২৩. রাজচক্র

চ্যাপ্টার

দরজায় নক করার শব্দে ঘুম ভেঙ্গে গেল আহমদ মুসার।
বিছানায় যেমন শুয়েছিল, তেমনি শুয়ে থেকেই উৎকর্ণ হলো আহমদ মুসা।
নক হলো আবার।
এবার ভালো করে শুনেই বুঝতে পারল ডোনা নক করছে দরজায়। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল, রাত সাড়ে তিনটা।
এত রাতে ডোনা? নিশ্চয় অঘটন কিছু ঘটেছে। দ্রুত উঠল আহমদ মুসা।
দরজা খুলল। দ্রুত বলল, ‘কিছু ঘটেছে, তুমি ভালো আছো?’
‘না ঘটেনি। কিন্তু মনে হয় ঘটতে যাচ্ছে। খবর আছে’।
বলে ডোনা ঘরে প্রবেশ করার জন্যে পা বাড়াল।
আহমদ মুসা হাত দিয়ে বাধা দিল ডোনা কে। বলল, ‘চল করিডোরের চেয়ারে গিয়ে দু’জন বসি’।
‘ডোনা বাধা পেয়ে বিব্রত কণ্ঠে বলল, ‘কেন?’
‘কিছু মনে করোনা। রাত সাড়ে তিনটায় এসে তুমি আমার ঘরে প্রবেশ করবে এটা ঠিক নয়’।
এক রাশ লজ্জা এসে আচ্ছন্ন করল ডোনার মুখমণ্ডল। মুখ নিচু করল। বলল ‘ধন্যবাদ’।
বলে ডোনা পিছন ফিরে বেরিয়ে এল করিডোরে।
দু’জনে গিয়ে চেয়ারে বসল।
‘তোমাকে আবারও ধন্যবাদ। তোমাকে আল্লাহ্‌ এত সতর্ক করেছেন, এ জন্যে আল্লাহ্‌র শুকরিয়া আদায় করছি’। বলল ডোনা।
‘এসব থাক। তুমি বল কি ঘটেছে’।
‘জাহরা ইভানোভা এই মাত্র টেলিফোন করেছিল। গুরুতর সংবাদ’।
‘কি?’
‘আমার এই বাড়ির কে একজন মহিলার সাথে একজন পুলিশ অফিসারের যোগাযোগ হয়েছে। সেই পুলিশ অফিসার কাজ করছে গ্রেট বিয়ারের পক্ষে। তাঁদের পরিকল্পনা হয়েছে, আজ রাত সাড়ে চারটায় তোমাকে কিডন্যাপ করা হবে। এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করার জন্যে সেই পুলিশ অফিসার আজ আমাদের বাড়ির পাহারার তদারকিতে থাকবে। রাত সাড়ে চারটায় গ্রেট বিয়ারের লোকরা পুলিশের ছদ্মবেশে সেই পুলিশ অফিসারের সহায়তায় গেট দিয়ে আমাদের বাড়িতে প্রবেশ করবে। আর এদিকে সেই মহিলা তাঁর আগেই তাঁকে সরবরাহ করা ক্লোরোফরম পয়জন তোমার ঘরে স্প্রে করে তোমাকে সংজ্ঞাহীন করে রাখবে। তোমার ঘরের ডুপ্লিকেট চাবিও গ্রেট বিয়ারকে সরবরাহ করা হবে। কিডন্যাপ করে তোমাকে ওঁরা নিয়ে যাবে গোপন সুড়ঙ্গ পথে। এ সুড়ঙ্গ পথের খবরও গ্রেট বিয়ারকে দেয়া হয়েছে’।
‘আমি এখানে আছি সেই খবরও তাহলে সেই মহিলাই ওদেরকে দিয়েছে’।
‘সেটাই স্বাভাবিক মনে করছি’।
আহমদ মুসা কোন কথা বলল না। চেয়ারে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করেছিল। ভাবছিল।
কয়েক মুহূর্ত পড়েই সোজা হয়ে বসল। বলল, ‘ডোনা তুমি তোমার রুমে ফিরে যাও। কোন চিন্তা না করে ঘুমিয়ে পড়। আমি এ দিকের ব্যাপারটা দেখছি’।
‘কি করতে চাও তুমি? পুলিশ বেশের গ্রেট বিয়ারের লোকদের আটকাবে?’
