২৩. রাজচক্র

চ্যাপ্টার

তাড়াহুড়ো করে বেরুচ্ছিল আহমদ মুসা। দরজাতেই মুখোমুখি হলো ডোনার সাথে।
ডোনা থাকে তার পিতার সাথে তাদের রয়্যাল প্যালেসে। আহমদ মুসাকেও সেখানে থাকার অনুরোধ করেছিল ডোনার আব্বা মিঃ প্লাতিনি। কিন্তু আহমদ মুসা রাজী হয়নি। যুক্তি দিয়ে বলেছিল, আহমদ মুসাকে খুবই ব্যস্ত থাকতে হবে। তাই স্বাধীনভাবে থাকার একটা জায়গা তার দরকার। তাছাড়া সবচেয়ে গুরুত্ব যে বিষয়চির উপর দিয়েছিল, তাহলো, এবার তাকে কি ধরনের শত্রুর মুখোমুখি হতে হবে তা বলা যাচ্ছে না। ডোনাদের বাড়িটা তাদের নজরে আনা ঠিক হবে না। এই শেষ যুক্তিটায় ডোনার আব্বা রাজী হয়ে যায় আহমদ মুসার সাথে। তবে আহমদ মুসার থাকার ব্যবস্থা ডোনার আব্বাই করে দেয় তাদের সদ্য কেনা একটা বাংলোতে।
সালাম বিনিময়ের পর আহমদ মুসা ডোনাকে রক্ষ্য করে বলল,‘কি ব্যাপার ডোনা, অকস্মাত?’ আহমদ মুসার কণ্ঠে বিস্ময়।
‘বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যাবার পথে উঠলাম। কেন আসতে নেই?’ বলল ডোনা।
ডোনা বিশ্ববিদ্যালয়ের তার শেষ পরীক্ষা দেবার জন্যে তৈরি হচ্ছে। সামনেই তার পরীক্ষা।
‘তুমি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে টেলিফোন করেছিলে। কিন্তু বলনি তো তুমি আসবে।’
‘তখন ভাবিনি, কিন্তু আসার পথে হঠাৎ মনে হলো কি করছ একটু শুনে যাই। সেই সাথে একটা সারপ্রাইজ দেয়াও হলো।’
‘কিন্তু দেখা নাও পেতে পারতে। দু’এক মিনিট পরে এলে আর দেখা পেতে না।’
‘যাক, সব সময়ই ভাগ্য আমার পক্ষে থাকে। এখন বল, তাড়াহুড়ো করে কোথায় বেরুচ্ছ?’
‘রুশ দূতাবাসে।’
গম্ভীর হলো ডোনা। বলল,‘আমি উদ্বিগ্ন। কে শত্রু কে মিত্র আমি বুঝতে পারছি না। তুমি তো চূড়ান্ত কথা বলে দিয়েছ এসব নিয়ে আমি যেন চিন্তা না করি। নাক না গলাই।কিন্তু তা কি পারা যায়? বল, ঘটনা কোন দিকে গড়াচ্ছে? কি তোমার প্ল্যান? না হলে কিন্তু তোমার পিছু নেব আমি।’
‘দোহাই আল্লাহর। তুমি তা পার। তোমার সব রকম দুঃসাহস আছে। তুমি কিন্তু তা করো না। সেদিন তো সব বলেছি। নতুন তেমন কিছু বলার নেই। আজ সকালে প্যারিস উপকণ্ঠের সেই রহস্যপূর্ণ বাড়িতে গিয়েছিলাম। কিন্তু বাড়িটা খালি। সাইনবোর্ড টাঙানো ‘বাড়িটি সংস্কারের জন্যে নির্দিষ্ট।’ হতাশ হয়ে ফিরে এসেছি।
‘কি আশা নিয়ে গিয়েছিলে সে বাড়িটিতে?’
‘জাহরা ইভানোভার কাছ থেকে প্রত্যক্ষ না হলেও পরোক্ষ কিছু সাহায্য পাওয়া যেতো। তাছাড়া ঐ বাড়ির লোকদের উপর নজর রেখে ওদের নতুন কোন ঘাটির নাগাল পাওয়া যেতো।’
‘জাহরার পিতার নাম কি বলেছিলে?’
‘নিকিতা স্ট্যালিন।’
‘রুশ দূতাবাসে কি জন্যে যাচ্ছ?’
‘যাবার কোন জায়গা নেই বলে। তাছাড়া তিনি টেলিফোন করেছিলেন দেখা করার জন্যে।’
‘ঠিক আছে। ফিরে এসে আমাকে টেলিফোন করো। তোমার দেরি করে ফেললাম, আসি।’
সালাম দিয়ে ডোনা বিদায় নিল।
আহমদ মুসা গাড়ি স্টার্ট দিল রুশ দূতাবাসের উদ্দেশ্যে।
আহমদ মুসা রুশ রাষ্ট্রদূত পাভেলের ঘরে ঢুকতেই রাষ্ট্রদূত উঠে দাঁড়িয়ে স্বাগত জানিয়ে বলল,‘এস এস, তোমার অপেক্ষা করছি।’
আহমদ মুসা হাসল। বলল,‘বলুন।’
‘বলব কি, আমি বড় বিপদে। প্রচন্ড চাপ আমাদের সরকারের তরফ থেকে। ক্যাথারিনকে উদ্ধার করা যায়নি, অন্যদিকে তাতিয়ানাও নিখোঁজ। অথচ আমাদের জাতীয় দিবস ঘনিয়ে আসছে। ঐ দিনই শাসনতন্ত্র সংশোধনের মাধ্যমে রাশিয়ার নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্র ব্যবস্থা প্রবর্তন করার সবকিছু ঠিক-ঠাক হয়ে গেছে।’ বলল রাষ্ট্রদূত পাভেল।
‘একটা কথা বলুন তো, রাশিয়ার ভীষণ অর্থনৈতিক দুর্দিন চলছে, এর মধ্যে নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে একটা বড় খরচ মাথায় তুলে নিচ্ছে কেন?’
বসল পাভেল। বলল,‘রাজ পরিবারের কাছে যে অর্থ রয়েছে তা দিয়ে রাশিয়া এক যুগ চলতে পারে।’
‘কি বলছেন আপনি, ওরা তো যাযাবর। রাশিয়ায় ওদের কোন নির্দিষ্ট ঠিকানা নেই। বিদেশেও তারা অধিকাংশ ভাড়া বাড়িতে থাকে।’ কৃত্রিম বিস্ময় নিয়ে বলল আহমদ মুসা।
‘তুমি কিছু জাননা দেখছি। বলশেভিক কম্যুনিস্টরা নিকোলাশ (দ্বিতীয়) এবং তার স্ত্রী পুত্র কন্যাদের হত্যা করেছিল বটে, কিন্তু তাদের ধনভান্ডারের এককণাও তারা পায়নি। সবই জমা রয়ে গেছে রাজ পরিবারের গুপ্ত ধনভান্ডারে।’
‘সেটা কোথায়?’
‘রাশিয়ায়।’
‘তাহলে সেটা তো আপনাদের দখলে।’
‘না। ধন ভান্ডার রাশিয়ায় বটে, কিন্তু কেউ তার সন্ধান জানে না। পৌনে একশ বছর কম্যুনিস্ট সরকার চেষ্টা করেও সে ধন ভান্ডারের সন্ধান পায়নি। আজকের রাশিয়ার জাতীয়তাবাদী সরকারও খুঁজে পেতে ব্যর্থ হয়েছে। আগের রাজধানী পিটার্সবার্গে (পরে নাম হয়েছে স্ট্যালিনগ্রাদ) অথবা তার আশেপাশে কোথাও লুকানো আছে সেই শত শত বছরের সঞ্চিত বিস্ময়কর ধন ভান্ডার।’
‘সেই ধনের লোভেই কি নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্র ব্যবস্থার প্রবর্তন?’
আবারও হাসল পাভেল। বলল, ‘রাশিয়া তার এই দুর্দিনে সেই ধন পেলে বেঁচে যায়, কিন্তু ধনের জন্যে রাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা নয়। রাশিয়ার রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্যেই একটা নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্র ব্যবস্থার প্রয়োজন।’
‘রাশিয়ার এই প্রয়োজন যতখানি, ততখানি কিন্তু চেষ্টা হচ্ছে না প্রিন্সেস ক্যাথারিনের উদ্ধারের জন্যে।’
‘না, তুমি ঠিক বলনি। আমাদের চেষ্টা ছাড়াও আমরা ফরাশি পুলিশ ও ইন্টারপোলের সাহায্য চেয়েছি। তবে একথা ঠিক যে, কোন কাজেই কোন ফল দেয়নি।’
‘নিকিতা স্ট্যালিন নামে কাউকে চেনেন?’
রাষ্ট্রদূত একটু চিন্তা করে বলল, ‘ঐ নামে উল্লেখযোগ্য কেউ রুশ কমিউনিটিতে নেই।’
‘কিন্তু লোকটা বিখ্যাত ধনাঢ্য ব্যক্তি। বহুদিন প্যারিসে বাস করছেন।’
‘নামটি হয় নকল, নয়তো কোন নকল নামে সে পরিচিত।’
‘জাহরা ইভানোভা নামে তার একটা তরুণী মেয়ে আছে।’
রাষ্ট্রদূত পাভেলের কপাল কুঁচকালো। চিন্তা করে বলল,‘তারও এই নাম নকল হতে পারে, অথবা নকল নামে সে সমাজে পরিচিত।’
আহমদ মুসা কখনও এদিকটা চিন্তা করেনি। সে মিঃ পাভেলের কথার যৌক্তিকতা স্বীকার করল। তবে আহমদ মুসার মনে হলো, সে আসল নামই শুনেছে। তাদের ভিন্ন অফিসিয়াল নাম থাকতে পারে। যে নামে তারা বাইরেও পরিচিত।
রাষ্ট্রদূত পাভেলের ইন্টারকম কথা বলে উঠলঃ স্যার,‘ভ্লাদিমির মায়োভস্কি এসেছেন।’
‘হ্যাঁ, পাঠিয়ে দাও।’ বলল রাষ্ট্রদূত পাভেল।
আহমদ মুসা ‘মায়োভস্কি’ নাম শুনে চমকে উঠল। কিন্তু তার সাথে ভ্লাদিমির যুক্ত থাকায় মনটা আবার ঠিক হয়ে গেল।
দরজায় দু’বার সক হলো।
‘এসো।’ বলল রাষ্ট্রদূত পাভেল।
দরজা ঠেলে প্রবেশ করল ভ্লাদিমির মায়োভস্কি।
তার দিকে চোখ পড়তেই চমকে উঠল আহমদ মুসা। গোটা শরীরে একটা উষ্ণ স্রোত বয়ে গেল তার।
মায়োভস্কির চোখেও মুহূর্তের জন্যে আঠার মত লেগে গিয়েছিল আহমদ মুসার মুখের উপর। সেই সাথে তার চোখ দু’টি জ্বলে উঠেছিল। কিন্তু সংগে সংগেই সে সামলে নিল নিজেকে।
রাষ্ট্রদূত পাভেল মায়োভস্কিকে এসো বলেই মনোযোগ দিয়েছিল দিনের কর্মসূচীর দিকে।
চোখ সেখান থেকে ফিরিয়ে নিয়ে একবার মায়োভস্কির দিকে চেয়ে আহমদ মুসার দিকে মুখ ঘুরিয়ে মায়োভস্কিকে দেখিয়ে বলল,‘ইনি ভ্লাদিমির মায়োভস্কি। এখানে সিকিউরিটি চীফের দায়িত্ব পালন করছেন।’ তারপর মায়োভস্কিকে বলল আহমদ মুসার দিকে ইংগিত করে,‘ইনি মিঃ আবদুল্লাহ। খুব সাহসী ও পরোপকারী ছেলে। প্রিন্সেস ক্যাথারিনের পরিবারের বন্ধু। ক্যাথারিনকে উদ্ধারের ব্যাপারে তার সাহায্য আমরা পেতে পারি।’
আহমদ মুসা ও মায়োভস্কি কারো ঠোঁটেই তখন শুভেচ্ছার হাসি ফুটে ওঠেনি। তবু তারা একে অপরকে হাত তুলে স্বাগত জানাল।
রাষ্ট্রদূত পাভেল মায়োভস্কিকে কিছু বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু সেই সময় তার লাল টেলিফোনটি বেজে ওঠায় বলা হলো না। টেলিফোনের রিসিভার তুলে নিল রাষ্ট্রদূত পাভেল। টেলিফোনে কিছু একটা শুনেই সে বলে উঠল, ‘না লাইন দেবার দরকার নেই। হোল্ড করো। আমিই আসছি ওয়্যারলেসে।’
টেলিফোন রেখে দ্রুত মায়োভস্কির দিকে চেয়ে বলল,‘তোমাকে খোঁজ করছিলাম একটা কথা বলার জন্যে। ওলগা, তার মা ও অন্যান্যরা গেছে সাঁজেলিঁজে’র সান্ধ্য মেলায়। ওলগা আবার অন্য প্রোগ্রামে যাবে। সুতরাং একা পড়বে ওরা। দিন কাল ভাল নয়। তোমার লোকদের ওদিকে খেয়াল করতে বলো।’
কথা শেষ করেই উঠে দাঁড়াল রাষ্ট্রদূত পাভেল এবং আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে বলল,‘আমি একটা জরুরী কাজে যাচ্ছি। তোমার নাস্তা খেয়ে তারপর যাবে। আর তোমার সাথে কথা শেষ হলো না। তোমাকে আবার ডাকব।’
রাষ্ট্রদূত কথা শেষ করতেই মায়োভস্কি বলে উঠল,‘আমি আসি স্যার?’
