২৫. আটলান্টিকের ওপারে

চ্যাপ্টার

চোখ খুলল আহমদ মুসা। চোখ খোলার পর তার চোখ ঘরের তিন দিকে ঘুরে এল। হাসপাতালের সুসজ্জিত একটা কক্ষ।
দরজার পর্দায় সুন্দর করে লেখা, ‘কুইন এলিজাবেথ হাসপাতাল।’
মাথায় হাত না দিয়েই বুঝল, গোটা মাথায় তার ব্যান্ডেজ। মাথা ভারি এবং বেদনা।
মাথা বাঁদিকে একটু ঘুরাতেই আহমদ মুসা ডাঃ মারিয়া মার্গারেটকে দেখতে পেল।
ডাঃ মার্গারেট এল আহমদ মুসার সামনে।
‘গুড ইভনিং ডাক্তার।’
‘ওয়েলকাম আহমদ আবদুল্লাহ।’বলে একটু ভাবল ডাঃ মার্গারেট। তারপর বলল, ‘গুড ইভনিং বললবেন কেন, কি করে বুঝলেন যে এখন বিকেল?’
‘টেবিলের ফুলদানিতে তাজা ফুল দেখে। সাধারণত হাসপাতালের কক্ষগুলোতে বিকেলে ফুল সরবরাহ করা হয়।’
‘স্থান বিশেষে নিয়ম তো আলাদাও হতে পারে।’
‘হাসপাতালের সকালটা খুব ব্যস্ত সময়। এ সময় হাসপাতালে ফুল সরবরাহের পরিবেশ থাকে না। তবে আরও কিছু কারণ আছে।’
ডাঃ মার্গারেট কিছুটা অবাক হলো। বলতে গেলে বেশির ভাগ সময় হাসপাতালে কাটে, কিন্তু সেতো এ বিষয়টা এতদিন লক্ষ্য করেনি! বলল, ‘সে কারণগুলো কি?’
আহমদ মুসার ঠোঁটে ঈষৎ হাসি। বলল, ‘প্রথমত, আমার ক্ষুধা। মনে হচ্ছে, খাওয়ার পর অন্তত পাঁচ ছয় ঘন্টা পার হয়েছে। দ্বিতীয়ত, আপনার ক্লান্তি। দীর্ঘ সময় আপনি ডিউটিতে আছেন। কিন্তু আপনার চোখে-মুখে রাত জাগার চাপ নেই।’
ডাঃ মার্গারেটের চোখে-মুখে ফুটে উঠল বিস্ময়। বলল, ‘সামান্য কয়েক মুহূর্তে আপনি এত জিনিস খেয়াল করেছেন! এত সুক্ষ্ণ বিষয় আপনার চোখে পড়ে! আপনার পরিচয় কি? পেশা কি?’
‘আমার পাসপোর্টে কিছু তো পেয়েছেন?’
‘আপনার পাসপোর্ট আমি দেখেছি কি করে বুঝলেন?’ডাঃ মার্গারেটের কণ্ঠে আবারও বিস্ময়।
‘পাসপোর্টে লেখা আমার পূর্ণ নাম আপনার মুখে শুনেছি।’
ডাঃ মার্গারেট টেবিলের পাশের চেয়ারটিতে ধপ করে বসে পড়ল।
তার চোখে মুখে প্রবল উৎসুক্য। বলল, ‘বলুন তো আপনার পকেট থেকে কিছু খোয়া গেছে কিনা?’
‘না খোয়া যায়নি।’
‘কি করে নিশ্চিত হলেন আপনি এতটা?’
‘আপনার প্রশ্ন থেকে?’
‘আমার প্রশ্ন থেকে?’বিস্ময়ে চোখ কপালে তুলে বলল ডাঃ মার্গারেট।
‘হ্যাঁ।আপনার প্রশ্ন থেকে বুঝা যাচ্ছে, খোয়া যাওয়ার মত কিছু আমার পকেটে ছিল যা আপনি দেখেছেন। যখন দেখেছেন, তখন তা খোয়া যাওয়ার কথা নয়।’
এবার ডাঃ মার্গারেটের চোখে বিস্ময় বিমুগ্ধ দৃষ্টি। বলল, ‘আপনি শার্লক হোমস-এর মত কোন গোয়েন্দা নাকি? এমন সুক্ষ্ণ বিশ্লেষণ সাধারণ মাথার কাজ নয়।’
আহমদ মুসার জন্যে খাবার এল। সবজির স্যুপ। এক গ্লাস দুধ। ‘সবজির স্যুপে প্রাণীজ কোন চর্বি নেই তো?’এ্যাটেনডেন্টের দিকে চেয়ে বলল আহমদ মুসা।
এ্যাটেনডেন্ট কিছু বলার আগেই ডাঃ মার্গারেট বলল, ‘ভেজিটেবল ওয়েল আছে, প্রাণীজ চর্বি কোন ভেজিটেবল স্যুপে দেয়া হয় না।’
‘শুকরসহ কিছু প্রাণী আছে, সেগুলো ছাড়া সব কিছুই খাই।
আমাদের ধর্মে এগুলো খাওয়া নিষিদ্ধ।’বলল আহমদ মুসা।
‘বুঝেছি। আচ্ছা বলুন তো, এই নিষিদ্ধ হওয়ার ব্যাপারটা কি ধর্ম প্রবর্তকদের লোকাল কালচার থেকে এসেছে?’
‘দু’একটা এমন ঘটা বিচিত্র নয়, তবে ইসলামে নিষিদ্ধ হওয়ার ব্যাপারটা সেই প্রাণীর ধরণ ও গুণাগুণের সাথে সংশ্লিষ্ট। হিংস্র ও জঘন্য চরিত্রের প্রাণীকে খাদ্য হিসেবে ব্যবহার ইসলামে নিষিদ্ধ হয়েছে।’
‘শুকর নিষিদ্ধ হওয়ার পেছনেও কি একই কারণ?’
‘আমার মনে হয় তাই।’
‘প্রাণীর গোশতের গুনাগুণ একটা যুক্তিসংগত বিবেচ্য বিষয়। কিন্তু প্রাণীর হিংস্রতা ও চরিত্র কি করে নিষিদ্ধের কারণ হতে পারে?’
‘যা খাওয়া হয়, তার বস্তুগত দিকের মত তার জেনেটিক প্রভাবও পড়ে কিনা তা আপনারা ডাক্তাররাই ভাল বলতে পারেন।’
ডাঃ মার্গারেট হাসল। বলল, ‘খাদ্যের উদ্দ্যেশ্যই তো খাদ্য থেকে তার গুণাগুণ আহরণ করা।’
বলে একটু থেমেই আবার বলল, ‘জেনেটিক লাইনও দেখেছি আপনার নজরের বাইরে নয়। আসলে আপনি কে বলুন তো?’
আহমদ মুসা কিছু বলার জন্যে মুখ খুলেছিল। এ সময় কক্ষে প্রবেশ করল জর্জ জেফারসন।
ডাঃ মার্গারেট জর্জের দিকে তাকিয়ে’এস জর্জ’বলে আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে বলল, ‘এ আমার ছোট ভাই জর্জ জেফারসন। চার্লস বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। এই আপনাকে সংজ্ঞাহীন অবস্থায় হাসপাতালে নিয়ে এসেছে। জর্জই এখন আপনার’লোকাল গার্ডিয়ান’। তার কাছেই আপনার পাসপোর্ট, মানিব্যাগ ও ব্যাগেজ রয়েছে।’ হাসি মুখে কথা শেষ করল ডাঃ মার্গারেট।
শুয়ে থেকেই আহমদ মুসা হাত বাড়িয়ে দিল হ্যান্ডশেক-এর জন্যে।
জর্জ এগিয়ে এসে হ্যান্ডশেক করল। বলল, ‘কেমন বোধ করছেন এখন?’
‘ডাক্তার কাছে না থাকলে উঠে বসেই হ্যান্ডশেক করতাম। মাথা কিছুটা ভারি এবং কিছু বেদনা ছাড়া আর কোন অসুবিধা নেই।’
বলে একটু থামল। তারপর জর্জকে লক্ষ্য করে বলল, ‘আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। একটা বিষয় জিজ্ঞেস করতে চাচ্ছি।’
‘ওয়েলকাম। বলুন।’
‘যারা আমাকে আহত করল, তারা আমার সংজ্ঞাহীন দেহ নিয়ে যাবার চেষ্টা করেনি?’
‘না। তবে যাওয়ার সময় তারা বলেছে যে, এতে শিক্ষা না হলে পরে প্রাণটাও যাবে।’
আঁতকে উঠল ডাঃ মার্গারেট। বলল, ‘মিঃ আহমদ আবদুল্লাহ, ওদের আপনি কি করছেন? ওরা আপনার শত্রু কেন?’
‘আমি জানি না। ওদের সাথে আমার কোন ঘটনা ঘটেনি। কখনও কোন কথাও হয়নি ওদের সাথে আমার।’
‘হঠাৎ ওরা আপনাকে আক্রমণ করল কেন? ওরা যদি ছিনতাইকারী হতো, তাহলে ওরা আপনার মানিব্যাগ, হ্যান্ডব্যাগ রেখে যেত না।’ বলল জর্জ।
‘ঠিক বলেছ। ওঁদের শেষ যে কথা তুমি শুনেছ, তাতে প্রমাণ হয়, ওরা কোন বিশেষ কারণে আমার শত্রু এবং তারা চায় আমি তাদের পথ থেকে সরে দাঁড়াই।’
মুহূর্তের জন্যে থামল আহমদ মুসা। তারপর আবার শুরু করল, ‘ওদের একজনকে আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা বিভাগের পাবলিক রিলেশন্স অফিসার সুরাইয়া মাকোনির অফিসে বসে থাকতে দেখেছি, যখন আমি সেখানে গিয়েছিলাম। আমি যখন মিস মাকোনির সাথে কথা বলে বেরিয়ে আসি, তখন সে আমার পিছু পিছু আসে। আমি তাকে কোনই সন্দেহ করিনি। কিন্তু হঠাৎ সে পেছন থেকে এসে আমার পিঠে পিস্তল ঠেকিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐ গেটের দিকে নিয়ে আসে।’ থামল আহমদ মুসা।
‘কিছু বলেনি সে আপনাকে এ সময়?’বলল জর্জ।
‘কিছুই বলেনি।’
‘তারপর বলুন।’
আহমদ মুসা তার সংজ্ঞাহীন হওয়া পর্যন্ত সব ঘটনা বর্ণনা করল।
গোগ্রাসে খাওয়ার মত কথাগুলো গিলল দু’জনে।
আহমদ মুসা থামতেই ডাঃ মার্গারেট বলল, ‘পেছন থেকে চুপি চুপি এসে ঐ লোকটি মাথায় আঘাত না করলে তো আপনি দু’জনকেই কুপোকাত করে জিতেই গিয়েছিলেন।’
‘আপনার কি ধারণা, আপনাকে ওরা পিস্তল বাগিয়ে গেট পর্যন্ত নিয়ে এল, কিন্তু আপনি সংজ্ঞাহীন হবার পর আপনাকে নিয়ে গেল না কেন?’
ডাঃ , মার্গারেট থামতেই কথা বলে উঠল জর্জ।
‘আমার ধারণা, ওরা আনাকে ভয় দেখানোর জন্যে নির্যাতন করতে চেয়েছিল, ধরে নিয়ে যেতে চায়নি।’বলল আহমদ মুসা।’
‘আপনি মাকোনির কাছে কেন গিয়েছিলেন, কি আলাপ করেছিলেন মাকোনির সাথে?’
আহমদ মুসা সংগে সংগে উত্তর দিল না। ভাবল সে, জেনিফারের
নাম এখানে বলবে কিনা। আহমদ মুসা নিশ্চিত, জেনিফারের খোঁজ করার সাথে সাথে তার উপর ঐ আক্রমণের যোগ আছে। নিশ্চয় ঐ লোকেরা সেই খুনি গ্রুপ হবে, যারা জেনিফারের সাথীদের খুন করেছে এবং জেনিফারকেও খুঁজে বেড়াচ্ছে। নিশ্চয় ওরা আহমদ মুসাকে জেনিফারের কোন বিদেশী সাহায্যকারী মনে করেছিল, অথবা ভয় করেছিল যে, আহমদ মুসার মত বিদেশীর মাধ্যমে তাদের সব কথা জেনিফার বিদেশে পাচার করতে চাচ্ছে। এটা যাতে না হয় এজন্যে তারা ভয় দেখিয়ে তাদের পথ থেকে আহমদ মুসাকে সরিয়ে দিতে চায়।
একটু দেরী হয়েছিল আহমদ মুসার উত্তর দিতে। তখন জর্জ বলল, অল রাইট, কোন কনফিডেনশিয়াল কথা হলে আমরা শুনতে চাইব না।’
আহমদ মুসা জর্জের দিকে তাকিয়ে হাসল। বলল, ‘কনফিডেনশিয়াল নয়, নিতান্তই পার্সোনাল। বলতে কোনই আপত্তি নেই।’
বলে একটু থামল আহমদ মুসা। তারপর বলল, ‘অর্থনীতি বিভাগের ছাত্রী লায়লা জেনিফারকে কোথায় পাব এটাই খোঁজ করেছিলাম মাকোনির কাছে।’
আহমদ মুসা জেনিফারের নাম বলার সাথে সাথে জর্জের চেহারায়
একটা পরিবর্তন এল। হঠাৎ করেই তার চেহারায় একটা আরক্ত ভাব এল। তার চোখে কিছুটা সলাজ সংকোচের চিহ্ন। পর মুহূর্তেই সেখানে এল বেদনার সুক্ষ্ণ একটা কালো ছায়া। সে দু’চোখ দিয়ে যেন আহমদ মুসাকে গোগ্রাসে গিলছে। সে দৃষ্টিতে আহমদ মুসাকে পরখ করা, পরীক্ষা করার ভাব।
জর্জের এই পরিবর্তনে আহমদ মুসা বিস্মিত হলো। তার মনে হলো জর্জ জেনিফারকে চেনে। শুধু চেনা নয়, সম্ভবত জেনিফারকে সে বিশেষ দৃষ্টিতে দেখে। আহমদ মুসার সাথে জেনিফারের সম্পর্কটা কি, এই
ব্যাপারটা নিয়ে জর্জ অস্থির হয়ে পড়েছে। সে আহমদ মুসাকে প্রতিদ্বন্ধী ভাবতে শুরু করেছে। মনে মনে হাসল আহমদ মুসা। দেশ-কাল-পাত্র যাই হোক এই ক্ষেত্রে প্রতিদ্বন্দ্বী কাউকে সহ্য করা যায় না। খুশী হলো আহমদ মুসা, তার অনুমানটা সত্য হলে তার সামনে এগুবার একটা পথ হবে।
‘নিশ্চয় জেনিফার আপনার বন্ধু। কিন্তু মাকোনির কাছে গিয়ে তাকে খোঁজ করছিলেন কেন?’বলল জর্জ। তাঁর কণ্ঠ শুকনো।
আহমদ মুসা হাসলো। বলল, ‘হ্যা, বোন বন্ধুও হতে পারে?’
জর্জের চোখে লজ্জা-সংকোচ জড়ানো এক বিব্রত ভাব। বলল, ‘বুঝলাম না। জেনিফারের তো কোন ভাই নেই।’
‘জেনিফারের অদেখা, অচেনা এক ভাই আমি।’
‘জেনিফারকে আপনি দেখেননি, চেনেন না?’
‘না।’
জর্জের চোখ-মুখ একটু সহজ হলো। বলল সে, ‘কিন্তু তাহলে সে
আপনার বোন বা বন্ধু কেমন করে?’
