২৩. রাজচক্র

চ্যাপ্টার

রুশ রাষ্ট্রদুতের অফিস কক্ষে বসেছিল আহমদ মুসা।
তাঁর পাশের সোফায় বসেছিল রুশ রাষ্ট্রদূতের মেয়ে ওলগা।
রুশ রাষ্ট্রদূত পাভেল পাশের রুম থেকে এসে আহমদ মুসার সামনে দাঁড়াল। তাঁর হাতে একটি পাসপোর্ট। বলল, ‘মিঃ আবদুল্লাহ আপনার ভাবী স্ত্রী প্রিন্সেস মারিয়া জোসেফাইন ওরফে ডোনা জোসেফাইন দু’দিন আগে রাশিয়ার ভিসা নিয়েছে দেখলাম’।
ভীষণ বিস্মিত হল আহমদ মুসা। স্বয়ং রাষ্ট্রদূত না বললে এ কথাকে সে ইয়ার্কি বলে মনে করতো। কিন্তু মুখে কিছু বলল না আহমদ মুসা।
রাষ্ট্রদূত পাভেলের মুখে মজা দেখার মত হাসি। তাঁর হাতের পাসপোর্টটি আহমদ মুসার দিকে তুলে ধরে বলল। মিঃ আহমদ মুসাও ওরফে মিঃ আবদুল্লাহ আপনার ভিসা দিলাম। কিন্তু আপনার রাশিয়ায় তো যাওয়া হবে না, যদি আপনি আমাদের শর্তে না আসেন’।
আহমদ মুসা বিস্মিত হলো না। তাঁর পরিচয়, ডোনার পরিচয় রুশ রাষ্ট্রদূত যে জেনে ফেলবেন খুব শীঘ্রই, এটা সে আগেই মনে করেছিল।
আহমদ মুসা ভাবলেশহীন মুখে উঠে দাঁড়িয়ে পাসপোর্টটা রাষ্ট্রদূতের হাত থেকে নিল। কিন্তু কোন কথা বলল না।
রাষ্ট্রদূতই আবার কথা বলল, ‘ভাবছ কেমন করে তোমার পরিচয় জেনে ফেললাম? জেনেভাস্থ আমাদের দুতাবাস অবশেষে প্রিন্সেস তাতিয়ানার মৃত্যুর সময়কার ভিডিও-র একটা কপি বহু অর্থের বিনিময়ে কালোবাজারিদের মাধ্যমে জেনেভা পুলিশের কাছ থেকে কিনে ফেলেছে। এই মাত্র তাঁর একটা প্রিন্ট আমি পেলাম। দেখলাম’। থামল রাষ্ট্রদূত পাভেল।
আহমদ মুসার নতুন পরিচয় পেয়ে এবং তাঁর আব্বার পরবর্তী কথাগুলো শুনে বিস্ময়ে হাঁ হয়ে গেছে ওলগার মুখ। সেও সোফা থেকে উঠে দাঁড়িয়েছে।
‘কথা বলছেন না যে?’ বলল রাষ্ট্রদূত পাভেল আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে।
‘কি বলব?’
‘ঐ যে শর্তের কথা বললাম’।
‘শর্ত কি কেন আমি বুঝিনি?’
রাজকীয় ডাইরি ও রাজকীয় আংটি আপনি আমাদের দিয়ে দিবেন এবং আমরা আপনাকে রাশিয়া নিয়ে যাব রাজকীয় মেহমান হিসাবে। আপনি আমাদের সাহায্য করবেন ক্যাথারিনকে উদ্ধারের ব্যাপারে’।
‘শর্ত যদি আমি না মানি?’
‘তাহলে রাশিয়া যাওয়া তো দুরে থাক আপনি এ দুতাবাস থেকেই যেতে পারবেন না’।
‘তার মানে আপনারা বাধা দিবেন। তাহলে আমি কি বন্দী?’
আহমদ মুসা পেছনে তাকাল। দেখল তার পেছনেই সোফার ফুট খানেক দুরে দু’জন স্টেনগান উদ্যত করে দাঁড়িয়ে আছে।
এ ব্যাপার দেখে ওলগার চোখে-মুখে প্রবল বিস্ময় ও উত্তেজনা। সে তার আব্বাকে লক্ষ্য করে বলল, ‘আব্বা এসব আপনি কি বলছেন? সব অতীতকেই কি আপনি ভুলে গেলেন?’
