গেটের সামনে লম্বা আকৃতির একটা বাগান। তার একদিকের রাস্তা দিয়ে গাড়ি প্রবেশ করে, অপরদিকেরটা দিয়ে গাড়ি বেরিয়ে যায়।
বাড়িটার কেন্দ্রবিন্দু বরাবর ভুগর্ভস্থ একটা বিশাল কক্ষ। কক্ষের মধ্যখানে একটা টেবিলের তিন দিকে বসে গ্রেগরিংকো, উস্তিনভ এবং মায়োভস্কি। গ্রেগরিংকো রাশিয়ার ‘গ্রেট বিয়ার’-এর হোম এ্যাফেয়ার্সের প্রধান। উস্তিনভ ‘গ্রেট বিয়ার’-এর ‘অপারেশন রাজচক্র’কে নেতৃত্ব দিচ্ছে। আর মায়োভস্কি প্যারিসস্থ রুশ দূতাবাসের কেজিবি প্রধান এবং অপারেশন রাজচক্র-এর ইউরোপীয় ইউনিটের প্রধান।
‘এশিয়ান লোকটি কে? এমন অবিশ্বাস্য ঘটনা সে ঘটাল, বিশ্বাস করতে বল?’ কথা বলছিল গ্রেগরিংকো। তার চেহারায় প্রবল বিরক্তির ছাপ।
‘অবিশ্বাস্য মনে হয়েছে আমার কাছেও। জরুরী কল পেয়ে আমাকে যখন চলে আসতে হয়, তখন তাকে ক্রুশ বোর্ডে সেট করা শুধু বাকি ছিল। চারটি স্টেনগান ও একটা রিভলবারেরর বেষ্টনির মধ্যে ছিল সে। এই অবস্থায় এত কিছু ঘটা কিভাবে সম্ভব আমি বুঝতে পারছি না।’ বলল মায়োভস্কি শুকনো কণ্ঠে।
‘যে বিবরণ শুনলাম, তাতে তোমার পাঁচজন কি করবে। মুক্ত অবস্থায় শতজনের কাছেও সে ভয়ংকর। কে এই লোক।’ বলল গ্রেগরিংকো।
‘জানা যায়নি। তবে কেউ তাকে নিয়োগ করেছে।’ বলল উস্তিনভ।
‘কেন, কি উদ্দেশ্যে? ক্যাথারিনকে উদ্ধার করার জন্যে?’ বলল গ্রেগরিংকো।
‘এ বিষয়টা তো পরিষ্কার হয়ে গেছে। মুক্ত হবার পর সে পুলিশ নিয়ে সেখানে হাজির হয়েছিল। রুশ রাষ্ট্রদূতও সেখানে গিয়েছিল।’
‘তাহলে আমাদের রুশ সরকার কি তাকে নিয়োগ করেছে বলে আমরা ধরে নেব?’
