২৫. আটলান্টিকের ওপারে

চ্যাপ্টার

সম্রাজ্ঞী ক্যাথারিন সিংহাসনে বসে।
মার্চের পাঁচ তারিখেই তার অভিষেক হয়েছে। অর্থ্যাৎ এদিন ক্যাথারিন জারের সিংহাসনে বসার মধ্যে দিয়ে রাশিয়ায় নিয়মতান্ত্রিক রাজতান্ত্রিক ব্যাবস্থা চালু হয়েছে। এর আগের দিন পার্লামেন্টে সর্ব সম্মতিক্রমে এই লক্ষ্যে সংবিধান সংশোধন করা হয়েছে। বিরোধীদলের সদস্যরাও সংশোধনীর পক্ষে ভোট দিয়েছে। বিরোধীদলীয় নেতা বুলগানিনের ‘আইভান দি টেরিবল’ হওয়ার তথ্য ফাঁস হবার পর
বিরোধীদলীয় সকল সদস্য বুলগানিনের নিন্দা করেছে।
মার্চের পাঁচ তারিখে ক্যাথারিনের সিংহাসনে আরোহনকে রুশ জনগণ স্বাগত জানিয়েছে। ১৯১৭ সালের এই তারিখেই জার সম্রাট সিংহাসন পরিত্যাগ করে পার্লামেন্টের হাতে সব ক্ষমতা ছেড়ে দিয়েছিলেন। রুশ জনগণ মনে করছে, জারতন্ত্রও নয়, আবার কম্যুনিস্ট স্বৈরতন্ত্রও নয় এবং কান্ডারীহীন গনতন্ত্রও নয়, নতুন নিয়ম তান্ত্রিক রাজতন্ত্রের অধীন গনতন্ত্রে অবশ্যই রাশিয়ায় শান্তি সমৃদ্ধি ও স্থিতিশীলতা নিয়ে আসবে।
সম্রাজ্ঞী ক্যাথারিন তার অভিষেক অনুষ্ঠানের সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে জনগণের কাছে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, ‘জারদের অনেক পাপের তিনি প্রায়শ্চিত্ত করবেন এবং বিশ্ব সভায় রাশিয়ার শক্তি, সুনাম ও মর্যাদা বৃদ্ধি করবেন। স্বদেশ ও বিদেশ থেকে লুন্ঠনের মাধ্যমে জাররা শত শত বছর ধরে যে ধনাগার গড়ে তুলেছিলেন তা উন্মুক্ত করে তিনি পাওনাদারদের মধ্যে বিলিয়ে দেবেন।
সম্রাজ্ঞী ক্যাথারিনের এই ভাষণকে রুশ জনগণ অভিনন্দিত করেছে। পত্র-পত্রিকা সম্রাজ্ঞীর ন্যায়পরায়নতা ও প্রগতিশীল দৃষ্টিভংগির প্রশংসা করেছে। বলেছে, সম্রাজ্ঞীর অতীতের ভুল ও অবিচারের প্রতিকারের প্রতিশ্রুতি নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্রকে শক্তিশালী করবে এবং এর প্রতি মানুষের আস্থা বাড়াবে।
রুশ প্রধানমন্ত্রী, ডেপুটি প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রী সম্রাজ্ঞীর অফিসে প্রবেশ করার পর একটা লম্বা বাউ করে সিংহাসনের প্ল্যাটফরমের নিচে দু’পাশে রাখা সারিবদ্ধ চেয়ারের ডানদিকের প্রথমটিতে প্রধানমন্ত্রী কিরনস্কী জুনিয়র দ্বিতীয়টিতে ডেপুটি প্রধানমন্ত্রী এবং বামদিকর প্রথমটিতে অর্থমন্ত্রী এবং দ্বিতীয়টিতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বসলেন।
সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে প্রেসিডেন্টের পদ বিলোপ করার পর প্রেসিডেন্ট কিরনস্কী জুনিয়র প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন এবং প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন ডেপুটি প্রধানমন্ত্রী।
ওরা আসন গ্রহন করতেই সম্রাজ্ঞী ক্যাথারিন তার সামনের ফাইলের দিকে একবার চোখ বুলাল। তারপর সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় জানাবার জন্যে আমি আপনাদের ডেকেছি।’
ক্যাথারিন থামতেই প্রধানমন্ত্রী বিনয়ের সাথে বলল, ‘আমরা কৃতজ্ঞ সম্রাজ্ঞী।’
ক্যাথারিন বলা শুরু করল, ‘আমার অভিষেক অনুষ্ঠানের বক্তৃতায় আমি জনগণের কাছে যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম, সেটাই এখন আমি কার্যকরী করতে চাই। এ সম্পর্কিত আমার রাজকীয় ফরমান তৈরী সমাপ্ত হয়েছে। আজ ফরমান জারীর আগে আপনাদেরকে আমি বিষয়টি জানাতে চাই।’
‘মহামান্য সম্রাজ্ঞী, মাফ করবেন আমাকে। ফরমান জারীর আগে তো তা মন্ত্রী সভায় অনুমোদিত হতে হবে। ‘বিনয়ের সাথে বলল প্রধানমন্ত্রী।
হাসল ক্যাথারিন। বলল, ‘ধন্যবাদ প্রধানমন্ত্রী, আপনি ঠিকই বলেছেন। কিন্তু আমি রাষ্ট্রের সমসাময়িক কোন বিষয়ের উপর ফরমান জারী করতে যাচ্ছি না যে, এটা করতে মন্ত্রীসভার অনুমোদন লাগবে। কিন্তু সম্রাজ্ঞীর পারিবারিক বিষয়, রাজতন্ত্রের অতীত কোন বিষয়-সম্পত্তি যা রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রীয় কোষাগারের আইনানুগ কোন বিষয় নয়, ইত্যাদি ব্যাপারে সংবিধান সম্রাজ্ঞীকে ফরমান জারী বা সিদ্ধান্ত গ্রহণেরবাধা-বন্ধনহীন এখতিয়ার দিয়েছে।’
‘সম্রাজ্ঞী ঠিকই বলেছেন।’ বলল প্রধানমন্ত্রী।
ক্যাথারিন আবার শুরু করল, ‘আমার মা’র নেতৃত্বে সরকারের একজন ও রাজ পরিবারের একজন প্রতিনিধি সম্বলিত তিন সদস্যের কমিশন জার সম্রাটদের গোপন ধন-ভান্ডারের যে বিবরণ তৈরি করেছে তাতে আমার কাজ অনেকখানি সহজ হয়ে গেছে।’
একটু থামল ক্যাথারিন। থেমেই আবার শুরু করল, ‘কমিশনের রিপোর্ট জারের ধন-ভান্ডারের তিনটি বিভাগ দেখানো হয়েছে। যেমন, বৈদেশিক, দেশীয় ও পারিবারিক। বিদেশ থেকে আহরিত সোনা, স্বর্ণালংকার এবং স্বর্ণ ও রৌপ্য মুদ্রা বৈদেশিক বিভাগে এবং দেশ থেকে আদায়কৃত অর্থ রাখা হয়েছে দেশীয় বিভাগে এবং পারিবারিক অলংকারাদি ও অর্থ-সম্পদ সঞ্চিত করা হয়েছে পারিবারিক বিভাগে। আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি, বিদেশের লুণ্ঠিত সম্পদ সংশ্লিষ্ট দেশের জনগণের হাতে ফেরত দেব। দেশীয় বিভাগের অর্থ-সম্পদ পাবে রুশ জনগণ। এই টাকা তাদের চিকিৎসা, শিক্ষা ও বার্ধক্য ভাতা খাতে খরচ হবে। আর পারিবারিক সম্পদ যাবে জার পরিবারের কাছে।’
ফাইলের দিকে নজর দেবার জন্যে ক্যাথারিন একটু থামতেই প্রধানমন্ত্রী কিরনস্কী বলে উঠল, ‘মহামান্য সম্রাজ্ঞী, বিদেশ থেকে আহরিত টাকা কিভাবে সংশ্লিষ্ট দেশের জনগণকে ফেরত দেবেন। দেশ ও টাকার পরিমাণ চিহ্নিত হবে কিভাবে?’
