ্রতিভ ব্যবহার আমার ভাল লেগেছিল। জোসেফাইনের সাথে কথা বলা দেখে মনে হয়েছে সে যেন আমাদের একান্ত কেউ। তার পর দেখলাম তার ভদ্র ও ন্ম্রতার মধ্যে সিংহের শক্তি ও সাহস ও আছে।অদ্ভূত কৌশলে একাই সে হাইজ্যাকারদের কবল থেকে প্লেনের কয়েক’শ মানুষকে রক্ষা করে। অথচ আশ্চর্যের বিষয়, জেনেভা এয়ারপোর্টে নেমে অলক্ষ্যে সে সরে যায়। প্রশংসা ও পুরষ্কার কিছুই সে নেয়নি।এমন একজন লোক দারুন বিপদে পড়েছে। তাকে কি ক্লিনিকে ফেলে রাখা যায়? ডাক্তার ও নার্স প্রতিদিন একবার করে আসবে।’
‘কোথায় রেখেছেন?’
‘দু’তলায় উঠা-নামা করতে কষ্ট হবে চিন্তা করে একতলায় মেহমান খানায় রেখেছি’ ।
‘ঠিকই হয়েছে। লনে হাঁটতে পারবে।’ কিন্তু তাতিয়ানা মনে মনে বলল,’ খুব ভাল হয়েছে ওকে দু’তলায় না তুলে। একজন অপরিচিতের এইভাবে এখানে থাকার কথায় তাতিয়ানা অস্বস্তি বোধ করছিল।’
‘তুমি যাবে তাকে দেখতে?’
‘না। পরে।’ মুখে একথা বললেও মনে মনে সে বলল,’ সে কেন দেখতে যাবে তাকে?’
‘ও, ভুলে গেছি। তুমি দেখতে যাবে কেন? তুমি ত এমনিতেই অসামাজিক। তাঁর মধ্যে এখনতো আবার ছেলেদের সঙ্গকে আগুনের মত ভয় করে। আচ্ছা বলি, এভাবেই তোমার দিন চলবে?’
‘কেন ভালইতো চলছে আন্টি।’
‘ভালই চলছে? তাহলে অমন বাউন্ডেলে হয়েছো কেন? এদেশ থেকে সে দেশে শুধুই ঘুরে বেড়াচ্ছ কেন? বলেছিলাম, তোমাকে সুইজারল্যান্ড থেকে যেতে দিবনা।’
‘এমন শাসনের কণ্ঠ ভালই লাগছে আন্টি।’ বলতে বলতে তাতিয়ানার মুখ গম্ভীর হয়ে উঠল। সেখানে পাতলা বেদনার একটা আস্তরন।
কথা শেষ করেই তাতিয়ানা ছুট দিল তাঁর ঘরের দিকে।
সেদিনই বিকেল।
জিনা ডোনান্ট সেদিনের আনা বাজার ফ্রিজের শেল্পে সাজিয়ে রাখছিল। পাশেই দাঁড়ানো তাতিয়ানাকে বলল, ‘যাও তো এক গ্লাস গরম পানি মেহমানের টেবিলে রেখে চায়ের ট্রলিটা নিয়ে এস। না আপত্তি আছে যেতে?’
‘না আপা যাচ্ছি।’ বলে তাতিয়ানা এক গ্লাস গরম পানি একটা পিরিচের উপর রেখে আরেকটা পিরিচে ঢেকে দু’হাত দিয়ে ধরে নিয়ে চলল অসুস্থ আবদুল্লাহ নামের আহমদ মুসার ঘরের দিকে।
ঘরের দরজা খোলা ছিল।
দরজায় টাঙানো হয়েছিল পর্দা।
পর্দার ফাঁক গলিয়ে ঘরে প্রবেশ করল তাতিয়ানা।
দরজা সোজাই ভেতরে ঘরের ওপ্রান্তে পাতা ছিল আহমদ মুসার খাট। মাথা ছিল দরজার বিপরীত দিকে। চিৎ হয়ে শুয়েছিল সে। চোখ দু’টি বোজা।
ভেতরে ঢুকতেই তাতিয়ানার চোখ গিয়ে পড়ল আহমদ মুসার মুখের উপর।
চোখ পড়তেই প্রচণ্ডভাবে চমকে উঠল তাতিয়ানা।
পরক্ষনেই দেহ-মন অবশকারী এক প্রবাহ খেলে গেল তাঁর গোটা শরীরে।
তাঁর হাত থেকে গ্লাস পড়ে গেল। দু’টি পিরিচ গ্লাস ভেঙ্গে খান খান হয়ে বিরাট শব্দ করল।
শব্দে আহমদ মুসা চোখ খুলেছিল। দেখতে পেল তাতিয়ানাকে। বিস্ময়ের ধাক্কা তাঁর চিন্তাকেও মুহূর্তের জন্য আচ্ছন্ন করে ফেলল।
ওদিকে শব্দ শুনেই রান্না ঘর থেকে ছুটে এলো জিনা ডোনান্ট। এসে দেখল টলে পড়ে যাচ্ছে তাতিয়ানা। মেহমান এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তাতিয়ানার দিকে। তাঁর চখে-মুখে বিস্ময়।
জিনা ডোনান্ট তাতিয়ানাকে ধরে ফেলল। ধীরে ধীরে তাকে নিয়ে বসাল সে।
তাতিয়ানা সংজ্ঞা হারিয়েছে।
আহমদ মুসা উঠতে যাচ্ছিল।
‘মিঃ আবদুল্লাহ আপনি উঠবেন না। পাশের ঘরে নিয়ে যাচ্ছি একে আমি।’
জিনা ডোনান্ট তাতিয়ানাকে পাঁজাকোলা করে নিয়ে গিয়ে শুইয়ে দিল পাশের ঘরে এবং তাঁর সংজ্ঞা ফিরিয়ে আনার প্রচেষ্টায় লেগে গেল।
অল্পক্ষণের মধ্যেই স্ট্রেচার নিয়ে এলো দু’জন আয়া।
ততক্ষনে চোখ মেলেছিল তাতিয়ানা।
‘তোমরা একে এর ঘরে শুইয়ে দাও আমি আসছি।’
তাতিয়ানাকে নিয়ে উপরে উঠার সিঁড়ির দিকে চলল দু’জন আয়া।
তাতিয়ানা একবার চোখ মেলেই চোখ বুজেছে।
জিনা ডোনান্ট আহমদ মুসার ঘরে প্রবেশ করল। গ্লাস ও পিরিচের ভাঙ্গা টুকরোগুলো কুড়িয়ে আবর্জনার বাক্সে ফেলে ফিরে এল আহমদ মুসার কাছে। বলল, ‘আপনি তাতিয়ানাকে চিনেন?’
‘অবশ্যই চিনি। তাতিয়ানা এখানে কেন?’
‘আপনার প্রশ্নের জবাব দেব। কিন্তু আমার উত্তর পাওয়া শেষ হয়নি। কিভাবে তাকে চিনেন?’
‘তাতিয়ানা তাঁর আব্বার সাথে ছিল মধ্য এশিয়ায়।’ বলে আহমদ মুসা সংক্ষেপে তাতিয়ানার কিছু ভুমিকার কথা জানিয়ে বলল, ‘তাতিয়ানাকে চিনব না মানে, সে অবিস্মরণীয়। কিন্তু সে কি অসুস্থ?’
জিনা ডোনান্ট কিছুটা আনমনা হয়ে পড়েছিল আহমদ মুসার কাছে তাতিয়ানার কাহিনি শুনে। আহমদ মুসার প্রশ্নের উত্তরে বলল, ‘সে রকম কিছু নয়। তবু আমি দেখি। ওঁর জ্ঞান ফিরেছে।’
বলে জিনা ডোনান্ট তাড়াতাড়ি বেরিয়ে এল আহমদ মুসার ঘর থেকে।
তাতিয়ানা শুয়েছিল চোখ বুজে।
জিনা ডোনান্ট ধীরে ধীরে তাঁর পাশে এসে বসে তাঁর কপালে হাত রাখল।
ম্লান হাসি ফুটে উঠল তাতিয়ানার ঠোঁটে। তাতিয়ানা তার একটা হাত তুলে তাঁর কপালে রাখা জিনা ডোনান্টের হাতের উপর রেখে বলল, ‘এখন নিশ্চয়ই তুমি প্রশ্ন করবে, ‘ওঁর দরজায় গিয়ে হঠাৎ কি হল আমার? হঠাৎ মাথা ঘুরে গেল কেন?’
‘না তাতিয়ানা, এ প্রশ্ন আমি করব না। আমার বিশ্বাস ভালো কিংবা মন্দ প্রচণ্ড এক মানসিক উত্তেজনায় তুমি সংজ্ঞা হারিয়েছ। এ মানসিক উত্তেজনা কেন?’
‘হঠাৎ মাথা ঘুরে গিয়েছিল?’
‘ঘটনার আগ পর্যন্ত তোমার অবস্থার খবর জানি, মাথা ঘুরাবার মত কোন রোগই তোমার নেই। চেনা লোক দেখেই কি?’
তাতিয়ানা চোখ খুলল। হেসে বলল, ‘আপনি ওঁর সাথে কথা বলেছেন দেখছি।’
‘বলেছি। জেনেছি, তোমরা একে অপরকে চেন। এক সাথে তোমরা কিছু কাজও করেছ।’
‘আর কি বললেন উনি?’
‘বলেছেন, তাতিয়ানাকে শুধু চিনি তাই নয়, তাতিয়ানা অবিস্মরণীয়।’
‘অবিস্মরণীয় অর্থ কি আপা?’
‘যার কোন বিস্মরন নেই।’
‘আর স্মরন অর্থ কি?’
‘মনে রাখা। এসব অর্থ দিয়ে তোমার কি হবে?’
‘মনে রাখা বা ভুলে যাওয়ার ক্ষেত্রটা কি বলত?’
‘যে দুরে থাকে তাকে মানুষ স্মরন রাখে বা ভুলে যায়।’
ম্লান হাসি ফুটে উঠল তাতিয়ানার ঠোঁটে। মনে মনে সে বলল, তাতিয়ানা তাঁর কাছের নয়, মাত্র মনে রাখার মত দুরের কেউ। বুকের গভীরে অসহ্য এক যন্ত্রণা জেগে উঠল তাতিয়ানার।
কোন কথা বলল না তাতিয়ানা।
তাতিয়ানার ম্লান হাসি এবং তাঁর মুখে যন্ত্রণার সুক্ষ প্রকাশ দৃষ্টি এড়াল না জিনা ডোনান্টের।
তাতিয়ানার মুখের দিকে কয়েক মুহূর্ত স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে জিনা ডোনান্ট বলল, ‘একটা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করব?’
‘অবশ্যই। শান্ত কণ্ঠে বলল তাতিয়ানা।
‘বহুদিন পর পরিচিত কাউকে দেখলে আনন্দিত হবার কথা। কিন্তু তুমি সংজ্ঞা হারিয়েছ এবং দেখতে পারছি তুমি মুষড়ে পড়েছ। কেন?’
তাতিয়ানা হাসল।
উঠে বসল। জড়িয়ে ধরল জিনা ডোনান্টকে। বলল, ‘এসব কিছুনা আপা। অনেকদিন পর ওকে দেখে হঠাৎ যেন কি হয়ে গিয়েছিল।’
‘ও এমন কে যে, ‘পিটার দি গ্রেট’দের কন্যা এতটা অভিভুত হয়ে পড়েছিল’!
তাতিয়ানা তাঁর ডান হাতের তর্জনীটা জিনা ডোনান্টের ঠোঁটে চেপে ধরে বলল, ‘ও কথা বলনা আপা, ও কত বড় তা কল্পনারও বাইরে।’
‘উনি অসাধারণ সাহসী, কুশলী এবং অত্যন্ত সু-আচরনের সুন্দর মানুষ। কিন্তু তুমি কি বলছ?’
তাতিয়ানা তাড়াতাড়ি নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, ‘এ প্রসঙ্গ থাক আপা। চল উঠি।’
‘তাতিয়ানা তুমি আমাকে কি মনে করেছ? আমি কি শিশু, আমাকে যা তা দিয়ে বুঝ দিবে? আমাকে বলতে না চাইলে বলো না। আমি শুনার উপযুক্ত না হলে শুনব না। আমাকে বোকা সাজাবার প্রয়োজন নেই।’ বলে জিনা ডোনান্ট অভিমানে মুখ ভার করে চলে যাবার জন্যে উঠে দাড়াতে চাইল।
তাতিয়ানা তাকে জড়িয়ে ধরল। বলল, ‘আপা তোমাকে না বলার কিছু আছে? কিন্তু…?
‘কিন্তু কি?’
‘ব্যাপারটা খুব সাংঘাতিক ধরনের। বলা ঠিক হবে কিনা ভাবছি।’
‘কেন বলা ঠিক হবে না?’
‘ওঁর নিরাপত্তার প্রশ্ন আছে।’
‘ওঁর নিরাপত্তার প্রশ্ন? কে সে?’ চোখ কপালে তুলে প্রশ্ন করল জিনা ডোনান্ট।
‘বলছি। কিন্তু একটা অনুরোধ আপা।’
‘কি?’
‘ওঁর পরিচয় এমনকি আংকেলকেও বলবেনা।’
বিস্ময় দৃষ্টি নিয়ে জিনা ডোনান্ট তাকাল তাতিয়ানার দিকে। বলল, ‘তুমি এমন অনুরোধ করছ কেন? আমি আর আব্বা কি ভিন্ন? তুমি আব্বাকে চেননা?’
‘আমি জানি। তবু অনুরোধ, ওঁর আপত্তি না থাকলে পরে বলবে আপা।’
‘ঠিক আছে তাতিয়ানা তাই হবে।’
তাতিয়ানা আহমদ মুসার পরিচয় দল জিনা ডোনান্টকে।
নাম শুনেই জিনা ডোনান্টের মুখ ‘হা’ হয়ে গেল। জিনা ডোনান্ট কূটনীতিকের কন্যা এবং কূটনীতিকের স্ত্রী। খুব ভালো করেই সে জানে আহমদ মুসাকে।
তাতিয়ানা আহমদ মুসার পরিচয় দিয়ে কথা শেষ করলেও অনেকক্ষণ কথা বলতে পারল না জিনা ডোনান্ট।
‘তাতিয়ানা, আমার স্বপ্ন মনে হচ্ছে। বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করছে না যে, আহমদ মুসা আমাদের বাড়িতে, আমাদের মেহমান?’
একটু থামল জিনা ডোনান্ট। তারপর আবার শুরু করল, ‘তাঁর নিরাপত্তার কথা তুমি ঠিকই বলেছ। নিশ্চয়ই কোন বড় ঘটনা ঘটেছে সুইজারল্যান্ডে। আহমদ মুসা ছোট-খাটো ঘটনায় কোথাও যান না। তাঁর আহত হবার ঘটনা নিশ্চয় কোন বড় ঘটনার অংশ।’
‘ঠিকই বলেছ আপা। আমিও তাই মনে করি।’
‘তুমি কি মনে কর এখানে সে নিরাপদ। ক্লিনিক থেকে তাঁর শত্রুরা এ ঠিকানা জেনে নিতে পারে।’
‘নিরাপদ না হলে উনি আসতেন না, ক্লিনিকে থাকতেন। সবদিক না ভেবে কোন সিদ্ধান্ত তিনি নেন না। তবু তুনি ক্লিনিকে সাবধান করে দাও, তোমাদের ঠিকানা তাঁরা কাউকে যেন না দেয়।’
‘ঠিক আছে। কিন্তু তিনি নিচের তলায় থাকবেন, এটা খারাপ লাগছে। যাই হোক তিনি সন্মানের পাত্র।’
‘কিন্তু আংকেল কি বলবেন?’
‘আব্বারই প্রস্তাব ছিল তাকে দু’তলায় রাখা। আমি জোর দেয়ায় একতলায় রাখা হয়েছে। এখন দেখা-শুনার অসুবিধা হচ্ছে বলে ওকে দু’তলায় নেয়া যায়।’
‘হ্যাঁ এটা হতে পারে আপা।’
সেদিনই রাত দশটা।
গ্লাসে দুধ ঢালতে ঢালতে জিনা ডোনান্ট পাশে দাঁড়ানো তাতিয়ানাকে বলল, ‘দুধ কি আহমদ মুসাকে আমাকেই দিয়ে আসতে হবে, না তুমি যাবে?’
‘না। আমি যাব।’ তাতিয়ানার ঠোঁটে সলজ্জ এক টুকরো হাসি।
‘আবার ফেলে দিবে নাতো?’
হাসল। কথা বলল না তাতিয়ানা।
জিনা ডোনান্ট তাতিয়ানার দিকে মুহূর্তকাল তাকিয়ে থেকে বলল, ‘তোমাকে আমি বুঝতে পারছি না। তোমাকে এমন সংকুচিত, এমন ভেঙ্গে পড়া তো কোন সময় দেখিনি।’
হাসিতে উচ্ছসিত হওয়ার চেষ্টা করে বলল, ‘দাও দুধ।’
বলে দুধের গ্লাস নিয়ে তাতিয়ানা চলল আহমদ মুসার কক্ষের দিকে।
আহমদ মুসাকে বিকেলেই দু’তলায় আনা হয়েছে।
দু’তলার দক্ষিন-পুব দিকের একটা সুন্দর রুম তাকে দেয়া হয়েছে। জানালার ভারি পর্দাটা সরালে শুয়ে থেকেই লেকের আদিগন্ত বুকে চোখ বুলানো যায়।
জ্যোৎস্না প্লাবিত হ্রদের বুকের উপর চোখ মেলে শুয়ে ছিল আহমদ মুসা।
দুধের গ্লাস নিয়ে নিঃশব্দে ঘরে ঢুকল তাতিয়ানা।
চেষ্টা করেও তাঁর বুকের তোলপাড়টা বাঁধা দিয়ে রাখতে পারল না তাতিয়ানা। আহমদ মুসার কাছে এলেই এমন হচ্ছে। তাঁর অবস্থা ডোনান্ট আপারও নজর এড়ায়নি। অথচ সে চেষ্টা করছে তাঁর মনটাকে শত শক্তি দিয়ে বেধে রাখতে। তাতিয়ানা জানে, আহমদ মুসা পর্বতের মত এক অনড় পাথর। তাঁর বুকের উপর দিয়ে অশ্রুর প্রস্রবন গড়াতে পারে। কিন্তু তাঁর হৃদয়ে প্রবেশ করা যাবে না।
আহমদ মুসা তাঁর বিছানায় শুয়ে তাকিয়েছিল লেকের শান্ত রুপালী বুকের দিকে।
তাতিয়ানা দুধের গ্লাস নিয়ে আহমদ মুসার বিছানার পাশে গিয়ে দাঁড়ালো।
ভাবল একবার, ‘দুধ টেবিলে রেখে দেবে কিনা। কিন্তু আবার ভাবল, নিজের দুর্বলতা ঢাকতে সে এই অসৌজন্য দেখাতে পারেনা।
‘দুধ এনেছি।’ অনেক প্রস্তুতি নিয়ে বলল তাতিয়ানা।
একটু এগিয়ে এসে তাতিয়ানার হাত থেকে দুধের গ্লাসটা নিতে নিতে ওঁর দিকে তাকিয়ে হেসে বলল, ‘থ্যাংকস তাতিয়ানা।’
বলে আহমদ মুসা গ্লাস টেবিলে রাখতে যাচ্ছিল।
তাতিয়ানা বাঁধা দিয়ে বলল, ‘না টেবিলে রাখা নয়। ঠাণ্ডা হয়ে যাবে। এখনি খেয়ে নিন।’
‘ঠিক আছে। খেতে যখন হবে, খেয়ে নেয়াই ভালো।’
আহমদ মুসা দুধ খেয়ে গ্লাস টেবিলে রাখতে যাচ্ছিল।
তাতিয়ানা গ্লাস নিয়ে নিল আহমদ মুসার হাত থেকে। বলল, ‘ঠিক এগারোটায় ঔষধ খাবার সময় আসব।’ বলে চলে যাবার জন্যে ঘুরে দাড়াতে গেল তাতিয়ানা।
‘যেওনা তাতিয়ানা। গ্লাস টেবিলে রেখে চেয়ারটায় একটু বস।’
থমকে গিয়ে তাতিয়ানা বলল, ‘আচ্ছা।’
গ্লাস টেবিলে রেখে চেয়ার টেনে না বসে আহমদ মুসার বিছানার এক প্রান্তে জরো-সরো হয়ে মুখ নিচু করে বসল।
‘কেমন আছো তাতিয়ানা? তুমি কি অসুস্থ?’ বলল আহমদ মুসা।
চকিতে একবার আহমদ মুসার দিকে চেয়ে বলল, ‘কেন একথা বলছেন?’