‘ঘটনাচক্র তাই বলে। কিন্তু ব্যাপারটা সত্য নয়। রুশ সরকারের সংশ্লিষ্টতা থাকলে অবশ্যই আমি জানতাম। তাছাড়া এই কাজে একজন এশিয়ানকে নিয়োগ করার মত অসহায় অবস্থায় রুশ সরকার নিশ্চয় পৌঁছেনি।’ বলল মায়োভস্কি।
‘তোমার কথায় যুক্তি আছে মায়োভস্কি, কিন্তু তাহলে তার পরিচয় কি, এল কোত্থেকে?’ প্রশ্ন তুলল গ্রেগরিংকো।
সেটাই প্রশ্ন। প্যারিসে হঠাৎ করেই উদয় হয়েছে তার। মনে হয় তার উদয়ের সাথে তাতিয়ানার কোন সম্পর্ক আছে।’ বললো উস্তিনভ।
‘তাহলে তো ব্যাপারটা আরও সাংঘাতিক। আমরা তো তাতিয়ানার সাথে যুদ্ধে নামিনি, তাহলে তার লোকের সাথে আমাদের যুদ্ধ কেন? আমরা ক্যাথারিনের মত তাতিয়ানাকেও হাতে পেতে চাই।’ বলল গ্রেগরিংকো।
‘তার সাথে তাতিয়ানার সংশ্লিষ্টতার বিষয় স্পষ্ট নয়।’ বলল মায়োভস্কি।
‘সে কেন প্রিন্সেস ক্যাথারিনকে উদ্ধার করতে চায়, কেন তার পক্ষে সে কাজ করছে, এ বিষয়টা পরিষ্কার হলেই ও ব্যাপারটা স্পষ্ট হয়ে যাবে।’ বলল উস্তিনভ।
গ্রেগরিংকো নড়ে-চড়ে বসে কিছু বলার জন্যে মুখ খুলেছিল এ সময় সামনের দেয়ালে সেট করা কম্পিউটারে রেড সিগন্যাল জ্বলে উঠল, সেই সাথে বিপ বিপ শব্দ।
ওরা তিনজনই মুখ তুলে সে দিকে দৃষ্টি ফেরাল। তিনজনই ওরা এ্যাটেনশন হয়ে বসল। ওদের চোখে-মুখে প্রবল ভয় ও ভক্তির ছাপ।
ওদের সামনে দেয়ালে টিভি স্ক্রিন। ওদের তিন জোড়া চোখ সে স্ক্রিনের উপর নিবদ্ধ।
টিভি স্ক্রিনে ধীরে ধীরে মুখোশ ঢাকা একটা মুখ ভেসে উঠল।
ওরা তিনজনই মাথা নুইয়ে তাকে বাউ করল। মুখে উচ্চারণ করল ‘মহামান্য আইভান দি টেরিবল, আমরা আপনার খেদমতে।’
গ্রেট বিয়ারের বর্তমান নেতা ‘আইভান দি টেরিবল’ নাম গ্রহণ করেছে। রুশ সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠায় পিটার দি গ্রেটের পর সবচেয়ে ফলপ্রসূ ভূমিকা পালন করেন আইভান দি টেরিবল। অতি নিষ্ঠুর এই শাসকের সময়েই সাইবেরিয়া এবং ভলগা নদী পর্যন্ত ভূখন্ড রুশ সাম্রাজ্যের অন্তর্ভূক্ত হয়। রুশ রাজধানী হিসেবে মস্কোর পত্তন তিনিই করেন।
আইভান দি টেরিবলের অনুসরণে গ্রেট বিয়ার রুশদের জন্যে উৎকট ধরনের পুঁজিবাদী ডিক্টেটরশীপ কায়েম করতে চায়। রুশ সরকার নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্রের অধীনে রাশিয়ায় যে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছে তারও বিরোধী এরা।