‘মুসলিম নারী-পুরুষ সকলেই দেশ-কাল-পাত্র ছাড়িয়ে ভাই-বোন-এর সম্পর্কে আবদ্ধ।’
জর্জ ভাবছিল। একটু দেরী করল কথা বলতে। বলল, ‘আমি এখন বুঝতে পারছি, জেনিফারের খোঁজ করাই আপনার বিপদ ডেকে এনেছে।’
‘কেমন করে?’না বোঝার ভান করে বলল আহমদ মুসা। সে ভাবল, এরা সমস্যার কতটা জানে, তা জানা দরকার।
‘জেনিফার ও তার সাথীদের একটা সামাজিক গবেষণা একটি মহলকে সাংঘাতিক ক্ষেপিয়ে তুলেছে। জেনিফারকে তারা খুঁজছে। পালিয়ে বেড়াচ্ছে জেনিফার। এই অবস্থায় তার খোঁজ করার অর্থ আপনি তার সহযোগী কেউ হবেন। তার উপর আপনি বিদেশী। সুতরাং আপনাকে জেনিফার থেকে দূরে রাখার জন্যে যা ইচ্ছে তারা করতে পারে।’জর্জ বলল।
‘মহলটির পরিচয় কি?’
‘আমি জানি না। তবে অনুমান করি।’
‘কি সেটা?’
‘তারা সাংঘাতিক বর্ণবাদী একটা গ্রুপ। সারা ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জ জুড়ে তাদের নেটওয়ার্ক। এমন কি এর বাইরেও থাকতে পারে।’
বলে একটা ঢোক গিলল জর্জ। তারপর আবার বলল, ‘আমি জেনিফারকে বলেছিলাম গবেষণার সব কাগজপত্র, দলিল দস্তাবেজ ওদের হাতে তুলে দাও এবং নিজেকে এসব থেকে বিচ্ছিন্ন করে নাও। কিন্তু আমার কোন কথাকেই সে পাত্তা দেয় না, এ ক্ষেত্রেও দেয়নি। ভীষণ জেদী সে।’আবেগে গলাটা ভারি হয়ে উঠেছিল জর্জের।
জেনিফারের প্রতি জর্জের ক্ষোভ ও অভিমানের প্রকাশ এটা।
মনে মনে হাসল আহমদ মুসা। জর্জের কথায় বঞ্চিতের বেদনা আছে। এটা কি জেনিফারের তরফ থেকে সাড়া না পাবার বেদনা? বলল আহমদ মুসা, ‘গবেষণার দলিল-দস্তাবেজ ওদের হাতে তুলে দিলেই কি জেনিফার রক্ষা পেত?’
‘পঞ্চম খুনের পর ওরা মাকোনির মাধ্যমে জেনিফারের কাছে এই প্রস্তাব পৌছয়েছে। জেনিফার ব্রিলিয়ান্ট ছাত্রী বিবেচনায় তারা বলেছে, সে যদি ঐ সাম্প্রদায়িক পথ থেকে ফিরে আসে এবং ধর্মনিরপেক্ষ চেতনার সাথে একাত্মা হয়, তাহলে তার বিরুদ্ধে তাদের আর কোন অভিযোগ থাকবে না।’থামল জর্জ।
‘তারপর?’বলল আহমদ মুসা।
‘জেনিফারকে অনেক বুঝিয়েছি, স্যারদেরকে দিয়েও বুঝিয়েছি, জেনিফার আমার কোন কথা শুনবে না তবুও। আমার শুভেচ্ছাকে সে ভুল বুঝেছে। বলেছে, ‘আমি নাকি আমার জাতির পক্ষ নিয়েছি।’আবারও কণ্ঠ ভারী হয়ে এল জর্জের।
ডাঃ মার্গারেট এতক্ষণ নীরবে কথা শুনছিল। এবার কথা বলল সে, ‘জর্জ তুমি ভুল করেছ। জেনিফারের প্রতি তোমার প্রেম তোমাকে অন্ধ করেছে। তুমি একটা অন্যায়কে সমর্থন করেছ। জেনিফার তোমার বিরুদ্ধে অভিযোগ করতেই পারে।’
‘আমি যা করেছি জেনিফারের স্বার্থেই করেছি।’
‘জেনিফার তা মনে করে না। কারণ জেনিফার নিজের স্বার্থের চেয়ে একটা জনগোষ্ঠীর সামষ্টিক স্বার্থকে অবশ্যই বড় করে দেখতে পারে।’
‘আমিও বড় করে দেখি আপা।’
‘সবক্ষেত্রই দেখ। কিন্তু এ ক্ষেত্রে তা তুমি প্রমাণ করতে পারনি ব্যক্তি জেনিফারের কথা ভাবতে গিয়ে।’
‘কিন্তু বিকল্প যেটা করতে পারতাম, সেটা কি ভাল? দেখ জেনিফারের কি অবস্থা হয়েছে। একজন নিরপরাধ বিদেশী শুধু তাকে খোঁজ করার অপরাধে কি অবস্থায় পড়েছে। শুধু টার্কস দ্বীপপুঞ্জ কেন, ক্যারিবিয়ানের এক ইঞ্চি মাটি এমন নেই যেখানে জেনিফার নিরাপদ।’আবেগে রুদ্ধ হয়ে এল জর্জের কণ্ঠ।
ডাঃ মার্গারেটের মুখে চিন্তার ছাপ। বলল. ‘জর্জ তুমি জেনিফারের ব্যাপারে খুব ইমোশনাল হয়ে পড়েছ। বাস্তবতা তোমাকে দেখতে হবে। জেনিফারও কিন্তু দুর্বোধ্য। আমরা চাই না তুমি অহেতুক কষ্ট পাও।’
‘সব জানি আপা। তবু বলছি, আমার ব্যাপারটা আমার হাতে ছেড়ে দিন।’
আহমদ মুসার দুঃখ হলো জর্জ ছেলেটার জন্যে। বুঝা যাচ্ছে, সাড়া পায়নি জেনিফারের। খৃষ্টান জর্জ আর মুসলিম জেনিফারের বিষয়টা বিব্রত করল আহমদ মুসাকে। আবার খুশী হলো, জেনিফারের খোঁজ করার একটা পথ বের হলো বলে।
জর্জের কথার পর ডাঃ মার্গারেট আর কিছু বলেনি। একটা অস্বস্তিকর অবস্থা তাদের দু’ভাইবোনের মধ্যেই।
আহমদ মুসা নীরবতা ভাঙল। বলল, ‘স্যরি জর্জ, একটা অন্য প্রসংগ। জেনিফারের সন্ধান আমি কিভাবে পেতে পারি?’
জর্জ আহমদ মুসার দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকাল। বলল, ‘জেনিফার
এখন পলাতক অবস্থায়। তার সাথে আপনার দেখা করার বা দেখা করার চেষ্টায় তারও বিপদ হতে পার, আপনারও হতে পারে। শত্রুরা আপনাকেও চিনে ফেলেছে এবং শাসিয়েও গেছে।’
‘এ সব কিছু জেনেই আমি বলছি জর্জ।’
‘আপনি বলেছেন, আপনি তাকে চেনেন না, দেখেননি। তাহলে এই অবস্থার মধ্যে তার সাথে দেখা করার হেতু কি?’
সংগে সংগে জবাব দিল না আহমদ মুসা। একটু ভাবল। তারপর বলল, ‘সব কথা, এখন বলব না, শুধু এটুকু বলছি, ‘যে সমস্যায় জেনিফার জড়িয়ে পড়েছে, সে সমস্যা দেখার জন্যেই আমি এসেছি। জেনিফারের সাক্ষাত আমার এ জন্যে প্রয়োজন যে, বিতর্কিত গবেষণাটা আমি দেখতে চাই, তার কাছে শুনতেও চাই।’
ডাঃ মার্গারেট ও জর্জ দু’জনের চোখে-মুখে বিস্ময় ফুটে উঠল।
বলল, ‘দেখতে চান মানে, আপনি প্রতিকারে নামতে চান?’
‘সে লক্ষ্যেই এসেছি।’
‘আর কেউ এসেছে?’
‘না।’
‘আপনি একা নামবেন? জানেন এরা কত বড় শক্তি, কত বড় এদের নেটওয়ার্ক?’
‘একা কোথায়? সাথে আমার আল্লাহ আছেন। আর দেশের সব ভাল মানুষ তো আমার সাথে থাকবে।’
‘যা বললেন, এটা তো সান্ত্বনার কথা।’বলল ডাঃ মার্গারেট।
মার্গারেট থামতেই জর্জ বলে উঠল, ‘আমি বুঝতে পারছি না। আপনি একা মানুষ, খালি হাত। আপনি কিভাবে এমন একটা লড়াইয়ে নামতে পারেন? এই তো প্রথম দর্শনেই ওরা আপনাকে মেরে ফেলতে যাচ্ছিল।’
আহমদ মুসা হাসল। বলল, ‘আমি যদি জানতাম, ওরা সেই খুনি গ্রুপের, তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়ের দরজায় ওদের সাথে লড়াইয়ে নামতাম না।’
‘কি করতেন?’
‘ওদের হাতে ধরা দিতাম এবং এমন সব কথা বলতাম যাতে আমাকে ওরা ওদের ঘাটিতে ধরে নিয়ে যায়।’
‘ধরা দিতেন? কেন? কেন?’দু’জনে প্রায় এক সাথেই বলে উঠল।
দু’টি লাভের জন্যে। এক, তাদের ঘাটি চানা হতো। দুই, ওদেরও
চেনার সুযোগ হতো।’
কিন্তু ওরা যদি আপনাকে মেরে ফেলতো?’
‘জীবন-মৃত্যু আল্লাহর হাতে, কোন মানুষের হাতে নেই। সুতরাং এ নিয়ে চিন্তার কিছু নেই।’
ডাঃ মার্গারেট এবং জর্জ কিছু বলল না। তাদের অবাক দৃষ্টি আহমদ মুসার উপর নিবদ্ধ।
একটু পর ডাঃ মার্গারেট বলল, ‘আমার অনুমান তাহলে কি ঠিক, আপনি কোন গোয়েন্দা?’
‘আহমদ মুসা হাসল। বলল, ‘না।’
‘কেউ আপনাকে ডেকেছে? কিংবা কেউ পাঠিয়েছে আপনাকে?’বলল মার্গারেট।
‘লায়লা জেনিফার ডেকেছে।’
‘জেনিফার ডেকেছে?’দু’জনেই বলে উঠল এক সাথে।
‘হ্যাঁ।’
‘সে আপনাকে চেনে?’বলল জর্জ।
‘না।’
‘আপনাকে দেখেছে?’
‘না।’
‘আপনার সাথে কথা বলেছে?’
‘না।’
‘তাহলে কিভাবে ডাকল?’
‘সে হয়তো কোথাও আমার নাম শুনেছিল। সেই নামে আন্তর্জাতিক একটি মুসলিম সংস্থার ঠিকানায় আমাকে চিঠি লিখেছিল। সেই সংস্থা আমার কাছে চিঠি পৌছায়। সেই চিঠি পেয়ে আমি এসেছি।’
‘এ তো রূপ কথার গল্প।’বিস্মিত কণ্ঠে বলল মার্গারেট।
‘কিন্তু সত্য।’বলল আহমদ মুসা।
জর্জ কিছু বলতে যাচ্ছিল। আহমদ মুসা হাত জোড় করে বলল, ‘আর কোন কথা নয়। সব কথাই, একদিন জানবে। এখন আমাকে সাহায্য কর।’
‘আমি জেনিফারের বাড়ির ঠিকানা দিতে পারি। কিন্তু সে তো বাড়িতে নেই।’
‘ওর যে কোন একটা ঠিকানা পেলেই হলো। সেই ঠিকানা থেকে আরও ঠিকানা বেরিয়ে আসবে।’
‘ঠিকানা দিতে পারি একটা শর্তে।’
‘কি সেটা?’
‘জেনিফারের সাথে দেখা হওয়ার পর যখন আপনি কাজ শুরু করবেন, তখন আমার কথা মনে রাখবেন। কিছু না পারি আপনার ফায়ফরমাস মাটিতে পারব অবশ্যই।’
‘কিন্তু জর্জ, তুমি জেনিফারকে গবেষণার দলিল-দস্তাবেজ ওদের হাতে তুলে দিয়ে আপোস করতে বলেছিলে।’
‘বলেছিলাম। সেটা জেনিফারকে বাঁচানোর জন্যে। কিন্তু অন্যায়কে
‘ন্যা’ বলিনি।
‘কিন্তু ‘অন্যায়’কে অন্যায় বলা এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো এক জিনিস নয়।’
‘সেটা আমি জানি।’
‘ধন্যবাদ জর্জ। তোমার সাহায্যকে স্বাগত জানাই। কিন্তু কখন তোমাকে কি করতে হবে, তোমাকে স্বাধীনভাবেই সে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।’
‘আপনি কোথায় কি করছেন তা জানতে হবে তো?’
‘না জানলে সাহায্য করবে কি করে? যখন জানতে পারবে, তখনই সাহায্যের সময়।’
‘বুঝলাম।’বলল জর্জ।
ডাঃ মার্গারেটের বিস্ময় দৃষ্টি আহমদ মুসার উপর। জর্জ থামার সংগে সংগে সে বলল, ‘মিঃ আহমদ আবদুল্লাহ আসলে আপনি কে? আপনার মত বিদেশী একজনকে স্থানীয় কেউ সহযোগিতার অফার করলে, সেই সহযোগিতা গ্রহণ করার জন্য যেভাবে কথা বলে, আপনি তা বলেননি। যে কথা আপনি বলেছেন তা সেই বলতে পারে, যে সাংঘাতিক আত্ববিশ্বাসী এবং যে সাহায্য আপনি চেয়েছেন তা জর্জের জন্যে যতটুকু স্বাভাবিক ততটুকুই। এই গোটা দৃষ্টিভঙ্গিটাই অসাধারণ।’
‘ম্যাডাম, আমাকে যা দেখছেন আমি তাই। এতটুকুই কি যথেষ্ট নয়?’
ডাঃ মার্গারেট কিছু বলতে যাচ্ছিল, এ সময় নার্স দ্রুত ঘরে ঢুকে ডাঃ মার্গারেটকে বলল, ‘ম্যাডাম, প্রফেসর স্যার আসছেন।’
ডাঃ মার্গারেট চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াল।
কক্ষে প্রবেশ করল ইমারজেন্সী এবং ইনটেনিসিভ কেয়ার ইউনিটের প্রধান ডাক্তার।
কক্ষে প্রবেশ করে সকলের সাথে সম্ভাষণ বিনিময়ের পর আহমদ মুসার কাছে গিয়ে দাঁড়াল। বলল, ‘ইয়ংম্যান খুব ভালো আছ তাই না?’
‘জি ডক্টর।’বলল আহমদ মুসা।
ডাক্তার আহমদ মুসার ফাইল হাতে নিয়ে মাথার আঘাতের সর্বশেষ পরীক্ষার রিপোর্টসহ বর্তমান অবস্থার রিপোর্ট পরীক্ষা করল। তারপর আহমদ মুসার ডান হাত তুলে নিয়ে নাড়ী পরীক্ষা করল। তারপর আহমদ মুসার পিঠ চাপড়ে বলল, ‘উইল পাওয়ার নিয়ে তোমার কোন চর্চ্চা আছে নাকি হে। অদ্ভুত শক্ত তোমার নার্ভ। অপারেশনের ৪ ঘন্টা পর তোমার যে উন্নতি হয়েছে ৪ দিনেও তা হবার কথা নয়। তোমাকে অভিনন্দন ইয়াংম্যান।’
‘ওয়েলকাম, ডক্টর।’আহমদ মুসা বলল।
‘আরেকটা বিষয়ে তুমি লাকি ইয়াংম্যান। তোমার মাথায় বিভিন্ন সময়ে পাওয়া অনেকগুলো বড় বড় আঘাতের চিহ্ন। কিন্তু সবগুলো আঘাতই বিস্ময়করভাবে তোমার ব্রেণকে এড়িয়ে গেছে।’
‘আল্লাহর বিশেষ দয়া, ডক্টর।’
‘কিন্তু ইয়াংম্যান এতটুকু বয়সে তোমার এত শত্রু এল কোথেকে? সাবধান হবে।’
‘ধন্যবাদ ডক্টর।’
প্রধান ডক্টর বেরিয়ে গেল।
তার সাথে সাথে মার্গারেট ও জর্জও বেরিয়ে গেল প্রধান ডাক্তারের সাথে কথা বলতে বলতে।
প্রধান ডাক্তারকে কিছুদূর এগিয়ে দিয়ে ডাঃ মার্গারেট ও জর্জ ফিরল কক্ষে ফেরার জন্যে।
দরজায় প্রবেশের আগে ডাঃ মার্গারেট জর্জকে টেনে ধরল এবং সরিয়ে আনল একটু দূরে। বলল’ ‘আহমদ আবদুল্লাহকে কেমন বুঝছ তুমি?’