‘না, আমি কিছু করব না। ওঁরা এসে আমার ঘর বন্ধ দেখতে পাবে। কোন সংকেত থেকে তারা বুঝবে ক্লোরোফরম পয়জন স্প্রে হয়ে গেছে। তারা আনন্দের সাথে ডুপ্লিকেট চাবি দিয়ে ঘর খুলবে। দেখবে যে আমি নেই। তারা ছুটে যাবে তোমার কক্ষে। সম্ভবত তোমার লকেরও ডুপ্লিকেট চাবি তাঁদের কাছে। ঘর খুলে দেখবে, তুমি ঘুমিয়ে আছো, আর কেউ নেই ঘরে। তারপর বিভিন্ন ঘর তালাশ করবে, সুড়ঙ্গ পথ দেখবে। তারা ধরে নিবে কোনভাবে বিষয়টা জানতে পেরে আমি পালিয়ে গেছি’।
‘পালানোর ধারনা তারা করবে কেন? তুমি আজ বাড়িতে নেই এ ধারনাও তো তারা করতে পারে’।
‘না আমি রাতে শোবার পর গ্রেট বিয়ারকে খবর দেয়া হয়েছে এবং তাঁর ভিত্তিতেই তারা পরিকল্পনা ফাইনাল করেছে, এটাই যুক্তির দাবী’।
‘না আমি শোব না, আমি দেখতে চাই মহিলাটিকে যে ক্লোরোফরম পয়জন স্প্রে করতে আসবে এই কক্ষে’।
‘দেখার প্রয়োজন নেই ডোনা। আমি বোধহয় বলতে পারি কে সে’।
‘কে সে?’ উদগ্রীব ভাবে প্রশ্ন করল ডোনা।
‘তিনি তোমার খালাম্মা’।
‘খালাম্মা?’ আর্তকণ্ঠে বলে উঠল ডোনা।
‘গোটা বাড়ির মধ্যে আমার দৃষ্টিটা ওঁর উপর গিয়েছে’।
কিছুক্ষন কথা বলতে পারল না ডোনা। তাঁকে বিস্ময়-বিমূঢ় দেখাচ্ছে।
একটু সময় নিয়ে বলল, ‘তোমার সন্দেহের কারন’।
‘কারন কিছুই ঘটেনি। কিন্তু তোমার কাছ থেকে খবরটা শোনার পর আমার মনে হয়েছে এ ধরনের ঘটনা একমাত্র তিনিই ঘটাতে পারেন’।
‘এই মনে হওয়ার একটা কারন তো নিশ্চয় রয়েছে’।
‘তোমার সাথে আমার ভবিষ্যৎ সম্পর্কের ব্যাপারটাকে তিনি নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখে থাকেন। যেহেতু এমন চিন্তা তাঁর মাথায় আছে, সেজন্যে নীরবে আমাকে সরিয়ে দেবার কোন পথ পেলে তিনি তা গ্রহণ করতে পারেন’।
ডোনা একবার মুখ তুলে আহমদ মুসার দিকে তাকিয়ে মুখ নিচু করল। সংগে সংগে কোন কথা সে বলল না।
কিছুক্ষন পর মুখ তুলল ডোনা। তাঁর মুখ ম্লান। বেদনায় পাণ্ডুর।
বলল, ‘তুমি যদি এটা উপলদ্ধি করে থাক, তাহলে সেটা ঠিকই হবে। এর পিছনে ওঁর একটা স্বার্থ আছে।
‘কি স্বার্থ?’
‘ওঁর একটা ছেলে আছে। তাঁর একটা ধারনা ছিল, লুই পরিবার থেকে তাঁর জন্যে একটা মেয়ে তিনি নেবেন’।
‘সে মেয়েটি তুমি?’
‘হ্যাঁ’।
‘আমিই তাহলে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছি?’