মুখোশধারীর মুখ নড়ে উঠল। তার কণ্ঠে ধ্বনিত হলো,‘রাশিয়ার প্রিয় সন্তানগণ, রাশিয়ার বার জন মহান সন্তান নিহত হওয়ার ঘটনায় আমি যারপরনাই দুঃখিত ও বিস্মিত। বিস্ময় এজন্যে যে তোমাদেরকে কারো হাতে পরাজয় বরণের জন্যে পাঠানো হয়নি। বিস্ময় আরও এজন্যে যে, হত্যাকারীকে এখনও তোমরা ধরতে পারনি, সে এখনও জীবিত। তোমাদের এই ব্যর্থতার কারণে আমাদের গোপন পরিকল্পনা বাইরে প্রকাশ হওয়ার আশংকা সৃষ্টি হয়েছে, এটা ক্ষমার যোগ্য নয়।’ থামল মুখোশধারী।
এদের তিনজনেরই মুখ তখন ভয়ে ফ্যাকাশে। আবার কণ্ঠ ধ্বনিত হলো মুখোশধারীর। বলল, ‘আমি তোমাদের আরও কিছু সময় দিচ্ছি। মনে রেখ তার এক মুহূর্ত জীবিত থাকার অধিকার নেই। সে জীবিত থাকলে তোমরা বেঁচে থাকার অধিকার হারাবে। সব ঘটনার পর্যালোচনায় বুঝতে পারছি, প্রিন্সেস ক্যাথারিন তাতিয়ানার খবর জানে না এবং আংটি ও ডায়েরীর খবরও তার জানা নেই। তাতিয়ানাকে হাতে পাওয়াই আমাদের এখন প্রধান কাজ। তাতিয়ানাকে খুঁজতে হবে তোমাদেরকেই। ইন্টারনেট-এর সাহায্য নিয়ে তোমরা গত ছয় মাসের ইউরোপীয় সব বিমান বন্দরের যাত্রী তালিকা নাও। বের কর সর্বশেষ তাতিয়ানা কোথায় ল্যান্ড করেছে। লোকেশন চিহ্নিত করার পর সেখানে জালের ছাঁকুনি দাও। পেতেই হবে তাতিয়ানাকে। প্রথমে গুপ্তধন উদ্ধার তারপর ওদের দেখে নেব। দীর্ঘজীবী হোক রাশিয়া এবং রাশিয়ার সন্তানরা।’ থামমল মুখোশধারী। তার ছবিও সরে গেল স্ক্রীন থেকে।
ওরা তিনজন তখনও পাথরের মূর্তির মত বসে আছে।
নীরবতা ভাঙলো গ্রেগরিংকো। বলল, ‘উস্তিনভ তুমি তোমার সর্বশক্তি নিয়ে তাতিয়ানার খোঁজে লেগে যাও। ইউরোপের ছয় মাসের যাত্রী চার্ট যোগাড় করো আজ, কাল দু’দিনের মধ্যেই। আর মায়োভস্কি, তোমার দায়িত্ব হলো এশিয়ান যুবককে জন্মের মত শিক্ষা দেওয়া। তাকে হত্যা কর যেখানে পাও।’
মায়োভস্কি কিছু বলার জন্য মুখ খুলেছিল, কিন্তু তার আগেই কথা বলে উঠল ইন্টারকম। বলল, ‘মহামান্য গ্রেগরিংকো, জাহরা ইভানোভা এবং পিটার পাওয়েল এ্যাকসিডেন্ট করেছে। পিটার সাংঘাতিক আহত, ইভাও ছোট-খাট আঘাত পেয়েছে।’
জাহরা ইভানোভা এবং পিটার পাওয়েল বাড়িটার মালিক নিকিতা স্ট্যালিনের দুই সন্তান। নিকিতা ফ্রান্সে আশ্রয় গ্রহণকারী একজন ধনাঢ্য রুশ। সোভিয়েত ইউনিয়নের একজন ভিন্নমতালম্বী বিদ্রোহী হিসেবে সে ফ্রান্সে আশ্রয় পায়। কিন্তু কার্যত সে ছিল কেজিবি’র হার্ডকোর লবীর একজন প্রতিভাবান এজেন্ট। সে এখন ফ্রান্সে গ্রেট বিয়ারের প্রধান অবলম্বন। কোটিপতি নিকিতা এখন গ্রেট বিয়ারের গড ফাদারের ভূমিকা পালন করছে। তার মেয়ে জাহরা ইভানোভাও গ্রেট বিয়ারের একজন কর্মী।
‘ও গড! মিঃ নিকিতাকে জানান হয়েছে?’
‘তিনি এখন লন্ডনে। জানানো হচ্ছে।’
‘ডাঃ জ্যাকভ আছেন?’