‘মা, আমি রাষ্ট্রদূত। রাষ্ট্রের পক্ষে কাজ করা আমার দায়িত্ব। প্রিন্সেস তাতিয়ানা ভালবাসতেন মিঃ আবদুল্লাহ ওরফে আহমদ মুসাকে। মৃত্যুর সময় প্রিন্সেস সেই রাজকীয় ডাইরি ও রাজকীয় আংটি দিয়ে গেছেন আহমদ মুসাকে প্রিন্সেস ক্যাথারিনের হাতে পৌঁছবার জন্যে। আমাদের রাষ্ট্র ঐ দু’টো জিনিস খুঁজছে। জিনিস দু’টি আহমদ মুসা আমাদের দিয়ে দিলেই সব চুকে যায়’।
‘কিন্তু মিঃ রাষ্ট্রদূত আপনাদের সেই আশা পুরন হবে না। ক্যাথারিন ছাড়া ঐ জিনিস আর কেউ পাবে না’।
‘কিন্তু আমাদের পেতেই হবে, আপনাকে আমরা ছাড়ব না’।
‘পারলে তো অবশ্যই ছাড়বেন না’।
‘পারা সম্পর্কে আপনার সন্দেহ আছে?’ যতই বড় আপনি হন, রাষ্ট্রের চেয়ে বড় আপনি…..’।
রাষ্ট্রদূত পাভেলের কথা শেষ হলো না।
হঠাৎ আহমদ মুসার মাথা পেছনে সোফার সিটের দিকে ছুটে গেল। আর পা দু’টি উঠল আকাশের দিকে। তারপর অর্ধ চন্দ্রাকারে বেঁকে পেছনে দাঁড়ানো দুই স্টেনগানধারীর মাথায় তীব্রভাবে আঘাত করল।
সেই প্রচণ্ড লাথিতে স্টেনগানধারী দু’জন চিৎ হয়ে পরে গেল মাটিতে। তাঁদের স্টেনগান হাত থেকে খসে পরে গেল তাদের পাশেই।
আর আহমদ মুসার দেহ অর্ধ চন্দ্রাকারে ঘুরে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল দু’জনের মাঝখানে।
আহমদ মুসা তাদের দু’জনের স্টেনগান তুলে নিল হাতে।
মুহূর্তের মধ্যেই ঘটে গেল দৃশ্যপট পরিবর্তনের এই ঘটনা।
রাষ্ট্রদূত পাভেল ও ওলগা দু’জনের চোখই ছানাবড়া।
ধীরে ধীরে চোখের ছানাবড়া ভাব কেটে গিয়ে ওলগার ঠোঁটে আনন্দের হাসি ফুটে উঠল।
কিন্তু রাষ্ট্রদূত পাভেলের বিস্ময় বিমুঢ় ভাব কাটেনি। সে যেন বাকরুদ্ধ।
আহমদ মুসা দু’টি স্টেনগান হাতে নিয়ে ফিরে এল তার সোফায়। বলল, ‘স্টেনগান দু’টো আপাতত আমার কাছে থাকবে। বেরুবার সময় প্রয়োজন হতে পারে’।
বলে একটু থেমেই আবার শুরু করল, ‘বসুন মিঃ এ্যামবেসেডর’।
বসল রাষ্ট্রদূত পাভেল আহমদ মুসার সামনের সোফায়।
‘মিঃ রাষ্ট্রদূত, দয়া করে আপনার প্রহরী বেচারাদের যেতে বলুন’।
রাষ্ট্রদূত চোখ তুলে ওদের ইশারা করল। ওরা কক্ষ থেকে বের হয়ে চলে গেল।
ওরা বেরিয়ে যেতেই রাষ্ট্রদূত পাভেল বলে উঠল, ‘আপনার শক্তি ও কৌশলের প্রশংসা করছি আহমদ মুসা। কিন্তু রুশ সরকারকে এই চ্যালেঞ্জ দেয়া কি আপনার ঠিক হলো? দুজনকে আপনি কুপোকাত করেছেন, কিন্তু সত্যই আপনি দুতাবাস থেকে বেরিয়ে যেতে পারবেন না’।
আহমদ মুসা হাসল। বলল, ‘মিঃ রাষ্ট্রদূত আমাকে হত্যা করতে পারেন, কিন্তু আমাকে আটকাতে পারবেন না। আর মেরেও ফেলতে পারবেন না আমাকে, কারন তাতে রাজকীয় ডাইরি ও রাজকীয় আংটি চিরদিনের মত হারিয়ে যাবে’।
শেষ কথাটায় চমকে উঠল রাষ্ট্রদূত পাভেল। বলল, ‘আমরা রক্তারক্তিতে যেতে চাইনি। আমরা আপনাকে একটা শান্তিপূর্ণ সমাধানের প্রস্তাব দিয়েছি’।
‘কিন্তু আমার জন্যে ওটা সম্পূর্ণ অশান্তির’।
‘শান্তির সমাধান আপনার কাছে কি আছে?’