‘তখন হঠাৎ তুমি সংজ্ঞা হারালে। তাছাড়া তোমার কেমন যেন মনমরা ভাব দেখছি। তুমি তো এমন নও।’
হৃদয়ের সেই যন্ত্রণা অনুভব করল তাতিয়ানা। একটা করুন হাসি ফুটে উঠতে চাইল ঠোঁটে। একটা কথা ভেতর থেকে বুক ফুড়ে বের হতে চাইল, ‘মন তো অনেক আগে মারা গেছে। সেই সেন্ট্রাল এশিয়া থেকে বিদায় নেয়ার সময়। ভেতরটাকে কঠোর শাসন করে বলল, ‘আমি দুঃখিত। আপনাকে কোনদিন দেখব ভাবিনি, তাই হঠাৎ কি যেন হয়ে গিয়েছিল। আমাকে মাফ করবেন। আপনি এখন আমার সামনে, তবুও আমার যেন স্বপ্নই মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে অনেক ঘুমের মত ঘুম ভাঙলেই যেন দেখব সব মিথ্যা।’ কাঁপল যেন তাতিয়ানার কণ্ঠ।
একটু থামল। দম নিল একটা। তারপর বলল, ‘আপনি কেমন ছিলেন? এখানে কি ঘটেছে, আপনার এমন হল কেন?’
‘বলব। কিন্তু তাঁর আগে বল, ‘তুমি কোথায় কি করছ?’
ম্লান হাসল তাতিয়ানা। বলল, ‘আমার একাউন্টে আব্বার কিছু টাকা আছে। আব্বার একাউন্টের টাকাও আমি নমিনি হিসাবে পেয়েছি। তাই নিয়ে শুধু ঘুরছি।’
বেদনার একটা খোঁচা লাগল আহমদ মুসার মনে। আহমদ মুসার জন্যেই সে তাঁর আব্বাকে হারিয়েছে, বলতে গেলে স্বজন স্বদেশকে যে পরিত্যাগ করেছে। সর্বহারা হৃদয়কে নিয়ে তাঁর ঘোরা ছাড়া আর উপায় কি!
কোন কথা যোগাল না আহমদ মুসার মুখে। তাতিয়ানার শূন্য দৃষ্টি কি চায়, কিসের সন্ধান করছে আহমদ মুসা জানে। এখানেই নিজেকে অসহায় বোধ করে আহমদ মুসা।
তাতিয়ানাই কথা বলল আবার। বলল, ‘এবার আপনার কথা বলুন। আপনি কেমন ছিলেন?’
‘এই সময়ে আমি ফ্রান্স, ক্যামেরুন, মধ্য আফ্রিকা প্রজাতন্ত্র কঙ্গো ঘুরেছি। মধ্য আফ্রিকা প্রজাতন্ত্র থেকে এসেছি এখানে।’
‘সব জায়গায় বোধ হয় একই কাজ করেছেন’?
‘কি কাজ?’
‘লড়াই।’
‘আমার পেশাই তো ওটা।’
‘হলো না। পেশা নয় মিশন।’
‘পেশা নয় বলছ কেন?’ হেসে বলল আহমদ মুসা।
‘পেশার সাথে বিনিময়ের সম্পর্ক আছে, মিশন মানুষের স্বার্থে নিবেদিত। আপনি যা করছেন, তা কোন কিছুর বিনিময়ে নয়।’
‘ঠিক হলোনা। আমিও বিনিময়ে কাজ করছি।’
‘কেমন?’
‘আমি ‘ফি সাবিলিল্লাহ’ মানে আল্লাহ্‌র জন্যে কাজ করছি। কিন্তু এর বিনিময় আছে। আল্লাহ্‌ বিনিময়ের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।’
‘যেমন?’
‘বেহেশত লাভ।’
‘ও এই বিনিময়ের কথা বলছেন’ হাঁসতে লাগল তাতিয়ানা।
‘একে কেমন মনে করছ তুমি?’
‘এটা বিনিময় হলো? বিনিময় তো হাতে হাতে পেতে হয়। ওটা তো পরকালের কথা।’
‘পরকালের পাওয়াই তো সবচেয়ে বড় পাওয়া। সে পাওয়াটা অক্ষয়। ঐ পাওয়ার প্রতিই আমার লোভ। সুতরাং বলতে পার, বিনিময় ছাড়া আমি কাজ করছি না।’
‘যাক এই প্রসংগ। সুইজারল্যান্ডে আপনার কথা বলুন।’
‘মাফ করবেন। আমি কি ভেতরে আসতে পারি?’ তাতিয়ানার কথা শেষ হবার সাথে সাথেই দরজার পর্দা একটু ফাঁক করে বলল জিনা ডোনান্ট।
‘অবশ্যই, আসুন।’
ঘরে ঢুকল জিনা ডোনান্ট। বলল, দুঃখিত।‘মঁথে’ থেকে তাতিয়ানার টেলিফোন। কথা বলবেন নাতাশা।’
নাতাশা একজন সুইস কূটনীতিকের রাশিয়ান স্ত্রী। সে কূটনীতিকও দীর্ঘদিন ছিলেন মস্কোতে। বিয়েও করেন রাশিয়ায়। নাতাশার পরিবারও পূর্ব থেকেই তাতিয়ানার পরিবারের ঘনিষ্ঠ ছিল। বিয়েও হয় তাঁদের মধ্যতায়।
নাতাশার কথা শুনেই তাতিয়ানা উঠে দাঁড়াল। বলল আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে, ‘অনুমতি দিন।’
‘অবশ্যই।’
তাতিয়ানা চলতে শুরু করে বলল, ‘প্রশ্ন কিন্তু সবই থাকল।’
তাতিয়ানা বেরিয়ে গেলে জিনা ডোনান্ট এগিয়ে এসে টেবিল থেকে দুধের গ্লাস নিয়ে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আপনার বেশিক্ষন বসে না থাকা ভাল।’
‘ধন্যবাদ।’ বলে আহমদ মুসা শুয়ে পড়ল।
জিনা ডোনান্ট চারদিক চেয়ে বলল, সব ঠিক আছে। রাত এগারোটায় ওষুধ খেতে হবে।’
বলে জিনা ডোনান্ট চলে যাবার জন্য পা বাড়াল।
‘ম্যাডাম, আমার একটা অনুরোধ, ডাক্তারকে বলে কাল যাতে যেতে পারি, সে ব্যবস্থা দয়া করে করুন।’
জিনা ডোনান্ট হাসল। বলল, ‘জানি আপনার কাজ আপনার জীবনের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু জীবন না থাকলে কাজ থাকে না।’
আহমদ মুসা একটু বিস্মিত হলেন জিনা ডোনান্টের কথার ধরনে। বলল, ‘আর কিছু জেনেছেন?’
‘প্লেনেই আমি বুজেছিলাম। আপনি সাধারন কেউ নন। পরে প্রশংসা ও পুরস্কার এড়িয়ে যখন আপনি গায়েব হলেন, তখন আবারও মনে হয়ে ছিল আপনি অসাধারণ একজন। কিন্তু আপনি অসাধারনের মধ্যেও যে অনন্য একজন, তা তাতিয়ানার কাছে শোনার পড়েই বুঝলাম। আপনাকে খোশ আমদেদ। আমাদের এই ছোট্ট বাড়িটাকে ‘ঐতিহাসিক’ করার সুযোগ দেয়ার জন্যে আমরা কৃতজ্ঞ।’
‘আহমদ মুসার এ ফেভার পাবার কারন? তাতিয়ানার সৌজন্যে?’
‘আহমদ মুসা ফেভার পাবে না কেন?’
‘সে মুলত মুসলিম জাতির জন্যে কাজ করছে।’
‘মজলুমের পরিচয় মজলুম। যে কোন জাতিই মজলুম হয়ে দাড়াতে পারে, যেমন এখন মুসলমানরা। জাতির নাম তাঁদের যাই হোক তাঁরা মজলুম। এই মজলুমের পক্ষে দাঁড়ানোর অর্থ মানবতার পক্ষে দাঁড়ানো।’
আহমদ মুসা ধীরে ধীরে উঠে বসল। বলল, ‘আপনাকে ধন্যবাদ। অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। পক্ষপাতহীন ও মানবতার পক্ষে এমন রায় পশ্চিমে আমি খুব কম শুনেছি।’
‘ওয়েলকাম। আমার একটা জিজ্ঞাসা আছে।’
‘বলুন।’
‘আজ নয়। অনেক রাত হয়েছে। আপনি শুয়ে পড়ুন।’
বলে জিনা ডোনান্ট ‘আসি’ বলে ঘর থেকে বেরিয়ে এল।
দুই দিন পর।
আহমদ মুসা বসেছিল তাঁর বিছানায়।
তাতিয়ানা বসে ছিল বিছানার এক প্রান্তে। তাঁর চোখ-মুখ ভারি।
জিনা ডোনান্ট ঘরে প্রবেশ করল। বলল, ‘গাড়ি রেডি। কিন্তু আবার বলছি, কমপক্ষে আরও দু’টো দিন আপনার রেস্ট নেয়া প্রয়োজন।’
‘আপনাদের আমি সব বলেছি। যে কোন সময় ‘জীবন-হানি’ ঘটতে পারে ওয়ার্ল্ড নিউজ এজেন্সী অথবা ফ্রি ওয়ার্ল্ড টিভি’র কথা ভাবুন।’
‘দেখুন আপনারা যে বিষয়টাকে গোপন রাখছেন তা ঠিক হচ্ছে না। জাতি-বিদ্বেষ বশত দুটি সংবাদ মাধ্যমকে ধ্বংস করার করার যে প্রচেষ্টা চলছে তা বিশ্ববাসীর জানার অধিকার আছে।’
‘সেটা অবশ্যই জানবে। তবে এখন বললে সেটা প্রমান করা যাবেনা। ওদের হাতে-নাতে ধরিয়ে দিতে হবে। আগে প্রচার করলে সেটা পারা যাবে না।’
‘মানছি যুক্তি। এমন অসম লড়াই কি চলে? সেদিন কি হতো যদি একটা গাড়ি ঐ সময়ে না আসতো।’
‘আল্লাহ-এই ভাবেই অসহায়কে সাহায্য করেন।’
‘দুঃখিত। ভুলেই গিয়েছিলাম আপনি আহমদ মুসা। অসাধারণ বিবেচনায় আপনি পথ চলেন।’
‘দুঃখিত। এটা আমার অহংকার নয়। এটা আমার সাধারন বিবেচনা।’
‘ধন্যবাদ।’ হেসে বলল জিনা ডোনান্ট।
একটু থেমেই আবার বলল, আপনি তাহলে আসুন। আমি ওদিকটা দেখছি।’
বলে জিনা ডোনান্ট বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।
আহমদ মুসা উঠে দাঁড়ালো।
তাতিয়ানাও উঠে দাঁড়ালো। টেবিল থেকে ওষুধের প্যাকেট এবং ব্যবস্থাপত্র নিয়ে আহমদ মুসার ব্যাগে ভরে দিয়ে বলল, ‘ব্যবস্থাপত্র দেখে ওষুধ খাবেন। ওষুধের কোর্স শেষ হলে কোন ক্লিনিকে আবার যেতে হবে আপনাকে।’
‘ধন্যবাদ।’
‘ওষুধের কথা, ব্যবস্থাপত্রের কথা, ডাক্তারের কাছে যাবার কথা মনে থাকবে কিনা?’
‘কোনটারই গ্যারান্টি নেই।’
‘তাহলে আমি জেনেভায় যাব।’
‘জেনেভায় যাবে? ওষুধ আমার ব্যবস্থাপত্রের তদারকি করার জন্যে?’
‘ভয় নেই। আমি ওখানে আংকেলের বাসায় থাকব। আপনার সমস্যা সৃষ্টি করবো না।’
‘ধন্যবাদ তাতিয়ানা। তুমি চিন্তা করো না। যেভাবেই হোক আমার নিজের প্রতি প্রয়োজনীয় নজর আমি রাখি।’
‘সুতরাং কেউ যেন নাক গলাতে না যায় এই তো? এটা এক ধরনের স্বেচ্ছা নির্বাসন। এটা চলতে পারে না।’ গলা কাপছিল তাতিয়ানার।
আহমদ মুসা মুহূর্তের জন্য চোখ বুজল। তাতিয়ানার মনের অবস্থা তাঁর কাছে পরিস্কার। কিন্তু কি বলবে সে তাকে। অতীতের মতই সে বিষয়টাকে এড়িয়ে যেতে চায়। বলল, ‘ভেবনা তাতিয়ানা, সেখানে আমি নির্বাসনে নেই। সেখানে অনেক বন্ধু-বান্ধব আছে আমাকে সাহায্য-সহযোগিতা করার জন্যে।’
‘খুশি হলাম। তবে আপনিও জানেন, বন্ধু-বান্ধবরা ওষুধ খাইয়ে দেবার জন্যে দায়িত্বশীল নয়।’ ভাঙ্গা কণ্ঠস্বর তাতিয়ানার।
আহমদ মুসা কোন উত্তর দিল না।
ম্লান হেসে টেবিলে রাখা তাঁর ব্যাগের দিকে হাত বাড়াল।
তাতিয়ানা তাড়াতাড়ি ব্যাগটা তুলে নিয়ে বলল, ‘গাড়ি পর্যন্ত যদি ব্যাগটা বহন করে নিয়ে যাই, তাহলে এটা বড় রকমের কোন নাক গলানো হবেনা নিশ্চয়?’
বলে তাতিয়ানা ব্যাগ নিয়ে দরজার দিকে পা বাড়িয়ে বলল, ‘চলুন।’
গাড়ি বারান্দায় গিয়ে পৌঁছল আহমদ মুসা এবং তাতিয়ানা।
গাড়ির কাছে দাঁড়িয়েছিল জিনা ডোনান্ট।
একটু দুরে খেলা করছিল জিনা জোসেফাইন।
আহমদ মুসাকে গাড়ির কাছে দেখে ছুটে এল। আহমদ মুসাকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘আংকল আবার কবে আসবেন?’
‘আচ্ছা মা-মনি ভবিষ্যৎ কেউ বলতে পারে?’ তাঁর মাথায় আদরের হাত বুলিয়ে বলল আহমদ মুসা।
‘না, আপনি আসবেন কিনা বলুন। আপনার সেই গল্প বলা শেষ হয়নি।’
‘ঠিক আছে। গল্প তো অসমাপ্ত থাকতে পারেনা। আসতেই হবে তাহলে।’
‘আমি কিন্তু রোজ টেলিফোন করব।’
‘টেলিফোন নাম্বার কোথায় পাবে?’
‘কেন, আন্টির কাছে দেখেছি।’
‘বেশ করো। তবে আমাকে না পেলে গাল দিওনা যেন।’
‘কেন থাকবেন না ঐ টেলিফোনে?’
‘আমার তো নানা কাজ নানা জায়গায় থাকি।’
‘তাহলে ‘সানডে’ তে করব।’
‘আচ্ছা করো।’
তাতিয়ানা আহমদ মুসার ব্যাগ গাড়িতে তুলে দিয়ে গাড়ির দরজা মেলে ধরে বলল, ‘আসুন।’
আহমদ মুসা জিনা জোসেফাইনের কপালে একটা চুমু খেয়ে জিনা ডোনান্টের দিকে চেয়ে বলল, ‘তাহলে আসি। আপনাদের আতিথ্য ও আন্তরিকতার কথা কোন দিনই ভুলতে পারব না।’
‘ধন্যবাদ। আমরা কতটুকু কি করেছি জানি না। কিন্তু আমরা ধন্য বোধ করেছি আপনাকে আমাদের মাঝে পেয়ে। আব্বা টেলিফোন করেছিলেন। তিনি ফিরতে না পেরে দুঃখ করেছেন। তিনি জেনেভায় আপনার সাথে কথা বলবেন।’
‘আমি খুব খুশি হবো। তাকে আমার শ্রদ্ধা দেবেন।’
বলে আহমদ মুসা গুডবাই জানিয়ে গাড়ির দরজার দিকে এগুলো।
তাতিয়ানা দু’হাত দিয়ে দরজা খুলে ধরে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়েছিল। আহমদ মুসা জানে মুখ তোলার শক্তি তাঁর নেই। ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠল আহমদ মুসার। তাতিয়ানাকে সে কি বলবে? আহমদ মুসা তাকে এড়িয়ে চলছে, কোন প্রশ্রয় দিচ্ছে না, বিষয়টা তাতিয়ানাকে বেশী আহত করছে। ডোনার কথা তাকে বলা দরকার। কিন্তু বলতে চেয়েও বলতে পারেনি। কিন্তু বলতে চেয়েও বলতে পারেনি। পিতৃ-মাতৃহীনা, আত্মীয়-স্বজন থেকে একেবারে বিচ্ছিন্ন- বলা যায় সর্বহারা এই মেয়েটিকে এত বড় আঘাত সে কেমন করে দেবে! তাই ইচ্ছে করেও আহমদ মুসা মুখ খুলতে পারেনি।
নতমুখী তাতিয়ানাকে বলার মত কোন কথা আহমদ মুসার মুখেও যোগাল না।
শুধু ‘ধন্যবাদ তাতিয়ানা’ বলে আহমদ মুসা গাড়ির ভেতরে ঢুকে গেল।
তাতিয়ানা গাড়ির দরজা বন্ধ করে দিয়ে জানালায় মুখ এনে বলল, ‘আসসালামু আলাইকুম।’
বলে একটা ঢোক গিলেই আবার বলল, ‘মনে রাখবেন আপনি সুস্থ হননি। কাজ শুরুর আগে আপনার দু’তিন দিন বিশ্রাম প্রয়োজন।’ কন্ঠস্বর গম্ভীর তাতিয়ানার।
‘ধন্যবাদ তাতিয়ানা।’ বলল আহমদ মুসাও গম্ভীর কন্ঠে।
তাতিয়ানা সরে দাঁড়াল জানাল থেকে।
স্টার্ট নিল আহমদ মুসার গাড়ি। চলতে শুরু করল।
গাড়ির দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ পুতুলের মত দাঁড়িয়ে থাকল তাতিয়ানা।
তারপর সে জিনা জোসেফাইনের হাত ধরে ধীরে ধীরে উঠে গেল দু’তলায়।
সিঁড়ির মাথায় গিয়ে জিনা জোসেফাইন বাগানের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘দেখ আন্টি, সেই হলুদ পাখিটা আবার এসেছে। আমি যাই।’ বলে জিনা জোসেফাইন সিঁড়ি দিয়ে আবার ছুটে নিচে নেমে গেল বাগানের দিকে।
তাতিয়ানা অন্য সময় হলে জোসেফাইনের সাথেই ছুটতো বাগানের দিকে। কিন্তু এখন জোসেফাইনের কথা তার কানে গিয়েও যেন গেল না।
তাতিয়ানা তার ঘরে গিয়ে তার বিছানায় এলিয়ে পড়ল। বালিশ মুখ গুঁজল সে। তার মনে হলো, অকুল সমূদ্রে বহু কষ্টে খুঁজে পাওয়া অবলম্বনকে কে যেন নিষ্ঠুর ভাবে ছিনিয়ে নিয়ে গেল। হৃদয়ের সমস্ত চাওয়া দিয়ে যাকে সে জড়িয়ে ধরে বাঁচতে চেয়েছিল, সে নির্দয়ভাবে দূরে সরে গেল।
কান্নার প্রবল এক সাইক্লোন এসে দুমড়ে-মুচড়ে দিল তার বুক। সে সাইক্লোনে উদ্দীপ্ত সাগরের স্রোত এসে আছড়ে পড়ল তার দু’চোখে।
কাঁদছিল তাতিয়ানা।
কান্নার ধাক্কায় ফুলে ফুলে উঠছিল তার দেহ।
জিনা ডোনান্ট ঘরে ঢুকে এ দৃশ্য দেখে বিস্মিত হলো। ক’দিন ধরে যে সন্দেহ সে করছিল, তা সত্য তাহলে! কিন্তু এই ধরনের কান্না কেন? সামান্য বিচ্ছেদে তাতিয়ানার মত মেয়ের জন্যে এ ধরনের কান্না স্বাভাবিক নয়।
জিনা ডোনান্ট ধীরে ধীরে এসে তাতিয়ানার মাথায় হাত রাখল।
তাতিয়ানা মাথা তুলল। জিনা ডোনান্টকে দেখে তাড়াতাড়ি চোখ মুছে কান্না রোধের চেষ্টা করল।
কিন্তু পারল না।
দু’হাতে মুখ ঢেকে আবার কান্নায় ভেঙে পড়ল সে।
জিনা ডোনান্ট তাতিয়ানাকে বুকে টেনে নিল। বলল, ‘যা সন্দেহ করেছিলাম, দেখছি তাই সত্য হলো। কিন্তু কাঁদছ কেন? জেনেভা তো আধ ঘন্টার ড্রাইভও নয়। ইচ্ছা করলেই তো গিয়ে দেখে আসতে পারবে!’