‘তাকে টেলিফোন করা হয়েছে, আসছেন তিনি।’
‘অল রাইট, আমরা আসব।’
টেলিফোন রেখে গ্রেগরিংকো বলল, ‘ইভানোভা ও পিটার এ্যাকসিডেন্ট করেছে, চল দেখি।’
বলে গ্রেগরিংকো উঠে দাঁড়াল।
তার সাথে অপর দু’জনও।
বাড়ির কাছাকাছি হয়েই ইভানোভা গাড়িরর ইমার্জেন্সী সাইরেনের সুইচ অন করে দিয়েছিল।
গাড়ি নিয়ে আহমদ মুসা ক্লিনিকের বারান্দায় দাঁড়াল।
গ্রামীণ পরিবেশে টিলার উপরে নির্মিত বাড়িটি মুগ্ধ করল আহমদ মুসাকে।
বাড়ির ক্লিনিক অংশটি বাড়ির এক প্রান্তে। বাড়ির সম্মুখস্থ মূল চত্বর অতিক্রম করেই ওখানে যেতে হয়।
গাড়ি দাঁড়াবার সাথে সাথেই অপেক্ষমান দু’জন এ্যাটেনড্যান্ট ছুটে এলে।
ইভানোভা হেঁটেই ক্লিনিকে প্রবেশ করল। পিটার পাওয়েলকে নেয়া হলো স্ট্রেচারে।
কিন্তু সার্বক্ষনিক ডাক্তার তখন ক্লিনিকে হাজির নেই। জরুরী কল পেয়ে কোথাও গেছেন। বিকল্প এখনও এসে পৌঁছেনি।
অপেক্ষা করার সময় ছিল না।
আহমদ মুসাই পিটার পাওয়েল এবং ইভানোভার প্রাথমিক চিকিৎসার ব্যবস্থা করল। রক্ত পড়া বন্ধ হলো পাওয়েলের। দু’টি দাঁত ভাঙা ও চোখের নিচটায় বড় একটা ক্ষতের সৃষ্টি হওয়া ছাড়া বড় কোন ক্ষতি তার হয়নি। ইভানোভার কপালের একপাশ থেতলে ও কেটে গেছে। আরও কয়েক জায়গায় ছোট খাট আঘাত পেয়েছে ইভানোভা।
ব্যান্ডেজ নিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে ইভানোভা বলল, ‘আপনি কি ডাক্তার?’
‘না।’
‘ও তাহলে কোথাও কাজ করেছেন বুঝি?’
‘না তাও নয়।’
বিস্ময়ের চিহ্ন ফুটে উঠল ইভানোভার চোখে মুখে। ভাবল, ফাস্ট এইড-এর কাজ অনেকেই জানে, কিন্তু এমন নিখুঁত হাতের কাজ প্রোফেশনাল ছাড়া কিছুতেই সম্ভব নয়।
কিছু বলতে যাচ্ছিল ইভানোভা। একজন এ্যাটেনডেন্ট ছুটে এসে বলল, ‘মিঃ গ্রেগরিংকো আসছেন।’
তার কথা শেষ না হতেই দরজা ঠেলে প্রবেশ করল উল্লেখিত গ্রেগরিংকোরা।
আহমদ মুসা, ইভানোভা ও সাথের অন্যান্যরা তখন ইমার্জেন্সী হল রুমে।
আহমদ মুসা গ্রেগরিংকোদের দিকে তাকিয়েই ভূত দেখার মত চমকে উঠে ঘুরে দাঁড়িয়ে কয়েক পা এগিয়ে গিয়ে সকলের পেছনে এসে মুহূর্ত কয়েক দাঁড়াল। তারপর হাঁটা দিল বিপরীত দিকের দরজার দিকে।
গ্রেগরিংকা, উস্তিনভ ও মায়োভস্কি এক সংগে প্রবেশ করেছে হল ঘরে।