‘এসো।’ বলল রাষ্ট্রদূত।
বেরিয়ে গেল মায়োভস্কি।
রাষ্ট্রদূত পাভেলও এগুচ্ছিল দরজার দিকে।
আহমদ মুসা উঠে দাঁড়িয়ে বলল,‘আমিও আর বসছি না জনাব।’
‘না। নাস্তা না খেয়ে গেলে মনে করব অসৌজন্যমূলকভাবে আমি চলে গেলাম বলে তুমি অসৌজন্য প্রদর্শন করলে।’ বলল মুখ ঘুরিয়ে রাষ্ট্রদূত পাভেল।
‘ঠিক আছে।’ বলে বসল আহমদ মুসা।
ভালই হলো। আহমদ মুসা নিরিবিলি চিন্তা করার একটু সময়ও চায়।
তার মাথায় তখন চিন্তার ঝড়।
মায়োভস্কি এখানকার কেজিবি (রুশ গোয়েন্দা সংস্থা) প্রধান এবং সেই প্রিন্সেস ক্যাথারিনকে কিডন্যাপকারীদের একজন। রাষ্ট্রদূত কি তাদের এ ষড়যন্ত্র থেকে বিচ্ছিন্ন! বিচ্ছিন্ন তার প্রমাণ কি? মায়োভস্কির সাথে জড়িত নেই তাও যেমন প্রমাণ করা মুস্কিল, তেমনি জড়িত আছে, সেটাও প্রমাণিত নয়। তবে একটা বিষয়, ভাবল আহমদ মুসা, রাষ্ট্রদূত মায়োভস্কিকে আহমদ মুসার সামনে ডাকা কিছুটা প্রমাণ করে রাষ্ট্রদূত ষড়যন্ত্রের সাথে নেই। ডাকলেও আহমদ মুসাকে মুক্ত অবস্থায় বাইরে আসার সুযোগ দিত না।
দ্বিধা-দ্বন্দ্বের মধ্যেই আহমদ মুসা নাস্তা সেরে বাইরে বেরিয়ে এল।
গাড়ির দিকে এগুতেই হঠাৎ একটা শঙ্কা ঝড়ের বেগে এসে প্রবেশ করল আহমদ মুসার মনে। তার মনে হলো, মায়োভস্কি আহমদ মুসাকে এখান থেকে মুক্ত মানুষ হয়ে যেতে দেবে তা স্বাভাবিক নয়। আহমদ মুসাকে যেতে দেয়ার অর্থ তাদের নাম-ঠিকানা ফরাসি পুলিশ ও রুশ সরকারের কাছে প্রকাশ হয়ে পড়া। তাছাড়া তাদের দু’টি বড় বিপর্যয়ের প্রতিশোধের প্রশ্ন তো আছেই।
আহমদ মুসা গাড়ির দিকে এগুতে এগুতেই চারদিকে একবার তাকাল। না, সন্দেহজনক কিছু দেখতে পেল না।
আহমদ মুসা গাড়ির কাছে গিয়ে গাড়ির চারদিক ঘুরে ভেতরটা ভালো করে দেখে নিয়ে গাড়ির ভেতরে প্রবেশ করল। প্রথমেই বিস্ফোরক ডিটেকটরের সুইচ অন করে দেখে নিল গাড়িতে কোন বিস্ফোরক পাতা নেই।
গাড়ি স্টার্ট দিল আহমদ মুসা। চলতে শুরু করল গাড়ি।
আহমদ মুসার মন থেকে খুঁত খুঁতে ভাবটা গেল না। তার মনে হচ্ছে, শত্রুর চোখের অস্বস্তিকর ছায়ায় যেন সে দাঁড়িয়ে।
রিয়ারভিউতে চোখ রেখেছিল আহমদ মুসা, কিন্তু অনেক গাড়ির ভীড়ে বুঝা যাচ্ছিল না কিছুই।
রুশ দূতাবাস থেকে দুই কিলোমিটার দূরে বিরাট একটা মোড়। বিভিন্ন দিক থেকে আসা ছয়টি রাস্তার মোহনা এটা।
মোড়ের মুখে এসে গাড়িগুলো বিভিন্ন দিকে যাবার জন্য নির্দিষ্ট লেন দিয়ে এগিয়ে বিভিন্ন ফ্লাই ওভারে ও গ্রাউন্ড ওয়েতে বিভক্ত হয়ে যায়।
ঠিক এই জায়গায় এসে আহমদ মুসা গাড়ির গতি কিঞ্চিত স্লো করে লেন চেঞ্জ করছিল।
হঠাৎ গাড়ির পাঁজরে প্রচন্ড এক আঘাত। সেই আঘাতের সাথে দেহটাও যেন তার চ্যাপ্টা হয়ে গেল, মনে হলো আহমদ মুসার। ছুটে আসা ভাঙা কাঁচের টুকরায় ক্ষতবিক্ষত হয়ে গেল তার মুখ।
এই আঘাত সামলে উঠার আগেই গাড়ির বাম পাঁজরে আরও একটা ধাক্কা এসে পড়ল। চ্যাপ্টা হয়ে গেল গাড়ি।
প্রায় সাথে সাথেই সামনের উইন্ডস্ক্রীন ভেঙে একজন লোক ঝাঁপিয়ে পড়ল ভেতরে। প্রায় সংজ্ঞাহারা আহমদ মুসাকে টেনে বের করে নিয়ে গেল লোকটি।
এ সব কিছুই ঘটল ওলগার চোখের সামনে।
আহমদ মুসার গাড়িকে আর একটি গাড়ি যখন প্রথম আঘাত করল, তখন ওলগার গাড়ি এর সমান্তরালে বিপরীত প্রান্তের লেনে এসে দাঁড়িয়েছিল। তার অনিচ্ছাতেই যেন তার গাড়ি দাঁড়িয়ে পড়েছিল। দ্বিতীয় গাড়িটি যখন আঘাত করল আক্রান্ত গাড়িটাকে, তখন ওলগার হঠাৎ করে মনে হলো ব্যাপারটা দুর্ঘটনা নয়। গাড়ির আরোহীর হত্যা করাই কি আক্রমণকারীদের টার্গেট? হঠাৎ মায়োভস্কিকে ছুটে এসে উইন্ড শিল্ড ভেঙে ভেতরের লোকটিকে বের করতে দেখে খুশী হলো ওলগা। ভাবল, যাক আক্রান্তের পর উদ্ধার হওয়ার একটা পথ হলো।
মায়োভস্কি যখন আহমদ মুসাকে বের করে নিয়ে আসছিল, তখন মুখটা তার দেখতে পেল ওলগা। চমকে উঠল সে। এ যে মিঃ আবদুল্লাহ! তাকে কে মেরে ফেলতে চেষ্টা করেছিল?
মায়োভস্কি আহমদ মুসাকে নিয়ে দ্রুত তার গাড়িতে তুলল এবং সংগে সংগেই গাড়ি স্টার্ট দিল।
ওলগা ভাবল মিঃ আবদুল্লাহকে মায়োভস্কি নিশ্চয় হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছে। ওলগাও সিদ্ধান্ত নিল হাসপাতালে যাবার। আবদুল্লাহ একদিন তার নিজের জীবন বিপন্ন করে বাঁচিয়েছিল তাকে এবং তার মাকে। তার দুর্দিনে তার পাশে দাঁড়াতে পারলে ভালই হবে।
ওলগা তার গাড়ি ঘুরিয়ে নিয়ে চলল মায়োভস্কির গাড়ির পেছনে। মায়োভস্কির গাড়ি অসাধারণ লাল রংয়ের। তাই অনেক পেছনে পড়েও তার পিছু নেয়া কঠিন হলো না ওলগার।
অনেক ক্লিনিক, হাসপাতাল পেরুল, কিন্তু থামার নাম নেই মায়োভস্কির গাড়ির। তাহলে আব্দুল্লাহকে কি কোন নির্দিষ্ট হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছে? হতে পারে।
প্রায় ২০ মিনিট চলার পর মায়োভস্কির গাড়ি একটা সংকীর্ণ গলিতে ঢুকে একটা বাড়ির সামনে দাঁড়ালো। দাঁড়িয়েই হর্ণ দিল মায়োভস্কি। সংগে সংগেই বাড়ির সামনের গেটটি উপরে উঠে গিয়ে গাড়ি ঢুকতে পারে এই পরিমাণ উপরে উঠে স্থির হলো।
মায়োভস্কির গাড়ি দৌড় দিয়ে ভেতরে ঢুকে গেল।
ভেতরটা এক ঝলক দেখতে পেল ওলগা। বিস্মিত হলো ওলগা, ভেতরে যে কয়জন লোক তার নজরে পড়ল সবার হাতে স্টেনগান।
আরও একটা জিনিস ওলগার নজর এড়ালো না। সেটা হলো, মায়োভস্কির গাড়ি রুশ দূতাবাসের কূটনীতিকের গাড়ি নয়।
অনেক প্রশ্ন এসে ভীড় জমাল ওলগার মনে। কারা আবদুল্লাহকে হত্যার চেষ্টা করল, হঠাৎ মায়োভস্কি কোত্থেকে এল, উইন্ডশিল্ড ভেঙে তাড়াহুড়ো করে উদ্ধারের জন্যে এগুলো কেন, হাসপাতালে না নিয়ে তাকে অস্ত্রধারীদের আড্ডায় আনল কেন, কেন মায়োভস্কি কূটনীতিকের গাড়ি ব্যবহার করেনি। কোন প্রশ্নেরই সদুত্তর খুঁজে পেল না ওলগা।
বাড়িটার পাশেই কয়েকটা গাড়ির আড়ালে গাড়ি পার্ক করে ওলগা নজর রাখছিল বাড়িটার গেটের উপর।
মিনিট দশেক পরেই মায়োভস্কির গাড়ি বেরিয়ে এল। গাড়ির পিছে পিছে পকেটে হাত ঢুকানো দু’জন লোকও বেরিয়ে এসেছে। লোক দু’টি রুশ।
গেট পেরুবার পর গাড়ি রোডের উপর নেবার আগে গাড়ির জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে লোক দু’টিকে লক্ষ্য করে বলল,‘দেখো, সাবধান থেকো। দু’বার কিন্তু জাল কেটে পালিয়েছিল।’
বলেই তীর গতিতে গাড়ি ছাড়ল।
একটু সময় নিয়ে ওলগাও তার গাড়ি ছেড়ে দিল।
মায়োভস্কির শেষ কথাটা কানে আসার সাথে সাথে মুখ ম্লান হয়ে গেল ওলগার। শেষ ঐ কথাটা শোনার পর ওলগার বিন্দু মাত্র সন্দেহ রইল না যে, আবদুল্লাহ লোকটি বন্দী মায়োভস্কিদের হাতে। তাহলে নিশ্চয় মায়োভস্কিরাই সেই এ্যাকসিডেন্টটা ঘটিয়েছিল।
কিন্তু কেন? এই প্রশ্নটি ক্ষতবিক্ষত করল ওলগাকে। আবদুল্লাহর মত বিদেশী লোকের সাথে মায়োভস্কির কি শত্রুতা থাকতে পারে? মায়োভস্কির কথায় মনে হয় আরও দু’বার তারা আবদুল্লাহকে ধরেছিল।
বাড়িতে পৌঁছেও ওলগা আহমদ মুসার চিন্তাটা তার মাথা থেকে দূর করতে পারলো না।
একবার তার মনে হলো, ব্যাপারটা তার আব্বাকে (রাষ্ট্রদূত পাভেল) জানানো উচিত। কিন্তু তার মনে শংকা দেখা দিল, যদি ব্যাপারটার সাথে তার আব্বা অর্থাৎ দূতাবাস জড়িত না থাকে, আর যদি মায়োভস্কির কাজটা বেআইনি হয়, মায়োভস্কির ক্ষতি হবে। এই ক্ষতি ওলগা সহ্য করতে পারবে না।
ওলগা ও মায়োভস্কি পরস্পরকে ভালবাসে।
এই চিন্তা থেকেই ওলগা ব্যাপারটা তার আব্বাকে জানানো ঠিক মনে করল না। অথচ সে জানে, মায়োভস্কির এই কাজের সাথে যদি তার আব্বা অর্থাৎ দূতাবাস যদি জড়িত না থাকে, তাহলে আবদুল্লাহকে বাঁচানোর এটাই সবচেয়ে সহজ পথ।
পরিশেষে সিদ্ধান্ত নিল, ওলগা নিজে গিয়ে মায়োভস্কিকে অনুরোধ করবে আবদুল্লাহকে ছেড়ে দেবার জন্যে। যদি দেখা যায় দূতাবাস এই ঘটনার সাথে জড়িত এবং তার আব্বার অনুমতি ছাড়া মায়োভস্কি তাকে ছাড়তে পারছে না, তাহলে সে তার আব্বাকে অনুরোধ করবে।
সন্ধ্যা ৭ টায় টেলিফোনে কথা বলার পর ওলগা গিয়ে হাজির হলো মায়োভস্কির বাড়িতে।
ওলগা প্রবেশ করতেই মায়োভস্কি উঠে দাঁড়িয়ে স্বাগত জানিয়ে বলল, ‘ওলগা কিছু হয়নি তো?’ মায়োভস্কির চোখে-মুখে বিস্ময়।
‘কেন বলছ একথা?’ বলল ওলগা।‘তোমাকে টেলিফোন করে আনরা যায় না, সেখানে তুমি টেলিফোন করে আসবে, সেটা কল্পনাও করতে পারছি না।’
‘এটা কি অবাক হওয়ার মত কাজ?’
