২৪. জারের গুপ্তধন

চ্যাপ্টার

চ্যাপ্টার

মস্কোর দক্ষিণ অংশে মস্কোভা নদী লেনিন হিলস-এর পাদদেশে এসে ‘ইউ’ টার্ন নিয়েছে। এই ‘ইউ’ টার্নের যেখানে কমসোমলস্কায়া হাইওয়ে দক্ষিণ থেকে এসে মস্কোভা নদী অতিক্রম করে এগিয়ে গেছে সেদোভায়া রিং-এর দিকে, সেখানে মস্কোভা নদীর তীরে একটি দুর্গ সদৃশ বাড়ি।
বাড়িটার বিশাল গেটে একটা সুদৃশ্য সাইনবোর্ড। লেখা, ‘হেরিটেজ ফাউন্ডেশন’। সাইনবোর্ডে ‘হেরিটেজ ফাউন্ডেশন’-এর পরিচয় দিতে গিয়ে বলা হয়েছে, ‘সোশ্যাল রিসার্চ ফর ন্যাশনাল ইন্টিগ্রেশন’।
সরকারী কাগজে কলমে সংস্থাটি একটি জাতীয় এনজিও। এই এনজিও সাইনবোর্ডের আড়ালে এটাই গ্রেট বিয়ারের হেডকোয়ার্টার।
বাড়িটা এক সময় সোভিয়েত রাজবন্দীদের বধ্যভূমি বলে কথিত কেজিবি’র জেলখানা ‘লুবিয়াংকা’র অংশ ছিল। কমিউনিজমের পতনের পর বাড়িটা পরিত্যক্ত হয়। এই পরিত্যক্ত বাড়িটাই ‘হেরিটেজ ফাউন্ডেশন’-এর নামে গ্রেট বিয়ার কিনে নিয়েছে। গ্রেট বিয়ার লুবিয়াংকার ‘হেরিটেজ’ ঠিকই রক্ষা করছে একে আর একটা বধ্যভূমিতে পরিণত করে। লুবিয়াংকা ছিল কমিউনিজম প্রতিষ্ঠার বধ্যভূমি, গ্রেট বিয়ারের হাতে এসে এটা এখন হয়েছে রুশীয়করণের বধ্যভূমি। হেরিটেজ ফাউন্ডেশনের ভূগর্ভস্থ দু’টি তলা গ্রেট বিয়ারের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বধ্যভূমি হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
বাড়িটা দুর্গ সদৃশ, কারণ পাঁচতলা উঁচু বিরাট এলাকা নিয়ে তৈরি বিরাট বাড়িটার উত্তর দিকের প্রধান গেটটি ছাড়া আর কোন দরজা, জানালা, কার্নিশ, ব্যালকনি ইত্যাদি কিছুই নেই। বাড়ির বহির্দেয়ালের নিচ থেকে শীর্ষ পর্যন্ত প্রতি পনের ফুট দূরত্বে বিল্ডিং-এর চারদিক ঘুরে একসারি করে ঘুলঘুলি। ঘুলঘুলির আয়তন এক বর্গফুটের বেশি হবে না।
দুর্গ সদৃশ বাড়ির দক্ষিণ অংশে পাঁচ তলায় বিরাট একটি হলঘর।
ঘরে ডজন দুই বড় সাইজের কুশন চেয়ার। চেয়ারগুলোর সামনে খানিকটা ফাঁকা জায়গা। ফাঁকা জায়গাটার পরে প্রায় পাঁচ ফুট উঁচু একটা মঞ্চ।
মঞ্চের ঠিক মাঝখানে সাত ফুট উঁচু আরও একটা মঞ্চ। মঞ্চটির আয়তন পাঁচ বর্গফুটের মত হবে।
হলরুমের মেঝে থেকে এই মঞ্চটিকে সলিড মেঝে বিশিষ্ট বলে মনে হয়। আসলে মঞ্চটি দশ ফুট কংক্রিটের দেয়াল বিশিষ্ট একটা ফাঁকা চোঙা।
হলঘরের পঁচিশটি চেয়ারে পঁচিশজন লোক বসে। ওদের দিকে তাকালে ওদের পোশাক, স্বাস্থ্য, চেহারা, গাম্ভীর্য ইত্যাদি বলে দেয়, ওরা সবাই রাশিয়ার এক একজন দিকপাল।
ওদের স্থির এবং সম্ভ্রমপূর্ণ দৃষ্টি মঞ্চের উপরে মঞ্চের শীর্ষদেশটার উপর নিবদ্ধ।
তাদের চোখের সামনে বরাবরের মতই একটা সোনালী সিংহাসন উঠে এল মঞ্চের শীর্ষে। সোনালী সিংহাসনে সোনালী বর্মে ঢাকা একজন মানুষ। মুখেও সোনালী মুখোশ।
সোনালী সিংহাসনটি মঞ্চ শীর্ষে উঠে আসার সাথে সাথে হলের চেয়ারে বসা সকলে উঠে ডান হাত সামনে বাড়িয়ে মাথা নিচু করল।
মঞ্চ শীর্ষ থেকে গমগমে দু’টি শব্দ বেরিয়ে এল, ‘বস তোমরা।’
মাথা নিচু করে বসল সবাই।
সেই কণ্ঠ আবার ধ্বনিত হলো। মঞ্চ শীর্ষ থেকে ভেসে এল কথা, ‘রাশিয়ার গর্বিত সন্তানগণ, আপনাদের মাধ্যমে সকলের প্রতি আমার শুভেচ্ছা।’
বলে একটু থামল। মুহূর্তকাল পরে গম গম করে উঠল সেই কণ্ঠ আবার। বলল, ‘গোয়েন্দা প্রধান মাজুরভ, আমাদের ‘অপারেশন প্যারিস প্রজেক্ট’ সম্পর্কে বলার জন্যে তোমাকে নির্দেশ দিচ্ছি।’
‘মহামান্য আইভান দীর্ঘজীবী হোন।’
বলে সামনের সারি থেকে উঠে দাঁড়ানো মাজুরভ একটা ঢোক গিলে আবার শুরু করল, ‘প্রিন্সেস ক্যাথারিন ও ফরাসী রাজপরিবারের সদস্য প্রিন্স প্লাতিনিকে মস্কো নিয়ে আসতে পারার সাফল্য বাদে আমাদের প্যারিস অপারেশন ব্যর্থ হয়েছে। রাজকীয় ডায়েরী ও রাজকীয় রিং-এর সন্ধান পেয়েও এবং কার কাছে আছে জেনেও তা উদ্ধার করতে আমরা ব্যর্থ হয়েছি। সেই লোককে তিন বার ধরেও আমরা আটকাতে পারিনি। সেখানে পাঠানো প্রায় পুরো জনশক্তি আমাদের ধ্বংস হয়ে গেছে মাত্র একজন লোককে মোকাবিলা করতে গিয়ে। আমরা সেখানে আক্রমণের পর্যায় থেকে আত্মরক্ষার অবস্থানে নেমে এসেছি। আহমদ মুসা প্রিন্সেস ক্যাথারিন ও মিঃ প্লাতিনিকে উদ্ধার করার জন্যে ইতোমধ্যেই রাশিয়া যাত্রা করেছে বলে আমরা জানতে পেরেছি।’ থামল মাজুরভ।
মঞ্চ থেকে সেই কণ্ঠ বেজে উঠল আবার। বলল, ‘আরও সফলতা আছে। গ্রেগরিংকো, উস্তিনভ, ম্যালেনকভ, মায়োভস্কির মত অপদার্থদের দেশে ফিরে আসতে হয়নি। ওদের জন্যে আমাদের কোন বুলেট খরচ করতে হয়নি।’ থামল কণ্ঠটি।
হলে চেয়ারে বসা সকলের মুখ ম্লান হয়ে গেল। গ্রেট বিয়ারের আইনে ব্যর্থতার কোন জায়গা নেই। মৃত্যুই এর একমাত্র মূল্য। চেয়ারে উপবিষ্ট সকলের ম্লান মুখে এই ছবিই ভেসে উঠেছিল।
মঞ্চ থেকে ভেসে আসা কণ্ঠ থামতেই মাজুরভ সামনের দিকে মাথা নুইয়ে বলে উঠল, ‘মহামান্য আইভান দীর্ঘজীবী হোন’।
সেই কণ্ঠ আবার। বলল, ‘ভ্লাদিমির খিরভ, তোমার পরিকল্পনা জানাও।’
সামনের সারির মাজুরভের পাশ থেকে উঠে দাঁড়াল একজন। মাথা নুইয়ে সামনের দিকে দেহটা একবার ঝুঁকিয়ে বলল, ‘মহামান্য আইভান, আমাদের এ প্রজেক্টের নাম ‘অপারেশন ফরচুন প্রজেক্ট’। সংক্ষেপে ওএফপি (OFP)। এর লক্ষ্য, প্রিন্সেস ক্যাথারিনকে সিংহাসনে বসিয়ে নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সরকারী প্রয়াস বানচাল করা এবং নতুন আইভানের নেতৃত্বে রাশিয়ায় সেই আইভানের গৌরব-যুগ আবার ফিরিয়ে আনা। এজন্যে এ প্রজেক্টের মূল কাজ হলো, প্রিন্সেস ক্যাথারিনকে হাতের মুঠোর মধ্যে রাখা এবং আহমদ মুসাকে হাতের মুঠোয় এনে রাজকীয় ডায়েরী ও রাজকীয় আংটি উদ্ধার করা।’ থামল ভ্লাদিমির খিরভ।
কথা শেষ করেও দাঁড়িয়ে থাকল। মঞ্চের সেই কণ্ঠ থেকে বসার নির্দেশ এলে তবেই সে বসল।
‘মাজুরভ, এবার তুমি বল।’ ধ্বনিত হল মঞ্চ থেকে সেই কণ্ঠ।
মাজুরভ উঠে দাঁড়িয়ে তার নিচু মাথা সামনের দিকে একটু ঝুঁকিয়ে বলল, ‘আমরা মনে করছি, আহমদ মুসা রাশিয়া যাত্রা করেছে। তবে আমরা জানতে পারিনি সে কোন পথে রাশিয়া আসছে। আমাদের অনুমান, সে আকাশপথ নয়, স্থলপথকেই নিরাপদ মনে করবে। যতদূর জানা গেছে, লুই প্রিন্সেস মারিয়া জোসেফাইন তার সাথে রয়েছেন। আহমদ মুসা ও মারিয়া জোসেফাইন রুশ অ্যাম্বেসি থেকে ভিসা নিয়েছে, কিন্তু কি নামে নিয়েছে, কি বেশে নিয়েছে তা আমরা জানতে পারিনি। তাদের ভিসার কোন দরখাস্ত দূতাবাসের ভিসা সেকশনে নেই। স্বয়ং রাষ্ট্রদূত তাদের ভিসা ইস্যু করেছেন এবং সমস্ত রেকর্ড তার কাছেই রয়েছে। আমাদের সূত্র মনে করেন যে, এমনও হতে পারে যে, তাদের কোন রেকর্ডই অ্যাম্বেসিতে রাখা হয়নি।’
‘তারপর?’ মাজুরভ থামার সাথে সাথেই মঞ্চ থেকে কণ্ঠটি ধ্বনিত হলো।
‘পোল্যান্ড, চেকোশ্লোভাকিয়া, হাংগেরী, রুমানিয়া সীমান্তের যে কোন পয়েন্ট দিয়ে তারা রাশিয়া প্রবেশ করতে পারে। সীমান্তেই যাতে তাদের ফাঁদে ফেলা যায়, এ জন্যে আমাদের লোকদের এবং মিত্র রুশ পুলিশ ও বন্ধু দেশের পুলিশদের আমরা সতর্ক করে দিয়েছি।’
‘বলে যাও।’ মাজুরভ থামতেই মঞ্চের সেই কণ্ঠ ধ্বনিত হল অনেকটা বজ্রপাতের মতো।
মাজুরভ আবার শুরু করল, ‘সরকারের তৎপরতার দিকে আমরা নজর রাখছি। তারা এখন নিশ্চিত, প্রিন্সেস ক্যাথারিন রাশিয়ায়। তারা তাদের গোয়েন্দা ও পুলিশ বাহিনীকে সর্বাত্মক অনুসন্ধানের নির্দেশ দিয়েছে। তাদের ধারণা, প্রিন্সেস ক্যাথারিনকে মস্কো অথবা লেনিনগ্রাডেই রাখা হয়েছে। তারা আরও নিশ্চিত হবার পর কম্বিং অপারেশনেও যেতে পারে।’
একটু থেমে একটা ঢোক গিলে আবার শুরু করল মাজুরভ। বলল, ‘মিঃ প্লাতিনিকে রাশিয়ায় নিয়ে আসায় তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে ফ্রান্সের সরকারী মহলে। ব্যাপারটা প্রকাশিত হলে জনগণের চাপে সরকার খারাপ অবস্থায় পড়বে। সুতরাং ফরাসী সরকার হুমকি দিচ্ছে, সত্বর তাকে মুক্তি না দিলে তারা রুশ সরকারকে জানানো ছাড়াও ইন্টারপোল ও জাতিসংঘের সাহায্য নেবে। আমরা তাদের বোঝাবার চেষ্টা করেছি যে, ফরাসী প্রিন্সকে খুবই সম্মানের সাথে রেখেছি। আহমদ মুসাকে আমাদের মুঠোয় আনার জন্যে আর কোন উপায় ছিল না বলেই সাময়িকভাবে তাকে আমাদের পণবন্দী করতে হয়েছে। কিন্তু তারা এসব কিছুই শুনতে রাজি নয়। তারা আমাদের পনের দিন সময় দিয়েছে। এর মধ্যে তাকে রিলিজ করতে হবে। আর ইতোমধ্যে মিঃ প্লাতিনিকে ফরাসী প্রধানমন্ত্রীর সাথে কথা বলতে দিতে হবে।’ থামল মাজুরভ।
‘এসবই তোমাদের ব্যর্থতার মাশুল। তোমরা এক ছোকরা আহমদ মুসাকে হাতের মুঠোয় আনতে ব্যর্থ হয়ে ধরে এনেছ এক ফরাসী বুড়ো ভদ্রলোককে।’
একটু থামল মঞ্চ থেকে ছুটে আসা কণ্ঠটি। পরক্ষণেই আবার গর্জন করে উঠল, ‘তোমরা বুড়োকে ঠাণ্ডা কর। পারলে তাকে রাজি করিয়ে তার পরিবারের জন্যে তার কাছ থেকে মেসেজ নাও যে, তিনি ভাল আছেন। সত্বরই দেশে ফিরবেন। দেখ, লক্ষ্যে পৌঁছার আগে এসব নিয়ে আমরা কোন ঝামেলায় পড়তে চাই না।’
মঞ্চের সিংহাসনটি নড়ে উঠল। সেই সাথে জ্বলে উঠল মঞ্চে একটা নীল বাতি।
মুহূর্তেই হলে চেয়ারে বসা সকলে যন্ত্রের মত উঠে দাঁড়াল। সকলে সমস্বরে বলে উঠল, ‘দীর্ঘজীবী হোন, মহামান্য আইভান।’
মঞ্চ থেকে সেই কণ্ঠ গম গম করে বেজে উঠল, ‘ দীর্ঘজীবী হোক রাশিয়া। দীর্ঘজীবী হোন রাশিয়ার মহান সন্তানরা। শুনে রাখ সবাই, ব্যর্থতা ও ব্যর্থ দু’টিই রাশিয়া ও রাশিয়ার মহান জনগণের শত্রু।’
তার কণ্ঠ থামার সাথে সাথেই সেই স্বর্ণ সিংহাসন হারিয়ে গেল মঞ্চের বুকে।
সবাই সার বেঁধে একে একে বেরিয়ে গেল হল থেকে।
হল থেকে বেরিয়েই গ্রেট বিয়ারের গোয়েন্দা প্রধান মাজুরভ অপারেশন ফরচুন প্রজেক্ট (OFP)-এর প্রধান ভ্লাদিমির খিরভকে কানে কানে বলল, ‘চলুন, মিঃ প্লাতিনির কাছে এখনি যেতে হবে।’
মিঃ খিরভ মাথা নেড়ে সায় দিল।
মাজুরভের পাশেই হাঁটছিল আরেকজন। সে মাজুরভকে লক্ষ্য করে বলল, ‘মিঃ মাজুরভ, আহমদ মুসাকে কি আমরা বেশি গুরুত্ব দিচ্ছি না?’
প্রশ্ন করল নিকোলাস বুখারিন। রুশ সেনাবাহিনীর সদ্য বরখাস্তকৃত প্রতিভাবান এক যুবক জেনারেল। চরমপন্থী আচরণের জন্যে তাকে সেনাবাহিনী থেকে বরখাস্ত করা হয়েছে। সেনাবাহিনীতে থাকাকালীন সময়েই সে গ্রেট বিয়ারের সক্রিয় কর্মী ছিল। এখন সে গ্রেট বিয়ারের শীর্ষ অপারেশন কমান্ডার।
প্রশ্ন শুনে হাসল মাজুরভ। বলল, ‘আমরা তাকে গুরুত্ব দিচ্ছি না। এই গুরুত্ব সে আদায় করে নিয়েছে।’
‘আমিও কিছু জানি তাকে। এই ধরনের গুরুত্বপূর্ণ তাকে মনে করাই তার মোকাবিলায় আমরা দুর্বল হয়ে পড়ার কারণ।’
‘আপনার এই মনোভাবকে আমি অভিনন্দিত করছি, কিন্তু সেই সাথে সাবধানও করছি। কাউকে ওভারএস্টিমেট করার মধ্যে ক্ষতি আছে, কিন্তু কাউকে আন্ডারএস্টিমেট করার ক্ষতি অনেক বেশি।’ বলল মাজুরভ।
‘এই নীতিকথা অবশ্যই স্মরণযোগ্য, কিন্তু একজন এশিয়ানকে আমরা খুব বেশি উপরে তুলেছি। ওখান থেকে তাকে নামাতে হবে।’
‘ধন্যবাদ নিকোলাস। একজন অপারেশন কমান্ডারের কাছ থেকে আমরা এটাই চাই। কিন্তু আবার বলি, আহমদ মুসার ব্যাপারে সাবধান।’ মাজুরভ বলল।
নিকোলাস বুখারিন তার দুই তর্জনী দুই কানে ঢুকিয়ে বলল, ‘দুর্বলতার সূচক এই কথাগুলো আমি শুনতে চাই না, মিঃ মাজুরভ।’
মাজুরভ হাসল। বলল, ‘দুর্বলতার কথা শুনে হজম করাই কিন্তু সবলতার লক্ষণ জেনারেল।’
‘একটা যুদ্ধের জন্যে যা সত্য, তা একজন ব্যক্তির ক্ষেত্রে সত্য করার প্রয়োজন নেই মিঃ মাজুরভ।’
‘ব্রাভো মিঃ নিকোলাস বুখারিন। এই ধরনের ডেসপারেট যোদ্ধাই আমাদের প্রয়োজন।’ বলল ভ্লাদিমির খিরভ।
কয়েক মুহূর্ত তিনজনই চুপচাপ।
নীরবতা ভাঙল নিকোলাস বুখারিন। বলল মাজুরভকে লক্ষ্য করে, ‘একটা অপ্রাসঙ্গিক প্রশ্ন জিজ্ঞেস করতে পারি?’
‘এখন আপনার জন্যে সব প্রশ্নই সংগত ধরে রাখুন।’ মাজুরভ বলল।
‘আমরা এখন কোন লক্ষ্যে কাজ করছি, দেশপ্রেমহীন বিদেশের ক্রীড়নক সরকারের পতন ঘটানো, না জারের গুপ্তধন দখল?’ প্রশ্ন করল নিকোলাস বুখারিন।
‘এখন প্রথম ও প্রধান লক্ষ্য জারের গুপ্তধন দখল। এই দখলের মাধ্যমে আমরা রাশিয়ায় নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্র চালু করে সরকারের শেষ রক্ষার প্রয়াসকে নস্যাৎ করতে চাই। এই গুপ্তধনের অর্থশক্তিই আমাদেরকে সাহায্য করবে রাশিয়ার জন্যে রাশিয়ার সরকার কায়েম করতে এবং গুপ্তধনের নকশার জন্যে চাই রাজকীয় আংটি এবং রাজকীয় আংটির জন্যে আহমদ মুসাকে।’
‘কিন্তু আমি বুঝতে পারছি না, আহমদ মুসাকে হাতে পেলেই কি রাজকীয় আংটি এবং ডায়েরী আমরা পেয়ে যাব? ওগুলো কি তিনি আমাদের দেবার জন্যে পকেটে করে নিয়ে আসছেন?’
‘তা হয়তো নিয়ে আসছেন না। কিন্তু কান টানলে মাথা আসার মত, আহমদ মুসা হাতে এলে জিনিসও হাতে এসে যাবে।’ বলল মাজুরভই।
‘তা আসতে পারে। কিন্তু সেটা হতে পারে প্যারিস থেকে নিয়ে আসার ব্যাপার। আমরা কেন আহমদ মুসাকে রাশিয়ায় টেনে নিয়ে আসছি। প্যারিসে তাকে এবং জিনিসগুলোকে একসাথে পাওয়া সহজ ছিল।’
‘সে চেষ্টা তো হয়েছে জেনারেল।’
‘কোন চেষ্টাকেই শেষ চেষ্টা বলা ঠিক নয়।’
‘তা ঠিক। কিন্তু ঘটনার সাথে লুই রাজপরিবার জড়িয়ে পড়ার পর ফ্রান্স আমাদের জন্যে নিরাপদ ছিল না। এ দিকটা আপনি নিশ্চয় স্বীকার করবেন।’
জেনারেল নিকোলাস বুখারিন কোন উত্তর দিল না। ভাবছিল সে। তার মুখ আগের চেয়ে এখন প্রসন্ন।
‘প্রশ্ন শেষ তো মিঃ নিকোলাস?’
বলল ভ্লাদিমির খিরভ হাসিমুখে নিকোলাসের দিকে তাকিয়ে।
‘জ্বি, আপাতত। এখন আসতে পারি স্যার?’ মাজুরভ ও খিরভের দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে বলল নিকোলাস।
‘গুড নাইট জেনারেল নিকোলাস।’ প্রায় একসাথেই বলে উঠল মাজুরভ এবং খিরভ।
মাজুরভ ও খিরভ গিয়ে একটা লিফটে প্রবেশ করল।
লিফট গিয়ে গ্রাউন্ড ফ্লোরে থামল।
লিফট থেকে বেরিয়ে মাজুরভ ও খিরভ বিশাল এক চত্বরে এসে দাঁড়াল। বিশালতার জন্যে চত্বর বলে মনে হয়, কিন্তু আসলেই এটা একটা হলরুম। দেখতে ডিম্বাকৃতি। হলের চারদিক ঘুরে ঘরের সারি। ডিম্বাকৃতি এই হলরুমের মাঝখানে লিফট কক্ষ। কক্ষটির চারদিকে চারটা লিফট। চারটা লিফটের তিনটির দরজা থেকে বেরুলেই লাল কার্পেটে গিয়ে পা পড়ে। লাল কার্পেটের তিনটি রাস্তা সোজা এগিয়ে সারিবদ্ধ ঘরের তিনটি করিডোরে গিয়ে প্রবেশ করেছে।
কিন্তু মাজুরভ ও খিরভ যে লিফট থেকে বাইরে বেরুল, সেখানে লাল কার্পেট নেই এবং সেই দরজা থেকে সোজা এগোলে ঘরগুলোর সারিতে কোন করিডোরও পাওয়া যায় না। কিন্তু পাওয়া যায় একটা বন্ধ দরজা।
মাজুরভ ও খিরভ লিফট থেকে বেরিয়ে চত্বরে মুহূর্তকালের জন্যে দাঁড়াল। চারদিকে একবার তাকাল। তারপর লিফটের দরজা থেকে নাক বরাবর সোজা এগোলো। দাঁড়াল গিয়ে বন্ধ দরজার সামনে।
সংগে সংগেই দরজা খুলে গেল।
দরজার পরেই ছোট্ট একটা কক্ষ। কক্ষের মাঝখানে একটা টেবিল। টেবিলের তিন দিকে ছয়টা চেয়ার।
ঘরে ঢুকে মাজুরভ ও খিরভ টেবিলের দু’পাশের দু’টি চেয়ারে গিয়ে বসল।
বসার সাথে সাথেই কক্ষের দরজা বন্ধ হয়ে গেল এবং গোটা কক্ষটি দ্রুত নিচে নামতে শুরু করল।
কক্ষটি এক জায়গায় গিয়ে স্থির হলো। সাথে সাথেই মাজুরভ ও খিরভ চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াল। সংগে সংগে খুলে গেল কক্ষের দরজা।
মাজুরভ ও খিরভ কক্ষ থেকে বেরিয়ে যেখানে পা রাখল, সেটা একটা প্রশস্ত করিডোর। সাদা কার্পেটে মোড়া।
করিডোর ধরে হাঁটছিল মাজুরভ ও খিরভ।
করিডোরটির একদম শেষ প্রান্তে আরেকটা প্রশস্ত করিডোর। উত্তর-দক্ষিণে প্রসারিত। এ করিডোরটির পূর্ব ধার ঘেঁষে পাঁচটি স্বতন্ত্র কক্ষ। কক্ষ না বলে এগুলোকে ভিআইপি স্যুট বলাই ভাল। বিশাল কক্ষের প্রত্যেকটিতে শয়নকক্ষ, ড্রইং ও ডাইনিং কক্ষ রয়েছে। রয়েছে প্রশস্ত বাথ।
পাঁচটি কক্ষের দক্ষিণ দিক থেকে দ্বিতীয় কক্ষের দরজার সামনে গিয়ে দু’জন দাঁড়াল।
দরজায় একদম মুখ বরাবর উঁচুতে একটা ডিজিটাল কী-বোর্ড।
মাজুরভ তর্জনী দিয়ে কী-বোর্ডের কয়েকটা পয়েন্টে নক করল।
খুলে গেল দরজা।
সুসজ্জিত কক্ষের একটা সুদৃশ্য চেয়ারে বসে প্লাতিনি। তার সামনে টেবিল। টেবিলে বেশ কিছু বই। একটা বই খোলা ছিল প্লাতিনির সামনে।
‘ভেতরে আসতে পারি প্রিন্স প্লাতিনি?’ বলল মাজুরভ।
দু’জনের পায়ের শব্দে ওদের দিকে ফিরে তাকিয়েছিল প্লাতিনি।
ওদের দেখেই মুখটা অপ্রসন্ন হয়ে উঠেছিল প্লাতিনির। কিন্তু মুখে হাসি টেনেই বলল, ‘আসুন।’
প্লাতিনিকে ধন্যবাদ দিয়ে টেবিলের সামনে দেয়াল বরাবর রাখা সোফায় বসে পড়ল মাজুরভ ও খিরভ।
বসেই মাজুরভ বলল, ‘সম্মানিত প্রিন্স, আমরা দুঃখিত, অন্যের পাপের খেসারত আপনাকে দিতে হচ্ছে।’
‘কার পাপের কথা বলছেন?’
‘কেন, আহমদ মুসার পাপেই তো আপনি বন্দী?’ মাজুরভই বলল।
‘আপনাদের প্রিন্সেসের দেয়া দায়িত্ব সে পালন করতে চাচ্ছে শত বিপদ মাথায় নিয়ে। দায়িত্ব পালন, সততা, ওয়াদা রক্ষা ইত্যাদি কি পাপ?’
‘সে অনাহুত বিদেশী। আমাদের ব্যাপারে হস্তক্ষেপ তার অন্যায়।’
‘সে অনাহুত নয়। আপনাদের ক্রাউন প্রিন্সেসের দ্বারা সে দায়িত্বপ্রাপ্ত।’
‘মান্যবর, খৃস্টান তথা পশ্চিমের শত্রু একজন ব্লাডি এশিয়ানের পক্ষে আপনার এই পক্ষপাতিত্ব লজ্জাকর। আমাদের সাহায্য করা আপনার কর্তব্য।’
‘মজলুমের পক্ষ নেয়া লজ্জার নয়। গৌরবের। সম্পদ আত্মসাতে সাহায্য করা কি বৈধ?’
‘আমরা দুঃখিত, আপনার অসুবিধা আপনি বাড়াচ্ছেন মিঃ প্লাতিনি। সাহায্য যদি না করেন, আপনার কন্যাও তাহলে আমাদের পণবন্দী হয়ে এখানে আসবে। সুন্দরী ফরাসী প্রিন্সেস রুশদের হাতে পড়া কি তার সম্মানের জন্যে মানানসই হবে?’
চমকে উঠে মিঃ প্লাতিনি তাকাল মাজুরভের দিকে। মিঃ প্লাতিনির শান্ত মুখে এবার কিছু উদ্বেগের চিহ্ন ফুটে উঠেছে।
হাসল মাজুরভ। বলল, ‘মিঃ প্লাতিনি, আপনি যতটা সম্মানের, আহমদ মুসার বাগদত্তা আপনার কন্যা আমাদের কাছে ততটা সম্মানের নয়।’
প্লাতিনি নিজেকে অনেকটা সামলে নিয়েছে। বলল, ‘এই ভয় দেখিয়ে আমার কাছে আপনারা কি চাচ্ছেন?’
‘আমরা যেভাবে বলব সেভাবে একটা চিঠি আপনি লিখবেন আপনার মেয়েকে উদ্দেশ্য করে। এই বিল্ডিং-এর একজন সুইপার আপনার টাকার লোভে চিঠিটি অতি গোপনে নিয়ে পৌঁছাবে ফরাসী দূতাবাসে।’
‘তারপর?’
‘তারপর আপনার জানার আর কিছু নেই।’
‘তারপরের কথা আমি বলছি। আমার চিঠি পেয়ে আমার দেয়া ঠিকানায় ছুটে আসবে আমার মেয়ে এবং আপনারা তাকে পণবন্দী করবেন।’
‘বলেছি তো, এই সহযোগিতা করলে আপনার মেয়ের গায়ে আমরা হাত দেব না। আপনার মেয়ে আমাদের শত্রু নয়, শত্রু আমাদের আহমদ মুসা।’
প্লাতিনি চিন্তা করল। ভাবল, আহমদ মুসার জন্যে এ ধরনের চিঠিতে কোন ক্ষতি-বৃদ্ধি আছে কিনা? এ চিঠির মন্দ দিক তো পরিষ্কার, কিন্তু কোন ভাল দিকও আছে কিনা। অনেক ভাবনার পর সে বলল, ‘চিঠি কাল নিয়ে আসবেন, লিখে দেব।’
‘ধন্যবাদ প্রিন্স।’ বলে মাজুরভ ও খিরভ উঠে দাঁড়াল।
বেরিয়ে এল তারা ঘর থেকে।
লিফট দিয়ে উঠতে উঠতে খিরভ বলল, ‘তার মেয়েকে পণবন্দী করার ভয় দেখানোতে কাজ হয়েছে। এখন শিকার ফাঁদে পড়লেই হয়।’
‘ফাঁদে পড়তেই হবে। ফরাসী দূতাবাসে চিঠিটা পৌঁছার সাথে সাথে ফ্যাক্সে তা চলে যাবে প্যারিসে ডোনা জোসেফাইনের কাছে। আর ডোনা জোসেফাইন পেলে সংগে সংগেই তা সে জানাবে আহমদ মুসাকে।’
হাসল খিরভ। হাসল মাজুরভও।

ক্রেমলিনে প্রধানমন্ত্রীর কক্ষ।
প্রধানমন্ত্রী কেরনস্কী জুনিয়র এবং কেজিবি প্রধান মার্শাল জুকভ এক টেবিলে মুখোমুখি বসে।
কথা বলছিল মার্শাল জুকভ।
‘না, আমি মনে করি, প্রিন্সেস ক্যাথারিনের উদ্ধার এবং রাশিয়ায় নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্র ঘোষণার কাজ আমরা শিডিউল অনুসারে মার্চেই করতে পারবো।’
‘কিন্তু ‘মনে করি’ বলছেন, নিশ্চিত নয় কেন? এখানেই আমার উদ্বেগ।’ বলল প্রধানমন্ত্রী কেরনস্কী জুনিয়র।
মার্শাল জুকভ হাসল। বলল, ‘ঈশ্বরের জন্যে কিছু রেখেছি। বিষয়টা সম্ভবের মধ্যে না থাকলে ‘মনে করি’ বলতাম না। কোন সন্দেহ নেই, প্রিন্সেস ক্যাথারিনকে এখন হয় মস্কোতে, না হয় সেইন্ট পিটার্সবার্গে রাখা হয়েছে। আর আহমদ মুসার কাছে রাজকীয় রিং ও ডায়েরী রয়েছে, সেটাও জানা গেছে। এবং আহমদ মুসা ক্যাথারিনের সন্ধানে রাশিয়া এসেছে, সেটা আমাদের প্যারিস দূতাবাস জানিয়ে দিয়েছে।’
‘আহমদ মুসা আমাদের জন্যে সমস্যা নয়। ক্যাথারিনকে আমরা হাতে পেলে, ঐ জিনিসগুলো ক্যাথারিনের হাতে আসবে এবং তার মাধ্যমে আসবে আমাদের হাতে। সুতরাং ক্যাথারিনকে উদ্ধার করাটাই আসল বিষয়। সে ব্যাপারে বল।’
‘এজন্যে আমরা দেশব্যাপী জাল পেতেছি। কিন্তু সত্য বলতে কি, গ্রেট বিয়ার একটা অতি দক্ষ, কুশলী এবং হিংস্র সংগঠন। আমাদের প্রশাসন, পুলিশ, এমনকি সেনাবাহিনীতেও ওদের লোক আছে। বেশ কিছুকে চিহ্নিতও আমরা করেছি। তাদের অনেককে ডাবল এজেন্ট হিসেবে ব্যবহার করছিলাম। কিন্তু দুর্ভাগ্য, সকলেরই অপঘাতে মৃত্যু হয়েছে। আমরা মনে করছি, গ্রেট বিয়ারের কাছে তারা ধরা পড়ে যায় এবং সে কারণেই তারা নিহত হয়। আমরা আমাদের লোকদের আরও সাবধান করেছি। কিন্তু ভীষণ সাবধান ওরা। বার বার ওদের কাছাকাছি হয়েও আমরা ওদের গায়ে হাত দিতে পারছি না।’
‘নিশ্চয় আপনাদের পরিকল্পনা পাচার হয় কোন রকমে। প্যারিসে মায়োভস্কি আমাদের এক ইঞ্চি এগোতে দেয়নি। এমন মায়োভস্কি নিশ্চয় আরও আছে।’
‘আমি আপনার সাথে একমত স্যার। আমরা তাদেরও সন্ধান করছি। কিন্তু সমস্যা হলো, গ্রেট বিয়ারের চরম জাতীয়তার শ্লোগান বিশেষ করে তরুণদের খুবই আকৃষ্ট করছে।’
‘জানি আমি। বিকৃতি কোন সময়ই সুস্থতাকে অতিক্রম করে না। স্বীকার করতে হবে, অযোগ্যতাই আমাদের বড় বাঁধা। পাভেলের রিপোর্টে দেখলাম, একা এক মানুষ আহমদ মুসা তিনবার ওদের ঘাঁটিতে প্রবেশ করেছে এবং গুঁড়িয়ে দিয়েছে গ্রেট বিয়ারের সেখানকার শক্তিকে। চিন্তা করতে বিস্ময় লাগে, গ্রেট বিয়ারের প্যারিস অপারেশনে যাওয়া কোন নেতাই বাঁচেনি।’
‘আপনার সাথে আমি একমত স্যার। আহমদ মুসার তুলনা শুধু আহমদ মুসাই। কিছু দিন আগে সেন্ট্রাল এশিয়াতেও গ্রেট বিয়ারের সাথে আহমদ মুসার লড়াই হয়েছে। সে লড়াইতেও আহমদ মুসা মধ্য এশিয়ার গ্রেট বিয়ারকে ধ্বংস করেছিল। সবচেয়ে ভাল হতো যদি তাকে আমরা ব্যবহার করতে পারতাম।’
‘আমাদের রাষ্ট্রদূত পাভেল তো সে চেষ্টা করেছিল, কিন্তু সে আমাদের কথায় আসেনি।’
‘এরপরও রাশিয়ায় এসে সে যা করবে তা আমাদের সাহায্যেই আসবে। তাকে অনুসরণ করলেও আমাদের কাজ অনেক সহজ হয়ে যেতে পারে। এক ঢিলে দুই পাখি মারার সুযোগ হতে পারে। গ্রেট বিয়ার ও আহমদ মুসা দু’পক্ষেরই একসাথে সর্বনাশ আমাদের জন্যে লাভজনক।’
‘ঠিকই বলেছেন। প্রিন্সেস ক্যাথারিনের সাথে আহমদ মুসার সাক্ষাৎ ভিন্ন কোন পরিস্থিতির সৃষ্টি করতে পারে।’
‘প্রিন্সেস তাতিয়ানার সাথে আহমদ মুসার প্রেম আপনার যু্ক্তিকে সমর্থন করছে স্যার।’
‘পাভেলের রিপোর্ট অনুসারে বন্দী অবস্থায় প্রিন্সেস ক্যাথারিনের সাথে আহমদ মুসার এ পর্যন্ত দু’বার সাক্ষাৎ হয়েছে। প্রিন্সেস ক্যাথারিনের এ বিশ্বাস হওয়া স্বাভাবিক, আহমদ মুসাই একমাত্র তাকে উদ্ধারের জন্যে আন্তরিকভাবে চেষ্টা করছে।’
‘ঠিক স্যার।’
‘সুতরাং আপনি ঠিকই বলেছেন, গ্রেট বিয়ার ও আহমদ মুসাকে একসাথে আমাদের সামনে থেকে সরিয়ে দেয়ার মধ্যেই আমাদের লাভ।’
‘কাজটা সহজ হবে না।’
‘তা তো বটেই। তবে সুবিধা হলো, আহমদ মুসা এখানে কোন গ্রাউন্ড সাপোর্ট পাবে না। মধ্য এশিয়ার তুর্কি কমিউনিটির লোক ছাড়া তাকে সাহায্য করার কেউ নেই। এদের সংখ্যা খুবই নগণ্য। চোখ রাখতে হবে এদের উপর। আহমদ মুসার লোকেশন ডিটেক্ট করার জন্যেও এটা প্রয়োজন।’
‘আপনার পরামর্শ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমরা এদিকে লক্ষ্য রাখব।’
‘তবে মার্শাল জুকভ, প্রিন্সেস ক্যাথারিনকে উদ্ধারের মুহূর্ত পর্যন্ত আমাদেরকে খুব সন্তর্পণে এগোতে হবে।’
‘আমরা এ ব্যাপারে সতর্ক স্যার।’
জেনারেল জুকভের কথা শেষ হতেই ইন্টারকমে প্রধানমন্ত্রীর পিএস-এর গলা শোনা গেল। বলল, ‘স্যার, জরুরী একটা ফাইল এসেছে।’
‘পাঠাও।’ নির্দেশ দিল প্রধানমন্ত্রী কেরনস্কী জুনিয়র।
বলে কেরনস্কী জুনিয়র তার বাম পাশের কম্পিউটার স্ক্রীনের দিকে তাকাল। তারপর প্রিন্টারের একটা বোতামে নক করল।
সংগে সংগেই বেরিয়ে এল কাগজের একটা লম্বা শীট।
শীটটির উপর একবার নজর বুলিয়ে তা এগিয়ে দিল মার্শাল জুকভের দিকে।
মার্শাল জুকভও কাগজটির উপর নজর বোলাতে লাগল।
‘গ্রেট বিয়ার পাগল হয়ে উঠেছে আহমদ মুসাকে ধরার জন্যে।’ বলল প্রধানমন্ত্রী কেরনস্কী জুনিয়র।
কাগজ থেকে মুখ তুলে মার্শাল জুকভ বলল, ‘তাই তো দেখছি। আহমদ মুসার মত দেখতে বলেই নিশ্চিত না হয়ে একটি দম্পতিকে হত্যা করে ফেলল?’
‘হত্যা করার লক্ষ্য অবশ্যই ছিল না। কিন্তু স্বীকারোক্তি করাতে গিয়ে ব্যর্থ হওয়ার রাগে প্রথমে হত্যা করে স্ত্রীকে। তাতেও স্বীকারোক্তি না করায় লোকটির উপর যে নির্যাতন চলে তাতেই সে মারা যায়।’
‘বোঝা যাচ্ছে, পথেই আহমদ মুসাকে পাকড়াও করার জন্যে গ্রেট বিয়ার সর্বাত্মক জাল ফেলেছে। আহমদ মুসা ওদের হাতে গেলে যথাসময়ে লক্ষ্যে পৌঁছা আমাদের জন্যে যেমন কঠিন হবে, তেমনি জারের ধনভাণ্ডার উদ্ধারের চাবিকাঠি গ্রেট বিয়ারের হাতে চলে যাবে। যার ফলে জগতের শ্রেষ্ঠ ধনভাণ্ডার চিরতরে আমাদের হাতছাড়া হয়ে যেতে পারে।’
‘ফ্রান্স থেকে রাশিয়ামুখী সকল পথের উপর আমাদের প্রহরা গ্রেট বিয়ারের চেয়ে অনেক বেশি নিশ্ছিদ্র করে তুলতে হবে। আহমদ মুসাকে ওদের হাতে পড়তে দেয়া যাবে না। ওকে বন্দী করে রয়্যাল রিং এবং রয়্যাল ডায়েরী রক্ষা করতে হবে গ্রেট বিয়ারের হাত থেকে।’
প্রধানমন্ত্রী কেরনস্কী জুনিয়রের কথা শেষ হতেই তার ইন্টারকম আবার কথা বলে উঠল। কথা বলছে তার পিএস, ‘স্যার, আরেকটা ফাইল এসেছে। পাঠিয়েছেন প্যারিস থেকে রাষ্ট্রদূত পাভেল।’
‘হ্যাঁ। ওর কাছ থেকে একটা জরুরী মেসেজ আসার কথা। ও, কে।’
বলে প্রধানমন্ত্রী কেরনস্কী জুনিয়র কম্পিউটারের দিকে ঘুরল। কম্পিউটারে ফাইল কন্ডিশন দেখে নিয়ে ফাইলের একটা প্রিন্ট বের করে নিল।
দ্রুত চোখ বোলাল কাগজের শীটটার উপর। বলল মার্শাল জুকভকে লক্ষ্য করে, ‘আহমদ মুসার যে ছবি আমাদের কাছে আছে এবং ভিডিও-তে দেখা গেছে, সেই ছবিতেই সে ভিসা নিয়েছে।’
‘সাংঘাতিক দুঃসাহসী লোক সে। তার অজানা নয় যে, তার এই ছবি গ্রেট বিয়ার এবং আমাদের কাছে রয়েছে। নামও কি ঠিক রেখেছে ভিসায়?’ বলল জুকভ।
‘না। ‘আবদুল্লাহ’ নামে নিয়েছে।’
‘প্রবেশ পথ সম্পর্কে কি বলেছে?’
‘স্থল ও বিমান দুই-ই রেখেছে।’
‘তার উচ্চতা?’
‘পাঁচ ফিট আট ইঞ্চি।’
‘ওজন?’
‘একশ পঁচিশ পাউন্ড।’
‘এসব গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দূতাবাস থেকে প্রকাশ হয়ে পড়বে, সেটা তো অবশ্যই সে জানত।’
‘অবশ্যই জানার কথা।’
‘আহমদ মুসার মত লোক কি এত বড় দুর্বলতা নিয়ে রাশিয়া প্রবেশ করতে আসছে?’
‘ভিসা যখন নিয়েছে, তখন তো এর বিকল্প নেই।’
‘হতে পারে ভিসা নেয়াটা তার লোক দেখানো।’
‘অর্থাৎ সে ভিসা ব্যবহার করবে না মনে করছেন?’
‘আমার তা-ই মনে হয়। তার ছবি আমাদের ও গ্রেট বিয়ারের হাতে আছে জানার পর সে পাসপোর্ট ব্যবহার করবে বলে মনে হয় না।’
‘যদি তাই হয়, যদি সে ছদ্মবেশ নিয়ে সীমান্ত ক্রস করে, তাহলে তার সম্পর্কে পাওয়া তথ্যগুলো আমাদের উপকারে আসবে।’
বলে প্রধানমন্ত্রী কেরনস্কী জুনিয়র কাগজের শীটটি মার্শাল জুকভের হাতে তুলে দিয়ে বলল, ‘দেখুন, এতে আরও কিছু তথ্য আছে। এগুলো সর্বত্র আমাদের লোকদের জানিয়ে দিন।’
‘অবশ্যই স্যার।’ বলে কাগজের শীটটি হাতে নিয়ে বলল, ‘এখন উঠতে পারি স্যার?’
‘এস।’
উঠে দাঁড়িয়ে হ্যান্ডশেইক করে বিদায় জানাল মার্শাল জুকভকে প্রধানমন্ত্রী কেরনস্কী জুনিয়র।

তাল্লিন বিমানবন্দর। তাল্লিন এস্টোনিয়ার রাজধানী।
ফিন উপসাগরের তীরে দাঁড়ানো তাল্লিন একগুচ্ছ সাদা গোলাপের মত সুন্দর ও স্নিগ্ধ শহর।
লাউঞ্জের জানালা দিয়ে ফিন উপসাগরের দিকে এক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকা পেত্রভ বলল, ‘এই তাল্লিন আবার রাশিয়ার হবে শেখভ। রাশিয়ার কু-সন্তানরা এদের স্বাধীনতা দেয়ার নামে রাশিয়ার অঙ্গচ্ছেদ করেছে।’
‘যদি আমাদের আইভান দি টেরিবল ক্ষমতায় আসে তাহলেই।’ বলল শেখভ।
‘তাতো বটেই। কেরনস্কীর উত্তরসূরী কেরনস্কী জুনিয়রদের গণতন্ত্র শুধু রাশিয়াকে ধ্বংস করার জন্যেই। রুশ সাম্রাজ্য থেকে পনেরটি অংশ আগেই বিচ্ছিন্ন হয়েছে। চেচনিয়াও গেল। তারপর আরও যাবে। সুতরাং…।’
কথা শেষ না করেই থেমে গেল পেত্রভ। হেলসিংকি থেকে আসা একটা বিমান ল্যান্ড করছিল তাল্লিন বিমানবন্দরে। সে দিকেই চোখ গিয়েছিল তার।
পেত্রভ এবং শেখভ দু’জনেই গ্রেট বিয়ারের গোয়েন্দা অফিসার। ওরা মোতায়েন ছিল তাল্লিনে। মস্কোর গ্রেট বিয়ার হেডকোয়ার্টারের নির্দেশে ওরা দু’জনেই যাচ্ছে মিনস্কে। মিনস্ক থেকে পেত্রভ যাবে ব্রাডনো এবং শেখভ যাবে বিরেস্টে। দু’টিই পোল্যান্ড বর্ডারে রাশিয়ার সীমান্ত শহর। যতগুলো রেল ও সড়ক পথে আহমদ মুসা রাশিয়া প্রবেশের চিন্তা করতে পারে, তার মধ্যে এ দু’টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মধ্য ইউরোপীয় অঞ্চল থেকে মস্কো পৌঁছবার এ দু’টিই সবচেয়ে সংক্ষিপ্ত পথ। গ্রেট বিয়ার কর্তৃপক্ষ এ দু’টি প্রবেশ পথে তাদের শক্তি বৃদ্ধির জন্যেই তাদেরকে সেখানে পাঠাচ্ছে।
সময়ের ঘণ্টা দুয়েক আগে তারা বিমানবন্দরে এসেছে তাদের সামরিক বসকে অভ্যর্থনা জানাতে। গ্রেট বিয়ারের শীর্ষ অপারেশন চীফ নিকোলাস বুখারিন আসছে হেলসিংকি থেকে তাল্লিনে এস্টোনিয়ার গোয়েন্দা চীফের সাথে কথা বলার জন্যে। গ্রেট বিয়ার এস্টোনিয়ার গোয়েন্দা বিভাগের সহযোগিতা চায় আহমদ মুসার উপর চোখ রাখার জন্যে। পেত্রভ ও শেখভ বুখারিনকে স্বাগত জানাবার পর তারা মিনস্ক যাত্রা করবে।
যাত্রীরা ইমিগ্রেশন এরিয়া থেকে ডিপারচার লাউঞ্জে বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে।
বেরিয়ে এল নিকোলাস বুখারিন।
পেত্রভ ও শেখভ এগিয়ে গিয়ে স্যালুট দিল বুখারিনকে। বলল, ‘ওয়েলকাম জেনারেল।’
‘আপনাদের প্লেনের কত দেরি?’ জিজ্ঞেস করল বুখারিন।
‘অনেক সময় আছে। এখনও দেড় ঘণ্টার মত বাকি।’ বলল পেত্রভ।
‘চল, আমরা একটু বসি। কথা আছে।’ বলে বুখারিন লাউঞ্জের একটা সোফার দিকে এগোলো।
বুখারিন ও শেখভ আগেই গিয়ে বসেছিল সোফায়। পেত্রভও বসল বুখারিনের পাশে। বসে সামনের দিকে চাইতেই একজন যাত্রীকে দেখে তার উপর তার চোখটা আঠার মত আটকে গেল। মুহূর্ত কয়েক চেয়েই ভূত দেখার মত আঁৎকে উঠল পেত্রভ। সে দেখল, ছোট্ট একটি ব্রিফকেস হাতে আহমদ মুসা তাদের সামনে দিয়ে চলে যাচ্ছে ডিপারচার ডোরের দিকে।
বিস্ময়ে হা হয়ে যাওয়া মুখ নিয়ে কখন যেন উঠে দাঁড়িয়েছিল পেত্রভ।
বুখারিন ও শেখভ অবাক হয়ে পেত্রভের দিকে তাকাল। বলল, ‘কি ব্যাপার, পেত্রভ?’
ধপ করে বসে পড়ল পেত্রভ সোফায়। ওদের দু’জনের দিকে একটু ঝুঁকে পড়ে বলল, ‘ঐ যে আহমদ মুসা যায়।’
বলে অঙ্গুলি নির্দেশ করল একজন যাত্রীর প্রতি।
শেখভ ও বুখারিন দু’জনই শক খাওয়া মানুষের মত চমকে উঠে তাকাল লোকটির দিকে। তার উপর নজর পড়তেই তারা দু’জন বিস্ময়ে ‘থ’ হয়ে গেল। যাকে ধরার জন্যে রাশিয়ার গোটা সীমান্ত অঞ্চল তারা চষে বেড়াচ্ছে, সেই আহমদ মুসা এত কাছে!
‘ঠিক বলেছ পেত্রভ। ছবির সাথে ঠিক মিলে যাচ্ছে। সন্দেহ নেই, এ আহমদ মুসাই।’ চাপা উত্তেজিত কণ্ঠে বলল নিকোলাস বুখারিন।
‘ঠিক। চলুন ওকে পাকড়াও করি।’ দ্রুত কণ্ঠে বলল শেখভ।
‘না, এখানে নয়। চল ওকে ফলো করি। লাউঞ্জ থেকে বেরোনোর পর ওকে পাকড়াও করতে হবে। গাড়ি রেডি তো?’
‘রেডি।’
তিনজনেই উঠল। যাত্রীদের সাথে মিশে আহমদ মুসার তিন দিক ঘিরে ওরা চলতে লাগল।
লাউঞ্জ থেকে বেরিয়ে আহমদ মুসা সবে তার হাতের ব্রিফকেসটা মাটিতে রেখে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে পেছন ফিরতে গেছে, অমনি পেত্রভ ও শেখভ দু’পাশ থেকে দু’জন তার পাশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে রিভলভারের নল পাঁজরে চেপে ধরল। পেত্রভ দ্রুত কণ্ঠে বলল, ‘সামনে এগোও আহমদ মুসা, কোন চালাকির চেষ্টা করো না।’
আহমদ মুসা তাদের দিকে তাকালোও না। বললো, ‘নিজেদের আস্থা এত দুর্বল কেন? দুই পাঁজরে দুই রিভলভারের পাহারা নিয়ে কোন চালাকি করা যায় না।’ আহমদ মুসার কণ্ঠ একদম স্বাভাবিক এবং ঠোঁটে হাসি।
নিকোলাস বুখারিন পাশেই দাঁড়িয়েছিল। সে বিস্মিত হয়ে তাকাল আহমদ মুসার মুখের দিকে। ভাবল সে, পাগল নাকি লোকটা! তার মুখ দেখে মনে হচ্ছে, বিপদটা যেন তার নয়, আমাদের।
কথা শেষ করেই আহমদ মুসা ব্রিফকেসটা তুলে নিয়ে হাঁটতে শুরু করেছে।
গাড়িতে উঠল ওরা।
আগে থেকেই ড্রাইভিং সিটে বসা ছিল একজন। নিকোলাস বুখারিন উঠে বসল সামনের সিটে, ড্রাইভিং সিটের পাশে। আর পেছনের সিটে আহমদ মুসাকে মধ্যে বসিয়ে দু’পাশে বসল পেত্রভ ও শেখভ। তাদের দু’টি রিভলভার আহমদ মুসার দিকে তাক করা।
গাড়িতে বসেই ড্রাইভারের দিকে তাকিয়ে নির্দেশ দিল নিকোলাস বুখারিন, ‘সোজা সেইন্ট পিটার্সবার্গ (লেনিনগ্রাড) হয়ে মস্কো।’
গাড়ি স্টার্ট নিল।
‘কেমন লাগছে আহমদ মুসা? তুমি যে ছদ্মবেশ নাওনি, এজন্যে ধন্যবাদ।’ পেছন দিকে মুখ ফিরিয়ে আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে বলল নিকোলাস বুখারিন।
‘ছদ্মবেশ নিলে আপনাদের হাতে বন্দী হওয়ার সুযোগ কি করে পেতাম?’ খুব সহজ কণ্ঠে বলল আহমদ মুসা।
ভ্রু কুঞ্চিত হলো নিকোলাস বুখারিনের। মুখ ফিরিয়ে সে আহমদ মুসার দিকে একবার চাইল। তারপর বলল, ‘তার মানে ইচ্ছা করেই আমাদের হাতে ধরা দিয়েছ?’
‘অর্থ তা-ই দাঁড়ায়।’ বলল আহমদ মুসা।
‘কিন্তু কেন?’
‘আপনাদের কোথায় খুঁজতাম, কি করে খুঁজে পেতাম?’
‘ঠিক বলনি। তোমার নার্ভ খুব শক্ত। কথা সাজাচ্ছ তুমি।’
‘যদি তা-ই হয়, ছদ্মবেশ না নেয়ার কি কারণ থাকতে পারে বলুন?’
‘কিন্তু আমাদের সাক্ষাৎ পেয়ে ধরা তো পড়লে। জান তো গ্রেট বিয়ার শত্রুদের কি করে, বিশেষ করে তোমার মত শত্রুদের?’
‘প্রতিদ্বন্দ্বী দুই শত্রুর দু’জনই জেতে না। জেতে যে কোন একজন। এবার তোমরা জিতেছ।’
‘তারপর?’
‘সেটা ভবিষ্যতই বলবে।’
‘না, আমরা বলব।’
বলে নিকোলাস বুখারিন তার রিভলভারটা আহমদ মুসার দিকে তাক করে বলল, ‘এখনই এ রিভলভার কথা বলতে পারে এবং তোমার জীবন এখানেই সাঙ্গ হয়ে যেতে পারে।’
‘না, তোমার রিভলভার কথা বলতে পারে না। আমাকে হত্যা করার ক্ষমতা তোমার নেই, তোমাদের কারও নেই এই মুহূর্তে। আমাকে হত্যা করার চেয়ে রাজকীয় আংটি ও রাজকীয় ডায়েরী তোমাদের বেশি প্রয়োজনীয়।’
নিকোলাস বুখারিনের মুখটা মুহূর্তেই ম্লান হয়ে গেল। একটা জ্বলন্ত সত্য তার সামনে এসে দাঁড়াল। রাজকীয় আংটি এবং রাজকীয় ডায়েরী তাদের কাছে যতটা মূল্যবান, ততটা মূল্যবান এখন আহমদ মুসার জীবন তাদের কাছে। ও দু’টি জিনিস পাওয়ার আগে আহমদ মুসাকে তারা মরতে দিতে পারে না। বলল নিকোলাস বুখারিন, ‘এটাই তাহলে এখন তোমার শক্তির উৎস?’
‘হ্যাঁ, বলটা আমার কোর্টে। খেলাটা আমার এখতিয়ারে।’
‘কিন্তু তুমি আমাদের বন্দী। রাজকীয় আংটি এবং রাজকীয় ডায়েরী এখন আমাদের হাতের মুঠোয়। একদিকে তোমার জীবন রক্ষা, অন্যদিকে ও দু’টো জিনিস আমাদের হাতে তুলে দেয়া- এ দু’টির মধ্যে তুমি তোমার জীবনটাকেই বেছে নেবে নিশ্চয়। সুতরাং বলটা আমাদের কোর্টেই।’
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘আর আমি যদি একটা নয়, দু’টোকেই বেছে নেই?’
‘তার মানে তুমি বেঁচে যাবে এবং রাজকীয় আংটি ও ডায়েরীও দেবে না?’
‘হ্যাঁ, তা-ই।’
হাসল নিকোলাস বুখারিন। বলল, ‘কিছু সাফল্যের ঘটনা তোমাকে অতি আশাবাদীই শুধু নয়, অহংকারীও করে তুলেছে।’
‘অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই-এ বিজয়ের চিন্তা অহংকার নয়, খুবই স্বাভাবিক একটা মানবিক চিন্তা।’
‘অন্যায় তুমিই করেছ। আমাদের নিজেদের ব্যাপারে তুমি নাক গলিয়েছ।’
‘হাস্যকর কথা বলছ তুমি। তোমরা এবং গোটা রাশিয়া জানে, তাতিয়ানা ছিলেন ক্রাউন প্রিন্সেস। ক্রাউন প্রিন্সেস হিসেবে তিনি যে দায়িত্ব আমাকে দিয়েছেন, সেটা পালনে আমাকে বাঁধা দিয়ে তোমরা অন্যায় করছ। এবং সেটা তোমরা করেছ কোন জাতীয় বা জনগণের স্বার্থে নয়, জঘন্য ধরনের লোভের বশবর্তী হয়ে।’
গাড়িটি অনেকক্ষণ এস্টোনিয়ার রাজধানী তাল্লিন নগরী পেরিয়ে এসেছে। চলছে এখন উঁচু-নিচু টিলায় ভরা প্রান্তরের মধ্যে দিয়ে। টিলাগুলোতে পরিকল্পিত ফলের বাগান এবং মাঠে সবুজ ফসল।
আহমদ মুসার কথা শেষ হতেই জ্বলে উঠেছিল নিকোলাস বুখারিনের চোখ। উত্তেজনায় কাঁপছিল তার ঠোঁট। আহমদ মুসার কথার তৎক্ষণাৎ সে জবাব দিল না।
গাড়ির কিছুটা পেছনে একটা হর্ন বেজে উঠল।
হর্ন শুনেই উৎকর্ণ হয়ে উঠল আহমদ মুসা। তার চোখে-মুখে আনন্দের একটা বহিঃপ্রকাশ দেখা গেল।
নিকোলাস বুখারিনের ক্রুদ্ধ কণ্ঠে ধ্বনিত হলো, ‘তোমার অহংকার সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে আহমদ মুসা। ঠিকই বলেছ, তোমাকে হত্যা করতে পারি না, কিন্তু তোমাকে ল্যাংড়া, নুলো তো করতে পারি।’
বলে নিকোলাস তার রিভলভার ঘুরিয়ে নিচ্ছিল আহমদ মুসার দিকে।
ঠিক এ সময়েই ঘনতালে তিনটি হর্ন ভেসে এল পেছন থেকে।
সাথে সাথেই আহমদ মুসার দু’টি হাত শক্ত হয়ে উঠল।
পেছনের শেষ হর্নটির শব্দ মিলিয়ে যাবার সাথে সাথেই পেছন থেকে একটা গুলির শব্দ হলো এবং সামনের টায়ার বার্স্ট হয়ে সামনে হুমড়ি খেয়ে পড়ল গাড়িটি।
ট্রিগার টিপেছিল নিকোলাস বুখারিন। কিন্তু টায়ারে গুলি খেয়ে গাড়ির পেছনটা লাফিয়ে উঠলে গুলি লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে তা বিদ্ধ করেছিল পেত্রভকে।
আর গাড়ি উল্টে যাওয়ার আগেই আহমদ মুসা হুমড়ি খেয়ে পড়া শেখভের হাতের রিভলভার ছিনিয়ে নিয়েছিল।