ইভানোভা তাদের স্বাগত জানিয়ে ঘটনার বিবরণ দিল। তারপর আহমদ মুসাকে পরিচয় করিয়ে দেয়ার জন্যে পেছন দিকে চাইল। পেছনে তাকে দেখতে না পেয়ে বিস্মিত হলো ইভানোভা। ইভানোভা মনে করেছিল, অপরিচিত বলেই বোধহয় সামনে থেকে সরে দাঁড়াচ্ছে। এখন পেছনে আহমদ মুসাকে না দেখে বলা যায় চমকেই উঠল ইভানোভা। গ্রেট বিয়ারের কর্মী হিসেবে এর মধ্যে প্রবল একটা অস্বাভাবিকতা আঁচ করল। কিন্তু ব্যাপারটা গ্রেগরিংকোদের কাছে প্রকাশ করতে চাইল না।
তাড়াতাড়ি নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,‘সম্ভবত উনি টয়লেটে গেছেন পরিষ্কার হবার জন্যে। অনেক পরিশ্রম হয়েছে ওর। চলুন পাওয়েলকে দেখবেন।’
বলে গ্রেগরিংকোদের নিয়ে ইভানোভা পাওয়েলের কক্ষের দিকে হাঁটা শুরু করল।
‘ভদ্রলোকের নাম কি? কোথায় থাকেন?’ বলল উস্তিনভ।
ইভানোভা ঘুরে দাঁড়িয়ে সলজ্জ হেসে বলল,‘স্যরি, তাড়াহুড়োর মধ্যে কোনটাই জানার সুযোগ হয়নি।’
এই সময় ডাক্তারও এসে পৌঁছল।
ডাক্তারসহ সবাই পিটার পাওয়েলের কক্ষে প্রবেশ করল।
পিটার পাওয়েলকে দেখে ওরা চলে গেল। গাড়িতে ওদের বিদায় দিয়ে ইভানোভা ফিরে এল পাওয়েলের কক্ষে। দেখল, পাওয়েলকে নিয়ে ডাক্তার এবং নার্সরা অপারেশন থিয়েটারে প্রবেশ করেছে।
ইভানোভা আবার চারদিকে চাইল। আশেপাশে খোঁজ করল। কিন্তু আহমদ মুসাকে কোথাও পেল না।
ইভানোভার মনে প্রশ্নের অন্ত নেই। লোকটিকে যতটুকু সে বুঝেছে, তাতে এরকম কান্ড ঘটাবার লোক সে নয়। অত্যন্ত সপ্রতিভ, সতেচন, বুদ্ধিমান, স্পষ্ট, ঋজু ও সংবেদনশীল প্রকৃতির লোক সে। কিন্তু ওভাবে সে সরে পড়ল কেন? এখন ইভানোভার স্পষ্ট মনে হচ্ছে, গ্রেগরিংকোদের দেখার পরেই সে পেছনে সরে যায়। তাহলে কি সে গ্রেগরিংকোদের চেনা? কিন্তু চেনা হলেই সরবে কেন! চমকে উঠল ইভানোভা। তাহলে কি লোকটির পরিচয় এমন যে গ্রেগরিংকোদের সামনে পড়লে তার অসুবিধা হতো! কি সেই অসুবিধা যে তাকে অসৌজন্যমূলকভাবে পালাতে হলো? বড় ধরনের কোন ব্যাপার না হলে এমনটা ঘটতে পারে না।
এসব চিন্তা ভয়ানক উৎসুক করে তুলল ইভানোভাকে আহমদ মুসার ব্যাপারে।
ইভানোভা ছুটল আহমদ মুসার গাড়ি যেখানে পার্ক করা ছিল সেখানে। না, গাড়ি ঠিকই আছে। তাহলে নিশ্চয় সে চলে যায়নি। কিন্তু কোথায় সে?