কোন উত্তর দিল না তাতিয়ানা।
জিনা ডোনান্টের কথায় কান্না তার আরও বাড়ল।
জিনা ডোনান্ট বুঝতে পারলো না কি বলে তাকে সান্তনা দেবে। শুধু স্নেহের হাত বুলাতে লাগল তার মাথায়।
তাতিয়ানা ধীরে ধীরে শান্ত হলো। রুমাল দিয়ে চোখ – মুখ মুছে বলল, ‘স্যরি আপা। তোমাকেও কষ্ট দিলাম।’
‘ওসব সৌজন্য রাখ। তোমাদের কি ঘটেছে বলত? তুমি ইচ্ছা করলে জেনেভায় যেতে পারতে।’
তাতিয়ানা কোন কথা বলল না। শুধু তার চোখ দু’টি থেকে আবার দু’টি অশ্রুর ধারা নেমে এল।
জিনা ডোনান্ট তার চোখ মুছে দিয়ে বলল, ‘ব্যাপার কি বলত? কিছু ঘটেছে?’
‘কিছুই ঘটেনি।’ বলল তাতিয়ানা চোখ না তুলেই।
‘তাহলে এই কান্না কেন?’
‘এটা আমার একটা অন্যায় আপা।’
‘ভ্রু কুঞ্চিত হলো জিনা ডোনান্টের। ক্ষোভ ফুঠে উঠল চোখে-মুখে। ক্ষুদ্ধ কন্ঠে ডাকল, ‘তাতিয়ানা!’
‘জ্বি আপা।’
‘তুমি আমাকে বোকা ঠাওরাতে চাচ্ছ?’
‘স্যরি। না আপা।’
‘তাহলে বল কি ঘটনা?’
‘সত্যিই আপা কোন ঘটনা ঘটেনি।’
‘কিছু বলেছেন তিনি?’
‘কাউকে কাঁদাবার মত তিনি কি কিছু বলতে পারেন?’
‘ঠিক আছে। কিন্তু কিছু ঘটেনি, কিছু উনি বলেনি, তাহলে কি ঘটেছে তোমার?’
তাতিয়ানা কোন উত্তর দিল না। মাথা নিচু করে চুপ করে থাকল।
‘বল, তাতিয়ানা।’
‘কি বলব আপা। আমারই দোষ। আমি সোনা হরিণ ধরতে চাচ্ছি।’
ভ্রু কুঞ্চিত হলো আবার, জিনা ডোনান্টের। হঠাৎ তার চোখে ভেসে উঠল তাতিয়ানার ভবঘুরে জীবনের দৃশ্য। মনে পড়ল জীবন সম্পর্কে তাতিয়ানার হতাশার কথা।
সংগে সংগে চোখে-মুখে উদ্বেগ ফুটে উঠল জিনা ডোনান্টের। বলল, ‘তার মানে উনি তোমাকে প্রত্যাখ্যান করেছেন?’
তাতিয়ানা একটু সময় নিল জবাব দিতে। ধীরে ধীরে বলল, ‘প্রত্যাখ্যান করলে অন্তত বুঝতাম উনি আমাকে বুঝেছেন।’ ভাঙা গলা তাতিয়ানার।
‘তোমাকে উনি বোঝেননি। মানে উনি কি জানেন না তুমি তাঁকে ভালবাস?’
‘তাও তামি জানি না।’
‘বল কি? তার তরফ থেকে কিছুই জানতে পারনি?’
‘না আপা। বরফের মত ঠান্ডা উনি। ওর হৃদয় যেন পাথর। কোন আকাঙ্খা, কোন আকুতিই যেন সেখানে কোন স্পন্দন তোলে না।’
তৎক্ষণাৎ কোন উত্তর দিল না জিনা ডোনান্ট।
উদ্বেগ ও বেদনার একটা ছায়া নেমেছে তার চোখে-মুখে।
সে নীরবে বুকে জড়িয়ে ধরল তাতিয়ানাকে। বলল, ‘তুই দেখছি সর্বনাশ করে বসে আছিস। এমন একা একা কান্না তোর কে দেখবে! কেন তাঁকে বলিসনি পরিষ্কার করে সব কথা?’
‘ও যদি প্রত্যাখ্যান করতে গিয়ে কষ্ট পায় সেই ভয়ে।’
‘উল্টোটাও তো হতে পারে! ও অনেক বড়। সম্পূর্ণ ভিন্ন নৈতিকতার মানুষ। তুই ভূল করেছিস তাকে বুঝতে।’
‘আমি জানি না, জানি না।’ বলে দু’হাতে মুখ ঢেকে কান্নায় আবার ভেঙে পড়ল তাতিয়ানা।
জিনা ডোনান্ট তার একটা হাত তাতিয়ানার মাথায় বুলিয়ে তাতিয়ানার মুখের কাছে মুখ এনে বলল, ‘আমি কি ওঁকে বলব?’
তাতিয়ানা সংগে সংগেই মাথা নেড়ে জানাল, ‘না।’
‘তাহলে তুমি জেনেভায় ওর কাছে যাও।’
তাতিয়ানা আবার ঐ ভাবেই মাথা নেড়ে বলল, ‘না! ও এক সাংঘাতিক কাজে এখন মনোযোগ দিয়েছেন। এখন নয়।’
‘তাহলে তুমি এর মধ্যে গিয়ে ‘মঁথে’ নাতাশার ওখান থেকে ঘুরে এস। আলপস-এর বরফের রাজ্যে গেলে ভিন্ন এক স্বাদ পাবে।’
ঘরে ঢুকল এ সময় জিনা জোসেফাইন।
তাতিয়ানা তাড়াতাড়ি চোখ মুছে উঠে দাঁড়াল।
জিনা ডোনান্টাও।

‘প্রথম ব্যর্থতার একটা যুক্তি আছে। কিন্তু দ্বিতীয় ব্যর্থতার কি যুক্তি আপনাদের কাছে আছে?’ তীব্র কন্ঠে বলল ব্ল্যাক ক্রস প্রধান সাইরাস শিরাক।
জেনেভায় ব্ল্যাক ক্রসের অফিস। সাইরাস শিরাকের সামনে বড় টেবিলটা ঘিরে বসেছিল জেনেভা ব্ল্যাক ক্রস-এর চার শীর্ষ ব্যক্তি।
তাদের মুখ নিচু। কোন জবাব দিল না তারা।
আবার মুখ খুলল সাইরাস শিরাকই। বলল, ‘দ্বিতীয় ব্যর্থতার ঘটনায় দেখা যাচ্ছে, ঘটনাচক্রে আমাদের সে মিশন ব্যর্থ হয়নি। প্রমাণ হচ্ছে, সুপরিকল্পিতভাবে ফাঁদ পাতা হয়েছিল আমাদের ধরার জন্যে। ভাগ্যক্রমে পালাতে পেরেছিলে। কেন তোমাদের এই ব্যর্থতা?’
‘আমরা কিছুই বুঝতে পারছি না। তারা যদি আমাদের সন্দেহ করতো, তাহলে অবশ্যই পুলিশের সাহায্য নিত কিন্তু পুলিশ কিছুই জানে না।’ বলল মিঃ পল।
‘কিন্তু তারা সন্দেহ করেছে এটা তো সত্য?’
‘সত্য বলেই তো বিস্ময়। এ সাহস তারা পেল কোথায়? তারা নিজেরা আমাদের বিরুদ্ধে অগ্রসর হবে, এটা কল্পনাও করা যায় না।’
‘কিন্তু তা সত্য প্রমাণিত হয়েছে। WNA এবং FWTV-এর সাংবাদিক-কর্মচারীদের অফিস ও বাসার খবর জান?’
‘জানি, সেখানে সর্বাত্মক সতর্কতা।’
‘জানি, তারা নিজস্ব গাড়িতে চড়া কমিয়ে দিয়েছে। যারা চড়ে; তাদের গাড়ি সার্বক্ষণিক পাহারায় থাকে?’
‘জানি।’
‘এর অর্থ কি?’
‘তাদের কাছে আমাদের সিসি মাছির ব্যাপারটা ধরা পড়ে গেছে।’
‘তাহলে তারা পুলিশকে জানাচ্ছে না কেন, খবর নিয়েছ?’
‘এটাই এখন বড় রহস্য।’
‘প্রথম ব্যর্থতার ঘটনায় রেনেন তুমি যাকে দেখেছিলে, দ্বিতীয় ব্যর্থতার ঘটনায় যার দ্বারা আক্রান্ত হয়েছিলে, তারা এক লোক কিনা?’
‘পোশাক ভিন্ন ছিল, কিন্তু তাদের এক লোক বলেই মনে হয়েছে।’
‘আমার বিশ্বাস, এই-ই আসল লোক। এ ঘটনার মোড় পাল্টে দিয়েছে। তোমরা অপদার্থ তাকে বাগে পেয়েও শেষ করতে পারনি।’
‘একজন এশিয়ান কি এতবড় কেউ হতে পারে?’
‘সে কি এশিয়ান?’
‘হ্যাঁ এশিয়ান।’
ভ্রু কুঞ্চিত হলো সাইরাস শিরাকের। বলল, ‘এশিয়ানদের ছোট ভাবছ কেন? আহমদ মুসা তো এশিয়ান।’
‘সে কি আহমদ মুসা?’ কন্ঠে বিস্ময় ঝরে পড়ল মিঃ পলের।
‘নিশ্চিত করে বলা যাবে না। তবে কাজ দেখলে তার কথাই মনে হয়। আবার সুইজারল্যান্ড এমন কিছু আন্তর্জাতিক ঘটনা ঘটার কথা প্রচারিত হয়নি, যে কারণে তার মত লোক এখানে আসতে পারে।’
বলে একটু থেমেই আবার সে বলল, ‘সেদিন লোকটিকে তোমাদের জীবন্ত ছেড়ে দেয়া ঠিক হয়নি। আর লোকটি ক্লিনিক থেকে কোথায় গেল খুঁজে বের করতে পারলে না?’
‘ওদের রেকর্ডে কিছুই নেই। নিজের ইচ্ছাতেই রিলিজ নিয়েছে। একজন মহিলা ও একজন পূরুষের সাথে একটি প্রাইভেট গাড়িতে করে চলে গেছে।‘জেনেভা’ না ‘মরজে’তে গেছে কেউ বলতে পারছে না।’
চেয়ারে হেলান দিয়ে চোখ বুজেছিল সাইরাস শিরাক। মিঃ পল থামলে সে সোজা হয়ে বসে বলল, ‘যাই হোক, আমাদের পরিকল্পনা বিপর্যয়ের মধ্যে পড়েছে। যেভাবে আমরা এগুচ্ছিলাম, সেভাবে আর এগুনো যাবে না। এখন বল কোন পথে এগুবে। আমি চাই, সংবাদ সংস্থা দু’টি বন্ধ হোক।’
‘আমরা চাচ্ছিলাম, সিসি মাছি রহস্যকে আড়ালে রাখতে এবং তার সাথে আমাদের ষড়যন্ত্রটাকেও আড়াল করতে। যে কোন ভাবেই হোক সিসি মাছি রহস্যটা ধরা পড়ে গেছে এবং এটা ষড়যন্ত্রেও ফল তাও ধরা পড়ে গেছে। কিন্তু এ ষড়যন্ত্রের পেছনে কারা আছে এটা অবশ্যই ধরা পড়েনি।’ বলল রেনেন।
‘কেমন করে বলছ ধরা পড়েনি। আমাদের ঘাঁটি কিংবা আমরা আক্রমণের শিকার হইনি বলে?’ বলল সাইরাস শিরাক।
‘হ্যাঁ তাই।’
‘তোমার অনুমানের পেছনে আর কি যুক্তি আছে?’ সাইরাস শিরাক বলল।
‘তারা আমাদেরকে অথবা আমাদের অবস্থান চিহ্নিত করতে পারলে অবশ্যই তারা পুলিশের আশ্রয় নিত। তারা এখন যেটা করছে সেটা আত্মরক্ষার কাজ। তারা বাঁচতে চাইলে তাদের আক্রমণাত্মক হতে হবে এবং তা হতে হবে পুলিশের মাধ্যমে।’
‘তারা তোমাদের ধরার জন্যে তাড়া করেছে দীর্ঘ ৪০ মাইল পথ, এটা কি আক্রমণাত্মক কাজ নয়?’ সাইরাস শিরাক বলল।
‘সব জেনে-শুনে যে আক্রমণ সেটা বড় ধরনের কোন আক্রমণ নয়। ঘটনা চক্রে এ সুযোগ তারা পেয়েছে।’
‘তোমরা কি খোঁজ নিয়েছ, এই ঘটনার পর তারা পুলিশকে বলেছে কিনা?’ প্রশ্ন করল সাইরাস শিরাক।
‘আজই পুলিশের সাথে কথা বলেছি। তারা বলেছে, এই কেসের ব্যাপারে কোন অগ্রগতি নেই। WNA এবং FWTV কর্তৃপক্ষ সুনির্দিষ্ট কোন অভিযোগ আনতে পারেনি, পুলিশের পক্ষেও কিছু বের করা সম্ভব হয়নি।’ বলল মিঃ পল, জেনেভা ব্ল্যাক ক্রস প্রধান।
কোন কথা বলল না সাইরাস শিরাক। চোখ বন্ধ করে চেয়ারে হেলান দিল সে আবার। একটু পরে চোখ খুলে বলল, ‘এখন বল তাহলে এগুবে কিভাবে?’ সাইরাস শিরাকের দৃষ্টি রেনেনের দিকে।
রেনেন সিসি মাছি অপারেশন প্রজেক্টের প্রধান।
রেনেন বলল, ‘সিসি মাছির ব্যাপারটা পুলিশের কাছে ধরা পড়েনি। এটা আমাদের জন্যে এখনও একটা বড় ইতিবাচক দিক। এখনও এই অস্ত্র পূর্ণ কার্যকরী আছে। এই অস্ত্রের এবার গণ ব্যবহার করব।’
‘কিভাবে?’
‘সংবাদ সংস্থা দু’টির বিল্ডিং- এর নক্সা জোগাড় করেছি। সংস্থা দু’টির মিটিং এ্যারেঞ্জমেন্ট ও টাইম- সিডিউল জোগাড় করেছি। সংস্থা দু’টিতে প্রতিদিন সন্ধ্যায় স্টাফ মিটিং হয় একটি হল রুমে। সেখানে শীর্ষ থেকে সিনিয়র সবাই হাজির থাকে। সেখানে আমরা সিসি মাছি ছেড়ে দিতে পারি।’
‘কিন্তু কিভাবে?’
‘দু’টি মিটিং রুমই অফিস দু’টির পেছন সাইডে। একটার পেছন দিকের পরবর্তী বিল্ডিং একটা ৫ তলা কারপার্কিং। অন্যটার ব্যাকওয়ার্ড সাইডে আছে একটা গোডাউন। সুতরাং আমরা নির্বিবাদে স্যানিটারী সার্ভিসম্যানদের ইউনিফর্ম পরে মিটিং রুমের জানালায় ড্রিলিং করে পাইপের মাধ্যমে কয়েক ডজন ক্ষুধার্ত সিসি মাছি মিটিং রুমে ছেড়ে দিতে পারি।’ বলল রেনেন।
‘তোমার বুদ্ধি মন্দ নয়, তবে এত ঝামেলা করার চেয়ে আমরা মিটিং রুমটাই তো উড়িয়ে দিতে পারি।’ সাইরাস শিরাক বলল।
‘ওতে ঘটনার স্বাভাবিকতা নষ্ট হয়ে যাবে। প্রমাণ হবে সংস্থা দু’টি শত্রুর ষড়যন্ত্রের শিকার। এর রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া হবে গোটা দুনিয়া ব্যাপী।’
‘তোমার সিসি মাছিও তো ধরা পড়ে যাবে। প্রমাণ হবে ওটাও ষড়যন্ত্র।’
‘এটা প্রমাণ করা কঠিন হবে। ড্রিলিং করা ফুটো বুঝিয়ে দেয়া হবে সংগে সংগেই। আর সেই সময় বিদ্যুত যাবে কয়েক মিনিটের জন্যে। সে ব্যবস্থাও করা হয়েছে। সেই অন্ধকারে মানুষ কিছুই দেখবে না, কিন্তু মানুষের রক্তের গন্ধে পাগল সিসি মাছিগুলো ঠিক গিয়ে বসে যাবে লোকদের ঘাড়ে অথবা কানের পাশটায়। ঘাড় ও কানের পাশটা তাদের একটু চুলকাবে। ব্যস। আমাদের কাজ শেষ। চুলকানোর পর থাবা মেরে বা চুলকিয়ে সিসি মাছি নিজের অজান্তেই তারা মেরে ফেলবে। পরক্ষণেই আসবে আবার আলো। কারণ সার্কিট ব্রেকারের ক্রটিটা ততক্ষণে ঠিক হয়ে যাবে। আলো আসার পর দু’একটা মাছি থাকলেও তা তাদের দৃষ্টিগোচর হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম থাকবে। কারণ সিসি মাছি টিউবে নিষিক্ত হবার পর তার হিংস্রতা বেড়ে যাবে, কিন্তু উড়ার শক্তি ও আগ্রহ তার কমে যাবে।’
‘তার মানে আগের মৃত্যুগুলোর মতই এই গণ মৃত্যু রহস্যের আড়ালে ঢাকা থাকবে।’ সাইরাস শিরাক বলল।
‘আমি তাই মনে করি। গণমৃত্যু ওদের হলেও মৃত্যু তাদের এক জায়গায় হবে না। সময় ও অবস্থান হিসেবে কারও মৃত্যু হবে অফিসে, কারও বা বাড়িতে, আবার কারও হবে রাস্তায়। কিন্তু সকল মৃত্যুর উৎস যে মিটিং রুম তা কারও চিন্তাতেই আসবে না। অতএব সেখানে কোন অনুসন্ধানও হবে না।’
‘ব্রাভো, ব্রাভো। ধন্যবাদ মিঃ রেনেন। চমৎকার তোমার পরিকল্পনা। এই পরিকল্পনা কার্যকরী হলে সংবাদ মাধ্যম দু’টি সেদিনই বন্ধ হয়ে যাবে।’ আনন্দে টেবিলে মুষ্টাঘাত করে উচ্চস্বরে বলল সাইরাস শিরাক।
‘শুধু বন্ধ হয়ে যাওয়া নয়, সংস্থা দু’টির মালিক কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে মামলাও দায়ের হতে পারে ক্ষতিপূরণ দাবী করে অথবা এসব ঘটনার জন্যে তাদের অভিযুক্ত করে।’
‘কিন্তু রহস্যের কথা তারা যদি বলে দেয়?’ বলল সাইরাস শিরাক।
‘বললেও তা প্রমাণ করা কঠিন হবে। তাছাড়া কেন তারা বিষয়টা পুলিকে আগে জানায়নি, কেন তারা গোপন করেছে এজন্যে অভিযুক্ত হবে। এবং তাদের বিরুদ্ধেই এখন এ অভিযোগ উঠতে পারে যে, ষড়যন্ত্রটি তারাই করেছে বিশেষ উদ্দেশ্যে।’ বলল রেনেন।
‘ঠিক বলেছ রেনেন। তোমার বুদ্ধির প্রশংসা করছি। তোমাকে ধন্যবাদ।’
থেমে একটা দম নিল সাইরাস শিরাক। তারপর বলল, ‘তোমার পরিকল্পনা দ্রুত কার্যকরী করার ব্যবস্থা করা দরকার। কঁতদূর এগিয়েছ।’
‘খোঁজ-খবর নেয়া প্রায় সম্পূর্ণ। আমার সিসি বাহিনীও রেডি। এখন একটা দিন-ক্ষণ ঠিক করে এগুলেই হয়ে যায়।’ বলল রেনেন।
‘তোমার সিসি বাহিনীর সংখ্যা কত এখন?’ বলল সাইরাস শিরাক।
‘ছিল তিন ডজন। কিন্তু হ্রদের ঘাঁটিতে যে পরিবেশ ওদের রাখা হয়েছে তাতে ওদের বংশ বৃদ্ধিও ঘটেছে। তিন ডজন এখন মনে হয় ৬ ডজনেরও বেশী দাঁড়িয়েছে।’
‘ধন্যবাদ। বিরাট বাহিনী। দেখো, এই বাহিনী আমাদের ভাগ্য খুলে দেবে।’
‘ইশ্বর তাই যেন করেন মিঃ সাইরাস।’ বলল মিঃ পল।
টেলিফোন বেজে উঠল।
রেনেন উঠল টেলিফোন ধরার জন্যে।
সাইরাস শিরাকও উঠে দাঁড়াল। বলল, ‘আমি ওদিকে আছি।’
বলে সে দরজার দিকে পা বাড়াল।

‘আমাদের অবস্থার কথা বলছেন? আপনাকে হারিয়ে আমরা আতংকে উদ্বেগে দিশাহারা। পুলিশে খবর দেব না কি করব কিছুই বুঝতে পারছিলাম না আমরা। ভাবছিলাম, সিসি মাছির সব ব্যাপার পুলিশকে বলে পুলিশের আশ্রয় নেই।…’
বলছিল WNA-এর চেয়ারম্যান জামাল গটেফ। তার কথার মাঝখানেই আহমদ মুসা বলে উঠল, ‘সর্বনাশ …’
আহমদ মুসার কথার মাঝখানেই জামাল গটেফ আবার বলে উঠল, ‘সর্বনাশ হতে যাচ্ছিল, কিন্তু হয়নি। এক তরুণী রক্ষা করেছেন।’
‘এক তরুণী রক্ষা করেছেন?’
