২৫. আটলান্টিকের ওপারে

চ্যাপ্টার

জেনিফারদের বৈঠকখানা।
জেনিফারের দাদী, মা, জেনিফার এবং আহমদ মুসা বৈঠকখানায় বসে। বৈঠকখানার দেয়ালে বিরাট এক জাহাজের স্কেচ পাল তোলা জাহাজ। দেখেই আহমদ মুসা বুঝল জাহাজের স্কেচটা কোন পাকা হাতের
নয়। কোন অশিল্পীর আঁকা একটা শিল্প।
আহমদ মুসা উঠে গিয়ে জাহাজের স্কেচটা আরও ঘনিষ্ঠভাবে দেখল।
কিন্ত দেখতে গিয়ে আহমদ মুসা বিস্মিত হলো। স্কেচের নিচে পরিস্কার ভাষায় লেখা, ‘ক্যাপ্টেন জোয়ান ডি লিওন-এর জাহাজ, যাতে আমি ওসমান এফেন্দী চীফ নেভীগেটর হিসাবে সফর করেছি।’অর্থ্যাৎ এ স্কেচটা শুধুই স্কেচ মাত্র নয়, এটা একটা ইতিহাস। যে ইতিহাস বিশ্বের নামকরা মিউজিয়ামে থাকার কথা।
বিস্মিত আহমদ মুসা আরও একটি কারণে। জোয়ান ডি লিওনের
বিখ্যাত জাহাজের চীফ নেভীগেটর ওসমান এফেন্দী ছিল একজন মুসলমান।
আহমদ মুসা স্কেচের সামনে দাঁড়িয়েই মাথা ঘুরিয়ে জিজ্ঞেস করল সবাইকে লক্ষ্য করে, ‘এই স্কেচ এখানে কেন? আপনারা কোথায় পেলেন?’
‘কেন জিজ্ঞেস করছ ভাই?’বলল জেনিফারের দাদী।
‘এই স্কেচটা তো এক অমূল্য ইতিহাস। এটা বিশ্বের কোন বিখ্যাত মিউজিয়ামে থাকা দরকার। আমার মনে হয়, তুরস্কের ইতিহাস যাদুঘর এটা পেলে লক্ষ লক্ষ ডলার দিয়ে কিনে নেবে।’
‘কিন্তু ভাই, এটা মুল স্কেচ নয়। মুল স্কেচটা ছিল কাঠের। সেখান থেকে আমাদের কোন এক পূর্বপুরুষ কাউকে দিয়ে হুবহু নকল করিয়ে নিয়েছেন। আমরা বংশ পরম্পরায় এটা সংরক্ষণ করে দুধের সাধ ঘোলে মিটাচ্ছি।’
আহমদ মুসা তার সোফায় ফিরে এল। বলল, ‘দাদিজান, আপনার কথা বুঝলাম না।’
‘ঐ কাঠের উপরে আঁকা স্কেচটার উত্তরাধিকারী আমরা। আমাদের কাছে ওটা থাকা উচিত ছিল। কিন্তু আমরা নকল নিয়েই তুষ্ট আছি।’
‘কিন্তু ওসমান এফেন্দীর ঐ স্কেচের উত্তরাধিকার সকল মুসলমান। বিশেষভাবে আপনারা দাবী করছেন কেন?’
হাসল জেনিফাররা সবাই। বলল জেনিফারের দাদী, ‘কারণ আমরা, মানে আমাদের পরিবার, ওসমান এফেন্দীর উত্তর-পুরুষ।’
একটা বিস্ময় আছড়ে পড়ল আহমদ মুসার চোখে-মুখে। বলল সে উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে, ‘সত্যি? সত্যিই কি আমি ষোড়শ শতকের সমুদ্র বিহারী ওসমান এফেন্দীর বংশধরদের আমার সামনে দেখছি। তিনি গ্রান্ড টার্কস বসতি গড়েছিলেন?’
‘না, তিনি গ্রান্ড টার্কস-এ বসতি গড়েননি কিংবা বাস করেননি। তিনি বসতি স্থাপন করেছিলেন বাহামার সানসালভাডোরে। বিয়েও করেছিলেন এক রেড ইন্ডিয়ান কন্যাকে। কিন্তু সানসালভাডোরে বাস করতে পারেননি তাঁর বংশধররা। বৃটিশরা যখন বসতি স্থাপন করতে এল সানসালভাডোরে, তখন তাঁরা বিতাড়িত হলেন। শুনেছি, সেখান থেকে উচ্ছেদ হয়ে তারা বসতি স্থাপন করেছিলেন বাহামারই ক্রুকড দ্বীপে। পরবর্তীকালে সেখান থেকেও উচ্ছেদ হতে হয় তাদের। অবশেষে তারা আসেন তাদের পূর্ব পুরুষের প্রথম পদচিহ্ন ধন্য এই টার্কস দ্বীপপুঞ্জের এই সাউথ টার্কো দ্বীপে।’বলল জেনিফারের দাদী।
‘ওসামন এফেন্দী কি প্রথম নেমেছিলেন এই দ্বীপে?’বলল আহমদ মুসা।
‘হ্যাঁ, ভাই। বলতে পার এটা ছিল মহান অভিযাত্রী ক্যাপ্টেন জোয়ান পঞ্চ ডে লিওন-এর উদারতা। তিনি কলম্বাসের মত মুসলিম বিদ্বেষী ছিলেন না। কলম্বাস তার সমুদ্র যাত্রায় মুসলিম কুশলীদের সাহায্য নিয়েছিলেন বাধ্য হয়ে। কিন্তু তিনি তাদের নাম পাল্টে অমুসলমান বা ধর্মান্তরিত হিসাবে দেখিয়েছিলেন। কিন্তু জোয়ান ডি লিওন এই নীচতা দেখাননি।’
বলে একটা লম্বা দম নিল জেনিফারের দাদী। তারপর আবার শুরু করল, ‘১৫১২ সালের এক শুভ্র প্রত্যুষে জোয়ান ডি লিওনের জাহাজের চোখে এই দ্বীপপুঞ্জের অস্তিত্ব ধরা পড়েছিল। এই দ্বীপপুঞ্জে প্রথম ল্যান্ড করার সম্মান জোয়ান ডি লিওন তাঁর চীফ নেভিগেটর তুর্কি ওসমান এফেন্দীকে দিতে চেয়েছিলেন। একটা বোটে করে ওসমান এফেন্দীকে পাঠিয়েছিলেন দ্বীপে ল্যান্ড করার জন্যে। ওসমান এফেন্দী প্রথম দ্বীপে ল্যান্ড করেন। তিনি যেখানে ল্যান্ড করেন, সেটাই এখন এই দ্বীপপুঞ্জের প্রধান বন্দর। এই জায়গাটারও নামকরণ তিনিই করেন। নামটা এখন বিকৃত করে ফেলা হয়েছে…’
জেনিফারের দাদীর মুখ থেকে কথা কেড়ে নিয়ে আহমদ মুসা বলল, ‘আমারও তাই মনে হয়েছে।’সুসুলামা’কোন স্প্যানিশ শব্দ নয় বলে আমি মনে করি।’
‘বলছি, শোন। আমি আমার শ্বশুরের কাছে শুনেছি, সেই সময় ওসমান এফেন্দীর দেশ তুরস্কে’সুলতান সুলায়মান’নামে মহামতি এক বাদশাহ ছিলেন। ওসমান এফেন্দী তাঁর নামে বন্দরের জায়গার নাম রাখেন ‘সুলতান সুলায়মান’, যা বিকৃত হয়ে এখন হয়েছে ‘সুসুলামা’। এর সাথে পরবর্তীকালে যোগ হয়েছে ‘জোয়ান ডি’।
‘আল্লাহু আকবর। দাদিজান ‘সুলতান সুলায়মান’-এর নাম এতদূর পর্যন্ত এসেছে। তিনি ইতিহাসে একজন শ্রেষ্ঠ মুসলিম সুলতান ছিলেন। ভূমধ্য সাগরে তাঁর নৌবহর ছিল অপ্রতিদ্বন্দী।এই কারণে তাকে সাগর-অধিপতিও বলা হতো। তুরস্কের এই সুলতান বলা যায় সমগ্র মধ্য ইউরোপ পদানত করেন। ১৫২৯ সালে তিনি হ্যাংগেরী পেরিয়ে অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনার দরজা পর্যন্ত পৌছান। এই দুর সূদুরের একটি বন্দরের সাথে তার নাম জড়িয়ে আছে।’আহমদ মুসা বলল।
‘জোয়ান ডি লিওনের এটা মহানুভবতা এবং ওসমান এফেন্দীর এটা স্বজাতি প্রীতি। শুধু তাই নয়, ওসমান এফেন্দী তুর্কি ছিলেন বলে এই দ্বীপপুঞ্জের নামকরণ করা হয় টার্কস বা টার্কো দ্বীপপুঞ্জ।’বলল জেনিফারের দাদী।
‘আমি বন্দরে বাতিঘরের ‘স্মারক প্লেটে’ বাতিঘরের মূল প্রতিষ্টাতা ‘ও, এফেনডিও-এর নাম দেখলাম। ও, এফেনডিও অর্থ্যাৎ ওসমান এফেন্দীই তাহলে ছিলেন বাতিঘরের প্রথম প্রতিষ্টাতা।’
‘হ্যাঁ ভাই। শুনেছি, উনি দ্বীপে নেমে তাবু গেড়ে ৭ দিন দ্বীপে অবস্থান করেন। যেখানে তিনি ছিলেন, সেটাই এখন রাজধানী গ্রান্ড টার্কস।’থামল জেনিফারের দাদী।
আহমদ মুসাও এ সময় কোন কথা বলল না। ভাবছিল সে। এক সময় ধীরে ধীরে আহমদ মুসা বলল, ‘আপনারা বাহামার সানসালভাডোর থেকে ক্রুকড দ্বীপে, সেখান থেকে এলেন টার্কস দ্বীপপুঞ্জে। এখানেও মনে হচ্ছে এক নতুন বিপদ ঘনিয়ে আসছে।’
‘কি সেটা তুমি কি বুঝতে পারছ বাছা?’বলল জেনিফারের মা।
‘জেনিফারের কাছে যা শুনেছি এবং আমিও এ দ্বীপপুঞ্জে এসে যতটা শুনলাম তাতে আমি বুঝতে পারছি, পুরুষ শিশু হত্যার মাধ্যমে মুসলমানদের সংখ্যা কমানোই শুধু নয়, মুসলিম জাতি সত্তাকে বিকৃত ও পরিবর্তিত করারও প্রয়াস এটা। মুসলিম পুরুষের যদি অভাব ঘটে, মুসলিম মেয়েরা অন্য জাতির পুরুষকে যদি বিয়ে করতে বাধ্য হয়, তাহলে ধীরে ধীরে মুসলিম জাতির অস্তিত্ব এ দ্বীপপুঞ্জ থেকে আপনা থেকেই মুছে যাবে।’
‘এ তো পয়জনিং-এর মত ভয়াবহ ষড়যন্ত্র।’জেনিফারের মা-ই
বলল।
‘ঠিক বলেছেন খালাম্মা। তবে আমার মনে হচ্ছে, ষড়যন্ত্রটার গভীরতা আমরা আঁচ করতে পারছি না। এ ষড়যন্ত্রের গোড়া টার্কস দ্বীপপুঞ্জে প্রোথিত আছে, তা মনে হয় না।’
দীর্ঘশ্বাস ফেলল জেনিফারের দাদী। বলল, ‘শান্তি আমাদের জীবনে আর এল না।’
‘পৃথিবীতে ভালো-মন্দের লড়াই যতদিন থাকবে, মানুষের জীবনে ততদিন শান্তির পাশে অশান্তিও থাকবে।’বলল আহমদ মুসা।
জেনিফারের আম্মা উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, ‘তোমরা বস। ওদিকে একটু কাজ আছে, রাত অনেক হয়ে গেল।’
কথা শেষ করে সে হাঁটতে শুরু করল।
জেনিফারের দাদিও উঠে দাঁড়াল। বলল, ‘আর পারছি না বসতে। যাই, না শুয়ে আর হচ্ছে না।’জেনিফারের দাদীও চলে গেল জেনিফারের মায়ের পিছু পিছু।
ওরা উঠে গেলে জেনিফার এসে সোফায় আহমদ মুসার পাশে বসতে বসতে বলল, ‘এ ষড়যন্ত্রের গোড়া কোথায় থাকতে পারে বলে আপনি মনে করেন?’
আহমদ মুসা প্রশ্নের কোন উত্তর না দিয়ে জেনিফারের পাশ থেকে উঠে পাশের সিংগল সোফাটায় গিয়ে বসল।
হঠাৎ লায়লা জেনিফারের চোখ দু’টি চঞ্চল হয়ে উঠল। মুখে প্রথমে বিস্ময়, তারপর তাতে অপমানের চিহ্ন ফুটে উঠল। অপমান অতঃপর তার চোখ ছল ছল অশ্রতে রূপ নিল। লায়লা জেনিফার কিছুক্ষণ পাথরের মত স্থির থেকে দু’হাতে মুখ ঢাকল।
আহমদ মুসা অপ্রস্তুত হয়ে গেল জেনিফারের এই পরিবর্তনে। আহমদ মুসা জেনিফারকে কয়েকবার ডাকল। জিজ্ঞেস করল তাকে, কি হয়েছে তার।
জেনিফার কোন উত্তর দিল না।
অবশেষে আহমদ মুসা একটু শক্ত কণ্ঠে বলল, ‘জেনিফার এসব কি হচ্ছে? এ কান্নার অর্থ কি?’
জেনিফার এবার মুখ তুলল। অশ্রু ধোয়া তার মুখ। বলল, ‘আমরা ক্ষুদ্র, সামান্য কিন্তু এই সত্য কথাটা কি এভাবে না বললেই নয়?’
‘কি বলছ তুমি জেনিফার? আমি কিছুই বুঝলাম না।’ভ্রু-কুঞ্চিত হলো আহমদ মুসার।
‘আমরা অপমানিত হবার মত অবশ্যই। কিন্তু অপমান করার মত আপনি নন। আপনি অনেক…অনেক বড়।’অশ্রু বিজড়িত কণ্ঠে বলল জেনিফার।
বিব্রত বোধ করল আহমদ মুসা। বলল, ‘অপমানিত হওয়া বা করার কথা আসছে কি করে! আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।’
‘সকালে কম্যুনিটি সেন্টারে যাবার সময় আমি আপনার পাশে বসলে আপনি উঠে গিয়ে অন্য জায়গায় বসেছিলেন। আবার এখন আপনার পাশে বসলাম, আপনি সংগে সংগে উঠে গিয়ে ওখানে বসলেন। কেন আমি এতটাই কি…।’
কথাটা শেষ করতে পারলো না জেনিফার। কান্নায় আটকে গেল
তার কথা।
আহমদ মুসা সশব্দে হেসে উঠল।
হাসির শব্দে জেনিফার মুখ তুলে তাকাল আহমদ মুসার দিকে।
আহমদ মুসার হাসির শব্দ মিলিয়ে গেল। ধীরে ধীরে গম্ভীর হয়ে এল আহমদ মুসার মুখ। তারপর ধীরে ধীরে বলল, ‘তুমি বিষয়টাকে এভাবে নিয়েছ, এ জন্যে আমি দুঃখিত। আসলে কিছু বিষয় তোমাকে শেখাবার জন্যেই আমি ওরকম করেছি।’
‘শেখাবার জন্যে? কি শেখাবার জন্যে?’বলল বিস্মিত কণ্ঠে জেনিফার।
‘শেখার সুযোগ নেই বলে ইসলামের অনেক কিছুই তুমি এবং তোমরা জান না। ইসলামী সমাজে যাদের সাথে বিয়ে নিষিদ্ধ শুধুমাত্র তাদের সাথে ছাড়া অন্যদের সাথে মুসলিম মেয়েরা যথেচ্ছা মিশতে পারে না, একান্তে সাক্ষাত করতে পারে না, স্বাভাবিক চলাফেরা কালেও ঘনিষ্ঠ হতে পারে না। এই বিধান চাচাতো, ফুফাতো, মামাতো ভাই থেকে শুরু করে প্রতিবেশী ও অপরিচিত সবার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।’বলল আহমদ মুসা।
‘তার মানে আমি আপনার পাশে ঐভাবে বসতে পারি না, এই তো?
ধন্যবাদ।’গম্ভীর কণ্ঠে বলল জেনিফার।
কিন্তু তোমার মনের মেঘ কাটেনি জেনিফার?’
‘ইসলামের বিধান আমাদের অবশ্যই মানতে হবে। কিন্তু বাস্তবে কি এটা মানা হয়?’বলল জেনিফার আত্মপক্ষ সমর্থনের সুরে।
‘বাস্তব অবস্থা হলো, বেশির ভাগ লোক এটা মানেন না, মানেন কম লোক। কিন্তু এটা সুস্থতা নয়, মুসলমানদের আধঃপতনের একটা দৃষ্টান্ত এটা।’
‘আমি দুঃখিত আমার ব্যবহারের জন্যে।’
বলে একটু দম নিল জেনিফার। বলল আবার, ‘অনেক সময় আমি মনে রাখতে পারি না যে, আমার চাওয়া যতবড়, আমি তত বড় নই।’
আহমদ মুসার ঠোঁটে ঈষৎ হাসির রেখা ফুটে উঠল। বলল, ‘আজ বিকেলে আমি আমার স্ত্রীর সাথে টেলিফোনে আলাপ করেছি। তাকে বলেছি, জেনিফারকে যতটা ভেবেছিলাম তার চেয়েও ভাল এবং বুদ্ধিমতি সে।’
আহমদ মুসার এ কথার সাথে সাথে জেনিফারের চোখে-মুখে একটা চমকে উঠা ভাব ও বিব্রতকর অবস্থার একটা চিহ্ন ফুটে উঠল।
কথা বলতে একট দেরী করল জেনিফার।সম্ভবত নিজেকে সামলে নিল সে। বলল একটু পর, ‘আপনার স্ত্রী আছে? কোথায় তিনি?’