‘এতদিন যেভাবে কাজ চলছিল, সেভাবেই চলতে হবে। রুশ সরকার যেভাবে কাজ করছিল সেভাবেই তারা কাজ করবেন। আর আমার কাজ আমি করব। প্রয়োজনে দু’পক্ষের সহযোগিতা হতে পারে। ক্যাথারিন উদ্ধার হলে তাঁর হাতে ঐ ডকুমেন্ট দু’টো তুলে দিলেই আমার কাজ শেষ। আপনাদের প্রিন্সেস আপনাদের ডকুমেন্ট নিলে আপনারা কি করবেন আপনারাই সেটা দেখবেন’।
‘জনাব আহমদ মুসা যুক্তিসংগত কথা বলেছেন। তাঁর প্রস্তাব মেনে নেয়ার মধ্যে উভয় পক্ষেরই কল্যান রয়েছে আব্বা’। বলল ওলগা।
‘জিনিস দু’টি রুশ সরকারকে দেবেন না কেন? প্রকৃতপক্ষে রুশ সরকারই ও দু’টোর মালিক’।
‘সে বিচারের দায়িত্ব আমার নয়। যার হাতে জিনিষ দু’টো পৌঁছে দেয়া আমার দায়িত্ব, আমাকে শুধু সে টুকুই করতে হবে’।
‘আমার সরকারের সাথে এ বিষয় নিয়ে আলোচনার আগে আমি কিছুই বলতে পারছি না। কিন্তু আজ ছাড়লে আপনাকে যদি আর না পাই?’
আহমদ মুসা ভ্রু কুঞ্চিত করলো। বলল, ‘ছাড়লে’ কথাটা বলছেন কেন? আমার এখান থেকে যাওয়া না যাওয়াটা আপনার ইচ্ছা-অনিচ্ছার উপর নির্ভরশীল নয় মিঃ এ্যামবেসেডর’।
‘আমি ঠিক ও কথা বলি নি।আপনি চলে যাওয়ার পর আপনার দেখা কি করে পাবো সে কথাই বলতে চেয়েছি’।
‘দেখুন রুশ রাষ্ট্রদূতের সাথে আমার বিরোধ ঘটেছে নীতির প্রশ্নে। বিরোধ না থাকলেই সব ঠিক হয়ে যাবে’।
‘বিরোধ মেটার জন্যে সময় তো দরকার’।
‘বিরোধ মেটার খবর দিলে আমি খুশি হবো মিঃ এ্যামবেসেডর’।
বলে উঠে দাঁড়াল আহমদ মুসা। দু’টি স্টেনগানও সে হাতে তুলে নিয়েছে।
ওলগা ও উঠে দাঁড়াল আহমদ মুসার সাথে সাথে।
‘গুড ডে’ বলে আহমদ মুসা বেরিয়ে এল ঘর থেকে।
পাথরের মত বসে ছিল রাষ্ট্রদূত। কোন কথাই সে বলল না।
পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে ওলগা বলল, ‘আজ আমার এক সৌভাগ্যের দিন’।
‘কেন?’ বলল আহমদ মুসা।
‘কিংবদন্তী আহমদ মুসার সাথে শুধু দেখা নয়, কথা বলারও সৌভাগ্য হলো’।
‘কেন পরিচয় ও কথা তো আগেই হয়েছে’।
‘তখন মিঃ আবদুল্লাহ ছিলেন, আহমদ মুসা নয়’।
‘কিন্তু আপনি যাকে সৌভাগ্য বলছেন তা আমার জন্যে দুর্ভাগ্য ডেকে এনেছে। আপনার আব্বাসহ রুশ সরকারের বন্ধুত্ব হারালাম’।
‘রুশ সরকার কি করবে আমি জানি না, কিন্তু আপনার সহযোগিতার প্রস্তাবে রুশ সরকারের নিজেকে ধন্য মনে করা উচিত। জানেন? আমার আজই কেবল মনে হচ্ছে, ক্যাথারিন উদ্ধার হবে, নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠাও সম্ভব হবে’।
গেট পর্যন্ত পৌঁছে আহমদ মুসা দু’টি স্টেনগান ওলগার হাতে তুলে দিল।
স্টেনগান হাতে নিয়ে ওলগা বলল, ‘রাশিয়ায় যাবার আগে কি আবার দেখা হবে?’