‘তুমিই তো ভাল বুঝার কথা আপা।’
ডাঃ মার্গারেট একটু চিন্তা করল। বলল, ‘আমার মনে হচ্ছে তার
বড় কোন পরিচয় আছে।’
বলে একটু থামল। তারপর আবার শুরু করল, ‘ওঁর দৃষ্টি অসাধারণ তীক্ষ্ণ। বুদ্ধি ও বিশ্লেষণী শক্তি অসাধারণ ধারালো। প্রফেসর স্যার এখনি বললেন, ওঁর নার্ভ অসাধারণ এবং তাঁর কাছ থেকে শুনে যা বুঝা গেছে মারামারিতেও তিনি অসাধারণ। তাহলে উনি সাধারণ হন কেমন করে?’
‘আরেকটা বিষয় খেয়াল করেছ আপা, প্রফেসর বললেন, ‘মিঃ আহমদ আবদুল্লাহর মাথায় বিভিন্ন সময়ে পাওয়া অনেক আঘাত আছে। এ থেকে বুঝা যায়, হয় তিনি ক্রিমিনাল, না হয় তিনি কোন গোয়েন্দা। ক্রিমিনাল নন আমার বিশ্বাস, তাহলে তিনি গোয়েন্দা ধরনের কেউ হবেন।’
‘লায়লা জেনিফার তার নাম জেনেছে এবং সাহায্যের জন্যে ডেকেছে, এটাও বড় ব্যাপার। শুধু অসাধারণ নয়, খুবই অসাধারণ না হলে তাকে সাহায্যের জন্যে চিন্তা করতো না জেনিফার।’
‘আমারও তাই মত আপা। তাকে কি আবার জিজ্ঞেস করব তার
পরিচয়?’
‘না। যখন তিনি বলেননি, তখন না বলার পেছনে নিশ্চয় কারণ আছে, অথবা তিনি আস্থা রাখতে পারছেন না আমাদের উপর।’
‘এ জন্যেই কি আমি সাহায্য করতে চাইলে তিনি ঠান্ডা মনোভাব
পোষণ করেছেন?’
‘তা নাও হতে পারে। কিন্তু তুমি তো ওঁকে সাহায্য করতে যাচ্ছ না, সাহায্য করতে চাচ্ছ জেনিফারকে।’
‘জেনিফার আমার সাহায্য চায় না। তার সাহায্যের জন্যে লোক তো এসেছেই। কিন্তু ঐ খুনিরা ধরা পড়ুক, তাদের শাস্তি হোক এবং জেনিফার মুক্ত হোক, এটা আমার একান্ত কামনা বলেই আমি সাহায্য করতে চাই।’
হাসল ডাঃ মার্গারেট। বলল, ‘জেনিফারকে তুমি বুঝতে পারনি কিংবা জেনিফার তোমাকে বুঝতে পারেনি, এটা তোমারও ব্যর্থতা। এর দায় বেচারা আহমদ আবদুল্লাহর ঘাড়ে চাপিও না।’
হাসল জর্জ। বলল, ‘আহমদ আবদুল্লাহ জেনিফারের চেয়ে অনেক
উঁচুতে বটে, কিন্তু জেনিফার আমাকে তার চেয়ে অনেক নিচু মনে করে।’
হাসল ডাঃ মার্গারেট। বলল, ‘তা আমি জানি না। তবে প্রত্যেকেরই অধিকার আছে, সে যা ঠিক মনে করে সে মত পোষণ করার।’
জর্জ কিছু বলতে যাচ্ছিল। বাধা দিয়ে মার্গারেট বলল, ‘চল যাই, প্রফেসর স্যার আহমদ আবদুল্লাহর জন্য কি লিখে গেলেন, তার ফলোআপ করতে হবে।’
দু’জন কক্ষের দিকে পা বাড়াল।

একটা ছোট মটর বোট এগিয়ে চলছে সাউথ টার্কো দ্বীপের দিকে। টার্কস দ্বীপপুঞ্জের সবচেয়ে বড় দ্বীপ, গ্রান্ড টার্কস। এর পূর্ব-দক্ষিণে পর পর আরও দু’টো দ্বীপ। সাউথ টার্কো দ্বীপ গ্রান্ড টার্কস থেকে সোজা দক্ষিণে। টার্কস দ্বীপপুঞ্জের এটা দ্বিতীয় বৃহত্তম দ্বীপ।
মটর বোটে তিনজন আরোহী।
দু’জন কৃষ্ণাংগ। তাদের একজন ড্রাইভিং সিটে। সে যুবক বয়সের।
অন্যজন সাদা-কালো চুলের প্রৌঢ়।
বোটের ডেকে রাখা একমাত্র চেয়ারে আহমদ মুসা বসে।
এক সময় আহমদ মুসার পায়ের কাছে পাটাতনের উপর এসে বসল সাদা-কালো চুলের সেই প্রৌঢ়।
আহমদ মুসাও চেয়ার থেকে নেমে পাটাতনের উপর বসল।
প্রৌঢ়টি ইংরেজী স্প্যেনিশ মিশিয়ে বলল, ‘আপনি স্যার, আপনি অতিথি, আপনি সম্মানিত, আপনি এভাবে আমার পাসে বসবেন কেন?’বলে একটু সরে উঠে দাঁড়াচ্ছিল প্রৌঢ়টি।
আহমদ মুসা তাকে আবার টেনে বসিয়ে দিল। বলল, ‘দেখ আমি
মুসলমান। আমাদের ধর্মে সব মানুষ সমান। সাদা-কালো, ধনী-গরীব কিংবা শ্রমিক-মালিক-এর পার্থক্যের কারণে মানুষ ছোট-বড় হয় না। আমাদের ধর্মে মানুষ সম্মানিত-অসম্মানিত হয় ভালো কিংবা মন্দ কাজ করার ভিত্তিতে।’
‘আমাদের দ্বীপে অনেক মুসলমান আছে স্যার। আপনি ঠিকই বলেছেন, তাদের মধ্যে সাদা-কালোর ভেদ নেই। তারা এঁক সাথে বসে খায়। এক সাথে উপাসনা করে। কিন্তু স্যার, আমরা দেখছি, টাকা-পয়সা দিয়েই বড়-ছোটর বাছ-বিচার হচ্ছে।’
‘এর কারণ ইসলামের এই শিক্ষা আমরা হয় ভুলে গেছি, না হয় মানি না।’
‘জর্জ স্যাররা খুব ভাল স্যার। ওরা সাদা-কালো দেখে না। ওর বড় বোন ডাক্তার। সাদা-কালো দুই রুগী এলে কালোটাই সে প্রথম দেখে।’
‘ঠিক বলেছ, আমিও ওঁর রোগী ছিলাম।’
সাদা-কালো চুলের প্রৌঢ় কয়েক মুহূর্তের জন্যে নীরব থাকল।
তারপর বলল, ‘জর্জ সাহেব বলেছেন, আপনি যেখানে নামতে চান সেখানেই নামিয়ে দিতে হবে। কোথায় নামা আপনার পছন্দ হবে স্যার?
‘উপকূলের যে কোন জায়গায় নামা যায়?’
‘দু’চারটা জায়গা ছাড়া সব স্থানেই নামা যায়। তবে ঘাট বা বন্দরের জেটি ছাড়া নামলে কিছুটা পানিতে নামতে হয়।’
আহমদ মুসা মানচিত্র থেকে জেনেছে, সামনেই দ্বীপের উত্তর পাশে দ্বীপটির প্রধান বন্দর। এ বন্দর থেকে রাস্তা ছড়িয়ে পড়েছে গোটা দ্বীপে।
আহমদ মুসা এ পাশের এ বন্দরে না নামার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। জেনিফারের সাথে দেখা হওয়ার আগে কোন সংঘর্ষে সে লিপ্ত হতে চায় না।
আহমদ মুসা জর্জের হাতে লেখা জেনিফারের ঠিকানা বের করল পকেট থেকে। সে জর্জের কাছে শুনেছে, জেনিফারের বাড়ি দ্বীপটার দক্ষিণ-পশ্চিম অংশে। এলাকাটা নাকি পাহাড় ও উর্বর উপত্যকায় ভরা।
ঠিকানা লেখা কাগজ চোখের সামনে মেলে ধরল আহমদ মুসা।
গ্রামের নাম ‘সিডি কাকেম’।
নাম পড়ে চমকে উঠল আহমদ মুসা যেমন চমকে উঠেছিল গ্রান্ড টার্কস দ্বীপের প্রধান বন্দর’জোয়ান ডি সুসুলামা’নাম পড়ে। বরং তার চেয়েও এই নামে আরবীয় উপস্থিতিটা আরও স্পষ্ট। জর্জ ইংরেজীতে গ্রামটির নাম লিখেছে ‘Sidi Kacem’। আহমদ মুসা ভাবল, গ্রামটির এই নামকে’সিদি কাছেম’ও পড়া যায়।
‘সিদি কাছেম’ নাম উচ্চারণের সাথে সাথে আহমদ মুসার মন চলে গেল মুসলিম উত্তর আফ্রিকার দিকে। সেখানে মুসলমানদের মধ্যে এই ধরনের বহু নাম প্রচলিত।
আহমদ মুসা বলল, ‘আমি সিডি কাকেম গ্রামে যাব। বন্দরে না নেমে আর কোথাও নামতে পারি?’
‘বন্দরে নামার দরকার নেই স্যার। সিডি কাকেম’সবু’উপত্যকার মুখে ‘সেবু’ নদীর তীরে একটা বিখ্যাত গ্রাম। সেবু নদীর মোহনায় মৎস শিকারীদের একটা জেটি আছে। সেখান থেকে গ্রামটা সবচেয়ে কাছে। সেখানে নেমে হেঁটেও যাওয়া যায়, অটো হুইলারেও যেতে পারেন। ছোট নৌকা পেলে নৌকাতেও যেতে পারেন গ্রামটিতে।’
তার কথা শুনছিল আহমদ মুসা। কিন্তু’সেবু’নদীর নাম শোনার সাথে সাথে আহমদ মুসার মন ছুটে গিয়েছিল মরক্কোর আটলান্টিক উপকূল এলাকায়। তার চোখের সামনে ভেসে উঠল মরক্কোর রাজধানী ‘রাবাত’ থেকে একশ’সোয়াশ’মাইল পুবে সাগরের দিকে বয়ে যাওয়া ‘সেবু’ নদী এবং তার তীরের ‘সিদি কাছেম’ নামক শহরের দৃশ্য। পশ্চিম আটলান্টিকের ক্যারিবিয়ান সাগরে হারিয়ে থাকা একটা দ্বীপের একটা অখ্যাত গ্রামের নাম এই’সিদি কাছেম’এবং নদীর নাম ‘সেবু’হলো কি করে?
এ বিস্ময়টা চেপে রেখে আহমদ মুসা বলল, ‘আমাকে ঐ মৎস ঘাটেই নামিয়ে দিবেন।
বলে একটু থামল। তারপর আবার বলল, ‘আপনার পূর্ব পুরুষরা কোত্থেকে এসেছিল বলতে পারেন?’
সংগে সংগে উত্তর দিল না প্রৌঢ়টি।
একটু চিন্তা করল। বলল, ‘আমার মা অতীতের কথা আমাদের বেশি বলতেন। তাঁর কাছে শুনেছি, আমার পূর্ব পুরুষকে পশ্চিম আফ্রিকার গাম্বিয়া থেকে ধরে আনা হয়েছে। আমাদের সে পূর্ব পুরুষ গাম্বিয়ার একজন যোদ্ধা ছিলেন। তার’বাজুবন্ধ’টি আমরা বংশ পরম্পরায় সংরক্ষণ করে চলেছি। তাঁকে ষোড়শ শতকের প্রথম দিকে ধরে আনা হয় এবং দাস হিসাবে নয় যোদ্ধা হিসাবে তাঁকে ব্যবহার করা হয়। তখন সমগ্র ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জে চলছিল স্বর্ণ খনি আবিস্কার ও খননের ধুম। এই খনন কাজে দাস হিসাবে ব্যবহার করা হচ্ছিল এখানকার আদিবাসী রেডইন্ডিয়ানদের। আর তাদের কাবু রাখা ও পরিচালনার জন্যে ব্যবহার করা হতো আফ্রিকান নিগ্রোদের। যোদ্ধা হওয়ায় আমার পূর্ব পুরুষ এই কাজে গুরুত্বপূর্ণ পদ লাভ করেন। কিন্তু শীঘ্রই তিনি রেডইন্ডিয়ানদের উপর মালিকদের অমানুষিক নির্যাতনের প্রতিবাদ করেন। ফলে তার উপর নির্যাতন নেমে আসে এবং তিনি জেলে নিক্ষিপ্ত হন। তিনি জেল থেকে পালিয়ে কিউবা অঞ্চল থেকে বাহামা আঞ্চলে চলে আসেন। রেডইন্ডিয়ানদের কাছে তিনি হিরোতে পরিণত হন। বাহামা অঞ্চলে এসে বিয়ে করেন এক রেডইন্ডিয়ান মেয়েকে। প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে শ্বেতাংগদের ব্যবহারে ক্ষুদ্ধ হয়ে আমাদের পূর্ব পুরুষ চলে আসেন টার্কস দ্বীপপুঞ্জে।’থামল প্রৌঢ়টি।
বোটের চালক যুবকটির দিকে ইংগিত করে আহমদ মুসা বলল, ‘যুবকটি তোমার কে?’
‘আমার ছেলে।’গর্বের সাথে উচ্চারণ করল প্রৌঢ়টি।
‘তাই তো তোমার কাহিনী শুনে তার চোখ-মুখ উজ্বল হয়ে উঠেছিল।’
মুহূর্তের জন্যে একটু থেমে আহমদ মুসা যুবকটির দিকে তাকিয়ে
হেসে বলল, ‘আমিও খুশী হয়েছি তোমার পূর্ব পুরুষের পরিচয়ে।’
তারপর প্রৌঢ়ের দিকে চেয়ে আহমদ মুসা বলল, ‘তোমার সেই পুর্ব পুরুষের নাম কি?’
‘আরাবাকা।’বলল প্রৌঢ়।
“বাজুবন্ধ”;-এর কথা বললে। ওটা কার কাছে?
‘আমার কাছে। এই তো।’বলে প্রৌঢ়টি জামার হাতা উপরে তুলে বাজুবন্ধটি দেখাল।
খোদাই কাজ করা চাঁদির বাজুবন্ধ।
‘বাজুবন্ধ-এর উপর চোখ পড়তেই চমকে উঠল আহমদ মুসা।
বাজুবন্ধের উপর চোখ পড়তেই চমকে উঠল আহমদ মুসা। বাজুবন্ধের উপর খোদিত আরবী বর্ণমালা ক্যালিওগ্রাফী স্টাইলে লেখা।
‘হাতে নিয়ে দেখতে পারি বাজুবন্ধটি?’দ্রুত কণ্ঠে বলল আহমদ
মুসা।
প্রৌঢ়টি খুশী হয়ে বাজুবন্ধটি খুলে আহমদ মুসার হাতে দিল।
আহমদ মুসা নজর বুলাল বাজুবন্ধটির উপর।
পুরাতন ক্যালিওগ্রাফী স্টাইলে আরবী লেখা।
পড়ল আহমদ মুসা শ্বাসরুদ্ধ বিস্ময়ের সাথে। বাজুবন্ধটির ডিম্বাকৃতি উপরের অংশে চারদিকে ঘিরে আল্লাহু আকবর শব্দমালার একটি
ডিম্বাকার বৃত্ত। তার মাঝে লেখা’সোংগাই সুলতান আসকিয়া মুহাম্মাদের তরফ থেকে তরুণ সেনাধ্যক্ষ আবু বকর মুহাম্মদকে বীরত্বের প্রতীক হিসেবে।’লেখার নিচেই সুলতানী সিলমোহর।
পড়ে আনন্দ বিস্ময়ের শ্বাসরুদ্ধকর চাপে আহমদ মুসা কিছুক্ষণ কথা বলতে পারলো না। আবেগে উচ্ছ্বাসে ভারি হয়ে উঠেছিল তার চোখ-মুখ। বাজুবন্ধ থেকে মুখ তুলে স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে ছিল প্রৌঢ়টির দিকে।
‘কি দেখলেন? এভাবে তাকিয়ে আছেন কেন?’বলল প্রৌঢ়টি অবাক হয়ে।
তবু আহমদ মুসা কিছু বলল না।
আরও একটু পরে ধীরে ধীরে বলল, ‘জনাব বাজুবন্ধে কি লেখা আছে জানেন?’