‘হ্যাঁ জেনিফার। মদীনা শরীফে তাকে রেখে এসেছি।’
আবারও নীরবতা জেনিফারের। তার মুখ নিচু।
তার মুখের বিব্রত ভাব কেটে গেছে। কিন্তু সেখানে যেন স্থান করে নিয়েছে কিছুটা হতাশার বেদনা।
বলল এক সময় গম্ভীর কণ্ঠে, ‘আপনি ভাল এবং সবাইকে ভাল দেখেন। তাই তার কাছে আমাকে অমন ভাল বলতে পেরেছেন।’
আহমদ মুসার ঠোঁটে আবার এক টুকরো হাসির রেখা ফুটে উঠল।
বলল, ‘জর্জ কিন্তু তোমাকে আরও ভাল বলে, আরও ভাল জানে জেনিফার।’
চমকে উঠল জেনিফার। তাকাল আহমদ মুসার দিকে গভীর ভাবে।
বলল, ‘জর্জ কিছু বলেছে বুঝি? জর্জের এটা বাড়াবাড়ি।’ক্ষোভ ফুটে উঠল তার স্বরে।
‘জর্জ আমাকে কিছু বলেনি। কিন্তু তাদের দুই ভাই-বোনের আলোচনায় বুঝেছি, জর্জ তোমাকে অনেক বড় ও শ্রদ্ধার চোখে দেখে। তার বোনের আস্থা তোমার প্রতি অগাধ। ক’দিন ওদের সাথে ছিলাম। দেখেছি, জর্জ খুবই ভাল ছেলে।’
‘ভালো ছেলে, কিন্তু ভিন্ন বিশ্বাসের, ভিন্ন জাতের।’
‘বিশ্বাস অপরিবর্তনীয় নয় জেনিফার। আমার বুঝা যদি বেঠিক না হয়, তাহলে বলবো ওরা দু’ভাই-বোনই ইসলামের প্রতি অনুরক্ত। আর জাতের ব্যাপারটা কিছুই নয়। লক্ষ লক্ষ শ্বেতাংগ মুসলমান চিন্তা, চরিত্র ও যোগ্যতায় মুসলিম সমাজের নেতার আসনে উন্নীত হয়েছেন।’
‘কিন্তু জর্জের ঐ সব কথা বলে বেড়ানোর অভ্যাস আছে।’
জেনিফারের কণ্ঠ এবার অনেকটা দুর্বল।
‘জর্জকে দেখে কিন্তু আমার এমনটা মনে হয়নি। সে খুব রিজার্ভ ছেলে।’
‘জর্জ আপনাকে যাদু করেছে।’
‘কেন যাদু করবে? আমার বোনকে যাতে রাজী করাই, এ জন্যে?’
‘ভাইয়া, তাহলে আমি উঠলাম।’
বলে উঠে দাঁড়াচ্ছিল জেনিফার। তার কণ্ঠে কৃত্রিম রাগ। মুখ তার লজ্জায় আরক্ত।
ঠিক এই সময় বাইরের দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ হলো।
জেনিফার চলতে গিয়ে থমকে দাঁড়াল।
তারপর ঘুরে দাঁড়িয়ে বাইরের দরজার দিকে এগুলো খোলার জন্যে।
আহমদ মুসা ততক্ষণে উঠে দাঁড়িয়েছে। বলল, ‘দাঁড়াও জেনিফার, আমি দেখছি।’
আহমদ মুসা গিয়ে দরজা খুলল।
দরজা খুলেই চমকে উঠল আহমদ মুসা দরজায় দাঁড়ানো আবাবাকা অর্থ্যাৎ আবু বকর ও তার আব্বা সেই প্রৌঢ় ব্যক্তিকে দেখে।
আবু বকরই দরজার সামনে দাঁড়িয়েছিল। তার পেছনে তার পিতা।
‘কি ব্যাপার আবু বকর, তোমরা?’
‘স্যার খুব জরুরী খবর আছে। সেটা জানাতে এসেছি।’
আহমদ মুসা ঘুরে দাঁড়িয়ে জেনিফারকে বলল, ‘তুমি একটু ভেতরে যাও। এঁরা বৈঠকখানায় বসবেন।’
জেনিফার বৈঠকখানা থেকে বেরিয়ে ভেতরের দরজার আড়ালে দাঁড়াল।
আহমদ মুসা আবু বকর ও তার আব্বাকে ভেতরে নিয়ে এল।
তাদেরকে বসার জন্যে সোফা দেখিয়ে দিয়ে নিজে সোফায় বসল।
আবু বকর ও তার আব্বা সোফায় না বসে মেঝেয় ম্যাটের উপর বসে পড়ল।
আহমদ মুসা তাদের দিকে চেয়ে ক্ষুদ্ধ কণ্ঠে বলল, ‘আবু বকর তোমরা দেখছি আগের মতই আচরণ করছ। তোমরা না ইসলামে ফিরে এসেছ! ইসলামে কি সবাই ভাই ভাই নয়? দেখ তোমরা সোফায় উঠে না বসলে আমিও তোমাদের সাথে মেঝেতে বসব।’
সংগে সংগেই তারা দু’জন উঠে সোফায় বসল। তারপর আবু বকর বলল, ‘মাফ করুন অভ্যাস বদলাতে সময় লাগবে।’
‘এবার বল, জরুরী খবরটা কি?’
আবু বকর নড়ে-চড়ে বসল। তার মুখ গম্ভীর হলো। সেই গম্ভীর মুখে দেখা দিল প্রবল ভয়ের চিহ্ন। সে বলতে শুরু করল, ‘আমরা আপনাকে নামিয়ে দেবার পর স্থানীয় কয়েকজন জেলের সাথে চুক্তিতে এসেছিলাম। দু’দিন মাছ ধরার কাজ শেষে আজ সন্ধ্যায় ঘাটে ফিরে আসি। আমরা ঘাটে ফেরার পর দেখলাম, আগে থেকে দাঁড়ানো সেই স্টিম বোটটির পাশে আরেকটা মাঝারি আকারের বোট এসে দাঁড়াল। ওদের মধ্যে যে কথা শুনলাম তা ভয়াবহ।’ একটু থামল আবু বকর।
আবু বকর থামতেই আহমদ মুসা বলল, ‘কি সেটা?’
শুরু করল আবার আবু বকর, ‘শুনলাম, দু’দিন আগে একজন পথিক দ্বীপের ভেতরে যাওয়ার সময় সে দূর থেকে দেখেছে, ওকারী গ্রামের মসজিদের কাছে চারজন শ্বেতাংগকে হত্যা করেছে একজন এশীয়ান। মসজিদের সামনে গ্রামের লোকজন দাঁড়িয়েছিল। এশীয়ান লোকটি নাকি চারজনকে হত্যা করে একজন মেয়েকে উদ্ধার করে অটো হুইলারে চড়ে দ্বীপের ভেতরে চলে যায়। পথিক লোকটি ভয়ে ঘাটে ফিরে আসে। তার কাছ থেকে স্টিম বোটের লোকটি জানতে পারে ঘটনাটি। ঐ চারজন শ্বেতাংগ বোটের লোকটিরই সাথী ছিল। সে খবর জানার পর তার লোকদের দ্রুত এ দ্বীপে আসার খবর দিয়ে খবর সংগ্রহের জন্যে সে বের হয়। তারা জানতে পেরেছে, এশীয়ান লোকটি যে মেয়েটিকে উদ্ধার করেছে সে সিডি কাকেম গ্রামের এফেনডিও পরিবারের মেয়ে এবং এশীয়ানটি ঐখানেই আছে। এই আলোচনা শুনেই বুঝেছি আমরা ঐ এশীয়ান আপনিই হবেন।’ আবার একটু থামল আবু বকর মোহাম্মদ।
‘এটাই সেই ভয়াবহ সংবাদ?’ বলল আহমদ মুসা।
‘না স্যার, বলছি।’
বলে আবার শুরু করল, ‘আমরা ওদের যে ষড়যন্ত্র শুনে এলাম তা হলো, ‘আজ রাত ১২টার দিকে ওরা এই বাড়িটার উপর হামলা চালাবে। ধরে নিয়ে যাবে আপনাকে এবং জেনিফার নামে একটি মেয়েকে। ফেরার পথে ওরা ওকারী গ্রামের উপর আক্রমণ করবে রাত ৩টার দিকে। ঐ সময় ওদের আরেকটি গ্রুপ ঘাটের দিক থেকে এসে ওদের সাথে মিলিত হবে। ঐ গ্রুপটি আজ রাতে বাইরে কোথাও থেকে ঘাটে এসে পৌছবে।’
আবু বকর থামলে আহমদ মুসা শান্ত কণ্ঠে বলল, ‘তোমরা যে মোটর বোটকে ঘাটে আসতে দেখেছ তাতে ক’জন লোক আছে তোমাদের অনুমান?’
‘শুনেছি ওরা দশজন।’ বলল আবু বকর।
‘আগের বোটে ছিল একজন। তাহলে এগার জন।’
বলে আহমদ মুসা একটু থেমে বলল, ‘তোমরা তো খাওয়া-দাওয়া করনি। তোমরা হাত-মুখ ধুয়ে নাও।’ বলে আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল।
‘খাওয়ার কথা চিন্তা করছেন কেন? আর তো এক ঘন্টা সময় আছে। এখন কি হবে বলুন।’ উদ্বেগাকুল কণ্ঠে বলল আবু বকর।
‘এক ঘন্টা অনেক সময়। তোমরা আগে খেয়ে নাও।’
বলে আহমদ মুসা ভেতরের দরজার দিকে লক্ষ্য করে বলল, ‘জেনিফার দু’জন মেহমানের খাওয়ার ব্যবস্থা কর।’
দরজার আড়ালে জেনিফারের পাশে তার মা’ও এসে দাঁড়িয়েছিল।
জেনিফারের সাথে সাথে তার মাও শুনেছিল সব কথা।
ভয়ানক খবরটায় কাঁপছিল জেনিফার।
তার মায়ের মুখ ভয়ে ফ্যাকাশে হয়ে গিয়েছিল।
আহমদ মুসার কথা শেষ হতেই আবু বকর এবং তার পিতা এক সাথেই বলে উঠল, ‘এ সময় আমাদের পেটে কিছু ঢুকবে না, আমরা খেতে পারব না। আপনি খাওয়ার চিন্তা বাদ দিয়ে এখন কি করণীয় বলুন। বাড়ি থেকে সরতে হলে, তার ব্যবস্থা তো এখনই করতে হবে।’
আহমদ মুসা হাসল। বলল, ‘এত ব্যস্ত হবার প্রয়োজন নেই। আগে নিশ্চিন্তে বসে তোমরা খেয়ে নাও।’
আবু বকর এবং তার আব্বা বিস্ময়ে বিস্ফোরিত চোখে তাকাল আহমদ মুসার দিকে।
ওদিকে জেনিফার এবং ওর আম্মারও বিস্ময়ে কাঠ হয়ে যাবার অবস্থা। এই ভয়ানক খবর শুনে এবং এক ঘন্টা পর ভয়াবহ এক দূর্যোগ আসছে জেনেও আহমদ মুসা হাসছে।
আহমদ মুসা দু’জন আগন্তুককে খাওয়াবেই, এই কথা বুঝে জেনিফার তার মাকে কম্পিত কণ্ঠে বলল, ‘আম্মা খাবার টেবিলে দু’জনের খাবার যে দিতে হয়।’
‘দেব, দিচ্ছি। কিন্তু আহমদ মুসা কিছু ভাবছেন না কেন?’
‘হয়তো ভাবছেন।’
‘হবে হয়তো। আহমদ মুসা আগুনের উপর দাঁড়িয়ে হাসতে পারেন। আমরা তা পারব কি করে?’
আহমদ মুসা একটা কাসি দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করল।
কাসির শব্দ পেয়েই জেনিফার এবং তার মা তাড়াতাড়ি মাথার উপর চাদর টেনে দিল।
আহমদ মুসা ভেতরে প্রবেশ করতেই জেনিফারের মা প্রায় কাঁদো
কাঁদো কণ্ঠে বলল, ‘সব শুনেছি বাছা। এখন কি হবে?’
‘খালাম্মা আল্লাহর উপর ভরসা করুন, সব ঠিক হয়ে যাবে।’
‘দু’দিন আগেই তো একটা ঘটনা ঘটল। খুব ভয় করছে বাছা।’
‘ভয় করলে তো আমরা দুর্বল হয়ে পড়ব খালাম্মা। কোন ভয় নেই। আল্লাহর শক্তি সব শক্তির চেয়ে বড়।’
‘তুমি কি ভাবছ? আমরা সবাই বাড়িতে থাকব কিনা? কিংবা কি করতে হবে আমাদের?
‘কিছুই করতে হবে না খালাম্মা। আপনারা সবাই বাড়িতে থাকবেন। অসৎ উদ্দেশ্য নিয়ে যারা আসবে, তাদের ব্যাপারটা আমার উপর ছেড়ে দিন।’
‘গতবার এসেছিল চারজন, এবার নাকি অনেক আসছে।’
‘অনেকই আর কি। তবে দশজনের বেশি নয়।’
‘ওদের হাতে তো বড় বড় অস্ত্রও থাকবে।’
‘ সেটা ভাল। ও অস্ত্রগুলো পরে আমাদের কাজে লাগবে।’
জেনিফার এবং তার মা বিস্মিত দৃষ্টিতে আহমদ মুসার দিকে তাকাল। এত বড় বিপদ সামনে রেখে এত নিশ্চিন্ত, এমন নিশ্চিত কণ্ঠে কথা বলা কিভাবে সম্ভব? কি কি ঘটতে যাচ্ছে, কি হবে, এ ব্যাপারে নিশ্চিন্ত থাকলেই শুধু একজন নিশ্চিন্ত থাকতে পারে। তারা আহমদ মুসাকে আর কি বলবে খুঁজে পেল না।’
অবশেষে জেনিফারের মা বলল, ‘ওদের খাবার দিচ্ছি। ওরা কারা বাছা? খুব উপকার করল আমাদের।’
‘ওদের বোটে করে আমি এই দ্বীপে এসেছিলাম। সেই সূত্রে পরিচয়। ওরা খৃষ্টান ছিল, কিন্তু ওদের পূর্ব পুরুষ ছিল আফ্রিকার ‘গাম্বিয়া’ দেশের একটি বিখ্যাত মুসলিম পরিবার। ওদের কাছে পাওয়া একটা দলিল থেকে জেনে একথা ওদের বলি। শুনেই ওরা ইসলামে পুনরায় ফিরে এসেছে।’
‘আলহামদুলিল্লাহ।’ এক সাথেই বলে উঠল জেনিফার এবং তার মা।
জেনিফার আনন্দ-উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলল, ‘ভাইয়া আপনার আগমনে টার্কস দ্বীপপুঞ্জে নতুন বাতাস বইতে শুরু করেছে। এই ঘটনা তার একটা প্রমাণ।’
‘আল্লাহর শুকরিয়া আদায় কর জেনিফার।’
‘আলহামদুলিল্লাহ।’ বলল জেনিফার।
জেনিফারের মা খাবারের ব্যবস্থা করতে চলে গেল।
আহমদ মুসা প্রবেশ করল পাশেই তার ঘরে।
জেনিফারও নিঃশব্দে আহমদ মুসার পিছে পিছে তার ঘরে প্রবেশ
করল।
কিন্তু প্রবেশ করেই জেনিফার জিব কেটে তেমনি নিঃশব্দে দ্রুত বেরিয়ে এল ঘর থেকে। তার মনে পড়েছে, এভাবে একাকী অন্য লোকের সাথে কোন ঘরে প্রবেশ করা ইসলামে নিষিদ্ধ। আহমদ মুসা এটা দেখতে পেলে ভীষণ রাগ করবেন।
বাইরে এসে দরজায় দাঁড়াল জেনিফার।
আহমদ মুসা ঘরে প্রবেশ করেই সাইড টেবিল থেকে ব্যাগটা নিয়ে মেঝেয় রাখল। ব্যাগ খুলে বের করল ওকারী গ্রামের সংঘর্ষ থেকে কুড়িয়ে পাওয়া চারটি রিভলবার।
চারটি রিভলবারই চেক করল আহমদ মুসা।
একটি রিভলবারেই ছয়টি গুলী ভর্তি করে রাখা আছে। অন্য তিনটি খালি।
আহমদ মুসা ব্যাগ থেকে গুলী বের করে মেঝেয় রুমালের উপর রাখল।
দরজায় শব্দ পেয়ে আহমদ মুসা মুখ তুলে তাকাল দরজার দিকে।
দেখল, জেনিফার দরজায় ঠেস দিয়ে বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে আছে রিভলবারগুলোর দিকে।
আহমদ মুসা তার দিকে তাকাতেই জেনিফার মাথার ওড়নাটা কপালের উপর টেনি দিয়ে বলল, ‘ভাইয়া আমি একটু বাইরে দাঁড়িয়ে দেখছি।
আহমদ মুসা ঐ প্রশ্নের কোন উত্তর নাদিয়ে বলল, ‘ভাল, দেখ। রিভলবারের ব্যবহার তোমাদেরও শিখতে হবে।’
বলে আহমদ মুসা মনযোগ দিল তার কাজের দিকে। রুমালের উপর থেকে গুলী তুলে এক এক করে রিভলবারে ভরতে শুরু করল।
আহমদ মুসা কথা শেষ হতেই জেনিফার বলে উঠেছিল, ‘নেভিগেটর ওসমান এফেন্দীর বংশধররা কি যুদ্ধ করতে পারে?’
আহমদ মুসা কাজ অব্যাহত রেখে না তাকিয়েই বলল, ‘নেভিগেটর তুর্কি ওসমান এফেন্দী কার বংশধর জান?’