‘তোমার ক্ষেত্রে অবশ্যই। অন্যদের চেয়ে তোমার নৈতিকতাটা ভিন্ন।’
‘একে খারাপ মনে কর?’
‘আমার জন্যে আনন্দের, কিন্তু কষ্টকর।’
ওলগা মায়োভস্কির পাশে বসতে বসতে বলল,‘একটা অনুরোধ নিয়ে এসেছি।’
‘অনুরোধ নয়, আদেশ কর।’
গম্ভীর হলো ওলগা। একটু দ্বিধা করল। তারপর বলল,‘আজকে একটা ঘটনা ঘটেছে না?’
‘কি ঘটনা?’
‘তোমরা একজন আহত লোককে নিয়ে গেছ না?’
চমকে উঠল মায়োভস্কি।
স্থির দৃষ্টিতে তাকাল ওলগার দিকে। বলল, ‘তুমি কি করে জান?’
‘কেন আমি দেখেছি। আমি সাঁজেলিঁজে থেকে ফিরছিলাম। আমার গাড়ি তখন ওখানে এসে দাঁড়াতে বাধ্য হয়েছিল।’
‘কি দেখেছ তুমি?’
‘তোমরা আহত মিঃ আবদুল্লাহকে তুলে নিয়ে গেলে?’ থামল ওলগা।
‘আর কি দেখেছ?’
‘তোমরা তাকে হাসপাতালে না নিয়ে একটা বাড়িতে তুলেছ।’
মায়োভস্কির চোখে-মুখে দেখা দিল উদ্বেগ-আতংকের ছাপ। বলল, ‘তুমি সেখানে গিয়েছিলে কেন?’
‘মনে করলাম মিঃ আবদুল্লাহকে তোমরা হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছ, তাই তাকে দেখতে গিয়েছিলাম।’
মায়োভস্কি মুখ নিচু করেছে। তার চোখ-মুখ শক্ত হয়ে উঠেছে। সেখানে ভয় ও উদ্বেগের ছাপ। কিছুক্ষণ সে নির্বাক থাকল। তারপর বলল,‘তুমি কি বলতে এসেছ?’
‘আমার মনে হচ্ছে, মিঃ আবদুল্লাহকে তোমরা আটক করেছ কোন কারণে। তাকে ছেড়ে দেবার জন্যে অনুরোধ করতে এসেছি। সে একদিন আমাদের জীবন বাঁচিয়েছিল।’
‘আব্বাকে কিছু বলিনি। ভাবলাম, তোমাকে বললে যদি কাজ হয়, আব্বাকে আর বলবো না।’
মায়োভস্বির মুখ থেকে উদ্বেগের ভাবটা একটু দূর হলো। বলল,‘ঠিক করেছ। ভিষয়টা ভিন্ন ধরনের একটা ব্যাপার। তোমার আব্বার জানা উচিত নয়।’
‘ঠিক আছে, বলব না। কিন্তু বল, আমার অনুরোধ রাখবে?’
মায়োভস্কি কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল। তারপর বলল,‘তুমি কি মনে কর নিরপরাধ কোন লোককে আমরা আটকাতে পারি?’
‘না পার না।’
‘জান, লোকটি যে অপরাধ করেছে তাতে তাকে এক মুহূর্ত বাঁচিয়ে রাখা যায় না।’
‘কি অপরাধ করেছে সে?’
‘সব কিছু তোমার জানা ঠিক নয়। তুমি আমাকে বিশ্বাস কর না?’ মায়োভস্কি ওলগাকে কোলে টেনে নিয়ে বলল।
ওলগা এক হাতে মায়োভস্কির গলা পেঁচিয়ে ধরে বলল,‘তোমাকে বিশ্বাস না করলে দুনিয়ায় আর কাকে বিশ্বাস করব বল?’
‘তাহলে শোন, লোকটি ভয়ংকর। বাইরে ভাল মানুষী চেহারা দেখে তার কিছুই বুঝবে না। দেশ ও জাতির স্বার্থে অনেক কিছুই সবার অলক্ষ্যে করতে হয়। এ বিষয়টাও সেই রকম। বুঝেছ তুমি?’
মায়োভস্কির কোল থেকে মাথা তুলতে তুলতে ওলগা বলল,‘বুছেছি। কিন্তু………।’
‘কোন কিন্তু নয়, সে তোমাদের জীবন বাঁচিয়েছিল, সেটা তার একটা রাজনীতি ছিল।’
‘হতে পারে, কিন্তু…………।’
‘আর কোন কিন্তু নয়।’ বলে মায়োভস্কি তাকে নিবিড়ভাবে কাছে টেনে নিল।

শুয়ে ঘুম আসছিল না মায়োভস্কির। এপাশ ওপাশ করছিল অবিরাম।
একটা প্রচন্ড অপরাধ বোধ তাকে ক্ষত-বিক্ষত করছিল। সে ভাবছিল, ওলগার প্রতি তার ভালোবাসা গ্রেট বিয়ারের সুনির্দিষ্ট বিধান ভংগ করতে তাকে বাধ্য করেছে। গ্রেট বিয়ারের নির্দেশ হলো, গ্রেট বিয়ারের সদস্য নয় এমন কেউ গ্রেট বিয়ারের কোন লোক বা গ্রেট বিয়ারের কোন ঘাটি দেখে ফেললে তাকে অবশ্যই বাঁচিয়ে রাখা যাবে না। ওলগা মায়োভস্কিকে গ্রেট বিয়ারের লোক হিসেবে চিনতে পারা শুধু নয়, গ্রেট বিয়ারের একটা গুরুত্বপূর্ণ অপারেশন এবং একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘাটি দেখে ফেলেছে। এরপরও মায়োভস্তি তাকে জীবন্ত ছেড়ে দিয়েছে। এত বড় ঘটনা আইভান দি টেরিবলের অবশ্যই অজানা থাকবে না। নিশ্চয় তার এই বাড়ি আইভানের নজরের বাইরে নয়। তার এবং ওলগার কথোপকথন কে জানে এতক্ষণ তার কাছে পৌঁছে গেছে কিনা। কেঁপে উঠল মায়োভস্কি। শয্যা তার কাছে কাঁটা বলে মনে হতে লাগলো।
তাড়াতাড়ি উঠে বসল মায়োভস্কি।
সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল। গ্রেট বিয়ারের দাবীর কাছে তার ভালোবাসার কোন মূল্য নেই। উপায় নেই তার, কোরবানী দিতে হবে তার ভালোবাসাকে।
দ্রুত উঠে গিয়ে টিপয় থেকে মোবাইল টেলিফোন তুলে নিল। ডায়াল করে বলল,‘পেট্রভ তুমি তৈরি হয়ে এখনি এসো।’
টেলিফোন রেখে দিয়ে অস্থিরভাবে পায়চারী করতে লাগল মায়োভস্কি।
মিনিট দশেকের মধ্যে ডার্ক ছাই রংয়ের পোশাকে ঢাকা দীর্ঘদেহী একজন প্রবেশ করল মায়োভস্কির কক্ষে।
মায়োভস্কি ধপ করে সোফায় বসে পড়ল। তারপর একটা কাগজ লোকটির দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,‘পেট্রভ বুঝতে পারো কিনা দেখ।’
পেট্রভ নামক লোকটি কাগজটির উপর চোখ বুলিয়ে বলল,‘রাষ্ট্রদূত পাভেলের বাসার ভেতরের স্কেচ। আমাকে ঢুকতে হবে মিস ওলগার কক্ষে। হাতে নিডল গান। তার মৃত্যু নিশ্চিত হওয়ার পর আমাকে তার কক্ষ ছাড়তে হবে।’
মায়োভস্কির মুখের চেহারা পাথরের মত। গম্ভীর কণ্ঠে সে বলল,‘ধন্যবাদ পেট্রভ। পেট্রভ মনে রেখ তোমাকে সফল হতে হবে।’
‘বুঝেছি।’
মায়োভস্কি সোফায় হেলান দিয়ে চোখ বুজে বলল,‘যাও, তোমার ফেরা পর্যন্ত আমি এখানে বসে অপেক্ষা করবো।’
পেট্রভ বেরুবার জন্যে ঘুরে দাঁড়িয়েও থমকে দাঁড়াল,‘স্যার, তাকে যদি কক্ষে না পাওয়া যায়?’