ফাইল থেকে মুখ তুলে হাসল ক্যাথারিন। বলল, ‘আমার পূর্ব পুরুষরা নামের জন্যে যা করে গেছেন তা এখন আমার কাজে লাগছে। তারা তাদের ধন-ভান্ডারের বিদেশ বিভাগকে বিভিন্ন উপ-বিভাগে ভাগ করেছেন। একটি করে উপবিভাগকে একটি বিজয়ের স্মারক হিসেবে দেখানো হয়েছে। যেমন-এস্টোনিয়া, লিথুনিয়া ও ল্যাটভিয়া বিজয়ের স্মারক, পোলান্ড বিজয়ের স্মারক, রোমানিয়া বিজয়ের স্মারক, তুর্কি বিজয়ের স্মারক ইত্যাদি। সুতরাং প্রদর্শনীর জন্যে বিজয় থেকে লুন্ঠিত সম্পদকে আলাদা আলাদা করেই রাখা হয়েছে। তাই লুন্ঠিত সম্পদ ফিরিয়ে দেয়া খুবই সহজ হয়ে গেছে।’
থামল ক্যাথারিন।
উপস্থিত চারজনের কেউই কথা বলল না।
মুখ চোখ দেখে সবাইকে বিব্রত মনে হলো।
অবশেষে মুখ খুলল প্রধানমন্ত্রীই। বলল, ‘মাফ করবেন সম্রাজ্ঞী, এভাবে কি কেউ সম্পদ ফেরত দেয়?’
‘আমার জানা মতে দেয়নি কেউ। সবার পক্ষ থেকে সংশোধনের এই কাজ আমি শুরু করতে চাই।’
‘মহামান্য সম্রাজ্ঞী, এই কাজটি জার সম্রাটদের আবহমান ঐতিহ্যের বিপরীত হবে।’
‘আমাদের নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্রও তো জার সম্রাটদের ‘আবহমান’ ঐতিহ্যের বিপরীত। কিন্তু তবু তো করছি আমরা তা।’
‘মহামান্য সম্রাজ্ঞী, কোন দেশই তো এভাবে অর্থ ফেরত দেয়নি, দেয় না।’ বলল প্রধানমন্ত্রী।
‘সম্ভবত সে সব দেশে আপনাদের এই ক্যাথারিনের মত কেউ সিংহাসনে বসেননি।’
‘মাফ করবেন সম্রাজ্ঞী, এটা করে আমরা কি অর্জন করতে চাচ্ছি?’
‘এর মাধ্যমে আমি রাজপরিবারের পাপ স্খালন করতে চাচ্ছি। আর এই পাপ স্খালনের মাধ্যমে আমি মনে করি নতুন রাশিয়ার উখান ঘটবে এবং নতুন শক্তি ও সমৃদ্ধিতে হবে বলিয়ান। যা আমি অস্ত্রের জোরে নয়, রাশিয়ার হৃদয় দিয়ে অর্জন করতে চাই। ‘বলতে বলতে ক্যাথারিনের কণ্ঠ আবেগে ভারি হয়ে উঠল।’
প্রধানমন্ত্রী কিরনস্কী জুনিয়র তার আসন থেকে উঠে দাঁড়াল। বলল, ‘ধন্যবাদ মহামান্যা সম্রাজ্ঞী। আমার আর কোন জিজ্ঞাসা নেই। আমি আপনার সাথে একমত।’
‘ধন্যবাদ প্রধনামন্ত্রী। ধন্যবাদ আপনাদের সকলকে।’
সবাই উঠে দাঁড়িয়ে বাউ করল ক্যাথারিনকে।
তারপর অনুমতি নিয়ে ঘর থেকে দরজার দিকে এগুলো।
বাইরে বেরিয়ে চারজনই পাশাপাশি চলছিল।
কিছু বলার জন্যে উশখুশ করছিল ডেপুটি প্রধানমন্ত্রী। বলল সে অবশেষে, ‘সম্রাজ্ঞীকে তার সিদ্ধান্ত থেকে ফিরাবার কি কোন উপায় নেই?’
‘আমিও তাই ভাবছি। ‘বলল অর্থমন্ত্রী।
‘কিন্তু আমি মনে করছি, সম্রাজ্ঞীর সাহসী সিদ্ধান্ত রাশিয়াকে নতুন যুগে প্রবেশ করাবে এবং অতীতের অনেক ক্লেদ-কালিমা থেকে রাশিয়াকে মুক্ত করবে। এদিক দিয়ে রাশিয়ায় নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্র চালুর সিদ্ধান্ত ঐতিহাসিক এবং সার্থক প্রমাণিত হবে।’ বলল প্রধানমন্ত্রী।
‘কিন্তু রাশিয়ার তো ক্ষতি হচ্ছে। ‘বলল ডেপুটি প্রধানমন্ত্রী।
‘বড় বড় সুবিধা ও স্বার্থ আদায় করার জন্যে অনেক সময় নগদ ক্ষতি স্বীকার করতে হয়। এটা সেই রকম ব্যাপার।’ বলল প্রধানমন্ত্রী।
‘মানুষ কি এটা মেনে নেবে?’ বলল আবার ডেপুটি প্রধানমন্ত্রীই।
প্রধানমন্ত্রী হাসল। বলল, ‘আগেও সম্রাজ্ঞী পপুলার ছিলেন। কিন্তু তার দু’টি বক্তব্য রেডিও টিভিতে আসার পর বলা যায় তিনি একশ’ভাগ রাশিয়ানদের হৃদয় জয় করেছেন। আজ তাঁর এ ফরমান প্রকাশিত হবার পর আমি মনে করি স্বদেশের মত বিদেশেও তিনি মানুষের হৃদয় জয় করবেন।’
‘আপনার এসব কথা আমি মেনে নিচ্ছি। কিন্তু আহমদ মুসার মত একজন বিদেশী আমাদের সম্রাজ্ঞীর উপর প্রভাব খাটাবেন, তা আমি মেনে নিতে পারছি না।’ বলল ডেপুটি প্রধানমন্ত্রী।
‘দেখ, আহমদ মুসা আমাদের সম্রাজ্ঞীর জন্যে যা করেছেন, কোন রাশিয়ান কিন্তু তা করেননি। আর আহমদ মুসার ব্যাক্তিত্বকে ছোট করে দেখছ কেন? এই আহমদ মুসা ফরাসী রাজকুমারীকে বিয়ে করেছেন আর আমাদের ক্রাউন প্রিন্সেস তাতিয়ানারও তিনি ছিলেন প্রিয়তম ব্যাক্তি।’
‘তারা একজন মুসলিম আহমদ মুসার প্রতি কেন এমন করে ঝুঁকলেন। সেটাই আমার খারাপ লাগছে।’
প্রধানমন্ত্রী কিরনস্কী জুনিয়র একটু চিন্তা তারপর বলল, ‘তুমি ইতিহাসের ছাত্র। তোমার তো জানার কথা, রাশিয়ার রাজ পরিবারের সূচনাতেই তাদের রক্তের সাথে ‘মোঙ্গল’ রক্তের সংমিশ্রণ ঘটেছিল এবং সেই সময় মোঙ্গল রক্তের সাথে সংমিশ্রণ ঘটেছিল মুসলিম রক্তের। এই মুসলিম রক্তের প্রভাব ক্রাউন প্রিন্সেস তাতিয়ানার উপর পড়েছিল এবং হয়তো আমাদের সম্রাজ্ঞীর উপরও পড়তে পারে।’
‘এটা কি খারাপ খবর নয়?’ ডেপুটি প্রধানমন্ত্রী বলল।
‘কেন তোমার বোন দেশের শীর্ষ বুদ্ধিজীবী ডঃ নাতালোভা ও তোমার ভাগ্নী ওলগা কি ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট হননি? আমাদের সম্রাজ্ঞী তার উপকারীর ধর্মকে যদি ভাল চোখে দেখেন ক্ষতি কি?’