‘জি না।’ বলল জেনিফার।
‘তুর্কি সাম্রাজ্যের ওসমানিয়া খিলাফতের প্রতিষ্ঠাতা ওসমান (প্রথম)-এর বংশধর। এই তুর্কি সাম্রাজ্য সম্পর্কে জান?’
‘জানি না।’
‘এই তুর্কি সাম্রাজ্য ইউরোপ, এশিয়া ও আফ্রিকার বিশাল এলাকা নিয়ে গঠিত ছিল। সাত’শ বছর তারা রাজত্ব করে। এই সাম্রাজ্যের তুর্কি সেনাবাহিনী সম্পর্কে কিছু জান?’
‘দুঃখিত, জানি না।’
‘সেই তুর্কি সাম্রাজ্য এখন আর নেই। কিন্তু তুর্কি সৈন্যবাহিনীর নাম শুনলে এখনও ইউরোপীয়রা চোখে বিভীষিকা দেখে। এই সাম্রাজ্য শাসনকারী রাষ্ট্রনায়কও এই তুর্কি সেনাবাহিনীরই উত্তরসুরী। এখন বল যুদ্ধ তোমার সাজবে কিনা?
হাসল জেনিফার। বলল, ‘ভাইয়া মনে হয় আপনি মরা মানুষের মনেও আসার আগুন জ্বালাতে পারবেন।’
‘জেনিফার আশার প্রজ্জ্বলন এখন খুব বেশি প্রয়োজন। পশ্চিমী ঔপনিবেসিক শাসন এবং পশ্চিমের প্রযুক্তি, বিশ্বাস, অর্থ ও সামরিক শক্তি মুসলমানদেরকে তাদের নিজেদের ভবিষ্যত বিষয়ে হতাশার সাগরে ডুবিয়ে দিয়েছে। আজ তারা ইতিহাস জানলে তাদের আত্মপরিচয় তাদের কাছে পরিস্কার হবে। আত্ম-পরিচয় তাদের মনে আশার সৃষ্টি করবে। আশা নিয়ে আসবে আত্মবিশ্বাস এবং আত্মবিশ্বাসই করতে পারে তাদেরকে বিজয়ের পথে পরিচালিত।’
জেনিফার মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল আহমদ মুসার দিকে।
জেনিফারের মনে হলো, আহমদ মুসার কথাগুলো যদি কোন এক বিশ্ব মাইক যোগে বিশ্বের সব মুসলমানের কানে পৌছে দেয়া যেত! প্রশ্ন জেগে উঠল জেনিফারের মনে, আহমদ মুসার যোদ্ধা রূপ বড়, না তার এই মিশনারী রূপ বড়।
আহমদ মুসার কাজ শেষ হয়ে গিয়েছিল।
জেনিফারকে নীরব দেখে বলল, ‘নীরব কেন জেনিফার?’
বলে উঠে দাঁড়াল আহমদ মুসা রিভলবার চারটি কোট ও প্যান্টের চার পকেটে রেখে।
‘ভাবছিলাম আপনি যোদ্ধা না হয়ে মিশনারী হলে দুনিয়ার মানুষ বোধহয় বেশি উপকৃত হতো।’ বলল জেনিফার।
আহমদ মুসা সেদিকে কান না দিয়ে বলল, ‘চার রিভলবারে গুলী থাকল ২০ টা। আর ওরা মানুষ দশজন।’
‘আপনি কি এখন বেরুচ্ছেন?’ উদ্বিগ্ন কণ্ঠে জেনিফার বলল।
‘না, ওদের সাথে একটু কথা বলব।’
বলে আহমদ মুসা বৈঠকখানার ভেতরে ঢুকে গেল।
দেখল ওরা দুই বাপ-বেটা খেয়ে এসে বসেছে। আহমদ মুসাকে
দেখে ওরা উঠে দাঁড়াল।
আহমদ মুসা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই বলল, ‘আবু বকর গেটের বাইরে
রাস্তার পাশে দু’টি গাছ রয়েছে, তার আড়ালে বসে তোমরা অপেক্ষা করবে। ইনশাআল্লাহ রাত দু’টোর দিকে আমরা ওকারী গ্রামে যাত্রা করব।
‘স্যার আপনি কোথায় থাকবেন। সময় খুব বেশি নেই। ওদের ব্যাপারে কি করণীয় হবে?’ বলল আবু বকর।
‘আমি সামনে এগুচ্ছি। ওদিকটা আমি দেখব।’
আবু বকর এবং তার পিতা বিস্ময় ভরা চোখে তাকাল আহমদ মুসার দিকে। কিছু বলার চেষ্টা করল। কিন্তু তার আগেই আহমদ মুসা ভেতরে যাওয়ার জন্যে পা বাড়াল।
ভেতরে ঢুকে আহমদ মুসা দেখল জেনিফার এবং তার আম্মা দাঁড়িয়ে আছে। তাদের চোখ-মুখ উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় আচ্ছন্ন।
আহমদ মুসা ভেতরে ঢুকতেই জেনিফারের মা বলে উঠল, ‘গ্রামবাসীকে জানানো দরকার নয়? তাদের সাহায্য পাওয়া যেত।’
‘গ্রামবাসীদের সব কথা জানিয়ে তাদের সংগঠিত করার সময় আমাদের নেই। অসংগঠিত ভীড়, আতংক আমাদের বেশি ক্ষতি করতে পারে। তার উপর রাত। তাছাড়া কি ধরণের অস্ত্র, কি প্রস্তুতি নিয়ে তারা আসছে আমরা জানি না। এই অবস্থায় অপ্রস্তুত মানুষদের তাদের সামনে ঠেলে দিলে প্রচুর ক্ষয়-ক্ষতি হতে পারে।’
‘তাহলে একা তুমি তাদের সামনে যাচ্ছ কি করে? বলল জেনিফারের মা।
‘একা যাওয়ায় সুবিধা আছে। ওরা আমাকে সন্দেহ নাও করতে পারে। সেই সুযোগ তাদের ফাঁদে ফেলার একটা সুযোগ পেয়ে যেতে পারি।’
‘আমি কিছু বুঝতে পারছি না। আমার ভয় করছে। আমরা কি করব?’
আহমদ মুসা তাকাল জেনিফারের মা’র দিকে। তারপর ধীরে কণ্ঠে বলল, ‘খালাম্মা, কি ঘটবে আল্লাই জানেন। তাঁর উপর আমাদের ভরসা করা দরকার। তিনিই আমাদের সাহায্য করবেন।’
বলে আহমদ মুসা ঘুরে দাঁড়াল বাইরে বেরুবার জন্যে।
জেনিফার কয়েক পা এগিয়ে আহমদ মুসার সামনে দাঁড়াল। বলল, ‘আমরা কিছুই কি জানতে পারবো না, কিছুই করতে পারবো না?’ উদ্বেগ-উত্তেজনায় বিপর্যস্ত জেনিফারের ভারি কণ্ঠস্বর।
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘কি জানাব বল। সামনে কি আছে, কি করব আমিই তো জানি না। আমি চাচ্ছি ওরা বাড়ি পর্যন্ত না আসুক। সবচেয়ে ভাল গ্রামে ঢোকার মুখেই যদি ওদের আটকানো যায়।’
‘আপনি একা কি করে আটকাবেন? তার চেয়ে কি এটাই ভাল নয়, আমরা বাড়ি খালি করে চলে যাই। আমাদের পাবে না ওরা এসে।’
‘তারপর কি করবে? বাড়িতে ফিরবে?’
কথা বলল না জেনিফার।
আহমদ মুসাই বলল, ‘একবার পালালে পালিয়েই থাকতে হবে। কোথায় এত পালাবার জায়গা আছে? তাছাড়া আমরা এখন বাড়ি খালি করে চলে গেলে ওরা গোটা গ্রাম সার্চ করবে, মানুষের উপর জুলুম নির্যাতন করবে, এমনকি গ্রামবাসী যদি আমাদের হদিশ না দেয়, তাহলে ঘর-বাড়ি জ্বালিয়েও দিতে পারে। তার উপর ওকারী গ্রামের উপরও আজ রাতে তারা গণহত্যা চালাতে পারে। আমরা যদি এখানে ওদের বাধা দিতে পারি, তাহলে ওকারী গ্রামেও ওদের বাধা দেবার পথ হবে।’ থামল আহমদ মুসা।

জেনিফার ছল ছল চোখে বোকার মত দাঁড়িয়ে আছে। তার মুখে আর কোন কথা নেই। কথা খুঁজে পাচ্ছে না সে।
আহমদ মুসাই বলল কথা, ‘সুতরাং ওদের বাধা দেয়া এবং ওদের পরিকল্পনা ভন্ডুল করে দেয়াই এখন একমাত্র পথ।’
‘কিন্তু আপনি একা…।’
কথা শেষ করতে পারলো না জেনিফার। বাক রুদ্ধ হয়ে গেল তার।
‘একা কোথায়? আল্লাহ আমার সাথে আছেন। তাছাড়া চিন্তার কিছু নেই জেনিফার। একজন মুসলমান সাধারণ ভাবেই দশজন কাফের প্রতিপক্ষের সমান। ওরা সম্ভবত দশজনের বেশি আসতে পারছে না।’
বলে হাসল আহমদ মুসা। নিশ্ভিন্ত মনের সুন্দর একটা হাসি সেটা।
বিস্ময় জেনিফার এবং তার আম্মার চোখে-মুখে। পরিস্থিতির ভয়াবহতা কোনই কি প্রভাব ফেলেনি আহমদ মুসার মনে, ভাবল তারা।
‘আসি। আসসালামু আলাইকুম।’
বলে আহমদ মুসা জেনিফারের পাশ কাটিয়ে বাইরে বেরুবার জন্যে হাঁটা শুরু করল।
পাথরের মত হয়ে যাওয়া জেনিফার সালাম নিতেও ভুলে গেল। সে ছুটে গিয়ে তার মাকে জড়িয়ে ধরল। বলল সে, ‘আম্মা বিরাট লোক সে, খুবই মুল্যবান তার জীবন। আমিই তাকে ডেকে এনেছি এখানে। তখন আমি বুঝিনি, তাঁকে এমন ভয়াবহ এক যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে হবে। এখন কি হবে আম্মা?’
জেনিফারের মা জেনিফারকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘ওর ভাগ্যের
সাথে আমাদের ভাগ্য জড়িয়ে গেছে। ওঁর জয় হবে আমাদের বিজয়, আর ওঁর পরাজয় ডেকে আনতে পারে আমাদের ধ্বংস। এস আমরা বিলাপ না করে তার জন্যে প্রার্থনা করি।’
‘চলুন আম্মা।’
‘চল।’
উভয়ে হাঁটা দিল ছাদে উঠার কাঠের সিঁড়ির দিকে।

গ্রামে প্রবেশের মুখে প্রথম বাড়িটাই জেনিফারদের। একটা ছোট্ট টিলার মত উঁচু জায়গার উপর তাদের বাড়ি। বাড়ির একপাশ দিয়ে সড়ক চলে গেছে উত্তর দিকে বন্দর লক্ষে। সড়কের দু’ধারেই গ্রামের বাড়ি-ঘর। জেনিফারদের বাড়ির উত্তর পাশ থেকেই অন্যদের বাড়ি-ঘর শুরু হয়েছে। জেনিফারদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে টিলার গোড়া থেকে কয়েক পা দক্ষিণে এগুলেই একটা ছোট্র ব্রীজ। কাঠের তৈরী। ব্রীজটি ‘সেবু’ নদী থেকে বেরিয়ে আসা একটি খালের উপর। বছরের প্রায় সব সময়ই এতে পানি থাকে। ‘সেবু’ নদীটি গ্রামের পাশ ঘেঁষে দক্ষিণ দিকে বয়ে গেছে।
জেনিফারদের বাড়ি খাল ও ‘সেবু’নদীর ত্রিমোহনায়। আহমদ মুসা ব্রীজে পা দিতেই খুব কাছে মোটর ইঞ্জিনের শব্দ পেল। সংগে সংগেই আহমদ মুসা বুঝল অটো হুইলারের মত কিছু এগিয়ে আসছে।
হাতঘড়ির দিকে তাকাল আহমদ মুসা। রাত পৌনে ১২টা বাজে।
কারা আসছে? ওরাই কি?
আহমদ মুসা ব্রীজ পার হলো।
ব্রীজের মাথায় পৌছে দেখল, একটা হেড লাইট এগিয়ে আসছে।
আহমদ মুসা হাঁটা থামাল না।
আরও নিকটবর্তী হলো হেড লাইট।
আহমদ মুসার মাথায় হ্যাট, দুই হাত পকেটে।
সামনে রাস্তায় এক জায়গায় বাঁকা। বাঁকের উপর গাড়িটা উঠলে হেড লাইট অন্যদিকে সরে গেলে গাড়ির অবয়বটা পরিস্কার হয়ে উঠল। গাড়িটা একটা ডাবল অটো হুইলার। দশ বার জন লোক খুব সহজেই ওতে ধরবে।
ওরাই কি আসছে এ গাড়িতে?
আহমদ মুসা হাঁটছে।
গাড়ির হেড লাইট আহমদ মুসার গায়ে এসে পড়েছে।
আহমদ মুসা নিশ্চয় ওদের চোখে পড়েছে।
আহমদ মুসা পথচারী হিসাবে তাদের নিকটবর্তী হতে চায়। ওদের পরিচয় পাওয়া এবং ওদের মধ্যে পৌঁছা তার লক্ষ্য।
আহমদ মুসা রাস্তার এক পাশ দিয়ে চলছিল।
গাড়িটা আহমদ মুসার পাশে এসে ঘ্যাচ করে একটা কড়া ব্রেক কষল।
জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে শ্বেতাংগ ড্রাইভার বলল, ‘এই কোত্থেকে এলি, কোথায় যাবি?’
আহমদ মুসা হাত দিয়ে ইংগিত করে বলল, ‘ব্রীজের ওপারে ঐ যে বাড়ি ওখান থেকে এলাম।…’
আহমদ মুসা কথা শেষ করতে না দিয়ে বলল, ‘ওটাই জেনিফারদের বাড়ি না?’
আকাশে জ্যোৎস্না থাকায় ঐখান থেকে পরিস্কার দেখা যাচ্ছে জেনিফারদের বাড়িটা।
লোকটির প্রশ্নের উত্তরে আহমদ মুসা বলল, ‘হ্যাঁ।’
‘ওদের সাথে তোমার কিসের সম্পর্ক?’ বলল ড্রাইভার লোকটি।
‘আত্মীয়।’ বলল আহমদ মুসা।
শুনেই ড্রাইভার লোকটি লাফ দিয়ে গাড়ি থেকে নামল এবং গাড়ির পেছনে যারা বসে আছে তাদের লক্ষ্য করে বলল, ‘তোমরা নেমে এস।’
ড্রাইভার লোকটির হাতে একটা স্টেনগান।
অন্যরা যারা গাড়ি থেকে হুড়হুড় করে নেমে এল, তাদের হাতেও স্টেনগান।
‘কে তুমি? দেশ কোথায়? তোমাকে দেখে তো এদেশী মনে হচ্ছে না?’ দ্রুত কণ্ঠে বলল ড্রাইভার লোকটি।
বলেই লোকটি চোখের পলকে আহমদ মুসার মাথার হ্যাট খুলে নিল।
আহমদ মুসাকে দেখেই লোকটি বলে উঠল, ‘আরে! এতো এশীয়ান! সেই এশীয়ান?’