‘তোমার উপর দায়িত্ব তাকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেয়া, যেখানে পাবে সেখানে।’ কঠোর কণ্ঠে বলল কথাগুলো মায়োভস্কি। কিন্তু বড্ড শুষ্ক শুনাল তার কণ্ঠ।
পেট্রভ বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।
ওদিকে ওলগারও ঘুম আসছিল না। তার ভেতরে অসহ্য এক টানাপোড়েন। মায়োভস্কিকে সে ভালোবাসে। তার কথা সে বিশ্বাস করেছে। যতক্ষণ তার কাছে ওলগা ছিল, ভালই ছিল। কিন্তু যতই সময় যাচ্ছে, ভেতরের এক টানাপোড়েন তাকে পীড়িত করছে। আহমদ মুসার যে ভয়ংকর রূপ মায়োভস্কি ওলগার কাছে তুলে ধরেছে, সেটা মেনে নিতে তার কষ্ট হচ্ছে। ক্রিমিনালরা যতই তার অপরাধকে ভদ্র পোশাক আর ভদ্র কথার আড়ালে চাপা দিক, তার চোখ ও চেহারার আয়নায় তার যে আসল রূপ প্রকাশ পায় তা সে ঢাকতে পারে না কিছুতেই। আহমদ মুসার কোন কিছুই প্রমাণ করে না যে সে ক্রিমিনাল। আরও একটা কথাকে সে কিছুতেই মিলাতে পারছিল না। আহদ মুসা যদি রাশিয়ার শত্রু কিংবা রাশিয়ার বিবেচনায় কোন ক্রিমিনালই হবে, তাহলে রাষ্ট্রদূতের কাছ থেকে সে বিষয়টা গোপন রাখা হবে কেন? তাঁরই প্রথম জানার কথা। এ গোপনীয়তার অর্থ, কাজটা এমন যা রাষ্ট্রদূতের জানা ঠিক নয়, তিনি এটা পছন্দ করবেন না। এর অর্থ কাজটা বৈধ নয়।
এসব চিন্তার দ্বিমুখী টানাপোড়েনে অস্থির হয়ে উঠেছিল ওলগা। ঘুম ধরছিল না তার চোখে।
ঘর অন্ধকার।
দেয়াল বরাবর পর্দা টানা থাকায় এবং জানালায় গরাদ লাগানো থাকায় যেটুকু আলো আসতে পারতো তাও আসছে না।
হঠাৎ ধাতব ঘর্ষণের একটা অস্পষ্ট টানা শব্দ তার কানে এল। উৎকর্ণ হলো ওলগা উৎসের দিকে।
আবার শব্দ হলো তেমনি অস্পষ্ট। ওলগার বুঝতে বাকি রইল না যে, কেউ জানালার গরাদ এবং কাঁচের জানালা তুলল।
মুহূর্তেই উদ্বেগ ও আতংকের একটা ঢেউ খেলে গেল তার গোটা শরীরে।
পরক্ষণেই সতর্কতায় শক্ত হয়ে উঠল তার দেহ। বালিশের তলা থেকে রিভলবার এবং ক্ষুদ্র একটা টর্চ বের করে নিল। তার ডান হাতের রিভলবার স্থির তুলে ধরল শব্দের উৎস লক্ষ্যে। বাম হাতে তার টর্চ।
শব্দের উৎসের দিকে স্থির নিবদ্ধ তার দু’চোখ দেখল, অন্ধকার নড়ে উঠল এবং এক খন্ড সাদা আলো ফুটে উঠল অন্ধকারের বুকে।
ওলগা বুঝল, গরাদ ও কাঁচের জানালা খুলে কেউ প্রবেশ করছে তার ঘরে।
পর্দা আরও ফাঁক হলো। সেখানে আবির্ভূত হলো এক কালো ছায়ামূর্তি। ওলগা রিভলবারের ট্রিগারে তর্জনি রেখে টর্চের সুইচ অন করল ছায়ামূর্তিকে লক্ষ্য করে।
ঘটনার আকস্মিকতায়ও বিমূঢ় হলো না ছায়ামূর্তি।
টর্চের আলো জ্বলে উঠার সংগে সংগে ছায়ামূর্তি ডান হাত তুলে ধরেছিল। হাতে তার নিডল গান।
নিডল গান থেকে আলপিনের অগ্রভাগের মত এক ঝাঁক গুলী বের হয়। গুলী গুলোর অগ্রভাগ ভয়ংকর বিষাক্ত। বিষাক্ত নিডল কারও চামড়া ভেদ করে রক্ত স্পর্শ করার সাথে সাথে তার মৃত্যু ঘটে। আর এ নিডলগুলো এত শক্তি ও গতি সম্পন্ন যে, একমাত্র লোহার বর্ম ছাড়া সব রকম পোশাকই ভেদ করতে পারে।
ছায়ামূর্তি নিডল গান সমেত তার হাত তুলে স্থির হবার আগেই ওলগার রিভলবার গুলী বর্ষণ করল।
গুলীটি ছায়ামূর্তির বক্ষ ভেদ করল।
ছায়ামূর্তিটি বার কয়েক চক্কর খেয়ে আছড়ে পড়ল মেঝের উপর।
ওলগা টর্চ নিভাল, কিন্তু রিভলবার নামাল না। ছায়ামূর্তির সাথে আরও কেউ থাকতে পারে।
ওলগার রিভলবারের গুলী বর্ষিত হবার পর কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে রাষ্ট্রদূত পাভেল সহ বাড়ির সবাই ছুটে এল ওলগার ঘরে।
রাষ্ট্রদূত পাভেলই ঘরে আলো জ্বালল। দেখল রিভলবার হাতে ওলগাকে এবং রক্তাক্ত লাশটাকে।
রাষ্ট্রদূত ওলগার তাছে ঘটনা শোনার পর পুলিশে টেলিফোন করে ছায়ামূর্তিটির লাশের দিকে এগুতে এগুতে বলল,‘কে এই লোক?’
মূর্তিটি ভালো করে দেখে বলল,‘লোকটি রুশ কিন্তু অপরিচিত।’
তারপর লোকটির হাতে ধরে রাথা নিডল গান ভালো করে নিরীক্ষণ করে চমকে উঠল রাষ্ট্রদূত। নিডল গানটি যে শুধু রাশিয়াতেই তৈরি তা নয়, নিডল গানে রুশ গোয়েন্দা সংস্থা কেজিবি’র নতুন সংকেত চিহ্ন উৎকীর্ণ রয়েছে যা অন্যকেউ না বুঝলেও তিনি দেখেই বুঝলেন।
কেজিবির নিডল গান লোকটির হাতে দেখে তার চোখ-মুখ উদ্বেগে ছেয়ে গেল।
সে তাড়াতাড়ি হাতে গ্লাভস পড়ে লোকটির পকেট সার্চ করল। লোকটির বুক পকেটে প্রথমেই পেয়ে গেল একটি ছোট কাগজ। কাগজটি তার বাড়ির ইন্টরন্যাল ডায়াগ্রাম। যাতে দেখানো হয়েছে ওলগার ঘরে আসার পথ। ডায়াগ্রামের সাথে হাতের লেখার প্রতি নজর পড়তেই ভূত দেখার মত আঁৎকে উঠল রাষ্ট্রদূত পাভেল। হস্তাক্ষর দেখার সাথে সাথেই চিনতে পারলো ওটা মায়োভস্কির হাতের লেখা। তাহলে তো মায়োভস্কিই লোক পাঠিয়েছে ওলগাকে খুন করার জন্যে! কিন্তু কেন? ওলগা ও মায়োভস্কির ঘনিষ্টতা আছে বলেই তো তারা জানে। এর মধ্যে তাহলে এমন কিছু কি ঘটেছে যার জন্যে ওলগাকে তার খুন করার প্রয়োজন পড়েছে? বিষয়টা অস্বাভাবিক মনে হলো তার কাছে। আরও বড় কিছু কি আছে এর পেছনে?
ওলগা তার আব্বার ভাবান্তর দেখে বলল, ‘ও কাগজে কি কিছু পাওয়া গেছে আব্বা?’
রাষ্ট্রদূত পাভেল ওলগার দিকে কয়েক পা এগিয়ে এসে বলল,‘মায়োভস্কির সাথে তোমার বড় ধরনের কোন গন্ডগোল হয়েছে?’
ওলগা বিস্ময়ে চোখ দু’টো কপালে তুলে বলল,‘এ সময়ে এ প্রশ্ন কেন আব্বা?’
রাষ্ট্রদূত পাভেল তার স্ত্রী ছাড়া অন্য সবাইকে বাইরে যেতে ইংগিত করল এবং বলল ওলগাকে,‘মায়োভস্কি তোমাকে খুন করার জন্যে এই লোককে পাঠিয়েছিল।’
শুনে ওলগার চোখ বিস্ময়ে বিস্ফারিত হলো। কিছুক্ষণ কথা বলতে পারলো না ওলগা।
‘কিছু ঘটেছে তোমার সাথে তার?’ বলল ওলগার আব্বাই।
‘আমার সাথে কিছু ঘটেনি। তবে….।’
বলে একটু থামল ওলগা। তারপর বলল,‘মায়োভস্কি ও তার লোকরা মিঃ আবদুল্লাহকে আহত করে কিডন্যাপ করেছে। আমি তাকে অনুরোধ করতে গিয়েছিলাম তাকে ছেড়ে দেবার জন্যে।’
‘কেন আবদুল্লাহকে গ্রেপ্তার করেছে? কেমন করে তুমি জানতে পারলে? কেন আমাকে জানাওনি?’ এইভাবে এক সাথে অনেকগুলো প্রশ্ন করল রাষ্ট্রদূত পাভেল।
ওলগা সব কথা, সব বিবরণ তার আব্বাকে খুলে বলল।
ওলগার কথা শেষ হতেই রাষ্ট্রদূত উঠে দাঁড়াল। দ্রুত গিয়ে টেলিফোন তুলে নিল। নিরাপত্তা বিভাগকে নির্দেশ দিল, এখনি মায়োভস্কিকে আটক করতে এবং বলল,‘পুলিশের সাথে কথা বলে আমি আসছি।’
কিন্তু মায়োভস্কির বাড়ি শূন্য। তাকে পাওয়া গেল না।
তারপর লাষ্ট্রদূত পাভেল পুলিশকে বলে ছুটল আহমদ মুসাকে উদ্ধারের জন্যে। সেখানেও মায়োভস্কিকে পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু রাষ্ট্রদূত পাভেল তখনও বুঝেনি, মায়োভস্কির এই ভীমরতির কারণ কি!

ঘুটঘুটে অন্ধকার ঘর।
আহমদ মুসা সংজ্ঞা ফিরে পেয়ে চোখ মেলল। কিছুই দেখতে পেল না। তার কি ঘটেছে মনে করার চেষ্টা করল।
তার গাড়ির এ্যাকসিডেন্টে সে আহত হয়েছিল। কিন্তু সে জ্ঞান হারায়নি। তারপর মায়োভস্কি তাকে টেনে বের করল। গাড়িতে তুলল। তারপর ক্লোরোফরম ভেজা একটা রুমাল তার নাকে চেপে ধরল। কিছু মনে নেই এরপর।
বুঝা যাচ্ছে, এ্যাকসিডেন্টটা ছিল গ্রেট বিয়ারের পরিকল্পিত। মায়োভস্কি রাষ্ট্রদূতের কক্ষ থেকে বেরিয়ে আসার পর যে সময়টুকু পেয়েছিল তা সে এই পরিকল্পনায় ব্যয় করেছে। একটা কিছু সে করবে, রাষ্ট্রদূতের কক্ষ থেকে বেরুবার পর আহমদ মুসারও মনে হয়েছিল। কিন্তু কি করবে সেটা ভাবতে পারেনি।
তাহলে সে এখন গ্রেট বিয়ারের হাতে।
ধীরে ধীরে উঠে বসল সে। সর্বাঙ্গে ব্যথা।
এর মধ্যেও এই ভেবে খুশী হলো যে, তার হাত পা বাঁধা নেই। সম্ভবত তারা সংজ্ঞাহীন লোককে বাঁধার প্রয়োজন অনুভব করেনি।
চারদিকে হাত বুলিয়ে মেঝের কার্পেট ছাড়া আর কিছুই পেল না আহমদ মুসা।
এ সময় পায়ের শব্দ শুনতে পেল সে।
কয়েকজনের পায়ের সেই শব্দ থেমে গেল হঠাৎ।
ওরা দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে কি? দরজা খুলবে ওরা?
এই জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার মনে উদয় হওয়ার সংগে সংগেই যেভাবে সে মেঝের উপর কার্পেটে পড়েছিল সেইভাবে আবার শুয়ে পড়ল সংজ্ঞাহীনের মত।
খুলে গেল ঘরের দরজা। জ্বলে উঠল ঘরের আলো।
ঘরে প্রবেশ করল স্বয়ং গ্রেগরিংকো, উস্তিনভ এবং আরও দু’জন।
তাদের ঘরে ঢোকার পর পরই একটা ছোট ভ্যানে করে প্রিন্সেস ক্যাথারিনকে সেখানে আনা হলো।
প্রিন্সেস ঘরে ঢুকেই দেখতে পেল সংজ্ঞাহীনভাবে পড়ে থাকা রক্তাক্ত আহমদ মুসাকে। আঁৎকে উঠল সে আহমদ মুসার এই অবস্থা দেখে। একটা প্রবল যন্ত্রণা অনুভব করল সে তার হৃদয়ে। বলল সে গ্রেগরিংকোর দিকে তাকিয়ে,‘মিঃ গ্রেগরিংকো, এই লোকটি তো রাজ পরিবারের কেউ নয়, রাজ পরিবারের সাথে সম্পর্কিতও নয়। তাহলে কেন বার বার এইভাবে একে নির্যাতন করছেন?’
‘সম্মানিতা প্রিন্সেস, এ রাজ পরিবারের কেউ না হয়েও সে আমাদের পেছনে লেগেছে। সে এ পর্যন্ত আমাদের যে ক্ষতি করেছে, আমাদের সাম্প্রতিক ইতিহাসে তার কোন নজীর নেই। এর জন্যে আমাদের দু’টি মূল্যবান ঘাটি ছাড়তে হয়েছে, কয়েক ডজন লোককে হারাতে হয়েছে। একে শতবার হত্যা করলেও আমাদের প্রতিহিংসা মিটবে না। কিন্তু আমরা তাকে হত্যা করিনি। আমরা শুধু তার কাছে জানতে চাই, কেন সে আমাদের পিছু লেগেছে। তাতিয়ানা সম্পর্কে সে কি জানে?’
বলে একটু থেমেই সে উস্তিনভকে লক্ষ্য করে বলল, ‘এর তো জ্ঞান এখনও ফেরেনি। তাহলে একটু পরেই আমাদের কাজ শুরু করতে হবে, কেমন?’