‘হ্যাঁ, এক বিস্ময়কর তরুনী উদয় হয়েছিল।’
‘বিস্ময়কর তরুণী? কিভাবে সে রক্ষা করল?’
‘তিনি পরামর্শ দিয়েছিলেন, পুলিশে খবর দেয়া যাবে না, জনাব আহমদ মুসা পুলিশের কাছে যা প্রকাশ করতে বলেননি, তা প্রকাশ করা যাবে না। ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতে হবে, পারলে নিজেরা কিছু করতে হবে।’
এবার আহমদ মুসার কাছে অনেকটা পরিষ্কার হয়ে গেল তরুণীটি কে হতে পারে। বলল সে, ‘নিশ্চয় তরুণীটি ডোনা জোসেফাইন।’
‘জি হ্যাঁ। মারিয়া জোসেফাইন। ডোনা জোসেফাইনও তার নাম।’ বলল গটেফ।
বলে একটু থেমেই আবার গটেফ শুরু করল, ‘মেয়েটি ভীষণ বুদ্ধিমতী ও সাহসী। সেদিনের পর প্রতিদিন সে যোগাযোগ করছে। হঠাৎ তাঁর আগমন না ঘটলে উদ্বেগ-আতংকে আমাদের অবস্থা যে কি হতো বলতে পারি না।’
‘কিন্তু একজন অপরিচিত মেয়েকে কিভাবে আপনারা বিশ্বাস করে সব কথা বললেন?’
‘কোথায় অপরিচিত, সে তো আপনাকে চেনে?’
‘কিন্তু সেটা তো আপনারা জানেন না। কোন শত্রু তো এভাবে মিথ্যা কথা বলতে পারতো।’
কিছুটা গম্ভীর জামাল গটেফ। বলল, ‘তা পারতো। কিন্তু তিনি যেভাবে বলেছেন, সেভাবে পারতো না। শুধু তো আমি না। সেদিন মিটিং-এ সবাই হাজির ছিলেন। তার কথা সবাই এক বাক্যে বিশ্বাস করেছিলেন।
হাসল আহমদ মুসা। ঠিকই বলেছেন, ‘সত্যের আলাদা একটা শক্তি আছে। মেয়েটি কোথায়?’
‘ফাতেমা হিরেন বলতে পারবে। ওঁর সাথেই যোগাযোগ। কিন্তু বলুন তো? বিস্ময়কর মেয়েটি আসলে কে?’
‘ফ্রান্সের ‘লুই’ রাসপরিবারের বোধহয় একমাত্র রাজকন্যা।’
জামাল গটেফ কিছুক্ষণ ‘হা’ করে আহমদ মুসার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, ‘তাই বলুন। একজন অপরিচিত মেয়ে অপরিচিত পরিবেশে এসে যে ‘কমান্ড’ করল তা রাজকীয়ই বটে। কিন্তু ফরাসী রাজকুমারী এখানে কেন? তার ইসলাম গ্রহনের ব্যাপারটাই বা কি?’
‘যে কেউ তো ইসলাম গ্রহন করতে পারে।’
‘কিন্তু এখানে আসা তার মত রাজকুমারীর?’
‘কিন্তু সে তো এখন রাজকুমারী নয়।’
‘তবু তার আসাটা?’
আহমদ মুসা একটু হাসল। বলল, ‘সব প্রশ্নের উত্তরই একসাথে পাওয়া যায় না। সময় অনেক প্রশ্নের উত্তর আপনাতেই পরিষ্কার করে দেয়। আবার অনেক প্রশ্ন এমন আছে, সরাসরি যার জবাব খুবই বিব্রতকর হতে পারে।’
জামাল গটেফ হাসল। বলল, ‘আমার শেষ প্রশ্নটি কি তেমন ধরনের?’
‘কতকটা তাই।’ আহমদ মুসার ঠোঁটে লজ্জা মিশ্রিত হাসি।
‘মাফ করবেন। আমার প্রশ্ন জেরার মত হয়েছে। যা অসুন্দর অবশ্যই। কিন্তু মন মানছিল না। আলমাহদুলিল্লাহ, আমি জবাব পেয়ে গেছি। মুবারক হোক আপনাদের পবিত্র সম্পর্ক। আমাদের গর্ব আহমদ মুসা যোগ্য সাথী খুঁজে পেয়েছেন।’
গম্ভীর হয়ে উঠেছে আহমদ মুসার মুখমন্ডল। বলল, ‘মিসেস ফাতেমা হিরেন কি অফিসে আছেন?’
‘আছেন। কথা বলবেন?’
‘হ্যাঁ। যদি ডাকেন।’
‘কোন মহিলা সাংবাদিক কর্মচারীকে সম্মিলিত কোন মিটিং ছাড়া কোন কক্ষে ডেকে কথা বলা হয় না। ইন্টারকমে কথা বলা হয়। অথবা কাঁচঘেরা সাক্ষাতকার কক্ষে গিয়ে কথা বলা যায়।’
‘ধন্যবাদ। এটাই ইসলামী নিয়ম। তাহলে ইন্টারকমে ওঁর সাথে লাইন করে দিন।’
ইন্টারকমে ফাতেমা হিরেনের সাথে সংযোগ হওয়ার পর আহমদ মুসা ডোনা কোথায় জানতে চাইল।
ফাতেমা হিরেন বলল, ‘আজ সকালে ওরা ‘ম্যাটার হর্ণ’- এ গেছেন।’
‘ম্যাটার হর্ণ’ বলা যায় সুইজারল্যান্ডের শ্রেষ্ঠ পর্যটন কেন্দ্র। সেখানে কেউ ‘স্নো-স্কি’ করতে যায়, কেউ দেখতে যায়। সবচেয়ে বড় কথা ওখানে দাঁড়িয়ে আল্পস পর্বতমালার অপরূপ দৃশ্য দেখা যায়।
‘ওরা মানে আর কে আছে?’
‘মারিয়া জোসেফাইন আপা এবং তাঁর আব্বা।’
‘ওরা কোথায় উঠেছেন?’
‘উঠেছেন একটা ট্যুরিষ্ট কটেজে। তবে মাঝে মাঝে আত্মীয়ের বাড়িতেও থাকবে। টেলিফোন নম্বার দেব দু’জায়গার?’
আহমদ মুসা টেলিফোন নম্বারগুলো লিখে নিয়ে বলল, ‘আপনি ওর সাথে কবে কথা বলেছেন?’
‘প্রতিদিন কয়েকবার করে কথা হয়। আজ ওরা যাবার আগে মিস মারিয়া আমার সাথে কথা বলেছেন।’
একটু থেমেই ফাতেমা হিরেন আবার বলল, ‘জানেন আরও কি বলেছেন?’
‘কি বলেছেন?’
‘বলেছেন, আপনি শত্রুর হাতে ধরা পড়েননি।’
‘তাই বলেছেন? কি করে জানলেন?’
‘আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম। বলেছেন, আপনি শত্রুর হাতে ধরা পড়লে আমাদের দু’টো প্রতিষ্ঠানে আরও আক্রমণ হতো, থেমে যেতো না। আক্রমণ থেমে যাবার অর্থই হলো শত্রু পর পর দু’বার ব্যর্থ হবার পর পুরনো কৌশল নিয়ে সামনে এগুতে দ্বিধা করছে। আহমদ মুসা তাদের হাতে থাকলে বা আহমদ মুসাকে তাদের পথ থেকে সরাতে পারলে তারা এই দ্বিধা করতো না।’
‘ওর অনুমান ঠিক।’
‘ঠিক না হয়ে পারে। কে উনি দেখতে হবে তো!’
‘আপনি দেখছি তার অনেক কিছু জানেন?’
‘আমাদের ‘ভাবী’র অনেক কিছু জানব সেটাই তো স্বাভাবিক।’
‘দোয়া করুন আমাদের জন্যে।’ গম্ভীর কন্ঠে আহমদ মুসা বলল।
‘আমরা ভাগ্যবান এবং আনন্দিত যে, দু’জনকে এক সাথে দেখার সৌভাগ্য হলো।’
‘ধন্যবাদ। ওরা কবে ফিরবেন বলেছেন?’
‘বলেননি।’
আহমদ মুসা সালাম দিয়ে টেলিফোন রেখে দিয়ে জামাল গটেফকে লক্ষ্য করে বলল, ‘এখন উঠি।’
‘অবশ্যই উঠবেন। কিন্তু আমাদেরকে কিছু আশার কথা শোনান। আমরা সবাই আতংকে প্রতি মুহূর্তে ভাবছি, কোন দুঃসংবাদ কোত্থেকে আসে।’
আহমদ মুসা হাসল। বলল, ‘ডোনা জোসেফাইন মিসেস ফাতেমা হিরেনকে যে কথা বলেছেন, সেটা আপনাকে শোনাই। তিনি বলেছেন, ‘দু’টি সংস্থার উপর শত্রুর আক্রমন বন্ধ থাকাই প্রমাণ করে আহমদ মুসা শত্রুর হাতে পড়েননি। দু’বার ব্যর্থতার পর শত্রু এখন দ্বিধ্যগ্রস্ত। কোন পথে তারা এগুবে চিন্তা করছে।’
উচ্ছ্বাসিত হয়ে উঠল জামাল গটেফ। বলল, ‘ঠিক। কিন্তু এভাবে আমরা চিন্তা করতে পারিনি। ঠিক তাদের আক্রমণ এ কারণেই বন্ধ আছে। সত্যি মিস মারিয়া জোসেফাইনের বিচার-বুদ্ধি বিম্মযকর।’
‘আমি এখন উঠি জনাব। পরে দেখা হবে।’ বলতে বলতে উঠে দাঁড়াল আহমদ মুসা।
জামাল গটেফও উঠে দাঁড়াল। বলল,‘এখন তাহলে আমাদের করনীয়?’
‘চিন্তা করছি। মোরজে’র রাস্তায় সেই ঘটনার সময় ওদের একজনের একটা মানি ব্যাগ পড়ে গিয়েছিল। সেটা আমি পরে পেয়েছি। তাতে এক চিরকুটে একটা টেলিফোন নম্বার আছে। এই ক্লু ধরে একটু এগুবার চেষ্টা করে দেখি।’
বলে আহমদ মুসা সালাম দিয়ে দরজার দিকে পা বাড়াল।
জামাল গটেফ সালাম নিয়ে বলল,‘আল্লাহ আমাদের সহায় হোন।’
আহমদ মুসা কটেজে ফিরে টেলিফোন নম্বারটা নিয়ে অনেক ভাবল। টেলিফোন করে যাচাই করার চিন্তা সে বাদ দিয়ে দিল। টেলিফোন নম্বারটা যদি সত্যিই ব্ল্যাক ক্রস-এর কারো হয়, তাহলে তার টেলিফোন তাদের মনে সন্দেহের সৃষ্টি করতে পারে। কোন প্রকার সন্দেহের সুযোগ আহমদ মুসা তাদের দিতে চায় না।
টেলিফোন গাইড থেকে টেলিফোন নম্বারটির ঠিকানা নিয়ে সে দেখল, উত্তর জেনেভায় অবস্থিত লেক আইল্যান্ডের ৯৯নং বাড়ির টেলিফোন নম্বার এটি। নাম অনুসারে বাড়িটা একটা কমার্শিয়াল টিভি স্টুডিও।
হতাশ হলো আহমদ মুসা। অমন একটা কমার্শিয়াল স্টুডিও ব্ল্যাক ক্রস- এর ঘাঁটি নয় নিশ্চয়। আক্রমণকারীদের কেউ হয়তো অভিনয়ের সাথে জড়িত ছিল। তারই মানিব্যাগে ছিল নম্বারটা। যাচাই না করে শুধু অনুমানকে সত্য বলে ধরে নেওয়াও আহমদ মুসা ঠিক মনে করলো না।
পরদিন রাত ৯টা।
আহমদ মুসা লেক আইল্যান্ডে যাবার জন্যে তৈরী হয়েছে।
বেরুবার আগে সে টেলিফোন করল ফাতেমা হিরেনকে। জানতে চাইল ডোনা জোসেফাইনের কোন খবর আছে কিনা।
ফাতেমা হিরেন বলল, ‘না এ দু’দিন কোন টেলিফোন আসেনি।’
‘মি. জামাল গটেফকে টেলিফোন করে পেলাম না। তার জন্যে একটা মেসেজ কি আমি আপনাকে দিতে পারি?’
‘অবশ্যই। আপনার কোন কাজে আসতে পারা আমার জন্যে সৌভাগ্যের।’
‘আমি একটা ঠিকানায় যাচ্ছি, মিঃ জামাল সেটা জানতে চেয়েছিলেন। আপনি দয়া করে লিখে নিন।’
বলে আহমদ মুসা লেক আইল্যান্ডের সেই বাড়িটার নম্বার এবং টেলিফোন নম্বার তাকে দিয়ে দিল।
টেলিফোন শেষ করে আহমদ মুসা বেরিয়ে এল রাস্তায়।
একটা ট্যাক্সি ডেকে তাতে উঠে বসল।
ড্রাইভারকে লেক আইল্যান্ডে যেতে বলে সিটে গা এলিয়ে দিল সে।
বেশ অনেকটাই পথ।
দক্ষিণ জেনেভা থেকে যেতে হবে উত্তর জেনেভায়। লেক আইল্যান্ড উত্তর জেনেভারও উত্তর প্রান্তে। লেক জেনেভারই একটা উপদ্বীপ এটা।
রাতের অপেক্ষাকৃত ফাঁকা রাস্তা।
বিশ মিনিটেই আহমদ মুসা পৌঁছে গেল লেক আইল্যান্ডের কেন্দ্র বিন্দুতে।
‘কোথায় যাবেন স্যার?’ ফরাসী ভাষায় ড্রাইভার বলল।
‘লেকভিউ স্টুডিও তুমি চেন?’ জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা।
‘কত নম্বার স্যার?’
আহমদ মুসা নম্বার বললে সে বলল, ‘লোকেশানটা চিনেছি।’ বলে সে গাড়ি স্টার্ট দিল।
ড্রইভার ঠিক তার গাড়িটা নিয়ে দাঁড় করাল ৯৯নং লেক আইল্যান্ড বাড়িটার সামনে।
একদম পানির কিনারায় বাড়িটা। যেন পানি থেকেই উঠে এসেছে।
ড্রইভার গাড়ি দাঁড় করিয়েই বলল, ‘স্যার স্টুডিও তো চালু নেই।’
‘চালু নেই? কিন্তু সাইনবোর্ড তো দেখছি।’ বলল আহমদ মুসা।
‘সাইনবোর্ড আছে, কিন্তু স্যার দরজায় ‘খোলা’ কিংবা ‘বন্ধ’ নির্দেশক কোন সাইনবোর্ড নেই।’
‘এ ধরনের সাইন বোর্ড কি অপরিহার্য?’
‘কমার্শিয়াল প্রতিষ্ঠানের জন্যে এটা অপরিহার্যই।’
‘ঠিক আছে নেমে দেখি।’
বলে আহমদ মুসা গাড়ি থেকে নামল এবং ড্রইভারকে ভাড়া চুকিয়ে দিল।
নামল, কিন্তু মনটা খারাপ হয়ে গেল আহমদ মুসার। স্টুডিও যদি সত্যিই বন্ধ থাকে, তাহলে তাকে ব্যর্থ হয়ে ফিরে যেতে হবে। আর সেই সাথে যে লিংকটার উপর নির্ভর করছিল ক’দিন ধরে, তা ছিন্ন হয়ে যাবে। আবার তাকে হাতড়ে ফিরতে হবে ক’দিন কে জানে!
কিন্তু আবার ভাবল, স্টুডিও বন্ধ হয়ে যাওয়ার অর্থ এখানে কোন লোক না থাকা নয়। তার প্রয়োজন তো স্টুডিও- এর সাথে নয়, এখানে মানুষ থাকলেই তার চলে।
‘ধীরে ধীরে বাড়িটার দিকে এগুলো আহমদ মুসা।
তিন তলা বাড়ি।
লেকের তীরে লম্বালম্বি বিল্ডিংটি। বাড়ির মাঝ বরাবর উপরে উঠার সিঁড়ি।
সিঁড়ির মুখে গেট চাইনিজ স্টাইলে তৈরি।
সাইন বোর্ডে নিওন সাইনের আলো ছাড়া বাড়িটার কোথাও এক বিন্দু আলো নেই। সবগুলো জানালা বন্ধ। সবগুলোই লোহার গরাদ এঁটে দেয়া। এমনটা ক্বচিত দেখা যায়। বাড়িতে কেউ না থাকলেই সাধারণত বাড়ি এমনভাবে সীল করা হয়।
আবার সেই সন্দেহটা মাথা চাড়া দিয়ে উঠল আহমদ মুসার মনে, তাহলে বাড়িতে কি কেউ নেই?
আহমদ মুসা গিয়ে দাঁড়াল গেটের সামনে।
দেখল তার দরজা কাঠের হলেও মজবুদ। ইন্টারলক সিস্টেম, তাই বলা মুষ্কিল দরজাটা ভেতর থেকে বন্ধ, না বাইরে থেকে।
আহমদ মুসা ধীরে ধীরে দরজার নব ঘুরাল। দরজা বন্ধ।
আহমদ মুসা পকেট থেকে বের করল ‘মাস্টার কী।’
খুলে গেল তালা।
এক ঝটকায় খুলে ফেলল দারজা। বিদ্যুত বেগে একবার চোখ বুলিয়ে নিল সামনে।
কেউ কোথাও নেই।
সামনে ছোটা চার কোণা একটা করিডোর। করিডোরের সামনের প্রান্ত থেকে সিঁড়ি উঠে গেছে উপরে। সিঁড়ির আলোই ম্লান আলোকে আলোকিত করেছে সামনের করিডোরটিকে। করিডোরের আলো নিভানো।
করিডোরের ডান ও বাম দেয়ালে দু’টি দরজা বন্ধ। এ দু’টি দরজা দিয়ে নিচের তলার দু’পাশের ঘরগুলোতে প্রবেশ করা যায়।
সিঁড়িতে লাইট জ্বলা দেখে আহমদ মুসার মনে আশার সঞ্চার হলো যে, ভেতরে মানুষ আছে।
সিঁড়ির দিকে চাইল আহমদ মুসা। ভাবল উপরে উঠার কথা। কিন্তু পরক্ষণেই তার মনে হলো, অনুসন্ধানের কাজটা নিচ থেকেই হওয়া দরকার। মানুষ থাকলে কোথায় আছে, কতজন আছে, কিছুই তার জানা নেই। সবকিছু দেখে নিশ্চিত হয়েই তার সামনে এগুনো উচিত।
ডানদিকের অংশে প্রথমে প্রবেশের সিদ্ধান্ত নিল আহমদ মুসা।
দরজার নব ঘুরাল।
দরজা প্রধান গেটের মতই বন্ধ। আগের মতই অতি সহজে মাস্টার কী দিয়ে খোলা গেল।
আহমদ মুসা ভাবল খুবই সিম্পল একটা বাড়ি বলে মনে হচ্ছে এটাকে। ব্ল্যাক ক্রসরা তো এত সিম্পল বাড়িতে থাকে না। ডিজিটাল লকের- ব্যবহার সুইজারল্যান্ডে ব্যাপক। তাহলে বাড়িটা কি বন্ধ হয়ে যাওয়া একটা স্টুডিও মাত্র।
ডান অংশের প্রায় সবগুলো ঘরই একে একে দেখা হয়ে গেল। দেখে বিস্মিত হলো, সবগুলো ঘরই সাইন্ড প্রুফ।
হতাশ মনেই ফিরছিল আহমদ মুসা। দৃষ্টি আকৃষ্ট হবার মত কোন ঘরেই কিছু দেখলো না সে।
নিচের তলার লেকের দিক দিয়ে ফিরছিল সে। লম্বা করিডোর। করিডোরের ডান অর্থাৎ লেক প্রান্ত বরাবর দেয়াল। আর বাম পাশে ছোট-বড় বেশ কয়েকটি কক্ষ। সবগুলো রুমই স্যুটিং লোকেশন আকারে সাজানো। আহমদ মুসা ভাবল, নিশ্চয় বিল্ডিংটি স্টুডিও হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। না হলে স্টুডিওগুলো এভাবে থাকতো না।
কাউকে বা সন্দেহজনক কিছু না পেয়ে সন্দেহ জাগছিল আহমদ মুসার মনে গোটা বিল্ডিং কি এভাবেই পরিত্যক্ত?