বলেই লোকটি তার বাম হাত থেকে হ্যাটটি ফেলে দিয়ে দু’হাতে স্টেনগান তুলল আহমদ মুসার মাথায় আঘাত করার জন্যে।
এ রকমটাই ঘটবে আহমদ মুসা তা আগেই ধরে নিয়েছিল।
আহমদ মুসা তার ডান পা দিয়ে প্রচন্ড এক লাথি মারল তার হাঁটুতে, অন্যদিকে দু’হাত দিয়ে টলে উঠা লোকটির উত্তোলিত স্টেনগান কেড়ে নিল।
হাঁটুতে লাথি খাবার পর লোকটি পড়ে গেল। এই সুযোগে আহমদ মুসা হাতে পাওয়া স্টেনগানের নল ঘুরিয়ে নিল গাড়ি থেকে নেমে আসা লোকগুলোর দিকে।
তারা ঘটনার আকস্মিকতায় কেউ বিমুঢ় হয়ে পড়েছিল, কেউ কেউ স্টেনগানের নল উপরে তুলছিল।
আহমদ মুসা তাদেরকে প্রস্তুত হবার সুযোগ দিল না। ট্রিগার চেপে স্টেনগান ঘুরিয়ে নিয়ে এল লোকগুলোর উপর দিয়ে।
লোকগুলো গুলির ঝাঁকের মধ্যে পড়ে ঝাঁঝড়া দেহ নিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল।
আহমদ মুসা চোখ এদিক ফিরাতেই চমকে উঠল। দেখল, পড়ে যাওয়া লোকটি রিভলবার তাক করছে তার দিকে।
এদিকে চোখ পড়ার সংগে সংগেই আহমদ মুসা ঝাপিয়ে পড়ল মাটির উপর।
কিন্তু শেষ রক্ষা হলো না। বাম বাহুর সন্ধিস্থলের নিচে কিছুটা জায়গা ছিঁড়ে নিয়ে বেড়িয়ে গেল গুলী।
আহমদ মুসা মাটিতে পড়েই স্টেনগানের নল ঘুড়িয়ে নিয়ে গুলী করল।
লোকটি উঠে বসেছিল। দ্বিতীয় গুলী করার আগেই আহমদ মুসার স্টেনগানের গুলী তাকে ঘিরে ধরল।
আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াতে যাচ্ছিল। দেখল, গাড়ির ওপার থেকে একটি মুখ উঁকি দিয়ে আবার ত্বড়িৎ সরে গেল। তার স্টেনগানের নলও দেখা গেল। নলটি আহমদ মুসার দিকে তাক করার সুযোগ পায়নি।
গাড়ির ওপারেও তাহলে লোক আছে? কয়জন আছে? আহমদ মুসা গুণে দেখল এদিকে লাশ পড়েছে নয়টি। তাহলে ওপারে এক বা দুইজনের বেশি লোক নেই।
আহমদ মুসা গাড়ির এদিকটা ঘুরে গাড়ির ওপাশে লোকটির কাছাকাছি হবার চেষ্টা করল।
আহমদ মুসা গাড়ির এ প্রান্ত ঘুরে ওপাশের দিকে মুখ ঘুরাতেই দেখল, ওপাশের স্টেনগানধারী বাগিয়ে ধরা স্টেনগান নিয়ে একেবারে তার মুখের উপর।
এই অবস্থায় দু’জন দু’জনকে দেখে হকচকিয়ে গেল। দু’জনের হাতেই উদ্যত স্টেনগান। দু’জনের চোখ দু’জনের উপর নিবদ্ধ।
আহমদ মুসার প্রতিপক্ষের মধ্যে বিমূঢ় ভাব ছাড়াও ভীত হয়ে পড়ার
চিহ্ন স্পষ্ট।
এটাই আহমদ মুসাকে সাহায্য করল।
হকচকিয়ে উঠার ধাক্কা কাটিয়ে আহমদ মুসা যখন তার স্টেনগানের
ট্রিগার চেপে ধরল, তখনও তার প্রতিপক্ষ তার স্টেনগানের দিকে মনযোগই দেয়নি।
ফলে মাত্র দু’গজ দূরে থেকে ছুটে আসা গুলীর ঝাঁকে ঝাঁজরা হয়ে গেল তার দেহ।
আহমদ মুসা গাড়ির ভেতরে একবার নজর ফেলল, না কেউ আর নেই।
এতক্ষণে আহমদ মুসা গুলীতে আহত তার বাম বাহুর যন্ত্রণা অনুভব করল। তাকিয়ে দেখল, সেখান থেকে প্রচুর রক্তক্ষরণ হচ্ছে।
আহমদ মুসা হাত থেকে স্টেনগান ফেলে দিয়ে ডান হাত দিয়ে আহত স্থানটা চেপে ধরল।
তারপর কয়েক ধাপ এগিয়ে গাড়ির আড়াল থেকে বেরিয়ে আসতেই
আহমদ মুসা দেখল, একটু দূরে আবু বকর দাঁড়িয়ে আছে।
আহমদ মুসাকে দেখেই সে আনন্দে চিৎকার করে ছুটল ব্রীজের উপর দিয়ে জেনিফারদের বাড়ির দিকে। সেই সাথে তার উচ্চ কণ্ঠ শোনা গেল। সে চিৎকার করে বলছে, ‘সকলে শুনুন সুখবর, স্যার বেঁচে আছেন। আপনারা আসুন।’
অল্পক্ষণের মধ্যেই এক ঝাঁক লোক ব্রীজের উপর দিয়ে আলো হাতে ছুটে এল। তাদের সাথে ছুটে এল জেনিফারও।
লোকগুলো জেনিফারদের গ্রামের। গুলীর শব্দ শুনে সবাই এসে জমা হয়েছিল জেনিফারদের বাড়ির সামনে। সব কিছু তারা শুনেছে জেনিফার এবং আবু বকরের কাছে।
রক্তে ভাসমান দশজন শ্বেতাংগের লাশ দেখে এক ঝাঁক মানুষ গোটাটাই থমকে দাঁড়াল। এক অবিশ্বাস্য দৃশ্য তাদের সামনে! প্রথমেই এক রাশ আতংক ও ভয় তাদের ঘিরে ধরেছিল। আহমদ মুসা তার ডান হাত দিয়ে বাম বাহু চেপে ধরে দাঁড়িয়েছিল।
তার হাতও রক্তাক্ত হয়ে উঠেছিল।
জেনিফার ছুটে গেল তার কাছে। আর্তকণ্ঠে বলল, আপনি ভাল আছেন, আরও কোথাও গুলী লাগেনি তো?’
আহমদ মুসা হেসে বলল, ‘না লাগেনি।আমি ভাল আছি।’
বলে আবু বকরের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘স্টেনগানগুলো গাড়িতে তোল। ওদের পকেট সার্চ করে রিভলবারগুলো বের করে গাড়িতে রেখে দাও।’
সব মানুষ এসে ঘিরে দাঁড়াল আহমদ মুসাকে। সবার চোখে বিস্ময়-বিস্ফোরিত দৃষ্টি। যেন আহমদ মুসা গ্রহান্তর থেকে আসা কোন অতিমানব। তাদের বুঝেই আসছে না, এক নিরস্ত্রপ্রায় লোক দশজন অস্ত্রসজ্জিত শ্বেতাংগকে হত্যা করে এভাবে বিজয়ী হলো!
আহমদ মুসা আবু বকরকে নির্দেশ দেয়া শেষ করতেই জেনিফার বলল, ‘ভাইয়া, আপনার আহত জায়গাটা বাঁধতে হবে, না হয় তাড়াতাড়ি আপনি বাসায় চলুন।’
বলে জেনিফার এগিয়ে এল আহত জায়গাটা পরীক্ষার জন্যে।
সংগে সংগেই আহমদ মুসা বলল, চল বাসায় চল জেনিফার।
ব্যাগে আমার ফাস্ট এইড আছে।’
জেনিফারকে কথাগুলো বলেই আহমদ মুসা গ্রামের জনগণের দিকে
চেয়ে বলল, ভাইসব, আপনাদের মধ্যে এমন কেউ আছেন, যারা আজ রাতে আমার সাতে ওকারী গ্রামে যেতে পারেন?’
সবাই নীরব।
অবশেষে সেই নীরবতা ভেঙে এগিয়ে এল কয়েকজন যুবক। বলল, ‘আমরা রাজী, কখন যেতে হবে?’
‘এখন থেকে এক ঘন্টার মধ্যে।’
‘আমরা রাজী স্যার। কিন্তু…।’
‘কিন্তু কি?’
‘আমরা তো এসব বন্দুক চালাতে জানি না।’
ক্ষতি নেই তাতে।’
বলে আহমদ মুসা ডান হাত দিয়ে বাম বাহুটা ধরে হাঁটতে শুরু করল।
জেনিফারও হাঁটতে শুরু করেছে, তার ঠোঁটে এক টুকরো ম্লান হাসি।
সে চেয়েছিল আহমদ মুসার আহত জায়গায় তার ওড়নাটা দিয়ে বাঁধতে, অব্যাহত রক্ত ক্ষরণ রোধ করার জন্যে। কিন্ত সে বুঝেছে, আহমদ মুসা এটা চায় না। জেনিফার তার গা স্পর্শ করুক, শুশ্রুষা করুক তা সে চাচ্ছে না।
বাড়ির গেটেই দাঁড়িয়েছিল জেনিফারের মা এবং দাদী।
দূরে থাকতেই জেনিফার চিৎকার করে উঠল, ‘দাদী, আম্মা, আল্লাহর শুকরিয়া আদায় কর। ওরা দশজন এসেছিল, দশজনই নিহত হয়েছে।
আলহামদুলিল্লাহ পড়েই জেনিফারের মা আর্তকণ্ঠে বলে উঠল, ‘একি! কি সর্বনাশ! আমাদের বাছার কি হলো? কোথায় লেগেছে?’
বলে কয়েক ধাপ এগিয়ে এল জেনিফারের মা এবং দাদী।
আহমদ মুসা কাছাকাছি এসে বলল, ‘তেমন কিছু নয় খালাম্মা।
একটা গুলী বাহুর একটা ছোট অংশ তুলে নিয়ে গেছে।’
জেনিফারের মা কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে বলল, ‘কি বলছ বাবা তেমন কিছুই হয়নি। গুলী লেগেছে, কি আবার হবার বাকি আছে।’
বলে জেনিফারের মা ছুটে এসে আহমদ মুসাকে ধরে ভেতরে নিয়ে এল।
আহমদ মুসার ব্যাগ ছাড়াও জেনিফারদের ঘরেও ব্যান্ডেজ সরঞ্জাম
ছিল।
জেনিফারদের ব্যান্ডেজ সরঞ্জাম এবং আহমদ মুসার ব্যাগ থেকে ঔষধ নিয়ে আহমদ মুসার ব্যান্ডেজ বেঁদে দিল জেনিফারের দাদী, তার মা সাহায্য করল। ফায়ফরমাস খাটল জেনিফার।
ব্যান্ডেজ বাঁধা দেখছিল আর ভাবছিল জেনিফার, তার স্বপ্নের মানুষ আহমদ মুসা তার কল্পনার চাইতেও বড়। যুদ্ধের মাঠে যেমন, ঘরেও তেমনি সে। যুদ্ধের মাঠে যেমন শত্রুর বিরুদ্ধে সর্বাত্মক বিজয়ী, ঘরেও তেমনি নীতির প্রশ্নে আপোষহীন। জেনিফার তো নয়ই, জেনিফারের মা’র হাতেও তিনি ব্যান্ডেজ নেয়া পছন্দ করলেন না। কৌশলে তার মাকে অন্য কাজে ব্যস্ত করে তার দাদীকে কাজে লাগালেন। ইসলামের বিধানের উপর থাকার কি আপ্রাণ প্রয়াস এমন এক অসহায় মুহূর্তেও।
শ্রদ্ধায় ভক্তিতে মাথাটা নুয়ে এল জেনিফারের আহমদ মুসার প্রতি। মনে মনে সে বলল, ইসলামের নিয়ম-নীতি মানার ক্ষেত্রে নিশ্চয় সে তার স্বপ্নের মানুষের মতই হবার চেষ্টা করবে।
ব্যান্ডেজ বাঁধতে বাঁধতে জেনিফারের দাদী বলল, ‘শুনলাম, ওদের দশজনের কাছেই স্টেনগান ছিল। তুমি তো গেলে খালি হাতে। ওদের দেখে ভয় করেনি? ওদের মারলে?’
‘খালি হাতে যাইনি দাদী। আমার পকেটেও রিভলবার ছিল। কিন্তু ব্যবহার করতে হয়নি। ওদের অস্ত্র দিয়েই ওদের সাথে লড়াই করেছি।’
‘কিন্তু কি করে সম্ভব হলো, বুঝতে পারছি না।’ বলল জেনিফারের মা।
‘আমি তো আমার শক্তি বলে ওদের সাথে লড়তে যাইনি, গেছি আল্লাহর ওপর ভরসা করে। আর আল্লাহ তো সর্বশক্তিমান।’
‘বাছা, এই বিশ্বাসের শক্তি যদি সবার থাকতো!’ বলল জেনিফারের মা।
‘শুনেছি, কয়দিন আগে মাথায় সাংঘাতিক আঘাত পেয়ে হাসপাতালে ছিলে। আজ আবার এভাবে গুলী বিদ্ধ হলে। খারাপ লাগছে না?’ বলল জেনিফারের দাদী।
‘না খুব ভাল লাগছে দাদী। ঐ বার ঐভাবে আঘাত না পেলে জর্জকে বন্ধু হিসাবে পেতাম না। আর আজ গুলিবিদ্ধ না হলে আপনার এ আদর ভরা শুশ্রুষা পাওয়ার সুযোগ হতো না।’ হাসতে হাসতে বলল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসার কথা শেষ হতেই জেনিফারের দাদী দ্রুত বলল, ‘দাদু ভাই, ওভাবে বলে না। বিপদে খুশী হওয়ার কথা বলা ঠিক নয়।’
আহমদ মুসা গম্ভীর কণ্ঠে বলল, ‘ঠিক বলেছেন দাদী। আসলে আমি খুশী হইনি। দাদীর সাথে একটু মজা করছিলাম। এমন দাদী তো কখনও পাইনি।’
জেনিফারের দাদী ব্যান্ডেজ বাঁধা বন্ধ করে আহমদ মুসার চোখে চোখ রেখে বলল, ‘ওমন করে মায়া ধরিও না ভাই। শেষে কাঁদতে হবে। তোমার মত বনের পাখিকে পোষ মানাবার মত কেউ নেই।’
ভেজা কণ্ঠে বলল জেনিফারের দাদী।
‘আছে দাদী।’ বলল জেনিফার।
‘কে?’ জেনিফারের দিকে মুখ ঘুরিয়ে প্রশ্ন করল তার দাদী।
‘তিনি ‘মারিয়া জোসেফাইন’ আমাদের ভাবী। বলল জেনিফার।
‘আচ্ছা। নাম শুনলাম। আমার হতভাগী বোনকেও তাহলে তুমি কষ্ট দিচ্ছ। সেও দেখি তোমাকে পোষ মানাতে পারেনি।’ বলল জেনিফারের দাদী।
‘আপনার বোন আমাকে পোষ মানাবে কি! সেও তো আসতে চেয়েছিল এখানে। বহু কষ্টে রেখে এসেছি।’ বলল আহমদ মুসা।
‘যাক ভাই, পোষ মানাবার দরকার নেই তোমাকে। পোষ মানালে আমাদের মত যারা তারা তোমাকে তাহলে পাবে কি করে! তুমি একটা ভাল সংবাদ দিয়েছ। আমার ভাই যেমন, আমার বোনকে অবশ্যই তেমন তো হতে হবে।’
বলতে বলতে ব্যান্ডেজের শেষ মাথাটা পেষ্ট করে জেনিফারের দাদী
উঠে দাঁড়াল।
‘ধন্যবাদ দাদী।’ বলল জেনিফারের দাদীকে লক্ষ্য করে আহমদ মুসা।
‘ধন্যবাদের দরকার নেই ভাই। এই অবস্থায় ওকারী গ্রামে তোমার না গেলেই কি নয়?’
‘তাহলে কে যাবে দাদী?’
‘শুনলাম গ্রামের সাত আটজন যুবক রাজী হয়েছে। তার উপর তোমার আবু বকররা আছে।’
‘এরা কেউ বন্দুকটুকুও চালাতে জানে না দাদী। অথচ ওকারী গ্রামে আজ যে হামলা হবে, সেটা বড় ধরনের। সংখ্যায় তারা কম আসবে না, ভারী অস্ত্র নিয়েও আসতে পারে।’
‘কিছুটা তো দুর্বল ওরা হবে, এই দশজন তো ওদের সাথে শামিল হতে পারলো না।’ বলল জেনিফারের মা।
‘তা হবে বটে, কিন্তু এখানকার পরিস্থিতি আঁচ করার সাথে সাথে তারা ভয়ংকর হয়ে উঠবে। গ্রামের প্রতিটি লোক হত্যা ও প্রতিটি বাড়ি ধ্বংস করে তারা প্রতিশোধ নিতে চাইবে।’ বলল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসার কথা শুনে জেনিফার, জেনিফারের মা, তার দাদী সকলেই শিউরে উঠল ভয়ে। তারা যেন লাশে ভরা জ্বলন্ত ওকারী গ্রাম দেখতে পাচ্ছে। কিছুক্ষণ তাদের মুখে কোন কথা এল না।
নীরবতা ভেঙে কথা বলল দাদীই প্রথম। বলল, ‘এদের বিরুদ্ধে একা তুমি কি করবে?’
‘কি করতে পারবো আমি জানি না দাদী। কিন্তু আমাকে গ্রামবাসীর পক্ষে দাঁড়াতে হবে, এটা আমার দায়িত্ব। এরপর যা করার সে দায়িত্ব আল্লাহর।’ বলতে বলতে আবেগে কণ্ঠ ভারী হয়ে এল আহমদ মুসার।
আহমদ মুসার এ আবেগ সবাইকে স্পর্শ করেছে। সকলের মুখ গম্ভীর।
এবার দাদীই কথা বলল, ‘আমরা তো ভাই, তেমন কিছুই জানি না। কিন্তু এটুকু বলতে পারি, আল্লাহর উপর সম্পূর্ণ নির্ভরতা নিয়ে চোখ বন্ধ করে এমনভাবে যে দায়িত্ব পালনে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে, তাকে সাহায্য না করে আল্লাহরও উপায় নেই।’
‘আল্লাহ দাতা ও দয়াময়। আমাকে দোয়া করুন দাদী।’
এ সময় বাইরে গাড়ির শব্দ হলো।
একটি গাড়ি এসে বাইরে দাঁড়াল।
আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল।
বাইরের দরজায় নক হলো।
আহমদ মুসা এগিয়ে গিয়ে দেখল, আবু বকর দাঁড়িয়ে।
আহমদ মুসাকে দেখেই বলল, ‘গাড়ি নিয়ে এসেছি। গাড়িতে দশটি স্টেনগান ও দশটি রিভলবার রয়েছে। গ্রামের যুবকরা যারা যাবে, এক্ষুণি এসে পড়বে।’
আহমদ মুসা ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল রাত পৌনে ১টা। সে বলল, ‘আমরা একটায় ওকারী গ্রামের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করব।’
আর কোন নির্দেশ, স্যার? বলল আবু বকর।
‘ঠিক আছে, যাও।’
আবু বকর ঘুরে দাঁড়িয়ে চলে যাচ্ছিল।
আহমদ মুসা তাকে ডাকল।
ঘুরে দাঁড়িয়ে কয়েক ধাপ এগিয়ে এল।
‘গাড়ি কিভাবে নিয়ে এলে?’ জিঞ্জেস করল আহমদ মুসা।
লাজুক হাসি হাসল আবু বকর। বলল, ‘স্যার আমি অটো হুইলার ড্রাইভ করতে পারি। কিছুদিন আগে পর্যন্ত অটো হুইলার চালাতাম।’
‘সাবাস, আবু বকর। খুব কাজের ছেলে তুমি। আচ্ছা যাও।’
‘আপনার দোয়া চাই স্যার।’ বলে আবু বকর চলা শুরু করল।
আহমদ মুসা ফিরে এল বাড়ির ভেতরে।
যাচ্ছিল তার কক্ষের দিকে।
জেনিফার এল তার কাছে। বলল, ‘একটা বিষয় বুঝতে পারছি না, জিজ্ঞেস করতে পারি ভাইয়া?’