‘কিছু লেখা আছে জানি আমরা। কিন্তু কি লেখা আছে জানিনা।
আম্মার কাছে শুনেছি, আমার দাদা একবার হ্যাভানায়’আফ্রিকান ক্যারিবিয়ানদের’এক সম্মেলনে গিয়েছিলেন। একজন পন্ডিত লোক বাজুবন্ধটি পড়েছিলেন। ওখানে অনেক কিছু নাকি লেখা আছে। তার সাথে একজন বাদশাহর নাম ও আমার সেই পূর্ব পুরুষের নাম লেখা আছে। পন্ডিত ব্যক্তি দাদাকে বলেছিলেন, বাজুবন্ধটি কোন যাদুঘরে দিলে আমরা অনেক টাকা পাব। আপনি পড়তে পারেন ওখানে কি লেখা আছে?’
‘হ্যাঁ আমি পড়তে পারি, পড়েছি।’
‘প্রৌঢ়টি আনন্দে চিৎকার করে উঠল, ‘বাকা বোট বন্ধ করে এখানে এস। এ সুযোগ আর পাওয়া যাবে না।’ড্রাইভিং সিটে বসা ছেলেকে লক্ষ্য করে বলল প্রৌঢ়টি কথাগুলো।
‘বাকা’অর্থ্যাৎ প্রৌঢ়ের যুবক ছেলেটি এসে বসল প্রৌঢ় লোকটির
পাশে প্রচুর সংকোচ নিয়ে।
‘স্যার দয়া করে পড়ুন কি লেখা আছে। কি সৌভাগ্য আমাদের।’
আল্লাহু আকবার’শব্দ আপনারা শনেছেন?’বলল আহমদ মুসা
প্রৌঢ়কে লক্ষ্য করে।
‘শনেছি। মুসলমানদের মসজিদ থেকে এ শব্দ আমরা অনেক
শুনেছি।’বলল প্রৌঢ়টি।
আহমদ মুসা বাজুবন্ধের ডিম্বাকৃতি বৃত্ত ওদের সামনে তুলে ধরে বলল, এ বৃত্তের চারদিকে ঘিরে এগারবার’আল্লাহু আকবার’শব্দ লেখা আছে।
তারা বাপ-বেটা বিস্মিত কণ্ঠে প্রায় এক সাথেই বলে উঠল, ‘মুসলমানদের শব্দ এখানে কেন? কি অর্থ এর?’
‘কেন পরে বলছি। শব্দটির অর্থ’আল্লাহ’ অর্থাৎ ‘ঈশ্বর সর্ব শক্তিমান।’
একটু থেমে প্রৌঢ়ের দিকে চেয়ে আহমদ মুসা বলল, ‘বাজুবন্ধে একজন বাদশাহর নাম লেখা আছে বললেন, জানেন তার নাম?’
‘আমাদের কারোরই মনে নেই।’বলল প্রৌঢ়টি।
‘বাদশাহর নাম’আসকিয়া মোহাম্মদ।’
‘এ তো মুসলমানদের নাম। বাদশাহ কি মুসলমান?’
‘হ্যাঁ মুসলমান। সোংগাই সাম্রাজ্যের তিনি সর্বশ্রেষ্ঠ সুলতান ছিলেন। পশ্চিম আফ্রিকার সর্ব বৃহৎ সাম্রাজ্য ছিল এটা। এই সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা হয় ১৪৬৪ সালে। আরেকটা মুসলিম সাম্রাজ্য ‘মালি’র রাজধানীও এদের অধিকারে আসে। আসকিয়া মুহাম্মদ ১৪৯৩ থেকে ১৫২৮ সালপর্যন্ত দীর্ঘ ৩৫ বছর ক্ষমতায় ছিলেন। এই সুলতানেরই একজন সেনধ্যক্ষ ছিলেন আপনার পুর্ব পুরুষ, যিনি এই বাজুবন্ধের মালিক।
এই বাজুবন্ধে লেখা আছে সাহস ও বীরত্বের জন্যে বাদশাহ আসকিয়া মুহাম্মদ তাকে এই বাজুবন্ধ উপহার দেন।’থামল আহমদ মুসা।
প্রৌঢ় এবং তার ছেলে দু’জনের চোখেই আনন্দ, বিস্ময় এবং অনেক প্রশ্ন।আহমদ মুসা থামতেই প্রৌঢ় বলল, ‘তাহলে আমাদের পুর্ব পুরুষ একটি বিশাল সাম্রাজ্যের একজন সেনাধ্যক্ষ ছিলেন। কত বড় ছিল সেই সাম্রাজ্য? আমাদের গাম্বিয়া কি অন্তর্ভুক্ত ছিল?’
‘বললাম তো সোংগাই সালতানাত পশ্চিম আফ্রিকার সবচেয়ে বড় সাম্রাজ্য ছিল। মনসুর মুসা (১৩১২-১৩২৭) প্রতিষ্ঠিত মালি সাম্রাজ্যের পতনের পর সোংগাই সালতানাতের প্রতিষ্ঠা হয়। সোংগাইরা আগে অমুসলিম ছিল, মুসলিম সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার সাথে সাথে তারা মুসলমান হয়ে যায়। আজকের মৌরতানিয়ার কিছু অংশ, গাম্বিয়া, সেনেগাল, গিনি বিসাউ, গিনি, সিয়েরা লিওন, আইভরি কোস্ট, মালি বুকিনা ফাসো ইত্যাদি অঞ্চল নিয়ে সোংগাই সালতানাতের প্রতিষ্ঠা হয়েছিল।’থামল আহমদ মুসা।
প্রৌঢ় ও তার ছেলের চোখে-মুখে রাজ্যের বিস্ময়।
আহমদ মুসা থামলে যুবক বাকা বলল, ‘আপনি এত জানেন কি করে? আমাদের’গাম্বিয়া’আপনি দেখেছেন?’
‘দেখেছি। আটলান্টিকের কূল, ঘেঁষে দাঁড়ানো সুন্দর একটা ছোট্ট
দেশ এখন ওটা।’
‘দেখছেন?’ বলল আবার যুবক বাকা।
‘প্রৌঢ় এবং তার ছেলে বাকা দু’জনের চোখেই এক সীমাহীন আনন্দ ঝড়ে পড়েছিল।
আহমদ মুসা প্রৌঢ়ের দিকে চেয়ে বলল, ‘আপনার পূর্ব পুরুষের না, যেন কি বলেছিলেন?’
‘আবাবাকা।’ বলল প্রৌঢ় গর্বের সুরে।
‘এটা আপনার পূর্ব পুরুষের পুরো নাম নয়, এবং সঠিক উচ্চারণও এটা নয়।’
‘কি নাম। কি নাম লেখা আছে বাজুবন্ধে?’বাপ-বেটা দু’জনেই এক সাথে বলে উঠল। তাদের চোখে প্রবল বিস্ময় ও উৎসুক্য।
‘বলছি। কিন্তু তার আগে বলুন, আপনারা খৃষ্টান কবে থেকে?’
‘প্রৌঢ় ও তার ছেলে বাকা দু’জনেই নীরব।
একটু পরে প্রৌঢ় বলল, ‘আমরা জানি না।’
বৃদ্ধ থামল। একটা ঢোক গিলল। পরক্ষণেই বলে উঠল দ্রুত, ‘এ
প্রশ্ন করছেন কেন?’
‘এ প্রশ্ন করছি কেন আপনার পুর্ব পুরুষের নামই তার জবাব দেবে।’
আহমদ মুসা থামল।
তাদের বাপ-বেটার চোখে কিছুটা বিমুঢ় দৃষ্টি।
আহমদ মুসা বাজুবন্ধ-এর লেখার উপর তর্জনি স্পর্শ করে বলল, ‘শুনুন এখানে লেখা আছে ‘সোংগাই সুলতান আসকিয়া মুহাম্মদ-এর তরফ থেকে তরুণ সেনাধ্যক্ষ আবু বকর মোহাম্মদকে বীরত্বের প্রতীক হিসেবে।’
শোনার সাথে সাথে যুবক বাকা চিৎকার করে উঠল, ‘আমাদের পূর্ব পুরুষের নাম ‘আবু বকর মোহাম্মদ?’ কণ্ঠে তার প্রবল উচ্ছ্বাস।
‘তার মানে আমাদের পুর্ব পুরুষ মুসলমান ছিলেন?’ প্রৌঢ়ের কণ্ঠে শ্বাসরুদ্ধকর বিস্ময়।
‘নাম তো তাই প্রমাণ করে’। বলল আহমদ মুসা।
প্রৌঢ় ও যুবক বাকা স্থির, স্তম্ভিত দৃষ্টি আহমদ মুসার উপর নিবদ্ধ।
তারা যেন বাকহারা হয়ে গেছে। অনেকক্ষণ তারা কিছুই বলতে পারলো না। ধীরে ধীরে তাদের চোখের স্তম্ভিত দৃষ্টি কমে এল। কি এক আবেগে নরম হয়ে উঠল তাদের চোখ-মুখ।
ধীর কণ্ঠে প্রৌঢ়টি এক সময় বলল, ‘এ জন্যেই আপনি প্রশ্ন করেছেন আমরা খৃষ্টান কবে থেকে হলাম। আমারও মনে এখন এই প্রশ্ন জাগছে, কখন কেমন করে অতীত থেকে বিচ্ছিন্ন হলাম।
বৃদ্ধের চোখে আবেগময় এক শূন্য দৃষ্টি। একটা তন্ময়তা তাতে। আহমদ মুসা কথা বলে তার সে তন্ময়তা ভাঙতে চাইল না।
আনেকক্ষণ পর প্রোঢ়টি স্বপ্নভংগের মত হঠাৎ কথা বলে উঠল ধীরে শান্ত কণ্ঠে, ‘আমার প্রশ্নের উত্তর আমিও বোধহয় জানি।’বলে আবার থামল বৃদ্ধ।
শুরু করল একটু পরে, ‘আফ্রিকার কালো মানুষ যাদের ধরে আনা হয়েছিল, তাদের তো মানুষই মনে করা হতো না। তারা তাদের আত্মপরিচয়, সংস্কৃতি, শিক্ষা, ধর্ম রক্ষা করবে কি করে? খৃষ্টান নাম নিতে যেখানে তাদের বাধ্য করা হয়েছে, সেখানে তারা মুসলিম আচার-আচরণ ও পরিচয় রক্ষা করবে কিভাবে? শুনে যতটা মনে হয়েছে, আফ্রিকা থেকে ধরে আনা আমাদের পূর্ব পুরুষ নিজেকে রক্ষা করতে পেরেছিলেন, যার জন্যে সইতে হয়েছিল তাকে কারা যন্ত্রনাসহ অনেক দুঃখ-কষ্ট, পালিয়ে বেড়াতে হয়েছিল স্থান থেকে স্থানান্তরে। তারপর অন্যান্য অনেকের ক্ষেত্রে যা হয়েছে, আমাদের পরিবারেও তাই ঘটে। আমরা লীন হয়ে গেছি শাসক সম্প্রদায়ের সমাজ, সংস্কৃতি ও ধর্মের মধ্যে।’থামল প্রৌঢ়।
প্রৌঢ় থামতেই যুবক বাকা বলে উঠল, ‘আমি বুঝতে পারছি না, একটি সাম্রাজ্যের সেনাধ্যক্ষের মত একজনকে কিভাবে ইউরোপীয়রা ধরে আনল?
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘দিন কারও সমান যায় না। আসকিয়া মুহাম্মদ ১৫৮২ সালে মৃত্যু বরণ করলে সোংগাই সালতানাত দুর্বল হয়ে পড়ে। এরপর মরক্কো এ সাম্রাজ্যের উপর আক্রমণ চালায় এবং কিছু অংশ দখল করে নেয়। এরপর সোংগাই সালতানাতটি ছোট ছোট রাজ্যে ভাগ হয়ে যায়। তাদের পারস্পরিক লড়াই তাদের আরও দুর্বল করে দেয়। এরই সুযোগ নেয় ইউরোপীয়রা। সমগ্র পশ্চিম উপকূল জুড়ে তাদের দস্যুতা মানুষের জন্যে একটা ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। অনেক সময়ই বণিকের নির্দোষ ছদ্মবেশ পরে তারা আসত। সুযোগ পেলেই তারা চড়াও হতো স্থানীয় মানুষের উপর। যাকে যেখানে পেত ধরে নিয়ে যেত। এমনি ধরনের কোন এক ঘটনায় তোমার পূর্ব পুরুষ আবু বকর মোহাম্মদ তাদের ফাঁদে পড়ে যায়।’
একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলল প্রৌঢ়টি।
একটু চুপ থেকে প্রৌঢ়টি বলল, ‘আমার পূর্ব পুরুষের নাম অনুসারে আমার এই ছেলের নাম রেখেছিলাম আবাবাকা। এই নাম শুধরে দিলে এখন তো এর নাম হয়’আবু বকর মোহাম্মদ’। তাই না?’
‘হ্যাঁ।’বলল আহমদ মুসা।
কথা শেষ করেই আহমদ মুসা তাকাল যুবক বাকার দিকে। বলল, ‘তুমি মুসলিম নাম’আবু বকর মোহাম্মদ’গ্রহণ করতে রাজী হবে?’
যুবক বাকা মাথাটা সামনের দিকে ঝুকিয়ে আভূমি বাও করে বলল, ‘আমার পূর্ব পুরুষ যা আমিও তাই।’
বাকার চোখে মুখে গর্ব ও আনন্দের স্ফুরণ।
‘মোবারকবাদ আবু বকর মোহাম্মদ, এবার তুমি ড্রাইভিং-এ যাও।’
হাসি মুখে বাকা ওরফে আবুবকর উঠে দাঁড়িয়ে আহমদ মুসা ও পিতাকে মাথা ঝুঁকিয়ে একটা বড় বাও করে বোটের ড্রাইভিং সিটে গিয়ে বসল।’
ছুটে চলতে শুরু করল বোট।
প্রৌঢ় মশগুল হলো আহমদ মুসার সাথে নানা কথায়।
বোট এসে নোঙর করল সাউথ টার্কো দ্বীপের দক্ষিণ পাশের সেই মৎস ঘাটের জেটিতে।
জেটির এক পাশে তখন একটা মাঝারি আকারের স্টিম বোট নোঙর করা ছিল। বোটটির দিকে তাকিয়ে বিস্মিত কণ্ঠে ফিসফিস করে প্রৌঢ় বলল, ‘এটা একটা প্রাইভেট বোট। এ ধরণের বোট তো এখানে আসার কথা নয়।’
‘এসেছে যখন দরকারেই এসেছে।’বলে আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল।
আহমদ মুসা বোটের ভাড়া আগেই চুকিয়ে দিয়েছে। ভাড়া ঠিক নয়। যা ভাড়া তার কয়েক গুণের মত বেশি পয়সা গুঁজে দিয়েছে প্রৌঢ়ের হাতে। পয়সা সে নিতে চায়নি। বারবার বলেছে, ‘আপনার দেখা হওয়া আমাদের জীবনের এক শ্রেষ্ঠ ঘটনা। আপনার কাছ থেকে আমরা ভাড়া নিতে পারবো না।’
আহমদ মুসা বলেছে, ‘আমি ভাড়া দেইনি। হিসেব না করেই অল্প কিছু পয়সা দিয়েছি আপনাদের পরিবারকে আমার উপহার হিসেবে।’
অনেক সংকোচ করে সে অবশেষে টাকা নিয়েছে এবং বলেছে, ‘আবার কোথায় দেখা পাবে আপনার?’