‘না। তুমি আমার জীবনে না এলেও তাঁর স্বপ্ন সফল হতো না। আমার তরফ থেকে কিংবা আব্বার তরফ থেকে কোন সময়ই তিনি পাত্তা পান নি’।
মুহূর্তের জন্যে থামল ডোনা। সোজা হয়ে বসে বলল, ‘তুমি আমাকে গিয়ে ঘুমাতে বলছ। আমি যাচ্ছি না। আমি তাঁকে হাতে-নাতে ধরব। তারপর কালকে আমি…..’। উত্তেজিত কণ্ঠ ডোনার।
আহমদ মুসা ডোনা কে থামিয়ে দিয়ে বলল, ‘ধৈর্য ধর ডোনা। তিনি যেটা করেছেন, সেটা অনেকটাই স্বাভাবিক। এ জন্যে তাঁকে কিছু বলার, এমনকি তুমি বিষয়টা জান তাও তাঁকে জানতে দেয়ার প্রয়োজন নেই। তুমি গিয়ে ঘুমিয়ে পড়। খুব বেশি হলে তোমার ঘরের আশে পাশে দাড়িয়ে তাঁর অভিযানটা তুমি দেখতে পার’।
‘তারপর?’
‘তারপর গ্রেট বিয়ারের লোকরা এসে ঘুরে যাবে। সকাল থেকে আমাকেও এ বাড়িতে দেখা যাবে না’।
চমকে উঠল ডোনা। বলল, ‘তুমি কোথায় যাবে, কোথায় থাকবে?’
প্যারিসে আমাদের সাইমুমের একটা মেস আছে, আমি সেখানে চলে যাচ্ছি। সেখান থেকে টেলিফোনে তোমার সাথে প্রয়োজনীয় কথা হবে’।
কথা বলল না ডোনা। তাঁর মুখ নিচু।
অল্পক্ষণ পরে মুখ তুলল। তাঁর চোখের কোনায় অশ্রু। বলল, ‘আমার অ্যান্টির ষড়যন্ত্রের কাছে তোমাকে পরাজিত হতে দিতে পারি না’।
‘পরাজয়ের প্রশ্ন নয়, এটা একটা কৌশল। আমি চাচ্ছিনা তোমাদের বাড়িতে আর কোন রক্তারক্তি হোক। আমি এখানে থাকলে আগামীকাল রাতেও ওঁরা আসবে, পরেরদিন রাতেও আসবে। এমনকি দিনের বেলাতেও আসতে পারে। দ্বিতীয়ত আমি চাচ্ছিনা তোমার অ্যান্টি তোমারও শত্রু হয়ে দাঁড়াক। তোমার আব্বা না ফেরা পর্যন্ত এমনটাই থাকুক’।
‘তুমি এ বাড়িতে কেন থাকছ, তা কিন্তু তুমি ভুলে যাচ্ছ’।
‘না ভুলিনি। আমার এবং সাইমুমের জনা চারেক কর্মীর চোখ ২৪ ঘণ্টা এ বাড়ির উপর থাকবে’।
একটু থেমেই আহমদ মুসা আবার বলল, ‘তাহলে এখন ঘুমাতে যাও। সময় কিন্তু খুব বেশি নেই’।
‘তুমি আমাকে কাছ থেকে তাড়াতে পারলেই বাঁচ’। বলে ডোনা গম্ভীর মুখে উঠে দাঁড়ালো।
এমন সময় কিছু একটা শব্দ শুনে আহমদ মুসা উৎকর্ণ হয়ে উঠল। ভালো করে শুনে বলল, ‘ডোনা তোমার তিনতলার সিঁড়ি দিয়ে কেউ নামছে’।
ডোনাও উৎকর্ণ হয়ে উঠল। বলল, ‘ঠিক তাই’।
ডোনার চোখে-মুখে চাঞ্চল্য দেখা দিল। কিছু বলতে যাচ্ছিল ডোনা। আহমদ মুসা বাধা দিয়ে বলল, ‘ডোনা চল তাড়াতাড়ি সিঁড়ির পাশের ঐ করিডোরে যাই। সেখান থেকে সবকিছু দেখা যাবে’।
বলে আহমদ মুসা চলতে শুরু করল।
ডোনা চলল তাঁর পিছনে।
ওঁরা ওদিক গিয়ে একটা দেয়ালের আড়ালে গিয়ে দাঁড়ালো।
সিঁড়ি দিয়ে নামছে এক মহিলা। পাশটা দেখা যাচ্ছে। মুখ ভালোভাবে দেখা যাচ্ছে না।
‘অ্যান্টি নামছে’। ফিস ফিস করে নামল ডোনা।