হঠাৎ আহমদ মুসার চোখে একটা অসংগতি ধরা পড়ল। সে দেখল, ডান পাশের করিডোর বরাবর যে দেয়াল, তার রং একেবারেই নতুন এবং দেয়ালের গায়ে নির্দিষ্ট দূরত্বের ব্যবধানে সমান্তরাল যে লম্বা কাটা তাকেও মনে হচ্ছে খুব নতুন। কিন্তু বাম পাশের ঘরগুলোর যে দেয়াল তার রং বেশ পুরানো।
আহমদ মুসা বুঝল ডান পাশের দেয়াল নতুন অথবা নতুন রং করা।
কিন্তু বিল্ডিং-এর ডিজাইন দেখে দেয়ালটিকে নতুন বলে তার মনে হলো না। তাহলে পুরানো দেয়ালে নতুন রং করা হয়েছে। কিন্তু ঘর বাদ দিয়ে শুধু দেয়ালে রং কেন?
আরও একটা অসংগতি ধরা পড়ল আহমদ মুসার চোখে। একটা পেইন্টিং টাঙানো আছে ডান পাশের দেয়ালে। প্রথমত, এমন অফসাইড দেয়ালে পেইন্টিং থাকার কথা নয়। দ্বিতীয়ত, পেইন্টিংটা দেয়ালের অসংগতত জায়গায় টাঙানো। রীতি অনুসারে পেইন্টিংটা টাঙানোর কথা দেয়ালের মাঝবরাবর, কিন্তু টাঙানো হয়েছে এক পাশে।
এমন অসংগতি স্বাভাবিক নয় আহমদ মুসা ভাবল। তাহলে এই অস্বাভাবিকতা কেন?
আগমদ মুসা গিয়ে পেইন্টিংটির সামনে দাঁড়াল। আলপস-এর খুবই পরিচিত একটা ল্যান্ডস্কেপ। বলা যায় পর্যটন বিভাগের বিজ্ঞাপনী চিত্রের মত। দেয়ালে রং করে এমন একটা চিত্র এখানে টাঙানোর কোন যৌক্তিকতাই আহমদ মুসা খুঁজে পেল না।
আহমদ মুসা পেইন্টিংটি নামিয়ে নিল হাতে।
পেইন্টিং সরিয়ে নেবার সংগে সংগে আহমদ মুসার দৃষ্টি উন্মুক্ত জায়গার দু’টি বোতামের উপর নিবদ্ধ হলো। একটি লাল ও একটি সাদা।
হঠাৎ আহমদ মুসার চোখ দু’টি উজ্জ্বল হয়ে উঠল। লুকানো এ দু’টি বোতাম কোন নতুন পথের সংকেত কি?
বোতাম দু’টির সাধারণল অর্থ খুবই পরিষ্কার। সাদা বোতাম পজিটিভ, আর লাল বোতাম নেগেটিভ। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এই পজিটিভ ও নেগেটিভের পেছনে কোন রহস্য রয়েছে!
আহমদ মুসা ভাবল কোন প্রশ্ন পেছনে রেখে সামনে এগুনো ঠিক নয়।
আহমদ মুসা চাপ দিয়ে দেখল রিভলবার পকেটে ঠিকই আছে।
আহমদ মুসা বিসমিল্লাহ বলে সাদা বোতামে চাপ দিল।
সংগে সংগেই তার একবারে সামনেই দেয়াল সরে গিয়ে একটা দরজা বেরিয়ে পড়ল। সেই সাথে এক ঝলক ভ্যাপসা গরম বাতাস এসে লাগল তা গায়ে। বিস্মিত হয়ে তাকাল সে সামনে।
কড়া আলোয় ঝালসানো আয়তকার একটা চত্বর। উঁচু দেয়াল ও নিচ্ছিদ্র ছাদের নিচে একটা কাঁচের ঘর। গোটা চত্বর কর্দমাক্ত। স্যাঁৎস্যাঁতে পরিবেশ।
আহমদ মুসা দরজা দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করল।
আহমদ মুসা যতটুকু অনুমান করল তাতে বিল্ডিংটির পেছনে লেকের পানিতে মাটি ফেলে ভরাট করে কিছুটা জায়গা বাড়িয়ে নেয়া হয়েছে। আহমদ মুসা খেয়াল করল বাড়িটার দিকে আসার সময় বাড়ির পেছনে রেলিং ঘেরা বাড়তি একটা অংশ দেখেছে। সম্ভবত বসে বসে লেকের সৌন্দর্য উপভোগের জন্যে ওটা বাগান জাতীয় কিছু হবে। তারই একটা অংশে এই ঘর নির্মাণ করা হয়েছে। কিন্তু ঘরটা এমন নিচ্ছিদ্র, গরম ও স্যাঁৎস্যাঁতে কেন? কাঁচের ঘরটাই বা ঘরের ভেতরে কেন?
আহমদ মুসা ধীরে ধীরে এগুলো কাঁচের ঘরটার দিকে। কাঁচের ভেতরে ঘরের অবস্থার দিকে তাকিয়ে বিস্মিত হলো আহমদ মুসা। ঘরের ভেতরে এক শ্রেণীর লতাগুল্ম এবং সেই কর্দমাক্ত স্যাঁৎস্যাঁতে পরিবেশ। একটু ভালো করে চাইতে গিয়ে চোখ দু’টি আহমদ মুসার ছানাবড়া হয়ে গেল। দেখল বহু মাছি উড়ে বেড়াচ্ছে ভেতরে। দেখেই সে চিনতে পারল সিসি মাছি এগুলো।
শিউরে উঠল আহমদ মুসা, তাহলে সে ভয়ংকর মাছির গোডাউনে এসে হাজির! …
ভাবনায় ছেদ নামল আহমদ মুসার। পেছনে পায়ের শব্দ শুনতে পেল। তড়াক করে ঘুরে দাঁড়াল। কিন্তু দেখল একটা রিভলবারের নল তার কপাল বরাবর। তার দু’পাশে আরও দু’টি স্টনগান তার দিকে হা করে আছে।
‘কে তুমি? এ পর্যন্ত পৌঁছার কোন লোক এদেশে আছে বলে তো জানি না?’ বলল রিভলবারধারী।
আহমদ মুসা কোন উত্তর দিল না।
রিভলবারধারীই আবার বলল, ‘তুমিই সেই এশিয়ান। আমাদের নিরুপদ্রুব অগ্রযাত্রায় তুমি বিপর্যয় সৃষ্টি করেছ। কে তুমি?’
প্রশ্ন করেই আবার সে বলল, ‘এখান পর্যন্ত পৌঁছিলে কারও বাঁচার কথা নয়। কিন্তু তোমাকে এত সহজে হত্যা করা ঠিক হবে না। বস আসুক। তোমার গোড়ায় যাওয়া দরকার।’
কথা শেষ করেই একজন স্টেনগানধারীকে লক্ষ্য করে বলল, ‘একে বেঁধে ফেল।’
আহমদ মুসা কোন বাধা দিল না। দেয়ার পরিবেশও ছিল না। শুধু বলল, ‘তোমাদের বস কে?’
‘কে তা টের পাবে। বলল সেই রিভলবারধারী।
‘সাইরাস শিরাক কি?’
‘সাইরাস শিরাককে তুমি জান?’ বিস্ময় রিভলবারধারীর কন্ঠে।
আহমদ মুসা নিশ্চিত হলো, এরা ব্ল্যাক ক্রস নিঃসন্দেহে।
‘আমার প্রশ্নের জবাব না দিয়ে তোমার প্রশ্নের উত্তর আশা করতে পার না।’ বলল আহমদ মুসা।
‘সবই বুঝা যাবে সব আসলে। নিয়ে চল একে।’
আহমদ মুসার দুই হাত পিছমোড়া করে বেঁধে তাকে নিয়ে চলল।

বরফ ঢাকা আপার আল্পস-এর আবহাওয়া অনেকটাই অনিশ্চিত। ম্যাটার হর্ণ-এর ‘স্কি-রিপোর্ট’ থেকে তাতিয়ানা যখন বেরিয়েছিল, তখন আবহাওয়াটা পরিস্কারই ছিল।
সে ফিরছিল মঁথে শহরের নাতাশার ওখান থেকে।
মাঝ পথেই সে মুখোমুখি হলো তূষার বৃষ্টি এবং প্রবল বাতাসের।
রণ নদী থেকে কয়েক মাইল পুবে ‘মার্টিনি’ শহর পেরিয়ে কয়েক মাইল সামনে গিয়ে তাতিয়ানা বরফবৃষ্টির মধ্যে একটা গাড়িকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল। গাড়িটার পেছনে সে দেখল রেড এলার্ট লাইট জ্বলছে।
গাড়িটা ডোনার। সেও ফিরছিল ‘ম্যাটার হর্ণ’ থেকে জেনেভায়। এখানে এসে হঠাৎ তার গাড়ি বিকল হয়ে গেছে। গাড়ির এয়ারকন্ডিশন কাজ করছে না। অভাবিত এক বিপদে আটকা পড়েছে ডোনা এবং তার আব্বা। তাদের করবার কিছুই নেই। রেড এলার্ট বাতি জ্বালিয়ে তারা অপেক্ষা করছে সাহায্যের। টেলিফোনে সাহায্যের আবেদন করেছে নিকটবর্তী পুলিশ স্টেশনে।
তাতিয়ানার গাড়ি গিয়ে দাঁড়াল ডোনার গাড়ির পাশে।
ডোনা ও তার আব্বা বেরিয়ে এল গাড়ি থেকে। তাতিয়ানা কোন কথা বলার আগেই ডোনার আব্বা বলল, ‘আমি মিশেল প্লাতিনি ডিবেরী লুই। একজন ফরাসী সাবেক কুটনীতিক। এ আমার মেয়ে মারিয়া জোসেফাইন লুই। আমরা গাড়ি বিকল হওয়ায় এখানে আটকা পড়ে গেছি।’
তাতিয়ানা ডোনার আব্বার মুখের দিকে মুহূর্ত কয়েক স্থির দৃস্টিতে চেয়ে ঈষৎ মাথা নুইয়ে বাউ করে বলল, ‘আপনার নাম আমার মনে পড়ছে। আমি তখন অনেক ছোট। আপনাকে দেখেছিও মনে হয় মস্কোতে দু’একটা অনুষ্ঠানে।’
‘তোমার পরিচয় কি মা? মস্কোয় তোমার বাড়ি কিংবা …’
‘বলব সব। আমার গাড়িতে চলুন। পুলিশ আপনার গাড়ি পৌঁছে দেবে।’
‘পুলিশকে খবর দিয়েছি।’
‘ঠিক আছে। ওদের এখন বলে দেব, ওরা গাড়ি ‘মঁথে’ পৌঁছে দেবে। ওখানেই আমরা উঠছি।’
সবাই এসে তাতিয়ানার গাড়িতে উঠল।
ড্রাইভ করছিল তাতিয়ানা। তার পাশের সিটে বসল ডোনা। আর ডোনার আব্বা বসল পেছনের সিটে।
তাতিয়ানা গাড়ি স্টার্ট দিতে দিতে বলল, ‘আপনাদের কথা, আপনাদের পরিবারের কথা তখন আব্বা-আম্মার কাছে শুনেছি। ইশ্বরকে ধন্যবাদ, অনেকদিন পর আপনাদের সাক্ষাত লাভের সৌভাগ্য হলো।’
‘তোমার পরিচয় দিলেনা মা?’ পেছনের সিট থেকে বলল ডোনার আব্বা।
‘আমি দুর্ভাগা পিটার পরিবারের সন্তান। জার আলেকজান্ডার প্রথম এর পৌত্র পিটার চতুর্থ-এর পৌত্রের মেয়ে আমি।’
‘হ্যাঁ হ্যাঁ মনে পড়েছে। তোমার আব্বার নাম আলেকজান্ডার পিটার। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অনেকবার দেখা সাক্ষাত হয়েছে। তোমাকে দেখেছি। তুমি মারিয়া অর্থাৎ ডোনাকেও নিশ্চয় দেখে থাকবে।’
তাতিয়ানা ডোনার দিকে তাকিয়ে হেসে বলল, ‘মনে পড়ে আপনার কিছু?’
ডোনাও হেসে বলল,‘দু’চার বার কথা-বার্তাহীন কিছুক্ষণের দেখার কথা মনে রাখা সম্ভব নয়।’
‘ঠিকই বলেছেন। আমি কিছু স্মরণ করতে পারছি না।’
‘তবু দেখা হয়েছে এটা কিন্তু কম কথা নয়।’
‘অবশ্যই। মনে না থাকা অতীতটাই এখন আমাদের বন্ধুত্বের দৃঢ় বুনিয়াদ হতে পারে।’
‘নিশ্চয়।’
‘তোমার নাম কি মা? পেছন থেকে তাতিয়ানাকে লক্ষ্য করে বলল ডোনার আব্বা।
‘আমি তাতিয়ানা।’
‘ওয়েলকাম, পিটার দি গ্রেটের কন্যাকে।’
‘নামটাই এখন আছে, বাকি সবটুকুই দুর্ভাগ্য।’
‘ঐ দুর্ভাগ্য আমাদের ‘লুই’ পরিবারেও।’
‘কিন্তু লুই পরিবার ফ্রান্সে যে মর্যাদার আসনে রয়েছে, তা আমাদের নেই।’
‘ভেব না মা, তোমাদেরও সে দিন আসছে।’
বলে একটু থেমেই সে আবার বলল, ‘জান যে আলেকজান্ডার, প্রথম-এর প্রত্যক্ষ বংশধর তুমি, তিনি রুশদের কাছে কত বড়?’
‘জানি আংকেল। কিন্তু সেটা যে আপনাদের বিরুদ্ধে যায়?’ হাসতে হাসতে বলল তাতিয়ানা।
ডোনার আব্বা কথা বলতে যাচ্ছিল। বলতে গেলে তার মুখ থেকে কথা কেড়ে নিয়ে ডোনা বলল, ‘ফরাসী সম্রাট নেপোলিয়ন রুশ সম্যাট আলেকজান্ডার প্রথম-এর কাছে পরাজিত হয়েছিলেন, এটা আমাদের জন্যে দুঃখের। কিন্তু আলেকজান্ডার (প্রথম) রুশ জাতিকে যে রক্ষা করেছিলেন এ জন্যে শ্রদ্ধার পাত্র তিনি আমাদের।
‘ধন্যবাদ আপনাদের।’
‘ওয়েলকাম। আমার খুব আনন্দ লাগছে যে পিটার দি গ্রেটের একজন কন্যার এইভাবে দেখা পেলাম।’
‘আমার কথাই কিন্তু আপনি বলেছেন। আমার অনেক শোনা লুই পরিবারের আপনাদের দেখা হওয়াতে আমার সৌভাগ্য বলে মনে করছি।’
বাইরে তুষার বৃষ্টি বেড়ে গেছে। সেই সাথে বাতাসের বেগটাও বেড়েছে। এই আবহাওয়ায় তুষার ঢাকা পিচ্ছিল পথে গাড়ি চালানো খুবই ঝুঁকি পূর্ণ।
ডোনা কিছু বলার জন্যে মুখ খুলেছিল। কিন্তু ডোনার আব্বা তাকে বাধা দিয়ে বলল,‘কথা বলার চেয়ে সমানের দিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখাই বোধহয় আমাদের ভাল।’
‘ধন্যবাদ আংকেল। আমরা অনেকটা এসেছি। সামনেই রণ নদী। নদী-তীর বরাবর রাস্তাটা আরও একটু ভাল হবে।’
‘ধন্যবাদ তোমাকে তাতিয়ানা। তুমি ভাল ড্রইভ কর।’
‘ধন্যবাদ আংকেল।’
চলতে লাগল গাড়ি।
চারদিকের তুষার শুভ্র মৌন পরিবেশের মধ্যে দিয়ে চলছে গাড়ি।
অবিরল ধারায় আকাশ থেকে নামা তুষার কণা সাদা আলোর তীর বৃষ্টির মত বিদ্ধ করছে পৃথিবীর নীরব বুককে।
নীরবতার বুক চিরে দুর্বিনীতের মত এগিয়ে চলছে গাড়িটি।

একদিন পর।
রণ নদীর তীরে ‘মঁথে’ শহর।
নাতাশার বাড়ি।
নাতাশার তিন তলা সুন্দর বাড়িটা নদীর তীরেই।
দু’দিনের দারুণ খারাপ আবহাওয়ার পর এক খন্ড রোদে চারদিক ঝলমল করে উঠেছে।
ডোনা তার বেড রুমের ব্যালকোনিতে বসে নিজেকে মেলে দিয়েছে দুর্লভ রোদে।
ভেতরে বেড এবং টেবিল ড্রেসিং করছিল তাতিয়ানা।
তিন তলার দু’টি পাশাপাশি কক্ষে থাকে ডোনা ও তাতিয়ানা।
নিজের ঘর ড্রেসিং করার পর ডোনার ঘর ড্রেসিং করছে তাতিয়ানা চুপি চুপি।
ঘর বাড়ি ঠিক রাখার এ কাজগুলো নিজেদেরই করতে হয়। কিন্তু ডোনাকে কোন কাজেই হাত দিতে দেয় না তাতিয়ানা। তাই সে ডোনার ঘরটা ড্রেসিং করে নিচ্ছে চুপি চুপি ডোনাকে ব্যালকোনিতে পাঠিয়ে।
‘কোথায় তুমি তাতিয়ানা এস।’ ব্যালকোনি থেকে ডাকল ডোনা।
‘এই আসছি ডোনা।’ বলে জোরে হাত চালাল তাতিয়ানা।
ডোনার টেবিল ঠিক করার সময় তাড়াহুড়ো করে ডোনার হাতব্যাগ সরাতে গিয়ে খোলা হাত ব্যাগ থেকে ডোনার ছোট্ট নোটবুকটা ছিটকে পড়ে গেল মেঝেতে। নোট বুক থেকে একটা ফটো বেরিয়ে পড়ল।
মেঝে থেকে নোটবুক ও ফটো তুলতে গিয়ে ফটোর উপর নজর পড়তেই ভূত দেখার মত চমকে উঠল তাতিয়ানা। এ যে আহমদ মুসার ছবি! ডোনার হাত ব্যাগে কোত্থেকে এল!
ফটো হাতে তুলে নিয়ে কিছুক্ষণ পাথরের মত স্থির হয়ে বসে থাকল তাতিয়ানা।
তার মনে নানা’ প্রশ্নের ভীড়।
আহমদ মুসার ফটো এইভাবে কার কাছে থাকতে পারে? থাকতে পারে পুলিশের কাছে, গোয়েন্দা পুলিশের কাছে। অথবা থাকতে পারে আহমদ মুসার কোন আত্মীয়ের কাছে। কিংবা থাকতে পারে আহমদ মুসার প্রেমিকার কাছে।
ডোনা কে? সেকি গোয়েন্দা পুলিশ? আহমদ মুসার আত্মীয় কি সে?
আত্মীয় অবশ্যই নয়। ফ্রান্সের ‘লুই’ পরিবার ও এশিয়ান মুসলিম আহমদ মুসার মধ্যে কোন রক্তের সম্পর্ক থাকতে পারে না।
তাহলে ডোনা হয় গোয়েন্দা পুলিশ, নয়তো আহমদ মুসার প্রেমিকা। ‘আহমদ মুসার প্রেমিকা’ কথাটা ভাবতেই তাতিয়ানার ঠোঁটে বেদনার একখন্ড হাসি ফুটে উঠল। মনে মনে বলল, ‘আহমদ মুসার পাথর হৃদয় কাউকে ভালবাসতে পারে না।’
তাহলে কি ধরে নিতে হবে ডোনা ফরাসী গোয়েন্দা পুলিশ? তাই হবে যদি আহমদ মুসার সাথে তার হৃদয়ের সম্পর্ক না থাকে। কিন্তু ডোনাকে গোয়েন্দা পুলিশ ভাবতে কষ্ট লাগল তাতিয়ানার মনে। মাত্র একদিনেই ডোনা তাতিয়ানার হৃদয় জয় করে নিয়েছে।
‘তাতিয়ানা আসছ না যে?’ আবার ডোনা ডাকল ব্যালকোনি থেকে।
তাতিয়ানা তাড়াতাড়ি ফটো, নোটবুক হাত ব্যাগে ঢুকিয়ে টেবিলে রাখতে রাখতে বলল, ‘এই আসছি।’
বলে তাতিয়ানা মুখে হাসি ফুটিয়ে স্বাভাবিক হয়ে ছুটল ডোনার কাছে। সেই সাথে ভাবল ডোনাকে জানতে হবে।
গিয়ে সে ডোনার গলা জড়িয়ে ধরে তার পাশে বসে বলল, ‘মনে হচ্ছে তর সইছে না। প্রেমে পড়লে এমন হয়।’
‘তাহলে প্রেমে পড়ার অভিজ্ঞতা তোমার আছে? তাই কি?’ বলল ডোনা।
তাতিয়ানা ভাবল, নিজে ধরা না দিলে ডোনাকে ধরা যাবে না। বলল, ‘আছে, কিন্তু খুব খারাপ অভিজ্ঞতা।’
‘মানে?’