‘আমি আপনাদের ঠিকানা নিয়েছি। আমিই খোঁজ করব আপনাদের।’বলেছে আহমদ মুসা।
‘জর্জ স্যারদের ওখানে খোঁজ করলে আপনাকে পাবো না? বলেছে বৃদ্ধ।
‘নিশ্চয় খোঁজ পাবেন।’আহমদ মুসা বলেছে।
আহমদ মুসা বোট থেকে নামার জন্যে উঠে দাঁড়ানোর পর নিচু হচ্ছিল ব্যাগটা হাতে নেবার জন্যে।
আবু বকর ছুটে এল এবং ডেক থেকে ব্যাগ নিয়ে আহমদ মুসার
হাতে তুলে দিল।
আহমদ মুসা আবু বকরের পিঠ চাপড়ে বলল, ‘তোমার পূর্বপুরুষ সোংগাই সেনাধ্যক্ষ আবু বকর মোহাম্মদের মত তোমাকে হতে হবে।
পারবে না?’
হাসিতে মুখ উজ্জ্বল করে যুবকটি বলল, ‘পারবো স্যার।’
‘স্যার নয়, ভাই বলবে। ঠিক আছে?’
যুবকটি মাথা নেড়ে বলল, ‘ঠিক আছে।’
আহমদ মুসা বিদায় নেবার জন্যে প্রৌঢ়ের দিকে ফিরল।
প্রৌঢ়ের মুখ গম্ভীর।
আহমদ মুসা কিছু বলার আগে সে বলল, ‘আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি।’
‘কি সিদ্ধান্ত?’বিস্মিত কণ্ঠ আহমদ মুসার।
‘পূর্ব পুরুষের ধর্মে আমি ফিরে যাব।’
বলেই ছেলের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তোমার কি মত?’
‘আমি তো আগেই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি।’
আহমদ মুসা ‘আল্লাহু আকবার’বলে প্রৌঢ়কে, তারপর যুবক আবু বকরকে বুকে জড়িয়ে ধরল।
আহমদ মুসা যখন বোট থেকে নেমে বিদায় নিল, তখন প্রৌঢ় ও তার ছেলে দু’জনেরই চোখে অশ্রু চিক‌চিক করছিল।
প্রৌঢ়ের কাছে সিদি কাছেম-এ যাওয়ার যে দিক নির্দেশিকা পেয়েছিল তা অনুসরণ করেই আহমদ মুসা তখনও চলছিল।
গ্রামের মেঠোপথ। ঘাসে মোড়া।
এর উপর দিয়ে ‘অটো হুইলার’এর মত গাড়িও চলে।
রাস্তার দু’ধারের মাঠে কোথাও লেবুর ক্ষেত, কোথাও শশার ক্ষেত। উঁচু টিলার মত জায়গাগুলোতে প্রচুর আনারসের ক্ষেতও দেখা গেল। কিন্তু প্রচুর জায়গা খালি পড়ে আছে।
রাস্তার দু’ধারে মাঝে মাঝে গ্রামও দেখা যাচ্ছে। গ্রামগুলো জনবহুল নয়।
গ্রামের নারী-পুরুষের পরণে প্যান্ট-সার্ট, প্যান্ট গেঞ্জী, আবার অনেকের পরণে স্থানীয় পোশাক। কিছু কিছু মেয়ের পরণে স্কার্ট, সার্ট, ফ্রক, গাউনও রয়েছে।
গ্রামের মানুষ অধিকাংশই কালো। কিছু রয়েছে মিশ্র, যাদের অনেকে বাদামী ও সোনালী রংয়ের। শ্বেতাংগও দু’চার জন দেখা গেছে।
তাদের অধিকাংশের ভাষা ইংরেজী-স্প্যানিশ মেশানো। কেউ পরিস্কার ইংরেজীতেও কথা বলে।
আহমদ মুসা দুই ভাষাই জানে বিধায় তার কোন অসুবিধা নেই।
একটা বড় গ্রামের মধ্যে দিয়ে চলছিল আহমদ মুসা।
দু’ধারে গ্রাম বিস্তৃত, মাঝখান দিয়ে সড়ক।
সে সড়ক দিয়ে চলার সময় রাস্তার ডান পাশে একটা ঘরের উপর
নজর পড়তেই চমকে উঠল আহমদ মুসা।
ঘরটিতে কাঠের বেড়া, টিনের ছাদ। ঘরটির একটি দরজা। দরজা বরাবর উপরে ছাদে একটা কাঠের গম্ভুজ।
সড়কটি উত্তর-পশ্চিম কোণাকুণি হলেও সড়কের পাশের ঘরটি ঠিক পূর্বমুখী।
‘ঘরটি কি মসজিদ?’দেখার সংগে সংগে এই প্রশ্নটা আহমদ মুসার মনে জাগল।
ঘরটি যে মসজিদ টুপি মাথায় একজনকে ভেতর থেকে বের হয়ে আসতে দেখে একেবারে নিশ্চিত হলো আহমদ মুসা।
টুপি মাথায় দেয়া লোকটি বেরিয়ে বারবার রাস্তার দিকে তাকাল। তাকানোর মধ্যে কারও জন্যে প্রতিক্ষার ভাব। হঠাৎ আহমদ মুসার মনে পড়ল আজ শুক্রবার। সংগে সংগে তার কাছে পরিস্কার হয়ে গেল নামাযের জন্যে মসজিদে সমবেত হয়েছে মুসল্লিরা।
ঘড়ি দেখল আহমদ মুসা। বেলা ১টা বাজে।
আহমদ মুসা তাড়াতাড়ি উঠে গেল মসজিদে।
নলকূপ থেকে পানি নিয়ে অজু করল। টুপি ওয়ালা যে লোকটি বাইরে বেরিয়ে এসেছিল কৌতূহল নিয়ে তাকিয়েছিল আহমদ মুসার দিকে।
আহমদ মুসা অজু শেষ করে উঠে দাঁড়ালে সে কিছু বলতে যাচ্ছিল। আহমদ মুসা তাকে সালাম দিল।
সে ‘অ’লাকুম ছালাম’বলে সালাম নিয়ে বলল স্প্যানিশ মেশানো ইংরেজী ভাষায়, ‘নিশ্চয় আপনি বিদেশী? কোথায় বাড়ি?’
‘এশিয়ায়।’
কথা শেষ করেই আহমদ মুসা আবার বলে উঠল, ‘চলুন, নামায পড়ি। পরে কথা বলব।’
বলে আহমদ মুসা মসজিদে প্রবেশ করল।
মসজিদে প্রবেশ করার সময় আহমদ মুসার সালামের প্রতি সকলের দৃষ্টি আকৃষ্ট হলো। সকলেই একবার তাকাল আহমদ মুসার দিকে। সম্ভবত এভাবে সালাম কেউ দেয় না। যেহেতু কেউ নামায অবস্থায় নেই, বসে আছে, সে জন্যেই সালাম দিয়েছে আহমদ মুসা।
মসজিদে বিশ পঁচিশজনের মত মুসল্লি।
সুন্নত নামায শেষ করে সবার উপর একবার চোখ বুলাতে গিয়ে আহমদ মুসা দেখল, সবার মুখে একটা অস্বস্তির ভাব। যে লোকটিকে আহমদ মুসা বাইরে যেতে দেখেছিল এবং কথা বলেছিল, তাকে বারবারই বাইরে যেতে দেখল। একটা অস্থির ভাব তার মধ্যে।
আহমদ মুসা ঘড়ির দিকে তাকাল। বেলা তখন সোয়া একটা।
পাশের মুসল্লিটি একজন যুবক।
আহমদ মুসা তাকে অনুচ্চ কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল, ‘ইমাম ক’টায় খুতবা দেন?’
প্রথমে যুবকটি বুঝল না। সম্ভবত খুতবা অথবা ইমাম-এর উচ্চারণ তার কাছে কোনদিক দিয়ে নতুন মনে হয়েছে।
আহমদ মুসা তাকে বুঝিয়ে বলার পর সে বুঝল এবং বলল, ‘সোয়া একটায় হয়, কিন্তু ইমাম সাহেব আসেননি। বন্দরে গেছেন। নামাযের আগেই তার ফেরার কথা ছিল।’
আরও কিছুটা সময় চলে গেল।
প্রথম সারি থেকে একজন বয়স্ক লোক উঠে দাঁড়াল। তার মুখ ভরা দাড়ি। একমাত্র তার মাথায় পাগড়ী আকারে কাপড় বাঁধা। বলল ইংরেজী ও স্প্যানিশ মেশানো ভাষায়, ‘ভাইগণ, ইমাম সাহেব এখনও ফিরলেন না। আর দেরিও করা যায় না। খুতবা হচ্ছে না। এখন আমরা যোহরের নামায পড়ব।’
‘খুতবা পড়ার মত আর কেউ নেই?’বলে উঠল আহমদ মুসা সেই বৃদ্ধকে লক্ষ্য করে।
‘না নেই। গ্রামের যাকে আমরা ইমামের দায়িত্ব দিয়েছি, শুধু তিনিই পোর্টরিকোতে ৬ মাস থেকে কিছু শিখে এসেছেন’। বলল সেই প্রবীণ ব্যক্তি।
‘আপনাদের আপত্তি না থাকলে আমি খুতবা দিতে পারি।’বলল
আহমদ মুসা।
বিস্ময় ও কৌতূহল মিশ্রিত চোখে তাকাল প্রবীণ ব্যক্তিটি আহমদ
মুসার দিকে।
তারপর তিনি তাকালেন অন্যদের দিকে।
সবার দৃষ্টি আহমদ মুসার দিকে।
এই সময় আহমদ মুসার সাথে বাইরে কথা বলা লোকটি বলে উঠল, ‘উনি বিদেশী। এশিয়ায় দেশ। রাস্তা দিয়ে যা্চ্ছিলেন, মসজিদ দেখে নামায পড়ার জন্যে উঠে এসেছেন।’
প্রবীণ ব্যক্তিটি জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসাকে, ‘আপনার নাম কি?’
‘আহমদ আবদুল্লাহ।’
‘আপনাকে পেয়ে আমরা আনন্দিত। আসুন খোতবা দিন, আমাদের নামায পরিচালনা করুন।’বলল প্রবীণ লোকটি হাসিতে গোটা মুখ তার ভরিয়ে তুলে।
বাইরে বেরুনো ও আহমদ মুসার সাথে কথা বলা লোকটিই মোয়াজ্জিন।
সে আযান দিল।
আযানের উচ্চারণে বড় কোন ভুল নেই।
খোতবার একটা বইছিল।
বইটা হাতেই রাখল আহমদ মুসা। কিন্তু খুতবা দিল আরবীতে মুখস্থ। ইচ্ছাকরেই খুতবার মধ্যে অন্য ভাষায় কিছু বলল না। এদের অনুসৃত রীতি না জেনে খুতবার মধ্যে অন্য ভাষা নিয়ে আসা ভুল বুঝাবুঝির সৃষ্টি করতে পারে। গোটা খুতবাকালে সকলের বিস্ময় বিমুগ্ধ দৃষ্টি আহমদ মুসার উপর নিবদ্ধ ছিল। নামাযও পড়াল আহমদ মুসাই।
নামায শেষে সবাই এসে ঘিরে ধরল আহমদ মুসাকে।
প্রথমেই মাথায় পাগড়ী বাঁধা প্রবীণ ব্যাক্তিটি অত্যন্ত সম্মান ও শ্রদ্ধার সাথে হ্যান্ডশেক করল আহমদ মুসার সাথে। বলল, ‘আলহামদুলিল্লাহ। এমন আরবী পড়া, এমন সুন্দর কোরআন তেলাওয়াত কোনদিন আমরা শুনিনি। ধন্য হয়েছি আমরা।’
এরপর আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে কোথায় দেশ, কি নাম, কোথায় যাবে ইত্যাদি প্রশ্নের ঢল নামল চারদিক থেকে। যতটুকু জবাব দেয়া যায়, ততটুকু করে জবাব দিল।
যখন তারা শুনল আহমদ মুসা মক্কা, মদীনা হয়ে এখানে এসেছে, তখন তাদের আবেগ আরও উথলে উঠল। মনে হলো যেন আহমদ মুসাই মক্কা-মদীনা। আহমদ মুসার সাথে কথা বললে, একটু ছুঁলেও যেন মক্কা-মদীনায় স্পর্শ তারা পাবে।
ইসলাম ও ইসলামের নবী এবং ইসলামের পবিত্র স্থানের প্রতি তাদের এই আবেগ অভিভূত হলো আহমদ মুসা।
আহমদ মুসাও তাদের কাছ থেকে অনেক কিছু শুনল।
গ্রামের নাম ওকারী।
সবাই কৃষ্ণাংগ আফ্রিকান। প্রথমে তাদের পূর্ব পুরুষরা ডোমিনিকান অঞ্চলে ছিল। সেখান থেকে তারা এসেছে এই অঞ্চলে।
এই গ্রামসহ আশে-পাশের গ্রামে মুসলমানরাই সংখ্যা গরিষ্ঠ। দক্ষিণ টার্কো দ্বীপের এক তৃতীয়াংশ মুসলমান। বাকিরা খৃষ্টান। কিন্তু অন্যান্যরা আফ্রিকার আঞ্চলিক ধর্মে বিশ্বাসী।
এই অঞ্চলে এই একটি মসজিদ। সমগ্র দক্ষিণ টার্কো দ্বীপে মসজিদের সংখ্যা মাত্র দু’টি। অন্য মসজিদটি সিডি কাকেম গ্রামে। দ্বীপের উত্তারঞ্চলে শিক্ষা ও ব্যবসায় বাণিজ্যে উন্নত খৃষ্টানদের প্রাধান্য বেশি। ঐ অঞ্চলে আফ্রিকার আঞ্চলিক ধর্মে বিশ্বাসী লোকদের সংখ্যাও বেশি।
ধর্ম শিক্ষক ও ইমামের খুব অভাব। দুই মসজিদে দু’জন ইমাম
আছেন, যারা পোর্টরিকোর এক মসজিদ থেকে ৬ মাস ট্রেনিং নিয়ে এসেছেন। নামায পড়ানো, ধর্ম শিক্ষা দেয়ার ব্যাপারে তারাই সব এ অঞ্চলের।
তাদের পূর্ব পুরুষরা আফ্রিকার কোন অঞ্চল থেকে এখানে এসেছে তা বলতে পারলো না। তবে আহমদ মুসা গ্রামের আফ্রিকান নাম দেখে অনুমান করল তাদের পূর্ব পুরুষদের দক্ষিণ নাইজেরিয়া অঞ্চল থেকে ধরে আনা হতে পারে। দক্ষিণ নাইজেরিয়ার’বেনু’নদীর তীরে’ওকারী’নামে একটা ছোট্র শহর আছে।
আহমদ মুসা কথায় কথায় তাদের অসুখ-বিসুখ ও চিকিৎসা সুযোগের কথা তুলে শিশুদের চিকিৎসা ও পরিচর্যা সম্পর্কে জানতে চাইল। তার লক্ষ্য, ছেলে শিশু মৃত্যুর ব্যাপারে কোন তথ্য পাওয়া যায় কিনা।
আহমদ মুসা জানতে পারল, দ্বীপে একমাত্র ডাক্তারখানাটি বন্দরে। গ্রামাঞ্চলে কিছু গ্রাম্য ডাক্তার আছে। হাসপাতাল আছে গ্রান্ড টার্কস শহরে। ইদানিং শিশু চিকিৎসায় সংকট দেখা দিয়েছে। জন্মগ্রহণের পর বেশীর ভাগ শিশু বাঁচছে না।
‘কোন শ্রেণীর শিশু বেশি মারা যাচ্ছে? ছেলে না মেয়ে?’জিজ্ঞেস
করে আহমদ মুসা।
প্রবীণ ব্যক্তিটি সংগে সংগে উত্তর দিল না। চিন্তা করল, তারপর এর ওর দিকে তাকাল, নিচু স্বরে কয়েকটা কথা বলল। সবশেষে একটু দূরে বসা একটি তরুণের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘কলিন কামেল আমরা তো দেখছি গত ক’বছরে যত শিশু মারা গেছে তার ৯০ ভাগই ছেলে শিশু।
তুমি ডাক্তরি কলেজে পড়, হাসপাতালে যাও। তুমি কিছু বলতে পার কিনা?’