ডেপুটি প্রধানমন্ত্রী ইউরি অরলভের দু’চোখে মুহূর্তের জন্যে আনন্দের একটা বিদ্যুত চমক খেলে গেল। কিন্তু মুখের গার্ম্ভীর্য সে নষ্ট হতে দিল না।
প্রধানমন্ত্রীর কথার পর কোন কথা ডেপুটি প্রধানমন্ত্রী আর বলল না।
কথা বলল আবার প্রধানমন্ত্রীই। বলল, ‘সম্রাজ্ঞীর ভুমিকায় আমি আনন্দিত। তিনি একাই শুধু জনপ্রিয় হবেন না, তাঁর সাথে সাথে জনপ্রিয় হবে আমাদের সরকারও। তার ঐতিহাসিক সিদ্ধান্তকে যদি আমরা পুঁজি হিসাবে কাজে লাগাতে পারি, তাহলে আমাদের সরকারের সুনাম বিদেশেও বৃদ্ধি পাবে। দীর্ঘস্থায়ী হবে আমাদের সরকার।’
সকলেই ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানাল প্রধানমন্ত্রীর কথায়।
লিফটের সামনে তারা পৌঁছে গেছে।
লিফটের দরজা খুলে গেলে প্রবেশ করল তারা লিফটে।

সম্রাজ্ঞী ক্যাথারিনের অন্দর মহলের প্রাইভেট ড্রইংরুম।
একটি সোফায় সম্রাজ্ঞী ক্যাথারিন বসে। সামনে আরেকটি সোফায় আহমদ মুসা ও ডোনা জোসেফাইন পাশাপাশি।
সম্রাজ্ঞী জারের ধন-ভান্ডার সংক্রান্ত তার ফরমান ঘোষণার ক’দিন পর ক্যাথারিন ও আহমদ মুসার এই সাক্ষাৎ।
সম্রাজ্ঞী ক্যাথারিনের জারের ধন-ভান্ডার সম্পর্কিত ফরমান বিস্মিত করেছিল আহমদ মুসাকে। আহমদ মুসার জিজ্ঞাসার জবাবে ক্যাথারিন ব্যাখ্যা করছিল তার পরিকল্পনা।
ব্যাখ্যার এক পর্যায়ে সে বলল, ‘জারের ধন-ভান্ডারের বণ্টন সংক্রান্ত আরেকটা বিস্তারিত ফরমান আমার তৈরি হয়ে গেছে। এই ফরমান প্রকাশিত হলে দেখা যাবে, মুসলমানদের তুর্কি খিলাফতের ব্যাপক অঞ্চল লুণ্ঠন করে জাররা যে অর্থ তার ধন-ভান্ডারে সঞ্চয় করেছিল, তার পরিমাণ বর্তমান হিসেবে দুই হাজার কোটি ডলার। এই অর্থ আমি তিন ভাগ করে দুই ভাগ দান করতে চাই সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের বর্তমান সরকারের শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে। বাকী এক ভাগ যাবে ইসলামী সম্মেলন সংস্থার বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি উন্নয়ন তহবিলে।’ থামল ক্যাথারিন।
‘দ্বিতীয় ভাগের কাজ সহজ, কিন্তু প্রথম দুই ভাগের অর্থ বন্টনের কাজ কিভাবে নির্ধারণ করবেন?’ বলল আহমদ মুসা।
সেটা আমি করে ফেলেছি। বোসনিয়া হার্জেগোভিনার পশ্চিম সীমান্ত থেকে কাম্পিয়ান সাগরের উত্তর সীমান্ত পর্যন্ত ৬৮ টি মুসলিম নগরী অগ্নিদগ্ধ করাসহ এই অঞ্চলে জাররা ব্যাপক লুণ্ঠন চালায়। মায়না, আকডিয়া, বাজারজিক, গ্রেভনা ইত্যাদির মত নগরীতে কেউ বেঁচে ছিল না। এই অঞ্চলগুলোও পড়েছে এখন কাজাখস্তান, চেচনিয়া, তাতারস্তান, আজারবাইজান, ইউক্রেন, রোমানিয়া, বুলগেরিয়া, সার্বিয়া ও বোসনিয়ার মধ্যে। তবে বৃহত্তর অংশে পড়েছে চেচনিয়া, তাতারস্তান, ইউক্রেন ও ককেশীয় অঞ্চলে। এদের মধ্যে আবার সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্থ অঞ্চল হলো চেচনিয়া ও তাতার অঞ্চল। আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি, প্রথম ভাগের দুই তৃতীয়াংশ অর্থ্যাৎ ৮শ কোটি ডলার যাবে এই দুই রাষ্ট্রে।’
‘ধন্যবাদ সম্রাজ্ঞী ক্যাথারিন।’ বলে হাসল আহমদ মুসা। তারপর বলল, ‘মানুষ তো বলতে পারে, মুসলমানদের আপনি বেশি ফেভার করেছেন। এটা কি প্রতিদানের মত কোন অনুগ্রহ?
‘কিসের প্রতিদান?’
‘একজন মুসলমানের কাছে আপনি কিছু সাহায্য পেয়েছিলেন, তার প্রতিদান।’
‘সেই মুসলমান কি কোন প্রতিদান চান?’
‘চাইবে কেমন করে? সে তো সীমহীন দানের কিঞ্চিত প্রতিদান হিসেবে এটা করেছে।’
উত্তরে বলল সম্রাজ্ঞী ক্যাথারিন, ‘স্থান ও পাত্রের অনেক পার্থক্যের বিচারে প্রতিদান অবশ্যই চাইতে পারেন। কিন্তু প্রতিদান হিসাবে আমি এটা করছি না। বলতে পারেন এটা রক্তের একটা টান।’ বলে হাসল ক্যাথারিন। বলল আবার, ‘রাজকীয় পারিবারিক ইতিহাসেও বলে, আমাদের রাজপরিবার ও রাজত্বের প্রতিষ্ঠা হয়েছিল মোঙ্গলদের দ্বারা। মস্কো অঞ্চলের অনেক প্রিন্সের মধ্যে একজন প্রিন্স ইউরি বিয়ে করেছিলেন মোঙ্গল খানের এক বোনকে ১২ শ’ খৃস্টাব্দের শুরুর দিকে। তারপর মোঙ্গল সৈন্যের সাহায্য নিয়েই প্রিন্স ইউরি প্রতিদ্বন্দ্বীদের হারিয়ে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তাঁর রাজত্ব। সেই থেকে অর্থ্যাৎ ১২৩৭ খৃস্টাব্দ থেকে ১৪৮০ খৃস্টাব্দ পর্যন্ত ২৪৩ বছর রাশিয়ার রাজপরিবার ও রাজত্বের উপর মোঙ্গলদের নিয়ন্ত্রন ছিল। ১২২৭ সালে চেঙ্গিসখানের মৃত্যুর পর তাঁর পরিবার ও রাজত্ব চার ধারায় বিভক্ত হয়ে পড়ে। এই চার ধারার সবকটির উপর ইসলাম প্রভাব বিস্তার করে। সুতরাং মস্কোর উপর ২৪৩ বছরের মোঙ্গল প্রভাবের সময় রাশিয়ার রাজপরিবারের সাথে ইসলাম ধর্মের অনুসারী মোঙ্গলদের ব্যাপক বৈবাহিক সম্পর্কের সৃষ্টি হয়। এইভাবে মুসলিম রক্ত প্রবেশ করেছে রাশিয়ার রাজপরিবারে। প্রথম দিকে রাজপরিবারের অনেক রাজকুমার, রাজকুমারী ও সদস্য প্রকাশ্যে ইসলামের অনুসরণ করতো। কিন্তু আইভান দি টেরিবলের সময় পরিস্থিতি পাল্টে যায়। মোঙ্গলদের সাথে বৈরিতা বাড়ার সাথে সাথে মুসলমানদের প্রতি বিদ্বেষও বৃদ্ধি পায়। কিন্তু রক্তের টান তো একটা আছেই।
দীর্ঘ এক বক্তব্য দেয়ার পর থামল সম্রাজ্ঞী ক্যাথারিন।
‘ধন্যবাদ সম্রাজ্ঞী, অনেক নতুন তথ্য দিয়েছেন আপনি আপনার রয়্যাল ডায়েরী থেকে। আমরা খুশি হয়েছি, রয়্যাল ডায়েরী সম্ভবত কোন সত্যই গোপন করেনি। মহামান্যা সম্রাজ্ঞীর শাসন যদি রয়্যাল ডায়েরীর মত স্বচ্ছ হয় এবং হবে বলেই প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে, তাহলে রাশিয়া ও মুসলিম বিশ্ব সম্পর্কের এক নতুন যুগে প্রবেশ করবে। তবে একটা প্রশ্ন সম্রাজ্ঞী। আপনি যে রক্তের টানের কথা বললেন, তা আইভান দি টেরিবল-এর ১৫৪৭ সালে ক্ষমতায় আসার পর কোন সময়েই দেখা যায়নি কেন?’ বলল আহমদ মুসা।
হাসল ক্যাথারিন। বলল, ‘বংশ তত্ব সম্পর্কে বৈজ্ঞানিক তত্ব হলো, বংশীয় ‘জীন’-এর প্রভাব কখন বা কত জেনারেশন পরে কার মধ্যে হঠাৎ করে প্রকাশ পাবে, তা বলতে বিজ্ঞানও অপারগ। তাছাড়া অতীতে আহমদ মুসার মত একজনের সাথে হয়তো এই বংশের কারো সাক্ষাত ঘটেনি। আহমদ মুসার সাথে আমারও সাক্ষাত না হলে রক্তের টান উপলদ্ধি করার সুযোগ আমার হতো কিনা বলা মুস্কিল।
‘আপনার এই রক্তের টান কি মুসলমানদের অর্থ মুসলমানদের ফিরিয়ে দেয়া পর্যন্তই?’