‘ঠিক বলেছেন।’ বলল উস্তিনভ।
গ্রেগরিংকো ভ্যানের ড্রাইভারের দিকে তাকিয়ে বলল,‘সম্মানিতা প্রিন্সেসকে তাঁর ফ্লাটে নিয়ে যাও।’
সবাই কক্ষ থেকে বেরিয়ে গেল।
কক্ষ থেকে বেরুতে বেরুতে গ্রেগরিংকো উস্তিনভকে বলল, ‘একটু পর তোমরা এসে একে বেঁধে ছোট ভ্যানে করে নিয়ে যাবে। আমিও যাব প্রিন্সেসের ওখানে। শেষ নাটক ওখানেই হবে।’
কক্ষের দরজা বন্ধ হয়ে গেল। আবার সেই ঘুটঘুটে অন্ধকার।
আহমদ মুসা আবার ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল। মুখ মাথা ব্যথায় টন টন করছে। শরীরের হাড়গোড়ও যেন গুড়ো হয়ে গেছে।
উঠে বসতেই মাথাটা ঘুরে গেল। মাটিতে দু’হাতের হেলান দিয়ে শরীরটাকে স্থির রাখল সে। এ সময় তাকে দুর্বল হলে চলবে না। প্রবল মানসিক শক্তি দিয়ে দেহের সব শক্তিকে একত্রিত করতে চাইল সে।
ধীরে ধীরে সে উঠে দাঁড়াল। অন্ধকার ঘরে পায়চারী করল। আহত শরীরকে চাঙ্গা করতে চেষ্টা করল। ব্যথা জ্বর জ্বর শরীরের বিভিন্ন অংশের স্টিফনেস দূর করতে গিয়ে নতুন ব্যথায় তার মুখ ফুঁড়ে আর্তনাদ বেরিয়ে এল, নিজের মুখ নিজেই চেপে ধরল সে।
দরজার দিকে পা করে যেভাবে চিৎ হয়ে শুয়ে ছিল, সেভাবেই আবার শুয়ে পড়েছে।
শুয়ে শুয়ে আহমদ মুসা অপেক্ষা করছে আবার সেই পরিচিত পদশব্দের।
অবশেষে সে পদশব্দ শোনা গেল দরজার বাইরে।
দরজা খুলে গেল।
উস্তিনভ, চারজন স্টেনগানধারী এবং একটি ছোট ভ্যান নিয়ে একজন ড্রাইভার-এই ছয়জন প্রবেশ করল ঘরে।
আহমদ মুসাকে একইভাবে সংজ্ঞাহীনের মত পড়ে থাকতে দেখে উস্তিনভ স্টেনগানধারী একজনকে বলল,‘দেখ তো নাড়া দিয়ে, সংজ্ঞাহীন না সে ঘুমুচ্ছে।’
স্টেনগানধারী একজন এগিয়ে বাম হাতে স্টেনগান নিয়ে ডান হাতে আহমদ মুসাকে পরীক্ষা করার জন্যে ঝুকে পড়ল। তার স্টেনগান ধরা বাম হাত খানাও আহমদ মুসার বুকের প্রায় কাছাকাছি।
আহমদ মুসা এমন একটা সময়েরই অপেক্ষা করছিল।
মাটিতে নেতিয়ে পড়ে থাকা আহমদ মুসার দু’টি হাত চোখের পলকে উঠে এল। ছিনিয়ে নিল ঝুকে পড়া লোকটির বাম হাত থেকে স্টেনগান এবং শুয়ে থেকেই গুলী বৃষ্টি করল ওদের লক্ষ্য করে।
উস্তিনভরা বোঝার আগেই সব শেষ। ছয়টি রক্তাক্ত লাশ পড়ল কার্পেটের উপর।
আহমদ মুসা আরেকটি স্টেনগান কুড়িয়ে কাঁধে ফেলে হাতের স্টেনগান বাগিয়ে ধরে ছুটল দরজা পেরিয়ে করিডোর ধরে।
করিডোরের একটা বাঁক ঘুরতেই আহমদ মুসা মুখোমুখি হয়ে গেল মায়োভস্কির। মায়োভস্কির সাথে আরও চারজন। ওদের হাতে স্টেনগান, মায়োভস্কির হাতে রিভলবার।
আহমদ মুসা মুহূর্ত মাত্রও নষ্ট করেনি। মায়োভস্কিদের উপর চোখ পড়ার সাথে সাথেই আহমদ মুসার স্টেনগান গর্জে উঠল। এক ঝাঁক গুলী গিয়ে ঘিরে ধরল ওদেরকে। হুমড়ি খেয়ে পড়ল পাঁচটি লাশ করিডোরের উপর। আহমদ মুসা লাফ দিয়ে লাশগুলো ডিঙিয়ে ছুটল সামনে।
করিডোর দিয়ে ছুটতে গিয়ে উপরের তলায় উঠার সিঁড়ি পেয়ে গেল।
প্রশস্ত সিঁড়ি।
আহমদ মুসা নিঃসন্দেহ যে, প্রিন্সেস ক্যাথারিনকে উপরের কোন তলায় কোথাও রাখা হয়েছে।
আহমদ মুসা সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠতে শুরু করল। শরীর টেনে নিয়ে উঠতে কষ্ট হচ্ছিল।
কয়েক ধাপ উঠতেই উপরের সিঁড়িতে পায়ের শব্দ পেল।
সেদিকে চাইতেই দেখল আহমদ মুসা, তিনজন দ্রুত নামছে সিঁড়ি দিয়ে। ওদের সাথে চোখাচোখি হয়ে গেল।
আহমদ মুসার স্টেনগান তখন ডান হাতে ঝুলানো। তোলার সময় নেই।
আহমদ মুসা লাফিয়ে পড়ল নিচে করিডোরে। প্রচন্ড ব্যথা পেল। শরীরের হাড়-গোড় যেন ভেংগে গেল তার। কিন্তু সেদিকে মনোযোগ দেয়ার সময় নেই। করিডোরে লাফিয়ে পড়ে শোয়া অবস্থাতেই গুলী বৃষ্টি করল উপরের সিঁড়ি লক্ষ্যে। ওদিক থেকেও গুলি বৃষ্টি হচ্ছে। কিন্তু ওরা আর নামেনি, সিঁড়ির যেখানে ছিল, সেখান থেকেই গুলী বৃষ্টি করছে। সিঁড়ির বাঁক কোন পক্ষের গুলীকেই লক্ষ্যে পৌঁছতে দিচ্ছে না।
গুলী বৃষ্টি অব্যাহত রেখেই আহমদ মুসা গড়িয়ে সরে এল দেয়ালের আড়ালে। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে ছুটল সামনের দিকে।
অল্প এগুতেই একটা বড় দরজা পেয়ে গেল। আর করিডোরটি বাঁক নিয়ে ডান ও বাম দু’দিকে চলে গেছে।
আহমদ মুসা খোলা দরজা পথে ঘরের বিপরীত দিকের দরজা দিয়ে লনে একটা গাড়ি দাঁড়ানো দেখতে পেল। বুঝল এটাই বাইরে বেরুবার পথ।
দরজা পথে ছুটল আহমদ মুসা গাড়ির দিকে। পেছনে ব্রাশ ফায়ারের শব্দ ছুটে আসছে। কয়েকটি গুলী এসে পেছনে ফেলে আসা দরজা দিয়ে ঘরে প্রবেশ করেছে।
আহমদ মুসা লনে একটি স্টেনগান ফেলে দিয়ে অন্যটি হাতে নিয়ে গাড়ির ড্রাইভিং সিটে উঠে বসল। গাড়ির চাবি গাড়ির কি হোলে ঝুলছিল।
আহমদ মুসার গাড়ি যখন রাস্তায় নেমে ছুটতে শুরু করেছে, তখন আহমদ মুসাকে ধাওয়া করে আসা স্টেনগানধারীরা লনে এসে দাঁড়িয়েছে।
ছুটছে আহমদ মুসার গাড়ি। কোথায় ছুটছে, তার কোন চিন্তা আহমদ মুসার মাথায় নেই।
মাথাটা তার ঝিম ঝিম করছে। স্টেয়ারিং হুইলে রাখা তার হাত দু’টি শিথিল হয়ে আসছে। চোখের দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসছে তার। দেহের সব শক্তি একত্রিত করে হাত দু’টি সবল এবং চোখ দু’টি তার খোলা রাখতে চেষ্টা করছে।
আহমদ মুসার ভাগ্য ভালো যে, তখন রাতের শেষ প্রহর। রাস্তায় গাড়ি তেমন নেই বললেই চলে। তাই নিরাপদে চলতে পারলো অনেক দূর। ছোট ছোট ট্রাফিক বিধি লংঘন হলেও বড় কিছু ঘটলো না।
আহমদ মুসার গাড়ি তখন চলে এসেছে শিন নদীর তীর অঞ্চলে।
হাত দু’টি আর স্টেয়ারিং হুইলে থাকছে না আহমদ মুসার। চোখের সামনে তার সবকিছু ঘুরছে। আহমদ মুসা বুঝল, আর পারবে না সে এগুতে। দেহের সব শক্তি তার নিঃশেষ। শেষ মুহূর্তে আহমদ মুসা তার পা চেপে গাড়ি দাঁড় করাতে চেষ্টা করলো। পারলো না। গাড়িটা একটা গাছের সাথে ধাক্কা খেল এবং আপনাতেই দাঁড়িয়ে পড়লো।
আহমদ মুসার দেহটা গড়িয়ে পড়ল সিটের উপর।

টেলিফোন পাশে রেখে দু’হাতে মুখ ঢাকলো ডোনা।
উস্কো-খুস্কো তার চেহারা। রাতে ভালো ঘুম হয়নি তার। রাতে বার বার টেলিফোন করে জানতে চেষ্টা করেছে আহমদ মুসা ফিরেছে কিনা। তারপর সকাল থেকে প্রতি ঘন্টায় টেলিফোন করেছে। না, আহমদ মুসা ফেরেনি। এখন বেলা দশটা।
পাশের সোফায় বসে ডোনার আব্বা মিঃ প্লাতিনি খবরের কাগজ পড়ছিল।
মেয়ের দিকে তাকিয়ে কাগজ পাশে রেখে বলল, ‘কোন খবর মা?’
হাত দু’টি মুখ থেকে সরিয়ে শুকনো কণ্ঠে বলল,‘না আব্বা ফেরেনি। কোনও খবরও নেই।’
মিঃ প্লাতিনি রাতে মেয়েকে সান্ত্বনা দিয়েছে বার বার এই বলে যে, নিশ্চয় কোন কাজে জড়িয়ে পড়েছে। দেরী হচ্ছে। এসে পড়বে। আহমদ মুসার জীবনে এমন ঘটনা অহরহই ঘটে। কিন্তু সকাল থেকে এ সান্ত্বনার বাণী প্লাতিনির মুথেও আর আসছে না। উদ্বেগ তাকেও আচ্ছন্ন করে ফেলেছে।
একটু সময় নিয়ে সে ধীরে ধীরে বলল,‘প্যারিসের বাইরে কোথাও তো যেতে পারে সে।’
‘কোন প্রকার প্রোগ্রাম-পরিকল্পনা ছাড়াই তিনি রুশ দূতাবাসে গিয়েছেন।’
‘সেখানে গিয়েও তো কোন প্রোগ্রাম হতে পারে?’
‘তাহলে দূতাবাসে টেলিফোন করব?’
‘করতে পার। কিন্তু পরিচয় না দিলে তো কোন ইনফরমেশন সেখান থেকে পাবে না।’
‘পরিচয় দেব।’
‘সেটা আহমদ মুসা পছন্দ করবে কিনা।’
‘আব্বা, তার অনুপস্থিতিতে সিদ্ধান্ত নেবার দায়িত্ব আমাদের। আমি আমার নাম বলব, বন্ধু পরিচয় দেব। ঠিকানা বলার প্রয়োজন হবে বলে মনে করি না।’
‘ঠিক আছে, টেলিফোন করতে পার।’
ডোনা টেলিফোন করল দূতাবাসে। পেল রাষ্ট্রদূতকে। ডোনা নিজের পরিচয় দিয়ে বলল,‘আমি ডোনা জোসেফাইন। মিঃ আবদুল্লাহ আমার বন্ধু।’
‘মিঃ আবদুল্লাহর বন্ধু?’
একটু থামল রাষ্ট্রদূতের কণ্ঠ। কয়েক মুহূর্ত সময় য়ে সে বলল, মিঃ আবদুল্লাহ কোথায় সেটাই বুঝি জানতে চান?’