‘অবশ্যই।’
‘যারা বন্দুক চালাতেও জানে না, তাদের আপনি ওকারীতে গুলী বৃষ্টির মধ্যে নিয়ে যাচ্ছেন কেন?’
‘ওদের নিয়ে যাচ্ছি যুদ্ধ করার জন্যে নয়, একটা বিশেষ উদ্দেশ্যে নিয়ে যাচ্ছি।’
‘কি সেটা?’
‘আগে শোনার চেয়ে পরে শুনলে ভালো লাগবে।’
‘ঠিক আছে।’
‘ধন্যবাদ জেনিফার।’
বলে আহমদ মুসা তার কক্ষের দিকে চলে গেল। পোশাক পাল্টে ওকারী গ্রামে যাবার জন্য প্রস্তুত হতে লাগলো সে।

আহমদ মুসার অটো হুইলার তখনও ওকারী গ্রামের মাইল দুই উত্তরে।
একটা বাঁক ঘুরতেই হঠাৎ একটা হেড লাইট চোখে পড়ল তার।
মনের কোণায় চিন্তা জাগল আহমদ মুসার, এত রাতে কারা আসতে পারে? ঐ শ্বেতাংগ গোষ্ঠীর কোন পশ্চাৎ বাহিনী নয়তো? হতেও পারে, আবার নাও পারে।
তবে সাবধান হওয়া উচিত, ভাবল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসা ড্রাইভ করছিল। তার পাশের সিটে বসেছিল আবু বকর।
আহমদ মুসা আবু বকরের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘সামনের গাড়িটাকে জিজ্ঞাসাবাদ না করে যেতে দেয়া যাবে না।’
সামনের গাড়ির হেড লাইট অনেক কাছে চলে এসেছে। রীতিমত চোখে লাগছে।
আহমদ মুসা স্টেনগানটা ডান পাশে ডান হাতের কাছে রাখল।
সামনের গাড়িটা একদম কাছে চলে এসেছে।
আহমদ মুসা ইচ্ছা করেই রাস্তার ঠিক মাঝখান দিয়ে গাড়ি চালাচ্ছে। উদ্দেশ্য হলো, সামনের গাড়ির প্রতিক্রিয়া জানা। যদি ওটা ঐ শয়তানদের কারও গাড়ি হয়, তাহলে গাড়িটা নিশ্চয় ক্রুদ্ধ প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করবে। ক্রুদ্ধ হর্ণ বাজাবে। পাশ কাটিয়ে যাবার চেষ্টা না করে রাস্তার মাঝ দিয়ে এসে মুখোমুখি গাড়ি দাঁড় করিয়ে বাহাদুরি দেখাবার চেষ্টা করবে। আর যদি গাড়িটা সাধারণ কারও হয়, তাহলে এই রাতে ঝামেলা এড়িয়ে পাশ কাটিয়ে চলে যাবার চেষ্টা করবে।
আহমদ মুসার দ্বিতীয় অনুমানটাই ঠিক হলো। গাড়িটা রাস্তার প্রান্ত দিয়ে পাশ কাটিয়ে যাবার চেষ্টা করল।
আহমদ মুসা বুঝল গাড়িটা সাধারণ বা ভালো লোকেরই হবে।
আহমদ মুসার কৌতুহল হলো, গাড়িটা এত রাতে কোথায় যাবে তা জানার জন্যে। তাছাড়া গাড়িটা নিশ্চয় সেই মৎস বন্দর থেকে আসছে।
ওদিকের অবস্থা কিছু হয়তো বলতেও পারবে সে।
আহমদ মুসা তার গাড়ি ক্লোজ করে ঐ গাড়িটার চলার পথ অনেকটা রুদ্ধ করে দিয়ে বলল, ‘গাড়ি কোথায় যাবে?’
গাড়ি থেকে উত্তরে আসতে দেরী হলো। একটু দেরী করে বলল, ‘এই সামনের গ্রামে।’
‘কোন গ্রামে?’ জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা।
এবারও উত্তর এল না তাড়াতাড়ি।
ভ্রু কুচকালো আহমদ মুসা। নিশ্চয় সন্দেহজনক কিছু আছে এ গাড়িতে। জেনিফারদের বাড়িতেই যাচ্ছে না তো?
কথাটা ভাবার সাথে সাথেই আহমদ মুসার হাতের টর্চ জ্বলে উঠল।
টর্চের আলো ভ্যান বক্সে বসা একজন মাত্র লোকের উপর গিয়ে পড়তেই আহমদ মুসা চমকে উঠল, ‘একি! এ যে জর্জ!’
‘একি, তুমি কোথেকে জর্জ এই রাতে?’
আহমদ মুসার প্রথম প্রশ্ন শুনেই জর্জ একে আহমদ আবদুল্লাহর কণ্ঠ বলে সন্দেহ করেছিল। দ্বিতীয় প্রশ্ন শুনে তার সন্দেহ আরও বেড়ে গেল।
এবার চিনতে পেরে আনন্দে চিৎকার করে উঠল জর্জ, ‘আবদুল্লাহ ভাই আমি আপনার কাছেই যাচ্ছি।’
বলতে বলতে জর্জ গাড়ি থেকে নেমে এল।
আহমদ মুসাও গাড়ি থেকে নামল।
দু’জন মুখোমুখি হলো। চাঁদের জ্যোৎস্নায় দু’জন দু’জনকে খুব ভালো দেখতে পাচ্ছে।
আহমদ মুসার বিস্ময় তখনও কাটেনি। বলল, ‘তোমরা সবাই ভালো আছ তো? তুমি এভাবে এ সময় এদিকে আসবে, তা ভাবতেই পারছি না আমি।’
‘আমরা ভাল আছি। আপনাদের কোন খারাপ খবর নেই তো?’
‘খারাপ ভাল মিলিয়ে খবর আছে। কিন্তু তার আগে বলল, ‘তোমার এই নৈশ অভিযান কেন?’
জর্জ একটু ভাবল। বোধ হয় কথা গুছিয়ে নিল। তারপর বলল, ‘আজ সন্ধ্যায় আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপাশে যে রেস্টুরেন্ট সেই রেস্টুরেন্টে বসে খাচ্ছিলাম। আমার টেবিলেই আমার মত আরেকজন শ্বেতাংগ বসেছিল। তার হাতে মোবাইল টেলিফোন। আমি তখনও খাচ্ছিলাম। তার মোবাইলে টেলিফোন এল। টেলিফোনে কথা বলল সে। তার কথাগুলো এমনিতেই আমার কানে এসে ঢুকছিল। আমার তেমন মনযোগ ছিল না। কিন্তু এক পর্যায়ে আমার কান উৎকর্ণ হয়ে উঠল। তখন সে বলছিল, সিডি কাকেম গ্রামে আরও একটি দল যাবে আজ রাতে, সে দল ওকারী গ্রামে ফিরে আসলে তবেই ওকারী গ্রামে অপারেশন শুরু হবে। এই কথা শোনার সাথে সাথে আমার কাছে পরিস্কার হয়ে গেল যে, জেনিফারদের বাড়িতেই আক্রমণ হবে যেখানে আপনিও আছেন। আমার মনে হলো, ‘নিশ্চয় আপনারা খবরটা জানেন না। সংগে সংগেই আমি সিদ্ধান্ত নিলাম সিডি কাকেম গ্রামে আসব। কিন্তু রাস্তায় বোটের ইঞ্জিন গন্ডগোল করায় প্রায় ঘন্টা দুই সময় আমার নষ্ট হয়েছে। এ দিকের কি খবর ভাইয়া?’
‘না, তার আগে বল, টেলিফোনে আর কি শুনেছিলে?’
‘হ্যাঁ। উপরে যে কথার উদ্ধৃতি দিলাম, তারপর আরেকটি এই ধরণের বাক্য বলেছিল, ওকারী গ্রামের দক্ষিণে ঝোপ আচ্ছাদিত যে টিলা, ওখানে ওরা আগে থেকেই অপেক্ষা করবে। সিডি কাকেম থেকে তারা ওখানেই ওদের সাথে মিলিত হবে।’
‘ধন্যবাদ। বন্দরে তুমি কিছু দেখেছ?’
‘বন্দরে তিনটি বোট দেখেছি। যে বোটের পাশে আমার বোটটি নোঙর করেছিল, সে বোটটি বেশ বড়। তাঁতে আমার মনে হয় পনের বিশজন লোক ছিল। আমাদের বোটটি নোঙর করতেই বোটের কেবিন থেকে কে একজন বলে উঠেছিল, কোন চিড়িয়ারে ওখানে? বোটের ডেক থেকে একজন উত্তরে বলেছিল, না কিছু না, একজাত।’
”ধন্যবাদ জর্জ, খুবই মূল্যবান তথ্য তুমি নিয়ে এসেছ।’
আহমদ মুসা একটু থেমে স্বরটা নিচু করে বলল, ‘জর্জ আমাকে বাঁচানো গরজ, না জেনিফারকে?’
জর্জের মুখ লাল হয়ে উঠল লজ্জায়। বলল, ‘ওঁর কথা বলবেন না ভাইয়া, অত উঁচুতে আমার তাকানো ঠিক নয়।’
‘এখন তুমি নতুন জেনিফারকে দেখবে জর্জ।’
হাসল জর্জ। বলল, ‘ভাইয়ার যাদু স্পর্শে তা হতে পারে।’
বলে একটু থেমে আবার শুরু করল, ‘আপনার জন্যে একটা সুসংবাদ আছে ভাইয়া।’
‘কি সেটা?’
‘আমি এবং আপা গতকাল গ্রান্ড টার্কস মসজিদে গিয়ে ইসলাম গ্রহণ করেছি।’
‘কি বলছ তুমি? মজা করছ আমার সাথে’ বলল আহমদ মুসা।
‘মজা করার মত বিষয় এটা ভাইয়া?’
‘কিন্তু এত বড় ঘটনা, আমি জানলাম না।’
‘আমি আপাকে বলেছিলাম আপনি ফিরলে এই অনুষ্ঠান করতে।
কিন্তু আপা বললেন, আপনাকে সারপ্রাইজ দেবেন।’
‘সারপ্রাইজ সত্যি দিয়েছ। এবার এস।’
বলে আহমদ মুসা বুকে জড়িয়ে ধরল জর্জকে। বলল, ‘স্বাগত তোমাকে আলোর পথে, মুক্তির পথে।’
‘আলহামদুলিল্লাহ, দোয়া করুন ভাইয়া।’
আহমদ মুসা জর্জকে আলিঙ্গন থেকে ছেড়ে দিয়ে বলল, ‘হঠাৎ তোমাদের এই সিদ্ধান্ত কিভাবে হলো?’
‘হঠাৎ নয় ভাইয়া, দু’বছর আগে আমি ও আপা এক ছুটিতে স্পেন সফরে গিয়েছিলাম। আমরা দু’জনেই ইতিহাস ভক্ত। গিয়েছিলাম কর্ডোভা, গ্রানাডা, মালাগা’র ঐতিহাসিক নিদর্শন এবং প্রাচীন মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়গুলো দেখতে, যে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে ইউরোপীয় ছাত্ররা শিক্ষা লাভ করে এসে অন্ধকার ইউরোপকে আলোকিত করেছিল। আমরা অভিভূত হই মুসলিম সভ্যতার নিদর্শন দেখে। আমরা ব্যথিত হয়েছিলাম একটি সভ্যতার হিংসার আগুনে বিধ্বস্ত হওয়া দেখে। সেখান থেকেই ঐ সভ্যতা সম্পর্কে জানার একটি তীব্র আগ্রহ সৃষ্টি হয় আমাদের মধ্যে। আমরা ফেরার পথে বেশ কিছু বই কিনে আনি লন্ডন থেকে। এই বইগুলো পড়তে গিয়েই ইসলামের প্রতি আমরা আকৃষ্ট হই। আমাদের মনে হয় মানুষের ধর্ম প্রকৃতপক্ষেই শুধু ইসলামই। এই সময়ই আপনার সাথে আমাদের দেখা হয়।যে ইসলামকে বই পড়ে আমরা জেনেছিলাম, সে ইসলামকে আমরা স্বচক্ষে দেখলাম আপনার মধ্যে। আপনি সিডি কাকেমে চলে আসার দিনই আমরা দু’ভাই-বোন সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলাম ইসলাম গ্রহণের। পরদিনই আমরা গেলাম গ্রান্ড টার্কস মসজিদে। ‘থামল জর্জ।
আহমদ মুসা আবার জড়িয়ে ধরল জর্জকে। বলল, ‘আমি খুশি হয়েছি জর্জ। খুশি লাগছে এ জন্যে যে, ‘টার্কস দ্বীপপুঞ্জ শুধু নয় গোটা ক্যারিবিয়ানে নতুন সুর্যোদয় আসন্ন।’
‘আলহামদুলিল্লাহ ভাইয়া।’
একটু থেমেই জর্জ আবার বলল, ‘এদিকের খবর কি ভাইয়া?’
আহমদ মুসা কিছুক্ষণ আগে সিডি কাকেমে যা ঘটেছে তা জানাল এবং বলল, ‘রাত ৩টার দিকে ওরা ওকারী গ্রামে হামলা চালাবে। আমরা ওখানেই যাচ্ছি। দেখি কি করা যায়। তুমি সিডি কাকেমে গিয়ে বিশ্রাম নিতে পার।’
‘কেন ভাইয়া, আমার কোন যোগ্যতা নেই তাই? আমি অন্তত আপনার গাড়ি ড্রাইভ করতে পারব। রিভলবার, স্টেনগানগুলো যদি থাকে, রিলোড করতে পারবো।’
আহমদ মুসা হাসল। বলল, ‘ঠিক আছে, তোমার গাড়ি ঘুরিয়ে নাও।’
ওকারী গ্রামের কাছাকাছি পৌছে আহমদ মুসার নির্দেশে দুই গাড়িরই হেডলাইট নিভিয়ে দেয়া হলো।
সুন্দর জ্যোৎস্না থাকলেও রাস্তার দু’পাশে মাঝে মাঝে গাছ থাকায় অন্ধকার ঠেলেই দু’টি গাড়িকে সামনে চলতে হচ্ছে।
ওকারী গ্রামের উত্তর পাশের মাঠটা ফাঁকা। চড়াই-উৎড়াই ভরা। মাঝে মাঝে লেবুর ক্ষেত।
এই মাঠের মধ্য দিয়েই গাড়ি চলছে আহমদ মুসাদের।
হঠাৎ আহমদ মুসার চোখ সামনের রাস্তার ডান পাশে গাছ তলার একটি চলন্ত জমাট অন্ধকাররের উপর আটকে গেল। চলন্ত জমাট অন্ধকারটি এসে রাস্তার উপর একটা গাছের আড়ালে গুটি-সুটি মেরে বসল।
দ্রুত ভাবছিল আহমদ মুসা। শত্রু পক্ষ? শত্রু পক্ষ এমন জায়গায় গাড়ি লক্ষ্যে ওঁৎ পাতার প্রয়োজন কি? আর লুকিয়ে দেখার মত আত্মরক্ষামূলক অবস্থানে তাদের যাবার দরকার কি? তাহলে?
সেই ছায়ামূর্তিটির বরাবর গাড়ি এসে গেছে। গাড়ি আস্তে আস্তেই চলছিল।
আহমদ মুসা ডান হাতে টর্চ নিল এবং একই সাথে গাড়ির ব্রেক কষল, অন্যদিকে টর্চের ফোকাস ফেলল কালো ছায়ামূর্তির উপর। সাথে সাথে নামল আহমদ মুসা লাফ দিয়ে গাড়ি থেকে।
টর্চের আলোতে যে ধরা পড়েছে সে একজন কৃষ্ণাংগ।
টর্চের আলো তার মুখে পড়ার সংগে সংগে সে ভয়ে কুকড়ে গেছে।
পালাবার চেষ্টাও সে করতে পারেনি।
আহমদ মুসা তার দিকে ভালো করে তাকাতেই চমকে উঠল। একে তো শুক্রবারে ওকারী গ্রামের মসজিদে সেই প্রবীণ ব্যক্তিটির সাথে দেখেছি। ভালো করে আবার পরখ করল আহমদ মুসা। ঠিক, এ সেই যুবকই।
যুবকটি প্রাথমিক বিমূঢ় ভাব কাটিয়ে উঠেছে। তার হাতের ছোরাকে সে শক্ত হাতে উদ্যত করে তুলে ধরল।
আহমদ মুসা বলল, ‘ছোড়ার প্রয়োজন নেই। তুমি আমার শত্রু নও।’
বলে আহমদ মুসা টর্চের আলো নিজের মুখের দিকে ঘুরিয়ে নিল।
ছেলেটি চিনতে পারল আহমদ মুসাকে। সে ছুটে এল আহমদ মুসার কাছে। সালাম দিয়ে বলল, ‘স্যার আপনার ওদিকের খোঁজ নেবার জন্যেই এখানে বসেছিলাম।’
‘কি খোঁজ?’
‘ওদের একটা দল সিডি কাকেমে আপনাদের ধরার জন্যে গেছে।
আমরা উদ্বিগ্ন কি হয় সে খবর জানার জন্যে।’
ওদের সম্পর্কে আর কি জান?’
‘আমরা খবর পেয়েছি, আজ রাতে ওরা আমাদের গ্রামে আক্রমণ করবে।’
‘জান? কি করে?’
একজন জেলে আমাদেরকে এ খবর দিয়েছে। সে শুনেছে একজন কৃষ্ণাঙ্গ বোটম্যানের কাছ থেকে।’
‘খবর শোনার পর কি করেছ তোমরা?’