‘এ প্রশ্নের জবাব আমি দেব না।’
‘কিন্তু জবাবটার প্রতি আমার আগ্রহ বেশি।’
‘তাহলে অপেক্ষা করতে হবে আমি বেসরকারী লাইফে ফেরত না যাওয়া পর্যন্ত।’
‘আলহামদুলিল্লাহ। আমি জবাব পেয়ে গেছি।’
‘যদি পেয়ে থাকেন, তাহলে তা শুধু আপনি এবং প্রিন্সেস মারিয়া জোসেফাইনের জন্যেই।’ গম্ভীর কণ্ঠে বলল ক্যাথারিন।
‘বুঝেছি। কিন্তু সম্রাজ্ঞীর তো কোন রিটায়ারমেন্ট নেই।
একজন সম্রাজ্ঞীর বেসরকারী লাইফ কোনদিনও আসে না।’
‘এসব বিষয়ে আমি এখন চিন্তা করছি না। সাম্রাজ্যটা আগে ঠিক করতে দিন। তারপর এসব নিয়ে চিন্তা করা যাবে। সিংহাসন আমার কাছে কোনদিনই বড় ছিল না, কোনদিনই বড় হবে না।’
‘কিন্তু সম্রাজ্ঞী, আমাদের কাছে এ সিংহাসনের মূল্য অনেক।’
‘আমিও সেটা জানি। আমার কোন সিদ্ধান্তই কাউকে হতাশ করার মত হবে না।’
‘আলহামদুলিল্লাহ। আজ মনে পড়ছে তাতিয়ানাকে। তার দেয়া দায়িত্ব দেখছি আমাদের জন্যে পরম সৌভাগ্যের প্রমাণিত হলো।’
‘কিন্তু আমার জন্যে তার চেয়েও পরম সৌভাগ্যের প্রমাণিত হয়েছে। আমি পেয়েছি নতুন জীবন।’
‘তবে দুর্ভাগ্য হয়েছে তাতিয়ানার।’
‘না। অমন সৌভাগ্যের মৃত্যু যদি আমার ভাগ্যে জুটতো! মদীনায় কবর হয়েছে তার!’ ক্যাথারিনের কণ্ঠ ভারি হয়ে উঠেছিল।
একটু থামল। নিজেকে স্বাভাবিক করে তোলার চেষ্টা করল।
তারপর সম্রাজ্ঞী ক্যাথারিন বলল, ‘ক’দিন খুব খারাপ লেগেছিল আপনি খাঁচা ভাঙা পাখির মত পালিয়ে যাবেন, তারপর রাশিয়ার সাথে আপনার সব সম্পর্কের ইতি ঘটবে, এই ভাবে।’
‘মনে হচ্ছে, এখন খারাপ লাগছে না?’
সম্রাজ্ঞী ক্যাথারিন হাসল। বলল, ‘খারাপ না লাগার কারণ ঘটেছে। মনে হচ্ছে, রাশিয়া আপনার সাথে একটা সম্পর্কের বাঁধন তৈরি করতে যাচ্ছে।’
‘সেটা কি? আহমদ মুসার চোখে কৌতূহল।
আবার হাসল ক্যাথারিন। বলল, ‘বলছি। আপনাকে কষ্ট দিয়েছি একথা বলার জন্যেও।’
কথা শেষ করে গম্ভীর হল ক্যাথারিন। বলল ডোনাকে লক্ষ্য করে, ‘প্রিন্সেস মারিয়া জোসেফাইন, আপনি ওলগার ওখানে ক’সপ্তাহ আছেন, কেমন মনে হয় তার মাকে?’
হঠাৎ এমন প্রশ্নে বিস্মিত হলো ডোনা। একটু সময় নিয়ে জবাব দিল, ‘ঠিক মাকে যেমন মনে হয়।’
‘ধন্যবাদ প্রিন্সেস। এ প্রশ্নটা আমি ওলগাকেও করেছিলাম দু’সপ্তাহের সাহচর্যে প্রিন্স প্লাতিনি লুইকে তার কেমন মনে হয়। সেও ঠিক এমন জবাবই দিয়েছিল।’ থামল সম্রাজ্ঞী ক্যাথারিন।
‘কথাটা বুঝলাম না সম্রাজ্ঞী।’ বলল আহমদ মুসা।
‘অর্থ পরিস্কার। আমরা মারিয়া জোসেফাইনকে একজন মা দিতে চাই এবং ওলগাকে দিতে চাই একজন পিতা।’
ডোনা সোফা থেকে লাফ দিয়ে উঠল। আনন্দে তার চোখ-মুখ নাচছে। স্থান-কাল-পাত্র ভুলে সে চিৎকার করে উঠল, ‘চমৎকার, চমৎকার, মহামান্যা সম্রাজ্ঞী আপনাকে মোবারকবাদ।’
কিন্তু আহমদ মুসার চোখে-মুখে আনন্দের চেয়ে বিস্ময়ের ঘোর বেশি। বলল সে, ‘ডোনার আনন্দের সাথে আমি শেয়ার করছি। কিন্তু সম্রাজ্ঞী, ‘এই পর্বত প্রমাণ ভারি কথাটা বলবে কে, তুলবে কে? রাজী করাবে কে?’