ছেলেটি বিনীতভাবে উঠে দাঁড়াল, ‘বিষয়টার প্রতি আমি লক্ষ্য রাখিনি। তবে গত কয়েকদিন আগে কলেজে শিশু মৃত্যুর হার নিয়ে আলোচনা হয়েছিল। সেখানে এ বছরের একটা পরিসংখ্যানে মৃত শিশুদের তালিকা দেয়া ছিল। আমি সেটা পড়েছিলাম। আমার মনে হয়েছিল ছেলে শিশু মৃত্যুর হার ৬০ ভাগের কিছু বেশি হতে পারে।’
‘ধন্যবাদ কামাল, ঐ তালিকায় তো সব ধর্মের শিশুরাই ছিল।’বলল আহমদ মুসা ছেলেটিকে লক্ষ্য করে।
‘জ্বি হ্যাঁ।’ছেলেটি বিনীতভাবে বলল।
আহমদ মুসা প্রবীণ ব্যাক্তিটির দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আপনার অঞ্চলে গত ক’বছরে ছেলে শিশু মৃত্যুর হার নব্বই ভাগ বললেন, অন্য ধর্মের লোকদের মধ্যে এই মৃত্যুর হার কেমন?’
প্রবীণ লোকটি চিন্তা করে বলল, ‘আমি যে হিসেবটা দিয়েছি আমাদের অর্থ্যাৎ মুসলমানদের মধ্যকার। যতটুকু খেয়াল করেছি, শিশু মৃত্যুর হার ইদানিং আমাদের চেয়ে ওদের অনেক কম।
আলোচনার এক পর্যায়ে আহমদ মুসা বলল, ‘আমি এখন উঠব। কিছু জরুরী কাজে আমি এখানে এসেছি।
আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল।
প্রবীণ ব্যাক্তিটি প্রবল বাধা দিয়ে বলে উঠল, ‘না, খেয়ে যেতে হবে। এভাবে যেতে পারেন না।’
আহমদ মুসা বিনীত কণ্ঠে বলল, ‘আজ পরিচয় হলো, সুযোগ হলে নিশ্চয় আর একদিন আসব। আজকের মত মাফ করুন।’
‘কোথায় যাবেন আপনি?’বলল প্রবীণ সেই লোকটিই।
‘সিডি কাকেম গ্রামে।’
‘এফেন্দী পরিবারের ওখানে?’
‘জ্বি হ্যাঁ।’
‘শুনেছি, ওদের কি একটা বিপদ হয়েছে।’
‘জানেন, বিপদটা কি?’
‘না। বলল প্রবীণ লোকটি।
‘জানি আমি।’বলল কলিন কামাল ছেলেটি।
‘কি জান?’বলল আহমদ মুসা।
‘পাশা পরিবারের জেনিফার আপা টার্কস দ্বীপপুঞ্জের বাসিন্দাদের
উপর পরিচালিত কি এক সমীক্ষায় সহায়তা করায় বিপদে পড়েছেন। গোপন একটি সংগঠন তাদের পেছনে লেগেছে। কয়েকজনকে তারা হত্যা করেছে। জেনিফার আপার জীবন বিপন্ন। উনি পালিয়ে আছেন।’বলল কলিন কামাল।
‘এসব কথা তো পত্রিকায় বের হয়নি। কোথায় শুনেছ?’
‘আমি এখনো শুনেছি চার্লস বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের ছাত্র একজন মুসলিম বন্ধুর কাছ থেকে।’
‘তোমরা জেনিফারদের কোন সাহায্য করছ না?’
‘সবাই ঐ গোপন দলকে ভয় করে।’
‘ঐ দলটি কারা?’
‘আমি জানি না। তবে শুনেছি, সমগ্র ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জ, এমনকি এর বাইরেও তারা শক্তিশালী।’
আহমদ মুসা মসজিদের বাইরে এল। সবাই এল তার সাথে সাথে।
ঠিক এই সময়ে অটো হুইলারের শব্দ এবং নারী কণ্ঠের চিৎকার
তার কানে এল।
মুখ ফিরিয়ে দেখল, দ্বীপের অভ্যন্তর থেকে ঘাট মুখী একটা অটো
হুইলার দ্রুত এগিয়ে আসছে। ঐ গাড়ি থেকেই আসছে নারী কণ্ঠের চিৎকার।
রাস্তার পাশে মসজিদের স্থানটা বেশ উঁচু। এখানে সড়ক অপেক্ষাকৃত নিচু।
গাড়ি একটু দূরে থাকতেই আহমদ মুসার চোখে পড়ল, এক শ্বেতাংগ গাড়ি ড্রাইভ করছে, আরেকজন শ্বেতাংগ তার পাশে বসে। পেছনের ভ্যান বক্সে আরও দু’জন শ্বেতাংগ বসে। তাদের পায়ের কাছে গাড়ির মেঝেতে পড়ে আছে একটি মেয়ে। সম্ভবত তার হাত-পা বাঁধা।
গাড়ি আরও কাছে এল।
আহমদ মুসা দেখল, ভ্যান বক্সের একজন শ্বেতাংগ গাড়ির মেঝেতে পড়ে থাকা মেয়েটির বুকে এক পা রেখেছে, আরেক পা মেয়েটির মুখে।
মেয়েটি অবিরাম মুখ এদিক ওদিক করে চিৎকার করছে ‘বাঁচাও’ ‘বাঁচাও’বলে।
আহমদ মুসার গোটা শরীরে প্রবল এক উষ্ণ স্রোত বয়ে গেল। শক্ত হয়ে উঠল তার হাত, পা, গোটা শরীর। তার মনে হলো, ঐ মেয়েটির ‘বাঁচাও”বাঁচাও’ আর্ত চিৎকারের মধ্যে গোটা মানবতার আর্ত ক্রন্দন যেন সে শুনতে পাচ্ছে।
সিদ্ধান্ত নিতে মুহূর্তও বিলম্ব হলো না আহমদ মুসার। বিলম্ব হলো
না তা কার্যকরী করতে।
আহমদ মুসা লাফিয়ে পড়ল নিচে। গাড়ির সামনে।
দু’হাত উঁচু করে বলল, ‘দাঁড়াও।’
ড্রাইভার শ্বেতাংগের মুখে তাচ্ছিল্যের হাসি ফুটে উঠল।
সে গাড়ি দাঁড় করাল।
লাফ দিয়ে নামল ড্রাইভিং সিট থেকে। তার সাথে সাথেই নামল তার পাশের জনও।
ড্রাইভিং সিটের লোকটি গটগট করে এসে আহমদ মুসার সামনে
দাঁড়াল। বলল, ‘দাঁড়িয়েছি। বল, কি জন্যে দাঁড়াতে বললি?’
‘যে মেয়েটি বাঁচার জন্যে চিৎকার করছে তাকে ছেড়ে দাও।’শান্ত কণ্ঠে বলল আহমদ মুসা।
ড্রাইভিং সিট থেকে নামা লোকটি হাসল। পেছনে তাকিয়ে ভ্যান বক্সের শ্বেতাংগ দু’জনের দিকে চেয়ে বলল, ‘তোরা নেমে আয়। মেয়েটিকে ছেড়ে দিতে বলছে। ছেড়ে দিবি কিনা দেখ।’
ওরা নেমে এল সংগে সংগেই।
ওরা এসে দাঁড়াল আগে থেকে দাঁড়ানো দু’জনের পাশেই।
ড্রাইভিং সিটের সেই লোকটিই আবার মুখ খুলল। কৌতুকের সুরে বলল, ‘বল আবার। কি যেন বলছিলি?’
‘আবার বলছি শুনুন, ইচ্ছার বিরুদ্ধে যে মেয়েটিকে ধরে নিয়ে যাচ্ছেন, তাকে ছেড়ে দি…।’
আহমদ মুসা কথা শেষ হবার আগেই ভ্যান বক্স থেকে নেমে আসা দু’জনের একজন ঝাঁপিয়ে পড়ল আহমদ মুসার উপর।
আহমদ মুসার চোখ-কান খাড়া ছিল আগে থেকেই। ত্বড়িৎ আহমদ মুসা তার দেহ কাত করে একদিকে সরিয়ে নিল। লোকটি সশব্দে পড়ে গেল মাটির উপর।
মাটিতে পড়ে গিয়েই আঘাত পাওয়া মাথা ও বুক নাড়তে নাড়তে
উঠে দাঁড়াল গোঁ গোঁ করতে করতে।
উঠেই মরণপণ এক ঘুষি চালালো আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে।
আহমদ মুসা ঘুষিটা বাম হাতে ঠেকিয়ে ডান হাতের দু’টি ঘুষি পর পর চালাল লোকটির তলপেটে।
লোকটি পেট চেপে ধরে বাঁকা হয়ে বসে পড়ল।
ড্রাইভিং সিটের লোকটিই বোধহয় হবে তাদের দলনেতা।
সে এবার দু’হাত মুষ্টিবদ্ধ করে ঝড়ের মত এগিয়ে এল।
আহমদ মুসা দু’ধাপ পিছিয়ে দু’পায়ের ফ্লাইং কিক চালাল ঝড়ের মত এগিয়ে আসা লোকটির বুকে।
উল্টে চিৎ হয়ে পড়ে গেল সে মাটিতে।
ফ্লাইং কিক ছুড়ে দেয়ার পর আহমদ মুসাও পড়ে গিয়েছিল মাটিতে।
আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াবার আগেই দেখল, অবশিষ্ট দু’জন ঝাঁপিয়ে পড়ছে তার উপর।
আহমদ মুসা ছিটকে সরে গিয়ে আত্মরক্ষা করল।
মসজিদের সামনে দাঁড়ানো লোকের ভয় ও উদ্বেগ নিয়ে তাকিয়ে আছে ঘটনার দিকে।
গাড়ির মেঝেতে পড়ে থাকা হাত-পা বাঁধা মেয়েটি উঠে বসে তাকিয়ে আছে। আতংক ও মত্যু ভয় তার চোখে-মুখে।
আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াবার আগেই দেখল ড্রাইভিং সিটের লোকটিসহ সবাই রিভলবার বের করেছে।
আহমদ মুসার উপর ঝাঁপিয়ে পড়া শেষ দু’জনের একজন আহমদ মুসার পাশেই পড়েছিল।
সেও পকেট থেকে রিভলবার বের করতে করতে উঠে দাঁড়াচ্ছে।
সময় ছিল না আহমদ মুসার হাতে। তিনটি রিভলবারের নল তাক করেছে।
আহমদ মুসা শোয়া অবস্থাতেই পাশের প্রায় দাঁড়িয়ে পড়া লোকটার পা ল্যাং মেরে উল্টো দিকে ঠেলে দিল।
লোকটির দেহ বোঁটা থেকে খসে পড়া ফলের মত এসে পড়ল আহমদ মুসার গায়ের উপর। তার হাতের রিভলবারটা তার হাত থেকে খসে একেবারে গিয়ে পড়েছিল আহমদ মুসার মুখে।
আহমদ মুসা লোকটিকে ল্যাং মারার সাথে সাথেই হয়েছিল গুলীর শব্দ।
লোকটি আহমদ মুসার উপর এসে না পড়লে গুলীটি আহমদ মুসার বুক বিদ্ধ করতো। মুহূর্তে দৃশ্যপটের পরিবর্তনে গুলীটি আহমদ মুসার বদলে এফোঁড় ওফোঁড় করে দিল আহমদ মুসার বুকের উপর আছড়ে পড়া লোকটির বুক।
আহমদ মুসা বাম হাত দিয়ে লোকটিকে নিজের বুকে চেপে ধরে
রেখেই তার মুখের উপর ছিটকে পড়া রিভলবারটি তুলে নিয়ে শুয়ে থেকেই রিভলবারের ট্রিগার একের পর এক চেপে রিভলবারের সামনে দিয়ে অর্ধচন্দ্রকারে ঘুরিয়ে নিয়ে এল।
চোখের পলকে তিনজন বুকে গুলী বিদ্ধ হয়ে ঢলে পড়ল মৃত্যুর কোলে।
আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল।
চারদিকে তাকাল আহমদ মুসা।
ভ্যান বক্সে বসে থাকা হাত-পা বাঁধা মেয়েটি কাঁপছে। তার মুখ মরার মত পাংশু। অনেকটা ভূত দেখার মতই সে তাকিয়ে আছে আহমদ মুসার দিকে।
মসজিদের সামনে দাঁড়িয়ে আছে মাথায় পাগড়ী পরা সেই প্রবীণ
লোকটি। তার পেছনে আর দু’জন যুবক। নিশ্চয় প্রবীণ লোকটিরই ছেলে বা আত্মীয় হবে যারা তাদের বাপ বা আত্মীয়কে ফেলে পালায়নি।
আহমদ মুসা কয়েক ধাপ এগিয়ে প্রবীণ সেই ব্যক্তিকে লক্ষ্য করে বলল, ‘জনাব কিছু বলবেন আপনি?’
সে দাঁড়িয়ে ছিল পাথরের মত। তার চোখে-মুখে আতঙ্ক এবং বিস্ময়।
আহমদ মুসার প্রশ্নের উত্তরে একটু সময় নিয়ে সে বলল, ‘আপনাকে ধন্যবাদ, আপনি একটি মেয়ের জীবন ও ইজ্জত রক্ষা করেছেন। কিন্তু এই দ্বীপাঞ্চলে শ্বেতাংগ হত্যা একটা সাংঘাতিক ব্যাপার। একজন শ্বেতাংগ হত্যার বিনিময়ে ডজন ডজন কৃষ্ণাংগকে নিহত হতে হয়। সেই কৃষ্ণাংগরা যদি মুসলমান হয়, তাহলে তো আর কোন কথায় নেই।
দেখুন, সবাই আতংকে পালিয়েছে।’
‘বলুন, আপনার কি পরামর্শ?’বলল আহমদ মুসা।
‘আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। তবে এর পরিণতি যাই হোক আমাদের মেনে নিতে হবে। করার কিছুই নেই।’বলল প্রবীণ লোকটি।
‘আমার দুটি পরামর্শ আছে জনাব।’
‘কি?’
‘প্রথম পরামর্শ, এই চারটি লাশ দূরে কোথাও সরিয়ে ফেলতে হবে। এখানকার সব রক্তের দাগ মুছে ফেলতে হবে। তারপর আপনারা কোন কিছু জানেন না, এই ভূমিকা গ্রহণ করতে হবে। দ্বিতীয় পরামর্শ, ‘আপনাদের মৎস ঘাটে এদের মোটর বোট নোঙর করা আছে। ওখানে একজন লোক ওদের আছে। আপনারা গিয়ে তাকে খবর দিন, তাদের চারজন লোক একজন বিদেশীর হাতে এখানে খুন হয়েছে। বিদেশী লোকটি তাদের খুন করে তাদের ধরে আনা একটি মেয়েকে মুক্ত করে লাশসহ অটো হুইলার নিয়ে দ্বীপের ভেতরে পালিয়ে গেছে। বিদেশীর হাতে বন্দুক ছিল বলে আপনারা কিছু করতে পারেননি।’
প্রবীণ লোকটি পরামর্শ দু’টি শুনে সংগে সংগেই কিছু বলল না। চিন্তা করল। একটু পর বলল, ‘আপনার দ্বিতীয় পরামর্শ গ্রহণ করার অর্থ অন্যায়ের পক্ষ অবলম্বন করা এবং উপকারী ভাইয়ের বিরুদ্ধে লড়াই-এ অবতীর্ণ হওয়া। আমরা এটা পারবো না। সুতরাং আপনার প্রথম পরামর্শ আমরা গ্রহণ করছি। তবে এ বিষয়টা গোপন থাকবে না, তারা জানতে পারবেই। জানতে পারার পর অবস্থা খুবই ভয়াবহ হবে।’
‘তাহলে দ্বিতীয় পরামর্শ আপনারা গ্রহণ করছেন না কেন?’