‘আপনি যদি চান এবং আসার যদি পরিবেশ থাকে’।
‘প্রিন্সেস ক্যাথারিনের উদ্ধারের ব্যাপারে আপনার সহযোগিতা লাগলে আমি বাধিত হবো। আর আমি আমার কিছু বন্ধু-বান্ধবের ঠিকানা দিতে চাই যারা আপনাকে সহযোগিতা করতে পারে’।
‘ধন্যবাদ। আমি এগুলো সংগ্রহের চেষ্টা করব’।
বলে আহমদ মুসা ঘুরে দাঁড়িয়ে হাঁটতে শুরু করল।

আহমদ মুসা ও ডোনা জোসেফাইন বসেছিল মুখোমুখি দু’টি সোফায়।
ডোনার মুখ নিচু। কথা বলছিল সে, ‘আমি মনে করি রাশিয়ায় আমার যেতে হবে, এই ধারনাতেই আমি ভিসা করেছি। অপরাধ হলে মাফ করে দাও’।
‘ভিসা করা অন্যায় নয়। এতে কোন অপরাধও হয়নি। বলছি তোমার রাশিয়া যাওয়া ঠিক কিনা’।
‘কেন ঠিক নয়?’
‘ওটা একটা যুদ্ধক্ষেত্র, ক্যাথারিনের উদ্ধারের উদ্যেশ্য ছাড়া অন্য কোন কাজ সেখানে নেই। তোমার ওখানে যেয়ে কোন কাজ নেই’।
ডোনার গম্ভীর মুখ আরও গম্ভীর হয়ে উঠেছে। মুখ তাঁর নিচু। বলল, ‘যেয়ে কোন কাজ নেই বটে, গেলে কোন অকাজ হবে?’
‘কাজ ও অকাজের কোন প্রশ্ন না থাকলে তুমি যেতে চাইছ কেন?’
ডোনা তৎক্ষণাৎ কোন উত্তর দিল না।
একটু পর ধীরে ধীরে বলল, ‘তুমি সব জেনেছ। আব্বা নেই। তুমি কার কাছে রেখে যাবে আমাকে? খালাম্মার কাছে?’ ভারি কণ্ঠ ডোনার।
ডোনার কথাটা হৃদয় স্পর্শ করল আহমদ মুসার। সত্যি তো, তাঁর খালাম্মা তাঁর নিরাপদ আশ্রয় নয়। কিন্তু তাঁকে রাশিয়া নিয়ে যাবে সে কেমন করে?
বলল আহমদ মুসা, ‘তুমি ঠিকই বলেছ ডোনা, কিন্তু তোমাকে রাশিয়ায় নেব কেমন করে? আগে তুমি তোমার আব্বার সাথে সফর করেছ, এখন?’
‘কেন তোমার সাথে?’
‘আমি ও তুমি একা এক সাথে সফর করতে পারি না। ইসলাম এ অনুমতি দেয় না’।
‘অনুমতির শর্ত?’