সম্রাজ্ঞী ক্যাথারিন ঠোঁটে এক টুকরো হাসি টেনে বলল, ‘সব কিছু অবহিত হবার পর আপনার কাছে আজ এ কথাটা তুলেছি ফাইনাল সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্যে।’
‘কিন্তু আমি যতদুর জানি ওলগার মা ও ডোনার আব্বার সাথে আপনার এ পর্যন্ত দেখা হয়নি। আপনি কোথা থেকে কি অবহিত হয়েছেন?’ বলল আহমদ মুসা।
‘আমাদের ডেপুটি প্রধানমন্ত্রী ইউরি অরলভ ওলগার আপন মামা।
তার তরফ থেকে কথাটা আমার কাছে এসেছে। তিনি জানিয়েছেন, ‘এ
ধরনের একটা উদ্যোগ যদি নেয়া হয় তালে দু’জনের কাছ থেকেই সম্মতি পাওয়া যাবে।’ বলল ক্যাথারিন।
‘আমিও মনে করি সম্মতি পাওয়া যাবে। যদি বিষয়টা কেউ না তুলতো, তাহলে আমি এবং ওলগাই কথাটা তুলতাম।’ বলল ডোনা।
‘তুমি এতটাই নিশ্চিত ডোনা? মনে রেখ, দু’জনই অত্যন্ত সম্মানিত ব্যক্তি। ওঁদের সামান্য বিব্রত করাও আমাদের ঠিক হবে না।’ বলল আহমদ মুসা গম্ভীর কণ্ঠে।
হাসল ডোনা। বলল, ‘ওরা অসম্মত হবেন না একথা আমি নিশ্চিত ভাবেই বলতে পারি।’
সম্রাজ্ঞী ক্যাথারিন বলল, ‘ধন্যবাদ প্রিন্সেস মারিয়া জোসেফাইন। কথাটা শুনার পর আমিই সবচেয়ে খুশী হয়েছি। সত্তরই ওলগার বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। তারপর ওলগার মা ডঃ নাতালোভা একেবারেই একা হয়ে যাবেন। আর প্রিন্সেস মারিয়া জোসেফাইন আহমদ মুসার সাথে চলে যাবার পর প্রিন্স প্লাতিনি লুইও ঐ ভাবে একা হয়ে যাবেন। এই বিয়ে দু’জনকেই এক অস্বাভাবিক অবস্থা থেকে বাঁচাবে।’
‘মহামান্যা সম্রাজ্ঞী, আল্লাহ যদি আমাদের এই ইচ্ছা পূর্ণ করেন, তাহলে আমার মাথা থেকে পর্বত প্রমাণ এক সমস্যা নেমে যাবে।’ বলল ডোনা।
‘যে সমস্যার আমি সমাধান পাচ্ছিলাম না, তার সমাধান পেয়ে যাব।’ আহমদ মুসা বলল।
‘তাহলে আহমদ মুসা ও মারিয়া জোসেফাইন আমরা এগুতে পারি?’ সম্রাজ্ঞী ক্যাথারিন বলল।
‘অবশ্যই। ‘দু’জনেই বলে উঠল।
সম্রাজ্ঞী ক্যাথারিন হেসে বলল, ‘আমারও একটা সমস্যার সমাধান হলো। রাশিয়া একটা সম্পর্কের বাধনে আহমদ মুসাকে বাধতে পারল।’
‘রাশিয়ার মেয়ে তাতিয়ানা রাশিয়াকে এবং রাশিয়ার রাজপরিবারকে অনেক আগেই আমার কাছে অবিস্মরণীয় করেছে।’ বলল আহমদ মুসা।
‘অবিস্মরণীয় হওয়া এবং আত্বীয়তা করা এক জিনিস নয় জনাব আহমদ মুসা। অবিস্মরণীয়কে স্মরণ করলেই চলে, কিন্তু মাঝে মাঝে বেড়াতে না এলে আত্বীয়তার প্রতি অবিচার হয়।’ বলল ক্যাথারিন।
‘বুঝলাম।’ আহমদ মুসা বলল।
‘তাহলে আমি বলে দিচ্ছি প্রধানমন্ত্রীকে অগ্রসর হবার জন্যে। অবশ্য প্রথমে কথাটা আমিই পাড়ব। বলব আমিই ডেকেছি ওঁদের এবং আমরা ঠিক করেছি ডঃ নাতালোভা ও প্রিন্স প্লাতিনি লুই-এর বিয়ে আগে হবে, এর এক সপ্তাহ পর ওলগার বিয়ে হবে।’ বলল ক্যাথারিন।
‘ঠিক আছে। এটাই স্বাভাবিক হবে।’ বলল আহমদ মুসা।
‘আমার খুব আনন্দ লাগছে। মনে হচ্ছে রাশিয়ায় অনেক দিন থাকব।’ বলল ডোনা।
‘ওয়েলকাম। আমাদের বাধন কার্যকরী হওয়ার প্রথম প্রমাণ এটা।’ হেসে বলল সম্রাজ্ঞী ক্যাথারিন।
‘আমার কথা তো বললাম। ওঁকে বলুন উনি থাকবেন কিনা।’ ডোনা বলল।
‘জিজ্ঞেস করার কোন দরকার নেই। কান টানলে যেমন মাথা আসে, তেমনি মারিয়া জোসেফাইন যেখানে, সেখানে আহমদ মুসাকেও পাওয়া যাবে।’ ক্যাথারিন বলল।
কথা শেষ করেই পাশে পড়ে থাকা তার হ্যান্ড ব্যাগ থেকে ক্যাথারিন তিনটা ইনভেলপ বের করল। তার মধ্যে একটা হাতে রেখে অন্য দু’টি আহমদ মুসা ও ডোনার হাতে তুলে দিল।
আহমদ মুসা ও ডোনা দু’জনেই ইনভলপ খুলল। তাতে পেল, রুশ নাগরিকত্বের একটি সনদপত্র এবং একটি রাশিয়ান ভিআইপি পাসপোর্ট।
আহমদ মুসা ও মারিয়া জোসেফাইন দু’জনের মুখই আনন্দে উজ্বল হয়ে উঠল।
পাসপোর্ট থেকে মুখ তুলে ক্যাথারিনের দিকে তাকিয়ে বলল আহমদ মুসা, ‘আমরা কৃতজ্ঞ সম্রাজ্ঞী।’
সম্রাজ্ঞী ক্যাথারিনের চোখ-মুখ আবেগে লাল হয়ে উঠছে। বলল, ‘কৃতজ্ঞতা প্রকাশের মত ব্যাপার এটা নয়। আপনারা এটা গ্রহন করলে আমরা সম্মানিত বোধ করব।’
থেমেই সম্রাজ্ঞী ক্যাথারিন তার হাতের তৃতীয় ইনভেলপটি তুলে দিল আহমদ মুসার হাতে।
আহমদ মুসা খুলল ইনভেলপ। বের হল, ‘গ্লোবাল ব্যাংক অব ব্যাংকস'(GBB)-এর ওপেন ইন্টারন্যাশনাল একাউন্টের একটা ‘কোড কার্ড’।
বিশ্বের সবচেয়ে দামী বস্তু হলো এই ‘কোড’। এই কোড নম্বার বিশ্বের যে কোন ব্যাংকের ‘অটো উইথড্রয়াল’ স্লিপে লিখে তাতে টাকার যে অংক লেখা হবে, ব্যাংক তা দিয়ে দিবে। বিশ্বের প্রত্যেক ব্যাংকের প্রত্যেক শাখার কম্পিউটার তার ইন্টার ন্যাশনাল ফাইলে এই কোড নম্বার সংরক্ষণ করে।
‘কোড কার্ডটা হাতে নিয়ে আহমদ মুসা কিছুক্ষণ স্তদ্ধ হয়ে থাকল। তারপর মাথা তুলে সম্রাজ্ঞী ক্যাথারিনের দিকে চেয়ে বলল, ‘একজন ব্যাক্তির জন্যে এই পুরস্কার বেশি হয়ে গেছে সম্রাজ্ঞী।’
‘না হয়নি। আমার জায়গায় তাতিয়ানা হলে আরও কি করতো আমি বুঝতে পারছি না।’ অপ্রতিরুদ্ধ এক আবেগে রুদ্ধ হয়ে গেল ক্যাথারিনের গলা। তার দু’চোখে থেকে নেমে এল দু’ফোটাআ অশ্রু।
আহমদ মুসা ও ডোনা জোসেফাইন এই অবস্থায় বিব্রত হয়ে পড়ল।
বলল আহমদ মুসা ধীরে ধীরে, ‘করার মত কিছুই আপনি বাকী রাখেননি সম্রাজ্ঞী। আমাদের সবচেয়ে বড় পাওয়া হলো, আপনি অপ্রকাশিত ঘোষণায় যা আমাদের জানিয়েছেন। তাতিয়ানার বিদেহী আত্মা সবচেয়ে খুশি হবে একথা জেনেই।
সম্রাজ্ঞী ক্যাথারিন রুমাল দিয়ে চোখ মুছে বলল, ‘আমি ও তাতিয়ানা যদিও ছিলাম এক মনের, এক চিন্তার। কিন্তু তার স্থান আমাকে দিয়ে পূরণ হবার নয়। একই সাথে তার মন ছিল কুসুমের মত কোমল, পাহাড়ের মত অনড় এবং আকাশের মত উদার। সেই তাতিয়ানা নেই, কিন্তু তার প্রিয়তম ব্যাক্তি আছেন। তাঁর জন্যে যা কিছু করি, তাকে আমার যথেষ্ট মনে হয় না।’
আহমদ মুসা লজ্জা-সংকোচে লাল হয়ে উঠেছে। বলল একটু সময় নিয়ে, ‘লজ্জা দেবেন না সম্রাজ্ঞী। আপনি যা করেছেন। অন্য কোন রুশ সম্রাজ্ঞীর কাছে তার একাংশও প্রাপ্য ছিল না। আপনি একান্ত আপনজন বলেই আমরা এবং আমাদের জাতি এসব পেয়েছে। আর আপনজন সব সময় পোশাকি প্রশংসার উর্ধ্বে।’