‘আমাদের অনেকেই হয়তো এটা গ্রহণ করতে রাজী হবে। কিন্তু শত্রুদেরকে গিয়ে বলে দিলেই কি আমরা বেঁচে যাব? তারা কিছুতেই আমাদের সন্দেহের বাইরে রাখবে না। তার ফলে এ ক্ষেত্রেও পরিণতি খুব ভাল হবে না। সুতরাং প্রথম পরামর্শই আমাদের জন্যেই শ্রেয়তর।’
বলে একটু থামল প্রবীণ লোকটি। একটা ঢোক গিলেই আবার বলে উঠল, ‘আপনি তাড়াতাড়ি চলে যান। মেয়েটিকেও আপনি পৌঁছে দেবেন।’
‘না, এখান থেকে লাশ সরানো এবং সব ঠিক ঠাক করার পর আমি যাব।’আহমদ মুসা বলল।
প্রবীণ লোকটি হাত জোড় করে বলল, ‘না, না, আপনি যান;মেয়েটি এবং আপনি আবারও বিপদে পড়তে পারেন।’
‘কিন্তু আপনারা তো বিপদে পড়ে গেছেন।’
হাসল প্রবীণ লোকটি। বলল, ‘আমরা বংশ পরম্পরায় এই বিপদের সাথেই তো লড়াই করছি। আফ্রিকার মাতৃভূমি থেকে আমাদের পূর্ব পুরুষরা ছিটকে পড়ার পর কোন মাটিতেই আমরা দাঁড়াতে পারছি না। অনেক দেশ, দ্বীপ পাল্টে এখানে এসেছি আমরা। এ মাটি আমাদের মাতৃভূমি হবে তা বলব কি করে?’
কথা শেষ করেই প্রবীণ লোকটি পাশের দুই যুবককে বলল কয়েকজন লোককে ডাকতে এবং কোদাল নিয়ে আসতে।
আহমদ মুসা একটু চিন্তা করে প্রবীণ লোকটিকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘জনাব এ লাশ চারটির দায়িত্ব আমি নিচ্ছি। আমি গাড়ি করে নিয়ে নিরাপদ কোথাও লুকিয়ে ফেলব। আপনারা এ জায়গাটা পরিস্কার করুন।’
বলেই আহমদ মুসা অটো হুইলারের ভ্যান বক্সে মেয়েটির কাছে উঠে এল।
মেয়েটি একুশ বাইশ বছরের তরুণী। গায়ের রং সোনালী। চোখ
নীল।
তার চেহারায় সেমেটিক, রেডইন্ডিয়ান ও আফ্রিকি বৈশিষ্টের সমন্বয়। এই বৈশিষ্ট মেয়েটিকে এক অপরূপ সুষমা দান করেছে।
মেয়েটি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে আহমদ মুসাকে। তার চোখে ভয় এবং আশার আকুতি।
আহমদ মুসা মেয়েটির মুখোমুখি হয়ে বলল, ‘দেখি বোন বাঁধন
খুলে দেই।’
আহমদ মুসা চাকু দিয়ে বাঁধন কেটে ফেলল। তারপর বলল, ‘বোন আপনি সামনে ড্রাইভিং সিটের পাশের সিটে গিয়ে বসুন। এখানে লাশগুলো উঠবে।’
বলে আহমদ মুসা ভ্যান বক্স থেকে নেমে এল।
মেয়েটিও নেমে এল পেছনে পেছনে যন্ত্রের মতো। নির্দেশ মত গিয়ে সিটে বসল।
প্রবীণ লোকটির ডেকে পাঠানো লোকেরা আসার আগেই আহমদ
মুসা চারটি লাশ তুলে ফেলল ভ্যান বক্সে।
তার আগে আহমদ মুসা চার জনের চারটি রিভলবার কুড়িয়ে নিয়ে নিজের ব্যাগে ঢুকিয়ে ব্যাগটি গাড়ির ড্রাইভিং সিটের পাশে রাখল।
লাশ চারটির পকেটে কাগজপত্র কিছু পেল না, মাত্র চারটি মানিব্যাগ। প্রত্যেকটি মানিব্যাগেই বেশ কিছু করে পাউন্ড আছে।
প্রবীণ লোকটি নেমে এসেছে তখন রাস্তায়। ততক্ষণে আরও কয়েকজন এসেছে।
আহমদ মুসা চারটি মানিব্যাগ প্রবীণ লোকটির হাতে তুলে দিয়ে বলল, ‘মানিব্যাগের টাকাগুলো যদি নিহত লোকদের পরিবারের হাতে পৌছানো যেত তাহলে সবচেয়ে ভাল হতো। তা সম্ভব নয় যখন, তখন এ টাকাগুলো আপনি ইয়াতিম দরিদ্রদের দান করে দিতে পারেন।’
‘কেন যুদ্ধক্ষেত্র থেকে কুড়িয়ে পাওয়া মাল কি যোদ্ধারা নিতে পারে না?’বলল প্রবীণ লোকটি।
আহমদ মুসা হাসল। বলল, ‘এটা তো কোন ঘোষিত যুদ্ধ ছিল না। আমরা একে অপরকে চিনি না। সুতরাং যুদ্ধলদ্ধ মাল এটা নয়। এ টাকাগুলো নীতিগত ভাবে নিহতদের পরিবারের প্রাপ্য।’
প্রবীণ লোকটি এবং তার সাথীরা বিস্ময়-বিমুগ্ধ চোখে তাকিয়ে ছিল আহমদ মুসার দিকে। বলল প্রবীণ লোকটি অবাক কণ্ঠে, ‘আপনার মত এমন কথা কখনও শুনিনি। এমন মনুষ থাকতে পারে বলেও জানতাম না। যতই সময় যাচ্ছে, আপনাকে দেখে আমরা অভিভূত হচ্ছি।’
তার কথার দিকে কান না দিয়ে আহমদ মুসা বলল, ‘জনাব আমি এখন যাচ্ছি। কিন্তু মনে রাখবেন, আমি আপনাদের পাশে আছি।’
বলে সবাইকে সালাম দিয়ে আহমদ মুসা অটো হুইলারের ড্রাইভিং সিটে এসে বসল।
গাড়ি ছুটে চলল উত্তরে দ্বীপের অভ্যন্তরে।
মেয়েটি গাড়ির জানালার প্রান্ত বাম হাতে আঁকড়ে ধরে মাথা নিচু করে বসেছিল।
তার গায়ে ম্যাক্সির মত একটি জামা। পরণে শর্ট ধরণের কিছু থাকতে পারে। খুবই ইনফরমাল পোশাক। সম্ভবত মেয়েটিকে ওরা যে অবস্থায় পেয়েছে, সেই অবস্থায় ধরে নিয়ে এসেছে। ওরা কারা ছিল? মেয়েটিই বা কে? তবে মেয়েটা যে শিক্ষিত, বুদ্ধি দীপ্ত ও অভিজাত তা তার চেহারা দেখেই বুঝা যায়।
পরক্ষণেই আহমদ মুসার মনে এ চিন্তার চেয়ে চারটি লাশের চিন্তাই বড় হয়ে উঠল।
মিনিট পনের ড্রাইভ করার পর আহমদ মুসা মেয়েটির দিকে চেয়ে বলল, ‘এ এলাকাতেই আপনার বাড়ি?’
মেয়েটি মুখ না তুলেই জবাব দিল, ‘জি।’
‘আপনি কি বলতে পারেন, এ লাশগুলো কোথায় লুকিয়ে ফেলা
যায়, এমন জায়গা এদিকে কোথাও আছে?’
মেয়েটি মুহূর্তের জন্যে আহমদ মুসার দিকে একবার তাকাল। তার দৃষ্টিতে ভয়ের চিহ্ন নেই, তার দৃষ্টিতে এখন বিস্ময়, শ্রদ্ধা ও মুগ্ধতা।
চোখ নামিয়ে মেয়েটি বলল, ‘আর দশ মিনিট ড্রাইভ করার পর
‘সেবু’নদীর ব্রীজ পাওয়া যাবে। নদীতে বেশ স্রোত আছে। ওখানে লাশগুলো ফেলে দেয়া যায়।’
‘ধন্যবাদ আপনাকে। এটাই করব।’
মেয়েটি আর কিছু বলল না। আহমদ মুসাও নীরব।
অল্পক্ষণ পর আহমদ মুসা বলল, ‘আপনাকে প্রশ্ন করতে পারি?’
চোখ দু’টি সামনে রাস্তার উপর প্রসারিত রেখে জিজ্ঞেস করলল আহমদ মুসা।
মেয়েটি মুহূর্তের জন্যে আহমদ মুসার দিকে চোখ তুলে আবার নামিয়ে নিল। বলল, ‘অবশ্যই।’
‘নিহত এই চারজন কে?’
‘আমি জানি না।’
‘এদের চেনেন না?’
‘জি না। কাউকেই চিনি না।’
‘আপনাকে এরা নিয়ে যাচ্ছিল কেন?’
‘আমাকে হত্যা করাই এদের উদ্দেশ্য।’
কিন্তু হত্যা করার জন্য নিয়ে যেতে হবে কেন। হত্যা করে রেখে যেতে পারতো। নিয়ে যাচ্ছিল কেন?’
‘আমি জানি না।’
আহমদ মুসা একটু ভাবল;তারপর বলল, ‘আপনাকে ওরা হত্যা করবে কেন?’
মেয়েটি একটু সময় নিয়ে জবাব দিল।বলল, ‘ঐ শ্বেতাংগ গ্রুপ
আমাদের অস্তিত্বেরও বিরোধী।’
আহমদ মুসা বুঝল মেয়েটি জবাব এড়িয়ে যাচ্ছে। হতে পারে শ্বেতাংগরা অশ্বেতাংগদের চরম বিরোধী। কিন্তু তারা কারো কারো অস্তিত্বের বিরোধী হয়ে উঠবে কেন? আহমদ মুসা আর কোন প্রশ্ন করল না।
‘সেবু’নদীর ব্রীজটি এসে গেল।
আহমদ মুসা গাড়ি দাঁড় করাল। নামল গাড়ি থেকে।
এলাকাটা এবড়ো-থেবড়ো একটা উপত্যকা। মাঝে মাঝে লেবু জাতীয় ফলের গাছ।
ব্রীজ থেকে একটু দূরে নদী তীরের সমতল ভূমিতে গমের গাছের
মত সবুজ ক্ষেত দেখতে পেল। জনমানবের চিহ্ন কোথাও নেই।
আহমদ মুসা এক এক করে চারটি লাশই ব্রীজ থেকে নদীতে ফেলে দিল।
আহমদ মুসা গাড়িতে ফিরে এল। তার জামা কাপড়, শরীর রক্তে ভেজা।
আহমদ মুসা ড্রাইভিং সিটে বসে বলল, ‘গাড়ি নিচে নদীর কিনারে নিয়ে যেতে চাই। গা’টা পরিস্কার করতে হবে। গাড়িটাও ধুয়ে ফেলা দরকার। আপনি কি উপরে অপেক্ষা করবেন?’
মেয়েটি অল্প একটু চুপ করে থেকে বলল, ‘রাস্তায় দাঁড়াতে ভয়
করছে। নেমে যাই, নিচে কোথাও দাঁড়িয়ে থাকব.’বলে নামতে যাচ্ছিল মেয়েটি।
‘ঠিক আছে। বসে থাকুন।’
বলে আহমদ মুসা গাড়ি ড্রাইভ করে ব্রীজের ওপারে নিয়ে রাস্তার
ঢাল বেয়ে নদীর তীরে নেমে একটা ঝোপের আড়ালে একদম নদীর কিনারে গাড়ি দাঁড় করাল।
আহমদ মুসা ব্যাগটা নিয়ে গাড়ি থেকে নামার উদ্যোগ নিল।
‘আমিও নামছি। ঝোপের ওপাশেই আমি আছি।’বলল মেয়েটি।
‘আপনি বসতে পারেন গাড়িতে।’
‘আপনি পোশাক পাল্টে পরিস্কার হয়ে নিন। আমি ওদিকে আছি।’
মেয়েটি ঝোপের আড়ালে গিয়ে ঘাসের উপর বসল।
মৃত্যুর প্রান্তে দাঁড়ানো ভয়াবহ ঘোরটি মেয়েটির এখনো কাটেনি। তবে মৃত্যুর মুখ থেকে যে তাকে ফিরিয়ে আনল আরও চারটি মৃত্যু ঘটিয়ে, সেই লোকটি তার কাছে এখন সবচেয়ে বড় গবেষণার বস্তু।’
ওকারী গ্রামের প্রবীণ চাচার কথা তার মনে পড়ল তিনি ঠিকই বলেছেন, এই লোকটির মত একজন লোকের দেখা মিলবে, সেও কোনদিন ভাবেনি। মৃত শত্রুর মানিব্যাগ তার পরিবারকে ফেরত দিতে হবে, এমন অদ্ভুত কথা কে বলতে পারে! চারজন শত্রু এবং চারটি রিভলবারের বিরুদ্ধে খালি হাতে বিজয়ী হওয়ার মত ঘটনা কে ঘটাতে পারে! ওকারী গ্রামের মানুষের গায়ে যাতে সন্দেহের আঁচড়ও না লাগে সে জন্যে সব দোষ নিজের ঘাড়ে তুলে নেয়ার কাজ একজন বিদেশী কিভাবে করতে পারে! মেয়েটির কাছে সবচেয়ে বড় মনে হলো, একজন যুবকের চোখ তার দিকে আটকে যাবার মত অবশ্যই সুন্দরী সে। কিন্তু এই যুবকের চোখ তার দিকে একবারও আটকায়নি। মনে হয়েছে, তার মত একজন সুন্দরী মেয়ে তার পাশে আছে, কাছে রয়েছে, এটা যেন সে দেখতেই পাচ্ছে না। কে এই লোক? প্রথমে ওর সাথে আসতে ভয় করেছিল। কিন্তু এখন আর ভয় করছে না। লোকটি মুসলমান সালাম দেয়া থেকেই বুঝা গেছে। কোন দেশের লোক সে? এশীয়ান তো অবশ্যই। কি করে লোকটি? ট্যুরিস্টদের মতই ব্যাগটা।
হঠাৎ মনে পড়লো মাকোনির কথা। মাকোনি তার অফিসে যাওয়া এক এশীয়ানের কথা বলেছিল। কিন্তু সেই এশীয়ানতো হয় মারা গেছে, নয়তো শয়তানদের হাতে পড়েছে। এ তাহলে কে?
আহমদ মুসার কথা মনে পড়ল মেয়েটির। মনটা ছ্যাঁৎ করে উঠল
তার। একি আহমদ মুসা হতে পারে? তার কল্পনার, তার স্বপ্নের আহমদ মুসার সাথে মিলাল সে এই লোকটিকে। তার সমগ্র অন্তর বলে উঠল এই লোকটি একমাত্র আহমদ মুসা হলেই সব দিক থেকে মানায়। লোকটি সাধারণ হয়েও একেবারে অসাধারণ। কথা ও কাজে শুধু নয়, পবিত্র এক অপূর্ব সম্মোহন আছে তার চোখে-মুখে। যা মানুষকে শুধু কাছেই টানে। ক’মিনিটই বা হলো তাকে দেখার। তার মনে হচ্ছে, ওঁর কাছে নিজের সবকিছু তুলে দেওয়া যায়।
ছোট্র শব্দে গাড়ির হর্ণ বেজে উঠল।
মেয়েটি ভাবল, ‘ও তাহলে গাড়িতে ফিরেছে। তাকে ডাকছে।
উঠে দাঁড়াল মেয়েটি। পা বাড়াল সে গাড়ির দিকে।
কিন্তু পা বাড়াতে গিয়ে একরাশ সংকোচ ও লজ্জা এসে তাকে ঘিরে ধরল। হঠাৎ করেই লজ্জা করছে তার ঐ লোকটির মুখোমুখি হতে।
এক পা দু’পা করে মেয়েটি গাড়ির কাছে গেল।
গাড়িটি ফেরার জন্যে ঘুরিয়ে নিয়েছে আহমদ মুসা। গাড়ির এদিকের দরজা খোলা।
মেয়েটি দেখল, লোকটি ড্রাইভিং সিটে বসে আছে। নতুন পোশাক তার গায়ে। দু’হাত স্টিয়ারিং-এ রেখে সামনের দিকে তাকিয়ে বসে আছে সে।
মেয়েটি গাড়ির দরজার কাছে আসতেই আহমদ মুসা মেয়েটির দিকে এক পলকের জন্যে তাকিয়ে বলল, ‘আসুন।’
মেয়েটি উঠে বসল।
সড়কে উঠে এল গাড়ি।
সড়কে উঠে গাড়ি দাঁড় করাল আহমদ মুসা। ‘আপনাকে পৌঁছে দিতে চাই। বলুন, কোথায় পৌঁছাতে হবে। আপনার বাড়ি কোথায়?’দৃষ্টি সামনে প্রসারিত রেখে কথাগুলো বলল আহমদ মুসা।
মেয়েটি তাকাল আহমদ মুসার দিকে। বলল, ‘আমার বাড়ি সিডি কাকেম গ্রামে।’
‘সিডি কাকেম গ্রামে!’বিস্মিত কণ্ঠে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসার কথায় মেয়েটি চমকে উঠল। তাকাল আহমদ মুসার দিকে। বলল, ‘চেনেন আপনি’সিডি কাকেম’গ্রাম?