ইভানোভা ছুটল গেটে। জিজ্ঞেস করল গেটম্যানকে চেহারা ও পোশাক আশাকের বিবরণ দিয়ে।
গেটম্যান তার কম্প্যুটারে গেটের টিভি ক্যামেরার কয়েক ঘন্টার ছবি সামনে নিয়ে এসে দেখাল। না, লোকটি গেট দিয়ে বের হয়নি, স্বগত উচ্চারণ করল ইভানোভা।
গেট ছাড়া অন্যদিক দিয়ে বের হওয়া কঠিন। বাড়ির চারদিকের প্রাচীর বরাবর টিভি ক্যামেরার পাহারা রয়েছে। রয়েছে ঝটিকা পাহারাদারদের ক্যাম্প। যারা সন্দেহজনক কাউকে দেখলে পর মুহূর্তেই তাকে পাকড়াও করবে।
সুতরাং লোকটি ভেতরেই আছে, এই সিদ্ধান্তে স্থির হলো ইভানোভা।
ইভানোভা দ্রুত ফিরে এল। গিয়ে প্রবেশ করল পিতার কনট্রোল রুমে।
বিশাল বাড়িটার ঠিক মাঝ বরাবর স্বতন্ত্র একটা ব্লক নিয়ে তাদের বাড়ি। বাড়ির অবশিষ্ট অংশ গ্রেট বিয়ারের গোপন ঘাটি হিসেবে ব্যবহার হয়। তবে ইভানোভাদের ব্লকের সাথে গোটা বাড়ির সংযোগ রয়েছে গোপন সুড়ঙ্গ পথের মাধ্যমে। আবার গোটা বাড়ির উপর নজর রাখার জন্যে টিভি ক্যামেরার একটা স্বতন্ত্র নেটওয়ার্ক-এর নিয়ন্ত্রণ হয় ইভানোভার আব্বার কনট্রোল রুম থেকে। ঘাটি এলাকার জন্যে ঘাটির একটা নিজস্ব নেটওয়ার্ক আছে যা গ্রেট বিয়ার নিয়ন্ত্রণ করে তাদের ঘাটির নিয়ন্ত্রণ কক্ষ থেকে।
ইভানোভা টিভি প্যানেলের সামনে বসে কনট্রোল সুইচ এক এক করে টিপে চলল। একটি সুইচ টেপার সাথে সাথেই একটি কক্ষ বা করিডোরের চিত্র ভেসে উঠেছে।
এক সময় একটা সুইচ টিপতেই একটা ঘরের বন্ধ দরজায় আহমদ মুসাকে দাঁড়ানো দেখলো ইভানোভা।
চমকে উঠে ইভানোভা ঝুকে পড়ল টিভির উপর। সে দেখল, ল্যাসার বিম দিয়ে দরজার লক গলিয়ে আহমদ মুসা ঘরে প্রবেশ করল। ঘরের চারদিকটা দ্রুত দেখল সে। তারপর সে ঘর থেকে বেরিয়ে একইভাবে পাশের ঘরে প্রবেশ করল। ঐভাবেই সারা ঘরে সে নজর বুলিয়ে চলল।
শিউরে উঠল ইভানোভা। ভাবল সে, লোকটা নিশ্চয় শত্রু পক্ষের সাংঘাতিক কেউ হবে। কিছু খুঁজছে সে? কি খুঁজছে? তাঁর টার্গেট কি গ্রেট বিয়ারের এ ঘাটির কনট্রোল রুম?