‘ধন্যবাদ। সিংহাসনের চেয়েও এটাআমার কাছে বড় পাওয়া।’
বলেই উঠে দাঁড়াল সম্রাজ্ঞী ক্যাথারিন। বলল, ‘চলুন আমরা নাস্তা করব।’
আহমদ মুসা ও ডোনা জোসেফাইন উঠে দাঁড়াল।

মস্কো ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট। সৌদি জাম্বুজেট টারমাকে দাঁড়িয়ে।
আহমদ মুসার গাড়ি রয়্যাল ওয়েটিং হাউজের গেটে গিয়ে দাঁড়াল।
প্রায় সংগে সংগে আরেকটা গাড়ি এসে আহমদ মুসার গাড়ির পেছনে দাঁড়াল।
দুই গাড়ি থেকে প্রায় এক সাথেই নেমে এল চারজন আরোহী।
প্রথম গাড়ি থেকে নামল আহমদ মুসা ও ডোনা জোসেফাইন এবং দ্বিতীয় গাড়ি থেকে নামল ডোনার আব্বা প্লাতিনি লুই এবং ডোনার নতুন মা ডঃ নাতালোভা।
রয়্যাল ওয়েটিং হাউসের গেটে সম্রাজ্ঞী ক্যাথারিনের ব্যাক্তিগত প্রতিনিধি হিসেবে দাঁড়িয়েছিল স্বয়ং সম্রাজ্ঞীর মা গ্রান্ড ডমেস লিওনিদা জিভনা।
রয়্যাল ওয়েটিং হাউজের দিকে প্রথমে এগুলো আহমদ মুসা। তার পেছনে ডোনা এবং তারপর ডোনার আব্বা-আম্মা।
গেটে আহমদ মুসা পৌছতেই লিওনিদা জিভনা সম্রাজ্ঞীর পক্ষে স্বাগত জানাল আহমদ মুসাকে।
‘সম্রাজ্ঞীর প্রতি আমি কৃতজ্ঞ। কিন্তু একটা সামান্য ফরমালিটির জন্যে মহামান্যা গ্রান্ড ডমেসকে কষ্ট দেয়ায় আমি দুঃখিত।’ বলল আহমদ মুসা বিনয়ের সাথে।
লিওনিদা জিভনা আহমদ মুসার পিঠ চাপড়ে সামনে এগিয়ে নিয়ে বলল, ‘ছোট ফরমালিটি কোথায় দেখলে বৎস। একদিকে তোমার হৃদয়, অন্যদিকে রুশ সাম্রাজ্যকে রাখলে তোমার হৃদয়ের ওজনই বেশি হবে।’
‘এটা একান্তই আপনার স্নেহের কথা।’
‘এত বড় স্নেহটা তোমাকে আদায় করতে হয়েছে এবং তা তোমার ঐ হৃদয় দিয়েই।’
‘মাতৃস্নেহের কাছে সন্তানের হৃদয়টা এমনই হয়। কিন্তু আমার যা কিছু ভালো তা ইসলামের শিক্ষারই ফল।’
‘শুধু সম্রাজ্ঞী নয়, আমাকেও তা তুমি উপলদ্ধি করিয়ে ছেড়েছ বৎস।’
কথা শেষ করে ডোনা জোসেফাইনের দিকে তাকিয়ে তার পিঠ চাপড়ে বলল, ‘ওয়েলকাম গ্রেট লেডি। তোমার সৌভাগ্যের চেয়ে তোমার দায়িত্ব কিন্তু অনেক বড়।’
‘আশীর্বাদ করুন।’
‘আশীর্বাদ করা ছেড়ে দিয়েছি, এবার দোয়া করব।’
‘আলহামদুলিল্লাহ।’ বলল ডোনা জোসেফাইন।
যাত্রীরা প্রায় বিমানে উঠে গেছে।
সৌদি বিমানের স্বয়ং ক্যাপ্টেন অল্প দূরে আহমদ মুসাকে স্বাগত জানিয়ে নিয়ে যাবার জন্যে অপেক্ষা করছে।
ডোনার সাথে তার আব্বার বিদায়ের দৃশ্যটা খুব করুণ হলো। বাপ-মেয়ে দু’জনেই অঝোরে কাঁদল।
ডোনা তার নতুন মা ডঃ নাতালোভাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে বলল, ‘আজই প্রথম আব্বাকে ছেড়ে কোথাও যাচ্ছি। কষ্টের মধ্যেও আমার আনন্দ এই যে, আমি আমার মা’র কাছে আব্বাকে রেখে যাচ্ছি। বোন ওলগা তো থাকলই।’
ডঃ নাতালোভা ডোনা জোসেফাইনকে অজস্র চুমু খেয়ে বলল, ‘মা হবার মত সুযোগ তো দিলে না তুমি।’
‘প্রথম দেখাতেই মা করে নিয়েছি আপনাকে।’
প্লাতিনি লুই জড়িয়ে ধরেছিল আহমদ মুসাকে। বলেছিল, ‘এ কান্না আমার আনন্দের। তোমার হাতে আমার হৃদয়ের টুকরোকে তুলে দিতে পারলাম কত পূণ্যের ফলে তা আল্লাহই জানেন।’
আহমদ মুসা ডঃ নাতালোভার কাছে বিদায় নিয়ে বলল, ‘শেষ পর্যন্ত ওলগা ও আসিফ আজিম-এর সাথে সাক্ষাৎ হলো না। নিশ্চয় জরুরী কিছুতে আটকা পড়েছে ওরা।’
বলে আহমদ মুসা ডোনা জোসেফাইনকে নিয়ে গ্যাংওয়ের দিকে এগুলো।
গ্যাংওয়ের মুখে দাঁড়িয়ে ছিল সম্রাজ্ঞীর প্রতিনিধি হিসেবে সম্রাজ্ঞীর মাতা লিওনিদা জিভনা।
লিওনিদা জিভনা আহমদ মুসার হাতে একটা রাজকীয় সিলমোহর যুক্ত ইনভলপ তুলে দিয়ে বলল, ‘আহমদ মুসার জন্যে সম্রাজ্ঞীর একটি চিঠি।’ তারপর আহমদ মুসাকে সম্রাজ্ঞীর পক্ষ থেকে রাশিয়া সফরের জন্যে ধন্যবাদ জানিয়ে এবং পুনরায় সত্তর রাশিয়া সফরে আসার আমন্ত্রণ জানিয়ে হেসে বলল, ‘নতুন মা পেয়ে পুরনো এক মাকে যেন ভুলে যেওনা বাছা।’
‘মা যত পুরানো হন, ততই তার মূল্য বাড়ে।’ বলে হাসতে হাসতে গ্যাংওয়েতে প্রবেশ করল আহমদ মুসা। তার সাথে সাথে ডোনা জোসেফাইন।
সৌদিয়ার ক্যাপ্টেন স্বাগত জানিয়ে সাথে নিয়ে গিয়ে বিমানের দুটি বিশেষ নির্ধারিত আহনে তাদের বসিয়ে বলল, ‘এ বিমান আপনার। আপনার কোন সেবায় লাগতে পারলে আমরা ধন্য হবো।
বলে আহমদ মুসার হাতে এক টুকরো কাজ তুলে দিয়ে বলল, ‘খাদেমুল হারমাইন শরীফাইনের মহামান্য বাদশার মেসেজ।’
সৌদি বাদশার ইন্টারনেট মেসেজ পড়ল আহমদ মুসা, ‘আমাদের মহান ভাই আহমদ মুসা এবং তার স্ত্রী সম্মানিতা বোন মারিয়া জোসেফাইনকে সৌদি আরবে খোশ আমদেদ জানাচ্ছি।’
পড়ে ইন্টারনেট মেসেজটি আহমদ মুসা ডোনার হাতে তুলে দিয়ে ক্যাপ্টেনকে ধন্যবাদ জানাল।
সিটে বসে সব ঠিকঠাক করে নেবার পর ডোনা জোসেফাইন আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে বলল, ‘সম্রাজ্ঞী ক্যাথারিনের ইনভেলপটি বোধহয় এবার খোলা যায়।’
‘ধন্যবাদ মনে করিয়ে দেবার জন্যে।’ বলে আহমদ মুসা ইনভেলপটি খুলে ফেলল।
ভেতর থেকে বেরুল একটি চিঠি। রাজকীয় প্যাডে লেখা সম্রাজ্ঞীর একটা চিঠি। চিঠিতে সম্রাজ্ঞী ক্যাথারিন লিখেছেন:
“মহান ভাই আহমদ মুসাকে রুশ সম্রাজ্ঞী তৃতীয় ক্যাথারিনের পক্ষ হতে, আমি যে কালেমায়ে তাইয়েবার সাক্ষ্য পাঠ করে ইসলাম গ্রহণ করেছি, তার সাক্ষ্য আল্লাহ ছাড়া দুনিয়াতে আর কেউ নেই। কিন্তু অন্তত একজন সাক্ষীর হাতে এমন একটা দলিল থাকা দরকার মনে করছি যাতে তিনি দুনিয়াবাসীর কাছে সাক্ষ্য দিতে পারেন, রুশ সম্রাজ্ঞী ক্যাথারিন মুসলিম ছিল, কাফের ছিল না। এই লক্ষ্যে আমি রুশ সম্রাজ্ঞী ক্যাথারিন আমাদের মহান ভাই আহমদ মুসাকে জানাচ্ছি যে, আল্লাহকে একমাত্র ‘ইলাহ’ এবং মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ (সঃ) কে শেষ রাসূল ঘোষণা করে পূর্ণভাবে আমি ইসলামে দাখিল হয়েছি।
আমার প্রকাশ্যে ঘোষণা দেয়ার অপরাগতাকে আল্লাহ সম্রাট নাজ্জাশির
ক্ষেত্রে যেভাবে মাফ করেছিলেন, সেভাবে মাফ করুন। আমীন!”