তাঁর হাতে কাগজের একটা ছোট্ট প্যাকেট।
আহমদ মুসা বলল, ‘ঐ প্যাকেটে আছে একটা স্প্রে পাম্প এবং কিছু ফাপা তাঁর। আর গুটানো কয়েকটা স্টিক। স্টিকটি খুলে ফেললে একটি দীর্ঘ স্টিকে পরিনত হয়। ঐ স্টিকের মাথায় ফাপা তাঁর বেঁধে ঘরের ভেতর ঢুকিয়ে দেয়া হয়। তারের এ দিকের প্রান্ত যুক্ত থাকে স্প্রে টিউবের সাথে। পাম্প সুইচ অন করার সাথে সাথে ফাপা তাঁর দিয়ে ক্লোরোফরম পয়জন ঘরের ভেতরে ঢুকে যায়। এই ক্লোরোফরম পয়জন সাধারন ক্লোরোফরম থেকে আলাদা। এ ক্লোরোফরম পয়জন কারো উপর প্রয়োগ করলে সে আপনা আপনি সংজ্ঞা ফিরে পায় না। ইনজেকশন দিয়ে তাঁর সংজ্ঞা ফিরিয়ে আনতে হয়। বারো ঘণ্টার মধ্যে সংজ্ঞা ফিরিয়ে না আনলে সংশ্লিষ্ট লোক মারা যেতে পারে। তবে উন্মুক্ত অবস্থায় এ পয়জন গ্যাস দশ মিনিটের মধ্যে কার্যকারিতা হারায়’।
চমকে উঠল ডোনা। মায়ের মত যাকে শ্রদ্ধা করে সেই খালাম্মা এত নিষ্ঠুর!
ডোনার খালাম্মা গিয়ে দাঁড়িয়েছে আহমদ মুসার বন্ধ দরজার সামনে।
‘ডোনা এবার যাও তোমার ঘরে। উনি কিংবা যারা আসছে তারা যদি আমার ঘর খুলে বসেন, তাহলে ওঁরা সকলেই ছুটবেন তোমার কক্ষের দিকে’।
‘ঠিক আছে যাচ্ছি। তুমি কতক্ষন থাকছ?’
‘ওঁরা সকলে চলে না যাওয়া পর্যন্ত’।
‘গুড নাইট। আসসালামু আলাইকুম’।
বলে ডোনা বিড়ালের মত নিঃশব্দে সিঁড়ি দিয়ে উঠে গেল তিন তলায়।
আহমদ মুসা ডোনার খালাম্মার দিকে নজর রেখেছিল। না সে পেছনে ফিরে তাকায় নি।
ডোনা চলে যাবার পর আহমদ মুসা গড়িয়ে গড়িয়ে গিয়ে আশ্রয় নিল সামনের ড্রয়িং স্পেসে এদিকের সোফা সেটের আড়ালে। ড্রয়িং কক্ষের একটি কোনাকে কভার করে রাখা সোফাটির পেছনে বেশ অনেক জায়গা। সেই স্পেসে গাছওয়ালা একটা টব থাকায় সুন্দর আড়ালেরও সৃষ্টি হয়েছে। ওখান থেকে উকি দিয়ে তিন তলায় উঠার সিঁড়ি দেখা যায়, আবার দোতলায় উঠার সিঁড়িও নজরে পরে।
আহমদ মুসা পকেট থেকে এম-১০ মেশিন রিভলবার বের করে দেখে নিল ঠিক আছে কিনা।
অবশ্য মনে মনে ভাবল, রিভলবারের আজ দরকার হবে না। সে আজ পুরোপুরিই দর্শক সাজবে। তখন দশ মিনিট পার হয়ে গেছে। আহমদ মুসা দেখল, ডোনার খালাম্মা তিনতলার সিঁড়ির দিকে এগুচ্ছে। ঠিক সেই সময় আহমদ মুসা দোতলায় উঠার সিঁড়িতে অনেকগুলো পায়ের শব্দ পেল। ওদের পায়ের শব্দ ডোনার খালাম্মাও শুনতে পেয়েছে।
সে মুহূর্তের জন্যে থমকে দাঁড়াল। তাকাল দোতালার সিঁড়ির দিকে। তারপর দ্রুত উপরে উঠে গেল।
আহমদ মুসাও দোতালার সিঁড়ির দিকে তাকাল। দেখতে পেল একজন পুলিশ উঠে আসছে। হাসি ফুটে উঠল আহমদ মুসার ঠোঁটে। গ্রেট বিয়ারের লোকদের ফরাসী পুলিশের পোশাকে বেশ মানিয়েছে।