‘চিনি না। কিন্তু আমি সেখানেই যাচ্ছি।’
চমকে উঠল মেয়েটি। তার মনের আকাশ থেকে একখন্ড মেঘ যেন সরে গেল। সব কিছু তার কাছে মুহূর্তে পরিস্কার হয়ে গেল।
বলে উঠল সে বিস্ময় বিজড়িত দ্রুত কণ্ঠে, ‘আপনি কি আহমদ মুসা?’
চমকে উঠল আহমদ মুসাও। একটি অপরিচিতা মেয়ের মুখে তার নাম শুনে। এক মুহূর্ত ভাবল আহমদ মুসা। তার কাছেও বিষয়টা যেন পরিস্কার হয়ে গেল। বলল মেয়েটির দিকে তাকিয়ে আহমদ মুসা, ‘আপনি নিশ্চয় লায়লা জেনিফার?’
আহমদ মুসার মুখে নিজের নাম শোনার সাথে সাথেই মেয়েটি দু’হাতে মুখ ঢেকে উপুড় হয়ে দু’হাটুতে মুখ গুজল।
বাঁধ ভাঙা বিস্ময়, আবেগ ও আনন্দে সংজ্ঞাহীনের মত নিজেকে যেন হারিয়ে ফেলল মেয়েটি। ঝর ঝর করে তার চোখ থেকে নেমে এল আনন্দের অশ্রু। আনন্দের অশ্রু কোত্থেকে যেন বাধ ভাঙা কান্না ডেকে নিয়ে এল।
ফুপিয়ে কাঁদল মেয়েটি ঐভাবে মুখ গুঁজে থেকে।
বুঝল আহমদ মুসা মেয়েটি লায়লা জেনিফার। কিন্তু স্তম্ভিত হলো মেয়েটি এইভাবে ভেঙে পড়ায়। হতে পারে, ভাবল আহমদ মুসা, কিছুক্ষণ আগের তার বিপদের কথা, হঠাৎ আহমদ মুসার দেখা পাওয়া ইত্যাদি বিষয় তাকে হয়তো আবেগ-প্রবণ করে তুলেছে।
আহমদ মুসা লায়লা জেনিফারকে লক্ষ্য করে বলল, ‘লায়লা জেনিফার খুব খুশী হয়েছি তোমার সাথে এভাবে দেখা হওয়ায়।
আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করা উচিত তিনি আমাদের সাহায্য করেছেন?’
জেনিফার ধীরে ধীরে মুখ তুলল। দু’হাত দিয়ে অশ্রু মুছে ফেলল। মুখ নিচু করেই বলল, ‘আমি দুঃখিত। আমার সৌভাগ্য আমি সহ্য করতে পারিনি। ছোট বুকে এত বড় সৌভাগ্য ধারণ করতে পারিনি আমি। আপনার সাথে এইভাবে দেখা হবে, জীবনের এক চরম সন্ধিক্ষণে আমার জন্যে আল্লাহ আপনাকে এভাবে পাঠাবেন, এমন আশা সব কল্পনার উর্ধ্বে ছিল।’
‘আল্লাহরই সমস্ত প্রশংসা।’
বলে আহমদ মুসা একটু থামল। বলল আবার, ‘তোমার বাড়ির খবর ভালো? ওরা কারও ক্ষতি করেনি তো?’
‘জি না। আমাকেই শুধু ওরা ধরে এনেছে। বাড়িতে আম্মা, দাদী ও চাকর-বাকর ছাড়া কেউ নেই এখন। বাড়ির কিংবা গ্রামের কেউ ওদের বাধা দিতে সাহস করেনি। তাই সেখানে কোন ঘটনা ঘটেনি।’নিচের দিকে চোখ রেখেই বলল লায়লা জেনিফার।
‘সিডি কাকেম কোন দিকে? যেমন চলছিল, সেই উত্তর দিকেই গাড়ি চলবে?’
‘জি। এ সড়ক আমাদের গ্রামের মধ্যে দিয়ে গেছে।’
শোনার সংগে সংগেই আহমদ মুসা গাড়ি স্টার্ট দিল।
চলতে শুরু করল গাড়ি।
‘লায়লা জেনিফার, ওরা কারা তোমাকে ধরে নিয়ে যাচ্ছিল?’আবার জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা।
‘ওরা সেই গোপন সংগঠনের লোক, যাদের কথা আমি আপনাকে লিখেছিলাম’।
‘আর কোন খুন হয়নি তো?’
‘আমার জানা মতে হয়নি।’
একটু থামল জেনিফার। সংগে সংগেই আবার শুরু করল, ‘মাকোনির অফিস থেকে ওরা একজন এশিয়ানকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল। সে এশিয়ান যদি আপনি না হন, তাহলে সে তাদের হাতে মারাও যেতে পারে।’
‘সে এশীয়ানকে ওরা ধরে নিয়ে গিয়েছিল কেন?’
‘তিনি মাকোনিকে আমার সম্পর্কে জিজ্ঞেসকরেছিলেন। এতেই তারা ধরে নিয়েছিল সেই বিদেশী নিশ্চয় আমাদের তৎপরতার সাথে জড়িত আছেন।’
‘কিন্ত সেই বিদেশীর কথা তুমি জানলে কেমন করে?’আহমদ মুসা বলল কিছুটা বিস্ময় নিয়ে।
‘মাকোনি আমাকে জানিয়েছে। মাকোনি মুসলিম এবং আমাদের
সাথে আছে।’
‘বুঝেছি, শত্রু পক্ষ সামনে হাজির ছিল বলেই সেদিন আমাকে সহযোগিতা করতে পারেনি।’
‘কিন্তু আপনাকে বলার জন্যে সে আপনার পিছু নিয়েছিল। তার ফলেই আপনার পরিণতিটা সে জানতে পারে এবং আমাকে জানায়।’
‘বুঝা যাচ্ছে, ঐ শত্রু পক্ষ মাকোনির কাছে আসে। মাকোনি তাদের পরিচয় জানতে পারেনি?’
‘আমি কোথায় আছি এটা খোঁজ নেয়া ছাড়া তারা আর কোন কথায় বলে না। ওদের ফলো করতেও মাকোনি সাহস করেনি।’
আহমদ মুসা কিছু বলতে যাচ্ছিল। কিন্তু তার আগেই লায়লা জেনিফার বলে উঠল, ‘আপনি ওদের আক্রমণে আহত সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়েছিলেন। ওরা কি আপনাকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল? আপনি ছাড়া পেলেন কিভাবে?’
‘কি করে কি হয়েছিল আমি কিছুই জানি না। আমার যখন সংজ্ঞা ফিরল, তখন দেখলাম আমি হাসপাতালে একটি ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটের অত্যন্ত নরম বিছানায় শুয়ে আছি। পাশে বসে আছেন এক মহিলা ডাক্তার। পরে জানলাম তাঁর নাম ডাঃ মার্গারেট। তিনিই জানালেন, তাঁর ভাই জর্জ আমাকে সংজ্ঞাহীন অবস্থায় হাসপাতালে নিয়ে আসে।’
‘আল্লাহর শোকর আপনি ভাল হাতে পড়েছিলেন। ডাঃ মার্গারেটের কোন তুলনা হয় না। আর জর্জের’সমাজ সেবা’তার সবচেয়ে প্রিয় হবি।’
‘হ্যাঁ ওরা খুব ভাল। ওদের বাসায় কয়েকদিন ছিলাম। জর্জই তোমার ঠিকানা দিয়ে আমাকে সাহায্য করেছে।’
একটুক্ষণ চুপ করে থাকল লায়লা জেনিফার। বলল পরে, ‘কিন্তু আপনি বন্দরে না গিয়ে উল্টো পথ দিয়ে এলেন কেন?’
‘যতটা কম লোকের নজরে পড়ি, সেটা আমি চাই। বন্দরে নেমে একজন বিদেশী সিডি কাকেম গ্রামে যাচ্ছে, এটা আমি কাউকে জানাতে চাইনি।’
‘আপনি এসব চেয়েছেন। আর আল্লাহ চেয়েছেন আপনাকে দিয়ে
আমাকে বাঁচাতে।’
‘ঠিক বলেছ।’
আবার নীরব হলো লায়লা জেনিফার।
অনেকক্ষণ পর বলল, ‘আপনি আমার পাশে বসে আছেন, আপনি গাড়ি ড্রাইভ করছেন, সবই স্বপ্ন মনে হচ্ছে আমার কাছে। অত্যন্ত নগণ্য এক বালিকার একটা ছোট্ট চিঠিকে আপনি এতটা গুরুত্ব দিয়েছেন?’
‘সেটা একটা ছোট্ট চিঠি ছিল, কিন্তু আমার কাছে তা ছিল হিমালয়ের মত ভারি। আর এমন চিঠি যিনি লিখতে পারেন, তিনি নগণ্য নন।’
আবার নীরব হলো লায়লা জেনিফার।
একটু পর বলল, ‘ছোটকে এমন বড় করে দেখতে পারেন বলেই
আল্লাহ আপনাকে এত বড় করেছেন।’ভারি কণ্ঠ লায়লা জেনিফারের।
আহমদ মুসা আলোচনা অন্যদিকে ঘুরিয়ে নিয়ে বলল, ‘ওদের সম্পর্কে কিছু জানার আগেই ওদের সাথে লড়াই শুরু হয়ে গেল। মূল বিষয়টা আমার জানা দরকার। সে জন্যেই তোমার সাহায্য নিতে ছুটে এসেছি।’
হাসল লায়লা জেনিফার। বলল, ‘জনাব মনে হচ্ছে কাজটা আপনার, গরজও আপনার, আমি বা আমরা সাহায্যকারী মাত্র।’
‘জাতির কাজ সকলের কাজ। কিন্তু যেহেতু আমি এ কাজ নিয়েই এখানে এসেছি, তাই এটাই আমার একমাত্র কাজ, কিন্তু তোমাদের একমাত্র কাজ নয়।’
‘কিন্তু কাজটা তো আমাদের?’
‘না, এটা জাতির কাজ।’
লায়লা জেনিফার গম্ভীর হলো। বলল, ‘এই জাতীয়তাবোধ কি কোথাও আছে? যদি থাকে, তাহলে ক্যারিবিয়ান মুসলমানদের এ দুর্দশা কেন?’
‘জেনিফার, ক্যারিবিয়ান মুসলমানদের খবরই শুধু তুমি জান বলে এ কথা বলছ। কিন্ত গোটা বিশ্ব জুড়েই মুসলমানরা কমবেশি দুর্দশা ভোগ করে চলেছে।’
‘আমাদের মত কি? ওকারী গ্রামে কিছুক্ষণ আগে যা ঘটল, ওটা যদি কোন ক্রমে প্রকাশ হয়ে পড়ে, তাহলে ও গ্রামের উপর কিয়ামত নেমে আসবে। পুলিশ, আইন, আদালত কিছুই তাদের পাশে দাঁড়াবে না। মুসলিম দেশে বা মুসলিম জনবহুল দেশে মুসলমানরা ভালই আছে।’
‘জেনিফার, তাদের বিপদটা তোমাদের থেকে ভিন্ন। একটু খোঁজ
নিলে জানতে পারবে, অধিকাংশ মুসলিম দেশেই ইসলামের আকিদা, বিশ্বাস নির্যাতনের শিকার। ইসলামের একনিষ্ঠ অনুসারী মুসলমানরা হত্যা, গুম, বন্দীদশা এবং সহায়-সম্পত্তির অপরিসীম ক্ষতির শিকার হচ্ছে। সেখানেও পুলিশ, আইন, আদালত তাদের কোন কাজে লাগে না।’
জেনিফারের মুখ বিস্ময়ে হা হয়ে গেল। বলল, ‘একি বলছেন আপনি? এমন কেন হবে? কারা এসব করবে? সবাই তো মুসলমান।’
‘তোমাদের যারা জুলুম অত্যাচার করছে, তারা শ্বেতাংগ এবং খৃষ্টান। আর ঐসব মুসলিম দেশে যারা এসব করছে, তারা শ্বেতাংগ, খৃষ্টান বা পশ্চিমীদের তৈরী করা লোক, যারা নামে মুসলমান, কিন্তু কাজে শ্বেতাংগ খৃষ্টানদের চেয়ে বিপদজনক।’
কথা বলল না জেনিফার।
আহমদ মুসার কথা সে বুঝার চেষ্টা করছে। বলল সে অল্পক্ষণ পর, ‘আমাদের সমস্যার সমাধানের জন্যে আপনাদের ডাকি। কিন্তু ওদের এই বিরাট সমস্যার সমাধান কে করবে?’জেনিফারের কণ্ঠে হতাশার সুর।
‘তাদের এ সমস্যার সমাধান অন্য কেউ করতে পারবে না। সেখানে অবস্থা হল, দেশ জনগণের এবং জনগণ মুসলিম। তাদের দ্বারা বা তাদের সমর্থন ও সাহায্যেই সেখানে সরকার গঠিত হয় এবং টিকে থাকে। সুতরাং জনগণ অর্থ্যাৎ মুসলিম জনগণ যদি তাদের সমস্যা উপলদ্ধি করে সচেতনভাবে ভোট দেয় এবং উপযুক্ত সরকার গঠন করে, তাহলে তাদের সমস্যার সামাধান হবে।’
‘ঐ উপলব্ধি করানোটা তো গুরুত্বপূর্ণ। ঐ কাজটা কে করবে?’
‘প্রত্যেক মুসলিম দেশেই ইসলামী আন্দোলন মানুষের চিন্তার পরিশুদ্ধি এবং তাদের সংগঠিত করার কাজ করছে। এখন তারা যত তাড়াতাড়ি জনগণের কাছে পৌছতে পারবে এবং জনগণ যত তাড়াতাড়ি তাদের গ্রহণ করতে রাজী হবে, তত দ্রুত হবে তাদের সমস্যার সমাধান।’
আহমদ মুসা থামল। থেমেই আবার শুরু করল, ‘জেনিফার তুমি
ওকারী গ্রামের বিপদের কথা বললে। সত্যই কি ঘটনাটা শত্রুর কান পর্যন্ত পৌঁছার সম্ভাবনা আছে?’
‘কোন সম্ভাবনা আমি দেখছি না। আমি’যদি’দিয়ে কথা বলেছি। যদি ফাঁস হয় তাহলে ওদের মারাত্মক বিপদ ঘটবে। অবশ্য সে বিপদটা একই সাথে বা তার আগে আমাদের উপরও আসবে।’
‘বুঝেছি, ওকারী গ্রামের খোঁজ-খবর রাখতে হবে জেনিফার।’
জেনিফার মাথা নেড়ে সায় দিল। বলল তারপর আনন্দের সাথে, ‘আমরা এখন আমাদের গ্রামে প্রবেশ করেছি। দেখুন গ্রামের লোকজন বেরিয়ে এসেছে। এ গাড়িটা আমাদের। ওরা সবাই এ গাড়ি চেনে।’
আহমদ মুসা মনযোগ দিল সামনে।
গ্রামের প্রবেশ মুখে লোকজনদের ভীড়ে আহমদ মুসাকে তার গাড়ির গতি স্লো করতে হলো।

Top