চিঠি শেষ সম্রাজ্ঞী ক্যাথারীনের দস্তখত এবং রাজকিয় সীল।
চিঠি পড়তে গিয়ে চোখ দিয়ে অশ্রু গড়ল আহমদ মুসার।
ডোনা জোসেফাইনও চিঠিটি পড়ল। বলল, ‘সেদিন পরোক্ষভাবে যে কথা তিনি বলেছিলেন, আজ কাগজে-কলমে তা জগতবাসীকে জানানোর ব্যাবস্থা রাখলেন তিনি। খোশ আমদেদ আমাদের মহান বোনকে।’ ডোনা জোসেফাইনের কণ্ঠও ভারী হয়ে উঠেছে আবেগে।
‘আলহামদুলিল্লাহ। আল্লাহ এই ভাবেই তাঁর সত্য দ্বীনকে দুনিয়ায় এগিয়ে নেবেন। তুমি নিশ্চয় জানতে পেরেছ ডোনা, ওলগার মামা ডেপুটি প্রধানমন্ত্রী ইউরি অরলভও গোপনে ইসলাম গ্রহণ করেছেন আগেই।’
‘হ্যাঁ, ওলগা আমাকে বলেছে।’
আহমদ মুসা এরপর কথা বলল না। একটু ভাবল। তারপর বলল, ‘রাশিয়ার রাজনৈতিক নেতৃত্ব পেছন দিকে ফিরে তাকিয়ে জাতির স্বার্থে জাতির ঐক্য ও অভিভাবকত্বের একটা কেন্দ্র খুঁজে নিয়েছে। আমাদের মুসলিম রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও ষড়যন্ত্রমূলকভাবে বিলুপ্ত, গণতান্ত্রিক খিলাফত ব্যবস্থাকে আবার ফিরিয়ে আনতে হবে। ইসলামী বিশ্বের ঐক্য ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্যে এর আর কোন বিকল্প নেই।’
তখন বিমানের দরজা বন্ধ গিয়েছিল। সিট বেল্ট বাঁধারও ঘোষণা দেয়া হয়ে গেছে।
আহমদ মুসা তার কথা শেষ করেই সিট বেল্ট বাঁধতে যাচ্ছিল।
হঠাৎ বিমানের দরজা আবার খুলে গেল।
খোলা দরজা দিয়ে দ্রুত প্রবেশ করল ওলগা এবং তার স্বামী আসিফ আজিম।
ওলগার গায়ের গাউন পা পর্যন্ত নামানো। তার মাথায় ওড়না কপাল ঢেকে চোখের প্রান্ত পর্যন্ত নেমে এসেছে।
ওলগা ও আসিফ দু’জনেই এসে সালাম জানাল আহমদ মুসা ও ডোনা জোসেফাইনকে।
ডোনা জোসেফাইন উঠে জড়িয়ে ধরেছে ওলগাকে। তারপর বলল, ‘কষ্ট হচ্ছিল এই ভেবে যে, ‘আমার নতুন বোনটার সাথে শেষ দেখা বোধহয় হলো….’
ওলগা ডোনা জোসেফাইনের ঠোঁটের উপর আঙুল চাপা দিয়ে বলল, ‘শেষ দেখা’ শব্দ বলতে পারবেনা, আরও অজস্রবার দেখা হবে।’
ডোনা জোসেফাইন হেসে বলল, ‘অবশ্যই।’
ওদিকে আহমদ মুসা আসিফ আজিমকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘মহামান্য
ভাই, না আসার চেয়ে এই দেরীতে আসাটা অবশ্যই শ্রেয়তর।’
লজ্জিত মুখে আসিফ আজিম আহমদ মুসার হাতে বড় একটি ফ্যাক্স মেসেজ গুঁজে দিয়ে বলল, ‘আপনার এই জরুরী ফ্যাক্সটি এসেছিল ওলগাদের বাসার ফ্যাক্সে। খবর পেয়ে ওটা আনতে গিয়েই দেরী হয়েছে ভাইয়া।’
আহমদ মুসা তার পিঠ চাপড়ে দিয়ে বলল, ‘ঠিক আছে, তোমরা ঠিক করেছ।’
বলে আহমদ মুসা ফ্যাক্স-মেসেজের দিকে মনোযোগ দিল। পড়লো: “আল্লাহর সৈনিক মুহতারাম আহমদ মুসা”,
“আমি টার্কস দ্বীপপুঞ্জের অতি সামান্য একজন বালিকা। গ্রান্ড টার্কস দ্বীপে চার্লস বিশ্ব বিদ্যালয়ের এডভান্সড স্কুল অবইকনমিককস-এর একজন ছাত্রী আমি। নাম লায়লা জেনিফার। একটি সমীক্ষা ও কিছু ঘটনা আমাদের ক’জনকে ভয়ানক উদ্বিগ্ন করেছে। এই উদ্বেগ থেকেই এই চিঠি লেখা। আমরা ক’জন ছাত্র জনসংখ্যার একটা ডেমোগ্রাফিক সমীক্ষা করতে গিয়ে একটা চাঞ্চল্যকর তথ্য পেয়ে যাই। গত ৬ বছরে জনসংখ্যার বিশেষ শ্রেণী মুসলমানদের পুরুষ জনসংখ্যা গড়ে ১৪ শতাংশ হারে হ্রাস পেয়েছে। পুরুষ জনসংখ্যা হ্রাসের ক্রমবর্ধমান চিত্র খুবই উদ্বেগজনক। ৬ বছরের প্রথম বছর শতকরা ৫, দ্বিতীয় বছর শতকরা ৮, তৃতীয় বছর ১১, চতুর্থ বছর ১৫, পঞ্চম বছর ২০ এবং ষষ্ঠ বছর ২৫ শতাংশ হারে পুরুষ জনসংখ্যা হ্রাস পেয়েছে। এই চাঞ্চল্যকর তথ্য আমরা আমাদের গবেষণা সংস্থার তরফ থেকে খবরের কাগজে দিয়েছিলাম। খবরটি ছাপা হয়নি। যে সাংবাদিক খবরটি আমাদের কাছ থেকে সংগ্রহ করেছিল, সে সেই রাতেই নিহত হয়। পরবর্তীতে গবেষণাটির ফিল্ড ওয়ার্কের সাথে জড়িত ৪জন ছাত্রই নিহত হয়েছে। সকল কাগজ-পত্রসহ আমাদের গবেষণা সংস্থাটির অফিস এক রাতে প্রচন্ড বিষ্ফোরণে ধ্বংস হয়ে গেছে।গবেষণার সাথে জড়িত পঞ্চম ব্যক্তি আমি এখনও বেঁচে আছি সম্ভবত এই কারণে যে আমি ফিল্ড ওয়ার্কে ছিলাম না, আমার দায়িত্ব ছিল ডাটা এ্যানালিসিস। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে যাই না। গ্রান্ড টার্কস দ্বীপ থেকেও আমি সরে এসেছি। লুকিয়ে বাস করছি অন্য একটি দ্বীপে। জানিনা ক’দিন বেঁচে থাকব। পরিস্থিতির আরও একটা উদ্বেগজনক দিক হলো, টার্কস দ্বীপপুঞ্জের পর আমরা পাশ্ববর্তী ককজ দ্বীপপুঞ্জ ও বাহামা দ্বীপপুঞ্জে সমীক্ষা শুরু করেছিলাম। শেষ করতে পারিনি। যতুটুকু করা গেছে তাতে সেখানেও কম বেশি একই চিত্র দেখা গেছে। হত্যাকান্ডের পর পুলিশের কাছে কেস দেয়া হয়েছিল। কিন্তু দুর্বোধ্য কারণে তদন্তেই যায়নি। বিশ্বের বড় বড় ঘটনার ভীড়ে এই ছোট ঘটনা আপনার দৃষ্টি আকর্ষণের মত নয়। তবু আপনাকে জানালাম। দুনিয়ার কাকে জানাতে পারি, চিন্তা করতে গিয়ে আপনার কথাই প্রথম মনে পড়ল। আপনার ঠিকানা জানিনা। রাবেতায়ে আলম আল ইসলামীর কাছে পাঠালাম। জানিনা আপনার কাছে পৌছবে কিনা। আমাদের টার্কস দ্বীপপুঞ্জের অস্তিত্ব বিশ্বের মানচিত্র খুঁজলে পাওয়া যায় না। আমেরিকার মানচিত্রও নয়। মধ্য আমেরিকার মানচিত্র একে দেখা যায় বাহামার পূর্ব-দক্ষিণে, ডোমিনিকান প্রজাতন্ত্র ও হাইতির উত্তর-পশ্চিমে এবং কিউবার উত্তর-পূর্ব আটলান্টিকের অথৈ পানিতে বিন্দুর চেয়েও ক্ষুদ্রাকার। ক্ষুদ্র দেশের আমরা কিছু মুসলিম এতই নগণ্য যে একমাত্র আল্লাহ ছাড়া কারও দৃষ্টি আমাদের দিকে পড়ে না।”
পড়া শেষে ফ্যাক্স মেসেজটি আহমদ মুসা তুলে দিল ডোনা জোসেফাইনের হাতে।
পড়তে গিয়ে উদ্বেগে ভরে গিয়েছিল আহমদ মুসার মন। চিঠির শেষ কয়টি লাইন পড়ে আহমদ মুসার দু’চোখ ভিজে উঠেছিল অশ্রুতে। তার চোখের সামনে ভেসে উঠল ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জের বহিরংগে আটলান্টিকের বুকে ভাসমান টার্কস দ্বীপপুঞ্জের দৃশ্য। আটলান্টিকের পানির উপর দাঁড়ানো মৌরতানিয়ার ‘নওয়াবিধু’ থেকে যদি আটলান্টিকের উপর দিয়ে সোজা একটা সরল রেখা টানা যায়, তাহলে সেই সরল রেখা টার্কস দ্বীপপুঞ্জের উপর দিয়ে অগ্রসর হয়ে কিউবার ‘কানাগুয়ে’ শহর ছেদ করবে। আহমদ মুসা আমেরিকা বিশেষ করে ল্যাটিন আমেরিকার মুসলমানদের নিয়ে ভেবেছে, কিন্তু টার্কস দ্বীপের মুসলমানদের কথা কোনদিন তার চিন্তাতেও আসেনি। সুতরাং লায়লা জেনিফারের অভিমান অসংগত নয়।
আহমদ মুসা তাকাল আসিফ আজিমভের দিকে। বলল, ‘লায়লা জেনিফারের ফ্যাক্সটা তার বিশ্ববিদ্যালয়ের ফ্যাক্স থেকে এসেছে। লায়লা জেনিফারের নামে এ্যাটেনশন লিখে একটা ফ্যাক্স করে দাও। লিখবে, প্রাপক তার ফ্যাক্স পেয়েছেন। তিনি প্রথম সুযোগেই টার্কস দ্বীপপুঞ্জ সফরে আসবেন।’
ডোনারও মেসেজটি পড়া শেষ হয়েছিল। সেও মুখ তুলেছে। শুনল আহমদ মুসার কথা।
আহমদ মুসার নির্দেশ পাবার পর আসিফ আজিম এবং ওলগা আহমদ মুসা ও ডোনা জোসেফাইনের কাছে বিদায় নিয়ে বের হয়ে গেল বিমান থেকে।
যাবার সময় ওলগার দু’চোখে অশ্রু টল টল করছিল।
ওরা চলে গেলে একটু পর ডোনা জোসেফাইন বলল, ‘পড়েই আমার লোভ লেগেছে ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জের ঐ অঞ্চলে যাবার। আমার মনে হচ্ছে, আকাশের অনন্ত নীলের নিচে অথৈ নীল পানিতে ভাসমান অসম্ভব এক সপ্নের দেশ ওটা।
‘আমিই বেশি খুশী হতাম তোমাকে নিতে পারলে। কিন্তু…।’
‘কিন্তু কি? মুখ ম্লান করে বলল ডোনা জোসেফাইন।
‘মদীনায় তোমাকে বিশ্রামে থাকতে হবে।’
‘কেন?’
‘এ সময় মেয়েদের ঝুঁকিপূর্ণ বেড়ানো চলে না। দু’মাস হয়ে গেছে। আর মাত্র আট মাস।’
লজ্জায় লাল হয়ে উঠল ডোনা জোসেফাইনের মুখ। সিটের হাতলে রাখা আহমদ মুসার হাতে ছোট একটা কিল দিয়ে মুখ নিচু করল সে।
‘তোমার আব্বা মিঃ প্লাতিনি, আম্মা ডঃ নাতালোভা এবং ওলগা তিনজনই আসছেন মদীনায় দীর্ঘ ছুটিতে। আনন্দেই তোমার সময় কাটবে। কেমন রাজী তো?’
‘কেন আসবেন ওরা? আমি তো জানি না।’
‘তোমার পরিচর্যার বুঝি দরকার নেই?’
‘বলেছ বুঝি সব তুমি ওঁদের? লজ্জায় মুখ লাল করে বলল ডোনা জোসেফাইন।
‘এ খবর বুঝি কেউ লুকায়?’
‘ও আল্লাহ, ছেলেদের একটুও লজ্জা নেই।’
বলে দু’হাতে মুখ ঢাকল ডোনা।
আহমদ মুসার মাথায় তখন অন্য চিন্তা। সে ভেবেছিল, ক’মাস সে মদীনায় কাটাবে। এ সময় ডোনার কাছে থাকাও দরকার। কিন্তু তা হলো না একদিনও সে আর শুয়ে বসে কাটাতে পারে না। সময় নষ্ট করতে পারে না সে কিছুতেই।
সে ঠিক করল, মদীনা শরীফ গিয়েই সে বুকিং দেবে ওয়াশিংটনের। সেখানে গিয়ে খোঁজ-খবর নিয়ে রুট ঠিক করে সে যাবে টার্কস দ্বীপপুঞ্জে। হাতের উপর ডোনার হাতের স্পর্শে সম্বিত ফিরে পেল আহমদ মুসা। তাকাল। দেখল, ডোনা নিস্পলক তাকিয়ে আছে তার দিকে। ডোনার চোখে এবার লজ্জা নেই। আছে স্ত্রীর নিঃসীম মমতা মাখানো স্নিগ্ধ দৃষ্টি। তাতে আছে দুর্ভাবনার একটা কালো ছায়া। আহমদ মুসাও তার দিক থেকে চোখ ফিরাতে পারলো না। ‘তুমি কি মন খারাপ করছ?’ ধীরে ধীরে বলল আহমদ মুসা ডোনা জোসেফাইনের হাত মুটোর মধ্যে নিয়ে। ডোনা মুখে কিছু বলল না। ‘না’ সূচক মাথা নাড়ল। শুকনো ঠোঁটে এক টুকরো হাসি টানার চেষ্টা করলো। কিন্তু তার সে হাসির সাথেই তার চোখ থেকে নেমে এল দু’ফোটা অশ্রু।

Top