আহমদ মুসা মুখ নিচু করল। নীরব রইল কোন উত্তর দিল না। ড্রয়িং রুমে প্রবেশ করল এ সময় জাহরা ইভানোভা। প্রবেশ করতে করতে বলল, ‘অনুমতির শর্ত আমি বলছি। তার আগে আমি মাফ চাইছি আড়ালে দাঁড়িয়ে আপনাদের কথা শোনার জন্যে’।
আহমদ মুসা ও ডোনা দু’জনেই মুখ তুলল। উঠে দাঁড়াল দু’জনেই।
স্বাগত জানালো জাহরা ইভানোভা কে। ডোনা বলল, ‘মাফ করব, কিন্তু তাঁর আগে দু’ঘণ্টা দেরিতে আসার কৈফিয়ত দাও’।
‘কৈফিয়ত কিসের? কাল গেছি দু’ঘণ্টা দেরিতে, আজ এলাম দু’ঘণ্টা দেরিতে। সমান সমান’।
বলে জাহরা ইভানোভা বসল ডোনার পাশে ডোনাকে জড়িয়ে ধরে।
তারপর চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে জাহরা ইভানোভা সোজা হয়ে বসল। বলল গম্ভীর কণ্ঠে, ‘এবার আসল কোথায় আসি’।
বলে একটু থামল। ধীরে ধীরে আবার শুরু করল, ‘আমি মনে করি রাশিয়ার সফরটা খুব কঠিন হবে। জনাব আহমদ মুসার ছবি গ্রেট বিয়ারের সবার কাছে সর্বত্র চলে গেছে। গ্রেট বিয়ারের প্রতি সহানুভূতিশীল রুশ পুলিশের কাছেও এ ছবি থাকবে। তাঁর উপর সরকারেরও টার্গেট হতে পারেন তিনি। যদি তা হন, তাহলে সব পুলিশের কাছে তাঁর ছবি চলে যাবে। এই অবস্থায় যে গোপনীয়তার সাথে সফর করতে হবে, তাতে আপনারা সফর শুরু করার আগে আইন ও সামাজিক বিধানমতে আপনাদের দু’জনের একাত্ন হতে হবে। এটাই অনুমতির শর্ত’।
ডোনা ও আহমদ মুসা দু’জনেই মুখ নিচু করল। ডোনার মুখ লাল হয়ে উঠেছে লজ্জায়। দু’জনেই নীরব।
‘কি ব্যাপার, বলুন আপনারা?’ জাহরা ইভানোভার চোখ দু’টি উজ্জ্বল। ঠোঁটে মধুর এক টুকরো হাসি।
ডোনা তাঁর লাজ রাঙা মুখ জাহরা ইভানোভার কাধে গুজে বলল, ‘এটাই যদি অনুমতির শর্ত হয়, এ শর্তে আমি রাজি’।
জাহরা ইভানোভা জড়িয়ে ধরল ডোনাকে। তারপর আহমদ মুসার দিকে চোখ তুলে বলল, ‘এবার বলুন জনাব আহমদ মুসা’।
‘ও কিন্তু শর্তের জালে পরে ‘হ্যাঁ’ বলেছে’। আহমদ মুসার ঠোঁটে হাসির রেখা।
জাহরা ইভানোভার ঠোঁটে দুষ্ট এক টুকরো হাসি ফুটে উঠল। বলল আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে, ‘শর্তের মধ্যে না পড়লে বিয়েতে উনি না বলতেন বুঝি?’
আহমদ মুসার চোখে-মুখেও লজ্জার ছায়া নেমেছে। বলল, ‘ওর আব্বার অনুপস্থিতিতে ব্যাপারটা কেমন হবে?’