‘প্রেমে পড়েছি কিন্তু প্রেম পাইনি। সুতরাং অভিজ্ঞতা খুব তিক্ত।’
ডোনা তাতিয়ানাকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘মিথ্যা বলছ। তোমার মত লাখে একজন নেই। তুমি প্রেম পাবে না ঠিক নয়।’
তাতিয়ানা ডোনার মুখ টেনে নিজের চোখের সামনে এনে হেসে বলল, ‘তোমার মত কোটিতে একজন মিলে না এমন প্রতিদ্বন্দ্বী যদি থাকে? তাছাড়া কারও হৃদয় যদি পাথরের হয়, তাহলে সেখানে ফুল ফুটবে কি করে?’
কথা শেষ করেই তাতিয়ানা বলল,‘নিশ্চয় আমার মত তিক্ত অভিজ্ঞতা তোমার নেই?’
ডোনা জবাব দিল না সংগে সংগে। তার ঠোঁটে মিষ্টি হাসি।
তাতিয়ানা সেদিকে চেয়ে বলল, ‘বুঝেছি। তোমার মিষ্টি হাসি জবাব দিয়েছে। এখন বল কোন সে সৌভাগ্যবান?’
ডোনা গম্ভীর কন্ঠে বলল, ‘বলতে পার আমি সুখী, কিন্তু সেই সাথে অসুখীও।’
‘সুখটা আবার অসুখ হলো কি করে?’
‘সুখের আকাশ যদি বিপদের পর বিপদের কালবৈশাখীতে ভরা থাকে, তাহলে সুখ আর থাকে কোথায়?’
‘বুঝলাম না, তোমাদের এমন বিপদের কথা তো শুনিনি?’
‘তাঁর জীবনও তো আমার জীবন!’
‘বুঝেছি। সেই ‘তিনি’টা কে?’
প্রশ্নটা করতে গিয়ে বুকটা কেঁপে উঠল তাতিয়ানার। যে বিপজ্জনক জীবনের কথা ডোনা বলছে, সে জীবনটা আহমদ মুসার নয়তো? ভাবতেই বুকটা তার যন্ত্রণায় ছিঁড়ে যেতে চাইল। তার মন বলল, উত্তরটা না শোনাই ভাল।
তাতিয়ানার প্রশ্নের জবাব ডোনা তৎক্ষণাৎ দেয়নি।
তাতিয়ানার দুর্বল মন জবাবের জন্যে ডোনাকে আর চাপ দিল না। উঠে দাঁড়াল তাতিয়ানা। বলল, ‘চল, অ্যান্টি, আংকেলরা ব্রেকফাষ্ট টেবিলে এসে গেছেন।’
ব্রেক ফাষ্ট সেরে রোদ আরেকটু তেতে উঠল ডোনা ও তাতিয়ানা নিচে নেমে এল রণ নদীর তীরে বেড়াবার জন্যে।
পাশাপাশি দু’জন হাঁটছিল।
প্রশ্নটার উত্তর ডোনা দেয়নি। কিন্তু তারপর থেকে তাতিয়ানার মন ভাল নেই। একটা অস্বস্তিকর যন্ত্রণা ছড়িয়ে পড়েছে যেন তার রক্তের প্রতিটি কণিকায়। জবাব তাকে পেতেই হবে।
মনটাকে শক্ত করে নিল তাতিয়ানা। তারপর ডোনাকে কাছে টেনে তার গলা জড়িয়ে ধরে বলল, ‘আমার জবাব কিন্তু দাওনি।’
‘কি বলব বল।’ সলজ্জ হেসে বলল ডোনা।
‘তিনি ফরাসী নিশ্চয়? দুরু দুরু বুকে প্রশ্ন করল তাতিয়ানা।
‘না তিনি ফরাসী নন।’
জবাব শুনে বুক ছ্যাঁৎ করে উঠল তাতিয়ানার। কিন্তু সামলে নিল নিজেকে। প্রশ্ন করল, ‘বিদেশী? কোন দেশী?’
‘ও এশিয়ান। কিন্তু ওর নির্দিষ্ট কোন দেশ নেই।’
বুকে একটা হাতুড়ির ঘা লাগল তাতিয়ানার। মিলে যাচ্ছে। আহমদ মুসার সথে মিলে যাচ্ছে তাঁর বর্ণনা। তাহলে আহমদ মুসাই কি সে? কিন্তু কোন নির্দিষ্ট দেশ না থাকা আরও শত শত লোক আছে।
কোন প্রশ্ন করতে পারলো না তাতিয়ানা।
ডোনাও কথা বলল না।
হাঁটছিল দু’জন পাশাপাশি।
অনেক্ষণ পর কম্পিত বুকে শেষ প্রশ্নটা করল, ‘কে এই অদ্ভুত মানুষ?’
‘নামটা নিষিদ্ধ। কিন্তু তোমাকে বলা যায়। তিনি ‘আহমদ মুসা।’
তীব্র শক ওয়েভের মত একটা আঘাত সামলাতে গিয়ে তাতিয়ানা তার চোখ বন্ধ করে ফেলেছিল।
নদী তীরের অসমান রাস্তায় বরফ মোড়া একটা পাথরের সাথে হোঁচট খেয়ে পড়ে গেল তাতিয়ানা।
ডোনা তাড়াতাড়ি তাকে তুলে বলল, ‘তুমি ঠিক আছে? কোথাও লাগেনি তো তোমার?’
‘ব্যস্ত হয়ো না ডোনা। কোথাও লাগেনি আমার। খেয়াল করিনি পাথরটাকে। হোঁচট খেয়েছি।’
ডোনা তাকে বুকে জড়িয়ে বলল, ‘তোমাকে কেমন বিমর্ষ লাগছে। তোমার শরীর খারাপ হয়নি তো?’
‘না ডোনা ভাল আছি। একটু মাথা ধরা তেমন কিছু নয়।’
‘তাহলে চল ঠান্ডায় ঘুরে কাজ নেই। বাসায় ফিরে যাই।’
‘তাই চল।’
বাসায় ফিরে এল ওরা।
তাতিয়ানা নিজেকে এতক্ষণ সামলে রাখতে পেরেছিল।
বাসায় ফিরে ডোনা বলল তাতিয়ানাকে, ‘তুমি একটু রেষ্ট নাও। মাথার ব্যথা না কমলে বিকেলে ডাক্তারকে কনসাল্ট করা যাবে।’
ডোনা নিজের ঘরে চলে গেল।
তাতিয়ানা নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল।
এতক্ষণ মনের সকল শক্তি দিয়ে নিজেকে ধরে রেখেছিল। আর পারল না। মেঝের উপরই সে কান্নায় ভেঙে পড়ল।
অতীতে আরও অনেক কেঁদেছে তাতিয়ানা। সে কান্না ছিল না পাওয়ার। কিন্তু আজকের কান্না সব হারানোর।
কাঁদতে কাঁদতে অবসন্ন তাতিয়ানা ঘুমিয়ে পড়েছিল মেঝেতেই।

তাতিয়ানা ডোনা ও তার আব্বাকে নিয়ে সেদিনই বিকেলে ফিরে এসেছিল জেনেভায়।
সেদিন দুপুরে ডোনা ফাতেমা হিরেনের সাথে টেলিফোনে কথা বলে জানতে পেরেছিল, আহমদ মুসা ফিরে আসার পর গত রাতে শত্রুর ঘাঁটিতে গিয়ে আর ফিরে আসেনি।
কথাটা শুনে মুষড়ে পড়েছিল ডোনা। আর আপাত শান্ত তাতিয়ানার হৃদয়ে উঠেছিল উদ্বেগ-উৎকন্ঠার ঝড়।
তাতিয়ানা সিদ্ধান্ত নিয়েছে ডোনাকে ঘুণাক্ষরেও কিছু জানতে না দেয়ার। ডোনার কাছ থেকে আরও কিছু সে শুনেছে। বুঝেছে, দীর্ঘদিন ধরে অসংখ্য ঘটনার মধ্যে দিয়ে আহমদ মুসার সাথে তার গভীর সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। ওদের মাঝখানে তার দাঁড়ানো ঠিক নয়। এসব কথা ভাবতে গিয়ে হৃদয় যেন রক্তক্ষরণ হয়েছে তাতিয়ানার।
আহমদ মুসার খবর পাওয়ার পর তাতিয়ানা আর দেরী করতে চায়নি। বিকেলেই চলে এসেছে ওদের নিয়ে।
জেনেভা পৌঁছেই ডোনা তাতিয়ানাকে নিয়ে চলে গেল ওয়ার্ল্ড নিউজ (WNA) এজেন্সীর অফিসে।
ফাতেমা হিরেনকে অফিসেই পেল ডোনা।
‘ওয়েলকাম মিস মারিয়া লুই। আমরা আপনার অপেক্ষা করছি।’ বলল ফাতেমা হিরেন।
‘আর কোন খবর আছে?’ বলেই ডোনা তাতিয়ানাকে দেখিয়ে বলল, ‘মিস তাতিয়ানা পিটার। আমার বোন, বন্ধু সব।’
‘খুশী হলাম। কেমন আছেন?’ বলল ফাতেমা হিরেন।
‘আমিও খুশী হলাম। ভাল আছি।’ বলল তাতিয়ানা।
‘ধন্যবাদ।’ বলে ফাতেমা হিরেন ডোনার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ওঁর খোঁজ নেবার জন্যে সাহায্য চাওয়া হয়েছিল। তিনজন এসেছেন।’
‘কাদের কাছে সাহায্য চাওয়া হয়েছিল?’
‘সাইমুমের কাছে।’
‘আচ্ছা কোত্থেকে ওরা এসেছেন?’
‘ফ্রান্স থেকে।’
‘ওরা কি বলেছেন?’
‘যে ঠিকানা আমাদের কাছে আছে, সে ঠিকানায় ওরা খোঁজ-খবর নিচ্ছেন। আজ রাতেই ওরা ঐ ঠিকানায় ঢুকবেন, যদি আপনারা ভিন্নমত না করেন।’
‘ওরা বলেছেন এটা?’
‘না এ মত মিঃ গটেফ এবং মিঃ জারমিসের। পরিকল্পনা চূড়ান্ত করার আগে তারা আপনার মত নিতে বলেছেন।’
‘ধন্যবাদ। পরিকল্পনা ঠিকই আছে। সাইমুমের লোকদের পরামর্শ দেবার মত আমার কিছু নেই। তবে ঠিকানার লোকেশান এবং ওরা রাতে ঠিক কয়টায় ওখানে পৌঁছবেন, তা আমরা জানতে চাই।’
‘ঠিক আছে মিঃ গটেফকে বলে আপনাকে জানিয়ে দিচ্ছি।’ বলল ফাতেমা হিরেন।
‘ধন্যবাদ। আমরা বাসায় যাচ্ছি। তথ্য দু’টো যত তাড়াতাড়ি জানতে পারি ততই আমাদের সুবিধা।’
‘আরেকটা কথা। মিঃ গটেফ বলেছেন, ওঁরা তিনজন অভিযানে গেলে বাড়ির বাইরে বাড়িটার উপর চোখ রাখার জন্যে মিঃ গটেফ ও মিঃ জারমিস কিছু লোক রাখার ব্যবস্থা করেছেন।
‘তা রাখতে পারেন। তবে ব্যাপারটা সাইমুমের লোকদের জানাতে হবে। আর ওঁদের আরও জানাবেন, আশে-পাশে আমাদের মত কেউ থাকতে পারে।’
বলে ডোনা উঠে দাঁড়াল।
ফাতেমা হিরেনও উঠে দাঁড়াল। গাড়ি পর্যন্ত এসে বিদায় জানাল। গাড়ি চলতে শুরু কররে তাতিয়ানা বলল, ‘তোমার সিদ্ধান্তকে মোবারকবাদ জানাচ্ছি ডোনা।’
‘কোন সিদ্ধান্ত?’
‘শত্রুর ঠিকানায় আমাদের যাবার সিদ্ধান্ত।’
‘তুমিও আমার সাথে যাবে তাতিয়ানা?’
তাতিয়ানার বুকের বেদনাটা চিন চিন করে উঠল। আহমদ মুসা বিপদে, একথা জেনেও সে চুপ করে বসে থাকবে! একটা বেদনার হাসি ফুটে উঠল তাতিয়ানা ঠোঁটে। বলল, ‘তুমি যাবে, আর আমি ঘরে বসে থাকব- একথা ভাবতে পার তুমি?’ মুখ না তুলেই কথা বলল তাতিয়ানা।
‘না পারি না তাতিয়ানা। মাত্র দু’দিনে আমরা যে শত বছরের মত একাত্ম হয়ে গেছি। তোমাকে ঘরে রেখে আমি যেতে পারতাম না। মনে হতো অর্ধেক শক্তি যেন আমি রেখে গেলাম। তুমি না যেতে চাইলেও তোমাকে টেনে নিয়ে যেতাম।’
ডোনা আনন্দে ডান হাত স্টেয়ারিং- এ রেখে বাম হাত বাড়িয়ে দিল তাতিয়ানার দিকে।
তাতিয়ানা ডান হাত দিয়ে চেপে ধরল ডোনার হাত।
‘আমরা সুখে-দুঃখে এক সাথে।’ তাতিয়ানার হাত শক্ত করে চেপে ধরে বলল ডোনা।
‘না সুখে নয়, সকল দুঃখে আমরা এক সাথে।’
‘সুখে নয় কেন?’
‘সুখটা রিজার্ভ থাক। দুঃখটাই ভাগ করে নেই।’
‘সুখ নিয়ে তুমি স্বার্থপর হতে চাচ্ছ কেন তাতিয়ানা?’
‘কিছু সুখ আছে যেখানে স্বার্থপর হতে হয়। ওর ভাগ দেয়া যায় না ডোনা।’ তাতিয়ানার ঠোঁটে হাসি, কিন্তু তার চোখে অশ্রু টল টল করে উঠল।
ড্রাইভিং সিটে বসা ডোনার চোখ সামনের দিকে নিবদ্ধ থাকায় এই অশ্রু সে দেখতে পেল না।
‘তাতিয়ানা তুমি শত বছরের অভিজ্ঞতা নিয়ে কথা বলছ। জীবন সম্পর্কে এই অভিজ্ঞতা তুমি পেলে কোথায়?’
হাসল তাতিয়ানা। বেদনার হাসি। বলল, ‘অনেক সময় এক মুহূর্তও একশ’ বছরের অভিজ্ঞতা এনে দেয়।
‘ঠিক বলেছ তাতিয়ানা।’
‘গাড়ি এসে দাঁড়াল ডোনার বাসার গাড়ির বারান্দায়। তাতিয়ানারাও এখানে থাকছে, যদিও সে এসে উঠেছে মিঃ কেলভিনের জেনেভার বাসায়। তার লাগেজ সবই রয়েছে সেখানে। শুধু সে থাকছে ডোনার সাথে।
রাত ১১টা বাজার ১৫ মিনিট আগেই ডোনা ও তাতিয়ানা ৯৯ নং লেক আইল্যান্ড বাড়িটার পাশে গিয়ে পৌঁছল। ‘সন্ধ্যার আগে এসে ডোনারা বাড়িটার চারদিক দেখে গেছে।
ডোনা তার গাড়ি দাঁড় করাল ৯৯ ও ৯৮ নং বাড়ির মাঝখানের প্যাসেজটায়। সেখান থেকে ৯৯ নং বাড়িটার তিনদিকে নজর রাখা যায়।
সাইমমের ওরা তিনজন, যারা আসবে এই বাড়িতে আহমদ মুসার সন্ধান নিতে আসার কথা রাত ১১টায়। ডোনারা ১৫ মিনিট আগে এসেছে। ওরা তিনজন কখন আসছে, কখন কোনদিক দিয়ে প্রবেশ করছে, ভেতরে কি ঘটে তার প্রতি দৃষ্টি রাখতে চায় তারা।
ডোনা বুঝতে পারল না সাইমুমের ওরা রাত ১১টা বেছে নিল কেন, রাত ১২টার পরে নির্জন পরিবেশে কেন নয়? আবার ভাবল, জনাকীর্ণ পরিবেশে ঝুকিপূর্ণ অভিযানের বিশেষ সুবিধাও আছে। হয়তো শত্রুর অসতর্ক অবস্থার এই সুযোগ তারা নিতে চায়।
ঠিক কাঁটায় কাঁটায় রাত ১১টায় সাইমুমের ওরা তিনজন এল।
বাড়ি থেকে একটু সামনে ফুটপাতের কার পার্কিং এ গাড়ি দাঁড় করাল ওরা।
ডোনার চোখে ‘নাইট বাইনোকুলার’ এবং কানে ডিস্ট্যান্ট হেয়ারিং মাইক্রো এ্যান্টেনা রয়েছে। এই বাইনোকুলার দিয়ে সিকি মাইল দূর পর্যন্ত রাতেও দেখা যায়। হেয়ারিং মাইক্রো এ্যান্টেনা দিয়ে দু’শ গজ দূরের ফিসফিসানি কথা পর্যন্ত শোনা যায়।
ডোনা শুনতে পেল গাড়ির ভেতরে ওদের তিনজনের শলাপরামর্শ।
ওদের একজন গাড়িতে অপেক্ষা করবে। আধ ঘন্টার মধ্যে না ফিরলে সেও বাড়িতে প্রবেশ করবে অন্য পথে।
দু’জন ওরা নেমে এল গাড়ি থেকে।
ওরা বাড়ির সামনে এসে সোজা প্রধান গেটে গিয়ে দাঁড়াল একেবারে স্বাভাবিক মানুষের মত। যেন এ বাড়িটা তাদেরই। তারপর পকেট থেকে চাবি বের করে দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করল।
ডোনা বুঝল, দরজার তালা খোলার জন্যে ওরা মাষ্টার কি ব্যবহার করছে। এটা খুবই সাধারণ ব্যাপার। কিন্তু ডোনা চমৎকৃত হলো শক্র ঘাঁটিতে প্রবেশের সময় ওদের স্বাভাবিকতা, নির্ভিকতা ও ঠান্ডা মাথার কাজ দেখে।
ডোনা তাতিয়ানার কানে কানে ফিস ফিস করে বলল, ‘আহমদ মুসার সাইমুম সত্যিই অনন্য।’
‘সত্যিই চমৎকৃত হওয়ার মত ঘটনা। বলর তাতিয়ানা।
ওরা ভেতরে চলে গেল তারপর সব নীরব।
‘৯৯নং এই বিল্ডিংটি সম্পূর্ণ সাউন্ড প্রুফ। মনে হয় স্টুডিও হিসাবেই একে সাউন্ড প্রুফ করা হয়েছিল।’ বলল ডোনা।
আধ ঘন্টা পার হয়ে গেল। কেউ ফিরল না।
ডোনা দেখল, গাড়ি থেকে তৃতীয় ব্যক্তি বের হয়ে এল। সে বাড়ির সামনের দিকটা এড়িয়ে ডোনাদের গাড়ি বাড়িটার যে পাশে ছিল সেই পাশে এসে বিল্ডিং- এর নিচে দাঁড়াল।
ডোনা বুঝতে পারল, সাইমুমের এ লোকটি বাড়ির এ পাশ দিয়ে সম্ভবত জানালার গরাদ খুলে বা কেটে ভেতরে প্রবেশের চেষ্টা করবে।
ডোনা তাতিয়ানাকে ইশারা করে গাড়ি থেকে বেরিয়ে এল।
সম্ভপর্ণে সাইমুমের তৃতীয় লোকটির পেছনে গিয়ে দাঁড়াল।
শেষ মুহূর্তে পায়ের শব্দ পেয়েছিল লোকটি। বোঁ করে ঘুরে সে বিভলবার তুলতে যাচ্ছিল।
‘রিভলবারের দরকার নেই। আমরা আহমদ মুসার শুভাকাঙ্খী। জানার কথা আপনাদের।’ বলল ডোনা।
লোকটির রিভলবার নেমে গেল। বলল, ‘জি ম্যাডাম, আমরা জানি। বলুন, কি আদেশ। নির্ধারিত সময় পার হয়ে গেছে। ওরা তো ফিরল না।’
‘আপনার ভেতরে প্রবেশের প্রয়োজন নেই। আপনি নিচে পাহারায় থাকুন। বাড়ি থেকে যাতে কেউ বেরুতেও না পারে, ঢুকতেও না পারে। আপনার টেলিফোন আছে?’