ইভানোভার গোটা শরীর শক্ত হয়ে উঠল উৎকণ্ঠায়। সে টিভি স্ক্রিনে চোখ রেখে টেলিফোন তুলে নিল হাতে। পেল ডিউটি অফিসারকে। বলল,‘মিঃ গ্রেগরিংকোকে এখনি জানান, আপনাদের ঘাটিতে সন্দেহজনক কেউ ঢুকেছে।’
কথা বলা অবস্থায়ও ইভানোভা সুইচ টিপে আহমদ মুসাকে অনুসরণ করছিল।
টেলিফোন করার পর ইভানোভার মনে কোথাও যেন একটা খোঁচা লাগল। যেই হোক লোকটা তার উপকার করেছে। ইভানোভা ও পিটার তার কাছে অনেক ঋণী। তাছাড়া অপরাধ প্রবণ মানুষকে সে চেনে। লোকটিকে দেখে চোখ, মুখ, কথা, আচরণ, হাসি-কোনদিক দিয়েই অপরাধী বলে মনে হয়নি।
মনটা অস্বস্তিতে ভরে গেল ইভানোভার। গ্রেগরিংকোদের হাতে পড়লে লোকটা নির্ঘাত মারা পড়বে।
কিন্তু পরক্ষণেই তার মনে হলো, এমন শত্রুপুরিতে যে একা ঢুকতে পারে, অত্যাধুনিক লেসার বীম যার অস্ত্র সে সাধারণ শত্রু নয়। এমন শত্রুর শাস্তি হতেই হবে।
টিভি স্ক্রীনে ইভানোভার চোখ ফলো করছিল আহমদ মুসাকে। হঠাৎ এক সময় দেখল, আহমদ মুসা একটা কক্ষ সার্চ শেষে দরজা বন্ধ করে প্রার্থনায় দাঁড়িয়ে গেল দক্ষিণ-পূর্বমুখী হয়ে।
ইভানোভা দেখেই বুঝতে পারল, ওটা মুসলমানদের নামায।
আহমদ মুসার এই মুসলিম পরিচয় পাওয়ার সাথে সাথেই ইভানোভার মনে হঠাৎ করেই একটা বিস্ময়-বিমূঢ়তা নেমে এল। লোকটি তাহলে মুসলমান।
এই পরিচয় পাওয়ার সংগে সংগে ইভানোভার হৃদয়ের একটা বন্ধ দুয়ার যেন খুলে গেল। স্মৃতির দিগন্তে কিছু স্মৃতি ভীড় করে উঠল।
কিছুটা আনমনা হয়ে পড়েছিল ইভানোভা।
পরক্ষণেই সতর্ক হয়ে উঠল। কিন্তু দেখল, সে ঘরটিতে আহমদ মুসা নেই।
পরে পেয়ে গেল তাকে করিডোরে।
আহমদ মুসা একের পর এক ঘর সার্চ করে চলল, আর ইভানোভার চোখ তাকে অনুসরণ করল। ইভানোভা উদ্বেগের সাথে সাথে লক্ষ্য করলো, আহমদ মুসা ঘাটির কেন্দ্রীয় কনট্রোল রুমের কাছে এসে পড়েছে। সে কি এই কনট্রোল রুমেরই খোঁজ করছে? কে এই লোকটি? বিপজ্জনক লোক তো?
ইভানোভার মোবাইল টেলিফোন বেজে উঠল।
ইভানোভা তুলে নিল টেলিফোন।
গ্রেগরিংকোর টেলিফোন। বলল, ‘ধন্যবাদ মা, আমরা এসেছি। লোকটাকে আমরা লোকেট করেছি। সে আমাদের কনট্রোল রুমে ঢোকার চেষ্টা করছে। সব দিক থেকে আমরা ভেতরে প্রবেশ করছি।’
একটু থেমে গ্রেগরিংকো আবার শুরু করল,‘তুমি খবর দেয়ার জন্যে ধন্যবাদ। তুমি কেমন করে বুঝতে পেরেছিলে যে, কেউ প্রবেশ করেছে?’