জাহরা ইভানোভা মুখ ঘুরিয়ে ডোনার কানের কাছে নিয়ে বলল, ‘এবার বল প্রিন্সেস’।
ডোনা তাঁর মুখটা জাহরা ইভানোভার কাঁধে আরও গুজে দিয়ে বলল, ‘আব্বার মত আছে। আমার পরিবারেরও সকলে বিষয়টা জানেন’।
জাহরা ইভানোভার মুখে আবার সেই দুষ্টুমির হাসি। বলল আহমদ মুসাকে, ‘আর পালাবার কি পথ আছে জনাব’।
আহমদ মুসা তখন গম্ভীর হয়ে উঠেছে। বলল, ‘পালাতে চাইনি কখনও। সহস্র দিন সহস্র রাত ধরে তো আমি এ দিনেরই অপেক্ষায় আছি’।
‘আলহামদুলিল্লাহ্‌’। শব্দটি মুখ ফুঁড়ে বেরিয়ে এল জাহরা ইভানোভার।
কথা বলেই জাহরা ইভানোভা হঠাৎ আবেগাপ্লুত হয়ে পড়ল। সে ডোনাকে জড়িয়ে ধরল বুকে। তার চোখ জানালা দিয়ে ছুটে গেল বাইরে। সে চোখে শুন্য দৃষ্টি। ভারি কাঁপা কণ্ঠে স্বগোতোক্তির মত সে বলল, ‘বহু বছর আগে মুসলিম প্রিন্সেস ফাতিমা জোহরাকে একজন রুশ জেনারেল বিয়ে করেছিল জোর করে, তার বহু বছর পরে ফাতিমা জোহরার এক উত্তর-সন্তান জাহরা ইভানোভা ইউরোপের শ্রেষ্ঠ প্রিন্সেসকে তাঁর পূর্ণ সম্মতিতে তুলে দিতে পারছে এক মুসলিম জেনারেলের হাতে। কত যে খুশি হতেন ফাতিমা জোহরা, যদি তিনি জানতেন!’
চোখের দু’কোনায় দু’ফোটা অশ্রু এসে জমেছিল জাহরা ইভানোভার।
ডোনা নিজের মাথার ওড়না দিয়ে মুছে দিল সে অশ্রু খুব মমতার সাথে। বলল, ‘এটাই প্রমাণ করে জাহরা ইভানোভা যে, পরাজয়ের কালো রজনী শেষে মুসলমানদের বিজয়ের যাত্রা শুরু হয়েছে’।
ডোনার কণ্ঠও রুদ্ধ এক আবেগের বিস্ফোরণে ভেঙে পড়ল।
ধীরে ধীরে আহমদ মুসার কণ্ঠেও উচ্চারিত হলো, ‘আমি আল্লাহ্‌র শুকরিয়া আদায় করছি, ক্রিমিয়ার অপরাজেয় এবং ন্যায়পরায়ন সুলতান করিম গিরাই-এর উত্তর-সন্তান এক রুশ কন্যা জাহরা ইভানোভা আমাদের বিয়ের মধ্যস্থতা করল’। আহমদ মুসার কণ্ঠও ভারি, তাঁর মুখ নিচু। আহমদ মুসা থামল।
সবাই নীরব।
তিন হৃদয়ের মাঝখানে স্বর্গীয় এক নীরব পরিবেশ।
নিরবতা ভাঙল জাহরা ইভানোভার মোবাইল টেলিফোনের বিপ বিপ শব্দ।
টেলিফোন কানে ধরেই জাহরা ইভানোভা সহাস্যে বলল, ‘আসসালামু আলাইকুম, ফাতমা।….সব রেডি?….ধন্যবাদ। কয়টা?…নাইস। ডাঃ জুবায়েরকে আমার ধন্যবাদ দিয়ো। ..আমি না। আমার পক্ষ থেকে তুমিই তাঁকে ধন্যবাদ দাও।…ঠিক আছে। ওকে। আসসালামু আলাইকুম’।
আনন্দে জাহরা ইভানোভার মুখ নাচছে। বলল, ‘আপনাদের কাছে মাফ চাই। একটা অনধিকার চর্চা করে ফেলেছি। সকালেই ফাতমাকে টেলিফোন করে বলেছিলাম, ‘সময় কম। আজকেই বিয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। সে যেন সবাইকে বলে এর ব্যবস্থা করে। ফাতমা এখন জানাল, মুসলিম কম্যুনিটি হলে আজ বাদ মাগরিব বিয়ে হবে। সবাই আয়োজনে লেগে গেছে। প্যারিস কেন্দ্রীয় মসজিদের ইমাম বিয়ে পড়াবেন’। থামল ইভানোভা।
‘আমাদের বিয়ে? আজ? বাদ মাগরিব?’ এক সাথেই আহমদ মুসা ও ডোনার বিস্ময় বিজড়িত কণ্ঠ ধ্বনিত হলো।
‘তোমাদের নয়তো কার বিয়ের জন্যে এত পাগল হবে জাহরা ইভানোভা?’