ওঁরা দ্রুত উঠে এল।
কয়েকজন দাঁড়ালো দোতলা ও তিনতলার সিঁড়ির মুখে। অবশিষ্টরা পুলিশ সুপারের পোশাকপরা একজনের নেতৃত্বে এসে দাঁড়ালো আহমদ মুসার ঘরের দরজায়।
পুলিশ সুপারের পোশাকধারী লোকটি দরজার গোঁড়ায় বসে পরে চৌকাঠের গোঁড়ায় কি যেন পরীক্ষা করল। তারপর উঠে দাড়িয়ে ছোট করে বলল, ‘ঠিক আছে। কাজ হয়েছে’।
বলেই সে পকেট থেকে একটা চাবি বের করে দরজার তালা খুলে ফেলল।
প্রথমেই ঘরে প্রবেশ করল রিভালবার বাগিয়ে পুলিশ অফিসারের বেশধারী লোকটি।
কয়েক মুহূর্ত পর দরজায় অপেক্ষমান সবাই ছুটে ভেতরে ঢুকে গেল। ঘরের ভেতর ছুটাছুটি ও উত্তেজিত কণ্ঠস্বর শুনতে পেল আহমদ মুসা। বুঝল সে, বিছানায় তাঁকে না পেয়ে হন্যে হয়ে ঘরের সর্বত্র খুজছে।
অল্পক্ষণ পরেই ছুটে বেরিয়ে এল সেই পুলিশ সুপারবেশী লোকটি। চাপা উত্তেজিত স্বরে বলল, ‘শয়তানটা ঘরে নেই। শূন্য ঘরে ক্লোরোফরম স্প্রে করা হয়েছে’।
বলে একটু থেমেই সে নির্দেশ দিল, ‘বাড়ির সবগুলো ঘর সার্চ করো তোমরা’।
‘স্যার, শয়তানটা প্রিন্সেস ডোনা জোসেফাইনের ঘরে মউজ করছে না তো’। একজন বলে উঠল।
‘ঠিক বলেছ তুমি। তোমরা কয়জন এসো আমার সাথে’।
বলে পুলিশ সুপারবেশী লোকটি দ্রুত তিন তলার সিঁড়ি দিয়ে উঠতে লাগল। তাঁর পেছনে পেছনে কয়েকজন।
তিনতলার মাথায় এ সময় এসে দাঁড়ালো ডোনার খালাম্মা। বলল সে পুলিশ সুপারবেশী লোকটিকে লক্ষ্য করে, ‘এত লোক দরকার নেই। আপনি আরেকজন লোক নিয়ে আসুন। প্রিন্সেস ডোনার ঘরের ডুপ্লিকেট চাবি আমার কাছে আছে’।
বলে ডোনার ঘরের দিকে হাঁটতে শুরু করল ডোনার খালাম্মা।
পেছনে পেছনে চলল পুলিশ সুপারবেশী লোকটি এবং আর একজন। পুলিশ সুপারবেশীর হাতে উদ্ধত রিভলবার এবং তাঁর সাথীর হাতের স্টেনগানও উদ্ধত।
ডোনার ঘরের তালা খুলল ডোনার খালাম্মা। দরজা খুলে ধরল সে-ই।
খোলা দরজা দিয়ে ওঁরা দু’জন প্রবেশ করল।
ডোনাকে ঘুমন্ত দেখা গেল তাঁর বেডে। ডোনার খালাম্মাসহ পুলিশবেশী গ্রেট বিয়ারের দু’জনের মুখ হতাশায় ছেয়ে গেল।
নিশ্চিত হবার জন্যে ওঁরা টয়লেট অংশসহ লুকানো যায় এমন সব জায়গায় আতিপাতি করে খুঁজল আহমদ মুসাকে।
হতাশভাবে ওরা তিন তলার অন্যান্য ঘর সার্চ করে দুতলায় সেই আগের জায়গায় নেমে এল। ডোনার খালাম্ম দোতালায় নামল না, দাঁড়িয়ে থাকল তিনতলার সিঁড়ির মাথায়।
বাড়ির চাকর-বাকর ও এ্যাটেনডেন্টদের এক জায়গায় জড়ো করে রেখে উপর-নিচ সবগুলো ঘর সার্চ করে সবাই ফিরে এল দোতলার সেই স্থানে।
‘শোবার পরে শয়তানটা আবার উঠে কোথাও চলে গেছে। শয়তানের বাপ শয়তান সে। বাতাস থেকে সে বিপদের গন্ধ আঁচ করতে পারে’।
‘স্যার এখন কি করণীয়?’