‘কি করার আছে! আমরা গ্রাম খালি করে চলে এসেছি।’
‘গ্রাম খালি করে? কোথায় এসেছ?’
মাঠের একটা স্থানের দিকে আঙুল দিয়ে ইংগিত করে বলল, ‘সবাই ওখানে আত্মগোপন করে আছে।’
‘কিন্তু গ্রাম এতে রক্ষা পাবে?’
‘পাবে না, কিন্তু জীবন বাঁচবে।’
‘মোকাবিলা করলে জীবন ও সম্পদ দুই-ই বাঁচতে পারতো।’
‘মোকাবিলা করতে পারলে তা হতো। কিন্তু মোকাবিলার শক্তি আমাদের নেই। লাঠি, ছুরি, তরবারি, তীরের বাইরে আমাদের কিছু নেই। এসব নিয়ে যুদ্ধ করে মরা যায়, জেতা যায় না।’
‘সিডি কাকেমের খবর জানার জন্য কেন তোমরা উদ্ভিগ্ন?’
‘আমরা সবাই ভাবছি সেখানে যদি আপনারা জেতেন, তাহলে আপনার সাহায্যের একটা সম্ভাবনা আমাদের থাকে।’
‘আলহামদুলিল্লাহ, তোমরা ঠিকই ভেবেছ। আমরা ওখানে জিতেছি। ওরা দশজনই মারা গেছে। আমরা তোমাদের সাহায্য করতেই এখানে এসেছি।’ থামল আহমদ মুসা।

থেমেই আবার বলল, ‘তুমি গিয়ে সবাই কে নিয়ে এস, আমরা সবাই গ্রামে ফিরব।’
যুবকটি সংগে সংগেই ছুটল। পনের মিনিট পর ফিরে এল সবাই কে
নিয়ে। ছোট বড় মিলে প্রায় ৫০০ মানুষের বিরাট দল। সবাই চলল গ্রাম অভিমুখে।
আহমদ মুসা তার পাশের সিটে তুলে নিয়েছে ওকারী গ্রামের সেই প্রবীণ ব্যক্তিকে। জেনেছে তার নাম আব্দুর রহমান ওকারী। তার ছেলের নাম ইসহাক আব্দুল্লাহ।
হেড লাইট নিভানো গাড়ি ধীরে ধীরে চলছিল।
আহমদ মুসার গাড়ি আগে। জর্জের গাড়ি তার পিছনে।
চলতে চলতে কথা হচ্ছিল আব্দুর রহমান ওকারীর সাথে।
আব্দুর রহমান ওকারী বলছিল, ‘এখন রাত আড়াইটা। নিশ্চয় ওরা এতক্ষণে পজিশন নিয়েছে। ওরা যদি কাকেমের কথা কোনভাবে জানতে পারে; তাহলে ওরা ধ্বংসের দৈত্যে পরিণত হবে। আমরা গ্রামে যাচ্ছি, কিন্তু আমাদের কি করণীয়?’
‘আমি আপনাদের গ্রামে পৌঁছে দিয়ে ওদের সাথে সাক্ষাত করতে যাব।’
‘সাক্ষাত করতে?’
‘জ্বি হ্যাঁ। সাক্ষাত না করলে সংঘর্ষ হবে কি করে?’
‘বুঝেছি। সিডি কাকেম গ্রামে যেভাবে বেরিয়েছিলেন?’
গ্রামের সেই মসজিদের পাশে পৌঁছার পর গাড়ি থামাল আহমদ মুসা। ধীরে ধীরে রাস্তা ও মসজিদের চত্বরে সব লোক জমা হয়ে গেল।
আহমদ মুসা আব্দুর রহমান ওকারীকে বলল, ‘জনাব লোকেরা আপাতত এখানেই বিশ্রাম নিক। এদিকটা ফায়সালা হবার পর সবাই বাড়ি ফিরে যাবে। মেয়েরা এই সময়টা মসজিদে বিশ্রাম নিতে পারে।’
আব্দুর রহমান ওকারী আহমদ মুসার এ প্রস্তাব মেনে নিল এবং গাড়ি
উপর দাঁড়িয়ে এ বিষয়টি ঘোষণা করে দিল।
এ সিদ্ধান্তে সবাই খুশী হল। অনিশ্চিত অবস্থার মধ্যে আতংক নিয়ে কারও বাড়ি ফিরতে মন সায় দিচ্ছিল না।
আবদুর রহমান ওকারী গাড়ির উপর থেকে নিচে নামতেই একজন লোক হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এল তার কাছে।
লোকটিকে দেখে আব্দুর রহমান ওকারী মনে উদ্বেগ, উৎসাহ দুইয়েরই প্রকাশ ঘটল।
আগন্তুককে দেখিয়ে সে আহমদ মুসাকে বলল, ‘এ ছেলে আমাদের অনুসন্ধান বিভাগের কর্মী। তাকে নিয়োগ করা হয়েছিল যারা ঘাট থেকে গ্রাম আক্রমণে আসবে তাদের গতিবিধি লক্ষ্য করতে।’
কথা শেষ করেই সে আগন্তুক লোকটিকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘কি খবর নিয়ে এসেছ? খুব উদ্বিগ্ন দেখাচ্ছে তোমাকে।’
‘ওরা দুই ভাগে ভাগ হয়েছে। দশজন যাচ্ছে গ্রামের পূব পাশে। আর
দশজন আসবে দক্ষিণ দিক থেকে। আর সিডি কাকেম থেকে যারা আসবে তারা ঘিরবে গ্রামের উত্তর দিক।’
আহমদ মুসা ঘড়ি দেখলে। রাত পৌঁনে তিনটা।
আহমদ মুসা বুঝল, ওরা আশা করছে রাত তিনটার মধ্যেই সিডি কাকেমে যাওয়া তাদের বাহিনী ফিরে আসবে এবং তখন তাদের অপারেশন শুরু করবে।
‘দক্ষিণ থেকে যারা আসবে তারা এখন কোথায়? খবর নিয়ে আসা লোকটিকে জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা।
‘ওরা কিছুদূর দক্ষিণে রাস্তার পাশে একটা ঝোপওয়ালা টিলার আড়ালে ওঁৎ পেতে বসে আছে।’
আহমদ মুসা আবদুর রহমান ওকারীর দিকে চেয়ে বলল, ‘জনাব আমি এই দশজনের কাছে যাচ্ছি।
বলে জর্জের দিকে তাকিয়ে আহমদ মুসা বলল, ‘জর্জ তুমি আমার গাড়ি ড্রাইভ করবে। চল।’
‘আমি বুঝতে পারছি না। গাড়ি নিয়ে কি করে যাবেন? ওরা তো টের পেয়ে যাবে।’ বলল আবদুর রহমান ওকারী।
আহমদ মুসা হাসল। বলল, ‘এই গাড়িটা ওদের। দেখুন সামনে নম্বার প্লেটে হোয়াইট ঈগল আকাঁ একটা কাগজ সেঁটে দেয়া। নিশ্চয় এটা ওদের মনোগ্রাম হবে। সুতরাং গাড়িকে ওরা সন্দেহ করবে না।
এটাই হবে আমাদের বড় অস্ত্র।
‘আহমদ মুসার কথা শুনে আবদুর রহমান ওকারী, জর্জ আবুবকর সহ সবাই গাড়ির নম্বার প্লেটের দিকে তাকাল, দেখল, একটা সাদা বর্ণের ‘T’ অক্ষরের উপর হোয়াইট ঈগলটি শিকারের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ার পোজ নিয়ে বসে আছে।
সকলের সাথে আহমদ মুসাও সেদিকে তাকাল। বলল, ‘T’ অক্ষরকে ক্রসও ধরা যায় যদি মনে করা হয় ঈগলের আড়ালে ক্রসের উপরের দন্ডটি লুকিয়ে আছে অথবা যদি মনে করা হয় ঈগল নিজেই ‘ক্রস’ এর সেই দন্ড।’
জর্জ উচ্ছ্বসিত কন্ঠে বলল, ‘ঠিক বলেছেন, ভাইয়া। হোয়াইট ঈগল ক্রসকে ভিত্তি করছে এবং তার ভিত্তিকে ক্যামোফ্লেজ করেছে।’
‘ধন্যবাদ জর্জ। তোমার ব্যাখ্যা সুন্দর হয়েছে শুধু তাই নয়, ভাবনার নতুন দিগন্তও উন্মচন করেছে। গ্রুপটির পরিচয় উদ্ধারে এটা আমাদের সাহায্য করবে।’
বলে আহমদ মুসা গাড়ির দিকে এগুলো।
জর্জও গিয়ে ড্রাইভিং সিটে বসল।
সবাইকে সালাম দিয়ে যাত্রা শুরু করল আহমদ মুসা।
হেড লাইট জ্বালিয়ে বেপরোয়া গতিতে এগিয়ে চলল গাড়ি।
মিনিট পাঁচেক ড্রাইভ করার পর রাস্তার ডান পাশের একটা ঝোপ আচ্ছাদিত টিলা অতিক্রম করতেই গাড়ির সামনে এক শেতাংগকে দেখতে পাওয়া গেল। সে দু’হাত উঁচিয়ে গাড়ি থামাতে ইশারা করে চিৎকার দিয়ে বলল, ‘আমরা সবাই এখানে’।
আহমদ মুসা জর্জকে লোকটির বাম পাশ ঘেঁষে গাড়ি দাঁড় করাতে বলল।
যখন গাড়ি দাঁড়াল, লোকটি তখন আহমদ মুসার হাতের নাগালের মধ্যে।
গাড়ি স্থির হবার সংগে সংগেই আহমদ মুসা ঝাঁপিয়ে পরে লোকটির গলা বাম হাতে পেচিয়ে ধরে লোকটিকে বুকের সাথে সেটে ধরে জর্জকে লক্ষ্য করে বলল, ‘তুমি পূবপাশে গাড়ির আড়ালে চলে এস।’
এই ফাঁকে লোকটি প্রাণপ্রণে চিৎকার করে উঠেছিল। উদ্দেশ্য ঘটনাটা সাথীদের জানিয়ে দেয়া।
তার উদ্দেশ্য ব্যর্থ হয়নি। তাদের কানে চিৎকার পৌছেছিল। তারা ছুটে আসছিল গাড়ির লক্ষ্যে।
আহমদ মুসা লোকটিকে বুকে সেটে রেখেই দ্রুত গাড়ির আড়ালে থেকে একটু দক্ষিণে এগিয়ে গেল।
একবার চিৎকার করার পরই লোকটির কন্ঠ রুদ্ধ হয়ে গেছে ক্রমেই নিস্তেজ হয়ে পড়েছে তার দেহ। লোকটিকে ঠেলে দক্ষিণে দিকে নিয়ে যাবার সময় আহমদ মুসা বুঝল, লোকটি প্রাণহীন হয়ে পড়েছে।
আহমদ মুসার ডান হাতে স্টেনগান।
আহমদ মুসার লোকটির কভার নিয়ে গাড়ির আড়ালে বেরিয়ে এসে দেখল সবাই ছুটে আসছে গাড়ির দিকে। তাদের দৃষ্টিও গাড়ির উপর নিবদ্ধ।
এই সুযোগের সদ্ব্যবহার করল আহমদ মুসা।
লোকটিকে ফেলে আহমদ মুসা দু’হাতে স্টেনগান তাক করলো ওদের দিকে।
ততক্ষণে আহমদ মুসা ওদের দৃষ্টিতে পড়ে গেছে। কেউ থমকে দাঁড়িয়েছে, কেউ আবার স্টেনগান ঘুরিয়ে নিচ্ছে।
কিন্তু আহমদ মুসার স্টেনগান তার আগেই তৈরি হয়ে গিয়েছিল।
ট্রিগারও চেপেছে আহমদ মুসা।
স্টেনগানের নল চোখের পলকে ঘুরে এল ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা লোকগুলোর উপর।
তারপর আহমদ মুসা এগিয়ে গেল তারা যেখানে লুকিয়েছিল সেখানে। আর কোন লোক নেই। গুণে দেখল দশটি লাশ পড়ে আছে মাটিতে। গুলীর কয়েকটা বাক্স পড়ে আছে তাদের লুকিয়ে থাকা জায়গায়।
জর্জ তখন গাড়ির আড়াল থেকে বেরিয়ে এসেছে।
আহমদ মুসা তাকে বলল, ‘জর্জ দশটি স্টেনগান ও গুলির বাক্সগুলো গাড়িতে তোল। আর দেখ, ওদের পকেটে রিভলবার থাকলে সেগুলোও নিয়ে নাও।’
এগুলো গাড়িতে তোলা হয়ে গেলে আহমদ মুসা হাতের স্টেনগান ছাড়াও আর একটি স্টেনগান তার কাধে ঝুলাল। তারপর জর্জকে বলল, ‘গাড়ি নিয়ে তুমি মসজিদে ফিরে যাও।’ ওখানে গিয়ে জনাব আব্দুর রহমান ওকারীকে বলে ইসহাক আবদুল্লাহসহ দশ বারজন লোককে এখানে পাঠাও লাশগুলোকে লুকিয়ে ফেলার জন্য।
আর এই গাড়িতে ১৮টি স্টেনগান ও ১২টি রিভালবার রয়েছে, এগুলোর উপর তুমি চোখ রাখবে।’
আহমদ মুসার কথা শেষ করল। কিন্তু জর্জ কিছু বলল না। আহমদ মুসা দেখল অপার বিস্ময় নিয়ে জর্জ তার দিকে তাকিয়ে আছে। বোবা হয়ে গেছে যেন সে।
‘কি ব্যাপার, এতগুলো লাশ দেখে তোমার খারাপ লাগছে?’ বলল আহমদ মুসা।
‘না ভাইয়া। আমি দেখছি আপনাকে। আমার বিস্ময় আপনি। আজ রাতের সিডি কাকেম গ্রামের ঘটনা আমি শুনলাম। এখন আবার দেখলাম। যা গল্পের বইয়ে পড়েছি, তা নিজের চোখে দেখলাম। আপনার সর্ম্পকে আমার কৌতুহল ধরে রাখতে পারছি না। আমি যেটুকু জানি, সেটুকুই আপনার পরিচয় হতে পারে না।’ থামল জর্জ।
‘সব জানবে, এখন যাও।’ বলল হাসি মুখে আহমদ মুসা।
‘আমি যাচ্ছি কিন্তু আপনি?’
‘আমি এখানেই অপেক্ষা করছি। ওরা এলে ওদের কাজ বুঝিয়ে দিয়ে ইসহাক আব্দুল্লাহকে নিয়ে গ্রামের পূবদিকে যারা গেছে তাদের সন্ধানে বের হবো।’
জর্জ গাড়িতে উঠে গাড়ি স্টার্ট দিয়ে চলে গেল। দশ বার মিনিট লাগলো লোকদের আসতে।
লাশগুলো মাটির তলায় লুকিয়ে ফেলার এবং রক্তগুলো মাটি চাপা দেবার নির্দেশ দিয়ে আহমদ মুসা ইসাক আবদুল্লাহকে নিয়ে মাঠের মধ্যে দিয়ে গ্রামের পূব প্রান্তের দিকে যাত্রা করল।
আহমদ মুসা ও ইসহাক যতটা সম্ভব ঝোপ-ঝাড় ও উঁচু জায়গায় কভার নিয়ে গ্রামের পূব প্রান্তের দিকে এগিয়ে চলল। ইসাক আবদুল্লাহ সব কিছু চেনে বলে অসুবিধা হলো না।

‘ইসহাক আবদুল্লাহ সামনের দিকে ভালো করে খেয়াল রেখো। এদিকে গুলীর শব্দ শুনে ওরা কিংবা ওদের কেউ খোঁজ নিতে এদিকে আসতে পারে’। বলল আহমদ মুসা।
সামনের দিকে চোখ রেখে ওকারী গ্রাম, গ্রামের মানুষের জীবন ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা করতে করতে চলছে দু’জন। কথায় কথায় কখন যেন আনমনা হয়ে পড়েছিল তারা।
হঠাৎ উদ্যত স্টেনগানধারী একজনকে সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আহমদ মুসা ও ইসাক আবদুল্লাহ ভূত দেখার মতই চমকে উঠল।
আহমদ মুসার একটি স্টেনগান কাঁধে ঝুলানো, আরেকটি হাতে ঝুলছে। আর ইসাক আবদুল্লাহর হাতে রয়েছে একটি বর্শা এবং কোমরে ঝুলানো একটি ছোরা।
উদ্যত স্টেনগান হাতে দাঁড়ানো লোকটির চোখে-মুখেও বিস্ময়।
লোকটি চিৎকার করে বলল, ‘কে তোরা? ওদিকে গোলা-গুলীর শব্দ হলো কোথায়?’