আহমদ মুসা ও ডোনা কোন কোন উত্তর দিল না। দু’জন দু’জনের দিকে একবার চেয়ে মুখ নিচু করল।
‘ভয় নেই তোমাদের। কেনা-কাটার কাজটা সেরে ফেলেছি। বিয়ের কেনা-কাটা করতে গিয়েই তো দু’ঘণ্টা দেরি করেছি’।
বলে ইভানোভা ডোনার মুখের কাছে মুখ নিয়ে বলল, ‘ধন্যবাদ দেবে না?’
ডোনার চোখ-মুখ লজ্জায় আনন্দে ভারি হয়ে উঠেছিল। সে জাহরা ইভানোভাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলল। বলল, ‘তুমি এত ভালো কেন?’
জাহরা ইভানোভা ডোনার মুখে হাত চাপা দিয়ে বলল, ‘শেরেক’ করো না, ‘শেরেক’ করো না। এ কথাটা জনাব আহমদ মুসার জন্যে রিজার্ভ করে রাখো’।
ডোনা জোহরা ইভানোভার পিঠে একটা কিল দিয়ে সরে বসে বলল, ‘দেখবে আমিও সুযোগ পাবো। ডাঃ জুবায়েরকে ফাতমার মাধ্যমে ধন্যবাদ দিলে কেন? নিজে দিতে পারলে না কেন?’
জাহরা ইভানোভার চোখে-মুখে এক ঝলক লজ্জা নেমে এল। একটু সলাজ হেসে বলল, ‘ওর সাথে তো এই সেদিন আমার পরিচয়’।
‘কবে পরিচয় এই প্রশ্ন তো আমি জিজ্ঞেস করিনি। এক দৃষ্টিতেই শত বছরের প্রেম হয়ে যায়। তুমি….।
ডোনাকে বাধা দিয়ে উঠে দাঁড়াল জাহরা ইভানোভা। বলল, ‘দেখ এসব আলোচনায় নষ্ট করার মত সময় আমার নেই। তুমি তোমার পরিবারকে জানাও বিষয়টা। আমি এখনি আসছি বাইরে থেকে’।
বলে আহমদ মুসাকে সালাম দিয়ে চলে গেল জাহরা ইভানোভা।
বসেছিল আহমদ মুসা ও ডোনা। দু’জনেরই মুখ নিচু। দু’জনের মধ্যে অস্বস্তিকর এক নিরবতা। মুখ তুলল ডোনা। তাকাল আহমদ মুসার দিকে।
আহমদ মুসাও তাকিয়েছে।
কিছু বলার জন্যে মুখ খুলেছিল ডোনা। কিন্তু পারলো না। রাজ্যের লজ্জা এসে ঘিরে ধরল তাঁকে। লজ্জায় আড়ষ্ট ঠোঁটে কথা ফুটে উঠা একটু হাসি নিয়ে মুখ নিচু করল আবার ডোনা।

পরদিন ভোর চারটা।
আহমদ মুসা হাতঘড়ির দিকে একবার তাকিয়ে উঠে বসল। বেড সুইচটি অন করল।
পাশে ডোনা অঘোরে ঘুমাচ্ছে। অবিন্যস্ত চুলের কয়েকটি গোছা মুখের উপর এসে পড়েছে।
আহমদ মুসা চুলগুলো মুখ থেকে সরিয়ে আস্তে আস্তে কয়েকটা টোকা দিল গালে।
নড়ে উঠে ধীরে ধীরে চোখ খুলল ডোনা। আহমদ মুসার দিকে তার চোখ পড়তেই লজ্জায় রাঙা হয়ে উঠল তার মুখ। দু’হাতে মুখ ঢাকল সে।
আহমদ মুসা ডোনার হাত দুটি মুখ থেকে সরিয়ে মুখের দিকে উকি দিয়ে বলল, ‘এসো নামাজের জন্যে তৈরী হই’।
বলে আহমদ মুসা উঠল বিছানা থেকে।
আহমদ মুসা টয়লেটের দিকে চলে গেলে গা থেকে কম্বল নামিয়ে কাপড় ঠিক-ঠাক করে ডোনা ও উঠে দাঁড়াল।

সাইমুম সিরিজের পরবর্তী বই
জারের গুপ্তধন

Top