প্রিন্সেস ডোনা জোসেফাইনকে আমরা নিয়ে যাব। তারপর কান টানলে মাথা আসার মত শয়তানটা গিয়ে হাজির হবে তাহলে। চল তোমরা তিনতলায়।
‘না একাজ তোমরা করো না। অবশ্যই সব কথা প্রকাশ হয়ে পড়বে। তোমাদের সাথে ফরাসি সরকারের সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং আমারও ক্ষতি হবে’।
‘কোন ক্ষতির ভয় আমরা করিনা ম্যাডাম। আহমদ মুসাকে আমরা চাই যে কোন মুল্যে। আর প্রিন্সেসকে আমরা যে কিডন্যাপ করেছি, একথা আপনি থানায় না জানালেই হলো। আহমদ মুসাকে পেলেই ওকে আমরা ফেরত দিয়ে যাব। প্রিন্সেসের কোন ক্ষতি হবে না। তিনি আমাদের শত্রু নন’।
‘না। পারিবারিক ভাবে এ ভয়ানক ঘটনার জন্যে দায়ী হবো আমি। সব কথা প্রকাশ হবেই। আমি এর সাথে একমত হতে পারিনা’।
পুলিশ সুপারবেশী লোকটি তিনতলার সিঁড়ির গোড়ায় দাঁড়ানো দু’জনের প্রতি ইংগিত করে বলল, ‘তোমরা ম্যাডামকে নিয়ে এসে শয়তানটার ঘরে ঢুকাও। আর ক্লোরোফরম করো। শান্তিতে ঘুমিয়ে থাকবে’।
তাঁর নির্দেশের সংগে সংগেই দু’জন গিয়ে ডোনার খালাম্মাকে ধরে নিয়ে এল এবং আহমদ মুসার ঘরে ঢুকিয়ে ক্লোরোফরম করে বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করে দিল।
পুলিশ সুপারবেশী লোকটি সবাইকে ডেকে নিয়ে সোফায় এসে বসল। তাঁকে ঘিরে দাঁড়াল সবাই। আহমদ মুসা যে সোফার আড়ালে লুকিয়েছিল, সে সোফায় ঠেস দিয়েও একজন দাঁড়াল।
‘শোন তোমরা, প্রিন্সেস ডোনা জোসেফাইন কি রকম বিপজ্জনক তোমাদের মনে আছে। গত বারের ঘটনায় সে আমাদের চারজনকে হত্যা করেছিল। তাঁকে কিডন্যাপ করা যায়নি। এবার সাবধান হতে হবে। একই সাথে তাঁকে আক্রমন করতে হবে। তবে গুলী করবে না কেউ। অন্য যে কোন ধরনের আঘাত তাঁকে করা যায়’।
বলে উঠে দাঁড়াল সুপার ছদ্মবেশী লোকটা। বলল, ‘এসো’।
সে আগে আগে চলল। তাঁর পেছনে একে একে চলল অন্যান্যরা।
আহমদ মুসার সোফায় ঠেস দিয়ে দাঁড়ানো লোকটি ছিল সর্বশেষ ব্যাক্তি।
তাঁর হাতে ঝুলছিল স্টেনগান।
সে পা বাড়িয়েছিল চলা শুরু করার জন্যে।
আহমদ মুসা নিঃশব্দে উঠে দাড়িয়ে ডান হাতের একটা তীব্র কারাত চালাল তাঁর ঠিক কানের নিচটায়।
তাঁর দেহটা একবার দুলে উঠে নীরবে পরে যাচ্ছিল।
আহমদ মুসা তাঁকে তাঁর স্টেনগান সমেত শুন্যে তুলে ধরে সোফার আড়ালে নিয়ে গেল। তাঁর স্টেনগানটা তুলে নিয়ে নিজের এম-১০ পকেটে রেখে দিল।
ওঁরা সবাই তখন তিনতলার সিঁড়িতে উঠেছে।
আহমদ মুসা গড়িয়ে গড়িয়ে সোফা ও দেয়ালের আড়ালকে আশ্রয় করে চলল সিঁড়ির দিকে।