তাল্লিন বিমানবন্দরে লাউঞ্জের যাত্রী সারিতে ডোনা জোসেফাইন আহমদ মুসার পেছনে ছিল। মাঝখানে কয়েকজন যাত্রী।
এটা ছিল আহমদ মুসারই পরিকল্পনা। প্যারিস থেকে বের হবার পর আহমদ মুসা ও ডোনা পাশাপাশি চলেনি, হোটেলের এক কক্ষে থাকেনি। চলার সময় আহমদ মুসা আগে থেকেছে। ডোনা জোসেফাইন বেশ পেছনে পেছনে চলেছে। হোটেলেও পাশাপাশি কক্ষে তারা ঘুমিয়েছে। এর দ্বারা আহমদ মুসা দু’টো জিনিস চেয়েছে। এক. ডোনা জোসেফাইনকে সন্দেহের বাইরে রাখতে এবং দুই. ডোনা জোসেফাইনকে দ্বিতীয় প্রতিরক্ষা লাইন হিসেবে ব্যবহার করতে।
ডোনা জোসেফাইন পেছন থেকে চোখ রেখেছিল আহমদ মুসার উপর। হঠাৎ তিনজন রুশকে আহমদ মুসার পেছনে এসে অবস্থান নিতে এবং তাদের চোখ-মুখের ভাব দেখে ডোনার মনে আশংকার সৃষ্টি হলো। তারপর যখন আহমদ মুসা ওদের দ্বারা ঘেরাও, তখন ডোনার বুঝতে বাকি রইল না যে, নিশ্চয় ঐ তিনজন রুশ গ্রেট বিয়ার কিংবা রুশ সরকারের লোক।
আহমদ মুসাকে ওরা গাড়িতে তোলার পর ডোনা ছুটোছুটি করল গাড়ির জন্যে। রেডি কোন গাড়ি হাতের কাছে পেল না। যা ছিল যাত্রীরা নিয়ে নিয়েছে। এখন হয় দু’এক মিনিট ওয়েইট করতে হয়, নয়তো পার্কিং-এ গিয়ে গাড়ি জোগাড় করতে হবে। কিন্তু সে সময় তার হাতে নেই।
এ সময় আল্লাহর রহমতের মত একটা গাড়ি এসে তার সামনেই পার্ক করল। মহিলা ড্রাইভার। বয়স পঁচিশ-ছাব্বিশ। এস্টোনীয়।
‘যাবে?’ জিজ্ঞেস করলো ডোনা।
‘হ্যাঁ। কোথায়?’
‘বলছি।’ বলে ডোনা তার ব্যাগটি গাড়ির পেছনের সিটে তুলে দিয়ে সামনে উঠে বসল। বলল, ‘ঐ যে সামনে ৩৮২০৯০ গাড়িটা যাচ্ছে, তাকে অনুসরণ করুন। ঐ গাড়িতে আমার স্বামী আছেন।’
ড্রাইভার মেয়েটি খুব সুন্দরী। বুদ্ধিদীপ্ত মুখ। চঞ্চল চোখ। গায়ে দামি পোশাক। সে একবার ডোনার দিকে পরিপূর্ণ দৃষ্টিতে চেয়েই গাড়ি স্টার্ট দিল।
কিছুদূর চলার পর মেয়েটি বলল, ‘গাড়িটা বেশ জোরে চলছে। ধরব কি গাড়িটাকে?’
‘না। পেছনে থাকুন এমনভাবে যাতে সন্দেহ না করে যে, আমরা পেছনে আছি।’
আবার মেয়েটি ডোনার দিকে তাকাল। বলল, ‘আপনার স্বামী কি বিপদে পড়েছেন?’
‘একথা বলছেন কেন? ডোনা তার বিস্মিত দৃষ্টি মেয়েটির দিকে তুলে বলল।
‘ম্যাডাম, আপনার চোখে-মুখে উদ্বেগ দেখছি তাই বললাম। আবার আপনি গাড়িটাকে অনুসরণ করবেন, অথচ ধরতে চাইছেন না গাড়িটাকে। তাছাড়া গাড়িটাতে যেহেতু আপনার স্বামী রয়েছেন, তাই গাড়িটা স্বাভাবিক ভাবেই আপনার জন্যে অপেক্ষা করবে, কিন্তু তা করছে না।’
ম্লান হাসল ডোনা। বলল, ‘ধন্যবাদ আপনাকে। অনেক চিন্তা করেছেন আপনি।’
বলে একটু থামল। তারপর বলল, ‘হ্যাঁ, ঠিকই বলেছেন আপনি। আমার স্বামী বিপদগ্রস্থ। তিনি কিডন্যাপড হয়েছেন।’
‘আপনার স্বামী কি রাশিয়ান?’
‘না।’
‘ওকে রাশিয়ানরা কিডন্যাপ করল কেন?’
‘কেমন করে বুঝলেন, রাশিয়ানরা কিডন্যাপ করেছে?’
‘রাশিয়ান ছাড়া ঐ ধরনের রাফ ড্রাইভিং কোন এস্টোনিয়ান করে না।’
‘সব রাশিয়ান কি এক রকম?’
‘তা জানি না। কিন্তু যে রাশিয়ানদের আমরা পঞ্চাশ বছর ধরে চিনেছি, তারা সব শয়তানের বাচ্চা।’
একটু থামল মেয়েটি। পরক্ষণেই বলল, ‘কেন ওরা আপনার স্বামীকে কিডন্যাপ করেছে? পুলিশে জানিয়েছেন আপনি?’
‘না, পুলিশকে জানাইনি।’
‘পুলিশে এখনি বলতে পারি টেলিফোনে। বলব?’
‘না, এখন দরকার নেই।’
মেয়েটি আবার মুখ ঘুরিয়ে ডোনার দিকে তাকাল। তার চোখে-মুখে বিস্ময়! বলল, ‘তাহলে আপনার পরিকল্পনা কি? শুধু কি অনুসরণ?’
গাড়ি তাল্লিন নগরীর বাইরে বেরিয়ে এসেছে। বাগান শোভিত টিলা এবং ফসলের প্রান্তরের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে চলেছে গাড়ি।
‘আপাতত অনুসরণ।’ বলে একটু থামল ডোনা। বলল, ‘আমাকে ড্রাইভিং-এ বসার অনুমিত দেবেন?’
মেয়েটি বিস্মিত হয়ে তাকাল ডোনার দিকে। বলল, ‘অবশ্যই, যদি আপনার কোন উপকার হয়।’
গাড়ি থামিয়ে মেয়েটি বলল, ‘আসুন।’
মেয়েটি এসে ডোনার সিটে বসল। আর ডোনা গিয়ে বসল ড্রাইভিং সিটে।
গাড়ি স্টার্ট দিতে দিতে ডোনা বলল, ‘আমি ডোনা জোসেফাইন। আপনাকে কি বলব?’
‘ড্রাইভার বলাই কি যথেষ্ট নয়?’
‘ড্রাইভার হলে ড্রাইভারের এ সিট আমাকে দিতেন না।’
‘তাহলে আমি কি?’
‘তা আমি জানি না। কিন্তু নিছক ভাড়ায় খাটা ট্যাক্সি চালক আপনি নন।’
হাসল মেয়েটি। বলল, ‘আমি ‘কেলা এলভা’।’
গাড়ির স্পিড বাড়িয়ে দিল ডোনা। অকারণেই হর্ন দিল।
ব্যাপারটার দিকে মনোযোগ দিয়ে কেলা এলভা বলল, ‘আপনার হর্নের ধরনটা কিন্তু খুবই সুন্দর।’
ডোনা ঠোঁটে হাসি টেনে কেলা এলভার দিকে তাকাল। বলল, ‘আমি সামনের গাড়িটাকে থামিয়ে দিতে চাই।’
‘কিন্তু কিভাবে?’
ডোনা তার কোটের পকেট থেকে রিভলভার বের করল।
চোখে-মুখে বিস্ময় ফুটে উঠল কেলা এলভার। একটু সময় নিয়ে বলল, ‘টায়ারে গুলি করবেন?’
‘তাছাড়া উপায় কি?’
‘কিন্তু তারপর?’
‘বলা ‍মুশকিল। আশা করি, আমরাই জিতব। আপনার কোন ভয় নেই। ওরা অ্যাকশানে আসার আগে দরকার হলে গাড়ি নিয়ে সরে পড়ার অনেক সময় থাকবে।’
‘আমি ভয়ের কথা বলিনি। জানতে চাচ্ছি আপনার পরিকল্পনা।’
‘ধন্যবাদ।’
বলে ডোনা বাঁ হাত স্টিয়ারিং হুইলে রেখে ডান হাতে রিভলভার তাক করল গাড়ির দিকে।
খুব সামনেই রাস্তাটা ‘L’ টাইপ একটা শার্প বাঁক নিয়েছে।
এমন একটা বাঁকই সর্বান্তকরণে চাচ্ছিল ডোনা। যাতে সামনের গাড়িটার সামনের টায়ার তাক করা এবং সহজে গুলিও করা যায়।
গুলি করল ডোনা।
সশব্দে টায়ার বার্স্ট করল দ্রুতগামী গাড়িটার। আর পরক্ষণেই গাড়ির পেছনটা শূন্যে উঠল এবং উল্টে গেল গাড়িটা। গড়াগড়ি খেল কয়েকটা।
ইতোমধ্যে ডোনার গাড়ি গাড়িটার কাছাকাছি এসে পড়েছিল।
গাড়ি থামাল ডোনা। পকেট থেকে পঞ্চাশ ডলার বের করে কেলা এলভার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ধন্যবাদ কো-অপারেশনের জন্যে। এই টাকাটা রাখুন। আপনি এখন গাড়ি নিয়ে যেতে পারেন।’
বলে ডোনা রিভলভার হাতে নিয়েই দ্রুত গাড়ি থেকে নামল।
কেলা এলভা টাকা হাতে নেয়নি। টাকা সিটের উপরে পড়েছিল ডোনার হাত থেকে।
দ্রুত কেলা এলভাও গাড়ি থেকে নামল। তার হাতেও রিভলভার।
গাড়ি থেকে বেরিয়েই রিভলভার তাক করল ডোনার দিকে। বলল, ‘যে গাড়ির টায়ার ফুটো করে থামিয়ে দিয়েছেন, সেটা আমাদের গোয়েন্দা বিভাগের গাড়ি। নিশ্চয় আপনার স্বামী আমাদের গোয়েন্দা বিভাগের হাতে। কেন আমি আপনাকে আমাদের বিরুদ্ধে সাহায্য করব?’
‘এস্টোনিয়ার গোয়েন্দা বিভাগে কি রুশরা চাকুরী করে?’
‘অবশ্যই না।’
‘ঐ গাড়িটা তিনজন রুশ নিয়ে যাচ্ছে।’
‘আমি বিশ্বাস করি না। গাড়িটা আমাদের।’
‘যদি গাড়িতে তিনজন রুশ থাকে?’
‘যদি থাকে এবং তারা আমাদের পক্ষের না হয়, তাহলে আমার কোন বৈরিতা থাকবে না আপনার প্রতি।’
এই সময় উল্টে যাওয়া গাড়ি থেকে গুলির শব্দ ভেসে এল।
ডোনা দ্রুত বলল, ‘আসুন দেখবেন।’ বলে ডোনা দ্রুত গাড়ির দিকে ছুটল।
ডোনার দিকে রিভলভার বাগিয়ে ছুটল কেলা এলভাও।
ডোনা গাড়ির কাছে ছুটে গিয়ে উবু হয়ে থাকা গাড়ির উঁচু হয়ে উঠা জানালা দিয়ে ভেতরে তাকাল।
গাড়ি উল্টে এক পাক খেয়ে কাত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এক দিকের জানালা মাটিতে মুখ থুবড়ে পড়ে আছে।
ডোনা দেখল, আহমদ মুসা একজন রুশের কাছ থেকে রিভলভার কেড়ে নিল। লোকটিও আহত। তাদের পাশেই দু’জন রুশের রক্তাক্ত দেহ পড়ে আছে।
কেলা এলভাও এসে দাঁড়িয়েছে ডোনার পাশে।
গাড়ির ইঞ্জিন দিয়ে ধোঁয়া উঠছে।
রিভলভার কেড়ে নিয়েই আহমদ মুসা সেই রিভলভার দিয়ে গুলি করে গাড়ির উইন্ডশীল্ড ভেঙে দিল।
গাড়ির ধোঁয়ার দিকে তাকিয়ে চমকে উঠল ডোনা।
ইঞ্জিন গাড়ির পেছনে। পেছনে থাকায় গাড়ির সামনেটা যতখানি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে, পেছনে তা হয়নি। কিন্তু পুরানো গাড়ি হওয়ায় প্রচণ্ড ঝাঁকুনিতে পেছনের কভার টপটি যেমন উঠে গেছে, তেমনি ক্ষতিগ্রস্থ কয়েলে আগুন ধরে গেছে। ফুয়েল ট্যাংকার থেকে তেল গড়িয়ে এসেছে। বাড়ছে ধোঁয়া। আগুন ফুয়েল ট্যাংকারে গেলে গোটা গাড়িই বিস্ফোরণে উড়ে যাবে।
ডোনা চিৎকার করে আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে বলল, ‘বেরিয়ে এস তাড়াতাড়ি। সময় নেই।’
কিন্তু আহত নিকোলাস বুখারিন এবং আহত এস্টোনীয় ড্রাইভার আটকা পড়েছিল। আহমদ মুসা গুলি করে উইন্ডস্ক্রীন ভেঙে ফেলার পর আটকে পড়া ড্রাইভারকে বের করার চেষ্টায় তৎপর হয়ে উঠেছিল।
ডোনার পেছনে দাঁড়িয়ে কেলা এলভাও দেখছিল ব্যাপারটা।
ডোনা ছুটে এসেছিল আহমদ মুসাকে সাহায্য করার জন্যে।
আহমদ মুসা ড্রাইভারকে ভাঙা উইন্ডস্ক্রীনের পথে ডোনার হাতে ঠেলে দিয়ে এগোলো নিকোলাস বুখারিনের দিকে।
ডোনা ড্রাইভারকে বের করছে দেখে আহমদ মুসা চিৎকার করে বলল, ‘তাড়াতাড়ি করো, গাড়িতে আগুন ধরে যাচ্ছে।’
কেলা এলভা পেছন থেকে এসে ডোনার সাথে লেগে গেল ড্রাইভারকে টেনে বের করার কাজে। সেও চিৎকার করে বলল, ‘সময় বেশি নেই, তাড়াতাড়ি করুন।’
গাড়ির সিট ও গাড়ির চ্যাপ্টা হয়ে যাওয়া বডির মাঝখানে আটকা পড়েছিল নিকোলাস বুখারিনের একটা পা।
আহমদ মুসা উবু হয়ে থাকা জানালা গুলি করে ভেঙে ফেলল।
ভাগ্য ভাল জানালার লক ক্ষতিগ্রস্থ হয়নি। আহমদ মুসা জানালা আনলক করে দু’পায়ে লাথি চালালো দরজায়।
দরজা আধা পরিমাণ খুলে গেল। ছাড়া পেয়ে গেল বুখারিনের পা।
মাথা ফেটে গিয়েছিল এবং বাম হাতটা ভেঙে গিয়েছিল বুখারিনের। তার ডান হাতে রিভলভার ধরা ছিল। সেটা দিয়েই দ্বিতীয় গুলি করতে যাচ্ছিল আহমদ মুসাকে। কিন্তু তার আগেই রিভলভার কেড়ে নিয়েছিল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসা যখন তাকে টেনে বের করছিল, তখন নিকোলাস বুখারিন চিৎকার করে বলছিল, ‘আমি তোমার অনুগ্রহ চাইনি। বেঁচে থাকলে তোমাকে আমি ছাড়বো না।’
আহমদ মুসা নিকোলাস বুখারিনকে বাইরে ছুঁড়ে দিয়ে বলল, ‘আমি কোন মানুষের করুণার মুখাপেক্ষী নই।’
আহমদ মুসা বাইরে বেরিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গেই প্রচণ্ড বিস্ফোরণে সমগ্র গাড়িটি একটা অগ্নিপিণ্ডের রূপ নিল।
অল্প দূরে দাঁড়িয়ে আহমদ মুসা সেই কুণ্ডলী পাকানো আগুনের দিকেই তাকিয়েছিল।
ডোনা এবং কেলা এলভা এসে আহমদ মুসার পাশে দাঁড়ালো।
‘দু’জন মানুষের জীবন রক্ষার জন্যে আপনাকে ধন্যবাদ। কিন্তু যে দু’জন মানুষ আগুনে ছাই হয়ে গেল, তাদের হত্যা আপনিই করেছেন।’ আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে কেলা এলভা বলল।
আহমদ মুসা কেলা এলভার দিকে তাকাল। হাসল। বলল, ‘ওয়েলকাম। দু’জনের একজনের হত্যা সেমসাইডের ব্যাপার। দ্বিতীয়জনের গুলি থেকে বাঁচার জন্যেই তাকে আমি গুলি করেছি।’
কথা শেষ করেই আহমদ মুসা আবার কেলা এলভাকে লক্ষ্য করে বলল, ‘আহত দু’জনের ব্যবস্থা করতে হয়। আপনি নিশ্চয় সাহায্য করবেন।’
‘ওরা আপনাকে কিডন্যাপ করেছিল। আপনার তাড়া কিসের? না কিডন্যাপের কাহিনীটা সাজানো?’ বলল কেলা এলভা।
‘আপনি কি কোন গোয়েন্দা কর্মী?’
‘আপনিও কোন গোয়েন্দার কেউ?’
‘কেন?’
‘না হলে এটা ধরলেন কি করে?’
‘না, গোয়েন্দা নই। নিজ স্বার্থে কারও পক্ষে আমি কাজ করছি না।’
‘তাহলে এসব গণ্ডগোলে কেন? না নিজেই কোন পক্ষ?’
‘না। মানুষ হিসেবে মানুষের জন্যে কাজ করছি।’
কথা শেষ করেই আহমদ মুসা বলল, ‘আহত দু’জনের কথা আমি বলেছিলাম।’
‘কিন্তু শত্রুর অবস্থা নিয়ে আপনি মাথা ঘামাচ্ছেন কেন?’
‘যুদ্ধ শেষে আহত সৈন্যরা আর শত্রু থাকে না, তারা মানুষ হয়ে যায়।’
তৃতীয়বার অবাক হলো কেলা এলভা। প্রথম অবাক হয়েছিল ডোনার কিছু কথায়। গাড়িতে আটকা পড়া শত্রুকে উদ্ধারের আকুলতা দেখে সে দ্বিতীয়বার অবাক হয়েছিল।
‘লড়াই তো শেষ হয়নি। দেখুন ওর চোখে আগুন জ্বলছে। রিভলভার কাছে থাকলে এখুনি গুলি করতো। কিংবা কাছে পেলে আপনাকে চিবিয়ে খাবে।’ নিকোলাস বুখারিনের দিকে ইংগিত করে বলল কেলা এলভা।
‘তবু তো শত্রু নিরস্ত্র, অসহায়।’
‘এমন মানবতাবাদী কেউ খুনোখুনির মত ঘটনায় যেতে পারে কি করে?’
‘মানবতাকে রক্ষার জন্যেই মানুষ নামের অমানুষদের অনেক সময় সরিয়ে দেয়ার প্রয়োজন।’
‘আপনি আদর্শবাদীদের মত কথা বলছেন। যাক, ঐ দেখুন, পুলিশ ও অ্যাম্বুলেন্স আসছে।’
‘আপনি জানিয়েছিলেন বুঝি?’
‘ঠিক ধরেছেন। তবে পুলিশ আপনাদের গ্রেফতার করবে না।’
‘কেন করবে না?’
‘আমি একটা অ্যাকসিডেন্টের কথা জানিয়েছি।’
অ্যাম্বুলেন্স এল। তার সাথে পুলিশের একটা গাড়ি। ড্রাইভারসহ অ্যাম্বুলেন্স কর্মী তিনজন এবং পুলিশ তিনজন।
পুলিশ তিনজন নেমে স্যালুট করল কেলা এলভাকে।
আহমদ মুসা বুঝল, মেয়েটি নিশ্চয় পুলিশ বা গোয়েন্দা অফিসার।
অ্যাম্বুলেন্স কর্মীরা প্রথমে ড্রাইভারকে অ্যাম্বুলেন্সে তুলে নিকোলাস বুখারিনের দিকে এগোলো।
আহমদ মুসা, কেলা এলভা এবং ডোনা কাছেই পাশাপাশি দাঁড়িয়েছিল।
অ্যাম্বুলেন্স কর্মীরা বুখারিনকে অ্যাম্বুলেন্সে নেবার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। ইতোমধ্যে পুলিশ অফিসার বুখারিনের মচকে যাওয়া পা দেখে তারপর মাথার আঘাত পরীক্ষা করার জন্যে তার দিকে ঝুঁকে পড়েছিল।
হঠাৎ বুখারিন পুলিশ অফিসারের কোমরে ঝুলন্ত খাপ থেকে রিভলভার তুলে নিয়েই গুলি করল আহমদ মুসাকে।
সৌভাগ্যই বলতে হবে আহমদ মুসার। সে বুখারিনের দিকে তাকিয়ে পুলিশ অফিসারের কাজ দেখছিল। বুখারিনকে রিভলভার কেড়ে নিতে দেখেই নিজেকে মাটির উপর ছুঁড়ে দিয়েছিল আহমদ মুসা এবং মাটিতে পড়েই গুলি করেছিল বুখারিনের হাতে।
আহমদ মুসা নিজেকে সরাতে না পারলে বুখারিনের গুলি তার উরুদেশ বিদ্ধ করতো। যথাসময়ে সরে পড়ায় লক্ষ্যভ্রষ্ট হলো বুখারিনের গুলি। উল্টো বুখারিনের রিভলভার ধরা ডান হাত আহমদ মুসার গুলিতে বিধ্বস্ত হলো।
বিধ্বস্ত হাতের দিকে কিন্তু কোন খেয়াল নেই বুখারিনের। সে সমানে চিৎকার করতে শুরু করেছে, ‘তোমরা সবাই এ ক্রিমিন্যালকে পাকড়াও করো। এ হলো সেই কুখ্যাত আহমদ মুসা। এই মাত্র আমার দু’জন সাথীকে সে হত্যা করেছে। এর পর্বতপ্রমাণ অপরাধের সাথে সাথে সে আমাদের যুবরাণী রাজকুমারী তাতিয়ানার হত্যাকারীও। একে ধরে দিলে আমরা গ্রেট বিয়ারের পক্ষ থেকে লক্ষ ডলার পুরস্কার দেব’, ইত্যাদি।
তার কথা শুনে পুলিশ অফিসার, তিনজন পুলিশ, দু’জন অ্যাম্বুলেন্স কর্মী এবং কেলা এলভা সকলেই চমকে উঠেছিল। মুহূর্তের জন্যে তাদের মধ্যে একটা বিমূঢ় ভাবও সৃষ্টি হয়েছিল।
তাদের বিমূঢ় ভাব কেটে যেতেই দ্রুত পুলিশ অফিসারটি তার রিভলভারটি কুড়িয়ে নিল। তা দেখে অন্য দু’জন পুলিশও তাদের রিভলভারের দিকে হাত বাড়াল।
আহমদ মুসা উঠে দাঁড়িয়েছে রিভলভার হাতে।
চট করে সে দু’ধাপ সরে কেলা এলভার পেছনে এসে তার মাথা বরাবর রিভলভার তাক করলো। পুলিশ অফিসারকে লক্ষ্য করে বলল, ‘রিভলভার ফেলে দিন এবং অন্য দু’জন পুলিশকেও ফেলে দিতে বলুন।’
তিনজন পুলিশ তাদের হাত থেকে রিভলভার ফেলে দিল।
ডোনা এগিয়ে গিয়ে রিভলভারগুলো তুলে নিল। ফিরে আসছিল ডোনা।
আহমদ মুসা বলল, ‘পুলিশ অফিসারটির কাছে ওয়্যারলেস সেট আছে ডোনা।’
বলেই পুলিশ অফিসারটিকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘ফেলে দিন ওয়্যারলেস সেটটি।’
পুলিশ অফিসারটি একবার কেলা এলভার দিকে তাকাল। তারপর পকেট থেকে বের করে ছুঁড়ে দিল ওয়্যারলেস সেটটি।
ডোনা ওয়্যারলেস সেটটি কুড়িয়ে ফিরে এল আহমদ মুসার কাছে।
‘ধন্যবাদ।’ ডোনাকে লক্ষ্য করে বলল আহমদ মুসা। তারপর বলল কেলা এলভাকে, ‘চলুন ম্যাডাম আপনার গাড়িতে।’
কেলা এলভা একবার মুখ ঘুরিয়ে আহমদ মুসার দিকে তাকাল। এবং হাঁটতে শুরু করল গাড়ির দিকে।
কেলা এলভা এবং ডোনাকে পেছনের সিটে বসাল। আহমদ মুসা ড্রাইভিং সিটে উঠে বসার আগে গুলি করে অ্যাম্বুলেন্স ও পুলিশের গাড়ির একটি করে টায়ার নষ্ট করে দিল।
কেলা এলভা সেদিকে তাকিয়ে বলল, ‘আহতদের হাসপাতালে নেবার পথ বন্ধ করে দিলেন?’
‘না, দেরি করালাম মাত্র। বাড়তি টায়ার লাগিয়ে অল্পক্ষণ পরেই যাত্রা করতে পারবে।’
‘কেন দেরি করালেন?’
‘আমি চাই না তারা পিছু নিক।’
‘বুঝেছি।’ কেলা এলভার চোখে সপ্রশংস দৃষ্টি।
আহমদ মুসা গাড়ি স্টার্ট দেবার আগে পকেট থেকে একটা রিভলভার বের করে পেছন দিকে তাকিয়ে ছুঁড়ে দিল কেলা এলভার কোলে। বলল, ‘আপনার রিভলভার।’
রিভলভারের দিকে একবার তাকিয়ে কেলা এলভা নিজের পকেটে হাত দিল। রিভলভার পেল না। বিস্ময় ফুটে উঠল তার চোখে-মুখে। বলল, ‘আমার পকেট থেকে রিভলভার কিভাবে আপনার কাছে গেল?’
‘যখন আমি আপনার পেছন থেকে রিভলভার তাক করি আপনার মাথায়, তখনই আপনার পকেট থেকে রিভলভার তুলে নেই। আপনি খেয়াল করেননি, মনোযোগ অন্যদিকে থাকার কারণে।’
‘নেয়ার পর রিভলভার আবার ফেরত দিচ্ছেন কেন?’
‘অন্যদের নেয়া হয়েছে, তাই আপনারও নেয়া হয়েছিল। অন্যরা এখানে নেই, তাই আপনারটা ফেরত দেয়া হলো।’
‘তার মানে আমাকে আপনাদের কোন ভয় নেই! কেন?’
‘ভয় নেই তা নয়, তবে বিদেশে যখন এসেছি, তখন কোথাও না কোথাও একটা আস্থার স্থান আমরা অবশ্যই খুঁজে পেতে চাইব।’
‘রিভলভার উঁচিয়ে কি এ আস্থা কেউ অর্জন করতে পারে?’
‘সে জন্যেই তো আপনার রিভলভার ফেরত দিলাম।’ ঈষৎ হেসে বলল আহমদ মুসা।
‘আমার ধারণার চেয়েও আপনি বুদ্ধিমান। কিন্তু আমার লোকদের হেনস্থা করে, আমাকে রিভলভারের মুখে ধরে এনে আপনি কোন সাহায্যের আশা করতে পারেন না। নিকোলাস বুখারিন বললেই কি আমরা আপনাকে গ্রেফতার করতাম মনে করেন?’
আহমদ মুসা হাসল। বলল, ‘আপনারা আমার কোন ক্ষতি করবেন বলে আমি রিভলভার, ওয়্যারলেস সেট কেড়ে নিয়ে ও গাড়ির টায়ার নষ্ট করে এবং আপনাকে ধরে এনে আপনাদের কষ্ট দিতে চাইনি। আসলে আপনাদেরকে একটা বিপদ থেকে আমি বাঁচিয়েছি।’
‘কেমন?’ কেলা এলভার চোখে-মুখে বিস্ময়।
‘আমি যদি কিছু না করতাম, তাহলে আমাদেরকে গ্রেফতার করতে হতো আপনাদের।’
‘কেন?’
‘গ্রেফতার না করলে আমাদের ছেড়ে দেয়ার দায়ে আপনারা অভিযুক্ত হতেন। গ্রেট বিয়ার, এমনকি রুশ সরকারের পক্ষ থেকে প্রবল চাপ আসতো আপনাদের উপর। সুতরাং, আমি যা করেছি, তাতে আপনারাও বেঁচেছেন, আমরাও বেঁচেছি।’
‘বুঝতে পারছি মিঃ আহমদ মুসা, কেন আপনি অজেয়। কিন্তু আপনারা বেঁচে গেছেন মনে করবেন না। আপনি পুলিশ অফিসারের ওয়াকিটকি নিয়ে এসেছেন। কিন্তু আসল ওয়্যারলেস তার পকেটেই রয়ে গেছে।’
‘ধন্যবাদ এই মূল্যবান ইনফরমেশনের জন্যে। আপনি আমাদের পাশে থাকা পর্যন্ত আমাদের কোন চিন্তা নেই।’ বলল আহমদ মুসা গাড়ির স্পীড বাড়িয়ে দিতে দিতে।
‘আমি কি আপনাদেরকে সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিয়েছি?’ বলল কেলা এলভা অনেকটা শক্ত কণ্ঠে।
‘প্রতিশ্রুতি দেননি। কিন্তু আমরা আপনার সাহায্য পাব।’
আহমদ মুসা তার গাড়ির স্পীড বাড়ানোর সাথে সাথে গাড়িটি একেবারে অ্যাবাউট টার্ন করে পুব দিকে যাওয়া শুরু করল।
‘কি ব্যাপার, কোথায় যাচ্ছেন?’
‘পূর্ব দিকে।’
‘সেতো দেখতেই পাচ্ছি। কিন্তু কোথায় যাচ্ছেন?’
‘আপাতত তারতু, তারপর কালান্তি।’
‘তারপর লেকের পথে রাশিয়ায় প্রবেশ?’ বলল কেলা এলভা।
‘ঠিক বলেছেন।’
চোখে-মুখে বিস্ময় ফুটে উঠেছে কেলা এলভার। আহমদ মুসার ক্ষমতা সম্পর্কে সে অবহিত। কিন্তু একটি ভিনদেশের মানচিত্র সম্পর্কে তার এত স্বচ্ছ ধারণা এবং এমন দ্রুত এমন একটি রুটের সিদ্ধান্ত সে নিতে পারে! অনেক এস্টোনীয় নাগরিকই জানে না যে, রাশিয়ায় অবৈধ প্রবেশের এটাই সবচেয়ে নিরাপদ পথ। লেক ‘পাইপাস’ অনেকটাই নির্জন। পশ্চিম তীরের উত্তরাংশের একটা অংশ ছাড়া লেক পাইপাসের গোটা তীরই সাধারণ ব্যবহারের অযোগ্য। রুশ পূর্ব তীরে কোন নগর-নগরী তো দূরে থাক, রাস্তাঘাটও গড়ে উঠতে পারেনি।
‘সত্যিই আমি চমৎকৃত। রাশিয়ায় অবৈধ প্রবেশের সবচেয়ে উত্তম পথ বেছে নিয়েছেন। লেক ‘পাইপাসে’ জেলেদের নৌকা ভাড়া করে আপনি একদম নির্বিবাদে রাশিয়ার লেক পুশকভে প্রবেশ করতে পারেন। তারপর লেক পুশকভের তীরে উঠে বা পুশকভ নগরী হয়ে রাশিয়ার যেথা ইচ্ছা যেতে পারেন।’
একটু থামল কেলা এলভা। তারপর বলল, ‘আমার প্রশ্ন দু’টি, এক, এই গোপন পথের কথা আপনি জানলেন কি করে? দুই, আপনার মত আদর্শবাদী লোক অবৈধ প্রবেশের মত দুর্বল ভিত্তি নিয়ে রাশিয়ায় যাচ্ছেন কেন?’
আহমদ মুসা হাসল। স্টিয়ারিং-এ দু’টি হাত এবং চোখ সামনে প্রসারিত রেখেই ধীরে ধীরে বলল, ‘সাইবেরিয়ার রুশ বন্দী শিবির থেকে পলাতক এস্টোনীয় লেখক এমাস্তে এলভার লেখা ‘দি লং নাইট’-এর ইংরেজি অনুবাদ পড়েছি। তাতে এই পথের বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে। এই পথেই এমাস্তে সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে পালিয়েছিলেন।’
কেলা এলভার চোখে আনন্দের স্ফূরণ। বলল, ‘আপনি এমাস্তে এলভার বই পড়েছেন! ভালো লেগেছে আপনার?’
‘সব মানুষেরই ভালো লাগার কথা। চিরন্তন এক কাহিনী।’
‘বইটির কোন দিক আপনার ভালো লেগেছে?’
‘এস্টোনীয় জনসংখ্যার এক-দশমাংশ মানুষ সাইবেরিয়ার সোভিয়েত বন্দী শিবিরে কিভাবে হারিয়ে গেল, তার এক মর্মন্তুদ চিত্র গ্রন্থটি। সবচেয়ে ভালো লেগেছে একজন পরাধীন দেশপ্রেমিকের অন্তর্জ্বালার দিকটি।’
‘ধন্যবাদ আপনাকে। ক্ষুদ্র এক জাতির সাহিত্য আপনি এইভাবে পড়েছেন?’
‘সংখ্যার কারণে কোন জাতি ক্ষুদ্র হয় না। হৃদয়ের কারণে ক্ষুদ্র জনসংখ্যার জাতিও বিশ্বে বড় আসন পেতে পারে।’
‘সব জাতির ক্ষেত্রেই কি আপনার এই কথা প্রযোজ্য?’
‘হৃদয়বৃ্ত্তি একটা মানবিক ধর্ম, যদি তা প্রবৃত্তির অমানবিক কোন চাহিদা দ্বারা কলুষিত না হয়। এই মানবধর্ম স্রষ্টার দেয়া একটা নিয়ামাত। এর কোন দেশ-কাল-পাত্র নেই।’
‘আপনি দেখছি পরম মানবতাবাদী, উদার। কিন্তু শুনেছি যে, চরম সাম্প্রদায়িক আপনি?’
‘তারা ঠিকই বলেছে, স্রষ্টা যতটুকু সাম্প্রদায়িক, আমি ততটা সাম্প্রদায়িক অবশ্যই।’
হাসল কেলা এলভা। বলল, ‘কথাটা মজার, কিন্তু বুঝলাম না।’
‘স্রষ্টা তার প্রত্যেকটি সৃষ্টিকে একটা সুনির্দিষ্ট নিয়মের মধ্যে রেখেছেন। কারও পক্ষে এই নিয়মের অন্যথা করার সুযোগ নেই। কোন উপায় নেই অসাম্প্রদায়িক বা ‘আনলফুল’ হবার। সুতরাং স্রষ্টা অসাম্প্রদায়িক নন, আমিও নই।’
‘কিন্তু মিঃ আহমদ মুসা, স্রষ্টার সেই আইন বা প্রকৃতিগত দেহতাত্ত্বিক ও বস্তুগত চরিত্র নিয়ে সাম্প্রদায়িকতার অভিযোগ কোথাও নেই। অভিযোগ এসেছে মানুষের স্বাধীন জীবন পরিচালনার উপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ নিয়ে।’
‘আচ্ছা বলুন তো, নিয়ন্ত্রণ প্রয়োজন হয় কোথায়?’
‘যেখানে আইন ভংগের সম্ভাবনা থাকে, ক্ষতির সম্ভাবনা থাকে, কোন ধরনের সংকটের সম্ভাবনা থাকে, ইত্যাদি।’
‘তাহলে মানুষের জীবন পরিচালনায় এসব কিছুই আছে কিনা?’
‘আছে, অবশ্যই। এ জন্যেই তো রাষ্ট্র, আইন, সংবিধান- এসব কিছু।’
‘রাষ্ট্র, আইন ও সংবিধানের নিয়ন্ত্রণ স্থান, কাল ও পাত্রের পরিবর্তনের সাথে সাথে পরিবর্তনশীল। এ নিয়ন্ত্রণ সংকীর্ণ গণ্ডীর ও সীমাবদ্ধ বুদ্ধির বলেই এই পরিবর্তন ঘটে। অথচ মানুষের জীবন একটা অব্যাহত বিষয়। এর জন্যে একটা কালোত্তীর্ণ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার প্রয়োজন আছে কিনা?’
‘সত্যিই কি প্রয়োজন আছে?’
‘জীবের বিশেষ করে মানুষেরও বস্তুগত দিক নিয়মের অধীন বলে, তার জীবন পরিচালনা একটা স্থায়ী নিয়মের অধীন হবে না কেন?’
‘মানুষের দেহগত দিকের মত তার জীবন পরিচালনাকে তাহলে একটা অলংঘনীয় বা স্থায়ী নিয়মের অধীন করে দেয়া হয়নি কেন?’
‘মানুষকে বিবেক-বুদ্ধি দেয়া হয়েছে বলেই এবং তাকে ভালো-মন্দ পার্থক্য করার বিচারবুদ্ধি দেয়া হয়েছে বলেই।’
‘যদি তা-ই হয়, তাহলে মানুষের জীবন পরিচালনার নিয়ন্ত্রণ তার বিবেক ও বিচারবুদ্ধির উপর ছেড়ে দেয়াই তো উচিত। খোদায়ী নিয়ন্ত্রণের আবার ব্যবস্থা কেন?’
‘মানুষ অতীত ও বর্তমান সম্পর্কে খুব অল্পই জানে এবং ভবিষ্যত সম্পর্কে কিছুই জানে না। মানুষের এই সীমিত জ্ঞান নির্ভর বিচারবুদ্ধির পক্ষে নিজেদের জীবনকে ব্যক্তিগত ও সামষ্টিকভাবে কল্যাণ ও মুক্তির পথে পরিচালনা করা সম্ভব নয়। সমুদের দিক নির্ণয়ের জন্যে যেমন আকাশের তারা, কম্পাস ও বাতিঘরের প্রয়োজন, স্থলপথে যেমন ম্যাপ ও রোড সাইনের প্রয়োজন হয়, তেমনি মানুষের আদর্শ, সৃষ্টি ও লক্ষ্যগত জীবন পরিচালনার জন্যে দিক-নির্দেশিকার প্রয়োজন আছে, যার অভাবে মানুষ লক্ষ্যচ্যুত হয়ে অশান্তি-অবিচার, জুলুম-অত্যাচারের ধ্বংসকরী পাঁকে নিমজ্জিত হয়ে যেতে পারে। এই দিক-নির্দেশিকারই নাম খোদায়ী জীবন বিধান।’
‘মিঃ আহমদ মুসা, জানতাম আপনি বিপ্লবী, কিন্তু এখন দেখছি আপনি দার্শনিক বা মিশনারীও।’
একথা বলে একটা দম নিয়েই বলল কেলা এলভা, ‘খোদায়ী জীবন বিধান যাকে বলছেন, তাদের মধ্যেই কি ঝগড়া কম! এর কি করবেন?’
‘মানুষের বিচারবুদ্ধি যদি স্বাধীনভাবে কাজ করে, তাহলে এ ঝগড়া বাঁধতে পারে না।’
‘কেমন করে?’
‘খোদায়ী জীবন-পদ্ধতি হওয়ার দাবিদার ধর্মগুলোর মধ্যে বিচারবুদ্ধির রায় অনুসারে একমাত্র ইসলাম ছাড়া অন্য কোনটাই আজকের মানুষের জীবন পদ্ধতি হওয়ার উপযুক্ত নয়।’
‘এটা তো আপনার কথা।’
‘আমার নয়, বিচারবুদ্ধির রায়ের কথা। কি বল মারিয়া জোসেফাইন?’ সমর্থনের জন্যে আহমদ মুসা চাইল ডোনার দিকে।
‘স্ত্রী তো স্বামীকে সমর্থন করবেই।’ হেসে বলল কেলা এলভা।
‘ও শুধু স্ত্রী নয়। ও একজন সচেতন ইউরোপীয়।’ বলল আহমদ মুসা।
মুখ খুলল ডোনা। বলল, ‘আমার নিজের কথা বলব না, আজকের পাশ্চাত্যের শ্রেষ্ঠ বুদ্ধিজীবীরা ধর্মনিরপেক্ষ আদর্শের নিরাপত্তা ও বিজয় সর্ম্পকে বলতে গিয়ে উল্লেখ করছেন, আধুনিক যুগ-জিজ্ঞাসার জবাব দেয়া ও আধুনিক মানুষের প্রয়োজন পূরণ করার ক্ষমতা ইসলাম ছাড়া অন্য কোন ধর্মের নেই।’
‘যেহেতু এ বিষয়ের উপর আমার পড়াশোনা নেই, তাই আমি কিছু বলব না। তবে আমি একটা বিষয়ে খুশি, আহমদ মুসা লেনিন, মাও সেতুং, হো চি মিন, চে গুয়েভারা, ক্যাস্ট্রো প্রমুখ বিপ্লবীর চেয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন মানুষ। যিনি ভয়ের বদলে আশার উদ্রেক করেন, যিনি রহস্যময় পূজ্য ব্যক্তিত্ব হবার বদলে বন্ধু হতে পারেন।’
কথা শেষ করেই কেলা এলভা সামনে একটা গাড়ির দিকে তাকিয়ে বলল, ‘মিঃ আহমদ মুসা, মনে হয় সামনে বিপদ আছে।’
‘কেন একথা বলছেন?’
‘সামনে যে গাড়িটা আসছে, ওটা এস্টোনীয় গোয়েন্দা পুলিশের বিশেষ পেট্রোল কার। বিশেষ মিশন ছাড়া এ গাড়িগুলোকে রাস্তায় ছাড়া হয় না।’
‘তাহলে?’
কেলা এলভা উঠে দাঁড়িয়ে স্টিয়ারিং হুইলের দিকে হাত বাড়িয়ে বলল, ‘আপনি পাশের সিটে, তারপর পেছনে চলে আসুন। আমি ড্রাইভিং-এ বসছি।’
কেলা এলভা ড্রাইভিং সিটে বসে হাসতে হাসতে বলল, ‘এভাবে ড্রাইভিং সিট ছেড়ে দেয়া কি ঠিক হলো মিঃ আহমদ মুসা?’
‘ড্রাইভিং সিট ছেড়ে দিয়েছি, কিন্তু আপনার নিয়ন্ত্রণ ছেড়ে দেইনি।’ বলল আহমদ মুসাও হাসতে হাসতে।
সামনের গাড়িটি এসে পড়েছে। হর্ন বেজে উঠল সামনের গাড়ি থেকে।
সংগে সংগে কেলা এলভাও হর্ন বাজাল একই নিয়মে, ঠিক আগের হর্নের আক্ষরিক অনুসরণ।
হর্ন বাজিয়েই থামিয়ে দিয়েছিল গাড়ি কেলা এলভা।
সামনের গাড়িটারও ড্রাইভিং উইনডো কেলা এলভার পাশাপাশি এসে দাঁড়াল।
সামনে থেকে গাড়ির ড্রাইভার হাত তুলে এস্টোনীয় ভাষায় বলল, ‘আমি সার্কেল ইন্সপেক্টর কেভিন।’
‘আমি সেন্ট্রাল ইন্সপেক্টর কেলা এলভা।’
চমকে উঠল ইন্সপেক্টর কেভিন। বলল, ‘এই যে খবর এল, আহমদ মুসা আপনাকে পণবন্দী করে পালিয়েছে? নির্দেশ এসেছে সবগুলো রাস্তা ক্লোজ করার।’
‘পালিয়েছে আহমদ মুসা। খুঁজছি আমিও তাকে।’
‘তাহলে জানিয়ে দিন এ খবরটা।’
‘আমার তো ওয়্যারলেস নেই।’
‘বুঝেছি। আমি জানিয়ে দিচ্ছি। ওরা কারা পেছনে?’
‘ফরাসী দম্পতি। আমার বন্ধু।’
বলে কেলা এলভা গাড়িতে স্টার্ট দিল।
স্যালুট দিল হাত তুলে ইন্সপেক্টর কেভিন।
ছুটে চলল কেলা এলভার গাড়ি।
‘ধন্যবাদ আপনাকে।’ পেছন থেকে কেলা এলভাকে লক্ষ্য করে বলল আহমদ মুসা।
‘ধন্যবাদ দরকার নেই। এবার কি করব বলুন।’ বলল কেলা এলভা।
‘কিন্তু তার আগে বলুন, অবস্থা কি দাঁড়াল। আমরা আপনাকে ফেলে পালিয়েছি এবং আপনি একটি ফরাসী দম্পতিকে পথ থেকে কুড়িয়ে আমাদের অনুসরণ করছেন, এই তো?’
‘জ্বি, হ্যাঁ।’
‘কিন্তু আপনাকে ফেলে আপনার গাড়ি নিয়ে আমার পালানোর কথা। আপনি গাড়ি পেলেন কি করে?’
‘এটা একটা প্রশ্ন বটে।’ একটু চিন্তা করল কেলা এলভা। তারপর বলল, ‘আমার গাড়ি লক করে চাবি ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে এই ফরাসী দম্পতির অধিকতর দ্রুতগামী নতুন গাড়ি নিয়ে আপনি পালিয়েছেন। চাবি খুঁজে পেতে বিলম্ব হয়। তারপর আপনাকে আমরা অনুসরণ করছি।’
‘ধন্যবাদ। আপনার কাহিনী সুন্দর। আর একটা কথা, ফরাসী দম্পতির গাড়ির কি পার্টিকুলারস পুলিশকে দেবেন?’
‘অযথা এই প্রশ্ন তুলছেন। পুলিশের কাছে জওয়াবদিহির পর্যায়ে অবশ্যই আমি নিজেকে নিয়ে যাবো না।’
কথা শেষ করেই কেলা এলভা আবার সেই পুরানো প্রশ্ন করল। বলল, ‘বলুন এখন কি করণীয়। সামনে শহরের প্রবেশমুখে পুলিশ সদলবলে আছে নিশ্চয়।’
‘আপনার কাহিনী দ্বিতীয় জায়গায় বলা আর ঠিক মনে করছি না। আপনার গাড়ির নেমপ্লেট উল্টে দিলে কেমন হয়?’
কেলা এলভা হাসল। বলল, ‘উল্টো দিকে একটা ভুয়া নাম্বার আছে।’
‘আল্লাহকে ধন্যবাদ। গাড়ি তাহলে থামান মিস…।’
বলতে গিয়ে থেমে গেল আহমদ মুসা। বলল পরক্ষণেই, ‘মাফ করবেন, আপনি মিস না মিসেস?’
কেলা এলভার হাস্যোজ্জ্বল মুখ হঠাৎ অন্ধকার হয়ে গেল।
গাড়ি থামাল সে। বলল, ‘ও প্রশ্ন থাক। গাড়ির নেমপ্লেট পাল্টে দেব?’ কেলা এলভার কণ্ঠস্বর হঠাৎ যেন ভিজে গেছে।
আহমদ মুসা এবং ডোনা কারোরই ব্যাপারটা দৃষ্টি এড়াল না।
কেলা এলভা গাড়ি থেকে নেমে পড়েছে।
আহমদ মুসাও নামল। বলল, ‘নেমপ্লেট আমিই পাল্টে দিচ্ছি, আপনি বসুন।’
ভারি হয়ে ওঠা মুখে হাসি টানার চেষ্টা করে বলল কেলা এলভা, ‘আমার গাড়ি, কাজটা আমিই দ্রুত পারব।’ বলে কাজে লেগে গেল কেলা এলভা।
আহমদ মুসাও গাড়ির পেছনের নেমপ্লেট উল্টে দেয়ার কাজে লেগে গেল।
কাজ শেষে কেলা এলভা আহমদ মুসার সামনে এসে বলল, ‘এবার?’ কেলা এলভার মুখে হাসি। অনেকখানি সহজ হয়ে উঠেছে সে।
‘আপনি পেছনে ডোনার পাশে বসুন। আমি ড্রাইভিং-এ বসব।’
‘কিন্তু…।’
তাকে বাঁধা দিয়ে আহমদ মুসা বলল, ‘এখনি সব বুঝবেন। আপনি বসুন।’
বলে আহমদ মুসা ড্রাইভিং সিটে গিয়ে বসল।
কেলা এলভাও পেছনের সিটে গিয়ে বসল।
‘ডোনা, ব্যাগ থেকে পাগড়ি ও শিখের দাড়িটা দাও।’
ডোনা ব্যাগ থেকে শিখের পাগড়ী ও দাড়ি বের করে আহমদ মুসার দিকে এগিয়ে দিল।
আহমদ মুসা এগুলো নিয়ে পরতে পরতে বলল, ‘ডোনা, ওকে তোমার পাগড়ী ও দাড়িটা বের করে পরিয়ে দাও।’
পাগড়ী ও দাড়ি পরতে গিয়ে কেলা এলভা হাসতে হাসতে বলল, ‘বুঝেছি এবার। আমি ও মিসেস ডোনা হলাম শিখ দম্পতি। আর আহমদ মুসা সাহেব হলেন শিখ ড্রাইভার। কিন্তু আমাদের দেশে শিখ ড্রাইভার তো নেই বললেই চলে।’
‘তা ঠিক। তবে জন দশেক তো আছে।’
চোখ কপালে তুলে কেলা এলভা বলল, ‘জানেন আপনি এ তথ্যও?’
‘এটা কি খুব বড় তথ্য? হেলসিংকিতেই এটা আমি পেয়েছি।’
‘ঠিক তাই। আপনি যে আহমদ মুসা, একথা আমি ভুলেই গিয়েছিলাম।’
কেলা এলভার কথা এড়িয়ে আহমদ মুসা বলল, ‘এই ছদ্মবেশ কোন কাজ দেবে বলে মনে করেন?’
‘না দেবার কারণ দেখি না। তবে পুলিশকে প্রকৃতপক্ষে কি নির্দেশ দেয়া হয়েছে আমি জানি না।’
গাড়ি আহমদ মুসার ছুটে চলল।
খুব সামনেই ‘পেদে’ নামের একটা বড় শহর।

রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে একজন পুলিশ অফিসার লাল পতাকা নাড়ছে।
আহমদ মুসা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখল সামনের পরিস্থিতিটা।
বড় একটি পুলিশ ভ্যান দাঁড়িয়ে আছে রাস্তার পাশে। তার সমান্তরালে রাস্তার উপর দাঁড়িয়ে আছে একটা পুলিশ জীপ। একজন উচ্চপদস্থ অফিসার বসে আছে জীপে। পুলিশ ভ্যান, জীপ ও রাস্তায় দাঁড়ানো মোট পুলিশ দশ-বারো জন।
আহমদ মুসা গাড়ি নিয়ে দাঁড় করাল জীপটির সামনে রাস্তার ঠিক মাঝ বরাবর। জীপ এবং পুলিশ ভ্যান দুটোই তার ডান পাশে থাকল।
আহমদ মুসার গাড়ি থামতেই ছুটে এল জীপে বসা পুলিশ অফিসারটি। ড্রাইভিং উইনডো’তে এসে পুলিশ অফিসারটি বলল, ‘সিংজী, আপনি কোত্থেকে আসছেন?’
‘তাল্লিন।’
‘সাথে ওরা কে?’
‘একটা শিখ দম্পতি।’
‘কোথায় যাবেন?’
‘তারতু।’
‘একটু থানা হয়ে যেতে হবে সিংজী।’
‘কেন?’
‘নির্দেশ হয়েছে, সব বিদেশীকেই থানার সাথে কথা বলে যেতে হবে। সার্চ করা ও কথা বলার পর চলে যাবেন।’
‘কিন্তু আমি তো এক মিনিট সময়ও দিতে পারবো না।’
‘পারতে হবে সিংজী, এটা নির্দেশ।’
‘এটা অন্যায়।’
‘দুঃখিত সিংজী।’ বলে পুলিশ অফিসারটি পাশে দাঁড়ানো পুলিশের দিকে চেয়ে বলল, ‘তুমি সিংজীকে নামিয়ে গাড়ি নিয়ে থানায় চল। আমি সিংজীকে নিয়ে আসছি।’
আহমদ মুসা বলল, ‘ঠিক আছে অফিসার, যাচ্ছি থানায়। চলুন।’ বলে গাড়ির দরজা বন্ধ করে দিল।
‘ধন্যবাদ।’ বলে পুলিশ অফিসারটি পাশের পুলিশকে ইংগিতে আহমদ মুসার পাশের সিটে উঠতে নির্দেশ দিয়ে নিজের গাড়ির দিকে এগোলো। আর পুলিশটি গাড়ির পেছন ঘুরে আহমদ মুসার পাশে উঠার জন্যে এগোলো।
আহমদ মুসা গাড়ি স্টার্ট দিয়ে বাম হাতে শক্ত করে স্টিয়ারিং ধরে ডান হাত দিয়ে পকেট থেকে রিভলভার বের করে বিদ্যুৎ বেগে তা উপরে তুলে পর পর দু’টি গুলি ছুঁড়ল। একটি গুলি জীপের সামনের চাকা, অন্যটি পুলিশ ভ্যানের সামনের চাকা গুঁড়িয়ে দিল।
আর গুলির সাথে সাথেই আহমদ মুসার গাড়ি বিদ্যুৎ বেগে ছুটে চলল সামনের দিকে।
কি ঘটে গেল বুঝে উঠতে উঠতে আহমদ মুসার গাড়ি লক্ষ্যে বন্দুক তোলার আগেই গাড়ি তাদের নাগালের বাইরে চলে এল।
শহরে প্রবেশ করল আহমদ মুসার গাড়ি।
আহমদ মুসা পেছন দিকে তাকিয়ে কেলা এলভাকে লক্ষ্য করে বলল, ‘কোন আড়াল পাওয়া যাবে গাড়ির নেমপ্লেট পাল্টাবার?’
‘একটু সামনে বাঁ দিকে যাবার একটা রাস্তা পাওয়া যাবে, সেটা একটা পার্কের পাশ দিয়ে গেছে।’
‘ধন্যবাদ।’
পার্ক পাওয়া গেল। পার্কে গাড়ি একটা ঝোপের আড়ালে দাঁড় করিয়েই আহমদ মুসা লাফ দিয়ে নেমে সামনের নেমপ্লেটটা ‍উল্টে দেবার কাজে লেগে গেল। আর কেলা এলভা পেছনের নেমপ্লেটটা উল্টিয়ে লাগিয়ে দিল।
আহমদ মুসা শিখের দাড়ি ও পাগড়ী খুলে ছুঁড়ে দিল ডোনার কাছে এবং কেলা এলভাকে লক্ষ্য করে বলল, ‘আপনি এবার দাড়ি-পাগড়ী খুলে কেলা এলভা সেজে ড্রাইভিং সিটে গিয়ে বসুন।’
‘ধন্যবাদ। আমি আর পারছি না দাড়ি আর পাগড়ী পরে থাকতে। চুলকাতে শুরু করেছে।’
বলে কেলা এলভা ওগুলো খুলে ডোনাকে দিয়ে ড্রাইভিং সিটে গিয়ে বসল। বলল, ‘খুবই মজার হবে। এখন ‘পেদে’ এবং সামনের রাস্তার পুলিশরা শিখ ড্রাইভারের শিখ দম্পতির গাড়ি খুঁজে মরবে। আমরা আরাম করে এগিয়ে যাব।’
কেলা এলভার গাড়ি অন্য আরেকটা পথ দিয়ে প্রধান সড়কে উঠে ছুটে চলল পুব দিকে।
রাস্তায় পুলিশের গাড়ির ছুটোছুটি। কয়েক জায়গায় কেলা এলভার গাড়ি থামাল। কিন্তু থামিয়েই তারা বলে উঠল, ‘না, এ গাড়ি নয়। শিখ ড্রাইভারের সে গাড়িতে আছে একজন শিখ পুরুষ এবং একজন মহিলা।’
গাড়ি বেরিয়ে এল ‘পেদে’ শহর থেকে।
আহমদ মুসা বলল, ‘সামনেই তো পোলি শহর। পোলি থেকে ‘ভিলিজান’ ঘুরে কি আমরা ‘তারতু’তে ঢুকব?’
‘দরকার নেই। তারতু আমার নিজের শহর। এবার আমার উপর সবকিছু ছেড়ে দিন। পুলিশ এখন বিভ্রান্ত। আর ভয় নেই।’
‘নিজের শহর মানে? তারতু আপনার জন্মস্থান?’ বলল ডোনা।
‘হ্যাঁ, আমার জন্মস্থান।’
‘কিন্তু আপনি থাকেন তো তাল্লিনে।’
‘তাল্লিন আমার চাকরী কেন্দ্র। কিন্তু বাড়ি আমার তারতু’তে।’
‘আপনার মিস্টার কোথায় থাকেন?’
মুহূর্তে মুখটা ম্লান হয়ে গেল কেলা এলভার। বেদনার একটা উচ্ছ্বাস উপচে উঠল সে মুখে।
সঙ্গে সঙ্গে কোন উত্তর দিল না কেলা এলভা। গাড়ি নিয়ে হঠাৎ ব্যস্ত হয়ে উঠল।
একটু পর কেলা এলভা মুখে হাসি টেনে বলল, ‘মিঃ আহমদ মুসা, অদ্বিতীয় আপনার পরিস্থিতি পর্যালোচনার ক্ষমতা। গাড়ির নাম্বার আর বেশ না পাল্টালে হয়তো বিপদে পড়তে হতো। কিন্তু এ চিন্তাটা আপনার মাথায় এল কি করে? আমি সহকর্মী গোয়েন্দা ইন্সপেক্টরকে যে কাহিনী বলেছি, সে কাহিনী বলেই সামনে এগোবার চেষ্টা করতাম।’
‘চিন্তাটা খুবই সাধারণ। আপনার বলা কাহিনীতে যথেষ্ট ফাঁক ছিল। ছাড়া পাওয়ার পর আপনার প্রথম দায়িত্ব ছিল হেডকোয়ার্টারে খবর দেয়া বা সেখানে হাজির হওয়া, কাউকে লিফট দেয়া নয়। সুতরাং আপনার পরিচয় নিয়ে আপনি ‘পেদে’ ঢুকলে আপনাকে অবশ্যই সেখানকার পুলিশ হেডকোয়ার্টারে তাল্লিনের সাথে কথা বলতে হতো। সেখানকার পুলিশরাও আপনার কাছে এটাই চাইতো।’ বলল আহমদ মুসা।
‘ওয়ান্ডারফুল! আপনার প্রত্যেকটা কথা সত্য। কিন্তু এমন চিন্তা আমার মাথায় আসেনি। সামনের শহর পোলি’তে এ বিপদ নেই?’
‘নেই। এখন শিখ ড্রাইভার ও শিখ দম্পতির বিষয়টা সামনে এসেছে। আপনাকে দেখলে সবাই এখন বুঝবে, আপনি বাড়িতে যাচ্ছেন।’
‘ঠিক বলেছেন।’
কথা শেষ করেই কেলা এলভা কিছু একটা বলার জন্যে মুখ খুলেছিল। তার আগেই ডোনা কেলা এলভাকে লক্ষ্য করে বলে উঠল, ‘মাফ করবেন, একটা জিজ্ঞাসা আমি ধরে রাখতে পারছি না।’
‘আমাকে?’
‘হ্যাঁ।’
মুখটা পেছনে ডোনার দিকে একটু ঘুরিয়ে হেসে বলল, ‘বলুন গ্রেট লেডি।’
‘গ্রেট লেডি! আমাকে বলছেন?’
‘আর কাকে বলব। আপনার মত মহা সৌভাগ্যবতী আর দ্বিতীয় নেই।’
‘আমি বিদ্রূপ বলে ধরে নেব।’
‘বিদ্রূপ বলে ধরে নেবেন? মিঃ আহমদ মুসাকে আপনি বিপ্লবের বিশ্বনায়ক মানেন না?’
‘তাতে কি?’
‘আহমদ মুসা বিশ্বনায়ক হলে বিশ্বনায়িকার মুকুট আপনার মাথায় ওঠে না?’
‘ও এই কথা!’ লজ্জায় রাঙা হয়ে উঠল ডোনার মুখ।
‘আপনাকে আপনি বুঝবেন না ম্যাডাম। বুঝবে আমার মত লাখো মেয়েরা।’ মুখে হাসি টেনেই বলল কেলা এলভা।
কথা শেষ করেই কেলা এলভা বলল, ‘দুঃখিত অন্য প্রসঙ্গে যাওয়ার জন্যে। আপনার জিজ্ঞাসা বলুন।’
গম্ভীর হলো ডোনা। বলল কেলা এলভাকে লক্ষ্য করে, ‘কিছু মনে করবেন না তো? ব্যাক্তিগত প্রশ্ন।’
মুখে সপ্রতিভ একটা হাসি টেনে কেলা এলভা বলল, ‘কি ব্যক্তিগত প্রশ্ন! বলুন?’
‘আমার মনে হয়েছে, আপনি মিস না মিসেস, আপনার মিস্টার কোথায়- এই দুই প্রশ্নের জবাব আপনি এড়িয়ে গেছেন। শুধু তা-ই নয়, প্রশ্ন দু’টিতে আপনি কষ্ট পেয়েছেন।’
আবার ম্লান হয়ে গেল কেলা এলভার মুখ। ধীরে ধীরে তার ঠোঁটে কান্নার মত করুণ একটা হাসি ফুটে উঠল।
অনেকক্ষণ পর বলল, ‘দুঃখিত মিসেস মারিয়া।’
বলেই একটু থামল। তারপর শুরু করল, ‘প্রত্যেকেরই জীবনে একটা ব্যক্তিগত অংশ থাকে যা তার একান্ত নিজস্ব। সেখানকার হাসি-কান্না হৃদয়ের কথার মতই সংগোপন। তবু বলছি আমি।’ থামল কেলা এলভা।
একটু পরে আবার মুখ খুলল।
সূক্ষ্ম কম্পন দেখা দিল তার ঠোঁটে। ঠোঁটের কম্পন তার বেড়ে গেল। ঠোঁট ফেঁড়ে তার কথা বেরিয়ে এল, ‘আমার স্বামী নেই- একথা বলতে আমার বুক ফেটে যাচ্ছে, আবার আছে তাও বলতে পারছি না।’
কেলা এলভার শেষের কথাগুলো ভেঙে পড়ল কান্নার চাপা উদ্দামে।
দু’চোখ থেকে তার নেমে এল দু’টি অশ্রুর ধারা।
ডোনা এবং আহমদ মুসা দু’জনেই স্তম্ভিত, বিব্রত।
পেছন থেকে ডোনা ধীরে ধীরে কেলা এলভার কাঁধে হাত রাখল। বলল, ‘আমি দুঃখিত কেলা এলভা। আমি বুঝতে পারিনি।’
কেলা এলভা ডান হাত স্টিয়ারিং-এ রেখে বাম হাত দিয়ে কাঁধে রাখা ডোনার হাত চেপে ধরল। বলল, ‘না মিসেস ডোনা। আপনি আমার উপকার করেছেন। আমার কাঁদা দরকার। না কাঁদলে আমি বাঁচব না, বুক ফেটে যাবে আমার।’
বলে কেলা এলভা কান্নায় লুটিয়ে পড়ল স্টিয়ারিং-এর উপর।
গাড়ির ব্রেক কষেছে সে। দাঁড়িয়ে পড়েছে গাড়ি।
ডোনা সিট থেকে উঠে কেলা এলভার মাথায় হাত রাখল। সান্ত্বনা দিল।
আহমদ মুসা বিমূঢ়। কর্তব্যপরায়ণ আনন্দ-উচ্ছল মেয়েটার বুকে দুঃখের এতবড় সমুদ্র লুকিয়ে আছে! দুঃখটা তার আসলে কি? স্বামী তার নেই বলেই মনে হয়। পশ্চিমী সমাজে স্বামীর সাথে বিচ্ছেদ হওয়াকে খুব বড় ঘটনা বলে দেখা হয় না। কেলা এলভার স্বামী না থাকার মধ্যে এতবড় দুঃখটা কিসের! ভেবে কোনই কূল পেল না আহমদ মুসা।
অল্প পরেই স্টিয়ারিং থেকে মাথা তুলে রুমাল বের করে চোখ মুছে পেছনে তাকিয়ে বলল, ‘ধন্যবাদ মিসেস আহমদ মুসা। আমি দুঃখিত।’
বলে সোজা হয়ে বসে গাড়ি স্টার্ট দিল। ছুটে চলল আবার গাড়ি।
কেলা এলভাই কথা শুরু করল। বলল, ‘স্যরি, খুবই আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছিলাম।’ থামল কেলা এলভা।
শুরু করল আবার, ‘জানতে চেয়েছেন আমি মিস না মিসেস, আমার স্বামী কোথায়! তিনি এস্টোনিয়া কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স-এর অপারেশন চীফ। অত্যন্ত প্রতিভাবান হিসেবে তরুণ বয়সেই তিনি এ দায়িত্ব পেয়ে যান। আজ ছ’মাস আমরা বিয়ে করেছি।’ থামল কেলা এলভা।
‘তারপর?’ বলল ডোনা।
‘বিয়ের পর দিনই তাকে একটা অপারেশনে বের হতে হয়। সে আর ফিরে আসেনি।’ শেষের কথাগুলো কান্নায় জড়িয়ে গেল কেলা এলভার।
থামল কেলা এলভা।
ডোনারাও তৎক্ষণাৎ কিছু বলল না। কিছুক্ষণ নীরবতা।
নীরবতা ভাঙল আহমদ মুসা। বলল, ‘সত্যিই এ এক মর্মান্তিক ঘটনা ম্যাডাম। আমার একটা প্রশ্ন, এই নিখোঁজ হওয়ার ব্যাপারে এস্টোনীয় গোয়েন্দা বিভাগ কি তথ্য জোগাড় করেছে?’
‘তাদের রিপোর্টে সুনির্দিষ্ট কোন তথ্যই নেই যা নিয়ে সামনে এগোনো যায়।’
‘তার ঐ অপারেশনটা কোন পক্ষ বা কোন দেশের বিরুদ্ধে ছিল?’
‘এ ব্যাপারে কোনই তথ্য নেই ঐ রিপোর্টে।’
‘রিপোর্টের সুপারিশেও কিছু নেই?’
‘কোন দেশকেই অভিযুক্ত করা হয়নি।’
‘দুঃখিত মিসেস এলভা, ঐ রিপোর্টটা ভুয়া।’
চট করে মুখ ঘুরিয়ে কেলা এলভা আহমদ মুসার দিকে একবার তাকাল। তার চোখে-মুখে বিস্ময়। বলল, ‘অল্প জেনেই একদম প্রান্তিক মন্তব্য করে ফেলেছেন। অন্য কেউ এ কথা বললে আমি হাসতাম। কিন্তু আপনার কথা আমাকে হাসার বদলে আতংকিত করেছে। কিন্তু প্রশ্ন, কেন আপনি এই রিপোর্টকে ভুয়া বলছেন?’
‘একটা দেশের কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স ডিপার্টমেন্ট যখন তার সাধারণ শত্রুও চিহ্নিত না করতে পারে, তখন বুঝতে হবে তার মধ্যে গণ্ডগোল আছে।’
‘সাধারণ শত্রু চিহ্নিত করা এবং একটি মারাত্মক অভ্যন্তরীণ ঘটনার জন্যে কোন দেশকে দায়ী করা কি এক জিনিস?’
‘এক জিনিস নয়। কিন্তু একটা দেশের কাউন্টার ইন্টেলিজেন্সের চীফ যখন কোন গুরুতর অপারেশনে বেরিয়ে নিখোঁজ হয়ে যায়, তখন অবশ্যই বিশেষ শত্রু দেশটির উপর গিয়ে নজর পড়তে হবে। রিপোর্টে এই ব্যাপারে কোন নির্দেশনা দিতে ব্যর্থ হওয়াই রিপোর্টটি ভুয়া হওয়ার প্রমাণ।’
কেলা এলভার মুখটি উজ্জ্বল হয়ে উঠল। আহমদ মুসা থামতেই সে বলে উঠল, ‘প্রত্যক্ষ প্রমাণ ছাড়াই দায়ী করা যায়, এমন শত্রু দেশ কি এস্টোনিয়ার আছে?’
‘এ প্রশ্ন তো আমিই আপনাকে করব।’
‘মাফ করবেন, আমি মিলিয়ে নিতে চাচ্ছি।’
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘সুইডেন, ডেনমার্ক, পোল্যান্ড, জার্মানী, রাশিয়া- সবাই এস্টোনিয়ার শত্রুর তালিকায় পড়ে। কিন্তু আজ এস্টোনিয়ার অস্তিত্বের শত্রু একটাই। সে হলো রাশিয়া।’
‘কেন?’
‘একমাত্র রাশিয়া ছাড়া ঐ দেশগুলোর কারোরই এই মুহূর্তে ভূখণ্ডগত সম্প্রসারণের কোন লক্ষ্য নেই। রাশিয়া বিশেষ করে রাশিয়ার একটি বিশেষ ক্ষমতাধর মহল সোভিয়েত ইউনিয়নের আকার ফিরে পেতে মরিয়া হয়ে উঠেছে।’
‘ধন্যবাদ।’ বলল কেলা এলভা।
কথা শেষ করেই বলে উঠল, ‘রাশিয়ার সেই ক্ষমতাধর মহলটি কে? সরকার? না বাইরের কেউ?’
‘আপাতত সরকার নয়।’
‘তাহলে?’
‘কারণ, সেখানে সরকারের মধ্যে সরকার আছে, সরকারের বাইরেও ছায়া সরকার আছে। কারা করেছে ব্যাপারটা বলা মুশকিল।’
‘ছায়া সরকার বলতে কি আপনি ‘গ্রেট বিয়ারকে’ ইংগিত করছেন?’
‘হ্যাঁ, তারা লেনিনীয় পন্থায় ক্ষমতা দখল করতে চাচ্ছে। ঠিক লেনিন ১৯১৭ সালে যেভাবে মেনশেভিখদের কাছ থেকে ক্ষমতা হাইজ্যাক করেছিল, ঠিক সেভাবেই।’
‘বুঝেছি। তাহলে কি আপনি নিশ্চিত, রাশিয়ারই কারও হাতে পড়েছিল আমার স্বামী?’
‘আপনার স্বামীর অপারেশন অভিযানের পথ সম্পর্কে কিছু জানতে পেরেছিলেন?’
‘তার গাড়িটি শেষবারের মত লোকেট করা হয় সামনের ‘তারতু’ থেকে উত্তরে।’
‘আমি নিশ্চিত ম্যাডাম। আপনার স্বামী রুশদের হাতেই পড়েছিল।’
উত্তরে কেলা এলভা কোন কথা বলল না। স্টিয়ারিং-এ রাখা তার ডান হাতটি শুধু মুষ্টিবদ্ধ হয়ে উঠল। তার অচঞ্চল দৃষ্টি প্রসারিত সামনের রাস্তার উপর। অনেকক্ষণ পর বলল, ‘আপনারও তো লড়াই রুশদের বিরুদ্ধে?’
‘রুশদের বিরুদ্ধে নয়, সেখানকার এক রুশ ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে।’
‘একই কথা। গ্রেট বিয়ার এখন লেনিনের প্রতিভূ, আইভান দি টেরিবলের মত জারদেরও প্রতিভূ। এক কথায়, সমগ্র রুশ মানসের প্রতিভূ।’
‘ঠিক। তবু তারা রাশিয়ার একটা গ্রুপ মাত্র।’
‘আপনার সাথে তর্কে যাবো না। রাশিয়ার সেই ষড়যন্ত্রকারী পক্ষ, আমি দেখছি, আমাদের কমন এনিমি। আপনি আমাকে সাহায্য করবেন, না আমি আপনাকে সাহায্য করব?’
‘দু’টোই প্রয়োজন।’
বলেই আহমদ মুসা কেলা এলভাকে লক্ষ্য করে বলল, ‘আপনার ‘পোলে’ শহর এসে গেল।’
‘কোন চিন্তা নেই। আমার উপর সবকিছু ছেড়ে দিন।’
কথা শেষ করেই নড়ে-চড়ে বসল কেলা এলভা। তার গাড়ির স্পীড বেড়ে গেল।

মস্কোভা নদী তীরের গ্রেট বিয়ারের সেই হেডকোয়ার্টার। পঁচিশ চেয়ারের সেই হলরুম। পঁচিশটি চেয়ারে পঁচিশ জন মানুষ। তাদের সামনে সাত ফুট উঁচু পাঁচ বর্গফুটের সেই মঞ্চ।
মঞ্চ ফুঁড়ে উঠে এল সেই সোনালী সিংহাসন। সোনালী সিংহাসনে বসা সোনালী বর্মে আপাদমস্তক ঢাকা সেই সোনালী মূর্তির মুখ থেকে নিঃসৃত হলো গমগমে এক আওয়াজ, ‘মহান রাশিয়ার সন্তানগণ, মাথা তোল।’
সামনের মঞ্চে সোনালী সিংহাসন উদয় হবার সংগে সংগে হলের পঁচিশজন মানুষ সবাই ‘মহামান্য আইভান’ বলে মাথা নিচু করেছিল।
তারা মাথা তুলল সবাই।
ধ্বনিত হলো সোনালী ছায়ামূর্তির কণ্ঠ। বলল, ‘নিকোলাস বুখারিন, প্রথমবার এবং শেষবারের মত তোমার ব্যর্থতাকে মাফ করে দেয়া হয়েছে এই বিবেচনায় যে, আহমদ মুসার কাছে তোমার পরাজয়ের কারণ আহমদ মুসার চেয়ে পেছনের গাড়িটার কৃতিত্বই বেশি, যার উপর তোমার কোন হাত ছিল না।’
নিকোলাস বুখারিনের মুখ ছিল ফাঁসির আসামীর মত। সোনালী ছায়ামূর্তি ‘আইভান দি টেরিবল’-এর ঘোষণা ধ্বনিত হবার সাথে সাথে তার উদ্দেশ্যে আভূমি নত হয়ে গেল নিকোলাস বুখারিনের মাথা।
আবার ধ্বনিত হলো ছায়ামূর্তির কণ্ঠ, ‘নিকোলাস বুখারিন, পরের বক্তব্য তুমি সবার অবগতির জন্যে বল।’
‘মহামান্য আইভান, পরের বক্তব্যও ব্যর্থতার এক করুণ কাহিনী’, কান্নার মত করুণ কণ্ঠে বলতে শুরু করল নিকোলাস বুখারিন, ‘গোটা এস্টোনিয়ায় তার চিহ্ন খুঁজে পাওয়া যায়নি। আমার আবেদনের পর এস্টোনিয়া সরকার ত্বরিৎ যে পদক্ষেপ নিয়েছে, তা যথোপযুক্তই ছিল। আহমদ মুসার হাত থেকে কেলা এলভাকে উদ্ধার করার মধ্যে তাদেরও স্বার্থ ছিল। কিন্তু সমস্ত রাস্তা বন্ধ করে দিয়েও আহমদ মুসার দেখা পাওয়া যায়নি। কেলা এলভাকে রাস্তায় ছেড়ে সে কোথাও সটকে পড়েছে। সন্দেহ করা হচ্ছে, যে শিখ ড্রাইভার ও শিখ দম্পতির সাথে পুলিশের সংঘাত হয়েছে, তাদের একজন আহমদ মুসা হতে পারেন। এই ঘটনার পর শিখ ড্রাইভার ও শিখ দম্পতিও হাওয়া হয়ে যায়। এই ঘটনার পর এস্টোনীয় পুলিশ কোন রাস্তাতেই সন্দেহজনক আর কিছু পায়নি। তবে একটা জিনিস পরিষ্কার, আহমদ মুসা লেক ‘পাইপাস’-এর দিকে এসেছে।’
‘মাজুরভ, তোমার গোয়েন্দা রিপোর্ট কি বলে?’
মাজুরভ উঠে দাঁড়িয়ে আভূমি একটা বাউ করে বলল, ‘মহামান্য আইভান, আমরা মনে করছি, কেলা এলভার গাড়িতে যে দম্পতি ছিল, সেটা আহমদ মুসা দম্পতি। কেলা এলভা বুলেটের মুখে মিথ্যা কথা বলেছে। আবার কেলা এলভা এবং আহমদ মুসা দম্পতিই শিখ ড্রাইভার ও শিখ দম্পতি সেজেছিল। পোলে ও তারতু শহরে প্রবেশের সময় কেলা এলভা এবং আহমদ মুসাদের কোন ছদ্মবেশ ছিল না। কিন্তু এস্টোনীয় পুলিশ তাদের কোন সন্দেহ করেনি। আহমদ মুসা কেলা এলভাকে পুতুলের মত ব্যবহার করেছে। কিন্তু তারতু প্রবেশের পর তারা নিখোঁজ হয়ে গেছে। খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, কেলা এলভা তার বাড়িতে যায়নি। সন্দেহ করা হচ্ছে, আহমদ মুসা লেক পাইপাসের পথে রাশিয়া প্রবেশ করেছে। পুশকভ শহর থেকে উত্তরে লেক পুশকভের পূর্ব তীরের অল্প পানিতে দু’টি গামবুট এবং একটি ডুবে যাওয়া নৌকা পাওয়া গেছে। মনে করা হচ্ছে, আহমদ মুসা দম্পতি এগুলো ব্যবহার করেছে। আহমদ মুসা পুশকভ থেকে মস্কো কিংবা সেইন্ট পিটার্সবার্গের দিকে যেতে পারে। আমরা এ দু’শহরগামী সব পথের উপর চোখ রেখেছি।’ থামল মাজুরভ।
সে থামতেই সোনালী ছায়ামূর্তির কণ্ঠে ধ্বনিত হলো, ‘মাজুরভ, তুমি যে মহাকাব্য পাঠ করলে, তার মহানায়ক দেখা যাচ্ছে আহমদ মুসা। যে রাশিয়ার বীর সন্তান জেনারেল বোরিস ও যুবরাজ পিটারসহ অসংখ্য রুশ-সন্তানের হত্যাকারী রাশিয়ার নাম্বার ওয়ান শত্রু। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, তোমার বর্ণনায় সে অপ্রতিরোধ্য। লজ্জা করল না তোমার এসব কথা বলতে?’ থামল ছায়ামূর্তি আইভান দি টেরিবল।
মাজুরভ কোন কথা বলল না। অসহায়ের মত বাউ করল সোনালী মূর্তি আইভানকে।
মাজুরভ গ্রেট বিয়ারের গোয়েন্দা প্রধান।
এবার সোনালী মূর্তি আইভানের কণ্ঠ ধ্বনিত হলো ভ্লাদিমির খিরভকে লক্ষ্য করে। খিরভ গ্রেট বিয়ারের অপারেশন ফরচুন প্রজেক্ট-এর প্রধান। অপারেশন ফরচুন প্রজেক্ট-এর লক্ষ্য, আহমদ মুসাকে হাতের মুঠোয় এনে রাজকীয় আংটি ও রাজকীয় ডায়েরী হাত করা এবং একই সাথে জারদের ধনভাণ্ডার কুক্ষিগত করা ও জারদের যুবরাজ্ঞী ক্যাথারিনকে হত্যা করে রুশ সরকারের নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্রে উত্তরণের উদ্যোগ বানচাল করে দেয়া।
আইভানের কণ্ঠে ধ্বনিত হলো, ‘এবার খিরভ, তুমি ব্যর্থতার কোন মহাকাব্য শোনাবে?’
খিরভ উঠে দাঁড়িয়ে ডান হাত বুকে রেখে বাউ করে বলল, ‘মহামান্য আইভান, আমরা নিশ্চিত, আহমদ মুসাকে আমাদের হাতের মুঠোয় আসতে হবে। তার মিশন হলো, ক্যাথারিনকে উদ্ধার করে রাজকীয় আংটি ও ডায়েরী তার হাতে বুঝে দেয়া। তার এ মিশনের দাবিই হলো, তাকে আক্রমণাত্মক হতে হবে এবং ক্যাথারিনকে উদ্ধারের জন্যে আমাদের খাঁচায় তাকে ঢুকতে হবে।’
একটু থামল খিরভ। তারপর আবার শুরু করল, ‘মহামান্য আইভান, ক্যাথারিনকে আমরা যেখানে রেখেছি, সেখানে শত্রু শুধু ঢুকতেই পারে, বেরুতে পারে না। সুতরাং অধৈর্য্য না হয়ে আমাদের অপেক্ষা করা দরকার, আহমদ মুসা আমাদের বড়শী কখন গিলছে। তারপরেই আমরা ডাঙায় টেনে তুলব।’
‘খিরভ, তুমি একজন জেনারেলের মত অংক কষলে, যা যুদ্ধক্ষেত্রের জেনারেলদের জন্যে প্রযোজ্য। কিন্তু আহমদ মুসা বন্দুক নির্ভর কোন জেনারেল নয়। সে একজন মাথাওয়ালা অতিসতর্ক বিপ্লবী । সে যদি জেনেই ফেলে ক্যাথারিন কোথায় আছে, তাহলে সেতো সরকারী সাহায্য নিয়েও অগ্রসর হতে পারে। তোমার জিন্দানখানা রাষ্ট্রশক্তি মোকাবিলা করার মত অবশ্যই নয়। এ সম্ভাবনার বিরুদ্ধে কি পদক্ষেপ তুমি নেবে?’ ধ্বনিত হলো সোনালী মূর্তি আইভানের কণ্ঠে।
‘মহামান্য আইভান, আহমদ মুসার সাথে রুশ সরকারের যোগাযোগ হওয়া এবং সমন্বিত একটা অভিযানের ব্যবস্থা হওয়া খুব বড় ঘটনা। আমরা তা অবশ্যই জানতে পারব এবং ক্যাথারিনকে উদ্ধারের প্রয়াস তাদের বানচাল হয়ে যাবে। সেই সাথে প্রমাণ হবে, একটা লোকহিতকর জাতীয় প্রতিষ্ঠানকে সন্দেহ করে তারা অন্যায় করেছে।’
‘তোমার আত্মরক্ষামূলক মনোভাব সম্পর্কে তুমি সতর্ক হও খিরভ। আমরা চাই না আমাদের শত্রু কিংবা সরকার আমাদের কোন আঙিনায় পা রাখার সুযোগ পাক।’ গর্জে উঠল আইভানের কণ্ঠ। গম গম করে বেজে উঠল সমগ্র হলঘর।
ভয় ছড়িয়ে পড়ল সবার চোখে-মুখে। চুপসে গেল ভ্লাদিমির খিরভের মুখ।
আইভানের গলাই আবার ঝনঝন করে উঠল। বলল, ‘বুঝেছ আমার নির্দেশ?’
‘বুঝেছি মহামান্য আইভান। শত্রু আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠার আগেই তাকে কাবু করতে হবে।’ বলল খিরভ।
‘আর এর অর্থ কি?’ ধ্বনিত হলো আইভানের কণ্ঠ।
‘আমাদের এখন প্রতি মুহূর্তের চেষ্টা হবে আহমদ মুসাকে আমাদের হাতের মুঠোয় আনা।’
‘শোন, আহমদ মুসার চেয়ে তার নববধূ কম মূল্যবান নয়। আহমদ মুসাকে কথা বলানো কঠিন। কিন্তু তার সুন্দরী নববধূকে যদি হাতে পাও, তাহলে আহমদ মুসা পাকা ফলের মত এসে হাতে পড়বে এবং পুতুলের মতই নাচানো যাবে আহমদ মুসাকে।’ বলল আইভান।
‘ধন্যবাদ, মহামান্য আইভান, আপনার এ নির্দেশ আমরা বাস্তবায়ন করব।’ বলল খিরভ মাথা নত করে।
‘সরকার কি করছে মাজুরভ?’ আইভানের লক্ষ্য এবার মাজুরভের দিকে।
মাজুরভ বলল, ‘মহামান্য আইভান, সরকার তার গোয়েন্দাদের ছড়িয়ে দিয়েছে এবং সকল চেকপোস্টকে সতর্ক করেছে। তাদের লক্ষ্য, আহমদ মুসাকে খুঁজে পাওয়া এবং তাকে সব সময় চোখে চোখে রাখা। তার যোগাযোগ ও অবস্থানের প্রতিটি স্থানকে চিহ্নিত করা। ক্যাথারিন উদ্ধার না হওয়া পর্যন্ত তারা আহমদ মুসাকে গ্রেফতার করবে না। তারা মনে করে, ক্যাথারিন উদ্ধারে আহমদ মুসা সরকারের সবচেয়ে উপকারী অস্ত্র।’ থামল মাজুরভ।
‘আহমদ মুসাকে খুঁজে পাওয়ার ক্ষেত্রে সরকারী এ উদ্যোগ থেকেও তোমরা সাহায্য পেতে পার।’ বলল আইভান।
‘অবশ্যই, মহামান্য আইভান।’ বলল খিরভ।
খিরভের কথা শেষ হতেই ঝন ঝন করে বেজে উঠল গোটা হলঘর। শোনা গেল, আইভানের ভারি ও উচ্চকণ্ঠ, ‘রাশিয়ার ঈশ্বর রাশিয়ার সহায় হোন। শোন রুশ সন্তানরা, কোন ব্যর্থতা আর বরদাশত করা হবে না।’
কথার সঙ্গে সঙ্গেই প্রায় সাত ফুট উঁচু বেদি থেকে সোনালী মূর্তি আইভানের অন্তর্ধান ঘটল।
জ্বলে উঠল হলঘরে আলো। এতক্ষণে সবার মুখে ফুটে উঠল স্বাচ্ছন্দ্য এবং কারও কারও মুখে হাসি।
সবাই হলঘর থেকে বাইরে বেরুবার জন্যে পা বাড়াল।
হলঘর থেকে বেরুবার পর ফিস-ফাস কথা শুরু হয়ে গেল তাদের মধ্যে।
পাশাপাশি হাঁটছিল মাজুরভ, খিরভ ও নিকোলাস বুখারিন।
নিকোলাসের দু’হাতে ব্যান্ডেজ। একটি পা আহত। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছিল সে।
মাজুরভ নিকোলাস বুখারিনের দিকে চেয়ে ঠোঁটে হাসি টেনে বলল, ‘আমি বুঝতে পারছি না বুখারিন, আহমদ মুসা বাঁচালো কেন তোমাকে নির্ঘাত মৃত্যুর হাত থেকে?’
বুখারিনের মুখে ফুটে উঠল একরাশ ঘৃণা। বলল, ‘আমি কিন্তু সংগে সংগেই বলে দিয়েছি, তার কোন অনুগ্রহ আমি চাইনি। সুযোগ পেলেই তাকে আমি হত্যা করব।’
‘এটা তো তোমার কথা বুখারিন। আমি জিজ্ঞেস করছি, সে তোমাকে বাঁচাতে এগিয়ে এল কেন নিজের জীবন বিপন্ন করে?’
‘শত্রুকে হাত করার একটা কৌশল বা তার এটা একটা ফ্যাশন।’
‘যে শত্রু মরে যাচ্ছে তাকে হাত করার প্রয়োজন কি?’
‘যা-ই বলুন, ব্যাটা ধড়িবাজ। এসব করেই নাম কিনেছে। তার কিন্তু এবার রক্ষা নেই।’
‘বুখারিন, আবেগ দিয়ে আহমদ মুসার মত শত্রুর মোকাবিলা করতে পারবে না। তাকে কাবু করতে হলে তাকে জানতে হবে। বিপদগ্রস্থ শত্রুর উপর আহমদ মুসা কখনও হাত তোলেনি, বরং তাকে সাহায্য করেছে। এটা আহমদ মুসার চরিত্রের একটা দিক। এটা জানা থাকলে এর সুযোগ তুমি নিতে পার।’ বলল ভ্লাদিমির খিরভ।
‘এটা তার বড়ত্ব জাহিরের একটা অহমিকা।’ বলল বুখারিন।
‘কিন্তু এ ধরনের বড়ত্ব জাহিরের জন্যে বড় মন ও বড় সাহস দরকার।’ বলল খিরভ।
‘এর দ্বারা আপনি কি বলতে চাচ্ছেন?’ বলল আবার বুখারিন।
‘বলতে চাচ্ছি, আহমদ মুসা অনেক বড় শত্রু। এ পর্যন্ত সে লক্ষ্য অর্জনে কোথাও ব্যর্থ হয়নি। সুতরাং তাকে ছোট করে নয়, বড় করে দেখেই তার বিরুদ্ধে অগ্রসর হতে হবে। আমাদের এ বারের ব্যর্থতা শুধু আমাদের নয়, রাশিয়ার ভবিষ্যতকেই ধ্বংস করবে।’
সবার মুখ গম্ভীর হয়ে উঠল। তাদের সামনে ভেসে উঠেছিল আইভানের আজকের শেষ কথা, ‘কোন ব্যর্থতাই আর বরদাশত করা হবে না।’
কিছুক্ষণ নীরবতা তাদের মধ্যে।
নীরবতা ভাঙল খিরভ। বলল, ‘আহমদ মুসার লক্ষ্য কি সেইন্ট পিটার্সবার্গ না মস্কো?’
‘আহমদ মুসা সময় নষ্ট করার পাত্র নয়। ক্যাথারিন যেখানে বন্দী আছে মনে করবে সেখানেই সে যাবে।’ বলল মাজুরভ।
‘আহমদ মুসা কি ভাবছে, সেটাই প্রশ্ন। গ্রেট বিয়ারের পুরানো হেডকোয়ার্টার সেইন্ট পিটার্সবার্গে। তাছাড়া সেখানে গ্রেট বিয়ারের তৎপরতাও বেশি। সুতরাং আহমদ মুসা সেইন্ট পিটার্সবার্গকে ক্যাথারিনকে লুকিয়ে রাখার স্থান হিসেবে চিহ্নিত করতে পারে। মস্কোতে গ্রেট বিয়ারের নতুন হেডকোয়ার্টারের সন্ধান তার জানার কথা নয়। এরপরও রাজধানী মস্কোতেও সে আসতে পারে।’ বলল খিরভ।
‘এস্টোনিয়া দিয়ে তার প্রবেশ থেকে মনে হয়, সেইন্ট পিটার্সবার্গ হয়ে সে মস্কো আসবে।’ বলল মাজুরভ।
কিন্তু কথা শেষ করেই মাজুরভ আবার বলল, ‘পুশকভ দিয়ে সে রাশিয়ায় প্রবেশ করায় সেইন্ট পিটার্সবার্গে তার প্রথম যাওয়ার ব্যাপারটা অন্তত অর্ধেক পরিমাণে কমে গেছে।’
‘যা-ই হোক, সবদিকেই আমাদের সমান নজর দিতে হবে। একটা খুশির কথা এই, আহমদ মুসাকে চিহ্নিত করা এবার অনেক সহজ হবে। তার সাথে রয়েছে তার ফরাসী স্ত্রী।’ বলল খিরভ।
‘ঠিক বলেছেন। এটা বড় একটা প্লাস পয়েন্ট আমাদের জন্যে।’ বলল মাজুরভ।
‘স্ত্রী সাথে নিয়ে আহমদ মুসার অভিযান এই প্রথম। এটা তার হবে বড় একটা দুর্বল দিক।’ খিরভ বলল।
‘মহামান্য আইভান যা বলেছেন, আহমদ মুসার স্ত্রীকে হাতের মুঠোয় পেলে সত্যি আহমদ মুসাকে পুতুলের মত নাচানো যাবে। নববধূর স্বার্থ সে সব স্বার্থের চেয়ে বড় করে দেখবে।’ বলল বুখারিন।
‘দেখ বুখারিন, তোমার চোখে কিন্তু লোভের চিহ্ন দেখছি।’ বলল খিরভ।
‘তার ফরাসী স্ত্রী দেখলে আপনারও লোভ হবে।’ বুখারিন বলল।
‘সাবধান বুখারিন। নিজের জীবনের কথা প্রথম ভেবো।’
লিফটের মুখে এসে পড়েছে ওরা তিনজন। দাঁড়ালো ওরা।
উঠে আসছে লিফট।

দক্ষিণ পুশকভের আবাসিক এলাকার ছোট বিলাসবহুল একটি বাংলো। বাংলোটির দু’তলার দক্ষিণ প্রান্তের একটি কক্ষে আহমদ মুসা ও ডোনা পাশাপাশি একটা সোফায় বসে।
বাড়িটা কেলা এলভার খালুর।
কেলা এলভার খালু বরিসভ একজন রুশ কাস্টমস অফিসার। পুশকভে সে দীর্ঘদিন ধরে রয়েছে। কেলা এলভার খালার সাথে তার বিয়ে হয় প্রেম করে তাল্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়। বরিসভ আসলে হাফ রাশিয়ান। তার মা ছিলেন এস্টোনীয়।
তারতু থেকে আসার সময় কেলা এলভা আহমদ মুসা ও ডোনাকে বার বার বলে দিয়েছিল, তারা পুশকভ কিংবা রাশিয়ার কোথাও যেন কোন হোটেল বা রেস্টহাউসে না ওঠে। উঠলেই তারা ধরা পড়ে যাবে। কারণ, গ্রেট বিয়ার এবং রুশ সরকার অবশ্যই তাদের প্রত্যেকটি হোটেল ও রেস্টহাউসে পাহারা বসিয়েছে।
কেলা এলভার অনুরোধেই আহমদ মুসা ও ডোনা কেলা এলভার চিঠি নিয়ে তার খালুর এ বাড়িতে এসে উঠেছে।
আহমদ মুসাদের সামনে বিছানো ছিল পশ্চিম রাশিয়ার একটা মানচিত্র।
আহমদ মুসা গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে মানচিত্রটি। কিন্তু ডোনার মনোযোগ সেদিকে নেই। ডোনা তার ডান হাত দিয়ে আহমদ মুসার গলা পেঁচিয়ে ধরে মাথাটা তার কাঁধে ঠেস দিয়ে বলল, ‘দেখ, কেলা এলভা আমাদের উপকার করেছে, তার স্বামীর সন্ধান কিন্তু করতেই হবে।’
আহমদ মুসা মানচিত্র থেকে মুখ তুলল। বলল, ‘ঠিক বলেছ। তার সাথে দেখা হওয়ায় অন্যদিক দিয়েও উপকৃত হয়েছি। সে যে বিশ্ববিখ্যাত এস্টোনীয় লেখক এমাস্তে এলভার নাতনি, এটা আমার জন্যে একটা বড় আবিষ্কার।’
‘দেখ মেয়েটা কত ভাল। একটুও আত্মপ্রচার নেই। তার বাড়িতে গিয়ে এমাস্তে এলভার পারিবারিক ছবি না দেখলে জানাই যেত না তার পরিচয়।’
‘সত্যিই ডোনা, ওর ঋণ শোধ হবার নয়। ‘পোলে’ ও ‘তারতু’তে তার বুদ্ধিমত্তার কারণেই আমরা ধরা পড়া থেকে বেঁচে গেছি। এমনকি তার বাড়িতেও আমরা ধরা পড়ে যেতাম। গ্রেট বিয়ার আগেই সেখানে পাহারা বসিয়েছিল। সে যদি গোপন পথে তার বাড়িতে নেয়ার ব্যবস্থা না করতো, যদি তাদের অবস্থানকে সবদিক থেকে গোপন না রাখতো এবং গোপনে যদি বের করে না আনতো তার বাড়ি এবং তারতু থেকে, তাহলে বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে পড়তে হতো আমাদের।’
‘একটা জিনিস আমি বুঝতে পারছি না। তার বাড়িতে আমরা তিনদিন ছিলাম। তার সাথে সকল আলোচনায় আমার মনে হয়েছিল, স্বামীর সন্ধান করার জন্যে রাশিয়ায় সেও আমাদের সঙ্গী হবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সে এ বিষয়ে কিছুই বলল না, কিছুই করল না।’
‘ধন্যবাদ ডোনা। আমিও এ রকমই ভেবেছি।’
একটু থামল আহমদ মুসা। তারপরেই আবার বলল, ‘সে তো সরকারী চাকুরে। চাইলেই যা ইচ্ছা তা করতে পারে না।’
‘তা-ই হবে।’ বলল ডোনাও।
আহমদ মুসা ডান হাত দিয়ে ডোনার মুখ একটু উঁচু করে তুলে ধরল। ঘনিষ্ঠভাবে চোখ রাখল ডোনার মুখে।
ডোনার মুখ রাঙা হয়ে উঠল লজ্জায়। বলল, ‘এভাবে দেখছ কেন?’
আহমদ মুসা হাসল। বলল, ‘এই যে বাড়ি, এমন একটা শান্তির নীড়ে তোমাকে মানায় বেশি।’
‘এমন কথা বলছ কেন?’
‘সুন্দর এই বাংলোতে তিনদিন আমাদের ভালোভাবে কাটল, তাই।’
‘ও, অভিযানের কথা ভাবছ। এই নরম শরীর নিয়ে আমি তোমার অভিযানে শরীক হতে পারবো না ভয় করছ?’
‘ভয় করছি না। সব ব্যাপারে আল্লাহর উপর ভরসা করি। তবু ভাবনা তো হয়ই। যাকে নিয়ে যত আশা, যত স্বপ্ন, তাকে নিয়ে তত উদ্বেগ তো হবেই।’
ডোনা তার মুখ আহমদ মুসার কাঁধে জোরে চেপে বলল, ‘আল্লাহই আমাকে এ পথে এনেছেন। তিনিই ভরসা।’ ভারি হয়ে উঠেছে ডোনার কণ্ঠ।
আহমদ মুসা ডোনার পিঠে সান্ত্বনার হাত বুলিয়ে বলল, ‘তুমি প্রস্তুত তো?’
‘হ্যাঁ।’
‘দু’টো গাড়ি ডাকতে বলেছি। ইনশাআল্লাহ, ক’মিনিটের মধ্যেই আমরা বেরুব।’
‘দু’টো গাড়ি কেন?’
‘তোমার জন্যে একটা, আমার জন্যে একটা।’
‘আমরা ভিন্ন দুই পথে যাব?’ ম্লান হয়ে উঠেছে ডোনার মুখ, তার কণ্ঠ শুষ্ক।
‘না, পথ আমাদের একটাই। যা তোমাকে বলেছি, পুশকভ থেকে বেরিয়ে দক্ষিণমুখী রোড ধরে ‘ওরসা’। ‘ওরসা’ থেকে পূর্বমুখী রোড ধরে সোজা মস্কো।’
‘সেটা জানি, কিন্তু তাহলে দুই গাড়ি কেন?’
‘অনেক কারণে। এক, আহমদ মুসাকে চিহ্নিত করার জন্যে শত্রুর কাছে আজ এক সহজ অস্ত্র হলো, আহমদ মুসা তার ফরাসী স্ত্রী নিয়ে পথ চলছে। আলাদা চলে শত্রুপক্ষকে বিভ্রান্ত করা। দুই, আমার বিপদ হলেও তোমার বিপদ যেন না আসে। অথবা দু’জন যেন একসাথে বিপদে না পড়ি। তিন, বিপদে যাতে একে অপরকে সাহায্য করার সুযোগ হয়।’
‘অবশ্যই, এদিকগুলোর প্রত্যেকটিই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু ভিন্ন চলতে গিয়ে আমরা যদি বিচ্ছিন্ন হয়ে যাই?’
আহমদ মুসা কিছু বলতে যাচ্ছিল। এই সময় দরজায় নক হলো।
পর মুহূর্তেই ঘরে প্রবেশ করল কেলা এলভার খালু মিঃ বরিসভ।
মিঃ বরিসভ পাশের সোফায় বসতে বসতে বলল, ‘দু’টো গাড়ি ঠিক হয়েছে, এসে গেছে। একটার পুরুষ, অন্যটার মেয়ে ড্রাইভার।’
আহমদ মুসার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বলল, ‘ধন্যবাদ। মহিলা আরোহীর জন্যে মহিলা ড্রাইভার ভালই হবে। মস্কো পর্যন্ত চুক্তি তো?’
‘একজন দক্ষ লোককেই পাঠিয়েছিলাম। যে দু’টো গাড়ি এনেছে, তার ড্রাইভার আমার পরিচিত ও বিশ্বস্ত।’
‘ধন্যবাদ জনাব।’
মিঃ বরিসভের ঠোঁটে অল্প এক টুকরো হাসি। চোখে-মুখে কি একটা দ্বিধা ভাব। দ্বিধা ঠেলে বলল অবশেষে, ‘আপনারা আমার স্নেহ প্রতিম কেলা এলভার বন্ধু। কিছু না মনে করলে একটা কথা বলি।’
আহমদ মুসা মিঃ বরিসভের দিকে একবার চোখ তুলে চেয়ে বলল, ‘অবশ্যই। বলুন।’
‘কেলা এলভা গোপন করলেও প্রথম দিনেই আমি আপনাকে চিনতে পেরেছি। আপনি আহমদ মুসা। কারণ, আপনি আসার একদিন আগেই আমাদের অফিসে আপনার ছবি পৌঁছে যায়।’
আহমদ মুসা সামান্যও চমকাল না। বিস্মিতও হলো না। বলল, ‘ছবি কার তরফ থেকে পৌঁছে?’
‘গ্রেট বিয়ার এবং সরকার-উভয়ের তরফ থেকেই।’
‘ছবির সাথে কি নির্দেশ ছিল?’
‘সরকারী নির্দেশ, আহমদ মুসাকে দেখা পেলেই সে বিষয়টা সংগে সংগেই থানায় জানানো। আর গ্রেট বিয়ারের নির্দেশ, আহমদ মুসা চিহ্নিত হবার সাথে সাথে একটা টেলিফোন নাম্বারে তা জানিয়ে দিতে হবে।’
কথা শেষ করে একটা ঢোক গিলে আবার বলতে শুরু করল, ‘আপনার সামনে এগোনো অত্যন্ত কঠিন হবে। মস্কো ও সেইন্ট পিটার্সবার্গগামী যত পথ আছে, তাতে নিশ্ছিদ্র পাহারা বসানো হয়েছে। প্রত্যেক রেল স্টেশনে প্রত্যেকটা বগি সার্চ করার ব্যবস্থা করা হয়েছে। তবে আপনি যে রুট বেছে নিয়েছেন, তা কিছুটা নিরাপদ হবে। কিন্তু প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে আপনি জিজ্ঞাসাবাদের মুখে পড়তে পারেন।’
ডোনার মুখ মলিন হয়ে গেছে।
আহমদ মুসা নির্বিকার। বলল, ‘ধন্যবাদ জনাব, এই ইনফরমেশনের জন্যে।’
আহমদ মুসা থামতেই মিঃ বরিসভ বলল, ‘আপনাদের দু’জনের আলাদা যাওয়ার সিদ্ধান্ত খুবই চমৎকার হয়েছে। হতে পারে, এই একটা কারণে আপনি নিরাপদে মস্কো পৌঁছে যাবেন।’
‘এতটা নিশ্চিতভাবে বলছেন কিভাবে?’
‘আহমদ মুসা তার ফরাসী স্ত্রীসহ সফর করছে, এই খবর সব জায়গায় এসেছে। সব পাহারাদারদের চিন্তা অধিকাংশ ক্ষেত্রে এই বিষয়টির দিকেই ঘুরপাক খাবে।’
‘আপনার চিন্তা সত্য হোক।’ সহাস্যে বলল আহমদ মুসা।
‘তবে আপনাদের কিছু ছদ্মবেশ নেয়া প্রয়োজন।’
‘কি ধরনের?’
‘আপনি ফরাসী ট্যুরিস্ট অ্যাক্সোবেটদের ছদ্মবেশ নিতে পারেন। মস্কোয় কয়েকটা থিয়েটারে এখন যাত্রা চলছে। মনে হবে, আপনি সেখানে যাচ্ছেন। আপনার স্লিম শরীরে অ্যাক্সোবেট ছদ্মবেশ মানাবে ভালো।’
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘ধন্যবাদ। কিন্তু পাবো কোথায় ঐ পোশাক?’
হাসল বরিসভও। বলল, ‘আমি জোগাড় করে রেখেছি।’
‘আমি কৃতজ্ঞ। এতটা স্নেহের চোখে দেখছেন আপনি আমাদের।’ ভারি কণ্ঠ আহমদ মুসার।
‘আমারও স্বার্থ আছে বৎস।’
‘কি সেটা?’
‘কেলা এলভা লিখেছে, সে যদি আপনার সাহায্য পায়, সে নিশ্চিত, তার স্বামীর সন্ধান সে করতে পারবে। আমিও এটা মনে করি।’
আহমদ মুসা একটু ভাবল। বলল, ‘বলুন তো, কেলা এলভার স্বামীকে রুশরা কেন আটক করে রাখবে?’
‘আমি ঠিক জানি না। তবে আমার অনুমান হয়, কেলা এলভার স্বামী অত্যন্ত প্রতিভাবান গোয়েন্দা অফিসার লেনার্ট লার এস্টোনিয়ার আত্মরক্ষার সাথে জড়িত রাজনৈতিক ও সামরিক বহু কিছুই জানেন। তাছাড়া পশ্চিমী গোয়েন্দা নেটওয়ার্কের অনেক কিছুই সে জানত, যার সাথে রাশিয়ার স্বার্থও জড়িত থাকতে পারে।’
‘বুঝেছি।’ বলল আহমদ মুসা।
‘ধন্যবাদ!’ বলে বরিসভ পোশাক আনার জন্যে বেরিয়ে গেল।
নিখুঁত একজন অ্যাক্সোবেটের পোশাকে আহমদ মুসা তার গাড়ির দিকে এগোলো।
ডোনা তার পাশাপাশি চলতে চলতে বলল, ‘শেষ নির্দেশ কি আমার জন্যে?’
আহমদ মুসা হাসল। বলল, ‘একাই তোমাকে মস্কো পৌঁছতে হবে, এভাবে মন তৈরি করে রাখ। আমার কথা ভেব না। তেমন কিছু যদি ঘটেই যায়, আমি তোমাকে খুঁজে নেব। ফি আমানিল্লাহ।’
বলে আহমদ মুসা তার গাড়িতে উঠে বসল।
ডোনার গাড়ি আরেকটু সামনে।
‘ফি আমানিল্লাহ’ বলে ডোনাও কয়েক পা হেঁটে গিয়ে তার গাড়িতে উঠল। ডোনার গাড়ি আগে। আহমদ মুসার গাড়ি পেছনে। দুই গাড়ি একই সাথে স্টার্ট নিয়ে যাত্রা শুরু করল।
গাড়িতে উঠেই আহমদ মুসা গাড়ির মস্কো পর্যন্ত ভাড়া বাবদ পাঁচ হাজার রুবল বুঝিয়ে দিল ড্রাইভারকে।
ড্রাইভার ভাড়ার চেয়ে আড়াই হাজার রুবল বেশি পেয়ে একটা লম্বা স্যালুট করল আহমদ মুসাকে।
‘রাস্তায় কখন কি ঘটে বলা যায় না তো, তাই ভাড়াটা আগেই দিয়ে দিলাম।’ ড্রাইভারকে লক্ষ্য করে বলল আহমদ মুসা।
‘আপনার অনুগ্রহ স্যার।’ আবার স্যালুট করে বলল ড্রাইভার।
ছুটে চলছে দু’টি গাড়ি ওরসার উদ্দেশ্যে। ডোনার গাড়ি ও আহমদ মুসার গাড়ির মধ্যে দূরত্ব সিকি মাইলের মত।
আহমদ মুসা সিটে হেলান দিয়ে ভাবছিল তার মিশনের কথা। কোথায় রেখেছে ওরা ক্যাথারিনকে? কোথায় রেখেছে ডোনার আব্বা মিঃ প্লাতিনিকে! নিশ্চয় সে জায়গা এতটাই নিরাপদ, যেখানে সরকারেরও চোখ পড়বে না বা সরকার তা খুঁজে পাবে না। আহমদ মুসা কিভাবে তার সন্ধান করবে। সবচেয়ে সহজ পথ ওদের হাতে পড়া, তাহলেই জানা যাবে ক্যাথারিন কোথায়। কিন্তু সে মস্কো পৌঁছে সবটা বুঝে নেয়ার আগে এত তাড়াতাড়ি ওদের হাতে পড়তে চায় না।
নড়েচড়ে বসল আহমদ মুসা।
মনে পড়ল ডোনার কথা। ঠোঁটে এক টুকরো হাসি ফুটে উঠল আহমদ মুসার। বেচারী খুব মনমরা হয়ে পড়েছে। এটাই প্রথম তার বড় ধরনের একটা অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়া। ডোনার বিদায়কালীন শুকনো ঠোঁট এবং নরম হয়ে ওঠা দৃষ্টির কথা মনে পড়তেই আহমদ মুসার মনও খারাপ হয়ে গেল। সংগে সংগেই তার মন থেকে প্রার্থনার বাণী উচ্চারিত হলো, আল্লাহ তার সহায় হোন। তার সম্মান ও মর্যাদা আল্লাহ রক্ষা করুন।
আহমদ মুসা হাতঘড়ির দিকে চেয়ে ড্রাইভারকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘‘ওরসা’ খুব সামনেই না?’
‘জ্বি, হ্যাঁ। আর দু’মাইল।’
‘দেখো, আগের মতই কোন চেকপোস্ট থাকলে আমার স্ত্রীর গাড়ি তা ক্রস না করা পর্যন্ত তুমি চেকপোস্টের মুখোমুখি হবে না।’
‘মনে আছে স্যার।’
আহমদ মুসা আবার গা এলিয়ে দিল গাড়ির সিটে।