ইসাক আবদুল্লাহ ভীত হয়ে পড়েছে। ফ্যাকাশে হয়ে গেছে তার মুখ ভয়ে। আর আহমদ মুসার চোখে-মুখে একটা নিদোর্ষ ও ভাবলেশহীন ভাব। যেন উদ্যত স্টেনগান হাতে কোন লোককে সে সামনে দেখছেই না। লোকটির প্রশ্নের জবাবে আহমদ মুসা বলল, আমরা পাশের গ্রামের লোক। আমাদের ছুটে যাওয়া কিছু পশুকে খুঁজতে বেরিয়েছি আমরা। গুলীর শব্দ কোথায়? গোলা-গুলী তো হয়নি। আমি আমার এই স্টেনগান দিয়ে ফায়ার শিখছিলাম। শেই শব্দই আপনি শুনেছেন’।
বলে আহমদ মুসা তার হাতের স্টেনগান সামনের লোকটিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘এই দেখেন এর অর্ধেক ম্যাগাজিন খালি।’
লোকটি স্টেনগানটিকে লুফে নিল এবং বলল, ‘তোমার কাঁধের স্টেনগানও আমাকে দাও।’
সুবোধ বালকের মত আহমদ মুসা কাধেঁর স্টেনগানটিও তার হাতে তুলে দিল।
দ্বিতীয় এই স্টেনগানটি হাতে পাওয়ার পর লোকটির উদ্ধত করে রাখা স্টেনগানের ব্যারেল অনেকখানি নিচে নেমে গেল এবং আহমদ মুসার কাছ থেকে পাওয়া স্টেনগাটি সে সময় কাঁধে ঝুলছিল।
এই সুযোগ নষ্ট হতে দিল না আহমদ মুসা।
চোখের পলকে তার ডান হাতে পকেটে ঢুকে গেল এবং বের করে আনল একটি রিভলবার। সংগে সংগেই গুলী বর্ষিত হলো রিভলবার থেকে। চোখের পলকেই ঘটে গেল ঘটনা।
লোকটির চোখে দৃশ্যটা ধরা পড়েছিল শেষ মুহূর্তে। কিন্তু স্টেনগান তোলার আর সুযোগ পেল না সে। মাথা তার গুড়ো হয়ে গেল আহমদ মুসার গুলীতে।
লোকটির পকেট সার্চ করে কোন কাগজপত্র পেলো না। পেল একটি রিভালবার ও একটি মানিব্যাগ।
আহমদ মুসা রিভলবারটি পকেটে পুরে ম্যানিব্যাগটা রেখে দিল আবার লোকটির পকেটেই।
‘ম্যানিব্যাগ মৃত মানুষের পকেটে রাখলে কোন লাভ হবে কি মৃত মানুষের?’ বলল ইসহাক।
‘লাভ তার হবে না, লাভ হবে আমাদের।’
‘কি লাভ জনাব?’
‘যে ঘটনা ঘটল তার সাথে অর্থলোভের কোনো সর্ম্পক ছিল না। তার টাকা পয়সা হাতে পেয়েও নেইনি, এর মাধ্যমে সেটা প্রমাণ হবে। এই অর্থ প্রত্যাখান করার ফলে আমাদের মধ্যে নিস্বাঃর্থ কাজের স্পৃহা বাড়বে।’
‘ওয়ারিশহীন এটা নিলে কি সে স্পৃহা কমতে পারে?’
‘কমতে পারে।’
‘কিভাবে?’
‘আজ যদি তার এই টাকাগুলো নেই, সে টাকায় আমার তোমার নিশ্চয় উপকার হবে। কালকে আরও কয়েকজন নিহতের টাকা আমাদের পকেটে আসবে। তাতে আমরা আরও উপকৃত হব। এইভাবে ধীরে ধীরে আমাদের মনে এই ধারণা জন্মাবে যে, শত্রুর বিরুদ্ধে এই অপারেশন, হত্যা ইত্যাদি নীতি ও আদর্শিক দিক থেকে প্রয়োজনীয়ই শুধু নয়, লাভজনক। ধীরে ধীরে এই লাভটাই এক সময় মুখ্য হয়ে ওঠবে। তখন আমার এই কাজগুলো আর নিঃস্বার্থ বা ‘ফি সাবিলিল্লাহ’ হবে না। এর চেয়ে বড় ক্ষতি আমার এবং তোমার আর কিছু হতে পারে না।’
ইসাক আবদুল্লাহর মুগ্ধ দৃষ্টি আঠার মত লেগে ছিল আহমদ মুসার মুখে। আহমদ মুসার কথা শেষ হলে বলল সে, ‘এই ধরণের কথা কোনদিন শুনিনি। এগুলো তো নতুন মানুষের কথা, নতুন মানসিকতার কথা, নতুন সভ্যতার কথা। এটাও কি ইসলামেরই শিক্ষা?’
‘অবশ্যই ইসহাক।’
বলে একটি স্টেনগান ইসাক আবদুল্লাহর কাঁধে তুলে দিয়ে আর দু’টি আগের মত করেই নিজে নিয়ে নিল।
আবার চলতে শুরু করছে ওরা। গ্রামের পুব প্রান্তে প্রায় এসে গেছে।
এখন দাড়িঁয়ে নয়, হামাগুড়ি দিয়ে পথ চলতে শুরু করেছে তারা। তাদের সন্ধানি দৃষ্টি এবার চারদিকে। একবার অমনোযোগিতার অপরাধ আল্লাহ মাফ করেছেন, তার পুনরাবৃত্তি আর তারা চায় না।
এক জায়গায় একটি ঝোপের আড়ালে বসে তারা বিশ্রাম নিচ্ছিল। পুব দিক থেকে আসা বাতাসে সিগারেটের গন্ধ তাদের নাকে ঢুকল। চমকে উঠল আহমদ মুসা। নিশ্চয় শত্রু আশেপাশে কোথাও আছে।
ভাবনা শেষ হতে পারেনি আহমদ মুসার।
মানুষের কথা শুনতে পেল একদম ঝোপের ওপাশেই। কথা বলতে বলতে কারা যেন এগিয়ে আসছে। কথাগুলো স্পষ্টভাবে আহমদ মুসার কানে এল, ‘কিছু একটা ঘটছে। এই মাত্র যে রিভালবারের গুলীর শব্দ এল তা খুব দূর থেকে নয়।’
কথাগুলো থেকে আহমদ মুসার মনোযোগ বিচ্ছিন্ন হবার আগেই ঝোপ পেরিয়ে তারা একদম সামনে এসে গেছে।
আহমদ মুসা স্টেনগান বাগিয়ে ধরে লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল।
স্টেনগান ওদের দিকে তাক করে চিৎকার করে বলল, ‘হাতের স্টেনগান ফেলে দাও তোমরা।’
এগিয়ে আসা লোকগুলোর কাছে এই চিৎকার বোমা পড়ার মতই বোধ হয় মনে হলো।
সামনের দু’জনের হাত থেকে স্টেনগান আপনাতেই যেন খসে পড়ল। অন্যেরা স্টেনগান ফেলেনি। কেউ কেউ ঘটনার আকস্মিকতার ঘোর কাটিয়ে উঠতে পারেনি। পেছন থেকে কয়েকজন দু’পাশে পালাচ্ছিল। আহমদ মুসা তাদের এ সুযোগ দিল না। গর্জে উঠল তার হাতের স্টেনগান। মুহুর্তেই নয়জন লাশ হয়ে ঢলে পড়ল মটিতে।
আহমদ মুসা লাশ গুণে দেখে বলল, ‘ইসহাক আবদুল্লাহ আমাদের পুর্বমুখী অভিযান শেষ।’
একটু থেমেই আবার বলল, ‘ওদের সকলের পকেট সার্চ কর। রিভালবার ও যেকোন ধরণের কাগজপত্র থাকলে নিয়ে নাও।’
এদের কাছেও কোন কাগজপত্র পাওয়া গেল না। রিভলবার পাওয়া গেল সকলের কাছেই। নয়টা স্টেনগানও নিয়ে নেয়া হলো। রিভালবারগুলো পকেটে এবং স্টেনগানগুলো দু’জন কাঁধে ঝুলিয়ে নিয়ে গ্রামের দিকে যাত্রা শুরু করল।
মসজিদ, মসজিদ চত্তর ও রাস্তায় জমায়েত গ্রামবাসীরা দারুন উদ্বিগ্ন। গুলির সবগুলো শব্দই তারা শুনেছে। এই গুলি কারা করল এবং কারা এর শিকার হল, সেটাই তাদের উদ্বেগ।
জর্জ ও আবু বকরের কাছে বসে ছিল আবদুর রহমান ওকারি।
তার মনে দুশ্চিন্তা ও গর্ব দুই-ই।দুশ্চিন্তা এই কারণে এই গোলা-গুলীর মধ্যে তার ছেলে কখনও যায়নি। আজ কি হয় কে জানে! আর গর্ব এই জন্যে যে, ‘আহমদ আবদুল্লাহর মত এত বড় বিদেশী লোক তার ছেলেকে পছন্দ করেছে তার সাথী হিসাবে।’
আবদুর রহমান ওকারী বার বার জিজ্ঞেস করেছে জর্জ এবং আবু
বকরকে, গ্রামের পূর্ব পাশ ঘুরে আসতে এত দেরী কেন্, আল্লাহ আমাদের বিজয়ী করবে তো ইত্যাদি। তারপর জিজ্ঞাসা করেছে, সত্যিই আহমদ আবদুল্লাহ কে? এ রকম লোক তো দেখিনি, শুনিনি এমন লোকের কথা। কোথেকে আল্লাহ তাকে আনলেন? ইত্যাদি।
জর্জ বলেছে, আমরাও কিছু জানি না। তার সম্পর্কে শুধু এইটুকু বলতে পারি, তিনি কোন সাধারণ লোক নন। হয় কোন ফেরেস্তা মানুষ রূপ ধরে এসেছেন, অথবা কোন অসাধারণ কেউ হবেন যে পরিচয় আমরা এখনও জানি না।
এই সময় আহমদ মুসা ও ইসাক আবদুল্লাহ মসজিদ চত্তরে প্রবেশ করল স্টেনগানের বোঝা নিয়ে।
সবাই আনন্দ ধ্বনি করে উঠল। কেউ কেউ আল্লাহু আকবার ধ্বনি দিল।
জর্জ, আবু বকর এবং আবদুর রহমান ওকারী তখনও বসে অস্ত্র রাখা অটো হুইলারে।
আহমদ মুসাকে দেখেই আবু বকর গাড়ি থেকে বেরিয়ে ছুটে গেল আহমদ মুসার কাছে। তার কাছের স্টেনগানগুলো নিয়ে আহমদ মুসার সাথে সাথে চলল জর্জের গাড়ির দিকে।
জর্জ গাড়ি থেকে বের হয়নি আহমদ মুসার নির্দেশ অনুসারে পাহারা থাকার জন্যে।
সব অস্ত্র রাখা হল গাড়িতে।
আহমদ মুসা গাড়িতে বসতেই আবদুর রহমান ওকারী বলল, ‘ওদিকের কি সংবাদ বলুন জনাব, আমাদের তর সইছে না।’
‘ওরা দশজনই মারা গেছে। বাকি কথা ইসহাক আব্দুল্লাহর কাছে শুনবেন।’
বলে একটু থেমেই আবার বলল, ‘আমার কিছু জরুরি কথা আছে।’
‘শুনব তার আগে বলুন, আমার ছেলের নামের প্রথম অংশ ‘ইসাক’ না ‘ইসহাক’। আপনি ‘ইসহাক’ বলছেন। বলল আবদুর রহমান
ওকারী।
‘শুদ্ধ উচ্চারণ ‘ইসহাক’। বলে থামল।
আবার শুরু করল আহমদ মুসা। বলল, ‘এখানে যারা হাজির আছে, তার মধ্যে জনাব আবদুর রহমান ওকারী ও ইসহাক আবদুল্লাহ এই
দু’জন ওকারী গ্রামের, জর্জ গ্রান্ড টার্কস দ্বীপের, আবু বকর ভিজকায়া মামুন্ড দ্বীপের। আর হাজির আছেন সিডি কাকেম গ্রামের কয়েকজন যুবক। ওরা পাশের গাড়িতে আছে। ডাকলেই আসবে। আর কাউকে ডাকার প্রয়োজন আছে বলে মনে করেন জনাব।’ শেষ বাক্যটা আবদুর রহমান ওকারীকে লক্ষ্য করে বলল আহমদ মুসা।’
‘কি কাজের জন্যে মানে এখন আলোচনার বিষয় হবে কি?’
‘এই দ্বীপ এবং দ্বীপপুঞ্জের ভবিষ্যত সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ কিছু বলতে চাই।’
‘তাহলে আমাদের গ্রামের ‘রক্ষা সমিতি’র সেক্রেটারী ফরিদ নোয়ানকোকে ডাকতে হয়। আমাদের ইসহাক আবদুল্লাহ গ্রামের ‘রক্ষা সমিতির’র সভাপতি।’
‘বেশ তাকে ডাকুন আর ও গাড়ি থেকে সিডি কাকেম গ্রামের ওদেরকেও ডাকতে হবে।’
সবাইকে ডাকা হলো।
অটো হুইলারের ভ্যান বক্সের সিটে গোল হয়ে সবাই বসল।
কথা শুরু করল আহমদ মুসা। বলল, ‘আজ যে ঘটনা ঘটল, তাতে শত্রুদের একটা বড় আক্রমণ রোধ করা গেছে। তাদের তিরিশজন মারা গেছে আজ। এর প্রতিশোধ তারা নিতে চাইবে এ দ্বীপে, কিংবা অন্য দ্বীপে। ঠিক কিনা?’
‘ঠিক।’ বলল জর্জ এবং আবদুর রহমান ওকারী প্রায় এক সাথেই।
‘যদি ঠিক হয়, তাহলে তিনটি বিকল্প ব্যবস্থা আমাদের সামনে। এক, পালানো, দুই, নীরবে মার খেয়ে নিঃশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়া এবং তিন, আজকের মত প্রতিরোধ করা। এ তিনের মধ্যে পালানো আসলে কোন বিকল্প নয়। পালিয়ে বাঁচা যায় না। অবশিষ্ট থাকে দু’ই বিকল্প। এর মধ্যে আমাদের কোনটি গ্রহণ করা উচিত?’ বলল আহমদ মুসা।
কিছুক্ষণ নীরবতা। সবাই একে অপরের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করল।
কিছুক্ষণ পর সবার পক্ষ থেকে প্রশ্নের উত্তরে বলল ইসহাক আবদুল্লাহ, শেষ বিকল্প ব্যবস্থাটাই আমাদের গ্রহণীয়। কিন্তু আজকের মত আপনাদের আমাদের সাথে থাকতে হবে।
‘আমি বিদেশি। আমি কতক্ষন থাকব। আপনাদের নিজের রক্ষার দায়িত্ব আপনাদেরই নিতে হবে।’ বলল আহমদ মুসা।
সে শক্তি এবং সাহস আমাদের অবশিষ্ট নেই ভাইয়া।’ বলল জর্জ।
‘তোমরা যদি ঐক্যবদ্ধ হও। একে অপরের পাশে দাঁড়াও এবং ওরা যা নিয়ে আসবে, সে প্রস্তুতি তোমাদেরও থাকে, তাহলে কি তোমরা ওদেও ভয় করবে?’
‘আমাদের ঐক্যও নেই, আমাদের অস্ত্রও নেই, আমাদের সাহসও
নেই। এসব যদি থাকে, ভয় অবশ্যই থাকার কথা নয়’।বলল আবু বকর।
‘এই ঐক্য এবং প্রতিরোধের শক্তি কী আপনাতেই আসবে না কেউ বা কিছু লোককে এর উদ্যোগ নিয়ে অর্জন করতে হবে? বলল আহমদ মুসা।
‘কিছু লোককে এর উদ্যোগ অবশ্যই নিতে হবে।’ জর্জ বলল।
এই উদ্যোগ নিতে তোমরা রাজী আছ?’ আহমদ মুসা বলল।
‘রাজী, কিন্তু…।’ কথা শেষ না করেই থেমে গেল ইসহাক আবদুল্লাহ।
‘কিন্তু কি।’
‘আবার সেই কথা, আপনাকে আমাদের সাথে থাকতে হবে, নেতৃত্ব দিতে হবে।’ বলল জর্জ।
‘আমিও আবার বলছি, তোমাদের মধ্যে শক্তি, সাহস, যোগ্যতা, সবই আছে। শুধু প্রয়োজন সে সবকে উজ্জীবিত করা।’
‘এই উজ্জীবিত করার দায়িত্বই আপনাকে নিতে হবে। গত কয়েক দিনে আমরা যেভাবে নিজেদের চিনতে শুরূ করেছি, তা আমাদের কাছে অজানা ছিল। এখনও বহু কিছুই আমাদের অজানা। এই জানাবার দায়িত্ব আপনি ছাড়া আর কে নেবে?’ বলল আবদুর রহমান ওকারী।
‘আমি আমার দায়িত্ব পালন করব। আমি জানতে চাই, তোমরা তোমাদের দায়িত্ব পালন করতে রাজী আছ কিনা।’
‘আমরা রাজী।’ সমস্বরে সবাই বলল।
‘পরিণতির কথা কি তোমাদের সামনে আছে? বলল আহমদ মুসা গম্ভীর কন্ঠে।’
‘আছে।’
‘শান্তির বদলে এই অশান্তির পথে গ্রহণে পক্ষে তোমাদের যুক্তি কি?’
‘আমরা শান্তিতে ছিলাম না। তিল তিল করে আমরা মরছিলাম। শান্তির জন্যে, স্বাধীনভাবে বাঁচার জন্যেই আমরা এই সংগ্রামের পথ গ্রহণ করতে চাই।’ বলল জর্জ।
জর্জ থামতেই বলে উঠল আবু বকর, ‘বর্তমান অবস্থার যে পরিনতি, আর প্রতিরোধ করার যে পরিনতি-এ দু’য়ের মধ্যে ক্ষতির দিক দিয়ে খুব পার্থক্য নেই। কিন্তু একটা বড় পার্থক্য রয়েছে। প্রথমটা অপমানকর মৃত্যু, আর দিতীয়টি বীরের মৃত্যু।’ আরেকটা পার্থক্য আছে। সেটা হলো, প্রথমটিতে আছে শুধুই ধ্বংস, কিন্তু দ্বিতীয়টির একটি বিকল্প হলো স্বাধীনতা ও সম্মানের জীবন।
জর্জ ও আবু বকরের কথা শুনে আহমদ মুসার মুখ আনন্দ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বলল সকলকে লক্ষ্য করে, ‘তোমাদের কথা বল।’
সকলে একবাক্যে বলে উঠল, ‘জর্জ ও আবু বকর যা বলছে, ওঠাই আমাদের সকলের কথা।’
‘যদি তাই হয়, তাহলে তোমাদের সংঘবদ্ধ কাজ দরকার এবং এজন্যে তোমাদের একটা সংগঠন দরকার। তোমরা একমত এ ব্যাপারে?’ বলল আহমদ মুসা।
আমরা একমত, আমরা রাজী।’ সকলে আনন্দে চিৎকার করে উঠল।
‘ধন্যবাদ। প্রথমে সংগঠনের একটা নামকরণ প্রয়োজন। তারপর প্রয়োজন প্রাথমিক একটা সেন্ট্রাল কমিটি গঠন। এরপর হতে হবে সংগঠনের লক্ষ্য নির্ধারণ। গঠনতন্ত্র, ইত্যাদির প্রণয়ন হবে পরবর্তী কাজ।’ একটু থামল আহমদ মুসা।
একটু ভাবল। তারপর বলল, ‘তোমাদের কারও কোন প্রস্তাব আছে এ সংগঠনের নাম কি হতে পারে, সে ব্যাপারে?’