আহমদ মুসা নিশ্চিত যে, ডোনা ঘুমায়নি এবং গোটা ব্যাপারতাই সে অবলোকন করছে। অবশ্যই সে এদের প্রতিরোধ করবে। কিন্তু এক রিভলবার দিয়ে এতগুলো স্টেনগানধারীর পরিকল্পিত আক্রমন মোকাবেলা করা তাঁর পক্ষে কঠিন।
ওরা সিঁড়ি পেরিয়ে তিনতলার ড্রয়িং রুম-এ উঠে ডোনার ঘরের দিকে চলল।
তিনতলার ড্রয়িং রুম থেকে এক প্রশস্ত করিডোর ধরে এগুতে হয় ডোনার বেড রুমের দিকে।
ওরা সেই করিডোর ধরে এগুচ্ছিল।
আহমদ মুসা গড়িয়ে গড়িয়েই উঠে এসেছে তিনতলার ড্রয়িং-এ। সোফার আড়াল নিয়ে সেই করিডোরের দিকে এগুচ্ছে আহমদ মুসা।
আহমদ মুসা তখন প্রশস্ত সেই করিডোরটির মুখে।
একটা রিভলবারের গুলীর শব্দ হলো। করিডোরের যে দিকে ডোনার ঘর তাঁর বিপরীত দিকের দেয়াল বরাবর সামনেই যে লোকটি হাঁটছিল, সে গুলী খেয়ে পরে গেল।
আহমদ মুসা বুঝল, দরজা খুলেই গুলী করেছে ডোনা।
একজন গুলী খাবার পর সবাই ওরা চলে এল ডোনার ঘর যেদিকে সেইদিকের সমান্তরালে।
আহমদ মুসা দেখল সঠিক কৌশল নিয়েছে এরা। দেয়ালের এই সমান্তরালে গুলী করতে হলে ডোনাকে অবশ্যই হাত ও মুখটা একটু বের করতে হবে, যা ডোনার পক্ষে সম্ভব হবে না। এই সুযোগ নিয়ে এরা দেয়াল ঘেঁষে এগিয়ে পৌঁছে যাবে ডোনার দরজার প্রান্তে। তখন দরজার কন্ট্রোল এদের হাতে এসে যাবে।
আহমদ মুসা দেখল, এদের একদম সামনের পুলিশ সুপারের পোশাকধারী লোকটি ডোনার দরজার প্রান্তে পৌঁছে গেছে।
আহমদ মুসা আর অপেক্ষা সমীচীন মনে করল না। স্টেনগানের ট্রিগারে তর্জনী স্পর্শ করে উঠে দাঁড়াল। স্টেনগান ওদের দিকে তাক করে বলল, ‘আর নয় বীর পুরুষরা, খেলা শেষ’।
চমকে উঠে সবাই একসাথে পেছনে তাকাল। তাকিয়েই রিভলবার ঘুরিয়ে নিয়েছিল পুলিশ সুপারের বেশধারী লোকটি।
তাকে সুযোগ দিল না আহমদ মুসা। তাঁর তর্জনী চেপে বসল স্টেনগানের ট্রিগারে। গুলীর এক অব্যাহত বৃষ্টি ঘিরে ধরল ওদের সবাইকে।
ওঁরা যে যেখানে ছিল, সেখানেই লাশ হয়ে পরে থাকল।
আহমদ মুসা ছুটে গেল ডোনার দরজায়। দেখল, দুই হাতে দুই রিভলবার নিয়ে দরজায় ঠেস দিয়ে দাড়িয়ে আছে সে।
‘আমি জানতাম প্রথম গুলীর পর তুমি সাড়া দেবে। রিভলবার দু’টি গাউনের দু’পকেটে রাখতে রাখতে বলল ডোনা।
‘কেন তোমার এই ধারনা হয়েছিল?’
‘তুমি নিশ্চয় দেখতে চাইবে, আমি পরিস্থিতি মোকাবেলায় কতটা প্রস্তুত’।
‘তুমি ঠিকই বলেছ। তবে ওদেরকে এ পর্যন্ত আসতে দেয়া, আমার এম-১০ ব্যবহার না করে স্টেনগান ব্যবহার করার ভিন্ন কারন রয়েছে’।
‘কি সেটা?’