‘না। সেটা আপনি নাও জানতে পারেন। আমি শুধু জানতে চাই আপনার ওখানে যাবার পর মিঃ আবদুল্লাহর কি ঘটেছে। তিনি এ পর্যন্ত বাসায় ফেরেননি।’
‘ধন্যবাদ মিস ডোনা জোসেফাইন। আপনি বুদ্ধিমতী, মিঃ আবদুল্লাহর উপযুক্ত বন্ধু। কিন্তু আপনাকে আমি কোন সুখবর দিতে পারবো না।’
বলে থামল রাষ্ট্রদূত পাভেল।
এদিকে ডোনার বুকটা থর থর করে কেঁপে উঠল। দ্রুত বলল,‘বলুন কি খবর?’ গলা কেঁপে উঠেছিল ডোনার।
‘আমি দুঃখিত মিস। আমরা চেষ্টা করেও কোন সাহায্য তাঁকে করতে পারিনি।’
অস্থির হয়ে উঠেছে ডোনা। উত্তেজনায় উদ্বেগে কাঁপছে তার শরীর। বলল,‘বলুন আপনি দয়া করে।’
রাষ্ট্রদূত পাভেল বিকেলে আহমদ মুসার রাষ্ট্রদূতের বাড়ি থেকে বের হওয়ার পর পরিকল্পিত মোটর দুর্ঘটনা থেকে শুরু করে তার বন্দী হওয়া, বন্দী খানায় রাষ্ট্রদূতদের অভিযানের বিবরণ দিয়ে বলল,‘যদিও মিঃ আবদুল্লাহকে আমরা পাইনি, তবু আমার কথা হলো সেখানে আমরা ১১টা লাশ পেয়েছি, সবই শত্রুদের। এর অর্থ আহমদ মুসার হাতেই তারা নিহত হয়েছে।’
‘তাহলে কি আবারও বন্দী হয়েছেন।’ ভাঙা গলায় বলল ডোনা।
‘বলা মুস্কিল, তবে আমার মনে হয় মিঃ আবদুল্লাহ বন্দী হলে শত্রুরা ঘাটি খালি করে পালাতো না।’
‘দয়া করে বলবেন কি, আপনারা কটায় গিয়ে শত্রুদের ঐ ঘাটি খালি দেখেন?’
‘তখন রাত সাড়ে ৪টা হবে।’
সময়টা শুনে হতাশা বাড়ল ডোনার। যেটুকু আশার আলো মনে জ্বলে উঠেছিল তাও নিভে যেতে চাইল। কথা বলতে পারল না ডোনা।
ওপার থেকে রাষ্ট্রদূতই বলল,‘কোন খারাপ কিছু চিন্তা করো না মা। ঈশ্বর তার সহায়। সে খুব ভাল ছেলে।’
‘থ্যাংকস। ঠিক আছে। গুড ডে জনাব।’
বলে ডোনা টেলিফোন রেখে দিয়ে তার আব্বার দিকে তাকিয়ে বলল,‘আব্বা ওঁর গাড়ি এ্যাকসিডেন্টে ফেলে ওকে আহত অবস্থায় কিডন্যাপ করা হয়েছে। যেখানে বন্দী করে রাখা হয়েছিল, সেখানে পুলিশ নিয়ে অভিযান চালিয়ে তাকে পাওয়া যায়নি। পাওয়া গেছে শত্রুদের ১১টি লাশ।’ কান্না জড়িত গলায় বলল ডোনা।
বলে ডোনা তার হাতের রুমালে মুখ ঢাকল।
ডোনার আব্বা এগিয়ে এসে মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,‘আল্লাহর উপর ভরসা কর মা। আমার মনে হয় সে সরে পড়তে পেরেছে।’
‘কিন্তু এতটা সময় তাহলে উনি কোথায়? এই পরিস্থিতিতে তিনি অবশ্যই টেলিফোনে তাঁর খবর জানাতেন।’
‘সেটাও নির্ভর করে সুযোগের উপর।’
ডোনা চোখ মুছে বলল,‘এখন কি করণীয় আব্বা?’
‘এস আমরা আল্লাহর উপর ভরসা করে অপেক্ষা করি।’
বলে একটু থেমেই আবার বলল,‘রুশ রাষ্ট্রদূতের সাথে কথা বলে তোমার কি মনে হলো?’
‘আমার মনে হয়েছে তিনি সত্য কথাই বলেছেন।’
ডোনার আব্বা কোন কথা বলল না।
ডোনাও নয়।
একটু পরে নীরবতা ভেঙে ডোনার আব্বা ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল,‘সাইমুমের টেলিফোন নাম্বারটা দাও, ওদের সাথে যোগাযোগ করে দেখি।’
হঠাৎ কিছু পাওয়ার আনন্দে ডোনার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল। বলল, ‘ওদের কথা ভুলেই গিয়েছিলাম আব্বা। যাই নিয়ে আসি ওদের নাম্বার।’
বলে ডোনা ছুটল উপরে ইঠার সিঁড়ির উদ্দেশ্যে।
ডোনার আব্বা সোফায় হেলান দিয়ে খবরের কাগজটা আবার তুলে নিল হাতে।

সকাল ৮টা। শিন নদীর তীর এলাকা তখনও গভীর কুয়াশায় ঢাকা।
ফাতমা ও তার আব্বা আবু আমের আবদুল্লাহ মোটর কারে যাচ্ছিলেন নদীর তীর বরাবর রাস্তা ধরে।
নদী তীরের এই জায়গাটা খুবই মনোরম। রাস্তা থেকে নদীর পানি পর্যন্ত নেমে গেছে পরিকল্পিত সাজানো গাছের সারি। গাছের ফাঁকে ফাঁকে বসার জায়গা। প্যারিসে এটা পিকনিকের একটা পপুলার স্পট।
ড্রাইভ করছিল ফাতমা।
তার চোখে পড়ল একটা গাড়ি গাছের গোড়ার সাথে আটকে আছে।
ফাতমা প্রথমে মনে করেছিল, কোন গাড়ি পার্ক করা আছে। কিন্তু পরে দেখল, গাড়িটা গাছের সাথে এ্যাকসিডেন্ট করেছে। গাড়ির সামনের কিছুটা অংশ দুমড়ে গেছে।
‘আব্বা, মনে হয় একটা গাড়ি এ্যাকসিডেন্ট করেছে। আটকে আছে একটা গাছের গোড়ায়।’ বলল ফাতমা।
ফাতমার আব্বা কিছু বলার আগেই ফাতমা গাড়ি দাঁড় করিয়ে ফেলেছে।
‘ঠিক আছে। চল দেখি। পুলিশ নিশ্চয় জানতে পারেনি।’ বলল ফাতমার আব্বা আবু আমের আবদুল্লাহ।
দু’জনেই নামল গাড়ি থেকে।
ফাতমাই আগে আগে চলল।
ড্রাইভিং সাইডের জানালা দিয়েই ভেতরে তাকাল ফাতমা। কিছু বুঝতে পারলো না। কুয়াশা সিক্ত জানালার কাঁচ দিয়ে সিটের উপর একজন লোক পড়ে থাকার আবছা দৃশ্য দেখতে পেল সে।

দরজা নিশ্চয় ভেতর থেকে লক করা। তবু ফাতমা দরজা টানল। সংগে সংগে খুলে গেল দরজা। দরজা পথে মুখ বাড়িয়ে দেখল, রক্তাক্ত একজন সিটের উপর পড়ে আছে।
‘আব্বা, মারাত্মক আহত একজন সিটের উপর পড়ে আছে।’ বলল ফাতমা।
‘বেঁচে আছে তো?’
সিটে পড়ে থাকা লোকটির মাথা ছিল ভেতরের দিকে। একটা হাত ঝুলে ছিল সিটের নিচে।
ফাতমা হাত তুলে নিয়ে পরীক্ষা করল। বলল,‘আব্বা, লোকটি বেঁচে আছে। লোকটি এশিয়ান আব্বা।’
‘এশিয়ান? আহা! চল দেখি বের করে আনি।’
দু’জনে ধরাধরি ধরে বের করে আনল গাড়ি থেকে লোকটিকে।
বের করে শুইয়ে দিয়ে মুখের দিকে তাকিয়েই চিৎকার করে উঠল ফাতমা,‘আব্বা, আহমদ মুসা।’
‘তাইতো মা, আহমদ মুসাই তো।’ আর্তনাদ করে উঠল আবু আমেরের কণ্ঠও।
‘আব্বা, সময় নষ্ট করা যাবে না, কোথায় নেব এঁকে?’
‘চল কাছেই একটা ভাল ক্লিনিক আছে।’
‘না, আব্বা, এঁকে অপরিচিত কোন ক্লিনিকে নিয়ে যাওয়া যাবে না।’
‘ঠিক বলেছ, আমাদের ক্রিসেন্ট ক্লিনিকেই চল নিয়ে যাই।’
আহমদ মুসাকে আবার তারা নিজেদের গাড়িতে তুলল।
ফাতমা বলল,‘আব্বা লক্ষ্য করেছেন, এঁর চোখ, মুখ, মাথার আঘাত কোনটাই তাজা নয়। সব রক্তই শুকনো।’
‘হ্যাঁ তাই তো দেখছি। এর অর্থ কি? গাড়ি এ্যাকসিডেন্টে সে আহত হয়নি?’
ফাতমা ড্রাইভিং সিটে উঠে বসতে বসতে বলল,‘আমার মনে হয় উনি আহত হয়েছেন অন্য কোন ঘটনায় এবং তা নিশ্চয় আট দশ ঘন্টা আগে। গাড়িতে তাঁর পাশে স্টেনগান পড়েছিল। আমার বিশ্বাস কোন সংঘর্ষের পর আহত অবস্থায় সরে আসার পথে তিনি এ্যাকসিডেন্ট করেছেন।’
গাড়ি তখন ঝড়ের গতিতে চলতে শুরু করেছে।
সকালের রাস্তা প্রায় গাড়ি শূন্য বলা যায়। ২০ মিনিটের মধ্যেই গাড়ি প্যারিস ক্রিসেন্ট ক্লিনিকে এসে পৌঁছল।
জরুরী অবস্থা ঘোষিত হলো প্যারিস ক্রিসেন্ট ক্লিনিকে। মাত্র ১০ মিনিটের মধ্যেই সিনিয়র-জুনিয়র সব ডাক্তার এসে হাজির হলো।
প্রাথমিক পরীক্ষা করে ক্লিনিকের প্রধান সার্জন ডাঃ ওমর ফ্লেমিং অপেক্ষমান উদ্বিগ্ন সকলকে জানাল, ‘ভয়ের বোধহয় কিছু নেই। বাইরে বড় ধরনের কোন আঘাত নেই। দীর্ঘক্ষণ ধরে প্রচুর রক্ত ক্ষরণের ফলেই ইনি সংজ্ঞা হারিয়েছেন। তবে আভ্যন্তরীণ পরীক্ষার পরেই বলা যাবে প্রকৃত অবস্থা কি।’
‘সে সব পরীক্ষায় কতক্ষণ লাগবে?’ বলল আবু আমের আবদুল্লাহ।
‘রক্ত লাগবে। সেলাই দিতে হবে। জ্ঞান ফিরিয়ে আনাই এখন প্রধান কাজ।’
সংগে সংগে চারদিক থেকে শতজন বলে উঠল,‘রক্তের গ্রুপ বলুন, যত রক্ত লাগে দেব।’
‘ধন্যবাদ। আমিও আপনাদের সাথে আছি।’
বলে ডাঃ ফ্লেমিং ইমারজেন্সী অপারেশন হলের ভেতরে ঢুকে গেল।
ঘন্টা দু’য়েক পরে ডাঃ যুবায়ের, ফাতমার ভাই বের হয়ে ডাঃ ফ্লেমিং-এর পক্ষ থেকে উদ্বিগ্ন ও অপেক্ষমানদের উদ্দেশ্য করে বলল,‘আমাদের মহান ভাই আহমদ মুসাকে ইনটেনসিভ কেয়ারে নেয়া হয়েছে। কোন মেজর অপারেশনের দরকার হয়নি। তবে জ্ঞান এখনও ফেরেনি।’
‘তাঁর আঘাতের ব্যাপারে আপনারা কি ধারণা করেছেন ভাইয়া।’ বলল ফাতমা।
‘তাঁর মাথা ও মুখের আঘাতের মধ্যে কিছু কিছু ভাঙা কাঁচ পাওয়া গেছে। তাঁর মাথা ও পাঁজরে প্রবল চাপ জনিত আঘাত। আমরা মনে করছি, ষোল সতের ঘন্টা আগে আরও একটা কার এক্সিডেন্টে সে মারাত্মকভাবে আহত হয়। দ্বিতীয় এক্সিডেন্টে তাঁর নতুন কোন ক্ষতি হয়নি।’
‘তাহলে জ্ঞান হারালেন কি করে?’
‘এটা তাঁর দ্বিতীয় বার সংজ্ঞা হারানো।’
‘কেমন করে জানলেন?’