ওরসার উপকণ্ঠ।
রাস্তার একটা তেমাথা।
পুশকভ থেকে যে রাস্তাটা এসেছে তা সোজা দক্ষিণে এগিয়ে শহরে ঢুকে গেছে। আর এখান থেকেই আরেকটা রাস্তা বেরিয়ে এগিয়ে গেছে পশ্চিমে।
তেমাথার উত্তর পাশে পুশকভ রোডের পশ্চিম পাশ ঘেঁষে একটা ডিপার্টমেন্টাল স্টোর। স্টোরের সামনে প্রায় রাস্তার উপর একটা জীপ এবং একটা ছোট মাইক্রো দাঁড়িয়ে আছে। রাস্তার দু’পাশে দু’জন স্টেনগানধারী। জীপের উপর হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে দু’জন। একজনের হাতে লম্বা অ্যান্টেনার ওয়্যারলেস।
পুশকভ হাইওয়ে দিয়ে ওরসা অভিমুখে একটা ট্যাক্সি আসতে দেখে দু’জন স্টেনগানধারী স্টেনগান তুলে সতর্ক হয়ে দাঁড়াল। ওয়্যারলেসধারীসহ যে দু’জন জীপে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়েছিল, তারা সোজা হয়ে উঠল।
‘দেখ জুকভ, গাড়িটার রেজিস্ট্রেশন একেবারে পুশকভের। থামাও গাড়ি। শিকার মিলতে পারে।’
‘ইয়েস বস।’ বলে জুকভ নামের লোকটি হাত তুলে ঠিক জীপের পাশেই ট্যাক্সিটি দাঁড় করাল।
ওয়্যারলেসধারী গাড়ির ভেতরে উঁকি দিয়ে মুখ তেতো করে বিড় বিড় করে বলল, ‘দুর্ভাগ্য, একজন মাত্র ভদ্রমহিলা। আমরা তো খুঁজছি একটা সুন্দর জোড়াকে।’ তারপর ওয়্যারলেস মুখের কাছে এনে কণ্ঠ উঁচু করে বলল, ‘মস্কো জিবি এইচ কিউ স্যার?’
ওপার থেকে যান্ত্রিক কণ্ঠে জবাব এল, ‘হ্যাঁ।’
‘আমি ওরসা থেকে বলছি স্যার।’
‘কি খবর?’
‘একটা ট্যাক্সি। একজন ফরাসী ট্যুরিস্ট মহিলা। রুশ মহিলা ড্রাইভার।’
‘দেবার আর খবর পেলে না। এক ফরাসী মহিলা দিয়ে কি করব? আমরা চাই জোড়া। ছেড়ে দাও।’
‘জ্বি, স্যার।’
বলে ওয়্যারলেস অফ করে দিয়ে জুকভকে ট্যাক্সির সামনে থেকে সরে যাবার ইংগিত করে বলল, ‘ক্লিয়ার।’
‘ক্লিয়ার’ বলার সাথে সাথে ট্যাক্সিতে বসা ফরাসী ট্যুরিস্ট মহিলাবেশী ডোনা জোসেফাইন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। সেই সাথে আবার বুঝল, পৃথকভাবে চলার আহমদ মুসার সিদ্ধান্ত কত সঠিক হয়েছে।
চেকপোস্ট পেরিয়ে গাড়ি ফুলস্পীডে উঠার পর ডোনা ড্রাইভারকে লক্ষ্য করে বলল, ‘মিস রোসা, তোমার রিয়ারভিউতে পেছনের গাড়ি দেখা যায়?’
‘জ্বি, না।’ বলল ড্রাইভার।
‘তাহলে নিশ্চয় গাড়ির গতি স্লো করেছে। তা না হলে যতক্ষণ আমাদের সময় গেছে, এখানে তাতে গাড়ি দেখা যাবার কথা।’
‘তা-ই হবে।’
ডোনার গাড়ি তখন ওরসা শহরের বুক চিরে তীব্র বেগে এগোচ্ছে মস্কো হাইওয়েতে ওঠার জন্যে।
এদিকে পেছনের চেকপোস্টে তখন ভিন্ন এক দৃশ্য।
ফরাসী অ্যাক্সোবেটের ছদ্মবেশধারী আহমদ মুসার ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে আছে চেকপোস্টে জীপের পাশে রাস্তার উপর। ট্যাক্সির দু’পাশে দুই স্টেনগানধারী। সামনে সেই জুকভ হাত তুলে দাঁড়িয়ে ট্যাক্সিটিকে থামিয়ে রেখেছে। আর ওয়্যারলেসধারী ম্যালেনকভ কথা বলছে ওয়্যারলেসে।
‘ইয়েস স্যার। একজন আরোহী। ফরাসী অ্যাক্সোবেটের পোশাকে। তবে তাকে ফরাসী মনে হয় না।’
‘কি মনে হয়?’
‘এশিয়ান ধরনের।’
‘কি বললে? এশিয়ান?’
‘হ্যাঁ।’
‘এই যে একটা মেয়েকে ছেড়ে দিলে সে ফরাসী ছিল না?’
‘হ্যাঁ, ফরাসী।’
‘হ্যাঁ, মিলে যাচ্ছে। পর পর, আগে এবং পিছে। শোনো।’ উত্তেজিত কণ্ঠস্বর ওয়্যারলেসের ওপার থেকে।
সোজা হয়ে দাঁড়ালো ওয়্যারলেসধারী ম্যালেনকভ। বলল, ‘ইয়েস স্যার।’
‘অ্যাক্সোবেটকে পাকড়াও করো। আর দেখ, গোঁফটা নকল কিনা। মিলাও আহমদ মুসার ছবির সাথে।’
শোনার সাথে সাথে হুংকার দিয়ে উঠল ম্যালেনকভ। চিৎকার করে উঠল, ‘বেরিয়ে এসো অ্যাক্সোবেট।’
বলে নিজেই গাড়ির দরজা খুলে হাত ধরে টেনে নামাল আহমদ মুসাকে। লাল ধরনের লম্বা গোঁফে মারল এক টান। খসে গেল নকল গোঁফ। চিৎকার করে উঠল আবার ম্যালেনকভ, ‘এই তো আহমদ মুসা। মিলে যাচ্ছে ছবির সাথে।’
দু’জন স্টেনগানধারী ছুটে এসে আহমদ মুসার দু’পাশে দাঁড়াল। আহমদ মুসার দুই পাঁজরে স্টেনগানের দুই নল। আরও দু’জন স্টেনগানধারী নেমে এসেছে মাইক্রো থেকে।
ওয়্যারলেসে মুখ লাগিয়ে ম্যালেনকভ তখন চিৎকার করছে, ‘হ্যাঁ স্যার, জ্বি স্যার, আহমদ মুসাই। একেবারে ছবির সাথে মিলে গেছে।’
‘শোন, চিৎকার করো না। মাথা ঠাণ্ডা কর। তোমার জীপটা এখনি পাঠিয়ে দাও সেই ফরাসী মহিলার সন্ধানে। ঐ মহিলাই আহমদ মুসার স্ত্রী। তাকে যে কোন মূল্যে পাকড়াও করতেই হবে। জীপের ড্রাইভারের সাথে যাবে জুকভ এবং দুই স্টেনগানধারী। আর তুমি আহমদ মুসাকে মাইক্রোবাসে তোল। তার দু’পাশে দু’জন স্টেনগানধারীকে বসাও। তুমি আহমদ মুসার পেছনে বসো তোমার রিভলভার তার মাথায় ঠেকিয়ে। দেখ, অন্যথা না হয়। যত দ্রুত সম্ভব চলে এস মস্কোতে। তোমাদের এগিয়ে নেবার জন্যে আমরাও এগোচ্ছি। পথেই দেখা হয়ে যাবে। খুব সাবধান।’ বলল মস্কো থেকে।
‘জ্বি স্যার। অবশ্যই স্যার।’ বলে ম্যালেনকভ ওয়্যারলেস অফ করে দিয়ে চিৎকার করে উঠল জুকভের দিকে চেয়ে, ‘তুমি, মেদভ ও শেখভ জীপ নিয়ে এখনি ছোটো যে ফরাসী মহিলা গেল তাকে ধরার জন্যে। যেখানে পাও, যেভাবেই পার, তাকে ধরতেই হবে।’
বলেই জীপের ড্রাইভারের দিকে চেয়ে খেঁকিয়ে উঠল, ‘হা করে কি দেখছ। এখনও জীপে স্টার্ট দাওনি কেন?’
ড্রাইভার চমকে উঠে জীপে স্টার্ট দিল। জুকভ লাফ দিয়ে ড্রাইভারের পাশের সিটে উঠল। আর দু’জন স্টেনগানধারী মেদভ ও শেখভ জীপের পেছনে উঠে বসল।
জীপ লাফ দিয়ে স্টার্ট নিয়ে ছুটে চলল তীর বেগে ডোনা জোসেফাইনের ট্যাক্সির উদ্দেশ্যে।
জীপ চলে যেতেই ম্যালেনকভ চিৎকার করে বলল, ‘জোসেফ, নিকো, তোমরা মেহমানের পকেট সার্চ করো। তারপর নিয়ে তোল মাইক্রোতে।’
দুই স্টেনগানধারীর নাম জোসেফ ও নিকো। তাদের একজন পকেট সার্চ করল আহমদ মুসার। পেল একটা রিভলভার।
ম্যালেনকভ জোসেফের কাছ থেকে রিভলভারটি নিতে নিতে আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে সোৎসাহে বলল, ‘তুমি আহমদ মুসা নও, কোন যুক্তি প্রমাণ আছে তোমার কাছে?’
‘আমার কিছুই বলার নেই।’ বলল আহমদ মুসা নির্বিকার কণ্ঠে।
‘জান তো, তোমাকে যেতে হচ্ছে মস্কোতে আমাদের সাথে?’
‘জানি।’
‘কি ব্যাপার, মনে হচ্ছে তোমার কিছুই হয়নি, তুমি বুঝতে পারছ তো সব কিছু?’
‘হ্যাঁ, বুঝতে পারছি। তোমার আনন্দে আমার খুব আনন্দ লাগছে।’
‘কেন?’
‘আহমদ মুসাকে ধরার জন্যে বড় রকম পুরষ্কার পাবে তুমি।’
‘পুরষ্কারের কথা জানি না। দেশের জন্যে কাজ করছি। আমাদের রাজত্ব এলে বড় দায়িত্ব অবশ্যই পাব।’
‘তোমাদের রাজত্ব কত দূরে?’
‘তোমাকে হাতে পাওয়া মানেই তো রাজত্ব পাওয়া।’
‘এই জন্যেই এত আনন্দ?’
‘অবশ্যই।’ বলে ম্যালেনকভ স্টেনগানধারী দু’জনকে নির্দেশ দিল আহমদ মুসাকে মাইক্রোতে তুলতে।
জোসেফ ও নিকো দু’জনে স্টেনগানের ব্যারেল দিয়ে ঠেলে আহমদ মুসাকে মাইক্রোতে তুলল। আহমদ মুসাকে মধ্যের সিটে বসিয়ে দু’পাশের সিটে দু’জন বসল আহমদ মুসার দিকে স্টেনগান তাক করে। আহমদ মুসার ঠিক পেছনের সিটে এসে বসল ম্যালেনকভ। তার হাতে রিভলভার। তাক করা আহমদ মুসার দিকে।
আহমদ মুসা মনে মনে প্রশংসাই করল ওদের, সতর্কতার মধ্যে ওদের কোন ত্রুটি নেই।
ড্রাইভার বসেই ছিল তার সিটে। ম্যালেনকভ এসে বসার সাথে সাথে গাড়ি স্টার্ট দিল ড্রাইভার।
‘মস্কোতে আমাকে কোথায় নেবে তোমরা, জেলখানায়?’ আহমদ মুসা মাথা ঘুরিয়ে জিজ্ঞেস করল ম্যালেনকভকে।
‘জেলখানায় কেন? আমরা কি সরকারের চাকর নাকি? বললাম না, আমাদের রাজত্বের জন্যে আমরা কাজ করছি।’
‘সেটা আবার কোন রাজত্ব?’
‘চল, সবই জানতে পারবে।’
‘কোথায় যেতে হবে, তোমাদের হেডকোয়ার্টারে?’
‘তাইতো যাবে।’
আহমদ মুসা খুশি হলো। তার টার্গেট, গ্রেট বিয়ারের মূল হেডকোয়ার্টার মস্কোতে না সেইন্ট পিটার্সবার্গে তা জানা। সম্ভবত মূল হেডকোয়ার্টারেই গ্রেট বিয়ার তাদের সবচেয়ে মূল্যবান বন্দী প্রিন্সেস ক্যাথারিন ও মিঃ প্লাতিনিকে আটক করে রেখেছে।
আহমদ মুসা একটু চিন্তা করে সরাসরি জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি প্রিন্সেস ক্যাথারিনকে চেন?’
‘চিনব না কেন?’ বলল ম্যালেনকভ।
‘তাকে নাকি তোমাদের সরকার ক্ষমতায় বসাচ্ছে?’
‘ছো…।’ বলে হো হো করে হেসে উঠল ম্যালেনকভ। বলল, ‘বামন হয়ে চাঁদে হাত। প্রিন্সেস ক্যাথারিনকে পাবে কোথায়?’
‘প্রিন্সেস ক্যাথারিন কোথায়?’
‘তুমি তো সাংঘাতিক লোক দেখি। কোর্টের মত জেরা শুরু করেছ। আর কোন কথা নয়। চল, সবই জানতে পারবে।’
বলে চুপ করল ম্যালেনকভ। আহমদ মুসা বুঝল, আর কোন কথাই ওর কাছ থেকে বের করা যাবে না। তবে আহমদ মুসা নিশ্চিত হলো, গেলে সে ‘সবই জানতে পারবে’ অর্থ ক্যাথারিনের বিষয়ও জানতে পারবে। তার মানে, প্রিন্সেস ক্যাথারিনের বিষয় সেখানে আলোচনা হবে, অথবা প্রিন্সেস ক্যাথারিনকে সে দেখতে পাবে।
বন্দী হওয়ায় যেটুকু উদ্বিগ্ন হয়েছিল আহমদ মুসা, এসব চিন্তা তাকে তার মিশনের ব্যাপারে আশান্বিত করলো। কিন্তু পরক্ষণেই মনটা উদ্বেগে ভরে গেল ডোনা জোসেফাইনের চিন্তায়। শয়তানদের হাতে ও ধরা পড়ে যাবে না তো!
ওরসা শহরের মধ্যে দিয়ে তখন ম্যালেনকভের গাড়ি তীব্র বেগে এগিয়ে চলেছে মস্কোর উদ্দেশ্যে।

ওদিকে আহমদ মুসাকে নিয়ে ম্যালেনকভের গাড়ি ছেড়ে দিতেই সক্রিয় হয়ে উঠল আহমদ মুসার ট্যাক্সির ড্রাইভার।
আহমদ মুসার সিটে আহমদ মুসার ব্যাগ পড়েছিল। ব্যাগটির দিকে চেয়ে ড্রাইভার ভাবল, মস্কো পর্যন্ত ভাড়া সে তো পেয়েই গেছে। সে মস্কো পর্যন্ত বন্দী আহমদ মুসার গাড়ি অনুসরণ করতে পারে। ব্যাগটি যদি ফিরিয়ে দেয়ার সুযোগ হয়, ফিরিয়ে দেবে। না হলে ব্যাগটি ফিরে এসে পৌঁছে দেবে বরিসভকে। কোথায় ওরা আহমদ মুসাকে নিয়ে যাচ্ছে, সেটাও তার জানা হয়ে যাবে। কোন সাহায্য বরিসভ তাকে করতেও পারে।
এই চিন্তার পর আহমদ মুসার ট্যাক্সি ড্রাইভার তার গাড়ি নিয়ে ছুটে চলল ম্যালেনকভের গাড়ি অনুসরণ করে।
দেখা গেল, ট্যাক্সি ড্রাইভারের গাড়ি চলা শুরু করার পর কিছু দূরে রাস্তার পাশে দাঁড়ানো একটা নতুন জীপও ছুটতে শুরু করল। জীপের ড্রাইভিং সিটে একজন তরুণী।

সূর্য ডুবে গেছে। সন্ধ্যার অন্ধকার তখনও নামেনি।
অল্প আগে ম্যালেনকভের গাড়ি বিখ্যাত স্মলেনস্ক শহর অতিক্রম করে এসেছে।
গাড়ি প্রবেশ করছে ‘দনপর’ নদীর ব্রীজে। এখানে সড়ক ও রেলপথ পাশাপাশি। দু’টো ব্রীজও প্রায় গায়ে গায়ে লাগানো। রেলওয়ে ব্রীজে তখন একটি রেলগাড়ি। প্রচণ্ড শব্দ হচ্ছে।
ম্যালেনকভের গাড়ির মধ্যে থেকেও আহমদ মুসা রেলের শব্দের মধ্যে যেন ডুবে গিয়েছিল।
হঠাৎ গাড়ির নিচে থেকেই আরেকটা প্রচণ্ড শব্দ উঠল। সেই সাথে হঠাৎ দেবে গেল গাড়ির পেছনটা প্রচণ্ড ঝাঁকি দিয়ে।
ঠিক পর মুহূর্তেই গুলির শব্দ। ঝন ঝন করে ভেঙে পড়ল গাড়ির কাঁচের জানালা। আর্তচিৎকার করে উঠল পেছন থেকে ম্যালেনকভের কণ্ঠ।
প্রথম গুলির পরপরই গর্জে উঠেছিল আরেকটা গুলির শব্দ। সেই সাথেই শোনা গেল ড্রাইভারের কণ্ঠে মরণপণ চিৎকার।
ততক্ষণে গাড়ি গিয়ে ব্রীজের প্রবেশ মুখে ব্রীজের রেলিং-এ গিয়ে ধাক্কা খেয়েছে।
আহমদ মুসা প্রথমটায় কিছু বিমূঢ় হয়ে পড়লেও পরক্ষণেই তার কাছে পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল যে, ম্যালেনকভদের গাড়ি আক্রান্ত হয়েছে।
প্রথম গুলির পরেই আহমদ মুসা গাড়ির প্রবল ঝাঁকুনিতে প্রথমে পেছনে, তারপর সামনে ঝুঁকে পড়া বিমূঢ় জোসেফ ও নিকোর মধ্যে নিকোর হাত থেকে নিজের হাতে স্টেনগান তুলে নিয়ে তার পাঁজরে গুঁতো চালিয়ে দু’হাতে স্টেনগানের দু’প্রান্ত ধরে তীব্রভাবে আঘাত করল জোসেফের ঘাড়ে।
দু’জনেই কুঁকড়ে পড়ে গেল সিটের উপর।
আহমদ মুসা স্টেনগান নিয়েই গাড়ির দরজা খুলে বেরিয়ে এল।
আহমদ মুসা দেখেছিল, ম্যালেনকভের গাড়িতে গুলি বর্ষণকারী গাড়িটি একটা জীপ এবং দ্রুত সামনে চলে গিয়েছিল।
আহমদ মুসা গাড়ি থেকে বেরিয়েই সামনে তাকাল। জীপের কোন চিহ্নই দেখল না। তাকাল পেছনে। দেখল, একটি ট্যাক্সি এসে ব্রীজের মুখে দাঁড়াল। দূরত্ব কয়েক গজ মাত্র। তখনও সন্ধ্যার অন্ধকার নামেনি। আহমদ মুসা ট্যাক্সির দিকে তাকিয়ে বিস্মিত হলো, ওটা তারই ট্যাক্সি, পুশকভ থেকে নিয়ে এসেছিল।
পরক্ষণেই আহমদ মুসা দেখল, ট্যাক্সি থেকে মুখ বাড়িয়ে ট্যাক্সি ড্রাইভার তাকে ডাকছে।
হঠাৎ সন্দেহের এক প্রবল ধাক্কা লাগল আহমদ মুসার মনে। তার ট্যাক্সিটি ম্যালেনকভের গাড়ির পেছনে কেন? ট্যাক্সি ড্রাইভার গ্রেট বিয়ারের লোক নয়তো?
আহমদ মুসা স্টেনগানের ট্রিগারে তর্জনী চেপে দ্রুত এগোলো ট্যাক্সির কাছে। বলল ড্রাইভারকে লক্ষ্য করে, ‘তুমি এখানে কেন?’
‘স্যার, গাড়িতে উঠুন। সব বলছি। এখান থেকে আগে আমরা পালাই। পুলিশ কিংবা কোন বিপদ এসে পড়তে পারে।’ বলল ড্রাইভার দ্রুত কণ্ঠে।
আহমদ মুসা চকিতে গাড়ির ভেতরটায় চোখ বোলাল, না, গাড়ির সিটে বা ফ্লোরে কেউ লুকিয়ে নেই। আহমদ মুসার ব্যাগটি পড়ে আছে পেছনের সিটে।
আহমদ মুসা স্টেনগান নিয়েই গাড়ির পেছনের সিটে উঠে বসল।
সঙ্গে সঙ্গেই গাড়ি স্টার্ট দিল ড্রাইভার।
ম্যালেনকভের গাড়িকে পাশ কাটিয়ে দ্রুত সামনে এগোলো ট্যাক্সি।
ব্রীজ পেরিয়ে বেশ কিছুদূর এসে গাড়ির গতি কিছুটা স্লো করে প্রথমেই মুখ খুলল ট্যাক্সি ড্রাইভার। বলল, ‘স্যার, আমাকে ভাড়া দিয়েছেন মস্কো পর্যন্ত। আপনাকে ওরা ধরে নিয়ে গেলে আপনার ব্যাগ রয়ে গেল আমার গাড়িতে। আমি মনে করলাম, মস্কো পর্যন্ত যাওয়া উচিত আপনাকে অনুসরণ করে। আপনাকে না পেলে আপনাকে কোথায় নিয়ে যায় দেখে অন্তত তা আমি রিপোর্ট করতে পারবো মিঃ বরিসভকে। ব্যাগও তাকে দিতে পারবো।’
‘ধন্যবাদ ড্রাইভার। তোমার বুদ্ধির প্রশংসা করছি। অথচ হঠাৎ এখানে দেখে আমি তোমাকে ওদের লোক বলে সন্দেহ করেছিলাম।’
‘ওরা কারা স্যার?’
‘গ্রেট বিয়ারকে চেন?’
‘চিনি স্যার। ওরা রাশিয়ায় ডিক্টেটরশীপ কায়েম করতে চায়।’
‘ঠিক বলেছ তুমি। এরা সেই দল।’
ড্রাইভার আর কোন কথা বলল না। কিছুক্ষণ নীরবতা।
আহমদ মুসাই আবার বলল, ‘জিজ্ঞেস করলে না আমি কে?’
‘স্যার, এত কথা কি ড্রাইভারের জন্যে মানায়?’
‘নিছক ড্রাইভার হলে মানায়।’
চকিতে মুখ ঘুরিয়ে কিছু বলতে যাচ্ছিল ড্রাইভার। তার আগেই আহমদ মুসা জিজ্ঞেস করল, ‘এসব কথা থাক। আসল কথা বল ড্রাইভার। গাড়িতে গুলি করল কে? তুমি কিছু জান?’
‘না স্যার। আমি তিনটা গুলির শব্দ শুনেছি। আমি যখন ব্রীজের মুখে এসে দাঁড়ালাম, তখন তো শুধু আপনাকেই দেখলাম। আমার প্রথমে মনে হয়েছিল, বোধ হয় আপনিই ভেতর থেকে গুলি করে বেরিয়ে এসেছেন। কিন্তু চাকায় গুলি দেখে তা আবার মনে হয়নি।’
‘একটা গাড়ি থেকে গুলি হয়েছে। গাড়িটা দ্রুত সামনে চলে গেছে।’
‘স্যার, গাড়িটা কি জীপ?’
‘হ্যাঁ, জীপ।’
‘স্যার, গুলির দু’মিনিট আগে একটা নতুন জীপ অত্যন্ত দ্রুতগতিতে আমাকে ওভারটেক করেছে। হতে পারে ঐ জীপ। কিন্তু জীপটিতে কোন আরোহী ছিল না। মনে হলো, একজন তরুণী জীপটিকে ড্রাইভ করছিল।’
‘তরুণী?’
‘হ্যাঁ, আমার তা-ই মনে হয়েছে।’
ড্রাইভারের শেষ কথাটায় চিন্তার অথৈ পানিতে পড়ে গেল আহমদ মুসা। এ ধরনের উদ্ধার অভিযান তার স্ত্রী তরুণী ডোনা জোসেফাইনের জন্যে মানায়। কিন্তু সে নয়। তার ট্যাক্সি অনেক সামনে চলে গেছে। তাছাড়া তাকে ধরার জন্যে তাকে ফলো করছে গ্রেট বিয়ারের জীপ এবং জীপটি নতুন নয়। সুতরাং কোনভাবে ডোনা জীপটি ছিনিয়ে এ অভিযান করেছে, এটাও নয়। ম্যালেনকভের গাড়ির উপর হামলা চালায় তাহলে কে? গ্রেট বিয়ারের তৃতীয় কোন শত্রু? কিংবা রুশ সরকারের কেউ? সন্দেহ নেই, গ্রেট বিয়ারের সাথে লড়াই-এ আহমদ মুসাকে জেতানোর মধ্যে সরকারের লাভ আছে। কারণ, তাতে প্রিন্সেস ক্যাথারিন উদ্ধার হয়ে যায় এবং তার মাধ্যমে সরকার জারের ধনভাণ্ডারও পেয়ে যায়। তাহলে এটা সরকারেরই কাজ। অর্থাৎ সরকারী লোক কি তাহলে তাকে অনুসরণ করছে? মনে মনে খুশি হলো আহমদ মুসা। সরকারী লোক অনুসরণ করলে ডোনা জোসেফাইনের নিরাপত্তাও হয়ে যায়। আহমদ মুসার মন উদ্বিগ্ন গ্রেট বিয়ারের জীপ ডোনার ট্যাক্সিকে অনুসরণ করার পর থেকেই।
আহমদ মুসা বলল, ‘গ্রেট বিয়ারের একটা জীপ আমার স্ত্রীর ট্যাক্সি অনুসরণ করেছে, তা দেখেছ তো?’
‘দেখেছি স্যার, ট্যাক্সির ড্রাইভার রোসা খুব চালাক এবং এক্সপার্ট স্যার। সে নিশ্চয় ব্যাপারটা বুঝবে এবং গ্রেট বিয়ারের জীপকে ঘোল খাইয়ে ছাড়বে স্যার।’
‘তুমি এতটা আশাবাদী কেমন করে?’
‘মিঃ বরিসভ সেভাবেই সিলেক্ট করেছেন স্যার। রোসাকে আমি ভালো করে জানি।’
‘তোমার কথা সত্য হোক ড্রাইভার। আমি এখন আমার স্ত্রীর সন্ধান করতে চাই। তুমি আমাকে কিভাবে সাহায্য করবে? সামনে আর কোন অসুবিধা আছে বলে মনে কর?’
‘মস্কো পর্যন্ত সামনে আর দু’টো বড় শহর আছে। ভাজমা এবং গ্যাগরিন।’
‘আমার তো মনে হয়, গ্রেট বিয়ার তার শিকার পেয়ে গেছে, এ ঘোষণা তাদের সব ক্ষেত্রে পৌঁছে গেছে এবং এ দু’টি শহরে মোতায়েন গ্রেট বিয়ারের লোকেরা ম্যালেনকভের গাড়ির অপেক্ষা করছে। অন্য কোন দিকে তাদের নজর যাবার কথা নয়।’
‘ঠিক বলেছেন স্যার। সামনে কোন অসুবিধা আর হবে না।’
‘আল্লাহ তা-ই করুন, তা-ই হোক ড্রাইভার। এস ড্রাইভার, এখন আমরা ভাবি, আমার স্ত্রীর গাড়ি আর সেই জীপটির কথা।’
‘মস্কো পৌঁছে রোসার সন্ধান আমি পাব স্যার। উভয়ে মস্কো পৌঁছার পর একটা জায়গায় আমাদের সাক্ষাৎ হবে, এই কথাই আমাদের আছে। অতএব, খবর আমরা পাচ্ছিই।’
‘ড্রাইভার, সত্যিই তোমাদের বুদ্ধিতে আমি চমৎকৃত হচ্ছি।’
‘ধন্যবাদ স্যার।’
তখন তীব্র বেগে এগিয়ে চলছে আহমদ মুসার গাড়ি। ভাজমা শহর অতিক্রমের সময় গাড়ির গতি স্লো হলো। কিন্তু কেউ গাড়ি আটকাতে এলো না, জিজ্ঞাসাবাদ করল না।
খুশি হলো আহমদ মুসা। তার অনুমান ঠিক।
ভাজমা শহর পার হবার পর আবার আহমদ মুসার গাড়ি তীব্র গতিতে ছুটল মস্কোর উদ্দেশ্যে।
আহমদ মুসা তার সিটে গা এলিয়ে দিয়েছে। তার শূন্য দৃষ্টি বাইরে সন্ধ্যার আলো-আঁধারীর বুকে নিবদ্ধ।
তার চোখের সামনে ভেসে উঠছে ডোনা জোসেফাইনের অতুলনীয় সুন্দর নিষ্পাপ মুখটি। এ মুখটি ঘিরেই আহমদ মুসার আজ নতুন স্বপ্ন, নতুন জীবন। জীবনে অনেক স্বপ্নই আহমদ মুসার ভেঙে গেছে। তাই যেন উদ্বেগের অপ্রতিরোধ্য এক যন্ত্রণা তার হৃদয়কে আজ দুমড়ে-মুচড়ে দিতে চাচ্ছে।
সিটে হেলান দেয়া আহমদ মুসার চোখ দু’টি আস্তে আস্তে বুজে গেল। তার মুখ থেকে সাহসের এক প্রার্থনা বেরিয়ে এল, ‘হাসবুনাল্লাহ, ওয়া নেয়মাল ওয়াকিল, নেয়মাল মাওলা ওয়া নেয়মান নাসির।’

ড্রাইভার রোসা উদ্বিগ্ন চোখে বার বার রিয়ারভিউ-এর দিকে তাকাচ্ছে।
হঠাৎ সে গাড়ির গতি বাড়িয়ে দিল। স্পীডোমিটারের কাঁটা সত্তর কিলোমিটার থেকে লাফিয়ে উঠল একশ’ দশে।
‘কি ব্যাপার মিস রোসা, হঠাৎ গাড়ির গতি বাড়িয়ে দিলেন যে!’
‘ওরসায় যে জীপটা আমাদের গতিরোধ করেছিল, সেই জীপটা আমাদের দিকে ছুটে আসছে।’
‘সেই জীপটা? চিনতে পেরেছেন?’
‘আমার সন্দেহ নেই, সেই জীপটাই।’
‘আমাদের লক্ষ্যে ছুটে আসছে কি করে বোঝা গেল?’ ডোনা জোসেফাইনের কণ্ঠে কিছুটা উদ্বেগ।
‘এই যে আমি গাড়ির গতি বাড়ালাম, সঙ্গে সঙ্গে জীপটির গতিও বেড়ে গেছে।’
‘এর অর্থ কি মিস রোসা?’
‘আপনি কি মনে করছেন ম্যাডাম?’
‘আমাদের দিকে ছুটে আসার অর্থ আমাকে সন্দেহ করেছে বা আমার পরিচয় জেনেছে। আর এর অর্থ, আমার স্বামীর পরিচয় ওদের কাছে প্রকাশ হয়ে পড়েছে এবং সম্ভবত উনি ওদের হাতে পড়েছেন।’ বলতে গিয়ে গলা কাঁপল ডোনা জোসেফাইনের।
‘আমারও তাই মনে হচ্ছে ম্যাডাম।’
বলে একটু থেমেই রোসা আবার বলল, ‘বলুন, এখন কি করণীয়?’
আহমদ মুসার চিন্তায় ডোনা জোসেফাইনের হৃদয় কেঁপে উঠেছিল। আহমদ মুসা ওদের হাতে পড়ার কথা ভাবতেই শ্বাসরুদ্ধ একটা যন্ত্রণার সৃষ্টি হয়েছিল তার গোটা হৃদয়জুড়ে।
কিন্তু ঠোঁট কামড়ে নিজেকে সম্বরণ করল ডোনা জোসেফাইন। একটু সময় নিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক করে তুলে রোসার প্রশ্নের জবাবে ডোনা জোসেফাইন বলল, ‘আমার স্বামী ওদের হাতে পড়ার পর এই খবর নিশ্চয় তারা সব জায়গায় দিয়েছে। সুতরাং পাহারা তুলে নেয়াই স্বাভাবিক। আর যদি আমার কথা ওদের জানিয়ে থাকে, তাহলে পাহারা থাকবে।’
বলে একটু থামল। তারপর আবার শুরু করল, ‘দ্বিতীয়টি যদি সত্য হয়, তাহলে সমস্যা দেখা দেবে। এক্ষেত্রে আমার পরামর্শ হলো, কোন অবস্থাতেই আমরা গাড়ি দাঁড় করাবো না। গাড়ি দাঁড়ানোর ভান করে, সঙ্গে সঙ্গেই আবার লাফ দিয়ে পালাতে হবে। যাতে তারা আমাদের গাড়িতে গুলি করার মত সময় হাতে না পায়। পারবেন না মিস রোসা? ভয় করলে অনুরোধ করব ড্রাইভিংটা আমাকে দিতে।’
রোসার মুখে হাসি ফুটে উঠলো। বলল, ‘পালানোর ট্রেনিং ড্রাইভারদের একটা বেসিক ট্রেনিং। দেখুন আমি কতটা পারি।’
‘ধন্যবাদ। আমি আপনাকে আরেকটু সাহায্য করব। আমি এস্টোনীয় যুবকের পোশাক নিচ্ছি। দেখা যাবে, আমাদের কেউ সন্দেহ করছে না।’
‘সুন্দর আইডিয়া।’ বলল হেসে রোসা।
ডোনা এস্টোনীয় যুবকের পোশাক পরল। মাথায় চুল ও মুখে স্কিন প্লাস্টিকের মুখোশ লাগানোর পর স্বয়ং রোসা চিৎকার করে উঠল, ‘মনে হয় ম্যাডাম, আপনার স্বামী দেখলেও এস্টোনীয় যুবক ভেবে আপনার সাথে হ্যান্ডশেক করবে।’
‘ধন্যবাদ মিস রোসা।’
রোসার কথাই ঠিক। ভাজমা শহরের প্রবেশমুখে গ্রেট বিয়ারের পাহারা ছিল। কিন্তু গাড়ির ভেতরে একবার তাকিয়েই গাড়ি ছেড়ে দিয়েছে। গাড়ি তারপর তীর বেগে ছুটেছে আবার। পেছনের জীপটা প্রায় কোয়ার্টার মাইলের মত পিছিয়ে পড়েছিল। পুরানো জীপ নতুন ট্যাক্সির সাথে পারছিল না। কিন্তু ডোনা জোসেফাইনের গাড়ি ভাজমা থামায় জীপটা প্রায় দেড়শ’ গজের মধ্যে এসে পড়েছিল। সেখান থেকে অবশ্য চিৎকার করে কিছু বলে বাঁধা দেয়ার পর্যায়ে জীপটি ছিল না
ভাজমা পার হয়ে এসে কিছু রিল্যাক্সড হয়ে রোসা বলল, ‘সামনে গ্যাগরিন, একটা শহর, তারপরেই মস্কো।
‘বোঝা গেল, গ্যাগরিনেও পাহারা থাকবে।’ বলল ডোনা জোসেফাইন।
‘গ্যাগরিনকে পাশ কাটাবার মত ডান বাম দু’দিকেই বাইপাস সড়ক আছে। যদি বলেন আমরা বাইপাস রুট নিতে পারি।’
‘পেছনে শত্রুর তাড়া রেখে সাইডে অপ্রশস্ত রোডে ঢোকা ঠিক হবে না।’
‘ঠিক বলেছেন।’
বলে রোসা পেছনে তাকিয়ে গাড়ির স্পীড আবার বাড়িয়ে দিল।
পেছনের জীপ আপ্রাণ চেষ্টা করছে ডোনা জোসেফাইনের জীপ ধরার জন্যে। কিন্তু গতির শক্তিতে কুলিয়ে উঠতে পারছে না।
সামনের স্কাই লাইনে গ্যাগরিন শহরের আলোকমালা সজ্জিত দৃশ্য খুব সামনে এসে গেছে।
হঠাৎ আঁৎকে উঠল রোসা, ‘দেখুন, আসার রাস্তা বাদ দিয়ে তাদের যাওয়ার রাস্তা ধরে চারটি হেডলাইট ছুটে আসছে সম্পূর্ণ বেআইনিভাবে।’
কথাটা রোসা ডোনা জোসেফাইনকে বলতেই ডোনা চিৎকার করে উঠল, ‘নিশ্চয় ওগুলো শত্রুর গাড়ি। সামনে থেকে আমাদের ঘিরে ফেলার চেষ্টা করছে।’
‘তাহলে বলুন ম্যাডাম, সামনেই ফ্লাইওভার আছে ডাইনের বাইপাসে যাবার।’ চিৎকার করে বলল রোসা।
‘তা-ই কর রোসা।’ দ্রুত বলল ডোনা জোসেফাইন।
ফ্লাইওভারটি তখন বলা যায় নাকের উপর। এক্সপার্ট ড্রাইভার রোসা বোঁ করে ঘুরিয়ে গাড়িকে তুলে আনল ফ্লাইওভারে।
ফ্লাইওভার থেকে ডোনার গাড়ি গিয়ে পড়ল ডাইনের বাইপাস সড়কে।
সড়কটি গ্যাগরিন শহর পাশে রেখে কয়েকটি লোকালয় স্পর্শ করে এগিয়ে গেছে মস্কোর দিকে।
বাইপাস সড়ক ধরে তীব্র বেগে ছুটে চলল ডোনা জোসেফাইনের গাড়ি।
‘মিস রোসা, পেছনে ছয়টি হেডলাইট মানে তিনটি গাড়ি আমাদের পিছু নিয়েছে।’
‘পেছনেরটি জীপ। সামনের দু’টিই মাইক্রো। সুতরাং স্পীডের দিক দিয়ে আমরা এখনও সুবিধাজনক অবস্থায় আছি।’ রোসা বলল।
‘আলহামদুলিল্লাহ।’ বলল ডোনা জোসেফাইন।
‘কি বললেন ওটা ম্যাডাম?’
‘ওটা একটা প্রার্থনা।’
‘আপনারা খুব ঈশ্বর মানেন, তাই না?’
‘সৃষ্টি করেছেন, তাই স্রষ্টাকে তো মানতেই হবে।’
‘না মানলে?’
‘না মানলে স্রষ্টার কোন ক্ষতি নেই, ক্ষতি নিজের।’
‘কেমন?’
‘কি কি করলে মানুষ, সমাজ, রাষ্ট্র সুস্থ থাকবে, সুশৃঙ্খল থাকবে, শান্তিতে থাকবে, সেগুলোই স্রষ্টা মানুষকে করতে বলেছেন। এগুলো করলে মানুষ এবং তার পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রেরই লাভ। না করলে ক্ষতি আকারে আসবে অসুস্থতা, বিশৃঙ্খলা এবং অশান্তি।’
‘অবাক কথা শোনালেন আপনি। ঈশ্বরের দেয়া কাজগুলোর কথা বললেন, সেগুলো তো রাষ্ট্রের সংবিধান এবং আইনের কাজ। কোন ধর্ম এসব বলে নাকি!’
‘বিশ্বে মানুষের জীবন ও চাহিদা সব সময় এক রকম ছিল না, তাই খোদায়ী ধর্মের ব্যবহারিক বিধান সব সময় এক রকম হয়নি। মানুষের জন্যে সর্বশেষ ও চূড়ান্ত যে ধর্ম আল্লাহ দিয়েছেন, তাতে মানুষের জীবন পরিচালনার ‍পূর্ণ দিকনির্দেশনা রয়েছে।’
‘সে ধর্ম কোনটি?’
‘ইসলাম।’
‘ও, মুসলমানদের ধর্ম।’
‘না, ইসলাম মুসলমানদের ধর্ম নয়। ইসলাম মানুষের ধর্ম। যখন মানুষ ইসলামী জীবনব্যবস্থাকে গ্রহণ করে, তখন তাকে বলা হয় মুসলমান। ‘মুসলমান’ অর্থ শান্তির পথ গ্রহণকারী, আল্লাহর বিধানের কাছে আত্মসমর্পণকারী ইত্যাদি।’
‘মানুষের জীবন পরিচালনার পূর্ণ দিকনির্দেশনা অন্য কোন ধর্মে নেই? যেমন, আমাদের খৃস্টান ধর্ম।’
‘নেই।’
‘কারণ কি? কারণ কি এটাই যে, যা আপনি বললেন, মানুষের জীবন ও চাহিদার সে রকম দাবি ছিল না?’
‘হ্যাঁ, তা-ই।’
‘বিষয়টা আরও পরিষ্কার হওয়া প্রয়োজন।’
‘যেমন, বৈঠায় যখন প্রয়োজন পূরণ হয়েছে, তখন পাল আসেনি। যখন পালে প্রয়োজন চলেছে, তখন ইঞ্জিন আসেনি। যখন ইঞ্জিনের নৌকা বা ইঞ্জিনের গাড়িতে প্রয়োজন শেষ হয়েছে, তখন উড়োজাহাজ হয়নি, ইত্যাদি। আরেকটা উদাহরণ দেয়া যায়। রাষ্ট্রের সংবিধান ও আইন প্রয়োজনের তাগিদেই ক্রমপরিবর্তনের মাধ্যমে পূর্ণতার দিকে চলে। খোদায়ী ধর্মের ব্যবহারিক বিধানের ক্ষেত্রেও তা-ই হয়েছে।’
‘ধন্যবাদ। বুঝলাম আমি। এর দ্বারা কিন্তু আরেকটা জিনিস প্রমাণ হয়ে যায়, আগের খোদায়ী ধর্মগুলো বাতিল, সর্বশেষ খোদায়ী ধর্মটাই শুধু অনুসরণযোগ্য। সত্যিই কি তাই?’
‘ধন্যবাদ। ঠিক বুঝেছেন আপনি।’
‘এটা কিন্তু খুব বড় কথা। আগের ধর্মগুলো এটা মানবে না।’
‘মানছে না বলেই তো সমস্যা। তা না হলে গোটা পৃথিবীতে আজ শান্তির রাজত্ব কায়েম হয়ে যেত।’
‘আমি ব্যাপারটা পরিষ্কার বুঝেছি। আমি মনে করি, এই স্বাভাবিক, সংগত ও যৌক্তিক বিষয়টি সকলেরই মানা উচিত।’
বলে একটু থেমে একটা ঢোক গিলেই আবার বলল, ‘ম্যাডাম, আপনি ফরাসী। শুধু তা-ই নয়, আরও যেটুকু শুনেছি, আপনি ফ্রান্সের মহামান্যা রাজকুমারী এবং অবশ্যই খৃস্টান ছিলেন। আপনি ইসলামের বিষয় এত গভীরভাবে জানলেন কি করে এবং বুঝতে পারলেন কি করে?’
রোসার মুখে নিজের পরিচয় শুনে চমকে উঠল ডোনা জোসেফাইন। মিঃ বরিসভ দায়িত্বের কারণে জেনেছেন। কিন্তু ট্যাক্সি ড্রাইভার রোসার তো জানার কথা নয়। জানলো কি করে? মিঃ বরিসভ তো এসব কথা ট্যাক্সি ড্রাইভারকে বলে দেবার কথা নয়।
ডোনা জোসেফাইন উত্তর দিতে একটু সময় নিল। কিন্তু তার মনের কৌতুহলটা চেপে গিয়ে রোসার প্রশ্নের উত্তরে বলল, ‘আমি ইসলাম শিখেছি আমার স্বামীকে দেখে, তার কাছে শুনে এবং পড়াশোনা করে।’
‘ম্যাডাম, আপনি কিন্তু সুন্দর বলতে পারেন। আমি ইসলাম সম্পর্কে পড়িওনি, তেমন কিছু শুনিওনি। কিন্তু আপনার কাছ থেকে এতটুকু শুনে আমার মনে হচ্ছে, আমার সব শোনা শেষ। আমি ইসলাম গ্রহণ করে ফেলেছি। ইসলাম গ্রহণ করতে হলে কি করতে হয়?’
‘আলহামদুলিল্লাহ!’ বলে ডোনা জোসেফাইন বিষয়টা রোসাকে বুঝিয়ে দিল।
‘বাহ, চমৎকার। খুব সোজা। একটা ঘোষণা মাত্র।’
তাদের এই আলোচনা আরও চলল।
রোসা আলোচনায় শরীক থাকলেও তার চোখ সামনের রাস্তা ও রিয়ারভিউ থেকে মুহূর্তের জন্যেও বিচ্ছিন্ন হয়নি।
মস্কো আর বেশি দূরে নয়।
মস্কোর উজ্জ্বল স্কাইলাইন চোখে লাগছে।
বাইপাস সড়কটি এখন আর বাইপাস সড়ক নেই, প্রসারতার দিক দিয়ে হাইওয়ের রূপ নিয়েছে। যাওয়ার সড়কটিতে চারটি লেন। মাঝখানে প্রশস্ত ডিভাইডার। ওপারে আসার সড়কেও চারটি লেইন।
পেছন থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে ডোনা জোসেফাইন রোসাকে লক্ষ্য করে বলল, ‘একটা ব্যাপার মিস রোসা, পেছনের পিছু নেয়া তিনটি গাড়ি ইতোপূর্বে সচেষ্ট ছিল আমাদের ধরার জন্যে। কিন্তু এখন সে চেষ্টা তাদের দেখছি না। ওরা একই গতিতে আমাদের পেছনে ছুটে আসছে।’
‘ইয়েস ম্যাডাম, আমিও এটা লক্ষ্য করেছি। বুঝতে পারছি না, এদের এই মত পরিবর্তন কেন?’
সঙ্গে সঙ্গে কথা বলল না ডোনা জোসেফাইন। চিন্তা করছিল সে। এক পর্যায়ে ডোনা জোসেফাইনের চোখে-মুখে চাঞ্চল্য দেখা দিল। সে দ্রুত কণ্ঠে বলল, ‘রোসা, তাহলে কি ওরা নিশ্চিত হয়েছে যে, আমাদের ধরার জন্যে ওদের ওমন প্রাণপণ ছোটার প্রয়োজন নেই, সামনে থেকে ওদের সাহায্য আসছে? অথবা আমাদের এভাবে তাড়িয়ে নিয়ে কি সামনে কোন ফাঁদে আটকাবার পরিকল্পনা করেছে?’
‘আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ ম্যাডাম। আপনি ঠিক চিন্তা করেছেন। এ না হলে ওদের মনোভাব পরিবর্তনের আর কোন যুক্তি নেই।’
‘তাহলে রোসা? এভাবে চলে ওদের ফাঁদে তো পড়া যাবে না।’
‘ম্যাডাম, আমরা যে সড়ক দিয়ে চলছি, সামনে তা বেঁকে গিয়ে উঠেছে লেনিন হাইওয়েতে। ঐ হাইওয়েটি মস্কোভা নদীর ‍পূর্ব পাশ দিয়ে গিয়ে পড়েছে মস্কোর সাদোভায়া রিং রোডে। হতে পারে ঐ হাইওয়ে দিয়েই ওদের কোন সাহায্য আসছে। আমরা বাঁ পাশের কোন এক্সিট রোড (ভিন্ন দিকে বেরুবার পথ) ধরে কমসোমল হাইওয়েতে গিয়ে উঠতে পারি। ঐ হাইওয়েটিও মস্কো স্টেট ইউনিভার্সিটি ও লেনিন হিলস-এর পাশ দিয়ে মস্কোভা নদী অতিক্রম করে গিয়ে পড়েছে সাদোভায়া রিংরোডে।
‘মিস রোসা, আপনি ঠিক চিন্তা করেছেন। সবচেয়ে কাছের এক্সিট রোড দিয়ে চলুন আমরা এ রোড থেকে সরে পড়ি।’
‘ইয়েস ম্যাডাম।’ বলে মাথা নাড়ল রোসা।
একটু সামনে এগিয়েই রোসা যে এক্সিট রোড দিয়ে বামে এগোলো, সেটা অপেক্ষাকৃত একটু উঁচু অধিত্যকার মত এলাকায় উঠে গেছে।
অধিত্যকা ধরে তীব্র বেগে ডোনা জোসেফাইনের গাড়ি এগোচ্ছিল।
উদ্বিগ্ন ডোনা তাকিয়ে ছিল পেছনে। পেছনের শত্রু গাড়িগুলোর দিকে। তাকিয়ে থেকেই চিৎকার করে উঠল ডোনা জোসেফাইন, ‘রোসা, আমরা যে সড়কটি ছেড়ে এলাম, সেই সড়ক ধরে উত্তর দিক থেকে ছুটে এল একটা গাড়ি। সেই গাড়ি এবং পেছনের তিনটি গাড়ি এখন ছুটে আসছে এই এক্সিট রোড ধরে।’
‘ঈশ্বরকে ধন্যবাদ, অল্পের জন্যে আমরা বেঁচে গেছি। দুই দিকের চাপে এতক্ষণ আমাদের চিড়ে-চ্যাপ্টা হতে হতো। সামনের ঐ গাড়িটারই তারা অপেক্ষা করছিল।’
‘এখন তো চারটা গাড়ি ছুটে আসছে পেছন থেকে। আমরা এভাবে কতক্ষণ আত্মরক্ষা করতে পারবো?’
‘সামনে থেকে আসা নতুন গাড়িটা কি গাড়ি মনে হচ্ছে?’
‘সামনের হেড লাইটের অবস্থান এবং পেছনের লাইটের সাথে দূরত্ব দেখে মনে হয়েছে গাড়িটা মাইক্রো।’
‘তবু রক্ষা, রাশিয়ান এ মাইক্রোগুলো তাদের স্পীড দিয়ে অন্তত আমার ট্যাক্সিকে ধরতে পারবে না। আর এই অধিত্যকায় তাদের আরও অসুবিধা হবে।’
কিছু বলল না ডোনা জোসেফাইন। তার দৃষ্টি তখনও পেছনের দিকে নিবদ্ধ।
ডোনা জোসেফাইনের গাড়ি উঠে এল কমসোমল হাইওয়েতে। ছুটে চলল তারপর তীর বেগে।
হাইওয়ের সে জংশনটি চোখের আড়াল হওয়ার আগেই ডোনা জোসেফাইন দেখল, পিছু নেয়া শত্রুর চারটি গাড়িই উঠে এসেছে হাইওয়েতে।
শত্রুর সে গাড়িগুলো বেশ পেছনে থাকলেও দুর্ভাবনা এসে ঘিরে ধরেছে ডোনা জোসেফাইনকে। সে শত্রুর কৌশল বুঝে ফেলেছে। ওয়্যারলেসে যোগাযোগের মাধ্যমে তাদেরকে সামনে ও পেছন থেকে ঘিরে ফেলার চেষ্টা করা হচ্ছে। হতে পারে দু’পাশ থেকে শত্রু আসতে পারে। ডোনা জোসেফাইন নিশ্চিত, কমসোমল হাইওয়েতে তারা উঠেছে, এটা শত্রুমহলে জানাজানি হয়ে গেছে। নিশ্চয় শত্রু পেছন থেকে যেমন, তেমনি সামনে থেকেও এখন ছুটে আসছে। উদ্বিগ্ন হয়ে উঠল ডোনা জোসেফাইন। সে তো আহমদ মুসা নয়, কিভাবে শত্রুর চতুর্মুখী এ হামলার মোকাবিলা করবে?
গাড়ি তখন ‘লেনিন হিলস’ এলাকায় পৌঁছে গেছে।
ডোনা জোসেফাইন মনস্থির করে রোসার দিকে চেয়ে বলল, ‘রোসা, আর সামনে এগোনো যাবে না। ডানে কিংবা বামে কোনদিকে গাড়ি সরিয়ে নাও।’
‘আর এগোনোই যাবে না ম্যাডাম। চেয়ে দেখুন।’ দ্রুত কণ্ঠে বলল রোসা।
ডোনা জোসেফাইন চমকে উঠে সামনে তাকিয়ে দেখল, সামনেই একটা রোড জংশন, যেখানে ফ্লাইওভারের মুখে হাইওয়ের একাংশ জুড়ে একটা কার এবং একটা জীপ দাঁড়িয়ে আছে আলো নিভিয়ে এদিকে মুখ করে।
কিছু বলতে যাচ্ছিল ডোনা জোসেফাইন। কিন্তু গাড়ির আকস্মিক ঝাঁকুনিতে মুখ থেকে কথা বেরুল না, কাত হয়ে পড়ে গেল সে সিটের উপর।
‘সংকীর্ণ হলেও একটা এক্সিট পেয়ে গেছি। মনে হচ্ছে, সরে পড়ার এটাই শেষ সুযোগ। গাড়ি ঘুরিয়ে নিলাম।’ বলল রোসা।
ডোনা জোসেফাইন উঠে বসে বলল, ‘ঠিক করেছ রোসা। আমিও এটাই বলেছিলাম।’
বলেই দ্রুত পেছনে সেই রোড জংশনের দিকে তাকাল ডোনা জোসেফাইন। দেখল, চারটা হেডলাইট এ এক্সিট রোডের দিকে ছুটে আসছে। এভাবে উল্টো দিকে আসতে দেখে ডোনা নিশ্চিত হলো, হেড লাইট নিভিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা গাড়ি দু’টি তাহলে শত্রুরই ছিল এবং তারা এখন ছুটে আসছে ডোনাদের গাড়ির লক্ষ্যে। ডোনা জোসেফাইন আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করল। অল্পখানেকের মধ্যে তৃতীয় সম্মুখ বিপদ থেকে বাঁচার আল্লাহ সুযোগ দিলেন।
ডোনা বলল আবার রোসাকে, ‘দাঁড়ানো গাড়ি দু’টি শত্রুরই। ওরা এখন ছুটে আসছে এদিকে।’
‘ম্যাডাম, এ রাস্তা দিয়ে বোধ হয় বেশি এগোনো যাবে না। মনে হচ্ছে, এটা একটা প্রাইভেট রোড। কোন অফিস বা কোন বাড়িতে গিয়ে এটা শেষ হয়েছে।’
একটা পাহাড়ের গা বেয়ে রাস্তাটা একেঁ বেঁকে উপরে উঠে গেছে। যেখানে পাহাড়ের গা’টা সমতল, সেখানে রাস্তায় কোন সাইড রেলিং নেই। আবার যেখানেই পাহাড়টা খাড়া হয়ে নিচে গেছে, সেখানেই সাইড রেলিং বা পিলার দিয়ে নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
রোসাই আবার কথা বলল, ‘ম্যাডাম, উপায় নেই, গাড়ি আমাদের ত্যাগ করতে হবে। উপরে বাসা বা অফিস যা-ই থাক, সেখানে আমরা নিরাপদ হবো না। সেখানে ওদের ছ’টি বহর গিয়ে হানা দেবে।’
‘আমি তোমার সাথে একমত রোসা।’ স্থির কণ্ঠে বলল ডোনা জোসেফাইন।
রাস্তা দু’পাশ জুড়েই ঘন ঝোপ-ঝাড়।
পাহাড়ের অনেক উপরে উঠে এসেছে তখন গাড়ি।
পাহাড়ের একটা বাঁক ঘুরে রোসা বলল, ‘ম্যাডাম, সামনে যেখানেই সমতল পাব, সেখানেই গাড়ি স্লো করবো। আপনাকে সেখানে নেমে যেতে হবে। তৈরি থাকুন।’
‘তারপর?’
‘তারপর আমি পরবর্তী খাড়া এলাকায় পৌঁছে রেলিং-এর একাংশ ভেঙে গাড়ি নিচে ফেলে দেব। আমি সরে পড়ব। আর গাড়ি নিচে পড়ে আগুনে পুড়ে ধ্বংস হয়ে যাবে। শত্রুরা ভাববে, আমরা অ্যাক্সিডেন্ট করে গাড়িসমেত ধ্বংস হয়ে গেছি। পরে আমরা দু’জন দু’জনকে খুঁজে নেব।’
‘ধন্যবাদ রোসা।’
‘ওয়েলকাম ম্যাডাম।’
ডোনা জোসেফাইন হাতের ব্যাগটাকে পিঠে ঝুলিয়ে নিল। আগে থেকেই পুরুষের পোশাক পরা ছিল, খুশি হলো, এতে সুবিধাই হবে।
উপত্যকার মত একটু সমতল জায়গায় এসে রোসা গাড়ি স্লো করল এবং সুইচ টিপে খুলে দিল দরজা।
ডোনা খোলা দরজা দিয়ে নিচে লাফিয়ে পড়ল।
গাড়িটা প্রায় ডেড স্লো হয়ে পড়েছিল, তবু একটা পা অসমান জায়গায় পড়ায় ঘুরে পড়ে গেল ডোনা পাশের ঝোপের উপর।
আসলে ঝোপটা ছিল রাস্তার সাইড রেলিংকে কেন্দ্র করে গজিয়ে উঠা নতুন লতা-পাতার ঘন আবরণ।
এই লতা-পাতার আবরণের কারণে রোসা রেলিং দেখতে পায়নি। অন্যদিকে উপত্যকার মত বলে একে সমতল ভূমি বলেই মনে করেছিল রোসা। আসলে সমতল নয়। পাহাড়ের সাংঘাতিক এক ঢালু এলাকা এটা।
ডোনা জোসেফাইনের দেহ নতুন গজানো হালকা লতা-পাতার উপর পড়ে রেলিং-এর ফাঁক গলিয়ে আছড়ে পড়ল পাহাড়ের ঢালে। ঢালের উপর পড়েই ডোনা জোসেফাইনের দেহ ওলট-পালট খেয়ে গড়িয়ে পড়তে লাগল নিচে।
পাহাড়ের এ ঢালটায় ছিল গা ভর্তি ঘাস এবং ছোট ছোট লতাগুল্ম। দেহটা আটকে যাবার মত কিংবা ধরে পতন রোধ করার মত গাছ-গাছড়া বা কোন অবলম্বন ছিল না। তার উপর মাঝে মাঝে ছিল পাথরের মত শক্ত মাটির ঢেলা এবং গাছের পুরানো মুথা। এ সবের আঘাতে ক্ষত বিক্ষত হতে লাগলো ডোনা জোসেফাইনের দেহ।
কি ঘটতে যাচ্ছে ডোনা জোসেফাইন বুঝতে পেরেছিল। সে চেষ্টা করছিল কোন অবলম্বন ধরে নিজের পতন রোধ করতে। কিন্তু পারছিল না।
শেষ পর্যন্ত ডোনা জোসেফাইন চেষ্টা করেছিল নিজের সংজ্ঞা ধরে রাখতে, যাতে কোন প্রতিকূল অবস্থায় আত্মরক্ষার ব্যবস্থা করা যায়। কিন্তু তাও পারল না ডোনা। সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলল ডোনা জোসেফাইন।