কোন উত্তর না দিয়ে আহমদ মুসা স্টেনগান তুলে দিল ডোনার হাতে। বলল, ‘তুমি পুলিশকে বলবে, তোমার খালাম্মাকে ক্লোরোফরম করে দোতলার এক কক্ষে আটক করার পর ওরা তোমাকে কিডন্যাপ করার জন্যে আসে। তাদের একজনকে রিভলবারের গুলীতে হত্যা করে তাঁর স্টেনগান ছিনিয়ে নিয়ে তারপর ওদের সবাইকে তুমিই হত্যা করেছ। তোমার খালাম্মার সাথে ওদের কথা শুনে তোমার বিশ্বাস হয়েছে পুলিশের ছদ্মবেশে ওরা ক্রিমিনাল, যারা তোমার পিতাকে কিডন্যাপ করেছে’।
বলে একটু থেমেই আহমদ মুসা আবার বলল, ‘তুমি এখনি টেলিফোন কর পুলিশ চীফকে যে, পুলিশের ছদ্মবেশে কিডন্যাপকারীরা ঢুকেছিল বাড়িতে এবং তারা নিহত হয়েছে’।
‘তার মানে তুমি কোন ভুমিকায় থাকছ না?’
‘না। পুলিশ আসার আগেই আমি চলে যাব। পুলিশই তোমার খালাম্মাকে উদ্ধার করবে ঐ ঘর থেকে’।
‘তারপর?’
‘আগে যা বলেছি সে ব্যবস্থাই চলবে। আমি গিয়ে সাইমুমের মেসে উঠছি’।
‘খালাম্মা কি বক্তব্য দেবেন পুলিশকে?’
‘সেটা তিনিই ঠিক করবেন। তুমি বলবে, হঠাৎ ঘুম ভাঙ্গার পর বাইরে অপরিচিত কণ্ঠস্বরে তুমি বেরিয়ে এসে দেখ, তোমার খালাম্মাকে ঐ ঘরে আটকাচ্ছে এবং কিছু লোক ছুটে আসছে তোমার ঘরের দিকে’।
‘বুঝেছি’।
‘বাড়ির চাকর-বাকরদেরও ওরা আটকে রেখেছে নিচের একটা কক্ষে। তারা তাদের বিবরন দিলে বিষয়টা আরও পরিস্কার হয়ে যাবে। ঠিক আছে?’
‘ধন্যবাদ। ঠিক আছে’।
বলে ডোনা তাঁর মোবাইলটা তুলে নিল পুলিশ চীফকে টেলিফোন করার জন্যে।
‘আসি’।
‘না। পুলিশ গেটে আসা পর্যন্ত তুমি অপেক্ষা কর’।
‘ঠিক আছে’। বলে বলে আহমদ মুসা বসল সোফায়।
ডোনাও বসল পাশের আরেক সোফায়।
‘যে লোককে তুমি কারাত মেরে ঘুম পাড়িয়েছ, তাঁর কি হবে?’
‘সে এতক্ষনে সংজ্ঞা ফিরে পেয়েছে এবং পালিয়েছে। খবর পৌঁছাবার জন্যে একজন লোক পালাক’।
‘কেন তাঁকে পাকড়াও করলে কিছু খবর পেতে না?’
‘সে আর কি খবর দিবে? এখন তো যুদ্ধক্ষেত্র রাশিয়ায়’।
‘রাশিয়া’ শব্দ শুনেই ম্লান হয়ে গেল ডোনার মুখ। আহমদ মুসা আবার রাশিয়ায় যাবে, এ কথা মনে হতেই হৃদয়ে তীব্র যন্ত্রণা অনুভব করে সে।
ডোনার মুখ নিচু।
আহমদ মুসা তখন ভাবছে এরপর কি ঘটেছে সে বিষয়ে।
টেলিফোন ধরে ডোনা বলল, স্বয়ং পুলিশ চীফ এসেছেন গেটে। আসতে বললাম’।
‘তাহলে আমার ছুটি। আসসালামু আলাইকুম’।
বলে উঠে দাঁড়াল আহমদ মুসা।
ডোনা সাথে সাথে উঠল নিচে নামার জন্যে।

Top