‘প্রথম এক্সিডেন্টের পর সংজ্ঞা না হারালে অন্তত মুখে রক্তের দাগ এভাবে থাকতো না। আঘাত কিংবা যে কোন কারণেই হোক রক্তের দাগ শুকানোর পর সে সংজ্ঞা ফিরে পায়।’
কথা শেষ করেই ডাঃ যুবায়ের ফাতমাকে কাছে ডাকল। কানে কানে বলল, ‘প্রিন্সেস মারিয়া জোসেফাইনকে ব্যাপারটা তো এখন জানানো হয়নি!’
‘ঠিক বলেছ ভাইয়া, কথাটা আমার মনেই আসেনি। এখনই জানাচ্ছি।’
বলেই ফাতমা ছুটল টেলিফোনের দিকে। কিন্তু ওপার থেকে টেলিফোন উঠাল না। বার বার নো রিপ্লাই হলো।
‘ওটা তোমার কোন বাড়ির নাম্বার? ওঁদের কয়েকটা বাড়ি আছে।’ বলল ডাঃ যুবায়ের।
‘আমি তা জানি না ভাইয়া। এ নাম্বারে কয়েকবার তার সাথে কথা বলেছি।’
‘ঠিক আছে। আল্লাহ ভরসা।’
বলে ডাঃ যুবায়ের ভেতরে চলে গেল।
বেলা তখন ১২টা।
আহমদ মুসার সংজ্ঞা ফিরেছে বেলা দশটার পর পরই।
আহমদ মুসাকে এনে রাখা হয়েছে তার জন্যে বিশেষভাবে সাজানো ক্লিনিকের বিশেষ একটি কক্ষে। কারও দ্বারা কখনও ব্যবহৃত হয়নি এমন বিছানা-পত্র, আসবাবপত্র তার জন্য ব্যবস্থা করা হয়েছে। ঘরটির আশেপাশের ঘরে ডাঃ ফ্লেমিং ডাঃ যুবায়েরসহ ডজন খানেক ডাক্তার ও নিরাপত্তা কর্মীর থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
তখন আহমদ মুসার কাছে বসে আবু আমের আব্দুল্লাহ, ডাঃ ফ্লেমিং, ডাঃ যুবায়ের, প্যারিসের মুসলিম কমুনিটির অন্যতম নেতা ও প্যারিসস্থ সাইমুম ইউনিটের উপদেষ্টা আবু বকর শিরাক এবং আরও কয়েকজন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ। পর্দার আড়ালে রয়েছে ফাতমা সহ প্যারিসের মহিলা নেত্রীরা।
ঘটনা ঘটার পর উদ্বিগ্ন সকলে চেপে ধরেছিল আহমদ মুসাকে।
যতটা বলা যায়, ততটা বলে থামল আহমদ মুসা।
কারো মুখে কোন কথা নেই। পিনপতন নীরবতা।
‘আমার একটা প্রবল কৌতুহল জনাব, আমরা এখানকার মুসলিম কমুনিটি ঘটনাক্রমে আপনাকে এখানে পেয়েছি। কিন্তু আপনার মিশনে এসে আপনি বাস করছেন অন্য কোথাও। আপনি যার মেহমান, সেই সৌভাগ্যবান ব্যক্তিটিকে আমার খুব জানতে ইচ্ছা করছে।’ বলল ‘ইয়ুথ সোসাইটি অব ইউরোপিয়ান রেনেসাঁ’- এর নতুন সেক্রেটারি জেনারেল হুয়ারী হাবিব বেনগাজি।
ডাঃ যুবায়ের কিছু বলতে যাচ্ছিল। আহমদ মুসা তাকে থামিয়ে হেসে বলল, ‘তাঁদের একজন এখানে আসবেন। না শুনে চোখেই দেখবেন।’
‘আলহামদুলিল্লাহ, শত্রুরা তোমাকে জীবন্ত ধরতে চেয়েছিল। কিন্তু তা তারা পারেনি। এটা আল্লাহর একটা সাহায্য।’ বলল আবু আমের আবদুল্লাহ, ডাঃ যুবায়েরের আব্বা।
‘সংজ্ঞাহীন অবস্থায় আপনি যে শত্রুর হাতে পড়েননি, এটাও আল্লাহর বড় একটা সাহায্য।’ বলল ডাঃ ফ্লেমিং।
‘অবশ্যই।’ বলল আহমদ মুসা।
এইভাবে প্রশ্নোত্তরর চলার এক পর্যায়ে হুয়ারী হাবিব বলে উঠল, ‘মাফ করবেন সকলে, একটু উঠতে হচ্ছে। এখনি ফিরে আসব’
‘আসুন।’ বলল আহমদ মুসা।
হুয়ারী হাবিব বের হয়ে গেল।
প্রায় সংগে সংগেই আহমদ মুসা ডাঃ যুবায়েরকে কাছে ডেকে কানে কানে বলল, ‘তুমি তোমার লোককে হুয়ারী হাবিবকে ফলো করতে বল। কোথায় কি করে কি বলে তার রিপোর্ট চাই।’
ডাঃ যুবায়েরের মুখে প্রবল বিস্ময়ের প্রকাশ ঘটল। কিন্তু কিছু বলল না।
সে উঠে দাঁড়াল এবং দ্রুত বের হয়ে গেল।
মিনিট পনের পরে ফিরে এসে আহমদ মুসার কানে কানে বলল, ‘হুয়ারী ঔষধ কিনতে গিয়েছিল। ফিরে আসে এখন টয়লেটে ঢুকেছে।’
আহমদ মুসার ভ্রু মুহূর্তের কুঞ্চিত হয়ে আবার মিলিইয়ে গেল। বলল, ‘যে লোককে পাঠিয়েছিলে তাকে ডাকো।’
লোকটি এসে আহমদ মুসার শয্যার কাছে হাঁটু গেড়ে বসল।
আহমদ মুসা ফিসফিসে কণ্ঠে বলল, ‘উনি সোজা দোকানে গিয়ে ঔষধ কিনে আনেন?’
‘না, উনি ঔষধ বের করতে বলে ভেতরে গিয়েছিলেন।’
‘কেন?’
‘টেলিফোন করার জন্যে।’
‘আপনি দেখেছেন টেলিফোন করতে?’
‘না দেখিনি। উনি দোকানীকে বলেছিলেন যে তিনি একটা টেলিফোন করবেন।’
‘ঠিক আছে। যান আপনি।’
লোকটি চলে গেলে আহমদ মুসা ডাঃ যুবায়েরকে ডেকে বলল, ‘একটা গাড়ির ব্যবস্থা কর। আমি এখনি যাব।’
ডাঃ যুবায়েরের মুখ কালো হয়ে গেল উদ্বেগ ও বিষণ্ণতায়। কিন্তু আহমদ মুসার মুখের দিকে চেয়ে কোন প্রশ্ন করার সাহস পেল না।
আহমদ মুসা যুবায়েরকে কথা বলা শেষ করেই উপস্থিত সকলের দিকে তাকিয়ে বলল, আমি দুঃখিত, জরুরী প্রয়োজনে আমাকে এখনই চলে যেতে হবে। আপনারা আমার জন্য দোয়া করুন। আপনাদের ভালবাসার জন্যে ধন্যবাদ।’
সকলেই এক বাক্যে বলল, ‘এই শরীর নিয়ে! না এটা হতে পারে না।’
ডাঃ ফ্লেমিং বলল, ‘আমি ডাক্তার, ডাক্তার হিসেবে এমন রুগী আমি ছাড়তে পারি না।’
আহমদ মুসা হাসল। বলল, ‘জনাব আপনি ঠিক বলেছেন। আমি ডাক্তার হলে এ কথাই বলতাম। কিন্তু এখনকার কাজ বিশ্রামের চেয়ে বড়।’
বলে আহমদ মুসা ধীরে ধীরে উথে বসল।
ডাঃ যুবায়ের বাইরে চলে গিয়েছিল। ফিরে এসে বলল, ‘গাড়ি রেডি।’
লিফটে ফাতমা বলল, ‘জনাব, ডোনা আপা আসার জন্যে তৈরি হচ্ছেন। দু’এক মিনিটের মধ্যেই যাত্রা করবেন।’
‘তুমি তাকে আসতে নিষেধ করে দাও।’
‘কোথায় যাচ্ছেন আপনি? তার ওখানে?’
‘না। কোথায় যাচ্ছি, সেটা আপাতত থাক।’
‘বাবা, আমাদের কোন অপরাধ হয়েছে? এভাবে আকস্মিক চলে যাবার সিদ্ধান্ত নিলেন?’ বলল বৃদ্ধ আমের আবদুল্লাহ।
আহমদ মুসা হাসল। বলল, ‘কিছুক্ষণের মধ্যেই আপনারা সব বুঝতে পারবেন। পরে আমি সব বলব এখন নয়।’
লিফট থেকে বের হয়ে আহমদ মুসা এগুলো গাড়ির দিকে। সাথে আবু আমের আবদুল্লাহ, ডাঃ ফ্লেমিং, ডাঃ যুবায়ের, হুয়ারী হাবিবসহ সকলেই।
সবাই তখনও প্রতিবাদ করছে আহমদ মুসার সিধান্তের। বিশেষ করে হুয়ারী হাবিব ব্যস্ত হয়ে উঠেছে আহমদ মুসাকে বাধা দেয়ার জন্যে।
আহমদ মুসা গাড়ির কাছাকাছি হলে ডাঃ যুবায়ের চাবি হাতে গাড়ির সামনে দাঁড়ানো একটি যুবককে দেখিয়ে বলল, ‘এ আমার ড্রাইভার, ড্রাইভ করবে।’
‘প্রয়োজন নেই। আমি ড্রাইভ করতে পারব।’
‘কেন? … অসম্ভব!’ বলল ডাঃ যুবায়ের।
‘ঠিক বলেছে যুবায়ের, বাবা।’ বলল আমের আবদুল্লাহ।
‘আমার উপর আপনাদের কোন আস্থা নেই?’
ডাঃ যুবায়ের এগিয়ে এসে আহমদ মুসার হাত চেপে ধরে আবেগ রুদ্ধ কণ্ঠে বলল, ‘আস্থা-অনাস্থার প্রশ্ন এখানে নয়। আমরা বলছিলাম, এইভাবে এই অবস্থায় নিরুদ্ধেশ যাওয়াটা আমরা সহ্য করতে পারছি না।’
‘ধন্যবাদ তমাদের ভালবাসার জন্যে। সকলকে ধন্যবাদ, আসসালামু আলাইকুম।’
গাড়ির ড্রাইভিং সিটে উথে বসল আহমদ মুসা।
বসাটা একটু জোরে হয়েছিল। মাথা ও গোটা শরীর চিন চিন করে উঠল।
মাথাটা সিটে আস্তে করে ন্যস্ত করে গাড়িতে স্টার্ট দিল আহমদ মুসা।
গাড়ি বারান্দা থেকে রাস্তায় নেমে এল আহমদ মুসার গাড়ি।
রাস্তায় নেমেই তিব্র গতিতে চলতে শুরু করল গাড়ি।
যতক্ষন গাড়ি দেখা গেল, তারা সবাই দাঁড়িয়ে থাকল। গাড়ি দৃষ্টির আড়ালে চলে যাবার পর সকলে ঘুরে দাঁড়াল।
আকস্মিক যা ঘটে গেল সবাই বিক্ষিপ্ত ভাবে আলোচনা করছিল। কেউ চলে যাবার, কেউ ক্লিনিকের ভেতরে যাবার উদ্যোগ নিয়েছে, এই সময় ঝড়ের গতিতে পর পর তিনটি মাইক্রোবাস এসে দাঁড়াল ক্লিনিকের গাড়ি বারান্দায়।
গাড়ি থেকে প্রায় দু’ডজন মানুষ নামল। তাঁদের কারও হাতে রিভলবার, কারও হাতে স্টেনগান।
তারা নেমেই কয়েকজন ক্লিনিকের চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ল। কয়েকজন গাড়ি বারান্দায় স্টেনগান বাগিয়ে দাঁড়িয়ে থাকল। অবশিষ্টরা ক্লিনিকে ঢোকার জন্যে ক্লিনিকের বারান্দায় উঠল।
যে লোক সবাইকে নির্দেশ দিচ্ছিল, ডাঃ ফ্লেমিং তার মুখোমুখি হয়ে বলল, ‘আমি ডাঃ ফ্লেমিং। ক্লিনিকের ডক্টর ইনচার্জ। আপনারা এসব কি করছেন, বুঝতে পারছি না।’
লোকটি ক্রুর হেসে বলল, ‘আপনাকেই তো বেশি দরকার। ভালই হলো।’
একটু থামল লোকটি। তারপর চোখে আগুন বর্ষণ করে বলল, ‘চলুন, আহমদ মুসা কোথায় আমাদের দেখিয়ে দিন।’
প্রথমটায় তার কথায় বিস্মিত ও কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েছিল ডাঃ ফ্লেমিং। তা মুহূর্তের জন্যে। মুহূর্তেই তার কাছে সব পরিস্কার হয়ে গেল। পরিস্কার হয়ে গেল কেন আহমদ মুসা এইভাবে চলে গেল। হৃদয়টা তার দারুণভাবে কেঁপে উঠল। যদি সে থাকতো, তাহলে কি হতো! তার মন ভরে গেল শ্রদ্ধায় আহমদ মুসার প্রতি।
‘আহমদ মুসা? যে আহত লোকটি আজ সকালে ভর্তি হয়েছিল, সেই এশিয়ান লোক?’