আহমদ মুসার গাড়ি কুটুজোভস্কি হাইওয়ে দিয়ে মস্কো শহরে প্রবেশ করল। এই হাইওয়ে দিয়ে মিনিট কুড়ি এগোবার পর গাড়ি ডান দিকে টার্ন নিল।
আহমদ মুসা ড্রাইভারের দিকে মুখ ঘুরিয়ে বলল, ‘পাভলভ, কোথায় যাচ্ছ?’
‘স্যার, ফরেন মিনিস্ট্রি রোডে ঢুকলাম। এখান হয়ে সাদোভায়া রিং রোডে পড়ব। তারপর পূর্বদিকে এগিয়ে টলস্টয় পার্কে প্রবেশ করব। সেখানে টলস্টয়ের বাড়ির সামনে দর্শনার্থী গ্যালারিতে রোসার সাথে আমার সাক্ষাৎ হবার কথা।’
‘ঠিক আছে। কিন্তু পাভলভ, আমি জানতাম, টলস্টয়ের বাড়িটা গোটা দক্ষিণ মস্কোর গোয়েন্দা হেডকোয়ার্টার।’
‘চিন্তার কিছু নেই স্যার। সে সোভিয়েত ইউনিয়ন নেই, সে কেজিবিও নেই।’
আধা ঘণ্টার মধ্যে আহমদ মুসার গাড়ি প্রবেশ করল টলস্টয় পার্কে।
টলস্টয় পার্ক মস্কোর সবচেয়ে বড় পার্ক। যেমন বড়, তেমনি মনোরম এ পার্ক। ইংরেজী বর্ণ ‘ইউ’-এর আকারে মস্কোভা নদী তিন দিক দিয়ে ঘিরে আছে পার্ককে। পার্কের দক্ষিণ পাশে লেনিন হিলস্‌। কমসোমল হাইওয়েটি লেনিন হিলস ও টলস্টয় পার্কের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে পড়েছে গিয়ে সাদোভায়া রিং রোডে।
টলস্টয়ের বাড়িতে দর্শক গ্যালারিতে আহমদ মুসা এবং পাভলভ অপেক্ষা করল রাত এগারটা পর্যন্ত। কিন্তু রোসার সাক্ষাৎ মিলল না।
কপাল কুঞ্চিত হলো আহমদ মুসার। ডোনা জোসেফাইন মস্কো পৌঁছার পর ট্যাক্সি আটকে রাখার কথা নয়।
পাভলভও ভাবনায় পড়ল। বলল, ‘যার বাড়িতে ম্যাডাম উঠবেন, সে বাড়ি খোঁজার জন্যে কি খুব বেশি দেরি হওয়ার কথা?’
‘অবশ্যই না। যার বাড়িতে উঠার কথা, তার সাথে কথা বলা হয়েছে পুশকভ থেকে। পরিষ্কার লোকেশন পাওয়া গেছে। চিনতে সামান্য অসুবিধা হওয়ারও কথা নয়।’
দু’জনের কেউই আর কথা বলল না।
আহমদ মুসা টেলিফোন করল সেই বাড়িতে পাবলিক বুথ থেকে। না, সেখানে ডোনা জোসেফাইন পৌঁছেনি। তাহলে কি রাস্তাতেই কোন কারণে তাদের দেরি হচ্ছে? না কোন বিপদে পড়েছে তারা?
এবার শংকা এসে ঘিরে ধরল আহমদ মুসাকে।
রাত এগারটার পর আহমদ মুসা ও পাভলভ ফিরে এল টলস্টয় পার্ক থেকে।
আবার পরদিন সেই অপেক্ষার পালা। অনিশ্চিত অপেক্ষা খুবই কষ্টকর।
আহমদ মুসা ও পাভলভ দু’জনই উদ্বিগ্ন।
তখন বেলা দশটা।
অস্থিরভাবে ঘুরছিল পাভলভ পার্কিং এরিয়ায়। কাছেই আহমদ মুসা একটা রেলিং-এ হেলান দিয়ে তাকিয়েছিল টলস্টয় হাউজ সংলগ্ন সুন্দর বাগানটার দিকে।
একটা ট্যাক্সি এসে থামল। পাভলভ ও আহমদ মুসা দু’জনেই শব্দ শুনে আগ্রহের সাথে তাকাল সেদিকে।
কিন্তু গাড়ির নাম্বারের দিকে তাকিয়ে দু’জনেই হতাশ হলো। না, ওটা রোসার গাড়ি নয়।
চোখ সরিয়ে নিতে যাচ্ছিল আহমদ মুসা। কিন্তু দেখল, ট্যাক্সি থেকে লাফ দিয়ে নামল রোসা।
রোসার দৃষ্টি পাভলভের দিকে। পাভলভও তাকে দেখতে পেয়েছে। ছুটে গেল পাভলভ রোসার দিকে।
কিন্তু রোসা খুব ঠাণ্ডা। সে পাভলভের একটা হাত ধরল মাত্র। কিন্তু উচ্ছ্বাস নেই। মুখ মলিন।
অজানা এক আশংকায় কেঁপে উঠল আহমদ মুসার মন।
পাভলভের চোখে-মুখে উদ্বেগজড়িত বিস্ময়।
আহমদ মুসা এগোলো রোসার দিকে।
আহমদ মুসার পরনে শিখ ট্যুরিস্টের পোশাক। রোসা চিনতে পারেনি আহমদ মুসাকে। একজন শিখ ট্যুরিস্টকে তার দিকে আসতে দেখে রোসা প্রশ্নবোধক দৃষ্টি তুলেছিল আহমদ মুসার দিকে।
হাসল পাভলভ। বলল, ‘রোসা, স্যারকে চিনতে পারনি? তাহলে সার্থক স্যারের ছদ্মবেশ।’
এতক্ষণে বুঝল রোসা। হাসল সেও। বলল, ‘সত্যি নিখুঁত ছদ্মবেশ।’
পরক্ষণেই হাসি মিলিয়ে গেল রোসার মুখ থেকে। ভারি ও মলিন হয়ে উঠল তার মুখ। বলল, ‘স্যার, ম্যাডামকে আমি পৌঁছাতে পারিনি। হারিয়ে ফেলেছি তাকে।’ অবরুদ্ধ এক আবেগের উচ্ছ্বাসে শেষের কথাগুলো তার ভেঙে পড়ল।
আহমদ মুসার বুকটা ধড়াস করে উঠল উদ্বেগের ধাক্কায়।
নিজেকে সামলে নিল আহমদ মুসা। কি কথা বলবে সে! হৃদয় কাঁপল তার কথা বলতে। রোসার কাছ থেকে পরবর্তী কি কথা সে শুনবে এই ভয়ে।
একটু সময় নিয়েই আহমদ মুসা শান্ত কণ্ঠে বলল, ‘বলুন, কি ঘটেছে?’
রোসা আহমদ মুসার আরও কাছে সরে এল। তারপর ধীরে ধীরে বলল সব ঘটনা। সামনে ও পেছন থেকে অব্যাহত তাড়া খেয়ে কিভাবে অবশেষে লেনিন হিলস-এর সংকীর্ণ রাস্তায় এসে পড়ল তারা, সে বিবরণ রোসা দিল। পরিশেষে বলল, ‘পেছন থেকে ছ’টা গাড়ি ছুটে আসছিল। এক সেকেন্ড নষ্ট করার সময় ছিল না। আমি উপত্যকা ধরনের সমতল জায়গা দেখে গাড়ি স্লো করেছিলাম। ম্যাডামও তৈরি ছিলেন। উনি লাফ দিয়ে নেমে পড়েছিলেন গাড়ি থেকে। পাহাড়ের আরও শীর্ষে উঠে গাড়ি পাহাড়ের নিচে ফেলে দিয়ে আমি লুকিয়ে পড়েছিলাম। ওদের ছ’টি গাড়ি এসেছিল, ওরা দেখেছিল নিচে পড়ে গিয়ে বিধ্বস্ত হওয়া প্রজ্জ্বলিত আমাদের গাড়ির দিকে। ওদের কথায় বুঝেছিলাম, ওরা বিশ্বাস করেছে অ্যাকসিডেন্টের শিকার হয়ে গাড়ির সাথে আমরাও পড়ে গেছি। এরপর ওরা সকলেই ছুটে গিয়েছিল পাহাড়ের নিচে বিষয়টা পরখ করে নিশ্চিত হবার জন্যে। ওরা চলে গেলে আমি ছুটে গিয়েছিলাম ম্যাডামকে যেখানে নামিয়ে দিয়েছিলাম সেখানে। কথা ছিল, আমরা দু’জন দু’জনকে খুঁজে নেব। কিন্তু আমি তাকে সেখানে পেলাম না। সেখানে রাস্তার আশ-পাশ পরখ করে আমি আঁৎকে উঠলাম। যাকে সমতল মনে করেছিলাম, সেটা সমতল নয়। সংকীর্ণ রাস্তার দু’পাশে লতা-পাতার আড়ালে লুকানো রেলিং ছিল এবং তার নিচেই অত্যন্ত ঢালু পাহাড়ের গা। সেদিন রাতে এবং আজ সকালে আমি জায়গাটা পরীক্ষা করে বুঝলাম, কোনও ভাবে তিনি লুকানো রেলিং-এর ফাঁক গলিয়ে পড়ে গেছেন। কিন্তু আজ সকালে পাহাড়ের সে ঢাল এবং নিচটা খোঁজাখুঁজি করে তাকে আমি পাইনি। যে জায়গায় তার গড়িয়ে পড়ার কথা, তার পাশ দিয়েই সড়ক। সড়কটি মস্কোভা নদীর একটা নৌ-বন্দর থেকে বেরিয়ে লেনিন হিলস-এর পাদদেশ দিয়ে চলে গেছে দক্ষিণ দিকে।
থামল রোসা।
‘ঐ সড়ক দিয়ে কি যেখানে আপনার গাড়ি ভেঙে পড়েছে, সেখানেও যাওয়া যায়?’ বলল আহমদ মুসা।
‘হ্যাঁ, ওটাই একমাত্র পথ। তবে গাড়ি যেখানে পড়েছে, সে জায়গাটা একটা গভীর খাদ। সড়ক থেকে বিশ-পঁচিশ গজ দূরে।’ রোসা বলল।
ম্লান হয়ে উঠেছে আহমদ মুসার মুখ। একটু ভাবল আহমদ মুসা। তারপর বলল, ‘আমরা কি ঐ এলাকায় যেতে পারি?’
‘অবশ্যই। এখনি যেতে পারি।’
‘ধন্যবাদ।’
বলেই আহমদ মুসা তাকাল পাভলভের দিকে। বলল, ‘তুমি কি বল?’
‘স্যার, এখনি যেতে পারি।’
কথা শেষ করেই পাভলভ হাঁটা দিল তার ট্যাক্সির লক্ষ্যে।
ড্রাইভিং সিটে বসল পাভলভ। তার পাশে রোসা। পেছনের সিটে আহমদ মুসা।
পাহাড়ের ঢাল বেয়ে ডোনা জোসেফাইনের যেখানে গড়িয়ে পড়ার কথা সেখানে পৌঁছল আহমদ মুসারা।
গাড়ি সড়কের পাশে পার্ক করে জায়গাটার দিকে এগোলো তারা।
পাহাড়ের ঢাল বরাবর সড়কের পাশ দিয়ে এক ফুট, দেড় ফুট উঁচু রক্ষা প্রাচীর। এরপর ঢালু হয়ে উপরে উঠে গেছে পাহাড়ের গা।
রোসা একটু সামনে এগিয়ে একটা এলাকা চিহ্নিত করে বলল, ‘আমি উপর থেকে কয়েকটা ভারি পাথর ফেলে দেখেছি, কোনটাই এই এলাকার বাইরে যায়নি। সুতরাং ম্যাডামের দেহ এর বাইরে যেতে পারে না।’
আহমদ মুসা কিছুটা ঝুঁকে পড়ে গভীরভাবে চোখ বোলাতে লাগল জায়গাটার উপর। আহমদ মুসা ভাবছে, এত উঁচু থেকে গড়িয়ে পড়ার পরে আহত হবার কথা। ঘাসে রক্তের দাগ থাকতে পারে। কিন্তু আহমদ মুসা তেমন কিছুই পেল না।
এলাকার এক জায়গায় অনেকখানি জায়গা জুড়ে ঘাস একইভাবে নিচের দিকে হেলে পড়া। অনেকগুলো ঘাসের ডগা ছেঁড়া আছে, দু’একটা ঘাস উপড়ে যাওয়াও রয়েছে।
আহমদ মুসা কি যেন ভাবল, তারপর নাক ঘাসের কাছাকাছি নিয়ে ঘ্রাণ নিল।
চোখ-মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল আহমদ মুসার। ডোনার ব্যবহৃত বিশেষ সেন্ট-এর গন্ধ পেল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসা মাথা তুলে বলল, ‘সন্দেহ নেই রোসা, ডোনা জোসেফাইনের দেহ সর্বশেষ এখানে এসেই স্থির হয়েছিল।’
‘কি করে বোঝা গেল?’
‘দেখুন এই জায়গাটার ঘাসের অবস্থা। আর এখানে আলাদা একটা গন্ধ আছে।’
রোসা ও পাভলভ দু’জনেই এগিয়ে এসে পরখ করে বলল, ‘ঠিক বলেছেন।’
আহমদ মুসা রাস্তায় নেমে এল। ওরা দু’জনও।
আহমদ মুসা আবার চারদিকে নজর বোলাল। বলল, ‘আমার বিশ্বাস, আহত বা সংজ্ঞাহীন ডোনা জোসেফাইনকে কেউ তুলে নিয়ে গেছে।’
রোসা ও পাভলভ দু’জনেই শুকনো মুখে আহমদ মুসার দিকে তাকাল। কথা বলল না।
আহমদ মুসাই আবার বলল রোসাকে লক্ষ্য করে, ‘আপনি এখানে কখন এসেছিলেন?’
‘প্রায় দেড় ঘণ্টা পর।’
‘তার আগে তো এখান দিয়েই ঐ ছয়টি গাড়ি আপনাদের গাড়ির ধ্বংসাবশেষ দেখতে গিয়েছিল?’
‘এদিক দিয়েই তো যাওয়ার পথ। কিন্তু তারা গিয়েছিল কিনা জানি না। আমি এসে কাউকে দেখতে পাইনি।’
‘ওরা গাড়ির ধ্বংসাবশেষ দেখতে আসবে বলেই তো নেমে এসেছিল।’
‘হ্যাঁ।’
‘তাহলে ধরে নিতে হচ্ছে, আপনার আসার আগেই ওরা এদিক দিয়ে গেছে।’
‘সম্ভবত এটাই ঘটেছে।’ বলে একটা ঢোক গিলেই রোসা আবার বলল, ‘তাহলে কি ম্যাডাম ওদের হাতেই পড়েছে আপনি মনে করেন?’ কাঁপা কণ্ঠ রোসার।
আহমদ মুসার বুকটাও কেঁপে উঠল তার কথা শুনে। গোটা দেহটাই যেন তার যন্ত্রণায় আর্তনাদ করে উঠল। তার সমগ্র সত্তা যেন বলে উঠল, ডোনা জোসেফাইনের মত নিষ্পাপ একটি ফুল ওদের হাতে পড়তে পারে না, পড়া উচিত নয়।
কিন্তু ঘটনা ঘটে থাকলে, সেই ঘটনা অস্বীকার করবে কে?
‘কি ঘটতে পারে আমি সেটাই বলছি রোসা। ঘটেছে তা আমি বলতে পারি না।’ আহমদ মুসা থামল।
ওরাও নীরব।
অল্পক্ষণ পরে নীরবতা ভেঙে আহমদ মুসা বলল, ‘গাড়ি যেখানে পড়েছিল, সেটা আর কতদূর?’
‘বেশি দূর নয়।’ বলল রোসা।
‘চলুন, যাওয়া যাক।’
সবাই গাড়িতে উঠে সামনে এগোলো।
পাহাড়ের দ্বিতীয় বাঁকটি পার হবার সময় রোসা বলল, ‘এই বাঁকের পরেই জায়গাটা।’
বাঁকটি পার হয়েই আহমদ মুসার গাড়ি আরেকটি গাড়ির প্রায় মুখোমুখি গিয়ে পড়ল। অল্পের জন্যে অ্যাক্সিডেন্ট থেকে বেঁচে গেল। দু’গাড়ির কোনটিই হর্ন ব্যবহার করেনি।
রাস্তায় ডিভাইডার দিয়ে আসা-যাওয়ার লেন আলাদা করা না থাকলেও লাল রেখা দিয়ে দু’টি লেন আলাদা করা রয়েছে। সামনের গাড়িটা রং লাইন দিয়ে আসছিল।
সামনের সেই গাড়িটিতে ড্রাইভারসহ চারজন আরোহী। দু’জন সামনে, পেছনে দু’জন।
গাড়িটার ড্রাইভার তার অন্যায় কাজের জন্য সামান্য ‘স্যরি’ শব্দটি পর্যন্ত উচ্চারণ করল না। গাড়িটিকে পাশ কাটিয়ে নিয়ে চলে গেল।
আহমদ মুসার মনটা তেতো হয়ে গেল তাদের আচরণে। দুর্বিনীত লোকদের ভালো করে দেখার জন্যে আহমদ মুসা গাড়িটার দিকে ভালো করে তাকাল।
ডোনাদের গাড়ি যে গভীর খাদে ভেঙে পড়েছে, সেই বরাবর এসে আহমদ মুসার গাড়ি থামল।
গাড়ি থেকে নেমে সামনে তাকাতেই আহমদ মুসার দৃষ্টি একটা বিষয়ের দিকে আকৃষ্ট হলো।
আহমদ মুসার গাড়ি যেখানে দাঁড়িয়েছে তার সামনেই গাড়ির চারটি চাকার আঁকা-বাঁকা চিহ্ন। দাগগুলো তাজা। মনে হয়, একটি গাড়ি এখানে দাঁড়িয়েছিল। তারপর গাড়ি ঘুরিয়ে নিয়ে আবার পেছন দিকে চলে গেছে। সামনের দিকে রাস্তায় গাড়ির চাকার কোন চিহ্ন নেই। পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে, রাতের পর সকালে এ পথে আর কোন গাড়ি চলেনি।
হঠাৎ আহমদ মুসার মনে ঝড়ের মত চিন্তাটা এল, তাহলে তো এই মাত্র চলে যাওয়া গাড়িই সেই গাড়ি, যে গাড়ি এখানে দাঁড়িয়েছিল। আর এখানে দাঁড়ানোর অর্থ, তারা ডোনা জোসেফাইনের ধ্বংসপ্রাপ্ত গাড়িটিই দেখতে এসেছিল। গাড়িটির আরোহীরা কেউ তো পুলিশ নয়। তাহলে ওরা কারা? নিশ্চয় গত রাতে ওরাই ডোনা জোসেফাইনের গাড়ি অনুসরণ করেছিল এবং ওরাই সম্ভবত ডোনা জোসেফাইনকে তুলে নিয়ে গেছে সংজ্ঞাহীন অবস্থায়। গত রাতে তারা ধ্বংসপ্রাপ্ত গাড়িটা পরীক্ষা করতে পারেনি। আজ সকালে এসেছিল সেই কাজে।
আহমদ মুসা আকাশের চাঁদ হাতে পাওয়ার মতই খুশি হয়ে উঠল। শয়তানদের ফলো করতে হবে। ওরাই এখন ডোনা জোসেফাইনকে উদ্ধার, প্রিন্সেস ক্যাথারিনকে উদ্ধার ও মিঃ প্লাতিনিকে উদ্ধারের সংযোগ সূত্র।
আহমদ মুসা গাড়ির দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে দ্রুত কণ্ঠে বলল, ‘পাভলভ গাড়িতে উঠো, মিস রোসা গাড়িতে উঠুন।’
বলে আহমদ মুসা দ্রুত গাড়িতে উঠে বসল। ওরা দু’জনও দ্রুত ফিরে এল গাড়িতে। বলল পাভলভ, ‘কি হলো স্যার?’
‘পাভলভ, যে গাড়িটা এখনি চলে গেল, যেভাবেই হোক তাকে ধরতে হবে।’ মনের উত্তেজনা আহমদ মুসার কণ্ঠে ধরা পড়ল।
পাভলভ ও রোসা দু’জনেই পেছন ফিরে আহমদ মুসার দিকে তাকাল। তাদের চোখে বিস্ময়। তাদের ভাবনা, ছোট-খাট কোন ব্যাপারে আহমদ মুসার মত ব্যক্তিত্ব এমন উত্তেজিত হয়ে পড়ার কথা নয়। বলল রোসা বিনীতভাবে, ‘জানতে পারি কি আমরা, কি ঘটেছে?’
রোসার প্রশ্নের ধরনে আহমদ মুসা হেসে উঠল। বলল, ‘অবশ্যই।’
বলে একটু থেমে আবার বলতে শুরু করল আহমদ মুসা. ‘আমি মনে করছি, ঐ গাড়ি বা ঐ গাড়ির আরোহীরাই গত রাতে আপনাদের গাড়ি অনুসরণ করেছিল এবং পরে এরাই সম্ভবত ডোনা জোসেফাইনকে সংজ্ঞাহীন অবস্থায় তুলে নিয়ে গেছে।’
অপার বিস্ময় ফুটে উঠল রোসা ও পাভলভের চোখে। বলল পাভলভ, ‘কিন্তু বোঝা গেল কিভাবে?’
আহমদ মুসা তাদেরকে সড়কে গাড়ির দাগের ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলল।
রোসা ও পাভলভের চোখে নতুন বিস্ময়। রোসা বলল, ‘ঠিক ধরেছেন। কিন্তু এত ছোট বিষয় এভাবে আপনার নজরে পড়ে?’
‘এসব বিষয় ছোট কোথায়? চোখে পড়ার মত যথেষ্ট বড়।’
‘কিন্তু আমাদের চোখে পড়েনি।’ বলল পাভলভ।
‘এসব কথা থাক পাভলভ। স্পীড আরও বাড়াতে পারো না?’
‘পাহাড়ী রাস্তা তো। চেষ্টা করছি স্যার।’ স্পীড বাড়িয়ে দিতে দিতে বলল পাভলভ।
কিন্তু এতসব চেষ্টার পরেও কমসোমল হাইওয়েতে উঠার আগে সামনের গাড়িটিকে নজরেই আনতে পারলো না। পাহাড়ের শেষ বাঁকটা ঘুরে আহমদ মুসার গাড়ি যখন কমসোমল রোডের মুখোমুখি হলো, তখন তারা দেখল, সামনের গাড়িটি কমসোমল হাইওয়েতে গিয়ে উঠল।
আহমদ মুসার গাড়ি যখন কমসোমল হাইওয়েতে উঠল, সামনের গাড়িটি তখন প্রায় দেড়শ’ গজ সামনে।
হাইওয়েতে তখন প্রচণ্ড ভিড়। খুব চেষ্টা করেও আহমদ মুসার গাড়ি সামনের সেই গাড়িটার খুব বেশি নিকটবর্তী হতে পারল না।
‘ঠিক আছে পাভলভ। এখন অনুসরণ করা ছাড়া আর করার কিছু নেই।’
কমসোমল হাইওয়ে লেনিন হিলস এর উত্তর প্রান্তে এসে মস্কোভা নদীর ব্রীজে প্রবেশ করেছে। সামনের গাড়িটা ব্রীজের কাছাকাছি গিয়ে বাম দিকের একটা এক্সিট রোড ধরে মস্কোভা নদীর তীর বরাবর পশ্চিম দিকে এগিয়ে চলল।
এ রাস্তায় ভিড় অপেক্ষাকৃত কম।
পাভলভ তার গাড়ির স্পীড বাড়িয়ে দিল। খান তিনেক গাড়ি ওভারটেক করে আহমদ মুসার গাড়ি যখন ঐ গাড়িটার কাছে পৌঁছল, ঠিক তখনই গাড়িটা বাম দিকে টার্ন নিয়ে একটা প্রাইভেট রোডে প্রবেশ করল। আহমদ মুসার গাড়ি একটু সামনে এগিয়ে একটা গাছের নিচে পার্ক করল।
আহমদ মুসা পেছন ফিরে গাড়ির দিকে চোখ রেখেছিল। দেখল, যে প্রাইভেট রোডে গাড়িটি প্রবেশ করেছিল, তা দক্ষিণ দিকে কয়েক গজ এগিয়ে একটা বিশাল বাড়ির বিরাট গেটে গিয়ে শেষ হয়েছে। গাড়িটি সেই গেট দিয়ে বাড়ির ভেতরে ঢুকে গেল।
বাড়িটার গেট বন্ধ ছিল। গাড়িটা বন্ধ গেটের সামনে দাঁড়াতেই গেট খুলে গিয়েছিল।
দুর্গ সদৃশ বাড়ির বিশাল গেটের বিরাট সাইনবোর্ডের সব লেখাই পরিষ্কার পড়তে পারছে আহমদ মুসা। সাইনবোর্ড অনুসারে বাড়িটি হলো ‘হেরিটেজ ফাউন্ডেশন’। হেরিটেজ ফাউন্ডেশনের পরিচয়ে বলা হয়েছে, ‘সোশ্যাল রিসার্চ সেন্টার ফর ন্যাশনাল ইন্টিগ্রেশন’ (জাতীয় সংহতির সামাজিক গবেষণা কেন্দ্র)।
‘হেরিটেজ ফাউন্ডেশন’ সংস্থাটি সরকারী না বেসরকারী বুঝতে পারল না আহমদ মুসা। আর ওরাই বা এ বাড়িতে ঢুকল কেন, এ বিষয়টাও বিস্ময় জাগাল আহমদ মুসার মনে।
অবশ্য হেরিটেজ ফাউন্ডেশনের পরিচয় থেকে আহমদ মুসার মনে হলো, এর সাথে রাজনীতির যোগ আছে। আর এমন ফাউন্ডেশনের সাথে দুর্গ সদৃশ এই বাড়িকেও বেমানান লাগলো আহমদ মুসার কাছে।
পল পল করে পঁচিশ মিনিট পার হয়ে গেল।
এ ধরনের অপেক্ষা খুবই কষ্টকর।
আহমদ মুসা বাড়িটার গেটের দিকে চোখ রেখেই পাভলভকে লক্ষ্য করে বলল, ‘পাভলভ, তোমাদের সাথে আমার একটা আলাপ হওয়া প্রয়োজন।’
‘বলুন স্যার।’ বলল পাভলভ।
‘তোমাদের সাথে চুক্তি ছিল আমাদেরকে মস্কো পৌঁছে দেয়া। পৌঁছে দিয়েছ। তারপরও আজ এই সময় পর্যন্ত তোমার গাড়ি ব্যবহার করেছি। তোমাকে আর কষ্ট দেয়া ঠিক হবে না। বাকি ভাড়াটা নিয়ে তুমি চলে যাও। আর মিস রোসা সম্ভবত চুক্তি অনুসারে মস্কো পৌঁছার টাকা পাননি। তার উপর তার গাড়ি নষ্ট হয়েছে আমাদের কারণেই। আমি ঐ ভাড়া ও গাড়ির দাম দিয়ে দিচ্ছি।’
পাভলভ ও মিস রোসা পরস্পরের দিকে চাইল। তাদের মুখ গম্ভীর।
একটু পর পাভলভ বলল, ‘ঠিক বলেছেন স্যার। আমরা ড্রাইভার। ভাড়ায় গাড়ি খাটাই। যে চুক্তিতে এসেছিলাম, সে চুক্তি শেষ। আমাদের চলে যাওয়াই উচিত। কিন্তু স্যার, মস্কোতে আপনার গাড়ি লাগবে। ভাড়াতেই গাড়ি নেবেন। তাহলে আমাদের নেবেন না কেন? আপনিই বলুন, অন্য ড্রাইভারের চেয়ে আমাদের কাছে ভালো সার্ভিস পাবেন কিনা?’
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘যুক্তিতে আমাকে বেঁধে ফেলেছ পাভলভ। কিন্তু একটা বড় ফাঁক রয়ে গেছে।’
‘স্যার সেটা কি?’
‘সব সময় আমি গাড়ি ব্যবহার করবো না। এমনও হতে পারে, দু’তিন দিন গাড়ি ব্যবহারের সুযোগ পাব না। এই অবস্থায় আমার পেছনে গাড়ি খাটানো তোমার জন্য লাভজনক হবে না।’
‘সে চিন্তা আমার স্যার। অন্য জায়গায় গাড়ি খাটাতে আপনার নিশ্চয় কোন নিষেধ থাকবে না।’
হাসল আহমদ মুসা। কিছু বলতে যাচ্ছিল। এমন সময় দেখল, সেই গেট দিয়ে আগের সেই গাড়িটিই বেরিয়ে এল। কিন্তু এবার গাড়িতে চারজন নয়। দু’জন। একজন ড্রাইভার এবং একজন আরোহী। আহমদ মুসার চিনতে অসুবিধা হলো না, এরা সেই চারজনেরই দু’জন।
আহমদ মুসা মুখ ঘুরিয়ে পাভলভকে বলল, ‘গাড়ি ঘুরিয়ে পিছু নাও গাড়িটার।’
সামনের গাড়িটা কমসোমল রোডে উঠে মস্কোভা নদীর ব্রীজ পার হয়ে এগিয়ে চলল। কিন্তু টলস্টয় পার্কের প্রান্তে এসে কমসোমল রোড ছেড়ে দিয়ে গাড়িটা বাঁ দিকে টার্ন নিয়ে পশ্চিম দিকে এগিয়ে চলল। মস্কোর বিখ্যাত ন্যাশনাল স্টেডিয়াম (সাবেক লেনিন স্টেডিয়াম) ও লুরানিকি স্পোর্টস কমপ্লেক্স বাঁয়ে রেখে স্পোর্টস রোড ধরে গাড়িটি সামনে এগোলো। কিন্তু শীঘ্রই আবার ডান দিকে টার্ন নিয়ে নেভিডিভিচ কনভেল্টের পুব পাশ দিয়ে টলস্টয় এভেনিউ ধরে উত্তরে এগিয়ে চলল। এই এভেনিউটি টলস্টয় পার্কের ভেতর দিয়ে টলস্টয়ের বাড়ির পাশ ঘেঁষে গিয়ে সাদোভায়া রিং রোডে উঠেছে।
টলস্টয় এভেনিউ মস্কোর সবচেয়ে নির্জন রাস্তা। আজ সোমবার প্রথম কার্যদিবস বলে মনে হচ্ছে আরও নির্জন।
এই নির্জন রোডে সামনের গাড়িটা হঠাৎ হার্ড ব্রেক কষে দাঁড়িয়ে পড়ল।
আহমদ মুসা কি করবে চিন্তা করে সিদ্ধান্ত নেবার আগেই তাদের গাড়ি সামনের গাড়ির কাছাকাছি এসে গেল।
সামনের গাড়িটি দাঁড়িয়েই আড়াআড়ি হয়ে গিয়েছিল।
আহমদ মুসাদের গাড়িকে দাঁড়াতেই হলো এই অবস্থায়।
আহমদ মুসাদের গাড়ি দাঁড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই সামনের গাড়ির দু’পাশ থেকে দু’জন স্টেনগান নিয়ে বেরিয়ে এল। একজন চিৎকার করে বলল আহমদ মুসাদের গাড়িকে লক্ষ্য করে, ‘তোমরা বেরিয়ে এসো গাড়ি থেকে।’
রোসা ও পাভলভ দু’পাশ দিয়ে দু’জন গাড়ি থেকে বেরুল।
আহমদ মুসা রিভলভার ধরা ডান হাতটা পেছনে নিয়ে গাড়ি থেকে বেরিয়ে উঠে দাঁড়াল।
আগের সেই লোকটিই চিৎকার করে বলে উঠল, ‘শিখ বেটা, তুই কেন গিয়েছিলি মস্কো হিলস (‘লেনিন হিলস’ নাম পরিবর্তন করে ‘মস্কো হিলস’ করা হয়েছে)-এর ঐ এলাকায়? আবার ফলোও করছিলি আমাদের। তোর জান নেয়ার আগে তোর পরিচয় নেয়া দরকার। তুই আয় আমাদের গাড়িতে।’
একটু থেমেই রোসাকে লক্ষ্য করে আবার বলল, ‘ছুঁড়ি, তুইও আয়, মউজ করার মত সুন্দরী তুই।’
বলেই লোকটি স্টেনগান তুলল পাভলভকে লক্ষ্য করে।
পাভলভকে লক্ষ্য করে স্টেনগান উঁচাতে দেখেই আহমদ মুসা বুঝে নিয়েছিল কি ঘটতে যাচ্ছে। আহমদ মুসা তাকে স্টেনগানের ট্রিগার চাপার সুযোগ দিল না। আহমদ মুসা বিদ্যুৎ বেগে তার ডান হাতটি সামনে নিয়ে এসেই পর পর দু’টি গুলি করল।
গাড়ির দু’পাশের দুই স্টেনগানধারী মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়ে ছিটকে পড়ল মাটিতে।
ঠিক এই সময়েই পেছনে অট্টহাসি শুনল।
চমকে ঘুরে দাঁড়াল আহমদ মুসা। দেখল, তাদের গাড়ির কয়েক গজ পেছনে আরেকটা কার এসে দাঁড়িয়েছে। আহমদ মুসা ভাবল, সামনের পরিস্থিতির দিকে মনোযোগ থাকার কারণে পেছনের এই গাড়ির আগমন তারা টের পায়নি।
সামনের গাড়ির মতই পেছনের গাড়ির দু’পাশে দু’জন দাঁড়িয়ে। তাদের দু’জনের হাতে দু’টি মেশিন রিভলভার। তাদের দু’জনেরই রিভলভারের নল স্থির নিবদ্ধ আহমদ মুসার দিকে।
আহমদ মুসা ঘুরে দাঁড়ালে অট্টহাসি হাসা লোকটি এবার শান্ত কণ্ঠে বলল, ‘দারুণ হাত দেখিয়েছ তুমি। তুমি শুধু শিখ ড্রাইভার নও।’
বলে চোখের দৃষ্টি আহমদ মুসার উপর স্থির রেখেই তার সাথীকে নির্দেশ দিল, ‘গিয়ে ওর রিভলভার নিয়ে নাও। আর ওকে বেঁধে নিয়ে এস।’
আহমদ মুসার রিভলভার ধরা হাতটি তখন নিচু। উপরে তোলার সময় হয়নি।
নির্দেশ পেয়ে দ্বিতীয় লোকটি এগিয়ে আসতে শুরু করেছিল আহমদ মুসার দিকে।
পিনপতন নীরবতা তখন।
এই সময় সেই নীরবতা ভেঙে পড়ল গুলির শব্দে। পর পর দু’টি গুলি।
গুলির উৎস লক্ষ্যে আহমদ মুসার চোখ দ্রুত ছুটে গিয়েছিল দক্ষিণে।
একজন কাউকে গাছের আড়াল দিয়ে রাস্তার দিকে ছুটে যেতে দেখল। তারপরেই একটা ইঞ্জিন স্টার্ট নেয়ার শব্দ।
অদৃশ্য থেকে আসা গুলির দু’জনেই শিকার হলো। যে লোকটি আহমদ মুসার দিকে আসছিল, তার দেহটি পড়ে গেল আহমদ মুসার থেকে কয়েক ফুট দূরে। আর যে লোকটি মেশিন রিভলভার বাগিয়ে দাঁড়িয়েছিল, তার দেহটি প্রথমে আছড়ে পড়ল গাড়ির উপর। তারপর গাড়ি থেকে গড়িয়ে পড়ল নিচে।
আহমদ মুসার কাছে আসল পাভলভ। তার পেছনে পেছনে রোসাও।
‘স্যার, আমি দেখতে পেয়েছি, ওটা সেই জীপ।’
‘আমারও তা-ই মনে হচ্ছে।’
আহমদ মুসার চোখে-মুখে গভীর চিন্তার রেখা। এটা সেই জীপ হলে, নিশ্চয় এ দুটো গুলি সেই মেয়েটির রিভলভার থেকেই এসেছে। কে এই মহিলা? আহমদ মুসাকে বাঁচাচ্ছে কেন? বিপদের চরম মুহূর্তে কোত্থেকে, কিভাবে সে আবির্ভূত হচ্ছে!
ভাবনায় ডুবে গিয়েছিল আহমদ মুসা।
‘স্যার, আমাদের সরে পড়া দরকার। পুলিশ এলে আমরা ঝামেলায় পড়ব।’ বলল পাভলভ।
‘হ্যাঁ, চল।’ বলে আহমদ মুসা গাড়িতে উঠার আগে গাড়ির কাগজপত্র নিয়ে নিল।
রোসা ও পাভলভও উঠল। বলল পাভলভ গাড়ি স্টার্ট দিতে দিতে, ‘কোথায় যাব স্যার?’
‘সামনে এগিয়ে সাদোভায়া রিং রোডে ওঠো।’
চলতে শুরু করল গাড়ি।
‘স্যার, আপনি আমাকে সাক্ষাৎ মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচিয়েছেন।’ বলল পাভলভ বিনীত কণ্ঠে।
পাভলভ থামতেই রোসা বলল, ‘আমরা চিরদিন কৃতজ্ঞ থাকব স্যার।’
আহমদ মুসার মুখে হাসি ফুটে উঠল। রোসাকে বলল, ‘জীবন পাভলভের, আপনি কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছেন কেন?’
রোসার মুখ লাল হয়ে উঠল লজ্জায়। সে প্রশ্নটা পাশ কাটিয়ে বলল, ‘আমাকে ‘আপনি’ না বলে ‘তুমি’ বলার জন্যে অনুরোধ করছি স্যার। পাভলভকে ‘তুমি’ বলেন। আমার খুব ভালো লাগে।’
‘ঠিক আছে। আমার প্রশ্নের উত্তরটা দাও।’
মুখ নিচু করল রোসা। মুখে সলাজ হাসি।
‘ও অনুগ্রহ করে বিয়ের কনসেন্ট দিয়েছে স্যার।’ পাভলভের ঠোঁটে হাসি।
কৃত্রিম রাগ ফুটে উঠল রোসার রাঙা মুখে। পাভলভের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তোমার ওটা ভাষা হলো!’
পাভলভ হাসল। বলল, ‘ঠিক আছে, ‘অনুগ্রহ’ শব্দ কেটে দিলাম।’
রোসা হাসল।
‘তোমাদের আগাম শুভেচ্ছা। আর শোন, তোমরা এ খুনোখুনির মধ্যে থেকো না, পুশকভে ফিরে যাও।’ বলল আহমদ মুসা।
‘না স্যার। এবারই প্রথম একটা সাহসের কাজ নিয়েছি বলে মনে করে রোসা। এ সুযোগ থেকে আমাকে ছাঁটাই করবেন না।’
সাদোভায়া রিং রোডে উঠে পড়েছে গাড়ি।
‘এবার কোন দিকে স্যার?’ বলল পাভলভ।
‘বিল্ডিং আরকাইভস-এ চল।’
‘বিল্ডিং আরকাইভস-এ কেন স্যার?’
‘‘হেরিটেজ ফাউন্ডেশন’-এর ইতিবৃত্ত আমি জানতে চাই।’
‘আপনি কিছু সন্দেহ করেন?’ বলল রোসা।
‘সন্দেহ করার সংগত কারণ আছে। যে চারজনকে লেনিন হিলস থেকে ফলো করেছিলাম, ওরা হেরিটেজ ফাউন্ডেশনে প্রবেশ করে। তাদের দু’জন বেরিয়ে আসে প্রথম গাড়িতে করে। পেছনের গাড়িতে আসা যে দু’জন মারা পড়ল, তারা ঐ চারজনের অবশিষ্ট দু’জন নয়। তার মানে, ঐ চারজনের দু’জন সেখানে রয়ে গেছে, তার বদলে সেখান থেকে এসেছে অন্য দু’জন। এর অর্থ, ‘হেরিটেজ ফাউন্ডেশন’ এই ব্যাপারের সাথে জড়িত।’
‘পেছনের গাড়িটিও হেরিটেজ ফাউন্ডেশন থেকে এসেছে মনে করেন?’ রোসা বলল।
‘অবশ্যই। হেরিটেজ ফাউন্ডেশনে বসেই পরিকল্পনা করা হয়েছে আমাদেরকে ফাঁদে ফেলে ধরার।’
‘হেরিটেজ ফাউন্ডেশনও কি এর সাথে জড়িত তাহলে?’
‘এটা বলা মুশকিল। কেউ হেরিটেজ ফাউন্ডেশনকে ব্যবহার করতে পারে। এ জন্যেই কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছার আগে হেরিটেজ ফাউন্ডেশন এবং ঐ বিল্ডিং সম্পর্কে জানতে চাই।’
‘বুঝেছি স্যার।’ বলল পাভলভ।
গাড়ি ছুটে চলল আরকাইভস-এর উদ্দেশ্যে।
মস্কোর ইনার রিং-এর ভেতরে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সংরক্ষিত এলাকার ভেতরে বিল্ডিং আরকাইভস।
সংরক্ষিত এলাকার প্রবেশপথেই আটকে গেল আহমদ মুসার গাড়ি। প্রহরী বলল, ‘বিশেষ বিভাগের অনুমতি লাগবে।’
পাভলভ গাড়ি ফিরিয়ে আনল পার্কিং-এ।
‘বিশেষ বিভাগ বলতে কি বুঝিয়েছে পাভলভ?’ জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা।
‘গোয়েন্দা বিভাগের সিকিউরিটি শাখা স্যার।’
গাড়ি পার্ক করে পাভলভ গাড়ি থেকে নেমে বলল, ‘স্যার, একটু বসুন। আমি অনুমতির ব্যাপারটা একটু দেখে আসি স্যার।’
আহমদ মুসা গাড়ির জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে বলল, ‘তুমি কি বলবে তাদের?’
পাভলভ একটু ভাবল। হাসল। তারপর বলল, ‘আপনার বেশ এবার নিখাদ ইহুদির মত। আমি বলব, একজন ইহুদি নগর পরিকল্পনা গবেষক আরকাইভস পরিদর্শন করতে চান।’
‘এতটুকুতে হবে?’
‘দেখি স্যার।’
বলে চলে গেল পাভলভ।
ফিরে এল পনের মিনিট পর হাসিমুখে।
সেদিকে তাকিয়ে রোসা বলে উঠল, ‘বলেছি না স্যার, নিশ্চয় অনুমতি হবে। অনুমতি না হলে ওর মুখে হাসি থাকতো না।’
পাভলভ এসে গাড়িতে ঢুকতে ঢুকতে বলল, ‘অনুমতি দিয়েছে স্যার।’
আপনাতেই ভ্রু দু’টি কোঁচকাল আহমদ মুসার। একজন ড্রাইভার পাভলভ কি করে এত তাড়াতাড়ি বিশেষ বিভাগ থেকে বিশেষ অনুমতি বের করে আনল! রোসা আগাম নিশ্চিত করে তা বললই বা কি করে? আহমদ মুসা কিছু বলার আগেই গাড়ি স্টার্ট দিতে দিতে পাভলভ বলল, ‘নগদ নারায়ণের সবাই বশ স্যার। বিশেষ করে আমাদের রাশিয়ায়।’
‘কিন্তু নগদ খরচ করার অনুমতি আমার কাছ থেকে নাওনি।’ বলল আহমদ মুসা।
‘মাফ চাই স্যার। অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা করেছি। অনুমতির সময় হয়নি।’ বলল পাভলভ বিনীত কণ্ঠে।
আহমদ মুসার মনের খুঁতখুঁতি গেল না। কিন্তু কিছু বলল না আর।
আরকাইভস-এ প্রবেশ করল আহমদ মুসা এবং ওরা দু’জন। আরকাইভস-এ প্রবেশের জন্যে বড় ধরনের প্রবেশ ফি দিতে হলো।
আরকাইভস-এর করিডোর দিয়ে চলতে চলতে আহমদ মুসা বলল পাভলভকে, ‘কোন বিল্ডিং-এর কম্পিউটার ডিস্কের যদি একটা প্রিন্ট নিতে চাই?’
‘আইনত পারা যাবে না। কিন্তু পয়সা দিলে সব হয় স্যার।’
‘এত কথা তুমি জান কি করে?’
সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিল না পাভলভ। এরপর হেসে বলল, ‘আমি কি রাশিয়ার ছেলে নই স্যার? আর ড্রাইভাররা তো অনেক কিছুই দেখে, জানে।’
আরকাইভস-এর ডিজাইন ডিস্ক কাউন্টারে গেল প্রথমে আহমদ মুসারা।
কাউন্টারের ভদ্রলোকটি ঋজু শরীরের গম্ভীর এক বৃদ্ধ।
আহমদ মুসা নিজের নতুন পরিচয়টা দিয়ে প্রয়োজনের কথা বলল।
ভদ্রলোক কোন কথা না বলে পাশের কম্পিউটারটির নব টিপে ডিজাইন ডিস্কের ক্যাটালগ পর্দায় নিয়ে এল। একের পর এক পর্দায় এল ডিস্কের ক্যাটালগ।
এক সময় পর্দায় স্থির হলো বৃদ্ধের চোখ। স্থির হবার পরক্ষণেই তার চোখ ছানাবড়া হয়ে উঠল। অস্বস্তিতে ভরে গেল তার মুখ। সে আহমদ মুসার দিকে চেয়ে বলল, ‘দুঃখিত, ডিস্কটা আমরা দেখাতে অপারগ।’
‘কিন্তু আমি তো উপযুক্ত ফি দেব।’
বৃদ্ধটি একটু দ্বিধা করল। তারপর বলল, ‘কিছু দিন আগে ডিস্কটি চুরি গেছে। আমরা নতুন ডিস্ক করতে পারিনি।’
চুরির সংবাদে আহমদ মুসা বিস্মিত এবং কিছুটা হতাশ হলো। বলল, ‘আমি একটা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করতে পারি?’
‘অবশ্যই।’ বৃদ্ধ বলল।
‘এ ধরনের চুরি কি অতীতে আর কখনও হয়েছে?’
‘জানি না। তবে আমার পঁচিশ বছরের আরকাইভস জীবনে এই প্রথম।’
‘আরেকটা কথা। আমার প্রয়োজন পূরণের বিকল্প কোন পথ আছে?’
‘আপনি ইতিহাস সেকশনে যান। সেখানে ইতিহাস সম্বলিত ডিস্ক আছে। তাতে ইতিহাসও পাবেন, ডিজাইনও পাবেন।’
‘ধন্যবাদ।’ বলে আহমদ মুসারা বেরিয়ে এল।
ইতিহাস সেকশনের লোকটি প্রাণবন্ত একজন যুবক।
আহমদ মুসা তাকে প্রয়োজনের কথা জানালে যুবকটি ভ্রু কুঞ্চিত করল।
চোখ নিচু করে মুহূর্ত সে ভাবল। তারপর বলল, ‘দুর্ভাগ্য স্যার, বিল্ডিংটি নতুনভাবে লীজে বরাদ্দ হবার পর বিল্ডিংটির উপর তৈরি সবগুলো ডিস্ক চুরি গেছে।’
চুরি যাওয়ার এই দ্বিতীয় সংবাদে আহমদ মুসা আর বিস্মিত হলো না। বরং খুশিই হলো সে। তার সন্দেহ ঠিক প্রমাণ হচ্ছে। বলল, ‘একটা সাহায্য করতে পারেন? কারা লিজ নিয়েছে বিল্ডিংটা?’
‘স্মৃতিশক্তি অত তীক্ষ্ণ, অত শক্তিশালী হলে কি এই আরকাইভস কাউন্টারে বসতাম?’
‘আর কোন সাহায্য করতে পারেন?’
যুবকটি একটু চিন্তা করে বলল, ‘অনুরূপ ডিস্ক গোয়েন্দা বিভাগের ‘হোম জিওগ্রাফি’ সেকশনে পাবেন।’
যুবকটিকে ধন্যবাদ দিয়ে বেরিয়ে এল আহমদ মুসারা।
আরকাইভস থেকে বেরিয়ে এসে পাভলভ তার ড্রাইভিং সিটে বসতে বসতে বলল, ‘স্যার, আপনি যদি বলেন, তাহলে গোয়েন্দা বিভাগের ‘হোম জিওগ্রাফি’ বিভাগ থেকে ডিস্কের একটা কপি আনার চেষ্টা করতে পারি।’
‘ওয়েলকাম পাভলভ। ডিস্কটা খুবই জরুরী দরকার আমার। কিন্তু পারবে তুমি?’
‘আমার পরিচিত লোক আছে স্যার। চেষ্টা করে দেখতে পারি।’
‘ঠিক আছে।’
‘ডিস্কটা এত জরুরী কেন স্যার?’ জিজ্ঞেস করল রোসা।
‘এখনও পর্যন্ত নিশ্চিত যে, তোমার ম্যাডাম (ডোনা জোসেফাইন) ওদের হাতেই পড়েছে। সুতরাং তাকে উদ্ধারের প্রস্তুতিতে এক মুহূর্তও দেরি করা যায় না। প্রতি সেকেন্ড আমার কাছে মনে হচ্ছে একটা যুগের মতন।’ আহমদ মুসার ম্লান কণ্ঠস্বর।
রোসা ও পাভলভ দু’জনেরই মুখ ম্লান হয়ে গেল। একটু পর পাভলভ ধীরে ধীরে বলল, ‘স্যার, হেরিটেজ ফাউন্ডেশনকে সত্যিই সন্দেহ হলে, সেখানে তো এখনই অনুসন্ধান চালানো যায়।’
‘আমি সফল হতে চাই পাভলভ। তাই আরেকটু জেনে অগ্রসর হতে চাই।’
‘ঠিক বলেছেন স্যার। হঠকারী কোন পদক্ষেপে ম্যাডামের উদ্ধার না হয়ে তার আরও ক্ষতি হতে পারে।’ বলল রোসা।
রোসার কথা একটা যন্ত্রণা ছড়িয়ে দিল আহমদ মুসার গোটা দেহে। তার ডোনা জোসেফাইনের কোন ক্ষতি হতে পারে, এমন আশংকার কথা সে ভুলে থাকতে চায়।
‘স্যার, আমি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের গোয়েন্দা দফতরে যাচ্ছি। আপনারা গাড়িতে থাকবেন। আমি ভেতরে গিয়ে চেষ্টা করে দেখি।’ বলল পাভলভ।
‘ঠিক আছে।’ বলল আহমদ মুসা।
আনমনা হয়ে পড়েছিল আহমদ মুসা। পাভলভের কথায় সম্বিত ফিরে এল তার। কিন্তু আবারও নানা চিন্তা এসে ঘিরে ধরল তাকে।
রোসা ঠিকই বলেছে। তাকে খুব সাবধানে এগোতে হবে। শুধু তো এখন প্রিন্স ক্যাথারিন, মিঃ প্লাতিনি উদ্ধার নয়, তার ‘রানী’কেও উদ্ধারের প্রশ্ন এবার।
এভাবে চিন্তা করতে গিয়েও আহমদ মুসার মন এক সময় প্রবলভাবে মাথা নাড়ল। তার ডোনা জোসেফাইন ঐ জঘন্য শত্রুর হাতে পড়বে কেন, কোন পাপে!
আহত মনের এই অসহায় জিজ্ঞাসার কোন জবাব দিতে পারল না আহমদ মুসা। তার মুখ থেকে পরম নির্ভরতার এক দোয়া বেরিয়ে এল, ‘হাসবুনাল্লাহ…।’