সংগে সংগে কেউ কোন উত্তর দিল না। সবাই ভাবল।
প্রথম কথা বলল প্রবীন আবদুর রহমান ওকারী। বলল, ‘এই শুভ ও বড় কাজটা আপনিই করুন। এটা যেমন ঐতিহাসিক হবে, বরকতও এতে আসবে।’
সবাই সমস্বরে তাকে সমর্থন করে বলে উঠল, ‘আমরাও সকলে এটাই চাচ্ছি।’
আহমদ মুসা একটু ভেবে নিয়ে বলল, ‘এই মুহূর্তে আমার মাথায় দু’টি নামের চিন্তা এসেছে। এক, ক্যারিবিয়ান ক্রিসেন্ট, দুই, আটলান্টিক ক্রিসেন্ট। তৃতীয় আরেকটা নামও হতে পারে ‘আমেরিকান ক্রিসেন্ট’। দেখ, তোমাদের কোন নাম পছন্দ হয়।’
‘ইসলাম’, ‘মুসলিম’ ধরনের জাতীয় পরিচয় জ্ঞাপক কোন শব্দ যে এখানে থাকলো না?’ প্রশ্ন করল আবদুর রহমান ওকারী।
‘ক্রিসেন্ট’ শব্দ দ্বারা এই প্রয়োজন পূরণ হয়ে যায়। গোটা দুনিয়ায় এখন এই ‘ক্রিসেন্ট’ শব্দ ইসলাম ও মুসলমানদের প্রতিনিধিত্ব করছে।’
‘ঠিক বলেছেন স্যার। খৃষ্টানদের যেমন ‘ক্রস’ মুসলমানদের তেমনি ‘ক্রিসেন্ট’।
বলল কলিন কামাল। চার্লস বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকেল ছাত্র। সে
সবশেষে এসে যোগ দিয়েছে মিটিং-এ।
এরপর সবাই নীরব। নীরবতা ভাঙল জর্জ। বলল, ‘তিনটি নামই ভাল। তবে আমার মতে গভীরতার দিক দিয়ে ‘আটলান্টিক ক্রিসেন্ট’ বেশি উপযুক্ত।’
‘জর্জ, তোমার চিন্তা আরেকটু বুঝিয়ে বল সবাইকে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘ক্যারিবিয়ান ক্রিসেন্ট’ ও ‘আমেরিকান ক্রিসেন্ট’ এই দুই নামের মধ্যে স্থানিক একটা সীমাবদ্ধতা আছে। সেদিকে থেকে একে আমার কাছে স্থুল মনে হয়েছে। অন্যদিকে ‘আটলান্টিক ক্রিসেন্ট’ নামের মধ্যে অগ্রসরমান মিশনারী স্পিরিটের একটা ভাব আছে। আজকের আমেরিকার ধর্ম, সভ্যতা যা কিছু আছে সব আটলান্টিকের পথেই এসেছে।’ থামল জর্জ।
জর্জ থামতেই আবু বকর মোহাম্মদ বলে উঠল, ‘আমি জর্জের সাথে একমত। কিন্তু তাঁর ব্যাখ্যা শুনেই আমার মনে হচ্ছে, নাম ‘আটলান্টিক ক্রিসেন্ট’ না হওয়াই ভাল। তাঁর ব্যাখ্যা অনুসারে ‘আটলান্টিক ক্রিসেন্ট’- এর মধ্যে এই ভাব আছে যে, ক্রিসেন্ট বা ইসলামের মিশন অভিযান করে আমেরিকার দিকে আসছে, যেমন এসেছে অন্য ধর্ম, অন্য সভ্যতাও। এতে মনে হতে পারে ইসলামকে এখানে আমদনী করা হচ্ছে। এ ধরণের মনে হওয়া খুব ভালো নয়। বরং আমরা যদি বলি, আমরা মুসলিম আমেরিকানরা আমেরিকান মুসলমানদের বাচাঁতে চেষ্টা করছি, ইসলামের উজ্জীবন ঘটাতে চাচ্ছি এখানে আমেরিকার স্বার্থে, আমেরিকান মানুষের স্বার্থে, তাহলে এটাই বেশি যুক্তিযুক্ত হয়।
এদিক থেকে ‘আমেরিকান ক্রিসেন্ট’ হওয়ায়ই ভাল আমার মতে।
আবু বকর কথা শেষ করতেই জর্জ উঠে গিয়ে আবু বকর কে জড়িয়ে ধরল। বলল, ‘ধন্যবাদ আবু বকর। তোমাকে সেই আবাবাকা মনে হচ্ছে না। এমন গভীর চিন্তা তোমার মাথায় এল কি করে? সমস্যার মৌলিক দিক এমনভাবে ভাবতে পারলে কি করে! তোমাকে আবার ও ধন্যবাদ আবু বকর।’
জর্জ ছেড়ে দিল আবু বকরকে।
‘স্যার, আমার সম্পর্কে উনি একটু বেশি বলেছেন।’ বলল আবু বকর আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে।
‘স্যার’ নয় ভাই বলবে।’ আবু বকরের কথা শেষ হবার সংগে সংগেই বলল জর্জ।
এর পর জর্জ আহমদ মুসার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আমি আবু বকরের যুক্তিকেই সঠিক মনে করছি। আমার মত প্রত্যাহার করছি ভাইয়া।’
‘ধন্যবাদ জর্জ।’ বলে আহমদ মুসা সবার দিকে চেয়ে বলল, এবার তোমাদের মত বল।
সবাই এক যোগে বলল, আমাদেরও মত ‘আমেরিকান ক্রিসেন্ট’ এর পক্ষে।
‘ধন্যবাদ তোমাদের।’ বলে একটু থামল আহমদ মুসা।
একটু ভাবল। শুরু করল আবার, আলহামদুলিল্লাহ। নাম ঠিক হয়ে গেল ‘আমেরিকান ক্রিসেন্ট টার্কস দ্বীপপুঞ্জ’। আমেরিকান ক্রিসেন্ট টার্কস দ্বীপপুঞ্জ।এর একটা প্রাথমিক সেন্ট্রাল কমিটি এখনই গঠিত হওয়া উচিত বলে আমি মনে করি।’
সকলে বলে উঠল, ‘আমরাও চাই।’
‘আমি মনে করি এই সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটির একজন প্রেসিডেন্ট, একজন সেক্রেটারী জেনারেল, চারজন সহকারী সেক্রেটারী জেনারেল এবং আটজন সদস্য থাকা উচিত। তোমরা কি মনে কর?
সকলে বলল, ‘আমরা একমত’।
‘আমি মনে করি আজ এখন তোমরা প্রেসিডেন্ট, সেক্রেটারী জেনারেল, দু’জন সহকারী সেক্রেটারী জেনারেল ও চারজন সদস্য ঠিক কর। অবশিষ্ট সাতজন পরে ঠিক হবে। তোমরা একমত?’ বলল আহমদ মুসা।
‘জি, একমত।’ সবাই বলল।
‘ধ্যনবাদ। বল তোমরা কিভাবে ঠিক করবে।’
‘আপনি ঠিক করে দিন।’
‘না, তা হয় না। তোমাদের নেতা তোমাদের ঠিক করতে হবে।’
বলে আহমদ মুসা ব্যাগ থেকে কতগুলো কাগজের শ্লিপ বের করল। প্রত্যেকের হাতে একটি করে শ্লিপ দিয়ে নিজের সিটে ফিরে এস বলল, ‘দেখ কাগজের শ্লিপে সভাপতি, সেক্রেটারী জেনারেল, দুই সহকারী সেক্রেটারী জেনারেল এবং চারজন সদস্যের পদের নাম আছে। এ পদগুলোর মধ্যে যে পদের জন্যে যাকে পছন্দ কর তার নাম লিখে দাও।’
দুই তিন মিনিটের মধ্যে সব কাগজ আহমদ মুসার হাতে এসে গেল।
আহমদ মুসা ভোট গণনা করল।
তারপর সকলের দিকে চেয়ে বলল আলহামদুলিল্লাহ। তোমরা আমাকে অবাক করেছ। তোমরা যে পদে যে ভোট পেয়েছ, সকলের কাছ থেকে পেয়েছ। অর্থাৎ ভোট ভাগ হয়নি। তোমাদের চিন্তার এই ঐক্য আমার কাছে আল্লাহর রহমতের বিশেষ ফল বলে মনে হচ্ছে।
আমার মনে হচ্ছে, ‘আমেরিকান ক্রিসেন্ট’ নামে যে সংগঠন তোমরা গড়ে তুললে আল্লাহ তাকে কবুল করেছেন।’…’
আহমদ মুসা বাক্যটি শেষ করার সাথে সাথে সকলে আনন্দে ‘আল্লাহ আকবর’ ধ্বনি দিয়ে উঠল।
আহমদ মুসা থেমে গিয়েছিল। আবার শুরু করল, ‘তোমরা এখানে আটজন যুবক হাজির আছ এবং দু’জন মুরব্বী হাজির আছেন। এই
দশজনের ভোটে নির্বাচিত আট সদস্যের কমিটি এখন আমি ঘোষণা করছি। সভাপতি পদে নির্বাচিত হয়েছে গ্রান্ড টার্কস এর মুহাম্মদ জর্জ জেফারসন।’
নাম ঘোষণার সাথে সাথে একমাত্র জর্জ ছাড়া উপস্থিত নয়জন ‘আল্লাহ আকবর’ ধ্বনি দিয়ে হাততালি দিয়ে উঠল।
আহমদ মুসা থেমে গিয়েছিল। আবার শুরূ করল, ‘সেক্রেটারী জেনারেল হিসাবে নির্বাচিত হয়েছেন ওকারী গ্রামের ইসহাক আব্দুল্লাহ।’
সংগে সংগেই আবার সেই আল্লাহ আকবর ধ্বনিত ও হাততালিতে আহমদ মুসাকে থেমে যেতে হলো।
আহমদ মুসা বলল, ‘তোমারা আমাকে ঘোষণা শেষ করতে দাও। তারপর ধ্বনি দিও, হাততালি দিও সবকিছু করো।’
বলে আহমদ মুসা আবার শুরু করল, সহকারী সেক্রেটারী জেনারেল নির্বাচিত হয়েছে ‘ভিজকায়া মামুন্ড’ দ্বীপের আবু বকর মুহাম্মদ। আরেকজন সহকারী সেক্রেটারী জেনারেল নির্বচিত হয়েছে সিডি কাকেম গ্রামের আলী রুফাই। আর চারজন সদস্য নির্বাচিত হয়েছে, ওকারী গ্রামের ফরিদ নোয়ারাকো ও কলিন কামাল এবং সিডি কাকেম গ্রামের ওমর লাওয়াল ও রমজান ইরোহা।’
আহমদ মুসা ঘোষণা শেষ করল।
কিন্তু ঘোষণা শেষ হলেও আল্লাহু আকবর ধ্বনি ও হাততালি দিয়ে আনন্দ প্রকাশ করা হল না। সকলের মুখ গম্ভীর মাথা নিচু।
আর জর্জ, ইসহাক আবদুল্লাহ ও আবু বকরের চোখ দিয়ে অশ্রু গড়াচ্ছিল। আহমদ মুসা ঘোষনা শেষ করে উঠে গিয়ে এক এক করে সকলকে বুকে জড়িয়ে ধরল।
কেঁদে ফেলল সকলেই।
আহমদ মুসা ফিরে এল তার আসনে। বলল, ‘তোমরা কাঁদছ দেখে আমার আনন্দ লাগছে। আজ কত বড় দায়িত্ব তোমরা কাঁধে তুলে নিলে তোমরা তা বুঝতে পেরেছ। এই মুহূর্তটা বিগলিত মন আর অশ্রু ভরা চোখ নিয়ে আল্লাহর কাছে সাহায্য চাওয়ার সময়। এস আমরা মুনাজাত করি।’
বলে আহমদ মুসা হাত তুলল মুনাজাতের জন্যে। তার সাথে সবাই হাত তুলল।
দোয়া শেষ আহমদ মুসা বলল, ‘তোমাদের যে সংগঠন গঠিত হলো, তার একটা উপদেষ্টা কাউন্সিল থাক প্রয়োজন। একটা তথ্য ও গবেষণা শাখা থাকতে হবে। এবং প্রতরিক্ষার জন্য গড়ে তুলতে হবে একটা ‘হোমগার্ড বাহিনী’। থামল আহমদ মুসা।
‘আমরা একমত।’ সবাই একযোগে বলল।
আবার শুরু করল আহমদ মুসা, ‘নয় সদস্যের একটা উপদেষ্টা কাউন্সিল হবে। জনসাব আবদুর রহমান ওকারী ও আবু বকরের আব্বা।
মোহাম্মদ আলী পাওয়েল এই দু’জনকে নিয়ে উপদেষ্টা কমিটি কাজ শুরু করবে। পরে সাতজন নেয়া হবে এবং তখন যথারীতি কমিটি গঠনহবে। আর তথ্য ও গবেষণা সেল গঠিত হবে মহিলাদের সাতজন সদস্য নিয়ে। আপাতত ডাঃ মার্গারেট ও লায়লা জেনিফার চেয়ারপারসন ও সেক্রেটারী হিসেবে কমিটির কাজ শুরু করবেন। অন্যদিকে হোমগার্ড বাহিনী গঠিত হবে এই দ্বীপপুঞ্জের আগ্রহী সকল যুবককে নিয়ে। আজ শত্রদের কাছ থেকে কুড়িয়ে পাওয়া ত্রিশটি স্টেনগান ও ত্রিশটি রিভলবার হবে এই বাহিনীর প্রথম অস্ত্র ভান্ডার। এই বাহিনীর ট্রেনিং-এর দায়িত্ব আমার। আজ সকাল থেকে এই ট্রেনিং শুরু হবে। তার আগে এখনই বাইরে উপস্থিত যুবকদের মধ্যে থেকে যারা আগ্রহী তাদের এই বাহিনীতে শামিল করার ব্যাবস্থা করুন। সিডি কাকেম গ্রাম থেকে রিক্রুটের দায়িত্ব নেবে আলী রুফাই, ওমর লাওয়াল এবং রমজান ইরোহা।’ থামল আহমদ মুসা।
থামার সংগে সংগে ভ্যান বক্সে উপস্থিত নয়টি কণ্ঠ উচ্চকণ্ঠে ‘আল্লাহু আকবে’ ধ্বনি দিয়ে উঠল।এই তকবির ধ্বনি রাতের নীরবতা চৌচির করে বাইরে অপেক্ষমান অর্ধ সহস্র নারী পুরুষের কানসহ বহুদূর পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ল।
টার্কস দ্বীপপুঞ্জের এটাই প্রথম সম্মিলিত তকবির ধ্বনি।
তকবির ধ্বনি মিলিয়ে যেতেই আবদুর রহমান ওকারী উঠে দাঁড়াল।
বলল আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে, ‘আমি আল্লাহর শুকরিয়া আদায়
করছি। আজ আমাদের নতুন জন্ম হলো এবং তা হলো ফেরেশতা তুল্য আপনার হাতে। কিছুক্ষণ পূর্ব পর্যন্ত আমার মনে প্রবল আকুলি বিকুলি ছিল আপনার সত্যিকার পরিচয় কি তা জানার জন্যে। কিন্তু এখন আর তা নেই। এখন আমার কাছে আপনার একটিই পরিচয়, আল্লা আপনাকে আমাদের জন্যে পাঠিয়েছেন। মনে আমার এখন একটাই উদ্বেগ, কখন আবার আল্লাহ আপনাকে সরিয়ে নিয়ে যান।’ থামল আবদুর রহমান ওকারী।
আহমদ মুসা হাত ঘড়ির দিকে তাকাল। তারপর বলল, ‘চলুন জনাব। তোমরা সকলে চল। সকলের কাছে ‘আমেরিকান ক্রিসেন্ট টার্কস দ্বীপপুঞ্জ’ (ACT) গঠিত হয়েছে তার ঘোষণা দিয়ে এর বাহিনীতে যোগ দেয়ার জন্যে যুবকদের আহব্বান করতে হবে।’
আহমদ মুসা উঠল। সবাই উঠে দাঁড়াল।
আগে চলল আহমদ মুসা। তার সাথে সাথে বলল আবদুর রহমান ওকারী।
গাড়ি থেকে নামতে নামতে আবদুর রহমান ওকারী আহমদ মুসাকে বলল, ‘জনাব আপনি প্রথমে কিছু বলুন। মানুষ উন্মুখ হয়ে আছে আপনার কথা শোনার জন্যে। খুব খুশি হবে তারা।’
‘অবশ্যই বলব জনাব। শুধু টার্কস দ্বীপপুঞ্জ কিংবা শুধু ক্যারিবিয়ানের জন্যে নয়, গোটা আমেরিকারে জন্যে এটা এক ঐতিহাসিক মুহূর্ত।’
নামল সবাই গাড়ি থেকে। চলল মসজিদের উঁচু চত্তরে উঠার জন্যে।
ওখান থেকে কথা বললে সবাই ভালো করে শুনতে পাবে। দেখতে পাবে।

Top