‘আছে।’
‘এখন থেকে ঠিক একঘন্টা পরেও আমরা না ফিরলে পুলিশে টেলিফোন করবেন। বলবেন, এই বাড়িতে কিছু লোককে কিডন্যাপ করে রাখা হয়েছে।’
‘জি, আচ্ছা। কিন্তু আপনারা কি ভেতরে প্রবেশ করবেন?’
‘হ্যাঁ।’
‘কিন্তু এটা কি ঠিক হবে? ভেতরে সাংঘাতিক কিছু ঘটেছে।’
‘আমরাও তাই মনে করি। সব বিবেচনা করেই আমরা এ সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’
বলে একটু থেমেই আবার বলল, ‘আপনি আপনার দায়িত্ব বুঝতে পেরেছেন তো?’
‘জ্বি।’
‘ঠিক আছে। আপনি আপনার গাড়িতে বসে অপেক্ষা করুন।’
লোকটি সালাম দিয়ে যেভাবে ঘুরা পথে এখানে এসেছিল, সেভাবেই সে তার গাড়ির দিকে চলে গেল।
‘তাতিয়ানা আমরা বাড়ির পেছনের দিক দিয়ে ঢুকব।’ বলল ডোনা।
‘তোমার সিদ্ধান্ত ঠিক আছে।’
বলে তাতিয়ানা একটু থামল। তার ভেতরটা উদ্বেগ-উৎকন্ঠায় কাঁপছে এই ভাবনায় যে, ভেতরে ভয়ানক কিছু ঘটছে। নিজেকে একটু সামলে নিয়ে বলল, ‘ভেতর সম্পর্কে তুমি কি ভাবছ ডোনা?’
‘ও ভাবনাটা মন থেকে আমি দূরে রাখতে চাচ্ছি। তা না হলে এগুতে পারব না, দুর্বল হয়ে পড়ব। এস কিছু না ভেবেই আমরা প্রবেশ করি। তোমার ভয় করছে কি?’
‘কিসের ভয়? কি আছে জীবনে? জীবনের কোন মায়া আমার নেই।’
ডোনার দিকে ফিরে দাঁড়িয়ে তাতিয়ানার মুখোমুখি হয়ে তার ঠোঁটে নিজের তর্জনি চাপা দিয়ে বলল, ‘এমন কথা বলো না তাতিয়ানা। জীবনকে ভালবাসা আল্লাহকে ভালবাসার অংশ।’
‘কিন্তু জীবন কোরবানী না দিলে তো কোন বড় কাজ হয় না। ইসলামও তো এই কুরবানী চেয়েছে।’
‘কিন্তু সেটা জীবনকে ভালবেসে আল্লাহর পথে সর্বাত্মক কাজ করার একটা অংশ। লক্ষ্য এখানে কাজ করা। কাজ করতে গিয়ে জীবন দেয়ারও প্রয়োজন হতে পারে।’
‘ধন্যবাদ ডোনা। বুঝেছি ব্যাপারটা। আসলে আমি ভয় পাচ্ছি না সেই কথাই বলতে চাচ্ছিলাম।’
‘ধন্যবাদ।’
‘বলে ডোনা বিল্ডিং-এর ছায়ার ঘন অন্ধকারের মাঝ দিয়ে বাড়ির পেছন দিকে চলল।
বাড়ির দেয়াল ঘেঁষে লেকের পানির কিনার পর্যন্ত গিয়ে দাঁড়ালো ডোনা। বাড়ির দেয়াল পানির ভেতর আরও কিছুটা এগিয়ে গেছে, তারপর পাওয়া যাবে বাড়ির পেছনের বাগান ঘেরা রেলিং।
ডোনা ও তাতিয়ানা দু’জনেই পরেছে ট্রাক-স্যুট। তার উপর পরেছে গলা থেকে পা পর্যন্ত নামানো গাউন। গাউনের উপর দিয়ে কোমরে বেল্ট আটকানো। মাথায় কালো রুমাল। তার উপর ফেল্ট হ্যাট।
গাউন দু’হাতে উঁচু করে ধরে পানিতে নামল ডোনা। তার পেছনে তাতিায়ানা। দু’জনেরই রাবারের মোজা পরা। হাঁটুর উপর পর্যন্ত উঠানো।
হাঁটু পানি পর্যন্ত নেমেই দেখল তারা রেলিং এর প্রান্ত পর্যন্ত পৌঁছে গেছে।
উপরে রেলিং এর দিকে একবার তাকিয়ে ডোনা বেল্টে ঝুলানো পকেট থেকে সিল্কের কর্ড বের করে রেলিং লক্ষ্যে ছুড়ল। দু’বারের চেষ্টা ব্যর্থ হবার পর তৃতীয় চেষ্টায় কর্ডের হুক রেলিং- এর সাথে আটকে গেল।
সিল্কের কর্ড বেয়ে প্রথমে উঠল ডোনা। তারপর তাতিয়ানা।
বাগানে দাঁড়িয়ে বাড়ির দিকে নজর বুলিয়ে দেখল, বাগানের গোটা উত্তর পাশ জুড়ে দাঁড়িয়ে আছে বাড়িটা। বাগানের পশ্চিম অংশে মনে হলো গোডাউন জাতীয় কিছু।
বাড়ির এপাশে একটি সিঁড়ি দেখে খুশী হলো ডোনা। বলল, ‘তাতিয়ানা এই সিঁড়িটা আমাদের জন্যে আল্লাহর রহমত।’
‘তা বটে। কিন্তু কোন তলায় প্রথম ঢুকবে বলে মনে করছ?’
চিন্তার রেখা ফুটে উঠল ডোনার চোখে মুখে। বলল, ‘গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন করেছ। ভাবতে হবে এ নিয়ে।’
তারা সিঁড়ির দিকে এগুবে, এমন সময় একটা শব্দ শুনে চাইল সামনের দিকে। দেখল, সিঁড়ি যেখানে শেষ হয়েছে তার সামনেই দেয়ালের গায়ে একটা দরজা নড়ে উঠছে।
ডোনা তাতিয়ানাকে নিয়ে বসে পড়ল।
ফুলের গাছার ফাঁক দিয়ে তারা দেখল ইস্পাতের দরজা খুলে একজন লোক বেরিয়ে এল। তার হাতে বৈদ্যুতিক লন্ঠন। সেই আলোতে দেখা গেল, বিদ্যুতের কিছু তার এবং একটা বাল্ব তার হাতে।
লোকটি হাতের বিদ্যুতের তারের প্রান্তটা নিয়ে সিঁড়ির সাথে বাঁধল এবং তাতে বাল্ব জ্বালাতেই আলো জ্বলে উঠল।
ডোনা বুঝল, বাগানের দিক থেকে তারা মনে হয় কিছু সন্দেহ করছে। তাই এদিকে আলো জ্বেলে রাখল।
লোকটা ফিরে যাচ্ছিল দরজার দিকে।
ডোনা সংগে সংগে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিল। ছোট একটা পাথরের টুকরো ছুড়ে মারল লোকটিকে লক্ষ্য করে।
লোকটি শক খাওয়া মানুষের মত চমকে উটে ফিরে দাঁড়াল। তার হাতে উদ্যত হযে উঠেছে রিভলবার।
ডোনা তার সাইলেন্সার লাগানো রিভলবার থেকে প্রথম গুলীটা ছুড়ল লোকটিকে লক্ষ করে।
লোকটি বুকে গুলী খেয়ে নিঃশব্দে ঢলে পড়ল মাটির উপর।
ডোনা ও তাতিয়ানা দেরী না করে হামাগুড়ী দিযে দরজার দিকে চলল।
দু’জন ভেতরে ঢুকল। দরজা বন্ধ করে দিল ডোনা।
‘তুমি ঠিকই বলেছিলে ডোনা, পুরো বাড়িটাই সাউন্ড গ্রুফ।’ ভেতরে ঢুকে চারদিকে তাকিয়ে বলল তাতিয়ানা।
ডোনা ডিস্ট্যান্ট হেয়ারিং কানে লাগাল।
কানে লাগিয়েই বলল, ‘তাতিয়ানা গুণ গুণ করতে করতে কেউ এদিকেই মনে হয় আসছে।
ডোনা ও তাতিয়ানা সিঁড়ির নিচে রাখা একটা বাক্সের আড়ালে লুকিয়ে পড়ল।
অল্পক্ষণের মধ্যেই একজন স্টেনগানধারী পাশের করিডোর দিয়ে এল। তার লক্ষ্য দরজা। কিন্তু দরজার দিকে তাকিয়ে দরজা বন্ধ দেখেই সে চিৎকার করে ডেকে উঠল, ‘হেভেন তুমি কোথায়? তোমার ডাক পড়েছে উপরে।’
বলে সে চারপাশে নজর করছিল। বাদদিকে তাকাতে গিয়েই সে দেখতে পেল উদ্যত রিভলবার হাতে দাঁড়ানো ডোনা ও তাতিয়ানাকে।
সেদিকে সে তার স্টেনগান ঘুরাতে যাচ্ছিল। কিন্তু তার আগেই ডোনার একটা গুলী গিয়ে বিদ্ধ করল স্টেনগান ধরা লোকটির ডান হাতকে। স্টেনগান পড়ে গেল তার হাত থেকে।
ডোনা দু’পা এগিয়ে বলল, ‘দ্বিতীয় গুলী এবার বক্ষদেশ বিদ্ধ করবে। বল, ‘বন্দীদের তোমরা কোথায় রেখেছ?’
লোকটি মুখ খুলল না।
ক্ষেপন করার মত সময় নেই ডোনাদের হাতে। ডোনার দ্বিতীয় গুলী গিয়ে বিদ্ধ করল লোকটির বক্ষদেশকে। ইতিমধ্যে তাতিয়ানা কুড়িয়ে নিয়েছিল লোকটির স্টেনগান।
‘তাতিয়ানা, আমার মনে হয় কর্তা ব্যক্তিরা উপরে আছেন। বন্দীও থাকতে পারে উপরে। চল আমরা যতদূর সম্ভব ওদের সংগঠিত হবার সুযোগ না দিয়ে এগুব।’
সিঁড়ি দিয়ে ডোনা ও তাতিয়ানা উঠতে লাগল পাশাপাশি।
ওরা দু’তলায় দেখল, দু’টো করিডোর দু’তলার দু’দিকে চলে গেছে। আর সিঁড়ি উঠে গেছে তিন তলায়।
ডোন উৎকর্ণ হয়ে উঠেছিল। বলল, ‘তাতিয়ানা সাবধান, অনেকগুলো পায়ের শব্দ পাচ্ছি। পশ্চিম দিক থেকে যেন কারা আসছে।’
বলে ডোনা পুব দিকের করিডোরের দিকে চলে গেল। আর তাতিয়ানা এক দৌড়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে দু’তলার হাফ ল্যাডিং-এ গিয়ে দাঁড়াল।
মাত্র বিশ সেকেন্ড। পশ্চিম পাশের করিডোর দিয়ে ৪জন লোক বেরিয়ে নিচে নামার জন্যে সিঁড়ি মুখে চলে এল। তাদের সকলের হাতেই স্টেনগান।
তাতিয়ানা প্রস্তুত ছিল।
ওরা চারজনও শেষ মুহূর্তে দেখতে পেল তাতিয়ানাকে। কিন্তু কিছু করার তারা সুযোগ পেল না। তার আগেই তাতিয়ানার গুলী বৃষ্টি ওদের ঘিরে ধরল।
সিঁড়ি মুখেই ওরা চারজন হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল।
সংগেই সংগেই বেরিয়ে এসেছিল ডোনা। তুলে নিয়েছিল স্টেনগান। তাতিয়ানার দিকে তাকিয়ে কিছু বলতে যাচ্ছিল।
এই সময় পূর্ব দিকের করিডোরের দিক থেকে একটি কন্ঠ চিৎকার করে উঠল, ‘স্টেনগান ফেলে দিয়ে হাত তুলে দাঁড়াও।’
ডোনাকে লক্ষ্য করে নির্দেশটা দেয়া হয়েছিল।
ডোনা করিডোরের দিকে ফিরে তাকিয়েই ফেলে দিল স্টেনগান। তাতিয়ানা ইতিমধ্যে ছুটে এসেছে দু’তলার সিঁড়ির মাথায়। দাঁড়াল সে দেয়ালের প্রান্ত ঘেঁষে স্টেনগান বাগিয়ে।
ডোনা স্টেনগান ফেলে দেয়ার সাথে সাথে করিডোরের দিক থেকে তিনজন ছুটে এসেছিল। তারা তাতিয়ানার স্টেনগানের সহজ শিকারে পরিণত হলো। আগের চারজনের সাথেই ওদের তিনজনের লাশ পড়ে গেল সিঁড়ির মাথায়।
তিন তলার করিডোর থেকে পায়ের শব্দ ভেসে আসছিল। উপর থেকে ছুটে আসা পায়ের শব্দ আগেই টের পেয়েছিল ডোনা তার ডিস্ট্যান্ট হেয়ারিং এ্যান্টিনায়। স্টেনগান তুলে নিয়ে সিঁড়ির রেলিং- এর কভার নিয়ে সাপের মত উঠে গিয়ে হাফ ল্যান্ডিং মুখে ওঁৎ পেতে বসেছিল ডোনা।
দু’জন তিনতলার পুব দিকের করিডোর দিয়ে ছুটে এসে সিঁড়ি দিয়ে নামতে যাচ্ছিল।
ডোনার প্রস্তুত স্টেনগান অগ্নিবৃষ্টি করল তাদের প্রতি।
দু’জনেরই দেহ ঝাঁঝরা হয়ে গেল। ঝরে পড়ল তাদের দেহ সিঁড়ির মাথায়।
ডোনা উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘তাতিয়ানা এস।’
বলে ডোনা ছুটে উপরে তিন তলায় উঠে গেল। তিন তলার ল্যাডিং-এর সীমানায় দেয়ালে পিঠ লাগিয়ে স্টেনগান বাগিয়ে দু’পাশের করিডোরের দিকে নজর রাখল সে।
তাতিয়ানা উঠে এলে দু’জন দুই করিডোরের দিকে নজর রাখল।
ডোনা উৎকর্ণ হয়ে দেখল, না কোন দিক দিয়েই কোন শব্দ আসছে না।
পল পল করে দু’মিনিট চলে গেল। না কোন দিক থেকেই কোন শব্দ আসছে না।
‘তাতিয়ানা, তুমি দুই করিডোরের দিকে নজর রাখ। আমি পশ্চিম অংশটা দেখে আসি।’
বলে ডোনা পশ্চিম দিকের করিডোর দিয়ে ভেতরে ঢুকে গেল।
ফিরে এল পাঁচ মিনিট পর। বলল, ‘একেবারে শূন্য। কেউ নেই।’
‘নিচে তো অবশ্যই কেউ নেই। উপরেও কি কেউ নেই?’
‘থাকলে সাত-আট মিনিট কেউ বসে থাকতো না। বিশেষ করে তারা যখন জানে না এদিকে কি ঘটেছে।’
এরপর দু’জনের একজন সামনে অন্যজন পেছন দিকে নজর রেখে পুব দিকের অংশে প্রবেশ করল।
বিড়ালের মত সন্তর্পণে কিছুটা চলার পর কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে ডোনা উৎকর্ণ হয়ে শুনতে চেষ্টা করল কোন শব্দ কোথা থেকে আসে কিনা।
এক জায়গায় দাঁড়াবার পর হঠাৎ ডোনার এ্যান্টেনায় ভেসে এল ক্লিক করে উঠা মোটা ধাতব একটা শব্দ। ডোনা নিশ্চিত হলো, এটা দরজা খোলা বা বন্ধ হবার শব্দ। শব্দের ডাইরেকশন বুঝতে চেষ্টা করে দেখল, যে করিডোরে তারা দাঁড়িয়ে আছে, সেখান থেকে পুবদিকে খুব কাছে থেকেই এ শব্দটা এসেছে।
এগুলো দু’জন করিডোর ধরে পুব দিকে।
একটু এগিয়েই পেল উত্তর দক্ষিণ একটা করিডোর।
ডোনা ও তাতিয়ানা করিডোরের দুই দেয়াল ঘেঁষে দু’জন খুব সন্তর্পণে মুখ বাড়াল করিডোরে।
করিডোর শূন্য। তবে খুব সামনেই করিডোরের ওপাশের দেয়ালে একটা দরজা।
ডোনা ভাবল, এই দরজা দিয়েই কেউ বেরিয়েছে বা ঢুকেছে তিরিশ-চল্লিশ সেকেন্ড আগে।
দরজার নব ঘুরিয়ে দেখল দরজা খোলা।
স্টেনগান বাগিয়ে ডোনা এক ঝটকায় খুলে ফেলল দরজা। প্রবেশ করল ডোনা।
কিন্তু তাতিয়ানা তৎক্ষণাৎ প্রবেশ করল না। দরজায় দাঁড়িয়ে চোখ রাখল বাইরের দিকে।
ভেতরে ঢুকেই ডোনা দেখতে পেল, ঘরের উত্তর পাশে একটা চেয়ারে আহমদ মুসা আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা। আরও দু’জন হাত-পা বাঁধা মেঝেতে পড়ে আছে। দুজনেই আহত।
ছুটে যাচ্ছিল ডোনা আহমদ মুসার দিকে। সে খেয়াল করেনি আহমদ মুসার পেছনেই আরেকজন দাঁড়িয়ে আছে। তারও হাতে স্টেনগান। তার হাত উঠে গেল দেয়ালের সুইচে। চিৎকার করে বলল, ‘হাত থেকে স্টেনগান ফেলে দিয়ে হাত তুলে দাঁড়াও। এক মুহূর্ত দেরী হলে আমি বিদ্যুতের ৪৫০ ভোল্টের সুইচ টিপে দেব। গোটা চেয়ার বিদ্যুতায়িত হয়ে অঙ্গারে পরিণত হবে আহমদ মুসা।’
সঙ্গে সঙ্গে পাথরের মত দাঁড়িয়ে গেল ডোনা। ফেলে দিল হাত থেকে স্টেনগান। হাত তুলে দাঁড়াল সে।
চমকে উঠেছিল তাতিয়ানা।
আশ্বস্ত হলো ডোনার স্টেনগান ফেলার শব্দ শুনে। একটু সময় পাওয়া গেল।
তাতিয়ানা তার রিভলবার বাগিয়ে দরজার চৌকাঠ ঘেঁষে কোন রকমে ডান চোখটা ভেতরে নিয়ে আহমদ মুসার পিছনে দাঁড়ানো লোকটাকে এক ঝলক দেখে নিয়ে বিসমিল্লাহ বলে গুলী করল তার মাথা লক্ষ্যে।
গুলী লোকটার কপাল ভেদ করে বেরিয়ে গেল।
ছিটকে তার দেহটা দেয়ালের সাথে ধাক্কা খেয়ে পড়ে গেল।
ছুটল ডোনা আহমদ মুসার বাঁধন খুলে দেয়ার জন্যে।
তাতিয়ানাও ঘরে প্রবেশ করে ছুটল সেদিকে বাঁধন খুলতে ডোনাকে সাহায্য করার জন্য।
বাঁধন খুলতে খুলতে হঠাৎ ডোনা চিৎকার করে উঠল, ‘তাতিয়ানা কেউ আসছে।’
ডোনা আহমদ মুসার সামনে হাতের বাঁধন খুলছিল। আর তাতিয়ানা পাশে দেহের বাঁধন কেটে দিচ্ছিল।
ডোনার চিৎকারের সংগে সংগে তাতিয়ানা ঘুরে দাঁড়াল।
ডোনাও ঘুরে দাঁড়িয়েছিল।
তাতিয়ানা ও ডোনা দু’জনেই দেখল, ঘরের মেঝে ভেদ করে একজন লোক আবির্ভূত হয়েছে ঘরের দক্ষিণ প্রান্তে। তার হাতের রিভলবার উঠে এসেছে আহমদ মুসার লক্ষ্যে।
লোকটির তর্জনি নড়ে উঠছ। তর্জনি চেপে বসেছে রিভলবারের ট্রিগারে।
বিমূঢ় তাতিয়ানা চিৎকার করে আছড়ে পড়ল গিয়ে ডোনার দেহের উপর। ঢেকে দিল ডোনার দেহকে নিজের দেহ দিয়ে। আর সেই সাথেই রিভলবার গর্জন করে উঠল লোকটির। তাতিয়ানার বুকের পাশ ভেদ করে গেল গুলীটি।
ডোনা ততক্ষনে তার কোমরের বেল্টে ঝুলানো পকেট থেকে রিভলবার তুলে নিয়েছিল।
সে বামহাতে তাতিয়ানাকে জড়িয়ে রেখে ডান হাত তুলে গুলী করল লোকটিকে। লোকটি এগিয়ে আসছিল সম্ভবত, আহমদ মুসাকে সঠিকভাবে টার্গেট করার জন্যে। দু’পা এগুতে পারল না। ডোনার গুলী তার কপাল গুড়িযে দিল।
ডোনা তাড়াতাড়ি তাতিয়ানাকে অতি সন্তর্পণে মেঝের উপর নামিয়ে রেখে আহমদ মুসার অবশিষ্ট বাঁধন কেটে দিয়েই তাতিয়ানার দেহ কোলে তুলে নিয়ে ডুকরে কেঁদে উঠল।
আহমদ মুসা মুক্ত হয়েই প্রথমে সাইমুমের দু’জনের বাঁধন কেটে দিল।
সাইমুমের দু’জন যোদ্ধা উঠেই দু’টো স্টেনগান হাতে তুলে নিল।
আহমদ মুসা তাতিয়ানার পাশে বসে তার একটি হাত হাতে নিয়ে বলল, এ তোমার কি হলো তাতিয়ানা। তুমি কিভাবে এখানে এলে, এর সাথে জড়িয়ে পড়লে!’