হেরিটেজ ফাউন্ডেশনের সেই হলরুম। হলের পঁচিশটি আসনে পঁচিশজন বসে। প্রথম সারির প্রথম চেয়ারে গ্রেট বিয়ারের গোয়েন্দা প্রধান মাজুরভ। দ্বিতীয় সিটে অপারেশন ফরচুন প্রজেক্ট-এর প্রধান ভ্লাদিমির খিরভ। এবং তৃতীয় চেয়ারে অপারেশন ফরচুন প্রজেক্ট-এর কমান্ডার জেনারেল নিকোলাস বুখারিন।
হলের সামনে পাঁচ ফুট উঁচু সেই রহস্যময় মঞ্চের বুক ফুঁড়ে উঠে এল সেই সোনালী সিংহাসনে আসীন সেই সোনালী মূর্তি।
চেয়ারে আসীন সকলের মাথা নিচু। যেন কোন নির্দেশের অপেক্ষায়।
অখণ্ড নীরবতার মধ্যে বজ্রপাতের মত কণ্ঠ ধ্বনিত হলো সোনালী চেয়ার থেকে। বলা হলো, ‘জেনারেল নিকোলাস বুখারিন, তোমার কিছু বক্তব্য আছে?’
মাথা নিচু করে উঠে দাঁড়াল বুখারিন। বলল, ‘মহামান্য আইভান, আহমদ মুসাকে আমরা গ্রেফতার করতে সমর্থ হয়েছি, কিন্তু ধরে রাখতে পারিনি। এ ব্যর্থতা স্বীকার করে নিচ্ছি। কিন্তু আমাদের এই ব্যর্থতা তৃতীয় পক্ষের কারণে। তৃতীয় কেউ তাকে পালাতে সাহায্য করেছে, অনুসন্ধানে এটা প্রমাণিত হয়েছে। মহামান্য আইভান, আমরা সব রকম চেষ্টা করে এবং ছ’টি গাড়ির বহর দিয়ে তাড়া করেও মিসেস আহমদ মুসাকে ধরতে পারিনি। আমরা মনে করেছিলাম, গাড়ি অ্যাক্সিডেন্টে ড্রাইভার ও মিসেস আহমদ মুসার মৃত্যু ঘটেছে। পরবর্তী পরীক্ষায় এটা ভুল প্রমাণিত হয়েছে। এ ব্যর্থতা স্বীকার করছি যে, মহিলাকে হাতের মুঠোর মধ্যে পেয়েও তাকে আমরা হারিয়েছি। কেবলমাত্র পাহাড়ের একটা ঢালে লেডিস সাইজ একটা হ্যাট এবং এক জোড়া লেডিস জুতা পেয়েছি। জুতাটি একটা ফরাসী কোম্পানীর। আমরা মনে করছি, হ্যাট ও জুতা মিসেস আহমদ মুসার হতে পারে। যদি তা-ই হয়, তাহলে মিসেস আহমদ মুসা পাহাড় থেকে গড়িয়ে পড়ে আহত হয়েছেন। যতদূর সম্ভব আশেপাশের সব ক্লিনিক ও হাসপাতালে আমরা খোঁজ নিয়েছি কোন ফরাসী মহিলা চিকিৎসা নিতে গেছে কিনা। কিন্তু সন্ধান পাওয়া যায়নি। সবশেষে আমাদের পিছু নেয়া এবং আমাদের হেডকোয়ার্টারের পাশ পর্যন্ত জনৈক শিখকে, যাকে এখন আহমদ মুসা বলে সন্দেহ করা হচ্ছে, ফাঁদে ফেলেও আমরা তাকে আটকাতে পারিনি। উপরন্তু আমাদের চারজন লোক প্রাণ দিয়েছে। আমাদের একজনের মৃত্যুকালীন জবানবন্দীতে প্রমাণিত হয়েছে যে, এখানেও একটি তৃতীয় পক্ষ রক্ষা করেছে আহমদ মুসাকে। তবু এটা আমাদের ব্যর্থতা। যতটা সতর্ক ও যতটা প্রস্তুত আমাদের হওয়া উচিত ছিল, তা আমরা হতে পারিনি। আমরা ব্যর্থ হয়েছি। তবে মহামান্য আইভান, এ ব্যর্থতার জন্যে আমার কোন গ্লানি নেই। যোগ্য ফাইট দেয়ার পর আমরা ব্যর্থ হয়েছি।’
থামল নিকোলাস বুখারিন।
সেই বজ্রকণ্ঠ আবার ধ্বনিত হলো, ‘ভ্লাদিমির খিরভ, এবার তুমি বল।’
মাথা নিচু করে উঠে দাঁড়াল খিরভ। বলল, ‘মিঃ বুখারিন শেষ দু’টি বাক্যে ঠিক বলেননি। আহমদ মুসা অজেয় নয়। আমরাই তাকে জয় করার যোগ্যতা দেখাতে পারিনি।’ থামল ভ্লাদিমির খিরভ।
‘তারপর।’ গর্জন করে উঠল সোনালী চেয়ারের কণ্ঠ।
‘মহামান্য আইভান, আপনার নির্দেশ।’ মাথা নুইয়ে বাউ করে বলল খিরভ।
খিরভ থামার সাথে সাথে দেখা গেল, চেয়ারের হাতলে রাখা নিকোলাস বুখারিনের দু’টি হাত হাতল থেকে উঠে আসা দু’টি হ্যান্ডকাফে আটকা পড়ে গেল এবং চেয়ারের দু’পাশে বেরিয়ে আসা দু’টি লোহার বাহুতে চেয়ারের সাথে বাঁধা পড়ে গেল নিকোলাস বুখারিনের দেহ। সেই সাথে দেখা গেল, চেয়ারের পায়া মেঝের ইস্পাতের বাঁধন থেকে আপনিই খুলে গেছে এবং চার পায়ার চার চাকাই সচল হয়ে উঠেছে।
চেয়ার গড়িয়ে হল থেকে বেরুবার ওয়াকিং করিডোরে গিয়ে থেমে গেল।
সোনালী চেয়ার থেকে ধ্বনিত হলো সেই বজ্রকণ্ঠ। বলল, ‘মিস ক্যাথারিনরা তিনজন যেখানে বন্দী আছে, সেখানে আরও দু’টি কক্ষ আছে। একটি আহমদ মুসার জন্যে, অন্যটিতে নিয়ে রাখ বুখারিনকে। তার বিচার আহমদ মুসার সাথে একবারেই করব। আহমদ মুসা যে অজেয় নয়, তা দেখেই তার মৃত্যুবরণ করা উচিত। নিকোলাস বুখারিনের মত একজন রুশ সন্তানকে ভুল ধারণা নিয়ে মরতে দিতে পারি না।’
একটু থামল বজ্রকণ্ঠ। তারপর আবার শুরু করল, ‘আহমদ মুসাকে আমাদের হাতের মুঠোয় আনার জন্যে আমরা আহমদ মুসার দোরগোড়ায় পৌঁছব, এটাই প্রয়োজন ছিল। কিন্তু আহমদ মুসাই তার লক্ষ্য অর্জনের জন্যে সাফল্যজনকভাবে আমাদের দোরগোড়ায় পৌঁছেছে। সে প্রমাণ করেছে, সে আমাদের চেয়ে অনেক বেশি দ্রুত, অনেক বেশি আক্রমণাত্মক। এ কারণেই তার কাছে আমাদের এক ধরনের পরাজয় ইতোমধ্যেই ঘটেছে। এরপরও অবিশ্বাস্য দ্রুত সে সামনে এগোচ্ছে। মাজুরভ, তোমার কাছে খবর আছে নিশ্চয়।’
মাজুরভ উঠে দাঁড়িয়ে মাথা নিচু করে বলল, ‘হ্যাঁ, মহামান্য আইভান। আমরা যে সব খবর সংগ্রহ করেছি, তাতে প্রতীয়মান হচ্ছে, আহমদ মুসা বিল্ডিং আরকাইভস-এ গিয়েছিল আমাদের এই হেরিটেজ ফাউন্ডেশন-এর ইতিহাস ও ডিজাইন সংগ্রহের জন্যে। আমাদের ভাগ্য ভালো, ইতিহাস ও ডিজাইনের গোটা কম্পিউটার ফাইল চুরি যাওয়ায় এগুলো তার হাতে পড়েনি। আহমদ মুসা এই বিল্ডিং-এর ইতিহাস ও ডিজাইন অনুসন্ধান করতে যাওয়ায় এটা প্রমাণ হয়েছে, হেরিটেজ ফাউন্ডেশনের আসল পরিচয় সে পায়নি। চেষ্টা করছে পাওয়ার।’ থামল মাজুরভ।
‘তোমার কথায় সান্ত্বনা আছে মাজুরভ। সান্ত্বনা দিয়ে পরাজয়ের বেদনা মোছা যায়, কিন্তু বিজয়ের অগ্নি স্ফুলিঙ্গ জ্বালানো যায় না।’
মুহূর্তের জন্যে থামল বজ্রকণ্ঠ। মুহূর্ত পরেই আবার শুরু করল, ‘আহমদ মুসার হেরিটেজ ফাউন্ডেশন-এর ইতিহাস ও ডিজাইন সন্ধান ছিল একটা বাড়তি ব্যবস্থা। হেরিটেজ ফাউন্ডেশনকে যদি সন্দেহ করেই থাকে, তাহলে এখানে প্রবেশের জন্যে কোন ইতিহাস বা ডিজাইনের দরকার তার হবে না। বুঝতে পেরেছ মাজুরভ?’
‘বুঝতে পেরেছি মহামান্য আইভান।’
‘কি বুঝেছ?’
‘আহমদ মুসা হেরিটেজ ফাউন্ডেশনের ইতিহাস ও ডিজাইন পায়নি বলে আমাদের আনন্দিত হবার কিছু নেই।’
সোনালী চেয়ারের সেই বজ্রকণ্ঠ আবার বলল, ‘আমার অনুমান ভুল না হলে তোমরা তার কাছে পৌঁছার আগে সেই-ই তোমাদের কাছে আসছে এই হেরিটেজ ফাউন্ডেশনেই।’
‘মহামান্য আইভান, এর মধ্যে একটা আমাদের ব্যর্থতা আছে, কিন্তু আহমদ মুসার জন্যে আছে চরম দুর্ভাগ্য।’
‘হ্যাঁ, রাশিয়ার প্রিয় সন্তানরা, চরম দুর্ভাগ্যই যেন তার হয়।’
কথা শেষ হওয়ার সাথে সাথেই সোনালী চেয়ারটি চোখের পলকে মঞ্চের ভেতরে ঢুকে গেল।
আইভান চলে গেলেও হলের চেয়ারে বসা অবস্থা থেকে কেউ উঠল না।
শুধু উঠল ভ্লাদিমির খিরভ। তারপর নিকোলাস বুখারিনকে নিয়ে দাঁড়ানো চেয়ার ঠেলে হলের দরজার দিকে এগিয়ে চলল সে।
হল থেকে বেরুবার পর চেয়ারসহ নিকোলাস বুখারিনকে নিয়ে লিফটে উঠল খিরভ। লিফট থেকে নেমে চলল নিচে।
লিফট উঠা-নামার লাইট ইনডিকেটরটি একদম বটম বোতামে পৌঁছতেই লিফট স্থির হয়ে দাঁড়াল।
লিফটের দরজা খুলে গেল।
লিফটের বাইরে বেশ প্রশস্ত চারকোণা একটা চত্বর। চত্বরটি প্রলম্বিত করিডোরের একটি গ্রন্থি। চত্বর এবং করিডোর সবই সাদা পুরু কার্পেটে মোড়া। দেয়াল ও ছাদও তাই।
লিফট-এর বিপরীত দিকে চত্বরের ওপাশে গার্ডরুম। লিফট এসে পৌঁছার সাথে সাথে লিফট-এর দরজা খোলার আগেই গার্ডরুম থেকে চার স্টেনগানধারী বেরিয়ে এসে তাক করেছে লিফট রুমকে।
লিফট রুমের দরজা খুলে যেতেই ভ্লাদিমির খিরভ মুখোমুখি হলো তাদের।
খিরভ দুই হাত তুলে বিভিন্ন ভঙ্গিতে দু’হাতের কয়েকটি আঙুল নাড়ল কয়েকবার।
এটা আঙুলের ভাষায় কথা বলা। যাতে বলা হলো, ‘আইভান দি টেরিবল জিন্দাবাদ’। যে বা যারাই এ লিফট দিয়ে নামুক, তাকে আঙুল দিয়ে এ কথা বলতে হয়। ব্যর্থ হলে স্টেনগানের ব্রাশফায়ার তার জন্যে নির্দিষ্ট।
খিরভের আঙুল স্থির হতেই চারজনের স্টেনগানের ব্যারেল নিচে নেমে গেল। চার পাথরের মূর্তি পিছু হটে ঢুকে গেল গার্ডরুমে। বন্ধ হয়ে গেল গার্ডরুমের দরজা।
খিরভ নিকোলাস বুখারিনের চেয়ার ঠেলে সেই চারকোণা চত্বরে প্রবেশ করল।
চত্বর থেকে পুবদিকের করিডোর ধরে এগোলো সামনে।
চত্বর থেকে করিডোরটি পশ্চিম দিকে বেশি দূর এগোয়নি। মাত্র কয়েক গজ। যেখানে গিয়ে শেষ হয়েছে, সেখানে দেয়াল জোড়া একটা পেইন্টিং। পেইন্টিংটি ইতিহাসের ‘আইভান দি টেরিবল’-এর একটা আবক্ষ চিত্র।
বুখারিনের চেয়ার ঠেলে নিয়ে চলছিল খিরভ। করিডোরের দু’পাশে সারিবদ্ধ ঘর।
এক স্থানে এসে করিডোরটি উত্তর-দক্ষিণে প্রশস্ত একটি করিডোরে এসে পড়ল। প্রশস্ত সে করিডোরের ‍পুব পাশ দিয়ে বড় ধরনের পৃথক পৃথক পাঁচটি ঘর।
খিরভ প্রশস্ত করিডোরটিতে নেমে বুখারিনের চেয়ার ঠেলে সোজা পুব পাশের রুমটির দরজার সামনে গিয়ে থামল।
ঘরটির দক্ষিণ পাশে পর পর তিনটি কক্ষ। আর উত্তর পাশে একটি।
ঘরে ডিজিটাল লক।
কয়েকটা অংকে টোকা দিতেই দরজা খুলে গেল।
চেয়ার ঠেলে বুখারিনকে নিয়ে ঘরে প্রবেশ করল ভ্লাদিমির খিরভ।
এতক্ষণ খিরভ ও বুখারিন পরস্পর একটি কথাও বলেনি।
চেয়ারসমেত বুখারিনকে ঘরে ঢুকিয়ে খিরভ প্রথমবারের মত বুখারিনের চোখে চোখ রাখল। বলল, ‘বুখারিন, আমরা সবাই রাশিয়ার সন্তান, রাশিয়ার সেবক। রাশিয়ার স্বার্থে আমাদের সবকিছুই মেনে নেয়া উচিত।’
নিকোলাস বুখারিনের মুখ পাথরের মত অচঞ্চল। তাতে ভয়ের লেশমাত্র নেই। খিরভের কথা শুনে তার ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠল। বিদ্রূপ মিশ্রিত হাসি। বলল, ‘মিঃ ভ্লাদিমির খিরভ, আমি সৈনিক। মৃত্যুকে আমি ভয় পাই না। দেশের জন্যে জীবন দিতে আমি সদা প্রস্তুত। কিন্তু তোমাদের ‘মহামান্য আইভান’ আর আমার দেশ রাশিয়া এক নয়।’
‘তুমি মিথ্যা বলছ। এটা নিছক একটা প্রতিক্রিয়া ছাড়া কিছুই নয়।’ প্রতিবাদ করল খিরভ।
‘আপনি আমাকে মিথ্যা বলুন আপত্তি নেই। কিন্তু শুনে রাখুন, দেশের শ্লোগান দিয়ে কোন ব্যক্তি বা কোন গ্রুপের ভাগ্য গড়া দেশপ্রেম নয়। দেশপ্রেম ও জাতিপ্রেমের সাথে গণতন্ত্র নিষ্ঠার কোন পার্থক্য নেই। স্বেচ্ছাচারী হয়ে দেশপ্রেমিক হওয়া যায় না। এটা আমি বুঝেছি, আপনারাও বুঝবেন।’
একটা প্রবল ভয় নেমে এল খিরভের চোখে-মুখে। দ্রুত বলল, ‘তোমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে। মহামান্য আইভান সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।’
‘আপনাকে এই অফিসিয়াল কথাগুলো অবশ্যই বলতে হবে মিঃ খিরভ। কিন্তু আপনি জানেন, এই হেরিটেজ ফাউন্ডেশনের বিল্ডিং লাখো মানুষের বধ্যভূমি লুবিয়াংকার অংশ ছিল। গণতান্ত্রিক রাশিয়া একে উদ্ধার করে মানুষের হাতে তুলে দিয়েছে। কিন্তু আপনার মহামান্য আইভান একে আবার লুবিয়াংকায় পরিণত করেছে। লেনিন-স্টালিনের স্বেচ্ছাচারিতা সোভিয়েত ইউনিয়নে টিকেনি, আইভানের স্বেচ্ছাচারিতাও রাশিয়ায় টিকবে না।’ দৃঢ় কণ্ঠে বলল বুখারিন।
‘আপনার এই পদস্খলনের জন্যে দুঃখ হয় মিঃ বুখারিন।’
বলে দরজা বন্ধ করে বেরিয়ে এল খিরভ।
তার চোখে-মুখে বুখারিনের উপর কোন ক্রোধ নয়, ভয়ের কালো ছায়ায় আচ্ছন্ন।
সে দ্রুত পা বাড়াল লিফটের দিকে।

লেনিন হিলস-এর পশ্চিমে মস্কোর বিখ্যাত মুভি স্টুডিও’র একটা অনুষ্ঠানে শরীক হয়ে বাড়িতে ফিরছে ডঃ নাতালোভা।
ডঃ নাতালোভা মস্কো স্টেট ইউনিভার্সিটির ভাইস-চ্যান্সেলর।
ডঃ নাতালোভা বসা ড্রাইভিং সিটের পাশের সিটে। ড্রাইভ করছে তারই মেয়ে ওলগা। ওলগা মস্কো স্টেট ইউনিভার্সিটির সদ্য নিয়োগপ্রাপ্ত একজন তরুণী অধ্যাপিকা।
তারা ফিরছে লেনিন হিলস-উপত্যকার সড়ক পথে। তখন রাত বেশ হয়েছে। তারা তখন পাহাড়ের একটা ঢালের প্রান্ত দিয়ে চলছে। হঠাৎ উপর থেকে ভারি কিছু গড়িয়ে পড়ার শব্দ পেল।
সেদিকে তাকিয়ে ডঃ নাতালোভা ও ওলগা দু’জনেই দেখল, রাস্তার একেবারে পাশেই একটা কিছু গড়িয়ে পড়ে স্থির হলো।
কোন পাথর নয় তারা নিশ্চিত।
ওলগা গাড়ি থামিয়ে ফেলেছে।
ডঃ নাতালোভা টর্চের আলো ফেলল গড়িয়ে পড়া বস্তুটির উপর। বলল, ‘ওলগা, এতো মানুষ!’
ডঃ নাতালোভা ও ওলগা দু’জনেই দ্রুত গাড়ি থেকে নামল। দ্রুত তারা পৌঁছল গড়িয়ে পড়া দেহটির পাশে।
টর্চের আলোতে দেখল আহত, রক্তাক্ত একটি যুবক। ডঃ নাতালোভা পরীক্ষা করে বলল, ‘যুবকটি বেঁচে আছে, সংজ্ঞা হারিয়েছে মাত্র।’
‘তাহলে আম্মা?’ বলল ওলগা।
‘চলো গাড়িতে তুলে নেই, কোন ক্লিনিকে নিতে হবে।’ ডঃ নাতালোভা বলল।
‘অবশ্যই। নাও এস।’
বলে ওলগা সংজ্ঞাহীন যুবকটির মাথার দিকে গিয়ে তুলে নেবার উদ্যোগ নিল। ওলগার মা ডঃ নাতালোভা পেছন দিকটা ধরল। গাড়িতে তুলে নিল তারা যুবকটিকে।
‘আম্মা, তুমি দেখ ওর সংজ্ঞা ফেরাতে পার নাকি। তাড়াতাড়ি তাকে ক্লিনিকে নিতে হবে।’
ওলগা তার ড্রাইভিং সিটে ফিরে গিয়ে গাড়ি স্টার্ট দিল। ছুটে চলল গাড়ি উপত্যকার পথ ধরে।
জ্ঞান ফেরাবার জন্যে যুবকটির দেহ নাড়া-চাড়া করতে গিয়ে চমকে উঠল ডঃ নাতালোভা, এতো ছেলে নয়। তার মাথার চুলও উঠে এসেছে হাতের সাথে এবং বেরিয়ে পড়েছে কালো চুলের বদলে মেয়েলি কাটের সুন্দর স্বর্ণাভ চুল।
চিৎকার করে উঠল ডঃ নাতালোভা, ‘ওলগা, পুরুষের ছদ্মবেশে এতো মেয়ে!’
‘আম্মা তা-ই?’ বিস্ময় ওলগার চোখে-মুখেও।
ডঃ নাতালোভা চেষ্টা করল। কিন্তু জ্ঞান ফেরার কোন লক্ষণ নেই।
ডঃ নাতালোভা সংজ্ঞাহীন মেয়েটির পিঠ থেকে ব্যাগটি সরিয়ে নিয়েছিল। ব্যাগ খুলে চেক করল ডঃ নাতালোভা। ব্যাগে ছোট-খাট কিছু প্যাকেট আছে। পোশাক আছে। মেয়েদের পোশাক।
পকেট সার্চ করতে গিয়ে আবার তার চমকে উঠার পালা। পকেটে পেল লোডেড একটি রিভলভার। কোমরের বেল্টের সাথে আটকানো থলিতে পেল পাসপোর্ট, মানিব্যাগ ইত্যাদি।
এ সময় ওলগা বলল, ‘আম্মা, ওর পুরুষ বেশ, গড়িয়ে পড়ে আহত হওয়া এই সব খুব স্বাভাবিক মনে হচ্ছে। আমার অনুমান ভুল না হলে, আমাদের এ রাস্তার উপরে পাহাড়ের গা বেয়ে যে রাস্তা সিকিউরিটি ব্যারাকের দিকে গেছে, সেই রাস্তায় কিছু একটা ঘটেছে। এর এভাবে গড়িয়ে পড়া তার রেজাল্ট হতে পারে।’
ডঃ নাতালোভা দ্রুত কণ্ঠে বলল, ‘আরও আছে ওলগা, ব্যাগে রিভলভার পাওয়া গেছে। পাসপোর্টের নামটা ফরাসী বলে মনে হচ্ছে।’
‘রিভলবার? কি নাম?’
‘মারিয়া জোসেফাইন লুই।’
‘ঠিক, ফরাসী নাম আম্মা। রিভলভারের ব্যাখ্যা কি করা যায় আম্মা?’
‘এটা বড় কথা নয়। আত্মরক্ষার মত প্রয়োজনেও মানুষের রিভলভার থাকতে পারে।’
মাইলকয়েক দক্ষিণে লেনিন হিলস-এর দক্ষিণ প্রান্তে মস্কো স্টেট ইউনিভার্সিটি। ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসেই ভিসি’র বাংলো। এখানেই ডঃ নাতালোভা এবং ওলগা থাকেন।
গাড়ি প্রবেশ করল ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসে।
‘জ্ঞান তো এখনও ফিরল না। কোথায় নেবে ওলগা একে?’
‘আমাদের ক্যাম্পাস ক্লিনিক যথেষ্ট হবে আম্মা। মাথায় কিংবা দেহে বড় কোন আঘাত নেই। কিন্তু উঁচু থেকে গড়িয়ে পড়তে গিয়ে অব্যাহত আঘাতে ওর সংজ্ঞা লুপ্ত হয়েছে।’
তখন বেশ রাত। আলো-আধাঁরী ঘেরা ক্লিনিক যেন ঘুমিয়ে পড়েছে।
গাড়ির ইমারজেন্সী লাইট জ্বালিয়ে এগিয়ে আসছিল ওলগার গাড়ি।
ক্লিনিকের গাড়ি বারান্দায় গাড়ি এসে দাঁড়াতেই ছুটে এল তিনজন একটা ট্রলি নিয়ে।
গাড়িতে ভাইস-চ্যান্সেলর ডঃ নাতালোভাকে দেখে চমকে উঠে লম্বা স্যালুট দিল তারা।
দ্রুত তারা মারিয়া জোসেফাইনকে ট্রলিতে শুইয়ে ছুটল ইমারজেন্সীর দিকে।
ওলগা মারিয়ার ব্যাগটা হাতে নিয়ে ডঃ নাতালোভার সাথে এগোলো সিঁড়ির দিকে।
রিসেপশনের সামনে দিয়ে একটু সামনে এগোলে ইমারজেন্সীতে ঢোকার বিশেষ গেট।
রিসেপশনের সামনে দিয়ে সেদিকেই এগোচ্ছিল ওলগারা।
রিসেপশনিস্ট মেয়েটি টেলিফোনে কথা বলছিল। সে দাঁড়িয়ে পড়েছিল ডঃ নাতালোভাকে দেখে।
হঠাৎ রিসেপশনিস্ট মেয়েটি ওলগার দিকে হাত তুলে বলল, ‘মাফ করবেন ম্যাডাম, রোগীটি কে?’
একটু ভেবে ওলগা উত্তর দিল, ‘আমার খালাতো বোন।’
‘ঈশ্বর তাকে সাহায্য করুন।’ বলে বসে পড়ল রিসেপশনিষ্ট মেয়েটি।
মারিয়া জোসেফাইনের জ্ঞান ফিরলে ডঃ নাতালোভা বাসায় ফেরে রাত এগারটার দিকে। ওলগা বাসায় ফেরেনি।
মারিয়া জোসেফাইনকে ভাইস-চ্যান্সেলরের ঘনিষ্ঠ আত্মীয় হিসেবে ভিআইপি বেড দেয়া হয়েছিল। ওলগা মারিয়া জোসেফাইনের পাশের বেডে শুয়েছিল।
দু’চারটা কথা বলেই ওলগা ঘনিষ্ঠ হয়ে গেছে মারিয়া জোসেফাইনের। অসুস্থ মারিয়া জোসেফাইনকে একা ফেলে সে বাসায় ফিরতে রাজি হয়নি।
ওলগাদের বাড়ি থেকেই ওলগা ও মারিয়া জোসেফাইনের জন্যে ব্রেকফাস্ট এসেছিল সকালে।
সকাল নয়টার দিকে ওলগাদের ভিআইপি রুমের পাশ দিয়ে যাচ্ছিল সেই রিসেপশনিস্ট।
দরজা খোলা ছিল।
রিসেপশনিস্ট দাঁড়াল। ওলগাকে লক্ষ্য করে বলল, ‘ম্যাডাম, সিকিউরিটির একজন কিছুক্ষণ আগে টেলিফোন করেছিল। জিজ্ঞেস করেছিল, রোগীর নাম কি, কেমন দেখতে, ইত্যাদি।’
মারিয়া জোসেফাইনও তার বেডে শুয়ে রিসেপশনিস্ট-এর কথা শুনছিল। তার কথা কানে যেতেই বুকটা কেঁপে উঠল মারিয়া জোসেফাইনের। ওরা ক্লিনিকে হামলা করবে নাকি?
ওলগা বলল, ‘কেন জানতে চেয়েছে? আপনি কি বললেন?’
‘ওরা দু’বার টেলিফোন করেছিল। প্রথমবার জিজ্ঞেস করল, ‘গত রাত বা আজ সকালে কোন অসুস্থ বা আহত মহিলা ক্লিনিকে এসেছে কিনা। আমি ‘এসেছে’ বলার সঙ্গে সঙ্গে ওপার থেকে ‘ধন্যবাদ’ বলে টেলিফোন রেখে দিল। এক মিনিট পরেই আবার টেলিফোন এল। জিজ্ঞেস করল, ‘মহিলাটি পরিচিত কিনা? নাম কি? বিদেশী কিনা? দেখতে কেমন? ইত্যাদি।’ আমি তাকে থামিয়ে দিয়ে বললাম, ‘শুনুন, মহিলাটি আমাদের ভাইস-চ্যান্সেলর ডঃ নাতালোভার বোনের মেয়ে।’ আমার একথা শোনার পর লোকটি বিরক্ত করার জন্যে দুঃখ প্রকাশ করে বলল, ‘এক ভয়ংকর মহিলাকে আমরা খুঁজছি। দেশের স্বার্থে তাকে আমাদের পাওয়া প্রয়োজন।’
‘ধন্যবাদ।’ ওলগা রিসেপশনিস্টকে লক্ষ্য করে বলল।
রিসেপশনিস্ট চলে গেল।
ওলগা হাসিমুখে তাকাল মারিয়া জোসেফাইনের দিকে। বলল, ‘সিকিউরিটির লোকরা আপনাকেই খুঁজছে।’
‘ওরা সিকিউরিটির লোক নয়।’
‘নয়? কারা ওরা?’
‘রাশিয়ার একটি গোপন সংগঠন।’
‘কোন সংগঠন জানতে পারি?’
মারিয়া জোসেফাইন ওলগার দিকে একবার তাকাল। তারপর বলল, ‘অবশ্যই। ‘গ্রেট বিয়ার’।’
‘গ্রেট বিয়ার?’
‘নিশ্চয় চেনেন সংগঠনটিকে?’
ওলগার চোখে-মুখে চিন্তার রেখা ফুটে উঠেছিল। বলল, ‘অবশ্যই চিনি।’
একটু থেমেই ওলগা আবার বলল, ‘তাদের সাথে আপনার ঝগড়া কেন?’
‘আমার কোন ঝগড়া নেই, আমাকে হাতে পাওয়ার মধ্যে তাদের কোন স্বার্থ আছে।’
ওলগা আবার মুখ খুলতে গিয়েও চুপ করল। ভাবল, এসব প্রশ্ন জেরার মত হয়ে যাবে।
একটু পর মারিয়া জোসেফাইনই বলল, ‘মিস ওলগা, আমার হাঁটার মত শক্তি হয়েছে। আমি চলে যেতে চাই। আমি সত্যিই বিপদে আছি। আমার স্বামী ওদের হাতে বন্দী।’
ওলগা তাকাল মারিয়া জোসেফাইনের দিকে। বলল ধীরে ধীরে, ‘বুঝতে পারছি। কিন্তু আম্মা এ অবস্থায় কিছুতেই আপনাকে যেতে দিতে রাজি হবেন না। চলুন, আপনাকে আমরা বাসায় নিয়ে যাব। ওখানে কোন বিপদের ভয় নেই। সুস্থ হবার পর চলে যাবেন।’
বলে ওলগা হাতের মোবাইল টেলিফোনে ডায়াল করা শুরু করল।
মারিয়া জোসেফাইন তাকে বাঁধা দিয়ে বলল, ‘আমাকে আপনারা চেনেন না। সব জেনে এইভাবে আপনারা আমাকে আশ্রয় দেবেন কেন? তার উপর শুনলেন, আমি এক ভয়ংকর মহিলা।’
‘এসব কথা আমার আম্মাকে বলবেন। তবে আমি এটুকু বলতে পারি, গ্রেট বিয়ারের কথাকে আমরা সার্টিফিকেট বলে মনে করি না।’
বলে ওলগা তার মা’কে টেলিফোন করে বলল, ‘আম্মা, সব কথা এসে বলব। আমি মিসেস মারিয়া জোসেফাইনকে বাসায় নিয়ে আসছি।’
ওপার থেকে ওর মায়ের কথা শুনে হাসিতে ভরে গেল মুখ, ‘ধন্যবাদ আম্মা, আমরা আসছি।’
কথা শেষ করেই বাইরে গিয়ে অ্যাটেনডেন্টকে সবকিছু গোছাতে বলে চলে গেল ক্লিনিকের অফিসে।
মিনিট পাঁচেক পরে ফিরে এসে বলল, ‘চলুন, সব কমপ্লিট।’
মারিয়া জোসেফাইন ধীরে ধীরে হাঁটতে শুরু করল।
দু’জন এসে উঠল গাড়িতে। ওলগা গাড়ি ড্রাইভ করল।
গাড়িতে উঠে বসে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করল মারিয়া জোসেফাইন। যখন সে চরম অসহায়, তখন আল্লাহ তাকে আশ্রয় দিলেন মস্কো স্টেট ইউনিভার্সিটির ভাইস-চ্যান্সেলরের বাড়িতে।
ওলগার পাশের কক্ষেই মারিয়া জোসেফাইনের থাকার ব্যবস্থা হলো।
বাসায় আসার পর পরই মারিয়া জোসেফাইনের জ্বর আসে। সঙ্গে সঙ্গেই ডাক্তার আনা হয়। ডাক্তার মারিয়া জোসেফাইনকে কমপ্লিট বেডরেস্টের জন্যে বলে। হাঁটা, চলা-ফেরা একদম নিষিদ্ধ করা হয়।
দু’দিন থেকে জ্বর আসেনি। শরীরের ভেতরের ব্যথা-বেদনাও কমে গেছে।
ডাক্তার আনা পাভলোভা শরীর পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ওলগাকে বলল, ‘হ্যাঁ ওলগা, এখন তোমার বোন কিছু হাঁটতে পারে। এঘর-সেঘর যেতে পারে।
এ সময় ডঃ নাতালোভা প্রবেশ করল ঘরে। বলল, ‘ডাঃ আনা, কেমন আছে আমার মেয়েটি?’
ডাঃ উঠে দাঁড়াল। ডঃ নাতালোভা সোফায় বসল।
ডাক্তার তার চেয়ারে বসতে বসতে বলল, ‘বিস্ময়কর উন্নতি হয়েছে ম্যাডাম। মাথায় এবং শরীরে যে ধরনের আঘাত, তাতে মাসখানেকের আগে উঠে দাঁড়াবার কথা নয়। মাথায় তো অপারেশনের দরকার ছিল। কিন্তু বিস্ময়করভাবে মস্তিষ্কের ব্লাড সার্কুলেশন স্বাভাবিক হয়ে গেছে। দেহের এই ধরনের বৈশিষ্ট্য বিরল। ওর রক্তও অসাধারণ গ্রুপের। আর দু’চার দিনের মধ্যে উনি ঘোড়ায় চড়ার মত অবস্থা ফিরে পাবেন।’
ডাক্তার তার যন্ত্রপাতি গুটিয়ে ব্যাগ নিয়ে উঠে দাঁড়াল।
ওলগা ডাক্তার আনা পাভলোভাকে গাড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে এল।
ডঃ নাতালোভা কথা বলছিল। বলছিল, ‘ডাঃ আনা ঠিকই বলেছে, তোমার মুখের দিকে চাইলে সত্যিই চোখ ফেরানো যায় না। কি এক অসাধারণ আভিজাত্য ছড়িয়ে রয়েছে তোমার মুখে। আসলে তুমি কে মা?’
মুহূর্তকাল চুপ করে থেকে মারিয়া জোসেফাইন বলল, ‘আমার নাম তো জানেন খালাম্মা। আমি ফ্রান্সের ‘লুই’ বংশের মেয়ে।’
‘‘লুই’ মানে ‘বুরবন’ রাজবংশের মেয়ে?’ ডঃ নাতালোভার কণ্ঠে বিস্ময়ের ছাপ।
‘জ্বি।’ বলল মারিয়া জোসেফাইন।
‘তার মানে তুমি ফ্রান্সের রাজকন্যা?’ বিস্ময়-বিমুগ্ধ কণ্ঠে বলল ওলগা।
‘ফ্রান্সে কোন রাজবংশ নেই এখন। লুই’রা এখন আর রাজপরিবার নয়।’ ম্লান হেসে মারিয়া জোসেফাইন বলল।
‘রাজত্ব গেলেও রাজবংশ থাকে। আমাদের জারদের রাজত্ব নেই, কিন্তু জাররা আছেন এবং নামমাত্র হলেও তাদের আবার সিংহাসন ফিরিয়ে দেয়া হচ্ছে।’
‘সত্যি সিংহাসন তারা পাচ্ছে?’
‘অবশ্যই। আর মাত্র কয়েকদিন। তার পরেই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার অধীনে নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্র চালু হচ্ছে।’
‘কে বসছেন সিংহাসনে?’
‘প্রিন্সেস তাতিয়ানার বসার কথা। কিন্তু গুজব শোনা যাচ্ছে, উনি নিহত হয়েছেন সুইজারল্যান্ডে। এখন শোনা যাচ্ছে, প্রিন্সেস ক্যাথারিন সিংহাসনে বসতে যাচ্ছেন।’
‘কিন্তু প্রিন্সেস ক্যাথারিন কি সিংহাসনে বসতে পারবেন?’
‘কেন পারবেন না? তুমি কিছু জান?’ বলল ডঃ নাতালোভা।
‘কিছু জানি। প্রিন্সেস ক্যাথারিন এখন গ্রেট বিয়ারের হাতে বন্দী।’
‘কেন গ্রেট বিয়ার তাকে বন্দী করেছে?’ বলল ডঃ নাতালোভা বিস্ময়ে চোখ কপালে তুলে।
‘গ্রেট বিয়ার নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্র চালুর প্রচেষ্টা বানচাল করতে চায়। দ্বিতীয়ত, জারের গোপন ধনভাণ্ডার কুক্ষিগত করতে চায়। দুই কাজের জন্যেই প্রিন্সেস ক্যাথারিনকে তারা হাতের মুঠোয় রাখতে চায়।’
ডঃ নাতালোভা এবং ওলগা দু’জনের মুখই ম্লান হয়ে গেছে। তাদের চোখে-মুখে উদ্বেগের চিহ্ন।
‘তুমি এসব জানলে কেমন করে?’ বলল ডঃ নাতালোভা।
‘আমার স্বামী প্রিন্সেস ক্যাথারিনকে উদ্ধারের চেষ্টা করছেন এবং সে জন্যেই তিনি রাশিয়ায় এসেছেন। এই তার অপরাধ। আমার স্বামী যেমন ওদের হাতে বন্দী, তেমনি আমার পিতাও। আমাকেও ওরা আটক করতে চায়।’
‘তোমার পিতা কেন বন্দী? তোমাকে কেন ওরা ধরতে এমন মরিয়া? আসল লোক তো ওদের হাতে রয়েছেই।’
‘আমার স্বামীর কাছ থেকে দু’টো জিনিস উদ্ধার করতে চায়, যা না পেলে জারের ধনভাণ্ডার কোনদিনই উদ্ধার করা যাবে না। আমার স্বামীর উপর চাপ সৃষ্টির জন্যেই আমাকে ওরা বন্দী করতে চায়।’
‘বুঝলাম। কিন্তু বুঝতে পারছি না, তোমার স্বামী প্রিন্সেস ক্যাথারিনকে উদ্ধার করতে আসবেন কেন? জারের গোপন ধনভাণ্ডারের সাথে তিনি জড়িয়ে পড়বেন কেন?’
ডঃ নাতালোভার কথা শেষ হতেই একটা প্যাকেট নিয়ে পরিচারিকা ঘরে প্রবেশ করল। সে ডঃ নাতালোভার হাতে প্যাকেটটি তুলে দিয়ে বলল, ‘লাইব্রেরী থেকে দিয়ে গেল।’
বড় এনভেলাপে একটা মোটা বই।
ডঃ নাতালোভা সেদিকে একবার তাকিয়ে এনভেলাপে একটা চুমু খেয়ে বইটি বের করল।
বইটি কোরআন শরীফ।
কোরআন শরীফ বের করে হাতে নিয়ে আবার চুমু খেল ডঃ নাতালোভা।
সেদিকে তাকিয়ে আছে মারিয়া জোসেফাইন। তার দু’চোখ প্রায় ছানাবড়া হয়ে যাবার জোগাড়।
ডঃ নাতালোভা মারিয়া জোসেফাইনের দিকে চাইল। তার অবস্থা দেখে বলল, ‘কি দেখছ, এটা কোন আজব জিনিস নয়, একটি ধর্মগ্রন্থ, কোরআন শরীফ।’
‘কোরআন শরীফে আপনি চুমু খেলেন, আপনি কি মুসলিম?’ বলল মারিয়া জোসেফাইন চোখে-মুখে বিস্ময় নিয়ে।
‘এবং আপনি?’ ওলগার দিকে চেয়ে দ্রুত কণ্ঠে বলল মারিয়া জোসেফাইন।
‘আমি আম্মার চেয়ে সিনিয়র মুসলমান।’ বলল ওলগা হাসিমুখে।
শোনার সঙ্গে সঙ্গে মারিয়া জোসেফাইন ‘আল্লাহু আকবর’ বলে দু’হাতে মুখ ঢাকল।
ওলগা লাফ দিয়ে মারিয়া জোসেফাইনের কাছে উঠে এল। মারিয়া জোসেফাইনের মুখ থেকে তার দুই হাত সরিয়ে নিল।
দেখা গেল, মারিয়া জোসেফাইনের ঠোঁটে আনন্দের হাসি। চোখ দিয়ে অশ্রু গড়াচ্ছে। আনন্দের অশ্রুতে ভেসে গেছে তার দুই গণ্ড।
‘আপনি মুসলমান?’ বলল ওলগা মারিয়া জোসেফাইনকে।
‘আলহামদুলিল্লাহ’। বলল মারিয়া জোসেফাইন।
শুনে পাগলের মত জড়িয়ে ধরল ওলগা মারিয়া জোসেফাইনকে। মারিয়া জোসেফাইনও জড়িয়ে ধরল ওলগাকে।
জড়িয়ে রেখেই ওলগা বলল, ‘ফরাসী রাজকুমারী মুসলমান হয়েছে, ইউরোপের জন্যে এটা একটা বড় খবর।’
মারিয়া জোসেফাইন ওলগার হাতের বাঁধন মুক্ত হয়ে বলল, ‘মস্কো স্টেট ইউনিভার্সিটির ভাইস-চ্যান্সেলর এবং তার অধ্যাপিকা কন্যা মুসলমান, এটা তার চেয়ে অনেক বড় খবর।’
বলে খাট থেকে নামল মারিয়া জোসেফাইন। নেমে এগোলো ডঃ নাতালোভার দিকে।
ডঃ নাতালোভাও উঠে দাঁড়িয়ে এগোলো মারিয়া জোসেফাইনের দিকে এবং তাকে জড়িয়ে ধরে তার কপালে বার বার চুমু খেল। বলল, ‘এ কারণেই প্রথম যখন দেখলাম, তখন থেকেই মনে হচ্ছিল একান্ত আপন কেউ।’ বলে পাশের সোফায় বসাল মারিয়া জোসেফাইনকে।
ওলগা গিয়ে মারিয়া জোসেফাইনের সোফায় বসল ঠাসাঠাসি করে এবং গলা জড়িয়ে ধরল মারিয়া জোসেফাইনের।
‘ওলগা, মুসলমান হিসেবে খালাম্মার চেয়ে সিনিয়র হলে কেমন করে বুঝতে পারলাম না।’ বলল মারিয়া জোসেফাইন।
‘আম্মার আগে আমি ইসলাম গ্রহণ করেছি। আম্মা আমার কাছে ইসলাম গ্রহণ করেছে।’
‘আর তুমি কার কাছে ইসলাম গ্রহণ করেছ?’
প্রশ্ন শুনেই মুখটা মলিন হয়ে গেল ওলগার। মারিয়া জোসেফাইনের গলা থেকে তার হাতটা খসে পড়ল।
‘কি হলো তোমার ওলগা?’ বলল মারিয়া জোসেফাইন।
‘মারিয়া, তুমি ওলগাকে এমন একজনের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছ যার কথা স্মরণ হলে সে ভেঙে পড়ে।’
‘কে সে?’
‘মস্কো বিশ্ববিদ্যালয়েরই একটি মেয়ে। ওলগার সাথে পড়তো। তার কাছেই ওলগা ইসলাম শেখে।’ বলল ডঃ নাতালোভা।
‘শুধু ইসলাম শেখা নয়। আম্মা যখন সোভিয়েত কারাগারে, আমার সামনে যখন সমগ্র জগৎ অন্ধকার, যখন জীবন আমার কাছে থাকা না থাকা সমান, সেদিন মাত্র তার কাছে আমি বেঁচে থাকার প্রেরণা পাই, সামনের জমাট অন্ধকারে আশার আলো জ্বলে উঠে, জীবনের নতুন অর্থ খুঁজে পাই আমি।’১
‘তিনি কোথায়? তার কথা স্মরণ হলে ভেঙে পড়ার কারণ?’
‘সে একজন উজবেক মেয়ে। মধ্য এশিয়া স্বাধীন হলে সে দেশে ফিরে যায়। বাড়িতে থাকাকালেই সে রাশিয়ার এক কু-সন্তান জেনারেল বরিসের দলের হাতে নির্মমভাবে নিহত হয়।’
জেনারেল বরিসের নাম শুনে মারিয়া জোসেফাইন চমকে উঠল। এই লোকটা তো ছিল আহমদ মুসার কট্টর দুশমনদের একজন এবং তার হাতেই নিহত হয়েছে মেইলিগুলি, আহমদ মুসার প্রথম প্রিয়তমা স্ত্রী।
‘জেনারেল বরিসের কথা আমি শুনেছি। কিন্তু এই জেনারেল বরিস একজন উজবেক মেয়েকে মারতে যাবে কেন?’
‘তার অপরাধ ছিল, তিনি ছিলেন বহু বিপ্লবের নায়ক আহমদ মুসার বাগদত্তা। তাকে হত্যা করে আহমদ মুসার উপর একটা প্রতিশোধ নেয় জেনারেল বরিস।’ বলল ডঃ নাতালোভা।
চমকে উঠল মারিয়া জোসেফাইন। বলল দ্রুত কণ্ঠে, ‘আপনি ফাতিমা ফারহানার কথা বলছেন? আপনারা আহমদ মুসাকে চেনেন?’
‘আমরা আহমদ মুসাকে চিনব না! মধ্য এশিয়ায় তার বিপ্লব রুশ জনগণের স্বাধীনতাকেও ত্বরান্বিত করেছে। তুমি ফাতিমা ফারহানার নাম জান কি করে? তুমিও কি আহমদ মুসাকে চেন?’ বলল ওলগা।
মারিয়া জোসেফাইন তৎক্ষণাৎ জবাব দিল না। তারপর মাথা নিচু করে ধীর কণ্ঠে বলল, ‘তিনি আমার স্বামী। তার কাছেই আমি ফাতিমা ফারহানার কথা শুনেছি।’
‘আম্মা’ বলে চিৎকার করে দাঁড়িয়ে পড়ল ওলগা। তার বিস্ময়-বিমূঢ় দৃষ্টি মারিয়া জোসেফাইনের মুখের উপর নিবদ্ধ। ডঃ নাতালোভারও বিমুগ্ধ দৃষ্টি মারিয়া জোসেফাইনের উপর।
মারিয়া জোসেফাইন বিমূঢ়ভাবে দাঁড়ানো ওলগাকে হাত ধরে টেনে পাশে বসালো। ওলগা পাগলের মত আবার জড়িয়ে ধরল মারিয়া জোসেফাইনকে। বলল, ‘আমাদের কি সৌভাগ্য, আল্লাহর কি দয়া যে, আহমদ মুসার স্ত্রীকে আমরা এত কাছে পেয়েছি। নিশ্চয় আহমদ মুসাকে দেখার সৌভাগ্যও আল্লাহ দেবেন।’
ডঃ নাতালোভা পাশের সোফাতে বসেছিল। সে মারিয়া জোসেফাইনের একটা হাত টেনে নিয়ে চুমু খেয়ে বলল, ‘এতক্ষণ তুমি ‘মা’ ছিলে, এখন তুমি আমাদের মাথার মণি হয়ে দাঁড়ালে। আহমদ মুসা আমাদের পরম শ্রদ্ধার, পরম সম্মানের, পরম আদরের।’
মারিয়া জোসেফাইন সোফা থেকে হঠাৎ ডঃ নাতালোভার পায়ের কাছে বসে পড়ল। দু’হাতে ডঃ নাতালোভার দু’হাঁটু পর্যন্ত জড়িয়ে ধরে তার উরুতে মুখ গুঁজে বলল, ‘না, আমি আপনার মেয়ে থাকতে চাই। আহমদ মুসা অনেক অনেক বড়, কিন্তু আমি খুব সামান্য।’
ডঃ নাতালোভা মারিয়া জোসেফাইনকে বুকে টেনে নিল। বলল, ‘না, তুমি সামান্য নও। সামান্য কেউ আহমদ মুসার সঙ্গী হতে পারে না। তিনি মুকুটহীন রাজা। রাজকন্যাই তার প্রাপ্য। আলহামদুলিল্লাহ, একজন নিখাদ রাজকন্যাই তিনি পেয়েছেন।’
লজ্জায় লাল হয়ে ওঠা মারিয়া জোসেফাইনকে ওলগা মায়ের কোল থেকে তুলে খাটে নিয়ে বসল। বলল, ‘আর বোন নয়, ভাবী। বোন তবু আমার আছে, ভাবী নেই। ভাবী পেলাম এবার।’
সলাজ হেসে বলল, ‘আমার আপত্তি নেই। কিন্তু আমার যত ননদ হবে, তাদের সামাল দেব কি করে!’
ওলগা কিছু বলতে যাচ্ছিল। তার মা ডঃ নাতালোভা তাকে বাঁধা দিয়ে বলল, ‘ওলগা, ভাবী তোমার থাকছে, পরে বলো।’ বলে ডঃ নাতালোভা মারিয়া জোসেফাইনের দিকে তাকাল এবং উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বলল, ‘তুমি যা বলেছ তাতে আহমদ মুসা এখন গ্রেট বিয়ারের হাতে বন্দী।’
‘আমি তা-ই মনে করছি।’
‘মনে করা কেন, নিশ্চিত জান না?’
‘নিশ্চিত জানি না, কার্যকারণ থেকে মনে করছি।’
‘ঘটনাটা খুলে বলবে মা? তোমার ঐ দশা কেন হয়েছিল, তাও কিন্তু আমরা জিজ্ঞেস করিনি।’
‘ঐ ঘটনা বললে তাতেই সব এসে যাবে খালাম্মা।’ বলে মারিয়া জোসেফাইন পুশকভ থেকে আহমদ মুসা ও মারিয়া জোসেফাইনের যাত্রা থেকে শুরু করে তার লেনিন হিলস-এ পৌঁছা পর্যন্ত সব কাহিনী খুলে বলল।
ডঃ নাতালোভা ও ওলগা বিস্ময় ও উদ্বেগ ভরা চোখে মারিয়া জোসেফাইনের কথা শুনল। তার কথা শেষ হলেও ডঃ নাতালোভা ও ওলগা কয়েক মুহূর্ত যেন কথা বলতে পারল না।
নীরবতা ভাঙল ডঃ নাতালোভা। বলল, ‘আলহামদুলিল্লাহ, আল্লাহ তার খাস রহমত দিয়ে তোমাকে রক্ষা করেছেন। আর তুমি ঠিকই বলেছ, কার্যকারণ থেকে আহমদ মুসা ওদের হাতে পড়াই বোঝায়।’
বলে একটু থামল। তারপর বলল, ‘আল্লাহ তাকে সাহায্য করুন। তাদের হাতে পড়া শেষ কথা নয়। আহমদ মুসার জন্যে এটা নতুন ঘটনাও নয়। এখন বল, আহমদ মুসা ক্যাথারিনের ঘটনার সাথে জড়িয়ে পড়লেন কেন? তার কাছে কি এমন জিনিস আছে যা পাবার জন্যে গ্রেট বিয়ার মরিয়া হয়ে উঠেছে?’
‘সে অনেক কথা খালাম্মা।’ বলে মারিয়া জোসেফাইন প্রিন্সেস তাতিয়ানার সাথে আহমদ মুসার পরিচয়ের কথা, সুইজারল্যান্ডের ঘটনা, সেখানে প্রিন্সেস তাতিয়ানার মর্মান্তিক মৃত্যু, তাতিয়ানা কর্তৃক রাজকীয় আংটি ও ডায়েরী প্রিন্সেস ক্যাথারিনের হাতে পৌঁছানোর দায়িত্ব আহমদ মুসাকে দেয়া, তার ফ্রান্সে আগমন ও গ্রেট বিয়ারের সাথে সংঘাত শুরু হওয়া, প্রভৃতি সব কথা ডঃ নাতালোভাকে খুলে বলল।
মারিয়া জোসেফাইন কাহিনী বলা শেষ করলেও ডঃ নাতালোভা ও ওলগা অনেকক্ষণ কথা বলল না। বিস্ময়-বিমুগ্ধ তাদের দৃষ্টি। ধীরে ধীরে তাদের বিস্ময়-বিমুগ্ধ চোখে দুশ্চিন্তার ছায়া নেমে এল। বলল ওলগা, ‘ভাবী, আমি একজন দেশপ্রেমিক রাশিয়ান। কিন্তু তবু আমি বলব, একটা দায়িত্ব পালনের জন্যে পর্বতপ্রমাণ ঝুঁকি নেয়া তার ঠিক হয়নি। উনি কোন ‘লা-ওয়ারিশ’ মাল নন যে, ইচ্ছেমত যে সে তাকে ব্যবহার করবে।’
ওলগা কথা শেষ করার আগেই মারিয়া জোসেফাইন তার তর্জনী ওলগার ঠোঁটে চাপা দিয়ে বলল, ‘প্রিন্সেস তাতিয়ানাকে ‘যে’ ‘সে’র দলে ফেল না ওলগা। তাতিয়ানা মধ্য এশিয়ার মুসলমানদের বিপদে নিজের পিতাকে পর্যন্ত কুরবানী দিয়ে যে সাহায্য করেছে, কোন কিছু দিয়েই তার মূল্য আদায় হবে না।১ সে আহমদ মুসাকে নিজেকে নিঃশেষ করে ভালোবেসেছে, কিন্তু কোন দাবি নিয়ে সে আহমদ মুসার কাছে দাঁড়ায়নি। সবশেষে যে গুলিটা আমার বুক বিদ্ধ করতো, সে গুলিটা প্রিন্সেস তাতিয়ানা নিজের বুকে নিয়ে তার ভাষায় ‘আহমদ মুসার প্রিয়তমা’কে রক্ষা করে তার ভালোবাসা কত বড় তার প্রমাণ দিয়েছে। সেই প্রিন্সেস তাতিয়ানার দেয়া দায়িত্ব পালন করতে কোন ত্যাগকেই আমাদের বড় করে দেখা উচিত নয়।’
‘বুঝলাম ভাবী। এ কাহিনী তোমার কাছে আরও শুনতে চাই।’
‘আমাদের প্রিন্সেস তাতিয়ানার জন্যে আমার গর্ব হচ্ছে। আহমদ মুসা তাতিয়ানাকে কি এই দৃষ্টিতে দেখে!’
‘অবশ্যই খালাম্মা। তাতিয়ানার মৃত্যুর পর নীরব অশ্রুতে তাকে ভাসতে দেখেছি। বলেছেন, ‘তাতিয়ানা শুধু দিয়েই গেল, নিল না কিছু।’’ বলল মারিয়া জোসেফাইন।
‘এখন আমাদের কি করণীয় আছে ভাবী? আহমদ মুসা ভাই শত্রুর হাতে পড়েছেন, এটা ধরে নিয়েই আমাদের কিছু করা দরকার কিনা?’ বলল ওলগা।
‘আমরা যদি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ি, তাহলে কি করব, এ ব্যাপারে আমার প্রতি তার নির্দেশ ছিল, আমি যেন নির্দিষ্ট ঠিকানায় থাকি। তিনিই আমাকে খুঁজে নেবেন।’ বলল মারিয়া জোসেফাইন।
‘নির্দিষ্ট ঠিকানাটা কি?’ বলল ওলগা।
‘আমাদের এক শুভাকাঙ্ক্ষীর কাছ থেকে মস্কোর একটা ঠিকানা আমরা নিয়ে এসেছি। সে ঠিকানাতেই আমার ওঠার কথা।’
‘টেলিফোন নাম্বার আছে?’
‘আছে।’
‘টেলিফোন করে আপনার মস্কো উপস্থিতির কথা তাদের বলে রাখা যায়।’
‘দু’দিন আগে এ উদ্দেশ্যে আমি সেখানে টেলিফোন করেছিলাম। পাইনি। রেকর্ডেড রিপ্লাই থেকে জানলাম, কি এক কাজে হঠাৎ মস্কোর বাইরে যেতে হয়েছে ওদের।’
‘তাহলে?’
‘দু’একদিনের মধ্যে মস্কোর ফরাসী দূতাবাসে গিয়ে খোঁজ নেব। আহমদ মুসা ওখানেও কোন মেসেজ রাখতে পারে।’
ওলগা ও ডঃ নাতালোভা দু’জনেই মাথা নাড়ল। ডঃ নাতালোভা বলল, ‘ঠিক মা, এটাই এখন প্রথম করণীয়।’
বলে একটু থেমে আবার শুরু করল, ‘কিন্তু মা, তোমার চলাফেরা নিরাপদ নয়। গ্রেট বিয়ারের লোকরা পাগলা কুকুরের মত হয়ে আছে।’
‘ঠিক বলেছেন খালাম্মা।’
‘আমিও সাথে যাব মা। একটু ছদ্মবেশ নিতে হবে ভাবীকে। অসুবিধা হবে না, সুপার প্লাস্টিকের স্কিন মাস্ক ভাবীর রয়েছে।’ বলল ওলগা।
‘ঠিক বলেছে ওলগা। কোন অসুবিধা হবে না।’ বলল মারিয়া জোসেফাইন।
ডঃ নাতালোভা উঠে দাঁড়াল। বলল, ‘যাই, স্টাডি রুমে একটু কাজ আছে।’
একটু থেমে ওলগাকে লক্ষ্য করে বলল, ‘তুমি মারিয়াকে নিয়ে বাগানের দিক থেকে একটু বেড়িয়ে এস।’
‘তার আগে আম্মা আমি আয়েশা আলিয়েভা আপাকে টেলিফোন করতে চাই।’
‘বেশ।’ বলে ডঃ নাতালোভা ঘরের দরজার দিকে পা বাড়াল।
‘আয়েশা আলিয়েভা কে ওলগা?’
‘হাসান তারিকের স্ত্রী। হাসান তারিককে চেন?’
‘নাম শুনেছি। ফিলিস্তিন বিপ্লবে আহমদ মুসার দক্ষিণ হস্ত ছিলেন।’
একটু থেমেই আবার বলল, ‘নাম শুনে মনে হচ্ছে, আয়েশা আলিয়েভা সোভিয়েত মেয়ে। কি করে বিয়ে হলো?’
‘আয়েশা আলিয়েভা উজবেক মেয়ে এবং অত্যন্ত প্রতিভাবান গোয়েন্দা অফিসার ছিলেন। হাসান তারিক সোভিয়েতদের হাতে বন্দী হয়ে আসেন ফিলিস্তিন থেকে সোভিয়েত ইউনিয়নে। আয়েশা আলিয়েভার উপর ভার পড়ে হাসান তারিককে সংশোধন অথবা জয় করে নেবার। কিন্তু আয়েশা তার প্রেমে পড়ে যান এবং ব্যর্থ হন। ব্যর্থতার দায়ে বন্দীশিবিরে পাঠানো হয় আয়েশা আলিয়েভাকে।’ থামল ওলগা।
‘তোমার সাথে পরিচয় কিভাবে?’
‘আমার আম্মা যে বন্দীশিবিরের যে সেকশনে ছিলেন, সেখানেই নিয়ে যাওয়া হয় আয়েশা আলিয়েভা ও রোকাইয়েভা নামে আরেক মেয়েকে। তারপর অনেক কথা। আরেক দিন বলব। সংক্ষেপে ঘটনা হলো, আয়েশা আলিয়েভা ও রোকাইয়েভা আম্মার পরামর্শে সেখান থেকে পালান এবং আমাদের কাছে ছিলেন ফাতিমা ফারহানা আপা তাদের সরিয়ে না নেয়া পর্যন্ত।’১
‘সে সময় আহমদ মুসার সাথে সাক্ষাৎ হয়নি?’ বলল মারিয়া জোসেফাইন।
‘আহমদ মুসার মূল কেন্দ্র তখন মধ্য এশিয়া। রাশিয়াতেও এসেছেন। কিন্তু তার সাথে দেখা হওয়ার মত ততটা বড় কিংবা সৌভাগ্যবান আমরা ছিলাম না।’
‘তোমার এ কথাগুলো আহমদ মুসাকে আমি বলব। এখন চল, আয়েশা আলিয়েভাকে টেলিফোন করবে। এ দিকের খবরটা হাসান তারিকের জানা দরকার। মধ্য এশিয়ায় সাইমুম সহযোগিতায় আসতে পারে।’
ওলগা তার মায়ের রেখে যাওয়া মোবাইল টেলিফোন হাতে তুলে নিল।
মস্কোর ফরাসী দূতাবাসে মারিয়া জোসেফাইন তার আইডেন্টিটি কার্ড দেখাতেই তথ্য অফিসারটি তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়িয়ে বাউ করল তাকে এবং তৎক্ষণাৎ সে ইন্টারকমে কথা বলল রাষ্ট্রদূতের সাথে।
কথা শেষ করেই বলল, ‘চলুন সম্মানিতা রাজকুমারী। রাষ্ট্রদূত আপনার জন্যে অপেক্ষা করছেন।’
তথ্য অফিসারটি মারিয়া জোসেফাইন ও ওলগাকে সাথে নিয়ে এগিয়ে চলল।
রাষ্ট্রদূতের অফিসে পৌঁছার পর দেখা গেল, রাষ্ট্রদূতের পিএস দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে তাদের জন্যে।
রাষ্ট্রদূতের পিএস মারিয়া জোসেফাইনদের স্বাগত জানিয়ে রাষ্ট্রদূতের কক্ষের দরজা খুলে দিল।
মারিয়া জোসেফাইন এবং ওলগা প্রবেশ করল ঘরে।
রাষ্ট্রদূত উঠে দাঁড়িয়ে তাদের স্বাগত জানাল।
বসার পর কুশল জিজ্ঞাসা হলো রাষ্ট্রদূত ও মারিয়া জোসেফাইনের মধ্যে।
তারপর মারিয়া জোসেফাইন সরাসরি প্রশ্ন করল রাষ্ট্রদূতকে, ‘সম্মানিত রাষ্ট্রদূত, আমার জন্যে কোন মেসেজ আছে কিনা?’
রাষ্ট্রদূত উত্তর দেবার আগে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে একবার ওলগা আরেকবার মারিয়া জোসেফাইনের দিকে তাকাল।
বুঝতে পেরে মারিয়া জোসেফাইন বলল, ‘সম্মানিত রাষ্ট্রদূত, এ ওলগা নাতালোভা। ও আমার বোন, বন্ধুর মত। আমাদের কোন কিছু গোপন নেই ওর কাছে। আপনি সব কথাই বলতে পারেন।’
‘ধন্যবাদ, সম্মানিতা প্রিন্সেস ডোনা জোসেফাইন। আপনার আব্বার কাছ থেকে একটা মেসেজ পেয়েছি আমরা।’
বলে একটা চিরকুট মারিয়া জোসেফাইনের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘আপনি পড়ুন সম্মানিতা প্রিন্সেস। তারপর কথা আছে, বলব।’
মারিয়া জোসেফাইনের চোখে-মুখে উদ্বেগ।
দ্রুত সে চিরকুটটির উপর চোখ বোলাল। তাতে লেখা, ‘মা ডোনা, বাবা আহমদ মুসা, খুব খারাপ অবস্থায় এরা রাখেনি। তবু এ জীবন অসহনীয়। একটা করে মুহূর্ত একটা যুগের মত। কবে এর ইতি হবে, কিংবা হবে না, কিছুই জানি না। সোভিয়েতরা সবচেয়ে বেশি অর্থের কাঙাল। এরই সুযোগ নিয়ে আমার বন্দীখানায় একজন উঁচু পর্যায়ের কর্মচারীকে, যে বাইরে যাতায়াত করে, আমার হীরের আংটি দিয়ে বশ করেছি। তার মাধ্যমেই চিঠিটি পাঠালাম। এখন থেকে প্রতি সোমবার বেলা এগারটায় টলস্টয় পার্কের টলস্টয় এভেনিউ-এর মাঝামাঝি ২১নং কালভার্টটির রেলিং-এ লাল জ্যাকেট ও নীল ফুলপ্যান্ট পরা একজন লোককে বসে থাকতে দেখবে। আর কালভার্টের দক্ষিণ গোড়ায় দক্ষিণমুখী হয়ে একটা ছোট নীল মাইক্রোকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখবে। ঐ মাইক্রোতে উঠে বসলে লাল জ্যাকেটওয়ালা লোকটিও মাইক্রোতে উঠে বসবে। তার কাছেই প্রয়োজনীয় সব কথা শুনবে। পরে সে তোমাকে বা তোমাদের নেভিডিভিচ কনভেন্টের সামনে নামিয়ে দিয়ে চলে আসবে।’
চিরকুটের লেখা শেষে দস্তখত। দস্তখতটি ভালো করে পরীক্ষা করে দেখেও কোন ত্রুটি পেল না মারিয়া জোসেফাইন। এটা আব্বারই দস্তখত।
চিরকুটটি পড়ার পর তা ওলগার হাতে তুলে দিয়ে তাকাল রাষ্ট্রদূতের দিকে। বলল, ‘চিঠি পড়লাম, বলুন এখন সম্মানিত রাষ্ট্রদূত।’
‘দস্তখত সম্পর্কে বলুন সম্মানিত প্রিন্সেস।’
‘দস্তখত আমার আব্বার।’
‘আমরা এ মেসেজ পাবার পর ফ্যাক্সে তা আপনার প্যারিসের বাড়িতে পাঠিয়েছি। এ ছাড়া আমরা এ মেসেজ পাবার পর দু’টি সোমবার পেয়েছি। একটি মেসেজ পাওয়ার পরদিন, আরেকটা ছিল গতকাল। দু’দিনই আমরা আমাদের গোয়েন্দা এজেন্টদের পাঠিয়েছি রাস্তার দু’দিক থেকে ঠিক এগারটায় ঐ ২১নং কালভার্ট অতিক্রম করার জন্যে। যাতে তারা লাল জ্যাকেটওয়ালা লোকটি এবং তার গাড়িকে দেখতে পায়। তাদের উপর নির্দেশ ছিল, যদি তারা দেখতে পায়, তাহলে অনেক দূর থেকে তাকে অনুসরণ করে ওদের ঘাঁটিকে চিহ্নিত করবে। কিন্তু দু’দিনের একদিনও পাওয়া যায়নি সেই লোক এবং সেই গাড়ি। আমরা মনে করছি, আহমদ মুসা এবং আপনি গেলেই শুধু ঐ তাকে এবং সেই গাড়িকে ঐ অবস্থায় পাওয়া যাবে।’
মারিয়া জোসেফাইন তৎক্ষণাৎ কোন কথা বলল না। ভাবল অনেকক্ষণ। তারপর ধীরে ধীরে বলল, ‘আহমদ মুসা নেই এ সময়। আমিই শুধু আছি। বলুন কি করণীয়।’
‘আমাদের লক্ষ্য সম্মানিত প্রিন্স প্লাতিনিকে উদ্ধার। এই উদ্ধারের জন্যে প্রয়োজন ওদের ঘাঁটি চিহ্নিত হওয়া। গোয়েন্দা লাগিয়ে আমরা সেটাই চেয়েছিলাম। হয়নি। এখন আমরা মনে করছি, সম্মানিতা প্রিন্সেস যদি যান, তাহলে ওরা থাকে কি না দেখা যেত। ওদের দেখা পেলেই তাদের অনুসরণ করার একটা সুযোগ হতো।’
‘আপনার কথা বুঝেছি। চিঠিরও দাবি এটাই। কিন্তু আমি যাব কিনা সিদ্ধান্ত নেবার আগে একটা বিষয় জানা দরকার। সেটা হলো, আপনাদের গোয়েন্দা দল চিঠির বক্তব্য অনুসারে লাল জ্যাকেটওয়ালা এবং তার গাড়ির দেখা পেল না কেন?’
‘সেটাই তো আমরা বুঝতে পারছি না। অবশেষে আমরা মনে করছি, সম্মানিত প্রিন্সেস গেলে চিঠির বক্তব্য সত্য হতে পারে।’
‘কিন্তু গোয়েন্দা দল গেলে তা সত্য হলো না কেন? এ প্রশ্নের সমাধান না করে ওদিকে পা বাড়ানো আমি মনে করি বিপজ্জনক হবে।’
‘কেন?’
‘আপনার গোয়েন্দারা লাল জ্যাকেটওয়ালা ও তার গাড়িকে না পাবার তিনটি কারণ হতে পারে। এক, লাল জ্যাকেটওয়ালা ঐ দু’দিন কোন কারণে আসেনি। দুই, আপনার গোয়েন্দা দল ঠিক রিপোর্ট দেয়নি। এবং তিন, লাল জ্যাকেটওয়ালা এসেছিল, কিন্তু আপনার গোয়েন্দা দলের উপস্থিতি টের পেয়ে সরে পড়েছে। এখন দেখা দরকার, এ তিনটি কারণের কোনটি সত্যের সবচেয়ে কাছাকাছি হতে পারে।’
‘ধন্যবাদ সম্মানিতা প্রিন্সেস। আমি আপনার সাথে একমত। কিন্তু এ তিনটি কারণের কোনটি সত্যের কাছাকাছি হতে পারে? প্রথমটি সত্য হওয়া স্বাভাবিক নয়। দ্বিতীয়টির সাথে সত্যের কোন দূরবর্তী সম্পর্কও নেই। এ দিক থেকে তৃতীয় কারণটি অপেক্ষাকৃত সত্যের কাছাকাছি হতে পারে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, গোয়েন্দা দলের উপস্থিতি লাল জ্যাকেটওয়ালা টের পাবে কি করে?’
‘টলস্টয় এভেনিউ-এর দুই প্রবেশ (অন্তত পার্কে) পথে পাহারা বসানো থাকলে টের পাওয়া কঠিন নয়।’
‘এটা যদি সত্য হয়, তাহলে বলা যায় চিঠির মাধ্যমে ফাঁদ পাতা হয়েছে।’
‘তা জানি না। কিন্তু এ রকম ধারণা করা অসংগত নয়।’
‘ধন্যবাদ সম্মানিতা প্রিন্সেস। আপনি ঠিক বলেছেন।’
বলে মুহূর্তকাল থামল রাষ্ট্রদূত। তারপর বলল, ‘তাহলে এখন কি করণীয় আমাদের?’
একটু ভাবল মারিয়া জোসেফাইন। বলল, ‘আগামী সোমবার সকাল আটটা-ন’টার দিকে টলস্টয় এভেনিউ-এর দু’প্রান্তে পাহারা বসাতে পারেন। যাদের দায়িত্ব হবে লাল জ্যাকেটওয়ালা লোক যখনই তার ছোট মাইক্রো নিয়ে টলস্টয় এভেনিউ-এর সেই কালভার্ট-এর দিকে যাবে, তখন দু’প্রান্ত থেকে তাকে ক্লোজ করে ধরে ফেলা অথবা তাকে অনুসরণ করা।’
মারিয়া জোসেফাইন থামতেই আনন্দে রাষ্ট্রদূত উঠে দাঁড়াল এবং হাসিমুখে মারিয়া জোসেফাইনকে বাউ করে বলল, ‘আমি আপনাকে অভিনন্দিত করছি সম্মানিতা প্রিন্সেস। আমাদের বুরবন রাজকুমারীর জন্যে আমি গৌরববোধ করছি। এই বুদ্ধিটা আমার এবং আমাদের গোয়েন্দাদের মাথায় আসেনি।’
‘ধন্যবাদ সম্মানিত রাষ্ট্রদূত।’
বলে একটু থামল। শুরু করল আবার, ‘আমাদের ধরে নিতে হবে, লাল জ্যাকেটওয়ালা যখন তার মাইক্রো নিয়ে টলস্টয় এভেনিউতে প্রবেশ করবে, তখন তাদের তরফ থেকেও এভেনিউ-এর দুই প্রান্তে পাহারা বসানো হবে। তাদের মোকাবিলায়ও প্রস্তুতি আমাদের থাকতে হবে। তবে আমার মতে, লাল জ্যাকেটওয়ালা টলস্টয় এভেনিউতে প্রবেশের সাথে সাথেই যদি তাকে দুই প্রান্ত থেকে ক্লোজ করা হয়, তাহলে ওদের পাহারায় মোতায়েন লোকরা সাহায্যে আসার সুযোগ পাবে না।’
‘সম্মানিতা প্রিন্সেস, আপনার পরামর্শ আমরা অক্ষরে অক্ষরে পালন করব। আপনি সবদিক চিন্তা করেছেন। আমার মন বলছে, আমরা সফল হবো। ঈশ্বর সাহায্য করুন।’
‘আমিন। আমরা এবার উঠতে পারি?’ বলল মারিয়া জোসেফাইন।
‘সম্মানিতা প্রিন্সেসের ঠিকানাটা…।’ কথা সমাপ্ত না করেই থেমে গেল রাষ্ট্রদূত।
মারিয়া জোসেফাইন উঠে দাঁড়িয়ে হাসতে হাসতে বলল, ‘আপনার গোয়েন্দারা তো অনুসরণ করবেই।’
রাষ্ট্রদূতও উঠে দাঁড়িয়েছে। অপ্রতিভ কণ্ঠে সে বলল, ‘মাফ করবেন সম্মানিতা রাজকুমারী। আমরা ঠিক মনে না করলেও দায়িত্ব হিসেবে অনেক কাজ করতে হয়।’
‘ধন্যবাদ। গোয়েন্দা পাঠানোর দরকার নেই।’
বলে একটা চিরকুট রাষ্ট্রদূতের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘এই মোবাইল নাম্বারে খোঁজ করলে আমাকে পাবেন। শুধু আপনার ব্যবহারের জন্যে এটা।’
চিরকুটটি হাতে নিয়ে রাষ্ট্রদূত বলল, ‘অনেক ধন্যবাদ সম্মানিতা প্রিন্সেস।’
তারপর ওলগার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘অনেক ধন্যবাদ এই ভিজিটের জন্যে। আশা করি আসবেন আবার।’
‘ওয়েলকাম সম্মানিত রাষ্ট্রদূত। অনেক কিছু শিখেছি আপনাদের আলোচনায়।’
মারিয়া জোসেফাইন ও ওলগা দু’জনেই রাষ্ট্রদূতের ঘর থেকে বেরিয়ে এল। রাষ্ট্রদূত দূতাবাসের ভেতরের গাড়ি বারান্দা পর্যন্ত এসে তাদেরকে বিদায় জানালো।
গাড়ির ড্রাইভিং সিটে বসল ওলগা। পাশের সিটে মারিয়া জোসেফাইন। গাড়িতে উঠেই মারিয়া জোসেফাইন সুপার প্লাস্টিকের স্কিন মুখোশটি পরে নিয়েছে।
গাড়ি বেরিয়ে এল দূতাবাসের গেট দিয়ে।
চলতে শুরু করল ওলগার গাড়ি।
‘ভাবী, আহমদ মুসা ভাইয়ের পছন্দকে আমি মোবারকবাদ জানাচ্ছি। তোমার কথা শুনে মনে হলো, তুমি আর এক আহমদ মুসা।’
‘তুমি সূর্যের সাথে মাটির প্রদীপের তুলনা করছ ওলগা।’
‘মাটির প্রদীপের সাথে সূর্যের কখনও মিলন হয় না ভাবী। আল্লাহ তা করেন না।’
‘থাক এসব কথা, এস সমস্যা নিয়ে ভাবি।’
‘তোমার ঠিকানা তুমি দূতাবাসে রাখলে না কেন? যে মোবাইলের নাম্বার তুমি দিলে, তা একটি সাংকেতিক নামে নেয়া এবং এর কোন গ্রাউন্ড অ্যাড্রেস নেই।’
‘শোন, দূতাবাসগুলো অধিকাংশ ক্ষেত্রেই একটা করে চিড়িয়াখানা। সবাই এখানে আমার বন্ধু নাও হতে পারে। এখানে রুশ সরকারের লোক যেমন থাকতে পারে, তেমনি থাকতে পারে গ্রেট বিয়ারের লোকও। তাদের হাতে আমার ঠিকানা যাওয়া কি ঠিক?’
‘ধন্যবাদ ভাবী। আমি এ দিকটা ভাবতেই পারিনি।’
বলে একটু থেমেই আবার শুরু করল, ‘আচ্ছা ভাবী, রাষ্ট্রদূত তোমাকে ‘ডোনা জোসেফাইন’ বলল কেন?’
হাসল মারিয়া জোসেফাইন। বলল, ‘আমার প্রকৃত নাম ‘মারিয়া জোসেফাইন লুই’ বটে, কিন্তু আমার ডাক নাম ‘ডোনা’। তাই সবাই আমাকে ‘ডোনা জোসেফাইন’ হিসেবেই জানে। আর রাজকীয় নাম ‘মারিয়া জোসেফাইন লুই’-এর চাইতে সাধারণ নাম ‘ডোনা জোসেফাইন’ আমার ভালো লাগে।’
‘কিন্তু ‘মারিয়া জোসেফাইন’ নাম হাজার গুণ বেশি ভালো লাগছে আমার কাছে।’
‘আহমদ মুসাও তা-ই বলেন।’
‘তুমি এখন কি বল?’
‘আমারও ভালো লাগতে শুরু করেছে।’ হেসে বলল ডোনা।
‘তোমার ডাক নামও ‘মারিয়া’ অথবা ‘জোসেফাইন’ হওয়া উচিত।’
‘কারণ?’
‘ডোনা নামটা হালকা, স্কুল ছাত্রীর জন্যে মানায়।’
‘ঠিক আছে, কোন নামেই আমার আপত্তি নেই।’
বলে একটু থেমেই আবার বলল, ‘এবার এস, সমস্যা নিয়ে আলোচনা করি।’
‘সোমবারে তো গোয়েন্দাদের রাষ্ট্রদূত সাহেব পাঠাচ্ছেন। আমাদের কি কিছু করণীয় আছে?’
‘চল আমরা টলস্টয় এভেনিউ দিয়ে ফিরি। দেখে যাই জায়গাটা। কিছু করার আছে কিনা বোঝা যাবে।’
‘ঠিক আছে।’
ছুটে চলল ওলগার গাড়ি।