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ। কোথায় সে, চলুন।’
‘কিন্তু সে তো এই ক’মিনিট হলো চলে গেছে?’
‘চলে গেছে? মিথ্যা কথা।’
‘মিথ্যা নয়, দেখুন এখানে অনেক লোক দাঁড়িয়ে আছে। জিজ্ঞাসা করুন’
‘না বিশ্বাস করি না। চলুন সার্চ করব।’
‘ঠিক আছে, চলুন।’
ডাঃ ফ্লেমিংকে নিয়ে একদল অস্ত্রধারী ঢুকে গেল ক্লিনিকের ভেতরে।
গাড়ি বারান্দায় লনের উপর তখনও স্তম্ভিতের মত দাঁড়িয়ে আবু আমের আবদুল্লাহ, ডাঃ যুবায়ের ও ফাতমা।
‘আল্লাহ আহমদ মুসাকে রক্ষা করেছেন। কিন্তু অবাক হচ্ছি, বুঝল কি করে সে যে এমন কিছু ঘটতে যাচ্ছে?’ ফিসফিসে কণ্ঠে বলল আবু আমের আবদুল্লাহ।
‘ভাইয়া নিশ্চয় কিছু জানেন?’ বলল ফাতমা।
কথা তাঁদের শেষ হলো না চিৎকার করতে করতে সদলবলে নেমে এল অস্ত্রধারীরা।
ডাক্তার ও অন্যান্য যারা ছিল সবাইকে ডেকে বলল, ‘ডাক্তার ফ্লেমিং কথা গোপন করছে। মুমূর্ষু প্রায় একজন লোক একা গাড়ি ড্রাইভ করে চলে যেতে পারে? আমরা এটা বিশ্বাস করি না।’
বৃদ্ধ আবু আমের বক্তা লোকটির দিকে এগিয়ে গেল। বলল, ‘ডাঃ ফ্লেমিং ঠিকই বলেছেন। আমিই সকালে লোকটিকে সংজ্ঞাহীন মুমূর্ষু দেখে আমার গাড়িতে এখানে নিয়ে এসেছিলাম। আবার আমার চোখের সামনেই সে নিজে ড্রাইভ করে চলে গেল। আমার কাছেও এটা মিরাকল, কিন্তু ঘটেছে এটা।’
একটু থেমে দূরে দাঁড়ানো একজনকে কাছে ডেকে তাকে দেখিয়ে বলল, ‘এই হল গাড়ির ড্রাইভার। ড্রাইভারকে সে নেয়নি।’
‘গাড়িটার নাম্বার কত?’ চিৎকার করে উঠল অস্ত্রধারী লোকটি।
ড্রাইভার লোকটি গাড়িটার নাম্বার তাকে জানাল।
সংগে সংগেই অস্ত্রধারী লোকটি পাশের একজনের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘গোটা প্যারিসে আমাদের সবাইকে নাম্বারটি জানিয়ে দাও। পুলিশকেও জানিয়ে তাঁদের সাহায্য চাও। যাবে কোথায় সে?’
অস্ত্রধারীরা চলে গেল।
ক্রিসেন্ট ক্লিনিকের সামনে লনে তখনও কয়েকজন দাঁড়িয়ে। আহমদ মুসাকে কেন্দ্র করে যারা এসেছিল, তারাও প্রায় সকলেই চলে গেছে। হুয়ারী হাবিবও।
লনে দাঁড়ানো সবার মুখে তখনও একটা দুঃস্বপ্নের ছাপ। সবাই মৌন।
মৌনতা ভেংগে কথা বলল প্রথমে আবু আমের। বলল সে, ‘চল উপরে একটু বসি।’ কথায় তার ক্লান্তির ছাপ।
সবাই উপরে উথে এল। বসল গিয়ে ডাঃ ফ্লেমিং-এর কক্ষে।
‘এরা কারা এসেছিল বুঝলে কিছু ডাক্তার?’ বসেই মুখ খুলল প্রথমে আবু আমের। বললেন ডাক্তার ফ্লেমিংকে লক্ষ্য করে।
‘বুঝতে পারিনি। তবে আহমদ মুসার কাছে যাদের কথা শুনলাম, সেই গ্রেট বিয়ারের ভাড়া করা লোক হতে পারে এরা।’ বলল ডাঃ ফ্লেমিং।
‘কিন্তু এরা তো রুশ নয়, ফরাসি।’ বলল ডাঃ যুবায়ের।
‘গ্রেট বিয়ারের ভাড়া করা লোকও তো হতে পারে।’ বলল ফাতেমা।
‘তা হতে পারে এবং আমার মনে হয় এটাই ঘটনা।’ বলল ডাঃ যুবায়ের।
‘কিন্তু আমি বুঝতে পারছি না, এত তাড়াতাড়ি জানল কি করে এবং এদের জেনে ফেলার ব্যাপারটা আহমদ মুসা জানল কি করে। এখন তো আমাদের কাছে পরিস্কার কেন তিনি তাড়াহুড়া করা চলে গেলেন।’ বলল ডাঃ ফ্লেমিং।
‘আল্লাহর হাজার শোকর যে তিনি চলে গেছেন। তিনি আমাদের অনুরোধ শুনলে যে কি হতো!’ বলল আবু আমের আবদুল্লাহ।
‘কিন্তু এমন কিছু ঘটবে তিনি তা আমাদের জানালেন না কেন?’ বলল ডাঃ ফ্লেমিং।
কথা শেষ করেই আবার সে শুরু করল, ‘ডাঃ যুবায়ের তুমি কিছু জান মনে হয়। তোমাকে কিছু তো বলেছেন তিনি।’
‘আমাকে এই বিষয়টা কিছুই জানাননি।’ বলে থামল ডাঃ যুবায়ের। তারপর চারদিক চেয়ে উঠে গিয়ে দরজা বন্ধ করে এসে বলল, ‘তিনি আমাকে বলেছিলেন হুয়ারী হাবিবকে ফলো করার জন্যে লোক পাঠাতে। উনি কোথায় কি করেন তা দেখার জন্যে। তিনি যখন জানতে পারলেন যে, হুয়ারী ঔষধ কিনতে গিয়ে টেলিফোন করেছেন। তখনই তিনি চলে যাবার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বলে আমার মনে হচ্ছে।’
‘তার মানে আমাদের হুয়ারী হাবিব টেলিফোনে আহমদ মুসার খবর শত্রুকে জানিয়েছেন!’ আর্তকণ্ঠে বলল ডাঃ ফ্লেমিং।
‘ঘটনা তো এটাই দাঁড়াচ্ছে।’ বলল আবু আমের আবদুল্লাহ।
‘কিন্তু বুঝতে পারছি না, হুয়ারী হাবিব সাহেবকে সন্দেহ করার হেতু কি?’ বলল ফাতমা।
‘শুনেছি, কোন অস্বাভাবিক জিনিসই আহমদ মুসার নজর এড়ায় না। নিশ্চয় আহমদ মুসা ভাই হুয়ারী হাবিবের কথা ও আচরনে অস্বাভাবিক কিছু টের পেয়েছিলেন।’
‘আল্লাহর হাজার শোকর যে, তিনি আহমদ মুসাকে এই দৃষ্টি দিয়েছেন। আমরা তো কিছুই বুঝিনি।’ বলল আবু আমের।
‘আর একটি ব্যাপার। আহমদ মুসা ড্রাইভার সাথে নিল না কেন?’ বলল ডাক্তার ফ্লেমিং।
‘আমাদের কাছেও এটা বিস্ময়ের!’ বলল উপস্থিত সবাই।
একটুক্ষণ নীরব সবাই।
নীরবতা ভাঙল ডাঃ ফ্লেমিং। বলল, ‘হুয়ারী হাবিব সম্পর্কে আমরা কি ভাববো?’
‘বিশ্বাসঘাতক ছাড়া আর কি!’ বলল ফাতমা।
ডাঃ ফ্লেমিং-এর টেলিফোন বিপ বিপ শব্দ করে উঠল।
ডাঃ ফ্লেমিং টেলিফোন ধরেই ডাঃ যুবায়েরের হাতে তুলে দিল। বলল, ‘তোমার টেলিফোন।’
টেলিফোন ধরেই বলল, ‘জি, আমি ডাঃ যুবায়ের। ঠিক আছে দিন তাকে।’
ওপারের কথা শুনেই আনন্দে চোখ-মুখ নেচে উঠল ডাঃ যুবায়েরের। স্পিকারে হাত চাপা দিয়ে সকলের দিকে চেয়ে বলল, ‘আহমদ মুসা ভাই।’
সবার মুখ আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠল নড়ে-চড়ে বসল সবাই।
ডাঃ যুবায়ের কথা বলল আহমদ মুসার সাথে। অস্ত্রধারীদের আসার কথা, হুয়ারী হাবিব ও ড্রাইভারের কথা – সবই বলল সে।
টেলিফোনে কথা শেষ করে টেলিফোন রাখতেই সবাই ব্যস্ত হয়ে উঠে ‘কেমন আছেন উনি, কি বললেন তিনি’, ইত্যাদি অনেক প্রশ্ন করে বসল।
ডাঃ যুবায়ের বলল, ‘উনি ভাল আছেন। গাড়ি আজ বেলা তিনটায় শিন নদীর ১১ নাম্বার ব্রীজের দক্ষিণ প্রান্তে থাকবে, তবে তা পুলিশের হাতে পড়াই ভাল……।’
যুবায়েরকে বাধা দিয়ে তার আব্বা আবু আমের বলল, ‘থাক তোমার গাড়ির কথা, হুয়ারী হাবিবের কথা কি বলল, সেটা বল।’
‘বলছি। হুয়ারী হাবিবের চেহারা, তার কথা ও আচরণ দেখে আহমদ মুসার সন্দেহ হয়। তাকে ফলো করে সন্দেহটা প্রমাণিত হয়। আহমদ মুসার মতে যে কোন কারনেই হোক হুয়ারী হাবিব ফরাসি পুলিশের পুতুল হিসেবে কাজ করছে। তিনিই পুলিশকে খবর দেন, পুলিশের একটা মহল জানায় তা গ্রেট বিয়ারকে। তবে আহমদ মুসা বলেছেন, এ বিষয়টা নিয়ে ফ্রান্সের মুসলিম কমুনিটিতে আলোচনা না হওয়া উচিত। কমুনিটির ঐক্য কোন ভাবেই নষ্ট হতে দেয়া যাবে না। নীরবে চেষ্টা করতে হবে তাকে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেয়ার জন্যে।’
একটু থেমে ডাঃ যুবায়ের আবার শুরু করল, ‘ড্রাইভারকে তিনি নেননি, কারণ ড্রাইভার তাতে বিপদে পড়ত। তাকে আহমদ মুসার ঠিকানা পুলিশ অথবা গ্রেট বিয়ারকে জানাতে বাধ্য হতে হতো। সকলকে তিনি সালাম জানিয়েছেন।’
ডাঃ যুবায়ের থামল।
‘আল্লাহ তাকে আরও দীর্ঘজীবী করুন। প্যারিসের মুসলিম কম্যুনিটির ভবিষ্যৎ ভেবে যে পরামর্শ দিয়েছেন, সেটাই ঠিক। বিশ্বাসঘাতক আমার মনে হয় শুধু হুয়ারী হাবিবি নন। আরও যারা আছেন, তাদের নীরবে চিহ্নিত করতে হবে। আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করি, আহমদ মুসা আমাদের দৃষ্টি খুলে দিয়েছেন। আমরা সাবধান হতে পারব।’
বলে আবু আমের আবদুল্লাহ উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, ‘আমরা চলি। ডাঃ ফ্লেমিং তোমাদের সময় আর নষ্ট করব না।’
ফাতমাও উঠে দাঁড়াল।
সালাম দিয়ে তারা পা বাড়াল দরজার দিকে।

Top