‘আমার আল্লাহ আমাকে এখানে নিয়ে এসেছেন। তাঁর কাছে সর্বান্তকরণে এমন কিছুই তো চেয়েছিলাম।’ ধীর কন্ঠে বলল তাতিয়ানা।
‘ডোনা তাতিয়ানাকে তুলে নাও। হাসপাতালে নিতে হবে।’ বলে আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল।
তাতিয়ানা ম্লান হাসল। বলল, ‘তুমি ব্যস্ত হয়ো না। হাসপাতালে যাবার সময় আমার নেই।’
ডোনা কেঁদে উঠে জড়িয়ে ধরল তাতিয়ানাকে, ‘না মরতে পার না, মরতে দেব না তোমাকে। এ তুমি কি করলে। কেন তুমি তোমার জীবন দিয়ে আমাকে বাঁচাতে গেলে?’
তাতিয়ানা ডোনার দিকে স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে বলল, ‘ না ডোনা, এক পাথর হৃদয়ে ফুল ফুটাতে পেরেছ তুমি, এক মহা বিপ্লবীর পাথর হৃদয় গলাতে পেরেছ তুমি, তুমি তার প্রিয়তমা। তোমার জীবন অসীম মূল্যবান, তোমাকে বাঁচতে হবে ওঁর জন্যেই।’
‘থাম, এসব কি বলছ তুমি।’ বলে তাতিয়ানার মাথা টেনে নিল বুকের আরও কাছে।
মুখ নিচু করে পাথরের মত বসেছিল আহমদ মুসা তাতিয়ানার পাশেই।
বহু কষ্টে তাতিয়ানা মুখ ঘুরিয়ে তাকাল আহমদ মুসার দিকে। অস্ফুট স্বরে বলল, ‘তাতিয়ানার দিকে একটু তাকাবে না?’
আহমদ মুসা তাকাল তাতিয়ানার দিকে। এই প্রথম তাতিয়ানার চোখে চোখ রাখল আহমদ মুসা।
হাঁপাচ্ছিল তাতিয়ানা। আহমদ মুসার চোখে চোখ রেখে ক্ষীণ কন্ঠে বলল, ‘একদিন তোমাকে বলেছিলাম, বিপ্লবীর মন থাকতে নেই। বলেছিলাম, বিপ্লবীরা রক্ত স্রোতের দেয়াল পেরিয়ে হৃদয়ের সবুজ উপত্যকা দেখতে পায় না। … আমার কথা ঠিক ছিল না। … আমি স্বীকার করছি, তুমি বিপ্লবী, কিন্তু তোমার একটি নরম মন আছে, সবুজ একটি হৃদয় আছে। তো…মাকে অভি…নন্দ…ন।’
বহু কষ্টে কথা শেষ করল তাতিয়ানা। চোখ দু’টি তার বুজে গেল।
আহমদ মুসার চোখ অশ্রুসিক্ত হয়ে উঠেছে। ঠোঁট দু’টি তার পাথরের মত স্থির। অশ্রু যে কথা বলল, ঠোঁট তা বলতে পারল না।
ধীরে ধীরে তাতিয়ানা চোখ খুলল। ডোনার দিকে চেয়ে ফিসফিসিয়ে বলল, ‘ডোনা, আরও কাছে এস, তোমাকে একটা চুমু খাব।’
ডোনা পাগলের মত চুমু খেল তাতিয়ানার কপাল, চোখ, গাল, ঠোঁট সবর্ত্র। কাঁদতে কাঁদতে বলল, ‘তুমি আমাকে এসব কথা বলনি কেন? কেন বলনি তুমি ওকে চিনতে, ভালোবাসতে! আমি ওঁকে ছাড়তে পারব না তাই বুঝি!’
এক টুকরো ম্লান হাসি ফুটে উঠল তাতিয়ানার ঠোঁটে। তার ক্ষীণ কন্ঠে ধ্বনিত হলো, ‘ডোনা বোন, সারাজীবন ধরে জীবনটা ভোগ করলেও আজকের মৃত্যুর মত এত সুখ আমি পেতাম না। কেঁদনা বোন, আমি মরে গেলেও তোমার মধ্যে আমি বেঁচে থাকব। আমরা দু’জন না একাত্মা! তাহলে তোমার চোখ আমার চোখ, তোমার ঠোঁট আমার ঠোঁট, তোমার কথা আমার কথা হবে না কেন?’
তাতিয়ানার শেষ কথাগুলো ক্ষীণতর হতে হতে নীরবতায় মিলিয়ে গেল।
পরক্ষণেই কষ্ট করে চোখ আবার খুলল তাতিয়ানা। তাকাল আহমদ মুসার দিকে। বলল, ‘তোমাকে একটা ভার দিতে পারি?’
‘বল।’ শুকনো কন্ঠ আহমদ মুসার। এই একটা শব্দ উচ্চারণ করতে গিয়েও তার ঠোঁট কাঁপল।
শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল তাতিয়ানার। হাঁপাচ্ছিল সে। দু’হাতে পাঁজরটা চেপে ধরে অস্ফুট কন্ঠে বলতে শুরু করল আহমদ মুসার দিকে তাকিয়ে, ‘আমার ব্রীফকেসে একটা ডায়েরী আছে। লক করা। এই ডায়েরী এবং আমার হাতের এই আংটি তোমাকে পৌঁছে দিতে হবে আমার ফুফু প্রিন্সেস ক্যাথরিন (তৃতীয়) কে। আমার পর পিটার পরিবারের একমাত্র উত্তরাধিকারী সে। উনি থাকেন প্যারিসের সোন নদীর দক্ষিণ তীরে লুই এর প্যালেস এলাকার ঐ বাড়িতে।’ বলে তাতিয়ানা ডোনার দিকে তাকিয়ে ক্ষীণ কন্ঠে বলল, ‘আমার আঙুল থেকে আংটি খুলে ওকে দাও।’
তাতিয়ানার ডান হাতের অনামিকা থেকে আংটি খুলতে খুলতে ডোনা বলল, ‘আমাদেরও বাড়ি ঐ এলাকায়। আমি এক ক্যাথরিনকে চিনি।’
তাতিয়ানার কানে কথাগুলো পৌঁছল কিনা বুঝা গেল না। সে বলেই চলল, ‘পিটার দি গ্রেট থেকে শুরু করে ক্যাথরিন (প্রথম), এলিজাবেথ, পিটার (তৃতীয়), ক্যাথারিন (দ্বিতীয়), পল (প্রথম), আলেকজান্ডার (প্রথম), নিকোলাস (প্রথম), আলেকজান্ডার (দ্বিতীয়), নিকোলাস (দ্বিতীয়)- অর্থাৎ সব রুশ সম্রাট এই আংটি সৌভাগ্যের প্রতীক হিসেবে পরেছেন।’
তাতিয়ানার শেষ কথাগুলো ভেংগে পড়ল গভীর ক্লান্তিতে। চোখ বুজে গেল তাতিয়ানার। দেহের স্পন্দন তার শেষ হয়ে যাচ্ছে।
কিছু বলার জন্যে ঠোঁট নাড়ছিল তাতিয়ানা।
চোখ তার ঈষৎ ফাঁক হযে গেল।
চোখ দু’টো আহমদ মুসার দিকে টেনে নিয়ে বলল, ‘আমার কবর দেয়ার সুযোগ হলে মুসলিম মতে আমার দাফন করো। তুমি মরজেস থেকে চলে আসার পর আমি জেনে…ভায় এ …সে ইস…লাম গ্রহ..ণ করে..ছি।’
তাতিয়ানার কথা থেমে যাবার সাথে সাথে তার দেহটাও নিশ্চল হয়ে পড়ল।
‘তাতিয়ানা, বোন আমার।’ বলে তাতিয়ানাকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়ল ডোনা।
ডোনার গাড়ির ড্রইভিং সিটে বসল আহমদ মুসা। আর ডোনা তাতিয়ানার মরদেহ কোলে করে গাড়ির পেছনের সিটে বসল। বসতে গিয়ে ফুপিয়ে কেঁদে উঠল ডোনা। এই গাড়ি করে দু’জন এসেছিলাম এবং পরিকল্পনা করেছিলাম। আর এখন …
কান্নায় রুদ্ধ হয়ে গিয়েছল ডোনার কন্ঠ।
আহমদ মুসা পিছন ফিরে চাইল, কিন্তু কোন কথা বলল না।
সাইমুমের দু’জন গিয়ে উঠেছিল সাইমুমের গাড়িতে।
উপর থেকে নামার আগেই আহমদ মুসা টেলিফোন করেছিল পুলিশকে যে, লেক আইল্যান্ড-এর ৯৯ নং বাড়িতে বড় ঘটনা ঘটেছে। আপনারা আসুন। একইভাবে WNA, FWTV, রায়টার, এএফপি, এপি- সবাইকে টেলিফোন করে খবর দিয়েছে।

রাত থেকেই রেডিও এবং টিভি নেটওয়ার্কের মাধ্যমে WNA ও FWTV সংবাদ সংস্থা দু’টির চাঞ্চল্যকর হত্যা রহস্য গোটা দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়ল। বলা হলো, ব্ল্যাক ক্রস সংবাদ সংস্থা দু’টিকে বন্ধ করার, ধ্বংস করে দেয়ার ষড়যন্ত্র এঁটেছিল। লেক আইল্যান্ডে তাদের নিজস্ব ঘাঁটিতে ব্ল্যাক ক্রসের প্রধান সাইরাস শিরাকসহ তাদের ১৩ জন লোককে নিহত অবস্থায় পাওয়া গেছে। এবং পাওয়া গেছে সিসি মাছির প্রজনন ও পালন ক্ষেত্র। পুলিশের বরাত দিয়ে বলা হয়েছে, সম্ভবত ব্ল্যাক ক্রসএর প্রতিদ্বন্দ্বী কোন গ্রুপ অথবা গোপন সৌখিন কোন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন তাদের হত্যা করে তাদের ষড়যন্ত্র ধরিয়ে দেবার ব্যবস্থা করেছে।
সুইজারল্যান্ডের সবগুলো দৈনিক ব্যানার হেডে খবরটি ছেপেছে। তারা সুইচ পুলিশের ব্যর্থতার তীব্র নিন্দা করেছে এবং দু’টি সংবাদ সংস্থার বিরুদ্ধে পরিচালিত ষড়যন্ত্রে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। সর্বাধিক প্রচাতি ‘দার ব্লিক’ পূর্বাপর ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ দিয়ে অবশেষে লিখেছে, “এই ঘটনা শুধু দু’টি সংবাদ সংস্থার নিরাপত্তাহীনতা নয়, গোটা সংবাদপত্র জগতের স্বাধীনতা ও নিরাপত্তাকে হুমকির সম্মুখিন করে তুলেছে। ব্ল্যাক ক্রস-এর গোটা কার্যক্রমের উপর ইন্টারপোলের মাধ্যমে তদন্ত হওয়া প্রয়োজন। তারা ইতিপূর্বে অনেক কুকীর্তি করেছে, মানবতার বিরুদ্ধে জঘন্য অপরাধ করেছে। মনে করা হচ্ছে, পুলিশের এবং প্রশাসনের একটি মহলের সাথে যোগ সাজশের মাধ্যমে বর্ণবাদী এই সংগঠনটি সর্বত্র যথেচ্ছাচার চালিয়ে যেতে পারছে। সুইচ পুলিশের কারা এর সাথে জড়িত রয়েছে, তারও অবশ্যই তদন্ত হওয়া প্রয়োজন।’
সব শেষে ‘দার ব্লিক’ লিখেছে, WNA এবং FWTV সংস্থা দু’টিসহ নিহতদের পরিবারের উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ হওয়া প্রয়োজন।’

WNA-এর চেয়ারম্যান মিঃ গটেফ এবং FWTV -এর চেয়ারম্যান মিঃ জারমিস জেনেভা বিমান বন্দরে আহমদ মুসার সাথে বিদায়ী হ্যান্ডশেক করতে গিয়ে বলল, ‘যে অবিস্মরনীয় কাজ আপনি করলেন, তার কৃতিত্ব দেবার জন্যে দুনিয়ার মানুষ লোক খুঁজে পাচ্ছে না। আহমদ মুসা আপনার কি ইচ্ছা করে না এই কৃতিত্বের মালিক হতে?’
আহমদ মুসা হেসে বলল, ‘আমার কোন কিছুই আমার নয়? সব কিছু যিনি দিয়েছেন, কৃতিত্ব তো তারই হবার কথা। সব কিছু যিনি দিয়েছেন তাঁর জন্যেই আমি কাজ করছি।’
‘একেই বলে বোধ হয় ফি সাবিলিল্লাহর কাজ?’ বলল মিঃ গটেফ।
মিঃ গটেফের কথা শেষ হতেই মিঃ জারমিস বলল, ‘প্রশংসা নয়, আমাদের কৃতজ্ঞতা আপনি নিন। এ দু’টি সংবাদ সংস্থা ধ্বংস হলে মুসলমানদের শুধু যে তাৎক্ষণিক অপূরণীয় এক ক্ষতি হতো তা নয়, এ ধরনের আর কোন সংবাদ সংস্থা গড়ে উঠতো না, গড়ে উঠতে তারা দিত না। এক অন্ধকারে ডুবে যেত মুসলিম উম্মাহ।’
‘সে মুসলিম উম্মারই তো আমি একজন গর্বিত সদস্য। সুতরাং একজন উপকৃতকে আবার কৃতজ্ঞতা কেন?’
বলে আহমদ মুসা আবার সালাম দিয়ে পা বাড়াল বিমানের দিকে।
বিমানে ডোনা এবং তার আব্বা আগেই উঠে গেছে। আহমদ মুসা বিমানে উঠে ডোনার আব্বার পাশে বসল। ডোনার আব্বার ওপাশে বসেছে ডোনা।
আহমদ মুসা বসতেই ডোনা বলল, ‘মদীনা শরীফ থেকে কি খবর পেলেন?’
‘তাতিয়ানার লাশ সকাল ১১টায় পৌঁছেছে মদীনা শরীফের বিমান বন্দরে। সেখান থেকেই দাফন গাহে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। আবার জানাযা হয়েছে সেখানে। দাফন হয়ে গেছে।’ বলল আহমদ মুসা।
সেদিন ঘটনার পর রাতেই আহমদ মুসা জুরিখস্থ সৌদি দূতাবাসের সাথে যোগাযোগ করে তাতিয়ানার লাশ মদীনায় দাফন করার অনুমতি চায়। সৌদি দূতাবাস রাতেই রিয়াদে সরকারের কাছে মেসেজ পাঠায়। সংগে সংগেই সরকার অনুমতি দিয়ে টেলিফোন করে। সকালেই সৌদি দূতাবাসের তত্ত্বাবধানে তাতিয়ানার লাশ দাফনের জন্যে মদীনা শরীফ পাঠানো হয়।
আমিনার (মেইলিগুলি) কবরের পাশেই তার কবর দেয়ার ব্যবস্থা করেছে আহমদ মুসা।
‘আলহামদুল্লিাহ।’ স্বগত উচ্চারণ করল ডোনা।
‘প্যারিসে টেলিফোন করে ক্যাথারিন-এর কোন খোঁজ পেয়েছিলে?’ ডোনাকে লক্ষ্য করে প্রশ্ন করল আহমদ মুসা।
সংগে সংগে ডোনা কোন উত্তর দিল না। একটু সময় নিয়ে ধীর কন্ঠে বলল, ‘মাফ করবেন’ ভেবেছিলাম বিমানে আপনাকে খবরটা দেব না। ওখানকার খবর মনে হচ্ছে ভাল নয়। আমি যে ক্যাথারিনকে চিনি, তিনি দু’দিন আগে অর্থাৎ এখানে তাতিয়ানার মৃত্যুর দিন প্যারিস থেকে নিখোঁজ হয়েছেন।’
‘নিখোঁজ হয়েছেন? না কিডন্যাপ হয়েছেন?’
‘দু’য়ের মধ্যে পার্থক্য কি?’
‘খোঁজ না পাওয়ার অর্থ কিডন্যাপ হওয়া নয়। কাউকে না বলে হঠাৎ কোথায়ও চলে গেলে, মারাত্মক আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হলেও মানুষ নিখোঁজ নয়।’
‘বুঝেছি। ধন্যবাদ। তাঁকে কিডন্যাপ করা হয়েছে বলেই মনে হয়। তিনি যথারীতি রাতে শয়ন করেন, কিন্তু সকাল বেলা তাকে বেডে পাওয়া যায়নি। তার জানালার গরাদ খোলা ছিল।’
‘তুমি যে ক্যাথারিনকে চিন সে কি রুশ।’
‘হ্যাঁ রুশ।’
‘তাহলে তোমার সন্দেহ কেন যে এ ক্যাথারিন সে ক্যাথারিন নাও হতে পারে?’
‘তাতিয়ানা ক্যাথারিন তৃতীয় -এর কথা বলেছে। আমার ক্যাথারিন তৃতীয় কিনা জানি না। আর রুশদের মধ্যে ক্যাথারিন নাম প্রচুর।’
‘ক্যাথারিনের সাথে কিভাবে তোমার পরিচয়?’
‘আমরা একই স্কুলে পড়েছি।’
‘সে যে পিটার পরিবারের কিংবা রাশিয়ার রাজপরিবারের কেউ, এমন কোন কিছু জানতে পারনি?’
‘না। তার বাসায় কোন সময় যাইনি। দেখিনি বাসা কোন সময়। কেউ তার বাসায় গেছে বলেও শুনিনি। আব্বা হয়তো কিছু বলতে পারেন, পিটার পরিবারের কেউ আমাদের ওখানে থাকে কিনা।’
‘স্যরি। আমিও জানি না। রুশ বিপ্লবের পর সেখানকার রাজপরিবারের যারা পালিয়ে এসেছে, তারা সবাই আত্মগোপন করে থাকছে। এমনকি তারা আগে ছেলে মেয়েদের স্কুলে পর্যন্ত পাঠাতো না সোভিয়েত গোয়েন্দাদের চোখে পড়ার ভয়ে। সুতরাং বাড়ির পাশে থাকলেও তাদের আসল পরিচয় জানা কঠিন।’
‘ঠিক বলেছেন। এটাই স্বাভাবিক ছিল।’
বলে একটু থেমেই আহমদ মুসা আবার বলল, ‘মাফ করো ডোনা আরেকটা প্রশ্ন। তোমার ক্যাথারিন কি ধরনের জামা-কাপড় পরতো?’
‘সবার থেকে আলাদা। লম্বা হাতাওয়ালা এবং পায়ের গোড়ালী পর্যন্ত নামানো জামা বা স্কার্ট পরতো সে।’
‘আমার অনুমান মিথ্যা না হলে এই ক্যাথারিন সেই ক্যাথারিনই হবেন।’
‘তাহলে তো দুঃসংবাদ। আমরা যার জন্যে ছুটে যাচ্ছি, তিনি তো নেই।’
‘কে জানে, হয়তো আমরা আর এক রহস্যের মুখোমুখি। তাতিয়ানা চলে গেছে, কিন্তু তার ডায়েরী এবং তার আংটি, জার সম্যাটদের সৌভাগ্য অঙ্গুরী, আমাদের কোথায় নিয়ে যাবে কে জানে?’
চমকে উঠল ডোনা। তার চোখে নামল উদ্বেগের একটা ছায়া। বুকও যেন কাঁপল তার। কথা বলল না সে।
আহমদ মুসাও কোন কথা বলল না।
অথৈ শূন্যে সাঁতার কেটে ছুটে যাচ্ছে বিমান প্যরিসের উদ্দেশ্যে।
আহমদ মুসা তার ক্লান্ত দেহটা এলিয়ে দিল বিমানের সিটে।

সাইমুম সিরিজের পরবর্তী বই

রাজ চক্র

Top