পরবর্তী সোমবার।
সকাল দশটা।
সাদোভায়া রিং রোড-এর একটি মোটরসাইকেল ভাড়ার শপ থেকে একটা মোটরসাইকেল টলস্টয় পার্কে প্রবেশ করল। ছুটে চলল পার্কের অভ্যন্তরে।
কমিউনিস্ট আমলে পার্কে মোটরসাইকেল ব্যবহার নিষিদ্ধ ছিল। এখন সে আইন অনেকখানি শিথিল করা হয়েছে। এখন মহিলাদের জন্যে কিংবা মহিলা বা শিশু সাথে পুরুষদের জন্যে পার্কে মোটরসাইকেল ব্যবহার বৈধ করা হয়েছে।
মোটরসাইকেলটি পার্কের মাঝামাঝি জায়গায় টলস্টয় এভেনিউ থেকে একশ’ গজ পরিমাণ পশ্চিমে বৃত্তাকার ফুলগাছ থেকে সৃষ্ট ঝোপের পাশে এসে থামল।
মোটরসাইকেল থেকে প্রথমে নামল ডোনা। সে পেছনের সিটে ছিল। তারপর নামল ওলগা। সেই চালাচ্ছিল মোটরসাইকেল।
নামার পর ওলগা মোটরসাইকেল ঠেলে নিয়ে ফুলগাছের বৃত্তের মধ্যে রাখল। লক করল গাড়ি।
দু’জনের মাথায় মোটরসাইকেলের হেলমেট। হেলমেট খুলে ওরা মোটরসাইকেলে রেখে দিল।
ডোনা কিংবা ওলগা কাউকেই চেনার কোন উপায় নেই। দু’জনের মুখেই স্কিন মুখোশ। দু’জনেই খেলোয়াড়ী চেহারার আধা সুন্দরী চৌকস মহিলাতে পরিণত হয়েছে।
যে ঝোপে তারা মোটরসাইকেল রাখল, সেখান থেকে আরও কিছু পুবে আরেকটি ঝোপ দেখা যাচ্ছে। ঠিক ওটা ঝোপ নয়। বৃত্তাকার ঝাউগাছের সারি।
ডোনা ও ওলগা গুটি মেরে দ্রুত ঝাউগাছের সেই ঝোপের দিকে চলল।
উঁচু বৃক্ষের মোটা মোটা কাণ্ডের আড়াল নিয়ে নিয়ে তারা চলল।
ঝাউ গাছের আড়ালে পৌঁছে তারা দেখল, টলস্টয় এভেনিউ-এর ২১ নম্বর কালভার্ট ত্রিশ গজের মত দূরে। মাঝখানে কয়েকটা উঁচু বৃক্ষ। গাছের শাখা-প্রশাখা অনেক উপরে। তাই কয়েকটা মোটা কাণ্ড ছাড়া দৃষ্টিপথকে বাঁধা দেবার আর কিছু নেই।
ডোনা ও ওলগা কালভার্টের উপর চোখ রেখে ঝোপের আড়ালে অবস্থান নিল।
একুশ নম্বর কালভার্টটির মত আরও চল্লিশটি কালভার্ট আছে পার্কের মধ্য দিয়ে প্রলম্বিত টলস্টয় এভেনিউতে। কোনটারই প্রস্থ পঁচিশ-তিরিশ ফুটের বেশি নয়। কালভার্টগুলো আসলে ফ্লাইওভারের মত। পার্কে বেড়ানো মানুষদের রাস্তা ক্রস করতে না হয়, সে জন্যই এগুলি তৈরি হয়েছে। কালভার্টের নিচ দিয়ে পার্কের পায়ে চলা পথ, পাথর বিছানো।
ডোনা ও ওলগা যখন সেই ঝোপে ওঁৎ পেতে বসল, তখন বেলা সাড়ে দশটা।
ঠিক যখন বেলা ১০টা ৪০ মিনিট, তখন বিস্ময়ের সাথে ডোনা ও ওলগা লক্ষ্য করলো, টলস্টয় এভেনিউ দিয়ে চলমান একটা জীপ থেকে দু’জন লোক গড়িয়ে পড়ল রাস্তায়। তারপর রাস্তা থেকে নেমে এল পার্কে।
কালভার্ট থেকে সাত-আট গজ দূরের পাশাপাশি প্রায় দু’টি গাছের মোটা কাণ্ডের আড়ালে এসে তারা ঘাপটি মেরে বসল।
‘ওরা কি গ্রেট বিয়ারের পক্ষ, না আমাদের পক্ষ?’ বলল ওলগা ডোনার কানে কানে।
‘নিশ্চিত, ওরা আমাদের পক্ষ নয়।’
‘তাহলে তো দেখা যাচ্ছে, শত্রুপক্ষ রাস্তার দু’প্রান্তে পাহারা বসানো ছাড়াও বাড়তি লোক আজ নিয়োগ করেছে।’
‘বোঝা মুশকিল, গত দু’দিনও হয়তো ওরা ছিল এই ভাবে গাছের আড়ালে।’
‘হতেও পারে।’
আর কোন কথা না বলে হাতের ব্যাগ থেকে বন্দুকের কিছু পার্টস বের করল এবং সংযোজন করতে লেগে গেল।
সংযোজন শেষ হলে দেখা গেল, খাট ব্যারেলের একটি স্বয়ংক্রিয় রাইফেল।
রাইফেলটি তাক করলো ডোনা ২১নং ব্রীজের দিকে।
ঠিক সকাল সাড়ে দশটায় একটা নীল মাইক্রোকে দক্ষিণ দিক থেকে একুশ নাম্বার কালভার্টের দিকে আসতে দেখা গেল। তার পঞ্চাশ গজ পেছনেই আর একটা জীপ।
মাইক্রো একুশ নাম্বার কালভার্টের গোড়ায় পৌঁছল, তখন উত্তর দিক থেকে আরেকটা জীপ তার প্রায় পঞ্চাশ গজ সামনে এসে দাঁড়িয়েছে।
ডোনা ফিস ফিস করে ওলগাকে বলল, ‘আমাদের গোয়েন্দাদের টাইমিং চমৎকার। ঠিক সময়ে ঠিক জায়গায় মাইক্রোকে ঘিরে ফেলেছে।
‘ঐ দু’দিন ঐ নীল মাইক্রো এল না, আজ আসার ব্যাখ্যা কি?’ বলল ওলগা।
‘মাইক্রোটিকে যদি এইভাবে সংগে সংগে ফলো না করে সেই এগারটার নির্ধারিত সময়ে দু’দিক থেকে দুটো গাড়ি একুশ নাম্বার কালভার্টের দিকে আসত, তাহলে মাইক্রোটিকে এইভাবে পেত না।’
‘কোথায় যেত?’
‘এই প্রশ্নের জবাব আমার কাছে এখনও স্পষ্ট নয় ওলগা।’
ডোনা ও ওলগা কথা বলছিল কিন্তু তাদের দৃষ্টি নিবদ্ধ ছিল মাইক্রোটির দিকে।
মাইক্রোটি দাঁড়িয়ে পড়েছে একুশ নাম্বার কালভার্টের দক্ষিণ গোড়ায়।
দু’দিক থেকে দু’টি জীপ এভেনিউ-এর একই লেন ধরে মাইক্রোর দিকে আসছিল।
এতক্ষণে মাইক্রো তার বিপদ টের পেয়ে গেছে।
মাইক্রোটির মাথা বোঁ করে পশ্চিম দিকে ঘুরে গেল এবং দ্রুত এভেনিউ থেকে কালভার্টের গোড়া ঘেঁষে পশ্চিমপাশে পার্কে নেমে এল।
পার্কের পৃষ্ঠদেশ থেকে এভেনিউ উঁচু প্রায় পাঁচ ফুট, তবে কালভার্টের জায়গায় উচ্চতা প্রায় সাত ‍ফুটের মত।
পার্কের মাটিতে নেমেই মাইক্রোটি আবার পুব দিকে ঘুরে কালভার্টের নিচে প্রবেশ করতে যাচ্ছিল।
ডোনা দ্রুত বলল, ‘ওলগা, তোমার প্রশ্নের উত্তর পাওয়া গেছে। আগের দুই সোমবার মাইক্রোটি শত্রুর গতিবিধির খবর পেয়ে এইভাবে কালভার্টের তলায় লুকিয়ে ছিল।’
‘ঠিক বলেছেন ভাবী।’
মাইক্রোটি পুব দিকে টার্ন নিতেই দক্ষিণ দিক থেকে আসা জীপ থেকে একটা গুলি মাইক্রোর সামনের চাকা গুঁড়িয়ে দিল।’
মাইক্রোটি আর এক ইঞ্চিও সামনে না এগিয়ে বসে পড়ল।
দু’দিক থেকে দুই জীপই তখন কালভার্টটির দু’পাশের গোড়ায় এসে দাঁড়িয়েছে।
টায়ার ফুটো হওয়া মাইক্রোবাসটি বসে পড়তেই মাইক্রোর ড্রাইভিং সিটের দরজা খুলে গেল। লাল জ্যাকেটওয়ালা একজন লোক ড্রাইভিং সিট থেকে লাফিয়ে পড়েই উবু হয়ে দৌঁড় দিল এবং এসে আশ্রয় নিল সেই দু’টি গাছের আড়ালে।
রিভলভার হাতে নেমে পড়েছিল দুই জীপ থেকে চারজন।
তারা গাড়ি থেকে নামার সাথে সাথে গাছের আড়ালে পুব থেকে লুকানো লোক দু’টি ব্রাশফায়ার করল সেদিক লক্ষ্য করে।
জীপ থেকে নামা লোক চারজন সংগে সংগে জীপে উঠে গেল।
ঠিক এই সময়ই টলস্টয় এভেনিউ-এর দু’দিক থেকে দু’টি মাইক্রো ছুটে এল।
জীপ দু’টির কাছাকাছি এসে ওরা ব্রাশফায়ার করল জীপ দু’টিকে লক্ষ্য করে।
জীপ দু’টি থেকে কোন পাল্টা গুলি হলো না।
ডোনা বলল, ‘গোয়েন্দা চারজন আত্মরক্ষার কৌশল নিয়েছে। মনে হয় তাদের কাছে রিভলভার ছাড়া কোন অস্ত্র নেই।’
মাইক্রো দু’টি থেকে দু’জন দু’জন করে চারজন লোক নেমে এল। ওদের হাতে স্টেনগান।
নেমেই স্টেনগানধারী চারজনের দু’জন পকেটে হাত দিয়ে বের করল ক্রিকেট বলের মত গোলাকৃতি একটা কাল বস্তু।
আঁৎকে উঠল ডোনা। বলল, ‘সর্বনাশ, ওরা গ্রেনেড চার্জ করতে যাচ্ছে জীপে। জীপসমেত চারজন গোয়েন্দাই ধ্বংস হয়ে যাবে।’
সময় নষ্ট করেনি ডোনা। কথা বলতে বলতেই রাইফেল তাক করল প্রথমে দক্ষিণের জনকে। ‘বিসমিল্লাহ’ বলে প্রথম গুলি ছুঁড়েই দ্রুত ব্যারেল উত্তরের লোকটির দিকে ঘুরিয়ে নিয়ে আরেকটা গুলি ছুঁড়ল।
গ্রেনেডধারী দু’জনের হাত গ্রেনেডসহ মাথা পর্যন্ত উঠেছিল জীপ দু’টি লক্ষ্যে। সে পর্যন্তই। হাত দু’টি আর এগোতে পারল না। দু’জনের মাথাই গুঁড়ো হয়ে গেল দু’টি গুলিতে।
তাদের সাথী দু’জন স্টেনগানধারী পশ্চিম দিকে একবার তাকিয়েই দ্রুত উঠে গেল গাড়িতে এবং গাড়ির কভার নিয়ে স্টেনগান তুলল। ফায়ার করল লক্ষ্যহীনভাবে।
এদিকে পেছন থেকে গুলির শব্দ শুনেই গাছের আড়ালে দাঁড়ানো তিনজন ঘুরে দাঁড়িয়েছিল। তাদের মধ্যে ছিল আতংকিত ও বিমূঢ় ভাব। তারা যেন গুলির ঠিক লোকেশনটা চিহ্নিত করতে পারছিল না। তাদের সামনেও অনেকগুলো গাছ এবং তারপর ঝাউ-এর ঝোপ।
দ্বিতীয় গুলিটি করেই ডোনা রাইফেলের ব্যারেল ঘুরিয়ে নিয়েছিল এই তিনজন লোকের দিকে। তিনজনের মুহূর্তকালের সিদ্ধান্তহীনতার সুযোগ গ্রহণ করলো ডোনা। পর পর গুলি করল দু’টি দুই স্টেনগানধারীর লক্ষ্যে। বসা অবস্থাতেই দু’জন বুকে গুলিবিদ্ধ হয়ে ছিটকে পড়ল গাছের পাশে।
লাল জ্যাকেটধারী উঠে দৌঁড় দিয়ে পালাচ্ছিল। ডোনা তার পায়ে গুলি করল তাকে জীবন্ত ধরতে হবে এই লক্ষ্যে।
গুলি খেয়ে লোকটি পা চেপে ধরে গড়াগড়ি দিতে লাগল।
এ সময় রিভলভারের দু’টি গুলির শব্দ শুনল মাইক্রো দু’টির দিক থেকে।
ওদিকে তাকাল ডোনা ও ওলগা। দেখল, মাইক্রোর খোলা দরজা দিয়ে লাফিয়ে পড়ছে অবশিষ্ট স্টেনগানধারী দু’জন। তাদের হাতে স্টেনগান নেই।
উত্তরের জন লাফিয়ে পড়ার সাথে সাথেই হ্যান্ড গ্রেনেডের বিস্ফোরণ হলো। উড়ে গেল তার দেহ।
আর দক্ষিণের জন নিচে লাফিয়ে পড়ে বাম হাত দিয়ে ডান হাত চেপে ধরে দৌঁড় দিচ্ছিল পালাবার জন্যে। মাইক্রোর আড়াল থেকে দ্রুত বেরিয়ে আসা দু’জন গোয়েন্দা তাকে ধরে ফেলল এবং টেনে তাকে জীপে তুলল।
তিনজন গোয়েন্দা ছুটে এল আহত হয়ে পড়ে থাকা লাল জ্যাকেটওয়ালার কাছ।
ডোনা এবং ওলগাও বেরিয়ে এসেছিল ঝোপের আড়াল থেকে। কয়েক ধাপ সামনে এগিয়ে গোয়েন্দাদের লক্ষ্য করে ফরাসী ভাষায় বলল, ‘ধরা পড়া থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্যে ও নিশ্চয় পটাসিয়াম সায়ানাইড জাতীয় কিছু খেয়েছে। আপনারা তাড়াতাড়ি যান। দেখুন ঐ বন্দীর যাতে এই একই পরিণতি না হয়।’
কথা শুনেই দু’জন ছুটল গাড়ির দিকে। একজন দাঁড়িয়ে থাকল। তার মাথা নিচু। ডোনার দিকে একটা বাউ করে বিনীত কণ্ঠে বলল, ‘মহামান্যা প্রিন্সেস, আমরা কৃতজ্ঞ। আমাদের চারজনের জীবন আপনি রক্ষা করেছেন।’
‘আপনি এ কথা চিনে বলছেন, না না-চিনে বলছেন?’
‘আমাদের বুরবন প্রিন্সেস পাঁচ ফিট সাত ইঞ্চি লম্বা এবং তার ফরাসী উচ্চারণ সম্রাজ্ঞী জোসেফাইনের মত।’
‘ধন্যবাদ।’ বলে ডোনা ওলগার দিকে চেয়ে বলল, ‘চল, আমরা ফিরি মোটরসাইকেলের স্থানে।’
ডোনা হাঁটতে শুরু করেছে। ওলগাও।
হাঁটতে হাঁটতে বলল, ‘বুঝলাম না, গোয়েন্দা অফিসার ‘বুরবন প্রিন্সেস’ বলল কেন?’
‘আমাদের রাজবংশকে ‘হাউজ বুরবন’ বলা হয়।’
‘আর সম্রাজ্ঞী জোসেফাইন নেপোলিয়নের স্ত্রী, তাই না?’
‘হ্যাঁ।’
টলস্টয় পার্ক পার হয়ে ওলগা মোটরসাইকেল ছেড়ে যখন সাদোভায়া রিং রোডে পার্ক করা নিজেদের গাড়িতে উঠল, তখন ওলগা বুক ভরে একটা নিঃশ্বাস নিয়ে বলল, ‘এতক্ষণে স্বস্তি বোধ করছি। মনে হচ্ছে, মায়ের মুখ তাহলে দেখতে পাব।’
‘কেন, আর কারও মুখ দেখতে ইচ্ছে হয় না?’
‘ওটা বিজ্ঞাপন দিয়ে বলার মত নয় ভাবী।’
‘তাহলে আছে নাকি?’
‘বলব না। তোমাকে আমার সাথে থাকতে হবে এবং তা আবিষ্কার করতে হবে।’
‘চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করলাম।’
‘ঠিক আছে।’ ওলগার মুখে দুষ্টু হাসি।

হেরিটেজ ফাউন্ডেশনের ভূ-গর্ভস্থ গ্রাউন্ড ফ্লোরে ভিআইপি লিফট থেকে নামল এক মুখোশধারী। তার পেছনে সামরিক পোশাক পরা দু’জন প্রহরী। তাদের হাতে লেটেস্ট মডেলের ক্ষুদ্রাকৃতি মেশিনগান। এ বহুমুখী মেশিনগান এক মিনিটে পাঁচশ গুলি বর্ষণ করতে পারে।
মুখোশধারীর পরনে রাজকীয় পোশাক। জাররা যে পোশাক পরতো সেই পোশাক। পায়েও সেই রাজকীয় জুতা।
লিফট থেকে নেমে পেছনে না তাকিয়েই মাথা সোজা রেখে নির্দেশ দিল, ‘লিফট লক করা হয়েছে?’
কথা হুংকারের মত শোনাল।
পেছনের প্রহরীদের একজন বাউ করে বলল, ‘মহামান্য প্রভু আইভান, আমি নিজ হাতে লক করেছি।’
‘এটাও লক করে দাও।’
বলে সামনে পা বাড়াল মুখোশধারী। তার হাঁটার স্টাইলও রাজকীয়।
তার পেছনে পেছনে দু’জন নিরাপত্তা গার্ড। হ্যান্ড মেশিনগানের ট্রিগারে তাদের হাত। একজন হাঁটছে সামনে তাকিয়ে আর একজন পেছন ফিরে।
মুখোশধারী যাচ্ছে প্রিন্সেস ক্যাথারিনরা যেদিকে আছে, সেদিকে। সে গিয়ে প্রবেশ করল ক্যাথারিনদের করিডোরে। দাঁড়াল গিয়ে প্রিন্সেস ক্যাথারিনের দরজায়।
দরজার ডিজিটাল লকের নির্দিষ্ট বোতামে নক করল মুখোশধারী। খুলে গেল দরজা।
ইজি চেয়ারে গা এলিয়ে বই পড়ছিল প্রিন্সেস ক্যাথারিন। দরজা খুলে যাওয়া দেখে সোজা হয়ে বসেছে সে।
প্রথমেই তার চোখ গিয়ে পড়ল মুখোশধারীর উপর। মুখের সোনালী মুখোশ ছাড়া সবটা পোশাকই ‘আইভান দি টেরিবল’ মানে জার চতুর্থ আইভানের মত।
চমকে উঠল প্রিন্সেস ক্যাথারিন। এই কি তাহলে গ্রেট বিয়ারের প্রধান! যে ‘আইভান দি টেরিবল’ সেজে বসেছে!
মুখোশধারীর কণ্ঠে ধ্বনিত হলো, ‘ক্যাথারিন, বেরিয়ে এস।’
বিস্মিত হলো ক্যাথারিন, কথা বলার স্টাইল জারদের মত। যেন কোন যাত্রা গানে কেউ জারের অভিনয় করছে।
ধীরে ধীরে বিস্ময়ের স্থান ক্রোধ এসে দখল করল। ক্ষুব্ধ কণ্ঠে প্রিন্সেস ক্যাথারিন বলল, ‘শিষ্টতা বজায় রেখে কথা বললে খুশি হবো।’
মুখোশধারীর কণ্ঠে আগের মতই ধ্বনিত হলো, ‘ক্যাথারিন, বেরিয়ে এস।’
‘ভালো ভাবে কথা বলুন। আমি জনৈক ক্যাথারিন নই, ক্রাউন প্রিন্সেস ক্যাথারিন।’
‘আমি আইভান, আমি নিজে ডাকছি, এটাই যথেষ্ট।’
‘শৃগাল সিংহের মুখোশ পরলেই সিংহ হয় না। সে শৃগালই থাকে।’
হুংকার দিয়ে উঠল মুখোশধারী আইভান। যেন পাওয়ারফুল লাউডস্পীকারে কেউ চিৎকার করে উঠল। বলল, ‘আমার সাথের এরা তোমার গায়ে হাত দিতে পারলে খুশি হবে। সেটাই করবো, তুমি বেরিয়ে না আসলে।’
‘কোথায় বেরুবো?’
‘তোমার গুরুজন প্লাতিনির ঘরে। কিছু কথা বলব তোমাদের দু’জনকে।’
প্রিন্সেস ক্যাথারিন রাজকীয় পদক্ষেপে বেরিয়ে এল।
ইতোমধ্যে আইভান মিঃ প্লাতিনির ঘর আনলক করেছিল।
মিঃ প্লাতিনি সোফায় বসেছিল। চমকে উঠল মুখোশধারী রাজবেশের আইভানকে দেখে।
প্রিন্সেস ক্যাথারিন গিয়ে বসল মিঃ প্লাতিনির পাশে।
আইভান ঘরে প্রবেশ করে প্লাতিনির পড়ার টেবিলের উপর বসল চেয়ারের উপর পা রেখে। যেন ওটাই তার সিংহাসন। সে কথা বলল আবার সেই লাউডস্পীকার মার্কা যান্ত্রিক সুরে।
বলল, ‘প্লাতিনি, তোমার সাথে আইভানের মহান রাশিয়ার কোন বিরোধ নেই। লড়াই আমাদের আহমদ মুসার সাথে। তোমার মেয়ে তাকে বিয়ে করে সেও উচ্ছন্নে গেছে। আহমদ মুসা ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ করেছে। প্যারিসে সে আমাদের কয়েক ডজন লোককে হত্যা করেছে। রাশিয়াতেও এ ক’দিনে আমাদের প্রায় ডজনখানেক লোক তার হাতে প্রাণ দিয়েছে। আমরা আর এক মুহূর্তও ক্ষেপণ করতে চাই না।’
বলে আইভান একটা কাগজ এগিয়ে দিল প্লাতিনির দিকে।
কাগজটি হাত পেতে নিয়ে তাতে নজর বোলাতে লাগল প্লাতিনি, পড়ল সেঃ
“বাবা আহমদ মুসা। আমি মৃত্যুর মুখোমুখি। আজ সন্ধ্যার মধ্যে যদি তুমি মস্কোর বেসরকারী রেডিওতে তোমার আত্মসমর্পণের ঘোষণা না দাও এবং রাতের মধ্যে যদি আত্মসমর্পণ না কর, তাহলে ওরা আমাকে হত্যা করবে। অনেক চেষ্টা করেছ, আমাকে মুক্ত করতে পারনি। শত ডজন হত্যা করেও আমাকে মুক্ত করতে পারবে না। সুতরাং সন্ধ্যার মধ্যেই সিদ্ধান্ত নাও, তুমি কি করবে।”
পড়া শেষ করে মুখ তুলল প্লাতিনি।
আইভানের কণ্ঠ যান্ত্রিক স্বরে বলল, ‘আমার বন্দীখানার সব ঘরেই ভিডিও রেকর্ডের ব্যবস্থা চালু আছে। তুমি কাগজের লেখাগুলো পড়ে যাও প্লাতিনি। তোমার কথা রেকর্ড হয়ে যাবে এবং আধা ঘণ্টা পরে মস্কোর বেসরকারী টিভি চ্যানেলে তা প্রচারিত হবে বার বার।’
‘আমি এটা পড়ব না।’
‘আমি দ্বিতীয় বার আদেশ করব না।’
বলে গ্লাভস ঢাকা হাত দিয়ে পকেট থেকে বের করল অস্বাভাবিক আকৃতির একটা রিভলভার। বলল, ‘এটা থেকে গুলি বের হয় না প্লাতিনি। বের হয় ভয়ানক শক্তিশালী বৈদ্যুতিক ক্যাপসুল। এ ক্যাপসুল লোহার বর্মও ভেদ করে, কিন্তু শরীরের চামড়া ভেদ করে না, বরং তাকে কামড়ে ধরে থাকে। যতক্ষণ কামড়ে ধরে থাকবে, শরীরে বিদ্যুৎ প্রবাহ বইবে। মৃত্যু যন্ত্রণা বোধ হবে, কিন্তু মৃত্যু হবে না।’
বলে আইভান রিভলভার তুলল প্লাতিনিকে লক্ষ্য করে।
প্রিন্সেস ক্যাথারিন আইভানকে বাঁধা দিয়ে বলল, ‘নামাও রিভলভারের নল।’
তারপর প্লাতিনির দিকে ফিরে তার হাত দু’টি চেপে ধরে বলল, ‘চাচাজান, আপনি বিবৃতিটি পড়ে ফেলুন।’
‘না মা, আহমদ মুসাকে এদের হাতে তুলে দেব না। আমার বেঁচে থাকার কোন প্রয়োজন নেই, কিন্তু মজলুম মানুষের স্বার্থে তাকে বাঁচতে হবে।’
‘চাচাজান, আপনি একটা বিবৃতি পড়ছেন, আহমদ মুসাকে এদের হাতে তুলে দিচ্ছেন না। আমি আহমদ মুসাকে যতটুকু দেখেছি, তাতে জানি, আপনার এ বিবৃতি তার অ্যাকশনকে জোরদার করবে, তাকে তার পথ থেকে বিচ্যুত করতে পারবে না।’
প্লাতিনি তাকাল প্রিন্সেস ক্যাথারিনের দিকে। প্লাতিনির মুখ তখন সহজ হয়ে উঠেছে।
তারপর সে চোখ ফেরাল আইভানের দিকে। বলল, ‘আচ্ছা, পড়ছি তোমার বিবৃতি।’
বলে প্লাতিনি খুব স্বাভাবিক কণ্ঠে বিবৃতিটি পাঠ করল।
‘ধন্যবাদ প্লাতিনি।’ পাঠ শেষ হলে প্লাতিনিকে লক্ষ্য করে বলল আইভান।
কথা শেষ করেই আইভান, আর একটি কাগজ তুলে ধরল প্রিন্সেস ক্যাথারিনের সামনে।
কাগজটি হাতে নিল ক্যাথারিন।
কাগজে লেখা আছে পড়ল প্রিন্সেস ক্যাথারিনঃ
“আমি ক্রাউন প্রিন্সেস ক্যাথারিন রুশ জাতির নতুন ত্রাতা আইভানের কাছে স্বেচ্ছায় আশ্রয় নিয়েছি। কেরনস্কী জুনিয়রের সরকার শাসনতান্ত্রিক রাজতন্ত্রের নামে রাজপরিবারকেও বিদেশী শক্তির লেজুড় করার যে উদ্যোগ নিয়েছে, তার সাথে আমি নেই। কেরনস্কী সরকার বিদেশী এজেন্ট ও ক্রাউন প্রিন্সেস তাতিয়ানাকে হত্যাকারী এবং অতি মূল্যবান রাজ-সম্পদ দখলকারী আহমদ মুসাকে লেলিয়ে দিয়েছে আমার পেছনেও। আমাকে সিংহাসনে বসানোর অজুহাতে জারদের শত শত বছরের ধনভাণ্ডার আত্মসাৎ করতে চায় সরকারের গুটিকতক লোক। এই ষড়যন্ত্র বানচাল করার জন্যে আমি রুশ জনগণের প্রতি উদাত্ত আহবান জানাচ্ছি।”
পড়া শেষ হলে মুখ তুলল প্রিন্সেস ক্যাথারিন। তার মুখমণ্ডল শক্ত এবং চোখে আগুন। বলল, ‘ভণ্ড আইভান, মনে করেছ জনগণের উদ্দেশ্যে আমি এটা পড়ব, তাই না?’
‘অবশ্যই তুমি এটা পড়বে এবং এখনি।’
‘তুমি ভণ্ড আইভান সেজেছ, অভিনয় করছ জারদের। কিন্তু তুমি রাজপরিবারকে আসলেই চেন না।’
‘চিনি কিনা দেখাচ্ছি।’ বলে আইভান তার রিভলভারের নল স্থির করল প্রিন্সেস ক্যাথারিন লক্ষ্যে।
প্লাতিনি চোখের পলকে উঠে প্রিন্সেস ক্যাথারিনকে আড়াল করে বলল, ‘আমি বেঁচে থাকতে প্রিন্সেস ক্যাথারিনের কোন ক্ষতি করতে পারবে না।’
হো হো করে হেসে উঠল আইভান। বলল, ‘আরো ভালো হলো। ক্যাথারিনের চেয়ে তোমার গায়ে বিদ্যুৎ চালালেই ক্যাথারিনকে দ্রুত রাজি করানো যাবে।’
বলে আইভান আবার তার রিভলভারের নল তুলল প্লাতিনিকে লক্ষ্য করে। আইভানের তর্জনী যাচ্ছিল রিভলভারের ট্রিগার স্পর্শ করতে।
চিৎকার করে উঠল প্রিন্সেস ক্যাথারিন। কিছু বলতে যাচ্ছিল ক্যাথারিন চিৎকার করে। ঠিক এই সময়েই মেশিনগান গর্জন করে উঠল বাইরে। আকস্মিক সেই শব্দে চমকে উঠল ঘরের সবাই। আইভানও।
সে লাফ দিয়ে মেঝেতে নামল। বিড়ালের মত এগোতে লাগল দরজার দিকে।

নিকোলাস বুখারিন তার বন্দী কক্ষে প্রথম কয়েক দিন ঘুমিয়েই কাটিয়েছে। আইভানের হুমকি বা ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তাই করেনি। বরং আহমদ মুসাকে বন্দী করার পর দু’জনকে একসাথে শাস্তি দেবে, এই ঘোষণায় খুশি হয়েছে নিকোলাস বুখারিন। এখন আর আহমদ মুসাকে তার শত্রু মনে হয় না। মনে হয়, আহমদ মুসাই ন্যায়ের পক্ষে রয়েছে। আহমদ মুসা যদি রাজকীয় আংটি এবং রাজকীয় ডায়েরী প্রিন্সেস ক্যাথারিনের কাছে পৌঁছাতে পারে এবং ক্যাথারিনের মাধ্যমে যদি রাশিয়ায় শাসনতান্ত্রিক রাজতন্ত্র কায়েম হয়, তাহলে তাতেই রাশিয়ার কল্যাণ হবে।
এই মানবিক পরিবর্তনের পর নিকোলাস বুখারিন নতুন করে ভাবতে শুরু করল, তাকে বাঁচতে হবে এবং তাকে এখান থেকে বেরুতে হবে। কিন্তু কিভাবে? এই পথ সন্ধানই তার এখন সর্বক্ষণের চিন্তা হয়ে দাঁড়াল।
সেই যে দরজা বন্ধ হয়েছে আর খোলা হয়নি। খাবার আসে দরজার স্লাইডিং উইন্ডো দিয়ে।
বুখারিন জানে, এই কক্ষের সব কথা, সব দৃশ্য টিভি ক্যামেরার মাধ্যমে রেকর্ড হচ্ছে।
নিকোলাস বুখারিন টিভি ক্যামেরার চোখ খুঁজে পেয়েছে। ইচ্ছে করলে সে ক্যামেরার চোখে এখন কাগজ লাগিয়ে টিভি ক্যামেরার ছবি ও সাউন্ডের রিলে বন্ধ করে দিতে পারে। কিন্তু নিকোলাস বুখারিন চিন্তা করেছে, শত্রুপক্ষকে হঠাৎ হুঁশিয়ার করায় লাভ নেই। প্রয়োজনে এই কৌশল কাজে লাগানো যাবে।
নিকোলাস বুখারিন জানে, বন্দীখানার কথা রেকর্ড হয়ে যেমন বাইরে যায়, তেমনি বাইরের বিভিন্ন রুমের কথা বন্দীখানায় আসতে পারে। মাত্র একটা সুইচ অন করতে হয় এবং সে সুইচটি কক্ষের কোন না কোন জায়গায় রয়েছে।
নিকোলাস সে সুইচ অনেক খুঁজেছে, কিন্তু পায়নি।
আজ নাস্তার পর নতুন এক দফা খুঁজতে শুরু করল সে।
খুঁজতে খুঁজতে দরজার ডিজিটাল কী-বোর্ডের পাশে কালো চৌকাঠে একটা কালো বোতামের সন্ধান পেল। এর অবস্থান দেখে মনে হচ্ছে, দরজার ডিজিটাল কী-বোর্ডের সাথে চৌকাঠের এই কালো বোতামটির সম্পর্ক নেই।
তাহলে এ বোতামটি কি?
বোতামে চাপ দিল নিকোলাস বুখারিন।
চাপ দেয়ার সংগে সংগেই ছাদের দিক থেকে কথা ভেসে আসতে শুরু করল।
নিকোলাস বুখারিন চমকে ঘুরে দাঁড়িয়ে তাকাল ছাদের দিকে। আশ্বস্ত হলো, টেলিভিশন ক্যামেরার সাথে রাখা নীরব স্পীকার এখন সরব হয়ে উঠেছে।
আর নিকোলাস বুখারিনের চমকে উঠার কারণ, যে কণ্ঠ শোনা যাচ্ছে সে কণ্ঠটি আইভান দি টেরিবলের।
আইভানের প্রথম যে কথা নিকোলাস বুখারিন শুনতে পেল তাতে আইভান প্রিন্সেস ক্যাথারিনকে তার কক্ষ থেকে বেরিয়ে আসতে বলছে।
মুখোশধারী সোনালী মোড়কের কাল শয়তান আইভান কি এখানে এসেছে? প্রিন্সেসকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে?
নিকোলাস বুখারিন উৎকর্ণ হলো স্পীকারের দিকে।
শুনতে লাগল আইভান ও ক্যাথারিনের মধ্যেকার উত্তপ্ত কথোপকথন।
ক্যাথারিন ঘর থেকে বেরিয়ে আসতে বাধ্য হওয়া, ক্যাথারিনকে প্লাতিনির ঘরে নিয়ে যাওয়া, প্লাতিনিকে অনিচ্ছাকৃত বিবৃতি দিতে বাধ্য করা- এ পর্যন্ত শুনতেই নিকোলাস বুখারিনের সর্বাঙ্গ জ্বলে উঠল ক্রোধে। এই আইভানকে আর এক ইঞ্চিও এগোতে দেয়া যায় না। কিন্তু ঘর থেকে বেরুবে কেমন করে?
হঠাৎ নিকোলাস বুখারিনের মনে পড়ল, সেদিন বন্দীখানায় নিয়ে আসার আগে সার্চ করা হয়নি তাকে। কোন আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে সেই হলে প্রবেশ বৈধ নয়। এ কারণেই তাকে সার্চ করার প্রয়োজন হয়নি। কিন্তু সেদিন তার পকেটে সদ্য সংগ্রহ করা কলমাকৃতির সুপার ম্যাগনেটিক টর্চ ছিল। এই টর্চ অন করলে অর্থাৎ সুইচ টিপে কলমের মাথা থেকে প্লাস্টিক কভার সরিয়ে নিলে যে ম্যাগনেটিক রেডিয়েশন হয়, তা একটি নির্দিষ্ট আওতার মধ্যে যে কোন ইলেকট্রনিক ব্যবস্থাকে নিষ্ক্রিয় করে দেয়। নিকোলাস বুখারিন ভাবল, সুপার ম্যাগনেটিক টর্চ ডিজিটাল লকের ইলেকট্রনিক ব্যবস্থা নিষ্ক্রিয় করে দেয়ার অর্থ লকিং সিস্টেম স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে যাওয়া অর্থাৎ আনলক হয়ে যাওয়া।
আনন্দে মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল নিকোলাস বুখারিনের।
ঠিক এ সময় আইভান প্রিন্সেস ক্যাথারিনকে ‍হুমকি দিয়ে বলছিল, ‘অবশ্যই তুমি এটা পড়বে এবং এখনি।’
নিকোলাস দ্রুত গিয়ে পকেট থেকে সুপার ম্যাগনেটিক টর্চ বের করে আনল এবং টর্চটি অন করে এগোলো দরজার ডিজিটাল লকের দিকে।
সুপার ম্যাগনেটিক টর্চ ডিজিটাল লকের উপর সেট করার পর মাত্র কয়েক সেকেন্ড। দরজা কিঞ্চিত কেঁপে উঠে ঢিলা হয়ে গেল।
অতি সন্তর্পণে দরজা খুলল নিকোলাস বুখারিন। কিন্তু এরপরও শব্দ হয়েছিল বোধ হয়।
নিকোলাস বুখারিন সামনে চোখ পড়তেই দেখল, পশ্চিম দিক থেকে যে করিডোরটি তাদের সামনের উত্তর-দক্ষিণ করিডোরে এসে পড়েছে, তার মুখে পশ্চিমমুখী হয়ে ওঁৎ পেতে থাকা হ্যান্ডমেশিনগানধারী একজন বোঁ করে ঘুরে দাঁড়াল এবং তার মেশিনগানটি বিদ্যুৎ বেগে উঠে এল বুখারিনের লক্ষ্যে।
নিকোলাস বুখারিন জানে, কোমরে ব্ল্যাক বেল্ট এবং মাথায় কাল হেলমেট পরা সামরিক পোশাকের এ লোকেরা আইভানের পার্সোনাল স্কোয়াডের লোক। মারা এবং মরা ছাড়া আর কোন শিক্ষা এদের নেই।
নিকোলাস বুখারিন তার সামনে সাক্ষাৎ মৃত্যুকে দেখতে পেল। সৈনিক সে, মৃত্যুকে ভয় করে না। কিন্তু আফসোস, ভণ্ড আইভানকে শাস্তি দেয়া হলো না।
হ্যান্ড মেশিনে শব্দ হলো সামনে থেকে।
নিজেকে মৃত্যুর হাতে সঁপে দিয়ে চোখ বন্ধ করলো নিকোলাস বুখারিন।