‘আমাদের যে লোকটি পৌঁছে দিয়েছিল, তাকে যখন কোথাও খুঁজে পেলাম না, যখন দেখলাম তার গাড়িও আছে এবং গেটে জানলাম যে, সে গেট দিয়ে বেরিয়ে যায়নি, তখন হঠাৎ করেই আমার মনে হলো, সে আমাদের ঘাটিতে প্রবেশ করতে পারে।’
ইভানোভা ইচ্ছা করেই সত্য গোপন করল। সত্য গোপনের আরেকটা কারণ, ঘাটি পর্যবেক্ষণ করার আলাদা টিভি ক্যামেরার নেটওয়ার্ক যে তার আব্বার আছে এটা গোপন বিষয়।
‘তোমাকে আবার ধন্যবাদ। তোমার অনুমান সত্য প্রমাণিত হয়েছে। লোকটা বিপজ্জনক।’ বলল গ্রেগরিংকো ইভানোভা থামার সাথে সাথেই।
‘চেনেন তাকে?’
‘আমি চিনি না, কিন্তু উস্তিনভ ও মায়োভস্কি ওকে দেখেছে। এই লোকটিই সেদিন আমাদের ডজন খানেক লোক হত্যা করে আমাদের প্যারিসের ঘাটি থেকে পালায়।’
শুনে বিস্ময়-বিস্ফারিত হয়ে উঠল ইভানোভার চোখ।
কিছু বলতে যাচ্ছিল ইভানোভা। কিন্তু ওপার থেকে গ্রেগরিংকো বলে উঠল,‘এখন রাখি মা। ওরা এগুচ্ছে, আমিও উঠি।’
টেলিফোন রেখে দিয়ে ইভানোভা টিভি স্ক্রীনের উপর ঝুঁকে পড়ে খুঁটে খুঁটে দেখল আহমদ মুসাকে। না, নিষ্পাপ একটি মুখ। চোখে-মুখে একটা উৎকণ্ঠা। কিন্তু সে উৎকণ্ঠায় কোন অপরাধের ছবি নেই। তার উৎকণ্ঠা বলছে, কোন হারানো জিনিস যেন সে খুঁজে পাচ্ছে না।
অন্য একটা টিভি স্ক্রীনের নব ঘুরিয়ে ইভানোভা দেখল, গ্রেগরিংকোর দল চারদিক থেকে ছুটে আসছে আহমদ মুসার দিকে।
হঠাৎ একটা উদ্বেগে ছেয়ে গেল ইভানোভার মন। প্রায় দেড় ডজন স্টেনগান ঘিরে ফেলেছে লোকটিকে। লোকটিকে হয় মরতে হবে, নয়তো আত্মসমর্পণ করতে হবে। কিন্তু তার সম্পর্কে যেটুকু জানল তাতে মনে হয়, সে আত্মসমর্পণ করার বদলে শেষ পর্যন্ত লড়াই করবে। কারণ সে জানে, গ্রেট বিয়ারের ডজনখানেক লোক হত্যার শাস্তি তার কি হতে পারে। সুতরাং আত্মসমর্পণের তার প্রশ্নই ওঠে না।
তাহলে সে মরবে?
কথাটা মনে হতেই হৃদয়ের কোথায় যেন যন্ত্রণা অনুভব করল। লোকটি তার এবং পিটারের উপকার বলেছে বলে নয়, কোন মুসলমানকে দেখলে এক ধরনের আবেগ অনুভব করে সে। এই আবেগ থেকেই এই যন্ত্রণা। মুসলিম লোকটি এমন বেঘোরে প্রাণ হারাবে তা তার হৃদয় মেনে নিতে পারছে না। অন্যদিকে আহমদ মুসাকে ক্রিমিনাল বলেও মনে করতে পারছে না।
প্রবল দ্বিধার মধ্যে পড়েছিল ইভানোভা।
এর মধ্যেই সে দেখল, গ্রেগরিংকোরা ঘিরে ফেলেছে আহমদ মুসাকে। গ্রেগরিংকোর হাতে হ্যান্ড মাইক। সে মাইক মুখের সামনে তুলে ধরল। ইভানোভা বুঝল, কিছু বলছে সে আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে।
| ← Previous | | | Next → | | সম্পুর্ণ বই এক পেজে »