মস্কোর ভোর রাত। লেনিন হিলস-এর পাদদেশ।
এখানে এসে মস্কোভা নদী ‘ইউ’ টার্ন নিয়েছে।
‘ইউ’-এর দুই বাহুর ঠিক মধ্যতলায় হেরিটেজ ফাউন্ডেশনের ঠিক নাম বরাবর সামনে মস্কোভা নদীর কূল ঘেঁষে একটা ওয়াটার প্ল্যান্ট।
এই ওয়াটার প্ল্যান্টটি এক সময় তৈরি হয়েছিল হেরিটেজ ফাউন্ডেশন অর্থাৎ সাবেক লুবিয়াংকা কারাগারের এই অংশটিতে পানি সরবরাহের জন্যে। মস্কোতে পানি সরবরাহের কেন্দ্রীয় ব্যবস্থা হওয়ার পর এই প্ল্যান্ট বন্ধ রাখা হয়েছে।
জাগরণ ক্লান্ত নগরী যেন এ সময় একেবারেই অচেতন। মস্কোভা নদীর দক্ষিণ বরাবর রাস্তাটিতে একটি গাড়িও চোখে পড়ছে না।
মস্কোভা নদীর বুকেও কোন কম্পন নেই। বরফে সাদা হয়ে আছে মস্কোভার বুক।
মস্কোভা নদীর কমসোমল ব্রীজের গোড়ায় আহমদ মুসা গাড়ি থেকে নামল।
পাভলভের সাথে হ্যান্ডশেক করে পাভলভ ও রোসা দু’জনকেই লক্ষ্য করে বলল, ‘তোমাদের আপাতত কোন কাজ নেই।’
‘মাফ করবেন স্যার, আপনার প্রোগ্রাম কি?’ বলল পাভলভ।
‘গ্রেট বিয়ারের ঘাঁটিতে প্রবেশ ছাড়া আর কিছু আমার মাথায় নেই। সেখানে প্রিন্সেস ক্যাথারিন আছে, মিঃ প্লাতিনি আছে, এটা আমি জানি না। আমার এই প্রবেশ বলতে পার অনুসন্ধানমূলক।’
‘আমাদের প্রতি কোন নির্দেশ স্যার?’
‘তোমরা ব্রীজের উত্তর গোড়ায় অপেক্ষা করতে পার।’
বলে আহমদ মুসা পাভলভের সাথে আবার হ্যান্ডশেক করে পা বাড়াল হেরিটেজ ফাউন্ডেশনের রাস্তার দিকে।
পাভলভ ও রোসা দু’জনেই আহমদ মুসার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়েছিল। আহমদ মুসা দৃষ্টির আড়াল হতেই রোসা বলল, ‘সত্যি পাভলভ, একে যতই দেখছি, অতীতের ধারণা পাল্টে যাচ্ছে। একজন বিপ্লবী এত মানবিক, এত হৃদয়বান হতে পারেন!’
‘পারেন রোসা, যদি তিনি স্রষ্টার হয়ে কাজ করেন। স্রষ্টা সকলের বলে তিনিও সকলের হয়ে যান।’
‘আমাদের সৌভাগ্য পাভলভ।’
‘অবশ্যই।’
‘এ ধরনের লোকের জন্যে এবং তার নির্দেশে হাসিমুখে জীবন দেয়া যায়।’
‘এ কারণেই তো আহমদ মুসার বাহিনী অজেয়।’
‘এখানে যে উনি একা?’
‘একা কোথায়? গোটা মধ্য এশিয়া ওর। রাশিয়াতেই যত মুসলমান আছে, সব তার কর্মী। প্রয়োজন এখনও হয়নি বলে কারও সাহায্য উনি নেননি।’
‘এখন বল আমরা কি করব? সরকারী দায়িত্ব অবশ্যই আমাদের পালন করতে হবে।’
‘অবশ্যই।’
বলে পাভলভ পকেট থেকে সিগারেট লাইটারের মত ক্ষুদ্র ওয়্যারলেস সেট বের করল। সেটটি অন করে মুখের কাছে নিয়ে বলল, ‘আমি পাভলভ। বরিসভ ইউনিট।’
একটু থামল। ওপারের কথা শুনল। তারপর বলল, ‘খবর আছে স্যার। আহমদ মুসা গ্রেট বিয়ারের হেডকোয়ার্টার হেরিটেজ ফাউন্ডেশনে প্রবেশ করেছে।’
একটু থেমে ওপারের কথা শুনে বলল, ‘ঠিক আছে।’
পাভলভ ওয়্যারলেস অফ করে দিয়ে বলল, ‘কি করণীয়, পরে জানাচ্ছে। বস বললেন, এটা দারুণ খবর। এ খবর যাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে, সেখান থেকে প্রেসিডেন্ট কেরনস্কী জুনিয়রের কাছে, তারপর সিদ্ধান্ত আসবে।’
চারদিক ফর্সা হয়ে গেছে। পুব দিগন্ত লাল হয়ে উঠেছে।
পাভলভ গাড়ি ড্রাইভ করে কমসোমল ব্রীজটির উত্তর গোড়ায় গিয়ে পার্ক করলো।
রোসা সিটে গা এলিয়ে বলল, ‘খুব খারাপ লাগছে পাভলভ, আমরা যে সরকারী গোয়েন্দা- এটা আহমদ মুসাকে না জানিয়ে আমরা তার সাথে প্রতারণা করছি।’
‘আমরা প্রতারণা করছি না, সরকার করছে। আমরা হুকুমের চাকর।’
‘আহমদ মুসা কি কিছুই বুঝতে পারেনি?’
‘তিনি বুঝতে পারেননি, একথা বলা মুশকিল। কিন্তু বুঝেছেন, এমন কিছু প্রমাণ তিনি দেননি।’
পাভলভের ওয়্যারলেস হাত ঘড়ির সময় জ্ঞাপনের মত দু’বার শব্দ করে উঠল।
আহমদ মুসার অ্যাসাইনমেন্টে আসার পর পাভলভ ও রোসা এই প্রথম সরকারী কল পেল। বরিসভ সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, পাভলভ ও রোসাই শুধু কল করবে, কোন কল তাদের কাছে আসবে না।
পাভলভ ওয়্যারলেস তুলে নিল কানের কাছে। শুনল ওপারের নির্দেশ এক মিনিট ধরে। তারপর ‘গুডবাই, স্যার’ বলে ওয়্যারলেস অফ করে দিল।
রোসা উন্মুখ হয়ে উঠেছিল ওপারের নির্দেশ শোনার জন্যে।
পাভলভ ওয়্যারলেস পকেটে রেখে বলল, ‘প্রেসিডেন্ট নির্দেশ দিয়েছেন, হেরিটেজ ফাউন্ডেশন পুলিশকে ঘেরাও করে হেরিটেজ ফাউন্ডেশনে প্রবেশের জন্যে।’
রোসার মুখ ম্লান হয়ে গেল। বলল, ‘আহমদ মুসার ক্ষতি হবে না এতে?’
পাভলভের মুখও ম্লান হয়ে গেল। বলল, ‘আমি জানি না সরকারী এই অভিযানের টার্গেট কি কি!’
‘আমার খুব খারাপ লাগছে পাভলভ। সরকার আহমদ মুসাকে কি দৃষ্টিতে দেখে, বল তো?’
‘সরকার প্রিন্সেস ক্যাথারিনকে উদ্ধারে আহমদ মুসার সহযোগিতা চায়। উদ্ধারের পর তার প্রতি সরকারের মনোভাব কি দাঁড়াবে, তা বলা মুশকিল।’ পাভলভ থামল।
রোসা কোন কথা বলল না।
পাভলভ রোসার ভারি মুখের দিকে চেয়ে তার একটা হাত হাতে নিয়ে বলল, ‘রোসা, আহমদ মুসাকে ছোট করে দেখো না। উনি গ্রেট বিয়ারকেও চেনেন, সরকারকেও চেনেন।’
রোসা মুখে ম্লান হাসি টেনে বলল, ‘তা-ই যেন হয় পাভলভ। প্রিন্সেস ক্যাথারিনকে উদ্ধার করতে এসে তিনি যেন বিপদে না পড়েন।’
ওদিকে আহমদ মুসা পাভলভ ও রোসার কাছে বিদায় নিয়ে মস্কোভা নদী তীরের রাস্তা ধরে এগোলো হেরিটেজ ফাউন্ডেশনের দিকে।
কিছুটা এগোবার পর আহমদ মুসা রাস্তা ছেড়ে দিয়ে নেমে গেল নদীর কিনারে।
হাতের প্যাকেট থেকে গামবুট বের করে তাতে দু’পা ঢুকিয়ে নিয়ে নদী-কিনারের বরফের উপর দিয়ে হেঁটে চলল আহমদ মুসা।
হেরিটেজ ফাউন্ডেশনের সামনের ওয়াটার প্ল্যান্টের বরাবর এসে সে এক মুহূর্ত দাঁড়াল, তারপর নদীর কিনার ধরে আরও পশ্চিমে এগিয়ে গেল।
অল্প কিছু যাওয়ার পর নদীর কিনার থেকে ক্রলিং করে তীরে উঠল। তীরে রাস্তার উত্তর পাশ ঘেঁষে একটা ছোট মাইক্রো দাঁড়িয়েছিল। মাইক্রোটির জানালায় হালকা শেডের কাঁচ।
আহমদ মুসা গাড়ি আনলক করে ড্রাইভিং সিটে উঠে সব ঠিক আছে কিনা পরীক্ষা করে আবার গাড়ি লক করে নেমে গেল নদীর কিনারে। ফিরে চলল আবার ওয়াটার প্ল্যান্টের দিকে।
দাঁড়াল কিছুক্ষণ ওয়াটার প্ল্যান্টের পাইপ ঘেঁষে।
ওয়াটার প্ল্যান্টের মোটা স্টীলের পাইপ এখনও আগের মতই ওয়াটার প্ল্যান্ট থেকে বেরিয়ে নদীতে ডুবে আছে।
ওয়াটার প্ল্যান্টের পাথরের তৈরি ঘরটি বেশ বড়। তবে এ ঘরে যন্ত্রপাতি কিছুই নেই। ঘরটি ব্যবহৃত হতো ওয়ার্কিং অফিস হিসেবে। যন্ত্রপাতির মূল এস্টাবলিশমেন্ট রয়েছে ভূগর্ভে।
কিন্তু বিল্ডিং-এর ইতিহাস ও ডিজাইন পরীক্ষা করে আহমদ মুসা জেনেছে, ওয়াটার প্ল্যান্টের কভারে এটা হলো গোপন প্যাসেজ যা দিয়ে হেরিটেজ ফাউন্ডেশনের ভূগর্ভস্থ অংশ দিয়ে ঐখানে যাতায়াত করা যায়। হেরিটেজ ফাউন্ডেশন যখন লুবিয়াংকার অংশ ছিল, এ গোপন প্যাসেজ দিয়ে মারাত্মক সব রাজবন্দীদের কারাগারে নেয়া হতো, আবার বের করা হতো।
কমিউনিস্ট সরকারের পতনের পর এবং সোভিয়েত সাম্রাজ্য ভেঙে পড়ার পর লুবিয়াংকা বন্ধ করে দেয়া হয় এবং লুবিয়াংকার এ অংশ বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের কাছে লীজ দেয়া হয়। সে সময় ভূগর্ভস্থ এই প্যাসেজ সীল করে দেয়া হয়।
আহমদ মুসা এই পথেই হেরিটেজ ফাউন্ডেশনে প্রবেশের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ পথে গিয়ে প্রথমেই পাওয়া যাবে হেরিটেজ ফাউন্ডেশনের বন্দীখানা যেখানে প্রিন্সেস ক্যাথারিন এবং মিঃ প্লাতিনি বন্দী থাকার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি।
ওয়াটার প্ল্যান্টের অফিস কক্ষের এক পাশ দিয়ে ভূগর্ভস্থ যন্ত্রপাতির কক্ষে নামার সিঁড়ি আছে। কিন্তু এ কক্ষের সাথে হেরিটেজ ফাউন্ডেশনে ঢোকার আন্ডারগ্রাউন্ড প্যাসেজের কোন সম্পর্ক নেই।
ওয়াটার প্ল্যান্টের যে মোটা পাইপটা নদীতে নেমে গেছে, তার নিচ দিয়ে তিন ফুট প্রশস্ত পাথর বিছানো একটা প্লেট ওয়াটার প্ল্যান্টের পাইপের গোড়া থেকে পানি পর্যন্ত ধাপে ধাপে নেমে গেছে।
পাইপের গোড়ায় যেখান থেকে পাথর বিছানো প্লেট বের হয়েছে, সেখানে বিল্ডিং –এর ডিজাইনে আহমদ মুসা দেখেছে দুই বর্গফুটের একটা উইন্ডো। এটাই হেরিটেজ ফাউন্ডেশনে প্রবেশের সুড়ঙ্গে ঢোকার পথ।
আহমদ মুসা পাইপের নিচ দিয়ে একটু উবু হয়ে পাথর বাঁধানো ধাপ বেয়ে পাইপের গোড়ায় গিয়ে বসল। দেখল, প্যাসেজের সেই মুখ, দুই বর্গফুটের উইন্ডোটি, কনক্রিট ওয়াল দিয়ে বন্ধ করা।
আহমদ মুসা পরীক্ষা করল এই ওয়াল অরিজিন্যাল কিনা। কিংবা পরবর্তীকালে এই দেয়াল তুলে প্যাসেজ বন্ধ করা হয়েছে কিনা। এবং এই প্যাসেজ বা সুড়ঙ্গ পথটি যখন চালু ছিল, তখন এটা কি দিয়ে বা কিভাবে বন্ধ রাখা হতো, এ বিষয়টাও আহমদ মুসা বুঝতে চেষ্টা করল।
টর্চের আলো ফেলে গভীরভাবে পরীক্ষা করে আহমদ মুসা বুঝল, এই দেয়াল পরবর্তীকালে তৈরি করা নয়। যখন প্যাসেজ ও আশপাশের দেয়াল তৈরি হয়েছে, তখনই তৈরি এই দেয়াল।
আর দেয়ালটির চারপাশ পরীক্ষা করে দেখল, দেয়ালটির দুই পাশ ও উপরের প্রান্তের সাথে তার পাশের দেয়ালের স্পষ্ট বিচ্ছেদ রেখা রয়েছে। কিন্তু তলার প্রান্তে সেই বিচ্ছেদ রেখা নেই। মনে হয় যেন দেয়ালটি মেঝের অভ্যন্তর থেকে উঠে এসেছে।
আহমদ মুসার মুখে হাসি ফুটে উঠল। সে নিশ্চিত হলো, এমন একটি স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা আছে, যে ব্যবস্থায় প্রয়োজনে দেয়ালটি মেঝের ভেতরে ঢুকে যায়, আবার বন্ধও করা যায়। এবং এই ব্যবস্থা দেয়ালের এপারে-ওপারে দু’দিকেই থাকা স্বাভাবিক।
আহমদ মুসা শেডের আড়াল দেয়া এলাকায় টর্চের আলো ফেলে তিল তিল করে খুঁজল আশপাশ, উপর-নিচে গোটা দেয়াল। কিন্তু সন্দেহ করার মত কোথাও কিছু পেল না।
হতাশ হলো আহমদ মুসা।
দেয়ালের উপরের অংশে চোখ বোলাতে গিয়ে পাইপের গোড়ায় চোখ গেল আহমদ মুসার।
স্টীল পাইপের গোড়ার এক ফুট পরিমাণ অংশ কালো রং করা। পানি পর্যন্ত অবশিষ্ট অংশের রং সাদা।
পাইপের এই ব্যতিক্রমটা প্রথম আহমদ মুসার দৃষ্টি আকর্ষণ করল।
এই কালো অংশে চোখ বোলাতে গিয়ে আহমদ মুসা দেখল, পাইপ যেখান থেকে বেরিয়ে এসেছে সেই দেয়াল থেকে এক ফুট পর্যন্ত পাইপের নিচের অংশ স্ফীত হয়ে উঠেছে। দেখলে মনে হয়, তৈরির সময় বাড়তি লোহার একটা স্তুপ সেখানে জমে গেছে। অথবা কোন কারণে পুরু করে সিমেন্ট লাগিয়ে দেয়া হয়েছে পাইপে।
পাইপের স্ফীত অংশ বেশ এবড়ো-থেবড়ো। এর উপর আহমদ মুসা অনেকটা অলসভাবেই চোখ বোলাচ্ছিল।
আহমদ মুসার চোখে পড়ল একটা বড় ধরনের স্ক্রু। তারও রং কালো। আহমদ মুসার মনে হলো, স্ক্রুটা পাইপের স্ফীত অংশকে পাইপের সাথে আটকে রাখার কাজে ব্যবহার করা হয়েছে। স্ক্রুর মাথা একটু বেরিয়ে আছে। যেন সবটা ভেতরে বসানো হয়নি। স্ক্রুটা লুজ হয়ে আছে কিনা তা দেখার জন্যেই আহমদ মুসা স্ক্রুর মাথায় তর্জনী দিয়ে চাপ দিল।
চাপ দেয়ার সংগে সংগেই স্ক্রুটি স্প্রিং এর মত নিচে বসে গেল। আর সেই সাথেই আহমদ মুসা বিস্ময় ও আনন্দের সাথে দেখল, প্যাসেজের বন্ধ দরজাটা খুলে গেছে।
আহমদ মুসা আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করল এবং গ্যাস মাস্ক পরে ঢুকে গেল প্যাসেজটিতে।
প্যাসেজের মুখ ছোট হলেও ভেতরটা বেশ প্রশস্ত। দাঁড়ানো যায়।
প্যাসেজের মেঝে এবং দেয়াল, ছাদ সবই পাথরের। ভেতরটা অন্ধকার।
আহমদ মুসা টর্চ জ্বেলে প্যাসেজের মুখ বন্ধ করার সুইচ খুঁজল। এটা পেতে বিলম্ব হলো না।
মুখের পাশেই প্যাসেজের দেয়ালে পাথর রং-এর ছোট চারকোণা একটা জায়গা। দেয়ালের লেভেল থেকে অপেক্ষাকৃত নিচু।
আহমদ মুসা আঙুল দিয়ে তার উপর চাপ দিতেই পাথর রং-এর প্লাস্টিক প্লেটটি দেয়ালের ভেতর সরে গেল। বেরিয়ে পড়ল একটা সুইচ। সুইচটা অফ করতেই প্যাসেজের মুখ বন্ধ হয়ে গেল।
আহমদ মুসা পকেট থেকে হেরিটেজ ফাউন্ডেশনের ডিজাইন বের করে আর একবার দেখল। প্যাসেজটা একেবারে সোজা এগিয়ে হেরিটেজ ফাউন্ডেশনের ভূগর্ভস্থ বটম ফ্লোরের উত্তর দেয়ালের পশ্চিম প্রান্তে গিয়ে ঠেকেছে।
আহমদ মুসা সেই প্রান্তে গিয়ে পৌঁছল।
প্যাসেজের মুখে আগের মতই একটি দেয়াল।
দেয়ালটি অরিজিন্যাল, না পরে তৈরি, রং দেখে তা ঠিক করতে পারলো না আহমদ মুসা। তবে বুঝল, পরে তৈরি হলে এমন মসৃণ হতো না। অবশেষে আরেকটা জিনিস চোখে পড়ায় আহমদ মুসা নিশ্চিত হলো, দেয়ালটি অরিজিন্যাল এবং আগের দরজার মতই নিয়ন্ত্রণযোগ্য।
দেয়ালের শীর্ষ অংশে দেয়ালের লেভেল থেকে অল্প নিচু চারকোণা দেয়াল রংয়ের একটা প্লাস্টিক বোর্ড। আগেরটার মতই বোর্ডের নিচে সুইচ আছে, আহমদ মুসা মনে করল।
দু’আঙুল দিয়ে চাপ দিয়ে বোর্ড সরিয়ে ফেলল আহমদ মুসা। কিন্তু ভেতরটা দেখে হতাশ হলো সে। সুইচের বদলে সেখানে কম্বিনেশন লক। তিন সারিতে তিনটি করে নয় পর্যন্ত নাম্বার চিহ্নিত নব রয়েছে। প্রত্যেকটির পাশে একটি করে ঘর খালি। অর্থাৎ বোর্ডে মোট আঠারোটি ঘর রয়েছে। এই আঠারোটি ঘরেই নাম্বার চিহ্নিত নবকে ঘোরানো যায়।
সাংঘাতিক জটিল এই কম্বিনেশন লক। একটি সারিতে তিনটি নাম্বার মিললেও দরজা খুলতে পারে। আবার দু’লাইন বা তিন লাইন মেলানোরও প্রয়োজন হতে পারে। তাছাড়া কম্বিনেশন হরাইজেন্টাল অথবা ভার্টিক্যালও হতে পারে।
গোলকধাঁধাঁয় পড়ে গেল আহমদ মুসা। ঘড়িতে দেখল, সকাল সাতটা।
আহমদ মুসার ইচ্ছা, ভোরের দিকে বন্দীখানায় সে প্রবেশ করবে। এ সময় অপেক্ষাকৃত নিরাপদ হতে পারে।
আহমদ মুসা বসে পড়ল প্যাসেজের মেঝেতে। চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ ভাবল। কিন্তু কোন কূলকিনারা পেল না।
বসে থেকেই আহমদ মুসা টর্চ জ্বালিয়ে এলোপাথাড়ি আলো ফেলছিল প্যাসেজে এবং প্যাসেজের মুখের দেয়ালে।
হঠাৎ আহমদ মুসার চোখে পড়ল, প্যাসেজ-মুখের দেয়ালে পাশাপাশি তিনটি তারকা। দেয়াল রং-এর কারণে দেয়ালের সাথে প্রায় মিশে আছে।
তিনটি তারকার একটি মজার ব্যাপার আহমদ মুসার দৃষ্টি আকর্ষণ করল। তিন তারকার প্রথমটির মাথা চারটি, দ্বিতীয়টির পাঁচটি এবং তৃতীয়টির ছয়টি।
এখানে এমনভাবে তিনটি তারা কেন? না হয় থাকল। কিন্তু তিন তারকা তিন রকম কেন? হেরিটেজ ফাউন্ডেশনে প্রবেশের মুখে দাঁড়ানো এই দেয়ালের এই তিন তারা কি পরিকল্পিত? কোন কিছুর ইংগিত দিচ্ছে কি এই তারা?
লাফ দিয়ে আহমদ মুসা উঠে দাঁড়ালো। তার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে।
আহমদ মুসা দাঁড়ালো গিয়ে কম্বিনেশন লকের সামনে। পাশাপাশি তিনটি অংকের প্রথমে নিয়ে এল চার, দ্বিতীয় অংকে নিয়ে এল পাঁচ এবং তৃতীয় অংকের স্থানে নিয়ে এল ছয়।
তিনটি অংক পাশাপাশি সম্পূর্ণ হওয়ার সাথে সাথে সুড়ঙ্গ মুখের দেয়াল সরে গেল।
আহমদ মুসা মনে করছিল, কনক্রিটের প্রলেপ দেয়া দু’ইঞ্চি স্টীলের এই দেয়াল সরে যাবার পর কনক্রিটের আরেকটা স্তুপ থাকবে। কিন্তু আহমদ মুসা বিস্মিত হলো, স্টীলের দেয়াল সরে যাবার পর সাদা কার্পেট মোড়া করিডোর পাওয়া গেল। তার অর্থ সুড়ঙ্গ পথ শেষ। সে এখন প্রবেশ করতে যাচ্ছে হেরিটেজ ফাউন্ডেশনের বন্দীখানায়।
আহমদ মুসা নিজেকেই প্রশ্ন করল, হেরিটেজ ফাউন্ডেশনের ইতিহাসে আছে, লুবিয়াংকা বন্ধ করে দিয়ে যখন একে বেসরকারী হাতে লীজ দেয়া হয়, তখন সুড়ঙ্গ পথ সীল করে দেয়া হয়, এর অর্থ তাহলে কি? ভাবল আহমদ মুসা আবার, তাহলে কি গোপন প্যাসেজ বা সুড়ঙ্গ পথে প্রবেশ ও বের হওয়ার নির্দেশিকা নষ্ট করে দেয়া হয়েছে এবং একেই কি সীল করে দেয়া বোঝানো হয়েছে! হতে পারে।
আহমদ মুসা সুড়ঙ্গ থেকে বেরিয়ে পা রাখল আলোকোজ্জ্বল করিডোরে।
আহমদ মুসা এই বন্দীখানার ডিজাইন এতবার দেখেছে যে, সবটা তার চোখের সামনে ভাসছে। বন্দীখানার ভিআইপি অংশ একেবারে পুবে।
সেদিকেই আহমদ মুসা এগোলো।
কোথাও কোন প্রহরী দেখলো না।
আহমদ মুসা ভাবল, অতি আত্মবিশ্বাসী গ্রেট বিয়ার সুরক্ষিত বন্দীখানায় তাহলে প্রহরী রাখার প্রয়োজন বোধ করেনি।
আহমদ মুসা এগোবার সময় দু’পাশে বন্ধ কক্ষ দেখল। বাম পাশে লিফট রুমও দেখল। তার বিপরীত বন্ধ ঘরটিও দেখল।
আরও পুবে এগোলো আহমদ মুসা।
আহমদ মুসা লিফট রুমের চত্বরটি পার হয়ে সামনে এগোবার সঙ্গে সঙ্গে লিফট রুমের বিপরীত দিকের কক্ষটির দরজা নিঃশব্দে খুলে গেল। বিড়ালের মত বেরিয়ে এল একসাথে চারজন প্রহরী। তাদের প্রত্যেকের হাত স্টেনগানের ট্রিগারে।
চারজনের চোখ-মুখ থেকে বিস্ময়-বিমূঢ় ভাব কাটেনি। সম্ভবত তারা বিস্মিত হয়েছিল লিফট দিয়ে না এসে অকল্পনীয় এক দিক থেকে আহমদ মুসাকে আবির্ভূত হতে দেখে।
সতর্ক আহমদ মুসা অবশেষে পেছনের পদশব্দ টের পেল। ঘুরে দাঁড়িয়েই দেখল, চারটি স্টেনগানের মুখে দাঁড়িয়ে সে।
চার স্টেনগানধারীর দূরত্ব আহমদ মুসা থেকে চার গজের মত।
আহমদ মুসা মুহূর্তের জন্যে বিমূঢ় হয়ে পড়ল। বন্দীখানায় প্রহরী থাকতে পারে, এটা সত্যিই সে মনে আনেনি।
চার স্টেনগানধারী পাথরের মত।
আহমদ মুসা বুঝল, নির্দেশ পালন ছাড়া অন্য কোন বিবেচনা ওদের কাছে নেই।
ওদের চারজনের তর্জনী স্টেনগানের ট্রিগারে। ওদের মুখভাবের দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছে। দৃঢ় হচ্ছে তাদের মুখের মাংসপেশী এবং কঠোর হয়ে উঠছে তাদের চোখ।
আহমদ মুসার কাছে পরিষ্কার, এটা গুলি করার পূর্ব মুহূর্ত।
এ সময় আহমদ মুসা করিডোরের পশ্চিম প্রান্তে কালো কাপড়ে আবৃত এক ছায়ামূর্তিকে এগিয়ে আসতে দেখল। তার হাতে হ্যান্ড মেশিনগান।
আহমদ মুসা বুঝতে পারল না, কালো মূর্তিটি শত্রু না মিত্র!
আহমদ মুসার ভাবনা শেষ হবার আগেই কালো কাপড়ের ছায়ামূর্তি তার ডান হাত তুলে ইশারায় আহমদ মুসাকে শুয়ে পড়তে বলল।
আহমদ মুসা পেছন দিকে এই ইশারার প্রতি তার দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখেছিল।
চার স্টেনগানধারী সম্ভবত এ বিষয়টি টের পেয়ে পেছনে কেউ এসেছে এই চিন্তায় তাদের চকিত দৃষ্টি পেছন দিকে ফিরে গিয়েছিল।
আহমদ মুসা সুযোগ নষ্ট করেনি।
নিজের দেহটাকে এই সুযোগে ছুঁড়ে দিয়েছিল মাটিতে।
ওদিকে ছায়ামূর্তি এরই অপেক্ষা করছিল। তার হ্যান্ড মেশিনগান সঙ্গে সঙ্গেই অগ্নি বৃষ্টি করল।
চার স্টেনগানধারী মুহূর্তের মধ্যে ঝাঁঝরা শরীর নিয়ে আছড়ে পড়ল মাটিতে।

রুশ সরকারের পুলিশ বাহিনীর সর্বোচ্চ প্রধানের নেতৃত্বে প্রায় শ’খানেক পুলিশ এসে হেরিটেজ ফাউন্ডেশন ঘেরাও করে ফেলল।
হেরিটেজ ফাউন্ডেশনের গেট বন্ধ।
পুলিশপ্রধান নির্দেশ দিল কামান দেগে গেট ভেংগে ফেলতে। তা-ই করা হলো।
ধ্বসে পড়া গেট দিয়ে পুলিশের একটা দল ভেতরে ঢুকতে যাচ্ছিল।
কিন্তু মেশিনগানের গুলি বৃষ্টি তাদের সামনে দেয়াল হয়ে দাঁড়াল।
গুলি করতে করতে পুলিশের দলটি পিছু হটে এল।
এই সময় হেরিটেজ ফাউন্ডেশনকে ঘিরে দাঁড়ানো পুলিশের উপর গুলি বর্ষণ শুরু হলো বিল্ডিং-এর এক তলা, দু’তলা ও তিন তলার ঘুলঘুলি ধরনের জানালা দিয়ে।
আকস্মিক এ আক্রমণে ক্ষতি হলো পুলিশের। উন্মুক্ত ময়দানে দাঁড়ানো পুলিশরা শেল্টার নেবার কোন জায়গা পেল না। বাধ্য হয়ে হেরিটেজ ফাউন্ডেশনের চারধারে দাঁড়ানো পুলিশকে নিরাপদ দূরত্বে সরে যেতে হলো।
অভিজ্ঞ পুলিশপ্রধান পুলিশের আর্টিলারী ইউনিটকে নির্দেশ দিল, বিল্ডিং-এর চারদিকের দেয়ালে চারটা সুড়ঙ্গ সৃষ্টি করতে।
নির্দেশ অনুসারে কামান দেগে বিল্ডিং-এর চার পাশের চার দেয়ালে চারটি সুড়ঙ্গ সৃষ্টি করা হলো। তারপর কামানের অগ্নিবৃষ্টির আড়ালে পুলিশরা সেই সুড়ঙ্গ দিয়ে প্রবেশ করল বিল্ডিং-এ।
এরপর মূল গেটে গ্রেট বিয়ারের প্রতিরোধ অনেকটা কমে এল।
গুলিবৃষ্টির আড়াল নিয়ে মূল গেট দিয়েও পুলিশ প্রবেশ করল হেরিটেজ ফাউন্ডেশনে।
অল্পক্ষণের মধ্যেই গোটা বিল্ডিং-এ ছড়িয়ে পড়ল সংঘর্ষ।
ঘণ্টা দুই পর গোলাগুলির শব্দ বন্ধ হয়ে গেল।
পুলিশ গোটা বিল্ডিং-এর নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করেছে।
পুলিশপ্রধান আলেকজান্ডার ভেরনভ একের পর এক কক্ষ দেখছেন। তৈরি হচ্ছে আহত-নিহতের তালিকা।
গোটা বিল্ডিং পরিদর্শনের পর হতাশ হলো পুলিশপ্রধান আলেকজান্ডার। প্রিন্সেস ক্যাথারিনকে তো নয়, তার কোন আলামতও কোথাও পাওয়া গেল না। আহমদ মুসারও চিহ্ন কোথাও নেই।
আহত অবস্থায় অনেকেই ধরা পড়েছে। তার মধ্যে রয়েছে গ্রেট বিয়ারের গোয়েন্দা প্রধান মাজুরভ এবং অপারেশন ফরচুন প্রজেক্ট-এর প্রধান ভ্লাদিমির খিরভ।
এ দু’জনকে পুলিশপ্রধান আলেকজান্ডারের কাছে আনা হলো।
আলেকজান্ডার তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করতে যাবেন, এমন সময় একজন গোয়েন্দা অফিসার এসে পুলিশপ্রধানের কানে কানে বলল, ‘ভূগর্ভে আরও দু’টি ফ্লোর আছে। সেখানেই প্রিন্সেস ক্যাথারিন এবং ফ্রান্স থেকে ধরে আনা মিঃ প্লাতিনিকে পাওয়া যাবে। জানা গেল, গ্রেট বিয়ারের প্রধান আইভানও সেখানে প্রবেশ করেছেন।’
শুনেই পুলিশপ্রধান আলেকজান্ডার প্রবল উত্তেজনায় উঠে দাঁড়াল। মাজুরভ ও খিরভের মুখোমুখি হয়ে পুলিশপ্রধান মাজুরভকে ধীর, কিন্তু অত্যন্ত কঠোর কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল, ‘ভূগর্ভে নামার পথ কোথায় মাজুরভ?’
প্রশ্ন শুনে একটু চুপ থাকল মাজুরভ।
তারপর পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকাল পুলিশপ্রধানের দিকে। তারপর আরও একটু ভাবল এবং বলল, ‘ভূগর্ভে যাওয়ার দু’টি লিফটই নিচে নিয়ে লক করেছেন আমাদের নেতা মহামান্য আইভান।’
‘কখন গেছেন তিনি?’
‘আমরা জানতে পারিনি। পরে জেনেছি তিনি নিচে নেমেছেন, এইটুকু।’
‘প্রিন্সেস ক্যাথারিন কোথায়?’
‘ভূগর্ভস্থ বন্দীখানায়।’
মাজুরভের কথা শেষ হতেই পুলিশপ্রধান আলেকজান্ডার বলল, ‘এদের নিয়ে চল, লিফট রুম আমাদের দেখিয়ে দেবেন।’
লিফট রুমের সামনে পৌঁছল তারা। লিফট রুম বন্ধ।
একজন পুলিশ নন-ফায়ার ধরনের প্রচণ্ড শক্তির গ্যাসীয় প্রেসার বম্ব চার্জ করে লিফট কক্ষের দরজা ভেঙে ফেলল।
উন্মুক্ত দরজা দিয়ে লিফট-সুড়ঙ্গে বিশ-পঁচিশ ফুট নিচে লক করে রাখা লিফট দেখা গেল।
পুলিশপ্রধানের নির্দেশে লিফটের উপর গ্যাসীয় প্রেসার বম্ব নিক্ষেপ করা হলো। লিফট মুহূর্তে টুকরো টুকরো হয়ে নিচে নামার পথ উন্মুক্ত করে দিল।
সঙ্গে সঙ্গেই গোটা পাঁচেক সিল্কের কর্ড নামিয়ে দেয়া হলো এবং দড়ি বেয়ে গেরিলা ইউনিটের পাঁচজন পুলিশ নিচে নেমে গেল।
তারা নিচে নেমে পজিশন নেয়ার পর ইংগিত করলে পুলিশপ্রধান আরও কয়েকজন অফিসারকে নিয়ে কর্ড বেয়ে নিচে নামল।
নিচে নেমে পুলিশপ্রধান আলেকজান্ডার সামনে তাকাতেই দেখতে পেল, গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে যাওয়া চারটি লাশ করিডোরে পড়ে আছে।
উদ্বেগে বিবর্ণ হয়ে উঠল পুলিশপ্রধানের মুখমণ্ডল। অসহনীয় এই দুশ্চিন্তা তার মনকে আচ্ছন্ন করে ফেলল যে, প্রিন্সেস ক্যাথারিনের কিছু হয়নি তো!

‘কাউন্সিল অব মুসলিম, মস্কো’ (সিএমএম)-এর গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ সভা শেষ হলো বেলা সাড়ে ন’টায়।
আহমদ মুসার বিষয় নিয়ে এই পরামর্শ সভার আয়োজন হয়েছিল ওলগার উদ্যোগে। খবর পেয়ে এ মিটিং-এ শরীক হয়েছিল মধ্য এশিয়া সরকারের নিরাপত্তা বিভাগের প্রধান আহমদ মুসার একজন শীর্ষ সহকর্মী যুবায়েরভ।
আহমদ মুসার খবর পেয়ে সবকিছু ফেলে ছুটে আসে সে মস্কোতে। পরামর্শ সভায় সে জানাল, আহমদ মুসা মুক্ত না হওয়া পর্যন্ত সে মস্কোতে থাকবে।
পরামর্শ সভায় আহমদ মুসাকে উদ্ধারের সার্বিক কার্যক্রমের দায়িত্ব দেয়া হয় সিএমএম-এর তরুণ প্রধান এবং মস্কোর ‘ইউনিভার্সিটি অফ টেকনোলজি’-এর অধ্যাপক আসিফ আজিমের উপর। আর অভিযান কার্যক্রমের দায়িত্ব নিয়েছে যুবায়েরভ নিজে।
এই পরামর্শ সভায় মেয়েরাও অংশগ্রহণ করে। মহিলা ও পুরুষের বসার স্থান আলাদা করা হয়েছিল। চোখের প্রান্ত পর্যন্ত নামিয়ে দেয়া চাদরে জড়ানো মেয়েরা পরামর্শ সভায় খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ডোনা জোসেফাইন ছিল এ মিটিং-এর মধ্যমণি। সে ছিল সবার কাছে আকাশের চাঁদের মত।
ডোনা জোসেফাইনের আগমন শুধু মস্কোতে নয়, সাড়া ফেলেছে গোটা মধ্য এশিয়ায়। মধ্য এশিয়া বিপ্লবের ছাত্রী-কর্মী, যেমন সুফিয়া সভেৎলানা, খোদেজায়েভা,কুলসুম ত্রিফোনভা, রইছা নভোস্কায়া, তাহেরভা তাতিয়ানা এবং মধ্য এশিয়া মুসলিম প্রজাতন্ত্রের প্রেসিডেন্ট কুতাইবার স্ত্রী শিরিন শবনম ও যুবায়েরভের স্ত্রী রোকাইয়েভা সকলেই দাবি তুলেছে, হয় ডোনা জোসেফাইনকে মধ্য এশিয়া যেতে হবে, নয়তো তারা সকলেই মস্কো আসবে। এরা সকলেই ছিল ফাতিমা ফারহানার সহযোদ্ধা ও বন্ধু।
ডোনা জোসেফাইনও খুশি হয়েছে এই প্রস্তাবে। বলেছে, ফাতিমা ফারহানার বন্ধু তারও বন্ধু। তাদের সাথে দেখা করতে পারলে সে খুশি হবে।
পরামর্শ সভা থেকে বেরিয়ে ওলগা ও ডোনা জোসেফাইন এগোচ্ছিল গাড়ির দিকে। ওলগা ও ডোনা জোসেফাইন পাশাপাশি।
ওলগার বাম পাশে একটু দূরে হাঁটছে আসিফ আজিম।
‘যুবায়েরভ ভাই যে কথা বলেছিলেন, একটা গাড়ি তোমাদের সাথে গেলে ভাল হতো না?’ ওলগাকে লক্ষ্য করে বলল আসিফ আজিম।
‘আজ একটা গাড়ি সাথে দিচ্ছ, কালও কি দিতে পারবে?’ বলল ওলগা।
‘প্রয়োজনে তাও করতে হবে।’
‘ভাল চিন্তা, তবে বাস্তব নয়।’
‘প্রয়োজন অনেক সময় অবাস্তবেরও পথ ধরে।’
‘আমাদের ক্ষেত্রে এমনটা না করলেও চলবে।’
‘চিন্তা তোমাকে নিয়ে নয়, ভাবীকে নিয়ে।’
‘আমাকে নিয়ে বুঝি কোন চিন্তা নেই?’ ওলগার ঠোঁটে দুষ্টুমির হাসি।
আসিফ আজিমের চোখে-মুখে লজ্জা এবং সেই সাথে বিব্রত ভাব ফুটে উঠল। বলল, ‘না, মানে আমি বলছি বর্তমান সংকটের কথা।’
ডোনা জোসেফাইনের ঠোঁটেও এক টুকরো হাসি ফুটে উঠেছে।
‘ঠিক আছে। আমি বুঝেছি।’ ওলগার ঠোঁটে সেই হাসি তখনও।
একটু থেমেই আবার বলল ওলগা, ‘আমরা আসি। সুন্দর আয়োজনের জন্যে ধন্যবাদ।’ বলে গাড়িতে উঠতে গেল ওলগা।
মিটিংটা আসিফ আজিমের বাড়িতেই অনুষ্ঠিত হয়। যুবায়েরভও তার অতিথি হয়ে আছেন।
কমিউনিস্ট আমলের শেষের দিকে স্ট্যালিন এভেনিউ-এর এ বাড়িটা ছিল মুসলিম মধ্য এশিয়ার মুক্তি আন্দোলন ‘সাইমুম’-এর একটা নিরাপদ আশ্রয়।
আসিফ আজিম-এর পিতা ‘ফেদর বেলিকভ’ ছিলেন কমিউনিস্ট সোভিয়েত সরকারের একজন রাষ্ট্রদূত। আর আসিফ আজিম-এর মা ছিল একজন কাজাখ মেয়ে। কাজাখ স্ত্রীর প্রভাবেই ফেদর বেলিকভ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন এবং তিনি এটা গোপন রেখে চলেন। তিনি একসময় ‘সাইমুম’-এর মস্কো অঞ্চলের প্রধান উপদেষ্টায় পরিণত হন।
আসিফ আজিম পিতা-মাতার সে ঐতিহ্য শুধু বজায় রাখা নয়, এখন মস্কোর মুসলিম কাউন্সিলের প্রধানের দায়িত্ব পেয়েছে।
গাড়িতে উঠে বসেছে ডোনা জোসেফাইন এবং ওলগা।
ওলগা গাড়ি ড্রাইভ করছে এবং পাশের সিটে ডোনা জোসেফাইন।
ছুটে চলল গাড়ি।
ডোনা জোসেফাইন হাত বাড়িয়ে ওলগার পাঁজরে একটা চিমটি কাটল এবং বলল, ‘তোমার ‘তাকে’ খুঁজে পেয়েছি ওলগা।’
‘কাকে?’
‘যাকে খুঁজে বের করতে আমাকে বলেছিলে?’
কথা বলল না ওলগা। তার মুখ লাল হয়ে উঠেছে। একটু পর বলল, ‘ভাবী, তাকে কি পাওয়া গেছে?’
‘নামও কি বলব?’
‘কিন্তু কি প্রমাণ তুমি পেয়েছ ভাবী?’
‘প্রমাণ তুমি নিজে। বল দেখি, আসিফ আজিম তোমার কেউ না।’
কথা বলল না ওলগা।
‘কেউ নয় বল।’ হেসে বলল ডোনা জোসেফাইন।
ওলগার চোখ-মুখে তখন ঝরে পড়ছে অনুরাগের একটা বিচ্ছুরণ।
ওলগা ডান হাত স্টিয়ারিং-এ রেখে বাম হাত বাড়িয়ে চেপে ধরল ডোনা জোসেফাইনের হাত। বলল, ‘কথা বলতে বলো না ভাবী।’
‘ঠিক আছে বলব না। খালাম্মা তো নিশ্চয় জানেন?’
‘আম্মার সাথেই তো ওর যোগাযোগ বেশি।’
‘তোমার সাথে বুঝি নেই?’
‘জান ভাবী, ও খুব আইডিয়ালিস্ট।’
‘এটা কি সৌভাগ্য নয়?’
‘অবশ্যই।’
‘আমি কনগ্রাচুলেট করছি ওলগা।’
ওলগা কিছু বলতে যাচ্ছিল।
ডোনা জোসেফাইন বাঁধা দিয়ে বলল, ‘ওলগা, ওদিকে শোন, কিসের শব্দ?’
উৎকর্ণ হলো ওলগা।
ডোনা জোসেফাইনই কথা বলল, ‘কামানের শব্দ ওলগা।’
‘ঐ তো, তার সাথে মেশিনগানের শব্দও শোনা যাচ্ছে।’
ডোনা জোসেফাইন কিছুক্ষণ উৎকর্ণ থেকে বলল, ‘রীতিমত যুদ্ধ ওলগা।’
‘মনে হচ্ছে, নদীর ওপারেই রাস্তার পাশে।’
ওলগার গাড়ি চলছিল তখন কমসোমল হাইওয়ে ধরে। পার হচ্ছিল টলস্টয় পার্ক। সামনেই কমসোমল হাইওয়ের উপর মস্কোভা ব্রীজ।
গাড়ির গতি স্লো করে দিয়েছিল ওলগা।
‘ব্রীজের ওপারেই গণ্ডগোলটা ওলগা। আমার মনে হয়, ব্রীজের গোড়ায় গাড়ি ঘুরিয়ে নিয়ে ন্যাশনাল স্টেডিয়ামের রাস্তা দিয়ে আমরা যেতে পারি।’
‘ঠিক বলেছ ভাবী।’
ওলগা ব্রীজের গোড়ায় গিয়ে গাড়ি ঘুরিয়ে নিল।
ওলগার গাড়ি কমসোমল হাইওয়ে পার হয়ে স্টেডিয়াম রোডে পড়তে যাচ্ছিল।
হঠাৎ ব্রীজের গোড়ায় কমসোমল হাইওয়ে এবং স্টেডিয়াম রোডের সংযোগস্থলে একটা ট্যাক্সিতে ঠেস দেয়া অবস্থায় রোসা ও পাভলভকে দেখতে পেল ডোনা জোসেফাইন।
‘গাড়ি বাম পাশে দাঁড় করাও ওলগা।’ দ্রুত কণ্ঠে বলল ডোনা জোসেফাইন। প্রবল উত্তেজনা ডোনা জোসেফাইনের চোখে-মুখে। পাভলভের কাছে আহমদ মুসার প্রকৃত খবর পাওয়া যাবে, কি হতে পারে সেই খবর, এসব চিন্তা ডোনা জোসেফাইনকে নতুনভাবে উদ্বিগ্ন করে তুলল।
ওলগা ডোনা জোসেফাইনের দিকে একবার তাকিয়ে গাড়ি রাস্তার পাশে নিতে নিতে বলল, ‘কি ব্যাপার ভাবী?’
‘যে দুই গাড়িতে আমি ও আহমদ মুসা পুশকভ থেকে এসেছিলাম, সে দুই গাড়ির ড্রাইভারকে ঐখানে দাঁড়ানো দেখছি। ড্রাইভার পাভলভের কাছে আহমদ মুসার প্রকৃত খবর পাওয়া যাবে।’
‘কিন্তু ভাবী, ওদের সাথে তোমার সাক্ষাৎ নিরাপদ হবে কিনা?’
‘না ওলগা, রোসা বিশ্বস্ত।’
‘আর ড্রাইভার পাভলভ?’
‘আমার ধারণা, দু’জন ভিন্ন নয়।’
ওলগা তার গাড়ি রোসা ও পাভলভের গাড়ির কাছাকাছি এনে দাঁড় করাল।
‘তুমি বস ওলগা, আমি কথা বলে আসি।’
‘না ভাবী, তোমার নামার দরকার নেই। তুমি ‘রোসা’ মেয়েটাকে ডাক।’
‘পাভলভকেও তো দরকার।’
‘রোসাই পাভলভকে ডাকবে।’
‘ঠিক বলেছ ওলগা, আমি সত্যিই খুব অস্থির হয়ে পড়েছি। আমাদের সতর্ক হওয়ার দরকার আছে।’
কথা শেষ করেই ডোনা জোসেফাইন গাড়ির দরজা খুলে দু’হাতে দরজা ধরে খোলা দরজায় ঠেস দিয়ে দাঁড়াল। তারপর নাম ধরে ডাকল ‘রোসা’কে।
রোসারা দাঁড়িয়ে ছিল মাত্র গজ পাঁচেক দূরে।
ডাক শুনে চমকে ফিরে তাকাল রোসা ডোনা জোসেফাইনের দিকে।
ডোনা জোসেফাইনকে চিনতে পারেনি রোসা।
ডোনা তার মুখের স্কিন মাস্ক খুলে ফেলল এবং ডাকল রোসাকে আবার।
এবার রোসা দ্রুত পাভলভকে কিছু বলেই ছুটে এল ডোনা জোসেফাইনের কাছে।
এসেই ডোনা জোসেফাইনের একটা হাত নিয়ে চুমু খেয়ে বলল, ‘ম্যাডাম, খবর আছে।’
রোসার কণ্ঠ দ্রুত। তার চোখে-মুখে উদ্বেগ।
এটা লক্ষ্য করে ডোনা দ্রুত বলল, ‘কি খবর? তোমার কি হয়েছে?’
‘স্যার গ্রেট বিয়ারের ঘাঁটিতে ঢুকেছেন।’
‘কোন স্যার? আহমদ মুসা?’ ডোনা জোসেফাইনের কণ্ঠেও উদ্বেগ ঝরে পড়ল।
‘জ্বি ম্যাডাম।’
‘গ্রেট বিয়ারের ঘাঁটি কোথায়?’
‘নদীর ওপারে। গোলা-গুলির শব্দ ওখান থেকেই আসছে।’
‘কামান ও মেশিনগানের শব্দ যেখান থেকে আসছে?’ উদ্বেগ-আতংকে রুদ্ধপ্রায় ডোনা জোসেফাইনের গলা।
‘জ্বি ম্যাডাম।’
ডোনা জোসেফাইন কথা বলতে পারলো না। কাঁপছে তার ভেতরটা। একা ঢুকেছে আহমদ মুসা! এত কামান, মেশিনগানের শব্দ কেন? কি হচ্ছে সেখানে? একেবারে ভেঙে পড়ার উপক্রম হলো ডোনার।
গাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছে ওলগা। সেও এসে দাঁড়িয়েছে ডোনার পাশে। সে বলল রোসাকে লক্ষ্য করে, ‘আহমদ মুসা গ্রেট বিয়ারের হাতে পুশকভ থেকে আসার পথে বন্দী হননি?’
‘হয়েছিলেন। কিন্তু কোন এক মহিলার সাহায্যে পথেই তিনি মুক্ত হয়ে যান।’
‘কে সে মহিলা?’ কম্পিত গলায় ডোনার প্রশ্ন।
‘মহিলার পরিচয় পাওয়া যায়নি। স্যারও তাকে দেখেননি। টলস্টয় পার্কে গ্রেট বিয়ারের সাথে সংঘর্ষের সময় স্যারকে আরও একদিন সেই মহিলা বাঁচিয়েছেন। এদিনও আড়ালে থেকে।’
রোসা থামতেই ওলগা বলল, ‘আহমদ মুসা কখন ঢুকেছেন গ্রেট বিয়ারের ঘাঁটিতে? গোলা-গুলি কখন থেকে শুরু হয়েছে?’
‘আরও কিছু ঘটনা ঘটেছে ম্যাডাম। আহমদ মুসা হেরিটেজ ফাউন্ডেশন অর্থাৎ গ্রেট বিয়ারের ঘাঁটিতে ঢুকেছেন ভোর বেলা। পুলিশপ্রধানের নেতৃত্বে পুলিশ বাহিনী এসে হেরিটেজ ফাউন্ডেশন ঘেরাও করেছে আধঘণ্টা আগে। কামান দেগেছে পুলিশ। মেশিনগানের শব্দ দুই পক্ষের।’
ডোনা জোসেফাইন ও ওলগা দু’জনের কারও মুখ থেকেই কোন কথা সরছে না। উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার পাহাড় এসে তাদের ঘিরে ধরেছে। আহমদ মুসা ভোর বেলা ঢুকেছেন, এখন বেলা দশটা। কি হচ্ছে সেখানে? কি অবস্থায় আছে আহমদ মুসা? কামান-মেশিনগানের যুদ্ধে সেতো একা এক মানুষ!
নীরবতা ভাঙল ওলগা। বলল, ‘আপনারা ওদিকে গেছেন?’
‘না, স্যার আমাদেরকে এখানেই অপেক্ষা করতে বলেছেন।’
‘তিনি বলেছেন?’
বলে ডোনা জোসেফাইন জড়িয়ে ধরল রোসাকে। কেঁদে ফেলল সে। আবার বলল, ‘ওর সাথে কখন দেখা হলো, কিভাবে দেখা হলো তোমাদের?’
‘আমরা একসাথেই আছি। আমরাই ভোরবেলা ওকে ব্রীজের দক্ষিণ গোড়ায় নামিয়ে দিয়েছি।’
‘তোমরা? বল তো আবার, কি বলেছেন উনি?’ চোখ মুছে বলল ডোনা জোসেফাইন।
‘আমরা ওকে নামিয়ে দিয়ে আমাদের প্রতি তার নির্দেশ জানতে চেয়েছিলাম। তিনি আমাদেরকে ব্রীজের উত্তর গোড়ায় অপেক্ষা করতে বলেছেন।’
ডোনা জোসেফাইন ওলগার দিকে তাকাল। বলল, ‘আমরা অপেক্ষা করব ওলগা।’
‘অবশ্যই।’ বলল ওলগা দৃঢ়কণ্ঠে।
‘রোসা, তুমি গাড়ির ভেতরে এস।’
বলে গাড়ির সামনের দরজা বন্ধ করে পেছনের দরজা খুলে ভেতরে ঢুকল ডোনা।
রোসা দ্বিধা করছিল ভেতরে ঢুকতে ও ডোনার পাশে বসতে।
ডোনা তাকে হাত ধরে টানল।
রোসা পাভলভের দিকে চেয়ে বলল, ‘তুমি গাড়িতে গিয়ে বস।’
বলে ভেতরে ঢুকে সিটের পাশে গাড়ির ফ্লোরের উপর বসে পড়ল রোসা।
ডোনা বাঁধা দিলে হাত জোড় করল রোসা। বলল, ‘এভাবে বসলেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করব ম্যাডাম। আপনি বাঁধা দেবেন না।’
ওলগা গিয়ে বসল তার ড্রাইভিং সিটে।
‘তোমরা তো এ পর্যন্ত ওর সাথে ছিলে?’
‘জ্বি ম্যাডাম।’
‘বল ওর এই কয় দিনের সব কথা।’
রোসা শুরু করল। শুনছিল ডোনা জোসেফাইন ও ওলগা।
শুনছিল বটে ডোনা জোসেফাইন। কিন্তু চোখ ও মন তার পড়েছিল ব্রীজ পেরিয়ে আসা কমসোমল হাইওয়ের উপর। কখন আসবেন তিনি, তার প্রিয়তম!
একটি করে মুহূর্তকে তার কাছে মনে হচ্ছে একটা করে যুগের মত। যন্ত্রণাদায়ক এক অপেক্ষা এটা। কিন্তু মনে হচ্ছে, এই অপেক্ষায় গোটা জীবন তার শেষ হলেও ক্লান্তি আসবে না।

সাইমুম সিরিজের পরবর্তী বই
আটলান্টিকের ওপারে

Top